ভূমিকা

সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম। আঞ্চলিকভাবে ভূ-রাজনৈতিক (Geo-Political), ভূ-কৌশলগত (Geo-Strategic) দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক এলাকা। ভারত মহাসাগরের প্রবেশ পথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যন্ত তাৎপর্যময় ভৌগলিক অবস্থান জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানচিত্রের উপর চোখ বুলালে বুঝা যায় যে, ভূ-খন্ডটি নিছক একটি ভৌগলিক অঞ্চলই নয়, উত্তরে ভারতের অংশ বিশেষসহ চীন, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পূর্বে ভারতের বিতর্কিত ও বিদ্রোহী এলাকা এবং পূর্বে মায়ানমার- এসব কিছু মিলিয়ে তা একটি স্ট্রাটেজিক ইউনিটের রূপ ধারণ করে। গত কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশেরই এই পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত কিছু লোক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী তৎপরতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে।

ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অনুবর্তী পশ্চাদভূমি হিসেবে এবং চীন, ভারত আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ান (ASEAN) ভুক্ত অর্থনৈতিক শক্তির প্রায় সমদুরবর্তী প্রভাবভূমি (Vicinal Land) হিসেবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-ভাগটি বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও গুরুত্ববহন করে এবং এটি বিশেষ তাৎপর্যময় স্থানে অবস্থিত। বাংলাদেশের এই বৃহৎ পার্বত্য অঞ্চলটি সব দিক থেকে ভূমি পরিবেষ্টিত। অঞ্চলটির সবচেয়ে নিকটতম সমুদ্র উপকূল দক্ষিণে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাইক্ষংছড়ি থেকে মাত্র ১২ কি. মি. পশ্চিমে কক্সবাজার জিলার উখিয়ার কাছে অবস্থিত। পার্বত্য রাঙ্গামাটির পশ্চিম প্রান্তের কাউখালি থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. দূরে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জিলার সংকীর্ণ একফালি ভূ-ভাগ, যা কোন স্থানেই পূর্ব-পশ্চিমে ৫০ কি.মি. এর চাইতে বেশি প্রশস্ত নয়, তা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমুদ্র থেকে পৃথক করে রেখেছে। চট্টগ্রামের বন্দর যা কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে তার নাব্যতা এবং সমস্ত চট্টগ্রামের বন্দর, কল-কারখানা এবং নগরীসহ সমস্ত জিলা, পাশ্ববর্তী কক্সবাজার, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী এবং লক্ষমীপুর জিলা সমূহের বিদ্যুতের সরবরাহ এই কর্ণফুলীর পানির উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া নৌপরিবহন এবং কৃষির জলসেচ ব্যবস্থার জন্য কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জিলাদ্বয় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রবাহিত কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা ইত্যাদি নদীর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। এইভাবে দেখা যায় যে, সমস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জিলাদ্বয়ের প্রায় দেড়কোটি মানুষের জীবন জীবিকা তথা অস্তিত্ব এবং বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের অস্তিত্ব ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অন্যতম উৎস পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে জড়িত। এ সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাছাড়া দুর্গম এবং পর্বতঘেরা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দর, মহানগর ও অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জিলার ভূ-ভাগকে ভূ-রাজনৈতিক এবং অবস্থানগত দুর্ভেদ্যতা দান করেছে। অন্যকথায় আল্লাহ না করুন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতায় চট্টগ্রাম অঞ্চল কৌশলগতভাবে (Strategically) ঐ এলাকাকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দুর্বল ও প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য দান করবে। বস্তুত এ জন্যই আধিপত্যবাদ, নব্য উপনিবেশবাদের এজেন্টরা বাংলাদেশের মানচিত্রের দশভাগের উপর লোমশ-নখর কালো থাবা বিস্তার করেছে। ড. এমাজউদদীন আহমদ লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে যে নিষ্ঠুর খেলা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূগোল
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুদুর অতীত থেকেই সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সে যুগে চট্টগ্রাম ছিলো বাংলার হরিকল জনপদ নিয়ে গঠিত। এটি ছিলো বরাবর বাংলাদেশের কন্টিগিউয়াস টেরিটোরি এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে এর সুস্পষ্ট, সুসংবদ্ধ গঠন ও অবয়ব প্রদানকারী অঞ্চল। বাংলাদেশের এক-দশমাংশ সার্বভৌম ভৌগলিক এলাকায় বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে হালকা জনসংখ্যা অধ্যুষিত অথচ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম পাহাড়ী ও বনাবৃত অঞ্চল। এখন থেকে ২০ কোটি বছর পূর্বে এ অঞ্চলে বিদ্যমান টেথিস সাগরের (Sea of Tethis) তলদেশ থেকে হিমালয় পর্বতমালার উত্থানের সময় শুরু হওয়া গিরিজনি আন্দোলনের (Mountain Building Tectonic Movement) ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সারি সারি পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ছোট ছোট টিলা, পাহাড়, উপত্যকা, নদী, হ্রদ, নালা-ঝর্ণায় পরিপূর্ণ। উঁচু-নীচু পাহাড়-পর্বত, পার্বত্য নদ-নদী, ঊর্বর উপত্যকা আর দুর্গম ঘন চিরহরিৎ বনভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে দান করেছে এক অনন্য নিসর্গ, আরণ্যক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি আর বৈচিত্রময় ভূগোল। প্রাণ বৈচিত্র, বনজ, কৃষি সম্পদের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানী তেল, ইউরেনিয়াম, মহামূল্যবান প্লাটিনামসহ বিভিন্ন খনিজ ধাতু এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ এ অঞ্চলে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পারমাণবিক চুল্লির অপরিহার্য জ্বালানী ইউরেনিয়ামের মওজুদ থাকার এক সম্ভাবনাময় এলাকা হলো এ তিনটি পার্বত্য জিলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ অতি মূল্যবান। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উপেক্ষণীয় নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাংশে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাংশে আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে প্রায় ২১۫ ২৫′ থেকে ২৩۫ ৪০′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১۫ ৫৫′ থেকে ৯২۫ ৪৫′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ভৌগলিক অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশ জুড়ে পর্বত সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম বা Chittagong Hill Tracts এর অবস্থান।
বাংলাদেশের তিনটি প্রশাসনিক জিলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন এর মোট ১৩,২৯৫ বর্গকিলোমিটার বা ৫০৯৩ বর্গমাইল এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্ত। ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম হতে পৃথক করে জিলার মর্যাদা প্রদান কালে এর আয়তন ছিল ৬,৭৯৬ বর্গমাইল। ১৯০১ সালে এর আয়তন হ্রাস পেয়ে ৫,১৩৮ বর্গমাইলে দাঁড়ায়। সবশেষে ১৯৪৭ সালে ৫০৯৩ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ব বাংলায় তথা পাকিস্তানে যোগ দেয়। অর্থাৎ ৮৭ বছরে (১৮৬০-১৯৪৭) ১৭০৩ বর্গমাইল এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ আয়তন ৫০৯৩ বর্গমাইল হলেও এর প্রাকৃতিক তথা বাস্তব আয়তন অনেক বেশি। পার্বত্যভূমি আর সমতল ভূমির আয়তন প্রাকৃতিক কারণে এক ধরনের নয়। যেমন পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির উপর অবস্থিত একটি পাহাড় খন্ডের পাদদেশ, ঢাল, মধ্যবর্তী ভাঁজ, উপরিভাগ ও তলদেশের চড়া বা জমিসহ জ্যামিতিক পরিমাপ করলে প্রতি বর্গমাইল এলাকা বেড়ে সোয়া দুই বর্গমাইলে পরিণত হয়। এই দৃষ্টিকোণ হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তব আয়তন হবে কমপক্ষে ১১,৪৫৯.২৫ বর্গমাইল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিরূপের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করেই একে সাধারণ সমভূমির মতো ৫০৯৩ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট বলে গণ্য করা হয়, যা দেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জিলা পর পর অবস্থিত। উত্তরে খাগড়ছড়ি জিলা, মাঝখানে রাঙ্গামাটি জিলা ও দক্ষিণে বান্দরবান জিলা। এই তিনটি প্রশাসনিক জিলায় উপজিলা/থানা আছে ২৫টি। রাঙ্গামাটিতে ১০টি : রাঙ্গামাটি সদর, বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, নানিয়ারচড়, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি, কাওখালি, কাপ্তাই, রাজস্থলি। খাগড়াছড়িতে ৮টি : খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, মানিকছড়ি, লক্ষীছড়ি, মহলছড়ি। বান্দরবানে ৭টি : বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা, লামা, থানচি, আলিকদম, নাইক্ষংছড়ি। আয়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার, সিঙ্গাপুর, মরিশাস কিংবা লুক্সেমবার্গের চেয়ে বড়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিরূপ সমতল ভূমি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাহাড়পুঞ্জের মধ্যস্থলে রয়েছে উপত্যকা যা অনেকটা সমতল, বনভূমিময় এবং ঝরণাধারা, যেগুলোকে বলা হয় ‘ছড়া’ বা ‘ছড়ি’। এ অঞ্চলের পাহাড় শ্রেণী উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। এগুলোকে দশটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয় : সুবলং, মাইনি, কাসালং, সাজেক, হরিং, বরকল, রাইনখিয়াং, চিম্বুক, মিরিঞ্জা। পাহাড়গুলো সাধারণত ১০০ থেকে ৩০০০ ফুট পর্যন্ত উঁচু। পর্বতগুলোর উপত্যকা সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এবং উচ্চতা কয়েকশ’ ফুট থেকে কয়েক হাজার ফুট পর্যন্ত। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং এর উচ্চতা ২৯৬০ ফুট। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নিয়ে নতুন বিতর্কের সূচনা হয় পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে। বলা হচ্ছে কেওক্রাডং নয়, তাজিংডংই (সরকার নাম রেখেছেন ‘বিজয়’) হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। একটি সূত্র থেকে তাজিংডং এর উচ্চতা ৩১৮৫ ফুট বলে জানা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের উচ্চতা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাহাড় ও অরন্যের রাখি বন্ধনে চির সবুজ পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীর অন্যতম দৃষ্টি নন্দন স্থান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় ও উপত্যকায় বয়ে চলেছে অনেকগুলো পাহাড়ি নদী। প্রধান নদী ৭টি : চেংগি, মাইনি, কাসালং, কর্ণফুলি, রাইনখিয়াং, সাংগু, মাতামুহুরি। হ্রদ ৪টি। প্রধান হ্রদ কাপ্তাই, এটি মানব সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদ, বৃহৎ জলাধার যার আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩০০ বর্গমাইল। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ (দৈর্ঘ্য ১৮০০ ফুট, উচ্চতা ১৫৩ ফুট) দেয়ার ফলে এ হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই হ্রদে নানা জাতের প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। বাকি তিনটি প্রাকৃতিক হ্রদ। রাইনখিয়ানকাইন, বোগাকাইন ও নুনছড়ি মাতাই পুখিরী। কর্ণফুলী নদীর উৎস স্থলে রাইনখিয়ানকাইন হ্রদটি অবস্থিত। এই হ্রদের দৈর্ঘ্য এক মাইল। এখান থেকে পানি বের হবার রাস্তা আছে এবং এর পানিতে প্রচুর মাছও জন্মে। ১৮৭৫ সালে লেফটেন্যান্ট জর্জ গর্ডন এই হ্রদটি আবিস্কার করেন। এই হ্রদ পালতাই পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণপূর্বে রেমা ক্রিটিং এর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক হ্রদ গুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ প্রাকৃতিক হ্রদ হলো বোগাকাইন। এটি বান্দরবান পার্বত্য জিলার অন্তর্গত রুমা থানার পূর্বদিকে শঙ্খ নদীর তীর থেকে ১৬ মাইল অভ্যন্তরে নাইতং মৌজায় এক পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। এই প্রাকৃতিক হ্রদের তীরগুলি পরস্পর সমান্তরাল ভাবে অবস্থিত বলে এটিকে মানুষের খনন করা দীঘি বলে মনে হয়। হ্রদের তিনদিকে সমতল থেকে ১৫০ ফুট পর্যন্ত স্থান উচুঁ বাঁশঝাড়ে আবৃত পর্বতশৃংগ দ্বারা পরিবেষ্টিত। হ্রদের চতুর্দিকে ১৫০০ ফুট থেকে ২০০০ ফুট পর্যন্ত উচ্চ মালভূমি রয়েছে। এই হ্রদের গভীরতা ১২৫ ফুট।
মাতাই পুখিরী হ্রদ। ত্রিপুরা লোকদের ভাষায় এর অর্থ দেবতার পুকুর। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জিলার অন্তর্গত মহালছড়ি থানার সদর দপ্তর থেকে ১২ মাইল উত্তরে আলুটিলা ‘নুনছড়ি’ নামে একটি ছোট নদীর উৎসস্থলে এই হ্রদটি অবস্থিত। এই হ্রদটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত হলেও হ্রদের চতুর্দিকে মালভূমি দ্বারা বেষ্টিত বলে এটাকে সমতল ভূমির মধ্যে অবস্থিত বলে মনে হয়। এই হ্রদের আয়তন প্রায় দুই একর। প্রায় ৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হলেও এই হ্রদের ধারে দাঁড়িয়ে এর উচ্চতা অনুভব করা যায় না। এই হ্রদের পানিতে প্রচুর মাছ। এর পানি পান করা যায়। হ্রদের চারদিকে ঘনগাছের বন থাকায় এটিকে বেশি আকর্ষণীয় দেখা যায়।
ভৌগলিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি পার্বত্য রাজ্য ও মায়ানমারের পশ্চিম সীমান্তের সাথে সংযুক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরে ও খাগড়াছড়ি জিলার পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়পুঞ্জ ও মায়ানমারের অংশ, দক্ষিণে মায়ানমার, পশ্চিমে সমতল উপকূলীয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জিলা অবস্থিত। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৩৬.৮০ কিলোমিটার, মিজোরাম রাজ্যের সাথে ১৭৫.৬৮ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সাথে ২৮৮.০০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সমগ্র এলাকাটি ফেনী, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং এদের শাখা নদী ও উপনদীর উপত্যকা দ্বারা সুস্পষ্ট চারভাগে বিভক্ত হয়েছে। এসব উপত্যকাগুলো হচ্ছে- চেঙ্গী উপত্যকা, কাসালং উপত্যকা, রাইনখিয়াং উপত্যকা এবং সাঙ্গু উপত্যকা। মৌসুমী জলবায়ুর অন্তর্গত বৃষ্টি-বিধৌত মাঝারি ধরনের জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম গেরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শস্থানীয়।
বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠী বা উপজাতির সংখ্যা ৪৬।
সারণী -১
বাংলাদেশে বসবাসকারী নৃ-গোষ্ঠীর তালিকা। তালিকাটি ১৯৯১ সালের আদমশুমারী রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
নং নৃ-গোষ্ঠীর নাম সংখ্যা নং নৃ-গোষ্ঠীর নাম সংখ্যা
১ চাকমা ২,৫২,৮৫৮ ১৫ তংচংগ্যা ২১,৬৩৯
২ সাঁওতাল ২,০২,১৬২ ১৬ বুনো ৭,৪২১
৩ গারো ৬৪,২৮০ ১৭ হাজং ১১,৫৪০
৪ ত্রিপুরা ৮১,০১৪ ১৮ হরিজন ১,১৩২
৫ মারমা ১,৫৭,৩০১ ১৯ খাসী ১২,২৮০
৬ ঊম্ ১৩,৪৭১ ২০ কোচ ১৬,৫৬৭
৭ খুমি ১,২৪১ ২১ মাহাতো ৩,৫৩৪
৮ চাক ২,১২৭ ২২ মনিপুরী ২৪,৮৮২
৯ খীয়াং ২,৩৪৩ ২৩ মুন্ডা ২,১৩২
১০ লুসাই ৬৬২ ২৪ ওঁরাও ৮,২১৬
১১ ম্রো ১২৬ ২৫ পাহাড়িয়া ১,৮৫৩
১২ মুরং ২২,১৭৮ ২৬ রাজবংশী ৭,৫৫৬
১৩ পাংখো ৩,২২৭ ২৭ উরুয়া* ৫,৫৬১
১৪ রাখাইন ১৬,৯৩২ অন্যান্য ২,৬১,৭৪৩
মোট ১২,০৫,৯৭৮
*(কেবল ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে এদের উল্লেখ পাওয়া যায়)
পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ১২টি উপজাতি বাস করে। উপজাতিদের সবাই বহিরাগত। এখানে বসবাসকারী উপজাতিদের সম্মিলিত সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র .৪৫% (দশমিক চার পাঁচ শতাংশ)। এরা বিভিন্ন কারণে বিশেষতঃ নিরাপদ আশ্রয় লাভের সন্ধানে তিববত, চীন, মায়ানমার এবং ভারতের বিভিন্ন পাহাড়ী অঞ্চল থেকে অনধিক ৪০০ বছর আগে বাংলাদেশের ভূখন্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে। এদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে চাকমারা নবাগত। নৃতাত্বিক বিচারে এরা সবাই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ১২টি উপজাতিরই নিজস্ব কথ্য ভাষা আছে। দুই একটি উপজাতির লেখ্য ভাষা থাকলেও কোন বাস্তব ব্যবহার নেই। এক উপজাতি অন্য উপজাতির ভাষা বুঝে না। এক উপজাতির সদস্য অন্য উপজাতির সাথে কথা বলার সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। প্রতিটি উপজাতি বাংলা ভাষা বুঝে এবং নিজস্ব উপজাতির বাইরে আসলে বাংলা ভাষায় কথা বলে।
আধুনিকায়ন বিশেষতঃ বাঙ্গালী বসতি স্থাপনের ফলে উপজাতীয়দের সনাতন জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যাযাবর জীবন পরিহার করে এরা স্থায়ী বসতি স্থাপনে অভ্যস্থ হচ্ছে। সভ্য জগতের মানুষের মতোই এরা পরিপাটি পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও এখন আর আগের মতো দিগম্বর তরুণ-তরুণী দেখা যায় না। জুম-নির্ভর জীবিকা বলতে গেলে উঠেই যাচ্ছে। এর বিপরীতে এরা সমতলের মতো আধুনিক কৃষিকাজ আয়ত্ব করেছে। চাকুরী, ব্যবসাসহ সমতলের মানুষের মতোই এরা বিভিন্ন পেশায় আসতে শুরু করেছে। বহু উপজাতীয় এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে চাকুরী ও শিক্ষার্জন উপলক্ষে অবস্থান করছে। অনেকেই দেশের বিভিন্ন শহরে স্থায়ী বাসগৃহ গড়ে তুলেছে। দেশের সমতলের তুলনায় পার্বত্যবাসীরা অতি দ্রুত আধুনিকতা ও শহুরে জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম
আজকের যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এর আলাদা কোন প্রশাসনিক অস্তিত্ব বাংলাদেশের মুসলিম শাসনামলে ছিলো না। প্রকৃত প্রস্তাবে ১৮৬০ সালের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্বই ছিলো না। তখন এটি ছিলো চট্টগ্রাম জিলার অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের ভেতরে, সেই প্রাচীন হরিকেল জনপদ থাকা অবস্থায়। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করে পৃথক জিলায় পরিণত করা হয়। বৃটিশরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার্থে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলকে ভিন্ন জিলা ঘোষণা করে। শাসনের জন্য নিয়োগ করা হয় একজন তত্বাবধায়ক বা জিলা প্রশাসক। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম বৃটিশ জিলা প্রশাসক ছিলেন মি. টি. এইচ. লুইন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে আজকের বাংলাদেশে ১২০৪ সাল থেকে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে বিপর্যয় পর্যন্ত মুসলিম শাসন চালু ছিলো। অন্য কথায় বৃটিশ পূর্ব বাংলাদেশে মুসলিম শাসন ৫৫৩ বছর (১২০৪-১৭৫৭) স্থায়ী হয়েছিল। ১৩৪০ সালে বাংলার সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৫০খ্রী.) সোনারগাঁ থেকে চট্টগ্রামে অভিযান পরিচালনা করেন। ফলে তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনাধীনে আসে। সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ মেঘনার তীরবর্তী শহর ও নদীবন্দর চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন।
এরপর দীর্ঘকাল চট্টগ্রাম অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীনে থাকে। রাজমালার বর্ণনায় জানা যায় যে, ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য ১৫১৩-১৫ খ্রী. চট্টগ্রামের কিয়দংশ দখল করেন। বাংলার তদানীন্তন শাসক হোসেন শাহী বংশের পরাক্রমশালী সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) দ্রুত সেনাবাহিনী প্রেরন করে পুনরায় সমগ্র চট্টগ্রামের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। হোসেন শাহী আমলে আরাকানের মগ রাজা মং খা রী (১৪৩৪-১৪৫৯) চট্টগ্রামের রামু অঞ্চল দখল করেন। এ দখলদারীর বিরুদ্ধে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের নেতৃত্বে অভিযান প্রেরিত হয়। সুলতান ইলিয়াস শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪) তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে পুরো চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনরায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালে আরাকান রাজা স্বল্প সময়ের জন্য এ অঞ্চল দখল করেন। সামরিক অভিযান পরিচালিত হয় আরাকান সম্রাট নুসরাত খানের নেতৃত্বে। জো আঁ দে বারোস এর Da Asia এবং সমসাময়িক পর্তুগীজ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আরাকানের রাজা বাংলার সুলতানদের সামন্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম অধিকারের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার ফলেই আরাকান রাজ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সামন্তে পরিণত হয়েছিলেন বলে পন্ডিতগণ মনে করেন। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ চট্টগ্রামকে দু’ভাগে ভাগ করে পরাগল খান ও খোদা বখশ খান কে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। খোদা বখশ খানের শাসনাধীন ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রাম।
দিল্লীর শূর সম্রাট শেরশাহের আমলে পর্তুগীজ নাবিকরা চট্টগ্রাম শহরের ২০ মাইল দক্ষিণে দিয়াংগা এবং আরাকান উপকূল সিরিয়ামে উপনিবেশ গড়ে তোলে। এ সকল পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিরা আরাকান কর্তৃপক্ষের নিকট বশ্যতা স্বীকার না করে প্রায়ই দ্বন্দ্ব কলহে লিপ্ত হয়। এ সকল পর্তুগীজ জলদস্যুরা চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগণ যারা সাধারণভাবে মগ্ নামে পরিচিত তাদের সহযোগিতায় সমতল এলাকায় দস্যুবৃত্তি পরিচালনা করতো। এ সকল দস্যুর অত্যাচারে সমতল অঞ্চলের জনগণের শান্তি ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয় এবং মোগল প্রশাসন এদেরকে শায়েস্তা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বাংলার তৎকালীন সুবেদার শায়েস্তা খান পর্তুগীজ উপনিবেশকারী এবং আরাকান রাজ্যের মধ্যকার কলহের সুযোগে ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল জয় করেন এবং ধার্মিক সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭) নির্দেশানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখেন ইসলামাবাদ। পরবর্তীতে ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত মোগল অধিকারে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বিরাজ করে।
বাংলাদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর বাংলার মুঘল সুবেদারগণ চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতেন এবং কোন কোন উৎপন্ন দ্রব্য ও পশুর (যেমন : হাতি, তুলা) উপর করারোপ করতেন। মুঘলদের পর উপনিবেশিক বৃটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। ১৭৬০ খৃস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার নবাব মীর কাসেমের (১৭৬০-১৭৬৪) নিকট থেকে চট্টগ্রামের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তার একশো বছর পরে ভারতের বৃটিশ শাসকরা তাদের ‘বিভক্ত করে শাসন করার’ (Divide and Rule) কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের জন্ম দেয়। ১৮৬০ খৃস্টাব্দের ২৬ জুনের নোটিফিকেশন নাম্বার ৩৩০২ এর ভিত্তিতে এবং একই সালের ১ অগাস্ট ১৮৬০, রেইডস এর ‘ফ্রন্টিয়ার এ্যাক্ট ২২ এফ ১৮৬০’ অনুসারে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী তাকিদে বৃটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী বৃহত্তর চট্টগ্রাম জিলাকে বিভক্ত করে এর পাহাড় প্রধান অঞ্চলকে স্বতন্ত্র ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ জিলার রূপ দেয়। ১৯০০ সালের ম্যানুয়েলের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম জিলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে প্রশাসনিক ও রাজস্ব সংক্রান্ত কর্মকান্ড পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০০ সালের ১লা মে বৃটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে এবং ঐ এলাকার স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে ‘নোটিফিকেশন ১২৩ পিডি’ চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, রেগুলেশন ১৯০০ (Chittagong Hill Tracts Regulation 1900) চালু করে। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী জিলা প্রশাসক সেখানকার সবধরনের অভিগমন বা জনস্থানান্তর বন্ধ বা প্রতিরোধ করতে পারতেন। ঐ আইন প্রণয়নের দ্বারা বৃটিশ বেনিয়া সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বহিরাগত যাযাবর উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে একটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসে বাধ্য করানোর প্রয়াস চালায় এবং দেশের মূল জনগণ তথা বাংলাভাষী বা বাঙালীর অবাধ গমনাগমন ও বসতি স্থাপনকে বিঘ্নিত করে ভূমিজ সন্তান (Son of the Soil) নয় এমন বহিরাগত ও বিদেশী এবং এদেশে অভিবাসী (immigrant) ভারত-বার্মা থেকে আগত চাকমা, টিপরা, লুসাই, মগ, মারমা উপজাতিদের ঠাঁই করে দেয়া হয়।
১৯৩৫ সালে বৃটিশ প্রণীত ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘সম্পূর্ণ বা পৃথক অঞ্চলে’ (Totally Excluded Area) হিসেবে চিহ্নিত করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সংলগ্ন বাংলাভাষী মুসলিম অধ্যুষিত সমতল অঞ্চলের আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বৃটিশ বেনিয়া উপনিবেশিকদের এই কৌশলের কারণ ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী প্রভাব ও বসতিস্থাপন প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং সেখানে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করা। প্রায় জনশূন্য এবং সম্পদ সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর বার্মা, আরাকান, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আগত বসতি স্থাপনকারী উপজাতিদের যতটুকুই দাবী ছিলো অঞ্চলটির কাছের সংলগ্ন চট্টগ্রামের সমতলবাসী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর ঐ অঞ্চলটির উপর অধিকার বা দাবী কোন যুক্তিতেই কম ছিলো না। কিন্তু স্বার্থান্বেষী বেনিয়া ইংরেজরা ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিকে লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করে। ১৯৫৬ সালে পৃথক অঞ্চলের বিধানের সমাপ্তি ঘটে। এই সালে প্রাদেশিক সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করে এবং এর সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের বুনিয়াদী গনতন্ত্র সংবলিত শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। মৌলিক গনতন্ত্রের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের রাজনৈতিক ধারায় মিশে যাওয়ায় সমতলের শাসন বহির্ভূত অঞ্চল (Excluded Area) এর মর্যাদারও স্বাভাবিক অবসান ঘটে।
ঐ বছর ম্যানুয়েলের ৫১ অনুচ্ছেদ রহিত করে পাকিস্তানের সর্বত্র সকল নাগরিকের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় ঢাকা হাইকোর্টের এক রায়ে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী বসতি গড়ে উঠতে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি মাত্র বৃহত্তর জিলা ছিলো। ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জিলায় বিভক্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালে সংসদে তিনটি জিলার জন্য তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ বিল পাশ করা হয়। এই বিলে স্থানীয় পরিষদের কাঠামোও নির্ধারণ করা হয়। এতে একজন চেয়ারম্যান (উপজাতীয়দের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন), ২০ জন উপজাতীয় সদস্য ও ১০ জন অউপজাতীয় সদস্য রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের এ প্রক্রিয়ায় বহিরাগত চাকমা, টিপরাদেরকে আরো মারাত্মক ইন্ধন যোগানো হয়।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বিতর্কিত পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তাঁর কার্যালয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত কম্পিউটারে মুদ্রিত ১৫ পৃষ্ঠার এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন সরকারী আওয়ামী লীগ দলের চীফ হুইফ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং শান্তি বাহিনীর পক্ষে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তুু লারমা। এই চুক্তি সংবিধান বিরোধী, দেশ বিরোধী, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিরোধী, গণতন্ত্র - মৌলিক অধিকার - সমতা-সমসুযোগ বিরোধী বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমরা এর বিরোধীতা তখন থেকেই করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আরো ১২টি উপজাতিকে বাদ দিয়ে চাকমা শান্তি বাহিনীর সাথেই সরকার চুক্তি করেছে। কেবল চাকমাদের সাথে চুক্তি অন্যদের অধিকার ও সুযোগ হরণ মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মুসলিম বাঙালীদের সম্পদ লুঠ-পাট, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালানো, তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, তাদের নারীদের ধর্ষণ, তাদের শিশুদের বিভৎসভাবে হত্যা করা, তাদেরকে আহত-নিহত করা, তাদের জমি কেড়ে নেয়া, তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা, তাদেরকে ঐ অঞ্চল থেকে বহিস্কার করা ইত্যাদি কু-কর্ম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরও শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীদের দ্বারা আজো অব্যাহত আছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৩৮ বছর ধরে যে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী দেশ রক্ষা করলো, বিদ্রোহ থামালো, স্বাধীনতা বাঁচালো, জীবন দিয়ে, ঘাম ও রক্ত দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করলো সে বাহিনীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে বর্তমান সরকার স্থানীয় বাঙালী মুসলিমদের জীবন ও সম্পদকে ১৯৯৭ এর শান্তি চুক্তি পূর্ববর্তী সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধহীন আক্রমণের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে সরকার সে ষড়যন্ত্রের ‘পাতানো ফাঁদে’ এদেশের এক সম্পদশালী এক-দশমাংশ এলাকাকে ঠেলে দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার অর্থ দাঁড়াবে বর্তমান বাংলাদেশের দশ ভাগের একভাগ ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকালয় থেকে সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয়ার ফলে সেখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তারা বাঙালীদের কাছ থেকে যথেচ্ছ চাঁদা আদায় করছে। কৃষিপণ্য বিক্রিতে, ছাগল বিক্রিতে, কাঠ বিক্রিতে, ফল-ফসল বিক্রিতে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। আগেও দিতে হতো। এখন তা বেপরোয়া রূপ ধারণ করেছে। শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে ভূমি। দখলে নিয়ে নিচ্ছে বাঙালীদের ইজারা নেয়া জমি, রাবার বাগান ও আম বাগান প্রভৃতি। চাকমা ভিন্ন অন্য উপজাতিরাও চাকমা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনের শিকার। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী হামলা থেকে তারাও রেহাই পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা এটাই। অন্য কথায় ভারতে প্রশিক্ষিত মাত্র কয়েক হাজার সশস্ত্র সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি ওখানকার সব বাসিন্দা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা বহুল আলোচিত এবং প্রচুর পরিমাণে পর্যালোচিত। এর ইতিহাস সম্পর্কে এখন প্রায় প্রত্যেকেই জানেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কোন দলের সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা। এ অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতীয় জনসমষ্টি যে ভূমিজ সন্তান নন এবং এ অঞ্চলে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে যে স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাও সবাই জানেন। এও জানেন যে, এ অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় জনগণ পাশাপাশি বসবাস করেছেন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। মাত্র কিছু সংখ্যক গণবিচ্ছিন্ন নেতা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এই শান্তিপূর্ণ নীরব অঞ্চলকে জাতীয় রাজনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে তুলে আনতে চেয়েছেন আঞ্চলিক, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বৃহৎ পরিমন্ডলে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রথম প্রকাশ ঘটে এ শতকের চতুর্থ দশকের মাঝামাঝি। তখন কিছু সংখ্যক উপজাতীয় নেতা ভারত বিভক্তি অপরিহার্য জেনে কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা যায় তার পথ অনুসন্ধান করেছেন, দাবী তুলেছেন। যোগাযোগ করেছেন হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদী নিখিল ভারত কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে। মহাত্মাগান্ধী, (১৮৬৯-১৯৪৮) সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, জয় প্রকাশ নারায়ণ (১৯০২-১৯৭৯) ও কংগ্রেস সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ কংগ্রেসের অন্যান্য নেতা এবং শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর মতো হিন্দু মহাসভা নেতার সাথে তারা যোগাযোগ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নিখিল ভারত কংগ্রেস নেতৃত্ব সরেজমিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এই এলাকায় একটি প্রতিনিধি দলও প্রেরণ করেন। এ সময় কংগ্রেস নেতা এ. বি. ঠক্কর সহ অন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিধিদল নিয়ে এসে সেখানকার উপজাতীয়দের ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবার জন্যে প্রকাশ্য প্রবল প্রচারণা চালায়। তাতে কাজ না হলে উপজাতীয় রাজারা ভারতীয় দেশীয় রাজ্যের রাজন্যদের মত মর্যাদাবান না হয়েও ১৯৪৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে গঠন করেন ‘দি হিলমেন এসোসিয়েশন’ ('The Hillmen Association')। লক্ষ্য ছিল অন্যান্য দেশীয় রাজ্যের রাজন্যদের মত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘দেশীয় রাজ্যে’ (Princely State) পরিণত করে প্রতিবেশী ত্রিপুরা, খাসিয়া বা কুচবিহারের ন্যায় রাজা শাসিত রাজ্যগুলির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জুড়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র সমবায় (Confederation) গঠন করা এবং ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। তাও যখন সম্ভব হয়নি তখন কংগ্রেস নেতা জওহর লাল নেহেরুর (১৮৮৯-১৯৬৪) মাধ্যমে ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্ট ব্যাটেনের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় যেন র‌্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রাচীন রেকর্ডপত্রে পাওয়া যায়, বাউন্ডারী কমিশনের (Boundary commission) স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ মাউন্ট ব্যাটেনের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এ কারণে যে, পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সমুদ্র বন্দর ‘চট্টগ্রাম অরক্ষিত’ হয়ে পড়বে যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতা অরক্ষিত হয়ে উঠবে যদি মুসলিম প্রধান মালদহ, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ র‌্যাডক্লিফ কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেন। একদিকে কংগ্রেস ভারতের পক্ষে আরও অনেক সুযোগ র‌্যাডক্লিফের বাউন্ডারী কমিশন থেকে হাতিয়ে নেয়া এবং অন্যদিকে মুসলিম লীগের প্রবল বিরোধিতার মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সরাসরি ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুসারে পূর্ব বাংলার সঙ্গে থেকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐসব চাকমা নেতা পাকিস্তানকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেননি। সবাই জানেন ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ১৯ অগাস্ট পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হলে ভারতীয় কংগ্রেস নেতা এ. বি. ঠক্করের প্ররোচনায় রাম-রাজত্বের মোহে উম্মাদ চাকমা নেতা কামিনী মোহন দেওয়ান , স্নেহ কুমার চাকমা , ঘনশ্যাম দেওয়ান প্রমুখ রাঙ্গামাটিতে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের সামনে ভারতীয় অশোক চক্রের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময় কি ঘটে তা একজন চাকমা লেখকের ভাষায় শোনা যেতে পারে: ‘এত আশা-আকাঙ্খা নিয়ে ভারতীয় পতাকা উড়ানো হলেও সঙ্গে সঙ্গেই রশির গিঁট খুলে নিজেই পতাকাটি মাটিতে পড়ে যায়। ফ্লাগ পোল থেকে নিজে নিজে খুলে পড়ায় সেদিন অনেকেই বলেছিলেন, মনে হয় এই মাটিতে ভারতীয় পতাকা কোনদিনই উড়বে না। অগত্যা এক তরুন চাকমা বালকের বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার মত কয়েকবার চেষ্টা পরিশেষে তিন চার গিট দিয়ে ভারতীয় পতাকা উড়ানো নিশ্চিত করলেও এ.বি.ঠক্কর পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারেন নি’। ১৫ অগাস্ট মারমারা বান্দরবানে উত্তোলন করেন বার্মার পতাকা। তখনকার চাকমা নেতা স্নেহকুমার চাকমা পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরবর্তীকালে তিনি ত্রিপুরা রাজ্য বিধান সভার সদস্যও হন।
