বিষয়সূচী
গ্রন্থকার পরিচিতি
উপক্রমণিকা
প্রথম অধ্যায়
আমার পরিচয়
শহর থেকে গ্রাম
জাঁকজমকপূর্ণ অট্টালিকা
পিতামহের জায়গীরসমূহ ও তার শাহী মেজাজ
পূর্বপুরুষের দেশ আলজেরিয়া
মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহাবের সাথে সম্পর্ক
শিক্ষা জীবনের সূচনা
কল্পনার জগতে বিচরণ
সহজাত প্রবণতা
কব্য ও কবিত্ব এবং সাহিত্য ও সংগীত
দ্বীনী জ্ঞান চর্চার দিকে প্রত্যাবর্তন
আল্লাহর সন্তুষ্টি
সিনেমা দেখা
আদরের দুলাল
জাতীয় মর্যাদাবোধ
গ্রাম থেকে শহরে
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
বি. এ. ডিগ্রী লাভ
মুষ্টিযুদ্ধ
কঠোর তত্বাবধান
বিবাহ বন্ধন
আদর্শ জীবন সংগিনী
সতী সাধ্বী স্ত্রী ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বামী
যুবক যুবতীদের প্রতি উপদেশ
আইনের পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা
আদর্শ শিক্ষকমণ্ডলী
মহিলাদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভংগী
ভুল বুঝাবুঝির অবসান
প্রাচীন প্রতিনিধিত্ব
ইনসাফের দাবী
আইন ব্যবসা শুরু
সততা ও দ্বীনদারী
নির্বাচনে অংশগ্রহণ
আত্মপ্রচার বিমুখতা
দ্বিতীয় অধ্যায়
ইবরাহীম আবদুল হাদীর নির্যাতন
বর্বরতা ও পাশবিকতার প্রতীক নাসের
শিক্ষালাভের জন্য দর্শন
পিস্তলের নল
উজীর আযমের প্রতিক্রিয়া
ইমাম হাসানুল বান্নার শাহাদাত
বায়ুমান যন্ত্র মোরগ
এই মহত্ব নীচতা
ফেরেশতা থেকে শয়তান
বিপ্লবের প্রাথমিক গতি-প্রকৃতি
রাজনৈতিক উপলব্ধি
সংবাদপত্র পাঠ
আলো ছায়া
জনসাধারণের রেফারেন্ডাম
আইন কলেজের শিক্ষা সমাপণী
যৌবন কাল ও দুরন্তপনা
আইন কলেজের মর্যাদা
সাহিত্য রসিকতা
অবসর গ্রহণ ও অধ্যয়ন
দ্বীনি বই-পুস্তকের প্রতি অনুরাগ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুরুচি
চুপ থাকাই কল্যাণকর
হালাল রিযিক
সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রলোভন
ওকালতির পেশা একটি প্রশস্ত ময়দান
দ্বীনের দাবী
তৃতীয় অধ্যায়
নির্বাপিত প্রেমাগ্নি আলোহীন
কালের দুর্যোগ ও সময়ের দুর্বিপাক
তুমিই বলো এ কেমন কথা
ইখওয়ানে যোগদানের পর
ঘৃণা ও ভালবাসা সবই একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে
আমার কর্মপন্থা আমীরি নয় ফকীরি
গ্রন্থকীট নয় গ্রন্থকার
আমীর-উমরাহ ও মন্ত্রীর দরবারেও বে-নিয়াজী
সত্য পথের আহবায়ক আল্লাহর দ্বারের ভিক্ষুক
মঙ্গলবারের দরস ও উহার প্রেক্ষিত
দরবেশের দরবার
চতুর্থ অধ্যায়
মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সাথে স্মরণীয় সফর
বায়ুর গতি নির্ণয়ক যন্ত্র
এখানে হতাশার কোন স্থান নেই
নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ
আদর্শ সমালোচনা
সহিত্য সমালোচনা
পঞ্চম অধ্যায়
আকীদাগত কারণে ইসরাঈলের সাথে শত্রুতা
ক্যম্প ডেভিড চুক্তি
ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক
ষষ্ঠ অধ্যায়
কচিকাচাঁদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা
পরিবর্তনের সূচনা
কুরআন ও তলোয়ার
ইখওয়ানের প্রতি অপবাদ
দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার
ইউনিভারসিটিতে দাওয়াতের কাজ
সাংবাদিকতার জগতে ইসলামী আন্দোলন
সংগঠন শামিল হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়
ইখওয়ানের সংগঠনভুক্ত ও দলবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য
নামকরণ
সপ্তম অধ্যায়
ইখওয়ানের প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহ
কুরআন এবং তলোয়ার
শান্তির শ্লোগান ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর আদর্শে
উৎসর্গীত আমার পিতা-মাতা
তরবারী ধারণকারী বাহু
পরাজয় আমাদের ভাগ্যলিপি নয়]
কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত থাকবে
ভিত্তিহীন অভিযোগ
ইখওয়ানের দাওয়াত শরীয়তের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন
অষ্টম অধ্যায়
মহান সন্তানের পরাজয়
মু’মিনগণ একে অপরের ভাই
তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী
ইখওয়ানের ফিকহী দৃষ্টিভংগী
ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার
করণীয় কি?
ইসলামী শিক্ষা ও তার প্রভাব
একটা মজার ব্যাপার
ধূমপান বর্জন
প্রশংসনীয় নৈতিক চরিত্র
অদম্য সাহস থাকলে পাথরও পানির মত মনে হয়
মু’মিনের আসল সম্পদ ঈমান
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা
নাহাস পাশা ও ইংরেজদের রক্তচক্ষু
মতবিরোধের অধিকার
হাসানুল বান্না এবং হাসান আল হুদাইবি
মানুষ হচ্ছে খনি সদৃশ
দাওয়াতে হকের আলোচনা
জিহাদের প্রকারভেদ
নবম অধ্যায়
দুটো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ
স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করণের উদ্দেশ্য
জেলখানার মধ্যে মজার কুস্তী
কারাগারের দারোগাগণ
অত্যাচারীদের পরিণাম
দৃঢ় সংকল্প অথবা অনুমতি
গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা
অতীত গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
মৌলিক ও সাধারণ উদ্দেশ্যাবলী
মু’মিনসলভ বিচক্ষণতা
এই বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণের কঠোর হস্তক্ষেপ রহস্যময়
জুলুমের দানব ও ধৈর্যের পাহাড়
নিম্নে পতিতদেরও নিম্নতম
অবশ্যই আখেরাতের আযাব খুবই অপমানকর
প্রীতি ও সৌহার্দ্যের শাহাদাতগাহ
মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতি
ইমাম শহীদের পয়গাম
ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
শক্তি অর্জন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
সব সংশয়ের সমাধান এবং সব জটিলতার চাবিকাঠি
ব্যাপকভিত্তিক ঘোষণাপত্র ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচী
আল্লাহর আইন
মুসলিমদের ইসলাম বিচ্যুতি
আমাদের হাতিয়ার
মুসলিম উম্মাহর নিকট আমাদের নবী
বিপর্যস্ত ও ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করণ
ব্যথার উপশম
নাহওয়ান নূর’ পুস্তিকা
ইমাম হাসানুল বান্নার দ্বিতীয় পুস্তিকা
ইখওয়ানের দৃষ্টিতে সমাধান
জাতিসমূহের উত্থান ও পতনের রহস্য
সৌভাগ্যের দিন
মুসলিম উম্মাহর সার্বিক ঐক্যের মূল উৎস
রাজনৈতিক দলসমূহ ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
বিশ্বজনীন ইসলামী আন্দোলন
মিসরীয় যুবসমাজ ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন
নিশ্চয়ই তোমাদের এ উম্মাত একই উম্মাতের অন্তর্ভূক্ত
আমাদের দাওয়াত পূর্ববর্তীদের দাওয়াতের নতুন সংস্করন
শত্রুর সাক্ষ্য
বাইয়াতের তাৎপর্য
সংস্কারের পর্যায়সমূহ
জিহাদের সংজ্ঞা
অনুকূল ও প্রতিকূল সর্বাবস্থায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-ই উদ্দেশ্য
ইতিহাস ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিসমূহ
ফুৎকারে এ প্রদীপ নির্বাপিত করা যাবে না
ভূপৃষ্ঠে আমাদের স্থায়ীত্ব প্রতিষ্ঠিত
হত্যার চক্রান্ত
নেতার আনুগত্য
ইবলীস ও তাঁর পরামর্শ সভা
প্রদীপ্ত সূর্য ঢাকা পড়লো অন্ধকারে
মজলুমের আর্তনাদ
অত্যাচারীকে অবকাশ দেয়ারও তাৎপর্য রয়েছে
দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’ম এর নির্বাচন
মুর্শিদে আম হাসান আল হুদাইবির ব্যক্তিত্ব
প্রথম ও দ্বিতীয় মুর্শিদে আ’মে-এর ব্যক্তিত্বের তুলনা
দৃঢ়তার পাহাড়
নতুন ফাঁদে পুরাতন শিকারী
এ সংগীত বসন্তের মুখাপেক্ষী নয়
শকুনী ও বাজপাখীর জগত এক নয়
দশম অধ্যায়
আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা দাতা
সর্বক্ষণ বেগবান
সসম্মানে মুক্তিদান
নাসেরকে কাফের ঘোষনা করার ব্যাপারে হাসান
আল হুদাইবির ভূমিকা
জামায়াতুল তাকফীর ওয়াল হিজরাহ
সা’দাত কর্তৃক আলোচনার আহবান ও তার ফলাফল
সম্ভাবনাসমূহ
ইখওয়ানের লিখিত ভূমিকা
ইখওয়ানের গুরুত্ব ও দেশপ্রেম
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত
রাটনো নির্দেশ
আমীরুল উমারা
মিথ্যার কোন ভিত্তি থাকে না
আতিথেয়তার পরীক্ষা
ইখওয়ানের প্রতি নাসেরের শত্রুতা
একাদশ অধ্যায়
শহীদ আবদুল কাদের আওদার জনপ্রিয়তা
জেল-জুলুম ও বন্দিত্ব
নাসেরের দায়াদ্রচিত্ততা ও ইনসাফ
আদালতের আচরণ
যিনি হন্তা তিনিই সাক্ষী ও বিচারক
অত্যাচারীরা সাবধান
মন্ত্রীত্বের প্রলোভন
শাইখ আল বাকুরী
রাজনৈতিক পরিশুদ্ধি
সেই ওয়াদা করেছে যা পূর্ণতা লাভ
উম্মে কুলসুমের গান ও আমরা
শিল্প ও শিল্পি
নীল উপত্যকার আধুনিক ফেরাউন
খর্বকায় নেতা ও মিসরের ইতিহাস
হোসনী মোবারকের অপূর্ণাঙ্গ সংস্কার
ইসলামী দুনিয়ার প্রথিকৃৎ
সাজসরঞ্জাম কম থাক আর বেশী থাক বেরিয়ে পড়ো
আল্লাহ জুলুমকেই জুলুমের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেন
যদি সত্যবাদী হও তাহলে আস
মর্দে মু’মিন
জামাল আবদুন নাসেরের বিদ্বেষ
কৃষি সংস্কার না কৃষি বিপর্যয়
যে ভূমি থেকে কৃষক তার খাদ্য পায় না
দ্বাদশ অধ্যায়
প্রকৃত অবস্থার স্বরূপ উদঘাটন
বৃটিশ দূতাবাসের সাথে আলোচনা
দুশ্চরিত্রদের বাহানার অন্ত থাকে না
বিশৃংখল রাজ্য অযোগ্য রাজা
সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়েছে
মু’মিনের দূরদিৃষ্টি ও শয়তানী চক্রান্ত
নাসেরের সাথে সাক্ষাত
নাজীবের বিরুদ্ধে নাসেরের ষড়যন্ত্র
গৃহযুদ্ধেল আশংকা
ত্রয়োদশ অধ্যায়
বিপ্লবের রোয়েদাদ
পাশ্চাত্য দূতাবাসসমূহ ও ইখওয়ান
হতে পারে তোমরা যা অপছন্দ করো তাই
তোমাদের জন্য কল্যাণকর
জুলুমের রাতের অবসান
একদিন কিংবা একদিনের কিছু অংশ
এই উচ্চ মর্যাদা যিনি লাভ করেছেন
স্বাধীনতা অমূল্য সম্পদ
প্রবৃত্তির আকাংখা ও তার পূজা
মুর্শিদে আ’ম এর আহবান ও আমার উপস্থিতি
মুসিবত কেটে গেল
সিন্ধি সাহেবের পুরস্কার ও পরিণতি
চতুর্ধশ অধ্যায়
ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা
জেনালের নাজিবের সাথে নাসের পন্থিদের দুর্ব্যবহার
ইখওয়ান ও আযাদ অফিসার-এর প্রথম পরিচয়
একটা মজার অভিজ্ঞতা
নাসের কাপুরুষ না বীরপুরুষ
জীবনপাত করার পুরস্কার
ক্ষমতার লোভ ও সেনাবাহিনী
রক্তই আর্তনাদ করে বলে দেবে খুনীর বাহুর পরিচয়
নাসেরের ইখওয়ানুল মুসলিমুনে যোগদান
ফারুকের দেশ ত্যাগ
আসল চেহেরা
কৃতকর্মের ফলশ্রুতি ও নাসের
বিক্রয়যোগ্য সম্পদ নাকি শিষ্টাচার
নিঃসেন্দেহে দুঃখের পর রয়েছে সুখ
ওগো মু’মিন বান্দাহ- তুমিই সৌভাগ্যবান আবার তুমিই হতভাগা
জামাল সালেমের পরিণতি
পঞ্চদশ অধ্যায়
মাহফিল পন্ড
নিকৃষ্টতম গুপ্তচরবৃত্তি
যেমন রাজা তেমন প্রজা
চেষ্টা দ্বারাই অভ্যাস গড়ে উঠে
আমাদের দূরদৃষ্টিকে ব্যাপকতা দাও
ত্রুটিমুক্ত ব্যবস্থা
সিরাজের দাওয়াত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
আমি কি আর আমার ক্ষমতাইবা কি?
বদদোয়া ও তার লক্ষ্য
জিহাদে অংশ গ্রহণের দাবী
ইখওয়ানের নামে ব্যাংগ বিদ্রূপ
ফিরিঙ্গি সভ্যতার দাস
ষষ্ঠদশ অধ্যায়
হাতের কঙ্কন দেখতে আর্শির কি প্রয়োজন?
রেকর্ড সংশোধনের জন্যে
শাহ ফারুকের শাসনকালের প্রাথমিক অধ্যায়
ইখওয়ানের আদর্শনীতি
সপ্তদশ অধ্যায়
আমার সমালোচনা পদ্ধতি
গন্তব্যে তারাই গিয়ে উপনীত হয়েছে যারা সফরে অংশগ্রহণ করেনি
নাসেরের সর্প স্বভাব ব্যক্তিত্ব
গুজবে কান দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়
মাথা উলংগ অথচ পায়ে মাথার রাজ মুকুট
অষ্টাদশ অধ্যায়
উনবিংশতম অধ্যায়
ইংরেজদের প্রতি আমাদের ঘৃণার কারণ
শহীদ ইবরাহীম আত তীব
শহীদ হিন্দাভী দুওয়াইর
শহীদ আবদুল কাদের আওদার চিঠি
হে দিব্যদৃষ্টির অধিকারীগণ! শক্তির নেশা বিপজ্জনক
ইখওয়ানের ওপর নির্যাতন চালানোর পুরষ্কার
বাদী নিজেই বিচারক
জামাল সালেমের পরিণতি
বিংশতম অধ্যায়
ইখওয়ানের নেতৃত্ব
কাকে বিশ্বাস করবেন
আবেগের ওপর যুক্তির বিজয়
আপন বন্ধুদের সাথে সাক্ষাত
তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করেন
একবিংশতম অধ্যায়
কৌশলের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষা অত্যাবশ্যক
ব্যক্তিত্বের লালন ও খ্যাতির আনন্দ
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
মুসলমানদের ঘাড়ের শিরা ও ইহুদী থাবা
সাংবাদিকতার ইসলামী নীতি
স্বৈরাচারীরা সাবধান!
বাইশতম অধ্যায়
পরিবার সংগঠন ও তার বাস্তবরূপ
গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের পার্থক্য
ভিন্ন ভিন্ন মানদন্ড
তাঁরই সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক রয়েছে অবনত
‘আদ দাওয়া’ অফিসে ইহুদী বুদ্ধিজীবিদের আগমন
প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের আতিথেয়তা
আফগান জিহাদ এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুন
হয়তো আমার কথা তোমার ভাল লাগবে
নির্বাচনী ময়দানে
তেইশতম অধ্যায়
সুদান আশার আলোকচ্ছটা।
কামাল আতাতুর্কের ধর্মহীন গণতন্ত্র
বিপ্লবী কাউন্সিল কর্তৃক ইখওয়ানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ
মিসর ও সিরিয়ার ঐক্য
জেনারেল নাজীবের সামরিক পদত্যাগ
ওয়াফদ পার্টির শাসনকাল
গোপন অধিবেশন
ভ্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মপন্থা ও তার ফলাফল
দাসদেরকে দাসত্বে সম্মান করা
কালের আয়নায় মিসর ও মিসরের বাইরের অবস্থা
মুর্শিদে আ’ম এর সিরিয়া ও লেবানন সফর
এসব ‍কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত
আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তোমরা শুধু তাই লাভ করতে পারো
সর্বাবস্থায় অস্থিরতা জাঁহাপনা।
মিষ্টার গান্ধির উদ্ধৃতি ও উদাহরণ
মূর্তির প্রেম থেকে হাত গুটিয়ে নাও এবং আপন
খুদীতে নিমগ্ন হয়ে যাও
দুনিয়ার এই ধন-সম্পদ-এই আত্মীয়-পরিজনের সম্পর্ক
হাসানের উৎসাহ এবং সৌন্দর্য থেকে বঞ্চনা
চব্বিশতম অধ্যায়
ইখওয়ানের সামরিক সংগঠন
দেশ ও জাতির হিফাজতে সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগীতা
হাসাল আল হুদাইবির নির্দেশনা বনাম সামরিক সংগঠন
বিষনাশক বিষে রূপন্তরিত হলো
তোমাদের কিন্তু লজ্জা নেই
নাসেরের ব্যক্তিত্বঃ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক
সাদাত নাসেরের স্থলভিষিক্ত
সাদাতের দৃষ্টান্তমূলক পরিণাম
সেনাবাহিনীর কাজ দেশের সীমান্ত রক্ষা, রাজনীতি নয়
বন্তুত তোমরা খুব কমই শিক্ষা গ্রহণ করে থাকো
একমুষ্টি মাটি কিন্তু জমিন থেকে আসমান পর্যন্তা বিস্তৃত
সুয়েজখাল জাতীয়করণ
হোসনি মোবারকের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী
পঁচিশতম অধ্যায়
সাদাতের হত্যা এবং ইখওয়ান
বিশ্লেষণ ও গুজব
আমার পথ ধনীর পথ নয় দারিদ্রের
সাদাতের বক্তৃতা
ধৈর্যের শেষ সীমা
কাঁপছে পাহাড় কাঁপছে তৃণভূমি ও নদীনালা
ঔদ্ধত্যে মোহাবিষ্ট দুর্বিনীত মস্তুক অবনত হলো
আবারো জুলুমের ঝঞ্ঝা
জিন্দানখানার পুরনো মেহমান
এসো হে বুলবুল! এক সাথে আহাজারি করি
সাদাত ও তার ইসরাঈলী বন্ধু
ছাব্বিশতম অধ্যায়
ইসলাম না সমাজতন্ত্র
দাস আর প্রভূ বলে কিছুই রইল না
যারা আসতে চাও জাহাজ জ্বালিয়ে দিয়ে এসো
বিশ্ব রাজনীতি পরিক্রমা ও ইখওয়ান
ভালুক ও নেকড়ের বানরের ন্যায় পিঠা বন্টন
আত্মনির্ভরতার অভাব ও মানসিক গোলামী
মিসরের অর্থনীতি এবং সরকারের ধ্বংসনীতি
সমৃদ্ধি লাভ কি এভাবেই সম্ভব!
করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ
মুসলিম দূতাবাসগুলোর স্বপ্ন
সাংস্কৃতিক দলঃ উম্মাতে মুসলিমার প্রতিনিধি
ইরাক-ইরান যুদ্ধ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ ছাড়া কিছুই নয়
হোসনি মোবারক ও জাফর নিমেরীর সাক্ষাতকার
মানুষের মৌলিক অধিকাসমূহই নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বানুভূতি সৃষ্টি করতে পরে
সাতাইশতম অধ্যায়
মাঝে মধ্যেই সেই প্রাচীন কিসসা কাহিনীর সান্নিধ্যলাভ
হিজাবের পথের ধূলাবালির আকাংখা
যবের রুটি ও আলী হায়দারের বাহু
আযাদ অফিসার-এর বিশ্বাসঘাতকতা
তাকওয়াই সর্বোত্তম পথের সম্বল
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব
উন্নত নৈতিক চরিত্রের নমুনা ও বীরত্বের উদাহরণ
কালের অবদান যুগ স্রষ্টা
সমস্যবলীর সমাধান করার উত্তম যোগ্যতা
ঈমান প্রবৃদ্ধিকর ঘটনাবলী
আটাশতম অধ্যায়
শোকাহত হৃদয়ের বেদনাদায়ক ক্ষত
জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ অধপতন থেকে মুক্তির পথ
কর্মফলেই জান্নাত ও জাহান্নাম
নব্যক্রুসেডের যুদ্ধসমূহ
মহাবিচারকের আদালত
আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে
ঊনত্রিশতম অধ্যায়
ইসলামী ঐক্যের আহবায়ক
আবু লাহাব নীতির বিদায় ও নবী মোস্তফা সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন
যাদের শৌর্যবীর্য
হিকমাত ও কৌশল মু’মিনের হারানো মিরাস
যুগের বিপ্লব
বিভিন্ন মানদন্ড ও পরস্পর বিরোধী আচরণ
আল্লাহ তায়ালা তার নুরকে (দ্বীনকে) পূর্ণতা দান করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে
ইখওয়ান ও শ্রমিক সংগঠনসমূহ
সুস্পষ্ট ঘোষণা
ত্রিশতম অধ্যায়
মন্ত্রীত্বের আকাংখায়
পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়
স্বরণীয় ছবি
বন্ধুদের মাঝে বিনম্র কিন্তু হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বে ইস্পাত কঠিন
সৎলোকদের সাহচর্যের প্রভাব
মুরীদ থেকে মুর্শিদে আ’ম
একটা তাজা উদ্যম একটা মহৎ ইচ্ছা
তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল
পরিপূর্ণ সৌন্দর্য থেকে পূর্নাঙ্গ প্রেম
একত্রিশতম অধ্যায়
সত্যের পথে আহবানকারীর জীবন ও চরিত্র
বাহুবল ও শক্তি প্রয়োগ
সা’দ জগলুল পাশার গাম্ভীর্য
শাহ অপেক্ষাও অধিক শাহ পূজারী
ইখওয়ানের শহীদগণকে ইহুদীদের ইংগীতেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে
বিশ্রি ও ন্যক্কারজনক খেলা
পি. এইচ. ডি- এর থিসিস ও ইখওয়ান
যাতে করে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাই থাকে সমুন্নত
বত্রিশতম অধ্যায়
আশা-আকাংখা ক্ষীণ কিন্তু উদ্দেশ্য মহান
চিত্তাকর্ষক বাচনভংগী ও মনোমুগ্ধকর দৃষ্টি
অন্তর ও দৃষ্টির মুসলিম
বাঁচার জন্য খাওয়া নাকি খাওয়ার জন্য বাঁচা
আমাদের মত কেউই নয়
সাইয়েদ কুতুব শহীদ
সাইয়েদ কুতুব শহীদের উপর মিথ্যা অভিযোগসমূহ
আবদুর রহমান সিন্ধি মরহুম
আবদুল কাদের আওদা শহীদ
জনাব সালেহ আবু রাকীক
উম্মাতের নামে পয়গাম
মানুষের অসহায়ত্ব
স্বাধীনতার ইসলামী তাৎপর্য
স্মৃতিচারণ সম্পর্কিত প্রসংগ কথা
গ্রন্থকার পরিচিতি
মুহতারাম ওমর তেলমিসানী ইখওয়ানুল মুসলিমুনের তৃতীয় মুর্শিদে আম। বর্তমানে তিনি জীবনের আশিটি বসন্তু পাড়ি দিয়ে এসেছেন। তাঁর সুনাম ও মর্যাদা সমকালীন ইতিহাসে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। ইখওয়ানের ওপর বিপদ মুসিবতের সময় অতিবাহিত হয়েছে। সে সময় তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দী জীবনযাপন করেছেন। তাসত্তেও কোন স্বৈরাচারী শাসকের সম্মুখে তাঁর মস্তুক অবনত হয়নি। ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের সাহায্যেও তাঁকে বাগে আনার বহু চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এরূপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অনমনীয়তা দান করেছেন।
পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন একজন আইনজীবি। তথাপি তিনি যেরূপ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আজীবন দাওয়াতে হকের দায়িত্ব পালন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নাম শোনার সংগে সংগে দাওয়াতে হকের একজন একনিষ্ঠ কর্মী এবং ইসলামী আন্দোলনের একজন অক্লান্ত পথপ্রদর্শকের চিত্র চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তিনি যৌবন উন্মেষের শুভ থেকেই সকল প্রকার আকর্ষণ মুক্ত একটা অদম্য কাফেলার সাথে এসে একাত্ম হন এবং তাদের সাথেই সারাজীবন পথ পরিক্রমা অব্যাহত রাখেন। একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে তিনি নিজেকে অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত এক সাথীরূপে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। যখন নেতৃত্বের শুরু দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করা হয় তখন এ মহান যিম্মাদারী ও দায়িত্বের বোঝা তিনি অত্যন্ত সুষ্ঠু সুন্দরভাবে পালন করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায়, উন্নত দৃষ্টিভংগী ও সুকোমল ব্যবহারের নেয়ামত দ্বারাও পরিপূর্ণরূপে ধন্য করেছেন। তিনি ছিলেন একটি শ্রেষ্ঠ কাফেলার প্রধান।
“তার স্মৃতিকথা” সর্বপ্রথম আরবী ভাষায় প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দৈনিক “আশশারকুল আওসাত” পত্রিকায় ১৯৮৪ সালের ৩রা জুলাই রোজ সোমবার থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। তার এ “স্মৃতিকথা” একটা সাক্ষাতকার হিসেবে প্রখ্যাত সাংবাদিক ইমাম আল গাজী বিন্যস্ত করেন। “আশশারকুল আওসাত” এ প্রকাশিত তার “স্মৃতিকথার” প্রথম কিস্তিই সৌভাগ্যবশতঃ আমি পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই এবং তখনই আমার মনে হয় যে বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ হওয়া দরকার। আমি তখন উচ্চ শিক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সউদী সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ইতিমধ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়ে গেছে। সুতরাং ইরানের বিপ্লবী আন্দোলন ও ইখওয়ান সংগঠনের নিষ্ঠাবান কর্মী এবং দায়িত্বশীলগণের সাথে মিলিত হবার যখনই সুযোগ পেতাম খোলামেলা আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের সুদীর্ঘ ও তিক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা জেনে নিয়ে আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য নিজের ঈমান, মনোবল ও যোগ্যতাকে আরো শানিত করে নিতে চেষ্টা করতাম। সুতরাং মুর্শিদে আম-এর জীবনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সঞ্চয় অবগত হবার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। তাই অল্প কয়েকদিনেই আমি কয়েক কিস্তির বাংলা তরজমা করে ফেললাম এবং আমি এ অনুবাদকর্ম ১৯৮৫ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের সমাপ্ত করে ফেলি। অনুবাদের কাজ সাধারণত তখন করতাম যখন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাশ থাকতো না। প্রধানত সালাতুল আছর থেকে এশা পর্যন্ত সময়কেই কাজে লাগাতে চেষ্টা করতাম। প্রতি সপ্তায় দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়া যেতো। শেষের দিকে ভ্রাতৃপ্রতীম ক্বারী হাবীবুর রহমান যথেষ্ট সহযোগীতা প্রদান করে। আমি তার দ্বারা অনুবাদ লিখার কাজ করতাম আর তিনিও দ্রুত গতিতে এবং নির্ভুলভাবে তা লেখার দায়ত্ব পালন করতেন। এভাবে খুব অল্প সময়েই কাজ সুসম্পন্ন হয়ে যায়। অতপর এ অংশগুলো সংশোধনও করে নেয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা ক্বারী সাহেবকে সর্বোত্তম বিনিময় দ্বারা ধন্য করুন। এ পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে গ্রন্থাকার পরিচিত তুলে ধরার আবশ্যকতা বোধ করছি।
ঈসায়ী চলতি শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বীনের সংস্কার সাধন ও পুনরুজ্জীবন দানের মহতী আন্দোলন “ইখওয়ানুল মুসলিমুন” নামে মিসরে শুরু হয়। এ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ। এ সুমহান ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ অত্যন্ত মহৎগুণবলী দ্বারা ধন্য করেছেন। তাঁর পরিচালিত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এতবেশী জনপ্রিয়, সর্বব্যাপী ও শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয় যে বাতিল পন্থী সমস্ত দলের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাতিল দল মত নির্বিশেষে এ আন্দোলনকে উৎখাত করার জন্য সযত্ন প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার নুর তথা দ্বীনে হক কখনো বাতিলের ফুৎকারে নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে না। আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। অথচ তা নিশ্চিহ্ন করার দূরভিসন্ধি গ্রহণকারীরা ধরা পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ হাসানুল বান্নার শাহাদাতের পর জনাব হাসান আল হুদাইবি আন্দোলনের মুর্শিদে আম নির্বাচিত হন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতা ও বিজ্ঞজনোচিতভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। তার নেতৃত্বকালীন সময় ছিলো কঠোর পরীক্ষার অ্ধ্যায়। এ পর্যায়েই সাইয়েদ কুতুব ও ইখওয়ানের অন্যান্য বহু গুণধর ব্যক্তিত্বকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলানো হয়। তথাপি আত্মনিবেদিত ও প্রবল ঈমানের বলে বলীয়ান ইখওয়ান ত্যাগ স্বীকার করতে থাকে এবং অকুতোভয়ে তাদের লক্ষ পানে অগ্রসর হতে থাকে। হাসান আল হুদাইবি (র) এর ইনতিকালের পর ইখওয়ানের প্রাক্তন সদস্য এবং ত্যাগ ও কুরবানীর মূর্তপ্রতীক শাকখ ওমর তিলমেসানী মুর্শিদে আম নির্বাচিত হন। তিনি ইখওয়ানের তৃতীয় আমীর বা মুর্শিদে আম। তার বয়স এখন আশি বছর। তা সত্ত্বেও তার যুবকসুলভ মনোবল দেখে ঈমান তাজা হয়ে উঠে। নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস জন্মে যে আল্লাহর প্রেমে বিভোর ব্যক্তি কখনো বুড়িয়ে যায় না বা দুর্বল হয়ে পড়ে না।
ওমর তিলমিসানী হচ্ছেন ইখওয়ানের ইতিহাসের আমানতদার। তাঁর বক্ষ এমন উজ্জল ও অকৃত্রিম ইতিহাসের উৎস, যা বর্তমান শতাব্দীতে সালফ ও সালেহীনদের স্মৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে। অন্যুন প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবত এ সংগঠনের প্রথম সারিতে কাজ করার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছেন। আরবী ভাষায় প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দৈনিক “আশশারকুল আওসাত” পত্রিকার পক্ষ থেকে একবার উস্তাদ তিলমিসানীর সাথে সাক্ষাতকারের আবেদন জানানো হয়। তখন মুর্শিদে আম- এর শারীরিক অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না। তদুপরী অতিসম্প্রতি সুইজারল্যান্ডে একটা বড়ো ধরনের অপারেশান করা হয়েছিলো। তা সত্ত্বেও যে তিনি পত্রিকার প্রতিনিধি ইমাম আল গাজীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তার স্মৃতিকথাকে সাক্ষাতাকার হিসেবে পাঠকগণের সমীপে উপস্থাপন করবেন। তার ঈমান প্রবৃদ্ধিকর স্মৃতি কথামালাগুলোই এখন “আশশারকুল আওসাত” পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৯৮৪ সালের ২৩ শে জুলাই সোমবার এর প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয়। তারপর প্রতি সপ্তাহে তিন দিন সোম, বৃহস্পতি ও শনিবার তা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।
“আশশারকুল আওসাত” আমাদের সময়কার সংবাদপত্র জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একটি দৈনিক। এ দৈনিকটি কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে একই সাথে বিশ্বের ছয়টি স্থান থেকে প্রকাশিত হয়। লন্ডন, প্যারিস, জিদ্দা, রিয়াদ, কাসাব্লাঙ্কা (মরক্কো) এবং নিউইয়র্ক-এর মুদ্রণ ও প্রকাশনার কেন্দ্র। এ পত্রিকায় ইসলামী ও পশ্চিমাজগতের পণ্ডিত, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিবিদ এমনকি বিশ্ববিখ্যাত ক্রিড়াবিদগণের স্মৃতিকথা প্রকাশ করে আসছে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পত্রিকাটির প্রকাশনা অনেক বেশী। সাক্ষাতকার প্রদানকারী খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ অথবা আত্মকাহিনী লেখক সাহিত্যিকদেরকে অত্যন্ত মোটা অংকের সম্মানী প্রদান করা হয়। পত্রিকার প্রতিনিধি যখন মুর্শিদে আমের খেদমতে তা প্রকাশ করেন। তখন তিনি অত্যন্ত দ্বিধাহীনচিত্তে বলেন, “আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ইতিহাস বিক্রি করতে চাই না।”
আমি যখন প্রথম কিস্তিতে এ খবর পাঠ করি, তখন তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হই। কিন্তু মনের মধ্যে একথাও জাগে যে, পারিশ্রমিক গ্রহণ করে তা ইখওয়ানের বাইতুলমালে জমা দিলে তাতে তো কোন ক্ষতি ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পর আমাকে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে একথা বলতে বাধ্য হতে হয়েছে যে, মুর্শিদে আম-এর উপরোক্ত সিদ্ধান্ত ছিলো সঠিক ও যথার্থ। আমি জানতে পেয়েছি যে, “আশশারকুল আওসাত” এর সুধী পাঠকগণের ওপর ও মন্তব্যের এমন সুদূর প্রসারী প্রভাবই পড়েছে যা হাজার হাজার কর্মী বছরের পর বছর অবিশ্রান্ত মেহনতের পরও ফেলতে পারতো না।
মুর্শিদে আম-এর এ সাক্ষাতকার থেকে তার ব্যক্তিগত অবস্থার পরিচয়ও পাওয়া যায়। কিন্তু মোটামুটিভাবে এটা সংগঠন, আন্দোলন এবং এর কঠোর প্রাণ কাফেলার সামগ্রিক কার্যক্রম অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর রক্তে সিক্ত ঘটনা প্রবাহ প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগ বিশেষ।
আজকের প্রকাশনায় সাইয়েদ হাসানুল বান্নার সাথে উস্তাদ তিলমিসানীর প্রথম সাক্ষাতকারের পর্যালোচনা সম্মানিত পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ আলোচনা তাঁর সাক্ষাতকারের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশে উল্লেখিত হয়েছে।
অনুবাদের কাজ চলাকালীন সময়ে মনে মনে ভাবছিলাম যে এ “স্মৃতিকথা” গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হলে এর নাম কি রাখা যেতে পারে? সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই মনের কোণে ভেসে ওঠে “স্মৃতির আমানত”। আর এখন এটা আল্লাহর রহমতে “ওমর তিলমেসানী ও ইখওয়ান” নামে গুণীজন ও সুধী পাঠকগণের খেদমতে হাজির করা হলো।
