মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজেরা এ উপমহাদেশের রাজত্ব কেড়ে নেবার পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ’ বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করলে এ প্রশ্নের জবাব সহজে বুঝে আসবে। অনেকেই এ ইতিহাসের গুরুত্ব দেন না। বর্তমানে ওলামা সমাজ যে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছেন তারা এ ইতিহাস জানলে নিজেদের করনীয় সম্পর্কে বিবেচনা করতে পারবেন। তাই অতি সংক্ষেপে দির্ঘ ইতিহাসের পাতা থেকে কিছু যরুরী ঘটনা বিশ্লষন করছি।

পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হবার পর সকল ময়দানে যখন মুসলমানদের উপর যুলুম ও নির্যাতন ব্যাপক হয়ে উঠল তখন নতুন করে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার এক মহান আন্দোলন রাজ্যহারা মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করল। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভি (রঃ)-এর বিপ্লবী ইসলামী চিন্তাধারার সূত্র ধরে মাওলানা সইয়েদ আহমেদ ব্রেলভী (রঃ) ও মাওলানা শাহ ইসমাইল দেহলভী (রঃ)-এর নেতৃত্বে তাহরিকে মুজাহিদীনের (মুজাহিদ আন্দোলন)মাধ্যমে উত্তর -পশ্চিম সিমান্ত প্রদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয়। সুদূর বাংলা থেকেও বহু মুজাহিদ সে আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের মাঝামাঝি বালাকোট নামক স্থানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ঐ দু’জন মহান মুজাহিদ নেতা শহীদ হন এবং ইংরেজ ও শিখদের সম্মিলিত শক্তির নিকট তাদের মুজাহিদ বাহিনী পরাজিত হবার ফলে ঐ ইসলামী রাষ্ট্রটি আর টিকে থাকতে পারে নি।

শহীদাইনে বালাকোট নামে প্রশিদ্ধ ঐ দু’জন মহান মুজাহিদ নেতা ইসলামী আন্দোলন ও ইকামাতে দ্বীনের এমন গভীর চেতনা মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করে ছিলেন যে,ইংরেজের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত মুসলিমদের মধ্যেও বালাকোটের পরাজয়ের তিব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। তাদের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধূমায়িত হয়ে উঠলো এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের রূপ লাভ করলো। এ বিদ্রোহে মুসলমান সিপাহীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করার ফলে সম্রাজ্যবাদী ইংরেজ মুসলমানদের উপর খড়গ হয়ে উঠল।

তখন মুসলমানদের চরম দুর্দিন। উপমহাদেশের হিন্দু শিখদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজ রাজত্ব মজবুত হতে থাকল। ইংরেজরা সকল ময়দানে অমুসলিমদেরকে অগ্রসর করে মুসলমানদেরকে দ্বিগুণ গোলামির যিঞ্জিরে আবদ্ধ করল। ইংরেজদের রাজনৈতিক গোলামী ও হিন্দু শিখদের অর্থনৈতিক দাসত্ব মিলে মুসলিম জাতিকে চিরতরে দাবিয়ে রাখার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করল।

পরাজিত,পর্যুদস্ত ও নিষ্পেষিত মুসলিম জাতি যখন দিশেহারা তখন ইংরেজ রাজ্যের অধিনে থেকেই শিক্ষা,চাকুরি,ব্যবসা ইত্যাদি ময়দানে হিন্দু ও শিখদের পাশাপাশি মুসলমানদের অগ্রসর করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে স্যার সাইয়েদ আহমাদ আলীগড় শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন। ইংরেজদের সাথে আপোষের মনোভাব নিয়ে ইংরেজী ভাষা শিখে যাতে মুসলমানরা যাতে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে দরদি মন নিয়ে তিনি এ পথে পা বাড়ান। ইসলামের দৃষ্টিতে এ পরাজিত মনোভাব আপত্তিকর হলেও তিনি পরম আন্তরিকতার সাথেই এ পদক্ষেপ নিলেন। এমন কি এ পরাজিত মনোভাবের ফলে তিনি কুরআনের এমন ব্যাক্ষ্যা দিতে আরম্ভ করলেন যা সত্যিকার ওলামা মহলকে বিচলিত করল। এরই ফলে শুরু হল দেওবন্দ আন্দোলন।

হযরত মওলানা কাসেম নানুতুভী (রঃ)-এর নেতৃত্বে মাওলানা শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভির চিন্তাধারার পথ ধরে কুরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের হেফাজতের মহান উদ্দেশ্য নিয়ে দেওবন্দ দারুল উলুম প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ গোটা উপমহাদেশের অগণিত মাদ্রাসা ঐ আন্দোলনেরই ফসল।

