প্রিয় কথাশিল্পী নসীম হিজাজী : তার জীবন ও কাজের কিছুটা বর্ণনা

ভারতীয় উপমহাদেশের যে কয়জন বিরল কথা সাহিত্যক স্থান ও কালের সীমানা অতিক্রম করে কালজয়ী সাহিত্যের আসরে স্থান করে নিয়েছেন, নসীম হিজাযী তাদের অন্যতম।

এক সময় বাংলার মুসলিম সমাজে যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন বিষাদ সিন্ধুর রূপকার মীর মোশাররফ হোসেন বা আনোয়ারা উপন্যাসের স্রষ্টা নজীবুর রহমান সাহিত্যরত্ন অথবা বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার যে শীর্ষ শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উর্দু সাহিত্যে নসীম হিজাযীর জনপ্রিয়তা তার চাইতে কোন অংশেই কম নয়। যারা তার কোন বই পড়েননি কিন্তু রূপালী পর্দায় দেখেছেন তার কাহিনীর চিত্ররূপ, তারাও উপলব্ধি করতে পারবেন, কাহিনী নির্মানে তিনি কতটা দক্ষ।

আজকের ইসলামী দুনিয়ায় কথা সাহিত্যকের সংখ্যা যেখানে নেহায়েতই নগন্য সেখানে নসীম হিজাযী গড়ে তুলেছেন ইসলামী উপন্যাসের এক বিশাল জগত। আর তাই, বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলন যত বিস্তৃত হচ্ছে, ততই তার সাহিত্যের স্বতঃষ্ফুর্ত অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। সমজদার পাঠকরা তার সাহিত্যের সাথে পরিচিত হয়ে পুলকিত, আনন্দিত। তার লেখায়, কাহিনীতে ফুটে উঠে এমন এক স্তেজ সজীবতা, এমন অনাস্বাদিত তিক্ত-বিষাদ-প্রানময় স্বাদ, প্রেমের মদির ছোয়ার পুলকিত শিহরন- অন্যত্র যা দুর্লভ। কাহিনি বিন্যাসে তার নাটকীয়তায় যেমন আমাদের আপ্লুত করে তেমনি তার সমাজ সচেতনতা বা আদর্শিক চেতনার প্রখরতা আমাদের শ্রদ্ধান্বিত করে তোলে। তার লেখায় যেমন একটা নিজস্বতা আছে তেমনি আছে প্রতিটি লেখার উদ্দেশ্যের একটি সুনিদির্ষ্ট কেন্দ্রবিন্দু, আছে সুষ্পষ্ট ব্যক্তব্য ও দ্ব্যররথহীন চেতনার মঞ্জিল। হাজারো নদি- উপনদীতে তরঙ্গের ডেউ তুলে অবশেষে তার সে চেতনাবিন্দু সমর্পিত হয় এমন এক সমুদ্রে- যেখানে অজস্র তরঙ্গভঙ্গে বেজে উঠে একটি মাত্র সুর, একটি মাত্র তান- যে তান মানবতার জয়গানে মুখরিত। জনপ্রিয়তার কারনে এ মহান শিল্পীর ডজনাধিক বই ইতিমধ্যে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হলেও লেখক সম্পর্কে আলোচনা পর্যালোচনা হয়নি কোথাও।


এ নন্দিত কথাশিল্পীর জন্ম অখন্ড ভারতে। ১৯১৪ সালের ১৯শে মে তৎকালীন গুরুদাস পুর জেলার সুজানপুর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। তার আসল নাম মোহাম্মদ শরীফ। বাল্য ও কৈশোর কাল গ্রামে কাটলেও তার সোনালী যৌবনটুকু দখল করে আছে ঐতিহাসিক লাহোর শহর। এখানেই তিনি লেখাপড়া করেন এবং লাহোর ইসলামীয়া কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন।