অবশ্য এ সাক্ষাতকার কিংবা “স্মৃতিকথাগুলোকে” সাধারণ প্রচলিত পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করা হয়নি। এ স্মৃতিকথা পড়তে গিয়ে সুধী পাঠকগণ বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাবেন যে, মুর্শিদে আম নিজেও এদিকে ইংগিত দিয়েছেন। কখনো কখনো মনে হয় যেন কোন কোন বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও জনাব তিলমিসানী কেবলমাত্র তার স্মৃতি শক্তির সাহায্যে এবং কোন প্রকার লিখিত রেকর্ডের সাহায্য না নিয়েই সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং কোন প্রকার লৌকিকতা ছাড়াই তার স্মৃতির প্রদীপ প্রজ্জলিত করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভংগী ছিল এই যে, স্বীয় পয়গাম ও আন্দোলনের পরিচিতি পাঠকদের নিকট পৌছে দেয়া। সুতরাং এ চিন্তাধারাকে কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে তিনি সাক্ষাতকার প্রদান করেন। আমার তো মনে হয় যে জনাব মুর্শিদে আম মৌমাছির মত প্রতিটি ফুল থেকে রস আহরণ করেছেন এবং রোগ নিরাময়কারী মধু দ্বারা তাঁর মৌচাক ভর্তি করেছেন। তিনি কোন কথা বর্ণনা করার সময় যেমন কোন কৃত্রিমতার আশ্রয় নেননি। তেমনি কোন প্রকার মেকিত্বের প্রলেপ দিতেও চেষ্টা করেননি। সত্যিই ন্যায় ও সত্যের একজন নিষ্ঠাবান দায়ীর চরিত্র মাহাত্মা এরূপ হওয়াই শোভনীয়। এরপর থাকে চরম উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতার কথা। সেটা কেবল আল্লাহ তায়ালার গুণাবলীর অংশ। সাধারণ মানুষ ভুল ভ্রান্তিও করে আবার সঠিক পথের সন্ধানও লাভ করে। কিন্তু সে নিষ্পাপ নয়। আল্লাহ তায়ালা শুদুমাত্র নবী রাসূলগণকেই নিষ্পাপ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন।
জনাব মুর্শিদে আম এর কথা আরবী ও ইংরেজী সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকায় বহুবার পড়ার সুযোগ পেয়েছি। তাঁর সাক্ষাতকার দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। তাঁর লিখিত কতিপয় দুর্লভ ও মূল্যবান প্রবন্ধ ‘আদ দাওয়া’ এবং আল মুখতারুল ইসলামী’ এর মত পত্রিকার পৃষ্ঠায় আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিলো। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর সাথে সাক্ষাতের দুর্লভ সুযোগও আমি পেয়ে যাই। তিনি সুদানে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে যোগদানের জন্য আগমন করেছিলেন। উক্ত সম্মেলনে যোগদানের সুযোগও আমার হয়েছিলো। সেখানেই তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়। যে ভালোবাসা ও একান্ত আপনার মত করে তিনি আমাকে সান্নিধ্য দান করেন। তা চিরদিন স্মৃতিপটে গাঁথা থাকবে। যদিও তিনি ছিলেন বয়সের ভারে ক্লান্ত এবং দুর্বল কিন্তু জেহাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত এ মহাপ্রাণ ব্যক্তি সর্বদা কর্মমুখর ও প্রাণ চঞ্চল থাকেন।
কনফারেন্স চলাকালীন সময়ে তাঁর কোন প্রোগ্রাম বা ভাষণ দেয়ার দায়িত্ব ছিলো না। কিন্তু সম্মেলন কক্ষে অথবা তার বাইরে যেখানেই তাকে পাওয়া যেতো, উপস্থিত সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো তাঁর উপর। অধিবেশনের বিরতির সময়ও মানুষ ভক্তি ভরে ও আবেগ আপ্লুত হয়ে তাঁর কাছে ছুটে যেতো। এটা ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমুনের প্রতি জনসাধারণের আবেগ ও ভক্তির বহিপ্রকাশ। আমি যখনই তার প্রতি লক্ষ্য করতাম, তখনই ইখওয়ানের ইতিহাস আমার মনের দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতো। তিনি এ ইতিহাসেরই আমানতদার এবং আন্দোলনের প্রাণ প্রবাহ।
মিসর ও মিসরের বাইরে যেখানেই তিনি যেতেন সেখানেই হক-এর অনুসন্ধানকারীগণ তাঁর প্রতি দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকতো। মিসর সরকার তার প্রোগ্রাম বানচাল করার জন্য যতই বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা করতো, ততই তার সুনাম ও সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। সম্মানিত পাঠকগণ! এ স্মৃতিকথা পাঠের সময়ও দেখতে পাবেন যে তিনি তাঁর বিদেশ সফরের আলোচনা করেছেন। রওয়ানা হওয়ার এবং ফিরে আসার সময় যেভাবে এয়ার পোর্টে এবং ইমিগ্রেশনে অফিসারগণ তাঁকে কষ্ট দিতো তা শুধু অনুতাপের বিষয়ই নয় বরং পুরোপুরি লজ্জাজনক ও কঠোরভাবে নিন্দার যোগ্যও বটে। তার অসীম উৎসাহ উদ্দীপনা ও একান্ত সদিচ্ছা আন্তরিকতার কারণেই তিনি তাদের এরূপ অশালীন আচরণে কখনো কিছু মনে করতেন না।
কুয়েতের প্রভাবশালী সাময়িকী “আল মুজতামা” তার ১৯৮৫ সালের পহেলা জানুয়ারী তারিখে প্রকাশিত সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লিখেছেনঃ জীবনের আশিটি বছর অতিক্রম করে আসার পরও শাইখ ওমর তিলমিসানীর অদম্য সাহস এবং সৎ উৎসাহ তাঁকে প্রাণ চঞ্চল করে রাখছে। গত সপ্তায় এক দিনেই তিনি তিনটি জনসমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। প্রথম অধিবেশন “হিযবুত তাজামুম” (মিসরের একটি বিরোধী রাজনৈতিক দল)- এর কেন্দ্রীয় দফতরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত হয়। অতপর যুব চিকিৎসক ইউনিয়নদের ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত কায়রোতে অবস্থিত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় দফতরের এক বিরাট সমাবেশে তিনি বক্তব্য রাখেন। তৃতীয় অধিবেশনের আয়োজন করে আইনজীবিদের ইউনিয়ন সিরাতুন্নবী (সা) উপলক্ষে। সেখানেও তিনি ভাষণ দান করেন। প্রতিটি অধিবেশনেই তিন সহস্রাধিক লোকের সমাগম হয়।
একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, হিযবুত তাজাম্মুর কেন্দ্রীয় দফতরে যখন তিনি তাশরীফ আনেন তখন উপস্থিত সকলের মধ্যে অত্যন্ত আবেগময় অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাকে স্বাগত জানানোর জন্য একধারে তিন মিনিট পর্যন্ত করতালি দেয়া হতে থাকে এবং মুহর্মূহ গগনবিদায়ী শ্লোগানের ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হতে থাকে। এমন সাদর ও উষ্ণ অভ্যর্থনা কোন বক্তা বা নেতাকে জানানো হয়নি। অথচ স্বয়ং “হিযবুত তাজাম্মুর” প্রধান জনাব খালেদ ‍মুহীউদ্দীনও বক্তাদের মধ্যে শামিল ছিলেন।
আরো মনে রাখা দরকার যে, সাইয়েদ তিলমিসানী তাঁর বাম চক্ষুর অপারেশন শেষে মাত্র কয়েক সপ্তাহ পূর্বে সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরে এসেছিলেন। এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি সক্রিয় নেতা হিসেবে সর্বদা কর্মতৎপর থাকেন।
এ খরবটি চলতি সপ্তাহের একটা আরবী পত্রিকা থেকে শুধু নমুনাস্বরূপ উল্লেখ করলাম। অন্যথায় মুর্শিদে আমের কর্মব্যস্ততার বিস্তারিত বিবরণ খুবই বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ।
ইখওয়ান ও জামায়াতে ইসলামী কার্যক্রমের তুলনামূলক আলোচনা সম্বলিত একটা নিবদ্ধ এ গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। আমরা আশা করি সুধী পাঠকগণ “ওমর তিলমেসানী ও ইখওয়ান” পাঠ করে সাইয়েদ ওমর তিলমিসানী ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন তথা মিসর ও আরব দেশসমূহের সাধারণ অবস্থা সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য অবগত হতে পারবেন। এ প্রবন্ধ থেকে দুটি ইসলামী আন্দোলনকে তুলনা করে পাঠকগণ উপলব্ধি করতে পারবেন যে, সংস্কার আন্দোলনগুলোকে দুনিয়ার সবখানেই একটি প্রতিকুলতার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। তাছাড়া সব আন্দোলনের মনযিলে মকসুদ এক হওয়া সত্ত্বেও নিজ নিজ এলাকা ও পরিবেশ তাদেরকে আপনাপন কর্মসূচী তৈরী করে নিতে হচ্ছে।
অনুবাদকালে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি যাতে বক্তার মূল বক্তব্য সঠিকভাবে পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করা যায়। তাই এটা শাব্দিক বা আক্ষরিক অনুবাদ নয় বরং ভাবানুবাদের সযত্ন প্রয়াস মাত্র। বিজ্ঞ সধী ও গুণীজনদের খেদমতে আরজ এই যে, কোন প্রকার ত্রুটিবিচ্যুতি ও দুর্বলতা তাঁদের দৃষ্টিগোচর হলো তারা যেন সেদিকে যথাযথভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করতে মর্জি করেন।
মূল প্রবন্ধ অধ্যয়ন করার সময় সুস্পষ্টভবে অনুভূত হয়েছে যে, যেসব চিন্তাধারা আল্লামা ইকবাল মারহুম ইম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত করার প্রান্তকর প্রয়াস পেয়েছিলেন, শাইখ ওমর তিলমিসানীও সেই একই ভাবধারায় উদ্দীপ্ত।
অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রদত্ত সমস্ত উপশিরোনামগুলো আমাদেরই উদ্ভাবিত। যে নিয়তে মুর্শিদে আম তার স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করিয়েছেন আল্লাহ সেই মহৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার তাওফিক দান করেন। অর্থাৎ চিন্তা চেতনার ধারা যেন বদলে যায় এবং মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তি তাদের হারানো মর্যাদা পুনরায় অর্জন করার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। কবির ভাষায়ঃ তোমার চেতনায় যদি বিপ্লবের সৃষ্টি হয় তাহলে। আশ্চর্য নয় যে চারদিকের বিরাজমান পরিবেশই বদলে যাবে! তোমার প্রার্থনা হচ্ছে যেন তোমার আকাংখা পূরণ হয়! আর আমার দোয়া হচ্ছে যেন তোমার আকাংখাই বদলে যায়!!
কবি আরো বলেছেন :
“জগত যদিও অন্য রকম হয়ে গেছে বলে মনে হয়!
তবুও দাঁড়াও তোমরা আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে!!
এ জমিন, এ আলো বাতাসে তোমরা রুখে দাঁড়াও আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে।
‘আনাল হক’ ধ্বনিকেক যিনি আগুনের রুপান্তরিত করেছেন তোমরা শিরা উপশিরায় সেই রক্ত প্রবহামান। অতএব উঠে দাঁড়াও।
ওয়াসসালাম।
উপক্রমনিকা
বিংশ শতাব্দির দুটো বিরাট ইসলামী আন্দোলন
বিশ্ব মানবতার হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা অগণিত নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, যারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জাতি ও সমকালীন বিশ্বের লোকদের সামনে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে গেছেন। ঐসব নবী রাসূল প্রেরণের শেষ পর্যায়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তিনি সমস্ত আদম সন্তানের জন্য এবং কিয়ামত পর্যান্ত সর্বকালের মানুষের জন্য হিদায়াতের পথের আহবায়ক এবং পথপ্রদর্শক। তাঁর পর আর কোন নবী রাসূলের আগমন ঘটবে না।
নবী আদমের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব তথা মহাগ্রন্থ আল কুরআন এবং পবিত্র সুন্নাহ উম্মাতের নিকট সোপর্দ করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছিলেনঃ “যতদিন পর্যন্ত তোমরা এ দুটো মৌলিক উৎসের শিক্ষা মুজবুতভাবে অনুসরণ করে চলেবে ততদিন কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।”
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন যে, আমার উম্মাতের উলামায়ে কেরাম বনী ইসরাঈলের আম্বিয়ায়ে এজামদের সমান।
অবশ্য এর অর্থ এটা নয় যে, আলেমদেরকে নুবায়াতের সমান মর্যাদা কিংবা নবীদের ন্যায় সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। বরং তার মর্মার্থ হচ্ছে এই যে, যেভাবে মহানবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্ববর্তী সমস্ত নবী রাসূলকে উম্মাতের সংশোধন সংস্কারের জন্য প্রেরণ করা হতো, এখন থেকে সেই গুরু দায়িত্ব অর্পিত হলো ওলামায়ে ইসলামের উপর।
দ্বীনের সংস্কার সাধন ও পুনরুজ্জীবনের জন্য আল্লাহ তায়ালা এ উম্মাতের মধ্য থেকে সাহসী আলেমক ও সৎব্যক্তিগণকে তাওফীক দিয়ে আসছেন যাতে তারা দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ঠ ভ্রান্ত রীতিনীতি ও আচার আচরনের মূলোৎপাটন করে আল্লাহর বান্দাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর স্বচ্ছ ঝর্ণাধারার কাছে নিয়ে আসতে পারেন। দ্বীনের সংস্কার সাধন ও পুরর্জীবনের আন্দোলন সকল যুগে ও সকল দেশেই কার্যকর ছিলো। সংস্কারকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আল্লাহ তায়ালা অজ্ঞতা ও গোমরাহীর মোকাবেলায় প্রকৃত জ্ঞান এবং দ্বীন হানিফকে পরিশুদ্ধ করে দেন। তথাপি এ কাজ অত্যন্ত কঠিন এবং ধৈর্যের দাবিদার। এ কাজ কেবল সেইসব লোকের পক্ষে সম্ভব যারা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যাবতীয় প্রতিকুলতার সম্মুখীন হবার জন্য সর্বদা জিহাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত থাকে।
বিংশ শতব্দীর ইসলামী উম্মাহ পশ্চাৎপদতা অধঃপতনের গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে রাজনৈতিক গোলামীর সাথে সাথে চিন্তাগত স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে নীলনদ উপত্যকায় আল্লাহ তায়ালা তার এক সত্যপ্রিয় বান্দাকে বাতিলের মোকাবিলা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। যিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত গুণাবলীর অধিকারী। আল্লাহ তাকে সবরকমের গুণ দান করেছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি মুসলিম উম্মার করুণ অবস্থা আবলোকন করে চিন্তিত ছিলেন। তিনিই তার যৌবন কালে মাত্র একুশ বছর বয়সে উম্মাহকে সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯২৭ সালে ইসমাঈলিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তখন তার সাথে ছয় সাথী ছিলেন। এই বিশাল ব্যক্তিত্ব সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এখন আর কারো পরিচয় করিয়ে দেয়ার অপেক্ষা থাকে না। তার পরিচালিত ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন যার প্রভাব মুসলিম বিশ্ব এবং আরব জাহান ছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে অনুভূত করা হচ্ছে।
হাসানুল বান্না যে সময় মিসরে সংস্কার আন্দোলন জোরদার করছিলেন ঠিক সেই সময়েই পাক ভারতীয় উপমহাদেশে তারই সমসাময়িক অপর এক নওজোয়ান মর্দে মু’মীন সম্পূর্ণ একই আঙ্গিকে ও একই প্রেক্ষাপটে চিন্তা ভাবনা শুরু করেছিলেন। তিনি তার ইমান উদ্দীপক লেখনী দ্বারা প্রতিটি জাগ্রত বিবেক, সচেতন ও নিষ্ঠাবান মুসলিমের অন্তরে সমকালীন জাহেলীয়াত ও পরিবেশ পরিস্থিতি সংস্কারের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। এ যুবকের নাম ছিলো সাইয়েদ আবুল আ’লা মুওদূদী মারহুম। তিনি ছিলেন বর্তমান শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ভাষ্যকার ও মুখপাত্র। তিনি ইসলামী আন্দোলনের একটা মজবুত ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তার নাম প্রস্তাব করা হয় “জামায়াতে ইসলামী”। সত্যের এ কাফেলায় সর্বপ্রথম ১৯৪১ সালে। বর্তমানে এ সংগঠন ও ইখওয়ানুল মুসলিমুন এর ন্যায় বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী।
সৌভাগ্যবশত এ দুটি সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খুবই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, অদম্য সাহসিকতা ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং এলেম ও আমলের গুণাবলীতে একজনের সাথে অন্যজনের রয়েছে পুরোপুরি সাদৃশ্য। উভয়ের যৌবন ছিলো নির্দোষ ও নিষ্কলুষ এবং চিন্তা-চেতনা ঊষা লঘ্ন থেকেই ছিলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে আলোকিত। দুই ব্যক্তিত্বকেই অল্প বিস্তর প্রায় একই রকম পরিবেশ পরিস্থিতিতে উম্মাহর সংস্কারে কাজ দুটো পৃথক প্রক্রিয়ায় আঞ্জাম দিতে হয়। বিপদ-মসিবত, দুঃখ-দৈন্যের প্রকৃতিও ছিলো প্রায় একই ধরনের। উভয়েই জাতিরে সামনে যে শ্লোগান পেশ করেন তাও ছিলো হুবহু একই। সেই শ্লোগান ছিলো أُدْخُلُوا فِى السِّلْمِ كَافَّة “পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো।”
আর এটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপারও নয়। কেননা বীজ যে বৃক্ষের হবে তা থেকে সেই বৃক্ষই উৎপন্ন হবে। যদিও দুটো আলাদা ভূখন্ডে একই আবহাওয়ায় ঐ বীজ বপন করা হয়। দুজনেরই চিন্তা একই সূত্রে গাঁথা ছিলো। তাই রোগ নির্ণয় ও তার চিকিৎসার পার্থক্য হওয়া সম্ভবই ছিল না।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধবাদীরা প্রত্যেকটি আন্দোলনের উপরই তাদের নিজ নিজ গোপন আস্তানা থেকে একই অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ করে থাকে। অভিযোগ উত্থাপন এবং দোষারোপের ফিরিস্তি দেখলে এবং সেগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করলে বিস্ময়ের অবধি থাকে না। মনে হয় যেন এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ একই কারখানায় তৈরী হয়ে আসছে। জামায়াতে ইসলামীর বিরোধীরা নির্বোধের মত অভিযোগ আরোপের সাথে সাথে অপেক্ষাকৃত একটি হালকা ভিত্তিহীন অপবাদও আরোপ করে থাকে যে এরা ইখওয়ানের সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় থাকে। মিসর ও অন্যান্য আরব দেশে যা কিছু লেখা হয় এরা অবিকল তাই নিজেদের দেশে ভাষান্তরিত করে থাকে। আমরা এখানে এসব অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করতে বা সেগুলোর পর্যালোচনায় যেতে চাই না। এ পর্যায়ে বরং সাইয়েদ কুতুব শহীদের দু শব্দের একটি সংক্ষিপ্ত জবাবই যথেষ্ট। প্রকাশ থাকে যে, ইখওয়ানের বিরোধীরা তাদের উপরও একই অভিযোগ আরোপ করতো যে, তারা জামায়াতে ইসলামীর চিন্তাধারারই ব্যপ্তি ও বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। সাইয়েদ কুতুব এর লেখনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করুন আবার সাইয়েদ মুওদূদীর লেখাও অধ্যায়ন করে দেখুন। মনে হবে যেন দুজন লেখকরই চিন্তাধারা একই উৎস থেকে উৎসারিত। বিশেষেতঃ “তাফহীমুল কুরআন” ও “ফি যিলালিল কুরআন”- এর মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যমান।
একবার সাইয়েদ কুতুব-এর সামনে জনৈক ব্যক্তি এ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, তার লেখনী সাইয়েদ মওদূদীর লেখনীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। তিনি এর জাবাবে বলেছিলেনঃ আমাদের চিন্তাধারার উৎস এক ও অভিন্ন। মাত্র দুশব্দের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এ জবাব সৃদীর্ঘ রচনা বা প্রবন্ধ বরং বিশাল আয়তনের গ্রন্থ থেকে বেশী অর্থবোধক اِنَّ فِى ذَلِكَ لِعِبْرةً لاُّولِى الْالباب “নিশ্চয়ই এতে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে এমন লোকদের জন্য যারা জ্ঞানবুদ্ধিকে কাজে লাগায়।”
সাইয়েদ মওদূদী ও সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের পরস্পরের সাথে কখনো সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তথাপি দুই মহান নেতার মধ্যে তাদের উভয়েরই বন্ধু কুয়েতের প্রখ্যাত ইসলামী নেতা শাইখ আবদুল আযীয আলী আল মাতলু এর মাধ্যমে পত্রের আদান প্রদান হতো। এতে ইখওয়ান ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং নিয়মিত দেখা সাক্ষাত হতে থাকে। সাইয়েদ মওদূদী ও সাইয়েদ হাসানুল বান্না দুই সংগঠনের প্রত্যেকটিকে অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং পরিপূরক মনে করতেন। তাদের মধ্যে এ অনুভূতি ছিল যে, আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একই। কেবলমাত্র ভৈৗগোলিক অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র আলাদা। আমি নিঃসঙ্কোচেব বলতে পারি যে জামায়াতে ইসলামী ও ইখওয়ানের দুজন কর্মী দুনিয়ার যে কোন স্থানে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেলে তারা মনে করে যে তারা দুজন একই বংশোদ্ভুত। যদি পৃথিবীর কোন অংশে কোন ইখওয়ানী ভাইয়ের ওপর অত্যাচার হয় তাহলে জামায়াত ইসলামীর প্রত্যেক কর্মী তার অন্তরের অন্তস্থলে বেদনা অনুভব করে। অনুরূপভাবে জামায়াত বা এর কোন কর্মীর ওপর নির্যাতন চালানো হলে সমগ্র পৃথিবীর ইখওয়ানী ভাইয়েরা তড়পাতে থাকে। এমনটা হবেই বা না কেন? আমাদের মনযিলে মকসুদ ও জীবন লক্ষ্য যে এক ও অভিন্ন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার বহুবার এরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কোন অজ্ঞতা অপরিচিত পরিবেশের কোন এয়ার পোর্টে কিংবা প্লেনের মধ্যে অথবা অন্য কোন স্থানে হঠাৎ কোন ইখওয়ানী ভ্রাতার সাথে সাক্ষাত হয়ে গেলে কথার ফাঁকে যখনই আমাদের কারো জানার সুযোগ হয় যে অপরজন ইসলামী সংগঠনের সাথে জড়িত। অমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পরস্পর গলাগলি কোলাকুলি হয়ে যায়। বিদেশী ও অপরিচিতির লেশমাত্র তখন আর অবিশষ্ট থাকে না। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হয় যেন আমরা বাল্যকাল থেকেই একত্রে বসবাস করে আসছি।
এটা ইসলামী আন্দোলনেরই কৃতিত্ব যে তার কর্মীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস الْحُبُّ فِى للهِ وَالبُغضُ للهِ (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে সকল প্রকার ভালবাসা এবং বৈরিতা) এর জীবন্ত নমুনা বানিয়ে দিয়েছে।
দুটি সংগঠনেরই দাওয়াত ও কর্মনীতির প্রতি লক্ষ করুন এবং বুনিয়াদী সাহিত্য সম্ভার পড়ে দেখুন। দায়িত্বশীলগণের বক্তৃতা বিবৃতি চিন্তাবিদগণের চিন্তা-ভাবনা লেখক সাহিত্যিকগণের লেখনী সাংবাদিকগণের পর্যালোচনা মোদ্দা-কথা যে কোন অংগনের উপর দৃষ্টিপাত করে দেখলে আপনার কাছে প্রতীয়মান হবে যে উভয় ফুলের তোড়য় একই গাছের ফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
এতোসব সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও আপনাপন পরিমন্ডলে এবং কর্মক্ষেত্রে দু’সংগঠনের অগ্রগতি এবং জিহাদের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। হাসানুর বান্না সাহিত্য সৃষ্টির তুলনায় মানুষের মন-মানসিকতা গঠনে ছিলেন বেশী তৎপর। পক্ষান্তরে সাইয়েদ মওদূদী যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী বাহিনী তৈরীর সাথে সাথে সাহিত্য রচনারও দিকে গুরুত্ব প্রদান করেন। হাসানুল বান্নাও ছিলেন সৃজনশীল লেখক ও সাহিত্যিক কিন্তু তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ছিলো বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরাদিকে সাইয়েদ মওদূদী খুব তেজস্বী বক্তা ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর ময়দানই ছিলো বেশী প্রশস্ত। বলিষ্ঠ ও গতিশীল লেখনীর এক এমন মহৎ গুণ তার মধ্যে ছিলো যা বদৌলতে তিনি তার সমকালীন সকলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তেমনিভাবে নীল নদের অববাহিকা চলতি শতাব্দীতে হাসানুল বান্না শহীদ অপেক্ষা আর কোন বড় বক্তা দেখতে পায়নি।
সাইয়েদ মওদূদী প্রত্যেক বিষয়ের ওপর কলম ধরেছেন। এমনকি সত্যকথা বলতে গেলে প্রত্যেক বিষয়ের হকও তিনি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তাফহীমুল কুরআন নামক কিতাবুল্লাহর তাফসীর ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মন্ডিত। এ বিষয়ে বহু চিন্তাবিদ পুরোদস্তুর মূল্যায়ণ করে এবং প্রাচীন ও আধুনিক অসংখ্য তাফসীরের সাথে তুলনা করে প্রমান করেছেন যে, এটা এক অতুলনীয় ও ব্যতিক্রম ধর্মী সৃষ্টি। জন্মনিয়ন্ত্রণ, পর্দা ও সুদ এর মত সংবেদশীল বিষয়াবলীর ওপরও তিনি কলম ধরেছেন। বিশেষথ এমন যুগ সন্ধিক্ষনে পাশ্চাত্য দর্শনের সম্মুখে ইসলামের বড় বড় মাশায়েখগণ হতবাক ও বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কারণ প্রদর্শন না করেই সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে ইসলামের দৃষ্টিভংগী অত্যন্ত সাহসিকতা এবং প্রামাণ্য তথ্য প্রমাণসহ উপস্থাপন করেন। তার ক্ষুরধার লেখনীর সর্বাপেক্ষা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট ও পরিপূর্ণতা হচ্ছে এই যে, তিনি পশ্চিমা দার্শনিক পন্ডিতদেরকে তাদের নিজেদের লেখনী এবং বাস্তবতার নিরীখে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।এমনকি তাদের দুর্বিনীত মস্তক অবনত করতে বাধ্য করেছিলেন। তার রচিত গ্রন্থাবলীর বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা এখানে উদ্দেশ্য নয়। শুধু উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটা বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা হলো। সারকথা এই যে তিনি একাই তার সংগঠনকে এত বিপুল পরিমাণে বিশ্বাস ও চিন্তার বিশুদ্ধিকরণ অস্ত্রযোগন দিয়ে গিয়েছেন যে, যদি কর্মীরা কাজ করতে ইচ্চা করে, তাহলে কোন ময়দানেই তাদের পরাজয়ের গ্লানিতে নিমজ্জিত হতে হবে না।
হাসানুল বান্না শহীদের যে সংক্ষিপ্ত অবকাশ নসীব হয়েছিলো, তাতেই তিনি ইসলামী আন্দোলনের চারা মানুষের মনের গভীরে প্রোথিত করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অত্যন্ত সাদাসিদে ভাষায় ও সহজবোধ্য বর্ণনা ভংগীতে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রাম গঞ্জে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তার পয়গাম ছড়িয়ে দেন। কৃষক মজুর জনতা তার পার্শ্বে এসে সমবেত হয়। সাহিত্য রচনা এবং প্রত্যেক বিষয়ের চিন্তা-চেতনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে তার অনুসারীগণ অত্যন্ত চমৎকারভাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তিনি মন ও মস্তিষ্কের নিকট আবেদন রাখেন। কিন্তু তার আবেদন দেমাগের তুলনায় দিলের নিকটই ছিলো বেশী। একইভাবে সাইয়েদ মওদূদী মানুষের মন ও মস্তিষ্ক উভয়ের উপরই কারাঘাত করেছিলেন; তবে তার লক্ষ্য ও গুরুত্ব ছিলো দেমাগের উপরই সমাধিক।
জামায়াতে সাইয়েদ মগুদূদী পরও চিন্তাশীলগনের ঘাটতি দেখা দেয়নি। তথাপি সত্য কথা হলো এ পর্যায় জামায়াত অপেক্ষা ইখওয়ান অনেক অগ্রসর ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। জামায়াতের চিন্তাবিদগণের মধ্যে মিয়া তোয়ায়েল মুহাম্মদ, মাসউদ আলম নাদভী মারহুম, অধ্যাপক আবদুল হামিদ সিদ্দিকী মারহুম, অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মদ, মালেক গোলাম আলী, নাঈম সিদ্দিকী, জান মুহাম্মদ ভূট্টো, সাইয়েদ হামেদ আলী, সাইয়েদ আসআদ গিলানী, আবাদ শাহপুরী, মুহতারাম খলিল আহমদ হামিদী, খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, মুহতারিমা মরিয়ম জামিলা, মুহাম্মদ সুলতান, মুহতারাম আবুল লাইছ, ডক্টর নাজাত উল্লাহ সিদ্দিকী, সদরুদ্দীন ইসলাহী, মুহাম্মদ ইউসূফ ইসলাহী, সাইয়েদ সরুজ কাদেরী, মুহতারাম আবদুল হাই, মারহুম আবদুর রহীম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কলম ধরেছিলেন এবং অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থাবলী দ্বারা সুধী পাঠক মন্ডলীকে ধন্য করেছেন এবং আজো করে চলেছেন। কিন্তু ইখওয়ান চিন্তাবিদগণের অবস্থান এক্ষেত্রে অনেক উর্ধে। হাসান আল হুদাইবি মারহুম, আবদুল কাদের আওদাহ শহীদ, মুহাম্মদ আল গাযালী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, মুহাম্মদ কুতুব, ইউসূফ আল কারযাভী, মুস্তাফা সিবায়ী মারহুম, মুস্তাফা যারকা, আল বাহী আল খলি, ফাতহী ইয়াকীন, সাঈদ হওয়া যায়নাব আল গাযালী, সাঈদ রামাদান, ইমাম আল খাত্তাব এর ন্যায় আরো অনেকে ছিলেন বা আছেন এরা এমন দূরদর্শী বিদগ্ধ সুপন্ডিত ব্যক্তিত্ব যে ইসলামকে জীবনের বিস্তীর্ণ অংগনে বলিষ্ঠ দলীল প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন। তারা শুধুমাত্র তাদের অনন্য সাধারণ জ্ঞান প্রতিভা ও লেখনী শক্তির স্বীকৃতিই সমসাময়িক বিশ্ব থেকে আদায় করেনেনি। বরং জ্ঞানের প্রতিটি মানদন্ডে এবং সাহিত্যিক হিসেবেও তাদের মর্যাদা সর্বজন স্বীকৃত। কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ও সমালোচকই এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না। তাদের লেখনীতে নতুনের ছাপ এবং শক্তি অনেক বেশী। প্রতিপক্ষকে লাজবাব করে দেবার মত তাদের যুক্তির বাস্তবতা। আপন দীপ্ততে ভাষ্বর যদি আমরা গভীর অন্তর্দৃর্ষি দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ণ করি তাহলে সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে যে অনাগত কালের বংশধরদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রস্তুত এ স্বর্ণমালার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ক্রমশ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। পক্ষান্তরে ইখওয়ানের মধ্যে এর বাঁধন আগামী দিনগুলোতে আরো সুবিন্যস্ত হবে বলে মনে হয়।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত ইংরেজী মাসিক আরাবিয়া (ARABIA) পত্রিকার ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর সংখ্যার উপসম্পাদক প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব ফাতহী উসমান “মুহতারাম মওদূদীর জীবনী ও কৃতিত্ব” শিরোনামে একটা প্রামাণ্য তথ্যবহুল ও মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি যদিও মৌলিকভাবে সাইয়েদ মওদূদীর (র) জীবনী ও কর্মতৎপরতার ওপর লিখিত হয়েছিলো, তথাপি বিদগ্ধ লেখক সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদ এবং সাইয়েদ মওদূদী উভয়ের সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়গ্রাহী তুলনামূলক আলোচনা পেশ করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর মতে সাইয়েদ হাসানুল বান্না শুরুতেই দলীয় শৃংখলা বিধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সমাজের বিভিন্ন স্তর ও শ্রেণী বিশেষত গ্রামীণ জনপদকে আন্দোলন সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত করে তোলেন, অথচ তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে সাইয়েদ মওদূদী লেখনী ও সংবাদ পত্রের মাধ্যমে তার সংস্কার কাজের শুভ সুচনা করেন। দলীয় ভিত্তি রচনার পূর্বে আর আকৃতি প্রকৃতি কাল্পনিক স্বরূপ ও মনস্তাত্বিক রূপরেখা পূর্ণাঙ্গ এবং ভারসাম্যপূর্ণ দলিল প্রমাণ সহ সাধারণ মুসলমানদের সামনে উপস্থপন করেন। সাইয়েদ মওদূদী বিরচিত গন্থ “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” গ্রন্থর নাম ও পর্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যা আল্লামা ইকবাল এবং মুহাম্মদ আলী জাওহার এর মত মহান নেতা ও পথনির্দেশকগণের ভূয়সী প্রশংসা ও অকুণ্ঠ স্বীকৃত আদায় করতে সক্ষম হয়। এ দু’পথপ্রদর্শকই নওজোয়ান মওদূদী অফুরন্ত সম্ভাবনা ও প্রতিভা লক্ষ্য করে তাকে নীরবে সুশৃংখলভাবে কাজ করে যাবার জন্য উৎসাহিত করেন, প্রাচ্যের কবি সম্রাটের ঐকান্তিক উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে সাইয়েদ মওদূদী সপরিবারে হিজরত করে পূর্ব পাঞ্জাব চলে আসেন এবং দারুল ইসলাম নামক আদর্শ পল্লীর ভিত্তি স্থাপন করেন..............
