ইহুদীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে জায়নবাদ (Zionism) নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। হিব্রু Zion শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। বলা বাহুল্য জয়ন হচ্ছে জেরুসালেমের একটি পাহাড়ের নাম এবং এর অর্থ হচ্ছে দাগ কাটার মতো ঘটনা বা স্মৃতি উৎসব। জায়নবাদ একক প্রস্তরের স্তম্ভ (Monolithic) ভিত্তিক আদর্শবাদী কোনও আন্দোলনের নাম নয়। 

এর বিভিন্ন রূপ রয়েছে; যেমন বার বরোচভের ন্যায় সমাজতান্ত্রিক, রাবিবস কুক ও রেইনেস এর ন্যায় ধর্মীয়, জীভ জারেটিনক্সির ন্যায় জাতীয়তাবাদী ও এসব জিন্সবার্গ (আহাদ হা’ম) এর ন্যায় সাংস্কৃতিক জায়নবাদীরাও এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ইউরোপ মহাদেশে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং বিদ্যমান পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে জায়নবাদ একটি মতবাদ হিসেবে বিকশিত হয়েছে এবং সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে বুদ্ধিবৃত্তিক স্রোতধারার বিভিন্ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দেশ ও চিন্তাবিদদের প্রকৃতি- বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে এই মতবাদ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রং ধারন করেছে। এ প্রেক্ষিতে জায়নবাদকে কোনও একক ব্যক্তি, গায়েবী গ্রন্থ, কোনও উক্তি বা ঘোষণার অভিব্যক্তি বলা যাবে না। ইহুদীরা জায়নবাদকে বিংশ শতাব্দিতে তাদের আদর্শিক সাফল্য গাথা বলে মনে করেন। একটি অসম্ভব স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য এই মতবাদ অনেক বাধার বিন্দাচল অতিক্রম করেছে। কেউ কেউ দাবী করে থাকেন যে জায়নবাদ প্রকৃত পক্ষে অনিষ্টকারী কোনও ষড়যন্ত্রের নাম নয়। তবে এটা স্বীকার করেন যে এই মতবাদ থেকে উৎসারিত কর্মকান্ড বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে একটি তীব্র গণবিদ্বেষ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। জায়নবাদকে পরিষ্কারভাবে জানতে হলে ইহুদীবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা বাঞ্চনীয়। বস্ত্ততঃ ইহুদীবাদ এবং জায়নবাদ হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
আল কুরআনে বণী ইসরাইল ও ইহুদী জাতি
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ) এর দুই পুত্র হযরত ইসমাইল (আ) এবং হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন আল্লাহর মনোনীত নবী। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর অপর নাম ছিল ইসরাইল (আ)। বাদশাহ নমরুদের প্রধান পুরোহিত আজরের সন্তান হওয়া সত্তেও ইব্রাহিম (আ) তাওহীদের উপর ইমান আনেন এবং সকল প্রকার শিরক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। এই অপরাধে বাদশাহ নমরুদ তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেন এবং আল্লাহ তাঁর অসীম রহমতে তাঁকে রক্ষা করেন। এর পর তিনি পিতৃভূমি ইরাক থেকে হিজরাত করে মিশর, জর্দান ও সওদী আরব সহ বিভিন্ন দেশে দ্বীনে হক এর দাওয়াত পেশ করতে থাকেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি স্বপ্নে প্রাপ্ত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানী করতে উদ্যত হন। আল্লাহ তাঁর এই কুরবানী গ্রহণ করেন। শৈশব থেকে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত তিনি দ্বীনে হক এর প্রতি যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন এবং তার জন্য নিজের সর্বস্ব কুরবানী করার যে নজির স্থাপন করেছেন আল্লাহ ইব্রাহিম (আ) কে এর প্রতিদান হিসেবে যে পুরস্কার দিয়েছেন সূরা আল বাকারার ১২৪ নং আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটির তর্জমা হচ্ছে, ‘‘ইব্রাহিমকে তার রব কিছু কিছু ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন। সে সব পরীক্ষায় সে সফল হল। তাকে আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানাবো। ইব্রাহিম নিবেদন করলেন, আর আমার বংশধরদের ব্যাপারেও কি এই ওয়াদা? উত্তরে আল্লাহ বললেন, আমার ওয়াদা যালিমদের জন্য নয়,’’।
আল্লাহ তাঁর ওয়াদা অনুযায়ী হযরত ইব্রাহিম (আ) কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি তাঁর দুই পুত্র হযরত ইসহাক ও হযরত ইসমাইল উভয়েই নবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। হযরত ইসহাক (আ) এর ছেলে হযরত ইয়াকুব (আ) ও নবী ছিলেন। তাঁর অপর নাম ছিল ইসরাইল অথাৎ আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর দাস। তাঁর বংশধররাই ইতিহাসে বনি ইসরাইল নামে খ্যাত। ইয়াকুব (আ) এর ১২টি ছেলের মধ্যে চতুর্থ ছেলের নাম ছিল ইয়াহুদা। ইহুদীরা হচ্ছে প্রকৃত পক্ষে ইয়াহুদারই বংশধর। তার থেকেই বনি ইসরাইলের ১২টি বংশের উৎপত্তি ঘটে। মাওলানা হামিদুদ্দীন ফারাহীর বর্ণনানুযায়ী ইয়াশুব রাজত্ব কালে অধিকৃত সকল এলাকা এই বারোটি বংশের মধ্যে বন্টন করা হয়। ফলে প্রাচীন আরবের এরশেলেম নামক স্থান থেকে শুরু করে দক্ষিণের সমগ্র এলাকা বনি ইয়াহুদের অধীনে চলে যায়। হযরত দাউদ (আ) এই বংশের লোক ছিলেন। তাঁর আমলে সমগ্র এলাকা বনি ইসরাইলের করতলগত হয়। তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আ) এর সময় ‘হাইকেলে সুলাইমানী’ তৈরী হয়েছিল। তাঁরা উভয়ে নবী ছিলেন।
হযরত সুলাইমান (আ) এর পরেই বনি ইসরাইলদের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। তারা দুভাগে বিভিক্ত হয়ে পড়ে। এর এক অংশের নাম বনি ইয়াহুদা অপর অংশ বনি ইসরাইল নামে পরিচিতি লাভ করে। কালের আবর্তে ইয়াহুদা ও বনি ইসরাইল ছাড়া অপর বংশের সমূহের নাম নিশানা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর পর ইতিহাসের পাতায় শুধু ইয়াহুদা ও বনী ইসরাইলের নামই পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ইতিহাসের রেকর্ড অনুযায়ী এরা যখন কালদানীদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ে তখন বনী ইসরাইল নামটি ইহুদীদের সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং কাল পরিক্রমায় ইসরাইল ও ইহুদী জাতি সম্মিলিত ভাবে একক একটি জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
এখানে আরেকটু গভীরে যাওয়া দরকার। এটা সর্বজনবিদিত যে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের পর হযরত ইব্রাহিম (আ) ছিলেন প্রথম বিশ্বজনীন নবী। ইসলামের দাওয়াত পৌছাবার জন্য প্রথমে তিনি নিজে সশরীরে ইরাক থেকে মিশর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে ইসলাম তথা আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান করতে থাকেন। এর পর তিনি এই মিশন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। এরই অংশ হিসেবে পূর্ব জর্দানে হযরত লুত (আ) কে নিযুক্ত করা হয়। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে নিযুক্তি পান তাঁর ছোট ছেলে হযরত ইসহাক (আ) (বিবি সারার গর্ভজাত) এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন তাঁর বড় ছেলে হযরত ইসমাইল (আ) কে (বিবি হাজেরার গর্ভজাত)। এর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে তিনি মক্কায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং তাঁকে সারা দুনিয়ার দীনী মিশনের কেন্দ্রে পরিণত করেন।
উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে হযরত ইব্রাহিম (আ) এর বংশ ধারা দুটি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি শাখা হচ্ছে হযরত ইসরাইলের সন্তান সন্তাতিবর্গ। এরা আরবের বাসিন্দা। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় শাখায় হযরত ইয়াকুব (আ) হযরত ইউসুফ (আ), হযরত মুসা (আ), হযরত দাউদ (আ), হযরত সুলাইমান (আ), হযরত ইয়াহিয়া (আ) হযরত ঈসা (আ) প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইয়াকুবের যেহেতু আরেক নাম ছিল ইসরাইল সেহেতু তাঁর বংশ বনী ইসরাইল নামে পরিচিত হয়। এই বংশধারার অবনতি ও অধঃপতন সূচিত হলে প্রথমে ইহুদীবাদ ও পরে খৃস্টবাদের উদ্ভব ঘটে। ইহুদীরা মুহাম্মাদ (সালস্নালস্নাহু আলাইহি ওয়াসালস্নাম) কে নবী হিসেবে গ্রহণ করেনি কেন না তিনি ইসমাইলের বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। ইহুদীরা বিবি হাজেরার গর্ভজাত বলে আরবদের Haggarine এবং ইসলামকে Haggarism বলে থাকে।
বনি ইসরাইলদের প্রতি আল্লাহর রহমত
আগেই বলেছি বনি ইসরাইলদের পূর্ব পুরুষ ও মিল্লাতে মুসলিমার পিতা ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ)। তারা যতদিন তার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে চলেছে, সততা, সরলতা ও পরিপূর্ণভাবে তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে ততদিন গোটা মানব জাতির ধর্মীয় নেতা ও পথ প্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেছে। দায়িত্ব পালনের এই মেয়াদ প্রায় পাঁচ হাজার বছর। আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে একটি জাতি হিসেবে বনী ইসরাইলের নেতৃত্ব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল বাকারার ৬৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘যে কিতাব তোমাদের দেয়া হয়েছে তা তোমরা মজবুত করে আকড়ে ধরবে। এতে যে হুকুম আহকাম ও উপদেশ বাণী লেখা আছে তা স্মরণ রাখবে। বস্তত: এরই সাহায্যে আশা করা যায় তোমরা তাকওয়ার নীতি মেনে চলতে পারবে।’’ একই সূরার ৮৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে,’’ আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবে না। পিতা মাতার সাথে, আত্মীয় স্বজনের সাথে, ইয়াতিম মিসকিনের সাথে ভাল ব্যবহার করবে। সাধারন মানুষের সাথে ভাল আচরণ করবে, মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া তোমরা সকলেই এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ এবং এখন পর্যন্ত সেই অবস্থাতেই আছ।’’ সূরা আল মায়েদার ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে,’’ আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের সাথে আছি যদি তোমরা নামাজ কায়েম রাখো যাকাত আদায় করো এবং আমার নবী গণকে মান্য করো, তাদের সাহায্য এবং শক্তি বৃদ্ধি করো এবং তোমাদের আল্লাহকে উত্তম কর্জ দিতে থাকো।’’ পথ ভ্রষ্ট হবার আগ পর্যন্ত বনি ইসরাইলদের পথ ছিল ইব্রাহীম (আ) এর পথ, তাওহীদের পথ। সূরা আল আনআমের ১৬১-১৬৩ নং আয়াতে আল কোরআন একথাই বলেছে। এতে বলা হয়েছে,
