হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ
-শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ)
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ
[প্রথম খণ্ড]

মূল
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)
অনুবাদ
অধ্যাপক আখতার ফারুক
এম, এম, এম, এ
প্রকাশনায়
রশীদ বুক হাউস
৬নং প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০

HUJJATULLAHIL BALIGAH
BY
SHAH WALIULLAH MUHADDIS-E-DEHLOVI

প্রকাশক
আবদুর রব খান
রশিদ বুক হাউস
৬ নং প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
[প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত]
প্রকাশকাল
দ্বিতীয় প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০০১ ইং
তৃতীয় প্রকাশঃ মে ২০০৮ইং
বর্ণবিন্যাস
ওয়ালেদাইন কম্পিউটার
প্যারিদাস রোড, ঢাকা
প্রাপ্তিস্থান
দারুচ্ছুন্নাত লাইব্রেরী
ছারছীনা শরীফ
ইসলামিয়া লাইব্রেরী
সাহেব বাজার, রাজশাহী
দেওয়ান ষ্টোর
বজ মসজিদ রোড, টাঙ্গাইল
দারুল বুহুছ লাইব্রেরী
মাদরাসা রোড, সোবহানী ঘাট, সিলেট
আলবারাকাত ইসলামি সেন্টার
পৌরবাজার, রংপুর
এছাড়াও বাংলাদেশের প্রতিটি ধর্মীয় লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়।

সূচীপত্র
বিষয়ঃ
(ক) গ্রন্থকার পরিচিতি
(খ) গ্রন্থের উদ্দেশ্য
১। প্রাক-প্রারম্ভিকা
২। প্রারম্ভিকা
৩। প্রথম খণ্ডঃ প্রথম পরিচ্ছেদ
৪। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, আলম-ই মিছাল
৫। তৃতীয় পরিচ্ছেদ, মালা-ই আলা
৬। চতুর্থ পরিচ্ছেদ, আল্লাহর অনড় বিধান
৭। পঞ্চম পরিচ্ছেদ, প্রাণের রহস্য
৮। দায়িত্ব তত্ত্ব
৯। দায়িত্ব মানুষের বিধি লিপি
১০। দায়িত্বই প্রতিদান চায়
১১। বিভিন্ন স্বভাবের বিচিত্র মানুষ
১২। কর্ম প্রেরণার উৎস
১৩। যার কাজ তার সাথেই থাকে
১৪। কাজের সাথে স্বভাবের সংযোগ
১৫। শাস্তি ও পুরস্কারের কারণ
১৬। পার্থিব ও অপার্থিব শাস্তি-পুরস্কারের রূপরেখা
১৭। পার্থিব শাস্তি ও পুরস্কার
১৮। মৃত্যু রহস্য
১৯। কবরে মানুষের অবস্থা
২০। বিচার জগতের তত্ত্বকথা
২১। মানব সমাজের বিভিন্ন সংগঠন
২২। সংগঠন উদ্ভাবন পদ্ধতি
২৩। প্রথম সংগঠন
২৪। জীবিকা পদ্ধতি ত
২৫। পারিবারিক ব্যবস্থা
২৬। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
২৭। রাজনীতি
২৮। রাষ্ট্রপতিগণের চরিত্র ও গুণাবলী
২৯। পরামর্শ পরিষদ ও কর্মককর্তাদের গুণাবলী ও দায়িত্ব
৩০। আন্তঃরাষ্ট্রিক নীতিমালা
৩১। সার্বজনীন মানবিক মৌলনীতি
৩২। মানব সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি
৩৩। মানবিক বৈশিষ্ট্য, বৈশিষ্ট্যের তাৎপর্য
৩৪। মানবিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য
৩৫। বৈশিষ্ট্য অর্জনে মানবের বিভিন্ন পদ্ধতি
৩৬। বৈশিষ্ট্যের দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্জনের নীতিমালা
৩৭। স্বভাব চতুষ্টয় অর্জন, অপূর্ণত্ব পূর্ণ করা ও হৃত বস্তু উদ্ধার করার পদ্ধতি
৩৮। মানবিকতা বিকাশের অন্তরায়
৩৯। অন্তরায় দূর করার পথ
৪০। পাপ-পূণ্যের বিবরণ
৪১। তওহীদ
৪২। শিরকের হাকীকত
৪৩। শিরকের প্রকারভেদ
৪৪। আল্লাহর গুণাবলীর ওপর ঈমান
৪৫। তাকদীরে বিশ্বাস
৪৬। ইবাদতের উপর ঈমান
৪৭। আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন
৪৮। ওযু ও গোসলের রহস্য
৪৯। নামাযের হাকীকত
৫০। যাকাতের হাকীকত
৫১। রোজার হাকীকত
৫২। হজ্জের হাকীকত
৫৩। বিভিন্ন পূণ্যের হাকীকত
৫৪। পাপের বিভিন্ন স্তর
৫৫। পাপের কুফল
৫৬। ব্যক্তিগত পাপ
৫৭। সামাজিক পাপ
৫৮। জাতি-ধর্মের ব্যবস্থাপনা, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মন্যায়কদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব
৫৯। নবুওয়াতের হাকীকত
৬০। দ্বীন এক, শরীয়ত বিভিন্ন
৬১। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে ভিন্ন ভিন্ন শরীয়ত প্রেরণের রহস্য
৬২। শরীয়তের জন্যে জবাবদিহির কারণ
৬৩। কলা-কৌশল ও কার্যকারণ রহস্য

অনুবাদকের আরজ
ইসলামী দুনিয়ার একটি অবিস্মরণীয় নাম হচ্ছে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী। আর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ হল তাঁর এক অবিনশ্বর কীর্তি। এ মহাগ্রন্থ শুধু মুসলিম জাহানেই নয়, সারা বিশ্বে এক মহা বিস্ময় হয়ে আছে। এ মহাগ্রন্থের মহান গ্রন্থকার কে ছিলেন তা বলা সহজ, কিন্তু কি ছিলেন তা অনুধাবন করা এ অধম তো দূরে, কোন উত্তমের পক্ষেও নিতান্তই দুরূহ ব্যাপার। তাই তাঁর গ্রন্থের ভাষান্তর ব্রতটি যে স্বতঃসিদ্ধ এক দুঃসাধ্য সাধনা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আল্লাহ পাকের লাখ লাখ শুকরিয়া যে, তিনি এ অধম বান্দাকে সেই দুঃসাধ্য সাধনার দুঃসাহস দান করেছেন আর তাওফিক দিয়েছেন তার পয়লা পর্ব সমাপ্ত করার। তাই তাঁরই সমীপে এ অধমের ঐকান্তিক প্রার্থনা, যেন তিনি এর দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত করার তাওফিকও এ অধমকে এনায়েত করেন।
ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ।
অসংখ্যদরূদ ও সালাম সেই মহানবী (সঃ)-এর উদ্দেশ্যে যে মহাজ্যোতিস্কের অপূর্ব জ্যোতি প্রভায় উপ-মহাদেশে এ বিস্ময়কর জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটেছে। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর আল-আসহাবের ওপরও এ অধমের দরূদ ও ছালাম পৌঁছে দিন। আমীন।
বস্তুতঃ ‘ফালিল্লাহিল হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতিটি বাণী ও বিধানই যে অকাট্য দলীল-প্রমাণ ধ্বারা প্রতিষ্ঠিত তাঁর জ্বলন্ত স্বাক্ষর বয়ে চলছে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ। তাঁর লৌকিক কি পারলৌকিক, জৈবিক কি আত্মিক কোন বাণী ও বিধানই যে অযৌক্তিক ও অবাস্তব নয় এ মহা গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় তার বলিষ্ঠ প্রমাণ যথার্থ ঈমানদার, আমলদার, এমন কি সম্ভবতঃ আল্লাহ ওয়ালায় পরিণত করতে সক্ষম।
তবে কথা হচ্ছে, লাখো গুরুর যিনি গুরু তাঁর গ্রন্থ স্বভাবতঃই গুরুজনদের জন্যে লিখেছেন যেন গুরুজনরা তা অনুধাবন করে লঘুজনদের পথনির্দেশ করেন। তাই লঘুজনরা যে সরাসরি এ গ্রন্থ হজম করতে পারবেন তা আশা করাই বাতুলতা মাত্র। এ কারণেই আশা করি লঘুজনরা গুরুজনদের মাধ্যম ছাড়া কখনও এ গ্রন্থ গলাধঃকরণ করতে গিয়ে জটিলতার শিকার হবেন না।
আধুনিক বিশ্বের এটাই বিস্ময় যে, দু’শ বছর আগের এক জ্ঞানতাপস কি করে একালের জটিল সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও অর্থনীতির এরূপ অত্যাধুনিক বিশ্লেষণ ও নীতিমালা দিয়ে গেলেন। আর কি করেই বা তিনি একালের প্রাত্যাহিক জটিল সমস্যাগুলোর এরূপ স্থায়ী সমাধান আবিস্কার করলেন। জ্ঞানের জগতে এরূপ অভাবনীয় দূরদর্শিতার নজীর তাদের সামজে আজও অনুপস্থিত।
শরীয়তের ছোট-বড় প্রতিটি বিধানই যে মানবকুলের জন্যে অশেষ কল্যাণপ্রদ ও তাদের সকল ব্যাধি নিরসনের অমোঘ বিধান তা এত অকাট্যভাবে এ গ্রন্থে উপস্থাপন করা হয়েছে যা এ কালের তর্কশাস্ত্রের মহাপণ্ডিতরাও খণ্ডন করতে পারবেন না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করার তাওফিক যার হয়নি তাকেও এ গ্রন্থ মানিয়ে ছাড়বে যে, মূলতঃ এ দ্বীনই সত্য দ্বীন। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার এটাই শ্রেষ্ঠতম সাফল্য।
মালা-এ-আ’লার সর্বোচ্চপরিমণ্ডল পরিবৃত্ত অবস্থায় যে মহাগ্রন্থ রচিত হয়েছে মালা-এ আসফালের সর্বনিম্ন পরিমণ্ডলের এ অধম বাসিন্দা তার কতটুকু মর্ম উদ্ধার করতে পেরেছে তা আল্লাহই ভাল জানেন। তবে সান্ত্বনা এই যে, যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। তাই বলছি, এক মহামানবের এ মহান গ্রন্থের কিছুমাত্র মর্ম উদ্ধার করে ও যদি জাতিকে উপহার দিতে সমর্থ হয়ে থাকি, তার সব কৃতিত্বই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। পক্ষান্তরে এ ক্ষেত্রে যা কিছু ব্যর্থতা ও ভুল-ভ্রান্তি তার সব দায়-দায়িত্ব একান্তই আমার, তাই অনুরোধ, কোন সহৃদয় গুরুজন যদি এ ক্ষেত্রে আমাকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন তা হলে সানন্দে ও সকৃতজ্ঞ চিত্তে তা গ্রহণ করা হবে।
আল্লাহ পাক এ গ্রন্থকেও মূল গ্রন্থের কমবুলিয়াত ও বরকত দান করুন এটাই আমার একমাত্র প্রার্থনা। আমীন।
আহকার
আখতার ফারুক