ফাতহী উসমান একদিকে যেমন ছিলেন একজন প্রখ্যাত কলামিষ্ট, সমালোচক ও আলেমে দ্বীন। তেমনি অন্যদিকে ছিলেন ইখওয়ানের অন্যতম নিবেদিত প্রাণ সদস্য। উপরোল্লেখিত লেখায় আল্লামা মওদূদী সম্পর্কে তার মূল্যায়ণ ও পর্যালোচনায় একথাও উল্লেখ করেন যে, মারহুম উন্নত চিন্তার দিক থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী এবং এ কারণে ইখওয়ানের সমস্ত নেতা ও লেখকের উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তিনি বলেনঃ
আল্লামা সাইয়েদ মওদূদী গ্রন্থাবলী যখন আরবী ভাষায় অনুদিত হয়ে ইখওয়ানী যুবক এবং জ্ঞানী ও চিন্তাশীলদের হাতে পৌছে, তখন তারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তারা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন যে, তাঁর লেখায় অত্যন্ত গভীরতা, প্রভাব যুক্তির বলিষ্ঠতা রয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক তথা প্রতিটি দিক ও বিভাগে তার রচিত গ্রন্থারাজি এমন জনপ্রিয়তা লাভ করে যার তুলনা মেলে না.................
জনাব ফাতহী উসমানের এ মূল্যায়ন যথার্থ যে আল্লামা মওদূদীর পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যাকর। বিদগ্ধ পন্ডিত সমাজ তাঁর লেখা পাঠ করে সম্বিত ফিরে পায়। তাঁর সাথে সাথে যদি সমকালীন ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে একমাত্র উস্তাদ মওদূদী ব্যতীত অবশিষ্ট সকল লেখকের (জামায়াত ও ইখওয়ানের লেখকবৃন্দসহ) মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। ইখওয়ানের অধিকাংশ লেখক যাদের নাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে এর চিন্তা এবং লেখায় নতুনত্ব ও মৌলিকত্ব রয়েছে। কিন্তু জামায়াতের লেখকগণের মধ্যে অধিকাংশের ইলমী কাজ উন্নত মান ও মূল্য এবং কল্যাণকারিতাসহ সুবিন্যস্ত তথ্যের মর্যাদা রাখে।
এ বিষয়ে অধিক লেখার অবকাশ নেই। অন্যথায় উদাহরণসহ বিভিন্ন লেখকের কাজের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করা যেতে পারতো। আরব ও পশ্চিমা দেশগুলোতে মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রীর জন্য সমকালীন সময়ে বহু মূল্যবান, তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে মুর্শিদে আম তার স্মৃতি চারণ গ্রন্থে এরূপ একটা প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন, আমার মনে হয় মুসলিম বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও এসব বিষয়ে থিসিস লেখার সুযোগ দেয়া উচিত। উপরোল্লেখিত বিষয়টি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং এর তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধের শিরোনাম হতে পারে।
ইখওয়ানের প্রথম মুর্শিদে আম মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ১৯৪৯ সালে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করেন। কিন্তু শাহাদাতের পূর্বে তিনি সমাজ জীবনের প্রত্যেক স্তরে সংগঠন কায়েম করেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের মধ্যে ইখওয়ানের কাজ শুরু থেকেই খুব শক্তিশালী ও সুশৃংখল ছিলো। গ্রামীণ চাষা-ভুষা ও কিষাণ-মজুর ছিলো এ সংগঠনের আগ্রণী বাহিনী। জামায়াত প্রথম থেকেই তার কর্মসূচীর মধ্যে এসব পেশাজীবি ও শ্রমজীবিশ্রেণীর মানুষদের সুশৃংখল করার বলিষ্ঠ সংকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কার্যক্ষেত্রে এ কাজ অনেক দেরীতে শুরু হয়। ফলে জামায়াত তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি, ইখওয়ান সংশ্লিষ্ট আংগনে যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলো। কেবলমাত্র ছাত্ররাই এমন একটা শ্রেণী যাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী ছাত্র সংগঠন ‘জমিয়তে তালাবা’ প্রথম থেকেই তৎপর ছিলো। অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাচনে কখনো কখনো জামায়াত তার প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করেছে। যেখানে গ্রাম, গ্রামান্তরে শতকরা আশিজন লোকের বাস- তারা আজও জামায়াতের দাওয়াত থেকে কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বহুদূরে অবস্থান করছে।
সাংবাদিকতার ময়দানে অবশ্য দুটি সংগঠনই বেশ কিছু কাজ করতে সক্ষম হয়েছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই ছিলেন একজন উচ্চস্তরের এবং সর্বজন স্বীকৃত সাংবাদিক। তিনি ছাড়াও মালিক নাসরুল্লাহ খান আযীয মারহুম, মিসবাহুল ইসলাম ফারূকী মারহুম, মুহতারাম আবদুল হামিদ সিদ্দিকী, নাঈম সিদ্দিকী, মাহেরুল কাদেরী মারহুম, চৌধুরী গোলাম জিলানী, হাসের ফারূকী, মাহমুদ আহমাদ মাদনী, মুজাফফর বেগ অনেক নওজোয়ান সাংবাদিক সাংবাদিকতার জগতে তাদের আসন করে নিয়েছেন। ইখওয়ানও সাংবাদিকতার ময়দানে অনেক বিধিনিষেধ সত্ত্বেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
জনাব উমর তিলমিসানী, হুসাইন আশুর, জনাব সালেহ আল ইসমাদী মারহুম, ফাতহী উসমান, নিশাত আল মিসরী, মুহাম্মাদ সালাহ উদ্দীন (আল-মাদানী), ইসমাঈল শাত্তী, ডক্টর মুহাম্মদ মাওরিদ এবং আরো অগণিত ইখওয়ানী সাংবাদিক এ পেশায় তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতি আদায় করেছেন। অনেক বিধিনিষেধ আরোপ সত্ত্বেও বেশ কয়েকটা দুনিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। সাংবাদিকতার জগতে দুটি সংগঠনের লেখকগণই ধর্মনিরপেক্ষ, কমিউনিষ্ট, বেদ্বীন, সুযোগসন্ধানী সরকারের বেতনভোগী সাংবাদিকদের সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছেন।
উপরে জনাব ফাতহী উসমানের যে প্রবন্ধের উল্লেখ করা হয়েছে তাতে তিনি ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ ও সাইয়েদ মওদূদীর (র) ব্যক্তিত্বের তুলনামূলক আলোচনা করে বলেছেন যে, দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বি ব্যক্তিত্বের প্রত্যেকেই দ্বীনি এবং আধুনিক জ্ঞানে সুগভীর পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। দ্বীনের সামগ্রিক ধারণা তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মতামতে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তারা উভয়েই ইসলামকে দ্বীন ও দুনিয়ার একমাত্র অনুসরণকারী আদর্শ বলে মনে করতেন। তাদের দৃষ্টিতে দ্বীন ও সরকার দুটি ভিন্ন জিনিস ছিল না। বরং একই যন্ত্রের দুটো অংশ মাত্র ছিলো। আলেম সমাজ ও রাজনীতিবিদ এই দুটি শ্রেণীর জন্যই এ ধারণা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই সরকার এবং মিসর ও মিহরাব উভয়স্থান থেকেই তাদের বিরোধিতা করা হয়েছে।
বস্তুত ফাতহী উসমান সাহেবের এই মূল্যায়ণ সম্পূর্ণ সঠিক ও যথার্থ। মিসরে যদিও আলেমদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা ততটা জোরদার হয়নি যতটা দেখা গিয়েছে এ উপমহাদেশে। তথাপি আলেমদের একটা ক্ষদ্র অংশ ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ফতোয়া দান এবং তাদেরকে ‘বিভ্রান্ত সংগঠন’ বলে মন্তব্য করাকে তাদের জীবনের মিশন বানিয়ে নিয়েছিলো। এখন থাকে জামায়াতে ইসলামী ও এ উপমহাদেশের আলেমদের ব্যাপারে। এ ক্ষেত্রে এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা কারো নিকটই অস্পষ্ট নয়। উরামা শ্রেণী প্রথম দিন থেকেই জামায়াত এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে পুরোপুরি যদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বসেছিলো। সত্যনিষ্ঠ নগণ্য সংখ্যক আলেম ছাড়া সবাই তাদের সে অনমনীয় আচরনের ওপর এখনো অটল রয়েছে। সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর বিরোধিতা তো কিছুটা উপলব্ধি করা যায় কিন্তু দ্বীনি আলেমদের এ কর্মনীতি একাধারে দুঃখজনক এবং বিস্ময়কর!
ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি ভিন্ন নয়। এ কারণেই ইখওয়ান ও জামায়াত উভয় সংগঠনই যুগপৎ জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগের সংশোধন সংস্কারে সাথে সাথে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইখওয়ান কখনো রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণের অনুমতিই লাভ করেনি। জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক ময়দানে বাহ্যতঃ তেমন উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। যদিওে সংগোপনে ও একান্তভাবে অর্থাৎ সাংগঠনিকভাবে প্রচুর সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত যে, এসেম্বলী এবং কাউন্সিল নির্বাচনী আসনসমূহের অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামায়াতের ব্যর্থতা সত্ত্বেও দেশের সাধারণ রাজনৈতিক ময়দানে শাসনতন্ত্র ও সংবিধান প্রণয়ন ও পরিবর্তনে অনৈসলামিক দৃষ্ঠিভংগীর মোকাবিলায় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও জনমত সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ প্রেমিক এবং ইসলামপ্রিয় শক্তির সাথে জামায়াতের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ দেদীপ্যমান। জামায়াতের সুসংগঠিত প্রচেষ্টা এবং এর কর্মীদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা বিরুদ্ধবাদীদের নিকট প্রশংসা কুড়িয়েছে। কোন ব্যতিক্রম ছাড়া দেশে আজ পর্যন্ত কোন আন্দোলনই জামায়াতের অংশগ্রহণ ছাড়া সফলতার মুখ দেখতে পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর ফাঁসির পর বেগম নুসরাত ভুট্টো যখন তার প্রতিশোধমূলক রাজনীতিকে সফল করার লক্ষ্যে গণতন্ত্র “পুনর্বহাল আন্দোলন” নামে একটা আন্দোলন পরিচালনা করতে চাইলে দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে ধর্ণা দেন। আন্দোলন পরিচালনা সকল চেষ্টা যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছিলো তখন নুসরাত ভুট্টো সাহেবকে এরূপ মন্তব্য করতে হয়েছিলো যেঃ
“যতোদিন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী কোন আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ না করে, ততদিন তার সফলতা নিশ্চিত হতে পারে না।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা জামায়াতের জন্য এমন একটা সার্টিফিকেট যা একজন প্রবল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিতে হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মরহুম একবার বলেছিলেন যে, এদেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের একটা মূল্য আছে; কারো কম আবার কারো কিছু বেশী। সে মূল্য আদায় করে দিলেই আপনি তাকে পেয়ে যাবেন। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর লোকদের কোন মূল্য নেই। তাদেরকে না খরিদ করা যায় না দমন করা যায়। প্রায় একই রকম বিবৃতি আইয়ুব খান সাহেবেরই এক ঘনিষ্ঠ সাথী এ, কে, সুমার মরহুমও করাচীতে মৌলিক গণতন্ত্রের অধীন এম, এন, এ নির্বাচিত হবার পর দিয়েছিলেন।
জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে জামায়াত কখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে বিজয়ী হতে পারেনি। কিন্তু ভুট্টোর মত একনায়ক যিনি ক্ষমতার মসনদ মজবুত হওয়ার ব্যাপারে গর্বিত ছিলো শেষ পর্যন্ত ইছরায় অবস্থানরত দরবেশের নিকট গিয়ে হাজির হতে হয়েছিলো। এটা জামায়াতের শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির অনস্বিকার্য প্রমাণ। দেশে যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও স্বাধীন ন্যায়ানগ পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকতো, তাহলে জামায়াত দেশের রাজনীতিতে এসেম্বলীতেও এতদিনে একটা শক্তি-হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো। তাছাড়া পকিস্তান আরো একটা সমস্যার সম্মখীন আর তা হচ্ছে এখানকার নির্বাচন পদ্ধতি। যদি কখনো ভুলক্রমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছেও তাহলে কারচুটি ও অসৎ পন্থা ছাড়াও তা হয়ে থাকে। বৃটিশ পদ্ধতির নির্বাচন সে বিষয়ে স্বয়ং বৃটেনের রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জনমত বর্তমানে সন্তুষ্ট নয়। ভোটার সিন্ধুর ভালুকাময় প্রান্তরে, বেলুচিস্তানের কঙ্করময় উপত্যকায়, পাঞ্জাবের গ্রামে গঞ্জে এবং সীমান্তের বরফাবৃত পর্বত চূড়ায় অর্থাৎ দেশের সর্বত্রই জামায়াতের ভোটার রয়েছে। কিন্তু তারা আছে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যদি আনুমানিক প্রতিনিধিত্বের নীতি গ্রহণ করা হয় তাহলে সব ভোট জাতীয় বা প্রাদেশিক পর্যায় একত্র হয়ে নির্বাচনের ফলাফলকেই বদলে দিতে পারতো।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই জামায়াতকে ভয় পায়। এদেশের ক্ষমতার মসনদে কোন ধর্মহীন অথবা মদ্যপায়ী আরোহন করুক কিংবা বাহ্যত কোন দ্বীনদার নামাযী শাসনকর্তা জেকে বসুক সরকারের গোটা মেশিনারী জামায়াতের অগ্রগতিতে অন্তরায় সৃষ্টির জন্য সকল শক্তি নিয়োজিত করে। এটা কতই না বিস্ময়কর যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে দেশের চারটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ঘোষণাপত্রে আনুমানিক প্রতিনিধিত্বের দাবী পেশ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ব্যতীত অন্যসব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের ঘোষণাপত্র থেকে দূরে সরে গিয়েছে। পিপলস পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, তাহরীকে ইস্তিকলাল ও জামায়াতে ইসলামী সকলেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবী করেছিলেন। যদিও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দ্বারা অন্যান্য পার্টি লাভবান হতে পারতো। কিন্তু বিদ্বেষের কারণে তারা সবারই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে অনীহা দেখা যায়।
রাজনৈতিক ময়দানে ইখওয়ান এখনো স্বাধীনভাবে অংশ গ্রহণের অনুমতি পায়নি। সিরিয়া, মিসর, জর্দান এবং সুদানে এ সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিস্তারিত বিশ্লেষণে না গিয়ে আমরা এতটুকু বলতে পারি যে, ইখওয়ানকে যদি জামায়াতের ন্যায় নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক দৃশ্যটাই বদলে যাবে। গত বছর মিসরে যে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির নির্বাচন হয়ে গেলো তার উল্লেখ করেছেন মুর্শিদে আম তিলমিসানী (র) তার স্মৃতিচারণ গ্রন্থে। এ নির্বাচনে ইখওয়ান ছাড়াও দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে অংশ গ্রহণের ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিলো। কোন বৈধ রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন ও ঐক্যফ্রন্ট করা ব্যতীত ইখওয়ানের কোন গত্যন্তর ছিলো না। অতএব সংগত কারণেই ইখওয়ান “হিজবুত আফদুল জাদীদ” এর সাথে মোর্চা গঠন করে। প্রায় সাড়ে চারশত আসনের মধ্যে “হিজবুল অফদ” ইখওয়ানকে শুধু আঠারটি আসনে তাদের প্রার্থী মনোনয়নের অনুমতি প্রদান করে। অথচ ইখওয়ানের দাবী ছিলো তাদেরকে অন্তত শাতধিক আসনে প্রার্থী মনোনয়নের অনুমতি দেয়া হোক। কিন্তু হিজবুল অফদ তাদের সিদ্ধান্তের উপর অটল থাকে। ফলে ইখওয়ান আঠারটি আসন ছাড়া অবশিষ্ট সমস্ত আসনেই হিজবুল অফদ এর প্রার্থীকে নির্বাচনী যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে দেয়।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার পর সকলেই হতবাক হয়ে যায় এবং চোখ কপালে তুলে নেয়। হিজবুল অফদ এবং ক্ষমতাসীনদল ছাড়া অন্যান্য পার্টি হিজবুত তাজাম্মু ও হিজবুল আহরার প্রভৃতির কেউ-ই একটা আসনও লাভ করতে পারেনি। হিজবুল অফদ সর্বমোট আটান্ন আসন পেয়ে যায়। তন্মধ্যে আট চল্লিশ আসনে জয়লাভ করে হিজবুল অফদ এর সদস্যরা। অবশিষ্ট দশ আসন লাভ করে ইখওয়ান। ইখওয়ান আঠারজনের মধ্যে দশজন প্রতিনিধির বিজয়লাভ বড় রকমের সফলতাই বটে। আরো উল্লেখ যে অন্য কয়েকটি আসনেও ইখওয়ানের প্রার্থীগণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিদের চেয়ে অধিক ভোট লাভ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতিই এমন ছিল যে, তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ, প্রত্যেক জেলাকে নির্বাচনী এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিলো এবং জেলার সীমানা সরকার তার মর্জিমত করে নিয়েছিলো। এখন মনে করুন একটা নির্বাচনী জেলায় চার কিংবা পাঁচটি রয়েছে। প্রত্যেক পার্টি তাদের চার অথবা পাঁচজন প্রার্থী মনোনয়ন দান করবে এবং প্রত্যেক প্রার্থী নিম্নোক্ত ছকে বর্ণিত জেলায় তার প্রতিদ্বন্দির মোকাবিলা করবে। কিন্তু ফলাফলের ঘোষণা দেয়ার কথা সামষ্টিক ভোটের আলোকে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করুন। মনে করি ‘ক’ নামক জেলায় রয়েছে চারটি আসন আর এ আসনগুলোতে নিম্নোক্ত প্রতিনিধি ও দলসমূহ অংশ গ্রহণ করছে।
নির্বাচনী জিলা- ক
এলাকা নং- ১
ক্ষমতাশীন দলা অফদ পার্টি অন্যান্য পার্টি
১২ হাজার (অফদী) ২ হাজার
৯ হাজার
এলাকা নং -৩
ক্ষমতাশীন দল অফদ পার্টি অন্যান্য দল
৯ হাজার (ইখওয়ানী) ৩ হাজার
১৪ হাজার এলাকা নং- ২
ক্ষমতাশীন অফদ পার্টি অন্যান্য দল
দল ১৫ (অফদী) ২ হাজার
১১ হাজার
এলাকা নং- ৪
ক্ষমতাশীন অফদ পার্টি অন্যান্য দল
দল ২৬ হাজার (অফদী) ১ হাজার
১৩ হাজার

উপরোক্ত নকশার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে অফদ পার্টি ’ক’ জেলার অধীনে চারটি আসনের প্রত্যেকটিতেই তার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলো। তন্মধ্যে তিন অঞ্চলেই ছিলো অফদ পার্টির প্রার্থী এবং মাত্র একটা এলাকায় ছিলো (ক অঞ্চল-৩) ইখওয়ানের প্রার্থী। ইখওয়ানের মনোনীত প্রার্থীগণ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিদের উপর সুস্পষ্ট অগ্রগতি লাভ করেছিলো। কেননা ঐ অঞ্চলে সর্বমোট ছাব্বিশ হাজার ভোট পড়েছিলো। তন্মধ্যে ইখওয়ানের প্রার্থী লাভ করে চৌদ্দ হাজার ভোট, ক্ষমতাশীন দলের প্রার্থী পায় নয় হাজার ভোট আর অন্যান্য দলের প্রার্থীরা পায় মাত্র তিন হাজার ভোট। এরূপ একক ও নিরংকুশ বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও ইখওয়ানের প্রতিনিধিকে বিজয়ী ঘোষণা করা যেতে পারে না। কেননা তার অপর তিন সাথী তাকে নিয়েই ভরাডুবির শিকার হয়েছে। তাই ভোট গণনা করার সময় চার অঞ্চলের সংগৃহিত ভোটই একত্রিত করা হয় এবং গড় গণনায় যে দলের প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে, তারাই সমস্ত আসনে জিতে যায়। তা ছাড়া যেদল বা জোট শতকরা আট ভাগেরও কম ভোট পায়। তাদের প্রাপ্ত ভোটেও এগিয়ে থাকা দলের অনুকূলে হিসেব করা হয়।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী ‘ক’ জিলার ভোটার সংখ্যা ও আসনসমূহ চিহ্নিত করার জন্য চার অঞ্চলের ভোট এক পুলে নিয়ে একত্র করা হয়।
ক্ষমতাশীন দল অফদ পার্টি অন্যান্য দল
‘ক’ নির্বাচনী অঞ্চল ১২ হাজার ৯ হাজার ২ হাজার
‘খ’ ” ” ১৫ হাজার ১১ হাজার ২ হাজার
‘গ’ ” ” ৯ হাজার ১৪ হাজার ৩ হাজার
‘ঘ’ ” ” ১৬ হাজার ১৩ হাজার ১ হাজার
নির্বাচনী ফলাফল ৫২ হাজার ৪৭ হাজার ৮ হাজার
এভাবে চার আসনেই সরকারীদল বিজয়ী হয়ে যায়। এদিকে অফদ ও ইখওয়ান সম্মিলিতভাবে যে আটান্ন আসনে বিজয় লাভ করে, তা বিভিন্ন নির্বাচনী জেলায় সামষ্টিক বিজয়ের কারণে হয়। ইখওয়ানের মুর্শিদে আম মুহতারাম উমর তিলমিসানী (র) নির্বাচনোত্তরকালে এক সাক্ষাতকারে এ তথ্য প্রকাশ করেন যে, কিছু সংখ্যক ইখওয়ান অফদ পার্টির এলাকা থেকেও নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে পৌছে গেছে। তিনি অবশ্য তাদের সংখ্যা ও নাম বলতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, সরাসরি ইখওয়ানের পরিচয়ে ও তাদের ব্যানারে যেহেতু আমাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের অনুমোদন নেই, তাই আমরা অত্যন্ত সুকৌশলে প্রত্যেক প্লাটফরম ব্যবহার করে পার্লামেন্টে গিয়ে পৌছার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। মিসরীয় পার্লামেন্টে গমনকারী দশজন ইখওয়ানী সদস্যের প্রত্যেকে খুবই যোগ্যতাসম্পন্ন এবং স্বীয় দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে সম্পাদনে সদা প্রস্তুত। বিদায়ী পার্লামেন্টেও ইখওয়ানের কোন কোন সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলো। তাদের মধ্যে শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলও ছিলেন। তিনি এবারও বিজয়ী দশজন সদস্যের অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। যারা অফদ পার্টির টিকেটে বিজয় লাভ করেছে। প্রচলিত নির্বাচনে পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভের কোন সুযোগ নেই। শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলই অফদ পার্টিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন পার্লামেন্টে। যার ফল দাঁড়ায় এই যে, সরকার ইখওয়ান ব্যতীত অন্য সকল দলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়। যেসব পার্লামেন্ট সদস্য স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, তাদেরকেও এখতিয়ার দেয়া হয় যে, তারা ইচ্ছা করলে কোন দলের পতাকা তলে সমবেত হতে পারেন। হিযবে আফদ এর প্রধান ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন গিয়ে শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈলের নিকট আবেদন জানায় যে, তিনি যেন অফদ পার্টির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন যেহেতু ইখওয়ানের ওপর বরাবর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিলো সেহেতু পারস্পারিক পরামর্শক্রমে ইখওয়ানে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে শাইখ সালাহ অফদের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
শাইখ সালাহ ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, সামাজিক, বন্ধুপ্রতীম, খুবই উন্নত চরিত্রের অধিকারী এবং অনুপম নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন। তার সুন্দর চেহারায় সর্বদা লেগে থাকতো মুচকী হাসির দৃপ্তি। সুদানে তার সাথে আমার সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব, যুক্তি-প্রমানসব স্বীয় বক্তব্য উপস্থাপন করা তার বৈশিষ্ট্য। কিছু দিন তিনি পার্লামেন্টে একাকী ছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই আরো আটজন সদস্য তার সাথে এসে মিলিত হয়। অফদ এর বর্তমান পার্লামেন্টারীদলের নেতা মমতাজ নাসার ছিলেন এ গ্রুপে এসে শামিল হওয়া সর্বাশেষ সদস্য।
শাইখ সালাহ আবু ইসমাঈল মূলত একজন আলেমে দ্বীন। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং বিশেষ করে পার্লামেন্টারী বিষয়েও তাঁর রয়েছে সুগভীর পান্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভংগী। বিগত পার্লামেন্টে তিনি যেরূপ বিচক্ষণতার সাথে কয়েকটা বিল উত্থাপন করেছিলেন এবং পার্লামেন্টে আলোচনা পর্যালোচনা চলাকালে অকট্য যুক্তি ও বাক চাতুর্য দ্বারা তার দৃষ্টিভংগী তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো পাশ করিয়ে ছেড়েছেন তা পার্লামেন্টারী ইতিহাসে কোন একক ব্যক্তির মহাকৃতিত্ব হিসেবে উজ্জল ও ভাস্কর হয়ে থাকবে। এটা অবশ্য স্বতন্ত্র কথা যে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঐ সব আইনে সাক্ষরদানকারী ক্ষমতাসীনদের তাতে স্বাক্ষর দিয়ে ইতিহাসে নিজেদের সুখ্যাতি লিপিবদ্ধ করানোর তাওফীক ও সৌভাগ্য হয় না।
বর্তমানে পার্লামেন্টে এক ভাষণ দানকালে জনাব মুহাম্মদ আল মুরাগী (ইখওয়ানের প্রখ্যাত সদস্য) সরকারের নিকট দাবী জানান যে, ইখওয়ানকে আইনানুগভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ এবং পার্লামেন্টারী গ্রুপ গঠন করার অনুমতি দেয়া হোক। তিনি আরো বলেন, আমি প্রথমেও ইখওয়ানী এবং শেষেও ইখওয়ানী এবং সুকৃতির আদেশ ও দুষ্কৃতির প্রতিরোধ আমার জীবনের একমাত্র কর্তব্য। যা থেকে আমি কখনো কোন অবস্থায়ই উদাসীন থাকতে পারি না।
এ ঘটনার উল্লেখ করে কুয়েতের মাসিক ম্যাগাজিন ‘আল মুজতামা’ ১৯৮৫ ঈসায়ীর ৮ই জানুয়ারী সংখ্যায় যে জনাব আল মুরাগীর বক্তব্যের জবাবে পার্লামেন্ট বিষয়ক মন্ত্রী অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে স্বীকার করেন যে, ইখওয়ান প্রকৃতপক্ষে দেশেপ্রেমিক ও ইসলামের পতাকাবাহী দল। জনসাধারণ এ দলকে খুবই ভালবাসা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। মন্ত্রী তাওফীক আবদুহু ইসমাঈলের এ সাহসিকতাপূর্ণ স্বীকৃতি সমগ্র মিসর এমনকি পুরো মুসলিম জাহানে অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে শ্রুত হয়। ইখওয়ানের মুর্শিদে আম জনাব ওমর তিলমিসানী এ বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে বললেনঃ
সত্য সত্যই, কেউ তা স্বীকার করুক বা নাই করুক। তথাপি ইখওয়ানের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত এমন অকপটে ও দ্বিধাহীন চিত্তে কোন মন্ত্রী প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে নিলো। আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মনে করি যে, এটা একটা সঠিক পদক্ষেপ যার ফলাফল ইনশাআল্লাহ দেশ, জাতি এবং ইসলামের অনুসারীদের জন্য খুবই উপকারী ও আনন্দদায়ক হবে।
অতিসম্প্রতি উমর তিলমিসানী একটি সাক্ষাতকার আরবী প্রকাশিত দৈনিকগুলোতে হয়েছে। মিসরে ইখওয়ানের সমর্থকদের সংখ্যা কত এ বিষয়ের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি অকপটে তাৎক্ষনিক জবাব দেন যে, “শতকরা নববই ভাগ কিংবা তদপেক্ষা কিছু বেশী”। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিগণ বিস্মিত হয়েও পুনরায় জিজ্ঞাস করে যে, “এর প্রমাণ কি”? তিনি জবাবে বলেনঃ আজই ইখওয়ানকে আইনগত অধিকার দিয়ে দেখো এবং দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করো। তাহলে প্রমাণ পেয়ে যাবে। যদিও মুর্শিদে আম-এর এ অনুমান বাহ্যতঃ প্রত্যাশা বলেই মনে হয়। তথাপি এটা অনুস্বীকার্য যে সর্বাসাধাণের নিকট ইখওয়ান খুবই প্রিয় একটি সংগঠন।
৭১ পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ইতিহাসে জামায়াত ইসলামীর সদস্য অতি নগণ্য সংখ্যায় জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও জাতীয় পরিষদে তাদের তৎপরতা সর্বদা গৌরবোজ্জলও প্রমাণিত হয়েছে। ইউনাইটেড পাকিস্তানে মাওলানা আবদুস সোবহান, এ, কে, এম ইউসুফ এবং আব্বাস আলী খান এবং বিভাগোত্তর পাকিস্তানের অধ্যাপক গফুর আহমদ মাহমুদ আযম ফারূকী, ডাক্তার নাজির আহমদ শহীদ এবং সাহেব জাদা শফি উল্লাহ প্রমূখ যোগ্যতম পার্লামেন্টেরীয়ান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রশ্নোত্তর পর থেকে কিংবা বাজেট, পররাষ্ট্র বিষয় অথবা আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলা বিধানের বিল পার্লামেন্টে আলোচনার বিষয় হিসেবে স্থান লাভ করুক- প্রত্যেক ক্ষেত্রে সকল পর্যায়েই হাতেগণা এই পার্লামেন্ট সদস্যগণ তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থান কোন ক্ষেত্রেই- কম নয় বলে সংখ্যা গরিষ্ঠ দলের নিকট থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। জনগণের মধ্যে কবে নাগাদ উপলব্ধি জাগ্রত হবে যে, এসব লোকই তাদের অধিকারের বিশ্বস্ত সংরক্ষক যাদের কর্মজীবন নিষ্কলুস এবং যাদের যাবতীয় প্রয়াস-প্রচেষ্টা পংকিলতা ও আবিলতা মুক্ত। জামায়াতে ইসলামীরও দায়িত্ব রয়েছে যে, অফিসের সীমানার বাইরে গিয়ে এবং তাদের রিপোর্টের পর্দা ছিন্ন করে বাস্তব ময়দানের চাহিদা ও সময়ের দাবীর প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করবে। ইখওয়ান জনগণকে সচেতন করে ও জাগিয়ে তুলে নিজেদের সাথে একাত্ম করে নিয়েছে। জামায়াতকে এ ক্ষেত্রে এখনও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে।
অবশ্য ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী উভয় সংগঠনই কঠোর পরীক্ষা ও প্রতিকুলতার বিভিন্ন মনজিল অতিক্রম করেছে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দুনিয়াতে হকের বিজয়ের জন্য যখনই কোন ব্যক্তি বা দল সাহসিকতার সাথে মাথা উঁচু করেছে তখনই তাদেরকে এসব মনযিল অতিক্রম করতে হয়েছে। কুরআন মজীদে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার হাদীসেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈমান ও ঈমানের পরীক্ষাকে পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করেছেন।
মুর্শিদে আম জনাব ওমর তিলমিসানীর এই স্মৃতি কথার স্থানে স্থানে এমন সব ঘটনা বর্ণনা আপনার দৃষ্টিগোচর হবে যা থেকে আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে বলিষ্ঠ ঈমান ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ইখওয়ানী মুজাহিদগণ তাদের মহৎ উদ্দেশ্য সিদ্দির স্বার্থে সকল প্রকার ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করার জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে থাকতো। বাতিল তার সমস্ত শক্তি ও নষ্টামী সত্ত্বেও তাদের মজবুত অবস্থানে কোন প্রকার বিচ্যুতি সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রথম মুর্শিদে আমকে তাঁর পূর্ণ যৌবনে মাত্র তিতাল্লিশ বছর বয়সে যেরূপ নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার ওপর বেশ কয়েকটা বই লেখা হয়েছে। আবদুল কাদের আওদা শহীদ ও তার সংগীদেরকে ১৯৫৪ সালে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। এসব অমূল্য জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি শুধুমাত্র নীল উপত্যকারই ক্ষতি হয়নি বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ অদ্যাবধি ও ক্ষতির জন্য তড়পাচ্ছে।
১৯৬৬ সালে পুনরায় সমকালীন ফেরাউন চলতি শতাব্দীর মহান ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ইসলামের কৃতি সন্তান সাইয়েদ কুতুব ও তার সাথীদেরকে ফাঁসি দেয়। এ ক্ষত কোন দিনও শুকাবে না কিংবা এ ব্যাপক ক্ষতির কোন ক্ষতিপূরণও কোন দিন হবে না। এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিলো সত্যের এ কাফেলাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করে দেয়া। কিন্তু এ অশুভ উদ্দেশ্য লাভে তাগুতী শক্তি কি আদৌ সফলকাম হয়েছে? কখখনো না!
জামায়াতে ইসলামীর উপরও বহু পরীক্ষা এসেছে। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতাকে মৃত্যুদন্ড শুনানো হয়েছিল এবং তার ঘনিষ্ঠ সাথীদেরকে দীর্ঘ মেয়াধী কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। এটা ১৯৫৩ সালের কথা, অর্থাৎ আওদা শহীদের শাহাদাতের এক বছর পূর্বে এবং ইমাম হাসানুল বান্না শাহাদাতের চার বছর পরে। ক্ষমা প্রার্থনার কথা উঠলে সাইয়েদ মওদূদী (র) এর মুখ থেকে সেই ঐতিহাসিক উক্তি উচ্চারিত হয় যা সোনালী হরফে লেখা হয়ে আছে এবং যার দীপ্তি কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের পথের পথপ্রদর্শনের পথ দেখাতে থাকবে। তিনি বলেছিলেনঃ “শুনে রাখো-----মৃত্যু এবং জীবনের ফয়সালা এ জীমনের উপর হয় না। বরং আসমানে হয়ে থাকে। যদি আমার মৃত্যুর সময় হয়ে থাকে, তাহলে দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আর যদি আমার জীবনের সময় এখনো বাকি থেকে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরাই উল্টো ফাঁসিতে ঝুলে যাবে। আমাকে মারতে পারবে না। এরপর থাকে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনের ব্যাপারটি। এরূপ দয়া ভিক্ষা কেবল একটি সত্তার কাছেই করা যেতে পারে যিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তোমাদের কাছে আমার জুতার কাঁটাও ক্ষমা চাইবে না.............।
এ উক্তির প্রতিধ্বনিতে বাতিলের প্রাসাদে ভূমিকম্পের কাঁপন ধরেছিলো এবং উক্তিকারী যে দৃঢ় বিশ্বাস থেকে একথা উচ্চরণ করেছিলেন সেই বিশ্বাসই ছিলো তাঁর কর্ম ও পুঁজি। জীবন অবশিষ্ট ছিল। তাই ফাঁসির কুঠরিতে স্থানান্তরিত হয়ে যাওয়া এবং ফাঁসির রজ্জু গলায় পরার সময় ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সত্যের সৈনিক বেঁচে থাকলেন। মৃত্যু পরাভূত হয়েছিলো এবং জীবন আশাভরা দৃষ্টিতে মুচকি হেসে ভবিষ্যত পানে তাকাচ্ছিলো।
আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাসে জামায়াতে ইসলামীর বার্ষিক সম্মেলনে প্রশাসনের ছত্রছায়ায় সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী দ্বারা আক্রমণ করানো হয়। এবারেও লক্ষ্য ছিলো সেই মর্দে দরবেশ যিনি ইতিপূর্বে আল্লাহর হুকুমে মৃত্যুকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁকে লক্ষ্য করেই গুলী বর্ষিত হচ্ছিলো এবং তাঁকে বসে পড়ার পরামর্শও দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ আরেকবার গর্জে উঠলো এবং চির অমর হয়ে থাকলো। “যদি আমি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?” ১৯৫৩ সনের ঘটনা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখ থেকে শুনেছিলাম এবং বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম। কিন্তু এ ঘটনা হাজার হাজার মানুষের মতো লেখক স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলো এবং ঈমান দীপ্ত কথা নিজ কানে শুনেছিলো। আজও ঐ কথাটির মুধরতা এবং তার সাথে ঈমানী শক্তি ও উষ্ণতা আমি নিজ কানে শুনেছিলাম এবং হৃদয়ের গভীরে উপলব্ধি করেছিলাম।
আল্লাহ বখশ শহীদ জীবনের নজরানা পেশ করলেন। এই অমূল্য জীবন হক এর রাস্তায় কুরবানী করার পর আন্দোলনের নেতা উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন।
“আমি এ মোকদ্দামা এমন এক আদালতে দায়ের করেছি যেখানে হক ও ইনসাফের সাথে ফয়াসালা হয়ে থাকে।” কবির ভাষায়ঃ
এ শহীদানের রক্তপণ গীর্জাধিপতিদের নিকট চেতনা!
যে খুনের মর্যাদা ও মূল্য হারাম শরীফ থেকেও পবিত্র!!
সে আদালতে ফয়সালার দিন তো নির্ধারিত সময়েই আসবে কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক আল্লাহ এই নশ্বর পৃথিবীতেও শ্রেষ্ঠ ও ঘটনার নায়কদের ভয়বহ পরিণতির সম্মুখীন করেছিল তা সত্যিই শিক্ষণীয়।
কারা জীবনের দুঃখকষ্ট জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা এবং মজলিশে শূরার সকল সদস্যকে বার বার ভোগ করতে হয়েছে। তথাপি বাতিলের সম্মুখে তারা কখনো মাথানত করেনি বা নতজানু হয়নি। সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতি দ্বারা সত্যানুরাগীদের হত্যোদম ও ভগ্নোৎসাহ করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রলোভনের ইন্দ্রজাল বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু বাজপাখীকে কোন মূল্যেই ফাঁদে ফেলা যায়নি।
মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু কোন অস্ত্র দিয়েই বিশ্বস্তদের অবিশ্বাসী ও নীতিহীন লোকদের সম্মখে নত করানো যায়নি। ভুট্টো ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করার পর দেশ বাসী তার নিকট থেকে জঘন্য একনায়কত্ব ও স্বৈরাশাসন উপহার পেয়েছে। প্রথমে দেশকে টুকরো টুকরো করা হলো। তারপর দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের নাম ও নিশানা মুছে ফেলার ঘৃণ্যতম পরিকল্পিত চক্রান্ত করা হলো। মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদকে গ্রেফতার করার পর জিন্দানখানায় তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করা হয় যা সকল যুগের বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত মার্জিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যার স্বভাবজাত সৌজন্য ও আভিজাত্য তার কট্টর বিরোধীরাও অকপটে স্বীকার করে থাকে। তাকে কারাগারের অন্ধকার প্রকেষ্ঠ গুণ্ডা বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে একান্ত নিষ্ঠুরভাবে চাবুক মারা হয়। তিনি দিনরাত তাদের অশ্রাব্য গালি গালাজের শিকার হতে থাকেন। তথাপি তাঁর অবিচল পায়ে না একটু কম্পন সৃষ্টি হয়েছে না তার আন্দোলনের সাথীদের উৎসাহ উদ্দীপনায় কোন প্রকার ভাটা পড়েছে।
ডাক্তার নাযীর আহমদ এবং অন্যান্য অগনিত অকুতোভয় নেতা ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীদেরকে পিপলস পার্টির গুন্ডা এবং এফ, এইচ এফ এর হায়েনারা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেয়। তা সত্ত্বেও কাফেলার অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি। এসব ঘটনাপ্রবাহ এখন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রতিটি ছাত্র এসব কাহিনী সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিফহাল রয়েছে।
জামায়াতের উপর যেসব কঠোর পরীক্ষা আপতিত হয়েছে তা ছিল জামায়াতের ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য। কিন্তু ইখওয়ানের ওপর অত্যাচার উৎপীড়নের কোন তুলনাই মেলে না। বছরের পর বছর এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিগণ যে পরিমাণ জুলুমেরন চাকায় পিষ্ট হয়েছেন কলম তা লিপিবদ্ধ করতে অক্ষম। তথাপি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পানে আগুয়ান এ কাফেলা আজও তার মনজিলে মাকসুদ অভিমুখে নিরন্তর ধাবমান রয়েছে। এটা তাদের বলিষ্ঠ ঈমান ও জিহাদী উদ্দীপনার অনস্বীকার্য প্রমাণ। বস্তুত বর্তমান শতাব্দীতে পরিচালিত দুনিয়ার কোন আন্দোলনের উপর এমন দুঃসহ বিপদ মুসিবত আসেনি যা এসেছে ইখওয়ানের ওপর। এ বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে ইখওয়ানের নেতৃবৃন্দ প্রচুর লিখেছেন যা বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে সত্যানুসন্ধানীদের ঈমানের উৎকর্ষ সাধনে নিয়োজিত রয়েছে। মুর্শিদে আম-এর এ স্মৃতিচারণ গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু সংখ্যক ঘটনা পড়লে শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায় এবঙ মনের মণিকোঠা থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে এরূপ দৃঢ়বিত্ত মহাপ্রাণ ব্যক্তিদের জন্য দোয়া বেরিয়ে আসে।
মুর্শিদে আম তিলমেসানী (আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবি করুন) তার এ গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাবলী ছাড়াও সম্প্রতি অপর এক সাক্ষাতকারে আরো কিছু হৃদয় বিদারক ও লোমহর্ষক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। “আল অতানুল আরাবী” পত্রিকায় প্রকাশিত এ সাক্ষাতকার থেকে একটা ঘটনা “আল মুজতামা” সাময়িকী তার ১৯৮৫ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশ করেছে। সাংবাদিক প্রতিনিধিবৃন্দ মিসরের নিবেদিত প্রাণ মুসলিম নওজোয়ানদের সম্পর্কে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে মুর্শিদে আম তার জবাবে বলেনঃ
তোমরা এ মানবতা বিধ্বংসী অত্যাচার-উৎপীড়নের প্রতি কেন শুধু অসহায়ের মত দৃষ্টিপাত করতে চাও, যা এ যুবকদের ওপর মিসরীয় কয়েদখানায় চলছে। মিসরের জেলখানায় বন্দী ইসলামী চিন্তাধারার অধিকারী যুবকদেরকে এমন পাশবিকতার লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে যা কল্পনাতীত। এরূপ অস্বাভাবিক ও অমানবিক আচরণের যথোপযুক্ত জবাব স্বরূপ যদি এ যুবকগণও রুঢ় আচরণ করতে উদ্যত হতো, তাহলে সে জন্য রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো এমন হৈচৈ আরম্ভ করে দিতো যা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের নিরাপদ রাখুন।
মিসরের জেলখানায় ১৯৫৪ এবং ১৯৬৫ সালে আমাদের সাথে নৃশংস আচরণ করা হয়েছে। তা অভিশপ্ত ইবলিশের চিন্তায়ও হয়তো কখনো স্থান পায়নি। আমি তোমাদেরকে কেবলমাত্র একটা কথাই বলে দিতে চাই যাতে তোমরা উপলব্ধি করতে পারো যে, এ পৃথিবীর বুকে ও যবনিকার অন্তরালে কত দুঃখজনক ঘটনা সংগঠিত হয়ে যাচ্ছে। “কারাগারের অভ্যন্তরে একবার আমার কুঠুরীর সম্মুখে আমারই এক সহোদরাকে এনে হাজির করা হয়। আমে কুঠুরীর ভেতর বন্দী ছিলাম এবং আমার পায়ে বেড়ি পরানো ছিল। জেল কর্মকর্তাদের সমাবেশের সামনে আমার ভগ্নিকে মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ শিশুর মত সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে ফেলা হয়। এ দৃশ্যের অবতারণা করা হচ্ছিলো আমার কুঠুরীর ঠিক সামনে-----।”
পাকিস্তানে ইসলাম বিরোধী শক্তিসমূহ এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণের ধমকই দিয়ে আসছে কিংবা পত্র-পত্রিকায় ও মঞ্চে ময়দানে ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারীনী দ্বীনি ভগ্নিগণের পবিত্র চরিত্রের ওপর অপবাদ ও কলঙ্ক লেপনের প্রচেষ্টয় নিয়োজিত রয়েছে। এমন কি মিসর ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব পৈচাশিক ও বর্বরোচিত আচরণ ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।
ইখওয়ানের পরীক্ষা ছিল জামায়াতের তুলনায় অনেক বেশী কঠিন ও হৃদয় বিদারক। কিন্তু ইসলামের এসব কৃতি সন্তানের প্রশংসা করতে হয়। কারণ, তাদের সংকল্প ও বলিষ্ঠতায় কখনো কোন দুর্বলতা স্থান পায়নি। এমন লোকেরাই নবী রাসূলদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং এরাই উজ্জল দ্বীপশিখা। আমার অন্তর সর্বদা তাদের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে থাকে। কবি বলেছেনঃ
থেকে যাবে তুমিই পৃথিবীতে অনন্য ও অদ্বিতীয় হয়ে!
কারণ তোমার হৃদয়ে প্রবিষ্ট হয়েছে লা’শারীকা লাহ!!
জামায়তে ইসলামী ও ইখওয়ানের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও অনুপম। দু’টি সংগঠনই তার কর্মীদেরকে এ শিক্ষা প্রদান করে থাকে যে সর্বপ্রথম নিজের ওপর কুরআন ও সুন্নাহকে কার্যকরী করবে এবং তারপর আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের চেষ্টা সাধনায় আত্মনিয়োগ করবে। ইসলামী আহকামের দৃষ্টিতে আমীরের আনুগত্য এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালবাসা এ আন্দোলনের অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য। যদিও এ সংগঠন থেকেও কোন কোন ব্যক্তি সয়ম বিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, কেউ একবার বুঝে শুনে তাদের সাথে গিয়ে শামিল হলে তারপর সারা জীবন এর সাথে একাত্ম থেকেই জীবন অতিবাহিত করে দেয়।
আশ্চার্যজনক কিছু করা এসব আন্দোলনের নীতি নয়। নীতি নৈতিকতা ও আইন কানুনের চৌহর্দ্দিতে থেকে লক্ষ অর্জনে ব্রতী হওয়াই এ দু’টি আন্দোলনের মৌলিক গুণ। শৃংখলা ও নিয়ন্ত্রণ এবং দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি এমন সব বৈশিষ্ট্য যার মোকাবেলা অন্য কোন দল করতে পারে না। মুর্শিদে আম তার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এ সূক্ষ্ম তত্ত্বটি অত্যন্ত স্পস্টভাবে বর্ণনা করেছেন। জামায়াতের সাহিত্যও এ চিন্তাধারাকে তার কর্মী ও সদস্যদের মনে খুব বলিষ্ঠভাবে বদ্ধমূল করে দেয়।
নিয়মিত বৈঠক এবং প্রতিটা বিষয় সংগঠিত আন্দোলন ও চেষ্টা সাধনা এ আন্দোলনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। প্রতি মংগলবারে ইখওয়ানের দারসে কুরআনের আলোচনা এ স্মৃতিকথার মধ্যে বড়ই ঈমান প্রবৃদ্ধিকারী। জামায়াতেরও সাপ্তাহিক বৈঠক এবং দারসে কুরআন ও হাদীসের অনুষ্ঠান অত্যন্ত সুষ্ঠু ও সুন্দর যাতে কখনো কোন অচলবস্থার সৃষ্টি হয় না।
সৌভাগ্য বশত ইখওয়ানের বর্তমান মুর্শিদে আম জনাব উমর তিলমিসানী এবং জামায়াতের বর্তমান আমীর জনাব মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদ এর অনেক কথা ও কাজে পরিপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়েই পেশাগত দিক থেকে আইনজীবি। দু’জনই বাল্যকাল থেকেই দ্বীনের প্রতি অনুরাগী এবং সকল প্রকার অন্যায় অপকর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী ছিলেন। উভয়েই অত্যন্ত সভ্রান্ত এবং উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং ত্যাগ, ক্ষমা ও মহত্বের মূর্ত প্রতীক। শুরুতে উভয়েই যখন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তখন পাশ্চাত্য পোশাক ও তাহযীব তামাদ্দুনে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু আন্দোলনে শামিল হওয়ার পর সম্পূর্ণরূপে বদলে যান। উস্তাদ ওমর কিছু দিন ওকালতির পেশা অব্যাহত রাখেন কিন্তু মিয়া সাহেব জামায়াতে যোগদানের পর পরই এ পেশা ত্যাগ করেন। উস্তাদ ওমরকে বিচারকের পদ অলঙ্কৃত করার অনুরোধ আসে। কিন্তু উভয় নেতাই এ পদ গ্রহণে অস্বীকৃতী জ্ঞাপন করেন।
মুহতারাম ওমর তিলমিসানীও ছিলেন একটা কৃষক অথবা জমিদার পরিবারের সাথে সম্পর্কিত আর মিয়া সাহেবের আগমন অনুরূপ পারিবারিক পরিবেশ থেকেই। কোমল হৃদবৃত্তি ও উদার মানসিকতায় দুই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বই সিক্ত। কিন্তু আল্লাহর নির্ধারিত শরীয়াতের সীমানা মেনে চলা এবং দ্বীনের অনুসরণে তারা কখনো কোন প্রকার আপোষ করেননি। কিংবা নমনীয়তা দেখাননি। উভয়েই কারাগারের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছেন এবং অবিচলভাবে সর্বদা জীবনের লক্ষ অর্জনে অগ্রসর হয়েছেন।
জনাব উমর তিলমিসানী ইখওয়ানে যোগদানের কিছুদিন পর থেকেই দ্বিতীয় মুর্শিদে আম মুহতারাম হাসান আল হুদাইবি মারহুম এর প্রতি তার অত্যন্ত ভালবাসা ও ভক্তি গড়ে ওঠে। আবার তিনিও তাকে অকৃত্রিম স্নেহ ভালবাসা দানে ধন্য করতে থাকেন। একইভবে মিয়া সাহেবও জামায়াতে যোগদানের পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্দোরনের প্রতিষ্ঠাতার বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হন এবং আজীবন আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর সাথে থেকে প্রত্যেক বিষয়েই তাঁর হিদায়াত ও দিকনির্দেশনা লাভ করতে থাকেন। দুই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে নীরবচ্ছিন্ন বিশ্বস্ততা নির্ভরযোগ্যতা ও ভালবাসার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এর ঈমান প্রবৃদ্ধিকর দৃশ্য গ্রন্থকার বহুবার স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। মিয়া সাহেব কখনো জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ৫/এ যিলদার পার্কে পৌঁছতেন কিংবা কোন সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মুর্শিদ মওদূদী (র) বড়ই দরদী মন ও হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার আবেগে তাকে বক্ষে জড়িয়ে ধরতেন। দর্শকমন্ডলী এ দৃশ্য অবলোকন ও প্রত্যক্ষ করে মিয়া সাহেবের সৌভাগ্যের ওপর ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেতো।
উস্তাদ ওমর তিলমিসানী সাইয়েদ হাসানুল বান্না শহীদের সাথে তার স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সফরসমূহের বিবরণ তুলে ধরেছেন তার স্মৃতিচারণে। কয়েক জায়গায় মুর্শিদে আম-এর স্নেহ বাৎসল্য ও ভালবাসার জীবন্ত চিত্র অংকন করেছেন। এখানে উভয় সংগঠনের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে কিছু সংখ্যক মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের তুলনামূকল আলোচনায় জড়িয়ে পড়েছি। বস্তুত এ আন্দোলনের রূপায়ণে, সংগঠনে সম্প্রসারণে এবং ব্যাপ্তিত ও বিস্তৃতি প্রদানে তাঁদের ঘাম-রক্ত জারক রস হিসেবে কাজ করেছে।
এসকল আবেদন নিবেদনের পরিসমাপ্তি টানতে গিয়ে আমি আরজ করতে চাই যে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশ ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের শোকর আদায় করছি যে, তিনি আমাদের সকল অক্ষমতা ও দুর্বলতার উপর তার রহমতের পর্দা অবারিত করে দিয়েছেন। অন্যথায় আমরা কিছুতেই এমন যোগ্যতার অধিকারী ছিলাম না। এমন দুর্বহ বোঝা বইতে পারি যে আমাদের ইখওয়ানী ভাইগণ ইতিমধ্যেই বহন করেছেন এবং দৃঢ়পদে টিকে রয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা এবং শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের কথা বাদ দিয়ে আমরা সকলেই সামষ্টিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। তথাপি আল্লাপ তায়ালার অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে আমি জামায়াতের একজন অযোগ্য সদস্য ও সাধারণ কর্মীরূপে নিসঙ্কোচে বলতে পারি যে, আমাদের মুর্শিদ মওদূদী এবং তার নিকটতম সাথী সংগীগণ ধৈর্য ও স্থৈর্যের পাহাড় ছিলেন। কোন বাতিল শক্তিই তাদেরকে তাদের অনুসৃত নীতি থেকে চুল পরিমাণও হটাতে পারতো না। ইখওয়ান সম্পর্কে ইতিহাস এ সাক্ষ্য নীরব সাক্ষী প্রদান করে যেঃ
“এ ঘরের সবটুকুই উজ্জল আলোর দীপ্তিতে ভরপুর হয়ে রয়েছে।” এসব লোক সব পরীক্ষায়ই সাফল্য অর্জন করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়াতে সুনাম সুখ্যাতি দান করেছেন এবং আখেরাতের অনন্ত জীবনেও আম্বিয়া, সিদ্দিকীন এবং গুহাদাগণের সারিতে অন্তর্ভুক্ত করে দিন। আমরা সাহসহীনেরাও তাদের প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের মধ্যে শামিল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও তাদের সাথে পরিণতি দান করুন।
“আমি তো সালেহীনদের ভালবাসি যদিও আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকেও সালাহ এবং সফলতা প্রদান করেন।” আমি মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদেরকে প্রতিটি পরীক্ষায় নিরাপদ রাখেন। আর যদি কখনো কোন পরীক্ষার সম্মুখীন হই, তাতে যেন তিনি স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহের সাহায্যে দৃঢ়তা দ্বারা আমাদেরকে ধন্য করেন।
জামায়াত ও ইখওয়ান মূলতঃ একই আত্মার দু’টো দেহবিশেষ। আমাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা বটে কিন্তু আমাদের মানযিলে মাকসুদ প্রথম দিন থেকেই এক ও অভিন্ন। ইসলামকে সুমন্নত করে তুলে ধরা আমাদের মূল লক্ষ্য। আর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। বাতিল সর্বদাই আমাদের ওপর রুষ্ট। ইসলামের কোন কোন পতাকাবাহীও আমাদের প্রতি যুদ্ধাংদেহী মনোভাব পোষণ করে থাকেন। আমার সকল বিষয়ে সঠিক ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালার উপর সোপর্দ করে দিয়েছি। মুর্শিদে আম তার স্মৃতিকথায় বারবার এ সত্যেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমরা সর্বদা আমাদের ঐ সকল ইসলাম প্রিয় ভাইদের সমীপে-যারা আমাদের উপর বিভিন্ন প্রকার অভিযোগ আরোপ করে নিজেদেরকে ইসলামের খাঁটি অনুসারী প্রমাণ করতে চান-সর্বদা এ আরজই করতে থাকবো। কবির ভাষায়ঃ
“জগতে তো কোন দেয়ালে গিয়ে আঘাত করিনি!
যাতে করে প্রমাণিত হতে পারে যে তুমি প্রস্তর খন্ড না কাঁচের টুকরো!!
আল্লাহ তাআয়া তোমার যুবকদের নিরাপদে রাখুন এবং তাদের আত্মঘাতি ও আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভংগী দ্বারা ধন্য করুন!! আমীন!!!
এম, আমীর হোসাইন আল মাদানী
মদীনা মুনাওয়ারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
আল সুবাই হল, সউদী আরব।
১৭ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৫ সালে।

প্রথম অধ্যায়

আমার পরিচয়

আমি একজন মুসলমান এবং মিসরের নাগরিক জীবনের আশিটি বসন্ত অতিক্রম করতে যাচ্ছি। ১৯০৪ সালে ৪ঠা নভেম্বর কায়রোর গৌরিয়া অঞ্চলের খোশ কদম নামক পল্লীতে আমার জন্ম। এটা একটা প্রাচীন মহল্লা। প্রাচীনতার প্রতিটি সংজ্ঞাই এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পুরাতন ধাঁচের দালান কোঠা, রাস্তঘাট ও অলি গলিও চাপা ও অন্ধকার। কামরাগুলো খুবই প্রশস্ত ও খোলামেলা কিন্তু নীরব ও কোলাহল মুক্ত। গোসলখানায় ব্যবহার্য পানি বাইরে থেকেই গরম করে নিতে হতো। সেকালের ওয়াটার হিটারগুলো বর্তমান কালের বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটার সমূহের সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ ছিল। হাম্মামের বাইরে ছোট একটা কামরা থাকতো যাতে গোসল সমাপনকারী ফ্লাটে যাওয়ার অব্যাহত পূর্বে সেখানে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারে। ঘরগুলোর প্রশস্ততার অনুমান এ থেকে করে নেয়া যেতে, পারে, একটা ফ্লাট কমপক্ষে আটশত বর্গমিটার আয়াতন সম্পন্ন হতো। গৃহের আঙিনা ও ছাদসহ প্রায় আটটি হাম্মাম ও টয়লেট থাকতো। কোন কোনটিতে মর্মর পাথরের টালি লাগিয়ে তার শোভা বর্ধন করা হতো আবার কোনগুলোতে সিমেন্টের সাধারণ তৈরী টালি লাগিয়ে নেয়া হতো।
শহর থেকে গ্রাম
এরূপ গৃহেই আমার জীবনের প্রথম তিন বছর অতিক্রান্ত হয়। তারপর আমাদের পরিবার অর্থাৎ আমার পিতা, পিতামহ এবং পরিবারের অন্যান্য সকল সদস্য এই বাড়ী পরিত্যাগ করে খামারে চলে যায়। শাবীনুল কানাতির কেন্দ্রের নাওয়া নামক গ্রামে ছিল এই খামারের অবস্থান। বর্তমান কালিউবিয়া প্রদেশের তৎকালীন নাম ছিল কমিশনারী। এই গ্রাম ছিল এরই অর্ন্তগত। কায়রো থেকে এই পল্লির দূরত্ব ছিল বাইশ কিলোমিটার। এই গ্রামেই ছিল রেলওয়ে ষ্টেশন, যেখানে গাড়ীগুলো এসে থামতো। তখনকার দিনে তৃতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণী পযর্ন্ত সকল বগীতেই পরিষ্কার পরিচ্ছনতা ও আরাম আয়েশের বেশ ব্যবস্থা ছিল।
মাত্র চার বছর বয়স থেকেই আমি আমার পরিপার্শ্বিকতাকে গভীর উপলব্ধিসহ দেখতে শুরু করেছিলাম। যে ঘরে আমরা থাকতাম লোকজন সেটাকে ‘প্রাসাদ’ বলে অভিহিত করতো। আমার দাদা মরহুম এই মহলের দু’টি ফ্লাটে তার দুই স্ত্রীর সাথে বসবাস করতেন। আমার মরহুম পিতাও তার দুই স্ত্রীর সাথে অপর ফ্লাটে থাকতেন। আমার মাতা ও বিমাতার ফ্লাট ছিল সামনাসামনি। আমার চাচা তার একমাত্র স্ত্রীর সাথে একটা ফ্লাটে অবস্থান করতেন। তিনি তখনো পর্যন্ত আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভব ছিলেন না।
জাঁকজকমকপুর্ণ অট্রালিকা
এই বিরাট মহলে ছিল মাত্র তিনজন চাকর ও চাকর ও চারজন চাকরানী। চাকরানী হাসিবা, বাবলা, সাঈদা ও বাখতিয়া এবং চাকর সারওয়ার, রায়হান ও তাহসীন।
তারা সকলেই ঘরের কাজকর্মে থাকতো সদা ব্যস্ত। মহলের মধ্যে মস্তবড় লংগরখানা ছিল। যেখানে বাবুর্চি ও খানসামারা খানা পাকানো ও খাওয়ানোর দায়িত্ব আঞ্জাম দিতো। মহলের মধ্যেই ঘোড়ার গাড়ী থাকতো যা চালাতো কোচম্যান, তাতে মাত্র একটা ঘোড়াই জুড়ে দেয়া হতো। মহলের পশ্চাৎদিক ঘেসে ছিল গবাদি পশুর আস্তাবল। যেখানে থাকতো বলদ, গাভী, মহিষ, উট, গাধা প্রভৃতি। একজন রাখাল ও তার একজন সহযোগী এসব গবাদি পশুর দেখাশুনা করতো।
মহলটি ছিল পাঁচ একরের সুসজ্জিত বাগান পরিবেষ্টিত। উহাতে ছিল মালটা, সিংতারা, আম, আঙ্গুর, বিভিন্ন প্রকার খেজুর, রাসবেরী, কলা, আপেল, নাশপাতি, লেবু, কমলালেবু, খুবানী, আলুচা মোদ্দাকথা তখনকার দিনের পরিচিত সব জাতের ফল। বাগানটি প্রায় সত্তর বছর ব্যাপী এই সকল ফলগাছ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল।
অন্দর মহলে ছিল ফুলের টবের সমাহার। সেগুলোতে শোভা পেতো গোলাপ, সুসেন, একফুল ও দু’ফুল বিশিষ্ট চামেলি, লবঙ্গফুল, আতর প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার ফুল। একজন মলি এসব ফুলের বাগান দেখাশুনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।
পিতামহের জায়গীরসমুহ ও তার শাহী মেজাজ
দাদা মরহুমের জমিদারী ছিল তিন শত একর ভূ-সম্পত্তি ও কয়েকটি বাড়ী নিয়ে। তন্মধ্যে নাওয়া নামক গ্রামে ছিল একশ’ আশি একর এবং আল মুজাযির শারকিয়ায় ছিল একশ’ বিশ একর। কায়রোর বিভিন্ন মহল্লায় ছিল সাতটি বাড়ী।
দাদা মরহুমের নাম ছিল আবদুল কাদের পাশা আত তিলমেসানী। তার মেজাজ ছিল সম্পূর্ণ শাহী প্রকৃতির। তিনি মুখে যা উচ্চারণ করতেন তা পুরো হওয়া ছিল জরুরী। অন্যথা হলে ক্রোধে তিনি ফেটে পড়তেন। ফল দাঁড়াতো বেত্রাঘাত ও প্রচন্ড মারপিট।
সুলতান আবদুল হামীদ দাদা মরহুমকে পাশা উপাধিতে ভূষিত করেছেলেন। দাদা মরহুমের একটা বিশেষ অভ্যাস ছিল যে, হজ্জের পর ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভ্যবগ্রস্ত ও সহায় সম্বলহীন হাজীদেরকে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সফরের ব্যবস্থা করে দিতেন এবং যাবতীয় খরচ তিনি নিজে বহন করতেন। এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, মরহুম ছিলেন খুবই দাতা ও দয়াদ্র হৃদয়। নাওয়া পল্লিতে প্রতি সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শনিবারে বড় বাজার বসতো। সে দিন দাদা মরহুম বাজার থেকে গোশত ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে আনতেন এবং নৈশ ভোজে ফার্মের সমস্ত কিষাণ মজুরকে আমন্ত্রণ জানাতেন। তারা সবাই উদর পূর্তি করে খেতো। তিনি নিজেও গিয়ে ঐ সব কৃষকদের মাঝে বসে পড়তেন। তাদের সাথে খোশ গল্প জুড়ে দিতেন এবং সাথে সাথে খাদ্যও খেতে থাকতেন।
পূর্ব পুরুষের জন্মভূমি আলজিরিয়া
একথা বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমাদের পূর্ব পুরুষরা মুলতঃ আলজিরিয়ার তিলমেসান এলাকার অধিবাসী ছিলেন। এবং ঐ এলাকার নামানুসারে আজ পর্যন্ত আমাদের বংশ পরিচয় তিলমেসানী বলে পরিচিত। ফরাসীরা আলজিরিয়া অধিকার করলে একমাত্র তিলমেসানই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মোকাবিলা করে। সর্বশেষ তিলমেসানের পতট ঘটে। তিলমেসানের অধিবাসীগণ যে বীরত্ব ও সাহসের সাথে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তির মোকাবেলা করে আজও পর্যন্ত ফরাসীরা তা স্বীকার করে থাকে। প্যারিসের লুভার যাদুঘরে একটা বিশেষ উইং রয়েছে যাতে তিলমেসানের অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য স্বরণীয় দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। এসব অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা ঐ সকল সিংহ হৃদয় মুসলমানগণ শেষ অবধি দুশমনদের মোকাবেলা করেছিল।
যে বছর তিলমেসান ফ্রান্সের অধিকারে চলে যায়। সেই বছরই অর্থা ১৮৩০ সালে আমার প্রপিতামহ স্বীয় পরিবার পরিজন সহ আলজিরিয়া থেকে হিজরত করে মিসরে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং ব্যবসা বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি খাদ্য শস্য ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন। মিসর, খার্তুম ও সিংগাপুরের মধ্যে তার কারবার পরিচালিত হতো। প্রপিতামহের ইনতিকালের পর যখন আমার পিতামহ কারবারের গুরুদায়িত্ব তার কাধে তুলে নেন তখন তিনি ব্যবসা ত্যাগ করে তার দু’টো জায়গীর এবং কায়রোর সাতটি বাড়র আমদানীর ওপর পরিতুষ্ট থাকেন। যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে।
মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাবের সাথে সম্পর্ক
দাদা মরহুম ছিলেন ইমাম মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহাব (র)-এর ভক্ত অনুসারীদের একজন। এই আন্দোলনের কয়েকখানা বই তিনি তাঁর নিজস্ব খরচে ছাপার ব্যবস্থা করে দেন। মুদ্রিত এসব গ্রন্থাবলীর মধ্যে কয়েকটি অদ্যাবধি সউদি আরবের লাইব্রেরীগুলোর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। দাদা নিজেও ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম, তিনি সর্বদা মাথায় পাগড়ী পরিধান করতেন। তার বন্ধু-বান্ধবাদের সকলেই আল-আজহারের বড় বড় আলেম ছিলেন। মরহুম শাইখ ইমামুস সাক্কা ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি এসব স্বনাম ধন্য ওলামায়ে কেরামদের প্রায়ই দাওয়াত করে নিয়ে আসতেন যাতে শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে এক আধদিনের জন্য সময় বের করে তাদেরকে তাঁর শান্তিময় কোলাহল মুক্ত ফার্মে সাদামাটা গ্রাম্য পরিবেশের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। যে রেলগাড়িতে এই আলেমগণের কায়রো থেকে মুযলিকান রেলওয়ে স্টেশনে এস পৌঁছার কথা থাকতো তা স্টেশনে এসে পৌঁছার পূর্বেই দাদা মরহুম সম্মানিত মেহমানগণকে স্বাগত জানানোর জন্য সেখানে উপস্থিত হতেন। দাদা ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল এবং খোশ মেজাজের মানুষ। যখন সল বন্ধুই (উলামায়ে আয্হার) গাড়ী থেকে বাইরে তাশরীফ নিয়ে আতেন তখন দাদা মরহুম আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে উঠতেন, “মাশাআল্লাহ তোমরা সকলেই দেখি তোমাদের পরিবার পরিজনের সকলকেই সাথে নিয়ে তাশরীফ এনেছো। এভাবে পরিজনদের সাথে আনতে কেউই কখনো অপারগতা প্রকাশ করতেন না” আবার কখনো বা অন্তত দু’একজন অক্ষমতা প্রকাশ করে বসতো। সাথে সাথে গোটা পরিবেশ যেন হাসি তামাশায় সুগন্ধি জাফরানের ক্ষেতে পরিণত হতো। এবং প্রত্যেকেই উল্লাসে ফেটে পড়তেন।
যখনতাঁদের সাথে নিয়ে গৃহ অভিমুখে রওয়ানা হতেন এবং চলার পথে খামারে কোন হাঁস, মুরগী অথবা মোরগ দৃষ্টি গোচর হলে চীৎকার কর বলে উঠতো: “আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করো। নিজেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।” স্বাগতম জানানোর পালা শেষ হলে ইল্মী আলোচনা শুরু হতো। দীর্গ সময় পর্যন্ত ভাবগম্বীর পরিবেশে আলোচনা অব্যাহত থাকতো। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতামতের উপর অটল থাকতো এবং আপনাআপন অভিমতের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ করতে থাকতো। কখনো কখনো জনসাধারণ এ দৃশ্য দেখে মনে করতো যে, এক্ষুণী বুঝি হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে। দুপুরের খানার সময় হওয়ামাত্র পরিবেশ আবার পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতো। যুক্তি-প্রমাণের ছড়াছড়িতে ভাটা পড়তো এবং হালকা হাসি তামাশা ও চটুলতা পরিবেশ ফিরে আসতো। মনে হতো যেন এখানে কোন বিতর্কের মাহফিরই জমেনি। এসব মাহফিলে এ জাতীয় মজলিশের প্রভাবে দ্বীনি ইলমের প্রতি আমার অনুরাগ অনেক বেড়ে যায় এবং এমন সব বিষয়ে আবার জ্ঞান লাভ হয় যে সম্পর্কে আমার সমবয়সী বালকরা থাকতো সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এমন কি আমার বড় দু’সহোদরও এসব ইসলামী কথাবার্তার ব্যাপারে ছিল একেবারেই উদাসীন। অবশ্য এটা ছিল আমার কিশোর বয়সের কথা।
শিক্ষা জীবনের সূচনা
যখন আমি গ্রামের বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করি তখন ঐ বিদ্যালয়ে গ্রামেরই দু’জন আলেম মরহুম শাইখ আবদুল আযীয আল-কালমাভী এবঙ মরহুম শাইখ আহমদ আল-রিফায়ী-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করি। বিদ্যালয়ের নাম ছিল “মাদ্রাসা সাইয়েদী আলী।”
আমি কুরআন মজীদ হেফয করার জন্য নিয়মিত পরিশ্রম করতে লাগলাম। জ্ঞানের জন্য জ্ঞানের প্রতি আমার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে দ্বীনি ইলমের প্রতি আমি গ্রামেই বেড়ে উঠেছি এবং গ্রামীন পরিবেশ ও কৃষক মজুরদের সাদামাঠা জীবনকে আমি অতিমাত্রায় ভালবাসতাম। একবার আমি নদীর পানিতে গোসলকরি এবং সে কারণে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ফলে আমাকে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তার নিদারুণ কষ্ট আজ পর্যন্তও আমি অনুভব করি। আমি নদীদে সাতার কাটতাম। যদিও বর্তমানে সাতহারে নিয়ম কানুন ও রহস্য ভুলে গিয়েছি। গম কাটার মওসুমে আমি ষাড়গুলোর পশ্চাতে আটি বাঁধা বোঝার ওপর বসে যেতাম। গমের স্তুপ এবং তীক্ষ্ম শীষের ওপরও কখনো কখনো শুয়ে পড়তাম। কখনো আবার ঘোড়ার নাংগা পিছে উঠে বসতাম এবং খামারের পার্শ্ববর্তী বালুকাময় জমিনের ওপর তার লাগাম ঢিলা করে দিয়ে খুব দৌড়াতাম।
কল্পনার জগতে বিচরণ
গ্রামের প্রতিটি জিনিসের সাথে ছিল আমার নিবিড় সম্পর্ক। গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, সহজ-সরল জীবন ধারা, রাতের নিঃসংগ জীবনে আমি আপন মনে আমার কল্পনার সাগরে সাতার কেটে বেড়াতাম। এই পরিবেশের প্রতি কেন আমার এত গাড় অনুরাগ ছিল এবং এর শুরু ও শেষ কোথায় তা আমার জানা ছিল না। এর প্রতি আমার এত অকৃত্রিম প্রেম-ভালবাসা কেন ছিল? সেই অজনা জিনিস কি ছিল যার প্রেমের ডোরে আমি বাঁধা পড়েছিলাম। এমন স্বাধীন চিন্তাধারা যার কোন কূল কিনারা ছিল না- কেন ছিল? ছিলই বা কিভাবে? এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তরই আমার জানা ছিল না। তা সত্ত্বেও ঐ মুহূর্তগুলো খুবই আনন্দের অত্যন্ত উপভোগের। আমি কার প্রেমিক ছিলাম এবং কেন? তা আমি কখনো জানতে পারিনি। ;আমি কি কোন কল্পনা প্রবণ লোক ছিলাম? আমার মধ্যে কি কোন কুসংস্কার দানা বেঁধেছিলো? আমার মধ্যে কি কোন মানসিক ব্যাধি বাসা বেঁধেছিলো? প্রকৃতপক্ষে আমি কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারতাম না। সেই সময় আমার মনে হতো পর-পাখা ছাড়াই আমি মহাশূন্যের গভীরে উড়ে বেড়াতে পার। কোন লক্ষ্য স্থির না করেই আমি উড়ে বেড়াই এরূপ আকাংখাই দুর্দমনীয়ভাবে আমাকে তাড়া করে ফিরতো।
আমি উড্ডয়নের ঐকান্তিক আকাংখা পোষণ করতাম। আমার কল্পনার পাখা আমাকে উড়িয়ে কোথায় নিয়ে যাবে? আমার মনজিল কোথায়? ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কতদূর উড়ে যাবো? আমার মনের কোণে এসব প্রশ্ন কখনো উঁকি মারতো না। আমার ছিল শুধু উড্ডয়নের প্রবল নেশা। এই উদগ্র কামনা ও দুর্নিবার আকাংখা স্বপনেও আমাকে উড্ডয়নের অনুশীলন করাতো। হয়তো বা এই শখ আজও আমার মনের মনিকোঠায় জাগরুক। এখন এটা আমার অত্যন্ত বিস্ময়কর সৌভাগ্য যে, আমার দাওয়াতী পরিভ্রমণ সুদূর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার শতশত ফ্লাইটে পরিব্যাপ্ত। অবিশ্রান্তভাবে আমি সুউচ্চ আকাশে এই দীর্গ সফল পরিক্রমমা সম্পন্ন করে চলছি। অনেক সময় এমনও হয় যে, একটা ফ্লাইট থেকে নেমেই অপর ফ্লাইট ধরতে হয় এবং এক বিমান থেকে অবতরণ করেই আরেকটি বিমানে আরোহণ করি। এই সফরসূচী থাকে ক্রমাগতভাবে; বয়সের আধিক্য এবং অসংখ্য রোগ ব্যাধি সত্ত্বেও। এই দুর্বল শরীরকে যুগের উত্থান পতন এবং ঝড়ো হাওয়ার প্রচণ্ড প্রতিকূলতা প্রবলভাবে তাড়া করেছে তথাপি সফর অব্রাহত রয়েছে আজও। আজও আমার ঐকান্তিক আকাংখা এই যে, আমি গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে গিয়ে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো কাটিয়ে দেই। পল্লীল নিঝুম-নিস্তব্ধ রজনী, রাতভর আলোকিত হয়ে উঠা ও নিভে যাওয়া তারার খেলা, খুব ভোরে মোরগের ডাক, অতি প্রত্যুষে পাখির কল-কাকলী, সর্বপ্রথম একটা পাখির কেক আওয়াজ তারপর সেই সুমিষ্ট সুর শুনে অন্যদের জেগে উঠা। অতপর একযোগে আল্লাহর প্রশংসা গীতি, মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদাত ও স্তুতির এই ঈমান জাগানো দৃশ্য। পাখিদের তাওহীদী গান- সেই প্রকৃতি সৃষ্টিকর্তার তাওহীদ- যিনি সকাল বেলা তাদেরকে খালি পেটে বাসা থেকে বের করে দেন আর সন্ধ্যায় সকলেই ভরা পেটে ফিরে আসে। মানুষ যদি পাখিদের নিকট থেকে এই শিক্ষা গ্রহণ করতো তা হলে আমাদের এই দুনিয়া শান্তি ও নিরাপত্তার আবাসে পরিণত হতো। যেহেতু বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক জিনিসকে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে ও বিচক্ষণতা সাথে সৃষ্টি করেছেন। তাই পাখিদের সৃষ্টি নৈপুণ্য ও গঠন প্রকৃতিতেই আনুগত্য রয়েছে। মানুষকে তিনি চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। আমরা আমাদের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তাকে জিজ্ঞেস করতে পারি না যে, কেন তিনি এরূপ করেছেন? আর এখানেই তাঁর অসীম কুদরাত ও অপার হিকমতের সার্থক পরিচয়। এর পশ্চাতে লুক্কায়িত নিগূঢ় রহস্য তিনিই জানেন। আমরা মানুষ। আমাদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতারকে বুঝে শুনে কাজে লাগাত হবে। যে আদেশ তিনি দিয়েছেন বিনা বাক্য ব্যয়ে ও সম্পূর্ণ শর্তহীনভাবেতা মেনে নিতে হবে। এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আমি আবেগ অনুরাগে ভরা একজন সাধারণ মানুষ। শিল্পকলাকে ভালবাসি এবং মানব জীবনের বিভিন্ন দিকে ও বিভাগে পুরোপুরি উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে অংশ গ্রহণ করে থাকি। আমি আমার সীমিত যোগ্যতা শক্তি ও সামর্থ বুদ্ধিমত্তা, বিবেক ও বিচক্ষণতা দ্বারা আমার রবের অতুলনীয় হিকমতের রহস্য যৎ সামান্য উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছি মাত্র।
সহজাত প্রবণতা
স্বভাব ও প্রকৃতিগতভাবে তর্ক-বিতর্ক ও বিবাদে বিসষ্বাদের প্রতি আমার কোন প্রবণতা ছিল না। আলোচনা পর্যালোচনা যখন বাকযুদ্ধ ও জিদের পর্যায়ে উপনীত হয় তখন আমি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তর্ক-বিতর্কের ময়দান থেকে আত্মরক্ষা করে সযত্নে কেটে পড়তাম। প্রত্যেক বিষয়েই আমি সৌন্দর্য প্রিয় বলে সকলের নিকট পরিচিত। মানুষের সৃষ্টি কৌশলই সৌন্দর্যের বিরাট নিদর্শন। পাখিদের আকৃতি ও প্রকৃতি এবং কারুকার্য খচিত পাখা ও পালক, হরিণের ক্ষিপ্রতা, তার পায়েল গোছার মাধুর্য ও কমনীয়তা, হাতীর বিশালায়তন শরীর এবং তার ধৈর্য, বাঘ ও নেকড়ের চোখের তীব্র চাহনী, পানির স্রোত ও তার কুলু কুলু ধ্বনি, পাতার মর্মর শব্দ, রেলগাড়ীর গতি এবং এই অনুভূতি যে রেল নয় বরং পৃথিবী তার পৃষ্ঠের সব কিছু নিয়ে তীব্র গতিতে পশ্চাৎ দিকে চুটে যাচ্ছে মনে হয় প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে যে নিজস্ব সৌন্দর্য বিরাজমান সেই শোভা ও সৌন্দর্যের প্রশংসায় আমি পঞ্চমুখ।
আমি পৃথিবীতে খুবই সাবধান ও সতর্ক জীবন যাপন করার প্রয়াস পেয়েছি। আপনারা আমাকে দেখতে পান যে, আমি সালাত ও সিয়ামের খুবই নিয়মাবর্তী। বাল্যকালেই কুরআনস মজীদ হিফয করার কাজ শুরু করেছিলাম। কিছু কিছু হাদীস ও দ্বীনি বই পুস্তক জীবনের প্রারম্ভিক স্তরেই পড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু এসব সত্ত্বেও শৌর্য-বীর্য ও নির্ভীকতা এবং প্রেম-প্রীতি ও মহব্বত ভালবাসার কাহিনীর প্রতিও আমার আকর্ষণ ছিল প্রবল। তাই আমি প্রথম প্রথম যেসব বই পুস্তক পড়তাম তার মধ্যে আবু যায়েদ আল-হিলালী সালামাহ রচিত বইও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আনতারা বিন শাদ্দাত ও সাঈফ বিন যি নিরানের জীবন কাহিনীও আমি অদ্যয়ন করেছি। অতপর ইসকান্দার দিমাছ বিরচিত সমস্ত গল্প কথা ও কল্পকাহিনী আমি পড়ে শেষ করেছি। ইসকান্দার দিমাছ ও তার পুত্রের শৌর্য-বীর্ঘ ও বীরত্ব গাথা খোশ গল্প দ্বারা বেশ প্রভাবিতও হয়েছি। এসব কাহিনীর মধ্যে নায়কের বীরত্ব এবং তার প্রেমিকার নিরাপত্তা বিধান রক্ষা কল্পে বিস্ময়কর ঘটনা প্রবাহ অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী মনে হতো। ছুটিকালীন সময় আমার গোটা সময়েই এ ধরনের বই পুস্তক পড়ে কাটতো। আমি গভীর মনোনিবেশ সহকারে এসব বই পুস্তক পড়তাম আর মনে মনে ভাবতাম যে, অনুরূপ কোন ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্যই আত্মনিয়োগ করি কিন্তু তাতে আমি সফলকাম হতে পারিনি।
কাব্য ও কবিত্ব এবং সাহিত্য ও সংগীত
আমি নৈরাজ্যবাদী সাহিত্য সেবীদের সাহিত্যও পড়া শোনা করেছি। মানফালুতির প্রায় সব ক’টি গ্রন্থই আমি পড়েছি। কতিপয় বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক কাহিনী পাঠ করে আমি মর্মভেদী কান্নায় ভেংগে পড়েছি। সাহিত্যের প্রতি এত অনুরাগ ও আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও আমি নিজে কিন্তু সাহিত্যিক হতে পারিনি। বছরের পর বছর আমি বাঁশী বাজিয়েছি কিন্তু বংশীবাদক হতে পারিনি। কবিতা চর্চার শখও আমার মধ্যে দানা বেঁধেছে এবং এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট মাথাও ঘামিয়েছি। নিজে কবিতা লিখেছি এবং শীর্ষস্থানীয় কবিদের সামনে তা উপস্থাপন করেছি। তারা আমার কবিতা পড়ে সবসময় আমাকে এই মন্তব্যই শুনাতেন যে, আমি যা কিছু লিখছি তা ছন্দময় বাক্য বিশেষ অবশ্যই কিন্তু তাকে কবিতা বলে অপবাদ দেয়া যায় না। সর্বশেষ যে কবিতা আমি লিখেছিলাম তা ছিল নিম্নরূপ। আপনি নিজেও পড়ুন এবং আমার জন্য দুঃখ ও করুণা প্রকাশ করুন।
(আরবী**************)
“আমি নিবেদিত করে দিয়েছি ওহীর জ্ঞানের নিমিত্তে আমার কাব্য প্রতিভাকে।
যার জন্য ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে পাখির সকল কল কাকলি।”
এই কবিতা দেখে আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন যে, তা কবিতা না কবিতার বিকৃতি। তাই আমি এখানেই ক্ষান্ত হলাম এবং কবিত্বকে চিরবিদায় জানালাম। শিল্পকলার যেসব বিষয়ে আমি প্রচেষ্টা চালিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি সেসব ক্ষেত্র থেকে আল্লাহ কেন আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তা তিনিই ভাল জানেন। এটা ছিল তার সূক্ষ্ম কৌশল যে সেইসব ক্ষেত্রের কোনটাতেই আমি সফলতার মুখ দেখতে পারিনি। আমার এসব প্রচেষ্টা শিল্প কলার সাথে নিষ্ঠুর তামাশা বৈ আর কিছুই ছিল না।
দ্বীনি জ্ঞান চর্চার দিকে প্রত্যাবর্তন
আমি পুনরায় দ্বীনি ইলমের চর্চায় মনোনিবেশ করলাম। এবারে আমি তাফসীরে যামাখশারী, তাফসীরে ইবনে কাসীর ও তাফসীরে কুরতুবী পড়ে ফেলাম। তা ছাড়া সিরাতে ইবনে হিশাম এবং সীরাতের ওপর লিখিত অন্যান্য বইও অধ্যয়ন করলাম। উসুদুল গাবা, তাবাকাতে কুবরা, নাহজুল বালাগা, আল-আমলী আল-ইফদুল ফরীদ (ইবনে সাইয়েদিহি), বুখারী ও মুসলিম ইত্যাদি বহু বিশালায়তন গ্রন্থ পাঠের সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। তা সত্ত্বেও আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই যে, আমি যা পড়েছি তা সাগরের এক বিন্দু পানির সমান যা মামুলী তৃষ্ণা নিবারণের জন্যেও যথেষ্ট নয়।
এসব চেষ্টা-সাধনা দ্বারা আমি এই একটা শিক্ষাই লাভ করেছি যে, আমি মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ পেয়েছি। তাই আমি কখনো আমার কথা বা কলম দ্বারা কোন মানুষের মর্মে আঘাত করার চেষ্টা করিনি। এমনকি যেসব লোক আমার ওপর আক্রমণ করেছে এবং আমার সাথে মতবিরোধের কারণে আমার বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করেছে তাদের ওপর কখনো প্রতি আক্রমণের চিন্তা করিনি।
আল্লাহর সন্তুষ্টি
যেহেতু আমি আমার নিজের মতামত ও ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেহেতু অন্যদের অভিমত ও ব্যক্তিত্বের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। আমি যা কিছু লিখি তা অত্যন্ত দায়িত্বানুভূতির সাথে এবং গভীর চিন্তা-ভাবনা করে লিখি। তাই স্বীয় সিদ্ধান্তের ওপর অটল ও অবিচল হয়ে থাকতে চাই। এজন্য অনেক সময় আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয় এবং আজও পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছি। আমি শৃংখল বন্দীত্ব এবং কষ্ট-মুসিবতের বহু মনজিলের মুখোমুশি হয়েছি। তবুও সত্য পথ থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই আমার এই ভূীমকা। হককথা বলাই আমার আকীদা ও ঈমানের দাবী। আমার প্রতিটি ধমনি ও শিরা উপশিরায় রক্তের মতই তা প্রবাহমান। এমন এক পরিবারে আমি সর্বপ্রথম চোখ মেলেছি যেখানে পরিবারের প্রতিটি সদস্য ছিল নিয়মিত নামায-রোযার পাবন্দ; নারী, পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই ছিল দ্বীনের অনুসারী। আমার মনে পড়ে না আমি কখন (কত বছর বয়সে) থেকে সিয়ামের অনুশীলন করতে এবং কখন সালাত আদায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। যা হোক এতটুকু অবশ্যই স্মরণ করতে পারি যে, যখনই আমার মধ্যে অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে এবং বিচার-বিবেচনার উন্মেষ ঘটেছে তখন থেকেই আমি নিজেকে সালাত ও সওমে অভ্যস্ত দেখতে পেয়েছি। গোটা জীবনে আমার এমন কোন সময়ের কথা মনে পড়ে না যখন আমি ফরয পরিত্যাগ করেছি।
সিনেমা দেখা
আপনি বিস্মিত হবেন এই জেনি যে, যখন আমি কর্মজীবনে প্রবেশ করে ওকালতীর পেশা গ্রহণ করি তখন শুক্রবার দিন (সাপ্তাহিক ছুটি থাকতো) যোহরের পর আমি ছবি দেখার জন্য সিনেমা হলে চলে যেতাম কিন্তু সেখানেও সালাত আদায়ের ব্যাপারে কোন প্রকার শৈথিল্য প্রদর্শন করতাম না। বিরতির সময় সিনেমা ভবনেরই এক পার্শ্বে গিয়ে সালাতুল আসর ও মাগরিব আদায় করে নিতাম। সেই যুগে আমি দেখতাম কিছু লোক মজলিসে বসতো এবং ছবি দেখতে যাওয়ার সময় হলে উপস্থিত লোকদের বলতো যে, মেহেরবানী করে আপনার একটু বসুন। আমাকে অনুমতি দিন বাইরে একটি জরুরী কাজের জন্য আমাকে যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থা ছিল এই যে, আমি অকপটে নিঃসংকোচে বন্ধুদের বলতাম যে, আমি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। অনেক সময় কোন কোন বন্ধু একথা শুনে বিস্মিত হতো এবং চোখ কপালে তুলে নিতো আবার কখনো কখনো বিরক্তি এবং উম্মাও প্রকাশ করতো (এই জন্য যে, আমি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি) কিন্তু আমি সর্বদা একই জবাব দিতাম “আল্লাহ তায়ালা জানেন যে, আমি কোথায় যাচ্ছি?। তারপর আমি যদি আল্লাহকেই ভয় না করি তা হলে আবার মানুষকে ভয় করার কি অর্থ থাকতে পারে? বিশেষত আমারএ কাজ যখন হারাম নয় যদিও মাকরুতো অবশ্যই।”
আদলের দুলাল
আমার বাল্যকাল এমন শান্তিময় আনন্দঘন ও আরামদায়ক ছিল যে, আমি যা আবদার করতাম সহজেই তা পেতাম, আমার দাদার ছিলো সাতটি সন্তান। দু’টি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে। আমার মরহুম পিতা সতেরটি সন্তান রেখে মৃত্যু বরণ করেন। তন্মধ্যে আটজন ছিল পুত্র সন্তান এবং নয়জন কন্যা সন্তান। পিতা মরহুমের নিকট তার সমস্ত সন্তানের মধ্যে আমিই অধিকতর প্রিয় ছিলাম। কারণ আমি কখনো পরীক্ষায় ফেল করতাম না এবং প্রত্যেক বছর ভাল পজিশন নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতাম। আমার বড় দুই ভাই পড়ালেখা চেড়ে কাজ-কারবারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত ব্যবসায়ে তাঁরা ভাল করতে পারেননি। কোন কোন শিক্ষককে আমার পড়ালেখার বিশেষ যত্ন নেয়ার জন্য গৃহশিক্ষক রূপে নিয়োগ করা হতো কিন্তু শিগ্গিরই একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেলো যে, আমাকে বিশেষ কোচিং দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। যখন আমি মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে (নবম শ্রেণী হতে দশম শ্রেণীতে) উত্তীর্ণ হই তখন গ্রীস্মকালীণ ছুটিতে আমি আমার সিলেবাস ভুক্ত বই আদ্যপান্ত পড়ে ফেলি। তাই অবকাশ যাপনের পর শিক্ষকগণ ক্লাসে যখন পাঠ দিতেন তখন সেগুলো ভালভাবে বুঝে নেয়া ও মনে রাখা আমার জন্য কোন ব্যাপার-ই হতো না। ক্লাসে কখনও থার্ড পজিশন অপেক্ষা খারাপ রেজাল্ট করতাম না। তথাপি কোন দিন আমার ফাস্ট বয় হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আমাদেরকে ইংরেজী ভাষা পড়াতেন মিষ্টার জ্যাকশন নামক জনৈক শিক্ষক। তিন ক্লাসে যখনই ছাত্রদেরকে কোন শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন তখন সাথে সাথে একথাও ব লে দিতেন যে, মুয়াররবা, বুশরা ও তিলমেসান ছাড়া আর কে এর অর্থ বলতে পারবে? তিনি জানতেন যে, আমরা তিনজন ছাত্র (আমি এবং উল্লেখিত দুই জন ছাত্র) পড়া পুরোপুরি তৈরী করেই ক্লাসে এসে থাকি।
জাতীয় মর্যাদাবোধ
আমার বয় যখন দশ বছর তখন আমি “আল-মুকতিম” পত্রিকা পড়া শুরু করি। প্রথম মহাযুদ্ধের সংবাদ আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়তাম। আমার মনের একান্ত আকাংখা ছিল এ যুদ্ধে ইংরেজ পরাজয় বরণ করুক যাতে আমার প্রিয় জন্মভূমি মিসর তাদের ছোবল মুক্ত হতে পারে এবং বৃটেনের এজেন্ট (ভাইসরয়)-এর অত্যাচার নির্যাতনের অবসান হয়। বৃটেনের প্রতিনিধিকে হিজহাইনেস বলা হতো, সে বড় অন্যায় ফরমান জারী করতো, সে প্রধান মন্ত্রীর নামে নির্দেশ জারী করতো এবং দেশের সমস্ত যুবককে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে “লাম বন্দী” নামক স্থানে পাঠিয়ে দিতো।
