সূরা আল-বাকারাহর ৩০ নং আয়াতে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা মানুষকে খলীফাহ বলে আখ্যায়িত করে বলছেন, وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً ۖ قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ ۖ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُونَ “যখন তোমার রব্ব ফেরেশতাদেরকে বললেন: নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলীফাহ সৃষ্টি করব; তারা বলল: আপনি কি যমীনে এমন কেহকে সৃষ্টি করবেন যারা তন্মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত করবে? এবং আমরাইতো আপনার গুণগান করছি এবং আপনারই পবিত্রতা বর্ণনা করে থাকি। তিনি বললেন: তোমরা যা অবগত নও নিশ্চয়ই আমি তা জ্ঞাত আছি” । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: খলীফাহ শব্দের অর্থ কী? খলীফাহ বলতে এখানে কাকে বোঝানো হয়েছে? মানুষ পৃথিবীতে কার খলীফাহ? আল্লাহর খলীফাহ নাকি অন্য কারো খলীফাহ? সম্প্রতি একটি শ্রেণী মানুষকে মানুষের খলীফাহ/স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করছে। অথচ এতদিন সবাই জেনে এসেছিল মানুষ আল্লাহর খলীফাহ। যেহেতু এ বিষয়গুলোর সাথে জড়িয়ে রয়েছে মানবজীবনের বিভিন্ন মৌলিক দিক, বিশেষ করে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে বিজয়ী করার দায়-দায়িত্ব, তাই আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এ বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। ১. খলীফাহ শব্দের শাব্দিক বিশ্লেষণ: খলীফাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: প্রতিনিধি; স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তি; উত্তরাধিকারী। যে অন্য কারো মালিকানার অধীনে প্রতিনিধি হিসেবে মালিক প্রদত্ত ক্ষমতা ও অধিকার প্রয়োগ করে। যে কারো পরে আসে এবং তার স্থলাভিষিক্ত হয় ইত্যাদি। যেমন: প্রখ্যাত আরবী অভিধান لسان العربএ বলা হয়েছে : الخليفة: الذي يستخلف ممن قبله، والجمع: خلائف. “খলীফাহ: যে তাঁর পূর্ববর্তী কারো স্থলাভিষিক্ত হয়। বহুবচন: খলাইফ”। তাফসীরে البحر المحيط এ বলা হয়েছে: الخليفة: القائم مقام غيره في الأمر الذي جعل إليه... وقيل : الخليفة اسم لكل من انتقل إليه تدبير أهل الأرض والنظر في مصالحهم. “খলীফাহ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে কারো স্থলাভিষিক্ত হয়ে কোন দায়িত্ব পালন করে। কারো কারো মতে: প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে খলীফাহ বলা হয় যার উপর পৃথিবীবাসীর ব্যবস্থাপনা ও তাদের ভালোমন্দ দেখাশুনার দায়িত্ব বর্তায়”। তাফসীরে রাযীতে বলা হয়েছে: الخليفة : من يخلف غيره ويقوم مقامه “যে অন্য কারো স্থলাভিষিক্ত হয়ে তার প্রতিনিধিত্ব করে সে ই খলীফাহ” । ২. “খলীফাহ” বলতে আয়াতে কাকে বোঝানো হয়েছে? এ ব্যাপারে তাফসীরকারকদের তিনটি অভিমত রয়েছে: ক. খলীফাহ দ্বারা এখানে শুধু আদম (আ.) কে বোঝানো হয়েছে। রুহুল মা‘আনী গ্রন্থকার আল্লামা আলুসী বলেন: "والمشهور: أن المراد به :آدم ـ عليه السلام ـ ، وهو الموافق للرواية ، ولأفراد اللفظ، ولما في السياق. ونسبة سفك الدم والفساد إليه حينئذ بطريق التسبب. أو المراد بمن يفسد إلخ من فيه قوة ذلك" “প্রসিদ্ধ মত হলো, খলীফাহ দ্বারা এখানে আদম (আ.) কে বোঝানো হয়েছে। এ মতটিই (সাহাবীদের থেকে প্রাপ্ত) বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এবং এ কারণেই খলীফাহ শব্দটি একবচন ব্যবহার করা হয়েছে। এমতাবস্থায় তার প্রতি রক্তপাত, হানাহানিকে আরোপণ করা হয়েছে রূপকার্থে تسبب (কারণ হওয়ার) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ আদম রক্তপাত করবে, তা নয়; বরং তাকে সৃষ্টি করার কারণে পরবর্তীতে এমনটি ঘটবে। কিংবা এ অর্থে যে, তার মধ্যে এ ধরনের কাজ করার শক্তি আছে। বাস্তবেই করতে হবে, তা নয় ।” খ. খলীফাহ দ্বারা এখানে আদম সন্তান বোঝানো হয়েছে। ফেরেশতাদের কথা مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا (যারা তন্মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে) দ্বারা এ অর্থই বোঝা যায়। আর খলীফাহ শব্দটিকে এক বচন ব্যবহার করায় কোন আপত্তি নেই। কারণ আদম মানব জাতির আদি পিতা। গোত্রপতির নাম উল্লেখ করে গোটা গোত্রকে বোঝানোর প্রচলন আরবী ভাষায় অনুমোদিত। তাছাড়া, “খলীফাহ” শব্দটি এমন একটি ইসম/বিশেষ্য, যা একবচন ও বহুবচন দুয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তদ্রূপ পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়ের জন্যই তা সমানভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। তাফসীরে (البحر المحيط)বলা হয়েছে: "وقيل: ولد آدم، لأنه يخلف بعضهم بعضا؛ إذ هلكت أمة خلفها أخرى. قاله الحسن، فيكون مفردا، أريد به الجمع". “অর্থাৎ কারো কারো মতে: খলীফাহ দ্বারা অদম সন্তানদের বোঝানো হয়েছে। কারণ তারা একজন অপরের স্থলাভিষিক্ত। একদল যখন ধ্বংস হয়ে যায়, আরেক দল এসে তার স্থান দখল করে। এটি হাসানের অভিমত। এ হিসেবে খলীফাহ শব্দটি একবচন হলেও এটি বহুবচনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । গ. তবে সর্বোৎকৃষ্ট মত হলো: এতদুভয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। অর্থাৎ খলীফাহ বলে এখানে আদম ও তাঁর সন্তান তথা গোটা মানব জাতিকেই বোঝানো হয়েছে। এ মর্মে বিশ্ববিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনু কাসির বলেন : والظاهر : أنه لم يرد آدم ـ عليه السلام ـ ؛ إذ لوكان ذلك لما حسن قول الملائكة : (أتجعل فيها من يفسد فيها ويسفك الدماء ...)، فإنهم أرادوا أن من هذا الجنس من يفعل ذلك" . “এ কথা স্পষ্ট যে, এখানে শুধুমাত্র আদমকেই বোঝানো হয় নি। যদি একমাত্র তাকেই বোঝানো হতো, তাহলে ফেরেশতাদের এ কথা বলা মোটেই উচিত হতো না। তারা আসলে সরাসরি আদমকে উদ্দেশ্য করেন নি; বরং সাধারণভাবে মানব জাতিকে বুঝিয়েছেন”। আল-আছাছু ফিততাফসীর গ্রন্থকার বলেন: والمراد بالخليفة في الآية: آدم و ذريته ، ولم يقل خلائف أو خلقاء؛ لأنه أريد بالخليفة : آدم ، واستغني بذكره عن ذكر بنيه، كما تستغني بذكر أبي القبيلة في قولك: مضر وهاشم. “খলীফাহ দ্বারা আয়াতে আদম ও তাঁর বংশধারাকে বোঝানো হয়েছে। আদম (আ.) এর কথা উল্লেখ করার কারণে তাঁর সন্তানদের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করা হয়নি। এ জন্যই খলীফাহ শব্দের বহুবচন ব্যবহার করা হয় নি। যেমন, কবীলাহ/গোত্রপ্রধানের নাম উল্লেখ করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়। যেমন: মুদার, হাশিম ইত্যাদি। ৩. আদম ও তাঁর সন্তানগণ কার খলীফাহ এবং খিলাফাতের তাৎপর্য: এ ব্যাপারেও গবেষকদের একাধিক মত রয়েছে: প্রথম অভিমত:. আদম ও তাঁর সন্তানগণ আল্লাহর খলীফাহ বা প্রতিনিধি। এটি ইবুন আব্বাস, ইবুন মাসঊদ (রা.) ও সুদ্দীর অভিমত। ইমাম তবারী বর্ণনা করেন: عن ابن عباس - وعن مُرَّة، عن ابن مسعود، وعن ناس من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم: أنّ الله جل ثناؤه قال للملائكة:"إني جاعل في الأرض خليفة". قالوا: ربنا وما يكون ذلك الخليفة؟ قال: يكون له ذُرّيةٌ يُفسدون في الأرض ويتحاسدون ويقتل بعضهم بعضًا . فكان تأويل الآية على هذه الرواية التي ذكرناها عن ابن مسعود وابن عباس: إني جاعل في الأرض خليفةً منّي يخلفني في الحكم بين خلقي. وذلك الخليفة هو آدمُ ومن قام مقامه في طاعة الله والحكم بالعدل بين خلقه. “ইবনু আব্বাস, মুররাহ, ইবনু মাসউদ এবং আরো কিছু সাহাবী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা ফেরেশতাদেরকে বললেন: “নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলীফাহ পাঠাবো”। তারা বলল: হে আমাদের রব! ঐ খলীফাহ কেমন হবে? আল্লাহ তা‘আলা বললেন: “তার অনেক সন্তান-সন্ততি হবে, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও হত্যা বিবাদ করবে”। ইমাম তবারী বলেন: “ইবনু মাসউদ ও ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে যে বর্ণনাটি উল্লেখ করলাম, এর ভিত্তিতে আয়াতটির ব্যাখ্যা দাঁড়ায়: নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার পক্ষ থেকে খলীফাহ পাঠাবো, যে আমার সৃষ্টির মধ্যে আমার পক্ষ থেকে (আমার দেয়া) বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করবে। আর সেই খলীফাহ হচ্ছেন আদম এবং যারা আল্লাহর অনুগত ও সৃষ্টির মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার স্থলাভিষিক্ত হবে”। ইমাম কুরতুবী (র.) এ প্রসঙ্গে বলেন: "والمعنى بالخليفة هنا في قول ابن مسعود وابن عباس ـ رضي الله عنهما ـ وجميع أهل التأويل: آدم ـ عليه السلام ـ ، وهو خليفة الله في إمضاء أحكامه وأوامره؛ لأنه أول رسول في الأرض". كما في حديث أبي ذر ، قال قلت : يا رسول الله أنبيا كان مرسلا ؟ قال : "نعم" الحديث “ইবুন মাসঊদ, ইবনু আব্বাস (রা.) এবং সমস্ত কুরআন-বিশ্লেষকের অভিমত হচ্ছে: খলীফাহ দ্বারা এখানে আদম (আ.) কেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর খলীফাহ/প্রতিনিধি। কারণ তিনিই পৃথিবীর বুকে প্রথম রাসূল। যেমনটি হাদীসে আবু যারে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন: আমি বললাম: হে আল্লাহর রসূল! তিনি (আদম) কি প্রেরীত নবী ছিলেন? রাসূল (স.) বললেন: হাঁ।” ইমাম রাযী তার তাফসীরে আদম (আ.) কে খলীফাহ হিসেবে আখ্যায়িত করার যে সব কারণ উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : إنما سماه الله خليفة؛ لأنه يخلف الله في الحكم بين المكلفين من خلقه ، وهو مروي عن ابن مسعود وابن عباس والسدي. وهذا الرأي متأكد بقوله تعالى: " يا داود إنا جعلناك خليفة في الأرض فاحكم بين الناس بالحق (ص: ২৬). “আল্লাহ তাঁকে খলীফাহ নামকরণ করেছেন। কারণ তিনি আল্লাহর সৃষ্টি মুকাল্লাফদের মাঝে শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ মতটি ইবনু মাসউদ, ইবনু আব্বাস ও সুদ্দী থেকে বর্ণিত। আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা এই মতটি সমর্থিত। “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলীফাহ বানিয়েছি। অতএব, তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার ফয়সালা কর”। (সোয়াদ: ২৬)। এ অভিমত অনুযায়ী খিলাফাতের তাৎপর্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা আদম (আ.) ও তাঁর সন্তানদেরকে এ পৃথিবী আবাদের মাধ্যমে মানুষের বসবাসযোগ্য করে তোলা ও এখানে সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। অর্থাৎ মানব জাতির জন্য তিনি যে সব বিধি-বিধান ও আইন-কানুন প্রবর্তন করেছেন, তা তাদেরকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে, এটা তাদের প্রতি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত দায়িত্ব। আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা প্রতিষ্ঠা করবে মানুষের অধিকার, নিশ্চিত করবে সর্বজনীন ন্যায়বিচার। আর দূরীভূত করবে সর্বপ্রকার অন্যায়, অনাচার, পাপাচার ও জুলুম নির্যাতন। আল্লামা বাইদাভী তাঁর তাফসীরে বলেন: "والمراد به آدم؛ لأنه خليفة الله في أرضه. وكذا كل نبي استخلفهم الله في عمارة الأرض وسياسة الناس وتكميل نفوسهم، وتنفيذ أمره فيهم. “এখানে খলীফাহ দ্বারা আদমকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, তিনি পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাহ। এভাবে প্রত্যেক নবীকেই তিনি পৃথিবীতে তাঁর খলীফাহ বানিয়েছিলেন। যেন তারা পৃথিবীকে আবাদ/বিণির্মান করতে পারে; মানুষকে শাসন করতে পারে; তাদেরকে মানসিক ভাবে বিকশিত করতে পারে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে ”। আল্লামা আলুসীও অনুরূপ তাঁর তাফসীরে রুহুল মা‘আনীতে এ মর্মে বলেন: "ومعنى كونه خليفة :أنه خليفة الله تعالى في أرضه، وكذا كل نبي استخلفهم في عمارة الأرض، وسياسة الناس، وتكميل نفوسهم وتنفيذ أمره فيهم، لا لحاجة به تعالى، ولكن لقصور المستخلف عليه ". “আদম (আ.) খলীফাহ হওয়ার তাৎপর্য হলো, তিনি পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাহ। এভাবে প্রত্যেক নবীকেই তিনি পৃথিবীতে তাঁর খলীফাহ বানিয়েছিলেন। যেন তারা পৃথিবীকে আবাদ/বিণির্মান করতে পারে; মানুষকে শাসন করতে পারে; তাদেরকে মানসিক ভাবে বিকশিত করতে পারে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ সুবানাহু তাদের মুখাপেক্ষী; বরং এর কারণ হচ্ছে, মানুষের দুর্বলতা ও অক্ষমতা” । খলীফাহ হিসেবে পৃথিবীর সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে: أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ (لقمان: ২০). “তোমরা কি দেখ না, আল্লাহ আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন”? (সূরা লুকমান: ২০)। আল্লাহর দেয়া নীতিমালা ও বিধি-বিধান অনুসারেই তার দেয়া সব কিছু ভোগ ও ব্যবহার করতে হবে। সুতরাং মানুষের জন্য আল্লাহর দেয়া সীমা লংঘন করা ও যথেচ্ছাচার প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। যে কেহই সীমা লংঘন করবে সে ই খিলাফাতের মহান দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হবে। পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে সে তখন আল্লাহর নিকট গণ্য হবে। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সৃষ্টির জন্য আল্লাহ প্রবর্তিত নিয়ম-নীতি, ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব স্বয়ং তিনিই গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে, মানুষের জন্য প্রবর্তিত বিধিবিধান বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদের উপরই চাপিয়ে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি ও যোগ্যতা দিয়ে তাদেরকে তিনি সুসজ্জিত করেছেন। তাই পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে, তার ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা। আর এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য প্রয়োজন সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের নেৃতত্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র। এ জন্যই ইমাম কুরতুবী এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলছেন: هذه الآية أصل في نصب إمام وخليفة يسمع له ويطاع ، لتجتمع به الكلمة ، وتنفذ به أحكام الخليفة. ولا خلاف في وجوب ذلك بين الأمة ولا بين الأئمة إلا ما روي عن الأصم حيث كان عن الشريعة أصم ، وكذلك كل من قال بقوله واتبعه على رأيه ومذهبه ، قال : إنها غير واجبة في الدين بل يسوغ ذلك ، وأن الأمة متى أقاموا حجهم وجهادهم ، وتناصفوا فيما بينهم ، وبذلوا الحق من أنفسهم ، وقسموا الغنائم والفيء والصدقات على أهلها ، وأقاموا الحدود على من وجبت عليه ، أجزأهم ذلك ، ولا يجب عليهم أن ينصبوا إماما يتولى ذلك. ودليلنا قول الله تعالى : {إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً} [البقرة : ৩০] ، وقوله تعالى : {يَا دَاوُدُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الأَرْضِ} [ص : ২৬] ، وقال : {وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الأَرْضِ} [النور : ৫৫] أي يجعل منهم خلفاء ، إلى غير ذلك من الآي. “একজন ইমাম ও খলীফা (রাষ্ট্রপ্রধান) প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এ আয়াতটিই হলো সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। যার আদেশ-নিষেধ শুনতে হবে এবং মান্য করতে হবে। যার দ্বারা নিষ্পত্তি ঘটবে সমস্ত মত পার্থক্য এবং বাস্তবায়িত হবে খিলাফাতের সমস্ত বিধিবিধান। এটা যে ওয়াজিব এ ব্যাপারে উম্মাত ও আয়িম্মদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। শুধুমাত্র আছাম্ম ও তার কিছু অনুসারী ব্যতীত কেউ এতে দ্বিমত পোষণ করেন নি। (আছাম্ম অর্থ বধির)। সে ছিল শরীয়ত থেকে বধির। আছম্মের মতে: উম্মাত যদি হাজ্জ ও জিহাদ করে, নিজেদের মধ্যে ন্যায় বিচার করে, নিজেরা সত্য