‘‘(হে মুহাম্মাদ) বলুন, আমার রব নিঃসন্দেহে আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সম্পূর্ণ ও সর্বতোভাবে সঠিক দ্বীন। যাতে একটু বাঁকা তেড়া নেই। ইব্রাহীমের পথ যা তিনি একাগ্রমনে অবলম্বন করেছিলেন। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। বলো, (হে রাসূল) আমার নামাজ আমার সকল নিয়ম কানুন, আমার জীবন আমার মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহ তায়ালার জন্য। যার কোন শরীক নেই। আমাকে একবারই আদেশ দেয়া হয়েছে। আর ইবাদাতের জন্য মাথা নতকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম।’’
বস্ত্তত: বনি ইসরাইল ও বনি ইয়াহুদাকে দাওয়াতে হকের পতাকাবাহী হিসেবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল। শাহাদাতে হক বা সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করাকে তাদের বুনিয়াদী দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবেও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। সূরা আলে ইমরানের ১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘‘এই সব আহলে কিতাবকে (বনী ইসরাইল) সেই ওয়াদাও স্মরণ করিয়ে দাও যা আল্লাহ তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তা এই যে তোমাদেরকে কিতাবের শিক্ষা লোকদের মধ্যে প্রচার করতে হবে। একে গোপন রাখতে পারবে না। কিন্তু তারা কিতাবকে পিছনের দিকে ফেলে রেখেছে এবং সামান্য মূল্যে তাকে বিক্রয় করেছে। তারা এসব যা কিছু করেছে তা কতই না খারাপ কাজ।’’
বনী ইসরাইলকে আল্লাহ যে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন প্রথম দিকে তারা তা সার্থকভাবেই পালন করেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাঁর রহমতের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনি তাঁর অসংখ্য নবী ও পাঠিয়েছেন। সন্দেহ নেই যে এই জাতির মধ্যে অনেক ভাল লোক ও ছিলেন যাঁরা এসব নবীদের (আ) ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। তাঁদের সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু এই গোষ্ঠির অধিকাংশ মানুষের আচার আচরণ কালক্রমে আল্লাহর কিতাব তাঁর হুকুম আহকাম এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি লজ্জাজনক ও শত্রু ভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বনী ইসরাইলদের পরহেজগার মুত্তাকী সদস্যদের প্রশংসা করা হয়েছে। সূরা আস্ সাজদার ২৩-২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
‘‘এর আগে আমি মূসাকে কিতাব দান করেছি। অতএব তা লাভ করা সম্পর্কে তোমাদের মনে কোনও সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া উচিত নয়। এই কিতাবকে আমি বনি ইসরাইলের জন্য হিদায়াত হিসেবে বানিয়েছি। যতদিন তারা ধৈর্য ধারন করেছে এবং আমার আয়াতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, ততদিন আমি তাদের মধ্যে এমন পথ প্রদর্শক ও নেতা পাঠিয়েছি যারা আমার নির্দেশে তাদের মধ্যে পথ প্রদর্শনের কাজ করেছে।’’
সূরা আল আরাফের ১৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘আর আমি এ ফিরআউন গোষ্ঠির যায়গায় ঐ সব লোকদেরকে এই জমিনের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত বলয়ের ওয়ারিশ বানিয়ে দিয়েছি সমৃদ্ধশালী করেছি যাদেরকে তারা দুর্বল করে রেখেছিল। এভাবে বনি ইসরাইলদের ব্যাপারে তোমার আল্লাহর কল্যাণময় ওয়াদা পূরণ হয়েছে। কারণ তারা ধৈর্যের সাথে কাজ করেছিল। আর ফেরআউন ও তার লোক জনদের সে সব কিছুই আমরা বরবাদ করে ছিলাম যা তারা বানাচ্ছিল এবং উঁচু করেছিল।
সূরা আল বাকারার ২৪৯-২৫১ নং আয়াতে তালুত এবং তাঁর সঙ্গী সাথীদের সত্যবাদিতা ও দৃঢ়তার কথা উল্লেখ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে,
‘‘এর পর তালুত এবং তার সহযাত্রী মুসলিমগণ যখন নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো তখন তারা তালুতকে বললো, আজ জালুত ও তার সৈন্য বাহিনীর সাথে মুকাবিলা করার কোন শক্তিই আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু যারা মনে করতো যে তাদেরকে একদিন আল্লাহর সাথে নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ করতে হবে তারা বললো: অনেকবারই দেখা গেছে যে এক ক্ষুদ্রতম দল আল্লাহর অনুমতি ক্রমে একটি বৃহত্তর দলের উপরে বিজয়ী হয়েছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন। যখন তারা জালুত ও তার সৈন্য বাহিনীর সম্মুখীন হলো তখন তারা দোয়া করলো: হে আমাদের রব আমাদেরকে ধৈর্যদান কর, আমাদের পদক্ষেপ সুদৃঢ় কর এবং এই কাফির দলের উপরে আমাদেরকে বিজয় দান কর। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অনুমতি ক্রমে তারা কাফিরদের পরাজিত করেছিল।’’
পক্ষান্তরে আল্লাহর অনুগ্রহ বিশ্ব জাহানের নেতৃত্ব মর্যাদা ও গৌরব পাওয়া সত্তেও বনি ইসরাইল তথা ইহুদীরা শেষ পর্যন্ত নাফরমানির পথকেই বেছে নিয়েছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল বেঈমান। তারা আল্লাহকে প্রদত্ত ওয়াদা খেলাপ করে বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল। সূরা আল মায়েদার ৬৯-৭১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘‘আমি বনী ইসরাইল থেকে মজবুত ওয়াদা গ্রহণ করেছি। তাদের নিকট অনেক রাসূল পাঠিয়েছি কিন্তু যখনি কোনও রাসুল তাদের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনও কথা নিয়ে এসেছে তখন তারা কাউকে মিথ্যাবাদী বলেছে, কাউকে হত্যা করেছে; এবং নিজেরা ধারনা করে নিয়েছে যে এখন আর কোনও ফিৎনার সৃষ্টি হবে না। তাই তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছিল, এর পরও আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্তেও তাদের লোক আরো বেশি অন্ধ ও বধির হতে চললো;
সূরা আল জাসিয়ার ১৬-১৭ নং আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামীন বনী ইসরাইল জাতির নাফরমানীর একটি ইতিহাস তুলে ধরেছেন। এতে বলা হয়েছে।
‘‘এর আগে আমি বনি ইসরাইলকে কিতাব হুকুম ও নবুয়াত দান করেছি। তাদেরকে আমি জীবন ধারনের জন্য উত্তম জীবিকা দান করেছিলাম। গোটা দুনিয়ার মানুষের উপর তাদেরকে অধিক মর্যাদাশীল করেছিলাম, দ্বীনের ব্যাপারে তাদেরকে সুস্পষ্ট হিদায়াত দান করেছিলাম। এরপর তাদের মধ্যে যে মতামত সৃষ্টি হলো তা তাদের অজ্ঞতার কারনে নয়, বরং নির্ভুল জ্ঞান লাভের পরই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। আর তা হয়েছে এ কারণে যে তারা একে অপরের উপর বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিল।’’
বনী ইসরাইল জাতি যখন অধঃপতনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন আল্লাহ তায়ালা বার বার তাদেরকে তার নেয়ামাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন নাফরমানির ইতিহাস তুলে ধরেন এবং সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের আহবান জানান। সূরা আল বাকারার ৬ থেকে ৯ নং রুকুতে আল্লাহ পাক এরই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এতে ফেরাউনী দলের দাসত্ব কালে তাদের করুন অবস্থা, পুত্র সন্তানদের হত্যা ও কন্যা সন্তানদের রেখে দেয়া, সাগরের বুক চিরে হিজরাতের পথ করে দেয়া, ফেরাউনী দলের নিমজ্জন, মূসা (আ) এর অনুপস্থিতিতে বাছুরের উপাসনা, আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলার জনŠ মুসা (আ) এর প্রতি বায়না, ভয়াবহ বজ্রপাতে তাদের মৃত্যু ও পুররুজ্জীবন দান, প্রচন্ড রোদের কষ্ট থেকে রক্ষা করার জন্য মেঘমালার ছায়া দান, বিনা পরিশ্রমে মান্না ও সালওয়ার ন্যায় সুস্বাদু খাবার সরবরাহ, প্রতিটি গোত্রের পানি চাহিদা মিটানোর জন্য স্বতন্ত্র ১২টি ঝর্না ধারার সৃষ্টি, খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি, গরু নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি, শনিবারের নিয়ম লংঘন, খুন রাহাজানির সাথে সম্পৃক্ততা, আমানতের খিয়ানত এবং আল্লাহর রহমত ও নেয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা এবং তার পরিণতি হিসেবে অভিশপ্ত জাতি হিসেবে তাদের বিধৃত করা হয়েছে।