গ্রন্থকার পরিচিতি
পটভূমিঃ
খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেই ইসলামের আওয়াজ ভারত উপমহাদেশে পৌঁছেছিল।
প্রাচীনকাল থেকেই আরব ব্যবসায়ীগণ ভারত উপমহাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখত। বিশেষতঃ শ্রীলঙ্কা ও উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাগুলোর সাথে আরবদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এ পথেই সুদূর চীন পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যিক নৌবহর যাতায়াত করত।
উপমহাদেশে শুধু বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমেই ইসলাম আসেনি; বরং হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর যুগেই এদেশে মুসলমানদের সামরিক অভিযান শুরু হয়। অতঃপর ৯২ হিজরীতে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম সিন্ধু জয় করে উমাইয়া খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতের সময়ে উপমহাদেশের পশ্চিম অঞ্চলের সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত মুসলমানদের সামরিক তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল। আব্বাসীয় খেলাফতের শেষভাগে সুলতান মাহমুদ বারংবার অভিযান চালিয়ে পশ্চিম ও উত্তর ভারতের বিশাল এলাকা দখল করেন।
মাহমুদ গজনভীর শাসন কালের পর মুহাম্মদ ঘোরীর শাসন শুরু হয়। মুহাম্মদ ঘোরী বারংবার অভিযান চালিয়ে উপমহাদেশের অধিকাংশ এলাকা জয় করেন। অতঃপর দাস, খিলজী ও লোদী বংশের শাসনামলে সর্ব ভারতে মুসলিম শাসনের জয় ডংকা নিনাদিত হয়। পরিশেষে মোঘল শাসনামলে গোটা উপমহাদেশ ইসলামী শাসনের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। অবশেষে সম্রাজ আলমগীরের সময়ে সাম্রাজ্যের চরম বিস্তৃতি ঘটে। কিন্তু তাঁর পরবর্তী সম্রাটদের দুর্বলতার কারণে মোঘল শাসনের পতন শুরু হয়। এমনকি শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা ইংরেজের হাতে চলে যায়।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) মোগল সম্রাটদের এই পতনকলের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তখন চারদিকে বিদ্রোহ ও হাংগামা চলছিল। রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের সর্বত্রই এক নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছিল। চারদিকে জুলুম, শোষণ ও অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ঠিক এমনি এক মুহুর্তে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) এক প্রভাতী সূর্যের ন্যায় আবির্ভূত হলেন। তিনি ইসলামকে বিকৃতির হাত থেকে মুক্ত করলেন। রাজনীতিকে ইসলামের সেবক ও ইসলামপন্থীদের শৌর্যের প্রতীকরূপে প্রতীয়মান করালেন।
নামঃ
হুজ্জাতুল ইসলাম শায়েখ কুতুবুদ্দিন আহমত ওরফে মাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী ইবনে শায়েখ আবদুর রহীম ইবনে শায়েখ ওয়াজিহ উদ্দীন ইবনে শায়েখ মুয়াজ্জিম ইবনে শায়েখ মানসুর ইবনে শায়েখ কামালুদ্দিন ছানী ইবনে শায়েখ কাজী কাসেম ইবনে শায়েখ কাজী বুধা ইবনে শায়েখ আবদুল মালেক ইবনে শায়েখ কুতুবুদ্দীন ইবনে শায়েখ কামালুদ্দিন (আউয়াল) ইবনে শায়েখ শামসুদ্দীন মুফতী ইবনে শের মালিক ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবুল ফাতাহ ইবনে উমর ইবনে আদিল ইবনে ফারূক ইবনে জার্জিস ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে উসমান ইবনে মাহান ইবনে হুমায়ুন ইবনে কুরায়েশ ইবনে সুলায়মান ইবনে আফফান ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে খাত্তাব আল কুরায়শী।
শাহ সাহেব (রাঃ) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ “তাফহীমাতে এলাহীয়ার” দ্বিতীয় খণ্ডে বলেনঃ
আমার মুহতারাম আব্বা (শায়েখ আবদুর রহীম) ছিলেন জাহেরী ও বাতেনী ইলমে পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন এক আরিফ বিল্লাহ ওলী। ঘটনাক্রমে তিনি একবার শায়েখ কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রাঃ)-এর মাজার জিয়ারত করতে গেলেন। শয়েখ বখতিয়ার কাকী (রাঃ) তাঁর সাথে কথাবার্তা বললেন। তিনি আব্বাকে একটি সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। সন্তানটি তাঁর ঘরেই জন্ম নেবে। তিনি তাঁকে নির্দেশ দিলেন ছেলের নাম রাখবে কুতুবুদ্দীন। অতঃপর যখন আমার জন্ম হল, আল্লাহ পাক তাঁকে কুতুবুদ্দিন নাম রাখার ব্যাপারটি ভুলিয়ে দিলেন। ওয়ালিউল্লাহ। পরে অবশ্য কুতুবুদ্দীন নামও রেখেছিলেন। শাহ সাহেব (রঃ) ফারূকী খান্দানের লোখ। তাই ইসলামের শুরু থেকেই তারা ইসলামী শিক্ষা ও রাজনীতির সমন্বয়কারী হিসেবে চলে আসছেন। তাঁদের বংশে বীরত্ব, বদান্যতা, জ্ঞান ও মর্যাদায় খ্যাতিমান বহু ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে।
তাঁর খান্দানের ভেতর সর্বপ্রথম উপমহাদেশে আগমন করেন শায়েখ শামসুদ্দীন মুফতী। তিনি দিল্লী থেকে ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থিত এক ক্ষুদ্র শহরে এসে অবস্থান নেন। তিনি অত্যন্ত উঁচু দরের আলেম, জাহেদ ও পরহেজগার বুযুর্গ ছিলেন। ইসলামের প্রচার-প্রসার কল্পে তিনি সেখানে একটি দ্বীনি মাদ্রাসা কায়েম করেন এবং দ্বীনের প্রচার কার্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সময়ে দিল্লী ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় তাঁকেই সবাই ধর্মীয় ও রাজণৈতিক পথপ্রদর্শক ভাবত। ফলে পার্থিব ঝগড়া-বিবাদের কাজী ও দ্বীনি মাসায়েলের মুফতী হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করতেন।
তাঁর পর থেকে শায়েখ মাহমুদ ইবনে কাওয়ামুদ্দীন পর্যন্ত কাজীর দায়িত্বভার তাঁদের হাতেই ছিল। তবে শায়খ মাহমুদ তা পরিত্যাগ করে সেনা বিভাগে যোগ দেন। শাহ সাহেব (রঃ)-এর দাদা পর্যন্ত তাঁর পূর্বপুরুষজরা জেহাদের ময়দানেই দ্বীনের শান-শওকত বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত থাকেন। কাফের-মোশরেকের বিরুদ্ধে জেহাদে লিপ্ত থাকাকেই তাঁরা পেশা করে নিয়েছিলেন। তাঁর দাদা শায়েখ ওয়াজিহুদ্দীন আজীবন রণাঙ্গণে কাটিয়েছেন। এমনকি মোগল সম্রাট মহিউদ্দীন মুহাম্মদ আলমগীরের সময়ে তিনি জেহাদের ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন।
শায়েখ ওয়াজিহুদ্দীনের তিন ছেলে ছিল, তারা হলেন শায়েখ আবু রেজা মুহাম্মদ, শায়েক আব্দুল হাকীম ও শায়েখ আবদুর রহীম। শাহসাহেবের পিতা শায়েখ আবদুল হাকীম ও শায়েখ আবদুর রহীম। শাহ সাহেবের পিতা শায়েখ আবদুর রহীম ১০৬৪ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুরআন শরীফ, নাহু, সরফ ও অন্যান্য প্রারম্ভিক শিক্ষার কিতাবাদি তার বড় ভাই শায়েখ আবু রেজা মুহাম্মদের কাছে পড়েন। পরবর্তী স্তরে তিনি আল্লামা মীর মোহাম্মদ জাহেদের কাছে জ্ঞানার্জন করেন। এমনকি কিতাবী ও তাত্ত্বিক জ্ঞানে তিনি এরূপ পারদর্শী হলেন যে, তিনি অনতিকালের ভেতর এ উভয়বিধ জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ালেন। সম্রাট-আলমগীর জিন্দাপীরের উদ্যোগে প্রণীত “ফতোয়ায়ে আলমগীরী” কিতাবের তিনি সম্পাদনতা ও শুদ্ধিকরণের দায়িত্ব পালন করেন। বাদশাহ আলমগীর তাঁর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিলেন।
শরীয়ী মাজহাদের দিক থেকে তিনি হানাফী ছিলেন। তাসাওফের ক্ষেত্রে তিনি নকশবন্দী তরীকার অনুসারী ছিলেন। অবশ্য দলীলের শক্তি ও প্রাধান্যের কারণে কখনও হানাফী মজহাবের বাইরেও ফতোয়া দিতেন। ১১৩১ খৃষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।
জন্মঃ
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) ১১৬৪ হিজরীর ১৪ই শাওয়াল বুধবার দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। শায়েখ আবদুর রহীম (রঃ)-এর জীবনচরিত “বাওয়ারিফুল মারিফাত” গ্রন্থে শাহওয়ালিউল্লাহ (রঃ)-এর জন্মকাল ও তার প্রাক্কালের এমনসব ঘটনাবলীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
শিক্ষা জীবনঃ
পাঁচ বছর বয়সেই কুরআন শিক্ষার জন্যে তাঁকে মকতবে ভর্তি করা হয়। সাত বছর হতেই তিনি কুরআনের হাফেজ হলেন। সে বছরেই তাঁর আব্বা তাঁকে রোযা রাখার নির্দেশ দেন। এমনকি ইসলামের অন্যান্য বিধি-বিধানও যথাযথভাবে আমল করার জন্যে উপদেশ দেন।
সাত বছর বয়স থেকেই তিনি ফার্সী কিতাব অনায়াসে পড়ার যোগ্যতা হাসিল করেন। এক বছরে ফার্সী শেষ করে নাহু, সরফ সম্পর্কিত গ্রন্থাদি পড়া শুরু করেন। দশ বছর বয়সে তিনি শরহে মোল্লা জামী আয়ত্ত করেন। মোটকথা মাত্র তিন বছরে তিনি নাহু-সরফে এরূপ পারদর্শী হলেন যে, উক্ত বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ পর্যন্ত তাঁর সামনে এসে মাথা নত করতে বাধ্য হতেন।
তিনি লোগাত, তফসীর, হাদীস, ফিকাহ, তাসাওফ, আকায়েদ, মানতেক, চিকিৎসা শাস্ত্র, দর্শন, অংক শাস্ত্র, জ্যোতি বিজ্ঞান ইত্যাদি শিখেন। মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি এসব কেতাব শেষ করেন। পুথিগত ও জ্ঞানগত সকল বিদ্যা শেষ করে তিনি তাঁর আব্বার হাতে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্যে বাইয়াত নেন। অতঃপর তিনি নকশবন্দীয়া তরীকার সুফীদের বিভিন্ন স্তর আয়ত্ত করেন। তিনি আধ্যাত্ম চর্চার ক্ষেত্রেও এরূপ দক্ষতা অর্জন করলেন যে, অল্পসময়ের ভেতরে তিনি সে জগতেও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করলেন। সলুক সম্পর্কিত তালীম শেষ হলে তাঁর আব্বা শায়েখ আবদুর রহীম তাঁর মাথায় মর্যাদার পাগড়ী বেঁধে দেন এবং তাঁকে শিক্ষা দান করার অনুমতি প্রদান করেন। এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করা হয়। তাতে দিল্লীর ওলামায়ে কেরাম, বুযুর্গানে দ্বীন, কাজীবৃন্দ ও অন্যান্য আমীর-উমারা উপস্থিত হন। সকলের উপস্থিতিতে শায়েখ আবদুর রহীম তাঁর ভাগ্যবান মহা মর্যাদাবান পুত্র শাহ ওয়ালিউল্লাহকে জাহের ও বাতেনী দ্বীনী ইলম শিক্ষা দানের অনুমতি দান করেন। পরন্তু তিনি নিজ পুত্রের ইলম ও হায়াত দারাজীর জন্যে দোয়া করেন। গোটা মজলিস আমীন, আমীন বলে দোয়ায় শরীক হন এবং এক যোগে তাকে মোবারকবাদ জানান।।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) তাঁর আব্বা ও শায়েখ মুহাম্মদ আফজল শিয়ালকুটির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
বিবাহঃ
শাহ সাহেব (রঃ)-এর বয়স যখন চৌদ্দ বছর, তখনই তাঁর পিতা তাঁকে বিয়ে করাবার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও সংসারের অন্য সবাই বিয়ের প্রস্তুতি নেই বলে ওজর পেশ করেন, তথাপি তাঁর পিতা সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি বরং অতি ক্ষিপ্রতার সাথে এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য উদগ্রীব হলেন। তিনি লিখে পাঠালেনঃ কেন আমি এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া করছি তা তোমরা অচিরেই বুঝতে পারবে। এ চিঠি পেয়ে সবাই রাজী হয়ে গেলেন এবং বিয়ে সম্পন্ন হল।
বিয়ের পর পরই তাঁর কজন নিকটাত্মীয় ইন্তেকাল করেন। কদিন না যেতেই শায়েখ আবু রেজার ছেলে আবদুর রশীদ মারা যান। তার কিছুদিন পর শাহ সাহেবের মাতা ইন্তেকাল করেন। তারপর স্বয়ং তাঁর আব্বা শায়েখ আবদুর রহীমও ইন্তেকাল করেন। এটাই ছিল শাহ সাহেবের বিবাহের ব্যাপারে তার পিতার তাড়াহুড়ার মূল রহস্য।
পর পর এতগুলো আঘাত স্বভাবতঃই তার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। তথাপি তিনি তাঁর জাহেরী ও বাতেনী ইলমের জোরে এসব বিপদাপদ সহজেই কাটিয়ে উঠেন।
হারামাইনের সফরঃ
১১৩১ হিজরীতে তার আব্বার ইন্তিকালের পর তিনি রহীমিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। তারপর একযুগ শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি আরব-আজমের সর্বত্র স্বীয় শিক্ষাগত যোগ্যতার বিরাট খ্যাতি অর্জন করেন। চারদিক থেকে ছাত্ররা ছুটে আসছিল তাঁর কাছে জ্ঞানার্জনের জন্যে। তারা জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানে পরিপূর্ণ হয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন। বার বছর শিক্ষকতার পর তিনি হজ্জের নিয়তে হারামাইন শরীফাইনে যাবার উদ্যোগ নেন এবং ১১৪৩ হিজরীতে তিনি হেজাজে তশরীফ নেন। অতঃপর ১১৪৫ হিজরীতে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় দু’বছর তিনি মক্কা ও মদীনায় কাটান। সেখানকার ওলামায়ে কেরামের সাথে মিলিত হন। সেখানকার হাদীসবেত্তাদের থেকে তিনি হাদীসের সনদ নেন। বিশেষতঃ শায়েখ ওবায়দুল্লাহ ইবনে শায়েখ মোহাম্মদ ইবনে সুলায়মান আল-মাগরেবীর কাছ থেকে তিনি বিশেষভাবে হাদীসের সনদ গ্রহণ করেণ। তাছাড়া সেকালের হারামাইনের সেরা আলেম, ফকীহ ও মুহাদ্দেস শায়েখ আবু তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আল-মাদানী থেকেও তিনি হাদীসের সনদ নেন। এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং বলেনঃ
“আমি হারামাইন শরীফাইনের অধিকাংশ বুযুর্গের সাথে দেখা করেছি। সেখানকার অধিকাংশ সর্বজ্ঞাতা পারদর্শী সম্মানিত লোকদের সাথে মেলামেশা করেছি। কিন্তু তাদের কাউকেই সর্বজ্ঞাতা পারদর্শী হয়েও উত্তম চরিত্রে বিমণ্ডিত রূপে দেখতে পাইনি। শুধুমাত্র শায়েখ আবু তাহের আল-মাদানীকে আমি সেরূপ পেয়েছি। তাঁর দূরদর্শিতা ও অগাধপাণ্ডিত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমি আমার গ্রন্থরাজির বিভিন্ন স্থানে তা উল্লেখ করেছি”।
শাহ সাহেব (রঃ) তাঁর সান্নিধ্যে যথেষ্ট সময় কাটিয়েছেন। তাঁর কাছে হাদীসের বর্ণনা শুনেছেন। মোটকথা শায়েখ আবু তাহের আল-মাদানী তাঁকে শুধু সনদ দেননি, তাঁর নিজস্ব খিরকাও শাহ সাহেবকে দান করেন। সে খিরকা জাহেরী ও বাতেরনী সকল প্রকার ইলম ও ফায়েজের আধার ছিল।
হারামইনে থাকা কালে তিনি শায়েখ তাজুদ্দীন হানাফীর খেদমতেও হাজির হন। তাঁর কাছ থেকেও তিনি সনদ হাসিল করেন। তাছাড়াও তিনি সেখান থেকে শায়েখ আহমদ থানাভী, শায়েখ আহমদ কাশানী, সাইয়েদ আবদুর রহমান ইদরিসী, শায়েখ শামসুদ্দীন মোহাম্মদ, শায়েখ ঈসা জাযরী, শায়েখ হাসান আজমী, শায়েখ আহমদ আলী, শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে সালেহ প্রমুখ থেকেও সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে সনদ হাসিল করেন। শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে সালেম আল বাসরী ওয়াল মক্কী সবচেয়ে উঁচু মর্যাদাসম্পন্ন মুহাদ্দেস ও আলিম ছিলেন।
দেশে প্রত্যাবর্তনঃ
হারামইন শরীফাইনের বুযুর্গ ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে জাহেরী ও বাতেনী ইলমে ভরপুর হয়ে শাহ সাহেব উপমহাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১১৪৫ হিজরীর ১৪ই রজব তিনি দিল্লী পৌঁছেন এবং নিজ পৈত্রিক আলয়ে অবস্থান করেন। কিছুদিন তিনি বিশ্রাম নেন। এ ফাঁকে দিল্লীর ওলামা-মাশায়েখদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। তারপর রহীমিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা দানের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শত শত হাদীস শিক্ষার্থী সেখানে ছুটে এসে তাঁর কাছ থেকে হাদীসের সনদ হাসিল করে চললেন। আশে-পাশের রাজ্যগুলোয়ও অনতিকালের ভেতর হাদীস চর্চা ছড়িয়ে পড়ল।
শাহ সাহেবের যুগে মুসলমান হাদীস সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েছিল। তারা ফিকাহ শাস্ত্রকেই ইলমের জন্যে যথেষ্ট ভাবত। শাহ সাহেবই হাদীসের গুরুত্ব সুস্পষ্ট করে তুলে ধরলেন। তিনি লোকদের কোরআন ও হাদীসের গভীর অধ্যয়ন এবং এ দুটোকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়ার ও সব মতভেদের বিষয়গুলোর মীমাংসা কোরআন ও হাদীস থেকে আহরণের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করেন। এমনকি এ ক্ষেত্রে তিনি আশাতীত সাফল্যও লাভ করেন।
মছলকঃ
শাহ সাহেবের অনুসৃত পন্থা ছিল সম্পূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থা। তিনি বিশুদ্ধ বর্ণনা ও যুক্তি-প্রমাণ এক করে ফকীহদের রাস্তায় চলতেন এবং অধিকাংশ ওলামা ও ফোকাহাদের মতৈক্যের ভিত্তিতে তিনি রায় দিতেন। মতভেদের বিষয়গুলোয় তিনি বিশুদ্ধ হাদীস অনুসরণ করতেন। দ্বীনী ইলমের ক্ষেত্রে তিনি ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তিনি হানাফী ও শাফেয়ী মজহাবকে প্রাধান্য দিয়ে পড়াতেন। উপমহাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী যেহেতু হানাফী মজহাবের অনুসারী তাই তিনি সে মজহাবের বিরোধিতা করতেন না।
প্রায় সমগ্র উম্মতই চারটি প্রণীত মজহাবের সাথে জড়িত হয়ে গেছে। তাই আমাদের যুগে তাদের তাকদীল করা বৈধ হয়ে গেছে। তার ভেতরে কয়েকটি কল্যাণকর দিক রয়েছে আর তা অস্পষ্টও নয়। যে যুগে মানুষের হিম্মত কমে গেছে আর মানুষের অন্তরগুলো বাসনা-কামনায় ভরপুর হয়ে গেছে, সে যুগে এ ছাড়া আর করারই বা কি আছে?
মতভেদের বিষয়গুলোয় তিনি বিশুদ্ধ হাদীস অনুসরণ করতেন। দ্বীনী ইলমের ক্ষেত্রে তিনি ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তিনি হানাফী ও শাফেয়ী মজহাবকে প্রাধান্য দিয়ে পড়াতেন। উপমহাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী যেহেতু হানাফী মজহাবের অনুসারী তাই তিনি সে মজহাবের বিরোধিতা করতেন না।
