সূচিপত্র

ভূমিকা
সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ উৎপত্তি ও বিকাশ
সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা
সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাঃ সম্পর্ক
সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন রূপ
• আইনগত সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব
• প্রকৃত সার্বভৌমত্ব ও নামসর্বস্ব সার্বভৌমত্ব
• আইনানুমোদিত সার্বভৌমত্ব ও বাস্তব সার্বভৌমত্ব
• পোপের সার্বভৌমত্ব .
• রাজার সার্বভৌমত্ব
• মার্কসীয় সার্বভৌমত্ব
• জনগণের সার্বভৌমত্ব
• সার্বভৌমত্বে বহুত্বের ধারণা
সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য
1. স্থায়িত্ব (Permanance)
2. সার্বজনীনতা (Universality)
3. অবিভাজ্যতা (Indivisibility)
4. অ-হস্তান্তরযোগ্যতা (Inalienability)
5. মৌলিকত্ব ও চরমত্ব (Original & absolute power)
6. অনন্যতা
সার্বভৌমত্বের অবস্থান নির্ণয়
সার্বভৌমত্বের ইসলামী ব্যাখ্যা
আল্লাহর আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব
কুর’আনের দৃষ্টিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
হাদীসের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্ব
আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ইমামগণের ইজমা‘ (ঐকমত্য)
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের খিলাফত (প্রতিনিধিত্ব)
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের স্বাধীনতা
আধুনিক গণতন্ত্র ও ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ একটি তুলনা
1. জনগণ বনাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
2. আইনপ্রণয়ণ কর্তৃপক্ষ
3. জনগণের ইচ্ছা বনাম আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ
গণতন্ত্রের ইসলামী রূপ
উপসংহার
গ্রন্থপঞ্জী

بسم الله الرحمن الرحيم

সার্বভৌমত্বঃ ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ভূমিকা
বর্তমানে পৃথিবীতে ‘সার্বভৌমত্ব’ সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণা তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন। তাঁর এ ক্ষমতায় কোনো অংশীদার বা প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ইসলামী রাষ্ট্রে তিনিই হচ্ছেন মৌলিক আইনের উৎস এবং সকল ক্ষমতার আধার। সব কিছুর সূচক হচ্ছে তাঁর ওপর ঈমান এবং তাঁর আইনের আনুগত্য। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা এ সৃষ্টিজগতের প্রভু, মালিক ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী, অতএব তাঁর বান্দাহদের জীবনযাত্রার নিয়ম কানুন নির্ধারণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাও তাঁর। মানবজীবনের বর্তমান দুর্যোগ-দুর্দশার একমাত্র কারণ হলো, সে নির্বোধের মতো সার্বভৌম আল্লাহ তা‘আলা থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও সার্বভৌম আল্লাহ তা‘আলার আইন-কানুনের খেলাফ করার কোনো অধিকার তার নেই, তা সত্ত্বেও অজ্ঞতাবশত সে আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন অন্যকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে তার রচিত আইন-কানুনের আনুগত্য করে এবং বিশ্বাস করে যে, এ পথেই তার সমৃদ্ধি আসবে। প্রত্যেক ঈমানদারের এ কথা মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার শাসনাধীনে কোনো মানুষের, এমন কি নাবী-রাসূলগণের পর্যন্ত, আল্লাহ তা‘আলার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়নের অধিকার নেই। মানুষ কোনো আদেশ বা নির্দেশ দিতে চাইলে তা আল্লাহ তা‘আলার আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে দিতে হবে।
‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ হল Sovereignty। এটি লাতিন শব্দ Superanus থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Superanus শব্দটির অর্থ হল Supreme অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে Sovereignty বা সার্বভৌমত্ব বলতে একক, অবিভাজ্য, নিরঙ্কুশ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও অবাধ ক্ষমতাকেই বুঝায়। আরবরীতে সার্বভৌমত্বের প্রতিশব্দ হল السيادة المطلقة হ ও। এর অর্থ হল- নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। এ অর্থে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সার্বভৌম সত্তা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى -‘‘সার্বভৌম মাত্রই আল্লাহ তা‘আলা।’’
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র-সংগঠনের একটি মৌলিক উপাদান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। একে রাষ্ট্র সংগঠনের পরশমণি বলা হয়। কারণ সার্বভৌমতেবর সংযোগ বা সংস্পর্শেই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োজন বোধে ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা তার অধীনস্থ সকল জনসমষ্টি ও সংস্থার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ও আনুগত্য লাভ করে।
বস্ত্তত সার্বভৌমত্ব একটি আইনগত ধারণা- সরকারের মাধ্যমে এর প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটে মাত্র। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছার যে প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটে থাকে, তা-ই আইনের মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ করে। অতএব রাষ্ট্রশক্তির আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের একক, অবিভাজ্য, সর্বোচ্চ ও চরম ক্ষমতাকেই সার্বভৌমত্ব বলা হয়। International Encyclopaedia of Social Sciences গ্রন্থে সার্বভৌমত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, The concept of ‘sovereignty’ implies a theory of politics which claims that in every system of government there must be some absolute power of final decision exercised by some person or body recognized both as competent to decide and as able to enforce the decision.-‘‘সার্বভৌমত্বের ধারণা এমন এক রাজনৈতিক মতবাদকে বুঝায়, যার দাবী হচ্ছে প্রত্যেক প্রকারের সরকার পদ্ধতিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এমন এক নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, যা কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি প্রয়োগ করবে এবং তা হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ও সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতাসম্পন্ন।’’

সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ উৎপত্তি ও বিকাশ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব শব্দটিকে অত্যাধুনিক বলে ধরা হলেও এ ধারণাটি নতুন নয়। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান লেখকদের Supreme power of the state (السلطة العليا) ও Fullness power (السلطة الكاملة) কথার মধ্যে অতীতকালের সার্বভৌমত্বের ধারণা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দার্শনিক প্লেটো (৪২৭-৩৪৭ খ্রি.পূ.) এক সময়ে বলেছেন, আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিক রাজা যেহেতু মানব সমাজে দুর্লভ, তাই আইনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র শাসিত হওয়াই শ্রেয়। এ কথা বলতে গিয়ে তিনি আইনকে ‘সর্বোচ্চ নিয়ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর এ কথা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি আইনকে ক্ষমতার ‘সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ’ বলতে চেয়েছেন। এটা সত্য যে, তাঁর সময়ে সঠিক অর্থে সার্বভৌমত্বের ধারণা জন্ম লাভ করেনি। কেননা তখনো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা ছিল না, যারা এ সার্বভৌম ক্ষমতার দাবী করবে। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি.পূ.)-এর লেখায় আমরা এ ধরনের একটি ভাবধারা দেখতে পাই। রাষ্ট্রের মধ্যে তিনি চরম ক্ষমতার অস্তিত্ব অনুভব করেন। এ কথা ঠিক তিনি উচ্চারণ না করলেও তাঁর ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতার (Supreme power) কথা উল্লেখ করেছেন।
সর্বপ্রথম আল-কুর’আনই সার্বভৌমত্বের বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করে একে রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলভিত্তি হিসেবে চিত্রিত করে। মাদীনা-রাষ্ট্র ছিল দুনিয়ার ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র। প্রকৃত অর্থে তখন থেকেই সার্বভৌমত্বের যথার্থ ধারণার প্রসার ঘটতে থাকে।
মধ্যযুগে ইসলামিক অর্থে অথবা আধুনিক অর্থে কোনো রাষ্ট্র ছিল না। তখনকার সামন্ত ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুরাই শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন এবং প্রজারাও তাঁদের নির্দেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে চলতো। পাশ্চাত্য ইতিহাসের এ অধ্যায়ে ইউরোপ ছিল হাজারো সামন্ত রাজ্যে বিভক্ত। আবার প্রায়ই তা ছিল শাসক ও পোপের কর্তৃত্ব দ্বন্দ্বের ধুলিঝড়ে অশান্ত। খ্রিস্টীয় নীতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা ছিল মূলত চার্চ ও শাসকের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস। গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সমগ্র মধ্যযুগ ব্যাপী চলেছে এ অন্তর্দ্বন্দ্ব। কখনও ধীর গতিতে, আবার কখনও তীব্র গতিতে; কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ধারায়।
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আধুনিক বিশ্বে সার্বভৌমত্বের ধারণাটি ইউরোপের নবজাগরণের ফলেই প্রসার লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে পোপের নৈতিক অধঃপতন হলে তাঁর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এ প্রতিক্রিয়ার সুযোগ গ্রহণ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজারা নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। অপরদিকে ইংল্যান্ডে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধের ফলে এবং ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনের ফলে সামন্ত প্রথার বিলুপ্তি সাধন ঘটে। এভাবে রাজার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো ক্রমে অপসারিত হওয়ায় রাজাকে কেন্দ্র করে সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। সর্বপ্রথম সার্বভৌমত্ব শব্দটি ব্যবহার করেন ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের তৃতীয় হেনরীর রাজতবকালে রাষ্ট্র-দার্শনিক জ্যাঁ বোঁদা (Jean Bodin [1530- 1596])। তিনিই প্রথম সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে আলোচনা করেন। তাঁর সময়ে খ্রিস্ট ধর্মের দুটি গ্রুপ- রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে দেশ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। তিনি ফরাসী দেশের ঐক্য স্থাপন করার উদ্দেশ্যে রাজার পক্ষ সমর্থন করেন এবং সার্বভৌমত্বের কর্তৃত্ব বলে সমস্ত নাগরিকের ওপর প্রবল প্রতাপে দেশ শাসন করার পরামর্শ দেন। তিনিই প্রথম সার্বভৌম শক্তিকে অসীম, অবিভাজ্য এবং চিরস্থায়ী বলেছেন। তাঁর কথায় নাগরিক ও প্রজাদের ওপর আইনের দ্বারা রাষ্ট্রের অপ্রতিহত চূড়ান্ত ক্ষমতাই সার্বভৌম ক্ষমতা। গিলক্রাইস্ট বলেন, ‘‘১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী লেখক জ্যাঁ বোঁদার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমত্ব কথাটি প্রায়োগিক অর্থে ব্যবহার হতে শুরু করেছে।’’
পরবর্তীকালে টমাস হব্স, জন লক্ ও রুশো সার্বভৌমত্বের ধারণাটির পরিবর্তিত রূপ দান করেন। হব্স তাঁর সামাজিক চুক্তি মতবাদে দেখিয়েছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা এমন একটি শক্তি, যার কাছে মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত স্বাভাবিক অধিকার ও স্বাধীনতা বিনা শর্তে ত্যাগ করে। বিনা শর্তে এই ক্ষমতা অর্পিত হয় বলে হব্স বর্ণিত সার্বভৌম ক্ষমতা চূড়ান্ত, অপ্রতিহত ও সীমাহীন। তাঁর মতে, সার্বভৌমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে না। তাঁর যে কোনো আইন প্রণয়ন ও তা বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে। এ রকম ক্ষমতা তিনি রাজার হাতে প্রদান করেন। লক্ তাঁর মতবাদে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, জনসাধারণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। শাসক জনগণের ক্ষমতার যিম্মাদার মাত্র। রাজা বা শাসন-কর্তৃপক্ষ জনগণ কর্তৃক অর্পিত শর্তানুসারে দেশ শাসন করবেন; কিন্তু শর্তসমূহ লঙ্ঘিত হলে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকবে। এভাবে তিনি জনগণের সার্বভৌমত্বের জয়গান করত ব্রিটেনের সংসদীয় সার্বভৌমত্বের প্রবক্তায় পরিণত হন। তিনি আইনসভাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জনগণের সার্বভৌমত্বের এ ধারণা রুশো তাঁর ‘সোশাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে লকের চেয়ে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রুশোকে ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের প্রাণপুরুষ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর মতে সার্বভৌমত্ব কোনো ব্যক্তি, সংস্থা কিংবা সরকারের হাতে অর্পিত হতে পারে না; তা সব সময় জনগণের সাধারণের ইচ্ছের (General Will) ওপরই ন্যস্ত থাকবে। সাধারণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না। হব্স যেখানে রাজার হাতে সার্বভৌমত্ব তুলে দিয়েছেন, রুশো সেখানে জনগণকে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রদান করেন। মূলত তিনিই জনগণের সার্বভৌমত্বের আসল প্রবক্তা। তিনি হব্সীয় চরমতন্ত্র এবং লকীয় জন-সার্বভৌমত্ব নীতির সমন্বয় সাধন করেন। রুশোর পর ইংরেজ দার্শনিক বেন্থাম (Bentham), মিল (Mill) ও আইনবিদ অস্টিন (Austin) প্রমুখের লেখায় সার্বভৌমত্বের এ ধারণা পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাঁরা রাষ্ট্রের আইনগত সার্বভৌমত্বকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
মুসলিম চিন্তাবিদগণের মধ্যে সর্বপ্রথম সাইয়িদ আবুল আ‘লা মাওদূদী (রাহ.) ইসলামী রাজনীতি বিজ্ঞানে শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনিই প্রথম কুর’আন ও সুন্নাহ দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করেন যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সার্বভৌম। সার্বভৌমত্বের সমুদয় বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র একমাত্র তাঁর মধ্যেই পাওয়া যায়। তাঁর ক্ষমতাই হল একক, অবিভাজ্য, অ-হস্তান্তরিত, সর্বোচ্চ, চরম ও নিরঙ্কুশ। মানুষের ওপর হুকুমাত, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার অধিকার বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো নেই। মানুষ মাত্রই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অধীন। কোনো ব্যক্তিই মানুষের ওপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার অধিকারী নয়। মাওদূদী (রাহ.)-এর পর মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমূন অভিন্ন ধারণা থেকে শব্দটি ইসলামী রাজনীতি বিজ্ঞানে ব্যবহার করে। এভাবে তা ইসলামী রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয় এবং তাবৎ পৃথিবীর সত্যিকার মুসলিমগণ সকলেই তাuঁদর এ চিন্তাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়।
এমনিভাবে এ বিষয়ের ওপর মুসলিম-অমুসলিম বহু চিন্তাবিদ তাuঁদর নিজ নিজ ধারণার ভিত্তিতে মতামত ব্যক্ত করেছেন। মূলত একটি বিষয়কে সকলেই মেনে নিয়েছেন যে, সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা। কেউ বা তা রাজার হাতে, কেউ ধর্মগুরুকে, আবার কেউ তা পার্লামেন্টে কিংবা জনগণের ওপর বা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলার ওপর অর্পণে মতামত দিয়েছেন।

সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা
সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। নিম্নে কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো -
জ্যাঁ বোঁদার মতে, Sovereignty is the supreme power of the state over citizens & subjects, unrestrained by laws. -‘‘সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝায় নাগরিক ও প্রজাদের ওপর আইনের দ্বারা রাষ্ট্রের অপ্রতিহত চূড়ান্ত ক্ষমতা।’’ তিনি এ কথাও স্বীকার করেন যে, বিধিসঙ্গত সার্বভৌম সত্তা মাত্রই প্রকৃতি বিধান (law of Nature) ও ঐশী বিধানের (divine law) অধীন। তাঁর সংজ্ঞানুসারে সার্বভৌমত্ব এক অথবা বহু হাতেই অবস্থান করুক না কেন এটা অসীম ক্ষমতা, যা নাগরিক ও অধীনস্থ সকলের ওপরেই প্রযোজ্য, কোনো প্রকার আইনের বন্ধনে শৃঙ্খলিত নয়।
জ্যাঁ বোঁদার পর সার্বভৌমত্বের উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যাকার হলেন হল্যান্ডের বিখ্যাত আইনবিদ হুগো গ্রোটিয়াস (Grotius) [মৃ.১৬২৫ খ্রি.]। তিনি সার্বভৌমত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, The supreme political power vested in him, whose acts are not subject to any other and whose will cannot be overridden. -‘‘সার্বভৌমত্ব হল সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, যার হাতে এ ক্ষমতা রয়েছে, তার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না এবং যার ইচ্ছা অন্য কারো মতামতের তোয়াক্কা করে না।’’
টমাস হব্স (Thomas Hobes) [১৫৮৮-১৬৭৯খ্রি.) সর্বপ্রথম সার্বভৌমত্বের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তাঁর মতে, ‘‘সার্বভৌম শাসক সকল আইনের উৎস এবং সকল আইনের উর্ধ্বে অবস্থিত।’’
এরপর জন লক্ (John Lock) ‘‘সীমাবদ্ধ সার্বভৌমত্ব’’ এবং জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো (Rousseau) [১৭১২-১৮৩২] ‘‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। রুশোর মতে, সার্বভৌম শক্তি সর্বোচ্চ এবং অবারিত ক্ষমতার অধিকারী; কিন্তু বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা শাসকের হাতে তা সীমিত থাকতে পারে না। রুশো সার্বভৌমত্বকে অবিভাজ্য এক এবং অসীম বলেছেন।
খ্যাতনামা ফরাসী লেখক দুগুই (Duguit) এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, The Commanding power of the state, it is the will of the nation organized in the state; it is the right to give unconditional orders to all individuals in the territory of the state. -‘‘ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদানের এবং নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডে সকল ব্যক্তিকে শর্তহীন নির্দেশ দেবার ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব।’’
উপযোগবাদী বেন্থাম (১৭৪৮-১৮৩২) বলেন যে, সার্বভৌম শক্তি আইন দ্বারা সীমিত না হলেও নীতি ধর্ম দ্বারা সীমিত। সমাজে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে যখন সার্বভৌম শাসনের প্রতিরোধ করা নীতি বিরুদ্ধ হবে না। রাষ্ট্র ব্যাপক গণমানুষের কল্যাণে শাসন কার্য পরিচালনা না করলে নাগরিকরা ন্যায়ের স্বার্থেই একে প্রতিরোধ করতে পারে।
জন অস্টিনের (John Austin) [১৭৯০-১৮৫৯] মতে, আনুগত্য ও শাসন- এ দুয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র মূলত গঠিত হয়। একদিকে সার্বভৌম শক্তি যেমন সকলের নিয়মিত আনুগত্য লাভের অধিকারী, অপর দিকে এর যাবতীয় নির্দেশ ও আদেশ আইনরূপে বিবেচ্য। অস্টিনের মতে সার্বভৌম শক্তি অসীম এবং তা অন্য কারো আদেশ মতে কাজ করে না। ব্লাকস্টোন সার্বভৌমত্বকে চরম অপ্রতিরোধ্য, শর্তহীন, সীমাহীন কর্তৃত্ব (The supreme, irresislable, absolute and uncontrolled authority) বলে আখ্যায়িত করেন।
ডব্লিউ. এফ. উইলোবি (Willoughby)-এর মতে, Sovereignty is the supreme will of the state. -‘‘রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ইচ্ছাই হল সার্বভৌমত্ব।’’
আমেরিকার খ্যাতনামা অধ্যাপক বার্জেস (Burgess)-এর মতে, It is the original, absolute, unlimited, universal power over the individual subjects and over all associations of subjects.-‘‘সকল ব্যক্তি-প্রজা এবং সংঘের ওপর মৌলিক, চরম, সীমাহীন ও সর্বাত্মক ক্ষমতাই সার্বভৌমত্ব।’’
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে সার্বভৌমত্বে নিম্নলিখিত দিকগুলো দেখতে পাওয়া যায়।
1. প্রত্যেক রাষ্ট্রের মধ্যেই একটি পরিষ্কারভাবে নির্দেশযোগ্য কর্তৃপক্ষ থাকবে, যার প্রত্যেকটি আদেশ ও নির্দেশ আইনরূপে বিবেচ্য হবে।
2. এই নির্দেশযোগ্য কর্তৃপক্ষ অপর কোনো কর্তৃত্বের আজ্ঞাধীন থাকবে না।
3. আইন হল সার্বভৌমের নির্দেশ। এই নির্দেশ ছাড়া আইনের অন্য কোনো উৎস নেই।
4. রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সার্বভৌমের নির্দেশ পালন করবে।
5. সার্বভৌমের ক্ষমতাই চূড়ান্ত এবং তার আদেশ লঙ্ঘন কিংবা ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হবে।

সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাঃ সম্পর্ক
বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ‘সার্বভৌমত্ব’ ও ‘স্বাধীনতা’ শব্দদ্বয়কে পরস্পর পরিপূরক অর্থেও ব্যবহার করেন। তাই সার্বভৌমত্বের সনাতন (traditonal) অর্থ বর্তমানে কিছু কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। এ কারণেই সার্বভৌমত্বকে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ (internal) ও বাহ্যিক (external) দুভাগে ভাগ করা হয়। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের ফলে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন ও প্রয়োজন বোধে ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা তার অধীনস্থ সকলের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আর বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের বলে রাষ্ট্র বাইরের অন্যান্য রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন ও মুক্ত থেকে রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বলতে মূলত স্বাধীনতাকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং সার্বভৌমত্বের মূল উদ্দেশ্য হল অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গেটেলের মতে, সার্বভৌমত্ব বলতে অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে বুঝায়।
বর্তমানে অনেক মুসলিম চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ আল্লাহ তা‘আলার সার্বভৌমত্বের ট্রাডিশনাল ধারণা থেকে সরে এসেছেন। তাঁরাও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদদের অনুকরণে স্বাধীনতার পরিপূরক শব্দরূপে সার্বভৌমত্ব শব্দটি ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা (استقلال) ও সার্বভৌমত্ব (سيادة) দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সার্বভৌমত্ব একান্তই আইনগত ধারণা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও কর্তৃত্বের একক, অবিভাজ্য, সর্বোচ্চ ও চরম ক্ষমতাই হল সার্বভৌমত্ব। আর এটা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অপরদিকে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হল বাইরের রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ বাইরের যে কোনো রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন ও মুক্ত থেকে দেশের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হওয়াকে স্বাধীনতা বলা হয়। তদুপরি সার্বভৌমত্বকে স্বাধীনতার পরিপূরক শব্দরূপে ব্যবহার করা প্রকারান্তরে তার প্রকৃত মর্ম ও তাৎপর্যকে আড়াল করার নামান্তর। উপরন্তু, এ ধরনের ব্যবহারের অন্তরালে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পন্ডিতদের ব্যর্থতা ঢাকার প্রয়াসও নিহিত রয়েছে। তাঁরা যখন সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে মানব সমাজে তার ‘প্রকৃত ধারকের’ সন্ধান করেন, তখন তাঁরা চরমভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাঁরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোথায় অথবা কার বা কাদের হাতে অবস্থিত- তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হিমশিম খেয়েছেন। কিন্তু ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও কর্তৃত্বের একক, অবিভাজ্য, সর্বোচ্চ ও চরম ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক হলেন ‘আরশের অধিপতি আল্লাহ তা‘আলা। অতএব, কোনো মুসলিম চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদের পক্ষে রাষ্ট্রের স্বাধীনতার পরিপূরক অর্থে সার্বভৌমত্বকে ব্যবহার করা আমি সমীচীন মনে করি না; বরং সার্বভৌমত্বকে তার সনাতন অর্থেই ব্যবহার করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত মনে করি।