আলীগড় আন্দোলন ইংরেজের সাথে লড়াই-এর পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। আর দেওবন্দ আন্দোলন ইংরেজের গোলামীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাবকে টিকিয়ে রাখারই চেষ্টা করে। কিন্তু বলাকোটের পরাজয়ের পর এবং সিপাহি বিদ্রোহে ব্যর্থ হবার ফলে মুসলমানদের পক্ষে এককভাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে দাড়ান আর সম্ভব হয় নি।

১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার পর তুরস্কের মুসলিম খেলাফতকে ইংরেজরা যখন খতম করার ব্যবস্থা করল তখন খেলাফত রক্ষার পক্ষে এক আন্দোলনের উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আবার জাগরন দেখা দেয়। খেলাফত আন্দোলন নামে খ্যাত এ আন্দোলন মুসলমানদের নেতৃত্বে শুরু হয়। এবং এতে দেওবন্দের ভূমিকা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ছিল।

মিঃ গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলন এ সুজগে ইংরেজ বিরোধী এ খেলাফত আন্দোলনের সাথে সহযোগিতা করে দেওবন্দের সাথে ঘনিষ্ট হলো। কিন্তু খেলাফত আন্দোলন ও ব্যর্থ হলো। ফলে দেওবন্দের নেতৃত্বে গঠিত জামিয়তে ওলামায়ে হিন্দ নামক নিখিল ভারত ওলামা সংগঠন আরও ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে পড়ল। ইখলাসের সাথেই ওলামায়ে হিন্দ বিশ্বাস করতেন যে,ইংরেজ দেরকে ভারত থেকে না তাড়ান পর্যন্ত মুসলমানদের কোন উন্নতি হতে পারে না এবং ইসলামী খেলাফ কায়েমও সম্ভব নয়। তারা একথা বিশ্বাস করতেন যে,মুসলমানদের একক চেষ্টায় ইংরেজদেরকে তাড়িয়ে দেশ আজাদ করা সম্ভব নয়। তাই ওলামায়ে হিন্দ গান্ধী ও নেহেরুর নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে মিলেই ইংরেজদেরকে বিতারিত করতে করতে চেষ্টা করলেন।

অপর দিকে আলীগড় আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদেরকে স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু বিদ্বেষী করে তুলল। তারা দেখল যে,ইংরেজী শিক্ষায় অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায় সরকারী চাকুরী,ব্যবসায়-বানিজ্য ও সব রকম পেশা দখল করে এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে,শিক্ষিত হয়েও মুসলমানরা কোথাও চাকুরি পাচ্ছে না। ইংরেজরা তো হিন্দুদেরকে একচেটিয়া অধিকার দিয়ে রেখেছিল। এখন সব ময়দানে মুসলমানরা ভাগ বসাতে চায় দেখে হিন্দুরা সব জায়গায় মুসলমানদেরকে কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করল। চাকুরী,ব্যবসা ও বিভিন্ন পেশায় হিন্দুদের এ আচরন আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদেরকে হিন্দু বিদ্বেষী করাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ওলামাদের সাথে এ ব্যপারে হিন্দুদের কোন সংঘর্ষ ছিল না। হিন্দুদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলে সর্বত্র যে হিন্দু প্রাধান্য সৃষ্টি হবে সেকথা আধুনিক শিক্ষত সমাজ যেভাবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিল ওলামা সমাজের পক্ষে তা বুঝা সম্ভব ছিল না। কারন মুসলিম সমাজের যে ময়দানে ওলামা কাজ করে ছিলেন সেখানে হিন্দুর সাথে তাদের স্বার্থের সংঘর্ষের কোন সম্ভানা ছিল না এবং হিন্দুদের সাথে কোথাও ওলামাদের প্রতিযোগীতার কারন ঘটে নি।

কংগ্রেসের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলেও মুসলমানরা হিন্দুর গোলামই থেকে যাবে বলে শিক্ষিত মুসলিম সমাজ তিব্রভাবে অনুভব করল। পাকিস্তান আন্দোলন এ অনুভূতিরই সৃষ্টি। মিঃ মুহাম্মাদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ দাবি করল মুসলমান সংখ্যা গুরু এলাকায় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র হতে হবে। এ দাবি ইংরেজ ও হিন্দুর গোলামিতে পিষ্ট মুসলিম সমাজের নব জাগরনের সৃটি করল। মিঃ জিন্নাহ মুসলমানদের নিকট কায়েদ আজম (শ্রেষ্ট নেতা)হবার মর্যাদা পেলেন।