প্রায় সমগ্র উম্মতই চারটি প্রণীত মজহাবের সাথে জড়িত হয়ে গেছে। তাই আমাদের যুগে তাদের তাকদীল করা বৈধ হয়ে গেছে। তার ভেতরে কয়েকটি কল্যাণকর দিক রয়েছে আর তা অস্পষ্টও নয়। যে যুগে মানুষের হিম্মত কমে গেছে আর মানুষের অন্তরগুলো বাসনা-কামনায় ভরপুর হয়ে গেছে, সে যুগে এ ছাড়া আর করারই বা কি আছে?
ছাত্রবৃন্দঃ
শাহ সাহেবের অসংখ্য ছাত্র ছিলেন। তাদের ভেতরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তাঁর চার ছেলে যথাক্রমেঃ শাহ আবদুল আসীফ, শাহ রফিউদ্দীন, শাহ আবদুল কাদের ও শাহ আবদুল গণী। অন্যান্যরা হলেনঃ শায়েখ মুহাম্মদ আশেক দেহলভী, শায়েখ মুহাম্মদ আমীন কাশ্মীরী, সাইয়্যেদ মুর্তজা বিলগ্রামী, শায়েখ জাফরুল্লাহ ইবনে আবদুর রহীম লাহোরী, শায়েখ মুহাম্মদ আবু সাঈদ বেরেলভী, শায়েখ রফিউদ্দীন মুরাদাবাদী, শায়েখ মুহাম্মদ আবুল ফাতাহ বিলগ্রামী, শায়েখ মুহাম্মদ মুঈন সিন্ধী, কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী প্রমুখ।
রচনাবলীঃ
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার ভেতরে প্রায় পঞ্চাশখানার খোঁজ পাওয়া গেছে। তিনি তফসীর, হাদীস, তাসাওফ অন্যান্য ইসলামী বিষয়াবলীর ওপর এমন সব গ্রন্থ রচনা করেন যা দেখে জাহেরী বাতেনী ইলমের ধারক ও বাহকগণ তাঁকে এক বাক্যে ইমাম হিসেবে মেনে নেন। তিনি কিছু গ্রন্থ আরবী ভাষায় ও কতিপয় গ্রন্থ ফার্সী ভাষায় রচনা করেন। তাঁর যুগে ফার্সী ছিল সরকারী ভাষা। তাই দেশব্যাপী এ ভাষায় বহুল প্রচলন ছিল। শাহ সাহেবের প্রণীত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থের পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হলঃ
১। ফৎহুল রহমান বতরজামাতুল কুরআনঃ
এটি হচ্ছে কুরআন পাকের ফার্সী অনুবাদ। আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এ অনুবাদ কার্যটি সম্পন্ন হয়েছে। তথাপি আজও এর কল্যাণকারিতা ও গুরুত্ব সমানেই অনুভূত হচ্ছে। শাহ সাহেব তাঁর অনুবাদে গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
২। আয যুহরাবীন ফি তাফসীরে সূরা বাকরা ওয়া আলে ইমরানঃ
এটা সূরা বাকারা ও আলে ইমরানের ফার্সী বিশ্লেষণ।
৩। আল-ফাউযুল কাবীরঃ
তফসীর শাস্ত্রের নীতিমালা সম্পর্কিত এ গ্রন্থখানি শাহ সাহেবের একটি মূল্যবান অবদান। এর মধ্যে তিনি কুরআন পাকের মূল পাঁচটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন। এতে তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা ও তার রীতি-নীতি সম্পর্কে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ও মূল্যবান আলোচনা করেছেন। মোটকথা শাহ সাহেবের এ ক্ষুদ্রাকৃতির গ্রন্থটি এ বিষয়ের ওপর রচিত বিরাট বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে দিয়েছে। কুরআন হরফের মুকাত্তায়াত ও অন্যান্য সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয় তিনি এতে সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
৪। ফতহুল কবীরঃ
এতে কুরআনেরক ঠিন ও দুর্লভ শব্দ ও পরিভাষার সহজ ও সুন্দর সমাধান রয়েছে। কিতাবটি আরবী ভাষায় লিখিত। কুরআনের আয়াত ও বিশুদ্ধ হাদীসের সাহায্যে তিনি বিভিন্ন শব্দ ও পরিভাষার বিশ্লেষণ করেছেন।
৫। আল মুনাওয়া মিন আহাদীসিল মুয়াত্তাঃ
ইমাম মালিকের হাদীস সংকলন “আল মুয়াত্তার” এক বিস্ময়কর আরবী ভাষ্য। শাহ সাহেব ফেকহী দৃষ্টিকোণ থেকে আর অধ্যায়গুলো সজ্জিত করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি ইমাম মালেকের সেসব মতামত বাদ দিয়েছেন বা অন্যান্য সকল মুজতাহিদের পরিপন্থী। তার বিন্যস্ত প্রতিটি অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কুরআনের আয়াতের তিনি সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। এ গ্রন্থটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করায় এর বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৩৫১ হিজরীতে মক্কা শরীফের “আল মাকতাবাতুস সালাফিয়া” থেকেও এটা অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়।
৬। আল সুসাফফা শরহে মুয়াত্তাঃ
এটি মুয়াত্তার ফার্সী ভাষ্য। সংক্ষিপ্ত হলেও ভাষ্যটি খুবই উপাদেয়। এতে তিনি মুজতাহিদ সুলভ পর্যালোচনা করেছেন। এতে তার ইজতিহাদ ও ইস্তেখরাজের যোগ্যতা প্রামণিত হয়েছে।
৭। আল আরবাঈনঃ
শাহ সাহেব এতে চল্লিশটি হাদীসের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। হাদীসগুলো স্বল্প কথায় অথচ ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ। হাদীসগুলো তিনি তাঁর শায়েখ আবু তাহের (রঃ)-এর সনদে হজরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন।
৮। মুসাল সিলাতঃ
এটি একটি ক্ষুদ্রকায় আরবী কেতাব। সনদ সম্পর্কিত অতি মূল্যবান তথ্য এতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
৯। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহঃ আরবী ভাষায় রচিত শাহ সাহেবের এ গ্রন্থটি একটি অমূল্য সম্পদ। এতে শরীয়তের বিধি-নিষেধগুলোর গূঢ় রহস্যাবলী তুলে ধরা হয়েছে। পরন্তু এ কালের আধুনিক মন-মানসের শরীয়ত সম্পর্কিত বিভিন্ন জিজ্ঞাসার চমৎকার জবাব দান করা হয়েছে। মোটকথা এ গ্রন্থটি একটি অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় গ্রন্থ। প্রাচীন ও নবীন সবার জন্যেই এটি সমান উপাদেয়।
১০। আকদুল জীদ ফিল ইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদঃ
ইজতিহাদ ও তাকলীদের ওপর লিখিত একটি বিরল আরবী গ্রন্থ।
১১। আল ইরশাদ ইলা মুহিম্মাতে ইলমিল ইসনাদঃ
এটি আরবী ভাষায় লেখা সনদ সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।
১২। আল ইনসাফ ফী-বয়ানে সাববিল ইখতিলাফঃ
এটি আরবী ভাষায় লেখা একটি উত্তম কিতাব। এতে ফকিহ ও মুহাদ্দেসের মতভেদের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। তাছাড়া তাকদীল করা বা না করার ব্যাপারেও এতে মনোজ্ঞ আলোচনা করা হয়েছে। শাহ সাহেব তাঁর আলোচনায় সকল সংকীর্ণতার অবসান ঘটিয়েছেন।
১৩। আল ইস্তিবাহ ফী-সালাসিলে আওলিয়া আল্লাহঃ
গ্রন্থটি ফার্সী ভাষায় রচিত। পয়লা খণ্ডে খ্যাতনামা আওলিয়ায়ে কেরামের সিলসিলার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে হাদীসের সনদসমূহ ও ফিকাহ শাস্ত্র সম্পর্কিত মূল্যবান তথ্যাবলী। হাদীস ও ফিকাহের ওপর শাহ সাহেব এ গ্রন্থটিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
১৪। তারাজিমু আবওয়াবিল বুখারীঃ
এটি আরবী ভাষায় একটি মূল্যবান গ্রন্থ। হায়দরাবাদে এটি ছাপা হয়।
১৫। ইযালাতিলখাফা আন খিলাফাতিল খুলাফাঃ
শাহ সাহেব (রঃ)-এর যুগে রাফেজীদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। শাহ সাহেব তাদের যাবতীয় প্রশ্নাবলীর জবাব দিয়ে এ গ্রন্থটি লিখেন। এতে তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন। পরন্তু ইসলামী হুকুমতের তাৎপর্য কি তাও তিনি তাতে সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। এমনকি ইসলামী হুকুমতের রূপরেখাও পেশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের গুণাবলী ও তাঁদের খেলাফতের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং ইসলামী রাজনীতির নীতিমালাগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ কিতাবের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে।
১৬। কুররাতুল আইনাইন ফী তাফাসিলিশ শায়খাইনঃ
এটি একটি ফার্সী গ্রন্থ। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত উমর ফারুক (রাঃ)-এর গুণাবলী ও মর্যাদার বিভিন্ন দিক তিনি এতে তুলে ধরেছেন। এ গ্রন্থে দলীয় প্রমাণ ও যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাঁরা দুজন উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাতে হযরত উসমান (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ)-এর বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা বর্ণনা করে রাফেজীদের সমালোচনার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন।
১৭। কিতাবুল ওয়াসিয়াতঃ
এটি একটি ফার্সী পুস্তিকা। এতে শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে তিনি পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন।
১৮। রিসালায়ে দানেশমন্দীঃ
এটিও একটি কল্যাণপ্রদ ফার্সী পুস্তিকা। এতে শিক্ষাদানের পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন।
১৯। আল কাওলুল জামীলঃ
শাহ সাহেব (রঃ) তাসাওফ তত্ত্বের ওপর সংক্ষেপে অথচ সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ এ গ্রন্থটি আরবী ভাষায় রচনা করেন। তাসাওফের চার তরীকার সিলসিলাগুলো এতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। এ চার তরীকাই উপমহাদেশে চালু রয়েছে। এতে তিনি তাঁর পিতা শাহ আবদুর রহীম ও অন্যান্য বুযুর্গতের ওজিফা ও দোয়া-দরূদ লিপিবদ্ধ করেছেন।
২০। সাতাআত, ২১। হামাআত, ২২। লামাহাতঃ
এ তিনটি পুস্তিকাও তাসাওফের ওপর লেখা হয়েছে।
২৩। আলতাফুল কুদসঃ
এটি ফার্সী ভাষায় লিখিত তাসাওফ সংবলিত অত্যন্ত মূল্যবান একটি পুস্তিকা।
২৪। তা’বীলুল আহাদীসঃ
এটি আরবী ভাষায় লেখা একটি কল্যাণপ্রদ গ্রন্থ। কুরআন পাকে যে সব আম্বিয়ায়ে কেরামের উল্লেখ রয়েছে, এ গ্রন্থে তাদের ঘটনাবলীর সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নবী করীম (সঃ) পর্যন্ত নবুয়তের যে ক্রমবিকাশ ও পূর্ণতা ঘটেছে তার রহস্য ও ব্যবস্থাপনা সংক্ষেপে ও সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তবে কিতাবটি স্বভাবতঃই জটিল ও আয়াশলব্ধ।
২৫। আল খায়রুল কাসীরঃ
এ কিতাবটিও আরবী ভাষায় রচিত। এটা সৃষ্টি জগতের রহস্য ও কলাকৌশলের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। এ বিষয়ের ওপর এটা এক অনন্য গ্রন্থ।
২৬। আত তাফহীমাতে এলাহিয়্যাঃ
এ গ্রন্থটি দু’খণ্ডে লিখিত। এর কিছু অংশ আরবী ও ফার্সিতে লেখা হয়েছে। এতে বিভিন্ন শ্রেণীর মাকালাত ও রিসালাত জমা করা হয়েছে। শরীয়ত ও যুক্তিবুদ্ধির বিভিন্ন সমস্যা এতে আলোচিত হয়েছে এবং ইলহামীপন্থায় তা উপস্থাপন করা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ একাডেমী থেকে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।
২৭। আল বদুরুল বালেগাহঃ
তাসাওফ শাস্ত্রের ওপর লেখা শাহ সাহেবের এ গ্রন্থখানি অনন্য। এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করলে শাহ সাহেবের অন্যান্য গ্রন্থ বুঝা সহজ হয়ে যায়। সত্য কথা এই যে, কিতাবটি শাহ সাহেবের অন্যান্য কিতাবের সারমর্ম। এ কিতাবটিও শাহ ওয়ালিউল্লাহ একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়।
২৮। ফুঁয়ূজ্বল হারামাইনঃ
এ গ্রন্থটিতে শাহ সাহেব সেই সমস্ত ব্যাপার সন্নিবেশিত করেছেন যা তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান কালে হযরত (সঃ)-এর রূহানী ফয়েযের মাধ্যমে হাসিল করেছেন। সংক্ষিপ্ত হলেও কিতাবটি অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ও কল্যাণকর।
২৯। আদদুররুস সামীন ফী মুবাশশিরাতে নবায়্যেল আমীনঃ
এ কিতাবে শাহ সাহেব তাঁর পিতা শায়েখ আবদুর রহীম ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শায়েখ আবুর রিজা মুহাম্মদের বিশেষ বিশেষ অবস্থা বর্ণনা করেছেন।
৩০। হুসনুল আকীদাঃ
আরবী ভাষায় লিখিত এ গ্রন্থটিতে আকায়েদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
৩১। ইনসানুল আইন ফী মাশায়েখিল হারামাইনঃ
ফার্সী ভাষায় এ গ্রন্থটিতে শাহ সাহেব ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন।
৩২। আল মুকাদ্দামাতুস সুন্নিয়াত ফী ইনতিসারে ফিরকাতুস সুন্নিয়াহঃ
এ গ্রন্থটিতে আরবী ভাষায় আকায়েদ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। এ গ্রন্থটি এ বিষয়ে অনন্য।
৩৩। আল মাকতুবুল সাদানীঃ
এটি তাওহীদের হাকীকত সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। তিনি ইসমাইল ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রূমীর কাছে এ চিঠি লিখেছিলেন।
৩৪। আল হাওয়ামেহ ফী শরহে হিজবিল বাহরঃ
এটি হিজবুল বাহর কিতাবের এক অতুলনীয় ভাষ্য।
৩৫। শেফাউল কুলুবঃ
এটি ফার্সী ভাষায় তাসাওফের ওপর লেখা একটি অতি উত্তম গ্রন্থ।
৩৬। সারূরুল মাখযানঃ
শায়েখ কবীরজান জানান দেহলভী (রঃ)-এর নির্দেশে শাহ সাহেব ফার্সী ভাষায় এ জ্ঞানগর্ভ কিতাবটি রচনা করেন।
৩৭। শায়েখ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল বাকীর প্রশ্নাবলীর জবাবঃ
৩৮। তাইয়েবুন নগমা ফী মহ সাইয়্যেদিল আরবে ওয়াল আজমঃ
এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসাপূর্ণ একটি আরবী কাব্যগ্রন্থ।
৩৯। মজমুয়ায়ে আশআরঃ
শাহ সাহেবের লিখিত বিভিন্ন কবিতার সংকলন গ্রন্থঃ
৪০। ফাতহুল ওয়াদুদ ওয়া মারিফাতিল জুনুদঃ
এ সংক্ষিপ্ত আরবী রিসালায় শাহ সাহেব সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।
৪১। আওয়ারিফঃ
আরবী ভাষায় লেখা এ পুস্তিকাটিতে তাসাওফ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
৪২। শরহে রুবাইয়্যাতাইনঃ
খাজা বাকী বিল্লাহ (রঃ)-এর দুটি রুবাইয়্যাতের ব্যাখ্যা।
৪৩। আনফালুল আরেফীনঃ
এটি শাহ সাহেবের রচিত একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। এতে তিনি তাঁর দাদা ও বংশের অন্যান্য বুযুর্গদের জীবনালেখ্য ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী সন্নিবেশিত করেছেন। তাঁদের জাহেরী ও বাতেনী ইলম ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীর এতে সবিস্তারে আলোচনা রয়েছে।
ইন্তেকালঃ শাহ সাহেব (রঃ) ১১১৪ হিজরীর ৪ঠা শাওয়াল সূর্যোদয়ের মুহুর্তে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে ১১৭৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মাত্র অল্প ক’দিন তিনি হাল্কা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তারপর তিনি দুনিয়া ছেড়ে রাব্বুল আলামীনের দরবারে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি….রাজিউন। পুরাতন দিল্লীর শাহজাহানাবাদের দক্ষিণ ভাগে তাঁকে দাফন করা হয়। সে কবরস্থানকে মুহাদ্দেসীনের কবরস্থান বলা হয়।
সন্তান-সন্ততিঃ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ)-এর পাঁচটি ছেলে জন্ম নিয়েছিল। এক ছেলে যৌবনে পদার্পণ করেই মারা যান। তাই তার সম্পর্কে তাঁর জীবনী গ্রন্থে তেমন কিছু লেখা হয়নি। অবশিষ্ট চার ছেলে যথাযোগ্য শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে তাঁর বংশকে সমুজ্জ্বল করেছেন। তাঁর জ্যৈষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ সন্তান শাহ আবদুল আযীয (রঃ) ১১৫৯ হিজরীতে জন্ম নেন এবং তাঁর সতের বছর বয়সে শাহ সাহেব ইন্তেকাল করেন। তাঁর শৈশবের লেখাপড়া পিতার কাছেই সম্পন্ন হয়।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি কোরআন পড়া শুরু করেন এবং তের বছর বয়সে তিনি নহু, ছরফ, ফিকাহ, মান্তেক, ইলমুল কালাম, আকায়েদ ইত্যাদি বিষয়ের কিতাবসমূহ আয়ত্ত করেন। অতঃপর পনের বছর বয়সে রহীমিয়া মাদ্রাসায় তাঁর পিতার মসনদে বসে শিক্ষা দানে ব্রতী হন। তাঁর গোটা জীবন শিক্ষা দানে ও কিতাব রচনায় ব্যয়িত হয়। তাঁর যুগে রাফেজী ও অন্যান্য বাতিল পন্থীদের প্রভাব অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। তাই তিনি তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালো কিতাব লিখেন। তাঁর রচিত তফসীরে আযীয ও তোহফায়ে ইসনা আশারিয়ায় তিনি রাফেজীদের বাতিল ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটন ঘটিয়েছেন। তাছাড়া মুহাদ্দেসদের অবস্থা ও হাদীস সংকলনসমূহের ওপর তিনি বুস্তানুল মুহাদ্দেসীন নামে এক তথ্য বহুল গ্রন্থ রচনা করেন। পরন্তু তিনি শরহে মিযানুল মান্তেক ও আযীযুল ইকতেবাস ফী ফাযায়েলে আখবারিন্নাস নামে আকায়েদের এক মূল্যবান ভাষ্য রচনা করেন। তার দ্বিতীয় সন্তানের নাম শাহ রফিউদ্দীন। তিনিও তাঁর পিতার কাছে শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করেন। শাহ রফিউদ্দিন কোরআন মজীদের সহজ উর্দু অনুবাদ করেন। সেটি অত্যন্ত কল্যাণপ্রদ ও জনপ্রিয় হয়েছে।
শাহ সাহেবের তৃতীয় ছেলের নাম শাহ আবদুল কাদের। তিনি তফসীর শাস্ত্রে পরম ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত সরল ও একান্ত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন পছন্দ করতেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি আকবরাবাদ মাজে মসজিদের এক হুজরায় কাটিয়ে গেছেন। তিনি কোরআনের এরূপ উত্তম অনুবাদ করে গেছেন যা বড় বড় তফসীরের কাজ দেয়। এ অনুবাদ ছিল ইলহামী অনুবাদ। উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম এক বাক্যে সেটাকে সর্বোত্তম অনুবাদ বলে গ্রহণ করেছেন।
তাঁর চতুর্থ ছেলের নাম শাহ আবদুল গনী। তিনি ইলমে তাসাওফে যথেষ্ট পারদর্শীতা অর্জণ করেন। তিনিও তার পিতার কাছে হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। খোদা নির্ভরতা ও স্বল্পে তুষ্টির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁরই পুত্র হলেন বালাকোটের শহীদ শাহ ইসমাঈল (রঃ)। তিনি পাঞ্জাব ও সীমান্তে কিছু এলাকা দখল করে ইসলামী হুকুমত কায়েম করেছিলেন। তাঁর “তাকবিয়াতুল ঈমান” ও “আল আবাকাত” কিতাবদ্বয় দেশ-বিদেশে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

