এক.

শুধু বাংলাদেশেই নয়, কিছু সাম্প্রদায়িক ও উদ্দেশ্যমূলক ইতিহাসকার ব্যতিত সকল সৎ, যোগ্য এবং প্রজ্ঞাবান ঐতিহাসিক একবাক্যে বলেছেন যে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল ষড়যন্ত্র আর বিদ্বেষের জাল জগৎশেঠের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়েছিল। রবার্ট ক্লাইভ স্বয়ং লিখেছেন, ‘‘কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি চক্রান্তের পেছনে থাকলেও আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল জগৎশেঠ নিজে।’’ (শিকদার, ২০০৬: ৪০)। মঁশিয়ে জা ল প্রমুখ সমকালীন-নিরপেক্ষ ইতিহাসকার লিখেছেন, অনেক দিন ধরে বাংলায় যে সব রাজনৈতিক বিপ্লব হয়েছে তার প্রধান হোতা ছিল জগৎশেঠ। ... ইংরেজরা যা করছে (পলাশীর কথিত যুদ্ধবিজয় এবং বাংলা-ভারতে উপনিবেশ স্থাপন) তা জগৎশেঠের সমর্থন ছাড়া কখনো করতে পারত না।’’ (প্রাগুক্ত)।
কে বা কারা এই জগৎশেঠ, সেটা জানা দরকার। শেঠরা বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশের লোক নয়। তারা উত্তর ভারতের যোধপুরের নাগোর এলাকার মানুষ। জৈন ধর্মের অনুসারী, হীরানন্দ তাদের পূর্ব পুরুষ। প্রথমে তারা ভাগ্যান্বেষণে বিহারের পাটনায় আসে। হীরানন্দের পুত্র মানিক চাঁদ ঢাকায় তার গদি স্থাপন করে। এ পর্যায়ে তৎকালীন শাসক মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়। মুর্শিদকুলী খানের অনুগমন করে তারা নতুন শহর মুর্শিদাবাদে এসে জেঁকে বসে। বাদশাহ ফররুখ শিয়ারের কাছ থেকে তারা শেঠ উপাধি লাভ করে মুর্শিদকুলী খানেরই বদৌলতে। ইতিমধ্যে সারা ভারতের প্রধান প্রধান নগরীতে শেঠদের গদি স্থাপিত হয় এবং চলতে থাকে অর্থলগ্নী ও সুদের ব্যবসা। বলা বাহুল্য, সে যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রচলিত না থাকায় জগৎশেঠরা অলিখিত ব্যাংকার হিসাবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কর্তৃত্ব চালাতে সচেষ্ট হয়। ১৭২২ সালে মানিকচাঁদের মৃত্যু হলে ভাগিনা ফতেচাঁদ প্রথম ‘জগৎশেঠ’ উপাধি প্রাপ্ত হয় এবং তার মৃত্যু হলে তদীয় পৌত্র মাহতাব চাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পায়। অপর শেঠ স্বরূপচাঁদ লাভ করে মহারাজ খেতাব। শেঠদের গদিতে তৎকালীন সময়ের বাজার মূল্যে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হত। এহেন জগৎশেঠরা পলাশী বিপর্যয়ের নেপথ্য কারিগর-ষড়যন্ত্রের হোতা।
মূলত নবাব সুজাউদ্দিনের সময় থেকেই এরা নানা অপকর্মে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। পরবর্তীতে নবাব আলীবর্দী তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখেন বটে, কিন্তু শেঠরা ঘাপটি মেরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চলাতে থাকে এবং রাষ্ট্রের সংহতির শিকড় কাটতে থাকে। শেঠরা নবাব পরিবারের মধ্যে অর্থ, ঘুষ ও কুমন্ত্রণা দিয়ে নানা উপদল তৈরি করে এবং একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। যে বিভক্তির কারণে তারা ইংরেজদেরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে তরুণ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে এরা প্রথম থেকেই ছিল খাপ্পা। যে কারণে তারা সিরাজের জন্য দিল্লি থেকে সনদ আনানোর ব্যাপারে চরম উদাসীনতা ও গড়িমসি প্রদর্শন করে। এরা প্রথমে শওকতজঙ্গ, পরে ইয়ার লতিফ ও সর্বশেষ মীর জাফরকে বাংলার নবাব বানানোর প্রজেক্ট গ্রহণ করে। কারণ নবাব সিরাজ ছিলেন লুটেরা-শোষক শেঠদের সীমাহীন নির্যাতন, কায়েমী স্বার্থ ও নীচুতার প্রতিবন্ধক। ফলে তারা নবাব পদে সিরাজকে সহ্য করতে পারেনি এবং নিজেদের বশংবদ একজনকে নবাব বানাতে বদ্ধ পরিকর হয়। এরাই পুরো ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে এবং ইংরেজ ও প্রাসাদের ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দূতিয়ালী ও সমন্বয়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ ও স্থানীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সম্পাদিত হয় বাংলার স্বাধীনতা-বিনাশী গোপন চুক্তি। আর এভাবেই পদদলিত হয় বাংলার স্বাধীনতা। (উইকিপিডিয়া)

দুই.