তিনি যে পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছিলেন সেটি ছিল এক জমিদার পরিবার। কালের বিবর্তনে জমিদারীত্বের প্রচন্ড প্রতাপ না থাকলেও জমিজমাই ছিল তাদের পরিবারের মুল উৎস। আর দশজনের মত পরিবারের লোকদেরও আশা ছিল, লেখা পড়া শেষ করে একদিন তিনি জমিদারীর দায়িত্ব বুঝে নেবেন। তার পিতা ছিলেন একজন শিক্ষিত ও সজ্বন ব্যক্তি। সেই সাথে ছিলেন উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা। তার আশা ছিল, তার এ ছেলে আরো গুরুত্বপুর্ণ সরকারী দায়িত্ব গ্রহন করে পিতার সুনাম বৃদ্ধি করবে।পরবর্তীতে তিনি পিতার সুনাম বৃদ্ধি করেছিলেন ঠিকই, তবে জমিদারির প্রসার ঘটিয়েও নয়, বড় কোন সরকারী পদ দখল করেও নয়। পড়াশোনার প্রতি তার ছিল অসম্ভব ঝোঁক। হাতের কাছে যে বই পেতেন তাই তিনি পড়ে ফেলতেন। পড়তে পড়তেই তিনি একদিন উপলব্ধি করলেন, ইচ্ছে করলে তিনিওতো কিছু লিখতে পারেন- এমন কিছু যা পাঠককে আরো তৃপ্তিকর কিছু উপহার দেবে।তার এই উপলব্ধিই তাকে লেখার জগতে টেনে আনে।


আল্লাহ প্রতিটি মানুষকেই কিছু না কিছু সামর্থ ও যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কারো কারো বেলায় এ যোগ্যতা বহুমুখীও হতে পারে। তবে তার মধ্যেও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যায়, যা অন্য গুন গুলোর উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। একজন মানুষকে আত্ন অন্বেষনের মাধ্যমে খুঁজে নিতে হয় কোন গুনটি তার মধ্যে প্রধান।এ প্রধান গুনটির চর্চা না করে কম প্রধান গুনটির চর্চা যেমন তার নিজের জন্য কল্যান বয়ে আনেনা, তেমনি তা হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহর নেয়ামতের নাশোকরীর নামান্তর। নসীম হিজাযী নিজেকে চিন্তে পেরেছিলেন এবং যথার্থ ক্ষেত্রেই নিয়োজিত করেছিলেন নিজের মেধা, মনন ও সময়কে। বালক বয়সে তিনি যখন গল্প করতেন, তখন দেখা যেত অন্যেরা তন্ময় হয়ে তার গল্প শুনছে। কাহিনী নির্মানের গুনটি এভাবে তিনি শৈশবেই আয়ত্ব করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন একজন লেখক হবার মত যোগ্যতা ও সামর্থ তার আছে। আর মুসলিম জাতিকে জাগানোর জন্য এর প্রয়োজন ও খুব বেশি। জাগতিক স্বার্থ ও মোহ অতিক্রম করে তাই তিনি নিজকে সে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করলেন।

তিনি দেশ বিদেশে নসীম হিজাযী নামে পরিচিতি লাভ করলেও এটি তার আসল নাম নয়। কলমী নাম হিসেবে এ নামটি তার নিজের দেয়া। তিনি তার লেখক সত্তার বিকাশের জন্য এ নামটি বেছে নেন। নামের সাথে হিজাযী সংযোজন ও যথেষ্ট তাৎপর্য পুর্ণ।

হেযাজের যে আলো বিশ্ব সভ্যতাকে গ্রাস করে নিয়েছে, সে আলোকেই তিনি মনে করেন তার অস্তিত্ব। হেজাযের সে আলোর পতাকাধারীদের মনে করেন তার পূর্ব পুরুষ- তার স্বকীয় সভ্যতার ধারক, বাহক ও উদ্বোধক। এজন্য খুব সচেতন ভাবেই তিনি ‘হিজাযি’ সংযুক্ত করেছেন।

প্রথম লেখাঃ


প্রথম যে উপন্যাসটি রচনায় তিনি হাত দেন তার নাম ‘ইনসান আওর দেবতা’ (মানুষ ও দেবতা)। এ উপন্যাসের ভিত্তি ছিল তার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি। হিন্দুদের সমাজ ও সভ্যতাকে তিনি নিজের জীবন ও অস্তিত্ব দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানানঃ ‘আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখনই আমি দেখেছি এবং উপলব্ধি করেছি যে, হিন্দুরা মুসলমানদের ঘৃনা করে। মুসলমানদের তারা বলে অচ্ছুৎ। মুসলমানরা তাদের খাবার ছুলে তা অপবিত্র হয়ে যায়।’ হিন্দু শাস্ত্রকারদের এ ধরনের মানবতা বিরোধী মতবাদ তার মানসলোকে যে আঘাত হানে তারই ফলে এই রচনায় তিনি মনোনিবেশ করেন। তার এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ব্রাম্মন্য ষড়যন্ত্র ও কুটিলতার শিকার তিনি নিজেও। যে গুরুদাসপুর জেলায় তার জন্ম সেটি ছিল মুসলিম প্রধান জেলা। সে জেলায় কেবল মাত্র একটি থানায় হিন্দুদের সংখ্যা সামান্য বেশী ছিল।