সাজরা
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ)

শাহ আঃ আযীয (রঃ) শাহ রফিউদ্দীন (রঃ) শাহ আঃ কাদের (রঃ) শাহ আঃ গণী

মোঃ মূসা মোঃ ঈসা মোঃ মাখসুস উল্লাহ হাসান জান

মোঃ ইসমাঈল শহীদ (রঃ)

গ্রন্থের উদ্দেশ্য
বর্ণনামূলক ও জ্ঞানগত বিদ্যার ওপর সেকালে ও একালে বহু বই লেখা হয়েছে। প্রত্যেক মনীষীই জ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন। সে যুগে বর্ণনামূলক বিদ্যারই সর্বাধিক চর্চা চলছিল এবং এটাকেই তখন যথেষ্ট মনে করা হত। মুসলিম জাহান তখন রাসূলে করীম (সঃ)-এর কাছাকাছি যমানায় লালিত হচ্ছিল। তাই রাসূল (সঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের ফয়েজ ও বরকতের প্রভাবে হাজারো দর্শনের দার্শনিক মার প্যাঁচ তাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়নি। তবে যতই ইসলামী দুনিয়ার প্রসারতা বেড়ে চলল আর এমনকি ইরান, হিন্দুস্তান ও পাশ্চাত্য জগতের বিভিন্ন এলাকায় যখন তা ছড়িয়ে পড়ল, তখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের দুষ্ট প্রভাব মুসলমানদের সহজ সরল ঈমান ও আকায়েদের মজবুত ভিত্তিকে দুর্বল করে দিল। ফলে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাজতের জন্যে এমন ব্যক্তিত্বের এ পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটালেন যাঁরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে তাদের স্তব্ধ করে দিলেন। তারা শুধু ইসলামের জন্যেই প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন না, পরন্তু দার্শনিকদের ভ্রান্ত চিন্তাধরার কল্পনার ফানুস ছিন্ন ভিন্ন করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন। ইসলামের ওপর বারংবার হামলা করেছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে লাঞ্ছনাকর পরাজয় ভিন্ন আর কিছুই জোটেনি। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভী (রঃ) ও তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার আবির্ভাব ও সৃষ্টির পেছনে আল্লাহ পাকের সেই মর্জিই সক্রিয় ছিল।
শাহ সাহেব (রঃ) এ গ্রন্থটিতে শরীয়তের রহস্যাবলী তুলে ধরেছেন। পূর্বসূরীদের কেউই এ বিসয়ের ওপর কলম ধরেননি। শাহ সাহেব (রঃ) শরীয়তের মূলনীতি দাঁড় করেছেন, তার শাখা-প্রশাখা বর্ণনা করেছেন। যদিও গ্রন্থখানি শরীয়তের রহস্যাবলীর ওপর তিনি লিখেছেন, তথাপি তিনি তাতে হাদীস, ফিকাহ, আখলাক, তাসাওফ ও দর্শনের সমারোহ ঘটিয়েছেন। উম্মতের ভেতর তিনিই প্রথম বর্ণনামূলক ও জ্ঞানগত বিদ্যার বিশেষজ্ঞ, যিনি শরীয়তের রহস্য বর্ণনা করতে গিয়ে শুধু জ্ঞানানুসন্ধানের পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি কিতাব ও সুন্নাতের প্রতিটি নির্দেশের এরূপ অনড় কারণ খুঁজে বের করেছেনযা কোন যুগেই কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে মনে হয় জ্ঞান ও যুক্তি শাস্ত্রের সকল স্তর আয়ত্তকারী এক বিশাল ব্যক্তিত্ব কথা বলেছেন। কখনও মনে হয়, মালায়ে আলার ইলহাম পেয়ে আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা দিচ্ছেন। কখনও দেখা যায় যে, এক মুজতাহিদ এমন ভাবে মসআলা পেশ করছেন যাতে চার মজহাবের সমন্বয় ঘটে যাচ্ছে। এমনকি কিতাব ও সুন্নাতের বক্তব্যের সাথে তা হুবহু মিলে যাচ্ছে।
আল্লামা আবু তাইয়্যেবা (রঃ) “হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ” সম্পর্কে বলেনঃ
“যদিও গ্রন্থটি ইলমে হাদীস নয়, তথাপি তাতে হাদীসের প্রচুর ব্যাখ্যা মিলে। এমনকি তাতে বিভিন্ন হাদীসের তত্ত্ব ও রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। সে যাক, পূর্ববর্তী বার শতকে আরব-আজমের কোন আলেম এরূপ মহামূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে যাননি। গ্রন্থটি এ বিষয়ে অনন্য। মোটকথা, গ্রন্থকারের এটা শুধু শ্রেষ্ঠ গ্রন্থই নয়, সর্বকালের একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ”।
শাহ সাহেব (রঃ) তাঁর গ্রন্থটিকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করেছেন। পয়লা খণ্ডটি সাত অধ্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রতিটি অধ্যায় কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছেন।

প্রথম খণ্ড
পয়লা খণ্ডে শাহ সাহবে (রঃ) শরীয়তের সেসব রহস্য ও নীতিমালা তুলে ধরেছেন যদ্বারা শরীয়তের বিধি-নিষেধসমূহ সহজেই বের ও উপলব্ধি করা যায়। অতঃপর তিনি পয়লা অধ্যায়ে মানুষকে কেন জবাবদিহি করা হবে আর কেন তাদের পুরস্কার বা শাস্তি দান করা হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ অধ্যায়ে তেরটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। পয়লা পরিচ্ছেদে সৃষ্টির উন্মেষ ও তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। যেহেতু সৃষ্টিতত্ত্বই সব কিছুর আদি প্রশ্ন, তাই তিনি সর্বাগ্রে সেটারই সমাধান দিয়েছেন। আর স্বভাবতঃই সামগ্রিক জ্ঞানের জন্যে রচিত গ্রন্থে এটাই সর্বাগ্রে ঠাঁই পাবে।
আমরা যদি সর্বাগ্রে অবতীর্ণ আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি, তাহলেও দেখতে পাই, সেখানেও সৃষ্টিতত্ত্ব দিয়ে শুরু করা হয়েছে। যেমনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
সূরা আলাক্বঃ আয়াত ১-২
অর্থাৎ, “সেই প্রভুর নামে পড়, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। সৃষ্টি করেছেন এক বিন্দু রক্তপিণ্ড থেকে”।
শাহ সাহেব (রঃ) ও আল্লাহ পাকের এ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অতঃপর তিনি আলমে মেসাল (নমুনা জগত) মালা-এ-আ’লা (উচ্চতর পরিষদ), হাকীকাতে রূহ (আত্মাতত্ত্ব) ও জবাবদিহি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। অতঃপর সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, সবাইকে কর্মফল ভোগ করতে হবে। ভাল কর্মের জন্যে ভাল ফল ও মন্দ কর্মের মন্দ ফল পাবে। তিনি এটাকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তা চার কারণে হবে। এক, যে প্রাকরের কাজ সেই প্রকারের ফল হওয়াই স্বাভাবিক।
দুই, মালা-এ-আ’লার সিদ্ধান্ত এটাই।
তিন, শরীয়তের চাহিদাও তাই।
চার, হুযুর (সঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ ওহীর এবং তাঁর দোয়া ও আল্লাহ পাকের সাহায্যের আশ্বাস স্বভাবতঃই সেটাকে অপরিহার্য করেছে।
অতঃপর তিনি বলেন, কর্মফলের পয়লা দুটি দিক হল স্বাভাবিক। তার পরিবর্তন অসম্ভব। তৃতীয়টি কালের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। চতুর্থটি নবী প্রেরণের পরে দেখা দেয়। অবশেষে তিনি কার্যকারণের বিভিন্ন দিক আলোচনা করে পয়লা অধ্যায় শেষ করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি পার্থব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা অর্থাৎ মানুষের সর্বাংগীন জীবন-ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কি কি পদক্ষেপ নিয়ে আমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পারি অতি চমৎকার ভাবে তিনি তা বর্ণনা করেছেন। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন কিভাবে সুখময় ও সুন্দর হতে পারে তা তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এ অধ্যায়টিকে তিনি এগারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। পয়লা পরিচ্ছেদে মানবিক প্রয়োজন ও মৌলিক অধিকারের নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর বিভিন্ন প্রয়োজন ও অধিকারের বাস্তবায়ন পদ্ধতি বলেছেন। ফলে নাগরিক জীবন, পারস্পরিক লেন-দেন, রাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির বিভিন্ন দিক এভাবে বিন্যস্ত করেছেন যা দেখে অত্যাধুনিক কালের রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরাও হতভম্ব হয়ে যায়।
শাহ সাহেব (রঃ) শাসকদের জীবন চরিত সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে বলেনঃ শাসককে অবশ্যই উত্তম চরিত্রের হতে হবে। তাকে এক দিকে বীরের মত শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে জন কল্যাণের প্রয়োজনে, অপর দিকে তাকে দয়ালুও হতে হবে। তাকে বিজ্ঞ হতে হবে যাতে ইসলামী বিধি-নিষেধগুলোর তিনি যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে পারেন। তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক, বুদ্ধিমান এক স্বাধীন পুরুষ হতে হবে। তা না হলে তার প্রভাব জনগণের ওপর পড়বে না। তাকে পূর্ণাঙ্গ দেহের এক সুস্থ ব্যক্তি হতে হবে। তা না হলে জনগণ তাকে যথাযথ সম্মান দিতে পারবে না। তাকে দাতা ও সামাজিক হতে হবে, তা হলে জনগণ তাকে ভালবাসবে। তাকে জন কল্যাণের কাজে নিয়োজিত হতে হবে, তা হলে জনগণ তাকে তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী ভাববে। তাকে চতুর শিকারীর দূরদর্শিতা নিয়ে জনগণের সাথে ব্যবহার বজায় রাখতে হবে এবং সময়সুযোগ মতে শিকারের কাজ করতে হবে। তার বড় কাজ হবে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে তাকে সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টির অধিকারী হতে হবে। এভাবে অল্প কতায় তিনি জনপ্রিয় শাসকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। শেষ পরিচ্ছেদে তিনি জনগণের ভেতরে প্রচলিত বিভিন্ন রীতি-নীতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করেন। চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি সৌভাগ্য নিয়ে আলোচনা করেন। সৌভাগ্য কাকে বলে এবং সৌভাগ্য সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা নিয়ে মানুষের ভেতরে কি কি মতভেদ রয়েছে এবং সৌভাগ্য অর্জনের উপায় নিয়ে তিনি এ অধ্যায়ে সমিস্তারে আলোচনা করেছেন। সৌভাগ্যের অধ্যায়টিকে তিনি তাওহীদ, শির্ক ও ঈমানের ওপর আলোচনা করেছেন। তাছাড়া নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত এবং তার সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান নিয়েও আলোচনা করেছেন। বিশেষতঃ এগুলোর রহস্য ও তত্ত্ববিশ্লেষণ করেন। পরিশেষে পাপের স্তরভেদ, পাপের ক্ষতি-সমূহ, বিশেষতঃ পাপ কি করে কোন ব্যক্তি বা সমাজকে ধ্বংস করে তা তিনি সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেন। তেমনি তুলে ধরেছেন পুণ্য কি ব্যক্তি ও সমাজকে ইহলোক ও পরলোকের শান্তি ও সুখের পথ খুলে দেয়।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি জাতীয় রাজনীতির ওপর আলোচনা করেছেন। এ অধ্যায়টিকে তিনি একুশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। দ্বীন ও মিল্লাতের বিভিন্ন ব্যাপারে জাতির পথপ্রদর্শক সম্প্রদায়, অতীতের ধর্মসমূহ, ইসলাম ও জাহেলী যুগের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা করেন। তাছাড়া এতে শরয়ী ও রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থার বিভিন্ন রহস্য ও তত্ত্বকথা তিনি তুলে ধরেছেন।
সপ্তম বা শেষ অধ্যায়টিকে তিনি এগারটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। তাতে নবুয়তী জ্ঞানসমূহ, হাদীস সংকলনাদি, সাহাবা, তাবেঈন ও ফকীহদের মতভেদ ও মতামতের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। শেষভাগে তিনি তাহারাত ও সালাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এভাবেই পয়লা খণ্ড সমাপ্ত হয়।

দ্বিতীয় খণ্ড
শাহ সাহেব (রঃ) তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ দ্বিতীয় খণ্ডে ইবাদত, সামাজিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সর্বাগ্রে তিনি নামায, রোযা ও হজ্জ্বের পরিচ্ছেদ কায়েম করেছেন। এ খণ্ডকে তিনি বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করেননি, বরং প্রত্যেকটি আলোচনা স্বতন্ত্র শিরোনাম দিয়েছেন। কায়িক আত্মিক ইবাদত সম্পর্কে আলোচনার পর ব্যবসা-বাণিজ্য, রুজীরুটি উপার্জনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করেন। কারণ, ইবাদত কবুলের ভিত্তিই হল হালাল রুজী। এ কারণেই ব্যবসায়ের রীতিনীতি ও অর্থোপার্জনের উপায়-উপকরণকে ইসলামী পদ্ধতিতে পরিচালনাই ইবাদত কবুলের চাবিকাটি। এরপর পারিবারিক ব্যবস্থার পরিচ্ছেদ দাঁড় করিয়েছেন। বিয়ে, তালাক, স্ত্রীর অধিকার, সন্তান-সন্ততির শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির ওপর সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। অতঃপর দেশ ও জাতি সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো আলোচনা করেছেন। খেলাফত, বিচার পদ্ধতি, দণ্ডবিধি, সমরনীতি ও অন্যান্য জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। তাঁর এ আলোচনা এতই পাণ্ডিত্যপূর্ণ যে, এ কালের পণ্ডিতরাও দেখে অবাক হয়ে যায়।
অবশেষে শাহ সাহেব জনসাধারণের সাধারণ জীবন যাপনকে বিভিন্ন রীতিনীতি আলোচনা করেছেন। আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাকার ব্যাপারে তিনি মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অবশেষে সাহাবায়ে কেরামের চারিত্রিক গুণাবলী তুলে ধরে তিনি তাঁর এ অমূল্য গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন।

