প্রসঙ্গ কথা
‘ইসলাম ও আধুনিকতা’ বইটি মরিয়ম জামিলার ‘ইসলাম ও মডার্নিজম’ গ্রন্হের অনুবাদ।
লেখিকা একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান। দেশ, কাল, পাত্র, ভাষা, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে ইসলামের সার্বজনীন শাশ্বত আবেদনে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর নিজ ধর্ম ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে ১৯৬১ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহনের আগে তিনি তাঁর নিজ ধর্ম, ইসলাম এবং সমসাময়িক অন্যান্য ধর্ম ও মতাদশ্যের তুলনামূলক অধ্যয়ন করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদদের সঙ্গে পত্র বিনিময় করেন। ফলে ইসলাম সম্পর্কে তিনি যে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন, এই বই-এর প্রতিটি পাতায় তার ছাপ সুস্পষ্ট।
ইসলামের যে মহান সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে মরিয়ম জামিলা নিজ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেন, তার প্রতি তাঁর নিষ্ঠা অপরিসীম। মুসলিম নামধারী ব্যক্তিবর্গ এসবের যে বিকৃতি ঘটাতে চেষ্টিত হয়েছেন, তা দেখে তিনি বড়ই ব্যথিত হয়েছেন। মুসলিম পণ্ডিত ও নেতাদের প্রতি তাঁর কঠোর সমালোচনা এই ব্যথারই বহিঃপ্রকাশ।
মরিয়ম জামিলা তার জীবনের মিশন হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তিনি নিজ জন্মভূমি আমেরিকা ও পরিবার পরিজনকে ত্যাগ করে ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানে যান এবং লাহোরের একজন মুসলমানকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যা ধর্মান্তরিত মুসলমান, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। কাজের সঙ্গে জীবনের সমন্বয় থাকায় মরিয়ম জামিলার বই-এর আবেদন হৃদয়স্পর্শী। লেখিকার মূল বক্তব্য Either accept Islam in to to or keep it aside, Islam admits no compromise. এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিনি ভারত উপমহাদেশ, তুরস্ক ও আরব জগতের মুসলিম নেতা ও পণ্ডিতদের কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার কারণে কোন ক্ষেত্রে তাঁর সমালোচনা হয়েছে রুঢ়।
মূল বইটি লিখিত হয়েছে ১৯৬৫ সালে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেদিকে খেয়াল রেখেই অনুবাদে বই-এর কিছু কিছু অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। পারম্পর্য রক্ষার শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে কিছুটা ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পরিপূর্ণ গ্রন্হ হিসেবে এই বইটি আমার প্রথম অনুবাদ। ১৯৭৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। বর্তমান সংস্করণ প্রকাশের পূর্বে বইটি আরেকবার আগাগোড়া দেখে যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সংশোধন করে দিয়েছি। আশা করি এ সংস্করণ পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বেশি পাবে।
ইসলামী সাহিত্যের পাঠকদের কাছে মরিয়ম জামিলা অপরিচিতা নন। তবে বাংলা ভাষায় এইটিই তাঁর প্রথম গ্রন্হ। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক পাঠিকাদের কাছে মূল বইটির অনুবাদ গ্রন্হটিও সমাদৃত হলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

এ কে এম হানিফ
লাল মাটিয়া, ঢাকা
নভেম্বর, ২০০৩

 

 

 

 

 

 


সূচি
 আমি কেন মুসলমান হলাম
 পশ্চিমা বস্তুবাদের দার্শনিক সূত্র
 আধুনিক দর্শনঃ এর বৈশিষ্ট্য ও পরিণতি
 সাংস্কৃতিক দাসত্ব রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়
 ইসলাম কি বিংশ শতাব্দীর ধারণার সঙ্গে আপোষ করতে পারে
 আধুনিকতার গলদ
 ইসলাম ও সমসাময়িক বিরুদ্ধ মতাদর্শ
 স্যার সৈয়দ আহমদ খানঃ মুসলিম বিশ্বের আধুনিকতার অগ্রদূত
 অবিশ্বাসের প্রবণতাঃ আমীর আলীর স্পিরিট অফ ইসলামের পর্যালোচনা
 মওলানা আবুল কালাম আযাদঃ মুসলিম ভারতে জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা
 সমসাময়িক মুসলিম পণ্ডিত্যের ওপর প্রাচ্যবাদের প্রভাবের একটি উদাহরণ
 জিয়া গোকলপঃ কামাল আতাতুর্কের অগ্রসেনা
 মোস্তাফা কামাল আতাতুর্কঃ জীবন ও কাজের মূল্যায়ন
 শেখ মোহাম্মদ আবদুহ
 কাসিম আমিন ও মুসলিম নারী মুক্তি
 ডঃ তাহা হোসাইনঃ মিশরের বুদ্ধিজীবীদের মূর্ত প্রতীক
 রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলাম বনাম আরববাদ
 “ইসলামী’ জাতীয়তাবাদ
 ইসলামের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা
 প্রগতিবাদ আমাদের মারাত্মক শক্র

 

 

 

আমি কেন মুসলমান হলাম
দশ বৎসর বয়সে ইসলামের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে। তখন আমি ইহুদীদের রবিবাসরীয় স্কুলের ছাত্রী। আমি আরব ইহুদীদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি। ইহুদী পাঠ্যপুস্তক থেকে আমি জানতে পারি যে, ইব্রাহিম (আঃ) আরব ও ইহুদীদের জনক। শত শত বছর পরে মধ্য ইউরোপের খৃস্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ইহুদীরা মুসলমান শাসিত স্পেনে কিভাবে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করে তাও আমাদের পড়ানো হয়। আরব ইসলামী সভ্যতার এই মহানুভবতা হিব্রু সংস্কৃতিকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিয়ে পৌঁছায়। ইহুদীবাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতাহেতু আমি মনে করেছিলাম আরব ভাইদের সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্যেই ইহুদীরা ফিলিস্তিনে ফিরে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আমি এও বিশ্বাস করেছিলাম যে, মধ্যপ্রাচ্যে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার স্বর্ণযুগ সৃষ্টিতে আরব ইহুদীরা পরস্পর সহযোগিতা করবে।
ইহুদীদের ইতিহাস পড়ার প্রতি গভীর অনুরাগ সত্ত্বেও রবিবাসরীয় স্কুলে আমি মোটেই সুখী ছিলাম না। এই সময় ইহুদীদের ওপর ‘নাজি’দের চরম অত্যাচার নেমে আসে। ইউরোপীয় ইহুদী সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে আমি নিজেও তার শিকার হয়ে পড়ি। কিন্তু আমি এই ভেবে হতাশ হয়ে পড়ি যে আমার সহপাঠি এবং তাদের অভিভাবক কেউই ধর্মের প্রতি একনিষ্ঠ নয়। ধর্মীয় সমাবেশের সময় শিশুরা প্রার্থনা পুস্তকের রসালো অংশগুলো পাঠ করে হেসে লুটোপুটি খেতো। শিশুরা এতই বেয়াড়া ও উচ্ছৃঙ্খল ছিল যে, তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং ক্লাস পরিচালনা করা শিক্ষকদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বাড়ীতেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না। আমার বড়বোন রবিবাসরীয় স্কুলের ওপর বিরক্ত হয়ে পড়ে। কারণ মা প্রতিদিনই তাকে শয্যা থেকে টেনে উঠাতেন আর এ কারণে প্রতিদিন ঝগড়া এবং কান্নাকাটি না করে সে ওদিকে পা-ই বাড়াতো না। এরূপ করতে করতে মা বাবা তার উপর বিরক্ত হয়ে তাকে তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। ইহুদীদের ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে ধর্মীয় সমাবেশে যোগদান এবং yom kippur- এর উপবাস করার পরিবর্তে আমাদের দু’জনকে পারিবারিক বনভোজন এবং অভিজাত রেস্তোঁরায় জাঁকালো অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হতো। যখন আমরা দু’জনে রবিবাসরীয় স্কুলে আমাদের অসহায়তার কথা বাবা মাকে বুঝালাম তখন তারা Ethical culture movement নামে স্রষ্টা সম্পর্কো হতাশ একটি মানবতাবাদী সংস্থায় যোগ দিলেন।
ঊনিশ শতকের শেষ ভাবে Felix adler এই নৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্মদাতা। পৌরহিত্য করার জন্য লেখাপড়া করতে গিয়ে Felix adler বুঝতে পারেন যে, অতি প্রাকৃত বা ধর্মতাত্মিক নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি নিষ্ঠা আপেক্ষিক এবং মানব রচিত। একটি মাত্র ধর্মই বিশ্বের জন্যে উপযোগী। এগার বছর বয়স থেকে আমি Ethical culture রবিবাসরীয় স্কুলে প্রতি সপ্তাহে যাতায়াত আরস্ত করি এবং পনের বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করা পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখি। এখানে আমি আন্দোলনৈর ধারণার সঙ্গে পূর্ণ পরিচয় লাভ করি এবং সকল চিরাচরিত ধর্মীয় আচারের প্রতি আমার অবজ্ঞা জন্মে।
বয়সন্ধি পর্যন্ত আমি মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত ছিলাম এবং বুদ্ধি পরিপক্ক হওয়ার পর আমি নাস্তিক্যবাদে আর সন্তুষ্ট থাকতে পারলাম না। আমি আমার জীবন সম্পর্কে নতুন করে অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়লাম। কিছুদিনের জন্যে আমি নিউইয়র্কের ‘বাহাই’ দলে যোগ দিলাম। মির্জা আহমদ সোহরাব (মৃত্যু-১৯৫৮ নামীয় জনৈক পারসী ‘পূর্ব পশ্চিমের পর্যটকদল’ নামীয় এই সংগঠনের নেতৃত্ব করছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন যে, ‘বাহাই’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল বাহা’-এর তিনি সচিব ছিলেন।
প্রথমতঃ ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভেবে এ মানবজাতির একত্ব প্রচারের কারণে ‘বাহাই-এর প্রতি আমার অনুরাগ জন্মে।কিন্তু আমি এই আদর্শের বাস্তবায়নে তাদের নিদারুণ ব্যর্থতা আবিস্কার করলাম। এক বছর পর বিরক্ত হয়ে তাদের প্রতি আমার মোহমুক্তি ঘটে। অষ্টাদশ বছর বয়সে ইহুদী যুব সংগঠনের স্থানীয় শাখা Mizrachi Hatzair-র সদস্য হয়ে যাই। কিন্তু কয়েক মাস পর যখন ইহুদীদের সত্যিকার চেহারার (যা আরব ও ইহুদীদের বিরোধের সঞ্চার করেছে এবং পুনর্মিলন অসম্ভব করেছে) সঙ্গে পরিচিত হয়ে হতাশার সঙ্গে যুব সংগঠন ত্যাগ করলাম।
আমার বয়স যখন বিশ এবং আমি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার পাঠ্যসূচির এক নৈর্বাচনিক বিষয় ছিল ইহুদী ধর্ম ও ইসলাম (Judaism and Islam)। আমাদের হিব্রু ভাষা বিভাগীর প্রধান অধ্যাপক Rabbi Abraham Isaac katash তার ছাত্রদের বুঝাতে চেষ্টিত হন যে, ইসলামের উৎপত্তি ইহুদী ধর্ম থেকে। তিনি আমাদের পাঠ্য পুস্তকে [Judaism in Islam, Washington square press New York, 1954 পূনর্মূদ্রণ Judaism and The Koran A, S, Barnes company New York 1962.] কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে কষ্টের সঙ্গে সেগুলোকে ইহুদী সূত্রের বলে প্রমাণের চেষ্টা করেন। যদিও তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের কাছে ইসলামের উপর ইহুদী ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা, তিনি আমাকে সোজাসুজি তার বিপরীত দিকটি বুঝিয়েছেন। কোরআনে বিস্তৃতভাবে পরকালের যে ধারণা দেয়া হয়েছে আমি তা মেনে নিতে পারলাম না। ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদীদের ঐশ্বরিক অধিকারও আমি শিকার করে নিতে পারলাম না। প্রাচীন বাইবেল এবং ইহুদীদের প্রার্থনা বইতে যে খোদার চিত্র অঙ্কিত রয়েছে তা আমার কাছে বিকৃত, অধঃপতিত অনেকটা স্থাবর সম্পত্তির প্রতিভু হিসেবে মনে হয়েছে।
ধর্মের সঙ্গে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ আধ্যাত্মিকভাবে ইহুদী ধর্মকে এমন দুর্বল করে গিয়েছে যা মোচন করা অসাধ্য বলে আমার মনে হয়েছে। ইহুদী ধর্মের অনমনীয় একলা চলো নীতির কারণেই ইহুদীরা সারা জীবন লাঞ্ছনার সম্মুখীন হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমার দৃঢ় ধারণা ইহুদীরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ ধর্মে আনার চেষ্টা করলে এমন করুণ পরিণতি কখনো আসতো না। কিছুদিনের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম ইহুদীবাদ হচ্ছে ইহুদী ধর্মের বর্ণবাদী ও গোত্রীয় নীতির সমন্বয়। এর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ। আমি যখন আরও জানলাম যে ইহুদীবাদের নেতাদের অনেকেই পর্যবেক্ষণশীল ইহুদী এবং সম্ভবতঃ ইসরাঈলের মত কোথাও ইহুদী ধর্ম এত গোঁড়া এবং চিরাচরিত আচার নিষ্ঠা নয়। তখন ইহুদী ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস আরও শিথিল হয়ে আসলো। যখন আমি দেখলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল ইহুদী নেতারাই ইহুদীবাদের সমর্থক এবং আরব ফিলিস্তিনীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন ও অবিচারের প্রতি নির্বিকার, তখন অন্তরের দিক থেকে আমি আর নিজেকে ইহুদী ভাবতে পারলাম না।
১৯৫৪ সালের নভেম্বরের এক সকালে অধ্যাপক Katsh বক্তৃতার সময় অখণ্ডনীয় যুক্তি দিয়ে বলেন, হযরত মূসা (আ) যে একত্ববাদ প্রচার করেছেন এবং সিনাই পর্বতে তার ওপর যে সব ওহি নাযিল হয়েছে সেগুলো সকল উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসাবে অপরিহার্য। Ethical culture এর মত নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকদের শিক্ষা [See ethical religion, David muzzey, American Ethical union, New York 1952, and religion without-revelation, Julian Huxley, New American library, New York, 1956.] অনুযায়ী সকল নৈতিকতা যদি সম্পূর্ণ মানব রচিত হয় তাহলে সময়, পরিস্থিতি এবং আবেগের বশে সেগুলো পরিবর্তন করা যেত। ফলে ব্যক্তি ও সমষ্টির ধ্বংসের জন্য সম্পূর্ণ অব্যবস্থার সৃষ্টি হতো।
অধ্যাপক Katsh বলেন, ইহুদী পুরোহিত Talmud গ্রন্হে পরকালের যে ধারণা দিয়েছেন তা স্বেচ্ছাচারী কোন চিন্তার ফসল নয় বরং নৈতিক প্রয়োজন। তিনি বলেন যারা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর আমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং শেষ বিচারের দিন আমাদের সকল কাজের হিসাব দিতে হবে এবং কাজ অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার পাব তারাই দীর্ঘ কল্যাণের নিমিত্তে সাময়িক সুখ বিসর্জন ও ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। অধ্যাপক Katsh যখন এরূপ বক্তব্য দিচ্ছিলেন আমি তখন প্রাচীন বাইবেল ও Talmud এর জ্ঞানের সঙ্গে কোরআন ও হাদীসের শিক্ষাকে তুলনা করছিলাম এবং ইহুদী ধর্মের গলদ লক্ষ্য করছিলাম। এরপর আমি ইসলাম গ্রহণ করি।
যদিও আমি ১৯৫৪ সালে মুসলমান হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার আমাকে যুক্তি দিয়ে এর বাইরে রাখার ব্যবস্থা করলো। আমাকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হলো যে, ইসলাম আমার জীবনে জটিলতার সৃষ্টি করবে কারণ এই ধর্ম ইহুদী ধর্ম এবং খৃষ্টান ধর্মের মত উদার নয়। আমাকে বলা হলো ইসলাম আমাকে আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং সম্প্রদায় থেকে পৃথক করে দেবে। সেই সময় আমার ঈমার এসব চাপ মোকাবিলা করার মত যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এসব আভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে আমি এতই অসুস্থ হয়ে পড়লাম যে, স্নাতক ডিগ্রী লাভ করার আগেই আমাকে কলেজ ছাড়তে হলো। যার ফলে আমি কোন ডিপ্লোমা অর্জন করতে পারলাম না।
পরবর্তী দু’বছর আমি বেসরকারী চিকিৎসাধীনে বাড়ীতে কাটালাম। আমার অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে লাগল। আমার পরিবার বেপরোয়াভাবে আমাকে ১৯৫৭-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বেসরকারী ও সরকারী হাসপাতালে অন্তরীণ রাখলেন কারণ আমি শপথ নিয়েছি কোন রকমে সুস্থ হলেই ইসলাম গ্রহণ করব। বাড়ী ফেরার অনুমতি পাওয়ার পরই নিউইয়র্ক শহরের মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সব সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম। সৌভাগ্যবশতঃ অপ্রত্যাশিতভাবে কয়েকজন পুরুষ ও মহিলার সঙ্গে পরিচিতও হলাম। এ সময় মুসলিম সাময়িক পত্রের জন্য লেখা এবং বিশ্বের মুসলমান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগ শুরু করলাম।
আলজিরিয়ার আলেমদের নেতা মরহুম শেখ ইব্রাহিমী, ওয়াশিংটন ডি সি’র তখনকার ইসলাম কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ মাহমুদ এফ হোবাল্লা, আল আজহার-এর ডঃ মুহাম্মদ এল বাহাই, প্যারিসের ডঃ হামিদুল্লাহ, জেনেভা ইসলামী কেন্দ্রের পরিচালক ডঃ সৈয়দ রমজান এবং মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদীর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম কবুল করার আগে আমি দেখেছি তথাকথিত আধুনিকতা আন্দোলন সমসাময়িক বিশ্বের ঈমানের পূর্ণতার ওপর বিরাট হুমকির সৃষ্টি করেছে। এর লক্ষ্য ছিল ঈমানের ধারণার সঙ্গে মানব রচিত দর্শন ও সংস্কারের গোঁজামিল দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। আমি বুঝতে পারলাম এই আধুনিকতাবাদীরা বিজয়ী হলে কোন কিছুই আর খাঁটি থাকবে না। শিশু হিসেবে আমি আামার নিজের পরিবারে দেখেছি কিভাবে উদার নৈতিকরা ওহির বিশ্বাসের অঙ্গচ্ছেদন করেছে। ইহুদী হিসেবে জন্ম এবং ইহুদী পরিবারের লালিত হয়ে আমি দেখেছি নাস্তিক্যবাদী পরিবেশের সঙ্গে ধর্মের আপোষের জন্যে কি অসার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।
সংস্কার প্রাপ্ত ইহুদী ধর্ম কেবলমাত্র ইহুদীদের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে তা নয় বরং তাকে সরাসরি উৎসাহিত করেছে। নাম ছাড়া কারও কোন ধর্মই ছিল না। আমার পুরো শিশুকালটাই আমি সংস্কার প্রাপ্ত ইহুদী ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা, মোনাফেকী এবং অন্তসারশূণ্যতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এমনকি অল্প বয়সেও আমার মনে হয়েছে এমন অসম্পূর্ণ সমঝোতা ধর্মের অনুসারী এমনকি শিশুদেরও আনুগত্য আকর্ষণ করতে পারে না। মুসলমানদের মধ্যে একই দশা দেখে আমি বড় নিরাশ হয়েছিলাম।
আমি দেখলাম মুসলমানদের মধ্যকার কিছু পণ্ডিত এবং নেতা ঐ ধরনের পাপ করছেন। যে পাপের জন্যে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইহুদীদের সীমাহীন লানত দিয়েছেন। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম যে, অপরাধের জন্যে আন্তরিক অনুতাপ এবং কার্যপ্রণালী পরিবর্তন না করলে ইহুদীদের মত আমাদেরকেও আল্লাহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। আমি শপথ নিলাম এসব বিপর্যয় ও বিচ্যুতি প্রতিরোদ করার জন্যে জেহাদ চালিয়ে যাব।
১৯৬১ সালের জানুয়ারীতে আমাকে লিখা প্রথম পত্রে মাওলানা মওদূদী লিখেছেন: “আমি যখন আপনার রচনা পড়ছিলাম, আমার মনে হয়েছে আমি আমার নিজের ভাবধারাই পড়ছি। আমার বিশ্বাস আপনি যখন উর্দূ শিখে আমার বই পড়ার সুযোগ পাবেন তখন আপনারও একই ধারণা হবে। আপনার সঙ্গে আমার পূর্বে পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও এই পারস্পরিক সহানুভূতি এবং চিন্তার ঐক্য নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করছে যে, আমরা দুজনই ইসলামের দ্বারা অনুপ্রাণিত”।
মরিয়ম জামিলা, সাবেক মার্গারেট মারকিউস।