ধারন করে, গনীমাত, ফাই, সাদাকাত যথাস্থানে বন্টন করে, অপরাধীদের উপর ইসলামের দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করে, তাহলেই দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য একজন ইমাম স্থাপন করা ওয়াজিব নয়। ইমাম কুরতুবী বলেন: ইমাম স্থাপন করা যে ওয়াজিব, এ মর্মে আমাদের দলীলগুলো হচ্ছে: ক. “নিশ্চয়ই পৃথিবীতে আমি খালীফা পাঠাবো” (সূরা আল-বাকারাহ: ৩০)। খ. “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলীফাহ বানিয়েছি। অতএব, তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার-ফয়সালা, শাসনকার্য পরিচালনা কর” (সূরা ছোয়াদ: ২৬)। গ. আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান গ্রহণ করবে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করবে আল্লাহ তাদেরকে যমীনে খিলাফাতে প্রতিষ্ঠিত করবেন” (সূরা নূর: ৫৫)” । (উল্লেখ্য যে, আছাম্ম যে অভিমত পোষণ করেছেন, তাও কিন্তু একজন রাষ্ট্রপ্রধান স্থাপন ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া কি হুদুদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?) দ্বিতীয় অভিমত: তারা জ্বীন জাতির খলীফাহ বা উত্তরসূরী/স্থলাভিষিক্ত। যারা তাদের পূর্বে পৃথিবীতে বসবাস করত। এ মর্মে ইমাম তবারী বর্ণনা করেন : عن ابن عباس قال: أول من سكن الأرضَ الجنُّ فأفسدوا فيها وسفكوا فيها الدماء وقتل بعضهم بعضًا. فبعث الله إليهم إبليس في جند من الملائكة، فقتلهم إبليس ومن معه حتى ألحقهم بجزائر البحور وأطراف الجبال. ثم خلق آدم فأسكنه إياها، فلذلك قال:"إني جاعل في الأرض خليفة" . فعلى هذا القول:"إني جاعل في الأرض خليفة"، من الجن، يخلفونهم فيها فيسكنونها ويعمرونها. “ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: পৃথিবীর প্রথম বাসিন্দা ছিল জ্বীন জাতি। তারা যখন পৃথিবীত পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি, রক্তপাত ও পরস্পর খুনাখুনীতে মেতে উঠল, তখন আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা‘আলা ইবলিসকে ফেরেশতাদের একটি দলের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ইবলিস তাদেরকে নিয়ে জ্বীনদেরকে হত্যা করল। যারা অবশিষ্ট ছিল তাদেরকে বিভিন্ন সাগর-দ্বীপে ও পাহাড়-পর্বতে নির্বাসিত করল। অতঃপর আল্লাহ আদম কে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বাসিন্দা বানিয়ে দিলেন। এ জন্যই আল্লাহ বলছেন, “আমি পৃথিবীতে খলীফাহ পাঠাবো”। ইমাম তবারী বলেন: “এই রেওয়ায়েতের আলোকে অর্থ দাঁড়ায়: আমি নিশ্চয়ই পৃথিবীকে জ্বীনদের স্থলাভিষিক্ত পাঠাবো। যারা হবে জ্বীনদের খলীফাহ। তারা পৃথিবীতে বসবাস করবে ও তা আবাদ করবে”। তৃতীয় অভিমত: মানুষ মানুষের খলীফাহ/স্থলাভিষিক্ত। অর্থাৎ তারা প্রজন্ম পরম্পরায় আসে। পূর্ববর্তীরা মারা গেলে পরবর্তীরা এসে খলীফাহ বা স্থলাভিষিক্ত হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আল্লামা ইবনু কাসির এ মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এই আয়াতের তাফসীরে তিনি বলছেন : {إِنّي جَاعِلٌ فِي الأرْضِ خَلِيفَةً} أي قوماً يخلف بعضهم بعضاً قرناً بعد قرن وجيلاً بعد جيل كما قال تعالى: {هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلائِفَ فِي الأَرْضِ} (فاطر: ৩৯)، قال: {وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الأَرْضِ} (النمل: ৬২) ، وقال: {وَلَوْ نَشَاءُ لَجَعَلْنَا مِنْكُمْ مَلائِكَةً فِي الأَرْضِ يَخْلُفُونَ} (الزخرف: ৬০)، وقال: {فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ} (مريم:৫৯). “নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলীফাহ পাঠাবো” অর্থাৎ এমন জাতি পাঠাবো যারা যুগ ও প্রজন্ম পরম্পরায় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হবে”। যেমন আল্লাহর বাণী “তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে খলীফাহ বানিয়েছেন” (ফাতির:৩৯)। “এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন” (নামল: ৬২)। “আমি ইচ্ছা করলে তোমাদের মধ্য হতে ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হত” (আযযুখরুফ: ৬০)। “তাদের পরে এলা অপদার্থ পরবর্তীরা” (সূরা মারইয়াম: ৫৯)। (এ সব আয়াতেও খলীফাহ শব্দটি এ অর্থই ব্যবহৃত হয়েছে)।” এটি হাসানেরও অভিমত । এ জন্য ইবনু কাসীর ইমাম কুরতুবীর অবস্থানকে খন্ডন করে বলেন: " وليس المراد ههنا بالخليفة: آدم ـ عليه السلام ـ فقط، كما يقوله طائفة من الفسرين، وعزاه القرطبي إلى ابن مسعود وابن عباس وجميع أهل التأويل. وفي ذلك نظر، بل الخلاف في ذلك كثير، حكاه الرازي في تفسيره وغيره. “এখানে খলীফাহ বলতে শুধু আদম (আ.) ই উদ্দেশ্য নন। যেমনটি তাফসীরকারকদের একটি দল বলে থাকেন। ইমাম কুরতুবী যে মতটিকে ইবনু মাসউদ, ইবনু আব্বাস ও সমস্ত কুরআন-বিশ্লেষকদের প্রতি আরোপ করেছেন। আসলে এ বিষয়টি গবেষণাসাপেক্ষ; বরং এ বিষয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে এবং অন্যান্যরা তা উল্লেখ করেছেন”। তাছাড়া, মানুষ আল্লাহর খলীফাহ বলাটা বাস্তবতা পরিপন্থী কথা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সদা বিরাজমান। তাই তার কোন স্থলাভিষিক্ত থাকার প্রশ্নই উঠে না। খলীফাহতো কেবল তারই হতে পারে, যে থাকে অনুপস্থিত। কোন মতটি সর্বোত্তম? উপরের আলোচনার আলোকে ‘মানুষ আল্লাহর খলীফাহ’ এই অভিমতটিই সর্বোত্তম ও গ্রহণযোগ্য। বরং ইমাম কুরতুবী এই অভিমতকে ইবনু আব্বাস, ইবনু মাসউদ ও সমস্ত কুরআন-বিশ্লেষকদের প্রতি আরোপণ করেছেন। তাফসীরে আল-খাযিনের মধ্যেও এই অভিমততেই বিশুদ্ধ বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে: "والصحيح: إنما سمي خليفة لأنه خليفة الله في أرضه لإقامة حدوده وتنفيذ قضاياه". “বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে: আদম (আ.) পৃথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান ও যাবতীয় হূদূদ বাস্তবায়ন এবং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহর খলীফাহ”। আল্লামা সা‘ঈদ হাওওয়া তাঁর الأساس في التفسير গ্রন্থে বলেন : هل هو خليفة عن الله؟ أم خليفة عن الجن؟ أو خليفة عن خلق آخرين؟ أقوال للمفسري. أقواها: الأول. وليس هنا نص قطعي في الموضوع. “তিনি (আদম) কি আল্লাহর খলীফাহ? না জ্বীনদের খলীফাহ? কিংবা অন্য কোন সৃষ্টির খলীফাহ? মুফাসসিরদের এ ব্যাপারে একাধিক অভিমত রয়েছে। তবে সর্বাধিক শক্তিশালী অভিমত হলো প্রথমটি। (অর্থৎ তিনি আল্লাহর খলীফাহ)। তবে এ ব্যাপারে অকাট্য কোন নস নেই।” ‘মানুষ আল্লাহর খলীফাহ” এই অভিমতটি প্রণিধানযোগ্য হওয়ার যৌক্তিকতা হচ্ছে: ১. শেষোক্ত অভিমতদ্বয় দ্বারা আলোচ্য আয়াতটির তাফসীর করার মধ্যে কোন তাৎপর্য নেই। জ্বীনের পরে মানুষের আসা বা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসা-এ কথার দ্বারা এমন কি আর সাব্যস্ত করা সম্ভব যা গুরুত্বের বিবেচনায় কুরআনে স্থান পাওয়ার মত যোগ্যতা রাখে? প্রজন্মের পর প্রজন্ম/জ্বীনের পর মানুষ আসলে কী হবে? আর না আসলেই বা কী হবে? তাছাড়া, এটাতো শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; পৃথিবীর অন্যান্য পশু-প্রাণীরাও তো প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে! ২. আর যে আয়াতগুলো ইবুন কাসীর প্রজন্ম পরম্পরা অর্থের স্বপক্ষে উল্লেখ করেছন, সেগুলোর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ঐ সব জায়গায় প্রজন্ম পরম্পরা অর্থই মানানসই হতে পারে। কিন্তু এখানে তা হয় না। কারণ আয়াতের পূর্ব-পরের সাথে এ অর্থের কোন সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায় না। ৩. আয়াতটির পূর্ব-পর বিশ্লেষণ করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, অত্র আয়াতটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বতা প্রতিষ্ঠা করা। এমন কি ইবনু কাসীর নিজেই এই আয়াতটি তাফসীরের প্রারম্ভে বলেছেন: يخبر تعالى بامتنانه