এই পর্যায়ে একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়ের উপর আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। বিষয়টি হচ্ছে জাতিগত শত্রুতার ধরন প্রকৃতি। দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে শত্রুতা বা মনোমালিন্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। একটি জাতির হাতে আরেকটি জাতি সাময়িকভাবে কষ্ট পেতে পারে এবং এক পর্যায়ে তা বিদ্বেষ ও শত্রুতায় রূপান্তরিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর প্রকৃতি সাময়িকই হয় এবং কালক্রমে তা শেষও হয়ে যায়। পক্ষান্তরে পার্থিব জীবন এবং মানবেতিহাসে জাতিগত ভাগ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি তিক্ত সম্পর্ক ও পরিলক্ষিত হয় যা ইতিহাসের চিত্র ও শত্রুতার ধারাকে সরল রেখায় এগিয়ে নিয়ে যায়। স্থায়ী কারনের ভিত্তিতে এ ধরনের তিক্ততা গড়ে উঠে এবং জাতীয় ইতিহাসের সাথে এ ধারারও বিলুপ্তি ঘটে। এ প্রেক্ষিতে ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে সাময়িক শত্রুতা যে কোন জাতির বা দলের হতে পারে। ইতিহাসের ধারা বিশ্লেষন করলে তাদের সাথে কেবল দু’টি জাতির স্থায়ী ও চিরন্তন শত্রুতা দেখা যায়। স্বয়ং আল কোরআন এই বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে।
‘‘অবশ্যই যারা ইমান এনেছে তাদের প্রতি শত্রুতায় মানুষের মধ্যে ইহুদী এবং যারা শিরক করে তাদেরকেই তোমরা সব চেয়ে উগ্র দেখতে পাবে।’’ (সূরা আল মায়েদাঃ ৮২)
অর্থাৎ দুনিয়ার দু’টি জাতিই হবে ইসলামের অনুসারীদের প্রতি সব চে বেশি শত্রু ভাবাপন্ন; তাদের একটি ইহুদী অন্যটি মুশরিক। এ কথা অনস্বীকার্য যে চিরন্তন বঞ্চনার অনুভূতি থেকেই চিরন্তন শত্রুতার জন্ম হয়ে থাকে। সাম্প্রদায়িক শ্রেষ্ঠত্বের মতবাদে বিশ্বাসী হবার কারনেও একটি জাতি আরেকটি জাতির চিরস্থায়ী শত্রুতে পরিণত হতে পারে। দুনিয়ার এই মতবাদে বিশ্বাসী তিনটি জাতি ছিল। এরা হচ্ছে ইহুদী, হিন্দু এবং পার্সী। স্বভাব প্রকৃতির দিক থেকে এদের বৈশিষ্ট্য অনেকটা অভিন্ন। নৃতাত্বিক পরিভাষায় এদের বলা হয় insular বা সংকীর্ণমনা। এরা সর্বদা রক্ত, অস্থি ও বংশ ধারার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে এবং তাদের দৃষ্টি থাকে অভ্যন্তরের দিকে এবং নিজের আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে তারা এতই সজাগ যে প্রতিটি ব্যাপারে তারা নিজেদের জাতি বংশ ও রক্তধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে চায়। বিজিত ও পরাজিত সকল অবস্থায়ই তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভিন্নতার চেতনা ও বিদ্বেষ সক্রিয় থাকে। এই বৈশিষ্ট্যের তিনটি জাতির মধ্যে যরথুষ্ট্রীয় অগ্নি উপাসক পার্সী জাতিটি সংখ্যাল্পতার কারনে বিশ্ব ইতিহাসে প্রভাবহীন হয়ে পড়েছে। অপর জাতি দুটি হিন্দু (মুশরিক) এবং ইহুদীরা জাত্যাভিমান নিয়ে এখনো টিকে আছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে হিন্দু বলতে তারা ব্রাক্ষ্মনদেরই বুঝিয়ে থাকে। নিম্ন বর্ণের বৈশ্য,শুদ্র বা ক্ষত্রিয়দের জন্মই হয় ব্রাক্ষ্মনদের সেবা করার জন্য। তারা যতই নিখাদ হিন্দু হোক না কেন কখনো ব্রাক্ষ্মন হতে বা ব্রাক্ষ্মনের ন্যায় ধর্মীয় সুযোগ সুবিধা পেতে পারে না। কোনও অহিন্দু হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে বৈশ্য, শুদ্র বা ক্ষত্রিয়দের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে কিন্তু ব্রাহ্মণদের নয়। অর্থাৎ হিন্দু বিবেচনার ভিত্তি ঈমান বা বিশ্বাসের উপর নয় বরং বংশ ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত।
ইহুদীরা কাউকে ইহুদী বানায় না। কেউ ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করলেও ইহুদী হতে পারে না। এ প্রেক্ষিতে সারা বিশ্বে ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় গোত্রগুলো খুঁজে বের করার জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে কোনও গোত্রের সাথে তাদের গোত্র বা বংশগত সামঞ্জস্য। এই উদ্যোগ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে নববই এর দশকের শুরুতে তারা সুদানের একটি গোত্রের সাথে তাদের গোত্রকে ইহুদী ফালাসা (Falasha) নাম দিয়ে তাদের লক্ষ লক্ষ সদস্যকে ইসরাইল ভূমিতে বসতি স্থাপনের সুযোগ দিচ্ছে। এর কিছু কাল পর উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরাম রাজ্যের কোন কোন গোত্রকে তারা ইহুদী বলে গণ্য করেছে এবং তাদের ইসরাইলে স্থানান্তরের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাইরের ইহুদীদের এনে ইসরাইলে বসবাসের সুযোগ দেয়া বর্তমানে ইহুদীদের একটি জাতীয় প্রয়োজন। কেননা ইসরাইলের প্রতিরক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা অত্যন্ত জরুরী। আর এই কাজটি করার জন্য প্রথম ঠেলে দেয়া হয় অভিবাসীদের। কেননা ইহুদীরা প্রাণ দিতে ভয় পায়। হিন্দুদের মধ্যে যেমনি ব্রাক্ষ্মন ইহুদীদের মধ্যে তেমনি সেফারদিম (Sepherdim) এবং আশকেনাজিম (Ashkenazim) নামক দু’টি উচ্চ বর্ণের সম্প্রদায় আছে যারা নিজেদের ইসরাইলের মালিক বলে মনে করে।
আলকোরআনের সূরা আল মায়েদার ৮২ নং আয়াতের প্রসংগ উল্লেখ করে আমি পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে বলেছিলাম যে ইহুদী এবং মুশরিক এই দুটি জাতি হচ্ছে মুসলিমদের প্রতি সবচেয়ে বেশি শত্রুতামুখর। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) নির্দেশ প্রনিধান যোগ্য।
আবু সাঈদ আল খুদরী (রা) নবী (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘‘তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতি অনুসরণ করবে প্রতি পদে পদে এমন কি তারা কোন গো সাপের গর্তে ঢুকে পড়লে তোমরাও তেমনি করবে। আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল, তারা কি ইহুদী ও খৃস্টান? রাসূল (সা) বললেন, নয় তো কারা? ‘‘(সহীহ আল বুখারী কিতাবুস সুন্নাহ অনুসরণ অধ্যায়)। এই হাদীস থেকে প্রতিপন্ন হচ্ছে যে মুসলিমরা ইহুদী ও খৃস্টানদের পদাংক অনুসরণ করার ফিতনার জড়িয়ে পড়তে পারে। অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, ততদিন কিয়ামাত হবে না যতদিন না তোমরা ইহুদীদের সাথে লড়াই করবে। এমনকি পাথরের পেছনে লুকানো ইহুদীকে নির্দেশ করে পাথর বলবে, হে মুসলিম, আমার পেছনে লুকিয়ে আছে একজন ইহুদী, একে হত্যা করো (সহহি আল বুখারী, কিতাবুল জিহাদ)।
এই হাদীস থেকে মুসলিম ও ইহুদীদের মধ্যকার অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। এ থেকে ইহুদীদের মনোভাব, তাদের সৃষ্ট বিপর্যয় এবং মুসলিম উম্মাহর সাথে তাদের সর্বশেষ যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কেও কিছুটা আন্দাজ করা যায়। একই ভাবে সূরা আল মায়েদার ৮২ নং আয়াতে উল্লেখিত ‘‘যারা শিরক করে’’ এই বাক্যাংশটি বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার ভাবে বুঝা যায় যে এই পরিভাষাটি হিন্দুদের জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে ইহুদীদের জন্য ইয়াহুদ শব্দটি। হিন্দু এবং ইহুদী উভয় জাতি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঐক্যবব্ধভাবে কাজ করছে। বিশ্লেষকরা এ ব্যাপারে একমত যে বৃটিশ আমলে হিন্দুস্তানে হিন্দু জাতির মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তা চেতনার যে প্রবাহ সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রকৃত পক্ষে ইহুদী প্রাচ্যবিদদের প্রচেষ্টারই ফল। এ প্রসংগে রাসূল (সা) এর দুটি হাদীস গভীর চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে। প্রথম হাদীসটি ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে ‘‘হিন্দুস্তানের যুদ্ধ’’ শিরোনামের আওতায় উদ্বৃত করেছেন। তার দ্বিতীয় হাদীসটি ইমাম আত্ তাবরানী রাসূল (সা) এর মাওলা ছাওবান থেকে রেওয়াত করেছেন। প্রথম হাদীসে রাসূল (সা) বলেছেন, আমার উম্মাতের দুটি দলকে মহান আল্লাহ জাহান্নামের আগুন থেকে নিস্কৃতি দিয়েছেন, তাদের একটি দল হচ্ছে তারা যারা হিন্দুস্তানে যুদ্ধ করবে, অপর দলটি হচ্ছে যারা মারইয়াম পুত্র ঈসা আলাইহিসসালাম-এর সাথে থাকবেন। দ্বিতীয় হাদীসটিতে হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূল (সা) আমাদের সাথে হিন্দুস্তানের যুদ্ধের ওয়াদা করেছেন। যদি আমার জীবন কালে সে যুদ্ধ হয় তাহলে আমি নিজেকে ঐ যুদ্ধে সপে দেব। যদি আমি নিহত হই তাহলে আমি হবো সর্বোচ্চ মর্যাদার শহীদ। আর যদি আমি সশরীরে ফিরে আসি তাহলে আমি হবো গুনাহ মুক্ত আবু হুরাইরা। এ ব্যাপারে আল্লামা তাহের ইবনে আলী গুজরাটির তাজকিরাতুল মওদুআত গ্রন্থে উল্লেখিত আরেকটি হাদীস ও উল্লেখযোগ্য। হাদীসটি হচ্ছে ‘‘ইহুদী ও হিন্দুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো যদিও তারা হয় সন্তুরটি বংশজাত।’’ আল্লামা হুসাইন ইবনে মুহাম্মদ সিসানী লাহোরী এটিকে মত্তদু বা বানোয়াট হাদীস হিসেবে গন্য করলেও এখানে দুটি কথা ও প্রশ্নের প্রেক্ষিতে হাদীসটি থেকে সত্যের যে আভা বেরিয়ে আসে তার ভিত্তিতে এটি সম্পর্কে পুনরালোচনা এবং তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়। বলা বাহুল্য খৃস্টানরাও দীর্ঘকাল মুসলিমদের সাথে শত্রুতা করে আসছে। এই শত্রুতা খিলাফতে রাশেদার সময় থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে চলে আসলেও তাকে সাময়িক বলতে না পারলেও স্থায়ী শত্রুতা বলা যেতে পারে না। ঐতিহাসিকরা এর অনেকগুলো কারন উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে মুসলিমদের সাথে প্রকৃত খৃস্টানদের শত্রুতা বড় জোর ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত স্বীকার করে নেয়া যেতে পারে। পূর্ব রোমান তথা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর খৃস্টানদের বৃহত্তম অংশের শক্তি সামর্থ নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকে। বুখারী ও মুসলিমে উদ্বৃত্ত হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত একটি হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘‘ আর কাইসার অবশ্যই ধ্বংস হবে এবং এর পর আর কোন কাইসার আসবেনা।’’ মুসলিম শরীফে নাফে ইবনে উতবা বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল (সা) এর জামানা থেকে কিয়ামাত পর্যন্ত সময়কালকে বাইরের সংঘাতের ভিত্তিতে কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে জাযিরাতুল আরবের যুদ্ধ, পারশ্যের যুদ্ধ, রোমের যুদ্ধ এবং সর্বশেষ দাজ্জালের যুদ্ধ। এই দৃষ্টিতে বিচার করলে বলা যায় ১৪৫৩ এর পর এই জামানা শুরু হয়েছে তার অবসান ঘটবে দাজ্জালের সাথে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই পর্যায়ে খৃস্টানদের সাথে সরাসরি যুদ্ধের ইংগত নেই। আবু দাউদের কিতাবুল মালাহিমে খরুজুদ দাজ্জাল অধ্যায়ে এবং মুসনাদে আহমদে আবু হুরাইরার বর্ণনাবলীতে বর্ণিত হাদীস থেকে অনুমান করা যায় যে প্রকৃত খৃস্টানরা শেষ পর্যন্ত ইসলামের উপর ঈমান আনবে।