(আরবী*********************************************************)
প্রাক-প্রারম্ভিকা
সব ধরনের প্রশংসাস্তুতি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। তিনিই ইসলাম ও হেদায়েতকে মানুষের প্রকৃতগিত করে দিয়েছেন। তাদের জন্য তিনি সত্য ধর্ম সহজ, সুস্পষ্ট ও সুলভ করে রেখেছেন। অথচ মানুষ নিজ থেকে মূর্খতা ও পাপাচারে আশ্রয় নিল। তথাপি তিনি অত্যন্ত দয়া দেখালেন। মানুষকে আঁধার থেকে আলোয় ও সংকীর্ণতা থেকে প্রসারতায় নিয়ে আসার জন্যে নবীদের পাঠালেন। নবীদের আনুগত্যকেই তিনি তাঁর আনুগত্য বলে স্থির করলেন। এটা কত বড় গৌরব ও মর্যাদার কথা।
তারপর তিনি নবীদের কোন কোন উম্মতকে জ্ঞানবান হতে ও তাঁর বিধি-বিধানের রহস্য জানতে শক্তি জোগলেন। এমনকি তাঁদের এক একজন এভাবে হাজার দরবেশের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলেন। ফেরেশতার জগতেও তাঁদের বিরাট মর্যাদার পর্যালোচনা চলল। আল্লাহর সৃষ্টি জগতের সব কিছুই এমনকি নদীর মাছ পর্যন্ত তাঁদের জন্য দোয়া করতে লাগল। আল্লাহ পাক নবীদের ও তাঁদের অনুসারীদের ওপর অহরহ অনুগ্রহ বর্ষন করে চলুন। বিশেষত খোলাখুলি মুজিযা নিয়ে আবির্ভূত আমাদের মহানবীকে (সঃ) তিনি তাঁর অনুগ্রহ ও জ্যোতির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন করুন। মহানবীর (সঃ) বংশধর ও সহচরদের নিজ দয়ায় ধন্য করুন এবং উত্তম পারিতোষিক দান করুন।
অতএব আল্লাহ পাকের অনুগ্রহপ্রার্থী ফকীর আহমদ ওয়ালিউল্লাহ ইবনে আবদুর রহীমের বক্তব্য হল এই, ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও কার্য-কলাপ সম্পর্কিত সব বিদ্যা ও তাঁর বিষয়গুলোর ভেতরে সর্বোত্তম ও শীর্ষস্থানীয় হল হাদীস শাস্ত্র।তাতে রয়েছে নবীকুল শিরোমণি মহানবীর (সঃ) কথা, কাজ ও সমর্থনের বিবরণী। তাই তা হল আঁধারের দীপশিখা ও পথের দিশারী। এ যেন দুনিয়াজোড়া দ্যুতিবিচ্ছুরক পূর্ণিমার চাঁদ। যে ব্যক্তি তা স্মৃতিস্থ করে কার্যকর করল, পথ পেয়ে অভীষ্ট অর্জন করল। যে ব্যক্তি উপেক্ষা করল, জীবন বরবাদ করল। কারণ, মহানবী (সঃ) বিধি-নিষেধ ও তার ভাল-মন্দ সম্পর্কিত সবকিছুই বর্ণনা করেছেন। বক্তৃতা, উপদেশ, উপমা, উদাহরণ সবকিছু দিয়েই তিনি বুঝিয়ে গেছেন। সে সব হাদীসের কলেবর কুরআনের সমান কিংবা তারও বেশি।
এ কথা সুস্পষ্ট যে, এ শাস্ত্রের বিভিন্ন স্তর রয়েছে এবং তার অনুসারীদেরও স্তরভেদ রয়েছে। এ বিদ্যার যেমন মগজ ও খুলি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভেতর ও বাইর। এর অধিকাংশ বিষয় আলেমগণ নিজ নিজ সূক্ষ্ম বিষয়ের সমাধান ও তাৎপর্য সহজলভ্য রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্রে কয়েকটি বিষয় আলোচিত হয়েছে। তার বাহ্যিক বিষয়গুলোর একটিতে রয়েছে সহী, জঈফ, মুস্তাফীজ, গরীব ইত্যাকার হাদীসের শ্রেণী বিন্যাস সম্পর্কিত আলোচনা। প্রাথমিক যুগের হাদীসবেত্তা ও হাদীসের হাফেজরা বিষয়টির ওপর অনেক কিছু লিখে গেছেন। দ্বিতীয় বিষয়টিতে রয়েছে কঠিন ও দুর্লভ হাদীসের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা। এ বিষয়ের ওপর আরবী বিষয়টিতে পাই হাদীসের বাক্য থেকে শরীয়তের বিধান উদ্ভাবন, তার তাৎপর্য অনুধাবন ও শাখা-প্রশাখা নিরূপণ সম্পর্কিত আলোচনা। এ বিষয়টিতে হাদীসের পরিচিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মনসুখ, মুহকাম, মরজুহ ও মুবরাম হাদীসের পরিচিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণ আলেমদের কাছে বিষয়টি হাদীস শাস্ত্রের সারবস্তু ও সব বিষয়ের সেরা বিষয় বলে বিবেচিত। মুহাক্কিক ফিকাহবিদগণ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন। এতো গেল একদিক।
আমার কাছে হাদীস শাস্ত্রের বিষয়গুলোর ভেতর শীর্ষস্থানীয় ও সূক্ষ্মতম, এমনকি সেগুলোর মূল ভিত্তি হল দ্বীনের রহস্যজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়টি। তাতে শরীয়তের বিধি-নিষেধের দর্শন, বিধানের বৈশিষ্ট্য ও যৌক্তিকতা এবং তত্ত্ব ও রহস্য বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর কসম, এটা এমন এক বিষয় যা নিয়ে আল্লাহর সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ফরজ ইবাদত সেরে অবশিষ্ট সম্পূর্ণ সময়টুকু গবেষণায় নিয়োজিত রাখে এবং এটাকেই নিজ পারলৌকিক সম্বল বলে মনে করে। কারণ, এ বিষয়ের বদৌলতেই মানুষ শরীয়তের রহস্যাবলী সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হয় এবং শরীয়তের বিষয়বস্তুর সাথে তাঁর ঠিক কবিতার সাথে কবরি, যুক্তি-প্রমাণের সাথে তর্ক শাস্ত্রবিদের, ব্যাকরণ অলংকারের সাথে ভাষাবিদের, ফিকাহর শাখা-প্রশাখার সাথে অসূলবিদদের মতই গভীর ও নিবিড়তম সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এ বিদ্যার সহায়তাই মানুষ কুহকী আলেয়া ও মায়া মরীচিকার হাতছানি থেকে হোই পায়। এ বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তি বিকারগ্রস্ত উটের মত বাঁকা চলন চলে না আর অন্ধ ঘোড়ায় চড়ে পথে-বিপথে ছুটে বেড়ায় না। কোন রোগীকে ডাক্তার সেব খেতে বলায় সে মাকালের সাথে তার সাদৃশ্য দেখে সেব ছেড়ে মাকাল খেলে যেরূপ মূর্খতা হয়, এ বিষয়ে অনভিজ্ঞরা তেমনি মূর্খ।
তেমনি এ বিদ্যার বদৌলতে আল্লাহর ফজলে ঈমানদার ব্যক্তির দিব্যদৃষ্টি লাভ ঘটে। তার অবস্থা দাঁড়ায় এই, কোন বিজ্ঞ ডাক্তার যেন তাকে মৃত্যুদায়ক বিষ খেতে নিষেধ করায় সে তা এ কারণে মনে নিল যে, তার ভেতরে অতিমাত্রায় তেজ ও শুষ্কতা থাকায় স্বভাবতঃই মানুষের জন্যে তা মৃত্যুদায়ক বলে নিজেই সে জানে। এখন মনে করুন, বিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে তার আস্থা কত বেড়ে গেল।
মহানবীর (সঃ) হাদীস এ বিষয়ের মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা বর্ণনা করে দিয়েছে। তাবেঈন ও সাহাবাদের কথা ও কাজের ভেতর দিয়ে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে প্রকাশ পেয়েছে। মুজতাহিদরা শরীয়তের প্রতিটি অধ্যায়ে তন্নিহিত কল্যাণকর রহস্যগুলো বর্ণনা করে আসছেন। তারপর তাঁদের অনুসারী মুহাক্কিকরা তার বিভিন্ন গূঢ়তত্ত্ব ও সুন্দর সুন্দর রহস্যের বিবরণী দিয়েছেন। এ কারণেই এ বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা ইজমায়ে উম্মতের বিরোধী এবং এটা আদৌ কোন নতুন বিষয় নয়।
তথাপি এ বিষয়ের উপর খুব কম লোকই গ্রন্থ রচনা করে গেছেন কিংবা এর মূলনীতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তাই এর কোনো নীতি পদ্ধতি বা মূলনীতি কেউ রচনা করেননি কিংবা এমন কোন কিছু রেখে যাননি যা থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জিত হতে পারে এবং জ্ঞান পিপাসুদের পিপাসা মিটতে পারে। মশহুর প্রবাদ রয়েছে, ‘তুমি যখন বাঘের পিঠে সোয়ার হবে, কে তোমার সঙ্গী হবে?’
তা হবেই বা না কেন? যে বিদ্যার পিঠে সোয়ার হতে গেলে শরীয়ত ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির সামগ্রিক জ্ঞান প্রয়োজন, বক্ষদেশ হতে হয় ইলমে লাদুন্নীতে (আল্লাহরদত্ত প্রত্যক্ষ জ্ঞান) পরিপূর্ণ, অন্তর হতে হয় আল্লাহরদত্ত আলোকে ভরপুর আয় তার সাথে স্বভাবে তেজস্বীতা ও মস্তিষ্কে প্রত্যুৎপন্নমতি তত্ত্ব থাকতে হয় এবং বক্তৃতা রচনার সুদক্ষ ও বাক্যের ব্যাখ্যা বিন্যাসে অতুলনীয় হতে হয়, সে বিদ্যায় সঙ্গী আসবে কোত্থেকে? তাকে তো এ বিদ্যার নতুন করে রীতি-নীতি ও মৌলভিত্তি রচনা করতে এবং তা থেকে শাখা-প্রশাখা উদ্ভাবনের বর্ণনামূলক ও বুদ্ধিগত দলীল-প্রমাণ বিন্যস্ত করতে হবে।
আমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ অশেষ। তিনি সে বিদ্যার কিছুটা দ্যুতি আমাকে দান করেছেন। অথচ নিজকে আমি অত্যন্ত নগণ্য ও ত্রুটিপূর্ণ বলে স্বীকার করি এবং নিজকে কখনও নির্ভুল ভাবিনা। কারণ, প্রবৃত্তি সতত খারাপ কথার দিকেই উস্কানী দিচ্ছে। ‘আমি একদিন আসরের নামাযের পর মুরাকাবায় বসলাম। হঠাৎ মহানবীর (সঃ) পবিত্র আত্মা দেখা দিল ও আমার উপর কাপড়ের মত একটা কিছু ঢেকে দেয়া হল। সংগে সংগে আমার ধারণা জন্মিল, আল্লাহর দ্বীনকে বিশেষ এক পদ্ধতিতে তুলে ধরার জন্য আমাকে ইংগিত দেয়া হল। তখন থেকেই আমার অন্তরে ক্রমবর্ধমা এক জ্যোতির বিকাশ অনুভভ করলাম’।
কিছুদনি পর ইলহাম (ঐশী ইংগিত) পেলাম এ বিরাট কাজে উদ্যোগী হবার জন্য। আমার ভাগ্যে বিশেষ একটি দিনও নির্ধারিত হয়ে এল। তখন এরূপ মনে হল, গোটা দুনিয়া আমার প্রভুর জ্যোতিতে পূর্ণ হয়ে গেল। এ যেন অস্তমান সূর্যের রক্তিম ছুটায় পৃথিবী উদ্ভাসিত। তাই সময় এসে গেল মহানবী (সঃ) প্রচারিত দ্বীনকে যুক্তি-প্রমাণের নবীন সাজে সজ্জিত করে ময়দানে হাজির করার।
তারপর আমি স্বপ্নে ইমাম হাসান-হুসায়েন (রাঃ)-কে মক্কায় এভাবে দেখতে পেলাম যে, তাঁরা আমাকে একটি কলম দিয়ে বললেন, এ কলমটি আমাদের নানা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর (সঃ)। বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, বিষয়টির ওপর এমন একখানা গ্রন্থ লিখব যার কল্যাণ সাধারণ-অসাধারণ ও উপস্থিত-অনুপস্থিত সবাই সমানভাবে পেতে পারে। মজলিসের সবাই যেন তা থেকে উপকৃত হয়। কিন্তু আমি একটা কথা ভেবে খুবই দ্বিধান্বিত ছিলাম যে, আশে-পাশে এমন কোন আলেম নেই যার সাথে এ ব্যাপারে জটিলতা দেখা দিলে পরামর্শ করতে পারি। আমার নিজের বিদ্যা-বুদ্ধিও তথৈবচ। যুগের মানুষের মূর্খতা ও সংকীর্ণতা এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ ত্রুটিপূর্ণ মত নিয়ে লক্ষঝস্ফ আমাকে আরও দুর্বল করেছে। তাছাড়া সমসাময়িকদের ভেতর বিরূপতার শিকড় থেকেই যায়। তেমনি পুস্তক প্রণেতা স্বভাবতঃই সমালোচনার শিকার হয়।
এরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর যখন কাটাচ্ছিলাম, তখন আমার বন্ধু প্রতিম ভাই মিয়া মুহাম্মদ সালমা ওরফে আশেক-[শাহ মুহাম্মদ আশেক হলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহর (রঃ) একান্ত শিষ্য ও মামাত ভাই। শরীয়তের রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত উন্মুখ ছিলেন।] এ বিষয়ে মর্যাদা বুঝতে পেলেন। তিনি এও উপলব্ধি করলেন, এ বিদ্যা ব্যতীত পূর্ণ সৌভাগ্য লাভ সম্ভব নয়। তিনি আরও জানলেন, সন্দেহ সংশয় নিয়ে আত্মোৎসর্গী সাধণা ও মতভেদ সমালোচনার ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া এ বিদ্যা অজির্ত হতে পারে না। তিনি বুঝতে পারলেন, এ বিদ্যার যিনি দ্বার উদঘাটন করলেন এবং যার সামনে এর সব জটিলতা পানি হয়ে গেল, তাঁর সহায়তা ছাড়া এ নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনাও চলেনা। তাই তিনি সেই লোকের সন্ধানে সম্ভাব্য সব শহরেই ঘুরে বেড়ালেন এবং যার থেকেই কিছু পেতে পারেন বলেন ভাবলেন, তাদের সবার সাথেই আলাপ করলেন। ভাল-মন্দ সবাইকে তিনি এভাবে পরীক্ষা করে চললেন। কিন্তু কারো থেকে কিছু পেলেন না এবং কাউকে এমন পেলেন না যাঁর সাথে এ ব্যাপারে কিছুটা ফলপ্রসূ জ্ঞান বিনিময় হতে পারে।
অবশেষে তিনি আমার কাছে এসে স্বস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি তখন থেকে আমার ছেনে লেগে রইলেন এবং যখনই আমি কিছু আলোচনা করতাম, বারংবার আমাকে ‘লাগামের হাদীস’ শোনাতেন। (হাদীসটির মর্ম এই, কারো কাছে কেউ কোন জ্ঞানের বিষয় জানতে চাইলে তা যদি সে গোপন করে তাহলে কেয়ামতের পর তার গলায় আগুনের লাগাম জুড়ে দেয়া হবে।) এমন কি তিনি আমার কোন ওজর-আপত্তিও শুনতেন না। আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে এ ব্যাপারে কিছু করতে বাধ্য করলেন। তখন আমি বুঝলাম, ইলহামে যে নির্ধারিত দিনটির কথা বলা হয়েছিল তা অত্যাসন্ন।
যেহেতু এ কাজ আমার পূর্ব নির্ধারিত এবং প্রতিটি অধ্যায়ে আল্লাহর মদদ কামনার জন্য আমি আদিষ্ট, তাই তাঁর দিকে মনোনিবেশ করলাম। ইস্তেখারা করে আল্লাহর সহায়তা প্রার্থনা করলাম। নিজ শক্তি ও যোগ্যতার কোন দখল দিলাম না। গোসলদাতার হাতের লাশের মতই আল্লাহর হাতে আমি নিজকে সমর্পণ করলাম। তারপর তিনি আমার কাছ থেকে যা পেতে চাইলেন তা শুরু করলাম। সবিনয়ে আল্লাহর কাছে এ কামনা কলাম, বাজে কথা থেকে যেন তিনি আমাকে ফিরিয়ে রাখেন এবং প্রত্যেক বস্তুর সঠিক রহস্য সম্পর্কে তিনি যেন আমাকে অবহিত করেন। অন্তর যেন নিষ্ঠাপূর্ণ, ভাষা অলংকারপূর্ণ ও বাক্য সততাপূর্ণ করেন। আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য যেন সহায়তা করেন। নিশ্চয় আল্লাহ বান্দার অতি কাছে থাকেন এবং ডাকের সংগে সংগে সাড়া দেন।
তথাপি আমি সেই ভাইটিকে শুরুতেই বলেছিলাম, আলোচনার মজলিসের আমি হলাম বোবা ব্যক্তি এবং দ্রুতগামী ঘোড়ার রেসে আমি খোঁড়া ঘোড়া। বিদ্যার পুঁজি আমার হারিয়ে গেছে। দানের হাড্ডিই আমার সম্বল। অন্তর আমার দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন ও ব্যতিব্যস্ত। তাই কিতাবের পৃষ্ঠায় চোখ বুলানো ও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার শক্তি আমার এখন নেই। কারো কথা মনে রাখার এবং যথাস্থানে উদ্ধৃতি দেয়ার মত স্মৃতি শক্তিও আমার এখন বেঁচে নেই। আমি যতটুকু করছি, নিজেই করছি। নিজের ধূলামাটি নিজেই একত্র করছি। আমি আমার জন্য নির্ধারিত সময়ের অনুবর্তী দাস। আমার অদৃষ্টের আমি শিষ্য। আমাকে যা বুঝানো হচ্ছে তাই বলছি, অন্তরে যা ঠাঁই পাচ্ছে সেটাই ভাল ভাবছি। তাই এতটুকু যে যথেষ্ট মনে করে, তার জন্য এটুকু হাজির রয়েছে। কিন্তু যারা আরও কিছু চায়, তারা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে।
আল্লাহ পাকের শরীয়তের বিধি-নিষেধ বান্দার জন্য তাঁর অনুগ্রহ ও পথ নির্দেশনা বৈ নয়। কুরআনের “ফালিল্লাহিল হুজ্জাতুল বালিগাহ” (পূর্ণ দীল প্রমাণ আল্লাহর সপক্ষে রয়েছে) আয়াতটি তো এ ইংগিতই দিচ্ছে। এ গ্রন্থখানি যখন সেই ইংগিতের তত্ত্ব উদঘাটন করতে চায় এবং শরীয়তের সেই দিগন্তের সমুজ্জল চন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তাই এর নাম ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ রাখা যায়। আল্লাহর আশ্রয়ই আমার জন্যে যথেষ্ট। তিনি উত্তম কারিগর। সেই মহান সর্বোন্নত সত্তার সহায়তা ছাড়া কোন শক্তিই শক্তি নয়, কোন দক্ষতাও দক্ষতা নয়।

