সেমিনার পেপার

(১)
বর্তমান বিশ্বে চলমান সবচেয়ে পুরনো স্বাধীনতার আন্দোলনের অন্যতম হল কাশ্মিরের মুক্তি সংগ্রাম। অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় (১৯৪৭-২০১০) স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক আন্দোলন-সংগ্রাম-তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। সময়ের প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামকেই কেবল কাশ্মিরের স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ঐতিহাসিকভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বিশ্বের ইতিহাসে কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের মতো অন্য কোন জনগোষ্ঠীকে এত দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হয়নি। এই দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগোষ্ঠী দু’টি একদিকে যেমন নিজস্ব স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা ও প্রত্যয়কে জাগ্রত রেখেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে ও দীর্ঘসূত্রিতায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিবর্গ এই মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত, বিপদগ্রস্ত, বিপথগামী ও নিপীড়ন-নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনা-মানবাধিকার হরণ, হত্যা-ধর্ষণ, রক্তপাত ও বিভীষিকার আন্তর্জাতিক চারণভূমিতে পরিণত করেছে। কাশ্মির ও ফিলিস্তিনকে সে দেশ দু’টির সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের ইচ্ছা বা কামনার অধীনে মুক্তি ও স্বাধীনতার ঠিকানায় পৌঁছার বদলে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিধরেরা নিজেদের কব্জা ও অধীনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে এবং এইভাবেই ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতার আন্দোলন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জর্জরিত ও রক্তাক্ত হচ্ছে। উল্লেখ্য, কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের উদাহরণ এই প্রমাণও দিচ্ছে যে, মুসলিম হওয়ার কারণেই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বৈধ অধিকার এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তিও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে- ন্যায়সঙ্গত দাবিও বছরের পর বছর ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। অথচ বিশ্বের প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার বুক চিরে খ্রিস্টান রাষ্ট্র পূর্ব তিমুরের প্রতিষ্ঠা কত সহজেই এবং কত স্বল্প সময় ও সংক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী আন্দোলনের মুখেই করা হয়েছে।
কাশ্মিরের মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলনকে জটিল থেকে জটিলতর করে দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তি। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে নানা দেশ। ফলে কাশ্মিরীদের মূল আন্দোলন চাপা পড়ে যাচ্ছে এবং ভারতীয় আক্রমণে ও সামরিক আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। এমনকি, কাশ্মিরের আপামর গণমানুষের সামগ্রিক ও সর্বাত্মক স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে ভারতীয় পক্ষ থেকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে, যা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কাশ্মিরের জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং একে আবর্তিত করে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও শক্তি প্রয়োগ এবং অপরাপর আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াই একটি সাচ্চা স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনের কি চরম ক্ষতি সাধন করছে, তা নিয়ে মুক্ত বিশ্ব বা দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশেই নয়, বাংলাদেশও গভীরভাবে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ ও চিন্তার সঙ্গত ও যথার্থ কারণ : ‘‘কাশ্মির সমস্যা শুধু ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে চরম মূল্য দিতে হবে। ফলে কাশ্মির প্রসঙ্গে আলোচনা ও তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা এবং সমাধান সূত্র খুঁজে বের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
(২)
দক্ষিণ এশিয়া তথা উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত একদার ভূ-স্বর্গ কাশ্মির বর্তমানে জ্বলন্ত, অগ্নিগর্ভ- স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার রণক্ষেত্র। অর্ধ শতাব্দীর অধিক কাল ধরে চলছে এই ন্যায়সঙ্গত স্বাধীনতার রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সর্বাত্মক সংগ্রাম। একদিকে কাশ্মিরের ব্যাপক জনগোষ্ঠী যখন স্বাধীনতার প্রেরণায় উজ্জীবিত ও সংগ্রামরত তখন কাশ্মির প্রসঙ্গে তিনটি রাষ্ট্রীয় শক্তি নিজ নিজ স্বার্থে আগুয়ান। এরা হল : ভারত, পাকিস্তান ও চীন। এ সকল পক্ষ কাশ্মির বিষয়টিকে নাজুক ও অমীমাংসিত করে রেখেছে। কাশ্মিরের জনগণকে নিজের মুক্তি, স্বাধীনতা ও ভাগ্য উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে বাধা সৃষ্টি করছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভারত সমগ্র কাশ্মিরের ৪৩ ভাগ এলাকা দখল করে রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে জম্মু, কাশ্মির উপত্যকা, লাদাখ এবং সিয়ানচেন হিমবাহ। পাকিস্তান অধিকার করে রেখেছে কাশ্মিরের ৩৭ ভাগ ভূ-খন্ড যার মধ্যে রয়েছে, আজাদ কাশ্মির (রাজধানী মুজাফফরাবাদ) এবং উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট এবং বেল্টিস্তান (Baltistan)। অন্যদিকে চীনের দখলে রয়েছে কাশ্মিরের ২০ ভাগ এলাকা, যার নাম আকসাই চীন (Aksai Chin)। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় চীন এটা দখল করে নেয়। এছাড়াও চীন ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে পায় পার্বত্য ট্রান্স-কারাকোরামের সাকসাম উপত্যকা। অবশ্য ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মিরের ভূ-খন্ড দখল করে রেখেছে ১৯৪৭ সাল থেকে। আর ১৯৪৭ সালে উপনিবেশিক ইংরেজরা উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাবার সময় কাশ্মিরকে সে দেশের জনগণের ইচ্ছা ও স্বাধীনতার অধীনে থাকার ব্যবস্থা না করে সংকটের ঘূর্ণাবর্তে ফেলে রেখে যায়। উপমহাদেশের অনেক সমস্যার মতোই কাশ্মির সমস্যাও ইংরেজ সৃষ্ট এবং ভারত কর্তৃক প্রলম্বিত। শুধু তাই নয়, কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারত ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সিয়ানচেন হিমবাহ নিয়ে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে পারমাণবিক উত্তেজনাপূর্ণ যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়। আর কাশ্মিরের (দখলকৃত) অভ্যন্তরে প্রচন্ড সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে। ফলে কাশ্মিরের সমগ্র ভূখন্ডটি বিভক্ত এবং জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং দখলদার ভারতের আগ্রাসনে কাশ্মিরের ব্যাপক অংশই দৃশ্যত পরাধীন ও নির্যাতিত হয়ে আছে।
[দখলদারিত্বের চিত্র]
দখলকারী দখলকৃত অঞ্চল জনসংখ্যা মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ অন্যান্য

ভারত কাশ্মির উপত্যকা ৪ মিলিয়ন ৯৫% ৪% - -
জম্মু ৩ মিলিয়ন ৩০% ৬৬% - ৪%
লাদাখ ০.২৫ মিলিয়ন ৪৬% - ৫০% ৩%
পাকিস্তান উত্তরাঞ্চলীয় কাশ্মির ১ মিলিয়ন ৯৯% - - ১%
আজাদ কাশ্মির ২.৬ মিলিয়ন ১০০% - - -
চীন* আকসাই চীন তথ্য অজ্ঞাত তথ্য অজ্ঞাত তথ্য অজ্ঞাত তথ্য অজ্ঞাত তথ্য অজ্ঞাত
• কমিউনিস্ট শাসনের চীন দখলকৃত এ অঞ্চলে কোন বিদেশিকে প্রবেশ করতে দেয় না এবং এ সংক্রান্ত কোন তথ্যও প্রকাশ করে না। চীন এমনও দাবি করে যে, ভারতের অরুণাচল প্রদেশটি তার অংশ।
[সূত্র : উইকিপিডিয়া, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১০ তারিখে প্রাপ্ত তথ্য]
(৩)
কাশ্মির ভূখন্ডে জনসমাজ গড়ে উঠেছে মুসলমিদের দ্বারা এবং রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সত্তাও বিকাশ লাভ করেছে মুসলিমদেরই নেতৃত্বে। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই কাশ্মির একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চল এবং মুসলিম কর্তৃত্বাধীন এলাকা। যদিও ইংরেজ আমলে এই ধারায় ব্যত্যয় ঘটানো হয়। ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, আঠারো শতক পর্যন্ত কাশ্মির শাসন হয়েছে পশতুন-দুররানি শাসনের অধীনে। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এসে এই মুসলিম শাসন আক্রান্ত হয়। ১৮১৯ সালে পাশ্ববর্তী পাঞ্জাবের শিখ রাজা রনজিৎ সিং কাশ্মির দখল করে নেয়। ১৮৪৫-৪৬ সালের ইংরেজ-শিখ যুদ্ধের মাধ্যমে কাশ্মির ‘লাহোর চুক্তি’-এর আওতায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দখলে আসে। অল্প দিন পরেই ‘অমৃতসর চুক্তি’- এর আওতায় ব্রিটিশরা পার্শ্ববর্তী জম্মুর হিন্দু রাজা গুলাব সিং-এর কাছে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে কাশ্মির বেঁচে দেয় এবং গুলাব সিংকে মহারাজা উপাধি দিয়ে জম্মু ও কাশ্মিরের শাসক পদে বসিয়ে দেয়। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি অঞ্চলে হিন্দু রাজার কর্তৃত্ব ও শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু হিন্দু শাসন ও দখলদারিত্ব কাশ্মিরের মানুষ মেনে নেয়নি। তারা ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে সংগ্রাম শুরু করে। ইংরেজ জেনারেল স্যার হেনরি লরেন্সের সহযোগিতায় হিন্দু ডোগরা বংশের সংখ্যালঘু রাজা সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মিরী মুসলিমদের দমন-পীড়ন শুরু করে এবং কাশ্মিরকে একটি নিপীড়নের জনপদে পরিণত করেন। ইমামউদ্দিনের পর গওহর রহমান স্বাধীনতার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামে (খন্ডিত অর্থে সিপাহী বিদ্রোহ) গুলাব সিং ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেন এবং এই ইংরেজ হিন্দু রাজশক্তির দ্বারা ১৮৬০ সালে গওহর রহমানের নেতৃত্বাধীন সংগ্রামকে দমন করেন। নেতৃবৃন্দ শহীদ হলেও কাশ্মিরী জনতা জম্মুর হিন্দু দখলদার শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ৫৬২টি দেশীয় রাজ্য (Princely State) তিন ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হয় ‘Indian Independence Act 1947’-এর আওতায় :