তার মতে পাক ভারতের দেশ বিভাগের সময় এ অঞ্চলটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হিন্দুস্থানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। এসব কারনে তিনি ‘ইনসান আওর দেবতা’ বইটির প্লটটি বেছে নেন তার প্রথম কাজ হিসেবে। বইটি লেখা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, ভারতীয় উপমহাদেশে তখন চলছিল স্বাধীনতা ও রেনেসাঁর সংগ্রাম। তিনি উপলব্ধি করেন, ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে দ্রুত সচেতন করা দরকার। জাগিয়ে তোলা দরকার এ জাতির সুপ্তিমগ্ন মর্দেমুমিন মুজাহিদদের। ফলে, বইটির সমাপ্তি না টেনেই তিনি নতুন লেখায় হাত দেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তার হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে ‘দাস্তানে মুজাহিদ’ (মরনজয়ী)। এটিই তার পুর্নাঙ্গ প্রথম উপন্যাস। এ বই মুসলমান্দের মধ্যে বুনে দিয়ে যায় জেহাদের আমোঘ মন্ত্র। মুসলিম জগতে সৃষ্টি করে অপূর্ব জযবা ও জোশ। ঈমানী চেতনায় উদ্দিপ্ত হয় তরুন সম্প্রদায়। ইসলামী বিপ্লবের নেশা জাগে তাদের বুকে বুকে। খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বেরোয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মুহাম্মাদ বিন কাশিম’। এখানেও মুর্ত হয়ে ওঠে তার জীবন জাগার গান। এর পর একে একে তার হাত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে এমন সব উপন্যাস- মুসলিম জাহান যার চমকের সাথে ইতিপূর্বে আর কখনো পরিচিত ছিলনা।

 

নসীম হিজাযীর প্রকাশিত গ্রন্থ তালিকা


-দাস্তানে মুজাহিদ- মরনজয়ী
-মুহাম্মাদ বিন কাশিম- মুহাম্মাদ বিন কাশিম
-ইনসান আওর দেবতা- মানুষ ও দেবতা
-আখেরী চাটান- শেষ প্রান্তর
-আওর তলোয়ার টুট গেয়ি- ভেঙ্গে গেল তলোয়ার
-মোয়াজ্জম আলী- খুন রাঙ্গা পথ
-কাফেলায়ে হেজায- হেজাযের কাফেলা
-আন্ধেরী রাত কা মুসাফির – আঁধার রাতের মুসাফির
-পাকিস্তাঞ্ছে দিয়ারে হরম তক- ইরান তুরান কাবার পথে
-সফেদ জাযিরা- সফেদ জাযিরা
-সাফফাত কি তালাশ- সংস্কৃতি সমাচার
-ছো সাল বাদ- তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে
-শাহীন- সীমান্ত ঈগল
-কালিসা আওর আগ- শেষ বিকেলের কান্না
-কায়সার ও কিসরা- কায়সার ও কিসরা
-সোহাগ
-খাক ও খুন
-ইউসুফ বিন তাশফিন- মুজাহিদের তলোয়ার
-আখেরি মা আরাকা

লেখকের মতে তার শ্রেষ্ঠ রচনা

লেখকের অনুভুতিও সমালোচকদের মতামত সবসময় এক হয়না। নসীম হিজাযীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি এ ব্যাপারে ও মতভেদ হতে পারে। যেমন কেউ কেউ লেখকের ‘শেষ প্রান্তর’কে তার শ্রেষ্ঠ রচনা বলেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতারা তার এ বইটি নিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছায়াছবিও নির্মান করেছেন। মাওলানা মওদুদী হেজাযের কাফেলাকে মনে করতেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। এ বইটি পড়ে তিনি এতই আপ্লুত হয়েছিলেন যে তিনি এর ভুমিকা পর্যন্ত লিখে দিয়েছিলেন।

