ভূমিকা-কথন
১৯৪৭ সালে যখন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা এ উপ-মহাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায়, তখন তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের হাতে ভারতকে প্রধানতঃ দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্পণ করে যায়। এর একটি ভারত, অপরটি পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুটি অংশের পূর্বাংশ-তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এতে ভারতের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা ছিল।
শত শত বছর জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। উপ-মহাদেশ বিভক্তির ভিত্তি হচ্ছে, দ্বি-জাতি তত্ত্ব। ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চল নিয়ে মুসলিমদের জন্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রসমূহ গঠনের সিদ্ধান্ত ত্রি-পক্ষীয়ভাবে মেনে নেয়া হয়। একটি পক্ষ কংগ্রেস, অপর পক্ষ মুসলিম লীগ এবং তৃতীয় পক্ষ বৃটিশ সরকার। এ সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, দেশীয় রাজ্যসমূহ, যা রাজা দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল এবং যেসব রাজ্য ভৌগোলিক ও প্রশাসনিকভাবে বৃটিশ-শাসিত ভারতভুক্ত ছিল না, তা ভারতে বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে। অথবা স্বাধীন থাকতে পারবে। এ হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভাগ্য ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র নির্ধারণের পূর্ণ এখতিয়ার তাদের জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকে। এককভাবে কাশ্মীর উপত্যকার বা সাধারণভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলিমরা বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় এবং ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নৃ-তাত্ত্বিক বিচারে কাশ্মীর উপত্যকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার কথা। তবে জম্মু ও কাশ্মীরে যেহেতু বৃটিশ শাসকদের নিযুক্ত একজন বহিরাগত ডোগরা রাজা হরিকিষেণ সিং বহাল ছিলেন, সে কারণে কাশ্মীর যেমন পাকিস্তানভুক্তির প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তেমনি ভারতেরও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
তবে ইতিহাসের এক নাজুক মুহূর্তে পাক-ভারতের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের উপজাতীয় পাঠান মুজাহিদরা কাশ্মীর দখল করে নিচ্ছে, এই অজুহাতে আতংকিত মহারাজা হরি সিংকে ভারতের কাছে সাহায্য চাইতে বাধ্য করা হলে ভারত জম্মু ও কাশ্মীরে তার সেনাবাহিনী পাঠিয়ে রাজ্যটি দখল করে নেয়। মুজাহিদদের অগ্রাভিযান ভারতের আবেদনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় মাঝপথে থেমে যায়। মোট উপত্যকার এক-তৃতীয়াংশ ‘আজাদ কাশ্মীর’ হিসেবে ভারতের দখলমুক্ত হয়। বাকী দুই-তৃতীয়াংশ জম্মু ও কাশ্মীর ভারত বিপুল সেনাবাহিনী দিয়ে আজ অবধি দখল করে রেখেছে।
পাক-ভারত দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার সিদ্ধান্ত এবং কাশ্মীরের জনগণের মতামত উপেক্ষা করে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীনতাকামী মুসলিম জনপদের ওপর ভারত ১৯৪৭-৪৮-এ যে সামরিক দখল প্রতিষ্ঠায় নগ্ন আগ্রাসন চালিয়েছে, তা আজও বহাল আছে। তবে তা কোন স্থায়ী ভিত্তি বা স্থিতিশীলতা পায়নি। জাতিসংঘের দলিলে আজও কাশ্মীর একটি বিরোধপূর্ণ অমীমাংসিত ইস্যু। জাতিসংঘের তদারকীতে কাশ্মীরে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতাকে ভারতই প্রথম স্বাগত জানায়। বরং ভারতই জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়ে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু ‘শান্তি-শৃঙ্খলার উন্নতি না হওয়া’ এবং অনুকূল অবস্থা তৈরি না হবার অজুহাতে ভারত ছয় দশকেরও বেশী সময় ধরে কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করেনি। এর মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে যুদ্ধবিরতি তথা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ রেখার কোন হের-ফের হয়নি। অর্থাৎ যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি। আঞ্চলিক উত্তেজনা বরং বেড়েছে। তবে ভারত ‘Instrurment of Accession’-এর অজুহাতে কাশ্মীরকে তার সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ভূ-খন্ডের অবিচ্ছেদ্য একটি রাজ্য হিসেবে ক্রমশঃ অন্তর্ভুক্তকরণের এক নোংরা সামরিক-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী জুয়াখেলা চালিয়ে আসছে। Instrurment of Accession সত্ত্বেও ভারত জম্মু-কাশ্মীরের Special Status স্বীকার করে তাদের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের দ্বারা কাশ্মীরের স্বাধীন সত্তা সংরক্ষণের অংগীকার করে। যা অন্য কোন দেশীয় রাজ্যের ক্ষেত্রে তারা করেনি। এমনকি হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, মানভাদর, গোয়া, দমন, দিউ সহ আরও অনেক দেশীয় রাজ্যকে জোর করে দখল করে নিলেও তাদের ভারত কাশ্মীরের মতো সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি, সর্বশেষ স্বাধীন রাষ্ট্র-ভূটানকে গ্রাস করে ভারতের একটি অঙ্গ রাজ্যের অবস্থানে অবনয়ন করা সত্ত্বেও ভূটানকে এ ধরনের কোন সাংবিধানিক স্টেটাস দেওয়া হয়নি। কিন্তু ভারত তাদের সংবিধানের ৩৭০-অনুচ্ছেদকেও অকার্যকর করে কাশ্মীরের বিশেষ সংরক্ষণ ও মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। অর্থাৎ কাশ্মীরকে গ্রাস করলেও ভারত তাকে তার সাংবিধানিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুরোপুরি অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নিতে পারেনি। অথবা কাশ্মীরের জনগণ, রাজা কিংবা শেখ আবদুল্লাহ কেউই এটা মেনে নেননি। তবু ভারত বলছে, কাশ্মীর তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কাশ্মীর ইস্যুতে তারা তৃতীয় পক্ষ বা আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর নাক গলানো মেনে নেবে না। এমনকি তাদের মতে, কাশ্মীর নিয়ে অন্যের কথা বলার এখতিয়ার তারা মানতে চায় না।
পাকিস্তানের ও ইতিহাসের গতিধারা
ইতিহাস কখনও কোন একক জাতি বা পরাশক্তির খেয়ালীপনার বা নিষ্ঠুরতার অনুবর্তী নয়। ইতিহাস আবর্তিত হয় তার আপন গতিপথে। ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক প্রকৃতি। আর প্রকৃতির নিয়ন্তা হচ্ছেন অদৃশ্যমান মহাশক্তিমান আল্লাহ রাববুল আলামীন। অবশ্যই ইতিহাসের উপাদান মানুষ ও তার পরিপার্শ্ব। অতি সম্প্রতি কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে ইতিহাসের অগ্নিগর্ভ দোলাচল আবার দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পাঁচ লাখ নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং আরও কয়েক লাখ নিরাপত্তা রক্ষী নিয়োগ করেও দিল্লী উপত্যকার আগুন নেভাতে পারছে না। ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল ভি.কে. সিং বলেছেন, কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর এখন কিছু করণীয় নেই। তাঁর মতে, কাশ্মীর সমস্যা রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবেই তার মীমাংসা করতে হবে।
কাশ্মীরে সম্প্রতি ভারতীয় দখলদার বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে এক কিশোরের নির্মম মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকা জুড়ে। এতে এ পর্যন্ত ১১১ জন অসামরিক শান্তিপ্রিয় কাশ্মীরি শাহাদাৎ বরণ করেন। গণ-বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ঠেকাতে ভারত সরকার ও তার বশংবদ রাজ্য সরকার উপর্যুপরি উপত্যকা জুড়ে কার্ফু্য জারী করে জনতার বিক্ষোভ ঠেকাতে পারেনি। বন্দুক-বেয়োনেটের নির্বিচার ব্যবহার ও দেখামাত্র গুলির নির্দেশকে উপেক্ষা করে কাশ্মীরের তরুণ-কিশোর, যুবক-নারীরা প্রতিবাদে-বিক্ষোভে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন। তারা ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার, গণহত্যা বন্ধ এবং ভারতীয় সেনার দখলদারিত্ব তুলে দিয়ে কাশ্মীরের অপহৃত ‘আজাদী’ ফিরিয়ে দেবার উচ্চকিত স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন। এবারই প্রথম কাশ্মীর উপত্যকার স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনগুলোর পরিচিত নেতাদের সাংগঠনিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক নির্দেশনা ছাড়াই জম্মু-কাশ্মীরের নতুন জেনারেশন ভারতীয় দখলদার সেনা ও দিল্লীর বশংবদ সরকারের বিরুদ্ধে আজাদীর লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছেন। এবারই প্রথম পাকিস্তান বা ভারত কথিত ‘ক্রস বর্ডার’ ইসলামী মুজাহিদ-জঙ্গিদের কোন ভূমিকা ছাড়াই উপত্যকার সাধারণ মানুষ স্ব-প্রণোদিত হয়ে আজাদীর দাবীতে রাজপথে নেমে এসেছেন। এটা কাশ্মীরের চলমান আজাদী সংগ্রামকে নতুন ডাইমেনশন দিয়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকার সবচেয়ে প্রধান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ৮১ বছর বয়স্ক স্বাধীনতা সংগ্রামী হুররিয়াত নেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানীকে গৃহবন্দী করে রাখা সত্ত্বেও কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে অতীতের চেয়ে বেগবান ও দুর্বার আজাদী আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। অপর শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা মাসারাত আলমকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। আজাদী আন্দোলনের একমাত্র মহিলা নেত্রী আয়েশা আন্দ্রাবীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-গুম-অপহরণ এবং প্রত্যক্ষ সামরিক আগ্রাসন সত্ত্বেও ভারত কাশ্মীরের নবীন প্রজন্মকে আজাদীর স্বপ্ন ও চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তবে ভারত সামরিক পথ ছেড়ে এই প্রথম কাশ্মীরে একটি সর্বদলীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে, সকল স্তরের মানুষের মতামত নিয়ে দিল্লী সরকারের নির্দেশে একটি রাজনৈতিক সমাধান সুত্র খুঁজে বের করতে। এটাও সমাধানের পথ নয়। কাশ্মীরে গিয়ে এই প্রতিনিধি দলটি জনগণের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। তারা জনমতের উত্তেজনা প্রশমন করার পথ খুঁজেছেন ভারতীয় সংবিধানের আওতায়। বিশেষ করে, ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরের জনগণকে যে ‘‘Special status” দিয়েছেন, এই প্রতিনিধি দল তা পুনর্বহালের প্রশ্ন পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। এমনকি দফায় দফায় ভারত সরকার তার বশংবদ ও পুতুল রাজ্য সরকারের মাধ্যমে ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনে সম্মতি আদায় করে ‘বিশেষ মর্যাদার’ বিকৃতি ঘটিয়ে কাশ্মীরকে যেভাবে কাগজে-পত্রে প্রায় ভারতীয় রাজ্য বানানোর প্রক্রিয়া শেষ করে এনেছে, তা প্রত্যাহারের বিষয় নিয়েও সর্বদলীয় রাজনৈতিক টিম মাথা ঘামায়নি। অর্থাৎ দিল্লী সরকারের প্রেরিত প্রতিনিধি দলের মিশন বিরাজমান ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করে জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ, মানবাধিকার পুনর্বহাল, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক সংস্কার, তথা বেকারত্ব নিরসনের বিষয়েই দৃষ্টি নিবব্ধ রাখেন। এতে সমস্যার মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটবে না।
তবে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল কাশ্মীরে গিয়ে ‘সবার সাথে’ মতবিনিময় করে দিল্লী সরকারের কাছে সংকট নিরসনের যে সুপারিশ তারা করেছেন, তার মধ্যদিয়ে কয়েকটি বিষয় স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রথমতঃ ভারত আভ্যন্তরীণ ও জাতীয়ভাবে এই প্রথম স্বীকার করলো যে, কাশ্মীরে সংকট বিরাজমান এবং সেখানে তারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ ভারতের গোলামী মেনে নেয়নি এবং মেনে নিতে প্রস্ত্তত নয়। তৃতীয়তঃ কাশ্মীর সমস্যার সামরিক সমাধান সম্ভব নয় এবং তারা শঠতা ও ভীতি সঞ্চার করে যে Instrument of Accession অস্ত্র ব্যবহার করে কাশ্মীর দখল-পর্ব সমাধা করেছে বলে বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিয়ে আসছিল, তার কোন ভিত্তি নেই। চতুর্থতঃ কাশ্মীর উপত্যকায় যে আজাদীর আওয়াজ উচ্চকিত হয়ে আসছে, তার পেছনে প্রতিবেশী পাকিস্তানের উস্কানীকে দায়ী করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘ক্রসবর্ডার টেরোরিজমের’ যে অভিযোগ উত্থাপন করে ভারত পাকিস্তানকে ‘জঙ্গিরাষ্ট্র’ হিসেবে একঘরে করতে চেয়েছে, সেই প্রচারণাটিও অসত্য বলে প্রমাণ হলো।
উল্লেখ্য, বেনজির ভুট্টো সরকার, জেনেভার মানবাধিকার সম্মেলনে কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলেও তা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারতের কূটচালে। ভারত আজ পর্যন্ত জম্মু-কাশ্মীরে কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল, আন্তর্জাতিক কিংবা স্থানীয় মানবাধিকার গ্রুপকে প্রবেশ করতে দেয়নি। যদিও বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশীদের অবাধ যাতায়াতকে বাংলাদেশ অনুমতি দিয়েছে।
কাশ্মীরের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, কথায় কথায় স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের ‘পাকিস্তান চর’ বা সন্ত্রাসী বানানোর এক বীভৎস অবদমন নীতি চালাচ্ছে দিল্লী সরকার। এ পর্যন্ত ভারতীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আজাদী আন্দোলনে কাশ্মীরের ৭০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন বলে কাশ্মীরি সূত্রগুলো উল্লেখ করেছে। আর কত রক্ত দিতে হবে, কাশ্মীরিরা তা জানেন না। সাম্প্রতিক সময়েও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১১১ জন তরতাজা মানুষ জীবন দিয়েও তারা নিবৃত্ত হননি। বরং আজাদীর আওয়াজ আরও দীপ্ত ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। কার্ফু্য প্রত্যাহার, স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া এবং কাশ্মীরে সর্বদলীয় ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সফরের পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। সেখানে এরপরও দফায় দফায় কার্ফু্য দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতাকামীদের বিক্ষোভ-জমায়েত ঠেকাতে দফায় দফায় কার্ফু্য দেওয়া একটা পুরনো রীতি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে যে আজাদীর চেতনা জাগ্রত রয়েছে, তা নিবৃত্ত করার কোন অস্ত্র ভারতের হাতে নেই।
নয়া বিশ্বযুদ্ধের নাভি-কেন্দ্র
কাশ্মীর শুধু পাক-ভারত সমস্যা ও উত্তেজনার মূল কেন্দ্রই নয়। কাশ্মীর হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বিশ্বযুদ্ধের একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, বিশ্বযুদ্ধের নাভি-কেন্দ্র। উপ-মহাদেশের শান্তি ও স্থিতি এবং নিরাপত্তার প্রেক্ষিতে বিচার করলে কাশ্মীর কেবল পাক-ভারত সমস্যারই কেন্দ্রবিন্দু নয়। পাকিস্তান ও ভারত দুটি পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত দেশ হবার কারণে দু’দেশের মধ্যে আর এক দফা যুদ্ধ বেঁধে গেলে তা পরমাণু যুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারে। এ কারণে কাশ্মীর নিয়ে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের অন্য সকল দেশেরও উদ্বিগ্ন হবার প্রশ্ন রয়েছে। বিগত কারগিল যুদ্ধের সময় পাক-ভারত পরমাণু যুদ্ধের কাছাকাছি উপনীত হয়েছিল।
ইরাক-আফগান যুদ্ধের পরাজয় মাথায় নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন-ন্যাটো সামরিক জোট- তাদের অবস্থান বদল করে এশিয়ায় তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি ও মনযোগ সংহত করতে শুরু করেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রায় পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েও ভূ-রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিক কারণে আফগান্তিান ছাড়তে পারছে না। রাশিয়া, মধ্য এশিয়া, ইরানকে চাপে রাখার সুযোগ হাতছাড়া করার লোভ সংবরণ করতে না পারা, পাকিস্তানের স্ট্রাটেজিক ও পরমাণু শক্তি স্থাপনার ওপর নজরদারি করা এবং ভারতের চীনা ভীতিকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার চীন বিরোধী সামরিক অক্ষ তৈরির সমরনৈতিক রাজনীতি ক্রমশঃ জোরদার করা হচ্ছে। চীনের সমরশক্তি বৃদ্ধি ও ভারতকে ঘিরে ধরার কৌশল ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে। এই সুযোগে মার্কিন-ইসরাইল পাশ্চাত্য অক্ষ ভারতের কাছে বিপুল অস্ত্র বিক্রির সুযোগ হাতিয়ে নিচ্ছে। চীনারা লাদাখ ও আকসাই চীনে সেনা মোতায়েন করায় এবং ঐ এলাকায় সামরিক নজরদারি বৃদ্ধি করায় ভারতের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজাদ-কাশ্মীর রুটে চীন চাইলে পাকিস্তানে সড়কপথে সামরিক সহায়তা দিতে পারে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গদর-এ চীনা সহায়তায় পাকিস্তানের সমুদ্র বন্দর তৈরি ভারতের উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। পাকিস্তানকে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করা কিংবা সীমান্ত বিলোপ করে ‘৪৭-পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়ে কংগ্রেস-হিন্দু মহাসভার অখন্ড’ ভারত তৈরির স্বপ্ন বিলাস সংকুচিত হয়ে আসছে। দিল্লী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথেও বৈরীতা হ্রাস করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায়। এতে তার আন্তরিকতার অভাব থাকা সত্ত্বেও এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানোসহ অন্তর্ঘাত পর্যায়ে বৈরীতা অব্যাহত রাখছে ভারত। কাশ্মীরসহ হিমালয়ান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে নয়া সামরিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, ভারত তাকে উপেক্ষা করতে পারছে না বলেই কাশ্মীর পলিসিকে অসামরিককরণ করে কাশ্মীরের জনগণের মন জয় করার উদ্যোগ নিতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের মন জয় ছাড়া যে ‘রাজ্য’ জয় স্থায়ী হয় না, ইতিহাসের এ সত্যকে ভারত বুঝতে শুরু করেছে কিনা, তারপরও এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখা যাচ্ছে। এর কোনটাই দিল্লীর নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের সুখকর শুভ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সহ বাঘা বাঘা নিরাপত্তা বিশ্লেষকও মাওবাদীদের উত্থানকে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড়ো সংকট বলে চিহ্নিত করেছেন। মাওবাদীদের সাথে আলোচনা-সংলাপ যেমন সফল হয়নি, তেমনি তাদের বিরুদ্ধে ঢালাও সামরিক বা আধা সামরিক অভিযান চালিয়েও বিশেষ সুবিধা করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি-চিদাম্বরম ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও পিছু হটে এসেছেন।
মাওবাদীরা সম্প্রতি কাশ্মীরের লড়াকু মানুষের আজাদী সংগ্রাম তথা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবীর প্রতি সংহতি ঘোষণা করায় একটা নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোও একই পথ অনুসরণ করলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। মাওবাদীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত ৬টি রাজ্যে কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচী পর্যন্ত ঘোষণা করেছে। [Maoists Intensify Activites : call strikes in six Ctates supporting Kashmir, Shamsuddin Ahmed, Holiday, 10 September, 2010]
Instrurment of Accession :
পন্ডিত নেহেরুর চাণক্য নীতি
১৮৬৯ সালে লর্ড মেয়ো ভাইসরয় হয়ে ভারতে আসেন। শিখদের সাথে সম্পাদিত ‘অমৃতসর সন্ধি’-তে জম্মু-কাশ্মীরের ওপর বৃটিশ শাসকদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছাড়াই ডোগরা রাজাদের হাতে জম্মু-কাশ্মীর ছেড়ে দেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। প্রথমতঃ বৃটিশরা ভারতে তাদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য কোন শক্তিশালী দেশীয় রাজার অস্তিত্ব চায়নি। দ্বিতীয়তঃ কাশ্মীর উপত্যকায় পুরনো পথে বহিরাগতরা এসে যেন তাদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা হানি ঘটাতে না পারে, সে বিবেচনায়ও জম্মু-কাশ্মীর উপত্যকায় কার্যকর কূটনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করেছে। ১৮৭১ খৃস্টাব্দে বৃটিশ সরকার কাশ্মীরের ডোগ্রা রাজাকে কাশ্মীরের বৃটিশ প্রতিনিধির মর্যাদাকে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধির মর্যাদা স্বীকার করিয়ে নিতে বাধ্য করেন। এর আগে কাশ্মীরের বৃটিশ প্রতিনিধি পাঞ্জাবের শিখ রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।
বৃটিশ সমরবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করতেন, রাশিয়া উত্তর দিক থেকে, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত হয়ে বারোগহিল ও ইশ্ককোমান পার হয়ে ভারতের মূল ভূ-খন্ডে হামলা চালাতে পারে। এ কারণে তারা হুনযা, নাগর, চিলাস, পুনিয়াল, ইয়াসিন ও গিলগিট অঞ্চলকে বিপজ্জনক মনে করতো। বৃটিশরা মহারাজার আন্তর্জাতিক সীমানা নিয়ন্ত্রণ ও কোন বৈদেশিক শক্তির সাথে সন্ধি সম্পন্ন রক্ষার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। তারা ভারতে নিজেদেরকেই কেবল সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তি মনে করতো। দেশীয় রাজাদের কার্যক্রম স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত রাখাই ছিল তাদের রাষ্ট্রীয় পলিসি। এরপর থেকে বৃটিশরা রাশিয়ার সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা চিহ্নিতকরণের পদক্ষেপ নেয়। মহারাজা রাশিয়ানদের কাছে নিজেকে স্বাধীন নৃ-পতি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইতেন এবং বৃটিশের প্রতি তার আনুগত্যকে ‘‘প্রতীকী’’ বলে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। এ বিষয়টিও বৃটিশদের শংকিত করে তোলে।
কাশ্মীরে বৃটিশ অনুগ্রহপুষ্ট ডোগ্রা মহারাজাকে শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর তারা সাম্রাজ্যের একটা
আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেন। এর মাধ্যমে তারা বিদেশী শক্তির কাছে সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছে।
১৯৩০ সালের ভারত শাসন আইনে প্রথম শাসনকার্যে ভারতীয়দের সীমিত অংশীদারিত্ব স্বীকৃতি পায়। কাশ্মীর উপত্যকায়ও এর ঢেউ আছড়ে পড়ে। ভারতের অন্যান্য স্থানে সরাসরি বৃটিশ শাসন বহাল থাকায় স্থানীয়দের শাসনকার্যে অংশীদারিত্ব সরাসরি স্বীকৃতি পায়। কিন্তু যেহেতু কাশ্মীর উপত্যকায় বৃটিশরা অবৈধভাবে একজন অত্যাচারী ও গণবিরোধী স্বঘোষিত রাজা চাপিয়ে দিয়েছে, তার ফলে ভারত-শাসন আইনের সুফল পাওয়া কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের জন্য কঠিন ছিল।
কাশ্মীর দীর্ঘকাল ধরে বহিরাগতদের দ্বারা শাসিত, শোষিত ও নির্যাতিত হয়েছে। সরকারী চাকুরী ও প্রশাসনে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভূমিপুত্রদের কোন অধিকার ও হিস্যা ছিল না। ফলে ‘কাশ্মীর কাশ্মীরিদের জন্য’’ উপত্যকায় ক্রমশঃ এই স্লোগানের ভিত্তিতে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এক পর্যায়ে রাজ্য সরকারের উচ্চপদ ও প্রশাসনে কাশ্মীরিদের নিয়োগের দাবী কিছুটা মেনে নেয়া হয় বটে।
কিন্তু ডোগ্রা রাজা তা কার্যকর করেনি। তার রাজ্য প্রশাসনে, রাজস্ব বিভাগ ও সেনাবাহিনীতে কাশ্মীরি পন্ডিত ও ডোগ্রা রাজপুত্র-শিখদের নিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কাশ্মীরি হিসেবে সরকারী সুযোগের প্রায় সবটুকুই সংখ্যালঘু স্থানীয় অভিজাত কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা দখল করে নিত। সেনা বাহিনীর উচ্চপদগুলো ছিল ডোগ্রা-রাজপুত্রদের জন্য সংরক্ষিত। কাশ্মীরি ভূমি পুত্রদের দীর্ঘকাল অসামরিককরণ করে রাখার ফলে তাদের পক্ষে অবৈধ ও বহিরাগত শাসকদের বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার সুযোগ ছিল সীমিত। ১৯৪৭-পরবর্তীকালে ভারত সামরিক শক্তিতে জম্মু-কাশ্মীর দখল করে নিলে সেখানে লাখ লাখ ভারতীয় সেনা সদস্যদের পদচারণা দেখা গেলেও রাজ্য নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা ভারতের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীতে কাশ্মীরীদের প্রবেশাধিকার সীমিত করে রাখা হয়। একটি জাতিকে নিরস্ত্র ও অসামরিক করে রেখে গোলামীর শৃঙ্খল পরিয়ে রাখাই এর উদ্দেশ্য।
কাশ্মীর উপত্যকায় ডোগ্রা রাজার অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লাহোরের মুসলিম মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার চালায়। ১৯২৯ খৃস্টাব্দে লাহোর থেকে আইন ডিগ্রী অর্জনকারী প্রথম কাশ্মীরী নেতা গোলাম আববাস সাংগঠনিকভাবে মহারাজার অপশাসনের বিরুদ্ধে ‘আন্জুমানে ইসলামিয়া’ সংগঠনের ব্যানারে মুসলিম যুবকদের সংগঠিত করেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা মুসলিম গ্রাজুয়েট যুবকরাও এতে যুক্ত হন। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রেমনাথ বাজাজ, গোলাম আববাস, মুহাম্মদ ইউসুফ শাহ প্রমুখ। ১৯৩১ সালে ইউসুফ শাহ তার চাচাকে শ্রীনগরের মীর ওয়াইজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
মহারাজা হরি সিং আবদুল কাদির নামের এক প্রতিবাদী মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা কারাগারমুখী মিছিল নিয়ে এগুতে চাইলে হরি সিং বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। এতে ২১ জন মুসলিম শহীদ হন। উত্তেজিত জনতা লাশ নিয়ে মিছিল করে শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হন। হিন্দুরা ডোগ্রা মহারাজার পক্ষ নেয়।
শেখ আবদুল্লাহ : ইতিহাসের নায়ক থেকে খলনায়ক
ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন্সে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে শেখ আবদুল্লাহ কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। মুসলিম হবার কারণে মহারাজা সরকারে তিনি কোন উচ্চপদে চাকুরী পাননি। বিদেশে উচ্চশিক্ষার আশাও তাঁর পূর্ণ হয়নি। ১৯৩০-এর দিকে শেখ আবদুল্লাহর রাজনীতিতে আগমন। শেখ আবদুল্লাহর কোন এক পূর্বপুরুষ হিন্দুব্রাহ্মণ পন্ডিত প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহীম কাশ্মীরের শাল ব্যবসায়ী। শেখ আবদুল্লাহ ভালো বক্তা ছিলেন এবং মানুষকে উত্তেজিত করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু অচিরেই মহারাজার কুনজরে পড়ে তিনি গ্রেফতার হন। ১০ মাস অন্তরীণ থাকার পর মুক্তি পেয়ে তিনি অন্যদের সাথে নিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন All India Kashmir Committee গঠন করেন। ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই এর উদ্বোধনী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সিমলায়।
এরপর শেখ আবদুল্লাহ তাঁর অপর বন্ধুদের নিয়ে ‘মুসলিম কনফারেন্স’ দল গঠন করেন। তিনি এর প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং গোলাম আববাস সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। শেখ আবদুল্লাহর ওপর আহমদিয়া কাদিয়ানীদের যেমন প্রভাব ছিল, তেমনি প্রভাব ছিল কাশ্মীরী পন্ডিতদেরও। আর কংগ্রেস নেতা পন্ডিত নেহেরু তো তাঁকে বন্ধুত্বের টোপ ফেলে দিকভ্রান্তই করে ফেলেন। ফলে শেখ আবদুল্লাহ মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বের রাজনীতির বদলে কংগ্রেসের সেক্যুলার রাজনীতিকেই তাঁর আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে তিনি ‘ন্যাশনাল’ যুক্ত করে ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে কাশ্মীরে কংগ্রেসের যমজ একটি রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে রাজনীতিতে আবির্ভূত হন।
পাকিস্তান-উত্তরকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে একইভাবে কংগ্রেসের প্রভাবে শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে সেক্যুলারিজমের আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ নামে রাজনীতি সূচনা করেন। এ কাজটি প্রথম শুরু করেন শেখ আবদুল্লাহ। এর ফলে মনোরঞ্জন ধর, ফনী মজুমদাররা কংগ্রেসের সানইবোর্ড গুটিয়ে আওয়ামী লীগের কান্ডারী হয়ে যান।
কাশ্মীর ও ন্যাশনাল কনফারেন্স মুসলিম জাতীয়তাবাদের বদলে সেক্যুলারিজম গ্রহণ করায় কাশ্মীরী পন্ডিত ও কংগ্রেসী ‘সেক্যুলাররা’ ন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিপি ধর, আই-কে-গুজরাল প্রমুখ। ডিপি ধর ১৯৭১-এ তার কমিউনিস্ট ব্যাকগ্রাউন্ডকে কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ভারতের ২০ সালা মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন এবং বাংলাদেশ-উত্তরকালে মুজিব সরকারের ওপর দিল্লী সরকারের পক্ষে ‘মগজ ধোলাই’ উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেছেন। আই-কে-গুজরাল প্রথমে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ‘গুজরাল ডকট্টিন’-এর উদ্ভাবক হিসেবে খ্যাত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ও কাশ্মীর উপত্যকার দুই ‘শেখ’-কে কংগ্রেসী নেতারা সেক্যুলারিজমের টোপে বশীভূত করে ইতিহাসের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছেন এবং দুই অঞ্চলের সাধারণ মুসলিমদের রাজনৈতিক বিপর্যয়কে অনিবার্য করেছেন। এ দুটি ঘটনা উপ-মহাদেশীয় রাজনীতিতে মুসলিমদের জন্য দুঃখজনক মাইলস্টোন। শেখ আবদুল্লাহ পন্ডিত নেহেরুর সেক্যুলারিজমের বন্ধুত্বের নামে প্রতারিত হয়েছেন এবং প্রধানতঃ তাঁর ভুলের জন্যই কাশ্মীরের মুসলিমরা ভারতের গোলামীর শৃঙ্খলে বন্দী হতে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মাইন্ড সেট বদলে দিয়ে তাদেরকে সেক্যুলারিজমের কামলা বানানোর নয়া প্রক্রিয়ায় বাঙালী মুসলিমদের রাষ্ট্রীয় অর্জন বিপন্ন হবার অবস্থা তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসের সেক্যুলারিজম ইউরোপের সেক্যুলারিজমের কার্বন কপি নয়। যদিও ভারতীয় কংগ্রেসের দুই দিকপাল ‘মহাত্মা’ গান্ধী ও পন্ডিত নেহেরু উভয়ই ইউরোপ উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত। কিন্তু কংগ্রেসের সেক্যুলারিজম হচ্ছে বর্ণচোরা ‘হিন্দুত্বের’ শোভন সংস্করণ। এতে মুসলিমের মুসলমানিত্ব বিসর্জন দিতে হবে এবং ‘ভারতীয়’ জাতীয়তার নামে তাঁদের হিন্দুত্বের পূজারী হতে হবে। জম্মু ও কাশ্মীর ভারতভুক্ত না হয়ে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে তখনই অস্তিত্ব লাভ করে টিকে থাকতে পারবে, যখন মুসলিম জাতীয়তা ও স্বাতন্ত্রকে তার রাজনৈতিক আইডেন্টিটি হিসেবে বুলন্দ করা সম্ভব হবে। কাশ্মীরের বৃহত্তর জনগণ ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণগতভাবে মুসলিম বলেই শেখ আবদুল্লাহর মতো রাজনৈতিক নেতাদের উদ্ভব ঘটেছে এবং জনগণ তাঁকে ‘শের-এ-কাশ্মীর’ হিসেবে তাকে তারা বরণ করে নিয়েছেন। দ্বিতীয়তঃ কাশ্মীর উপত্যকা কেবল ভৌগোলিক কারণেই নয়, স্বতন্ত্র ও ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এজন্যই থাকবে, যেহেতু কাশ্মীর একটি মুসলিম প্রধান জনপদ। শেখ আবদুল্লাহ কংগ্রেসের সেক্যুলারিজমের ধাঁন্ধায় সেক্যুলার রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে নেতৃত্ব ও দেশ দুটোই হারিয়েছেন। কংগ্রেস সেক্যুলার রাজনীতি করলেও গান্ধী নিজে ছিলেন প্রাচীন বৈদিক হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবনবাদী ‘মহাত্মা’। তাঁর রাজনীতির পাশাপাশি তাঁর ধর্মীয় আরাধনা-প্রার্থনাও চলেছে। গান্ধী বলতেন : ‘আমাকে দ্যাখো, আমি-ই হিন্দু-মন।’ হিন্দুত্ব ও হিন্দু বলয়ের সমর্থন বরাবরই কংগ্রেসের নেতাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রীডম’ বইয়ে ভারত বিভক্তির জন্য পন্ডিত নেহেরুর হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ ও হিন্দুত্বের বলয় ভেঙ্গে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের উদারতায় তাঁর উত্তরণ না ঘটাকে দায়ী করেছেন। এ উপ-মহাদেশের মুসলিমদের সেক্যুলারিজম গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে, কংগ্রেসের সর্বভারতীয় জাতীয়তা, -‘যা হিন্দুত্বের মুখোশ’ মাত্র, তার কাছে ক্রমশঃ নিজেদের স্বকীয়তা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দেয়ার আত্মঘাতী প্রক্রিয়া বরণ করে নেয়া।
শেখ আবদুল্লাহ আহমাদিয়া কাদিয়ানীদের ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ করেছেন, তা নিয়ে বিতর্কের কারণে অনেক মুসলিম নেতা তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন মীর ওয়াইজ মোহাম্মদ ইউসুফ শাহ। এদিকে ১৯৩৩ খৃস্টাব্দে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোল টেবিল কনফারেন্সে গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া ফেডারেশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। শেখ আবদুল্লাহ মনে করেন, জম্মু-কাশ্মীর যদি ভারত ফেডারেশনে যোগ দেয়, তাহলে মহারাজার পক্ষে নয়, কাশ্মীরের জনগণের পক্ষে তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন। ১৯৩৬ সালর ৮ মে জম্মু-কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স Responsible Governmet Day কর্মসূচী পালন করে।
মীর ওয়াইজ ইউসুফ শাহ শেখ আবদুল্লাহ থেকে আলাদা হয়ে যাবার পর ১৯৩৮-এর ২৬ মার্চ শেখ আবদুল্লাহ মুসলিম কনফারেন্সে এক ভাষণে শিখ-হিন্দুদের সমন্বয়ে কাশ্মীরে একটি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার প্লাটফরম গঠন করে জাতীয় আন্দোলন চালানোর মত প্রকাশ করেন। প্রেমনাথ বাজাজ তাঁর মতকে সমর্থন করেন। এখান থেকেই শেখ আবদুল্লাহ মুসলিম কনফারেন্স-এর নাম পরিবর্তন করে ন্যাশনাল কনফারেন্স নামে কংগ্রেসের অদলে সেক্যুলার সংগঠন গড়ে তোলেন। ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রথম অধিবেশনে মুসলিম লীগ নেতাদের কোন বাণী সংগ্রহের উদ্যোগ না থাকলেও কংগ্রেস নেতা পন্ডিত নেহেরু এক বাণীতে তাঁর রাজনৈতিক সংহতি ঘোষণা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘‘All the world is on the move and India must move with it, not seperately or isolation. India must attain her full freedom based on unity. I hope that the Coference will view all these events that are happening in true perspective so that the people of Kashmir may attain their freedom in the larger freedom of India. [Kashamir in the Corossfire- P-109]’’
ভারতের বৃহত্তর স্বাধীনতার মধ্যেই পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীরের স্বাধীনতাকে মূল্যায়ন করেছেন। কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত রেখেই তিনি তাই বাণী দিয়েছেন।
১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল কনফারেন্স-এর সুপুর সম্মেলনে শেখ আবদুল্লাহর ‘‘নয়া কাশ্মীর’’ মেনিফেস্টো গৃহীত হয়। এই কর্মসূচী সেক্যুলার-সমাজতেন্ত্রর মিশেল হিসেবে আলোচিত ছিল। মুসলিম ও হিন্দুদের রক্ষণশীল অংশ থেকে এই কর্মসূচীর প্রবল বিরোধিতা আসে। আই-কে-গুজরাল এবং ডিপি-ধরও তখন কাশ্মীরকেন্দ্রিক শেখ আবদুল্লাহর ‘নয়া কাশ্মীর’ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এঁরা দুজনই সর্বভারতীয় রাজনীতির বিশেষ স্থান দখল করেন। আই-কে-গুজরাল তো ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ন্যাশনাল কংগ্রেসকে মুসলিমরা কংগ্রেসের বি-টিম হিসেবেই মূল্যায়ন করেছেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখনও শেখ আবদুল্লাহর অনুকূলে না থাকায় শ্রীনগরে দলের ম্যানিফেস্টো ছাপতে কোন প্রেস রাজী হয়নি। আই-কে-গুজরাল লাহোরে তাঁর এক বন্ধুর প্রেস থেকে এটি ছাপেন। [Inder Gujral, Interview, New Delhi, 9 April, 1994/ প্রাগুক্ত-বই-পৃ. ১১১]
‘Mother India’ (New york, 1992, P-270) বইয়ের লেখক প্রণয় গুপ্ত দাবী করেছেন যে, শেখ আবদুল্লাহর জন্ম নিয়ে কিংবদন্তী আছে। এতে একটি বিস্ফোরক তথ্য উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন : ‘‘...The substantial rumor that Sheikh Abdullah was the ellegal son of Moti Neheru.’’। পন্ডিত নেহেরুর পিতৃসূত্রে শেখ আবদুল্লাহ তাঁর ভাই।
১৯৩৭ সালে শেখ আবদুল্লাহ রাজনৈতিক ইস্যুতে পন্ডিত নেহেরুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। লাহোর এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় শেখ আবদুল্লাহ এ সময় নেহেরুর সফরসঙ্গী হন। সেখানে তাঁরা ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আবদুল গাফফার খানের সাথে রাজনৈতিক ইস্যুতে মতবিনিময় করেন। কাশ্মীরের সেক্যুলার শেখ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ‘সীমান্ত গান্ধী’ গাফফার খানকে সাথে পেয়ে পন্ডিত নেহেরু মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ও শক্তিশালী প্রচারণা চালান। কাশ্মীরের রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে পন্ডিত নেহেরু ১৯৪০-এ [পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের সময়] খান আবদুল গাফফার খানকে নিয়ে কাশ্মীর সফর করেন। ১৯৪১ সালে গোলাম আববাস শেখ আবদুল্লাহর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলিম লীগের রাজনীতির সমর্থক হন। তিনি মীর ওয়াইজ ইউসুফ শাহের সাথে মিলে মুসলিম কনফারেন্স পুনরুজ্জীবিত করেন। এ সংগঠনটি উপমহাদেশীয় মুসলিমদের পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। কাশ্মীরে মুসলিম লীগের সমর্থন থাকলেও জম্মুতে ডোগ্রা ও হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল।
১৯৩৫ সালের দিকে ভারতীয় কংগ্রেস কাশ্মীরের ব্যাপারে তাদের নীতি অবস্থান স্পষ্ট করে। এতে তারা প্রকারান্তরে কাশ্মীরকে ভারতের ‘রাজ্য’ হিসেবেই উল্লেখ করেন। [কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি, ২৯ জুলাই-১, অগাস্ট, ১৯৩৫, আকবর রচিত, ‘বিহাইন্ড দ্য ভ্যালি, পৃ-৮১, প্রাগুক্ত-১১১]
মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি শুধু কাশ্মীরের ব্যাপারেই নন, রাজা শাসিত স্বাধীন ও আধা-স্বাধীন কোন দেশীয় রাজ্যের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিরোধী ছিলেন। এমনকি ‘পাকিস্তান’ নামকরণকারী চৌধুরী রহমত আলী কাশ্মীরকে পাকিস্তনের অন্তর্ভুক্ত দেখালেও তিনি তা অনুমোদন করেননি। জিন্নাহ সাহেব তাঁর স্বচ্ছ ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকেই বলেছেন : ‘‘We do not wish to interfare with the internal affairs of any state, for that is a matter primalrily to be resolved between the rulers and the people of the states. “[Mohammad Ali Jinnah, 17 June, 1947, Speeches and Statements, Government of Pakistan, 1989, P-17, প্রাগুক্ত, পৃ-১১২]
রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, মুসলিম লীগ বা জিন্নাহ সাহেবের সাথে শেখ আবদুল্লাহর সম্পর্ক কখনও আস্থা ও ওয়ার্কিং রিলেশন্সের অবস্থায় উপনীত হয়নি। ১৯৩৫ সালে জিন্নাহ-কাশ্মীর সফরে গেলে শেখ আবদুল্লাহর সাথে তাঁর প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তী পর্যায়ে বখশী গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে দিল্লীতে শেখ আবদুল্লাহ জিন্নাহর সাথে রাজনৈতিক ইস্যুতে আলোচনা করেন। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৪ সালে শেষবারের মতো কাশ্মীর সফর করেন। শ্রীনগরের শেখ আবদুল্লাহ, জি এম সাদিক, মাওলানা মাসুদি তাঁকে ব্যাপক সংবর্ধনায় গ্রহণ করেন। ন্যাশনাল কনফারেন্সে ভাষণ দিয়ে জিন্নাহ সাহেব মুসলিম কনফারেন্সেও বক্তব্য রাখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘‘If your objective is one, I am a Muslim and all my sympathies are for the Muslim cause.’’ [প্রাগুক্ত, পৃ, ১১২]
তবে শেখ আবদুল্লাহর সাথে জিন্নাহ সাহেবের রাজনৈতিক সম্পর্ক এরপর থেকে তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। কংগ্রেস শেখ আবদুল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক বাড়িয়ে দেয়। মুসলিম কনফারেন্সের নেতারা কাশ্মীরি ভাষাভাষী না হবার সুযোগে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সমর্থন-পৃষ্ঠপোষকতায় কংগ্রেসী পন্ডিতদের সহযোগিতায় শেখ আবদুল্লাহ ভারত ভাগের সময় কাশ্মীর উপত্যকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে ওঠেন।
শেখ আবদুল্লাহ নিজেও জানতেন যে, কাশ্মীর ভারতের সাথে যুক্ত হলে পাকিস্তান তা কখনও মেনে নেবে না এবং তাতে কাশ্মীর হবে দু’দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র। [Abdullah, Flames, P-83]। কিন্তু তিনি কাশ্মীরের ভারতভুক্তিও ঠেকাতে পারেননি। আবার কাশ্মীরকে ভারতের সামরিক শক্তি পরীক্ষার রণাঙ্গন থেকেও মুক্ত রাখতে পারেননি। প্রতারিত হয়ে শেখ আবদুল্লাহকে দীর্ঘকাল কারাবরণ করতে হয়েছে। শেষবারের মতো শেখ আবদুল্লাহ যখন মহারাজা শাসিত কাশ্মীরের প্রতিনিধি হিসেবে পন্ডিত নেহেরুর সাথে দেখা করতে যান, তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মহারাজা হরি সিংয়ের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত রামচন্দ্র কাক কাশ্মীর জুড়ে সামরিক শাসন জারী করেন।
কাশ্মীরের দুই শীর্ষ নেতা শেখ আবদুল্লাহ ও গোলাম আববাস কারাগারে থাকতে ১৯৪৭-এ মহারাজা হরি সিং আইনসভার নির্বাচন দেন। ন্যাশনাল কনফারেন্স নির্বাচন বর্জন করে। মুসলিম কনফারেন্স নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী দাবী করে। তারা মুসলিম লীগের রাজনৈতিক সমর্থন আশা করলে মুসলিম লীগ হাইকমান্ড দেশীয় রাজ্যসমূহের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার নীতিগত সিদ্ধান্তে অটল থাকায় ভারত হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র সফল করেছে প্রায় বিনা বাধায়। মুসলিম লীগের নেতাদের এই নিস্পৃহতাকে কাশ্মীরের জনগণ ভালোভাবে নেননি।
শেখ আবদুল্লাহর মোহমুক্তি
গভর্ণর জেনারেল লর্ড লরেন্স ডোগ্রা রাজা গুলাব সিংয়ের সাথে বৃটিশ শাসকদের অনৈতিক ও অবৈধ সম্পর্ক, কাশ্মীর ইজারা দানের ইতিহাস উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘‘We handed it over to the Dogra Rajput, Gulab Singh, Who paid up down at once in the hard cash which he had stolen form the Lahore darbar. [UN security council official Records, third year, neors, 1-15. P-337]
লাহোরের শিখ দরবার থেকে অর্থ চুরি করে গুলাব সিং সেই অর্থ বৃটিশদের ঘুষ দিয়ে কাশ্মীরের ইজারা চুক্তিপত্র খরিদ করেছিলেন।
ডোগ্রা রাজা হরি সিংয়ের দুঃশাসন ও যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাশ্মীর উপত্যকায় আধুনিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্য থেকে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ আন্দোলনের ধারায় শেখ আবদুল্লাহর রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। ক্ষয়িষ্ণু ও গণবিরোধী রাজতন্ত্রের দুর্দিন অাঁচ করেই পন্ডিত নেহেরু শেখ আবদুল্লাহর সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার ঐক্য গড়ে তোলেন। তবে পন্ডিত নেহেরুকে বিশ্বাস করে শেখ আবদুল্লাহ প্রতারিত হয়েছেন এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। পন্ডিত নেহেরু ডোগ্রা রাজার রোষানলে পড়ে গ্রেফতার হলে পন্ডিত নেহেরু তাঁর পক্ষে ডোগ্রা রাজার বাধার মুখে পড়েন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাহায্যে তিনি শেখ আবদুল্লাহকে মুক্ত করেন। এমনকি এ সময় পন্ডিত নেহেরুকেও ডোগ্রা রাজা গ্রেফতার করেছিলেন। ডোগ্রা রাজার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনকে সমর্থন করে পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীরের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন। অর্থাৎ কাশ্মীরের রাজনৈতিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার ওপর কংগ্রেস নেতাদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল স্বাধীনতা লাভের কয়েক দশক আগে থেকেই। গান্ধিজীর দৌত্যকর্মে নেহেরু বিরোধী ও মহারাজার পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাক-কে শিখ-বংশোদ্ভূত রাণীর মাধ্যমে অপসারণ করে তার জায়গায় পাঞ্জাবী মেহের চাঁদ মহাজনকে নিয়োগ দেওয়ার মধ্যদিয়ে ভারতের কাশ্মীরের ভারতভুক্তির ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন আরও সহজ হয়।
বৃহত্তর স্বাধীন ভারতের মধ্যে স্বাধীন কাশ্মীরের যে ধারণায় ও প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে শেখ আবদুল্লাহ স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা ছিল রাজনৈতিকভাবে অবাস্তব এবং কংগ্রেসী নেতাদের মানস- প্রকৃতিরও বিরোধী। ভারতের কংগ্রেস নেতারা যদি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো মেনে নিতে পারতেন, তাহলে ক্যাবিনেট মিশন প্লানেই উপ-মহাদেশের রাজনৈতিক সমাধান ঘটতো। বিভাজনের মধ্য দিয়ে দুই রাষ্ট্রের প্রয়োজন হতো না। যারা স্বাধীন ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক হিস্যা দিয়ে অখন্ড ভারত রাখতে চায়নি, তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতা মেনে নেবেন, এটা বিশ্বাস করা ছিল ইতিহাসের শিক্ষাকে অস্বীকার করা। সুতরাং শেখ আবদুল্লাহর প্রত্যাশা : .....Kashmir may attain their freedom in the larger freedom of India. [সূত্র M. J. Akbra, Kashmir Behind the vale, P-77] ছিল একটি মায়া মরীচিকা। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত শেখ আবদুল্লাহ ভারতের বৃহত্তর স্বাধীনতার মধ্যে ‘স্বাধীন’ কাশ্মীরের স্বপ্ন পোষণ করেছেন। গোয়েন্দা অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভারত ন্যাশনাল কনফারেন্সে বখশী গোলাম মোহাম্মদ ও মীর কাসিমদের মতো দালাল-বশংবদ তৈরি করে শেখ আবদুল্লাহ সরকারকে বন্দী করে কারাগারে পাঠায়।
মহারাজার বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে শেখ আবদুল্লাহ প্রকাশ্য জনসভার ভাষণে বলেন : ‘‘I never believed in Pakistan Slogan. Pandit Neheru is my freind and I hold Gandhiji in real reverence.’’ [সূত্র : প্রাগুক্ত-পৃষ্ঠা-১০৫]। দিল্লীতে শেখ আবদুল্লাহ পন্ডিত নেহেরুর আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন। পাঞ্জাবের মুসলিম প্রধান গুরুদাসপুর জেলার ভারতভুক্তির মাধ্যমে পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীরের সাথে ভারতের যোগাযাগসূত্র স্থাপন করে নিয়েছেন আগেই। এটা ছিল ষড়যন্ত্র এবং কাশ্মীরকে দখলে নেবার ভারতীয় সামরিক স্ট্র্যাটেজির অংশ।
শেখ আবদুল্লাহ এমন সময় ভারতের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ান, যখন তাঁর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার অভাব এবং তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তে বিভ্রান্ত জনমতকে তিনি কাজে লাগিয়ে পন্ডিত নেহেরু ও স্ব-দলীয় বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সফল হতে পারেননি। নেহেরু-প্যাটেলরা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ মুসলিম নেতৃত্ব, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, রফি আহমদ কিদওয়াই, এম সি চাগলা (আসাম) ও ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আবদুল গাফফার খানের মাধ্যমে শেখ আবদুল্লাহকে ভারতমুখী করে রাখার সর্বাত্মক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫৩-এর অগাষ্টে মার্কিন কূটনীতিক ও পাকিস্তানের সাথে মিলে কাশ্মীর স্বাধীন করার অভিযোগ এনে শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। ১১ বছর পর ১৯৬৪-এর ৮ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর আবার যখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তাঁর কারাবরণ ছিল আরও প্রলম্বিত এবং তিনি যখন মুক্তি পান, তখন তাঁর বয়স ৭৫।
শেখ আবদুল্লাহর কমিটমেন্ট ও পলিটিক্যাল ডাইমেনশন নিয়ে পন্ডিত নেহেরুর মনে ক্রমশঃ সন্দেহ তৈরি হয়। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ যেমন শেখ আবদুল্লাহর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে, তেমনি ভারত যে ক্রমশঃ কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা নিয়েও তাঁর ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তিনি মনে করতেন, ভারতের সাথে থাকলেই তারা নিরাপদ থাকবেন এবং সেক্যুলার ভারতের গণতান্ত্রিক সহযোগিতায় কাশ্মীরের জন্য অধিকতর লাভবান হবেন। কিন্তু বন্ধুত্ব ও প্রতিশ্রুতির আড়ালে যে ভারতের হিংস্র আগ্রাসী রূপ লুক্কায়িত ছিল, তা যখন শেখ আবদুল্লাহ বুঝতে পেরেছেন, তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের ক্ষমতায় ছিলেন। তবে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে দিল্লী শেখ আবদুল্লাহকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও বিলম্ব করেনি। শেখ অবদুল্লাহর রাজনৈতিক সহযোগী বখশী গোলাম মোহাম্মদ, জি এম সাদিক প্রমুখ রাজনীতিক এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু শিখ সহযোগী তাঁর অপসারণে দিল্লীর সাথে হাত মিলায়। ১৯৫৩ সালের অগাস্ট শেখ আবদুল্লাহর সরকার বরখাস্ত করার পর বখশী গোলাম মোহাম্মদ চীফ মিনিস্টার পদে আসীন হন। ভারত সরকার ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আর তাঁকে রাজনীতিতে ফিরতে দেয়নি। দীর্ঘ দুই দশক তাঁকে ভারত সরকারের মেহমান হিসেবে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তিনি যখন মুক্ত, তখন তাঁর বয়স ৭৫। শেখ আবদুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে দিল্লী সরকার একদিনের জন্যও তাঁকে মুক্ত রাখেনি। সাথে সাথেই কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।
শেখ আবদুল্লাহকে কারাগারে রেখেই ভারত কাশ্মীরের Constituent Assembly-তে Act of Accession এবং ইন্ডিয়ান সংবিধানের প্রতি অনুমোদন আদায় করে নেয়া হয়। যদিও এটা ৩০৭ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ভারতের সংবিধানের কাশ্মীরকে ‘বিশেষ মর্যাদা’-র পরিপন্থী।
১৯৫৮-এর জানুয়ারীতে মুক্তি পেলেও ২ মাসের মধ্যে শেখ আবদুল্লাহকে আবার গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। কংগ্রেসের বিশ্বস্ত বখশী গোলাম মোহাম্মদ সরকারের কঠোর সমালোচনা ছাড়াও শেখ আবদুল্লাহ সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে গণভোট দাবী করেন, ভারত সরকার এবার শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী মদদপুষ্ট হয়ে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবী তোলার অভিযোগ আনে।
মহারাজার উভয় সংকট
ভারতের নয়া রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন এবং কাশ্মীর উপত্যকায় যে নয়া রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে, মহারাজা হরি সিং তাকে বুঝতে পারেননি বা চাননি। ন্যাশনাল কনফারেন্সকে তিনি যেমন হুমকি মনে করেছেন, তেমনি মুসলিম কনফারেন্সকেও মেনে নেননি। তাঁর ক্ষমতা রক্ষার দুটি শর্ত তিনি উপেক্ষা করেছেন। প্রথমতঃ তিনি নিজেকে নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দাবী করে সকল দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে পারতেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি উপত্যকার স্বাধীনতা রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারতেন। রাজনৈতিক বিবর্তনের দিকে নজর না দিয়ে মহারাজা মধ্যযুগীয় রাজতান্ত্রিক কৌশলে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছেন। ভারতের কাশ্মীর আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার মতো সামরিক শক্তি মহারাজার ছিল না। উপরন্তু কাশ্মীরের শক্তিশালী হিন্দু পন্ডিতরা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির জন্য কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়েছে। মহারাজা ও তার ডোগ্রা জনগোষ্ঠী কাশ্মীরের ভূমিপুত্র নন, তারা বহিরাগত এবং তার পূর্ব পুরুষের ক্ষমতারোহণের ইতিহাস প্রতারণা ও ঔপনিবেশিক শক্তির অবৈধ দেশ বিক্রির সাথে যুক্ত।
মহারাজা হরি সিং-এর পুত্র করন সিং তাঁর পিতা সম্পর্কে লিখেছেন : “He was hostile to the Indian National Conference, led by Gandhi, Neheru and Patel, partly because of Close freindship with Abdullah.”