১৭৫৭ সালের ষড়যন্ত্রমূলক পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজদ্দৌলাহর পতন, বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়া এবং ইংরেজ উপনিবেশিক অপশক্তি কর্তৃক আমাদের দীর্ঘমেয়াদী আক্রান্ত ও পরাধীন হওয়া সর্ম্পকে প্রধানত তিনটি গ্রন্থের সূত্রে ইতিহাস চর্চিত হয়। গ্রন্থত্রয় প্রচন্ডভাবে সিরাজ-বিদ্বেষ পোষণ করে তৎকালীন চিত্র জানিয়েছে। ফলে ইতিহাসের বিকৃতি ও পক্ষপাত গোড়া থেকেই পুরো পরিস্থিতিকে আচ্ছন্ন করেছে। এ কারণে, মূল ঐতিহাসিক সত্যের কাছে পেঁŠছার পূর্বে গ্রন্থ তিনটি সম্পর্কে আলোকপাত করা সঙ্গত হবে।
গ্রন্থত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে নবীন হলো অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখিত নাটক সিরাজউদ্দৌলা’ যা সাহিত্যের অংশ, ইতিহাসের বিষয় নয়। সাহিত্যের সত্য বা বাস্তবতা আর ইতিহাসের সত্য বা বাস্তবতা একই বিষয় নয়। ফলে বঙ্কিম বা সুনীল উপন্যাস বা নাটকের নামে বহু ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বিষয় চর্চা করেছেন, যেগুলো ঐতিহাসিক সত্য নয়। লেখকের কল্পনা, ধর্ম-বর্ণ অঞ্চলগত মনোভাবের প্রকাশ, ক্ষেত্র বিশেষে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। অক্ষয় বাবুর নাটকটি ইংরেজ আমলে লিখিত এবং ইতিহাস হিসাবে গবেষণাপ্রসূত বিবরণ নয়। ফলে এতে লেখকের নিজস্ব বিলাস, কল্পনা, বিশ্লেষণ বহুলাংশেই ঐতিহাসিক সত্যের পরোয়া না করেই লিখিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, শহরে-গ্রামে এ নাটক বহুলভাবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং ঐতিহাসিক সত্যের উপরে আসন লাভ করেছে।
অন্য দুটি গ্রন্থের রচয়িতাগণ প্রায় সমসাময়িক এবং সেগুলো লিখিতও হয়েছে ঘটনার পর পরেই। একটির নাম ‘‘রিয়াজ-উস-সালাতিন’’, লেখক গোলাম হুসেন সলীম। অপরটি ‘‘সিয়ার-ই- মুতাখখিরিন’’, লেখক সাইয়েদ গোলাম হোসেন। রিয়াজ-রচয়িতা গোলাম হুসেন মুতাখখিরিন-রচয়িতা গোলাম হোসেন অপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও উভয়েই প্রায় এক সময়েই আপনাপন ইতিহাস সমাপ্ত করেন। রিয়াজ-রচয়িতা গোলাম হুসেন দরিদ্র গৃহস্থ। মুতাখখিরিন-রচয়িতা গোলাম হোসেন নবাব আলীবর্দীর আত্মীয় এবং সম্ভান্ত ওমরাহের মধ্যে পরিগণিত।
আত্ম পরিচয় দান কালে রিয়াজ-রচয়িতা স্বয়ং লিখেন (সলীম ২০০৫ : ১৯),
‘‘আমরা দীনদাস, মোহাম্মদের মধ্যস্থতার প্রার্থী, নাম গোলাম হুসেন, উপাধি সলীম ফকির, জৈদপুর, আমরা উচ্চপদাভিষিক্ত সম্মানভাজন সচ্চরিত্র, দয়ালু, ধীর স্বভাব, মহত্ত্ব ও ব্যবহারে প্রশংসনীয়, হাতেমের ন্যায় দানশীল, নওশেরওঁয়ার ন্যায় সদ্বিচারক এবং লোকপ্রিয়তা ও প্রশংসা সম্বন্ধে উদাসীন মিস্টার জর্জ উডনি মহোদয়ের নিকট কিছুকাল যাবৎ কর্মে নিযুক্ত হয়েছি।’’
ইতিহাস-লেখকের এইরূপ বর্ণনা পাঠ করে গোলাম হুসেনকে অতিবাদপরায়ণ চাটুকার বলে অনেকেই অবজ্ঞা করেন। মিস্টার জর্জ উডনি কেবল অন্নবস্ত্রদানের জন্যই হুসেনের নিকট হতে এতদূর প্রশংসা লাভ করেননি। সিরাজউদ্দৌলা নাটকের রচয়িতা অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় জানাচ্ছেন যে, ‘‘উডনির ইতিহাসনুরাগ প্রবল ছিল, এবং তাহার উত্তেজনাক্রমেই রিয়াজ-উস-সালাতিন রচিত হইয়াছিল।’’ (মৈত্রেয় ১৮৯৮)।
পলাশী যুদ্ধের ২৭ বছর পর উডনি সাহের ১৭৮৪ সালে নীলকুঠি অধ্যক্ষ হয়ে মুর্শিদাবাদ সংলগ্ন মালদহ আগমন করেন। তখন তার বয়স ২৪ এবং ক্ষমতা ও তেজ বিপুল। গোলাম হুসেন জানাচ্ছেন: ‘‘সহৃদয় মিস্টার জর্জ উডনি পুরাতত্ত্ব ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত বিষয়ক গ্রন্থ সর্বদা পাঠ করতেন এবং সর্বপ্রকার জ্ঞান ও শিক্ষালাভে উৎসাহী ছিলেন। হিজরি ১২০০ সালে (ইংরেজি ১৭৮৬) তিনি বঙ্গদেশের স্বাধীন নরপতি ও শাসক কর্তৃপক্ষের জীবন বৃত্তান্ত ও কার্যক্রম জানার জন্য উৎসুক হন। এজন্য তিনি প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ হতে তথ্য সংকলন করে জনসাধারণের বোধগম্য পারস্য ভাষায় বিবৃত করতে আদেশ দেন। আমরা বিদ্যাবুদ্ধিহীন, তথাপি প্রভুর নিয়োগ পালন করা কর্তব্য বলে এমন দুঃসাধ্য কার্য সম্পন্ন করতে স্বীকার করি। আমরা গ্রন্থ সংকলনে প্রবৃত্ত হয়ে নানা স্থান হতে বহু গ্রন্থ সংগ্রহ করে দুই বৎসরকাল এ কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। হিজরি ১২০২ মোতাবেক ইংরেজি ১৭৮৮ (পলাশীর ৩১ বছর পর) সালে গ্রন্থ সমাপ্ত করে উহা রিয়াজ-উস-সালাতিন নামে অভিহিত করি।’’ (সালীম ২০০৫:২০)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গোলাম হুসেন মিস্টার জর্জ উডনির অধীনে কি কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, কোন স্থানে তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। তদুপরি তিনি অযোধ্যা এদেশের লোক এবং নিজেকে কখনো বাঙালি মনে করতেন না। রিয়াজ উস সালাতিনে দেখতে পাওয়া যায়, গোলাম হুসেন মিস্টার জর্জ উডনি মহোদয়ের নিকট কালক্রমে কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর মাত্র দুই বছরের মধ্যেই কোন পূর্ব-প্রস্ত্ততি, পূর্ব-অভিজ্ঞতা ব্যতিরেকে এবং বহিরাগত ভিন্ন অঞ্চল-সমাজ-ভাষার লোক হয়েও পলাশী কেন্দ্রিক একটি জটিল ইতিহাস গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করা অস্বাভাবিক বিষয়।
এরূপ বহু অস্বাভাবিক বিষয়ই বাংলার ইতিহাস, বিশেষত পলাশী ও সিরাজদ্দৌলাকে আবর্তিত করে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা মূলত সিরাজ-পরবর্তী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সিরাজকে কালিমালিপ্ত করার ইতিহাস বিকৃতি মাত্র। এহেন গ্রন্থ হতেই পরবর্তী ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ড সাহেব ইতিহাস সংকলন প্রণালীর আভাস প্রাপ্ত হন। ঐতিহাসিক বেভারিজ এবং ব্লকম্যান রিয়াজ উস সালাতিনের যথাযোগ্য প্রশংসা করতে ত্রুটি করেননি। রিয়াজের ভূমিকাংশ থেকে তাদের প্রশংসা বাণী উদ্ধৃত করা হলে তা অনুধাবন করা সম্ভব হবে:
মিস্টার বেভারিজ লিখেন: The publication by our society of the Riyaz-us-Salatin is a valuable contribution to the history of Bengal.
ব্লকম্যান তার Geography and History of Bengal গ্রন্থে লিখেন: The latest writer of Bengal History is Ghulam Hussain of Zaidpur poetically styled Salim, who compsoed his Riyaz us Salatin, the Garden of Kings at the request of Mr. George Udny of Maldha. This work, the title of which contains in the numerical value of the letter the date of its completion (A.B. 1202 or A.D 1787-88) is rare, but is much prized as being the fullest account in Perisian of the Mohamedan History of Bengal, which the author brings down to his own time.