তবু, লেখক যে বইটিকে শ্রেষ্ঠ বলেন তাতে একটি আলাদা স্বাদ অবশ্যই পাওয়া যাবে। নসীম হিজাযী তার ‘কায়সার ও কিসরা’ উপন্যাসটিকে তার প্রধান উপন্যাস হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন। এটিকে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তিও মনে করেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক কলম পত্রিকার এক সাক্ষাৎকার থেকে এ সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়।

সে সাক্ষাৎকারে কায়সার ও কিসরা সম্পর্কে তিনি জানানঃ “ আমার লেখা কায়সার ও কিসরা আপনি হয়ত পড়ে থাকবেন। এটি আমার জীবনের অন্যতম কীর্তি।এ বই লেখার সময় আমার অবস্থা এমন হয়েছিল যে, অর্ধেক স্বপ্নময়তার মধ্যেই আমার দিন কেটেছে। আমি যেন তখন এক অশেষ আনন্দলোকে বিচরন করছিলাম।আমি তখন প্রার্থনা করতাম,এই বই শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আমার জীবনের পাট চুকে যায়। কারন, আমার মনে হত, আমার জীবনের যে মিশন,এই লেখার মধ্যেই দিয়ে তা পূর্ণতা লাভ করবে। ফলে, এর পরে বেঁচে থাকার কন মানে হয়না। কায়সার ও কিসরার এক একটি অধ্যায় লিখা হচ্ছিল আর আমার মনে উদয় হচ্ছিল নতুন নতুন চিন্তা।

হঠাৎ আমার মনে হল- আমি কতবড় দুর্ভাগা যে, যে অঞ্চল সমুহ নিয়ে আমার এ উপন্যাস, সে অঞ্চলগুলো আজো আমার দেখা হয়নি। না দেখেই আমি লেখা শুরু করে দিয়েছি। আমার মনের আকুতি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই এক অভাবিত ঘটনা ঘটল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমাকে সেই পূন্যময় স্থান সমুহ সফরের আমন্ত্রন জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠালেন। এ আল্লাহর এক গায়েবী মদদ। আমি কৃতজ্ঞতায় সেজদায় পড়ে গেলাম। তারপর ছুটলাম সেই পূন্যভুমির উদ্দেশ্যে। ইরান, ইরাক, লেবানন হয়ে পৌঁছলাম মক্কা নগরীতে। সে এক লম্বা কাহিনী।


আমি যখন কাবা শরীফে পৌঁছলাম- তখন সেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল। রহমতের বৃষ্টি। আমার যে কলম দিয়ে কায়সার ও কিসরা লিখেছিলাম, সেটাকে প্রথমে আবে জমজমে চুবালাম। পরে তা মিজাবে রহমতের সেই জায়গাটিতে রাখলাম, যেখানে পানির ধারাটা এসে পড়ছে। তার পর দোয়া করলামঃ ‘হে আল্লাহ, কোন ভুলত্রুটি যেন না হয়।গুনাহগার মানুষ আমি।তোমার প্রিয় হাবিব সরদারে দো আলম সম্পর্কে লেখার তৌফিক দাও আমায়। আমার দোয়া তুমি কবুল কর’। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমার জানা মতে এই বইয়ের এমনও পাঠক আছেন, যিনি এই বই আঠারো বার পড়েছেন। আমার এ বই লেখার পেছনে আমার উদ্দেশ্য আমার ব্যক্তিসত্ত্বার চাইতে অনেক বড় ছিল। আমি চেয়েছিলাম মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় এমন সঞ্জীবনী শক্তি সৃষ্টি করতে, যে শক্তি তাদের করে তুল্বে অপরাজেয়। দেখাবে বাঁচা ও মরার পথ। সে শক্তি তাদেরকে ইংরেজের জুলুম ছিন্ন করে স্বাধীন ভাবে বাঁচার সাহস জোগাবে। অন্তরে পয়দা করবে দ্বীনের খাস মোহাব্বত।’


কায়সার ও কিসরা সম্পর্কে নসীম হিজাযীর এ আবেগের সত্যি কোন তুলনা হয়না। নির্দ্বিধায় বলা যায় এটি তার অন্যতম রচনা।


নসীম হিজাযীর উপন্যাসঃ মাওলানা মওদুদীর মুল্যায়ন


মাওলানা মওদুদীর প্রিয় ঔপন্যাসিকদের একজন নসীম হিজাযী। এ উপন্যাস গুলিকে তিনি ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ হাতিয়ার মনে করতেন। কখনো কখনো পরামর্শ দিতেন। কখনো লিখে দিতেন বইয়ের ভুমিকা। নসীম হিজাযীর উপন্যাসের মুল্যায়ন করতে গিয়ে মাওলানা মওদুদী হেজাযের কাফেলা গ্রন্থের ভূমিকায় বলেনঃ ‘উর্দু ভাষা ও সাহিত্যে শিল্পে নসীম হিজাযী যে স্থান করে নিয়েছেন, সম্ভবতঃ আজো কেউ তার সমকক্ষ হতে পারেননি। তার বই সমূহে রয়েছে সেই সব শিল্প সুষমা ও সৌন্দর্য- একটি সফল উপন্যাসে যা থাকা উচিৎ। যুবক যুবতী এবং সাধারন পাঠক যে সব কারনে নিরস প্রবন্ধের চাইতে গল্প উপন্যাস পড়তে বেশী ভালোবাসে- তার লেখায় রয়েছে আকর্ষনের সেই চমক। সাহিত্যের এই জনপ্রিয় দিক্টির মাধ্যমে ইসলামের সাথে মুসলমান্দের গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি এবং ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে উন্নত নৈতিকতা সৃষ্টির কাজে ব্যপৃত রয়েছেন তিনি।এ উদ্দেশ্যেই তিনি তার উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এবং শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ। কাহিনী বিন্যাসের মধ্য দিয়ে এমন ভাবে তিনি পাঠকদের সামনে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন- পড়তে গিয়ে পাঠক টেরও পায়না, উপন্যাস নয় বরং সে আত্নস্থ করছে দরসে তাবলীগ।

আমার মতে এই বইগুলো লিখে নসীম হিজাযী জাতির এক বড়ো খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। শিক্ষিত সম্প্রদায় ও তরুন সমাজের মধ্যে এসব বইএর দ্রুত ও বহুল প্রচার হওয়া প্রয়োজন। নিরেট প্রেম সর্বস্ব গালগপ্পো না পড়ে এসব বই পড়লে তাতে যেমন পাওয়া যাবে উপন্যাস পড়ার আনন্দ ও চমৎকারিত্ব তেমনি মহৎ শিক্ষা ও ভাবের বিত্তে চিত্ত হবে সমৃদ্ধ’। মাওলানা মওদুদী এ শতাব্দীর এক বিরল ব্যক্তি- একটি সফল ইসলামী আন্দোলনের স্রষ্টা। নসীম হিজাযীর উপন্যাস সম্পর্কে তাঁর উচ্ছসিত প্রশংসা থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো, এ বইগুলো সত্যি ইসলামী আন্দোলনের জন্য সহায়ক ও অপরিহার্য।

বাংলা ভাষায় নসীম হিজাযীর মুল্যায়ন প্রসঙ্গঃ


১৯৬৩ সালে প্রথম নসীম হিজাযীর বই বাংলায় ভাষায় প্রকাশ পায়। প্রকাশের সাথে সাথে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক মহলে তিনি ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হন। পাঠক মহলে অভুতপূর্ব সাড়া পড়ায় তার পরবর্তী বইগুলো দ্রুত প্রকাশ পেতে থাকে। ইতিমধ্যে তার উল্লেখ যোগ্য অধিকাংশ বই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এখনো যে দু-একটি বই প্রকাশিত হয়নি তার কোন্টির অনুবাদ চলছে কোনটি যন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এককালীন মহাপরিচালক। বিশিষ্ট ইসলামিক চিন্তাবিদ ও সাহিত্যক জনাব এ জেড এম শামসুল আলম নসীন হিজাযী সম্পর্কে বলেনঃ ‘তিনি উপমহাদেশের সার্থক ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকদের অন্যতম। জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পটভূমিকায় রচিত তার উপন্যাস গুলো নৈতিক অবক্ষয়রোধ, মুল্যবোধের জাগরন, এবং জাতিসত্তার স্বকীয় অনুভূতির উজ্জীবনে ফলপ্রসু ও সুদুর প্রসারী অবদান রেখেছে। নসীম হিজাযীর উপন্যাসের ভিন্নরূপ স্বাদ, বৈশিষ্ট এবং স্বতন্ত্র সাহিত্য মুল্য তার উপন্যাস সম্পর্কে পাঠক মহলে প্রভূত কৌতুহল ও আগ্রহ সৃষ্টি করে।

নসীম হিজাযী ঔপন্যাসিক। তার উপর তিনি রকজন দরদী সমাজ সংস্কারক। উপন্যাস তার হাথে সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার। এদেশে কার্ল মার্ক্স এর ক্যাপিটাল যতটা জনপ্রিয় তার চেয়ে অনেক বেশী জনপ্রিয় ম্যাক্সিম গোকীর ‘মাদার’ এবং অন্যান্য উপন্যাস। উপন্যাস যে কেবন বিনোদন ছাড়া আরো মহত্ত কিছু হতে পারে তার প্রমান শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম চন্দ্র, ম্যাক্সিম গোর্কী, নসীম হিজাযী। ম্যাক্সিম গোর্কীর সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্য কমুনিজম প্রচার। বঙ্কিমচন্দ্র ও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্য হিন্দুসমাজের সংস্কার। নসীম হিজাযির পরিমন্ডল আরো বিস্তৃত। তার উপন্যাস মুসলিম সভ্যতার পতনের যুগদর্শন। কিভাবে সভ্যতা সংস্কৃতির সর্বোত্তম শিখরের অবস্থান থেকে একটি জাতি ক্রমশঃ অধপতিত হতে থাকে তারই রেখাচিত্র একেঁছেন নসীম হিজাযী। তাঁর উপন্যাস পড়তে পড়তে চোখে পানি চলে আসে। যেমন বড় বোনের কাছে মায়ের মৃত্যু কাহিনী শোনার সময় নিজের অলক্ষ্যে নয়ন অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়।’

একজন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে পাঠকদের প্রতি তার উদাত্ত আহবানঃ ‘ঈদের দিনে আপনজনদের সজ্জিত করার জন্যে আমরা দামী জামা কাপড় অলংকার দিয়ে থাকি। তাদের রুচি ও মনকে সুন্দর সুসজ্জিত করার জন্যে কি আমাদের কিছু করা উচিত নয়? চরিত্র গঠন্মুলক গল্প, উপন্যাস সহ মহৎ মানুষের জীবনী উপহার দিয়ে আমরা তাদের চারিত্রিক মান উন্নয়নে সাহায্য করতে পারি। পেটে ক্ষুধা নিবারনের জন্যে আমরা বাজার থেকে মাছ, গোস্ত, দই এবং মিষ্টি কিনে থাকি। আত্নার ক্ষুধা নিবারনের জন্যো সুরুচিশীল সাহিত্য সংরহ করা প্রয়োজন। যারা চান তারা তাদের সন্তান সন্ততি আবিলতা মুক্ত, রুচীবান মহৎ মানুষ হউক, পশুত্বের উর্ধে সুন্দর সমাজের আদর্শ নাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক , সমাজ সভ্যতার ক্রমাগত অধপতন এবং অবক্ষয় নয় বরং উন্নতি ও অগ্রগতিতে কিছুটা অবদান রাখুক, তাদের প্রতি আমাদের আবেদন, নসীম হিজাযীর উপন্যাস কিনে আপনজনদের উপহার দিন। এর চেয়ে সুন্দর উপহার বোধহয় আর কিছু হয় না।’

প্রিয় ব্যক্তিত্ব


নসীম হিজাযির প্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ হাসানুল বান্না, জামায়াতের ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদুদী, আল্লামা ইকবাল ও আল্লামা শিবলী নোমানী। নসীম হিজাযী বলেনঃ ‘আমি যদি কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকি তাহলে তিনি হলেন মাওলানা মওদুদী। এমনিভাবে আল্লামা ইকবালের সার্বজনীন ও বৃহত্তর চিন্তা চেতনায় ও আমি স্নাত। আমার চিন্তাধারা যদি পরিস্কার পানি হয়, তাহলে তার দুই তীর হলেন মাওলানা মওদুদী এবং আল্লামা ইকবাল। তাদের দান এইযে, এই পানিকে তারা বাইরে যেতে দেননি। আমার এ চিন্তাধারার পেছনে আল্লামা শিবলী নোমানীর অবদান ও যথেষ্ঠ।আর হাসানুল বান্না। তার শহীদী রক্ত এখনো আমার কাছে অম্লান, তরতাজা।’

জীবন- জীবিকা ও সংসার


তেইশ বৎসর বয়সে ১৯৩৭ সালে তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি তিন সন্তানের জনক। একছেলে মারা গেছে। বেঁচে আছে দুই ছেলে। জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাহিত্য চর্চাকে। যদিও পরিবারের কেউ এমনটি চায়নি। মাসিক কলম পত্রিকার সাক্ষাৎকারটিতে এ কথা তিনি অকপটেই স্বীকার করেছেন। তিনি জানানঃ ‘লেখার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী বিরোধীতা হয়েছে আমার পরিবার থেকেই। সবাই বলেছে, তুমি যে কলমের মাধ্যমে রোজগারের চেষ্টা করছো এ এক ব্যর্থ চেষ্টা। কোন পাগলেও এসব করেনা। যদি ভালো চাও তাহলে অন্য কোন কাজ করো।’ এর যে চমৎকার জবাব তিনি দিয়েছেন তা কেবন একজন খাঁটি ঈমান্দারের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। তিনি বলেনঃ ‘আমি তাদেরকে বলেছি যে, ইনশাল্লাহ কলমের মাধ্যমেই আল্লাহ আমাকে রুজি দেবেন। আর হয়েছেও তাই। আমি পয়সা থেকে পালাতে চেষ্টা করি আর পয়সা আমার পেছনে দৌড়ায়। আমি আল্লাহর কাছে অনেক কিছুই চেয়েছি, কিন্তু বেশী রুজি চাইনি। অথচ আল্লাহ আমাকে এ জিনিষটি আমার চাওয়ার চেয়ে বেশীই দিয়েছেন।’

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন তিনি। ইউরোপ, আমেরিকা, বৃটেন, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, মিশর, সৌদি আরব সহ পৃথিবীর বহু দেশ। এ সব সফর তাকে দিয়েছে অভিজ্ঞতার ভান্ডার। জুগিয়েছে প্রেরনা আর লেখার মাল মশলা।

অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ


নসীম হিজাযীর বইয়ের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। সমগ্র মুসলিম দুনিয়ায়ই তার উপন্যাস ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হচ্ছে। আরবি, বাংলা, সিন্ধি, মালয়ালম, গুজরাটি এমন কি চীনা ভাষায়ও তার বই প্রকাশিত হয়েছে। দুনিয়া জোড়া ইসলামী আন্দোলন যত ব্যাপক ও বিস্তৃত হচ্ছে, তার উপন্যাসও ততই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশীদের প্রতি লেখকের আহবান


কলমের সাক্ষাৎকারটিতে তাকে তার বাংলাদেশী ভাইদের প্রতি কোন পয়গাম আছে কীনা জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছেনঃ ‘বাংলাদেশী ভাইদের প্রতি আমার পয়গাম এইযে, আমাদের অস্তিত্ব ইসলামের ওপর নির্ভরশীল। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে ইসলামকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরি। এমন ভাবে, যেমন ভাবে ধরা উচিত। ইসলামের সাথে আমাদের সম্পর্ক যত গভীর হবে, আমরা যতটা নিকটবর্তী হবো ইসলামের- আল্লাহ তত বেশী তার রহমত দ্বারা আমাদেরকে আবৃত করবেন। মঞ্জিল যদি হয় ইসলাম- তবে যে পথেই আমরা এগুই বা যে মাধ্যমেই আমরা ব্যবহার করিনা কেন, শেষ পর্যন্ত রাস্তা এক বিন্দুতেই মিলিত হবে। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে, আমাদেরকে দুনিয়ায় কেবলমাত্র সৎকর্মের জন্যই পাঠানো হয়েছে। অসৎ কর্ম প্রতিহত করা-সেও সৎ কর্মেরই নামান্তর। তাই আসুন, বিনা দ্বিধায় কেবল সৎকর্মের জন্য কদম উঠাই। আল্লাহই আমাদের নেগাহবান এবং তার কাছেই আমরা ফিরে যাবো।’ আসুন আমরাও তার এ চেতনার সাথে একাত্ন হই। আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলি খালিদ, তারিক, মুসার মত মৃত্যুঞ্জয়ী মুজাহিদ।