ইসরাইল একটি অবৈধ রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের ১৫মে মুসলিম ফিলিস্তিনে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া রূপী ইহুদী ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে ইহুদীরা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিল এবং তাদের কোন সুনির্দিষ্ট জাতীয় বাসস্থান বা দেশ ছিল না। যে দেশে তারা বাস করত, তারা সে দেশেরই নাগরিক ছিল। ইসরাইলের আয়তন ২০,৭৭০ বর্গ কিলোমিটার (৮,০২৯ বর্গমাইল)। এ আয়তনের মধ্যে গাজা, পশ্চিমতীর, গোলান মালভূমি বা অন্য অধিকৃত আরব অঞ্চলগুলিকে ধরা হয়নি। সীমান্তরেখা ১,০০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। ইসরাইলকে ঘিরে আছে মিশর (২২৫ কি.মি), জর্ডন (২৩৮ কি.মি), লেবানন (৭৯ কি মি), সিরিয়া ৭৬ কি. মি), পশ্চিম তীর (৩০৭ কি. মি), গাজা উপত্যকা (৫১ কি. মি)। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর তটরেখা ২৭৩ কি. মি। জনসংখ্যা ৬২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮শত ৮৩ জন। জনসংখ্যা ৮৩ শতাংশ ইহুদী, ১৭ শতাংশ আরব। ইসরাইলের দখলে থাকা বিভিন্ন আরব এলাকার লোকসংখ্যা ইসরাইলের লোকসংখ্যা হিসেবে ধরা হয়েছে। অধিবাসীদের ইসরাইলি বলা হয়। সরকারি ভাষা হিব্রু। শিক্ষার হার ৯৫.১ শতাংশ। পূর্ব রাজধানী তেলআবিব। ১৯৫০ সালে ইসরাইল অধিকৃত আরব অঞ্চলের জেরুসালেমকে রাজধানী বলে ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘের কোন সদস্য তা মেনে নেয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সকল দেশের দূতাবাস তেলআবিব শহরেই আছে। তেলআবিব দেশের প্রধান বন্দর। হাইফা অন্য উল্লেখযোগ্য শহর। ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তে, পশ্চিম এশিয়ার শেষে, ১৯৪৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে গঠিত হয় অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ইসরাইলের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত জর্ডন নদীর পানিতে তার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল খুব উর্বর। দক্ষিণের নেজেভ অঞ্চল যা উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত ইসরাইলের ভূখন্ডের প্রায় অর্ধেক তা অনুর্বর মরু অঞ্চল। ইসরাইলের জাতীয় সেচ প্রকল্প নেজেভ অঞ্চলকে কর্ষণযোগ্য করে তুলছে। 

ইসরাইলের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী রয়েছে। সৈন্য সংখ্যা ১ লাখ ৬৮ হাজার। এর মধ্যে স্থলবাহিনীর সদস্য হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার, নৌবাহিনীর সদস্য ৮ হাজার, বিমান বাহিনীর সদস্য ৩৫ হাজার। তার ওপর তাদের রয়েছে ৪ লাখ ৮ হাজার রিজার্ভ মিলিশিয়া। সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ট্যাংক ৪.৩০০টি, জঙ্গী বিমান ৬১৩টি, যুদ্ধ জাহাজ ১৫টি, সাবমেরিন ৩টি, ২০০টি পারমাণবিক বোমা ও অসংখ্য প্যাট্রিয়টিক মিসাইল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র সাম্রাজ্যবাদীরা কোন মুসলিম দেশকেই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে দেবে না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অথচ ইসরাইলকে তারা করেছে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ। ইসরাইলে এমনভাবে সমরাস্ত্র কারখানাসমূহ গড়ে তোলা হয়েছে যে, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের অন্যতম সমরাস্ত্র ও সামরিক হার্ডওয়ার রফতানীকারক দেশ। ইসরাইলের দৃষ্টিতে সে চারধারে বৈরী প্রতিবেশী যেমন- ইরান, ইরাক , সৌদি আরব, সিরিয়া, জর্ডন, মিশর, আলজেরিয়া, লিবিয়া দ্বারা বেষ্টিত যাদের সম্মিলিত আয়তন ১৭ লাখ ৮৪ হাজার ৫ শত ৯৫ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ২৫ কোটি ৬ লক্ষ ৯৪ হাজার। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২৩ লাখ ৯৬ হাজার ৭ শত। ট্যাংক ১৬ হাজার ৫ শত ৪৭টি। সাবমেরিন ২৫টি। ডেস্ট্রয়ার/ফ্রিগেট ৩১টি। ইসরাইলের মতে তার পাশে যেহেতু বৈরী প্রতিবেশী রয়েছে সে জন্যই সে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। আর এ জন্য করতে হচ্ছে বিপুল অংকের বরাদ্দ। ২০০১ সালে ১০০টি দেশের বিবেচনায় ইসরাইল বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাশিয়াতে ইহুদী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় এবং ১৮৯৫ সালে এর গোড়াপত্তন ঘটে। উক্ত আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ‘ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও স্বীকৃতির ভিত্তিতে একটি স্থায়ী আবাসস্থান প্রতিষ্ঠা করা।’ ১৮৯৭ সালে ইহুদীদের প্রথম জাতীয়তাবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্ব ইহুদী কংগ্রেস সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ইহুদীদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৫০ জন ইহুদী পন্ডিত, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ অংশ নেন। অতঃপর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভিয়েনাবাসী ইহুদী নেতা, দার্শনিক ও সাংবাদিক থিউডর হারজেল (Theodor Herzel) একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন এবং তা হতেই আধুনিক কালের ইহুদী জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি হয়।
ইহুদী বিশ্বসংস্থা গঠন
ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কল্পনাকে বাস্তব রূপ দান করার জন্য ১৮৯৭ সালে থিউডর হারজেল বুদাপেষ্টে আন্তর্জাতিক ইহুদী আন্দোলনের (International zionism movement) জন্য একটি বিশ্বসংস্থা গঠন করেন। ফিলিস্তিনের মালিক উসমানীয় তুর্কী সালতানাতকে হারজেল স্বপক্ষে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ১৯০৪ সালে হারজেল মারা যান। ১৯০৫ সালে বৃটেন ইহুদীদেরকে তার আফ্রিকান উপনিবেশ উগান্ডা দিতে সম্মত হয়; কিন্তু ঐতিহাসিক ও ভাবাবেগগত কারণে ইহুদী কংগ্রেসের ফিলিস্তিনের প্রতি আকর্ষণ থাকায় তারা এ দান প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে আন্তর্জাতিক ইহুদী আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে। ইহুদীগণ ক্ষুদ্র আকারে ফিলিস্তিনে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করার অল্প পরেই শুরু হয় প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদী নেতা ও বিজ্ঞানী ডঃ চেইম ওয়েইজম্যান (Chaim Weizmann) ফিলিস্তিনে ইহুদীদের বসবাস করার অনুমতি লাভের বিনিময়ে ইহুদীদের কাছ থেকে মিত্র শক্তির গৃহীত ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দিতে তথা মওকুফ করে দিতে স্বীকৃত হন।
বেলফোর ঘোষণা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ ও মার্কিন সরকার ফিলিস্তিনে স্বতন্ত্র আবাসভূমির প্রশ্নে ইহুদীদের দাবীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ভ আর্থার বেলফোর (A.J. Balfour) ঘোষণা করেন যে, ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসস্থল স্থাপনে ইংরেজ সরকারের সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে এবং এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইংরেজ সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। এটিই বেলফোর ঘোষণা (Balfour Declaration) নামে খ্যাত। এ ঘোষণা বা অঙ্গীকারটি ইংরেজ ইহুদীদের নেতা ও জায়নিষ্ট সংস্থার পৃষ্ঠপোষক লর্ড জেমস রথচাইন্ডের প্রতি লিখিত হয়েছিল। এই ঘোষণার ভাষ্য ছিল সংক্ষিপ্ত, সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। এ ঘোষণার ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
২ নভেম্বর ১৯১৭
প্রিয় লর্ড জেমস রথচাইল্ড,
‘মহামান্য সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদী জাতির একটি জাতীয় স্বদেশভূমি (National Homeland) সৃষ্টির বিষয়টি সহানুভূতির সাথে দেখছে। এই লক্ষ্য অর্জনের ব্যবস্থা গ্রহণে সে তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। স্পষ্টত এ ঘোষণা ফিলিস্তিনে বিদ্যমান ইহুদী সম্প্রদায়গুলোর নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের বিরুদ্ধে কোন পক্ষপাতিত্ব করছে না। অনুরূপভাবে এটি অন্যান্য দেশে ইহুদীরা যে আইনগত ও রাজনৈতিক অবস্থায় আছে তার ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব যদি দয়া করে এ ঘোষণাটি জায়নিস্ট ফেডারেশনকে জানিয়ে দেন।
আপনার বিশ্বস্ত
আর্থার জেমস বেলফোর।
বৃটেন ছিল তদানীন্তন বিশ্ব পরাশক্তি। বৃটিশ সাম্রাজ্যে তখন নাকি সূর্য অস্ত যেতনা। ইহুদীরা তাই বিশাল বৃটিশ সাম্রাজ্যের দ্বারস্থ হয়। বৃটেন ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বেলফোর ঘোষণা দ্বারা ফিলিস্তিনে ইহুদীদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে বলে ইহুদী মহলে বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। বৃটেন ইহুদী সংঘের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ড বেলফোর ঘোষণাকে অভিনন্দিত করেন। প্রকৃতপক্ষে অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে ইহুদীদের সমর্থন লাভ ও মুসলিম ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে বেলফোর ঘোষণা রচিত হয়েছিল। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ (১৯১৬-১৯২১) এ ঘোষণাকে ইহুদীদের জন্য বৃটিশের একটি পুরস্কার বলে অভিহিত করেন। ফিলিস্তিন সমস্যা তথা মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য দলিল। লঘুচিত্তে এ ঘোষণা করা হয়নি। এ ঘোষণার পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল। যেমন-
১. রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর বৈপ্লবিক সরকার ‘বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হতে সরে দাঁড়াবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এ ইচ্ছা কার্যে পরিণত হলে পূর্ব ফ্রন্টে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক জার্মান সৈন্য পশ্চিম ফ্রন্টে নিয়োজিত হতে পারত। এর ফলে ফরাসি সীমান্তে মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ সম্ভাবনা দূর করার জন্য যে কোন উপায়ে আরও কিছু দিন রাশিয়াকে যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখার নীতি গৃহীত হয়। বলশেভিক বিপ্লবে রাশিয়ার ইহুদীগণ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের মধ্যেও বেশ কিছুসংখ্যক ইহুদী ছিল। মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে, ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নেতৃস্থানীয় বলশেভিক ইহুদীদের সন্তুষ্ট করতে পারলে তাদের সহায়তায় রাশিয়াকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর নেতৃত্বাধীন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত রাখা যাবে।
২. ১৯১৭ সালের এপ্রিলের ৬ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মানীর বেপরোয়া ডুবো জাহাজ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও সীমিতভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করেনি। এই অবস্থায় মিত্রশক্তিবর্গ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকতর অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (১৯১৩-১৯২১ কার্যকাল) সহ মার্কিন প্রশাসনের উপর ইহুদী বুদ্ধিজীবি ও ধনী-বণিকদের প্রভাব সম্বন্ধে সকলেই জ্ঞাত ছিলেন। বেলফোর ঘোষণার একটি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদীদের সহানুভূতি লাভ করে তাদের মাধ্যমে মার্কিন সরকারকে পূর্ণভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করানো সম্ভব হবে বলে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন।
৩. রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ হতে যে হারে ইহুদীগণ পাশ্চত্যদেশ সমূহে আগমন করছিল তা এ সমস্ত দেশের সরকার খুব প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। ইহুদী অভিবাসীদের ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে এই কষ্টকর দায়িত্ব হতে মুক্ত হওয়া যাবে বলে তারা মনে করেছিলেন।
৪. বেলফোর ঘোষণার পশ্চাতে নির্যাতিত ইহুদীদের প্রতি মানবিক সহানুভূতি ক্রিয়াশীল ছিল বলে দাবী করা হয়। মধ্যযুগ হতে আধুনিক যুগ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের হস্তেই ইহুদীরা নির্যাতিত হয়েছে বলে ইহুদীদের ভবিষ্যত নিরাপদ করা নিজেদের দায়িত্ব বলে খ্রিস্টান নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন।
৫. বেলফোর ঘোষণার পশ্চাতে বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থও লুকায়িত ছিল। সুয়েজখাল ও পার্শ্ববর্তী এলাকা বৃটিশ সাম্রাজ্যের জন্য এত প্রয়োজনীয় ছিল যে, এর নিরাপত্তার জন্য যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বৃটিশ সরকার প্রস্ত্তত ছিল। আরবদের উপর তারা আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন ইহুদীদের যদি কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে এই এলাকায় তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে তারা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রতিভূ হিসাবে কাজ করবে বলে তাদের ধারণা হয়েছিলো।
বেলফোর ঘোষণা শুধু ফিলিস্তিন সমস্যার ইতিহাসে নয় পরবর্তী সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘোষণা জায়নবাদীদের এক বিরাট বিজয়। এরপর জায়নবাদীদের লক্ষ্য হয় :