প্রারম্ভিকা
অনেকের ধারণা, শরীয়তের বিধি-বিধান কোন যুক্তি কল্যাণের ধার ধারে না। তেমনি এর কর্ম ও কর্মফলের ভেতর সাজুয্য খোঁজা নিরর্থক। যেমন কোন প্রভু তার ভৃত্যের আনুগত্য পরীক্ষার জন্য কোন পাথর তুলতে কিংবা কোন গাছ ছুঁতে বলেন এবং ভৃত্য তা করলে প্রভু পুরস্কার দেন, না করলে তিরস্কার করেন, এও তেমনি ব্যাপার।
অথচ এ ধারণা ভুল। রাসূলের (সঃ) সুন্নাত ও সাহাবাদের (রাঃ) ঐকমত্য এর বিপরীত কথা বলে। এ কথা কে না জানে, নিয়তগুণে কাজের বরকত আর প্রকৃতি অনুসারে কাজের কদর হয়। রাসূল (সঃ) বলেন, কাজের মূল্যায়ণ উদ্দেশ্যে। আল্লাহ পাকও বলেন, কুরবানীর রক্ত মাংস পাই না আমি, আমি পাই খোদাভক্তি।
তেমনি আল্লাহকে স্মরণে রাখা ও তাঁরই কাছে দাবী আব্দার তোলার জন্য নামাযের প্রবর্তনা। আল্লাহ বলেন, আমাকে স্মরণে রাখার জন্য নামায আদায় কর। নামাযের অপর উদ্দেশ্য হল, পরকালে আল্লাহর দীদারের মাধ্যমে তাঁর সৌন্দর্য অবলোকনের সামর্থ্য অর্জন। রাসূল (সঃ) বলেন, অচিরে তোমরা ঠিক চাঁদ দেখার মতই তোমাদের প্রভূকে দেখতে পাবে। তাঁর দর্শন লাভের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় পোষণ করো না। তাই ফজর ও আসরে যেন (শয়তানের কাছে) পরাভূত না হও।
যাকাতের উদ্দেশ্য হল অন্তর থেকে কার্পণ্য ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করা। যেমন আল্লাহ পাক যাকাত বিরোধীদের সম্পর্কে বলেন, “যাদের আল্লাহ কিছু দিয়েছেন তারা যেন কার্পণ্যকে নিজেদের কল্যাণকর না ভাবে; বরং তাদের জন্য তা পরম অকল্যাণকর। পরকালে কার্পণ্য সঞ্চিত ধন আগুনের বেড়ী হয়ে কৃপণদের গলা জড়িয়ে থাকবে”। রাসূলে পাক (সঃ) মা’আজ বিন গানামকে (রাঃ) বলেছিলেন, ‘ইয়েমনবাসীকে বলে দিও, আল্লাহ তোমাদের ধনীদের সম্পদ দিয়ে দরিদ্রের অভাব দূর করার জন্য যাকাত ফরজ করেছেন’।
রোযা ফরজ হয়েছে প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণের জন্য। যেমন রাসূল (সঃ) বলেন, কামনার ক্ষেত্রে রোযা রাখা খোঁজা হওয়ারই নামান্তর।
আল্লাহর স্মৃতি জড়িত স্থানগুলোকে মর্যাদা দেয়ার জন্য হজ্ব ফরজ করা হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মক্কার ঘরটি দুনিয়ার মানুষের (ইবাদতের) জন্য নির্ধারিত প্রথম ঘর। ঘরটি তাই বরকতপূর্ণ ও পথের দিশারী। তাতে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে”। তিনি আরও বলেন, “সাফা-মারওয়া পাহাড় দুটো আল্লাহর নিদর্শন বৈ নয়”।
এভাবে হত্যা বন্ধ করার জন্য প্রাণদণ্ডের বিধান প্রদান করা হয়েছে। তাই আল্লাহ বলেন, ‘হে জ্ঞানীবৃন্দ! এ প্রাণদণ্ডের ভেতর তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে’। তেমনি পাপাচার বন্ধের জন্য দণ্ডবিধি জারী করা হয়েছে। তাই আল্লাহ বলেন, ‘এর মাধ্যমে যেন (চোর) দুস্কর্মের পরিণতি ভোগ করে ও পথ পায়’।
আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করার ও পাপীদের পাপাচারের মূলোৎপাটনের জন্য জিহাদ ফরজ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ততক্ষণ সংগ্রাম চালিয়ে যাও যতক্ষণ না পাপাচারের বিলুপ্তি ঘটে ও আল্লাহর দ্বীন সর্বত্র বিজয়ী হয়’।
লেনদেন ও বিয়ে-তালাক ইত্যাদির বিধান রাখা হয়েছে সামাজিক ইনসাফ ও সততা প্রতিষ্ঠার জন্য। এ ছাড়া আরও অনেক বিধি-বিধান সম্পর্কে আল্লাহর বাণী ও রাসূলের হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। যুগে যুগে ধর্মবেত্তাগণ তা বর্ণনা করে আসছেন। তবে এ সব যার কিছু জানা নেই, তার এ ব্যাপারে কিছু বলারও অধিকার নেই। কিংবা জানা কিছু থাকলেও তা যদি সমুগ্রে সূঁচ ডুবিয়ে পানি মাপার মত হয়, তার থেকেই বা কি আশা করা যায়? তার তো উচিত নিজ জ্ঞানের দৈন্যের জন্য অনুতপ্ত হওয়া ও কান্নাকাটি করা।
আমি আবার বলছি, স্বয়ং মহানবী (সঃ) বিভিন্ন ওয়াক্তের রহস্য বর্ণনা করেছেন। যেমন, যুহরের পয়লা চার রাকা’আত সম্পর্কে বলেন, “তখন আকাশের দুয়ার খোলা হয় এবং আমি চাই, তখন আমার কিছু পূণ্য কাজ সেখানে প্রবেশ করুক”। ইয়াওমে আশুরার রোযা সম্পর্কে তিনি বলেন, সেদিন মূসা (আঃ) ও তাঁর জাতি (বনী ইসরাঈল) ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। সুতরাং বিধানটি আমরা পালন করছি মূসার (আঃ) সুন্নতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্যে।
মহানবী (সঃ) বিভিন্ন বিধি-বিধানেরও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। যেমন দেখুন, যে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগল, তাকে তিনি হাত ধুতে বললেন। তার কারণ হিসেবে তিনি বলে দিলেন, নিদ্রিত ব্যক্তির জানা নেই তার হাত কোথা থেকে কোথায় ফিরেছে। নাকে পানি দেয়া ও নাক ঝাড়া সম্পর্কে তিনি বললেন, মানুষের নাসিকায় রাতভর শয়তানের অবস্থিতি ঘটে অর্থাৎ তরল নোংরা পদার্থ প্রবহমান থাকে। নিদ্রায় ওজু ভংগ হবার কারণ সম্পর্কে তিনি বললেন, নিদ্রাবস্থায় মানুষের সব বাঁধন শিথিল হয়ে যায় অর্থাৎ পায়খানা-প্রস্রাবের পথে হাওয়া ও তরল পদার্থাদি নির্গমনের সম্ভাবনা থাকে।
তেমনি (হজ্বের সময়ে) পাথর নিক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বললেন, এ কাজে আল্লাহর স্মরণ হয়। কারো ঘরে দৃষ্টি না দেয়ার বিধান সম্পর্কে বললেন, অনুমতি প্রার্থনার উদ্দেশ্য হর, হঠাৎ নজর ফেরে কাউকে যেন কেউ অপ্রস্তুত অবস্থায়না দেখে। বিড়ালের ঝুটার পবিত্রতা বর্ণণা করতে গিয়ে কারণ দেখালেন, বিড়াল সচরাচর ঘুরে-ফিরে বেড়ায় বরে তার ঝুটা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব নয়।
কোন কোন বিধান সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য হয়েচে। যেমন স্তন্য দানের সময়গুলোয় স্ত্রী সহবাস এ জন্য নিষিদ্ধ ছিল, তাতে সন্তানের ক্ষতি হয়। এভাবে অবিশ্বাসীদের থেকে বিশ্বাসীদের স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির জন্য সূর্যোদয়ের সময়ে নামায নিষিদ্ধ হল। তিনি বললেন, অবিশ্বাসীরা সূর্যোদয়ের সময়ে পূজা করে এবং সূর্য শয়তানের মাথার ওপর থেকে বেরিয়ে আসে। তেমনি দ্বীনকে বিকৃতির হাত তেকে বাঁচানোর জন্য বিধান এসেছে। যেমন, যে ব্যক্তি নফলকে ফরজের সাথে মিলিয়ে পড়তে চেয়েছিল, হযরত উমর (রাঃ) তাকে বললেন, “অতীতের উম্মতরা ফরজ নফরের তারতম্য না করেই ধ্বংস হয়েছে”। তখন মহানবী (সঃ) বললেন, ইবনে খাত্তাব! আল্রাহ তোমাকে বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন করেছেন। তুমি ঠিক কথাই বলেছ। কোন বিধান মানুষকে দোষমুক্ত করার জন্য হয়েছে। যেমন, তিনি একজনকে এক কাপড়ে নামায বৈধ জানিয়ে বললেন, সবার কাছেই কি দুপ্রস্থ কাপড় রয়েছে? তেমনি স্বয়ং আল্লাহ পাক রমজানের রাতে স্ত্রী সহবাস বৈধ করতে গিয়ে বললেন, “জানতাম তোমরা নিষিদ্ধ করার বিধান মনে-প্রাণে পালন করতে পারছিলে না। এখন আল্লাহ তোমাদের উপর দয়ার্দ্র হয়ে কৃত পাপ মাফ করলেন। তাই এখন থেকে তোমরা রমজানের রাতে স্ত্রীর সান্নিধ্য নিতে পার”।
কখনও তিনি উৎসাহ ও ভীতি সম্পর্কিত বিধানের উল্লেখ করলে সাহাবাগণ সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন তুলতেন। তিনি তার রহস্য জানিয়ে সন্দেহের নিরসন ঘটাতেন। যেমন তিনি বললেন, ঘরে বা দোকানে একা নামায আদায়ের চাইতে মসজিদে জামাতে নামায আদায় করলে পঁচিশগুণ ছওয়াব বেশী পাওয়া যায়। এবং তা এ কারণে যে, কখনও কেউ ভাল ভাবে ওজু করে জামাতের জন্য মসজিদের দিকে অগ্রসর হয়, তখণও তার প্রতি পদক্ষেপে একটা পাপ মুছে যায় ও একটা পূণ্য লিখা হয়। অন্যত্র তিনি বলেন, স্ত্রী সহবাসেও পুণ্য মিলে। জনৈক সাহাবা প্রশ্ন তুললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেটা তো কামনার আনুগত্য হল, তাতে পুণ্য মিলবে কেন? তিনি জবাব দিলেন, যদি তা হারাম পথে করত, তা হলে পাপ হত না? তাই যখন সে হালাল পথে তা করল পূণ্য লাভ করত।
অন্য এক মজলিসে তিনি বললেন, দুজন মুসলমান যখন সশস্ত্র দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তখন নিহত ও হন্তান দু’জনই জাহান্নামী হয়। সাহাবারা প্রশ্ন তুললেন, হন্তার জন্য জাহান্নাম ঠিকই, কিন্তু নিহত মুসলিম কেন জাহান্নামে যাবে? তিনি জবাব দিলেন, সেও হন্তাকে হত্যার জন্য সচেষ্ট ছিল। এরূপ অসংখ্য স্থানে সাহাবাদের সংশয় নিরসনের জন্য বিধান ব্যাখ্যাত হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস জুমআর দিন গোসল করার কল্যাণময়তা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। যায়েদ ইবনে ছাবেত ফল পুষ্ট হবার আগে তা কেটে বাজারে বিক্রয় নিষিদ্ধ করণের কারন বর্ণনা করেছেন। ইবনে উমর কাবা ঘর তাওয়াফের সময় শুধু দুটো রুকন চুমু খাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করেছেন। তারপর তাবেঈন ও মুজতাহিদীন বিধি-নিষেধের উদ্দেশ্য ও কারণ উপলব্ধি করে এসেছেন। প্রত্যেকটি সরাসরি আদেশ ও নিষেধের তারা কারণ দেখিয়েছেন। হয় তা কল্যাণ লাভের জন্য, নয়তো। অকল্যাণ রোধের জন্য এসেছে। তাঁদের গ্রন্থাবলীতে সেগুরোর সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। ইমাম গাজ্জালী, ইমাম খাত্তাবী ও ইবনে আবদুস সালাম প্রমুখ শরীয়তের বিধি-নিষেধের অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রহস্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাঁদের এ সাধনার পুরস্কার দিন।
কিন্তু, এ সব বাদ দিলেও শরীয়তের বিধি-বিধান ওয়াজিব ও হারাম হওয়ার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধ হওয়াটাও একটা বড় কারণ। তাই তা প্রতিপালনকারী পুরস্কার পাবে এবং অমান্যকারী শাস্তি পাবে। এটা ঠিক নয় যে, কর্মের ভার বা মন্দ কর্তার শাস্তি বা পুরস্কার লাভের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা নেহাৎ খেয়ালী ব্যাপার। শরীয়তের শুধু এ কাজও নয়, কোন বিধানের কি দোষ গুণ তা বর্ণনা করেই ছেড়ে দেবে এবং কোনটি হালাল বা হারাম তা বলে দেবে না। তা হবে যেন কোন ডাক্তার শুধু ওষুধের গুণাগুণ আর রোগের বিভিন্ন নাম বলেই কর্তব্য শেষ করল। শরীয়ত সম্পর্কে কোন কোন লোকের ধারণা সেরূপ। অথচ তা সম্পূর্ণ ভুল। ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখলেও এ ধারণা ছুঁড়ে ফেলতে হয় এবং মেনে নেয়া যায় না কিছুতেই। তা হবেই বা না কেন? দেখুন, মহানবী (সঃ) তারাবীর নামাযে অংশ গ্রহণ না করার কারণ সম্পর্কে বললেন, আমার ভয় হয়, তা হলে এ নামায তাদের জন্য ফরজ হয়ে যাবে। আরও বললেন, সব চাইতে পাপী মুসলমান সে, প্রশ্ন তোলার কারণে যার মুবাহ বস্তু হারাম হয়ে যায়।
এ ছাড়াও অনুরূপ অনেক হাদীস আছে যদি এ ধারণাই সত্য হত যে, কারণ ছাড়া কোন বিধান হতেই পারে না, তা হলে যে মুকীমের ঠিক মুসাফীরের মতই অসুবিধা ও কষ্ট দেখা দিত, তার জন্যও রোযা ভংগ কা সংগত হত। যে কষ্টের কারণে রোযা ভংগ বৈধ হল, সে কারণ উভয়ের ভেতরেই সমানে বিদ্যমান। তেমনি মুসাফির মুকীমের বিধানের বেলায়ও এ সত্য প্রযোজ্য। তাই কোন আদেশ-নিষেধ যদি দলীল-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে তা বাস্তবায়নের জন্য যুক্তির অপেক্ষায় থাকা চলে না। কারণ, সীমিত জ্ঞানের মানুষ অধিকাংশ বিশেষ বিশেষ বিধানের সূক্ষ্ম যুক্তি-প্রমাণ উপলব্ধি নাও করতে পারে। অথচ শরীয়ত তা পালন করা ওয়াজিব করে দিয়েছে। মহানবীর (সঃ) জ্ঞান আমাদের সকলের জ্ঞানের চাইতে নিঃসন্দেহে বেশী নির্ভরযোগ্য। তাই যুক্তি-জ্ঞান অযোগ্যের জন্য অনুপযোগী মনে করা হয়েছে। এবং কুরআনের তাফসীরের জন্য যে সব শর্ত আরোপ হয়েছে, এ জ্ঞান অর্জনের জন্যেও তা করা হয়েছে। মহানবী (সঃ) সুন্নাহর সমর্থন ছাড়া শুধুমাত্র যুক্তি প্রয়োগের দ্বারা কোন মীমাংসা খোঁজা হারাম করা হয়েছে।
আমার আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, সঠিক কথা হল এই, শরীয়তের অনুসরণের জন্য তা আল্লাহ-রাসূলের বিধি-নিষেধ হিসেবে প্রমাণিত হওয়াই যথেষ্ট। উপমা স্বরূপ বলা যায়, কোন মালিকের কতিপয় ভৃত্য অসুস্থ হয়ে পড়ল। মালিক তাদের ওষুধ খাওয়াবার জন্য বিশেষ একজন লোক নিযুক্ত করলেন। এখন যদি ভৃত্যরা সেই ব্যক্তির ব্যবস্থা মতে ওষুধ খেতে থাকে, তা হলেই তাদের প্রভুর আনুগত্য প্রকাশ করা হল। প্রভুও তাতে খুশী হবেন, তারাও রোগমুক্ত হবে। পক্ষান্তরে যদি তারা সে ব্যক্তির কথা না শোনে, তা হলে মূলতঃ তারা মালিকের নির্দেশ অমান্য করল। ফলে তারা যেমন সুস্থ হবেনা, তেমনি পুরস্কৃতও হবে না; বরং তিরস্কৃতই হবে। এমনকি রোগ তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।
মহানবী (সঃ) বলেন, ফেরেশতারা বলাবলি করছেন, এ ব্যক্তির (মহানবীর) অবস্থা হল এই, কেউ একটি ঘর তৈরী করে সেখানে নানা ধরনের খানাপিনা সাজিয়ে রেখে কাউকে দাওয়াত দিতে বলল। যারা তার দাওয়াদ গ্রহণ করল, তারা ঘরে এল ও খানাপিনা পেয়ে গেল। পক্ষান্তরে যারা তা করল না, তারা ঘরেও এল না এবং খানাপিনাও পেল না।
আমার বক্তব্যের সাথে মহানবীর (সঃ) এ হাদীসের মিল রয়েছে। মহানবীর (সঃ) নিম্ন বক্তব্যের তাৎপর্যও তাইঃ
“আমার ও আল্লাহ যা দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছেন, তার উপমা হচ্ছে এই, কোন ব্যক্তি কোন জাতিকে এসে বলল, আমি নিজ চোখে শত্রু সৈন্য দেখে এসে তোমাদের সতর্ক হতে বলছি এবং এখান থেকে পালাতে বলছি। যারা তার কথা শুনে সংগে সংগে পালাল, তারা শত্রু সৈন্যের হামলা থেকে বেঁচে গেল। পক্ষান্তরে যারা তার কথা মিথ্যা ভাবল এবং অলস নিদ্রায় রাত কাটাল, ভোর হওয়ামাত্র শত্রু সৈন্যের হামলায় তারা নিহত হল।