[Kashmir in Crossfire-Victoria schofield. অন্যদিকে মহারাজা হরি সিং মুসলিম লীগের দ্বি-জাতি তত্ত্বেরও ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। করনসিং লিখেছেন : “when the crucial moment came, ... he found himself alone and friendless, Singh, Heir Apparent, P-42/প্রাগুক্ত-পৃ-১১৭]
করনসিং জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতা নস্যাতের পেছনে স্বামী সন্ত দেব-কে সরাসরি দায়ী করেছেন। এই ধর্মীয় নেতার প্ররোচনায় মহারাজা এক ইউটোপিয়ান হিন্দু রাজ্যের মরীচিকায় অন্ধ ছিলেন। করন সিং লিখেছেন : “The Swami encouraged the Maharaja’s feudal ambitions ‘planting in my father’s miind visiondt of an extended kingdom sweeping down to lahore itself where our ancestor Maharaja Gulab Singh and Raja Suchet Singh had played such a crucial role a century earlier.” [ibid, P-38]
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন চাইলে ভারত ত্যাগের আগেই কাশ্মীর উপত্যকায় গণভোট অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে সেখানকার সমস্যার নিষ্পত্তি করে দিতে পারতেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা ছাড়াও সিলেটের
পাকিস্তান ভুক্তির ব্যাপারে যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে, তাহলে কাশ্মীরের গণভোট অনুষ্ঠানকে কেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন তার এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করেননি? এখানেই কংগ্রেসের চাতুরী ও মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে তাঁদের গোপন অাঁতাতের বিষয়টি উঠে আসে। সবাই জানেন, মাউন্ট ব্যাটেন ছিলেন পন্ডিত নেহেরুর বন্ধু এবং তার স্ত্রী এডুইনা ছিলেন পন্ডিত নেহেরুর প্রণয়ী। ভারতের কাশ্মীর দখলের পর পন্ডিত নেহেরু যখন প্রথমবার কাশ্মীর সফর করেন, তখন এডুইনা লন্ডন থেকে এসে কাশ্মীরে তাঁকে সঙ্গ দেন। তাছাড়া মাউন্ট ব্যাটেনকে ভারত বিভক্তির সময় ভারতের ভাইস রয় হিসেবে নিযুক্ত করার ব্যাপারে লন্ডনে রাণীর কাছে কংগ্রেসী নেতারা দেন-দরবার করেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রেখে ভারতকে গ্রাস করার জন্য কাশ্মীরকে অরক্ষিত রেখে দেন। এমনকি মাউন্ট ব্যাটেন চাইলে হিন্দুপ্রধান মুসলিম নিজাম-শাসিত হায়দ্রাবাদের সাথে মুসলিম প্রধান হিন্দু রাজা শাসিত কাশ্মীরকে বিনিময় করে পাকিস্তানের ভাগেও কাশ্মীরকে ফেলতে পারতেন।
কাশ্মীর যাতে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় অথবা কাশ্মীর যাতে ভারতে যোগ দিতে বাধ্য হয়, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন সে লক্ষ্যেই কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ জুন ভাইস রয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন শ্রীনগর সফর করেন। তিনি পন্ডিত নেহেরুর ব্রীফ এবং কাশ্মীর সংক্রান্ত লিখিত গাইড লাইন সাথে নিয়ে শ্রীনগর আসেন। তার লক্ষ্য ছিল, মহারাজাকে ভারতে যোগদানে সম্মত করানো। নেহেরু মহারাজাকে চাপে রাখতে শেখ আবদুল্লাহকে লাইমলাইটে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। ন্যাশনাল কনফারেন্স ইন্ডিয়ান কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিল। পাকিস্তান মুসলিম লীগ, জিন্নাহ এবং দ্বি-জাতি তত্ত্ব নিয়ে শেখ আবদুল্লাহর অনীহা ও অশ্রদ্ধা ছিল সুবিদিত। শেখ আবদুল্লাহ বলেছেন : ‘I never believed in Pakistan’s slogan pandit Nehere is my best fried and I hold Gandhi is real reverence. [M.J. Akbar, Kashmir : Behind the vale, P-205]’
কিন্তু মহারাজা হরি সিং ভারত বা পাকিস্তান কারও সাথেই যুক্ত হতে ইচ্ছুক ছিলেন না। মহারাজার পুত্র করন সিং বলেছেন : ‘My father wanted to accede to India nor to Pakistan. He was thinking in terms an Indepemdent kashmir, which would have stayed as a zone of peace between India and Pakistan.” [Interview with Aouthor Omkar Razdan, at Delhi, on 25th April, 1997].
মহারাজার প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাক-কে ভারতের পক্ষে ওকালতির জন্য ব্যবহার করা হয়। মাউন্ট ব্যাটেন মহারাজার প্রতি পাকিস্তানের সাথে যোগ না দিতে রীতিমতো হুঁশিয়ার করে দেন। [সূত্র : V.P. Menon, The story of The Intigration of the Indian States, Calcutta, 1936, p-394/প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১২২]
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের শ্রীনগরে অবস্থানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহারাজা অবহিত ছিলেন বলেই তিনি দারুণ অস্বস্তিতে ছিলেন। তিনি মাউন্ট ব্যাটেনকে মাছ শিকারসহ নানা স্থূল ও বিনোদনমূলক কর্মসূচীতে ব্যস্ত রাখেন। মাউন্ট ব্যাটেনের চাপ নাকচ করতে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি মাউন্ট ব্যাটেনের কাছ থেকে আড়াল হতে একদিন সময় নিলেন। কিন্তু পরদিন অসুস্থতার অজুহাতে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে রাজা দেখা দেননি।
ব্যর্থ হয়ে মাউন্ট ব্যাটেন দিল্লী ফিরে গেলে নেহেরু হতাশ হন। পন্ডিত নেহেরু মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে এক লিখিত পত্রে জানান : ‘‘There was considerable disappoitnment at the lack of results of your visit.” [Neheru to Mount Batten 27 July, 1947, In Transfer, Vol-XII. Doc. 249, P-368/প্রাগুক্ত পৃ-১২২]
মাউন্ট ব্যাটেন মহারাজার কাছে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি প্রসঙ্গ উত্থাপনের সুযোগ নিতেই মহারাজা অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। ভিপি মেনন, যিনি স্বাধীনতা পূর্বকালে ভারত সরকারের সাংবিধানিক উপদেষ্টা ছিলেন, তাঁর মতে, মহারাজা স্বাধীন জম্মু-কাশ্মীর গঠনের বাইরে আর কোন চিন্তা করেননি। যদিও মাউন্ট ব্যাটেন মহারাজাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগণের চাপে মহারাজা পাকিস্তানে যোগ দিলে তাকে ‘an unfairly act’ - হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ভারতের প্রতি মহারাজাকে নমনীয় করতে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলও পত্র যোগাযোগ করেছেন। [সূত্র : Patel to Harri Singh, 3 July 1947, in Transfer, Vol-Xll, Doc-34, P-33/প্রাগুক্ত-১২৩] প্যাটেল ছিলেন কংগ্রেস তথা ভারত সরকারের পক্ষে ‘দেশীয় রাজ্য’ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।
মাউন্ট ব্যাটেনের মিশন সফল না হলেও কংগ্রেস নেতারা, বিশেষ করে পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীর দখল করার অভিসন্ধি ত্যাগ করেননি। পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীরের ব্যাপারে এতটাই অন্ধ ছিলেন যে, তাঁকে কাশ্মীর ও দিল্লীর মধ্যে যে কোন একটি বেছে নিতে বললে তিনি হয়তো কাশ্মীরের উপরই বাজি ধরতেন। প্যাটেলকে এক পর্যায়ে নেহেরু বলেছেন : ‘Kashmir meant nrere to thim than anything eles.’ [প্রাগুক্ত-পৃ-১২৩] ভারত স্বাধীন হবার অব্যবহিত পর পন্ডিত নেহেরু নিজেই কাশ্মীর সফরের উদ্যোগ নিলে সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনা করে মাউন্ট ব্যাটেন তাকে নিবৃত্ত করেন। কাশ্মীরের বৃটিশ রেসিডেন্ট উলফ্রেডকেও মাউন্ট ব্যাটেন এ নিয়ে পত্র লিখেন। [সূত্র : Mount Batten to Webb, 28 June, 1947, Transfer, vol-Xll, Doc-302, P-449/প্রাগুক্ত-পৃষ্ঠা-১২৩]
মাউন্ট ব্যাটেন লিখেন : ‘....a visit by him to kashmir at this moment could only produce a most explosive situation.’। এ কারণে মাউন্ট ব্যাটেন নেহেরুর বদলে গান্ধীকে কাশ্মীর পাঠাতে পরামর্শ দেন।
পন্ডিত নেহেরুকে মহারাজা হরি সিং শুধু অপছন্দই করতেন না, প্রচন্ডভাবে ঘৃণাও করতেন। এর আগে মহারাজা নেহেরুকে শ্রীনগরে গ্রেফতারও করেছিলেন। ভারত থেকে বৃটিশ শাসকের বিদায়কালে পন্ডিত নেহেরু অযাচিতভাবে কাশ্মীর গেলে একটা বড়ো ধরনের গোলযোগ ঘটতে পারে এবং এমনকি নেহেরু আবারও মহারাজা গ্রেফতার করতে পারেন। সবদিক বিবেচনায় কাশ্মীর মিশনে গান্ধিজীকে পাঠানোই উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়।
কোন মুসলিম লীগ নেতা বিরোধপূর্ণ হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় বা কাশ্মীর সফরে যাননি। পন্ডিত নেহেরুর ব্যক্তিগত আবেগকে ব্যবহার করে ভারত কাশ্মীর সম্পর্কে একটা ‘মীথ’ তৈরি করেছে। কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালিনী পর্যন্ত পাঞ্জাবের পাতিয়ালা, ফরিদকোট, কাপুরথালা সফর করে ঐসব এলাকাকে ভারতে যোগ দিতে প্রচার চালান।
১৯৪৭ সালের ১ লা অগাস্ট, ভারত স্বাধীনের দু’সপ্তাহ পূর্বে দিল্লীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ‘অহিংসার অবতার’ গান্ধিজী কাশ্মীরি জনগণের স্বাধীনতা হরনের মিশন নিয়ে শ্রীনগর যান। পথে বারমূলায় গান্ধীজি কাশ্মীরি জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পড়েন। এমনকি বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়ির কাঁচ ভেংগে ফেলে। কিন্তু গান্ধিজী তাঁর এ সফরকে ‘শান্তির লক্ষ্যে অরাজনৈতিক সফর’ হিসেবে উল্লেখ করে ধোঁকা দিয়ে শ্রীনগর প্রবেশ করতে সক্ষম হন। শ্রীনগরে মহারাজা হরি সিং ও তার রাণীর সাথে গান্ধিজী সাক্ষাৎ করেন। অনেকে মনে করেন, শিখ রাণীর মাধ্যমে গান্ধিজী মহারাজার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। গান্ধিজী তাঁর সফরকে যে অরাজনৈতিক ধারায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, বৃটিশ সূত্রও তা স্বীকার করেছে।
ফিল্ড মার্শাল অচিনলেক-এর প্রাইভেট সেক্রেটারী শহীদ হামিদ লিখেছেন : ‘In reality it was to presesurise the Maharaja to accede to India and to remove Kak. [প্রাগুক্ত-পৃ.১২৪] প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র কাক-কে অপসারণ এবং মহারাজার ওপর কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত করার ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করাই ছিল গান্ধিজীর কাশ্মীর সফরের লক্ষ্য। তাঁর এ সফরের পরই মহারাজা হরি সিং তাঁর দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরি পন্ডিত রামচন্দ্র কাক-কে অপসারণ করে কংগ্রেস বান্ধব মহাজনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন।
জিন্নাহ সাহেব বার বার মহারাজার কাছে কাশ্মীরের জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের মতামতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আহবান জানিয়েছেন। [সূত্র : প্রাগুক্ত, পৃ-১২৪] জিন্নাহ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন : ‘Wisdom demands that the feelings and sentiments of the Muslim who from 80 percent of the population should not ignored, much lees hurt’ [প্রাগুক্ত]
এমনকি জিন্নাহ সাহেব জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার প্রতিও সম্মতি জানিয়েছেন। [সূত্র : Mehammad Ali Jinnah, 17 June, 1947, Speehesd and Statsments, p-17, প্রাগুক্ত, পৃ-১২৫]
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪৭ সালের ৫ জুন পাকিস্তানের অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জ করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এতে বলা হয় : ‘The resolution went on to say that once presnet positions, had subsided
the false doctrine of two nations theory will be described and discarded by all.’ [প্রাগুক্ত, পৃ-১৩১]
১৯৪৭ সালের ১২ অগাস্ট মহারাজা হরি সিং পাকিস্তানের সাথে একটি ‘stand still’ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তান বৃটিশ শাসন মুক্ত হয়ে একটি নয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ সত্ত্বেও কাশ্মীরের সাথে যে বাণিজ্য, পর্যটন, যোগাযোগসহ অন্যান্য সম্পর্ক ছিল তা অব্যাহত থাকবে। ভারত এ চুক্তিতে খুশী ছিল না। কাশ্মীর নিয়ে ভারতের আগ্রাসী দূরভিসন্ধি মুকাবিলায় পাকিস্তানী নেতারা দূরদর্শী পরিকল্পনা নেননি। মহারাজার সাথে তারা যে stand still চুক্তি সম্পাদন করেছে, ভারত কাশ্মীর দখল করে নিলে সে চুক্তিই শুধু অকার্যকর হবে না, পাকিস্তানের নিরাপত্তাও চাপের মুখে পড়বে। পরিস্থিতি এবং কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের আলোকে পাকিস্তানের কাশ্মীর ইস্যুতে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ার প্রত্যাশা ছিল। পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর কাশ্মীরের মুসলিমরা পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করেন। তবে মহারাজার পুলিশ তা নামিয়ে ফেলে। পাকিস্তানপন্থী সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।
উপজাতীয় মুসলিমদের গণ-অভ্যুত্থান
বৃটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে কর্মরত সৈনিকদের মধ্যে ৭০ হাজারেরও বেশী সদস্য ছিলেন, যারা জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের অধিবাসী। এদের মধ্যে মুসলিম সৈনিকদের সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহারাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ বৃদ্ধি পেলে মহারাজা উপজাতীয় মুসলিমদের সেনাবাহিনীতে রিক্রুট বন্ধ করে দেন। যুদ্ধশেষে এসব সৈনিকরা কর্মস্থলে যোগ দিতে না পেরে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশ হয়ে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান। এদিকে পুঞ্চ এলাকার মুসলিম উপজাতীয়রা মোটামুটি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতেন। মহারাজার পুঞ্চের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ঐ এলাকার মানুষের ক্ষোভের সৃষ্টি করে। যুদ্ধ ফেরৎ বেকার সৈনিকদের অসন্তোষ একত্র হয়ে মহারাজার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পটভূমি তৈরি হয়।
১৯৪৭-এর বসন্তকালে পুঞ্চ-এ কর প্রদান বন্ধের আন্দোলন শুরু হয়। মহারাজা শিখ ও হিন্দু সেনাদের ব্যবহার করে কর প্রদানে জনগণকে বাধ্য করতে চান। সরদার মোহাম্মদ ইব্রাহীম কয়েক হাজার উপজাতীয় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী নিয়ে মহারাজার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। তার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। তারা স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। উল্লেখ্য, পুঞ্চ এলাকায় মুসলিম অধিবাসীদের ওপর প্রতিবেশী জম্মু থেকেও ডোগ্রা মহারাজার সেনাদল দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার-নির্যাতন-লুণ্ঠন চালিয়ে আসছিল। পাকিস্তানের সাথে মহারাজার ‘স্থিতাবস্থা চুক্তি’ থাকা সত্ত্বেও মহারাজা ঝিলাম নদীর তীর পর্যন্ত তার সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। এতেও উত্তেজনা ও অবিশ্বাস বেড়ে যায়। বৃটিশ মেজর জেনারেল স্কট ছিলেন ডোগ্রা মহারাজার কমান্ডার ইন চীফ। কিন্তু মহারাজা তার ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তার জায়গায় একজন ভারতীয় সেনা কমান্ডার নিয়োগ করা হয়।
এদিকে কাশ্মীর উপত্যকায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগ রুট পরিহার করে পাঠানকোট রুটে ভারত-শ্রীনগরে সৈন্যবাহিনী পাঠায়। সেনা পারাপারের জন্য তারা রাভী নদীতে দ্রুত নৌকাব্রীজ তৈরি করে। মহারাজা নিজেও দিল্লীর সাথে বিকল্প সামরিক যোগাযোগ উন্নয়নে ইচ্ছুক ছিলেন। যাতে পাকিস্তান বাধা দিলেও তার অসুবিধা না হয়। তবে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর প্রথম দলটি বিমান যোগে শ্রীনগরে অবতরণের আগেই ভারত অবৈধভাবে অতিদ্রুতগতিতে কাশ্মীরকে তাদের কেন্দ্রীয় পোস্টাল সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসে। ভারত মহারাজা হরি সিং-কে শেখ আবদুল্লাহর সাথে সন্ধি করে চলার পরামর্শও দেয়। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৭-এর ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মহারাজা শেখ আবদুল্লাহকে বন্দী করে রাখেন। পাক-ভারত স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ও তিনি কারাগারে। কারামুক্তির পর শেখ আবদুল্লাহ ভারতে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র দেখতে পান যে কাশ্মীরের রাজনৈতিক স্টেটাস নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন।
শেখ আবদুল্লাহ দাবী তুললেন : ‘... We the people of kashmir must now see to it that our long cherished dream is fulfilled. The dream of freedom, welfare and progrss. [Abdullah, Speeches at Huzuribag, 2 October, 1947, in Flames, P-86]
শুরুতে শেখ আবদুল্লাহ ভারতের আগ্রাসী পরিকল্পনার ভয়ংকর রূপ অনুধাবন করতে পারেননি। পন্ডিত নেহেরু ১৯৪৭-এর অক্টোবরে অল ইন্ডিয়া স্টেটস পিপলস কনফারেন্সের সেক্রেটারী দ্বারকানাথ কেচরু-কে শেখ আবদুল্লাহর মনোভাব পরিবর্তনের মিশন নিয়ে শ্রীনগরে পাঠান। তিনি দিল্লীতে ফিরে গিয়ে জানান যে, শেখ আবদুল্লাহ ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে রাজী হয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি তারা গোপন রাখেন। কেচরু মহারাজার সাথে যে কোন ধরনের চুক্তি সম্পাদনসহ শক্তি প্রয়োগে কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করার সুপারিশ করেন। তার মতে অন্যথায়, মুসলিম লীগ নেতা ও উপজাতীয় প্রাইভেট সেনাবাহিনী মিলে কাশ্মীর দখল করে নেবে। তখন ভারতের কিছুই করার থাকবে না।
শেখ আবদুল্লাহ দিল্লী সফরের পর লাহোরে গিয়ে পাকিস্তানী নেতাদের সাথেও আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তার আগেই তিনি জি এম সাদিক ও ড. তাসিরকে লাহোরে পাঠান। বখশী গোলাম মোহাম্মদ আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। এ সময় পাকিস্তানে দ্রুত এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, কাশ্মীর পাকিস্তানের সাথে থাকবে। কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানের ধনী ব্যক্তিরা ভূমি খরিদেও তৎপর হন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান শ্রীনগরে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। মহারাজার সাথে কূটনৈতিক চ্যানেলে পাকিস্তানের যোগাযোগ থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রামচন্দ্র কাক-কে অপসারণ করে তার জায়গায় ভারতপন্থী এক সাবেক মেহের চাঁদ মহাজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করায় পাকিস্তানের পক্ষে মহারাজার সাথে অর্থবহ সম্পর্ক রাখা দুরূহ হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী মহাজন নিজের বুদ্ধি-এখতিয়ারে ভারতকে প্রয়োজনে সেনা পাঠাতে আগাম অনুরোধ জানান। ভারত মহারাজার সম্মতি আদায় ছাড়াও কাশ্মীরের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহর সমর্থন আদায়ের জোরদার প্রচেষ্টা চালায়। প্রধানমন্ত্রী ও মহারাজার প্রতি ভারতের পরামর্শ ছিল, যে কোন মূল্যে শেখ আবদুল্লাহর সাথে সমঝোতায় উপনীত হতে হবে। সরদার প্যাটেলও এ ব্যাপারে মহাজনকে তাকিদ দিয়ে চিঠি লিখেন। এতে তিনি লিখেন : ‘... It is my sincere and earnest advice to you to make a substantial gesture to win Sheikh Abdullah’s support.’ [প্রাগুক্ত, পৃ-১৩৮]
এরপরই প্রধানমন্ত্রী মহাজন প্যাটেলের কাছে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রী মহাজনের একমাত্র মিশন ছিল কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার কংগ্রেসের মিশন বাস্তবায়ন করা। পাকিস্তান সরকারী ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাশ্মীর দখল করে ভারতের কাশ্মীর দখলের সামরিক অভিযান প্রতিরোধে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। উপজাতীয় মুজাহিদরা নিজেদের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় কাশ্মীরের জনগণের আজাদী পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সশস্ত্রভাবে জড়িয়ে পড়েন।
জনগণের ‘জিহাদ’ অধ্যায়
মহারাজা হরি সিং কার্যতঃ সিদ্ধান্তহীন ও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, কাশ্মীরের বৃহত্তর জনগণের সমর্থন তাঁর সাথে ছিল না। সামরিক শক্তিও তাঁর ব্যাপক ছিল না, যা নিয়ে তিনি ভারত ও উপজাতীয় মুসলিমদের আক্রমণ মুকাবিলা করতে পারেন। এ অবস্থায় তাঁর অসহায়ত্ব ভারতের ওপর তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাঁকে নির্ভরশীল করে তোলে।
মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড ও সীমান্ত মুজাহিদরা ঝিলাম নদী অতিক্রম করে কাশ্মীরে ঢুকে পড়েন। কাশ্মীরের নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষও মুজাহিদদের অভিযানকে সমর্থন জানান এবং তাদের সাথে যোগ দেন। কাশ্মীরের মুসলিম কনফারেন্স নেতারা বন্দী থাকায় এবং পাকিস্তান সরকারীভাবে এ অভিযান সমর্থন করতে না পারায় মুজাহিদ বাহিনী ছিল রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাহীন। প্রফেসর জায়েদী লিখেছেন : মুজাহিদদের এ অভিযানে জিন্নাহ সাহেবের কোন সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং উপজাতীয় ‘‘মুজাহিদরা সরকারী সমর্থন বা অনুমোদনের তোয়াক্কা করেননি। তাদের গতি রুদ্ধ করার সামর্থ্য ও ফলাফল নিরূপণ করাও পাকিস্তান সরকারের জন্য সম্ভব ছিল না। তারপরও এর দায় পাকিস্তানের ওপরই চাপানো হয়েছে।’’ জিন্নাহ সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারী কে.এইচ খুরশীদ লিখেছেন, ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ জিন্নাহ সাহেব কাশ্মীর নিয়ে তার সাথে দু’ঘণ্টার মতো আলোচনা করেন। তিনি কাশ্মীরের মুসলিম নেতাদের কাছে প্রাইভেট সেক্রেটারীর মাধ্যমে যে বার্তা পাঠান তা হচ্ছে : ‘... Please convey to our leaders in kashmir taht I do not want to create any trouble for the Maharaja at the moment. I want them to remain calm and we shall deal with the situation later on as it arises.’ [সূত্র : K.H. Khurshid as qoated Rajindra Sareen, ‘Pakistan : The India Factor’, New Delhi, 1947, P-221]
ভারত সরকার মুজাহিদদের ‘হানাদার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অথচ তারাই শঠতা ও কৌশলে মহারাজার অসহায়ত্বের সুযোগে বিশাল সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। মুজাহিদদের অভিযানের প্রতি কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের স্বত্বঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। মুজাহিদরা কোন রাষ্ট্রশক্তি ছিল না বলে কাশ্মীরের মানুষের আজাদী পুনরুদ্ধার করা ছাড়া তাদের অন্য কোন স্থায়ী রাজনৈতিক-সামরিক লক্ষ্য ছিল না। তারা কাশ্মীরের ভূ-খন্ড দখল করতেও যাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আকবরকে মুজাহিদদের প্রেরণার আইকন হিসেবে বলা হলেও তা পুরোপুরি সত্যি নয়।
শেখ আবদুল্লাহ ও তার ন্যাশনাল কনফারেন্স মুজাহিদদের অভিযান প্রতিরোধে জনগণকে সংগঠিত করেছেন। মহারাজা শিখ ও হিন্দু যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন।
ভারতের নগ্ন সামরিক অভিযান
মহারাজা হরি সিং এক অনিশ্চিত অবস্থায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের চাপে বাধ্য হয়ে ভারতের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠান। যদিও তার এই সিদ্ধান্তের প্রতি উপত্যকার জনগণের কোন সমর্থন ছিল না। উপজাতীয় মুজাহিদদের আক্রমণ মহারাজার ভারতের কাছে সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়তো কাজ করেছে। ভারতের গভর্ণর জেনারেল দিল্লীতে বিদেশী কূটনীতিকের সাথে বৈঠক করা কালে পন্ডিত নেহেরু তাকে কাশ্মীর আক্রমণের খবর দেন। পাঠান উপজাতীয়দের এই অভিযান রুখতে দিল্লীতে মন্ত্রী সভার ডিফেন্স কমিটি বৈঠকে সেনা প্রেরণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে মহারাজার সম্মতি বা আহবানের আগেই দিল্লী সামরিক অভিযান শুরু করে। সুতরাং উপজাতীয় পাঠানরা আক্রমণ না করলেও ভারত অভিযান চালাতো। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের প্রেস সচিব অ্যালান ক্যাম্পবেল লিখেছেনঃ
‘‘Mountbatten contented, however, that it would be the height of folly to send troops in to a neutral state, where we had no right to send them, seince Pakistan could do exactly the same thing, which could only result in a clash of armed forces and in war, “[সূত্রঃ Campbell-jhonson, Mission with Mountbatten, p-224]