ক. অন্য মিত্র শক্তি কর্তৃক বেলফোর ঘোষণা অনুমোদন,
খ. সাইকস-পিকো চুক্তিতে ফিলিস্তিনে যে আন্তর্জাতিক প্রশাসন প্রবর্তিত হওয়ার কথা ছিল তার পরিবর্তে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি শাসন চালু করা।
প্রথম লক্ষ্য সহজেই অর্জিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি ঘোষণাটি অনুমোদন করে। দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের পথে একমাত্র ফরাসী সরকার প্রতিবন্ধকা সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু ফরাসী জায়নবাদীগণ তাদের সরকারের উপর যথেষ্ট পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় সম্ভাব্য ফরাসী বিরোধিতা দূরীভূত হয় এবং স্যানারোমা সম্মেলনে ব্রিটেনকে ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেটরী শাসন কর্তৃত্ব প্রদান, ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইহুদী এজেন্সীর (Jewish Agency) সহযোগিতায় কাজ করবে বলে ফ্রান্স একমত হয়।
তবে ফিলিস্তিন সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের সুস্পষ্ট নীতির অভাব ছিল। বেলফোর ঘোষণার অস্পষ্টতা ছাড়াও ইহুদীদের আবাসভূমির পরিধি সম্বন্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কোন ধারণা ছিল না। জায়নবাদীদের দাবী যে ফিলিস্তিনের সীমানার বাইরে পরিব্যাপ্ত ছিল সে সম্বন্ধে অনেকেই ওয়াকিফহাল ছিলেন না। ১৯১৯ সালে প্যারিস সম্মেলনে জায়নবাদীগণ যে স্মারকলিপি পেশ করেন তাতে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের পূর্ণ সীমানা বিস্তারিতভাবে দেয়া হয়। এই সীমানার মধ্যে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শাসনাধীন সমগ্র ফিলিস্তিন ছাড়া-
ক. হারমন পর্বতে জর্ডন নদীর উৎপত্তিস্থল এবং লিতানী নদীর দক্ষিণ অংশসহ দক্ষিণ লেবানন;
খ. ইয়ারমুক নদী, কানেতরা শহর ও গোলান উচ্চভূমিসহ দক্ষিণ-পশ্চিম সিরিয়া;
গ. জর্ডন উপত্যকা, ডেডসী এবং আম্মানের পশ্চিম অঞ্চল হতে আকাবা পর্যন্ত ভূভাগ এবং
ঘ. আল আরিশ হতে আকাবা উপসাগর পর্যন্ত এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বৃটিশ শাসনে ইহুদীদের সুযোগ : ১৯১৭ সালে জেরুসালেম বৃটিশের দখলে চলে যায়। বৃটিশ ছত্রছায়ায় এ সময় ফিলিস্তিনে বিপুলভাবে ইহুদী আগমন শুরু হয়। ১৮৯৫ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল ৪৭০০০। তখন মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫৩ হাজার। ১৯১৯ সাল নাগাদ ইহুদীদের সংখ্যা ৫৮ হাজারে উন্নীত হয়।

ম্যান্ডেট শাসনামলে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমণ ও আরবদের অসন্তোষ : বৃটিশ ম্যান্ডেট শাসনাধীন আসার পর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে এসে ভিড় জমাতে থাকে। বৃটেন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেখানে ইহুদীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। তাদের জমি কেনার অধিকার দেয়া হয়। ফলে দ্রুত ইহুদী সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম সংঘবদ্ধ আগমন (আলিয়া) ম্যান্ডেটরি শাসনের পূর্বে ঘটলেও বাকি চারটি আলিয়া বৃটিশ শাসনামলেই ঘটে ও শেষ আলিয়াতেই সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক ইহুদী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। নিম্নের পরিসংখ্যান হতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে ।

আলিয়া বৎসর আগত ইহুদী
প্রথম ১৮৮২-১৯০৩ ৩০,০০০
দ্বিতীয় ১৯০৪-১৯১৪ ৪০,০০০
তৃতীয় ১৯১৫-১৯২৩ ৩৫,০০০
চতুর্থ ১৯২৪-১৯৩১ ৮২,০০০
পঞ্চম ১৯৩২-১৯৪৮ ৩,০০,০০

বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনের অর্থনীতিতে বহিরাগত ইহুদীদের নিয়ন্ত্রনাধিকার দিয়ে আইন প্রণয়ন করে। ধনী, শিক্ষিত, ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রতিভাবান ইহুদীদের প্রভাবের মুখে গরীব ফিলিস্তিনী মুসলিমরা ক্রমে তাদের জমি ও ব্যবসা সম্পত্তি হারিয়ে নিজ বাসভূমেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে। বিত্তবান ইহুদীরা দরিদ্র ফিলিস্তিনীদের ভূমি ক্রয় করে তাদেরকে সর্বহারায় পরিণত করে। এভাবে ইহুদীদের আগমন ফিলিস্তিনী আরবদের স্বার্থহানি ঘটায়। এতদ্ব্যতীত ফিলিস্তিনে ইহুদী প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও শোকের দেওয়াল (Wailing wall) বলে তীর্থ স্থানটি ইহুদীরা দখল করে নেয়। এটি মুসলিমদেরও পবিত্র ধর্মীয় স্থান ছিল। ইহুদীরা তেলআবিব শহর ও হাইফায় বন্দর নির্মাণ করে। আন্তর্জাতিক ইহুদী কংগ্রেসের সভাপতি নাহুম গোল্ডম্যান ঘোষণা করেন যে, বৃটেন যদি ফিলিস্তিনের শতকরা ৬৫ ভাগ এলাকায় আমাদের জন্য একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয় তাহলে আমরা ফিলিস্তিনে বৃটেনের নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর জন্য ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ করে দিতে রাজী আছি। এসব কারণ এবং বৃটিশ ভেদ নীতির ফলে ফিলিস্তিনী মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। অপমানিত ও বঞ্চিত ফিলিস্তিনী নাগরিকরা এ অন্যায়, অবৈধ ও অপমানাত্মক পরিস্থিতির প্রতিকার প্রার্থনা করে লীগ অব নেশনসের কাছে আর্জি পেশ করে। এ অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার জন্য ফিলিস্তিনীরা বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের আশ্রয় নেয়। বৃটিশ বাহিনী তা নৃশংস ভাবে প্রতিহত করে। বৃটিশ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনীরা ১৯২০, ১৯২৮, ১৯২৯ সালে বিদ্রোহ করে। এ সময় মুসলিম-ইহুদী দাঙ্গাও দেখা দেয়। ১৯৩০ সালে শোকের দেওয়ালকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনী আরব ও ইহুদী দাঙ্গা শুরু হয়। বৃটিশরা ইহুদীদের পক্ষ নেয়। ফিলিস্তিনে অবস্থানরত বৃটিশ সৈন্য বাহিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে জরুরী আইন প্রয়োগ করে। সমগ্র ফিলিস্তিনকে তারা বন্দীশিবিরে পরিণত করে। ১৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা, ৩০ হাজারেরও বেশি আহত এবং ১ লক্ষ ফিলিস্তিনীকে কারাগারে অথবা নির্যাতন শিবিরে প্রেরণ করে। তবুও সংঘাত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ১৯৩০ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা যুদ্ধের পূর্বেকার সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলে ফিলিস্তিনী আরবগণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

ইহুদীদের জন্য রুশ কমিউনিস্টদের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা : ক্রেমলিন ১৯২০ সালে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট গেরিলা নেতা ভ্লাদিমির গাব্রটস্কীকে ফিলিস্তিনে পাঠায় ইহুদী যুবকদের ট্রেনিং এর দায়িত্ব দিয়ে। রাশিয়া এ সময় ইহুদীদের অর্থনৈতিক সহযোগিতাও প্রদান করে। ইহুদীদের প্রাপ্ত অর্থের ৪০ ভাগেরই যোগানদার ছিল রাশিয়া। এছাড়া ফিলিস্তিনে মস্কো প্রেরিত প্রতিনিধিদল কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফিলিস্তিনে রুশ ইহুদীদের জন্য জমি কিনে। ১৯২১-৩৯ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে আমদানী হওয়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ ইহুদীর মধ্যে রাশিয়া থেকে আসা ইহুদীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার।

বৃটিশ সরকার কর্তৃক ইহুদী পুনর্বাসন স্থগিত করণ ও সিম্পসন কমিশন গঠন : ১৯৩০ সালে ওয়ার্লড জায়নিষ্ট অর্গানাইজেশন ও ফিলিস্তিন ইহুদী এজেন্সী এ দু’টি ইহুদী সহায়ক সংস্থার সাথে বৃটিশ সরকারের মতবিরোধ দেখা দিলে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদীদের পুনর্বাসন সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে স্যার জন হোপ সিম্পসনের নেতৃত্বে একটি কমিশন নিয়োগ করে। এ কমিশনকে ফিলিস্তিনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট পেশের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিত্তশালী ও স্বার্থ-বুদ্ধিসম্পন্ন ইহুদীদের সাথে প্রতিযোগিতায় ফিলিস্তিনীরা যে স্বভাবতঃই হেরে যাচ্ছে একথা রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিভাবে ফিলিস্তিনীরা উৎখাত হয়েছে তাও রিপোর্টে উল্লেখিত ছিল। ইহুদী ও ফিলিস্তিনী আরব নেতৃবর্গের সাথে সংযুক্তভাবে বৃটিশ সরকার কোন আপোষ মীমাংসায় উপনীত হতে পারলেই আরব-ইহুদী সংঘর্ষের অবসান হতে পারে এ অভিমতও রিপোর্টে ব্যক্ত করা হয়। এ কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিন নীতির কতক পরিবর্তন সাধন করে।
আন্তর্জাতিক ইহুদী আন্দোলনের নেতৃবর্গের সাথে বৃটিশ মনোমানিল্য ও বৃটিশ সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ : সিম্পসন কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিন নীতিতে কিছু পরিবর্তন সাধন করলে বিশ্ব ইহুদী সংস্থা এর নিন্দা করে। ইহুদী নিয়ন্ত্রিত গণ-মাধ্যমসমূহে বৃটিশ নীতির নিন্দার ঝড় উঠে। ডঃ ওয়েইজম্যান এর প্রতিবাদে বিশ্ব ইহুদী সংস্থার সভাপতি পদত্যাগ করেন এবং বৃটিশ সরকারের ফিলিস্তিন নীতিকে ইহুদীদের স্বার্থবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে অভিযোগ করেন। বৃটিশ সরকার ইহুদীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকা করেছে এ কথাও বলা হয়। এ সময় বৃটেনের শ্রমিক দলীয় প্রধানমন্ত্রী র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ড (১৯২৯-৩৫) তাঁর সরকারের ফিলিস্তিন নীতির ৩টি মূল সূত্র স্পষ্টভাবে ইহুদীদের জানিয়ে দেন। এ ৩টি মূল সূত্র হচ্ছে :
১. বৃটিশ সরকারের ফিলিস্তিন নীতির প্রথম সূত্র হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের বসবাসের সুযোগ দেয়া, ফিলিস্তিনকে ইহুদী স্থানে পরিণত করা নয়।
২. সংখ্যাগুরু আরবদের স্বার্থ রক্ষাও সরকারের কর্তব্য।
৩. ক্রমান্বয়ে ম্যান্ডেট দেশ ফিলিস্তিনকে স্বায়ত্বশাসনের উপযোগী করে তোলাও বৃটিশ সরকারের উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব।

বৃটিশ সরকারের নীতি পরিবর্তন : জার্মানীতে হিটলারের উত্থানে বৃটিশ সরকারের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে পরবর্তী রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী স্টানলি বলডুইন (১৯৩৫-৩৭) এর আমলে ইহুদীদের সাথে আবার সম্পর্কের উন্নতি ঘটে।

১৯৩৫-৩৬ সালে ফিলিস্তিনে দলে দলে ইহুদীদের আগমন : ইতোমধ্যে জার্মানীতে হিটলারের (১৮৮৯-১৯৪৫) ক্ষমতা লাভের পর ইহুদী দলন শুরু হয় এবং ইহুদীরা দলে দলে জার্মানী থেকে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ইহুদী আগমনের সংখ্যা ১৯৩২ সালে বাৎসরিক ৯ হাজার হতে ১৯৩৫ সালে ৬০ হাজারে পরিণত হয়। জার্মানীতে ৬ লক্ষ ইহুদী বাস করত। ইহুদীরা মিত্র শক্তির পক্ষে তাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করলে হিটলার বহু ইহুদীকে বন্দী করেন, বহু নিহত হয় বাকীরা পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে পালিয়ে যায়। শেষ তক তারা ফিলিস্তিনে গিয়ে হাজির হয়। ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা অসাধারণভাবে বেড়ে গেলে ফিলিস্তিনী আরব নেতৃবর্গ প্রমাদ গুণে। ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা যুদ্ধের পূর্বেকার সংখ্যার তুলনায় প্রায় চতুর্গুণে দাঁড়ায়।

১৯৩৬ সালের ফিলিস্তিনী-ইহুদী সংঘর্ষ : ১৯৩৬ সালে ফিলিস্তিনীদের মাতৃভূমি রক্ষার প্রয়াস, ইহুদীবাদ বা ইহুদী পুর্নবাসন আন্দোলন ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ এ তিন দ্বন্দ্ব শুরু হলে ফিলিস্তিনীরা আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ করে। এর আগে ১৯৩৫ সালে যৌথভাবে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের মারফত ফিলিস্তিনে আরব ও ইহুদীদের নিয়ে একটি আইন সভা গঠনের প্রস্তাব ইহুদী নেতাদের বিরোধিতায় বাতিল হয়ে যায়। ফিলিস্তিনীগণ ইহুদীদের নিকট জমি বিক্রয় নিষিদ্ধ করন, ফিলিস্তিনে ইহুদীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করন এবং ফিলিস্তিনে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি দাবী বৃটিশ সরকারের নিকট পেশ করে। কিন্তু বৃটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী এ সকল দাবী মেনে নিতে অস্বীকার করে ইহুদীদের পক্ষাবলম্বন করলে ব্যাপক ইহুদী বিরোধী সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতির চাপে পড়ে বৃটিশ সরকার একটি কমিশন গঠন করে।

পীল কমিশনঃ ফিলিস্তিনে উদ্ভুত পরিস্থিতির মীমাংসার জন্যে ১৯৩৭ সালে একটি রাজকীয় কমিশন গঠিত হয়। এ কমিশনের উপর ফিলিস্তিনী-ইহুদী দ্বন্দ্বের সম্পূর্ণ তথ্যাদি সংগ্রহ করা ও তদনুযায়ী সুপারিশ করার ভার দেয়া হয়। আর্ল পীল ছিলেন এ কমিশনের সভাপতি। তাই এটি পীল কমিশন নামে পরিচিত। পীল কমিশনের রিপোর্টে ফিলিস্তিনকে তিন ভাগে ভাগ করার পরিকল্পনা পেশ করা হয়। প্রথমতঃ ইহুদীদের জন্য একটি ইহুদী রাষ্ট্র গঠিত হবে। দ্বিতীয়তঃ জেরুসালেম, বেথেলহাম প্রভৃতি পবিত্রস্থান ইংরেজদের ম্যান্ডেট শাসনের অধীনে থাকবে এবং নেজারেথ ও গ্যালিলির উপর ইংরেজ প্রভুত্ব কায়েম হবে। তৃতীয়তঃ ফিলিস্তিনের অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন আরব রাষ্ট্র গঠিত হবে। এ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনে দ্বন্দ্বমান কোন পক্ষই সমর্থন করেনি। ক্রমেই আরব-ইহুদী বিবাদ তীব্র হয়ে উঠে।

দ্বিতীয় কমিশন ও লন্ডন বৈঠক : পীল কমিশনের ব্যর্থতার পর ১৯৩৮ সালে বৃটিশ সরকার দ্বিতীয় একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশনের সুপারিশ ক্রমে ফিলিস্তিন বিভাগের পরিকল্পনা পরিত্যাক্ত হয় এবং ইহুদী ও ফিলিস্তিনী প্রতিনিধিবর্গকে ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে লন্ডনে এক বৈঠকে আহবান করা হয়। কিন্তু তারা একত্রে বসতে অসম্মত হলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন (১৯৩৭-১৯৪০) তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে নিজ নিজ অভিযোগ বৃটিশ পক্ষকে জানাতে বলেন হয়। যদি আপোষ মীমাংসা সম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে উভয় পক্ষকে নিয়ে যুগ্ম বৈঠক বসবে বলে স্থির করা হয়। কিন্তু এবারও কোন মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব হল না।

সমস্যা সমাধানের বৃটিশের নিজস্ব প্রয়াস : পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে বৃটিশ সরকার একটি আপোষ মীমাংসার পরিকল্পনা কার্যকর করে। পরবর্তী ৫ বছরের জন্য বৎসরে ১০ হাজারের বেশি ইহুদী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে পারবে না বলে একটি নীতি গৃহীত হয়। কঠোর সামরিক প্রহরার দ্বারা শান্তি রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এর অব্যবহিত পরেই বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আরব-ইহুদী প্রশ্নের কোন স্থায়ী মীমাংসা সম্ভব হল না। বিশেষ করে এসময় ইহুদীরা বৃটেনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ইহুদী-মার্কিন ষড়যন্ত্র : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই মধ্য প্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের পথ খুঁজছিল। ১৯৪২ সালে ডঃ ওয়েইজম্যান সহ কয়েকজন ইহুদী নেতার উদ্যোগে নিউইয়র্কের ইহুদী সম্মেলনে ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯৪৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইহুদী সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারী এস, ট্রুম্যানের (১৯৪৫-১৯৫৩) উপর চাপ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রেঃ ট্রুম্যান ১ লক্ষ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে গ্রহণ করতে বৃটেনের উপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু আরব অসন্তোষের ভয়ে বৃটিশ প্রধামন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী (১৯৪৫-১৯৫০) তাতে সম্মত হননি। যুদ্ধোত্তরকালে ইহুদীদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব বৃটেন হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। তাই এ সময় মধ্যপ্রাচ্য সমস্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। বৃটেন যখন ফিলিস্তিন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলাপ আলোচনা করছে ঠিক সে সময়ই হঠাৎ প্রেঃ ট্রুম্যান ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। এভাবে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা মার্কিন সমর্থনে বাস্তব রূপলাভের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

জাতিসংঘ প্রস্তাব : ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে বৃটেন ফিলিস্তিন সমস্যা জাতিসংঘে উত্থাপন করলে সমস্যাটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। কমিটি ফিলিস্তিন পরিদর্শন করে ৩১শে আগস্ট রিপোর্ট পেশ করে। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত সম্বন্ধে সদস্যবৃন্দ একমত হতে পারেনি। বিশেষ কমিটির একাংশ যেমন ইরান, ভারত, যুগোশ্লাভিয়া আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের ভিত্তিতে একটি যুক্তরাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তাব করে। কিন্তু কমিটির অধিকাংশ সদস্য যেমন- কানাডা, চেকোশ্লোভাকিয়া, গুয়াতেমালা, হল্যান্ড, পেরু, সুইডেন ও উরুগুয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ আরব ও ইহুদীদের মধ্যে ফিলিস্তিন বিভাগের সিদ্ধান্ত পেশ করে। তারা জেরুসালেম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষেও মত প্রকাশ করেন। জায়নবাদীগণ স্বাভাবিকভাবেই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দান করেন এবং সাধারণ পরিষদে এ প্রস্তাব যাতে গ্রহীত হয় সে ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘর সাধারণ পরিষদ তার ১৮১নং প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদী রাষ্ট্রে বিভক্ত করণের পক্ষে মত দেয়। প্রস্তাবটিতে ইহুদী রাষ্ট্রে ইহুদী দখলকৃত অঞ্চলসমূহ ছাড়াও আরব অধ্যুষিত বীরসেবা ও পূর্ব গ্যালিলি জিলা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দু’রাষ্ট্রের মাঝখানে জেরুসালেমসহ একটি আন্তর্জাতিক এলাকা রাখা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৩৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ১৩টি। আরব লীগ এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনের শতকরা ৮ ভাগ ইহুদী [যাদের ৯০%ই বহিরাগত] পেল দেশের ৫৬ ভাগ এলাকা আর ৯২ ভাগ মুসলিম বাসিন্দারা পেল ৪৪ ভাগ এলাকা। এ ঐতিহাসিক অবিচার কর্ম বৃহৎ চতুঃশক্তির ইহুদী সখ্যতার ফলেই সম্ভব হয়।

শেষ লগ্নে বৃটেনের ভূমিকাঃ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত ফিলিস্তিন বিভক্ত করণের প্রস্তাব গ্রহণের সাথে সাথে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ইহুদীরা এ সময় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। বৃটিশ সেনাবাহিনী ইহুদীদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেয়। ইহুদী সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ‘হাগানা , ইরগুন স্টার্নের বেপরোয়া দল, পালমাক বাহিনী জাবোটিনস্কির নেতৃত্বাধীন রিভিশানিষ্টস, (Rivtionists) এ সময় বর্বর কর্মকান্ড শুরু করে। বাধ্য হয়ে দেশপ্রেমিক ফিলিস্তিনীরাও অস্ত্র ধারণ করে। ফিলিস্তিনীরা দেশের ৮২ ভাগ এলাকার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিমা শক্তিগুলি এতে বিচলিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিল নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়। ফিলিস্তিন বিভক্তির জন্য নিযুক্ত কমিশন নিরাপত্তা পরিষদের নিকট সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সাহায্য দানে সক্ষম ছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে পেশকৃত উক্ত প্রার্থনাটি বৃটিশ ভেটোতে বাতিল হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের নিযুক্ত কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কোন কাজ করা সম্ভব হয়নি।

বৃটিশ সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা : ইতোমধ্যে বৃটিশ সরকার ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে এর মধ্যে ফিলিস্তিন থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কিন্তু তার আগেই তারা ফিলিস্তিন দখলে ইহুদীদের সাহায্য করে। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় ইহুদীরা আরব এলাকাগুলোতে ব্যাপক হামলা চালায়। বৃটিশ সৈন্যরা সেঞ্চুরিয়ান ট্যাঙ্কসহ সর্বাধুনিক অস্ত্র দিয়ে ইহুদীদের সাহায্য করছিল। বৃটিশ সৈন্যরা ইহুদীদের পক্ষে আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ইহুদীদের জয় সুনিশ্চিত করে। বৃটিশ ও ইহুদীরা চক্রান্ত করে ১৯৪৮ সালের ১০ এপ্রিল দেইরইয়াসীন, ১৮ এপ্রিল টিবেরিয়াম, ২১ এপ্রিল হাইফা, ২৭ এপ্রিল সামাখ, ২৮ এপ্রিল সালামেহ, ইয়াজুর, বিতদাজুন, জাফফার পার্শ্ববর্তী এলাকা, ৩০ এপ্রিল বেইসান, ১০ মে সাফাদ, ১৩ মে জাফফা থেকে আরবদেরকে বহিষ্কার করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে পর্যন্ত জাতিসংঘের দেয়া কথিত ম্যান্ডেট শাসনের কাজে নিয়োজিত বৃটিশ বাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে এসব আরব এলাকা দখলে ইহুদীদের সর্বাত্মক সহায়তা করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন যখন ফিলিস্তিনে বৃটেনের ম্যান্ডেট শাসন থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে আলোচনা করছে তখন ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে বৃটেন একতরফাভাবে ম্যান্ডেট শাসন প্রত্যাহার করে নেয়। বৃটিশ সৈন্যও প্রত্যাহার করা হয়। ফিলিস্তিন ত্যাগের সময় বৃটিশরা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ইহুদীদের দিয়ে যায়।

ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা : ইহুদীগণ পূর্ব থেকে প্রস্ত্তত হয়েই ছিল। তারা সরকার কাঠামোও ঠিক করে রেখেছিল। ১৯৪৮ সালের ১৪মে তারিখের মধ্যরাতে ইহুদীরা তেলআবিবকে রাজধানী করে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। বিশ্ব ইহুদী সংস্থা ইহুদী নেতাদেরকে সংগ্রহ করে এনে প্রথম সরকার গঠন করে। ডঃ ওয়েজম্যান হন এ নতুন রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং ডেভিড বেনগুরিয়ান হন প্রধানমন্ত্রী। জায়নবাদীরা প্রস্ত্তত হয়েই ছিল। তাদের একটি ছায়া সরকার সব সময়ই ছিল। এভাবেই আরব দুনিয়ায় ইংগ-মার্কিন, ফ্র্যান্স-রুশ সাম্রাজ্যবাদের সন্তানরূপে বিষফোঁড়ার ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় অভিশপ্ত ইহুদীদের এক নতুন রাষ্ট্র ইসরাইল। বৃটিশরাই মুসলিমদেরকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বুকের উপর বসিয়ে দেয় ইহুদীদের। ইঙ্গ-মার্কিন সর্বাত্মক মদদেই তারা হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য।

বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক ইসরাইলকে স্বীকৃতি দান : ইহুদীদের রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণার মাত্র দু’মিনিটের মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারী এস ট্রুম্যান (১৯৪৫-১৯৫৩) এ রাষ্ট্রের প্রতি তার দেশের স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করেন। স্বীকৃতি দানকারীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন। বৃটেন এবং ফ্রান্সও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৫০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহেরু ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেন। বহিরাগত সংখ্যালঘু ইহুদী কর্তৃক অবৈধভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ৮০ ভাগ ফিলিস্তিনে জবর দখল প্রতিষ্ঠা, সংখ্যাগুরু ফিলিস্তিনীদের পৈত্রিক ভিটে মাটি থেকে বহিষ্কার, ভৌগোলিক সংহতি লংঘন, ধর্মীয় পবিত্র স্থানসমূহের অমর্যাদা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদ লংঘন করার মত সীমাহীন অপরাধ করা সত্বেও মার্কিন, সোভিয়েত, বৃটেন ও ফ্রান্সের সাম্র্যাজ্যবাদী সরকারগুলো তাদের প্রভাব খাটিয়ে ১৯৪৯ সালের ১১ মে তথাকথিত ইসরাইল রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত করে নেয়।

ইসরাইল গঠনের পর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসদের আরেক রূপ। যখন রাষ্ট্র শক্তি আন্তর্জাতিক আইন-কানুন ও রীতিনীতি লংঘন করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তখন তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূল উদ্দেশ্য তিনটি। যেমন- (১) জোরপূর্বক কারো আদায় আনুগত্য করা। (২) আত্মরক্ষা করা। (৩) আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল কোন ইস্যু হতে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো।

১. ইসরাইলে দলে দলে ইহুদীদের আগমন : ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই পৃথিবীর সব এলাকা থেকে ইহুদীদের ইসরাইলে পাঠানো শুরু হয়। আগত ইহুদীদের পুনর্বাসন কাজ শুরু হয়। এ সাথেই শুরু হয় ফিলিস্তিনী মুসলিমদের হত্যা, লুণ্ঠন ও উচ্ছেদের কাজ। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলিম সব কিছু হারিয়ে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশসমূহে আশ্রয় নেয়।

২. ইরগুণ ভাই লিউমীর গণ হত্যা : ইহুদী সন্ত্রসবাদী মেনাহিম বেগিনের নেতৃত্বাধীন ইহুদী সন্ত্রাসবাদী দল ‘ইরগুন ভাই লিউমী’ ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল জেরুসালেমের নিকটবর্তী দিইর ইয়াসিন গ্রামে এক বর্বর হামলা চালিয়ে গ্রামের মহিলা ও শিশুসহ ২৫৪ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনার সন্ত্রস্ত হয়ে ফিলিস্তীনীরা তাদের বাসভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে। এদের মধ্যেই ছিলেন সেদিনের বালক ইয়াসির আরাফাত। তখন তারা নিশ্চিত ছিল যে ন্যায়ের পথে যুদ্ধে তাদের জয় হবে এবং তারা আবার ফিরে আসবে মাতৃভূমিতে। ইহুদী লেখক জন কিমজে দিইর ইয়সীন গ্রামের হত্যাকান্ডকে ঞযব ফধৎশবংঃ ংঃধরহ ড়হঃযব ঔবরিংয ৎবপড়ৎফ বলে আখ্যায়িত করলেও এ হত্যকান্ডের নায়ক ও পরবর্তীতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাহিম বেগিন একে এক বড় ধরনের বিজয় বলে অভিহিত করেন।

৩. পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের পদক্ষেপ : ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনীদের নির্মম ভাগ্য বিপর্যয়ে পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশসমূহ বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারা এ অবৈধ রাষ্ট্রটিকে প্রতিহত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আরব লীগভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিনীদের রক্ষায় এগিয়ে আসে। জর্ডনের সেনাবাহিনী জেরুসালেমসহ পূর্ব ফিলিস্তিন মুক্ত করে। ইরাকী বাহিনী তড়িৎ গতিতে তেলআবিবের ৩ মাইলের মধ্যে গিয়ে পৌঁছে। অন্যদিকে মিশরীয়রা গাজা ভূখন্ডের (Gaza strip) উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মিশর, সিরিয়া ও জর্ডনের ইসলামী আন্দোলন ‘ইখওয়ানুল মুসলিমূন’ও ফিলিস্তিনীদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। নব্য ইসরাইল রাষ্ট্রের মুমূর্ষ অবস্থায় তার মুরুববীদের চাপে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটা ফায়সালার স্বার্থে ৪ সপ্তাহের জন্য যুদ্ধ বিরতি হয়। যুদ্ধ বিরতির সুযোগে মার্কিন, সোভিয়েত, বৃটেন ও ইসরাইলের অন্যান্য মুরুববীরা একদিকে ইসরাইলকে অঢেল অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে প্রতি আক্রমণের জন্য প্রস্ত্তত করে তোলে, অন্যদিকে আরব রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি এবং তাদের কারো কারো সাথে গোপন অাঁতাত গড়ে তোলে। ফলে ইহুদীরা যখন সাম্রাজ্যবাদী মদদ পুষ্ট হয়ে যুদ্ধ বিরতি লংঘন করে নতুন আক্রমণ শুরু করল, তখন জর্ডনকে নিষ্ক্রিয় দেখা গেল, মিশর গাজা রক্ষা ছাড়া অন্য কিছুতেই এগিয়ে এলোনা। ইরাকী বাহিনীকে একা পড়ে গিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে পিছু হটতে হল। ইসরাইলীরা জর্ডন নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা এলাকা ছাড়া ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট সব এলাকাই দখল করে নিল এবং দখলীকৃত এ গোটা এলাকাই ইসরাইল নামে অভিহিত হল। ১৯৪৯ সালের ৭ই জানুয়ারী যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুদ্ধে আরব দেশগুলির পরাজয় আরব মানসিকতার উপর প্রচন্ত আঘাত হানে। প্রতিটি আরব দেশেই জনমত এতবেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে যে, বিভিন্ন দেশের সরকারগুলির পক্ষে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয়নি। আরবদের এই পরাজয়ের ফলে জায়নবাদীগণ বিভক্তি পরিকল্পনায় তাদের জন্য যতখানি ভূখন্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল তা অপেক্ষা অনেক বেশি জায়গা দখল করে। আরবগণ এই দখলীকৃত এলাকা প্রত্যার্পণের দাবি করলেও পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ সমর্থনপুষ্ট ইসরাইল এ দাবীর প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়নি।

আরবদের এই শোচনীয় পরাজয়ের বহুবিধ কারণ ছিল। প্রথমত আরব দেশগুলির অধিকাংশই ছিল সদ্য স্বাধীন, না হয় বিদেশী নিয়ন্ত্রনাধীন। সিরিয়া ও লেবানন মাত্র দু’বছর পূর্বে স্বাধীনতা লাভ করে। মিশর ও ইরাকে তখন পর্যন্ত বৃটেনের সেনাবাহিনী ও প্রভাব বিদ্যমান ছিল। ফলে এই সমস্ত দেশের সরকারগুলির রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তার সাথে তাদের কোন পরিচয় ছিল না। দ্বিতীয়ত অভিজ্ঞতা ছাড়াও আরবদের মধ্যে একতাবোধের অভাব ছিলো। বিভিন্ন আরবদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো সমঝোতা বা অভিন্ন কার্যক্রম ছিল না। ফলে ইহুদীগণ তাদের সুবিধা মতো স্থানে ও সময়ে আলাদা আলাদা এক একটি আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জয়ী হয়েছে। ফিলিস্তিনের মানবতাবাদী শিক্ষাবিদ মুসা আলামী এ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন : ওঞযব ঔবংংঃড়ড়শ ভঁষষ ধফাধহঃধমব ড়ভ ড়ঁৎ ফরংঁহরঃু ধহফঃযব ধহধৎপযু ড়ভ ড়ঁৎ ংবঃঁঢ়; ডযবহঃযবঃরসব ধিং ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহবঃযবু পড়ষষবপঃবফ ধষষঃযবরৎ ভড়ৎপবং ধহফ ফবধষঃঁং যবধাু পড়হপবহঃৎধঃবফ নষড়ংং.... ঞযঁংঃযব পড়ঁহঃৎু ভবষষ,ঃড়হি ধভঃবৎঃড়হি,ারষষধমব ধভঃবৎারষষধমব, ঢ়ড়ংরঃরড়হ ধভঃবৎ ঢ়ড়ংরঃরড়হ, ধং ধ ৎবংঁষঃ ড়ভঃযরং ভৎধমসবহঃধঃরড়হ, ষধপ ড়ভঁহরঃু ধহফ ড়ভ ধ পড়সসড়হ পড়সসধহফ. এতে যাদের নিয়ে যুদ্ধ সে ফিলিস্তিনীদেরই ক্ষতি হল। এ সময় থেকেই সত্যিকারভাবে ফিলিস্তিনী জাতীয়তাবাদের সূচনা।

এই সামরিক অনৈক্য বহুলাংশে রাজনৈতিক অনৈক্য ও ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রতিফলন। আরব লীগের নেতৃত্বের জন্য মিসর ও ইরাকের মধ্যে কোন্দল সামরিক ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জর্ডনের আমীর আবদুল্লাহ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আরব স্বার্থ বিসর্জন দিতে সর্বদাই প্রস্ত্তত ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল বৃটিশ সৃষ্ট ‘আরব লিজিয়নের’ সাহায্যে জর্ডন নদীর পশ্চিম তীরের কিছু ভূভাগ দখল করে নিজের রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি করা। মুফতি আমিন আল হুসাইনী তাঁর পরিকল্পনার পথে প্রতিবন্ধক মনে করে মুফতিকে শায়েস্তা করার জন্য ইহুদী সংস্থার নেত্রী গোল্ডামায়ারের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র করতেও তিনি পশ্চাৎপদ হয়নি।

তৃতীয়ত আরব রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের দুর্নীতি তাদের পরাজয়ের পথ প্রশস্ত করেছিল। মিশরের রাজা ফারুক ও তাঁর পার্শ্বচরগণ সেনাবাহিনীর জন্য অকেজো অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করে নিজেদের জন্য বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু এ অস্ত্র দিয়ে মিসরীয় বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে সাফল্য প্রদর্শন করা সম্ভব ছিল না। সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী জামিল মারদামের ভ্রাতা ক্যাপ্টেন ফুয়াদ মারদাম সিরীয় জনসাধারণ প্রদত্ত অর্থে ইতালী হতে অস্ত্রঅস্ত্র ক্রয় করে উৎকোচের বিনিময়ে অস্ত্র ভর্তি জাহাজগুলি ইহুদীদের হাতে সমর্পণ করে। এ ধরনের বহু উদাহরণ হতে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, ইহুদীগণ যে উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ও স্বজাতিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করেছিল তা আরব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিল না।

চতুর্থত ভৌগোলিক অবস্থা আরবদের বিপক্ষে কাজ করেছিল। কয়েকটি আরব দেশের বাহিনী বহু দূর হতে এসে এত ক্লান্ত ছিল যে, তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। এ সম্বন্ধে জর্ডনের সেনাপতি গ্লাব পাশা মন্তব্য করেছেন : ু
ওঃ রং হড়ঃ ৎবধষরুবফঃযধঃযব ফরংঃধহপব ভৎড়স ইধমযফধফঃড় ঐধরভধ রং ংবাবহ যঁহফৎবফ সরষবং, ধং ভধৎ ধং ভৎড়স ঈধষধরংঃড় ঠরবহহধ ড়ভ খড়হফড়হঃড় ইবৎষরহ. গড়ৎবড়াবৎ,ঃযব মৎবধঃবৎ ঢ়ধৎঃ ড়ভঃযরং ফরংঃধহপব রং ধপৎড়ংং ধিঃবৎষবংং ফবংবৎঃ.চ
পক্ষান্তরে ইহুদীদের সীমিত এলাকার মধ্যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ম্যান্ডেট শাসনামলে এই এলাকায় চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ফলে ইহুদীদের পক্ষে এক রণাঙ্গন হতে অন্য রণাঙ্গনে দ্রুত সৈন্য প্রেরণ করা সম্ভব ছিল। রসদপত্র ও যন্ত্রাংশের জন্য কোন ইহুদী বাহিনীকে বেশীদূর যেতে হয়নি। যুদ্ধের সময় এ ধরণের সুযোগ সুবিধাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করতে বহুলাংশে সাহায্য করে।

৪. ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ :
ক. ১৯৫৬ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে বৃটেন ও ফ্রান্সের মদদে ২৯শে অক্টোবর ইসরাইল মিশর আক্রমণ করে এবং সুয়েজখালের পূর্বতীর পর্যন্ত সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ এলাকা দখল করে নেয়। ৩১ শে অক্টোবর ফ্রান্স ও বৃটেন এ আক্রমণে অংশ নেয়। অবশেষে কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে যুদ্ধ বিরতি হয়।
খ. ১৯৬৭ সালের ৫ই জুন আবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। ৬দিনের এ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক সাহায্য লাভকারী ইসরাইলের হাতে আরবরা নিদারুনভাবে পরাজিত হয়। যুদ্ধের ফলে মিশরের গাজা ও সিনাই অঞ্চল, জর্ডনের জর্ডন নদীর পশ্চিমতীর ও জেরুসালেম এবং সিরিয়ার গোলান হাইটস ইসরাইলের দখলে চলে যায়। এরপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২নং প্রস্তাব গ্রহণ করে এতদঞ্চলের সকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি এবং অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলী সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের আহবান জানায়। কিন্তু সে প্রস্তাব আজও কার্যকর হয়নি। তাই জেরুসালেম এখন পর্যন্ত ইসরাইলের জবর দখলে রয়েছে। ইসরাইল জেরুসালেমকে তার স্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে বলেছে, সে কখনও জেরুসালেম হাত ছাড়া করবে না।
গ. ১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর সুয়েজখাল সেক্টরে মিশরীয় সেনাবাহিনী ও গোলান উপত্যকায় সিরীয় বাহিনী ইসরাইলী অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করলে পুনরায় ব্যাপক যুদ্ধ হয়। অকস্মাৎ পরিচালিত এ আক্রমণে ইসরাইল অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে যায়। মিশরের সেনাবাহিনী এক দুর্ধর্ষ অভিযানে ইসরাইলের অহংকার এবং অজেয় বলে কথিত বারলেভ প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙ্গে সম্মুখে অগ্রসর হয়। ইসরাইলের নিশ্চিত পতন ঠেকানোর জন্য ওয়াশিংটন তেল আবিবের মধ্যে সাহায্যের সেতু রচিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরে সাহায্য বন্ধ করে দেয় এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। ১৭ দিন স্থায়ী এ যুদ্ধ অবশেষে জাতিসংঘের চেষ্টায় বন্ধ হয়।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর জর্ডন নদীর পশ্চিম তীর, গোলান মালভূমি, গাজা এলাকা ও সিনাই উপদ্বীপ দখলের পর এসব এলাকায় বসবাসকারী আরবদের উপর একই ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন চাপিয়ে দেয়া হয়। বিজিত এলাকাগুলোতে জাতিসংঘের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে যে হারে ইহুদী বসতি স্থাপন করা হয়েছে বা এখনও হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে এ সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ও পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে জায়নবাদকে অন্ধ জাতি বিদ্বেষ (Racism) বলে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে তা জায়নবাদীদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করেছে।
ইসরাইল নামক এই বিষাক্ত সাপটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুধ-কলা দিয়ে পুষে যাচ্ছে। ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে যে কোন অন্যায় করে বসতে পারে এবং দুনিয়ার আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করতে পারে। এখনও আন্তর্জাতিক ইহুদী সংস্থা বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলোকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। তারা ঐ সকল দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, মিডিয়া ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, বৃটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও চীনে তাদের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। সাম্রাজ্যবাদী মদদে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কত বড় এবং ভয়াবহ তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরাইল দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। সমানে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর ধ্বংস করছে। রাস্তাঘাটে প্রতি পদে পদে চেক পয়েন্ট স্থাপন করেছে এবং করছে। চাকরি করতে দিচ্ছে না। তারা দেয়াল নির্মাণ করছে, সে দেয়াল আবার বর্ডারে নয়, ফিলিস্তিনী ভূমির উপর। এগুলোই যে মুক্তিযুদ্ধের কারণ তাকেই তারা এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী দোসরা সন্ত্রাস বলছে। যদি এটি সন্ত্রাস হয়ে থাকে তাহলে ইসরাইলের সন্ত্রাস এর থেকে একশত গুণ বড়। সাম্রাজ্যবাদীদের অবৈধভাবে সৃষ্ট ইসরাইলের উৎপাত-উৎপীড়ন-সন্ত্রাসে প্রতিনিয়ত অতিষ্ঠ হচ্ছে নির্দোষ নিরপরাধ ফিলিস্তিনীরা। জায়নিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী এই সন্ত্রাসী শক্তি তাদের মুরুববীদের মদদ পুষ্ট হয়ে আরব জাহান, মধ্যপ্রাচ্য তথা তামাম মুসলিম দুনিয়ার জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক স্থায়ী হুমকি। শুধু তাই নয়, এখন খোদ মুরুববীদের জন্যও হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরাইল মাথা ব্যথার কারণ, বিশ্বশান্তির জন্য হুমকির প্রতীক। তাদের অযৌক্তিক অমানবিক একগুঁয়েমীতে বাধা প্রদান করা হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলেও দাম্ভিক ঘোষণা দিয়েছে সেই চরম উদ্ধত ও নিষ্ঠুর ইহুদি সাইলক গোষ্ঠী।
আল কুদ্স আশ শরীফ আজ ইসরাইলের জবর দখলে। ১৯৬৭ সালের ৫ই জুনের যুদ্ধে জেরুসালেম দখল করার পর থেকে আজ পর্যন্ত অধিকৃত ফিলিস্তিনের পবিত্র স্থানসমূহের উপর ইসরাইলী আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। তাদের আচরণ দ্বারা বুঝা যায়, বাইতুল মাকদিসের ইসলামী চরিত্র পরিবর্তন করে ইহুদীকরণের আগ পর্যন্ত তারা ক্ষান্ত হবার নয়। আর তাদের সে ইচ্ছা মসজিদুল আকসা ও কুববাতুস্ সাখরা ধ্বংস করার আগ পর্যন্ত পূরণ হবার নয়।
ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানী সংক্রান্ত এমন একটি নিদর্শন খুঁজে বেড়াচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে যে, মসজিদুল আকসা ও কুববাতুস্ সাখরা হাইকালে সুলাইমানীর উপর প্রতিষ্ঠিত। যেন তারা এই অজুহাত দেখিয়ে তা ভাংগার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর এ পর্যন্ত ১০ পর্যায়ে খনন কাজ চালানো হয়েছে। এজন্য মসজিদে আকসার পার্শ্ববর্তী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মুসলিমদের উৎখাত করা হয়েছে।
১৯৬৭ সালের ৩১শে আগস্ট ইহুদীরা জোর করে মসজিদুল আকসার প্রধান গেইট বাবুল মাগরেবার চাবি নিয়ে যায় যেন তারা যে কোন সময় বোরাক দেয়ালের কাছে যেতে পারে। ১৯৬৯ সালের ২১শে আগস্ট ডেনিস মাইকেল মসজিদুল আকসায় অগ্নি সংযোগ করে। অগ্নিকান্ডের ফলে মসজিদের আসবাবপত্র, দেয়াল, সালাহউদ্দিনের মিম্বার এবং মসজিদের দক্ষিণাংশ জ্বলে যায়। ১৯৮০ সালের ১লা মে ইহুদীরা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মসজিদুল আকসাকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। তারা মসজিদের নিকটবর্তী একটি ইহুদী গীর্জার ছাদের উপর এক টনেরও বেশি বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দেয়। মুসলিমদের সতর্কতার কারণে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই অপরাধে সন্ত্রাসবাদী মায়ের কাহানাকে অভিযুক্ত করা হয়।
১৯৮৬ সালের ৯ই জানুয়ারী ইসরাইলী সেনাবাহিনীর সীমান্ত রক্ষীবাহিনী মসজিদে আকসা এলাকায় সান্ধ্য আইন জারী করে। ইসরাইলী নেসেটের অভ্যন্তরীণ কমিটির ৮ সদস্যসহ আরো কিছু নেসেট সদস্য এবং টেলিভিশনের ফটোগ্রাফার মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে। মসজিদের রক্ষীরা বাধা দিলে রক্ষীদেরসহ বেশ কিছু মুসল্লীকে আটক করে এবং ইসরাইলী বাহিনী মুসল্লীদের উপর কাঁদানে গ্যাস ও গোলা নিক্ষেপ করে। ফলে ১৬ জন মুসল্লী আহত হয়।
১৯৮৮ সালের ১৫ই জানুয়ারী ইসরাইলী বাহিনী মসজিদুল আকসায় গুলি চালিয়ে ২৮ জন মুসল্লীকে হত্যা করে এবং ১১৫জন মুসলিমকে আহত করে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব জেরুসালেমের সালওয়ান এলাকার ৬টি মুসলিম পরিবারকে বিতাড়িত করা হয় এবং সেগুলোতে পরে বিদেশাগত ইহুদীদেরকে পুনর্বাসন করা হয়।
ইসরাইল সরকার অধিকৃত আরব এলাকা ইহুদী করণের উদ্দেশ্যে ইহুদী বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। একমাত্র পূর্ব জেরুসালেম শহরেই ৭০ হাজার ইহুদীকে পুনর্বাসনের জন্য ২০ হাজার আবাসিক ইউনিট তৈরী করা হয়েছে। মুসলিমদেরকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত করাই এর উদ্দেশ্য।
ইসরাইল জায়নবাদী ও বর্ণবাদী একটি রাষ্ট্র। ধ্বংসাত্মক ও বর্ণবাদী ইহুদীবাদ ইসরাইলকে পরিণত করেছে একটি কলোনিয়াল স্টেট’-এ। ১৯৪৮ সালে গঠিত হলো রাষ্ট্র ইসরাইল। এরপর ৬০ বছর পেরিয়ে গেল। আরব-ইহুদি বিরোধের অবসান হলো না। এই ৬০ বছর ধরে ইসরাইলের পোলারাইজেশন ঘটেছে একটি কলোনিয়েল এন্টারপ্রাইজে। এই ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের প্রতি ব্যাপক দমনমূলক।

বুলডোজারের মেসেজ
বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে ফিলিস্তিনীদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে ২০০টি ইহুদি বসতি বা সেটেলমেন্ট। এগুলোতে ৫ লাখ ইহুদি বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে দেড় লাখ ইউনিট বাড়ি। কখনো এগুলো গড়ে তোলা হয়েছে ফিলিস্তিনীদের কৃষি জমির ওপর। সেখানে কার্যকর করা হয়েছে জোনিং রেস্ট্রিকশন, ফলে ফিলিস্তিনীরা সেখানে কোন ভবন নির্মাণ করতে পারে না। ১৯৬৭ সালের পরবর্তী সময়ে ইসরাইল ধ্বংস করেছে ১৮ হাজার ফিলিস্তিনী বাড়ি। এখানো এ ধ্বংস প্রক্রিয়া রয়েছে অব্যাহত। নিয়মিত চলে বুলডোজারে মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়ার কাজ। এর পেছনে তেমন কোনো নিরাপত্তাজনিত কারণও নেই। জেফ হ্যালপার এর নাম দিয়েছেন ‘ন্যাশনাল অবসেশন’। তাঁর মতে ইসরাইল ঘৃণাভরে আন্তর্জাতিক সব আইন-কানুন লঙ্ঘন করে একটি জাতিকে ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ দিয়ে চলছে। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের জন্য তা মর্মপীড়াদায়ক ও ধ্বংসাত্মক। ফলে একটি ফিলিস্তিনী পরিবার তার থাকার সবটুকু জোগাড়ের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মহিলাদের জন্য পরিস্থিতিটা আরো খারাপ- ইসরাইলিদের এই বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়ার সময় অনেক ফিলিস্তিনী মা তার প্রিয় শিশু কিংবা কোনো প্রিয়জনকেও হারায়। প্রিয়জনকে এভাবে হারানো একজন মায়ের জন্য কতটুকু মর্মপীড়াদায়ক তা শুধু ভোক্তভোগী ফিলিস্তিনী মায়েরাই জানে। বুলডোজারের এ ধ্বংসলীলা অনেক ফিলিস্তিনী শিশুর লেখাপড়ার সুযোগটুকু বন্ধ করে দেয়। শিশুরা হারায় স্কুলে যাওয়ার সুযোগ। এর প্রতিকারের কোনো সুযোগ নেই ফিলিস্তিনীদের কাছে। তাদের কাছে পাঠানো হয় ডিমলিশন নোটিস। এর সাথে কোনো আনুষ্ঠানিকতা, বৈধতা ও প্রশাসনিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি বাড়িঘর থেকে মালপত্র সরিয়ে নেয়ার ফুরসতও কোনো কোনো সময় দেয়া হয় না। শুধু প্রাণ নিয়ে পালানোর সুযোগটাই যেন দেয়া হয়। তাও সবার ভাগ্যে জোটে না। বিশেষ করে ইসরাইলিদের খাতায় যেসব ফিলিস্তিনী ওয়ান্টেড বলে চিহ্নিত, তাদের বেলায় এমনটি ঘটে। তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়া হয় অতর্কিত হামলা চালিয়ে। প্রয়োজনে গ্রেফতার ও খুনও করা হয় ফিলিস্তিনীদের।তাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়ার কাজটি চলে তাৎক্ষণিকভঅবে। কখনো কখনো থেমে থেমে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে চলে এই ভাঙচুরের কাজ। তাদের বাড়িতে হামলা চলে প্রধানত শেষ রাতে কিংবা ভোর রাত্রে, যখন বাড়ির মানুষ সাধারণত ঘুমে থাকে।
ইসরাইলের পাঁচটি সরকারি সংস্থা গ্রিন লাইনের উভয় পাশে এই পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে।
পশ্চিম তীর ও সাবেক গাজায় এ দায়িত্বে নিয়োজিত ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বেসামরিক প্রশাসন। জেরুসালেমের নগরে এ দায়িত্ব পালন করে ইনটেরিয়র মিনিস্ট্রি ও জেরুসালেম মিউনিসিপ্যালিটি। ইসরাইলের ভেতরে বেদুইন ঘরবাড়ির ওপর নজরদারির দায়িত্ব রয়েছে ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রি, ইসরাইল ল্যান্ডস অথরিটি ও অ্যাগ্রিকালচার মিনিস্ট্রির ওপর। অধিকন্তু ইহুদি প্রধান মিউনিসিপ্যালিটিগুলো এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে লড, বামলে ও জাফে’র মতো মিশ্রনগরীগুলোতে।
আরবদের তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে জনবিচ্ছিন্ন ছোট ছোট ছিটমহলে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। এগুলোকে বলা হয় ‘শ্যারনের ক্যান্টন’। সে দেশের ১৫ শতাংশ ভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে এসব ক্যান্টন। পশ্চিম তীরের ৪২ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে এ ধরনের ‘এ’ ও ‘বি’ এলাকা। ইসরাইলের ৩.৫ শতাংশের আছে এ ধরনের এনক্লেভ বা ছিটমহল। জোনিংয়ের মাধ্যমে এসব এলাকায় আরবদের কার্যত বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। পূর্ব জেরুসালেমের এক শতাংশ এলাকায়ও গড়ে তোলা হয়েছে এ ধরণের এনক্লেভ। সামাজিক চাপ ও ভীতি নিয়ে ফিলিস্তিনীরা বসবাস করছে এসব এনক্লেভে।
ইসরাইলের জোনিং ও মাস্টার প্লানে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়ার অনুমোদন রয়েছে। এমনটি ঘটছে এমন একটি দেশে যেখানে দেশটির ৯০ শতাংশ ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদিরা।
এসব ভূমিতে ফিলিস্তিনীদের প্রবেশাধিকার নেই। জেরুসালেমের কথাই ধরা যাক। পশ্চিম জেরুসালেম ইহুদিদের জন্য। জেরুসালেমের পূর্বাংশে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ইহুদিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেখানে ইহুদি ৭২ শতাংশ। আরবরা ২৮ শতাংশ। ফিলিস্তিনীদের সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার। এরা সেখানে বসবাস করছে কঠোর বেষ্টনীতে বাঁধা ছিটমহলে বা এনক্লেভে। ইসরাইলি বসতিগুলো দখল করে নিয়েছে তাদের ৩৫ শতাংশ ভূমি। আর পূর্ব জেরুসালেমের অর্ধেকেরও বেশি অংশ ঘোষিত হয়েছে ‘ওপেন গ্রিন স্পেস’ হিসেবে। সেখানে ফিলিস্তিনীরা জমির মালিক হতে পারে, তবে সেখানে কোনো নির্মাণ কাজ চালাতে পারে না। ফলে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর ও সম্প্রদায়গত চাহিদা মেটানোর সুযোগ এদের জন্য রয়েছে শুধু পূর্ব জেরুসালেমের ১১ শতাংশ অংশে। যা পুরো জেরুসালেমের মাত্র ৭ শতাংশে। ফিলিস্তিনীরা বসবাস করতে পারে না ইহুদিদের জন্য নির্ধারিত পশ্চিম জেরুসালেমে।
পশ্চিম তীরেও বিদ্যমান একই ব্যবস্থা। এর পেছনে কারণ একই-আটক, অবরোধ, প্ররোচিত অভিবাসন ও অব্যাহতভাবে ইসরাইলের সম্প্রসারণ। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ‘মাস্টার প্ল্যানে’-পশ্চিম তীরের ৭০ শতাংশকে ‘কৃষি জমি’ হিসেবে চি˝˝ত করে সেখানে ফিলিস্তিনীদের ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৫ সালের দ্বিতীয় ওসলো চুক্তির মাধ্যমে এই টেরিটরিতে জেরুসালেমকে এ,বি,সি,ডি এলাকা এবং হেবরনকে এইচ-১ ও এচই-২ এলাকায় বিভক্ত করা হয়। এসব বিভাজনে শুধু ইহুদিদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা, নিরাপত্তা অঞ্চল ও সামরিক এলাকা সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া পূর্ব জেরুসালেমের বেশির ভাগ অংশে শুধু ইহুদিদের জন্য ‘ওপেন গ্রিন স্পেসে’ নামের আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। অপর দিকে ফিলিস্তিনীদের অবরোধ করে রাখা হয় বিচ্ছিন্ন ক্যান্টনগুলোতে। ক্যান্টনগুলোতে আসা রাস্তাগুলোতে কার্যকর রয়েছে নানা বাধা এবং আছে শত শত ভাসমান চেকপয়েন্ট। আর এ ক্যান্টনগুলোর চারপাশে রয়েছে ইসরাইলি ইহুদিদের বসতি।
ইসরাইল ফিলিস্তিনে যা করছে তাতে ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নানা আইন। এরা যেভাবে ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর ধ্বংস করছে, তা যুদ্ধাপরাধের শামিল। এরা লঙ্ঘন করছে চতুর্থ জেনেভা কনভেশন। বিশেষভাবে লঙ্ঘন করছে এ কনভেনশনের ৫৩ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদে বলা আছে : অহু ফবংঃৎঁপঃরড়হ নু ধহ ড়পপঁঢ়ুরহম ঢ়ড়বিৎ ড়ভ ৎবধষ ড়ৎ ঢ়বৎংড়হধষ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃু নবষড়হমরহম রহফরারফঁধষষু ড়ৎ পড়ষষবপঃরাবষুঃড় ঢ়ৎরাধঃব ঢ়বৎংড়হং.... রং ঢ়ৎড়যরনরঃবফ.
২০০৪ সালের মে মাসে গৃহীত জাতিসঙ্ঘের ১৫৪৪ নম্বর প্রস্তাবে এ প্রেক্ষাপটে ইসরাইলকে চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন মেনে চলার কথা বলে এবং তৎকালে বিদ্যমান পরিস্থিতি উন্নয়ন ঘটাতেও বলা হয়। কিন্তু ইসরাইল তা লঙ্ঘন অব্যাহত রাখে। গ্রিন লাইনের উভয় পাশে চলে ইহুদিদের ‘এথনোক্রেসি’। ফিলিস্তিনীদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়ার কাজও এরা যথারীতি চালিয়ে যায়। ইসরাইলে ‘নিশুল’ ডিসপ্লে-সমেন্ট পলিসি এ কাজকে আরো জোরদার করে তোলে। জেফ হ্যালপার তা উল্লেখ করেছেন এভাবে:
The Message of Bulldozers : Get Out. You do not belong here. We uprooted you in 1948, and well do it again throughout the `Land of Israil’. Palestinians have no right to claim a home in our country.
ইসরাইলি সরকারের আরেক পরিকল্পনা হচ্ছে পুরো পূর্ব জেরুসালেমকে বিভেদ দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলে এর থেকে পশ্চিম তীরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। অবশ্য ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলছে, নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগ কমানোর জন্য এই বিভেদ দেয়াল তৈরী করা হচ্ছে। ১৯৬৭ সালে দখল করা ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে ইসরাইল একটি জনসংখ্যা গণনা সমীক্ষা চালায়। এখন সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনীদের স্থায়ী অধিবাসীর মর্যাদা দিলে, যারা সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেনি, সেসব ফিলিস্তিনী সে অধিকার হারায়। স্থায়ী অধিবাসীর মর্যাদা পাওয়া ফিলিস্তিনীদের ইসরাইলি নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যাপারে কিছু শর্ত পালন করতে হয়। তাদের ঘোষণা করতে হবে তাদের অন্য কোনো দেশের কোনো ধরনের নাগরিকত্ত নেই এবং তাদের কিছু হিব্রু ভাষা জ্ঞান রয়েছে। বেশির ভাগ ফিলিস্তিনী তখন রাজনৈতিক কারণে ইসরাইলের নাগরিকত্ব প্রার্থনা করেনি। ফলে দখল করা ফিলিস্তিনী ভূখন্ডে বসবাসকারী ফিলিস্তিনীদেরকে ইসরাইলিরা বিবেচনা করতে থাকে প্রত্যাবাসিত বিদেশীদের মতো। যদিও এই ফিলিস্তিনীরা এ ভূখন্ডেই জন্ম নিয়েছে। এটাই তাদের জন্মভূমি। সারা জীবন কাটিয়েছে এ ভূখন্ডেই। অথচ নেই তাদের নিজস্ব দেশ। এসব স্থায়ী অধিবাসীদের ভোটাধিকার আছে পৌরসভার নির্বাচনগুলোতে। কিন্তু ভোটাধিকার নেই ইসরাইলি পার্লামেন্ট ‘নেসেটে’ নির্বাচনে। কিছু শর্তাধীনে ফিলিস্তিনী শিশুদের স্থায়ী রেসিডেন্স মর্যাদা দেয়া হয়। আবার এসব রেসিডেন্ট ফিলিস্তিনীরা নন রেসিডেন্টকে বিয়ে করলে তাদের ফ্যামিলি রি-ইউনিয়নের জন্য আবেদন জানাতে হয়। ইসরাইলি নাগরিকদের জন্যই শুধু সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষিত।
ফিলিস্তিনে বসবাসকারীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের ওপর আরোপ করে নানা বৈষম্যমূলক আচরণ। আইডি কার্ডে শ্রেণীবিভাজন ও আমলাতান্ত্রিক বিধিনিষেধ তেমনি একটি পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে ১৯৫২ সালের ‘ল অব এন্ট্রি টু ইসরাইল’ এবং ১৯৭৪ সালের ‘এন্ট্রি টু ইসরাইল রেগুলেশন’ তেমনি দু’টি বৈষম্যমূলক আইনি হাতিয়ার। ফিলিস্তিনীদেরকে বিদেশ যেতে হলে ইসরাইলের কাছে থেকে রি-এন্ট্রি ভিসা সংগ্রহ করতে হয়, নইলে এরা ফিরে আসার অধিকার হারিয়ে ফেলে। ফিলিস্তিনীরা অন্য কোন দেশে পাসপোর্ট গ্রহণ করলে কিংবা গ্রহণের আবেদন করলেই ইসরাইলে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার হারায়। ইহুদিদের ক্ষেত্রে এসব শর্ত আরোপ করা হয় না। তা ছাড়া বিদেশে সাত বছরের বেশি অবস্থান করলেও ইসরাইলে বসবাসের অধিকার হারায় ফিলিস্তিনীরা। ১৯৯৬ সালে ইসরাইল সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, জেরুসালেমে বসবাসরত কোনো ফিলিস্তিনী পশ্চিম তীরে গিয়ে সাত বছরের বেশি বসবাস করলেও ইসরাইলে স্থায়ী বসবাসের অধিকার হারাবে। এমনি আরো শত বাধা অধিকৃত ফিলিস্তিনীদের ওপর প্রয়োগ করছে বর্বর ইসরাইলিরা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হল ইসরাইল। সন্ত্রাসের মাধ্যমে এ রাষ্ট্রের জন্ম এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমেই ইসরাইল বিশ্বব্যাপী ধিকৃত। মুহাম্মদ হাসনাইন হাইকল ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত শহীদ, আহত ও পঙ্গু ফিলিস্তিনীদের পরিসংখ্যান দিয়েছেন এভাবে :
২,৬১,০০০ জন শহীদ
১,৮৬,০০০ জন আহত
১,৬১,০০০ জন পঙ্গু।
এছাড়া প্রায় দু মিলিয়ন ফিলিস্তিনী স্বদেশ ছেড়ে বাইরে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের পরিবারবর্গ সহ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সে দু’মিলিয়ন দেশছাড়া ফিলিস্তিনী এখন ৫ মিলিয়নে পৌঁছে গেছে। সঠিক সংখ্যা হচ্ছে ৫ মিলিয়ন ৪ লক্ষ।
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মার্কিন মদদপুষ্ট ইহুদীরা হেবরনের ইব্রাহিম মসজিদে হামলা চালিয়ে ফজরের নামায আদায়রত শতাধিক মুসলিমকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ১৯৯৪ সালের ২রা মার্চ ইসরাইলী বাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে ৬ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালের ২ জানুয়ারী সেনাবাহিনীর একটি টহলদার ইউনিট ৪ জন ফিলিস্তিনী পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকান্ডের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইহুদী সৈন্যরা বলে যে, অন্ধকারে তারা পুলিশকে সন্ত্রাসী মনে করে গুলি চালিয়েছিল।
৫ জানুয়ারী ১৯৯৬ ইসরাইলী সিক্রেট পুলিশ ‘শিনবেথ’ এক গোপন বোমা হামলায় নেতৃস্থানীয় ফিলিস্তিনী যোদ্ধা আয়াশকে হত্যা করে। ২৫ আগস্ট ১৯৯৬ বিনা অনুমতিতে নির্মিত হবার অজুহাতে ইসরাইল সরকার পূর্ব জেরুসালেমের একটি ফিলিস্তিনী প্রতিষ্ঠানের ভবন ভেঙ্গে দেয়। এই একই দিনে ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরব অধ্যুষিত রামাল্লা এলাকায় ইহুদী আবাসনের লক্ষ্যে নতুন ৯০০ গৃহ নির্মাণের নির্দেশ জারী করেন। পূর্ব জেরুসালেম এলাকায় ইহুদীদের আবাসনের জন্য আরও ১৩২টি ইমারত নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ইসরাইলী প্রতিরক্ষারমন্ত্রী নাবলুস এলাকায় ফিলিস্তিনীদের জমি জবরদখল করে ইহুদীদের জন্য আরও ১২০০ গৃহ নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন।
১৯৯৭ সালের ২৮ জানুয়ারী ইসরাইল সরকার ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকৃত জেরুসালেম ও বেথেলহেম শহরের মধ্যবর্তী আরব এলাকা ‘হার হোমা’য় এক লক্ষ জন অধ্যুষিত একটি ইহুদী আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করার অনুমিত প্রদান করে। অথচ অসলো চুক্তির শর্তানুসারে নেতানিয়াহু সরকারই ১৯৯১ সালে গৃহীত এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। ‘প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের পর পর দুটি পত্রের অনুরোধকে উপেক্ষা করে নেতানিয়াহু ১৮ মার্চ ১৯৯৭ ‘হার হোমা’ প্রকল্পটি চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেন। পরদিনই বেথেলহেমে গোলযোগ শুরু হয়। ২১ মার্চ ১৯৯৭ হেবরনে ফিলিস্তিনী বিক্ষোভকারীদের মিছিলে গুলিবর্ষণ করে ইসরাইলী বাহিনী একজনকে হত্যা এবং অপর ১০০ জনকে মারাত্মকভাবে আহত করে। ৮ এপ্রিল ১৯৯৭ ইহুদী বাহিনী ৯ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০০ ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১২ বছর বয়স্ক ফিলিস্তিনী বালক মুহাম্মাদ আল দুররাহ। ২৯ মার্চ, ‘২০০২ অপারেশন ডিফেন্সশীলন্ড’ এর আওতায় ইসরাইল ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকাগুলিতে প্রবেশ করে হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি ধ্বংস করে দেয় ‘ ফিলিস্তিন অথরিটির’ প্রশাসনিক কাঠামো। বন্দী করে প্রায় ৮৫০০ ফিলিস্তিনীকে। পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতকে (১৯২৩-২০০৪) গৃহবন্দি করা হয় তাঁর রামাল্লা সদর দফতর মুকাত্তাতে। ৯-১৯ এপ্রিল ২০০২ ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান এবং বুলডোজার সজ্জিত ইসরাইলী বাহিনী মাটির সাথে গুড়িয়ে দেয় জেনিন শরণার্থী শিবির। বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় কমপক্ষে ৫০ জন, গৃহ হারা হয় কয়েকশত ফিলিস্তিনী। ঘটনার তদন্তে গঠিত জাতিসংঘ কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইল। ১৩ এপ্রিল ২০০২ আল ফাতাহ সাধারণ সম্পাদক, নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা মারওয়ান বারঘোটিকে গ্রেফতার করে ইসরাইলী বাহিনী। ২২ মার্চ ২০০৪ ফজরের নামায শেষে হুইল চেয়ারে বসা অত্যাচারিত ফিলিস্তিনী জনতার আধ্যাত্মিক নেতা আল হারকাতুল মুকাওয়ামাতুল ইসলামিয়াহ (হামাস) এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিন (১৯৩৬-২০০৪) বাসায় ফেরার পথে ইসরাইলী হেলিকপটার থেকে নিক্ষিপ্ত গোলায় শহীদ হন। শহীদের পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হয় গাজার রাজপথ। মুত্যৃমুখী ফিলিস্তিনী জনতাকে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা দিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় বীর শেখ ইয়াসিন। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই তিনি বেঁচে ছিলেন।
২০০৪ সালের ১৭ এপ্রিল গাজা সিটিতে যাওয়ার পথে হামাস প্রধান আবদুল আজিজ রানতিসির (১৯৪৭-২০০৪) গাড়ী লক্ষ্য করে ইসরাইলী হেলিকপটার থেকে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। এতে তাঁর পুত্র মুহাম্মাদসহ দুজন সঙ্গী শহীদ হন এবং মারাত্মক আহত অবস্থায় রানতিসিকে গাজার আস শিফা হাসপতালে নেয়ার পর তিনি শাহাদাত বরণ করেন। উল্লেখ্য যে তিনি ১৯৯৩-১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ইসরাইলী কারাগারে আটক ছিলেন, এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রানতিসি আরও ১০ বার কারাবরণ করেন। ২০০৬ সালের ২৪ জুন ইসরাইল গাজা থেকে একজন ফিলিস্তিনী চিকিৎসক ও তাঁর ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। এই অপহরণের প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিস্তিনী যোদ্ধারা ২৫ জুন গাজা সীমান্তে ইসরাইলী সেনা চৌকিতে হামলা চালায়। এতে ২ জন সৈন্য নিহত হয়। ফিলিস্তিনী যোদ্ধারা গিলাত শালিত নামক একজন ইহুদী সৈন্য অপহরণ করে। অপহৃত সৈন্যকে উদ্ধারের নামে ইসরাইল গাজায় বেসরকারী ভবন, বাড়িঘর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটসহ বহু স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। শতাধিক ফিলিস্তিনী প্রাণ হারায়। আহত হয় অনেক। ২৯ জুন ২০০৬ ইসরাইলী সেনারা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ৯জন মন্ত্রী ও ২০ জন পার্লামেন্ট সদস্যসহ ৬৪ জন হামাস সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। এ কাজ সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা। একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের মত একটা স্বাধীন দেশের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আটক করেছে ইসরাইল। বিশ্ববাসী এই বর্বরোচিত ঘটনায় বিস্মিত হয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর ২০০৮ গাজা উপত্যকায় এহুদ ওলমার্টের ইসরাইলী সেনারা আক্রমণ শুরু করে। দু সপ্তাহ ধরে একটানা হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের চূড়ান্তপর্ব শেষ হয়। প্রায় প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ হতাহত হয়েছে। ডঃ এরিক ফস জানান, গাজার শিফা হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। টেলিভিশনে তিনি কথা বলার সময়ই নারী-শিশুসহ শত শত আহত ফিলিস্তিনী ওই হাসপাতালে আসছিল। এম্বুলেন্সের সাইরেনে কেঁপে উঠছিল পুরো গাজা। এরিক ফস জানান, ‘আহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক ব্যক্তি। বহুসংখ্যক শিশু মারাত্মক আঘাত পেয়ে হাসপাতালে এসেছে।’ ‘নিহতদের অন্তত ২০ ভাগ শিশু।’
অন্যান্য আরবদেশে ইসরাইলের সন্ত্রাস
ইসরাইল একক বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন মদদে বেপরোয়া ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। অধিকৃত ফিলিস্তিনে নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি ইসরাইল লেবাননের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে হামলা করে জেনেভা ও জাতিসংঘ প্রস্তাব লংঘন করে। ইসরাইল বৈরুতে নির্বিচার বোমাবর্ষন করেছে, সেখানে তারা যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে, নির্বিচারে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এগুলো সবই যুদ্ধাপরাধ। ১৯৮২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে দক্ষিণ লেবানন দখলদারিত্বের সময় ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে লিটানি থেকে লেবাননের অতিপ্রয়োজনীয় পানি, এমনকি ভূউপরিস্থ পলিমাটিও নিয়ে যায়। এছাড়া তারা লেবাননী নাগরিকদের অপহরণ ও লুটতরাজ অব্যাহত রাখে। হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ জোরদার হওয়ায় ২০০০ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন ছেড়ে যায়।
এর আগে ১৯৬৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইসরাইল বৈরুত বিমান বন্দরে হামলা চালিয়ে ১৩টি বেসামরিক বিমান ধ্বংস করে দেয়। ১৯৭৩ সালের ১০ এপ্রিল ইসরাইলী কমান্ডোরা বৈরুতে হামলা চালিয়ে ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ তিন ফিলিস্তিনী নেতাকে হত্যা করে। ১৯৭৮ সালের ১৪-১৫ মার্চ একটি ফিলিস্তিনী হামলার জবাবে ইসরাইল বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। লিতানি নদী পর্যন্ত বিশাল এলাকা ইসরাইল দখল করে নেয়। ১৯৮২ সালের ৬ জুন বৃটেনে নিযুক্ত ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত স্লোমো আরগভকে হত্যা চেষ্টার বদলা নিতে ইসরাইল ‘অপারেশন পিস ফর গ্যালিলি’ শিরোনামে লেবাননে পূর্ণ আগ্রাসন চালায়। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ লেবাননের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বশির জামায়েল আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। পরদিন ইসরাইল বাহিনী পশ্চিম বৈরুত দখল করে। ইহুদী মদদপুষ্ট ফালানজিস্ট বাহিনী ১৬-১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ পশ্চিম বৈরুতে সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনীদের নির্বিচারে হত্যা করে। এটি ইতিহাসে অন্যতম জঘন্য গণহত্যা যা সাবরা-শাতিলা গণহত্যা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৯ সালের ২৮ জুলাই ইসরাইলী জিবসিতে হিজবুল্লাহ নেতা শেখ আব্দুল করিম উবায়েদকে অপহরণ করে। ১৯৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী দক্ষিণ পূর্ব সিডনে ইসরাইলী হেলিকপটার গানশিপের হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহ সেক্রেটারী জেনালের শেখ আববাস আল মুসাবি। এই হত্যাকান্ডের জন্য এ সময়ের সেনা কর্মকর্তা ও পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এ্যারিয়েল শ্যারণকে দায়ী করা হয়। ১৯৯৩ সালে ইসরাইল আবারো লেবাননে হামলা চালায় হিজবুল্লাহকে নির্মূল করার জন্য। ২৫-৩১ জুলাই পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী যুদ্ধ চলে। ১৯৯৬ সালের ১১ এপ্রিল ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন এবং বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় জিলায় হিজবুল্লাহর ঘাঁটিগুলোতে ব্যাপক বোমা হামলা চালায়। এই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন গ্রেপস অব র‌্যাথ’ (ক্রোধের আঙ্গুর অভিযান)। প্রায় ৪০০ সাধারণ মানুষ এতে প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮ এপ্রিল ১৯৯৬ কানায় একটি জাতিসংঘ শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলী হামলায় ১০০ এরও বেশি লেবানিজ শরণার্থী প্রাণ হারায়। ১৯৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী হিজবুল্লাহ মহাসচিব আচাম আল মুসাভি নিহত হন। ইসরাইলী একাধিক হেলিকপটার গানশিপ তাঁর গাড়ি বহরে হামলা চালিয়ে এ ঘটনা ঘটায়। ১৯৯৪ সালের ২১শে মে ইসরাইলী কমান্ডোরা ‘আমল’ থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া গ্রুপ বিলিভার্স রেজিস্টান্স (বিশ্বাসীদের প্রতিরোধ) এর প্রধান মোস্তফা দিব আল দিরানিকে অপহরণ করে তাঁর বাড়ি থেকে। ২৪শে মে ২০০০ এস এল এর পতন এবং হিজবুল্লাহ বাহিনীর দ্রুত অগ্রসর হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়। ২৫শে মে দিনটিকে ২০০০ সাল হতে লেবাননে ‘প্রতিরোধ ও মুক্তি দিবস’ হিসেবে প্রতি বছর সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। ২০০৬ সালের ১২ জুলাই হিজবুল্লাহ দুইজন ইসরাইলী সৈন্যকে বন্দী করার পর ইসরাইল লেবাননে বিমান ও নৌ হামলা শুরু করে। ফলে অনেক বেসামরিক লোক নিহত হয়। ধ্বংস হয় বহু অবকাঠামো। লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় অর্জন করতে না পেরে হামলা চালিয়েছে নিরীহ জনগোষ্ঠী ও তাদের আবাসিক ভবনের উপর। এভাবেই আবাসিক কোয়ার্টার, কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র বোমা মেরে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিস্ফোরণ ও বিধ্বংসী শক্তির বিচার করে বলা যায়, ইসরাইল লেবাননে এটম বোমা ফেলেছে। সুপরিকল্পিত বোমা বর্ষণের দ্বারা ইসরাইল লেবাননের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই হলো প্রকৃত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ। ব্যাপক ধ্বংস ও সহিংসতার দ্বারা অসামরিক জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে ইসরাইল এসব করছে। লেবাননে ইসরাইলের এই কৌশল নতুন কিছু নয়। ১৯৬৮ সাল থেকে ইসরাইল অন্তত পাঁচবার লেবাননে এই কৌশল প্রয়োগ করেছে। ডজন ডজন সড়ক সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বৈরুত বিমান বন্দর ধ্বংস করেছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে হামলা করেছে। সামরিক নেতাদের গুপ্ত হত্যা করেছে।
আগ্রাসী ইসরাইল শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবাননে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পলায়নপর মানুষই নয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদেরও টার্গেট করে বোমা মেরে হত্যা করেছে। ইসরাইল ২০০৬ সালের ২৫ জুলাই দক্ষিণ লেবাননে কৈয়ার্ম শহরে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষন চৌকিতে বিমান হামলা চালিয়ে চারজন সামরিক পর্যবেক্ষককে হত্যা করে। নিহত চার পর্যবেক্ষক ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, কানাডা ও চীনের নাগরিক। চীন সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহববান জানায়। তদানীন্তন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টের নিছক দুর্ঘটনার দাবী প্রত্যাখ্যান করে একে পরিকল্পিত হামলা বলে কঠোর সমালোচনা করেন।
এন্টবী অপারেশন
১৯৭৬ সালে ইসরাইল উগান্ডার এন্টবী বিমান বন্দরে হামলা চালায় তার হাইজ্যাক করা যাত্রীবাহী বিমান উদ্ধারে। এ অভিযান সফল হয়। এন্টবী অভিযানই পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিনকে সর্বোপরি ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের আরো বেপরোয়া ও দুঃসাহসী করে তোলে।

ইরাকের ‘আসিরাক’ পারমাণবিক প্রকল্পে ইসরাইলের বিমান হামলা
১৯৮১ সালের ১৪ই জুন রোববার ইরাকের ‘আসিরাক’ পারমানবিক প্রকল্পে ইসরাইলের বিমান হিমালা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের জঘন্য উদাহরণ। বাগদাদের কাছে আসিরাক পারমাণবিক প্রকল্পটি অবস্থিত ছিল। ইসরাইলী জঙ্গী বিমান হামলা চালিয়ে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লী ধ্বংস করে দেয়। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী মেনাহেম বেগিন (১৯৭৭-১৯৮৩ কার্যকাল) এ অভিযানের নামকরণ করেছিলেন ‘অপারেশন ব্যাবিলন’। মাত্র কয়েক মিনিট সময়ে ইসরাইলী ক্রেক পাইলটের দুটি দল একটি অত্যাধুনিক ও সুরক্ষিত এবং চারপাশে বিমান বিধ্বংসী কামান ও স্যাম ৬ ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে ঘেরা একটি পারমাণবিক প্রকল্প ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। কতটুকু গোপনয়তা রক্ষা করলে কিরূপ দুর্ধর্ষ ও বলিষ্ঠ মনের অধিকারী হলে এবং পরিকল্পনা কতটুকু নিখুঁত হলে দুটি বৈরী দেশের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে স্বীয় ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারে বেগিনের ‘অপারেশন ব্যাবিলন’ তথা ইসরাইলীদের ভাষায় ‘ইরাকের গোপন অভিসন্ধি’ ব্যর্থ করে দেয়ার সফল অভিযান। মুত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এমন ২৪জন ক্রেক পাইলট এ অভিযানে এফ-১৫ ও এফ-১৬ নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এমন একজন কর্নেল যিনি ১৯৬৭, ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে আরবদের বিরুদ্ধে কমব্যাট মিশনে কাজ করেছেন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত মিশরের সিনাই অঞ্চলের ইতজিয়ন বিমান ঘাঁটি থেকে জর্ডন ও সৌদী আরবের উপর দিয়ে গিয়ে ইরাকের পারমাণবিক চুল্লিতে হামলা করা হয়। সিনাইয়ের বিমান ঘাঁটি থেকে লক্ষ্যবস্ত্তর দূরত্ব, উষর মরুভূমির ভয়াবহতা, জর্ডন ও সৌদী আরবের রাডার যন্ত্রকে ফাঁকিয়ে দিয়ে যাওয়া, সর্বোপরি বাগদাদের রাডার সজ্জিত এবং লক্ষ্যবস্ত্তর চারপাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত স্যাম-৬ ক্ষেপনাস্ত্র সজ্জিত এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী ইসরাইলীরা ফিরে আসতে সক্ষম হয়। সাড়ে ছ’শ মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বাগদাদে হামলা চালানো যতোই কঠিন হোক ইসরাইলী পাইলটরা সেটি করেছে। কতিপয় বিমান অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড়ে যায়। কয়েকটি খুব উঁচু দিয়ে আর কয়েটি বিমান ঘন কুয়াশার জাল বিস্তার করে আকাশপথে, যাতে করে শত্রুপক্ষের রাডার যন্ত্রকে ফাঁকি দেয়া যায়। তাছাড়া এমন গাঢ় ধোঁয়া বিমানগুলো থেকে ছাড়া হয় যেন কয়েকটি যাত্রীবাহী ও বাণিজ্যিক বিমান আকাশে উড়ছে এমনটি মনে হয়। ১৫টি এফ-১৫ ইন্টারসেপটার ধেয়ে এলো মরুভূমি দিয়ে। পাহাড়ের দিক থেকে এলো কয়েকটি এফ-১৬ ফাইটার বম্বার। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো কি যেন ঘটে গেলো। বিনা মেঘে যেন ভয়াবহ ও প্রলয়ঙ্করী বজ্রপাত। মাত্র দু মিনিট সে প্রলয় নেশার তান্ডব চললো। তারপরই সবাই দেখলো, আসিরাক পারমাণবিক চুল্লী থেকে মারাত্মক অগ্নিকুন্ডলী বের হচ্ছে যা ক্রমে সে প্রকল্পটিকেই বিধ্বস্ত করে দেয়। সব কাজ শেষ করে পরদিন রাতে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন বলেন, ইরাক পারমাণবিক চুল্লী পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করলে ইসরাইল আবারো তা ধ্বংস করে দেবে। তিনি আরো বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলের যতো নিন্দে করা হয়েছে, তাতে কিছু যায় আসে না। ইসরাইলের ক্ষমা চাওয়ারও কিছু নেই।
মুসলিম বিশ্বের প্রভাব প্রতিপত্তিকে বাধা দেয়ার জন্য ইহুদী পরিকল্পনা কত সূদুর প্রসারী তা বুঝা যায় পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা করার সাত মাস আগে ১৯৮০ সালে ইরাকী আণবিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা ডঃ ইয়াহিয়া আল মেশহাদকে প্যারিসের হোটেল কক্ষে ইসরাইলী গুপ্ত ঘাতক সংস্থা কর্তৃক হত্যা করা থেকে। এখানে উল্লেখ্য যে ইরাকের নিকট বিক্রীত ফ্রান্সের পারমাণবিক রিএ্যাকটর বাগদাদে নিয়ে যাওয়ার পথ থেকেই হাইজ্যাক করার প্লান ছিল ইহুদী সন্ত্রাসবাদীদের। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষান্ত হয়নি ইসরাইল।
১৯৮৪ সালের ২৯শে জুন বৈরুতগামী সাইপ্রাসের ফেরী জাহাজ ইসরাইলী সন্ত্রাসবাদীদের হাইজ্যাকের শিকার হয়। যাত্রীদেরকে জিম্মী হিসেবে আটক করা হয়।

তিউনিসে পিএলওর সদর দফতরে ইসরাইলী বিমান হামলা
১৯৮৫ সালের ১লা অক্টোবর সহস্রাধিক কিলোমিটার দূরে তিউনিসে অবস্থিত ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (PLO) সদর দফতরে ইসরাইল বিমান হামলা চালিয়ে তা বিধ্বস্ত করে।
সুদানের সামরিক বহরে ইসরাইলী বিমান হামলা
১৫ জানুয়ারী ২০০৯ সুদানের মরুভূমিতে সন্দেহভাজন গাজাগামী অস্ত্রবহনকারী একটি গাড়ী বহরের উপর ইসরাইল বিমান হামলা চালায়। ইসরাইলের দুজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে চাইম ম্যাগাজিন এ তথ্য জানিয়েছে। ৩০ মার্চ ২০০৯ টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্টে বলা হয়, ২৩টি ট্রাকের একটি সামরিক বহরের ওপর হামলা চালিয়েছিল ইসরাইলের যুদ্ধ বিমান। কয়েক ডজন ইসরাইলী যুদ্ধ বিমান এ হামলায় অংশ নিয়েছিল।
ইহুদীরা সন্ত্রাসী। এরা চুক্তিভংঙ্গকারী, অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী, কাপুরুষ, বর্বর, অকৃতজ্ঞ, দাম্ভিক, বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকির প্রতীক। দুনিয়ার দিক দিগন্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অভিশপ্ত বাস্ত্তহারা ইহুদীরা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের উপর অমানবিক নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করছে ঘরবাড়ি থেকে। আসলে ইহুদীরা বিচ্ছিন্ন ও বিপদাপন্ন। জেফ হ্যালপার সন্ত্রাসী ইসরাইলী মনোভাবের একটি তালিকা পেশ করেছেন যা নিম্নরূপ :
১. ইসরাইল হচ্ছে শিকার, লড়ে চলছে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আরবরা স্থায়ী শত্রু, তারা শান্তি প্রত্যাখ্যান করে। তারা ইসরাইল ধ্বংস করতে মরিয়া, এ দ্বন্দ্ব অপরিহার্য।
২. ফিলিস্তিনী সন্ত্রাসই মূল সমস্যা, ইসরাইল এর জন্য দায়ী নয়, ইসরাইল যা করে শুধু তার নিরাপত্তার জন্যই করে।
৩. ইসরাইল কোনো ধরনের দখল করেনি, ভূমিগুলো বিরোধপূর্ণ ও বিতর্কিত এবং
৪. কোনো রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়; ইসরাইলকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে বলতে হবে; দুর্গ ইসরাইল’ অবস্থা বজায় রেখেই চলতে হবে; একমাত্র বেনতুস্তান ধরনের ফিলিস্তিন আলাদা রাষ্ট্র হতে দেয়া যেতে পারে; অ-টেকসই, আধা-সার্বভৌম, চারপাশ দিয়ে ইসরাইল বেষ্টিত এবং পাশের শক্তিশালী প্রতিবেশী ইসরাইলের ইচ্ছা-অনিচ্ছানির্ভর।
ইসরাইলীদের সামগ্রিক মনোভাবটাই জেফ হ্যালপার সংক্ষেপে তালিকাভুক্ত করেছেন এভাবে। এসব মনোভাব কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর এ ধরনের অবাস্তব আর অকার্যকর মনোভাব নিয়েই ইহুদিরা আগে থেকেই বন্ধ করে রেখেছে ফিলিস্তিন সমস্যার শান্তি-সমাধান, পুনঃ বন্ধুত্ব স্থাপন, সত্যিকারের নিরাপত্তা, সুষ্ঠু ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধানের যাবতীয় পথ। সে কারণেই ফিলিস্তিন সমস্যা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন সমস্যা। এখনো ইসরাইল তা অব্যাহত রাখছে তার নিজের স্বার্থে। আর তার নিজের কৃতকর্মের জন্য অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে ফিলিস্তিনীদের ওপর। আর পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট হওয়ার কারণে এখনো এ ব্যাপারে ইসরাইল নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। বিশেষ করে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থন এ সমস্যা সমাধানের পথে বাধার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপর দিকে ফিলিস্তিনীরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে শুধু নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের ওপর ভরসা করে।
বছরের পর বছর ধরে ইসরাইল সমঝোতাকে পদদলিত করে আসছে বার বার। এড়িয়ে গেছে শান্তির পথ, বেছে নিয়েছে দ্বন্দ্ব আর দমন-পীড়নের-সন্ত্রাসের পথ। তেমন উদাহরণ বিস্তর। কিন্তু পাশ্চাত্য ও বিশ্বের মানুস সে সম্পর্কে জানে খুবই কম।
ইসরাইল দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার পথই বেছে নিয়েছে। একদিকে আরবদের বাস্ত্তচ্যুত করছে। অপর দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গড়ে তুলছে ইসরাইলি বসতি। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সমাধানের পথ জটিলতর হচ্ছে।
জর্জ বিটারের বক্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বিশ্বশান্তির জন্য সমস্যা হচ্ছে ইসরাইল। ইসরাইলকে ফিলিস্তিন ভূখন্ড থেকে সরিয়ে বিশ্বের অন্যত্র পুনর্বাসিত করলে ল্যাঠা যায়। আর তা করা হলে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা থাকবে না। আরবদের সঙ্গে ইসরাইলের ভাল সম্পর্ক স্থাপনের মূল কথা হচ্ছে, তাদের অধিকৃত ভূখন্ড ছেড়ে দিতে হবে। ইহুদীরাই আরব ভূখন্ড কেড়ে নিয়েছে।
এটাই সত্য যে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ইহুদী ইসরাইলের যে আগ্রাসী ভূমিকা, তা থেকে ইসরাইলকে কখনোই নিবৃত্ত করা যাবে না। এটা ইসরাইলের সহজাত স্বভাব দোষ। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর নাম শুনলেই ইহুদীদের মধ্যে এমন এক অস্বাভাবিক বিক্রিয়া (এলার্জি) ও প্রতিহিংসা সৃষ্টি হয়, যার কোন উপশমও নেই, চিকিৎসাও নেই। মুসলিম উম্মাহকে আজ শক্তির উৎসমূলে ফিরে আসতে হবে। যে শক্তিবলে একদিন মদীনা থেকে ইহুদীদের বিতাড়ন সম্ভব হয়েছিল, খাইবার থেকে উৎখাত সহজ হয়েছিল, জেরুসালেম কবজায় আনার সাধ্য হয়েছিল- সেই শক্তির আদি উৎসে প্রত্যাবর্তন করেই ইসরাইলী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