তাছাড়া মহানবী (সঃ) আল্লাহ পাক থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক বলেছেন, তোমাদের কর্মফলই তোমাদের দেয়া হবে। আমি বলছি, আসল সত্য এ দুটো চরম মতের মাঝখানে রয়েছে এবং সেটাই কেবল উভয় মতের ভেতর সামঞ্জস্য বিধান করতে পারে। কর্ম ও আল্লাহর মর্জী এ দুটোই শাস্তি ও পুরস্কার দানের ক্ষেত্রে সমানে সক্রিয়। তাই শরীয়ত শুধু বিধি-নিষেধের উল্লেখ ও গুণাগুণ বর্ণনায় সীমিত থাকে না, তাকে বৈধ-অবৈধ করারও ক্ষমতা রাখে। এটাই মধ্যবর্তী মতবাদ। জাহেলী জীভনের পাপের শাস্তি ইসলাম গ্রহণের পর হবে কি হবে না। এ উভয় মতেরও সমাধান মধ্যবর্তী মতের ভেতর রয়েছে।¬–[মধ্য পথ অনুসারে শরিয়ত যেমন যুক্তি নির্ভর নয়, তেমনি যুক্তি বর্জিতও নয়। এটাই গ্রন্থকারের মত। ফলে ইসলাম গ্রহণ করলে জাহেলী জীবনের শুধু শিরকের জন্য জবাবদিহি হবে, আহকামের জন্য নয়। কারণ, শিরক ছেড়ে তওহীদ নেবার জন্য জ্ঞানই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে আহকাম জ্ঞানের মুখাপেক্ষী নয়। অথচ একদল ফিকাহবিদ জাহেলী জীবনের সব পাপের জবাবদিহি কথা বলে। অন্যদল সবই ক্ষমা পাবে বলে জানেন।]
একদল লোক মোটামুটি ভাবে জানেন যে, বিধি-বিধানের মহৎ উদ্দেশ্যাবলী ও যুক্তি রয়েছে এবং তার কর্মের জন্য যে পুরস্কার ও শাস্তি রাখা হয়েছে তা মনস্তাত্ত্বিক কারণে। অর্থাৎ সুফলের আশা ও কুফলের ভয়ে মানুষ সঠিক পথ অবলম্বন করে। যেমন নবী করীম (সঃ) বলেন, ‘সাবধান! মানবদেহে একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে। যতক্ষণ তা বিশুদ্ধ থাকে, গোটা দেহ ঠিক থাকে। যখন সেটা খারাপ হয়, গোটা দেহ খারাপ হয়ে যায়। সেটাই হল অন্তর’।
কিন্তু সংগে সংগে তারা এ কথাও বলেন, ‘এ নিয়ে একটা পৃথক বিষয় রচনা ও তার শাখা-প্রশাখা নির্ণয় করা নিষিদ্ধ। এর যুক্তি সংগত কারণ তো এই, বিষয়টি খুবই সূক্ষ্ম ও জটিল। শরীয়ত সংগত কারণ হল এই, মহানবীর (সঃ) সময়ের পূর্বসূরীরা তাঁর জ্ঞানালোকের আভায় উজ্জ্বল থেকেও এ বিষয়ে কোন গ্রন্থ রচ না করে যাননি। ফলে এ বিষয়ে এড়িয়ে চলার ওপরেই যেন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথবা এ কথাও বলা চলে যে, সেটাকে একটা পৃথক বিষয় হিসেবে দাঁড় করানোর ভেতর কোন দীর্ঘ মেয়াদী কল্যাণ নেই। কারণ, শরীয়ত পালনের জন্য তার উদ্দেশ্য ও যুক্তি জানার প্রয়োজন হয় না।
উক্ত দলের এ ধারণাও ভুল। তাঁরা যে বলেছেন, বিষয়টি সূক্ষ্ম ও জটিল বলে তা নিয়ে পৃথক বিষয় রচনা অসম্ভব, এ কথা ঠিক নয়। কারণ কোন বিষয় কঠিন বলে তা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করতে অসুবিধা হয় না। দেখুন, ইলমে তাওহীদ (একত্ববাদ তত্ত্ব) এর চাইতেও সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়। তা উপলব্ধি ও আয়ত্ত করা খুবই কঠিন কাজ। তা সত্ত্বেও আল্লাহ যাঁকে তওফিক দিয়েছেন, তিনি তা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তেমনি বিভিন্ন বস্তুগত শিক্ষাও পর্যালোচনা এবং আয়িত্ত করা কম কঠিন নয়। কিন্তু যখন তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামানো হয় ও তার পটভূমি আস্তে আস্তে উদঘাটিত হয়, তখন তাতেও দক্ষতা অর্জিত হয়। তার নিয়ম-কানুন ও শাখা-প্রশাখা উদ্ভাবন করা সহজ হয়ে যায়। যদি তাঁদের বক্তব্যের তাৎপর্য এই হয় যে, বিষয়টি বেশ কঠিন, তা হলে তা সমর্থনযোগ্য। কিন্তু একেবারে অসম্ভব বলরে হয়, বিদ্বানের ওপরেও বিদ্বান রয়েছে। অভীষ্ট তো মানুষকে কষ্ট ও শ্রম দ্বারাই অর্জন করতে হয়। বিদ্যার পৃষ্ঠে তো মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে ও মেধাকে সতেজ করেই আরোহণ করতে পারে।
তারপর তারা যে বললেন, ‘পূর্বসূরীরা রচনা করে যাননি এটাও কেন যুক্তি নয়। কারণ, নতুন করে রচনার পথে তা অন্তরায় হয় না। মহানবী (সঃ) নীতি নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন। আইনজ্ঞ সাহাবা যথা আমীরুল মুমিনীন উমর (রাঃ), আলী (রাঃ), যায়েদ (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ তাঁর নীতি অনুসরণ করে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচ না ও গবেষণা চালিয়ে সবগুলোর কার্যকরণ বলে গেছেন। তাপর যুগে যুগে দ্বীনের পতাকাবাহী মনীষীরা সে ব্যাপারে সংশয় ও জটিলতা সৃষ্টি হলেই, আল্লাহদত্ত জ্ঞান থেকে প্রয়োজনীয় কথা প্রকাশ ও প্রচার করতেন। তাঁরা বিতর্ক ও বহাসের তরবারি দিয়ে বিদআতের সৈনিকদের টুকরা টুকরা করে ফেলতেন। তেমনি ধর্মহীনতাকেও তাঁরা নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন।
আমি এখন পর্যন্ত এটাই যথাযথ মনে করি যে, বিভিন্ন মতের উদ্ধৃতি সহ উক্ত বিষয়ের ওপর রচনার প্রয়োজন এ কারণে ছিলনা যে, তাঁরা মহানবী (সঃ) কাছাকাছি সময়ের এবং তাঁর সংস্রব ও প্রত্যক্ষ প্রেরণা লাভের সৌভাগ্য তাঁদের হয়েছিল। এ কারণেই তাঁদের ভেতর মতভেদও কম ছিল। আকীদাও (ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা) তাদের সুস্পষ্ট ছিল। সব রকমের মানসিক স্বস্তি ও স্থিরতা তাদের ছিল। কারণ, তাঁরা মহানবী (সঃ) থেকে কোন কথা প্রমাণিত হলেই পালন করতেন এবং বেশি জিজ্ঞাসাবাদ ও খোঁজাখুঁজি চালাতেন না। প্রমাণিত বর্ণনাকে তাঁরা যুক্তির মানদণ্ডে বিচারের প্রয়োজনীয়তা ভাবতেন না। তা ছাড়া বিরাট ও গভীর জ্ঞানের বিষয় নিয়ে তাঁরা নির্ভরযোগ্য জ্ঞানীদের কাছে আলোচনা করতে পারতেন। এ সব কারণেই তাঁরা উক্ত বিষয়টি এত নিষ্প্রয়োজন ভাবতে পেরেছেন।
শুধু তাই নয়। যেহেতু তাঁরা প্রাথমিক যুগের লোক, হাদীস বর্ণনাকারীদের সাথে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। কোন জটিলতা দেখা দিলে সংগে সংগে জেনে নেবার সুযোগ ছিল। মতভেদ কম ছিল এবং মনগড়া হাদীস বর্ণনার আশংকা ছিল না। তাই হাদীস শাস্ত্রের ওপরও গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তাঁরা ভাবেন নি। যেমন ‘গরীব হাদীসের ব্যাখ্যা, হাদীসের বর্ণনাকারীদের পরিচিতি, হাদীসের জটিলতা, হাদীসের বিভিন্নতা, সহীহ, জঈফ, হাসান ও মওজু হাদীসের পার্থক্য জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের ওপর কোন গ্রন্থই তাঁরা রচনা করে যাননি। তা হয়েছে তাঁদের অনেক পরে। এর মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখা তখনই নির্ধারিত হয়েছে, মুসলমানদের যখন সে সবের তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে এবং এগুলোর করার ভেতরেই ইসলামের কল্যাণ প্রতীয়মান হয়েছে।
তারপর ফকীহদের ভেতর বিধি-বিধানের কারণ নির্ণয়ে মতভেদ দেখা দেয়ার রূপরেখাতেও যথেষ্ট মতভেদ সৃষ্টি হল। এমনকি এরূপ প্রশ্নও দেখা দিল যে, এর পেছনে স্বতন্ত্র কোন কল্যাণের উদ্দেশ্য আদৌ রয়েছে কিনা? যদি থেকে থাকে তো শরীয়তের দৃষ্টিতে নির্ভরযোগ্য কল্যাণময়তা কি করে হাসিল করা যায়?
অবশেষে নেহাৎ ধর্মীয় ব্যাপারেও যুক্তি-বুদ্ধির আশ্রয় শুরু হল। ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা ও মসআলায় সন্দেহ সৃষ্টি হতে লাগল। তারপর অবস্থা এই দাঁড়াল, প্রমাণিত বর্ণনাকেও যুক্তি-বুদ্ধির সাথে খাপ খাওয়ানো শুরু হল এবং শোনা ব্যাপারকে নিজ নিজ বুঝের সাথে মিলিয়ে নিতে লাগল। এমনকি এটাকেই তারা দ্বীনের পূর্ণ সহায়তা ও খেদমত ভাবতে লাগল। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের মতভেদ দূর করার জন্য এটা চমৎকার পন্থা ও আল্লাহর পরম ইবাদত বলে বিবেচিত হয়ে চলল।
শরীয়তের রহস্য উপেক্ষাকারীদের “এটাকে স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে কোন উপকার নেই” বক্তব্যটিও ভুল। আমি বলছি, তাতে বিরাট বিরাট কল্যাণ রয়েছে। তাঁর কয়েকটি এখানে বলছি।
এক, এতে মহানবীর (সঃ) বিরাট এক মু’জেযা প্রকাশ পায়। কারণ, তাঁর ওপর যে কুরআন অবতীর্ণ হয়, তৎকালীন ভাষালংকারিকরা তার সামনে মাথা নত করেছিলেন। তার যে কোন একটি সূরার সমকক্ষতা তারা সবাই মিলেও করতে পারেননি। তারপর যখন তৎকালীন আরবী ভাষাবিদরা অতীত হলেন এবং কুরআনের ভাষা ও অলংকারের অতিমানবীয় গুণ সম্পর্কে মানুষ বেখেয়াল হয়ে চলল, তখন উম্মতের শিক্ষাবিদরা সেটা তুলে ধরাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য।
তেমনি মহানবীর (সঃ) ওপর পূর্ণ শরীয়ত এসেছে। অন্যান্য নবীর বেলায় ছিল অপূর্ণ। তাই তার ভেতরে এমন সব সূক্ষ্ম কল্যাণ রয়েছে যা সাধারণের উপলব্ধির বহির্ভূত ব্যাপার। সে সবের তত্ত্ব ও সৌন্দর্য তো তাঁর সমসাময়িক কালের লোকেরা প্রত্যক্ষ সংযোগ ও প্রেরণার মাধ্যমে পেয়ে যেতেন। তাঁদের কথা ও বক্তৃতায় তা প্রকাশও পেয়েছে। কিন্তু তাঁদের অন্তর্ধানের পর সে সব তত্ত্ব ও সৌন্দর্য তুলে ধরা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাহলে সবাই সহজেই বুঝতে পাবে, তাঁর শরীয়ত ঐশী ও পূর্ণাঙ্গ শরীয়ত এবং কোন মানুষ কিছুতেই এটা রচ না করতে পারে না।
দুই, এর ফলে পরিপূর্ণ মানসিক স্বস্তি অর্জিত হয়। যেমন ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, প্রভু! মৃতকে তুমি জীবিত করতে পার সে বিশ্বাস আমার রয়েছে। তথাপি স্বচক্ষে তা আবার দেখতে চাই শুধু বিশ্বাস পরিপূর্ণ স্বস্তি দানের জন্য। মূলত দলীল-প্রমাণের আধিক্য ও বিশ্বাস সৃষ্টির অন্যান্য পন্থা প্রয়োগ দ্বারা অন্তর মজবুত হয় এবং মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নির্মূল হয়।
তিন, কল্যাণপ্রার্থীরা যখন পুণ্য অর্জনের জন্য প্রয়াসী হয় ও কোন বিধানকে কি কি কল্যাণ তাও ভালভাবে জানতে পায় এবং তার আনুষংগিক দাবীগুলোর প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখে, তখন তার সামান্য পুণ্য কাজও অশেষ ফল দান করে। শরীয়ত সে দেখে-শুনে পাকা হয়ে ভালভাবে পালন করে, অন্ধভাবে মানেনা। এ কারণেই ইমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর ব্যবহারিক গ্রন্থগুলোর ইবাদতের বিধি-নিষেধের রহস্যাবলী অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছেন।
চার, ফিকাহবিদদের ভেতর বিধি-বিধানের প্রশ্নে এ কারণেই মতভেদ দেখা দিয়েছে যে, বিধানের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে তাঁদের মতভেদ ছিল। কিয়াসের জন্য কোন কারণটি গ্রহণযোগ্য ও উপযোগী তা নির্ণয়ে তাঁরা মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন নি। সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য বিষয়টির উদ্দেশ্য ও কারণসমূহ জানা অত্যাবশ্যক।
পাঁচ, বিদ’আতিরা দ্বীনের অনেক ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি করে দিয়েছে। তারা কোন কোন বিধান সম্পর্কে বলছে, এটা যুক্তি বহির্ভূত কথা। বুদ্ধি যা সমর্থন করেনা, হয় তা বর্জন করতে নয় তার বুদ্ধিসম্মত কোন ব্যাখ্যা বের করতে হবে। সেমতে কবর আজাবকে তারা অযৌক্তিক বলে থাকে। তেমনি হিসেব-নিকেশ, পুলসিরাত ও মীযান সম্পর্কে বিতর্ক তুলে তারা বিকৃত ব্যাখ্যা দান করে থাকে। এভাবে একদল লোক (ইসমাইলিয়া) দুনিয়াময় সন্দেহের ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। তারা বলছে, রমযানের শেষ দিন রোযা ফরজ আর শওয়ালের প্রথম দিন রোযা হারাম হওয়ার যৌক্তিকতা কি? এ ধরনের আরও অনেক তর্ক সৃষ্টি করেছে তারা। ছওয়াব ও আজাব নিয়ে তারা হাসি-তামাসা করে। তাদের মতে সেগুলো শুধু ভয় ও লালসা দেখিয়ে কাজ আদায়ের ব্যবস্থা। আসলে ওসব কিছু নেই। এমনকি যুগের এক সেরা নরাধম উদ্দেশ্যমূলক হাদীস তৈরী করে মুসলমানদের ওপর এ অপবাদ চাপাল, তাদের ভেতর ভাল ও মন্দের কোন তারতম্য নেই।
এখন বলুন, এ সব দলের সৃষ্ট সংশয়গুলো দূর করার জন্য সব কিছুর উদ্দেশ্য ও রহস্য বর্ণনা এবং এ সম্পর্কে নীতি নির্ধারণী গ্রন্থ রচনা ছাড়া উপায় কি? যে ভাবে ইহুদী, নাসারা ও নাস্তিক প্রভৃতির মোকাবিলার জন্য করা হয়েছে, তেমনি বিভ্রান্ত মুসলমানদের জন্যও করতে হবে।
ছয়, ফিকাহবিদদের একটি দল রায় দিয়েছেন, জ্ঞান বিরোধী সব হাদীসই অগ্রাহ্য করা হবে। ফলে অনেক সহীহ হাদীসও বাদ পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। মুসাবাহা ও কিল্লাতাইনের হাদীস দুটো তার উদাহরণ।–[দুগ্ধবতী উট, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে ঠেকিয়ে স্তন ফাঁপিয়ে ক্রেতা ফাঁকী দেবার মাসআলা এসেছে মুসার হাদীস থেকে। পক্ষান্তরে দু’মশকের বেশী পানী হলে নাপাক হয়না মাসআলাটির মূলে হল কিল্লাতাইনের হাদীস। দুটো হাদীসই সিয়া সিত্তায় ঠাঁই পেয়েছে।] এ ক্ষেত্রে হাদীসবেত্তাদের জন্য এ সব হাদীসের যুক্তি ও কল্যাণের দিকগুলো বর্ণনা না করে উপায় আছে কি?
শরীয়তের যুক্তি-কল্যাণ ব্যাখ্যাত হওয়ার বিষয়টির এ সব ছাড়াও বহু গুরুত্ব রয়েছে। তাই দেখতে পাবেন, কিছু বর্ণনা করতে কিংবা কোন নীতি নির্ধারণ করতে যেখানে আমি অগ্রসর হব, সেখানেই এমন সব কিছু মাঝে মাঝে বলব যা কোন তর্ক শাস্ত্রবিদ কিংবা কালাম শাস্ত্রবিদ বলেননি। যেমন, হাশর ময়দানে আল্লাহ পাকের বিভিন্ন জ্যোতিতে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ। তা হবে বস্তু জগতের ঊর্ধ্বে এমন এক দুনিয়ায় যেখানে কর্ম ও তাৎপর্য নিজ নিজ যথাযোগ্য রূপ নিয়ে ধরা দেবে। পৃথিবীতে যত ঘটনা ও বিবর্তন দেখা দেয়, প্রথমে সেখানে (স্বরূপ জগত) জন্ম নেয়। সেখানে কর্মের সাথে কর্তার মানসিকতাও রূপ নিয়ে ধরা দেবে। জীবনে ও মরণে এ স্বরূপের ভিত্তিতেই ফলাফল দেয়া হবে। আমার সে বর্ণনায় তকদীর অর্থাৎ আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনড় ও তার বাস্তবায়ন অপরিহার্য কিনা তার রহস্যও আলোচিত হবে।