 

পশ্চিমা বস্তুবাদের দার্শনিক সূত্র
প্রাচীন গ্রীস সমাজই ইতিহাসের গোড়ার দিকে তার নিয়ম-প্রণালী, প্রথা, শিল্পকলা ও বিজ্ঞান থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করেছে। অপর কথায় প্রাচীন গ্রীসই ছিল প্রথম সত্যিকার, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। তার দর্শনের ভিত্তি ছিল সৌন্দর্য ও ন্যায় বিচারে পরিপূর্ণ অখণ্ড সমাজ বুদ্ধি ও মানব মনীষার প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এতে অতি প্রাকৃতিক কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আজ পর্যন্ত এই ধর্মনিরপেক্ষ ধারণাই পশ্চিমা সভ্যতার মূল চাবিকাঠি হয়ে আছে।
প্রাচীন গ্রীকদের মতে মানুষের নগ্ন শরীরে সৌন্দর্য চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছে। নর-নারীর নগ্ন দেহই গ্রীক শিল্পকলার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ভাস্কর্যশিল্প এবং চিত্রকররা বিরামহীনভাবে এ চিত্র অঙ্কন করে চলেছে। শরীরের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে খেলাধূলাকে খুবই উৎসাহ দেয়া হয়। ছোট খাট বা কোন অখ্যাত শহর নেই যেখানে খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের জন্যে সরকারী ব্যায়ামাগার নেই। ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার অভিপ্রায়ে উন্মুক্ত ষ্টেডিয়ামে নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। হাজার হাজার লোক এসব খেলা উপভোগ করে। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দেরকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করা একটা প্রথায় পরিণত হয়েছে। অলিম্পিক খেলা এসব প্রতিযেগিতার মধ্যে খুবই প্রসিদ্ধ। এই প্রতিযোগিতা এখনও চলছে।
প্লেটোর (৪২৭-৩৪৭ খৃঃ পূঃ) রিপাবলিকের একটি উদ্ধৃতি। তিনি তার গুরু সক্রেটিসের (৪৬৯-৩৯৯ খৃঃ পূঃ) মুখ দিয়ে কল্পিত সুখ রাজ্য তথা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচয় দিয়েছেন এই ভাবে- Glaucon সক্রেটিসকে প্রশ্ন করলঃ তুমি কি মনে কর, প্রহরারত কুকুরদের মধ্যে পুরুষ কুকুর যে কাজ করে মাদি কুকুরদেরও তা করা উচিত। অথবা পুরুষ কুকুরদের সঙ্গে কি মাদি কুকুরদেরও শিকার করা উচিত, অথবা বাচ্চা জন্ম এবং লালনের জন্যে তাদের কুকুরশালায় রাখা উচিত এবং পুরুষ কুকুরদের কি শক্ত কাজের সঙ্গে দলের রক্ষণাবেক্ষণও করা উচিত।
সক্রেটিস বললেনঃ তাদেরকে সবকিছু এক সঙ্গে করতে হবে। পুরুষ শক্তিশালী এবং মাদি দুর্বল কেবলমাত্র এই ধারণা ছাড়া।
কিন্তু একই প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান না দিয়ে তুমি কি পশুদেরকে একই কাজে ব্যবহার করতে পারবে?
অসম্ভব?
‘এখন পুরুষদেরকে গান এবং শরীরচর্চা শিখানো হয়। সুতরাং মহিলাদেরকে এ দুটি শিল্প শিখাতে হবে এবং একইভাবে তাদের কাজে লাগাতে হবে। কুস্তির স্কুলে আমরা পুরুষদের সঙ্গে মহিলাদেরকেও নগ্ন অবস্থায় ব্যায়াম করতে দেখতে চাই। শুধু যুবতী নয়-বৃদ্ধাদেরকেও। ব্যায়ামাগারে বৃদ্ধদের সঙ্গে বৃদ্ধাদেরকেও আমরা এবড়ো থেবড়ো অবস্থায় দেখতে চাই। যারা খেলায় এখনো সুন্দর তাদের দেখতে ভাল লাগে না’।
“কিনউত আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেরেছি, এ সব জিনিস লুকিয়ে রাখার চাইতে বিবস্ত্র করা ভাল। চোখের ভালোর চাইতে যুক্তিতে যা ভাল তাই শ্রেষ্ঠ। এই সব মহিলাদেরকে পুরুষদের সাধারণ সম্পত্তি হতে হবে; কোন ব্যক্তিরই নিজস্ব ব্যক্তিগত স্ত্রী থাকা উচিত নয়, সন্তানরাও হবে সাধারণ সম্পত্তি। পিতামাতা তার সন্তান চিনবে না এবং সন্তানরাও পিতামাতা চিনবে না”।
“আমি তোমার বাড়ীতে শিকারী কুকুর এবং খেলার পাখী দেখছি। তুমি কি কোনদিন তাদের মিলন অথবা প্রজননের দিকে নজর দিয়েছো?”
“এর পর আমাদের সিদ্ধান্তঃ শ্রেষ্ঠ পুরুষদের শ্রেষ্ঠ মহিলাদের সঙ্গে মেশা উচিৎ এবং কেবলমাত্র শ্রেষ্ঠ লোকদের লালন করার উচিত। যদি দলকে ছিম-ছাম থাকতে হয় তাহলে অন্যদের লালন করার অনুচিত। শাসকরা ছাড়া এই শিশু হত্যার কথা অন্যদের জানতে দেয়া উচিত নয়। শাসকদেরকে শাসিতের কল্যাণের জন্যে মিথ্যা এবং প্রতারণার আশ্রয় নিতে হবে। আমরা আগেই বলেছি চিকিৎসা হিসেবে এসবই প্রয়োজন। ক্রটিপূর্ণ সন্তান জন্মালে তার জন্যে খাদ্য এবং লালন পালন ব্যবস্থা নেই- এই যুক্তিতে তাকে সরিয়ে দিতে হবে”।
রোমের ইহুদী ও খৃষ্টানরা গ্রীসের এই ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরাধিকারকে গ্রহণ, লালন এবং বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করেছে। অবশ্য সবকিছুর উর্ধ্বে রোমানরা ছিল সামরিকমনা। ফলে সৌন্দর্য পূজার পরিবর্তে শীগগীরই শক্তি পূজা শুরু হয়েছে। গ্রীকদের আদর্শবাদ ক্রমবর্ধমান বৈরাগ্যবাদ, পলায়নবাদের রূপ নিয়েছে। এই কারণে রোমান দার্শনিক Tyre- এর maximus নাস্তিক্যবাদের পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তি দিয়েছেন।
“অবিনশ্বরের সকল কিছুর অবিনশ্বর থাকার ইচ্ছা রয়েছে। তার অপরিবর্তিত ইচ্ছায় যদি প্রার্থনা করা হয়, তিনি কি করতে বলেছেন তা তাঁকে জিজ্হেস করা অর্থহীন। যদি কেউ তার নির্ধারিত কাজের বিপরীত করার জন্যে তার কাছে প্রার্থনা করে, প্রার্থনাকারী চায় সে দুর্বল, নগণ্য, অসঙ্গত হোক। তিনি দুর্বল, নগণ্য এবং অসঙ্গত বিশ্বাস করার অর্থ তাকে নিয়ে তামাসা করা। তোমার কোন ভাল কাজের ইচ্ছা জাগলে তোমার প্রার্থনা ছাড়াই তিনি তা করবেন। তার কাছে অনুনয় করার অর্থ তাকে অবিশ্বাস করা, অথবা বিষয়টি এমন অন্যায় যার দ্বারা তুমি তাকে অপমান করো। তুমি উপযুক্ত হও অথবা অনুপযুক্ত হও- করুণা তুমি পাবে, যদি তুমি উপযুক্ত হও- সে তোমার চাইতে ভাল জানে, যদি অনুপযুক্ত হও, যা পাওয়ার যোগ্য নও তা চেয়ে তুমি আরেকটি পাপ করো। এক কথায় আমরা স্রষ্টার কাছে এজন্য প্রার্থনা করি যে তাকে আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতায় চিন্তা করি”। (The portable Voltaire Viking press New York, 1949)
রোম সাম্রাজ্যের পতন এবং রেনেসাঁর উদ্ভব পর্যন্ত হাজার বছরে রোমান ক্যাথলিক গীর্জাই প্রাধান্য পেয়েছে। মধ্যযুগ নামে পরিচিত এই সময়ে প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সঙ্গে ইউরোপের ঐতিহাসিক পারস্পর্য বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বস্তুতঃ মধ্যযুগ তার নিজস্ব সুস্পষ্ট ও একক সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। প্রাচীন গ্রীস, রোমান সমাজ বা আজকের ইউরোপের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন বৈশিষ্টই তার নেই। বস্তুতঃ মধ্যযুগের সভ্যতাকে কেবলমাত্র ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পশ্চিমা বলা যেতে পারে।
মধ্যযুগীয় সভ্যতা সকল দিক থেকে আধুনিক সভ্যতার বিরোধী এবং বিপরীতধর্ম ছিল। এ কারণে ইউরোপের ইতিহাসের কোন অধ্যায় সম্পর্কে অপবাদ দেয়া হয়নি। একই কারণে ইংরেজী ভাষায় ‘মধ্যযুগীয়’ শব্দের চাইতে খারাপ ভাষা ব্যবহৃত হয়নি। যখনি কোন আমেরিকান বা ইউরোপীয় এই বিশেষণের সম্মুখীন হয়েছেন তার মনে বর্বর, সামন্ত অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ‘কালোযুগ’ ভেসে উঠেছে। কোন পশ্চিমা লোক বিশ্বের কোন এলাকা বিশেষ করে অনগ্রসর এলাকার বর্ণনা দিতে ইচ্ছুক হলে তাকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইউরোপের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সমালোচনা মুক্ত ভক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে খৃষ্টান ধর্ম পরিহারকে রেনেসাঁসের সঙ্গে সংযৃক্ত করেছেন। রেনেসাঁ সত্যিকারভাবে বুঝিয়েছে খৃষ্টান ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নবায়ন। এই ভাবে পশ্চিমা সভ্যতা তার আদি বক্তব্যে ফিরে গেছে। এখন পর্যন্তও সেভাবেই চলছে।
রেনেসাঁর মূল প্রেরণার সংক্ষিপ্তসার যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন Ivicolo Machiavelli (১৪৬৯-১৫৩২)। ইতালীর ফ্লোরেন্সের অধিবাসী মেকিয়াভেলি তার সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আসন লাভ করেন। তার তের বছরের কর্মজীবনে পার্শ্ববর্তী স্পেন এবং ফ্রান্সের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির তুলনায় ইতালীর অসহায়ত্ব তাকে হীনমন্য করে রেখেছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের পর মেকিয়াভেলি পদচ্যুত এবং দেশান্তরিত হন। প্রবাসী জীবনে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, সংহতকরণ ও সম্প্রসারণের ব্যাপারে সব চাইতে প্রভাবশালী বক্তব্য সম্বলিত The prince পুস্তক রচনা করেন। সব কিছুর উর্ধে মেকিয়াভেলী ছিলেন জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক। তার স্বপ্ন ছিল আধিপত্যশালী বিশ্বশক্তি হিসেবে অখণ্ড ইতালীর আত্মপ্রকাশ। মেকিয়াভেলী ছিলেন আধুনিক একদলীয় শাসনের জনক। তিনি ক্ষমতাকে তার চূড়ান্ত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
“আমি জানি কোন প্রিন্সের মধ্যে সকল সদগুণ সকলের প্রসংসার্হ”। তবে সেগুলো কারো পক্ষে অজৃন, ধারণ বা পালন সম্ভব নয়, একজন মানুষের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। সে যদি মনে করে থাকে তাকে সকল অন্যায় পরিহার করার মত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হতে হবে, দেখা যাবে গুণ বলে বিবেচিত এমন কিছু জিনিসও কারো ধ্বংসের কারণ হতে পারে এবং এমন কিছু জিনিস-যা দোষ বলে মনে হয়- তা কারো বৃহত্তর নিরাপত্তা এবং কল্যাণে আসতে পারে।
প্রত্যেকেই জানেন ধূর্ততা ছাড়া কোন প্রিন্স যদি সকলের বিশ্বাস নিয়ে নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করে তা কতই প্রশংসনীয়। তবুও আমাদের যুগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, যে সব প্রিন্স মহৎ কাজ করেছেন সৎ বিশ্বাসের প্রতি তাদের সামান্য শ্রদ্ধাই আছে, তারা ধূর্ততর সঙ্গে মানুষের মস্তিস্ক বিগড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সৎ লোকদের ওপর জয়ী হছেছেন।
এই ধরনের একজন প্রিন্সকে পশুরু মত কাজ করার জন্যে শৃগাল এবং সিংহের অনুকরণ করতে হবে। কারণ সিংহ নিজেকে ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে পারে না এবং শৃগাল নিজেকে নেকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। অতএব একজন প্রিন্সকে ফাঁদ চেনার জন্যে শৃগাল এবং নেকড়েদের ভীত করার জন্যে সিংহ হতে হবে। যারা কেবল সিংহত হতে চান তারা এটা বোঝেন না। সুতরাং বুদ্ধিমান শাসককে কখনো শাসিতকে বিশ্বাস করা উচিত নয়, এটা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। যখন তিনি যুক্তি দিয়ে তা বুঝবেন তখন ক্ষমতা তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। যখন তিনি যুক্তি দিয়ে তা বুঝবেন তখন ক্ষমতা তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। যদি সকল মানুষ ভাল হতো তাহলে এই উপদেশ সঠিক হতো না। কিন্তু যেহেতু তারা খারাপ এবং তোমার সঙ্গে বিশ্বাস রক্ষায় বাধ্য নয়, সুতরাং তুমিও তাদের সঙ্গে বিশ্বাস রক্ষায় বাধ্য নও। অনেকে প্রিন্সের বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে কত প্রতিশ্রুতি মূল্যহীন হয়েছে এবং কত অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তার ভুরি ভুরি আধুনিক নজির তুলে ধরবেন এবং যারা শৃগালকে অনুকরণ করেছে তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে বলে প্রমাণ দেবেন। তবে এই চরিত্র গোপন রাখা প্রয়োজন এবং ভান করা, কপটতা দেখানো খুবই ভাল। মানুষ এতই সরল এবং বর্তমান প্রয়োজনকে মেনে নিতে এতই প্রস্তুত যে যিনি প্রতারণা করেন তিনি দেখবেন যে, প্রতারিতরাই প্রতারণার সুযোগ দিয়েছে।
একজন প্রিন্সকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে যে, তার মুখ থেকে যেন ক্ষমা, বিশ্বাস, মানবতা, আন্তরিকতা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধী কোন কথা না বেরোয়। এই গুণ ছাড়া আর বিশেষ কিছুর প্রয়োজন নেই কারণ মানুষ সাধারণতঃ হাতের চাইতে চোখ দিয়েই বিচার করে। কেননা প্রত্যেকেই দেখতে পায় কিন্তু অল্প লোকই অনুধাবন করতে পারে। প্রত্যেকেই দেখে তুমি দেখতে কেমন, খুব অল্প লোকই অনুধাবন করে তুমি কি এবং এই স্বল্পসংখ্যকরা বহু লোকের যুক্তির কাছে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশে সাহসী হবে না। মানুষের কাজ বিশেষ করে প্রিন্সের কাজের বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ থাকে না। “উদ্দেশ্যই উপায়ের যথার্থ নির্ধারণ করে”।
প্রটেষ্টান্টদের সংস্কার আন্দোলন খৃস্টান ধর্মের ওপর এমন আঘাত হেনেছে যে, পরবর্তীকালে কখনো খৃষ্টানধর্ম ও তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। গীর্জার ক্ষমতা, দুনীতি ও অপকর্মের সংশোধনের কোন পথ না পেয়ে মার্টির লুথার তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন এবং নিজে একটি ধর্মমত প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন। পোপের কর্তৃত্ব ও ল্যাটিন ভাষা প্রটেষ্টান্টদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ খুবই শক্তিশালী হয়েছে। শক্তিশালী খৃষ্টান সাম্রাজ্যের স্থলে বহু ক্ষুদ্র, দুর্বল গোত্রের সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকেই সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অপরের বিরোধীতা করেছে। প্রটেষ্টেন্ট দেশসমূহে সরকারী নিয়ন্ত্রণে জাতীয় গীর্জা স্থাপন করা হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য জায়গার মত ধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শাসকদের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
সংক্ষেপে প্রটেষ্টান্ট সংস্কার আন্দোলনের পর রেনেসাঁর পন্ডিতরা গীর্জার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকেই সব চাইতে শক্তিশালী হাতিয়ার বানিয়েছে। ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬১৫) The new atlantis গ্রন্হে বৈজ্ঞানিক প্রেরণার সার সংক্ষিপ্ত করেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাল্পনিক দ্বীপে একটি ইংলিশ জাহাজ অবতরণ করবে তার প্রধান গর্বের কাজ হবে বিজ্ঞান গবেষণার জন্যে নিবেদিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। শাসক যাত্রীদেরকে এই বলে পরিচালিক করেছেন “জ্ঞানানুসন্ধান ও জিনিসের গুপ্তরহস্য উদ্ধার করে সম্ভব সকল জিনিসের পরিচয় উদঘাটনের মাধ্যমে মানব সাম্রাজ্যের সীমা বাড়ানোর পর আমাদের ভিত্তি স্থাপন সমাপ্ত হবে”।
Descartes পরীক্ষামূলক পদ্ধতির উন্নয়নের ওপর গবেষণা চালান অপরদিকে জ্ঞাত জিনিসের প্রমাণের পরিবর্তে নতুন সত্য আবিষ্কারের জন্যে Francis bacon, এরিষ্টটল ও মধ্যযুগীয় পন্ডিত দার্শনিকদের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গবেষণা শুরু করেন। Descartes এর মত পশ্চিমা দার্শনিকদের কাছে প্রকৃতি আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যবিহীন যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষসহ সকল জীবন্ত প্রাণী স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। Descartes দম্ভপূর্ণ উক্তি করে বলেছেন “আমাকে উপাদান দাও আমি বিশ্ব সৃষ্টি করব”।