সার্বভৌমত্বের বিভিন্ন রূপ
পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই সার্বভৌমত্বের রূপ এক নয়। সার্বভৌম ক্ষমতার অবস্থান এবং ব্যবহারের প্রকৃতি অনুযায়ী সার্বভৌমত্বকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। যেমন-
• ‘আইনগত সার্বভৌমত্ব’ ও ‘রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব’
আইনগত সার্বভৌমত্ব (Legal sovereignty) বলতে সেই সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বুঝায়, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত আদেশ বা নির্দেশ আইনের আকারে প্রকাশিত হয়। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই আইন প্রণয়নকারী চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষকেই আইনগত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলা হয়। আইন প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের আদেশই চূড়ান্ত। এই আইন অমান্য করার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নেই। এমন কি রাষ্ট্রের কোনো বিচারালয়ও এই আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে না। আইনবিদগণের মতে এটাই হল প্রকৃত সার্বভৌমত্ব। সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভাই হল দেশের আইনগত সার্বভৌম। আইনসভা বিধিসম্মতভাবে যে আইন প্রণয়ন করবে, তা সকলের জন্য অবশ্য পালনীয়।
আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে এ আইনগত সার্বভৌমত্বের পেছনে অত্যন্ত অস্পষ্ট হলেও আরেক সার্বভৌম শক্তির উপস্থিতি অনুভূত হয়- যা আইনগত সার্বভৌমকে প্রভাবিত করে। এটা অত্যন্ত অনির্দিষ্ট ও অসংগঠিত; কিন্তু বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর প্রকাশ ঘটে। কাজেই আইনসঙ্গত সার্বভৌমত্বকে নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি বা প্রভাবকে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব (Political sovereignty) বলা হয়। ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসন, জনমতগঠনকারী বিভিন্ন মাধ্যম এবং নির্বাচকমন্ডলীকে রাজনৈতিক সার্বভৌম বলা যেতে পারে।
• ‘প্রকৃত সার্বভৌমত্ব’ ও ‘নামসর্বস্ব সার্বভৌমত্ব’
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান নামমাত্র সার্বভৌম। তাঁর নামে সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার হলেও প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করেন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা। এ কারণে বলা হয় যে, ব্রিটেনের রাজা এখন রাজত্ব করেন, শাসন করেন না। ব্রিটেনের রাজা নামমাত্র শাসক বা সার্বভৌম (Titular head or sovereign) এবং পার্লামেন্ট হল প্রকৃত সার্বভৌমত্বের অধিকারী (Real sovereign)। সুতরাং সংসদীয় গণতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন নামসর্বস্ব সার্বভৌম, পার্লামেন্টের আস্থাভাজন মন্ত্রীসভা হল প্রকৃত সার্বভৌম এবং রাষ্ট্রপ্রধানসহ আইনসভা হল আইনগত সার্বভৌম।
• ‘আইনানুমোদিত সার্বভৌমত্ব’ ও ‘বাস্তব সার্বভৌমত্ব’
আইনানুমোদিত সার্বভৌমত্ব হল আইনসঙ্গত সার্বভৌমত্ব। আইনই এর ভিত্তি, আইনানুমোদিত সার্বভৌম আইন অনুসারে দেশ শাসন করেন এবং জনগণের নিকট থেকে স্বভাবজাত আনুগত্য লাভ করে থাকেন। যে কোনো রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারকে এরূপ সার্বভৌম বলা যেতে পারে। আইনের দৃষ্টিতে এ জাতীয় সার্বভৌমত্বকেই প্রকৃত সার্বভৌমত্ব বলা হয়।
কিন্তু যদি দেখা যায় যে, কোনো রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি নির্বাচিত না হয়েও আইন অনুসারে কিংবা আইনের বিরুদ্ধে নিজের বা নিজেদের কর্তৃত্বকে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন, তখন তাকে বাস্তব সার্বভৌম বলা যেতে পারে। সার্বভৌমত্বের এ দুটির মধ্যে সুন্দর পার্থক্য দেখা যায়, যখন যুদ্ধ কিংবা বিপ্লব কিংবা শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে আইনগত যিনি সার্বভৌম, কার্যত তার হাতে সার্বভৌমত্ব থাকে না। যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আইনের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে অথবা বিভিন্ন পদ্ধতিতে যুদ্ধ ও বিপ্লবের সময় নিজের অথবা নিজেদের ইচ্ছে সকলকে মানাতে সক্ষম হয় তাকে বাস্তব সার্বভৌম বলা হয়।
• পোপের সার্বভৌমত্ব
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরে পোপ অর্থাৎ খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতারা ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। রাজা যদিও রাজমুকুট পরিধান করে দেশ শাসন করতো; কিন্তু পোপরাই ছিল আইনের উৎস এবং ন্যায়-অন্যায় নির্ণয়ের মাপকাঠি। তাঁরা অনেক সময় ধর্মের নাম ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতো এবং এভাবে নিজেদের স্বার্থ ও অভিলাষ পূরণের চেষ্টা চালাতো। সাধারণ জনগণ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে তাuঁদর আনুগত্য করে যেত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ-‘‘তারা আল্লাহকে ত্যাগ করে তাদের ‘আলিম ও দরবেশদেরকে এবং মাসীহ ইবন মার্ইয়াম (আ.)কেই রাবব অর্থাৎ সার্বভৌম সত্তা রূপে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদেরকে কেবল এ নিদের্শই দেয়া হয়েছিল যে, এক আল্লাহ ছাড়া তারা আর কারো দাসত্ব করবে না। তারা যা কিছু আল্লাহর সাথে শারীক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি পবিত্র।’’ উল্লেখ্য যে, প্রাচীন খ্রিস্টানরা তাদের ‘আলিম ও দরবেশদেরকে ‘রাবব’ বলে ডাকতো, তা নয়; বরং তারা আইনের উৎস ও বিধানদাতা হিসেবে তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতো। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রাহ.) বলেন, إنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا يَعْبُدُونَهُمْ؛ وَلَكِنَّهُمْ كَانُوا إذَا أحَلُّوا لَهُمْ شَيْئاً اسْتَحَلُّوهُ, وَإذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئاً حَرَّمُوهُ.-‘‘তারা তাদের দাসত্ব ও পুজা করতো না; বরঞ্চ ‘আলিম ও দরবেশরা যে সব বিষয়কে হালাল বলতো তারাও তো হালাল রূপে গ্রহণ করতো এবং তারা যে সব বিষয়কে হারাম বলতো তারাও তা হারামরূপে গ্রহণ করতো।’’ বলা বাহুল্য যে, আল্লাহ তা‘আলার আইন ও নির্দেশের বিরোধিতা করে তাদের আনুগত্য করা তাদেরকে রাবব ও মা‘বূদ সাব্যস্ত করার নামান্তর। হযরত ‘আদী ইবনু হাতিম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ আয়াত শুনে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বললাম, إنَّهُمْ لَمْ يَعْبُدُوْهُمْ.-‘‘তারা (খ্রিস্টানরা) তো তাদের (‘আলিম ও দরবেশগণের) ইবাদাত করে না!’’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, بَلَى، إنَّهُمْ حَرَّمُوْا عَلَيْهُمْ الْحَلَالَ، وَأحَلُّوا لَهُمُ الْحَرَامَ، فَاتَّبَعُوْهُمْ، فَذَلِكَ عِبَادَتُهُمْ إيَّاهُمْ. -‘‘কেন নয়? তারা (‘আলিম ও দরবেশরা) হালালকে হারামে পরিণত করেছে এবং হারামকে করেছে হালালে। আর খ্রিস্টানরা তাদের আনুগত্য করে। এই হল তাদের প্রতি খ্রিস্টানদের ইবাদাত।’’ .
• রাজার সার্বভৌমত্ব
রাজতন্ত্রে সাধারণত রাজাই আইনের একমাত্র উৎস। কারো কাছে তাঁর জবাবদিহি করতে হয় না। তিনি আইনের উর্ধ্বে বিবেচিত হন এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হন। ইংল্যান্ডের নিয়মতান্ত্রিক আইনে এখনো বলা হয়ঃ " The king can do no wrong". ম্যাকিয়াভেলী লিখেছেন, ‘‘একজন সার্বভৌম রাজা অন্যায়কে দমনের জন্য অন্যায়ের আশ্রয় নিতে পারবেন। কোনো ধর্ম ও নৈতিকতাবোধের অনুগামী হবেন না তিনি। ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতাকে যিনি টিকিয়ে রাখতে পারবেন তিনিই শ্রেষ্ঠ শাসক। কোনো আইন ও নীতিমালার বিধিবদ্ধ রূপ থাকা জরুরী নয়; বরং ক্ষমতার মাসনাদ পাকাপোক্ত করার জন্য যে পদ্ধতিই শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হবে সেটাই আইন।’’ ফির‘আউনই হচ্ছে রাজার সার্বভৌমত্বের অতি প্রাচীন দৃষ্টান্ত। সে নিজেকে সার্বভৌমত্বের মালিক ও আইনের উৎস এবং জনগণকে নিজের গোলাম মনে করতো। সে দাবী করেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى. -‘‘আমি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রাবব অর্থাৎ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী।’’
• মার্কসীয় সার্বভৌমত্ব
সার্বভৌমত্ব সম্বন্ধে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল সার্বভৌম ক্ষমতা এক বিশেষ ধরনের সরকারী কর্তৃত্ব। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে এ সার্বভৌমত্ব মালিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন। সমাজে যে শ্রেণীর হাতে উৎপাদনের উপাদানগুলো থাকে রাষ্ট্র তাদের ইচ্ছায়ই পরিচালিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রমজীবীদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। এ ধরনের রাষ্ট্রে আইন শ্রমজীবীদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়। সম্ভবত সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রে কমিউনিষ্ট পার্টিই রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বলে বিবেচিত হয়। শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণী রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তির অধিকারী এ কথা মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করলেও কার্যত এ ক্ষমতা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে কমিউনিষ্ট পার্টির গুটিকতেক এলিট কর্মকর্তা।
• জনগণের সার্বভৌমত্ব
এটিই হচ্ছে সার্বভৌমত্বের সর্বশেষ রূপ। জনগণের সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝানো হয় সকল ক্ষমতার আধার ও আইনের উৎস হচ্ছে জনগণ। তারাই হল সার্বভৌমত্বের মালিক ও কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীন রোমে এ ধারণা বিদ্যমান ছিল যে, জনগণই চরম ক্ষমতার অধিকারী। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে চরম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ তত্ত্বের উদ্ভব হয়। জন লক অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম স্বৈরাচার তন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলতে সচেষ্ট হন। এরপর জ্যাঁ জ্যাঁক রুশো ও জেফারসনের হাতে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ তত্ত্ব স্পষ্টরূপ পরিগ্রহ করে। সর্বশেষ ফরাসী বিপ্লবের পর এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণায় জনগণের সার্বভৌমত্বের জয়যাত্রা সূচিত হয়। এরপর থেকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং মূলমন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। আর এ সার্বভৌমত্বই সাধারণ নাগরিক থেকে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সার্বভৌমিকতায় রূপ নেয় যেমন ‘জনগণ পার্লামেন্ট  সরকার  সরকার প্রধান’।
আধুনিক গণতন্ত্রে জনগণকে যদিও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করা হয়; কিন্তু দেশ পরিচালনায় জনগণের কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে - তা দেখা যায় না। কেননা নির্বাচনের পর জনসাধারণ তাদের নিজ নিজ কাজে ফিরে যায় এবং রাষ্ট্রীয় কাজে জনসাধারণের অংশগ্রহণের অনুপস্থিতির সুযোগে শাসকগোষ্ঠী তাদের আপন স্বার্থে দেশকে পরিচালনা করতে থাকে।
এ জাতীয় সার্বভৌমত্বে জাতীয় ও গণপ্রতিনিধিদের আল্লাহ, রাসূল, দীন, আসমানী কিতাব এবং নৈতিকতাবোধের আনুগত্য জরুরী নয়; বরং জনগণের ইচ্ছে এবং তাদের পছন্দের আনুগত্য করাই অপরিহার্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, British parliament can do everything except making a man a woman and a woman a man. -‘‘ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একজন পুরুষকে মহিলা এবং একজন মহিলাকে পুরুষে রূপান্তর করা ছাড়া আর সবই করতে পারে।’’ এ কথা দ্বারা বুঝা যায়, এ জাতীয় সার্বভৌমত্বে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে।
• সার্বভৌমত্বে বহুত্বের ধারণা
সার্বভৌম ক্ষমতার একত্ববাদের (Monism) বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বহুত্ববাদের (Pluralism) আবির্ভাব হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত রাজনীতিবিদগণ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে একক, অবিভাজ্য, অ-হস্তান্তরযোগ্য, অসীম, সর্বব্যাপী ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী বলে মত প্রচার করেছেন। রাষ্ট্রের এই একক ক্ষমতার প্রতিবাদরূপে বহুত্ববাদের জন্ম হয়। গিয়ার্কী, মেইটল্যান্ড, বার্কার, লাস্কি, ম্যাকাইভার প্রমুখ লেখক সর্বশক্তিমানরূপী রাষ্ট্রের অনিয়ন্ত্রিত সার্বভৌম শক্তির একত্ব ও নিয়ন্ত্রণহীনতার সমালোচনা করে বলেন যে, রাষ্ট্র কখনোই একক, অবিভাজ্য, অসীম ও অনিয়ন্ত্রিত সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হতে পারে না। তাঁরা মনে করেন, অসংখ্য সামাজিক সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা যেমন- ধর্ম, বিদ্যালয় ও ক্লাব প্রভৃতির ভেতর মানুষের সত্তা বিকশিত হয়। রাষ্ট্র একটি মাত্র উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। তা হল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। অতএব রাষ্ট্র তার নিজ কার্য পরিধির ভেতরেই সার্বভৌম। তেমনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও স্ব স্ব ক্ষেত্রে সার্বভৌম। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র থেকে সৃষ্টি হয়নি; রাষ্ট্র সৃষ্টি হবার বহু পূর্বে সমাজ জীবনে এগুলোর অস্তিত্ব ছিল এবং এগুলো মানুষের বিবিধ উপকার সাধন করে। এ কারণে লোকেরা এই সংস্থাগুলোকে সযত্নে গড়ে তোলে এবং তাদের ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আনুগত্যের বিরাট অংশ এগুলোর জন্য প্রয়োগ করে। তা ছাড়া মানুষ তার স্বার্থ ও প্রয়োজনে অন্যান্য যে সকল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, তাদের প্রতিও মানুষের আনুগত্য রয়েছে। অধিকন্তু বর্তমান যুগে কোনো রাষ্ট্রই চরম বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের অধিকারী নয়। আর্ন্তজাতিক আইনের দ্বারা চরম বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব সীমাবদ্ধ।

সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য
সার্বভৌমত্বের প্রকৃতি ও সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। নিম্নে এ বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করা হল-
1. স্থায়িত্ব (Permanance)
সার্বভৌম ক্ষমতা হল চিরন্তন ও শাশ্বত। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব যতদিন বিদ্যমান থাকে, ততদিন সার্বভৌমত্বও স্থায়ী হয়। রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু সে জন্য সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে না। এ ক্ষমতা হঠাৎ অর্জিত হয় না এবং হঠাৎ কারো ইচ্ছার কারণে বিলীন হয়ে যায় না।
2. সর্বজনীনতা (Universality)
সার্বভৌমত্ব সর্বব্যাপক ও সর্বজনীন। সর্বজনীনতার অর্থ হল রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ের ওপর সার্বভৌমের ক্ষমতা অবাধ ও বন্ধনহীন। এই ক্ষমতা বলেই রাষ্ট্র তার অন্তর্গত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করে।
3. অবিভাজ্যতা (Indivisibility)
প্রকৃতিগত দিক থেকে সার্বভৌমত্ব একক ও অবিভাজ্য এবং এর প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো ক্ষমতা নেই। তদুপরি সার্বভৌমত্বকে বিভক্ত করে বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে অর্পণ করা যায় না। কেননা এ রূপ কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিলুপ্ত ঘটে।
4. অ-হস্তান্তরযোগ্যতা (Inalienability)
সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য কর্তৃত্ব, যা হস্তান্তরযোগ্য নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কোলের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতা কোনো ক্রমেই হস্তান্তরযোগ্য নয়। সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের প্রাণ। সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করার অর্থ রাষ্ট্রের আত্মহত্যারই নামান্তর। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
5. মৌলিকত্ব ও চরমত্ব (Original & absolute power)
সার্বভৌমত্ব হল মৌলিক, চরম ও সীমাহীন ক্ষমতা। রাষ্ট্রের সার্বভৌম রাষ্ট্রের অন্তর্গত ব্যক্তি, সংঘ বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। সার্বভৌমের ইচ্ছাই আইন। এ আইন লঙ্ঘন করলে শাস্তি পেতে হয়। সার্বভৌম ক্ষমতাকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জ বা অস্বীকার করতে পারে না। L. Lipson-এর কথায় Sovereignty is a power over citizens and subjects that is supreme and above the law.-‘‘ সার্বভৌম হল নাগরিক ও প্রজাদের ওপর চরম ক্ষমতা এবং তা আইনের উর্ধ্বে।’’ বন্টসলি বলেন, ‘‘ সার্বভৌমত্বকে সীমিত করতে পারে এমন শক্তি নেই।’’
6. অনন্যতা
সার্বভৌম ক্ষমতা অনন্য। অন্য কোনো ক্ষমতাই এর তুল্য নয়। রাষ্ট্রের হাতে এই অনন্য ক্ষমতা রয়েছে বলেই তা অন্যান্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে অনন্য। এই অনন্য ক্ষমতা বলেই রাষ্ট্র সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং বাধ্যতামূলকভাবে নাগরিকদের নিকট থেকে আনুগত্য লাভ করে।
উল্লেখ্য যে, সার্বভৌমত্বের উপর্যুক্ত সকল বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে, এগুলো একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে পাওয়া যায়। কোনো মানুষই এগুলোর অধিকারী হতে পারে না। কেননা-
প্রথমত আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতাই হল একমাত্র অক্ষয়, চিরন্তন ও শাশ্বত। অপরদিকে কোনো মানুষের ক্ষমতাই চিরন্তন ও অক্ষয় নয়। ইমাম রাগিব ইস্পাহানী, আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী, ইমাম গাযালী, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, হাকীম আবূ নাছর ফারাবী প্রমুখ মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ কারণে কেবল আল্লাহকেই সার্বভৌমত্বের অধিকারী রূপে ঘোষণা করেছেন।
দ্বিতীয়ত আল্লাহর ক্ষমতাই হল একমাত্র সর্বব্যাপক ও সর্বজনীন। সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি বস্ত্তই কেবলমাত্র আল্লাহর একচ্ছত্র প্রভুত্বের অধীন ও তাঁর অনুগত। নিখিল জাহানের পরতে পরতে একমাত্র তাঁরই নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব চলছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ -‘‘ আসমান-যমীনের সব কিছুই তাঁর অনুগত।’’ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ-‘‘ তাঁর সিংহাসন আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে।’’ পক্ষান্তরে কোনো মানুষের ক্ষমতাই সে যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন সর্বব্যাপক ও সর্বজনীন নয়। কেননা কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁর ক্ষমতার একটা সীমাবদ্ধতা অবশ্যই রয়েছে।
তৃতীয়ত আল্লাহর ক্ষমতাই কেবল একক ও অবিভাজ্য। এতে কেউ তাঁর শরীক হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا-‘‘ তিনি তাঁর সার্বভৌমত্বে কাউকেও অংশীদার রূপে গ্রহণ করেন না।’’ তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতাকে বিভক্ত করে এক এক ভাগের জন্য এক একজনকে সার্বভেŠমত্বের মালিক মনে করা পরিষ্কার শির্ক। পক্ষান্তরে কোনো মানুষের ক্ষমতাই অবিভাজ্য নয়। কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে তার ক্ষমতা ভাগ হয়ে যায়। এ কারণে বর্তমানে আধুনিক গণতন্ত্রে বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রের একক ও অবিভাজ্য সার্বভৌম ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছে।
চতুর্থত আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতাই হল একমাত্র মৌলিক, চরম, চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও সীমাহীন। তাঁর ক্ষমতা তাঁর নিজস্ব। কারো থেকে প্রাপ্ত নয়। অধিকন্তু তাঁর ক্ষমতাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বা তার ওপর কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে- এমন কেউ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ -‘‘ আল্লাহ তা‘আলা ফায়সালা করেন। তাঁর ফায়সালা পুনর্বিবেচনা করার কেউ নেই।’’ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَلَنْ تَجِدَ مِنْ دُونِهِ مُلْتَحَدًا-‘‘তাঁর ফারমান পরিবর্তন করার কেউ নেই। তাঁর মুকাবিলায় তুমি কোনো আশ্রয়স্থল পাবে না।’’ অপর দিকে কোন মানুষের ক্ষমতা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মৌলিক ও সীমাহীন নয়; বরং তার ক্ষমতা অপরের মাধ্যমে প্রাপ্ত এবং আইন বা অন্য কিছু দ্বারা সীমাবদ্ধ। বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রের চরম ও অপ্রতিহত ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছে। তাদের মতে রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়। এর অধিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের অধিকারের দ্বারা, প্রজাদের সাথে চুক্তির শর্ত দ্বারা এবং মৌলিক বিধানের দ্বারা সীমিত। অধিকন্তু, স্যার হেনরী মেইন ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দ্বারা প্রমাণ করেন যে, বাস্তবক্ষেত্রে কোনো সার্বভৌমই অসীম ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম হয়নি।
পঞ্চমত নিখিল বিশ্বে আল্লাহই হলেন একমাত্র অনন্য সত্তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ -‘‘তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’’ পৃথিবীর সকল কিছুই তাঁর অধীন। তিনি কারো অধীন নন। তাঁর ইচ্ছাই একমাত্র চূড়ান্ত। তিনি যা ইচ্ছে করেন। তাঁর স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মত কেউ নেই।