আপনাদের স্মরণ রাখা উচিত, এ সব রহস্য উদঘাটনের সিদ্ধান্ত আমি তখনই নিয়েছি, যখন কুরআন, হাদীস ও ‘আছার’-এর সমর্থন ও সহায়তায় পেয়েছি। এমনকি আহলে সুন্নতের যে সব বিশিষ্ট মনীষীরা আল্লাহদত্ত জ্ঞান (ইলমে লাদুন্নী) প্রাপ্তি ঘটেছে, তাঁদেরও সমর্থন দেখতে পেয়েছি। তাঁরা অনেক রীতি-নীতির বর্ণনা প্রদান করতে গিয়ে এর ওপর ভিত্তি করেছেন।
আহরে সুন্নত মূলতঃ বিশেষ এক মজহাবের নাম নয়। বরং ইসলামের অনুসারীরা দ্বীনে জরুরী বিষয়গুলোর ঐকমত্য রেখেই কোন কোন শাখা-প্রশাখায় গিয়ে মত পার্থক্যের শিকার হয়েছেন। দু’ধরনের মতভেদের মস’আলা-মাসায়েল রয়েছে। এক, কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত ও সহী হাদীস থেকে যা প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রাথমিক যুগের ধর্মবেত্তা সাহাবা ও তাবেঈনরা যা মেনে নিয়েছেন। পরবর্তী কালে ফিকাহবিদরা নিজ নিজ বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে মস’আলা তৈরী শুরু করলে একদল লোক সেগুলো আঁকড়ে থাকেন। তারা বুদ্ধি-গ্রাহ্য রীতি-নীতির কোন তোয়াক্কা করলেন না। তাঁরা কোথাও যদি যুক্তির আশ্রয় নেন তো নেহাৎ বিরোধিতা ঠেকানো ও আত্মতুষ্টি লাভের জন্য করেন। তার উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের আকীদা সুপ্রমাণিত করা। এ দলের নাম আহলে সুন্নত আল জামা’ত।
কিন্তু, একদল যেখানে যা কিছু নিজ বিবেক বুদ্ধির বিপরীত দেখেছেন, ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করে তার প্রকাশ্য অর্থ থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। কবরের জিজ্ঞাসাবাদ, আমলের ওজর দেয়া, পুলসিরাতে আরোহণ, আল্লাহর দীদার, জাওলিয়ার কেরামত ইত্যাকার ব্যাপার কুরআন-হাদীস থেকে সুপ্রমাণিত হয়েছে এবং প্রাথমিক যুগের সাহাবা ও তাবেঈনরা এগুলো মেনে গেছেন। কিন্তু একদল লোকের জ্ঞান এগুলোর নাগাল পেলনা। তাই তারা এগুলো ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে মোটামুটি অস্বীকার করে চলল। অন্য একদল বলল, যদিও আমরা সেগুলো বুঝতে পারছিনা, তথাপি সেগুলোর ওপর ঈমান রাখছি। এক্ষেত্রে আমার কথা এই, সেগুলোর ওপর শুধু ঈমানই রাখছিনা, তত্ত্বও জানি।
দ্বিতীয় ধরনের মাস’আলা হল এই, কুরআন, হাদীস কিংবা সাহাবাদের ‘আছার’ থেকে তার প্রমাণ মিলে না, সবকিছুই সে ব্যাপারে নীরব। পরবর্তীকালে একদল লোক জন্ম নিল সে ব্যাপারে জ্ঞানলব্ধ রায় দিতে। যেমন ফেরেশতার ওপর নবীদের মর্যাদা দান, হযরত ফাতিমার (রাঃ) ওপর হযরত আয়েশার (রাঃ) মর্যাদা দান ইত্যাদি। অথবা কুরআন-সুন্নাহ থেকে সুপ্রমাণিত মস’আলার আনুষংগিক কোন ব্যাপারে মস’আলা দাঁড় করা। যেমন পার্থিব সাধারণ কার্যকলাপ কিংবা পার্থিব উপাদান উপকরণ সম্পর্কে মস’আলা। পৃথিবী লয়শীল প্রমাণ করার জন্য ‘অংশ হয়না এমন অংশ নেই’ ও ‘ধ্বংস হয়না এমন উপাদান নেই’ সিদ্ধান্তটি প্রতিষ্ঠিত করা তার অন্যতম উদাহরণ। তেমনি ‘আল্লাহ পাক কোন বস্তুর মাধ্যম ছাড়াই সমগ্র জগত সৃষ্টি করেছেন’ এ বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিজ্ঞানীদের ‘এক বস্তু থেকে শুধু এক বস্তুই জন্ম নিতে বা প্রকাশ পেতে পারে, যুক্তি খণ্ডনের মস’আলা। তেমনি ‘মু’জিযা’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুক্তি শাস্ত্রবিদদের ‘কার্য কারণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক’ যুক্তিটি ভ্রান্ত প্রমাণের মস’আলা। তেমনি হাশর ময়দানে ‘সশরীরে উত্থান’ প্রমাণ করার জন্য ‘লয়প্রাপ্তের পুনরাগমন অসম্ভব’ যুক্তির অসারতা সম্পর্কিত মস’আলা। এরূপ আরও ব হু মস’আলা গ্রন্থের পর গ্রন্থ পূর্ণ করে রেখেছেন।
অথবা কুরআন-সুন্নাহ থেকে সুপ্রমাণিত মস’আলার মৌলিক ব্যাপারে একমত থাকলেও তার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যায় মতভেদ দেখা দিয়েছে। যেমন আল্লাহ পাক দেখেন ও শুনেন এ ব্যাপারে কারো মতভেদ নেই। কিন্তু কিভাবে দেখেন ও শুনেন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মতভেদ দেখা দিয়েছে। একদল তো বললেন, তাঁর দেখা-শোনার অর্থ জানা। অর্থাৎ মানুষ দেখে-শুনে যা জানে তা তিনি না দেখে-শুনেই জানেন। আরেক দল বলছেন, তা নয়। দেখা-শোনা ও জানা দুটো পৃথক ও স্বতন্ত্র গুণ। তেমনি আল্লাহর ‘চিরঞ্জীব’ ‘সর্বজ্ঞ’ ‘ইচ্ছাময়’ ‘সর্বশক্তিমান’ ‘শ্রেষ্ঠতম বাগ্মী’ হওয়ার কারো মতভেদ নেই। তবে একদর তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললেন, এগুলোর বাহ্যিক অর্থ নেয়া যাবেনা; বরং এ সব থেকে তাঁর অস্তিত্বের পরিধি, প্রভাব, কার্যকলাপ ইত্যাদির আভাস নিতে হবে। উক্ত সাতটি গুণের সাথে তাঁর দয়া, ক্রোধ, দানশীলতার কোন পার্থক্য নেই। এমনকি কোন হাদীস থেকেও তার সমর্থনে কোন প্রমাণ মিলেনা। অথচ অন্য দল বলছেন, তা নয়। এসব তাঁর মৌল সত্তায়ই বিদ্যমান রয়েছে।
তেমনি আল্লাহর ‘তখতে আসীন হওয়া’ কিংবা তাঁর ‘মুখমণ্ডল’ অথবা ‘হাসি’ সম্পর্কে মোটামুটি সবার ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। একদল বলছেন, এগুলোর বাহ্যিক অর্থের বদলে তাৎপর্য গ্রহণ করতে হবে। ‘তখতে আসীন হওয়া’ অর্থ দখল, বিজয় বা শাসন ক্ষমতা। তেমনি ‘মুখমণ্ডল’ বলতে তাঁর মৌল সত্তা বুঝানো হয়েছে। অন্যদল এর আলোচনাই বাদ দিয়ে বলছেন, এসবের অর্থ বা তাৎপর্য কোনটিই আমাদের জানা নেই।
আমি এ দু’দলের কোন এক দলকে আহলে সুন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্য দলের ওপর প্রাধান্য দিতে পারিনা। কারণ, নিছক সুন্নত অনুসরণ করা যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে এ সব ব্যাপারে আদৌ মাথা ঘামানো উচিত নয়। প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা তা করে যান নি। কিন্তু, যদি সবিস্তার বর্ণনার প্রয়োজন দেখা দেয়, তা হলে তাঁরা কিতাব ও সুন্নাহ থেকে যা কিছু বের করেছেন শুধু সেগুলোই ঠিক ভাবতে হবে এবং যে সব ব্যাপারে কিছু বলে যান নি, সেগুলোই ঠিক ভাবতে হবে এবং যে সব ব্যাপারে কিছু বলে যাননি, সেগুলোর ক্ষেত্রে নীরব থাকতে হবে, এটা আদৌ জরুরী নয়। তাঁরা যেটাকে ঠিক ভেবেছেন সেটাই ঠিক, যেটাকে কঠিন, যেটার আলোচনা নিষ্প্রয়োজন ভেবেছেন, সেটাই নিষ্প্রয়োজন, যেটার যা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন, সেটাই নির্ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, এ সব ধারণা ভুল।
আমি আগেই বলে এসেছি, মতভেদের দ্বিবিধ মস’আলার প্রথম ধরনের মস’আলার সুন্নী হওয়া প্রয়োজন বটে, দ্বিতীয় ধরনের সুন্নীদের ভেতরেও যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। যেমন আশআরীয়া ও মাতুরিদিয়ার মতভেদ। এ কারণেই আপনি যুগে যুগে বড় আলেম ও ধর্মবেত্তাদের দেখতে পাবেন, তাঁরা যে কোন ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রহস্য উদঘাটন করতে দ্বিধান্বিত হননি। সুন্নতের সরাসরি বিরোধী কিছুনা হলে তা তারা এড়াবার চেষ্টাও করেন নি। যদিও মুতাকাদ্দেমীন (পূর্বসূরীরা) সে ব্যাপারে কিছুই বলে যান নি।
যেখানে মতভেদ রয়েছে, সেখানে আমি স্পষ্ট ও উজ্জ্বল পথ বেছে নেব, অন্য কোন দিকে তাকাব না। এমনকি কিনারা ধরে চলার বদলে মাঝ পথ দিয়েই চলব। অন্যান্যের মতামতেরও তোয়াক্কা করব না।
এটাও লক্ষ্য করুন, প্রত্যেক বিষয়ের বৈশিষ্ট্য ও প্রত্যেকটি স্থানের একটি চাহিদা রয়েছে। ‘গরীব’ হাদীস নিয়ে যারা মাথা ঘামায়, তাদের সহী ও জঈফ হাদীসের ওপর মন্তব্য করা ঠিক নয়। হাদীসের হাফেজের জন্য ফিকাহর কোন মতটি প্রাধান্য পাবে ও গ্রহণযোগ্র হবে তা বলা অশোভন। তেমনি হাদীসের রহস্য ও কথা বলার লোকের জন্যও ফিকাহর সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা ঠিক নয়। তার তো লক্ষ্য ও সীমারেখা হবে মহানবীর (সঃ) বাণীর সে সব রহস্য ও তত্ত্ব উদঘাটন করা যা স্বয়ং মহানবী (সঃ) বিবেচনা করে গেছেন। হোক সে বাণী মুহকাম কিংবা মনসুখ, তার বিরোধী অন্য কোন দলীল থাক বা না থাক এবং ফকীহরা সেটাকে প্রাধান্য দিক বা না দিক।
হ্যাঁ কোন বিষয়ের প্রবর্তকের সে বিষয়ের সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন বিষয়ও আলোচনা না করে উপায় থাকে না। হাদীস শাস্ত্রের জন্যও এটা উপযোগী যে, তাতে বিভিন্ন শহরে সংকলিত হাদীস গ্রন্থ প্রকাশের ও ফকীহদের কার্যকলাপের র যে সব হাদীস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা বলে দেয়া। তাতে যদি প্রাসংগিক কোন ইজতিহাদী মসআলা কিংবা কোন সত্য অনুসন্ধানের প্রয়াস থাকে, সেটা যে কোন শাস্ত্রবিদের জন্য কোন নতুন কথা নয় এবং তার জন্য তাঁদের নিন্দা করা চলে না।
আমি তো যতখানি সম্ভভ সংস্কার চাই। এখন তাতে সাফল্য অর্জন করা বা না করা আল্লাহর মদদের ওপর নির্ভর করছে। আমি তাঁর ওপরই ভরসা করি এবং তাঁর দিকেই মনোনিবেশ করেছি। তাই এক্ষেত্রে আমার থেকে যদি কুরআন-হাদীসের, উত্তম যুগের মুসলমানের, অধিকাংশ গবেষকের কিংবা বৃহত্তম মুসলিম দলের বিরোধী কিছু প্রকাশ পায়, সেজন্য আমি দায়ী হব না তা জানি। তথাপি যদি আমার কাছ থেকে এমন কোন কথা বেরোয় সেটাকে ভুল-ভ্রান্তি বলেই ধরে নেবেন। যদি কেউ আমাকে সেই ভ্রান্তির মোহ থেকে মুক্ত করেন কিংবা আমার ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করেন, আল্লাহ পাক তাকে কল্যাণকর প্রতিদান দেবেন। পক্ষান্তরে যারা প্রারম্ভিক ধর্মবেত্তাদের কথা চুরি করে তর্ক-বিতর্কের ঝড় তোলে এবং নিজেদের বিরাট তার্কিক বলে জাহির করে, তাদের প্রতিটি কথা মেনে নেয়া এবং তা অনুসরণ করে চলা আমার জন্য অপরিহার্য নয়। তাঁরাও মানুষ ছিলেন, আমরাও মানুষ। কোন বিষয়ে তাদের পাল্লা ভারী, কোন বিষয়ে আমাদের পাল্লা ভারী।
আমি এ গ্রন্থটিকে দু’খণ্ডে বিভক্ত করেছি। প্রথম খণ্ডে আমি শরীয়তের বিধানগুলোর গূঢ় রহস্য সম্পর্কিত মহানবীর (সঃ) যুগের সর্বমতের বিশেষজ্ঞদের সর্ববাদী সম্মত মূলনীতিসমূহ তুলে ধরেছি। সাহাবাদের এগুলো জিজ্ঞেস করে জানতে হয়নি। মহানবী (সঃ নিজেই এগুলো বলে দিতেন। কোন মসআলার শাখা-প্রশাখা বলতে গিয়ে শুধু তার মূলনীতির দিকে ইংগিত দেয়ার মতই ছিল তা। উদ্দেশ্য হল, প্রয়োজনীয় মুহুর্তে শ্রোতারা যেন সে মুলনীতির ভিত্তিতে শাখা-প্রশাখা তৈরী করে নিতে পারে। সে যুগে মিল্লাতে ইসমাইলিয়া নামধারী আরব ইহুদী আরব ও নাসারা আরবরা এ ধরনের যা কিছু করত, সাহাবাদের তা দৃষ্টিতে ছিল। তাই তাঁরা এ বিষয়ে পারদর্শী হয়েছিলেন। যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন তাঁরা এ ব্যাপারে।
আমি দেখলাম, যদি গোটা শরীয়তের গূঢ় তত্ত্বের সবকিছুর ওপর চিন্তা-ভাবনা করা হয়, তাহলে সেগুলো দুটো ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রতীয়মান হয়। এক পাপ-পুণ্যের পর্যালোচনা। দুই, মিল্লাত ও জাতির রাজনৈতিক সমস্যাবলীর পর্যালোচনা। তারপর এটাও জানা গেল, পাপ-পুণ্যের তত্ত্বকথা তখনই জানা যেতে পারে, যখন কর্মের বিনিময়, কল্যান লাভের পন্থাসমুহ ও সৌভাগ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।
এটাও জানা গেল, এ বিষয়টি যে কয়েকটি মস’আলার ওপর নির্ভরশীল, এ বিদ্যায় সেগুলো গোড়াতেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ের ভেতর তার তত্ত্বালোচনা এ জন্য মিলেনা যে, প্রত্যেকেই আপনা থেকে সেগুলোকে সব মজহাবের স্বীকৃত সত্য বলে মেনে নিয়েছে। এমনকি সেগুলোকে সর্বজনবিদিত বলেও মানা হয়েছে। এ বিদ্যার শিক্ষাদাতাদের বিচক্ষণতার প্রতি ভাল ধারণা নিয়েও তা বাদ দেয়া হতে পারে। এও হতে পারে, এর চাইতেও কোন উন্নত ইলমের ভেতরের দলীলগুলো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আমি কলেবর বেড়ে যাবার ভয়ে এ গ্রন্থে প্রাণ ও মনের অস্তিত্ব প্রমাণ ও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর সেগুলোর সুখ বা দুঃখ পাওয়া সম্পর্কে সবিস্তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন ভাবিনি। কারণ, অন্যান্য গ্রন্থে এর ওপর বহু আলোচনা হয়ে গেছে। অবশ্য সে গ্রন্থে এ ব্যাপারে যে কথা বাদ পড়েছে কিংবা যেদিক আলোচিত হয়নি, আমি নিজ তওফীক অনুসারে সেটুকুই এ গ্রন্থে আলোচনা করেছি। সর্বজন স্বীকৃত বিষয়গুলোরও আমি শুধু সেটুকু আলোচনা করেছি যা পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোয় করা হয়নি। আমার পর্যালোচনায় বর্ণনার উদ্ধৃতি এবং মূল দলীল-প্রমাণও নেহাৎ কম রয়েছে।
এ সব কারণেই আমি প্রথম খণ্ডে প্রথমে সে ব্যাপারই আলোচনা করব যা বিনা প্রশ্নে ও উদ্দেশ্যে এ বিষয়ের ভেতর অন্তর্ভুক্ত হওয়া অপরিহার্য। এরপর আসবে কর্ম ফলের অবস্থা পর্যালোচনা। তারপর আসবে বনি আদমের প্রকৃতিগত কল্যাণ কামনা সফলের সেই পন্থা যা আগে আর কেউ এভাবে দেখায়নি, দেখাবার কথা ভাবতেও পারেনি। তারপর মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য এবং পারলৌকিক মংগলের রহস্য বলা হয়েছে। তারপর মহানবীর (সঃ) বাণী থেকে শরীয়তের বিধান উদ্ভাবনের পন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ডে নিম্নলিখিত বিষয় সম্পর্কিত হাদীসগুলোর তত্ত্ব ও রসহ্য ব্যাখ্যাত হয়েছে। এক, ঈমান। দুই, ইলম। তিন, তাহারাত। চার, সালাত। পাঁচ, যাকাত। ছয়, সওম। সাত, হজ্জ্ব। আট, ইহসান। নয়, মুজামিলাত। দশ, তদবীরে মানাযেল। এগার, সিয়াসাতে মুলক। বার, আদাবে মাঈশাত। তেন, বিবিধ (সীরাত, ফিতনা, মানাকেব)।
এক্ষণে উদ্দেশ্য বর্ণনার সময় এসে গেছে। সব ধরনের স্তুতি প্রশংসা শুধু আল্লাহ পাকের জন্য নিবেদিত। আল্লাহর স্তুতি দিয়ে গ্রন্থের শুরু এবং তার স্তুতি দিয়েই এর সমাপ্তি।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি