হাদীছ নিয়ে বিভ্রান্তি


ড.আ.ছ.ম.তরীকুল ইসলাম
ভূমিকা
হাদীছ হচ্ছে ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান উৎস, যার উপর ভর করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসলামী শারী‘আতের গগনচুম্বি অট্টালিকা। হাদীছকে বাদ দিয়ে ইসলামের পরিপূর্ণ রূপ কল্পনাও করা যায় না। ইসলামের অস্তিত্বের সাথে ওৎ-প্রোতভাবে জড়িত এই হাদীছ সম্পর্কে আমাদের কিছু সংখ্যক লোকের স্বচ্ছ ধারণা নেই। সেই কারণেই তাদের মধ্যে হাদীছ কেন্দ্রিক কিছু বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে। হাদীছ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাদান ও এই সব বিভ্রান্তি অপনোদনই হচ্ছে এই লেখাটির প্রতিপাদ্য বিষয়।
হাদীছ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে, আমাদের সমাজের অনেকেই হাদীছকে যথাযথ মূল্যায়ন করে এর শিক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছেন না। অনেকের নিকট হাদীছ যেভাবে গুরুত্ব পাওয়ার প্রয়োজন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। হাদীছের গুরুত্ব যে ঈমান আকীদাহর সাথে সম্পর্কিত, মুসলিম থাকা না থাকার সাথে সম্পর্কিত; এই শাশ্বত সত্যটি প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। হাদীছকে গুরুত্ব দেওয়ার সাথে সাথে জাল, মিথ্যা ও দুর্বল হাদীছের ব্যাপারে যাতে আমরা সকলেই সতর্ক থাকি, সেই বিষয়টিও এখানে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। পক্ষপাতদুষ্ট ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী বর্জন করে নিরপেক্ষ ও উদার মন নিয়ে হাদীছ অধ্যয়নের দিকে এখানে উদাত্ত আহবান জানানো হয়েছে। হাদীছকে যথাযোগ্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যাতে কেউ বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করতে পারে, সে বিষয়েও এখানে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। হাদীছ নিয়ে বিষোদগারকারীদের থেকে মুসলিম উম্মাহকে সাবধান থাকার পরামর্শও দেয়া হয়েছে এখানে। যে সব ক্ষেত্রে হাদীছ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে, তার সবটুকুও আলোচনা সম্ভব না হলেও, প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করার লক্ষ্যে উদাহরণস্বরূপ দু’একটি বিষয় এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। চিন্তাশীল ও গবেষক পাঠকগণ এই লেখা থেকে আরো গবেষণা করার খোরাক পাবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। লেখাটিকে তথ্য নির্ভর করা ও একে ত্রুটিমুক্ত করার জন্য যারা সুচিন্তিত পরামর্শ দিয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন, তাদের প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ। উল্লেখ্য যে, এখানে উল্লিখিত তথ্যসূত্র আল-মাকতাবাতুশ শামিলার তৃতীয় সংস্করণ হতে সংগৃহিত হয়েছে। লেখাটি ছাপানোর দায়িত্ব নেয়ায় বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃপক্ষকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসকে কবুল করুন। পাঠক সমাজকে এত্থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
ড. আ.ছ.ম. তরীকুল ইসলাম

بسم الله الرحمن الرحيم

১. সূচনা
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীছ হচ্ছে এ জীবন ব্যবস্থার প্রধান উৎস। আল-কুরআন আল্লাহ রাববুল ‘আলামীনের পক্ষ হতে পাঠানো বিশ্ব মানবতার জন্য পথ নির্দেশিকা। অনুসরণ করার একমাত্র উপযোগী এ মহাগ্রন্থ মানব জাতির জন্য অতুলনীয় এক আলোক বর্তিকা। এরই পাশাপাশি রয়েছে, বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিশুদ্ধ হাদীছসমূহ। অসংখ্য হাদীছের নির্মল আলোক রশ্মিও ইসলামের দৃষ্টিতে নিখিল বিশ্বের মানুষের জন্য সঠিক পথ ও পাথেয় হিসেবে গণ্য।
নিঃসন্দেহে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা মহিমান্বিত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নির্ভুল বাণী। কোন সন্দেহ-সংশয় থেকে এ গ্রন্থ একেবারেই মুক্ত। বিশুদ্ধ হওয়ার যে কোন মানদন্ডে এ গ্রন্থ পূর্ণ ভাবে উত্তীর্ণ। তথ্যের বিশুদ্ধতায়, ভাব, ভাষা, উপস্থাপনা মোটকথা সকল দিক থেকে এ গ্রন্থ অসাধারণ ও তুলনাহীন। এ আল-কুরআন যেই প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার বাণী, তাঁরই স্বীকৃত রাসূল হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁরই রেখে যাওয়া অসংখ্য বিশুদ্ধ হাদীছও বিশুদ্ধ পন্থায় সংরক্ষিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। বলা বাহুল্য, আল-কুরআন ও আল-হাদীছকে একত্রে অনুসরণ করা না করাকে নিয়ে অনেকের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, মহামহিম আল্লাহর বাণী মহাগ্রন্থ আল কুরআনই আমাদের পথ নির্দেশিকা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুধু এ গ্রন্থকে অনুসরণ করলেই চলবে। অন্য কোন কিছু তো নয়ই এমনকি হাদীছ অনুসরণেরও প্রয়োজন নেই। অপর পক্ষ বলেছেন, না, হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে, শুধু আল কুরআনকে অনুসরণ করা কোন ক্রমেও সম্ভব নয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন ও হাদীছ- ইসলামের এ দুই প্রধান উৎসই সম্মিলিত ভাবে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ রূপ দান করেছে। এর একটিকে বাদ দিয়ে পরিপূর্ণ ইসলাম কল্পনাও করা যায় না। বরং শুধু আল-কুরআনকে মেনে চলা এবং হাদীছকে অস্বীকার করা ইসলামে জঘণ্যতম অপরাধ।
উল্লেখিত এ উভয় পক্ষই আল-কুরআন ও হাদীছের অনেকগুলো প্রমাণ তাদের মতামতকে সুদৃঢ় করার জন্য উপস্থাপন করেছেন। এখন এ উভয় পক্ষেরই অবস্থান ইসলামের আলোকে মূল্যায়ণ হওয়া অতীব প্রয়োজন। বিষয়টি অমীমাংসিত থাকলে এর নেতিবাচক প্রভাবে মুসলিম উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে, তাও আজ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাদীছ ইসলামের এমন কোন নগণ্য উৎস কিনা, যা উপেক্ষা করে ইসলামী জীবন বিধান পরিপালন করা সম্ভব, এ প্রসংগটিও বিবেচনায় আনা আজ সময়ের অনিবার্য দাবী। হাদীছকে কেন্দ্র করে শুধু মুতাওয়াতির হাদীছ ব্যতীত আহাদীছুল আহাদ গ্রহণ করা না করা, দুর্বল হাদীছ কোন কিছুর ফাদীলাত বর্ণনার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা বৈধ কি না, বিপক্ষীয় মতামতের পক্ষে উপস্থাপিত হাদীছসমূহে বস্ত্তনিষ্ঠ সমালোচনার অপ্রতুলতা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি এমন সব বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটাচ্ছে, যা মুসলিম উম্মাহকে সমস্যাগ্রস্ত করে তুলছে। ইসলামের নিরপেক্ষ পক্ষপাতশূণ্য দৃষ্টিকোণ থেকে বক্ষ্যমাণ বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট মূল্যায়ণ সকলের সম্মুখে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াসই হচ্ছে এ লেখাটি। বিষয়টিকে সুবিন্যস্ত ভাবে উপস্থাপনের জন্য কয়েকটি উপ শিরোনামে বিভক্ত করা হয়েছে।
২. বিশুদ্ধ হাদীছ সংরক্ষণ ও জাল হাদীছ রচনার কারণসমূহ
হাদীছ হচ্ছে আরবী শব্দ, পুরাতনের বিপরীত বুঝাতে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- যে কোন খবর, চাই তা কমই হোক অথবা বেশিই হোক। সুতরাং যে কোন সংবাদ, কথা ও খবরকেই হাদীছ বলা হয়। পরিভাষায় হাদীছের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হচ্ছে-
وأنه جميعا ما أضيف إلى النبي "صلى الله عليه وسلم" قولا أو فعلا أو ةقريرا أو صفة.
‘‘সকল প্রকার কথা, কাজ, সম্মতি ও গুণাবলী যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে সম্বোধন করা হয়েছে তাকেই হাদীছ বলে।’’ অনেকেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুণাবলীকে হাদীছের অন্তর্ভুক্ত করেন না। মূলত: এটিও হাদীছের অন্তর্ভুক্ত। আছহাব রাদিআল্লাহু আনহুমের কাজ কথা ও সম্মতিকে হাদীছের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকলেও এ বইয়ে শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা, কাজ ও তাঁর মৌন সম্মতিকে হাদীছ বলে গণ্য করা হয়েছে। এটি মূলতঃ সুন্নাতের সমার্থবোধক।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম দিকে সীমিত পরিসরে হাদীছ লিখনের অনুমতি দিলেও ব্যাপকভাবে হাদীছ লিখতে নিষেধ করেছিলেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন লেখার চর্চা সে সময় অব্যাহত ছিল। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সাথে হাদীছের যাতে কোন প্রকার সংমিশ্রণ না ঘটে, সে জন্যই মূলত সূক্ষ্ম ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছসমূহ না লেখার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।
মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের পরেও আছহাব রাদিআল্লাহু আনহুম-এর মধ্যে লেখকের সংখ্যা নগণ্য হওয়ায় ও লিখিত বিষয়াদি সংরক্ষণের পদ্ধতিতে ব্যাপকতা লাভ না করায়, বেশ কিছু সময় ধরে হাদীছ লেখার কাজ যথাযথ ভাবে শুরু হয়নি। তবে আছহাব রাদিআল্লাহু আনহুম অত্যন্ত সতর্কতার সাথে মৌখিক ভাবে ব্যাপক আকারে হাদীছ চর্চা অব্যাহত রাখেন। এমন কি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে সংঘটিত যুদ্ধ বিগ্রহ, ঘটনা প্রবাহ, ঐতিহাসিক বিষয়াদিরও চর্চা তাঁদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। তাঁরা হাদীছের পাশাপাশি একে অপর থেকে এগুলোর শিক্ষা গ্রহণ করতেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরে আল-খুলাফাউর রাশিদূন ও উমাইয়া খালীফাদের একটি সময়কাল পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ে লেখনীর মাধ্যমে ও মৌখিকভাবে হাদীছ চর্চা অব্যাহত ছিল। সে যুগের লোকেরা ছিলেন খুবই মেধাসম্পন্ন ও তীক্ষ্ম মেধা শক্তির অধিকারী। তাঁদের প্রখর স্মৃতি শক্তি ছিল বিস্ময়কর। হাদীছ সংরক্ষণের ব্যাপারে তাঁদের স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করা অমূলক কিছু ছিল না। প্রাথমিক যুগে হাদীছ লিপিবদ্ধ না হওয়ার এটাও একটি সংগত কারণ। যুগের পরিবর্তনে যখন স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়, তখন হাদীছ লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিচক্ষণ শাসক ‘উমার ইবন আবদিল আযীয’ রাহিমাহুল্লাহ সরকারী ভাবে মদীনার গর্ভনরকে হাদীছ লেখার নির্দেশ দান করেন। এরপূর্বে বিছিন্নাকারে কিছু লেখা হলেও আনুমানিক ১০০ হিজরী সনে তাঁর নির্দেশে ব্যাপকভাবে হাদীছ লেখা শুরু হয়। পরবর্তিতে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের সকল এলাকার প্রশাসককে সে এলাকায় সন্ধান প্রাপ্ত হাদীছ লিপিবদ্ধ করার জন্য সরকারী নির্দেশ জারী করেন। তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দেন-
انظر ما كان من حديث رسول الله صلي الله عليه وسلم فاكتبه فإني خفت دروس العلم وذهاب العلماء ولا تقبل إلا حديث النبي صلي الله عليه وسلم .
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করুন। হাদীছ পেলেই তা লিপিবদ্ধ করুন। আমি ইলম ধ্বংস হওয়া এবং আলিমদের চলে যাওয়ার ভয়ে ভীত হচ্ছি। এ ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করবেন না।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘আবূ বাকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন ‘আমর ইবন হাযম’ (মৃত: ১২০ হি:) কয়েকটি গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেন। তবে এগুলো উমার ইবন আবদিল আযীযের নিকট পাঠানোর পূর্বেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় ইবন শিহাব যুহরীই যে সর্বপ্রথম হাদীছ লিপিবদ্ধ করেন, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। তিনি কাগজ কলম নিয়ে আলিমদের কাছে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন এবং তাঁদের নিকট হতে যে হাদীছ শুনতেন, তা লিপিবদ্ধ করতেন।
অনেক ছাহাবীই হাদীছ লিখতে গিয়ে পুস্তিকাও তৈরি করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, যা ছাহাইফুছ ছাহাবাহ (صحائف الصحابة) নামে পরিচিত। এই সকল ছাহীফার মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য ছাহীফাহ হচ্ছে-
1. আবূ বাকর রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ, তন্মধ্যে যাকাত সংক্রান্ত হাদীছ একত্রিত করা হয়েছিল।
2. আলী রাদি আললাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
3. আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আছ রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
4. ইবনু আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমার ছাত্র সা‘ঈদ ইবন জুবায়ির রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
5. ইবনু আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমার অন্য ছাত্র মুজাহিদ ইবন জাবিরের ছাহীফাহ।
6. আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে লিখিত বাশীর ইবন নুহায়িক রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
7. জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাত্র আবূ যুবায়ির মুহাম্মাদ ইবন মুসলিম ইবন তাদরীসিল মাক্কী রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
8. হিশাম ইবন উরওয়াহ ইবনুয্ যুবায়ির রাদি আল্লাহু ‘আনহুর ছাহীফাহ।
উল্লেখযোগ্য যে এইসব ছাহীফায় ব্যাপক সংখ্যক হাদীছ সন্নিবেশিত করা হয়নি। তাবি‘ঈ ও তাবি‘ঈনের যুগে মূলত অনেক হাদীছের সংকলন সংকলিত হয়। যাঁরা এই হাদীছ সংকলনে ভূমিকা রাখেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, মক্কার আবূ মুহাম্মাদ আবদিল মালিক ইবন যুরায়িজ (১৫০ হিঃ), সিরিয়ার আবূ আমর আবদুুর রহমান ইবন আমরুল আওযা‘ঈ (১৫৬ হিঃ), ইয়ামানের মু’আম্মার ইবন রাশিদ (১৫৩ হিঃ), বছরায় সা‘ঈদ ইবন আবী ‘উরুবাহ (১৫৬ হিঃ), আররাবি‘ ইবন ছুবায়হি (১৬০ হিঃ) ও হাম্মাদ ইবন সালামাহ (১৭৬ হিঃ), কুফায় মুহাম্মাদ ইবন ইছহাক (১৫১ হিঃ) ও সুফিয়ানুছ ছাত্তরী (১৬১ হিঃ), মিশরে আল-লায়িছ ইবন সা’আদ (১৭৫ হিঃ) রাহমাতুল্লাহি ‘আলাইহিম আজমা‘ঈন প্রমুখ। তাঁদের লিখিত এই সকল সংকলন আমাদের নিকট পৌঁছায়নি। সর্ব প্রথম সংকলিত যে গ্রন্থটি আমরা পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছি সেটি হচ্ছে- ‘‘আল-মু’আত্তা ইমাম মালিক’।
হাদীছবেত্তাদের মৃত্যুর কারণেও হাদীছ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। যার অনিবার্য পরিণতিতে হাদীছের লিপিবদ্ধকরণের কাজ সম্প্রসারণ লাভ করে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে যাতে কেউ মিথ্যা হাদীছ রচনা না করতে পারে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় মিথ্যা হাদীছ বর্ণনাকারীর জন্য কঠোর শাস্তির হুশিয়ারী দেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن المغيرة رضي الله عنه قال سمعت النبي صلى الله عليه و سلم يقول : إن كذبا عليّ ليس ككذب على أحد، من كذب علي متعمدا فليتبوأ مقعده من النار .
‘মুগীরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি রাসূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমার প্রতি মিথ্যা চাপিয়ে দেয়া অন্য কারো প্রতি মিথ্যা চাপিয়ে দেয়ার মত নয়; যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার ওপর মিথ্যা চাপিয়ে দিল সে জাহান্নামকে তার নিজের স্থান বানিয়ে নিল।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে হাদীছ রচনা করে আমার নামে, ‘‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম’’ বলেছেন, বলে চালিয়ে দেবে সে জাহান্নামী। আসলে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবদ্দশায় কেউ নিজে হাদীছ রচনা করে তার নামে চালিয়ে দেয়ার ধৃষ্টতা না দেখালেও তাঁর মুত্যুর পরে এক পর্যায়ে এ ধরনের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। এখানে উল্লিখিত হাদীছটি এ প্রমাণ বহন করে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছের জগতে মিথ্যা হাদীছের প্রচলনের আশঙ্কা করেই সকলকে সতর্ক করার জন্য এ বক্তব্য দান করেছিলেন। অপরিণামদর্শী কিছু দুর্বল ঈমানের অধিকারী মুসলিম এবং মুসলিম নামধারী ইসলামের শত্রুরাই মূলতঃ মিথ্যা হাদীছ প্রচলনের জঘন্য কাজ শুরু করে। হাদীছবেত্তাগণ জাল হাদীছ প্রণয়নের কয়েকটি কারণ চি‎‎‎‎‎‎হ্নত করেছেন। যেমন-
2.1 রাজনৈতিক বিরোধ
পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝি, শত্রুদের কু-যুক্তি, শয়তানের কু-মন্ত্রণায় ইসলামের রাজনৈতিক আকাশে এক পর্যায়ে মত বিরোধের ঘনঘটা ঘনীভূত হয়। যে কারণে শুরু হয় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। ‘আলী রাদিআল্লাহু ‘আনহুর সাথে মু‘আবিয়া রাদিআল্লাহু ‘আনহুর এবং আবদুললাহ ইবন যুবায়ির রাদিআল্লাহু ‘আনহুর সাথে আবদুল মালিকের এবং উমাইয়াদের সাথে আববাসিয়াদের মতপার্থক্য নিজেদের সমর্থনে জনমত গঠনের জন্য জাল হাদীছ রচনার ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাঁদের সমর্থকদের কেউ কেউ নিজেদের পক্ষের মতামত সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মিথ্যা হাদীছ রচনার মত জঘন্য কাজ করতেও দ্বিধা করত না। তাদের এ ঘৃণিত আচরণের কারণে হাদীছশাস্ত্রে অনেক জাল হাদীছের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ‘আলী রাদিআল্লাহু ‘আনহুর প্রশংসায় আহমাদ ইবন নাছর আযযিবক, হাববাহ ইবন জুওয়াইন, বাশার ইবন ইবরাহীম, ‘ইবাদ ইবন ইয়া‘কুব, আবদুল্লাহ ইবন দাহির অসংখ্য জাল হাদীছ রচনা করেছে। যারা বানূ উমায়য়্যাহ এবং তাদের সহযোগীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করত তারা যে জাল হাদীছের মাধ্যমে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইত নিম্মের জাল হাদীছটি তার জাজ্জ্বল্য উদাহরণ-
তাদের ভাষায় স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إن أهل بيتي سيلقون من بعدي من أمتي قتلا وتشريدا ، وإن أشد قومنا لنا بغضا بنو أمية وبنو المغيرة وبنو مخزوم.
‘নিশ্চয় আমার পরে আমার উম্মাতের মধ্য হতে আমার আহলিল বায়িত হত্যা ও নির্বাসনের ভেতর নিক্ষিপ্ত হবে, আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে আমাদের উপর সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হচ্ছে, বানূ উমায়য়্যাহ, বানূল মুগীরাহ ও বানূ মাখযূম। এই ধরণের অবান্তর বক্তব্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত। সুতরাং এ হাদীছ যে মিথ্যা তা সহজেই অনুমেয়।
2.2 গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা
জাহিলী ধ্যান-ধারণাপুষ্ট কিছু লোকের মধ্যে নিজেদের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য মন গড়া কিছু হাদীছ রচনা করার প্রবণতা দেখা গেছে। এসব হাদীছের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিশেষ বিশেষ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা। আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেও এমন অনেক হাদীছ বানানোর প্রমাণ আছে। এগুলো আসলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত তাঁর মুখ নিসৃত কোন হাদীছ নয়। এগুলো আসলে অন্যদের রচিত, যা তারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য বলেই চালিয়ে দিয়েছে। জাতি ও গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করে রচিত জাল হাদীছের উদাহরণ হচ্ছে-
خير الناس العرب وخير العرب قريش وخير قريش بنو هاشم وخير العجم فارس...
‘‘উত্তম মানুষ হচ্ছে আরবরা, উত্তম আরব হচ্ছে কুরায়িশরা, উত্তম কুরায়িশ হচ্ছে বানূ হাশীম আর উত্তম অনারব হচ্ছে পারস্যবাসীরা।’’
2.3 ‘আকীদাহ বিশ্বাস ও ফিকহী মাসআলায় মতানৈক্য
গ্রীক ও রোমান দর্শনের বিষবাষ্প দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অথবা ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্রে পড়ে কিছু পথভ্রষ্ট ব্যক্তি আল-কুরআন সুন্নাহর সঠিক ‘আকীদাহ বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হয়। তারা তাদের এ ভ্রান্ত মতামত প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেরাই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে হাদীছ বানিয়ে তা নিজেদের ভ্রান্তমতকে প্রতিষ্ঠা করার প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করত। এর সাথে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দূরতম কোন সম্পর্কও ছিল না। শুধু যিনদিকরাই ১৪ হাজার হাদীছ রচনা করে। এর চেয়ে আরো ভয়াবহ হচ্ছে, আহমাদ ইবন আবদুুল্লাহ আল জুবিয়ারী, মুহাম্মাদ বিন আকালাহ আল কিরমানী ও মুহাম্মাদ ইবন তামীমুল ফারয়ারী, এ তিনজন মিলে ১০ হাজার জাল হাদীছ রচনা করে। অনেকেই ফিকহ মাসআলা অনুসরণের ক্ষেত্রেও সঠিক পথ থেকে বিচ্যূত হয়। ফিকহ শাস্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু আলিমের এরূপ জাল হাদীছ রচনার ন্যাক্কারজনক ভূমিকাও লক্ষ্যণীয়।
উদাহরণ স্বরূপ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে-
عن أنس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم " يكون في أمتى رجل يقال له محمد بن إدريس أضر على أمتى من إبليس.
‘আনাস রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মাতের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস নামের এক ব্যক্তি ইবলিসের চেয়েও আমার উম্মাতের জন্য বেশি ক্ষতি কারক হবে।’ এটি যে শাফি‘ঈ মাযহাবের বিরোধীদের দ্বারা রচিত, তা সহজেই অনুমেয়। আরো বর্ণিত হয়েছে যে-
عن أنس رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم " من رفع يديه في الركوع فلا صلاة له ".
‘আনাস রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে তার দু’হাত রুকু‘র সময় উচু করবে, তার ছালাত আদায় হবে না।’ হাত উঁচু করার বিপক্ষীয়দের পক্ষ থেকে বানানো এটি একটি জাল হাদীছ। যারা রামাদান মাসে বিশ রাক‘আত ছালাতুত তারাবীহ আদায় করাকেই অত্যাবশ্যকীয় করে নিয়েছে তাদের রচিত একটি জাল হাদীছ হচ্ছে-
حديث ابن عباس رضي الله عنهما قال: أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يصلي في شهر رمضان عشرين ركعة .
‘রাসূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসে বিশ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন।’ এটি মূলত একটি ছাহীহ হাদীছের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং হাদীছটি যে জাল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ছাহীহ হাদীছটি হচ্ছে-
عَنْ أَبِى سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللّهِ -صلى الله عليه وسلم- فِي رَمَضَانَ قَالَتْ مَا كَانَ رَسُولُ اللّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَزِيدُ فِى رَمَضَانَ وَلاَ فِى غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً.
‘আবূ সালামা ইবনু ‘আবদির রহমান রাদিআল্লাহু ‘আনহু ‘আয়িশা রাদিআল্লাহু ‘আনহাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, রমাদানে ‘রাসূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন, ‘রাসূলূল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমাদান ও এ ব্যতীত অন্য মাসেও এগারো রাকা‘আতের বেশি ছালাত আদায় করতেন না।’
হাদীছ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে-
القرآن كلام الله تعالى غير مخلوق، فمن قال مخلوق فهو كافر بالله. ’’
‘আল্লাহর বাণী আল-কুরআন সৃষ্ট নয়, যে বলে এটি সৃষ্ট সে আল্লাহর সাথে কুফরী করে।’ আসলে এটি হাদীছ নয়, এটি মূলত আহলূস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতের কিছু আলিমদের বক্তব্য। আল-কুরআন সৃষ্ট, না সৃষ্ট নয়, এ নিয়ে যখন আকীদাহগত মতভেদ তুঙ্গে, তখন আহলূস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতের কিছু অতি উৎসাহী লোক তাদের পক্ষের দলীলকে অকাট্য প্রমাণের জন্য যে এটিকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলে চালিয়ে দিয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। ‘আকীদাহ সংক্রান্ত মতানৈক্য যে হাদীছ জাল করাকে উৎসাহিত করেছে এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
2.4 উৎসাহ প্রদানে অতিরঞ্জন
কোন কাজের ফদিলত বা মর্যাদা বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও হাদীছ জাল করার অপকর্ম বেশ লক্ষ্যণীয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গের নমনীয়তা, অসতর্কতা ও অদূরদর্শিতা, ভালো কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে বাড়াবাড়ি করতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। কোন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রমাণ, কোন আয়াতের বিশেষ গুরুত্ব দান ও কোন সূরার বিশেষ ফদিলত বর্ণনা করতে গিয়ে তারা যে, নিজেরাই অসংখ্য হাদীছ রচনা করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে চালিয়ে দিয়েছে, তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ হচ্ছে, ফাদাইলের গ্রন্থসমূহ। তাফসীরে বায়দাভী ও তাফসীরে খাযিনের মত গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর গ্রন্থে আবু আছমাহ নূহ ইবন আবী মারইয়াম হতে ভিন্ন ভিন্ন সূরা তিলাওয়াতের যে ফদিলত বিষয়ক হাদীছ বর্ণনা করা হয়েছে, তা এখানে উদাহরণ হিসাবে উলেলখ করা যায়। এর অধিকাংশ সনদই আবদুল্লাহ ইবন আববাস (রা) সূত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন বলে বলা হলেও, এর সাথে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। এ বিষয় প্রমাণের জন্য একটি ঘটনাই যথেষ্ট। বর্ণিত হয়েছে যে-
قيل لأبي عصمة نوح بن أبى مريم المروزى من أين لك عن عكرمة عن بن عباس في فضائل القرآن سورة سورة وليس عند أصحاب عكرمة هذا ! فقال: إنى رأيت الناس أعرضوا عن القرآن واشتغلوا بفقه أبى حنيفة ومغازى ابن إسحاق فوضعت هذا الحديث .
‘আবূ ‘ইছমাহ নূহুবনু আবী মারয়ামিল মারূযী কে বলা হয়েছিল : আল-কুরআনের প্রতিটি সূরার ফাদীলাত সম্পর্কে আপনি ‘ইকরামাহ সূত্রে ইবন ‘আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে যা বর্ণনা করেছেন, তা কোত্থেকে বর্ণনা করেছেন? ‘ইকরামার সাথীদের নিকট তো এগুলো নেই। তিনি বললেন- ‘আমি দেখলাম মানুষ আল-কুরআনবিমুখ হয়ে আবূ হানীফার ফিকহ ও ইবন আবী ইসহাকের মাগাযী নিয়ে মাশগুল হয়ে পড়েছে, তখন আমি এই হাদীছগুলো বানিয়ে ফেললাম।’ আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن مهدي قال قلت لميسرة بن عبد ربه من أين حئت بهذه الأحاديث من قرأ كذا فله كذا؟ قال وضعتها أرغب الناس فيها.
‘ইবন মাহদী বলেন, আমি মায়সারাহ ইবন ‘আবদি রাবিবহকে বললাম, যে এটি পাঠ করবে তার জন্য এটি; আপনি কোথা হতে এ হাদীছগুলো বর্ণনা করেছেন? তিনি বললেন, আমি লোকদেরকে এদিকে উৎসাহী করার জন্য এগুলো বানিয়েছি,’ সুতরাং ভাল কাজে উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রেও অসংখ্য জাল হাদীছ রচনা হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
2.5 রাজা বাদশাদের আনুকূল্য অর্জন
অনেকেই তদানিন্তন রাজা বাদশাদের আনুকূল্য লাভের আশায় তাদের খুশি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে জন্য তারা এমন কিছু হাদীছ নিজে রচনা করেছিল যা রাজাদের নৈকট্য লাভে সহায়ক হয়। যেমন আববাসী খালীফাহ হারুনুর রাশীদ কবুতর উড়াতে খুবই ভালবাসতেন। তঁকে খুশি করার জন্য আবুল বুখতারী একটি জাল হাদীছ রচনা করে। তার বর্ণনা হচ্ছে-
حدثنى هشام بن عروة عن أبيه عن عائشة: " أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يطير الحمام.
‘হিশাম ইবন ‘উরওয়াহ সূত্রে বর্ণিত, তার পিতা ‘আয়িশাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবুতর উড়াতেন।’
2.6 ওয়াজ নাছীহাতে বিস্ময়কর কিছু সংযোজন
কিছু ব্যক্তিবর্গ ছিলেন ওয়াজ- নাছীহাত নিয়ে ব্যস্ত। তাঁরা শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ, তাদেরকে বিস্মিত করা, তাদেরকে কাঁদানো, হাসানো প্রভৃতি লক্ষ্যকে সামনে রাখেন। তাঁরা আজগুবী বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী তৈরি করে, তা গ্রহণযোগ্য করার জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে চালিয়ে দিতেন। কোন কিছুকে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রসংশা করতে গিয়ে তা প্রমাণ করার লক্ষ্যে তাঁরা হাদীছ জাল করতেন। এর উদাহরণ হচ্ছে -
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: " الديك الأبيض الأفرق حبيبي وحبيب حبيبي، جبريل يحرس بيته وستة عشر بيتا من جيرته، أربعة من اليمين وأربعة من الشمال وأربعة من قدام وأربعة من خلف.
‘আনাস ইবন মালিক রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঝুটি ওয়ালা সাদা মোরগ আমার বন্ধু, আমার বন্ধুর বন্ধু, জিবরাঈল ‘আলায়হিস সালাম তার ও তার পার্শ্বের ১৬ টি বাড়ি পাহারা দেন; তার ডানের চারটি, বামের চারটি, সামনের চারটি ও পেছনের চারটি।’
حدثنا إبراهيم بن عبد الواحد الطبري قال سمعت جعفر بن محمد الطيالسي يقول صلى أحمد بن حنبل ويحيى بن معين في مسجد الرصافة فقام بين أيديهم قاص فقال حدثنا أحمد بن حنبل ويحيى بن معين قالا حدثنا عبد الرزاق عن معمر عن قتادة عن أنس قال قال رسول الله من قال لا إله إلا الله خلق الله من كل كلمة منها طيرا منقاره من ذهب وريشه من مرجان... فجعل أحمد بن حنبل ينظر إلى يحيى بن معين ويحيى ينظر إلى أحمد فقال له أنت حدثته بهذا فيقول والله ما سمعت بهذا إلا الساعة فلما فرغ من قصصه ... قال له يحيى بن من حدثك بهذا الحديث؟ فقال أحمد بن حنبل ويحيى بن معين فقال أنا يحيى بن معين وهذا أحمد بن حنبل ما سمعنا بهذا قط في حديث رسول الله فإن كان ولا بد من الكذب فعلى غيرنا فقال له أنت يحيى بن معين قال نعم قال لم أزل أسمع أن يحيى بن معين أحمق ما تحققته إلا الساعة فقال له يحيى كيف علمت أني أحمق قال كأن ليس في الدنيا يحيى بن معين وأحمد بن حنبل غيركما قد كتبت عن سبعة عشر أحمد بن حنبل ويحيى بن معين فوضع أحمد كمه على وجهه وقال دعه يقوم فقام كالمستهزئ بهما.
‘ইবরাহীম ইবনু ‘আবদুল ওয়াহিদিত তাবারী বলেন- আমি জা‘ফার ইবন মুহাম্মাদুত তায়ালিসীকে বলতে শুনেছি, আহমাদ ইবন হাম্বল এবং ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন আররাছাফাহ মাসজিদে ছালাত আদায় করেন। এ সময় একজন গল্পকার বললেন, আমাদেরকে আহমাদ ইবন হাম্বল এবং য়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তারা বলেন, আমাদেরকে ‘আবদুর রায্যাক ইবন মু‘আম্মার কাতাদাহ সূত্রে আনাস রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি لا إله إلا الله বলবে এর প্রত্যেকটি শব্দদ্বারা আল্লাহ একটি পাখি তৈরি করবেন, যার ঠোট হবে স্বর্ণের আর পালক হবে মারজানের।... এটি শুনে আহমাদ ইবন হাম্বল ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈনের দিকে আর ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন আহমাদ ইবন হাম্বলের দিকে তাকাতাকি শুরু করলেন। আহমাদ ইবন হাম্বল ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈনকে বললেন, আপনি কী এ কথা বলেছেন? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি এই মাত্র এটি শুনলাম। ঐ ব্যক্তি যখন তার গল্প বলা শেষ করলেন, তখন ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন বললেন, কে আপনাকে এ হাদীছ শুনিয়েছেন? তিনি বললেন, আহমাদ ইবন হাম্বল এবং ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন। তিনি বললেন, আমি ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন আর এ হলেন আহমাদ ইবন হাম্বল। আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছে কক্ষনো এ কথা শুনেনি। তাহলে এটা অবশ্যই মিথ্যা হবে। তবে আমরা ব্যতীত অন্য কেউ হতে পারে। তিনি বললেন, আপকি কী ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন? তিনি বললেন, হাঁ, তিনি বললেন, আমি শুনতাম ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন একজন আহমাক, এইমাত্র তা প্রমাণিত হলো। ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন তাকে বললেন, তুমি কিভাবে জানলে যে আমি একজন আহমাক? তিনি বললেন, দুনিয়ায় কি আর কোন আহমাদ ইবন হাম্বল এবং ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন নেই? আমি তো সতের জন আহমাদ ইবন হাম্বল এবং ইয়াহয়িয়ুবনু মা‘ঈন থেকে (হাদীছ) লিখেছি। তখন আহমাদ ইবন হাম্বল তার হাতের পুট ঐ ব্যক্তির চেহারার উপর রাখলেন এবং বললেন, তাকে ছেড়ে দিন, সে দাঁড়াক, সে তাদের দু’জনের সাথে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে দাঁড়াল।’ একজন মিথ্যুক হাদীছ নিয়ে কত বড় জালিয়াতি করতে পারে তারই জাজ্জ্বল্য উদাহরণ হচ্ছে এই ঘটনা।
উল্লেখ্য যে, ওয়াহাব ইবন মুনাযারাহ বিভিন্ন আমলের ফাদীলাতের হাদীছ নিজেই বানাতেন।
২.৭ মিথ্যা হাদীছ প্রণয়নের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞতা
ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। এখানে দুনিয়া বিরাগী হয়ে আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন ও বৈরাগ্য সাধনের কোন সুযোগ নেই। এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য হচ্ছে-
لا رهبانية في الإسلام-
‘ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই’।
এরপরেও অনেক দুনিয়াত্যাগী সুফী সাধক অজ্ঞতা বশতই এ জীবন যাপন শুরু করেন, যা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র উপায়। তাঁরা বনে জঙ্গলে, লোক চক্ষুর অন্তরালে ইবাদাত বন্দেগী, যিকর আযকারের অনুশীলন শুরু করেন। ইসলামে তার কোন অনুমোদন না থাকলেও তা দীনী কাজ হিসাবে মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা পেতে থাকে। তাঁরা তাঁদের এ কর্মকান্ডকে ইসলামী কর্মকান্ড বলে প্রতিষ্ঠিত করা এবং সাধারণ জনগণকে এদিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে অনেক এমন মন গড়া হাদীছ বানিয়ে তা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলে চালিয়ে দিতেন। তাঁদের চিন্তা ছিল এই যে, দীনের স্বার্থে এ ধরনের মিথ্যা হাদীছ রচনা করা অপরাধের কিছু নয়। এরা মূলতঃ বিভ্রান্ত সূফী মতবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। তাঁদের অসতর্কতা ও অজ্ঞতাও মিথ্যা হাদীছ রচনার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। এইরূপ জাল হাদীছের জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে -
أفضل الزهد في الدنيا ذكر الموت
‘দুনিয়ার সর্বোত্তম যুহ্দ হচ্ছে, মৃত্যুকে স্মরণ করা।’
আরো উদাহরণ হচ্ছে -
الدنيا حرام على أهل الآخرة والآخرة حرام على أهل الدنيا والدنيا والآخرة حرام على أهل الله
‘আখিরাতমুখী লোকদের জন্য দুনিয়াদার হওয়া হারাম, দুনিয়াদার লোকদের জন্য আখিরাত হারাম, আল্লাহ ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারাম।’
এমনি অসংখ্য জাল হাদীছের প্রচলন লক্ষ্য করে ‘ইলমুল হাদীছের বিদগ্ধ পন্ডিতগণ বিশুদ্ধ হাদীছ সংরক্ষণে আত্মনিয়োগ করেন। উদ্ভব হয় রিজাল শাস্ত্রের। শুরু হয় সনদের যাচাই বাছাই। প্রয়োগ হতে থাকে আল জারহ ওয়াত-তা‘দীল বা হাদীছ বর্ণনাকারীদের বস্ত্তনিষ্ঠ সমালোচনা পদ্ধতি। করা হয় এক সনদে বর্ণিত হাদীছ অন্য সনদে বর্ণিত হাদীছের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা। প্রণয়ন করা হয় হাদীছ গ্রহণযোগ্য হওয়ার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নীতিমালা। যার অনিবার্য পরিণতিতে জাল ও দুর্বল হাদীছ থেকে বিশুদ্ধ হাদীছ পৃথক করা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। সন্দেহাতীত ভাবে হাদীছ গ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং বর্তমানে জাল হাদীছ ও ছাহীহ হাদীছ স্পষ্টাকারে পার্থক্য হয়ে গেছে।
৩. ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীছ
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীছের অবস্থান মূল্যায়ন করতে হলে, এ হাদীছ যেই মহা মানব রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে উৎসারিত হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাঁকে মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যক। যাঁরা হাদীছ বাদ দিয়ে শুধু কুরআনের মধ্যেই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সব কিছুই রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে শুধু কুরআনই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছে, সে বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেয়া অত্যাবশ্যক। এখানে সংক্ষেপে আল-কুরআনে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে ভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো-
৩.১ আল-কুরআনে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেমন-
৩.১.১ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যই হিদায়াত
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যের মধ্যেই হিদায়াত বা সঠিক পথ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-
وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
‘এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে হিদায়াত লাভ করবে, আর স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়াই হলো রাসূলের কাজ।’
সুতরাং কারো সঠিক পথের অনুসারী হতে হলে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা পথে চলা ব্যতীত সম্ভব নয়। হিদায়াত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্পষ্ট দিক-নির্দেশনার মধ্যে নিহিত রয়েছে। তাঁর এ নির্দেশনা পরিত্যাগ করে হিদায়াত প্রাপ্তির কোন সুযোগ নেই। তাঁরই আনুগত্য হিদায়াত আর তাঁরই বিরোধিতা ও অবমাননা পথভ্রষ্টতা, তা কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত হলো। সুতরাং যারা হাদীছ বাদ দিয়ে শুধু আল-কুরআন অনুসরণ করতে চায় তাদের কুরআনই তো মানব রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা তাঁর বিশুদ্ধ হাদীছকে আনুগত্য করেই হিদায়াত লাভের পথ নির্দেশ দিয়েছে।
৩.১.২ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথনির্দেশ অলংঘনীয়
ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাস্তব রূপকার হচ্ছেন, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি উত্তম কাজের পথ নির্দেশ দিয়েছেন, যেমনি খারাপ কাজ থেকেও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা তাঁর বান্দাদেরকে এ নির্দেশ মত কাজ করতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এ বিষয়ে বলেছেন-
وَمَا آَتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللّهَ إِنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.
‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছে, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেছে, তা থেকে বিরত থাক। এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর।’
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের এ আয়াতের স্পষ্ট শিক্ষা হচ্ছে, কোন মুসলিমের জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ ও নিষেধ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাঁর নির্দেশ ও নিষেধ উপেক্ষা করাই হচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশ অবমাননা করা। আর আল্লাহর নির্দেশ অবমাননা করলে মুসলিম থাকার কোন সুযোগ থাকে না। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের নির্দেশও যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করা, বিশুদ্ধ হাদীছেও তা বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَبْدِ اللّهِ قَالَ لَعَنَ اللّهُ الْوَاشِمَاتِ وَالْمُوتَشِمَاتِ وَالْمُتَنَمِّصَاتِ وَالْمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ الْمُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللّهِ فَبَلَغَ ذَلِكَ امْرَأَةً مِنْ بَنِي أَسَدٍ يُقَالُ لَهَا أُمُّ يَعْقُوبَ فَجَاءَتْ فَقَالَتْ إِنَّهُ بَلَغَنِي عَنْكَ أَنَّكَ لَعَنْتَ كَيْتَ وَكَيْتَ فَقَالَ وَمَا لِي أَلْعَنُ مَنْ لَعَنَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَنْ هُوَ فِي كِتَابِ اللّهِ فَقَالَتْ لَقَدْ قَرَأْتُ مَا بَيْنَ اللَّوْحَيْنِ فَمَا وَجَدْتُ فِيهِ مَا تَقُولُ قَالَ لَئِنْ كُنْتِ قَرَأْتِيهِ لَقَدْ وَجَدْتِيهِ أَمَا قَرَأْتِ وَمَا آتَاكُمْ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا قَالَتْ بَلَى قَالَ فَإِنَّهُ قَدْ نَهَى عَنْهُ قَالَتْ فَإِنِّي أَرَى أَهْلَكَ يَفْعَلُونَهُ قَالَ فَاذْهَبِي فَانْظُرِي فَذَهَبَتْ فَنَظَرَتْ فَلَمْ تَرَ مِنْ حَاجَتِهَا شَيْئًا فَقَالَ لَوْ كَانَتْ كَذَلِكَ مَا جَامَعْتُهَا.