অপরিবর্তণীয় গাণিতিক আইনে সমগ্র সৌরজগত পরিচালিত হয়, নিউটনের (১৬৪৫-১৭২৭) এই মতবাদে আত্মহারা হয়ে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত যুগের প্রবক্তারা প্রচার করেছেন, মানুষের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের বিপরীত সকল বিশ্বাস পরিহার করতে হবে। ভাগ্য, ভবিষ্যৎ বাণী ওহিসহ সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে কুসংস্কার বলে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হয়েছে। Valtaire (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেনঃ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন চিন্তা না করেই ঘড়ি সংযোজন করারীর মত ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। Hume (1711-1776) সকল ধর্মীয় বিশ্বাস এই বলে বাতিল করেছেন যে, এগুলো বিজ্ঞান বা মানবীয় প্রজ্ঞার দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। তিনি ভলতেয়ারের প্রত্যাদেশ (ওহি) ক্ষমতাহীন ঈশ্বরকে আক্রমণ করে বলেছেনঃ আমরা ঘড়ি বানাতে দেখেছি কিন্তু পৃথিবী বানাতে দেখিনি!
যদি পৃথিবীল কোন মালিক থাকেন, তিনি অনুপযুক্ত কর্মী অথবা কাজ সমাপ্ত করে অনেক আগে মারা গেছেন বা তিনি পুরুষ অথবা মহিলা ঈম্বর বা অনেক সংখ্যক ঈশ্বর আছ। তিনি সম্পূর্ণই ভাল, সম্পূর্ণই খারাপ অথবা দুই বা কোনটাই নন। সম্ভবতঃ তিনি খারাপ। পরকালের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হিউমের যুক্তি হচ্ছেঃ কোন জীবন সম্পর্কে আমাদের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন যুক্তি নেই যে, যেখানে মানুষের ফেলে যাওয়া জীবনের জন্যে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দেয়া হবে। গণিত যেমন ধর্মতত্ব ও মানব জ্ঞানের অন্যান্য শাখা থেকে স্বাধীন ঠিক তেমনি নৈতিকতাও একটি বিজ্ঞান। Dideroit এবং রুশোর মত দার্শনিকেরা সম্মত হয়েছেন যে, ব্যবহার এবং সুখই নৈতিকতার একমাত্র মান নির্ণায়ক। সঙ্গীদের ন্যায্য অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত না করে মানুষের উচিত যতবেশী সম্ভব আনন্দ ও সুখ প্রত্যাশা করা। কোন সম্পর্কই সকলকে আনন্দ দিতে পারে না, তবে উপকার করতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে তারা লক্ষ্য করেন যে, পুরুষ নারীর চিরাচরিত সততার দাবীর মধ্যে কোন কল্যাণ নেই।
অতীতের সকল বিশ্বাসকে ভ্রান্ত জ্ঞান ও ধ্বংস করে ‘আলোকপ্রাপ্ত’রা বিশ্বাস করলেন যে, সার্বজনীনগণশিক্ষা যে বুদ্ধি বৃত্তি ও বিজ্ঞান প্রচার করেছে তাতে বিশ্বে একটি সত্যিকার স্বর্গ প্রতিষ্ঠিত হবে। নিজের ভাগ্য রূপ দেয়ার বৈজ্ঞানিক যাদু এখন মানুষের করায়ত্বে রয়েছে। সমগ্র বিশ্বে স্বাধীনতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য এবং সার্বজনীন শান্তি বিরাজ করবে। ক্রমবর্ধমান জ্ঞান মানব জীবনকে দীর্ঘায়িত করবে এবং সকল রোগ ও কষ্ট নিঃশেষ করে দেবে। পরবর্তী শতকের প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এই নতুন বিশ্বাসকে বদ্ধমূল করেছে যে, কোন অলৌকিক সাহায্য ছাড়াই বিশ্বের মানব জীবন পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
নিম্নস্তরের প্রাণী থেকে বিবর্তনবাদের মাধ্যমৈ মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কিত ডারইউনের (১৮০৯-১৮৮২) মতবাদ নৈতিক মূল্যবোধকে নূতন খাতে প্রবাহিত করেছে। দার্শনিকরা এখন চিন্তা শুরু করলেন যে, অবিরাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানবসমাজ অনিবার্যভাবে আরো উচ্চ এবং জটিল অবস্থায় গিয়ে পৌঁছবে। মানব সমাজে জৈবিক বিবর্তনবাদ প্রয়োগ হওয়ার ফলে এই সমাজ ‘আধুনিক’ ‘অত্যাধুনিক’ অগ্রসরমান এবং প্রগ্রতিশীল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ঐতিহাসিকরা মানুষকে প্রকৃতির সন্তান এবং অংশ হিসেবে দেখতে থাকলো। খুবই নিম্ন পর্যায়ে থেকে বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে মর্মন্তুদ সংগ্রাম করে মানুষ বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে বলে ধরে নিলাম। ডারউইন পশ্চিমা দার্শনিকদের বুঝালেন যে, মানুষ অন্যান্য পশুর মতই একটি সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রজাতি। William James (1843-1910) বিবেক অথবা মনের অস্পষ্ট ধারণার মূল্য সম্পর্কেও প্রশ্ন তুললেন। তার মতে এটি রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ফল এবং স্নায়ূর ওপর বাইরের চাপের ফলে সব কিছুর সৃষ্টি। মনস্তাত্ববিদ Pavlov (১৮৪৯-১৯৩৬) কুকুর, বানর ও গেরিলার ওপর গবেষণা চালিয়ে মানুষের ব্যবহারের কার্যকারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন।
FREUD (১৮৫৯-১৯৩৯) মানুষের অসংগত ব্যবহারের মূলে আবিষ্কার করলেন শৈশব অবস্থায় অপরিণত মস্তিষ্কের ওপর চাপ। আধুনিক দার্শনিকেরা ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে আরেকটি হাতিয়ার পেলেন। ফ্রয়েড বললেন ছোট শিশু তার মা বাবার অনুসরণ করল। কারণ তাঁরা তার জীবন দিয়েছেন, কষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন, সুশৃংখল থাকতে বাধ্য করেছেন এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর ধর্মীয় আচার আচরণের জন্যে পুরষ্কার ও শাস্তির ভয় দেখালেন। ধর্ম মানুষের তৈরী এবং নৈতিকতা অবিসংবাদিত নয়, বরং আপেক্ষিক এই ধারণা ইতিহাস, সমাজবিদ্যা ও নৃতত্বের ছাত্রদের কাছে খুবই ভাল লাগল।
এই ভাবে বিশিষ্ট মার্কিন নৃতত্ববিদ তার The tree lf culture (১৯৫৩) নামক পুস্তকে বললেনঃ ইহুদীধর্ম ও ইসলামের আপোষহীন একত্ববাদ আরবের যাযাবর উপজাতির পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ধারণা থেকে উদ্ভুত। তিনি লিখলেনঃ “সর্বশক্তিমান দেবতার ধারণা প্রাচীন আরব জাতির পারিবারিক জীবন থেকে সরাসরি এসেছে। এই দেবতা ন্যায়-অন্যায় করুক পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করা যায়। প্রতিটি কাজের ব্যাপারে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল সৃষ্টিকারী অতি স্বাতন্ত্র্যবাদও মুসার (আ) আইন কানুনের সারসংক্ষেপ। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার এই বেড়াজালে বিশ্বাসী লোকেরা এমন শিশুর মত হয়েছে যে, শিশু তার বাবার আদেশ নিষেধই মনে রাখতে সক্ষম। ঈশ্বর আরবীয় পরিবারের পিতার প্রতিমূর্তি- যার পিতৃতান্ত্রিক একনায়কত্বের গুণের অতিশয়োক্তি রয়েছে।
ফ্রয়েড ধর্মের ঐশ্বরিক উৎপত্তির কথা অস্বীকার করেই সন্তুষ্ট হননি। বরং ধর্মীয় বিশ্বাস যে কোন দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে এই ধারণাও বাতিল করেছেন।
“এটা সত্য নয় যে, বিশ্বের এমন একটি শক্তি আছে যে, প্রত্যেকের ব্যক্তিগত কল্যাণ দেখাশুনা করে এবং তাদেরকে আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে নেয়। আদতে মানুষের ভাগ্য সার্বজনীন ন্যায় বিচারের নীতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ভূকম্পন, বন্যা এবং আগুন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ এবং পাপী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য করে না। এমনকি সমস্ত খারাপ লোক ও ভাল লোকগুলোকে পৃথক থাকলেও আমরা কোন অবস্থায় দুষ্ঠদের শাস্তি পেতে এবং গুণীদেরক পুরস্কৃত হতে দেখি না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় খারাপ ও অসৎ লোকেরা যা চায় তাই পায়। কিন্তু ধার্মিকেরা শূণ্য হাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। মায়ামমতাহীন দাম্ভিক শক্তিই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে। ধর্ম যে ঐশ্বরিক ন্যায় বিচারের শাসনের কথা বলে তার কোন অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। বিজ্ঞানের প্রাধান্য যতই অস্বীকার করা হোক তাতে প্রকৃতি ও বহিঃর্বিশ্বের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা পরিবর্তিত হবে না। অপরদিকে ধর্ম একটি বালকসুলভ মায়া বিভ্রম। আমাদের সহজাত আকাঙ্খাতেই তার শক্তি নিহিত”। (Freud: Great Thinkers of the western World, Encyclopedia Britanica)
কার্ল মার্কসের হাতে বস্তুবাদী দর্শন চূড়ান্ত রূপ পেলো। কার্ল মার্কসের মতে মানব ইতিহাসে সমাজ এবং সংস্কৃতির সবদিকই অর্থনৈতিক কার্যকরণেল ফলশ্রুতি। ব্যক্তি বিশেষ তার চারিদিকের ঘটনাবলীর সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। বস্তুগত পরিবেশের গতিশীল উন্নয়নের মাধ্যমে একটি পরিপুর্ণ সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়অ অনিবার্য। আজকের পশ্চিমা সভ্যতার পিছনে মার্কসের মতবাদের বিরাট অবদান রয়েছে। মার্কসীয় মতবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সেভিয়েত ইউনিয়নেও আগ্রহের সঙ্গে গৃহীত হয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন লক্ষ্য সম্পর্কে সৎ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফন্দিবাজ এবং কপটাচারী।
বার্টাণ্ড রাসেল বস্তুবাদী দর্শণ তুঙ্গে পৌঁছিয়ে দেন। তিনি লিখেনঃ “মানুষ কার্যকারণের সৃষ্টি, তার প্রাপ্তির শেষ নেই, তার জন্ম, বৃদ্ধি, আশা, ভয়, ভালবাসা, বিশ্বাস অণুর বিন্যাসের ফলশ্রুতি। কোন প্রকার বীরত্ব চিন্তার গভীরতা এবং আবেগ ব্যক্তি বিশেষকে কবর থেকে দূরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ যুগের সকর পরিশ্রম, সকল নিষ্ঠা মানব মনীষার সকল প্রেরণা সৌর জগতের বিশালকায় মৃত্যুর মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য। মানুষের সাফল্যের সমগ্র মন্দির বিশ্বের ধ্বংসাবশেষের নীচে অবশ্যই সমাধিস্ত হবে। এসব জিনিস এতই নিশ্চিত যে, তাদেরকে অস্বীকারকারীর কোন দর্শনই টিকে থাকতে পারে না। এ সত্যের মঞ্চে কেবলমাত্র অনমনীয় হতাশার দৃঢ় ভিত্তির দ্বারাই নিরাপদ মানব বসতি গড়ে তোলঅ সম্ভব”। (Makers of Modern Mind, Randall, Columbia University Press, New York 1930)
Schopen Hauer বস্তুবাদী দর্শনের যৌক্তিক সমাধান টানলেন। তার কাছে জীবনের অস্তিত্ব লক্ষ্যহীন, চঞ্চল তৎপরতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক শক্তি। “সকল আকাঙ্খার মূলে রয়েছে প্রয়োজন, ঘাটতি এবং তা-ই কষ্টকর। মানুষের প্রকৃতি মূলতঃ নিষ্ঠুর এবং তার অস্তিত্ব তাই কষ্টকর হতে বাধ্য। অপরদিকে যে যদি সহজ সন্তুষ্টির সঙ্গে সকল কাঙ্খিত জিনিস লঅভ করে এ ধরনের অসার ক্লান্তিতে তার হৃদয় ভরে গেলে সে হৃদয় তার জন্যে অসহনীয় বোঝা হয়ে পড়ে। এই ভাবে জীবন গোলকের মত কষ্ট থেকে ক্লান্তিতে এবং ক্লান্তি থেকে কষ্টে দোল খেতে থাকে। জীবন শিলা ও আবর্তে পরিপূর্ণ সমুদ্রের মত, মানুষ যা সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করে যদিও সে জানে যে সকল প্রচেষ্টা এবং দক্ষতার সঙ্গে প্রবেশ করতে পারলেও সে জাহাজডুবি তথা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছায়। প্রতিটি মানুষ এবং তার জীবনে গতি-প্রকৃতির সীমাহীন প্রেরণায় আরেকটি ক্ষনিকের স্বপ্ন মাত্র। বেঁচে থাকার অবিরাম প্রচেষ্টায় মানুষ প্রকৃতির সীমাহীন প্রান্তরে এসে ঠাঁই নেয়। প্রকৃতিও ক্ষণিকৈর জন্য আশ্রয় দিয়ে আবার সীমাহীন অতলান্তে বিলীন করে দেয়”। (Makers of the Modern Mind)
ধর্ম বিশ্বাসের বাস্তব মূল্য অস্বীকার করে ফ্রয়েডকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, বিজ্ঞান বিকল্প নয়। “বাস্তব জগতের ওপর গুরুত্ব ছাড়া বিজ্ঞান অবশ্যই নেতিবাচক বক্তব্য দেয়। তার সীমা স্পর্শনীয় বস্তুগত সত্য এবং মায়াকে সে অস্বীকার করে। আমাদের অনুসারীদের যারা এ ধরনের কার্যাবলীতে অসন্তুষ্ট এবং ক্ষণেক শান্তির জন্য আরো অধিক আকাঙ্খা করেন তারা যেখানে তা পাবেন সেখানে খোঁজ করতে পারেন। কিন্তু আমরা তাদের সাহায্য করতে পারি না”। (Encyclopedia Britanica)
“বর্তমান জীবনের কষ্ট, ক্ষুধা, যন্ত্রণা, বার্ধক্য, মৃত্যু এবং ক্ষত স্পষ্ট হয়েছে অথবা সম্ভবতঃ আগের চাইতে একটু বেশী করে অনুভূত হয়েছে দু’টি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা। কবি ও উপন্যাসিকসহ বস্তুবাদী চিন্তাবিদদের খোদার বিরুদ্ধে বাদানুবাদের মূল বিষয়ও এটি। তারা তার করুণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং ধর্মতত্ত্ববিদদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রতি ফোটা অশ্রুর জন্যে পুরষ্কারের অঙ্গীকার করে মানব মনীষার সঙ্গে তামাসা না করতে। কারণ কাগজের নোটের নগদ বিনিময় মূল্যের নিশ্চয়তা না থাকলে তা স্রেফ ধোকা।
এই উচ্ছ বাচ্যের মূল হচ্ছে জীবনের অমরত্বে অবিশ্বাস। আমরা যদি এখন ব্যর্থ হই, আমরা চিরদিন ব্যর্থ হবো কারণ কোন অতীতই ফিরে আসে না। যদি আমরা এ জীবন হারাই আমরা সব কিছুই হারালাম কারণ এটাই প্রথম এবং শেষ সুযোগ। মৃত্যু আসার সঙ্গে সঙ্গেই আশা-আকাঙ্খা, বিপদ, ভয়, পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা হঠাৎ থেমে যায়। জীবনের এই সীমিত ধারণা নিয়ে এটাই স্বাভাবিক যে, আমাদের দুঃখ কষ্টের হিসাব করব এবং অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার কামনা করব এবং ভাববো আমরা যে সব অন্যায় আচরণের শিকার সবই আমাদের নিজেদের তৈরী”।
অন্যায় আচারণ সম্ভবতঃ কোনদিন সম্পূর্ণ শেষ হবে না। এসব থাকতে এসছে। খোদা সবাইকে মোহাম্মদ আলীর (মুষ্ঠিযোদ্ধা) মত স্বাস্থ্য, রকে ফেলারের মত ধন এবং বার্টাণ্ড রাসেলের মত বুদ্ধিমত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি অভবা, দারিদ্র রোগ এবং বার্ধক্যের জন্যে সার্বজনীন বীমা পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেননি। বিজ্ঞানীরা আমাদের ওয়াদা দিতে পারেন যে, এই শতক শেষ হওয়ার আগে প্রত্যেক ব্যক্তির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ী এবং গাড়ী থাকবে। তপ্ত সূর্যের নীচে কিভাবে ঘামাতে হয় অথবা শীতের রাতে কি ভাবে কাঁপতে হয় আমরা জানবো না। আমাদের ক্ষুদ্রতম ব্যক্তিও আরামদায়ক কাজ পাবে, মনোমুগ্ধকর ও প্রচুর বেতন পাবে এবং একই সঙ্গে যুগের শিল্পকলা ও সংস্কৃতি উপভোদ করার মত অখণ্ড অবসর পাবে। এধরনের স্বপ্ন যদি সত্যি হয় তাহলে মানবতার জন্যে সেটি দুর্ভার্গের দিন হবে।
আমরা পৃথিবীকে এসেছি কাজ করতে, সংগ্রাম করতে, আমাদের দুঃখ ও উৎকষ্ঠার শরীক হতে এবং পৃথিবীর কল্যাণে অবদান রাখতে, আধ্যাত্মিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, অত্যাচার এবং অবিচার, হিংসা, ঘৃণা লাঘব বা নিমূর্ল করতে। এটি একটি বিরাট কাজ সম্ভবতঃ আমরা তা শেষ করতে পারবো না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের চেষ্টার দ্বারা আমরা ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর দৃষ্টিতে কতটা লাভবান হলাম সেটাই আমাদের দেখার বিষয়। বাকীটুকু দেখা আল্লাহর নিজের দায়িত্ব। কেবলমাত্র এই ধরনের আশা ও প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথীবীদে আমাদের জীবন, কাজ এবং মৃত্যু কামনা করা উচিত। [S. Ahmad, Back to God v. Yaqeen Intermational, Karachi April 22, 1967.]