সার্বভৌমত্বের অবস্থান নির্ণয়
আধুনিক পাশ্চাত্যবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সার্বভৌমের জন্য উপর্যুক্ত গুণ ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে অপরিহার্য মনে করেন বটে; কিন্তু এগুলো কি কোনো রাজা, ব্যক্তিসমষ্টি বা জনগণের মাঝে পাওয়া সম্ভব? অথবা এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোনো রাজা, ব্যক্তিসমষ্টি অথবা জনগণের হাতে সোপর্দ করা কি নিরাপদ? নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী যে কোনো ‘বাদশাহ বা শাসনকর্তার কথাই চিন্তা করি না কেন, তাঁর ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের মূল্যায়ন করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, কতো দিক দিয়েই না তিনি বাধাগ্রস্ত এবং কতোভাবেই না অসংখ্য বহিঃশক্তি তাঁর ইচ্ছা ও মর্জির বিরুদ্ধে তাঁকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে, তাকে অক্ষম করে দিচ্ছে। ঠিক এ কারণেই রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পন্ডিতগণ যখন সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে মানব সমাজে তার ‘প্রকৃত ধারকের’ সন্ধান করেন, তখন তাঁরা চরমভাবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাঁরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কোথায় অথবা কার বা কাদের হাতে অবস্থিত- তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাঁরা ঠিক করে বলতে পারছেন না যে, এ সার্বভৌমত্ব সরকারের মধ্যে না আইন পরিষদের মধ্যে, না নির্বাচকমন্ডলীর মধ্যে, না জনসাধারণের মধ্যে। কারো মতে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাসক সার্বভৌমত্বের অধিকারী। ১৮১৪ সালে এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, গ্রেট ব্রিটেনের সম্রাট রাজকীয় সার্বভৌমত্বের অধিকারী। যদিও তার সার্বভৌমত্বকে ধর্ম থেকে সনদ লাভ করতে হয়। আবার কারো মতে, রাষ্ট্রের আইনসভাই হল সার্বভৌম। আর কারো মতে জনগণই হল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।... তবে সাধারণত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে রাজা, অভিজাততন্ত্রে একটি বিশেষ গোষ্ঠী, আধুনিক গণতন্ত্রে জনসাধারণ, সমাজতন্ত্রে কমিউনিষ্ট পার্টির গুটিকতেক কর্তাব্যক্তিকেই সার্বভৌমত্বের অধিকারী মনে করা হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আধুনিক রাজনীতিবিজ্ঞানীরা প্রকৃত সার্বভৌম সন্ধানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দুনিয়ার এ সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে যেন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, أَأَرْبَابٌ مُتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ -‘‘ ভিন্ন ভিন্ন সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করা ভাল, না মহা পরাক্রমশালী এক আল্লাহকে সকল প্রকার সার্বভৌমত্বের মালিক স্বীকার করা উত্তম?’’ ইসলামী রাষ্ট্রে আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী। সার্বভৌমত্বের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ও গুণ একমাত্র তাঁর মধ্যেই পরিপূর্ণ রূপে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত পশ্চিমা সভ্যতা রাজা, ব্যক্তিসমষ্টি অথবা জনগণের হাতে সার্বভৌমত্ব তুলে দিয়ে এর নতীজা কি দাঁড়িয়েছে তাঁরা তা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এর ফল মোটেই সুখকর হয়নি। সম্ভবত সেই জন্যই ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক হ্যারল্ড লাস্কি বলেছেন, It would be of lasting benefit to political Sceince, if the whole concept of sovereignty was surrendered. -‘‘সার্বভৌমত্বের ধারণাটি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিলেই রাষ্ট্র বিজ্ঞানের স্থায়ী কল্যাণ সম্ভব।’’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্রাবি (Kraby)ও বলেন, The notion of sovereignty is no longer recognized among civilized people and should be expunged from political theory. -‘‘ সভ্য মানুষের কাছে আর সার্বভৌমত্বের ধারণা স্বীকৃত নয়। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্ব থেকে একে বাদ দেয়া দরকার।’’ কিন্তু এটাও একটা প্রান্তিক মত। সার্বভৌম তো আসলেই আছেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, পশ্চিমের বস্ত্তবাদী দার্শনিকবৃন্দ প্রকৃত সার্বভৌম আল্লাহ তা‘আলাকে অস্বীকার করে সার্বভৌম নয় এমন শক্তি বা সত্তাকে সার্বভৌম গণ্য করে দুনিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে বড়ো ধরনের সংকট সৃষ্টি করে রেখেছেন।

সার্বভৌমত্বের ইসলামী ব্যাখ্যা
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে জানা যায় যে, নির্দেশ দান ও ক্ষমতা প্রয়োগের সে উচ্চতর ও স্বাধীন উৎসকেই সার্বভৌমত্ব বলা হয়, যা সকলে অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে বাধ্য। এ অর্থে সার্বভৌমত্ব এক ধরনের প্রভুত্বের মর্যাদা লাভ করেছে। ইসলামে এ সার্বভৌম প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্ধারিত। ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى -‘‘সার্বভৌম মাত্রই আল্লাহ তা‘আলা।’’ ধর্মবিবর্জিত পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় গজিয়ে ওঠা অবাস্তব ও দ্বান্দ্বিক সার্বভৌমত্বের অনেক পূর্বেই ইসলাম সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করে রেখেছে, সার্বভৌমত্বের শাশ্বত অমিয় বাণী- أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ-‘‘ সাবধান! সৃষ্টি তাঁরই এবং এর ওপর প্রভুত্ব চালাবার, একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।’’
ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। মূলত এ ধারণার ওপরই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোটা অট্টালিকা প্রতিষ্ঠিত। এ ধারণার মূল কথা হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো দেশের অধিবাসীরাই দেশের প্রকৃত মালিক নয়; বরং সেই মহান আল্লাহই হচ্ছেন সমগ্র দেশ ও রাজ্যের প্রকৃত মালিক, যিনি দেশ ও তার অধিবাসী- তথা সমগ্র আকাশ ও পৃথিবীকে নিজ ক্ষমতা বলে সৃষ্টি করেছেন। উপরন্তু, সৃষ্টির ওপর তাঁর একচ্ছত্র মালিকানা, কর্তৃত্ব এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অবিভাজ্য ও অংশীদারহীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ-‘‘ তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহর।’’ الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ-‘‘তিনি হলেন সেই সত্তা, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বের মালিক। তিনি কাউকেও পুত্র বানান না। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশীদার নেই।’’ تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ-‘‘সকল মর্যাদা-শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সেই সত্তাই যাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’’ أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ-‘‘আল্লাহ কি সকল শাসনকর্তার বড় শাসনকর্তা নন?’’وَهُوَ الَّذِي فِي السَّمَاءِ إِلَهٌ وَفِي الْأَرْضِ إِلَهٌ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْعَلِيمُ -‘‘এবং তিনি সেই সত্তা যিনি আসমানেও ইলাহ এবং যমীনেও ইলাহ। তিনি প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞানী।’’ এ আয়াতগুলো থেকে জানা যায় যে, মহান আল্লাহই হলেন এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি এ বিশ্ব জাহান সৃষ্টি করার পর এমন নয় যে, তিনি এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে গেছেন; বরং তিনি ছোট-বড় প্রত্যেকটি বস্ত্তর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন-কর্তৃত্বের যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ এবং এ কাজে তাঁর সাথে কেউ সামান্যতমও শারীক নেই। অতএব, বিশ্ব জাহানের প্রতিটি বস্ত্ত যেহেতু একমাত্র আল্লাহর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্বের অধীন, তাই মানুষের ওপর হুকুমাত, প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার অধিকারও বিশ্ব সৃষ্টিকর্তা, বিধানদাতা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নেই। মানুষ মাত্রই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অধীন। কোনো ব্যক্তিই মানুষের ওপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব করার অধিকারী নয়। মানুষের মর্যাদা হলো, সে সর্বোচ্চ শাসকের প্রতিনিধি এবং তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে সর্বোচ্চ শাসকের আইনের অনুগামী।
কাজেই ইসলামের বিধানানুযায়ী আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সার্বভৌম শক্তির মালিক। আর আল্লাহ তা‘আলার সার্বভৌমত্ব বলতে বুঝায় আল্লাহর চূড়ান্ত, চরম ও অপ্রতিহত ক্ষমতা। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রেঞ্চলী বলেন, ‘‘সার্বভৌমের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের মধ্যেই নিহিত।’’ আল-কুর’আন অনেক আগে বলে দিয়েছে যে, সার্বভৌম শক্তি নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগে স্বাধীন ও নিরঙ্কুশ, فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ -‘‘যা ইচ্ছে তা-ই করার অধিকারী।’’ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ-‘‘ নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা আদেশ করেন।’’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী একচ্ছত্র শাসক। তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যে কোনো হুকম দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার রাখেন। তাঁর নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে কোনো প্রকার উচ্চবাচ্য করার বা আপত্তি জানানোর কোনো অধিকার কারো নেই। কুর’আন বলেছে, لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ-‘‘সার্বভৌম যা করেন সে বিষয়ে তাuঁক কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে না, তিনি কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন; বরং সকলেই একমাত্র তাঁর কাছেই জবাবদিহি করতে বাধ্য।’’ ইমাম রাগিব (রাহ.) লিখেছেন, ‘‘সার্বভৌমত্ব এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহ ছাড়া অপর কারো জন্য হওয়া সম্ভব নয়।’’ ড. ফারয আস-সানহুরী বলেন, رُوْحُ التَّشْرِيعِ الإسْلامِيِّ تَفْتَرِضُ أنَّ السِّيَادَةَ بِمَعْنَى السَّلْطَةِ غَيْرِ الْمَحْدُوْدَةِ لَا يَمْلِكُهَا أحَدٌ مِنَ الْبَشَرِ، فَكُلُّ سَلْطَةٍ إنْسَانِيَّةٍ مَحْدُوْدَةٍ بِالْحُدُودِ الَّتِي فَرَضَهَا اللهُ، فَهُوَ وَحْدَهُ صَاحِبُ السِّيَادَةِ الْعُلْيَا، وَمَالِكُ الْمُلْكِ،-‘‘ ইসলামের দৃষ্টিতে কোন মানুষই (চরম ও সীমাহীন ক্ষমতা অর্থে) সার্বভৌমত্বের মালিক হতে পারে না। কেননা কোনো মানুষের ক্ষমতা চরম ও নিরঙ্কুশ নয়; বরং তার যে কোনো ক্ষমতাই আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখার আওতাধীন। অতএব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ও রাজত্বের মালিক।’’
ইসলাম কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না। কেননা প্রকৃত অর্থে সার্বভৌমত্ব হচ্ছে এক উচ্চশক্তির আধার। যা কখনো ভুল করতে পারে না। অথচ মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। সুতরাং সার্বভৌমত্বের অধিকার তার নেই। গতানুগতিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যক্তি, গোত্র, শ্রেণী অথবা বিশেষ জনসংখ্যা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রের সকল নাগরিককেই বিনা দ্বিধায় সার্বভৌম শক্তির আদেশ পালন করতে হয়, তার সিদ্ধান্তকে চরম সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে হয়। এহেন অসীম ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো গোষ্টী বা দলের হাতে এলে তা দ্বারা বৃহত্তর মানব সমাজের যথার্থ কল্যাণ হতে পারে না। কেননা মানুষ একদিকে যেমন পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী নয়, অন্যদিকে তেমনি সে স্বার্থপরতা, অর্থলোভ, ক্ষমতা ও প্রাধান্য লিপ্সা ইত্যাদি মানবীয় দুর্বলতার অধীন। এমতাবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা তাদের ওপর ন্যস্ত হলে তারা তাদের সীমাবদ্ধতার দরুন বা অন্যদের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের মানসে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি প্রবর্তন করবে। পক্ষান্তরে সার্বভৌমত্ব যদি আল্লাহর হয়, তবেই রাষ্ট্র নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, জাতি বা দলের স্বার্থ বা অভিলাষ পূর্ণ করবে না; বরং তখন সমগ্র শক্তি ও সামর্থ্য এবং যাবতীয় উপায়-উপাদান একান্তভাবে নিয়োজিত করা হবে মহান আল্লাহর মর্জি লাভ করার জন্য। আর এভাবেই সমগ্র জনগোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। কারণ আল্লাহর প্রভুত্ব সকলের জন্য সমান।
চিরঞ্জীব-অক্ষয় ও শাশ্বত হওয়াও সার্বভৌমের একটি বিশেষ গুণ। আর এ গুণ আল্লাহ ছাড়া আর কারো থাকতে পারে না। বস্ত্তত একটি জীবন্ত সমাজ সংস্থার জন্য চিরঞ্জীব-শাশ্বত সত্তাই অপরিহার্য। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কর্তৃক নির্ধারিত সার্বভৌমই এ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। রাষ্ট্রীয় আইনের ধারায় জীবনের স্পন্দন অনুভব করাও সম্ভব এই চিরঞ্জীব সত্তাকে আইনের উৎসরূপে মেনে নিলে। ইমাম রাগিব ইস্পাহানী, আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী, ইমাম গাযালী, ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, হাকীম আবূ নাস্র ফারিয়াবী (রাহ.) প্রমুখ মুসলিম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ কারণে কেবল আল্লাহ তা‘আলাকেই সার্বভৌমত্বের একমাত্র অধিকারী রূপে ঘোষণা করেছেন।
কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে যদি সার্বভৌম শক্তি বলে মেনে নেয়া হয়; তথাপিও তার মধ্যে সার্বভৌম শক্তির গুণাবলী থাকতে পারে না। কারণ জন্মগতভাবে সে এ সব গুণ থেকে বঞ্চিত। অমরত্ব, চিরঞ্জীবতা, চিরস্থায়িত্ব, ব্যাপকতা, অবিভাজ্যতা, নিখুঁত জ্ঞানের অধিকার, ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে অবস্থান ইত্যাদি গুণ মানুষের নেই, থাকতে পারে না। আর নেই বলেই তার ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা অর্পিত হলে তা মানব সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার বিপরীতে ক্ষুদ্র স্বার্থে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অধিকন্তু, মানুষ - সে ব্যক্তি হোক, শ্রেণী হোক কিংবা কোনো জাতি বা সমষ্টিই হোক- সার্বভৌমত্বের এতো বিরাট ক্ষমতা সামলানোই তার পক্ষে অসম্ভব। জনগণের ওপর হুকম চালাবার সীমাহীন অধিকার তার থাকবে, তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অন্য কারো থাকবে না এবং তার সকল সিদ্ধান্তই নির্ভুল মনে করে শিরোধার্য করে নেয়া হবে, এ রূপ অধিকার ও কর্তৃত্ব যদি কোনো মানবীয় শক্তি লাভ করতে পারে, তবে সেখানে যুলম, নিপীড়ন ও নির্যাতন হওয়া একেবারে অনিবার্য ব্যাপার। মানুষ যখনই জীবনের এ পথ অবলম্বন করেছে, তখনি ভাঙন, বিপর্যয় ও অশান্তি সর্বগ্রাসী হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ যার বাস্তবিকপক্ষে সার্বভৌমত্ব নেই এবং যাকে সার্বভৌমত্বের অধিকারও প্রদান করা হয়নি, তাকেই যদি কৃত্রিমভাবে সার্বভৌমত্বের অধিকার ও কর্তৃত্ব দান করা হয়, তবে সে কিছুতেই এ পদের যাবতীয় ক্ষমতা ও ইখতিয়ার সঠিক পন্থায় ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না। পবিত্র কুর’আন এই কথাই নিম্নোক্ত ভাষায় ঘোষণা করেছে- وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ.-‘‘যারা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারা যালিম।’’
বস্ত্ততপক্ষে সার্বভৌমত্বের সমুদয় বৈশিষ্ট্য ও সংজ্ঞা সামনে রেখে উন্মুক্ত মনে এর আধার সন্ধান করলে নিঃসন্দেহে মনে হবে যে, তামাম জাহানের একমাত্র স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলাই সার্বভৌমত্বের আধার হতে পারেন। একমাত্র তাঁর মধ্যে যাবতীয় গুণাবলীর বর্তমান থাকা শোভা পায় এবং নিখিল সৃষ্টিকুলে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কোনো শক্তি বা সংস্থাই সার্বভৌমত্বের মালিক হতে পারে না। মূলত নিখিল বিশ্বের প্রতিটি পরতে পরতে তাঁরই নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব চলছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ -‘‘ আসমান-যমীনের সব কিছুই তাঁর অনুগত।’’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার একক ও নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করাই প্রকৃতির অমোঘ বিধান এবং এ আনুগত্যের মাধ্যমেই বিশ্বচরাচর চিরগতিশীল ও কর্মচঞ্চল হয়েছে। অতএব ‘বিশ্ব প্রাকৃতিক সার্বভৌমত্ব’ (Universal sovereignty) একমাত্র তাঁর জন্যই। মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও একমাত্র তাঁর প্রভুত্ব এবং তাঁরই বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। কেননা সমাজ বা রাষ্ট্রও বিশ্ব প্রকৃতির মৌল ভাবধারার পরিপন্থী অন্য কোনো ব্যবস্থার ভিত্তিতে চলতে পারে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো ব্যক্তি, কোনো দল, কোনো পার্লামেন্ট বা কোনো জাতি কিংবা সমগ্র মানবও সার্বভৌমত্বের দাবী করতে পারে না। কারো এ রূপ দাবী করা একান্তই অমূলক যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের স্রষ্টা; কিন্তু তিনি আমাদের আদেশ-নির্দেশ প্রদানের কর্তা ও বিধানদাতা নন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ-‘‘লোকেরা জিজ্ঞেস করে, কর্তৃত্বের কোনো অংশ আমাদের জন্য আছে কী? বল- হে নাবী, সমগ্র কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহরই একাধিকারভুক্ত।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলাই হলেন এ বিশ্বের সার্বভৌম শাসক। কোনো ব্যক্তি, বংশ, শ্রেণী, জাতি, এমনকি গোটা মানবজাতিরও সার্বভৌমত্বের বিন্দুমাত্র অধিকার নেই।
মোট কথা, প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য এবং মৌলিক আইন ও বিধান রচনা রাষ্ট্রের এ সকল কার্য সম্পাদনের নিরঙ্কুশ অধিকার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। এ ব্যাপারে কেউ তাঁর শারীক নেই। সেই আল্লাহই সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। তাঁর নিকট কোনো মানুষের গোপন রহস্যও অজ্ঞাত নয়। বিচার দিনে তিনি মানুষের সকল কার্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব গ্রহণ করবেন। তাঁর হিসাব গ্রহণ থেকে কেউ রেহাই পেতে পারবে না। সকলেই ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ জীবন ব্যাপী কাজের জন্য আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। তাই মানুষের কাজ হলো কেবল তার স্রষ্টা রাজাধিরাজ আল্লাহর আইন মেনে চলা। এ প্রসঙ্গে কবি ইকবাল (রাহ.) বলেন,
سرورى زيبا فقط اس ذات بے همتا كو هے حكمراں هے بس وهى باقي بتان آزرى
-‘‘কর্তৃত্ব কেবল সে একক সত্তার জন্যই শোভা পায়। তিনিই একমাত্র শাসক। আর অবশিষ্ট সকল কিছুই আযারের প্রতিমা।’’
মু‘মিনরা একদিকে নিজেদেরকে আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে স্বীকার করবে, অপরদিকে তারা আল্লাহদ্রোহীদের আনুগত্য করবে এবং তাদের কাছে নিজেদের বিষয়াদির ফায়সালা চাইবে- এ ধরনের কাজ ঈমানের দাবীর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক ও স্পষ্টত কপটতা। যদি কেউ এমনটি করে, তবে নিজেকে মু’মিন ও মুসলিম দাবী করা সত্ত্বেও সে আল্লাহর অনুগত বান্দাহদের দল থেকে বিচ্যুত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا -‘‘ সঠিক পথ সুস্পষ্ট হবার পরেও যে ব্যক্তি রাসূলের সাথে বিরোধ করবে এবং মু’মিনদের নীতি-আদর্শের বিপরীত পথে চলবে, তাকে আমরা সে দিকে চালাবো, যে দিকে সে নিজেই মোড় নিয়েছে। আর তাকে আমরা জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো, যা খুবই নিকৃষ্ট স্থান।’’
ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ‘প্রকৃত সার্বভৌমত্ব’ ও ‘নামসর্বস্ব সার্বভৌমত্ব’ নামে দুই ধরনের সার্বভৌমত্ব দেখা যায়। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আল্লাহ তা‘আলাকে কেবল নীতিগতভাবে সার্বভৌম সত্তা হিসেবে মেনে নেয়াই যথেষ্ট নয়। কার্যত তাঁর নির্দেশ ও ফায়সালাগুলো মেনে নেয়াও অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহর নির্দেশগুলোকে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে কার্যকর করাই আল্লাহকে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে মেনে নেয়ার প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ-‘‘ আর আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদাত কর এবং তাগুত থেকে বিরত থাক।’’ اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ -‘‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রাবেবর নিকট থেকে যা নাযিল হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে বাদ দিয়ে কোন মনগড়া পৃষ্ঠপোষকের অনুসরণ করো না।’’ ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ-‘‘অতঃপর আমি তোমাকে দীনের এক বিশেষ পদ্ধতির ওপর স্থাপন করেছি। তুমি তাঁরই অনুসরণ কর। যাদের কোনো জ্ঞান নেই তাদের খাহেশের অনুসরণ করো না।’’ অতএব কোনো রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র হতে হলে আল্লাহ তা‘আলাকে প্রকৃত অর্থেই সার্বভৌম শক্তি হিসেবে মেনে নিতে হবে। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে তাঁর আইন ও নির্দেশ কার্যকর করতে হবে।