কাশ্মীরের মতো একটি নিরপেক্ষ’ রাজ্যের ভূ-খন্ডে ভারতের সেনা অভিযান পাঠানোর কোন অধিকার নেই। এই একই ভূমিকা নিতে পারতো সেখানে পাকিস্তানও। আর সেটা হলে সামরিক সংঘাত, যুদ্ধ অনিবার্য হবে। মাউন্ট ব্যাটেন তখন ভারত সরকারের গভর্ণর জেনারেল হলেও মন্ত্রীসভা বা কংগ্রেস হাইকমান্ডের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার ছিল না। তবে এই সিদ্ধান্তের ঐতিহাসিক দায় বৃটিশের শেষ প্রতিনিধি মাউন্ট ব্যাটেনকেই নিতে হবে। তিনি কাশ্মীরের জনগণের ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য পন্ডিত নেহেরুর চেয়েও বেশী দায়ী। তাঁর এই সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের ব্যাপারে ইতোপূর্বে ঘোষিত মহারাজা ও জনগণের সম্মতির অধিকারের অস্বীকৃতি এবং মাউন্ট ব্যাটেনের আগের সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক। তারপরও মাউন্ট ব্যাটেন এই সিদ্ধান্তকে অস্থায়ী এবং শর্তযুক্ত ব্যবস্থাপত্র হিসেবে অনুমোদন করার কথা বলেছেন। মাউন্ট ব্যাটেনের ভাষায়ঃ
‘a referendum’, plebiscite,election or ever if these methods were impractible, by reprenctative public meetings” [প্রাগুক্ত. p-224]
তবে গণভোট বা নির্বাচন অসম্ভব বা অবাস্তব বিবেচিত হলে জনপ্রতিনিধিদেরকে মতামতের যে কথা মাউন্ট ব্যাটেন বলেছেন, তাতে ভারতের দূরভিসন্ধি বাস্তবায়নের পথ খোলা রাখা হয়েছে। ভারত কাশ্মীরে ‘শান্তি’ ও ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরে না আসার অজুহাতে অবিরাম গণভোট অস্বীকার করে এসেছে। তাছাড়া লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের নীতিকথা নেহেরু বা প্যাটেল ডাস্টবীনে ছুঁড়ে ফেলেছেন। আগাগোড়াই বৃটিশরা হিন্দু-মুসলিম, কংগ্রেস-মুসলিম লীগের জন্য দ্বৈত নীতি অনুসরণ করেছে।
ভারতের সূত্র মতে, মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, ২৪শে অকটোবর, ১৯৪৭। ভারত সরকার ভিপি মেননকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শ্রীনগর পাঠান ২৩ অকটোবর ’৪৭। আর ভারতীয় সেনাবাহিনী শ্রীনগর পৌঁছে ২৭ অকটোবর, ৪৭। শ্রীনগরে গিয়ে ভিপি মেনন কবরের নিস্তব্ধতা দেখতে পান। মহারাজার কোন সেনাকে তিনি দেখতে পাননি। পাঠান মুজাহিদ বাহিনী তখন বারমুল্লা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভিপি-মেনন মহারাজা হরি সিংকে নিশ্চল ও ভাগ্যের হাতে সমর্পিত এক মানুষ হিসেবে দেখতে পেয়েছেন। তবে শ্রীনগরে গিয়ে ভিপি মেনন প্রধানমন্ত্রী মহাজনের সাথে করণীয় নির্ধারণে পরামর্শ করেন। মহারাজা হরি সিং তখন কার্যতঃ ভারতের হাতে জিম্মি। এ সময় ভিপি মেনন ও রাজার প্রধানমন্ত্রী মহাজন রাজা হরি সিংয়ের নিরাপত্তার অজুহাতে সপরিবারে তাদের প্রাসাদের বাইরে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। মহারাজাকে তারা- পাঠানদের আক্রমণ ও তারা তাকে বন্দী করে যে কোন চুক্তি করতে বাধ্য করতে পারে বলে ভয় দেখান। মহারাজার এডিসি ক্যাপ্টেন দেওয়ান সিং একথা জানিয়েছেন। [সূত্রঃ ভিক্টোরিয়া স্কফিল্ড-এর Kashmir in Crossfire, p-145] জনসমর্থন কিংবা সেনা-শক্তি কোনটাই রাজাকে আত্মরক্ষার প্রেরণা দিতে পারেনি এবং তিনি ভারতীয়দের পরামর্শ অনুযায়ী শ্রীনগরের প্রাসাদ ছেড়ে আত্মরক্ষার পলায়ন করেন সপরিবারে। তারা শ্রীনগর ছেড়ে জম্মু এসে আশ্রয় নেন। দীর্ঘ যাত্রাপথে মহারাজা কোন কথা বলেননি। জম্মুতে নিজ ভবনে এসে তিনি বলেনঃ ‘‘We have lost kashmir”; মহারাজার পলায়ন এবং ভারতীয়দের জিম্মায় জম্মুতে এসে আশ্রয় গ্রহণের পর ভিপি মেননকে শ্রীনগরে গেস্ট হাউজে বিশ্রামে থাকা অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরু সেখানে থাকা নিরাপদ নয় বলে টেলিফোনে তাকে জানান। ভিপি মেনন- মহারাজার প্রধানমন্ত্রী মহাজনকে নিয়ে প্রথম ফ্লাইটেই দ্রুত দিল্লী রওয়ানা হন।
শ্রীনগর সহ কাশ্মীর ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিম্মায় চলে আসে। মহারাজার শাসনের কোন অস্তিত্ব রইলো না। ভিপি মেননের শ্রীনগর থেকে দিল্লী ফিরে আসার সময় অপেক্ষারত সর্দার প্যাটেল তাকে বিমান বন্দরে রিসিভ করেন। দিল্লী বিমান বন্দর থেকেই ভিপি মেননকে নিয়ে সর্দার প্যাটেল ডিফেন্স কমিটির চলমান বৈঠকে গিয়ে হাজির হন। কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর ডিফেন্স কমিটি এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, ‘‘it was decided that the accssion that a plebiscite would be held in the state when law and order situation allowed”- [সূত্রঃ Menon Iteigration of the Indian States, p-400] তবে Law and order- পরিস্থিতি ৬০ বছরে কখনও গণভোট অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করেনি।
১৯৪৭-এর ২৭ অকটোবর ভারতীয় শিখ ব্যাটালিয়নের ৩০০ সদস্য বিমানযোগে শ্রীনগরে পৌঁছে। এই বাহিনীর সাথে প্রধানমন্ত্রী মেহের চাঁদ মহাজনও ছিলেন। সাবেক সেনা অফিসার মহাজন নিজেও ছিলেন একজন শিখ। তিনিই প্রতারণা করে Accession দলিলে মহারাজার স্বাক্ষর নিয়েছেন। ভিপি মেনন দিল্লীর ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের সাথে মদ্যপানরত অবস্থায় বলেনঃ “We have the kashmir. The bastered signed the Act of Accession. And now that we have got it. We will never let it go.” [প্রাগুক্ত-পৃ-১৪৯]
পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ভারত একতরফা দাবী করে আসছে যে, ২৬ অকটোবর, ১৯৪৭ থেকে কাশ্মীর ভারতের ভূ-খন্ডের অংশ এবং “Therefore that their action in sending in troops to assist in the defence of the state against the Pathan raiders was legitimate” [প্রাগুক্ত-পৃ-১৫০]
জম্মু-কাশ্মীর স্টেটের প্রতিরক্ষায় সাহায্যকারী বাহিনী হিসেবে ভারত যদি কাশ্মীরে গিয়ে ডাকে, তবে তারপরে তার ভূমিকাতো দখলদারির। ‘পাঠান হানাদারদের’ প্রতিরোধ যদি বৈধ হয়, তাহলে রাজা বা কাশ্মীরের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে কাশ্মীর ফিরিয়ে দিয়ে ভারত সেখান থেকে চলে আসছে না কেন?
উপ-জাতীয় পাঠানদের অভিযান নিয়ে যতো বিতর্কই থাক, তাদের অভিযানের ফলেই-কাশ্মীরের ৩২,০০০ মাইল এলাকা ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পাকিস্তানের-নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এই বিভাজন ও লাইন অব কন্ট্রোল আছে বলেই কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের আজও দরকষাকষির ক্ষমতা রয়েছে। কাশ্মীরি পন্ডিত ও লেখক প্রেমনাথ বাজাজ মুজাহিদদের অভিযানকে ইতিবাচক বলেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
“They wanted to liberate kashmir from the tyranny of the Maharaja and nationalist renecgds, And we should not forget that some members of the Indian army did no less of looting and molesting” [প্রাগুক্ত]
পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বৃটিশ কমান্ডার ইন-চীফ জেনারেল গ্রেসীকে কাশ্মীরে সেনা অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি সরকারের নির্দেশ পালন করেননি। ফিল্ড মার্শাল অচিনলেক কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর অবতরণের পর জেনারেল গ্রেসীকে ট্রুপস নিয়ে মুভ করতে নিষেধ করেন। জিন্নাহ সাহেবও ভারতের সাথে কাশ্মীর নিয়ে মারাত্মক কোন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। যদিও তিনি কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনের ফলে সেখানকার মুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। জর্জ কানিংহাম লিখেছেনঃ
“in his (jinnah) own mind, he had really ruled out the possibility of sending troops in to fight” [সূত্রঃ Cunningham Dairy’, 28 october, 1947 [প্রাগুক্ত-পৃ- ১৫৩]
কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ স্যার ফ্রাংক মেজারডি ইংল্যান্ড থেকে রাওয়ালপিন্ডি আসার আগে দিল্লী যান। সেখানে তিনি লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে কাশ্মীর যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহ নিয়ে অংশ গ্রহণ করতে দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ
“He was surprised to bring Mountbatten directing the military operations in Kashmir’, Writes Cunningam,” [প্রাগুক্ত-পৃ-১৫৩]
১৯৪৭-এর ১লা নভেম্বর মাউন্ট ব্যাটেন লাহোরে জিন্নাহ সাহেবের সাথে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন। ভারতীয় সামরিক অভিযান নিয়ে পাকিস্তানকে যথাসময়ে অবহিত না করার জন্য জিন্নাহ সাহেব ভারতের গভর্ণর জেনারেল হিসেবে মাউন্ট ব্যাটেনকে সরাসরি অভিযুক্ত করেন। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবতরণের পর জিন্নাহ সাহেব বার্তা পেয়েছেন। তখন কিছু করার ছিল না। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান ‘fraud and violence’ এর অভিযোন আনে।
মাউন্ট ব্যাটেন মহারাজার কথিত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারকে কার্যতঃ সমর্থন করেছেন। মহারাজার পূর্বপুরুষের হাতে যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কাশ্মীর উপত্যকাকে অবৈধভাবে তুলে দিয়েছিলেন, তারা মহারাজা হরি সিং-এর Act of Accession-কে সমর্থন না করলে তাদের অতীত ভূমিকার ন্যায্যতা থাকে না। কিন্তু সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ভারতে তো তখন কোন ঔপনিবেশবাদী সরকার ছিল না। তারা কাশ্মীরের অবৈধ দখলদার মহারাজার লিখিত সম্মতিপত্রের ওপর ভিত্তি করে কাশ্মীর দখলকে বৈধতা দিতে চাইছে কীভাবে? দীর্ঘ ৬ দশক ধরে ভারত লাখ লাখ সেনাবাহিনী বহাল রেখেও কাশ্মীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে আলাপকালে জিন্নাহ সাহেব বলেছিলেনঃ “With the troops of the Indian Domination in military occupation of Kashmir and with the National Conferece under Sheikh Abdullah in power, such propaganda and pressure could be brought to bear that the average Muslim would never have the Courage to vote for Pakistan,” [প্রাগুক্ত-পৃ-১৫৩]
জিন্নাহ সাহেবের আশংকার চেয়েও কাশ্মীরের অবস্থা ছিল আরও নাজুক। পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীরীদের গণভোটে অংশ নিয়ে মত প্রকাশ তো দূরের কথা, কাশ্মীরীরা স্বাধীনতার দাবী জানিয়েও ভারতীয় সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি খেয়ে জীবন দিচ্ছে।
মহরাজা হরি সিং-এর সম্মতি আদায়ের পর ভারতের প্রধান লক্ষ্য হয় শেখ আবদুল্লাহকে বশ করা। শেখ আবদুল্লাহর নামে ভারত প্রচার করে দেয় যে, তিনি আফগানদের অভিযান প্রতিরোধে দিল্লীর কাছে অল জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্সের পক্ষে সামরিক সাহায্য চেয়েছেন। মহারাজার বৈধতায় ভারতের প্রশ্ন ছিল বলেই Act of Accession-এ তারা শেখ আবদুল্লাহকে পার্টি করাতে চেয়েছে। এতে দিল্লী আরও প্রমাণ করেছে যে, মহারাজার সম্মতি সত্যি ও পরিপূর্ণ নয়। শেখ আবদুল্লাহ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা সত্ত্বেও তিনি তখনও জনগণের নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধি নন। একজন ক্ষমতাহারা-পলায়নপর শাসকের চুক্তির বৈধতা ও মূল্য কোনটাই আইনের দৃষ্টিতে বৈধ থাকতে পারে না। এতে কাশ্মীরের জনগণও কোন পার্টি নয়। সপরিবারে মহারাজা পালিয়ে যাবার পর কার্যতঃ কাশ্মীরের ওপর তার কোন বৈধ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তবে ডোগ্রা রাজা অর্থের বিনিময়ে কাশ্মীর কিনে নিয়ে যে অপরাধ করেছেন, পন্ডিত নেহেরুর অপরাধ তাতে আরও অমার্জনীয় ও কলংকজনক। যদিও ভারত এই শর্ত মেনে নিয়েছিল যে, মহারাজা হরি সিং-এর সার্বভৌম ক্ষমতা অক্ষত থাকবে এবং কোন অবস্থায়ই তাকে ভারতীয় সংবিধান মেনে নিতে বাধ্য করা করা যাবে না। [সূত্রঃ M.J.Akbar, Behind the vale, p-135]
ভারতের স্বাধীনতা সূর্য- উদয়কালে যখন কাশ্মীরে গণতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাব অনিবার্য, তখন পতনোন্মুখ- ক্ষয়িষ্ণু মহারাজার সাথে ভারতের চুক্তি করাই একটা গণবিরোধী ষড়যন্ত্র। শেখ আবদুল্লাহ এই তথাকথিত Act of Accession-এ কাউন্টার স্বাক্ষর করেননি। রাজ্য হারানোর পরও মহারাজা হরি সিং শেখ আবদুল্লাহর সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাননি। প্রতারণা বুঝতে পেরে এক পর্যায়ে মহারাজা হরি সিং চুক্তি প্রত্যাহারের কথা জানিয়ে সরদার প্যাটেলকে চিঠিও লিখেন। ১৯৪৮-এর ৩১ জানুয়ারীতে লেখা এ চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, চুক্তি অনুযায়ী তার ভূ-খন্ড ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে তিনি কোন অগ্রগতি দেখছেন না। কাশ্মীর ইস্যুটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চলে যাওয়ায় মহারাজার জন্য কাশ্মীর ফিরে পাওয়া আরও দুরূহ হবে। আর কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে তাতে যে মহারাজার কপাল আরও পুড়বে, তা তিনি বুঝতে পারেন। [সূত্রঃ প্রাগুক্ত-পৃ-১৬৭]
দৃশ্যতঃ শেখ আবদুল্লাহর গুরুত্ব বাড়াতে কংগ্রেসের চাপ ও পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী মহাজনও ’৪৮-এর মার্চে পদত্যাগ করেন। কাশ্মীরের ক্ষমতার গগনে উদীয়মান সূর্যের পাশে মহারাজা ক্রমশঃ ম্লান ও অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকেন। নেহেরুর আনুকূল্যে শেখ আবদুল্লাহ অর্ন্তবর্তী সরকারের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ পদটি দখল করতে চাইলেন। কিন্তু মহারাজা আগের মতোই সেনাবাহিনীর ‘গান-স্যালুট’ নিতে চাইলেন। ১৯৪৯ সালে ভারত সরকার মহারাজা হরি সিং ও রাণীকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানেই মহারাজাকে কিছুদিনের জন্য সপরিবারে বাইরে যাবার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রস্তাবটি দেন প্যাটেল। নম্রভাবে বললেও তা ছিল নির্দেশসুলভ। ঐ আলোচনায় উপস্থিত মহারাজার পুত্র করন সিং পরে লিখেছেনঃ “My father was stunned. Although rurmours to the effect that he might be pushed out of the state had ben in the air for some time, he never belived that even the Sardar would advise him to adopt this course. He emerged from the meetting ashen-faced .....my mother went to her room Where she feeling herself onto her bed and burst into teers,” [সূত্র : Hari Singh to Patel, 9 September, 1948, প্রাগুক্ত-পৃ-১৬৮]
এরপর মহারাজা হরি সিং আর কখনও জম্মু-কাশ্মীরে ফিরে যেতে পারেননি। মহারাজা হরি সিং ভারতের বোম্বেতে [মুম্বাই] মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে করন সিং প্রথমে রাজ প্রতিনিধি এবং পরে সদর-ই-রিয়াসাত-হিসেবে নামমাত্র পদমর্যাদায় বহাল ছিলেন। কিন্তু এরপর ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত গভর্ণর হয়েছেন রাজ্য-প্রধান বা রাজ্যপাল। প্রধানমন্ত্রীর পদটি কিছুদিন বহাল থাকলেও পরে তা মুখ্যমন্ত্রী বা চীফ মিনিস্টারের পদাবনতিতে এসে দাঁড়ায়।
তবে ভারত যেখানে কাশ্মীরকে পরিপূর্ণভাবে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বানাতে চেয়েছে, তাতে ‘কাশ্মীরিয়াত’-এর স্বাতন্ত্র ও জাতিগত সার্বভৌমত্ব নিয়ে টিকে থাকার প্রশ্নে ক্রমশঃ অনড় অবস্থান নেওয়া শেখ আবদুল্লাহর সাথে পন্ডিত নেহেরুর সম্পর্কে চিড় ধরতে দেরী হয়নি। যদিও ১৯৪৮-এর জানুয়ারীতে শেখ আবদুল্লাহ জাতিসংঘে কাশ্মীরের ভারত চুক্তিকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে ভারত বুঝতে পারে যে, শেখ আবদুল্লাহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য অন্তর্জাতিক শক্তির সাথে কাশ্মীরের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করছেন। নিউইয়র্কে শেখ আবদুল্লাহ আজাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট সরদার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানের এ্যাডভাইজার ড. তাসেরকে বলেছেনঃ “ only this, Kashmir should be on independent State, free from both India and Pakistan, “[প্রাগুক্ত-পৃ-১৭০]
পাকিস্তানের তদানীন্তন চীফ সেক্রেটারী চৌধুরী মেহোম্মদ আলীকেও শেখ আবদুল্লাহ বলেছেনঃ Put some trust in Kashmiris, they will not join in conspiracies against Pakistan and be bought over, “ [প্রাগুক্ত-পৃ-১৭০] ১৯৫৩ সাল থেকেই নেহেরু আবদুল্লাহর বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা
১৯৪৭-এ লাহোরে যখন মাউন্ট ব্যাটেন আলোচনায় বসেন, তখনই তিনি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের মধ্যস্ততার প্রস্তাব করেন। এতে ভারতেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল। যুদ্ধ ও শক্তি প্রয়োগ এড়াতে- ভারতই মূলতঃ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ও গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয়। প্রথমতঃ ভারতের সামরিক শক্তি সঞ্চয় ও কাশ্মীরে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তাব বৃদ্ধির জন্য তার সময়ের প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়তঃ ধোঁকা দেওয়ার জন্য তার একটি বাহানা ও মাধ্যমের প্রয়োজন ছিল। গণভোট অনুষ্ঠানকে তারা শুরুতেই শর্তযুক্ত করে ‘আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে’ বলে অভিহিত করেছে। ‘ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০-অনুচ্ছেদে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা স্বীকার করার পরও একই প্রস্তাবে তারা সময়ের বিবর্তনে কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ বলে উল্লেখ করেছে।
ভারত প্রথম দিকে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের সাথে ইক্যুয়াল স্টেটাস মেনে নিয়ে আলোচনায় রাজী ছিল না। তাদের মতে, কাশ্মীরের ওপর ভারতের দাবীর মতো পাকিস্তানের দাবী সমান্তরাল হতে পরে না। তবে শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে পন্ডিত নেহেরু পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সাথে জাতিসংঘ চার্টারের ৩৫ ধারা অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তিতে সম্মতির কথা জানান। ১৯৪৭ এর ৩১ ডিসেম্বর পন্ডিত নেহেরু জাতিসংঘ মহাসচিবকে যে পত্র দেন তাতে উল্লেখ করেনঃ “To remove the misconception that the Indiam Goverrment is using the prevailing situation in jammu and kishmir to reap political profits, the Goverment of India wants to make it very clear that as soon as the raiders are driven out and normalcy is restored, the people of the State will freely decide their fate and that descission will be taken according to the universslly accepted democratic means of plebescite or referendum,” [সূত্র : jawaharlal Neheru, as quoted in korbel, Danger in Kasmiri, 48,p-161]
পন্ডিত নেহেরু জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব সম্প্রদায়, কাশ্মীরের জনগণ ও অপরপক্ষ পাকিস্তানের প্রতি যে অংগীকার করেছেন, তা অন্য কোন ঘটনা বা পরিস্থিতিতে পরিবর্তনযোগ্য নয়। ১৯৪৮ এর জানুয়ারীতে জাতিসংঘে কাশ্মীর নিয়ে যাকে- ভারত প্রথম বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। চৌধুরী জাফরুল্লাহ খান পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। এ সময় জাতিসংঘে পাকিস্তানের নৈতিক অবস্থান শক্তিশালী ছিল। বৃটিশ- আমেরিকার সদস্যদের সমর্থনে জাফরুল্লাহ খানের সফল কূটনৈতিক তৎপরতা এবং তাঁর ক্ষুরধার বক্তব্য ভারতের অবস্থান দুর্বল করে দেয়। এ অবস্থায় সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল কাশ্মীর ইস্যু জাতিসংঘে উত্থাপনকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। এটাকে তিনি ভারতের দাবীর নৈতিক দুর্বলতার স্বীকৃতি হিসেবে দেখেছেন। ১৯৪৮-এ কাশ্মীরকে অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে চি‎‎হ্নত করে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এতে কাশ্মীর সমস্যা সরেজমিনে তদন্তে, United Nations Commission For India and Pakistan [UNCIP] গঠন করা হয়। দ্বিতীয়বার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আর একটি প্রস্তাব পাস করে ১৯৪৮, এর ২১ এপ্রিল। ১৯৪৮-এর ১৩ অগাস্ট জাতিসংঘ একই বিষয়ে আর একটি প্রস্তাব পাস করে। জোসেফ করবেটের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এ রিপোর্টে বলা হয়ঃ “Shall be determined in accordance with the will of the people” [প্রাগুক্ত-পৃ-১৬১]
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয় ১৯৪৯ সালের ১লা জানুয়ারী। যুদ্ধ- বিরতির প্রস্তাব আর দ্বি-পাক্ষিক স্বাক্ষরিত বিষয়ই রইলো না। এখানে মধ্যস্থতাকারী সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের ভূমিকা যুক্ত হওয়ার কাশ্মীর ইস্যুটি একটি আন্তজার্তিক বিরোধপূর্ণ ইস্যু হিসেবে স্বীকৃত হয়। যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে উভয় দেশ স্বাক্ষর করার ফলে এটা স্বীকৃত হয় যে, কাশ্মীর ইস্যুর নিষ্পত্তিতে ভারত যে সামরিক আগ্রাসন ও ছলনাপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে কাশ্মীর দখলের একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বৈধ ও চূড়ান্ত নয়। প্রথমতঃ কাশ্মীর সার্বিক বিচারেই একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র এবং কাশ্মীরের জনগণের গণতান্ত্রিক মতামতই হচ্ছে তার রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের চূড়ান্ত মানদন্ড। যুদ্ধবিরতি চুক্তির দোহাই দিয়ে ভারত যে সামরিক দখলদারিত্ব চালিয়েছে, তা অকার্যকর হয়ে গেছে এবং কাশ্মীর উপত্যকা মহারাজার সাথে কথিত চzুক্ত বা ভারতের সামরিক অভিযান- পূর্বাবস্থায় ফিরে গেছে। উপজাতীয় মুজাহিদদের অভিযান বা পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে ভারত যাই কিছুই বলুক না কেন, তার কোন ভিত্তি নেই। সর্ববিচারেই ভারত-কাশ্মীরে অবৈধ হানাদার। জাতিসংঘও উপরিউক্ত মতের সমর্থন জানায়। ডিক্টোরিয়া স্কফিল্ড নিখেছেনঃ “On 5 january, 1949, UNCIP once more affirmed that When the truce agreement had been signed, the question of the Accession of State of jammu and kahmir to India or Pakistan would be decided through `the democratic method of free and impartial plebiscite.’ [Resolution, 5 January 1949, Doc. No S/1196, dated 10 january, 1949, as quoted in Kashmir in the Security Council, p-16 [প্রাগুক্ত-১৬১]
১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট, পাকিস্তানের সাথে ভারত “Stand stik Agreement” সম্পাদন করার পর জম্মু-কাশ্মীরে ভারত কোন সামরিক অভিযান চালাতে পারে না। মহারাজাও পাকিস্তানের সাথে একটি ‘Stand still’ চুক্তি করার পর তৃতীয় পক্ষের কাছে সামরিক সহায়তা চাইতে বা Act of accession চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন না। ভারত নিজেও এই চুক্তি এবং কাশ্মীরে তার সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি সংহত করতে শেখ আবদুল্লাহর সমর্থন অনিবার্য বলে মনে করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, মহারাজা একাই কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভবিষৎ নির্ধারণের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নন। তবে শেখ আবদুল্লাহর ভূমিকা প্রথম দিকে যাই থাক, তাতে জনগণের কোন ম্যান্ডেট ছিলনা। উপরন্ত, মহারাজা Act of Accession Agreement বাতিলের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত দাবী জানিয়েছেন। একইভাবে শেখ আবদুল্লাহ ভারতের অবৈধ দখলমুক্ত করে কাশ্মীরের- পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করায় ভারত সরকার অবৈধভাবে কাশ্মীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাকে দীর্ঘকাল কারা অন্ধকারে রেখে তার সামরিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। কাশ্মীরের কিছু বিশ্বাসঘাতক ভারতের কলাবরেটর হিসেবে কাজ করলেও জনগণ তাদের ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। কাশ্মীরে ভারতের কোন বৈধ সাংবিধানিক ও আইনগত কর্তৃত্ব না থাকায় শেখ আবদুল্লাহসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী নেতাদের আটক করারও কোন বৈধ কর্তৃত্ব তাই ভারতের থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়তঃ ১৯৪৭-এর ২৬ অকটোবর মহারাজা হরি সিংয়ের সাথে সম্পাদিত ভারতের চুক্তিটি আগ্রাসী শক্তির ছলনা ও প্রতারণার একটি দলিল। মহারাজা কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তখন ক্ষমতা হারানোর অপেক্ষায় ছিলেন। ভারত তখন ত্রাতার ভূমিকায় এসে কাশ্মীরের জনগণকে নতুন করে শৃংখলিত করেছে। মহারাজা হরি সিং ও তার পূর্বসূরীরা কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের ওপর যে মধ্য যুগীয় নিপীড়ন ও শোষণ-লুণ্ঠন চালিয়েছেন, ভারতের সামরিকতন্ত্র কাশ্মীরীদের ওপর তার চেয়েও ভয়ংকর নিপীড়ন ও পরাধীনতার শৃংখল চাপিয়েছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিদায়কালে এ উপমহাদেশ সহ হিমালায়ান উপত্যকার মানুষের মাঝে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের যে স্বপ্ন মুকুরিত হয়ে উঠেছিল, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের যে প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছিল, কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতের সামরিক আগ্রাসনের ফলে তা আবারও কয়েক দশকের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