আসল খৃস্টান বলতে ইহুদীজাত খৃস্টান ইহুদী খৃস্টান এবং খৃস্টান ইহুদী ছাড়া বাকী সকল খৃস্টানকেই বুঝায়। ইহুদী খৃস্টান হচ্ছে এমন সব খৃস্টান যাদেরকে প্রকাশ্যে জায়নবাদী খৃস্টান বলা হয়। খৃস্টান ইহুদী হচ্ছে এমন সব ইহুদী যারা অন্তরের দিক থেকে ইহুদী কিন্তু বাহ্যতঃ নিজেদের মিশনের সফলতার জন্য খৃস্টান হয়ে গেছে। আবার ইহুদীজাত খৃস্টান হচ্ছে এমন সব খৃস্টান যারা ইহুদী চক্রান্তের ফলে আসল খৃস্টানদের প্রতি বিরূপ ও ক্ষুব্ধ হয়ে আলাদা হয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বের খৃস্টানদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি হচ্ছে এই ইহুদীজাত খৃস্টান। ১৪৫৩ সালের পর থেকে খৃস্টবাদের মূল ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে এই ইহুদী জাত খৃস্টান, খৃস্টবাদী ইহুদী ও ইহুদীবাদী খৃস্টানের ইতিহাস। এছাড়া ১০৯৯ সাল থেকে ১২১২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ক্রুসেড যুদ্ধ গুলোর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই যুদ্ধগুলোতে সমগ্র খৃস্টান জগত অংশ গ্রহণ করলেও মূলতঃ এগুলো ছিল ইহুদী চক্রান্তের ফল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইহুদীরা তাদের চিরশত্রু খৃস্টানদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে খৃস্টান জগত কেবল যে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় তাই নয় বরং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রোমের পোপ সহ ইউরোপের খৃস্টান রাজ্য গুলোও ইহুদীদের ঋণে আকণ্ঠ ডুবে যায়। এভাবে পর্দার আড়ালে থেকে ইহুদীরা খৃস্টবাদকে বিধ্বস্ত করে সমগ্র ইউরোপের নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
জায়নবাদের ক্রম বিকাশ
জায়নবাদের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এবং বাইরের ঘটনা প্রবাহ এই বিভক্তির জন্য দায়ী। জায়নবাদের এই অধ্যায়গুলো নিম্নরূপঃ
১. প্রাক-জায়নবাদঃ রাষ্ট্রহীন নাগরিক হিসেবে (Stateless citizen) ইহুদীদের দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর দীর্ঘ পরিক্রমায় সর্বদাই জায়নবাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি ও ইসরাইল ভূমির প্রতি ইহুদীদের বন্ধন অটুট ছিল। এই সময়ে ইহুদী পুনরুদ্ধার বা খৃস্টবাদের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের আকারে জায়নবাদ প্রকাশ করা হতো। Yovel Yirmiyahu-এর ভাষায়:
"Zionism was a natural product of the culture of the Jewish people in Exile. It did not spring full blown from a void with the creation of the Zionist movement in 1897. The central idea of Zionism, disputed by anti-zionists, is that the Jews are a people, a nation tied to a specific land and not just a religion. It is a misconception to think that this idea was born in 19th century. Since the Romans exiled the jews from the land that the Jews called Judea and the Romans called Palestine, the Jews had referred to the lands outside the land of Judea or Israel as Gola meaning "exile" rather than Diaspora and to their condition as Galut. Both were always terms with negative and bitter connotations. Implicitly then, there was a land from which Jews were exiled and to which they understood that they belonged.
ইহুদীদের দাবী অনুযায়ী খৃস্টের জন্মের প্রায় ১২০০ বছর পূর্ব থেকেই তারা ইসরাইল ভূমিতে বসবাস করে আসছিল। মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্যসাগরের সংগমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে এই ভূমিটি মিশর, সিরিয়া ও এশিয়া মাইনর, আবিসিনিয়া, বেবিলোনিয়া, পার্সিয়া, সিলিউসিড গ্রীক ও রোমানরা দখল করে নেয়। বিজয়ী জাতিসমূহের কেউই ইসরাইল ভূমিকে তাদের জাতীয় আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেনি ও একমাত্র ইহুদীরাই তাকে মাতৃভূমির মর্যাদা দিয়েছে। ইসরাইলের ইতিহাস, ভূগোল, আবহাওয়া, পরিবেশ সর্বত্রই ইহুদীদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস এবং আচার আচরণের ছাপ রয়েছে বলে তারা মনে করেন। বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট ইহুদীদের সৃষ্টি। এতে তাদের পুণ্যভূমি ও তাদের জাতীয় ইতিহাস বিধৃত রয়েছে। এই বাইবেল শুধু ইহুদীদের সংস্কৃতিরই ভিত্তি নয় বরং পাশ্চাত্যের খৃস্টানদের সংস্কৃতিরও মেরুদন্ড। রোমানরা ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদীদের নির্বাসনে পাঠানোর পর পিতৃভূমির সাথে তাদের সম্পর্ক একমাত্র বাইবেলই সংরক্ষণ করেছে। দৈনিক প্রার্থনায় তারা ফিলিস্তিনের পুনর্গঠন কামনা করেছে এবং মধ্যযুগের কবি সাহিত্যিকদের লিখনীতে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
ইহুদীরা ফিলিস্তিনের সাথে স্বাভাবিক ও আধ্যাত্মিক উভয় সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ১৩৫ সালের বার কোচা বিদ্রোহের পর থেকেই এমনকি তাদের এই যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। এই বিদ্রোহের পর রোমানরা ইহুদীদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করে। পরবর্তী বছরগুলোতে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং ক্রুসেডের আগে মুসলিম শাসনামলে ১০০০ খৃস্টাব্দে তাদের সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষে পৌছে। ক্রুসেডের নেতা কর্মীরা অধিকাংশ ইহুদী ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে, অনেককে নির্বাসনে পাঠায় এবং মুসলিম সেনানায়ক সালাহ উদ্দিন যখন ফিলিস্তিন পুনর্দখল করেন সেখানে ইহুদী পরিবারের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার।
মুসলিম শাসকরা ইহুদীদের প্রতি কখনো রূঢ় ব্যবহার করেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এই ইহুদীরা পর্যায়ক্রমে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেছে। কখনো তারা এসেছে ধর্ম প্রচারের নামে, তুর্কী শাসকদের আমন্ত্রণে অথবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নির্যাতনের হাত থেকে বাচার জন্য। তুর্কী শাসকরা তাইবেরিয়াস এবং হেব্রনে বসতি স্থাপনের জন্য ইউরোপের ইহুদী সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বর্তমানে এই দুটি অঞ্চল ছাড়াও সাফেদ, জেরুসালেম, নাবলুস এবং গাজায় বসবাসকারী ইহুদীদের অধিকাংশই মুসলিম আমলে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী।
জায়নবাদ ও ইহুদীদের মুক্তি
ফরাসী বিপ্লব এবং নেপোলিয়ানের উত্থান ইউরোপীয় ইহুদীদের মুক্তি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে এবং এর ফলে তারা অন্যান্য নাগরিকদের ন্যায় সমান অধিকার পেতে সক্ষম হয়েছে। তাদের প্রতি উদারনীতি অনুসরণের এই ঘটনা পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ার উপরও প্রভাব সৃষ্টি করে। এর ফলে ইহুদী সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তন আসে যা কট্টর জায়নবাদীদের মনপুত: ছিল না। ইয়োভেলের মতে,
"The enlightenment of the 18th Century and this emancipation of the 19th were a great shock for jewish culture and identity. Jews split into several groups during the 19th century. Ultra orthodox groups remain loyal to the culture of the ghetto, which excluded the possibility of intermingling in modern society or gaining a modern education. A second group attempted to assimilate completely into European society, converting to Christianity and losing their Jewish identity. A third group believed that they could integrate as modern citizens with equal rights and still maintain their jewish faith while renouncing any cultural or group allegiance to Judaism. They formed various euphemisms for their identity, such as Hebrews or Germans of the mosaic faith. This group founded the Reform Judaism movement. The assimilationists view point took it on faith that once the jews "become like everyone else” would be accepted in society as equals and would become Germans, Italians, Englishmen or Frenchmen.