অতএব, বাংলার ক্ষেত্রে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা ১৭৫৭ সালের পলাশীর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র মতো লেখকও অন্যভাবে যে সত্যটি স্বীকার করেছেন (মৈত্রেয়):
‘বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। যাহা কিছু বাঙ্গালার ইতিহাস নামে পরিচিত, তাহার অধিকাংশই বাঙ্গালীর লেখনী প্রসূত নহে। যাহা বা বাঙ্গালীর লেখনী প্রসূত তাহাও বিদেশীয় লেখকবর্গের চবির্বতচবর্বণ মাত্র।’
ইতিহাস বিকৃতির ধারাবাহিকতায় কবি নবীনচন্দ্র সেন পলাশীর যুদ্ধ কাব্যে ইংরেজের জয়গান এতই কুরুচিপূর্ণভাবে গেয়েছেন যে, প্রসঙ্গটির উল্লেখপূর্বক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেন:
‘সেকালে ইংরেজ ও বাঙ্গালী মিলিত হইয়া সিরাজের নামে কত অলীক কলংক রটনা করিয়া গিয়াছেন তাহা ইতিহাসের নিকট অপরিচিত নহে। অবসর পাইলে একালের প্রতিভাশালী সাহিত্যসেবকগণ এখনো কত নূতন নূতন রচনা কৌশলের পরিচয় প্রদান করিতে পারেন, পলাশীর যুদ্ধ উহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। যাহা সেকালের লোকেও জানিত না, যাহা সিরাজউদ্দৌলার শত্রুদলও কল্পনা করিতে সাহস পাইত না- এ কালের লোকে তাহারও অভাব পূরণ করিতে ইতস্তত করিতেছে না।’

তিন.
নবাব আলীবর্দী খান মহবত জং যখন মারা যান তখন জয়েন উদ-দীন আহমদ খানের পুত্র, আলীবর্দীর দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নিজামতের মসনদে বসেন। আলীবর্দী জীবিতকালেই সিরাজকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন এবং সিরাজকে নিজামতের মসনদে বসিয়ে আলীবর্দী নিজে এবং দরবারের অন্য আমিরগণ আনুগত্য দেখিয়েছিলেন ও উপহার দিয়েছিলেন। রিয়াজে লিখা হয়েছে (সালীম ২০০৮ : ১৮৫) : সিরাজ ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিকতা দেখাতেন। এ অভিযোগের ব্যাপারে সমকালীন অন্যান্য ঐতিহাসিক (যারা সিরাজ পরবর্তী ইংরেজ শাসকদের অনুগ্রহভাজন ছিলেন) একই মত পোষণ করেছেন। যেমন, ‘ইব্রাত-ই-আরবাব-ই-বসর গ্রন্থে সিরাজকে লঘুচিত্ত, একগুঁয়ে, বদ-মেজাজী, অধীর ও বদ-জবান এবং কাউকে রেহাই দিয়ে কথা বলতেন না’ বলা হয়েছে।
সিয়ার উল মুতাখখিরিন এ (২য় খন্ড, ৬২০ পৃ.) বলা হয়েছে : ‘‘সিরাজ কর্কশ ও অভদ্র কথাবার্তা এবং সরকারি কর্মচারিদের ঠাট্টা ও উপহাস করায় সকলের মনে ক্ষোভ ছিল।’’
কেবল এগুলোই যদি সিরাজের অপরাধ হয় এবং তাঁর পাপের তালিকা যদি এতেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে এত লঘু পাপে বাংলার সিংহাসন বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া, এত বড় দন্ড দেওয়া হল কেন, এমন জিজ্ঞাসার উদ্বেগ হওয়া সমীচীন। আসলে সিরাজ উত্তরাধিকার সূত্রে ষড়যন্ত্র ও দুর্ভাগ্যের ভাগীদার ছিলেন। সে সময় আলীবর্দীর অপর কন্যা নওয়াজেশ আহমদ খান সাহামত জং এর বিধবা ঘসেটি বেগম কতগুলো কারণে সিরাজের বিরোধিতা করেন। জগৎশেঠ ঘসেটি বেগমের নিকট গিয়ে তাকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেন।
ক্ষমতা আরোহণের পর সিরাজ অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও সামগ্রিক পরিস্থিতি অাঁচ করে নিজের সুবিধা অনুযায়ী কিছু প্রশাসনিক ও সামরিক পরিবর্তন করেন। কিন্তু মহবত জং-এর ভগ্নিপতি ও সামরিক বাহিনীর প্রধান মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান তা মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এমনকি, তিনি নবাব সিরাজকে পর্যন্ত সম্মান প্রদর্শনে বিরত থাকেন। (সালীম ২০০৮ : ১৮৬)। এ প্রসঙ্গে সিয়ার-ই-মুতাখখিরিনে লিখা হয়েছে যে: মীর জাফরের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় তিনি মরহুম মহবত জং এর অন্যান্য কর্মচারিদের সঙ্গে নিয়ে সিরাজের পতনের এবং নিজে মসনদ দখল করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন। (২য় খন্ড, ৬২১ পৃ:)। ইব্রাত-ই-আরবার-ই-বসর-এর ২৬ পৃষ্ঠায় লিখা রয়েছে যে, সিরাজের অধীনতা ছিন্ন করার জন্য দরবারের পুরাতন আমিরগণ ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন।’’
যদিও রিয়াজে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তথাপি সিয়ার এবং ইব্রাত এ উল্লেখিত হয়েছে যে, সিরাজ ক্ষমতা গ্রহণের পর সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্নোক্ত কার্যগুলোর দ্বারা রাজত্ব আরম্ভ করেছিলেন:
১. ঘসেটি বেগমকে দমন এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ;
২. মীর জাফরের অবাধ্যতার কারণে বিশ্বস্ত মোহনলালকে প্রধান উজির পদে নিয়োগ;
৩. ষড়যন্ত্রকারী রাজবল্লভকে বন্দিকরণ;
৪. ইংরেজদের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের ঘাটি কলকাতা জয়; এবং
৫. পূর্ণিয়া জয়।
নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, উপরোক্ত কাজগুলো অন্যায় হয়নি, সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে অবিবেচনাপ্রসূত হয়নি। কারণ, আলীবর্দীর দেওয়ান সাহামত জং-এর নিকট আমানত রাজকীয় সম্পদ ঘসেটি বেগম কর্তৃক দখল করার ও নিয়ে যাওয়ার কোনই অধিকার ছিল না। সিরাজ আইনসঙ্গতভাবে আলীবর্দীর উত্তরাধিকার হওয়ায় উক্ত সম্পদ পুনরাধিকার করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ছিল। দ্বিতীয়ত: মীরজাফরকে কোণঠাসা করারও প্রয়োজন ছিল। কেননা, আলীবর্দীর জীবিকতকালেও মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় মীর জার অকৃতজ্ঞ ও বিশ্বাসঘাতকরূপে প্রমাণিত হয়েছিল। সুতরাং সিরাজের পক্ষে তাকে সন্দেহ করা ও তাকে সৈন্যবাহিনীর ও প্রশাসনিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখাও অযৌক্তিক হয়নি। তৃতীয়ত: রাজবল্লভকে প্রহরাধীন রাখা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একান্ত প্রয়োজন ছিল। কেননা, সাহামত জং এর (ঢাকার প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর) জাহাঙ্গীরনগরের (বা ঢাকার) এই ধূর্ত ডেপুটি দেওয়ান বা পেশকার যথাযথভাবে হিসাব নিকাশ পেশ করতে পারেনি এবং এই ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে। চতুর্থ: বিশিষ্ট আমাত্য কৃষ্ণদাশ সমস্ত অর্থ ও সম্পদসহ কলকাতা পালিয়ে যায়। সুতরাং সরকারি অর্থ সম্পদ উদ্ধার ও বিদ্রোহী কৃষ্ণদাশ ও তার আশ্রয়দাতা ইংরেজদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ¬¬সরাজকে কলকাতা আক্রমণ করতে হয়েছিল। পঞ্চমত:, পূর্ণিয়া বিজয়েরও বিশেষ রাজনৈকি প্রয়োজন ছিল। কারণ, মীর জাফরের প্ররোচনায় পূর্ণিয়া হতে শওকত জং বাংলার গদি দাবি করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মীর জাফর বিপ্লব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করে এবং এহেন উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য বাংলার নবাব হওয়ার আশা দিয়ে বিদ্রোহে নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য শওকত জংকে পত্র পাঠায়। উক্ত পত্র পাওয়ার পর শওকত জং বিহারের পূর্ণিয়ায় যে ষড়যন্ত্র শুরু করে, তা নির্মূল করা সিরাজের জন্য অপরিহার্য ছিল। শওকত জং-এর সঙ্গে যুদ্ধের কারণ সিরাজ নন, সিরাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লব সৃষ্টির ষড়যন্ত্রই এর অন্তর্নিহিত কারণ। ফলে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ ব্যতিত সিরাজের সামনে অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না।

চার.
