একজন সভ্য মানুষ কখনো গালি দেন না, তিনি কখনো অশ্লীল কথা বলেন না, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমন করে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেন না। একজন ভদ্র-সভ্য মানুষ এসব করতেই পারেন না। কথায় আছে ব্যবহারে বংশের পরিচয়। সভ্য মানুষের মতো আচরণ তার ভালো বংশপরিচয় এবং উন্নত আচরণ প্রকাশ করে। ভদ্র-সভ্য ভালো মানুষ কারো প্রতি রাগান্বিত হলেও খারাপ ভাষা ব্যবহার করেন না। তাদের রাগ প্রকাশের ভঙ্গিটাও হয় সভ্য, সুন্দর ও সংযত। অপরদিকে একজন অসভ্য-অভদ্র মন্দ মানুষ যখন রেগে যায় তখন সে ভুলে যায় ভদ্রতা-সভ্যতা এবং তার পাশবিক রূপ বেরিয়ে আসে। সে তখন গালি দেয়, ব্যক্তি আক্রমন করে, যুক্তিহীন পাশবিক আচরণ করে। সে এগুলো ব্যবহার করে জিততে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই হেরে যায়।
একজন অসভ্য-অভদ্র মন্দ মানুষ যখন যুক্তিতে হেরে যায় তখন সে সাহায্য নেয় গালির। কারন গালির ভুমিকা হচ্ছে আলোচনার পথরোধ করা। আপনি কাউকে একটা যুক্তি দিলে তার একটা সম্ভাবনা থাকে সেই যুক্তিটা খন্ডানোর। কিন্তু যেই আপনি তাকে গালি দিলেন তখন তার খন্ডানোর আর কিছু থাকে না।

গালি দেয়া, অশ্লীল কথা বলা, অশ্লীলতা ছড়ানো আমাদের সমাজের এক মারাত্মক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটি একটি মানসিক ব্যধিও বটে। বর্তমানে স্যোশাল নেটওয়ার্কও এর বাইরে নয়। বরং অনেকসময় দেখা যাচ্ছে অফলাইনের সভ্য মানুষটিই অনলাইনে এসে অসভ্য-অভদ্র-বর্বর আচরণ করছে।
অনলাইন ও স্যোশাল সাইটগুলোতে যেসব অশোভনীয় আচরণগুলো লক্ষণীয়ঃ
১. যে কোন পোষ্ট নিজের মতের অমিল হলেই গালাগাল করা
২. যুক্তির পরিবর্তে পাল্টা অযৌক্তিক ও অশ্লীল ভাষায় আক্রমন করা
৩. পোস্টে বা কমেন্টে অশ্লীল ছবি বা ভিডিও বা এসবের লিঙ্ক পোষ্ট করা
৪. অপরের অমতে ট্যাগ করা
৫. মিথ্যা/অসত্য তথ্য/ছবি ছড়িয়ে দেয়া
৬. কারো ছবিকে এডিট করে হেয় করার কাজে ব্যবহার করা
৭. অন্যের লেখা বা পোষ্ট নিজের বলে চালিয়ে দেয়া।
৮. সত্য-অসত্য যাচাই না করে লাইক/শেয়ার করা।
৯. প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র না দেয়া
১০. অপ্রাসঙ্গিক এ্যাড দেয়া
১১. অপ্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করা,
১২. অধিক প্রশ্ন ও বেশি কথা বলা,
১৩. নিজের আমিত্ব জাহির বাক পটুত্ব করা,
১৪. কারো কথার মাঝখানে টক্কর দেয়া,
১৫. না বুঝে হইচই করা,
১৬. অন্যায়ের পক্ষে তর্ক করা,
১৭. বিচার মানি তাল গাছ আমার এরুপ প্রবণতা,
১৮. নোংরা গান শোনা, দেখা ও চর্চা করা,
১৯. অল্প জেনেই সিদ্ধান্ত নেয়া,
২০. যাচাই না করে বিশ্বাস করা

এসবই হচ্ছে কু-স্বভাবের অর্ন্তভুক্ত। গালিগালাজ করা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচয় নয়। মুদ্রাদোষ বা অভ্যাসবশত অনেকেই কথায় কথায় গালি দেন, অনেকেই হাসি-তামাশা ও ঠাট্টাচ্ছলেও অন্যকে গালি দিয়ে বসেন এসবের কোনোটিই ঠিক নয়।

শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামে গালি দেয়া, অশ্লীল কথা বলা, অশ্লীলতা ছড়ানো নিষিদ্ধ এবং পাপের কাজ। যেমন-
আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“যেসব লোক ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের বিনা কারণে কষ্ট দেয় তারা একটা অতি বড় মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় উঠিযে নেয়।” (সূরা আহযাবঃ ৫৮)

কুরআনে মহান আল্লাহ মুমিনদের ভদ্রতা শিক্ষা দিয়ে বলেছেন-
“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কোনো দল যেন অপর কোনো দলকে উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর ফুসূক অতি মন্দ। যারা তওবা করে না তারাই যালেম।” সূরা হুজুরাত : ১১

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স:) বলেছেন, “মুসলিমানদেরকে গালমন্দ করা ফাসেকী আর তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা কুফরী।” (বুখারী ও মুসলিম)
সাদ ইবনে মালিক (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন- মুসলমানদের গালি দেয়া জঘন্য পাপ (ফাসেকী)। (নাসাঈ, ইবনে মাজা)

হযরত আবু যর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (স:) কে বলতে শুনেছেন, কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে যেন ফাসেক অথবা কাফের এর অপবাদ না দেয়। কেননা সে যদি প্রকৃতই তা না হয়ে থাকে তবে এই অপবাদ তার নিজের ঘাড়ে চেপে আসবে। ( বুখারী)
হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেছেন, পরস্পরকে গালি দানকারীর মধ্যে যে পূর্বে গালি দিয়েছে সে দোষী, যদি নির্যাতিত (প্রথম যাকে গালি দেয়া হয়েছে) ব্যক্তি পরিসীমা অতিক্রম না করে থাকে। (মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি)

নবী (সঃ) আরো বলেন- ৪টি স্বভাব থাকলে সে মুনাফিক। তাহলো- আমানত খেয়ানত করা, মিথ্যে বলা, ওয়াদা খেলাফ করা, ঝগড়া ও গালমন্দ করা (বোখারী, মুসলিম)।

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, স্বীয় পিতামাতাকে গালি দেয়া কবিরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি কি তার পিতামাতাকে গালি দিতে পারে? রাসূল সাঃ বললেন, হ্যাঁ, এভাবে দিতে পারে যে, ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির পিতাকে গালি দিবে, আর উক্ত ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির পিতাকে গালি দিল। ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির মাকে গালি দিল, তখন উক্ত ব্যক্তি প্রথম ব্যক্তির মাকে গালি দিল।{সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৪৬, শরহু মাশকিলুল আসার, হাদীস নং-৮৯৯}

ইসলাম যেসব আচরণগত উপদেশ দিয়েছে সেগুলোর একাংশ দেখে নেই-
নবী (সঃ) বলেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপকারী, অশ্লীল ও গালিগালাজকারী হয় না। [তিরমিজি ২০৪৩]
ইসলামে সুন্দর ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী (সঃ) বলেন “ইসলাম হচ্ছে সুন্দর ভাষায় কথা বলা ও ক্ষুধার্তকে আহার দেয়া”।
রাসূল (সঃ) বলেছেন “তোমরা ভাষায় মিষ্টভাষি হও, আচরণে সংযমি হও।”
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদের) ধুলি ও জাহান্নামের ধোঁয়া কোন বান্দার মধ্যে কখনো একত্র হতে পারে না। অনুরূপভাবে মনের সংকীর্ণতা ও ঈমান কখনো একত্র হতে পারে না। (নাসাঈ, ইবনে মাজা)

সামুরা (রা.) বলেন, নবী (স.) বলেছেন- তোমরা পরস্পরকে আল্লাহর অভিশাপ, আল্লাহর ক্রোধ এবং আগুনের দ্বারা অভিসম্পাত করো না। (তিরমিজি, আবু দাউদ)

মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, “তোমাদের কারো রোযার দিন হলে সে যেন অশ্লীল না বকে ও ঝগড়া-হৈচৈ না করে; পরন্তু যদি তাকে কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়তে চায়, তাহলে সে যেন বলে, ‘আমি রোযা রেখেছি, আমার রোযা আছে।” (বুখারী ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১নং)
আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) বলেন- যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা বলে এবং তা প্রচার করে তাদের উভয়ে সমান পাপী। (আদাবুল মুফরাদ)

ইসলাম কঠোর ও নরম ভাষা ব্যবহারের অনুমতিও দিয়েছে, কিন্তু তা ক্ষেত্র বিশেষে। তবে সেই ভাষা অবশ্যই অশ্লীল নয়।
নবী (সঃ) বলেন, “তুমি হক কথা বলো যদিও তা তিক্ত হয়’। তিনি আরো বলেন- ‘‘সুন্দর ভাষা জান্নাতে পৌঁছায় আর দূর্ব্যবহার দোযখে পতিত করে’ (বুখারী)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- মুমিন ব্যক্তি চিন্তাশীল, গম্ভীর ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি প্রতারক, ধোঁকাবাজ, কৃপণ, নীচ ও অসভ্য হয়ে থাকে। (আবু দাউদ)

আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) কখনো অশ্লীলভাষী, অভিশাপকারী বা গালি বর্ষনকারী ছিলেন না। অসন্তুষ্ট হলে তিনি বলতেন- তার কি হলো? তার কপাল ধূলিমলিন হোক। (বুখারী)

এসব আয়াত ও হাদীস থেকে বুঝা যায় ইসলাম এসেছে মানুষকে সভ্য-ভদ্র-ভালো বানানোর জন্য। তাই যারা ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করে তারা হয় ভদ্র ও শালীন।

কখনো কোন শিক্ষিত মানুষকেও দেখা যায় প্রতিপক্ষকে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছেন এবং বিভিন্ন মন্দ উপাধী বা গালি ব্যবহার করে তাকে হেয় করার চেষ্টা করছেন যা খুবই দুঃখজনক। এক্ষেত্রে অবশ্যই তার এধরনের আচরণ আমরা বর্জন করব। তিনি শিক্ষিত বা ভদ্র হিসেবে পরিচিত বলেই তার অভদ্র আচরণকে আমরা অনুসরণ করব না।

কারো আক্রমনের শিকার হলে আমরা ধৈর্য্য ধরবো। এরকম একটি ঘটনা-
নবী করিম (সা) একদা বসিয়াছিলেন, তাহার উপস্থিতিতে এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর (রা) কে গালি দিল। তিনি (ঐ ব্যক্তির বার বার গালি দেওয়া এবং হযরত আবু বকর (রা) এর সবর ও খামুশ থাকার উপর) খুশী হইতে থাকেন এবং মুচকি হাসিতে থাকেন। অত:পর যখন সেই ব্যক্তি অনেক বেশী গালিগালাজ করিল তখন হযরত আবু বকর (রা) তাহার কিছু কথার জবাব দিলেন। ইহার উপর রাসুল (সা) অসন্তুষ্ট হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। হযরত আবু বকর (রা) ও তাহার পিছনে পিছনে তাহার নিকট পৌঁছিলেন এবং আরজ করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাল্লাহ (সা)! (যতক্ষণ) ঐ ব্যক্তি আমাকে গালি দিতেছিল আপনি সেখানে অবস্থান করিতেছিলেন, তারপর যখন আমি তাহার কিছু কথার জওয়াব দিলাম তখন আপনি নারাজ হইয়া উঠিয়া গেলেন। রাসুল (সা) এরশাদ করিলেন, (যতক্ষণ তুমি চুপ ছিলে এবং সবর করিতেছিলে তোমার সহিত একজন ফেরেশতা ছিল, যে তোমার পক্ষ হইতে জওয়াব দিতেছিল। তারপর যখন তুমি তাহার কিছু কথার জওয়াব দিলে (তখন সেই ফেরেশতা চলিয়া গেল আর) শয়তান মাঝখানে আসিয়া গেল। আর আমি শয়তানের সহিত বসি না। (এই জন্য আমি উঠিয়া রওয়ানা হইয়া গিয়াছি) ইহার পর তিনি এরশাদ করিলেন, হে আবু বকর! তিনটি বিষয় আছে যাহা সম্পূর্ণ হক ও সত্য যে বান্দার উপর কোন যুলুম অথবা সীমালঙ্ঘন করা হয় আর সে শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য উহা মাফ করিয়া দেয় (ও প্রতিশোধ না লয়) তখন উহার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাহাকে সাহায্য করিয়া শক্তিশালী করিয়া দেন। যে ব্যক্তি আত্মীয়তা বজায় রাখার জন্য দানের রাস্তা খোলে আল্লাহ তায়ালা উহার বিনিময়ে অনেক বেশী দান করেন। আর যে ব্যক্তি সম্পদ বৃদ্ধি বরার জন্য সওয়ালের দরজা খোলে আল্লাহ তায়ালা তাহার সম্পদ আও কমাইয়া দেন। (মুসনাদে আহমদ)

সর্বোপরি ধর্মীয় ছোট কোন বিষয়ে বিতর্ক ও গালিবাজদের সবসময় এড়িয়ে চলতে হবে।

আল্লাহ বলেন- “যারা আল্লাহর রাসূলের সামনে তাদের কন্ঠ নিচু রাখে তারাই সে সব লোক আল্লাহ যাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।” সুরা হুজরাত: ৩

কালের বদৌলতে এখন কিশোর,তরুন, যুবক ও আবাল বৃদ্ধসহ দেশের একটি অংশ এখন ইন্টারনেট ব্যাবহার করে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া সবার কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করায় এই মাধ্যমকে একটি চক্র অপব্যাবহার করে নানা অপরাধ সংঘঠিত করছে। তাই এ মাধ্যমের যথাযথ ব্যবহার করা আজ সময়ের দাবী। তাই এই মাধ্যমকে ভাল কাজে ব্যবহার করে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে জনমত গঠন করার লক্ষ্যে আমরা প্রত্যেকেই এক একজন মিডিয়া কর্মীর ভূমিকা পালন করে সমাজের সকল অবিচার অনাচারকে রুখে দিতে পারি। আসুন সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই-“সত্যই আমাদের পুঁজি, সত্যই আমাদের যুক্তি”।