আবদুল্লাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহ লানত করেছেন ঐসব নারীর প্রতি যারা অন্যের শরীরে উল্কি অংকন করে, নিজ শরীরে উল্কি অংকন করায়, যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রূরুর চুল উপড়িয়ে ফেলে ও দাতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। এসব নারী আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃতি সাধন করেছে।
এর পর বানু আসাদ গোত্রের উম্মে ইয়াকুব নাম্নীয় এক মহিলার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে সে এসে বলল, আমি জানতে পারলাম, আপনি এ ধরণের মহিলাদের প্রতি লানত করেছেন। তিনি বললেন- আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার প্রতি লানত করেছেন, আল্লাহর কিতাবে যার প্রতি লানত করা হয়েছে, আমি তার প্রতি লানত করব না ? তখন মহিলা বলল, আমি দুই ফলকের মাঝখানে যা আছে (পূর্ণ কুরআন) পড়েছি। কিন্তু আপনি যা বলেছেন, তা তো পাইনি? আবদুল্লাহ বললেন, যদি তুমি আল-কুরআন পড়তে তাহলে অবশ্যই তা পেতে, তুমি কি পড়নি? ‘‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।’’ মহিলা বলল- হ্যাঁ নিশ্চয়ই পড়েছি। আবদুল্লাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু বললেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন। মহিলা বলল- আমার মনে হয় আপনার পরিবারও এ কাজ করে। তিনি বললেন- যাও এবং ভালভাবে দেখে এস। তারপর মহিলা গেল এবং ভালভাবে দেখে এল। কিন্তু তার প্রয়োজনের কিছুই দেখতে পেলোনা। তখন তিনি বললেন, যদি আমার স্ত্রী এমনটি করত, তবে সে আমার সঙ্গে একত্রে থাকতে পারত না।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ ও নিষেধ পূর্ণভাবে পালন করা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। সুতরাং যারা শুধু আল-কুরআন পালন করার পক্ষে সেই আল-কুরআনই তো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পথনির্দেশ তথা হাদীছকে অলংঘনীয় বলে উল্লেখ করেছে।
৩.১.৩ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমানের প্রতি আহবান করার দায়িত্বপ্রাপ্ত
মুসলিম হওয়ার অনিবার্য শর্ত হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর ঈমান আনা ও ঐকান্তিক বিশ্বাস স্থাপন করা। একজন মুসলিমের জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে আহবান করার গুরুদায়িত্ব আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তা‘য়ালা তাঁরই হাবীব রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর ন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا. لِتُؤْمِنُوا بِاللّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
‘আমি তোমাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি, যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন, তাঁর রাসূলকে শক্তি যোগাও ও তাকে সম্মান কর এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।’ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর মানুষ যাতে ঈমান আনে তারই ব্যবস্থা করা, এ আয়াতে সেই শাশ্বত সত্য কথাটিই ফুটে উঠেছে। সুতরাং আল-কুরআনের আলোকেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপেক্ষা করে মহা মূল্যবান ঈমান লাভ করার কোন পথ নেই। যারা হাদীছকে উপেক্ষা করে তারা মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপেক্ষা করে। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে যেহেতু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপেক্ষা করে ঈমান লাভের কোন সুযোগ নেই, সেহেতু হাদীছ প্রত্যাখ্যান করেও ঈমান লাভের কোন পথ নেই। এটিও যে আল-কুরআনেরই বাণী শুধু আল-কুরআনের অনুসারীদেরকে এই সত্য উপলব্ধি করা উচিত।
৩.১.৪ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁর আনুগত্য
যে কোন রাসূল প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে করে মানব জাতি তাঁর আনুগত্য করে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللّهِ
‘আমি এ উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশেই তার আনুগত্য করা হবে।’ সুতরাং, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করানোই হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আল-কুরআনের দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করা ব্যতীত আল্লাহ সুবহানাহু তা‘য়ালার এ অভিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন কোন ক্রমেই সম্ভবপর নয়। সুতরাং যারা তাঁর হাদীছ মানতে অস্বীকার করল, তারা মূলত তাঁর আনুগত্যকেই অস্বীকার করল, আর যারা তাঁর আনুগত্য স্বীকারকে প্রত্যাখ্যান করল তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে প্রেরণের যে সুমহান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা ধূলিস্যাত করে দিল। আর যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল তারা মূলত কুফরীই করল।
৩.১.৫ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য ও আল্লাহর আনুগত্য অবিচ্ছেদ্য
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যকে স্পষ্ট ভাষায় অভিন্ন ও অবিভাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, আল্লাহর আনুগত্য হচ্ছে, তিনি যে খালিক ও ইলাহ সে হিসেবে; আর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য হচ্ছে, তাঁরই রাসূল হিসেবে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আনুগত্য বলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই আল-কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللّهَ
‘কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল ।’
কুরআনের দু’টি জায়গায় একই ভাষায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَأَطِيعُوا اللّهَ وَرَسُولَهُ
‘এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।’
তিনি অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন-
أَطِيعُوا اللّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
‘আল্লাহর আনুগত্য কর এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর।’
ভাষার সামান্য কিছু ভিন্নতা থাকলেও মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের এতগুলো আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আল্লাহর আনুগত্যের সাথে সাথে কোন বিভাজন ও পার্থক্য না করেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দ্বারা মূলত উভয়েরই আনুগত্য যে অপরিহার্য, শুধু আল্লাহর আনুগত্য করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য বর্জন করার যে কোন সুযোগ নেই, সেই কথাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এমন কি একটি আয়াতে শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করারও নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ.
‘তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা রহমত প্রাপ্ত হতে পার।’
সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যের মূল আধার হাদীছকে বর্জন করার কোন সুযোগ আল-কুরআন কোন মুসলিমকে দেয় না। সুতরাং শুধু আল-কুরআন অনুসরণের প্রবক্তারা আল-কুরআনেরই এ নির্দেশ কি ভাবে উপেক্ষা করছে?
৩.১.৬ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীও ওহী
ওহী হচ্ছে সন্দেহাতীত জ্ঞানের উৎস। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী তাঁর মনগড়া কোন কিছু নয়। এটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীকৃত বাণীরই
অন্তর্ভুক্ত, সে বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেন-
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى. وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى . إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
‘তোমাদের সাথী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয় এবং সে এগড়া কথাও বলে না। এ তো ওহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।’ এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বলেন-
إنما يقول ما أمر به، يبلغه إلى الناس كاملا موفَّرًا من غير زيادة ولا نقصان.
‘তিনি অবশ্যই এটি তাঁকে যেমনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা পরিপূর্ণ ভাবেই কম বেশি না করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।’ সুতরাং একথা দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কোন বাণী মনগড়া নয়। বরং তা ওহীরই অন্তর্ভুক্ত। মূলত ওহী সাধারণত দীন সম্পর্কিত বিষয়েই হয়ে থাকে। আর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষে ওহী পরিবর্তনের চেষ্টা করাও শোভনীয় নয়। বরং তিনি যদি ওহী পরিবর্তনের চেষ্টা করতেন, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা শক্ত হাতে তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা নিবেন বলেও হুশিয়ারী দিয়েছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল্লা বলেন-
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ . لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ. ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ . فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ.
‘সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করত, আমি অবশ্যই তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, এবং তার জীবন ধমনী কেটে দিতাম, এরপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তাকে রক্ষা করতে পারত।’ সুতরাং সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য। তাঁর বাণী সকল সন্দেহ ও সংশয়ের উর্দ্ধে। আল-কুরআনে এত স্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপনের পরেও কি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ উপেক্ষা করা অথবা অস্বীকার করার সুযোগ কোন মুসলিমের জন্য রয়েছে?
৩.১.৭ আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার ও হালাল হারাম নির্ণয়ের দায়িত্বে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম
সফলকাম ব্যক্তিদের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার অর্থাৎ সৎকার্যের আদেশ ও অসৎ কাজের বাধা প্রদান ও কোন কিছুকে হালাল ও হারাম নির্ণয় করার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্যতম কার্যক্রম ছিল, সে প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছে। এ প্রসংগে আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল্লা বলেন-
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آَمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
‘যারা এ উম্মী নবী রাসূলের অনুসরণ করে, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজিলে লিপিবদ্ধ রয়েছে, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করে, তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্ত্ত হালাল ও অপবিত্র বস্ত্ত হারাম করে এবং তাদের উপর বিদ্যমান গুরুভার ও শৃঙ্খল থেকে তাদেরকে মুক্ত করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার প্রতি অবতীর্ণ নূর (কুরআন) কে অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম।’
ইসলামে সৎকাজ ও অসৎকাজ এবং হালাল ও হারাম বিষয়টি খুবই ব্যাপক। সুতরাং এ আয়াতের শিক্ষাই হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু কুরআনে বর্ণিত সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এবং কুরআনে বর্ণিত হালাল হারামকেই ঘোষণা দিয়ে ক্ষ্যান্ত হননি, তার বাইরে বিদ্যমান অনেক সৎকাজের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন ও অসৎকাজকে নিষেধ করেছেন এবং এর বাইরেরও অনেক কিছুকে হালাল ও হারাম হওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে হাদীছ না মানলে ইসলামের অনেক আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার এবং হালাল ও হারাম আমাদের অগোচরেই থেকে যাবে। যারা তাঁর হাদীছ মানতে অস্বীকার করে তারা তাঁর এ সব হালাল - হারাম ও মা’রূফ মুনকারও অলক্ষ্যে অস্বীকার করে। আল-কুরআনের দ্বারাই অত্যাবশ্যকীয় করা ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেও কি কারো মুসলিম থাকার সুযোগ থাকে!
৩.১.৮ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন হিকমাত শিক্ষাদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে আল-কুরআন শিক্ষাদানের মহান শিক্ষক হিসাবে তাঁকে যেমন প্রেরণ করেছেন, একই সাথে হিকমাতের মত অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষাদানের দায়িত্বও তাঁকে অর্পণ করেছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ ‘আয্যাহ ওয়া জাল্লা ইরশাদ করেন-
لَقَدْ مَنَّ اللّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ.
‘আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট এই রাসূল প্রেরণ করেছেন, যে তার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল।’
এ আয়াতের অনিবার্য শিক্ষা হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের পাশাপাশি তাঁর উম্মাতকে হিকমাতও শিক্ষা দিতেন। এখানে আল-কুরআনও শিক্ষা দিতেন এবং হিকমাতও শিক্ষা দিতেন; এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, হিকমাত আল-কুরআনের বাইরের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর
বাস্তবতার আলোকে আল-কুরআনের সাথে অতিরিক্ত আর যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন তা মূলত তাঁরই দিক নির্দেশনা যা পরবর্তীতে হাদীছ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ জন্য অনেক মুফাচ্ছির এ আয়াতে ‘হিকমাত’ বলতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত তথা হাদীছকেই চি‎‎হ্নত করেছেন। সুতরাং কুরআনের বাইরে যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন, তা একজন মুসলিমের পক্ষে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। বরং এ হিকমাত তথা হাদীছ পালনও আল-কুরআনের আলোকে তার জন্য অপরিহার্য পালনীয়। যারা এ অপরিহার্য বিষয়কে বর্জন করে যতই তারা শুধু আল-কুরআনেরই অনুসরণের দাবী করুক না কেন তারা মূলত আল-কুরআনকেই বর্জন করে।
৩.১.৯ বিবাদ-বিসম্বাদে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত :
মানুষের মধ্যে কোন তর্ক-বিতর্ক, মতানৈক্য ও বিবাদ-বিসম্বাদ দেখা দিলে, সে ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমাধানের মানদন্ড হিসেবে মেনে নেয়া প্রত্যেক মু’মিনের জন্য অত্যাবশ্যক। কোন বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমাধান দিয়ে গেছেন তা নি:শর্তভাবে মেনে নিলেই শুধু কোন ব্যক্তি মু’মিন থাকার সুযোগ পান। আর তা মেনে না নিলে, তার মু’মিন বলে পরিচয় দেয়ার অধিকার থাকে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এ বিষয়ে ইরশাদ করেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ। তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার তোমার উপর অর্পণ করে; এরপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।’ সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিচার ফায়সালা মনে প্রাণে মেনে নেয়া না নেয়াই হচ্ছে ঈমানের মানদন্ড। তাঁর অসংখ্য হাদীছে তাঁর এ বিচার ফায়সালার বর্ণনা এসেছে। যারা তাঁর হাদীছ অস্বীকার করে তারা তাঁর এ বিচার ফায়সালাকেও অস্বীকার করে। আর যারা এটা অস্বীকার করে তারা কক্ষনো মু’মিন থাকার দাবী করতে পারে না।
৩.১.১০ আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফায়সালা অভিন্ন
কোন সমস্যা সমাধানে অথবা কোন বিচার কার্যের ফায়সালার ক্ষেত্রে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর নিজের ফায়সালার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ফায়সালাকেও অভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেছেন। একথা মূলত: উভয়ের ফায়সালাকে ভিন্ন করে দেখার কোন সুযোগ রাখেনি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَإِذَا دُعُوا إِلَى اللّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ مُعْرِضُونَ. وَإِنْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَقُّ يَأْتُوا إِلَيْهِ مُذْعِنِينَ . أَفِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ أَمِ ارْتَابُوا أَمْ يَخَافُونَ أَنْ يَحِيفَ اللّهُ عَلَيْهِمْ وَرَسُولُهُ بَلْ أُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ . إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
‘আর যখন তাদেরকে তাদের মধ্যে বিচার ফায়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান জানান হয় তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এদের যদি কিছু প্রাপ্য থাকে তাহলে তারা বিনীতভাবে রাসূলের নিকট ছুটে আসে। এদের
অন্তরে কি ব্যাধি আছে, না তারা সংশয় পোষণ করে, না তারা ভয় করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদের প্রতি যুল্ম করবেন? বরং তারাই তো যালিম। মু’মিনদের উক্তি তো এই যে, যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম, আর তারাই তো সফলকাম।’
এ আয়াতগুলোতে একক কোন বিচার ফায়সালার দিকে আহবান জানানোর কথা না বলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সম্বিলিত বিচার ফায়সালার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিচার ফায়সালাকে ভিন্নভাবে দেখে তাকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। একইভাবে হাদীছে বর্ণিত বিচার ফায়সালাকেও উপেক্ষা করা যায় না।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এখানে উল্লিখিত এই আয়াতসমূহে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে তার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে-
1. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনই হচ্ছে মানবজাতির জন্য চলার সঠিক পথ।
2. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ পালন ও নিষেধ বর্জন ব্যতীত মুসলিম হওয়া অসম্ভব।
3. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপেক্ষা করা ঈমানের প্রতি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, দাওয়াত দিয়েছেন তা উপেক্ষা করারই নামান্তর ।
4. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্যহীনতা তাঁকে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়েছে তা অস্বীকার করারই শামিল।
5. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য না করে, শুধু আল্লাহর আনুগত্য করার দাবি অর্থহীন।
6. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। তা অস্বীকার করা আল-কুরআন নামক ওহী অস্বীকার করার মতই জঘন্য।
7. ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হালাল হারাম পরিপূর্ণভাবে জানতে ও মানতে হলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ ব্যতীত সম্ভব নয়।
8. ইসলামী জ্ঞানের অংশ হিকমাত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমেই শিক্ষালাভ সম্ভব।
9. বিচার ফায়সালার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন, তা উপেক্ষা করে মু’মিন থাকার কোন সুযোগ নেই।
10. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাশ কাটিয়ে পরিপূর্ণ আল-কুরআন পালনের চিন্তা অবান্তর।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মূল্যায়ন করে তাঁর হাদীছ অবমূল্যায়নের কোন সুযোগ নেই, একইভাবে তাঁর হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে মূল্যায়ন করার দাবিও অযৌক্তিক। এখানে বর্ণিত আয়াতগুলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে যে ভাবে সম্পৃক্ত করেছে তার ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে এবং তাঁর হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামকে কল্পনাও করা যায় না। একই সাথে আল-কুরআন পরিপূর্ণভাবে মেনে মুসলিম থাকতে হলে, উল্লেখিত এ আয়াতগুলো অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। আর এ আয়াতগুলো অনুসরণ করতে হলে সেগুলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ও তাঁর হাদীছকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে সেভাবেই তাঁকে ও তাঁর হাদীছকে গ্রহণ করা অপরিহার্য। সুতরাং তাঁকে ও তাঁর হাদীছকে বাদ দিয়ে কুরআনের অনুসারী হওয়ার চিন্তা ইসলামের দৃষ্টিতে একেবারেই অবাস্তব। আজগুবী কল্পনা। অবান্তর চিন্তা বই কিছু নয়। তাহলে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকেই বলা যায় যে, তাঁকে ও তাঁর হাদীছকে বাদ দিয়ে ইসলামকে চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। তাঁর হাদীছ অস্বীকার করা বা বাদ দেয়া হচ্ছে, মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বর্জন করারই অপর নাম। কুরআনের মূল্যায়নেই যেহেতু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেহেতু যারা কুরআনকেই মানতে চায় তাদের বুঝা উচিত যে কুরআনের অপরিহার্য দাবীই হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তথা তাঁর হাদীছকে অনুসরণ করতে হবে।
৩.২ হাদীছের অপরিহার্যতা
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের দৃষ্টিতেই বিভিন্নভাবে হাদীছের অপরিহার্যতা ফুটে উঠেছে। এ গুলোর বর্ণনা হচ্ছে-
৩.২.১ হাদীছ বর্জন ঈমানের পরিপন্থী
হাদীছ হলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা, কাজ, সমর্থন ও তাঁর গুণাবলীর প্রতিফলন। হাদীছকে অস্বীকার করার অর্থই হলো, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করা। আর তাঁকে অস্বীকার করে ইসলামী জীবন বিধানের মানদন্ডে কারো মু’মিন থাকার কোন সুযোগ থাকে না। বরং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের অপপ্রয়াস চালায় কুরআনেই তাদেরকে প্রকৃত কাফির বলে চি‎‎হ্নত করেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। তিনি ইরশাদ করেন- -
إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَنْ يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَنْ يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَلِكَ سَبِيلًا . أُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا.
‘এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মধ্যে (ঈমানের ব্যাপারে) তারতম্য করতে চায় এবং বলে আমরা কতককে বিশ্বাস করি ও কতককে অবিশ্বাস করি, আর তারা মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, এরাই প্রকৃত কাফির এবং কাফিরদের জন্য আমি লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করেছি।’ সুতরাং রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখানোর যেমন কোন সুযোগ নেই, তেমনি হাদীছ না মেনে শুধু আল-কুরআন মেনে মু’মিন থাকার কোন সুযোগ নেই।
3.2.2 হাদীছ বর্জন করে ইসলামী শারী’আত পালন একেবারেই অবাস্তব
ইসলামী শারী’আতে হুকুম আহকামের জন্য দলীল হওয়ার ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও আল-হাদীছের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এটি সঠিক যে, হাদীছের চেয়ে আল-কুরআনের রয়েছে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আল-কুরআন সরাসরি আল্লাহর বাণী, যা তিনিই অবতীর্ণ করেছেন। যা তিলাওয়াত করা ইবাদাত বলেই গণ্য। সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হয়েও কুরআনের একটি আয়াত রচনার যোগ্যতা রাখেনা। এসব বিবেচনায় আল-কুরআন হাদীছ থেকে আরো বেশি মর্যাদাপূর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই। এর অর্থ এ নয় যে, হাদীছকে বাদ দিয়ে ইসলামী বিধি-বিধান শুধু কুরআনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। মূলত, আল-কুরআন ও হাদীছের সমন্বয়েই ইসলামী শারী‘আহর পরিপূর্ণ রূপ অস্তিত্ব লাভ করেছে। আল-কুরআন হলো ইসলামী শারী‘আহর প্রথম উৎস আর হাদীছ হলো তার দ্বিতীয় উৎস। কুরআনে বর্ণিত ইসলামী শারী’আহর অনেক কিছুই সংক্ষিপ্ত, যা হাদীছে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বিজ্ঞোচিত এক ব্যবস্থাপনা। তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইসলামী শারী’আহকে আরো বিকশিত করে উপস্থাপনের দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন। এ প্রসংগে তিনি ইরশাদ করেন-
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ.
‘এবং আমি তোমার প্রতি আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।’ এ আয়াতের স্পষ্ট শিক্ষা হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহিস সাল্লাম-এর অন্যতম দায়িত্বই হচ্ছে, প্রয়োজনে কুরআনকে বিশ্লেষণ করা। এ বিষয়ে তিনি আরো ইরশাদ করেন-
وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ.
‘আমি তো তোমার প্রতি আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।’
সুতরাং আল-কুরআন বিশ্লেষণ করা হলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আল্লাহ প্রদত্ত অন্যতম দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কুরআনের যে বিশ্লেষণ হয়েছে, তার বাস্তব রূপই হচ্ছে হাদীছ। এখানে হাদীছ অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে, আল্লাহ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল-কুরআন বিশ্লেষণের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা অস্বীকার করা। আল্লাহর পক্ষ হতে তার প্রতি দেয়া এ দায়িত্ব অস্বীকারের অর্থই হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে বিশ্লেষণ দিয়েছেন, তা অস্বীকারের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদানকারী সত্তা আল্লাহকে অস্বীকার করা।
প্রত্যহ কতবার ছালাত আদায় করতে হবে, এ ছালাতের সময় কখন থেকে আরম্ভ হবে আর তা কখন শেষ হবে, প্রতিটি সময়ে কত রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হবে, ছালাত আদায়ের সময় সাজদাহ ও রুকূ‘ কখন করতে হবে, ছালাতের মধ্যে কী কী পাঠ করতে হবে, কী কী কাজ করলে ছালাত ভংগ হবে; এমনি অসংখ্য বিষয় যা ছালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট, তার কোন ন্যূনতম বর্ণনাও কি কুরআনে রয়েছে? আল-কুরআনে ছালাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে মাত্র। এর আনুষঙ্গিক এ সব বিষয়ে তো হাদীছই আমাদেরকে পথ নির্দেশনা দিয়েছে। হাদীছেই তো এসেছে- রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
صلوا كما رأيتموني أصلي
‘আমাকে যেমনিভাবে ছালাত আদায় করতে দেখ তেমনি ভাবেই ছালাত আদায় কর।’ যারা হাদীছ অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায়, তারা হাদীছ বাদ দিয়ে ছালাত আদায়ের সামান্য চিন্তাও কি করতে পারে? কখনো সম্ভব নয়। সেজন্য হাদীছ বাদ দিয়ে যারা শুধু আল-কুরআন মানার আস্ফালন দেখায়, তারা মূলত অলক্ষ্যে ছালাতের বাস্তব রূপকেই অস্বীকার করে।
একই ভাবে আল-কুরআনে যাকাত আদায়ের নির্দেশ এসেছে। কোন কোন সম্পদের কত দিন পর পর, কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে, তা কি হাদীছের মাধ্যম বাদ দিয়ে অন্য মাধ্যমে জানা সম্ভব? ছিয়াম পালনের হুকুম আহকাম, হজ্জ পালনের নিয়মাবলী, দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী নিয়ম নীতি অনুযায়ী ক্রয়-বিক্রয়, পারস্পরিক আদান প্রদান, বিবাহ শাদীর পদ্ধতি প্রভৃতি অসংখ্য কর্মকান্ড পরিচালনা পদ্ধতি হাদীছ অমান্য করে পালন করা কোন ভাবেও সম্ভব নয়। ইবন হাযম রাহিমাহু আল্লাহ এ বাস্তবতাকেই তুলে ধরে হাদীছ অস্বীকারকারীদেরকে প্রশ্নাকারে বলেছেন যে-
في أي قرآن وجد أن الظهر أربع ركعات وأن المغرب ثلاث ركعات وأن الركوع على صفة كذا والسجود على صفة كذا وصفة القراءة فيها والسلام وبيان ما يجتنب في الصوم وبيان كيفية زكاة الذهب والفضة والغنم والإبل والبقر ومقدار الأعداد المأخوذ منها الزكاة ومقدار الزكاة المأخوذة وبيان أعمال الحج من وقت الوقوف بعرفة وصفة الصلاة بها وبمزدلفة ورمي الجمار وصفة الإحرام وما يجتنب فيه وقطع يد السارق وصفة الرضاع المحرم وما يحرم من المآكل وصفة الذبائح والضحايا وأحكام الحدود وصفة وقوع الطلاق وأحكام البيوع وبيان الربا ... وإنما في القرآن جمل لو تركنا وإياها لم ندر كيف نعمل فيها وإنما المرجوع إليه في كل ذلك النقل عن النبي صلى الله عليه و سلم .فلا بد من الرجوع إلى الحديث ضرورة ولو أن امرأ قال لا نأخذ إلا ما وجدنا في القرآن لكان كافرا بإجماع الأمة ولكان لا يلزمه إلا ركعة ما بين دلوك الشمس إلى غسق الليل وأخرى عند الفجر.
‘যোহরের চার রাক‘আত, মাগরিবের তিন রাক‘আত, রুকু’ ও সাজদাহ এর প্রকৃতি, কিরাআতের অবস্থা, ছালাম ফিরানোর বিবরণ, ছিয়ামে যা বর্জনীয়, স্বর্ণ, রৌপ্য, ছাগল ও উটের যাকাত আদায়ের পদ্ধতি, হজ্জ পালনের কর্মকান্ড বিশেষ করে ‘আরাফাতে অবস্থান এবং ‘আরাফাতে ও মুজদালিফায় ছালাত আদায়ের বিবরণ, (আকাবাতে) পাথর নিক্ষেপ, ইহরামের বর্ণনা এবং ইহরাম অবস্থায় যা পরিত্যাজ্য তার বর্ণনা, চোরের হাত কর্তন, ক্রয়-বিক্রয়ের বিধি-বিধান, সুদের বর্ণনা... তোমরা কোন কুরআনে পেয়েছ? আল-কুরআন হচ্ছে সারসংক্ষেপ, যদি হাদীছ বর্জন করি তাহলে কিভাবে তা কার্যে পরিণত করব, তা আমরা জানব না। সুতরাং হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন অত্যাবশ্যক। যদি কোন ব্যক্তি বলে যে, আমরা কুরআনে যা পাই তাই গ্রহণ করব, সমগ্র উম্মাহ তার কাফির হওয়ার ব্যাপারে এক মত। তার জন্য সূর্য অস্ত যাওয়া থেকে অন্ধকার রাত পর্যন্ত এক রাক‘আত এবং ফজরের সময় শুধু আরো এক রাক‘আত ছালাত আদায় অপরিহার্য হবে।’ সুতরাং হাদীছ অস্বীকার করে শুধু আল-কুরআন অনুসরণের দাবি একেবারেই অবান্তর, অবাস্তব, অমূলক ব্যতীত আর কিছু নয়।
৩.২.৩ আল-কুরআন অনুধাবনের জন্য হাদীছের অপরিহার্যতা
ছাহাবীগণ আরবী ভাষাভাষী হয়েও প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআনের কিছু কিছু বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝতেন না। এক পর্যায়ে আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন-
الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ
‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করে নি।’ যুলম থেকে বেঁচে থাকা কঠিন কাজ বিধায় আছহাব রাদিআল্লাহু আনহুম এ আয়াত নিজেদের জন্য অনুসরণ করাকে অসম্ভব বলে মনে করলেন। তাঁরা বললেন, يارسول الله فأينا لايظلم نفسه؟ ‘‘হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের কে রয়েছে যে, নিজের নফছের উপর যুলম করে না? তিনি বললেন- ليس ذلك إنما هو الشرك ‘তোমরা এ দ্বারা যা বুঝেছ তা নয়, এখানে ‘যুলম’’এর অর্থ হচ্ছে, শিরক।’
এ আয়াতে ‘যুলম’ দ্বারা যে শিরক বুঝানো হয়েছে, তা মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। এখানে হাদীছ অস্বীকার করে এ আয়াতের সঠিক অর্থ অনুধাবণ করা কি আদৌ সম্ভব? আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন-
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللّهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ . تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا وَيَضْرِبُ اللّهُ الْأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ . وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَار.ٍ
‘তুমি কি লক্ষ্য কর না আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎ বাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ, যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা উর্ধ্বে বিস্তৃত। যা প্রত্যেক মওসুমে তার প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে ফল দান করে থাকে এবং আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। কু-বাক্যের তুলনা এক মন্দ বৃক্ষ, যার মূল ভূপৃষ্ঠ হতে বিছিন্ন, যার কোন স্থায়িত্ব নেই।’
এখানে দুটি আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ "شجرة طيبه" দ্বারা যে খেজুর গাছ ও "شجرة خبيثة" দ্বারা যে হানজালাহ বৃক্ষকে বুঝানো হয়েছে, তা হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। হাদীছে যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن أنس بن مالك أن رسول الله صلى الله عليه و سلم أةي بقناع جزء فقال : مثل كلمة طيبة كشجرة طيبة أصلها ثابة وفرعها في السماء ةؤةي أكلها كل حين بإذن ربها فقال : هي النخلة ومثل كلمة خبيثة كشجرة خبيثة اجةثة من فوق الأرض ما لها من قرار قال : هي الحنظلة .
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন এখানে كلمة طيبة كشجرة طيبة أصلها ثابت وفرعها في السماء تؤتي أكلها كل حين بإذن ربها বক্তব্যে شجرة طيبة হচ্ছে খেজুর গাছ এবং كلمة خبيثة كشجرة خبيثة اجتثت من فوق الأرض ما لها من قرار বক্তব্যে شجرة خبيثه এর অর্থ হচ্ছে, হানজালাহ বৃক্ষ।’’
হাদীছ অস্বীকার করলে এ দুটির সঠিক অর্থ উপলব্ধি করা কি কোন ভাবেও সম্ভব? আল-কুরআন বুঝার জন্য যে হাদীছের প্রয়োজন তার আরো প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর বাণী-
يُثَبِّتُ اللّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآَخِرَةِ وَيُضِلُّ اللّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللّهُ مَا يَشَاءُ.
‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী, তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা যালিম আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।’ এ আয়াতে ‘‘আখিরাত’’এর অর্থ হচ্ছে, কবরে প্রশ্নোত্তরের সময়। এখানে আখিরাতের স্বাভাবিক অর্থ পরকাল না হয়ে যে কবরে মুনকার ও নাকীরের প্রশ্নোত্তরের সময়কালকে বুঝানো হয়েছে, তা মূলত হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। হাদীছ অস্বীকার করলে এ বাস্তব সত্য বুঝার সুযোগ থাকবে কি?
এমনি অসংখ্য আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাদীছ ব্যতীত উপলব্ধি করা কোন প্রকারেও সম্ভব নয়। সুতরাং কুরআনের অনেক অংশ বুঝার জন্য আমরা হাদীছের উপরই নির্ভরশীল। হাদীছ অস্বীকার করে কুরআনের অনেক অংশই অনুধাবন করা অসম্ভব। সে জন্য যারা হাদীছ বাদ দিয়ে আল-কুরআন বুঝার অপচেষ্টায় ব্যস্ত, তারা মূলত বিভ্রান্তির ভেতরেই রয়েছে। হাদীছ উপেক্ষা করে আল-কুরআন বুঝা একেবারেই অবাস্তব।
৩.২.৪ হাদীছ ব্যতীত ইসলামী শারী‘আতের পূর্ণ বিধিবিধান পালন অসম্ভব
যারা শুধু কুরআনের আলোকেই ইসলামী শারী‘আতকে কল্পনা করে, তারা মূলত ইসলামী শারী‘আতের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ইসলামী শারী‘আতের এমন অনেক হুকুম আহকাম রয়েছে, যে সম্পর্কে কুরআনে কিছুই পাওয়া যায় না। মূলত হাদীছ দ্বারাই তা প্রমাণিত হয়েছে, আল-কুরআন দ্বারা নয়। এ প্রসঙ্গে এখানে শুধু কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হচ্ছে-
ক. দাদী-নানীকে উত্তরাধিকারী ঘোষণাঃ
ইসলামী শারী‘আহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, মৃতের মাতা না থাকলে মৃতের দাদী ও নানী তার সম্পদের এক-ষষ্ঠাংশের উত্তরাধিকারী হয়। এটি আল-কুরআন দ্বারা নয়, শুধু হাদীছ দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। বর্ণিত হয়েছে
عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- جَعَلَ لِلْجَدَّةِ السُّدُسَ إِذَا لَمْ تَكُنْ دُونَهَا أُمٌّ.
‘যদি মাতা না থাকে তাহলে দাদী বা নানীকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক-ষষ্ঠাংশ উত্তরাধিকার প্রদেয় বলে ঘোষণা করেছেন।’
হাদীছ না মেনে, শুধু আল-কুরআন মানতে গেলে ইসলামী শারী‘আতের দাদী-নানীকে উত্তরাধিকার নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটি বাদ দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যা মূলত ইসলামী শারী‘আতকে সংকুচিত হতে বাধ্য করে। ইসলামী শারী‘আতের এ সংকোচন ইসলামী শারী‘আতের পরিপূর্ণতার পরিপন্থী।
খ. স্ত্রীর সাথে তার খালা অথবা ফুফুকে একই সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখাকে অবৈধকরণঃ
ইসলামী শারী‘আহতে নিজের স্ত্রীর সাথে তার খালা অথবা ফুফুকে একত্রে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করাকে হারাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আল-কুরআনের কোথাও এ বিধান প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু হাদীছে উল্লেখ হওয়ার কারণে ইসলামে এটাকে হারাম বলে গণ্য করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে-
عن الشعبي سمع جابرا رضي الله عنه قال : نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم أن ةنكح المرأة على عمتها أو خالتها.
‘শা‘বী জাবির রাদি আল্লাহু ‘আনহু থেকে শুনেছেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন মহিলাকে তার ফুফু ও তার খালার সাথে একত্রে বিয়ে করাকে নিষেধ করেছেন।’
যারা হাদীছ পরিপালনকে অস্বীকার করে, কুরআনে এ বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ না থাকার কারণে কি এটাকে হালাল বলে মনে করবে? ইসলামে সর্বসম্মত ভাবে স্বীকৃত এ হারামকে হালাল জ্ঞান করা, মূলত ইসলামী শারী‘আতের অংশ বিশেষ না মানারই
নামান্তর, যা মূলত ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোর অপরাধ। সুতরাং ইসলামী শারী‘আহ মানতে হলে হাদীছ মানা অপরিহার্য।
গ. মৃত মাছ, পঙ্গপাল, কলিজা ও প্লীহা ভক্ষণ বৈধকরণঃ
আল-কুরআনে যে কোন মৃতকে ও রক্ত ভক্ষণকে হারাম ঘোষণা করেছে। আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّم.ُ
‘হারাম করা হয়েছে তোমাদের উপর মৃত ও রক্ত।’ এ আয়াত অনুযায়ী যেহেতু যে কোন মৃত ও রক্ত ভক্ষণ করা হারাম সেহেতু মৃত মাছ, কলিজা ও প্লীহা রক্ত বিশেষ হওয়ায় তা হারাম হওয়া অপরিহার্য ছিল। কিন্তু হাদীছ মৃত মাছ, পঙ্গপাল এবং জবহকৃত পশুর কলিজা ও প্লীহাকে এ হারামের গন্ডিমুক্ত করে এগুলোকে হালাল বলে ঘোষণা দিয়েছে। বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن عمر أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: أحلت لكم ميتتان ودمان فأما الميتتان فالحوت والجراد وأما الدمان فالكبد والطحال.
‘‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের জন্য দুটি মৃত ও রক্তকে হালাল করা হয়েছে। মৃত দু’টি হচ্ছে, মাছ ও পঙ্গপাল এবং রক্ত দু’টি হচ্ছে, কলিজা ও প্লীহা।’
যারা হাদীছ অস্বীকার করে শুধু কুরআনকে মেনে আত্মতৃপ্তি বোধ করেন, তারা কি মৃত মাছ, পঙ্গপাল, কলিজা ও প্লীহা খাওয়াকেও কুরআনে হারাম হওয়ার কারণে তা হারাম মনে করেন? নিশ্চয় তাদের তা মনে করার কথা নয়। অলক্ষ্যেই তারা হাদীছকে মেনেই মূলত এগুলোকে হালাল মনে করে থাকেন। সুতরাং তাদের শুধু আল-কুরআন মানার এ দাবী যে অসম্ভব ও অবাস্তব তা তারা নিজেরাই প্রমাণ করলেন।
ঘ. ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পিতামাতা ও সন্তানের উত্তরাধিকারঃ
আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
يُوصِيكُمُ اللّهُ فِي أَوْلَادِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ فَإِنْ كُنَّ نِسَاءً فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِنْ كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلِأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِنْ كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلِأُمِّهِ الثُّلُثُ.
‘আল্লাহ তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান, কিন্তু কেবল কন্যা দুইয়ের অধিক থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তি দুই-তৃতীয়াংশ, আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধেকাংশ। আর সন্তান থাকলে পিতা-মাতা প্রত্যেকের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-ষষ্ঠাংশ, সে নিঃসন্তান হলে এবং পিতা-মাতাই উত্তরাধিকারী হলে তার মাতার জন্য এক-তৃতীয়াংশ।’ এই আয়াত প্রত্যেক পিতা-মাতা তার সন্তানের এবং প্রত্যেক সন্তান তার পিতামাতার উত্তরাধিকারী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তারা একে অপরের ধর্মাবলম্বী হোক বা না হোক, তার কোন বর্ণনা এখানে নেই। তবে হাদীছেই মূলত কাফির পিতামাতা মুসলিম সন্তানের অথবা কাফির সন্তান মুসলিম পিতামাতার উত্তরাধিকারী না হওয়ার স্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। মুসলিম উম্মাহও এই সিদ্ধান্তকে অনুশীলন করে আসছে। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، أن النَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: لا يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ، وَلا يَرِثُ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ.
‘উসামাহ ইবন যায়িদ রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত মহানবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলিম কাফিরের উত্তরাধিকারী হয় না এবং কাফিরও মুসলিমের উত্তরাধিকারী হয় না।’ উত্তরাধিকারীর এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাটি কস্মিনকালেও শুধু কুরআনের মাধ্যমে জানা সম্ভবপর নয়। এজন্য অবশ্যই হাদীছের দ্বারস্থ হওয়া ব্যতিত কোন বিকল্প নেই।
ঙ. পূর্ববর্তী স্বামীর সাথে বিবাহঃ
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ.
‘এরপর যদি যে তাকে তালাক দেয় তবে সে তার জন্য বৈধ হবে না, যে পর্যন্ত সে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়।’ এ আয়াতে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার তালাকদাতা স্বামীর জন্য বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কারো সাথে শুধু বিবাহ হওয়াকেই শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তার সাথে মেলামেশা করা না করা বা অন্য কোন দ্বিতীয় স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক দেয়ার পর ইদ্দত পালন করা না করার বিষয়, এখানে উল্লেখ হয়নি। শুধু কুরআনের অনুসারীরা কি এই আয়াতের সরাসরি বক্তব্য অনুযায়ী প্রথম স্বামীর তালাকের পরপরই অন্য কারো সাথে বিবাহ দিয়ে সে তালাক দিলে ঐ মহিলাকে তার প্রথম স্বামীর সাথে ইদ্দত ছাড়াই বিবাহকে অনুমোদন দেবেন? ইসলামের দৃষ্টিতে এটি কক্ষনো বৈধ হবে না। বরং হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এ জন্য দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার মেলামেশা অত্যাবশ্যক। বর্ণিত হয়েছে- রিফা’আতুবনু সামওয়াল আল-কুরাযী রাদি আল্লাহু ‘আনহু তার স্ত্রী তামীমাহ বিনত ওয়াহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহাকে তিন তালাক দিলেন। আব্দুর রহমান ইবনুয যুবায়ির রাদি আল্লাহু ‘আনহু তাকে বিবাহ করেন। তিনি ছিলেন স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করতে অক্ষম। তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। রিফা’আহ রাদি আল্লাহু ‘আনহাকে তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-
تُرِيدِينَ أَنْ تَرْجِعِي إلَى رِفَاعَةَ، لاَ، حَتَّى تَذُوقِي عُسَيْلَتَهُ، وَيَذُوقَ عُسَيْلَتَك.
‘তুমি কি রিফা‘আর কাছে ফিরে যেতে চাও? কক্ষনো না, যতক্ষণ না তুমি তার (ইবনুয যুবায়িরের) মধুর স্বাদ এবং সে তোমার মধুর স্বাদ গ্রহণ না করে।’ সুতরাং প্রথম স্বামীর নিকট ফিরে যেতে হলে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে নির্জনবাস অপরিহার্য, তা শুধু হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত।
চ. চোরের হাত কাটার পরিমাণঃ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ইরশাদ করেন-
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللّهِ وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ.
‘এবং পুরুষ চোর এবং নারী চোর, তাদের হস্তচ্ছেদ কর, এ তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ হতে আদর্শ দন্ড, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ এ আয়াতে কি পরিমাণ চুরি করলে হাতের কোন পর্যন্ত কাটা যাবে তার বর্ণনা নেই। শুধু কুরআনের অনুসারীগণ তাহলে এই আয়াত কিভাবে কার্যকর করবেন? হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قال النبي صلى الله عليه و سلم تُقْطَعُ الْيَدُ فِي رُبْعِ دِينَارٍ فَصَاعِدًا.
‘আয়িশাহ (রা) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন‍‍‍‍‍‍‘দীনারের এক-চতুর্থাংশের বেশি চুরি করলে (চোরের) হাত কাটতে হবে।’ আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَدِىٍّ : أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- قَطَعَ يَدَ سَارِقٍ مِنَ الْمَفْصِلِ.
‘আদী রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে- রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম চোরের হাতের কবজির গিরা থেকে কেটেছিলেন।’ সুতরাং চোরের সাজা কার্যকরের জন্য হাদীছের বর্ণনা অবশ্যই পালনীয়, যা শুধু কুরআনের দ্বারা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
আসলে ইসলামী শারী‘আতের বিধি বিধানে এমন কিছু হালাল হারামের বিষয় রয়েছে, যার পরোক্ষ বা সারসংক্ষেপ আলোচনাও কুরআনে নেই, যা মূলত হাদীছের দ্বারাই প্রমাণিত, যা হাদীছের উপরই নির্ভরশীল। যারা হাদীছ অনুসরণের বিরোধিতা করেন, তারা ইসলামে সর্বসম্মত এরূপ অসংখ্য হালাল হারামের বিধি বিধানকেও অমান্য করতে বাধ্য হন, যা মূলত ইসলামী শারী‘আতের পূর্ণ বিধি বিধান পালনের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সে জন্য হাদীছ না মেনে পরিপূর্ণ ইসলামী শারী‘আহ পরিপালনের কোন সুযোগ নেই। ইসলামে হালাল হারাম সম্পর্কে যে মূল বক্তব্য তার মর্মার্থ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কিছু হালাল করলে তা হালাল এবং তিনি কোন কিছু হারাম করলে ইসলামে তা হারাম বলেই গণ্য হয়। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে-
عن الْحَسَنُ بْنُ جَابِرٍ قَالَ سَمِعْتُ الْمِقْدَامَ بْنَ مَعْدِي كَرِبَ يَقُولُ حَرَّمَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ خَيْبَرَ أَشْيَاءَ ثُمَّ قَالَ يُوشِكُ أَحَدُكُمْ أَنْ يُكَذِّبَنِي وَهُوَ مُتَّكِئٌ عَلَى أَرِيكَتِهِ يُحَدَّثُ بِحَدِيثِي فَيَقُولُ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ كِتَابُ اللّهِ فَمَا وَجَدْنَا فِيهِ مِنْ حَلَالٍ اسْتَحْلَلْنَاهُ وَمَا وَجَدْنَا فِيهِ مِنْ حَرَامٍ حَرَّمْنَاهُ أَلَا وَإِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلُ مَا حَرَّمَ اللّهُ.
‘আল- হাসান ইবন জাবির রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আল-মিকদাম ইবন মা‘দিকারব রাদি আল্লাহু ‘আনহুকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু দ্রব্যকে খাইবারের দিন হারাম করেন এরপর বলেন, তোমাদের কেউ আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার নিকটবর্তী হয় এমন অবস্থায় যে, আমার হাদীছ বর্ণিত হলে সে তার পালঙ্কে হেলান দিয়ে বলে, ‘আমাদের মাঝে তো আল্লাহর কিতাব রয়েছে। এর মধ্যে আমরা যা হালাল পাবো তা আমরা হালাল করব, এখানে আমরা যা হারাম পাবো তা হারাম করব।’ সাবধান, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা হারাম করেছেন তা তো আল্লাহর হারাম করারই মত।’ সুতরাং হাদীছের মাধ্যমে যা হালাল সাব্যস্ত হয়েছে, তা ইসলামে হালাল আর যা হারাম সাব্যস্ত হয়েছে তা অবশ্যই হারাম বলেই গণ্য।
হাদীছ হচ্ছে ইসলামী শারী‘আতের দ্বিতীয় উৎস। প্রধান উৎস কুরআনের পরেই যার অবস্থান। কুরআনের প্রতি অতি আগ্রহ সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহকে হাদীছ বিমুখ করতে পারলে ইসলামী শারী‘আতের আসল রূপকে বিকৃত করা সম্ভব। ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন করার এক জঘন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে, হাদীছ অস্বীকার করার ইসলাম বিদ্বেষী এ মতবাদ। ইসলাম বিদ্বেষী শত্রুদের সৃষ্ট রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ ইসলাম বিধ্বংসী মতবাদের ফাঁদে যারা পা দিয়েছে, তারা মূলত ইসলামের শত্রু, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শত্রু, কুরআনের শত্রু। তারা ইসলামের শত্রুদের হাতের ক্রীড়নক। সে জন্য তারা হাদীছের অপরিহার্যতাকে উপলব্ধি করে না। আসলে হাদীসের অনুসরণ ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪. হাদীছ কেন্দ্রিক কিছু বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
ইসলামের অন্যতম উৎস হাদীছকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিভ্রান্তির উদ্ভব হয়েছে। সে গুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
৪.১ সম্পূর্ণ হাদীছকে অস্বীকার করা
বিষয়টিকে স্পষ্টাকারে বুঝার জন্য এ বিভ্রান্তির পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪.১.১ হাদীছ অস্বীকারের পটভূমি
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রিসালাত অস্বীকার করার সূত্রপাত তাঁর রিসালাত প্রাপ্তির পরপরই হয়েছে। মক্কার কাফিররা ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রদূত। আসলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ অস্বীকার তাঁর রিসালাতকে অস্বীকার করারই নামান্তর। তিনি আল্লাহর রাসূল নন, তিনি আল্লাহর নবী নন, এ বলে তাঁর রিসালাত ও নাবুওয়াতকে অস্বীকার করা আর তাঁর বিশুদ্ধ হাদীছ অস্বীকার করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা তাঁকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে মেনে নেয়ার পরে, তাঁর হাদীছ অস্বীকার করার সুযোগই থাকে না। তাঁর রিসালাত অস্বীকার করার প্রবণতাই মূলতঃ তাঁর হাদীছ অস্বীকার করার পথ তৈরি করে। তিনি আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এ বিশ্বাস যদি কারো থাকে, আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনের প্রামাণ্য দলীল হওয়ায় সে তা কক্ষনো অস্বীকার করতে পারে না। এ মানদন্ডে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রিসালাত অস্বীকারকারীরাই তাঁর হাদীছ অস্বীকারকারী। অন্য কথায় তাঁর হাদীছ অস্বীকারকারীরাই তাঁর রিসালাত অস্বীকারকারী। সুতরাং হাদীছ অস্বীকারের সূত্রপাত মক্কার কাফিরদের থেকেই শুরু হয়েছে। তবে মুসলিম হওয়ার দাবিদার হয়েও কে বা কারা সর্বপ্রথম হাদীছ অস্বীকার করেছে, কে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাজ ও কথার বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম অবস্থান নিয়েছে, তা আলোচনা করতে হলে বিষয়টি গভীরে প্রবেশ বিশেষ জরুরী।
এক সময় ‘যুবায়ির ইবনুল ‘আওআম রাদি আল্লাহু ‘আনহু ও একজন আনছারী ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহুর মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে পানি সরবরাহ নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়। তাঁরা এ সমস্যার নিষ্পত্তির জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বলে সমাধান দেন যে -
اسق يا زبير ثم أرسل الماء إلى جارك
‘হে যুবায়ির, তুমি সর্বপ্রথম তোমার কৃষিক্ষেতে, তারপর তোমার প্রতিবেশীর ক্ষেতে পানি সরবরাহ করবে।’
তখন উক্ত ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে বললেন, সে আপনার ফুফাত ভাই বলে কি এ সুযোগ পেল? তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেহারা রাগে লালবর্ণ হয়ে গেল। তখন অবতীর্ণ হল:
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
‘কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ। তারা মু’মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারভার তোমার উপর অর্পণ না করে; এরপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।’ আসলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধে একজন মুসলিমের প্রথম বিরোধিতা হলেও উক্ত ছাহাবী পরে নিজের ভুল উপলব্ধি করে তাওবাহ করার কারণে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ অস্বীকারের সূত্রপাত এখান থেকে হয়েছে বলে প্রমাণ হয় না। অন্য বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে -
أن أبا سعيد الخدري رضي الله عنه قال: بينما نحن عند رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو يقسم قسما أتاه ذو الخويصرة وهو رجل من بني تميم فقال: يا رسول الله اعدل فقال ويلك ومن يعدل إذا لم أعدل قد خبت وخسرت إن لم أكن أعدل فقال عمر يا رسول الله ائذن لي فيه فأضرب عنقه فقال دعه...
আবু সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি হুনাইনের যুদ্ধে প্রাপ্ত গাণীমাতের মাল বন্টন করছিলেন। এ সময় বানু তামীম-এর যূল খুওয়ায়ছিরাহ নামক এক ব্যক্তি এসে বলল- হে আল্লাহর রাসূল, বন্টনে ইনসাফ করুন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘‘তুমি ধ্বংস হও, আমি ইনসাফ না করলে আর কে ইনসাফ করবে ? আমি যদি ইনসাফ না করি, তাহলে আমি তো ধ্বংস হবো এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবো। উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহু বললেন ‘‘আমাকে অনুমতি দিন। আমি তার ঘাড় বিচ্ছিন্ন করে দিই।’’ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘তাকে ছেড়ে দাও ... ।’’ এ হাদীছ স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, যূল খুওয়ায়ছিরাহ ছিল প্রথম ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ অমান্যকারী। পরবর্তী কালে ইসলামী ‘আকীদাহ বিশ্বাসের চিরশত্রু শি‘আহ, রাফিদী ও খারিজীরাই হাদীস অস্বীকার করার দৃষ্টতা দেখায়। তবে এ সম্প্রদায়গুলোর হাদীছ অস্বীকার করার ধরণ ও প্রকৃতি ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
৪.১.২ হাদীছ অস্বীকারকারী সম্প্রদায়সমূহ
৪.১.২.১ শি‘আহ সম্প্রদায়
আহলিল বায়িতের বাইরের কেউ খালীফাহ হতে পারে না, শি‘আহ সম্প্রদায়ের এই ‘আকীদাহ বিশ্বাস লালিত হওয়ার কারণে যারাই আবূ বাকর, ‘ঊমার, ‘উছমান রাদি আল্লাহু ‘আনহুমের খিলাফাতকে মেনে নিয়েছিলেন তাদের হাদীছ তারা গ্রহণ করে না। কেননা এরা হচ্ছে, তাদের দৃষ্টিতে কাফির। সেজন্য অধিকাংশ ছাহাবীদের বর্ণিত হাদীছগুলোকে তারা অস্বীকার করেছেন। সুতরাং বলা যায়, তারা অধিকাংশ হাদীছ অস্বীকারকারী হলেও, তাদের পছন্দনীয় কিছু ছাহাবীর সামান্য সংখ্যক হাদীছ গ্রহণ করেছে যার সংখ্যা একেবারেই নগন্য। সমুদয় হাদীছকে তারা অস্বীকার করে নি। আহলিল বায়িতের রাবীদের সূত্রে বর্ণিত হাদীছই শুধু তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য; সেজন্য তারা আছ-ছাদিক তার পিতা বাকির হতে, তিনি তার পিতা যাইনুল ‘আবিদীন হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৌহিত্র আল-হুসায়িন রাদিআল্লাহু আনহু হতে, তিনি তার পিতা ‘আলী রাদিআল্লাহু আনহু হতে, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হাদীছই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করে। অন্য কোন ছাহাবীর হাদীছ নয়।
4.1.2.2 রাফিদী সম্প্রদায়
রাফিদী হচ্ছে শি‘আহদের একটি উপ-সম্প্রদায়। হাদীছ অস্বীকারকারী হিসেবে তারাও শি‘আহদের মতই। তবে তাদের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে মূল শি‘আহদের থেকে আরো জঘন্য। তারা মূল শি‘আহদের মত কিছু ছাহাবীর বর্ণিত হাদীছ গ্রহণ করলেও অধিকাংশ ছাহাবী বর্ণিত হাদীছ অস্বীকার করার সাথে সাথে অসংখ্য জাল হাদীছ নিজেরাই প্রণয়ন করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলে চালিয়ে দিয়েছে । হাদীছ শাস্ত্রকে বিতর্কিত করার ক্ষেত্রে তাদের এ জঘন্য ষড়যন্ত্র যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
৪.১.২.৩ খারিজী সম্প্রদায়
ইজতিহাদী ভুল বুঝাবুঝির কারণে আলী রাদিআল্লাহু আনহু ও মু‘আবিয়া রাদিআল্লাহু আনহু এর মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা নিষ্পত্তি করার পক্ষেই সকল ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম একমত হন। যুদ্ধই হক ও বাতিলের মধ্যে সুষ্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণের জন্য একমাত্র পন্থা বলে স্বল্প সংখ্যক তথা কথিত মুসলিম যারা মুসলিম উম্মাহর বলয় থেকে বের হয়ে যায় তারাই খারিজী সম্প্রদায় নামে পরিচিতি লাভ করে। তারা সকল ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুমকে আস্থা যোগ্য মনে করে না বিধায়, তাদের বর্ণিত হাদীছকে তারা অস্বীকার করে। সকল হাদীছই তাদের নিকট অগ্রহণযোগ্য। তারা কুরআনের বাইরে সকল ইসলামী বিধি-বিধানকে অস্বীকার করে। সেজন্য কুরআনে বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার কথা না থাকায়, তারা এ ইসলামী দন্ডবিধিকেও অস্বীকার করে। নিজের ঔরসজাত ছেলে ও মেয়ের কন্যাকে বিবাহ করাও তাদের কারো কারো নিকট এ জন্য বৈধ যে, কুরআনে এটাকে হারাম করা হয়নি। মোট কথা তারা সীমাহীন
বিভ্রান্তিতর মধ্যে নিপতিত রয়েছে।
৪.১.২.৪ মু‘তাযিলাহ সম্প্রদায়
হাদীছ অস্বীকার করার ক্ষেত্রে মু’তাযিলাহ সম্প্রদায় তিন শ্রেণীতে বিভক্ত।
ক. হাদীছুল মুতাওয়তির ও আহাদীছুল আহাদ উভয় প্রকার হাদীছই মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনার কারণে প্রত্যাখ্যাত।
খ. শুধু হাদীছুল আহাদই প্রত্যাখ্যাত।
গ. কাওলী হাদীছ মাত্রই প্রত্যাখ্যাত। তারা মুহাদ্দিছগণকে তিরস্কার করে। আবূ হুরাইরা রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হাদীছকে প্রত্যাখ্যাত মনে করে। উমার (রা) কে গালি দেয় এবং ইবন মাস‘উদকে (রা) মিথ্যাবাদী বলে জানে। তারা মদ্যপায়ীর দন্ডবিধি, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শাফা‘আত ও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাকে দর্শনের হাদীছসমূহকে অস্বীকার করে। এই সকল বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের কারণেই হাদীছ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় । উল্লেখ্য যে, এই বিভ্রান্তি ত্রয়োদশ হিজরীর আগ পর্যন্ত তেমন ব্যাপকতা লাভ করেনি।
হাদীছ অস্বীকারকারীদের বিভ্রান্ত মতামতের সারাংশ নিম্নরূপ-
1. আল্লাহর কিতাব কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
2. হাদীছ ওহী নয়।
3. হাদীছ সম্মানিত হওয়ার অনুপযুক্ত।
4. হাদীছের অনুসরণ শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
5. হাদীছ কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক।
6. হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে শারীআতের উৎস বলে বিবেচিত হত না।
7. আল-কুরআনে যে হাদীছের বক্তব্য নেই, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
8. হাদীছ শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগেই অনুসরণযোগ্য ছিল, পরবর্তীতে নয়।
৪.১.২.৫ বক্তব্য বিবৃত হাদীছ (الحديثالقولي) অস্বীকারকারী সম্প্রদায়
কোন কোন সম্প্রদায় হাদীছকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। যথা :-
K. কর্ম বিবৃত হাদীছ (الحديث الفعلي ) : যে হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাজের বর্ণনা এসেছে ,তাকে কর্ম বিবৃত হাদীছ বলে।
L. বক্তব্য বিবৃত হাদীছ (الحديث القولي) : যেখানে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বক্তব্য উল্লেখ হয়েছে, তাকে বক্তব্য বিবৃত হাদীছ বলে।
তাদের নিকট হাদীছের সনদ যাই হোক না কেন হাদীছ যদি কর্ম বিবৃত হয়, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য। আর হাদীছের সনদ যতই উচ্চমানের হোক না কেন, তা বক্তব্য বিবৃত হলে তা কোন ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা মূলতঃ বক্তব্য বিবৃত হাদীছকে অস্বীকারকারী। একই ব্যক্তির কর্ম কেন্দ্রিক হাদীছ অনুসরণীয় আর বক্তব্য কেন্দ্রিক হাদীছ বর্জনীয় হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে হয় না। দুই প্রকার হাদীছের মূলকেন্দ্র একই ব্যক্তি হওয়ার পরেও এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি মূলতঃ অমূলক। এটিও অন্য একটি বিভ্রান্তি। এরাও মূলত পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত।
৪.১.২.৬ আহাদীছুল আহাদ অস্বীকারকারী সম্প্রদায়
মুতাওয়াতির ঐ হাদীছকে বলা হয় যে হাদীছের বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত বেশি যে, এতগুলো লোকের কোন একটি মিথ্যা হাদীছ বর্ণনার উপর একমত হওয়া অসম্ভব। এদের সংখ্যা সকল স্তরেই অনেক ছিল এবং সনদের শেষ পর্যায়ের বর্ণনাকারী সরাসরি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেই তাঁর থেকে শ্রবণ করেছেন যেমন-
من كذب علي متعمدا فليتبوأ مقعده من النار.
‘যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা কথা বলল, সে জাহান্নামে তার বাসস্থান বানিয়ে নিল।’
হাদীছ অস্বীকারকারীদের কিছু ব্যক্তি শুধু এ মুতাওয়াতির হাদীছকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন, এ ব্যতীত সকল হাদীছকে এমনকি আহাদীছুল আহাদকেও অস্বীকার করেছেন। তবে কিছু ব্যক্তি আবার ‘আকীদার সাথে সম্পর্কিত নয় এ রূপ খাবরুল আহাদকে অস্বীকার করেছেন অন্য হাদীছকে নয়। অর্থাৎ যে সকল খাবরুল আহাদ ‘আকীদাহ বিষযক নয় তারা তা অস্বীকার করেন নি, শুধু ‘আকীদাহ বিষয়ক খাবরুল আহাদকে অস্বীকার করেছেন। এ উভয় সম্প্রদায়ই মূলত বিভ্রান্ত।
খারিজী সম্প্রদায়ের সকল হাদীছ প্রত্যাখ্যান করার মতাদর্শে প্রভাবপুষ্ট একটি সম্প্রদায় পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশেও শুধু হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ মতবাদের সম্প্রসারন ঘটানোর জন্য যুগ যুগ ধরে চেষ্টা সাধনা অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানে উপস্থাপিত হলো।
৪.১.৩ আধুনিক কালে হাদীছ অস্বীকারের ষড়যন্ত্র ও তার প্রবক্তাগণ
খৃস্ট ঊনবিংশ শতাব্দিতে হাদীছ অস্বীকার করার একটি চক্র গড়ে উঠে। এদের সাথে জড়িতরা কেউ মূলত ইসলামী শার‘ঈ জ্ঞানে আলোকিত ছিলেন না। তারা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। প্রাচ্যবিদদের অথবা ইসলামের শত্রুদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে তথাকথিত এ সব মুসলিম তাদের সুরে সুর মিলিয়েছেন। এরা বুঝে অথবা না বুঝে বিভিন্ন যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামের মূল উৎসের অন্যতম উৎস হাদীছকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন। মিশরের তদানিন্তন রাষ্ট্রপ্রধান ইসমাইল ইবন ইব্রাহিম বিন মুহাম্মাদ আলী পাশা (১৮৩০-১৮৯৫) মিশরীয় আদালতে খৃস্টানদেরও কাজী হওয়ার বৈধতা দান করেন। এটি ছিল মূলত: ইসলামকে ঐ ভূখন্ডে পরাভূত করার প্রথম পদক্ষেপ। এরপর জামাল উদ্দীন আফগানী (১৮৩৮-১৮৯৭) ১৮৭০ সালে মিশরে আসেন। তিনি ছিলেন ইসলাম, খৃস্টান ও ইয়াহুদী; এই তিন ধর্মের একত্রিত করণের প্রবক্তা। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে, মুহাম্মাদ রাশিদ রিদা ও তার ছাত্র মুহাম্মাদ আব্দুহু দেশে সেক্যুলারিজম তথা দীনকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যান। তাদেরই পথ ধরে মুহাম্মাদ আব্দুহুর ছাত্র মুস্তাফা আবদুর রাযযাক দীন সংশোধনীর (الإصلاح الديني) নামে তিন দফার দিকে মানুষদেরকে আহবান জানান। এর মধ্য দিয়েই মূলত মিশরে হাদীছ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তার এই তিন দফার এক দফা ছিল- ধর্মীয় বিষয়ে শুধু কুরআনই হবে মূল উৎস। আর এই দফাই হচ্ছে মূলত হাদীছ বিরোধীদের মূল দর্শন। মুসলিম নামধারী হয়েও যারা হাদীছের বিরুদ্ধে এ জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, তাদের কয়েকজন হলেন-
৪.১.৩.১ মাহমূদ আবূ রায়য়্যাহ
তিনি ছিলেন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মিশরীয়। তিনি ইসলামের মূল উৎসের অন্যতম উৎস হাদীছকে অস্বীকারকারী। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাস হতে আর-রিসালাহ নামক একটি ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করেন। এটি পরবর্তিতে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল ‘‘আদওয়াউন ‘আলাস্সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়াহ’’। এ বইতে তিনি হাদীছ সংকলন সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর কথাবার্তা তুলে ধরেন। এগুলো মূলত হাদীছ শাস্ত্রকে বিতর্কিত করতে ও এ বিষয়ে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন-
ক. অলঙ্কার শাস্ত্রের কিংবদন্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ হওয়া উচিত ছিল অলঙ্কারে পরিপূর্ণ। তা না হয়ে যেভাবে তা অলঙ্কারহীন অর্থ প্রকাশ করে, তা সত্যই আশ্চর্যজনক। এগুলো যে তাঁর ভাষায় বর্ণনা করা হয়নি, এটি তারই প্রমাণ। এগুলো যদি তাঁর ভাষায় বর্ণনা করা হত, তাহলে এমনটি হত না।
খ. হাদীছ বর্ণনাকারীরা যে ভাবে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে সন্দেহমুক্ত হয়ে প্রশান্ত চিত্তে হাদীছ গ্রহণ করা যায় না। কেননা তাঁদের বর্ণনা পদ্ধতিতে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয়ের কারণ রয়েছে।
গ. হাদীছই মুসলিম উম্মাহকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে যদি হাদীছ লেখা হত, তাহলে এমনি ভাবে মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হওয়ার সুযোগ পেত না।
ঘ. ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম ছিলেন সহজ সরল প্রকৃতির। ইয়াহুদী পন্ডিতদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত উপলব্ধি করার যোগ্যতা তাদের ছিল না। সেই সুযোগে তারা যথা ইচ্ছা হাদীছ জাল করেছে। তাঁরা এ জাল হাদীছটাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।
এ ছিল হাদীছ শাস্ত্রকে বিতর্কিত ও একে সন্দেহ সংশয়ের ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষেপের জন্য শাণিত অভিযোগের ভাষা। একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে এগুলো যে অসার, অযৌক্তিক এবং সত্যের অপলাপ ব্যতীত কিছু নয়, তা সহজেই বুঝা যায়। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীছ আজও অলঙ্কার শাস্ত্রের পথিকৃৎ হিসেবে বিরাজ করছে। সেজন্য তাঁর হাদীছ হুবহু বর্ণনা না করার কারণে, অলঙ্কারহীন হয়ে পড়েছে এ দাবী সত্য নয়। এর জাজ্জ্বল্য উদাহরণ হচ্ছে-
১. বর্ণিত হয়েছে-
عن سلمة عن أبيه قال : سمعت رسول الله صلى الله عليه و سلم يقول :... و من مات حتف أنفه وقع أجره على الله قال و إنها لكلمة ما سمعتها من أحد من العرب أول من رسول الله صلى الله عليه و سلم يعني بحتف أنفه على فراشه فقد وقع أجره على الله.
সালামাহ তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ... যে ব্যক্তি তার নাককে ধ্বংস করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তার ছাওয়াব আল্লাহর উপরেই বর্তায়। বর্ণনাকারী বলেন, এটি এমন একটি বাক্য, যা আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূর্বে আরবদের কারো নিকট হতে শুনিনি; যার (আলঙ্কারিক) অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি তার বিছানায় মারা যায়, আল্লাহ তারও ছাওয়াব দেবেন।’’ এখানে তাঁর এ বাণী যে কোন মাপকাঠিতে উচ্চ অলঙ্কারে সুসজ্জিত তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সুতরাং তাঁর বাক্যে কোন অলঙ্কার নেই, এটি ডাহা মিথ্যা কথা।
২. আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن كثير بن عباس قال رسول الله صلى الله عليه و سلم الآن حمي الوطيس.
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এখন তন্দুর উত্তপ্ত হয়েছে।’’ হুনাইনের যুদ্ধে যখন প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয় সে সময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি বলেছিলেন। এর আসল অর্থ হচ্ছে, ‘এখন প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়েছে’। এটিও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উচ্চাঙ্গের আলঙ্কারিক বাক্যগুলোর মধ্যে একটি।
৩. আরো বর্ণিত হয়েছে-
...قال حذيفة: قلت يا رسول الله هل بعد هذا الشر خير قال هدنة على دخن قال قلت يا رسول الله هدنة على دخن ما هي قال لا ترجع قلوب أقوام على الذي كانت عليه.
...হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, এ খারাপের পরে কি কোন ভালো রয়েছে? তিনি বললেন, ‘সন্ধি নষ্ট হয়েছে’। ‘আমি বললাম এর অর্থ কি? তিনি বললেন, ‘সম্প্রদায়ের লোকদের আত্মা কক্ষনো পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসবে না।’ هدنة على دخن এর আসল অর্থ হচ্ছে, ধোঁয়া যেমন খাদ্যকে নষ্ট করে দেয়, তেমনি সন্ধি নষ্ট হয়ে গেছে। যা মূলত খারাপকেই ইঙ্গিত করে, যা অলঙ্কারের দিক থেকে উত্তীর্ণ একটি বাক্য বিশেষ। এ বাক্যটি মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছে যে আলঙ্কারিক বাক্য বিরাজমান তারই উজ্জ্বল সাক্ষী। এমনি অসংখ্য হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আরবী ভাষার অলঙ্কার শাস্ত্রের উদাহরণ হিসেবে বিরাজ করছে। সুতরাং মাহমূদ আবূ রায়য়্যাহর দাবী, হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষায় বর্ণিত হলে সেখানে অলঙ্কার পরিলক্ষিত হত, যা বর্তমানে নেই; এ দাবী সত্য নয়। বরং অলঙ্কারপূর্ণ এ সব হাদীছ এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, অধিকাংশ হাদীছই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষায়ই বর্ণিত হয়েছে।
তার ভাষায়, হাদীছ বর্ণনাকারীরা যেভাবে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে সন্দেহমুক্ত হয়ে প্রশান্ত চিত্তে হাদীছ গ্রহণ করা যায় না; এটি একটি অবান্তর দাবী মাত্র। ইসলামের বিদগ্ধ মুহাদ্দিছ রাহিমাহুল্লাহ সূক্ষ্ম মানদন্ড নির্ধারণ পূর্বক তার আলোকে যাচাই বাছাই করে সকল ছাহীহ হাদীছকে জাল হাদীছ থেকে পৃথক করেছেন। তাঁদের সংকলিত এ ছাহীহ হাদীছ সমূহের গ্রন্থরাজিও আমাদের মাঝে বিরাজমান। এমনকি দুর্বল সনদের হাদীছগুলোও চি‎‎হ্নত হয়েছে, জাল হাদীছ দ্বারা যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য জাল হাদীছসমূহকে বিভিন্ন গ্রন্থে একত্রিতও করা হয়েছে। এর পরেও হাদীছ বর্ণনাকারীরা যে ভাবে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে সন্দেহমুক্ত হওয়া যায় না, এ অজুহাতে বিশুদ্ধ হাদীছকেও বর্জন করা, একেবারেই অযৌক্তিক নয় কি?
হাদীছ রাসূলুললাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে লেখা না হওয়ার কারণে মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়েছে, মাহমূদ আবূ রায়য়্যার এ দাবীটিও অসার। অনেক হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে যে লেখা হয়েছে ইতোপূর্বে আমরা তার স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। আর হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে লেখা না হওয়ার কারণে মুসলিম উম্মাহ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়েছে, এ কথার ঐতিহাসিক কোন ভিত্তি নেই। বরং সর্বজন বিদিত সত্য কথা হচ্ছে, হাদীছ বিরোধী পক্ষই এ উম্মাহকে শতধা বিভক্ত করে ছেড়েছে । বিশুদ্ধ হাদীছের চেয়ে ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধিকে বেশি বেশি প্রাধান্য দেয়ায় তারাই এ উম্মাহকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে ফেলেছে। সুতরাং তার এ দাবী অলীক।
ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম সহজ সরল প্রকৃতির ছিলেন বলেই ইয়াহুদীরা জাল হাদীছ প্রণয়য়ের সুযোগ নিয়েছে এবং ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম প্রতারিত হয়েছেন, এটিও একটি অবান্তর দাবী। ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত যে, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব, ‘আমর ইবনুল ‘আছ, ‘আলী ইবন আবী তালিব, ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস, ‘আবদুর রাহমান ইবন ‘আউফ প্রমুখ ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম সহ এরূপ অগণিত ছাহাবী বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী ছিলেন। এদের বিচক্ষণ কর্ম তৎপরতা ও দায়িত্ববোধের কারণেই অল্প দিনের ব্যবধানে সমগ্র পৃথিবীর অর্ধেক অংশ মুসলিমদের অধীনতা স্বীকার করেছিল, এটা সর্বজন বিদিত ইতিহাস হওয়ার পরেও ছাহাবীদের নির্বুদ্ধিতাকে কাজে লাগিয়ে ইয়াহুদীরা হাদীছ জাল করার সুযোগ লাভে সক্ষম হয়েছিল এ অভিযোগ কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বরং আল-কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত যে, কাফিরদের ব্যাপারে শক্ত অবস্থান অবলম্বন ও সচেতন থাকাই ছিল ছাহাবী রাদি আল্লাহু আনহুমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুতরাং যুক্তিতর্ক, বাস্তবতা, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভংগি সকল দিক থেকেই আবূ রায়য়্যাহর অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। তিনি মূলত ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতের ক্রীড়নক হয়েই ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, ইসলাম বিদ্বেষীদের হাতে নিজের মস্তিষ্ক বিক্রয় করার কারণে তিনি এ সব আজেবাজে ভিত্তিহীন কথাবার্তা উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তার এ ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে সকলের সচেতন থাকা উচিত।
৪.১.৩.২ আত-তাবীব মুহাম্মাদ তাওফীক (মৃত্যু ১৩৩৮ হি:)
তিনি পেশাগত দিক থেকে একজন ডাক্তার ছিলেন। তিনিও হাদীছকে অস্বীকার করতেন। এ প্রসঙ্গে মিশরের ‘আল-মানার’ পত্রিকায় ‘‘আল-ইসলাম হুওয়াল কুরআনুল কারীম ওয়াহদাহু’’ শিরোনামে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি হাদীছের বিরুদ্ধে শক্ত ভাষায় বিষোদগার করেন। তাঁর লেখার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে-
ক. হাদীছ সন্দেহাতীত নয়। বরং সন্দেহযুক্ত। আর সন্দেহযুক্ত কোন কিছু আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং হাদীছও গ্রহণযোগ্য নয়।
খ. হাদীছে মিথ্যা ও জাল অনুপ্রবেশ করেছে। মিথ্যা ও জাল কোন কিছু ইসলামের উৎস হতে পারেনা। গবেষকদের মতে জাল হাদীছের সংখ্যা, বিশুদ্ধ হাদীছের চেয়ে বেশি। এটা কি বিবেকসম্মত যে, আল্লাহ বিশ্ব নিখিলের জীবন বিধানকে এ কিছুর উপর ভিত্তি দান করলেন যার সত্য মিথ্যা নিরূপণ করা অসম্ভব। আসলে তার এ দাবী অযৌক্তিক। বিশুদ্ধ হাদীছ যে সন্দেহাতীতভাবেই বিশুদ্ধ তা আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিদগ্ধ মুহাদ্দিছগণ জাল হাদীছ থেকে বিশুদ্ধ হাদীছতে স্পষ্টাকারে বেছে পৃথক করেছেন, আমাদের নিকট বিশুদ্ধ হাদীছে গ্রন্থাবলীই তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ। এর পরেও তার এ অসার বক্তব্যের কোন মূল্য রয়েছে কি?
৪.১.৩.৩ ডক্টর ইসমাঈল আদহাম (মৃত্যু: ১৯৫০)
তুরস্কের বংশোদ্ভুত এ লেখক মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ‘মাছাদিরুত তারিকুল ইসলামী’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি হাদীছ বর্জনের বক্তব্য স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন। তাঁর ভাষায়- ছাহীহ গ্রন্থসমূহে যে সমস্ত হাদীছ একত্রিত হয়েছে তার ভিত্তি সুদৃঢ় নয়। বরং এগুলো সন্দেহ ও সংশয়পূর্ণ। উল্লেখ্য যে, মুহাদ্দিছদের নিরলস প্রচেষ্টা, যুক্তিযুক্ত ও যথার্থ পদ্ধতি এবং বিজ্ঞানসম্মত পন্থা অবলম্বনের কারণে এখন সন্দেহমুক্ত হাদীছ একেবারেই পৃথক করা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং হাদীছ সন্দেহযুক্ত সন্দেহে সকল হাদীছ বর্জন করা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
৪.১.৩.৪ কবি আহমাদ যাকী আবূ শাদী (মৃত্যু: ১৯৫৫)
মিশরীয় এ কবি তাঁর ‘ছাওরাতুল ইসলাম’ শীর্ষক গ্রন্থে হাদীছ সম্পর্কে খুবই আপত্তিকর কিছু কথা-বার্তা উত্থাপন করেন। মিথ্যার ছড়াছড়িতে পরিপূর্ণ এ বইটি। এ বইতে তিনি হাদীছ ও হাদীছ সংকলকদের কঠোর ভাষায় বিদ্রুপ করেছেন। যেমন তার ভাষায়-
ক. সুনানু ইবনু মাজাহ, আল-বুখারী এবং সমগ্র হাদীছের গ্রন্থসমূহ এমন সব হাদীছ ও সংবাদে পরিপূর্ণ, যা কোন বিবেক ছাহীহ বলে গ্রহণ করতে পারে না । এর অধিকাংশই ইসলাম, মুসলিম ও নবীদের নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপে পরিপূর্ণ, যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলে আমরা কখনোই গ্রহণ করতে পারি না।’’
খ. আবূ হুরাইরা, আনাস ইবন মালিক ও আব্দুল্লাহ ইবন ‘আববাস রাদিআল্লাহু আনহুম প্রত্যেকেই হাদীছ জাল করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা পাশ্চাত্যের ইসরাঈলিয়াত দ্বারা প্রভাবিত। আসলে আবূ শাদীর এ কথাগুলো ডাহা মিথ্যা কথা। এ সব প্রখ্যাত ছাহাবী রাদি আল্লাহু আনহুম জাল হাদীছ রচনা করেছেন, তারা ইসলাম, মুসলিম ও নবীদের নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছেন এর কি কোন প্রমাণ রয়েছে? এ সব অভিযোগ অসত্য, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। তাঁদের ব্যাপারে এ অযৌক্তিক বিষোদগার শুধু ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকেই সম্ভব, যার উত্তর দেয়ারও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
৪.১.৩.৫ আহমাদ আমীন (মৃত্যু : ১৯৫৪)
তিনিও হাদীছ অস্বীকারকারী ছিলেন। তাঁর মতে, হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগেই জাল হওয়া শুরু হয়। তা না হলে, জাল হাদীছ রচনাকারীকে রাসূলুল্লাহ জাহান্নামের অধিবাসী হওয়ার কথা উল্লেখ করতেন না। ছাহাবীগণই বেশি বেশি হাদীছ জানতেন। তাঁদের মারা যাওয়ার কারণে হাদীছের সংখ্যা দিন দিন কম হওয়ার কথা ছিল; তা না হয়ে খুলাফায়ে রাশিদূনের আমলের চেয়ে উমাইয়া যুগে হাদীছ বেশি দেখা গেছে। একই ভাবে উমাইয়া যুগের চেয়ে আববাসীয়াহ যুগে হাদীছের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মুহাদ্দিছদের নিরলস প্রচেষ্টা ও যুক্তিযুক্ত যথার্থ পদ্ধতি অবলম্বনের কারণে এখন সন্দেহমুক্ত হাদীছ একেবারেই পৃথক করা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং জাল হাদীছের সংখ্যাধিক্য বিশুদ্ধ হাদীছ পরিপালনের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধক হতে পারে না। সে জন্য জাল হাদীছের সংখ্যাধিক্যের অজুহাতে বিশুদ্ধ হাদীছকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোন সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন যে-
وفي الحق أن المحدثين عنوا عناية كبيرة بالنقد الخارجي ولم يعنوا هذه العناية بالنقد الداخلي، فقد بلغوا الغاية في نقد الحديث من ناحية رواته جرحا وتعديلا، فنقدوا رواة الحديث في أنهم ثقات أو غير ثقات، وبينوا مقدار درجتهم في الثقة وبحثوا هل تلاقى الراوي والمروي عنه أو لم يتلاقيا، وقسموا الحديث باعتبار ذلك ونحوه إلى حديث صحيح وحسن وضعيف، وإلى مرسل ومنقطع، وإلى شاذ وغريب وغير ذلك.
‘এটি সত্য যে, মুহাদ্দিছগণ বাহ্যিক যাচাই বাছাইকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন যেমনটি তারা অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে দেননি, তারা হাদীছকে তার বর্ণনাকররীর জারহ ও তা’দীল বিষয়ে যাচাই এর ক্ষেত্রে শীর্ষে পৌঁছিয়েছিলেন। তারা হাদীছের বর্ণনাকারীর গ্রহণযোগ্যতা অথবা অগ্রহণযোগ্যতা এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতার স্তর নির্ণয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। বর্ণনাকারী যার থেকে বর্ণনা করেছেন, তার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা, উভয়ে কখনো মিলিত হয়েছিলেন কিনা; সে বিষয়ে তারা গবেষণা করেন। এই প্রেক্ষাপটে হাদীছকে তারা ছাহীহ, হাসান, দুর্বল, মুরসাল, মুনকাতি শায ও গারীব হিসেবে ভাগও করেছেন।’’ এখানে তিনি স্পষ্টত: হাদীছের ভাষ্য বাস্তবতার সাথে কতটুকু সঙ্গতিশীল তা বিবেচনায় এনে হাদীছকে যাচাই বাছাই না করার জন্য মুহাদ্দিছগণকে দোষারূপ করেছেন। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে হাদীছ শাস্ত্রকে বিতর্কিত করা।
আসলে তার এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। মুহাদ্দিছগণ যেমনটি সানদ নিয়ে পর্যালোচনা করে হাদীছের মান নির্ণয় করেছেন তেমনটি হাদীছের মাতন (মূল ভাষ্য) নিয়েও তারা পর্যালোচনা করেছেন। শাযকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। আশ-শায ফিস সানদ এবং আশ-শায ফিল মাতান। মুহাদ্দিছগণ হাদীছের মূল টেক্স (المتن) নিয়ে মোটেও যাচাই বাছাই করেননি, এই অভিযোগ ঠিক নয়। তিনি মূলত এ দুটি বিষয় অবতারণার মাধ্যমে হাদীছের ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টিরই অপচেষ্টা চালিয়েছেন, যা সঠিক তথ্য নির্ভর নয়।
৪.১.৩.৬ মুহাম্মাদ আবূ ইয়াযীদ আল দামানহুরী
তাঁর দৃষ্টিতে হাদীছ হচ্ছে মুসলিমদের জন্য এবং ইসলামের জন্য একটি মুছিবত। তিনি এ বিপদ থেকে মুক্তির জন্য হাদীছগুলো পুড়িয়ে ফেলাই উত্তম বলে ঘোষণা দিয়েছেন। মানুষদেরকে হাদীছের অনিষ্টতা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি প্রথমে আল বুখারী, তারপর মুসলিম তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য হাদীছ পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দেন।
এ বক্তব্য আবূ ইয়াযীদ আল দামানহুরীর ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হাদীছ আসলে এ উম্মাহর জন্য এক বিশাল নিয়ামাত। হাদীছের অনুপস্থিতিতে এ উম্মাহ এক সেকেন্ডের জন্যও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। যারা এটাকে ইসলামের জন্য মুছিবত বলে পুড়িয়ে ধ্বংস করার পরামর্শ দেন তারা এ উম্মাহর শত্রু। উম্মাহকে বিপাকে ফেলে শত্রুদেরকে খুশী করাই তাদের উদ্দেশ্য।
৪.১.৩.৭ ড. আহমাদ সুবহী মানসূর : (জন্ম ১৯৪৯)
তিনি ১৯৪৯ সালের ১লা মার্চ মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি আল-আযহারে প্রথমত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হাদীছ অস্বীকার করার দায়ে তাকে সেখান থেকে বহিস্কার করা হয়। ১৯৭৭ সাল হতে তিনি আল-কুরআনই ইসলামের একমাত্র উৎস; এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হন। সেই সময় হতেই তিনি হাদীছ বিরোধী তৎপরতার সাথে জড়িত। বহুদিন ধরে বিভিন্নভাবে প্রবন্ধ, পুস্তক, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে এই জঘন্য চিন্তা চেতনা সম্প্রসারণের কাজে তিনি লিপ্ত রয়েছেন। তিনি কিছুদিন যাবৎ মিশরের ইবন খালদুন সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। সরকার উক্ত সেন্টার বিলুপ্ত করার পর, তিনি বহিস্কৃত হয়ে আমেরিকাতে পাড়ি জমান। ২০০৪ সাল থেকে তিনি ইন্টারনেটে তার এই হাদীছ বিরোধী লেখনি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে হাদীছকে অস্বীকার করেছেন, তার আল-মুসলিমূল আছী গ্রন্থটি হচ্ছে এর প্রামাণ্য দলিল।
৪.১.৩.৮ নাছর হামিদ আবূ যায়িদ: (জন্ম ১৯৪৩)
১৯৪৩ সালের ১০ই জুলাই তিনি মিশরের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি মূলত: একজন ভাষা বিজ্ঞানী। প্রথমে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন ভাষাতত্ত্বেরও শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে তিনি হল্যান্ডের লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিভিন্ন পুরস্কারেও পুরস্কৃত হয়েছেন।
১৯৯৫ সালে যখন তিনি অধ্যাপক হওয়ার জন্য তার গবেষণাকর্ম নির্ধারিত পর্ষদে পাঠান, তখন তাকে অধ্যাপক পদ দেয়া হয় ঠিকই; তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাকে কাফির বলে আখ্যায়িত করে, তাকে দেশ থেকে বহিস্কৃত করা হয়। মূলত: তার এই গবেষণাকর্ম ছিলো ইসলামের মূল দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক। মিশরের খ্যাতনামা বিদ্বান যেমন আব্দুছ ছাবুর শাহীন, ড. মুহম্মদ বুলতাজী, ড. আহমাদ হায়কাল, ড. ইসমাঈল সালিম প্রমুখ ব্যক্তিত্বও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন লেখা লেখেন। মূলত: আবূ যায়িদের অধিকাংশ লেখনীতে ইসলামের চিন্তা চেতনাকে আক্রমণ করা হয়েছে। বিশেষ করে তিনি আল-কুরআনকে সমালোচনার ক্ষেত্রে ইসলামী বিদ্বেষী পাশ্চাত্য মনীষীদের দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে অনেক ইসলাম বিরোধী প্রতিষ্ঠান তাকে বিভিন্ন পদকে সম্মানিত করেছে। তিনি মূলত: কুরআনের মতই হাদীছকেও অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।
৪.১.৪ পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপ-মহাদেশে হাদীছ বিরোধী আন্দোলন ও এর প্রবক্তাগণ
হাদীছ অস্বীকার করার এ প্রবণতার বিরুদ্ধে ইসলামের বিদগ্ধ মনীষীগণের শক্ত অবস্থানের কারণে সমগ্র বিশ্বে ইসলাম বিদ্বেষীদের প্রপাগান্ডা অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। একপর্যায়ে পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশ ইংরেজদের উপনিবেশিক শাসনে চলে যায়। এদেশে ইংরেজরা তাদের এ শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী করার জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে অসংখ্য জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ইসলামের মূল উৎস সম্পর্কে তাদের মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি ছিল সেগুলোর অন্যতম। এ বিষয়ে তারা সুনিপুণ কর্মসূচী গ্রহণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় তথাকথিত একশ্রেণীর মুসলিমকে তারা নিজেদের বশিভূত করে ফেলে। হাদীছের বিরুদ্ধে তাদেরকে ব্যবহার কারার সুবর্ণ সুযোগ তারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তারা একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহলকে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে হাদীছ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় করে তোলে। তাদের মূল দর্শন ছিল, ইসলামের জন্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মত শাশ্বত উৎসই যথেষ্ট। এর জন্য হাদীছ মূল্যহীন, হাদীছের কোন প্রয়োজন নেই। তারা বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যাতে মুসলিমদের মনে হাদীছের প্রতি সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়, তার অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের অনেকেই ইংরেজদের ফাঁদে পা দিয়ে হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের জঘন্য কর্মকান্ডসহ এ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে উপস্থাপন করা হল।
৪.১.৪.১ স্যার সাইয়িদ আহমাদ (মৃত্যু ২৭, মার্চ, ১৮৯৮ খৃ:)
পাশ্চাত্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত স্যার সাইয়িদ আহমাদ খান ইবন আহমাদ মির আল-মুত্তাকী ইবন ’ইমাদুদ্দীন আল-হুসায়নী ১৮১৭ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ প্রতিভার অ©র্ধকারী, তিনি ছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ইংরেজদের বড় দালাল, তাদের স্বার্থ সংরক্ষনে খুবই তৎপর। ইসলাম, কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী ‘আকীদাহ বিশ্ব^াসের বিরুদ্ধে তাঁকে ইংরেজরা এমনভাবে ব্যবহার করে যে, তিনি ইসলামের ছদ্মাবরণে ইসলামের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছেন। তিনি কুরআনের অপব্যাখ্যা করেছেন। জিন, ফেরেস্তা, শয়তানের মত অদৃশ্য বিষয়কে তিনি অস্বীকার করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে, আল্লাহ শুধু কুরআনের অর্থকেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন, ভাষাকে নয়। সেই অর্থকে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের ভাষায় রূপদান করেছেন। সুতরাং কুরআনের ভাষা আল্লাহর ভাষা নয়। হাদীছের ব্যাপারে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য হচেছ, হাদীছ দীর্ঘদিন লিপিবদ্ধ না হওয়ায় সেখানে অনেক কিছু সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন সংঘটিত হয়েছে। এমনকি অনেকেই জাল হাদীছ রচনা করার কারণে, হাদীছ সন্দেহ ও সংশয় মুক্ত নয়। সে জন্য নির্ভেজাল কুরআনই ইসলামী জীবন বিধানের একমাত্র উৎস। কোন ক্রমে ইসলামের গ্রহণযোগ্য উৎস হওয়ার যোগ্যতা হাদীছের নেই। পবিত্র হাদীছের প্রতি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সন্দেহ, সংশয় ও বিভাজন সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি হাদীছ গ্রহণের এমন কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করেন, যার মানদন্ডে কোন হাদীছই যাতে গ্রহণযোগ্য হওয়ার সুযোগ লাভ না করে। হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করার পাকা পোক্ত ব্যবস্থা করতে তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তির ছত্রছায়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তিনি হাদীছের বিরুদ্ধে এ জঘন্য ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে হাদীছ গ্রহণযোগ্য হওয়ার তিনটি শর্ত হচ্ছে-
১. হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভাষায়ই বর্ণিত হতে হবে এবং তা সন্দেহাতীত ভাবে বিশুদ্ধ প্রমাণিত হতে হবে।
২. বর্ণনাকারীর ভাষায় হাদীছের অর্থ বর্ণিত হলে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
৩. কোন হাদীছের ব্যাখ্যায় ইসলামের বিদগ্ধ পন্ডিতগণের মধ্যে দ্বিমত সৃষ্টি হলে, সে হাদীছও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।
আসলে এ তিনটি শর্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ছিহাহ সিত্তাহ এমনকি ছাহীহ আল-বুখারী ও ছাহীহ মুসলিম শরীফের মত হাদীছ গ্রন্থের একটি হাদীছও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। উল্লেখ্য যে, কোন মুতাওয়াতির হাদীছও তাঁর এ শর্ত পরিপূর্ণ করে গ্রহণযোগ্য হাদীছ হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে না। সুতরাং তাঁর এ শর্তাবলীতে উত্তীর্ণ হাদীছ গ্রহণযোগ্য বিবেচনার অর্থই হচ্ছে, এ মানদন্ডের কোন হাদীছ যেহেতু নেই, সেহেতু কোন একটি হাদীছও অনুসরণ যোগ্য নয়। অন্য কথায়, তাঁর এ দর্শনই হচ্ছে, সমগ্র হাদীছকে অস্বীকার করারই বুদ্ধিবৃত্তিক ষড়যন্ত্র। তিনি মূলত সমগ্র হাদীছ অস্বীকারকারী। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে হাদীছ অস্বীকার করার যে জঘন্য প্রবণতা শুরু হয়, তিনি তারই মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। কুরআনের প্রতি অতিশয় আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ছদ্মাবরণে তাঁর এ হাদীছ বিদ্বেষী অবস্থান, এ ভূখন্ডের মুসলিম উম্মাহকে যে দ্বিধা বিভক্ত হওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল, তা থেকে ইংরেজরাই মূলত লাভবান হয়েছে।
৪.১.৪.২ ‘আবদুল্লাহ জিকরালবী
পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে হাদীছ বর্জন আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত হচ্ছেন পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের জিকরালাহ শহরে জন্মগ্রহণকারী ‘আবদুল্লাহ ইবন আব্দুল্লাহ জিকরালবী। ইংরেজ ষড়যন্ত্রে বিভ্রান্ত এ ব্যক্তি মূলত হাদীছ অস্বীকার করার বিষয়ে স্যার সাইয়িদ আহমাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সমগ্র হাদীছকে অস্বীকার করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আহলুয যিকর ওয়াল-কুরআন’ নামে একটি পথভ্রষ্ট সংগঠনের ছত্রছায়ায় তিনি ও তাঁর সহযোগীরা জোরালোভাবে হাদীছ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। তাঁর এ আন্দোলনের প্রতিপক্ষ হিসেবে সেই সময় ইসলামের প্রসিদ্ধ আলিমগণ কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা ‘ইশা‘আতে সুন্নাত, নামে একটি নিয়মিত পত্রিকার মাধ্যমে আবদুল্লাহ জিকরালবীর বিভ্রান্তিমসূহকে মুসলিম উম্মাহর নিকট তুলে ধরেন। তাঁরা তাকে কাফির বলে ফাতওয়া দেন। এ পথভ্রষ্ট ইংরেজদের হাতের ক্রীড়নক হয়ে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তেই মৃত্যুবরণ করেন। হাদীছকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে তিনি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ বপন করেন, তা ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের দুশমনদের শক্ত আঘাত হানার পথকেই উন্মুক্ত করেছে।
৪.১.৪.৩ খাজা আহমাদ উদ্দীন অমৃতসরী
খাজা আহমাদ উদ্দীন ইবন খাজা মিয়া মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবরাহীম ছিলেন ভারতের অমৃতসরে জন্মগ্রহণকারী । তিনি পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের হাদীছ অস্বীকারকারী পূর্ববর্তী দুই নেতা স্যার সাইয়িদ আহমাদ ও আবদুল্লাহ জিকরালবীর চিন্তা চেতনা দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। তিনি আব্দুল্লাহর সাথে প্রায়ই সাক্ষাত করতেন। উম্মাতে মুসলিমাহ নামক একটি দল গঠন করে তিনি তাঁর এ হাদীছ বিরোধী তৎপরতা জোরদারের ব্যবস্থা করেন।
৪.১.৪.৪ গোলাম আহমাদ পারভেজ
গোলাম আহমাদ পারভেজ ইবনে ফাদলে দীন ইবন রাহীম বাখশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীছ অস্বীকারকারী হিসাবে এমন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন যে, হাদীছ বিরোধীগণই তাঁর দিকে সম্বোধিত হয়ে ‘পারভেজিয়ীন’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। ‘তুলু‘ই ইসলাম’ নামে তিনি একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করে তার মাধ্যমে হাদীছ বিরোধী এ চিন্তা চেতনার সম্প্রসারণ ঘটানোর প্রচেষ্টা চালান। পরবর্তীতে ‘নাদী তুলুই ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা হাদীছ বিরোধী আন্দোলনে খুবই সোচ্চার ছিল। হাদীছ বিরোধী আন্দোলনের পূর্ববর্তী প্রবক্তারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সব কিছুই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে থাকার কারণে কুরআনকেই ইসলামের একমাত্র উৎস মনে করে হাদীছকে অস্বীকার করার দাবী করেন। পক্ষান্তরে গোলাম আহমাদ পারভেজ তদানিন্তন শাসক গোষ্ঠির আনুকূল্য লাভের জন্য, হাদীছ অস্বীকার করার সাথে সাথে কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রজাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য শাসক গোষ্ঠির একচ্ছত্র কর্তৃত্বের বৈধতা দানের ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা দেয়ার যোগ্যতা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নেই বলেই একদিকে হাদীছ অস্বীকার করতেন, অপর দিকে স্বয়ং নিজেই কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা দিতেন, যা মূলত রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদেরকে খুশী করত। তাদের পক্ষ থেকে প্রজাদেরকে শায়েস্তা করাকে বৈধতা দিতেও তিনি কার্পণ্য করতেন না।
যাই হোক, তিনি ও তাঁর অনুসারীদের এ জঘন্য দর্শনের বিরুদ্ধে ইসলামের তদানিন্তন প্রসিদ্ধ আলিমগণ জোরালো ভূমিকা পালন করেন। আল্লামা মাওদূদী রাহিমাহু আল্লাহ এর মত প্রথিতযশা মনীষীও এ বাতিল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বিশ্বের সেই সময়ের ইসলামী মনীষীগণ পারভেজের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ফাতওয়া দেন। তাঁরা ঘোষণা করেন যে, তিনি ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, তিনি মূলত কাফির, তাঁর অনুসারীও কাফির।
৪.১.৪.৫ আব্দুল খালিক মালওদাহ
হাদীছ অস্বীকারকারীদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন, আব্দুল খালিক মালওদাহ। তাঁর কর্মকান্ড দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, তিনি গোলাম আহমাদ পারভেজ দ্বারা প্রভাবিত। তবে তিনি হাদীছ অস্বীকারকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা না করে ‘তাহরীকে তা’মিরে ইনসানিয়াত’ নামে নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পৃথক ভাবে এটি কেন করলেন, তার সঠিক কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হওয়ায় অঢেল অর্থ খরচের বিনিময়ে নিজের পরিচিতি বিস্তৃতির জন্য একই উদ্দেশ্যে একটি ভিন্ন নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলে মনে করা হয়। তাঁর এ সংগঠন পূর্ববর্তী সংগঠনের মত তেমন ব্যাপকতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি।
যাই হোক, পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে পবিত্র হাদীছ অস্বীকারকারীদের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত কিছু ইসলাম বিরোধীদের কর্মতৎপরতার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র এখানে উপস্থাপন করা হল। উল্লেখ্য যে, হাদীছ ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদ্বেষী এ সব ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের তদানিন্তন ইসলামের বড় বড় পন্ডিতদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের কারণে তাদের এ হাদীছ বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়। দুঃখের বিষয় হল, তাদের এ তৎপরতা তেমন ব্যাপকতা লাভ না করলেও তাদের বেশ কিছু অনুসারী এ ভূখন্ডে আজও সক্রিয় রয়েছে। তারা তাদের এ মতামতকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপতৎপরতা আজও চালিয়ে যাচ্ছে। কুরআনের খুব একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করে তারা মূলত: ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজেই নিয়োজিত রয়েছে। এরা ইসলামের শত্রুদের হাতের পুতুল। এরাও ইসলামের শত্রু, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শত্রু, হাদীছ বিদ্বেষী।
এখানে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের অনুসারীরা খারিজী সম্প্রদায়ের মতই সমগ্র হাদীছকেই অস্বীকার করেছেন। বর্তমান যুগেও আমাদের দেশে কিছু লোকজন দেখা যায়, যারা হাদীছকে তেমন গুরুত্ব দেন না। তারা কিছু কিছু হাদীছকে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অস্বীকার করার ধৃষ্টতাও দেখান। হাদীছকে নতুন ভাবে যাচাই বাছাই করার আহবান জানাতেও তারা দ্বিধা করেন না। আসলে সানদ ও মাতন গবেষণা করে হাদীছ যাচাই বাছাই করার সুযোগ এখনো সবার জন্য অবারিত রয়েছে। তাই বলে, বস্ত্তনিষ্ঠ ভাবে হাদীছ যাচাই বাছাই না করে বিভিন্ন অজুহাতে কিছু কিছু হাদীছ বর্জনের জন্য পুনর্বিবেচনার দাবী সত্যই রহস্য জনক। আসলে তাদের এ ভূমিকা ইসলামের জন্য সুখকর নয়। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস অতি গুরুত্বপূর্ণ এ হাদীছ নিয়ে টালবাহানা, ইসলামের দুশমনদের পাতানো ফাঁদে পা দেয়ার নামান্তর কি না, তাও গভীর ভাবে অনুধাবন করা জরুরী।
৪.১.৫ সকল হাদীছকে অস্বীকার করার বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
এক শ্রেণীর লোক সম্পূর্ণ হাদীছকে অস্বীকার করেছেন। তারা কিছু বিভ্রান্তিমূলক প্রমাণাদিও উপস্থাপন করেছেন। তারা হাদীছের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন। তাদের এ সব বিভ্রান্তি অপনোদন হওয়া খুবই জরুরী। এখানে তাদের সেই বিভ্রান্তিগুলোকে তুলে ধরে তা উন্মোচন করা হল-
প্রথম বিভ্রান্তি : আল-কুরআনেই সবকিছু বিদ্যমানঃ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ
‘আমি প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ কিতাব তোমার উপর অবতীর্ণ করলাম।’ সুতরাং তাদের ভাষায় স্পষ্টত ব্যাখ্যাস্বরূপ আল-কুরআন অবশিষ্ট থাকার পর, হাদীছ একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। তিনি অন্যত্র আরো ইরশাদ করেছেন:
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ .
‘আমি কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেইনি।’ কুরআনে যেহেতু কোন কিছুই বাদ দেয়া হয়নি, তাদের ভাষায় সেহেতু আমাদের চলার জন্য কুরআনই যথেষ্ট, হাদীছ একেবারেই নিষ্প্রয়োজন।
প্রথম বিভ্রান্তির অপনোদন: এখানে তারা দুইটি আয়াতকে তাদের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন । তাদের বিভ্রান্তি উন্মোচনের জন্য আয়াত দুটির পৃথকভাবে আলোচনা হওয়া জরুরী।
প্রথম আয়াত সম্পর্কে ভ্রান্তি অপনোদন:
১. মূলত ইলম দুই প্রকার। একটি হচ্ছে, দীনী ইলম ও অপরটি দীন বহির্ভূত ইলম। দীন বহির্ভূত ইলম কুরআনে থাকার কথা নয়। সেখানে রয়েছে শুধু দীনী ‘ইলম। দীনী ইলম আবার দুই প্রকার: মূল ইলম ও প্রশাখা ইলম। কুরআনে সব কিছুর বর্ণনা রয়েছে দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, দীনী ইলমের সকল মূল বিষয় এখানে উল্লেখ রয়েছে, তবে দীনের শাখা-প্রশাখা জানার জন্য অবশ্যই কুরআনের বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনীয় বস্ত্তটিই হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ। সেই বাস্তবতার আলোকেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে-
عن المقدام بن معديكرب عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال : ألا إني أوتيت الكتاب ومثله معه لا يوشك رجل شبعان على أريكته يقول عليكم بهذا القرآن فما وجدتم فيه من حلال فأحلوه وما وجدتم فيه من حرام فحرموه ألا لا يحل لكم لحم الحمار الأهلي ولا كل ذي ناب من السبع...
‘সাবধান! আল-কুরআন ও তার মতই কিছু আমাকে দেয়া হয়েছে। নিকটতম সময়েই কোন পরিতৃপ্ত ব্যক্তি আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বলবে, এ আল-কুরআন পরিপালনই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। এর মধ্যে যা হালাল পাবে, তা হালাল বলে গণ্য করবে; এর মধ্যে যা হারাম পাবে, তা হারাম বলে গণ্য করবে। সাবধান! তারা গৃহপালিত গাধা, প্রতিটি নখর বিশিষ্ট হিংস্র প্রাণী... তোমাদের জন্য যেন হালাল না করে।’ এখানে কুরআনের মতই যা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়া হয়েছে, সেটিই হচ্ছে হাদীছ। যারা হাদীছের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুধু কুরআনকে অনুসরণ করে, তারা যে মারাত্মক বিভ্রান্তির ভেতরে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাও এখানে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তিনি এখানে তাদের থেকে সাবধানতা অবলম্বনেরও নির্দেশ দিয়েছেন।
২. কুরআনেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করারও নির্দেশ এসেছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, ওহী ব্যতীত কোন কিছু বলেন না, তাও সেখানে পরিষ্কার ভাষায় উল্লেখ হয়েছে; এ বক্তব্য মূলত হাদীছ যে শারী‘আতের উৎস তার প্রমাণ বহন করে। কুরআনে জাহান্নামের শাস্তির অনিবার্যতার অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ হয়েছে- وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ ‘এবং সে মু’মিনদের রাস্তা ব্যতীত অন্য রাস্তাকে অনুসরণ করে।’ অর্থাৎ মু’মিনরা যে রাস্তায় একত্রিত হয় সে রাস্তাই সঠিক রাস্তা। এ আয়াত ইজমা’ যে শারী‘আতের দলীল, তার ইংগিত দেয়। একই ভাবে ইসলামী শারী‘আতে ইজতিহাদও কুরআনের আলোকেই স্বীকৃত। সুতরাং কুরআনে সবকিছু বর্ণিত রয়েছে এর অর্থ হচ্ছে, হাদীছ, ইজমা ও ইজতিহাদকে কুরআনের ব্যাখ্যায় ব্যবহার করলে কুরআনে আর কোন কিছু অস্পষ্ট থাকবে না। ইসলামী শারী‘আতে হাদীছ, ইজমা ও ইজতিহাদ আল-কুরআন দ্বারাই স্বীকৃত। আর হাদীছ, ইজমা ও ইজতিহাদের উপর ভিত্তি করে ইসলামী শারী‘আতে যা কিছু স্থান পেয়েছে তা কুরআনের প্রত্যক্ষ ইংগিতেই স্থান পেয়েছে। সুতরাং তা কুরআনেই রয়েছে বলে ধর্তব্য। সে কারণে ইসলামী শারী‘আতের সব কিছু আল-কুরআনে রয়েছে বলে উল্লেখ হওয়ার অর্থ এ নয় যে, এ আয়াত শুধু কুরআনকেই ইসলামী শারী‘আতের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করে। যদি তাই হত, তাহলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করাকে আল-কুরআন এত গুরুত্বের সাথে নির্দেশ দিত না। কুরআনের এরূপ আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনায় আনা ঠিক নয়। সমগ্র কুরআনকে একত্রিত করে বুঝার চেষ্টা করলে কুরআনের আসল বক্তব্য অনুধাবন করা সম্ভব। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য, তাঁর দায়িত্ব, কুরআনের দৃষ্টিতেই তাঁর মূল্যায়ন প্রভৃতি আলোচনা যে সকল আয়াতে উল্লেখ হয়েছে যার কিছু আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি, তার সবগুলো একত্রিত করে অধ্যয়ন করলে হাদীছ বাদ দিয়ে শুধু আল-কুরআন মানার এ প্রবণতা যে একেবারেই ভ্রান্ত তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। বরং এ সব আয়াত পরিষ্কার ভাষায় হাদীছ পরিপালনের অনিবার্যতাকে জোরালোভাবে তুলে ধরে। যেমন আল্লাহর বাণী-
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ.
‘এবং আমি তোমার প্রতি আল-কুরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুষ্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যাতে তারা চিন্তা করে ।’
এ আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অন্যতম দায়িত্বই হচ্ছে, কুরআনের ব্যাখ্যাদান। এখানে উল্লেখিত আয়াত দ্বারা যদি একথা বুঝানো হয়ে থাকে যে, কুরআনে সবকিছু স্পষ্ট রয়েছে বলে এর কোন ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই, তা হলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল-কুরআন বুঝানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, এ ধরণের আয়াতের কি প্রয়োজন ছিল? মনে রাখা উচিত যে, এ আয়াতটিও কুরআনের অংশ, যে তা অস্বীকার করবে, সে সরাসরি কুরআনের অংশকেই অস্বীকার করল। তাছাড়া কুরআনের স্পষ্ট বক্তব্য থাকলেও তা আরো স্পষ্ট করার জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দায়িত্ব দেয়ায় অসুবিধা কোথায়? যাই হোক কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের ব্যাখ্যাদানকারী। সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ কুরআনের ব্যাখ্যা বিধায় কুরআনের এ আয়াতই তা মেনে চলার স্পষ্ট নির্দেশনা দান করে। সেই কারণে কুরআনের শুধু এ একটি আয়াতের দিকে তাকিয়ে কুরআনে সব কিছুর বর্ণনা আছে মনে করে, হাদীছ বর্জন করা স্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়।
দ্বিতীয় আয়াত সম্পর্কে ভ্রান্তি অপনোদন:
আল্লাহর বাণী ‘আমি কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেইনি।’ এ দ্বারা আল-কুরআনে সবকিছু রয়েছে বিধায় হাদীছ নিষ্প্রয়োজন এ ধারণা অবান্তর। এখানে মূলত কিতাব বলতে লাওহি মাহফুজকে বুঝানো হয়েছে, কুরআনকে নয়। অর্থাৎ লাওহি মাহফুজে কোন কিছুই সন্নিবেশিত হতে বাদ নেই, এ আয়াতের বক্তব্য এটাই। সুতরাং এ আয়াত দ্বারা কুরআনে সবকিছুই আলোচিত হয়েছে বলে হাদীছ নিষ্প্রয়োজন, এ দাবী কোন ক্রমেও সঠিক নয়। উল্লেখ্য যে, এ আয়াতটি হিজরাতের পূর্বে মক্কাতেই অবতীর্ণ হওয়া সূরাহ আল-আন‘আমেরই অন্তর্ভুক্ত। ইসলামের অধিকাংশ বিধি বিধান তো হিজরাতের পরে মদীনাতে অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে ‘কিতাব’ অর্থ যদি আল-কুরআন মনে করা হয়, তাহলে এ দ্বারা মদীনায় অবতীর্ণ কুরআনের অংশ ব্যতীতই মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনেই সব কিছু রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়। তাহলে মদীনায় অবতীর্ণ হওয়া কুরআনও তো তাদের দৃষ্টিতে হাদীছের মতই অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হওয়া দরকার ছিল; আর যদি তা-ই হত তাহলে আল-কুরআনের একটি অংশ অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হত, আর তা হতো একেবারেই অযৌক্তিক। সুতরাং সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণিত যে, এখানে কিতাবে সবকিছুই রয়েছে বলে যে উল্লেখ হয়েছে, তা দ্বারা মূলত লাওহি মাহফুজকেই বুঝানো হয়েছে, কুরআনকে নয়। সেজন্য অধিকাংশ তাফসীরকারকই এখানে ‘কিতাব’ বলতে লাওহি মাহফুজকেই বুঝিয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে এ আয়াত দ্বারা কুরআনে সব কিছু রয়েছে বলে প্রমাণ উপস্থাপন করে হাদীছ অস্বীকার করার কোন যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
অপরপক্ষে অগণিত আয়াতই তো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল কর্মকান্ড ও হাদীছ গ্রহণ ও অনুসরণ করাকে অপরিহার্য ঘোষণা করেছে। একইভাবে এসব আয়াত তো হাদীছ অস্বীকার করাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কারও করেছে, যা আমরা ইতোপূর্বেই আলোচনা করেছি। সুতরাং যারা এসব অযৌক্তিক প্রমাণাদি উপস্থাপন করে হাদীছকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায় তারা বিভ্রান্ত, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তারা এজন্যই ব্যর্থ হয়েছে যে একই বিষয়ে কুরআনের যত আয়াত এসেছে তা এক সাথে একত্রিত করে তারা তা অনুধাবনের চেষ্টা করে নি। আমাদের বিশ্বাস, যদি একই বিষয়ের সকল আয়াতকে সম্মুখে রেখেই হাদীছ অস্বীকারকারীরা আল-কুরআন বুঝার চেষ্টা করত, তাহলে তারা বিভ্রান্ত হতো না। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ পথভ্রষ্ট
বিভ্রান্তরা কুরআনের অনুসারী বলে দাবী করলেও, তারা আসলে কুরআনকে অনুসরণ করা থেকেও যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। তাহলে দিবালোকের মত পরিষ্কার হলো যে, এখানে উল্লেখিত আয়াত দুটি কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে হাদীছ বর্জন করার দলীল যথাযথ নয়।
দ্বিতীয় বিভ্রান্তি : রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও ভুলভ্রান্তি বিদ্যমান :
তাদের ভাষায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও ভুলভ্রান্তি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং হাদীছও ভুল হতে পারে। সেজন্য তা গ্রহণযোগ্য নয়। তারও যে ভুলভ্রান্তি রয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে-
ক. খেজুর বৃক্ষের নিষেককরণ (Fecundation)ঃ
তাদের ভাষায়, কখনো কখনো তাঁর দৃষ্টিভংগি যে ভুল ছিল, তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। যেমন তিনি খেজুর গাছের পুং কেশরকে স্ত্রী কেশরের সাথে মিলাতে নিষেধ করার কারণে ফলন কমে যাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, এটি তো আমি ধারণা করেই বলেছিলাম। আর ধারণা ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। যেমন এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
فإني إنما ظننت ظنا فلا تواخذونى بظنى
‘এটি ছিল আমার একটি ধারণা, আমার কোন ধারণার ব্যাপারে আমাকে ধরো না।’ সুতরাং যেহেতু তিনি ভুল করেন, সেহেতু তাঁর থেকে উৎসারিত কোন হাদীছের অনুসরণ অপরিহার্য হওয়া বাস্তব নয়।
আসলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ কথার বাস্তব রূপ উপলব্ধি করতে হলে, এ হাদীছের বিস্তারিত বর্ণনা অনুধাবন করা জরুরী। বর্ণনাটি হচ্ছে-
عن موسى بن طلحة عن أبيه قال مررت مع رسول الله -صلى الله عليه وسلم- بقوم على رءوس النخل فقال: ما يصنع هؤلاء. فقالوا يلقحونه يجعلون الذكر فى الأنثى فيلقح. فقال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- ما أظن يغنى ذلك شيئا. قال فأخبروا بذلك فتركوه فأخبر رسول الله -صلى الله عليه وسلم- بذلك فقال: إن كان ينفعهم ذلك فليصنعوه فإنى إنما ظننت ظنا فلا تؤاخذونى بالظن ولكن إذا حدثتكم عن الله شيئا فخذوا به فإنى لن أكذب على الله عز وجل.
‘মূসা ইবন তালহা তাঁর পিতা রাদী আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এ অবস্থায় যাচ্ছিলাম যে, একটি সম্প্রদায়ের লোকেরা খেজুর বৃক্ষের মাথায় কাজ করছিল। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তারা কি করছে? তারা বলল- তারা তালকীহ্ তথা খেজুর গাছের পুং কেশর স্ত্রী কেশরের সাথে মিলিয়ে নিষেক (Fecundation), বা গর্ভাধান করছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- আমি ধারণা করছি, এতে কোন লাভ নেই, তাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়ে দাও। তারা (এ কথা শুনে) এ কাজ বর্জন করল। এ বিষয়ে তাকে সংবাদ দেয়া হলে, তিনি বললেন- এ দ্বারা যদি তারা লাভবান হয়, তাহলে তারা এটা করবে, কেননা আমি এটা ধারণা করেছি, আর ধারণার বিষয়ে আমাকে পাকড়াও করো না। পক্ষান্তরে আমি আল্লাহ সম্পর্কে যা বলি, সে বিষয়ে আমাকে পাকড়াও করতে পার, আর আমি আল্লাহ সম্পর্কে মূলত কোন মিথ্যা বলি না।’
ভ্রান্তি অপনোদনঃ
একটু চিন্তা করলে এ হাদীছের আলোকে এ কথাই স্পষ্ট হয় যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই এখানে ঘোষণা দিয়েছেন, ওহীর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি ধারণার বশীভূত হয়ে কোন কিছু বলেন না। এখানে নিষেকের ক্ষেত্রে তিনি যা বলেছেন, তা ধারণার উপর ভিত্তি করে বলার স্বতস্ফূর্ত স্বীকৃতিও তিনি দিয়েছেন। সুতরাং এ কথা হাদীছ অস্বীকারকারীদের পক্ষের প্রমাণ নয় বরং তাদের বিপক্ষীয়দেরই প্রমাণ হতে পারে। কেননা এখানেও স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে, তিনি ধারণা করে কিছু বললে তা অনুসরণীয় না হলেও, ওহীর উপর ভিত্তি করে কিছু বললে তা অবশ্যই অনুসরণীয়। তাঁর হাদীছ যেহেতু কুরআনের দৃষ্টিতেই ওহী সেহেতু তা অবশ্যই ভুল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে। আর ভুল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে হওয়ার কারণেই তাঁর হাদীছ অবশ্যই অনুসরণীয়। ধারণার উপর ভিত্তি করে বিশেষ একটি বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সিদ্ধান্ত দিলেন। তার এ সিদ্ধান্ত ওহী ভিত্তিক ছিল না বলে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়ার পরেও, এ ঘটনাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে তাঁর জীবনের হাজার হাজার ওহী ভিত্তিক হাদীছকে অস্বীকার করা কস্মিন কালেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি স্পষ্টত একটি বিভ্রান্তি। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও ভুল করেন’ এটা প্রমাণের জন্য তারা একটি হাদীছের উপরই নির্ভর করেছেন, যে হাদীছকেই তারা অস্বীকার করেন, এটা একটা হাস্যকর ও স্ববিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ দলীল দ্বারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ অস্বীকার করা একেবারেই অযৌক্তিক। বরং হাদীছও একদিকে যেমন ওহী ভিত্তিক তারও প্রমাণ অপরদিকে হাদীছও ওহী হওয়ার কারণে তা অবশ্যই অনুকরণীয় এ হাদীছ তারও জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।
খ. বদর যুদ্ধে মুসলিম সৈন্যের স্থান নির্ধারণঃ
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের যুদ্ধে মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য একটি স্থান নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে জনৈক ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহু তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ স্থান কি আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছে, না এটি আপনার নিজস্ব মত? তিনি বললেন- এটি আমার নিজস্ব মত। তখন উক্ত ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহু অন্য একটি স্থানকে যুদ্ধ কৌশলের জন্য আরো উত্তম বলে পরামর্শ দিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা গ্রহণ করলেন। সে অনুযায়ী তিনি ছাহাবীর পরামর্শ দেয়া স্থানেই সৈন্য সমাবেশ করেন। এ ঘটনা তাদের ভাষায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন তার প্রমাণ। সুতরাং তাঁর হাদীছও নির্ভুল হবে না এটাই স্বাভাবিক।
ভ্রান্তি অপনোদন:
এ ঘটনায় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট করেই বললেন যে, এটি ওহী নয়, এটি আমার নিজস্ব মত। এ দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এটা ছিল একটা পার্থিব বিষয়, যা ওহী সংশ্লিষ্ট নয়। সুতরাং এটি ওহী ছিল না। তাঁর জীবনের পার্থিব বিষয়ের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনের অসংখ্য হাদীছ যা ওহী, যা নির্ভুল বলে প্রমাণিত; তাকে অস্বীকার করা কোন ক্রমেও যৌক্তিক হতে পারে না। এ ঘটনা কুরআনে উল্লেখ হয়নি। যেহেতু ঐ পক্ষ আল-কুরআন ব্যতীত অন্য কিছুকে মানে না, সে জন্য এ ঘটনাকে তাদের পক্ষের দলীল হিসাবে উপস্থাপন করার কোন অধিকারও তাদের নেই। পার্থিব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহুর পরামর্শ নিয়েছেন। নিজের মতের উপর দৃঢ় না থেকে, তাদের পরামর্শ বাস্তবায়ন করেছেন। এটি মূলত ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় যে পরামর্শকে অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তারই প্রমাণ বহন করে। নিজেই নিজস্ব মতের চেয়ে অন্যের মতকে উত্তম মনে করে গ্রহণ করার অর্থ এ নয় যে, তিনি ভুলের মধ্যে থাকার কারণেই অন্যের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সুতরাং ইহলৌকিক বিষয়ের এ ঘটনাকে খালিছ ওহী অর্থাৎ হাদীছ অস্বীকার করার দলীল হিসাবে উপস্থাপন করা সঠিক নয়।
গ. বদরের যুদ্ধবন্দিদের সাজা প্রদানঃ
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের যুদ্ধবন্দিদের সাজা কি হবে, এ প্রসংগে ছাহাবীদের পরামর্শ আহবান করেন। ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহু এদেরকে হত্যা করার পরামর্শ দিলেন। আবু বাকর রাদি আল্লাহু ‘আনহু অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্ত করার পক্ষে মত দিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বাকর রাদি আল্লাহু ‘আনহু এর মত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহু এর মতের পক্ষেই আল-কুরআন অবতীর্ণ হলো। তিনি সে ওহী অনুযায়ী তাদের সাজা বাস্তবায়ন করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মতকে গ্রহণ করেছিলেন আল-কুরআন তার বিপরীত অবতীর্ণ হওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, তাঁর মত সঠিক ছিল না। যেহেতু তাঁর মত সঠিক না হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেল, সেহেতু তাঁর হাদীছও সন্দেহমুক্ত নয়। সে কারণে তাঁর হাদীছ আমল করা অপরিহার্য নয়।
ভ্রান্তি অপনোদন:
আসলে পূর্ববর্তী ঘটনাটি তো হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। এটা হাদীছ অস্বীকারকারীদের পক্ষে দলীলই হতে পারে না। তারপরেও গভীরভাবে অনুধাবন করলে পরিষ্কার হয় যে, এটি হাদীছ অনুসরণকে যারা অপরিহার্য মনে করেন, তাদের পক্ষেরই দলীল। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দীনী বিষয়ে কোন কিছু ভুল করলে, আল্লাহ তাঁকে সাথে সাথে ওহীর মাধ্যমে সংশোধনের ব্যবস্থা করেন, এ ঘটনা তার জাজ্জ্বল্য প্রমাণ। সুতরাং কোন দীনী বিষয়ে ভুলের উপর তাঁর প্রতিষ্ঠিত থাকার কোন সুযোগই ছিল না। এমন কি দীনের অপরিহার্য অংশ নয়, এমন কোন ক্ষেত্রেও তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিলে, তাও ওহীর দ্বারা সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এ ঘটনা তারই দলীল। অন্য ঘটনা হচ্ছে তাঁর নিজের স্ত্রীকে খুশী করার জন্য একটি হালালকে নিজের জন্য হারাম করার শপথ নেয়ার ঘটনা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন-
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللّهُ لَكَ تَبْتَغِي مَرْضَاةَ أَزْوَاجِكَ وَاللّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
‘হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তা নিষিদ্ধ করছ কেন? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাচ্ছো, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ এ আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, তাঁর কোন ভুল অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। সেজন্য তাঁর হাদীছ যে সন্দেহমুক্ত তা সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণিত। সেই কারণেই হাদীছ অনিবার্য পালনীয়। একে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং বদরের যুদ্ধবন্দির ঘটনা বিপক্ষীয় দলের স্বপক্ষের দলীল হতে পারে না। পরিশেষে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবনেও ভুলভ্রান্তি লক্ষ্যণীয় প্রমাণের মাধ্যমে যারা হাদীছ অস্বীকার করার যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছে, মূলত এ বিষয়ে তাদের স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণেই তা করেছে। এগুলো, আসলে তাদের বিপক্ষীয়দের দলীল। এগুলো বরং হাদীছ পরিপালন যে অপরিহার্য সেই বাস্তবতারই জ্বলন্ত প্রমাণ।
তৃতীয় বিভ্রান্তি : হাদীছ লেখা নিষিদ্ধ হওয়ায় দুর্বল ও জাল হাদীছের প্রচলন:
এ প্রসংগে তারা যে দলীল উপস্থাপন করে তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عن أبي سعيد الخدري أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: لا تكتبوا عني ومن كتب غير القرآن فليمحه...
‘তোমরা আমার কোন কিছু লিখবে না, যে আল-কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখেছে তা মুছে ফেলবে...।’
তাদের ভাষায়, হাদীছ যদি শারী‘আতের উৎসই হত তাহলে তাকেও গুরুত্ব দিয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম লেখানোর ব্যবস্থা করতেন। যেহেতু তিনি তা না করে বরং তা লিখতে নিষেধ করলেন, সেহেতু হাদীছ অনুসরণ অপরিহার্য নয়। না লেখার কারণে অনেক দা‘য়ীফ বা দুর্বল হাদীছ এমনকি জাল হাদীছও হাদীছের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ লাভ করেছে। যে কারণে হাদীছসমূহের অংশ বিশেষ সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়েছে। সে জন্য হাদীছ অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি প্রশ্ন বিদ্ধ হওয়ায়, এখন আর হাদীছ অনুসরণ অপরিহার্য নয়।
ভ্রান্তি উন্মোচনঃ
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালে, সবার জন্য হাদীছ লেখাকে অনুমোদন দিলে হাদীছ ও কুরআনের সংমিশ্রণ হওয়ার আশংকা ছিল। এটি ছিল মূলত ইসলামী শারী‘আতের মূল উৎস আল-কুরআনের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে বড় আকারের ঝুঁকি। সে জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যৌক্তিক কারণেই হাদীছ লেখাকে সর্বসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করেননি। আল-কুরআন লেখকের স্বল্পতা, লেখনী উপকরণের অপ্রতুলতাও প্রথম যুগে হাদীছ না লেখার কারণ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এখানে উল্লেখিত এ একটি হাদীছ ছাড়াও কিছু হাদীছ দ্বারা হাদীছ লেখা নিষিদ্ধ করার প্রমাণ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এমন অনেক হাদীছ রয়েছে, যা স্পষ্টত হাদীছ লেখা যে নিষিদ্ধ ছিল না, তার প্রমাণ বহন করে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছ হচ্ছে, ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদি আল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ লেখার ব্যাপারে জানতে চাইলে, তিনি বলেন-
اكتب فوالذي نفسي بيده ما خرج مني إلا حق.
‘লেখ, যার হাতে আমার নাফস তাঁর শপথ, আমার মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া কিছুই বের হয় না।’
ছাহাবাহ রাদি আল্লাহু আনহুমের মধ্যে কেউ কেউ যে হাদীছ লিখতেন, তারও প্রমাণ রয়েছে, যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن منبه يعني وهبا عن أخيه سمعت أبا هريرة يقول ليس أحد أكثر حديثا عن رسول الله صلى الله عليه وسلم مني إلا عبد الله بن عمرو فإنه كان يكتب وكنت لا أكتب.
‘ওয়াহাব ইবন মুনাববাহ তাঁর ভাইয়ের সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি আবূ হুরাইরা রাদি আল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছেন, আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর রাদি আল্লাহু আনহু ব্যতীত অন্য কেউ আমার চেয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছ বেশি জানতেন না, কেননা, তিনি হাদীছ লিখতেন আর আমি লিখতাম না।’ মাক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খুতবাহ শ্রবণ করে ইয়ামানের এক ব্যক্তি এটা লিখে দেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুরোধ জানালেন। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তা লিখে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اكتبوا لأبي شاه.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবু শাহ এর জন্য এটি লিখে দাও।’
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হাদীছ লেখার নিষেধকৃত হাদীছের চেয়ে লেখার অনুমোদন দেয়ার হাদীছের সংখ্যাই বেশি। শুধু তাই নয় আবু সা’ঈদ আল-খুদরীর রাদি আল্লাহু ‘আনহু পূর্বোল্লেখিত যে হাদীছ দ্বারা হাদীছ লেখা নিষিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ দেয়া হয়, তা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছ নয় বলেও ইমাম আল বুখারী রাহিমাহুল্লাহ প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সে দৃষ্টিতে এটি কোন অকাট্য দলীল নয়। সুতরাং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ কুরআনের মত গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই এটাকে তিনি লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। হাদীছ না লেখার কারণেই হাদীছে দুর্বল হাদীছ ও জাল হাদীছের অনুপ্রবেশের যে অভিযোগ উঠেছে তাও ভিত্তিহীন, কেননা হাদীছ ব্যাপকভাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে নয় বরং লিপিবদ্ধ হওয়ার যুগেই মূলত জাল হাদীছ রচনার দুঃখজনক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণিত। আর এটি মূলত ইসলামের শত্রুদেরই ষড়যন্ত্রের ফসল। সুতরাং নির্ধারিত যুগে হাদীছ লিপিবদ্ধ হয়নি বলে, জাল হাদীছ ও দা‘য়ীফ হাদীছের বেশি ছড়াছড়ি দেখা দেয়, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ দ্বারা হাদীছকে কেন্দ্র করে কোন সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।
চতুর্থ বিভ্রান্তি: ছাহাবীদের হাদীছ বিমুখতা ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণে অবহেলা:
বিভ্রান্তিঃ তাদের ভাষায়, ইসলামে হাদীছ গুরুত্বহীন বলেই ছাহাবীগণ রাদি আল্লাহু আনহুম হাদীছ চর্চা থেকে বিরত ছিলেন। তাঁরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণকেও গুরুত্ব দিতেন না। সুতরাং হাদীছ গুরুত্বহীন। একে তেমন গুরুত্ব না দিলেও চলে।
ভ্রান্তি অপনোদনঃ এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা। বরং ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছকে মুখস্থ রাখা ও তা কার্যে পরিণত করাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেন। তাঁর যে কোন কাজ ও কথাকে নিজেদের জীবনে
বাস্তবায়নে তাঁরা ছিলেন খুবই তৎপর। তাঁরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছকে যে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতেন, প্রমাণ হিসাবে কিছু উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করা হল-
ক. পালাক্রমে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্য লাভের কর্মসূচী গ্রহণ:
নিজের অন্য দায়দায়িত্ব ও কর্মব্যস্ততার কারণে একজন ছাহাবী রাদি আল্লাহুর পক্ষে সকল সময় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহচর্য লাভ করা সম্ভবপর হত না। তাঁর সমগ্র কর্মকান্ডই ছিল ছাহাবীদের জন্য অনুকরণীয়। যাতে নিজেদের অনুপস্থিতির কারণে তাঁর কোন কাজকর্ম অগোচরে না থেকে যায়, সে জন্য ছাহাবীরা পালাক্রমে তাঁর সাহচর্য গ্রহণ করতেন। কেউ না কেউ তাঁর সাথে থাকার চেষ্টা করতেন। ইমাম আল বুখারী রাহিমাহুল্লাহ ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন-
عن عمر قال : كنت أنا وجار لي من الأنصار في بني أمية بن زيد وهي من عوالي المدينة وكنا نتناوب النزول على رسول الله صلى الله عليه وسلم ينزل يوما وأنزل يوما فإذا نزلت جئته بخبر ذلك اليوم من الوحي وغيره وإذا نزل فعل مثل ذلك .
‘মদীনার একপ্রান্তে অবস্থিত বানূ উমাইয়্যাহ ইবন যায়িদ গোত্রের আমার এক আনসার প্রতিবেশী ও আমি পালাক্রমে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট যাওয়া আসা করতাম। আমি একদিন যেতাম, তিনি অন্যদিন যেতেন। আমি গেলে সেই দিনের ওহী ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল কাজ সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতাম। আর তিনি গেলে একই ভাবে তিনি সেই দিনের ওহী ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাজ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতেন।’ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কার্যক্রম তথা হাদীছের কোন অংশ যাতে নিজেদের অগোচরে না থেকে যায়, সে বিষয়ে ছাহাবীগণ যে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন এ ঘটনা তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ। এরপরেও তাদের এ দাবীর কোন ভিত্তি রয়েছে কি?
খ. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুকরণে জুতা বর্জন:
বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي سعيد الخدري إن رسول الله صلى الله عليه وسلم صلى فخلع نعليه فخلع الناس نعالهم فلما انصرف قال لم خلعتم نعالكم؟ فقالوا: يا رسول الله رأيناك خلعت فخلعنا قال إن جبريل أتاني فأخبرني أن بهما خبثا.
‘আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথীদের নিয়ে ছালাত আদায় করছিলেন। হঠাৎ তিনি জুতা খুলে ফেললেন। তাঁকে দেখে ছাহাবী রাদি আল্লাহু আনহুমও তাঁদের জুতা খুলে ফেললেন। ছালাত শেষ হলে তিনি ছাহাবীদেরকে বললেন, কোন্ কারণ তোমাদেরকে জুতা খুলতে বাধ্য করল? তাঁরা বললেন, আপনাকে আমরা জুতা খুলে ফেলতে দেখেছি। তখন তিনি বললেন, জিবরাইল আমাকে আমার জুতায় ময়লা রয়েছে বলে সংবাদ দিয়েছিলেন।’ ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তথা তাঁর হাদীছ ও কাজকর্মকে অবমূল্যায়ন ও উপেক্ষা করেননি। বরং তাঁরা সন্দেহাতীত ভাবে তাঁর সকল কিছুকেই অনুকরণ করতেন তারই উজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে, এ ঘটনা। এরপরেও কি হাদীছ বিদ্বেষীদের অভিযোগের কোন মূল্য রয়েছে?
গ. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আংটি পরিধান ও বর্জন:
বর্ণিত হয়েছে যে-
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما قال : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يلبس خاتما من ذهب فنبذه فقال لا ألبسه أبدا فنبذ الناس خواتيمهم.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বর্ণের আংটি পরিধান করা শুরু করলে, আছহাব রাদি আল্লাহু আনহুমও তাঁদের আংটি স্বর্ণ দ্বারা বানিয়ে পরিধান শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা নিক্ষেপ করলেন এবং যখন এ ঘোষণা দিলেন যে, আমি আর কখনো তা পরিধান করব না, তখন লোকেরাও তা নিক্ষেপ করলেন।’ ছাহাবাহ রাদি আল্লাহু আনহুম হাদীছ বিমুখ ছিলেন ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণকে গুরুত্ব দিতেন না বলে যারা হাদীছের গুরুত্বকে ভূলুণ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে তাদের দাবী একেবারেই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তার নির্ভেজাল অনুকরণ ও আনুগত্যের এ রূপ অসংখ্য সত্য ঘটনা ছাহাবা রাদি আল্লাহু আনহুম যে তাঁর যথার্থ অনুসারী ছিলেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেশ করে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছকেও যে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, এর আরো জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে-
1. রাত্রিতে মহিলাদের মাসজিদে আগমন
বর্ণিত হয়েছে -
عن ابن عمر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تمنعوا النساء من الخروج إلى المساجد بالليل . فقال ابن لعبد الله بن عمر لا ندعهن يخرجن فيتخذنه دغلا. قال فزبره ابن عمر وقال أقول قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- وتقول لا ندعهن!
‘ইবন ’উমার রাদিআল্লাহু আনহুমা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা রাত্রিতে মহিলাদেরকে মাসজিদে আসতে বাধা দেবে না। ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমারের ছেলে (এ কথা শুনে) বললেন, আমরা তাদেরকে বাইর হতে দেব না। কেননা তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। তিনি তার মুখে থাপ্পড় দিয়ে বললেন, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলছি, আর তুমি বলছ, তাদেরকে আমরা বাইর হতে দেব না!’ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছের বিরোধিতা করার কারণে ইবন ‘উমার তাঁর ছেলেকে যে শক্ত ভাষায় সতর্ক করেছিলেন, আর তিনিও যে একথা শ্রবণের পর টু শব্দটিও করলেন না, এটা ছাহাবীদের রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছের প্রতি আনুগত্যেরই জাজ্জ্বল্য প্রমাণ।
2. হাদীছই ছালাতসমূহের রাক‘আতের সংখ্যা নির্দেশক
বর্ণিত হয়েছে -
عمران بن حصين جالس فذكروا عنده الشفاعة فقال رجل من القوم يا أبا نجيد لتحدثونا بأحاديث ما نجد لها أصلا في القرآن، فغضب عمران بن حصين وقال لرجل قرأت القرآن؟ قال: نعم. قال وجدت فيه صلاة المغرب ثلاثا وصلاة العشاء أربعا وصلاة الغداء ركعتين والأولى أربعا والعصر أربعا؟ قال: لا. قال فعمن أخذتم هذا الشأن ألستم وأخذناه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم؟
‘ইমরান ইবন হুছাইন রাদিআল্লাহু আনহু বসা অবস্থায় ছিলেন। লোকেরা তাঁর নিকট শাফা‘আতের প্রসংগ উল্লেখ করলেন। উপস্থিত জনগণ থেকে একজন বললেন, হে আবূ নুজায়ীদ, আপনি আমাদেরকে এ হাদীছ বলছেন, যার মূল আমরা কুরআনে পাই না। তখন ‘ইমরান রাগান্বিত হয়ে ঐ ব্যক্তিকে বললেন, আপনি কি আল-কুরআন পাঠ করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তখন ‘ইমরান বললেন, আপনি কি সেখানে ‘ইশার ছালাত চার, মাগরিবের ছালাত তিন, ফজরের ছালাত দুই, জোহরের ছালাত চার এবং আছরের ছালাত চার রাক‘আত করে পেয়েছেন? তিনি বললেন, না। ইমরান বললেন, আপনি এটি কার নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন? আপনি কি এটা আমাদের নিকট থেকে গ্রহণ করেননি, যা আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছি?’ সুতরাং আছহাব রাদি আল্লাহু আনহুমের সময় কুরআনকেই মূল্যায়ন করে হাদীছকে উপেক্ষা করা হত, এ দাবী সঠিক নয়।
3. পাথর নিক্ষেপ নিষিদ্ধকরণ
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن مغفل أنه رأى رجلا يخذف، فقال له:لا تخذف فإن رسول الله صلى الله عليه وسلم نهى عن الخذف أو كان يكره الخذف وقال إنه لا يصاد به صيد ولا ينكأ به عدو ولكنها قد تكسر السن وتفقأ العين ثم رآه بعد ذلك يخذف فقال له أحدثك عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه نهى عن الخذف أو كره الخذف وأنت تخذف؟ لا أكلمك كذا وكذا !
‘‘‘আবদুল্লাহ ইবন মুগাফফাল রাদি আল্লাহু ‘আনহু এক ব্যক্তিকে ছোট পাথর নিক্ষেপ করতে দেখে বললেল, তুমি পাথর নিক্ষেপ করনা, কেননা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাথর নিক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন, অথবা পাথর নিক্ষেপকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি বলেছেন, এ দ্বারা কোন কিছু শিকার করাও যায় না এবং শত্রুও হত্যা করা যায় না, তবে এটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলে এবং চক্ষু কানা করে দেয়। এর পরেও ঐ ব্যক্তি পাথর নিক্ষেপ করছিল। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ বলছি যে, তিনি এটাকে নিষেধ করেছেন অথবা তিনি এটাকে ঘৃণা করতেন, তারপরেও তুমি এটা করছ? আমি এরূপ কথা আর তোমাকে বলব না!’ এ দ্বারা হাদীছ অবজ্ঞাকারীকে শক্ত ভাষায় সতর্ক করা হয়েছে। এ ঘটনাটি হাদীছকে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে আছাহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুম যে শক্ত অবস্থানে ছিলেন তার প্রমাণ বহন করে।
আসল কথা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণ রাদি আল্লাহু ‘আনহুম হাদীছকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন। হাদীছকে সম্মান করা,
বাস্তবায়ন করা, সংরক্ষণ করা ও প্রচার করার ক্ষেত্রে তাদের একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সামান্য ঘাটতি ছিল না। হাদীছের প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল বিশিষ্ট কিছু ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহুমের বক্তব্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-
1. আবূ বাকর আছ-ছিদ্দীক রাদি আল্লাহু ‘আনহু
তিনি বলেন-
" لست تاركاً شيئاً كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعمل به ، إلا عملت به فإني أخشى إن تركت شيئاً من أمره أن أزيغ . "
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা আমল করতেন, আমি তা থেকে কিছুই বর্জন করি না, বরং তা আমল করি। আমি ভয় করি যে, যদি আমি এ থেকে কিছু পরিহার করি, তাহলে আমি পথভ্রষ্ট হব।’
2. উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহু
তিনি আল-হাজরুল আসওয়াদ চুম্বন করার সময় যে ঐতিহাসিক বাণীটি উচ্চারণ করেন তা মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ ও সুন্নাহ পালনে তাঁর দৃঢ়তার কথা স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি বলেন-
إني أعلم أنك حجر لا تضر ولا تنفع ولولا أني رأيت النبي صلى الله عليه و سلم يقبلك ما قبلتك. ‘আমি জানি তুমি একটি পাথর মাত্র, ভালমন্দ কিছুই করতে পারো না, আমি যদি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমিও তোমাকে চুম্বন করতাম না।’
3. ‘আলী ইবন আবি তালিব রাদি আল্লাহু ‘আনহু
তিনি বলেন-
ألا إني لست بنبي ولا يوحى إلي ولكني أعمل بكتاب الله وسنة نبيه صلى الله عليه وسلم ما استطعت.
‘সাবধান, আমি নবী নই। আমার নিকট ওহীও আসে না। তবে আমি আল্লাহর কিতাবকে এবং নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহকে যথাসাধ্য আমল করার চেষ্টা করি।’
উল্লেখ্য যে, শুধু আছহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুই নন বরং আছহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুমের একান্ত অনুগামী তাবি‘ঈ রাহিমাহুল্লাহও হাদীছ পরিপালনে ছিলেন খুবই অগ্রসর। তাঁদের কিছু বক্তব্যও এখানে উপস্থাপন করা যায়-
1. কাতাদাহ ইবন দি’আমাহ রাহিমাহুল্লাহ (১১৭ হি.)
তিনি বলেন-
والله ما رغب أحد عن سنة نبيه صلى الله عليه و سلم إلا هلك فعليكم بالسنة وإياكم والبدعة.
‘আল্লাহর শপথ, কোন ব্যক্তি তার নবী আলাইহিস সালামের সুন্নাহ থেকে বিমুখ হলে সে অবশ্যই ধ্বংস হবে। তোমরা শক্তভাবে সুন্নাহকে ধারন করবে এবং বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যান করবে।’
2. ইবন শিহাব আয-যুহরী রাহিমাহুল্লাহ (১২৪ হি.)
বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن شهاب بلغنا عن رجال من أهل العلم أنهم كانوا يقولون الاعةصام بالسنة نجاة.
‘ইবন শিহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বিদ্বানদের কিছু ব্যক্তি হতে আমাদেরকে পৌঁছানো হয়েছে যে, ‘তারা বলতেন, সুন্নাহকে শক্তভাবে ধারণ করার মধ্যে রয়েছে মুক্তি।’
আইম্মায়ি মুজতাহিদীনও হাদীছের মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। কেউ কস্মিনকালেও হাদীছের বিরুদ্ধে কোন কিছু সহ্য করেন নি। আবূ হানিফা (১৫০ হি.) রাহিমাহুল্লাহ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-
كان الإمام أبو حنيفة يقول اياكم والقول في دين الله ةعالى بالرأي عليكم باةباع السنة فمن خرج عنها ضل ودخل عليه مرة رجل من أهل الكوفة والحديث يقرأ عنده فقال الرجل دعونا من هذه الأحاديث فزجره أبو حنيفة أشد الزجر وقال له لولا السنة ما فهم احد منا .كان يقول لم تزل الناس في صلاح ما دام فيهم من يطلب الحديث فإذا طلبوا العلم بلا حديث فسدوا.
‘আল-ইমাম আবূ হানিফাহ রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍‘দীনের প্রসঙ্গে মতামতের ভিত্তিতে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন। সুন্নাহর অনুসরণ আপনাদের উপর অত্যাবশ্যক।’ এক সময় কুফা হতে এসে এক ব্যক্তি তাঁর নিকট এমন সময় প্রবেশ করল যে, তাঁর নিকট হাদীছ পঠিত হচ্ছিল। সেই ব্যক্তি বলল, এইসব হাদীছ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করুন। তখন আবূ হানিফাহ রাহিমাহুল্লাহ প্রচন্ড আকারে ধমক দিলেন এবং বললেন, ‍সুন্নাহ না থাকলে আমাদের কেউ আল-কুরআন বুঝবে না। তিনি বলতেন, ‘মানুষ যতক্ষণ হাদীছ চর্চা করবে, ততক্ষণ তারা সফলতা লাভ করবে। যখন হাদীছ বাদ দিয়ে অন্য ইলম অমেবষণ করবে, সঠিক ইসলামের দরজা তাদের থেকে বন্ধ হয়ে যাবে।’
আল-ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
ما من أحد إلا ومأخوذ من كلامه ومردود عليه إلا رسول الله صلى الله عليه و سلم .
‘যে কোন ব্যক্তির কথা গ্রহণ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হতেও পারে, শুধু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা ব্যতীত।’
আল-ইমাম শাফি‘ (২০৪ হি.) রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
وليس ينبغي في سنة رسول الله صلى الله عليه و سلم إلا اتباعها بفرض الله عز و جل.
‘আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার পক্ষ থেকে ফরজ হওয়ার কারণে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য করা ব্যতীত অন্য কিছু করনীয় নেই।’ তিনি আরো বলেন-
أجمع المسلمون على أن من استبان له سُنةٌ عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحِلّ له أن يدعها لقول أحد.
‘মুসলিমগণ এই বিষয়ের উপর ইজমা‘ করেছে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত প্রকাশিত হওয়ার পর অন্য কারো জন্য তা প্রত্যাখ্যান করা হালাল হবে না।’
আল-ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
من ردّ حديثَ رسولِ الله صلى الله عليه وسلم فهو على شفا هلَكَة.
‘যে ব্যক্তি হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে সে ধ্বংস হওয়ার কিনারায় অবস্থান করে।’
তিনি আরো বলেন-
لا تقلد في دينك أحداً من هؤلاء، ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابهِ فخُذ به.
‘দীনের ব্যাপারে ওদের অন্ধানুকরণ করো না। নবী আলায়হিস সালাম ও তার ছাহাবীগণ রাদি আল্লাহু ‘আনহুম যা নিয়ে এসেছেন তাকে অনুসরণ কর।’
আল-হাসান ইবনু আলী আল বিহারী (৩২৯ মৃ.) রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
إذا سمعت الرجل يطعن على الآثار ولا يقبلها ، أو ينكر شيئاً من أخبار رسول الله صلى الله عليه وسلم فاتهمه على الإسلام ، فإنه رديء المذهب و القولৃ. القرآن أحوج إلى السنة من السنة إلى القرآن .
‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখবে যে, সে আছারকে তিরস্কার করছে এবং সে তা গ্রহণ করছে না অথবা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছকে অস্বীকার করছে সে মূলত ইসলামকেই অভিযুক্ত করছে। কেননা সে তার পন্থাগত দিক ও বক্তব্যগত দিক থেকে নিম্নমানের। হাদীছ হাদীছের যতটুকু মুখাপেক্ষী কুরআন তা থেকেও হাদীছের বেশি মুখাপেক্ষী।’
সুতরাং হাদীছ সংক্রান্ত বিষয়ে আছহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুম তাবি‘ঈ, আইম্মা ও সালাফি সালিহীনের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁরা কক্ষনো হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করেননি বরং সকল সময় হাদীছকে নিজেরাও অনুকরণ করতেন অন্যদেরকেও তা অনুকরণের উপদেশ দিতেন।
এমনি আরো অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে যে, ছাহাবী রাদিআল্লাহু আনহুম ও অন্যান্য আলিমগণ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ পরিপালনে ছিলেন বদ্ধপরিকর ও আপোসহীন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আছহাব রাদি আল্লাহু ‘আনহুম তাঁর হাদীছ অনুসরণের ক্ষেত্রে অবহেলা করতেন এটা ডাহা মিথ্যাচার বই কিছু নয়। সুতরাং হাদীছ বিদ্বেষীদের দাবী, আছহাব রাদিআল্লাহু আনহুম হাদীছকে গুরুত্ব দিতেন না; এটা একেবারেই অসত্য।
পঞ্চম বিভ্রান্তি : জাল হাদীছের ছড়াছড়ি:
বিভ্রান্তিঃ তাদের ভাষায়, জাল হাদীছের এত বেশি প্রচলন হয়েছে যে, আসল হাদীছ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর, সেজন্য ছাহীহ হাদীছের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে হাদীছ অনুসরণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
অপনোদনঃ তাদের এ দাবী মোটেও সঠিক নয়। হ্যাঁ, বিপুল সংখ্যক জাল হাদীছ সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ নেই। তবে ইসলামের বিদগ্ধ মুহাদ্দিছিন রাহিমাহুমুল্লাহ বিজ্ঞানসম্মত ও সূক্ষ্ম মানদন্ড নির্ধারণ পূর্বক তার আলোকে যাচাই বাছাই করে সকল ছাহীহ হাদীছকে জাল হাদীছ থেকে পৃথক করেছেন। তাঁদের সংকলিত এ ছাহীহ হাদীছসমূহের গ্রন্থরাজিও আমাদের মাঝে বিরাজমান। এমনকি দুর্বল সনদের হাদীছগুলোও চি‎‎হ্নত হয়েছে, জাল হাদীছ দ্বারা যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয় সে জন্য জাল হাদীছ সমূহকে বিভিন্ন গ্রন্থে একত্রিতও করা হয়েছে। এর পরেও জাল হাদীছের বাহানা উত্থাপন করে আসল হাদীছকে বর্জন করা একেবারেই অযৌক্তিক।
ষষ্ঠ বিভ্রান্তি : হাদীছের বর্ণনা শব্দভিত্তিক না হয়ে অর্থভিত্তিক হওয়ার অনুমোদন
বিভ্রান্তিঃ কুরআনের ভাষা পরিবর্তন অবৈধ। পক্ষান্তরে হাদীছের বর্ণনা অর্থ ভিত্তিক (رواية بالمعنى) হলেও তা অনুমোদিত। সেজন্য অনেক সময় হাদীছ বর্ণনাকারী সঠিক শব্দ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় হাদীছের ভাবার্থ পরিবর্তন হয়ে ভুল অর্থ প্রকাশ হওয়ার যথেষ্ট আশংকা থাকে, এতে হাদীছের বিশুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার কারণে হাদীছ অনুসরণের অপরিহার্যতা অযৌক্তিক।
অপনোদনঃ ইসলামের বিদগ্ধ মনীষীগণ হাদীছকে হুবহু শব্দ অপরিবর্তিত রেখে বর্ণনা করাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে সীমিত পর্যায়ে শর্ত সাপেক্ষে বিশেষ বিশেষ নিয়মনীতি অনুসৃত হলে, অর্থভিত্তিক বর্ণিত হাদীছ বর্ণনাকেও অনুমোদন করেছেন। সেক্ষেত্রে বর্ণনাকারীর জন্য যে সমস্ত শর্ত অপরিহার্য করা হয়েছে, তাতে হাদীছ অর্থভিত্তিক বর্ণিত হলেও মূল অর্থ পরিবর্তিত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। হাদীছ অর্থ ভিত্তিক বর্ণনার জন্য অনিবার্য শর্ত হচ্ছে, বর্ণনাকারীকে বিশুদ্ধ আরবী ভাষার শব্দার্থ, শব্দচয়ন পদ্ধতি, সমার্থবোধক শব্দজ্ঞান, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শব্দার্থ পরিবর্তনের নিয়মনীতি, শব্দালংকার, বাক্য বিন্যাস, প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। উল্লেখ্য যে, এ শর্ত পূর্ণ না হলে কোন বর্ণনাকারীর জন্য অর্থের আলোকে হাদীছ বর্ণনা বৈধ নয়। এ শর্ত পূরণ হলে হাদীছের অর্থ বিকৃত হওয়ার আশংকা একেবারেই থাকে না। এ প্রসংগে আয়িশা রাদিআল্লাহু ‘আনহা এর বর্ণনা উল্লেখ করা যায়। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن هشام بن عروة عن أبيه قال قالت لي عائشة رضى الله عنها يا بنى أنه يبلغنى أنك تكتب عنى الحديث، تعود فتكتبه فقلت لها أسمعه منك على شيء ثم أعود فأسمعه على غيره فقالت هل تسمع في المعنى خلافا؟ قلت لا, قالت لا بأس بذلك.
‘হিশাম ইবন ‘উরওয়াহ তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আয়িশা রাদিআল্লাহু ‘আনহা ‘উরওয়াহ ইবনুয যুবাইর রাদিআল্লাহু ‘আনহুকে বললেন যে, হে বৎস, আমাকে জানানো হয়েছে যে, তুমি আমার থেকে হাদীছ শুনে তা লিখে থাক; পরবর্তীতে এই একই হাদীছ পুনরায়ও লিখ? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি আপনার থেকে হাদীছ শুনি এবং পরে তা আপনার থেকে অন্য শব্দেও শুনে থাকি। আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা বললেন- তুমি কি এ দুইয়ের অর্থের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখ? তিনি বললেন, না। তখন আয়িশা রাদিআল্লাহু আনহা বললেন, তাহলে কোন ক্ষতি নেই।’ সুতরাং হাদীছের হুবহু শব্দ বর্ণনা না করে, অর্থ বর্ণনা করলে হাদীছের মূল অর্থের বিকৃতি ঘটতে পারে এ অভিযোগ যথাযথ নয়। সে জন্য এ ভ্রান্ত অভিযোগের উপর ভিত্তি করে হাদীছ অস্বীকার করা একেবারেই অযৌক্তিক।
আসলে হাদীছ অস্বীকার করার কুমন্ত্রনা ইসলামী শারী‘আহকে ধ্বংস করার জঘন্য ষড়যন্তকারী ইসলাম বিদ্বেষীদের সৃষ্টি। যারা ঈমান বিধ্বংসী এ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে, অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বর্জিত কিছু দলীল প্রমাণাদি উপস্থাপন করে, এর পক্ষে সাফাই গাইতে ব্যস্ত তারা মূলত বিভ্রান্তিতেই নিপতিত রয়েছে। মোটকথা, তাদের এ চিন্তা চেতনার কোন ভিত্তি নেই, তারা মূলত কুরআন, হাদীছ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর সতর্ক থাকা অপরিহার্য।
৪.২ আহাদীছুল মুতাওয়াতির গ্রহণ ও আহাদীছুল আহাদ বর্জনে বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
আহাদীছুল মুতাওয়াতির গ্রহণ ও আহাদীছুল আহাদ বর্জন একটি বড় বিভ্রান্তি। এক শ্রেণীর পথভ্রষ্ট লোক সকল প্রকার হাদীছকে অস্বীকার করে, যা ইতোপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। যারা মুতাওয়াতির হাদীছকে মানে তারা অন্তত : ওদের চেয়ে কিছুটা হলেও ভালো। তবে তারা খাবরুল আহাদকে অস্বীকার করে। এ ক্ষেত্রেও তারা পথভ্রষ্ট। এদের মতবাদের স্বরূপ, এদের বিভ্রান্তির প্রকৃতিও উন্মোচন করা হচ্ছে, সময়ের অনিবার্য দাবী। সেই প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অনুধাবনের জন্য সর্ব প্রথমে আল- আহাদীছুল মুতাওয়াতিরা ও আহাদীছুল আহাদের সংজ্ঞা সম্পর্কে ধারণা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আল-হাদীছুল মুতাওয়াতির (الحديث المتواتر)ঃ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি শুনে অথবা দেখে সনদের প্রথম থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত এত সংখ্যক বর্ণনাকারী হাদীছ বর্ণনা করেছেন যে, সংখ্যাধিক্যের কারণে এতগুলো লোক একত্রে মিথ্যাবাদী হতে পারে বলে ধারণা করা যায় না। এরূপ হাদীছকে আল-হাদীছুল মুতাওয়াতির বলে। যেমন :
১. হাদীছ গ্রন্থে এসেছে-
عن المغيرة رضي الله عنه قال : سمعت النبي صلى الله عليه و سلم يقول : إن كذبا علي ليس ككذب على أحد من كذب علي متعمدا فليتبوأ مقعده من النار.
‘আল-মুগিরাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় আমার প্রতি মিথ্যা চাপিয়ে দেয়া এবং অন্য কারো প্রতি মিথ্যা চাপিযে দেয়া এক নয়; যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার ওপর মিথ্যা চাপিয়ে দিল, সে জাহান্নামকে তার বাসস্থান বানিয়ে নেয়।’
২. হাদীছ গ্রন্থে আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال :أمرة أن أقاةل الناس حةى يشهدوا أن لا إله إلا الله وأن محمدا رسول الله ويقيموا الصلاة ويؤةوا الزكاة...
ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যতক্ষণ না মানুষ ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ এ কথার সাক্ষ্য দেবে, ছালাত কায়িম না করবে এবং যাকাত প্রদান না করবে; ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে আমাকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে...।’ এ হাদীছ দুটো এত বেশি সংখ্যক বর্ণনাকারী হতে বর্ণিত হয়েছে যে, সংখ্যাধিক্যের কারণে এতগুলো লোক একত্রে মিথ্যাবাদী হতে পারে, সে ধারণাটিও করার সুযোগ নেই। সুতআং হাদীছটি মুতাওয়াতির।
হাদীছুল আহাদ (حديث الآحاد) যে হাদীছের বর্ণনা কারীর সংখ্যা মুতাওয়াতির হাদীছের বর্ণনাকারীর সংখ্যায় পড়ে না, তাকে হাদীছুল আহাদ বলে। যেমন- রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী-
عن أنس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين.
আনাস রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার পিতা, তার সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে তার নিকট প্রিয় হই।’
ইতোপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, এক শ্রেণীর লোক আহাদীছুল আহাদকে ইসলামী শারী‘আতের দলীল হওয়ার যোগ্য মনে করে না। তারা শুধু আল- হাদীছুল মুতাওয়াতিরকেই শারী‘আতের দলীল হিসেবে গণ্য করে। অন্য ভাষায়, তারা আল-হাদীছুল মুতাওয়াতিরকে অনুসরণ করতে আপত্তি নেই বলে। তবে আহাদীছুল আহাদকে অস্বীকার করে থাকে। তাদের বক্তব্যও বিভ্রান্তির নামান্তর। কারণ এরূপ হাদীছ বাদ দিলে শারী‘আতের অসংখ্য হুকম আহকাম থেকে আমরা বঞ্চিত হবো। আসলে বর্ণনাকারীর সংখ্যা মুতাওয়াতিরের স্তরে না পৌঁছালেও যদি বর্ণনাকারী সত্যবাদী, আস্থাভাজন ও ‘আদল সম্পন্ন প্রমাণিত হয় তাহলে তাঁর হাদীছ গ্রহণ করতে আপত্তি করা ঠিক নয়।
বিভ্রান্তি: হাদীছের বর্ণনাকারী ভুল করতেও পারেন, ভুল নাও করতে পারেন। অনেক সময় বর্ণনাকারীকে প্রকাশ্যে নির্ভরযোগ্য মনে হলেও পরোক্ষভাবে তিনি মিথ্যুক ও মুনাফিকও হতে পারেন। এ অবস্থায় হাদীছ মুতাওয়াতির না হয়ে আহাদ হলে তার বিশুদ্ধতা ও গ্রহণযোগ্যতা সংগত কারণেই লোপ পায়। সে জন্য আহাদীছুল আহাদ অনুসরণ যোগ্য হতে পারে না। তাদের এ মতামতের পক্ষে তারা যে দলীল উপস্থাপন করে তা হচ্ছে-
প্রসিদ্ধ ছাহাবী আবু মূসা আল-আশ‘আরী রাদি আল্লহু ‘আনহু এর বর্ণিত ‘বাড়িতে প্রবেশের জন্য তিন তিনবার অনুমতি চেয়ে অনুমতি না পাওয়া গেলে ফিরে যাওয়া’ এর হাদীছকে ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহু অমান্য করেছিলেন। এটি আহাদীছুল আহাদের অন্তর্ভুক্ত। আর আহাদীছুল আহাদ যদি অমান্য করা বৈধ না হত, তাহলে ‘উমারের মত ব্যক্তিত্ব তা অমান্য করতেন না। সুতরাং আহাদীছুল আহাদ অনুসরণ অপরিহার্য নয়।
অপনোদন: আসলে এটি একটি বিভ্রান্তি। ‘উমার রাদিআল্লহু ‘আনহু এটিকে আহাদীছুল আহাদ মনে করে, এ হাদীছকে আমলে আনেন নি বা এটা মানতে অস্বীকার করেছেন, এটা ঠিক নয়। যে কোন কেউ যাতে নিজের প্রতি নিজে আস্থাশীল না হয়ে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ বর্ণনা করার দু:সাহস না দেখান, সেজন্য ‘উমার এ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ‘উমার রাদিআললাহু আনহু কিন্তু ইরাকের গভর্নর সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাছ রাদি আল্লহু ‘আনহুর বিরুদ্ধে একজন মাত্র লোকের অভিযোগকে আমলে এনে তদন্তের ব্যবস্থা করেছিলেন। একদিকে এ ঘটনা যেমন তিনি যে একজনের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিলেন তার প্রমাণ, একই ভাবে সা‘দের প্রতি তাঁর আস্থা থাকার পরেও তিনি এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তারও জাজ্জ্বল্য প্রমাণ বহন করে। সুতরাং কোন বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াটাই ছিল তাঁর স্বভাবজাত কাজ। সুতরাং আবূ মূসা রাদি আল্লাহু ‘আনহু একক ব্যক্তি হিসাবে একটি বিষয় উপস্থাপন করায় তিনি এ ঘটনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিষয়টি তেমন নয়। এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্যই মূলত এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহু দুগ্ধের সম্পর্ক প্রমাণের জন্য মহিলাদের স্তন চুষার ক্ষেত্রে একজনের দেখাকেই দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন বলে প্রমাণ রয়েছে। তাহলে তিনি আহাদকে গ্রহণ করেন নি, একথা সঠিক নয়। এছাড়াও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক ক্ষেত্রে মাত্র এক একজন ছাহাবীকেই বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। বিভিন্ন রাজা বাদশাহদের নিকট একজন মাত্র বাহককে দিয়ে তাঁর পত্র প্রেরণের ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে। যেমন তিনি একমাত্র দাহিয়াতুল কালবী রাদি আল্লাহু ‘আনহুকে হিরাক্লিয়াসের নিকট পত্র সহকারে পাঠিয়েছিলেন। যদি একজনের বক্তব্য বা কাজ গ্রহণযোগ্য না হতো, তা হলে তিনি তাঁকে একা কিভাবে পাঠালেন? আবদুল্লাহ ইবন হুযাইফাহ রাদি আল্লাহু আনহুর সম্মুখে পারস্য সম্রাট মহানবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পত্র ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেছিল, সেই সংবাদও তো একমাত্র আবদুললাহর নিকট থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। তিনি একা এর বর্ণনাকারী হওয়ার পরেও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ বর্ণিত ঘটনাকে কিভাবে মেনে নিলেন? একই ভাবে মুয়াজ ইবন জাবাল, ‘আলী, আবূ মূসা আল আশ‘আরী রাদি আল্লাহু ‘আনহুম প্রত্যেককেই তিনি একক ভাবেই তো ভিন্ন ভিন্ন স্থানের আমীর করে পাঠিয়েছিলেন। দাওয়াতি কাজেও এক ব্যক্তিকেই পাঠানোর অনেক প্রমাণ রয়েছে। তাহলে যদি মুতাওয়াতির হাদীছের জন্য যে সংখ্যক বর্ণনাকারী প্রয়োজন, সেই সংখ্যার কম সংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে বর্ণিত কোন কিছু প্রহণ করা সঠিক না হয়; তাহলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র একেক জন করে ছাহাবীকে ঐ সব ক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন কেন? এদ্বারা স্পষ্ট হল যে, মুতাওয়াতির হাদীছের বর্ণনাকারীর সংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক এমন কি এক জনের বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য বলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ হতে অনুমোদিত ছিল। সুতরাং কারো বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে অসংখ্য আছহাব রাদি আল্লাহু আনহূম দ্বারা বর্ণিত হওয়া অত্যাবশ্যক নয়। সে জন্য আহাদ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করে শুধু মুতাওয়াতির হাদীছকে গ্রহণ করা একটা বিভ্রান্তি বই কিছু নয়। আসলে হাদীছের সানদ যদি অবিচ্ছিন্ন হয়, বর্ণনাকারী যদি আস্থাভাজন ও ‘আদল সম্পন্ন হয়, তাহলে হাদীছ বর্ণনাকারীর সংখ্যাধিক্য মূল বিষয় নয়। বর্ণনাকারীর নীতি নৈতিকতা, আমানাতদারী, সত্যবাদিতাই হচ্ছে হাদীছ গ্রহণযোগ্য হওয়া না হওয়ার মানদন্ড।
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সকল হাদীছুল আহাদ সন্দেহযুক্ত নয়। বিশুদ্ধ সনদে হাদীছ গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হাদীছুল আহাদ একেবারেই সন্দেহমুক্ত। মুহাদ্দিছিন রাহিমাহুমূল্লাহ যেমন আল বুখারী, মুসলিম, ইবন মাজাহ, আবূ দাউদ, তিরমিযী, আন-নাসাঈ, মালিক, আহমাদ ইবন হাম্বল, আল হাকিম, বাইহাকী, ইবন আবি শায়বাহ, আব্দুর রাযযাক প্রমুখ কর্তৃক সংকলিত হাদীছ গ্রন্থসমূহে যে সকল হাদীছুল আহাদকে তাঁরা ছাহীহ সনদে সংকলন করেছেন, সেগুলো অবশ্যই অনুসরণযোগ্য। এইসব হাদীছ সম্পর্কে যুগে যুগে আলিমগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে ইজমা‘ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কেউ এগুলোকে হাদীছুল আহাদ বলে অমান্য করার ইঙ্গিতও করেন নি। এ প্রসঙ্গে ইবন তায়মিয়্যাহ রাহিমাহু আল্লাহ বলেন-
" وأما ما لا يرويه إلا الواحد العدل ونحوه ولم يتواتر لفظه ولا معناه لكن تلقته الأمة بالقبول عملا به وتصديقا له، فهذا يفيد العلم اليقيني عند جماهير أمة محمد من الأولين والآخرين ، أما السلف فلم يكن بينهم في ذلك نزاع ."
‘যে হাদীছ একজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী ব্যতিত কেউ বর্ণনা করে নি এবং যার শব্দ ও ভাব মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছায় নি, তবে মুসলিম উম্মাহ তাকে আমল ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন, তা মূলত উম্মাতি মুহাম্মাদীর প্রথম ও শেষের সকলের নিকট অকাট্য ও সুনিশ্চিত জ্ঞান হিসেবে গণ্য। পূর্ববর্তী আলিমদের নিকট এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই।
আল-হাদীছুল মুতাওয়াতিরের সংখ্যা খুবই কম। ইসলামী শারী‘আর প্রায় সবটুকু অথবা অধিকাংশটুকু যেহেতু আহাদ হাদীছের দ্বারাই প্রমাণিত, সেহেতু আহাদ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করার অর্থই হচ্ছে, ইসলামী শারী‘আহকেই অথবা ইসলামী হুকম আহকামের অধিকাংশকেই প্রত্যাখ্যান করা। ইসলামের শত্রুরা সেজন্যই সুনিপুণ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের নিকট আহাদ হাদীছকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই শুধু মুতাওয়াতির হাদীছকে গ্রহণ করা যায়, এমন একটি জঘন্য ফাঁদ পেতেছে। এটি ইসলামের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। মুসলিমদের যারা না বুঝে দুশমনদের এ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছে, তাদের তাওবা করে সত্যের দিকে ফিরে আসা উচিত।
উল্লেখ্য যে, সমগ্র হাদীছ অস্বীকারকারীদের সংখ্যা আহাদীছুল আহাদ অস্বীকার করে শুধু মুতাওয়াতির হাদীছকে গ্রহণকারীদের সংখ্যার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এমনকি আমাদের পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে এ দ্বিতীয় দলের কেউ আছেন বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে প্রথম দলের বেশ কিছু অনুগামী এ দেশে পূর্বেও ছিলো, আজও আছে।
৪.৩ মান নির্ণয় ব্যতীতই হাদীছ অনুসরণে বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
প্রথম দল সকল প্রকার হাদীছকেই অস্বীকার করে। দ্বিতীয় দলের লোকেরা শুধু আল-হাদীছুল মুতাওয়াতির ব্যতীত সকল হাদীছকেই অস্বীকার করে। এ দুই দলের বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন ইতোমধ্যে আমরা সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপন করেছি। তাদেরই মত অন্য একশ্রেণীর লোকও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। তারা কোন যাচাই বাছাই না করেই জাল হাদীছ ও দুর্বল হাদীছকেও বিশুদ্ধ হাদীছের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। সকল হাদীছকেই বিচার বিশ্লেষণ না করে তা অনুসরণের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এদের দৃষ্টিভঙ্গি বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই নন্দিত হোক না কেন, তারাও মূলত বিভ্রান্তির বেড়াজালেই আটকা পড়েছে। তারা যা করছে, তা কোন সচেতন মুসলিমের কাছ থেকে কখনো কাম্য নয়।
হাদীছ সংকলনের পূর্বেই হাদীছকে কেন্দ্র করে যে সমস্যাগুলোর উদ্ভব ঘটে, এখানে এ বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য সেই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী। কখনো কখনো হাদীছ বর্ণনাকারীর মধ্যে স্মরণশক্তির অপ্রতুলতা, তাঁর কাজকর্ম আস্থাযোগ্য না হওয়া, তাঁর মধ্যে মিথ্যা বলার অভ্যাস ত্যাগ না করার মত বিভিন্ন দোষ পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে হাদীছ স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল বলে চি‎‎হ্নত হয়। একই ভাবে ইসলামী শারী‘আহকে কলুষিত করার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য যিনদিক, অগ্নিউপাসক, যারদাশী, মাযদাশীর মত পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের মতই অনেক সুফী-সাধক ও দার্শনিকরাও হাদীছ জাল করতে শুরু করে। তারা নিজের অনুসৃত মাযহাবের পক্ষে দলীলকে শক্তিশালী করা, অহেতুক মানুষদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, ভালো কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা, স্বীয় মতবাদের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি দাঁড় করানো প্রভৃতি লক্ষ্য অর্জনের জন্য অসংখ্য জাল হাদীছ রচনা করে, যা আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম না বললেও এমন অনেক কিছুকে তাঁর বক্তব্য বলেই চালিয়ে দেয়া হত। এ গুলো হচ্ছে একেবারেই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ আল-জুবিয়ারী, মুহাম্মাদ ইবন আকালাহ আল-কিরমানী, মুহাম্মাদ ইবন তানীমিল ফারয়ারী প্রত্যেকেই দশ হাজারের মত জাল হাদীছ রচনা করে। একই নিকৃষ্ট কাজে অংশ গ্রহণ করে মদীনার ইবন আবী উবাই, বাগদাদের আল-ওয়াকিদী, সিরিয়ার মুহাম্মাদ ইবন সায়ীদ আল-মাছলূব, খোরাসানের মুকাতিল ইবন সুলায়মান। মূলত এ সমস্ত হাদীছ মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা, ইসলামী ‘আকীদাহ বিশ্বাসে বিভ্রান্তি, অযৌক্তিক কাজ কর্মে অনুপ্রেরণা, ইসলামকে হাস্যকর করার মত বাজে অবস্থা সৃষ্টিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এমনকি এ সকল জাল হাদীছের মধ্যে এমন কথাবার্তাও রয়েছে, যা বিশুদ্ধ হাদীছ এমনকি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সাথেও সাংঘর্ষিক। এ পরিস্থিতিতে কোন যাচাই বাছাই না করে সকল হাদীছ অনুসরণের অর্থই হচ্ছে, অলক্ষ্যে দুর্বল এমনকি মিথ্যা ও জাল হাদীছকেই অনুসরণ করা যা মূলত কখনো কখনো মানুষের ঈমান আকীদাকেও বিনষ্ট করে ফেলতে পারে, ইবাদাতকে ধ্বংস করতে পারে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে পারে। এ সকল ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে ইসলামকে রক্ষনাবেক্ষন করার জন্যই আববাসীয় খালীফা আবূ জা‘ফর আল-মানছুরের নির্দেশনায় ইমাম মালিক ইবন আনাস রাহিমাহুল্লাহ সর্ব প্রথম একলাখ দুর্বল ও জাল হাদীছ থেকে বেছে বেছে সাতশ’ ছাহীহ হাদীছ সংকলন করেন, যা আল মুওআত্তা’ নামে পরিচিত। এরপর আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এক লক্ষ হাদীছ হতে পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে চার হাজার এবং মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ তিন লাখ হাদীছ হতে পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে প্রায় ছয় হাজার হাদীছকে ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য বলে চিহ্নিত করেছেন। অন্যান্য হাদীছ সংকলকের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। এদ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছের চেয়ে দুর্বল ও জাল হাদীছের সংখ্যা বেশি হলেও আল্লাহর অপার রাহমাত যে, তিনি তাঁর বিশেষ কিছু হাদীছ বিশারদ বান্দাকে সৃষ্টি করে তাঁদের মাধ্যমে হাদীছ তথা ইসলামী শারী‘আর অন্যতম উৎসকে মারাত্মক বিধ্বংসী ব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করেছেন এবং জাল হাদীছগুলোকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর স্বকীয়তা অটুট রেখে একে সমুন্নত থাকার ব্যবস্থা করেছেন। অন্যথায় ইসলামী শারী‘আর যে করুণ পরিণতি ঘটত তা থেকে ইসলামকে কোনভাবেও রক্ষা করা সম্ভব হত না। সে জন্য মুসলিম উম্মাহকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘লার কোটি কোটি শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত।
জাল ও দুর্বল হাদীছের কুপ্রভাবঃ
জাল ও দুর্বল হাদীছ অসংখ্য মুসলিমকে ঈমান আকীদাহ, আমল আখলাক, সামাজিক রীতিনীতি, এক কথায় ইসলামের সঠিক ধ্যাণ ধারণা থেকে বিচ্যুত করে। অনেককে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করে ফেলে। বিতর্কিত করে তোলে ইসলামী শারী‘আকে। ইসলাম নিয়ে শত্রুদেরকে অহেতুক মিথ্যা অভিযোগ সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়ে, ইসলামকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করে। এগুলোর জাজ্জ্বল্য প্রমাণ হিসাবে উদাহরণ স্বরূপ তথাকথিত এসব হাদীসের দু’একটি এখানে উপস্থাপন করা হল-
1. বর্ণিত হয়েছে-
النظر إلى الوجه الحسن يجلو البصر والنظر إلى الوجه القبيح يورث الكلح
‘সুন্দর চেহারার দিকে তাকালে চক্ষু তীক্ষ্ম হয়, আর অসুন্দর চেহারার দিকে তাকালে কুৎসিত চেহারার উত্তরাধিকারী হতে হয়।’ আরো রচিত হয়েছে-
النظر إلى الوجه الجميل عبادة
‘সুন্দর চেহারার দিকে তাকানো ইবাদাত ।’
হাদীছ দু’টি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত হয়েছে বলা হলেও হাদীছ দুটি জাল, যা অন্যরা রচনা করেছে। আল-কুরআনে পুরুষদেরকে মহিলাদের থেকে আর মহিলাদেরকে পুরুষদের থেকে দৃষ্টি নিম্নগামী রাখাকে অপরিহার্য করা হয়েছে। এ হাদীছ মূলত: কুরআনের এ বাণীর পরিপন্থী। যারা এ হাদীছ পালন করে, তারা মূলত দৃষ্টি নিম্নগামী রাখার কুরআনী নীতি ভংগ করে কবীরা গুনাহর মত পাপে লিপ্ত হয়। সুতরাং জাল হাদীছ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে পাপ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, এ হাদীছ তারই প্রমাণ। এমনি অসংখ্য জাল হাদীছ মানুষদেরকে ছাওয়াব প্রাপ্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করলেও তা মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী না হওয়ার কারণে উক্ত হাদীছে বর্ণিত আমল করে মানুষ সময়ের অপচয় করে; তেমনি ইসলামের পক্ষ থেকে সেটি ছাওয়াবের কাজ বলে স্বীকৃত না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ছাওয়াবও তাদের ভাগ্যে জুটছেনা। একই ভাবে এ সব জাল হাদীছ মানুষকে সস্তা আমলের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ায়, মানুষ ছাহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত বহু উত্তম কাজকে বর্জন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। বিশেষ যিকরের মাধ্যমে পৃথিবীর চেয়ে প্রশস্ত জান্নাত প্রাপ্তির সুযোগের সন্ধান দিলে যত বড় ছাহীহ হাদীছেই জিহাদের কথা বলা হোক না কেন তা কি কেউ কার্যে পরিণত করতে যাবে? কখনো নয়। নির্ধারিত পরিমাণ ছাদাকাহ দিলে কোন ব্যক্তির জান্নাতে যাওয়া নিশ্চিত হলে, কেউ কি সুদ, ঘুষ ও মুনাফাখোরী বর্জন করে দরিদ্রতাকে মেনে নিতে চাইবে? বরং এ সব আকাম-কুকামের দ্বারা অর্জিত অর্থ দিয়েই ছাদাকাহ প্রদানের মাধ্যমে জান্নাত ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় নামবে, এটাই স্বাভাবিক। এসব জাল হাদীছ দ্বারা ইসলামের আসল কাজ বাদ দিয়ে অনেকেই ইসলামের নামে একাজ সেকাজ করে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর থাকে। আসল কাজ বাদ দিয়ে অনর্থক কাজ করলে তার পরিণতি শুভ হওয়ার কথা নয়। মুসলিম সমাজের বেশ কিছু লোক বাছ-বিচার না করে জাল ও দুর্বল হাদীছ অনুসরণ করার কারণে এ সমাজকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
২. বণিত হয়েছে-
عن سلمان قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: كنت أنا وعلى نورا بين يدى الله قبل أن يخلق آدم بأربعة عشر ألف عام، فلما خلق الله آدم قسم ذلك النور جز أين، جزء أنا وجزء علي.
‘সালমান রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির পূর্বেই আমি ও আলী চৌদ্দ হাজার বছর আল্লাহর নিকটে নূর হিসেবে সংরক্ষিত ছিলাম, আদম সৃষ্টির সময় তিনি এ নূরকে দুই ভাগে ভাগ করেন তার একটি অংশ আমি এবং অন্য অংশ আলী।’ আজগুবী এ হাদীছটি যে আলী রাদিআল্লাহু ‘আনহুর ভালবাসায় অতিরঞ্জনকারী শি‘আদের দ্বারাই রচিত হয়েছে, তা সহজেই বুঝা যায়। ইসলামের ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য খুলাফায়ে রাশিদূনের তিনজন খালীফা আবূ বাকর, উমার ও ‘উছমান রাদিআল্লাহু ‘আনহুমের খিলাফাতকে অবৈধ ঘোষণা করে আলী রাদিআল্লাহ আনহুকেই একমাত্র খিলাফাতের হকদার প্রমাণিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। তারা এ জন্য আলী রাদি আল্লাহু আনহু এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা সম্বলিত এরূপ অসংখ্য হাদীছ নিজেরাই তৈরি করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামে চালিয়ে দিয়েছে। তথাকথিত এ সব হাদীছ জাল করা ও তা অনুসরণের অর্থ হচ্ছে, ইজমায়ে ছাহাবী দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইসলামী খিলাফাতকে বিতর্কিত করা। আর ইসলামী খিলাফাতকে বিতর্কিত করতে পারলেই ইসলামের ভিতকে নড়বড়ে করা সম্ভব। শত্রুদের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাতা এ ফাঁদে কোন মুসলিমের পা দেয়া সমীচীন নয়। একই ভাবে তাদের ভাষায় রাসূলুললাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন-
" النظر إلى علي عبادة "
‘আলীর দিকে দৃষ্টিদান ইবাদাত।’ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
علي خليفتي‘আলী আমার খালীফা।’
এসব জাল হাদীছ যদি যাচাই বাছাই না করে আমল করা শুরু হয় তাহলে ইসলামের অবস্থাটা কি হবে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনে জাল হাদীছ গুলো প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফারয।
৩. বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال قال النبي صلى الله عليه و سلم: عرى الإسلام وقواعد الدين ثلاثة عليهن أسس الإسلام من ترك واحدة منهن فهو بها كافر حلال الدم شهادة أن لاإله إلا الله والصلاة المكتوبة وصوم رمضان .
‘ইবন ‘আববাস রাদি আল্লাহু আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘ইসলামের বন্ধন ও দীনের ভিত্তি হচ্ছে তিনটি, যার উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। এর একটি বর্জন করলে সে কাফির, তাকে হত্যা করা বৈধ। আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, এ কথার সাক্ষ্য দান, ফরজ ছালাত আদায়, রমাদানের ছিয়াম পালন।’ এটি একটি দায়ীফ তথা দুর্বল হাদীছ। দুটি কারণে এ হাদীছের উপর আমল করা দুরূহ। প্রথমত: হাদীছটি আল-বুখারী ও মুসলিম রাহিমাহুমাল্লাহ একমতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক। উক্ত হাদীছে ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বলে উল্লেখ হয়েছে। সেখানে উল্লেখিত অন্য দুটি ভিত্তি হচ্ছে, যাকাত প্রদান ও হজ্জ পালন; সুতরাং এ দুর্বল হাদীছ দ্বারা ইসলামের ভিত্তির সংখ্যা তিনের মধ্যে সংকুচিত করার মাধ্যমে, মূলত এখানে ইসলামের মূল ভিত্তির সংখ্যাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: উল্লেখিত এ দুর্বল হাদীছে যে কোন একটি ভিত্তি বর্জন কারীকে হত্যাযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামে ফারযকৃত কোন কাজ অস্বীকার না করে, শুধু এমনিতে তা বর্জন করলে, সে হত্যাযোগ্য কাফির, এমন কোন প্রমাণ অন্য হাদীছে তো নেইই, এমনকি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আল-খুলাফাউর রাশীদূনের কর্মকান্ডেও এ রূপ দেখা যায় না। হাদীছে বলা হয়েছে-
عن أبي سفيان قال سمعت جابرا يقول سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول: إن بين الرجل وبين الشرك والكفر ةرك الصلاة .
‘আবূ সুফিয়ান রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, আমি জাবির রাদিআল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, একজন মানুষের শিরক ও কুফর করার মধ্যে পার্থক্য ছালাত বর্জনই নির্ধারণ করে।’ এখানে ছালাত ত্যাগকে কুফরী বললেও সে যে হত্যাযোগ্য তার বর্ণনা নেই। অন্যত্র এ মর্মে কোন হাদীছও খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং এ দুর্বল হাদীছের বক্তব্য কার্যকর করলে যেমন ছাহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়, তেমনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাললাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আল-খুলাফাউর রাশীদূনের অনুসৃত কার্যক্রমের বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়। আর এ রূপ কোন কাজকর্ম মূলত ইসলামের ভিতকে সমস্যাগ্রস্ত করে তোলে। ইসলামকে করে প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্বল হাদীছ যে ইসলাম পরিপালনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে, এটা তার স্পষ্ট প্রমাণ।
৪. বর্ণিত হয়েছে-
أن أبا الدرداء قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا سمعتم بجبل زال عن مكانه فصدقوا وإذا سمعتم برجل تغير عن خلقه فلا تصدقوا به...
‘আবূদ্ দারদা’ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাললাম বলেছেন- ‘যখন তোমরা শুনবে যে, একটি পাহাড় স্থানচ্যুত হয়েছে, তোমরা তা বিশ্বাস করলেও যখন শুনবে কেউ তার চরিত্র পরিবর্তন করেছে, তখন তা বিশ্বাস করবে না...।’
হাদীছটি দুর্বল হাদীছ। হাদীছটিতে দুটি বিষয় গুরুত্বসহকারে অনুধাবন করা প্রয়োজন। প্রথমত: হাদীছটি বিশুদ্ধ হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক। বর্ণিত হয়েছে-
عن أبى أمامة قال قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أنا زعيم... وببيت فى أعلى الجنة لمن حسن خلقه.
‘আবূ উমামাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘আমি সর্বোচ্চ জান্নাতে অবস্থিত ঘরে বসবাসকারী উত্তম চরিত্রবানদের নেতা।’ যদি কারো নিজ প্রচেষ্টায় উত্তম চরিত্র অর্জন সম্ভব না হয়, তাহলে তাদেরকে সর্বোচ্চ জান্নাতের পুরস্কার কেন দেয়া হবে? দ্বিতীয়ত: এখানে উল্লেখিত এ দুর্বল হাদীছ দ্বারা বুঝা যায়, মানুষকে যে চরিত্র দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা পরিবর্তন হওয়ার নয়। ইসলামের ভ্রান্ত একটি সম্প্রদায় যারা তাকদীরের ব্যাপারে মানুষ অপারগ ও কর্তৃত্বহীন বলে মনে করে, এ হাদীছটিকে তারা ব্যবহার করে তাদের অ©র্ভমতকে সুদৃঢ় করেছে। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাতি ওয়াল-জামা‘আতের মত হচ্ছে, মানুষই ভালকাজ ও মন্দকাজ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সে ইচ্ছা করলে ভাল কাজও করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে খারাপ কাজও করতে পারে। সে তার ইচ্ছাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে স্বাধীন বলেই সে পুরস্কার ও তিরস্কারের অধিকারী হবে। সুতরাং বিশুদ্ধ হাদীছের বিপরীতে এ হাদীছের অবস্থান ও একইভাবে আহলুস সুন্নাতি ওয়াল-জামা‘আতের ‘আকীদাহ বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া; এ কথারই প্রমাণ বহন করে যে, এ ধরণের বহু দুর্বল হাদীছ মূলত ইসলামী চিন্তা চেতনা ও ‘আকিদার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যা তৈরি করেছে।
৫. আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن أبى هريرة قال قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - : من سافر يوم الجمعة دعا عليه ملكاه أن لا يصاحب في سفره ولا ةقضى له حاجة.
‘আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি জুম‘আবারে ভ্রমণ করে, দুইজন ফেরেশতা তার জন্য এ বদ দু‘আ করে যে, কেউ যাতে তার সাথী না হয় এবং তার প্রয়োজন যাতে পূর্ণ না হয়।’ হাদীছটি জাল ও বানোয়াট হাদীছ। ইসলামে কোন বিশেষ দিনে ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। বরং এর বিপরীতে বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে-
عن الأسْودَ بن قَيْس عن أبيه قال: - أبْصَرَعُمَرُ بن الخطَّاب رجُلاً على هَيْئَةِ السَّفَر فسمعه يقول : لولا أن اليوم يَوْمُ جمعة لخرجتُ . فقال عمر : أخْرُجْ فَإنَّ الجمعة لا تحبُس عن سفر.ٍ
‘আল-আসওয়াদ ইবন কায়িস তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহু একজন লোককে জুম‘আবারে সফরের ব্যাপারে এ কথা বলতে শুনলেন যে, আজ জুম‘আবার না হলে, আমি সফরে বের হতাম। তিনি বললেন, ‘বের হও, জুম‘আবার কাউকে ভ্রমণ থেকে বিরত রাখে না।’ সুতরাং কখনো কখনো জাল হাদীছ ইসলামের ন্যূনতম সম্পর্কহীন বিষয়কে জটিল করে উপস্থাপন করে। এ হাদীছটি তার বড় প্রমাণ। একই সাথে ইসলাম বিশেষ কোন দিনকে যে অশুভ বলে চি‎‎হ্নত করে না, এ হাদীছটি তার সাথেও সাংঘর্ষিক।
৬ . বর্ণিত হয়েছে-
عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - : من قرأ قل هو الله أحد مايتي مرة كتب الله له الفا وخمس مائة حسنة إلا أن يكون عليه دين.
‘আনাস রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুইশত বার قل هوالله احد পড়বে, যদি তার কোন ঋণ না থাকে, তাহলে আল্লাহ তার জন্য এক হাজার পাঁচশত ছাওয়াব লিখবেন।’ হাদীছটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত। এভাবে ছাওয়াবের প্রতিশ্রুতি দেয়া এরূপ বহু জাল হাদীছ রয়েছে। এ সব হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয় নি। সে জন্য এ মিথ্যা হাদীছের উপর ভিত্তি করে কেউ এ সব আমল করলে সে যে কোন ছাওয়াবই পাবে না এটাই বাস্তব। সে ছাওয়াব প্রাপ্তির আশায় এ গুলো করবে কিন্তু সে কোন ছাওয়াবই পাবে না, তাহলে তার এ কাজ হচ্ছে মূল্যহীন। তাকে সময় অপচয় করে মূল্যহীন কাজ করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ তো করেছে এ মিথ্যা হাদীছই। সুতরাং এরূপ অসংখ্য মিথ্যা হাদীছ যে মানুষকে অহেতুক মূল্যহীন কাজ করিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তা জাজ্জ্বল্যভাবে প্রমাণিত।
৭. বর্ণিত হয়েছে -
عن حبان بن أبي جبلة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: كل أحد أحق بماله من والده وولده والناس أجمعين.
‘‘হিববান ইবন আবী জাবালাহ রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘প্রত্যেকেই তার পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষের চেয়েও নিজের সম্পদ ব্যবহারে নিজেই বেশি হকদার।’ অর্থাৎ, নিজের সম্পদ যে কোন ব্যক্তি যেমন ইচ্ছা তেমন খরচ করতে পারে, যাকে ইচ্ছা তাকে দেয়ায় অধিকার রাখে। এ হাদীছটি খুবই দুর্বল। এটি ছাহীহ আল-বুখারী ও ছাহীহ মুসলিমের ছাহীহ হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক। এ দুর্বল হাদীছটি নিজের সন্তানদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে অনুমোদন দেয়। পক্ষান্তরে একটি ছাহীহ হাদীছে নু‘মান ইবন বাশীর রাদিআল্লাহু আনহুর পিতা নু‘মানের অন্য ভাইকে সম্পদ না দিয়ে শুধু নু‘মানকে দিলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
فاتقوا الله واعدلوا بين أولادكم
‘আল্লাহকে ভয় কর, এবং তোমার সন্তানদের মধ্যে ইনছাফ কর।’
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ইনছাফ ও ন্যায়নীতি গ্রহণকে অপরিহার্য করেছে, এ দুর্বল হাদীছটি ইসলামের সেই বৈশিষ্ট্যেরও বিরোধী।
৮. বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي هريرة، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إن لله ةسعة وةسعين اسما كلهن في القرآن، من أحصاهن دخل الجنة".
আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাললাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিরানববইটি নামের প্রত্যেকটি আল-কুরআনে রয়েছে, যে তা গণনা করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ আসলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালার ৯৯টি নাম আল-কুরআনে নেই। সেই হিসেবে এ হাদীছটি হচ্ছে মুনকার। অর্থাৎ, এ হাদীছ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক।
৯.বর্ণিত হয়েছে-
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
من ةمسك بالسنة دخل الجنة. قالة عائشة ما السنة؟ قال حب أبيك وصاحبه يعنى عمر.
‘যে সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। ‘আয়িশাহ রাদিআল্লাহু আনহা বললেন, সুন্নাহ কি? তিনি (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন- তোমার পিতা ও তার সংগী অর্থাৎ ‘উমার কে ভালবাসা।’
হাদীছটি দুর্বল। সুন্নাহ বলতে যা প্রচলিত তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাজ, কথা ও সমর্থিত বিষয়। এখানে উল্লেখিত ‘সুন্নাহ’ শব্দটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে দুইজন ছাহাবী আবু বাকর ও ‘উমার রাদিআল্লাহু ‘আনহুমার ভালবাসাকে সুন্নাহ বলে উল্লেখ করা হাদীছটিকে বিতর্কের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। অন্য কোন ছাহীহ হাদীছও সুন্নাহ-এর এ অর্থ বহন করে না। একইভাবে শুধু এ দুইজন ছাহাবী রাদি আল্লাহু ‘আনহুমাকে ভালবেসেই জান্নাতে যাওয়ার বিষয়টিও গ্রহণীয় নয়। শি‘আ সম্প্রদায় আলী রাদিআল্লাহু ‘আনহুর ভালবাসার অতিরঞ্জন করে অসংখ্য হাদীছ নিজেরাই রচনা করেছে। তারা আবূ বাকর ও ‘উমার রাদিআল্লাহু ‘আনহুমাকে গালি গালাজ করতেও দ্বিধা করেনি। তাদের বিপরীতে অবস্থানকারীরা নিজেদের সপক্ষের মতকে সুদৃঢ় করার জন্য এ হাদীছটি নিজেরা রচনা করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। মোট কথা, দুর্বল হাদীছ ইসলামে যথেষ্ট সমস্যা সৃষ্টি করে, এ হাদীছটিও তার স্পষ্ট প্রমাণ। ছাহীহ হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুন্নাহ সম্পর্কে বলেছেন-
عن عبد الرحمن بن عمرو السلمي أنه سمع العرباض بن سارية قال: وعظنا رسول الله صلى الله عليه وسلم... فعليكم بما عرفتم من سنتي وسنة الخلفاء المهديين الراشدين.
‘‘আবদুর রাহমান ইবন ‘আমরিস সালামী রাদি আল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার সুন্নাহ ও সঠিক পথপ্রাপ্ত আল-খুলাফাউর রাশিদূনের সুন্নাহর যা তোমরা জানতে পেয়েছ, তা পরিপালন তোমাদের উপর অত্যাবশ্যক।’ উপরে উল্লেখিত ঐ দুর্বল হাদীছটি এ ছাহীহ হাদীছের সাথেও সাংঘর্ষিক।
১০. আরো বর্ণিত হয়েছে -
من زارني وزار أبي ابراهيم في عام واحد دخل الجنة.
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি একই বছরে আমাকে ও আমার পিতা ইবরাহীমকে যিয়ারত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
হাদীছটি ইবন তাইমিয়্যার নিকট জাল, ইমাম নববীর নিকট এটি ভিত্তিহীন। অন্য একটি ছাহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لا تشدوا الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد مسجدي هذا والمسجد الحرام والمسجد الأقصى.
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘তিনটি মাসজিদ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর উদ্দেশ্যে সফর করবে না।’ উপরের জাল হাদীছটি এ ছাহীহ হাদীছটির সাথেও সাংঘর্ষিক।
এ রূপ জাল ও দুর্বল হাদীছ মূলত: ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমস্যাগ্রস্ত করে ফেলেছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে মুসলিম উম্মাহ বিচ্যুত হয়ে এসব হাদীছের অনুসরণ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। এ গুলো ইসলামী শারী‘আহকে দ্বিধা বিভক্তির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। যার অনিবার্য পরিণতিতে মুসলিম উম্মাহ ইসলামী বিধান নিয়ে হয়েছে দ্বিধা বিভক্ত। হাদীছ যাচাই বাছাই করে বিশুদ্ধ হাদীছকেই শুধু গ্রহণ করলে এ হাজারো সমস্যা থেকে মুসলিম উম্মাহ নিষ্কৃতি পেত। সেজন্য মুসলিম উম্মাহর বিশুদ্ধ হাদীছ থেকেই ইসলামী শারী‘য়াহ বুঝে তা বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
বলাবাহুল্য, জাল ও দুর্বল হাদীছ তো দূরের কথা, বর্তমানে বিভিন্ন বুজুর্গ ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে এমন সব আজগুবি, অলীক কথাবার্তায় পরিপূর্ণ অসংখ্য বই বাজারে ছাড়া হচ্ছে, যা মূলত সঠিক ইসলামের প্রতিনিধিত্ব তো করেই না বরং তা দ্বারা মুসলিম উম্মাহ বিভ্রান্ত হচ্ছে। হাদীছ গ্রহণের ক্ষেত্রে যেখানে খুবই সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য, সেখানে মনীষীদের এ সব কথাবার্তা কি এমনিতেই গ্রহণ করা ঠিক? সুতরাং জাল ও ভিত্তিহীন হাদীছ একেবারেই বর্জনীয়। সাথে সাথে অন্যান্যদের এই সব কথাবার্তা যা ছাহীহ হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক, ইসলামী ‘আকীদাহ বিশ্বাসের পরিপন্থী তাও প্রত্যাখ্যান করা অপরিহার্য।
৪.৪ বিশুদ্ধ হাদীছ বর্জন করে বিশেষ ব্যক্তি,সম্প্রদায় ও মাযহাবের অন্ধানুকরণে বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
ফারয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম ইসলামী শারী‘আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মুজতাহিদ ইমামগণের দৃষ্টিভংগির পার্থক্য হওয়ার কারণে, শারী‘আহ সংক্রান্ত যে মাযহাবগুলোর উদ্ভব হয়েছে, তা মূলত ফারয-ওয়াজিব ও হালাল-হারামকে কেন্দ্র করে নয়। এ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে সুন্নাহ, নফল, মুবাহ, সর্বোত্তম নির্বাচনের ভিন্নতা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। আল-কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বর্ণনার দ্বারা ফারয-ওয়াজিব ও হালাল-হারাম যা নির্ধারিত হয়েছে, দু’একটি বিষয় ব্যতীত সে সম্পর্কে সকল মাযহাব এক ও অভিন্ন। সে জন্য ছালাত কত ওয়াক্ত, কোন কোন ওয়াক্তে কত রাক‘আত ফারয, কোন মাসে ছিয়াম পালন ফারয ইত্যাদি নিয়ে কোন মাযহাবে মত পার্থক্য নেই। সুন্নাহ, নফল ও মুবাহ বিষয়ে কখনো কখনো মতপার্থক্য হওয়ার কারণ হিসাবে মুজতাহিদ আলিমদের হাদীছ কেন্দ্রিক দৃষ্টিভংগি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। হাদীছের সানদ, মূল বক্তব্য, বর্ণনাকারী প্রভৃতি ক্ষেত্রে এক একজনের দৃষ্টিভংগি এক এক হওয়ার কারণে, তাঁদের মতামতও ভিন্ন হয়ে থাকে। কোন কোন সময় কোন কোন হাদীছ উক্ত মতামত প্রদান করার সময় মতামত প্রদানকারীর নিকট না পৌঁছানোর কারণেও এ মত পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আশার বাণী হচ্ছে এটাই যে, প্রত্যেক মাযহাবের ইমাম তাঁর মতামতের বিপরীতে কোন বিশুদ্ধ হাদীছ পরবর্তীতে পাওয়া গেলে, সেই হাদীছের বক্তব্য তাঁর মাযহাবের বিপরীতে হলেও উক্ত বিশুদ্ধ হাদীছের বক্তব্যই তাঁর মাযহাব হিসেবে গণ্য হবে বলে, স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে যে কোন মুসলিম, বিশুদ্ধ কোন হাদীছের সন্ধান পেলেই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদানের লক্ষ্যে নিজের মাযহাবের প্রতি অন্ধ অনুকরণ বর্জন করে ঐ হাদীছকে গ্রহণ করাই ছিল ইসলামের অনিবার্য দাবী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এরূপ পরিস্থিতিতে নিজের অনুকরণীয় মাযহাবের প্রতি গোঁড়ামী প্রদর্শন করে, ঐ হাদীছের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাতেও কোন কোন মুসলিম পিছপা হন না। এটি একটি চরম বিভ্রান্তি। এ বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার কারণে অনেক মুসলিম অনেক সময় বিশুদ্ধ হাদীছ পরিপালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে দু’একটি উদাহরণ উপস্থাপন করা খুবই জরুরী। যেমন :
১. সফরে একত্রে দুই ওয়াক্ত ছালাত আদায়:
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
أَنَّ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ أَخْبَرَهُمْ أَنَّهُمْ خَرَجُوا مَعَ رَسُولِ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي غَزْوَةِ تَبُوكَ فَكَانَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْمَعُ بَيْنَ الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ .
‘মু‘আয ইবন যাবাল রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন যে, তাঁরা তাবুকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বের হয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সময় যুহর ও আছর এবং মাগরিব ও ইশার ছালাতকে একত্রিত করে আদায় করেছিলেন।’’ বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ كَانَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْمَعُ بَيْنَ الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ فِي السَّفَر.
‘আনাস ইবন মালিক রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুহর ও আছর এবং মাগরিব ও ইশার ছালাতকে সফর অবস্থায় একত্রিত করে আদায় করতেন।’
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
عن ابْنُ عَبَّاسٍ أنه قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَمَعَ بَيْنَ الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ وَالْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ.
ইবন আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যুহর ও আছর এবং মাগরিব ও ইশার ছালাতকে একত্রে আদায় করতে দেখেছি।’
ইমাম আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ বুখারী শরীফে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন-
الجمع فى السفر بين المغرب والعشاء.
‘সফর অবস্থায় মাগরিব ও ইশার ছালাতকে একত্রে আদায় করণ’। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন-
عَنْ سَالِمٍ ابن عبد الله عَنْ أَبِيهِ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْمَعُ بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ إِذَا جَدَّ بِهِ السَّيْرُ.
‘সালিম ইবন ‘আবদিল্লাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফরে তাড়াতাড়ি করতে চাইলে, মাগরিব ও ইশার ছালাতকে একত্রে আদায় করতেন।’
মূলত রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে অনেক হাদীছ এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি সফর অবস্থায় একত্রে দুই ওয়াক্তের ছালাত আদায় (جمع بين الصلاتين) করতেন। সেই হাদীছগুলো থেকে এখানে কয়েকটি হাদীছ উল্লেখ করা হলো। এ হাদীছগুলো স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, কোন মুসলিম সফর অবস্থায় একই সাথে দুই ওয়াক্তের ছালাতকে একত্রে আদায় করার ইচ্ছা করলে হাদীছ দ্বারা তা অনুমোদিত। অনেক মুসলিম রয়েছেন, এক্ষেত্রে সফরে দুই ওয়াক্ত ছালাতকে একই সাথে একত্রিত করে আদায় করাকে তো বৈধ মনে করেনই না, বরং কেউ তা করলে কঠোর ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। এটা কি হাদীছের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের প্রমাণ বহন করে? যেহেতু এর স্বপক্ষে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ রয়েছে, তার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য না দেখিয়ে, নিজে নিজেই হোক অথবা অন্য কোন পক্ষ থেকে প্রভাবিত হয়েই হোক; গোঁড়ামী বশত এ হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, হাদীছ পরিপালনের ক্ষেত্রে চরম আকারের বিভ্রান্তি নয় কি?
২. ফসলের যাকাত:
ইসলামের পক্ষ থেকে নির্ধারিত সম্পদের যাকাত ফারয। সম্পদের যাকাতের মত, ফসলের যাকাতও ফারয। আল-কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, وآتوا حقه يوم حصاده ‘ফসল কাটার দিন তাদের হক তাদেরকে দিয়ে দাও।’’
এখানে আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশের কারণে ফসলের যাকাত ফারয । তাছাড়া এ প্রসঙ্গে ছাহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ عَنْ أَبِيهِ رَضِيَ اللّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: فِيمَا سَقَتْ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشْرُ وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ.
সালিম ইবন ‘আবদিল্লাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানিতে অথবা প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত মাটি হতে উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ এবং সেচ দ্বারা উৎপাদিত শস্যের এক দশমাংশের অর্ধেক (যাকাত হিসেবে) দিতে হবে।’
অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ بعَثَنِي رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْيَمَنِ وَأَمَرَنِي أَنْ آخُذَ مِمَّا سَقَتْ السَّمَاءُ وَمَا سُقِيَ بَعْلًا الْعُشْرَ وَمَا سُقِيَ بِالدَّوَالِي نِصْفَ الْعُشْرِ
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ইয়ামানে এ নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেন যে, আমি যাতে বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে উৎপাদিত শস্যের এক-দশমাংশ এবং সেচ দ্বারা উৎপাদিত শস্যের এক-দশামাংশের অর্ধেক (যাকাত হিসাবে) গ্রহণ করি।’
আরো বর্ণিত হয়েছে-
أن أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ.
‘নিশ্চয় আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু ‘আনহু বলতেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত নেই।’
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ مِنْ التَّمْرِ صَدَقَةٌ
‘আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু ‘আনহু বলতেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম খেজু্র উৎপাদিত হলে তার যাকাত নেই।’ এক ওয়াসাক হচ্ছে, ১২৯ কিলোগ্রাম, সুতরাং ৫ ওয়াসাক হচ্ছে, ৬৪৫, কেজি বা পঁচিশ মণ পাঁচ কেজির সমান।
উল্লেখিত এ হাদীছসমূহ অনুধাবন করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন মৌসুমে কেউ কম পক্ষে পঁচিশ মণ পাঁচ কেজি কোন ফসল উৎপাদন করলে, সেচ দ্বারা তা উৎপন্ন হলে, বিশ ভাগের একভাগ, আর সেচ দ্বারা উৎপন্ন না হয়ে এমনিতে উৎপন্ন হলে, তার দশভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে দিয়ে দেয়া অপরিহার্য। এ যাকাত আদায় করাই হচ্ছে, উল্লিখিত ছাহীহ হাদীছগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার একান্ত দাবী।
পক্ষান্তরে যে কোন বাহানায় এ যাকাত কেউ আদায় না করলে, তিনি হাদীছ পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে গণ্য হওয়াই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য যে, অনেকে বিশেষ কোন আলিম সম্প্রদায় বা মাযহাবের অনুকরণ করে ফসলের এ যাকাত না দেয়ার যুক্তি হিসেবে, উক্ত জমির খাজনা দেন বলে কারণ উল্লেখ করে থাকেন। হাঁ, এটা যথার্থ যে, খারাজী জমির উৎপাদিত ফসলের যাকাত দিতে হয় না । তবে ইসলামের বিজ্ঞ ফকীহদের মতামত অনুযায়ী, আমাদের দেশে, আমরা আমাদের সরকারকে যে খাজনা দেই, তা ও খারাজ যে এক নয়, আমরা অনেকেই বুঝি না। খারাজী জমির গ্রহণ যোগ্য সংজ্ঞা বিবেচনা করলে দুই ধরণের জমিকে খারাজী জমি বলে চিহ্নিত করা যায়। বলা হয়েছে-
وهي أرض العجم التي فتحت عنوة فأبقيت بأيدي أصحابها وضرب عليها الخراج ، أو الأرض التي صالح أهلها عليها على خراج يؤدونه .
ক. সেটি ঐ ভূখন্ড, যা যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমদের দখলে আসলেও উক্ত জমির অমুসলিম মালিকরা, ইসলামী রাষ্ট্রের উক্ত জমি নিজেদের দখলে রাখে এবং বিনিময়ে উক্ত জমির জন্য নিজেদের পক্ষ হতে নির্ধারিত কর আদায় করে থাকে।
খ. যুদ্ধের মাধ্যমে তা মুসলিমদের দখলে না আসলেও ঐ জমির অমুসলিম মূল মালিকরা সন্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত কর আদায় করতে স্বতস্ফূর্ত ভাবে একমত হয়।
এ সংজ্ঞার আলোকে আমাদের দেশের ফসলী জমি যুদ্ধ করেও প্রাপ্ত নয় এবং বিশেষ কর দেয়ার শর্তে সন্ধির মাধ্যমেও প্রাপ্ত নয়। সুতরাং এ জমি কোন ভাবেই খারাজী জমি নয়। সেই জন্য একজন মুসলিমের ঈমানের অনিবার্য দাবীই হচ্ছে, উল্লেখিত এ ছাহীহ হাদীছগুলোর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখিয়ে ফসলের যাকাত দানের ক্ষেত্রে ছাহিবে নিছাব হলে তা যথাযথ আদায় করা। পরিতাপের বিষয় যে, এ সব হাদীস পরিপালনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে থাকার কারণে, অসংখ্য মুসলিম তাদের ঈমানের এ অনিবার্য দাবী পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
৩. কবর সংস্কৃতি:
ছাহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ.
‘জাবির রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর বাঁধাতে, তার উপর বসতে এবং তার উপর ঘর তৈরি করতে নিষেধ করেছেন।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে-
عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى النَّبِيُّ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تُجَصَّصَ الْقُبُورُ وَأَنْ يُكْتَبَ عَلَيْهَا وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهَا وَأَنْ تُوطَأَ.
‘জাবির রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর বাঁধাতে, তার উপর কিছু লিখতে, তার উপর ঘর তৈরি করতে ও তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন।’ আবূ সালমা বলেন, হাদীছটি হাসান ও ছাহীহ। কোন কোন হাদীছ গ্রন্থে পা দ্বারা দলিত করার কথাটি উল্লেখ নেই। এ হাদীছের অংশ বিশেষ উল্লেখ হয়েছে নাসাঈতে ও ইবন মাজাহতে।
এ হাদীছগুলো কবর পাকা করা, তার উপর গুম্বুজ বা যে কোন বিল্ডিং তৈরি ,তার উপর কিছু লেখাকে ষ্পষ্ট ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অন্য হাদীছও কবরের মাটিকে পর্যন্ত উচু না করে, তা সমতল করতে নির্দেশ দান করে। যেমন বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي الْهَيَّاجِ قَالَ قَالَ عَلِيٌّ رَضِيَ اللّهُ عَنْهُ أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَدَعَنَّ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ وَلَا صُورَةً فِي بَيْتٍ إِلَّا طَمَسْتَهَا.
‘আবুল হায়য়াজ বলেছেন, ‘আলী রাদি আল্লাহু ‘আনহু তাকে বলেন যে, আমি কি তোমাকে এমন একটি কাজে পাঠাব না, যে কাজে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন? আর তা হচ্ছে, কোন উচু কবর সমতল করা ব্যতীত ও কোন ঘরের ছবি মুছে ফেলা ব্যতীত ক্ষান্ত না হওয়া ।’
অন্য বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে-
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَائِرَاتِ الْقُبُورِ وَالْمُتَّخِذِينَ عَلَيْهَا الْمَسَاجِدَ وَالسُّرُجَ.
‘ইবন আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর যিয়ারতকারিণী মহিলা এবং কবরকে সিজদার স্থান ও প্রদীপের স্থানে পরিণতকারীদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন।’
আরো বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَأَنْ يَجْلِسَ أَحَدُكُمْ عَلَى جَمْرَةٍ فَتُحْرِقَ ثِيَابَهُ فَتَخْلُصَ إِلَى جِلْدِهِ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَجْلِسَ عَلَى قَبْرٍ.
‘আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর বসলে তার কাপড় পুড়ে এ আগুন তার চামড়ায় পৌঁছে যাওয়াটা, কোন কবরে বসার চেয়ে উত্তম।’
অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَأَنْ أَمْشِيَ عَلَى جَمْرَةٍ أَوْ سَيْفٍ أَوْ أَخْصِفَ نَعْلِي بِرِجْلِي أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَمْشِيَ عَلَى قَبْرِ مُسْلِمٍ.
‘‘উকবাহ ইবন ‘আমির রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জ্বলন্ত অঙ্গারের অথবা তরবারির উপর আমার চলা অথবা আমার জুতা আমার পায়ের সাথে সেলাই করে নেয়া, আমার নিকট কোন মুসলিমের কবরের উপর চলার চেয়ে উত্তম।’
উল্লিখিত এ হাদীছসমূহে কবর গাঁথা, উঁচু করা, ও কবরে বাতি দেয়া, কবরস্থানে বসে থাকাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে। বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারাই ইসলামে এসব কাজ অবৈধ প্রমাণিত হয়েছে। এতগুলো বিশুদ্ধ হাদীছ এ বিষয়ে বর্ণিত হওয়ার পরেও, আমাদের দেশে অনেক কবরেই এ সব নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে, যা মূলত ছাহীহ হাদীছের পরিপন্থী।
হাদীছের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করে কোন হাদীছকে প্রাধান্য দেয়ার ব্যাপারে যার যোগ্যতা নেই, তার জন্য অবশ্যই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগিতে হাদীছের তুলনামূলক পর্যালোচককে অনুকরণ করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে একজন বিশ্লেষক, গবেষক ও পর্যালোচকের সাথে অন্য বিশ্লেষক, গবেষক ও পর্যালোচকের মত পার্থক্য হলে, গোঁড়ামী করে কোন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই নিজের পছন্দনীয় বিশ্লেষক, গবেষক ও পর্যালোচকের মত গ্রহণ করলে, অন্যটিকে অগ্রহণীয় মনে করে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করা কোন ভাবেই সঠিক নয়। যে কোন কারণেই হোক কখনো কখনো একই বিষয়ে একাধিক সমালোচকের পক্ষে যদি একই মতের গ্রহণযোগ্য ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের হাদীছ পাওয়া যায়, তাহলে একটি মাত্র মতের পক্ষের হাদীছগুলো গ্রহণ করে এর বিপরীতে অবস্থিত হাদীছগুলোকে অবমূল্যায়ন করা ও এগুলির প্রতি কঠাক্ষ করাও কিন্তু আপত্তিকর।
এ বিষয়ে স্পষ্ট কথা হচ্ছে, কোন সঠিক হাদীছ পাওয়া গেলে এর বক্তব্য কোন মাযহাবের মতামতের বিরোধী হলেও উক্ত মতামত বর্জন করে, উক্ত হাদীছ অনুসরণ যেমন অত্যাবশ্যক; তেমনি দুই বা একাধিক সঠিক হাদীছ কোন বিষয়কে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে পরিপালন করার অনুমোদন রাখলে তার একটি গ্রহণ করে, অন্যটিকে একেবারেই বর্জন করা অথবা তার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করাও কোন নিরপেক্ষ হাদীছ অনুসরণকারীর কাজ নয়। নিজের মতের পক্ষের হাদীছটিই শুধু ছাহীহ, আর এর বিপক্ষের হাদীছ কিছুই নয়, এ ধারণাও বড় এক বিভ্রান্তি । আমি মাযহাব মানি না, এরই প্রবক্তা সেজে, অলক্ষ্যেই আবার অন্ধ অনুকরণীয় অন্য কোন মাযহাবের জন্ম দিলাম কি না, তাও বিবেচনায় আনা বিশুদ্ধ হাদীছের আনুগত্যের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৪.৪.১ মাযহাবের অন্ধানুকরণ সম্পর্কে ইমামদের বক্তব্য
চার মাযহাবকে কেউ কেউ কঠোর ভাষায় গালি গালাজ পর্যন্ত করেন। এর ইমামদেরকেও শক্ত ভাষায় তিরস্কার করেন। কিন্তু এ সকল ইমাম ছাহীহ হাদীছকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তাঁদের মতের বিপরীতে ছাহীছ হাদীছ পাওয়া গেলে উক্ত ছাহীহ হাদীছের বক্তব্যই তাঁর মত বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে তাঁদের পূর্বের মত রহিত বলে বিবেচিত হবে বলেও, তাঁরা স্পষ্ট বক্তব্য রেখে গেছেন । তাঁদের বক্তব্য নিম্নরূপ :
১. ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন-
إذا صح الحديث فهو مذهبي.
‘যখন হাদীছ বিশুদ্ধ হবে, তখন তা আমার মাযহাব বলেই গণ্য হবে।’ তিনি অন্যত্র বলেন-
لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه.
‘কারো জন্য এটা বৈধ হবে না যে, আমি আমার কথা কোন স্থান থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে গ্রহণ করা।’
1. ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেন -
ليس أحد بعد النبي إلا ويؤخذ من قوله ويترك إلا النبي.
‘নবীর পরে এমন কেউ নেই, নবী ব্যতীত যার কথা গ্রহণ যোগ্য ও বর্জন যোগ্য নয়।’ অর্থাৎ নবী বাদে সবাই ভুল করে, আমি ও অন্যান্যরাও নিশ্চয় ভুল করতে পারি। তিনি আরো বলেন-
إنما أنا بشر أخطئ وأصيب فانظروا في رأيي فإن وافق الكتاب والسنة فخذوه وما لم يوافقهما فاتركوه.
‘নিশ্চয় আমি মানুষ, ভুলও করি, নির্ভুলও করি, সেজন্য আমার মত দেখুন, এর মধ্যে যা কিতাব ও সুন্নাহর সাথে মিলবে তা গ্রহণ করুন, আর যা মিলবে না তা বর্জন করুন।’
৩. ইমাম শাফিঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন -
إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا قولي.
‘আমার গ্রন্থের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের বিপরীত কিছু দেখলে, আমারটি বর্জন করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতটি গ্রহণ করবেন।’ তিনি আরো বলেছেন-
"كل مسألة صحّ فيها الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم عند أهل النقل بخلاف ما قلت، فأنا راجع عنها في حياتي وبعد موتي."
‘প্রতিটি মাস‘আলাতে হাদীছ বিশারদদের থেকে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যদি তা আমি যা বলেছি তার পরিপস্থী হয়, তাহলে আমার জীবদ্দশায় ও ওফাতের পরেও আমি উক্ত মত থেকে ফিরে এসেছি বলে গণ্য হবে।’
৪. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
"لا تقلدني ولا تقلد مالكاً ولا الشافعي ولا الأوزاعي ولا الثوري، وخذ من حيث أخذوا."
‘আমাকে এবং মালিক, শাফিঈ, আল-আওযায়ী ও আছ-ছাওরী রাহিমাহুমুল্লাহ কাউকে অনুকরণ করো না, তারা যেখান থেকে গ্রহণ করেছে সেখান থেকে গ্রহণ কর।’
সুতরাং ইজতিহাদের ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টিভংগির কারণে অথবা হাদীছ তাঁদের নিকট না পৌঁছার কারণে একের থেকে অন্যের মত পৃথক হলেও, প্রত্যেক ইমামের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীছ অনুসরণ করা ও হাদীছের আলোকে যাতে প্রত্যেক মুসলিম চলেন তার দিক নির্দেশনা দেয়া। সেজন্য ইসলামের বিজ্ঞ মনীষীগণ চার মাযহাবের ইমামদের সম্পর্কে সামান্য কোন খারাপ ধারণাও পোষণ করতেন না। এ প্রসংঙ্গে সাউদী আরবে দারুল ইফতার ফাতওয়া বিভাগের সুস্পষ্ট বক্তব্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে-
لم يدع أحد من الأئمة الأربعة إلى مذهبه ولم يتعصب له، ولم يلزم الناس بالعمل به أو بمذهب معين، إنما كانوا يدعون إلى العمل بالكتاب والسنة -رحمهم الله- ويشرحون نصوص الدين، ويبينون قواعده، ... ويأمرون أن يضرب برأيهم عرض الحائط إذا خالف الحديث الصحيح."
‘চার মাযহাবের কোন ইমাম তাঁর মাযহাবের দিকে কাউকে আহবান জানাতেন না এবং নিজের মাযহাব নিয়ে গোঁড়ামিও করতেন না। বরং তাঁরা কিতাব ও সুন্নাহ এর আলোকে কাজ করার দিকে আহবান জানাতেন। দীনের ভাষ্যাদি ব্যাখ্যা করতেন, এর নিয়ম পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতেন।...কোন ছাহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে তাঁদের মত পাওয়া গেলে তাঁদের মতকে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিতেন।’
একথা দ্বারা স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, চার মাযহাবের ইমামদের বিশুদ্ধ হাদীছের পক্ষ অবলম্বন করার কারণে ছালাফে ছালিহীন ও ইসলামের বিজ্ঞ পন্ডিতগণ তাঁদেরকে কখনো খারাপ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতেন না। ইসলামী জ্ঞান গবেষণার জগতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের সকলের কাছে তাঁরা বিশেষ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তাঁদের সুদৃঢ় বক্তব্য অনুযায়ী তাঁদের মতের বিপরীতে কোন হাদীছ পাওয়া গেলেও উক্ত হাদীছ অনুসরণ করাই হবে মুসলিম হিসাবে আমাদের অনিবার্য কর্তব্য।
৫. ইবনু তায়মিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
والسنة هي العيار على العمل وليس العمل عيارا على السنة.
‘সুন্নাহর মাপকাঠিতে আমল হতে হবে, আমলের মাপকাঠিতে সুন্নাহকে বিচার করা যাবে না।’
অর্থাৎ আমলের সঠিকতা যাচাই এর জন্য সুন্নাহকে মাপকাঠি ধরে নিতে হবে। কারো আমলকে হাদীছের মানের মনে করে তা অনুসরণ করা যাবে না। তিনি আরো বলেছেন-
الاجتهاد إذا خالف السنة كان مردودا.
‘ইজতিহাদ যদি সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ সুতরাং ইজতিহাদের মাধ্যমে কোন কিছু উপস্থাপন করলে যদি তা হাদীছের বিরোধী হয় তাহলে তা কক্ষনো গ্রহণ করা যাবে না। বরং হাদীছটিই হবে ইজতিহাদের মাপকাঠি।
৪.৫ হাদীছ পরিপালনে গোঁড়ামীর বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
ইতোপূর্বের আলোচনায় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যে, হাদীছ পরিপালনে পক্ষপাতিত্ব, গোঁড়ামী ও অন্ধ অনুকরণ হাদীছের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের পরিপন্থী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা অনেকেই এ দোষে দুষ্ট। নিজের মতের বিপক্ষের ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছ পাওয়া গেলে, সেটাকে কটাক্ষ, উপেক্ষা ও অহেতুক সমালোচনা না করে, বরঞ্চ কখনো কখনো সেটার আমল করে, আমরা যে ছাহীহ হাদীছের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যশীল, তা প্রমাণ করা উচিত। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ স্বরূপ দুই একটি বিষয় এখানে উপস্থাপন করা যায়। এ সব বিষয়ে সকল পক্ষকে সমর্থন দেয়ার বিশুদ্ধ হাদীছও পাওয়া গেছে। সে ক্ষেত্রে কোন পক্ষের হাদীছকে কটাক্ষ না করে, এ সব হাদীছের আলোকে আমরা সকল পদ্ধতিই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমল করতে পারি। যেমন-
১. ছালাতুল বিতরের রাক‘আত:
ছালাতুল বিতর কত রাক‘আত এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা যারা যে মতকে অনুকরণ করি সেটাকেই নির্ভুল মনে করে, তার পক্ষের হাদীছগুলোকে দলীল হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাই। একইভাবে বিপক্ষের উপস্থাপিত হাদীছগুলোকে আমলে আনার সামান্য সদিচ্ছা তো পোষণ করিই না, বরং সেগুলোর বিরোধিতা করাকে যথার্থ কাজই মনে করি। এমনকি নিজের মতই যে সঠিক, তা প্রমাণের জন্য আদাজল খেয়ে লেগে যাই। যার অনিবার্য পরিণতিতে একপক্ষ অন্য পক্ষের হাদীছকে যা ইচ্ছা তাই বলে সমালোচনা করতেও পিছপা হই না। এ কাজটি মূলত ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ারই নামান্তর। ঈমানের অনিবার্য দাবী হচ্ছে, ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। যাই হোক, ছালাতুল বিতরের রাকা‘আত নিয়ে যে হাদীছগুলো বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছগুলো হচ্ছে নিম্মরূপ:
ক. বিতর এক রাক‘আত:
বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عمر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: صلاة الليل مثنى مثنى فإذا أردت أن تنصرف فاركع واحدة توتر لك.
ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রাত্রির ছালাত (তাহাজ্জুদ) দুই রাক‘আত করে করে, যখন তুমি এ থেকে ফিরে যেতে (এটা পূর্ণ করতে) চাও, তখন এক রাক‘আত আদায় করবে, যা তোমার ছালাতকে বেজোড় বানিয়ে দেবে।’ অন্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي مجلز قال سمعت ابن عمر يحدث عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الوتر ركعة من آخر الليل.
আবূ মাজলায সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘‘বিতর হচ্ছে শেষ রাত্রিতে এক রাক‘আত।’
عن ابن عمر أن رجلا سأل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صلاة الليل، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: صلاة الليل مثنى مثنى فإذا خشي أحدكم الصبح صلى ركعة واحدة توتر له ما قد صلى.
ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের ছালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন; তিনি বললেন, ‘রাতের ছালাত হচ্ছে, দুই রাক‘আত দুই রাক‘আত করে, যখন তোমাদের কেউ সকাল হওয়ার আশঙ্কা করে, এক রাক‘আত ছালাত আদায় করবে যা তার আদায় করা ছালাতকে বেজোড় বানিয়ে দেবে।’ এখানে বর্ণিত হাদীছগুলো বিভিন্নভাবে বর্ণিত হলেও বর্ণনাকারী একই, এগুলোর বক্তব্য হচ্ছে, ছালাতুল বিতর এক রাক‘আত।
খ. বিতর এক রাক‘আত হতে পাঁচ রাক‘আত:
যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي أيوب الأنصاري أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال: الوتر حق، فمن شاء فليوتر بخمس ، ومن شاء فليوتر بثلاث ، ومن شاء فليوتر بواحدة .
আবূ আইয়ূব আল-আনসারী রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল-বিতর হচ্ছে অপরিহার্য, যে চায় পাঁচ রাক‘আত দ্বারা, যে চায় তিন রাক‘আত দ্বারা, যে চায় এক রাক‘আত দ্বারা বিতর করবে।’ আল-আলবানীর মতে হাদীছটি ছাহীহ।
গ. বিতর পাঁচ রাক‘আত ও সাত রাক‘আত:
বর্ণিত হয়েছে-
عن أم سلمة قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بخمس وبسبع لا يفصل بينهن بسلام ولا بكلام.
উম্মু সালামাহ রাদি আললাহু ‘আনহা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচ ও সাত রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, সালাম এবং কোন কথার দ্বারা এ গুলোর মধ্যে কোন বিভাজন করতেন না।’
ঘ. বিতর তিন রাক‘আত
বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عباس قال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى بـ (سبح اسم ربك الأعلى) وفي الثانية بـ(قل يا أيها الكافرون) وفي الثالثة بـ(قل هو الله أحد).
ইবন ‘আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, প্রথম রাক‘আতে سبح اسم ربك الأعلى দ্বিতীয় রাক‘আতে قل يا أيها الكافرون এবং তৃতীয় রাক‘আতে قل هوالله أحد পড়তেন।’ আল-আলবানী এ হাদীছটি ছাহীহ বলেছেন।
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن عباس أنه رقد عند رسول الله -صلى الله عليه وسلم- فاستيقظ فتسوك وتوضأ وهو يقول (إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ) فقرأ هؤلاء الآيات حتى ختم السورة ثم قام فصلى ركعتين فأطال فيهما القيام والركوع والسجود ثم انصرف فنام حتى نفخ ثم فعل ذلك ثلاث مرات ست ركعات كل ذلك يستاك ويتوضأ ويقرأ هؤلاء الآيات ثم أوتر بثلاث.
‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ঘুমালেন, এরপর তিনি (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুম থেকে জাগলেন, মিছওয়াক করে অজু করলেন, এরপর পড়লেন إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ এবং একই সূরাহ সমাপ্ত করে তিনি দাঁড়ালেন, এরপর লম্বা কিয়াম ও সিজদাহ সহকারে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন, এরপর তিনি ফিরে গিয়ে নাক ডেকে ঘুমালেন। এমনিভাবে মিছওয়াক, ওজু এবং ঐ সব আয়াত তিলাওয়াত শেষে তিনি তিন বারে ছয় রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন, এরপর তিন রাক‘আত বিতর আদায় করলেন।’
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عمر بن الخطاب أنه أوتر بثلاث ركعات لم يفصل بينهن بسلام.
‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, ছালাম দ্বারা তন্মধ্যে কোন ভাগ করতেন না।’
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان نبي الله صلى الله عليه و سلم لا يسلم في ركعتي الوتر.
‘আয়িশাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহা সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছালাতুল বিতরের দুই রাক‘আতে ছালাম ফিরাতেন না।’ আল হাকিম বলেন আল-বুখারী ও মুসলিমের দেয়া শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছাহীহ। ইমাম আয্ যাহাবী তাঁর সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেছেন।
উল্লেখ্য যে ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সম্পর্কে আরো অনেক বর্ণিত হাদীছ রয়েছে।
যাই হোক পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ সকল হাদীছ ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সংখ্যা প্রসংগে চারটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।
এক : ছালাতুল বিতর এক রাক‘আত, দুই : তিন রাক‘আত,
তিন : পাঁচ রাক‘আত, চার : সাত রাক‘আত।
এখানে এটাও বুঝা যাচ্ছে যে, বিতর এক রাক‘আত হওয়া, তিন রাক‘আত হওয়া বা ততোধিক হওয়া গ্রহণযোগ্য হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। এ চারটি বর্ণনা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ অথবা বক্তব্য। তিনি কখনো বা এক রাক‘আত, কখনো তিন রাক‘আত, কখনো বা এর চেয়ে বেশি রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেছেন। সুতরাং এ চারটির যে কোন একটি আমল করাই হাদীছ দ্বারা অনুমোদিত। যিনি এক রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেন, তার পক্ষে তিন বা ততোধিক রাক‘আতকে অস্বীকার করা যেমন সঠিক নয়, তেমনি যিনি তিন রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেন, তাঁর পক্ষে এক বা তিনের অধিক রাক‘আত ছালাতুল বিতরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কোন ভাবেই ঠিক নয়। যেহেতু এ সকল অবস্থাই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, সেজন্য সত্যিকারের হাদীছ পালনকারীর জন্য উচিত, এখানে উল্লিখিত সকল প্রকারের হাদীছের উপরই আমল করা অর্থাৎ কখনো এক, কখনো তিন, কখনো বা ততোধিক রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করা। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলাভী রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্যও অনেকটা এমনই। তিনি একই বিষয়ে একাধিক মতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য ছাহীহ হাদীছ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
الحق عندي في مثل ذلك أن الكل سنة ونظيره الوتر بركعة واحدة أو بثلاث
‘এ সব বিষয়ে সঠিক হচ্ছে এটাই যে, প্রত্যেকটিই সুন্নাহ। ছালাতুল বিতরের এক রাক‘আত অথবা তিন রাক‘আত এর উদাহরণ।’ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলাভী রাহিমাহুল্লাহর মত নিরপেক্ষভাবে গ্রহণযোগ্য হাদীছ পরিপালনে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা সকলের জন্যই অপরিহার্য।
২. ইমামের পেছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ করা:
ইমামের পেছনে যারা ছালাত আদায় করেন, তাদেরকে মুক্তাদী বলা হয়। ইমাম সাধারণত সূরাতুল-ফাতিহাহ ছাড়া কুরআনের অন্য অংশও পড়ে থাকেন। মুক্তাদী অন্য অংশ পড়া না পড়া নিয়ে, কোন মতভেদ না থাকলেও, মুক্তাদী সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়বেন কিনা এ নিয়ে ফকীহদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছ হচ্ছে-
ক. ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ নিষ্প্রয়োজন
কিরাআত উচ্চস্বরে পড়ার ছালাত হোক অথবা চুপি চুপি পড়ার ছালাত হোক, উভয় অবস্থাতে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ করা নিস্প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,
عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل إلا وراء الإمام.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইমামের পেছনে নয় এমন এক রাক‘আত ছালাত আদায় করলে যদি কেউ সূরাতুল-ফাতিহাহ না পড়ে, তাহলে সে ছালাতই আদায় করেনি।’ (তিরমিযী এ হাদীছটিকে ছাহীহ বলে মন্তব্য করেছেন) অর্থাৎ নিজে ছালাত আদায় করলে, অবশ্যই সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়তে হবে। তবে ইমামের পেছনে আদায় করলে না পড়লেও চলবে। এ হাদীছ অনুযায়ী উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠের ছালাত হোক অথবা মনে মনে কিরাআত পাঠের ছালাতই হোক; উভয় অবস্থাতেই ইমামের পেছনে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়া নিষ্প্রয়োজন। আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن شداد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من كان له إمام فإن قراءة الإمام له قراءة.
‘আবদুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের কিরাআতই হচ্ছে তার জন্য কিরাআত।’ আল-আলবানী হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।
এ হাদীছটি যেহেতু ইমামের যে কোন কিছুকে পড়াকে মুক্তাদীর জন্য পড়া হিসাবে গণ্য করাকে সমর্থন দেয়, সেহেতু এই আলোকে ইমাম সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়লে, ইমাম কিরাআত উচ্চ স্বরে পড়ুন অথবা নিচু স্বরে পড়ুন, উভয় অবস্থাতেই মুক্তাদীর জন্য তা পড়ার প্রয়োজন হবে না।
খ. ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ অত্যাবশ্যকীয়
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-
قال عبادة بن الصامت: صلى بنا رسول الله -صلى الله عليه وسلم- بعض الصلوات التى يجهر فيها بالقراءة ، فالتبست عليه القراءة ، فلما انصرف أقبل علينا بوجهه فقال : هل تقرءون إذا جهرت بالقراءة؟ গ্ধ. فقال بعضنا : إنا نصنع ذلك. قال : فلا، وأنا أقول ما لى أنازع القرآن ، فلا تقرءوا بشىء من القرآن إذا جهرت إلا بأم القرآن.
‘উবাদাহ ইবনুছ ছামিত রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, প্রকাশ্যে কিরাআত আদায় করতে হয় এমন ছালাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আমাদের ইমামতি করেন। (তাঁর) কিরাআত তালগোল পাকিয়ে গেল। যখন তিনি সালাম ফিরালেন তখন আমাদের দিকে ফিরে বললেন, আমি যখন আল-কুরআন প্রকাশ্যভাবে পড়ি তখন কি তোমরাও কুরআন পড়? আমাদের কেউ কেউ বললেন হাঁ, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন না, আমি বলছি (কি ব্যাপার) আমার সাথে কুরআন নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা হচ্ছে! যখন আমি উচ্চস্বরে কিরাআত পড়ব তখন শুধু সূরাতুল-ফাতিহাহ ব্যতীত অন্য কিছু তোমরা পড়বে না।’
আবুল হাসান আদ-দারা কুতনী বলেন, এই হাদীছের সনদ হাসান, এর বর্ণনাকারীগণ আস্থাযোগ্য (ثقات)
এ হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামের পেছনে সূরা আল ফাতিহাহ পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রমাণ পেশ করে। এ বিষয়ে আরো বর্ণিত হয়েছে -
عن أبى هريرة عن النبى -صلى الله عليه وسلم- قال : من صلى صلاة لم يقرأ فيها بأم القرآن فهى خداج - ثلاثا - غير تمام.
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন তিনবার বলেছেন, যে সূরাতুল ফাতিহাহ ব্যতীত ছালাত আদায় করে সেটি অপরিপূর্ণ।’’
এ হাদীছ প্রতিটি ছালাতে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ যে অত্যাবশ্যক, তারই স্পষ্ট দলীল।
গ. উচ্চস্বরের কিরাআত বিশিষ্ট ছালাতে ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ নিষ্প্রয়োজন
এমন গ্রহণযোগ্য হাদীছ পাওয়া যায়, যা স্পষ্টত এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, ইমাম যে ছালাতে প্রকাশ্যে কিরাআত পাঠ করবেন, সে ছালাতে যেহেতু সূরাতুন ফাতিহাহ মুক্তাদীও শুনে থাকেন, সে জন্য তাঁর সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ করার প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم انصرف من صلاة جهر فيها بالقراءة فقال هل قرأ معي أحد منكم آنفا ؟ فقال رجل نعم يا رسول الله قال إني أقول مالي أنازع القرآن!
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘ছালাতে উচ্চস্বরে কিরাআত পড়া হয়েছে এমন ছালাত থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের কেউ কি একটু পূর্বে আমার (কুরআন) পাঠের সাথে সাথে কোন কিছু পাঠ করছিলে? একজন বলল, জ্বি হ্যাঁ, হে রাসূলাল্লাহ। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি বলছি, আমার সাথে কুরআন নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা হচ্ছে!’’ অর্থাৎ আমি অহেতুক কুরআন পড়তে থাকব, আর তা শ্রবণ করা হবে না, এটি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
আল-আলবানী হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরো বার্ণত হয়েছে -
عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: إنما جعل الإمام ليؤتم به . فإذا كبر فكبروا . وإذا قرأ فأنصتوا .
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইমাম বানানো হয়েছে তাকে অনুসরণ করার জন্য, সুতরাং সে যখন তাকবীর দেবে তোমরাও তাকবীর দেবে আর সে যখন (কোন কিছু) পড়বে তোমরা চুপ থাকবে।’
এখানের وإذا قرأ فأنصتوا বাক্য ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ ছাহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।
এ হাদীছে ইমাম যখন কোন কিছু তিলাওয়াত করবে, তখন চুপ থাকতে বলা হয়েছে। এ দ্বারা শ্রবণের উদ্দেশ্যেই চুপ থাকা প্রমাণিত হয়। সুতরাং যে ছালাতে ইমাম উচ্চ স্বরে কিরাআত পাঠ করবেন, সে ছালাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের কোন অংশ না পড়ে চুপ থাকারই যে নির্দেশ দিয়েছেন, এ হাদীছ সেই কথারই প্রমাণ বহন করে। তাহলে ইমাম উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠ করলে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়ার প্রয়োজন নেই।
এখানে ইমাম সাহেবের পেছনে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়া, না পড়া নিয়ে তিন ধরনের হাদীছ পাওয়া গেল। হাদীছবেত্তাদের মানদন্ড অনুযায়ী এখানে উল্লেখিত কোন হাদীছ এ অবস্থায় নেই যা দা‘য়ীফ (দুর্বল) বা অন্য কোন কারণে একেবারেই উপেক্ষা যোগ্য। সুতরাং নিঃশর্ত ভাবে যাঁরা হাদীছ পরিপালন করতে চান, তাঁদের ছালাত আদায়ের সময় এ তিন শ্রেণীর হাদীছই বিবেচনায় আনা জরুরী। কোন এক শ্রেণীকে অগ্রহণযোগ্য বলা তাঁদের জন্য উচিত হবে না। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, কেউ যদি এ তিন শ্রেণীর সব হাদীছের উপর আমল করতে পারেন, তা হলে ভাল। অন্যথায় যে কোন এক শ্রেণীর উপর আমল করলেই যথেষ্ট। তবে অন্য দুই শ্রেণীকে বিভিন্ন অজুহাতে সমালোচনা করে, এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা, কোন ভাবেই ঠিক হবে না।
৩ . মোজার উপর মাসাহ করা
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মূলত বাস্তব সম্মত, যা পালন করা কষ্টকর তো নয়ই, বরং তা সহজেই পালনযোগ্য। অজু করার সময় বারবার মোজা খুলে পা ধোয়া বেশ কষ্টসাধ্য। সে জন্য পা থেকে মোজা না খুলে, তার উপর মাসাহ করাকে ইসলামী শারী‘আহ অনুমোদন দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে এ বিষয়ে স্পষ্ট হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছ হচ্ছে-
عن عروة بن المغيرة بن شعبة ، عن أبيه قال : قلت : يا رسول الله ، أتمسح على خفيك ؟ قال : نعم ، إني أدخلتهما وهما طاهرتان.
‘উরওয়াতুবনুল মুগীরাতুবনি শূ‘বাহ তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি আপনার মোজার উপর মাসাহ করলেন? তিনি বললেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি পবিত্র অবস্থায় পা দুটিকে তন্মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ছিলাম ।’
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে-
عن همام بن الحارث قال : رأيت جرير بن عبد الله بال ثم توضأ ومسح على خفيه ثم قام فصلى فسئل فقال رأيت النبي صلى الله عليه و سلم صنع مثل هذا.
‘হাম্মাম ইবনুল হারিছ বলেন, আমি জারির ইবন আবদুল্লাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহুকে পেশাব করে অজু করার সময় তাঁর দুই মোজার উপর মাসাহ করে ছালাত আদায় করতে দেখলাম। তাঁকে (এ বিষয়ে) প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ভাবেই করতে দেখেছি।’
আরো বর্ণিত হয়েছে -
عن صفوان بن عسال قال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يأمرنا إذا كنا على سفر أن لا ننزع خفافنا ثلاثة أيام ولياليهن إلا من جنابة ولكن من غائط وبول ونوم.
‘ছাফওয়ান ইবন আসসাল বলেন, আমরা সফর অবস্থায় থাকলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন, যাতে আমরা জানাবাত অবস্থা (যা গোসলকে অনিবার্য করে) ব্যতীত পায়খানা, পেশাব ও ঘুমের জন্যও তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মোজা না খyুল।’ (তিরমিযী হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।)
অন্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عن خزيمة بن ثابت عن النبي صلى الله عليه و سلم إنه قال : في المسح على الخفين يوم وليلة للمقيم وثلاثة أيام ولياليهن للمسافر.
‘খুযাইমা ইবন ছাবিত রাদি আল্লাহু ‘আনহু মোজার উপর মাসাহ সম্পর্কে বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসাফির অবস্থায় তিন দিন ও মুকিম (মুসাফির নয় এ) অবস্থায় একদিন ও একরাত।’
عَنْ أبى هريرة قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إذا أدخل أحدكم رجليه في خفيه وهما طاهرتان فليمسح عليهما ثلاث للمسافر ويوم للمقيم .
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ পবিত্র অবস্থায় তার দুই পা দুই মোজায় প্রবেশ করালে, সে তার উপর মুসাফির অবস্থায় তিন দিন ও মুকীম অবস্থায় একদিন মাসাহ করতে পারবে।’ আল-আলবানী এ হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।
অনেকেই মনে করেন আমরা যে মোজা ব্যবহার করি তা ও এখানে হাদীছে বর্ণিত (الخف) এক নয়। আসলে এ ধারণাটি ঠিক নয়। মোজাকেই আরবিতে الخُفّ বলে। অভিধানে বলা হয়েছে- الخُفّ بالفارسية مُوزَه । ফারসি ভাষায় الخُفّ হচ্ছে মোজা। বাংলা ভাষাতেও ফার্সি ভাষার অনেক শব্দের মতই ফার্সি ‘মোজা’ শব্দটিও ব্যবহার হয়। সুতরাং বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত মোজা ও হাদীছগুলোতে বর্ণিত খুফ্ফ যে একই, তা সন্দেহাতিতভাবেই প্রমাণিত। অতএব খুফ্ফ সম্পর্কিত সকল হাদীছই মোজার ব্যাপারে প্রযোজ্য।
মূলত এ প্রসংগে বর্ণিত হাদীছগুলো একত্রিত করলে স্পষ্ট যে কথাটি বুঝা যায় তা হচ্ছে, অজু অবস্থায় কেউ মোজা পরিধান করলে তার উপর গোসল ফারদ হওয়ার মত কোন কিছু না ঘটলে, সে ব্যক্তি মুকীম হলে একদিন এক রাত, আর মুসাফির হলে তিন দিন তিন রাত, মোজা না খুলে তার উপর মাসাহ করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারবে। এ পর্যায়ে মোজা কি দ্বারা তৈরি, তা কতটুকু শক্ত, এ দ্বারা কত পথ অতিক্রম করা সম্ভব ইত্যাদি কোন শর্ত আমরা হাদীছে দেখতে পাই না।
আমাদের পূর্ববর্তী অনেক বিচক্ষণ আলিমও কিন্তু একই বিষয়ে একাধিক মতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন ছাহীহ হাছীসে পাওয়া গেলে তার উপর আমলের আহবান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছালাতুল ফাজরে কুনূত পড়ার বৈধতার হাদীছ বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন-
ومن هذا أيضا جهر الإمام بالتأمين وهذا من الاختلاف المباح الذي لا يعنف فيه من فعله ولا من تركه وهذا كرفع اليدين في الصلاة وتركه وكالخلاف في أنواع التشهدات وأنواع الأذان والإقامة وأنواع النسك من الإفراد والقران والتمتع وليس مقصودنا إلا ذكر هديه صلى الله عليه و سلم الذي كان يفعله هو.
‘উচ্চস্বরে ইমামের আমীন বলাও এইরূপ। এটি ঐ ধরনের মুবাহ বিষয়ক মতভেদ, যা করা অথবা বর্জন করা সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করা যাবে না। এটি ছালাতের মধ্যে হাত উঠানো না উঠানো, বিভিন্ন প্রকার তাশাহ্হুদ পাঠ, আযান দেয়া, ইকামত দেয়া, ইফরাদ, কিরান ও তামাত্তু‘ হাজ্জে কুরবানী দেয়ার ভিন্নতার মতই। আমাদের উদ্দেশ্য রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথ যা তিনি করতেন তা স্মরণ করিয়ে দেয়া।’ অর্থাৎ যে কোন একটিকে ‘আমল করলেই চলবে, কোন একটির উপর শক্ত অবস্থান ঠিক নয়। তিনি কাফিরদের সন্তানদের জান্নাতে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে, বিভিন্ন পক্ষের দলীল উপস্থাপনের এক পর্যায়ে আরো বলেছেন যে-
أن عادتنا في مسائل الدين كلها دقها وجلها أن نقول بموجبها ولا نضرب بعضها ببعض ولا نتعصب لطائفة على طائفة بل نوافق كل طائفة على ما معها من الحق ونخالفها فيما معها من خلاف الحق.
‘দীনের ছোট বড় সকল মাসআলার বিষয়ে আমাদের নীতি হচ্ছে, এর দাবী অনুযায়ী কথা বলা, একে অপরকে ঘায়েল করব না এবং এক দলকে বাদ দিয়ে অন্য দলের প্রতি গোঁড়ামীও করব না। বরং যে দলের পক্ষে সত্য রয়েছে, আমরা তার সাথে একাত্ম হবো আর যাদের সাথে সত্য পরিপন্থী কিছু থাকবে আমরা তার বিরোধী হবো।’ সুতরাং আমাদেরও এ সব মনীষীদের মতই প্রতিটি বিষয়ে গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে দলীলকে বিবেচনায় আনা ও বিরোধী পক্ষের প্রতি উদার হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমরা অনেক সময় হাদীছের অনুমোদিত অনেক বিষয়কে সতর্কতা অবলম্বনের অজুহাতে বর্জন করে থাকি। ইবন কায়য়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
والاحتياط حسن، ما لم يفض بصاحبه إلى مخالفة السنة، فإذا أفضى إلى ذلك فالاحتياط ترك هذا الاحتياط.
‘সতর্কতা অবলম্বন করা উত্তম, যদি তা সতর্কতা অবলম্বনকারীকে হাদীছের বিরুদ্ধে না নিয়ে যায়। যদি হাদীছের বিরুদ্ধে নিয়ে যায়, তা হলে উক্ত সতর্কতাকে বর্জন করাই সতর্কতা।’ সুতরাং সতর্কতা অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে হাদীছের অনুমোদন রয়েছে কি না, তা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
৪.৬ ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির মানদন্ডে হাদীছ বর্জন ও গ্রহণে বিভ্রান্তি ও তার অপনোদন
কেউ কেউ হাদীছ অনুসরণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে নিজের ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধিকে মানদন্ড হিসেবে ব্যবহার করেন। কোন হাদীছকে তাদের ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি যদি গ্রহণযোগ্য মনে করে, তাহলে তারা সেই হাদীছ গ্রহণ করেন এবং সেই অনুযায়ী আমলও করে থাকেন। পক্ষান্তরে কোন ছাহীহ হাদীছকেও যদি তাদের ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য মনে করে, তাহলে তারা তা কক্ষনো মেনে নেন না। এরাও মূলত জাহামিয়্যাহ সম্প্রদায়ের মতই। ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির মানদন্ডে বিশ্লেষণ করে জাহামিয়্যাহ সম্প্রদায় ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি গ্রহণযোগ্য মনে করে না বিধায় অসংখ্য ছাহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ সব হাদীছকে তারা অস্বীকার করে। খারিজী ও মু‘তাযিলা সম্প্রদায়ও কবরের আযাব বর্ণিত হয়েছে, এমন সব হাদীছ এমনকি কবরের প্রশান্তি, কবরে প্রশ্নোত্তর, কবরে শারীরিক শাস্তি প্রদান ও সশরীরে পুনরুত্থানকেও ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি গ্রহণযোগ্য মনে করে নি বলে অস্বীকার করেছে। তারা মূলত এ সব বিষয়গুলোকে তাদের ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির মাপকাঠিতে অযৌক্তিক মনে করেছে; সেই কারণেই তারা এ সব হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করেছে। পক্ষান্তরে এ সব বিষয় স্পষ্ট ছাহীহ হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত । উদাহরণ স্বরূপ-
১. কবর ‘আযাব:
আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর প্রসিদ্ধ হাদীছ গ্রন্থে ‘‘কবরের আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা’’ শিরোনামে একটি অধ্যায় উল্লেখ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সেখানে ছাহীহ হাদীছও বর্ণনা করেছেন। যেমন-
عن موسى بن عقبت قال سمعت أم خالد بنت خالد قال ولم أسمع أحدا سمع من النبي صلى الله عليه وسلم غيرها قالت: سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يتعوذ من عذاب القبر.
মূসা ইবন ‘উকবাহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে এটি তিনি ব্যতীত অন্য কেউ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাললাম থেকে শুনেন নি। উম্মু খালিদ বিনত খালিদ রাদি আল্লাহু ‘আনহা বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবর আযাব থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে শুনেছি।’ এ বিষয়ে ছাহীহ হাদীছে আরো বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
...إن هذه الأمة تبتلى في قبورها فلولا أن لا تدافنوا لدعوت الله أن يسمعكم من عذاب القبر الذي أسمع منه...
‘...নিশ্চয় এ উম্মাতকে তার কবরের ভেতর পরীক্ষা করা হবে। যদি তোমরা দাফন করবে না এ আশঙ্কা না হত, তাহলে অবশ্যই আমি আল্লাহর নিকট এমন দু‘আ করতাম যে, আমি যেমন কবরের আযাব শুনতে পাচ্ছি, তোমাদেরকেও যেন তিনি তেমনটি শুনিয়ে দেন।...’ এমনিভাবে বুখারী শরীফে ১২ টি, মুসলিম শরীফে ১১ টি, মুসতাদরাক ‘আলাছ ছাহীহাইনে ১৩টি, ছাহীহ ইবন হিববানে ২৫টি ও ছাহীহ ইবন খুযাইমাহতে ৫টি ছাড়াও অনেক হাদীছ গ্রন্থে ছাহীহ হাদীছে বিভিন্নভাবে কবর আযাবের প্রসঙ্গ উল্লেখ হয়েছে।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনেও কবর আযাবের প্রসংগে আল্লাহ মদীনার মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেন- سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّوْنَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيْمٍ.
‘‘আমি তাদেরকে দু’বার শাস্তি দেব ও পরে তারা প্রত্যাবর্তিত হবে মহাশাস্তির দিকে।’’
এরপরেও ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য নয় মনে করে এ সব হাদীছকে অবমূল্যায়ন করার কোন সুযোগ আছে কি?
২. কবরে শারীরিক শাস্তি প্রদান:
মারা যাওয়ার পর শরীর পঁচে গলে ধ্বংস হয়ে যায় বিধায় কবরে ফেরেশতাদের পক্ষ হতে মৃত ব্যক্তিকে প্র্শ্ন করা ও শারীরিক শাস্তি দেয়াকেও ‘আকল যুক্তি সঙ্গত মনে করে না। এ যুক্তিতে তাদের অনেকেই এ সম্পর্কের হাদীছগুলোকেও অস্বীকার করেছে। পক্ষান্তরে এ প্রসংঙ্গে বিশুদ্ধ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عن أنس رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: العبد إذا وضع في قبره وتولي وذهب أصحابه حتى إنه ليسمع قرع نعالهم أتاه ملكان فأقعداه فيقولان له ما كنت تقول في هذا الرجل محمد صلى الله عليه وسلم؟ فاما المومن فيقول أشهد أنه عبد الله ورسوله فيقال انظر إلى مقعدك من النار أبدلك الله به مقعدا من الجنة قال النبي صلى الله عليه وسلم فيراهما جميعا وأما الكافر أو المنافق فيقول لا أدري كنت أقول ما يقول الناس فيقال لا دريت ولا تليت ثم يضرب بمطرقة من حديد فيصيح صيحة يسمعها من يليه إلا الثقلين.
আনাস রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোন বান্দাহকে তার কবরে রেখে তার সাথীসঙ্গীরা চলে যায়, এমনকি সে তাদের জুতার শব্দ পর্যন্তও শুনতে পায়, এ অবস্থায় দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে বলে, এ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি? সে বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর রাসূল। তখন তাকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার জন্য নির্ধারিত ঐ স্থানকে দেখো, যে স্থানকে আল্লাহ তোমার জন্য জান্নাতের স্থানে পরিবর্তন করেছেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সে তখন দুটি জায়গাকেই দেখবে। আর যদি সে কাফির অথবা মুনাফিক হয়, তা হলে সে বলবে, লোকে যা বলত আমিও তাই বলতাম; আমি তাঁর (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাকে বলা হবে, তুমি জানার চেষ্টাও কর নি, (কুরআন) তিলাওআতও কর নি। এরপর লৌহার হাতুড়ী দিয়ে তাকে পেটানো হবে, সে জোরে চিৎকার করতে থাকবে, যা শুধু মানুষ ও জিন ছাড়া সকলেই শুনতে পাবে।’ এখানে দুই ফেরেশতা কবরবাসীকে যে বসাবেন বলে উল্লেখ হল, এদ্বারা স্পষ্টত সশরীরে বসানোই বুঝা যায়। সুতরাং ছাহীহ হাদীছ দ্বারাই সশরীরে কবর আযাব হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।
৩. কবরে নিয়ামাত দান:
একই কারণে অর্থাৎ ‘আকল, বিবেক বুদ্ধি ও যুক্তির মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তারা কবরে প্রশান্তি ও নিয়ামত দানের হাদীছকেও অস্বীকার করেছে, পক্ষান্তরে এ বিয়ষটিও বিশুদ্ধ হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। যেমন অন্য বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে-
قال عليه السلام :أنه يفسح له في قبره سبعون ذراعا ويملأ عليه خضرا إلى يوم يبعثون.
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার কবরকে সত্তর গজ প্রশস্ত করে তা পুনরুত্থান পর্যন্ত সবুজে (নি‘আমতে) পরিপূর্ণ করে দেয়া হবে।’
৪. সশরীরে পুনরুত্থান:
‘আকল, বিবেক বুদ্ধি ও যুক্তির মাপকাঠিতে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার দোহাই দিয়ে তারা সশরীরে পুনরুত্থানকেও অস্বীকার করেছে, পক্ষান্তরে এর বিপরীতে ছাহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ما بين النفختين أربعون... قال ثم ينزل الله من السماء ماء فينبتون كما ينبت البقل ليس من الإنسان شيء إلا يبلى إلا عظما واحدا وهو عجب الذنب ومنه يركب الخلق يوم القيامة.
আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুই ফুৎকারের মধ্যে চল্লিশের ব্যবধান হবে... এরপর আসমান থেকে বৃষ্টি শুরু হলে, যেমন তৃণলতা অঙ্কুরিত হয়, তেমনি তারাও অঙ্কুরিত হবে; একটি হাড় ব্যতীত মানুষের সকল হাড়ই ধ্বংস হয়ে যাবে, সেটি হচ্ছে, মেরুদন্ডের নিচের সর্বশেষ অংশ, যা দ্বারা কিয়ামাতের দিন মানুষকে পুনর্গঠন করা হবে।’ আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن أبى هريرة أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال كل ابن آدم يأكله التراب إلا عجب الذنب منه خلق وفيه يركب.
আবূ হুরাইরাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনূ আদমকে মাটি ভক্ষণ করবে, শুধু তার মেরুদন্ডের সর্বশেষ অংশ ব্যতীত। যা থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা থেকে তাকে আবার পুনর্গঠন করা হবে।’ বর্ণিত হচ্ছে-
عن بن عباس رضي الله عنهما عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إنكم محشورون حفاة عراة غرلا.
ইবন ‘আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে খালি পায়ে, উলঙ্গ ও খাতনা বিহীন অবস্থায়।’
উল্লেখিত হাদীছগুলো সবই ছাহীহ।
এরূপ বহু বিশুদ্ধ হাদীছ সশরীরে পুনরুত্থানের পক্ষে জ্বলন্ত প্রমাণ থাকার পরেও শুধু ‘আকল, বিবেক বুদ্ধি ও যুক্তি গ্রহণ করে না, এ অজুহাতে তারা এগুলোকে অস্বীকার করে যাচ্ছে। আসলে সশরীরে পুনরুত্থানের পক্ষে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনেও অনেক আয়াত রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন-
وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ . قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ .
‘এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন সেটি পঁচে গলে যাবে? বল, এর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনি, যিনি তোমাকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেক সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ সুতরাং আল-কুরআনের আলোকেও তো যে কোন মুসলিমের জন্য সশরীরে পুনরুত্থানকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এটি মূলত গায়িবি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যা মানুষের সীমাবদ্ধ বিবেক বুদ্ধি দ্বারা কস্মিনকালেও বুঝা সম্ভব নয়।
৫. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মি‘রাজ :
‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি সমর্থন না করায় তারা এক রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সশরীরে মাক্কা মুকার্রমার মাসজিদুল হারাম থেকে
ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিস হয়ে উর্দ্ধলোকে ভ্রমণকে অস্বীকার করে থাকে। তাদের ভাষায় মানুষকে যে প্রকৃতি ও শক্তি সামর্থ্য দেয়া হয়েছে, তাতে এত অল্প সময়ে কারো পক্ষে সশরীরে মাক্কা মুকার্রমার মাসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিস হয়ে উর্দ্ধলোকে ভ্রমণ করাকে কোন ক্রমেই ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধি সমর্থন করে না। বরং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, মানুষের এ দেহ এত দ্রুতগামি হলে তাতে আগুন লেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে বাধ্য। একইভাবে মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে অতিক্রম করার মত কোন যান আবিষ্কার না হওয়ায় মি‘রাজ সশরীরে সংঘটিত হওয়া ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির সাথে সাংঘর্ষিক। সে জন্য মি‘রাজের হাদীছকে কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
আসলে তাদের এ বক্তব্যের বিপক্ষে অত্যন্ত জোরালো হাদীছ রয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن مالك بن صعصعة رضي الله عنهما أن نبي الله صلى الله عليه وسلم حدثهم ...أتيت بدابة دون البغل وفوق الحمار أبيض فقال له الجارود هو البراق. فحملت عليه فانطلق بي جبريل حتى أتى السماء الدنيا فاستفتح فقيل من هذا قال جبريل قيل ومن معك قال محمد قيل وقد أرسل إليه قال نعم قيل مرحبا به فنعم المجيء جاء ففتح ...
মালিক ইবন ছা‘আছা‘আহ রাদিআল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বলেছেন, ‘...খচচর ও গাধার মাঝামাঝি একটা সাদা প্রাণী আনা হলো। ’আল-জারূদ বলেন, ওটা ছিল বুরাক। যাঁ আমাকে বহন করে চলছিল। আমার সাথে জিবরাঈল ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামও ছিলেন। আমরা দুনিয়ার আসমানে উপনীত হলাম। এটা খুলে দেয়ার আবেদন করলে বলা হলো, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি জিবরাঈল। বলা হলো, আপনার সাথে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বলা হলো, যাঁকে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে, তিনি? তিনি বললেন, হাঁ। বলা হলো, তাঁকে সাদর সম্ভাষণ। কত উত্তম
আগন্তুকই না এসেছেন! এরপর তা খুলে দেয়া হলো।...’’ এমনি ভাবে এ ঘটনার সমস্ত বর্ণনা তিনি উল্লেখ করলেন।
এ ধরনের বহুসংখ্যক ছাহীহ হাদীছে এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তারা এ ধরনের ছাহীহ হাদীছগুলোকে ‘আকলের মাপকাঠিতে অগ্রহণযোগ্য বলে অস্বীকার করেছে। পক্ষান্তরে এ ঘটনা তো কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈলেও উল্লেখ হয়েছে। তারা নিজেদেরকে শুধু কুরআনের পৃষ্ঠপোষক দাবী করলেও বাস্তবে সেটিকেও তারা অস্বীকার করে । এটাই হচ্ছে বিশুদ্ধ হাদীছের চেয়ে ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধিকে বেশি বেশি প্রাধান্য দেয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ, যা একজন মুসলিমের জন্যে মোটেও শোভনীয় নয়। এটি মূলত একটি মারাত্মক বিভ্রান্তি, যা ছাহীহ হাদীছের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের স্পষ্ট লংঘন।
কোন হাদীছ ‘আকলের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এভাবে হাদীছকে বর্জন করা কোন ক্রমেই যুক্তি সঙ্গত নয়। কেননা মানুষের জ্ঞানের রয়েছে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা, সংকীর্ণতা, সে যতটুকু জানে তার চেয়ে তার অজ্ঞতাই বেশি । রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীছ মূলত ওহী গায়ির মাতলু, অর্থাৎ এর ভাব হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার আর ভাষা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। এ সত্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে আল্লাহর বাণীতে-
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى.
‘‘এবং সে মনগড়া কথাও বলে না বরং এটা তো ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।’’ সুতরাং মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ওহীকে সীমাবদ্ধ ‘আকল অনুমোদন না দেয়ায় ‘আকলকে প্রাধান্য দিয়ে ওহীকে বর্জন করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। মানুষের বিবেক বুদ্ধি যে অসংখ্য ভুল করে তার ভুরি ভুরি প্রমাণও রয়েছে। মানুষের ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধি আজ যে বিষয়কে নির্ভুল বলে মনে করছে, কালের ব্যবধানে তা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উদ্ভাবিত ডারউইনের বিবর্তনবাদের উপর ভিত্তি করে মানুষ যে বানরের থেকে উদ্ভূত জাতি তা বেশ কিছু দিন বিজ্ঞানের জগতে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করলেও আজ তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে জীনের আবিষ্কারের ফলে পরিস্কার ভাবে জানা গেছে যে, মানুষের জীন ও বানরের জীন কোন ভাবেই এক নয়, বরং তা একেবারেই ভিন্ন। সুতরাং সন্দেহাতীত ভাবে আজ প্রমাণিত হয়েছে যে, মানুষ কক্ষনো বানরের বংশোদ্ভুত নয়। ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উদ্ভাবিত ডারউইনের বিবর্তনবাদের উপর ভিত্তি করে মানুষ যে বানরের থেকে উদ্ভূত জাতি, এ দর্শন যে একেবারেই ভুল ছিল, তা আজ সর্বজন বিদিত। একই ভাবে ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উদ্ভাবিত চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক’দিন আগেও হৃৎপিন্ডের স্পন্দন থেমে গেলেই প্রাণীকে মৃত বলে ঘোষণা দেয়া হত। পক্ষান্তরে আজকাল এ থিউরী পরিবর্তিত হয়েছে। এখন সেই একই চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, হৃৎপিন্ডের স্পন্দনের সাথে মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। মস্তিষ্কের কোষের নিষ্ক্রিয়তাই এখন মৃত্যুর চি‎হ্ন। হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যে দিন এ থিউরিও পরিবর্তিত হবে। সুতরাং ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধি দ্বারা উদ্ভাবিত কোন জ্ঞান শাশ্বত সত্য ও নির্ভুল হতে পারে না। সে জন্য হাদীছের চেয়ে ‘আকল বা বিবেক বুদ্ধিকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনার কোন সুযোগ নেই। ‘আকল ও বিবেক বুদ্ধির মানদন্ডে গ্রহণযোগ্য কি না তা বিবেচনায় না এনে শর্তহীন ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের মতই রাসূলুল্লাহ ছাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আনুগত্য তথা তাঁর হাদীছ পরিপালনকে আল-কুরআনের ভাষায় মু’মিন হওয়ার জন্য অনিবার্য শর্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِيناً.
‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে, সে তো স্পষ্ট পথভ্রষ্ট হবে।’ আল্লাহ আরো বলেন-
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُوْنَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوْا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيْمًا.
‘‘কিন্তু না, তোমার রাবেবর শপথ, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসস্বাদের বিচার ভার তোমার উপর অর্পণ না করে; অতপর তোমার সিদ্ধান্ত সন্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।’’
সুতরাং মু’মিন থাকতে হলে বিশুদ্ধ হাদীছ প্রত্যাখ্যানের কোন সুযোগ নেই।
কেউ কেউ মতামত দিয়ে থাকেন যে, কয়েক লক্ষাধিক হাদীছ হতে অনেক হাদীছকে বাদ দিয়ে ইমাম আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ ছাহীহুল বুখারী সংকলন করে থাকলে, তিনি তো অনেক হাদীছই প্রত্যাখ্যান করেছেন, আমরা যদি বুখারীরও কিছু হাদীছ প্রত্যাখ্যান করি, তাহলে দোষের কি? এটিও মূলত বিশুদ্ধ হাদীছের বিরুদ্ধে এক জঘন্য ষড়যন্ত্র, এটি একটি মারাত্মক বিভ্রান্তি। ইমাম আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ একটি সংকলন তৈরির জন্য প্রথমে একটি মানদন্ড স্থির করে নেন। সে মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীছগুলোকে তাঁর সে সংকলনে সংকলিত করেন। ইমাম আল-বুখারী রাহিমাহুল্লাহ যে হাদীছগুলো বাদ রেখেছেন, তা তাঁর নির্ধারিত মানদন্ডে উত্তির্ণ না হওয়ার কারণেই করেছেন। কিন্তু তিনি বলেন নি যে, এ সংকলিত হাদীছগুলোর বাইরে যা রয়েছে, সেই গুলো প্রত্যাখ্যাত। অপরদিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিছের মত হচ্ছে, যে কোন মানদন্ডে বুখারীর হাদীছগুলো ছাহীহ। সুতরাং বুখারীর কোন হাদীছ প্রত্যাখ্যান মূলত ছাহীহ প্রমাণিত হাদীছ প্রত্যাখ্যানেরই শামিল, যা মূলত পূর্বোল্লেখিত কুরআনের আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী ঈমানেরই পরিপন্থী।
৫. উপসংহার
আমাদের মাঝে বিশুদ্ধ হাদীছের যে ভান্ডার রয়েছে, তা মূলত ইসলামের এক অমূল্য সম্পদ। এটি হচ্ছে, ইসলামের দ্বিতীয় উৎস। এই উৎসের পূর্ণ হোক অথবা আংশিক হোক, বাদ দিয়ে ইসলামের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। ইসলামের পরিপূর্ণতার বহুলাংশ এই হাদীছসমূহের উপর নির্ভরশীল। ইসলামের উৎস থেকে সেগুলো বাদ দিলে ইসলাম শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হবে না, বরং ইসলামের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। বিশুদ্ধ হাদীছের প্রতি সন্দেহ সংশয় মূলত রিসালাত তথা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি সন্দেহ সংশয়কে অনিবার্য করে। আর রিসালাত হচ্ছে ইসলামের অন্যতম অংশ, যার অনুপস্থিতি ইসলামকে অস্তিত্বহীন করারই নামান্তর।
অনেকেই আল-কুরআনের অতি উৎসাহী ভক্ত সেজে, কুরআনকেই যথেষ্ট মনে করে, পরিপূর্ণ হাদীছের অথবা আংশিক হাদীছের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি না করেই, তাদের হাতে হাত মিলিয়ে হাদীছের অপ্রয়োজনীয়তার পক্ষে ওকালতি করেই চলেছে। আসলে তাদের এই হাদীছ বিরোধী তৎপরতা ইসলামের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। তারা মূলত ইসলামকে ধবংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এটি অলক্ষ্যে তাদের ঈমানকেও ধ্বংস করে ফেলছে। পক্ষান্তরে বিশুদ্ধ হাদীছের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য সাধন করে ইসলামকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচানোর ও এর মাধ্যমে নিজেদের দুর্লভ ঈমানকেও হিফাযত করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ সকল মুসলিমকে বিশুদ্ধ হাদীছের খালিছ অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন! 
- সমাপ্ত -

প্রবন্ধটি এপ্রিল ২২, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক অনুষ্ঠিত স্টাডি শেসনে মূল প্রবন্ধ হিসাবে পঠিত।

গ্রন্থপঞ্জীঃ
1. আল-কুরআনুল কারীম
2. আহমাদ আমীন, ফাজরুল ইসলাম, কায়রো, ১৯৯২
3. আহমাদ আমীন, দুহাল ইসলাম, মিশর, ১৯৬৪
4. আহমাদ, মুসনাদ, মিশর, তাবি.
5. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু ‘আলাল বাহারির রায়িক, তাবি
6. ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-ইনতিকা’ তাবি
7. ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-জামি‘ তাবি
8. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু রাদ্দিল মুখতার, বায়রূত, ১৪১৫ হি
9. ইবন আবী শায়বাহ, আল-মুছাননাফ ফিল আহাদিছি ওয়াল আছার, রিয়াদ, ১৮০৯ হি:
10. ইবন মাজাহ, সুনান, বায়রূত, তাবি
11. ইবন কাছীর,তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১৪২০ হি. মাদীনাহ
12. ইবন হাযম, ইহকাম ফী উছূলুল আহকাম, মিশর, তাবি
13. ইবন হিববান, আবু হাতিম, ছাহীহ ইবন হিববান, বায়রূত, ১৪১৪ হি
14. ইবনুল-জাওযী, আল-মাওদু‘আত, তাবি
15. ইবন খুযায়মাহ, আছ-ছাহীহ, বায়রূত, ১৩৯০ হিঃ
16. আল- আলবানী, আল-সিলসিলাতুদ দা‘য়ীফাহ, রিয়াদ
17. ছাহীহ আল-বুখারী, আছ-ছাহীহ, বায়রূত, ১৪০৭হি
18. আবূ দাঊদ, সূনান, বায়রূত, তাবি
19. আন-নাবাভী, শারহুন ‘আ মুসলিম, বায়রূত, ১৩৯২ হি:
20. আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক ‘আলাছ ছাহীয়ায়ীন, বায়রূত, ১৪১১ হি
21. আর-রাযী, আত-তাফসীরুল কাবীর, তাবি
22. আয-যামাখশায়ী, আল-কাশশাফ, তাবি
23. আশ-শাশী, আবূ সা‘ঈদ আল-হায়ছাম, মুসনাদুশ শাশী, মাদীনাহ মুনাওয়ারাহ, ১৪১০হি
24. আল-আসকালানী, ফাতহুল বারী, বায়রূত, ১৩৭৯ হি
25. আত-তাবারানী আল-মু’জামুল কাবীর, আল-মাওছিল, ১৪০৪ হি
26. আল-খাতীব আল বাগদাদী, আল-কিফায়াতু ফি ‘ইলমির রিওয়ায়াহ, মদীনাহ মুনাওয়ারাহ, তাবি
27. আল-যুরজানী, আল-মুখতাছারু ফি উছুলিল হাদীছ, তাবি
28. আযযার‘ঈ, আবূ ‘আবদুল্লাহ, নাকলুল মানকুল ওয়াল মুহিককুল মুমায়য়িয বায়নাল মারদুদ ওয়াল মাকবুল,রিয়াদ, তাবি
29. আল-ফাত্তানী, মুহাম্মাদ তাহির ইবন ‘আলী আল- হিন্দী, তাজকিরাতুল মাউ‘দুআত, তাবি
30. আল-আলবানী, নাছীর উদ্দীন, আল-সিলসিলাতুছ ছহীহাহ, তাবি
31. আবী য়া‘লা, আহমাদ ইবন ‘আলী, দামিশক, তাবি
32. আয-যাহাবী, শামসুদ্দীন, মিযানুল ই‘তিদাল ফী নাকদির রিজাল বায়রূত, ১৯৯৬
33. আশ-শাফী‘ঈ, মুসনাদ, বায়রূত, তাবি
34. আল-‘আসকালানী, তাহযীবুত তাহাজীব, বায়রূত ১৪০৪ হি
35. আদ-দারাকুতনী, সুনান, বায়রূত, ১৩৮৬ হি
36. আত-তাহাবী, শারহি মা‘আনিল আছার, বায়রূত, ১৩৯৯ হি
37. আল-আশ‘আরী, মাকালাতূল ইসলামিয়ীন তাবি
38. আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, বায়রূত, ১৪১১ হি
39. আল-বুরহানপূরী,‘‘আলাউদ্দীন ‘আলী আল-হিন্দী, কানযুল ‘উম্মাল, বায়রূত, ১৪০১ হি
40. আস-সুয়ূতী জালাল উদ্দীন, ওয়াল মাহাল্লী, তাফসীরুজ জালালাঈন, তাবি
41. আস-সুয়ূতি, জালাল উদ্দীন, তানভীরুল হাওয়ালিক ‘আলা মুয়াত্তা মালিক, মিশর, তাবি
42. আস-সুয়ূতী, জালাল উদ্দীন, আল-লাআলিল মাছনু‘আহ ফিল আহাদিছূল মাছনু‘আহ, বায়রূত, তাবি
43. আস-সুয়ূতী জালাল উদ্দীন, ও অন্যান্যরা, শারহি সুনানু ইবন মাজাহ, করাচী, তাবি
44. আস-সুয়ূতী জালাল উদ্দীন, ওয়াল মাহাল্লী, তাফসীরুল জালালায়িন, কায়রো, তাবি
45. আস-সুয়ূতী, জালাল উদ্দীন, জামি‘উল হাদীছ, তাবি
46. আল-জারাহী, ইসমা‘ঈল ইবন মুহাম্মাদ, কাশফুল খাফা’, বায়রূত, ১৪০৫ হি
47. আল-হারাবী, আলী ইবন সুলজান, আল-মাছনু, যিয়াদ, ১৪০৪ হি
48. আস-সিবা‘ঈ, মুসতাফা, আস-সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরী‘ইল ইসলামী, বায়রুত , ১৯৭৬
49. আত-তিরমিযী, আস-সুনান, বায়রূত, তাবি.
50. আফীফ আত-তববারা, রূহুদ্দxীনল ইসলামী, তাবি
51. ‘আফিফী আব্দুর রাজ্জাক, শুবহাতু হাওলাস্সুন্নাহ, সৌদী আরব, ১৪২৫ হি
52. ড. খাদিম হুসাইন ই’লাহী বখশ, কুরাআনিউন ওয়া শুবহাতুহুম হাওলাস সুন্নাহ, তায়িফ, ১৪০৯ হি
53. কিল‘আজী, মুহাম্মাদ রাওওয়াস, মু‘জামু লুগাতিল ফুকাহা, বায়রূত, ১৪০৫ হি
54. মাহমূদ আবূ রায়য়্যাহ, আদওয়াউন ‘আলাস্সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যাহ, কায়রো, ১৯৯৪
55. ছাহীহ মুসলিম, আছ-ছাহীহ, বায়রূত, তাবি
56. আল-মানার ম্যাগাজিন
57. ছাওরাতুল ইসলাম ম্যাগাজিন
58. আল ফাতহ ম্যাগাজিন

 

ফুটনোটঃ

. আল-জাওহারী, আছ-ছিহাহু ফিল-লুগাহ, তাবি, ১১৭ পৃঃ
. হাসানুল বান্না, রাসাইলুল ইমামি হাসালিল বান্না, তাবি., ১খ, ৪৫৮ পৃঃ
. ছাহীহ আল বুখারী, আছ- ছাহীহ , বায়রূত, ১৪০৭ হি:, ১খ., ৪৯ পৃ:
. আস-সুয়ূতি, তানভীরুল হাওয়ালিক ‘আলা মুয়াত্তা মালিক, মিশর, ১৯৬৯, ১খ. ০৫ পৃ:
. ইবন আবী শায়বাহ, আল-মুছাননাফ ফিল আহাদিছি ওয়াল আছার, রিয়াদ, ১৮০৯ হি, ১খ. ০৬ পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ., ৪৩৪ পৃ:
. ইবনুল-জাওযী, আল-মাওদু‘আত, ১৩৮৬ হি:, ১খ. ৮ পৃ:
. আল- হিন্দী, ‘আলী ইবন হুসামুদ্দীন, কানযুল ‘উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল, তাবি. ১১খ. ১৬৯পৃ:
. আশ-শাওকানী, আল-ফাওয়ায়িদুল মাজমুআ‘তু ফীল-আহাদিছিল মাওদু‘আহ, বায়রূত, ২৪০৭ হি:,১খ., ৪১৪ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ৯পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ৪৩ পৃ:
. প্রাগুক্ত
. আত-তাবারানী, আল-মু‘জামূল আওসাত, কায়রো, ১৪১৪হি: ৫খ., ৩২৪ পৃ: আল- আলবানী হাদীছটিকে জাল বলেছেন। ইরওয়াউল গালীল ফি তাখরীজি আহাদীছু মানারিস সাবীল, ১৪০৫ হি:, বায়রূত, ২খ. ১৯১ পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ. ৩৮৫ পৃ:, ছাহীহ মুসলিম, আছ-ছাহীহ, তাবি., ২খ., ১৬৬ পৃ:
. আছ-ছাগানী, আল-মাওদূ‘আত, তাবি., ১খ. ৪ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ৪১ পৃ:
. ইবনুল-জাওযী, ১খ. ৪০ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ১২ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ৩খ. ৫পৃ:
. আস-সুয়ূতী, আল-লাআলিল মাছনু‘আহ ফিল আহাদিছূল মাছনু‘আহ, বায়রূত, তাবি, ২খ. ৯১ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ৮ পৃ:
. আস-সুয়ূতী ও অন্যান্যরা, শারহি সুনানু ইবন মাজাহ, করাচী, তাবি, ১খ. ২৮৯পৃ:
. আল-আলবানী , আল-সিলসিলাতুদ্দয়ীফাহ, রিয়াদ, তাবি. ৫খ. ৩১০ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ. ১০৫পৃ:
. আফীফ আত-তববারা, রূহুদ্দxীনিল ইসলামী, তাবি. ৪৬৩-৪৬৫পৃ:
. সূরাহ আন- নূর: ৫৪
. সূরাহ আল-হাশর:০৭
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৪খ. ১৮৫৩ পৃ:
. সূরাহ আল-ফাতহ: ০৮-০৯
. সূরাহ আন- নিসা : ৬৪
. সূরাহ আল-নিসা : ৮০
. সূরাহ আল-আনফাল : ০১. ২০, ৪৬, আল- মুজাদিলাহ : ১৩
. সূরাহ আন-নিসা : ৫৯, আন-নূর : ৫৪, মুহাম্মদ : ৩৩, আত-তাগাবুন : ১২
. সূরাহ আন-নূর : ৫৬
. সূরাহ আন-নাজম : ২-৪
. ইবন কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ১৪২০ হি., মদীনাহ, ৭খ. ৪৪৩ পৃ:
. সূরাহ আল হাক্কাহ : ৪৪-৪৭
. সূরাহ আল-‘আরাফ : ১৫৭
. সূরাহ আলে-ইমরান : ১৬৪
. আস-সুয়ূতী জালাল উদ্দীন ওয়াল মাহাল্লী, জালাল উদ্দীন, তাফসীরুল জালালায়িন, কায়রো, তাবি, ১খ. ৯০পৃ:
. সূরাহ আন -নিসা : ৬৫
. সূরাহ আন- নূর : ৪৮-৫১
. সূরাহ আন-নিসা: ১৫০-১৫১
. সূরাহ আন-নাহল: ৪৪
. সূরাহ আন-নাহল: ৬৪
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১ খ., ২২৬ পৃ:, ৫খ. ২২৩৮ পৃ:, ৬খ. ২৬৪৭পৃ:
. ইবন হাযম, ইহকাম ফী উছূলুল আহকাম, মিশর, তাবি, ২খ. ৭৯-৮০পৃ:
. সূরাহ আল-আন’আম: ৮২
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৩ খ., পৃ. ১২৬২
. সূরাহ ইবরাহীম: ২৪-২৬
. ইবন হিববান, আবু হাতিম, ছহীহ ইবন হিববান, বায়রূত, ১৪১৪ হি. ২খ, ২২৩ পৃ:
. সূরাহ ইবরাহীম :২৭
. ছাহীহ আল বুখারী, ৪খ. ২৭৩৫ পৃ:
. আবূ দাঊদ, সূনান, বায়রূত, তাবি, ৩খ. ২২২পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৫খ. ১৯৬৫পৃ:
. সূরাহ আল-মায়িদাহ: ০৩
. ইবন মাজাহ, সুনান, বায়রূত, তাবি., ২খ. ১১০২ পৃ:
. সূরাহ আন-নিসাঃ ১১
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৬খ. ২৪৮৪ পৃঃ, ছাহীহ মুসলিম, ৫খ. ৫৯ পৃঃ
. সূরাহ আল-বাকারাহ: ২৩০
. ছাহীহ আল-বুখারী, ২খ. ৯৩৩ পৃঃ, ছাহীহ মুসলিম ২খ. ২০৫৫ পৃঃ, মানিক মুয়ত্তা’, দামিস্ক, ১৪১৬ হিঃ ২খ. ৫১৮ পৃঃ
. সূরাহ আল-মায়িদাহ: ৩৮
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৬খ. ২৪৯২ পৃঃ
. আল-বাইহাকী, আন-সুনানুল কুবরা, মাক্কাহ, আল-মুকাররামাহ, ১৪১৪ হিঃ ৮খ. ২৭০ পৃঃ
. আহমাদ, মুসনাদ, মিশর, তাবি., ২৮খ. ৪২৯ পৃঃ
. আন-নাবাভী, শারহু মুসলিম, বায়রূত, ১৩৯২ হি:, ১৫খ. ১০৭পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ২খ., ৮৩২ পৃ:
. সূরাহ আন -নিসা : ৬৫
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৩খ. ১৩২১ পৃ:
. আল-বুগদাদী, ‘আব্দুল কাহির, আল-ফিরাকু বায়নাল ফিরাক, তাবি, কায়রো, ৩৫১ পৃ:
. ড. খাদিম হুসায়িন ইলাহী বখশ, ২১১ পৃঃ
. প্রাগুক্ত ২১৪ পৃঃ
. প্রাগুক্ত ১৫৫ পৃঃ
. ছাবরী, মুছতাফা, আল-কাওলুল ফাছল, ২১৯ পৃঃ
. আল-মানার, নবম খ. ৫১৭ পৃঃ
. প্রাগুক্ত, ১০ খ. ২২৩ পৃঃ
. ড. খাদিম হুসায়িন ইলাহী বখশ, আল-কুআনিউন, তায়িফ, ১৪০৯ হি:, ১০৫ পৃঃ
. প্রাগুক্ত, ২২১
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ., ৪৩৪ পৃ:
. মাহমূদ আবূ রায়য়্যাহ, আদওয়াউন ‘আলাস্সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যাহ, কায়রো, ১৯৯৪, ১৯ পৃ:
. প্রাগুক্ত ২৫৮ পৃ:
. প্রাগুক্ত ২৬৯ পৃ:
. প্রাগুক্ত ১৪৭ পৃ:
. আল-হাকিম ২খ. ৯৭পৃ:
. আহমাদ, ৩ খ. ২৯৮ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম ৩ খ. ১৩৯৮ পৃ:
. ইবন হিববান, ১৩খ.২৯৯ পৃ:
. আল মানার, ৯ম খন্ড, ৯-১০ পৃষ্ঠা
. আল-মানার, ৯ম খন্ড, ৫১৬ পৃ.
. আস-সিবা‘ঈ ড., আস-সুন্নাতু ওয়া মাকানাতুহা ফিত তাশরীঈল ইসলামী, বায়রূত,১৯৭৬, ২৭৩ পৃ:
. ছাওরাতুল ইসলাম, বায়রূত, তা.বি, ২৫ পৃ:
. প্রাগুক্ত পৃ: ৬৩
. ফাজরুল ইসলাম, কায়রো, ১৯৯২, ২৫৮ পৃ:
. দুহাল ইসলাম, মিশর, ১৯৬৪, ২খ. ১৩০ পৃ.
. ড. আহমাদ আমীন, দুহাল ইসলাম, মিশর, তাবি ২খ. ১৩০ পৃঃ
. আল ফাতহ ম্যাগাজিন, ২খ. ৫০৪ পৃ.
. সূরাহ আন-নাহল: ৮৯
. সূরাহ আল-আন’আম: ৩৮
. আর-রাযী, আত-তাফসীরুল কাবীর, ৯খ.,৪৪৯ পৃ: (উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্র:)
. আবূ দাঊদ, ৪খ., ২০০ পৃ:
. সূরাহ আন-নিসা: ১১৫
. আয-যামাখশায়ী, আল-কাশশাফ, তাবি., ১খ.৪৬৩ পৃ:, (উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্র:)
. সূরাহ আল- নাহল : ৪৪
. আস-সুয়ূতী, জালাল উদ্দীন, ওয়াল মাহাল্লী, সূরাহ আল-আন‘আমের উক্ত ৩৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
. আশ-শাশী, আবূ সা‘ঈদ আল-হায়ছাম, মুসনাদুশ শাশী, মাদীনাহ মুনাওয়ারাহ, ১৪১০হি, ১খ. ৬৯ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ১৮৩৫পৃ:
. সূরাহ আন-নাজম: ৪৩
. সূরাহ আল-আনফাল: ৬৭-৬৯
. সূরাহ আত-তাহরীম: ০১ ও পরবর্তী আয়াতসমূহ
. ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ২২৯৮ পৃ:
. আল-‘আসকালানী, ফাতহুল বারী, বায়রূত, ১৩৭৯ হি. ১খ. ২০৮ পৃ.
. আহমাদ, ২খ. ১৬২ পৃ.
. প্রাগুক্ত, ২খ. ৪০৩ পৃ.
. ছাহীহ আল বুখারী, ২খ. ৮৫৭ পৃ.
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ. ৪৬ প:ৃ.
. আহমাদ, ৩খ. ২০পৃ.; আল-হাকিম, ১খ. ১৩৫পৃ.
. ছাহীহ আল বুখারী, ৫খ. ২২০৩ পৃ.
. ছাহীহ মুসলিম, ১খ. ৩২৭পৃ.; আত-তিরমিযী, ২খ, ৪৫৯পৃ.
. আত-তাবারানী আল-মু’জামুল কাবীর, আল-মাওছিল, ১৪০৪ হি. ১৮খ. ২১৯পৃ:
. ছাহীহ আল বুখারী, ৫খ., ২০৮৮পৃ.:
. ছাহীহ আল বুখারী, ৩খ. ১১২৬ পৃঃ, আল-বাইহাকী, ৬খ. ৩০১ পৃঃ
. ছাহীহ আল-বুখারী, ২খ. ৫৭৯ পৃঃ, ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ৪৪ পৃঃ, আহমাদ, ১খ. ২৫৭ পৃঃ
. আহমাদ ,২খ. ৪৬৯ পৃঃ, আল-হাকীম, ৩খ. ১৩২ পৃঃ
. আস-সুয়ূতি, মিফতাহুল জান্নাতি ফিল-ইহাতিজাজি বিসসুন্নাহ মাদূনাহ, ১৩৯৯ হি: ১খ. ৭০ পৃঃ
. আল-লালকায়ী, হিবাতুল্লাহ ইবনুল হাসান, শারহু উছুলুল ই’তিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামায়াহ, রিয়াদ ১৪০২ হি. ১খ. ৯৫ পৃঃ
. আল-ইরাকী আব্দুর রাহীম, আল-মুসতাখরাজ আলাল মুসতাদরাক, তাবি ১৫ পৃঃ
. আদ-দিহলভী, আহমাদ ইবন আব্দির রাহীম, , ইকদুজ জায়য়িদ ফি আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াত-তাকলীদ কাহিরাহ ১৩৮৫ হি. ৩২ পৃঃ
. ইবন কাইয়্যিম, হাশিয়াতু আলা সুনানী আবী দাউদ, বায়রূত, ১৪১৫ হি. ১৩খ. ৪৫ পৃঃ
. যীনু, মুহাম্মদ ইবন জামীল, তাওজীহাতুন ইসলামিয়াতুন ফিল ইছলাহিল ফারকি ওয়াল মুজতামাহ, সাউদী আরব, ১৪১৮ হি. ১৪০ পৃঃ
. আলী ইবন নায়িফুস শাহূদ, মাওসু’আতুত দিফা আনির রাসূলুল্লাহ ছ. ৪খ. ১৩৯ পৃঃ
. প্রাগুক্ত
. আল-বিহারী, হাসান ইবনু ‘আলী,শারহিস কিতাবসি সুন্নাহ, দাম্মাম, ১৮০৭ হি:, ৩৫ পৃঃ
. আল-খাতীব আল-বুগদাদী, আল-কিফায়াতু ফি ‘ইলমির রিওয়ায়াহ, মদীনাহ মুনাওয়ারাহ, তাবি., ১খ. ২০৫ পৃ:
. আল-জুরযানী, আল-মুখতাছারু ফি উছুলিল হাদীছ, তাবি., ১পৃ:
. ছাহীহ আল বুখারী, ১খ., ৪৩৪ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ২খ.৫০৭ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ১খ., ১৪ পৃ:, ছাহীহ মুসলিম, ১খ., ৬৭ পৃ:
. মুখতাছিরুছ ছাওয়াইক, ২খ. ৩৭২ পৃঃ
. ইবনুল জাওযী,. ৬পৃ: ও পরবতী পৃষ্ঠাসমূহ
. আল- আলবানী, আল-সিলসিলাতুদ দা‘য়ীফাহ, রিয়াদ, ১খ., ২৫৭পৃ:
. আযযার‘ঈ, আবূ ‘আবদুল্লাহ, নাকলুল মানকুল ওয়াল মুহিককুল মুমায়য়িয বায়নাল মারদুদ ওয়াল মাকবুল, রিয়াদ, ১৪১১ হি:,১খ. ৫৪ পৃ:
. সূরাহ আন্ নূর :৩০-৩১
. ইবনুল জাওযী, ১খ. পৃ. ১৪
. প্রাগুক্ত, ১খ. ৯৭পৃ;
. আল-আলবানী, নাছীর উদ্দীন, আল-সিলসিলাতুছ ছহীহাহ, তাবি. ৪খ. ৩০পৃ:
. আবী য়া‘অলা, আহমাদ ইবন ‘আলী, দামিশক, ১৪০৪ হি: ৪খ. ২৩৬ পৃ:
. ছাহীহ আল- বুখারী ১খ. ১২পৃ.; ছাহীহ মুসলিম ১খ. ৪৫ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ১খ. ৮৮পৃ:
. আহমাদ, ৬খ. ৪৪৩ পৃ;
. আবূ দাউদ, ৪খ. ২৫৩পৃ:
. আয-যাহাবী, শামসুদ্দীন, মিযানুল ই‘তিদাল ফী নাকদির রিজাল বায়রূত, ১৯৯৬, ২খ.২৯৯পৃ:
. আশ-শাফী‘ঈ, মুসনাদ, বায়রূত, তাবি, ১খ. ৪৬পৃ;
. আল-‘আসকালানী, তাহযীবুত তাহাবী, বায়রূত ১৪০৪ হি:, ২খ. ১১৩ পৃ:
. আদ-দারাকুতনী, সুনান, বায়রূত, ১৩৮৬ হি: ৪খ. ২৩৫পৃ:
. ছাহীহ আল বুখারী, ২খ. ৯১৪পৃ:
. আল-বুরহানপূরী,‘‘আলাউদ্দীন ‘আলী আল-হিন্দী, কানযুল ‘উম্মাল, ১৪০১ হি:, বায়রূত, ১৪০৫ হি: ১খ. ৪৫১ পৃ
. আস-সুয়ূতী, জালাল উদ্দীন, জামি‘উল হাদীছ, ২০খ. ১৭৮ পৃ:
. আল-হাকিম, ১খ. ১৭৫ পৃ:
. আল-জারাহী, ইসমা‘ঈল ইবন মুহাম্মাদ, কাশফুল খাফা’, বায়রূত, ১৪০৫ হি:, ২খ.,৩২৯ পৃ:
. আল-হারাবী, আলী ইবন সুলজান, আল-মাছনু, যিয়াদ, ১৪০৪হি:, ১খ. ১৮৪পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ২খ. ৯৭৫ পৃ:
. আবূ দাউদ, খ.২, পৃ.০৪, ইবন হিববান, মুহাম্মাদ, ৪ খ. ৪৬৯ পৃ:, আহমদ, ৫ খ, ২৩৭ পৃ.
. আহমাদ, ৩খ. ১৩৮পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ১খ., ৪৯১ পৃ.
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ..৩৭৩ পৃ:
. সুরা আল- আন‘আম : ১৪১
. ছাহীহ আল বুখারী ২খ. ৪৫০ পৃ; আত-তিরমিযী, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে ৩ খ. ৩১ পৃ.; আহমাদ জাবির রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে, ৩ খ. ৩৪১ পৃ
. ইবন মাজাহ, ১ খ. ৫৮১ পৃ.,আন-নাসাঈ, ৫ খ. ৪২ পৃ: ছাহীহ মুসলিম, ২ খ. ৬৭৩ পৃ.
. ছাহীহ মুসলিম, ২ খ. ৬৭৩ পৃ.
. ছাহীহ আল বুখারী ২ খ., ৫২৯ পৃ.
. ফাতওয়াইল আযহার ৯ খ. ২৪৬ পৃ.
. কিল‘আজী, মুহাম্মাদ রাওওয়াস, মু‘জামু লুগাতিল ফুকাহা, বায়রূত, ১৪০৫ হিঃ ১খ.৫৫পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ২খ. ৬৬৭ পৃ.
. আত-তিরমিযী, ২ খ. ৩৬৮ পৃ.
. ইবন হিববান, ৭ খ. ৪৩৪ পৃ ; আল-হাকিম, ১খ. ৫২৫ পৃ.
. আন- নাসাঈ, ৪ খ ৮৮ পৃ.; ইবন মাজাহ, ১ খ. ৪৯৮ পৃ.
. আন- নাসাঈ, ৪ খ. ৮৮ পৃ.
. আবূ দাউদ, ৩ খ. ২১৮ পৃ; আত-তিরমিযী ২ খ. ১৩৬ পৃ.; ইবন হিববান ৭ খ. ৪৫৩ পৃ; আল-হাকিম, ১ খ., ৫৩০ পৃ
. ছাহীহ মুসলিম, ২ খ. ৬৬৭ পৃ; ইবন হিববান, ৭ খ. ৪৩৭ পৃ.; আবূ দাউদ, ৩ খ. ২১৭ পৃ.; আন- নাসাঈ, ৪ খ. ৯৫ পৃ; ইবন মাজাহ ১ খ. ৪৯৯ পৃ.; আহমদ ২ খ. ৩০১ পৃূ
. ইবন মাজাহ, ২ খ. ২২৩ পৃ আলবানীর মতে হাদীছটি ছাহীহ
. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু রাদ্দিল মুখতার, বায়রূত, ১৪১৫ হি:, ১খ. ৭২ পৃ:
. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু ‘আলাল বাহারির রায়িক, ৬ খ. ২৩৫পৃ:, ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-ইনতিকা’ ১৪৫পৃ:
. ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-জামি‘, ২খ. ৯১পৃ:
. আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মা্দ ইবন আব্দুল্লাহ আল- খারাশী, শারহি মুখতাছারি খালীল, ২১ খ.২১৩ পৃ
. আন- নাবাভী, আল-মাজমু‘, বায়রূত, তাবি., ১খ.,৬৩ পৃ:
. আল-বদর, ‘আব্দুল মুহসিন, কুতুবু ‘আব্দুল মুহসিন, ১৪২৩ হি: ১৮খ., ৩৯ পৃ:
. আল আছরী, আবদুল্লাহ ইব্ন আব্দুল হামীদ, আল-আওজীয় ফি ‘আকীদাতিস সালফীছ ছালিহ, সৌদী আরব, ১৪২২ হিঃ ১ খ. ১২৮ পৃ.
. আদ-দুআইশ, আইমান ইবন আব্দুর রাজ্জাক ফাতওয়াল লাজনাতুদ দায়্যিমাহ লিন বুহুছিল ওয়াল-ইফতা, ১৯১৭ হিঃ রিয়াদ ৬ খ. ৪৭৮ পৃ:
. ইবনু তাইমিয়্যাহ ই‘লামিল মুওয়াক্কি‘ঈন, বায়রূত, ১৯৭৩, ২খ. ২৮০ পৃ:
. প্রাগুক্ত, ২খ. ২৯৬ পৃ:
. ইবুন হিববান,,৬ খ. ৩৫৪ পৃ.
. মুসলিম, খ.১ পৃ.৫১৮
. প্রাগুক্ত, খ.১ পৃ.৫১৬
. ইবন হিববান, ৬ খ.১৭০পৃ:; ইবন মাযাহ; ১ খ. ৩৭৬ পৃ., হাকিম, ১ খ. ৪৪৪ পৃ:
. আল- আলবানী, ছাহীহু ওয়া দা‘‘য়ীফু ইবন মাযাহ, ৩খ., ১৯০ পৃ:
. আন- নাসাঈ, ১খ. ৪৪১ পৃ.
. আহমাদ, ১ খ. ২৯৯ পৃ: , আন- নাসাঈ, ১খ. ৪৭৭ পৃ.
. আল-আলবানী কিতাবু ছালতুত তারাবীহ, ১ খ. ১১০পৃ:
. মুসলিম, ১ খ. ৫৩০ পৃ:
. ইবন আবী শায়বাহ, ৩ খ. ৯০ পৃ:
. আত-তাহাবী, শারহি মা‘আনিল আছার, ১খ., ৪৮১ পৃ:
. দিহলাভী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ২খ., ১০ পৃ
. মালিক, ১ খ. ৮৪ পৃ, আত-তিরমিযী, ২ খ. ১২২ পৃ.
. আল-বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২ খ..১৬০ পৃ; আদ-দারা কুতনী ১ খ. ৪০২ পৃ:
. আল-হাকিম ১ খ.,৩৬৪ পৃ:, আল-বায়হাকী, ২ খ. ১৬৬ পৃ:
. আল বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা, তাবি- খ. ২, পৃ. ১৬৫।
. আহমাদ ৬ খ. ২৭৫ পৃ:, ইবন মাযাহ ১ খ., ২৭৪ পৃ:, ছাহীহ মুসলিম. ১ খ ২৯৬ পৃ:.
. আত-তিরমিযী, ২ খ., ১১৯ পৃ:, ইবন হিববান, ৫খ., ১৫১ পৃ: আবূ দাউদ ১ খ., ২১৮ পৃ:, ইবন মাজাহ ১ খ., ২৭৬ পৃ:
. আহমাদ, ২ খ., ৩৭৬ পৃ:, ইবন মাজাহ ১ খ. ২৭৬ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ১ খ., ৩০৪ পৃ:
. ছাহীহ আল বুখারী ১ খ., ৮৫ পৃ:,ইবন খুযায়মাহ, ১ খ.,ৃ ৯৫ পৃ:, , ইবন হিববান ৪ খ., ১৫, পৃ:, সালিক ,১ খ., ৩৩ পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১ খ., ১৫১ পৃ:
. আত-তিরমিযী, ১ খ., ১৫৯ পৃ:
. ইবন হিববান, ৪ খ. ১৫৮পৃ., আহমাদ, ৫ খ. ২১৫পৃ:
. ইবন আবী শায়বাহ , ১ খ. ১৬৭ পৃ:
. ইবন দুরাইদ, জামহারাতুল লুগাহ, তাবি., ২খ. ২৫৮ পৃ:
. আল-জাওযী, ইবনুল কাইয়্যিম, যাদুল মা‘আদ, কুয়িত, ১৪০৭ হি:, ১খ., ২৫৬ পৃ:
. আল-জাওযী, ইবনুল কায়য়্যিম, তরীকুল হিজরাতায়িন ওয়া বাবুস সা‘আদাতায়িন, আদ-দাম্মাম, ১৪১৪ হি: ১খ. ১২৫পৃ:
. ইগাছাতিল লুহফান, বায়রূত, ১৩৯৫ হি:, ১খ. ১৬৩ পৃ:
. আল-আশ‘আরী, মাকালাতূল ইসলামিয়ীন, ১খ. ১০৬ পৃ:
. ‘আফিফী আব্দুর রাজ্জাক, শুবহাতু হাওলাস্সুন্নাহ, সৌদী আরব, ১৪২৫ হি:, ১খ. ১৮ পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৫খ., ২৩৪১ পৃ:
. প্রাগুক্ত
. ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ৩১৯৯ পৃ:
. সূরা আত্-তাওবাহ : ১০১
. ছাহীহ আল-বুখারী, ১খ., ৪৪৮ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ৪খ.,২২০০ পৃ: উল্লেখ্য যে নবীদের শরীর মাটি ভক্ষন করতে পারবে না।
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৪খ. ১৮৮১ পৃ:
. ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ২২৭০পৃ:; মালিক ১খ.২৩৯ পৃ:
. ছাহীহ আল বুখারী ৩খ. ১২২২ পৃ: ও ৩খ.১২৭১ পৃ:; ছাহীহ মুসলিম, ৪খ. ২১৯৪ পৃ:
. সূরাহ ইয়াসিন ৭৮-৭৯
. ‘আফিফী আব্দুর রাজ্জাক, ১৮ হতে পরবর্তী পৃ:
. ছাহীহ আল-বুখারী, ৩খ. ১৪১০ পৃ: ও আত-তিরমিযী, ৫খ. ৩১৬ পৃ:
. সূরাহ আন-নাজম : ০৩-০৪
. সূরাহ আল- আহযাব : ৩৬
. সূরাহ আন-নিসা : ৬৫