তৃতীয়তঃ মহারাজার শাসন কর্তৃত্ব বিকল হয়ে যাবার ফলে তিনি যখন সপরিবারে শ্রীনগর থেকে নিরাপত্তার জন্য জম্মু পালিয়ে যান, সে অবস্থায় অপর কোন আগ্রাসী শক্তির সাথে তার কোন চুক্তির কার্যকারিতা ও বৈধতা থাকতে পারে না। এ সময় ভারতের চক্রান্তে মহারাজা হরি সিং পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাহীন ও আশ্রয়চ্যুত নিঃসঙ্গ এক জন-নিপীড়ক-মধ্যযুগীয় রাজার সাথে সন্ধি করে ভারত তার সকল অপকর্ম ও নিপীড়নের দায় ঘাড়ে তুলে নিয়েছে এবং এ কারণে রাজার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের ক্ষোভ-আক্রোশের দায় ভারতকেই বহন করতে হবে।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ উপলব্ধির পর শেখ আবদুল্লাহ তাঁর অবস্থান বদল করে বলেনঃ “No one can deny that the communal sprit still cxists in India...if there is a rsurgence of commualism in India, how are we to convince the Muslims of kashmir that India does not intend to swallow up Kashmiris?” [সূত্রঃ Sheikh Abdullah, 10 April, 1952 as quoted in Balarajpuri, Triumph and Tragedy, New Delhi, 1981, p-99 [প্রাগুক্ত-১৭২]
১৯৫২-এর জুলাইয়ে শেখ আবদুল্লাহ ভারত সরকারের সাথে ‘দিল্লী এগ্রিমেন্টে’ সম্মত হন। এই চুক্তিমূলেই ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে। কিন্তু ভারত নিজেই তার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থেকে সরে আসে এবং ক্রমশঃ কাশ্মীরকে তার একটি অঙ্গ রাজ্যের অবস্থানে নামিয়ে আনে।
ভারতের বর্তমান অবস্থান হচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীর তার ভূ-খন্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান বা আন্তজার্তিক সম্প্রদায়ের নাক গলানোর কোন অধিকার নেই বলে ভারত বলে বেড়াচ্ছে। তবে ১৯৭১-এর যুদ্ধ-পরবর্তী ‘সিমলা চুক্তিতেও’ কাশ্মীরকে ভারত অমীমাংসিত ইস্যু বলে স্বীকার করে নিয়ে শক্তি প্রয়োগ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই দু‘দেশের মধ্যকার বিরোধগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে।
কাশ্মীরের অশিতিপর বয়সের স্বাধীনতাকামী ইউসুফ বুচ সম্প্রতি ওয়াশিংটনে কাশ্মীরী-আমেরিকান কাউন্সিল ও অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যানিটারিয়ান লয়ার্সের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনে বলেছেনঃ ‘ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ১৯৫২ সালের ২৬ জুন বলেছিলেন যে, ‘‘কাশ্মীরের সম্ভাব্য গণভোটে যদি কাশ্মীরীরা ভারতের সাথে না থাকার রায় দেয়, আমরা অবশ্যই তা মেনে নেবো। আমরা তাদের অবদমনে কোনো সেনাবাহিনী পাঠাব না। প্রয়োজনে উদ্ভূত বাস্তবতার নিরিখে আমরা সংবিধান সংশোধন করতেও প্রস্ত্তত।’’ [সূত্রঃ কাশ্মীরকে নিয়ে কেন এত নিষ্ক্রিয়তা? এম. আবদুল হাফিজ, নয়া দিগন্ত, ১৭ অকটোবর, ২০১০]
গণভোট প্রসঙ্গ
জাতিসংঘ মিশনের মূল দায়িত্ব ছিল জম্মু-কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের সম্ভাব্যতা যাচাই করে গণভোট অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, ঐ অঞ্চলের অসামরিকীকরণ করে উত্তেজনা- সংঘাতের প্রশমন করা। ১৯৫০-এর ২৭ মে অস্ট্রোলিয়ান জুরিস্ট Sir Own Dixon- ‘গণভোট ও অসামরিকীকরণ’ সম্পর্কে বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করেন। পন্ডিত নেহেরু এর তীব্র বিরোধিতা করে তা নাকচ করে দেন। ১৯৫১-এর জানুয়ারীতে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টারস সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ান প্রাইম মিনিস্টার রবার্ট মেঞ্জিস কাশ্মীরে কমনওয়েলথ সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ও তদারকীতে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানে সেনাবাহিনীকে সহযোগী হিসেবে থাকবে বলে সুপারিশও রাখা হয়। পাকিস্তান এ প্রস্তাব মেনে নিলেও ভারত আবারও তা নাকচ করে।
১৯৪৮-এর ১৩ অগাস্ট ও ৪৯-এর ৫ জানুয়ারী যুগপৎভাবে জাতিসংঘে গৃহীত প্রস্তাব ভারত ও পাকিস্তান মেনে নেয়। বৃটেন ও আমেরিকা মিলে এ প্রস্তাব তৈরি করে। এতে আরও বলা হয় যে, গণভোট অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া সফল না হলে, পক্ষগুলো সালিশ বৈঠকে বসে সমস্যার নিষ্পত্তি করবে। এবারও পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু ভারত নাকচ করে দেয়।
১৯৫২ সালের নববর্ষে পন্ডিত নেহেরু পাকিস্তানকে যুদ্ধের হুমকি দেন। বলেন : “...Warned of fullscale war if Pakistan accidenatally invaded kashmir”[ প্রাগুক্ত]
১৯৫২-র ২৪ অকটোবর কাশ্মীর ও পাকিস্তান জুড়ে ‘কাশ্মীর দিবস’ পালন করা হয়। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের ব্যর্থতা ও ভারতের সামরিক দখলদারিত্বের প্রতিবাদে এটা ছিল প্রথম সংঘবদ্ধ আনুষ্ঠানিক গণবিক্ষোভ।
পরাশক্তির ভূমিকা
জাতিসংঘ প্রস্তাব তথা ‘গণভোট’ বাস্তাবায়ন প্রক্রিয়ায় প্রধানতঃ পশ্চিমা শক্তিগুলোর সক্রিয় ও ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যুতে পরাশক্তিগুলোর ভূমিকায় প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করে। প্রথমতঃ পন্ডিত নেহেরুর আধাসমাজতান্ত্রিক-নন-এলাইন ধাঁচের পররাষ্ট্র নীতি, দ্বিতীয়তঃ ভারতের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের লবী এবং তৃতীয়তঃ পাকিস্তানের সাথে মার্কিন সামরিক গাঁটছড়ার কারণে মস্কো ভারতের পক্ষে ছিল। গণচীন সরাসরি কোন পক্ষ না নিলেও পরিস্থিতির ওপর তার তীক্ষ্ণ নজরদারি অব্যাহত রাখে। লাদাখ ও আকসাই চীন কাশ্মীরেরই বিতর্কিত অংশ। সামরিক কারণেই চীন এ অঞ্চলের গতি-প্রকৃতিকে উপেক্ষা করতে পারে না।
১৯৫৭ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সুইডিশ প্রেসিডেন্ট ড. গুনার জেরিং উপমহাদেশ সফর করেন। তিনি কাশ্মীর সরেজমিনে সফর করে উভয়পক্ষকে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ মেনে চলতে এবং শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা মেনে চলার আহবান জানান। ১৯৬২ সালে ড. গ্রাহাম দ্বিতীয়বারের জন্য উপমহাদেশ সফরে আসেন। তিনি জাতিসংঘের পূর্ব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার তাকিদ দিয়ে ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানে উদ্যোগী হবার তাকিদ দেন। এবারই প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাক-মার্কিন সামরিক মেরুকরণের সাথে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ইস্যুটি একাকার করে কাশ্মীরের জনগণের ভাগ্য বিপর্যয়ে নারীদের ভূমিকা পালন করেছে। এ সময় জাতিসংঘে সোভিয়েত প্রতিনিধি বলেন : ‘It is now quite unrealistic demand a plebiscite.’ [প্রাগুক্ত-১৭৯]
এমনকি, সোভিয়েত প্রতিনিধি কাশ্মীরে ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগকে আক্রমণ করে একথাও বলেন যে, টেকসাস, ওহিও-রাজ্যেও তারা এ রকম গণভোট অনুষ্ঠান করতে প্রস্ত্তত কিনা?
১৯৬০ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি জীবন্ত সমস্যা হিসেবে আলোচিত ছিল। ১৯৬২-তে উত্তর-পূর্ব ফ্রান্টিয়ার ও লাদাখ অঞ্চলে চীন-ভারত সৈন্য সমাবেশ যে আঞ্চলিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তেমনি কাশ্মীরের সামরিক ও কৌশলগত গুরুত্ব ভারতের কাছে আরও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। চীনের সাথে ভারতের সদ্ভাব্য সামরিক সংঘাতের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ব্যাপকভাবে সামরিক অস্ত্র-সরঞ্জাম দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সামরিক প্যাক্ট থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে না জানিয়েই তারা ভারতের সাথে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এতে ভারত আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং জাতিসংঘ সহ যে কোন আন্তর্জাতিক মহলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ভারতকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন হয় এবং এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট আইউবের সাথে মার্কিনীদের সম্পর্কে চিড় ধরে। এসব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট আইউব তাঁর লেখা ‘Freinds Not Masters’-বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এমনকি আইউব মন্ত্রীসভার এককালীন চৌকস সদস্য এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও তাঁর লেখা বই ‘The Myth of Independence’-এ মার্কিন বন্ধুত্ব নিয়ে প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন।
তবে বৃটিশ ও মার্কিন কূটনৈতিক প্রতিনিধি ডানকান সিডনি ও আরভেল হ্যারিম্যান-আইউব-নেহেরুর মধ্যে একটি আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনও তখন ঐ দুই পশ্চিমা কূটনীতিকের সাথে দিল্লী আসেন। ১৯৬২ সালের ২৯ নভেম্বর আইউব-নেহেরু যুক্ত বিবৃতিতে কাশ্মীরসহ অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয় উভয় দেশের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়।
১৯৭১-এ যুদ্ধের পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত ‘সিমলা চুক্তিতে’ কাশ্মীর ইস্যু সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য অনুচ্ছেদ : ‘In Jammu and Kashmir, the line of Control resulting from cease-fire of December 17, 1971 shall be respected by both sides without prejudice to the recognised position of either side. Neither side shall seek to alter in unilaterally, irrespective of mutual differences and legal interpretation. Both sides further undertake to refrain from threat or of the use of force in vciolation of the line.’ [প্রাগুক্ত, পৃ-২১১]
সাম্প্রতিক ভারতীয় উদ্যোগ
ভারতের সর্বদলীয় সংসদীয় দলের অন্যতম সদস্য সিপিআই (এম) শীর্ষ নেতা প্রকাশ কারাত কাশ্মীর উপত্যকা সফর করে লিখেছেন : ‘‘কাশ্মীরে দমন-পীড়ন বন্ধ হোক, শুরু হোক আলোচনা’’। সম্প্রতি তাঁর লেখায় তিনি ৭ দফা সুপারিশ করেছেন। প্রকাশ কারাত-এর এই প্রস্তাবনাটি ৩০ অগাস্ট, ২০১০-এ কলকাতার ‘দৈনিক গণশক্তি’ প্রকাশ করেছে। ভারতের একজন বামপন্থী রাজনীতিকের দৃষ্টিতে কাশ্মীর পরিস্থিতির একটা অনুপুঙ্খ বর্ণনার স্বাদ পাঠককে দিতে চাই বলে লেখাটি হুবহু উদ্ধৃত করছিঃ
‘‘গত আড়াই মাস ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় অস্থিরতা ও গন্ডগোল চলছে। একদিকে ধারাবাহিকভাবে মানুষের বিক্ষোভ ও হরতাল এবং অপরদিকে জারি সরকারী কারফিউ। দোকান, বাজার-হাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ, ফলে জীবন যাত্রা স্তব্ধ।
১১ই জুন থেকে ২২শে অগাস্ট পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে সেখানে প্রাণ হারাতে হয়েছে ৬২ জন তরুণকে (এই সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ১১১-তে এসেছে)। যাদের বয়স ৮ থেকে ২৫ বরছ। সি আর সি এফ পিকেটের বিরুদ্ধে তরুণরা পাথর ছুঁড়েছে এবং অনিবার্যভাবে তার পরিণতিতে গুলি বর্ষণ, যাতে ঘটেছে মৃত্যু ও গুরুতর আঘাত। এই ধরনের একটি মৃত্যুর ফলে বিক্ষোভ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে, লক্ষ্য করা গেছে ভারতীয় রাষ্ট্র সম্পর্কে পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার মনোভাব ও প্রচন্ড রাগ।
গত ২২শে ও ২৩শে অগাস্ট আমি এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম শ্রীনগর পরিদর্শন করেছি। আমাদের সফরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল, যেসব পরিবার তরুণ সদস্যদের হারিয়েছে তাদের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন এবং সেখানকার মানুষ যে কষ্ট ভোগ করছেন, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা। আমরা সেখানে বিভিন্ন অংশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি জানার চেষ্টা করেছি। আমরা সেখানে অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা পার্টি সদস্য এবং সি পি আই (এম)-র রাজ্য কমিটির সদস্যদের এবং সি পি আই প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।’’
বর্বরোচিত পুলিশী ব্যবস্থা
কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার যেভাবে পরিস্থিতির মুকাবিলা করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে শোচনীয় ধরনের। প্রথমতঃ যুবকদের (যাঁদের বেশির ভাগই তরুণ) গণ-বিক্ষোভ এবং জঙ্গী ও সন্ত্রাসীবাদীদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের মুকাবিলার মধ্যে কোনোরকম পার্থক্য করা হয়নি। একের পর এক ঘটনায় কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনী প্রস্তর নিক্ষেপকারী জনতার উপরে গুলিবর্ষণ করেছে। শুধু যে যুবকদের মৃত্যু ঘটেছে তাই নয়, শ’য়ে শ’য়ে মানুষ বুলেটের আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই ধরনের বর্বরোচিত পদ্ধতি যদি ভারতের অন্য কোনো জায়গায় চালানো হতো, তাহলে সেখানে প্রচন্ড বিক্ষোভ ও গন্ডগোল তৈরি হতো। কাশ্মীরী জনগণ যে বর্বরতার শিকার হচ্ছেন, সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্পৃহতার দরুন তাঁরা মনে করছেন ভারত সরকার কাশ্মীরকে দেশের বাকি অংশের চাইতে
আলাদাভাবে দেখে।
যে পদ্ধতিতে পুলিস প্রস্তর নিক্ষেপকারী জনতার বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করে থাকে, তার পিছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই। তা ছাড়া যেভাবে কিশোরদের জেলে পোরা হচ্ছে, সেটাও বরদাস্ত করা যায় না। ‘জন নিরাপত্তা’ আইনে গ্রেপ্তার হওয়া যুবকদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে জম্মু ও উধমপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সরকার পুরোপুরি অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণের মধ্যে তারা অপদস্থ হয়েছে। জনগণের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। সরকার বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে আইন-শৃৃঙ্খলার ইস্যু হিসাবে দেখায় এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় মানুষের আন্দোলন ও বিক্ষোভের উপরে কট্টরপন্থী ও মৌলবাদীদের প্রভাব ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে যারা মধ্যপন্থী, তারা কোনোরকম নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পেল না।
এরই মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্রচন্ড বিক্ষোভের মধ্যেও কিন্তু সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ‘অমরনাথ যাত্রা’ শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। যাতে যোগ দিয়েছিলেন ৪.৫ লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে দিয়ে ‘কাশ্মীরিয়াৎ’-এর অন্তর্নিহিত সহিষ্ণুতা ও শুভেচ্ছার পরিচয় পাওয়া গেলো। কাশ্মীরী সমাজের বৈশিষ্ট্য হলো ‘কাশ্মীরিয়াৎ’।
কাশ্মীর উপত্যকায় মানুষের এই বিক্ষোভকে লস্কর-ই- তৈয়বা বা অন্যান্য উগ্রপন্থী সংগঠনগুলির কাজ বলে ছাপ মারা অনুচিত। যেভাবে ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবং প্রতিবাদের যে তীব্রতা তাতে বোঝা যায় এসবের পিছনে স্ব-চালিত গতি আছে। এই দিনটি যদি আমরা ভুলে যাই এবংএই আন্দোলনকে প্ররেচিত আন্দোলন বলে ধরে নিই, তাহলে আমরা পরিস্থিতির মুকাবিলায় আরো ভুল করবো।’’
আশু ব্যবস্থাসমূহ
স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনা ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কাজকর্ম যাতে দ্রুত শুরু হতে পারে সেই লক্ষ্যে কিছু আশু ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী। যেমন :
১. বিক্ষোভ প্রশমিত করতে পুলিশের গুলিচালনা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য করার অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। কারফিউ জারি থাকার সময় নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজন যেন বাড়িতে প্রবেশ না করে এবং বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মহিলাদের অপদস্ত করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
২. যাঁরা মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন তাঁরা অনেকেই শ্রমিকশ্রেণীর হতদরিদ্র অংশ। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আহত ব্যক্তিদের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া জরুরী। এমন অনেক আহত ব্যক্তি আছেন, যাঁরা আগামী দিনে বরাবরের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়বেন। তাঁদের পুনর্বাসন ও তাঁদের পরিবারগুলি, জীবন-জীবিকা ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করার জন্য একটি কর্মসূচী হাতে নিতে হবে।
৩. কারাগারে বন্দী কিশোরদের অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে থাকা ছোটখাটো মামলা খারিজ করা দরকার।
৪. আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট (এ এফ এস পি এ) অনুযায়ী যে দানবীয় ক্ষমতা আছে তা খর্ব করা উচিত। সি পি আই (এম) ঐ আইনে থাকা দানবীয় ক্ষমতাগুলো খারিজ করার জন্য দাবী জানিয়ে আসছে। শ্রীনগর এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলে যে ‘উপদ্রুত এলাকা আইন’ চালু আছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে এ এফ এস পি এ স্বাভাবিকভাবেই অকেজো হয়ে পড়বে।
৫. দীর্ঘকালের অর্থনৈতিক অচলাবস্থার ফলে বহু দোকান মালিক ও ক্ষুদ্রশিল্প মালিক অর্থনৈতিক দিক থেকে শেষ হয়ে গেছেন। তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবনের জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাঁদের অর্থনৈতিক সহায়তাও দেওয়া দরকার।
৬. শুধু যে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ধরনের বেকারী আছে তা নয়, গত তিন মাসে দিনমজুরেরা রোজগার করতে পারেননি। সরকারের উচিত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং অবিলম্বে যাঁরা তাঁদের জীবিকা খুইয়েছেন তাঁদের জন্য ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করা।
৭. পুলিশের বাড়াবাড়ির যে সব অভিযোগ আছে সেগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। দ্রুত এই ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
সাধারণ মানুষের কাছে অন্যতম তিক্ত বিষয় হলো বাড়াবাড়ি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যারা দোষী বলে চিহ্নিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। এর আগে পাথরিবাল ঘটনায় কয়েকজন সেনা অফিসার জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাঁদের বিচারের জন্য সরকার অনুমতি দেয়নি। সাম্প্রতিক মাচিল সংঘর্ষে সীমান্ত পেরিয়ে আসা জিহাদী আখ্যা দিয়ে তিনজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় বর্তমানের এই অস্থিরতা ও গন্ডগোল। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা বরদাস্ত করা হবে না। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত। ভুয়া সংঘর্ষের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস
কাশ্মীরের ইতিহাস হলো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস। ৩৭০ ধারার মাধ্যমে ভরতীয় সংবিধানে জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তা বছরের পর বছর ধরে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। কেন্দ্রে একের পর এক কংগ্রেস সরকার এসেছে। কিন্তু তারা কাশ্মীরী জনগণের সত্তা ও বিশেষ মর্যাদা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও সর্বাধিক স্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রে ‘আকাশ হলো ঊর্ধ্বসীমানা’। বি জে পি- নেতৃত্বাধীন সরকার জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় গৃহীত প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি হয়নি। ঐ প্রস্তাবে স্ব-শাসনের ক্ষেত্রে ১৯৫৩ সালের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানানো হয়েছিল। বাস্তবতা হলো, কংগ্রেস এবং বি জে পি উভয়েই ঐ রাজ্যের জন্য আরো স্ব-শাসনের বিরেধী।
আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্যেগ নেওয়ার বিষয়ে ইউ পি এ সরকারের রেকর্ড খুব খারাপ। আলোচনার ক্ষেত্রে রাজ্যের সব অংশকে যুক্ত করা প্রয়োজন। সরকারের প্রথম মেয়াদে দিল্লি ও শ্রীনগরে রাউন্ড টেবল বৈঠক হয়েছে। তাছাড়া গঠিত হয় ৪টি সাব কমিটি। বিচারপতি সাগির আহমদের নেতৃত্বে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে যে ওয়াকিং গ্রুপ তৈরি হয়েছিল তার রির্পোট ভীষণভাবে নৈরাশ্যজনক।’’
নিঃশর্ত আলোচনা
সি পি আই (এম) জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য সর্বাধিক স্ব-শাসনের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে দাবী জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি তারা ঐ রাজ্যে তিনটি অঞ্চলের জন্য স্ব-শাসনের পক্ষেও সওয়াল করছে। এই তিনটি অঞ্চল হলো- জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ। কথা হয়েছে, রাজনৈতিক মীমাংসা যেন অবশ্যই প্রতিফলিত হয় সাংবিধানিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে, যা এই ধরনের স্ব-শাসন সুনিশ্চিত করবে। বর্তমান সন্ধিক্ষণে, যা জরুরী তা হলো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কাজকর্মের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। এই বিষয়টি সুনিশ্চিত করার পর ইউ পি এ সরকারের উচিত আর কালক্ষেপ না করে সব অংশকে যুক্ত করে রাজনৈতিক আলোচনার একটি
কাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) ঘোষণা করা। সেটা সম্ভব হবে যদি এ আলোচনার ব্যাপারে কোনো পক্ষ প্রাক-শর্ত পেশ না করে।
এখন যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে এই আস্থার সঞ্চার করা যে, কাশ্মীর সংক্রান্ত সমস্ত ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য আন্তরিক প্রয়াস রয়েছে এবং সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। সি পি আই (এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটির আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে এবং আমাদের পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি আরো বিশদভাবে ঘোষণা করা হবে। কাশ্মীর ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সি পি আই (এম) গোটা দেশে প্রচার অভিযান চালাবে।’’
ভারতের রক্ষণশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মুখপত্র ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা গোষ্ঠীর সাময়িকী বিখ্যাত ‘দেশ’ গত ২ অকটোবর/২০১০ তাদের ‘চিঠিপত্র’ কলামে কলকাতার জনৈক রুদ্র সেন- লিখিত একটি তথ্যসমৃদ্ধ বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ‘স্বায়ত্তশাসন নয়, আজাদীই চাইছেন কাশ্মীরের মানুষ’, শীর্ষক লেখাটি প্রাসঙ্গিক বলে তা উদ্ধৃত করছিঃ ‘দেশ এ (১৭ জুলাই ও ২ সেপ্টেম্বর ২০১০ সংখ্যায়) প্রকাশিত নিবন্ধ ও সেই সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চিঠি ও পাল্টা চিঠি পড়ে বর্তমান পত্র লেখকের মনে হয়েছে, নিবন্ধ ও পত্রাবলিতে কাশ্মীর উপত্যকার ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ভারত সরকারের ভূমিকার প্রকৃত বিশ্লেষণ অনুপস্থিত থেকে গিয়েছে। বিগত ষাট বছরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্ট ক্ষমতা হস্তান্তরের পর গঠিত ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বাধীন কাশ্মীরের প্রতি আগ্রাসী নীতি নেয় ও কাশ্মীর ভূখন্ড দখলের চেষ্টা করে। পাকিস্তানের মদদে কাশ্মীরে উপজাতি প্রধান অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়, যা তৎকালীন কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহের শাসন ক্ষমতাকে বিপন্ন করে তোলে। তখন তিনি ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চাইলে ভারতীয় শাসককুল তাঁকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির জন্য চাপ দিতে থাকেন। উপজাতি-বিদ্রোহ সামলাতে না পেরে তিনি ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন ও ১৯৪৭-এর ২৬ অকটোবর ভারতে শর্তসাপেক্ষে অন্তর্ভুক্তি বা Instrument of Accession এ সই করেন। ভারত সরকার তাঁকে সেনা সহায়তা করে উপজাতি-বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে। যদিও কাশ্মীরের কিয়দংশ তাঁর ও ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে যায়, যা ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পরিচিত। এই সমস্ত কর্মকান্ডে সাধারণ কাশ্মীরী জনতার কোনও ভূমিকাই ছিল না। তাঁরা অবশ্য চিরকালই তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে ভালবেসে এসেছেন। ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজার সমঝোতাকে তাঁরা কোনও দিনই মেনে নেননি।
কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর কাশ্মীরী জনগণের মতামত অনুযায়ী কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে এমন শর্ত থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল একটি প্রস্তাবনায় (Resolution) কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ শাসন ক্ষমতা সম্পর্কে কাশ্মীরের জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি গণভোট গ্রহণের প্রস্তাব করে। বলা বাহুল্য, সেই গণভোটি আজও গৃহীত হয়নি। ১৯৪৭-এ ভারতভুক্তির পর থেকেই শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরী জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীতে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেই আন্দোলনের চাপেই ভারত সরকার জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কয়েকটি বিশেষ সুবিধে প্রদান করে। ‘আজাদী’ বা স্বাধীনতার বদলে কাশ্মীর পায় খানিকটা স্বায়ত্ত শাসন, যা আসলে কাশ্মীরী জনতার আজাদীর দাবীকে প্রশমিত করতে চালু করা হয়। কাশ্মীরী জাতিসত্তাকে অবদমিত করে রাখার দমনমূলক নীতি থেকে ভারত কখনও সরে আসেনি। সেনা পাঠিয়ে, নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়ে, রাজ্যে পুতুল সরকার বসিয়ে বকলমে সামরিক শাসনই চালিয়ে এসেছে নয়াদিল্লীতে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার। যতবার স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন দানা বেঁধেছে, ততবার চলেছে সেনা-আগ্রাসন, পুলিশী নির্যাতন, গুমখুন, ভুয়ো সংঘর্ষ সাজিয়ে খুন, গণধর্ষণ ও গণহত্যা। আর বারবারই কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবীতে আন্দোলনকে ‘আইন শৃঙ্খলার সমস্যা’ বা ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বলা হয়েছে ‘পাক-মদদপুষ্ট জঙ্গি’।
উপত্যকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, যারা কাশ্মীরী জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করত, তাদের শাসন ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন, ন্যাশনাল কনফারেন্স, যার নেতা ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরী জনতার কাছে ভারত রাষ্ট্রের ‘মুখ’। যে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবী নিয়ে শেখ আবদুল্লাহর উত্থান, সেই মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে কাশ্মীরী জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁর পুত্র ফারুক ও পৌত্র ওমর আবদুল্লাহ। এঁরা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করেছেন এবং কাশ্মীরী উপত্যকায় ভারত রাষ্ট্রের ‘প্রতিনিধি’তে পরিণত হয়েছেন। প্রতিবারের মতো এবারও এঁরা আন্দোলনকারীদের ‘পাকপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আন্দোলন বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। আন্দোলনকারীদের উপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় আক্রমণ যেমন, পুলিশী হামলা, গ্রেফতার, নির্বিচার হত্যাকে সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন।
ফারুক ওমর সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট অথবা আফম্পা) এর মতো গণতান্ত্রিক অধিকার খর্বকারী, স্বৈরাচারী আইন সরাসরি সমর্থন করে কাশ্মীরী জনতার মুখ বন্ধ করতে চাইছেন। ‘আজাদী’কে গুরুত্ব না দিয়ে, কিছুটা স্বায়ত্ত শাসন দিয়ে কাশ্মীরের আইন শৃঙ্খলার অবনতির দোহাই দিয়ে, স্বাধীনতাকামী হুরিয়াত কনফারেন্স ও অন্যান্য বিরোধী ও আন্দোলনকারী নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসে আন্দোলনের মূল দাবীকে চাপা দিতে চাইছেন। আজ যদি তাঁদের এই ষড়যন্ত্রমূলক প্রস্তাবে আন্দোলনকারীরা সাড়া দেয়, তাহলে লাভবান হবে দিল্লীর সরকার। আর ক্ষতি হবে মুক্তিকামী কাশ্মীরী জনতার। কাশ্মীরের চিরসংগ্রামী মানুষ আবার বঞ্চিত হবেন জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রকৃত অধিকার থেকে।’’ (রুদ্র সেন, কলকাতা, ৭০০০২৮)
ভারতীয় মিডিয়ায় কাশ্মীর
ভারতের ‘ফ্রন্ট লাইন’ ২৪ সেপ্টেম্বর/২০১০-এ এ.জি. নূরানীর জম্মু ও কাশ্মীর সম্পর্কিত আর একটি লেখা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি দিল্লী সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগকে ‘First Steps’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘The situation in kashmir calls for immediate steps to create conditions conducive to a twopronged dialogue process.. তবে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির আগে কট্টর হিন্দুবাদী বিজেপি-র মতো বিরোধী দলের সাথেও সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি লিখেছেন : ‘One such step is reform of the Armed Forces (special Powers) Act, 1958., But before that, it is imperative that New Delhi shed its opposition to peaceful expression of the people’s sentiment.” -অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য নিয়ে ভারতের যে কোন সরকারেরই যে কোন সাহসী ভূমিকা নিতে হলে একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করা দরকার। এ জি নূরানীর মতে, ভারত সরকার যদি সংবিধানের ৩৭০-ধারায় প্রদত্ত ‘বিশেষ মর্যাদার’ সুরক্ষা পুনর্বহাল করার লক্ষ্যে ৩৭০-ধারার হুবহু পুনর্বহাল করতে পারে এবং সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত শাসন দিয়ে কাশ্মীরীদের সাথে সমঝোতায় উপনীত হতে পারে, তাহলে সমস্যার সাময়িক নিষ্পত্তি আশা করা যায়। সংবিধানের ৩৭০-এর সাথে (২) উপ-অনুচ্ছেদ যুক্ত করে রাজ্যের মর্যাদা ও ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এর ফলে রাজ্য সরকার বরখাস্তের ক্ষমতা ভারতের রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত হয়েছে। শেখ আবদুল্লাহর সরকার বরখাস্ত এবং বখশী গোলাম মোহাম্মদ ও মীর কাসিম সরকার নিয়োগ করা হয় সংবিধানের এই পরিবর্তিত ধারার ক্ষমতাবলে। তবে জাতিসংঘের আওতায় জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রশ্নটি, বিশেষ করে কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠানের আগে ভারত একতরফাভাবে এ রাজ্য নিয়ে সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক-সামরিক যে কোন ধরনের পরিবর্তন আনুক না কেন, তা বৈধ হতে পারে না। এটা ভারতের আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত, আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী এবং কাশ্মীরের জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বিরোধী। সুতরাং ভারতের এ পদক্ষেপ যে কোন বিচারেই অকার্যকর। কাশ্মীরের জনগণের বাইরে যদি অন্যপক্ষগুলোকে হিসাবের মধ্যে আনতে হয়, তাহলে পাকিস্তান, ভারত ও জাতিসংঘকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আজাদ-কাশ্মীরও একটি পক্ষ।
ভারত তার সাংবিধানিক অংগীকার লঙ্ঘন করে ৩৭০-অনুচ্ছেদকে একটি কাগুজে দলিলে পরিণত করেছে। এ জি নূরানীর মতে : ‘What happens in that only the shell is there, Article 370, whether you keep it or not, has been completely emtied of its contents. Nothing has been lift in it.’ [Front Line, 24 September, 2010]
কাশ্মীরের সার্বভৌম ‘সদর-ই-রিয়াসাতের’ সার্বভৌম বিশ্লেষণটি বাতিল করে ভারতের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত গভর্ণরের দ্বারা তা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। মীর কাসিমের উত্থাপিত (৩১ অকটোবর/১৯৫১) কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলী-র প্রস্তাবে বলা হয় : ‘This Asssembly resolves that it shall stand dissolved on the 26th day of Janurary, 1957.’ ভারতের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারি লাল নন্দ এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন : ‘The constituent Assembly is gon. Terefore, the provision is otiose... and the President (India) has got unfattered Clause(3).’ - দেখা যাচ্ছে, কাশ্মীরকে ভারতীয় রাজ্যের অন্তর্ভুক্তকরণ পর্যন্ত বিতর্কিত কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলীকে রক্ষা করা দরকার ছিল। গণ-পরিষদ বিলোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীয় পার্লামেন্ট। এরপর মীর কাসিম-বখশী গোলাম মোহাম্মদরা সেটা তাদের গণ-পরিষদে অনুমোদন করেছেন। ভারতীয় সংসদকে কাশ্মীরের জনগণ এ অধিকার দেয়নি। মীর কাসিমরাও যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার পক্ষেও তারা জনগণের কোন ম্যান্ডেট নেয়নি।
এ জে নূরানীও এ ব্যাপারে একই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘The Kashmiri people and thier constituent Assembly, in what form was prevail it was absolute and soverign, Indian authority has nothing to nul and void their will of non-accession to India.’ -প্রাগুক্ত।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের যে কোন ক্ষমতা কেন্দ্রকে দিতে হলে তা পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস হতে হবে এবং Article 368, section (2)-এর আওতায় তা পার্লামেন্টে ‘Ratify’ হতে হবে। কিন্তু ভারত সরকার এই ক্ষমতা নির্বাহী ক্ষমতা বলে রাজ্য সরকার থেকে কেড়ে নিয়ে ভারতের সংবিধানের আওতায় তাদের রাষ্ট্রপতির ওপর অর্পণ করেছে। একটি ভূয়া ও কারচুপির নির্বাচনে গঠিত তথাকথিত গণ-পরিষদে কতিপয় ভারতীয় এজেন্ট ঐ অবৈধ Accession-কে অনুমোদন করেছেন। এই অবৈধ প্রক্রিয়ার সাথে কাশ্মীরের জনগণ সম্পৃক্ত নন। অন্যদিকে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণে গণভোট অনুষ্ঠানের স্বীকৃত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, বিকৃতকরণ বা বিলোপ করার কোন অধিকার ভারত সরকারের নেই।
জম্মু-কাশ্মীর সরকারের আইন সচিব জি-এ, লোন ভারতের এ ষড়যন্ত্র উন্মোচন করেছেন। তাঁর মতে, ভারত সরকার গভর্ণর জগমোহনকে (শিখ) নিযুক্ত করে ‘by sheer manipulation’ করে কীভাবে ভারতীয় সংবিধানের ২৪৯ অনুচ্ছেদকে ‘The residuary power of legalissation-’ কাশ্মীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। [সূত্র : Kashmir Times, April, 20, 1995]
আজাদী আন্দোলনের তিন পুরোধা
কাশ্মীরের আজাদী আন্দোলনের আপোষহীন নেতাদের মধ্যে বর্ষীয়ান ও প্রভাবশালী নেতা হচ্ছেন অল পার্টি হুররিয়াত কনফারেন্স নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানী। ভারত সরকার তাঁকে কয়েক মাস ধরে গৃহবন্দী করে রেখেছে। Ayasha Anrabi (আয়েশা আন্দ্রাবী)- একমাত্র স্বাধীনতাকামী মহিলা নেত্রীকে গত ২৮ অগাস্ট, ’১০ গ্রেফতার করা হয়েছে। আজাদী আন্দোলনের অপর শীর্ষ নেতা মাসরাত আলম বেশ কিছুদিন ধরে আত্মগোপনে থাকলেও গত ১৯ অকটোবর/২০১০ তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
ফ্রন্ট লাইন-এ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১০-এ সুজ্জাত বুখারী লিখেছেন : ‘The 81 year-old zeelani is seen as an icon of the ‘freedom struggle’ by most young people in Kashmir’- কাশ্মীরের আজাদী আন্দোলনের পতাকা এই বর্ষীয়ান নেতা দৃঢ়ভাবে বহন করে চলেছেন। নির্লোভ-সৎ এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত দৃঢ়চেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী স্বাধীনতাকামী সকল পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। কাশ্মীরের ওপর ভারত সরকার বা রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। মডারেট গণতন্ত্রী-অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলারদের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেই। মাসারাত আলমকে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ভারত বিরোধী গণ-জাগরণের নেপথ্য সংগঠক হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত গোপন আস্তানা থেকে পুলিশ তাঁকেও গ্রেফতার করেছে। সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী ভারতের সাথে কোন রকম সমঝোতা বা আপোষরফায় বিশ্বাসী নন। কাশ্মীরের আজাদীর প্রশ্নে গিলানীর কঠোর অবস্থানের কারণে তাঁকে দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে সম্মান করা হয়। গিলানী রাজনীতি শুরু করেছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের মাধ্যমে। পরে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত হন। কাশ্মীর রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে তিনি তিনবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর পরে তিনি ভারতের সংবিধানের আওতায় নির্বাচনী প্রক্রিয়া নাকচ করেন। তাঁর মতে, ‘The Assembly as the meeting place of “Indian agents”. এসেম্বলীকে গিলানী ভারতীয় এজেন্টদের মিলন কেন্দ্র বলে মনে করেন।
৩৭ বছরের মাসারাত আলম একজন আপোষহীন স্বাধীনতাকামী। তিনি গিলানীর অনুসারী। মাসারাত আলম মুসমি লীগ রাজনীতিক হিসেবে গিলানীর সূচিত ২০০৮ সালের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দৃশ্যপটে আসেন। হত্যা-ধর্ষণের প্রতিবাদ সহ অমর নাথ মন্দিরে কাশ্মীরের শত শত বিঘা জমি প্রদানের সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠনের অভিযোগে মাসারাত আলম গ্রেফতার হলে দু’বছর কারাগারে কাটান। সম্প্রতি তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হলো। মাত্র গত জুনে মাসারাত আলম কারাগার থেকে মুক্তি পান। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানকে প্রথম যে হত্যাকান্ডটি উদ্দীপ্ত করে, তা হচ্ছে তোফায়েল মাট্টো নামের এক কিশোর কাশ্মীরীর হত্যা। সেনাবাহিনীর গুলিতে তার মৃত্যু হয়। মাসারাত আলম স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী তরুণ ও যুবকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় প্রভাবশালী নেতা। তিনি মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কর্মীদের কাছে নির্দেশনা দান ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ভিসিডি ব্যবহার করেন। তাঁর মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে ৫ লাখ রুপি।
আয়েশা আন্দ্রাবীকে গত ২৮ অগাস্ট/২০১০ গ্রেফতার করা হয়েছে। স্বাধীনতাকামী একমাত্র প্রভাবশালী মহিলা নেত্রী হিসেবে তিনি যথেষ্ট সুপরিচিত। তিনি গিলানী-মাসারাত আলমের মতোই ‘হার্ডলাইনের।’ ১৯৮০ সালে ‘দুখ্তারান-ই-মিল্লাত, সংগঠনের মাধ্যমে আয়েশা আন্দ্রাবী দৃশ্যপটে আসেন। ১৯৯০-এর দিকে তিনি কাশ্মীরকে ‘ইসলামিক স্টেট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তির পক্ষপাতি। বিভিন্ন মেয়াদে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। তার শিশু সন্তানও তাঁর সাথে কারাগারে ছিল। কাশ্মীরের মুজাহিদ কমান্ডার আশিক হোসেন ফাকতো ওরফে মোহাম্মদ কাসিমকে তিনি বিয়ে করেছেন। একজন মানবাধিকার কর্মীকে হত্যার অভিযোগে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে।
বাহ্যিক উপলব্ধি ও নেতিবাচক মানসিকতা
ভারত সরকারের মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বদলীয় সংসদীয় দল কাশ্মীর সফর করে এসে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও বিক্ষোভ মোচনে ৮ দফা সুপারিশ পেশ করেছেন। এদিকে দিল্লী সরকার কাশ্মীর ইস্যুতে সেখানকার রাজনৈতিক নেতা ও স্বাধীনতাকামী সংগঠনের নেতাদের সাথে আলোচনা করে সরকারের সাথে আপোষ মীমাংসার একটা প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করতে সহায়তা দিতে পারবেন, এই প্রত্যাশায় তিন সদস্যের একটি আলোচক প্যানেলের নাম ঘোষণা করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি-চিদাম্বরম সম্প্রতি এ আলোচক প্যানেলের নাম ঘোষণা করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন তথ্য কমিশনার এম এম আনসারী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাধা কুমার। আলোচকরা জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের সকল নেতাদের সাথেই আলোচনা করবেন। জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা ইনস্টিটিউট অব পীস-এর প্রধান রাধা কুমার মধ্যপন্থী হুররিয়াত নেতা মীর ওয়াইজ ওমর ফারুক ও স্বাধীনতাকামী নেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানীর সাথে নেপথ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি রাধা কুমার কাশ্মীর সফর করেন এবং শ্রীনগরে চিকিৎসাধীন গিলানীর সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন।
জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন মতের নেতাদের সাথে স্থায়ী সংলাপ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী পরিষদ কমিটির বৈঠকে। এ বৈঠকে সরকার ঘোষিত ৮ দফা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এ আলোচকদের নিয়োগ করা হয়। দিল্লী সরকারের ৮ দফার মধ্যে গত ১১ জুন/১০ থেকে শুরু হওয়া গণ-আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দেবার ঘোষণাও রয়েছে। জননিরাপত্তা আইনের আওতায় আটক ব্যক্তিদের মামলাসমূহ অবিলম্বে পুনর্বিচেনার জন্য রাজ্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মধ্যপন্থী হুররিয়াত নেতা মীর ওয়াইজ মোহাম্মদ ফারুক সরকার নিযুক্ত প্যানেলের সাথে আলোচনায় রাজী থাকলেও স্বাধীনতাকামী আপোষহীন নেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানী এটাকে ‘নিষ্ফল চেষ্টা’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি কাশ্মীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তাঁদের ৫ দফা পূরণ না করা পর্যন্ত কোন আলোচনা সুফল বয়ে আনবে না বলে মনে করেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ভারত সরকারের সংলাপ প্রক্রিয়াকে সময় ক্ষেপণের কৌশল বলে মনে করেন। কাশ্মীরে যতোদিন ‘জননিরাপত্তা আইন’ বলবৎ থাকবে এবং সেনা-নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অসীম ক্ষমতার চাবুক থাকবে, ততোদিন কাশ্মীর গণহত্যা ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সরকারকে কাশ্মীরের বেশ কিছু এলাকা থেকে সেনা টহল তুলে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন কাশ্মীর সফরকারী রাজনৈতিক নেতারা। সন্দেহবশতঃ কাশ্মীরীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে সেনা ও নিরাপত্তা রক্ষীদের নির্যাতন বন্ধের ব্যাপারেও তারা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সরকার এসব পরামর্শ কতটা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বাধীনতাকামী নেতাদের গ্রেফতার এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও কাশ্মীর উপত্যকায় উপর্যুপরি কার্ফু্য দেবার ঘটনা ঘটছে। কার্ফু্য থাকাকালীন সময়ে সিভিল প্রশাসন অকার্যকর থাকে এবং নিরাপত্তা বাহিনী সিআরএফপি এবং সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ও তৎপরতা বেড়ে যায়। কার্ফু্য ভঙ্গকারী কিংবা সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গুলি করলেও তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না।
সরকারের সামগ্রিক আচরণে কোন নমনীয়তা ও মানবিকতার নমুনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে কাশ্মীর উপত্যকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর নিরাপত্তা বাহিনী সেনা সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিহত হয়েছেন, তারা কেউই তাদের সাথে বন্দুকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। তারা সবাই নিরীহ মানুষ। সম্প্রতি ‘রেডিও তেহরান’ কাশ্মীরের নির্যাতিত মানুষের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে একটি ফিচার প্রকাশ করেছে। ‘গণবিক্ষোভ : কাশ্মীরের হাসপাতালগুলো কি নয়া দিল্লীর বক্তব্য সমর্থন করে?’ শীর্ষক প্রশ্নবোধক ঐ ফিচারটিতে কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।
‘দৈনিক সংগ্রাম’ ২১ অকটোবর/১০ ফিচারটি প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, যারা সাম্প্রতিক তিনমাসে কাশ্মীরে নিহত ও আহত হয়েছেন, তাদের বসয় ১৫ থেকে ৩৫ বছর। আহতদের গুলি লেগেছে কোমরের নীচে। আহতরা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। তাদের ব্যান্ডেজ করা পা উপরের দিকে টানিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাসপাতালে বেডে শুয়ে তাঁরা কাতরাচ্ছেন। ভবিষ্যৎ জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ বহনের দুর্ভাবনায় তাঁরা অসহায় কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন। অথচ তাঁরা নিজেরা জানেন না কী তাঁদের অপরাধ। ভারতের অন্য কোন রাজ্যে জলকামান ও টিয়ারগ্যাস বা লাঠিচার্জ ব্যবহার না করে কখনও পাখীর মতো এ রকম গুলি করে মানুষ হত্যার নজীর নেই। এমনকি সশস্ত্র মাওবাদী গেরিলাদের সাথে ভারতের নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী কাশ্মীরের মতো নিষ্ঠুর আচরণ করে না। কাশ্মীরকে যদি ভারত তাদের রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে, অথচ বিগত ৬০ বছরে তাদের কাছে জনগণের প্রাপ্য লাঞ্ছনা, বুলেট ও বারুদের জবাব ছাড়া আরও কিছুই পায়নি। ৬০ বছরে ভারতের দখলদার বাহিনীর দ্বারা নিহত কাশ্মীরীর সংখ্যা যদি ৬০ হাজারও ধরা হয়, তাহলে প্রতি বছর তারা এক হাজার কাশ্মীরীকে হত্যা করেছে। আহত ও পঙ্গু করেছে এর কয়েকগুণ মানুষকে। প্রতিদিন গড়পরতা ২/৩টি মানুষকে ভারতীয় দখলদারিত্বের স্বীকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে, যা ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনকালেও ভারতের কোথাও ঘটেনি।
এবারের গুলি বর্ষণে এখন পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকায় মৃত্যুর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১১, আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও অনেকে। পুলিশের ধর-পাকড়, জিজ্ঞাসাবাদ-গ্রেফতারের ভয়ে অনেক আহত ব্যক্তি গোপন চিকিৎসা নেয়। আহতদের অনেককে ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে চলতে হবে সারা জীবন। অনেকে কোনদিন আর কখনো দাঁড়াতে ও হাঁটতে পারবেন না। বিগত তিন মাসের তান্ডবে আহত ২০০ রোগীর চিকিৎসা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতাল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।’’
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দাবী করেছেন যে, বিক্ষোভকারীরা যখন প্রচন্ডভাবে মারমুখো হয়ে উঠে এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে, তখন নিরূপায় হয়ে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়। যারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তাদেরকে প্রোভোক ও উত্যক্ত না করলে কখনও তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম ফেলে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চড়াও হয় না। ইট-পাটকেল-পাথরের জবাবে কোন সভ্য দেশের নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়, এ ঘটনা কেবল ভারতীয় ‘বৃহৎ গণতন্ত্রের’ ধ্বজাধারীদের পক্ষেই সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনৈক খৃস্টান পাদ্রীর পবিত্র কুরআন পোড়ানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী প্রথম গুলি চালিয়েছে। চলতি নভেম্বর/১০, মাসের ১৩ তারিখ তাংমার্গ শহরে মুসলিমদের হাজার খানেক মানুষ প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। নিরাপত্তা বাহিনী তাদের তাড়া দেয়। হঠাৎ করেই বিনা উস্কানীতে এবং সতর্কতা না জানিয়ে গুলি বর্ষণ করা হয়। ১০ থেকে ২০ মিটার দূর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী টার্গেট করে গুলি চালায়। তারা ফাঁকা আওয়াজ করেও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেবার চেষ্টা করেনি। এ ঘটনায় আহত ২৩ বছরের সাজ্জাদ নবী হাসপাতালে শুয়ে ‘রেডিও তেহরান-প্রতিনিধিকে’ এ কথাই বলেছেন। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ২৪ বছরের মোখতার আহমদ। মোখতার বলেছেন : ‘বিক্ষোভ মিছিল থেকে পুলিশ বিনা কারণে দশটা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপরই জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তাদের মুক্তির দাবীতে স্থানীয় থানার সামনে জড়ো হয়। এরপর সি আর পি এফ হঠাৎ করেই গুলি বর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ মোখতার আহমদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরও পুলিশ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে।