মোটকথা পূর্ব বাংলার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে যে ভারত বিভক্তি হয় সেটা তারা মানেননি। ২১ অগাস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট তাদের দমন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন পাকিস্তানের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মোটকথা ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তিন সার্কেলের তিনজন উপজাতীয় প্রধান বা রাজা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আশায় বৃটিশ বেনিয়া কর্তৃপক্ষ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তদবীর করেছিলেন। তারা ত্রিপুরা, কুচবিহার ও খাসিয়া অঞ্চল সমন্বয়ে ভারতীয় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে একটি কনফেডারেশন প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তারা ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে উল্লাস প্রকাশ করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন এ্যাক্ট ১৮৮১’ বাতিল করা হয়। ১৯৫৬ সালে অনন্ত বিহারী খীসা এবং মৃণাল কান্তি চাকমার নেতৃত্বে ‘হিল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের দ্বারা গঠিত এটাই প্রথম উল্লেখযোগ্য সংগঠন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে যথাক্রমে ১৯৫৬ এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানেও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘বহির্ভূত এলাকা’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু ১৯৬৩ সালে সংবিধানের এক সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয় এবং এই এলাকাকে ‘উপজাতি এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আইয়ূব খানের শাসনামলে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে উপজাতীয় জণগনকে জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। এ সময়ে উপজাতীয় কর্মচারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে বদলি করা হয়। শুধু উপজাতীয়দের দ্বারা গঠিত পুলিশ বাহিনী বাতিল করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আয়ত্তাধীনে আনা হয়। এভাবে বৃটিশ সরকার কর্তৃক দেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদার অবসান হয়।
১৯৬৫ সালের ১৮ জুন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য ছাত্র সমিতি’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। পরের বছর অনন্ত বিহারী খীসা এবং জে. বি. লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি (আদিবাসি) কল্যাণ সমিতি’ নামে আরো একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
কেউ কেউ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার জন্ম হয় যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন বিচ্ছিন্নতার পথ পরিহার করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের মূল স্রোতে মিশে যেতে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশী জাতিসত্তার বদলে বাঙালী জাতিসত্তার বিষয়টিকে একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা দিলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (১৯৭২-৭৫ এ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য) এর প্রতিবাদ করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে যান, স্মারকলিপি দেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের অসন্তোষ উত্থাপন করে তা সমাধানের দাবী জানান। শেখ মুজিবুর রহমান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে বাঙালি হয়ে যাবার কথা বলেন। তিনি বলেন ‘যা বাঙালি হইয়া যা’। শেখ মুজিবের এই প্রস্তাবে নিজেদের ঐতিহ্য ও স্বকীয় জাতিসত্তার ভবিষ্যত সম্পর্কে উপজাতিয়রা বিচলিত বোধ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারী চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি উপজাতীয় প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাজা মং প্রু সাইন চৌধুরীর নেতৃত্বে আরেকটি পার্বত্য প্রতিনিধি দল শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তবে তারা তাদের দাবিগুলো রেখে যান।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১৫ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করে উপজাতীয়দের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো ছিল-
১। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ সংবলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
২। উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষনের জন্য ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুরূপ সংবিধি বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা।
৩। উপজাতীয় রাজাদের দফতরগুলো সংরক্ষণ করা।
৪। সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের সংশোধন-নিরোধ সংক্রান্ত বিধি রাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যে চার দফা দাবী উত্থাপন করেছিলেন তার একটিও পূরন না করে তিনি পাহাড়িদের বাঙালী হয়ে যাবার কথা বলায় পাহাড়িরা মারমুখী হয়ে উঠে। মূলত এ কারনেই সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে দেশে যে প্রথম সংবিধান প্রণীত হয় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা তাতে সই করেননি।
মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার দাবিকে একদিকে শেখ মুজিব উপেক্ষা করেন; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়কে পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান। ত্রিদিব রায় তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশে ফিরে আসতে অস্বীকার করেন। ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটির এক নির্বাচনী জনসভায় চাকমা রাজার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতার কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যাবার পরামর্শ দেন। এ জনসভায় বলেছিলেন, From this day onward the tribals are being promoted into Bengalis.
শেখ মুজিবুর রহমান উপজাতীয়দের চার দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করার পর উপজাতীয়রা উপলব্ধি করলো যে বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করা ছাড়া তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। এর ফলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৫ মে গঠিত হয় রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি। ১৬ মে গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জে এস এস)। রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি ও জনসংহতি সমিতি-এ দুটি সংগঠনের কোনোটিই মার্কসবাদী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সংগঠন দু’টি ছিল মার্কসবাদী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শে সংমিশ্রিত সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে জনসংহতি সমিতি সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বলে। উল্লেখ্য জনসংহতি সমিতির চার দফা কর্মসূচী পাহাড়িদের নিকট ম্যাগনাকার্টা হিসেবে চিহ্নিত হলেও এ দফাগুলোতে শ্রমিক-কৃষকের দাবি তুলে ধরা হয়নি। চার দফা দাবি আদায় ও আওয়ামীলীগ সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শেখ মুজিবের আওয়ামী শাসনামলেও আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ৭ই জানুয়ারী ১৯৭৩ সালে সেনা উইং সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গঠন করেন। ১৯৭৩ সালে গঠিত হলেও এর কার্যকলাপ ১৯৭৫ সালের অগাস্ট মাসের পর অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। শান্তিবাহিনীর কার্যকলাপ এ সময়ে বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের চাকমা গেরিলাদের সহযোগিতা। ১৯৭৬ সালের জুনে বিলাইছড়ি আর্মড পুলিশ ক্যাম্প এবং বেতছড়িতে শান্তিবাহিনী প্রথম হামলা করে। ওই বছর জিয়াউর রহমান পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। রাজা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়কে এই বোর্ডের উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৭ সালের ৪ জুলাই জিয়াউর রহমান গঠন করেন ট্রাইবাল কনভেনশন। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে এম এন লারমা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। তবে জাসদ প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমা (২৯৯ পার্বত্য চট্টগ্রাম-১), স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ প্রু চৌধুরী (৩০০ পার্বত্য চট্টগ্রাম-২) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র উইং শান্তিবাহিনীর অন্যতম নেতা সন্তু লারমা ও চবরি মারমা ১৯৭৬ সালের কোন এক সময় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়। এ সময় শান্তি বাহিনীর নেতৃত্বে আসেন প্রীতিকুমার চাকমা। ১৯৮১ সালে শান্তি বাহিনীর সাথে সরকারের আলোচনার শর্ত হিসেবে সন্তু লারমা ও চবরি মারমা মুক্তি পেয়ে পাহাড়ে ফিরে আসেন।
জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী ১৯৭৮ সালে আদর্শিক কারণে সাংগঠনিক বিপর্যয়ে পতিত হয়। এ সময়ে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ জাতীয়তাবাদী আদর্শের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করতে চায়। অন্যদিকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রলম্বিত যুদ্ধের মাধ্যমে পাহাড়িদের অধিকার আদায় করতে আগ্রহী। এ আদর্শিক সংঘাতের ফলে দু’গ্রুপে হানাহানি শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের ১৪ জুন সন্তু লারমার অধীনস্থ শান্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রীতি গ্রুপের প্রভাবশালী কমান্ডার অমৃতলাল চাকমা ওরফে বলি ওস্তাদসহ অনেককে হত্যা করে এবং প্রতিশোধ হিসেবে মানবেন্দ্র লারমা প্রীতি গ্রুপের একটি সুইসাইড স্কোয়াডের হাতে ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ নিহত হন। ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখের ঘটনা ১৯৮৭ সালের ভারতীয় পত্রিকায় নিম্নলিখিতভাবে বর্ণিত হয়েছে :
"Priti Kumar and his protagonists in the organisation called for 'decisive war' to end in the seccssion of the CHT from Bangladesh and its subsequent merger with India... Manobendra Larma, who viewed India as an expansionist bourgeois state advocated long protracted form of armed struggle to achieve autonomy within Bangladesh, not to secede from it. Manobendra saw the Chakma struggle "as part of the struggle of the toiling masses of Bangladesh." In fact, the cause of immediate differences between the two groups was Manobendra's decision to stop the raids on the non-tribal settlements created by Bangladesh authorities to resettle large members of Muslim peasants and landless labourers in the hill tracts. Priti Kumar felt that time was runnig out for the Chakma. "Now or Never" was his call...
এই মৃত্যু এবং পার্টির ভাঙন সম্পর্কে ৩১ ডিসেম্বর সন্তু লারমা একটি ছাপানো বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘গত ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ১৯৮৩ ইংরেজী তারিখ জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণিত ও কলঙ্কিত কালো দিবস। এই দিনে জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার চক্রান্তকারী, ক্ষমতালোভী ও বিভেদপন্থী গিরি (ভবতোষ দেওয়ান), প্রকাশ (প্রীতি কুমার চাকমা), দেবেন (দেব জ্যোতি চাকমা), পলাশ (ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান) চক্র এক বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে জুম্ম জাতির চেতনা ও জাগরণের অগ্রনায়ক, মহান দেশপ্রেমিক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের অগ্রনায়ক, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের একনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু, কঠোর সংগ্রামী, ত্যাগী, ক্ষমতাশীল ও দূরদর্শী মহান জাতীয় নেতা, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে তাঁর ৮ (আট) জন সহকারী (পরিমল বিকাশ চাকমা, মনিময় দেওয়ান, কল্যাণময় খীসা, সৌমিত্র চাকমা ও অর্জুন ত্রিপুরা প্রমুখ) সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। .. .. .. সহকর্মীদের কয়েকজনের মরদেহের ওপরও ব্রাশ ফায়ার করে মরদেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে তারা তাদের ঘৃণিত চরিত্র উন্মোচন করে গেছে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যুর পর শান্তিবাহিনী লারমা গ্রুপের নেতৃত্ব ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর সন্ত লারমা গ্রহণ করে। এ সময়ে ১৯৮৩ সন্ত লারমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে রূপায়ণ কুমার চাকমা পার্টির নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৮৫ সালে আদর্শিক কারণে লারমা গ্রুপ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উষাতনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এবং রূপায়ণ দেওয়ানের নেতৃত্বে অপর গ্রুপ পার্বত্য চট্টগ্রামে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে দেবেন পলাশের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ প্রীতির নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে ভিন্নভাবে কাজ করতে থাকে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বেগম খালেদা জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সাথে পুনরায় সংলাপের ব্যবস্থা করেন। জনসংহতি সমিতি এ সময়ে তাদের পূর্বের পাঁচ দফা দাবি সংশোধিত করে পুনরায় সরকারের নিকট পেশ করে। জনসংহতি সমিতির পাঁচ দফা প্রকৃতপক্ষে পূর্বের পাঁচ দফা দাবির অনুরূপ। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে মতৈক্যের ভিত্তিতে একটি চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তি ‘‘শান্তি চুক্তি’’ নামে পরিচিত হয়। তবে চুক্তি সইয়ের পরপরই উপজাতি জনগণের একটি অংশ পার্বত্য চুক্তিকে ‘আপসের চুক্তি’ বলে আখ্যায়িত করে চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। পাহাড়ি গণপরিষদ (পিজিপি), গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম (ডিওয়াইএফ)- কেন্দ্রীয় আহবায়ক মিঠুন চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)- বর্তমান সভাপতি অংগ্য চাকমা , হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচ ডব্লিও এফ) - কেন্দ্রীয় সভানেত্রী সোনালী চাকমা , এ চুক্তির বিরোধিতা করে। চুক্তি বিরোধীদের দাবী জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে যে চুক্তি করেছে তার মাধ্যমে উপজাতিদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। উপজাতীয়রা পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের যে দাবি জানিয়ে আসছিল সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে তা অর্জিত হয়নি। তাই উপজাতীয় পাহাড়ী জনগণের স্বার্থরক্ষা ও পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা। এরই মধ্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশন দু’ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ থাকে চুক্তির বিপক্ষে অন্য ভাগ চলে যায় চুক্তির পক্ষে। পরে চুক্তি বিরোধী কয়েকটি সমমনা গোষ্ঠীকে নিয়ে প্রসীত খীসার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউ.পি.ডি.এফ) গঠিত হয়। তিনি সে সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন। পরে তার একক নেতৃত্বে দলটি গড়ে উঠে। এখন এ দলটি পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন দাবী করে আন্দোলন করছে। তদের সশস্ত্র বাহিনী আছে এটিও তারা স্বীকার করেন না। তবে পার্বত্য তিন জিলায় ইউপিডিএফ’র কয়েক হাজার সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। পার্বত্য রাজনীতিতে ইউ.পি.ডি.এফ এখন একটি বড় শক্তি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- তিন পার্বত্য জিলাতেই এদের সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে। পার্বত্য এলাকার অন্যতম প্রধান সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সংগে ইউ.পি.ডি.এফের বিরোধ গোড়া থেকেই। চুক্তি বিরোধী ইউ. পি.ডি.এফের দাবী পার্বত্য অঞ্চলের পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। এ সংগঠনের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্বে রয়েছেন প্রসীত বিকাশ খীসা, (পিতা- অনন্ত বিহারী খীসা), সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা, অন্যান্য নেতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রদিপন খীসা, চন্দন চাকমা প্রমুখ। এই ফ্রন্ট মনে করে স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা মনে করে এই চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার ও পাহাড়িদের ভূমি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হবে না। ইউ.পি.ডি.এফ. সৈন্য প্রত্যাহার ও জাতিসত্তাগুলোর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধানের গুরুত্ব প্রদান করে। এভাবে দেখা যায় যে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে পাহাড়ের মানুষ দ্বিধা বিভক্ত। জনসংহতি সমিতির বিকল্প হিসেবে জুম্ম ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (Jumma Naitonal Democratic Front) গঠিত হয়েছে বলেও পত্রিকায় খবর পাওয়া যায়। শান্তি বাহিনীর বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে ‘জুম্ম ন্যাশনাল আর্মি’ (Jumma National Army)। অন্যান্য সংগঠন হচ্ছে নয়া সেতু (সভাপতি নিত্যানন্দ পাল)। পার্বত্য চুক্তির প্রধান অঙ্গীকার মুতাবিক পাহাড়ের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা, বেআইনী অস্ত্রের বন্দুকযুদ্ধ, সন্ত্রাস, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপন, অবৈধ আধিপত্য বিস্তার, গুপ্তহত্যা আজো বন্ধ হয়নি। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ১৩ বছর পূর্ণ হলেও আজও পাহাড়ে শান্তি ফেরেনি। কমেনি খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি। শান্তি চুক্তির আগে শুধু শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাস চললেও চুক্তির পর দ্বিমুখী এবং বর্তমানে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজিতে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম। শান্তি চুক্তির নামে পার্বত্য এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জিলাতেই চাঁদাবাজি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। চুক্তিবিরোধী ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), চুক্তি পক্ষের জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং নানা মতবিরোধের কারণে এই দুই গ্রুপ থেকে বের হয়ে নতুন জন্ম নেয়া ‘চিটাগাং হিল ট্রাক্টস ন্যাশনাল ফোরাম (সিএইচটি এনএফ) এর ব্যানারে চাঁদাবাজি চলছে। রাঙ্গামাটিতে জেএসএস সমর্থকরা ‘সন্তোষ’ এবং ইউপিডিএফ সমর্থকরা ‘গুন্ডুস’ বাহিনী হিসেবে পরিচিত। খাগড়াছড়িতে জেএসএস সমর্থকরা ‘সদক’ এবং ইউপিডিএফ সরাসরি নিজেদের পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করে। অন্যদিকে বান্দরবানে নতুন জন্ম নেয়া এনএইচটিএফ সদস্যরা ‘বোরখা পার্টি’ হিসেবে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে এহেন অপরাধ নেই যা হয়নি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে সন্তু লারমার শান্তি বাহিনী। আবারো সশস্ত্র যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন সন্তু লারমা। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বেশ কিছু বড় ধরনের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা মুক্ত, পরিস্থিতি শান্ত এমনটি বলার অবকাশ নেই। পাহাড়ি বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙ্গালীরা প্রতিনিয়ত এদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। মনে রাখতে হবে বিদেশী সাহায্যপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদ সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বিগত ৩৫ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে শান্তিবাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র উপজাতীয়দের হামলায় প্রায় ৮৫ হাজার সৈন্য, বিদ্রোহী ও বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত, অরক্ষিত। সেখানকার পাহাড়ে, অরণ্যে, চরাচরে আজ মুসলিম বাংলাভাষী জনতার হাহাকার, আহাজারি আর আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রায়শই খুন-অপহরণ হচ্ছে মুসলিম বাংলাভাষীরা। বড় বড় নৃশংস হত্যাকান্ড-লংগদু হত্যাকান্ড, কাউখালী হত্যাকান্ড, বরকলের ভূষণ ছড়া হত্যাকান্ড, পানছড়ি হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার নব খাগড়াছড়িতে ৭ জন সৈনিক হত্যাকান্ড, রামগড় থানার ঝগড়াবিল বাজার হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির লোগাং হত্যাকান্ড, নানিয়ারচর হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির মহাজন পাড়ার হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার হত্যাকান্ড, বাঘাইছড়ি থানার গুলশাখালী, গাঘছড়া, মাইনী, বড় মহিল্লা ও কালাপাকজ্জার ৩৪ বাঙালী কাঠুরের হত্যাকান্ড, খাগড়াছড়ির কুমিল্লা টিলার হত্যাকান্ড, নাইক্ষ্যাংছড়ি পাড়া ও বলিপাড়ার হত্যাকান্ড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত উপজাতিদের ধর্মকর্ম, সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার ধরনও পরস্পর থেকে ভিন্ন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে চাকমারা একচেটিয়া আধিপত্য
বিস্তার করে আছে। চাকমারা মূলত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও এখন তাদের একটা বড় অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশনগুলো খুব তৎপর এবং উপজাতিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। উপজাতীয়দের বেশ ব্যাপকহারে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি মনে হয় পার্বত্য সমস্যার নতুন উপাদান যোগ করেছে। জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমাদের পরই অর্থ্যাৎ দ্বিতীয় স্থানে বাঙালিদের অবস্থান। বাঙালিদের আবার সবাই মুসলমান। এ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার তিনটি কারণ প্রধান বলে মনে হয়। প্রথমত. সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, দ্বিতীয়ত. বাঙালী বসবাসকারীদের প্রত্যাহার, তৃতীয়ত. পুঞ্জীভূত ভূমি সমস্যা- ভূমি জরিপ ও বন্টন। তবে তাৎক্ষনিক কারন হিসেবে মনে হয় সেনাবাহিনী ও বাঙালি বসবাসকারীদের প্রত্যাহারের দাবির বিষয়টিই প্রধান। চাকমা উপজাতিদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ’র দাবি তাই। এরা এসব দাবি সংবলিত স্মারকলিপিও স্থানীয় জিলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছে। পাল্টা স্মারকলিপি পেশ করেছে বাঙালিদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যায় ভারতের ভূমিকা
ভারতীয় চক্রান্তের সর্বাধিক প্রকট ফসল হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংকট। নিজেদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত ৭টি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমনকারী ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী নামক সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, এ কথা সর্বজনবিদিত। আজ আর কারো সন্দেহ নেই যে, দরিদ্র বাংলাদেশের সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশদ্রোহী উপজাতীয়দের নেপথ্য মদদদাতা শক্তি ভারত। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ভারত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে ডাকে এবং শান্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে চায়। এমনও জানা যায় যে, মুজিব হত্যাকান্ডের পর লারমা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের আশ্রয়ে চলে যান এবং ত্রিপুরা রাজ্যের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মাধ্যমে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কার্যক্রম পরিচালিত করতে থাকেন। বেশ কিছু গ্রুপকে ট্রেনিং দেয়া ছাড়াও ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ভারত শান্তি বাহিনীকে অস্ত্র ও গোলা বারুদের দু’টি বড় ধরনের চালান দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সম্পদের এক অনাহরিত রত্নভান্ডার। ভূ-মানচিত্রের এই বর্নিল স্বপ্নিল ভূস্বর্গ নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত। ভারত চাচ্ছে ফেনী নদীর কোল ধরে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করতে। ওদিকে নাফ নদীর তীর পর্যন্ত ভারতের আধিপত্য বিস্তৃত হলে তাদের ‘সাতকন্যার’ স্বাধীনতার আহাজারি পাহাড় পরিবেষ্টিত বিজন জনপদের বন বাদাড়ে গুমরে গুমরে এক সময় নিঃশব্দ হয়ে যাবে। নতজানু করা যাবে বেয়াড়া প্রতিবেশী স্বাধীনতার অহমবোধে উজ্জীবিত বাংলাদেশীদের। প্রাচুর্যের ভান্ডার লোপাট করা সহজ হবে। শ্যেন দৃষ্টি ফেলা যাবে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর। চৈনিক চাপ, বার্মিজ প্রভাব সহজেই মুকাবিলা করা যাবে- এমন একটি ‘সহজ-সরল’ অথচ ষড়যন্ত্রমূলক অশুভ পরিকল্পনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কাজ শুরু করে। পঞ্চাশের দশক থেকে ভারত অনেক কাষ্ঠখন্ড পুড়িয়েছে- বাংলাদেশ কাবু করার জন্য। স্বাধীনতার উষা লগ্নেই ভারত চেয়েছিলো বাংলাদেশের অর্জনগুলো হাতিয়ে নিতে। তাদের ‘সহায়তায় প্রাপ্ত স্বাধীনতা’কে হাইজাক করতে। বাংলাদেশের গর্ব, অহম ও আত্মমর্যাদাবোধকে দাবিয়ে দিতে। তাই অকৃতজ্ঞ বাংলাদেশীদের প্রতি ভারত রুষ্ট। নতুন পরিকল্পনায় যাবার আগে ভারত নানা কৌশলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর দেউলে বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাই করে নেয়। পরবর্তী সময়ে টার্গেট করে বাংলাদেশের দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীকে। তাই নানা ছল-ছুতায় তারা সহজ-সরল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদেরকে গিনিপিগ হিসেবে বাছাই করে। স্বাধীনতার মন্ত্র শোনায়, আশ্বস্ত করে ‘৯ মাসে বাঙালীদের স্বাধীন করে দিয়েছি। ছ’মাসে তোমাদেরকে (চাকমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করে দেবো’। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর মোহনবাঁশী শান্তিবাহিনীকে বাস্তবতা ভুলিয়ে দিলো। চাকমা সন্ত্রাসীরা দলে দলে আশ্রয় নিলো ভারতের শরনার্থী শিবিরে। হাতে পেলো অস্ত্র। ভারতীয় পরিকল্পনার অশুভ ছায়াপাতের কারণে তারা ‘সাতকন্যা’র মাতম শুনলোনা, উলফার (ULFA) লড়াইয়ের খবর পেলো না, ত্রিপুরার ভেতরের খবর জানলো না। মিজোরামে কি ঘটছে বুঝবার সুযোগ হলো না। দম দেয়া কলের পুতুলের মত ভারতীয় ইচ্ছা পূরণ করার আত্মঘাতী মরন খেলায় মেতে উঠলো। বিভিন্ন ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে এমন সব কথা বেরিয়ে আসে যাতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই শান্তি বাহিনীর সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ভারতের ‘দি টেলিগ্রাফ’ প্রত্রিকায় নভেম্বর ১৯৯৬-এ শান্তিবাহিনীর সাথে ভারতীয় সংযোগের চিত্র প্রকাশিত হয়। কলকাতার ‘আলোকপাত’ পত্রিকার নভেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যায় উত্তম উপাধ্যায় নামে একজন রিপোর্টার খুবই পরিস্কার ভাবে জানিয়েছেন, ‘‘এখন ১০ হাজার চাকমার মিলিশিয়া বাহিনী যে ভারতীয় সাহায্যেই পুষ্ট এটা ত্রিপুরার ছোট ছোট বাচ্চারাও জানে’’। এরূপ প্রকাশ্য ঘোষণার পর এমন কথা বলা নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে, শান্তিবাহিনী ভারতেরই সৃষ্টি।
বিশিষ্ট ভারতীয় গবেষক-বিশ্লেষক অশোক এ বিশ্বাস তার “RAW’s Role in Furthering India’s Foreign Policy” শীর্ষক পুস্তিকায় শান্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সংযোগের কথা খোলাখুলি বলেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “RAW is now involved in training rebels of chakma tribes and Shanti Bahini who carry out subversive activities in Bangladesh”. এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘র’ বর্তমানে চাকমা উপজাতি ও শান্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণদানে সরাসরি জড়িত যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানারকম নাশকতামূলক তৎপরতা চালায়।
১৯৯৭ সালে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রাক্তন হাইকমিশনার ফারুক সোবহান (পরে পররাষ্ট্র সচিব) ‘‘এশিয়া এজ’’-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ “The Bangladesh Government felt that the main support for the ‘Shanti Bahini’ was being provided by the Research and Analysis Wing in India”.- এর অর্থ হচ্ছেঃ বাংলাদেশ সরকার মনে করে যে, শান্তিবাহিনীর মূল সমর্থন আসছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এ্যান্ড এনালিসিস উইং- এর কাছ থেকে। এ কথাও আজ জানা হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন ভারতের মিজোরাম রাজ্যের ডাইরেন্ডীতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জাংগল ওয়ারফেয়ার স্কুলেও শান্তিবাহিনীর সদস্যদের মিলিটারী ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। এই সামরিক স্কুলের কমানডেন্ট ব্রিগেডিয়ার ত্রিগুলেশ মুখার্জী। এই স্কুলে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে শান্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালের নভেম্বরে ভারতীয় চীফ অব আর্মী স্টাফ জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী পুরো বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এখানকার পরিস্থিতি তিনি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির মিলিটারী ফরমেশনগুলি সফর করার সময় ডাইরেন্ডীতে আসেন। এখানে জাংগল ওয়ারফেয়ার স্কুলে সামরিক প্রশিক্ষণরত বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জেনারেল শংকর রায় আশা ব্যক্ত করেন যে, শীঘ্রই শান্তিবাহিনী সম্মানের সাথে স্বদেশভূমি জুম্মল্যান্ড-এ ফিরে যেতে পারবে।
লক্ষ্যণীয় যে, শান্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় অবৈধ সংযোগ কত গভীরে রয়েছে জেনারেল শংকরের বক্তব্য থেকে তা বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের জুনে সরকার গঠন করার পর থেকেই শান্তিবাহিনীকে জামাই আদর করে হাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম তুলে দিচ্ছেন এবং শেষাবধি তা যাচ্ছে ভারতের খপ্পরে। জেনারেল শংকর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিবাহিনী প্রশ্নে ভারতের পরিকল্পনা এবং নিকট ভবিষ্যতের করণীয় জানতেন বলেই এত নিশ্চিতভাবে শান্তিবাহিনীর স্বদেশভূমি জুম্মল্যান্ডে অচিরেই ফিরে যাবার আশ্বাস দিয়েছেন। ভারত, ভারতীয় RAW এখন এই কাজই করাচ্ছে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে। সন্তু লারমার সঙ্গে চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
দুর্ভাগা জাতি টের পেলো না এতসব অশুভ চক্রের গোপন তৎপরতা। আরো দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের মেরুদন্ডহীন সরকারগুলো জাতিকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বুঝাতে চেষ্টা তো করলোই না, অধিকন্তু ভারতীয়দের অন্যায় চাপ, মিথ্যা অভিযোগ মুকাবিলায় হিমশিম খেলো। ভারত কল্পিত অভিযোগ তুললো, বাংলাদেশ উলফাদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণ-আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এটা যে বঙ্গভূমিওয়ালা এবং শান্তিবাহিনী লালনের বৈধতা নেয়ার কূটনৈতিক চাল তা প্রথমেই সরকার বুঝতে পারলো না। উল্টো নতজানু হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতীয় আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠা সন্ত্রাসীদের সাথে শান্তি চুক্তির মহড়া দিতে শুরু করলো। উস্কানীদাতা ভারত নেপথ্যে খেলে সে প্রচেষ্টাও ভন্ডুল করে দেয় এবং নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষন করে। ভারত বেহুদা গত ৩৫ বছর ধরে জনসংহতি সমিতিকে লালন-পালন করেনি। ইচ্ছা চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করে মিজোরাম, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুনাচলের সমৃদ্ধি সাধন করা। ভারতের পরিকল্পনা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাবেদার প্রশাসনের ব্যবস্থা করে নিজেদের এলাকার স্বাধীনতাকামীদের শায়েস্তা করা। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করা। তার জন্য শান্তি বাহিনীকে তারা জামাই আদরে প্রতিপালন করেছে। তারাই শান্তিবাহিনী ও জনসংহতির বুদ্ধি, পরামর্শ, অস্ত্র, আশ্রয় ও মন্ত্রণাদাতা। তারাই সাপ হয়ে কামড়ায় ওঝা হয়ে ঝাড়ে। তাদের ভারতীয় পরিকল্পনা প্রথমেই বোধগম্য হলো বাংলাদেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কাছে। এক্ষেত্রেও টার্গেট হলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। পরিস্থিতিকে ভারত এমন পর্যায়ে ঠেলে এনেছে যে, বর্তমান সরকার নিজ ভূ-খন্ডের সার্বভৌমত্বের কথা না ভেবে সেনা প্রত্যাহারের শান্তিবাহিনীর আবদারে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় বলয় সমৃদ্ধ আরেক ‘দেশ’ বানানোর চক্রান্ত শান্তিবাহিনী ও ইউপিডিএফ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশীদের ‘নিজভূমে পরবাসী’ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।