 

আধুনিক দর্শণঃ এর বৈশিষ্ট্য ও পরিণতি
আধুনিকতা, ধর্ম এবং তার সকল আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটা প্রচণ্ড বিদ্রোহ। ইউরোপীয় রেনেসাঁ বিশেষ করে মেকিয়াভেলির নীতিজ্ঞানশূণ্য রাজনৈতিক দর্শনে এই বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ১৮ শতকের আলোকপ্রাপ্ত ফরাসী দার্শনিকের হাতে এর পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং ১৯ শতকের ইউরোপ ডারউইন, মার্কস এবং ফ্রয়েডের হাতে তা সর্বোচ্চ সীমা প্রাপ্ত হয়। পশ্চিম ইউরোপের জন্মস্থান থেকে এই দুষ্ট ক্ষত বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে হামলা চালিয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। বস্তুতঃ এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আধুনিকতা সর্বব্যপী এবং সার্বজনীন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। যারাই এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদেরকে আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রগ্রতিশীল বলে অভিনন্দিত করা হয়েছে অপর দিকে যারা অনীহা দেখিয়েছে তাদেরকে অনগ্রসর, মধ্যযুগীয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে কোণঠাসা করা হয়েছে। এই কারণেই এশিয়া ও আফ্রিকার নেতারা স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর আধুনিকতার প্রতি এতই অন্ধ বিশ্বাস স্থাপন করেছে যে প্রকারান্তরে তারা তাদের উপনিবেশিক শাসকদেরও হার মানিয়েছে।
আধুনিকতা কম্যুনিজম, সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, প্রয়োগবাদ, প্রত্যক্ষবাদ, ফ্যাসিবাদ, নাৎসীবাদ, ইহুদীবাদ, কামালবাদ এবং আরব জাতীয়তাবাদের ছদ্মাবরণে আবির্ভূত হয়েছে। অবশ্য এইসব আধুনিক মতাদর্শের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং ঘৃণা সত্ত্বেও নিবিষ্ট পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে তারা একই গাছের বিভিন্ন শাখা মাত্র।
আধুনিকতার মূল বক্তব্য পরকালকে অস্বীকার করা। পরকালকে অস্বীকার করার ফলে অনিবার্যভাবে এই সিদ্ধান্তে আসে যে, দৈহিক আরাম আয়েশ, বস্তুগত সমৃদ্ধি, পার্থিব সাফল্য এবং ব্যক্তিগত সুখই জীবনের লাভজনক লক্ষ্য। মানুষের কাজের জন্যে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীর কথা অস্বীকার এবং ন্যায়ই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে এই বিশ্বাস ধ্বংস করে নৈতিকতার ওপর মরণাঘাত হেনেছে।
সকল আধুনিক মতাদর্শের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মানব পূজা। কোন কোন সময় বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণে মানব পূজা চলে। আধুনিকতাবাদীরা জানেন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতি পর্যায়ক্রমে তাদেরকে ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী করবে। মানব পূজার আরেকটি ধরন হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। জাতয়িতাবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিদেশী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে নিজের বিশেষ দলের পূজা। নাৎসী জার্মানীতে ইহুদী হত্যা, ইসরাঈলে আরব হত্যা, ভারতে মুসলমান হত্যা এবং অতি সম্প্রতি সাইপ্রাসে তুর্কী হত্যার ঘটনায় এর প্রমাণ মিলে। জাতীয়তাবাদ সর্ব শক্তির অধিকারী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য দাবী করে। রাজনৈতিক নেতারা দেবতায় পরিণত হয়। তাদের ছবি এবং মূর্তি সর্বত্র জনসমক্ষে রাখা হয়। নাৎসী সৈন্যরা বক্ষে তাদের ছবি এবং মূর্তি সর্বত্র জনসমক্ষে রাখা হয়। নাৎসী সৈন্যরা বক্ষে হিটলারের ছবি রাখতো এবং যদি তারা আহত অথবা হাসপাতালে মারা যেতো তাদেরকে এ ছবি চুম্বন এবং চোখের ওপর রাখতে দেখা যেতো।
রাশিয়ায় প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে একটি কাঁচের পাত্রে লেনিনের মরদেহ বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়। মস্কোর রেডস্কোয়ারস্থ তার সমাধি জাতীয় মাজার, শীতকালে এক নজর দেখার জন্যে মানুষ সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। লেনিনের সমাধি পরিদর্শনকারীরা সেখানে গীর্জার মত পরিবেশ দেখতে পান। ষ্টালিনের মৃত্যুর পর তার মরদেহও একই কায়দায় কাঁচের পাত্রে যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ক্রুশ্চেভ তাকে অসঈকার কার পর একই সঙ্গে সকল গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে তার ছবি ও মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। চীনের কম্যুনিষ্ট শাসনের অধিনেও মাও সেতুংকে ঈশ্বরের মত পূজা করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে তার লিখা বইকে ধর্মীয় গ্রন্হের মর্যাদা দিতে শেখানো হচ্ছে।
রেলের কামরা, সরকারী বাস, রেস্তোঁরা, রাস্তার মোড়, রাস্তার পার্শ্বের পায়ে চলার পথ, বিমান বন্দরে যাত্রীদের বসার স্থান অথবা আকাশে উড্ডয়নরত বিমান যাই-ই হোক না কেন সব জায়গায় রেডগার্ডরা রয়েছে এবং মাও-এর বাণী নিয়ে গান, আবৃত্তি ও নাচানাচি করছে। চীনের বাণিজ্যিক বিমান পরিবহনে চকলেট, চা এবং সিগারেট দেয়ার পর পরই যুবতী বিমানবালারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে লাল বই বের করে মাও-এর বাছাইকৃত অংশগুলো পড়তে থাকে। যাত্রীরা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করুক আর নাই-ই করুক এরপর তারা কোরাস গাইতে থাকে। এই ‘পবিত্র অনুষ্ঠান শেষ হলে বিমান বালারা নেচে নেচে গান শুরু করে। বিমান বন্দরে অবতরণ পর্যন্ত এ নাচ গান চলতে থাকে। সমগ্র চীনের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান চলে। [সাংস্কৃতিক বিল্পব।“ Chinas new Generation Taking over” Qudratullah Shahab, The Pakistan Times, Lahore, October-1, 1967.]
কোন ব্যতিক্রম ছাড়া সকল আধুনিক মতাদর্শ অতীন্দ্রিয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। অপর কথায় সত্য নির্ণয়ের কোন চূড়ান্ত মাপকাঠি নেই। বরং সততা, নৈতিক মূল্যবোধ আপেক্ষিক বিষয়। সময় স্থান ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের যথার্থতা সীমিত। ‘ওহি’ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে আধুনিকতাবাদীরা গতিহীন এবং অসার বলে অভিহিত করেছেন। পরিবর্তনই একটা গুণ এবং যত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয় ততই ভাল। আধুনিকতাবাদের চূড়ান্ত গুণ হচ্ছে ‘আধুনিক’ মহিলাদের পোশাকের ক্ষেত্রে সর্বশেষ ফেশান, সর্বাধুনিক মডেলের গাড়ী এবং নাচের সর্বাধুনিক মুদ্রাকে সবকিছুর উর্ধে স্থান দেয়া হয়।
আধুনিক মতাদর্শের অপর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন ও জীবনকে যতদূর সম্ভব শিথিল করা। কার্ল মার্কস নিজেও তার কমিউনিষ্ট ঘোষণা পত্রে (১৮৪৮) পারিবারিক জীবন পুরোপুরি শেষ করে দেয়ার ওকালতি করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কম্যুনিষ্ট চীন এই লক্ষ্য সাফল্য জনকভাবে অর্জন করেছে। অকম্যুনিষ্ট দেশে সুক্ষ্মভাবে এই প্রচেষ্টা চলছে, তবে কার্যকর হচ্ছে না। পরিবারের বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার ১। শিল্পায়ন ২। শহর কেন্দ্রিক জীবন ৩। নারী মুক্তি।
বস্তুতঃ তিনটি ব্যাপার একই সঙ্গে চলতে থাকে। আধুনিক শিল্পায়ন ব্যবস্থা উচ্চ বেতন ও অন্যান্য সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বিরাট সংখ্যক সুস্থ সবল লোককে পরিবার ও গ্রামের সুসংহক সমাজ বন্ধন থেকে টেনে বিরাট শহরের অজ্ঞাত পরিবেশে নিক্ষেপ করে। এই ভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবার ভেঙ্গে যায় এবং পৃথক হয়ে যায়। শিল্পোন্নয়নের ফলে পরিবার আত্মনির্ভর অর্থনৈতিক ইউনিট থাকতে পারে না। এর ফলে পিতা তার জীবনের অধিকাংশ সময় বাড়ী এবং স্ত্রী থেকে দূরে থাকেন। ফলে স্ত্রীও সংসারের প্রতি বিরাগভাজন হয়ে অন্যদিকে আসক্ত হয়ে পড়েন। যদিও শিশুসদন, কিন্ডার গার্টেন এবং স্কুলগুঅের সংখ্যা ক্রমাগত বর্ধিত হারে ছেলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তবুও বিরাট সংখ্যক শিশু নিজের খেয়ালখুশিতে অযত্নে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এই পরিস্থিতিতে যুব অপরাধ মহামারী আকারে দেখা দেয়া অসঙ্গত নয়।
“আমাদের যুগের যুবক যুবতীরা দুর্দশার সঙ্কেত দিচ্ছে। তারা চায় আমরা তাদের সংকট অনুধাবন করি। যুব সংকটের প্রধান গতিগুলো নিম্নরূপ: ১। অভূতপূর্ব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সমাজবিরোধী আচরণ প্রবণতা ২। যৌন আচরনেল বিশৃংখলা এবং বিকৃতি ৩। সবকিছুতে উত্তপ্তভাব এবং সর্বত্র এর সংক্রমন ও নতুন যে কোন কিছুর প্রতি অদম্য আগ্রহ ৪। পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক, সঙ্গীদের সাহচর্যের ঝোঁক, দুঃসাহস হারানো এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতা হ্রাস ৫। বর্জনের আগ্রহ, আশা ও বিশ্বাস হারানো, মোহমুক্তি এবং আদর্শের গিতশীলতা নষ্টজনিত হতাশা ৬। পরিবার ও সমাজের লক্ষ্যের সঙ্গে নিজের লক্ষ্যের সমন্বয় সাধনে ব্যর্থতা, পশ্চাৎগামিতা, অপ্রতিভ অবস্থা, নিজের পরিচয় খণ্ডিতকরণ এবং সবশেষে সামাজিক সম্মিলনে নিদারুণ বিশৃংখলা ও অরক্ষিত যুব মানসের আবেগময় পতন মানসিক অসুস্থতা। [Adolscent struggle as protest, nathan W ackerman, The voice of America forum lectures: The family series No. 6. Washingtion Dc. 1971.]
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নারী মুক্তি সকলের জন্যে শক্তিশালী এবং অপরিহার্য হাতিয়ার প্রমাণিত হয়েছে। যতদূর সম্ভব গৃহকর্তী এবং মাতৃত্বকে আকর্ষণহীন, অসন্তুষ্ট ও অহেতুক প্রমাণিত করে মহিলাদেরকে বাড়ী থেকে বাহিরে আসতে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। গণসংযোগ মাধ্যমগুলোতে চিরাচরিত নারীর ভূমিকা ছোট করে দেখানো এবং পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মহিলাদের কাজকে আকর্ষণীয় প্রমাণিত করে এই কাজ করা হয়েছে। যে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেচে সে পরিবার প্রধান হিসেবে স্বামীর কর্তৃত্ব নষ্ট করেছে। একইভাবে যে পরিবারে মা কর্তৃত্ব করে সে পরিবারের সন্তান পিতার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।
ক্রমবর্ধমান অবৈধ যৌন স্বাধীনতাই সব চাইতে ক্ষতি সাধন করেছে। নারীর দেহকে বাণিজ্যিক রূপ দেয়ার কোন প্রচেষ্টাই বাকী রাখা হয়নি। অবিবাহিত মহিলাদের গর্ভধারণের সংখ্যা বৃদ্ধি, অবৈধ সন্তান, গর্ভপাত, তালাক, যৌন অপরাধ এবং যৌন ব্যাধি থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আধুনিকতায় আচ্ছন্ন দেশগুলোতে বহুবিবাহ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ এবং এজন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অপরদিকে যৌন সম্পর্কের জন্য কোন আইনগত শাস্তির বিধান নেই বরং এটাকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে বিবেচনা করা হয়।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় পারিবারিক জীবনের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব থেকে বয়স্কদের জন্যে আশ্রয়হীনতার পথ প্রশস্ত হয়। জাতীয়তাবাদে আচ্ছন্ন দেশগুলোতে বিশেষ যুব উৎসব, খেলাধুলা, সামরিক কুচকাওয়াজ এবং রাজনৈতিক বিক্ষোভকে যুবক যুবতীদের গৌরবের বিষয় মনে করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপে সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও গণসংযোগ মাধ্যমগুলোতে যৌন আকর্ষন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে যৌবনের পূজা করা হয়। কম্যুনিষ্ট অথবা অকম্যুনিষ্ট যে দেশই হোক আধুনিকতায় আচ্ছন্ন হলে সেখানে বৃদ্ধদের সামাজিক মর্যাদা খুবই নীচ। বয়স্কদের প্রাচীন ও যুগের অনুপযোগী ভাবার শিক্ষা দিয়ে বিভিন্ন বয়সের লোকদের দ্বন্দ্ব প্রকটিত করা হয়।
আধুনিক যুবকেরা বয়স্কদের প্রতি দায়িত্ব থকে অব্যাহতিকে নিজেদেরসুখ স্বাচ্ছন্দের জন্যে অপরিহার্য মনে করে। যারা অভিভাবকদের যত্ন করে তারা এটা অসহ্য বোঝা মনে করে। পর্যায়ক্রমে নার্সিং হোম অথবা হাসপাতালে রুগ্ন এবং অক্ষম বৃদ্ধদের জীবনকে অপ্রয়োজনীয় এবং সামাজিক দায় বলে মনে করা হয়। বরস্ক লোকেরা নিজেদের বয়সের জন্যে লজ্জা অনুভব করা এবং যতদূর সম্ভব যৌবনকে ধরে রাখার চেষ্টা করা বিস্ময়কর কিছু নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলারা চুলে কলপ দেয়া, প্রসাধন এবং দেহের স্থুলত্ব কমাবার জন্যে কল্পনাতীত অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেন। পঞ্চাশ বছরের মহিলা বিশ বছরের যুবতীর দৈহিক গঠন না থাকায় নিজেকে অপরাধী মনে করে।
আজকের যুবকেরা জীবনের ভাল জিনিস থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় করে। তারা বার্ধক্য এবং মৃত্যুর ভয়ে আতংকগ্রস্ত। তারা যৌবনের হালকা চাকচিক্যকে ধরে রাখতে চায়। তারা নিজেদেরকে বাহ্যিক দিক থেকে যুবক এবং আকর্ষনীয় রাখার জন্যে স্বর্গমর্ত ঘুরে মরে। তারা কাপড়, খাওয়া এবং প্রসাধনীতে মাতোয়ারা থাকে। তারা এই মশগুলভাবকে হাস্যাস্পদ পর্যায়ে নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মহিলারা সাজগোছ, চুলে কলপ, পরচুলা পরা এবং মুখকে নতুনরূপ দেয়ার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেন। যৌবনকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মা মেয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেয়েরা চীৎকার করে বলে ‘আমি আমার মাকে মায়ের মত দেখতে চাই, বোনের মত নয়’। অপরিপক্কতার গুণ শুধুমাত্র কৈশোর পর্যায়ে নয় বরং মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রসারিত করে। আত্মকেন্দ্রিক এই প্রতিযোগিতা মানুষকে তার পরিবার, পরিবেশ এবং আত্মীয়স্বজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করে যাতে পৃথিবীটা এক জঙ্গলে পরিণত হয় এবং প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের জন্যই সৃষ্ট হয়েছে এই ধারণা জোরদার হয়। এই সুবিধাবাদী মনোভাব মানুষকে নিঃসঙ্গ, যান্ত্রিক এবং মানসিক গুণবর্জিত করে তোলে। ব্যবসায়িক দুনিয়ার মত পরিবারিক জীবনও লাভ লোকসানের মাপকাটিতে বিচার করা হয়। অর্থ এবং প্রতিপত্তিকেই প্রভু বানানো হয়। মানুষকে বস্তু হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানবিক সম্পর্ক মানবেতর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। অপর পর্যায়ে প্রকৃত জিনিসের স্থলে বাহ্যিক আবরণকে মূল্য দেয়া হয়। তুমি কে সেটা নয় বরং তোমার চেহারা কেমন সেটাই বিচার করা হয়। মানুষের সম্পর্ক পোষাক এবং প্রসাধনের দ্বারাই নির্ণিত হয়। ক্ষমতা এবং প্রভুত্বের লক্ষ্য অস্বাভাবিক গুরুত্ব লাভ করে, পারিবারিক স্নেহ-প্রীতি, একতা, আনুগত্য, অংশীদারিত্ব, সহযোগিতা তার পদতলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। [Adolescen struggle as protest, Nathan, W. Ackerman op cit. pp 8-9.]
আধুনিকতার সবচেয়ে বড় গলদ হচ্ছে মানব জীবনের ব্যাপক ধারণা লাভে ব্যর্থতা। উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায় ফ্রয়েডের মতে মানুষের স্বাস্থ্য এবং সুখ অবাধ যৌনজীবনের ওপর নির্ভরশীল, অপরদিকে মার্ক্সের মতে অর্থনীতিই মানুষের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। সকল আধুনিকতাবাদীই চরম একমুখী মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। মানব জীবনের একটি দিক যৌন অথবা আর্থিক যাই-ই হোক না কেন তাকে সমগ্র মানব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন জ্ঞান করে ভেদ বুদ্ধিহীনভাবে অহেতুক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অপর কথায় বলা যায় জীবনের একটিমাত্র অংশকে সমগ্র জীবন মনে করে ভুল করা হয়েছে।
পশ্চিমী সভ্যতার এই দুর্ভাগ্য আকস্মিক বা মানুষের দুর্বলতার কারণে নয়। মানুষ মহৎ নীতি নিয়ে বাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মহৎ নীতিগুলো নিজেরাই অসম্পুর্ণ। পশ্চিমা সভ্যতা, মতবাদ এবং বাস্তবতা দু’দিকে থেকে অনিষ্টকর। পশ্চিমা সভ্যতার এই দুর্ভাগ্য আকস্মিক বা মানুষের দুর্বলতার কারনে নয়। মানুষ মহৎ নীতি নিয়ে বাস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মহৎ নীতিগুলো নিজেরাই অসম্পূর্ণ। পশ্চিমা সভ্যতা, মতবাদ এবং বাস্তবতা দু’দিক থেকে অনিষ্টকর। পশ্চিমা সভ্যতার পথ নির্দেশক দর্শনসমূহও এই দোষে দুষ্ট। ফলে সমগ্র ব্যবস্থাও এর প্রভাবমুক্ত নয়। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, পশ্চিমা সভ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই মহত্ব অর্জন করেছে। অবশ্য এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, সত্যের আবরণেই মিথ্যা সব সময় অগ্রসর হয়। এখনো তার প্রকৃতরূপ ধরা পড়লে তা সম্পূর্ণই অন্ধকার মনে হবে।

