অবতরণিকা 

পঠিতব্য মূল বিষয়ে যাবার আগে আমি মনে করি, বাংলাদেশ কেন ভারতের মতো বৃহৎ ও নিকটতম প্রতিবেশীর সামগ্রিক আক্রমণের টার্গেট, তার কার্যকারণ খুঁজে দেখা দরকার। আর এ জন্য আমাদেরকে ইতিহাসের পেছনের ঘটনাবহুল অধ্যায়ে আলোকপাত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। যদিও ঘটনা প্রবাহের ঐতিহাসিক ধারাভাষ্যকে অনেকে ভারত বিরোধী মানসিকতার চর্বিতচর্বন বলে ব্যাখ্যা করতে চাইতে পারেন। অথবা দুটি দেশের মধ্যকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সৌহাদ্যপূর্ণ সহযোগিতার ক্ষেত্রে অতীতচারিতাকে টেনে আনাকে পাকিস্তান পর্বের ভারত বিরোধী ফোবিয়ার সাথেও সরলীকরণ করতে পারেন। কিন্তু ভারতের সামরিক আসামরিক নীতি নির্ধারক গবেষক-নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাংবাদিক রাজনীতিক, ধর্মীয় নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে সবার মাঝেই বাংলাদেশ বিরোধী একটা প্রচারণার ঐক্যতান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এর উৎস বা পটভূমি কী? এই সাথে প্রাসঙ্গিক যে প্রশ্নটি ওঠে, তা হচ্ছে, ভারতের জনগণের অগ্রসর অংশের এবং সরকারী পর্যায়ের বাংলাদেশ বিরোধী ঢালাও অপপ্রচারের জন্য বাংলাদেশ বা এ দেশের জনগণ কতটা দায়ী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাংলাদেশ ভারতীয় এই বুদ্ধিবৃত্তিক সামরিক-অসামরিক আমলাতন্ত্রের কূট প্রচারণার বিষ-দংশন থেকে কীভাবে মুক্তি পেতে পারে? কিংবা ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধাবোধ এবং সৌহার্দের হাত প্রসারিত না হলে বাংলাদেশ একা কখনও এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের জন্য ভারতীয় সরকারী বেসরকারী বুদ্ধিজীবী ও কুশলী প্রচারকদের মুকাবিলায় দু’ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রথমতঃ ভারতে যেমন বাংলাদেশকে ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বলয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছায়া গ্রাসে ‘লীন’ করার একটি সর্বাত্মক জাতীয় লক্ষ্য ও কর্মনীতি গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। ভারতের দিক থেকে এটাকে তার আগ্রাসী জাতীয়তাবাদাশ্রিত দেশপ্রেম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ভারতীয় হিন্দুদর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রান্তিক দেশপ্রেম হিটলারের উগ্রজাতীয়তাবাদের সাথে তুলনীয় হলেও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে এটিকে তারা জাতীয় অহংকার ও ঐক্যের সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। একুশ শতকে ভারতকে ‘আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার’ থেকে ‘বৈশ্বিক সুপারপাওয়ারে’ উন্নীত করার জাতীয় চেতনার সাথে রাজনীতিক-সামরিক-অসামরিক-আমলা-বুদ্ধিবৃত্তিক থিংকট্যাংককে একাট্টা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসন, অবিরাম অন্তর্ঘাত, বৈরিতা অনুধাবন করা এবং জাতি-রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অনিবার্যিক স্বার্থে ভারতের চানক্য কুশলী যুদ্ধ মুকাবিলায় বাংলাদেশে রয়েছে নানা মত ও পথ। অর্থাৎ জাতি-রাষ্ট্র দুর্বল করে তাকে কুক্ষিগত বা পদানত করে রাখার ভারতীয় নীলনকশাকে মুকাবিলায় বাংলাদেশ কোন অভিন্ন জাতীয় নীতি অবস্থান গড়ে তুলতে পারেনি।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে ভারতের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা, জাতিগত মনস্তাত্বিক হীনমন্যতা এবং ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার চিরকালীন শৃংখলজনিত মানসিক প্রতিবন্ধী চেতনা জাতিগত দেশপ্রেমকে খন্ডিত, বিকৃত বা আত্মসমর্পিত করে রেখেছে। দ্বিতীয়তঃ ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখরতায় এবং প্রতিরোধের সক্রিয়তায় যাদেরকে অগ্রসরমান দেখা যায়, তাদের একটি বড়ো অংশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিতর্কিত বা ভূমিকার সূত্রে ভারত বিরোধিতাকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ধারার সাথে একাকার করে এর গুরুত্ব ও জনগণের কাছে তার আবেদনকে খাটো করে দেখানো হয়ে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহীদ জিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যে দিকদর্শন দিয়েছেন, যার ভিত্তি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী দর্শন যার প্রাণস্পন্দন, তাকে যারা ধারণ ও লালন করছেন, দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে তাদের নেতৃত্বও ভারতের প্রশ্নে সুসংহত, সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত নীতি কৌশলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন অবস্থায়ও জাতীয়তাবাদী সরকার এডহক ভিত্তিতে পররাষ্ট্র নীতি পরিচালনা করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাহাদাতের পর জাতীয়তাবাদী শক্তি তাদের নীতি আদর্শ-লক্ষ্যসমূহ কাগজে কলমে বন্দী রেখেই ক্ষমতার দায়শোধ করেছে। ফলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে রাষ্ট্র নির্মাণ ও জাতি রাষ্ট্র রক্ষার মূল সূত্র অন্তর্হিত হয়ে ক্ষমতার রাজনীতির স্থূলতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই অবক্ষয় ও বিচ্যুতি থেকে উদ্ধার লাভের উপায় বের করা রাজনীতিকদেরই দায়িত্ব। জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী মহলও দিশাহীন লক্ষ্যচ্যুত রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হতাশা ও নিষ্ক্রিয়তার দীর্ঘশ্বাস চাপছেন। অসংগঠিত ও লক্ষ্যহীন জাতি অতি সহজেই বিদেশী আগ্রাসনের শিকার হতে পারে। এদেশের ইসলামী শক্তিসমূহের মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার সূত্রে জাতি-রাষ্ট্র রক্ষার চলমান সংগ্রামকে তাদের নেতৃত্বদানের গ্রহণযোগ্যতাকে ‘স্বাধীনতা বিরোধিতার’ প্রশ্নে দুর্বল করে জনগণের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার নানা কূটকৌশল চলছে। এ ধরনের যুথবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে ওঠার আগেই ইসলামী শক্তিকে নির্মূলের নিশানা বানানো হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করণ, ৩৮ বছর আগের তামাদী হয়ে যাওয়া ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের দাবী তুলে একাত্তরের যুদ্ধের ধারায় জাতিকে অতীতমুখী ও বিভক্ত করা, বিশেষ বিশেষ অপছন্দের রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পায়তারা, এসবই ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী মনস্তাত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের পরিপূরক। মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সেনাবাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা তৈরীর নতুন বাহানা তৈরী করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সহজাত ইসলামীকরণের প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করে তুরস্কের আদলে সেক্যুলার ধারায় বিন্যাস করার দেশী-বিদেশী চাপও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে যারা আধিপত্যবাদের শৃংখলে বন্দী করে আশ্রিত রাষ্ট্র বানিয়ে রাখতে চায়, অথবা জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তিকে হীনবল ও বিভক্ত করে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাবেদার গোষ্ঠীকে বসাতে চায় তারা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার মূলভিত্তি ইসলামকে সমাজ ও রাজনৈতিক জীবন এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদা থেকে নির্বাসনে পাঠাতে চায়। ভারত উৎসারিত বাংলাদেশ বিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক ও মিডিয়া সন্ত্রাসের উপসর্গ হিসেবে ইসলামী জঙ্গিবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ যায়গা দখল করে নিয়েছে। ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা তাই সাময়িক বিষয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা ভারতের জাতিগত বিশেষতঃ হিন্দু ও রাষ্ট্রাচারের নীতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারত নেহরু ডকট্টিন অনুযায়ী এ অঞ্চলে কোন স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে নিতে ইচ্ছুক নয়। একারণে ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে সার্বভৌম সমতার রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয় না। আস্থাশীল সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও ভারত সব সময়ই অনীহ।
অনেকে মনে করেন, ১৯৪৭-এর দেশ বিভক্তির সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্তই সকল অনর্থের মূল। দ্বিতীয়তঃ ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তার ভৌগোলিক বিভক্তির জন্য মুসলিম লীগের ‘সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতিই দায়ী। এই সমীকরণের সূত্র টেনে তারা আরও একধাপ এগিয়ে বলতে চান যে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের খন্ডিতকরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের সমীকরণকে ভুল প্রমাণ করেছে। তবে এই সুবিধাবাদী স্থূল সমীকরণ মেনে নিতে হলে বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিই থাকে না। বাংলাদেশকে একটি ভাষাভিত্তিক সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। আবারও সেই ব্যর্থতা মুছে বাংলাদেশকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার খুঁটির ওপর ‘সেক্যুলার’ বাংলাদেশ গড়ার কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে ফ্যাসীবাদী তান্ডব কিংবা বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপকে ডেকে আনা হবে কিনা, সে আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্র কাঠামোর সেক্যুলার রূপান্তর কিংবা সন্ত্রাসী শক্তির অন্ধ অনুগামী একটি তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছেঃ প্রধানতঃ ১. ইসলামী শক্তি, ২. সেনাবাহিনীর ইসলামী চেতনা, ৩. জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তির জোটবদ্ধ রাজনীতিকে।
১/১১-এর আকস্মিক পটপরিবর্তন অনিবার্য ছিল না, তবে আবার অপ্রত্যাশিতও ছিল না। ইসলামী জঙ্গিবাদ, ভারতীয় জঙ্গী বিদ্রাহীদেরকে বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ব্যবহারের অভিযোগ, সুশাসনের অভাব, নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক অবক্ষয় এবং গণতান্ত্রিক শাসনের বিকৃতির সূত্র ধরে বাংলাদেশকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বানানোর চাপ ভারতের আগ্রাসী পরিকল্পনাকে অভূতপূর্ব আনুকূল্য দিয়েছে। জাতীয় সেনাবাহিনীর নীতি নির্ধারকরা বিগত ২২শে জানুয়ারীর সংবিধান নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহযোগিতার বদলে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করায় ১/১১ এর পটপরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি সেনাসমর্থিত সরকারের রাজনীতি দমনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বদলে সকল আক্রমণ মাথা পেতে নিয়েছে। বাংলাদেশে দু’ভাবে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার গদিচ্যুত হয়েছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিও একইভাবে বিলুপ্ত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে, ১৯৭৫-এ আওয়ামী লীগের দ্বারা সংসদীয় গণতন্ত্রের কফিনে এক দলীয় বাকশালের পেরেক ঠুকে ফ্যাসীবাদকে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের শাসন পদ্ধতি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করা। অন্যটি হয়েছে ১৯৮২ সালে নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে তদানীন্তন সেনাপ্রধান এরশাদের ক্ষমতা দখল। এক্ষেত্রেও প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের সহায়তা ছিল দৃশ্যমান। ছিল প্রতিবেশী ভারতের প্রত্যক্ষ মদদ। আড়াই দশক পর ১/১১-এর আগে আওয়ামী লীগ তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীদের নিয়ে চরম নৈরাজ্য, রাজপথে লগি-বৈঠার সন্ত্রাস, গণহত্যার তান্ডব সৃষ্টির পথ ধরে ভিন্ন আঙ্গিকে ‘সেনাসমর্থিত’ অভিনব সরকারের আবির্ভাব ঘটায়। এটা সামরিক অভ্যুদয়ের ভিন্ন রূপ। এ সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থনে যেমন ভারত-মার্কিন-যায়নবাদী চক্র সক্রিয় ছিল, তেমনি আওয়ামী লীগও বলেছে যে, তারাই আন্দোলন করে এ সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। ভারতীয় মিডিয়া এ পটপরিবর্তনকে বলেছে, ‘ফ্রেন্ডলী ক্যু’। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরাজমান স্থিতাবস্থা নস্যাৎ হোক সেটা সেনাবাহিনীর জেনারেলরাও চাইবেন বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, চারদলীয় জোট আবারও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করুক, আওয়ামী লীগ যেমন সেটা মেনে নেবে না, তেমনি সেনাবাহিনীর জেনারেলরাও মানবেন না। এদিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে আবারও অস্থিতিশীলতার আবহ বা অসাংবিধানিক শাসনের আবহ তৈরীর আশংকা রয়েছে। বাংলাদেশে অতীতে যতোবার ইতিহাসের বাঁক পবির্তনকারী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে সেনাবাহিনীর মেরুকরণেরও প্রভাব ছিল। আগামী দিনে জাতিসংঘ ও গ্লোবাল রাজনীতির পার্টনার বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দ্বারা জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে কোন বড়ো অভিযান সম্ভব কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। যারা বাংলাদেশ থেকে তথাকথিত স্বাধীনতা বিরোধীদের উৎখাতে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ কামনা করছেন এবং এতে ভারতের অর্থবহ সহায়তা প্রত্যাশা করছেন তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসতে না পারলে ভিন্ন পথেই হাঁটবেন। সুতরাং গণতান্ত্রিক উৎকর্ষের জন্য যে সহিষ্ণুতা ও দলীয় সম্প্রীতি দরকার তা কখনও এখানে গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে ভারতের হস্তক্ষেপ যদি আরও প্রত্যক্ষ ও সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে তাহলে তার সাথে এ্যাংলো স্যাকশান আমেরিকান যায়নবাদী চক্রের বৈশ্বিক ছত্রছায়া থাকবে। মুম্বাই ম্যাসাকারের পর পাকিস্তানকে নিয়ে গ্লোবাল রাজনীতির পার্টনাররা ভারতকে সামনে রেখে যে আগ্রাসী থাবা বিস্তার করেছে, তা এ উপ-মহাদেশে আর একটি পলাশী অধ্যায় সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরী করেছে। ভারত এবার পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের দিকেও নজর ফিরিয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পি. চিদাম্বরম অতি সম্প্রতি লোকসভায় বলেছেন, ভারত বিরোধী জঙ্গীরা বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ব্যবহার করে যাবে, ভারত এটা মেনে নেবে না। জঙ্গী নিয়ন্ত্রণে নয়াদিল্লী ঢাকার ওপর চাপ বৃদ্ধি করেছে বলে আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে।
এতে করে পাকিস্তানের মতোই তথাকথিত ইসলামী জঙ্গী এবং সন্দেহভাজন ইন্ডিয়ান মুক্তি যোদ্ধাদের দমন কিংবা বাংলাদেশে বন্দী উলফা নেতাদের ফেরৎ দানের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লীর চাপ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কিভাবে মুকাবিলা করবে, সেটাই নির্ণেয় বিষয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাষ্ট্রীয় প্রচারণার পটভূমি ও প্রকৃতি বোঝাতে আমি এই সুবিস্তৃত গৌরচন্দ্রিকা টানার প্রয়োজন মনে করছি। বাংলাদেশ বিরোধী এই অপপ্রচার, তথ্য সন্ত্রাস এবং রাষ্ট্রীয় অন্তর্ঘাত বাংলাদেশকে ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্র বানানোর ইন্ডিয়ান ডকট্টিনেরই সুনির্ধারিত পরিণতি। বাংলাদেশ এই বিপজ্জনক বৃত্ত থেকে কীভাবে বের হবে, সেটাই ভাবনার বিষয়।

পাক-ভারত সংঘাতের ছায়া
১৯৪৭ পরবর্তীকাল থেকে ভারত তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘ বিনিয়োগ করেছে, তার সুফল পেয়েছে ১৯৭১ সালে। তবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতীয় নেতাদের ‘হাজার বছরের’ বদলা নেবার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিলেও তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে যথেষ্ট ফারাক ছিল। না পাবার হতাশাজনিত প্রতিহিংসায় উদ্ধত ভারতের দুর্বীনিত আগ্রাসন তাই বাংলাদেশের ভাগ্যলিপি হয়েছে। ভারতভুক্ত পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ হতভাগ্য মুসলিম দেশ-মাটি-ঘর-বাড়ির মায়াত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করতে না পেরে ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণীর শৃংখলিত নাগরিক হিসেবে ন্যুব্জদেহ বনি আদমের ভাগ্যলিপি মেনে নিয়েছে। পশ্চিম বাংলার বাংগালী মুসলিমরা না বাংগালী, না মুসলিম এ দুয়ের মাঝামাঝি ন-পুংসক হয়ে ‘ভারতীয়’ হতে চেয়েও চরম লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হচ্ছে। ১৯৪৭-এর র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদের ভৌগোলিক বিভক্তির সুবিধাভোগী বৃহত্তর বাংগালী মুসলিম জনগোষ্ঠী নতুন সফরে কিস্তি ভাসানোর ঝুঁকি নিলেও ১৯৭১-এ ভারতের সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার অভিযাত্রায় শামিল হয়। কিন্তু ভারতের কাছে তারা যেমন প্রতারিত হয়েছে, তেমনি ভারতও যে প্রত্যাশায় সেনা, অর্থ, রাজনৈতিক, মানবিক সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তার সুফল পায় নি। এ হিসেবটা ভারতের। তবে বাংলাদেশের মানুষ মনে করেন, পাকিস্তানকে খন্ডিত করণই ভারতের জন্য বড়ো পাওনা। অন্ততঃ তার নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে এটা তার জন্য এক বিশেষ প্রাপ্তি।
তবে ভারত আরও বেশি কিছু প্রত্যাশা করায় তার প্রাপ্তিতেও শূন্যতা থেকে গেছে। ভারতের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার স্বরূপ বোঝার জন্য একাত্তরের ঘনিষ্ঠতার প্রয়োজন ছিল। ভারতের প্রতি এ দেশের মানুষের যে মোহ ছিল, তা ১৬ই ডিসেম্বর-৭১ থেকেই কেটে যেতে থাকে। কেননা ভারত ত্রাতার ভূমিকায় এসে ভাগ্যবিধাতা বা ভক্ষকের রূপে আবির্ভূত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাপ্রধান কিন্তু মার্শাল মানেক শ’ একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই রাজনীতিকদের ঘোর প্যাঁচ এড়িয়ে নিরেট সত্যি উচ্চারণ করে গেছেন। তিনি বলেছেনঃ যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে ভারতের আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈনিকেরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি একথা উপলব্ধি করি। বাংলাদেশীদের কখনোই ভারতের প্রতি তেমন ভালোবাসা ছিল না। আমিও জানতাম, ভারতের প্রতি তাদের ভালোবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন।’’ [দ্য ষ্টেটসম্যান’, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৮]।
ভারতের খ্যাতিমান কূটনীতিক এবং মুক্তযুদ্ধকালে দিল্লীর সাউথ ব্লকে ‘ইস্ট পাকিস্তান ডেস্ক’ এর প্রধান স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ঢাকায় ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার জে এন দীক্ষিত তাঁর ‘লিবারেশন এন্ড বিয়ন্ড’ বইতেও বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক এবং দিল্লীর আচরণ সম্পর্কে একই অনুভূক্তি ব্যক্ত করেছেন। ভারতের সম্ভবতঃ একমাত্র রাজনীতিক রাজা গোপালাচারী ১৯৭১ সালে ভারতকে তার ভূমিকা সীমিত রাখতে বলেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, বাংগালী মুসলমানদের ঘুমন্ত জাতীয়তাবাদ জাগ্রত হয়ে উঠলে দিল্লীকে পস্তাতে হবে। কিন্তু ভারত নানা কারণেই অসম্ভবকে সম্ভব করায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। প্রথমতঃ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন এবং তিনদিক দিয়ে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত বাংলাদেশকে শ্বাস নিতে হলেও ভারতের নেকনজরে থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তার কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশকে চিরকাল ভারতমুখী করে রাখবে। তৃতীয়তঃ বাংলাদেশে ভারতের অঘোষিত নাগরিক এবং লালিত পঞ্চমবাহিনীর যুথবদ্ধ অন্তর্ঘাত ভারতের প্রতি বাংলাদেশকে চিরকাল নতজানু রাখবে। চতুর্থতঃ ২৫ সালা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির বাধ্যবাধকতা। পঞ্চমতঃ বাংলাদেশের সংবিধানে ভারতের নীতিমালার অনুসরণ। ষষ্ঠতঃ অর্থনৈতিকভাবে ভারতের ওপর বাংলাদেশের অনিবার্যিক নির্ভরশীলতা। সপ্তমতঃ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে ভারতের ব্যাপক ছায়াপাত এবং পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সহজাত প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণা।
ভারতের দিক থেকে এ প্রত্যাশা হয়তো অমূলক ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার অহংকারকে আহত করে ভারত যে অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে রেখেছে, সেটাই তাকে সন্নিকটবর্তী হবার পথ আগলে রেখেছে। এটাকে ফিল্ডমার্শাল মানেকশ’ বলেছেন, ভারতের ‘বেনিয়াসুলভ আচরণ।’ একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বিষয়টি মূল্যায়ন করতে পারলেও ভারতের ধীমান বর্ষীয়ান রাজনীতিকরা ১৯৪৭ এ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ‘পূর্ববঙ্গের’ ফিরে পাওয়ার সুযোগকে স্বার্থপরতায় বরণ করে নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর ভারত বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে ভুল করেছিল বলেও অনুশোচনা করেছে। ভারতের ভূমিকা যে লিবারেটরের নয়, বরং দখলদার বাহিনীর মতো, সেটা ১৬ই ডিসেম্বর’৭১ এ সম্পাদিত আত্মসমর্পন দলিলেই তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে, বাংলাদেশের সরকার বা ‘মিত্রবাহিনীর’ বাংলাদেশী পক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের কোন প্রতিনিধির উপস্থিতি অংশগ্রহণ তথা স্বাক্ষরদানের সুযোগ সুপরিকল্পিতভাবে কেড়ে নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার তথা তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বের প্যারালাল ‘মুজিববাহিনী’ গঠন ও তাকে নিজের প্রভাব বলয় সৃষ্টির কাজে ব্যবহার, মুক্তিযুদ্ধ উত্তর কালে ‘মুজিব বাহিনীর’ কার্যক্রমকে নিজস্ব পরিকল্পনায় বিন্যাস ও প্রসারিত করা এবং সেনাবাহিনীর প্যারালাল রক্ষীবাহিনী গঠনের মাধ্যমে ভারতীয় করণের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে আত্মস্থ করে নেবার প্রক্রিয়া ব্যর্থ না হলে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া সত্ত্বেও ভারতের কবজা থেকে বাংলাদেশ ছুটে যেতে পারতো না। প্রকৃত অর্থে, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী সশরীরে বিদ্যমান না থাকলেও ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির অঘোষিত একাধিক বাহিনী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ৭৫-পূর্ব পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্ব তথা এর ভ্রম্নণ গড়ে ওঠার পর্বে শেখ মুজিবের নেতৃত্বের পাশাপাশি ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপ’কে ভারত সরাসরি পরিচালনা করেছে। এই ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসটিই’ একাত্তরের ২৫ মার্চের পর ভারতে মুজিব বাহিনীর খোলসে নতুন করে আবির্ভূত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে ভারত বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ পতাকা নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদকে মাঠে নামায়। জাসদের সশস্ত্র প্রতিরোধের ধারায় ‘গণবাহিনী’ পর্যন্ত গঠিত হয়। যার শাখা জাতীয় সেনাবাহিনী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। জাতীয় সেনাবাহিনীর বিকাশের সূচনাপর্বে ‘গণবাহিনীর’ ধাঁচে সেনা বাহিনী গড়ে উঠলে আমাদের জাতীয় সেনাবাহিনীর বর্তমান কাঠামো কখনো তৈরী হতো না। ‘গণবাহিনীর’ কনসেপশন আমাদের সেনাবাহিনীর বিকাশ অাঁতুড়ঘরেই নি:শেষ করে ফেলতো। ১৯৭৫-এর আগষ্ট পট পরিবর্তন এবং জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সংঘটিত পরবর্তী সিপাহী জনতার বিপ্লব সফল না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ইন্ডিয়ানদের দ্বারাই লিখিত হতো।
ভারত বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সহজাত প্রবৃত্তিকেই পাকিস্তানী ধারার প্রত্যাবর্তন হিসেবে সরলীকরণ করে থাকে। এটা তার পাকিস্তান ফোবিয়ার নবসংস্করণ। ভারত বাংলাদেশের স্বকীয়তা সংরক্ষণের সংগ্রামের মাঝে বাংলাদেশের মাঝে আর একটি পাকিস্তানের ছায়া দেখে আসছে। এটা মূলতঃ ভারতের নীতি ভংগীর পরাজয়ের স্বীকৃতি। পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে লাখো মানুষের আত্মত্যাগ সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের আস্থা ধরে রাখতে পারেনি এবং ভারতের কাছে সাহায্য না চেয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তান গণচীনের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হচ্ছে। এর দায় পুরোপুরি ভারতের। ভারতকে নিজের তৈরী করা এই অন্ধ বৃত্ত ভেংগে বেরিয়ে আসতে হবে। ভারতের দিক থেকে এটা সম্ভব না হলে বাংলাদেশকেই তার অস্তিত্বের সহযাত্রীদের বেছে নিতে হবে।
একক বিশ্বব্যবস্থার ভারতের অবস্থানঃ
বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি
ভারত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি। শুধু সামরিক ও ভৌগোলিক বিশালত্ব ও অবস্থানগত বিচারেই নয়। শতকোটি মানুষের বিকাশমান অর্থনৈতিক বিচারেও আগামী দিনে ভারত গণচীনের পাশাপাশি একটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। শুরুতে ভারত জোট নিরপেক্ষ নীতিমালার একটা বাতাবরণ তৈরী করে তৃতীয় বিশ্বের কাছে একটা নন্দিত ইমেজ গড়ে তোলার প্রয়াস চালালেও ১৯৭১-এর পাকভারত যুদ্ধের সময় তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ২০ সালা সামরিক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে তার জোটনিরপেক্ষ নীতির মুখোশ খসে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারত এমন একটা বৈশ্বিক অবস্থায় মৈত্রী সম্পাদন করেছিল, যখন বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ব্লক ও মার্কিন-ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশ সমূহের সমন্বয়ে দুটি বিশ্বে বিভক্ত। বিশেষ করে ঐ সময়টা ছিল দুটি শিবিরের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের চরম উত্তেজনা ও বৈরিতা এবং শাক্তি-দ্বন্দ্বের নাটকীয়তার দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ।
ঔপনিবেশিক আমলের শুরু থেকেই বৃটিশ-বেনিয়া শাসকদের সাথে ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রথমে এর ভিত্তি মুসলিম শাসন-কর্তৃত্বের অবসান ঘটাতে বিকাশমান ইংরেজ রাজশক্তির নেক নজর পাবার লক্ষ্যে নিবেদিত হলেও হিন্দুদের রাজনৈতিক চেতনায় দিল্লীর সিংহাসনের উত্তরাধিকারীত্ব দখল করার স্বপ্ন যুক্ত হয়। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বের একশ বছর (১৮৫৭-এর সিপাহী জনতার মহাসংগ্রামের পূর্ব পর্যন্ত) ভারতের অগ্রসর হিন্দু এলিটরা ইংরেজদের আনুগত্য-আরাধনায় নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরী করেছে। আর এটা করতে গিয়ে তারা বৃটিশ-ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিপক্ষ হাজার বছরের মুসলিম শাসকদের উচ্ছেদে ইংরেজদের অনুগত মুৎসুদ্দী-কলাবরেটরের ভূমিকা পালন করেছে। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় আঞ্চলিক হিন্দু মারাঠা নেতা শিবাজীর বিদ্রোহের ধারায় ভারতে হিন্দুদের রাজনৈতিক আস্তিত্বের ভ্রুণ তৈরী হয়। হিন্দুদের এই মুসলিম বিরোধী চেতনাকে ব্যবহার করেই ইংরেজ কোম্পানী শাসকগণ এবং পরবর্তীকালে বৃটিশ রাজের অমাত্যরা হিন্দুদের পূর্ণ সহযোগিতায় ভারতের সকল পর্যায় থেকে স্বাধীন মুসলিম শাসকদের উচ্ছেদ করেছে। ফলে নব জাগ্রত হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্বকারী এলিট সমাজ যেমন ইংরেজদের প্রতি বরাবর চিরকৃতজ্ঞ থেকেছেন, তেমনি ইংরেজ শাসকরাও তাদের ঔপনিবেশিক যুগের অবসানকালে হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অনেক নজীর তৈরি করে গেছেন। ফলে ১৯৪৭-এর দেশ বিভক্তির পর থেকে ভারত প্রতিটি পর্যায়ে বৃটিশ আমেরিকান আনুকূল্য পেয়ে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে কাশ্মীর ইস্যু, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ এর পাক-ভারত যুদ্ধ, পাকিস্তানের পরমাণু ইস্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কিংবা ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির ভারতঘেঁষা নীতির কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান মার্কিন ছত্রছায়া পায়নি। যুদ্ধ বিরতি হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তাসখন্দ শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। ১৯৭০-এর সংকট উত্তরণে মার্কিন কূটনীতি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না। ফলে একটি রাজনৈতিক সংকটের সামরিক সমাধান রক্তাক্ত অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর মার্কিন কূটনৈতিক চাপ থাকলে ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র সীমালংঘন করতে পারত না।
সোভিয়েত রাশিয়ার ভাংগন ও সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের অভিঘাত মুক্ত হয় বটে। তবে এতে নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ইউরোপও ন্যাটো সামরিক জোটের সহযোগী হয়ে কার্যত বিশ্বব্যাপী একক মার্কিন কর্তৃত্বকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের ফলে তাদের ‘ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেংগে যায়। এর ফলে বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যই শুধু বিনষ্ট হয়নি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ধ্বংস্তূপের ওপর স্নায়ুযুদ্ধ মুক্ত বিশ্বে একক শক্তির অভ্যুদয় ঘটে। এতে তামাম মুসলিম বিশ্বকে প্রতিপক্ষের নিয়তি বরণ করতে হয়। স্যামুয়েল হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ থিউরীর বিভাজন রেখা ধরে ৯/১১-এর বিমান হামলার দায় ইসলামী জঙ্গীদের ঘাড়ে চাপানোর মধ্য দিয়ে বিশ্ব আর একটি নতুন অবস্থার মুখোমুখি হয়। পরিবর্তিত বিশ্বে জঙ্গিবাদী ও জঙ্গী তৈরীর কারখানা যাদের হাতে, জঙ্গিবাদ দমনের অস্ত্রও তাদের হাতে। মাঝ খান থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র-শক্তি আক্রান্ত ও জবর দখল হতে থাকে। যে সব মুসলিম দেশ জঙ্গিবাদ ইস্যুতে এখনও সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়নি, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তবে বিশ্ব শক্তির নতুন মেরুকরণে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলী অক্ষের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং ভারতের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক তথা দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিগত ১/১১-এর পট পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে ভারসাম্য ছিল। অর্থাৎ পাক-চীন-মার্কিন শক্তির মাঝে স্বতন্ত্র ধারায় সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব বলয় থেকে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু ১/১১-এর পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শাসন ক্ষমতায় আবির্ভূত সেনা সমর্থিত সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্রেসীর সরকারের মাধ্যমে ভারতীয় লবী একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে ভারতীয়দের প্রভাব ১৯৭১-পরবর্তী সময়ের চেয়েও ব্যাপক ও বিপজ্জনক ধারায় উপনীত হতে যাচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেটওয়ার্ক মূলত: তার সাম্রাজ্যকে নিরাপদ, অক্ষত এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাখার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্বের তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করা এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকে ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলী অক্ষ সামনে নিয়ে আসলেও মূলত: এর পেছনেও পশ্চিমা খৃস্টীয় জগতের ক্রুসেডীয় প্রতিহিংসার ছায়া রয়েছে। ৯/১১-এর পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বুশের ‘অন্তহীন’ যুদ্ধের শুরুতে বুশ বলেছিলেন ঈশ্বর তাকে এ যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে কট্টর যায়নবাদী-উগ্রবাদী ‘নিউকন’ এবং ভারতের উগ্র হিন্দুদের মধ্যে ইসলামী শক্তি ধ্বংসে এক অশুভ ঐক্য গড়ে উঠেছে। ঔপনিবেশিক যুদ্ধের সূচনায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তায় হিন্দুত্ব যেমন হাত মিলিয়েছিল, বর্তমান সময়েও যায়নবাদীদের তদারকীতে কট্টর পৌত্তলিক হিন্দুত্বের প্রতিনিধিত্বকারী ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি এবং মার্কিন অক্ষ একাট্টা হয়েছে। মুম্বাই ম্যাসাকারের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসত্তা বিনাশী শক্তির প্রত্যক্ষ মেরুকরণ ঘটেছে। এই অবস্থা তৈরির জন্য এতকাল মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তিক সন্ত্রাসকে ভারতের রাষ্ট্রশক্তি মদদ ও প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশকে একটি ‘অকার্যকার’ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিপন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে ত্রি-শক্তির সক্রিয়তা দৃশ্যমান। ভারত শুধু রাজনৈতিক ও সামরিক কারণেই নয়, তার জাতিগত হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের দায়বদ্ধতার কারণেই রাষ্ট্রীয় সম্প্রসারণবাদ ও প্রতিপক্ষকে জাতিগত সহিংসতা-অন্তর্ঘাতে নি:শেষ করতে চায়। ভারতের সামনে একদিকে রয়েছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তির হাতছানি, তেমনি ভারতকে গণচীনের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে রয়েছে ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদী অক্ষের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধার আগ্রহ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের দীর্ঘকালের আগ্রাসী নীতি- তাই নব পর্যায়ে ত্রয়ী বৈশ্বিক শক্তির মদদ পেয়ে আরও আগ্রাসী ও সহিংস হয়ে উঠেছে। মুম্বাই ম্যাসাকারের পর ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি আরও আগ্রাসী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগ্রাসনের ক্ষেত্র তৈরী করা এবং ‘অকার্যকর’ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে চিহ্নিত করা ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রোপাগান্ডার সাথে যায়নবাদী পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তা মিডিয়া সন্ত্রাসকে বাংলাদেশের জন্য অসহনীয় ও বিপজ্জনক করে তুলেছে। তবে ভারতীয় মিডিয়া সন্ত্রাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের পক্ষে স্থানীয় ‘পঞ্চমবাহিনীর’ সহায়ক ভূমিকা জাতি-রাষ্ট্রের অন্তর্ঘাত মুকাবিলার শক্তিকে দুর্বল করে রেখেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের মিডিয়া সন্ত্রাসের ইস্যুগুলো হচ্ছে :
১. বাংলাদেশ ইসলামী মৌলবাদের দিকে জাতি-রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করছে।
২. বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ পালিত ও বর্ধিত হচ্ছে। যা ইসলাম এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকেই প্রাণ-রস আহরণ করছে।
৩. বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ইসলামী জঙ্গী ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গীরা ব্যবহার করছে।
৪. বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তিসমূহ ইসলামী-জঙ্গিবাদকে লালন ও পরিপুষ্ট করছে।
৫. বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের ইসলামীকরণ ভারতের নিরাপত্তার জন্য বিপদ তৈরি করছে।
৬. বাংলাদেশকে ইসলামী শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারত বৈরিতা পরিহার করতে হবে এবং বাংলাদেশের কাছে ভারত তার নিজের প্রয়োজনে যা কিছু চায়, অবলীলায় তা পরিশোধ করতে হবে।
১/১১ এর পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মূলত: ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের জন্য বাংলাদেশ আরও উন্মুক্ত অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তির বিনাশ, সেনাবাহিনীকে ভারতীয় আগ্রাসনের বাস্তবতা ভুলে অভিন্ন প্রতিরক্ষা নীতিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিকে ভারতের সাথে জুড়ে দেওয়ার চাপ বাড়ছে। জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল নির্ধারণকারীদের একটি অংশ বাংলাদেশের জন্য স্বাধীন কিংবা বিপরীতমুখী কোন প্রতিরক্ষা নীতি ও প্রতিরক্ষা শক্তির উন্নয়ন ঘটানোকে ভারতের প্রতি বৈরিতা বলে মনে করেন। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের একশ্রেণীর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, রাজনৈতিক-বুদ্ধিজীবী ও সামাজিক শক্তির ভারতীয়দের চেয়েও অতিমাত্রায় ভারতমুখী ভূমিকা জাতি-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভেতর থেকেই অন্তর্ঘাতের ক্ষত তৈরি করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিপদ হচ্ছে, ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশ কোন জাতীয় নীতি তৈরি করতে পারেনি। ভারতের জন্য যা তাদের নিরাপত্তা ইস্যু, বাংলাদেশের জন্য তা অস্তিত্বের মামলা। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ ইস্যু কিংবা ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিবাদের ঘাঁটির অস্তিত্ব নিয়ে ভারত যতোই প্রোপাগান্ডা করুকনা কেন, তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এই উদ্ভট ও নাজুক ইস্যুতে ভারতীয় গোয়েবলসীয় প্রচারবিশারদদের চেয়েও বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়া কর্মী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকদের অসত্য প্রতিষ্ঠায় ভারতের পক্ষে সাফাই সাক্ষী হিসেবে ন্যাক্কারজন্যক ভূমিকা জাতীয় কলংককে অমোচনীয় করে রেখেছে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ক্ষোভ, অভিযোগ, প্রতিহিংসা অন্তহীন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু ও উপজাতীয়রা অরক্ষিত, বিপন্ন এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এ বিষয়টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সংকট নিয়ে ভারতীয়দের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতা-লন্ডন-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় সেমিনার-আলোচনা সভা হচ্ছে। এতে বরাবরই বাংলাদেশের ব্যাপারে ভুল বার্তা যাচ্ছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ সহ মাইনরিটি স্বার্থ রক্ষার নামে গজিয়ে ওঠা নানা সংগঠন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু উপজাতীয়দের উস্কানী দিয়ে মেজরিটির দেশে তাদেরকে সংখ্যালঘুদের তাবেদারীতে ন্যস্ত করতে চায়। বাংলাদেশের মানুষের বৃহত্তর মুসলিম ধর্মীয় চেতনা ও ইসলামী আদর্শের মধ্যেই ব্যাপক সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানবিক উপসর্গ বিদ্যমান। ইসলামী জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মিথ্যা অপবাদে বাংলাদেশকে যারা ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ বানাতে চায়, তারাই আধিপত্যবাদের সহায়ক পঞ্চম বাহিনী। এরা ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগান্ডার অন্ধ চুঙ্গাবাজই নন, বাংলাদেশের সেক্যুলার রাষ্ট্রীয় চরিত্র পুনরুদ্ধারে এরা ভারতের হস্তক্ষেপে তাবেদার সরকার গঠনেও প্রস্ত্তত। ১৯৪৭-র বিভক্তির পর বাংলাদেশ থেকে অপশন দিয়ে স্বেচ্ছায় ভারতে চলে যাওয়া কোটি কোটি হিন্দুদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা দিয়ে পুনর্বাসন করার দাবী উঠেছে। ভারতের পশ্চিম বাংলায় সেখানকার বাংগালী হিন্দুদের একটি অংশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জিলা নিয়ে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ বা একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী তুলেছে। বাংলাদেশের অভিন্ন-অবিচ্ছেদ্য ভৌগোলিক ও নৃ-তাত্ত্বিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক ঐক্যের ধারা ধ্বংস করে বাংলাদেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করার দাবীও কেউ কেউ তুলেছেন। এটা বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের খপ্পরে পড়তে সুযোগ তৈরি করে দেবে। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় একটি তাবেদার সরকার না বসানো পর্যন্ত দিল্লী বিশ্রাম নেবে না। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের বিনিময় ছাড়াও বৈশ্বিক পরাশক্তির মদদপুষ্ট আঞ্চলিক শক্তি ভারত বাংলাদেশের কাছে স্থল ট্রানজিট, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, গ্যাস, কয়লাসহ বাংলাদেশকে অভিন্ন প্রতিরক্ষা নীতিতে শরবিদ্ধ করতে চায়। জঙ্গিদমনে বাংলাদেশের সাথে মিলে ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে সামরিক অভিযান চালানোর অব্যাহত চাপের কাছে বাংলাদেশ নতি স্বীকার না করা পর্যন্ত ভারত চাপ বাড়িয়েই চলবে। শাসন ক্ষমতায় যদি একটা দুর্বল ও নতজানু নীতির তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে ভারতের কোন দাবীই অপূর্ণ থাকবে না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চাপ ও পিঠ চাপড়ানী এবং পঞ্চমবাহিনী ব্যবহার করে অন্তর্ঘাত চালানোর কৌশলে ভারত লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। ভারতের প্রতিটি বোমা-সন্ত্রাসের সাথে কোন না কোনভাবে বাংলাদেশকে জড়িয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র চরিত্রকে জঙ্গিবাদের দোষে দুষ্ট করা ভারতীয়দের কৌশল। এই অভিযোগকে ভারত ক্রমশ: সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী করেছে।
একক বিশ্বব্যবস্থার ভেতর থেকে বাংলাদেশ তার জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম সত্তাকে সংরক্ষণ করে আঞ্চলিক পরাশক্তির সাথে কীভাবে সার্বভৌম সমতা নিয়ে টিকে থাকবে, তার উপায় উদ্ভাবনই হওয়া উচিত রাজনীতির মূলমন্ত্র। মুম্বাই ম্যাসাকারের পর জঙ্গিবাদের সংজ্ঞা নির্ণয় ও জঙ্গী দমনে ভারতের দিক নির্দেশনা মেনে নিতে সবাইকে বাধ্য করা অথবা ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদীদের মদদপুষ্ট ভারতীয় সমরকুশলীদের প্রণীত যুদ্ধ নীতির শিকার হবার একটি আতংক তৈরি করা হয়েছে। একে জাতীয় ঐক্য ও বুদ্ধিমত্তায় মুকাবিলা করতে না পারলে আত্মসমর্পণ করে কারজাইয়ের ভূমিকা গ্রহণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সরকারকে বাধ্য করা হবে।
১/১১-এবং ভারতের তথ্যসন্ত্রাস
ভারতের তথ্যসন্ত্রাস এবং অন্তর্ঘাত অনেক আগেই আঞ্চলিক বৃত্ত অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক শক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর বিপদ তৈরি করেছে। এখানেও ৯/১১-উত্তর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-নীতির ছায়া পড়েছে। সুতরাং ৯/১১-এর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের তথ্যসন্ত্রাস ছিল গতানুগতিক এবং আঞ্চলিক ও দ্বি-পাক্ষিক সংঘাতের বৃত্তে বন্দী। এরপর ভারত এক্ষেত্রে তার অন্তর্জাতিক সহায়ক শক্তির বুদ্ধি-পরামর্শ প্রযুক্তি টেকনিক পেয়েছে। বিশেষ করে, ভারতের জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ ক্ষুন্ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যদি পাকিস্তানের ওপর থেকে আশীর্বাদের ছায়া অপসারণ করে নিতে ভারত তার প্রচেষ্টা সফল করতে পারে, তাহলে পাকিস্তানকে নিয়ে নয়াদিল্লী যে কোন নিষ্ঠুর খেলাই খেলতে পারবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত রিপাবলিকান প্রার্থী ম্যাককেইন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস ভারত সফর করে জঙ্গি মুকাবিলায় শুধু ভারতের পক্ষে থাকার আশ্বাসই ব্যক্ত করেন নি। পাকিস্তান ও পাকিস্তান কেন্দ্রিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন নির্মূলে মার্কিন সরকার ভারতের সকল বক্তব্যের প্রতি অন্ধ সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানকে ভারতের ক্লায়েন্ট স্টেটের মতো নতজানু হয়ে সকল হুকুম তামিল করার ছবকও দিয়েছেন। পাকিস্তান কী করবে, সেটা তার নিজের ব্যাপার। তবে মার্কিন কূটনীতি ও রণনীতিতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের প্রয়োজন এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ব্যাপারেও ভারত একইভাবে মার্কিনীদের চোখে ঠুলী লাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে ইঁদুর-বিড়াল খেলায় বিজয়ী হতে চায়।
বাংলাদেশে যারা অনুসন্ধানী রাজনৈতিক সাংবাদিকতায় উৎসাহী এবং বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সিক্রেট এজেন্ডার খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন, বিগত ২২শে জানুয়ারী সংবিধান নির্ধারিত নির্বাচন বানচালই ঐ গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রধান এজেন্ডা ছিল এবং তারা তাতে সফল হয়েছে। অথচ ভারত সরাসরি কোন হস্তক্ষেপ করেনি। গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ করার হাতিয়ার হিসেবে একটি বড়ো দল, এনজিও সুশীলদের ব্যবহার করার মাধ্যমে নির্বাচন ভন্ডুল করে দেয়। এখানে জাতীয় সেনাবাহিনীর জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন এক অবস্থা তৈরি করা হয়, যাতে সেনাবাহিনীর পক্ষেও নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের নামে প্রচারিত একটি বিবৃতির সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তার বদলে দুবছরের সরকারের পক্ষে স্ট্রাইকিংফোর্স হিসেবে কাজ করে এসেছে। পরে জানা গেছে, জাতিসংঘ ঐ বিবৃতি দেয়নি। জাতিসংঘের কথিত ঐ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, দুই প্রধান দল ও জোট তথা দুই নেত্রীর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনী নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে একদিকে মানবাধিকার লংঘিত হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ মিশনে তাদের সমুদয় চাকুরী হারাবে। এর সত্যাসত্য যাচাই কিংবা জাতিসংঘের মনোভাব বদলানোর কোন চেষ্টাই সেদিনের সরকার করেননি।
১/১১-এর পট পরিবর্তনকে ভারতীয় মিডিয়া ‘ফ্রেন্ডলী ক্যু’ কলে অভিমত দিয়েছে। তারা এ সরকারের আমলে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে বিশেষ ঘনিষ্ঠতায় নিয়ে গেছে। এ সরকার গণচীন,
পাকিস্তান, মুসলিম বিশ্বের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতপ্রেমের বিশেষ ধারা তৈরি করেন। ভারতের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এ সরকারের আমলেই ঢাকা সফর করে বাংলাদেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র দেখতে চান বলে দাবি তুলেছেন। শেখ হাসিনার প্রবাসী পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় জনৈক মার্কিন-ইহুদী লেখক সিওভাক্কোর সাথে মিলে এক লেখায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ইসলাম মুক্ত তথা বাংলাদেশকে ‘সেক্যুলার’ বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চান। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তির যে ধারা রাষ্ট্র সরকারের জন্য একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতি তৈরি করেছে, তা সরাসরি ভারতের আধিপত্যবাদী স্বার্থের পরিপন্থী। এ কারণে ভারত ইচ্ছা পূরণের একটি তাবেদার সরকার চাইছে। দেশপ্রেমিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দিয়ে তাবেদারদের ক্ষমতার দৃশ্যপটে টেনে আনার জন্য বাংলাদেশে যা কিছু ঘটানোর প্রয়োজন হয়েছে, তা তারা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সূত্রে বাংলাদেশের ওপর ভারত যেভাবে প্রভাব বলয় গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাতে তারা পুরোপুরি সফল না হলেও হাল ছেড়ে দেয়নি। একাত্তরের মতো আর একটি মুক্তিযুদ্ধের হুংকার যারা দিচ্ছেন, তাদের পেছনেও এ ধরনের প্রণোদনা থাকা খুবই স্বাভাবিক। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কার্যত জনযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। তবে আধিপত্যবাদী ভারতই একে একটি একক দলের বিজয়কীর্তি হিসেবে আগলে রেখে তাদের দখলদার বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় ঐ দলটিকে ক্ষমতায় অভিষিক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ উত্তরকালে জাতীয় ঐক্য ও পুনর্গঠনের জন্য জাতীয় সরকারের জন্য আকাংখাকে অবজ্ঞা করেই দলীয় সরকারের অহংকারের কাছে জাতীয় বিজয়ের কীর্তিকে পদদলিত করা হয়েছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্বে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সকল দল ও মতকে একই সামিয়ানার নীচে নিয়ে আসার সম্ভাবনাকেও কাজে লাগানো হয়নি। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনার বহু আগে থেকেই এর সংগঠকদের ওপর ভারত এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল, যাতে করে বিভাজন রেখার দুই প্রান্তে অবস্থান নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। এর লক্ষ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে জাতিকে চিরদিনের জন্য বিভক্ত রেখে আধিপত্যবাদের হিংস্র নখরে বাংলাদেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে রাখা। জাতীয় মুক্তির গতিধারায় ১৯৭১পর্বে ভারত এদেশের ইসলামী শক্তির জন্য যে ফাঁদ পেতে রেখেছিল, তারা তাতেই পা দিয়ে ফেঁসে যায়। তবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা কার্যত একটি যুদ্ধ প্রহসনের মধ্য দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করার গোপন প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এই রূঢ় সত্য উদ্ঘাটনও উপলব্ধি করা পাকিস্তানের স্ব-ঘোষিত রক্ষকদের জন্য সম্ভব ছিল না। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চারদশক পরও যখন বৃহত্তর জনগণকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে, তখন তাদের পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’-‘যুদ্ধাপরাধী’, হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণের মূল সংগ্রামকে দুর্বল করা হচ্ছে।
ভারত বাংলাদেশের ওপর বিষ-দাঁত বসাতে না পেরে ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদীদের সাথে নিয়ে তার অশুভ পরিকল্পনাকে আরও শাণিত ও ব্যাপক রূপ দিয়েছে। বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-বন্দর-স্থল ট্রানজিট সহ অন্যান্য কৌশলগত ক্ষেত্রে ভারতের লোলুপ থাবা বিস্তারের প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি প্রভৃতি সংস্থার প্রত্যক্ষ ওকালতি ছাড়াও মার্কিন দুতিয়ালীও সমভাবে সক্রিয়। বাংলাদেশকে ‘অকার্যকর’ রাষ্ট্র বা ইসলামী জঙ্গিবাদের ‘অভয়ারণ্য’ হিসেবে প্রমাণ করার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বাধীন মিডিয়া সন্ত্রাসের যারা কুশলী তাদের অবস্থান ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনে। আন্তর্জাতিক যায়নবাদ এদের সমন্বয় সাধন করছে।
ভারতের বিশ্ব শক্তি হয়ে ওঠার সাধনা, তার সহজাত ইসলাম ভীতি এবং তার আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ-সংঘাত-সশস্ত্র জনযুদ্ধ মাওবাদী অভিঘাত মুকাবিলা করার প্রয়োজন যায়নবাদী বৈশ্বিক শক্তির ওপর তার নির্ভরতাকে এমনভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ভারতকে গণতন্ত্রের আবরণে একটি ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রশক্তিতে পরিণত করতে যাচ্ছে। মুম্বাই ম্যাসাকারের পর ভারতের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস দমনের কর্ম কৌশল নিরূপণে বৈদেশিক শক্তি তথা ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদী নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ওপর ভারতের নির্ভরতা কার্যত তার সার্বভৌম সত্তাকেও আঘাত করতে শুরু করেছে। তবে এই ত্রয়ী শক্তির সাথে ভারতের মেরুকরণ এ অঞ্চলেরর দুটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ে আঘাত হানার উপসর্গ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের জনগণের বিপন্নবোধের এও একটি উপসর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়াদিল্লীর আয়নায় এবং ভারতের আগ্রাসী পরিকল্পনায় বিবেচনা করলে বাংলাদেশের পক্ষে আধিপত্যবাদ মুকাবিলা করা হবে অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের মিডিয়া সন্ত্রাস ও সরকারী পর্যায়ে ব্লাকমেইলিং আজ আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয় নয়। এক মেরু বিশ্বে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদী চক্রের কাজে সহযোগী হিসেবে ভারতের যোগদান বাংলাদেশের সংকটকে তীব্র করে তুলেছে। প্রতিবেশী ভারতের দায়িত্বশীল মহল জঙ্গিদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে বাংলাদেশে সামরিক হানার উস্কানীও দিয়েছেন।
মুম্বাই ম্যাসাকারের নানা বিশ্লেষণ হয়েছে, তবে ভারত মুম্বাই জঙ্গিদের পাকিস্তানের লোক বলে চিহ্নিত করলেও ভারতীয় বিশ্লেষকদের ভিন্ন মতও রয়েছে। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় এবং মহারাষ্ট্রের ফ্রীল্যান্স সাংবাদিক অমরেশ মিশ্রের দুটির বিশ্লেষণ চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে। এতে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. মুম্বাই ঘটনার সাথে ভারতের আভ্যন্তরীণ ঘটনার যোগসূত্র এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দুই. ভারতের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তিন. চিরাচরিত নিয়মে এ ঘটনায় ভারত তার আজন্ম শত্রু পাকিস্তানকে আঘাত হানার সুযোগ পেয়েছে। মুম্বাই ঘটনায় পাকিস্তান এজন্যই মদদ দেবেনা যে, এ ঘটনা সূত্রে তাকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত্ত হতে হবে। রাষ্ট্রহীন জঙ্গিদের দমন করা সব রাষ্ট্রের জন্যই কঠিন। ভারত ৫০ বছরেও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে পারেনি। মাওবাদীদের তৎপরতা ভারতে ক্রমবর্ধমান। ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি পাকিস্তান বা আজাদ কাশ্মীরে কোন সশস্ত্র তৎপরতা গড়ে উঠে থাকে তার দায় ভারতেরও রয়েছে। তবে পাকিস্তান সরকারের গৃহীত কোন পদক্ষেপেই যদি ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট না হয়ে নিজেরাই পাকিস্তানী ভূ-খন্ডে সামরিক হামলাকে প্রাধান্য দেয় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের কিছু করণীয় নেই। আধিপত্যবাদী ও পাশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের যুথবদ্ধ আক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর শক্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তি। জঙ্গিবাদের মদদতাতা ও লালনকারী কলাবরেটর হিসেবে দেশপ্রেমিক এই শক্তিকে চিহ্নিত ও নিন্দিত করে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় ও অকার্যকর করে রাখাই ভারতীয় মিডিয়া সন্ত্রাসের লক্ষ্য। এই সাথে রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতির অভিযোগ চাপিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ব্যবহার করে জাতীয়তাবাদী-ইসলামী শক্তিকে অবদমন করার সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নেপথ্যচারী শক্তি হিসেবে আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে সংঘাতমুখী ও জটিল করে দেবে।

মুম্বাই ম্যাসাকারঃ
অপবাদের দায় চাপানোর কুশলতা
মুম্বাই ম্যাসাকার ভারতের মতো একটি বড়ো দেশের নিরাপত্তার দুর্বলতা ও প্রতিরÿার অÿমতা প্রকাশ করে দিয়েছে। হামলাকারীরা যদি সমুদ্রপথ ব্যবহার করে ভারতের প্রতিরÿা ব্যুহ এবং মুম্বাইয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে ভারতে প্রবেশ করে ৬০ ঘন্টা ধরে গোটা ভারত সরকারকে জিম্মি করে থাকে, তবে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ভারত ভবিষ্যতে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে, তাও বিশ্বাস করা যায় না। ভারতের ভাষ্য অনুযায়ী ১০ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রম্নপ যদি পাকিসত্মান থেকে কয়েকশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসে মুম্বাই ম্যাসাকার করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতেও অন্যান্য বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র গ্রম্নপ এরকম হামলা চালাতে পারে। অর্থাৎ মুম্বাই ম্যাসাকারের মাধ্যমে তারা সন্ত্রাসীদেরকে আক্রমণের পথ ও কৌশল দেখিয়ে দিয়েছে। ভারতের জন্য মুম্বাই ম্যাসাকারকে আর একটি ৯/১১ হিসেবে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারনা চালানো এবং এই ঘটনার সূত্রে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেবার অভিঘাত এ অঞ্চলে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
মুম্বাই ম্যাসাকার সম্পর্কে অমরেশ মিশ্র পিলে চমকানো তথ্য-বিশেস্নষণ দিয়েছেন। এটি ভারতের মূলধারার মিডিয়া যেমন উপেÿা করেছে, তেমনি ভারতীয় সরকারী মহলও একে পাশ কাটিয়ে গেছে। অমরেশ মিশ্র নিজেই লিখেছেনঃ মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে যারা মিডিয়া এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের বক্তব্যে অতি উৎসাহী হয়ে পড়েন এবং বাসত্মবতা অনুধাবন করতে পারেন না, তাদের প্রতি আমার করম্নণা হয়।’’
বিবিসি রিপোর্টের উলেস্নখ করে অমরেশ মিশ্র লিখেছেনঃ মুম্বাইয়ে হামলাকারীদের কয়েকজন ভারতীয় ছিল না এবং অবশ্যই মুসলিমও নয়। একে ৪৭ রাইফেলধারী দুই যুবক, যারা মুম্বাইয়ের শিবাজী রেলওয়ে ষ্টেশনে হামলা চালায়, তাদের চেহারা ছিল বিদেশীদের মতো ......। এন্ড্রু জি মার্শালকে উদ্ধৃত করে অমরেশ মিশ্র লিখেছেনঃ ‘বিদেশীদের মতো চমৎকার চুলধারী কমান্ডোরা কয়েক বোতল বিয়ার খেয়ে শামত্মভাবে বহুলোককে হত্যা করলো, এতে মনে হয় যে, মুম্বাইয়ের হামলা ছিল দেশজ ভারতীয় মুসলমান অথবা আরব আল কায়েদা সন্ত্রাসীদের নয় বরং এরা ছিল এ্যাংলো-আ্যামেরিকান গোপন গোয়েন্দা দল।
এই হামলার ফলে পাকিসত্মান ভাংগার ভিত্তি তৈরী হয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং এই এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিসত্মার ঘটায়। মুম্বাই হামলার সাথে ভারত-পাকিসত্মান অথবা পাকিসত্মানী মুসলিম এবং হিন্দু ভারতীয়দের কিছু করার ছিল না।
পাকিসত্মানকে অস্থিতিশীল করে তোলা এবং শেষ পর্যায়ে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করার প্রচেষ্টায় প্রতিবেশী দেশসমূহে বিশৃংখলা ও স্থিতিহীনতার বিসত্মার ঘটানো হচ্ছে। একটি নতুন সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে কৌশলগত এলাকা সৃষ্টির অংশ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে ইরাকের মাধ্যমে গৃহীত এ্যাংলো আমেরিকান প্রচেষ্টার অধীনে ইরানের প্রতিবেশী ইরাকে এর বাসত্মবায়ন ঘটানো হয়েছে। এন্ড্রু মার্শাল এর লেখা বই Divide and Conquer : Anglo American Imperial Project এ ব্যাপারে বিসত্মারিত তথ্য উলেস্নখ করা হয়েছে।
অমরেশ মিশ্র দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন, মুম্বাইয়ের ইহুদী কেন্দ্র নরিমন হাউসে হামলার ঘটনা ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দৃশ্যপটে টেনে আনে। .... আমেরিকার বর্তমান ÿমতাসীন মার্কিন অভিজাত সংস্থা White Anglo-Saxon Protestant (WASP) Forces যায়নবাদীদের সাথে এক চুক্তিতে পৌঁছেছে। নরিমন হাউসে ইহুদী রাববী ও তার নবপরীণীতা স্ত্রীকে হত্যার মাধ্যমে যায়নবাদীরা দুটি লÿ্য পূরণ করেছে। এক. এই ঘটনায় মোসাদ কমান্ডোদের জড়িত থাকার বিষয়টি আড়াল করতে পেরেছে। দুই. এই হত্যাকান্ডে তারা জাতীয় ও আমত্মর্জাতিক ÿÿত্রে সহানুভূতি পাচ্ছে। যায়নবাদীরা নিজেদের লোক হত্যা করে প্রতিপÿ ঘায়েল করার কৌশল দীর্ঘদিন ধরেই অবলম্বন করে আসছে। ভারতের মুম্বাইয়ে সবরমতি ট্রেনে হিন্দু উগ্রবাদীরা অগ্নিসংযোগ ঘটিয়ে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের হত্যা করে তার দায় মুসলিমদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এরই পটভূমিতে গুজরাটের কসাই নরেন্দ্রমোদীর নেতৃত্বে সেখানে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। সম্প্রতি মুম্বাই ম্যাসাকারের আগে মুম্বাইয়ের মালেগাঁওয়ে মুসলিম জনপদে হিন্দু জঙ্গিবাদীরা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একাংশের সমর্থন ও সংঘ পরিবারের উগ্র ধর্মীয় নেতা নেত্রীদের মদদে বোমা সন্ত্রাস চালিয়ে ধরা পড়েছে। ভারতের নিরপেÿ গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, এর আগে ভারত থেকে পাকিসত্মানগামী যাত্রীবাহী ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণও ঘটিয়েছে হিন্দু জঙ্গিরা। যায়নবাদী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এর সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের অভিজ্ঞতা বিক্রয় ও সহযোগিতা চুক্তির পর ভারতে যায়নবাদীদের কায়দায় নকল ইসলামী জঙ্গি তৈরী করে ভয়ংকর সন্ত্রাসের নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে একের পর এক। এই ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন লেঃ কর্ণেল পুরোহিত এবং হিন্দুজঙ্গিবাদী সন্নাসিনী সাধবী প্রজ্ঞা গ্রেফতার হন। আরও গভীরে গিয়ে তদমত্ম করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মুম্বাইয়ের এন্টি টেরোরিষ্ট স্কোয়াডের প্রধান হেমমত্ম কারেকার ও তার সহযোগীকে মুম্বাই ম্যাসাকারের দিনই অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা হত্যা করেছে। যদিও ভারতীয় কর্তৃপÿ দাবী করছে যে, মুসলিম বন্দুকধারীরাই কারেকারকে হত্যা করেছে। তবে ঘটনার প্রত্যÿদর্শীরা এ ঘটনাকে মূল ঘটনা চাপা দেবার কৌশল বলে মনে করেন। হেমমত্ম কারেকারের স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুকে রহস্যজনক বলে মনে করেন। এমনকি তিনি নরেন্দ্রমোদীদের থেকে সরকারী ÿতিপূরণের অর্থ নিতে অস্বীকার করেছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়া তার আর কোন সন্ধান পাচ্ছে না। ভারতীয় কর্তৃপÿ মিসেস হেমমত্ম কারেকারের কোন বক্তব্যই যাতে মিডিয়ায় না আসে সে ব্যাপারে কঠোর ভূমিকায়।
অমরেশ মিশ্র লিখেছেনঃ ‘হলসবার্গ’ গত কয়েক মাস ধরে হামলা পরিকল্পনাকারীদের ঘরভাড়া দিয়েছিল এবং তারা এই অপারেশনকে অধিকতর কার্যকর করতে সাহায্য করেছিল। হলসবার্গকে জেরা করার সুযোগ পাওয়া গেলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। তবে এটা ভারত সরকারই চাইবে না। অমরেশ মিশ্র উলেস্নখ করেছেন, হামলাকারীরা ইসরাইলের মোসাদ কমান্ডো এবং মুম্বাইয়ের ইহুদী কেন্দ্র নরিমন হাউসকে তারা সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। নৌ পথে পাকিসত্মান থেকে কমান্ডো হামলার বিষয় প্রমাণ করতে তারা বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। একজন ইহুদী লেখক যায়নবাদ ও হিন্দুত্বের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি উলেস্নখ করেছেন। তবে ভারতীয় পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, মিডিয়া ইহুদীদের কেন্দ্র নরিমন হাউসকে নিয়ে কোন সন্দেহের আলো ফেলতে চায় নি। মুম্বাইয়ের উত্তেজিত জনতা নরিমন হাউসের ওপর সন্দেহ করে হামলার প্রস্ত্ততি নিতেই সেখানে পুলিশী নিরাপত্তা দেওয়া হয়। নরিমন হাউসে বিলম্বে পুলিশী অভিযান চালানো হয়। এ নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মুম্বাইয়ের চামা হাসপাতালে হামলাকারী বন্দুকধারীরা অনর্গল মারাঠী ভাষায় কথা বলেছে। ‘মহারাষ্ট্র টাইমস’ এ খবর দিয়েছে। অমরেশ মিশ্র লিখেছেনঃ মুম্বাই থেকে যে সব ইহুদী ইসরাইলে হিজরত করেছিল, তারা অনর্গল মারাঠী বলতে পারে এবং মোসাদ তাদের রিক্রুট করে।’’
অমরেশ মিশ্রের বিশেস্নষণঃ
১. কতিপয় সস্ত্রাসী সম্ভবতঃ শ্বেতাঙ্গ ছিল।
২. তারা হয়তো ভাড়াটে সৈন্য ছিল।
তাহলে তারা কোন দেশের? মোসাদ ও সিআইএ-র তথাকথিত জিহাদী গ্রম্নপ সহ বেশ কয়েকটি ভাড়াটে সেনা গ্রম্নপ রয়েছে।
৩. কারেকারের হত্যকারী মারাঠী ভাষীদের পরিচয় কি? তাহলে মোসাদ কী কারেকারকে হত্যায় মারাঠী ভাষী সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছে? উলেস্নখ্য কারেকার বিরোধী হিন্দুত্ববাদী পুলিশ অফিসার এবং ছোট রাজনের [হিন্দুবাদী জঙ্গিনেতা] লোকদের একটি যৌথ টিম কারেকারকে নিয়ে যায়। ছোট রাজন হত্যার অভিযোগে মুম্বাই পুলিশের একজন অফিসারকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
৪. মহারাষ্ট্রের পদত্যাগী মুখ্যমন্ত্রী বিলাস রাও দেশমুখ ঘটনার সময় মুম্বাই ছিলেন না। তবে রাত ৯টায় খবর পেয়েও তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী শিবরাজ পাতিলকে বিষয়টি জানান রাত ১১টায়। রাতে কারেকার যখন ঘটনাস্থলে আসেন, তখন সেখানে কোন পুলিশ ছিল না। এ সময় মুম্বাইয়ের ৪০ হাজার পুলিশের কোনই তৎপরতা দেখা যায়নি।
অমরেশ মিশ্র লিখেছেনঃ রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যমত্ম যে সময় সন্ত্রাসীরা নিরূপদ্রবে লোকদের হত্যা করছিল, সে সময় মুম্বাই পুলিশকে ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে রাখা হয়।
এদিকে অরম্নন্ধতি রায় লিখেছেনঃ ‘৯ মানে ১১ নয়, ভারতও নয় আমেরিকাঃ ১৫.১২.০৮ প্রথম আলো [ভারতের আডটলুক’] মিস রায় লিখেছেনঃ ‘সন্ত্রাসবাদ মুকাবিলা করার একমাত্র পথ হলো, আয়নায় দানবের প্রতিবিম্ব দেখা। ওটা আমাদেরই প্রতিবিম্ব। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক সড়ক সঙ্গমে। একদিকের পথে লেখা রয়েছে, ‘ন্যায়বিচার’, অন্যপথটি ‘গৃহযুদ্ধের’ দিকে গেছে। তৃতীয় কোন পথ আর নেই, নেই ফিরে যাওয়ারও কোন উপায়। অরম্নন্ধতী লিখেছেনঃ ‘মুম্বাই হামলার জন্য ভারত সরকার জোরের সঙ্গে দায়ী করেছে পাকিসত্মানের আইএসআইয়ের মদদপুষ্ট লস্কর-ই-তাইয়েবাকে। এর মধ্যে পুলিশ জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ পুলিশবাহিনীর কর্মকর্তা শেখ মুখতার ও কলকাতা নিবাসী তাউসিফ রহমানকে আটক করেছে। সুতরাং কেবল পাকিসত্মানী নাগরিকদের দোষারোপ করাটা কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সবসময়ই দেখা যায়, সন্ত্রাসবাদের গোপন কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে এক বৈশ্বিক নেটওয়ার্কও উন্মোচিত হয়। তারা কেবল দুটি দেশের মধ্যেই কাজ করে না। তাদের কাজকর্ম আমত্মর্জাতিক। আজকের দুনিয়ায় কোন সন্ত্রাসী হামলার জন্য একক কোনো দেশকে দায়ী করা অবাসত্মব, যেমন অবাসত্মব আমত্মর্জাতিক পুঁজিকে কোন একক দেশের বলে চি‎‎হ্নত করা।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় পাকিসত্মানে আক্রমণ করলে সন্ত্রাসীদের শিবির হয়তো ধ্বংস হবে, কিন্তু সন্ত্রাসীরা রয়ে যাবে। মনে রাখা দরকার, পরাশক্তির বন্ধু হয় না, হয় এজেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি মাখামাখির পরিণতি সর্বনাশা। ইরাক আফগানিসত্মানের উদাহরণ সামনেই আছে। অন্যদিকে যুদ্ধে জড়িত হলে ভারতের লাভ একটাই- আভ্যমত্মরীণ সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়া। আর একটি লেখায় অরম্নন্ধতি রায় লিখেছেনঃ ‘আমরা জানি ইসরাইল হলো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার খুঁটি এবং সব দিক থেকে মার্কিন সাহায্যপুষ্ট রাষ্ট্র। সুতরাং আমেরিকা ও ইসরাইল ধারণাগতভাবে আলাদা দুটি দেশ নয়। এবং খেয়াল করলে দেখবেন, ইসরাইল ও আমেরিকার মুসলিম বিদ্বেষের সাথে ভারতের শাসক মহলের মুসলিম বিদ্বেষ কীভাবে একাকার হয়ে যাচ্ছে।’ [প্রথম আলোঃ জেড নেট : ১৪ অক্টোবর-২০০৮]
উপমহাদেশীয় মুসলিমদের স্বার্থের বিপরীত মেরম্নতে অবস্থানকারী এবং ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রবাসী প্রবীণ বাংলাদেশী সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাম্প্রতিক এক লেখায় ‘‘ভারত-ইসরাইল অাঁতাত : উপমহাদেশে মোসাদের কালো ছায়া’’-য় আরও কিছু তথ্য বিশেস্নষণ বিধৃত হয়েছে। দৈনিক ডেসটিনি : ২৫.০৯.০৮ তিনি লিখেছেন : ইসরাইলের সাথে ভারতের সম্পর্ক কূটনৈতিক অর্থনৈতিক পর্যায় অতিক্রম করে সামরিক সহযোগিতায় রূপামত্মরিত হয়েছে। মোসাদের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে তিনি প্রতিবেশীদের জন্য বিপজ্জনক হুমকি বলে উলেস্নখ করেছেন। গাফফার চৌধুরী লিখেছেন : উপমহাদেশের আকাশে মোসাদের কালো থাবার ছায়া গোটা দÿÿণ এশিয়ার জন্যই এক ভয়াবহ বিপদ সংকেত। উলেস্নখ্য, ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতের অন্ধ পাকিসত্মান বৈরিতার ফলে ভীতিগ্রসত্ম পাকিসত্মান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মার্কিন মৈত্রীর খেসারত দিতে গিয়ে পাকিসত্মান এখন তার সার্বভৌমত্ব ও ভূ-খন্ডগত নিরাপত্তা হারানোর পথে। ভারতকে গণচীন ও ইসলামী জঙ্গিবাদে ভীতির মুখে ইঙ্গ-মার্কিন-যায়নবাদী চক্র আর একটি সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ঝুঁকিতে নামিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের শূণ্য ফলাফল নিয়ে বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ তারপরও বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী এ যুদ্ধ যুগ যুগ ধরে চলবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে দÿÿণ এশিয়ায় ভারতের ঘাড়ে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নয়া দায় চাপিয়ে অমেরিকা স্বসিত্ম পেতে চাইছে। সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ফলে ভারতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে, সেই সূত্রে ভারতের বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি সুবিধাবঞ্চিত জনগণ এবং জাতিসত্তার স্বীকৃতির জন্য লড়াইরত জনগোষ্ঠী এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে কিনা, সে প্রশ্ন যৌক্তিকভাবেই উঠেছে। ভারতীয় শাসকরা ইসলামী জঙ্গিবাদ দমনের নামে এ অঞ্চলে যে যুদ্ধের দাবানল জ্বালাতে শুরম্ন করেছেন, তা থেকে তাদের সরানো কঠিন হবে। হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক ফ্রন্ট-বিজেপির সাথে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় জঙ্গিপনায় প্রতিযোগিতা করছে। প্রথমত: তাদের সামনে রয়েছে একটা জাতীয় নির্বাচন এবং দ্বিতীয়ত: গান্ধী পরিবারের উত্তর সূরী রাহুল গান্ধীর ÿমতার পথ মসৃন করার দায়ও কংগ্রেস নেতৃত্বের ঘাড়ে চেপেছে। মার্কিন আশীর্বাদ পুরোপুরি ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ায় আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার ভারতের দÿÿণ এশিয়ায় উগ্রতা ও খবরদারি আরও বাড়বে। একক বিশ্বব্যবস্থার মেরম্নকরণের পুরো সুবিধা ভারত ভোগ করছে।
এই পটভূমিতে ইন্ডিয়ান-পলিটিকো-কালচারাল-মিলিট্যান্ট-ষ্ট্রাটেজিস্টদের মিলিত কলম সন্ত্রাস বাংলাদেশকে ঘিরে আরও বেগবান হবে। বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ-দুর্নীতি অপশাসনের অপবাদে মিডিয়া-সন্ত্রাসের মাধ্যমে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর লÿ্য বাসত্মবায়ন অনেকদূর এগিয়েছে। বিগত ১/১১-এর পটভূমি তৈরিতে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আমত্মর্জাতিক মিডিয়ার কার্যকর ভূমিকা কারও দৃষ্টি এড়ায়নি।
একক বিশ্বব্যবস্থায় সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কার্যকারণে ‘এমবেডেড জার্নালিজম’ তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকতা, বিশেষ করে বড়ো বড়ো প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিকানায় করপোরেট পুঁজির আবির্ভাব তথ্য ও মতের সাম্রাজ্যিকীকরণ করেছে। ৯/১১-এর পর এর দায় আল-কায়েদা-বিন লাদেন ও সাদ্দাম হোসেনের ওপর চাপানোর ÿÿত্রে সাংবাদিকতার নামে গল্প-কাহিনী প্রচার ও তাতে বিশ্বাসযোগ্যতার অনুপান আনয়নে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কার্যকর ও আগ্রাসী। টুইন টাওয়ার হামলার পর যে যুদ্ধটা হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছে মিডিয়া। ভারতের রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদ এবং হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক-সামাজিক সংগ্রামের সাথে সেখানকার সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী-থিংকট্যাংকের অধিকাংশই একাত্ম।
সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের জুজু মূলত: সাম্রাজ্যবাদের এক মারণাস্ত্র। এই সাথে তারা দুর্বল গণতন্ত্র, সংখ্যালঘু-উপজাতীয়দের নিরাপত্তা, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ দমনে অÿমতা ইত্যাদির মানদন্ডে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে ‘ব্যর্থ’ বা প্রায় অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর কৌশল সাম্রাজ্যবাদীদের আর একটি মারণাস্ত্র। এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করে অন্য রাষ্ট্রের ওপর সরাসরি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা অথবা তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার পথ তৈরী করা হয়েছে। ইসলামী জিহাদীদের সশস্ত্র তৎপরতা প্রমাণের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ তাদের লালিত নকল জিহাদী ও জঙ্গিদের পর্যমত্ম ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাধিক্য এবং জনগণের ইসলামী চেতনা-মসজিদ-মাদ্রাসা-খানকাহ্ ইত্যাদির অসিত্মত্বের কারণে ভারতের পÿÿ বাংলাদেশকে টার্গেট করা সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ভারতীয়করণ করার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্র রÿার সংগ্রামকে দুর্বল করা হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌম উত্থান ও পরিচিতিকে ভারত উদ্ধত্য হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশের ইসলামী আইডেন্টিটির সাথে তার অসিত্মত্ব জড়িত। এই পরিচিতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেুক্যুলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অমত্মর্ঘাত চলছে।
১৯৪৭ পূর্ব সংখ্যাতাত্ত্বিক ভীতি
১৯৪৭ সালে ভারত ভেংগে মুসলিমদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র-পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে। যদিও হিন্দু-বৃটিশ চক্রামেত্ম ভারতের সবগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা পাকিসত্মানের অমত্মর্ভুক্ত হয়নি। ভারত বিভক্তির পূর্বে অখন্ড ভারতে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের নীতিতে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো সমন্বিত ক্যাবিনেট মিশন পস্নানকে কংগ্রেসী নেতা গান্ধী নেহরম্ন নাকচ করেছিলেন মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভীতিকে সামনে রেখে। একইভাবে সর্বশেষ স্বাধীন সার্বভৌম যুক্তবাংলার প্রসত্মাবটিও কংগ্রেস নেতৃত্ব বাংগালী মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রভাবের ভয়ে বাতিল করে দেয়। ভারতের আসাম রাজ্যে বর্তমানে বাঙ্গালী মুসলিমদের বিতাড়ন অভিযান চালানো হচ্ছে। সেখানকার মুসলিমদের একদিকে যেমন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তেমনি তাদের ওপরও ইসলামী জঙ্গিবাদের অপবাদ চাপানো হচ্ছে। ভারতের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশেস্নষকরা আসামে মুসলিম জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান হারকে সেখানে মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিম বাংলা, বিহারসহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের স্থানীয় বা প্রাদেশিক রাজনীতিতে মুসলিমদের প্রভাব সীমিত রাখার বিষয়ে তারা খুবই সচেতন। ভারতের মুসলিমরা কখনও যাতে শাসকের ভূমিকায় উন্নীত হতে না পারে, ভারত সে ব্যাপারে অতি সতর্ক। কেননা, মুসলিমদেরকে রাজনীতি-অর্থনীতির সমপর্যায়ে টেনে নেবার মতো উদারতা ভারত আজও অর্জন করতে পারেনি। মুসলিমদের অবদমিত রাখতে ভারত সবকিছু করছে। ভারতের দুদিকে দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। ভারতে রয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি মুসলিম। ভারতের হরিজন-দলিত ও নিম্নবর্ণের বঞ্চিত হিন্দুদের সংখ্যা বর্ণ হিন্দুদের থেকে আলাদা করলে তাদের সংখ্যাও ৫০ কোটির ওপরে হবে। এই বিপুল জনসংখ্যার মনসত্মাত্ত্বিক ÿÿাভ কিন্তু ব্রা‏‏হ্মণ্যবাদী-উচ্চ বর্ণের ভারতীয় হিন্দুদের বিরম্নদ্ধে ফুঁসছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যেমন ভারতের ভেতরের দলিত ও নিম্নবর্ণের মানুষকে অবদমিত করে রেখেছে, তেমনি সামরিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ভারত প্রতিবেশী দুটি মুসলিম রাষ্ট্রকে শৃংখলিত ও নতজানু করে রাখতে চাইছে।
অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে অপপ্রচারের প্রধানকেন্দ্র ভারতের পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা। কলকাতা তথা পশ্চিম বাংলার রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশেরই পূর্ব পুরম্নষ পূর্ববাংলা থেকে ৪৭ এর দেশবিভক্তির ÿত চি‎হ্ন নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। পূর্বপুরম্নষের ভিটেমাটি ছেড়ে যাবার বেদনামিশ্রিত ÿÿাভ তাই পশ্চিম বাংলার বাংগালী হিন্দুদের মধ্যে প্রবল। যদিও এদের অনেকেই স্বাধীন পাকিসত্মানের রাষ্ট্রকাঠামোতে পূর্ববাংলার বাংগালী মুসলিমদের রাষ্ট্রনৈতিক উত্থানকে সহ্য করতে না পারার আক্রোশবশে ভারত চলে গেছেন। পূর্ব বাংলার চাষা-ভূষা-রায়ত-প্রজার সাথে সমামত্মরালে বসতে-চলতে বা তাদের নেতৃত্বে বসবাস করার গস্নানি বহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘পূর্ববাংলার’ অগ্রসর হিন্দুরা দলে দলে ভারতে চলে যান। এরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ভারতভুক্তি কামনা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। অথবা তারাও ‘এপার বাংলার’ সাথে মিলন তৃষ্ণায় ভারত ত্যাগ করে আসতে চান নি। পাকিসত্মান বিভক্তির পর কলকাতার বাংগালী হিন্দুদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকবে না। তাও যখন ব্যর্থ হলো তখন তারা দিলস্নীকে আর একবার বাংলাদেশে সামরিক হামলা চালানোর উস্কানীও দিচ্ছে। কলকাতার বাবু কালচারের পুরোধাদের আশীর্বাদে সেখানে বাংলাদেশ ভেংগে স্বাধীন বঙ্গভূমির দাবীদারদের বাড়বাড়মত্ম। কলকাতা থেকেই আওয়াজ তোলা হচ্ছে- বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের। বলা হচ্ছে, তাদের ঘর বাড়ি দখল করে নেয়া হচ্ছে। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করে ভারতীয় বাংগালী হিন্দুদেরকে তা ফেরত দিতে বলা হচ্ছে। বাংলাদেশে ও কলকাতায় হিন্দুদের সভা-সম্মেলন থেকে দুই-আড়াই কোটি হিন্দুদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরকে নাগরিকত্ব সহ সহায় সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে বলা হচ্ছে। নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘ, CAAMB (Campaign Against Atrocities on Minorities in Bangladesh) ধরনের বহু সংগঠন গড়ে উঠেছে। একাধিক বাংলাদেশ বিরোধী ওয়েবসাইট রয়েছে কলকাতায়। যারা অবিরত বাংলাদেশকে ঘিরে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার চালায়। নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘের কর্তাব্যক্তি ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার প্রতিপাদ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো। ভারতের বামফ্রন্ট সরকার বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়াকে তাদের জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আনুষ্ঠানিকভাবে দিলস্নী সরকারের কাছে নালিশ জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ ইসলামী জঙ্গিবাদের ‘অভয়ারণ্য’ এবং উলফা সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গীদের ঘাঁটি থাকার কারণে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ হুমকি হয়ে উঠেছে। সুতরাং বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে সামরিক হসত্মÿÿপই হতে পারে এর প্রতিকার। কৌশলগত কারণেই পশ্চিম বাংলা সরকার কলকাতায় বাংলাদেশ বিরোধীদের মদদ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ বা বাংগালী মুসলিম ইস্যুতে পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্ট এবং সংঘ পরিবারের উগ্র হিন্দুদের আচরণ ও দৃষ্টিভংগিতে কোন পার্থক্য নেই। উগ্র হিন্দুবাদী নেতা প্রবীণ তেগাড়িয়া আসামের গৌহাটিতে এসে বলেছিলেন, আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের বাংলাদেশের সীমামত্ম এলাকার ভূ-খন্ড দখল করে সেখানে পুনর্বাসন করা হবে। বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় মিডিয়া সন্ত্রাসীরা অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন হিরন্ময় কারলেকার। এই ভদ্রলোক বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদকে ভয়ংকর বিপজ্জনক হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে Bangladesh : Next Afghanistan' নামে একখানা বই লিখে ফেলেছেন। এ বইয়ের অধিকাংশ তথ্য উপাত্ত স্থানীয় প্রথম আলো, ডেইলী স্টার, জনকণ্ঠ, যুগামত্মর, ভোরের কাগজ, সংবাদ প্রভৃতি পত্রিকা থেকে নেয়া। পশ্চিম বাংলার আর একজন থিংকট্যাংক সদস্য হচ্ছেন সুমিত গাঙ্গুলী। তিনিও যায়নবাদী থিংকট্যাংকের কলাবরেশনে বাংলাদেশ বিরোধী গবেষণা কর্মে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদের বিপদ সম্পর্কে নানা বানোয়াট কথা লিখেছেন। অরবিন্দ আদিগাও প্রায়শই বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় সক্রিয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে এরা বাংলাদেশ বিরোধিতায় অবতীর্ণ হননি। এদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিপুল অর্থের বিনিময়ে। বাংলাদেশে এদের বেশ কিছু সহযোগী ও রিসোর্স পারসন রয়েছেন।
বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে বিদেশী সাংবাদিক Bestil Lintner প্রথমে লিখেন, ‘A Cocoon of Terror। এতে বাংলাদেশের বিরম্নদ্ধে ইসলামী জঙ্গিবাদের অপবাদ চাপানো হয়। ভারতীয় লেখক অরবিন্দ আদিগা লিখেন- State of Disgrace, নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক নিবন্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এতে লিখা হয় : বাংলাদেশ : পরবর্তী ইসলামী বিপস্নবের ÿÿত্র! টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন : আল কায়েদার নিরাপদ আশ্রয় বাংলাদেশ। এছাড়া লস এঞ্জেলস টাইমস, নিউজউইক, নিউইয়র্ক টাইমস সহ বেশ কিছু পশ্চিমা প্রিন্ট মিডিয়া বাংলাদেশ বিরোধী পরিকল্পিত মিডিয়া ক্যাম্পেইনে যুক্ত ছিল এবং এখনও আছে।
একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রধানত ভারতের উৎসাহে যায়নবাদীদের মদদে বাংলাদেশ বিরোধী সার্বিক প্রচারণা চলে আসছে। বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় ইন্দো-যায়নবাদী লবীই মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। এই মহলের স্পন্সরশিপে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বর্ণাঢ্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে। এসব মিডিয়ার সীমামত্মবহির্ভূত আনুগত্য, জাতীয় এজেন্ডার চেয়ে গেস্নাবাল এজেন্ডার প্রতি দায়বদ্ধতা, বাংলাদেশকে ইসলামী জঙ্গিবাদের আখড়া প্রমাণের নিরলস সাধনা ভারতীয় বা যায়নবাদী প্রোপাগান্ডার চেয়েও দেশের বেশি ÿতি করছে।
বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণার কিছু ধরণ
সাম্প্রতিতম ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। ঢাকার ‘দৈনিক সংবাদ’ গত ১৭.১২.০৮ তারিখ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ‘জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে ঢাকার ওপর দিল¬ীর চাপ’। অপর রিপোর্ট ‘ ভারতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ । অভিযোগটা অতি পুরনো। তবে তার উপস্থাপনা নতুন। মুম্বাই ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী শিবরাজ পাতিলের পদত্যাগের পর নয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই লোক সভায় চিদাম্বরম জঙ্গিবাদে মদদদানের জন্য বাংলাদেশকে অভিযুক্ত করেন। বাংলাদেশ ভারতের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. ইফতেখার চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ যে কোন দেশের সঙ্গে সন্ত্রাস বিরোধী কাজে সহায়তা করবে। বাংলাদেশে কোন সন্ত্রাসবাদীর কর্মকান্ড চালানোর সুযোগ নেই। বাংলাদেশে কোন সস্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী নেই। এখানে সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। ভারতের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ১৬-১২.২০০৮ জানায়, ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরাম লোকসভায় ‘বাংলাদেশ তাদের মাটিতে ভারত বিরোধী জঙ্গিদের অবাধে কার্যকলাপ চালাতে দিতে পারে না’ মর্মে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ধরন বিশেস্ন¬ষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের ব্যাপারে বাংলাদেশকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন, তাতে তার বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে তিনি যেন নিশ্চিত হয়েই এসব কথা বলছেন। অর্থাৎ বাস্তবতা যাই থাক, বাংলাদেশকে চাপে রাখার জন্য নয়াদিল¬ী জঙ্গিবাদের অস্ত্র ব্যবহার করেই যাবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, ভারত বিরোধী কোন জঙ্গির এদেশে অবস্থানের কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ তার নিজের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, পাশাপাশি অন্য রাষ্ট্রের অখন্ডতার প্রতি সম্মান জানিয়ে আসছে। তিনি উভয় দেশের মঙ্গলের জন্য এরকম অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য পরিহার করা উত্তম বলে মনে করেন।
এদিকে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় অগ্রগামী ভারতের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের একই তারিখের সংখ্যায় লিখেছে : ‘ মুম্বাই সন্ত্রাসে পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে যারা জঙ্গিদের যোগাযোগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলার পরও সে দেশে সামরিক অভিযানের পথে যেতে ভারত রাজী নয়। ঠিক তেমনই উত্তর পূর্বের জঙ্গি সংগঠনগুলোর শিবির গুঁড়িয়ে দিতে বাংলাদেশে এখনই যৌথ সেনা অভিযানের পক্ষপাতি নয় ভারত। কারণ পশ্চিম ও পূর্বের দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে একসঙ্গে বিবাদে যেতে চাইছে না ভারত। আপাতত: তাই ঢাকার ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েই সরকার বাংলাদেশে কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার পথ নিচ্ছে। বাংলাদেশের মাটিতে উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গিদের শিবিরগুলো যে পাক গুপ্তচর সংস্থা- আইএসআই-এর পৃষ্ঠপোষকতাতেই চলে সে বিষয়ে ভারতের হাতে প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশে পাক মদদপুষ্ট ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গেও উলফা ও উত্তর-পূর্বের অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পি চিদাম্বররম বাংলাদেশকে ভারতের প্রত্যাশা অনুধাবনের আহবান জানিয়ে বলেছেনঃ ‘‘বাংলাদেশও বোঝা উচিৎ তাদের কি কর্তব্য। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হলে আখেরে বাংলাদেশেরই ক্ষতি।’’
ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি চোখ রাঙ্গানীর আভাষ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে জঙ্গিবাদ, ভারতীয় গেরিলাদের মদদদান বা আইএসআইয়ের সাথে যোগসাজসে বাংলাদেশের ভূ-খন্ডকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের দায় স্বীকার করে নিলেই ভারতের দৃষ্টিতে ‘কর্তব্য’ পালন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি ও ভারতীয় বিদ্রোহীদের খাঁটি ধ্বংসে যৌথ সামরিক অভিযান চালানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে, ভারতে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার বা মিডিয়া সন্ত্রাসের উৎস ও মদদদাতা হচ্ছে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সরকারগুলো এবং দিল¬ীর কেন্দ্রীয় সরকার। এই একই ধারা অনুসরণ করছেন ভারতীয় বুদ্ধিজীবি ও নিরাপত্তা বিশেস্নষকরা। তারা বাংলাদেশকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে বিকৃতভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করে থাকেন। ভারতের বাংলাদেশ বিরোধী সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী কুল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং নিরাপত্তা বিশেস্নষকদের অন্ধ অনুগামী হিসেবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচারণা চালায়। এটাকে বাংলাদেশ বিরোধী মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বেশ কিছু ভারতীয় পন্ডিত যায়নবাদীদের নিবিড় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশীয় নিরাপত্তা ইস্যু এবং জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা কর্মের নামে সুসংগঠিতভাবে উচ্চ মাত্রার তথ্য সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা-ই শীর্ষে। সুমিত গাঙ্গুলি, হিরন্ময় কারলেকার, অরবিন্দ আদিগা, সি, রাজামোহন প্রমুখ ভারতীয় বুদ্ধিজীবী কোন না কোনভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গে¬াব্যাল মিডিয়া যুদ্ধের অংশীদার। বাংলাদেশের জন্য এখানেই রয়েছে বড়ো সমস্যা।
বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র প্রমাণ করতে দেশের ভেতরে যেমন রাজনৈতিক, সামাজিক সুশীল এবং তাদের কতিপয় মিডিয়া তৎপর, তেমনি দেশের বাইরে ভারতীয় থিংকট্যাংকের প্ররোচনা এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে মিডিয়া সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক সামাজিক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দেশের ভেতরে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ সাম্প্রাদায়িক জুজুর অজুহাত তুলে যেমন সাম্প্রাদায়িক অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা নেতিবাচক কর্মকান্ড চালাচ্ছে, তেমনি তাদের সংগঠনের প্রবাসী শাখাগুলোও ইউরোপ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী ক্রুসেড চালিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এ প্রক্রিয়া চালিয়ে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যবহিত পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতন অভিযোগ উত্থাপনের পর হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা আরও আগ্রাসী ও অন্তর্ঘাতী হয়ে উঠে। ২০০৪ সালের এপ্রিল ও মে মাসে সংগঠনটি নিউইয়র্কে ইএন পস্নাজা হোটেলে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের দাবী জানায়। সেমিনারের অন্যতম বক্তা ছিলেন ভারতীয় নাগরিক অধ্যাপক বেদপ্রকাশ নন্দা। যুক্তরাষ্ট্রের কলারোস বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিঃ নন্দা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনে মিঃ নন্দা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নিরাপত্তা পরিষদকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ করতে হবে। এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ‘ঐক্য পরিষদ’ নেতা দ্বিজেন ভট্টাচার্য। এ সেমিনারে প্রধান বক্তা ছিলেন মিডল ইস্ট ফোরাম ইউএস পিস ইনস্টিটিউট-এর পরিচালক ড্যানিয়েল পাইপস, ভারতীয় নিউজার্সি রাজ্য এসেম্বলীম্যান উপেন্দ্র শিভুকালা, ভারতীয় নাগরিক জিতেন্দ্রকুমার, পাদ্রী লুইস ব্র্যাকসটন ও আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি খালিদ হাসান, রূপা বর্ণিক, কানাডা ঐক্য পরিষদ নেতা কিরিট বিক্রম সিনহা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী সম্প্রদায় এবং সন্তু লারমার প্রতিনিধি আইনজীবী লা লাম লাই এবং খাসিয়া সম্প্রদায় প্রতিনিধি সজীব দ্রং। নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত এ খবরটি ১৮মে, ২০০৩ তারিখে ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রকাশ করে।
এ সেমিনারের মূল থিম ছিলঃ ‘রাইজ অব মিলিট্যান্ট ইসলাম ইন বাংলাদেশ: হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন ইন বাংলাদেশ: হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন এন্ড দ্য ক্যাম্পেইন অব রিলিজিয়াস এন্ড এথনিক ক্লিনসিং। প্রধান বক্তা ড্যানিয়েল পাইপস কট্টর ইসলাম বিরোধী হিসেবে সুপরিচিত। যদিও তিনি কখনও বাংলাদেশ সফর করেননি। তারপরও বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উলেস্ন¬খ করেনঃ ‘‘১৯২০ সাল থেকে চরমপন্থী ইসলামের প্রসার ঘটেছে। পাকিস্তানের মাওলানা মওদুদী এবং মিসরের হাসান আল বান্না নিজেদের মতবাদকে ইসলামী পন্থা হিসেবে চালু করে দিয়েছেন। সে থেকে চরমপন্থী ইসলামের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। টাইম ‘ম্যাগাজিন’ ১৪ অক্টোবর, ২০০২-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, টাইমস এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল কান্দাহার থেকে জাহাজে করে তালেবানরা বাংলাদেশে অস্ত্র শিপমেন্ট করেছে। সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তদন্ত করা উচিৎ।
২০০৪ সালের ২৫ এপ্রিল ইনকিলাব এ প্রকাশিত আর একটি খবর ‘‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিরূপ প্রচারণাঃ ৩০ এপ্রিল নিউইয়র্কে শুনানী : হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা।’’ নিউইয়র্ক থেকে বার্তা সংস্থা ‘এনা’ পরিবেশিত খবরে বলা হয়, কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড পীস পার্ক’ বাংলাদেশ বিরোধী দলীয় রাজনীতিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত দমন পীড়নে গভীর উদ্বেগ এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যাঘুদের মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের ওপর বুশ প্রশাসনের ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রীডমের উদ্যোগে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি শুনানী অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রীডমের শুনানীতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের (চারদলীয় জোট) বিভিন্ন পদক্ষেপের বৈরী ও বিকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ক শীতাংশু গুহ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।’
সীতাংশু গুহ এক সময় দৈনিক সংবাদ-এ সাংবাদিকতা করেছেন এবং সিপিবি-র রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। বামপন্থী প্রগতিবাদী হলেও তিনি বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী কট্টর সাম্প্রদায়িক অবস্থান নিয়েছেন। এই সীতাংশু গুহই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের সময় তাঁর বিরুদ্ধে একটি উকিল নোটিশ করিয়েছিলেন। এই সীতাংশু গুহ রাই জোট সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু দলনের ইস্যুতে ভারতের কলকাতায় আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন।
বাংলাদেশকে ঘিরে মোসাদ-‘র’-এর ষড়যন্ত্র
আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা তাদের ২০০৮ সালের বার্ষিক রাজনৈতিক সমীক্ষায় ভবিষ্যদ্বাণী করে লিখেছে যে, বাংলাদেশে ২০০৮ সাল ঘোষিত নির্বাচনের বছর হলেও ‘‘ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতময়’’ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। James Astill নয়াদিল¬ীর ডেটলাইনে “There will be no election in Bangladesh in 2008”-২০০৮ সালে বাংলাদেশ কোন নির্বাচন হচ্ছে না- শীর্ষক এক রিপোর্টে এ কথা উলে¬খ করেছেন। James Astill কিসের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন নিয়ে এমন নিশ্চিত নেতিবাচক রিপোর্ট করেছেন, তা উলেস্ন¬খ করেননি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বিস্মিতভাবে প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশে যেখানে নির্বাচনমুখী একটা প্রবাহ শুরু হয়েছে, সেখানে ‘ইকোনমিস্ট’-এর দিল¬ী প্রতিনিধির এই আশংকার ভিত্তি কি? পর্যবেক্ষক মহল আরও প্রশ্ন তুলেছেন, James Astill কী তাহলে যায়নবাদী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী ‘র’-এর নীল নকশা জেনে নিয়েই আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে চূড়ান্ত নেতিবাচক কথা লিখেছেন। বাংলাদেশ ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির সংবিধান নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি। ঐ সময়ও আন্তর্জাতিক আঞ্চলিক চক্র আভ্যন্তরীণ সংঘাত ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচাল করেছে। অতীতের সংঘাত, রক্তপাত, নৈরাজ্য, ব্যর্থতা পেছনে ফেলে বাংলাদেশ যখন আর একটি নির্বাচনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতার ঘূর্ণিপাকে ফেলে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ তকমা এঁটে দেওয়ার জন্য চিহ্নিত আন্তর্জাতিক মহলটি বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০০৮ সালের ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীতে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন।
কয়েকদিন আগে ‘আমার দেশ’ (২৭.১১.০৭) এ ‘মোসাদ’ ও ‘র’ তৎপরঃ বড় ধরনের নাশকতার আশংকা’ শীর্ষক প্রকাশিত একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্টের কথা এ প্রসঙ্গে উলে¬খ করা যায়। এ রিপোর্টে উলে¬খ করা হয়েছিল যে, ‘‘বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ফিলিস্তিন বানানো ও চরম নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে ইসরাইলী গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এবং ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ উঠেপড়ে লেগেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ও নাশকতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে এই দুটি সংস্থা চাইছে, তাদের পছন্দনীয় পক্ষের অনুকূলে আবহ তৈরী করতে।’’ আসন্ন নির্বাচনকে ব্যাহত করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ইস্যু তুলে সরকারকে লক্ষ্যচ্যুত করার রাজনীতিও চলছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে যে বিদেশী চক্রটি সক্রিয়, তারাই জাতীয় বিভাজন ও সংঘাতের নয়া উপাদান হিসাবে নন ইস্যুকে উস্যু বানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নাক গলানো, অন্তর্ঘাত সৃষ্টি এবং প্রতিবেশী দেশটির পক্ষ থেকে বিভিন্নমুখী ইস্যুতে তাদের পালিত পকেট সংগঠনসমূহ ব্যবহার করে নতুন করে নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরী করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতীয় রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে ইকোনমিস্ট এর আগাম নেতিবাচক মন্তব্য বাংলাদেশের ভেতরে নির্বাচন বহির্ভুত নন ইস্যু নিয়ে রাজনীতি ঘোলাটে করার আন্তর্জাতিক প্যাকেজ কর্মসূচির অংশ বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
ভূ-মন্ডলীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা সমীকরণে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ-এর সাথে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বহুমাত্রিক নিবিড় সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিকতর ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের এগ্রিসিভ সীমান্ত নীতি এবং সীমান্তে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ মোসাদ-এর বিশেষজ্ঞদের অবদান বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় অস্থিতিশীলতা ও অশান্ত পরিবেশ তৈরীর ক্ষেত্রেও ‘র’-ও ‘মোসাদ’ একযোগে কাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশকে মুসলিম মেজরিটির একটি মডারেট গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অগ্রগতির ধারায় এগিয়ে যেতে না দেওয়ার ব্যাপারে ‘র’ও ‘মোসাদ’ যুথবদ্ধ কর্মসূচি নিয়েছে।
‘ইকোনমিস্ট-এর সমীক্ষক জেমস অস্টিল লিখেছেনঃ “Bangladesh will worsen in 2008. Its technocratic administration, installed by the army in January 2007, promises to hold elections in December 2008. It will break its promise. At the army’s behest, it has arrested the country’s main political leaders, Khaleda Zia and Sheikh Hasina Wazed. The charges against the two women of corruption and extortion, respectively may or may not be deserved. But, in the absenee of other leaders, their parties demand their release. This gives the army a choice : democracy and the two Begums (as The feuding Mrs. Zia and Sheikh Hasina are known) or no Begums and no democracy. It will choose the latter in 2008. Public dissatisfaction with the government will increase during the year. Violent protests are all but guaranteed.”
জেমস অস্টিল-এর এই সরাসরি মন্তব্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রকেই উন্মোচিত করেছে। তারা বাংলাদেশে যা চায়, অন্যের ঘাড়ে তা চাপিয়ে তা প্রকাশ করেছে মাত্র। বাংলাদেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেওয়াই তাদের নীল নকশার লক্ষ্য।
ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ
‘আনন্দবাজার পত্রিকার’ ২২ মার্চ-২০০৭-এর রিপোর্টঃ
‘অস্ত্র কিনতে দাউদের সঙ্গে ‘ডিল করেন খালেদা-পুত্র।’ জিয়া পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র বিএনপি-র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তাকের রহমানের গ্রেফতার সম্পর্কে পত্রিকাটি রিপোর্ট করতে গিয়ে নয়াদিল¬ীর কর্তৃপক্ষের মনোভাব সম্পর্কে রিপোর্টের শুরুতেই উলেস্ন¬খ করে যে, ‘‘যতই কান্নাকাটি করুন, তাঁর কারাবাসের ঘটনায় স্বস্তি সাউথ বস্ন-কে’। ভারতের মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীমের ছবির সাথে তারেক রহমানের ছবি প্রকাশ করে দাউদের সাথে তারেকের যোগসূত্র প্রমাণের প্রয়াস চালানো হয়। এ রিপোর্টে আরও উলে¬খ করা হয় ’’ .... ভারত যেটা চাইছিল প্রকারান্তরে সেটাই ঘটেছে বাংলাদেশে। ভারত বিরোধী জঙ্গিঘাঁটি প্রশ্রয় দেওয়া ও অনুপ্রবেশ নিয়ে বাংলাদেশ সবসময়েই দিল¬ীর রক্তচাপ বাড়িযে রেখেছে। ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তাই আপাতত:
স্বস্তিতে ভারত।’ তবে দু’বছরের মাথায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি-চিদাম্বরম আবারও ভারত বিরোধী জঙ্গীরা বাংলাদেশের ভূ-খন্ড তৎপর বলে অভিযোগ করে প্রমাণ করলেন যে, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারেনি।
‘আনন্দ বাজার পত্রিকা’ ২৫ মার্চ’০৭ একই বিষয়ে আরও একধাপ এগিয়ে আর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এর শিরোনামঃ ‘‘দাউদ যোগ, তল¬াসী খালেদার দফতরেও।’’ ঢাকা থেকে প্রেরিত পত্রিকার ‘নিজস্ব সংবাদদাতার’ পাঠানো এ রিপোর্টেও তারেক রহমানে ছবি রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়ঃ মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম এবং ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা গোষ্ঠীর সাথে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেধা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের যোগাযোগ খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা। ‘‘উলেস্নখ্য ‘যৌথ বাহিনীর’ ৮ ঘন্টাব্যাপী ‘হাওয়া ভবনে’ অভিযানের প্রসঙ্গ উলেস্ন¬খ করে রিপোর্টে বলা হয়ঃ অভিযানের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ভবনের কর্মচারীরা গোপন কাগজপত্র নিয়ে আগেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। ...... প্রয়োজনে তারেককে আবার হেফাজতে নিয়ে দুবাই ও দাউদ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে ঘনিষ্ঠসূত্রে জানা গিয়েছে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকার একই বিষয়ের ২৫ মার্চ’০৭ এর আর একটি রিপোর্ট। ঢাকার ডেট লাইনে পিটিআই পরিবেশিত এ রিপোর্টের শিরোনামঃ ‘‘তদমত্ম : দাউদ চক্রে তারিক? তলস্ন¬াসী খালেদার দপ্তরে।’
সেনা প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের ভারত সফর সম্পর্কে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ‘১লা মে’০৭ তারিখ লিখে যে, ‘‘ওয়াকিবহাল শিবিরের মতে, তাঁর (মইন) ভবিষ্যৎ কর্মপন্থায় ভারতের সিলমোহর লাগাতে আগ্রহী তিনি।’’
South Asia Analysis Group-এর ব্যানারে ভারতীয় লেখক ডঃ সুভাস কপিলা ২৩ জুলাই’০৮ লিখেছেনঃ Bangladesh : Visit of Indian Army chief significant.’
এতে তিনি লিখেছেন : India’s policy establishment needs to factor in its strategic and political calculus the centrality of the Bangladesh Army chief and the Bangladesh Army in Bagnaldesh's policy establishment and governance.
ভারতের ‘ডেইলি পাইওনিয়ার’ পত্রিকা অনলাইন ২৬ ফেব্রম্নয়ারী/০৮ রিপোর্টে বলেছে : ভারত সফররত বাংলাদেশের সেনা প্রধান জেনারেল মইন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুন:প্রবর্তনে ভারতের সমর্থন চেয়েছেন। ‘পাইওনিয়ার’-এর মতে, ‘বাংলাদেশের শাসন ÿমতার মূল ব্যক্তি হচ্ছেন জেনারেল মইন।’’ জেনারেল মইন ভারতীয় সেনাপ্রধানের আমন্ত্রণে গত ২৪ ফেব্রম্নয়ারী থেকে ১ মার্চ/০৮ পর্যমত্ম ভারত সফর করেন। ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মানস ঘোষও লিখেছেন : ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই জেনারেল মইনের সফরকে গুরম্নত্ব দিচ্ছে ভারত।’ তবে ভারতীয় মিডিয়ায় সেনাপ্রধানের সফর নিয়ে যেভাবে উচ্ছ্বাস ও তথ্য উপস্থাপন করেছে, তা নিয়ে সেনাসদরও ভিন্নমত প্রকাশ করে প্রেসনোট দিয়েছে। এ ব্যাপারে ‘দৈনিক সংগ্রাম’ ২৮ ফেব্রম্নয়ারী/০৮ লিখেছে জেনারেল মইনের সফরের সময়কে বেছে নেয়া হয়েছে : বিভেদ-বিভ্রামিত্ম সৃষ্টির জন্য ভারতীয় মিডিয়ার তথ্য সন্ত্রাস। এ ব্যাপারে ভারতীয় সাংবাদিক লেখক ভাস্কর রায়ের ২৪ ফেব্রম্নয়ারী/০৮ তারিখের "Bangladesh Army Cheif visits India লেখায় আর একটি লেখায় ২৭ ফেব্রম্নয়ারী/০৮ ‘সিফি-ডট কম ওয়েব সাইটে/- Dhaka needs to barn'- এ বাংলাদেশের সেনা প্রধানের ভারত সফরকে ভারতের ইচ্ছা পূরণের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ভাস্কর রায় ২৬শে ফেব্রম্নয়ারী/০৮ ইন্টার ন্যাশনাল রিপোর্ট ডট কম এ Democracy in Bangladesh and its impact on India- তেও বাংলাদেশকে ভারতীয় প্রভাব বলয়ে টেনে নিতে জেনারেল মইনের সফরকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। মি: ভাস্কর রায় লিখেছেন : Indian security officials had lamented that recent terrorist attacks in India like Varanas, Delhi, Mumbai, Hydrabad and even Ludhiana and all had Bangladesh connections. It is alleged that Islamic terrorist choose the porous border between India and Bangladesh for carrying out terrorist activities in India.
উদ্ধৃতি লম্বা করলে নিবন্ধের কলেবর আরও বেড়ে যাবে। শেষ করার আগে আরও কয়েকটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্যের ইতি টানবো। ২০০৭ সালের ৮ এপ্রিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট : সীমামত্ম নিয়ে বুদ্ধের-উদ্বেগ : ঢাকাকে জার্নাল নয়াদিলস্নী।’ ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ‘আনন্দবাজার’ এর রিপোর্ট : বাংলাদেশী সেনারা প্রশিÿণ দিচ্ছে ভারতীয় জঙ্গিদের, রিপোর্ট ঢাকাকে। এই উদ্ধৃতির সাথে আর একটি তথ্য সূত্র যোগ করতে চাই। সন্ত্রাস ও অনুপ্রবেশ মুকাবিলায় পরামর্শ দিতে উচ্চ পর্যায়ের ইসরাইলী সামরিক প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেন। ইসরাইলী সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল Moshe Kapalinsky-র নেতৃত্বে ১২ জুন/০৮ একটি উচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রতিনিধি দল ভারত সফর করেন। উলেস্নখ্য, ভারত-ইসরাইল সামরিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গত কয়েক বছর বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।।
সুতরাং বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের যে মিডিয়া সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় অমত্মর্ঘাতের ক্রুর থাবা বিস্তৃত তা এখন আর কোন দ্বি-পাÿÿক বা আঞ্চলিক বিষয় নয়। এটি এখন বিশ্ব যায়নবাদীদের লালনে ও পরিচর্যা পৃষ্ঠপোষকতায় গেস্নাবাল আগ্রাসনের রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশকে তার অর্জিত স্বাধীনতা ও জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌম অসিত্মত্ব রÿা করতে হলে চলমান রাজনীতিতে রাষ্ট্র রÿার বহুমুখী সংগ্রামের কর্মসূচী ও কৌশল যুক্ত করতে হবে। কেবল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বা ভারতের নিন্দা জানিয়ে সর্বতোমুখী আগ্রাসন অমত্মর্ঘাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচানো যাবে না।
[প্রবন্ধটি জানুয়ারী ১৫, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।]


----০----