প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা আবুল আসাদ লিখেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সমস্যাজড়িত ও দুর্বল সময়কালে হঠাৎ করেই চাকমাদের মাথায় এসে প্রবেশ করল যে বাংলাদেশের ঐ অঞ্চলটার মালিক মোক্তার তারাই। এই অমূলক চিন্তা তাদের মাথায় কে ঢুকালো জানি না, তবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সুযোগে জেনারেল ওবানের মত কূটবুদ্ধির অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছিলো। তারাই এই বিভেদ ও ষড়যন্ত্রের বীজ বুনে যেতে পারে। এর কিছু বিশ্বাসযোগ্যতা এ জন্যেই আছে যে, ঐ শ্রেণীর চাকমারা ভারতীয় অর্থ অস্ত্রেই বাংলাদেশের ঐ পাহাড়ী অঞ্চলের নিরীহ বাসিন্দাদের খুন করে চলেছে। এমনটা বিশ্বাসযোগ্য হবার আরেকটা কারণ হলো, ভারতের অন্নদা-শক্তি-সুনীল বাবুরা ঢাকাই পরিচয়ের নাটাই বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে যখন ৪৭ পূর্ব ভারত প্রতিষ্ঠার কথা বলতে পারেন, তখন ষড়যন্ত্র পটু ওবান বাবুরা একশ্রেণীর চাকমাদের মাথায় ঐ ধ্বংসাত্মক চিন্তা অবশ্যই ঢুকাতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষভাবে ভারতের বেছে নেয়ার কারণ তিনটি- এক. বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলে নিরংকুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতা একটি বাধা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সে তুলনায় অনুকূল। দুই. সহজ সরল উপজাতি-গোষ্ঠীগুলোর সম্ভাব্য স্পর্শকাতর দিকগুলোকে দাবী বা সমস্যা হিসেবে কাজে লাগানোর সুযোগ। তিন. বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ কৌশলগত এলাকা। যার পশ্চাদভূমি একটি প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর (চট্টগ্রাম)। এই জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রামকে কুক্ষিগত করার চেষ্টায় সেখানে অবিরত অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখা হয়।
চাকমা বিচ্ছিন্নতাবাদের উদ্দীপক ভারত অকারণে এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। ভারতের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। ভারতীয় কর্মকর্তা এবং কাউন্টার ইন সারজেন্সি বিশারদরা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থান ও পরিবেশকে ভারতের স্বার্থ, এমনকি আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষায় হুমকি মনে করেন। মৌসুমি বনভূমির অন্তর্গত পার্বত্য চট্টগ্রাম মাঝারি ধরনের গেরিলা যুদ্ধ চালানোর এবং তাদের অভয়াশ্রমের জন্য আদর্শ স্থানীয় বিধায় পাকিস্তান আমলে ভারতের নাগা-মিজো বিদ্রোহীদের গোপন ঘাঁটি এখানে গড়ে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রামু, বলিপাড়া, আলিকদম, দীঘীনালা, মোদক ও থানচিতে মিজো গেরিলাদের ঘাঁাটি ছিল। সুতরাং ভারত সরকার পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সব সময়ই ছিল উদ্বিগ্ন।
১৯৭১ সালে সর্বাধিক ভারতীয় সৈন্য মিত্রবাহিনীর ছদ্মাবরণে তৎপর ছিল পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়, নাগা-মিজো বিদ্রোহীদের ঘাঁটি অনুসন্ধান এবং সেগুলো ধ্বংস করার অভিযানে। অপারেশন ‘ঈগল’ নাম দিয়ে জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে নাগা-মিজোদের গোপন ঘাঁটি তছনছ করে। এ ছাড়া র’ (RAW) এর সৃষ্ট মুজিব বাহিনী নাগা-মিজো বিদ্রোহীদের নির্মূলকরণে ভারতীয় বাহিনীকে সহায়তা করে। RAW বুঝে শুনেই মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়কত্ব মরহুম শেখ ফজলুল হক মণিকে প্রদান করে। বাংলাদেশ যেন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিতে কখনোই ভারতবিরোধী শিবিরের সাথে হাত মেলাতে না পারে সে জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভারত শান্তিবাহিনীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কারণ ভারত জানত শরণার্থী সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জিইয়ে রাখা যাবে না।
সম্প্রতি কলকাতা প্রেসক্লাবে ৩ মার্চ ২০১০ বুধবার ‘চট্টগ্রাম হিল ট্রাক্টস সাপোর্ট গ্রুপ কলকাতা’ নামে একটি সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের কথিত হামলার প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলন করে। এ সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন কবি তরুণ সান্যাল। কলকাতা প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের চারদিকে বুকে ছবি সংবলিত ও শ্লোগানে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে চাকমা তরুণ-তরুণীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্ল্যকার্ডে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে লেখা ছিল, শান্তিচুক্তির জন্য আমরা অস্ত্র সমর্পণ করেছি, যদি সেই চুক্তি বাস্তবায়িত না হয়, ‘আমরা আবার অস্ত্র ধরতে বাধ্য হব।’ এ সংবাদ সম্মেলনের সভাপতি তরুণ সান্যাল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পরমাণু শক্তি তৈরির খনিজ রয়েছে সে জন্য চাকমাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছে। উপজাতিদের সাপোর্ট গ্রুপ কলকাতায় কেন বিষয়টি একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেই অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির দাবিনামা
ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতি এক স্মারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি দাবিনামা পেশ করে। তাদের কয়েকটি দাবি হলোঃ
1. ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিন পার্বত্য জিলার প্রতিটি থানায় দুই-তৃতীয়াংশ উপজাতীয় (জুম্ম) সাব-ইন্সপেক্টর ও কনন্সেটেবল নিয়োগ করতে হবে;
2. জুম্ম শরণর্থীদের জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে শরণার্থীদের বসতভিটা, বাগান, চাষের জমি, জুম মহল, মন্দিরের জমি, আশ্রমের জমি, পালি কলেজের জমি, শ্মশান ভূমি ও সংরক্ষিত মৌজা বনাঞ্চল অবিলম্বে ফেরত দিতে হবে;
3. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন করে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম শুরু করা হোক;
4. জুম্ম শরণার্থীদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত চলমান নিয়মানুসারে নিয়মিত রেশন প্রদান অব্যাহত রাখা হোক;
5. জুম্ম শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের সুষ্ঠুভাবে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে সমতলের বিভিন্ন জিলা থেকে আনা জমিজমা দখলকারী বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা হোক;
6. চুক্তি মুতাবেক সকল অস্থায়ী সেনা, আনসার, এপবিএন ও ভিডিপি ক্যাম্পসহ অপারেশন উপকরণ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক এবং নতুন ক্যাম্প স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ করা হোক;
7. চুক্তি মুতাবেক প্রত্যাগাত শরণার্থীদের কৃষি ঋণ, অন্যান্য ব্যাংক ঋণ, সরকারি সংস্থা থেকে নেয়া ঋণ সুদাসলে মওকুফ করা হোক এবং আত্ম কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প চালূ ও সহজ শর্তে সুদমুক্ত দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ প্রদান করা হোক;
8. স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সেটেলার বাঙালিদের দায়ের করা জমি সংক্রান্ত হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও সাজা মওকুফ করা হোক;
9. যে সব চাকরিজীবী শরণার্থীকে এখনও পূর্বের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়নি, তাদেরকে অবিলম্বে চাকরিতে পুনর্বহাল ও জ্যেষ্ঠতা প্রদানসহ অন্য সুবিধাদি প্রদান করা হোক। পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার জুম্ম শরণার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়সের শর্ত শিথিল করে তিন পার্বত্য জিলা পরিষদ ও পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডে ২০ শতাংশ কোটা দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ করা হোক;
10. স্বেচ্ছায় প্রত্যাগত ও ১৯৯৪ সালে প্রত্যাগত ১৭৯৫টি শরণার্থী পরিবারকে তিন হাজার টাকা করে প্রদান করা হোক;
11. যে সমস্ত পরিবার বসত ভিটা ও জমিজমা ফেরত পায়নি তাদেরকে জমিজমা ফেরত দিয়ে গৃহ নির্মাণ বাবদ ১০ হাজার টাকা এবং কৃষি অনুদান বাবদ ৫ হাজার টাকা প্রদান করা হোক;
12. চুক্তি মুতাবেক সকল ভূমিহীন শরণার্থীকে ভূমি বন্দোবস্তী প্রদান করা হোক এবং যে সমস্ত পরিবার হালের গরুর টাকা পায়নি তাদেরকে হালের গরু কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হোক;
13. বেদখল হওয়া ৯টি মন্দির, ২টি অনাথ আশ্রম, একটি পালি কলেজ ও ২টি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান ফেরত ও সেগুলি পুন:নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক। স্থানান্তরিত ২টি সরকারি বাজার, ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় আগের জায়গায় স্থানান্তর করা হোক এবং অবৈধভাবে স্থাপিত ৫টি বেসরকারি বাজার অবিলম্বে উচ্ছেদ করা হোক;
14. প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের সরকার প্রদত্ত রেশনের পরিবহন, ঘাটতি, বিতরণ ও ওঠা নামার বকেয়া খরচের টাকা অবিলম্বে প্রদান করা হোক;
15. তালিকা বহির্ভূত এক হাজার একশত তিপ্পান্ন (১১৫৩)টি পরিবারের ন্যায় ৫৫টি পরিবারকে সমানভাবে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হোক;
16. পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা এবং সে তালিকার ভিত্তিতে সকল নির্বাচন করা হোক (যাতে স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্য থেকে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা যায়);
17. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হোক এবং উপজাতীয়দের থেকে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অবিলম্বে নিয়োগ করা হোক।
উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপজাতিদের ‘আদিবাসী’ বানানোর চক্রান্ত
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ২৮ জানুয়ারি ২০১০ এক প্রজ্ঞাপনে ‘উপজাতীয় সম্প্রদায়কে আদিবাসী অভিহিত করার অপতৎপরতা’ প্রসঙ্গে জিলা প্রশাসকের কাছে এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। প্রেরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪৫টি উপজাতি বাস করে। বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম জিলা পরিষদ আইন, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কোথাও আদিবাসী অভিহিত করা হয়নি। তথাপি সরকারী একাধিক প্রজ্ঞাপনকে অবজ্ঞা করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কতিপয় নেতা ও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ এমনকি সাংবাদিকরা ইদানীং এদেরকে উপজাতি না বলে আদিবাসী বলছে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করতে প্রজ্ঞাপনে নির্দেশ দেয়া হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সরকারদলীয় এমপি জনাব আসাদুজ্জামান নূর, মহাজোটের অংশীদার এমপি জনাব রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই উপজাতির পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহারের জন্য রীতিমত দৃঢ় অবস্থানে আছেন। এদের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিরা উপজাতি ও আদিবাসীর পার্থক্য বুঝেন না এটা বিশ্বাস করা যায় না। খোদ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও সরকারের ভেতরে ও বাইরে একটি বিশেষ মহল উপজাতি আদিবাসী বিতর্ক জিইয়ে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের প্রায় ৪৫টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করছেন। সরকার ও উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিজেরাও নিজেদের উপজাতি বা জুম্ম জনগণ মনে করে থাকেন। কিন্তু সমতলের উৎসাহীরা তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন। অথচ নৃতাত্বিক, জাতিতাত্বিক, ভাষাতাত্বিক, ঐতিহাসিক এবং অন্যকোন বিচারেই তারা বাংলাদেশের ভূ-পরিমন্ডলের আদিবাসী (Aboriginals) হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন না। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ও আদিবাসী ফোরামের সভাপতি সন্তু লারমা পাহাড়ী জনগণকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও তার স্ব-গোত্রীয় নেতারাই এর বিরোধিতা করছেন। পাহাড়ীদের একটি বড় অংশ যারা নিজেদের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে সক্রিয় রেখেছেন তারাও ‘আদিবাসী’ শব্দটি মেনে নিতে নারাজ। ইউপিডিএফ প্রধান প্রসিত খীসার মতে, পাহাড়ে বসবাসকারীরা পাহাড়ী, তারা আদিবাসী নয়। জে এস এস এর বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা ও পাহাড়ীদের অধিকারের প্রশ্নে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত সুধা সিন্ধু খীসাও নিজেদের ‘আদিবাসী’ নয় জুম্ম জনগণ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তির মুখবন্ধে নিজেদেরকে উপজাতি দাবি করেই জে এস এস নেতা সন্তু লারমা পার্বত্য শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বিগত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে ‘আদিবাসী’ ইস্যুটি নতুন মাত্রা লাভ করে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় উপদেষ্টা হওয়ার পর। তারপর কিছু মুখচেনা বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার নেতা-নেত্রী, এনজিও এবং মিডিয়া ইস্যুটিকে নিয়ে মাতামাতি করতে থাকে। অথচ সরকার যৌক্তিক কারনে কোন দিনই উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ বলে উল্লেখ করেনি। উপজাতীয়দেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত করার অপতৎপরতায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিব্রতবোধ করেন। ইনাম আহমদ চৌধুরীর মতে, পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতিরা কেউই আদিবাসী নন। তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে এই এলাকায় এসে বসতি গেড়েছেন। আর সংবিধানেও কাউকে কোন নির্দিষ্ট এলাকার আধিপত্য দিয়ে দেয়ার এখতিয়ার কাউকে দেয়নি।
বিদেশি মহাশক্তিধরদের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে ‘আদিবাসী’ বানানোর চেষ্টা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এ প্রচেষ্ঠার সঙ্গে যেমন এদেশে অনেক এনজিও জড়িত, তেমনিভাবে কিছু বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার গ্রুপসহ রাজনৈতিক দলও এসবের পৃষ্ঠপোষকতা করে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোকে আদিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলে তাদের স্বার্থে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ সহজ হয়ে পড়ে। জানা যায়, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক চার্টারে ‘আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত যে কোনো দেশে জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে’- এমন ক্লজ আছে। এ দিক থেকে বিচার করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষার নামে জাতিসংঘের মাধ্যমে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই এদেশে চলছে। শান্তি রক্ষার নামে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আমাদের সেনাসদস্যদের পাঠিয়ে আমরা যেমন জাতীয় গৌরবের ঢাকঢোল বাজাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিসংঘের নেতৃত্বে অন্য কোনো দেশের সৈনিকরা যদি শান্তি রক্ষার নামে এদেশে এসে ঘাঁটি গাড়ে তখন কী আমরা গৌরবের ঢাক-ঢোল বাজাবো? বিষয়টি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার হবে যে সব ব্যক্তি, এনজিও ও রাজনৈতিক দল এদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহকে আদিবাসী বানানোর চেষ্টা করছে, তারা কার স্বার্থে কাজ করে চলেছে।