মুসলমানদের এ পৃথক আন্দোলনে বিচলিত হয়ে কংগ্রেস দাবী করল যে,ভারতে সব ধর্মের লোকই ভারতীয় জাতি হিসেবে এক জাতি। ধর্মের ভিত্তিতে এ মহান জাতিকে বিভক্ত করা কিছুতেই উচিত নয়। কংগ্রেসে এ ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ দাবি করল যে,মুসলমানদের আদর্শ ইসলাম এবং ইসলাম শুধু ধর্ম নয়। তাই ইসলামী জীবন বিধানের ভিত্তিতে মুসলমানরা একটি ভিন্ন জাতি। সে হিসেবে ভারতে দুটো জাতি রয়েছে। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী মুসলিম জাতি এ আদর্শে বিশ্বাসীদের সাথে মিলে এক জাতি হতে পারে না। এ মতবাদই দ্বিজাতি তত্ব বা “টুনেশান থিউরী” হিসেবে বিখ্যাত।

এ ভাবেই কংগ্রেসের এক জাতি তত্ব ও মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ব যখন বিরোধ বাধল তখন ওলামায়ে হিন্দ কংগ্রেসের পক্ষেই সমর্থন জানাল। উলামায়ে হিন্দ নেতা হযরত মাওলানা হুসাইল আহাম্মদ মাদানী (রঃ)এ বিষয়ে ১৯৩৮ সালে লাহোর শাহী মসজিদে যে বিখ্যাত বক্তৃতা করেন তাতে তিনি একজাতি তত্ব কে ইসলাম বিরোধী নয় বলে প্রমান করার চেষ্টা করলেন। তার এ বক্তৃতাটি মুত্তাহিদা কাওমিয়াত আওর ইসলাম (একজাতি তত্ব ও ইসলাম) নামে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ সালে এ বক্তৃতার সমস্ত যুক্তি খন্ডন করে কুরআন হাদীস ও ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস থেকে বলিষ্ট যুক্তি দিয়ে মাওলানা মওদুদি (রঃ) প্রমান করেন যে,কংগ্রেসের এক জাতি তত্ব ইসলামী জাতীয়তার সম্পূর্ন বিরোধী। তাঁর এ বইটি “মাসালায়ে কাওমিয়াত’ (জাতীয়তা সমস্যা)নামে প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় এর অনুদিত বইটির নাম “ইসলাম ও জাতীয়তা বাদ”।

জাতীয়তা নিয়ে এ বিতর্কের ফলে ভারতকে অখন্ড রেখে স্বাধীন করার কংগ্রেসী আন্দোলন ও সুসলমানদের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের মুসলিম লিগের আন্দোলন রাজনৈতিক ময়দানে চরম তিক্ততার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে কংগ্রেস সমর্থক ওলামায়ে হিন্দের বিরুদ্ধে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এর প্রতিক্রিয়া ওলামা সমাজেও দেখা দেয়। দেওবন্দের অধিকাংশ ওলামা কংগ্রেসের সাথে গেলেও মাওলানা সাব্বির আহামদ ওসমানী (রঃ)ও মাওলানা মুফতী মুহুম্মদ শফী (রঃ)-এর নেতৃত্ব অনেক ওলামা পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ১৯৪৩ সালে জামিয়তে ওলামায়ে আসলাম নামে ওলামাদের একটি পালটা সংগঠন কায়েম করে মুসলিম লিগের সমর্থন করেন। মাওলানা জাফর আহমাদ ওসমানী (রঃ),মাওলানা সমসুল হক ফরিদপুরী (রঃ),মাওলানা মুফতী দ্বীন মুহাম্মাদ খান (রঃ), শর্ষিনার পীর সাহেব ও ফুরফুরার পীর সাহেব প্রমুখ অনেক ওলামা পাকিস্তান আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দেন। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রঃ)-ও মুসলিম লীগের সমর্থন দেন।

এভাবে ওলামা কেরাম বিভক্ত হয়ে এক দল কংগ্রেসের অখন্ড ভারত মতবাদের সমর্থন করেন এবং অন্যদল ভারত বিভাগ করে পাকিস্তান কায়েমের পক্ষ অবলম্বন করেন। এতে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয় তার ফলে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ওলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে মুসলিম লীগকে স্বাধিনতার বিরোধী ও ইংরেজের দালাল আক্ষা দেয়া হয়॥