على بني آدم بتنويهه بذكرهم في الملأ الأعلى قبل إيجادهم “আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানদের সৃষ্টির আগেই তাদেরকে নিয়ে ফেরেশতা জগতে আলোচনা করেছিলেন। এই আয়াতে বনী আদমের প্রতি আল্লাহ তাঁর এই অুনগ্রহের কথা উল্লেখ করছেন”। এ কথাও স্পষ্ট যে, প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলেই শুধুমাত্র এই বিষয়টি সাব্যস্ত করা সম্ভব। অবশিষ্ট অর্থগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বতা ও মর্যাদা প্রমাণের কোন উপাত্ত নেই। থাকলেও তা খুবই গৌণ। যা প্রথম অর্থের ধারেকাছেও যেতে পারে না। ৪. প্রথম তাফসীরটি আয়াতের সামনে একটি নতুন অর্থের দ্বার উম্মোচন করে দেয়। পক্ষান্তরে অবশিষ্ট তাফসীরগুলো পুরাতনকেই পুনরাবৃত্তি করে। অর্থাৎ মানুষ গতানুগতিক ধারায় তাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মতই একটি জাতি। তাদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোন মর্যাদা বা দায়-দায়িত্ব নেই। অথচ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নীতি হলো: التأسيس أولى من التكرار “কোন কথাকে নতুন অর্থে প্রয়োগ করা পুনরাবৃত্তি করা থেকে উত্তম”। ৫. প্রখ্যাত মুফাসসির শায়খ মুতাওয়াল্লী আশশা‘আরাভী বলছেন : والله سبحانه وتعالى يخبرنا أن البشر سيخلفون بعضهم إلى يوم القيامة . . فيقول جل جلاله : { فَخَلَفَ مِن بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُواْ الصلاة واتبعوا الشهوات فَسَوْفَ يَلْقُونَ غَيّاً } [ مريم : ৫৯ ] ولكن هذا يطلق عليه خَلْفٌ . ولا يطلق عليه خليفة . ولكن الله جعل الملائكة يسجدون لآدم ساعة الخلق وجعل الكون مسخرا له فكأنه خليفة الله في أرضه . “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এ মর্মে আমাদেরকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, মানুষ পরস্পর পরস্পরের পরে আসবে/খলীফাহ হবে। যেমনটি অন্য আয়াতে তিনি বলছেন: “তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীরা; তারা সালাত নষ্ট করল ও লালসাপরবশ হলো; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। ”(সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৯)। তবে এই অর্থে খলীফাহ শব্দটি ব্যবহৃত না করে خَلْفٌ (খলফুন) শব্দের প্রয়োগ করা হয়। ফেরেশতাদেরকে দিয়ে আদম কে সিজদা করানো এবং সমগ্র সৃষ্টিকে আদমের সেবায় নিয়োজিত রাখার দ্বারা এ কথাই যেন বলা হয়েছে যে, আদম পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফাহ”। ৬. বলা হতে পারে, পরস্পরের পরে আসবে/মানুষ একে অপরের খলীফাহ হবে, এ কথার মধ্যেও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, তাহলো: মানুষকে শিক্ষা দেয়া যে, তুমি পৃথিবীতে চিরদিন থাকতে পারবে না। বরং তোমার আগেও যমীনে অনেকে এসেছিল; কিন্তু তারা আজ নেই। তদ্রুপ তুমিও একদিন থাকবে না। তোমাকে চলে যেতে হবে। পার্থিব জীবনের এই হাকীকাত সম্পর্কিত বিশ্বাস ও ধারণা মানুষকে অবশ্যই ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে। এর উত্তরে বলা যায়, হ্যাঁ। এ শিক্ষাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু আয়াতে বর্ণিত ফেরেশতাদের কথাগুলো প্রথম অভিমতটির সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। ফেরেশতাগণ মহাপাপ শিরকের কথা উল্লেখ না করে ফাসাদ ও রক্তপাতের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টিকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আর এ কথা সত্য যে, আল্লাহর আইন লঙ্ঘন অনুপাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। তাই আদমকে আল্লাহ তাঁর খলীফাহ বানিয়ে তার আইন বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে ফিৎনা ফাসাদের পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী আল্লাহর আনুগত্যের আলোকে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফেরেশতাদের কথার প্রেক্ষিতে “আমি যা জানি তোমরা তা জানো না’ আল্লাহু সুবাহানাহু ওয়াতা‘আলার এ বাণীতে ঐ অর্থের ইঙ্গিত মেলে। ইমাম ইবনু কাসির এর ব্যাখ্যায় বলছেন: {إِنِّي أَعْلَمُ مَا لا تَعْلَمُونَ} أي إني أعلم من المصلحة الراجحة في خلق هذا الصنف على المفاسد التي ذكرتموها مالا تعلمون أنتم فإني جاعل فيهم الأنبياء وأرسل فيهم الرسل ويوجد منهم الصديقون والشهداء والصالحون والعباد والزهاد والأولياء والأبرار والمقربون والعلماء والعاملون والخاشعون والمحبون له تبارك وتعالى المتبعون رسله صلوات الله وسلامه عليهم، وقد ثبت في الصحيح أن الملائكة إذا صعدت إلى الرب تعالى بأعمال عباده يسألهم وهو أعلم: كيف تركتم عبادي ؟ فيقولون: أتيناهم وهم يصلون وتركناهم وهم يصلون. “আমি যা জানি তোমরা তা জান না” অর্থাৎ মানব প্রজাতি সৃষ্টির মধ্যে তোমরা যে সব ফাসাদের কথা উল্লেখ করেছ, তার চেয়ে কল্যাণের মাত্রাই বেশি, আমি তা জানি। তোমরা তা জান না। আমি তাদের মধ্যে অসংখ্য নবী বানাবো, অসংখ্য রাসূল পাঠাবো। তাদের মধ্যে থাকবে অনেক সিদ্দীক, শহীদ, সালিহ/পুন্যবান, ইবাদাতপরায়ণ, যাহিদ, অলী, আবরার, নৈকট্যপ্রাপ্ত, কর্মশীল, আল্লাহভীরু, আল্লাহ প্রেমিক, রসূলদের অনুসারী”। সহীহ হাদীসে রয়েছে, ফেরেশতাগণ যখন বান্দাদের আমলসমূহ নিয়ে রবের কাছে যান, তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন Ñ যদিও তিনি সর্বাধিক জ্ঞাত Ñ : তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? তারা বলে: আমরা যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখন তাদেরকে নামাযরত অবস্থায় পেয়েছিলাম। আবার যখন তাদেরকে রেখে এসেছিলাম তখনও তারা নামাযরত অবস্থায় ছিল।” ৭. আল্লাহ সর্বদা বিরাজমান। এ কথা অবশ্যই সত্য। তবে এখানে খলীফাহ বলতে আল্লারহ অনুপস্থিতি বোঝানো হয়নি। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় তাঁর বিধিবিধান নিজের ও অন্যদের জীবনে বাস্তবায়ন বোঝানো হয়েছে। এ অর্থেই উক্ত অভিমতের প্রবক্তাগণ ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন: তাফসীর কুরতুবীতে বলা হয়েছে : وهو خليفة الله في إمضاء أحكامه وأوامره “আদম আল্লারহর আদেশ-আহকাম বাস্তবায়নে আল্লাহর খলীফাহ”। ৮. আল্লাহর বাণী: {يَا دَاوُدُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الأَرْضِ} [ص : ২৬] “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে খলীফাহ বানিয়েছি। অতএব, তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার-ফয়সালা, শাসনকার্য পরিচালনা কর” (সূরা ছোয়াদ: ২৬)। এ আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এখানে খলীফাহ দ্বারা আল্লাহর খলীফাহ ই উদ্দেশ্য। ৯. হযরত আবু বকর (রা.( কে খলীফাতুল্লাহ/আল্লাহর খলীফাহ বলা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে “খলীফাতুন্নবী” বলতে আদেশ দেন। এর দ্বারা প্রথম অর্থ গ্রহণ না করার প্রমাণ দেয়া ঠিক হবে না। কারণ: ক. এই আয়াতে যে খিলাফাতের কথা বলা হয়েছে, তা হচ্ছে সাধারণ ও ব্যাপক অর্থবোধক। অর্থাৎ তা আল্লাহর আইনের কাছে আত্মসমর্পণকারী সকল মানুষের উপর প্রযোজ্য। পক্ষান্তরে হাদীসের মধ্যে খিলাফাতের কথা বলা হয়েছে, তা বিশেষ অর্থে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধনের অভিধায় হিসেবে বলা হয়েছে। খ. অথবা আবু বকর (রা.) শুধুমাত্র ন¤্রতা ও সৌজন্যতা প্রদর্শনের জন্য অমন কথা বলেছেন। ১০. আরেকটি কথা হলো, প্রথম অর্থ ছাড়াও এখানে আরো যতগুলো অর্থ বলা হয়েছে, সবগুলো অর্থ একসাথে গ্রহণ করাতেও কোন আপত্তি নেই। কারণ এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেহেতু কোন একটি অর্থের স্বপক্ষে অকাট্য নস/প্রমাণ নেই। তাই সবগুলো অর্থেরই সম্ভাবনা রাখে আয়াতটি। আর তাই একসাথে সবগুলো গ্রহণ করলেও কোন সমস্যা নেই। والله ولي التوفيق লেখক: ড. বি. এম. মফিজুর রহমান আল-আযহারী। অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্বদ্যিালয় চট্টগ্রাম।