বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ইসলামী ব্যবস্থাপনা
শেখ মোহাম্মদ শোয়েব নাজির
শুরুর কথা [Foreword]
জীবন-মৃত্যু, মানুষের জীবনে এক সর্বজনীন অনিবার্য সত্য। আর ব্যবস্থাপনা, মানব জীবনে এক অনিবার্য প্রয়োজন। অব্যবস্থাপনা বলতে আমরা যা বুঝে থাকি তা হচ্ছে ‘‘দুর্বল ব্যবস্থাপনা বা খারাপ ব্যবস্থাপনা।’’ মানব জীবনে ব্যবস্থাপনা-শূন্য কোন কর্মকান্ডের অস্তিত্ব নেই। একান্ত ব্যক্তিগত জীবন হতে শুরু করে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, ব্যবসায়িক, শিক্ষা জীবন তথা সামরিক-বেসামরিক জীবনের সকল পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। ব্যবস্থাপনার এই অপরিহার্যতা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য, সব দেশের জন্য, সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আজ বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষ বসবাস করছে। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের এই কর্মতৎপরতাকে ব্যবস্থাপনার ভাষায় Diversified Workforce হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। Diversified Workforce এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতার পাশাপাশি যোগাযোগের সহজতার কারণে বিশ্বকে এখন Global Village হিসেবেই মানুষ বিবেচনা করে। Global Village-এর সুবাদে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের পক্ষে যে কোন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে।
কুরআন কোনো ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বই-পুস্তক নয় কিংবা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), ব্যবস্থাপনার ভাষায় কথিত কোনো ব্যবস্থাপনা Expert নন। এমনি এক অবস্থায় Diversified Workforce এবং Global Village বিবেচনায় ‘‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’’ কতটুকু যৌক্তিক? কতটুকু সফল? কতটা বাস্তব? প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণা এবং কার্যাবলীর চলমান বাস্তবতায় ‘‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’’-র আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি-না? Global Village-এর যুগে ‘‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’’-র ধারণা আদৌ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি? বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা ধারণা ও নীতির অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ‘‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’’-ধারণা এমন অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণার জন্ম ও বিকাশ এবং ইসলামী ব্যবস্থাপনা ধারণার জন্ম ও বিকাশের মধ্যে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভংগিগত একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলাম মানুষের পার্থিব ও পারলৌকিক এই দুই জীবনকে অবিভাজ্য মনে করে। প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণা বা Concept মানুষকে উৎপাদনের একটি উপকরণ মাত্র মনে করে, যার সাথে শুধুমাত্র পার্থিব জীবনের সংশ্লেষ রয়েছে। স্পষ্টতঃই প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণায় মানুষকে শুধুমাত্র আর্থিক উপযোগ সৃষ্টির সক্ষমতার প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। ফলে প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাঝে ধারণাগত মৌলিক পার্থক্য, কার্যতঃ প্রায়োগিক পার্থক্য সূচিত করে।
অবিভাজ্য ধারণার প্রেক্ষিতে ইসলামী ব্যবস্থাপনা ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা নিরপেক্ষ একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ধারণার প্রতিফলন করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা এর সামগ্রিকতার এক একটি অংগ। এ প্রেক্ষিতে ইসলামী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা একটি সামগ্রিক আলোচনার দাবী রাখে। আলোচনার দাবী পূরণে মৌলিক ব্যবস্থাপনার [Fundamental Management] সাথে ইসলামী ব্যবস্থাপনার স্বরূপ তুলে ধরার পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি মানবীয় মৌলিক দিকে ইসলামী ব্যবস্থাপনার কিছু দিক-নির্দেশনা বর্তমান প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ইসলামী ব্যবস্থাপনা কি? [What is meant by Islamic Management?]
ইসলামী ব্যবস্থাপনা আলোচনা করার পূর্বে ব্যবস্থাপনা বলতে প্রচলিত ধারণাগুলো কি তা আলোচনা করা যাক। ইংরেজী Management শব্দটির সমার্থক গণ্য করা হয় “to handle” অর্থাৎ চালনা করা বা পরিচালনা করা। তাই ব্যবস্থাপনা বলতে কোন প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এতে নিয়োজিত ৬টি গুরুত্বপূর্ণ উপায়-উপকরণকে [Men, Machine, Materials, Money, Market and Method] সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোকে বুঝায়।
ব্যবস্থাপনা মূলতঃ নেতৃত্বদানের কৌশল। লক্ষ্য নির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ, বর্ণিত ৬টি গুরুত্বপূর্ণ উপায় উপকরণকে সংগঠিত করণ, মোটিভেশন বা প্রবৃত্তকরণ, সমন্বয়করণ, নির্দেশনা প্রদান এবং সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনই ব্যবস্থাপনার মৌলিক কর্মকান্ড। ব্যবস্থাপনা মাত্রই এসব কাজ সম্পাদন করা বুঝায়।

প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপরোক্ত উপকরণাদির মধ্যে মানুষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষই বাকী উপকরণগুলোর ব্যবহারকারী। এ প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপনা বলতে মানুষকে পরিচালনা করাও বুঝায়। Management শব্দটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করে- অর্থাৎ Manage + Man + Tactfully = Management এভাবেও কেউ কেউ ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা দিতে চেয়েছেন। রু ও বায়ার্স-এর মতে ‘অন্যদের দ্বারা কাজ করিয়ে নেয়াই ব্যবস্থাপনা (Management is getting things done by others)১
ব্যবস্থাপনা বিশারদ ‘কুনজ’ ও ‘ডনেল’ এর ভাষায় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে, পরিকল্পনা, সংগঠিতকরণ, নির্দেশনাদান, প্রবৃত্তকরণ বা মোটিভেটিং, সমন্বয়করণ ও নিয়ন্ত্রণ কাজের একটি সমন্বিত সামাজিক প্রক্রিয়া। যা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষ, যন্ত্রপাতি, মালামাল, অর্থ, বাজার ও পদ্ধতিকে দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠানের জনশক্তির কর্মপ্রচেষ্টায় প্রয়োগ করা হয়। [Management is a distinct social process consisting of planning, organizing, directing motivating, coordinating and controlling, applied to the efforts of employees to utilize efficiently man, materials, machine, methods, money and market with a view to a achieving predetermined objectives.]২
L.A. Allen এর ভাষায়, “Management is what a manager does.৩ ব্যবস্থাপক যা করেন তাই ব্যবস্থাপনা।
জর্জ আর টেরী ও ফ্রাংকলিন এর মতে, ‘‘ব্যবস্থাপনা হলো এমন একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া যা মানুষ ও অন্যান্য সম্পদসমূহের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনের নিমিত্তে পরিকল্পনা, সংগঠন, উদ্বুদ্ধকরণ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যাদি সম্পাদন করে। [Management is a distinct process consisting of activities of planning, organizing, actuating and controlling, performed to determine and accomplish stated objectives with the use of human being and other resources.]৪
একটি রেখাচিত্রের সাহায্যে ব্যবস্থাপনার ধারণা তুলে ধরা হলঃ

 

 

 

 

 


ছক চিত্রঃ ব্যবস্থাপনা ধারণা মডেল৫

এ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা বিশারদদের যতগুলো সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো এবং ব্যবস্থাপনা মডেল চিত্রেও যা ফুটিয়ে তোলা হল, তাতে স্পষ্ট হয়ঃ
1. পুরো ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াটি একজন ব্যবস্থাপকের উপর নির্ভরশীল।
2. 6M-কে handle করার বা ব্যবহার করার নিরঙ্কুশ এখতিয়ার দেয়া হয়েছে ব্যবস্থাপককে। এতে কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি।
3. ব্যবসায় বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বস্ত্তগত লক্ষ্য অর্জনই মুখ্যতঃ ব্যবস্থাপনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এবং এখানে পারলৌকিক জীবনের কোন ভূমিকা বিবেচনা করা হয়নি। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণা পারলৌকিক জীবন বর্জিত ধারণা হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।
4. যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা বিশারদ বা স্কলারই প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণার পুরোহিত বা দিক নির্দেশক। এখানে কোন মৌলিক অনুসরণীয় আদর্শ নেই।
5. Ends Justifies the means এটাই প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণার মূল কথা। এমনকি প্রতারণা, জালিয়াতি ইত্যাদি লক্ষ্যাজ©র্ন সহায়ক হলে তা বরণীয় বিবেচিত হয়। যে কোন রক্ষণশীল মনোভাব লক্ষ্যার্জনের বাধা বিবেচিত হলে বরং তা বর্জনীয় গণ্য হয় অথবা আপোষ করা হয়।
6. নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কর্মচারীদেরকে উৎপাদনের একটি উপকরণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। মানুষের divine dignity বা আশরাফুল মাখলুকাত ধারণা এখানে পরিতাজ্য বিবেচিত।
7. ন্যায়বিচার ব্যবস্থাপকের ইচ্ছাধীন।
8. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সীমা ব্যবস্থাপক পর্যন্ত বিস্তৃত। আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার কোন ধারণা এতে নেই।
9. প্রেষণার জন্য নৈতিকতা কোন বাধা নয়। শারিরীক-আর্থিক যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
10. প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং একচেটিয়া বাজার ধারণার পৃষ্ঠপোষক।
11. প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণায় জীবনের অবিভাজ্যতার স্পর্শ নেই। জীবন অবিভাজ্য। আর ঐসব দিক অবিভাজ্য জীবনের এক একটি অংশ এভাবে জীবনকে বিবেচনা করা হয় না। জীবনের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত প্রত্যেকটি দিককে বিচ্ছিন্নভাবে পরিমাপ করা হয়। ফলে জীবন হয়ে পড়ে সমন্বয়হীন। একদেশদর্শী।
প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণার এসব বিষয়কে মূল্যায়ন করেই ইসলামী ব্যবস্থাপনাকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করবো। ইসলাম জীবনকে অবিভাজ্য মনে করে। জীবনের সবকটি দিক তাওহীদের সুতোয় গাঁথা। একজন অনুসরণীয় পথপ্রদর্শক জীবনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের দিশারী। যিনি ইহলৌকিক জীবনের সবের্বাচ্চ কল্যাণ এবং পারলৌকিক জীবনের সফলতা একসাথে কিভাবে পাওয়া যায় তা একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের মত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ইসলামে, ব্যবস্থাপকের নিকট স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সাথে সাথে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর কাছেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। ইসলাম কর্মচারীদের আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বিবেচনা করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যার্জনে শরীয়ত নির্ধারিত নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছে। মানবজীবনের সকল কর্মকান্ডকে আল্লাহর হক বা হককুল্লাহ এরং বান্দার হক বা হক্কুল ইবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে ইসলাম একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থার ধারণার বিপরীতে অবাধ বাজার নিশ্চিত করেছে। একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থায় বান্দার হক ভয়ানকভাবে উপেক্ষিত হয় এবং মানুষকে চরম স্বেচ্ছাচারী ও নৈতিকতা বিবর্জিত সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করে।
সার্বিক প্রেক্ষিতে, ইসলামী ব্যবস্থাপনা বলতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশিত মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, সততা ও দক্ষতার সাথে শরীয়াতসম্মতভাবে পূর্ব নির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনে পরিচালিত কর্মকান্ড [পরিকল্পনা, সংগঠন, সমন্বয়, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ]-কে বুঝায়।

 

ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ (Origin & Evolution of Management)
ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি, মানবজাতির সূচনাকাল থেকেই বলা যায়। আর মানুষ যখন সংঘবদ্ধ হয়েছে, পেশা অবলম্বন করেছে, কাজ সম্পাদনে অন্যের সহায়তা গ্রহণ করেছে তখন হতেই ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ক্রমবিকাশ শুরু হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ) একা ছিলেন না, স্ত্রীসহ একটি পরিবার সংগঠিত হয়েছিল। পৃথিবীতে আল্লাহ আদম (আ)-কে একা পাঠাননি। সংঘবদ্ধ একটি পরিবারকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবীর জীবন যেন সুখের হয় এবং পারলৌকিক জীবন যেন দুঃখভরা না হয়, তাই আল্লাহ পৃথিবীর জীবন পরিচালনায় কিছু নির্দেশ আদম (আ)-কে দিলেন। যা বাস্তবায়নে স্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে আদম (আ)-কে একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের ভূমিকায় নামতে হয়েছিল।
আল্লাহ বলেন,
‘‘... অতঃপর আদম তার প্রতিপালকের নিকট হতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হল।...’’
‘‘... যখন আমার পক্ষ হতে তোমাদের নিকট সৎপথের কোন নির্দেশ আসবে তখন যারা আমার সৎপথের নির্দেশ অনুসরণ করবে তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না ’’।

একটি পরিবারের মৌলিক চাওয়া-পাওয়া আর কোটি কোটি পরিবারের মৌলিক চাওয়া-পাওয়ার মাঝে মৌলিক কোনই পার্থক্য নেই। আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে স্ত্রীর সহযোগিতা নিয়ে প্রথম মানব, প্রথম নবী প্রকৃতপক্ষে Micro ব্যবস্থাপনার সূচনা বা পত্তন করেছিলেন। যা আজ গোটা পৃথিবীতে কোটি কোটি পরিবার নিয়ে Macro ব্যবস্থাপনার পত্তন হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী প্রক্রিয়ায় বিকশিত ব্যবস্থাপনার ফলাফল মানবজাতি বিষময়রূপে ভোগ করেছে। যুগে যুগে মানব সমাজ হতে ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ও সুন্দর চরিত্রের মানুষকে মনোনীত করে আল্লাহ মানবজাতিকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। যেমন, ইউসুফ (আ)-এর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় দুর্ভিক্ষ মুকাবিলা করা, মূসা (আ)-এর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ফিরাউনের ‘‘ডিভাইড এন্ড রুল’’ নীতি ব্যর্থ হওয়া। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনালী সমাজ উপহার দেয়া। এসবই মানবজাতির ইতিহাসে Macro ব্যবস্থাপনার ক্রমবিকাশের সোনালী ইতিহাস।
বর্তমান ব্যবস্থাপনা শাস্ত্র ব্যবস্থাপনার ক্রমবিকাশকে ৫টি পর্যায়ে ভাগ করেছে
ক) প্রাচীন যুগ (খ্রীস্টের জন্মের পূর্ব পর্যন্ত) [Ancient Period]
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ হতে ৫২৫ অব্দ পর্যন্ত সময়ের কীর্তিসমূহ প্রাচীন মিশরের ব্যবস্থাপকীয় ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডের সাক্ষ্য বহন করে। হিব্রু সভ্যতায় হযরত মূসা (আ)-এর ভূমিকা ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখে। আইন প্রণয়ন, সরকার পরিচালনা ও মানব সম্পর্ক উন্নয়ন বিষযে দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে হযরত মূসা (আ)-এর অবদান স্মরণীয়।
চৈনিক সভ্যতায় ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার উন্নতিতে লাও-জু (Lau-Tzu)-এর অবদান লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন চীনের প্রশাসনে বিশেষজ্ঞকর্মী (Staff advice) ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারার বিকাশে গ্রীক সভ্যতারও অবদান রয়েছে। দার্শনিক প্লেটো একজন ব্যক্তিকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি কাজ অর্পন করার কথা বলেছেন। এ সভ্যতায় সর্বোত্তম পদ্ধতি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো।
খ) মধ্যযুগ (খ্রিস্টের জন্মের পর হতে শিল্প বিপ্লবের পূর্বকাল) [Middle Stage]
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খোলাফায়ে রাশেদার আমলে শাসন ব্যবস্থা ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য অবদানের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রয়েছে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম )বলেন, প্রতিশ্রুতি ঋণের মত (Promise is a debt) অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের মত প্রতিশ্রুতি পূরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। যা ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য কল্যাণমূলক অবদান রাখতে সহায়তা করেছে। তিনি আরো বলেন ‘‘যারা প্রতারণা করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয় [Those who cheat is not of us (Shahih Muslim)]।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ ব্যক্তিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’’ [Anyone who treats those under his authority badly, will not enter Paradise.] । এভাবে ব্যবস্থাপনাকে একটি কল্যাণমূলক মানবিক কর্মকান্ডে উপনীত করেছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পরবর্তীতে হযরত আবুবকর ও উমার (রা)-এর সময়ে ব্যবস্থাপনা কর্মকান্ডকে TQM (Total Quality Management i.e. Nevere Ending Process of development) পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। হযরত আবু বকর ও হযরত উমার (রা) কর্তৃক অনুসৃত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মডেল ছিল নিম্নরূপঃ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ছক চিত্রঃ হযরত আবু বকর ও হযরত উমার (রা) কর্তৃক অনুসৃত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মডেল।
এছাড়াও মধ্যযুগে যারা ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে অবদান রাখেন তাদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হলঃ
1. আল ফারাবি (Al-Farabi)ঃ ৯০০ খ্রিস্টাব্দে আল ফারাবি লিখিতভাবে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। তিনি নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণ এবং পরিত্যাজ্য দোষসমূহ তুলে ধরেন।
2. ইমাম গাজ্জালি (Imam Gazzali)ঃ ১১০০ খ্রীস্টাব্দে ‘নাসিহাত আল মুলক’ নামক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। শাসকশ্রেণীর প্রয়োজনীয় গুণাবলী সম্পর্কে তিনি সেখানে আলোকপাত করেন।
3. লুকা প্যাসিওলি (Lucca Pacioli)ঃ ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে লুকা প্যাসিওলি দু-তরফা হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন। যা ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কাজে যথেষ্ট সহায়ক হয়।
4. থমাস মুর (Thomas More)ঃ মধ্যযুগের শেষের দিকে ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারীদের মধ্যে থমাস মুরের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশেষায়ন এবং মানবশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করে অপচয়রোধ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কথা বলেন।
গ) শিল্প বিপ্লবকাল (১৭৫০-১৮৫০) [Industrial Revolution Period]
শিল্পবিপ্লবকালে ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারীদের সম্পর্কেসংক্ষিপ্ত কথাঃ
1. জেমস স্টুয়ার্ট (James Stewart)ঃ ১৭৬৭ সালে স্যার জেমস স্টুয়ার্ট ক্ষমতার উৎসের তত্ত্ব প্রদান করেন এবং শিল্পোৎপাদনে যন্ত্র প্রর্বতনের পক্ষে জোরালো মতামত দেন।
2. এ্যাডম স্মিথ (Adam Smith)ঃ ১৭৭২ সালে এ্যাডাম স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশন’ নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বর্ধিত উৎপাদনে শ্রম বিভাগের উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং ব্যবস্থাপনার বহুবিধ সমস্যা ও ধারণা তুলে ধরেন।
3. ম্যথে বোল্টন ও জেমস ওয়াট (Mathew Boulton & James Watt)ঃ এ দুই বিজ্ঞ উদ্ভাবক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনার প্রয়োগ করেন।
4. রবার্ট ওয়েন (Robert Owen)ঃ তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, অন্যান্য সম্পদের উপর বিনিয়োগের তুলনায় মানবশক্তি খাতে বিনিয়োগ কয়েকগুণ লাভজনক। শ্রমিক-কর্মী ব্যবস্থাপনায় তার বিশেষ অবদান রয়েছে।
5. চার্লস ব্যাবেজ (Charles Babbage)ঃ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপক চার্লস ব্যাবেজ কম্পিউটারের আবিষ্কারক। ব্যবসায়ে সফলতার জন্য, ‘‘ব্যবস্থাপনা’’ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে তিনি প্রমাণ করেন এবং ব্যবস্থাপনায় গণিত শাস্ত্রের প্রয়োগে তিনি অবদান রাখেন।
ঘ) শিল্প বিপ্লব পরবর্তী যুগ (১৮৫০-১৯৫০) [Post Industrial Revolutionary Period]
এ সময়ে যে সকল মনিষী ব্যবস্থাপনা শাস্ত্রের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তার মধ্যে এফ. ডব্লিউ টেইলর ও হেনরি ফেওল অন্যতম। এ সময়ে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা একটি ব্যবস্থাপনা মতবাদ হিসেবে প্রতিদ্ধি লাভ করে।
1. এফ. ডব্লিউ. টেইলর (F. W. Taylor)ঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম নেয়া এ প্রতিভাধর ব্যক্তি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা মতবাদের রূপকার। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জনশক্তির পূর্ণ ব্যবহারের জন্য বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন করেন। এতে ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারায় ও পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
2. হেনরি ফেওল (Henry Fayol)ঃ হেনরি ফেওল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় ১৪টি মূলনীতির নির্দেশ করেন। যা আধুনিক ব্যবস্থাপনায় অনুসৃত হয়ে থাকে।
ঙ) আধুনিক যুগ (Modern Stage)
শিল্প বিপ্লব পরবর্তীকালে ব্যবস্থাপকীয় তত্ত্ব ও এর প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছিল তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ও আচরণ বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। এর মধ্যে, ম্যাকগ্রেগর, আব্রাহাম মাসলো, র্হাজবার্গ, পিটার এফ. ড্রাকার প্রমুখ মনিষীর নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, নিউম্যান, জর্জ আর. টেরি, কুঞ্জ ও ডোনাল, ফিলিপ কটলার, এসপি রবিন্স আধুনিক ব্যবস্থাপনা চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছেন।
অন্যদিকে আধুনিক যুগে ইসলামী ব্যবস্থাপনার ধারণাকে এগিয়ে নিতে ড. এন. জাবনাউন, নিক মুহাম্মদ আফিন্দি, রফিকুল ঈসা বেকেন, জামাল বাদাবী, মোস্তফা কামাল আইয়ুব, ইসমাইল নূর, খালিদ আহমদ, সাইয়েদ ওসমান আল হাবশী, আইডিত গাজালী, ড. গোলাম মহিউদ্দিন, খুররম মুরাদ, ফরিদউদ্দিন মাসউদ প্রমুখ মনিষীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

ব্যবস্থাপনাঃ বিজ্ঞান না কলা [Management : Science or Arts]
বিজ্ঞান হল সুসংঘবদ্ধ ও সুশৃংখল জ্ঞান। আর এই জ্ঞানের প্রয়োগ কৌশলই কলা। ব্যবস্থাপনার জন্য সুশৃংখল জ্ঞান যেমন প্রয়োজন তেমনি এর সঠিক প্রয়োগে লাগসই কৌশলের কোন বিকল্প নেই। সফল ব্যবস্থাপনা এ দুয়ের সমন্বয় ছাড়া সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান কিনা? বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-
1. সত্যকে জানবার একটি সুশৃংখল জ্ঞান।
2. শুধুমাত্র ধারণার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল এমন জ্ঞান নয়।
3. জ্ঞানটি পরীক্ষিতভাবে সত্য।
ব্যবস্থাপনার যেসব নীতি, পদ্ধতি ও ধারণা প্রয়োগ করা হয় তা সুশৃংখল জ্ঞানের মধ্যেই পড়ে, যা অবশ্যই পরীক্ষিত। যেমন, উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সংগঠন কাঠামো করে, বিভিন্ন ব্যক্তির দায়িত্ব নিরূপণ করে দিলে, উদ্দেশ্য অর্জন সহজ হয়- এ তথ্যটি একটি পরীক্ষিত সত্য। ব্যবস্থাপনার নীতিগুলো শুধুমাত্র ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন, বেশী মজুরী প্রদান করলে, কর্মে উৎসাহ বেড়ে যায় অথবা প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন হারে মজুরী প্রদান করলে উৎপাদন বেড়ে যায়। এসব ধারণা নির্ভর নয় বরং যুক্তিযুক্ত।
এসব পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান তবে এটা পরিপূর্ণ বিজ্ঞান নয়। এটা সামাজিক বিজ্ঞান। যেমন রসায়ন বিজ্ঞানে, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের মিশ্রণে পানি হবে। এটা অবধারিত সত্য। কিন্তু ব্যবস্থাপনা এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, যা খুবই জটিল এবং পরিবর্তনশীল। যেমন, ব্যবস্থাপনা নির্দেশনার কোন বিশেষ পদ্ধতি। একই পরিবেশের মধ্যে সকল কর্মীর উপর একইভাবে এর ব্যবহার সমান ফলাফল দেয় না। কারণ সকল শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক গঠন এক নয়। তাই একই নির্দেশনায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মীরা বিভিন্নভাবে নাড়া দেয়। ইসলামী ব্যবস্থাপনায়ও বিষয়টি একই রকম। ইসলামী ব্যবস্থাপনা ধারণা বা Islamic Management Concept-এ আল্লাহর আদেশ অমান্য করে গৃহীত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ক্ষতি। এ ক্ষতি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যবসায়, অর্থনীতি, রাজনীতি সবকিছুতেই। বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। ব্যবস্থাপনা একটি সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে, ইসলামী ব্যবস্থাপনায় উক্ত পরীক্ষিত ও প্রমাণিত সত্যগুলোই বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচিত। এ বিষয়ে কুরআনে অসংখ্য পরীক্ষিত ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
কলা হলো কোন কাজ করার কৌশল। বিজ্ঞানের তত্ত্ব বাস্তবে ব্যবহারের পদ্ধতি এবং কৌশল। কলা ও বিজ্ঞান পরস্পরের পরিপূরক অর্থাৎ বিজ্ঞানকে সফলভাবে ব্যবহার করার জন্য কলা প্রয়োজন। আবার উল্টোভাবে বলা যায়, কলার সফলতা আসে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান হলেও এর সফল ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থাপনার আওতার মধ্যে, কলার উপস্থিতি থাকতে হবে।
এ বিষয়ে তিনটি কেস স্টাডি আলোচনা করা হলঃ
কেসস্টাডি-১ঃ
ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল করতে কম্পিউটার স্থাপনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। এটি বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু কম্পিউটার স্থাপনের বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে গতিশীল করবে না। কম্পিউটারকে কাজে লাগানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের কাউকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব প্রদান করাই হল কলা।
কেসস্টাডি-২ঃ
কোম্পানীর চেয়ারম্যান মি.এক্স-এর কক্ষে কম্পিউটার ম্যানেজার হাতে একটা ডকুমেন্ট নিয়ে প্রবেশ করলেন। চেয়ারম্যানকে সেটি দেখিয়ে প্রশ্নের আকারে বললেন, ‘‘এখানটায় একটু সই করে দেবেন দয়া করে?
কি এটা? চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন।
‘‘আপনি বুঝবেন না’’, কম্পিউটার ম্যানেজার জবাব দেন, ‘‘এটা কম্পিউটার এর সঙ্গে সম্পর্কিত’’। চেয়ারম্যান তার প্রচ্ছন্ন রাগ দমন করে বলেন, ‘‘ওটা এখানে রেখে যান যখন বুঝতে পারবো তখনই সই করবো’’। কম্পিউটার ম্যানেজার মহা খ্যাপপা। গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ‘এটা কম্পিউটার এর বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত একটি সাধারণ কন্ট্রাক্ট মাত্র। এটা আটকে রেখে চেয়ারম্যান কন্ট্রাক্টর-এর কাছে আমাকে হেয় করছেন। তারা বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপেক্ষা করছে...।’’
কম্পিউটার ম্যানেজার ইচ্ছে করলে বিষয়টি অন্যভাবে মুকাবিলা করতে পারতেন। বলতে পারতেনঃ ‘‘স্যার, এটি আমাদের কম্পিউটার এর নিয়মিত বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি সংক্রান্ত। আমি এটা ভাল করে দেখে নিয়েছি, আপনি যদি পড়তে চান তাহলে আমি রেখে যেতে পারি। যদিও আমি জানি আপনার হয়তো সময় হবে না এটা পাঠ করার। যদি চান তাহলে দয়া করে এখানটায় সই করে দিতে পারেন।’’ সম্ভব ছিল যে চেয়ারম্যান ডকুমেন্টটি সই করে তখনই তা ফেরত দিতে পারতেন। কিন্তু, ‘‘আপনি বুঝবেন না।’’ কথাটি সত্য হলেও তা তাকে আহত করে এবং তার মনে বৈরীতা সৃষ্টি করে।
এখানে কম্পিউটার সংক্রান্ত বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের গোটা ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানসম্মত একটি পদক্ষেপ ছিল কিন্তু কম্পিউটার ম্যানেজারের কলা জ্ঞানের অভাব বিষয়টিকে সফল হতে দেয়নি। ব্যবস্থাপনা জগতে এমন অনেক সত্য রয়েছে যা প্রয়োগকারীর কলা জ্ঞানের অভাব, সে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়।
কেসস্টাডি-৩ঃ ফিরাউন ও মূসা (আ)
৪২. তুমি [মূসা (আ)] এবং তোমার ভাই [হারুন (আ)] আমার নিদর্শনসহ যাত্রা কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না।
৪৩. তোমরা উভয়ে ফিরআউনের নিকট যাও; সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে।
৪৪. তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।
৪৬. তারা বলল হে আমাদের রব! আমরা আশংকা করি সে আমাদের উপর বাড়াবাড়ি করবে অথবা অন্যায় আচরণে সীমালঙ্ঘন করবে।
৪৭. তিনি বললেন, ‘তোমারা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সংগে আছি’, আমি শুনি ও আমি দেখি।
আয়াতগুলোতে মূসা (আ) ও হারুন (আ)-কে একজন সীমালঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রপ্রধানকে (বর্তমানের প্রচলিত ভাষায় লৌহমানব) সতর্ক করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যা করতে হবে সে বিষয়ে আল্লাহতাআলা নির্দেশনা দিয়েছেনঃ
1. যতই লৌহমানব হোক না কেন, ভয় করবে না।
2. যতই নির্যাতনের আশংকা হোক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।
3. সীমালঙ্ঘনকারী হলেও তার সাথে নম্রতার সাথে কথা বলতে হবে। যাতে করে সত্যকে গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার কোন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ হতে মূসা (আ) ও হারুন (আ)-এর জন্য এটি একটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ মিশন ছিল। যার সফলতার উপর ফিরআউন প্রতিষ্ঠিত গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নির্ভর করছে। যেখানে মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব করার, জুলুম-নির্যাতন করার আর অবকাশ থাকবে না। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে অনেক ব্যাপক একটি সামাজিক পরিবর্তন। যা সমাজ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। সমাজ বিজ্ঞানের এই বিশাল কর্মটি সফলভাবে সাধন করতে যে কলা প্রয়োজন সে কথাই আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিলেন, ফিরাআউনের সাথে নম্রভাবে কথা বলার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থাপনাতে বিজ্ঞান ও কলার সমন্বয়েই সকল ব্যবস্থাপনার দিক নির্দেশনা রয়েছে। অনেক সময় সত্য পথের অনুসারী হবার অহংকারে অনেকে কলার প্রয়োগকে অহেতুক মনে করে। অথচ কলার প্রয়োগকে অহেতুক মনে করার মধ্য দিয়ে কার্যতঃ ইসলামী ব্যবস্থাপনাকেই অস্বীকার করা হয় এবং সত্যকে সমাজে প্রতিষ্ঠার পথে নিজেরাই প্রকারান্তরে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কলাকে এড়িয়ে ইসলামী ব্যবস্থাপনার কোন অস্তিত্ব নেই।
ইসলামী ব্যবস্থাপনার আওতা বা পরিধি [Scope of Islami Management]ঃ
ইসলামে জীবন হচ্ছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক এই দ্বিমাত্রিক স্তরের এক অবিভাজ্য রূপ। আর তার ব্যবস্থাপনার আওতাও উভয় স্তরের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন- একটি দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও একটি মাদক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রক্ত-বংশ নির্বিশেষে মানুষের কল্যণেই নিবেদিত। অন্যদিকে মাদক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রক্ত-বংশ নির্বিশেষে মানুষের দীর্ঘস্থায়ী অকল্যাণে নিয়োজিত।
দ্বিমাত্রিক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামী ব্যবস্থাপনায় মাদক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সকল ধরনের কার্যাবলী এর আওতা বর্হিভূত। কিন্তু একমাত্রিক জীবন ব্যবস্থায় যেখানে ইহলৌকিক জীবনই চূড়ান্ত সেখানে এ ধরনের সবই আওতার মধ্যে বিবেচিত। যদিও মানব কল্যাণে আসে না এমন কাজ ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত নয় বলে সাধারণতঃ স্বীকার করা হয়ে থাকে। এ হল উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ হতে ইসলামী ব্যবস্থাপনার আওতা।
প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনায় দেখা যায়, সকল ধরনের ব্যবসায়ী ও অব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে যেমন, অফিস-আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা অথবা অন্য যে কোন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন। তাহলে এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার আওতা বলতে ব্যবসায়ী ও অব্যবসায়ী সকল প্রতিষ্ঠানই এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ হতে একটি পতিতালয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হলেও এটা ইসলামী ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত নয়। কারণ, পতিতালয় কোন ধর্মের, কোন সমাজের জন্যই কল্যাণমূলক নয়। মর্যাদাপূর্ণ নয়।
একটি প্রতিষ্ঠান একজন ব্যবস্থাপকের অধীনে অল্প কিছু কর্মী নিয়ে শুরু হলেও কালক্রমে তা একাধিক ব্যবস্থাপক ও বহু অধীনস্থ কর্মীতে সম্প্রসারিত হয়। প্রতিষ্ঠানের ক্রমোন্নতি এর জটিলতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবস্থাপনার আওতার ব্যাপকতা বৃদ্ধি করে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে এগিয়ে যেতে ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। এ প্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ ব্যবস্থাপনা, মধ্যম ব্যবস্থাপনা, নিম্ন ব্যবস্থাপনা, সাধারণ ব্যবস্থাপনা, কর্মী ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বিপনন ব্যবস্থাপনা, বিক্রয় ব্যবস্থাপনা, ক্রয় ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যয় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ধারণার। পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের তথ্য সংগ্রহ, নীতি, কর্মসূচী গ্রহণ, সংগঠনের জন্য সরলরৈখিক, উপদেষ্টা নীতি, বিভাগীয়করণ কমিটি বা দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কেন্দ্রীকরণ, বিকেন্দ্রীকরণ, কর্তৃত্বস্থাপন, দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন; নির্দেশনার জন্য নেতৃত্ব, প্রেষণা, প্রণোদনা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিবেদন, পরিদর্শন। ব্যবস্থাপক ও নির্বাহীদের কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে ভারসাম্য রক্ষা করা, নির্বাহীদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদানসহ তাদের কাজের তদারক ও নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনীয় কর্মী বাহিনী সংগঠন, তাদের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা- এসবই ব্যবস্থাপনার আওতার মধ্যে পড়ে। ইসলামী ব্যবস্থাপনারও বিষয়টি তাই। তবে ইসলামী ব্যবস্থাপনার আওতায় যে বিশেষ দিকটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলো, কর্মীর মূল্যায়ন। প্রতিটি কর্মীকেই প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান সম্পদ বিবেচনা করতে হবে এবং আরো বিবেচনা করতে হবে যে, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-রক্ত-বংশ নির্বিশেষে, প্রতিটি মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। তাই এদের মানবিক সকল চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
‘‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার উচিৎ তাকে তাই খাওয়ানো যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরানো যা সে নিজে পরে থাকে। আর তাকে এমন কর্মভার দিবে না, যা তার সাধ্যাতীত। যদি কখনো তার উপর অধিক কর্মভার চাপানো হয়, তবে যেন তাকে সাহায্য করে।’’
তিনি আরো বলেন ‘‘It is most important for you to provide food and clothing to your assistants [Shahih Muslim]’’ ‘‘Those who work for you are your brothers, Allah has made them your assistants. (Al-Bukhari and Al-Tirmizi)’’. । যখন কেউ কোন কাজ সূচারুরূপে সম্পাদন করে, আল্লাহ তা ভালবাসেন- Allah loves that when anyone does a job he does it perfectly [আল বাইহাকী ] আল্লাহতাআলা বলেন, ... এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নত করি যাতে একে অপরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে...। আল্লাহতাআলা আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ কারও উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।’’
ইসলাম যেমন কর্মীকে মূল্যায়ন করার তাগিদ দিয়েছে তেমনি কর্মীকেও দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘একজন কর্মী তার নিয়োগকর্তার সম্পদের রক্ষক -A worker is the Guardian of his employers property [সহীহ আল বুখারী এবং মুসলিম]।’’
ইসলামী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব [Importance of Islamic Management]ঃ
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, পারিবারিক জীবনের যে কোন ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নের এবং নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত। মাদক ব্যবসা, পতিতালয়ের ব্যবসা, মজুদদারীর মাধ্যমে একচেটিয়া কারবার, অস্ত্রের কারবার ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণায় স্বীকৃত হলেও ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মানবজাতির জন্য কল্যাণমূলক নয়। ইসলাম যেসব বিষয় (পণ্য বা সেবা) হারাম/নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সেসব বিষয়ের ব্যবসায় বা সেসব পণ্য বা সেবাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মানব কল্যাণমুখী বলে প্রমাণিত হয়নি। আর ইসলামী ব্যবস্থাপনা হল একটি মানব কল্যাণমুখী ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সার্বজনীন ব্যবস্থাপনা। তাই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ইসলামী ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।

ইসলামী ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য [Goal & Objectives of Islamic Management]ঃ
ইসলামী ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইহলৌকিক ও পারলৌকিক, জীবনের এই দ্বিমাত্রিক ধারণাকে ভিত্তি করেই নির্ধারিত হয়। পারলৌকিক জীবনের জবাবদিহিতার মূল্যবোধ ছাড়া ইসলামী ব্যবস্থাপনার কোন অস্তিস্ত্ব নেই। ইসলামী ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে আলোচনা করা হল ঃ
লক্ষ্যঃ
ইসলামী ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য হল ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ অর্জন। বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে কুরআনের সূরা আল বাকারায় উদ্বৃত আয়াতেঃ “Our Lord! Give us in this world that which is good and in the Hereafter that which is good, and save us from the torment of the Fire!”- ‘‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে পার্থিব জীবনের কল্যাণ দান করুন এবং পারলৌকিক জীবনের কল্যাণ দান করুন এবং ভয়াবহ অগ্নি শাস্তি হতে আমাদেরকে রক্ষা করুন।’’
উদ্দেশ্যঃ ইসলামী ব্যবস্থাপনা, নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য পরিচালিত হয়ঃ
1. প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রাখা।
2. প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
3. চাহিদা মুতাবিক, ইসলামে হালাল বা বৈধ সকল পণ্য ও সেবার মানসম্মত যোগান প্রদান করা।
4. সেবা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বজায় রাখা ও উন্নয়ন করা।
5. খরচ কমিয়ে কিন্তু মান ক্ষুন্ন না করে মিতব্যয়ীতার সাথে উৎপাদন নিশ্চিত করা। যা পণ্য বা সেবার প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নিশ্চিত করবে।
6. প্রাপ্ত সম্পদসমূহ যেমন যন্ত্রপাতি, মানবসম্পদ, অর্থ ইত্যাদির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা।
7. শ্রমিক-কর্মচারীদের ‘‘উৎপাদনের একটি উপকরণ মাত্র’’ হিসেবে বিবেচনা না করে, আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা এবং পাচঁটি মেŠলিক চাহিদা পূরণের সাধ্যমত ব্যবস্থা করা।
8. নতুন ও উন্নত কৌশল ও কার্যাবলীর প্রবর্তন করে পণ্য ও সেবার উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন সাধন করা।
9. জাতীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখা বা দেশ গড়ার অংশীদার হওয়া।
10. মানবসম্পদ উন্নয়নের উদ্দেশ্যে দক্ষ কর্মী বাছাই ও নৈতিকতা ভিত্তিক যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান।
11. প্রতিটি বিভাগে সুষ্ঠু কার্যকারিতা বজায় রেখে প্রতিষ্ঠানের ভিশন ও মিশন অর্জনে দক্ষতা ও ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষ পরিচালনা নিশ্চিত করা।
ইসলামী ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা [Management Skill in Islamic Management]ঃ
ইসলামী ব্যবস্থাপনার জন্যেতো বটেই সব ধরনের ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অপরিহার্য। সাধারণভাবে এই দক্ষতাকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
1. কারিগরী দক্ষতা।
2. মানবিক সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতা।
3. ধারণাগত দক্ষতা।
4. রোগ নির্ণয়মূলক দক্ষতা।
১. কারিগরী দক্ষতাঃ
কারিগরী দক্ষতা হল যন্ত্রপাতি, প্রক্রিয়া ইত্যাদি ব্যবহার করার যোগ্যতা। এ যোগ্যতাকে দক্ষতা তখনই বলা যাবে যখন দ্রুততম সময়ে তা ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
২. মানবিক সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতাঃ
মানবিক সম্পর্ক বিষয়ক দক্ষতা হল যে কোন পরিস্থিতিতে অধস্থনদের মধ্যে উদ্দেশ্যবোধ, ক্রিয়াবোধ ও আনুগত্যবোধ সৃষ্টিতে সক্ষমতা এবং অসন্তোষ জাতীয় পরিস্থিতি মুকাবিলায় বিচক্ষণতা। যেমন, কর্মচারীদের মধ্যে দাবী-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ চলাকালীন সময়ে কোন শ্রমিক-কর্মচারীর শাস্তি ঘোষণা- অসন্তোষকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই শাস্তি প্রয়োগ করতে হলে অসন্তোষ কমে আসলে শাস্তির প্রয়োগ করাই বিচক্ষণতা বিবেচিত হয়।
৩. ধারণাগত দক্ষতাঃ
ধারণাগত দক্ষতা হল, প্রতিষ্ঠানের সকল কাজের একটি সাধারণ ধারণা রাখা এবং তাদের সমস্যায় সমাধানের ক্ষমতা থাকা। প্রতিষ্ঠানের সকল কাজের গতির একটি সমন্বিত রূপ দেখার ক্ষমতা। কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কাজের বিভিন্ন অংশ একত্রীভূত হয় অথবা কোন একটি অংশে পরিবর্তন হলে, তা অন্যান্য অংশকে কীভাবে প্রভাবিত করে ইত্যাদি ধারণা করার ক্ষমতাই ধারণাগত দক্ষতা।
৪. রোগ নির্ণয়মূলক দক্ষতাঃ
কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ। এজন্য অনেক কারণ দায়ী হতে পারে, যেমন কর্মীদের মজুরী কম, কাজের পরিবেশ অসহনীয়, শ্রমের যুক্তির চেয়ে শ্রমিকের যুক্তির প্রভাব, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের ইন্ধন, রাজনৈতিক প্রভাব, অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক উচ্চাভিলাশ ইত্যাদি। রোগ নির্ণয়মূলক দক্ষতা হল বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অবস্থার প্রকৃতি এবং তার পেছনে দায়ী কারণগুলোকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা। অন্য কথায়, রোগ নির্ণয়মূলক দক্ষতা শুধুমাত্র কোনো ঘটনা কেন ঘটেছে তা নির্ণয় করা নয়, বরং অন্য অবস্থায় কি ঘটতো তাও পূর্বানুমান করা বুঝায়।
ইসলামী ব্যবস্থাপনায় ব্যবস্থাপনা পরিবেশ [Management Environment in Islamic Management] ঃ
ইসলামী জীবন দর্শনের দ্বিমাত্রিক জীবন ব্যবস্থার নৈতিক মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে, ব্যবস্থাপনায় ইসলামী পরিবেশ নিশ্চিত করা ইসলামী ব্যবস্থাপনার পূর্বশর্ত। সাধারণভাবে সব ধরনের ব্যবস্থাপনার পরিবেশকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১. অভ্যন্তরীণ পরিবেশ (Internal Environment)
২. বাহ্যিক পরিবেশ (External Environment)
১. অভ্যন্তরীণ পরিবেশ (Internal Environment)ঃ অভ্যন্তরীণ পরিবেশের উপাদান বলতে সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনার উপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানকেই বুঝায়। সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান বলতে কাঁচামাল, শ্রমিক-কর্মী, পরিচালনা পর্ষদ, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা, মালিক বা শেয়ার হোল্ডার ইত্যাদি।
২. বাহ্যিক পরিবেশ (External Environment)ঃ বাহ্যিক পরিবেশ বলতে সংগঠনের বাইরের ঐসব উপাদানকে বুঝায় যা সংগঠনের কাজের জন্য প্রাসঙ্গিক। যেহেতু কোন সংগঠনই স্বনির্ভর নয়। অস্তিত্ব বজায় রাখার স্বার্থে অভ্যন্তরীণ পরিবেশের পাশাপাশি বাহ্যিক পরিবেশের উপরও নির্ভর করতে হয়।
বাহ্যিক পরিবেশে সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী এবং পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারকারী উভয় প্রকার উপাদানই রয়েছে।
সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলো হলোঃ
প্রতিযোগী (Competitors), ক্রেতা বা ভোক্তা (Customers or End users) সরবরাহকারী (Suppliers or Vendors), মধ্যস্থ ব্যবসায়ী (Middlemen), কৌশলগত মিত্র (Strategic allies), সরকারী সংস্থা (Govt. Agencys), বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান (Investment Body) ইত্যাদি।
পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান গুলো হলো, প্রযুক্তি (Technology), অর্থনীতি (Economy), রাজনৈতিক (Political), সাংস্কৃতিক (Cultural), ভৌগলিক (Physical), সামাজিক (Social), ধর্মীয় (Religious), আইনগত (Legal Elements) এবং আন্তর্জাতিক উপাদান (International Elements)।
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় পরিবেশের সকল উপাদান বিবেচনায় ইসলামী পরিবেশ নিশ্চিত করা একটি ব্যাপক সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার অংশ। এক্ষেত্রে তাই অগ্রাধিকারমূলকভাবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশের উপাদানগুলোকে ইসলামের উদার মূল্যবোধের আলোকে কাঠামোবদ্ধ করা এবং দীর্ঘমেয়াদী সময়ের প্রয়োজন এমন উপাদানগুলোকে কাঠামোবদ্ধ করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা। ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি মূল্যবোধগুলোর চর্চায় ব্যাপকভাবে মানুষের অংশগ্রহণই মূলতঃ ব্যবস্থাপনায় ইসলামী পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। আর ইসলামী মূল্যবোধ চর্চায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ব্যাপক হওয়া সম্ভব হবে, ইসলামী মূল্যবোধ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপকভাবে সামাজিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব ও ব্যবস্থাপনায় ইসলামী পরিবেশঃ
প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণায় ‘Profit maximization’ হচ্ছে ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য আর প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সাধন হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। এরূপ লক্ষ্য অর্জনে সমাজ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ও সুদৃষ্টির প্রয়োজন পড়ে। আর এজন্য ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বিষয়টি আরও স্পষ্টকরণ হয়েছে- Bartol ও Martin এর মতামতে। Bartol ও Martin-এর “Organizational social responsibility refers to the obligation of an organization to seek actions that protect and improve the welfare of society along with its own interests.” অর্থাৎ ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক দায়িত্বপালন একটি প্রতিষ্ঠানের সেই সকল দায়বদ্ধতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যা পালনের ফলে সমাজের কল্যাণ ও অগ্রগতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বার্থও সংরক্ষিত হয়।’’
ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছেঃ
প্রথমত ঃ Profit maximization [যে কোন উপায়ে]।
দ্বিতীয়ত ঃ সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শক্তির সুদৃষ্টি অর্জন।
তৃতীয়ত ঃ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংরক্ষণ বা উদ্ধারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ।

এই তিনটি উদ্দেশ্য অর্জনে প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ধারণায়, কোন নৈতিক কাঠামো অনুসরণের কথাই বলা হয়নি।
কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব পালন দ্বিমাত্রিক মূল্যবোধের এক অপরিহার্য অঙ্গ। এতে Fair Profit -এর মাধ্যমেই Profit maximization হতে পারে, সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শক্তির সুদৃষ্টি অর্জনও সম্ভব হয় এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও ব্যবসার সম্প্রসারণও ঘটে। আর এভাবে ব্যবস্থাপনায় ইসলামী পরিবেশ তরান্বিত হয়। প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় সামাজিক দায়িত্ব পালন কৌশলগত। ইসলামী ব্যবস্থাপনায় সামাজিক দায়িত্ব পালন ইসলামী নৈতিক কাঠামোর ভেতর একটি অপরিহার্য কর্মকান্ড। পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন, ইসলামের দ্বিমাত্রিক জীবন দর্শনের ফলে ইসলামী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রকের কাজ করে এবং একটি সার্বজনীন মানবিকতাবোধের ভেতর দিয়েই প্রতিষ্ঠানের সব ইহলৌকিক লক্ষ্যই সফলভাবে অর্জিত হয়। অন্যদিকে প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় যেহেতু কোন নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছাড়াই Profit maximization করার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, তাই এক্ষেত্রে অমানবিক পথ বেছে নিতে কারো আর বাধা থাকে না। সেটা ব্যবসার নামে টেন্ডারবাজী, অফিসে স্বজনপ্রীতি, রাজনীতিতে খুনাখুনি, সামাজিকতায় চরিত্র হনন, অর্থনীতিতে দারিদ্র্যমুক্তির আড়ালে ক্ষুদ্র ঋণের নামে সুদের শোষণ ইত্যাদি যে কোন কিছু হতে পারে।
প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, ইসলামী ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশ [Effective Organization, Islamic Management and Internal Environment]
ইসলামী ব্যবস্থাপনায় যে প্রতিষ্ঠানই পরিচালিত হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানটি কতটুকু কার্যকর তা নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের কিছু উপাদানের কার্যকারিতার উপর। যেমনঃ
প্রথমত ঃ জনশক্তির উদ্দেশ্যবোধ।
দ্বিতীয়ত ঃ সতর্কতাবোধ।
তৃতীয়ত ঃ অধঃস্তনদের জন্য উৎকণ্ঠা।
চর্তুথত ঃ শারীরিকভাবে একত্রে কাজ করা।
পঞ্চমত ঃ ন্যায়বিচার (Justice) নিশ্চিত করা।
১। উদ্দেশ্যবোধ [Commitment] ঃ কার্যকর প্রতিষ্ঠানে কোন না কোন ভাবে একটি ব্যাপক উদ্দেশ্যবোধ সঞ্চারিত থাকে। প্রায় প্রত্যেকেই জানে তার কাছে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশা কি? অন্যদিকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে লোকজনের মাঝে এমন উদ্দেশ্যবোধ লক্ষ্য করা যায় না। দেখে যেন মনে হয় তরা উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে চলেছে। ‘অংশগ্রহণ’ এর লক্ষ্যে সভা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু সেই সভাগুলো সর্বাধিক জরুরী সিদ্ধান্তগুলো স্থগিত রেখেই শেষ হয়ে যায়।
একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা, এতে কর্মরত লোকজনের মধ্যে সর্বাধিক উদ্দেশ্যবোধ সম্পন্ন ব্যক্তির অনুপাত এর উপর নির্ভরশীল। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানসমূহে সাধারণ উদ্দেশ্যবোধ এর মাত্রা খুবই কম। এক্ষেত্রে লোকজন কোনরূপ অঙ্গীকার, সম্পৃক্ততা কিংবা অবদানবোধ নিয়ে কাজ করে না।
উদ্দেশ্যবোধ এর সাথে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বা কোন পদমর্যাদার সংশ্লিষ্টতা নেই। অর্থাৎ কোন বিশেষ প্রতিষ্ঠান বা পদমর্যাদার লোকের মধ্যে উদ্দেশ্যবোধ কার্যকর থাকবে ব্যাপারটি এমন নয়। কোন প্রতিষ্ঠানে, এমনকি চেয়ারম্যান-এরও এমন উদ্দেশ্যবোধ থাকে না, যে চেয়ারম্যান-এর কাছে অফিসের কাজের চাইতে গলফ খেলা বা টিভিতে খেলা দেখা অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে। অপরদিকে একজন সাধারণ শ্রমিক বা কর্মীর মাঝেও একটি উদ্দেশ্যবোধ লক্ষ্য করা যেতে পারে।
বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করে তুলতে উদ্দেশ্যবোধ-এর দু’টো কেস উল্লেখ করছিঃ
কেস-১ঃ একজন ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট একটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি প্রস্ত্ততকারী ফ্যাক্টরী পরিদর্শনে যান। ফ্যাক্টরীতে সম্প্রতি উৎপাদন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং তাতে সবাই তখন ভীষণ উৎফুল্ল। মহাব্যবস্থাপক, ব্যবস্থাপক উভয়েই বিষয়টি পরিদর্শককে অবহিত করলেন। প্রোডাকশান ম্যানেজারও ঐ সুসংবাদটি তাকে দিলেন। শেষে ওয়ার্কশপে এসে পৌঁছলে একজন লেদমেশিন অপারেটরও এ নিয়ে কথা বলছে- পরিদর্শকের তা নজর কাড়ে। তখন পরিদর্শক সেই শ্রমিককে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘আপনি এ ব্যাপারে এত আগ্রহী হলেন কেন? ম্যানেজার এবং সুপারভাইজারদের কথা না হয় বুঝলাম তারা হয়তো পদোন্নতি পাবেন। আপনার বেলায় কি হচ্ছে, এখন দশটা লেদ আপনার চারপাশে চলছে যা বেড়ে কুড়িটি হবে। তার অর্থতো হল আরও অধিক শব্দ।’’ লেদ অপারেটর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, না না আপনি অবস্থাটা বুঝছেন না। আমরা সারা দেশের গ্রামগুলোর বিদ্যুতায়নের সঙ্গে জড়িত। দ্বিগুণ ক্ষমতা দিয়ে বিদ্যুতায়নের গতিও দ্বিগুণ হবে। আমি নিজে যে গ্রাম থেকে এসেছি সেখানে মাত্র তিন বছর আগে বিদ্যুৎ এসেছে এবং তারপর গ্রামে জীবনযাত্রার মান বদলে যেতে দেখেছি। এটা এই ফ্যাক্টরীর সম্প্রসারণের সাথে সাথে আরও দ্রুত বিস্তার লাভ করবে।
যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন এই অপারেটরের মাঝে উদ্দেশ্যবোধ কতোটা থাকতে পারে।
কেস-২ঃ উদ্দেশ্যবোধ সনাক্ত সম্ভব যদি বিবেচনা করা যায় কিসের আকর্ষণে প্রতিদিন মানুষ কাজে ছুটে যায়। কোনো এক ক্ষেত্রে, এক ব্যক্তি সকালে ঘুম থেকে ওঠে, কিন্তু তার আলস্য যেন কাটে না। ভাবে আজ ডুব দেবে, অফিসে যাবে না। তারপর ভাবে, না এরি মধ্যে বেশ ক’দিন ক্যাজুয়েল লীভ ভোগ করেছি, সামনে হয়তো আরও কিছুদিন ছুটির প্রয়োজন হবে। নাহ্, তারচেয়ে বরং আজ অফিসে যাই, একদিনের ক্যাজুয়েল ছুটি বাঁচাই। অন্য একটি ক্ষেত্রে, এ ব্যক্তি হয়তো সকালবেলায় জ্বর জ্বর অনুভব করছে, অনেকদিন ছুটিও তার পাওনা আছে, কিন্তু সে ভাবে ‘শরীরের ঐ অবস্থা সত্ত্বেও সে অফিসে যাবে কেননা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাকে করতে হবে।’ সুতরাং স্ত্রীর কাছে জ্বর এর ভাবটা গোপন করে যায় এই ভয়ে যে স্ত্রী যদি তাকে অফিসে যেতে বাধা দেন।
স্পষ্টতঃই এই ব্যক্তির একটি উদ্দেশ্যবোধ আছে। জ্বর আসছে মনে হলেও সেই লোকটির উদ্দেশ্যবোধ তাকে কাজে যেতে অনুপ্রাণিত করছে।
২। সতর্কতাবোধ [Awareness]ঃ উঁচু কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল সতর্কতাবোধ। যেমন কারোর যদি নজরে পড়ে যে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট কোন সুযোগের অপচয় হচ্ছে কিংবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোথাও অনভিপ্রেত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তাহলে সে সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানের কাউকে অবহিত করা জরুরী মনে করে, যার সর্ম্পকে সে জানে যে তার কাছে গেলে এসবের প্রতিকার পাবে। এভাবে অবহিত করার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক সিস্টেম, পদ্ধতি, যোগাযোগের ব্যবস্থা ইত্যাদি যেমন একদিকে অলংঘনীয়ভাবে বিদ্যমান থাকে তেমনি একটা প্রচ্ছন্ন উপলব্ধিও সকলের মাঝে বিরাজ করে যে এগুলো প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের অধীন এবং প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা থাকলে ঐ যোগাযোগ চ্যানেল-এর ব্যতয় ঘটানো যেতে পারে কিংবা সিস্টেম বা পদ্ধতি ভেঙ্গে সুনির্দিষ্ট ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বলা যাবে।
অপরদিকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে কোথায় কি হচ্ছে সেদিকে কারোর কোন ভ্রূক্ষেপ থাকে না। অপচর্চা ও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে; সেগুলো প্রতিরোধ করার জন্য কারোর মাথা ব্যথা নেই। ফলাফল দাঁড়ায়, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট সুযোগ হাতছাড়া হয় এবং কাজও কম হয়। যদি কেউ স্ব-উদ্যোগে প্রকৃত কিংবা সম্ভাব্য অপকর্ম সম্পর্কে রিপোর্ট করে, পাল্টা তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে এবং নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি সুযোগ-এর সুবিধা লাভে ব্যর্থ হয় কিংবা সম্ভাব্য দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোন আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। বাস্তবে দেখা যায়, একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে শীর্ষব্যক্তি সর্বশেষে অবহিত হন।
৩. অধস্তনদের জন্য উৎকণ্ঠা [Responsibility to Employees/Fellows]ঃ জনশক্তির কর্মসম্পাদন ক্ষমতা, সম্ভাবনা এবং অগ্রগতির প্রতি সজাগ ও সচেতন থাকার অর্থে অধস্তনদের জন্য উৎকণ্ঠা, উঁচু কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় উজ্জ্বলতম বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে, ব্যক্তির প্রতি ব্যবস্থাপনার কোন যত্ন নেই, বরং জন্তু বা যন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন আছে। লোকজনদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়ন এর প্রতি ব্যবস্থাপনার কোন আগ্রহই নেই। ফলে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে অধস্তনগন তাদের করণীয় কাজের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দেয় এবং তারা অনুভব করে যে উপরে কেউ আছেন যিনি তাদের ভালমন্দ দেখছেন। আর অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে অধস্তন ব্যক্তি কখনো তার কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দেয় না। সে নিশ্চিত যে তার ঘর নিজেকে সামলাতে হবে। তাই চিন্তায় থাকে কি করা যায়, বস এর কাছ থেকে কখনো কোনো সমর্থন প্রত্যাশা করা যায় না। কার্যকর ইসলামী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে তাই ব্যবস্থাপনাকে অধস্তনদের প্রতি দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে। অধস্তনদের প্রতি দায়িত্ব বলতে কি বুঝায় তা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিম্নোক্ত হাদীস হতে সুস্পষ্ট হয়ঃ
‘‘তারা (অধঃস্তনরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কারো (দীনী) ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকে তা থেকে পরিধান করতে দিবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবে না। আর সেই কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয়, তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে।’’
অন্যদিকে কার্যকর ইসলামী ব্যবস্থাপনায় অধঃস্তনদের দায়িত্ব বলতে কি বুঝায় তাও নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস হতে সুস্পষ্ট হয়ঃ ‘‘একজন অধঃস্তন নিয়োজিত ব্যক্তি (শ্রমিক বা কর্মচারী), তার নিয়োগকর্তার সম্পদের অভিভাবক বা সংরক্ষক।’’
অর্থাৎ কার্যকর ইসলামী ব্যবস্থাপনায় নিয়োগকর্তা অধস্তনদের অধিকার পূরণে যেমন উৎকণ্ঠিত থাকেন তেমনি অধীনস্থ নিয়োজিত যেমন শ্রমিক-কর্মচারীরা নিয়োগকর্তার স্বার্থ সংরক্ষণে সক্রিয়ভাবেই সচেষ্ট থাকে।
৪. শারীরিকভাবে একত্রে কাজ করা [Tem Spirit]ঃ উঁচু কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হল, একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার মধ্যে কাজ চলে। স্মারকপত্র চালাচালি হয়। আনুষ্ঠানিক সভায় সমস্যা সমাধান বা মুকাবিলা করার চাইতে সমস্যাকে এদিক-ওদিক ছুড়ে মারার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে ‘‘দশে মিলি করি কাজ’’ এ নীতির শত্রুর অভাব নেই। কম-বেশী দুঘর্টনা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই ঘটে। কার্যকর প্রতিষ্ঠানে লোকজন একে অপরের সংগে সাক্ষাৎ করে এবং এ দুর্ঘটনায় সৃষ্ট সমস্যা মুকাবিলার জন্য সবাই ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে কাজ করে। অকার্যকর কোন প্রতিষ্ঠানে একে অপরের সংগে ঝগড়া বিবাদ কিংবা শত্রুতা থাকলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দুর্ঘটনাটির সুযোগ নেয়।
ইসলামী ব্যবস্থাপনায় দিনে-রাতে পাঁচবার একত্রে সালাত আদায় করার বিধান পালনের মাধ্যমে শারীরিকভাবে একত্রে কাজ করার এবং বিভিন্ন পদবীতে কর্মরত সবার একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা মালিক যখন শ্রমিক-কর্মচারীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে সালাত আদায় করেন, তখন ইসলামী ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বাস্তবরূপ লাভ করে। এছাড়াও একই পোশাক, একই খাবার ইত্যাদি নীতিমালা কার্যকরী করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলা যায়। যা প্রতিষ্ঠানকে উচ্চ কার্যকারিতা সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর।
৫. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা [Ensuring Justice]ঃ উঁচু কার্যকারিতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিষ্ঠানে রক্ত, বর্ণ, বংশ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল স্তরের জনবলের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ইসলামের নির্দেশনাও তাই। আল্লাহ বলেনঃ ‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ, যদিও এটা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতামাতা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্টতর। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়োনা। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা কর আল্লাহতো তার সম্যক খবর রাখেন।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ ন্যায়বিচার/ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ (Fair dealing)...এর নির্দেশ দেন; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’’
ন্যায়বিচার, উচ্চ-প্রণোদনা বা প্রেষণার অন্যতম উৎস। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক নির্মল সম্পর্কের ও টীম স্পিরিটের একমাত্র ভিত্তি। ন্যায়বিচার সকল নেতৃত্বের চাবিকাঠিও। অন্যদিকে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে স্বজনপ্রীতি বা আঞ্চলিকতা ন্যায়বিচারের স্থলাভিষিক্ত হয়। ন্যায়বিচারের অভাবে উচ্চ মাত্রার উদাসীনতা এবং দুর্বল টীম স্পিরিট প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশইঃ অকার্যকর করে তোলে।
ইসলামী ব্যবস্থাপনা ও হেনরী ফেয়ল (Henry Fayol)-এর ১৪টি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা [Islamic Mgt. and 14 Mgt. principles of Henry Fayol] ঃ
ফরাসী শিল্পপতি হেনরী ফেয়ল ১৮৪১ সালে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৬ সালে ফরাসী ভাষায় ব্যবস্থাপনা নীতিমালার উপর তার ‘Administration Industrially Generale’ বইটি প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে তা ইংরেজিতে অনূদিত হয়। ফেয়ল তার অভিজ্ঞতা থেকে ১৪টি ব্যবস্থা নীতির উল্লেখ করেন। ইসলামী ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিকোণ হতে উক্ত ১৪টি ব্যবস্থা নীতির প্রায়োগিক আলোচনা নিম্নরূপঃ
১. শ্রম বিভাজন (Division of Labour)ঃ শ্রমশক্তি ব্যবহারে বিশেষায়নের নীতি প্রয়োগ করা উচিৎ। যেমন, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে সম্পূর্ণ জামা একজন তৈরি করে না। -একজন শুধু জামা কাটে, একজন মেশিনে সেলাই করে, একজন হাতের কাজ করে। এভাবে ভাগ করে দক্ষতার সাথে কাজ করলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়। বদরের যুদ্ধে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবাদের শ্রম বিভাজন করে তিরন্দাজী, ঘোড় সওয়ারী এবং সম্মুখ যোদ্ধাদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষের বিশাল আয়োজন সত্ত্বেও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শ্রম বিভাজন ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে সহায়তা করেছিল। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘যখন কেউ কোন কাজ সূচারুরূপে সম্পাদন করে আল্লাহ তা ভালবাসেন।’’
শ্রম বিভাজন সূচারুরূপে কার্য সম্পাদনের একমাত্র হাতিয়ার। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘‘সে ব্যক্তির জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে আন্তরিক এবং তার নিয়োগকর্তার অর্পিত দায়িত্ব সূচারুরূপে, নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সাথে সম্পাদন করে।’’
২. ক্ষমতা ও দায়িত্ব (Authority and responsibility)ঃ ক্ষমতা ও দায়িত্ব পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। কোন নির্বাহীকে কোন কাজের দায়িত্ব দিলে, ঐ কাজটি করার জন্য তাকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দিতে হবে। আল্লাহ পৃথিবীর বুকে যত রাসূল বা নবীকে রিসালাত বা নবুওয়তের দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করেছেন তাদের প্রত্যেককেই যুক্তিযুক্ত ক্ষমতাও দিয়েছিলেন।
৩. শৃঙ্খলা (Discipline)ঃ সাফল্যের জন্য শৃঙ্খলা অপরিহার্য। দিনে-রাতে পাঁচবার সালাতে অংশগ্রহণ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে। এ শৃঙ্খলা শুধু পার্থিব জীবনের সফলতা নয়, পারলৌকিক জীবনের সফলতারও চাবিকাঠি। ইসলামী ব্যবস্থাপনায় সালাত আদায় আবশ্যিকভাবেই অপরিহার্য। এছাড়া ইসলামী ব্যবস্থাপনায় রয়েছে আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য। যা প্রতিষ্ঠানে শৃংখলা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
৪. আদেশের ঐক্য (Unity of Command)ঃ প্রতিষ্ঠানের সু-ব্যবস্থাপনার জন্য একজন কর্মীর শুধুমাত্র একজন নির্বাহীর কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়া উচিৎ। দ্বৈত নির্দেশনা কাজে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। ইসলামে আদেশের ঐক্যের এতটাই গুরুত্ব যে, তিনজনের একটি সফর কর্মসূচীতে একজনকে, আদেশের জন্য নির্বাহী বা নেতা মনোনীত করে নিতে তাগিদ দিয়েছেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘কোন সফরে যদি তিনজন ব্যক্তি থাকে তবে তারা যেন তাদের মধ্য হতে একজনকে নির্বাহী নিয়োগ করে’’।
সফর সবসময়ই স্বল্পমেয়াদী। অন্যদিকে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য নিয়ে। কাজেই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার আদেশে ঐক্য একটি অপরিহার্য ইসলামী ব্যবস্থাপনা নীতি।
৫. নির্দেশনার ঐক্য (Unity of direction)ঃ একই উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত একটি শাখার সকল কাজের জন্য একটি পরিকল্পনা এবং এর তত্ত্বাবধানে একজন নির্বাহী থাকবে। চতুর্থ নীতির সাথে এর পার্থক্য হল, চতুর্থ নীতিটি কর্মী সংক্রান্ত, এই নীতিটি প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পর্কিত। সেইসাথে শ্রম বিভাজনের মত একে কর্ম বিভাজন নীতিও বলা যায়। যা একজন নির্বাহীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। যাকাত আদায় ও বন্টন এবং রাষ্টীয় নিরাপত্তা শাখার জন্য দুইজন নির্বাহীর পরিবর্তে একজন হলে তাতে নির্দেশনার ঐক্য বিঘ্নিত হতে পারে।
৬. ব্যক্তির চাইতে সমষ্টির স্বার্থ সংরক্ষণ (Subordination of individuals to General Interests)ঃ সমষ্টির স্বার্থের মাঝেই ব্যক্তির স্বার্থ রয়েছে। ব্যক্তি যখন বুঝবে সমষ্টির স্বার্থ বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং এই স্বার্থ সংরক্ষণে তার নিজেরও স্বার্থ কিছুটা সংরক্ষিত হচ্ছে, তখন সে কাজ গভীর আন্তরিকতার সাথেই করবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি ভালকাজ করে বা নেক আমল করে তা তার নিজের জন্যই। নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাক। তা তোমার পক্ষ থেকে তোমার জন্যই সাদাকা।
৭. পারিশ্রমিক (Remuneration)ঃ পারিশ্রমিক এবং পারিশ্রমিক দেয়ার নিয়ম এমন হওয়া উচিৎ, যাতে কর্মী এবং মালিক সবাই সন্তুষ্ট থাকে। এ প্রসঙ্গে তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করছিঃ
ক. নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘‘ মজুরের মজুরী নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।’’
খ. নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’।
গ. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ উত্থাপন করবেন। তন্মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছেঃ যে ব্যক্তি কাউকে মজুর হিসেবে খাটিয়ে ও তার দ্বারা পূর্ণ কাজ আদায় করা সত্ত্বেও শ্রমিকের মজুরী দেয় না।’’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘‘For your workers there must be satisfaction with their basic requirements. [Shahih Muslim]’’
৮. কেন্দ্রীকরণ (Centralization)ঃ ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ বা বিবেন্দ্রীকরণ ততটুকুই হওয়া উচিৎ, যতটুকু প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক সাফল্যের জন্য দরকার। ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ বা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং যা কার্যকর ব্যবস্থাপনার জন্য বাধা তাহল অধস্তন ও নির্বাহীদের পারস্পরিক আস্থার অভাব, এ বাধাকে জয় করতে হবে। আর ইসলাম পারস্পরিক আস্থার অভাব মিটিয়ে দেয়। তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই Right man in the right place নিশ্চিত করতে হবে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘If you give a job to someone who is not knowledgeable just wait for the destruction’’
৯. ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শৃঙ্খল (Scalar Chain)ঃ প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত নির্বাহীদের পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত হওয়া। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ সম্বন্ধ খুবই কার্যকর। এ সম্বন্ধের অভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ দীর্ঘসূত্রিতায় আক্রান্ত হয়। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ এ সম্বন্ধ সৃষ্টির চাবিকাঠি।
১০. সবকিছু অবস্থানমত থাকা (Order)ঃ লক্ষ্যার্জনে কাজকে সুষ্ঠু গতিতে এগিয়ে নিতে সবকিছু জায়গামত থাকা প্রয়োজন। উহুদের যুদ্ধে পাহাড়ের ফাঁদ পাহারায় থাকতে যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাদের জায়গামত না থাকাতে মুসলিমদের লক্ষ্য পূরণ ব্যাহত হয়েছিল।
১১. সমতা (Equity)ঃ সমতা বা Equity বলতে মালিকপক্ষের নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন ব্যবহার এর মাধ্যমে কর্মীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য এবং নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করা বুঝানো হচ্ছে। সমতা বস্ত্ততঃ ন্যায়বিচার অর্থে। আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ (Fair dealing)...এর নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’’
ইসলামে সমতা বা ন্যায়বিচারকে বলা হয় Hygiene Factor, যা প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিবেশকে সুস্থ রাখে এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে অক্ষুন্ন রাখে।
১২. কর্তৃত্বের স্থায়িত্ব, কাজের স্থায়িত্ব (Stablity of Tenure)ঃ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কর্তৃত্ব ও কর্মীদের কার্যকালের নিরাপত্তা বিধান দরকার। যদি প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন পরপর কর্মী বদল হয়, তবে তা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অপরদিকে প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের প্রতিও বাধা স্বরূপ। ইসলামী ব্যবস্থাপনায় তাকওয়ার গুণ, জনশক্তির মাঝে পারস্পরিক গভীর আস্থার একমাত্র ভিত্তি। তাকওয়ার অধিকারী এবং যোগ্য কর্মীদল গড়ে তোলা সম্ভব হলে ঘন ঘন কর্মী বদলের কোন প্রয়োজন হয় না।
১৩. উদ্যোগ গ্রহণ (Initiative)ঃ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ও পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কর্মীরা যাতে ব্যক্তিক উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত হয়, সেদিকে নির্বাহীর লক্ষ্য রাখা উচিৎ। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘An employee who excels in his devotion to Allah and also renders to his master what is due to him of duty, sincerity and obedience, for him there is double reward with Allah [Al-Bukhari]’’ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘‘Allah loves that when anyone does a job, he does it perfectly. [Al-Bukhari]’’
১৪. একতাই শক্তি (Esprite de Corps)ঃ প্রতিষ্ঠানের সাফল্য যৌথ প্রচেষ্টার উপর নির্ভলশীল; তাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম এমন হতে হবে যাতে কর্মীদের কার্যধারার মধ্যে একতা আনা সম্ভব হয়। ইসলামী ব্যবস্থাপনায় একতা ও শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘যারা ঐক্যবদ্ধভাবে সুদৃঢ় প্রাচীরের মত আল্লাহর পথে [In the way of Allah] সংগ্রাম করে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।’’
১৯১৬ সালে উপস্থাপিত হেনরী ফেয়লের এই নীতিমালাগুলো আধুনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হেনরী ফেয়লের নীতিমালার সাথে ইসলামী ব্যবস্থাপনার সার্বিকভাবে তুলনা, বিপরীতমুখী নয় বরং ইসলামে এসব নীতিমালা ১৪০০ বছর পূর্বেই আলোচিত ও অনুসৃত হয়েছিল।
এছাড়া বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক ও প্রবক্তা বলে খ্যাত ফেডরিক উইনস্লো টেলর ১৯১১ সালে তার বিখ্যাত বই ‘বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতিমালা (The Principles of Scientific Management) প্রকাশ করেন।
ফেডরিক উইনস্লো টেলর, যে মৌলিক নীতিমালা বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর বলে মনে করতেন, তাহলোঃ
1. অনুমানের উপর নির্ভর না করে বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিমালা ব্যবহার করা।
2. দলগত কাজে বিভেদ নয়, একতা।
3. ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশৃংখলার চাইতে দলের সকল সদস্যদের সহযোগিতা অর্জন করা।
4. সীমিত নয় বরং সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করা।
5. শ্রমিকের এবং কোম্পানীর স্বার্থে শ্রমিককে সম্ভাব্য পরিপূর্ণভাবে উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা।
ফেডরিক উইনস্লো টেলর কর্তৃক উপরের যে মৌলিক নীতিমালাগুলো বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কার্যকর বলে মনে করতেন, ১৪০০ বছর পূর্বে ইসলাম বিষয়গুলোকে যেভাবে মূল্যায়ন করেছে তা ব্যবস্থাপকীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নে আলোচনা করা হলঃ
অনুমানের উপর নির্ভর না করে বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিমালা ব্যবহার করাঃ
তথ্যকে যাচাই করে ব্যবহার করার জন্য আল্লাহ, কুরআনের সূরা আল হুজুরাত-এ যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা ব্যবস্থাপকীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করলে ইসলামে বিজ্ঞানভিত্তিক নীতিমালা ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে ১৪০০ বছর আগেই। আল্লাহ বলেন, ‘‘হে মুমিনগণ, যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বস, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।’’
দলগত কাজে বিভেদ নয়, একতা ঃ
দলগত কাজে ইসলাম বিভেদ বর্জন করে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছে। শুধু তাই নয় বিভেদ করলে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে তাও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে।’’
আল্লাহ আরো বলেন, ‘‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’’
ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিশৃংখলার চাইতে দলের সকল সদস্যদের সহযোগিতা অর্জন করাঃ
দলের সকল সদস্যদের সহযোগিতা অর্জন করতে ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধের যে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত ও নির্দেশনা রয়েছে তা যে কোন প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আল্লাহ বলেন, ‘‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন কর .......... ’’
সীমিত নয় বরং সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করাঃ
বস্ত্ততঃ উদ্দেশ্যবোধ বা কমিটমেন্ট হতেই সবের্বাচ্চ প্রণোদনা উৎসারিত। আর সবের্বাচ্চ প্রণোদনাই কেবল সবের্বাচ্চ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে। ইসলাম ১৪০০ বছর পূর্বেই সবের্বাচ্চ প্রণোদনার বিষয়ে ভূমিকা রাখার যে দিক নির্দেশনা দিয়েছে তা এখনও অনন্য।
নবী (সা) বলেন, ‘‘সে ব্যক্তির জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে আন্তরিক এবং তার নিয়োগকর্তার অর্পিত দায়িত্ব সূচারুরূপে, নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সাথে সম্পাদন করে।’’ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘‘যখন কেউ কোন কাজ সূচারুরূপে সম্পাদন করে আল্লাহ তা ভালবাসেন।’’
শ্রমিকের এবং কোম্পানীর স্বার্থে শ্রমিককে সম্ভাব্য পরিপূর্ণভাবে উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করাঃ
শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রর্দশন না করা, মজুরী নিয়ে অবিচার না করা, মৌলিক প্রয়োজন পূরণের মত ন্যূনতম মজুরী দিয়ে সুবিচার করা, ঘাম শুকোনোর আগেই তার মজুরী পরিশোধ করা এবং সাধ্যাতীত কাজের বোঝা তার উপর না চাপানো - কোনো শ্রমিক-কর্মচারীর সাথে যদি এই ব্যবহার করা হয় তবে কার্যতঃ তা শ্রমিককে সম্ভাব্য পরিপূর্ণভাবে উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ারই নামান্তর। আর শ্রমিকদের এসব অধিকার ঘোষিত ও বাস্তবায়িত হয়েছে ১৪০০ বছর পূর্বেই।
আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ (Fair dealing)...এর নির্দেশ দেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।’’ আল্লাহতাআলা আরো বলেন, ‘‘আল্লাহ কারও উপর এমন কোন কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত।’’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার উচিৎ তাকে তাই খাওয়ানো যা সে নিজে খায় এবং তাকে তাই পরানো যা সে নিজে পরে থাকে। আর তাকে এমন কর্মভার দিবে না, যা তার সাধ্যাতীত। যদি কখনো তার উপর অধিক কর্মভার চাপানো হয়, তবে যেন তাকে সাহায্য করে।’’
হেনরী ফেয়লের ব্যবস্থাপনার ১৪টি মূলনীতি এবং ফেডরিক উইনস্লো টেলর প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা নীতিমালার সাথে ইসলামী ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটি ক্ষেত্রে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তা হল হেনরী ফেয়ল ও টেলর তাদের এই নীতিমালা প্রয়োগে নৈতিকতার ভূমিকাকে কোন প্রয়োজনই মনে করেননি। অন্যদিকে ইসলামী ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নৈতিকতাকে এড়িয়ে গেলে তা আর ইসলামী ব্যবস্থাপনাই থাকে না।
ইসলামী ব্যবস্থাপনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যাবলী (Islamic Managemant & Managemant Function)
ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার সকল কাজ : যেমন পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মী সংস্থান, নির্দেশনা, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ, একটি বড় ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমনি প্রয়োজন তেমনি একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যার্জনের জন্যও ব্যবস্থাপনার এ সকল কাজ সম্পাদনের বিকল্প নেই। একজন পরিবার প্রধান যেমন ব্যবস্থাপক তেমনি একজন সরকার প্রধানও এক অর্থে ব্যবস্থাপক। পরিবার প্রধান যদি পরিকল্পিতভাবে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও উপকরণাদির সুষ্ঠু ব্যবহার ব্যবস্থাপনা কার্যাদির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পারেন তবে তার পক্ষে লক্ষ্যার্জন সম্ভব হয়। অন্যদিকে একজন সরকার প্রধানকেও তার জনগণ ও সহায় সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে ব্যবস্থাপনা কার্যাদির সহায়তা নিতে হয়। সকল সমাজেই ব্যবস্থাপনার কাজের ধরন ও প্রকৃতি মোটামুটি একই ধরনের। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিষ্ঠান ও সমাজভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও বিশ্বায়নের এ যুগে ব্যবস্থাপনা ও তার কার্যাদি সার্বজনীনতা লাভ করেছে।
ইসলামী ব্যবস্থাপনায় এই সার্বজনীন কার্যাদির ভূমিকা, ইসলামী নৈতিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। তাই একজন ইসলামী ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিকে ব্যবস্থাপনার সার্বজনীন কার্যাদি যেমন নিশ্চিত করতে হয় তেমনি নিশ্চিত করতে হয় ইসলামী নৈতিকতার মান। প্রসঙ্গতঃ ব্যবস্থাপনা কার্যাদির একটি প্রধানতম কার্য প্রেষণা বা প্রণোদনা নিয়ে কেসস্টাডি ভিত্তিক আলোচনা করা হলঃ
কেসস্টাডি ভিত্তিক প্রধানতম ব্যবস্থাপনা কার্য
প্রেষণা বা উদ্বুদ্ধকরণ ব্যবস্থাপনা কার্যাদির একটি প্রধানতম কার্য। যার সঠিক প্রয়োগ, প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যাজর্নের সহায়ক এবং ভুল প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অন্যান্য সকল কার্যাদি অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশকালে যে কোন ব্যক্তির কার্য সম্পাদনের দু’টি স্তর এর কথা ভাবা যায়।
প্রথমত ঃ কত অল্প কাজে সে সারতে পারে
দ্বিতীয়ত ঃ কতোটা বেশী সে করতে সক্ষম। এই দুটির মাঝের প্রভেদই হল, প্রেষণা বা উদ্বুদ্ধকরণ বা মটিভেশন।
একজন ব্যক্তির সর্বাধিক কর্ম সম্পাদনের বিষয়টি খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। যতোই সে ঐ স্তরে পৌঁছতে যাবে ততোই স্তরটা আরও উপরে চলে যায় আর এভাবেই একজন ম্যানেজারের বিকাশ ঘটে। চিরাচরিত পথে যেভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়, তা হচ্ছে গাজর এবং লাঠি বা টাকা এবং ভয়। আমরা যদি একজন কর্মচারীকে বলি ‘‘আমি চাই আজ বিকেলের মধ্যে এ কাজটি করা হোক, তা না হলে আগামীকাল আর আসবার কথা তুমি ভেবো না’’। প্রচুর সম্ভাবনা থাকে যে, সে কাজটি সেরে রাখবে। সমস্যাটা হল, ধরা যাক সে উল্টো বলছে, ‘‘আমি এ কাজটি আজ বিকেলের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারবো না এবং আগামীকাল আমি আসছি। দেখবো আপনি কি করেন?’’ তাহলে আপনি সমস্যায় পড়ে যাবেন। কেননা ভীতিটা এখন আপনার দিকে। এখন ভয় অনেক কম, ফলে ভয়-ভীতি দ্বারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ বা ম্যানেজ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
ভয়-ভীতি যদি কাজ না করে তবে সাধারণতঃ অর্থের ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ লাঠিতে কাজ না হলে গাজর ব্যবহার করো। কিন্তু অর্থও তার নিজস্ব সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রথম এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো, কতোটা অর্থ পাওয়া যাবে? অর্থ প্রদান করবার সহজতম পন্থা হলো ওভারটাইম দেয়া। কিন্তু একবার যদি কেউ তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তবে সে স্বাভাবিক সময়ে কাজ করতে চাইবে না। কোন একজন শ্রমিক যেমন বলেছিল, ‘সময় মানে অর্থ, কিন্তু ওভারটাইম মানে অধিক অর্থ।’ একজন লোক যত বেশী অর্থ পায় ততো বেশী সে চায়, ফলে ওভারটাইম বাড়তেই থাকে। একদিন হয়ত আপনার বস বলবেন, ‘আপনার ডিপার্টমেন্টে অতিরিক্ত ওভারটাইম হচ্ছে। এটা কমান, একেবারে বাদ দিয়ে দিন। আপনি ডিপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে আপনার লোকজনকে বলবেন, ‘এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। সাথে সাথে তারা জানতে চাইবে কতোটা ওভারটাইম?
আপনি বলবেন, ‘কোনো ওভারটাইম নয়। তারা বলবে, ওভারটাইম নয় মানে? ওভারটাইম ছাড়া কিভাবে কাজটি করা যাবে? তাই ওভারটাইম দ্বারা ম্যানেজ করা মানে নিজের সমস্যা নিজেই সৃষ্টি করা এবং অচিরেই দেখা যাবে ওভারটাইম ছাড়া ম্যানেজই করা যাচ্ছে না। যখন ওভারটাইম পাওয়া যাবে না তখন সকল ব্যবস্থাপনা জানালা দিয়ে পালাবে।
ফলে এটা বুঝা যাচ্ছে যে, অর্থ ও ভয় মানুষ পরিচালনার ক্ষেত্রে বা মটিভেশনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। তাহলে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে ভবিষ্যতে তিনটি উদ্বুদ্ধকরণ উপাদানের কথা ভাবতে হবেঃ
ক) স্বকীয়তাবোধ বা একাত্মতাবোধ।
খ) গুরুত্ববোধ এবং
গ) উন্নয়নবোধ।
ক) স্বকীয়তাবোধ বা একাত্মতাবোধঃ নিজের মনে করাই স্বকীয়তাবোধ। একবার কোনো ব্যক্তি যদি উপলব্ধি করতে পারে যে, প্রতিষ্ঠানটি তার নিজের তাহলে তা ঐ ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় উদ্বুদ্ধকরণের কারণ হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধিই একটি উদ্বুদ্ধকারী শক্তি। স্বকীয়তাবোধের উপলব্ধি মানুষকে জীবন বির্সজন দিতেও উদ্বুদ্ধ করে। সৃষ্টি করে গভীর ঐক্যবোধ। ‘‘আমরা’’ বোধ ‘‘তারা’’ বোধ নয়। একতা, বিভেদ নয়। এভাবে পুরো জনশক্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্যপানে এগিয়ে যায়।
সেনাবাহিনীতে একজন সৈনিক জীবনের ঝুঁকি নেয়। কমান্ডারের নির্দেশ নিয়ে কোন সৈনিক ব্যয় এবং সুবিধা বিশ্লেষণ করে না যে, শক্রর পোস্ট দখল করা এবং একটি মেডেল পাবার চান্স আমার কতটুকু এবং পাশাপাশি কতটুকু চান্স আছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে চিরতরে ধরাশায়ী হবার। সৈনিক তার জীবন বাজী রাখে। এটাই মটিভেশন। সেনাবাহিনীতে এই মটিভেশন তৈরিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। প্রথমতঃ মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সফলতার ধারণা, দ্বিতীয়তঃ দেশপ্রেমের প্রতিদান, তৃতীয়তঃ একই ইউনিফর্ম, চতুর্থতঃ অফিসার-জওয়ান সবাই একই সঙ্গে প্রচুর শারীরিক প্রশিক্ষণ নেয়া, কুচকাওয়াজ, পঞ্চমতঃ শান্তির সময়ে অফিসার-জওয়ান একসাথে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ। এভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে স্বকীয়তাবোধ হয়ে ওঠে জীবন উৎসর্গকারী মটিভেশন। জাপানের শিল্প কারখানায় মটিভেশনের লক্ষ্যে চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সবাই একরকম ইউনিফর্ম পরিধান করে, রং, কাপড়ের মান এক ও অভিন্ন। ফলে দৃষ্টিগত অভিন্নতা সৃষ্টি হয়। সবার মাঝে স্বকীয়তাবোধ তৈরি হয়। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, কোন দেশে এই স্বকীয়তাবোধের অভাব হলে, ‘‘আমরা’’ ধারণার পরিবর্তে ‘‘তারা’’-র ধারণা বিকশিত হলে সে দেশ, সে জাতির দুর্ভাগ্য অনিবার্য।
খ. গুরুত্ববোধঃ কোন প্রতিষ্ঠানের যেখানে প্রত্যেকে ক্ষমতাহীন এবং ক্ষমতাহীনতার ভাবটা বিরাজমান সেখানে প্রেরণা বা অনুপ্রেরণা জাতীয় কিছু আশা করা বৃথা। যেখানে মানুষ উপলব্ধি করে তাদের ক্ষমতা রয়েছে, তারা কিছু করতে পারে, তারা অনুপ্রাণিত হতে পারে। কিছু করতে পারার অবকাশ যে প্রতিষ্ঠানের অধঃস্তনদের মধ্যে রয়েছে তা অবশ্যই কর্তৃপক্ষের গুরুত্বরোধের পরিবেশ তৈরির ফলাফল।
কেসস্টাডিঃ ১
একটি বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘‘তোমার চোখে কোন কিছু খারাপ ঘটে যাচ্ছে দেখলে কি করবে? উত্তরে সে বললো, ‘‘আমার বস এর কাছে গিয়ে বলবো।’’ তারপর তাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হল, ‘‘ধরো যদি তোমার বস না শোনেন? তাহলে আমি তার বস এর কাছে যাব।’’ সোজা উত্তর শ্রমিকটির। তাকে আরো প্রশ্ন করা হলো, ‘যদি তিনিও না শোনেন? ‘তাহলে তো আমাকে তার উপরওয়ালার কাছে যেতে হবে। যদি তিনিও শুনতে না চান তোমার কথা? ধরো এই বসদের মধ্যে কেউই তোমার কথা শুনছেন না, তাহলে? এভাবে প্রশ্ন করার পর শ্রমিকটির সর্বশেষ জবাব দিল ‘‘আমি চেয়ারম্যান এর কাছে যাবো, তিনি শুনবেন।’’ প্রত্যয়দীপ্ত জবাব শ্রমিকটির।
এই যে পরম আস্থা এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকেই সূচিত হয় ক্ষমতাবোধের, যা গুরুত্ববোধেরই ফলাফল। যেখানেই মানুষের মধ্যে এমন ক্ষমতাবোধ কিংবা উপলব্ধি জাগে, বোঝা যাবে সেখানেই তারা উদ্দীপিত এবং লক্ষ্যপানে তারাই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়।
কেসস্টাডিঃ ২
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের একজন চৌকস কর্মকর্তাকে ডেকে তার বস একান্তে নিয়ে বললেন, ‘এ কাজটা আমি অন্য কাউকে দিতে চাই না। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে দিনে চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করতে হলেও তা সম্পন্ন করবে।’ তারপর সফলভাবেই সে কর্মকর্তা তার কাজটি সম্পাদন করেছিলেন।
এ শুধুই গুরুত্ববোধের ফলাফল। তাই গুরুত্ববোধ একটি উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী উপাদান। যা কখনই শাস্তির ভয় বা অর্থের প্রলোভন দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে গুরুত্ববোধের যথেষ্ট ব্যবহার যেন কারো অহংকে অনর্থক উসকে না দেয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবীদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনায় স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় গুরুত্ববোধের মাধ্যমেই উদ্বুদ্ধ করেছেন। অর্থের প্রলোভন তিনি কখনই দেখাননি। আর আল্লাহর শাস্তির ভয়ই শুধু দেখিয়েছেন। অপছন্দনীয় বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে উপেক্ষার নীতিই অনুসরণ করেছেন।
Motivation ব্যবস্থাপনা কর্মকান্ডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক মোটিভেশন ব্যতীত ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কার্যাবলী মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসলামী ব্যবস্থাপনায় ঈমান, তাকওয়া ও তাওবাহ হচ্ছে মোটিভেশনের তিন মূলভিত্তি। ইসলামী ব্যবস্থাপনার সফলতা এই তিন ভিত্তিতে মোটিভেটেড জনবলের উপর নির্ভর করে।

গ. উন্নয়নবোধঃ
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল উন্নয়নবোধ বা প্রবৃদ্ধির উপলব্ধি। যখন কোন শ্রমিক বা কর্মী এ উপলব্ধি করে যে ‘আমি কিছু শিখছি, আমার কর্মদক্ষতা বাড়ছে’’ তখন এই উন্নয়নবোধই তাকে একথা শেখায় যে, এই প্রতিষ্ঠান আমার, আমার প্রবৃদ্ধি এখানেই। আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে যেতে হবে। যতক্ষণ তারা মনে করে যে, তারা কিছু শিখছে, ততক্ষণ তারা অনুপ্রাণিত এবং কাজ করতে প্রস্ত্তত। এর বিপরীত অবস্থা হল, যখনই তারা অনুভব করবে এখানে শেখার কিছুই নাই, শুধু ঘানি টানা, তখন উদ্বুদ্ধহীনতা তাদের পেয়ে বসে।
কেস স্টাডিঃ ১
অফিসের বস তার সহকর্মীকে বলছেন, ‘‘আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে evergreen, যান কাজ করুন। সমস্যায় পড়লে বলবেন।’’
এ ধরনের বসের অধীনে কর্মীর অনুভূতি হচ্ছে ‘আমার বিকাশের সুযোগ হল।’ কর্মী এখানে দারুণ অনুপ্রাণিত।
সাড়ে ছ’ কিংবা আট ঘণ্টা শুধু নয়, দশ এমনকি এগার ঘণ্টা কাজ করতেও কর্মী তখন দ্বিধা করে না।
কেসস্টাডিঃ ২
অফিসের বস তার সহকর্মীকে বলছেন, ‘‘এমন কাজ কি আপনি আগে করেছেন? যদি না করে থাকেন তবে অন্য কাউকে বলছি এটা করার জন্য কিংবা আমি নিজেই করবো।’’ অথবা অফিসের বস তার সহকর্মীকে বলছেন, ‘‘যদিও এমন কাজ আপনি আগে করে থাকেন, তবুও আপনি কাজটা আমার কাছ থেকে বুঝে নেবেন, কোনো চিঠি বাইরে পাঠাবেন না, খসড়া আমাকে দেখাবেন, চিঠিটা আমিই পাঠাবো।’’
এ ধরনের বসের অধীনে কর্মীর অনুভূতি দাঁড়ায়- ‘‘আমি মনে হয় কিছুই শিখিনি দিন দিন আমার পারার ক্ষমতা যেন হ্রাস পাচ্ছে। তখন কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কর্মী। আর সম্ভাব্য সবধরনের ছুটি নিতে আগ্রহী হয়ে উঠে - নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি, অর্ধবেতন ছুটি, সীক লীভ ইত্যাদি।
মানুষকে তার উন্নয়ন বা তার বিকাশে সহযোগিতা করা মানে মানুষকে সম্পদে পরিণত করা। ইসলামী ব্যবস্থাপনার মূল কথাই হচ্ছে মানুষকে সম্পদে পরিণত করা।
যে কোন প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল রাখতে মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা কার্য (Function)। তথ্য প্রযুক্তি ও মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ তার অধিকার নিয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক সচেতন এবং সোচ্চার। ফলে অধঃস্তনকে বরখাস্ত করাটা এখন খুব সহজসাধ্য নয়। অনেক সময় এটা তদারককারী কর্মকর্তার জন্য বুমেরাং হয়ে যায়। এমনি এক অবস্থায় ভয়-ভীতি, মোটিভেশনে কোন অবদান রাখে না। একইভাবে স্বল্পমেয়াদে অর্থের ব্যবহার কাজ করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ মোটিভেশনে চাকুরী হতে বরখাস্তের ভয় [লাঠি] এবং অর্থের প্রভাব [গাজর] বস্ত্ততঃ খুবই সাময়িক ফলাফল দেয়। দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রকৃত উদ্দীপনার সূত্রই হচ্ছেঃ ক. স্বকীয়তাবোধ বা একাত্মতাবোধ খ. গুরুত্ববোধ এবং গ. বিকাশ বা উন্নয়ন বোধ
উদ্দীপনার এই সূত্র বস্ত্তগতে বিদ্যমান যে কোন সূত্রের মতই মানব মনের জগতের জন্য সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য।

প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ব্যবস্থাপনার মৌলিক পার্থক্য [Difference Between Conventional Management & Islamic Management] ঃ

প্রচলিত ব্যবস্থাপনা (Conventional Management)
১. লক্ষ্য অর্জনের পথে নৈতিক মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ নয়। Ends Justifies the means এটাই প্রচলিত ব্যবস্থাপনার মৌলিক দর্শন।
২. মিশন, ভিশন ও কার্যাবলী বাস্তবায়নে নৈতিকতার কোন বাধন নেই।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যার্জনে অমানবিক উপায় অবলম্বন দোষণীয় নয়।
৪. বস্ত্তগত লাভালাভই প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
৫. মানুষকে একটি উৎপাদন বা ব্যবস্থাপনা উপকরণ মাত্র বিবেচনা করা হয়।
৬. সকল আর্থিক লেনদেন সুদভিত্তিক।
৭. ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সামাজিক দায়বদ্ধতার [CSR] ধারণা।
৮. সম্পদের সার্বভৌমত্বের ধারণায় আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে কার্যতঃ প্রত্যাখ্যান করা।
৯. নিরংকুশ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের স্বীকৃতি।
১০. যে কোন পণ্য বা সেবা উৎপাদনে অবাধ স্বাধীনতা এবং তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এখানে মানব কল্যাণ গৌণ বিবেচিত।
১১. সুবিচার নয়, স্বার্থ উদ্ধার।
১২. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপকীয় বস্তবাদী বিশ্লেষণ।
১৩. সাংগঠনিক (organizational) সাংস্কৃতিতে নিরেট বস্ত্তবাদী চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন।
১৪. ব্যবস্থাপনায় নারীদের অবাধ ব্যবহার।
১৫. ব্যবস্থাপনা কার্যে মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে অবজ্ঞা করা।

ইসলামী ব্যবস্থাপনা (Islamic management)
১. লক্ষ্য অর্জনের পদ্ধতি, লক্ষ্য অর্জনের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
২. মিশন ও ভিশন অর্জনে নৈতিক বাধনকে অংগীভূত মনে করা।
৩. কোন যুক্তিতেই লক্ষ্য অর্জনে অমানবিক উপায়কে স্বীকৃতি না দেয়া।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্যর্জনে গৃহীত সিদ্ধান্তে অবিচল অস্থায় নিরলস কাজ করে যাওয়া।
৫. মানুষকে ‘‘আশরাফুল মাখলুকাত’’ বিবেচনায় ব্যবহার করা।
৬. সুদমুক্ত আর্থিক লেনদেন অগ্রাধিকার পাওয়া।
৭. মানুষের কল্যাণে সামাজিক দায়বদ্ধতার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা।
৮. সম্পদ হচ্ছে পরীক্ষা এবং আমানত। সম্পদে আল্লাহরই শুধু সার্বভৌমত্ব এ নীতির প্রতিফলন করা।
৯. বৃহত্তর জনগোষ্ঠির কল্যাণ বিবেচনায় নিরংকুশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের কোন স্বীকৃতি নেই।
১০. মানব হিতকর নয় এমন পণ্য বা সেবার উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় অপারগতা।
১১. সবার জন্য সুবিচারের মাধ্যমে বস্ত্তগত লক্ষ্যার্জন।
১২. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপকীয় বাস্তবতাকে বস্তবাদী ও ইসলামী নৈতিকতা ভিত্তিক বিশ্লেষণ এবং শুরার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
১৩. সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে ইসলামী মূল্যবোধ বা চেতনার প্রতিফলন।
১৪. ব্যবস্থাপনায় নারীদেরকে সুরক্ষিত, নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশে কাজ করার সুযোগ প্রদান ।
১৫. মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সফলতা বিবেচনায় ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা করা।
১৬. চূড়ান্ত প্রচেষ্টাকে নিশ্চিত করার পর আল্লাহর উপর নির্ভরতা।
১৭. উন্নয়নের জন্য নিরবছিন্ন প্রচেষ্টা।
১৮. গুরুতর বা সাধারণ যে কাজই হোক তা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা।
১৯. অনুমান নয়, যাচাইকৃত তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপকীয় কার্য পরিচালনা করা।
২০. পার্থিব জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য এবং অনন্ত জীবনের সফলতা অর্জনই ইসলামী ব্যবস্থাপনার মূল ভিশন।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যবস্থাপনা [Islamic Management In Different Field]ঃ
সামাজিক ক্ষেত্রেঃ
সমাজবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করা মানুষের স্বভাবজাত। মানুষের প্রতি মানুষের মেলামেশার, জানার স্বাভাবিক আকর্ষণ এবং জীবন ধারনের জন্য অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হতেই সামাজিক জীবনের সূচনা। মানবজাতি বা ‘‘আল-ইনসানু’’-এর মূলধাতু ‘‘ইন্সুন’’ মানে মনের আকর্ষণ, ঝোক প্রবণতা, ভালবাসা, মেলামেশা। মানুষের সৃষ্টির মূলেই রয়েছে অন্যের প্রতি আর্কষণ, ভালবাসা আর মেলামেশা। সামাজিক জীবন গড়ার এ হচ্ছে মূল ভিত্তি। সমাজের মানুষগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কগুলো যেন সুন্দর হয়, সুখময় হয়, কল্যাণময় হয়, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এরই লক্ষ্যে আল্লাহতাআলা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালবাসা ও দয়া। আল্লাহ বলেন, ‘‘তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’’

মানুষের সমাজকে লক্ষ্য করেই কুরআনের বিধান নাযিল হয়েছে। যেসব আয়াতে ব্যক্তি গঠন ও ব্যক্তি সংশোধন বিষয়াদির উল্লেখ রয়েছে সেগুলোও মূলতঃ সমাজের উপকারার্থে। সালাত, যাকাত, হজ্জসহ যাবতীয় মৌলিক ইবাদাত যথাযথভাবে সম্পাদন করার জন্য সমাজ জীবনই প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র। ঈমান গ্রহণ করার অর্থ দাড়ায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নেতৃত্ব মেনে নেয়া এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে অঙ্গীকার করা। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন সালাত জামায়াতের সাথেই আদায় করতে হয়। সাওম বা রমাদানের রোযারও রয়েছে এক সামাজিক রূপ। সমাজ থেকে মিথ্যা কথা ও কাজকে বর্জন করার একমাসব্যাপী ঈমানদারদের প্রশিক্ষণ। যাকাত হচ্ছে সমাজের ধনী দরিদ্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিতে এক অনন্য ব্যবস্থা। আর হজ্জের যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করা একার কাজ নয়। আর আল্লাহ হজ্জের জন্য সামর্থ্যবান সকলকেই একযোগে আহবান করেছেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ইসলামের মৌলিক সকল ইবাদাতেরই রয়েছে সামাজিক রূপ।

সামাজিক জীবনে ইসলামী ব্যবস্থাপনার মূলনীতি (Principles of Islamic Management of Social Life) ঃ
১। ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেইঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘আর বৈরাগ্যবাদতো তাদেরই আবিষ্কৃত, আমি তো তাদের এ বিধান দেইনি’’
সামাজিকভাবে মানুষের পুতঃপবিত্র জীবন যাপনের পথ ইসলামে রয়েছে। পবিত্র জীবন যাপনের জন্য বৈরাগ্যবাদ অবলম্বনের প্রয়োজন ইসলামে নেই।
২। ঐক্যবদ্ধ থাকাঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা সবাই একত্রিত হয়ে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’ সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর বিধানকে অাঁকড়ে থাকা এবং বিচ্ছিন্নতার সকল উস্কানীকে এড়িয়ে চলার দীক্ষাই ইসলাম মানুষকে দিয়েছে।
৩। মানব জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে আর বিরত রাখবে মন্দ কাজ থেকে।’’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কল্যাণের জন্যই মুসলিম জাতির উত্থান। আন্তর্জাতিকতার এত উদার ঘোষণা ও দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত ইসলামই মানব জাতির কাছে সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেছে।
৪। দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো
দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আল্লাহ এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি ইয়াতীম ও মিসকীনদের সহায়তায় উৎসাহ দেয় না তাদেরকে দীনের অস্বীকারকারীরূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রচলিত ব্যবস্থাপনায়, ব্যবস্থাপনার সামাজিক দায়িত্ব বা কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি (CSR) হিসেবে যা বিবেচিত, ইসলামে তা দেড় হাজার বছর পূর্বেই প্রত্যেক মানুষের মৌলিক দায়িত্ব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাকে এড়িয়ে গেলে ইসলামকে অস্বীকার করার শামিল গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি কি এমন লোককে দেখেছ, যে দীনকে অস্বীকার করে? সেতো ঐ ব্যক্তি যে ইয়াতীমকে রূঢ়ভাবে তাড়িয়ে দেয়, আর সে মিসকীনদের খাবার দানে মানুষকে উৎসাহিত করে না।’’
৫। সহযোগিতার হাত বাড়ানোঃ
আল্লাহ বলেন, ‘‘প্রত্যেক মুসলিম ভাই ভাই।’’ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘‘তুমি তোমার মু’মিন ভাইকে সাহায্য কর, চাই সে যালিম হোক অথবা হোক মাযলূম।’’ উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম যালিমকে সাহায্য করার তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, যালিমকে যুলুম থেকে বিরত রাখাই তাকে সাহায্য করা।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোন মু’মিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।’’

 

৬। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানোঃ
সকল প্রকার প্রতিবেশীর সাথে সদাচারের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতাআলা। আল্লাহ বলেনঃ ‘‘নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী এবং সাথী-সঙ্গীদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে।’’ আল্লাহ সকল প্রকারের ও সকল পর্যায়ের প্রতিবেশীর সাথে সদাচারের নির্দেশ দিয়েছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া ঈমানের পরিপন্থী কাজ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘ঐ ব্যক্তি ঈমানদার নয় যে, তৃপ্তি সহকারে খানা খায় অথচ তার প্রতিবেশী তার পাশে পড়ে থাকে অভুক্ত অবস্থায়।’’
প্রতিবেশী যে কোন ধর্মের, যে কোন বর্ণের এবং যে কোন আদর্শের অনুসারীই হোক না কেন, সর্বাবস্থায় প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানো এবং তার সাথে সদ্ব্যবহার করার প্রতি ইসলাম প্রত্যেক মু’মিনকে উদ্বুদ্ধ করে। পৃথিবীর সকল মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবীয় আচরণ প্রদর্শন ইসলামেরই শিক্ষা। সকল প্রতিবেশীর প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ ঈমানেরই দাবী।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়। প্রশ্ন করা হল; হে আল্লাহর রাসূল! কে সেই ব্যক্তি? জবাবে তিনি বলেনঃ যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকতে পারে না।’’
৭। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠাঃ
নারীদের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সব ধরনের টিজিং ও হয়রানি থেকে তাদের মুক্ত রাখা নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে জীবন-যাপন করবে।’’ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে উত্তম তারা, যারা নিজেদের স্ত্রীদের নিকট উত্তম।’’
৮। অমুসলিমদের সাথে সহাবস্থানঃ
ইসলামী রাষ্ট্রে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম বা বসবাসকারী নাগরিকদের অধিকার প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘মনে রেখ যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের প্রতি অত্যাচার করে, তাকে কষ্ট দেয়, তার সম্মানহানি করে অথবা তার কোন সম্পদ জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে পক্ষ অবলম্বন করবো।’’ এমনকি কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে যদি তার মুসলিম নাগরিকদের উপর অত্যাচার করে, অবিচার করে তার প্রতিশোধ স্বরূপ কোন ইসলামী রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকের উপর কোন প্রতিশোধ নিতে পারবে না। কোনভাবেই অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার ক্ষু্ণ্ণ করা যাবে না।
৯। আল্লাহ তা‘আলার নিকট চাওয়া
সর্বোপরি সামাজিক সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ রাববুল আ’লামীনের নিকট দু’আ চাইতে হবে। কারণ তিনিই প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য সৃষ্টি করেন। আল্লাহ বলেন, ‘‘তিনি তাদের অন্তরের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের মনে প্রীতি সঞ্চার করতে পারতে না; কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেঃ
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি হবার কারণে এর রয়েছে ব্যাপক পরিধি। অর্থনীতি এর একটি অন্যতম দিক। সুষম সম্পদ বণ্টনকে কেন্দ্র করে বিশ্বে নানা অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আর এ লক্ষ্যে পাশ্চাত্য সভ্যতায় সর্বোচ্চ সম্মানের নিদর্শন হিসেবে নোবেল প্রাইজও দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় যে, পাশ্চাত্য জগত কিংবা সমাজতান্ত্রিক জগত কিন্তু এখনও পর্যন্ত সুষম সম্পদ বণ্টনে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এই অক্ষমতার পেছনে যে কারণ রয়েছে, তা হলো, অর্থনৈতিক তত্ত্ব - শুধু একটি তত্ত্বই। এই তত্ত্বের পেছনে সামাজিক বা রাজনৈতিক মোটিভেশন থাকলেও তা পক্ষপাতদুষ্ট। সেই সাথে তত্ত্ব প্রয়োগের কোন সার্বজনীন প্রয়োগবিধি নেই। মানবীয় সব তত্ত্বেরই এ এক অনিবার্য অক্ষমতা। ফলে পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক উভয় বিশ্বেই অর্থনৈতিক তত্ত্বের সফলতা নিয়ে বির্তক থেকেই যায়।
অন্যদিকে ইসলামী জীবন পদ্ধতিতে অর্থনীতির কিছু মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সম্পদের সুষম বণ্টনে সুস্পষ্ট খাতসহ প্রয়োগ বিধিও বলা আছে। সেই সাথে আছে উচ্চমাত্রার মোটিভেশন। এতে করে ইসলামের অর্থনীতির বাস্তবায়ন অন্যান্য যে কোন তত্ত্বের চেয়ে সহজ এবং মানবিক। তাই ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর হবার পর জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই উন্নত হয়েছিল যে যাকাত গ্রহণের মত মানুষের অভাব পড়ে গিয়েছিল।
অর্থনীতির ইসলামী ব্যবস্থাপনা মূলনীতি (Principles of Islamic Management of Economy)
1. সম্পদ ও ক্ষমতায় আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্য।
2. রক্ত, বর্ণ, গোত্র, বংশ নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্ববোধের মূল্যবোধ চর্চা।
3. ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কর্মসংস্থানের অধিকার সংরক্ষণ।
4. স্বনির্ভরতা অর্জনের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা।
5. ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করণ।
6. অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার স্বাধীনতা নিশ্চিত করণ।
7. যাবতীয় কর্মকান্ডে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন।
8. আয়ের সুষম বণ্টন।
9. আয়-ব্যয়ের ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ।
10. নিষিদ্ধ দ্রব্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের অবৈধতা।
11. সুদ বিবর্জিত ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।
12. আল কারদুল হাসান বা বিশ্বস্ত ঋণ বা আল্লাহকে ঋণ প্রদান। [ক্ষুদ্র ঋণ বা সুদ ভিত্তিক ঋণ নয়।]
13. শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষণ।
14. মজুদদারী ও কালোবাজারীর অবৈধতা।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেঃ
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যবস্থাপনা, পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যকে ঘিরে আবর্তিত। বিষয়টি কুরআনের সূরা তাওবা, সূরা ফাতহ ও সূরা সফে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহতাআলা উল্লেখ করেছেন। সূরা ফাতহ-এ আল্লাহ বলছেন, ‘‘তিনিই তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য জীবন বিধান সহ পাঠিয়েছেন, আর সব জীবন বিধানের উপর একে জয়যুক্ত করার জন্য। আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ঠ।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহতাআলা এই মিশন ও ভিশন দিয়ে রাসূল হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনিত করেছিলেন।
বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে গোটা বিশ্বেই ইসলামের আদর্শিক প্রভাব স্বল্পমাত্রাতে হলেও সক্রিয় রয়েছে। ইসলামের আদর্শিক সৌন্দর্য এখনও বহু নর-নারীকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। সার্বিক বিবেচনায় অন্যান্য সকল জীবন বিধানের উপর ইসলামী জীবন বিধানকে বিজয়ী করার রাজনৈতিক মিশন ও ভিশন ছাড়া মুসলিমদের বিকল্প কিছু করার অবকাশ নেই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সে মিশন ও ভিশনকে অর্জন করতে ব্যবস্থাপনাকেও ইসলামের আঙ্গিকে সাজাতে হবে। সার্বিক অর্থনৈতিক সফলতা, রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন হলেই কেবল সম্ভব হয়। তাই রাজনৈতিক লক্ষ্যার্জন, ইসলামী ব্যবস্থাপনায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
রাজনৈতিক লক্ষ্যার্জনে ইসলামী ব্যবস্থাপনার মূলনীতি (Principles of Islamic Management of Political Aim) ঃ
1. কুরআন, সুন্নাহ এবং সোনালী যুগের ইসলামী রাষ্ট্রের ঘটনা প্রবাহের আলোকে চলমান ঘটনা প্রবাহের হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত পুংখানুপুংখ ও বস্ত্তনিষ্ঠ বিশ্লেষণ।
2. ক্ষুদ্র কিংবা বড়ো পরিসরে আশ শুরার [ক্ষুদ্র কিংবা বড়ো তা নির্ধারণ করবেন যিনি পরামর্শ নিতে চান তিনি] মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
3. গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর অবিচলতা।
4. শুরার অনুমোদিত পন্থায় স্বচ্ছতার সাথে নেতৃত্ব নির্বাচন।
5. যে কোন Conflict ধরনের বা বিরোধ মীমাংসায় কুরআনের সুবিচার সংক্রান্ত নির্দেশকে বিচক্ষণতার সাথে প্রয়োগ করে সুবিচার নিশ্চিত করা।
6. দেশের আর্থ-সামাজিক বিকাশে বিদ্যমান আইনসমূহের পর্যালোচনা ও শরীয়া সম্মত আইন প্রণয়নের জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন সেল প্রতিষ্ঠা করা এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ-র আওতায় আনা।
7. প্রকাশ্য ও গোপন সব ধরনের দাওয়াতী কার্যক্রমকে সর্বস্তরে জনপ্রিয় করে তোলা, শুধু অধঃস্তন দায়িত্বশীলদের জন্য নির্দিষ্ট না করা, গণমানুষের মধ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা, আখিরাতমুখী জীবন গড়া এবং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো।
8. যাকাতভিত্তিক অর্থনীতির সফলতার বাস্তবতা কার্যকরভাবে তুলে ধরতে যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জনশক্তির মাঝে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলা এবং নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতার নিশ্চিত করা। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক তৎপরতা হয়েছে বহুমুখী। এর প্রকারভেদ লক্ষাধিক। এসব অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অধিকাংশই অর্থলগ্নি বা আর্থিক ঋণ নির্ভর। বর্তমান অর্থনৈতিক তৎপরতার এ প্রেক্ষিতে যাকাতের নীতি প্রয়োগের বাস্তবতা নিরূপণ করা একটি গবেষণাপ্রসূত ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ। রাজনৈতিক লক্ষ্যার্জনে যাকাত ভিত্তিক এ অর্থনৈতিক তৎপরতা চালানোর কোন বিকল্প নেই।
9. শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাক্কালে নয়, নিয়মিতভাবে মা-শিশু, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, মাঠে-ময়দানে, রাস্তা-ঘাটে, গরীব কর্মচারীদের মাঝে সমাজ সেবামূলক কাজ পরিচালনা করা। এসব সমাজ সেবামূলক কার্যক্রম গণভিত্তি রচনায় সফল অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
10. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইসলামের পক্ষে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মতামত প্রতিফলন করা এবং সকল ধরনের অনুনমোদিত হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করা।
11. গণমানুষের সমস্যা শুনতে সময় দেয়া।
বাংলাদেশে ইসলামী ব্যবস্থাপনার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা [Problems of Exploring Islamic Mgt. In Bangladesh] ঃ
স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক, HSBC সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু ব্যাংক ইসলামী Mode-এ ব্যাংকিং ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কিন্তু তাতে ইসলামী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবসার যে প্রসার ঘটেছে বাংলাদেশ, ইসলামী ব্যবস্থাপনার প্রসার সেভাবে হয়নি। এর প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সঠিকভাবে চি˝˝ত করার উপরই নির্ভর করে তা অতিক্রমের উপায় উদ্ভাবনের। প্রতিবন্ধকতাগুলো এমনঃ
1. রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রশাসনে ‘ইসলাম অগ্রাধিকার’ এই নীতির অভাব।
2. ইসলামী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণা কর্মের অভাব।
3. প্রচলিত ব্যবস্থাপনা বিশারদদের ‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ে অনুৎসাহ ও অনীহা বা আগ্রহের অভাব।
4. ইসলামী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গবেষণা ভিত্তিক প্রকাশনার অভাব।
5. শিক্ষা কারিকুলামে এ বিষয়ে কোন কোর্স না থাকা।
6. ইসলামী ব্যবস্থাপনার কোন মডেল প্রতিষ্ঠান না থাকা।
7. প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ও ইসলামী ব্যবস্থাপনার মাঝে ঐক্যমত্য ক্ষেত্র চিহ্নিত করার অভাব।
8. ইসলামী ব্যবস্থাপনার সার্বজনীনরূপ ও মানবিক আবেদন উপস্থাপনে পারদর্শিতার অভাব।
9. মুসলিম সমাজে ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’ এই চেতনার অভাব।
10. ইসলামী ব্যবস্থাপনা ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অভাব।
11. ইসলামী ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব।
12. ইসলামী ব্যবস্থাপনা ধারণাকে এগিয়ে নিতে সঠিক নেতৃত্বের অভাব।
13. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
14. ইসলামী ব্যবস্থাপনায় পেশাদারী দক্ষতার অভাব।
15. যোগাযোগ ও তথ্য বিষয়ক সমস্যা।
16. ব্যবস্থাপনা, মালিকানা থেকে পৃথক। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোন উৎপাদন বা ব্যবসায় সম্প্রসারণের কথা কল্পনাও করা যায় না। ব্যবস্থাপনায় স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়ে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগের ফলে সংগঠন ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় নেমে আসে এবং কারবারগুলো অদক্ষ ও অযোগ্য লোকে ভরে যায়।
17. জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনার অভাব।
18. মেধা পাচার।
19. সমন্বয় সমস্যা।
20. ন্যায্য পারিশ্রমিকের অভাব।
বাংলাদেশ ইসলামী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাসমূহের দূরীকরণের উপায় [Remedies]ঃ
1. ইসলামী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশাসনে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি।
2. ইসলামী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা কর্মে স্পন্সর করা।
3. প্রচলিত ব্যবস্থাপনার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশারদের ইসলামী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রণ জানানো।
4. ব্যাপকভাবে ইসলামী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা কর্ম প্রকাশে আগ্রহী উদ্যোক্তার অনুসন্ধান।
5. দেশের শিক্ষা-কারিকুলামে ইসলামী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পর্যাপ্ত কোর্স চালু করা।
6. ইসলামী ব্যাংকগুলোকে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামী ব্যবস্থাপনার মডেল হিসেবে দাঁড় করানো।
7. প্রচলিত ব্যবস্থপনার নৈতিকতা নিরপেক্ষ আধুনিক পদ্ধতিসমূহ ইসলামী ব্যবস্থাপনায় প্রয়োগ করা।
8. ‘‘ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইসলামী ব্যবস্থাপনার সুফল সার্বজনীন’’ - এ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটানো।
৯. ইজম ও বস্ত্তবাদী জীবনের নানামুখী চেতনা নয়, ‘ইসলাম একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’- এ চেতনাতেই ব্যবস্থাপনা মডেল গড়ে তোলা।
10. দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
11. জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা চালু করা।
12. ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করে শ্রমিক-কর্মচারীদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন এবং মেধা পাচার রোধ করা।
13. সুষ্ঠু সমন্বয় নিশ্চিত করা। অবশ্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুষ্ঠু সমন্বয়ের পূর্বশর্ত।
14. ব্যবস্থাপনার অধিকার বা হক হলো দক্ষ ব্যবস্থাপক পাবার আর স্বজনের প্রতি প্রীতি বা হক হলো ব্যক্তিগত আর্থিক অনুগ্রহ পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার।
15. দ্রুত ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার।
উপসংহার [Conclusion]
কুরআনের পথদিশায় জীবনের রয়েছে দ্বি-মাত্রিক ধারণা : ইহজাগতিক ও পারলৌকিক জীবন। কুরআন, জীবনের এই দ্বি-মাত্রিক ধারণাকে গোটা মানব জাতির ক্ষেত্রে অবিভাজ্য মনে করে এবং ধারণাগত বা তত্ত্বগতভাবে নয় প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে মূল্যায়ন করে। তাই ইসলামী ব্যবস্থাপনায় মানব জাতির অবিভাজ্য জীবনের সফলতা খুঁজতে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন ছিলো যিনি ইহজাগতিক ও পারলৌকিক এই উভয় জীবনে প্রায়োগিকভাবে সফল ব্যবস্থাপক একজন মানুষ হিসেবে যোগ্য বিবেচিত হবেন। মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), প্রচলিত ব্যবস্থাপনার ভাষায় তথাকথিত কোন ব্যবস্থাপনা Expert ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘‘The only man in history who was supremely successful on both the religious and secular levels”. ভারতের অবিসংবাদিত নেতা MK Gandhi-র দৃষ্টিতে অবিভাজ্য জীবনের সফলতার লক্ষ্যে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা, শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, গোটা মানব জাতির সম্পদ- ‘‘I have read sir Abdullah Suhrawardy’s collections of the saying of the Prophet with much interest and profit. They are among the treasures of mankind, not merely Muslims” পারলৌকিক ও ইহজাগতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে এমন একজন সফল মানুষের অনুসরণে ইহজাগতিক ও পারলৌকিক, এই দ্বি-মাত্রিক জীবনের ব্যবস্থাপনায় সফলতা আসবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন করা জ্ঞানপাপীর অথবা নিরেট মূর্খতার পরিচায়ক।
Diversified Workforce-এর জন্য Ensuring justice for all, Ensuring Human Rights [সকলের জন্য ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা] এবং Total Quality Management [TQM]-এর বাস্তব অনুশীলনে ইসলামী ব্যবস্থাপনার রয়েছে সমুজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য, রয়েছে অবিভাজ্য জীবনের সফলতার বৈজ্ঞানিক দিক-নির্দেশনা, যা আধুনিক ব্যবস্থাপনারও অপরিহার্য অংগ। Global Village-এর আজকের বিশ্বেও একইভাবে ইসলামী ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিকসহ জীবনের সকল দিকে সফল ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা ধারণা ও নীতির বর্তমান বাস্তবতায় ‘‘ইসলামী ব্যবস্থাপনা’’- ধারণাটি স্থানীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে অনিবার্য সফলতার এক অব্যর্থ অবলম্বন। তবে ইহজাগতিক ও পারলৌকিক জীবনের দ্বি-মাত্রিক ধারণাকে স্বীকার করেই এ সফলতা অর্জন সম্ভব হবে।

 

 


--০--

 

 

 

 

ফুটনোটঃ

 

. সূরা আল বাকারাহঃ ৩৭-৩৮, আল কুরআনুল কারীম, ইফা বাংলাদেশ।
. Mohammad Khalequzzaman, Management, p-5-7/ 2nd Edition t
. Reportedly At-Tabaraani from Ali and Abdullah Ibn Mas’ood
. Islam & Business Page-131 & 187

. জামে আত্-তিরমিযী, হাদীস নং-৯৭৭।
. Dr. Md. Golam Mohiuddin, Basic Management, Page-128

. Dr. Anwar Hossain & Md. Zakir Hossain, Principles of Management, Bangladesh Open Unversity, p-4
. Dr. Anwar Hossain & Md. Zakir Hossain, Principles of Management, Bangladesh Open Unversity, p-5
. শারু এস রাংনেকার, কর্পোরেট ম্যানেজারদের ভুবনে, পৃষ্ঠা-৬৯
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা তা-হা, ২০ঃ ৪২-৪৭।
. ইফাবা গবেষণা-৪২, প্রকাশনা-১৯৭৯/৬, সম্পাদনা পরিষদ সম্পাদিত, জুন ২০০০, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃষ্ঠা-৪৩৯।
. Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-72-73
. Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-78
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা যুখরুফ, ৪৩ঃ ৩২।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল বাকারা, ২ঃ ২৮৬।
. Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-78
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা অঅল বাকারা, ২ঃ ২০১।
. Mohammad Khalequzzaman, Management, 2nd Edition, p-64-69.
. Kathryn M. Bartol & David C. Martin – Management, Mc grawHill Inc., 2nd Ed. p-103
. শারু এস রাংনেকার, কর্পোরেট ম্যানেজারদের ভুবনে, পৃষ্ঠা ঃ ৫৫-৫৬
. সহীহ আল-বুখারী , ২য় খন্ড, পৃ.-৮৯৪
. সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিম
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন্ নিসা, ৪ঃ ১৩৫।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন্ নাহল, ১৬ : ৯০।
. Dr. Anwar Hossain & Md. Zakir Hossain, Principles of Management, Bangladesh Open Unversity, p. 38-39

. বায়হাকী
. সহীহ আল বুখারী
. আবু দাউদ
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল জাসিয়া, ৪৫ঃ ১৫।
. সহীহ আল-বুখারী ও সহী মুসলিম, রিয়াদুস সালেহীন ১ম খন্ড, পৃ.-১১৪
. বায়হাকী, ইসলামের অর্থনীতি, পৃ.-১১৭
. ইবনে মাজা, সূত্রঃ হিদায়া, ৩য় খন্ড, পৃ. ২৯৩
. সহীহ আল বুখারী, হিদায়া, ৩য় খন্ড, পৃ.২৯৩
. Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-73
. Said by Abu Huraira, Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-74
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন্ নাহল, ১৬ঃ ৯০।
. Nik Mohammed Affendi Bin Nik Yusufe, Islam & Business, P-78
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল আনফাল, ০৮ঃ ৪৬।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আস্ সাফফ্, ৬১ঃ ০৪।
. Dr. Anwar Hossain & Md. Zakir Hossain, Principles of Management, Bangladesh Open Unversity, p. 37
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল হুজুরাত্, ৪৯ঃ ০৬।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল আনফাল, ০৮ঃ ৪৬।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল আনফাল, ০৩ঃ ১০৩।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল হুজুরাত্, ৪৯ঃ ১০।
. সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম।
. বায়হাকী।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন্ নাহল, ১৬ঃ ৯০।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল বাকারা, ২ঃ ২৮৬।
. ইফাবা গবেষণা-৪২, প্রকাশনা-১৯৭৯/৬, সম্পাদনা পরিষদ সম্পাদিত, জুন ২০০০, দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, পৃষ্ঠা-৪৩৯।
. Mohammad Khalequzzaman, Management, 2nd Edition, p. 51-56
. শারু এস রাংনেকার, কর্পোরেট ম্যানেজারদের ভুবনে, পৃষ্ঠাঃ ১১৫-১২৭
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আর রুম, ৩০ঃ ২১।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল হাদীদ, ৫৭ঃ ২৭।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আলে ইমরান, ০৩ঃ ১০২।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আলে ইমরান, ০৩ঃ ১১০।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা মাউন, ১০৭ঃ ১-৩।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল হুজুরাত, ৪৯ঃ ১০।
. সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ মুসলিম, সূত্র: মিশকাত, পৃ.৪২২।
. সহীহ মুসলিম, সূত্র: মিশকাত, পৃ.৩২।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন্ নিসা, ০৪ঃ ৩৬।
. সূত্র: মিশকাত।
. বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত, পৃ.৪২৪।
. সূত্র: মিশকাত।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আন-নিসা, ০৪ঃ ১৯।
. জামে আত-তিরমিযী, সূত্র: মিশকাত, পৃ.২৮১।
. কিতাবুল খারাজ, পৃ. ৮২।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা আল আনফাল, ০৮ঃ ৬৩।
. ইসলামিক ফাউন্ডেশান বাংলাদেশ, কুরআনুল করীম, সূরা ফাতাহ, ৪৮ঃ ২৮।
. Michael H. Hart, The 100, A Ranking of The Most Influential Persons In History, pp-33.
. Syed Ashraf Ali, Islam : what others say, pp-96।