যুদ্ধের ঐ সময়টা ছিল বিশেষভাবে জুলুম ও নির্যাতনে ভরা। বৃটিশ রাজের নির্দেশে জোরপূর্বক জনসাধারণের নিকট থেকে উট ও গাধা ছিনিয়ে নেয়া হতো এবং রসদপত্র বহনের জন্য বৃটিশ সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া হতো। অনুরূপভাবে ধান, যোয়অর ও অন্যান্য খাদ্যশস্য নামমাত্র মূল্যে জোর করে কিনে নেয়া হতো। কারো আর্তনাম ও আহাজারী শোনার কোন প্রশ্নই উঠতো না। এজন্য আমাদের প্রজন্ম ও আমাকে সমকালীন লোকদের ফিরিঙ্গী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি প্রচণ্ড শত্রুতা ছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়অ মাত্রই মিসরীয়রা ১৯১৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত করে বসে। তাতে বৃটিশ আধিপত্য খতম হয়নি বটে কিন্তু জাতি কিছু অধিকার আধাস্বায়ত্বশাসন এবং আভ্যন্তরীন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু অধিকার লাভ করে।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষের লাভা উদগীরণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত জাতি ১৯৫৪ সালে ইংরেজদের দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
আমি মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনা শুরু করি মাদ্রাসা আল জমিয়তুল খাইবিয়াতুল ইসরামিয়াতে। কিছুদিন পর আর রাশাদ মাধ্যমিক স্কুলে চলে যাই এবং পরিশেষে ইলহামিয়া মাধ্যমিক স্কুল থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করি।
গ্রাম থেকে শহরে
দাদাজানের মৃত্যুর পর আমার পিতা তাঁর দুই স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের সাথে নিয়ে কায়রোস্থ খোশ কাদাম নামক মহল্লায় বাসস্থানে চলে আসেন। এ স্থানটির কথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই বাসস্থানটি ছিল অনেক বিস্তৃত ও প্রশস্ত। এই বাড়ীর আয়তন ছিল আটশত বর্গমিটার। এ বাড়ীর সর্বাপেক্ষা অদ্ভূত ব্যাপার ছিল এই যে, এর কোন জানালাই বাইরের দিকে খোলা যেত না বরং সবগুলো জানালাই প্রশস্ত ও বিস্তৃত আঙ্গিনার দিকেই খুলতে হতো।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের সময় আমাকে একাধারে তিনটি স্কুল পরিবর্তন বিনা কারণে করতে হয়নি। জমিয়তুল খাইরিয়া স্কুলে যখন আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন একদিন চিত্তবিনোদনের অবকাশে আমাদের ক্লাসে কিছু শোরগোল হলে স্কুলের একজন অফিসার আমার শ্রেণী কক্ষে আসেন। তিনি আমাদেরকে ভর্ৎসনা করেন এবং পূর্ণ নীরবতা অবলম্বনের নির্দেশ দেন। তিনি ডেস্কগুলোর মাঝে ইতস্তত পায়চারি করতে থাকেন। এই সময় তিনি মুহাম্মদ আলী নামক একজন ছাত্রকে নাড়াচড়া করতে দেখেন আর যায় কোথায়? তিনি সেই বেচারাকে তার কোটের কলার ধরে নিয়ে আসেন এবং তার পোশাকে কালী ঢেলে দেন। আমার নিকট এ দৃশ্য ছিল অত্যন্ত অশোভনীয়। আমি ঐ ছাত্রটির আর্থিক সংগতি সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। এ জুলুম দেখে আমি নীরবে তা মেনে নিতে পারলাম না। আমার মর্যাদা বোধ আমাকে প্রতিবাদ মুখর হতে বাধ্য করলো। আমি চীৎকার করে সেই অফিসারকে লক্ষ্য করে বলে উঠলাম: “এটা কি ধরনের জুলুম ও বর্বরতা?” আমার কথা শুনে তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আমি তার নির্দেশ পালনে অসম্মতি প্রকাশ করলাম। তিনি আমার কাছে আসলেন এবং আমার কাপড় টানতে শুরু করলাম। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে শক্তিশালী। কেননা আমি ছিলাম বাল্য বয়স্ক অথচ তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ যুবক। তিনি আমাকে ক্লাস রুম থেকে টেনে হেচড়ে বের করে আনলেন। দরজার বাইরে আমাকে রেখে আমার ডেস্কের পাশে গেলেন যেখানে আমার ব্যাগ ও বই পুস্তক পড়েছিল। তিনি আমার বই খাতাগুলো আমার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন। তিনি আমার বই খাতাগুলো আমর মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন। আমি ঐ বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে পাল্টা তার মুখের ওপর নিক্ষেপ করলাম। এক মিনিট অবধি উভয়ই একে অন্যের দিকে বইগুলো নিক্ষেপ করতে থাকলাম। অবশেষে অনন্যোপায় হয়ে তিনি আমাকে কঠোর হস্তে ধরে ফেললেন এবং টানতে টানতে সোজা হেড মাষ্টার সাহেবের নিকট নিয়ে হাজির করলেন। প্রধান শিক্ষকের নাম ছিল কিরারাহ আফেন্দী। তিনি আমাকে তার স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং পরদিন আমার অভিভাবককে সাথে নিয়ে যেতে বললেন। বাড়ীতে গিয়ে আমি আদ্যপান্ত সমস্ত ঘটনা আমার পিতার নিকট বর্ণনা করলাম এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, আর কোনদিন এ স্কুলে ফিরে যাব না। (মুহাম্মদ আলী সালেম পরে পুলিশ একাডেমীতে ভর্তি হয় এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়।) আমার পিতাও আমাকে বাধ্য করেননি। অগত্যা আমি প্রথম শিক্ষা বৎসরটি আর-রাশাদ মাধ্যমিক স্কুলে সমাপ্ত করি। এটা ছিল দারবুল জামহীর রোডে অবস্থিত একটা প্রাইভেট স্কুল। অন্যান্য বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত এই স্কুলেও ভাল পড়ালেখা হতো না। তখনকার দিনে প্রাইভেটট স্কুলগুলোর অবস্থা প্রায়শ এমনই হতো। দ্বিতীয বছরের প্রারম্ভেই আমি ইলহামিয়া স্কুলে গিয়ে ভর্তি হই। এই স্কুলটি ছির সরকারী মনজুরী প্রাপ্ত।
বি, এ, ডিগ্রী লাভ
এই স্কুল থেকে বছরের শেষে ভাল নম্বর পেয়ে আমি বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই এবং এই স্কুলেই ওপরের শ্রেণীতে ভর্তি হই। এখানে বি, এ, পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এখান থেকেই আমি ১৯২৪ সালে মানবিক বিভাগে বি, এ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এ বছর সারা দেশে বি, এ, পরীক্ষায় মাত্র সাতশত সত্তর জন (৭৭০) ছাত্র উত্তীর্ণ হয়। তন্মধ্যে আমি একাত্তর (৭১) নাম্বারে অর্থাৎ ক্রমানুসারে সত্তর জনের পরে সফলতা লাভ করি। আমি আটর্স বিভাগে এজন্য ভর্তি হয়েছিলাম যে, অংকশাস্ত্র ও হিসাব বিজ্ঞানে আমি ছিলাম বেশ দুর্বল। আজ পর্যন্তও আমি অংক অপেক্ষাকৃত কম বুঝি। কেউ হিসাব বিজ্ঞানে আমার সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হউক এমন প্রত্যাশা আমি কখনো করতাম না।
অনুরূপভাবে আমি এমন ইচ্ছাও কখনো পোষণ করতাম না যে, আমার নিকট থেকে প্রত্যেক জিনিসের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও চুলচেরা হিসেবে গ্রহণ করুক। আমি যা বলছি আল্লাহ তার সাক্ষী। কেউ আমাকে কোন দায়িত্ব অর্পণ করলে আর আমি তা গ্রহণ করলে আমার পূর্ণ শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতা দিয়ে সেই গুরু দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার চেষ্টা করেছি এবঙ এজন্য নিরন্তর আল্লাহর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেছি। ফলাফল কি দাঁড়াবে সেই হিসেব বা সে জন্য কোন পরোয়া করতাম না। ফলাফল তো আল্লাহর হাতে এবং তারই ইখতিয়ারাধীন। আমার ওপর শুধু চেষ্টা করার দায়িত্বই অর্পণ করা হয়েছে। পুরোপুরি চেষ্টা করার পর এমন মানসিক প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি আমি লাভ করি যার কোন সীমা নেই। বান্দার প্রতি আল্লাহর অশেষ মহব্বত ও রহমত এইযে, তিনি অনুগ্রহ করে তাকে শুধু কাজ ও চেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছেন। সফলতা এবং অনুকুল ফলাফলের দায়িত্ব তার ওপর বর্তায়নি।
মুষ্টি যুদ্ধ
ইসলামিয়া স্কুলে অধ্যয়নরত থাকাকালে আমি কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করি। এই পর্যায়ে আমি আমার বাহ্যিক জাঁকজমকের প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করি। ইতিপূর্বে আমি শুধু জ্ঞান আহরণ ও অধ্যয়নের প্রতি যত্নবান ছিলাম। সুতরাং আমার জুতা সর্বদা চকচক করতো। প্যান্টের ভাঁজ কখনো নষ্ট হতে দিতাম না। সবসময় মনে হতো যেন এই মাত্র ইস্ত্রী করে আনা হয়েছে। দুপুরের পর আমি যখন স্কুল থেকে বাড়ী ফিরে আসতাম তখন আমার নিজের কামরায় বসে জুতায় পালিশ লাগিয়ে খুব করে ব্রাশ করতাম। প্যান্টে কিঞ্চিৎ পানির ছিটা দিয়ে উত্তমরূপে ভাঁজ করে তারপর বিছানার দুই গদির মাঝখানে সাজিয়ে রেখে দিতাম। এভাবে তাতে কড়া ভাজ পড়ে যেতো। মাধ্যমিক স্কুলে আমি এমন কোন সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখিন হইনি সাধারণত যুবকরা যেমনটি হয়ে থাকে। আমি সাধারণত ছেলেদের মত একজনের অপরজনের পশ্চাতে দৌড়ানো এবং সাধারণ বুট পরিধান করে খেলার কসরত করা থেকে সর্বদা দূরে থাকতাম। এই সময় আমি অবশ্য বক্সিং শিকার চেষ্টা করি কিন্তু আমার ক্রীড়া শিক্ষক একিদিন এমন বক্সিং (মুক্কা) মানে যে, আমি চির দিনের জন্য বক্সিং-এর অনুশীলন পরিত্যাগ করি। আমি স্কুল স্কাউটিং টিমেও অংশ গ্রহণ করি কিন্তু শীগ্রই তা থেকেও কেটে পড়ি। আমার সমস্ত শিক্ষা জীবনে আমিকোন ক্রীড়াতেই সরাসরি অংশ গ্রহণ করতে পারিনি। যদিও দেশী বিদেশী ক্রীড়া জগতের খবর ও রিপোর্টের প্রতি আমার ঝোঁক ছিল অত্যন্ত বেশী।
কঠোর তত্বাবধান
মাধ্যমিক শিক্ষার পুরোটা সময় আমি আমার মরহুম পিতার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ছিলাম। এই তত্বাবধান ছিল বড় সূক্ষ্ম ও কঠোর। আমার শেষ পিরিয়ড কখন শেষ হতো এবং হিলমিয়া ও খোশ কাদামের মধ্যে দুরত্ব কতটুকু তা তিনি ভাল করেই জানতেন। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে কত সময় লাগতে পারে। এতসব চুলচেরা হিসেব নিকেশের দাবী ছিল এই যে, আমি যেন নির্দিষ্ট সময়ে ঘরের দরজায় পৌঁছে যাই। তিনি দরজার সিঁড়িতে বসে অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন এবং হস্তস্থিত ঘরির প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। আমি দরজায় পৌঁছেই সালাম আরজ করতাম এবং পিতার হস্ত মুবারক চুম্বন করতাম। অতপর সিড়ি ভেংগে সোজা আমার পড়ার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করতাম।
যদি কখনো নির্ধারিত সময় থেকে আমার পাঁচ মিনিট বিলম্ব হয়ে যেতো তা হলে আমার রক্ষা ছিল না। দুর্ভাগ্যআমার ওপর আপতিত হতো—এমন সব তিরস্কার ও ভর্ৎসনা শুনতে হতো যা থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। এই তিরস্কার ও ভর্ৎসনার সন্মখে আমি একেবারে বাকহীন হয়ে যেতাম। জাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে কিংবা আত্মপক্ষ পসমর্থন করতে একটি মাত্রই শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে অথবা দুষ্কর্মে বিবরণ সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সাহস হতো না। এতসব কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে আমি ছিলাম বড় সৌভাগ্যের অধিকারী। সকারণ পিতা মরহুমের এরূপ কঠোরতার পশ্চাতে তার পিতৃসুলভ ও স্নেহ ও বাৎসল্য চাক্ষুষ দেখতে পেতাম। সেকালে কৌলিণ্যের দাবী ছিল এই যে, পিতা নিজে কখনো পুত্রকে বলবে না যে, বৎস! আমি তোমাকে ভালবাসি। পিতার স্থানে পিতা এবং পুত্রের জায়গায় পুত্র। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মর্যাদা ও সম্মান আছে। পারস্পরিক স্নেহ ও ভালবাসার বন্ধন যত দৃঢ়ই হোক না কেন প্রত্যেকের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা জরুরী।
বিবাহ বন্ধন
মাধ্যমিক স্কুলে চতুর্থ বর্ষে থাকা কালেই আমার পিতা আমর বিবাহের চিন্তা ভাবনা করেন। তিনি আমার দ্বীনের বাকী অর্ধেকের হেফাজতের ব্যবস্থা করে দিতে চাচ্ছিলেন। অথচ আমার বড় আরো ভাই ছিল এবং তাদের তখনো বিয়ে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা তখন আমার বিবাহের প্রস্তুতি চলছিল। প্রকৃত ব্যপার ছিল এই যে, মুহতারাম পিতা আমাকে কিছুটা বেশী ভালবাসতেন। আমার বিয়ের কাহিনীও বড় বিস্ময়কর।
আমি আমর পাঠ্য জীবনে যা কিছু পড়েছিলাম তাতে আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, আমার জীবন সংগিনী বাছাই করার নিরংকুশ অধিকার রয়েছে আমর এবং এতে কারো হস্তক্ষেপ না করা উচিত। কিন্তু এটা ছিল আমার মানসিক কল্পনা ও অনুমান মাত্র। বাস্তব অবস্থা ছিল এ থেকে ভিন্নতর। আর এটা সত্য যে, বাস্তব কুসংস্কার ও অলীক কল্পনা অপেক্ষা অনেক বেশী কার্যকর হয়ে থাকে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পর আমার মাতা আমাকে বলতে লাগলেন “তোমার আব্বা আমাকে বলেছেন আমি যেন তোমাকে জানিয়ে রাখি আগামী কাল সালাতে মাগরিবের পর তোমাকে অমুখ শাইখের বাড়ীতে যেতে হবে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম “আম্মু, এর কোন কারণ কি আপনার জানা আছে?” জবাবে তিনি বললেন, “যে শাইখ সাহেবের বাড়ীতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী কাল সালাতে মাগরিবের পর তাঁর কন্যার সাথে তোমার বিয়ে হবে।”
সত্য বলতে কি আমার জন্য এটা ছিল আনন্দ দায়ক খবর। কেননা আমি জীবনেরবিশটি বসন্ত তখন পশ্চাতে ফেলে এসেছি। প্রকৃতিগতভাবে আমার বিয়ের প্রয়োজন ছিল। এখন হালাল পন্থায় জৈবিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে। এতো গেলো একদিক। কিন্তু অপর দিকে আমার ভিতরে পৌরুষ এবং জীবন সংগিনী নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার স্বাধীনতার ধারণা আমাকে বিদ্রোহ করার জন্য উস্কানি দিতে শরু করে। তবে এই বিদ্রোহ ও তার প্রকাশ আমি কেবলমাত্র আমার মায়ের নিকটই করতে পারতাম। এ ব্যাপারে আব্বাজানের সামনে মুখ খোলার দুঃসাহস আমার ছিল না।
আমি অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে আম্মাজানকে বললাম, “আমি কখনো সেখানে যাবো না এবং বিয়েও করবো না। আমি কেবল একশর্তে বিবাহ করতে রাজী আছি যদি স্ত্রী নির্বাচনের ইখতিয়ার আমর থাকে।” প্রতুত্তরে আম্মা বললেন, “তোমার সাথে এই বাজে আলোচনা ও বিতর্কে লিপ্ত হয়ে মাথা খারাপ করার কোন দরকার আমার নেই। তবে তোমার এরূপ ঔদ্ধত্য ও বিদ্রোহের কথা আমি তোমার পিতার নিকট পৌঁছে দিচ্ছি যাতে তিনি যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।”
আব্বা ঘরে ফিরে আসলে আম্মাজান তাঁকে আমার বক্তব্য জানালেন। তিনি অত্যন্ত শান্তভাবে বক্তব্য শুনলেন এবং আম্মাজানকে বললেন, ইনশাআল্লাহ সে নারাজ হবে না। সে পালিয়ে যাবে কোথায়? আমি তাকে এখন মানুষ বানিয়ে দিতে চাই। যাতে সে মানুষের সাথে উঠা বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমি তার বিয়ে পরিকল্পনা কর দেবো। আমি তার অভিভাবক। ইনশাআল্লাহ আজই বিয়ে সম্পন্ন হবে।
আদর্শ জীবন সংগিনী
মা আমাকে পিতার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। বাবার অনমনীয়তা দেখে আমি হঠকারিতা পরিত্যাগ করলাম। তা না করে আমার কোন গত্যন্তরও ছিল না। বস্তুত মুহতারাম পিতার অন্তরে আল্লাহ যে কথা জাগুরক করে দিয়েছিলেন তাতে বড়েই কল্যাণ নিহিত ছিল। আমার আব্বাজান আমার বিয়ের মাত্র ছয় মাস পর ইনতিকাল করেন। ১৯২৪ সালে জানুয়ারী মাসে তাঁর মৃত্যু হয়। আল্লাহ তায়ালা আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে আমার অর্ধেক দ্বীনের হিফাজতের ব্যবস্থা করে দিলেন এবং আমাকে সিরাতুল মুস্তাকিবের ওপর কায়েম থাকার তওফীক দিয়েছেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি আর কোন দিন কোন মহিলার প্রতি চোখ তুলে তাকাইনি এবং নিজের জীবন সংগিনী ছাড়া কখনো কোন রমণীর কল্পনাও আমার মনে জাগতে দেইনি। আমি আমার সারা জীবন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে এই নেক বখত মহিলার সাথে কাটিয়ে দেই। সুদীর্ঘ তিপান্ন বছর ব্যাপী চলে আসছে আমাদের এই আনন্দঘন দাম্পত্য জীবন। আমার এই অনুপমা স্ত্রী ১৩৯৯ হিজরী সালের রমজান মাস মোতাবেক ১৯৭৯ সালের আগস্ট মাসে আমাকে বিচ্ছেদ বেদনার সাগরে ডুবিয়ে পরপারে চলে গেছেন। তিনি একাধারে সাত বছর অবধি শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু তার ইবাদাতের ক্ষেত্রে কোন ভাটা পড়েনি। যেদিন তাঁর ইনতিকাল হয় সেদিন সেহরীর সময় আমরা উভয়েই রোযা রাখি এবং একত্রে সালাত আদায় করি। কিন্তু ইফতারীর সময় হওয়ার পূর্বেই তিনি তার মনজিলে গিয়ে পৌঁছেন। তাঁর কথা স্মরণ করে আজও আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। কেউ আমার সামনে তাঁর আলোচনা করলে আমার মন উৎফুল্লা হয় এবং চোখ দু’টি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
মরহুমা ছিলেন একজন আদর্শ স্ত্রী, বিয়ের পর যখন তিনি আমাদের এখানে আসলেন তখন থেকেই নিজ হাতে রান্না করতেন এবং ঘরের সমস্ত কাজকর্ম, কাপড় ধোয়া, গৃহের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাচ্চাদের দেখাশোনা ও লালন-পালন ইত্যাদি কাজে অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে ব্যস্ত থাকতেন। বাড়ীতে পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে কাজ করে আনন্দ পেতেন। আমার সমগ্র জীবনে কখনো তিনি এমন কথা বলেননি যে, “আপনি এই কাজ কেন করেছেন?” কিংবা অমুক কাজ কেন করেননি? তিনি জীবনে নিজের জন্য কখনো কোন জিনিসের বায়না ধরেননি। আমিও তাই তাঁর চাওয়ার পূর্বেই প্রতিটি আবশ্যকীয় জিনিসপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে এনে দিয়েছি।
সতী সাধ্বী স্ত্রী ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বামী
বিয়ের পর তিনি সত্যি সত্যিই একজন গৃহরাণী হয়ে পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকলেন। সুদীর্ঘ সতের বছর পর্যন্ত তো তিনি কখনো একাকী ঘর থেকে বাইরে পা রাখেননি। এই পুরো সময় কখনো তিনি কোন ট্রেন কিংবা বাসেও আরোহণ করেননি। যদি কখনো কোন বিবাহ শাদী অথবা কোন শোকানুষ্ঠানে তাঁকে তার আত্মীয় স্বজনদের পার্শ্বে গিয়ে দাঁড়াতে হতো তখন আমি নিজে আমার গাড়ীতে করে নিয়ে যেতাম। আমি আমার গৃহিণীর ব্যাপারে অত্যন্ত মর্যাদাবোধ সম্পন্ন ছিলাম। সূর্যালোকের ক্ষেত্রেও যেন আমার এই মর্যাদাবোধ ছিল সতকর্ক যেন তার কিরণচ্ছটা কোনভাবে আমার স্ত্রীর শরীর দেখে না ফেলতে পারে। অনুরূপভাবে বায়ুর প্রবাহ সম্পর্কেও আমার ছিল প্রবল বিতৃষ্ণা যাতে উহা তার ব্যবহৃত পোশাকের ওপর দিয়ে কখনো প্রবাহিত হয়ে না যায়। আমার এই সূতীক্ষ্ম মর্যাদাবোধের পুরোপুরি উপলব্ধি ছিল আমার স্ত্রীর। তাই তিনি কখনো এ কঠোরতার জন্য অসন্তোষ প্রকশ বা আপত্তি উত্থাপন করেননি। তার কারণ ছিল এই যে, এই সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধে তিনিও সন্তুষ্ট চিত্তে আমার অংশীদার ছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা এই মহিলার গর্ভে আমাকে বহু সন্তান দান করেছেন। তাদের মধ্যে থেকে এখন অবশ্য মাত্র দুই পুত্র ও দুই কন্যা জীবিত আছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্টি থাকেন। আল্লাহর শোকর আমর সমস্ত সন্তান সৎ শিষ্ট ও অনুগত।
আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার সূক্ষ্ম মর্যাদাবোধের অনুভূতির একটা ঘটনা বর্ণনা করছি। ঘটনাটা এই মুহূর্তেই আমার মনে পড়লো। জামাল আবদুন নাসেরে জিন্দাখানায় আমাকে এক নাগাড়ে সতের বছর কাটাতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালের জুলাই পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময় মরহুমা একজন আদর্শ স্ত্রীর কৃতিত্ব অত্যন্ত ধৈর্য, দৃঢ়তা এবং সদাচরণের সাথে পেশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। জেলখানায় একাধারে দশ বছর ছিল আমার সশ্রম কারাদন্ড। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় আমার স্ত্রী একবারও আমার সাথে সাক্ষাত করতে আসেননি। কেননা এটা আমার মোটেও পসন্দনীয় ছিল না। যে জেলখানার লোকজন এবং আমার ইখওয়ানী ভাইয়েরা আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখতে পাক। ইখওয়ানী ভাইয়েরাও বার বার অনুরোধ করেন যে, এ আচরণ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার আচরণ এবং তিরস্কার যোগ্য। তাদের ঐকান্তিক অনুরোধ বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত আমি আমার স্ত্রীকে কারাগারে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি দেই। তিনি আমার সাথে মিলিত হওয়ার জন্য জেলখানায় আগমন করলে আমি ভাব গম্ভীর পরিবেশেসাতে স্বাগত জানাই। যেন আমরা একে অন্যের নিকট থেকে একদিন কিংবা এক দিনের অংশ বিশেষের জন্য বিচ্ছিন্ন ছিলাম মাত্র। আমার দীর্ঘ কারাবাস ও গৃহ থেকে অনুপস্থিতির এই সময়কালে আল্লাহর এই বান্দী কখনো আমার কাছে কোন প্রকার অস্বস্তি প্রকাশ করেনি। কিংবা আমার আত্মীয় স্বজনের জন্য কোন সমস্যাও সৃষ্টি করেনি। যদিও আমার মা এবং ভাইবোনদের পক্ষ থেকে অনেক সময় তার সাথে রূঢ় আচরণও করা হয়েছে।
যুবক যুবতীদের প্রতি উপদেশ
আমি নওজোয়ান ছেলেমেদের উপদেশ দিতে চাই। এ উপদেশ আমার সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস। যুবক যুবতীরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে তারা যেন তথাকথিত প্রেমকে তার ভিত্তি না বানায়, বিয়ের পূর্বে যা (পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণর ফলে) সৃষ্টি হয়। প্রেম ঘটিত বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সফল হয় না। যে ভাবাবেগ তাড়িত অবস্থাকে ভালবাসা ও প্রেম বলে আখ্যায়িত করা হয় তা একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, দুই তিন বছরের মধ্যেই তা নির্বাচিত হয় এবং আবেগের অপমৃত্যু ঘটে। ভালবাসা ঘৃণায় অথবা অন্তর নিস্পৃহতায় রূপান্তরিত হয়। বিশেষত যখন আগমন ঘটে নবজাতকের তখন এই আবেগ সম্পূর্ণ ঠান্ডা হয়ে যায়। ভাটা পড়ে আসে সেই অনুভূতিতে।
বিয়ের ব্যাপার আমার উপদেশ হচ্ছে, প্রথমে দেখতে হবে পিতামাতা এই বিয়েতে সম্মত কিনা তার পর দেখা আবশ্রক স্বামী স্ত্রীর সামঞ্জস্যতা ও সোমঝোতা। যদি এরূপ না করা হয় তাহলে সেই বিয়ে দ্বারা সেই উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না। যে জন্য বিয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক শুধু মাত্র সাময়িক ও আবেগ দাড়িত প্রেম প্রীতির ওপর স্থায়ী হতে পারে না। এর ভিত্তি হওয়া উচিত পবিত্রতা ও অকৃত্রিমতা। উভয়েই উভয়ের জন্য আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার অনুভূতি পোষণ করতে পারলে দাম্পত্য জীবনে জান্নাতী আবেশ ও সুষমা নেমে আসবে। ফলে বিয়ে স্থায়ী কল্যাণ ও সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
ধ্বংস নেমে আসুক এমন স্বামী স্ত্রীর ওপর যারা বিযের পর আপন সাথী ছাড়া অন্য কারো প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা তার জন্য অন্তরে ভালবাসার লালন করতে শুরু করে।
আমার মনে পড়ে আমি ১৯৩৬ সালে দাস পাশা মার্কা ফিলিফস রেডিও গ্রাম ক্রয় করেছিলা। আমার মরহুমা স্ত্রী সুস্পষ্টভাবে আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে, রেডিওতে যখন তিনি রিয়াদুস সানবাতি মরহুমের গান শুনেন তখন এ গান ও তার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর তার খুব ভাল লাগে। আমি তাকে বললাম, “যখনই ঘোষকের মুখে রেডিওতে সানবাতির নাম শুনবে তখনই রেডিও বন্ধ করে দিবে।” মরহুমা কোন প্রকার ইতস্তত না করেই সাগ্রহে ও সানন্দে আমার এই নির্দেশ মেনে নেন। আমি যুবক যুবতীদের বলতে চাই যে, পিতামাতার স্ত্রী নির্বাচনে সন্তুষ্ট থাকবে। কিংবা নিজের পসন্দের মেয়ের ব্যাপারে মাতাপিতাকে সম্মত করতে চেষ্টা করো। পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির ফল অত্যন্ত দুঃখজনক পরিণাম এবং বর্ণনাতীত মুসিবত। আর তাদের সন্তুষ্টির ফল সীমাতিরিক্ত সৌভাগ্য ও সুখ-শান্তি লাভ।
আইনের পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা
১৯২৪ সাল ইউনিভার্সিটি ল’ কলেজে ভর্তি হওয়ার অব্যবহিত পরই আমার যৌবনের উন্মেষ ঘটে। আমি আইন মহাবিদ্যালয়ে এজন্য ভর্তি হয়েছিলাম যে, আইন ব্যবসায়ের প্রতি ছিল আমার প্রবল অনুরাগ। উকিলগণ যখন মজলিশে বসে কথাবার্তা বলতেন তখন আমার কাছে তাদেরকে খুবই সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় মনে হতো। মোকদ্দমাসমূহের শুনানী ও বিশ্লেষণে তাদের ধরণ ধারণ বিশেষত যখন জজ সাহেবগণ নীরবে বসে তাদের যুক্তিসমূহ শুনতে থাকেন তখন তাদের গুরু গম্ভীর মনে হতো। উকিলদের সম্পর্কে পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে আমি যেসব বিবরণ পড়তাম তাতে আমার এই ধারণা হয়েছিল যে, তারা মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষক। তারা দুর্বলদের সহযোগিতা প্রদান করে এবং তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে দেয়। সর্বোপরি যে কথাটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার যোগ্য তা হচ্ছে তারা কারো কর্মচারী নয়। বরং তাদের পেশা স্বাধীনতা ও স্বয়ম্ভবতার গ্যারান্টি।
আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পর্যায়ে আমি কখনো কোন ক্লাসে অকৃতকার্য হইনি। কিন্তু আইন কলেজে এসে আমি একাধিকবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছি। অবশ্য আমার অকৃতকার্যতার কতগুলো কারণ ছিল:-
১।বিয়ে : আমি কলেজ জীবনে বিয়ে করি এবং পিতা হওয়ার গৌরব অর্জন করি। অতেএব স্ত্রী পরিজনের কারণে পড়াশুনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারিনি। এমনকি ক্লাসেও আমি নিয়মিতভাবে হাজির হতে পারতাম না।
২। জাতির আযাদী আন্দোলনে যোগদান: আমি অধিকাংশ সময়ই আন্দোলনের কাজে অংশ গ্রহণ করতাম এবং বহুবার সা’দ জগলুল পাশার নিকট বায়তুল উম্মাহ চলে যেতাম। তার কথা বার্তায় ছিল যাদু মন্ত্রের মত আকর্ষণ। সেখান ঘন্টার পর ঘন্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতাম।
৩। পিতার ইনতিকাল ও গাড়ী ক্রয়: ইত্যবসরে আমার পিতা ইনতিকাল করেন। অমনি সেই নিয়ন্ত্রণ যা এত দিন তিনি কঠোরভাবে কার্যকরী করে আসচিলেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই পর্যায়েই আমি একটা (গাড়ী) রিন্যুকা পরুলিয়া নম্বর ২৭৫১ ক্রয় করি। এখন আমার আনন্দ স্ফূর্তির সুযোগ ও উপকরণ হস্তগত হয়ে যায় যা এতদিন মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এই পর্যায়ে আমি মদ ও ব্যভিচার ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত অভ্যাস ও আচরণ রপ্ত করে ফেলি যা আমীর ওমরাহদের সন্তানদের বৈশিষ্ট্য। সিনেমা ও থিয়েটারে গমন করা নৃত্যু ও সংগীতের আসরে নর্তন কুর্দন করা আমর অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। আল্লাহর মেহেরবানী যে, তিনি আমাকে মাদক দ্রব ও জ্বেনা থেকে নিরাপদ রেখেছেন।
আদর্শ শিক্ষক মন্ডলী
আইন কলেজে দেওয়ানী আইনের উস্তাদ ছিলেন ডক্টর আবদুর রাজ্জাক আল সানহুরী মরহুম। তিনি শুধু তার বিষয়েরই সুদক্ষ শিক্ষক ছিলেন না। বরং প্রকৃতপক্ষে তিনি নৈতিক গুণাবরী ও বৈষয়িক লেন-দেনের ক্ষেত্রেও খুবই উন্নত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের নিকট গ্রহণযোগ্রতা লাভ করতে পারেননি। তার আওয়াজ ছিল অত্যন্ত কর্কষ ও ক্ষীন এমন কি তাকে “ছাত্রদের জ্বীন” নামে অভিহিত করা হতো। তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ফরাসী ভাষাকে আরবী ভংগিতে বলতে শুরু করেন। যখন তিনি দেখেন যে, দেওয়ানী আইনের পত্রে কোন কোন চাত্র খুবই দুর্বল তখন তিনি আমাদের সকলকে ডেকে পাঠান এবং নির্ধারিত পিরিয়ড ছাড়া আরো অতিরিক্ত পিরিয়ড আমাদের দিয়ে দেন। এই সময় তিনি আইনের অধিকতর জটিল দিকগুলো বিশ্লেষণ করতেন যা নিয়মিত ক্লাসে আমরা শিখে নিতে পারতাম না। আর এই অতিরিক্ত সময় তিনি কোন প্রকার আর্থিক বিনিময় ব্যতীতই প্রদান করতেন। অথচ আধুনিক কালের কোন কোন ডক্টর এবং প্রফেসরের মত ডক্টর সানহুরী মরহুম ধন্য ব্যক্তি ছিলেন না। এসব ডক্টর তো তাদের গৃহে অনেক বেশী অর্থের মিনিময় ছাত্রদেরকে কোটেশন পড়াতেন। এমনকি এই অন্যায় অবৈধ কর্মতৎপরতার সমালোচনা করার মতও কোন লোক ছিল না। ছাত্রদের অন্তরে সেই শিক্ষকের প্রতি কি সম্মান বোধ জাগবে যার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করার পর ছাত্রদেরকে তার বিল পরিশোধ করতে হয়। শিক্ষকগণ জ্ঞান শিক্ষা দিতে গিয়ে পয়সার জন্য হাত প্রসারিত করলে তা কি মানানসই হয়?