উপরে বর্ণিত ইহুদীদের তিনটি গ্রুপের মধ্যে তৃতীয় গ্রুপটি অধিকতর সফল হয়েছে বলে মনে হয়। তারা যুগের পরিবর্তনকে সামনে রেখে রূপের পরিবর্তন করে বিভিন্ন জাতির সাথে মিশে গেছে, কিন্তু নিজেদের ইহুদী জাতি সত্তাকে অক্ষুন্ন রেখে সংস্কার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের কোন কোন দেশে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে জনরোষে পড়তে হলেও তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এটা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দির ইউরোপ ও আমেরিকায় ইহুদীরা অত্যন্ত ঘৃণার পাত্র ছিল। ঐ সময় এ দুটি মহাদেশের বাসিন্দাদের অনেকের বাড়িতেই একটি সাইন বোর্ড ঝুলতে দেখা যেতো যাতে লেখা থাকতো ‘‘Dogs and Jews are not allowed” ইহুদীদের তৃতীয় গ্রুপটির অক্লান্ত পরিশ্রমে বিংশ শতাব্দিতে এসে এখন আর এই সাইন বোর্ড দেখা যায় না। কুকুর এখন ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের অনেকেরই বিছানা ও প্রাতঃ এবং সান্ধ্য ভ্রমনের সাথী আর ইহুদীরা তাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
বৃটিশ জায়নবাদ
ধর্মীয় ও বাস্তব সম্মত অন্যান্য কারণে জায়নবাদের নামে ইহুদী সংস্কার আন্দোলন বৃটিশ বুদ্ধিজীবীদের বিপুল ভাবে আকৃষ্ট করে। এই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতা তাদের মধ্যে বিপ্লবী হবার অনুপ্রেরণাও যোগায়। অবশ্য এক্ষেত্রে ইহুদী নারী ও নগদ নারায়নের যোগ যে ছিল না তা বলা যাবে না। কমুনিষ্ট আন্দোলন যেমন আমাদের দেশের সম্ভ্রান্ত অনেক মুসলিম পরিবারের ইংরেজী পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় ও পারিবারিক ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিয়ে বিপ্লবী বানিয়ে দিয়েছিল তেমনি উনবিংশ শতাব্দিতে ইহুদীবাদ পুনরুজ্জীবনের উপর ভিত্তি করে J.N Darloy প্রতিষ্ঠিত Plymouth Brethren নামক সংস্কার আন্দোলনও বিলাতের শিক্ষিত যুব শ্রেনীকে ইহুদী পুনর্বাসনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১৮৪০ এর দশকে লর্ড সভার দু’জন সদস্য সাফটেসবারী এবং পালামারষ্টন এই মর্মে প্রস্তাব করেন যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের একটি কলোনী প্রতিষ্ঠাই বিশ্ববাসী ইহুদী সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাদের এই দর্শনও প্রস্তাবকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ইহুদী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং নাট্যকাররা এগিয়ে আসেন। সেক্সসপিয়ার ও অন্যান্য লেখকদের ইহুদী দর্শন বিরোধী নাটক উপন্যাসের মুকাবিলায় বাজারে নতুন নতুন সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। লর্ড বায়রন, বেজ্ঞামিন ডিসরেইলী, জর্জ ইলিয়ট ও ওয়াল্টার স্কটের গল্প উপন্যাস এবং কবিতা প্রবন্ধ এরই প্রমান। বলা বাহুল্য ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদী রাষ্ট্র ঘোষণার পেছনে বৃটিশ রাজনীতিকদের তুলনায় সে দেশের কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নাট্যকারদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে সক্রিয়।
ধর্ম বনাম জায়নবাদ
ইহুদী ধর্মগুরুদের সকলেই জায়নবাদী আন্দোলনের ব্যাপারে এক মত ছিলেন না। তাদের ভয় ছিল একটি ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব কৌশলগত কারনে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেলে ধর্ম আর কখনো তার মর্যাদা ফিরে পেতে পারে না। প্রেসবার্গের রাববী (১৭৬২-১৮৩৯) Rabbi Moses Schreiber এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি জায়নবাদের নামে যে কোন সংস্কার আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। রাদুনের হাফেজ চেইম Rabbi Israd Meir Ha-cohen ও এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি Aqudath Yisrael নামক একটি সংস্থারও প্রধান ছিলেন। এদের অনেকের ধ্যান ধারনাই ছিল আমাদের দেশের তবলিগ জামায়াতের মতো। তারা মনে করতেন যে ধর্মের সাথে রাজনীতি বা জীবনের দৈনন্দিন তৎপরতা যুক্ত করার প্রয়োজন নেই। এতে ধর্ম তার বিশুদ্ধতা হারায়। অন্যদিকে ধর্মের উসুল সমূহ যদি পালন করা হয় এবং ধর্ম পুস্তককে সহিহ ভাবে পড়তে শেখা হয়, জীবনাচারে সততা নিষ্ঠা থাকে তাহলে আপনা আপনিই নেতৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থা ধর্ম প্রতিষ্ঠার অনুকূলে চলে আসবে এবং ইহুদীরা পুণ্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ইহুদী সমাজে এই গ্রুপটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। মসির জন্য অপেক্ষা না করে জায়নবাদীদের যে দলটি ইসরাইল ভূমি পুনরম্নদ্ধারের পক্ষে ছিল (Proto Zionism) তারাই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে। তারা প্রথমতঃ ইসরাইলে ভূমি ইজারা ও পরে ক্রয়ের মাধ্যমে বসতি শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মিত্র শক্তি ও বৃটিশ সরকারকে ব্যবহার করে বালফোর ঘোষণার মাধ্যমে গোটা ভূখন্ড দখল করে নেয়।
প্রোটো জায়নবাদের পরের অধ্যায়টি এই মতবাদের ইতিহাসে Foundational Zionism নামে পরিচিত। এই সময়ে Theodor Herzl এবং Chaim Weizmann এর নেতৃত্বে জায়নবাদ একটি সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। রাজনৈতিক জায়নবাদ, সাংস্কৃতিক জায়নবাদ, ধর্মীয় জায়নবাদ, ভূখন্ডগত জায়নবাদ থেকে শুরু করে জায়নবাদী কংগ্রেস ও বৃটিশ ম্যান্ডেট আদায় পর্যন্ত সকল তৎপরতাই এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই অধ্যায়ে জায়নবাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
ম্যান্ডেটরী জায়নবাদ
বৃটিশ ম্যান্ডেটের আওতায় ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে জায়নবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব ইউরোপ থেকে ইসরাইলে স্থানান্তরিত হয়। এই সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের এনে ফিলিস্তিন তথা ইসরাইলে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করণ, আরবদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং তাদের প্রতিরোধ ও হলোকাষ্ট থেকে ইহুদীদের উদ্ধার প্রভৃতি জায়নবাদীদের প্রধান কাজ। ডেভিড বেন গুরিয়ন এই সময় এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
যুদ্ধোত্তর জায়নবাদ
ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর আরবদের সাথে যুদ্ধ এবং পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক নব প্রতিষ্ঠিত এই ইহুদী রাষ্ট্রটিকে আনবিক অস্ত্রে সুসজ্জিত করণের ঘটনা জায়নবাদের আদর্শিক ও ভূখন্ডগত উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আরবদের সাথে ছয়দিন মেয়াদী যুদ্ধে ইসরাইলের বিজয় জায়নবাদীদের মধ্যে নতুন উদ্যমের সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদীরা জায়নবাদীদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সারা বিশ্বে জায়নবাদ পুনরুদ্ধারে আলোক ছটা ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি এর ফলে সামরিক সম্প্রসারণবাদও উৎসাহিত হয়। এর ফলে লিকুড পার্টি ও মোনাচেম বেগিন নেতৃত্বে আসেন এবং বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে উঠে। নেতৃত্ব কট্টরপন্থী সংস্কারবাদীদের হাতে চলে যাওয়ায় আরব ভূখন্ড অগ্নিগর্ভা হয়ে পড়ে।
বস্ত্তত: ১৯৭৭ সালে লিকুড পার্টি ক্ষমতার আসার পর ইসরাইল সরকার ও জায়নবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব কাঠামো অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ইহুদী বসতি স্থাপনের ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। তারা মুক্ত বাজার অর্থনীতির অনুকূলে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা পরিত্যাগ করে। ইসরাইলের ঐতিহাসিক সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনা হয় এবং জায়নবাদী বিভিন্ন দল উপদলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন দেশের জায়নবাদী আন্দোলন সমূহ ভূমি পুনরুদ্ধার ও বসতি স্থাপন আন্দোলনের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে। তবে জায়নবাদীদের মধ্যে এক্ষেত্রে এখনো অনেক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক জিভ স্টার্নহেলের একটি মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন,
"Those Israelis who opposed the settlement movement initiated a reaction against the zionist swing to the right. This reaction depressed itself in the form of zionist opposition to government policies, and of anti-zionist opposition which called itself Post-zionist. The zionist opposition seeks to end the occupation and settelement of territories conquered in 1967. The latter group tries to discredit zionsm as imperalist movement and wants to end the jewish state of Israel. As a byproduct of the Oslo Peace Process and the subsequent violence the post Zionist movement achieved considerable prominence for a time, while the ultimate victory seems to wait for the extremists.