 

সাংস্কৃতিক দাসত্ব রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়
যদিও এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের ঈমান এবং মানুষ হিসেবে আমাদের অনন্য পরিচিতির দিক থেকে বিদেশী রাজনৈতিক শাসনের চাইতে সাংস্কৃতিক অধীনতা অনেক বেশী ক্ষতিকর। তবে বাস্তবে সাংস্কৃতিক দাসত্ব রাজনৈতিক দাসত্বের সঙ্গে শুধুমাত্র সম্পৃক্তই নয় বরং সকল ইচ্ছা ও কাজে তা অবিভাজ্য। প্রায় ৬শ বছর আগে কৃতি মুসলমান ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন তার মুকাদ্দীমায় এই সত্য স্বীকার করেছেন।
“বিজিতরা সব সময় বিজয়ীদের পোশাক, প্রতীক, বিশ্বাস এবং অন্যান্য আচার প্রথা অনুকরণ করতে চেষ্টা করে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ সব ময় বিজয়ীদের কাছে প্রিয় পাত্র হতে আগ্রহী হয়। এটা দুই কারণে হয় প্রথমতঃ বিজয়ীদের প্রতি শদ্ধা, দ্বিতীয়তঃ বিজয়ীদের মত যোগ্যতার অধিকারী হলে তাদের পরাজয় হতো না- এই মনোভাব হেতু যোগ্যতা অর্জনের জন্যে। এই বিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী হলে এটা একটা ব্যাপক আস্থার ভাব সৃষ্টি করে এবং বিজয়ীদের সকল কিছু অনুকরণে বিজিতরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এই বিশ্বাস অজ্ঞাতভাবে অথবা বিজয়ের জন্যে বিজয়ীদের শারীরিক ও অস্ত্রের শক্তির চাইতে আচার আচরণ প্রাধান্য বিস্তার করেছে- এই বিশ্বাস থেকে সৃষ্টি হতে পারে। এই অবস্থায় তখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে বিজয়ীদের অনুকরণ পরাজয়ের কারণ দূরীভূত করবে। এইভাবে দেখা যায় বিজিতরা পোশাক, অস্ত্র ধারণ যন্ত্রপাতি এবং জীবন ধারণের সকল পদ্ধতিতে বিজয়ীদের অনুকরণ করে। বস্তুত প্রতিটি দেশই তার বৃহৎ বিজয়ী প্রতিবেশীকে অনুকরণের চেষ্টা করে। স্পেনের মুসলমানেরা বিজয়ী প্রতিবেশী খৃস্টানদেরকে অনুকরণ করেছে। খৃষ্টানদের পোষাক, অলঙ্কার এবং আচার আচরণের বিভিন্ন দিক এমন কি ঘরে ছবি রাখার ব্যাপারে মুসলমানরা তাদের অনুকরণ করেছে। সযত্ন পর্যবেক্ষণ এই হীনমন্যতা সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে”।
ইবনে খালদুন মানুষের মনস্তত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। তার সময়ের স্পেনিশ মুসলমানদের ন্যায় আজকের ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরাও অনুকরণ করছে। অবশ্য এটা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় বিদেশী সভ্যতার অন্ধ ও সমালোচনাহীন অনুকরণ স্বতঃস্ফূর্ত নয়। আমাদের বিদেশী প্রভুরা শাসনের প্রথম লগ্ন থেকেই খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের জীবন পদ্ধতিকে ধ্বংস করে সেখানে তাদের আচার পদ্ধতি চালূর ষড়যন্ত্র করেছিলেন। তার ফলশ্রুতিতে অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তাদের আচার প্রথা প্রবেশ করেছে।
প্রায় একশ বছর আগে বৃটিশ সরকার উপমহাদেশের মুসলমানদের অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান এবং কার্যকরভাবে শাসনের নির্দিষ্ট পদক্ষেপের প্রস্তাব দানের জন্যে ডঃ ইউলিয়াম হান্টারকে নিযুক্ত করেছিলেন। সেই হিসেবে ১৮৭১ সালে তিনি লিখলেনঃ আমাদের ভারতীয় মুসলমানঃ তারা কি রাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বিবেকের কাছে বাধা! মুসলমানদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে ফেলার জন্যে এবং তাদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে ‘সবজান্তা’ ডঃ হান্টার প্রস্তাব করেছেন ইংরেজী শিক্ষার।
তার বইয়ের সমাপ্তি পর্বে তিনি তার সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। “এভাবে মুসলমান যুবকদেরকে আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনার ভিত্তিতে শিক্ষিত করে তুলতে পারি। তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে এবং ধর্মশিক্ষার বিষয়ে সামান্যতম হস্তক্ষেপ না করেই আমরা তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি যাতে করে তারা ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করলেও ধর্মান্ধ হবে না। বিশ্বের অন্যতম চরম গোঁড়া সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুরা যেভাবে সহনশীলতার শিক্ষা পেয়েছে, মুসলমানদেরকেও সেই পদ্ধতি অনুসরণে উৎসাহিত করা যেতে পারে। অনুরূপ সহনশীলতা মুসলমানদেরকে তাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে গোঁড়ামী থেকে মুক্ত করে আনবে, যে গোঁড়ামী তাদেরকে নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা ও অপরাধজনক কাজের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে। আর এসবই তারা করে এসছে ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে। মুসলমানী আইনশাস্ত্র আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নিয়মিত পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু এটাকেই শিক্ষার মৌল লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেয়া ঠিক হবে না। মুসলমানী আইন মানে মুসলমানী ধর্ম মুসলমানরা সমগ্র পৃথিবীতে তাদের আইনানুগ অধিকারে বিশ্বাসী। তারা আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব আনুগত্য অথবা খৃষ্টান সরকারের অধীনতার কথা জানে না। মুসলমানী আইন সরকারের কোন প্রয়োজন এবং জীবন সম্পর্কে তার ছাত্রদেরকে কোন ধারণা দেয় না। এর পরিবর্তে আমাদের উচিৎ একটা উদীয়মান মুসলিম জাতি গড়ে তোলা যারা নিজস্ব সংকীর্ণ শিক্ষা পদ্ধতি ও মধ্যযুগীয় ভাবধারার গণ্ডীতে আবদ্ধ না থেকে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের নমনীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। ইংরেজী প্রশিক্ষণ জীবনের লাভজনক অধ্যায়ে প্রবেশের নিশ্চয়তা দেবে। কোন পদ্ধতি প্রবর্তনের দ্বারা হিন্দু ও মুসলমানদের সমভাবে উচ্চতর ধর্মীয় ধারণায় উন্নতী করা সম্ভব সে সম্পর্কে আমি এখানে কিছু বলতে চাই না। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে অনুরূপ উন্নত অবস্থায় তারা একদিন উপনীত হবে এবং এতদিন নেতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও আমাদের প্রবর্তিত শিক্ষা পদ্ধতি হচ্ছে এ বিষয়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ”।
ডঃ হান্টারের ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হয়েছে এবং আজ আমরা তার ফল ভোগ করছি। বংশ পরম্পরায় পাওয়া সেই সম্পত্তি ৪৭ এর স্বাধীনতার পরও সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় এখনও বহাল রয়েছে। বৃটিশ শিক্ষা পদ্ধতি এতই দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়েছে যে, সমগ্র উপমহাদেশে আধুনিকতা তথা ধর্মনিরপেক্ষতার বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদের মোকাবিলা করার জন্যে পর্যাপ্ত ইসলামী জ্ঞান দানে সক্ষম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও কোথাও নেই। আমাদের যুবকেরা নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোন আকর্ষণ ছাড়াই বড় হচ্ছে। এতে এতে বিস্ময়ের কিছু্ই নেই।
বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে Lord cromer ছিলের আরব বিশ্বের বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব। ১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত পঁচিশ বছর প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে তিনি মিশর শাসন করেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কৌশল জানার জন্যে তার বিরাট বই Modern Egypt অপরিহার্য। বই এর সমাপ্তিতে তিনি কোন সন্দেহের অবকাশ রাখেননি যে, সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের চাইতে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের নীতিই ছিল তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
“কোন বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন রাজনীতিকের চিন্তা করা ঠিক নয় যে, ইসলামকে পুণর্জীবন দানে সক্ষম- এমন পরিকল্পনা তাদের রয়েছে, বস্তুতঃ ইসলাম এখনো মরে যায় নি, বরং শতাব্দী ধরে টিকে থাকার যোগ্য। তবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে তা মৃতপ্রায়, তার ক্রমাগত অবনতি কোন আধুনিক তত্ব প্রয়োগে, তা যতই দক্ষতার সঙ্গে করা হকো না কেন ঠেকানো যাবে না। এই পর্যন্ত যতটুকু বিচার করা যায় তাতে দু’টি মাত্র বিকল্প পন্হা সম্ভব। মিশরকে পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে নতুবা বৃটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিদেত হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই দুই বিকল্পের প্রথমটির পক্ষে। আমরা যা করব তাতে ভাল, জোরদার এবং স্থিতিশীল সরকারের ব্যবস্থা করতে হবে যা অরাজকতা এবং দেউলিয়াত্ব দূর করে মিশরকে ইউরোপের জন্যে সমস্যায় পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। এ ধরনের সরকারের কাজে আমাদের বেশী মাথা ঘামানো উচিৎ নয়। তবে আমাদের বিদায়ের পর সরকারকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যা পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ…. এটা মনে করা ঠিক হবে না যে মিশরে সম্পূর্ণ মুসলমানী নীতির ওপর প্রাচীন চিন্তাধারা ও পশ্চাদগামী সরকার প্রতিষ্ঠার সময় ইউরোপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে। মিশর যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে ঐ ধরনের চিন্তাধারা অনুসৃত হলে বস্তুগত স্বার্থের সাংঘাতিক ক্ষতি হবে।
যারা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান এবং সমস্যার সমাধান চান তাদেরকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে মিশরের নতুন বংশধর পশ্চিমা সভ্যতা সত্যিকারভাবে অনুসরণ বা গ্রহণে বাধ্য হয়। আমার বিশ্বাস ইংল্যাণ্ডের সুমহান পরিচালনায় পশ্চিমা সভ্যতার রশ্মি কৃষ্ণ আফ্রিার সবচাইতে দুর্ভেদ্য স্থানে গিয়ে পৌঁছুবে এবং এমনকি মিশরের ক্লেদাক্ত কৃষকেরা ও তাতে নতুন জীবন লাভ করবে। মিশরীয়দের অজ্ঞতা এবং অকৃতজ্ঞতা সত্ত্বেও আমি এখনো আশা করি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ বংশধরেরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখবে যে, Anglo-saxon জাতির লোকেরা প্রথম তাদের অত্যাচারী কৃতদাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে, তারা তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে যে, তারাও মানবিক আচরণ পাওয়ার অধিকারী, তারা তাদের সামনে নৈতিক অগ্রগতি এবং চিন্তার স্বাধীনতা ও বস্তুগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পথ উন্মুক্ত করে খুলে দিয়েছে পশ্চিমা সভ্যতার সত্যিকার মহাসড়ক”।
এটাই ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্য, স্বাধীনতার পরও কেন আমাদের ওপর বিদেশী প্রভাব এত জোরদার তার জবাবও এই বৃটিশ শাসকের উক্তি থেকে পাওয়া যাবে। বস্তুতঃ সকল প্রচারণা সত্ত্বেও আমাদের স্বাধীনতা একটা সামান্য ব্যাপার মাত্র। দীর্ঘদিন আমাদের দেশ বিদেশী শাসনাধীন ছিল, আমাদের জনগণকে অতীত ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে বিদেশী প্রভুরা খুব যত্নের সঙ্গে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এইভাবে তারা সাফল্যের সঙ্গে বিশেষতঃ সামাজিক দিক থেকে প্রাজ্ঞ লোকদের মধ্য থেকে একদল সাক্ষী গোপাল ও গৃহশক্র বিভীষণ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন। তথাকথিত রাজণৈতিক স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়ার পর আমাদের নেতৃত্ব এই পশ্চিমা চক্রের হাতে গিয়ে পড়ে।
বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে এই নেতৃত্ব অব্যাহত থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। কারণ আমাদের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশই তাদের ধ্যান-ধারণা এবং তাদেরকে ঘৃণা করতো এই কারণে গণতান্ত্রিক পন্হায় পশ্চিমা সভ্যতার বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ল। এই জন্যে খুবই শক্ত হাতে একনায়কত্ব চাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হলো। যারা এর বিরোধীতা করলো তাদেরকে নির্দয়ভাবে নিশ্চিহ্ন করা হলো। এমনকি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের জনগণকে দেয়া গণতান্ত্রিক সুযোগ সুবিধা মুসলমানদের দিতে রাজী হবে না, কারণ তারা ভাল করেই জানে মুসলমনাদের মনে ইসলামের প্রভাব খুবই জোরদার, গণতান্ত্রিক রায় প্রকাশের সুযোগ একবার আসলেই সকল মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর এই অবস্থা হলে এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের প্রভুত্ব চিরদিনের জন্যে খতম হয়ে যাবে। এই জন্যে ইসলামী আন্দোলনকে তাদের বিরাট ভয়, বিশ্বব্যাপী তাদের সংগঠিত সকল চক্রান্তের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনকে শেষ করা।
রাজনৈতিক দাসত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত অর্থনৈতিক দাসত্বকেও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না, বরং বলা যায় অর্থনৈতিক দাসত্বই আমাদের এই পরিস্থিতিতে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য করেছে। অর্থণৈতিক উন্নয়নের নামে বৃহৎ শক্তিবর্গ বিদেশী সাহায্যের টোপ গেলাতে উৎকণ্ঠিত। উচ্চ হারে সুদ নিয়ে এই সাহায্য শেষ পর্যন্ত গ্রহীতা দেশকে ভিক্ষুকে পরিণত করে। এতে কোন অতিশয়োক্তি নেই যে, পশ্চিম বিরাট বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো তাদের সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশর প্রধান মাধ্যম। অনুন্নত (এখন উন্নয়নগামী) মুসলিম দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে পর্যায়ক্রমে বিরাট বিরাট বিলাসবহুল ভবন, অত্যাধুনিক কারুকার্যের হোটেল, শহরের রূপ পাল্টিয়ে দেয়।
ব্যবস্থা হয় নৈশ ক্লাব এবং ক্যাবারে নাচের। হলিউয থেকে অপরাধমূলক ও অবৈধ যৌন সংসর্গের জঘন্য ছবি আসে, তার অনুকরণে দেশে ছবি নির্মিত হয়, পর্ণ ছবি, পুস্তক এবং বিদঘুটে পোশাক এসে বাজারে সয়লাবের সৃষ্টি করে যা সামাজিক উৎকর্ষতার চূড়ান্ত বিকাশ বলে বিবেচিত হয়। খাদ্যে ভেজাল দেয়া আমাদের শরিয়তের বিরাট পাপ বণে গণ্য হলেও এই পরিবেশে তা দ্রুত প্রসার লাভ করে এবং অ্যের জীবন ও স্বাস্থ্যের বিনিময়ে ভেজালদানকারী দিনে দিনে প্রাচুর্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে। মাদক দ্রব্যের ব্যবহার অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, আমাদের বেতারগুলো কদর্য ও নগ্ন গানের দ্বারা সাধারণ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
বিদেশী প্রভাবিক শিল্প ও বাণির্জিক সংস্থায় পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ করিয়ে মেয়েদেরকে চাকুরীতে নেয়া হয়। এই ভাবে আমাদের মহিলারা স্ত্রী, মা, বোন এবং কন্যার পবিত্র আসন থেকে বাস ট্রেনের টিকেট সংগ্রাহক, ব্যাংকের কেরানী, টেলিফোন অপারেটর, সেলস গার্ল, বিমানবালা, রেস্তোঁরার ওয়েট্রেস, হোটেলের কক্ষ সেবিকা, ফেশান মডেল এবং বেতার, টেলিভিশন, ছায়াছবি ও রাষ্ট্র আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গায়িকা ও নর্তকীতে পরিণত হয়। এই ভাবে পর্যায়ক্রমে পর্দা, বাড়ী, পরিবার অবৈধ যৌন সংসর্গের জোয়ারে ভেসে যায়। যুবক যুবতীরা একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে গড়ে উঠে। এইসব ব্যাপার আকস্মিকভাবে হয় না। বরং আমাদের ওপর যারা প্রভুত্ব বজায় রাখতে চায় তারা খুবই সতর্কতা ও দক্ষতার সঙ্গে আমাদের জীবন প্রবাহে এ সবের অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। আমাদের শক্ররা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে আমাদের অধঃপতন ঘটিয়ে দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে ছোট করতে চায়। তাদের স্বার্থেই আমাদের অধঃপতন ঘটুক আমাদের দেশ দুনীতিতে ভেসে যাক এটাই তাদের কাম্য।
এই ভীতি কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্যে আমাদেরকে বুঝতে হবে রাজনৈতিক দাসত্ব আর সাংস্কৃতিক দাসত্ব কেন অবিচ্ছেদ্য, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া সত্যিকার রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। বিরোধী এবং বিদেশী শাসনের অধীনে ইসলামের উৎকর্ষ অসম্ভব। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের ইসলামী পুনর্জাগরণের সকল আন্দোলনকে পযর্ণ সমর্থন জানাতে হবে এবং আমাদের সরকার যাতে আইন হিসেবে ইসলামের নির্ভেজাল শরিয়তকে গ্রহণ করে সে জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। ইসলামী আন্দোলনকে সকল গণ সংযোগ মাধ্যমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে হবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে।
কোন বিদেশী শক্তি যাতে আমাদের ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি করতে না পারে তার তীব্র বিরোধিতা করতে হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে আমাদের সম্পূর্ণভাব নিজস্ব সম্পদ ও বন্ধু মুসলিম দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে। প্লেগরূপী বিদেশী সাহায্য অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেন, বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গের সঙ্গে আমাদেরকে সমঅংশীদার হিসেবে সৎ ব্যবসার ওপর জোর দিতে হবে। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ সব সময় ইসলামকে তাদের এই শক্তিশালী শক্র জ্ঞান করে আসছেন ফলে তাদের নতুন বংশধরেরা একই দৃষ্টি ভঙ্গিতে ইসলামকে অধ্যয়ন করে থাকে।
পশ্চিম ইউরোপ থেকে উদ্ভুত বস্তুবাদী দর্শনই প্রতিটি মুসলিশ দেশে ইসলামী জীবন পদ্ধতি পুনরুজ্জীবনে সব চাইতে বড় বাধা হয়ে আছে। এই কারণে আমদের কিছু উলেমাকে পাশ্চাত্যের অধিবাসী হয়ে ইউরোপের সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম এবং দর্শন পড়তে হবে যাতে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নত দর্শন উপস্থাপন করা যায়। এই ভাবে সকল দিক থেকে আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করতে হবে যাতে আমাদের ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি করে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি।

 

ইসলাম কি বিশ শতকীয় ধারণার সঙ্গে আপোষ করতে পারে?
‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে’। প্রতিটি মুসলিশ দেশের আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদের মুখে বারবার একথা শোনা যাচ্ছে। তারা সব সময় আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমরা অতিক্রান্ত যুগের ধ্যান ধারণা নিয়ে বাঁচতে পারি না। আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে যে, ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘোরানো অবস্তাব, কারণ ইতিহাসের গতি কেউই পরিবর্তন করতে পারে না। অতএব ক্রম পরিবর্তনশীল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সঙ্গে ঈমানকে খাপ খাওয়ানো ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর নেই। শক্তিশালী হওয়ার জন্যে আমাদেরকে কোরআনের চিরাচরিত ব্যাখ্যা বর্জন করতেহবে এবং আধুনিক জীবনের আলোকে যুক্তিসঙ্গতভাবে তা অধ্যয়ন করতে হবে। মুসলিম দেশের সরকারসমূহ নিজেদের লক্ষ্য অনুযায়ী ইসলামের সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। আমরা এখন সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ সুপারিশসমূহ এবং ইসলামী সম্প্রদায়ে তার ফলাফল খতিয়ে দেখব।
সুবিধাবাদের দ্বারা প্রভাবিত দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মযাজকমণ্ডলীর অভিসম্পাতগ্রস্ত বস্তু। আধুনিক শিক্ষিত নেতারা আমাদেরকে খেলাফতের ধারণা সম্পূর্ণ বিলোপ করে ভবিষ্যতে এর পুনরুজ্জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং সরকারকে ‘মধ্যযুগীয়’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। অতএব আধুনিক বিশ্বে স্থান পাওয়ার জন্যে মুসলমানদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সঙ্গে আপোষ করতে হবে। এই যুক্তির সারবত্তা প্রমাণের জন্যে আমাদের সকল অনিষ্টের মূলে খেলাফতকে দায়ী করে মুসলিম পুস্তক [Islam and Principles of govt (Al- Islam wa usul Alhukm) Ali Abd Al Raziq, Cairo, 1925 from here we start (min Huna Nabda) Khalid Mohmad Khalid, Cairo, 1950.] লেখা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে, খেলাফত ইসলামদের অংশ নয় কারণ মহানবীর মিশন ছিল কেবলমাত্র প্রচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি কখনো শাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কেবলমাত্র অপরিহার্য তাকে বাধ্য করেছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছি। ইসলামী সমাজ ছাড়া ইসলাম বাঁচতে পারে না এবং ইসলামী সমাজ সুসংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব নয়।
আমাদের আধুনিক শিক্ষিতরা শরিয়তকে যুগের অনুপযোগী এবং এর বিচার পদ্ধতিকে পশ্চিমা বিচার পদ্ধতির চাইতে নিম্নমানের মনে করেন। তাদের মতে কেবলমাত্র ধর্মনিরপক্ষ আইনই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে। [A Modern Interpretetion of islam, Asat Ali Fyazee, Asia Publishing House, Bombay, 1963.] অবৈধ যৌন সম্পর্ক, মদ্যপান, জুয়া এবং সুদে টাকা ধার দেয়ার জন্যে কোরআন ও সুন্নাহের আরোপিত শাস্তিকে নিষ্ঠুর এবং অমানুষিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আইনের শিথিলতা থেকেই কি তার গুণাগুণ বিচার্য? অপরাধীরা কি সমাজের চাইতেও বেশী সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারী? আইনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ কি শীগগীরই ফাঁকা উক্তিতে পরিণত হয় না?
বর্ণ, ভাষা এবং ভৌগলিক পার্থক্যের উর্ধে ইসলামের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রাধান্যেল সঙ্গে সামাঞ্জস্যহীন। এই কারণে একে বিশ শতকের ধ্যান ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে আমাদের আধুনিক শিক্ষিত নেতারা উম্মতের স্থলে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ [Turkish nationalism and Western civilization. Ziya gokalp, Columbia university Press, New York, 1859.] কে গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। অভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্যের পরিবর্তে আমাদের নেতারা পৌরণিক ঐতিহ্যের ওপর জোর দেন, ভাবখানা এমন যে তা ছিল স্বর্ণযুগ, ইসলাম আমাদেরকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই কারণে তুর্কী জাতীয়তাবাদীরা ওসমানীয় যুগকে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষার আধিপত্য বলে ঘৃলা করেন এবং একই ধ্যান ধারণার বশবর্তী হয়ে রেজা শাহ পাহলভী আর্যসম্প্রদায়ের কথিত আবাসভূমি হিসেবে ‘পারস্যকে’ ইরানে রূপান্তরিত করেন।
আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের আনুষ্ঠানিক অনুবাদের জন্যে অব্যাহত চীৎকারের পিছনেও জাতীয়তাবাদী চিন্তাদারা কাজ করেছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ল্যাটিন হরফ চালু এবং অনারব মুসলিম দেশে আরবীকে অবজ্ঞা করে ইংরেজী ভাষার প্রাধান্য, চলিত ভাষার পরিবর্তে সর্বোকৃষ্ট ভাষা প্রচলনের জন্যে আরব জাতীয়তাবদীদের দাবীকে জোরদার করেছে। এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কোরআনের ভাষাকে ক্রমেই অস্পষ্ট করে তুলছে। আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের অনুবাদ শুধুমাত্র উম্মাৎকেই ধ্বংস করবে না উপরন্তু (খোদা না করুন) মূল পাঠকেও বিকৃত করবে।
প্রতিটি মুসলিম দেশেই যারা কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে থাকেন তারা দুনিয়ার সঙ্গে সকল প্রতিযোগিতার জন্যে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা ভাল মন্দ বিচার না করে আধুনিক সভ্যতার সকল অবদানকে গ্রহণের জন্যে জোর দেন। অন্য কথায় তারা বোঝাতে চান যে, আমাদের সমাজকে শক্তিশালী করতে হলে কোন প্রকার বাছবিচার ছাড়াই জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্যে বিদেশী কারিগরি ‘সাহায্য’ কর্মসূচী, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ণ করে দারিদ্র, রোগ ও নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। যারা মনে করেন যে, আমরা কেবলমাত্র আধুনিক সভ্যতার ভাল দিক গ্রহণ করব এবং খারাপ দিক বর্জন করব তাদের মনে রাখা উচিৎ যে প্রত্যেক সভ্যতারই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কোন সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিককে পৃথক করা যায় না বরং তার একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল।
এই কারণে কোন সভ্যতার বাস্তব সাফল্য তার মৌলিক চরিত্রের প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। আধুনিকতাবাদের শিষ্যরা এতই অর্থনৈতিক বাতিকগ্রস্ত যে, অর্থনীতিই তাদের বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। পরকালকে অস্বীকার করার ফলে মার্কিন এবং ইউরোপীয়রা তাদের সকল প্রচেষ্টা স্বাস্থ্য ও দৈহিক আরাম আয়েসের জন্যে ব্যয় করে। পার্থিক সমৃদ্ধির জন্যে পর্যায়ক্রমে তারা এক্ষে্রে সকল মানুষকে পশ্চাতে ফেলে যায়। ইসলাম সহ অন্যান্য সভ্যতা কখনও এই সাফল্য অর্জন করতে পারে না। এর কারণ নীতিগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অস্বীকার নয় বরং জীবনের অন্যান্য দিককে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেদিকে দৃষ্টি দেয় বলে।
মুসলিম নারী মুক্তিকে সামাজিক অগ্রগতির জন্যে অপরিহার্য [The new woman, Qassim Amin bey, cairo 1901.] মনে করা হয়। নারীত্ববাদীরা নারী মুক্তি বলতে অত্যাধুনিক ফ্যাশন অবলম্বন, ঘরের বাইরে চাকুরী নেয়া, পরিবার ও বাড়ীর সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে জনজীবনে পূর্ণ অংশ গ্রহণকে বুঝিয়ে থাকেন। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি সরকার পাশ্চাত্যের পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণকে উৎসাহিত করেন। তুরস্ক আইনের মাধ্যমে পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এই ক্ষেত্রে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পশ্চিমা পোশাককে প্রগতি ও অগ্রগতির প্রতীক এবং চিরাচরিক পোশাককে পশ্চাৎপদতার চিহ্ন আখ্যায়িত করা হয়। এই পোষাক ক্রমেই গ্রামের গরীব জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মূসলমানিত্বের দৃষ্টিগোচর চিহ্নকে বর্জন এবং ইসলাম বিরোধী সভ্যতার পোশাক, কারুকার্য এবং জীবন পদ্ধতি গ্রহণ স্বধর্ম ত্যাগের নামান্তর। [Islam at the Cross Roads, Mohammad assad, Lahore 1904. Nationalism and India, Maulana Maudoodi, Pathankot 1939] আমাদের মহানবী বেঈমানদের অনুকরণকারীদের নিন্দা করার সময় এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন।
এইভাবে আমরা দেখেছি যে, কেন বিশ শতকীয় প্রেরণার সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। আমরা মুসলমানরা আধুনিক জীবনের সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর যতই চেষ্টা করব ততই দুর্বল হয়ে পড়ব। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয় বরং সময়ের প্রতিকূলে লড়াই করেই আমরা শক্তিশালী ও জোরদার হবো।

