ভূমিকা : 

ফিরে দেখা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের মহাসংগ্রাম-মহাবিদ্রোহ-১৮৫৭।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারকামী মহাবিপ্লব-বিদ্রোহের দেড় শতবর্ষ [১৮৫৭-২০০৭] উপলক্ষে বাংলাদেশের ভাবুক-চিন্তক-মননশীল মানুষের অভিব্যক্তি ও পর্যালোচনার খুব বেশি উদ্যোগ, সরকারী দিক থেকে তো নয়ই, বেসরকারী পর্যায় থেকেও আমাদের নজরে আসে নি। একটি প্রায়-ব্যক্তিগত প্রয়াসের ধারাবাহিকতায় একমাত্র সঙ্কলন মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ প্রকাশ পায়, যেটি কাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত দিক থেকে একাডেমিক বাধ্যবাধকতামুক্ত থেকে অনেক অপ্রথাগত লেখাও মৌলিক গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে স্থান দিয়েছে। ফলে ১৮৫৭ সম্পর্কে একটি বারোয়ারী স্মারকরূপে সঙ্কলনটি প্রায় তিন শতাধিক পৃষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট নানা সঙ্গ-অনুসঙ্গকে স্পর্শ করেছে বটে কিন্তু এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটি কমপ্রিহেন্সিভ নলেজ সোর্স হিসাবে পরিণত হতে পারে নি। উল্লেখ্য, উক্ত সঙ্কলনে ‘‘১৫০ বছর পর ফিরে দেখা প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ ১৮৫৭’’ শিরোনামে আমার একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ সংযোজিত হয়। বর্তমান লেখাটি সেই প্রবন্ধেরই একটি বর্ধিত ও পরিমার্জিতরূপ, যেখানে ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক ঘটনা-প্রবাহের অনুপুঙ্খ ধারাক্রমকে বর্তমান আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী-লুটেরা অপশক্তির হস্তক্ষেপজাত পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসমনস্ক পাঠকের বাস্তব-প্রয়োজনীয়তার আলোকে বিন্যস্ত করে উপস্থাপনা ও পর্যালোচনা করা হয়েছে।
যদিও আজ থেকে দেড় শতাব্দী আগেকার ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসিত ভারতবর্ষের সেই গৌবরময়, বিপ্লবী, স্বাধীনতা-পুনরুদ্ধারকামী এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ বিরোধী দেশপ্রেমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য এবং বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা কমে নি, তথাপি বিষয়টিকে নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা বা আলাপ-আলোচনা লক্ষ্য করা যায় নি। যেমনভাবে ১৮৫৭ সালের ঘটনা-প্রবাহে ভীত-শঙ্কিত ইংরেজ দখলদার-সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মাতাল-আক্রোশে নরহত্যা, অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামীদের নির্মূল করেছিল এবং সিপাহি-জনতার দেশপ্রেমিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মিথ্যা ইতিহাস বিনির্মাণ করেছিল, তেমনিভাবে আমাদের নির্লিপ্ততা প্রকারান্তরে ইংরেজ কলোনিয়াল ডিসকোর্সকেই মেনে নেওয়ার শামিল বলে মনে করা দরকার। কিন্তু সবাই চুপ থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রচারণা এবং ধারাকে মেনে নেবেন, ইতিহাস এমনটি কখনই বলে না। যে কারণে ভারতের বোম্বে থেকে প্রকাশিত ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি ১৮৫৭ সাল সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বিশাল সঙ্কলন প্রকাশ করেছে; বাংলাদেশ থেকেও দেশপ্রেমিক-স্বদেশপ্রেমীরা বিচ্ছিন্ন লেখালেখি এবং সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন এ কারণেই যে, ১৮৫৭ সালের চেতনাগত আন্দোলন-সংগ্রামের পথেই ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশকে স্বাধীনতা দিয়ে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ১৯৪৭ কিংবা পরবর্তীতেও উপমহাদেশের আপামর মানুষ স্বাধীনতার অভিমুখটি সনাক্ত করতে পেরেছে ১৮৫৭ সালের সহাচৈতন্যের শিক্ষা থেকেই। অতএব আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও পরম্পরায় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের যাবতীয় ঘটনাবলী ও শিক্ষা খুবই প্রাসঙ্গিক প্রেরণাস্থল। ভবিষ্যতেও আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে ১৮৫৭-এর অনুপ্রেরণা অপরিসীম শক্তিস্থল। বিশেষত, বিশ্বায়নের নামে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি যেভাবে উন্নয়নকামী দেশসমূহের দিকে লোলুপ কালোহাত বিস্তার করছে এবং ২০০৭-২০০৮ সময়কালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে তাদেরকে যেভাবে অনুপ্রবেশ ও হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে, সেই সূত্রে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য, সাফল্য-ব্যর্থতা নতুনভাবে পাঠ এবং অনুধাবণ করে নেওয়ার ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত এটাও মনে রাখতে হবে যে, ১৮৫৭ সালে দিল্লি, লাখনৌ, মিরাট, অযোধ্যা, বুন্দেলখন্ডসহ সমগ্র উপমহাদেশে যা ঘটেছিল, আজকে তেমনটিই ঘটছে বাগদাদ, বসরা, কাবুল, কান্দাহারে। আমরা নিজেরাও আতঙ্কিত সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ তান্ডবের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায়। এটা ঠিক যে, দেড় শতাব্দীতে রূপ-চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্যের বদলের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখ-মুখোস-পরিচয়ের বদল হয়েছে বটে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের শোষণমুলক-ইসলামবিরোধী অভিমুখটি ঠিকই রয়ে গেছে। সেদিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-প্রতিনিধি ব্রিটিশরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লুণ্ঠন করতে, খ্রিস্ট ধর্ম চাপিয়ে দিতে, ইউরোপিয় শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়ে দেশবাসীকে বন্দী করতে এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা কেড়ে নিতে। একালে একই কর্মকান্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রধান শক্তির আসনে বসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। এরা ইরাকে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে হানা দিয়েছে একইভাবে লুণ্ঠন করতে, স্বাধীনতা কেড়ে নিতে এবং খ্রিস্ট ধর্মের জয়ডঙ্কা বাজাতে। প্রেসিডেন্ট বুশ জানিয়ে গেছেন যে, তিনি যিশুর প্রেরণায় ক্রুসেডে নেমেছেন যদিও যিশু ছিলেন রক্তপাতের ঘোরতর বিপক্ষে। সাম্রাজ্যবাদী-হানাদাররা সারা দুনিয়াকে এবং এমন কি তাদের ধর্মপুরুষকে পর্যন্ত বিকৃত তথ্যের আড়ালে রেখে যতই সাধু সাজবার চেষ্টা করুক না কেন, আমেরিকা-ইসরায়েল-ভারতের মৈত্রী ১৮৫৭ সালের মতোই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, কারা আমাদের স্বাধীনতার পক্ষ আর কারা স্বাধীনতা-হননকারীদের দোসর এবং ঔপনিবেশিক যুদ্ধ শেষতক ঔপনিবেশিক-আধিপত্যবাদী যুদ্ধ বলেই প্রকৃত দেশপ্রেমিক-স্বাধীনতাকামীদের চোখে ধরা পড়বেই।
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, সেকালের মতো একালেও সাম্রাজ্যবাদের দাসানুদাস আর গোলামের কোনও অভাব আজকেও হয় নি। সেকালের মতো একালের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, মিডিয়ার একটি অংশ দৃশ্যমান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যারা মোটেই তখনকার তুলনায় এখনও সাম্রাজ্যবাদের কম গুণগান করছে না। চিরকালই একটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী উদারনৈতিকতার মুখোস চাপিয়ে সাম্রাজ্যবাদের লজ্জাহীন দালালি ও লেজুড়বৃত্তি করে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যারা সেদিন দাঁড়িয়েছিল, তাদের বক্তব্য, বিবৃতির সাথে আজকের দিনের সাম্রাজ্যবাদী সমর্থকদের মতামতের কি আশ্চর্য মিল! কলকাতার তৎকালীন প্রধান পত্র-পত্রিকা এবং অগ্রণী বুদ্ধিজীবীদের প্রেতাত্মা ঢাকায় কিভাবে এসে ভর করেছে সেটা এক মহাবিস্ময়! আরও উল্লেখ্য যে, তখন স্বাধীনতাকামী না-বলে ইংরেজ ও কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবী-মিডিয়া বলতো In 1857 a Muslim meant a rebel আর এখন মুসলিমদের দেখলেই বলার চেষ্টা করা হচ্ছে জঙ্গি বা মৌলবাদী! ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! শতবর্ষের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রকৃত বিপ্লবী-স্বাধীনতাকামী-মুক্তিযোদ্ধার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার কাজটি এখনও সম্পন্ন হয় নি। এসব হতাশা আর অবক্ষয়ের মধ্যেও আশার আলো আছে। কেননা, ১৮৫৭ সাল আমাদেরকে শত্রু-মিত্র চিনিয়ে গেছে, পথে দিশা রেখে গেছে। সেটি সর্বাংশে সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদবিরোধী সংগ্রামের চিহ্ন। কোনও সন্দেহ নেই আজকেও মানব জাতির প্রধান সমস্যার নাম সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদ, যার থেকে মুক্তির জাতীয় মহাসড়কে পৌঁছানোর প্রধান অবলম্বন অবশ্যই ১৮৫৭ সালের শিক্ষা ও প্রেরণা। দৃশ্যত ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লব পরাস্ত হয়েছিল নেতৃত্বের দুর্বলতাসহ হিন্দু, শিখ, নেপালি শক্তির ষড়যন্ত্র ও আপোসকামিতার জন্য। তারপরেও ১৮৫৭-এর ঘটনা-প্রবাহ সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ উৎখাতের মাধ্যমে মুক্তি আর স্বাধীনতার অনন্ত প্রেরণা জাগিয়ে রেখেছে উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, দেশপ্রেমিক, স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য। আমরা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে, আন্দোলন-সংগ্রামে, মুক্তি মিছিলে শুনতে পাই ১৮৫৭ সালের অনিঃশেষ আহবান।
স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ
‘খালক-ই-খুদা/মুলক-ই-পাদশা/হুকুম-ই-সিপাহ’ [পৃথিবী আল্লাহর, সাম্রাজ্য বাদশাহর এবং নেতৃত্ব/আদেশ সিপাহিদের] শ্লোগান দিয়ে আজ থেকে ঠিক ১৫০ বছর আগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে যে সর্বভারতীয় ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ শুরু হয়, তাকে নানাজন নানাভাবে দেখেছেন। ইংরেজরা এই যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ হিসাবে না দেখে, দেখেছেন ‘বিদ্রোহ’ হিসাবে। তারা স্বাধীনতাকামী সিপাহি-জনতার সম্মিলিত গণযুদ্ধকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে খন্ডিত পরিচয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন। কমিউনিস্টরা একে দেখেছেন ‘শ্রেণী যুদ্ধ’ হিসাবে। মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ একাডেমিশিয়ানরা বলেছেন, এটি একটি ‘শ্রেণী চরিত্রবিহীন জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ’। মুসলিম-জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী-পুনরুজ্জীবনবাদীরা এই যুদ্ধকে দেখেছেন ‘ইসলামী শাসন পুনপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা’ হিসাবে।
অন্যদিকে, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব বা মহাবিদ্রোহকে অনেকে ঔপনিবেশিক-পরাধীন ভারতবর্ষের ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’ বলে চিহ্নিত করেন। সন্দেহ নেই, ১৮৫৭ সালের বিপ্লব-বিদ্রোহ সমগ্র ভারতকে আন্দোলিত করার মাধ্যমে জাতীয়ভিত্তিক সংগ্রাম প্রচেষ্টার অংশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এটিই স্বাধীনতার জন্য প্রথম উদ্যোগ ছিল না।
বস্ত্ততপক্ষে আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু হয় পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে স্বদেশের স্বাধীনতার অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই, যার প্রথম নায়ক ছিলেন মীর কাশিম। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁর জামাতা হওয়ার কারণে মীর কাশিমের প্রাথমিক ভূমিকার ফলে ইংরেজ শাসকরা কিছুটা উপকৃত হলেও তিনি যখন নিজে নবাব হন তখন ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠীর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি অনুধাবণে সক্ষম হন এবং আগ্রাসী-উপনিবেশিক-সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা-পুনরুদ্ধারের জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। নানা শাঠ্য-ষড়যন্ত্রের কারণে মীর কাশিম সফল হতে না-পারলেও তাঁরই পথ ধরে পরবর্তী শতবর্ষে ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকির বিদ্রোহ, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধ যুদ্ধ, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন, দক্ষিণ ভারতের টিপু সুলতানের স্বাধীনতার সংগ্রাম, সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির জিহাদ আন্দোলন প্রভৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশের নীল বিদ্রোহ ও বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভূমিকাই ছিল প্রধান।
মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশীর ঘটনার পরবর্তী শতবর্ষের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত এসব অসংখ্য বিপ্লব-বিদ্রোহ-আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার পুনরুদ্ধারের সশস্ত্র ও সর্বাত্মক প্রচেষ্টার পটভূমিতেই আসে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, মহাবিপ্লব। ফলে এটি একটি আকস্মিক বা প্রথম ঘটনারূপে চিহ্নিত হতে পারে না। চিহ্নিত হতে পারে সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের অন্যতম প্রধান মুক্তিযুদ্ধরূপে, অন্যতম প্রধান জনআন্দোলনের বৈপ্লবিক-ঘটনারূপে।
পটভূমি
একটি আকস্মিক বা প্রথম ঘটনারূপে নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের অন্যতম প্রধান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনারূপে ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লব বা মহাবিদ্রোহকে চিহ্নিত করা হলেও পূর্ববর্তী শতবর্ষের অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের পলাশী পরবর্তীকালের বিপ্লব-বিদ্রোহ-সংগ্রাম-আন্দোলনের সঙ্গে এর মৌলিক-চারিত্র্যিক-বৈশিষ্ট্যগত সুস্পষ্ট পার্থক্য বিরাজমান। একই সঙ্গে ১৮৫৭ সালের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছিল কতিপয় সমকালীন বিষয়, যেগুলোর সম্মিলিত প্রভাব অগ্নিগিরির বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষের সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সমগ্র জন-জীবন আর সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে।
• পূর্ববর্তী বিপ্লব-বিদ্রোহ-সংগ্রাম ছিল দেশের কোনও না কোন অঞ্চলে সীমাবদ্ধ কিন্তু ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হয় সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী। মহাবিদ্রোহের আগে কেবলমাত্র সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির নেতৃত্বাধীন জিহাদ আন্দোলনই সমগ্র ভারতবর্ষকে সাড়া জাগাতে কিয়দাংশে সফল হয়।
• পলাশী বিপর্যয়ের পরবর্তী শতবর্ষের [১৭৫৭-১৮৫৭] প্রেক্ষাপটে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সর্বপ্রথমবারের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু নেতা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এর বাস্তবসম্মত কারণও ছিল। পলাশী বিপর্যয়ের পূর্বেই ইংরেজরা মহারাষ্ট্রের উগ্র-হিন্দু মারাঠাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতবর্ষ থেকে মুসলিম শাসন উৎখাতে তাদেরকে প্ররোচিত করে। মহীশূরের টিপু সুলতানকে ১৭৯৯ সালে পরাজিত ও হত্যা করে মহীশূর রাজ্য জবরদখল করার সময়ও ইংরেজরা সফলভাবে মারাঠাদের ব্যবহার করে। কিন্তু ১৮১৭-১৮ সালে প্রবল আক্রমণাত্মক যুদ্ধে ইংরেজগণ মারাঠাদের চরমভাবে পর্যদুস্ত করে দেয়। ফলে তাঁতিয়া তৌপিসহ মারাঠা নেতারা ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠেন।
• ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এ সময় একটি নতুন আইন জারি করার মাধ্যমে ‘কোন অপুত্রক দেশীয় রাজা দত্তক পুত্র গ্রহণ করলে তাঁর উত্তরাধিকার অতীতের ন্যায় গ্রাহ্য না-করার’ সিদ্ধান্ত নেয়। এই আইনের কারণে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানা সাহেব বার্ষিক তৎকালীন আট লক্ষ টাকার বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হন। এই একই আইনের অজুহাতে ঝাঁন্সিসহ বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্য ইংরেজরা দখল করে নেয়। এসব কারণে মারাঠা নেতা তাঁতিয়া তৌপির মতোই নানা সাহেব, ঝাঁন্সির রাণী লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ হিন্দু দেশীয় রাজন্যবর্গ প্রথমবারের মতো ইংরেজবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং ১৮৫৭ সালে বিপ্লবাত্মক কার্যক্রমে যোগদান করেন।
• পলাশী-পরবর্তী ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চরম দুঃশাসনের সময়কালে মুসলিম রাজন্যবর্গের অনেকেই ইংরেজদের প্রতি ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে না-ঘাঁটানোকেই নিরাপদ এবং বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করতেন। অযোধ্যার নবাব সৈয়দ ওয়াজেদ আলী শাহ ছিলেন এমনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ১৮৫৬ সালে ইংরেজরা তুচ্ছ অজুহাতে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে তাঁর রাজ্য দখল করে নেয় এবং তাঁকে কলিকাতায় নির্বাসিত জীবন-যাপনে বাধ্য করে। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। প্রসঙ্গত, ১৮৪৩ সালে ব্রিটিশরা সিন্ধু রাজ্যটিকে ‘প্রজাদের মঙ্গলের’ বাহানায় দখল করে। আর অযোধ্যা ছিল ১৮০১ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলসলির সঙ্গে সম্পাদিত সন্ধি অনুযায়ী ‘রক্ষিত বা আশ্রিত করদ মিত্র রাজ্য’। কিন্তু ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬ জোরপূর্বক রাজ্যটি দখল করে নবাবকে বার্ষিক বারো লাখ রূপি ভাতা দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হলে তিনি সেখানে ব্রিটিশবিরোধী শক্তির সঙ্গে গোপনে সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অযোধ্যা দখলের মাধ্যমে ভারতে শেষ স্বাধীন মুসলিম রাজ্যের পতন ঘটানো হয়। হতভাগ্য নবাবের সকল স্থাবর-অস্থাবর ধন-সম্পদ, এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরির তৎকালীন দুই লাখ টাকা মূল্যের হস্তলিখিত গ্রন্থাদি, প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগার পূর্ণ করা হয়। এর চেয়েও অধিকতর পৈশাচিক ব্যবহার এবং বর্বরতা করা হয় বিশেষত অন্তঃপুরবাসিনী বেগমদের সঙ্গে। তাঁদেরকে বলপূর্বক অন্তঃপুর থেকে বাইরে এনে লুণ্ঠন করা হয়। পাশবিকভাবে খুলে নেওয়া হয় মূল্যবান পোশাক, অলঙ্কারাদি এবং ভূষণসমূহ। এসব নিষ্ঠুরতা, মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের অদম্য লালসাপূর্ণ নিপীড়ন, নিস্পেষণ, মর্মন্তুদ হাহাকার ও আর্তনাদের রূপ ধারণ করে ভারতের আকাশ-বাতাস মথিত করে এবং সাতান্ন সালে বিরাট বিপ্লবরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
• ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে ইংরেজ বেনিয়া শক্তি সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী নখর বিস্তার করে ক্রমশ যখন কেন্দ্রস্থল দিল্লির দিকে হানা দিচ্ছিল তখন সেখানে নামমাত্র মোগল বাদশাহ ছিলেন বয়োবৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর। সমগ্র ভারতবর্ষে ক্রমবর্ধমান ইংরেজ আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি ও সামর্থ্য তখন ক্ষয়িষ্ণু মোগল শাসকের ছিল না। বাহাদুর শাহ মনে মনে ইংরেজদের প্রতি যত ক্ষোভই পোষণ করুন না কেন, বাস্তবে তিনি আগ্রাসন রুখে দাঁড়ানোর জন্য কোন চেষ্টাই করেন নি বা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঘটনাচক্রের এক পর্যায়ে এই নিরীহ কবিতাপ্রেমী বাদশাহকেই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের নেতৃত্ব দান করতে এবং সে কারণে চরম ও অন্যায় দন্ড ভোগ করতে হয়েছিল। বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি বিদ্রোহের পূর্ব থেকেই ধূর্ত ইংরেজের কু-নজর ছিল। দিল্লির এই প্রায়-ক্ষমতাহীন শাসকের দিকে লক্ষ্য রেখেই ইংরেজরা বিদ্রোহের আগেই নির্দেশ জারী করেছিল যে, বাহাদুর শাহের পর আর কেউ সম্রাট থাকবেন না এবং সম্রাট না থাকার কারণে মোগল বংশের কেউই লালকেল্লায় বসবাস করতে পারবেন না। তাদেরকে বাস করতে হবে শহরের মেহেরালী নামের এক নগণ্য মহল্লায় সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে সাধারণ সুযোগ-সুবিধার মধ্যে। বিদেশী দখলদারদের এহেন নির্দেশ কেবল মোগল বংশকেই নয়, সমগ্র দেশবাসীকেও দারুণ ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। কারণ সেদিন এই মোগল সম্রাটই ছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সর্বশেষ প্রতীক। তাঁকে সামনে রেখেই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহী স্বাধীনতাকামীগণ স্বদেশের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সর্বশেষ সশস্ত্র লড়াইয়ের সূত্রপাত করেন।
• এভাবেই মুক্তি মিছিলে সক্রিয় হয়েছিলেন ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও বেগম জিনাত মহল, অযোধ্যার ক্ষমতাচ্যুত নবাব সৈয়দ ওয়াজেদ আলী শাহ ও বেগম হযরত মহল, ঝাঁন্সির রাণী লক্ষ্মীবাঈ, মারাঠা নেতা তাঁতিয়া তৌপি, নানা সাহেব এবং রায়বেরেলির মুজাহিদ নেতা মাওলানা আহমদুল্লাহ।
• মহাবিদ্রোহের সামনের কাতারের নেতাদের মধ্যে একমাত্র মাওলানা আহমদুল্লাহই সিংহাসন, ভাতা বা কোন ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা হারানোর কারণে নয়, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার এবং বিদেশী দখলদার-সাম্রাজ্যবাদী বিতাড়নের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির শাহাদাতের পর তাঁর এই সুযোগ্য শিষ্যই পাটনায় একটি কেন্দ্র স্থাপন করে স্বাধীনতার বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে স্বাধীনতাকামী-মুজাহিদ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাংগঠিক তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। মূলত তিনিই ছিলেন স্বাধীনতাকামী-মুজাহিদ বাহিনী এবং মহাবিদ্রোহের অন্যান্য সহযোগী শক্তিসমূহের [সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও বেগম জিনাত মহল, নবাব সৈয়দ ওয়াজেদ আলী শাহ ও বেগম হযরত মহল, রাণী লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া তৌপি, নানা সাহেব প্রমুখ] মধ্যে প্রধান যোগসূত্র।
কার্যকারণ
১৮৫৭ সালের সর্বব্যাপ্ত সিপাহি-জনতার সম্মিলনে জনযুদ্ধের সূচনা সম্পর্কে যেমন বহুমত রয়েছে, তেমনি রয়েছে একাধিক কারণের সমাবেশ। অনেকে কারণ হিসাবে একাধিক্রমে ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষকে চিহ্নিত করেছেন। যুবরাজ মির্জা ফিরোজ শাহের ঘোষণা হতে ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের ক্ষোভের কতক সুস্পষ্ট কারণ দেখতে পাওয়া যায়। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা কারণ হিসাবে এগুলোর ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মাত্রাগুলো অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। যেমন:
1. ইংরেজদের অভিপ্রায় পূর্বতন রাজা এবং ওমরাহদের বংশ ধ্বংস করা;
2. ইংরেজরা ভারতের সমস্ত ধর্মের গ্রন্থসমূহ ধ্বংস করছে;
3. তারা দেশীয় রাজন্যবর্গের ভূমি-অধিকার অস্বীকার করছে;
4. ভারতীয় নারীদের বিয়ের মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতে স্বতন্ত্র একটি জাতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে;
5. দেশীয় সিপাহিদের তারা বিশেষ আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেয় না;
6. ইংরেজরা দেশীয় সিপাহিদের কাছে অস্ত্র হস্তান্তরে অনিচ্ছুক;
7. ইংরেজদের সঙ্গে একত্রে খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা তথা সাংস্কৃতিক আনুগত্যের সম্পর্ক স্থাপন না করলে তারা দেশীয়দের চাকুরি দেয় না;
8. ইংরেজরা মৌলভী ও ব্রাহ্মণদের ধর্ম প্রচারে বাধা দিচ্ছে;
9. ভারতীয়দের ব্রিটিশ আইনে বিচার করা হচ্ছে;
10. খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তকরণের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে;
11. ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি ইংরেজরা অবজ্ঞা দেখাচ্ছে;
12. ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মান্তর করণের কাজে কোম্পানি অনুমতি দিয়েছে।
ইংরেজ গবেষক-লেখকেরা অন্যবিধ বিষয়াবলীকে যুদ্ধের পটভূমি বা কারণ হিসাবে তুলে ধরেছেন। ১৮৫৭ সালের যুদ্ধাবস্থার বিশ্লেষক-গবেষক মন্টগোমারী মার্টিনের মতে:
1. অত্যাচারি ও শোষণমূলক ভূমিনীতি;
2. অদক্ষ প্রশাসন ও বিচার;
3. সরকারি চাকুরি হতে ভারতীয়দের বর্জন নীতি;
4. ইংরেজদের দেশীয় ভাষার অবজ্ঞা এবং দেশীয়দের প্রতি হীন ও অবজ্ঞামূলক মনোভাব;
5. শিক্ষানীতি, ধর্মীয় সংস্কার ও মিশনারিদের কার্যকলাপ;
6. জাতিভেদ প্রথা;
7. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা;
8. ক্রটিপূর্ণ মুদ্রানীতি;
9. আফিমের একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার;
10. জনহিতকর কার্যে কোম্পানির অবজ্ঞা;
11. ইংরেজদের কর্মোদ্যমের অভাব;
12. দেশীয় রাজ্য সংযোজন নীতি;
13. হিন্দু উত্তরাধিকারী আইনের বিরুদ্ধাচরণ;
14. সাতারা, নাগপুর, কর্ণাট, ঝাঁন্সি, তাঞ্জোর ও অযোধ্যা ইত্যাদি দেশীয় রাজ্যের উপস্থিতির বিলোপ সাধন;
15. বাংলার সৈন্যের সার্বিক অবস্থা, শিথিল আইন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক কর্মচারিদের প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ, বেসামরিক নিয়োগ, স্বল্প সংখ্যক ইউরোপিয় সৈন্যের ভারতে উপস্থিতি, সিপাহিদের ষড়যন্ত্র;
16. পারস্য ও রাশিয়ার বৈদেশিক ষড়যন্ত্র।
১৮৫৭ সালে মহাযুদ্ধের পেছনে যে যথেষ্ট পরিমাণ কারণ বিদ্যমান ছিল, এবং এটি যে কেবল বিচ্ছিন্ন ষড়যন্ত্র বা ক্ষমতা দখলের মুসলিম চক্রান্ত ছিল না, সেটা বিভিন্ন লেখকের বিশ্লেষণ ও মতামতসমূহকে তুলনা করা হলেই অনুধাবণ করা যায়। ইংরেজ লেখকের পাশাপাশি এদেশীয় লেখকদের মতামত লক্ষ্য করলেও একই চিত্র উদ্ভাসিত হয় যে, এটি একটি মুসলিম নেতৃত্বাধীন সর্বভারতীয় জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল এবং সিপাহি ও জনতার সম্মিলনে এটি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হকের মতে:
‘‘সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী সংঘটিত প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, যাকে ইউরোপিয় ঐতিহাসিকরা সিপাহি বিদ্রোহ বলে আখ্যায়িত করেন। এই স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো দেশব্যাপী জনগণের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন; যার সূচনা হয়েছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং ফরায়েজি সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। এই স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর ফলশ্রুতি এবং এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম সবাই সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র দেশকে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের অধীনে একত্রিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। অবশ্য আলীগড়পন্থী মুসলিমদের মতে এটাই ছিল মুসলিমদের ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের সর্বশেষ প্রচেষ্টা।’’
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিমদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ ও নেতৃত্বের কারণে ‘মুসলিম মানেই বিদ্রোহী’ বলে ইংরেজরা উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট ইংরেজ গবেষক ও ঐতিহাসিক P. Hardy তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Muslims of British India” গ্রন্থে লিখেছেন:
“For most British observers in 1857 a Muslim meant a rebel.”
১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা বা আজাদীর যুদ্ধে মুসলিমদের ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করে আরেক ইংরেজ ঐতিহাসিকও অভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন:
“The first sparks of disaffection it was generally agreed, were kindled among the Hindu sepoys who feared an attack upon their caste. But the Muslims then fanned the flames of discontent and placed themselves at the head of movement, for they saw in these religious grievances the stepping stone to political power. In the British view it was Muslim intrigue and Muslim leadership that converted a sepoy mutiny into a political conspiracy, aimed at the extinction of the British Raj.”
[সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ধর্মের ওপর আঘাতের ভয়ে হিন্দু সৈন্যরা অসন্তোষের প্রথম শিখাটি জ্বালিয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা সেই অসন্তোষের অগ্নিশিখাকে উস্কে দেয় এবং নিজেদেরকে আন্দোলনের শীর্ষ স্থানে নিয়ে যায়। তারা এই ধর্মীয় আঘাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় যাওয়ার প্রথম সিড়িটি দেখতে পায়। ইংরেজদের মতে, এটা ছিল মুসলিমদের ষড়যন্ত্র ও নেতৃত্ব, যা একটি সামান্য সিপাহী বিদ্রোহকে ইংরেজ শাসনের অবসানকামী রাজনৈতিক চক্রান্তে রূপান্তরিত করে।]
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ইংরেজ কর্তৃক উপমহাদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী সময়কালে মুসলিমদের উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটটিকে ব্রিটিশ গবেষকরা ঘৃণ্যভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং শত সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় যে প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতব্যাপী সূচিত হয়েছিল, তাকেও মুসলিম নেতৃত্বে পরিচালিত ‘ইংরেজ শাসনের অবসানকামী রাজনৈতিক চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মুসলিমরা নেতৃত্বে ছিলেন এটা ঠিক। কারণ, ইংরেজ শাসনকে চ্যালেঞ্জ করার মত নেতৃত্ব, এলিট শ্রেণী ও সামরিক সক্ষমতা সেই আমলের ভারতে অন্য কোন সম্প্রদায়ের ছিল না। কিন্তু এটা তো কোনভাবেই কেবল ‘ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত’ ছিল না; ছিল জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে মুসলিমদের নেতৃত্ব দান ও অবদান রাখার বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক::
‘‘১৮৫৭ সালের যুদ্ধের সমস্ত দায়-দায়িত্ব মুসলিমদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। ব্রিটিশদের ক্রোধানলে পড়ার জন্য এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলন বা আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়াটাই যথেষ্ট ছিল। ইংরেজ-হিন্দু নির্বিশেষে মুসলিমদেরকে এ যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছে।’’
স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমদের মধ্যে প্রথম দিকের লেখক হিসাবে ১৮৫৭ সালের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে ‘সিপাহি বিদ্রোহের কারণ’ নামে যে গ্রন্থ লিখেছিলেন, তাতে তিনি পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেন যে, ‘‘বিজাতীয় শাসন বিলোপ করার উদ্দেশ্যে জাতি কোনো হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়নি।’’ অথচ ১৮৫৭ সালে মুসলিম নেতৃত্বে সংঘটিত একটি সর্বাত্মক গণআন্দোলন ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে বিকৃতভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে ইংরেজ গবেষক-লেখকেরা আমাদের বিপ্লবী-স্বাধীনতাকামী-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবময় ধারাবাহিকতাকে পথভ্রষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছে।
ইতিহাস বিকৃতির সূচনা
১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রামের ঘটনাবলীকে বিকৃত করা এবং মুসলিমদের স্বাধীনতাকামী-জাতীয়তাবাদী-বৈপ্লবিক আন্দোলনকে ‘ক্ষমতা দখলের বিচ্ছিন্ন চক্রান্ত’ বা ‘ওয়াহাবী ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি ক্ষুদ্র ও ভ্রষ্ট চরিত্রে প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে ইংরেজ এবং তাদের বশংবদ, বিশেষ করে, বাঙালি মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায়ের লেখক-গবেষকদের তৎপরতার একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করা হলে বুঝা যাবে যে, তারা ১৮৫৭ সালকে কত সিরিয়াসভাবে নিয়েছিল এবং এর মূল স্পিরিটটিকে নস্যাৎ করতে কত নৈপুণ্য দেখিয়েছিল। মূলত আমাদের ভূখন্ডে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা ও বিকাশ এখান থেকেই শুরু হয়।
স্যার উইলিয়ম মূরের [১৮১৯-১৯০৫] নাম এক্ষেত্রে প্রথমে চলে আসে, যিনি ১৮৫৮-১৮৬১ সালে Life of Mohammed এবং ১৮৯১ সালে The Caliphate, its Rise, Decline and Fall নামের দু‘টি বড় মাপের গ্রন্থ রচনা করেন এবং যার প্রধান লক্ষ্যই ছিল এই মিথ বা উপকথাকে প্রতিষ্ঠা করা যে, ‘ইসলাম এক হাতে তরবারি আর অন্য হাতে কুরআন নিয়ে বিশ্ব দখল করেছে।’ মূরের উদ্দেশ্যকে বলতে গিয়ে আরেক বিশিষ্ট ইংরেজ পন্ডিত পি. হার্ডি লেখেন:
“whose [books] helped to foster the myth of the Muslim as always armed with the sword in one hand and the Qur`an in the other.”
১৮৫৭ সালের অকটোবর মাসে যুদ্ধের মধ্যে মূর তাঁর ভাইকে এক চিঠিতে লেখেন:
“The Musulmans, while they thought their cause had a fair chance of final success have frequently compromised themselves by flagrantly traitorous acts. At Allygurh, for instance, the Musulmans were for a considerable time dominant; they forcibly converted many Hindoos; they defied our Government in the most insolent manner; all the ancient feelings of warring for the Faith, reminding one of the days of the first Caliphs, were resuscitated.”
ইংরেজদের সৃষ্ট ইতিহাস বিকৃতির ধারা এবং মুসলিমদের চরিত্র হননের কাজটি অতি দ্রুত তৎকালীন রাজধানী কলকাতার হিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ সোৎসাহে শুরু করে। মুসলিমদের ওহাবী, বিপ্লবী, সন্ত্রাসী, মধ্যযুগীয়, অনাধুনিক ইত্যাদি কুৎসার মাধ্যমে চিত্রিত করা হতে থাকে। যে বিবরণ প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আরও বিস্তারিতভাবে দেওয়া হয়েছে এবং মজার ব্যাপার হলো আজ অবধি ইতিহাস বিকৃতির এহেন ধারা আমাদের পারিপার্শ্বে অব্যাহত রয়েছে।
নেতৃত্বের নানা দিক
ইতিহাস বলছে, পলাশী বিপর্যয়ের [১৭৫৭] ঠিক ১০০ বছর পর ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বিশাল-বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে জাতীয় মুক্তির সানাই এবং স্বাধীনতার যুদ্ধের রক্ত-পাগল-করা দামামা বেজে উঠে। শত বছর ধরে এদেশের স্বাধীনতাকামী মুসলিমরা নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে ‘রাণীর বিদ্রোহী প্রজা’ অভিধা লাভ করেছিলেন, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ছিল তারই অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। স্বাধীনতাকামী বৈপ্লবিক-জিহাদি আন্দোলনের নায়কগণই ছিলেন ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বা ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’-এর নেতৃত্ব দানকারী মূল শক্তি ও আদর্শিক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রস্থল।
১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব ও প্রেরণায় মুসলিমদের অগ্রণী ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। ইংরেজ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী মুসলিম আন্দোলন ও সংগ্রামের অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ধারা ১৮৫৭ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বহিরাগত-দখলদারদের ক্ষমতার ভিত্তি।
সংক্ষিপ্তভাবে যদি আমরা ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটগত দিকটিকে আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, ভারতে মুসলিম নেতৃত্ব ও মানস যে কোনো বহিরাগত আদর্শ বা শক্তির মুকাবিলায় সদা প্রস্ত্তত ও সংগ্রামরত থেকেছে। বলতে গেলে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর [১৭০৭] পর মোগল সাম্রাজ্যের যে অবক্ষয় ও পতনের যুগ শুরু হয়, তখন থেকেই সূচিত হয় মুসলিমদের পুনরুত্থানের প্রচেষ্টা। সেই সময় মুসলিমদের আত্মশুদ্ধিভিত্তিক যে সংস্কার আন্দোলনের শুরু হয়, বস্ত্তত তা থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম নবজাগরণ ও পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহ [রহ.]-এর নেতৃত্বে সূচিত ‘তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া’ বা ইংরেজদের ভাষায় ‘তথাকথিত ওয়াহাবি আন্দোলন’ পরবর্তীকালে তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজের শিষ্য সৈয়দ আহমদ বেরেলভি শহীদের অধিনায়কত্বে শিখ ও ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। সৈয়দ আহমদ বেরেলভির শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটে। সুদূর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা থেকে পূর্ব প্রান্তের বাংলায়ও এর সজোর ধাক্কা লাগে। তৎকালীন বাংলার পূর্বাঞ্চলে [বর্তমান বাংলাদেশে] হাজি শরিয়তুল্লাহ এবং তাঁর পুত্র মোহসেনউদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ এবং পশ্বিমাঞ্চলে [বাংলাদেশের খুলনা-যশোর এবং ভারতের অধীনস্থ পশ্চিম বঙ্গ] মির নেসার আলী তিতুমীরের অধিনায়কত্বেও মুসলিম জাগরণবাদী-প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। এইসব আন্দোলন অচিরেই ভূম্যাধিকারী ও ইংরেজ প্রশাসনবিরোধী কৃষক-প্রজাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলনের রূপ লাভ করে। দুদু মিয়া ও তিতুমীরের প্রতিরোধ আন্দোলনের পাশাপাশি সৈয়দ আহমদ শহীদের অনুসারীরা ১৮৪০-এর দশকে নতুনভাবে সজ্জিত হয়ে ১৮৫০-এর দশকে তুমুল ইংরেজবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, ‘‘১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধেও এ আন্দোলনের জোর পরোক্ষ প্রভাব ছিল।’’
১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হলে ‘‘ফরায়েজিরা মুসলিম শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবার আশায় আশান্বিত হয়। কারণ, তাদের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব কারও অজানা ছিল না। তাছাড়া তাদের চলাফেরা ও কথাবার্তায় এসব মনোভাব প্রকাশ পেত। তদুপরি এ সময় ইংরেজ সরকারের কাছে নামে-বেনামে ফরায়েজিদের বিরুদ্ধে এ মর্মে চিঠি আসতে আরম্ভ করে যে, তারা সিপাহিদের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। অধিকন্তু তাঁরা বিদ্যালয় থেকে তাঁদের ছেলেমেয়েদের ফেরত নিচ্ছে। আগামীতে তাঁরা মুসলিম শাসনের প্রতিনিধি হতে পারে, এমন খবরও পত্র মারফত সরকারকে জানানো হয়। ফরিদপুরের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট সরকারের কাছে উল্লেখ করেন যে, ফরায়েজিরা একযোগে বিদ্রোহের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে এবং তাঁরা সিপাহিদের কাছে সমর্থনের জন্য লিখেছে।’’
দৃশ্যতই দেখতে পাওয়া যায় যে, প্রথম স্বাধীনতার প্রাক্কালে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশবাদ বিরোধী সকল ইসলামী শক্তিই তাদের সংগ্রামী গণপ্রতিরোধ আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে ১৮৫৭ সালে প্রেক্ষাপটে কাজে লাগাতে সচেষ্ট ছিল। উল্লেখ্য:
‘‘১৮৩১ সালে [৬ মে] বালাকোটে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির মুজাহিদ-মুক্তি বাহিনীর আপাতঃ বিপর্যয়ের পর স্বাধীনতাকামী জিহাদি-বিপ্লবী ভাবধারায় উজ্জীবীত নেতৃবৃন্দ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন কেন্দ্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভির অন্যতম অনুসারী হাফিয কাসিম। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে জেনারেল বখত খান, মওলানা আহমদউল্লাহ শাহ ও মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদী দিল্লি কেন্দ্রে, হাজি ইমদাদুল্লাহ ও তাঁর অনুসারীগণ শামেলি, সাহারানপুর ও থানাভবনে সক্রিয় ছিলেন। হাফিয কাসিমের অনুসারী নেতৃস্থানীয় স্বাধীনতা-সংগ্রামী-মুজাহিদদের মধ্যে দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা কাসিম নানুতুভি, মওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, মওলানা মোহাম্মদ মুনীর প্রমুখ বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্বে উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ও কানপুরসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে এক সুগ্রন্থিত যোগসূত্র বিদ্যমান ছিল।’’
বিশিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ গবেষক আনিসুজ্জামানের মতে:
‘‘...এই পূর্বপরিকল্পনার পশ্চাতে তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়াপন্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। বিদ্রোহী সৈন্যদের সর্বাধিনায়ক বখত আলী খান এ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁর গুরু সরফরাজ আলী ছিলেন কেরামত আলী জৌনপুরীর শিষ্য। বিদ্রোহীদের আর দু‘জন নায়ক শাহজাদা ফিরোজ শাহ এবং মৌলভি আহমদউল্লাহও ওয়াহাবি ছিলেন। এই বিদ্রোহে হাজার হাজার ওয়াহাবি স্বেচ্ছাসেবক যোগ দিয়েছিলেন।’’
আনিসুজ্জামানের ব্যাখ্যায় ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম আকস্মিক ছিল না এবং এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। যদিও তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে গ্রহণকারীদেরকে ঢালাওভাবে ওয়াহাবি বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও আমরা ইংরেজ কর্তৃক ওয়াহাবি অভিধা ব্যবহারের ষড়যন্ত্রমূলক উদ্যোগ সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৫৬ সাল থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা মওলানা আহমদউল্লাহর সিদ্ধান্তে বিপ্লব ও বিদ্রোহের সঙ্কেতবাহী চাপাতি রুটি এবং রক্তজবা ফুল বিতরণ শুরু হয়ে যায়। আনিসুজ্জামান রক্তজবা ফুলের বদলে পদ্মফুলের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সংশয়ের সঙ্গে লিখেন: ‘‘...চাপাটি আর পদ্মবিলি হবার কাহিনী যত অতিরঞ্জিতই হোক না কেন, এর মূলে কিছু সত্যতা নিশ্চয় ছিল।’’ অন্যদিকে, গবেষক-ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন:
‘‘এক গ্রামের নেতার হাত থেকে দ্রুত অন্য নেতার হাতে ঘুরছিল বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী চাপাতি রুটি। এক সৈন্য আরেক সৈন্যের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন রক্ত-রঙিন আযাদী বিপ্লবের ইঙ্গিতবাহী জবা ফুল। সে কার্যক্রম ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত। দিল্লি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সবখানে বিপ্লবীদের কার্যক্রমের খবর প্রতিদিনই সতর্কতার সাথে পৌঁছে যাচ্ছিল।’’
সিপাহি যুদ্ধে ইতিহাস রচয়িতা রজনীকান্ত গুপ্তও মুসলিমদের নেতৃত্বদান এবং চাপাতির প্রসঙ্গ স্বীকার করে লিখেছেন:
‘‘এর মধ্যে রুটি বা চাপাতির ঘটনা এসে পড়ে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে এ চাপাতি ঘুরতে থাকে। গ্রামের প্রধান এই চাপাতি অন্য গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। কেউ এটা নষ্ট করে না। সরকার অনুসন্ধান করে এর কোনো হদিস বের করতে ব্যর্থ হয়। তবে অধিকাংশ লোক এ মত পোষণ করে যে, এই চাপাতি দেশের মুসলিমদেরকে একসূত্রে গ্রথিত করছে এবং শীঘ্রই সকলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সমুত্থিত হবে।’’
এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সর্বাত্মক যুদ্ধ কোন আকস্মিক বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া বা পরিকল্পনাবিহীন কোন ঘটনা মাত্র নয় এবং এই আন্দোলন-সংগ্রাম-যুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন সংগ্রামী মুসলিম নেতৃবৃন্দ, যাঁদের ছিল ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ঐতিহ্য এবং যাঁদেরকে ইংরেজ ও ধর্মনিরপেক্ষ গবেষকরা ‘ওয়াহাবি’ অভিধায় বিচ্ছিন্নভাবে চিত্রিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেন। এ কারণেই দেখা যায়, ১৮৫৭ সালের এপ্রিল মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে জনগণকে অনুপ্রাণিত করা এবং ইংরেজবিরোধী প্রচারপত্র বিলির অপরাধে সংগ্রামের অগ্রণী নেতা মওলানা আহমদউল্লাহকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়। আটক ও শহীদ হওয়ার পূর্ব-পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনকে তিনি বেগবান করে গেছেন এবং ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে মাদ্রাজে যে বক্তৃতা করেন, তাকে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদবিরোধী স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক দলিল বলা যায়:
‘‘দেশবাসী, আপনারা জেগে উঠুন। ফিরিঙ্গি কাফেরদের উৎখাত করতে আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। এই কাফেররা ন্যায়কে পদদলিত করছে, আমাদের স্বরাজ্যে তারা লুণ্ঠন করছে। এই কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য আমাদেরকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সে সংগ্রাম হবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য জিহাদ।’’
স্বাধীনতা আন্দোলনের এমন অসংখ্য নেতা ভারতবাসীকে ইংরেজ বিতাড়ণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সশস্ত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন। দিল্লির মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নায়কদের সংগ্রামী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এক ঘোষণা পত্র প্রচার করেন এবং ‘‘বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান।’’
মূলত মুসলিম নেতৃত্বই ছিল যুদ্ধের চালিকা শক্তি। স্যার জেমস আউটরামের মতে, ‘‘বিপ্লবী মুসলিমগণই ছিলেন এই বিদ্রোহের মূল শক্তি।’’ বিদ্রোহ দমনের কাজে নিয়োজিত দু‘জন ইংরেজ সৈন্য ১৮৫৭ সালে বেনামীতে লেখা বিদ্রোহের ইতিহাসমূলক একটি গ্রন্থে স্বাধীনতা আন্দোলনে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলীর ভূমিকা প্রসঙ্গে লিখেন:
‘‘রাজ্যচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলী ১৮৫৬ সালের এপ্রিলে কলকাতায় নির্বাসিত হন এবং তিনি ব্রিটিশ শাসন উৎখাতের উপায় তালাশ করতে থাকেন। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং সৈন্যদের সমর্থন আদায়ের জন্য তিনি চেষ্টা চালাতে থাকেন। অযোধ্যার নবাবের সভাসদ ও অনুচরবৃন্দ সন্দেহাতীতভাবে এই বিদ্রোহে জড়িত ছিল।’’
স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য মুসলিমরা কিরূপ ভয়াবহ নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেটা জানা যায় আন্দামান দ্বীপে বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামী মওলানা ফজলে হক খয়রাবাদীর বিবরণে:
‘‘স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তবেই কোন হিন্দুকে আটক করা হতো, কিন্তু পালাতে পারেনি এমন একজন মুসলিমও সে দিন বাঁচে নি।’’
কত স্বাধীনতা-সংগ্রামী মুসলিম এবং আলিম-মুজাহিদের জীবন ব্রিটিশ ফাঁসি কাষ্ঠে বা বুলেটে শহীদ হয়েছিল, সে বিশাল হিসাব পাওয়াও আজ আর সম্ভব নয়। ঢাকার সদরঘাটের অদূরে বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক বা ‘আন্টাঘর ময়দান’-এ মাসের পর মাস শহীদদের পবিত্র লাশ ঝুঁলিয়ে রেখে জনগণকে ভীত ও দুর্বল করতে চেয়েছিল ইংরেজরা। বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল ঢাকার লালবাগের অদূরে স্থাপন করেছিল স্বাধীনতাকামীদের নির্যাতন করার জন্য কারাগার। সমগ্র ভারতের বড় বড় শহরগুলো হয়ে ওঠেছিল মুসলিমদের তাজা রক্তে রঞ্জিত। দিল্লি, আগ্রা, কানপুর, মিরাট, সাহারানপুরসহ সারা ভারতে মুসলিম নিধনের এত বড় ঘটনা ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। যুদ্ধোত্তরকালে ইংরেজ শাসনে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে মুসলিমদেরকে কোণঠাসা করে এমন শোচণীয় পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হয়, যেন তারা আর কখনওই ১৮৫৭ সালের মত নেতৃত্ব দিয়ে দেশবাসীদের স্বাধীনতার যুদ্ধে উজ্জীবীত করতে না পারে এবং নিজেরাও যেন স্বাধীনতার দাবীতে আর কখনওই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
ব্যর্থতার নেপথ্য এবং বিপ্লবীদের ইতিবৃত্ত
প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনেই একজন মূল বা কেন্দ্রীয় নেতার প্রয়োজন হয়। শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর তখন ৮২ বছরের নিবু নিবু প্রদীপ। বিপ্লবীরা তাঁকেই নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করায় বৃদ্ধ সম্রাট বললেন, ‘‘আমি সর্বান্তকরণে তোমাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমার না-আছে অর্থ, না-আছে সৈন্য।’’ এই কথায় জনসাধারণ সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘‘হুজুর, আমরা ধনও চাই না, সৈন্যও চাই না। আমরা চাই যে, আপনি অনুগ্রহ করে আপনার নেতুত্বের সমর্থন আমাদের দিন।’’ বাদশাহ তখন বললেন, ‘‘আমার যা কিছু আছে তা তোমাদের দায়িত্বে দিলাম। তবে তোমরা বিশৃঙ্খলা করো না। তোমরা লুটপাট ও নারী-শিশুদেরকে হত্যা করো না। আমার সম্পত্তি-অলঙ্কার বিক্রয় করে তোমাদের বেতন দেব।’’ বৃদ্ধ বাদশাহ বাহাদুর শাহের নেতৃত্বে ভারতীয় জনসাধারণের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সফলতার মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়। কারণ সেখানেও ছিল বেঈমানী। মোহনলাল, গোবিন্দ দাস, আগাজানদের বিশ্বাসঘাতকতা, ভারতীয় রাজন্যবর্গের অসহযোগিতা, উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রের অভাব সর্বভারতীয় স্বাধীনতার প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয় নি। বাহাদুর শাহ নিজের অনেক কিছু বিক্রয় করে বিপ্লবী সৈনিকদের ছয় মাসের অগ্রিম বেতন দিলেন। যখন আর পেরে উঠলেন না, তখন ভারত সম্রাট ভিক্ষুকের মত ধনী ব্যবসাদার রামজীমলকে বললেন, ‘‘আমি আপনার নিকট অর্থ ঋণ হিসাবে চাচ্ছি, কর হিসাবে নয়।’’ কিন্তু রামজীমল ঋণ দিতেও অস্বীকার করলেন। অথচ আগ্রার ধনী ঠিকাদার জ্যোতিপ্রসাদ ইংরেজদের ত্রিশ হাজার টাকা যুদ্ধকালীন তহবিলে সাহায্য দিলেন। এদিকে হঠাৎ বাজার থেকে রসদ ও বারুদ উধাও হয়ে গেল। যামিনী দাসের মত অর্থলোভীরা আটার মজুদ গড়ে তুললেন। যিনি বারুদ লুকিয়ে রেখে সঙ্কট সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন তার নাম দেবীলাল। ঐ বারুদ দিয়ে তিনি ইংরেজদের সাহায্য করেছিলেন। ফলে যুদ্ধের গতি ঘুরে গেল। ১৮৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সম্রাট বুঝতে পারলেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে তাঁর আর বেশি দেরি নেই। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র কেশ রক্ষিত যে বাক্সটি তাঁর কাছে ছিল, সেটি ইংরেজ ও তাদের দোসরদের দ্বারা কলঙ্কিত হওয়ার ভয়ে তিনি সেটি হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়ার মাজারের তত্ত্বাবধায়নকারীর হাতে সঁপে দিলেন এবং নিজে সপরিবারে হুমায়ুন মাকবারা বা হুমায়ুনের সমাধিস্থলে আত্মগোপন করে রইলেন। কুখ্যাত ইংরেজ সেনাপতি হডসন নির্দয় অপমান সহকারে সম্রাটকে গ্রেফতার এবং দুর্গে বন্দী করলেন। যে সম্রাট একদিন বিপ্লবীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না-করতে এবং নারী-শিশু হত্যা করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন, ইংরেজ সেনাপতি হডসন সেই সম্রাটের দুই পুত্রসহ পরিবারের মোট ২৯ জন শিশু, বালক, বালিকাকে দিল্লির প্রকাশ্য রাজপথে নৃশংসভাবে হত্যা করলো। এমন কি, এহেন পাষন্ড হডসন সেই ২৯ জন নিহত বাচ্চার কাটা মাথা সম্রাটকে পাঠিয়ে দিল। পরিবারের অবশিষ্টদেরসহ সম্রাটকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়। অথচ তিনি ভারতবর্ষে তাঁর কবরের জন্য মাত্র একখন্ড জমির জন্য হাহাকার করেছিলেন। রেঙ্গুনে তিনি বিনা চিকিৎসায় একটি ছোট্ট কামরায় দুঃখময় বন্দী জীবন কাটান এবং পরবর্তীতে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর শুক্রবার তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়। রেঙ্গুনেই নির্বাসিত শেষ মোগল সম্রাটের সমাধি রয়েছে।
১৯৭৭ সালের অকটোবর মাসের কয়েক দিন বাংলাদেশ সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে তৎকালীন বার্মা বা বর্তমান মায়ানমার সফরের সময় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী-এর সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়া সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সম্পর্কে খোঁজখবর নেন এবং সে সকল তথ্য তাঁর রঙ্গুম রঙ্গিলার দেশে নামক গ্রন্থে উলে¬খ করেন : ...সকাল আটটায় সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজার পরিদর্শনের কর্মসূচী। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। ইংরেজরা তাঁকে মহাবিপ্ল¬বে নেতৃত্বদানের অভিযোগে প্রহসনমূলক এক বিচারের মাধ্যমে এখানেই নির্বাসন দন্ড দিয়েছিল। তাঁর নির্বাসিত জীবন এই রেঙ্গুন নগরীর উপকণ্ঠে পুরাতন ঘোড়দৌড়ের মাঠের নিকটে একটি দ্বিতল কাঠের ভবনে কড়া প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় অত্যন্ত অনটনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। বাহাদুর শাহের মাজারে যখন উপনীত হলাম, তখন সেই হতভাগ্য সম্রাটের অন্তিম জীবনের বেদনা-বিধুর দিনগুলির দীর্ঘশ্বাস যেন অনুভব করতে লাগলাম সেখানকার নীরব-নিস্তব্ধ ভাবগম্ভীর পরিবেশে। দিল্লি¬র সিংহাসন হারালেন, সাম্রাজ্য হারালেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। সর্বস্ব হারিয়েও
অন্তিম জীবন স্বদেশের মাটিতে অতিবাহিত করার অধিকারটুকুও পেলেন না। সম্রাট চলেছেন নির্বাসনে। সঙ্গে আছেন রাণী জিনাত মহল এবং শাহজাদা জওয়ান বখত। পথে পথে জনসমুদ্র, তাদের চোখে দরবিগলিত ধারায় অশ্রু। সম্রাট নিজেই কাঁদছেন আর দু‘হাত তুলে আল্ল¬াহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন: ‘আমার এই অভাগা অসহায় লোকদের তুমি ছহি ছালামতে রেখো হে রহমানুর রহিম।’ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন স্বভাব কবি এবং সুফি-সাধক। তাঁর রচিত গজল ও কবিতা উর্দু এবং পারসি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সেই সব গজল ও কবিতায় তাঁর নির্বাসিত জীবনের করুণ কাহিনীর ছাপ সুস্পষ্ট। এ ধরনের একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন: ‘আমি কারো নয়নমণি নই, নই গো কোনো প্রাণের শান্তি ধারা/এক মুঠো ধুলির মতো আমি রয়ে গেলাম শুধুই ছন্নছাড়া/চেহারা আমার হয়েছে বিবর্ণ সৌন্দর্যের নাহি লেশ/আমি যেন ফসলের অবশেষ।’ কবিতাটি ইংরেজিতে পেয়েছিলাম। তা মোটামুটি বাংলা করেছিলাম সেদিন ডায়েরির পাতায় তাৎক্ষণিকভাবে। বাহাদুর শাহের মাজারে গিয়ে সেই আক্ষেপ-হাহাকারের আরো অনেক কথা শুনেছিলাম। হতভাগ্য সম্রাট ও তাঁর পরিবারের জন্য ভাতা দেয়া হতো মাসিক মাত্র ছয়শ’ টাকা। রাণীর অলঙ্কার বিক্রি করে সম্রাটের গ্রাসাচ্ছাদন চালাতে হতো। ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর সম্রাট বাহাদুর শাহ মারা যান। তাঁর অন্তিম শয্যা পাশে উপস্থিত ছিলেন রাণী জিনাত মহল, পুত্র জওয়ান বখত, পুত্রবধূ ও ছোট এক নাতনী। ১৮৮৬ সালের ১৭ জুলাই রাণী জিনাত মহলের মৃত্যু হয়। সম্রাটের কবরের নিকটে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৮৮৪ সালে মৌলমেইনে চরম দারিদ্রে্য শাহজাদা জওয়ান বখত মারা যান। তাঁকে কোথায় কবর দেওয়া হয়, তা এখনো অজ্ঞাত। সম্রাট বাহাদুর শাহ ও রাণী জিনাত মহলের কবরও বহুকাল যাবৎ অনাবিষ্কৃত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আবদুস সালাম নামের একজন বাঙালি মুসলিম অনেক কষ্ট করে সম্রাট ও রাণীর কবর আবিষ্কার করেন। বাহাদুর শাহ জাফরের আধ্যাত্ম সাধনার গুণে তাঁকে প্রবাসী মুসলিমরা পীর জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতো। এখনো তাঁর মাজার শরীফে প্রতি বছর সপ্তম চান্দ্র মাসে পবিত্র ওরস উদযাপিত হয়ে থাকে। মাজারের নিকট দিয়ে যে সড়কটি বিখ্যাত সোয়েডাগন প্যাগোডার দিকে চলে গেছে তা জাফর শাহ রোড নামেই পরিচিত। মাজারটি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বর্মা সরকার মাজারের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সাহায্য করে থাকেন। এসব কথা আমাদেরকে বলেন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার উ. ইউনুস। তিনি আমাদের মাজার শরীফের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন মাজারের পেশ ইমাম মৌলানা নূও মোহাম্মদের সাথে। মৌলানা সাহেবের বাড়ি কুমিল্ল¬ার চৌদ্দগ্রামে। তবে তিনি লেখাপড়া শিখেছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও সাতকানিয়ায়। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের রুহের মাগফেরাত কামনা করে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। ফেরার সময় মনে পড়ল তাঁরই বুকফাটা আর্তনাদ: ‘‘হাউ আনফরচুনেট ওহ জাফর/আর্ট দাউ টু বি ডিনাইড ইভেন টু ইয়ার্ডস অব ল্যান্ড/ফর গ্রেভ ইনদি কান্ট্রি দাউ লাভড।’ [কী দুর্ভাগা তুই রে জাফর/যে দেশকে তুই ভালোবাসিস/তার বুকে তোর কবরের জন্য/দুই গজ জমিও হায় তোকে দেয়া হলো না।]
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের মত ১৮৫৭ সালে মহাসংগ্রামও ব্যর্থ হয় জমিদার আর রাজা-মহারাজাদের বেঈমানির কারণে। এই মহাসংগ্রামকে ইংরেজ ও তাদের তাঁবেদার রাজা-জমিদাররা যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তীতে যে নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের মাধ্যমে নস্যাৎ করেছিল তার নজীর ইতিহাসে বিরল। বাহাদুর শাহ গ্রেফতার হওয়ার পর ইংরেজরা দিল্লিসহ সারা ভারতে যে নিষ্ঠুর হত্যালীলা চালিয়েছিল তা দেখে বিখ্যাত কবি মির্জা গালিব, যিনি সে সময় দিল্লিতে ছিলেন, লিখেছিলেন:
‘‘রক্তের সমুদ্র দেখেছি, আল্লাহ আর কতদিন দেখাবেন কে জানে!’’
নির্যাতনের করুণ ইতিকথা মিশে রয়েছে ১৮৫৭ সালের সঙ্গে। ইন্ডিয়ান মিউটিনি গ্রন্থে চার্লস বল লিখেন: ‘‘বেসামরিক ও সামরিক আদালতের হুকুমে যাদেরকে গুলী করে মারা হয় বা যাদেরকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়া হয় বা ফাঁসিতে হত্যা করা হয়, তাদের সংখ্যা ভয়ঙ্করভাবে বেশি। যুদ্ধ শেষে ইংরেজরা একটি ব্যাপক গণহত্যা চালায়। কমপক্ষে ত্রিশ হাজার মুক্তিকামী সিপাহি এবং পঞ্চাশ হাজার স্বাধীনতাকামীকে হত্যা করা হয়।’’ ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিরোধ-যুদ্ধে শহীদ সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির রক্তাক্ত কাটা-তাজা মাথা ভারতবাসীকে দিয়ে গেছে ইংরেজরা। ১৮৫৭ সালের বীর-বিপ্লবী মৌলভি আহমদউল্লাহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসম সাহসিকতায় লড়াই করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামনে এক জ্বলন্ত আতঙ্কে পরিণত হন। এ কারণেই ইংরেজ সরকার তাঁকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেওয়ার জন্য তৎকালীন ৫০,০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। অর্থের লোভে এবং ইংরেজ প্রভুদের খুশি করার জন্য পোয়াইনের রাজা জগন্নাথ বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে তাঁকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গুলী করে হত্যা করে এবং তাঁর ছিন্ন শির ইংরেজ প্রভুর কাছে প্রেরণ করে। এক নিষ্ঠুর ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আহমদউল্লাহর ছিন্ন শির প্রকাশ্য স্থানে দুইদিন ঝুলিয়ে রেখে জনসাধারণের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের জন্য প্রদর্শনী করা হয়। মিথ্যা সভ্যতাগর্বী ইংরেজরাজ বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কারস্বরূপ রাজা জগন্নাথকে ৬৫ হাজার টাকা পুরস্কার এবং জমিদারি দান করে।
অন্য এক বিবরণে জানা যায়:
‘‘বিপ্লবের এক পর্যায়ে মৌলভি আহমদউল্লাহর প্রচেষ্টায় অযোধ্যার বেগম হজরত মহলের পুত্র বিরজিস কদরকে সিংহাসনে বসানো হয় এবং অভিভাবকরূপে বেগম হজরত মহল দেশের শাসন কার্য তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করেন। আহমদউল্লাহ এবং বেগম হজরত মহল ইংরেজ ফৌজের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। আহমদউল্লাহ মুহাম্মদীপুরে ইসলামী হুকুমত কায়েম করেন। শাহজাদা ফিরোজ শাহসহ আরও কয়েকজন সেই হুকুমতের উজির নিযুক্ত হন। সেনাপতি পদে নিযুক্ত হন জেনারেল বখত শাহ। আহমদউল্লাহ রাজা বলদেব সিংহের আমন্ত্রণক্রমে গডডি অভিমুখে রওয়ানা হন। একদিন বিশ্বাসঘাতকদের প্ররোচনায় তিনি হাতীর পিঠে আরোহণ করেন এবং সেই অবস্থায় লুকিয়ে থাকা শত্রুর গুলীতে শাহাদৎ বরণ করেন। তাঁর শির খন্ডিত করে কোতোয়ালিতে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং দেহ খন্ড-বিখন্ড করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কয়েকদিন পর আহমদপুর মহল্লায় তাঁর পবিত্র শির দাফন করা হয়। আহমদউল্লাহর হত্যাকারীকে রাজা বলদেব সিংহ ৫০ হাজার টাকা বখশিশ দেন।
অযোধ্যার ক্ষমতাচ্যুত নবাবের বেগম হজরত মহল ১৮৫৭ সালে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। রাজধানী লাখনৌ-এর প্রতিরক্ষায় উন্নততর অস্ত্রসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি নিজে অংশ গ্রহণ করেছিলেন এবং লাখনৌ-এর পতন হলে তিনি রাজধানী ত্যাগ করে ফয়জাবাদে আহমদউল্লাহর বিপ্লবী বাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। শাহজানপুরের প্রচন্ড লড়াইয়ের সময় ইংরেজ বাহিনী সমস্ত দিক ঘিরে ফেললে অসম সাহস ও অসীম দক্ষতার সঙ্গে পথ তৈরি করে তিনি ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী নেপালের তরাই-এর দিকে চলে যান। কঠোর পরিশ্রম ও দুর্ভোগে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে নেপালের পাহাড়ি জনপদে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় বীরাঙ্গনা হজরত মহল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বীরাঙ্গনা হজরত মহল নেপালে প্রচন্ড বিরূপতার সম্মুখীন হন। ‘প্রতিবেশী শক্তিবর্গের বিরোধিতা’ অধ্যায়ে আমরা অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ১৮৫৭ সালের ঘটনা-প্রবাহে নেপালের বিরোধিতাপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরবো। এক্ষণে একজন প্রতক্ষ্যদর্শীর বিবরণ উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক হবে:
‘‘কাঠমান্ডুতে প্রায় পাঁচ বছর ছিলাম। নেপালি জামে মসজিদে জুম্মার নামায পড়তে গিয়ে সামনে পড়ত অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের দ্বিতীয় বেগম হজরত মহলের কবর। মসজিদের আঙিনায় স্বাধীনতা আন্দোলনের আরও কিছু নেতার কবরও রয়েছে। এঁরা কোনওক্রমেই ইংরেজ আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। লাখনৌ-এর নবাব-পত্নী সাধারণ ঘর থেকে এসে বেগম হন। এই শিল্পানুরাগী মহিলা পরবর্তীতে জাতির জন্য অস্ত্র তুলে নেন। এবং এভাবেই একজন সাধারণ মহিলা ইতিহাসে অমর স্থান অর্জন করেন। উল্লেখ্য, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে লাখনৌ-এর চিফ কমিশনার হেনরি লরেন্স নিজের লোকজনসহ রেসিডেন্সিতে আশ্রয় নেন। বিপ্লবীদের হাতে লরেন্স নিহত হলে স্বাধীনতাকামীরা পুরো এলাকা অবরোধ করে। ২৫ সেপ্টেম্বর হ্যাভলক ও আউটরামের নেতৃত্বে আরেকটি বিরাট ইংরেজ বাহিনী অযোধ্যায় এসে পৌঁছায়। জেনারেল নেইল এ সময়ে নিহত হন। নভেম্বরের প্রথম দিকে কলিন ক্যাম্পবেলও সসৈন্যে অযোধ্যায় এসে ইংরেজ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেন। অবশেষে নেপালি বাহিনী ইংরেজের সাহায্যে এগিয়ে এলে অযোধ্যা দখল করা সম্ভব হয়।’’
১৮৫৭ সালের ব্যর্থতার সঙ্গে মিশে রয়েছে আরও হাজারও বিপ্লবীর আত্মত্যাগের ইতিবৃত্ত। বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে গান রচিত হয়েছে ‘বড়লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম ভারতবাসী।’ অথচ ইতিহাস বলছে অন্য কথা:
‘‘ক্ষুদিরাম কোন ব্রিটিশ বড়লাটকে মারেনও নাই, মারতে যানও নাই। মিসেস কেনেডি নামক এক নিরীহ ইংরেজ মহিলাকে হত্যা করার অপরাধে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ভারতের দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে একজন মাত্র বড়লাটই বিপ্লবীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তাঁর নাম লর্ড মেয়ো। ১৮৭২ সালে বড়লাট লর্ড মেয়ো আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার জেল পরিদর্শনে গেলে সেখানে নির্বাসন দন্ডপ্রাপ্ত ‘ওহাবি বিপ্লবী’ মোহাম্মদ শের আলি শাবলের আঘাতে এফোঁড় ওফোঁড় করে লর্ড মেয়োকে হত্যা করে। পরে ইংরেজরা শের আলিকে ফাঁসি দেয়।’’
চট্টগ্রামের বিপ্লবী সূর্যসেনের ব্যাপারেও অনেক কথা হয়। কিন্তু ইতিহাস আবারও জানাচ্ছে যে:
‘‘সূর্যসেনের ৬৫ বৎসর আগে ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের বিপ্লবী বীর রজব আলি বিরাট দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম ট্রেজারি এবং জেল দখল করে নেন। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেন এবং তিনটি সরকারি হাতি ও সদ্য কারামুক্ত কয়েদীসহ চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। পথে ত্রিপুরার রাজা ঢাকা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের গতিরোধ করায় তারা মনিপুর অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে সিলেটের লাতু নামক স্থানে সিলেট বাহিনীর অধিনায়ক মেজর বাঙ-এর সৈন্যদের সাথে বিপ্লবীদের যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে মেজর বাঙ নিহত হয়। বিপ্লবীদের অধিকাংশও শহিদ হন। পরে খাদ্য ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে হাবিলদার রজব আলি ও তাঁর অনুগত সৈন্যদল রেঙ্গুনের গহীন পার্বত্য জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয় সেখানেই তাঁদের মৃত্যু হয়।’’
১৮৫৭ সালের বিপ্লবীরা আপাত পরাজিত হলেও থেমে থাকেন নি; বরং প্রবল প্রতাপে সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী ইংরেজদের হটিয়ে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।
‘‘১৮৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মহম্মদ আবদুল্লাহ নামক এক বিপ্লবী কলকাতা টাউন হলের সামনে চিফ জাস্টিস নরম্যানকে গুলী করে হত্যা করেন। পরে তিনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। ... মহম্মদ আসফাকউল্লাহ, পীর মহম্মদ, মাওলানা ইসমাঈল, হাফেজ আ. সামাদ, মহম্মদ রইসউল্লাহ, ইকবালমান্দ, গজনফর হোসাইন, সাখাওয়াত হোসাইন, তফাজ্জল হোসাইন, কাজি মিঞাজান, রহিম বখশ, আবদুল করিম, মাওলানা ইলাহি বখশ প্রমুখ গুচ্ছ গুচ্ছ নাম, যাঁরা ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছেন। গবেষক ঐতিহাসিকদের মতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য প্রায় পাঁচ লক্ষ বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়জনার নাম আমরা জানি, কয়জনাই বা আমাদের আলোচনায় উঠে আসেন। নিজেকে চিনি না বলেই অপরের ঘরে বাস করতে আমাদের বড়ই আহ্লাদ। সে ঘর যতই গোলামখানা বা কামলাখানা হোক না কেন, আমাদের পুলকের অন্ত নেই!’’
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা
সিপাহি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ গ্রন্থে রতন লাল চক্রবর্তী দাবী করেন যে: ‘‘প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম অন্যান্য জনগণ সিপাহি যুদ্ধের সময় ছিল নিস্ক্রিয়। ভারতের অন্যান্য কতিপয় অঞ্চলের মতো ভূস্বামী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী কোম্পানিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে, অবশ্য এই সহযোগিতার মূলে ছিল শ্রেণী স্বার্থ আদায়।’’ সন্দেহ নেই, গ্রন্থের নাম থেকেই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্ট। তিনি জাতীয় সংগ্রাম বা স্বাধীনতার যুদ্ধ না বলে ১৮৫৭ সালের ঘটনাবলীকে নাম দিয়েছেন ‘সিপাহি যুদ্ধ’। ইংরেজ সহযোগীরূপে ভূস্বামী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলে তিনি যাদেরকে যুদ্ধের সময় নিস্ক্রিয় বলেছেন, তারা ১৭৯৩ সালের ইংরেজ-প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’-এর সুবিধাভোগী নব্য হিন্দু জমিদার শ্রেণী এবং ১৮০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সনদ প্রাপ্ত কলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাদের হীন কার্যকলাপের কিয়দংশ এই অধ্যায়ে পর্যায়ক্রমে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি শ্রেণী স্বার্থ আদায়ের জন্য হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্তদের আনুগত্যকে চিহ্নিত করলেও তাদের সম্প্রদায়গত চারিত্র্যিক অবস্থানটিকে নিরূপণ করেন নি। তবে শিবনাথ শাস্ত্রী ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে কোনরূপ রাখঢাক না করেই সে কাজটি করেছেন। তিনি পরিস্কার ভাষায় ১৮৫৭ সালের ঘটনাবলীকে মিউটিনির হাঙ্গামা নামে অভিহিত করে যা লিখেন তা অপরিবর্তিত বানান ও ভাষায় উল্লেখ করা হলো:
‘‘১৮৫৭ সালে মহারানী প্রজাদিগকে অভয়দান করিয়া ভারতসাম্রাজ্য নিজহস্তে লইলেন; কলিকাতা শহর আলোকমালাতে মন্ডিত হইল; চারিদিকে আনন্দধ্বনি উঠিল। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গদেশে ও সমাজে এক মহোপকার সাধিত হইল; এক নবশক্তির সূচনা হইল; এক নব আকাঙ্ক্ষা জাতীয় জীবনে জাগিল।...বিদ্রোহজনীত উত্তেজনাকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ নামক সাপ্তাহিক ইংরাজি কাগজ এক মহোপকার সাধন করিল। পেট্রিয়ট সারগর্ভ সুযুক্তিপূর্ণ তেজস্বিনী ভাষাতে কর্তৃপক্ষের মনে এই সংস্কার দৃঢ়রূপে মুদ্রিত করিবার প্রয়াস পাইলেন যে, সিপাহি-বিদ্রোহ কেবল কু-সংস্কারাপন্ন সিপাহিগণের কার্য মাত্র, দেশের প্রজাবর্গের তাহার সহিত যোগ নাই। প্রজাকূল ইংরাজ গবর্নমেন্টের প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুরক্ত এবং তাহাদের রাজভক্তি অবিচল রহিয়াছে। পেট্রিয়টের চেষ্টাতে লর্ড ক্যানিং-এর মনেও এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল; সেজন্য এদেশীয়দিগের প্রতি কঠিন শাসন বিস্তার করিবার জন্য ইংরাজগণ যে কিছু পরামর্শ দিতে লাগিলেন, ক্যানিং তাহার প্রতি কর্ণপাত করিলেন না। পূর্বেই বলিয়াছি সেই কারণে তাঁহার স্বদেশীগণ তাঁহার Clemency Canning বা ‘‘দয়াময়ী ক্যানিং’’ নাম দিল। এমনকি তাঁহাকে দেশে ফিরাইয়া লইবার জন্য লন্ডনের প্রভুদিগকে অনেকে পরামর্শ দিতে লাগিলেন। পার্লিয়ামেন্টেও সেকথা উঠিয়াছিল; কিন্তু ক্যানিং-এর বন্ধুগণ পেট্রিয়টের উক্তিসকল উদ্ধৃত করিয়া দেখাইলেন যে, এদেশবাসীগণ ক্যানিং-এর প্রতি কিরূপ অনুরক্ত এবং ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের প্রতি কিরূপ কৃতজ্ঞ।...সকলে উত্তেজনাতে পড়িয়া স্থিরবুদ্ধি হারাইয়াছিল, কেবল পেট্রিয়ট হারায় নাই; এজন্য রাজপুরুষগণের নিকট ইহার আদর বাড়িয়া গেল। এরূপ শুনিয়াছি পেট্রিয়ট বাহির হইবার দিন লর্ড ক্যানিং-এর ভৃত্য আসিয়া পেট্রিয়ট আফিসে বসিয়া থাকিত, প্রথম কয়েকখানি কাগজ মুদ্রিত হইলেই লইয়া যাইত। হিন্দু পেট্রিয়টের এই প্রভাব দেখিয়া দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিগণ পুলকিত হইয়া উঠিলেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ এবং রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী প্রভৃতি নব্যবঙ্গের নেতৃগণ হরিশের পৃষ্ঠপোষক হইয়া তাঁহাকে উৎসাহ দিতে লাগিল।’’
ইতিহাস জানাচ্ছে যে, ১৮৫৭ সালে মহাসংগ্রামের ব্যর্থতায় বাংলার হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। মুসলিমদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে গদগদ ভাষায় তারা ইংরেজ শাসকের প্রদি তাদের আনুগত্য নিবেদন করেন। ‘সাহিত্য-সম্রাট’ নামে খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্র, যিনি মুসলিম-বিদ্বেষী রচনার জন্য বিখ্যাত, সংবাদ ভাস্কর পত্রিকায় লিখলেন:
‘‘হে পাঠক, সকলে উদ্বাহু হইয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর। আমাদের প্রধান সেনাপতি সক্ষমরূপে দিল্লি প্রবেশ করিয়াছেন। পাঠকগণ জয় জয় বলিয়া নৃত্য কর। হিন্দু প্রজাসকল দেবালয়ে পূজা দাও। আমাদের রাজ্যেশ্বর শত্রুজয়ী হইলেন।’’
আর তৎকালীন বিখ্যাত কবি ঈশ্বর গুপ্ত মুসলিমদের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে গদগদ চিত্তে ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য নিবেদন করে লিখলেন:
‘‘যবনের যত বংশ এবারে হবে ধ্বংস/সাজিয়াছে কোম্পনীর সেনা/গরু জরু লবে কেড়ে, চাপ দেড়ে যত নেড়ে/এই বেলা সামাল সামাল।’’
তিনি আরও অগ্রসর হয়ে হিন্দু ধর্মকে ইংরেজ সেবায় ব্যবহার করলেন:
‘‘চিরকাল হয় যেন বৃটিশের জয়/বৃটিশের রাজলক্ষ্মী স্থির যেন রয়/এমন সুখের রাজ্য আর নাহি হয়/শাস্ত্রমতে এই রাজ্য রামরাজ্য কয়।’’
ঈশ্বর গুপ্ত একটি জনপ্রিয় শ্লোগান পর্যন্ত তৎকালে ইংরেজানুগ এবং বিপ্লববিরোধী জনমত গঠনের লক্ষ্যে প্রচার করেন:
‘‘ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয়/মুক্ত মুখে বল সবে বৃটিশের জয়।’’
হিন্দু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক মুখপাত্র হিসাবে কবি-সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত ১৮৫৭ সালের ঘটনা-প্রবাহ সম্পর্কে স্বীয় সামাজিক শ্রেণীর মনোভাবকেই বারংবার তুলে ধরেছেন। কেননা, তাঁর সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর সে সময় সম্পূর্ণভাবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির পক্ষে এবং সংগ্রামী-স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সংবাদ এবং সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ করতে থাকে। একটি সখ্যায় পত্রিকাটি লেখে:
‘‘অবোধ যবনেরা [মুসলিম] উপস্থিত বিদ্রোহ সময়ে গভর্নমেন্টের সাহায্যার্থে কোন প্রকার সদানুষ্ঠান না করাতে তাহাদিগের রাজভক্তি সম্পূর্ণ বিপরীতরূপ রহিয়াছে এবং ‘বিজ্ঞ লোকেরা’ তাহাদিগকে নিতান্ত অকৃতজ্ঞও জানিয়াছেন।’’
ঈশ্বর গুপ্ত কর্তৃক সংবাদ প্রভাকর-এ উল্লেখিত মুসলিম বিদ্বেষী ‘বিজ্ঞ লোকেরা’ ছিলেন রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, নবীন চন্দ্র সেন এবং স্বয়ং ঈশ্বর গুপ্ত।
১৮৫৭ সালের মহাসংগ্রামের বিরুদ্ধে হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইংরেজানুগ মনোভাবকে বিশ্লেষণ করে সুপ্রকাশ রায় ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গ্রন্থে লিখেন:
‘‘ইহারা [হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী] প্রথম হইতেই ইংরেজী শিক্ষা ও সভ্যতার মোহে আত্মহারা হইয়া ইংরেজদেরও ভারত জয়কে ‘ভগবানের মঙ্গল বিধান’ বলিয়া বরণ করিয়া লইয়াছিল। সুতরাং মহাবিদ্রোহে ইংরেজদের পরাজয় তাহারা কল্পনাও করিতে পারিত না। সমসাময়িককালে শহুরে মধ্যশ্রেণী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ সরকারকে সাহায্য না করিলেও অনেকেই মহাবিদ্রোহের নিন্দায় মুখর হইয়া উঠিয়াছিলেন, এমনকি স্বাধীনতার অগ্রদূত বলিয়া কথিত কবি ঈশ্বর গুপ্ত যিনি ‘বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া স্বদেশের কুকুর পূজা করিব’ বলিয়া আস্ফালন করিতেন, তিনিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার জন্য নানা সাহেব, ঝাঁন্সির রাণী ও অন্যান্যদের প্রতি কুৎসিত কটাক্ষ করিয়া গাত্রদাহ নিবারণ করিয়াছিলেন এবং ইংরেজ ভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছিলেন।’’
হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মতোই হিন্দু শোষক-বুর্জোয়া শ্রেণীও ইংরেজ দালালির মাধ্যমে বিপ্লবকে নস্যাৎ কল্পে তৎপরতা চালায়:
‘‘হিন্দু, জমিদার, ব্যবসায়ী ও বুদ্ধিজীবীরা সিপাহী বিপ্লবের বিরোধিতা করেন। ১৮৫৭ সালের ২৫ মে তারিখেই বর্ধমানের জমিদার মহারাজা মহৎব চাঁদ ২৫০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ একটি স্মারকলিপি মারফৎ ইংরেজ শাসকদের প্রতি তাদের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।’’
১৮৫৭ সালের ১০০ বছর পূর্বে বাংলা ও ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী পলাশীর যুদ্ধের সময়ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিন্ন মনোভাব লক্ষ্য করা যায়:
‘‘পলাশীর এই যুদ্ধকে কোন কোন হিন্দু লেখক ‘দেবাসুর [দেবতা ও অসুর বা অশুভ শক্তি] সংগ্রাম’ নামে অভিহিত করেছেন। এখানে ‘দেবতা’ ইংরেজ-লুটেরা ক্লাইভ আর ‘অসুর’রূপে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে জীবন দানকারী তরুণ নবাব সিরাজকেই চিহ্নিত করা হয়। পলাশীর শোকাবহ বিপর্যয়কে কলকাতায় [হিন্দু নাগরিকগণ কর্তৃক] ‘পলাশীর বিজয়োৎসব’রূপে পালন করা হয় এবং হিন্দুদেবী দুর্গার অকালবোধনের মাধ্যমে বসন্তকালীন দুর্গোৎসবকে শারদীয় দুর্গোৎসবরূপে পালন করে ক্লাইভকে দেবতুল্য সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হয়।’’
অদ্যাবধি বসন্তকালের বদলে শারদীয় দুর্গোৎসব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে পালিত হচ্ছে।
প্রতিবেশী শক্তিবর্গের বিরোধিতা
১৮৫৭ সালে মহাসংগ্রামের সময় ভারতবর্ষের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর কয়েকটি স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অবস্থান গ্রহণ করার মাধ্যমে ইংরেজদের বিজয়কে সম্ভব করে।
অযোধ্যা যখন বিপ্লবীদের দখলে এবং সেখানে লরেন্স ও নেইলের মত ইংরেজ কমান্ডার নিহত হয়েছে আর হ্যাভলক, আউটরাম, কলিন ক্যাম্পবেলরা কোনও মতেই স্বাধীনতাকামীদের হটিয়ে অযোধ্যাসহ লাখনৌ উদ্ধার করতে পারছে না, তখন সর্বমোট ১৪ হাজার প্রশিক্ষিত নেপালি গুর্খা সৈন্য এসে ইংরেজদের সাহায্য করে এবং সম্মিলিতভাবে হামলা চালিয়ে অয্যোধা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়। মহাবিদ্রোহ দমনে নেপাল সরকার ইংরেজদের খুবই প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান করে সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে, এমন কি খোদ নেপালের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত একটি বাহিনী নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে মিলিতভাবে স্বাধীনতাকামীদের আক্রমণ করেন। শামীমা সিদ্দিকার লেখা গবেষণাগ্রন্থ মুসলিম অব নেপাল-এ নেপালি গবেষক রিমিকেশ সাহার বরাতে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষে মহাবিদ্রোহের খবর নেপালে পৌঁছলে ৩১ মে ১৮৫৭ তারিখে নেপালের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণা বাহাদুর ইংরেজদের সাহায্য করার প্রস্তাব পাঠান। জঙ্গ বাহাদুর নামের এক ক্ষমতার দাবিদার সামরিক কর্মকর্তাও একই ধরনের প্রস্তাব দেন। কাঠমান্ডুতে অবস্থানরত ইংরেজ রেসিডেন্ট মেজর জজ র‌্যামসে জঙ্গ বাহাদুরের সাহায্য প্রস্তাবকে অবহেলা করে প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণা বাহাদুরের সাহায্য গ্রহণের জন্য গভর্নর জেনারেলের নিকট নোট পাঠান। যখন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর পক্ষ থেকে অবিলম্বে নেপালি সাহায্য গ্রহণের সম্মতি এলো, তখন ক্ষমতার দাবিদার জঙ্গ বাহাদুর অধিকতর সাহায্য করার ব্যাপারে ইংরেজদেরকে সন্তুষ্ট করে ইংরেজদের সহযোগিতায় নেপালের প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করে নেন। জুলাই মাসের মধ্যে তিন হাজার নেপালি গুর্খা সৈন্য ভারতবর্ষের সীমান্ত সুগার্ডলিতে জমা হয়। তারা পিছন দিক দিয়ে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছ থেকে জৌনপুর, বারানসী, আজমগড় দখল করে। ক্ষমতা দখলকারী নেপালি প্রধানমন্ত্রী নিজে দশ সহস্রাধিক সৈন্যের বাহিনী নিয়ে ভারতের পথে যাত্রা করেন। কাঠমান্ডু থেকে বিদায়কালে তিনি ইংরেজদেরকে সহযোগী হওয়ার পিছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। প্রথমত: এটা প্রমাণ করা যে, নেপালিরা হল বিশ্বস্ত তাদের প্রতি, যারা তাদেরকে সম্মান করে। দ্বিতীয়ত: ইংরেজদের ক্ষমতা বেশি। তৃতীয়ত: ইংরেজ বিজয়ী হলে নেপালের লাভ হবে। আসল যে কারণটি তিনি অব্যক্ত রাখেন, তা হলো ইংরেজের সাহায্যে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অভিপ্রায়। অনেকের মতে, তার উদ্যোগ কতকটা বর্তমান কালের পাকিস্তানি জেনারেল মোশারফ কর্তৃক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করার মতো। দেশে এই জেনারেলের গণভিত্তি নেই, তাই তিনি মার্কিনীদের শক্তিতে দাঁড়াতে চান। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জঙ্গ বাহাদুরও ইংরেজদের পক্ষে রাখতে চেয়েছিল। ইংরেজরা মহাবিদ্রোহ শেষে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জঙ্গ বাহাদুর ও তার বংশকে শক্তি যোগাতে থাকে। ফলে পরবর্তী প্রায় একশ’ বছর ধরে জঙ্গ বাহাদুরের বংশের লোকেরাই নেপালের প্রধানমন্ত্রী হতে থাকে এবং রাজাকে হাতের পুতুলে পরিণত করে।
শুধু ১৮৫৭ সালেই নয়, নেপালিরা ১৮৫৮ সালেও ইংরেজানুগত্য অব্যাহত রাখে। জানুয়ারি ১৮৫৮ সালে জঙ্গ বাহাদুর স্বাধীনতা-সংগ্রামী নিজাম মোহাম্মদ হোসেনের মুজাহিদ বাহিনীকে পিছন থেকে হামলা করার মাধ্যমে গোরখপুর দখল করে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। ১৭ মে ১৮৫৭ সালে তৎকালীন ইংরেজ শাসনের কেন্দ্রস্থল কলকাতা থেকে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং নেপালকে জানান যে, ইংরেজরা নেপাল সরকারের কাছ থেকে পূর্বে ছিনিয়ে নেওয়া কিছু এলাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া নেপালিদেরকে ইংরেজ সরকার তাদের কাজের পুরস্কারস্বরূপ দুই লাখ ত্রিশ হাজার ছয়শ’ পনের রূপি এবং জীবিত ও মৃত সৈনিক-কর্মকর্তাদেরকে আরও চার লাখ পঞ্চাশ হাজার রুপি প্রদান করে। এর ফলে নেপালিদের ইংরেজানুগত্য আরও বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৯ সালে ইংরেজ ও নেপালি যৌথ বাহিনী নেপাল-ভারত সীমান্তে সম্মিলিত অভিযান চালিয়ে আত্মগোপনকারী স্বাধীনতা-সংগ্রামীর অকাতরে হত্যা ও আটক করে। শুধু অযোধ্য, লাখনৌ বা উত্তর ভারত নয়, নেপালি সৈন্যরা বাংলাতেও ইংরেজদের পক্ষে স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এমন কি, জঙ্গ বাহাদুর ইংরেজ বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নেপালের মাটিতেও বিপ্লবীদের খোঁজে ব্যাপক তল্লাশী চালায়। তবে, ইতিহাসে এমন তথ্যও রয়েছে যে, প্রচুর ধন-সম্পদের বিনিময়ে তিনি অনেক বিপ্লবীকে নিজের হেফাজতে লুকিয়ে রাখেন। অর্থলিপ্সাই ছিল জঙ্গের একমাত্র নীতি। ফলে তিনি যাঁদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অযোধ্যার বেগম হজরত মহল ও তাঁর পুত্র বিরজিস কদর, নানা সাহেব ও তাঁর পুত্র দেবী বক্স, রাজপুত নেতা বেনিমাধো, জ্বালা প্রসাদ, বেরিলির খান বাহাদুর খান। বেগম হজরত মহল পরিবারের আটাশ জন সদস্যসহ কাঠমান্ডুতে রাজার ‘যপোথলী দরবার’ নামের এক প্রাসাদে বসবাসের সুযোগ পান প্রচুর অর্থেও বিনিময়ে। উল্লেখ্য, মহারাজা রনজিত সিংহের মহারাণী জিনদান চান্দ কাউর চুনার দুর্গের বন্দীদশা থেকে পালিয়ে নেপালে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জঙ্গ বাহাদুরের অর্থলিপ্সা সামাল দিতে না পেরে মহারাণী ইংরেজের সঙ্গে সন্ধি করে ভারতে ফিরে আসেন। মায়ের মৃত্যুর পর বিরজিস কদরও নেপালে অবস্থান অপেক্ষা ইংরেজের সঙ্গে সন্ধি করে ভারতে ফিরে আসাকেই পছন্দ করেন। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের অধীনে কর্মরত মুফতি মাওলানা সারফারাজ আলি শাহও কাঠমান্ডুতে চলে আসেন। তিনি সেখানে নেপালি জামে মসজিদের সংস্কার সাধন ও ধর্ম-কর্ম-সমাজসেবার মাধ্যমে দিন গুজরান করেন। মৃত্যুর পর মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়।
বিপ্লবীদের সঙ্গে কেবল নেপাল নয়, অপরাপর প্রতিবেশীরাও ইংরেজ তোষণ নীতির কারণে ভালো ব্যবহার তো করেই নি বরং চূড়ান্ত বিরোধিতা এবং ক্ষতি করেছে। বীর বিপ্লবী হাবিলদার রজব আলি, যিনি সূর্যসেনের অর্ধ শতক পূর্বেই চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল করাসহ ইংরেজদের পরাজিত করার প্রথম নায়ক, তিনি ত্রিপুরারাজের ষড়যন্ত্রের শিকার হন এবং মনিপুর এবং বার্মার পক্ষ থেকেও কোন সাহায্য না পেয়ে রেঙ্গুনের গভীর অরণ্যে যুদ্ধ করতে করতে শহিদ হন।
স্বাধীনতাহীনতা আর পশ্চাতপদতার লাঞ্ছনা
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর উপমহাদেশের মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে প্রকৃত ক্ষমতা ইংরেজের হাতে চলে গেলে প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে এবং একশ’ বছরের বঞ্চনার পর ১৮৫৭ সালে মুসলিমগণ যখন দখলদার ইংরেজ-সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির কবল থেকে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে গিয়েও নানা শাঠ্য-ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ব্যর্থ হয়, তখন আরও ভয়ানকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জিন্দানখাসায় তাদেরকে বন্দী হতে হয়। ফলে তাঁদের দুর্ভাগ্য ও পশ্চাতপদতার সীমা-পরিসীমা থাকে নি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা একজন ঐতিহাসিকের বিশ্লেষণে নিন্মরূপ:
‘‘যাহার [মুসলিমগণ] পূর্ব-পুরুষগণ এক সময় কোম্পানির বণিকদিগকে ভারতবর্ষে আশ্রয় দিয়াছিলেন, যাহার পূর্ব-পুরুষের সৌজন্যে বণিক কোম্পানি বাঙালায় আপনাদের ব্যবসা চালাইয়া সুবিধা পাইয়াছিলেন এবং যাহার পূর্ব-পুরুষেরা কোম্পানিকে বাঙালা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি দিয়া গৌরবান্বিত করিয়াছিলেন তিনিই এখন সেই বণিক কোম্পানির বিচারে, সেই বণিক কোম্পানির কৃপায় এরূপ ক্ষমতাশূন্য, প্রভুত্বশূন্য ও রাজলক্ষণশূন্য হইয়া পড়িলেন।’’
স্বভাবতই রাজনৈতিক ক্ষমতা, শক্তি ও সাম্রাজ্য হারানোর ফলে মুসলিমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তদুপরি ইংরেজরা কখনও ভুলতে পারে নি যে দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতাপ্রিয় এবং অপরাপর সম্প্রদায়ের মত দালালি ও মোসাহেবীতে মোটেই অভ্যস্ত নয়। ব্রিটিশদের দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, মুসালিমরা ইংরেজ শাসনের সঙ্গে কখনও আপোষ করবে না এবং স্বাধীনতা লাভের প্রচেষ্টা থেকে কখনও বিরত হবে না। ফলে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের চরম দিনে ইংরেজ ও তার বশংবদ-তাবেদারগণ যখন উল্লাস, আনন্দ, অর্থ-উপার্জন এবং নিজেদের শান-শওকত বৃদ্ধিতে মশগুল, তখন ‘‘ইসলাম ও মুসলিমরা গালমন্দ আর অপব্যাখ্যা ছাড়া অতি অল্প কিছুই লাভ করেছে।’’
১৮৫৭ সালের পর মাত্র এক যুগের মধ্যেই মুসালমগণ এমন ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত, লাঞ্ছিত ও অপমানিত হন, যা খোদ ইংরেজ-কর্মচারী ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারও লুকিয়ে রাখতে পারেন নি:
‘‘নিজেদের পদ্ধতিতে শিক্ষিত মুসালমরা দেখেছে যে তারা শাসন বিভাগের সব ক্ষমতা ও সব রকম মাহিনা-মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অথচ এগুলো পূর্বে তাদেরই একচেটিয়া অধিকারে ছিল। তারা এটাও দেখেছে যে, জীবন-ধারণের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা হিন্দুদের হাতে ক্রমে ক্রমে চলে যাচ্ছে।’’
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মুসালমগণ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর ব্যাপারে আপোস করতে ব্যর্থ হয়েছে, যেরূপ আপোসমূলক মনোভাব ও আচরণ দেখা গেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। মুসলিমগণ মতাদর্শও পরিবর্তন করতে পারে নি, যা ইংরেজ শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ সংস্কৃতি আর খ্রিস্ট ধর্মের মাধ্যমে ভারতবর্ষে এসেছে। সৈয়দ আহমদ খান যদিও ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে ছিলেন, বলেছেন:
‘‘পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে লোকজন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হবে, এ মর্মে খিস্টান মিশনারিদের ঘোষণার পর স্বভাবতই মুসলিমরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য হারাবার আশঙ্কা করে। তাই ধর্মীয় ব্যাপারে সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে মুসলিমরা অধিক মনক্ষুণ্ণ হয়।’’
তদুপরি এডমন্ড নামের একজন খ্রিস্টান পাদ্রি ১৮৫৫ সালেই কলকাতা থেকে এ মর্মে প্রচারপত্র বিরি করেন যে, সারা ভারতে যেহেতু এক রাজত্ব কায়েম হয়েছে এবং বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে সর্বত্র সমভাবে খবরাখবর পৌঁছে যাচ্ছে, এখন ধর্মও এক হয়ে যাওয়া উচিত। সকলেই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এক ধর্মাবলম্বী হয়ে যাওয়া দরকার। এটা ঠিক যে, এ সময় মুসলিমের চেয়ে হিন্দুরাই অধিক সংখ্যায় খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে তবুও এটা ‘‘মুসলিমদেরকে চিন্তামুক্ত করতে পারে নি।’’
রাজনৈতিক ক্ষমতা লুণ্ঠিত হওয়ার পর ভারতীয় মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয় শিক্ষাক্ষেত্রে। মুসলিমদেরকে ধর্ম বিমুখ করার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানভিত্তিক নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এবং পাঠ্যপুস্তকের আমূল পরিবর্তন করা হয়। মিশনারি স্কুল স্থাপন করে খ্রিস্ট ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করায় ইসলামী শিক্ষা ও চেতনার মূলোৎপাটনের ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সা গোপন থাকে নি। তদুপরি প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শিক্ষাকে সুপরিকল্পিতভাবে অকেজো করে দিয়ে মুসলিমদেরকে প্রবলভাবে আঘাত করার সাক্ষ্যও পাওয়া যায় খোদ ইংরেজ গবেষকের বয়ানে:
‘‘আমরা এ রকম এক শিক্ষাপ্রণালী আমদানী করেছি যার দ্বারা তাদের সমগ্র সম্প্রদায় বেকার হয়ে গেছে এবং তারা অপমান ও দারিদ্রের মুখে পতিত হয়েছে। আমাদের অনুসৃত শিক্ষাপ্রণালীতে উচ্চশ্রেণীর লোকদের জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তাদের জীবনোপায়ের কোনও ব্যবস্থা না থাকার দরুন তার দ্বারা কত মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।’’
শিক্ষা ও সরকারি কাজের ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই ভাষা ও জ্ঞানে দক্ষদের সমাজ ও প্রশাসনের শীর্ষে বসানো হয় শতবর্ষ ধরে প্রতিষ্ঠিত মুসলিমদেরকে হটিয়ে। শিক্ষা ও প্রশাসনে ‘‘আরবি-ফারসির আধিপত্যের অবসান মুসলিমদের নিজস্ব শিক্ষা ও সংস্কৃতির মৃত্যুর আঘাতরূপে প্রতীয়মান হয়।’’ অন্যদিকে ব্রিটিশ ক্ষমতা এবং তাদের ভাষা ও শিক্ষানীতি হিন্দুদের জন্য প্রভু পরিবর্তনের ন্যায় ছিল। ফলে তারা এ পরিবর্তন ‘অতি সহজে এবং সুখানুভূতিতে’ গ্রহণ করে এবং সর্বাবস্থায় ব্রিটিশ-প্রভুর আনুগত্য অব্যাহত রাখে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষাক্ষেত্রে পেছনে ঠেলে দেওয়ার ফলে অবহেলিত-ক্ষতিগ্রস্ত-দুর্দশগ্রস্তে মুসলিমগণ চাকুরি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চরমভাবে বঞ্চিত হয়ে দারিদ্র্য ও বেকার জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে থাকে এবং তাদেরকে রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতির সকল প্রকার সুযোগ, সুবিধা ও সাহায্য থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। যারা শাসক ছিল, তাদেরকে কেবল শাসিতই নয়, অবহেলিত, নিঃস্ব এবং নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা হয় ক্ষমতা দখলকারী ইংরেজ এবং তাদের তাবেদার শ্রেণীর সর্বান্তকরণ ষড়যন্ত্র, প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের মাধ্যমে। পরিস্থিতি কতটুকু শোচনীয় এবং ভয়াবহ আকার ধারন করে, সে বিবরণ পাওয়া যায় সমসাময়িক একটি ফারসি পত্রিকার ভাষ্যে:
‘‘ ছোট-বড় সব রকম চাকুরি ক্রমে ক্রমে মুসলিমদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য জাতিকে বিশেষ করে হিন্দুদেরকে দেয়া হচ্ছে। সব জাতির প্রজাকে সরকার সমান নজরে দেখতে বাধ্য কিন্তু যামানা আজকাল এমন হয়েছে যে, সরকারি চাকুরি থেকে বাদ দেবার জন্য গেজেটে মুসলিমদের নাম বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়। কিছুদিন আগে সুন্দরবন অঞ্চলের কমিশনারের অফিসে কয়েকটি চাকুরি খালি বলে কমিশনার সরকারি গেজেটে সে সম্পর্কে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, চাকুরিগুলো কেবল হিন্দুদের দেওয়া হবে। মুসলমানরা আজকাল এতদূর নিচে নেমে গেছে যে, তারা সরকারি চাকুরির জন্য উপযুক্ত হলেও সরকারি ইশতেহারে তাদেরকে বিশেষভাবে বাদ দেওয়া হয়।’’
বিশ্লেষকদের মতে: ‘‘মুসলিমদের এমনভাবে চাকুরি ও অন্যান্য সুবিধা থেকে সরিয়ে রাখা হয় যে, শেষ পর্যন্ত তাদের কপালে কুলী, পিয়ন ও চাপরাশীর চাকুরি ছাড়া অন্য কোনও পদ থাকে না।’’
রাজনৈতিক অধিকার হননের পর মুসলিমদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দায়-দায়িত্বের জন্য দায়ী করে পরবর্তী দশ-পনের বছর ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগীরা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ধ্বংসলীলা চালায়। জীবন বাঁচাবার জন্য হাজার হাজার মুসলিমকে দেশত্যাগ করতে হয়। হাজার হাজার মুসলিমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। অনেককে বিনাবিচারে গুলী করে মারা হয়, সন্দেহের বশে চরমভাবে লাঞ্ছনা আর নাজেহাল করা হয় এবং আরও শত শত মুসলিমকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ব্রিটিশপন্থী বলে পরিচিত সৈয়দ আহমদ খান পর্যন্ত বলেন:
‘‘১৮৫৭-৫৮ সালের পর এমন কোনও অত্যাচার সংঘটিত হয় নি যার দোষ মুসলিমদের ঘাড়ে চাপানো হয় নি, যদিও সত্যিকারের অপরাধী ছিল হিন্দু রামদিন বা মাতাদিন।’’
ইংরেজ কর্তৃক দিল্লি অধিকারের পর পাইকারি হারে হত্যা, গৃহদাহ ও লুঠতরাজের ফলে দিল্লির পুরাতন মোগল ঐতিহ্য ধুলিস্মাৎ হয়ে যায়। ইংরেজদের বিবাদ ছিল বিদ্রোহী-বিপ্লবীদের সঙ্গে, কিন্তু ইংরেজরা বিপ্লবী-বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী তথা মুসলিম জনতার সক্রিয়-নিষিকয় প্রতিটি সদস্যের ওপর পাগলা কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাছাড়া ইংরেজদের প্রতি শিখ সৈন্যদের সমর্থন বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ ও প্রদর্শনের জন্য পাঞ্জাবি-শিখ অফিসাররা দলবল নিয়ে এমনই উন্মাদনা আর বর্বরতা প্রদর্শন করে, যা ক্ষেত্র বিশেষে ইংরেজ নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায়। মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বাছ-বিচারবিহীন যে জঘন্য অত্যাচার, অবিচার, লাঞ্ছনা চালানো হয় তা অবর্ণনীয়, অকল্পনীয়। দিল্লি অধিকারের বেশ কিছুদিন পর অবধি মুসলিম পরিচয়যুক্ত বেসামরিক লোকদেরকেও পর্যন্ত দেখা মাত্রই গুলী করা হতো। বেঁচে গেলে সামরিক আইনের আওতায় প্রহসনমূলক বিচার-নাটক করে নির্মম শাস্তি দেওয়া হতো, যার বেশির ভাগই মৃত্যুদন্ড আর কমপক্ষে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। ইংরেজের অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কোনও নিরীহ, অভিজাত বা ভালো মুসলিমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেই তা সহজে বিশ্বাস করা হতো এবং সাক্ষ্যদানকারীকে পুরস্কৃত করা হতো। এভাবে একদল দালাল-তাবেদার, যাদের ধর্মীয় পরিচয় বলার অপেক্ষা রাখে না, মুসলিমদের আক্রান্ত করার আর ইংরেজ অনুগ্রহ প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে, দিল্লির সমস্ত যশস্বী ব্যক্তি যাদের নাম স্যার সৈয়দ আহদম তাঁর আসার-উল-সানাদিদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তাঁরা হয়ত মৃত অথবা বাঁচার তাগিদে পলাতক। দিল্লির লাল কিল্লা ও জুম্মা মসজিদের মধ্যবর্তী মোগল অভিজাত শ্রেণীর আবাসিক বিরাট এলাকা ধূলিস্মাৎ করে ফেলা হয়। সম্রাট শাজাহানের নির্মিত বিরাট জুম্মা মসজিদ সেনাবাহিনী দখল করে এবং ইঙ্গ-ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় তথাকথিত বুদ্ধিজীজীগণ তুমুল বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয় যে, একে ধ্বংস করা ভালো হবে না গির্জায় রূপান্তরিত করা হলে উত্তম হবে!