আসলে জায়নবাদ ইহুদী চরমপন্থীদের একটি আন্দোলন। শুধু ইসরাইল ভূমি অথবা বনী ইসরাইলদের শাসনাধীন গোটা ভূখন্ডে ইহুদীবাদ কায়েমই তাদের লক্ষ্য নয় বরং গোটা বিশ্বের উপর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইহুদী খৃস্টান এবং পৌত্তলিক হিন্দুদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর রয়েছে। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিলিস্তিন হামলার মধ্য দিয়ে জায়নবাদের চরমপন্থী রূপ পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। মানবতা বিরোধী তাদের এই হামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং বিশ্ব শক্তিগুলো তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
গবেষকদের মতে দুনিয়ায় যে সমস্ত সংস্থা সরাসরি জায়নবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং পরোক্ষভাবে তাদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে তাঁদের সংখ্যা লক্ষাধিক। এই মতবাদটি একটি ফিতনা যার প্রভাবে সারা দুনিয়া বিধ্বস্ত হবার উপক্রম হয়েছে। ইহুদী ও জায়নবাদীরা যে যখন যেখানে যে অবস্থায় থাকে তখন সেই অবস্থাকে ব্যবহার করে তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। সম্ভাবনাময় ব্যক্তিদের প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা নারী, অর্থ বিত্তসহ প্রলুব্ধ করার যাবতীয় উপাদানকে ব্যবহার করে। ইউরোপের রেনেসাঁ আসলে ছিল ইহুদী চক্রান্তের সাফল্যের সূচনা। রেনেসাঁর পর তারা চক্রান্তের জাল বিস্তার করে খৃস্টানদের ঐক্য ও রোমান সাম্রাজ্যকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। খৃস্টানদের আকিদা বিশ্বাস এবং চিন্তা চেতনায় এমন সব বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে যার ফলে তারা পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়ে যায়। কোটি কোটি খৃস্টানদের প্রাণ দিতে হয়। তারা বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইহুদীরা প্রকাশ্য ও গোপন চক্রান্তের মাধ্যমে প্রায় অর্ধেক খৃস্টীয় জনতাকে নিজেদের সহযোগী ও ক্রীড়নকে পরিণত করে। এবং এভাবে তাদের শত্রু Roman Catholic ও Orthodox Church এর কার্যক্রমকে দুর্বিষহ করে তোলে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে খৃস্টান জগতের অর্ধেক এখন জায়নবাদী ইহুদীদের দখলে, তারা তাদের কথায় উঠে বসে এবং অন্ধের মত তাদের অনুসরণ করে। এ ব্যাপারে প্রটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। ইহুদী অনুপ্রেরণায় এরা ল্যাটিন বা পশ্চিমা খৃস্টবাদ থেকে আলাদা হয়ে বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে গেছে। যেমন, মোরাভিয়া, লুথারিয়া, ক্যালভিনিয়া এবং প্রেসবাইটেরিয়ান সম্প্রদায়। এর ভিত্তিতে তাদের গীর্জাও ভাগ হয়েছে। চার্চ অব ইংল্যান্ডের বাপটিস্ট, কংগ্রেগেশানালিস্ট, মেথডিস্ট, ইভানজেলিকান, মডার্নিস্ট ও এংলো ক্যাথলিক প্রভৃতি শাখা এরই প্রমাণ বহন করে। বিশ্বব্যাপী রোমান ক্যাথলিকদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হোলি সিটি তাদেরই প্ররোচনায় বিশাল ভূখন্ড ছেড়ে রোমের একটি পাহাড়ের কয়েক একর জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।
একটি অভিশপ্ত জাতি হিসেবে ইহুদীরা খৃস্টানদের কাছেও নিন্দিত ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁ, ফরাসী বিপ্লব এবং zionist International Jewry’র ন্যায় প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে এবং জায়নবাদী নেতাদের বুদ্ধিমত্তার কারণে তাদের এই নিন্দিত অবস্থা বর্তমানে আর নেই বললেই চলে। খৃস্টান জগত সর্বসম্মতভাবে এই আকিদা পোষন করতো যে ইহুদীরা হচ্ছে আল্লাহর নবীদের হত্যাকারী একটি জাতি (Diecide nation) । এ প্রেক্ষিতে ইহুদীদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করা খৃস্টানদের উপাসনার একটি অপরিহার্য অংশ ছিল। ১৯৬৫ সালের ২৮ অক্টোবর দ্বিতীয় ভ্যাটিকানের এক নির্দেশনামায় গুড ফ্রাইডে উপাসনার এই অংশটি পরিত্যাগ করা হয়। সংখ্যায় অনেক কম হলেও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা, সাহিত্য সাধনা, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম, সমর বিদ্যা, প্রশাসনসহ অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের উপর তাদের পরিকল্পিত দখল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদী ইহুদীদের অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। আমেরিকা এখন শুধু তাদের বন্ধু নয়, পথ প্রদর্শকও।
জায়নবাদী সংগঠনসমূহের শ্রেণীবিন্যাস
আগেই বলেছি জায়নবাদী ইহুদীরা দুনিয়ার এমন কোনও দেশ নেই যেখানে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেনা। আস্তিক, নাস্তিক, পৌত্তলিক সকল মতবাদের মানুষকে টার্গেট করে তারা কাজ করছে এবং সর্বত্র সাংগঠনিক নিপুণতার পরিচয় দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বব্যাপী কর্মরত জায়নবাদী সংগঠনসমূহকে কাঠামোগত দিক থেকে ১০টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছেঃ
১। আদর্শিক (Ideological)
২। রাজনৈতিক (Political)
৩। প্রশাসনিক (Administrative)
৪। সামাজিক (Social)
৫। বুদ্ধিবৃত্তিক (Intellectual)
৬। বৈজ্ঞানিক (Scientific)
৭। সাংস্কৃতিক (Cultural)
৮। ধর্মীয় (Religious)
৯। কৌশলগত (Strategic)
১০। সরবরাহ সুযোগ সুবিধাগত (logistic)

আবার কার্যক্রমের দিক থেকে তারা এগুলোকে ইতিবাচক, নেতিবাচক, সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় এই চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। তদুপরি কর্ম বিভক্তি অনুযায়ী এই সংস্থাগুলোকে সম্প্রচার ও পরিধারন এই দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যোগাযোগের দিকে থেকে ও আট প্রকারের জায়নবাদী প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। এ গুলো হচ্ছেঃ
১। গোপন তবে সক্রিয় (Secret active)
২। গোপন তবে নিষ্ক্রিয় (Secret passive)
৩। অধিভুক্তি বহির্ভুত (Unattached)
৪। প্রত্যক্ষ (Direct)
৫। পরোক্ষ (indirect)
৬। স্বতঃস্ফূর্ত (Spontaneous)
৭। সংকট কালীন (Critical)
৮। স্ববিকশিত (Self growing)
আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে এগুলোকে দুভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন প্রাণবন্ত এবং পরিত্যক্ত।
আগেই বলেছি সারা বিশ্বে জায়নবাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অগণিত সংস্থা কাজ করছে। তবে এর সাফল্য ও ক্রম বিকাশে যেসব সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এবং রাখছে সেগুলোর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এরা জন্মগতভাবে ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত তৎপর। এর মধ্যে কিছু আছে প্রত্যক্ষ ইহুদী সংগঠন, কিছু পরোক্ষ সংগঠন, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এমনকি মুসলিম নামধারী সংস্থাও।
এক. প্রত্যক্ষ ইহুদী সংগঠন
১। আন্তর্জাতিক ইহুদী কংগ্রেস
২। আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট লীগ
৩। বেরিহাহ মুভমেন্ট (Berihah movement)
৪। বেনেই মোশা (Benei mosha)
৫। হা পু-এল হা মিযরাচি (Ha Poel Ha Mizrachi)
৬। হা সোমের হা যায়ের (Ha shomer Ha zair)
৭। হা নওয়ার হা জিওনী (Ha Noar Ha ziyyoni)
৮। আগুদাত ইসরাইল (Agudat Israel)
৯। বেতার (Betar)
১০। বিলু (Bilu)
১১। বান্ড (Bund)
১২। ডোরশেই জায়ন (Dorshei zion)
১৩। ইজরাত আহিম (Izrat Ahim)
১৪। হার্বোনেম (Habonem)
১৫। হাদাসাহ (Hadassah)
১৬। হাগানাহ (Haganah)
১৭। হাখশারাহ (Hakhsharah)
১৮। হ্যাসিদিজম (Hashidism)
১৯। হাসকালাহ (Haskalah)
২০। হেদের মেতুকান (Heder metukkan)
২১। হা হালুজ (He Halutz)
২২। হেরুত (Herut)
২৩। হোভেওয়াই জাইয়ন (Hovevii zion)
২৪। Helfjverein Der Deutchem Juden
২৫। Hestadrunt
২৬। Irgun zevai Leummi
২৭। Jewish Agency world zionists organisation
২৮। Jewish Colonial Trust
২৯। Jewish Legion
৩০। Jewish Natural Fund
৩১। Lohami Herul Israel
৩২। Kadumah
৩৩। Kneset Israel
৩৪। Malabi
৩৫। Mahal
৩৬। Mapam
৩৭। Migrachi
৩৮। New zionist organization
৩৯। Pioneer women
৪০। Po Alei zion
৪১। Shalia plu Shelihum
৪২। V'aad Le Ummi
৪৩। Women zionist organistion (WIZO)
৪৪। Young Judea
৪৫। Youn Aliyah
৪৬। Zeirei zion
৪৭। Zyyoni zion
দুই. পরোক্ষ ইহুদী সংগঠন
১। Anglican Church of England
২। International Communist Congress
৩। United Nations Organization
৪। International Monetary Fund
৫। World Bank
৯। International Association & Poets, Play writes, Editors Essayists and Novelists.