এই কর্মনীতি ছাত্রদের মনে এই বিশ্বাসই সৃষ্টি করে যে, এই পৃথিভীতে কোন জিনিসই এমনকি জ্ঞানও বস্তুগত বিনিময় ছাড়া লাভ করা যায় না। ফলে ছাত্ররাও শুধু জ্ঞান লাভের জন্য জ্ঞান চর্চার করতে পারে না। বরং তাদের নিকট এই জ্ঞান আর্থিক লাভের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারা এই লক্ষ্য পানে পাগলপারা ও হন্যে হয়ে ছুটতে থাকে যাতে বেশী বেশী অর্থ উপার্জন সম্ভব। ধন-সম্পদ অর্জন করা তাদের এক নম্বর লক্ষ্যে পরিণত হয় এবং যাবতীয় নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়। উন্নত দেশসমূহে ছাত্ররা জ্ঞান অর্জন করে এজন্য যাতে বিষয়বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে এবং অর্জিত সেই শিক্ষার সাহায্যে কোন নতুন আবিষ্কার ও মতবাদ উপস্থাপন করতে এবং সৃষ্টি রাজ্যের রহস্য নিগুঢ় তত্ব মানুষের নিকট উদঘাতি করে দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার এই উদ্দেশ্যই একেবারে বদলে গেছে। এ কারণেই সেসব জাতি দ্রুত উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিযে চলেছে। আর আমরা অনুন্নতই রয়ে গিয়েছি। তারা শক্তিশালী আমরা দুর্বল। আমরা মৌলিক শিক্ষার জন্য শিক্ষা লাভ করা সম্পূর্ণ ভুলে বসেছি। জ্ঞান লঅভের জন্য ত্যাগ ও পরিশ্রম এখন পুরোনো দিনের কাহিনী। আমরা প্রত্যেকেই নিজের জীবন যাত্রার মান অধিকতর উন্নত সমৃদ্ধ করার চিন্তায় বিভোর। অন্যসব মানুষ অনাহারে মৃত্যু বরণ করুক তাতে কিছু যায় আসে না। স্বার্থপরতারি এই জীবনধারাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।
আমি কয়েকবার বলেছি যে, এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে সরকার দ্বীনি সংগঠনগুলোকে এই কাজ আঞ্জাম দেয়অর জন্য নিয়োগ করুক। মুসলিম ও খৃস্টান নির্বিশেষে ধর্মীয সংগঠনগুলোই এই সমস্যার সমাধান একযোগে চেষ্টা করে বের করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা যথাক্রমে মসজিদ ও গীর্জায় করা যেতে পারে। মুসলিমদের নিকট মসজিদ এবং খৃস্টানদের গীর্জা পবিত্র স্থান। সুতরাং এই সকল স্থানে অনুষ্ঠিতব্য শিক্ষামুলক ক্লাস থেকে দুর্বল ছাত্রগণও অল্প বিস্তর উপকৃত হতে সক্ষম হবে।
মহিলাদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভংগী
আমার দৃষ্টিতে মহিলাদের জন্য উপযুক্ত স্থান ঘর ও গৃহের চার দেয়াল পরিবেষ্টিত স্থান। এর বাইরে তাদের কোন অবস্থান আমি স্বীকার করতে পারি না। বর্তমান যুগের নওযোয়ান ছেলেমেদেয়দের মধে প্রচলিত আচার আচরণ আমি একেবারেই পসন্দ করি না। নারী ও পুরুষের কোন সহ অনুষ্ঠানে যদি কখনো আমার যোগদানের সুযোগ হয় বিশেষত যেখানে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা বেশী সেখানে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে আসে। নির্লজ্জের মত বার বার চেয়ে দেখা তো দূরের কথা আমি কখনো কোন পরনারীর চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। আমি মহিলাদের সমাবেশে বক্তব্য পেশ করা কিংবা মহিলাদের সাথে সরাসরি কথাবার্তা বলাও পসন্দ করি না। তথাকথিত সংস্কৃতিবান লোকেরা এই মানসিকতাকে দোষ ও দুর্বলতা বলে মনে করেন এবং কাপুরুষ বলে গালি দিয়ে থাকেন। এই লোকেরা যা ইচ্ছা তাই বলে বেড়া কিন্তু আধুনিকতাবাদ ও তার নারী পুরুষের স্বাধীনতার সাথে আমার কি সম্পর্ক? নারী পুরুষের মধ্যে সাম্যের মতবাদেরও আমার নিকট কোন গুরুত্ব নেই। আল্লাহ তায়লা পুরুষকে পুরুষ করে সৃষ্টি করেছেন এবং নারীকে নারী প্রকৃতি দ্বারা ধন্য করেছেন। মানুষ আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কৌশল এবং তার নিগুঢ় তত্তব ও প্রকৃতি কিভাবে পরিবর্তন করতে পারে? আমাদের সরলমনা যুবক যুবতীদেরকে বাহ্যত সমৃদ্ধি ও আধুনিক ধ্যান-ধারণার আকর্ষনীয় দিকসমূহ দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু তারা তা বাস্তবের কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। নারী-পুরুষের এই সাম্যের অর্থ কি? যে নারী নিজেকে পুরুষের সমান বলে মনে করে সে তার মর্যাদা হারাবার পূর্বেই নারীত্ব থেকেও বঞ্চিত হয়ে যায়।
যতদিন আমি একজন উকিল হিসেবে প্রাকটিস করেছি ততদিন আমি আমার ব্যক্তিগত সচিবকে বিশেষভাবে নির্দেশদিয়ে রেখেছিলাম যে, আমার চেম্বারে আমর নিকট যেন কখনো কোন মহিলা একাকী না আসে। যদি কখনো কোন মহিলাকে কোন কাজে আসতে হয় এবং তার সাথে কোন পুরুষ লোক না থাকে তা হলে সেক্রেটারী অবশ্যই তার সাথে যেন আমার অফিসে আসে।
আমাকে একবার আরব আমীরাতে মহিলাদের এক কনফারেন্সে যেতে হয়। সেখানে আমি কোন কোন মহিলার প্রশ্নে নির্ভিকতা ও নির্লজ্জতার বহর দেখে হতবাক হয়ে যাইা। আমি ইশারায় ইংগিতে জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। একবার আমি ইটালী গিয়েছিলাম। সেখানকার কুমু শহরের এক হোটেলে অবস্থান করছিলাম।আমার ক্ষৌরকার্য করানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই আমি হোটেলের সেলুনে বুকিং করিয়ে পাঠাই। যথা সময়ে আমি সেলুনে গিয়ে উপস্থিত হই এবং দেখতে পাই যে সেখানে ক্ষৌরকার্য সম্পাদনের জন্য মহিলারা কর্মরত। একজনও পুরুষ ছিল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম: “আমার ক্ষৌরকার্য কে করবে?” তখন তারা একটা মেয়ের দিকে ইংগিত করলো। তারপর আমি পুনরায় প্রশ্ন করলাম: “এখানে কোন পুরুষ ক্ষৌরকার নেই?” তারা বললো: “না”। একথা শুনে আমি: “বললাম তাহলে আমি ক্ষৌরকর্মই করবো না।” এই বলে আমি আমার রুমে ফিরে গেলাম। এই ঘটনা পুরো হোটেলে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হলো। উপস্থিত সকলেই এটাকে অদ্ভূত ঘটনা মনে করে প্রত্যেকের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করতে থাকে আর আমি সারারাত আল্লাহর শোকার আদায় করতে থাকি এই জন্য যে, তিনি আমাকে এমন এক দেশে জন্মলাভ করিয়েছেন যেখানে আর যাই হোক অন্তত হালাল হারামের পার্থক্য মানুষ এখনও করে থাকে।
ভুল বুঝাবুঝির অবসান
আমার মহিলাদের ভূমিকা হবে বিশ্বস্ত স্ত্রীরূপে পুরো ঘরকে আনন্দ মনজিল এবং জান্নাতসম বানিয়ে দেয়া। আমার স্ত্রী ছিলেন ঠিক এ ধরনের একজন মহিলা। সে আমার সন্তানদের গর্ভে ধারণ করে এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাদেরকে উত্তম রূপে লালন পালন করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমার ছেলেমেয়েরা যার সাথেই মিশুক না কেন সার সাথেই সম্মানজনক ব্যবহার করে এবং বিনিময়ে তারাও অনুরূপ সৌজন্যমূলক ও ভদ্রজনোচিত ব্যবহার লাভ করে থাকে। আমি এখানে একটা ভুল বুঝাবুঝিও চিন্তাজগত থেকে দূর করে দিতে চাই। আমার এসব কথাবার্তা থেকে কখনো যেন এরূপ ধারণা না করা হয় যে, নারী জাতির প্রতি আমার রয়েছে বিদ্বেষ ও ঘৃণা। কখ্খনো নয় আল্লাহ তায়ালা সাক্ষী এবং তিনি জানেন নারী জাতিকে আমি কত বেশী সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকি। আর আমার এই মনোভাব ও অনুভূতি প্রকৃতপক্ষে মহিলাদের প্রতি অনেক বেশী সম্মান বোধের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমি তাদেরকে অন্যদের অসৎ উদ্দেশ্যের শিকার ও কুদৃষ্টি থেকে পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ দেখতে চাই। আমি নারী শিক্ষার বলিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক। আমি সর্বদাই এ বিষয়ে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছি যে, নারীদের শিক্ষা লাভের সুযোগ দিতে হবে। যাতে তারা তাদের নারীত্বের পূর্ণাংগ বিকাশ ঘটাতে পারে। এবং সতীত্ব ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। আমি চাই নারীদের ব্যাপারে প্রচলিত সমস্ত সন্দেহ সংসয়ের অবসান হোক। ইসলামী বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নারীদের অধিকার ও কর্তব্য এবং শাস্তি ও পুরষ্কারের দিক দিয়ে পুরোপুরি পুরুষের সমকক্ষ বানিয়ে দিয়েছেন। নারীর কাম্য এ ছাড়া আর কি হতে পারে। মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ পরস্পর সমান। উভয়ের রয়েছে কর্মের আপন গন্ডি। তথাকথিত আধুনিকতা ও প্রগতিবাদীদের সাম্য এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সাম্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রাচীন প্রতিনিধিত্ব
ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত ছাত্র থাকা কালই রাজনৈতিক কার্যক্রমে খুব আন্তরিকতার সাথে অংশ গ্রহণ করতে থাকি। এই পর্যায়ে আমি অফদ পার্টির একজন ঐকান্তিক সমর্থক ছিলাম। আমি অধিকাংশ সময় ‘উম্মাহ হাউসে” যাতায়াত করতাম। আমার মনে আছে সা’দ জগলুল পাশা “কাশকুল” পত্রিকা নেয়ার জন্য কোন ছাত্রকে পাঠিয়ে দিতেন। পত্রিকাটি ছাপার সাথে সাথেই তিনি তা চেয়ে পাঠাতেন। এই পত্রিকায় মুদ্রিত কার্টুন সমূহ তিনি খুবই কৌতুহলের সাথে দেখতেন। এই পত্রিকাটি অফ্দ পার্টি এবং তার নেতৃত্বের কট্টর বিরোধী ছিল। এতে সা’দ জগলুল ও তার পার্টির ওপর অত্রন্ত সূক্ষ্ম ও নগ্নভাবে হামলা করা হতো। এবং ব্যঙ্গচিত্রও ছাপা হতো। কিন্তু তিনি কখনো এসব লেখা ও কার্টুন দেখে অসন্তোষ কিংবা উত্তেজনা প্রকাশ করতেন না।
আমি যদিও অফ্দ পার্টির লোক ছিলাম কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসমাঈল সিদকী পাশা মরহুম সম্পর্কে আমি বিশেষ মতামত পোষণ করতাম। অধিকাংশ লোকই আমার এই দৃষ্টিভংগির সাথে দ্বিমত পোষণ করতো। তবে একথা সত্য যে, সিদকী পাশা জনসাধারণের মধ্যে কখনো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। জনগণের ওপর দমননীতি ও বল প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসব সত্ত্বেও আমি নিজের পার্টির এই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কিচু মহৎগুণের ভক্ত ছিলাম।
সিদকী পাশা মিসরীয় জাতি সম্পর্কে বলতেন যে, এরা প্রতিটি সরকারের অনুগত এবং উদীয়মান সূর্যের পূজারী। এই দৃষ্টিভংগী পোষণ করার ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং জনগণের সাথে তার আচরণ অত্যাচার ও উৎপীড়নের ওপর ছিল ভিত্তিশীল। তথাপি নিসন্দেহে তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার রাজনীতিবিদ। তিনি তার রাজনীতিকে দেশে বিরাজিত পরিস্থিতিরে মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল যদি (ইংরেজদের থেকে) পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক অধিকার লাভ করা সম্ভব না হয় তাহলে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকু ছেড়ে দেয়া উচিত নয়। (পক্ষান্তরে অফ্দ পার্টির নেতা এবং জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা সা’দ জগলুল পাশা জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি বলতেন বিদেশী আধিপত্যবাদের কবল থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করতে হবে নতুবা শুরু করতে হবে অসহযোগ আন্দোরন।) রাজনৈতিক ময়দানে সিদকী পাশার এই দৃষ্টিভংগী ভ্রান্ত ছিল না। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভের জন্যে লাগাতার সংগ্রাম অব্রাহত রেখে আংশিক অধিকার ও আযাদী আদায় করে নেয়াতে কোন ক্ষতি ছিল না।
ইনসাফের দাবী
সম্ভবত আজও মানুষের মনে আছে যে, সিদকী পাশা তার মন্ত্রীত্বের সময় আলেকজান্দ্রিয়াস্থ আল কুরনীশ রাজপথ নির্মাণের ঠিকাদারী দানতুমার কোম্পানীকে দিলে তখন চার দিক থেকে তার ওপর বিশ্বাস ভঙ্গের অপবাদ আরোপ করা হয়। পরবর্তীকালের ইতিহাস অবশ্য প্রমাণ করে যে, এ অভিযোগ ছিল মিথ্যা। এই কুর্ণিশ সড়ক অদ্যাবধি আলেকজান্দ্রিয়াতে বিদ্যমান। এবং এর পরিপাটি রূপ সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করছে। আলেকজান্দ্রিয়ার এই মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাসমূহের অন্যতম। সড়কটির উপযোগিতা এখন আর কারো অজানা নয়। এই সড়ক আলেকজান্দ্রিয়ার জন্য অনেক কল্যাণ বয়ে এনেছে। যতদিন আলেকজান্দ্রিয়া থাকবে ততদিন এই সড়কও থাকবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, যেসব লোক এই সৌন্দর্যমন্ডিত ও লাভজনক উপঢৌকন আলেকজান্দ্রিয়াকে দিয়েছে আজ কেউ তুলেও তাদেরকে স্মরণ করে না।
সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য ছিল খুবই প্রবল। কিন্তু মতবিরোধকারীগণ ছিলেন কাজের মানুষ। জাতীয ইস্যুগুলোতে মতোভেদ যত তীব্রই হোক তারা পরস্পরে অত্যন্ত সৌহার্দ ও বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক বজায় রাখতেন। একজন অন্যজনের কাছে আসা যাওয়াও করতেন। এবং সন্ধ্যায় একই আসরে সমবেত হয়ে সকলে গল্প গুজবে মেতে উঠতেন। আজকাল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির মধ্যে যেরূপ হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতামূলক মনোভাব বিদ্যমান এবং দলীয় হীনমন্যতা ও সংকীর্ণতা ব্যাপক তখনকার দিনে এর নাম নিশানাও ছিল না। রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিসমূহের মধ্যে যে ব্যাপক শত্রুতা ও দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী বিদ্যমান তৎকালে তার কোন নাম গন্ধও ছিল না। কোন ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত হয় না। বরং বিজয় লাভের জন্য সকল প্রকার বৈধ অবৈধ কূটকৌশল অবলম্বন করে। অথচ মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন নজীরও রয়েছে যে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি হয়েছে। ইয়াহহিয়া পাশা ইব্রাহীমের মন্ত্রীত্বের আমলে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সর্বাপেক্ষা বেশী সম্ভাবনাময় দল পরাজয় বরং করে এবং অফ্দ পার্টি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয় লাভ করে। এতসত্ত্বেও রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সম্প্রীতি সৌহার্দ থাকার কারণে কোন প্রকার রাজনৈতিক শত্রুতা কিংবা তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি।
আমাদের মতে মিসরের কোন লোকই নির্বাচনের বিরোধিতা করে না। বিজয়ী ও বিজিত সকলেই নির্বাচনের পক্ষে।কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো দলভিত্তিক বর্তমান রাজনীতিতে ক্ষমতার মসনদে প্রতিষ্ঠিত দল নির্বাচন নামক প্রহসন করা সত্ত্বেও কখনও ইনসাফপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে দেয় না। তাদেরকে তো যে কোন মূল্যে নির্বাচনে বিজয় লাভ করতেই হয়। যদিও জনগণ তাদের প্রতি সম্পূর্ণ অনাস্থাই প্রকাশ করুক না কেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। বিশ্বসভায় আমরা কখনো প্রকৃত সম্মান অর্জন করতে পারবো না যা আমরা কামনা করে থাকি; যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে আমূল পরিবর্তন সাধন না করি।
আইন ব্যবসা শুরু
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করার পর আমি কর্ম জীবনের প্রারম্ভে উতবা খাজরা এলাকায় জনৈক উকিল সাহেবের দপ্তরে শিক্ষাণবিশী করি। উকিল সাহেবের নাম ছিল ইব্রাহীম বেগ জকি। তিনি প্রথমে জজ ছিলেন। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রাকটিস শুরু করেছিলেন। আমি আজীবন মাযহাবের গোঁড়ামী ও পক্ষপাতিত্ব থেকে দূরে ছিলাম। এবঙ কখনো এরূপ চিন্তা করিনি যে, কাউকে মুসলিম হতে হলে তাকে অবশ্যই মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করতে হবে, যদি সে মাযহাব ভুলের ওপর থাকে তবুও। আবার কেউ খৃস্টান ধর্মের অনুসারী বলে তার বিরুদ্ধাচরণ করাও জরুরী যদিও সে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। জানি না সাদাতের সময় কোন্ শয়তান মাযহাবের পক্ষপাতিত্বের এই ফিতনা ও বিপর্যয় কখনো স্থান পায়নি তা আল্লাহ ভাল করেই জানেন। এখানকার প্রত্যেক শহরেই মিসরীয়রা বাস করতো এবং অন্যদেরকে মিসরীয় বলে মনে করা হতো। দ্বীনের প্রত্যেক অনুসারী কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই এবং কারো হস্তক্ষেপ ব্যতীতই নিজ নিজ পরিমন্ডলে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন অতিবাহিত করছিলো।
শিক্ষাণবিশীর মেয়াদ শেষকরার পর শাবিনুল কানাতির অঞ্চলে আমি আমার নিজস্ব দপ্তর খুলে ব সলাম।সত্য কথা বলতে কি। আমি আমার পেশায় না ছিলা অপ্রতিদ্বন্দ্বিী আর না একেবারেই অখ্যাত ও অজ্ঞাত বরং এ দু’ প্রান্তিকের মাঝামাঝি ছিল আমার অবস্থান। কালুবিয়াস্থ কমিশনারীর প্রত্যেক আদালতে আমার হাতে কোন না কোন মোকদ্দমা অবশ্যই থাকতো। তাছাড়াও আল্লাহর মেহেরবানীতে সারা দেশ থেকে আমার নিকট মামলাসমূহ আসতিা। উত্তর দিকে দূরতম স্থান যেখানেই আমার মামলার তদবীর করার জন্য যেতে হয় উহার নাম ছিল তানতা। আবার দক্ষিণ দিকে সুদুর এলাকায় অবস্থিত আদালাত যেখানে মামলাসমূহ রুজু করা হতো তার নাম ছিল তাহতার আদালত, এভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার যশ ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
সততা ও দ্বীনদারী
আমি আমার পেশা জীবনের প্রারম্ভেই আল্লাহর নামে শপথ করেছিলাম যে, মক্কেলদের কখনো প্রতারণার মধ্যে ফেলে রাখবো না। কোন বাদী কিংবা বিবাদী কোন দেওয়ানী মামলা নিয়ে আমার কাছে আসলে আমি তার কেসটি তার মুখেই বিস্তারিত শুনে নিতাম। প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ যেমন কেসের তারিখ, প্রেক্ষাপট, সাক্ষী এবং আনুসংগিক অন্যান্য সকল ব্যাপারে পুরো তথ্য নিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম। মোকদ্দমাত সত্য হলে তা তদবীর করতে সম্মত হতাম এবং সংগে সংগেই আদি অন্ত ও সাক্ষী ইত্যাদি দেখে যতি মনে হতো যে, এই মোকদ্দমায় জিতে যাবো তাহলে মক্কেলকে বলে দিতাম ঠিক আছে মামলা দায়ের করে দিচ্ছি। আর যদি কেসের প্রকৃতি দ্বারা উপলব্ধি করতে পারতাম যে, এ কেসে সফলতার কোন সম্ভাবনা নেই। তা হলে অকপটে মক্কেলকে বলে দিতাম, অনর্থক পয়সা খরচ করবেন না। বরং প্রতিপক্ষের সাথে আপোষ-মীমাংসা করে ফেলুন। কেস গ্রহণের অর্থ কখনো এই ছিল না যে, এরূপ কেসকে শতকরা একশত ভাগই সাফল্য লাভ করতো। বরং এ হতো আমার প্রাথমিক ধারণা ও অনুমান মাত্র। অনেক সময় এমনও হতো যে, যে মামলা আমি হাতে নিয়েছিলাম সে হেরে গেছে আর যার কেস আমি গ্রহণ করিনি সে জিতে গেছে। আমি মূলত আমার উপার্জন হালাল পন্থায় করতে চেয়েছি। এজন্যই মোকদ্দমাসমূহের সত্যতা ও যথার্থতা এমন কি জয়লাভের জন্য উপস্থাপিত ঘটনাপ্রবাহ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়ণ করে নিতাম। আমার অনুমান ভুলও হতে পারতো কিন্তু আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস ও আগ্রহ উৎসাহ এই লক্ষ্যে পরিচালিত হতো যে, মোকদ্দমা দায়েরকারীকে তার তদবীরের খরচতো অন্তত বহন করতে হবে। বাকী ফলাফলের নিশ্চিত জ্ঞান তো তদবীরের খরচতো অন্তত বহন করতে হবে। বাকী ফলাফলের নিশ্চিত জ্ঞান তো আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নিকট সুস্পষ্ট নয়। অবশ্য ফৌজদারী মামলায় আমি যখনই অনুমান করতে পেরেছি এবঙ যখনই কোন ফায়সালার বিরুদ্ধে আপিল দায়েল করেছি তখন সর্বপেক্ষত্রেই অভিযুক্ত ব্যক্তি হয় মুক্তি লাভ করেছে নয়তো অপরাধীর শাস্তি কিছুটা লাঘ করা হয়েছে। মোক্কদমার ফাইল ও রেকর্ডপত্র দেখে আমি সেসব বিষয় বুঝে ফেলতাম যার ভিত্তিতে আদালতে দলিল-প্রমাণ পেশ করা যেতে পারে। আল্লাহর মেহেরবানীতে তাতে সফলতা আসতো।
নির্বাচনে অংশ গ্রহণ
এমনিতে আমার পেশাগত জীবন অব্যাহত ছিল। আলহামদুলিল্লাহ এতে আমি বেশ সফলও হয়েছি। এই পর্যায়ে আমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মনোনীত প্রার্থ হিসেবে বেশ কয়েকবার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করি কিন্তু একবারও সফলকাম হতে পারিনি। কারণ নির্বাচনের নিয়ম-নীতি এবং তাতে জয়লাভের জন্য প্রকাশ্য ও গোপনীয় কৌশল সম্পর্কে আমি একেবারেই অবহিত ছিলাম না। নির্বাচনে জেতার জন্য সাধারণত এমন সব তদবীর করা হয় যা নৈতিকতা বা শরীয়াত কোনটাই অনুমোদন করে না। যেমন মিথ্যা খবর ও প্রচার-প্রচাগান্ডা, ঘুষ-স্বেচ্ছাচারিতা ও ভয় ভীতি প্রদর্শন। এসব হাতিয়ার আমার ছিল না এবং যে দ্বীনের আমি অনুসরণ করি তার শিক্ষার মধ্যেও এগুলো ছিল না। এসব নোংরা কূটকৌশল থেকে সর্বদা আমি আমার দেহ ও আত্মাকে রক্ষা করে চলি। সাধারণ মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ভাল। মজার ব্যাপার হলো এই যে, কালউবিয়া অঞ্চলে অফ্দ পার্টির লোকেরাও আমাকে তাদের দলের সদস্য বলে মনে করতো এমনকি হিযবুল আহরার এর দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণও আমার নাম তাদের দলের সদস্য তালিকায় লিখে নিতো। সকলের সাথেই বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। লজ্জা শরমের কারণে আমি নীরবে আমার কাজ করে যেতাম। যতদিন পর্যন্ত আমার নিকট ইসলামের সীমানা এবং হালাল হারামের চৌহদ্দি থেকে বাহির হয়ে যাওয়ার দাবী না করা হয় ততদিন তাদের সাথে আমি আমার সম্পর্ক খারাপ করতে পারি না। এ ছিল আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। সৃষ্টিগতভাবেই আমার স্বভাব প্রকৃতি এরূপ ছিল।
আত্মপ্রচার বিমুখতা
কোন কোন সময় মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমার ছাত্রজীবনে যে সকল ছাত্র বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নির্বাচনে বিজয়ী হতো এবং যাদের নাম সমসাময়িক সংবাদপত্রে ছাপা হতো আমার নাম তাদের সাথে কেন দেখা যায় না।
এর জবাব হলো আমার স্বভাব-প্রকৃতি বড়ই বিস্ময়কর। খ্যাতি নামধাম এবং প্রচার প্রপাগান্ডার প্রতি আমার রয়েছে ঘৃণা। এখনো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যেসব লোক আমাকে জানে তা একান্ত অনিচ্ছাকৃত ও আমার অপারগতারই ফল মাত্র। যদি আমার সাধ্যাতীত না হতো তা হলে আমি এমন সংগোপনে ও নীরবে থাকতাম যে, কেউ আমার নাম পরিচয় জানার সুযোগও পেতো না। পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। তাছাড়া দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করতে গিয়ে আমাকে এসব কিছুই মেনে নিতে হয়েছে। আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়ার জন্র ইখওয়ানের বাইয়াত বিশেষত নিয়তের বিশুদ্ধতার ওপর ভিত্তিশীল। ইখওয়ানের নেতৃত্বের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সাহিত্য সাময়িকীতে আমার আলোচনা পকাশিত হতে থাকে। এতে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার ব্যতীত সুনাম সুখ্যাতি সঅর্জনের উদ্দেশ্য আমার নেই। আল্লাহ তায়ালা তো অন্তর্যামী। তিনি মানুষের নিয়ম ও মনের অবস্থা খুব ভালভাবেই জানেন। হৃদয়ের গভীরে লুকায়িত গোপনীয় সবিষয়টাও তিনি ভালভাবে জানেন।
আপনি দেখছেন যে পারিবারিক পরিবেশে আমি জন্মগ্রহণ করেছি তা ছিল অনাবিল দ্বীনি পরিবেশ। আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছাও সর্বদা এই ছিল যে, নিষ্ফল ও অনর্থক কাজকর্ম থেকে আত্মরক্ষা করে চলি। আমার মরহুম পিতার কঠোর তত্বাবধান এবং স্বীয় সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য তার বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন এসব কিছুর সমন্বয়ে গঠিত একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রভাব আমার নীরব প্রকৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আমি সর্বদা গুণীজনদের মজলীশে গিয়ে বসা এবঙ তাদের সাথে চলাফেরা করারও প্রয়াস পেতে থাকি। তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকা ছিল আমার দ্বিতীয় চারিত্রক বৈশিষ্ট্য। কৃত্রিমতা আমি কখনো পসন্দ করি না। আমি অন্যদের আবেগ অনুভূতির প্রতি সর্বদা সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। এসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমার এই ব্যক্তিত্ব গঠন করেছে আজ যা আপনারা আমার মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন।
আমার মনের একটা দৃঢ় সংকল্প হচ্ছে, আমার কোন কথা ও আচরণ দ্বারা আমি কখনো কোন মানুষের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবো না। কেউ আমাকে কোন কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলেও না। ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শগতভাবে আমি তার বিরোধী হলেও না। এ কারণে আজীবন কোন ব্যক্তিগত ব্যাপারে কখনো কোন লোকের সাথে আমার কোন প্রকার বিরোধ ও সংঘাত হয়নি। অবশ্য দাওয়াতে হকের আন্দোলনে কিছু লোক আমার সাথে সীমাহীন দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাদের সেই অত্যাচার ও নির্যাতনের মোকাবেলায় আমি এই সান্ত্বনাই পেতে চেষ্টা করতাম যে, আমি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত তাদের জুলুম ও নিপীড়ন আমার ব্যক্তিগত কোন অশোভনীয় আচরণের ফল নয় বরং তাদের ইসলাম বিদ্বেষী মানষিকতা-ই এর মূল কারণ। আমি তাদের সকল অত্যাচার উৎপীড়ন অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাতে ষহ্য করেছি এবং কোন প্রকার অভিযোগ ও অসন্তোষ প্রকাশ না করেই জালিমদের মোকদ্দমা মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে এসেছি। ইবরাহীম আবদুল হাদী মরহুম এবং জামাল আবদুল নাসের মরহুমের হাতে বর্ণনাতীত অত্যাচার সহ্য করেছি। তথাপি আমি কখনো তাদের সম্পর্কে আমার অন্তরে না কোন প্রতিহিংসা লালন করেছি, না কোন অশালীন বাক্য প্রয়োগ করেছি। তা করার প্রয়োজনই বা আমার কি। যখন পুরো বিষয়টা সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহাপরাক্রমশালী ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার মালিকের নিকট সোপর্দ করা আছে। তখন তাঁর ফায়সালার প্রতি কৃকজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত থাকাই আমার কর্তব্য।
দ্বিতীয় অধ্যায়
ইখওয়ানের সাথে আমার সম্পর্ক এবং হাসানুল বান্না শহীদের সাথে আমার সাক্ষাতের ঘটনা বড় হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষনীয়। এ সাক্ষাতকারের সূচনাপর্ব শুনেই আপনি সমাপ্তি পর্বের বিবরণ উপলব্ধি কতে পারবেন। আমি যখন ওকালতির ব্যবসায় গ্রহণ করি তখন শাব্বিনুল কানাতের এলাকায় দপ্তর খুলে বসি। আমার বাসস্থান ছিল পেম্বার থেকে এগার কিলোমিটার দূর তিলমেসানী ফার্মে। আমি ঘর থেকে অফিসে যাতায়াতের সময় বাস এবং রেলগাড়িতে ভ্রমণ করতাম। গৃহে আমার কাজ ছিল মুরগী পালন। এই খামারে আমি আমার মানসিক প্রশান্তির জন্য যে মুরগীর খামার খুলেছিলাম তাতে মোরগ-মুরগী ছাড়াও নানা জাতের কবুতর এবং খরগোশও পালতাম। এই ফার্মেই ছিল আমার থাকার ঘর। এবং সেখানেই ছিল মনোলোভা এক পুষ্পোদ্যান।
১৯৩৩ সালের প্রথম দিকের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি তখন ফুল বাগানে বসে ছিলাম। ফার্মের চৌকিদার এসে আমাকে খবর দিলো দু’জন আপ টু ডেট লোক আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমি আমার পরিবার পরিজনকে অন্দর মহলে চলে যাওয়ার জন্য ইংগিত করলাম এবং চৌকিদারকে মেহমানদরে ভেতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম। দু’জন যুবকই ভিতরে প্রবেশ করলো এবং তাদের পরিচয় প্রদান করলো। তাদের কেজন ছিলেন ইজ্জত মুহাম্মাদ হাসান আর অপর জনের নাম ছিল মুহাম্মাদ আবদুল আল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিলো শাব্বিনুলি কানাতের কসাইখানার কর্মচারী এবং শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন ডেল্টা রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার। মেহমানদের স্বাগত জানানো ও আথিথেয়তার কিছু সময় কেটে গেল। চা পান শেষে ইজ্জত মুহাম্মাদ হাসান নীরবতা ভংগ করে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কি করেন?” এ ধরনের প্রশ্ন আমার কাছে অদ্ভূত মনে হলো। আমি তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেলাম এবং কৌতুকের ভংগীতে জবাব দিলাম, “আমি এখানে মুরগীর বাচ্চা পুষি।”
আমার কৌতুককর জবাবে মেহমানদের স্নায়ুর ওপর অস্বাভাবিক প্রভাব পড়লো না। বরং জবাব শুনে ইজ্জত মুহাম্মদ হাসান বললেন, “আপনার ন্যায় নওজোয়ানদের জন্য মুরগীর বাচ্চা পালনের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা করছে।” আমি এখনো পর্যন্ত গাম্ভীর্যের পরিবর্তে রসিকতা পূর্ণ মেজাজেই কথাবার্তা শুনছিলণাম। সুতরাং আমি সেই ভংগিতেই পুনরায় প্রশ্ন করলাম, “সেটা কি জিনিস যা মুরগীর বাচ্চা অপেক্ষা অধিক আমার মনোযোগ ও প্রশিক্ষণের উপযুক্ত?” মেহমান গাম্ভীর্য সহকারে প্রত্যুত্তরে আজর করলেন, “মুসলিমগণ আপনার মনোযোগ লাভের অধিক উপযুক্ত। তারা তাদের দ্বীন থেকে দূরে সরে পড়েছে এবং এই উদাসীনতা তাদেরকে এতবেশী প্রভাবহীন করে দিয়েছে যে, তাদের নিজের দেশেও তাদের কোন গুরুত্ব এবং বিন্দুমাত্র ইজ্জত ও সম্মান নেই। বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থান তো না থাকার সমান।”
“আমি এই জটিল ব্যাপারে কি করতে পারি বলুন। আমর শক্তি সামর্থই বা এমন কি আছে?”