ঐ সময় আমি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন ছাত্র কর্মী হিসেবে ওলামায়ে হিন্দের সম্পর্কে যে মনোভাবই পোষন করতাম,পরবর্তী কালে সমস্ত ঘটনাকে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে বিচার করে আমি সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে,ওলামায়ে হিন্দ মুসলিম লীগ নেতাদের দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়া সম্ভব বলে সংগত কারনেই বিশ্বাস করতেন না। তাই দেশ ভাগ করে মুসলিম জাতিকে দু’ দেশের মধ্যে বিভক্ত করা তারা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেননি। কিন্তু কংগ্রেসের অখন্ড ভারতের মতবাদ যে মুসলিমদের জন্য মারাত্বক ছিল সে বিষয়ে সংগত কারনেই তাদের ধারনা ছিল না। আন্তরিকতা থাকা সত্বেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভূল হওয়া অসম্ভব নয়। একথা আমার বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে,মাওলানা মাদানী (রঃ)-এর মতো ব্যক্তি ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি হবে বুঝেও দুনিয়ার কোন স্বার্থে কাজ করতে পারেন। এ মানের লোকদের নিয়তের উপর হামলা করার সাহস আমার নেই। ভুল এক কথা,আর বদ- নিয়তে কাজ করা অন্য কথা।

যা হোক উপমহাদেশের ওলামা সমাজ বিভক্ত হয়ে এক দল কংগ্রেস সমর্থক ও অন্য দল মুসলিম লীগ সমর্থকের ভূমিকায় যখন সক্রিয়,তখন মাওলানা মওদূদী তাঁর “তারজুমানুল কুরআন” নমক মাসিক পত্রিকার মাধ্যমে এমন একটি তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করলেন যা ওলামায়ে কেরামের উভয় দলকেই সন্তুষ্ট করল। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে মাওলানার বইটি মুসলিম লীগ পন্থি ওলামায়ে কেরাম মাওলানা মাদানী (রঃ)-এর একজাতি তত্বের মতবাদের বিরুদ্ধে একটি মযবুত হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগান। কিন্তু ১৯৪০ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাওলানা মওদূদীর “ইসলামী হকুমাত কিসতারাহ কায়েম হোতি হায়” (বাংলায় অনুদিত বইটির নাম–ইমলামী বিপ্লবের পথ)নামক বক্তৃতায় মুসলিম লীগ মহল অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। সে বক্তৃতায় তিনি যুক্তি দিয়ে প্রমান করেন যে,দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে মুসলিমদের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন অত্যন্ত সঠিক ও পূর্ন সমর্থন যোগ্য হওয়া সত্বেও মুসলিম দেশ কায়েম হলেও কিছুতেই তারা ইসলামী হুকুমাত বা সরকার কায়েম করতে পারবে না। নবী করীম (সঃ)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষন করে তিনি দেখলেন যে,ইসলামকে জানে এবং নিজেদের জীবনে মানে এমন নেতৃত্ব ও কর্মী বাহিনী তৈরীর কোন কর্মসূচী না থাকায় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে শুধু অক্ষমই হবে না বরং ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করলে তারা সে আন্দোলনের নেতাকে ফাঁসি দেয়া প্রয়োজন মনে করবে। এ বক্তৃতার ঠিক ১৪ বছর পর সত্যিই তাঁর এ অনুমান সত্য প্রমানিত হয়। ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগ শসনামলে তাঁকে এক অজুহাত দেখিয়ে ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়েছিল।

মাওলানা মাদানী (রঃ)-এর একজাতি তত্বের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদূদীর বইটি প্রকাশিত হবার পর দেওবন্দ থেকে ক্রমাগত মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া বের হতে থাকে। কংগ্রেসকে সমর্থন করা মুসলমানদের কিছুতেই উচিত নয় বলে মাওলানা মওদূদী যত জোরালোভাবে লিখতে থাকলেন ততই ফতোয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকলো। এভাবে মাওলানা মওদূদী একদিকে কংগ্রেস সমর্থক ওলামায়ে কেরামের ফতোয়ার শিকারে পরিনত হলেন,অপর দিকে মুসলিম লীগ মহলের নিকটও নিন্দনীয় হলেন। অবশ্য পাকিস্তান কায়েম হবার পূর্ব পর্যন্ত মাওলানা মওদূদীর কতক লেখা পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক ছিল বলে মুসলিম লীগ নেতারা তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি। কিন্তু পাকিস্তান কায়েম হবার পর তিনি ১৯৪৮ সালে ইসলামী শসন তন্ত্র রচনার দাবী তুলবার সাথেসাথেই তাকে পাকিস্তান বিরোধী বলে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে জেলে আটক করা হয়।