১০। International Free Mason Movement
১১। Oxfam
১২। The Rockfellers Institute/Centre
১৩। Amnesty International
১৪। The Loyds
১৫। Bank Luxembarg
১৬। Bank Barmuda
১৭। Bank of Grand Caymon
১৮। International Red Cross
১৯। The Group of Thirty
২০। The Chase Manhatton
২১। City Bank
২২। Clouser
২৩। Ford Foundation
২৪। The Council for Parliamet of the World Relgions
২৫। Multinational Corporations
আন্তর্জাতিক সংস্থা
১। UNDP
২। FAO
৩। UNCTAD
৪। WHO
৫। UNIDO
৬। UNICEF
৭। UNESCO
মুসলিম নামধারী সংগঠন
১। কাদিয়ানী সম্প্রদায়
২। বাহাই সম্প্রদায়
৩। দ্রুজ সম্প্রদায়
৪। ইসমাইলী সম্প্রদায়
৫। নুসাইরী সম্প্রদায়
৬। মুতাজিলা সম্প্রদায়
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন যে, বিভিন্ন মুসলিম দেশের ধর্মনিরেপক্ষতাবাদী সমাজতন্ত্রী কম্যুনিষ্ট, প্রগতিবাদী, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও তথাকথিত জেহাদী ও ইজতেহাদী গ্রুপ ও গ্লোবাল সংস্থাগুলো প্রকৃতপক্ষে জায়নবাদীদেরই সৃষ্টি। সমাজতন্ত্রের জন্মদাতা, কার্লমার্কস থেকে শুরু করে দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার সরকার পরিচালনায় যারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ছিল জায়নবাদী ইহুদী। বিপ্লব পূর্ব যুগে রাশিয়ায় সোসালিষ্ট ডেমোক্রেটিক নামক যে দল আন্দোলনের অগ্রভাবে ছিল তার ৫০ শতাংশ সদস্যই ছিল ইহুদী। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলাম, ইসলামের সভ্যতা সংস্কৃতি, আচার আচরণ ধ্বংস ও মুসলিমদের সন্তানদের নাস্তিক্যবাদী কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য তারাই অর্থ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। চীন, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলি এমনকি আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও জায়নবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। জার্মানীকে ইহুদী মুক্ত করার জন্যই হিটলার গণহত্যার আশ্রয় নিয়ে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জার্মানীর পূর্বাংশ ইহুদী নেতৃত্বাধীন সমাজতন্ত্রের কবলে চলে যায়।
ভারতবর্ষে জায়নবাদী ইহুদীবাদীদের উদ্যোগে, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা অর্থায়নে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলও রয়েছে। এদের মধ্যে কোন কোন দল সরাসরি জায়নবাদী স্বার্থ দেখা শোনা না করলেও পরোক্ষভাবে তাদের সহযোগিতা করে। আবার কোন কোন দল রাখ ঢাকা না করেই ইহুদী স্বার্থ আদায়ের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এর মধ্যে তাদের নিজেদের স্বার্থের সম্পৃক্ততাও রয়েছে।
এই দল ও প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেঃ
১। Indian National Congress.
২। Theosophical Society of India
৩। Ram Krishna Mission
৪। Brahma Samaj
৫। Hindu Mahasabha
৬। Rastria Swayang Sebak Sangha & Sangha pariber (Rss & Sangha pariber)
৭। Arjya Samaj
৮। Dalit voice
৯। Bahujan samaj parties
১০। All Socialist parties
১১। All communist parties
১২। Free Thinkers
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শুরু থেকে একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে জায়নবাদী ইহুদীরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চক্রান্তের জাল বিস্তার করে এসেছে। তুর্কী খিলাফতের আমলে আরব অনারবদের মধ্যে এক দিকে বিদ্বেষ সৃষ্টি অন্য দিকে সুলতানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর আরব অফিসারদের লেলিয়ে দিয়ে বৃটিশ ও ইহুদীরা যৌথভাবে তুরষ্কের মুসলিম সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দেয়। তারা ফ্রি ম্যাসন আন্দোলনের মাধ্যমে তুরষ্কের যুব শ্রেণীকে ইসলাম ও খিলাফাতের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। মুস্তফা কামাল পাশা ইহুদীদেরই ক্রীড়নক হিসেবে মুসলিম জাহানের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের কেন্দ্রকেই শুধু ধ্বংস করেনি বরং তুরষ্কক কয়েক শতাব্দি পিছিয়ে দিয়েছে। তাদের সৃষ্ট অন্তর্বিরোধ মুসলিমরা লুফে নেয় এবং তাদের অনৈক্য জায়নবাদের লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে এই উপ-মহাদেশ ও তাদের চক্রান্তের থাবা থেকে নিস্তার পায়নি। এখানে কাজ করার জন্য তারা বিশেষভাবে ইস্পাহানি ও বাগদাদী ইহুদীদের কাজে লাগায়। মেধার দিক থেকে তারা ছিল শীর্ষে। তাদের ভাষা ছিল আরবী, ফারসী ও তুর্কী যা মুসলিম শাসনামলে উপ মহাদেশের দেশ গুলোতে বহুল ব্যবহৃত ভাষা ছিল। তৎকালীন সময়ে মোঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় দিল্লী ছিল সমগ্র প্রাচ্য জগতের কেন্দ্র বিন্দু। এ প্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইহুদী সংগঠন গুলো দলে দলে দিল্লীতে চলে আসতে থাকে এবং সমগ্র উপ-মহাদেশে তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। মুঘল সাম্রাজ্য এক সময় অত্যন্ত বুদ্ধিমান, মেধাবী ও গভীর দৃরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত হতো। ধীরে ধীরে নিম্ন মানের কর্মকর্তারা তাদের স্থান দখল করে নেয় এবং আরাম আয়েশ ব্যভিচার অনাচার তাদের বৈশিষ্ট হয়ে পড়ে। তাদের দুর্বলতা ও মেধাহীনতার সুৃযোগে ইহুদীরা সক্রিয় হয়ে উঠে এবং ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন মুঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে তার দুটি স্তম্ভ শিয়া ও সুন্নীদের পারস্পরিক সংঘাতে জড়িয়ে দেয়। অনেক ফ্রি ম্যাসন ইহুদী নিজেদের বিশেষ করে কিরগিজী, আমিনী, গুর্জিস্থানী ও ইস্পাহানী শিয়া হিসেবে পরিচয় দিয়ে এবং শিয়া নাম গ্রহণ করে ইহুদী স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট হয় বলে বিশ্লেষকদের ধারনা। বিগত চার শ বছরে উপ-মহাদেশে শিয়া সুন্নীদের মধ্যে যতগুলো সংঘাত হয়েছে সেগুলোকে এ প্রেক্ষাপটে নতুন করে অনুসন্ধান পর্যালোচনা ও অধ্যয়ন করা প্রয়োজন।
আকবরের দ্বীনে ইলাহী জাহাঙ্গীরের আমলে শিয়াদের ব্যাপক প্রভাব বুদ্ধি, আলমগীরের আমলে শিয়া সুন্নী দ্বন্দ, পরবর্তী মোঘল শাসকদের আমলে উভয় সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ এর সবই এই চক্রান্তের একটি উল্লেখ যোগ্য অংশ। আকবরের আমলে শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, জাহাঙ্গীরের আমলে মুজাদ্দিদ আলফেসানী, শাহজাহানের আমলে শাহ কালিম উল্লাহ দেহলভী এবং আমলগীর ও পরবর্তী মোঘল শাসকদের আমলে তিন সুফী ও মুহাদ্দিস যথাক্রমে হযরত মীর্জা মজহার জানেজানান, শাহ ফখরুদ্দিন ও শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলোভী এবং আঠারো শতকের শেষের দিকে ও উনবিশ শতকের শুরুতে শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভীর প্রচেষ্টাবলী এই সয়লাবের গতিরোধ করারই প্রচেষ্টা ছিল। ইহুদীরা শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদেরকে প্রভাবিত করে এবং লক্ষ্য হাসিলের জন্য তারা সুন্নীদের মধ্যে এমনকি সুফিয়ায়েকিরামদের কোন কোন শ্রেণীকে ক্রীড়নকে পরিণত করার চেষ্টা চালায়। এদের মধ্যে পীর মাশায়েখ উলামায়ে দ্বীন এবং সাধারণ মুসলিমরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। হযরত শাহ কালিমুল্লাহর পত্রাবলী এবং শাহ ওয়ালি উল্লাহর অসিয়ত নামা এই তথাকথিত সুফীদের চেহারা উন্মোচন করে দিয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে ফ্রি ম্যাসন আন্দোলনের ভূমিকা বিশেষ করে এর নেতা সারমদের অবদান এখন ঐতিহাসিকদের কাছে অত্যন্ত পরিস্কার। তার সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিলেন নামুদ ওয়া নামুদ। শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের এক রেফারেন্স থেকে জানা যায় যে তিনি ইহুদী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
ফ্রি ম্যাসনের নয় দফা
জায়নবাদের ক্রম বিকাশের ধারনা এই উপ-মহাদেশে ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে দুর্বল ও খন্ড বিখন্ড করার লক্ষ্যে ভারত বিভাগের আগে ও পরে একটি নয় দফা কর্ম পরিকল্পনাকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়।