বিভিন্ন এনজিও, বিদেশী সংবাদ মাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খৃস্টান রাষ্ট্রসমূহ এ সকল ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গোপনীয় প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ইউএনডিপি, ডানিডা, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় কোটি ডলার বিনিয়োগ এবং উপজাতীয়দের ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা উপজাতীয়দের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এর আগেও পররাষ্ট্র এবং পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে অনুরূপ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব সম্প্রতি উপজাতি-আদিবাসী বিতর্ক ও নব্য উপনিবেশবাদ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, বিদেশী শক্তির প্রতিভূ ‘নব্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ বলে কুখ্যাত অপতৎপরতাকামী এনজিও চক্র ও খৃস্টান মিশনারী গোষ্ঠী বাংলাদেশে বসবাসকারী উপজাতীয় ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনসম্প্রদায়গুলোকে এ দেশের ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। উপজাতীয়রা (Tribals) সব সময়ই যে আদিবাসী হবে এমন কথা ঠিক নয়। মতলববাজ এনজিওচক্র তাদের আদিপত্যবাদী বিদেশী প্রভুদের ভূ-রাজনৈতিক নীল-নকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের নানা শান্তিপ্রিয় নিরীহ ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলোকে এ দেশের ‘আদিবাসী’ হিসেবে ঘোষণা করছে, প্রচার প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে অত্যন্ত নিপুণ কৌশলে। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো এ দেশের আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নয়- তার প্রমাণ প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ RHS Huschinson (1906), TH lewin (1869), J.Jaffa(1989), অমরেন্দ লাল খিসা (১৯৯৬) এববং এন আহমেদ (১৯৫৮) প্রমুখের লেখা, গবেষণাপত্র, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। তারা সবাই এক বাক্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজাতীয়দের নিকট অতীতের কয়েক দশক থেকে নিয়ে মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে এ দেশে স্থানান্তরিত হয়ে অভিবাসিত হবার যুক্তি-প্রমাণ ও ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
স্বাধীন জুমল্যান্ড ও চাকমাল্যান্ড
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী উপজাতীয়দের মধ্যে চাকমারা হচ্ছে সর্বাধিক সুবিধা প্রাপ্ত। সেখানকার উপজাতীয়দের নাম ভাঙ্গিয়ে মূলত: চাকমা উপজাতিভুক্ত কতিপয় বিদেশী এজেন্ট কেবলমাত্র উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জন্য চাকমা প্রভাবিত পৃথক রাজ্য ‘জুমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার বায়না ধরেছে। শান্তিবাহিনীর উপরস্থ ও অধীনস্থ সকল সন্ত্রাসী বিচ্ছিন্নতাবাদীই মুসলিম ও বাংলাভাষীমুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং আদতে তাদের স্বাধীন জুম্মল্যান্ড বা চাকমাল্যান্ড গঠনে বদ্ধপরিকর। শান্তিবাহিনীর দাবী অনুযায়ী বাঙালী উচ্ছেদ করতে হবে এবং তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির উপর একচ্ছত্র অধিকার, কর্তৃত্ব ও মালিকানা দিতে হবে। এটি সংবিধান বিরোধী, মৌলিক অধিকার বিরোধী, দেশবাসীর অধিকার হরনের শামিল। ভূমির উপর কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের। শান্তিবাহিনী বাঙালীদেরকে নিজ দেশে ‘বহিরাগত’ ‘সেটলার’ বলে অভিহিত করে এবং বাঙালীদের বহিস্কারের দাবী করছে এবং বাঙালীদেরকে অত্যাচার, নিপীড়ন, সন্ত্রাস ও হত্যার শিকারে পরিণত করেছে। তারা নিজ দেশে পরবাসী। অথচ তারা রোসাং, আরাকান তথা মায়ানমার বা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, কেউবা আরো দূরের কোন স্থান থেকে এসেছে। তারাই বহিরাগত, অভিবাসী, পরদেশী, তারা এখানকার ভূমিপুত্র বা আদিবাসী নয়। তারা ভারতীয় চাকমাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসছে এবং চাকমা মেজোরিটি তৈরি করে কেবল ‘জুমল্যান্ড’ নয় বরং বাংলাদেশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন ‘চাকমা ল্যান্ড’ বানিয়ে ফেলার চেষ্টায় রত। বস্তুত: ভারতীয় কর্তৃপক্ষের, গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এবং ভারতীয় এ্যানালিষ্ট ও পত্র-পত্রিকার ভাষায় ‘জুমল্যান্ড’ বদলে গিয়ে ‘চাকমাল্যান্ড’ কথাটি এসে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী আরো লিখেছেন, চাকমারা বহিরাগত হয়েও সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে নিজেদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপূত্র এবং বাস্তবে যারা এদেশবাসী সে বাঙালীদেরকে বহিরাগত বলে ভারতীয় প্রভাবে এবং তাবেদার সরকারের নোংরা সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন করে ‘জুমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার দাবী উঠিয়েছে। এই ‘জুম’ শব্দটি চাকমাদের ভাষার নয়, এটি কোলদের শব্দ। এছাড়া জুম চাষ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০%-এরও কম। আবার চাকমারা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের অর্ধেকের অর্ধেকেরও কম তথা কেবল দশমিক বাইশ শতাংশ। তারা আরো ১২টি উপজাতির নাম ভাঙ্গিয়ে বাস্তবে তাদের প্রতারিত করে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক দশমাংশ ভূ-খন্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামটি পর্যন্ত চিরতরে মুছে দিয়ে ‘জুমল্যান্ড’ এবং প্রকৃত প্রস্তাবে ‘চাকমাল্যান্ড’ কায়েম করতে চায় দেশীয় ষড়যন্ত্রী ও প্রতিবেশী প্রভু রাষ্ট্রের সহায়তায়।
উপজাতীয়দের স্বার্থ, পাহাড়িদের স্বার্থ ইত্যাদির কথা বলে চাকমারা এককভাবে নেতৃত্ব, সুবিধা, অর্থবিত্ত, আখের- সবকিছুই ঘুচিয়ে নিচ্ছে, মাখন সব খেয়ে ফেলছে। স্বাধীন জুমল্যান্ডের দাবী তুলে বাস্তবে তারা চাকমাল্যান্ড প্রতিষ্ঠার দিকে এগুচ্ছে। ০.২২% সামান্য বহিরাগত চাকমাদের জন্য অভূতপূর্ব উন্নয়ন, সুযোগ-সুবিধা, বিশেষ মর্যাদা, বিশেষ কোটা, প্রতি বাঙালী মুসলমান অপেক্ষা প্রতি উপজাতীয় ব্যক্তি ২১ গুণ বেশি সুবিধা লাভ- এককভাবে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে রিজিওনাল কাউন্সিল, উপজাতীয়দের একচ্ছত্র কর্তৃত্বে পার্বত্য শাসন, ভূমির উপর সহ অন্যান্য দখলদারির ব্যবস্থা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি গমনে বাধা দেয়া হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনবসতি এলাকা সমূহের ৭০ ভাগই এককভাবে উপজাতিদের দখলে। কেবল অবশিষ্ট ৩০ ভাগে বাঙালীদের সাথে তাদের সহাবস্থান। তাও চাকমারা সহ্য করতে রাজি নয়, যদিও তারা নিজেরাই এ দেশে বহিরাগত।
আলাদা পতাকা ও মানচিত্র
পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পৃথক পতাকা ব্যবহারের মাধ্যমে হঠাৎ করে পাহাড়িদের আলাদা ভূখন্ড প্রতিষ্ঠার প্রচারণা শুরু হয়েছে। ইউএনপিও’র ওয়েবসাইটে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের এ পতাকার ছবি দেয়া হয়েছে। প্রতিনিধিত্বহীন জাতি ও জনগোষ্ঠী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে এতে তুলে ধরা হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব তিমুরও এই সংগঠনের সদস্য ছিল। এতে ১৯৯১ সালের আদমশুমারির বরাত দিয়ে তিন পার্বত্য জিলার ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৫ জনের মধ্যে ৫১.৪৩ শতাংশ পাহাড়ি এবং ৪৮.৬৭ শতাংশ বাঙালি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি মাত্র ৯ শতাংশ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউএনপিও’র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও অভিবাসী বাঙালিদের সমতলে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুটি এখনো নিষ্পত্তি করা হয়নি।
রহস্যময় পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এক রহস্যজনক সংগঠনের নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন তদারকির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করা হয়। ২০০৮ সালে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এটি পুনর্গঠিত হয়। ২০০৮ সালের ৩১ শে মে ও ১লা জুন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে বাংলাদেশ ও বাইরের বিভিন্ন দেশের ১২ জনকে এর সদস্য করা হয়। ব্রিটিশ লর্ডসভার সদস্য লর্ড এরিক অ্যাভবারি, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলাতানা কামাল চক্রবর্তী ও ডেনমার্কের ড. ইদা নিকলেইসেনকে কো-চেয়ার করা হয় কমিশনের। পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কমিশন পার্বত্য তিন জিলা থেকে সেনা প্রত্যাহার, অভিবাসী বাঙালিদের সরিয়ে এনে সেখানে পাহাড়িদের পুনর্বাসন, চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ি প্রধান স্থানীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও পাহাড়িদের ভূমির মালিকানার বিষয়টি ল্যান্ড কমিশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করার সুপারিশ করে। কমিশন বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের মতো সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার জন্যও সুপারিশ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা সেখান থেকে স্বেচ্ছায় সমতলে চলে আসতে না চাইলে তাদের রেশনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিতে বলেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিশন। কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের তাদের সম্মতি নিয়ে সমতলভূমিতে পুনর্বাসনের ফলপ্রসূ প্রক্রিয়া হাতে নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছে, যেসব বসতি স্থাপনকারী স্বেচ্ছায় সমতলভূমিতে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে রাজি হবে, তাদেরকে তিন বছরের জন্য নতুন স্থানে বিনামূল্যে রেশন সরবরাহ করা হবে। এর পাশাপাশি তাদেরকে নগদ অর্থসহায়তা, চাকরি, প্রশিক্ষণ ও পরিবহনের সুবিধা দিতে হবে। একই সাথে সরকার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের কিংবা নবাগতদের জন্য নতুন কোনো সুযোগ-সুবিধা কিংবা বৈষয়িক প্রণোদনা দেয়া যাবে না। যারা স্বেচ্ছায় সমতল ভূমিতে পুনর্বাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং বর্তমান স্থানে থেকে যেতে চাইবে তাদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
কমিশন পার্বত্য জোনের বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের জমিকে অবৈধভাবে দখলকৃত বলে উল্লেখ করে বলেছে, ভূমি ল্যান্ড কমিশন এসব জমি ‘প্রকৃত’ পাহাড়ি মালিকদের ফিরিয়ে দিলে তা ‘স্বেচ্ছায়’ বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র পুনর্বাসিত হতে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করবে। কমিশন উল্লেখ করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার ধরন মূলত রাজনৈতিক। তাই এ সমস্যার সামরিক সমাধানের চেয়ে রাজনৈতিক সমাধানই কাম্য। যথাশিগগির সম্ভব শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। কমিশন বলেছে, উপজাতীয়দের মধ্যে বরাদ্দকৃত ভূমির স্বত্ব রেকর্ড, রিসেটেলমেন্ট ও প্রত্যাবাসিত পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত বিধি-বিধান বাস্তবায়ন, বাঙালিদের ‘অবৈধভাবে’ দখল করা ভূমি বাতিলের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা এবং পাহাড়ি লোকদের জোরপূর্বক উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে অযথা ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শান্তিচুক্তিতে প্রস্তাবিত ল্যান্ড কমিশনকে দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে। এই ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
সম-অধিকার আন্দোলন অভিযোগ করেছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল রাঙ্গামাটি জিলার বাঘাইহাটের গঙ্গারামমুখ এলাকায় কিছু সশস্ত্র ‘উপজাতীয় সন্ত্রাসী’দের সাথে গোপন বৈঠক করেছে। প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি জিলার ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি’র কর্মকর্তাদের সাথেও গোপন সভা করে।
এখনো অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম
নিবিড় পাহাড়, নিশ্চুপ জলাধার আর নির্দোষ প্রাকৃতিক উপস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণে যে বিশাল পার্বত্য অঞ্চল তাকে অশান্ত, বিক্ষুব্ধ জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ, মর্মান্তিক এবং রক্তাক্ত। ড. মাহফুজ পারভেজ লিখেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পারতো বাংলাদেশের শান্তির সুইজারল্যান্ড; হয়ে গিয়েছে তীব্র অশান্তির লেবানন। অশান্তি কাউকে রক্ষা করেনি; কোন পক্ষকেই বিজয়ী করেনি। বাড়িয়েছে হিংসা, রক্তপাত ও বিভেদ। সংঘাত নিরসনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনাও চলেছে পাশাপাশি। এবং সে ধারায় ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। ‘শান্তিচুক্তি’ শান্তি আনতে পারেনি। ‘শান্তিচুক্তি’ জন্ম দিয়েছে নতুন উত্তেজনার। সেখানে আজো প্রবাহিত হচ্ছে হিংসার ঝরনাধারা। সেখানে চলছে Internal War। অভ্যন্তরীণ লড়াই, সংঘাত হানাহনির করাল গ্রাসে পার্বত্য ভূমি ও মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত; সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যের সংঘাত এখন জাতীয় রাজনীতিকেও গ্রাস করেছে।
পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম আকস্মিকভাবে অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত ১৯-২০ ফেব্রুয়ারী ২০১০ প্রথম ঘটনা ঘটে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজিলার সাজেক ইউনিয়নের বাঘাইহাটে। সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এল থাঙ্গা পাঙ্খো বলেছেন, বাঘাইহাটের সহিংসতার জন্য দায়ী চাকমা পাহাড়িরা। তারা বিনা উস্কানিতে হামলা করেছে। চাকমারা নিজেদের ঘর নিজেরা পুড়ে দিয়ে বাঙালিদের ওপর দোষ চাপিয়েছে। চাকমারা অতি বাড়াবাড়ি করছে বলেও তার অভিমত। ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০১০ আবার সংঘর্ষ ঘটে খাগড়াছড়িতে। রক্তক্ষয়ী এসব সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছে- এদের দু’জন বাঙালি। সেনাবাহিনীর একজন সদস্যসহ আহত হয়েছে কয়েকশ’। শত শত বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনার দিন রাতে খাগড়াছড়ি শহর ও তার আশপাশের এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। এরপর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ১৪৪ ধারা বলবৎ করা হয়। ১৪৪ ধারা তুলে নেয়ার ৫২ ঘন্টা পর পূর্ব শালবনের আদর্শপাড়া গ্রামের চারটি বাঙালি বাড়ি উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। হামলার শিকার বাঙালীরা এখনও হামলা আতংকে ভীত সন্ত্রস্ত। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীও নামানো হয়। হঠাৎ কেন পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত হয়ে উঠেছে এটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এ সংঘাতময় জনপদ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজেই বুঝা যায়। সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার পর সরকার বিকল্প কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে বিরাজমান বিরোধ, বিশেষত ভূমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ- আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, পাহাড়ি-বাঙালির বিরোধের মূল কারণ যে ভূমির মালিকানা তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।
এ ছাড়া পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) চুক্তি পক্ষ ও চুক্তি বিপক্ষের ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মধ্যে সংঘাত লেগেই আছে। বর্তমান এ সংঘাত বেড়ে গিয়ে অশান্ত হয়ে উঠেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিবদমান উপজাতীয় দুই গ্রুপের সদস্যরা আধিপত্য বিস্তার ও একে অন্যকে নির্মূল করতে পরস্পরের ওপর সশস্ত্র হামলা জোরদার করেছে। প্রতিনিয়ত রাঙ্গামাটির কোনো না কোনা গ্রামে দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছেই। পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন বেড়ে গেছে। সশস্ত্র এ সংঘাতে হতাহতের প্রকৃত হিসাবও অজানা থেকে যাচ্ছে। গহিন জঙ্গলে বন্দুকযুদ্ধে শত শত রাউন্ড গুলি বিনিময়ে হতাহত হলেও তাদের সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ঘটনার পর তল্লাশি করে হতাহতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। সম্প্রতি পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সুযোগে অব্যাহত সন্ত্রাস আর খুনাখুনি বাড়ছে। চলছে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া।
সারণী -২
পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ-এর আধিপত্যের তুলনামুলক চিত্র-
নং এলাকা জেএসএস ইউপিডিএফ নং এলাকা জেএসএস ইউপিডিএফ
১ রাঙ্গামাটি (সদর) ১০০% ০% ১৪ মাটিরাঙ্গা ৫০% ৫০%
২ বাঘাইছড়ি ৯০% ১০% ১৫ রামগড় ৩০% ৭০%
৩ লংগদু ১০০% ০% ১৬ মানিকছড়ি ৫০% ৫০%
৪ বরকল ৫০% ৫০% ১৭ মহালছড়ি ২০% ৮০%
৫ নানিয়ারচর ১০% ৯০% ১৮ লক্ষিমছড়ি ০% ১০০%
৬ কাউখালী ০% ১০০% ১৯ বান্দরবান(সদর) * ০%
৭ জুরাইছড়ি ১০০% ০% ২০ রোয়াংছড়ি ৯০% ১০%
৮ কাপ্তাই ৫০% বাঙালিদের
আধিপত্য ২১ রুমা ** **
৯ রাজস্থালি ০% ০% ২২ লামা * ০%
১০ বিলাইছড়ি ১০০% ০% ২৩ থানচি ** **
১১ খাগড়াছড়ি
(সদর) ৫০% ৫০% ২৪ আলিকদম * ০%
১২ পানছড়ি ৫০% ৫০% ২৫ নাইক্ষংছড়ি ০% (বাঙালি
আধিপত্য) ০%(বাঙালি
আধিপত্য)
১৩ দিঘিনালা ২০% ৮০%
* জেএসএস এর কার্যক্রম সামান্য এবং ইউপিডিএফ-এর কোনই কার্যক্রম নেই।
** এখানে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ প্রভাব নেই। এগুলো বাঙালি আধিপত্যপূর্ণ এলাকা।
সূত্র : গ্লোব নিউজ ম্যাগাজিন, মার্চ ১৬-৩১, ২০০৪
গত ১৫ মে ২০১০ জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে জুরাছড়িতে দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হয়। ১৭মে রাজস্থলী উপজিলায় এ দুই উপজাতি সংগঠনের বন্দুকযুদ্ধে মারা যান একজন ও আহত হয় একজন। ২০ মে জুরাছড়িতে দুই গ্রুপের মধ্যে আবারো বন্দুকযুদ্ধ হয়। এই ঘটনায়ও দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
এসব ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। লোকজনের চোখে ঘুম নেই। মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের উপায়