শ্রীনগর-হাসপাতালে গুলিতে আহত চিকিৎসাধীনরা বলেছেন, তারা নিজেরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর কোন ইট-পাটকেল পাথর নিক্ষেপ করেননি। তবে তারা যতোদিন বেঁচে থাকবেন, ততোদিন কাশ্মীরকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়ে যাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন। কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলীয় শহর সোপোরে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত ২৬ বছরের আশরাফ জানান, ‘আমাকে লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি চালানো হয়েছে। পুলিশ ঘরে ঢুকে হামলা করে। যা পায়, তা ভাংচুর করে। আমাদের মা-বোনদের মারপিট করে। তাই বাঁচতে হলে ‘আমাদের স্বাধীনতা চাই।’ ১৫ বছরের আহত কিশোর আকিবের শয্যাপাশে বসে তার মা রাজা বেগম জানান, রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় সে নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে আহত হয়েছে। রাজা বেগম বলেন : ‘‘কাশ্মীরের কর্তৃপক্ষ কতটা অমানুষ হতে পারে, এটি তারই একটি উদাহরণ। ভারতকে সবাই গণতান্ত্রিক বলে। কিন্তু কাশ্মীরের দিকে তাকান। দেখবেন, আমরা এখানে জঘন্যতম সেনাশাসনের অধীন জীবনপাত করছি।’’
ভারতীয় নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনীর কাজই হচ্ছে কাশ্মীর উপত্যকায় নির্যাতন চালানো ও মানুষ হত্যা করে ভীতি ও সন্ত্রাস তৈরি করা। নির্বিচার গুলি চালাতে তারা পারঙ্গম। এমনকি তারা ভুয়া এনকাউন্টার সাজিয়েও মানুষ হত্যা করছে। তাদের এই গণহত্যা নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকলে কাশ্মীরের প্রতিটি মানুষই আজাদী সংগ্রামের সৈনিক হতে বাধ্য হবেন।
দখলদার বাহিনীর পাইক-পেয়াদারা
কাশ্মীরের জনগণের আজাদী দমন করতে ভারত তার পাঁচ লক্ষাধিক নিয়মিত সেনাবাহিনী ছাড়াও, প্যারা মিলিশিয়া বাহিনী, স্পেশাল ব্রাঞ্চ কাশ্মীর, কাউন্টার ইন্টোলিজেন্স কাশ্মীর, সেন্ট্রাল রিভার্জ পুলিশ ফোর্স [সি আর পি এফ], স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ, নিয়মিত পুলিশ বাহিনী ইত্যাদি নানা ধরনের লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করে উপত্যকাকে অশ্রু ও রক্তের এক বধ্যভূমি বানিয়েছে।
এসব ঘাতক-নির্যাতক বাহিনীর কর্মকান্ডকে বৈধতা দান ও অব্যাহতির জন্য কালো আইন চালু করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে : Armed Forces Spcial Powers Act-1958 এবং অন্যটি হচ্ছে, Disturbed Arcas Act-1961 প্রথম কালো আইনটি চালু করেন পন্ডিত নেহেরু এবং দ্বিতীয়টি তাঁর কন্যা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। ভারত ১৯৫৮ সাল থেকে আজ অবধি একদিনের জন্যও Armed Forces Spcial Powers Act-1958-কে স্থগিত করেনি। ফলে কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরের মানুষ এক নিষ্ঠুর বন্দীশালায় বসবাস করছেন। রক্ষণশীল হিসেবেই এসব ভারতীয় ঘাতক বাহিনীর হাতে প্রায় ৫০ হাজার কাশ্মীরীকে জীবন দিতে হয়েছে। অন্য হিসেবে ৭০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ।
ভারতের কূটনীতি এবং কাশ্মীর পরিস্থিতি : মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ
ভারত দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে এজন্য ভারতকে ৪টি শর্ত পূরণ করতে হবে। যথা : ১. নিজ দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ২. আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইন-কানুনসমূহের অনুসরণ, ৩. গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং ৪. মানবাধিকার সংরক্ষণ।
এসব শর্ত পূরণে ভারতের সামর্থ্য ও সদিচ্ছা পর্যবেক্ষণে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর সহযোগী অধ্যাপক ও Peoples Tribunal-এর যুগ্ম আহবায়ক ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ড. অঞ্জনা চ্যটার্জি ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের মানবাধিকারের পরিস্থিতি তদন্ত করে একটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। ৬ সদস্যের ঐ কমিটি ২০০৮-এর এপ্রিলে গঠিত সদস্যদের নিয়ে ঐ বছরের ১৮ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত কাশ্মীরের বারমুল্লা ও কুপওয়ারী জেলায় তদন্ত কার্য পরিচালনা করেন। এ অভিজ্ঞতা নিয়ে ড. অঞ্জনা চ্যাটার্জি একটি প্রবন্ধ রচনা করেন যা London Institute of South Asia- জার্নালের অকটোবর-ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এতে তিনি লিখেছেন, বারমুল্লা জেলার কাদার মধ্যে, পাথরের স্তূপের নিচে, ঘন ঘাসের মাঠে, পাহাড়ের পাদদেশে ও সমতল ভূমিতে ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর নির্যাতনে নিহত কাশ্মীরের ৯৪০টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ কবরেই একাধিক ব্যক্তির লাশ রয়েছে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর নির্দেশে বাধ্য হয়ে জনগণ নিজেদের আপনজনের কবর খুঁড়তে বাধ্য হয়। টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে বিদেশী জঙ্গী আখ্যা দিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করে ও তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। এ জন্য কোন প্রমাণ বা তদন্তের প্রয়োজন হয়নি। তিনি বারমুল্লা জেলার উরি ও রাজামহল্লায় ১৯৯৬-৯৭ সালের ২২টি গণকবর, কাজীপুরায় ১৯৯১ সালের ৭টি গণকবর (যেখানে ১৩ জনকে কবস্থর করা হয়েছে), মীরমহল্লা, কিছামা, শিরী জনপদে ১৫০টি গণকবরের সন্ধান পান যেখানে ১৯৯৪-২০০৩ সাল নাগাদ ২২৫ থেকে ২৫০টি লাশকে সমাহিত করা হয় এবং আদর্শ গ্রাম সংলগ্ন ৯টি গণকবরের সন্ধান পান।
কুপওয়ারা জেলার ট্রেহগাম গ্রামে তিনি ১০০টি গণকবরের সন্ধান পান যার মধ্যে ২৪টি গণকবরের লাশসমূহের পরিচয় এলাকাবাসী সনাক্ত করেছে। এখানে শায়িত আছেন শেখ আবদুল্লাহ গঠিত ধর্মনিরপেক্ষ দলের প্রধান নেতা মকবুল বাট। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি সেক্যুলার, স্বাধীন গণতান্ত্রিক কাশ্মীরের দাবী করেছিলেন। দীর্ঘদিন ভারতের কুখ্যাত তিহার জেলে আটক রাখার পর ১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে ভারতীয় সুপ্রিয় কোর্ট মকবুল বাট-এর ফাঁসির রায় প্রদান করে। মকবুল বাট-এর ভাইপো পারভেজ আহমদ বাট তদন্তদলকে জানায়, ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বেই মকবুল বাটের ভাই হাবিবুল্লাহ বাটকে ভারতীয় বাহিনী অপহরণ ও গুম করে।
এরপর তদন্ত দল রেজিপুরায় যান এবং ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শহীদী গোরস্থানে যান। সেখানে ২৫৮টি গণকবরণ রয়েছে। উক্ত কবরসমূহের নম্বর ও পরিচিতি বিদ্যমান। এরপর তারা সাদীপুরা ও কান্ডিতে যান। স্থানীয়রা সেখানে ২০ জনের গণকবরের সন্ধান দেন, যেগুলো বুনোফুলের জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। সাদীপুরায় কাশ্মীরীদের নেতা রিয়াজ আহমেদ বাট-এর কবর রয়েছে। যাঁকে ২৯/০৪/২০০৭ সালে তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর বাধার মুখে তদন্ত দল তাদের তদন্ত অসমাপ্ত রাখতে বাধ্য হয় এবং ড. অঞ্জনা নিজ কর্মস্থলে ফিরে যান।
ড. অঞ্জনা তাঁর প্রবন্ধে কাশ্মীর উপত্যকার যে ভয়ঙ্কর বর্ণনা দেন তা হলো দুই দশকের সহিংসতা ও নৃশংসতায় ৭০,০০০ (সত্তর হাজার)+ কাশ্মীরীকে হত্যা করা হয়েছে, ৮০০০+কে গুম করা হয়েছে, ৬০,০০০+কে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে, ৫০,০০০+এতিম শিশু রয়েছে, অগণিত নারী ও বালিকাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, সেখানকার মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেশি। ২০০৭ সালের কাশ্মীরের একমাত্র হাসপাতালে মানসিক রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮,০০০। সেখানে মাইলের পর মাইল নিরাপত্তা বাহিনী কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। আইন-কানুন, মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, রাজনীতি করার অধিকার দানবিক শক্তি দিয়ে পদদলিত করা হচ্ছে। কাশ্মীরের প্রতিটি নাগরিকই ভুক্তভোগী। তাদের প্রত্যেকের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে, প্রত্যেকের মনে রয়েছে অনেক না বলা কথা, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে তারা বিপর্যস্ত। বাস্ত্তচ্যুত অগণিত মানুষের হাহাকার কাশ্মীর উপত্যকায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
তদন্ত দলের সদস্যদের পরিণতি : এডভোকেট ইমরোজ ও ড. অঞ্জনার নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটির সদস্যদের তদন্তকালীন ও পরবর্তী পরিণতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :
তদন্তকালীন সময়ে তদন্ত দলকে বিভিন্ন ভারতীয় বাহিনী পদে পদে বাধা দিয়েছে। তাদের গাড়িকে বিভিন্ন বাহিনী অনুসরণ করেছে, সাধারণ নাগরিকদের সাথে কথা বলতে বাধা দিয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যদের টেলিফোনে জানমালের হুমকি দিয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যদের উপর সংক্ষিপ্ত সময়ে যে নির্যাতন নেমে এসেছে তা হলো :
১. ড. অঞ্জনাকে ইমিগ্রেশন বিভাগ হয়রানি করেছে, ফিরতি পথে বিমানে টেলিফোন করে প্রাণনাশ ও ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে।
২. এডভোকেট ইমরোজকে তিনবার হত্যা করা চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে নিজ গৃহে বাস করেন না।
৩. খুররম পারভেজ তাঁর পা হারিয়েছেন।
৪. গৌতম নবলক্ষ্যা ও জহির উদ্দীনকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে এবং চরম ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
সরকারের সাথে সাথে উগ্র হিন্দুদের দল তদন্ত কমিটির সদস্যদেরকে প্রাণে মারার ও তাদের পরিবারকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে।
ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনের পন্থাসমূহ
তদন্তকালে ড. অঞ্জনা ভারতীয় বিশেষ বাহিনীসমূহ ও পুলিশী নির্যাতনের যে সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছেন
তা নিম্নরূপ :
ক. আটক করার পর একজন লোককে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পা উপর দিয়ে ঝুলানো হয়, অতঃপর তার মলদ্বারে সিরিঞ্জ দিয়ে পেট্রোল প্রবেশ করানো হয়। পরবর্তীতে মুখে কাপড় বেঁধে পানি ঢালা, পানিতে চুবানো, ক্ষুধার্ত রাখা, অঙ্গহানি করা এবং নারী ও শিশুকে ধর্ষণ ও বলাৎকার করা।
খ. অনেক কাশ্মীরী বালক শৈশবে নিজের বাহুতে ঈগলের ছবি বা উল্কি অাঁকে। ভারতীয় বাহিনী এরূপ উল্কিকে আজাদীর চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং সংশ্লিষ্ট স্থান জ্বালিয়ে দেয়।
গ. সেনা সদস্যরা একজন তরুণীকে তাঁর মায়ের সামনে ধর্ষণ করছিল। উক্ত মা অনুনয় বিনয় ও কান্নাকাটি করছিল মেয়ের মুক্তির জন্য। সেনা সদস্যরা গান পয়েন্টে উক্ত মাকে মেয়ের ধর্ষিত অবস্থা দেখতে বাধ্য করে এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।
ঘ. তদন্ত টীম শ্রীনগরের দুটি পরিবারের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। সাক্ষ্যে তারা বলে, পুলিশ শ্রীনগরের পুরাতন শহরে তাদের সন্তানদের গুলি করে হত্যা করে ফেলে যায়। রাতে পরিবারের সদস্যরা লাশ তুলে এনে কবর দেয়ার বন্দোবস্ত করলে পুলিশ পুনরায় ফিরে আসে। পরিবারের সহায়-সম্পদ বিনষ্ট করে এবং নারীদেরকে নির্যাতন করে।
ঙ. তদন্ত দল উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুপওয়ারা সফরের সময় ১৯৭৯ সালে স্থাপিত ৬টি বিশাল আর্মি ক্যাম্প দেখেন যেখানে আর্মি ও প্যারামিলিশিয়া ক্যাম্পের পরিচালনাধীন সাতটি ইন্টারোগেশন সেল প্রত্যক্ষ করেন। কাছাকাছি স্থানে স্থাপিত পুলিশ পরিচালিত অনুরূপ সেল আরও ছিল।
চ. কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখিকা মরিয়ম ছাকিনা তাঁর “The sentiment in the streets of Srinagar.” প্রবন্ধের শুরু করেছেন এভাবেঃ
Kashmir burn’s... It has been, since the Maharaja’s fateful manoeuvring in 1947 that sealed Kashmir’s miserable plight, however not perhaps with so much passion and fervour of the mass-man on the streets in the face if indiscriminate brutality perpatrated by the Army of one of the world’s biggest democracies.’’
ছ. ভারতের বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ও লেখিকা অরুন্ধতী রায় কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘‘It is the only thing Kashmir wants. Denial is delusion;... Day after day hundreds of thousands of people swarm around places that hold terrible memories for them. They demolish bunkers, break through cordons of concertina wire and stare siraight down the barrels of soldiers, machine gun’s, saying what very few in India want to hear. [সূত্র : মরিয়ম ছাকিনার প্রবন্ধ, LISA journal oct-dec-2008]
জ. কাশ্মীরে ভারতীয় নির্যাতন সম্পর্কে কাশ্মীরী নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানী লিখেছেন : Today, the numbers of Kashmiri prisoners languishing Indian Jails suffering torture and abuse that is obscured by India’s Propaganda machinery is appllingly high. Kashmiris refuse to forget the father’s, brothers and sons killed or ‘disapperaed’ the mother’s, sisters and daughters raped... Leaders of Kashmir’s freedom fighting movement Labour in prisons. (সূত্র : Authentic voice of south Asia, Syed Ali Shah Geelani, p-155)
পাকিস্তানের অবস্থান
পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা বিভক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত। এই সাথে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর হচ্ছে বাড়তি বিষফোঁড়া। ভারতের প্রথম অভিযোগ, উপ-মহাদেশ বিভক্তকারী ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব’ নিয়ে। দ্বিতীয় অভিযোগ, ‘সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের’ ভিত্তিতে পাকিস্তানের অভ্যুদয়। তৃতীয় অভিযোগ, পাকিস্তানের অস্তিত্ব নিয়ে। চতুর্থ অভিযোগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সামরিক প্যাক্ট-এ শামিল হওয়া। পঞ্চম অভিযোগ, পাকিস্তান তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামরিক শক্তি সঞ্চয় করেছে। পঞ্চম অভিযোগ, ভারতের সমান্তরালে পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি অর্জন। ষষ্ঠ অভিযোগ, ১৯৭১-এ দ্বি-খন্ডিত হয়েও পাকিস্তান টিকে আছে এবং ভারতের জন্য পাকিস্তানের দিক থেকে তাদের নিরাপত্তার এতটুকুও থ্রেট কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। ষষ্ঠতঃ পাকিস্তান হচ্ছে, ‘ইসলামী মিলিট্যাক্ট গোষ্ঠীর প্রজনন ক্ষেত্র’। যা শুধু ভারতের নিরাপত্তার জন্যই তারা ক্ষতিকর বলে মনে করে না, পশ্চিমের মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং গণতান্ত্রিক স্থিতির প্রতিও হুমকি বলেও তারা মনে করে। সপ্তমতঃ কাশ্মীরে স্বাধীনতার আন্দোলন, ভারতের দৃষ্টিতে যা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’- তার পেছনে পাকিস্তান উস্কানী দিয়ে যাচ্ছে। ভারত দখলীকৃত কাশ্মীরসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে যতো সব অন্তর্ঘাত ও বোমা-সন্ত্রাস চলছে, তা পাকিস্তান ভূ-খন্ড থেকে পরিচালিত ‘ক্রোসবর্ডার টেরোরিজমের’ কারণে ঘটছে। ভারতের এই অভিযোগের তালিকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের সর্বশেষ অভিযোগ হচ্ছে, মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ত থাকা।
সুতরাং কেবল কাশ্মীর ইস্যুই পাক-ভারত বিরোধ ও আস্থার সংকট নিরসনের একমাত্র দাওয়াই নয়। দ্বি-পাক্ষিক আজন্ম বৈরীতার সাথে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণে ভারতের সাথে হাত মিলিয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইল অক্ষশক্তি। গণচীনের বিরুদ্ধে ভারতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের পশ্চিমাদের লক্ষ্যও এই সাথে মিলিয়েছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরবর্তীকালে ভারত-পাকিস্তান ‘সিমলা চুক্তিতে’ স্বাক্ষর করে। এতে শক্তিপ্রয়োগ নয়, আলাপ-আলোচনার প্রক্রিয়াই হবে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার সকল অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের উপায় বলে দু’পক্ষই স্বীকার করে নিয়েছে। অবশ্য ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তান ভারতের মধ্যে আর কোন বড়ো ধরনের যুদ্ধ হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে কারগিল নিয়ে সামরিক সংঘাতকে কেন্দ্র করে দু’দেশের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধ শুরুরও একটা আশংকা তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ড. কাদির খান বলেছেন : ‘পাকিস্তানের কাছে পরমাণু বোমা থাকায় ভারত নতুন করে পাকিস্তানের সাথে আর কোন যুদ্ধে জড়ায়নি।’ তবে ৯/১১-এর পর পাক-ভারত বিরোধের চিরচেনা দৃশ্যপটের সাথে মার্কিন স্টাবলিশমেন্ট ঘোষিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ পাকিস্তানকে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিবেশী আফগানিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, মার্কিন-ন্যাটো বাহিনীর বিশাল সামরিক শক্তি সমাবেশ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে যেমন ঘোলাটে ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে, তেমনি পাকিস্তানের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চরিত্রও বদলে দিয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআই’র পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাইভেট বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্যের অবাধ বিচরণ ও অন্তর্ঘাত চালানো ছাড়াও পাকিস্তানের মূল ভূ-খন্ডে চালকবিহীন মার্কিন ড্রোন যুদ্ধ বিমানের উপর্যুপরি হামলা, আফগান, তালেবান-ইসলামী জঙ্গি ইস্যুকে পাকিস্তানকে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখার ফলে দ্বি-পাক্ষিক আস্থার সংকট পাকিস্তানের জন্য এক শ্বাসরুদ্ধকর উভয় সংকট তৈরি করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কোরেশী ওয়াশিংটনে মার্কিন নীতি নির্ধারকদের প্রতি পাকিস্তানের ‘সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের’ আহবান জানিয়েছেন। আমেরিকা পাকিস্তানের অখন্ডত্ব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা না করে বরং পাকিস্তানকে ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করতে চায় বলে পাকিস্তানীরা ব্যাপকভাবে সন্দেহ করছেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় (FATA, Federal Administratered Area) তারা নতুন ভূগোল তৈরি করতে চায়। আফগানিস্তানে মার্কিন-ন্যাটো বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত তালেবানদের সাথে মার্কিন সামরিক কমান্ড এবং কারজাই সরকার আপোষ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিলেও পাকিস্তানকে ইসলামিক মিলিট্যান্টদের সাথে সমঝোতা করতে দিতে চায় না খোদ মার্কিন সরকার ও পেন্টাগন। আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধকৌশল অনেকটা সীমিত ও ডিফেনসিভ হয়ে আসছে। এই সাথে পাকিস্তানের উপ-জাতীয় অঞ্চলে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও সামরিক অভিযান স্তিমিত হয়ে এসেছে। এই উপজাতীয় পশতুনরা যেমন মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ শক্তির প্রমাণ দিয়েছেন, তেমনি কাশ্মীরের মুজাহিদ অভিযানের মূলশক্তিও ছিলেন। আফগান উপজাতীয়তদের ঐতিহ্যবাহী সামরিক সাহসিকতা ধ্বংস করার নানামুখী চক্রান্তের ঘূর্নাবর্তে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। তবে পাকিস্তানের করাচীসহ মসজিদ-মাদ্রাসায় নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের আভাস পাওয়া যায়। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সাম্প্রতিক গণজাগরণের পর পাকিস্তানের করাচীতে ব্যাপক হত্যাকান্ড সেখানকার রাজনীতিকে আরও সংঘাতমুখী ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এসব অন্তর্ঘাতের পরিণতি পাকিস্তানের জন্য শুভ নয়। মার্কিন ‘ড্রোন’ বিমান হামলায় বিপুল সংখ্যক সিভিলিয়ানের মৃত্যুর সাথে তিনজন সেনাবাহিনীর সদস্যের মৃত্যু ঘটলে পাকিস্তান-আফগানিস্তানে-আমেরিকানদের সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দেয়। একই সময় পাকিস্তান ভূ-খন্ডে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু জ্বালানীবাহী ট্যাংকার জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানী সেনাহত্যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে কয়েক দফা ‘ক্ষমা’ চাইবার পর ঐ সরবরাহ লাইন পাকিস্তান আবার খুলে দিয়েছে। তবে একটা অবিশ্বাস ও লুকোচুরির দোলাচল পাক-মার্কিন সম্পর্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। ফলে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে পাকিস্তানের দরকষাকষির অবস্থানটি কৌশলগত কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এদিকে বব ওয়ার্ডের সাড়া জাগানো ‘ওবামা’স ওয়ার’ বইয়ে পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারীর এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি নতুন করে পাক-মার্কিন সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি নিয়ে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি করেছে। ‘দ্য নিউজ’ ও এএফপি-র বরাত দিয়ে ‘দৈনিক নয়া দিগন্তের’ সাম্প্রতিক এক খবরে : [১৪/১০/১০] পাকিস্তানের সাথে মার্কিন বন্ধুত্বর স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ‘জারদারী আইএসআই-র সমর্থিত এক বিস্ফোরক মন্তব্যে বলেছেন যে, পাকিস্তান হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তাঁকে এ তথ্য দেন এবং পাকিস্তানী গোয়েন্দারাও এর সত্যতা স্বীকার করেছেন। এর সাথে ভারতের সহযোগিতা সম্পর্কেও পাকিস্তান ওয়াকিবহাল। বায়তুল্লাহ মেহমুদের সাথে মার্কিন সিআইএ-এর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এই সংগঠনের ক্যাডাররাই বেনজীর ভুট্টোকে হত্যা করেছে বলে ব্যাপক ধারণা রয়েছে। পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার লক্ষ্য এর পেছনে লুক্কায়িত বলে মনে করা হয়।
পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রসঙ্গ তুলে ভারত মনে করে, দেশটি ভেঙ্গে পড়তে পারে। যদিও ২০০৯ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন : ‘আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি প্রচেষ্টা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ...যদি পাকিস্তানী নেতাদের সততা থাকে, তাহলে আমরা তাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমরা তাদের সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো।’’ [সূত্র : অপর্ণা পান্ডে, দি মেইল, পাকিস্তান : কালের কণ্ঠ : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০]