এই নয় দফার মধ্যে রয়েছে (১) শাসক সম্প্রদায় তথা প্রভাবশালী মহলে অনুপ্রবেশ করে তাদের প্রভাবিত করা এবং তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করা। (২) ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের প্রভাবিত করা। (৩) মুসলিম শাসক বৃন্দ, উলামা মাশায়েখ ও আম জনতাকে পরষ্পর পরষ্পর থেকে বিছিন্ন করে দেয়া (৪) মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা (৫) তাদের দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করা অথবা দুনিয়ায় বুক থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা (৬) উলামা মাশায়েখদের খতম করে দেয়া (৭) সচেতন ও বাধাদান করার মতো ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের খতম করে দেয়া (৮) আলিমদেরকে নিজেদের মধ্যে এবং উলামা মাশায়েখদের পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাত মুখর করে তোলাএবং (৯) উলামায়ে কেরামকে গোপন পদ্ধতিতে এমন ভাবে সংঘাতে লিপ্ত করা যাতে তারা কারুর ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে সাধারণ মানুষ তা অনুভব করতে না পারে এবং অন্যদিকে এই সংঘাতকে সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র মুসলিম সমাজে আগুন ধরিয়ে দেয়া। দেশ বিভাগের আগে ও পরে তারা এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখে কাজ করেছে এখনো করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ হবার পর এর সাথে নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।
এই নতুন মাত্রার মধ্যে রয়েছে এই অঞ্চলে মুসলিম জাতি সত্তাকে ধ্বংস করার জন্য বাইরে থেকে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী গোষ্ঠির সাথে অাঁতাত করে অর্ধ শিক্ষিত এবং বিভ্রান্ত কিছু আলিমের উপর ভর করে জিহাদের অপব্যাখ্যা এবং কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী জংগীবাদী ধ্যান ধারনা বিকাশের ব্যাপারে তাদের অপচেষ্টা। এ অগ্রগামী ভূমিকা পালনের জন্য অমুসলিমদের মুসলিম বেশে তারা সামনে নিয়ে এসেছে। ভারতের সংঘ পরিবার ইহুদীদের গৃহে লালিত একটি আন্দোলন। বিশ্ব ইহুদী কংগ্রেসের সাথে তাদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রকাশ্য এবং জার্মানী ও পূর্ব ইউরোপীয় ইহুদীদের সংগঠনের আদলে তাদের সংগঠিত করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য ইঙ্গ- জায়নিষ্ট ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই উপ-মহাদেশের মুসলিমদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে তাদের উপর যে কয়টি মারাত্মক আঘাত হানা হয় তার মধ্যে তাদের ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার উপর আঘাতটিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। ১৭৭৬ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলিমরা জমি থেকে বেদখল হয়ে যায় এবং জমির মালিকানা হিন্দুদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। এই আইন উত্তর ভারতে রায়তওয়ারী পদ্ধতি এবং পশ্চিম ভারতে মাহালওয়ারী পদ্ধতি নামে প্রবর্তন করা হয়। এভাবে অত্যন্ত নিপুণতার সাথে ১৮৫০ সালের মধ্যে সমগ্র উপ-মহাদেশের জমি থেকে মুসলিমদের বেদখল করে দেয়া হয়। পরবর্তী বছর সমূহে শিক্ষা সংস্কৃতি, কৃষি শিল্প বাণিজ্য সরকারী ব্যবস্থাপনা সহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সকল খাত থেকে তারা উৎখাত হয়ে যায়। বাংলার গর্ব মসলীনের দুনিয়াব্যাপী বাজার থেকে তাদের উচ্ছেদ করার জন্য মুসলিম তাঁতীদের বুড়ো আঙ্গুঁল কেটে দেয়া হয়।
১৯৪৭ সালে মুসলিমদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমি হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও এই ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। এই দেশটি যাতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে স্থিতিশীল থাকতে না পারে জায়নবাদী ও হিন্দু আধিপত্যবাদী শক্তি তা নিশিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে এবং তাদের এজেন্টদের ব্যবহার করে এই দেশটির পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করে পূর্বাঞ্চলকে অনেকটা উপনিবেশের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন অবধারিত হয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে ভারতীয় হিন্দুরা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্বাধীনতার পরও এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জন মানুষের ধর্ম ও আকিদা বিশ্বাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার জায়নবাদী পরিকল্পনা এখনো কার্যকর আছে। একই ভাবে পাকিস্তানও যাতে সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে তার জন্য হিন্দু-ইহুদীবাদী চক্র সক্রিয় রয়েছে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পারমাণবিক শক্তি অর্জনকে মুসলিম দেশগুলোর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তানের উপর হামলা এবং দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে এই দেশগুলোকে সম্পৃক্ত করণ, ফিলিস্তিনে গণহত্যা ইসরাইলের মানবতা বিরোধী কর্মতৎপরতা, কাশ্মীরের গণহত্যা পারমাণবিক কর্মসূচী বন্ধ করার জন্য ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ জায়ন বাদী কর্মসূচীর একটি অংশ। ভারত ইসরাইল সামরিক চুক্তি ও অস্ত্র তৈরীর জন্য যৌথ প্রকল্প গ্রহণ বারাক মিসাইল ক্ষেপনাস্ত্র সংগ্রহ প্রভৃতি এই আন্দোলনের অন্যতম মোড় যা ইসলাম বিরোধী এই দুটি জাতিকে (ইহুদী, মুশরিক) একক প্লাটফরমে এনে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনে অনুপ্রাণিত করছে। ফিলিস্তিন ভূমিতে অভিশপ্ত ইহুদীরা এখন রাষ্ট্রহীন নাগরিকের ন্যায় বিশ্বব্যাপী লাঞ্ছিত নয়, বরং তারা সর্বত্র মুসলিমদের লাঞ্ছিত করছে। খৃস্টান, মুশরিকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা এখন সারা দুনিয়ায় কর্তৃত্ব করতে চায়।
উপসংহার
মুসলিম জাতি এখন সর্বত্র মাযলুমের ভূমিকায় রয়েছে। অনৈক্য জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা তাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। এই অবস্থায় দুনিয়ার বুকে টিকে থাকতে হলে এবং সার্থকভাবে জায়নবাদকে মুকাবিলা করতে হলে তাদের কিছু করণীয় রয়েছে।
এর প্রথম কাজটি হচ্ছে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রত্যাবর্তন করা। কোরআন সুন্নাহর অনুসরণে তাদের মনোনিবেশ করতে হবে। মুসলিমদের ভেবে দেখতে হবে যে আল্লাহর দরবারে তাদের অপরাধ কি অভিশপ্ত ইহুদীদের তুলনায় এতই বেশি হয়ে গেছে যে ইহুদীর হাতে তাদের মার খেতে হচ্ছে? কোনটা আল্লাহর পরীক্ষা এবং কোনটা তার গযব তা তাদের উপলব্ধি করতে হবে।
দুই. জীবনাচরণকে কোরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে পুনর্গঠনের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামীকী করণ করতে হবে।
তিন. ইহুদী ও জায়নবাদী চক্রান্ত সম্পর্কে উম্মাহকে সার্বক্ষণিক ভাবে সতর্ক করার ব্যবস্থা করতে হবে। নিজস্ব গণ মাধ্যম, সংবাদ সংস্থা, টিভি চ্যানেল, পত্র পত্রিকা ও সাময়িকী যেমন প্রতিষ্ঠা করতে হবে তেমনি সেগুলো পরিচালনার জন্য যোগ্যতা ও ইসলামী চরিত্র সম্পন্ন জনবল তৈরী করতে হবে।
চার. জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মুসলিমদের হারানো সম্পদ। এই সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
পাঁচ. মুসলিম জাতি সংঘ প্রতিষ্ঠা, ইসলামী কমন মার্কেট প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বে ইসলামী অর্থনীতি চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে সক্রিয় ও পুনগঠিত ওআইসি এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
ছয়. ডলার ষ্টালিং ও ইউরোর ন্যায় মুসলিম দেশ সমৃহ নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন করতে পারে। আই এম এফ এর বিকল্প হিসেবে ইসলামিক মনোটারী ফান্ড গঠন করা যেতে পারে।
ইহুদী খৃস্টান নিয়ন্ত্রনাধীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সমৃহের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পর্যায় ক্রমে যদি মুসলিম বিশ্ব নিজস্ব সংগঠন ও উৎস সমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে তাহলে আশা করা যায় যে তারা আস্তে আস্তে জায়নবাদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারবে।
[প্রবন্ধটি মার্চ ১৯, ২০০৯ তারিখ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসাবে উপস্থাপিত হয়]


তথ্যপুঞ্জিঃ
১। The Jewish chronicle, London 1913.
২। Protocal of the Learned Elders of zion.
৩। Lt Iyael Daiyan, A soldiers Diary, Telaviv, 1968 R.W. Setor Watson..
৪। R.W. Seton Watson Rise of Nationality in the Balkan.
৫। Barnard Lewish, The Emegence of Modern Turkey.
৬। Misbahul Ilam fung, Jenrish Cuspiracy is the Muslim world.
৭। Henry Klien, Zion Rnle the world, Now year.
৮। Alexander Bihleman, the Jewirsh people face the postwar world.
৯। আসবার আলম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদী চক্রান্ত।
১০। আব্দুল খালেক, ইহুদী চক্রান্ত।
১১। এ বি এম খালেক মাহমুদার অভিশপ্ত ইহুদী জাতির বেঈমানীর ইতিহাস।
১২। A.D Gordon, Our Tasks Ahead.
১৩। Shbtar Tevcth, Ben-Lowisca and the palestimen Arales: From peace to mor.
১৪। University of Califarnia, Land, Labow and origin of the Isracli paletinia Conflict.

 

--o--