 

আধুনিকতার গলদ
মুসলমান জনসমাজে আধুনিকতাবাদী বলতে এমন লোককে বোঝায়, সে হযরত মোহাম্মদ (সা) থেকে আগত এবং সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ইসলামের প্রতি বিরাগভাজন এবং ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার কোন দ্বন্দ্ব নেই বলে প্রমাণে সচেষ্ট হন। নামে মুসলমান হলেও আধুনিকতাবাদী ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার আলোকে ইসলামকে বিচার করেন। ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তার মনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। ইসলামের যা কিছুই ইউরোপীয় আদশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন তাই বাতিল করার পক্ষে তিনি ওকালীত করেন।
“আমরা জানি আন্তর্জাতিক জগৎ, বিশেষ করে পশ্চিমা খৃষ্টীয় জগত আমাদের দেশে কি ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য উৎকষ্টা নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। আমরা এখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাদের বিরাট ভয়; বেঈমানদের বিরুদ্ধে জেহাদ পুনঃপ্রচলন ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্ভাবনাসহ ইসলামী দেশসমূহে আল্লাহতন্ত্র চালূ হবে। যদি আমরা একদিকে পশ্চিমাদেরকে আশ্বাস দেই যে আমরা তাদের বিপদের কারণ হবো না অপর দিকে আমরা দেশে কি করব সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে। [Philososphy and Ideology, Hazi Agus Salim, Former Foreign Minister of Indonesia, The light organ of the Ahmedia movement, Lahore, September 8, 1967.] আমাদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে দেশে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রচলন করতে হবে।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহুর শিষ্য এবং কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর (১৯২৭-২৯/১৯৩৫-৪৫) মোস্তফা আল-মারাগী কতিপয় আমেরিকান মুসলমানদের জন্যে দেয়া এক বার্তায় আধুনিকতাবাদীদের আদশ্য মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,
“এইসব লোক ইসলাম সম্পর্কে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেছেন। আমি আশা করি তারা কখনো ইসলামী দেশ সফর করবেন না এবং আমরা যে কার্পণ্য, অজ্ঞতা, একগুয়ে এবং অনগ্রসরতা প্রদর্শন করি তা দেখতে পাবেন না”। [Quoted from “The Re-Evaluation of Islam in Turkey” Fareed S. Jafri, The pakistan times, Lahore, 1967.]
কানাডীয় একজন মুসলমান একই পুস্তকের সমালোচনা করতে গিয়ে আমার কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতেও একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “আল্লাহ আমাকে একজন ককেশীয়, একজন কানাডীয়, বিশ শতকের একজন মানুষ হিসাবে তৈরী করেছেন এবং তিনি আমাকে মুসলমানও করেছেন। যদি আমি কালো, অপরিচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বেদুঈন হতাম, যারা তাদের পূর্ব পুরুষের ন্যায় বসবাস করে তাহলে মরে যেতাম। যদি ইসলাম পরিপূর্ণভাবে অমুসলিম দেশে টিকে থাকার অযোগ্য হতো, যদি একজন মুসলমান পশ্চিমা হতে না পারতো, আধুনিক অথবা পশ্চিমা আধুনিকতা গ্রহণ করতে না পারতো খৃষ্টীয় পরিবেশে উন্নতি করতে না পারতো তাহলে এই ধর্ম মরুভূমির বাসিন্দাদের জন্যেই উপযুক্ত হতো- যেখান থেকে তার আবির্ভাব ঘটেছে”।
আধুনিকতাবাদীরা শুধু জোরের সঙ্গে নিজেদের মুসলমানিত্ব প্রচার করেই ক্ষ্যান্ত হয় না উপরন্তু নিজেদেরকেই সর্বোত্তম এবং সত্যিকার মুসলমান বলে দাবী করে। তাদের বিরোধিতাকারীদের প্রতিক্রিয়াশীল একগুয়ে অথবা অসংস্কৃত বলে আখ্যায়িত করে। তাদের মধ্যকার আদর্শবাদী এবং উচ্চমনারা বিভ্রান্তি প্রচার করে বেড়ান যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতার আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা করে কেবলমাত্র তারাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। জীবন সম্পর্কে দুটি বিরোধী দর্শনের দুঃখজনক সংঘর্ষের সমাধান করতে গিয়ে তারা অসামঞ্জস্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধরে আত্মপ্রবঞ্চনায় অস্বাভাবিক মাত্রায় মেতে উঠেন। পাঠকদের আধুনিকতাবাদীদের সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়ার জন্য ইসলামের ইতিহাসের বহুল অপব্যাখ্যার কিছু নজির তুলে ধরা হলো।
১। আধুনিকতাবাদীদের মতে আমাদের মহানবী ও খেলাফতের সময় ইসলাম ছিল খুবই উদার, প্রগতিশীল এবং যুক্তিনির্ভর ধর্ম। কিন্তু আমাদের ইমাম, কাজী, ঐতিহ্যবাদী ও ধর্মতত্ববিদদের হাতে ইসলাম সেকেল অযৌক্তিক, সংকীর্ণ, অচল ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে, যা আমাদের বর্তমান দুর্বলতা এবং অবমাননার জন্যে দায়ী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিকতাবাদীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুসলিম বিশ্বের সকল অনিষ্টের মূলে রয়েছে উলেমা এবং ধর্মীয় পন্ডিতেরা। তাদের একজন লিখেছেন, “সৌদী আরব থেকে মৌরিতানিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম দেশের জনগণ আজ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। মোল্লারা এই অবনতির জন্যে পশ্চিমা প্রভাবকে দায়ী করবেন। তারা ভুলে যান যে, যে সব যায়গায় এখনও পশ্চিমা প্রভাব পড়েনি সেখানেও ইসলামের করুণ অবস্থা দৃষ্টি গোচর হয়। তারা কি এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন যে, পশ্চিমা প্রভাব যেখানে যায়নি সেগুলোই হচ্ছে সব চাইতে খারাপ এবং পশ্চাৎপদ এলাকা।
অপরদিকে সেখানে শতাব্দী ধরে মোল্লারা ধর্মীয় কর্তৃত্বের অপব্যবহার করে আসছে। এটা তাদের জন্যেই হয়েছে যারা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামকে অবাধে মিশে যেতে না দিয়ে নিশ্চল করে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের সকল দুযোর্গ থেকে মুক্তির জন্যে আমাদেরকে যুক্তি মানেন না এমন লোকদের দেয়া কোরআনিক ব্যাখ্যা ভুলে যেতে হবে। যখন আমরা নিজেরা কোরআন বুঝতে চেষ্টা করব, তখন আমরা ইসলামকে রক্ষা করতে পারব, আমাদের নারীদেরকে ১৪শ’ বছরের অবমাননা থেকে রক্ষঅ করতে পারব এবং আমরা তাদেরকে স্বাধীনতা ও সাম্যের রাজপথে দাঁড় করাতে পারব। প্রেমের দ্বারা ধর্মের অনুশীলন চলবে, জোর করে নয়। জীবন একঘেয়েমী মুক্ত হবে, প্রার্থনার সঙ্গে খেলাধূলাও চলবে এবং আমরা স্বচ্ছ হীরার ন্যায় ইসলামের মর্মাথ উপলব্ধি করব। [The need for Re-Evalution of Islam in pakistan, Fareed S. Jafri. Pakistan times, Lahore, August 11, 1967.]
অপর কথায় আমাদের প্রিয় নবীর জীবদ্দশা থেকে এখন পর্যন্ত মুসলমানরা ইসলামের সম্পুর্ণ ভুল ব্যাখ্যঅ করছেন। কেবলমাত্র তখনকার পশ্চিমা সভ্যতায় প্রভাবিক আধুনিকরা সত্যিকার অর্থে ইসলামের সঠিক জ্ঞান লাভ করেছেন। বোখারী, মুসলিম, আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালিক, আহামদ ইবনে হাম্বল, আল-গাজ্জালী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত যুক্তিহীন পন্ডিতেরা সবাই ভুল করেছেন এবং যতদিন মুসলমানেরা এদেরকে শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে মেস্তফা কামাল আতাতুর্কের মত লোককে শ্রদ্ধা করতে না শিকে ততদিন আমাদের মুক্তি নেই।
২। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংঘাতময় ইসলামের এমন সব চিরন্তন নীতি ও আইন কানুন পৃথক করে নিতে হবে। এগুলো নবীর যুগের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে ছিলো যা আমাদের মত অগ্রসর সমাজের জন্যে অবান্তর এবং অযোগ্য, সুতরাং এগুলো বাদ দিতে হবে। এমন কি নামাজ, রমজানের মাসে রোজা, যাকাত এবং হজ্বের মত প্রশ্নাতীত অপরিহার্য এবাদও এমন শিথিল ও নমনীয়ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে এগুলো পালনের বাধ্যবাধকতা না থাকে।
৩। মধ্যযুগের ইউরোপের সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানদের এতই উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে যে তাদের ছাড়া আজকের আধুনিক সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হতো না। অপর কথায় ইসলাম ছিল পশ্চিমা সভ্যতার জনক। পশ্চিমা সভ্যতা তারই নীতি ও মূল্যবোধের আরও উন্নত সংস্করণ। যদিও মুসলমান নামধারী নয় পম্চিমা সভ্যতার অনুসারীরা মুসলমানদের চাইতেও সত্যিকার ইসলামী প্রেরণায় উজ্জীবিত। এই কারণে মুসলমানেরা আধুনিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে প্রকৃত উত্তরাধিকার ফিরে পেতে পারে।
আমাদের মহানবী এবং তার সাহাবীদের উদারতা প্রগতিশীল মনোভাবের উচ্ছাসিত প্রশংসা করে এরা এমন ভাব দেখায় যে, তারা ইসলামের কোন একক দিক নয় বরং তাদের কাংখিত উপায়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামই তারা পেতে চায়। সীমাহীন খোদা ভীতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিতকারী আমাদের ইমামদের সম্পর্কে তাদের আত্মপ্রাসাদপুর্ণ অনুমান আমাদের লোভের কারণ। তারা ইসলামেরে যে ব্যাখ্যঅ করেছেন নাস্তিক ও বস্তুবাদী লোকদের ব্যাখ্যাকে তার চাইতে উন্নত জ্ঞান করে আধুনিকতাবাদীরা ইসলাম ভক্তির কি হাস্যকর পরাকাষ্ঠই না দেখান।
ইসলামের চিরন্তন পবিত্র নীতির প্রতি তাদের কপট ভক্তি শ্রদ্ধা অবিশ্বাস ও সরাসরি অস্বীকারকে গোপন করারই হীন প্রচেষ্টা মাত্র। সুযোগ পেলে তারা কোন কিছুই বাদ দিতেন না। আধুনিকতাবাদীদের মতানুযায়ী স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের যদি স্বাভাবিক অস্তিত্ব না থাকে এবং জোর করে ভিন্ন মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ছাড়া যদি নিজস্ব কোন গুণাগুণ না থাকে তাহলে ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ বা আদো মুসলমান থাকার কোন প্রয়োজন আছে কি?

 