পাকিস্তান যতো সংকটেই থাকুক, কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে তারা কখনও নির্বিকার থাকেনি। পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনায় মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, কাশ্মীরের আন্দোলনে পাকিস্তানে নৈতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন সবসময় রয়েছে। কাশ্মীরে ভারতের উৎপীড়নের বিষয়টি বিশ্ব দরবারে উত্থাপন করার কথাও তিনি বলেছেন। ভারত যাতে এই উৎপীড়নের পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়, তার জন্য পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি করবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হলে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ভারতও অভিযোগ তুলেছে যে, পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুটি জাতিসংঘ টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার লংঘন বন্ধ এবং কাশ্মীরের মানুষকে নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সেখানকার সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান সরকারকে দ্বি-পাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তৎপর হতে সরকারের ওপর আভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে। উল্লেখ্য, পাক-ভারত যুদ্ধের পর প্রায় ৪০ বছর কেটে গেলেও ভারত ‘সিমলা চুক্তি’ অনুযায়ী কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে কোন আগ্রহ দেখায়নি। পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যু জাতিসংঘ উত্থাপন করতে পারবে না, তারা কোথাও এ রকম দাসখত দেয়নি। জাতিসংঘও কাশ্মীর ইস্যুতে দায়মুক্ত হতে পারেনি।
কাশ্মীরের জনগণের কাছে জাতিসংঘ যে নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, তারও সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। জাতিসংঘ গৃহীত কাশ্মীর সম্পর্কিত একাধিক প্রস্তাব এবং কাশ্মীর সংক্রান্ত জাতিসংঘ মিশনের অন্যান্য কার্যক্রম জাতিসংঘ মুছে ফেলতে পারে না। সুতরাং জাতিসংঘ কার্যক্রম যেখানে স্থবির হয়ে আছে, সেখান থেকেই তা নতুন করে সক্রিয় করতে হবে। ভারতের প্রতি বিগত ৬ দশক ধরে পক্ষপাতিত্ব করে বিশ্ব সম্প্রদায় ভারতকে দানবে পরিণত করেছে। কাশ্মীরের মানুষ এই দানবের কবল থেকে মুক্তি চায়। জাতিসংঘ ইরাক-আফগানিস্তান-ফিলিস্তিন ইস্যুতে পর্বত প্রমাণ ব্যর্থতার নজীর স্থাপন করে তার ইমেজ ধ্বংস করেছে। কাশ্মীর ইস্যুতে এবার জাতিসংঘ তার প্রাতিষ্ঠানিক অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে কিছুটা হলেও ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিন্তু মার্কিন পলিসি একেবারে ভারতঘেঁষা হওয়ায় তাদের কাছে এ ব্যাপারে আশা করা বৃথা।
কাশ্মীর নিয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা
পাকিস্তানের ‘ডন’ পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত’ [২৩ অকটোবর, ২০১০] খবর দিয়েছে,
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কোরেশী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে আসন্ন ভারত সফরকালে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনার আহবান জানিয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কোরেশী বলেছেন, কাশ্মীরে সম্প্রতি সন্দেহভাজন জঙ্গি দমনের নামে ভারতীয় নিরাপত্তা ও সেনাবাহিনী যে অভিযান চালাচ্ছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসন তথা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানের অনুরোধ রক্ষা করে ভারতের ওপর কাশ্মীর ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করার পক্ষপাতি নন বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা কাশ্মীর নিয়ে নাক গলাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ হচ্ছে, ভারত ও পাকিস্তানকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে হবে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নতুন করে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চাওয়ার একদিন পর ওয়াশিংটন এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করলো। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পি-জে ক্রাউলী তাঁদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন : ‘দুটি দেশের জন্যই কাশ্মীরের গুরুত্ব আমরা স্বীকার করি। আঞ্চলিক উত্তেজনার নিরসন ঘটিয়ে কাশ্মীর সমস্যার একটি সুষ্ঠু সমাধান আমরা দেখতে চাই। এ ব্যাপারে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আরো আলোচনা হওয়া দরকার। উভয় দেশের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টিতে ভূমিকা রাখার
আহবান পাইনি।’
এর অর্থ, কাশ্মীর ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অনুরোধ অপরিহার্য বলে মনে করে। আর তারা এও জানে যে, ভারত কখনও এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে তাদের ডাকবে না। কাশ্মীর সমস্যার শুরুতে জাতিসংঘে মার্কিন প্রতিনিধি সেখানে গণভোট অনুষ্ঠানের জাতিসংঘ প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করেন। তখন সোভিয়েত প্রতিনিধি এর বিরোধিতা করেন।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন : ‘এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার বহু বিরোধের মীমাংসায় যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করছে। কাশ্মীরী জনগণের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এর সূচনা হওয়া উচিৎ। গত তিন মাসে কাশ্মীরে ১০০-এর বেশী লোক নিহত হয়েছে। যার বেশীর ভাগই কিশোর ও যুবক।’’ [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ অকটোবর/২০১০]
কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের কাছের এক গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে এক সংঘর্ষে আরও তিনজন স্বাধীনতাকামীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ঐ স্থানের এক ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালানোর আগেই ভারতীয় সেনাদের সাথে স্বাধীনতাকামীদের সংঘর্ষ বাঁধে বলে বলা হচ্ছে। ৯ ঘণ্টা ধরে চলা বন্দুক যুদ্ধ শুরু হলেও এলাকার কয়েকশ’ অধিবাসী নিরাপত্তার জন্য গ্রাম ছেড়ে যান। সর্বশেষ এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, কোন রাজনৈতিক নিষ্পত্তি কাশ্মীরীরা মেনে নেবে না।
বিচার্য অনুসিদ্ধান্ত
কাশ্মীর উপ-মহাদেশের এক জ্বলন্ত সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান না করে কাশ্মীরকে এশিয়ার আর একটি রক্তাক্ত ফিলিস্তিন বানিয়ে রাখা হয়েছে। আরব-ফিলিস্তিনীদের পিতৃভূমি দখল করে খৃস্টীয় সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে ইহুদীরা শুধু একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করেনি। ইসরাইল তার সামরিক নিষ্ঠুরতা-অন্তর্ঘাত এবং সম্প্রসারণবাদী নীতির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে রাষ্ট্রহীন ফিলিস্তিনী জনপদগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, ব্যাপক ও নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ইরান-তুরস্ক-পাকিস্তানসহ ইসরাইলের সামরিক দস্যুতার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। ইসরাইলী নিরাপত্তা ডকট্রিন অনুযায়ী এশিয়া-আফ্রিকা কিংবা ইউরোপ যেখানেই হোক, তারা কোন রাজনৈতিক ও সামরিক হুমকিকে গুড়িয়ে দিতে কুণ্ঠিত নয়। ইসরাইল হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ছাউনী। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিশ্ব ব্যবস্থায় তার আধিপত্য রক্ষায় ইসরাইল হচ্ছে তার অপরিহার্য অংশীদার।
ইসরাইলের সাথে পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সামরিক প্রাযুক্তিক কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার নজীরবিহীন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতকে আরও বেপরোয়া, হিংস্র ও লক্ষ্যভেদী করে তুলেছে। কাশ্মীর সহ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের দমনে ভারতীয় সামরিক নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ইসরাইলের সামরিক ও মোসাদ-এর গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ইসরাইল যেমন বিশ্বে একটি স্ব-ঘোষিত ধর্মতাত্ত্বিক সিকিউরিটি স্টেট, তেমনি ভারত হচ্ছে আর একটি সিকিউরিটি স্টেট- যা দৃশ্যতঃ সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে পরিচয় দিলেও মূলতঃ ভারত হচ্ছে একটি অঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্র। ইসরাইল যেমন তথাকথিত পবিত্র ভূমি উদ্ধারের ‘মীথ’ তৈরি করে একটি বিশাল ভূ-খন্ড নিয়ে ইহুদী সাম্রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, ভারতও তেমনি ‘অখন্ড’ ভারত তথা ‘ভগবান রামচন্দ্রের’- হারানো স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়ে কাবুল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠার নীল নকশা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। ভারত তার চারদিকের সকল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সামরিক সক্ষমতা অর্জনের বিরোধী। অন্যদিকে এসব রাষ্ট্রের দুর্বলতা-অস্থিতিকে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এ কারণে ভারত সবগুলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চালকের আসন দখলসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বলয়ের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিকে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি প্যাকেজ পলিসি-র আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যা ভারতের আঞ্চলিক সম্প্রসারণবাদী নীতির পরিপূরক। এ অঞ্চলে একমাত্র পাকিস্তান এবং তার পরমাণু শক্তি ও সামরিক সামর্থ্যই ভারতের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাঁধা। জন্ম মুহূর্ত থেকে ভারত একদিনের জন্যও পাকিস্তানকে ইতিবাচকভাবে দেখেনি। পাকিস্তানের অভ্যুদয়-অস্তিত্বই ভারতের জন্য এক অসহ্য যন্ত্রণা। তাই পাকিস্তানকে ‘ইসলামীকরণের’ জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চক্রে পাকিস্তানকে একটি ইসলামী জঙ্গিবাদী ভঙ্গুর দেশ হিসেবে ‘সীল’ মেরে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র চলবে কিনা, নাকি সামরিক সরকারের আবির্ভাব ঘটিয়ে পেন্টাগনের যুদ্ধবাজদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অতীতের মতোই পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে কিনা, কতটুকু করবে, এ নিয়ে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কোরেশীকে এখনও দেন-দরবার করতে হচ্ছে!
ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলী অক্ষের দোসর হিসেবে ভারতের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। ভারতীয় সামরিক তাত্ত্বিক ও সিভিল থিংকট্যাংক পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকা না থাকা নিয়ে অবিরাম হতাশাজনক প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বহুমাত্রিক সংঘাতপ্রবণতা পাকিস্তানের শত্রুদের লক্ষ্য অর্জনের পথ সহজ করে দিচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে [FATA] একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও নাকি মার্কিন পরিকল্পনায় রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলসহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রোভোকেটিং বিমান হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার মার্কিন মিশনের সামরিক লক্ষ্য যদি পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন করা প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে থাকে, তবে তার পরিণতি এড়ানো পাকিস্তানের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে। ভারত ও ইসরাইলের স্বার্থ এবং তার নিজের ভূ-রাজনৈতিক ষ্ট্র্যাটেজিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখন্ডত্বকে অবজ্ঞা করার মার্কিন নীতি-অবস্থান পাকিস্তানের জন্য শাঁখের করাতের বিপদ ডেকে এনেছে। পাকিস্তানকে তার অভ্যুদয়ের পর থেকেই মার্কিন অক্ষ তার বাধ্যতামূলক মৈত্রীর নীতিতে গিনিপিগ ভিক্টিম করে রেখেছে। পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর মার্কিন তাঁবেদারী পাকিস্তানকে আমেরিকার কাছে সহজলভ্য ও অবজ্ঞার পাত্র বানিয়েছে। আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা-বৈরীতা অতিক্রম যে মনীষী বিজ্ঞানীর অক্লান্ত সাধনায় পাকিস্তানে পরমাণু অস্ত্র বানাতে সক্ষম হয়েছে, সেই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী ড. আবদুল কাদির খানকে জেনারেল মোশাররফ আমেরিকার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন তাঁকে পাকিস্তানে বন্দী জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা ও গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে। পাকিস্তান তার পারমাণবিক অর্জন ধরে রাখতে পারবে কিনা, সে প্রশ্নে পাকিস্তানী নাগরিকরা উদ্বিগ্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা যখন সফরে আসছেন, তখন ভারতের অতি নিকটতম প্রতিবশী এবং মার্কিনীদের দুর্দিনের ষ্ট্র্যাটেজিক পার্টনার পাকিস্তানকে তিনি পাশ কাটিয়ে যাবেন। ভারতের সাথে মার্কিন সম্পর্ককে পাকিস্তানের সমান্তরালে টেনে এনে ভারতকে অসন্তুষ্ট করতে চায় না ওবামার প্রশাসন। অর্থাৎ পাকিস্তান এখন মার্কিনীদের প্রায়োরিটি তালিকা থেকে ক্রমশঃ অপসৃয়মান এক অতীত। পাকিস্তান ইচ্ছা করলে তার নিজের প্রয়োজনে হোয়াইট হাউস পেন্টাগনের তোয়াজ করবে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কিয়ানীর সাথে সম্প্রতি মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ৩০ মিনিট আলোচনা হয়েছে ওয়াশিংটনে। এতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে মার্কিনরা তাদের অবস্থার পরিবর্তন করতে কতটা রাজী হয়েছে, তা অনিশ্চিত। পাকিস্তান না চাইলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন ‘ড্রোন’ বিমান হামলা চলবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস অন্ততঃ জেনারেল কিয়ানীকে ড্রোন বিমান হামলা বন্ধের নিশ্চয়তা দেননি। যদিও প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন : ‘‘পাক-মার্কিন সম্পর্ক হবে অংশীদারিত্বের।’’ কিন্তু এই আশ্বাস সত্ত্বেও এই অংশীদারিত্বে পাকিস্তানের সার্বভৌম হিস্যা কতটুকু থাকবে, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি।
এই সামগ্রিক অবস্থাকে সামনে রেখে বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিধারা মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে, ইন্ডিয়ান ডকট্টিন তার সফলতার প্রায় ষোলকলা পূর্ণ করতে চলেছে। বাংলাদেশ সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সেক্যুলার পরিচিতির পালক পরিধান করতে যাচ্ছে। উপ-মহাদেশ বিভক্তির প্রাক্কালে আজ থেকে ৬ দশক আগে কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহও ভারতীয় কংগ্রেস ও পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর সেক্যুলার পন্থার অনুসারী হয়ে নিজেও প্রতারিত হয়েছেন এবং কাশ্মীরীদেরও ভাগ্য বিপর্যয় ঘটিয়েছেন। শেখ আবদুল্লাহ খুব অল্প সময়েই ভারতের সেক্যুলারিজম ও বন্ধুত্বের স্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন। ভারত থেকে সরে আসতে গিয়ে নিজেই ভারতীয় ব্রাক্ষণ্যবাদী চক্রের আক্রোশের শিকার হয়ে দীর্ঘ দু’দশকেরও বেশী কারা জীবনের নিঃসঙ্গতা ভোগ করেছেন। কারামুক্ত হয়ে তিনি যখন বেরিয়েছেন, তখন তাঁর বয়স ৭৫ বছর, জীবন সায়াহ্নের প্রান্তে দাঁড়িয়ে কাশ্মীরের ব্যাঘ্র, শের-এ-কাশ্মীরের স্তিমিত গর্জনশক্তি উচ্চকিত হয়নি। এর পাশাপাশি ভারত বখশী গোলাম মোহাম্মদ, মীর কাসিমদের মতো অনেক দালাল তৈরি করে কাশ্মীরকে শৃংখলিত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। শেখ আবদুল্লাহ তাঁর রাজনৈতিক মিশনে একজন ব্যর্থ, প্রতারিত ও নিঃসঙ্গ খলনায়ক হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন। কাশ্মীরের জনগণ তাঁর সেক্যুলারিজমের সাথে সখ্যতার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে। ভারত সেক্যুলারিজমের উচ্চকণ্ঠ প্রবক্তা হয়েও কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সহ্য করতে পারছে না।
কাশ্মীরের ‘শেখ’ যেখানে ঠেকে শিখেছেন, আমাদের ‘শেখ’রা সেখানে দেখেও শিখতে চান না। কাশ্মীরের নির্যাতিত জনগণ যেখানে বিপুল রক্ত দিয়ে ভারতীয় সেক্যুলার রাষ্ট্র কাঠামোর বৃত্ত থেকে বের হবার নিরন্তর দুর্বার সাহসী সংগ্রামের ধারাকে বেগমান করেছে, আমরা সেখানে নতুন করে ভারতীয় সেক্যুলারিজমের গহবরে আত্মপরিচয় হারানোর আত্মঘাতী উন্মাদনায় মেতে উঠেছি।
দ্বি-পাক্ষিক চুক্তিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে ভারতের ‘বৃহৎ’ বন্ধুত্বের কাছে সমর্পিত করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় অবধারিত পরিণতি হচ্ছে, সিকিম অথবা কাশ্মীরের ভাগ্যবরণ করা। কাশ্মীরের এক কোটিরও বেশী জনগণ পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা উপস্থিতি, নির্যাতন, নিগ্রহ-গণহত্যা অগ্রাহ্য করে ভারতের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসার বিরোচিত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ১৬ কোটি মানুষের এ বাংলাদেশকে দিল্লীর আশ্রিত রাষ্ট্র বানানোর খেলায় আমরা এখনও নীরব দর্শকের ভূমিকায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারত যে যুক্তিতে সম্পৃক্ত হয়েছে, কাশ্মীরের মুক্তি সংগ্রামে অন্যান্য রাষ্ট্র একই যুক্তিতে সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত জাতি-গোষ্ঠীর পাশে অবস্থান নেবার অংগীকার রয়েছে। বাংলাদেশ তাহলে কী করবে?
কাশ্মীর নিয়ে আর একটি পাক-ভারত যুদ্ধ মানেই পরমাণু যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া। এতে বাংলাদেশেরও অস্তিত্বের ঝুঁকিও রয়েছে। ভারতের সাথে বন্ধুত্ব সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে তাকিদ দিতে হবে। একদা বৃটিশ-ওলন্দাজ-পর্তুগীজ-ফরাসী ঔপনিবেশের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পুনরায় পশ্চিমা রাজনৈতিক শক্তির সামরিক অর্থনৈতিক গোলামে পরিণত হতে যাচ্ছে।
রাজনীতিকরা জনগণের সমর্থন পেয়েও ভারতের রাষ্ট্রীয় বলয় পরিহার করার শক্তিও হারাতে বসেছেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব লালন ও সংরক্ষণে তাদের মানসিক শক্তি ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ক্ষয়িষ্ণু। ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর-মিন্দানাওয়ের লড়াকু মুসলিমদের ভাগ্য বরণের আগেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। কাশ্মীর হতে পারে আমাদের জন্য এক জ্বলন্ত শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা। তবে জনগণই হচ্ছে আশাবাদের মূল ভরসা। মুসলিম জনতার রাজনৈতিক অভিপ্রায়ই এ উপ-মহাদেশে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসত্তার মাঝে মুসলিমদের গৌরবময় অতীত ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লালন করা সম্ভব। ভারতভুক্ত ২০ কোটি মুসলমানের স্বপ্ন ও সার্বভৌম চেতনা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। স্বাধীন ভারতে মুসলিমরা পরাধীন। তারা কতিপয় সংখ্যাতাত্ত্বিক বিড়ম্বনা কিংবা রাজনৈতিক শক্তির গিনিপিগ। ভারতে শত শত রক্তাক্ত গুজরাট-আহমেদাবাদ-
অযোধ্যায় বধ্যভূমিতে মুসলিমরা বলির পাঠা। মুসলিমদের টিকে থাকতে হলে আত্মসমীক্ষা ও আত্মানুসন্ধান দরকার।
১৯৪৭-এর রাজনৈতিক অর্জনটুকু না আসলে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মুসলিমদের অবস্থা ভারতীয় মুসলিমদের চেয়েও শোচনীয় হতো। জিন্নাহ সাহেব মুসলিমদের অতীত স্বপ্ন লালন ও ভবিষ্যতের স্বপ্নকে পরিপূর্ণ করার একটি ভূ-খন্ড দিয়ে গিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার অপবাদে, আত্মবিশ্বাস ও শিকড় বিরোধী বিচ্যুতির ঘূর্নাবর্তে পড়ে সেই অর্জন আমরা হারাতে পারি না। এত ব্যর্থতা ও হতাশার মধ্যে কাশ্মীরের আজাদী পাগল মানুষ আমাদের দিশারী। এক অসম দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে কাশ্মীরী জনগণের মহাসংগ্রাম একদিন সফল হবেই। আমরা সেই সুদিনের প্রত্যাশায় রইলাম। সৌখিন রাজনীতিক, পথ ভোলা, আয়েশী ধর্মতাত্ত্বিক কিংবা মগজ বিক্রি করা সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্রেট অথবা ভাড়াটে সুশীলদের বন্দীশালা থেকে সাধারণ মানুষকে বের হয়ে আসার পথ দেখাতে হবে। পঞ্চাশের দশকে যেমন তৃণমূল জনগণের জাগরণে উপমহাদেশের নতুন ভূগোল ও ইতিহাস তৈরি হয়েছিল, সেই জনগণের কাছেই আবার ফিরে যেতে হবে। তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই কেবল এ অঞ্চলের মুসলিমদের আত্মবিলোপ ও বিপর্যয় ঠেকাতে পারে। ভারত হয়তো সাময়িকভাবে তার আধিপত্যবাদের বিজয় অত্যাসন্ন দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের মনের দরজায় তালা দিয়ে তাদের আজাদী হরণ করে ভারত যদি আর একটি মোঘল সাম্রাজ্য বা বৃটিশ মহারাণী ভিক্টোরিয়ার স্বপ্ন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, তবে তা বুমেরাং হবে। ভারতের ভেতরের গণসংগ্রামের সাথে বাইরের গণমানুষের বিদ্রোহের স্রোতধারা মিলিত হয়ে যে অগ্নিগিরি প্রচন্ড গতিবেগ ধারণ করবে, তা সামাল দেবার শক্তি ভারতের নেই। ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক শক্তি ধ্বংসের বিভীষিকা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোন বিজয় পায়নি। ইরাক আছে, ইরাকে নতুন প্রজন্মই ইরাককে নেতৃত্ব দেবে। ফিলিস্তিনীরাও মৃত্যুর রক্তাক্ত উপত্যকা সাঁতরে জীবনের ঠিকানা খুঁজে নেবে।
সর্বহারাদের জীবন দেওয়া ছাড়া প্রতিরোধের আর কোন শাণিত অস্ত্র নেই। ইরাক আফগানিস্তানে লাখো লাখো সাধারণ মানুষ কিংবা প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের রক্তের বন্যায় সাঁতার কেটে ক্লান্ত অবসন্ন ক্রুসেডীয় দানবরা ক্লান্ত, অবসন্ন। তারা স্বদেশে ফিরে যেতে চায়। ইরাক-আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা পালন করেছে, ভারত কাশ্মীরসহ এ অঞ্চল জুড়ে যদি মৃত্যু ও ধ্বংসের সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে চায়, তাতে কেউ বাধা দেবার নেই। গণচীন ভারতের সামরিক অভিলাষ প্রতিরোধে কতটা ঝুঁকি নেবে, তা পরিষ্কার নয়। কাবুল থেকে কাশ্মীর-দিল্লী-বাংলাদেশ পর্যন্ত নব্য সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা উদ্যত। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলিম নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকেই প্রতিরোধের প্রস্ত্ততি নিতে হবে। জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের রক্তক্ষয়ী আজাদী সংগ্রাম এই বার্তাই দিচ্ছে। কাশ্মীর দূরের জনপদ হলেও কাশ্মীরী মুসলিমরা আমাদের আত্মার আত্মীয়, সংগ্রামের সহযোদ্ধা এবং আজকের প্রেক্ষিতে তারা মুক্তিকামী সকল মানুষের প্রেরণা। উপমহাদেশের মুসলিমরা আজাদী পেয়েও তারা আজ হারাতে বসেছে। আর কাশ্মীরিরা আজাদী পুনরুদ্ধারের অন্তহীন সংগ্রামে লিপ্ত। দুটি ধারার প্রায় সহাবস্থান নতুন করে ইন্ডিয়ান ডকট্রিনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ঐক্য এবং চেতনার সমসূত্রকে গ্রন্থিত করেছে। এখানে নয়া ইতিহাস গড়ার সম্ভাবনা।
তথ্যসূত্র :
১. Kashmir : In The Crossfire, Victoria Schofield, 1.B. Tairis Publishers, London, New york, 1996.
২. Pakistan : At The Crosscurent of History, Lawrence Ziring, Vangaurd, Lahore, karachi, Islamabad.
৩. The Trauma of Kashmir, The Untold Reality, Omkar Razdan, Oxford University Press, New York, Printed in Pakistan. New Sketch Graphics, Karachi, Published by Ameena Saiyid, Oxford University Press, Karachi, Pakistan.
৪. The Myth OF INDEPENDENCE, Zulfikar Ali Bhutto, Oxford University Press, Lahore, Karachi,
Dacca, 1949.
৫. Frenids Not Masters, Muhammad Ayub Khan, University Press Ltd, Dhaka, Bangladesh.
৬. অশান্ত কাশ্মীর, এস এম নজরুল ইসলাম, সম্পাদক, মাসিক- ইতিহাস, অন্বেষা।
৭. Front Line (India), K A K AND SHEIKH, A.G. Noorani, September, 10, 2010.
৮. Front Line, Jammu and Kashmir, First steps, A.G Noorani, September, 24, 2010.
৯. Holiday, Dhaka, September, 10, 2010.
১০. The New AGE, Dhaka, Dispute heats up again in Kashmir valley, Zeenat Khan, October, 19, 2010.
১১. দৈনিক গণশক্তি, কলকাতা, ৩০ অগাস্ট, ২০১০।
১২. ‘দেশ’ - কলকাতা, ২ অকটোবর, ২০১০।


প্রবন্ধটি ২৭শে নভেম্বর, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত হয়।