মাওলানা মওদূদী দ্বীজাতি তত্বের পক্ষে তার বলিষ্ঠ ও শ্রেষ্টতম রচনা দ্বারা পাকিস্তান আন্দোলনকে শক্তিশালী করা সত্বেও তিনি মুসলিম লীগে যোগ দান করেন নি। ১৯৪০ সালে আলীগড়ে পূর্বোল্লিখিত বক্তৃতার পর এক বছর ক্রমাগত তিনি তার মাসিক পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম লীগ নেতাদের নিকট এমন কতক কর্মসূচীর প্রস্তাব দেন যা না হলে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র বানানো যাবে না। কিন্তু লীগ নেতারা কোন সাড়া না দেয়ায় তিনি ১৯৪১ সালের আগষ্ট মাসে উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে লাহোর আগত ৭৫ জন লোক নিয়ে ঐসব কর্মসূচীর ভিত্তিতে “জামায়াতে ইসলামী”র সংগঠন শুরু করেন। ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ঐসব প্রস্তুতিমূলক কাজ করার ফলেই পাকিস্তান কায়েম হবার পর ইসলামী শাসনতন্ত্রের আন্দোলন মুসলিম লীগ সরকারের তীব্র বিরোধিতা স্বত্বেও এত জোরদার হয়।

বালাকোট ময়দানে ১৮৩১ সালে সইয়্যেদ আহমাদ ব্রেলভী (রঃ)ও শাহ ইসমাইল শহীদ (রঃ)-এর শাহাদাতের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের পতন হয়। এর পর দীর্ঘ একশ বছর মুসলমানদের মধ্যে কি আবস্থা বিরাজ করছিল,এর সংক্ষিপ্ত ধারনা এখানে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এ থেকে অনুমান করা যায় যে,কেন একশ বছরের মধ্যেও ইকামাতে দ্বীনের আর একটি আন্দোলন শুরু হতে পারে নি। ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন জোরদার হয়ে উঠল এবং মুসলমানরা যখন আবার জেগে উঠে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবী জানাবার মতো শক্তি পেলো তখনই ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন গড়ে তুলবার পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন আবার মুসলমানদের মনে সাড়া জাগালো। এসময় যদি বড় বড় ওলামাগণ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের পেছনে না যেয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারতেন তাহলে হয়তো উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্নরূপ হতো। পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবার মহান উদ্দেশ্য হয়তো পূর্ন হতো। উপমহাদেশের মুসলমানদের দূর্ভাগ্য যে ঐ উপযুক্ত সময়ে ওলামায়ে কেরাম “ইকামাতে দ্বীনের” ডাক দিতে পারলেন না।

এ ডাকই দিলেন মাওলানা মওদূদী ১৯৪১ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ৩৮ বছর। কিন্তু সে সময় বড় বড় ওলামা প্রায় সবাই কংগ্রেস বা লীগে বিভক্ত। অথচ ঐ দু’ পথের কোনটাই ইসলামী নেতৃত্বে পরিচালিত ছিল না। এ থেকেই মনে হয় যে,তখনকার রাজনৈতিক পরিবেশ ওলামায়ে হিন্দের নিকট ইংরেজ থেকে আজাদী হাসিলই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আর লীগ পন্থি ওলামাদের নিকট দেশ ভাগ করে স্বাধীন মুসলীম দেশ কায়েমই আসল লক্ষ্য ছিল। এ দুটো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিজের নেতৃত্ব দেয়ার মতো পজিশন তাদের ছিল না। তাই তাদের কংগ্রেস ও লীগ নেতাদের পেছনেই চলতে হয়েছে।

ইতিহাসের ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের আলেম সমাজকে সঠিক শিক্ষা গ্রহন করতে হলে তাদেরকে গভীরভাবে এবং ধীরচিত্তে চিন্তা করতে হবে। ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত ও কর্মসূচী নিয়ে এ দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিনত করার আন্দোলন করাই যে দ্বীনের দাবী তা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। বিলম্ব করলে বোখারার ন্যয় চির গোলামী,আর না হয় আফগানিস্থানের মতো মুসিবতে পড়বার আশংকা রয়েছে। খোদা না করুন এমন অবস্থা হলে যেটুকু দ্বীনের খেদমতে ওলামাগণ এখন নিযুক্ত আছেন এটুকুর সুযোগ থাকবে কিনা সন্দেহ।