আল্লাহর আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব
আইন প্রণয়ন ও নির্দেশ দানের অধিকার কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সুনির্দিষ্ট। তাঁর এ আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকার করার নাম ঈমান ও ইসলাম এবং তা অস্বীকার করার নামই নিরেট কুফর। অতএব, যে রাষ্ট্র আল্লাহর আইনগত সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়ে গঠিত হয়েছে তার আইন পরিষদও আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ মতৈক্যের বলেও কোনো আইন পাশ করার অধিকারী হবে না। আল্লাহর আইনের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইন রচনা করা আইন পরিষদের ইখতিয়ার বহির্ভূত এবং আইন পরিষদ এই ধরনের কোনো আইন পাশ করলেও তা অনিবার্যরূপে সংবিধানের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে। তদুপরি রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আনুগত্য অনিবার্যরূপে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের অধীন হবে, তা থেকে স্বাধীন হবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার আইন ও বিধি-বিধান অনুসরণের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে জনগণের নিকট আনুগত্য দাবী করার কোনো অধিকারই রাষ্ট্রের নেই। এ কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবে বলেছেন, لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ-‘‘আল্লাহর আইন ও নির্দেশ অমান্য করে সৃষ্টির আনুগত্য কিছুতেই করা যাবে না।’’
এখানে উল্লেখ্য যে, স্থূল দৃষ্টি সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি ‘আল্লাহ তা‘আলা আইনগত সার্বভৌমত্বের অধিকারী’- কথাটি শুনার পর ধারণা করতে পারে যে, এ অবস্থায় ইসলামী রাষ্ট্রে মানবীয় আইন প্রণয়ন করার মোটেই কোনো সুযোগ নেই। কেননা এখানে তো আইনদাতা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। আর মুসলিমদের কাজ হচ্ছে কেবল আল্লাহর প্রদত্ত আইনের আনুগত্য করে যাওয়া। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, ইসলাম মানুষের আইন প্রণয়নকে চূড়ান্তভাবেই নিষিদ্ধ করে দেয় না; বরং তাকে আল্লাহর আইনের প্রাধান্যের দ্বারা সীমাবদ্ধ করে দেয়। শারী‘আতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই- এ ধরনের বহুবিধ শাসনতান্ত্রিক সমস্যায় ও সামাজিক জীবনের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনাদির সাথে সংশ্লিষ্ট খুuঁটনাটি বিষয়ে ইসলামের মৌল নীতিমালার ভিত্তিতে শারী‘আতের প্রাণসত্তার সাথে সামঞ্জস্যশীল আইন প্রণয়নের অধিকার ইসলাম মানুষকে দান করেছে।
ইসলামী রাষ্ট্রে ‘রাজনৈতিক প্রভুত্ব’ (Political sovereignty)ও ‘আইনগত সার্বভৌমত্বের’ মতো একমাত্র আল্লাহরই স্বীকার করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার আইনগত সার্বভৌমত্ব মানব সমাজে যে প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক শক্তিবলে কার্যকর করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে, আইন ও রাজনীতির পরিভাষায় তাকে কখনো সার্বভৌমত্বের মালিক বলা যায় না। যে শক্তির আইনগত সার্বভৌমত্ব নেই এবং যার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার এক উচ্চতর আইন আগে থেকে সীমিত ও অনুগত বানিয়ে দিয়েছে এবং যার পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা তার নেই, সে সার্বভৌমত্বের ধারক হতে পারে না, এটাই তো সুস্পষ্ট কথা। তবে এ প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা বা মর্যাদা কোন্ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা যেতে পারে? পবিত্র কুর’আন এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। কুর’আন মাজীদ এই প্রতিষ্ঠানকে ‘খিলাফাত’ নামে ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ এই প্রতিষ্ঠান ‘একচ্ছত্র শাসক’ নয়; বরং একচ্ছত্র শাসকের প্রতিনিধি মাত্র।

আল কুর’আনের দৃষ্টিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
ইসলামে সার্বভৌমত্ব নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য স্বীকৃত। পবিত্র কুর’আনের বহু জায়গায় এ কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহ কেবল ধর্মীয় অর্থেই মা‘বূদ নন; বরং রাজনৈতিক ও আইনগত দিক থেকেও তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, শাসক ও সার্বভৌমত্বের মালিক। তিনি সমস্ত জগত ও সাম্রাজ্যের মালিক। তিনি স্রষ্টা, সৃষ্টিজগত তাঁরই। তাঁর সাম্রাজ্যে তাঁর সৃষ্টির ওপর তাঁর ছাড়া অপর কারো শাসন-সার্বভৌমত্ব চলতে পারে না। উপরন্তু তিনিই হলেন একমাত্র আইনদাতা। আইন রচনা করার অধিকার একমাত্র তাঁরই। তাঁর আইনই হচ্ছে মূল্যবোধের একমাত্র ভিত্তি। এ আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালিত হবে এবং সকলকেই এ আইন মেনে চলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার এই সার্বভৌমত্ব আল কুর’আন এতোটা পরিষ্কারভাবে এবং এতোটা জোরের সাথে পেশ করে যতটা জোরের সাথে এবং পরিষ্কারভাবে তাঁর ধর্মীয় সার্বভৌমত্বের ‘আকীদা পেশ করে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ তা‘আলার এ দুটি মর্যাদা (ধর্মীয় সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমত্ব) তাঁর উলুহিয়্যাত ও তাওহীদের অবশ্যাম্ভাবী ফল। এর একটিকে অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এর কোনো একটিকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উলুহিয়্যাত ও তাওহীদকে অস্বীকার করা। নিম্নে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হল-
১. إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ-‘‘ শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার (অর্থাৎ সার্বভৌম ক্ষমতা) আল্লাহ ব্যতীত আর কারো জন্যই নয়। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কারো দাসত্ব ও বন্দেগী করা যাবে না। এটিই হল সঠিক জীবনপদ্ধতি। অথচ অধিকাংশ লোকই তা জানে না।’’ এটি হযরত ইউসূফ (‘আলাইহিস সালাম)-এর ভাষণের একটি অংশ। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাওহীদের ব্যাপারে এটি সর্বোত্তম ভাষণসমূহের অন্যতম। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আসল মালিক ও প্রভু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি সার্বভৌমত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের যাবতীয় অধিকার ও ক্ষমতা নিজের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন এবং তাঁরই আদেশ হচ্ছে, তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না। আয়াতে উল্লেখিত সার্বভৌমত্বকে শুধুমাত্র ‘‘বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্বের’’ (Universal Sovereignty) অর্থে সীমাবদ্ধ করার মতো কোনো শব্দ বা সম্বন্ধ এখানে বিদ্যমান নেই। আল্লাহ তা‘আলার এই সার্বভৌমত্ব যেমন বিশ্বজনীন, তদ্রূপ রাজনৈতিক, আইনগত, নৈতিক ও বিশ্বাসগত সবদিকেই পরিব্যাপ্ত। আল্লাহ তা‘আলা কেবল ‘ رَبِّ النَّاسِ’ (মানুষের প্রভু) ও ‘ إِلَهِ النَّاسِ’ (মানুষের উপাস্য)ই নন; বরং ‘ مَلِكِ النَّاسِ ’ (মানুষের শাসক)ও। অতএব এ কথা পরিষ্কার যে, এটা কেবল বিশ্বজনীন সার্বভৌমত্ব নয়; বরং সুস্পষ্ট আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব। নিম্নোক্ত আয়াতগুলো থেকে এ কথা আরো অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।
২. إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ -‘‘ শাসনের অধিকার অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব কেবল আল্লাহর জন্যই। তিনিই সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই হলেন সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।’’
৩. وَلَا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَدًا-‘‘ তিনি তাঁর শাসন-কর্তৃত্বে কাউকেও অংশীদার রূপে গ্রহণ করেন না।’’
৪. أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ-‘‘ সাবধান! সৃষ্টি তারই এবং এর ওপর প্রভুত্ব চালাবার, একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।’’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা এ বিশ্ব জগত সৃষ্টি করার পর এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে কোথাও বসে যাননি; বরং তিনিই সৃষ্টির ছোট-বড় প্রত্যেকটি বস্ত্তর ওপর কর্তৃত্ব করছেন। পরিচালনা ও শাসন-কর্তৃতেবর যাবতীয় ক্ষমতা কার্যত তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। প্রতিটি বস্ত্ত তাঁর নির্দেশের অনুগত। অতি ক্ষুদ্র অণু-পরমাণুও তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَمَنْ زَعَمَ أنَّ اللهَ جَعَلَ لِلْعِبَادِ مِنَ الْأمْرِ شَيْئًا، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أنْزَلَ اللهُ عَلَى أنْبِيَائِهِ؛ لِقَوْلِهِ: { أَلا لَهُ الْخَلْقُ وَالأمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ }. -‘‘যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহদের জন্যও কিছু মাত্র শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার দান করেছে,তা হলে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর নাবীগণের প্রতি অবতীর্ণ বাণীর সাথে কুফরী করেছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘ সাবধান! সৃষ্টি তারই এবং এর ওপর প্রভুত্ব চালাবার, একে শাসন করার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।...’’
৫. يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ -‘‘তারা বলে, আমাদের হাতে কি কোনো কর্তৃত্ব আছে? তুমি বলে দাও, সকল কর্তৃত্বই আল্লাহর হাতে।’’
৬. ثُمَّ رُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلاَهُمُ الْحَقِّ أَلاَ لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ-‘‘অতঃপর সবাইকে তাদের সত্যিকার অভিভাবক আল্লাহ তা‘আলার কাছে পৌঁছানো হবে। জেনে রেখো, শাসন-কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই জন্য। তিনি দ্রুততম হিসাব গ্রহণকারী।’’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মুফাসসির ইবনু জারীর আত-তাবারী (রাহ.) বলেন, أَلاَ لَهُ الْحُكْمُ وَالْقَضَاءُ دُونَ سِوَاهُ مِنْ جَمِيعِ خَلْقِهِ-‘‘শাসন ও বিচার-ফায়সালার একচছত্র অধিকার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কারো এ অধিকার নেই।’’ আল্লাহ তা‘আলার এ অধিকার দুনিয়া ও আখিরাত- উভয় জগতের জন্য প্রযোজ্য। কেননা মানুষের দুনিয়াবী ‘আমালের ওপর ভিত্তি করেই পরকালের হিসাব সম্পন্ন করা হবে। দুনিয়ায় তারা আল্লাহ তা‘আলার প্রদত্ত আইন-কানূন ও বিধি-বিধান কি পরিমাণ মেনে চলেছে- তার ভিত্তিতেই তাদের হিসাব করা হবে এবং প্রতিফল দেয়া হবে।
৭. أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ-‘‘তারা কি জাহিলিয়্যাতের শাসন কামনা করছে? অথচ যারা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে তাদের জন্য আল্লাহর আইনের শাসনের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো শাসন হতে পারে না।’’ হযরত হাসান আল-বাসরী (রাহ.) বলেন, এ আয়াতে জাহিলী শাসন বলতে আল্লাহ তা‘আলার শাসন ব্যতীত অন্য যে কোনো শাসনকে বুঝানো হয়েছে।
৮. وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ. ... فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ. ... فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ -‘‘যে সব লোক আল্লাহর অবতীর্ণ আইনে শাসন কার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির, ..তারা যালিম..তারা ফাসিক..।’’ এ আয়াতগুলোতে যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য তিনটি উক্তি করেছেন। এক. তারা কাফির, দুই. তারা যালিম, তিন. তারা ফাসিক। এর সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর হুকম ও তাঁর অবতীর্ণ আইন ত্যাগ করে নিজের বা অন্য মানুষের মনগড়া আইনের ভিত্তিকে ফায়সালা করে সে আসলে তিনটি মারাত্মক অপরাধ করে। প্রথমত তার এ কাজটি আল্লাহর হুকম অস্বীকার করার শামিল। কাজেই এটা কুফরী। দ্বিতীয়ত তার এ কাজটি সুবিচারের পরিপন্থী। কেননা কেবল আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিধানগুলোই হল পুরোপুরি ইনসাফ ও ন্যায়ভিত্তিক। কাজেই তাঁর হুকম থেকে সরে এসে যখন সে ফায়সালা করল, সে আসলে যুলম করল। তৃতীয়ত বান্দাহ হওয়া সত্ত্বেও যখনই সে নিজের প্রভুর আইন অমান্য করে নিজের বা অন্যের মনগড়া আইন প্রবর্তন করল, তখনই সে দাসত্ব ও আনুগত্যের গন্ডীর বাইরে পা রাখল। আর এটি অবাধ্যতা বা ফাসিকী। এ কুফরী, যুলম ও ফাসিকী তার নিজের ধরন ও প্রকৃতির দিক দিয়ে অনিবার্যভাবে আল্লাহর হুকম অমান্যেরই বাস্তব রূপ। তবে আল্লাহ তা‘আলার হুকম অমান্য করার যেমন পর্যায়ভেদ আছে, তেমনি এ তিনটি বিষয়েরও পর্যায়ভেদ আছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার হুকমকে ভুল কিংবা অযৌক্তিক বা অকল্যাণকর এবং নিজের বা অন্য কোনো মানুষের হুকমকে সঠিক ও অধিকতর কল্যাণকর মনে করে আল্লাহ তা‘আলার হুকমের বিরোধী ফায়সালা করে সে পুরোপুরি কাফির, যালিম ও ফাসিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার হুকমকে সত্য বলে বিশ্বাস করে, কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করে, সে ইসলামী মিল্লাতের বহির্ভূত না হলেও নিজের ঈমানকে কুফরী, যুলম ও ফাসিকীর সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনু ‘আববাস (রা.) বলেন, مَنْ جَحَدَ مَا أنْزَلَ اللهُ فَقَدْ كَفَرَ. وَمَنْ أقَرَّ بِهِ وَلَمْ يَحْكُمْ فَهُوَ ظَالِمٌ فَاسِقٌ.-‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অস্বীকার করবে সে কাফির হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে সত্য বলে স্বীকার করে; কিন্তু কার্যত তার বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে যালিম ও ফাসিক।’’
৯. أَفَغَيْرَ اللَّهِ أَبْتَغِي حَكَمًا وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ إِلَيْكُمُ الْكِتَابَ مُفَصَّلًا-‘‘আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো শাসককে খুঁজবো? অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন বিস্তারিত বিধিসহকারে।’’
১০. وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا.-‘‘ যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো ফায়সালা দেবে, তাতে কোনো মু’মিন নর-নারীর জন্য এ ইখতিয়ার নেই যে, সে তা লঙ্ঘন করবে। আর যে এ রূপ করবে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হবে।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান পোষণ করার ঘোষণা করবে আর জীবনের সামগ্রিক বিষয়াদি পরিচালনা করবে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশাবলীকে বাদ দিয়ে অন্যদের আইন অনুযায়ী, ইসলাম কোনো অবস্থাতেই এমনটি বরদাশত করতে প্রস্ত্তত নয়। এর চেয়ে বড় স্ববিরোধিতা আর কিছু হতে পারে না।
১১. أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ-‘‘ তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহর। আর তিনি ভিন্ন পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যকারী আর কেউ নেই।’’ এখানে আল্লাহর জন্য ‘মুলক’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি বাদশাহী, রাজত্ব, সর্বময় কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের অর্থে বলা হয়ে থাকে। এ আয়াতের মর্ম হচ্ছে, মহান আল্লাহই এ বিশ্ব জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক এবং তাঁর শাসন ক্ষমতায় কারো সামান্যতমও অংশ নেই।
১২. أَفَغَيْرَ دِينِ اللَّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ -‘‘তারা কি আল্লাহর দীনের পরিবর্তে অন্য দীন তালাশ করছে। অথচ আসমান-যমীনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তাঁরই আনুগত্য করে যাচ্ছে। উপরন্তু, সব কিছুকেই তাঁরই দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’’
১৩. وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ -‘‘যে লোক ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দীন তালাশ করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হবে।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, ইসলামই হল আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র গ্রহণযোগ্য জীবনবিধান, যা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সকল দিক ও বিভাগে অকুণ্ঠ চিত্তে মেনে চলা প্রত্যেকের ওপর ফারয। ইসলামে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই যে, কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশও মেনে চলবে, পাশাপাশি অন্যের নির্দেশও মেনে চলবে। কেউ এ রূপ করলে তার এ কাজ শির্ক রূপে গণ্য হবে। আর কেউ অহঙ্কারের সাথে আল্লাহর কোন নির্দেশ লঙ্ঘন করলে সে তো কাফিরই হয়ে যাবে।
১৪. يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا . أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا.-‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলবে। আনুগত্য করবে রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বের অধিকারী তাদেরও। তবে যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়, তা হলে তোমরা বিবাদের বিষয়টিকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে নেবে (অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করবে), যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হও। এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। এ আয়াত থেকে জানা যায়, যে কোনো সময় কোনো বিষয়ে পারস্পরিক মতবিরোধ দেখা দিলে বিবাদ পরিহার করে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানের দিকে ফিরে যাওয়া এবং সেখানে বিবাদের মিমাংসা অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফারয। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا-‘‘অতএব, না, তোমার রাবেবর কসম! তারা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদে তোমাকে ফায়সালাকারী রূপে গ্রহণ করবে। উপরন্তু, তারা তোমার ফায়সালার ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখতে পাবে না এবং তারা তা সম্পূর্ণ হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করে নেবে।’’ এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নিজের কসম খেয়ে বলেছেন যে, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সানন্দে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যাবতীয় সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করে নেবে। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফায়সালা মেনে চলার নির্দেশ তাঁর যুগের সাথে সীমিত নয়। মুফাসসিরগণ সকলে এক বাক্যে বলেছেন যে, তাঁর ওফাতের পর তাঁর পবিত্র শারী‘আতের ফায়সালাই হল তাঁর ফায়সালা। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আবূ বাকর আর-রাযী আল-জাসসাস (রাহ.) বলেন, فِي هَذِهِ الْآيَةِ دَلَالَةٌ عَلَى أَنَّ مَنْ رَدَّ شَيْئًا مِنْ أَوَامِرِ اللَّهِ تَعَالَى أَوْ أَوَامِرِ رَسُولِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُوَ خَارِجٌ مِنْ الْإِسْلَامِ سَوَاءٌ رَدَّهُ مِنْ جِهَةِ الشَّكِّ فِيهِ أَوْ مِنْ جِهَةِ تَرْكِ الْقَبُولِ وَالِامْتِنَاعِ مِنْ التَّسْلِيمِ ، وَذَلِكَ يُوجِبُ صِحَّةَ مَا ذَهَبَ إلَيْهِ الصَّحَابَةُ فِي حُكْمِهِمْ بِارْتِدَادِ مَنْ امْتَنَعَ مِنْ أَدَاءِ الزَّكَاةِ وَقَتْلِهِمْ وَسَبْيِ ذَرَارِيِّهِمْ ؛ لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى حَكَمَ بِأَنَّ مَنْ لَمْ يُسَلِّمْ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَضَاءَهُ وَحُكْمَهُ فَلَيْسَ مِنْ أَهْلِ الْإِيمَانِ .-‘‘এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি সন্দেহবশত কিংবা অমান্য করে আল্লাহ কিংবা তাঁর রাসূলের কোনো নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করবে, সে মূলত ইসলাম থেকেই বের হয়ে যাবে। এ আয়াত থেকে আরো জানা হয় যে, যারা যাকাত আদায় করা থেকে বিরত ছিল, তাদেরকে ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেবার ব্যাপারে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করা ও তাদের পরিবার-পরিজনকে বন্দী করার ব্যাপারে সাহাবা কিরাম (রা.) যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন- তা সঠিকই ছিল। কেননা আল্লাহর নির্দেশ হল, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফায়সালা ও নির্দেশকে মেনে নিতে পারবে না, সে মূলত ঈমানদারই নয়।’’
১৫. পবিত্র কুর’আনে হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিস সালাম)-এর বক্তব্য এসেছে এভাবে- وَمُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَلِأُحِلَّ لَكُمْ بَعْضَ الَّذِي حُرِّمَ عَلَيْكُمْ وَجِئْتُكُمْ بِآَيَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِيعُونِ . إِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِيمٌ . -‘‘আমি সেই শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার সামনে তাওরাতে আছে। আর তোমাদের জন্য যে সব জিনিস হারাম করা হয়েছিল তার কতকগুলো হালাল করার জন্য আমি এসেছি। দেখো, তোমাদের রাবেবর পক্ষ থেকে আমি নিদর্শন নিয়ে এসেছি। কাজেই আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। আল্লাহ আমার রাবব এবং তোমাদেরও রাবব। কাজেই তোমরা তাঁর দাসত্ব কর। এটিই সঠিক পথ।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায়, সকল নাবীর মতো হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিস সালাম)-এর দা‘ওয়াতেরও তিনটি মৌলিক বিষয়বস্ত্ত ছিলঃ
ক. সার্বভৌম কর্তৃত্ব, যার দাসত্ব ও বন্দেগী করতে হবে এবং যার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত বলে স্বীকার করতে হবে।
খ. ঐ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারীর প্রতিনিধি হিসেবে নাবীর নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে।
গ. মানুষের জীবনকে হালাল ও হারামের বিধিনিষেধে আবদ্ধকারী আইন ও বিধিবিধান একমাত্র আল্লাহই দান করবেন।
১৬. وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ-‘‘তোমাদের জিহবা সাধারণত যে সব ভুয়া হুকম জারি করে তেমনি করে তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয় যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করে, তারা সফলকাম হবে না।’’ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কোনো বস্ত্তকে হালাল বা হারামে পরিণত করার অধিকার কোনো মানুষের নেই। এ অধিকার একমাত্র আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত। অন্য কথায়, একমাত্র আল্লাহই হলেন আইন প্রণেতা। অন্য যে কেউ নিছক নিজের রায় ও ইচ্ছার ভিত্তিতে আল্লাহর হালালকৃত বস্ত্তগুলোকে হারামে এবং আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তগুলোকে হালালে পরিণত করার ধৃষ্টতা দেখাবে, সে প্রকারান্তরে আল্লাহর অধিকারেই হস্তক্ষেপ করে। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহ.) বলেন, وَالْإِنْسَانُ مَتَى حَلَّلَ الْحَرَامَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - أَوْ حَرَّمَ الْحَلَالَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - أَوْ بَدَّلَ الشَّرْعَ - الْمُجْمَعَ عَلَيْهِ - كَانَ كَافِرًا مُرْتَدًّا بِاتِّفَاقِ الْفُقَهَاءِ . - ‘‘কোনো ব্যক্তি যখন কোনো সর্বস্বীকৃত হারামকে হালাল জানে, বা সর্বস্বীকৃত হালালকে হারাম জানে কিংবা সর্বস্বীকৃত বিধানকে পরিবর্তন করে, সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফির ও মুরতাদ্দ হয়ে যাবে।’’ অন্য আয়াতে আল্লাহর এ বক্তব্য এভাবে এসেছে, قُلْ أَرَأَيْتُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ لَكُمْ مِنْ رِزْقٍ فَجَعَلْتُمْ مِنْهُ حَرَامًا وَحَلَالًا قُلْ آَللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى اللَّهِ تَفْتَرُونَ-‘‘ হে নাবী, তাদের বল, তোমরা কি কখনো এ কথা চিন্তা করেছো যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যে রিযক অবতীর্ণ করেছেন তার মধ্য থেকে তোমরা নিজেরাই কোনোটাকে হারাম ও কোনোটাকে হালাল করে নিয়েছো? তাদের জিজ্ঞেস করো, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন? নাকি তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছো?’’ এ আয়াতগুলোতে মানুষের হালাল ও হারাম করার স্বাধীন ক্ষমতাকে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ বলে অভিহিত করার কারণ হলো, যে ব্যক্তি এ ধরনের বিধান তৈরি করে তার এ কাজটি দুটি অবস্থার বাইরে যেতে পারে না। হয় সে দাবী করছে, যে জিনিসকে সে আল্লাহর কিতাবের অনুমোদন ছাড়াই বৈধ বা অবৈধ বলছে তাকে আল্লাহ বৈধ বা অবৈধ করেছেন। অথবা তার দাবী হচ্ছে, আল্লাহ নিজের হালাল ও হারাম করার ক্ষমতা প্রত্যাহার করে মানুষকে স্বাধীনভাবে তার নিজের জীবনের শারী‘আ তৈরি করার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ দুটি দাবীর মধ্যে থেকে যেটিই সে করবে তা নিশ্চিতভাবেই মিথ্যাচার এবং আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ ছাড়া আর কিছুই হবে না।
১৭. أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ وَلَوْلَا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَإِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ-‘‘তাদের জন্য আল্লাহর সমকক্ষ কি কেউ রয়েছে, যারা তাদের জন্য এমন বিধান প্রবর্তন করে, যার অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা দেননি। যদি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ব্যাপারে ফায়সালা হয়ে যেত। নিশ্চয় যালিমদের জন্য রয়েছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’’ এ আয়াত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে, বিধান ও আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র অধিকারী হলেন আল্লাহ তা‘আলা। আর তাঁর বান্দাহদেরকে একমাত্র তাঁরই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। যদি কেউ জেনে-শুনে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘন করে কারো আইনের আনুগত্য করে, তা হলে সে প্রকারান্তরে তাকে আল্লাহর সমকক্ষে পরিণত করল।
১৮. ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ-‘‘অতঃপর আমি তোমাকে দীনের এক বিশেষ পদ্ধতির ওপর স্থাপন করেছি। তুমি তাঁরই অনুসরণ কর। যাদের কোনো জ্ঞান নেই তাদের খাহেশের অনুসরণ করো না।’’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট মুফাসসির আত্ তাবারী (রাহ.) বলেন,
فَاتَّبِعْ تِلْكَ الشَّرِيعَةَ الَّتِي جَعَلْنَاهَا لَكَ ، وَلاَ تَتَّبِعْ مَا دَعَاكَ إِلَيْهِ الْجَاهِلُونَ بِاَللَّهِ الَّذِينَ لاَ يَعْرِفُونَ الْحَقَّ مِنَ الْبَاطِل ، فَتَعْمَل بِهِ فَتَهْلِكُ إِنْ عَمِلْتَ بِهِ.
‘‘অর্থাৎ আমি যে শারী‘আত তোমার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি, তুমি তারই অনুসরণ কর। আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যারা জাহিল, যারা সত্য ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না, তুমি তাদের কথা মেনে চলবে না। যদি তুমি তাদের কথা মেনে চল, তবে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আববাস (রা.), কাতাদাহ ও ইবনু যায়দ (রাহ.) প্রমুখ থেকেও একই রূপ তাফসীর বর্ণিত রয়েছে। অন্য আয়াতে এ নির্দেশ আরো স্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ. -‘‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রাবেবর নিকট থেকে যা নাযিল হয়েছে তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে বাদ দিয়ে মনগড়া পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ করো না।’’
এগুলো হল কুর’আনের অকাট্য সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী। এগুলোতে সন্দেহ-সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আর এই হলো সেই মৌলিক ‘আকীদা-বিশ্বাস, যার ওপর ইসলামের চিন্তাদর্শন এবং রাষ্ট্র ও সমাজ-সভ্যতার ভিত স্থাপন করা হয়েছে। আর মুসলিমরা ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের ঈমানের দাবী পূরণ করতে পারবে না, যতোক্ষণ না তারা সার্বভৌম আল্লাহর প্রদত্ত আইনের ভিত্তিতে নিজেদের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করবে। মুসলিমদেরকে মাসজিদে গিয়ে যেমন আল্লাহর কাছে সাজদা অবনত হতে হবে, তেমনি মাসজিদের বাইরে এসেও তাঁর নির্দেশ ও আইন মেনে চলতে হবে।

হাদীসের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্ব
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও অসংখ্য হাদীসে এ কথা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র সার্বভৌম। আল্লাহ ছাড়া সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা আর কারো জন্যই নয়। তিনিই হলেন একমাত্র আইনদাতা, শাসক ও সার্বভৌমত্বের মালিক। রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র ভিত্তি হল তাঁর কিতাবের বিধানসমূহ। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের এ ইখতিয়ার নেই যে, তিনি আল কুর’আনের নির্দেশ ও বিধান ত্যাগ করে নিজের কিংবা অন্য কারো আইন বা বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। নিম্নে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল-
১. হযরত আবূ মুতাররিফ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি বনূ আমিরের প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে গমন করেছিলাম। আমরা তাকে أَنْتَ سَيِّدُنَا -‘‘আপনি আমাদের সাইয়িদ’’ (অর্থাৎ সার্বভৌম) বলে সম্বোধন করলাম। তখন তিনি বললেন, السَّيِّدُ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى -‘‘সার্বভৌম মাত্রই আল্লাহ তা‘আলা।’’ তখন আমরা তাঁকে وَأَفْضَلُنَا فَضْلًا وَأَعْظَمُنَا طَوْلًا -‘‘আমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহিয়ান’’ বলে সম্বোধন করলাম। এবারে তিনি বললেন, قُولُوا بِقَوْلِكُمْ أَوْ بَعْضِ قَوْلِكُمْ وَلَا يَسْتَجْرِيَنَّكُمْ الشَّيْطَانُ -‘‘ তোমরা তোমাদের এ কথা কিংবা তোমাদের কোনো কোনো বক্তব্য ব্যক্ত করতে পারো। তবে শায়তান যেন তোমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। অর্থাৎ তোমরা আমার প্রশংসা করতে গিয়ে যেন অতিরঞ্জিত না কর।’’ এ হাদীস থেকে জানা যায়, সার্বভৌম অর্থে السَّيِّدُ হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। এ অর্থে তিনি ভিন্ন অন্য কোনো السَّيِّدُ নেই। এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হাদীসের বিশিষ্ট ভাষ্যকার মানাবী (রাহ.) বলেন, (السَّيِّدُ) حَقِيْقَةً هُوَ (اللهُ) لا غَيْرُهُ أيْ هُوَ الَّذِيْ يَحِقُّ لَهُ السِّيَادَةُ الْمُطْلَقَةُ فَحَقِيْقَةُ السَّؤُدَدِ لَيْسَتْ إلَّا لَهُ إذْ الْخَلْقُ كُلُّهُمْ عَبِيْدُهُ.-‘‘প্রকৃতপক্ষে সাইয়িদ (সার্বভৌম) একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সাইয়িদ (সার্বভৌম) নেই। অর্থাৎ তিনিই হলেন একমাত্র নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী। বস্ত্ততপক্ষে প্রকৃত কর্তৃত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত আর কারো হতে পারে না। কেননা সৃষ্টির সকলেই হল তাঁর বান্দাহ।’’
২. আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, الْعِزَّةُ للهِ ، وَالْجَبَرُوْتُ للهِ ، وَالْعَظْمَةُ للهِ ، وَالْكِبْرِيَاءُ للهِ ، وَالسُّلْطَانُ للهِ ، وَالْمُلْكُ للهِ وَالْحُكْمُ للهِ وَالْعِزَّةُ للهِ ، وَالْقُوَّةُ للهِ ،... -‘‘ সকল পরাক্রমতা আল্লাহর জন্য, সকল প্রতাপ আল্লাহর জন্য, সকল মহিমা আল্লাহর জন্য, সকল বড়ত্ব আল্লাহর জন্য, সকল বাদশাহী আল্লাহর জন্য, সকল রাজত্ব আল্লাহর জন্য, সকল শাসন-কর্তৃত্ব আল্লাহর জন্য, সকল শক্তি আল্লাহর জন্য...।’’
৩. আমরা প্রায় দু‘আ মা’ছূরায় আল্লাহ তা‘আলার সর্বময় কর্তৃত্ব, রাজত্ব ও সার্বভৌমত্বের কথা ঘোষণা করে থাকি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মাতকে নামাযে এ দু‘আ পড়তে শিখিয়েছেন, الّلهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ ، وَلَكَ الْمُلْكُ كُلُّهُ ، وَبِيَدِكَ الْخَيْرُ كُلُّهُ ، وَإلَيْكَ يَرْجِعُ الْأمْرُ كُلُّهُ , أسْألُكَ مِنَ الْخَيْرِ كُلِّهِ وَأعُوْذُ بِكَ مِنَ الشَّرِّ كُلِّهِ. -‘‘হে আল্লাহ, সকল প্রশংসা আপনার জন্য। সকল রাজত্ব আপনার জন্য। সকল কল্যাণ আপনারই হাতে এবং সকল কর্তৃত্ব আপনার পানেই রুজু হবে। আমি আপনার কাছে সব ধরনের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করছি এবং সব ধরনের অনিষ্টতা থেকে পানাই চাই।’’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, জিব্রাইল (‘আলাইহিস সালাম) বলেছেন, إنّ خَيْرَ الدُّعَاءِ أنْ تَقُوْلَ فِي الصَّلَاةِ...-‘‘ এটি নামাযের মধ্যে সর্বোত্তম দু‘আ।’’
৪. উম্মুল হুছায়ন (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজ্জের সময় আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে এ কথা বলতে শুনেছি যে, إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُم بِكِتَابِ اللَّهِ فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا -‘‘যদি নাককাটা কোনো হাবশী গোলামকেও তোমাদের ওপর আমীর নিযুক্ত করে দেয়া হয়, সে যে যাবত তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের বিধানানুযায়ী পরিচালনা করবে, ততক্ষণ তোমরা তার কথা শুনবে ও মেনে চলবে।’’ এ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র ভিত্তি হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের বিধানসমূহ।
৫. ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমার (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ أَحِلُّوا حَلَالَهُ وَحَرِّمُوا حَرَامَهُ-‘‘আল্লাহর কিতাব মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর কিতাব যা হালাল করে দিয়েছে, তোমরা তাকে হালাল মানো। আর যা হারাম করেছে, তোমরা তাকে হারাম করো।’’
৬. আবূ ছা‘লাবাহ আল-খুশান্নী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ فَرَضَ فَرَائِضَ فَلاَ تُضَيِّعُوهَا وَحَرَّمَ حُرُمَاتٍ فَلاَ تَنْتَهِكُوهَا وَحَدَّ حُدُودًا فَلاَ تَعْتَدُوهَا وَسَكَتَ عَنْ أَشْيَاءَ مِنْ غَيْرِ نِسْيَانٍ فَلاَ تَبْحَثُوا عَنْهَا.-‘‘আল্লাহ তা‘আলা কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তোমরা তা নষ্ট করো না, কিছু হারাম বিষয় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তোমরা তা লঙ্ঘন করো না, কিছু সীমা নির্ধারণ করেছেন, তোমরা তা অতিক্রম করো না, ভুল না করেও কিছু ব্যাপারে তিনি মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা তার সন্ধানে নেমে পড়ো না।’’
৭. ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমার থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, لَا يُؤْمِنُ أحَدُكُمْ حَتَّى يَكُوْنَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ. -‘‘ তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না, যে যাবত তার প্রবৃত্তি (আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে) আমার অর্জিত বিধি-বিধানের অনুগত হবে না।’’ এ হাদীস থেকেও জানা যায় যে, কোনো মুসলিম ততোক্ষণ পর্যন্ত তার ঈমানের দাবী পূরণ করতে পারবে না, যতোক্ষণ না সে সার্বভৌম আল্লাহ তা‘আলার প্রদত্ত আইনের ভিত্তিতে নিজের প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ইমামগণের ইজমা‘ (ঐকমত্য)
আল্লাহ তা‘আলার আইনগত ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের এই ধারণা ইসলামের প্রাথমিক মৌলিক নীতিমালাসমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রাথমিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত ইসলামের ইমাম (আইনতত্ত্ববিদ)গণ এই ব্যাপারে এক মত যে, হুকম দেয়ার এবং আইন প্রণয়নের একচ্ছত্র অধিকার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সুনির্ধারিত। ইমাম গাযালী (রাহ.) বলেন, أَمَّا اسْتِحْقَاقُ نُفُوذِ الْحُكْمِ فَلَيْسَ إلَّا لِمَنْ لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ، فَإِنَّمَا النَّافِذُ حُكْمُ الْمَالِكِ عَلَى مَمْلُوكِهِ لَا مَالِكَ إلَّا الْخَالِقُ فَلَا حُكْمَ وَلَا أَمْرَ إلَّا لَهُ.-‘‘যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং কর্তৃত্বের অধিকারী তাঁর নির্দেশই কেবল কার্যকর হবার উপযোগী। কেননা গোলামের ওপর তার মালিকের নির্দেশই প্রয়োগ হবে- এটাই স্বাভাবিক। আর স্রষ্টা ছাড়া (সৃষ্টির) মালিক বলতে কেউ নেই। অতএব স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারো নির্দেশ দানের এবং শাসন ও কর্তৃত্ব করার কোনোই অধিকার নেই।’’ বিশিষ্ট ইসলামী আইন বিশারদ আমিদী (রাহ.) বলেন, اِعْلَمْ أنَّهُ لَا حَاكِمَ سِوَى اللهِ تَعَالَى، وَلَا حُكْمَ إلَّا مَا حَكَمَ بِهِ. -‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোনো হাকিম (শাসক) নেই এবং তিনি যে ফারমান দিয়েছেন তা-ই কেবল হুকম হিসেবে গণ্য।’’ তিনি আরো বলেন, وَاتْرُكُوْا حُكْمَ كُلِّ حَاكِمٍ، وَقَوْلَ كُلِّ قَائِلٍ دُوْنَ قَوْلِ اللهِ تَعَالَى وَقَوْلِ رَسُوْلِ اللهِ (صلى الله عليه وسلم). -‘‘আর তোমরা প্রত্যেক শাসকের নির্দেশ এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা ব্যতীত অন্য যে কারো কথাকে প্রত্যাখ্যান করো।’’ ইমাম ইবনু হাযম (রাহ.) বলেন, وَالْكُلُّ عَبِيْدٌ لَا أمْرَ لَهُمْ وَلَا حُكْمَ إلَّا مَا حَكَمَ بِهِ عَلَيْهِمْ.-‘‘আর প্রত্যেকেই আল্লাহর দাস। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যে নির্দেশ দিয়েছেন তা ছাড়া তাদের জন্য অন্য কারো কোনো নির্দেশ ও হুকম মোটেই প্রযোজ্য হতে পারে না।’’ বিশিষ্ট ইমাম জালাল আল-মাহাল্লী (রাহ.) বলেন, لَا حُكْمَ إلَّا لِلَّهِ -‘‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো জন্য শাসন ও কর্তৃত্বের অধিকার নেই।’’ শায়খ ফারজ সানহুরী (রাহ.) বলেন, لَا حَاكِمَ إلَّا الله، وَلَا حُكْمَ إلَّا مَا حَكَمَ بِهِ، عَلَى مَا اتَّفَقَتْ عَلَيْهِ كَلِمَةُ الْمُسْلِمِيْنَ. -‘‘ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোনো হাকিম নেই। অর্থাৎ হুকম দেয়ার অধিকার আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কারো নেই। তাঁর ফারমানই একমাত্র হুকম। এটা এমন একটি বিষয়, যে সম্পর্কে সমস্ত মুসলিম একমত।’’ এ প্রসঙ্গে ইসলামী আইন বিশ্বকোষ ‘মাওসূ‘আতুল ফিকহিল ইসলামী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, لَا حَاكِمَ سِوَى اللهِ سُبْحَانَهُ، وَلَا حُكْمَ إلَّا مَا حَكَمَ بِهِ، وَلَا شَرْعَ إلَّا مَا شَرَعَهُ, عَلَى هَذَا اتَّفَقَ الْمُسْلِمُوْنَ.-‘‘আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোনো হাকিম (শাসক) নেই। তিনি যা নির্দেশ দিয়েছেন তা ছাড়া আর কারো কোনো নির্দেশ হতে পারে না। তিনি যে বিধান দিয়েছেন তা ছাড়া আর কোনো বিধান হতে পারে না। এ বিষয়ে সকল মুসলিমই একমত।’’

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের খিলাফাত (প্রতিনিধিত্ব)
আল্লাহ তা‘আলার একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব ও আইন রচনার নিরঙ্কুশ অধিকার স্বীকার করে নিলে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আল্লাহ তো মানুষের ধরা ছোঁয়ার উর্ধ্বে, কাজেই পার্থিব রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড পরিচালনা ও যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য কার শরণাপন্ন হওয়া যাবে? এ প্রশ্নের জবাব হল- আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কল্যাণের জন্য সকল আইন-কানূন আল-কুর’আনের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট প্রেরণ করেছেন, সেই জীবন বিধানকে বিজয়ী ব্যবস্থা হিসেবে মানুষের জীবন ও যমীনে প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই আল-কুর’আনের অনুশাসন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য লোকায়িত শাসনের প্রয়োজন অবশ্যাম্ভাবী।
এ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমাত কায়িম করার জন্য মানুষ হচ্ছে তাঁর খালীফা (প্রতিনিধি)। আর আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত এ প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা লাভ করেই মানুষ সমগ্র জীব জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসন অধিকার করেছে। আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে সম্বোধন করে বলেছেন, هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ -‘‘সেই মহান আল্লাহই তোমাদেরকে পৃথিবীতে তাঁর খালীফা নিযুক্ত করেছেন।’’ বস্ত্তত এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এক মহা দায়িত্ব ও পবিত্র আমানত। তিনি এ দায়িত্ব যোগ্য, সৎ ও আল্লাহভীরুদের হাতে অর্পণ করে থাকেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেছেন, وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ-‘‘ আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ, রাসূল এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং সে অনুযায়ী সৎ কাজ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি পৃথিবীর খিলাফাতের দায়িত্বভার অর্পণ করবেন যেমন তিনি তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে তাঁর খালীফা নিযুক্ত করেছিলেন।’’ অন্য এক আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, ثُمَّ جَعَلْنَاكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ مِنْ بَعْدِهِمْ لِنَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ -‘‘সেই লোকদের পরে আমরা তোমাদেরকেই পৃথিবীতে খালীফা বানিয়েছি। তোমরা কি রকম কাজ কর তা প্রত্যক্ষ করাই এর মূল উদ্দেশ্য।’’
উপর্যুক্ত আয়াতগুলো থেকে দুটি কথা স্পষ্টভাবে অবগত হওয়া যায়।
এক. মানুষের মর্যাদা হচ্ছে ‘খিলাফাতের’ [প্রতিনিধিত্বের]; ‘সার্বভৌমত্বের’ নয়। কোনো রাষ্ট্র যদি স্বীকার করে নেয় যে, আল্লাহ তা‘আলার হুকমই চূড়ান্ত ও অকাট্য বিধান, শাসন বিভাগ এর পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারবে না, আইন পরিষদ এর পরিপন্থী কোনো বিধান রচনা করতে পারবে না এবং তার বিচার বিভাগও এর পরিপন্থী কোনো রায় দিতে পারবে না, তা হলেই এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়ায়, সে আল্লাহর বিপরীতে সার্বভৌমত্বের দায়িত্ব থেকে বিরত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় মূলত আল্লাহ তা‘আলার প্রতিনিধির মর্যাদা গ্রহণ করে নিয়েছে।
দুই. খিলাফাতের বাহক কোনো ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র বা শ্রেণী হবে না; বরং সকল ঈমানদারই আল্লাহ তা‘আলার খালীফা বা প্রতিনিধি। কিন্তু যেহেতু সর্বসাধারণ মানুষ সকলেই একত্রে ও একই সাথে খিলাফাতের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পরিচালনার যোগ্য হয় না এবং আলাদাভাবেও প্রত্যেক ব্যক্তিই এই কার্য সমাধা করতে পারে না, সে জন্য খিলাফাত পরিচালনার দায়িত্ব সবার পক্ষ থেকে নির্বাচিত খালীফাদের ওপরই ন্যস্ত করা হয়। খিলাফাতে ইলাহিয়্যাহ বা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন একজন নির্বাচিত আমীর। তিনি জনগণের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার পরিচালক হবেন। তিনি সার্বভৌম আল্লাহর আইনকে তাঁর প্রকৃত লক্ষ্য অনুযায়ী কার্যকর করবেন এবং তাঁর নির্দেশিত পথে রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচালনা করবেন।
বস্ত্তত আমীর ইসলামের সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। যাবতীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্মে আমীরের ওপর একান্তভাবে নির্ভর ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আমীর নিজে ব্যক্তিগতভাবে যতদিন পর্যন্ত আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজকে যতদিন পর্যন্ত ইসলামী বিধান অনুসারে পরিচালনা করতে থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত জনগণকে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ। তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ -‘‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্য থেকে আমীরের আনুগত্য কর।’’ যে মাত্র তিনিও আল্লাহর কোনো বিধান লঙ্ঘন করবেন, তা হলে তার ওপরেও আল্লাহর আইন কার্যকর হবে এবং সে ক্ষেত্রে জনগণকে তাঁর আনুগত্য করতে হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, لا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ.-‘‘স্রষ্টার বিধান অমান্য করে কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।’’ لَا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةِ اللَّهِ إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ-‘‘আল্লাহর নাফরমানী করে কারো কোনো ধরনের আনুগত্য করা যাবে না। আনুগত্য করতে হবে কেবল মা‘রূফ অর্থাৎ বৈধ ও সৎ কাজে। ’’ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ-‘‘মুসলিম ব্যক্তিকে সব সময় আদেশ শ্রবণ ও অনুসরণ করে চলতে হবে, চাই সাগ্রহেই হোক, কিংবা বাধ্য হয়ে- যতক্ষণ না তাকে কোনো পাপ কাজের আদেশ করা হয়। কিন্তু কোনো পাপ কাজের হুকম দেয়া হলে তা কোনোভাবে শুনাও যাবে না, মানাও যাবে না।’’
এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়ার অর্থ হবে যাদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের দায়িত্ব তাঁরা হবেন আল্লাহর বিধানের অধীন। তাঁরা পৃথিবীতে আল্লাহর নির্দেশ মাফিক কাজ করবেন। অর্থাৎ মানুষ [ জনগণজনপ্রতিনিধি আমীর] যে অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা অসীমও নয়, নয় নিরঙ্কুশ; বরং তা আল্লাহর অশেষ অসীম, সর্বাত্মক সার্বভৌমত্বের অধীন, তাঁরই দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়িত হচ্ছে ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য দেয়া তাঁরই শারী‘আতের মাধ্যমে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, মানুষের ক্ষমতা হচ্ছে প্রয়োগের, বাস্তবায়নের এবং কার্যকরকরণের। এ শক্তি অসীমও নয়, জন্মগতও নয়, নয় নিজস্ব অর্জিত কিছু। কাজেই সেই ক্ষমতা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। পারে না আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোনো কাজে তা প্রয়োগ করতে।
যুগে যুগে নাবী-রাসূলগণ এসেছেন আল্লাহর সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠার জন্যই। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল আল্লাহর। নাবী-রাসূলগণ ছিলেন সে আইনের বাস্তবায়নকারী। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে উদ্দেশ্য করে বলেন,إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ وَكَفَى بِرَبِّكَ وَكِيلًا -‘‘(হে নাবী), আমার বান্দাহদের ওপর তোমার কোনো আধিপত্য নেই। তোমার রাবেবর আধিপত্যই যথেষ্ট।’’
মাদীনা রাষ্ট্রের প্রশাসনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রয়োগকারী ছিলেন। আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বে আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে তিনি ছিলেন মাদীনা রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বস্ত্তত মাদীনা রাষ্ট্রে আল্লাহ তা‘আলা ছিলেন সার্বভৌমত্বের অধিকারী আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কার্যত বাস্তবায়নের অধিকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ -‘‘ (হে নাবী,) পূর্ণ সত্যতার সাথে আমরা এ কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে করে আল্লাহর দেখানো সত্যালোকের মাধ্যমে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করতে পার।’’ وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ -‘‘ আর আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী তুমি তাদের মাঝে ফায়সালা কর। তাদের ইচ্ছা বাসনার অনুসরণ করো না। সাবধান থেকো, তারা যেন তোমাাকে ফিতনায় নিমজ্জিত করে আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান থেকে এক বিন্দুও বিভ্রান্ত করতে না পারে।’’ قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ -‘‘(হে নাবী), বলে দাও, আমি এ কিতাবকে নিজের তরফ থেকে বদলাবার অধিকারী নই। আমি তো কেবল সেই ওহীরই আনুগত্য করি, যা আমার প্রতি নাযিল করা হয়। আমি যদি আমার প্রভুর অবাধ্য হই, তা হলে আমার কঠিন দিন সম্পর্কে ভয় হয়।’’
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনগত সার্বভৌমত্ব এবং কার্যত সার্বভৌমত্বের মধ্যে পার্থক্য মাঝে মাঝে দেখানো হয়। তবে এটা স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন যে, ইসলামের দৃষ্টিতে সার্বভৌমত্বের এ দু দিক বা রূপ দুটি ভিন্ন বস্ত্ত নয়। এটি যেন ছবির দুটি দিক, যেন এপিঠ ওপিঠ এবং এ দুয়ের সমন্বয়েই ইসলামী সার্বভৌমত্বের আসল রূপ ফুটে ওঠে।
ইসলামে আইনগত সার্বভৌম আল্লাহ এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান রাষ্ট্রের চূড়ান্ত নির্দেশ বা আইনের আকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইন দেশের বিচারালয়ে স্বীকৃত হয়ে কার্যকর হয়। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রশাসনের সবাই আল্লাহর আইনের অধীন। রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহর আইনের বরখেলাফ কিছু করলে বিচারালয় তাকে যে কোনো শাস্তি দিতে পারে। বিচারক আল্লাহর আইনের প্রতিনিধি হিসেবেই বিচার করবেন। বস্ত্তত এটাই আইনের শাসন, যা একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং মানুষ মূলত আল্লাহর বিধানকে বাস্তবায়িত করণের কার্যই সম্পাদন করবেন। সার্বভৌম আল্লাহর আইনকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করে রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনকল্যাণকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবর্তমানে ঈমানদার ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিলে রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হবে তাঁরই বিধানসমূহ বাস্তবে কার্যকর করা। অন্য কথায় এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হবে আল্লাহর বিধানকে কার্যকর করণের যন্ত্রমাত্র। এ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হবে আল্লাহর। আল্লাহর এ সর্বোচ্চ ক্ষমতা ইসলামী শারী‘আহর প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়েই বিমূর্ত হয়ে ওঠে।
মানুষ যদি আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোনো আইন প্রণয়ন করে বা তার বিপরীত কোনো ফরমান বা অর্ডিন্যান্স জারি করে অথবা জাতির প্রতিনিধি রাষ্ট্রপ্রধান তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা হলে এ অবস্থাসমূহে কাজটি শারী‘আতের সানাদবিহীন বলে গণ্য হবে এবং তাদের ইখতিয়ার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে তা বাতিল হয়ে যাবে। কেননা মানুষের ক্ষমতা হলো প্রয়োগের ও বাস্তবায়নের। তার ক্ষমতার সীমানা হচ্ছে আল্লাহর শারী‘আতকে কার্যকর করার মধ্যে, কোনো নতুন শারী‘আত বা শারী‘আত বিরোধী আইন রচনা করে তা জারি করার মূলগতভাবেই তার কোনো অধিকার নেই।

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও মানুষের স্বাধীনতা
কেউ এ আপত্তি তুলতে পারে, আল্লাহ তা‘আলাকে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী মেনে নেয়ার অর্থই হলো তিনি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও আত্মার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এর জবাব হলো, আল্লাহ তা‘আলা যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নিজের হাতে রেখেছেন, সেটা মানুষের স্বাভাবিক ও জন্মগত স্বাধীনতা হরণ করবার জন্য নয়; বরং তা রক্ষা করার জন্যই রেখেছেন। মানুষকে বিপথগামী হওয়া ও নিজের পায়ে কুড়াল মারা থেকে রেহাই দেয়াই এর উদ্দেশ্য। পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র সম্পর্কে দাবী করা হয় যে, তাতে গণসার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু উক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে এই দাবীর সারবত্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। যে জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে একটা রাষ্ট্র গড়ে ওঠে, তারা সবাই স্বয়ং আইন প্রণয়নও করে না, তা কার্যকরও করে না। কতিপয় নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তারা বাধ্য হয়, যাতে ঐ ব্যক্তিবর্গ তাদের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, এ সকল ব্যক্তি জনগণের উপকারার্থে নয়; বরং নিজেদের ব্যক্তিগত, দলীয় ও শ্রেণীগত স্বার্থের তাকিদেও অনেক সময় আইন রচনা করে। অতঃপর জনগণের দেয়া ক্ষমতা বলেই এ সব গণবিরোধী আইন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। এভাবে কোন এক পর্যায়ে পৌঁছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতিপয় নির্দিষ্ট ব্যক্তির স্বেচ্ছাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে।
যদিও মেনে নেয়া হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ইচ্ছানুসারে আইন প্রণীত হয়ে থাকে, তথাপি অভিজ্ঞতা থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সাধারণ জনগণ নিজেরা নিজেদের ভাল-মন্দ পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম নয়। মানুষের এটা স্বাভাবিক দুর্বলতা যে, নিজের জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবতার কিছু দিক সে উপলব্ধি করতে পারে এবং কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। এজন্য তার সিদ্ধান্ত সাধারণত একপেশে হয়ে থাকে। ভাবাবেগ ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা তার ওপর কখনো এতো প্রবল হয়ে ওঠে যে, সে সম্পূর্ণ নির্ভেজাল জ্ঞানগত ও যুক্তিসঙ্গত উপায়ে নির্ভুল ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত ও মতামত খুব কমই গ্রহণ করতে পারে। এর প্রমাণ হিসেবে বহু উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে দীর্ঘ সূত্রিতা এড়ানোর জন্য আমেরিকার মদ নিষিদ্ধকরণ আইনের উদাহরণটি তুলে ধরছি। যুক্তি, বুদ্ধি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, মদ্যপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এবং মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিগুলোর ওপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। এ তথ্যের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের জোরেই যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারী মাসে শাসনতন্ত্রের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে মদকে অবৈধ ঘোষণা করে আইন পাশ করা হয়; আবার ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে শাসনতন্ত্রের ২১তম সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্ববতী আইন বাতিল করে মদকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। যে জনতার রায়ে মদকে একসময় হারাম করা হয়েছিল, তাদের রায়েই পুনরায় তাকে হালাল করা হলো। মদকে হারাম থেকে হালাল করার কারণ এই ছিল না যে, তাত্ত্বিক ও যৌক্তিকভাবে মদ খাওয়া উপকারী সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল; বরং এর একমাত্র কারণ এই ছিল যে, জনগণ তাদের জাহিলী প্রবৃত্তির লালসার গোলামে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের সার্বভৌমত্বকে নিজ নিজ প্রবৃত্তির কাছে সমর্পন করেছিল, আপন কামনা-বাসনাকে নিজেদের খোদা বানিয়ে নিয়েছিল এবং এই খোদার গোলামী করতে গিয়ে তারা যে আইনকে একদিন তাত্ত্বিক ও যৌক্তিকভাবে সঠিক মনে করেছিল, তাকে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়ে গিয়েছিল। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মানুষ তার নিজের জন্য আইন প্রণেতা (Legislature) হবার পুরোপুরি যোগ্যতা রাখে না। সে অন্যান্য প্রভুর গোলামী থেকে রেহাই পেলেও নিজের অবৈধ খায়েশের গোলাম হয়ে যাবে এবং নিজ প্রবৃত্তির পরিচালক শায়তানকে খোদা বানিয়ে নেবে। এ সব লোকদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا . أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا . -‘‘তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে খোদা (অর্থাৎ উপাস্য) বানিয়ে নিয়েছে। তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশই শোনে অথবা বুঝে? তারা তো চতুষ্পদ জন্তুর মতোই; বরং আরো পথভ্রান্ত।’’ فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ. -‘‘অতঃপর তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তবে জেনে নাও যে, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তিরই গোলামী করছে। আর যে আল্লাহর হিদায়াতের পরিবর্তে নিজ প্রবৃত্তির গোলামী করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না।’’ সুতরাং মানুষের নিজ স্বার্থেই তার স্বাধীনতার ওপর যুক্তিসঙ্গত সীমারেখা ও বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। এগুলোকে ইসলামের পরিভাষায় ‘হুদূদুল্লাহ’ (আল্লাহর সীমারেখা) বলা হয়। জীবনের প্রত্যেক বিভাগে কতিপয় মূলনীতি, বিধি ও অকাট্য নির্দেশাবলীর সমন্বয়ে রচিত এই বিধি-নিষেধ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ভারসাম্য ও সুষমতা বজায় রাখার জন্য আরোপ করা হয়েছে। এগুলো দ্বারা মানুষের স্বাধীনতার সীমা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে এবং বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই সীমারেখার মধ্যে থেকে তোমরা নিজেদের আচরণের জন্য প্রাসঙ্গিক বিধি প্রণয়ন করে নিতে পার। কিন্তু তোমাদের এই সীমা লঙ্ঘন করার অনুমতি নেই। এই সীমা অতিক্রম করলে তোমাদের জীবন বিপর্যয় ও বিকৃতির শিকার হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ-‘‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে, সে নিশ্চয় নিজেরই অনিষ্ট করে।’’
উদাহরণস্বরূপ মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের কথাই ধরা যাক। এতে আল্লাহ তা‘আলা ব্যক্তি মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করে, যাকাতকে ফারয করে, সূদকে হারাম করে, জুয়াকে নিষিদ্ধ করে, উত্তরাধিকার আইন জারি করে এবং সম্পদ উপার্জন, সঞ্চয় ও ব্যয় করার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে কয়েকটি সীমারেখা চিহ্নিত করে দিয়েছেন। মানুষ যদি এ সীমারেখাগুলো ঠিক রাখে এবং এগুলোর আওতাধীন থেকে লেনদেন ও কায়কারবার সংঘঠিত করে, তা হলে একদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতাও বহাল থাকবে, অপরদিকে শ্রেণীসংগ্রাম এবং একশ্রেণীর ওপর অন্য শ্রেণীর আধিপত্যের সেই পরিবেশও সৃষ্টি হতে পারে না, যা শোষণ-নিপীড়নমূলক পুঁজিবাদ থেকে শুরু হয়ে শ্রমিকদের একনায়কত্বে গিয়ে সমাপ্ত হয়।
অতএব, এ ক্ষেত্রে এ কথা খুব জোরালোভাবে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা এমন একটি স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় সংবিধান মানুষকে দিয়েছেন, যা তার স্বাধীনতার প্রাণশক্তিকে এবং তার চিন্তাশক্তি ও বোধশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় না; বরং তার জন্য একটা সুস্পষ্ট ও নির্ভুল সোজা পথ দেখিয়ে দেয়, যাতে সে নিজের অজ্ঞতা ও দুর্বলতাবশত পথভ্রষ্ট হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত না হয়। তার শক্তি ও প্রতিভাগুলো ভুল পথে অপব্যয় ও অপচয়ের শিকার হয়ে বিনষ্ট না হয়; বরং সে যেন নিজের সত্যিকার কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে সোজাসুজিভাবে এগিয়ে যেতে পারে।
আধুনিক গণতন্ত্র ও ইসলামে সার্বভৌমত্বের ধারণাঃ একটি তুলনা
1. জনগণ বনাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
আধুনিক গণতন্ত্রে গণমতের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় এবং পরিবর্তিত হয়; ইসলামও তা-ই দাবী করে। কিন্তু এতদুভয়ের মধ্যে মেŠলিক পার্থক্য এই যে, আধুনিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্র সীমাহীন ও নিরঙ্কুশ শক্তির মালিক। এখানে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ কিংবা জনগণের পক্ষে সরকার। অর্থাৎ মানুষই সর্বেসর্বা। মানুষই সকল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো শক্তির কর্তৃত্ব মেনে নেয়া এবং তার নিকট জবাব দেবার চেতনা এখানে অবর্তমান। আল্লাহ তা‘আলা আছেন- এ কথা স্বীকার করে নিতে গণতন্ত্রে যদিও বাঁধা নেই; তবে গণতন্ত্রের মূল চেতনা হল- যদি তিনি থাকেন, তা হলে তিনি আসমানেই থাকবেন। এই যমীনের মানুষের ওপর তাঁর কোন কর্তৃত্ব চলবে না।
পক্ষান্তরে ইসলামের গণতান্ত্রিক খিলাফাত আল্লাহ তা‘আলার আইনের অনুসরণ করতে বাধ্য। এখানে সার্বভৌম ক্ষমতার নিরঙ্কুশ মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। কোনো ব্যক্তি, জনগণ বা সরকার এ ক্ষমতায় সামান্যতমও অংশীদার নয়। ইসলামী শাসন মূলত নিরঙ্কুশ খোদায়ী শাসন। মানুষ আল্লাহ তা‘আলার খালীফা হিসেবে তাঁর বিধি-বিধানগুলোকে বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল মাত্র। অতএব, ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যে এ মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান থাকতে ইসলামী রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্য পরিভাষা অনুসারে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ বলা সমীচীন নয়।
2. আইনপ্রণয়ণ কর্তৃপক্ষ
পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে আইনসভাই হল আইনগত সার্বভৌম। তাই আইনসভার সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে কোনো আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করতে পারেন। এখানে সাধারণত সংখ্যাগুরুর মতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়; লোকদের গুণের বিচার করা হয় না। যেমন কোনো দিকে যদি একান্ন ভোট পড়ে এবং এই ভোটারদের সকলেই মূর্খ, স্বার্থপর ও মূল বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ হয়; তবুও তাদের মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপর পক্ষে অন্য দিকে যদি এক ভোট কম অর্থাৎ ঊনপঞ্চাশ ভোট পড়ে এবং ভোটারদের সকলেই মূল বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানকারী হয়ে থাকে; তবুও তাদের মতামতের কোনো মূল্য দেয়া হবে না। এ কারণেই মহাকবি ইকবাল বলেছিলেন, ‘‘গণতন্ত্র এমন এক শাসন ব্যবস্থা, যেখানে বান্দাহদের গণনা করা হয়; ওযন করা হয় না।’’
পক্ষান্তরে ইসলামে আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র সার্বভৌম। এখানে মানুষের আইন প্রণয়নের অধিকার নেই। আইন প্রণয়নের একমাত্র অধিকারী হলেন আল্লাহ তা‘তালা। তবে শারী‘আতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই- এ ধরনের বহুবিধ শাসনতান্ত্রিক সমস্যায় ও সামাজিক জীবনের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনাদির সাথে সংশ্লিষ্ট খুuঁটনাটি বিষয়ে ইসলামের মৌল নীতিমালার ভিত্তিতে শারী‘আতের প্রাণসত্তার সাথে সামঞ্জস্যশীল আইন প্রণয়নের অধিকার ইসলাম মানুষকে দান করেছে। ইসলামের এ গতিশীল ব্যবস্থাটির নাম হলো ইজতিহাদ। বিকাশমান নিত্য-নতুন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত নতুন নতুন প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে ইজতিহাদের মাধ্যমে মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তা ছাড়া আইনসমূহকে শ্রেণীবদ্ধভাবে শাসনতান্ত্রিক রূপদান ও কার্যকর করার ব্যবস্থা নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রীয় সংকট ও এর ছোট-খাট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। এ ব্যাপারে মাজলিসে শূরার সদস্যগণ ইসলামের মৌলিক নীতি ও উদ্দেশ্যাবলীকে সামনে রেখে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
তবে যে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে তাতে তাঁদের বক্তব্যকেই চূড়ান্ত আইন হিসেবে মেনে নিতে হয়। মাজলিসে শূরার কোন সদস্যই আল্লাহর কুর’আন ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাতের বিপরীত কোনো মত প্রকাশ করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে না। যেমন ইসলামে মদসহ তামাম নেশার বস্ত্ত যে হারাম- এ ব্যাপারে শূরার সদস্যদের দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। তবে হ্যাঁ, দ্বিমত হতে পারে, আইনের প্রয়োগ নিয়ে এবং তার ওপরেই আলোচনা হবে, এমনকি এ নিয়ে ভোটাভোটিও হতে পারে। যিনি ভাল টেকনিক উপস্থাপন করতে পারবেন, তাঁরটাই গ্রহণ করা হবে। তদুপরি যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না, সে সকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ লোকদের অভিমতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।

3. জনগণের ইচ্ছা বনাম আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ
পাশ্চাত্য গণতন্ত্রে যেহেতু জনগণের সাধারণ ইচ্ছাই হল প্রকৃত সার্বভৌম, তাই সেখানে নির্দিষ্ট কোনো আদর্শিক মানদন্ড থাকে না। জনগণের ইচ্ছাই হল ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি। আর জনগণের ইচ্ছা যেহেতু পরিবর্তনশীল, তাই গণতন্ত্র কোনোভাবেই স্থায়ী ও সুদৃঢ় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; বরং এতে সুবিধাবাদ ও বহুরূপীভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে গণতন্ত্রকে একটি আদর্শহীন নীতি-নিরেপক্ষ শাসনব্যবস্থাও বলা হয়। যেমন মদ্যপান যুক্তি, বুদ্ধি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একটি নিন্দিত কাজ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের জোরেই যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারী মাসে শাসনতন্ত্রের ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে মদকে অবৈধ ঘোষণা করে আইন পাশ করা হয়; আবার ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে শাসনতন্ত্রের ২১তম সংশোধনীর মাধ্যমে পূর্ববতী আইন বাতিল করে মদকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। তদ্রূপ জাতিসংঘের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন শীর্ষক কায়রো সম্মেলনের উদ্যোক্তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের জোরেই সমকামিতা, বহুগামিতা, গর্ভপাত ও অবৈধ যৌনাচারের মতো অতিশয় বিভৎস কুকর্মগুলোকে বৈধতা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইসলামী ও ভ্যাটিকানের ধর্মীয় পক্ষের সফল প্রতিরোধ ও দৃঢ় অবস্থানের কারণে তা পুরো সফল হয়নি; তবে ব্রিটেন, আমিরেকাসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মতামতের জোরে এ সমস্ত জঘন্য অপরাধগুলোকে আইন করে সিদ্ধ করা হয়েছে। তদুপরি গণতন্ত্রে নীতিগতভাবে রাষ্ট্রের সকল জনগণের ইচ্ছার কর্তৃত্বের কথা বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রের সকল জনগণের ইচ্ছার কর্তৃত্বের কোনো অস্তিত্বই বর্তমান নেই। এটি একটি কল্পনা মাত্র। এর নামে দলীয় ইচ্ছার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব চলতে থাকে। জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন এতে খুব একটা দেখা যায় না। তা ছাড়া গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্তে সংখ্যালঘুকে দারুন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ কারণেই রাজনীতি বিজ্ঞানে ‘‘tyranny of the majority’’ প্রত্যয়টি বিশেষভাবে প্রচলিত হয়ে আসছে।
পক্ষান্তরে ইসলামে রাষ্ট্র এক সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী নীতির ওপর চালিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রদত্ত নিয়ম-নীতি, নৈতিক বিধি-বিধান ও নির্দেশাবলী দ্বারা জনগণের ইচ্ছাবাসনার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার সিদ্ধান্ত ভোটের মাধ্যমে হতে পারে না। এ সব শাশ্বত মূল্যবোধের ব্যাপার। এ সবে পরিবর্তন সাধনের ইখতিয়ার কারো নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا.-‘‘ যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো ফায়সালা দেবে, তাতে কোনো মু’মিন নর-নারীর জন্য এ ইখতিয়ার নেই যে, সে তা লঙ্গন করবে। আর যে এ রূপ করবে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হবে।’’ তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সরকার গঠন ও পরিচালনা জনগণের রায় অনুযায়ী হতে হবে- এ নীতিতে গণতন্ত্রের সাথে ইসলাম একমত। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণ লাগামহীন ও স্বেচ্ছাচারী নয়। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, মানুষের জীবন-যাপনের মূলনীতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি সবকিছুই জনগণের ইচ্ছানুযায়ী হতে হবে এমন নয়। এমনও হতে পারে না যে, যে দিকে জনগণ ঝুuঁক পড়বে ইসলামী রাষ্ট্রও সে দিকেই কাত হয়ে পড়বে।
পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সর্বতোভাবে সেক্যুলারিজমের সাথে জড়িত। এখানে রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি কোন ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে আগ্রহী হয় তবে সে তা অনায়াসেই করতে পারে। কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মানুষ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। এ সকল ক্ষেত্রে মানুষ নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও ইচ্ছা-আকাঙ্খা ও প্রচলিত প্রথা অথবা মানব রচিত আইন অনুসারে কাজ করতে বাধ্য হয়।
অপরদিকে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এখানে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞান সম্মত সমাধান রয়েছে। তাই ইসলামে দীন ও রাষ্ট্র একই সূত্রে গ্রথিত। রাষ্ট্র থেকে দীনকে এবং দীন থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো সুযোগ নেই। যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আবূ বাকর (রা.)-এর যুদ্ধ ঘোষণা থেকে জানা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি মুসলিম নাগরিক ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনেও ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য। বিশ্ববরেণ্য মুসলিম দার্শনিক কবি ইকবাল বলেন, ধর্ম ও রাষ্ট্র দেহ ও আত্মার সমতুল্য। এদের পারস্পরিক নিবিড় সংযোগ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরিহার্য আর এদের পারস্পরিক বিরোধ বিচ্ছেদের নিশ্চিত পরিণতি ধ্বংস। তিনি ধর্মহীন রাজনীতিকে ‘ভুতের কন্যা’ ও ‘পঙ্কিল মনোবৃত্তি’র পরিচায়ক বলে উল্লেখ করেছেন।

গণতন্ত্রের ইসলামী রূপ
গণতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের ধারণাটি কোনো মুসলিম নীতিগতভাবে মেনে নিতে পারে না। যদি কোনো মুসলিম এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, জনগণই নিরঙ্কুশ ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং আল্লাহ তা‘আলার দেয়া আইনের পরিবর্তে মানব রচিত আইনই বর্তমান সময়োপযোগী এবং অধিক কল্যাণকর, তা হলে সে আর মুসলিম থাকবে না। তবে পারিভাষিক ও তাত্ত্বিক অর্থে গণতন্ত্র বলতে যা বুঝায় (অর্থাৎ জনসাধারণের এবং জনসাধারণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকারের কর্তৃত্ব) তার সাথে ইসলামের বড় ধরনের মিল আমরা খুuঁজ পাই। গণতন্ত্রের মানে কখনো এ নয় যে, একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে নাস্তিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। তার মানে এও নয় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সংবিধানে রাষ্ট্রের বিবেচনা অনুযায়ী কিছু স্থায়ী মৌলিক নীতিমালা সন্নিবেশ করা যেতে পারবে না। পাশ্চাত্যে প্রচলিত গণতন্ত্রেও নীতিগতভাবে কিংবা প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু নিয়ম-নীতি আছে যেগুলোর ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই বা যেগুলো পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। গণতন্ত্রের অনেক প্রবক্তা জোর দিয়ে বলেন যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তিকেই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করতে এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না। অনেকে এমনও বিশ্বাস করেন যে, কম্যুনিষ্ট পার্টির আদর্শ, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীর প্রকৃতি যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কার্যকারণের সাথে সংঘাতময়, তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তার অস্তিত্বকে বৈধ হিসেবে স্বীকার করা উচিত নয়।
অতএব যে দেশের জনসাধারণের অধিকাংশই মুসলিম হয়, যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং শারী‘আতের আইন প্রবর্তনকে বাধ্যতামূলক দীনী কর্তব্য বলে বিশ্বাস করে, তা হলে তাদের গণতন্ত্র চর্চাও আল্লাহ তা‘আলার বিধানসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত রেখেই ইজতিহাদের ব্যাপক ক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হবে। মুসলিমদের গণতন্ত্র হবে আল্লাহ তা‘আলাকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মেনে নিয়ে শাসন ব্যবস্থাকে খিলাফাতের ধারণার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করা। স্বাধীন জনমতের ভিত্তিতেই সরকার গঠিত হবে এবং সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম পরামর্শক্রমেই চলতে থাকবে। আর এ জন্য যুগোপযোগী ও কল্যাণকর যে কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে। পাশ্চাত্য জগতে ধর্মকে গণতন্ত্র থেকে পৃথক করার কারণে কোনো কোনো ইসলামপন্থীর মনে এই চিন্তার সৃষ্টি হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। এ ধরনের চিন্তাধারার পেছনে যে বিশ্বাস কাজ করেছে তা হচ্ছেঃ দুটি পদ্ধতির মাঝে মৌলিক ও আদর্শগত পার্থক্য দেখা দিলে এদের একটিকে গ্রহণ করে অন্যটি থেকে দূরে থাকার জন্য তাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে হবে। অথচ ইসলাম সব সময় নিজ আদর্শের বিশুদ্ধতা ও যোগ্যতার সাথে সাথে কোনো কোনো মানবীয় অভিজ্ঞতা, যা ইসলামী শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাকে নিজের কাঠামোর মধ্যে গ্রহণ করেছে।
উপসংহার
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলামে জনগণের সার্বভৌমত্ব নয়; জনগণের প্রতিনিধিত্বই কাম্য। কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা দল বা শ্রেণীর একচেটিয়া শাসন ক্ষমতা ইসলাম সমর্থন করে না। আধুনিক গণতন্ত্র জনগণের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের যে নীতি পেশ করেছে, তা বাস্তবতার দিক থেকেও ভ্রান্ত, পরিণামের দিক দিয়েও অত্যন্ত মারাত্মক। প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র তিনিই, যিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রতিপালন ও পরিবর্ধনের উপায়-উপকরণ সরবরাহ করেছেন, যার ইচ্ছায় মানব জাতির ও সমগ্র সৃষ্টি জগতের অস্তিত্ব বিদ্যমান এবং যার শক্তিশালী আইনের বন্ধনে সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্ত্ত আবদ্ধ। তাঁর বাস্তব ও প্রকৃত সার্বভৌমত্বের অধীনে যে সার্বভৌমত্বের দাবী করা হোক না কেন তা নিছক বিভ্রান্তি বৈ অন্য কিছু নয়। এ বিভ্রান্তির আঘাত প্রকৃত সার্বভৌমের গায়ে লাগবে না; বরঞ্চ লাগবে সে নির্বোধ সার্বভৌমত্বের দাবীদারের ওপর, যে তার আপন মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ।
বস্ত্তত আল্লাহ তা‘আলাকে সার্বভৌম মেনে নিয়ে মানব জীবনের শাসন ব্যবস্থা খিলাফাতের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ খিলাফাত নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক হতে হবে। স্বাধীন জনমতের ভিত্তিতেই সরকার প্রধানের নির্বাচন হতে হবে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই শূরা বা পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হবেন। তাঁদের পরামর্শক্রমেই সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম চলতে থাকবে। কিন্তু এসব কিছু এ অনুভূতি নিয়েই করতে হবে যে, দেশ আল্লাহ তা‘আলার। আমরা মালিক নই; বরং তাঁর প্রতিনিধি। আমাদের প্রতিটি কাজের হিসাব প্রকৃত মালিকের নিকট দিতে হবে। আমাদের শূরা বা পার্লামেন্টের বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি এ হতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলার কুর’আন ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহই হবে সকল আইনের উৎস। যে সব ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার আইনে সুস্পষ্ট হিদায়াত নেই, সে সব ব্যাপারে পার্লামেন্ট বা বৈধ আইনী কর্তৃপক্ষ পরামর্শের ভিত্তিতে আইন রচনা করতে পারবে। কিন্তু এ সব আইন অবশ্যই সেই সামগ্রিক কাঠামোর মেজাজ ও প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে, যা আল্লাহ তা‘আলার মৌলিক হিদায়াত আমাদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে।
وَآَخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
-সমাপ্ত-
গ্রন্থপঞ্জী
আল-কুর’আন
আত-তাফসীর
তাবারী, মুহাম্মাদ, ইবনু জারীর, জামি‘উল বায়ান ‘আন তাভীলিল আ’য়িল কুর’আন, বৈরূতঃ দারুল ফিকর, ১৪০৫হি.
ইবনু কাছীর, আবুল ফিদা’ ইসমা‘ঈল,তাফসীরুল কুর’আনিল ‘আযীম, রিয়াদঃ দারু তাইয়িবাহ, ১৯৯৯
আলূসী, শিহাবুদ্দীন মাহমূদ, রুহুল মা‘আনী
বাগাভী, মুহ্য়ুস্ সুন্নাহ, মা‘আলিমুত তানযীল, রিয়াদঃ দারু তাইয়িবাহ, ১৯৯৭
আল-জাসসাস, আবূ বাকর,আহকামুল কুর’আন, দারুল ফিকর
ইস্পাহানী, হুসায়ন আর-রাগিব, আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল কুর’আন

আল-হাদীস
বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমা‘ঈল,আস-সাহীহ, বৈরূতঃ দারু ইবনি কাছীর, ১৯৮৭
মুসলিম, আস-সাহীহ, বৈরূতঃ দারু ইহয়া’ইত তুরাছিল ‘আরাবী, তা.বি.
আবূ দাউদ, সুলায়মান,আস-সুনান, বৈরূতঃ দারুল ফিকর, তা.বি.
তিরমিযী, আবূ ‘ঈসা মুহাম্মাদ, আল-জামি‘, বৈরূতঃ দারু ইহয়া’ইত তুরাছিল ‘আরাবী, তা.বি.
আহমাদ, ইমাম ইবনু হাম্বাল, আল-মুসনাদ, মিসর, মু’আস্সাসাতু কুরতুবাহ, তা.বি.
ইবনু হিববান, মুহাম্মাদ, আস-সাহীহ,,বৈরূতঃ মু’আস্সাসাতুর রিসালাহ, ১৯৯৩
তাবারানী, আবুল কাসিম, আল-মু‘জামুল কাবীর, মাওসূলঃ মাকতাবাতুয যাহরা, ১৯৮৩
তাবারানী, আদ-দু‘আ
দারা-কুতনী, ‘আলী, আস-সুনান, বৈরূতঃ দারুল মা‘আরিফাহ, ১৯৬৬
বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান
ইবনু আবী শায়বাহ, ‘আবদুল্লাহ, আল-মুছান্নাফ, রিয়াদঃ মাকতাবাতুর রুশদ, ১৪০৯হি.
আবুশ শায়খ ইস্পাহানী, আল-‘আযমাতু
বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদাইন
ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাতুল কুবরা
মানাবী, মুহাম্মাদ ‘আবদুর রা’উফ, ফায়যুল কাদীর
ইবনু হাজার আল-‘আসকালানী, ফাতহুল বারী শারহু সাহীহিল বুখারী
খাত্তাবী, ‘আওনুল মাবূদ ফী শারহি সুনানি আবী দাউদ

আল-ফিকহ ও উসূল
আমিদী, আল-ইহকাম ফী উসূলিল আহকাম, বৈরূতঃ আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৩৮৭ হি.
গাযালী, আল-মুস্তাস্ফা
ইবনু তাইমিয়্যাহ, আহমাদ, মাজমূ‘আতু ফাতাওয়া ইবনি তাইমিয়্যাহ, বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ
ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, ই‘লামুল মুওয়াক্কি‘ঈন
হুসামী, মুসাল্লামুছ ছুবূত
ইবনু হাযম, ‘আলী আয-যাহিরী,আল-মুহাল্লা, দারুল ফিকর
আল-‘আত্তার, হাশিয়াতুল ‘আত্তার ‘আলা শারহিল জালাল আল-মাহাল্লী ‘আলা জাম‘ইল জাওয়ামি‘,
মাওসূ‘আতুল ফিকহিল ইসলামী
সানহুরী, শায়খ ফারজ, দুরূসুন ফী তারিখিল ফিকহি

রাজনীতি বিজ্ঞান ও বিবিধ
দেহলভী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, দেওবন্দ, ১৯৮৭,
মাওদূদী, সাইয়েদ আবুল আ‘লা, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, ঢাকাঃ শতাব্দী প্রকাশনী, ১৯৯৭
আয়েশ উদ্দীন, রাষ্ট্রচিন্তা পরিচিতি, ঢাকাঃ আইডিয়াল লাইব্রেরী, ১৯৭৬
এমাজ উদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, ঢাকাঃ বাংলাদেশ বুক করপোরেশন লিঃ, ২০০৭
মাকসুদুর রহমান, ড. মোঃ, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা, রাজশাহীঃ বুক্স প্যাভিলিয়ন, ২০০৩
Appadorai, The Substance of Politics, NewYork : Oxford University Press, 1956
Cole, G.D.H., Rousseau`s Social contract and Discourses, London : Everyman`s Library, 1913
Gilchirst, R.N.,Principles of Political Science, Madras: Oreint Longmans, 1962
Lasky, H.J., A grammer of Politics, London : George Allen & Unwin Ltd., 1967
Lipson, L., Great Issues of Politics, NewYork : Prentice Hall INC, 1954
Machiavelli, The prince and the discourses, New York: The Modern Library, 1950
Murphy, J.S. Political Theory : A conceptual Analysis, Ontario: The Dorsey Press, 1968
International Encyclopedia of Social Sciences
Stanford Encyclopedia of Philosophy (Article: Soverignty)
..., আস-সিয়াদাতু ফিল ইসলাম
..., মু‘জামুল কানূন
..., কাওয়া‘ইদু নিযামিল হুকমি ফিল ইসলাম
..., আদ-দাওলাতু ওয়াস সিয়াদাতু ফিল ফিকহিল ইসলামী
..., আল-ইসলাম ওয়াল কানূনুদ দাওলী
নুরুদ্দীন, আবূ সাঈদ, মহাকবি ইকবাল, ঢাকাঃ আল্লামা ইকবাল সংসদ, ১৯৯৬
নরেন বিশ্বাস, বাংলা উচ্চারণ অভিধান, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী, ২০০৩
শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ, ইসলামী গণতন্ত্রের রূপরেখা, ঢাকাঃ প্রফেসর পাবলিকেশন্স, ২০০৫
মাসিক পৃথিবী, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা, বর্ষ-৬, সংখ্যা-৫, ১৯৮৭ ও বর্ষ-৮, সংখ্যা-১২, ১৯৮৯

 

--০--

 

ফুটনোটঃ

. কোনো মানুষ, চাই সে নাবী বা রাসূলই হোন না কেন, স্বতন্ত্রভাবে হুকম দেয়া ও নিষেধ করার একচ্ছত্র অধিকারী নন। নাবী-রাসূলগণ (‘আলাইহিমুস সালাত)ও আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অনুগত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন)إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ -‘‘আমি শুধু ওহীযোগে প্রাপ্ত নির্দেশই মেনে চলি।’’ (আল-কুর’আন,৬ [সূরাতুল আন‘আম]ঃ ৫০) সাধারণ মানুষকে নাবী-রাসূলের আনুগত্য করার নির্দেশ এ জন্য দেয়া হয়েছে যে, তাঁরা নিজেদের হুকম নয়; বরং আল্লাহ তা‘আলার হুকম জারী করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ...-‘‘কোনো মানুষের এ অধিকার নেই যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, কর্তৃত্ব ও নাবুওয়াত দান করবেন আর সে জনগণকে বলবে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও; বরং শুধু এ কথাই বলবে যে, তোমরা আল্লাহর দাস হয়ে যাও।’’(আল-কুর’আন,৩ [সূরা- আলু ‘ইমরান]ঃ ৭৯)
. আস-সিয়াদাতু ফিল ইসলাম, পৃ. ১২৪-১২৯
. সার্বভৌমত্বঃ এটি ‘সার্বভৌম’ শব্দের গুণবাচক বিশেষ্য। ‘সার্বভৌম’ শব্দটি সর্ব ও ভূমি শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এর মূল আভিধানিক অর্থ হল- সমুদয় ভূমির অধীশ্বর (প্রভু)। (নরেন বিশ্বাস, বাংলা উচ্চারণ অভিধান, পৃ. ৪৮৬) এ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে বস্ত্তত আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র সার্বভৌম। তিনি ব্যতীত সমগ্র পৃথিবীর প্রভু ও মালিক বলতে আর কেউ নেই, হতেও পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, إِنَّ الْأَرْضَ لِلَّهِ-‘‘সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র মালিক হলেন আল্লাহ তা‘আলা।’’(আল-কুর’আন,৭ [সূরা- আল-আ‘রাফ]ঃ ১২৮) অন্য আয়াতে তিনি নিজেকে مَالِكَ الْمُلْكِ-‘‘সমস্ত রাজ্যের মালিক’’ নামে অভিহিত করেছেন। (আল-কুর’আন,৩ [সূরা- আলু ‘ইমরান]ঃ ২৬)
. Appadorai, The Substance of Politics, p. 52
. মু‘জামুল কানূন, পৃ. ৬৩৭, কাওয়া‘ইদু নিযামিল হুকমি ফিল ইসলাম, পৃ. ২৪
. আরবীতে السَّيِّدُ শব্দটি মালিক, সার্বভৌম, নৃপতি, শ্রেষ্ঠ ও নেতা প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ সকল অর্থে প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলাই হলেন একমাত্র সাইয়িদ। তাই কোনো কিছুর দিকে সম্বন্ধ করা ছাড়া সাধারণভাবে শব্দটি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা সমীচীন নয়। এ প্রসঙ্গে ‘আল্লামা খাত্তাবী (রাহ.) বলেন, وَلَكِنْ لَا يُقَالُ السَّيِّد عَلَى الْإِطْلَاق مِنْ غَيْر إِضَافَة إِلَّا فِي صِفَة اللَّه تَعَالَى-‘‘ ‘সাইয়িদ’ শব্দটি কোনো কিছুর প্রতি সম্বন্ধ করা ছাড়া সাধারণভাবে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো জন্য ব্যবহার করা যাবে না।’’ ইমাম মালিক (রাহ.)-এর এক বর্ণনা মতে, কাউকে يَا سَيِّدِي বলে ডাকা মাকরূহ। (আল-খাত্তাবী, ‘আওনুল মা‘বূদ, খ.১১,পৃ. ১১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, খ.৮,পৃ.২২) তবে কোনো কিছুর প্রতি সম্বন্ধ করে কিংবা দলনেতা ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অর্থে শব্দটি আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য ব্যবহার করতে কোনো দোষ নেই। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও কোনো কোনো হাদীসে নিজেকে السَّيِّدُ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন, أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا فَخْرَ -‘‘আমি কিয়ামাতের দিন সর্বশ্রেষ্ঠ আদাম সন্তান । এতে আমার কোন গর্ব নেই।’’ (আত্ তিরমিযী, আল-জামি‘, [কিতাবুল মানাকিব], হা.নং: ৩৫৪৮)
. আবূ দাউদ, আস-সুনান, (কিতাবুল আদাব), হা.নং:৪১৭২; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হা.নং: ১৫৭১৭, ১৫৭২৬; নাসা’ঈ, আস-সুনানুল কুবরা, হা.নং:১০০৭৪
. রাষ্ট্রের চারটি মৌলিক উপাদান রয়েছে। এগুলো হল- ১.স্থায়ী জনসমষ্টি, ২.নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড, ৩. সরকার ও ৪. সার্বভৌমত্ব। এ চারটি উপাদানের একত্র সমাবেশ ঘটলেই একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সার্বভৌমত্ব। স্থায়ী জনসমষ্টি, ভূ-খন্ড এবং সরকার থাকলেই রাষ্ট্র হয় না। সার্বভৌম ক্ষমতা না থাকার জন্য কোন রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশগুলো রাষ্ট্র নয়। একই কারণে আশ্রিত রাষ্ট্র বা রাজ্যও পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র নয়।
. ‘কাওয়া‘ইদু নিযামিল হুকমি ফিল ইসলাম ’ গ্রন্থে সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে- "هي السلطة العليا المطلقة التي تفردت وحدها بالحق في إنشاء الخطاب الملزم المتعلق بالحكم على الأشياء والأفعال" (কাওয়া‘ইদু নিযামিল হুকমি ফিল ইসলাম, পৃ. ২৪)
. International Encyclopedia of Social Sciences, voll. 15-17, p. 77.
. এ কারণে এরিস্টটলকে ‘সার্বভৌমত্বের প্রাচীন প্রবক্তা’ বলা হয়। (আয়েশ উদ্দীন, রাষ্ট্রচিন্তা পরিচিতি, পৃ.৩৪)
. আদ-দাওলাতু ওয়াস সিয়াদাতু ফিল ফিকহিল ইসলামী, পৃ.২৩-৫৫; মাকসুদুর রহমান, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা, পৃ. ১৪০
. মাকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০
. Gilchirst, R.N., Principles of Political Science, p.101
. Stanford Encyclopedia of Philosophy (Article: Soverignty) http:// plato. stanford.edu/ entries/ sovereignty/
. Murphy, J.S. Political Theory : A conceptual Analysis,p.133
. Gilchirst, Op. cit, p.138
. মাকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪২
. এর মানে এ নয় যে, মাওলানা মাওদূদী (রাহ.)ই ইসলামী রাজনীতি বিজ্ঞানে সর্বপ্রথম এ চিন্তার প্রবর্তক ছিলেন; বরং ইসলামের সত্যনিষ্ঠ ইমাম ও চিন্তাবিদগণ সকলেই এ বিষয়ে একমত যে, পৃথিবীতে আইনগত কর্তৃত্ব কেবল আল্লাহ তা‘আলার। এর ওপর ইমামগণের ইজমা‘ (ঐকমত্য) সংঘঠিত হয়েছে। (মাওসূ‘আতুল ফিকহিল ইসলামী, খ.১, পৃ.৩) তবে তাঁরা তাuঁদর এ চিন্তার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিভাষা ব্যবহার করেননি। তাঁরা সাধারণত لا حكم إلا من الله (আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো কোনো শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার নেই) অথবা لا حاكم إلا الله (আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কোনো শাসক নেই) দ্বারা তাঁদের উপর্যুক্ত চিন্তা ব্যক্ত করতেন। এ ক্ষেত্রে মাওলানা মাওদূদী (রাহ.)-এর অবদান হল- তিনিই সর্বপ্রথম তাঁদের উপর্যুক্ত চিন্তাকে আধুনিক পরিভাষা ‘সার্বভৌমত্ব’ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন।
. Stanford Encyclopedia of Philosophy (Article: Soverignty); এমাজ উদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা, পৃ.২০৫-৬; মাকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ.১৩৫-১৩৬
. আল-কুর’আন, ৯ (সূরা আত-তাওবাহ)ঃ ৩১
. দেহলভী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, খ.১,পৃ. ২৯৫
. আত্ তিরমিযী, আল-জামি‘, [কিতাবুত তাফসীর], হা.নং: ৩০২০; ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৪,পৃ.১৩৫
. Machiavelli, The prince and the discourses
. আল-কুর’আন, ৭৯ (সূরা আন-নাযি‘আত)ঃ ২৪
. Cole, G.D.H., Rousseau`s Social contract and Discourses, p.20
. Lipson, L., Great Issues of Politics, p. 172
. মকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৮
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ৮৩
. আল-কুর’আন, ২ (সূরা আল-বাকারাহ)ঃ ২৫৫
. আল-কুর’আন, ১৮ (সূরা আল-কাহাফ)ঃ ২৬
. আল-কুর’আন, ১৩ (সূরা আর-রা‘দ)ঃ ৪১
. আল-কুর’আন, ১৮ (সূরা আল-কাহ্ফ)ঃ ২৭
. আল-কুর’আন, ১১২ (সূরা আল-ইখলাস)ঃ ৪
. আল-কুর’আন, ১২ (সূরা ইউসূফ)ঃ ৩৯
. Lasky, A grammer of Politics, p.45-46.
. মকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮
. আল-কুর’আন, ৭ (সূরা আল-আ‘রাফ)ঃ ৫৪
. আল-কুর’আন, ২ (সূরা আল- বাকারাহ)ঃ ১০৭
. আল-কুর’আন, ২৫ (সূরা আল-ফুরকান)ঃ ২
. আল-কুর’আন, ৬৭(সূরা আল-মুলক)ঃ ১
. আল-কুর’আন, ৯৫ (সূরা আত-তীন)ঃ ৮
. আল-কুর’আন, ১১ (সূরা হূদ)ঃ ১০৭; ৮৫ (সূরা আল-বুরূজ)ঃ ১৬
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ১
. আল-কুর’আন, ২১ (সূরা আল-আম্বিয়া)ঃ ২৩
. আর-রাগিব আল-ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাতু ফী গারীবিল কুর’আন, খ.১,পৃ. ১৯
. সানহুরী, ড. ফারয, দুরূসুন ফী তারিখিল ফিকহি
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ৪৫
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ৮৩
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ১৫৪

. আল-কুর’আন, ৪ (সূরা আন-নিসা’)ঃ ১০৫
. আল-কুর’আন ১৬ (সূরা আন-নাহল)ঃ ৩৬
. আল-কুর’আন ৭ (সূরা আল-আ‘রাফ)ঃ ৩
. আল-কুর’আন ৪৫ (সূরা আল-জাছিয়াহ)ঃ ১৮
. দেখুন, আল-কুর’আন, ১২ (সূরা ইউসূফ)ঃ ৪০; ৭ (সূরা আল-আ‘রাফ)ঃ ৩; ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ৪৪
. আহমাদ, আল-মুসনাদ, [মুসনাদু ‘আলী], হা.নং: ১০৪১;[মুসনাদু ইবন মাস‘উদ], হা.নং:৩৬৯৪
. তবে কোন কোন মুসলিম চিন্তাবিদ এ রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য ‘আপেক্ষিক সার্বভৌমত্ব’ (Relative sovereignty) কিংবা ‘নির্বাহী সার্বভৌমত্ব’ (Executive sovereignty) পরিভাষাও ব্যবহার করেছেন। (আল-ইসলাম ওয়াল কানূনুদ দাওলী, পৃ. ২৫১-৩)
. মাওদূদী, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, পৃ. ২১৩
. আল-কুর’আন, ১২ (সূরা ইউসূফ)ঃ ৪০
. আল-কুর’আন, ১১৪ (সূরা আন-নাস)ঃ ১-৩
. আল-কুর’আন, ১২ (সূরা ইউসূফ)ঃ ৫৭
. আল-কুর’আন, ১৮ (সূরা আল-কাহাফ)ঃ ২৬
প্রসিদ্ধ তাবি‘ঈ কারী ‘আমির (রা.) আয়াতটি এভাবে পড়েছেন- وَلَا تُشْرِكْ فِيْ حُكْمِهِ أحَداً -‘‘তুমি তাঁর শাসন-কর্তৃত্বে কাউকে শারীক করো না।’’ (বাগাভী, মুহ্য়ুস্ সুন্নাহ, মা‘আলিমুত তানযীল, খ.৫,পৃ. ১৬৫) এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল কিংবা প্রত্যেককেই তাঁর শাসন-কর্তৃত্বে কাউকে শারীক করতে নিষেধ করেছেন। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেককেই কেবল আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানেরই আনুগত্য করতে হবে। আল্লাহর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে কারো কর্তৃত্ব মেনে চলা শির্কের নামান্তর।
. আল-কুর’আন, ৭ (সূরা আল-আ‘রাফ)ঃ ৫৪
. তাবারী, জামি‘উল বায়ান.., খ.১২,পৃ.৪৮৪; ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৩,পৃ.৪২৭
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ১৫৪
. আল-কুর’আন, ৬ (সূরা আল-আন‘আম)ঃ ৬২
. তাবারী, জামি‘উল বায়ান.., খ.১১,পৃ.৪১৩
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ৫০
. ইবনু কাছীর, তাফসীরু কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৩, পৃ.১৩১
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ৪৪-৪৭
. ইবনু কাছীর, তাফসীরু কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৩, পৃ.১১৯
কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতগুলোকে আহলু কিতাবদের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত বলে গণ্য করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের শব্দের মধ্যে এ ধরনের ব্যাখ্যা করার কোন অবকাশ নেই। হযরত হুযাইফা (রা.)কে জনৈক ব্যক্তি বলেছিলো, এ আয়াত তিনটি তো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। সে বুঝাতে চেয়েছিল যে, ইয়াহুদীদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা হুকমের বিরুদ্ধে ফায়সালা করে সে-ই কাফির, যালিম ও ফাসিক। এ কথা শুনে হযরত হুযাইফা (রা.) বলে ওঠেনঃ نعم الإخوة لكم بنو إسرائيل، إن كانت لهم كل مُرَّة، ولكم كل حلوة! كلا والله، لتسلكن طريقَهم قِدَى الشراك. -‘‘এ বনী ইসরাঈল তোমাদের কেমন চমৎকার ভাই! তিতোগুলো সব তাদের জন্য আর মিঠাগুলো সব তোমাদের জন্য। কখনো নয়, আল্লাহর কসম! তাদেরই পথে তোমরা কদম মিলিয়ে চলবে।’’ (আত্ তাবারী, জামি‘উল বায়ান.., খ.১০,পৃ. ৫৭) হযরত হাসান বাসরী (রা.) বলেন, وهي علينا واجبة.-‘‘এ আয়াতের বিধান আমাদের জন্যও অবশ্যাম্ভাবী।’’(ইবনু কাছীর, তাফসীরু কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৩, পৃ.১১৯)
. আল-কুর’আন, ৬ (সূরা আল-আন‘আম)ঃ ১১৪
. আল-কুর’আন,৩৩ (সূরা আল-আহযাব)ঃ ৩৬
. আল-কুর’আন, ২ (সূরা আল-বাকারাহ)ঃ ১০৭
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ৮৩
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ৮৫
. একই বক্তব্য অন্য আয়াতে এভাবে এসেছে- وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ -‘‘তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ কর, তার ফায়সালা আল্লাহর কাছেই সোপর্দ কর।’’ (আল-কুর’আন, ৪২ [সূরা আশ-শূরা], ১০) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালাই আসল ফায়সালা। প্রত্যেকটি বিষয়ে ও কাজে তোমাদেরকে সে দিকেই রুজু‘ হওয়া উচিত।
. আল-কুর’আন, ৪ (সূরা আন-নিসা’)ঃ ৬৫
. আল-জাসসাস, আহকামুল কুর’আন, খ.৪,পৃ. ৪৫১
. আল-কুর’আন, ৩ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ৫০-৫১
. আল-কুর’আন, ১৬ (সূরা আলু ‘ইমরান)ঃ ১১৬
. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুর’আনিল ‘আযীম, খ.৪,পৃ. ৬০৯; আলূসী, রুহুল মা‘আনী, খ.১০,পৃ.৩২৮
তবে যদি সে আল্লাহর আইনকে মেনে নিয়ে তাঁর ফরমানসমূহ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে বলে যে, অমুক জিনিসটি বৈধ এবং অমুক জিনিসটি অবৈধ, তা হলে তা হতে পারে।
. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘আতু ফাতাওয়া ইবনি তাইমিয়্যাহ, খ.১,পৃ. ২৬৩
. রিযকঃ আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ায় মানুষকে যা কিছু দান করেন, তা সবই তাঁর রিযক।
. আল-কুর’আন, ১০ (সূরা ইউনূস)ঃ ৫৯
. মাওদূদী, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, পৃ.১২৫
. আল-কুর’আন, ৪২ (সূরা আশ- শূরা)ঃ ২১
. আল-কুর’আন ৪৫ (সূরা আল-জাছিয়াহ)ঃ ১৮
. তাবারী, জামি‘উল বায়ান.., খ.২২,পৃ.৭০
. আল-কুর’আন ৭ (সূরা আল-আ‘রাফ)ঃ ৩
. السَّيِّدُ শব্দটিতে যেহেতু আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও মালিকানার অর্থও নিহিত রয়েছে, তদুপরি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঐ লোকেরা অতিমাত্রায় প্রশংসার উদ্দেশ্যে তাuঁক السَّيِّدُ বলে আখ্যায়িত করেছে, তাই তিনি তাঁকে السَّيِّدُ বলে অভিহিত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন।
. আবূ দাউদ, আস-সুনান, (কিতাবুল আদাব), হা.নং:৪১৭২; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হা.নং: ১৫৭১৭, ১৫৭২৬; নাসা’ঈ, আস-সুনানুল কুবরা, হা.নং:১০০৭৪
. মানাবী, ফায়যুল কাদীর, খ.৪,পৃ. ২০০
. আবুশ শায়খ ইস্পাহানী, আল-‘আযমাতু, হা.নং:১০১
. আত্ তাবারানী, আদ-দু‘আ, হা.নং:১৬৩৯; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, হা.নং:৪২২৮
কোনো কোনো সূত্রে এ হাদীসে ولك الأمر كله-‘‘সকল কর্তৃত্ব আপনার জন্য’’ও বর্ণিত হয়েছে। (আবুল ফাতহ আল-আযদী, আল-মাখযূন ফী ‘ইলমিল হাদীস, হা.নং: ৩৫)
. বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান, হা.নং:৪২২৮
. মুসলিম, আস-সাহীহ, (কিতাবুল ইমারাত) হা.নংঃ ৩৪২২; ইবনু হিববান, আস-সাহীহ, (কিতাবুস সিয়ার), হা.নং:৪৬৪৭
. আহমাদ, আল-মুসনাদ, [মুসনাদু ‘আবদিল্লাহ ইবনু ‘আমর (রা.)], হা.নং:৬৩১৮,৬৬৮৬; তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা.নং: ১৬৪৮৬
. দারা-কুতনী, আস-সুনান, [কিতাবুর রিদা‘], হা.নং:৪৪৪৫
. বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদাইন, হা.নং:৪৩; ইবনু বাত্তাহ, আল-ইবানাতুল কুবরা, হা.নং: ২৯১
. হুসামী, মুসাল্লামুছ ছুবূত, ( مسألة:لا حكم إلا من الله تعالى بإجماع الأمة) ; আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.১,পৃ.১৭
. গাযালী, আল-মুস্তাসফা, খ.১,পৃ. ১৫৯
. আমিদী, আল-ইহকাম ফী উসূলিল আহকাম, খ.১,পৃ.৭৯
. আমিদী, প্রাগুক্ত, খ.১,পৃ.৯৩
. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা, খ.৫, পৃ.৬২৮
. আল-‘আত্তার, হাশিয়াতুল ‘আত্তার ‘আলা শারহিল জালাল আল-মাহাল্লী ‘আলা জাম‘ইল জাওয়ামি‘, খ.১,পৃ. ২০৬
বাদরুদ্দীন যারকশী আশ-শাফি‘ঈ তাঁর ‘আল-বাহরুল মুহীত’ (খ.১,পৃ.২০৩) -এর মধ্যে ও ইবনু নাজ্জার আল-হাম্বালী তাঁর ‘শারহুল কাওকাবিল মুনীর’ (খ.১,পৃ.১৫৫)-এর মধ্যে একই রূপ কথা বলেছেন।
. সানহুরী, শায়খ ফারজ, দুরূসুন ফী তারিখিল ফিকহি,
. মাওসূ‘আতুল ফিকহিল ইসলামী, খ.১, পৃ.৩
. আল-কুর’আন, ৩৫ (সূরা ফাতির )ঃ ৩৯
. আল-কুর’আন, ২৪ (সূরা আন-নূর)ঃ ৫৫
. আল-কুর’আন, ১০ (সূরা ফাতির )ঃ ১৪
. ‘সমস্ত ঈমানদার খিলাফাতের বাহক’- এটা এমন একটি মূলনীতি যার ওপর ইসলামে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ভিত্তি যেখানে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের’ (Popular Sovereignty) নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে ক্ষেত্রে ইসলামে গণতন্ত্রের ভিত্তি ‘সামগ্রিক প্রতিনিধিত্বের' (Popular Vicegerency) ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ খিলাফাতের এ দায়িত্ব কোন এক ব্যক্তি বা শ্রেণীর জন্য নয়; বরং রাষ্ট্রের সকল মুসলিমদের ওপর একটি জামা‘আত হিসেবে অর্পণ করা হয়েছে। এর অনিবার্য দাবি হলো, মুসলিমদের মর্জি মতো সরকার গঠিত হবে, সরকার তাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবে এবং তার প্রতি মুসলিমগণ যতক্ষণ সন্তুষ্ট থাকবে সেই সরকার ততক্ষণই ক্ষমতায় থাকবে। এ কারণেই আবূ বাকর (রা.) নিজকে ‘আল্লাহর খালীফা’ বলতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন। কারণ খিলাফাত মূলত মুসলিম উম্মাহকে প্রদান করা হয়েছে, সরাসরি তাuঁক নয়। তাঁর মর্যাদা কেবল এই ছিল যে, মুসলিমগণ তাদের মর্জি মাফিক তাদের খিলাফাতের কর্তৃত্বকে তাঁর নিকট অর্পণ করেছিলেন মাত্র।
. আল-কুর’আন, ৪ (সূরা আন-নিসা’)ঃ ৫৯
. আত্ তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা.নং:১৪৭৯৫; ইবনু আবী শায়বাহ, আল-মুছান্নাফ, (কিতাবুল জিহাদ), খ.৭,পৃ.৭৩৭
. বুখারী, আস-সাহীহ, [কিতাবু আখবারিল আহাদ], হা.নং: ৬৭১৬; মুসলিম, আস-সাহীহ, [কিতাবুল ইমারাত], হা. নং: ৩৪২৪
. বুখারী, আস-সাহীহ, [কিতাবুল আহকাম], হা.নং: ৬৬১১; মুসলিম, আস-সাহীহ, [কিতাবুল ইমারাত], হা. নং: ৩৪২৩
. আল-কুর’আন,১৭ (সূরা আল-বাকারাহ)ঃ ৬৫
. আল-কুর’আন, ৪ (সূরা আন- নিসা’)ঃ ১০৫
. আল-কুর’আন, ৫ (সূরা আল-মা’য়িদাহ)ঃ ৪৯
. আল-কুর’আন, ১০ (সূরা ইউনূস)ঃ ১৫
. আস-সিয়াদাতু ফিল ইসলাম, পৃ. ১২৪-১২৯
. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হার্ন শ (Hearnshaw) বলেন, ‘‘সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সব সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাতন্ত্রের দিকে ঝুuঁক পড়ে।’’ কথায় বলা হয়, Absolute majority is tantamount to monarchy-‘‘ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজতন্ত্রের অনুরূপ।’’ (মকসুদুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫২)
. আল-কুর’আন, ২৫ (সূরা আল-ফুরকান)ঃ ৪৩-৪৪
. আল-কুর’আন, ২৮ (সূরা আল-কাসাস)ঃ৫০
. আল-কুর’আন, ৬৫ (সূরা আত-তালাক)ঃ১
. মাওদূদী, ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, পৃ.৯৭-৯৯
. এ ধরনের শাসনকে ইংরেজীতে ‘ Theocracy ’ বলা হয়। তবে ইউরোপ যে থিওক্র্যাসির সাথে পরিচিত, ইসলামী থিওক্র্যাসি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইউরোপ যে থিওক্র্যাসির সাথে পরিচিত, তাতে একটি বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী (Priest class) আল্লাহ তা‘আলার নামে নিজেদের বানানো আইন-কানুন চালু করে। এভাবে তারা কার্যত জনসাধারণের ওপর নিজেদের প্রভুত্ব চাপিয়ে দেয়। পক্ষান্তরে ইসলাম যে থিওক্র্যাসি পেশ করে, তা কোন নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং সাধারণ মুসলিমদের হাতে নিবদ্ধ থাকে। আর এই সাধারণ মুসলিমরা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে।
. নুরুদ্দীন, আবূ সাঈদ, মহাকবি ইকবাল, পৃ. ২৩৬
. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টকভেলির কথায় …most danger is the tyranny of the majority-‘‘গণতন্ত্রের প্রধান সমস্যাই হল সংখ্যাগুরুর স্বৈরাচার।’’
. আল-কুর’আন, ৩৩ (সূরা আল-আহযাব)ঃ ৩৬
. যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের ব্যাপারে আবূ বাকর (রা.) বলেন, وَاللَّهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ الْمَالِ وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عَنَاقًا كَانُوا يُؤَدُّونَهَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهَا-‘‘আল্লাহ তা‘আলার কাসম! যারা নামায ও রোযার মধ্যে পার্থক্য করবে (অর্থাৎ নামায পড়বে; কিন্তু যাকাত দেবে না), তাদের বিরুদ্ধে আমি লড়াই করবোই। কেননা যাকাত হলো সম্পদের অধিকার। আল্লাহর কাসম! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে তারা যদি যাকাত রূপে কোন মেষ শাবকও আদায় করে থাকত, যদি তারা এখন আমাকে তা আদায় করতে বিরত থাকে, তা হলে আমি তাদের বিরুদ্ধে এর জন্য লড়াই করবো।’’ (আল বুখারী, আস-সাহীহ, [কিতাবুয যাকাত], হা.নং: ১৩১২; মুসলিম, আস-সাহীহ, [কিতাবুল ঈমান], হা.নং: ২৯)