ইসলাম ও সমসাময়িক বিরুদ্ধ মতাদর্শ
‘বিরুদ্ধ মত’ শব্দটা আজ এতই অপ্রিয় যে, যে কেউ কোন ব্যক্তি বা ধারণার বিরুদ্ধে তাকে আনতে চাইলে আমাদের ‘আলোকপ্রাপ্ত উদার নীতিকরা’ তাকে গোঁড়া এবং ধর্মোম্মাদ বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাচীন ধর্মমতের আমন্ত্রণকে যতই গালাগাল দেয়া হেকা না কেন যেখানে তার আমন্ত্রণ অপরিহার্য এবং যুক্তিসংগত সেখানে তার আগমন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। খৃস্টান মিশন এবং পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা আমাদের জন্যে জোড়াতালি দেয়া নতুন ধরনের ইসলাম চালুর প্রচেষ্টায় আমাদের দেশয়ি আধুনিকতাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন করেন।
ডঃ কেনেথ ক্র্যাগ তার ‘কল অফ দি মিনারেট’ এ বলেছেন, “ইসলামের আবির্ভাবকালে অনৈসলামী ভাবধারা প্রতিরোধে রক্ষণশীলরা তত্বগত দিক থেকে সঠিক ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। ওহি থেকে সৃষ্ট মুসলিম আইনের ভিত্তি প্রয়োগের উপযোগী, পরিণামদর্শী এবং সাংসারিক বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিল, সহস্রাধিক বছর পরে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিচু সংশোধন, প্রতিযোজন এবং পরিবর্ধন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আধুনিক মন যখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ইসলামের প্রকৃতির খৃষ্টীয় পরিবর্তন বা জীবনে তার প্রযুক্ততা অস্বীকার করার ব্যাপারে সর্কতা প্রকাশ করে তখন তারা সঠিক পথে চলে।
অতএব আমাদেরকে (খৃষ্টান মিশনারী) সহানুভূতির সঙ্গে ইসলামকে সত্যিকার গণতন্ত্র, সঠিক সমাজতন্ত্র, নির্দোষ পুঁজিবাদ এবং স্থাযী শান্তির সমপর্যায়ে দেখতে প্রস্তুত থাকতে হবে। লর্ড ক্রমারের বিখ্যাত এবং বেকুবী ধারণা ‘সংস্কার হলে ইসলাম থাকে না’ এই মন্তব্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। আমরা চাইনা এবং তা ঠিকও নয় যে এক কালে ইসলাম যেভাবে ছিল এখনও সেইভাবে অবিকৃত থাকবে”।
এর অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশীয় আধুনিকতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও বস্তুবাদের সঙ্গে ইসলামকে জোর করে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে খৃষ্টান মিশন এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করছেন। বস্তুতঃ তারা ওদেরই দায়িত্ব সম্পাদনের ঠিকাদারী নিয়েছেন।
ইসলাম প্রিয় প্রতিটি পণ্ডিতের দায়িত্ব হচ্ ইসলামের নিরঙ্কুশ আবহমানতা, সার্বজনীনতা, চূড়ান্ত আত্মনির্ভর ও মানব রচিত আদর্শ থেকে তাকে স্বাধীন রাখার জন্যে সর্বসম্মত প্রচেষ্টা চালানো। কোরআন এবং সুন্নাহর বর্ণিত বৈশিষ্ট্রের যথার্থ হেয় করার যে কোন প্রচেষ্টা প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী হিসেবে সরাসরি প্রত্যাখ্যঅন করা উচিৎ। উম্মাতের মতবিরোধ পরিহার করার জন্যে বিরুদ্ধ মতবাদকে ব্যক্তিগত বা দলের পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিৎ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি নিজেকে উম্মাতের অংশ জ্ঞান করেন এবং আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের (সা) শেষ নবুয়তকে প্রকাশ্যে অস্বীকার না করন তাকে আমরা উম্মতের বহির্ভূত করতে পারি না। কোন ব্যক্তির চূড়ান্ত বিচারের ভার আল্লাহর হাতে। অবশ্য একটি আধুনিক ইসলাম বিরুদ্ধ আন্দোলনকে শীগগীর নিন্দে করা হলে সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে আমাদের বংশধরদের মধ্যে কোন সন্দেহ দানা বেঁধে উঠতে পারবে না। এই ধরনের সিদ্ধান্তে বিলম্ব ইসলামের কোন নির্ধারিত শিক্ষা নেই এবং তা মুসলমান নামধারী শাসকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল- এই ধারণাকেই জোরদার করবে।
আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সবচাইতে অশুভ প্রচেষ্টা হচ্ছে আধুনিক চিন্তার আলোকে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা। তাদের মনোমোহিনী সঙ্গীত হচ্ছে ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামকেও পরিবর্তন করতে হবে’। ‘প্রগ্রতি’তে এরা এতই আচ্ছন্ন যে, যে কোন মামুলি পরিবর্তনকেই তারা বিরাটগুণ মনে করেন। তারা কখনো ভাবেন না যে এই পরিবর্তন আমাদের কল্যাণ কি অকল্যাণ আনছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামের পরিবর্তন করতে হবে তাতে যে ক্ষতিই হোক না কেন। তাদের দৃষ্টিতে একমাত্র গুণ হচ্ছে বাতাসের অনুকূলে ভেসে যাওয়অ। কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বড় কথা নয়।
পশ্চিমারা যদি গান, নাচ, ছবি এবং মূর্তি ভালবাসে তাই সত্যিকার (?) ইসলামী এবং মুসলমানদেরকেও তা করতে হবে। পুঁজির সুদ যদি আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি হয় অনগ্রসরতা ও অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠে প্রগতিশীল ও আধুনিক হওয়ার জন্যে মুসলিম দেশেও তা চালূ করতে হবে। সর্বাধুনিক ফ্যাশন যদি আধুনিক জীবনের প্রবণতা হয় তাহলে তাকে ইসলামী পোষাক ঘোষণা করে আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। খৃষ্টান মিশনারীরা যদি পর্দাকে তথাকথিত নারী অবনতি ও হীনমন্যতার প্রতীক আখ্যায়িত করে নিন্দে করে, ইউরোপ ও আমেরিকার মত নারী মুক্তির সহায়তা করার জন্যে আমাদেরকে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
আধুনিকতাবাদীরা যদি বহুবিবাহ এবং তালাকের সাহায্যে বিবাহ বিচ্ছেদকে অসহনীয় অন্যায় বলে, তাহলে আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রগতিশীল হওয়ার জন্যে মুসলিম বিশ্বকেও সেই ভাবে মুসলিম পারিবারিক আইনের পরিবর্তন করতে হবে। ডঃ কেনেথ ক্রাগ লিখেছেনঃ “সাদারণভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, সমান আচরণের শর্তে চার স্ত্রী গ্রহণের কোরআনিক অনুমতি প্রকৃতপক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা। বাইবেলের সমালোচনায় যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন, ফলাফল খুবই কাঙ্খিত।
ডঃ কেনেথ ক্র্যাগ এবং আগ্রহীদের জন্যে এটি কাঙ্খিত। এই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তিতে কতখানি বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা এবং কপটতা আছে তাতে কিছু এসে যায় না। লক্ষ্যই কার্য পদ্ধতির যথার্থ নির্ণায়ক।

 

স্যার সৈয়দ আহমদ খানঃ মুসলিম বিশ্বের আধুনিকতার অগ্রদূত
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালের ১৭ই অক্টোবর দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে গড়ে উঠেন। তিনি প্রাচীন ও চিরচরিত ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করেন। তবে আরবী এবং ফার্সীর ব্যাপারে এতই অসহিষ্ণু ছিলেন যে, যখনই পেরেছেন তা পরিহার করেছেন। যৌবনকালে তিনি অবাধ জীবন যাপন রেছেন এবং নাচ গানের উৎসবে খুবই ঘনঘন যাতায়াত করতেন। ১৮৩৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীতে চাকুরী নেন। যথা নিয়মে বিভিন্ন শহরে তিনি সাবজজ নিযুক্ত হন।
উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি যৌবনের বেখেয়ালী অবস্থায় অর্জিত সামান্য ইসলামী জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তার সময়ের খ্যাতনামা পণ্ডিতদের কাছে অধ্যয়ন শুরু করেন। অবসর সময়ে নবীর জীবনীসহ কয়েকটি ধর্মীয় পুস্তিকা রচনা করেন। এগুলোতে ধর্মীয় গোঁড়ামী থাকলেও বিষয়বস্তু এবং সাহিত্যিক মানে ছিল খুবই সাধারণ।
১৮৪৭ সালে ‘দিল্লীর বিখ্যাত জনগণ ও স্মৃতিস্তম্ভে’র ইতিহাস Athar al sanadid প্রকাশ করে স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। এ ঐতিহাসিক কাজে পাণ্ডিত্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় লেখায় তার পাণ্ডিত্যের দৈন্য খুবই সুস্পষ্ট হয়েছিল। এটি ১৮৫৪ সালে পুনঃমুদ্রিত হয় এবং বহুবছর পরে ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়। ১৮৬৩ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান লণ্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির অবৈতনিক সদস্যপদ লাভ করেন। এই বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে উর্দু কবি গালিব মন্তব্য করেছেন যে, সৈয়দ আহমদ খানের উচিৎ ভারতে ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে ইংরেজী সংস্কৃতি অধ্যয়নে আত্ননিয়োগ করা। আমরা এখন দেখতে পাব কত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি এই উপদেশ গ্রহণ করেছিলেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে ভারতে বৃটিশ রাজত্ব থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, ভারতের মুসলমানদের মুক্তির পথ হচ্ছে বৃটিশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা এবং তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করা। তিনি নিজেকে স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারী করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, ধর্মীয় কারণে মুসলমান এবং খৃস্টানদের শক্রতা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কারণ বিশ্বের সকল ধর্মের চাইতে খৃস্টান ধর্ম এবং তার প্রবর্তকের প্রতি মুসলমানদের সর্বাধিক শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি ইংরেজেদের আশ্বাস দিলেন যে, ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, “আল্লাহর ইচ্ছায় যদি আমরা কোন জাতির অধীনস্থ হই এবং তারা যদি ভারতে বৃটিশের ন্যায় আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়, ন্যায়ের সঙ্গে শাসন করে, দেশে শান্তি বজায় রাকে এবং আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা ও সম্পত্তির প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়, আমরা তাদের আনুগত্য করতে বাধ্য”।
ইসলামকে রাজণৈতিক গোলামীতে রাখার ব্যাপারে আপোষ করতে গিয়ে তিনি ঈসা (আ)-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, মিশরের ফেরাউন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার আনুগত্য করেছেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার উৎসাহে তিনি বৃটিশ সরকারের অধীনস্ত মুসলিম কর্মচারীদের জন্যে সরকারী বিশেষ নির্দেশ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। “আমি এতে সমদর্শী ও নিরপেক্ষ বৃটিশ সরকারের পুরস্কার ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করব, যাতে ভারতের সকল মুসলমান এটা পড়ে আমাদের দয়ালু সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে”। [Reforms and religious ideas of Sir Sayyid Ahmed Khan J. M. S. Beljon, Nd. Ashraf. Lahore. P-2.]
মুসলমানদের ইংরেজী সংস্কৃতি প্রীতি বাড়ানোর জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সামাজিক ব্যবধান দূর করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। এই সময় তিনি খৃস্টানদের সঙ্গে একই টেবিলে মুসলমানদের খাওয়া আইনসঙ্গত ঘোষণা করে তার বিখ্যাত ফতোয়া জারী করেন। এই ধারনার প্রতি মুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্যে তিনি কোরআনের ঐ সব আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে আহলে কিতাবদের খাদ্য মুসলমানদের জন্যে জায়েয। কিন্তু ধর্মীয় আচার অনুসারে হারাম গোস্তের প্রশ্ন দেখা দিলে তিনি দারুণ অসুবিধায় পড়েন। তিনি সন্দিগ্ধ হাদীসের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, জবাই না করা জন্তুর গোস্তও মুসলমানেরা খেতে পারে।
১৮৬৯ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ ইংল্যান্ড সফররের সিদ্ধান্ত নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ শক্তির উৎসের সন্ধান লাভ করে তার দেশবাসীকে একই পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ভারতের মুসলমানদের চাইতে ইংরেজদের শুধু শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে নয় বরং সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রাধান্য লক্ষ্য করে অভিভূত হয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালের ১৫ই আক্টোবর লণ্ডন থেকে বাড়ীতে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, ইংরেজদের চাটুকারীতা না করেও আমি বলতে পারি ভারতের বাসিন্দা উচ্চ কিংবা নীচ, ব্যবসায়ী কিংবা ছোট দোকানদার, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ইংরেজদের সঙ্গে শিক্ষা আচার ব্যবহার এবং সততার দিক থেকে তুলনায় সক্ষম সুন্দর মানুষের কাছে ক্লেদাক্ত জন্তুর মত। ভারতের অধিবাসীদের পুরুষত্বহীন নিবোর্ধ ভাবার ইংরেজদের যুক্তি আছে। আমি যা দেখেছি এবং প্রতিদিন যা দেখি কোন কোন ভারতীয়ের পক্ষে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। ‘মোহাম্মদী’ সম্প্রদায়ের চতুর্দিকে আত্মপ্রসন্না স্বজাত্যের মারাত্মক আবরণ রয়েছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের পুরনো কাহিনী স্মরণ করে এবং ভাবে যে, তাদের মত কেউই নেই। মিশর এবং তুরস্কের ‘মোহাম্মদী’রা দিন দিন সভ্য হচ্ছে। এখানকার মত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষত করা না গেলে ভারতীয়দের পক্ষে সভ্য এবং সম্মানিত হওয়া অসম্ভব।
স্যার সৈয়দ আহমদ প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, আধুনিকতার পরিপন্হি প্রাচীন আচার-আচরণ পরিহার করা হলে মানবতা, সভ্যতা ও অগ্রগতির বাহনরূপী সত্যিকার ধর্মে ইসলামকে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
মুসলমানদের মধ্যকার আধুনিকতাবাদীদের উন্নতির জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৮ সালে আলিগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, আরবী ফার্সী, উর্দু অথবা যে কোন ভারতীয় ভাষার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে অসন্দিগ্ধ হয়ে তিনি ইংরেজীকেই শিক্ষার একক মাধ্যম করার ওপর জোর দেন। ১৯২০ সালে আলিগড় স্কুল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হয়।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান আধুনিক আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের অগ্রদূত। আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কিছু বক্তব্য নিম্নরূপঃ
১। বহু বিবাহ ইসলামের প্রকৃতি বিরুদ্ধ, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এর অনুমতি দেয়া উচিৎ নয়।
২। ইসলাম দাসপ্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে এমন শরিয়তের অনুমোদন প্রাপ্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসত্ব করানো যাবে না।
৩। আধুনিক ব্যাংকিং, বাণিজ্যিক লেন দেন, কর্জ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রাভৃতিতে যে সুদের ব্যবস্থা আছে তা ঠিক রিবার (সুদের) ব্যাখ্যার আওতায় পড়ে না, অতএব তা কোরআনী আইনের বিরুদ্ধে নয়।
৪। কোরআন এবং সুন্নাহ চুরির জন্যে হাতকাটা, ভেজাল দেয়ার জন্যে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা এবং অবিবাহিত যুবক-যুবতীর যৌন সংসর্গের জন্যে যে একশ বেত্রাগাতের শাস্তি বিধান করেছে তা বর্ববতার পরিচায়ক এবং প্রাথমিক যুগে যখন জেল ছিল না কেবলমাত্র তখনকার জন্যে তা প্রযোজ্য ছিল।
৫। আত্মরক্ষার অন্তিম প্রয়োজন ছাড়া জেহাদ নিষিদ্ধ।
স্যার সৈয়দ আমহ খান ইসলামের একমাত্র সত্য জিনিস বিবেচনা করেছেন উনিশ সতকের বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদের সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য বিধান। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, ধর্ম যদি মানব প্রকৃতি বা সাধারণ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ণ হয় তবেই তা সত্য হতে পারে। ইসলাম বিজ্ঞান এবং যুক্তিভিত্তিক ধর্ম প্রমাণ করার জন্যে তিনি ভাগ্য, ফেরেশতা, জ্বিন, কুমারীর গর্ভে হযরত ঈসার (আ) জন্মকে অস্বীকার করেছেন, নবীর (সা) মিরাজে গমনকে একটা সাধারণ স্বপ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং শেষ বিচারের দিনে স্বশরীরে উপস্থিতি, বেহেশত দোজখ প্রভৃতিকেও অস্বীকার করে বলেছেন এগুলো শাব্দি অর্তে গ্রহণ না করে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা উচিৎ। তিনি ওহি নাজিলের মত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়কেও মানসিক অসুস্থতাজনিত মতিভ্রমের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের ওহি বিহীন ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে খোদাকে বিশ্বাস করেছেন। তার মতে খোদা নির্জন এবং সম্পূর্ণ বস্তুনিরপেক্ষ। প্রকৃতির বিদান অপরিবর্তনীয়। এমনকি খোদাও তা পরিবর্তন করতে পারেন না। সুতরাং তার কাছে প্রার্থনার কোন মানে নেই। এ ধরনের নিষ্প্রাণ ও নৈর্ব্যক্তিক দেবতার প্রতি আমাদের কোন আগ্রহই থাকতে পারে না।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতে কোরআন এবং সুন্নাহর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কোরআন এবং হাদীসের যেসব আয়াতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কথা-বার্তা বলা হয়েছে সেগুলো নবীল যুগের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য ছিল। আমাদের মত আলোকপ্রাপ্ত আধুনিক সভ্যতার জন্যে তা সম্পূর্ণ অনুপযোগী। অতএব মুসলমানরা যদি ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি হিসেবে অনুসরণ না করে তাহলে পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণে কোন বাধা নেই।
এটা সুস্পষ্ট যে, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনে কোন আগ্রহ ছিল না। তার সম্পর্কে এতটুকু বলা যায় যে, তিনি ভারতের মুসলমানদের সামাজিক এবং আর্থিখ কল্যাণ চেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল পার্থিব অগ্রগতির মাধ্যমেই তারা উন্নতি করতে পারবে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যে, ইতিহাসে কোন জাতিই এমনকি বস্তুগত দিক থেকেও বিদেশী শাসনাধীনে উন্নতি লঅভ করতে পারেনি। মীর্জা গোলাম আহমদ (১৮৩৯-১৯০৮) বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার মনিবের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন, বৃটিশ শাসনের জন্যে এক ফোটারক্তদানকে খুবই অপরিহার্য ঘোষণা করে। অপরদিকে জেহাদকে একটি অপরাধ হিসেবে নিন্দা করে তিনি বস্তুত স্যার সৈয়দ আহমদের ধারণাই সমর্থন করেছেন।
ভারতে নির্বাসনকালে জামালুদ্দিন আফগানী (১৮৩৮-৯৭) স্যার সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি তার Al- Urwah Al- Wuthqz গ্রন্হে লিখেছেন, “ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মুসলমানদেরকে চরিত্রহীন করার জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খানকে উপযুক্ত পাত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন, এ জন্যে তারা তাকে প্রশংসা ও সম্মান করতে শুরু করলেন এবং আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করলেন এবং এটাকে মুসলমানদের কলেজ আখ্যায়িত করলেন, যাতে ঈমানদারদের সন্তানদের আকৃষ্ট করে তাদের মধ্যে নাস্তিকতা প্রচার করা যায়। বস্তুবাদী স্যার সৈয়দ আমহদ খান ইউরোপের বস্তুবাদীদের চাইতেও জঘন্য, কারণ পশ্চিমা দেশে যারা ধর্ম ত্যাগ করে তারা দেশপ্রেম ত্যাগ করে না এবং পিতৃভূমিকে সমর্থন করার উৎসাহ হারায় না। অপরদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং তার বন্ধুরা বিদেশী স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন”। [The refroms and religious Ideas of Sir Sayyid Ahmed Khan, op. cit, pp 117-119.]
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পরবর্তী পশ্চিমানুসারীদের ওপর তার প্রভাব অস্বাভাবিক নয়। তার আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বক্তব্য আজও বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসৃত হয়। আমীর আলী, চিরাগ আলী, খুদা বকশ, গোলাম আহমদ পারভেজ, খলিফা আবদুল হাকিম এবং কাদিয়ানী আন্দোলনের মাওলানা মোহাম্মদ আলী লাহোরী তার বক্তব্যই পুনরাবৃত্তি করেছেন। এখন পর্যন্ত তাদের নতুন কোন বক্তব্যই নেই।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি