ভূমিকাঃ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩৭টি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো এদেশের জন্য একটি কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭৩ সনে ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের চিন্তা-চেন্তনার পরিপন্থী হওয়ায় তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। পরবর্তী কালে আরো কয়েকটি শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়েছিলো। কিন্তু ড. কুদরাত-ই-খুদা কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি অবলম্বন করে এগুতে গিয়ে সেই কমিটিগুলোও জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী সরকার আরেকটি শিক্ষা কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু কুদরাত-ই-খুদা কমিশন কর্তৃক প্রণীত এবং জাতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত সেই শিক্ষা নীতিকেই ভিত্তি বানিয়ে নতুন দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য এই কমিটিকে বলা হয়েছে। একটি প্রত্যাখ্যাত শিক্ষানীতিকে নতুন কমিটির জন্য ভিত্তি বানানোটাও অযৌক্তিক।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় চিন্তা-চেতনার নিরিখে একটি কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি সম্পর্কে আমার বক্তব্য তুলে ধরার জন্য এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ঐতিহাসিক পটভূমিঃ
বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা পেশ করা দরকার। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের প্রাক্কালে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি অঙ্কশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র ও ব্যাকরণ শিক্ষার প্রচলন ছিল। মুসলিম শাসনের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে:: মক্তব ও মাদ্রাসা, মসজিদ ও মঠ এবং ব্যক্তিগত বাড়িতেও শিক্ষা কর্ম চলতো এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বর্ণ-গোত্র-ধর্ম নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল।
১. এডামস রিপোর্ট (১৮৪৪) : ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন প্রবর্তিত হওয়ায় শিক্ষার ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সাধিত হয়। ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিং-এর আমলে এডাম নামে জনৈক স্কটল্যান্ডবাসীকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং কমিটি এডামস রিপোর্ট নামে সরকারের কাছে সে রিপোর্টটি জমা দেয় তাতে সাত শ্রেণীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা ছিল। যেমন : (১) দেশীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় (২) মিশনারী বিদ্যালয় (৩) পারিবারিক বিদ্যালয় (৪) ইংরেজী বিদ্যালয় ও কলেজ (৫) দেশীয় বালিকা বিদ্যালয় (৬) দেশীয় মাইনর বিদ্যালয় ও (৭) বয়ষ্ক বিদ্যালয়। এছাড়া হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক পৃথক বিদ্যালয় ছিল। তাছাড়া ১৭৬৫ সাল থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ ছিল। পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্ম শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
২. উডস ডেসপাস (১৮৫৪) : ভারতবর্ষে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য হাউস অব কমন্স ‘উডস ডেসপাস’ নামক ব্যক্তিকে প্রধান করে একটি সিলেক্ট কমিটি গঠন করে এবং এ কমিটির সুপারিশসমূহকে উডস ডেসপাস শিক্ষা রিপোর্ট বলে। এই রিপোর্টে ভারতবর্ষে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইউরোপে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষার অনুকরণে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করা হয়।
৩. হান্টার কমিশন (১৮৮২) : বৃটিশ সরকার ডেসপাস কমিশনের শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত একটি মূল্যায়ন ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্যে ১৮৮২ সালে উইলিয়াম হান্টারকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করে।
৪. লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংস্কার (১৮৯৮)ঃ যে সময় ও যে সব অঞ্চলে বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষা সংস্কার ও ব্যবস্থা নিয়ে গণরোষ সৃষ্টি হয়েছিল সে সময় অর্থাৎ ১৮৯৮ সালে লর্ড কার্জন ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন যিনি উইলিয়াম হান্টার কর্তৃক সুপারিশকৃত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন পর্যালোচনা এবং তা আরো বেগবান করার জন্য একটি রিপোর্ট পেশ করেন।
৫. স্যাডলার কমিশন (১৯১৭)ঃ লর্ড কার্জনের সংস্কার রিপোর্টটির অব্যবহিত পরে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কতিপয় জটিল সমস্যা দেখা দেয়ায় লিডস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য স্যার মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়।
৬. সার্জেন্ট পরিকল্পনা (১৯৪৪)ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ভারতবর্ষের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন সৃষ্টি হয় এবং এ প্রেক্ষিতে ভারতে বড়লাটের নির্দেশে শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার জন সার্জেন্টের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়।
৭. আকরাম খান কমিটি (১৯৫২)ঃ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালে একটি কমিটি গঠন করে।
৮. আতাউর রহমান খান কমিশন (১৯৫৭)ঃ আকরাম খান কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না হওয়ায় গণরোষ সৃষ্টি হয় এবং তদানীন্তন সরকার আতাউর রহমান খানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে।
৯. শরীফ কমিশন (১৯৫৮)ঃ পাকিস্তান হওয়ার পর এদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানা জটিলতা, অভিযোগ ও অনুযোগ সৃষ্টি হয় এবং এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে জনাব এস.এম. শরীফের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন।
১০. এয়ার মার্শাল নূর খান শিক্ষা কমিশন (১৯৬৯)ঃ পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এয়ার মার্শাল নূর খান শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় এবং কমিশন পাকিস্তান সৃষ্টির পটভূমিকা ও জনগণের প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা পূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয় যার প্রেক্ষিতে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি.এস.সি. তে একটি সেমিনারে বক্তব্য দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র আবদুল মালেক শাহাদাত বরণ করেন। এরপর শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশ আন্দোলন এবং পরে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
বক্তব্যঃ
একটি দেশের জাতীয় শিক্ষানীতি সেদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে সে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোকিত করার প্রধান সোপান, জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তি, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, জনগণের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের বিভাজন দূরীকরণের সফল সহায়ক শক্তি এবং জাতীয় মিশন ও ভিশন বাস্তবায়নের রূপকার। জনগণকে সকল প্রকার আর্থ-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উদ্দীপক ও প্রেরণাদানকারী শক্তি হিসেবেও কাজ করবে এহেন শিক্ষাব্যবস্থা। শুধু তাই নয় জনগণকে তার সর্বোচ্চ ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপিত করবে এ শিক্ষা ব্যবস্থা। জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি ও শৃংখলা স্থাপন ও প্রতিষ্ঠায় এ শিক্ষা ব্যবস্থা শক্তি যোগাবে জনগণের মধ্যে অদম্য প্রত্যয় সৃষ্টির মাধ্যমে। মূলতঃ শিক্ষা ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠে গোটা জাতীয় সত্তার কাঠামো। কিন্তু বিগত ৩৬ বৎসর দেশে সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা, যা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য উপযুক্ত ও প্রযোজ্য, তা চালু না থাকার কারণে আমাদের জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট আদর্শিক শূন্যতা, নৈতিক দুর্বলতা, ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিভাজন, আগামী প্রজন্মের মধ্যে হতাশা, জাতীয় উন্নতিতে স্থবিরতা, জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে অশান্তি বিশৃংখলা ও অস্থিরতা ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই উল্লেখিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং স্বাধীন শক্তিশালী দেশ হিসেবে দুনিয়ার বুকে দাঁড়াতে হবে এবং টিকে থাকতে হবে- এটা নির্ভর করছে স্বাধীন, সর্বজনীন, বৈজ্ঞানিক, ধর্মীয় চেতনার উদ্দীপক, গ্রহণযোগ্য ও সমন্বয় সাধনকারী শিক্ষা ব্যবস্থার উপর।
বাংলাদেশে প্রণীত শিক্ষানীতিসমূহঃ
বাংলাদেশে বহু শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় এবং শিক্ষা কমিশনসমূহ শিক্ষানীতিও প্রণয়ন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ যাবৎ কোন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত হয়নি সঙ্গত কারণেই। এ সমস্ত কমিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৭৪-কে ভিত্তি করে যা কুদরাত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট নামে তখন থেকে খ্যাত।
সুতরাং তখন ছিল ১৯৭৪ সাল আজ ২০০৯ সাল; প্রায় তিন যুগের ব্যবধান সময়ে সমগ্র দেশ ও দুনিয়ায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে বিধায় সে রিপোর্টের ভিত্তিতে বর্তমানে নতুন কোন শিক্ষানীতি প্রণয়নের চিন্তা যথার্থ হবে না।
বর্তমান সরকার হয়তো বা এহেন প্রেক্ষাপটকে স্বীকার করেই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় সরকার সেই ১৯৭৪ সনে গঠিত ডঃ কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ও সুপারিশমালাকে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৭৪ সন ও ২০০৯ সনের মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে; সুতরাং সঙ্গত কারণেই ১৯৭৪ সনের শিক্ষা কমিটির রিপোর্টকে টার্মস অব রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করা আদৌ ঠিক নয়। কেননা সে কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তি ছিল তখনকার রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। কিন্তু ১৯৭৫ সনে এ চার মূলনীতির তিনটির মধ্যে বিরাট সংশোধনী আনয়ন করা হয়। মূলতঃ কুদরাত-ই-ই খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলঃ (ক) সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির কর্মী তৈরি করা এবং (খ) ধর্মীয় চিন্তা চেতনা বিবর্জিত সেক্যুলার চিন্তা-চেতনা সৃষ্টি ও এর আলোকে ব্যবহারিক জীবন গড়ে তোলা। কমিশনের ভাষায় আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বোধ শিক্ষার্থী চিত্তে জাগ্রত ও বিকশিত করে তুলতে হবে এবং তাদের বাস্তব জীবনে যাতে এর সম্যক প্রতিফলন ঘটে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে....................(অধ্যায় ১ :২)। এ ছাড়া কমিশনের রিপোর্টে জাতীয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চরিত্র গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করলেও চরিত্র গঠনের জন্য ধর্মশিক্ষা ও নীতি শাস্ত্রের কোন প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়নি; বরং চরিত্র গঠন ও সুনাগরিক তৈরির জন্য চার মূলনীতির উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছেঃ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট বোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত করে তাকে সুনাগরিক করে গড়ে তোলাই হবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য..........(অধ্যায় ২ : ৪)। অধিকন্তু কমিশন দেশপ্রেম সৃষ্টির জন্য বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শের সম্যক উপলব্ধি অর্জনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে......(অধ্যায় ২ : ১৩)। কুদরাত-ই-খুদা কমিশন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আদর্শ বিবর্জিত করার লক্ষ্যে যে রূপরেখা দিয়েছে তার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছেঃ (ক) সেকুলার পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, (খ) নতুন ভাবধারায় উজ্জীবিত শিক্ষক নিয়োগ, (গ) প্রাক-প্রাথমিক স্তর হবে ধর্মের প্রভাবমুক্ত (ঘ) প্রাথমিক শিক্ষা-প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একই মৌলিক পাঠ্যসূচী ভিত্তিক এক ও অভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা........(অধ্যায় ৭ : ৯), (ঙ) মাধ্যমিক শিক্ষা (৯ম-১২শ শ্রেণী)-মাধ্যমিক স্তরে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে কোন ধর্মশিক্ষা থাকবেনা.....(অধ্যায় ৮ : ১১), ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে ঐচ্ছিক হিসেবেও ধর্মশিক্ষা থাকবেনা........(অধ্যায় ৮ : ১১), একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে কোন বিভাগেই ঐচ্ছিক হিসেবে ‘ধর্মশিক্ষা’ নেয়া যাবে না......(অধ্যায় ৮ : ১১), বৃত্তিমূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত মৎসশিল্প, তাঁত শিল্প, কাফে কাজ, কেশ বিন্যাস, নৃত্য ইত্যাদি ৪১টি বিষয়ের মধ্যে ‘ধর্ম’ শিক্ষা হবে একটি এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে কৃষি, গার্হস্থ্য অর্থনীতি ইত্যাদির মধ্যে একটি ধর্ম বিভাগ রাখা হয়েছে, (চ) মাদ্রাসা শিক্ষা স্কুল শিক্ষার পর্যায়ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে কমিশন চরম অবজ্ঞা করেছে এবং কমিশনের ভাষায় মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটা একদেশদর্শী; কেননা সকল শিক্ষার্থীকেই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষা প্রদান মাদ্রাসার লক্ষ্য....(অধ্যায় ১.২) সাধারণ শিক্ষার মত মাদ্রাসায় ও ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কোন ইসলামী শিক্ষা দেয়া যাবে না, ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী পর্যন্ত সপ্তাহে ইসলামী শিক্ষার জন্য মাত্র দুটো পিরিয়ড থাকবে এবং মাধ্যমিক স্তরে মাদ্রাসা ছাত্ররা তিন বছর মেয়াদী বৃত্তিমূলক ধর্মশিক্ষা লাভ করতে পারবে, তবে তদসঙ্গে অবশ্যই বাংলা, ইংরেজী, গণিত ও বিজ্ঞান পড়তে হবে (৭ম অধ্যায়)। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলার ভাবধারায় গড়ে তোলাই ছিল ডঃ কুদরাত-ই খুদরা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট-এর মূল টার্গেট ও লক্ষ্য।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এটা যুক্তিপূর্ণভাবেই বলা যায় যে নবনিযুক্ত জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি কিছুতেই ১৯৭৪ সনের গঠিত কুদরাত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট যা জাতি কর্তৃক সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যাত, একটি মুসলিম প্রধান দেশের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ও যে রিপোর্টের মেয়াদ ৩৪ বৎসর উত্তীর্ণ হয়ে গেছে তা কিছুতেই ভিত্তি হিসেবে বা টার্মস অব রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করতে পারেনা। অধিকন্তু এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের শুরুতেই যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল যার অতীত ছিল বৃটিশ আমলের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানী আমলের সংশোধনীমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা যা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। এহেন সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা মূলতঃ দ্বিবিধ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল যার একটি ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চালুকৃত তথাকথিত আধুনিক বা ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা আর অন্যটি ছিল মাদ্রাসায় (আলীয়া ও কাওমী) চালুকৃত ধর্মীয় বা উর্দু-আরবী শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি পরিবারের দুই ভাই এক ভাই আধুনিক বা ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত আর অন্য ভাই মাদ্রাসায় উর্দূ-আরবী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত- এ দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য, একজন মিষ্টার অন্যজন মোল্লা নামে অভিহিত; এক ভাই সমাজ পরিচালক বা সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা সাহেব, আরেকভাই মসজিদ মাদ্রাসায় ইমাম-মোয়াল্লেম হিসেবে সমাজে ভূমিকা রেখে আসছে; অথচ একই সমাজে এভাবে সৃষ্ট-সম্পূর্ণ বিপরীত দুটো স্রোতধারা আদৌ কাম্য নয়। তবে বিগত ৩৬ বৎসর কিছু কিছু সংস্কারের মাধ্যমে মাদ্রাসার আলীয়া নেছাবের মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যেমন মাদ্রাসার দাখিল ও আলিম-কে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি সমপর্যায় এবং সর্বশেষ ফাজিল ও কামিলকে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের সমমান দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এখনও শিক্ষা ব্যবস্থায় সেই দুটো স্রোতধারার মধ্যে বিরাট বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায় যা স্বাধীন দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। যদিও আলীয়া নেছাবের মাদ্রাসায় উক্ত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে কিন্তু বৃটিশ পাকিস্তানী আমল থেকে চালুকৃত কওমী বা খারিজী নেছাবের মাদ্রাসায় আদৌ কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থার উক্ত দুটো ভিন্ন ধারা ছাড়াও বর্তমানে যেটি সবচেয়ে বেশি জোরদার ব্যক্তিক্রমধর্মী ধারা সৃষ্টি হয়েছে তা হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ও-লেভেল এবং এ-লেভেল যার প্রোডাক্টসমূহ আমাদের প্রচলিত উক্ত দুই ধারার প্রোডাক্টসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং বাংলাদেশের সমাজের সাথে বিপরীত ধর্মী।
এহেন অবস্থায় বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি উল্লেখিত তিনটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি সমন্বিত, কার্যকরী, সর্বজনীন, বিজ্ঞানসম্মত, স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি বা একক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আদৌ কোন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও ঘোষণা দিতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে বিজ্ঞ মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কেননা উক্ত জাতীয় কমিটিতে ত্রিধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত শিক্ষাবিদকে যেমন অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি অপর দিকে কমিটি এ যাবৎ জনমত যাচাই বা কোন মত বিনিময় অনুষ্ঠান বা কোন প্রশ্নমালাও পত্রিকায় প্রকাশ করেননি। এতে মনে হচ্ছে উক্ত কমিটি এককভাবে সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে কিছু একটা রিপোর্ট তৈরি করে ফেলবে এবং সরকারের ক্ষমতাসীন কালে সুপারিশমালা প্রকাশ বা বাস্তবায়ন করতে পারলেও পারে নাও পারে, যেমন অতীতে কোন কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে উল্লেখ্য, উল্লেখিত তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ যা কঠোর চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা দাবি করে। যদি তাড়াহুড়া করে অতীতের কমিশনগুলোর মত একদেশদর্শী, অপূর্ণাঙ্গ, সমন্বয়হীন এবং স্বাধীন দেশের জন্য অনুপযুক্ত কোন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় এবং এর আলোকে কোন শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয় তবে তা অতীতের মত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাই সুধী মহলের প্রত্যাশা এমনটি যেন না হয়। কেননা তিন যুগ অতীত হয়ে গেল এখনও আমাদের দেশের উপযোগী কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতি আমরা প্রণয়ন করতে পারলাম না এর চেয়ে চরম হতাশার বিষয় আর কি হতে পারে এবং আর কত যুগ আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হব। অথচ চলমান ও পরিবর্তনশীল দুনিয়া সামনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে এবং জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন যুগ সূচিত হচ্ছে ও উন্নয়নের ধারা এগুচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০
বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি’-তে বলা হয়েছে একদিকে ১৯৭৪ সালে সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার আলোকে প্রণোদিত কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে, অপরদিকে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গঠিত প্রফেসর ড. এম শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০-এর রিপোর্টকেও গাইডলাইন হিসেবে অনুসরণ করতে। মূলতঃ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০-এর প্রতিবেদন ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট-এর নব্য সংস্করণ। কেননা উক্ত শিক্ষানীতিতেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হৃদয়ে লালিত আদর্শ ইসলামের প্রতিফলন ঘটেনি; বরং নামে মাত্র ধর্মীয় শিক্ষার কিছু ব্যবস্থা রেখে জাতির নব প্রজন্মের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা লালন করে দেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানানোর হাতিয়ার ও মাল-মসলা তৈরির দীর্ঘমেয়াদী ও সুদূর প্রসারী কৌশলের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এতে ভূমিকাসহ ২৮টি অধ্যায়, ২টি সরণী ও ৫টি সংযোজনী রয়েছে যেগুলোর বিশ্লেষণ অত্র সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আদৌ সম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০ প্রণয়নে মূলতঃ গ্রহণীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কোন মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল না। ১৯৭৬, ৭৮, ৮৩ ও ১৯৮৭ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলোর কোন রিপোর্টের পর্যালোচনা হয়নি বরং ১৯৯৭ সালে গঠিত কমিশন রিপোর্ট এর মূল্যায়নের উপর বিভিন্ন মহল থেকে সংগৃহীত মতামত নিয়ে শিক্ষানীতিকে ভাষা, বাক্য ও শব্দের মারপ্যাচে আওয়ামী লীগের দলীয় আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা সর্বজনীন আদর্শ ইসলামকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ প্রণীত হয়েছিল। এ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০-এর রিপোর্টের ২৮টি অধ্যায়ের ত্রুটিসমূহ এখানে সংক্ষিপ্ততার কারণে উল্লেখ করা গেলনা। এমতাবস্থায় ২০০৯ সালের জন্য গঠিত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির জন্য জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ যুক্তিসঙ্গত কারণেই কোন গাইড লাইন হতে পারে না।
অত্র প্রবন্ধে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে যাতে করে আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি ২০০৯ এগুলোকে বিবেচনায় রাখতে পারে।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে কতিপয় সুপারিশ
বিষয়ভিত্তিক
এক. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীকে সচেতন করে তোলা।
৩. মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবহিতকরণ এবং শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর (যেমনঃ আল্লাহভীতি, পরকালীন জবাবদিহিতা, ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শিষ্টাচারবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, শৃংখলা, সামাজিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদির) বিকাশ ঘটানো।
৪. দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী, উৎপাদন সহায়ক ও সৃজনধর্মী করে তোলা; শিক্ষার্থীদেরকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, বস্ত্তগত ও নৈতিক শক্তির সমন্বিত জ্ঞানসম্পন্ন, দায়িত্ববান ও কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশে সহায়তা প্রদান করা।
৫. শিক্ষাকে ব্যাপক ভিত্তিক করার লক্ষ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেয়া, শ্রমের প্রতি শিক্ষার্থীদেরকে শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তোলা এবং শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে আত্মকর্ম সংস্থানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা।
৬. বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং ইসলামের সর্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।
৭. শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে শিক্ষার যাথাযথ মান নিশ্চিত করা এবং পূর্ববর্তী স্তরে অর্জিত (শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ) জ্ঞান, দক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গির ভিত দৃঢ় করা ও এগুলো সম্প্রসারণে সহায়তা করা এবং নবতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদেকে সমর্থ করে তোলা। এ লক্ষ্যে শিক্ষা প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ অবদান রাখার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা।
৮. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা এবং নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত করে বংশ পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।
৯. শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণময় সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী স্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষালাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা।
১০. শিক্ষাকে জাতি, ধর্ম, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা।
দুই. প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা
১. দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মসজিদকে কেন্দ্র করে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটানো সম্ভব। এতে নতুন করে অবকাঠামো তৈরির বাড়তি খরচ ও ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত অতি দ্রুত শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। তাই শিশুমনে ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞান ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাদানের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে দেশব্যাপী মসজিদভিত্তিক আদর্শ ফোরকানিয়া মক্তব চালু করা দরকার। প্রাথমিকভাবে বাংলা, অংক ও আরবী এবং পরবর্তিতে ইংরেজি লেখা ও পড়া শেখানো এর আওতায় থাকবে।
২. দেশব্যাপী নিরক্ষরতা দূরীকরণে আদর্শ ফোরকানিয়া মক্তব বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে। এতে করে নির্দিষ্ট কোর্স সমাপ্ত করে যে কেউ সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান দুটি বছর বেঁচে যাবে। অন্য দিকে যারা আর পড়তে পারবে না তারাও মোটামুটি শিক্ষিত হিসেবে জীবন-যাপন করতে পারবে।
তিনঃ প্রাথমিক শিক্ষা
১. প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপ হতে পারেঃ
ক. শিশুর যথাযথ মানসম্পন্ন ব্যবহারিক সাক্ষরতা নিশ্চিত করে তাকে উচ্চতর ধাপের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী ও আগ্রহী করে তোলা।
খ. শিশুকে জীবন-যাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা অর্জনের মাধ্যমে মৌলিক শিখন চাহিদা পূরণের সমর্থ করা এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষালাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
গ. শিশুর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশগঠনমূলক কাজে তাকে উদ্বুদ্ধ করা এবং মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা ও জ্ঞান দান করা।
ঘ. সুপ্ত ও সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ ও অর্থপূর্ণ শ্রমের প্রতি আকৃষ্ট করার মাধ্যমে শিশুকে তার জীবন সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জনে সমর্থ করা।
ঙ. শিশুমনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃংখলা, শিষ্টাচারবোধ, মানবাধিকার, সহমর্মিতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা করা এবং ধার্মিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক করে গড়ে তোলা।
২. মেয়াদঃ প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত হতে পারে।
৩. বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ঃ
ক. দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজমান নৈতিক অবক্ষয় রোধকল্পে এবং সরকারী-বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন এন.জি.ও পরিচালিত বিদ্যালয়/শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে একই মান ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা। একইভাবে ইংরেজি মাধ্যম কিন্ডারগার্টেন, ও-লেভেল এ-লেভেলসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচীতে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো।
খ. ইবতেদায়ী মাদরাসায় স্বাতন্ত্র বজায় রেখে শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
গ. কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারের স্থানীয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসা। এসব বিদ্যালয় সরকার নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে রেজিষ্ট্রেশনের জন্য আবেদন করলে বেসরকারী বিদ্যালয় রেজিষ্ট্রেশন আইন ১৯৬২ অনুসারে এসব বিদ্যালয়ের বিষয় বিবেচনা করা।
৪. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবস্ত্তঃ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার বিষয়সমূহ হতে পারে মাতৃভাষা, গণিত, পরিবেশ পরিচিতি, বিজ্ঞান এবং আরবী ও ইসলাম শিক্ষা/ধর্মীয় শিক্ষা। এছাড়া থাকবে শারীরিক শিক্ষা। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন ও পরিবেশের উপযোগী কিছু বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করা, যাতে যারা আর বিদ্যালয়ে পড়বে না এ শিক্ষার ফলে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে।
চারঃ গণশিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ শিক্ষার্থীর বয়স ও শিক্ষা-বিষয়কে ভিত্তি করে গণশিক্ষার দুটি ধারা থাকতে পারেঃ বয়ষ্ক শিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। বয়ষ্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষকে সাক্ষর, লেখাপড়া, হিসাব-নিকাশে ন্যূনতমভাবে দক্ষ, মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানবিক গুণাবলীর চেতনায় উদ্দীপ্ত এবং স্বাস্থ্য-পরিবেশ সচেতন করে তোলা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার পরিপূরক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে যে সকল শিশু-কিশোর বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না, ঝরে পড়ে যায়, তারা ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাসহ মৌলিক শিক্ষা লাভ করবে এবং কিছু ব্যবহারিক শিক্ষাও পাবে যা তারা প্রয়োজনে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে।
২. উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার বয়স ৪ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
৩. প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ প্রণীত হবে। উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণে জাতীয় চাহিদার প্রতিফলন থাকবে।
৪. বয়ষ্ক শিক্ষার আওতায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে সাক্ষরতা শিক্ষা, সচেতনতা অর্জন ও পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন।
৫. দেশের সকল নিরক্ষর নারী-পুরুষের জন্য পৃথকভাবে বয়ষ্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে নিরক্ষরদের মধ্যে যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৫ বছর তারা অগ্রাধিকার পাবে।
৬. বয়ষ্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য মসজিদকে অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে ও শিক্ষাকে গণমুখী করার লক্ষ্যে এ শিক্ষার কেন্দ্ররূপে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ উদ্দেশ্যে মসজিদভিত্তিক আদর্শ ফোরকানিয়া মক্তব, এ ছাড়া স্থানীয় ক্লাব, কাচারী ঘরকেও কেন্দ্র বানানো যেতে পারে।
পাঁচঃ মাধ্যমিক শিক্ষা
১. মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
ক. শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধা ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করা।
খ. কর্মজগতে অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে শিক্ষার্থীকে তৈরি করা।
গ. উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীকে প্রস্ত্তত করা।
ঘ. শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তরে প্রাপ্ত মৌলিক জ্ঞান সম্প্রসারিত ও সুসংহত করা।
ঙ. শিক্ষার্থীকে মৌলিক বিষয়ে অধিকতর জ্ঞান দান করা।
চ. ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন এবং নৈতিকমান সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলা।
২. শিক্ষার মাধ্যমঃ শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। বিদেশীদের জন্য ইংরেজি/আরবী মাধ্যম চালু থাকবে এবং সেক্ষেত্রে সহজ বাংলা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
৩. শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যপুস্তকঃ
ক. মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের তিনটি ধারার মধ্যে ২টি ধারা অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ধারায় নির্ধারিত অভিন্ন শিক্ষাক্রম এবং সাধারণ আবশ্যিক বিষয়সমূহে অভিন্ন পাঠ্যসূচী অনুসরণ করতে হবে। তবে দ্বিতীয় ধারা অর্থাৎ মাদরাসা শিক্ষায় স্বতন্ত্র ও সমমান বজায় রেখে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করতে হবে।
খ. মাদরাসা শিক্ষার সকল বিষয়ে পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্ব দিতে হবে
প্রস্তাবিত মাদরাসা টেক্সটবুক বোর্ডকে।
গ. ও লেভেল এ লেভেলসহ ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে।
৪. শিক্ষক নিয়োগঃ
ক. শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার বর্তমান অবস্থা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং মেধাবী যোগ্য শিক্ষক নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
খ. সরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের চাকুরী বিধির অনুরূপ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণের জন্য চাকুরী বিধি প্রণয়ন করা। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি, এসিআর লেখাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম প্রচলন করতে হবে।
গ. বেসরকারী স্কুল কলেজের ন্যায় সরকারী স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের চাকুরীর বয়স ৬০ বছর করতে হবে।
ছয়ঃ বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) ও কারিগরি শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ দক্ষ জনশক্তি জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী অসম প্রতিযোগিতায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি ও শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের অদক্ষ জনশক্তিকে বৃত্তিমূলক এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান শিক্ষার দ্রুত সম্প্রসারণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করতে হবে। বর্তমানে বিজ্ঞান প্রযুক্তির সম্প্রসারণ গ্রাম বাংলায় কৃষি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই দ্রুত ঘটছে। এ সকল ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগরি জনশক্তির খুবই প্রয়োজন। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা থাকবে অধিক। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি সরবরাহ করতে না পারলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সংকুচিত হবে। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রেরণের জন্য দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করতে হলে কেন্দ্রীয়ভাবে ১টি এবং সারা দেশে প্রতি জিলায় ১টি করে National Training Institute স্থাপন করতে হবে। এভাবে অদক্ষ জনশক্তির পরিবর্তে দক্ষ জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে শীঘ্রই দেশের অর্থনীতির ভিত্তি সুদৃঢ় করা সম্ভব হবে।
২. দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে মাদরাসা শিক্ষাসহ মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে বৃত্তিমূলক করা দরকার।
৩. বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) ও কারিগরি শিক্ষার সকল পর্যায় ও সেক্টরে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মানবৃদ্ধির লক্ষ্যে ধর্মীয় শিক্ষা (বিশেষ পাঠ) অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে।
সাতঃ মাদরাসা শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ মাদরাসা শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন করা। শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা, যেন এ বিশ্বাস তার সমগ্র চিন্তা ও কর্মে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ইসলামের যথার্থ সেবক ও রক্ষকরূপে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা এবং পার্থিব কল্যাণ, পরকালীন শান্তি ও আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি লাভ করা। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তারা ইসলামের আদর্শ ও মর্মবাণী ভাল করে জানে, সে অনুসারে সুদৃঢ় নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ও তার উন্নয়ন বিধানে উদ্যোগী হয়। পাশাপাশি জীবন ধারণ সংক্রান্ত ও বিভিন্ন জাগতিক কাজকর্মে পারদর্শী হয়ে ওঠার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে পারে।
২. বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশরূপে প্রতিষ্ঠিত। এই শিক্ষার স্বকীয়তা বজায় রেখে একে আরও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার যাতে এটি নতুন প্রাণরসে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে।
৩. সাধারণ শিক্ষার ন্যায় মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ সমভাবে উন্মুক্ত রাখতে হবে। এই উদ্দেশ্যে গাজীপুরে স্থাপিত মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীগণ দেশে ও বিদেশে নিয়োগ ক্ষেত্রে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নিজকে গড়ে তোলার সুযোগ পায়। এ উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে মাদরাসাগুলোর জন্য বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ন্যায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুবিধাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. সাধারণ শিক্ষার ন্যায় মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার, শিক্ষা উপকরণ, বৃত্তিদান, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. মাদরাসা শিক্ষা ধারায় শিক্ষার্থী মূল্যায়ণ প্রক্রিয়া মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বে রাখতে হবে।
৭. মাদরাসা শিক্ষার উচ্চ অর্থাৎ ফাযিল ও কামিল শ্রেণীকে যথাক্রমে ডিগ্রী ও মাস্টার্সের মান দিয়ে তার শিক্ষাক্রম/পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন, শিক্ষাঙ্গনগুলোর তদারকি ও পরিবীক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালনসহ সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ এপিলিয়েটিং ক্ষমতা সম্পন্ন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার উপর ন্যস্ত করতে হবে।
৮. প্রতি জিলায় ১টি করে মাদরাসাকে সরকারীকরণ করতে হবে।
৯. মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।
১০. মহিলা মাদরাসার জন্য মহিলা শিক্ষক এবং বালক মাদরাসার জন্য পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
১১. মাদরাসার সকল পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। বর্তমান মাদারাসা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটকে মানসম্পন্ন করা ও মহিলা শিক্ষিকাদের আলাদা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. প্রতি বিভাগে একটি করে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৩. মাদরাসার জন্য আলাদা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড গঠন করতে হবে।
১৪. স্কুলের অনুরূপ ৫ম ও ৮ম শ্রেণীর মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উপজিলা পর্যায় পর্যন্ত সরকারী বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫. মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ১ম শ্রেণী থেকে মাতৃভাষার সাথে আরবী ও ইংরেজী বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
১৬. পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদীসগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজিয়ে পড়াতে হবে। যেমনঃ তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত, তাকওয়া, চিকিৎসা, ভূগোল, সমাজ-বিজ্ঞান, সামাজিক আচরণ ইত্যাদি অধ্যায় ভাগ করে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭. আকাইদ বিষয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি বিষয়ের বিশ্লেষণ সন্নিবেশ করতে হবে।
১৮. বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিমদের অবদানের বিষয়গুলোকে পড়াতে হবে।
১৯. প্রচলিত ধর্মগুলোর সাথে ইসলামের তুলনামূলক আলোচনার বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
২০. ব্যবস্থা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ের সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনা পরিবেশন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আটঃ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন, আচরণগত উৎকর্ষ সাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতার সৃষ্টি ও চরিত্র গঠন। বিশেষভাবে মুসলিম শিক্ষার্থীগণ ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে দীন পালনে উজ্জীবিত হবে। বর্তমানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় বিষয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। এ সকল ব্যবস্থা সুসংহত ও গতিশীল করে যথাযথ মানসম্পন্ন ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাদান হবে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
২. ইসলাম শিক্ষাঃ
ক. শিক্ষার্থীদের মনে যাতে আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের প্রতি অটল ঈমান গড়ে ওঠে সেভাবে ইসলাম শিক্ষা দিতে হবে।
খ. ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ভালভাবে অবহিত হওয়ার জন্য উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
গ. শিক্ষার্থীর চরিত্রে মহৎ গুণাবলী অর্জন ও তাদের নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে হবে। ইসলাম শিক্ষার উদ্দেশ্যাবলী ও বিষয়বস্ত্তকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক শ্রেণীর প্রান্তিক যোগ্যতা চিহ্নিত করতে হবে।
ঘ. প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারগরি ও উচ্চ শিক্ষার সকল পর্যায়ে ও স্তরে ইসলামী শিক্ষার বিশেষ কোর্স বাধ্যতামূলক রাখতে হবে।
৩. হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য শিক্ষাঃ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য স্ব স্ব ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
নয়ঃ উচ্চ শিক্ষা
১. লক্ষ্য উদ্দেশ্যঃ
ক. নিরলস জ্ঞান চর্চা ও নিত্যনতুন বহুমুখী গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমসম্প্রসারণ।
খ. জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি।
গ. দেশের অদক্ষ ও স্থবির জনসংখ্যাকে এই যুগের রাষ্ট্র ও সমাজের উপযোগী কর্মচঞ্চল জনশক্তিতে রূপান্তরিত করণ।
ঘ. উপরিউক্ত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য উচ্চ শিক্ষার নীতিমালা হতে হবে নিম্নরূপঃ
* ধর্মীয় ও বৈষয়িক জ্ঞানে সমৃদ্ধ, পরমত সহিষ্ণু, মানবমুখী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।
* বৃদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার প্রসারতা বিকাশে সহায়ক।
* সম্পূর্ণ সমাজমুখী অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজের সমস্যা সনাক্তকরণে সচেষ্ট ও সমাধান প্রয়োগে উপযুক্ত।
* আধুনিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের উন্নয়ন ও প্রগতির অনুষঙ্গী।
* উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে সমাজের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে একে সমাজ সংযুক্তকরণে প্রতিশ্রুত।
* শিক্ষকতা ও গবেষণার মান উন্নত করতে সমর্থ এমন ব্যবস্থা থাকা।
২. মাধ্যমিক শিক্ষা সফলভাবে সমাপ্ত করার পর ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করবে। এক্ষেত্রে মেধাগত সমতা নিশ্চিত করার জন্য মাদরাসা শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী সাধারণ শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির সমমানের হতে হবে।
৩. শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ, যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ও কলেজে, উচ্চ শিক্ষা প্রদান করতে হবে। শিক্ষার্থীর মেধা, আগ্রহ ও প্রবণতার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কোটা পদ্ধতি বা অন্য কারণে ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত শিথিল করা যাবে না।
৪. প্রত্যেক কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে হবে।
৫. দেশের উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে অনুমোদিত ও প্রস্তাবিত বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি ও শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত উপযুক্ত মানের হতে হবে।
৬. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ‘৭৩-এর অধ্যাদেশ’ সর্বোতভাবে পরিবর্তন করে বর্তমান সময় উপযোগী করতে হবে।
দশঃ প্রকৌশল শিক্ষা
প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার লক্ষ্য হবে সমাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন, বাস্তবধর্মী দক্ষ প্রকৌশলী ও কারিগরি জনশক্তি গড়ে তোলা যারা দেশের উন্নয়নে, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে, দারিদ্র বিমোচনে এবং সমাজ ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখবে। নৈতিক মান উন্নত করার জন্য ও শিক্ষায় প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এগারঃ চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা
১. চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে হবে নিম্নরূপঃ
ক. দেশের সমস্ত অধিবাসীকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে স্বাস্থ্যবান ও কর্মক্ষম রাখার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত মানের চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী ও সকল প্রকারের বিশেষজ্ঞ তৈরি করা।
খ. চিকিৎসা পেশা অন্যান্য সকল পেশার চেয়ে স্পর্শকাতর, শারীরিক ও মানসিক কষ্ট/অসুস্থতা তথা জীবন-মৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে জড়িত বলে চিকিৎসক, সেবক-সেবিকা সকল স্বাস্থ্যকর্মী যেন সংবেদনশীল বিবেকবান মানুষ হিসেবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হন সে জন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করা।
গ. দেশের ব্যাধি ও চিকিৎসা সমস্যাবলীর মুকাবিলায় উপযুক্ত চিকিৎসা শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞ তৈরির লক্ষ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা।
ঘ. চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল উন্নতির সুফল দেশের জনগণের বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ, সেবক-সেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসা কৌশলীদের জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণের ব্যবস্থা ও এদের সবাইকে দীনি দৃষ্টিভঙ্গি দেয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও মানব সেবায় অনুপ্রাণিত করা।
২. আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি ঐতিহ্যগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা ব্যবস্থারও উন্নয়ন সাধনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে যাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদান উপযুক্ত মানসম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের অবদান এবং এ বিষয়ে কুরআনের শিক্ষা নিয়ে একটি বিশেষ কোর্স চালু করতে হবে।
বারঃ বিজ্ঞান শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ বিজ্ঞান শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রস্ত্তত করা যেন তারা প্রতিভা বিকাশে, জ্ঞানের সাধনা ও সৃষ্টিশীলতার আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রযুক্তি শিক্ষা ও মানবিক শিক্ষার যে পারস্পরিকতা ও পরিপূরকতা তা উপলব্ধি করে একটি সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার অংশরূপে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রক্রিয়া চলবে। বিজ্ঞান শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি ত্বরান্বিত করা। শিক্ষার সব স্তরেই বিজ্ঞান শিক্ষা উক্ত উদ্দেশ্যেই নিবেদিত হবে।
২. বিজ্ঞান শিক্ষা প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করতে হবে। শিশুদেরকেও বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত প্রাকৃতিক ঘটনামালা ও নিয়মগুলোর সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে হবে। প্রাথমিক স্তরে প্রকৃতি, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলি সম্পর্কে শিশুরা যাতে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে সেজন্য নানা চিত্র প্রদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও নানাবিধ সহজ পরীক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৩. প্রাথমিক স্তরের ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার একটি সমন্বিত কোর্স থাকতে হবে।
৪. মাধ্যমিক স্তরে যাতে করে শিক্ষার্থী পঠিত বিজ্ঞান শাখাগুলোর মৌলিক বিষয়সমূহ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা এবং এগুলোর ব্যাখ্যা বাস্তব জীবনের কার্যকারিতার দিকগুলো জানতে পারে সেভাবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে এবং পাঠদান করতে হবে। বিজ্ঞানের বইয়ে, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের যথাসম্ভব আধুনিকতম আবিষ্কারের ঘটনা ও দৃষ্টান্ত সহজভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৬. বিজ্ঞান গবেষণার জন্য উন্নত আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার গড়ে তুলতে হবে।
৭. মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণের ক্ষমতাকে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
৮. বিজ্ঞান, বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান দানের সাথে সাথে শিক্ষার্থীদেরকে ইংরেজী ও আরবী ভাষার জ্ঞান দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯. বিজ্ঞানে ও গণিতে মুসলিমদের অবদান সম্পর্কে প্রতি শ্রেণীতে বিশেষ পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে শিক্ষার্থীগণ পূর্ববর্তীদের অবদানের কথা জেনে নিজেরাও অনুপ্রাণিত হবে।
তেরঃ কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা
১. সকল সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিআইটিসমূহে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ থাকতে হবে।
২. ডিগ্রী প্রদানকারী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য কোর্স কারিকুলাম আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
৩. তৃণমূল পর্যায়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জিলা ও উপজিলা পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৪. আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার মান সংরক্ষণের জন্য জাতীয় পরীক্ষা পদ্ধতির আওতায় মান নির্ধারণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বেসরকারী খাতকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
৬. কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
চৌদ্দঃ কারবার (বিজনেস) শিক্ষা
১. কারবার শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপ হতে পারেঃ
* কারবার শিক্ষা ও জ্ঞান সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া।
* প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামোর নিম্নস্তরে দক্ষ কর্মী তৈরি করা ও সহায়তা করা।
* আত্মকর্মস্থানে সহায়তা করা।
* আত্মকর্মসংস্থান উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করা।
* একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রস্ত্তত করা।
২. দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের জনবলের চাহিদার ভিত্তিতে কারবার শিক্ষার সম্প্রসারণ, পরিমার্জন ও সমন্বয় সাধন করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. কারবার শিক্ষার সকল স্তরে শিল্প, বাণিজ্য ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত রীতি পদ্ধতি ও সম্ভাব্য উন্নয়ন চাহিদার আলোকে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন স্তরের জন্য স্তর ভিত্তিক উদ্দেশ্য ও চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করতে হবে।
৪. কারবার শিক্ষার সকল স্তরে ব্যবসা ও কারবার সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালাসহ মৌলি ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পনেরঃ কৃষি শিক্ষা
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কৃষি একটি ফলিত বিজ্ঞান। কৃষি বলতে বুঝায় দেশের শস্য, পশুসম্পদ, মৎস্যসম্পদ ও বনসম্পদের পরিকল্পিত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা। কৃষি শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিম্নরূপ হতে পারেঃ
০ দেশের পরিবেশগত শক্তি ও সম্ভাবনার বিকাশ সাধন।
০ জাতীয় উন্নয়ন কৃষি নির্ভর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
০ বিজ্ঞান ও যান্ত্রিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থার দ্বারা কৃষি সম্পদের যথাযথ বিকাশ।
০ পেশা ও বিজ্ঞান হিসেবে জাতীয় জীবনে কৃষির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রসার।
০ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে দেশের স্থলজ ও জলজ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি।
০ কৃষি শিক্ষার মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধকরণ।
০ দেশের মাটি, পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
০ কৃষিকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের চাবি-কাঠি হিসেবে উপলব্ধি করার জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও সচেতনতা সৃষ্টি।
০ কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ।
০ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, অপুষ্টি দূরীকরণ ও দারিদ্র বিমোচন।
০ গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ এবং আদর্শ কৃষিবিদ তৈরির জন্য কৃষি শিক্ষার সকল পর্যায়ে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা।
ষোলঃ আইন শিক্ষা
১. আইন শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে নিম্নরূপ
ক. জনগণের আইনগত অধিকার সংরক্ষণে সহায়তা করা।
খ. সুদক্ষ, আইনজীবী ও আইনবিদ তৈরি করা।
গ. এমন উচ্চ যোগ্যতা, উন্নত চরিত্র, ধীশক্তি ও জ্ঞান-সম্পন্ন ব্যক্তি সৃষ্টি করা যারা-
• আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে।
• দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবে।
• পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার আদর্শ স্থাপন করবে।
• আইন ও বিচার পদ্ধতির সংস্কার ও উন্নতি সাধন করতে পারবে।
• আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজের নতুন নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে আইনশিক্ষা ও তার ব্যবহারিক অনুশীলনের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারবে।
ঘ. ইসলামের ফৌজধারী ও দেওয়ানী আইনসহ ইসলামী আইন দর্শন সম্পর্কে পারদর্শী হবে।
সতেরঃ নারী শিক্ষা
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ দেশ ও সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি শিক্ষা। সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক নানা কারণে এদেশের দরিদ্র মানুষ যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি সর্বস্তরে ব্যাপক সংখ্যক নারীও এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর সার্বিক উন্নয়নে ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে নীতিমালা প্রণয়ন ও সে আলোকে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে স্বতন্ত্র মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন করা, স্বীয় অধিকারের ব্যাপারে প্রত্যয়ী করা, নারীর উপযোগী পেশায় দক্ষ করে তোলা, সুখী ও কাঙ্ক্ষিত পরিবার গঠনে উৎসাহিত করা।
২. নারীদের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৩. প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে পাঠ্যসূচীতে ইসলামের আলোকে নারীর মর্যাদার কথা তুলে ধরতে হবে।
৪. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচীতে মহিলা সাহাবী ও অন্যান্য প্রখ্যাত আদর্শবান নারীদের জীবনী ও লেখা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করার জন্য দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রীদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আঠারঃ বিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, স্কাউট ও গার্লস গাইড
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ যে সব শিশু শারীরিক ও মানসিক সমস্যার জন্য তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ করতে পারে না তাদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষা, দক্ষ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা, বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা। বিশেষ শিশুদের আওতায় পড়ে শ্রবণ প্রতিবন্ধী, শারীরিক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত শিশুরা। প্রতিবন্ধীত্বের ধরন ও মাত্রার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করা বিশেষ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
২. বিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, স্কাউট ও গার্লস গাইড ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে।
ঊনিশঃ সামরিক শিক্ষা
১. সামরিক শিক্ষা প্রত্যেক নাগরিকে জন্য বাধ্যতামূলক করা।
২. প্রাথমিক স্তর থেকে এ শিক্ষা শুরু হবে। মাধ্যমিক স্তরে প্রত্যেক বিভাগের সাথে এটা সাধারণভাবে সংযুক্ত থাকবে।
বিশঃ গ্রন্থাগার বিজ্ঞান
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা দেশের নাগরিকদের জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, গবেষণা, নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শিক্ষা গ্রহণে গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। স্থানীয়, জাতীয়, ইসলাম, মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্য সহজ লভ্য করার দায়িত্ব হল দেশের গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রগুলোর, এই প্রত্যয়কে ভিত্তি করে দেশের গ্রন্থাগার ও তথ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
২. মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে উন্নত ও আধুনিক মানের গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার কর্তৃক গ্রন্থাগারের জন্য বার্ষিক মঞ্জুরী দিতে হবে।
৩. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্রন্থাগারকে তথ্য প্রযুক্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে এবং গবেষণা কাজে সহায়তার জন্য গ্রন্থ ও সাময়িকী ক্রয়ের জন্য ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. বিভাগীয় শহর, জিলা এবং প্রত্যেক উপজিলা ও ইউনিয়নে পর্যায়ক্রমে গণগ্রন্থাগার স্থাপন করতে হবে। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ শহরগুলোতে নগর গ্রন্থাগার ও পৌর গ্রন্থাগার স্থাপন করবে।
একুশঃ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
১. প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের একটি সুনির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. কর্মরত শিক্ষকদের দক্ষতা মূল্যায়ণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কোন দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলে তা বিশেষ ব্যবস্থায় দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩. প্রশিক্ষণার্থীদের আর্থিক মঞ্জুরী বাড়ানো এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. শিক্ষকদের ধর্মীয় ও নৈতিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান সম্বলিত ১০০ নম্বরের ১টি বিষয় বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য স্ব স্ব ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বাইশঃ শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যপুস্তক
১. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ শিক্ষার মূল প্রাণবিন্দু শিক্ষাক্রম। তাই শিক্ষাক্রমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধ, জাতীয় আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সমকালীন চাহিদার প্রতিফলন ঘটবে এটা যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা ও গ্রহণক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম প্রণীত হবে এটিও কাঙ্ক্ষিত। যেহেতু একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের বিরাজমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠা বাঞ্ছনীয়, তাই পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার শিক্ষাক্রমে এগুলোর প্রতিফলন সুনিশ্চিত করতে হয়। মূলতঃ শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাঙ্ক্ষিত আচরণিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি দক্ষ, দেশপ্রেমিক, আত্মনির্ভরশীল, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, শ্রমনিষ্ঠ সুনাগরিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলাই শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষাকে এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর সোপান হচ্ছে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচীর আলোকেই রচিত হয় পাঠ্যপুস্তক। তাই শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব অপরিসীম।
২. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচীঃ
ক. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচীতে সামাজিক, মানবীয়, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
খ. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরসহ শিক্ষার প্রতিটি স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচীতে জাতীয় আদর্শ ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মাতৃভাষা, দেশজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
৩. পাঠ্যপুস্তকঃ
ক. প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য পাঠসহায়ক সামগ্রীর মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যাপার বর্তমানে অনুসৃত নীতিমালা অব্যাহত থাকবে।
খ. মাধ্যমিক স্তরের জন্য শ্রেণী ও বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্ব থাকবে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে তার অধীনে এবং পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বাজারজাত করণের দায়িত্ব থাকবে প্রস্তাবিত পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ বোর্ডের অধীনে।
৪. পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের নীতিমালাঃ
ক. বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
খ. পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী অনুযায়ী প্রতিটি বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডঃ
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে বিভক্ত করে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও মুদ্রণের জন্য ২টি পৃথক সংস্থা গঠন করতে হবে।
তেইশঃ শিক্ষা প্রশাসন
সকল স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনকে গতিশীল, ত্রুটিমুক্ত ও স্বচ্ছ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৎ, ধার্মিক ও যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে হবে।
চবিবশঃ শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে বিশেষ কয়েকটি পদক্ষেপ
১. শিক্ষক সমাজের একাংশের নৈতিকতাবোধের অভাবে দেশে ব্যাপকভাবে প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা এবং কোচিং সেন্টার চালু হয়েছে। তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নন এমন কোন ব্যক্তি যদি কোচিং সেন্টার চালাতে চান তা করতে পারবেন, তবে তা যথাযথ মানসম্পন্ন হতে হবে এবং চালু করার/রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।
২. শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন।
৩. ট্রাস্ট/সোসাইটি পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান যেহেতু তুলনামূলকভাবে উন্নত, সেহেতু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সহযোগিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে ছোট্ট একটি ভূ-খন্ডে দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে লালিত পালিত হয়ে আসছে এমন একটি আদর্শ যা সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন যা যুগ ও কালের আবর্তে বিলীন হবার নয়। সকল দেশের মানুষের মতো এ দেশের মানুষও শুধু শরীর বা জড় সর্বস্ব মানুষ নয়। বরং তারাও আত্মা সম্পন্ন মানুষ। ঘোষিতব্য শিক্ষানীতিতে জড় ও আত্মার সমন্বয়, মৌলিক মানবীয় ও নৈতিক গুণাবলীর সমন্বয়, ব্যবহারিক বা বাস্তব জীবনের সাথে গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের সমন্বয়, অতীত ও বর্তমান ইতিহাস, পৌরবিজ্ঞান ও অর্থনীতির সাথে জীবনবোধ, নীতিবোধ, আদর্শবোধ ও ঐতিহ্যবোধের সমন্বয়, ইহলৌকিক জীবনের সাথে পারলৌকিক জীবন (যা অত্যন্ত সীমিত হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি বিশ্বাস করে না যাদেরকে নাস্তিক বলা হয়) এর সমন্বয়, চলমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে স্রষ্টার সৃষ্টি তত্ত্বের বা সৃষ্টি রহস্যের সমন্বয় এবং ধর্মীয় শিক্ষার সাথে বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমন্বয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষানীতিতে প্রাধান্য পেতে হবে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা, মনন ও চিন্তাধারা, আমাদের জাতীয় আদর্শের অনুকূলে প্রভাবিত করে তাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশের আগামী দিনের সুযোগ্য নাগরিক ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের আসনে পৌঁছিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তাদেরকে জনশক্তি ও মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার কৌশল।
এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষানীতি সাজিয়ে নিলেই তা হবে উপযোগী ও বাস্তব ধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা। আমরা আশা করবো, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন।

[প্রবন্ধটি ১০ই অকটোবর, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।]