বিদ্রোহী শওকত জং এবং ষড়যন্ত্রের ইন্ধনদাতা ইংরেজদের পতন সাধন করে কলকাতা বিজয় শেষে সিরাজ যখন রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন, তখন চক্রান্তের নতুন ছকের খেলা শুরু হয়। পতিত ও পরাজিত শওকত জং-এর অস্তিত্বহীন অবস্থায় সিরাজ নিধনে ইংরেজদেরকে একমাত্র শক্তিধররূপে দৃশ্যপট পাওয়া যায়। জগৎশেঠ মীর জাফরকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, ইংরেজদের সাহায্য ছাড়া সিরাজকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। অতএব জগৎশেঠের দুতিয়ালীতে মীর জাফর ও ইংরেজদের মধ্যে নৈকট্য বৃদ্ধি পায় এবং ষড়যন্ত্রের গভীর জাল বিস্তৃতি লাভ করে।
উল্লেখ্য, সিরাজ কর্তৃক কলকাতা হতে ইংরেজগণ ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর অধিকাংশই নদীপথে পালিয়ে যায়। কলকাতার ইংরেজ কুঠির প্রধান ড্রেক অন্য কয়েকজন ইংরেজসহ দক্ষিণ দিকে মাদ্রাজে পলায়ন করে। তখন ক্লাইভ দক্ষিণ অঞ্চলের শাসক নাজিম সালামত জং-এর পক্ষে ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করে ফিরছিল। ড্রেক ও কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা অন্য ইংরেজগণ মাদ্রাজের কুঠির ইংরেজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরামর্শপূর্বক সাব্যস্ত করে যে, ক্লাইভ বাংলা থেকে পলায়িত ইংরেজদের সঙ্গে কলকাতা যাবে। বাংলার আমিরদের মধ্যে অসন্তুষ্টির সংবাদ পেয়ে ক্লাইভ নবাব সিরাজের কলকাতাস্থ গভর্নর মানিকচাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাকে পরাজিত ও পলায়নে বাধ্য করে কলকাতা পুনর্দখল করে। ইংরেজরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত স্বজাতির সৈন্যদের একত্রিত করে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় ও শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করে। বাংলার শাসকদের মধ্য থেকে উস্কানি এবং গোপনে সাহায্য পাওয়ার আশ্বাসে ইংরেজগণ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে আরো যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে থাকে। এক্ষেত্রে জগৎশেঠের মাধ্যমে মীর জাফর ও ইংরেজের মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হওয়ায় ইংরেজরা বাংলার রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের সাহস, সুযোগ ও পথ পায়।
ইংরেজ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজ সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালান। কলকাতা পতনের সংবাদ পেয়ে নবাব রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সসৈন্যে কলকাতার উপকণ্ঠে কারহাটির বাগানে শিবির স্থাপন করেন। ইংরেজরা বিপুল বিক্রমে শক্তিশালী কামান, গোলা ইত্যাদির সাহায্যে নৈশ আক্রমণ করে। এক্ষণে নবাব প্রতিপক্ষ ইংরেজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধি এবং নিজের বাহিনীর বিশৃঙ্খলা টের পান। নিজের অবস্থা সুসংহতকরণার্থে উদ্বিগ্ন নবাব আপাতত যুদ্ধ না করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। মুর্শিদাবাদে নবাব অদ্ভূত অবস্থা দেখতে পান- জগৎশেঠ ছিলেন অত্যন্ত তৎপর আর অন্যান্যরা নিরুদ্বিগ্ন যেন দেশে কোন বিদেশি আক্রমণই করেনি। রিয়াজে উল্লেখিত বিবরণে জানা যায় (সালীম ২০০৮:১৮৮-৮৯): সিরাজ কতিপয় আমির ও সেনাপতিকে অসন্তুষ্ট দেখেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রধান ছিলেন মীর মুহম্মদ জাফর খান বাহাদুর। তিনি পূর্বে প্রধান সেনাপতি ছিলেন। কিন্তু নানা অযোগ্যতার জন্য তার পরিবর্তে খাজা হাদী আলী খানকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রধান সেনাপতি খাজা নিজেও বাড়িতে দুয়ার বন্ধ করে বসে ছিলেন। মীর জাফরের প্রাসাদের সামনে বড় বড় কামান সাজিয়ে সিরাজ তার অট্টালিকা ভূমিস্মাৎ করার উদ্যোগ নেন এবং তাকে নগর ত্যাগ করতে আদেশ দেন।
এই পর্যায়ে এসে নবাব সিরাজ কালবিলম্ব করেন এবং গুপ্ত শত্রুদের ফাঁদে ধরা দেন। দেশ যখন শত্রু পরিবেষ্টিত এবং শত্রু আক্রমণের মুখে তখন ভেতরে শত্রুদের দমনে সিরাজ কিছুটা ব্যতিব্যস্ত ও বিভ্রান্তও হন বটে। মীর জাফর মূল ষড়যন্ত্রকারী জগৎশেঠের ইঙ্গিতে দৃশ্যত নবাবের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং নানা রকমের কৈফিয়ত দিয়ে ক্ষমা চান ও নবাবের পক্ষে লড়াই করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। সিরাজ সরলভাবে পুরো বিষয়টিকে দেখে আশ্বস্ত হন এবং মীর জাফরকে নিষ্কৃতি দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযাত্রী হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
এই সুযোগে জগৎশেঠ পারস্পরিক প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি দ্বারা চূড়ান্তভাবে ষড়যন্ত্র নকশা অনুমোদন করিয়ে নেয় এবং আরো সেনাপতিদের দলভুক্ত কিংবা হীনবল করতে চেষ্টা চালায়। ইব্রাত-ই-আরবার-ই-বসর গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ২৬) উল্লেখিত হয়েছে যে, এই ষড়যন্ত্রের প্রধান নায়ক জগৎশেঠ সেনাপতি মীর জাফর, দুলাব রাম (জানকী রামের পুত্র), ঘসেটি বেগম (আলীবর্দীর জামাতা নওয়াজেশ মুহম্মদ খানের বিধবা) প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সক্রিয় সহযোগিতা ও পারস্পরিক স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ করে। চক্রান্ত সফল করতে ঘসেটি বেগমকে এতোটাই প্রলুব্ধ করে যে, জগৎশেঠের পরিকল্পনা অনুযায়ী বেগম তার লুক্কায়িত ও তছরূপকৃত সরকারি অর্থ দিয়ে মীর জাফরকে অকাতরে সাহায্য করে। এবং জগৎশেঠ অতি দ্রুততার সঙ্গে ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে দেয়। ফলে মীর জাফর তার অন্যতম বিশ্বস্ত আমির বেগকে পত্র দিয়ে কলকাতায় পাঠায় এবং ইংরেজদের সাহায্য চায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নবাব সিরাজ কলকাতা দখলের পর এই আমির বেগ কয়েকজন ইংরেজ মহিলাকে ড্রেকের জাহাজে তুলে দেয়। সেইজন্য আমির বেগ ইংরেজদের আস্থাভাজন ছিল। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে আমির বেগ মীর জাফরের পক্ষে ক্লাইভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং সিরাজের বিরুদ্ধে কতিপয় কাল্পনিক অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে কয়েকজন সম্ভ্রান্ত রাজকর্মচারি স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি/দরখাস্ত/পত্র মীর জাফরের পক্ষে ক্লাইভের কাছে হস্তান্তর করে- যাতে সিরাজের কবল থেকে তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। জগৎশেঠ তার কলকাতাস্থ প্রতিনিধি উমিচাঁদ এবং দুলাব রামও তার প্রতিনিধিকে উক্ত ষড়যন্ত্র সফল করার উদ্দেশ্যে ইংরেজদের প্ররোচিত করতে নির্দেশ দেয়। মীর জাফর ক্লাইভকে লিখে যে, ক্লাইভ কেবল ইংরেজ সৈন্যদের নিয়ে অগ্রসর হলেই মীর জাফর ও তার সহযোগীরা সর্বাত্মক সাহায্য করবে এবং এজন্য ক্লাইভকে তিন কোটি টাকা উপহার দেওয়া হবে। ক্লাইভ সমগ্র পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে দেখতে পেয়ে নিঃসঙ্গ ও একাকী নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পলাশীর প্রান্তরে উপস্থিত হয়। (মুতাখখিরিন, ২য় খন্ড, পৃ: ৬৩৭)। এই ষড়যন্ত্রের নানা দিক সম্পর্কে তারিখ-ই- মনসুরীতেও বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। ব্লকম্যান তারিখ-ই-মনসুরী থেকে কয়েকটি মন্তব্য Journal of the Asiatic Society তে (part 1, No. 11, 1867) প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চন্দননগরের ফরাসি গভর্নর এম. রেনল্টের প্রতি বিরাগভাজন টেরানিউ নামক জনৈক ফরাসি কর্মচারি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তার সাহায্যে ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর ক্লাইভ ও ওয়াটসনের হস্তগত হয়। চন্দননগরের পতনের পর মঁসিয়ে ল’ নামক জনৈক ফরাসি সৈন্যাধ্যক্ষ নবাব সিরাজের দরবারে আসে এবং তেলিঙ্গা নামক একটি সৈন্যদল সজ্জিত করে। ইংরজগণ ষড়যন্ত্র কারীদের ইঙ্গিতে নবাবের উপর চাপ প্রয়োগ করে যে, ইংরেজদের শত্রুকে দরবারে রাখা যাবে না। কিছু পত্র আদান প্রদান করার পর সিরাজ তার দরবারে ঘাপটি মারা ইংরেজ বন্ধুদের পুন: পুন: চাপে এবং ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে মঁসিয়ে ল’কে রাজধানী থেকে বিদায় দেন। এই সময় ক্লাইভ নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম ও একটি টাকশাল তৈরি করে। ইত্যবসরে সিরাজ কর্তৃক দক্ষিণাঞ্চলের ফরাসি সৈন্যাধ্যক্ষ এম. বসির নিকট লিখিত কয়েকটি পত্র দরবারের গুপ্ত মিত্রদের তথ্যের ভিত্তিতে ইংরেজরা হস্তগত করতে সক্ষম হয় এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে নবাব শক্তি সঞ্চয় করছে মর্মে ধারণা লাভ করে। ইংরেজরা এ কারণে নবাবকে যুদ্ধের মাধ্যমে দমন করার কথাও জানাতে থাকে। সামগ্রিকভাবে ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে একটি বৈরি ও যুদ্ধংদেহী পরিবেশ সৃষ্টিতে ষড়যন্ত্রকারীরা যে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হচ্ছিল, তা ক্রমেই সফল হতে থাকে। দুঃখজনক সত্য এটাই যে, চারপাশ থেকে ষড়যন্ত্রকারীরা যে নবাবকে কোণঠাসা করছে তা জগৎশেঠ, মীর জাফরের তীব্র তোষামোদ ও সাজানো আচরণের জন্য নবাব স্পষ্টত বুঝতে পারছিলেন না এবং বণিক ইংরেজরাও যে কোন্ শক্তির বলে এতোটুকু মাথাচাড়া দিচ্ছে, সেটা সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। উপরন্তু বিদেশী ইংরেজদের কৌশলী সরল ব্যবহার এবং ধীর অথচ নিশ্চিত শক্তি সঞ্চয়পূর্বক অগ্রসর হওয়ার ঘটনা বিশ্লেষণের বদলে ষড়যন্ত্রকারীদের উস্কানিতে নবাব উত্তেজিত হয়ে উঠেন এবং তাঁর ক্রোধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে নবাব রাজধানী মুর্শিদাবাদে ইংরেজ রেসিডেন্টকে ভয় প্রদর্শন করেন এবং ক্লাইভের পাঠানো একটি চিঠি ছিঁড়ে ফেলেন। এ পর্যায়ে নবাবের দরবারে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নবাব যে একটি পুতুলের মতো দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পড়ে পড়ে গেছেন, তখন পর্যন্ত সেটা বুঝতে তো পারেনইনি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের দিকেই ভরসার জন্য তাকিয়ে ছিলেন। ফলে নবাব সভাসদদের ভয়ে ও সামরিক বাহিনীকে হাতে রাখার স্বার্থে ইংরেজ রেসিডেন্টকে খেলাত দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং ক্লাইভের নিকট কৈফিয়ত দিয়ে পত্র পাঠান। কিন্তু সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে ক্লাইভ এবং জগৎশেঠ-মীর জাফর যে চক্র গড়ে তোলে, নবাবের কৈফিয়তমূলক পত্র সেই চক্র ভাঙতে পারেনি। বরং নবাবকে প্রহসন ও তোশামুদির মধ্যে রেখে গোপনে বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের গভীরতা অনুভব করতে পর্যন্ত নবাব ব্যর্থ হয়েছিলেন বলেও কোন কোন ইতিহাসকার মনে করেছেন। তারিখ-ই-মনসুরী অনুযায়ী, নবাবের চারপাশে অবস্থান করেই জগৎশেঠ, ওয়াটস, মীরজাফর, উমিচাঁদ ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়ন করে। সিয়ার উল মুতাখখিরিনের মতে, (ষড়যন্ত্রকারীরা) চোখের সামনেই সকল কাজ করেছে। কলকাতায় এদের প্রত্যেকেরই এজেন্ট বা প্রতিনিধি ছিল। ক্লাইভ এ সকল এজেন্টের মাধ্যমে দরবারের সকল তথ্য অবগত হত এবং রেসিডেন্ট ওয়াটসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিত। মূলত একটি সাজানো নাটকের অংশ হিসাবে পুরো ঘটনা-প্রবাহ সিরাজের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং নবাব সেটা টেরও পাননি।
পাঁচ.
আমির বেগ কর্তৃক মীর জাফরের পত্র, জগৎশেঠ ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্টদের প্ররোচনা এবং অর্থ ও ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি ক্লাইভকে মুর্শিদাবাদের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ক্লাইভের পক্ষে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়নি যে, তার সামনে বিরাট সুযোগ অপেক্ষমান এবং সুযোগটি হাসিল করার উপযুক্ত ক্ষেত্রও প্রস্ত্তত হয়ে আছে। অতএব, পুরো পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে দেখতে পেয়ে ক্লাইভ কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে পলাশীর প্রান্তরে এসে উপস্থিত হয়। রিয়াজের বিবরণ অনুযায়ী (২০০৮:১৮৯): কর্মের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ যখন কাজ করা উচিত ছিল তখন না করে সিরাজ ইংরেজ বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে অগ্রসর হন। তিনি মীর জাফরকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে তোষামোদ করতে থাকেন। মীর জাফর কপট আনুগত্য প্রদর্শন করে। সিরাজ যখন চুনাখালি থেকে অগ্রসর হন তখন মীর জাফরও অগ্রসর হয়ে সিরাজের সৈন্যবাহিনী থেকে অর্ধ ফারসাখ দূরে শিবির স্থাপন করে। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর মদন এই সময় নবাব সিরাজকে বলেন যে, ইংরেজরা মীর মুহাম্মদ জাফরের প্ররোচনায় আসছে; সুতরাং মীর মুহাম্মদ জাফরকে প্রথমে শেষ করা উচিত এবং তাকে হত্যা করার সংবাদ পেলে ইংরেজরা আর অগ্রসর হতে সাহস করবে না। এই পরামর্শ সিরাজ গ্রহণ করেননি, তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়ণে আগ্রহী ছিলেন। এহেন পরামর্শ গ্রহণ না করায় রিয়াজের লেখক কাব্যচ্ছলে লিখেন: সেই বিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শের প্রতি/এই তরল-হৃদয় ব্যক্তি (সিরাজ) বধির হয়ে রইল।
চুনাখালী থেকে সিরাজ দাউদপুর পৌঁছে সংবাদ পান যে, ইংরেজরা কাটোয়া পুড়িয়ে দিয়েছে। রিয়াজের ভাষ্যমতে: সেইসময় মোহনলাল তিরস্কার করে সিরাজকে বলেন, আপনি আমার সর্বনাশ করেছেন; আমার সন্তানদের পিতৃমাতৃহীন করলেন। মোটের ওপর পরদিন সকালে মুতাবিক ৫ শাওয়াল দিল্লিতে বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের রাজত্বের তৃতীয় বৎসরে একদিকে ইংরেজ সৈন্যরা পলাশী থেকে এবং অন্যদিকে সিরাজের বাহিনী দাউদপুর থেকে কামানের গোলাবর্ষণ দ্বারা যুদ্ধ আরম্ভ করে। মীর জাফর তার বাহিনীসহ বামদিকে দূরে দাঁড়িয়েছিল। সিরাজ তাকে নিকটে আসবার জন্য তলব করা সত্ত্বেও মীর জাফর নিজ স্থান ত্যাগ করেনি। ঘোরতর যুদ্ধের সময় যখন রক্তারক্তি চলছে এবং নবাব বাহিনীর বিজয়ের সূচনা দেখা দিয়েছে, সেই সময় অকস্মাৎ একটি কামানের গোলার আঘাতে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান মীর মদনের পতন হয়। এই দৃশ্য দেখে সিরাজের সৈন্যদের মনোভাব পরিবর্তিত হয় ও গোলন্দাজরা মীর মদনের লাশ নিয়ে শিবিরে চলে যায়। তখন বেলা দ্বিপ্রহর। শিবিরের লোকেরা পলায়ন আরম্ভ করে। নবাব তখনো যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। সূর্যাস্তের দু’ঘন্টা পূর্বে সিরাজের সৈন্যরাও পলায়ন করে। কোন গত্যন্তর না দেখে নবাবও যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজের প্রতিষ্ঠিত মনসুরগঞ্জে পৌঁছে কোষাগারের দ্বার খুলে সমস্ত অর্থ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করেন। কিন্তু অত্যধিক উদ্বেগে সেখানে না থাকতে পেরে সন্ধ্যার পর সিরাজ তার বেগম, সন্তান এবং মালমাত্তা, মূল্যবান মণিমুক্তা ও প্রচুর মুদ্রাসহ এক নৌকায় উঠে পূর্ণিয়া ও আজিমাবাদের দিকে রওয়ানা হন। সিরাজের পরাজয়ের পর মীর জাফর নবাব-শিবিরে প্রবেশ করেন এবং রাত্রিতে ইংরেজ প্রধানদের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং পরদিন সকালে সিরাজের পশ্চাদ্ধাবন করে মুর্শিদাবাদ পৌঁছেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূল দেখে মীর জাফর দুর্গে প্রবেশ করে বাংলার মসনদে আরোহণের বিজয়বাদ্য বাজাবার আদেশ দেন। নগরে শান্তি ও নিরাপত্তা ঘোষণা করে তিনি সুবাদারির পতাকা উত্তোলন করেন। তদীয় জামাতা মীর কাশেমকে একদল সৈন্যসহ সিরাজকে বন্দি করার জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু সিরাজ নৌকাযোগে রাত্রিকালে দ্রুত মালদহ অতিক্রম করে বাবিয়াল পৌঁছেন। এখানে এসে তিনি জানতে পারেন যে, নাজিমপুরের মুখে নদীতে নৌকা চলাচল করতে পারে না। তখন তিনি বাধ্য হয়ে নৌকা থেকে নেমে সেখানকার অধিবাসী দানশাহ পীরজাদার বাড়ি যান। দানশাহ ইতিপূর্বে সিরাজের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। সিরাজকে নিজের আয়ত্তে পেয়ে সুযোগ বুঝে দানশাহ তাকে প্রতিশ্রুতি এবং সান্ত্বনা দেন এবং বাহ্যত খাদ্য প্রস্ত্ততের আয়োজন করেন। এদিকে দানশাহ মীর জাফরের ভ্রাতা আকবরনগরের (রাজমহল) ফৌজদার মীর দাউদ আলী খানকে সিরাজ সংক্রান্ত সংবাদ পাঠান। দাউদ আলী খানের গোয়েন্দারা সিরাজের সন্ধান করছিল এবং চরম বিজয় মনে করে দ্রুত পৌঁছে সিরাজকে বন্দি করে দানশাহ (সিয়ারে দানাশাহ নামে বর্ণিত)-এর বাড়ি থেকে আকবরনগরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মীর কাশিম তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। মীর জাফর তাকে কারারুদ্ধ করে। পরদিন ইংরেজদের পরামর্শে এবং জগৎশেঠের জেদাজেদিতে তাকে হত্যা করা হয় এবং লাশ হাতির পিঠের হাওদায় করে নগর পরিক্রম করানো হয়। (রিয়াজ ২০০৮ : ১৯০) পরে নবাব মহবত জং-এর সমাধি সৌধ খোশবাগে সিরাজের লাশ দাফন করা হয়। কিছুদিন পরে সিরাজের ছোটভাই মীর্জা মেহদি আলী খানকেও অত্যাচার করে হত্যা করা হয় এবং সিরাজের কবরের পাশে তার লাশ দাফন করা হয়। নবাব সিরাজের নিজামত ছিল মাত্র এক বছর চার মাস।
ছয়.
তৎকালীন ইতিহাসের নানা সূত্রমতে, ১৭৫৭ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে ক্লাইভ কলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে ১৭ তারিখে পলাশীর দক্ষিণে অবস্থিত কাটোয়া শহরে পৌঁছেন ও সেখানকার দুর্গ অধিকার করেন। ২১ জুন অপরাহ্ন ৪ টার সময় ক্লাইভ কাটোয়া থেকে রওয়ানা হয়ে হুগলি নদী পার হন এবং ২৩ জুন সকালে পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। নগরের সৈন্যবাহিনীকে তখন দেখা যাচ্ছিল। কামানের গোলা থেকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ইংরেজগণ নবাব শিবির আক্রমণ করে কিন্তু আমির মীর মদন (থনটন তাকে মুদুম খান বলে অভিহিত করেছেন) বীর বিক্রমে বাধা দেন। বেলা প্রায় ১২টার সময় মীর মদনকে কামানের গোলায় আহত অবস্থায় নবাবের শিবিরে আনার কিছুক্ষণ পর তাঁর মৃত্যু হয়। মোহনলাল সে সময় মীর মদনের স্থান গ্রহণ করে যুদ্ধ চালাতে থাকেন। ষড়যন্ত্রের আশংকায় নবাব এ সময় মীর জাফরকে শিবিরে ডেকে পাঠান। মীর জাফর যুদ্ধে কোনই অংশগ্রহণ করেনি। নবাবের ঐকান্তিক অনুরোধে অবশেষে নবাব কর্তৃক মোহনলালকে অবিলম্বে যুদ্ধ থেকে বিরত করার শর্তে মীর জাফর পরদিন সকালে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সিরাজ সম্মত হন। মোহনলাল শিবিরে ফিরে আসেন। সেনাপতি মোহনলাল যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা নিরাশ হয়ে পলায়ন করতে থাকে। সন্ধ্যার পূর্বেই নবাবের সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই প্রকার যুদ্ধে ইসলাম ভারত হারিয়েছিল। ব্লকম্যানের তারিখ-ই-মনসুরীতে উপরিউক্ত মন্তব্য রয়েছে।
সিয়ার-উল-মুতাখখিরিনে (২য় খন্ড, ৬৩৮ পৃ.) বলা হযেছে, ইংরেজরা মীর জাফর-জগৎশেঠের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু যুদ্ধ সমাসন্ন, তাই ক্লাইভের গতিবিধি লক্ষ্য করে নবাব অসন্তুষ্ট সেনাপতিদের সঙ্গে বিরোধ দূর করার চেষ্টা করেন। এরা বাহ্যত আনুগত্য প্রকাশ করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নবাবের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। প্রতিরোধ-প্রাকার ও ঘাঁটি তৈরি তত্ত্বাবধানের জন্য সিরাজ আগেই বিশ্বাসঘাতক দুলাব রামকে (রায়দূর্লভ) প্রেরণ করেন এবং স্বল্পকাল পরে সৈন্যাধ্যক্ষদ্বয় মীর মদন ও মোহনলাল এবং বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে নিয়ে নবাব নিজে পলাশী যান। ক্লাইভও আন্দাজ দু’হাজার সৈন্যসহ পলাশী ছিল। ক্লাইভ কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে যুদ্ধ আরম্ভ করে। মীর জাফর দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল। অপরাহ্ন প্রায় তিনটা পর্যন্ত মীর মদন বীর বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। মোহনলালও ক্লাইভের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। এদের বীরত্ব ও আন্তরিকতা লক্ষ্য করে ক্লাইভ নিরাশ হয়ে উমিচাঁদকে ভৎর্সনা করে। কারণ এরা ক্লাইভকে বলেছিল, সকলেই নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং কেউই তার পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে এই সময় কামানের গোলার আঘাতে মীর মদন আহত হন এবং তাকে নবাবের শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মীর মদনের মৃত্যু হয়। এই সময় সিরাজ উৎকণ্ঠিত হয়ে মীর জাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে যুদ্ধ করার জন্য মিনতি করেন। এমনকি, মীর জাফরের সামনে পাগড়ি রেখে নবাব সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই করুণ আবেদনেও মীর জাফরের মন বিগলিত হয়নি। বরং মীর জাফর বন্ধুত্বের মুখোশে তার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ মতলব ঢেকে রেখে এই মিথ্যা উত্তর দেয় যে, আজ দিন অবসানপ্রায়। আর যুদ্ধের সময় নাই। আজ যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিন। আগামীকাল আমি সমগ্র সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনার পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করব। সিরাজ মীর জাফরের ফাঁদে পা দিয়ে যুদ্ধরত মোহনলালকে ফিরে আসতে সংবাদ দেন। মীর মদনের মৃত্যুর পর মোহনলাল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহনলাল বলে পাঠান যে, তিনি এখন ঘোরতর যুদ্ধে ব্যস্ত, এতেই ভাগ্য নির্ধারিত হবে। সুতরাং এখন তার ফিরবার সময় নেই। সিরাজ আবার মীর জাফরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মীর জাফর ধূর্তের মতো পূর্বের পরামর্শ পুনরুক্তি করে। তখন মোহনলালকে ফিরে আসার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। মোহনলালের প্রত্যাবর্তনে সিরাজের সৈন্যবাহিনীর ওপর মারাতমক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সৈন্যরা চারদিকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সিরাজ তখন দ্রুত মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন এবং কিছুক্ষণ মনসুরাবাদে অবস্থানের পর নিজেকে মিথ্যাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক সভাসদগণ দ্বারা পরিবৃত্ত দেখে বেগম পরিবার ও সভাসদসহ ভগবানগোলা যাত্রা করেন। সেখান থেকে নৌকাযোগে আজিমাবাদ রওয়ানা হন এবং ফরাসি সেনাপতি মঁসিয়ে ল’কে তার সঙ্গে যোগদানের জন্য এক পত্র প্রেরণ করেন। ল’ পৌঁছবার পূর্বেই তিনি পাটনা অভিমুখে রওয়ানা হন। বেগম ও পরিবারবর্গ কয়েকদিন যাবত অনাহারে থাকায় তিনি রাজমহলে নেমে দানশাহ নামক এক ফকিরের বাড়ি যান। ফকির বাহ্যত খিচুড়ি তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পূর্বের অসদ্ব্যবহারের জন্য নবাবের প্রতি তার ক্রোধ ছিল। ফকির সিরাজের উপস্থিতির সংবাদ তৎক্ষণাৎ রাজমহলে মীর জাফরের ভ্রাতা মীর দাউদের নিকট পাঠান। মীর জাফরের জামাতা মীর কালিম এসে সিরাজকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে নিয়ে যায়, সেখানে মীর জাফর ও তার পুত্র মীরন সিরাজকে হত্যা করে। সিরাজের মৃতদেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে শহরে প্রদর্শন করা হয়।

সাত.
কোনরূপ ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণে না গিয়ে তৎকালীন ইতিহাসকার সালীম প্রণীত রিয়াজের একটি ভাষ্য দিয়ে উপসংহার টানা যেতে পারে। যাতে ১৭৫৭ সালের পুরো বিষয়টিই কিরূপ হিংসাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ ছিল তা অাঁচ করা যাবে।
বাংলার ইতিহাসের এই বিপ্লবের ফলে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শাসনের স্থানে ইরেজরা এদেশের সর্বময় কর্তা হয়েছিল। এই পরিণতিকে জনসাধারণের কল্যাণার্থে বিধাতার কল্যাণময় দানরূপে গণ্য করা যেতে পারে। তৎকালে বাংলার জনসাধারণ নৈতিক অধঃপতের চরম সীমায় পৌঁছে ছিল। কৃতজ্ঞতা ও বিশ্বাসঘাতকতার বিষ সর্বত্র প্রবেশ করেছিল। মিথ্যাচার ও অর্থগৃধ্রুতা তাদের অন্তরের অন্তস্থলে বাসা বেঁধেছিল। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও অর্থলোভের মোহে তারা তাদের রাজার যৌবনসুলভ ত্রুটি ও পারিবারিক ঈর্ষার সুযোগ নিয়েছিল। তারা সর্বপ্রকার কৃতজ্ঞতার ও সম্মানের মনোভাব ত্যাগ করে। এই কারণে তাদের নৈতিক অধঃপতন রোধের জন্য মুসা পয়গম্বরের মতো একজন রক্ষাকর্তার প্রয়োজন হয়েছিল। দেশের পাপ দূর করে জনসাধারণকে উদ্ধার ও সংস্কারের জন্য বিধাতা তাই সাগর পার থেকে ইংরেজদের মাধ্যমে উদ্ধার কর্তা প্রেরণ করেছিলেন। (সালীম ২০৮ : ৩৭৬)
দেশের সংস্কৃতি, ঐক্য, নেতৃত্ব ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সুস্পষ্ট দিকগুলোতে চিহ্নিত না করে তৎকালীন ঐতিহাসিকগণ পরবর্তী শাসক ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় অদৃষ্টের উপর সকল দোষ চাপিয়ে যে ভুল করেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কি করছি সেটা আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে ১৭৫৭ সালের পলাশীতে স্বাধীনতার অবসান এবং প্রাসঙ্গিক ঘটনা পরম্পরা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিদেশি ষড়যন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ চক্রান্ত থেকে রক্ষা করারও।
এই বাস্তবতার সূত্র ধরে প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বলছেন (আহমদ ২০০৯: ৩২): আমি ১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয়কে স্মরণ করি আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মনে রেখে, কিভাবে একটি স্বাধীন জনপদ তার স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে পারে তা ফিরে দেখার জন্য। এর প্রয়োজন অনুভব করি এই জন্যে যে, আঠারো শতকের প্রথম দিক থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা যেমন ছিল আজকের বাংলাদেশের অবস্থা প্রকৃতিগত দিক থেকে তার প্রায় কাছাকাছি।
খুবই সঙ্গত কারণে একইভাবে অনেকেই আশংকা প্রকাশ করে থাকেন, আজকের বাংলাদেশের অবস্থা ১৭৫৭-এর বাংলা থেকে খুব বেশি ভিন্ন নয়। শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের অপরিণামদর্শী নীতির দিকে তাকিয়ে, অদক্ষ এবং দলীয় আনুগত্যের প্রকরণে বিভক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে, দেশের অর্থনীতিকে ক্রমবর্ধমান হারে বিদেশ নির্ভর করার ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়নকারীদের আগ্রহকে স্মরণে রেখে, দেশের অসংখ্য বিদেশ-নির্ভর এনজিওদের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমকে মনে করে এবং অপরিণত নেতৃত্বের সুযোগ নিয়ে যেভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের হস্তক্ষেপ প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে, তা পর্যালোচনা করলে তাদের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক তা বলা যাবে না। অনেকে বলেন, যে বটবৃক্ষটি পলাশীর ষড়যন্ত্রের সাক্ষীরূপে এখনও টিকে রয়েছে, আড়ইশো বছরেরও বেশি সময় পরেও কোন পরিব্রাজকের চোখে পড়বে সেই বটবৃক্ষে রয়েছে প্রচুর সংখ্যক শকুন। তখনো তারা ছিল। এখনো রয়েছে। কোনটির রং সাদা, কোনটির ধুসর বা বাদামী। সিরাজদ্দৌলার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। মীর জাফর- জগৎশেঠের রয়েছে অসংখ্য উত্তরপুরুষ। শকুনের মতো এদেরও বংশবিস্তার ঘটেছে। তাই আশঙ্কা।

সহায়ক গ্রন্থ
শিকদার আবদুল হাই, ভ্রমণ সমগ্র (পলাশী ভ্রমণ পর্ব), ঢাকা, অনন্যা প্রকাশনী, ২০০৬
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন), ঢাকা, দিব্য প্রকাশ, ২০০৫
গোলাম হোসাইন, সিয়ারউল মুতাফাখিরিন, ঢাকা, বাংলা একাডেমী
এমাউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ, ঢাকা, গতিধারা প্রকাশনী, ২০০৯
মৈত্রেয়, অক্ষয় কুমার, সিরাজউদ্দৌলা, কলিকাতা, ১৮৯৮
ইত্রাত-ই-আরবার-ই-বসর
গোলাম হুসেন সালীম, বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতিন, নতুন সংস্করণ), ঢাকা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ২০০৮
উইকিপিডিয়া
Blockman, Geography and history of Bengal, Calcatha
Journal of the Asiatic Society, Part-1. No. 11, 1867

--০--