[প্রবন্ধটি ১৪ মে ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসাবে উপস্থাপিত হয়]

 

 

ফুটনোটঃ

. দখলদার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আগে ইরাকের ছিল ১০ লক্ষ্য সৈন্য। ছিল ৪৬৫০টি ট্যাংক।
. রসায়ন শিল্পের শহর খ্যাত সুইজারল্যান্ডের শিল্প সমৃদ্ধ নগরী ব্যাসেল। ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট (BIS) এর প্রধান কার্যালয় এই শহরেই অবস্থিত।
. তুরষ্কে উসমানীয় বংশের সুলতান আব্দুল হামিদ যখন ক্ষমতায় (১৮৭৬-১৯০৯), তখন ইহুদীরা তাঁর কাছ থেকে ফিলিস্তিনে জমি ক্রয় করতে চেয়েছিল। তিনি ইহুদীদের কাছে এক ইঞ্চি জমিও বিক্রি করতে রাজী হননি। এ জন্যে ফিলিস্তিন দখল করতে ইহুদীরা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।
. হারজেলের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক ইহুদী আন্দোলনের নেতা নির্বাচিত হন নাহুম সোকোলভ। তিনি ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইহুদীদের আর কোন লক্ষ্য নেই। বিস্তারিত দেখুন, মুহাম্মদ হাসনাইন হাইকল, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম, ইহুদী ষড়যন্ত্র ও আরবদের ভূমিকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ডিসেম্বর ২০০৩, পৃ. ১০৮।
. ওয়াইজম্যান তাঁর স্মারকে উল্লেখ করেছেন বেলফোর ছিলেন প্রোটেষ্ট্যান্ট খৃস্টান ও জায়নবাদী। তিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট তাওরাতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইহুদীরা পুনরায় ফিলিস্তিনে প্রত্যাবর্তন করবে। তিনি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আল্লাহর কাছে এর উত্তম বিনিময়ের আশা করেছিলেন।
. বেলফোর ঘোষণা বিষয়ে আরও জানার জন্য দেখুন মুহাম্মদ হাসনাইন হাইকল, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১০।
. Ben Halpern, the Idea of the Jewish state (Cambridge, Mass : Harvard university press, 1961, pp. 303-304.
. রাশিয়ায় ইহুদী বিরোধী আন্দোলনের ফলে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ হতে উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে ইহুদীদের ফিলিস্তিনে আগমনকে প্রথম ‘আগমন’ (আলিয়া) বলে অভিহিত করা হয়। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচটি আলিয়ায় ইহুদীগণ ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে।
. S. N. Eiesnstadt, Israeali Society (Landon : Weidenfeld and Ncolson, 1967), P. 11.
. লোক দেখানোর জন্য ব্রিটিশ বেনিয়ারা এরকম কয়েকটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। কিন্তু এসব কমিশনের সুপারিশ কখনই তারা বাস্তবায়ন করেনি। ১৯২০ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদী মুসলিম সংঘর্ষের পর পালিন কমিশন, ১৯২১ সালে হেক্রাফট কমিশন, ১৯২৯ সালে ‘অশ্রু প্রাকারের’ সংঘর্ষের পর ১৯৩০ সালে শ’ কমিশন, ১৯৩৬ সালে পীল কমিশন ও ১৯৩৮ সালে উজহড কমিশন গঠিত হয়।
. ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে কোন বৃহৎশক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কমিটির সদস্য দেশগুলি ছিল : অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চেকোশ্লোভাকিয়া, গুয়াতেমালা, ভারত, ইরান, হল্যান্ড, পেরু, সুইডেন, উরুগুয়ে ও যুগোশ্লাভিয়া।
. ১৯৪৬ সালের ১৬ জুন সন্ত্রাসবাদী হাগানা ফিলিস্তিনের সাথে পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর সংযোগ রক্ষাকারী ১১টি সেতু ধ্বংস করে।
. মেনাহেম বেগিনের নেতৃত্বে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদী দল ইরগুন ভাই লিউমী (Ergun zvai Leumi) সংক্ষেপে ইরগুন নামে পরিচিত। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসের ২৯ তারিখে জেরুসালেমের কিং ডেভিড হোটেলের একাংশ ইরগুন দলের সন্ত্রাসীরা ধ্বংস করে। এখানে সরকারী দফতরে কর্মরত শতাধিক বৃটিশ ও আরব নিহত হয়।
. Jon Kimche, the seven fallen pillars (New York, 1953) p. 228 এবং Menachen Bligion, the retold : Story of the lrgun (New York 1951)
. Musa Alami, The Lesson of Palestine Middle East Journal, October, 1949.
. ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের জাতীয় নেতা ছিলেন জেরুসালেমের মুফতি আমিন আল হুসাইনী, তাঁর পুরো নাম ছির মোহাম্মদ সাঈদ হাজী আমিন আর হুসাইনী। তিনি পবিত্র নগরী জেরুসালেমের হুসাইনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন।
. এ সম্বন্ধে দেখুন, Pamela Ferguson, The Palestione Problem (London: Martion Brian, 1973) P. 55.
. সফিউদ্দিন জোয়ারদার, আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, বাংলা একাডেমী, এপ্রিল ২০০৩, পৃ. ৩৯২।
. Sir John Bagat Glubb, A Soldier with the Arabs (London: Hodder and Stoughton, 1959, PP 94-95.
. এ বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, এ এন এম সিরাজুল ইসলাম, আল আকসা মসজিদের ইতিকথা, বিআইসি, এপ্রিল ১৯৯২, পৃ. ৯২-৯৪।
. জেফ হ্যালফার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম নেয়া একজন ইসরাইলি অধ্যাপক। যিনি একজন শান্তিবাদী ও মানবাধিকার কর্মী। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘ইসরাইল কমিটি এ্যাগেইনিষ্ট হোমডিমোনিউশন’ তথা ICAHDI জেফ হ্যালপার এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসরাইলের দখলদারী নীতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনেক ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ও ‘সিভিল ডিস অবিডিয়েন্স’ কর্মসূচীর আয়োজন করেন।
. উদ্ধৃত গোলাপ মুনীর, ইসরাইল তোমার ষাট বছরের পাপ (প্রবন্ধ), অন্যদিগন্ত অক্টোর ২০০৮ সংখ্যা, পৃ. ৯৪।
. মুহাম্মদ হাসনাইন হাইকল, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১।
. ইসরাইলী হামলায় হামাসের আধ্যত্মিক নেতা শেখ ইয়াসীন শহীদ হলে রানতিসি হামাস প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, হামাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান মুখপাত্র এবং ফিলিস্তিনী মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। ফিলিস্তিনের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের হত্যা পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় ইসরাইলী হামলায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
. ডঃ এরিক ফস নরওয়েজিয়ান চিকিৎসক। এই একমাত্র বিদেশী চিকিৎসককে হামলাকালীন সময়ে গাজায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে হানাদার ইহুদীরা। ইহুদী নরহত্যার সাক্ষী এই নরওয়েজিয়ান চিকিৎসক সিএনএন টেলিভিশনে যে সাক্ষাৎকার প্রদান করছেন তা থেকে গাজায় ইসরাইলী নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জানতে পারে বিশ্ববাসী। বিস্তারিত দেখুন সাপ্তাহিক কাগজ, ১১ জানুয়ারী ২০০৯, পৃ. ২১-২৪।
. প্রায় ১১০০ (লেবানীজ শহীদ হন। ৯ লাখ লেবানীজ উদ্বাস্ত্ত হয়ে পড়েন। বাড়িঘর ধ্বংস হয় ৭ হাজার। সেতু ধ্বংস হয় ৬২টি।
. দেখুন দৈনিক সংগ্রাম, ৪ এপ্রিল ২০০৯ সংখ্যা, পৃ.৭।
. মাসিক অন্য দিগন্ত, অক্টোবর ২০০৮ সংখ্যা, পৃ. ৯৫।
. জর্জ বিটার, ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে নিযুক্ত লেবাননের চার্জ দ্য এফেয়ার্স।
. অগাস্ট ২০০৬ প্রথম আলো পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে জর্জ বিটার এ বক্তব্য রাখেন। দেখুন মাসিক অন্যদিগন্ত, অক্টোবর ২০০৮, পৃ. ১৩২।