দুর্গম পাহাড়ে সৌন্দর্যের অপার লীলার ভেতরে বেড়ে উঠা বর্তমান পাহাড়ি ও বাঙালি প্রজন্ম পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান চান। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারন মানুষ চান শান্তি, তারা সংঘাত-সহিংসতা চান না। চাঁদা না দিয়ে তারা নির্বিচারে জীবন কাটাতে চান। সেই সাথে চান সামনে এগিয়ে যেতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ চায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান।
1. পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক সমস্যা এবং এর সামাধানও করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। শান্তিচুক্তিকে রাজনৈতিক সমাধানের পদক্ষেপ হিসেবে ধরে নিলেও তা যে কোনো সমাধান দিতে পারেনি, এটাই দেখা যাচ্ছে, এর একটা বড় কারণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হয়েছে নির্বাহী ক্ষমতাবলে, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত থাকলেও তা সংসদে আলোচিত ও অনুমোদিত হয়নি। উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে যে সমঝোতা ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে উপজাতিগুলোর পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেছিলেন বান্দরবন জিলার বোমাং রাজা সহ ১৭ জন বিশিষ্ট নেতা, রাঙ্গামাটি জিলার ২১ জন বিশিষ্ট নেতা আর খাগড়াছড়ি জিলার ২৭ জন বিশিষ্ট নেতা। তখন জনসংহতি সমিতি বা শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে কেউ এই সমঝোতা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। বস্ত্তত এ সময় থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের শুরু। সমঝোতা ঘোষণাপত্র উপেক্ষা করে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা সরকার কেবল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান পাহাড়িদের বাঙালি করার চেষ্টা করে যে ভুল করেছিলেন, শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিসহ অন্যান্য উপজাতিকে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব না দিয়ে কেবল শান্তিবাহিনী প্রভাবিত চাকমাদের সাথে শান্তিচুক্তি করে আরেকটি ভূল করলেন। কারণ এ শান্তি চুক্তি বাঙালিদের কল্যাণে না এসে তাদের যেমন বঞ্চিত করেছে তেমনি বঞ্চিত করেছে অন্যান্য উপজাতিদের। সুতরাং শান্তিচুক্তি সংশোধন করে তাতে বাঙালিসহ সব উপজাতিকে আনুপাতিক হারে ক্ষমতার অংশীদার করতে হবে, যাতে তাদের অধিকার নিশ্চিত হয় এবং নিজ নিজ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। রাজনৈতিক সমাধান বা শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাধারণ পাহাড়ী-বাঙ্গালী কারো দ্বিমত নেই।
2. সংবিধান সংশোধন না করায় শান্তি চুক্তি সংবিধানিকভাবে অবৈধ থেকে গেছে। এ চুক্তির মাধ্যমে সংবিধানে বর্ণিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়েছে। শান্তি চুক্তি সাংবিধানিক বৈধতার জন্য এখনো সংসদে উত্থাপিত ও অনুমোদিত হতে পারে। নয়তো আদালতে এর সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নে রায় হলে গোটা চুক্তিই বাতিল হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য শান্তি চুক্তির বৈধতা প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ গড়িয়েছে আদালতে। আদালতের রায়ে পুরোটা চুক্তি বাতিল না হলেও এর আওতায় গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সম্পূর্ণ এবং পার্বত্য জিলা পরিষদের কয়েকটি ধারা অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে সামনে রেখে সংবিধানের আওতায় সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। নীতিগত প্রশ্নে ছাড় দেয়ার কোন অবকাশই নেই।
3. পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার সম্ভব নয়, যুক্তি সংগতও নয়। সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হলে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে তাতে পার্বত্য অঞ্চলে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
4. পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে উগ্র উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। অবৈধ অস্ত্র ও উগ্র উপজাতীয়দের সন্ত্রাস পার্বত্য চট্টগ্রামকে গভীর সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ বাঙালি ও উপজাতিরা বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতির জন্য দায়ী নয়।
5. প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্প গুলো পুনঃস্থাপন করতে হবে।
6. পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য যতদিন প্রয়োজন ততদিন সেখানে সেনাবাহিনী বহাল রাখা ছাড়া উপায় নেই। সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ থাকত না। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেনাবাহিনী এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে যে ভাবে নিয়োজিত রয়েছে, একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামেও নিয়োজিত রয়েছে এবং থাকবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বও তাদের। সেখানে সেনাবাহিনী না রাখার বাস্তব অর্থ দাঁড়াবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া।
7. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশীদের গোপন তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং উন্নয়ন সংস্থার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশীদের গোপন তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
8. নতুন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি গড়ে তোলার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
9. দ্রুত ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী সবার জন্য ভূমি বন্টন করে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
10. পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালীদের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। একজন উপজাতীয় নেতা এল থাঙ্গা পাঙ্খো বলেছেন বাঙালি ও পাহাড়িরা মিলেমিশেই যুগ যুগ ধরে সেখানে বসবাস করে আসছেন। সমস্যা সেখানে এতদিন হয়নি। এখন হচ্ছে কেন? পাঙ্খোর কথার মধ্যেই সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে ‘স্ট্যাটাস কো’ অর্থ্যাৎ যে যেখানে আছে সে সেখানে থাকবে। কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এটি উপলদ্ধি করতে হবে ইতিহাস পাহাড়ী ও বাঙালীদের ভৌগলিক সান্নিধ্যে এনেছে, রাজনৈতিক বিভেদের দেয়াল তুলে অমানবিক বিয়োগান্ত নাটকের অবতারণা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না।
11. পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়েই ঐক্যবদ্ধভাবে মুকাবিলা ও সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এখানে বসবাস করছে হতভাগ্য ভূমিহীন এক জনগোষ্ঠী, যারা এক টুকরো জমি ও একটু জীবিকার আশায় প্রতিকূল পরিবেশে আস্তানা গড়তে গিয়েছে। এদের নিয়ে ‘রাজনীতি’র খেলা করা উচিত হবে না। সংবিধানের ৩৬, ৩৭ ও ৪২ নং ধারা অনুযায়ী একজন বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস, সম্পত্তি অর্জন ও চলাফেরা করার অধিকার রাখেন। তথকথিত গণশুনানির আয়োজন করে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। গত ৩৮ বৎসরে পাহাড়িরা জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালীদের সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ তাদের ইচ্ছা ছিল পাহাড়কে বাঙালীমুক্ত করা।
12. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-সীমানার ভেতরে বসবাসরত বাঙালী জনগোষ্ঠীকে তাদের বর্তমান দারিদ্র্য ও অনগ্রসরতার হাত থেকে মুক্তির জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালীদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
13. গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত প্রায় ৩০,০০০ বাঙালী পরিবারকে তাদের পুরনো গ্রামে বসতভিটায় ফিরিয়ে নিতে হবে অথবা নতুনভাবে চিহ্নিত খাস জমিতে তাদেরকে বসতি করতে দিতে হবে।
14. পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বন্দ্বটা হলো উপজাতীয় বনাম অ-উপজাতীয়, সংঘর্ষের সময় রাজনৈতিক দল বিচার হয় না। সেজন্য দলমত নির্বিশেষে পার্বত্য রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বা থীম হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয়া-শরণার্থী হওয়া বন্ধ করা এবং আর্থ-সামাজিকভাবে এমন পরিবেশ বজায় রাখা যাতে করে শান্তি প্রক্রিয়া মাঝে মধ্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেও পুনরায় চালু করা যায়।
15. পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি গুলোর সামগ্রিক বিকাশ এবং মূল জাতীয় স্রোতধারার সঙ্গে তাদের কার্যকর ও অর্থবহ সংযোগ সাধন করতে হবে।
16. পার্বত্য চট্টগ্রামে সত্তর ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করতে হবে। এই ভূমি জরিপের সাথে এই অঞ্চলে অভিবাসিত বাঙালীদের বর্তমান ও ভবিষ্যত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জরীপে প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাসজমি বেরিয়ে আসবে যাতে করে বর্তমানে অবস্থানরত বাঙালিদেরকে খাস জমি দেয়া যাবে। বিবিধ কারণে বাঙালিদের পার্বত্য এলাকার সীমারেখার ভেতরেই খাস জমি দিয়ে বা পুনর্বন্টন করে এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত বা উপকরণগত সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে উপজাতীয়দের সাথে পাশাপাশি অবস্থানে রাখতে হবে।
17. সন্ত্রাসী কর্মকান্ড- অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে তুলতে হবে এবং রাজনৈতিক ও মনস্তাত্বিকভাবে পার্বত্যবাসী উপজাতীয়দের বাংলাদেশের জাতীয় সত্তায় বা রাষ্ট্রীয় সত্তায় সমন্বিত (Integrated) করতে হবে। এটি একান্তভাবে সম্ভব না হলেও তা সম্ভব করার জন্য গঠনমূলক প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে।
18. পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ঘরে-বাইরে একশ্রেণীর শক্তি যেভাবে ষড়যন্ত্র করছে, যেভাবে মাথা তুলেছে, তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। একমাত্র কূটনীতিক ও বিদেশের বৈধ কোন প্রতিনিধি ছাড়া খৃস্টান মিশনারী, সাম্রাজ্যবাদের আশির্বাদপুষ্ট এনজিও, বিদেশী সাহায্য সংস্থার সকল বিজাতীয় বিদেশীর পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
19. সীমান্ত পাহারা জোরদার করতে হবে। সুদূর মায়ানমার থেকে রামগড় পর্যন্ত পাহাড়ি সীমান্ত শুধু বিডিআর দ্বারা তদারকি করা সম্ভব নয়, সমীচীনও নয়। চোরাচালান ও দুষ্কৃতিকারীদের অনুপ্রবেশ রোধে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও সক্রিয় সহযোগিতা অপরিহার্য।
উপসংহার
পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানকার ইস্যু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। এ অঞ্চলে কোন গ্রুপ বা গোষ্ঠীকে একক মনোপলি দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে কোনো বহিঃশক্তির কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা-সংগঠনের হস্তক্ষেপের অবকাশ নেই। যদি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে কারো ন্যায়সঙ্গত সহযোগিতা সরকার কামনা করে, কেবল তখনই নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে এবং যথানিয়মে বাইরের কেউ সহায়তা করতে পারে। কিন্তু তা কিছুতেই বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে না। সন্দেহ নেই, গত তিন দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। সেখানে অনেক রক্ত ঝরেছে। মরেছে অনেক নিরীহ প্রাণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন প্রয়োজন সহাবস্থান, শান্তি ও উন্নয়ন। এই অঞ্চলে আর যেন কোন রক্ত না ঝরে। নিঃশেষ হয় না যেন নিরীহ প্রাণ। সন্তু লারমা অতীতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও, এদেশের মানুষ তাকে একজন পাহাড়ি নেতা হিসেবে সম্মান করে। এ সম্মান তাকে রাখতে হবে। তিনি যদি বর্ণবাদী আচরণ করেন, তাহলে তিনি শুধু বিতর্কিতই হবেন। বিদেশী সহযোগিতার একটি তথাকথিত ‘চাকমা রাষ্ট্র (?) প্রতিষ্ঠিত করার যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তা বাংলাদেশের মানুষ কোনদিনই হতে দেবে না। এ দেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে একদিন যুদ্ধ করেছিল। সেই যুদ্ধে চাকমারা এদেশবাসীর সাথে শরীক হয়নি সত্য; কিন্তু যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশটির জন্ম হলো, তার একদশমাংশ এলাকা আজ বিচ্ছিন্ন (?) হবে যাবে সেখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হবে, এটা এদেশবাসী কিছুতেই হতে দেবে না। ১৯৯৭ সালের চুক্তির পরও পরিস্থিতির প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটেনি এবং এই ইস্যুর সুষ্ঠু, স্থায়ী ও যথাযথ সুরাহার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ববোধ, আন্তরিক সততা ও সংযম অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইইউসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দাতা ও উন্নয়ন সহযোগীরূপে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু অন্যায় ও অযাচিত নাক গলানোর মাধ্যমে কূটনৈতিক সীমা লঙ্ঘন করার অধিকার নেই কারো। কিভাবে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মাঝে বৈষম্য-বিভ্রান্তি দূর হয়ে পার্বত্যাঞ্চলে প্রকৃত শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সেটাই হতে হবে সবার অভীষ্ট। আর বাংলাদেশের উন্নয়ন আর নিরাপত্তার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অত্যন্ত জরুরী। 

লেখক-পরিচিতি : জনাব মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম- বিশিষ্ট ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ এবং প্রাবন্ধিক।
লেখা-পরিচিতি : প্রবন্ধটি ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশ ইসলামিক সেনটার কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত হয়।

 

 

ফুটনোটঃ

 

. ড. মোহাম্মদ আবদুর রব, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূগোল ও ভূ-রাজনীতি, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক স্মারক, অতন্দ্র জনতা বাংলাদেশ, ধানমন্ডি, ঢাকা, ১৯ অক্টোবর ১৯৯৭, পৃ.১১০-১১১।
. ড. এমাজউদদীন আহমদ, জুমল্যান্ডের পরিণতি, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পূর্বোক্ত, পৃ.১৭।
. ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী ও ড. মোহাম্মদ আব্দুর রব, পার্বত্য চট্টগ্রাম : ভূ-রাজনীতি ও বিপন্ন সার্বভৌমত্ব, লেখকদ্বয় কতৃৃক প্রকাশিত, ঢাকা, ১লা জানুয়ারী, ১৯৯৭, পৃ.-৫।
. জাফর আহমদ নূর, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্বমোড়লদের হেড লাইটের আলো পড়েছে (প্রবন্ধ), পৃ-১।
. খাগড়াছড়ি জেলার সামুতং-এ ০.১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ইতোমধ্যে আবিস্কৃত হয়েছে। কাপ্তাই ও আলীকদমে কঠিন শিলা পাওয়া গেছে। রামুতে পাওয়া গেছে গ্যাস, সেই সাথে আলিকদমে পেট্রোলিয়াম ও লামায় পাওয়া গেছে কয়লা। মানিকছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে রয়েছে পাথরের বিরাট মওজুদ। দেখুন ড. তারেক শামসুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রাম কোন পথে? আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৩।
. সুগত চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও সংস্কৃতি, ট্রাইবাল অফিসার্স কলোনী, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৩, পৃ.১৫।
. পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য খাগড়াছড়ি, পার্বত্য রাঙ্গামাটি, পার্বত্য বান্দরবান ১৯৮৮ সালে তিনটি জেলার মর্যাদায় বিভক্ত হয়। দ্রষ্টব্য : জাতীয় সংসদের এ্যাক্ট, বাংলাদেশ গেজেট, ২রা মার্চ, ১৯৮৯।
. জয়নাল আবেদিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম: স্বরূপ সন্ধান, বুক মিউজিয়াম পরিবেশিত, ২৬ মার্চ ১৯৯৭, পৃ. ১৭।
. জয়নাল আবেদীন, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭-১৮।
. লেবানন ৪০৩৪ বর্গমাইল (১৪৪৩২ বর্গ কি.মি.), সাইপ্রাস ৩৫৭১ বর্গমাইল (৯২৫০ বর্গ কি.মি), ব্রুনাই ২২২৫ বর্গমাইল (৫৭৭০ বর্গ কি.মি), কাতার ৪৪০২ বর্গমাইল (১১৪০০ কি.মি) সিঙ্গাপুর ২৪০ বর্গমাইল (৬২২ বর্গ কি.মি), মরিশাস ৭২০ বর্গমাইল (১৮৬৫ বর্গ কি.মি), লুক্সেমবার্গ ৯৯৮ বর্গমাইল (২৫৮৬ বর্গ কি.মি) আয়তন বিশিষ্ট।
. সার্ভে অব বাংলাদেশের তথ্য, উদ্বৃত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন, মাওলা ব্রাদার্স, ফেব্রুয়ারী ২০০১, পৃ. ১৭।
. দৈনিক জনকন্ঠ, ৩০ জানুয়ারী ২০০০।
. ড. মাহফুজ পারভেজ, বিদ্রেহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তি চুক্তি, সন্দেশ, শাহবাগ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, পৃ.৯।

. বাংলাদেশে কতটি নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে রয়েছে মত পার্থক্য। এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি দলিলপত্র এবং বিভিন্ন গবেষণাপত্রে ভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়। কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১২, কেউ বলেছেন ১৫, আবার কেউ বলেছেন ৪৬। যেমন, মাহমুদ শাহ কোরেশি সম্পাদিত ‘ট্রাইবাল কালচার ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মার্কিন নৃ-বিজ্ঞানী Peter J. Bertocci ১৯৯১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ১২। আবার ১৯৯৪ সালের আদম শুমারী রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ.জি.সামাদ বলেছেন, দেশে ১৫টি নৃ-গোষ্ঠী বাস করছে। মাহমুদ শাহ কোরেশি নিজেই বলেছেন বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৩১। অন্যদিকে নৃতত্ত্ববিধ সি. মেলোনি বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসরত নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৬। তিনি অবশ্য ভাষাগত দিক থেকে নৃ-গোষ্ঠী গুলোকে ওই ৪৬ ভাগে ভাগ করেন। দেখুন, গৌতম মন্ডল, অশান্তির বেড়াজালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, নিউজ নেটওয়ার্ক, ধানমন্ডি, ঢাকা, জুলাই ২০০৫, পৃ.৩৩।
. রাঙ্গামাটিতে বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ১১টি (চাকমা, মারমা, তংচংগ্যা, ত্রিপুরা, পাংখো, লুসাই, বোম, খিয়াং, মুরং, চাক, খুমি)। খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী উজাতির সংখ্যা ৪টি (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল)। বান্দরবন জেলায় বসবাসকারী উপজাতির সংখ্যা ১২টি (মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, তংচংগ্যা, বোম, চাকমা, খুমী, খিয়াং, চাক, উসাই, লুসাই, পাংখো)। বিস্তারিত দেখুন অশোক কুমার দেওয়ান, চাকমাজাতির ইতিহাস বিচার, দিপীকা দেওয়ান প্রকাশিত, খবংপর্যা, খাগড়াছড়ি, নভেম্বর ১৯৯১; বিরাজ মোহন দেওয়ান, চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, উদয় শংকর দেওয়ান প্রকাশিত, উত্তর কালিন্দীপুর, রাঙ্গামাটি, জানুয়ারী ২০০৫; প্রভাংশু ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস, এপ্রিল ২০০৬; আতিকুর রহমান, পার্বত্য তথ্য কোষ ১-৯ খন্ড, পর্বত প্রকাশনী, সিলেট, নভেম্বর ২০০৭; আবদুস সাত্তার, পাকিস্তানের উপজাতি, পাকিস্তান পাবলিকেশন্স ঢাকা, ১৯৬৬।

. S. Mahmood Ali, ‘The Fearful state: Power people and Internal war in South Asia’, London and new Jersy: ZED Books, 1993, উদ্বৃত ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ.৫।

. ৫ম খন্ড- বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের এ্যাকট, বিল ইত্যাদি, বাংলাদেশ গেজেট, মার্চ ২, ১৯৮৯; উদ্বৃত ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বোক্ত পৃ. ৫।
. জাফর আহমদ নূর, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ব মোড়লদের হেড লাইটের আলো পড়েছে (প্রবন্ধ), পৃ.১।
. ধর্মযাজক ফাদার টীম ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে খৃস্টানীকরণ (Christianization) প্রোগ্রাম শুরু করেন। পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া তিনি এখানে বিগত ৩৭ বছর যাবত অবস্থান করে ছোট বড় সকল উপজাতি সদস্যদের খৃস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে পার্শ্ববর্তী মিজোরাম (৯০% খৃস্টান ও ইহুদী), ত্রিপুরা (৩০% খৃস্টান), মনিপুর (৪০% খৃস্টান), আসাম (৪৫% খৃস্টান), মেঘালয় (৮০% খৃস্টান), অরুনাচল (৭০% খৃস্টান) রাজ্যের খৃস্টান ও ইহুদীদের সাথে ধর্মীয় বন্ধন গড়ার কাজটি লোকচক্ষুর অন্তরালে সাফল্যের সাথে করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ধর্মযাজক বিশাল কর্মকান্ড পরিচালনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেমোগ্রাফিক ডিনামিকস পরিবর্তনের পাশাপাশি সকল উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অত্যাধুনিক বিশাল খৃস্টান ডরমিটরী, গীর্জা, মিশনারী স্কুল, বাইবেল কেন্দ্র, পাঠাগার, সার্ভিস সেন্টার, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট ও শক্তিশালী স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
. ড. এমাজউদদীন আহমদ, বাংলাদেশ রাজনীতি : কিছু কথা ও কথকথা, মৌলি প্রকাশনী, বাংলা বাজার, ঢাকা, মে ২০০২, পৃ. ১৬২-১৬৩।
. কামিনী মোহন দেওয়ান ও স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতির একটি প্রতিনিধি দল এবং ভুবন মোহন রায়ের নেতৃত্বে পার্বত্য রাজাদের আরেকটি প্রতিনিধি দল দিল্লি গিয়ে পৃথক পৃথকভাবে কংগ্রেস নেতাদের সাথে সাক্ষাত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন জানান।
. পার্বত্যাঞ্চলের প্রথম গনসংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতির সভাপতি ছিলেন কামিনী মোহন দেওয়ান। পিতার নাম ত্রিলোচন দেওয়ান। দেশ বিভাগের সময় ভারতের সঙ্গে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালানোর দায়ে তিনি কারাবরন করেন। রাঙ্গামাটি জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান (১৯৮৯) গৌতম দেওয়ান তার নাতি।
. বৃটিশ আমলের অন্যমত উপজাতীয় নেতা। পিতার নাম শ্যামচন্দ্র চাকমা। জনসংহতি সমিতি তথা শান্তি বাহিনীর অন্যতম উপদেষ্টা। ভারতের পক্ষ নেয়ায় হুলিয়া জারী হওয়ায় তিনি ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে জনপ্রতিধি নির্বাচিত হন।
. ভারতপন্থী চাকমা নেতা, পিতার নাম কালাহুলা দেওয়ান। ঘনশ্যাম দেওয়ানের আপন ভাগ্নে শান্তিবাহিনীর অন্যতম নেতা সমীরন দেওয়ান (মেজর মলয়)।
. এস.বি. চাকমা, উপজাতীয় নেতৃত্ব: সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিকথা, উদ্বৃত ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ.৩৭।
. সৈয়দ আজিজ উল আহসান ও ভূমিত্র চাকমা, ‘প্রব্লেমস অব ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন ইন বাংলাদেশ : দি চিটাগাং হিল ট্রাকটস’, এশিয়ান সার্ভে, ভলিউম ২৯, নং-১০, অকটোবর, ১৯৮৯, পৃ-৯৫৯-৯৭০।
. সত্তর এর নির্বাচনের সময় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার উপদেষ্টা ছিলেন। বাড়ী মোবাছড়িতে। পার্বত্য এলাকায় বেশ কয়েকটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অনন্ত বাবুর ছেলে প্রসীত বিকাশ খীসা পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালের নেতা এবং ইউপিডিএফের বর্তমান সভাপতি।
. সালাম আজাদ, শান্তিবাহিনী ও শান্তিচুক্তি, আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃ.২২।
. মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার পিতার নাম বিত্ত কিশোর লারমা, মায়ের নাম সুহাসিনী। তিনি অমৃতলাল দেওয়ানের ভাগ্নে। উল্লেখ্য সন্তু লারমা মামাতো বোন বিয়ে করেন। অন্যকথায় অমৃতলাল দেওয়ানের মেয়েকে বিয়ে করেন।
. হুমায়ুন আজাদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ.১৮।
. সালাম আজাদ, পূর্বোক্ত, পৃ.১২-১৩।
. পার্বত্য চট্টগ্রামের এককালের শক্তিশালী আওয়ামী লীগ নেতা। পিতা দিগম্বর চাকমা। দাদা লালমনি ডাক্তার স্বাস্থ্য বিভাগে চাকুরী করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্য নিয়ে সব সময় চিন্তা করতেন এবং সমস্যা সমাধানে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিবাদী ভূমিকায় বিশ্বাসী ছিলেন।
. আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩১-৩২।
. ১৯৫১ সালের ৭ অক্টোবর চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায় মারা যাওয়ার পর ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ তদীয় পুত্র রাজা ত্রিদিব রায় রাজ সিংহাসনে আরোহন করেন। পাকিস্তান শাসনামলে রাজা ত্রিবিদ রায়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান সরকারের সাথে তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিজয়ী হন।
. কলিকাতার তৎকালীন হিন্দু ব্যারিষ্টার সরল সেনের কন্যা বিনীতা রায়কে চাকমা রাজা নলিনাক্ষ রায় বিয়ে করেন। এই বিয়ের মাধ্যমে চাকমা রাজ পরিবারে হিন্দু আচার অনুষ্ঠানের বিকাশ ঘটে।
. সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম, নাথ ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ.৯।
. এ দলের সদস্য ছিলেন : মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, জ্ঞানেন্দ্র বিকাশ চাকমা, চারু বিকাশ চাকমা, বি.কে. রোয়াজা, স্নেহকুমার চাকমা প্রমুখ।
. ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী খাগড়াছড়ির ইটছড়ির গভীর অরণ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অনুজ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার ডাকনাম শন্তু বা শান্তি অবলম্বনে এদেরকে ডাকা হতো শান্তিবাহিনী। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে রিজার্ভ আর্মড পুলিশের ওপর অতর্কিতে প্রথম-হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে শান্তি বাহিনী; দেশব্যাপী শান্তিবাহিনীর নাম আলোচিত হতে থাকে।
. প্রীতিকুমার চাকমা ছিলেন ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সভাপতি। ১৯৮৫ সালের ২০ এপ্রিল রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রীতি গ্রুপের ২৩৩ জন শান্তিবাহিনীর সদস্য আত্মসমর্পন করেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অধিনায়ক মেজর জেনারেল এম. নুরুদ্দীন খানের কাছে অস্ত্র জমা দেন। ২৯ জুন বাংলাদেশ সরকার ও প্রীতি গ্রুপের মধ্যে আত্মসমর্পনের পর প্রীতি কুমার চাকমা বিদ্রোহ ছেড়ে ভারতে পরম সুখে সংসার করছেন। দেখুন হুমায়ুন আজাদ, পূর্বোক্ত। উদ্বৃত ড. মাহফুজ পারভেজ, পূর্বোক্ত পৃ. ৪৭।
. উল্লেখ্য ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পিই- ২৯৯ পার্বত্য চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পুনরায় জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, অনন্ত বিহারী খিসা, চারু বিকাশ চাকমা প্রমুখ বাকশালে যোগদান করেন। ‘বাকশাল’ (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) ছিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত দেশের একমাত্র দল; সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান বদলে ফেলে ‘বাকশাল’ এর মাধ্যমে দেশে একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
. অমৃত লাল চাকমা ওরফে ক্যাপ্টেন অসাধ্য (বলি ওস্তাদ) ইপি আর এর হাবিলদার ছিলেন। তিনি শান্তি বাহিনীর প্রথম অস্ত্র প্রশিক্ষক নলিনী, রনজন চাকমা ওরফে মেজর অফুরন্ত এর অধীনে শান্তি বাহিনীর সহকারী অস্ত্র প্রশিক্ষক ছিলেন।
. Life is not Ours. The Report of the Chittagong Hill Tracts Commission, May 1991, P-20.
. সালাম আজাদ, পূর্বোক্ত, পৃ.১৬-১৭।
. উষাতন তালুকদার পাহাড়ী ছাত্র সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন। শান্তি বাহিনীর তিনি প্রভাবশালী সদস্য এবং মেজর উষাতন তালুকদার সমীরন নামে পরিচিত। তার অপর নাম মলয়।
. রূপায়ণ দেওয়ান ওরফে মেজর রিপ হচ্ছেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জামাতা, শান্তিবাহিনীর প্রভাবশালী ফিল্ড কামান্ডার। তিনি পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রথম সেক্রেটারী ছিলেন।
. পাহাড়ী গন পরিষদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রসীত বিকাশ খীসা। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘জনসংহতি সমিতি ফ্যাসিস্ট কায়দায় এগুচ্ছে... .. এ চুক্তিতে শান্তি আসবে না’ (সাক্ষাৎকার মানব জমিন, ১৯ অক্টোবর ১৯৯৭)।
. পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ২১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গত ২০ মে ২০০৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ায় এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থায় জনগণের বিরুদ্ধে সরকার। সরকার, সেনাবাহিনী ও সন্তু লারমা চক্রের মিলিত ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এ গ্রুপটি ইউপিডিএফের অংগ সংগঠন।
. হিল ‘উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন নেত্রী কল্পনা চাকমা ১৯৯৬ সালের ১২ জুন শান্তিবাহিনী কর্তৃক অপহৃত হন।
. তিন পার্বত্য জেলায় চাঁদাবাজি চলছেই, সমকাল রিপোর্ট, ৫ ডিসেম্বর ২০০৯ সংখ্যা, পৃ-৩।
. দেখুন দৈনিক সমকাল, ৩ ডিসেম্বর ২০০৯, পৃ-৯
. নিরাপত্তা বিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের মতামত, দৈনিক নয়াদিগন্ত, ৮ অগাস্ট ২০০৯, পৃ-১।
. দেখুন দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৭ অগাস্ট ২০০৯, পৃ-১৬।
. মাসুদ মজুমদার, মাসুমুর রহমান খলিলী, আলম আজাদ, সম্পাদকীয়, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!! পূর্বোক্ত, পৃ.৬।
. হুমায়ুন আজাদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা, পূর্বোক্ত, পৃ.২৪।
. ড. আমেনা মহসীন, The politics of Natinalism: The case of chittagong Hill Tracts, ইউপিএল, ঢাকা ১৯৯৭, পৃ. ৬৬।
. এস. কালাম উদ্দীন, A Tangled Web of Insurgency, ফারইস্ট ইকনমিক রিভিউ, হংকং, ২৩ মে ১৯৮০: সুবীর ভৌমিক, Insurgent Crossfire: North-East India, ল্যানসার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৬, নয়াদিল্লী; উদ্বৃত ড. মাহফুজ পারভেজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫-৪৬।
. তালুকদার মনিরুজ্জামান, বিদেশী সাহায্যপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদ সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!! পূর্বোক্ত, পৃ. ২৩।
. উদ্বৃত ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী ও ড. মোহাম্মদ আবদুর রব, পূর্বোক্ত, পৃ.৫৪।
. উদ্বুত ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী ও ড. মোহাম্মদ আবদুর রব, পূর্বোক্ত, পৃ.৫৪।
. ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তিবাহিনী ও ভারতীয় অবৈধ সংযোগ, পূর্বোক্ত, পৃ.৫৪-৫৫।
. মাসুদ মজুমদার ও অন্যান্য, পূর্বোক্ত, পৃ.৭।
. ড. সাঈদ-উর-রহমান, প্রসঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম : খসড়া চুক্তি প্রকাশ করা দরকার, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮১।
. আবুল আসাদ, উড়ে আসাদের জুড়ে বসতে দেয়া যায় না, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!!, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১।
. আমির খসরু, প্রসঙ্গ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, আহা পর্বত! আহা চট্টগ্রাম!! পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২।
. এম. আবদুল হাফিজ, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব, অন্য দিগন্ত, মার্চ ২০১০, পৃ. ৩০।
. মোহাম্মদ মাতিন উদ্দিন, এইচ. এম. এরশাদের মন্তব্য নিয়ে কিছু কথা, দৈনিক আমার দেশ, ৯ মার্চ ২০১০, পৃ.৬।
. উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান, পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও সমসাময়িক ঘটনা বিষয়ে গত ৬ মার্চ ২০১০ ‘ঢাকা পোষ্ট’ এর গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতা, দৈনিক সংগ্রাম, ৭ মার্চ ২০১০, পৃ.১।
. উদ্বৃত গৌতম মন্ডল, অশান্তির বেড়াজালে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, নিউজ নেটওয়ার্ক, জুলাই ২০০৫, পৃ. ৬২-৬৩।
. RHS Hutchinson, An Account of Chittagong Hill Tracts গ্রন্থটি ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয়। চাকমা জাতির পরিচয় সহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবিধ বিষয়ের উপর এ গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ইংরেজ ডেপুটি কমিশনার Capt. T. H. Leara বিরচিত ‘The Hill Tracts of chittagong and the Dewllers Therein গ্রন্থটি’ ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয়। J.Jaffa, Chakmas: Victims of Colonialism and Ethro-centric Nationalism, The Main Stress, 28 Oct. 1989; অমরেন্দ্র লাল খিসা, সিফটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয ১৯৯৬; এন. আহমেদ, The Evolution of Bounderies of East Pakistan, Oriental Geographer, Vol.ii, No.4, Dhaka, 1958.
. দেখুন দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ মে ২০১০, পৃ.১।
. জয়নাল আবেদীন,পার্বত্য চট্টগ্রাম, স্বরূপ সন্ধান, ২৬ মার্চ ১৯৯৭, ঢাকা, পৃ-৯।
. ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭।
. ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭।
. এবনে গেলাম সামাদ, পাহাড়িরা স্বতন্ত্র জাতি নয়, অন্য দিগন্ত, মার্চ ২০১০, পৃ.৩৩।
. ড. মাহফুজ পারভেজ, বিদ্রোহী পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শান্তিচুক্তি, সন্দেশ, শাহবাগ, ঢাকা ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯, পৃ.২০। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম (The Management of Ethic conflicts in South Asia: The case of Chittagong Hill Tracts) বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তাঁর গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ড. আমেনা মহসীন।
. বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি দুর্গম ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদের নাম সাজেক। প্রায় ২০ হাজার জনবসতি নিয়ে ৬শ’ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ভারতের মিজোরাম সংলগ্ন এলাকাটি ৩৬নং সাজেক ইউনিয়ন নামে পরিচিত। এটি একটি সাধারণ জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন গহীন পার্বত্য অঞ্চল।
. সংসদীয় কমিটির পার্বত্য রিপোর্ট নিয়ে তোলপাড়, দৈনিক নয়াদিগন্ত ১১ মার্চ ২০১০ পৃ.১।
. দেখুন দৈনিক ইনকিলাব এল থাঙ্গা পাঙ্খোর সাক্ষাৎকার, ৮ মার্চ, ২০১০। মি. পাঙ্খো সাক্ষাৎকারে আরো অনেক তথ্য দিয়েছেন। নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছেন; ৪১টি বাঙালী পরিবারের জায়গা দখল করে নিয়েছে চাকমারা, বাঙালিরা কোন ত্রাণ পাচ্ছে না।
. খাগড়াছড়িতে বাঙালীদের বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৬ জন নাগরিক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে খাগড়াছড়ি জেল হাজতে রয়েছে। দেখুন দৈনিক সংগ্রাম, ২৫ মে ২০১০, পৃ.-৪।
. গত ১ মার্চ ২০১০ বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় যুব সংহতির বর্ধিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ. এম. এরশাদ এ মন্তব্য করেন। দেখুন মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন, এইচ এম এরশাদের মন্তব্য নিয়ে কিছু কথা, আমার দেশ ৯ মার্চ ২০১০, পৃ.৬।