ধর্ম, সংস্কৃতি, ইজ্জত, আব্রু হারানোর মতোই দীর্ঘস্থায়ী বেদনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় দীর্ঘমেয়াদী পরাধীনতা, যা মুসলিম জনগোষ্ঠী কখনওই মেনে নিতে পারে নি এবং সময়-সময়ই স্বাধীনতার দাবীতে তৎপর হয়েছে।
স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের প্রতি বিজয়ী ইংরেজ সরকার ও সহযোগী শ্রেণীর মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপ ছিল অপোষহীন এবং অত্যন্ত উগ্র। বিপ্লবোত্তরকালে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ইংরেজ অত্যাচার ও উৎপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ছিলো বর্ণনাতীত, ‘যা ভারতের ইতিহাসে ব্রিটিশদের একটি সত্যিকারের কলঙ্কময় অধ্যায়।’
উপসংহার : ১৫০ বছরের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি
১৮৫৭ সালের মহাসংগ্রাম আপাত-ব্যর্থ বলে মনে হলেও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন এবং ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে জনগণের মুক্তির সংগ্রামী ঐতিহ্য ও চেতনার জন্য এহেন বিপ্লবাত্মক-স্বাধীনতাকামী ঘটনা-প্রবাহের অবদান ও প্রতিক্রিয়া অপরিসীম। এর বাস্তব প্রমাণ হলো, ১৮৫৭-এর মাত্র ৯০ বছরের মাথায় সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজকে উৎখাত করে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে উপমহাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। মুসলিমগণ সুদীর্ঘ বছর পর আবার ফিরে পায় স্বাধীনতার স্বাদ এবং উপমহাদেশের আপামর জনতা লাভ করে মুক্তির আনন্দ। কিন্তু আজকে প্রশ্ন হলো উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষই কি প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছে----কাশ্মীরী, পাঠান, শিখ, হরিজন, সংখ্যালঘু ভারতীয় মুসলিম/খ্রিস্টান/বৌদ্ধ কি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা না অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছে? স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের মহাসংগ্রামের ১৫০ পরেও কি সেই সংগ্রামের অগ্রসেনানী মুসলিমগণ উপমহাদেশের দেশগুলোতে আবার স্বাধীন-স্বকীয়তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন? ১৫০ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে আত্মসমালোচনার দর্পণে নিজেদেরকে দেখে দেখে তারা কি আত্মপরিচয়ের হারানো উপলব্ধি খুঁজে পেয়েছেন? চিনতে পেরেছেন কি নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে, যা ১৫০ বছর আগে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী-ঔপনিবেশিক অপশক্তি স্থানীয় দালাল ও তাবেদারদের সহযোগিতায় ধ্বংস করেছিল? বর্তমানেও চলমান একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার নামে বিশ্বের দেশে দেশে, এমন কি আমাদের আশেপাশে পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদ-ইহুদি-জায়নবাদ-ব্রাহ্মণ্যবাদের মিলিত আক্রমণের নব-নব রূপ, কৌশল ও চরিত্র ইসলামী মতাদর্শ আর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত ও ধ্বংসের পাশবিক উৎসবে মেতে উঠেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা আমাদের আত্মউপলব্ধি ও উজ্জীবনের ধারাকে প্রকৃত কল্যাণ ও সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছে দেওয়ার সঙ্কল্পে সঠিক পথ ও পন্থা অনুসরণ করতে পারি নি এবং পারছি না।
এই না-পারার ব্যর্থচক্র থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারে ১৮৫৭-এর ঐতিহাসিক সফলতা-ব্যর্থতার শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা থেকে প্রাপ্ত সত্যনিষ্ঠ-নির্মোহ উপলব্ধি। 
গ্রন্থপঞ্জী
এস.এন সেন [১৯৫৭], ‘‘দ্যা রিভল্ট অব ১৮৫৭’’, কলকাতা : স্টেটসম্যান।
আখতার-উল-আলম [২০০৯], ‘‘বাহাদুর শাহ জাফর এবং ঐতিহাসিক সিপাহী-বিপ্লব’’, ফাহমিদ-উর-রহমান সম্পাদিত মহাবিদ্রোহ ১৯৮৭, ঢাকা : বদ্বীপ প্রকাশন।
আনিসুজ্জামান [১৯৬৯], মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, ঢাকা: বাংলা একাডেমী।
আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ [১৯৭৪], সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, ঢাকা : নওরোজ।
আববাস আলী খান [], বাংলার মুসলিমদের ইতিহাস, ঢাকা :
এমরান জাহান [২০০৯], ‘‘ইস্ট ইন্ডিয়া ম্পোনীর শাসন ও পরাধীন মুসলমান ১৭৫৭-১৮৫৭ : অতঃপর স্বাধীনতার
সংগ্রাম’’, ফাহমিদ-উর-রহমান সম্পাদিত মহাবিদ্রোহ ১৯৮৭, ঢাকা : বদ্বীপ প্রকাশন।
আরিফুল হক [২০০৯], ‘‘আমাদের স্বাধীনতার বাঁকে ১৮৫৭’’, ফাহমিদ-উর-রহমান সম্পাদিত মহাবিদ্রোহ
১৯৮৭, ঢাকা :বদ্বীপ প্রকাশন।
কামালউদ্দিন হোসেন [১৯৯৮], রবীন্দ্রনাথ ও মোগল সংস্কৃতি, ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
বিমলেন্দু বড়ুয়া [২০০৫], রঙ্গুম রঙ্গিলার দেশে, চট্টগ্রাম: লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া।
মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯], ‘‘সিপাহী বিপ্লব-স্বাধীনতা সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট’’, ফাহমিদ-উর-রহমান
সম্পাদিত মহাবিদ্রোহ ১৯৮৭, ঢাকা : বদ্বীপ প্রকাশন।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৮], বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ, ঢাকা : কথামেলা প্রকাশন।
মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৬], আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, ঢাকা : কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড।
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার [১৯৭৪], দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমান্স, [আবদুল মওদুদ অনুদিত], ঢাকা : নওরোজ।
মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫], ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ঢাকা : বাংলা একাডেমী।
মুহাম্মদ আজিজুল হক [১৯৬৯], বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা, ঢাকা : এশিয়ান পাবলিশার্স।
মাহতাব সিং, তাওয়ারিখে হাজারা
মুহাম্মদ সিদ্দিক [২০০৯], ‘‘সিপাহী বিপ্লব, বেগম হজরত মহল ও নেটিভদের বিশ্বাসঘাতকতা’’, ফাহমিদ-উর-রহমান সম্পাদিত মহাবিদ্রোহ ১৯৮৭, ঢাকা : বদ্বীপ প্রকাশন।
নবহরি কবিরাজ [১৯৫৭], স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, কলিকাতা : ন্যাশনাল বুক এজেন্সি।
সুপ্রকাশ রায় [১৯৮৩], ভারতের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক সংগ্রাম, কলিকাতা : পত্রপুট।
হাসান জামান [--], শতাব্দী পরিক্রমা, ঢাকা :-----।
সৈয়দ আহমদ খান [১৯৭৯], ভারতের বিদ্রোহের কারণ, ঢাকা : নওরোজ।
হেমচন্দ্র কানুনগো [১৯৮৪], বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা, কলিকাতা : চিরায়ত প্রকাশন।
ফাহমিদ-উর-রহমান [২০০৯], [সম্পাদিত], মহাবিদ্রোহ ১৯৮৭, ঢাকা : বদ্বীপ প্রকাশন।
শিবনাথ শাস্ত্রী [২০০৬], রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, ঢাকা : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
রতন লাল চক্রবর্তী [১৯৯৬], সিপাহি যুদ্ধ ও বাংলাদেশ, ঢাকা : বাংলা একাডেমি।
রজনীকান্ত গুপ্ত [১৮৯৩], সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, কলিকাতা : প্রকাশকের নাম নেই।
S.M. Ikram [1965], Modern Muslim India and the Birth of Pakistasn, Lahore: Pakistan Press and Publication.
Abdul Bari [1960], The Reform Movement in Bengal and History of the Freedom Movement, Dhaka: APB Library.
J.W. Sherer [1898], Daily Life During the Indian Mutiny: Personal Experience of 1857, London..
Santimoy Roy [1979], Freedom Movement and Indian Muslims, New Delhi.
Muinud-Din-Ahmad Khan [1965], A History of the Faraidi Movement in Bengal [1881-1909], Karachi.
Narahari Kaviraj [1982], Wahabi and Farazi Rebels of Bengal, New Delhi:
Riswikhash Saha [2000], Modern Nepal, Kathmandu: Kantipur Press.
J.W. Sherer [1898], Daily Life During the Indian Mutiny : Personal Experience of 1857, London.
G. N. Dodd, The History of the Indian Revolt.
Montogomery Martin, The Indian Empire.
P. Hardy [2002], The Muslims of British India, Cambridge : The Cambridge University Press.
Thomas R. Mtcalf [1965], The Aftermath of Revolt : India 1857-1870, Princeton: Princeton Press Ltd.
William Muir [1902], Records of the Intelligence Department of the North-West Provinces during the Mutiny of 1857, vol. 1, Edinburgh : Edinburgh Press Ltd.
Mahmud Hussain, The Success of Sayyid Ahmed Shahid: History of the Freedom Movement.
Sufia Ahmed [1974], Muslim Community in Bengla [18884-1912], Dhaka: Bangla Academy.
Qureishi, I.H [1967], A Short History of Pakistan, Karachi : Pakistan Publications.


লেখক-পরিচিতি : ড. মাহফুজ পারভেজ- কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক এবং অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম।
লেখা-পরিচিতি : প্রবন্ধটি ৩১শে অকটোবর, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়]

 

রেফারেন্সঃ

. বর্তমানে যারা ১৮৫৭ সালের ঘটনা-প্রবাহ নিয়ে গবেষণা এবং লেখালেখি করছেন, তাদের সকলেই বিভিন্ন পর্যায়ে এই মতামতই অভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছেন।
. যুদ্ধকালীন সময়ে একজন ইংরেজ প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, এলাহাবাদের ফতেপুরে অনিয়মিত অশ্বারোহী সিপাহিগণ প্রথমে এই শ্লোগান দিয়েছিল। পরে এটি সমগ্র যুদ্ধকালে জাতীয় শ্লোগান হিসাবে উচ্চারিত হয়। বিস্তারিত দেখুন, J.W. Sherer, [1898: 29].
. মীর কাশিম আলী খান গোড়াতে ছিলেন ষড়যন্ত্রের অন্যতম সহযোগী। কিন্তু প্রথমে তিনি ষড়যন্ত্রের গভীরতা ধরতে পারেন নি। ভেবেছিলেন, জগৎশেঠ ও তার সহযোগীরা শুধু সিরাজকে সরিয়ে তার শ্বশুড় মীর জাফরকে নবাব বানাবে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় ইংরেজদের কাছে দুইশত নৌকা সোনা-চাঁদিসহ দফায় দফায় যুদ্ধের কথিত-ক্ষতিপূরণ বাবদ ঘুষ দিতে দিতে মীর জাফর ফতুর হয়ে গেলে খোদ তাকেই নবাব করা হয়। তখন তিনি ইংরেজ এবং সহযোগী শেঠ-রায়-চাঁদচক্রের সর্বগ্রাসী-আগ্রাসী রূপটি ধরতে পারেন এবং দেখতে পারেন যে, ইংরেজের সঙ্গে হিন্দু মারোয়ারি গোষ্ঠীর আঁতাতটি মূলত ইসলামবিরোধী সুগভীর চক্রান্তের ফল এবং শোষণের মতলবেপূর্ণ। ফলে তিনি কালবিলম্ব না-করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লড়াই করতে করতে তিনি ইংরেজ-কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে বনে-জঙ্গলে আত্মগোপন করে ফিরছিলেন। জঙ্গলেই তাঁর দুই পুত্র নিহত হয়। নির্বংশ মীর কাশিম এরপর কোথায় উধাও হয়ে যান----ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব। শুধু দীর্ঘদিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় দিল্লির আজমিরি গেটের নিকট রাস্তার উপরে। বিস্তারিত, আখতার-উল-আলম [২০০৯: ৩৬]। অন্য একজন গবেষকের মতে, ‘‘১৭৭৭ সালের ৬ জুন দিল্লির আজমিরী দরজার বাইরে অজ্ঞাত পরিচয় মুসাফিররূপে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন মীর কাশিম। তাঁর মাথার নিচে রাখা নামাঙ্কিত চাদর দেখেই বাংলার এই ভাগ্য-বিড়ম্বিত নবাবকে সেদিন সনাক্ত করা সম্ভব হয়।’’ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৮:৪৩]
. বিশ্লেষকদের মতে, মীর কাশিম মসনদে বসেই পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সমর্থ হন এবং ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার অতীত ভুলের কাফফারা আদায়ে সচেষ্ট হন। ইংরেজ প্রভাব থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেন। তিনি দেশের অর্থনীতিকে ইংরেজ ও মারোয়ারিদের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন ও সাবলম্বী করার পদক্ষেপ নেন। পাটনার নায়েব নাযিম রামনারায়ণ, গুপ্ত-পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা রাজা মুরলী ধর, ঢাকার দিওয়ান রাজবল্লভ, সুদের কারবারি জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভসহ কয়েকজন প্রধান ব্যক্তিকে তিনি দেশদ্রোহিতা এবং ষঢ়যন্ত্র করার কারণে গ্রেফতার করেন। কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড হয়। জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভকে মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে বস্তায় ভর্তি করে গঙ্গা নদীবক্ষে নিক্ষেপ করা হয়। মীর কাশিম কাটোয়া, গিরিয়া ও উদয়নালায় ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এবং রাজত্ব হারিয়ে অযোধ্যায় আশ্রয় নেন। মীর কাশিমকে সরিয়ে ইংরেজরা পুনরায় মীর জাফরকে কলকাতা থেকে ধরে এনে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসায় ১৭৬৩ সালে। মীর কাশিম অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাহ এবং মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে ইংরেজবিরোধী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি সম্মিলিত বাহিনীসহ ১৭৬৪ সালে বক্সার নামক স্থানে ইংরেজ বাহিনীকে মুবাবিলা করার জন্য উপস্থিত হন। অযোধ্যার মন্ত্রী বেনী বাহাদুর, মোগল সম্রাটের দিওয়ান সেতাব রায় এবং মীর কাশিমের খ্রিস্টান সেনাপতি মার্কাট এবং আরাটোনা গোপনে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলায়। তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় বক্সারের যুদ্ধক্ষেত্রেও পলাশীর প্রহসন-নাটকের পুনারাবৃত্তি ঘটে। বিস্তারিত, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৮:৪৮-৯]
. ইংরেজ বিরোধী শত-সহস্র আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব, বিদ্রোহের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: নরহরি কবিরাজ [১৯৫৭], সুপ্রকাশ রায় [১৯৮৩], হেমচন্দ্র কানুনগো [১৯৮৪]
. সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির নেতৃত্বাধীন জিহাদ আন্দোলনে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী তাঁর অনুসারীগণ অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও জিহাদ আন্দোলনের মূল কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। তিনি তাঁর সহচরদের নিয়ে শাহাদাত বরণও করেন সেখানেই। জিহাদ আন্দোলনের তৎপরতা সমগ্র উপমহাদেশে পরিব্যাপ্ত ছিল বলে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহ সংগঠন, পরিচালনা ও নেতৃত্বদানে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির অনুসারী জিহাদ আন্দোলনের নেতা-কর্মীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে আরও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এ সংক্রান্ত বিবরণ বিস্তারিতভাবে জানতে, দ্রষ্টব্য, Santimoy Roy [1979], মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫], Muinud-Din-Ahmad Khan [1965], Narahari Kaviraj [1982].

. মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯:১৪]
. বিস্তারিত দেখুন, মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫]
. অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের হিস্টরি অব দ্য ইন্ডিয়ান রিভল্ট গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ‘‘১৯ জুন ১৮৫৭ সালে অযোধ্যার সাবেক নবাবের কোলকাতাস্থ গার্ডেন রিচের বাসস্থানে ইংরেজ সামরিক বাহিনী খোঁজাখুঁজির পর ‘মোহামেডান স্কেচ ম্যাপ’ পায়, যাতে লেখা ছিল ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের শতাব্দী পূর্তির দিন বিদেশীদের উচ্ছেদ করে দেশীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।’’ মুহাম্মদ সিদ্দিক [২০০৯:১৯১]
. আববাস আলী খান [২৯৪-৫]
. পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে
. পরবর্তী অংশে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
. মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯:১৫]
. পূর্বোক্ত
. যুবরাজ মির্জা ফিরোজ শাহের ঘোষণা থেকে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো লিপিবদ্ধ করা হয় G. N. Dodd লিখিত The History of the Indian Revolt গ্রন্থের ৪১০-১১ পৃষ্ঠায়

. বিস্তারিত দেখুন, Montogomery Martin, The Indian Empire, vol. 2, pp. 1-3.
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:৩৮-৯]।
. P. Hardy, The Muslims of British India, Cambridge: The Cambridge University Press, 2002, p. 62.
. Thomas R. Mtcalf, The Aftermath of Revolt: India 1857-1870, Princeton, 1965, p. 298.
. ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং হিন্দু জমিদার শ্রেণীকে মুসলিম নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সমাজ কাঠামোর ওপরে বসানো সম্ভব হয়নি। প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যর্থতার পর ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে সম্পূর্ণভাবে নিচে ঠেলে দেওয়ার কাজটি ইংরেজ-হিন্দু যৌথ উদ্যোগে পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। বিস্তারিত, দেখুন,
ক] মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫]
খ] P. Hardy [2002]
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:৪০]
. সৈয়দ আহমদ খান [১৯৭৯:৫]
. এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে আরও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে
. P. Hardy [2002:62]
. William Muir [1902: 46]
. আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ধারার ঐতিহাসিক বিবরণ এবং আন্দোলন-সংগ্রামের রূপরেখা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, দেখু মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৬]
. আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা কত তীব্র ছিল এবং সেইসব আত্মশুদ্ধির উদ্যোগ ইসলাম ধর্ম-দর্শন-সংস্কৃতির বিশুদ্ধ বিকাশের জন্য কতই না দরকারী ছিল, তার একটি উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট হবে: ‘‘মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন হিন্দু রায়তদের আচার-অনুষ্ঠান এমনভাবে পালন করত যে তাদেরকে শুধু অনুষ্ঠানে নয় বরং নামেও পৃথক করা দুষ্কর হতো। মুসলিমদের নামের মধ্যে এরূপ নামও ছিলো যথা: গোপাল, নেপাল, গোবর্ধন ইত্যাদি।’’ বিস্তারিত, দেখুন, Abdul Bari [1960].
. হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শে দেশবাসীকে প্রতিষ্ঠিত করাই এই অন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বলেই এর নাম ‘তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া’। অকৃত্রিম ইসলামি সমাজব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এরা আপোষহীন ও অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যান। সকল ধরনের ইসলামবিরোধী কাজ, যেমন, শির্ক, বিদাত, কবর পূজা, পীর পূজা, যা ইসলামের নামে প্রচারিত ও পরিচালিত ছিল, সেগুলোর মূলোৎপাটনে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান অনস্বীকার্য। বিস্তারিত, দেখুন, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ [১৯৭৪]
. ভারতের ‘তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনকে এদেশের মুসলিমদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র হিসাবে এ আন্দোলনের নেতা ও অনুসারীদেরকে ইংরেজরা ‘ওয়াহাবি’ নামে চিহ্নিত করে। শান্তিময় রায়ের মতে, ‘ভারতে জনসাধারণের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত সর্বপ্রথম আন্দোলন ওয়াহাবিদেরই।’ দ্রষ্টব্য, Santimoy Roy [1979:20]| হবিবুল্লাহর [১৯৭৪:১১৯] মতে, ‘আধুনিক মুসলিম সমাজে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের সূচনা হয় ওয়াহাবি আন্দোলনের মাধ্যমেই। শুধু তাই নয়, ভারতের কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ঐ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে’
. ইংরেজ শাসনের কুপ্রভাবের প্রতিক্রিয়ায় মুসলিমরা দেখতে পায় যে, তারা সত্যিকারের ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়েছে এবং তারা শিক্ষাগতভাবে পশ্চাৎগামী, সংস্কৃতিগতভাবে নীতিভ্রষ্ট, ধর্মগতভাবে অধঃপতিত এবং রাজনৈতিকভাবে একটা হতাশাব্যঞ্জক সম্প্রদায়ে অবনতি লাভ করেছে। ইসলামের মূল কর্তব্য বা ‘ফরজ’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যা ফরায়েজি আন্দোলন নামে খ্যাত। ভারতীয় মুসলিমদের আরেকটি সংস্কার আন্দোলন, যা পরে বৈপ্লবিক রূপ পরিগ্রহ করে। এই আন্দোলনের নেতা পূর্ব বঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরের হাজি শরিয়তুল্লাহ [১৭৮১-১৮৬২] প্রথম ব্যক্তি যিনি নিম্ন ও পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদেরকে তাদের আত্মোপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করেন। বিস্তারিত, দেখুন,
Muinud-Din-Ahmad Khan [1965]
. সৈয়দ আহমদ শহীদের শিক্ষা ও আদর্শে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু সংগ্রামী অনুসারীর সৃষ্টি হয়। তারা সৈয়দ আহমদের শাহাদাতের পরেও আদর্শিক জিহাদ অব্যাহত রাখেন। পশ্চিম বঙ্গের ২৪ পরগণার বারাসাত অঞ্চলের মির নিসার আলী ওরফে তিতুমীর [১৭৮২-১৮৩১] আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য ছিল মুহাম্মদীয়া ধর্মের মৌলিক বিষয়াদি অতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা এবং হিন্দু ধর্মের সংমিশ্রণে যেসব কুসংস্কার অনুপ্রবেশ করেছে সেগুলোকে পরিহার করা। ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রজা-জনসাধারণকে সংগঠিত করে তিনি নারিকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেন এবং সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করে শহীদ হন। বিস্তারিত, দেখুন, Narahari Kaviraj [1982]|
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:২]
. বিস্তারিত, দেখুন, Muinud-Din-Ahmad Khan [1965]; Narahari Kaviraj [1982]
. পাঞ্জাবের হাজারা জিলার বালাকোট নামক স্থানে সৈয়দ আহম্মদ ইংরেজের প্ররোচণায় শিখ ও পাঠান ষড়যন্ত্রে শহীদ হলে তাঁর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার আন্দোলন আপাত স্তিমিত থেকে পরে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্তারিত, দেখুন, মাহতাব সিং, তাওয়ারিখে হাজারা।
Mahmud Hussain, The Success of Sayyid Ahmed Shahid: History of the Freedom Movement.
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৬:১০৬-৭]
. আনিসুজ্জামান [১৯৬৯:৫০]
. আনিসুজ্জামান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭
. রজনীকান্ত গুপ্ত [১৮৯৩:৬২-৩]
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৮
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৭
. প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ তথা সিপাহি-জনতার মহাযুদ্ধে ১৫০ বছর পরেও মুসলিমরা কি উপমহাদেশের দেশগুলোতে আবার স্বাধীন-স্বকীয়তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন? ১৫০ বছরের সুদীর্ঘ সময়ে আত্মসমালোচনার দর্পণে নিজেদেরকে দেখে দেখে তারা কি আত্মপরিচয়ের হারানো উপলব্ধি খুঁজে পেয়েছেন? চিনতে পেরেছেন কি নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে, যা ১৫০ বছর আগে ইংরেজ উপনিবেশিক-সাম্রাজ্যবাদীরা ধ্বংস করেছিল। আজকেও একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সেই ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা আমাদের আত্মউপলব্ধি ও উজ্জীবনের ধারাকে সাফল্যের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার সঙ্কল্পে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। উপসংহারে আমরা এই প্রশ্নেই আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত রাখতে সচেষ্ট হয়েছি।

. বিমলেন্দু বড়ুয়া [২০০৫:৪২-৩]
. ইতিহাসের কী ঈঙ্গিত কে জানে! মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং শেষ শাসকের কবর ভারতের বুকে হয় নি। বাবর সমাহিত রয়েছেন কাবুলে আর বাহাদুর শাহ জাফর রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুনে! বিস্তারিত দেখুন, কামালউদ্দিন হোসেন [১৯৯৮]
. ‘‘ক্ষিপ্ত ইংরেজদের হাতে শুধু বুড়োবুড়ি ও কেবল শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। ইংরেজরা জয় লাভ করার পর আনন্দের চোটে লাখনৌ-এর সেইসব দেশী সিপাহীকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে, যারা লাখনৌকে রক্ষা করতে ইংরেজদের সঙ্গ দিয়েছিল।’’ এস.এন সেন [১৯৫৭]
. চার্লস বল নিহতের প্রকৃত সংখ্যা লুকিয়েছিলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণে কমপক্ষে এক লক্ষ মানুষকে ১৮৫৭ এবং তৎপরবর্তী সময়ে ইংরেজরা গণহত্যার মাধ্যমে নিধন করে। আর পলাশী থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়কালে [১৭৫৭-১৯৪৭] ইংরেজ কর্তৃক এবং ইংরেজের প্ররোচণায়-সৃষ্ট দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারী-মন্বন্তরে ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আহত, নিহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়
. হাসান জামান, [,,,:১৪৭]
. ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ইংরেজ কর্তৃক অযোধ্যা দখল এবং নবাবকে কলকাতায় নির্বাসিত করার বিবরণ পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে
. পরে নেপালে তাঁর অবস্থান প্রসঙ্গে আরও আলোচনা করা হয়েছে।
. বিস্তারিত, দেখুন, মুহাম্মদ সিদ্দিক [২০০৯]
. আসলে নেপালি বাহিনীর কাজটি ছিল অতর্কিতে পেছন থেকে ছুরিকাঘাতের শামিল। লাখনৌ ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র। কেন্দ্রের পতনে স্বাধীনতার সংগ্রামের সেন্ট্রাল কমান্ড সেন্টার নস্যাৎ হয়। নেপালিরা সাহায্য না-করলে লাখনৌতে ইংরেজরা নিশ্চিহ্ন হত এবং পরিণতিতে ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। পরবর্তীতে প্রতিবেশী শক্তির ভূমিকা আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে এসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে
. এই পরিচিতি ১৮৫৭ সালের বিপ্লবীদের ব্যাপারে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ইংরেজ-হিন্দু ষড়যন্ত্র এবং ইতিহাস বিকৃতির বিষয়টি রিচনার বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে।
. আরিফুল হক [২০০৯: ৫৩]
. ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের জেলখানায় স্বাধীনতাকামী এবং বিপ্লবীদেরই অধিক হারে থাকার ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে।
. আরিফুল হক [২০০৯: ৫৩]
. আরিফুল হক [২০০৯: ৫৩]
. রতন লাল চক্রবর্তী [১৯৯৬: ১৪৯]
. জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা তো দূরের কথা, এহেন জাতীয় স্বার্থমূলক কোনও ধারণাই তৎকালীন মধ্যবিত্ত বঙ্গ সমাজ তথা কলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু শিক্ষিত সমাজে ছিল না। ছিল ঘটনা সম্পর্কে ব্রিটিশের মতোই মিউটিনি বা বিদ্রোহ এবং হাঙ্গামা নামক অভিব্যক্তি। বিস্তারিত, দেখুন, শিবনাথ শাস্ত্রী [২০০৬]
. ১৮৫৭ সালে জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনকে কখনও হাঙ্গামা এবং কখনও উত্তেজনা বলে অভিহিত করা হয়েছে
. শিবনাথ শাস্ত্রী [২০০৬:১৮১-২]
. মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯:১৭]
. মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯:১৮]
. পূর্বোক্ত
. এমরান জাহান [২০০৯:২৩৩]
. এমরান জাহান [২০০৯:২৩২]
. পূর্বোক্ত
. সুপ্রকাশ রায় [১৯৮৩]
. মোহাম্মদ আবদুল গফুর [২০০৯:১৭]
. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান [২০০৮:৪২]
. এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও তথ্য, দেখুন, মুহাম্মদ সিদ্দিক [২০০৯]
. ইংরেজদের প্রতি নেপালি সাহায্যের বিষয়টি নেপালের সকলেই মেনে নেয় নি। রাজপরিবার, আমলা ও সেনাবাহিনীতে এ নিয়ে ছিল মতপার্থক্য। নেপাল সেনাবাহিনীর ওরুঙ্গ সম্প্রদায়ের রেজিমেন্টে এ নিয়ে ছিল অসন্তোষ। রিশিকেশ সাহা [২০০০]
. রিশিকেশ সাহা [২০০০]
. যে বিবরণ পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে
. তিনি বলতে মোগল শাসনের সমাপ্তিকালের মোগল সম্রাট আকবর শাহ এবং বাহাদুর শাহকে গণ্য করা যেতে পারে
. রজনীকান্ত গুপ্ত [১৮৯৩:১৪৯]
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:৪৩]
. ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার [১৯৭৪:১৪৫]
. সৈয়দ আহমদ খান [১৯৭৯:২৫]
. পূর্বোক্ত
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:৪৪]
. উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এসব স্কুলে এসে ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করেন এবং খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে উত্তর দিতে পারলে শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করেন। তদুপরি স্কুল পরিদর্শনের জন্য যারা চাকরিপ্রাপ্ত হয়, তারা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের খ্রিস্ট ধর্মানুসারী করতে এমন উৎসাহ ও তৎপরতা চালায় যে, লোকজন তাদের নাম দেয় ‘কালো পাদ্রী’। বিস্তারিত, সৈয়দ আহমদ খান [১৯৭৯:২১-২২]।
. ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার [১৯৭৪:১৪২]
. মুহাম্মদ আজিজুল হক [১৯৬৯:১১]
. Sufia Ahmed [1974:7-8]
. ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার [১৯৭৪:১৬৯]
. Qureishi, I.H [1967:131]
. সৈয়দ আহমদ খান [১৯৭৯:৬০]

. S.M. Ikram [১৯৬৫:৩২]।
. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক [১৯৯৫:৬০]।