1. রাজ্য ইচ্ছা করলে ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে;
2. রাজ্য ইচ্ছা করলে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে; এবং
3. রাজ্য ইচ্ছা করলে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখে স্বতন্ত্র থাকতে পারবে।
কিন্তু বাস্তব অবস্থা হয় ভিন্নতর। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্টের পরপরই একের পর এক দেশীয় রাজ্য দখল করে নেয়। দেশীয় রাজ্যগুলো স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি। হায়দারাবাদ, জুনাগড়সহ অসংখ্য দেশীয় মুসলিম প্রধান রাজ্য স্বাধীন থাকতে কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যবাহিনী দ্রুত আক্রমণ করে রাজ্যগুলো দখল করে নেয়। আধুনিক ইতিহাসে এমন জঘন্য দখলদারিত্বের ঘৃণ্য উদাহরণ বিরল।
কাশ্মির ছিল এমনই একটি বড় আকারের দেশীয় রাজ্য, যার সিংহভাগই ছিল মুসলিম-যারা পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু রাজা হিন্দু ছিলেন বলে তিনি জনতার গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে পদদলিত করে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ষড়যন্ত্র অাঁচ করতে পেরে ১৯৪৭ সালের অকটোবর মাসে হিন্দু ডোগরা রাজার কবল থেকে স্বদেশের মুক্তির জন্য কাশ্মিরের জনগণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। ২৭ অকটোবর রাজা জনদাবির বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে ‘Instrument of Accession’. চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ অবস্থায় তীব্র গণআন্দোলন ও অসন্তোষ তৎকালীন রাজা হরি সিং-এর পতন আসন্ন করে ফেলে। রাজার আহবানে ভারত তখন সৈন্য পাঠিয়ে কাশ্মির দখল করে নেয় এবং স্বাধীনতাকামীদের চরমভাবে দমন করতে থাকে। একজন গবেষকের ভাষায়, কাশ্মির প্রসঙ্গে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু ভারত বেআইনীভাবে কাশ্মিরে সৈন্য পাঠিয়ে দেশটি দখল করে নেয়- যদিও সৈন্য পাঠানোর আগে পর্যন্ত কাশ্মির সরকারিভাবে ভারতে যোগ দেওয়ার কথা জানায় নি বা এ মর্মে কোন চুক্তিও স্বাক্ষর করেনি। (There was no Iron-clad legal evidence to unequivocally prove that Pakistan was officially involved. It would have been illegal for India to unilaterally intervene in an open, official capacity unless Jammu and Kashmir officially joined The Union of India, at which point it would be possible to send in its forces and occupy the remaining part.) কিন্তু ভারত কোন আইনগত বৈধতা বা নীতি নৈতিকতার পরোয়া না করেই কাশ্মিরে সৈন্য পাঠিয়ে দেয় এবং জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হিন্দু রাজার সহযোগিতায় দেশটিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। এহেন ষড়যন্ত্রমূলক, সাম্প্রদায়িক ও সামরিক বল প্রয়োগমূলক ভারতীয় তৎপরতার ফলে কাশ্মিরকে ঘিরে সঙ্কট ঘণীভূত হতে থাকে এবং গণতান্ত্রিক চেতনার মৃত্যু হয়। কিন্তু স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরী জনগণ সূচনা থেকেই এর প্রতিবাদ এবং অব্যাহত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। আর ভারতের এহেন আগ্রাসনমূলক কার্যকলাপের ফলে কাশ্মির প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
(৪)
কাশ্মির প্রসঙ্গে সৃষ্ট উত্তেজনায় উপমহাদেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। উপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ অন্ধকার কালের অবসান ঘটলেও কাশ্মিরকে ঘিরে নতুন উত্তেজনা দানা বেঁধে ওঠে। ভারত যখন কাশ্মির দখল করতে সৈন্য পাঠায়, তখন হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরী প্রচন্ড নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয় এবং ভারতীয় সৈন্যদের অত্যাচার ও আক্রমণে বহু কাশ্মিরী দেশত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে আসতে থাকে। ফলে ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে লিপ্ত হয়। প্রথম কাশ্মির যুদ্ধ নামে পরিচিত এই লড়াই ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়- ভারত সে সময় বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল কাশ্মির প্রসঙ্গে ৪৭নং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং উভয় পক্ষকে অস্ত্র বিরতি করার জন্য আহবান জানায়। পুরো সঙ্কটকে পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ভারত বা পাকিস্তান নয়- ‘কাশ্মিরের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কাশ্মিরের জনগণের’ বলে মত দেয় এবং গণতান্ত্রিক গণভোটের মাধ্যমে সে মতামতের ভিত্তিতে সঙ্কট নিরসনের সিদ্ধান্ত জানায়। (“The final disposition of the state of Jammu and Kashmir will be made in accordance with the will of the people expressed through the democratic method of a free and impartial plebiscite conducted under the auspices of The United Nations.”)
ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে অস্ত্র বিরতি কার্যকর করে। কিন্তু গণভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাশ্মিরের গণরায় গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অদ্যাবদি সম্ভব হয়নি। এর জন্য ভারতের অনীহা অন্যতম অন্তরায়। কারণ, ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতিতে সঠিক রায় প্রদান করা জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘ গণভোটের মূল সিদ্ধান্তের আলোকে আরো কিছু উপ-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু সেগুলো ‘কাগুজে বাঘ’ এর মতো তর্জন-গর্জন ছাড়া সমস্যার সমাধানে কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি। ইত্যবসরে ১৯৬২ সালে চীন ও ভারত কাশ্মির ইস্যুতে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের একাধিক ছোট-বড় যুদ্ধ হয়। এইসব যুদ্ধ এবং দখলকৃত কাশ্মিরে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর বর্বর আক্রমণে ১৯৪৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং গৃহহীন, উদ্বাস্ত্ত ও দেশান্তরী হয় কমপক্ষে ৫ লাখ কাশ্মিরী। এখনও প্রতিদিন রক্তপাত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে কাশ্মিরে।
(৫)
কাশ্মির প্রসঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান পর্যালোচনা করা হলে দেখা যায়, কিভাবে একটি স্বাধীনতাকামী জনপদ ও জনগণকে বছরের পর বছর অবদমিত রাখা হচ্ছে এবং তাদের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার বহি:প্রকাশ ঘটাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ পর্যায়ে আমরা ভারত, পাকিস্তান ও চীনের বক্তব্য ও অবস্থান পরীক্ষা করে দেখবো এবং কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীনতার মূল দাবিটিকে বিভিন্ন পক্ষ কেমন করে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে- সেটা পর্যালোচনা করবো।
** কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারতীয় মনোভাব :
• ভারত মনে করে, জম্মু ও কাশ্মিরের মহারাজার সঙ্গে ২৬ অকটোবর ১৯৪৭ সালে স্বাক্ষরিত Instrument of Accession’ চুক্তি ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইনের আওতায় বৈধ।
• পরবর্তীতে জম্মু ও কাশ্মিরের শাসনতান্ত্রিক পরিষদ মহারাজার Instrument of Accession’ চুক্তিটিকে গ্রহণ করে এবং শাসনতান্ত্রিক পরিষদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে কাশ্মিরের জনগণ ভারতের পক্ষে থাকার মত দিয়েছে।
• ভারত মনে করে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠানের পরিস্থিতি কাশ্মিরে নেই। (সেই পরিস্থিতি যে, সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারতই দিনের পর দিন নষ্ট করে যাচ্ছে সেটা অবশ্য তারা স্বীকার করতে নারাজ।)
• ভারত দ্বি-জাতি তত্ত্ব মেনে নিয়ে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরে এই নীতি মেনে নেয়নি- কারণ, ভারতের মতে, কাশ্মিরের ভূগোল ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
• ভারত দাবি করে যে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী কাশ্মিরকে যথেষ্ট স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হচ্ছে, ফলে স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই।
• ভারত এটাও দাবি করে যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ‘সিমলা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় তাতে সকল সমস্যা (কাশ্মিরসহ) উভয় দেশের দ্বি-পক্ষীয় সমঝোতায় নিষ্পন্ন করার কথা বলা আছে। (“All differences between India and Pakistan including Kashmir need to be settled through bilateral negotiations as agreed to by the two countries when they signed The Simla Agreement on 2 July, 1972.”
অর্থাৎ ভারত কোন পর্যায়েই কাশ্মিরের জনমতকে মেনে নিতে বা গ্রাহ্য করতে রাজি নয়। কাশ্মিরের জনগণের মতকে সামনে আনার কোন পথই ভারত খোলা রাখেনি। এমনকি, জাতিসংঘ কর্তৃক গণভোটের বিষয়টিকেও প্রলম্বিত করতে করতে বর্তমানে নিজের অভ্যন্তরীণ ও পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় বিষয়ে পরিণত করেছে। ভারত এভাবেই কাশ্মির, কাশ্মিরের জনগণ ও তাদের স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক দাবিকে রাজনীতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে বছরের পর বছর দমন করে চলেছে।
** কাশ্মির প্রসঙ্গে পাকিস্তানের মনোভাব
• পাকিস্তান মনে করে কাশ্মিরের মহারাজা জনসমর্থনহীন শাসক এবং ভারতের বংশবদ। কাশ্মির প্রসঙ্গে কোন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার বৈধ অধিকার ও ক্ষমতা এই শাসকের নেই এবং জনগণ তাকে এমন ক্ষমতা তো দেইনি বরং তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আন্দোলন করেছে। ফলে মহারাজা কর্তৃক স্বাক্ষরিত ‘Instrument of Accession’, যার ভিত্তিতে কাশ্মিরকে ভারত দখল করেছে, সেটা অবৈধ এবং দালালির দাসখতমূলক চুক্তি বৈ আর কিছু নয়।
• কাশ্মির প্রসঙ্গে ভারত চরম বেঈমানী ও প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছে বলে পাকিস্তান মনে করে। কারণ হায়দারাবাদ ও জুনাগড়ের শাসকগণ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও জনগণ অধিকাংশ হিন্দু থাকায় শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারেনি। ভারত সেগুলো দখল করে নেয়। কিন্তু কাশ্মিরের ব্যাপক জনগণ মুসলিম হলেও সংখ্যালঘু রাজার মতকে ভারত প্রাধান্য দিচ্ছে- যেমনটি হায়দারাবাদ বা জুনাগড়ের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়নি।
• পাকিস্তান মনে করে মহারাজার কোন কর্তৃত্ব ও বৈধতাই নেই। তিনি যে কাশ্মিরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা আইনসঙ্গত নয়, জনসমর্থিতও নয়। বরং ভারত ও মহারাজার ষড়যন্ত্র থেকেই কাশ্মির সমস্যার উদ্ভব।
• পাকিস্তান ঐতিহাসিক দলিল ও তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে এটাও মনে করে যে, ভারত মহারাজার সঙ্গে চুক্তির আগেই কাশ্মিরে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে এবং পরবর্তীতে ‘তথাকথিত’ কাগজপত্রের ভিত্তিতে অত্যন্ত অন্যায় ও জবরদস্তিমূলকভাবে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাশ্মির দখল করেছে।
• কাশ্মিরের বর্তমান জনআন্দোলন ও স্বতস্ফূর্ত সংগ্রাম প্রমাণ করেছে যে, জনগণ ভারতের সঙ্গে থাকতে চায় না- ফলে কাশ্মির সমস্যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী করার পক্ষে পাকিস্তান।
• পাকিস্তানের মতে, কাশ্মিরী জনগণ আসলে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এবং হিন্দু মহারাজার সাম্প্রদায়িক আবেগ ও ষড়যন্ত্রমূলক মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে অঞ্চলটিকে দখল করে রেখেছে। পাকিস্তান কাশ্মিরের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ জনআন্দোলনরূপে স্বীকার করে।
• পাকিস্তান দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে যে, ভারত কাশ্মিরে কেবল স্বাধীনতাকেই দমন করছে না- হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের মাধ্যমে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, যা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের নিন্দা ও প্রতিবাদ করা উচিত।
• পাকিস্তানের মতে, ভারত কাশ্মির দখলের ক্ষেত্রে উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার নেপথ্যে কার্যকর দ্বি-জাতি তত্ত্ব মানেনি- জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সিদ্ধান্ত পালন করেনি।
• পাকিস্তান মনে করে, কাশ্মিরে সময় সময় যে নির্বাচন হচ্ছে, সেটা বৈধতাহীন ও জনগণের সমর্থনবিহীন। কারণ ৭০-৮০ ভাগ জনগণই ভোট বয়কট ও বর্জন করে।
কাশ্মির প্রসঙ্গে চীনের মনোভাব
• চীন সরকার কাশ্মিরের উত্তর দিকের সীমান্তকে মেনে নেয়নি। চীন মনে করে সেখানে কিছু অংশের মালিক সে।
• চীন কারাকোরাম ও আকসাই চীন অঞ্চলের মতো অরুণাচল ও হিমাচল প্রদেশের কিছু অংশকে নিজের বলে দাবি করে।
• ১৯৬৩ সালে ট্রান্স কারাকোরামে চীন পাকিস্তানের সঙ্গে সীমানা বিষয়ক সমঝোতা করলেও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত বিদ্যমান রেখেছে।
কাশ্মিরীদের মনোভাব
• জম্মু ও কাশ্মির কখনোই ভারতের অধীনে ছিল না, এমনকি অঞ্চলটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির অধীনেও ছিল না। ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীন ও স্বশাসিত ছিল।
• কাশ্মিরকে ভারত-পাকিস্তান এবং সামান্য হলেও চীন কর্তৃক অধিকার করে রাখা অন্যায়। কাশ্মিরকে মূল ভৌগোলিক আকার ও আয়তনে কাশ্মিরীদের অধীনে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়াই সঙ্কট নিরসনের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত।
• মহারাজা রাজধানী থেকে পালিয়ে গিয়ে ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি করেন, তা আইনগতভাবে ভিত্তিহীন ও জনগণের সামান্যতম সমর্থনবিহীন। মহারাজার চুক্তি করার কর্তৃত্ব নেই।
• কাশ্মিরে শাসনতান্ত্রিক পরিষদ কর্তৃক ভারতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিছক সাজানো নাটক। কাশ্মিরের কেউই তা মানেনি- গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মিরের জনগণকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রদানই ন্যায়সংঙ্গত কাজ ছিল- যা ভারতের চাপে ও অসহযোগিতায় হতে পারেনি। তবে কাশ্মিরী জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতার কথা এবং ভারতের সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে।
• কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলন আইনগত ও রাজনৈতিকভাবে বৈধ। এর সঙ্গে জঙ্গিবাদ বা অন্য কিছুর সম্পর্ক নেই। ভারত বরং গণআন্দোলনকে ক্ষুদ্র গন্ডিতে ব্যাখ্যা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
(৬)
কাশ্মিরের বর্তমান পরিস্থিতি এই ২০১০ সালে অত্যন্ত অগ্নিগর্ভ। ভারত নানা আলোচনার ফাঁদে এবং নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্য দিকে কেবলমাত্র ১৯৯০-১৯৯৯ সালের মধ্যে ১০ হাজার স্বাধীনতাকামী নিহত হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে ১৫ হাজার নারী। গৃহহীন ও আটক হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ১৯৪৭ থেকে হিসাব করা হলে সেই সংখ্যা উদ্বেগজনক। ভারতীয় বিশ্লেষক স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে, ‘‘ভূ-স্বর্গ এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় অবরুদ্ধ এক উপত্যকা। ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মিরের অধিবাসীদের সাম্প্রতিক প্রতিবাদ এবং তৎসহ আন্দোলন ভয়াবহতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে- রক্তাক্ত হয়েছে কাশ্মিরের নাগরিক জীবন।’’
এ কথা ঠিক যে, কাশ্মির সমস্যা নতুন নয় এবং সমস্যাটির সমাধান হচ্ছে না । বিশেষ করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সমস্যা জিইয়ে রাখছে সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও জনগণের রক্তের বিনিময়ে। ভারত সরকারের দেয়া জোড়াতালির সমাধানের বদলে কাশ্মিরের মানুষ চাইছে পূর্ণ এবং স্বচ্ছ স্বাধীনতা। সরকারের অনেক রকম প্রলোভনের মতো ২০১০ সালে ঘোষিত হয়েছে ৮ দফা শান্তি প্রস্তাব। অস্ত্রধারী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর পাথর ছোড়ার দায়ে গ্রেফতারকৃত কাশ্মিরী যুবক-যুবতীদের মুক্তি, নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত ১০৮ জনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট এবং ব্যাঙ্কারের সংখ্যা কমানো- এমন অনেক উপাদানই রয়েছে এই আটটি প্রস্তাবে। তবে শান্তি প্রস্তাবের দু’টি দিক সর্বাক্ষেপা গুরুত্বপূর্ণ : ১. কাশ্মিরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যথাযথ আলোচনার জন্য থাকবে একটি নতুন আলোচনাকারী দল এবং ২. কেন্দ্রের নির্দেশে সংযুক্ত কমান্ড কাশ্মিরের উপদ্রুত ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা খতিয়ে দেখবে।
এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, কাশ্মিরী জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশই এখন ইন্ডিয়ার সঙ্গে থাকতে নারাজ। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুললাহ ও তার দল কম জনসমর্থন নিয়ে যাই বলুক না কেন, জনপ্রিয় দল হুররিয়াত কনফারেন্সের নেতা সৈয়দ আলি শাহ গিলানি কাশ্মিরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন না। স্বাধীনতার তীব্র আন্দোলনরত কাশ্মিরের পরিস্থিতি গিলানির বক্তব্যকেই সত্য বলে প্রমাণিত করেছে। গত ছয় দশকে কাশ্মির নিয়ে অন্তত শতাধিক আলোচনা চক্র হলেও ফল হয়নি কিছুই। এসকল বাতকা বাত মানুষের মধ্য থেকে স্বাধীনতার স্পৃহা লুপ্ত করতে পারেনি- যেমন পারেনি সামরিক আক্রমণ। তাহলে সমাধান কোন পথে? বলা বাহুল্য, কাশ্মিরের স্বাধীনতাই হল একমাত্র সমাধান। আনন্দের বিষয় হলো, কোন ভারতীয় বিবেকের কাছে সৎ থেকে অবশেষে বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, স্বায়ত্তশাসন বা অন্য কিছু নয় আজাদি বা পূর্ণ স্বাধীনতাই চাইছেন কাশ্মিরের জনগণ। এ রকম একটি মূল্যায়নকে উপসংহার হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে :
বিগত ষাট বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পর গঠিত ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বাধীন কাশ্মিরের উপর দখল কায়েম করতে চায়। কাশ্মিরের মহারাজা জনচাপ সামলাতে না পেরে ভারতের পক্ষে চলে যান এবং ১৯৪৭ এর ২৬ অকটোবর ভারতে শর্ত সাপেক্ষে অন্তর্ভুক্তি বা ‘Instrument of Accession’-এ সই করেন যা জনগণ মেনে নেয়নি। জাতিসংঘ (১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল) কাশ্মিরের জনগণের মতামত অনুযায়ী কাশ্মিরের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্তটিও বাস্তবায়ন করা যায়নি। এজন্য গণভোট অনুষ্ঠান করা যায়নি। অন্যদিকে ১৯৪৭-এ ভারতভুক্তির পর থেকেই শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মিরী জাতিসত্তার স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনের চাপেই ভারত সরকার জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কয়েকটি বিশেষ সুবিধা প্রদান করে- জনগণ যাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এতে স্বাধীনতার বদলে কাশ্মিরীরা পায় খানিকটা স্বায়ত্ত্বশাসন- যা আসলে কাশ্মিরী জনতার স্বাধীনতার দাবিকে প্রশমিত করার ষড়যন্ত্র মাত্র। কাশ্মিরীদের স্বাধীনতার আন্দোলন ও জনদাবিকে অবদমিত করে রাখার দমনমূলক নীতি থেকে ভারত কখনও সরে আসেনি। সেনা পাঠিয়ে, নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়ে, রাজ্যে পুতুল সরকার বসিয়ে আসলে সামরিক শাসনই চালানো হচ্ছে কাশ্মিরে। যতবার স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন দানা বেঁধেছে, ততবারই চলেছে সেনা আগ্রাসন। পুলিশি নির্যাতন, মানবাধিকার লংঘন, গুম, খুন, ভূয়া সংঘর্ষ সাজিয়ে খুন, গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা। আর বারবারই কাশ্মিরের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে গণআন্দোলনে ‘আইন শৃংখলার সমস্যা’ বা সন্ত্রাসবাদ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’ আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বলা হয়েছে ‘পাক-মদদপুষ্ট জঙ্গি।’ এতেও আন্দোলন থামেনি। উপত্যকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা কাশ্মিরী জনগণের স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতো তাদের শাসনক্ষমতার লোভ দেখিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন, ন্যাশনাল কনফারেন্স, যার নেতা ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহকে কাশ্মিরী জনতার কাছে নেতা হিসাবে দাঁড় করানো হয়- যদিও ব্যাপক জনগণের মধ্যে তাকে নিয়ে আপত্তি রয়েছে। যে স্বাধীনতার দাবি নিয়ে শেখ আবদুল্লাহর উত্থান, সেই মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে কাশ্মিরী জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁর পুত্র ফারুক ও পৌত্র ওমর আবদুল্লাহ। এঁরা বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করেছেন এবং কাশ্মির উপত্যকায় ভারত রাষ্ট্রের শোষণের প্রতিনিধিতে পরিণত হয়েছেন। প্রতিবারের মতো এবারও এঁরা আন্দোলনকারীদের ‘পাকপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আন্দোলন বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। আন্দোলনকারীদের উপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় আক্রমণ যেমন, পুলিশি হামলা, গ্রেফতার, নির্বিকার হত্যাকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন।
ফারুক-ওমর সশস্ত্রবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন-এর মত গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বকারী, স্বৈরাচারী আইন সরাসরি সমর্থন করে কাশ্মিরী জনতার মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। স্বাধীনতাকে গুরুত্ব না দিয়ে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দিয়ে, কাশ্মিরের আইন-শৃংখলার অবনতির দোহাই দিয়ে, স্বাধীনতাকামী হুররিয়াত কনফারেন্স ও অন্যান্য বিরোধী ও আন্দোলনকারী নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসে আন্দোলনের মূল দাবিকে চাপা দিতে চাইছেন। কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনভাবে কাশ্মির সমস্যার সমধান সম্ভব নয়।


[প্রবন্ধটি ১২ই ফেব্রুয়ারী, ২০১১ তারিখ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত হয়।

 

রেফারেন্সঃ

. কাশ্মির ইস্যুর গুরুত্বের বিষয়টি ও বাংলাদেশের নানা শ্রেণী ও পেশার নাগরিকগণের উদ্বেগ ও চিন্তার বহি:প্রকাশ নানা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-আলোচনায় উঠে আসতে দেখা যায়। গত ৩ অকটোবর ২০১০, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়া ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি সোসাইটি (এসএওয়াইপিপি) ‘‘কাশ্মির ইস্যু এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা : বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ভাবনা’’ শীর্ষক এক সেমিনারের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিআইসি গত ২৭ নভেম্বর, ২০১০ তারিখে কাশ্মিরের সমস্যা নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে।
. উক্ত সেমিনারের আলোকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভাষ্য। দ্রষ্টব্য, প্রথম আলো, ৪ অকটোবর ২০১০, পৃষ্ঠা ১৯.
. Kashmir and Jammu-Imperial Gazetter of `India, Vol. 15. P.72 থেকে জানা যায়, কাশ্মিরের অবস্থান ৩২০১৭´ থেকে ৩৬০৫৮´ উত্তর এবং ৭৩০২৬´ থেকে ৮০০৩০´ পূর্বে। জম্মু হল সর্ব দক্ষিণ অংশ, যা পাঞ্জাবের ঝিলাম, গুজরাট, শিয়ালকোট ও গুরুদাসপুরের সন্নিকটে অবস্থিত। উত্তরে হিমালয়ের প্রায় ৮ হাজার ফুট উচ্চস্থান পর্যন্ত কাশ্মিরের বিস্তার যা পামিরের মালভূমির দিকে চলে গেছে। পুরো অঞ্চলটিই একটি অনিন্দ-সুন্দর উপত্যকা, যেখানে পাইন, ডক, ঝাউ, চিনার বৃক্ষ আর রডোড্রেনড্রান ফুলের ছড়াছড়িতে রঙিন। চিনাব আর ঝিলাম নদীর সঙ্গে অসংখ্য হ্রদ মিলেমিশে কাশ্মিরের নিসর্গকে স্বর্গীয় মহিমায় উদ্ভাসিত করেছে যা এখন রক্তাক্ত ও আক্রান্ত (আয়তন ৮০,৯০০ বর্গ মাইল)।
. A. Lamb, 1991, Kashmir : A disputed Legacy (1846-1990), Roxford Books.
. Kazi S. M. Khasrul Alam Quddusi, “Kashmir Issue : Historical Perspective and Youth-led Uprising, “Keynote Paper of Seminar organized by SAYPPS, University of Chittagong, October 3, 2010.
. Rekha Chowdhury, “The Second Uprising”, Economic and Political Weekly, Vol. XLV, No.39, Sept. 25, 2010.
. ব্রিটিশ শিখ যুদ্ধের সময় গুলাব সিং প্রথমে নিরপেক্ষ এবং পরে জম্মু থেকে ইংরেজদের সাহায্য সহযোগিতা করে। দালালির পুরস্কার স্বরূপ তাকে মাহরাজা উপাধি ও কাশ্মির দেয় ইংরেজরা।
. Mridu Rai, 2000, The Question of Religion in Kashmir : Sovereignty, Legitimacy and Right, (1846-1947), Ph, Thesis, Columbia University.
. Kashmir and Jammu Imperial Gajttee of India, Vol.15, p. 96.
. দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে হায়দারাবাদ, জুনাগড়, কুচবিহার, ত্রিপুরা, জম্মু ও কাশ্মির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
. মাহফুজ পারভেজ, ‘ভারতের বৈরী আচরণ’ সেমিনার স্বারক ২০০৮, বিআইসি, ঢাকা।
. A. Lamb, পূর্বোক্ত।
. পূর্বোক্ত।
. বিস্তারিত, Kazi S.M. Khasrul Alam Quddusi (2010). p.3
. সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা দ্রষ্টব্য। যুদ্ধের মধ্যে কারগিল ও সিনায়চেনে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। আর কাশ্মিরে মিছিল-মিটিং ও বাড়ি ঘর থেকে ধরে নিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা প্রচুর।
. ভারত সরকারের মিনিস্ট্রি অব একস্ট্রারন্যাল আফেয়ার্স কাশ্মির সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে যে মনোভাব ও অবস্থান ব্যক্ত করেছে, এখানে তার সারাংশ তুলে ধরা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে, দেখুন (www.meaindia.nic.in).
. ভারতের এই দাবি অত্যন্ত বিতর্কিত এবং অস্বচ্ছ। কোথাও স্পষ্টত ভারতে অন্তর্ভুক্তির কথা চুক্তিতে নেই। তদুপরি শাসনতান্ত্রিক পরিষদের ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন রয়েছে। ভারত কর্তৃক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এমনটি করানো হয়েছে পরিষদের দ্বারা। যেমনভাবে সিকিমকেও পরে ভারত গ্রাস করে।
. ভারতের এই দাবির হাস্যকর দিকটি সম্পর্কে সকলেই অবগত। কারণ, কাশ্মির এখন সেনা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে বাইরের কেউ যেতে পারে না এবং স্থানীয় মানুষের জীবনও চলছে সেনা আইনে- গণতান্ত্রিক/মানবাধিকারের ভিত্তিতে নয়।
. Kazi S.M. Khasrul Alam Quddusi (2010), p-4
. Aftab Sadar, The Kashmir Issue, Myth and Reality, Delhi, 2002.
. পূর্বোক্ত।
. পূর্বোক্ত।
. Human Rights Watch Report 2001.
. পুষ্পল গঙ্গোপাধ্যায়, দেশ, ২ অকটোবর ২০১০.
. বিস্তারিত, পুর্বোক্ত।
. রুদ্র সেন, দেশ, ২ অকটোবর, ২০১০