মেহমানগণ বললেন যে, এ ময়দানে আপনি একা নন। বরং আপনার মত যুবকদের একটা সংগঠন গঠিত হয়েছে। এক মহান ব্যক্তি সাইয়েদ হাসানুল বান্না এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতহা এবং মুর্শিদে আ’ম। কিছুদিন পর সেই যুবক দু’জন পুনরায় আমার দপ্তরে আগমন করেন এবং আমাকে বলেন যে, সাইয়েদ সাহানুল বান্নাহর সাথে আমার সাক্ষাতের কর্মসূচী তৈরী হয়ে গেছে। মুর্শিদে আ’ম কায়রোস্থ ইলিকিনিয়া রোডের ছিরামিয়া এলাকায় আবদুল্লাহ বেগ মহল্লাহয় থাকতেন।
পূর্ব নির্ধারিত সময়ে আমি মুর্শিদে আ’ম-এর বাসায় দরজায় গিয়ে পৌঁছি। দরজার কড়া নাড়তেই বড় দরজা খুলে গেলো। আমি দ্বারদেশে করাঘাত করলাম এবং জবাবে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম “কে?” আমি বললাম: “শাব্বিনুল কানাতির থেকে আগাত এডভোকেট ওমর তিলমেসানী”। সংগে সংগে তিনি ওপরের কক্ষ থেকে নীচে নেমে আসেনে এবং আমাকে স্বাগত জানান। অনন্তর বাইরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় ডান পার্শ্বে যে কামরা ছিল তার দরজা খোকলেন। আমি মেজবানের পেছনে পেছনে সেই রুমে গিয়ে প্রবেশ করি। কক্ষটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই কামরার মধ্যে কি আছে তা আমি মোটেও অনুমান কতে পারলাম না। মেজবান কক্ষের একমাত্র জানালাটি খুলে দিলে ভেতরে আলো প্রবেশ করলো। তখন আমি লক্ষ করলাম যে কক্ষটি অত্যন্ত সাদাসিদে এবং সাদা গোছের ছোট একটা অফিস। দপ্তরের মধ্যে রাখা কয়েকখানা চেয়ার যেগুলো গতানুগতিকভাবে কাঠ মিস্ত্রীদের হাতে তৈরী। চেয়ারগুলোর ওপর কিচু ধূলাবালি জমে ছিল। মেজবান একটি চেয়ারে বসলেন এবং আমার বসার জন্যে অপর একটি চেয়অর এগিয়ে দিলেন। মূল্যবান সুট পরে সেই চেয়ারে বসা আমার কাছে কিছু অপসন্দনীয় মনে হলো। কিন্তু আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে চেয়ারের ওপর বিছিয়ে বসে পড়লাম। মেজাবান কৌতুহলী দৃষ্টিাতে আমাকে নিরীক্ষণ করছিলেন। তাঁর ঠোটে স্নেহ দরদভরা হাঁসি যেন নৃত্যু করছিল।
আমি লক্ষ্য করলাম এবং মনে মনে ভাবলাম যে, মুর্শিদে আম’ম হয়তো আমার এই কীর্তিকলাপ দেখে বিস্মিত হয়েছেন। এখানে দু’টি ভিন্ন পথ ছিল। যে ব্যক্তি ফ্যাশন পূজারী এবং উন্নত ও মূল্যবান পোশাকের প্রতি যত্নবান সে দাওয়াতে হকের কঠিন রাস্তায় কিভাবে চলতে পারবে? কোথায় বাহ্যিক কেতাদুরস্ত ঢঙে চলা আর কোথায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর দাবী? দাওয়াতে হকের দায়িত্ব তো জীবনে কঠোর পরীক্ষা বিপদাপদ নিয়ে আসে। এর সাথে একত্মতা প্রকাশ করলে আরাম এয়শ ও ভোগ বিলাস সবকিচুই ত্যাগ করতে হয়। দুঃখ-কষ্ট ও মসিবত বরদাশ করতে হয়। একাকীত্ব ও নিঃস্বঙ্গতার জ্বালা সইতে হয়।
আমার বাহ্যিক জাঁকালো অবয়ব সত্ত্বেও মুর্শিদে আ’ম এর চেহারায় কোন প্রকার অস্বস্তি বা অস্থিরতা ছিল না। সাধারণ মানুষ হলে আমাকে দেখা মাত্র দাওয়াতে হকের দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত মনে করে বসতো। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কাছে তার পয়গাম ও কর্মসূচী পেশ করতে শুরু করলেন। কি ছিল তার পয়গাম? তার পয়গামের মূল কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ছিল যে, “শরীয়াতের বিধি-বিধানের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জন এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনসাধারণের মধ্রে মানসিক প্রস্তুতি ও অনুভূতির তীব্রতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বসাধারণের সম্মুখে এই সত্যটি উদঘাটিত ও সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরতে হবে যে, কোন প্রকার কল্যাণ ও মঙ্গল একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারো থেকে লাভ করা সম্ভব নয়। তাঁর দেয়া জীবন বিধান ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করতে হবে.....”
“হাসানুল বান্না শহীদ অত্যন্ত সফল ও কার্য়কর ভংগিতে দাওয়াত পেশ করলেন। আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত গভীর মনোনিবেশ সহকারে তাঁর সমস্ত কথা শুনলাম। তাঁর কথা বলার মাঝে আমি একবারও কোন কথা বলিনি। বক্তব্য শেষ করে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আমার সাথে ঐকমত্য পোষন করতে পারছেন?” আমার মুখ খোলার পূর্বেই তিনি পুনরায় বলতে লাগলেন, “দেখুন! এখনই জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাকে পুরো এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে কুব গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন। হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মূল্যায়ণ করুন। স্বীয় বিবেকের রায় গ্রহ?ণ করুন। আমি আপনাকে পিকনিক কিংবা আনন্দ ভ্রমণের দাওয়াত দিচ্ছি না?। আমি আপনাকে যে কথার দিকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি তা অত্যন্ত দুঃসাহসী লোকদের কাজ। আপনার মন যদি এতে সাড়া দেয় এবং আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আপনার হৃদয় মনকে উদার ও উন্মুক্ত করে দেন তা হলে খুবই ভাল কথা। আগামী সপ্তাহে বাইয়াতের জন্য আসুন। আর যদি এ কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে না পারেন তা হলেও কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, আপনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের একজন হিতাকাংখী বন্ধু।”
যে ঈমান সঞ্জীবনী মজলিশে বসার এবং অতুলনীয় কথাবার্তা দ্বারা উপকৃত হওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছি তারপরও কি কেউ বাইয়াত (আনুগত্য শপথ) গ্রহণ করতে মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব করতে পারে? (কিন্তু যেহেতু মুর্শিদের নির্দেশছিল তাই সে দিনের মত) আমি চলে আসলাম এবং আদেশ মোতাবেক এক সপ্তাহ পর পুনরায় যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম। আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে হাসানুল বান্নার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। এই বাইয়াত ছিল আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্র ও সৌভাগ্যজনক ঘটনা। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দিরও অধিক সময় যাবৎ কাজ করার সম্মান আমি লাভ করেছি। এই বাইয়অতের পর যখন থেকে আমি হকের রাস্তায় চলতে শুরু করলাম তখন থেকেই পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিপদ-মুসিবতের যাতাকলে পিষ্ট হয়ি আমাকে চলতে হয়েছে। এসব ঘটনা ইতিহাসের অংশ। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার পশ্চাতে আমার রবের সমীপে তার যথাযথ পুরস্কার লাভের প্রত্যাশা ছাড়া আমার আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। (আমার বিনম্র প্রার্থনা) এসব ত্যাগ ও কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গণ্য হোক এবং এর পুরস্কার ও পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকটই নির্ধারিত থাকুক।
আমার মনের ঐকান্তিক আকাংখা হলো, আজকের যুবক মুসলিমগণ এই বৃদ্ধ (তিলমেসানী) থেকে যিনি তাঁর জীবনের আশিটি বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন এই শিক্ষা গ্রহণ করুক যে, আল্লাহ তায়ালা (পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য থেকে) যা কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন তা অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাথে সহ্য করতে হবে এবং আল্লাহ তায়ালার মর্জির ওপর সর্বদা সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার কোন ফায়সালা এবং ভাগ্যের ব্যাপারে তিল পরিমাণ আপত্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। আমার আরো কামনা হলো সর্বদা আল্লাহর রহমাত ও সাহায্য আমার ওপর বর্ষিত হতে থাকুক আর যখন আমি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরদিনের তরে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করবো তখনো যেন আল্লাহর পথের একজন সৈনিক হিসেবে তার নিকট যেতে পারি। আমার আন্তরিক বাসনা হলো আমার সমস্ত আশা ভরসা ও চাওয়া পাওয়া যেন আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত থাকে। তার সত্য প্রতিশ্রুতির ওপর থাকে আমার এমন পরিপূর্ণ বিশ্বাস যা অনুরণিত হয় আমার প্রতিটি শিরা উপশিরায়। যে পর্যন্ত আমার এমন সৌভাগ্য ও মর্যাদা লাভ না হয়ে যায় যে, আমি আমার নিজ চোখে আমার মওলা ও মনীব এবং প্রভু ও প্রতিপালককে দেখতে পাই অথবা আপন হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই ও নিরাপত্তা ও সফলতার যোগ্র তাকওয়ার অধিকারীগণকেই বানিয়েছেন। আমি আল্লাহ তায়ালার নিকট এই দোয়া করছি তিনি যেন আমাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সকল সদস্যকে সত্যিকার অর্থে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করেন এবং আমাদেরকে তার সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের উপযুক্ত বানিয়ে দেন.....।”
ইমাম হাসানুল বান্নার সাথে আমি আমার প্রথম সাক্ষাতের কাহিনী বর্ণনা করলাম। আমাদের মধ্যে যে কেউ-ই ইমামের সাথে সাক্ষাত করেছেন সে-ই এ ব্যাপারে অবগত যে শহীদ আমাদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছেন। তিনি আমাদেরকে কোন মিথ্যা আশ্বাস দেননি। আমাদেরকে তিনি এমন কথা কখনো বলেননি যে, এই পথে পা রাখার সংগে সংগেই সমগ্র পৃথিবী আমাদের স্বাগত জানানো ও বরণ করে নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিংবা আমাদের গলায় ফুলের মালা পরাতে এগিয়ে আসবে অথবা জীবনের ভোগ বিলাস ও আরাম-আয়াসের উপায় উপকরণ অপেক্ষা করতে থাকবে। না কখ্খনো নয়। বরং তিনি আমাদেরকে সর্বদা সাবধান ও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দাওয়াতে হকের রাস্তা কন্টকাকীরণ কঠিন উপত্যকা পরিক্রমা মাত্র। বড়ই বন্ধুর ও দুরতিক্রম্য এই পথ, যে কেউ-ই এই দাওয়াত কবুল করতে এগিয়ে আসুক না কেন তাকে ভালভাবে বুঝে শুনে অত্যন্ত সাবধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তারপর যখন নির্যাতনের যাতাকলে ঘুরতে আমম্ভ করবে তখন কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। বরং বলিষ্ঠ হাতে ধৈর্যের লাগাম ধরে স্থরিভাবে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। মুর্শিদে আ’ম কখনো কাউকে প্রতারিত করেননি। বরং প্রথম থেকেই এই পথের দাবী সম্পর্কে অবহিত করে এসেছেন।
অতপর তারা যখন সাহসের সাথে কোমর বেঁধে এই কাফেলার সংগে চলতে থাকে তখন আল্লাহ তাদের অন্তরে পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। তাদের আন্তরিক সম্পর্ক এত গভীল যে, মানুষ তা দেখে হতবাক হয়ে যায়। এমনকি কেউ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “যদি কোন ইখওয়ানী আলেকজান্দ্রীয়ায় চীৎকার করে উঠে তা হলে আসওয়ানের ইখওয়ানী তা শুনতে পায়।” আর আমি বলে থাকি যে, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত মজবুত ও নিবিড় যে, ইউরোপে অবস্থানকারী কোন ইখওয়ানী যদি কোন জিনিসের আকাংখা করে আর কানাডায় বসবাসরত কোন ইখওয়ানী তা জানতে পারে এবং বুঝেন যে, তিনি তা পূরণ করতে পারেন তা হলে তার চাওয়ার পূর্বেই তিনি তা পূরণ করে দেবেন। এ জন্য শর্ত শুধু একটিই, তা হচ্ছে এরূপ কামনা বাসনা আল্লাহর আনুগত্যের সীমার মধ্যে হতে হবে, এর বাইরে যাওয়া চলবে না।
সত্য পথে চলতে গিয়ে আমি কঠিন মসিবত সহ্য করেছি। কিন্তু কখনো কোন অভিযোগ উত্থাপন করিনি। ইবরাহীম আবদুল হাদী মরহুম এবং জামাল আবদুল নাসের মরহুমের হাতে নির্যাতনের যাতাকলে আমার অন্যান্য ইখওয়ানী সাথীদের মত আমিও বছরের পর বছর ধরে পিষ্ট হয়েছি। কিন্নতু আমি এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কখনো কোন অশালীন উক্তি করিনি। কিংবা মনে কোন প্রকার বিদ্বেষও পোষণ করিনি, কেননা আমার বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার নিকট সোপর্দ করে দিয়েছি।
ইবরাহীম আবদুল হাদীর নির্যাতন
১৯৪৮ সালে ইবরাহীম আবদুল হাদী আমাকে সর্বপ্রথম গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কারাগারে বন্দী করে এবং তুর পাহারে নির্বাচিত করে। কিন্তু মানুষ তার সমস্ত চক্রান্ত সত্ত্বেও খুবই দুর্বল ও অসহায়। ক্ষমতার যে মসনদে বসে গর্বে ও অহংকারে মানুষের বুক ফুলে ওঠে অথচ সেই মসনদ তার শেষ রক্ষা করতে পারে না। অবশেষে ইবরাহীম আবদুল হাদীও মসিবতে পড়ে যায় এবং তার মসনদও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অতএব আমাকে ও আমার অপর দুই কয়েদী বন্ধু জনাব মুহাম্মাদ আল আল বাহী মরহুম ও উস্তাদ মুহাম্মাদ আল খাদরামীকে (আল্লাহ তার হায়াত দীর্ঘায়িত করুন) তুর থেকে তার কাছে ডেকে পাঠায়। পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে আমাদেরকে নিয়ে হাজির করা হয়। আমাদেরকে একটা প্রশস্ত কামরায় নিয়ে বসানো হয়। উজীরে আযম ইবরাহীম আবদুল হাদী তার দফতরে উপস্থিত ছিলেন। আমাদেরকে এক এক করে তার চেম্বারে ডেকে পাঠানো হয়। সর্বপ্রথম মরহুম মুহাম্মাদ আলবাহীর ডাক পড়ে, তারপর উস্তাদ আল্ খাদরামীর এবং সর্বশেষে ডাকা হয় আমাকে। আমাদেরকে একে একে প্রধান মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করানো হয়।
উস্তাদ আল্ খাদরামকী যখন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে উপস্থিত ছিলেন তখন করিম সাবিত পাশা মরহুম (অন্যতম মন্ত্রী) দ্রুত গতিতে বাহির থেকে আসেন। দেখে মনে হচ্ছিল যে, কেউ পেছন দিক থেকে তাকে জোরপূর্বক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুত গতিতে সে প্রধান মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করে এবং কয়েক মিনিট পর তড়িৎ গতিতে আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। সে অত্যন্ত অস্থির ছিল। বস্তুত উজীরে আযমের রূঢ়তা ও কঠোরতার কারণে ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই তটস্থ ছিল।
বর্বরতা ও পাশবিকতার প্রতীক নাসের
অত্যঅচার উৎপীড়ন ও জুলূম নিপীড়নে জামাল আবদুন নাসের ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইবরাহীম আবদুল হাদী ছিল কঠোর ও নিষ্ঠুর। কিন্তু নাসেরের ব্যাপারই তো ছিল আলাদা। ইবরাহীমের অত্রাচার-নির্যাতনের যেখানে সমাপ্তি ঘটতো নাসেরের জুলুম নির্যাতন সেখান থেকে শুরু হতো। অত্যাচার ও নির্যাতনের এমন সব অমানবিক পন্থা নাসের উদ্ভাবন করেছিল তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করি। সে তার পরে আগমনসকারী অত্যাচারীদের সর্বজন স্বীকৃতম উস্তাদ হিসেবে পরিগণিত।
শিক্ষা লাভের জন্য দর্শন
ইবরাহীম আবদুল হাদীর শাসনকালের সমাপ্তি ছিল নির্মম ও শিক্ষণীয়। যার বিবেক একেবারে মরে যায়নি সে অবশ্যই এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ ক রতে পারে। ঈদের পূর্ব রাতে বাদশাহ উজীরে আযমকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এই জালিম ব্যক্তির পদত্যাগের খবর ঈদের দিন পত্র-পত্রিকায় লাল ব্যানার হেডে মুদ্রিত হয়। প্রত্যেক পত্রিকা তাদের উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে জাতিকে সুসংবাদ পরিবেশন করে যে, শাহ্ ফারুক উজীরে আযমকে বরখাস্ত করে দেশবাসীকে ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার প্রদান করেছেন। আহ! তারপর আগমনকারীগণ এই লাঞ্ছনাকর ও শিক্ষনীয় পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো। কিন্তু ক্ষমতার নেশাতে মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে থাকে। তাই দেয়ালের লিখন কে পাঠ করবে এবং সুবিবেচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
পিস্তলের নল
যাই হোক এখন উজীরে আযমের সাথে সাক্ষাতের কাহিনী শুনুন। যখন আমার পালা আসল আমি প্রধান মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলাম। আমার আবা ছিল আমার কাঁধের ওপর। আমি সালাম দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। কিন্তু উজীরে আযমের অবজ্ঞানজনক আচরণ ছিল দেখার মত। সে আমার সালঅমের জবাব পর্যন্ত দিল না। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সেই সময় তিনি বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে আটকে গিয়েছিল। আমি নিজেই আলোচনার সূচনা করে উজীরে আযমের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জটিলতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। এই সময় একজন বড় অফিসার ওমর হোসাইন আমার পিঠের ওপর পিস্তলের নল তাক করে দাঁড়িয়েছিল সম্ভব সে তখন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইনচার্জ ছিল। মনে করুন তার পিস্তলের নল আমার কানপট্টি স্পর্শ করছিলো। একবার মনে করলাম পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তা জ্বালাই। কিন্তু বিবেক বাধা দিলো। কারণ পকেটে এই মুহূর্তে হাত দেয়া নিশ্চিত মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো ছাড়া কিছু নয়। যদিও কক্ষে প্রবেশের অব্যবহিত পূর্বেই সিকিউরিটির লোকজন খুব ভাল করে আমার বডি তল্লাসী করেছিলো কিন্তু যে ব্যক্তি পিস্তল উঁচিয়ে দন্ডায়মান ছিল তার ওপর কি ভরসা করা যেতে পারে যে, আমার হাত নাড়ানোকেই সে প্রধানমন্ত্রীর ওপর আক্রমণের উদ্যোগ মনে করে গুলী করে বসবে না? এমতাবস্থায় যদি আমি জীবন দিয়ে দিতাম তাহলে আল্লাহ তায়ালার কাছে তো অবশ্যই শাহাদাতের মৃত্যু বলে গণ্য হতো। কিন্তু কোন প্রকার মোকাবিলা ছাড়া জীবনটা দিয়ে দেয়াও তেমন ভাল কোন কাজ নয়।
উজিরে আযমের প্রতিক্রিয়া
কিছুক্ষণ পর প্রধান মন্ত্রী আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই আসল মতলব ব্যক্ত করলেন। তথাপি বিদগ্ধ পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য একটা কথা বলে রাখা জরুরী মনে করি। আর তা হচ্ছে, তার কথার ভংগী আনোয়ার সাদাতের ভংগী থেকে ছিন্ন ছিল। আনোয়অর সাদাতের সাথে সাক্ষাতের সময় “ওমর, ওমর!” বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু ইবরাহীম আবদুল হাদী “ওস্তাদ ওমর” বলে কথার সূচনা করেন। তিনি বলেন, “ওস্তাদ ওমর” আমি আপনাকে শুধু তিনটা প্রশ্ন করতে চাই। যদি আপনি সঠিক জবাব দেন তাহলে আপনাকে এবং অন্য সমস্ত ইখওয়ানী কয়েদীদেরকে সংগে সংগে মুক্ত করে দেয়া হবে। এর অন্যথা হলে জেনে রাখুন সব কয়েদীর কয়েদ ও নজর বন্দীর সমস্ত দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তাবে। কেননা আপনারা ইখওয়ানের হাই কমান্ডের সদস্য।
১। আপনাদের অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম কোথায়?
২। সেই স্টেশনটি কোথায় যেখান থেকে আপনারা অস্ত্রশস্ত্র বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করে থাকেন?
৩। ইখওয়ানের গুপ্ত সংগঠনের নেতা কে কে?
আমি তাকে যথার্থ উত্তর দিলাম যে, “আপনার এসব প্রশ্নের কোন একটির জবাবও আমার কাছে নেই।” অতএব আমাদেকে তুরের পরিবর্তে পুনরায় আল হাইকসিতার জিন্দানখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।
ইমাম হাসানুল বান্নার শাহাদাত
ইবরাহীম আবদুল হাদীর আমলে ইখওয়ানের যে ভূমিকা ছিল, সুধী পাঠক একটু চিন্তা করলেই স্বাভাবিকভাবেই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমরা ইবরাহীমের ক্রোধ ও রোষাণলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলাম। কারণ আমরা জনসাধারণকে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে আসছিলাম। আমরা জাতির মন-মগজে একথা বদ্ধমূল করে দিচ্ছিলাম যে, দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। এবং সরকার জনগণের যাবতীয় অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন “আযাদ অফিসার কিংবা মুক্ত কর্মকর্তাগণের” নামও কেউ শুনেনি। জাতির মধ্যে উপলব্ধি ও সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি লক্ষ্য করুন। অতপর আমাদের সম্পর্কে বিপ্লবী “আযাদ অফিসারগণের” তৎপরতাও নিরীক্ষণ করুন। আবদুন নাসের ও তার সহযোগীরা আমাদেরকে বিপ্লবের শত্রু উপাধিতে ভূষিত করে। সে তো নির্লজ্জতার এমন নিম্নস্তরে পৌঁছে গিযেছিল যে, আমাদের ইমাম শহীদ হাসানুল বান্নার শাহাদাতের অভিযোগও আমাদের ওপরই আরোপ করে। আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ছিল এই যে, ইমামের শাহাদের পর আমরা আনন্দোৎস করেছিলাম এবং মিষ্টান্ন বিতরণ করেছিলাম। কবির ভাষা:
বিবেক ও কান্ডজ্ঞান লোপ পেলে বিস্ময়ের আর কি থাকে যে তার পর এরূপ কথাবার্তা বলে বেড়ানো স্বাভাবিক।
বায়ুমান যন্ত্র মেরাগ
আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে কারা? বিপ্লবের অধিনায়ক এবং তাদের তপ্লীবাহক সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ। আজ পর্যন্তও এই গীত গাওয়া অব্যাহত গতিতে চলছে। যে কেউ-ই শাসক গোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র হতে চায়- সে-ই এ সস্তা হাতিয়ার ব্যবহার করে ইখওয়ানের ওপর ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতে শুরু করে। শাহ্ ফারুকের আমলে আমরা তার ভুল ও অন্যায় কার্যক্রম এবং স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপের পুরোপুরি সমালোচনা করতাম। কিন্তু এই সব সুশীল ও সাহসী সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ তাদের মর্যাদাবোধের প্রকাশ ঘটাতো এভাবে যে, তারা শাহের স্তব স্তুতি ও প্রশংসা গীতিতে ভরা লম্বা চওড়া প্রবন্ধ লিখতো এবং তাকে আসমানে পৌঁছিয়ে দিতো। শাহ সম্পর্কে তাদের লিখনীও ভাষায় লেখা হতো:
“প্রথম শিক্ষক”
“মিশরের প্রথম প্রকৌশলী”
“জন্মভূমির প্রথম নিষ্ঠাবান কর্মী”
এভাবে তার জন্য সর্বক্ষেত্রে “সর্ব প্রথম” শব্দ প্রয়োগ করতো। এমনকি তারা এমন সব কথা বলতো ও লিখতো যাতে লজ্জা শরমের আর কোন বালাই থাকতো না। তারপর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে এই কলমধারীগণই তাদের কলম ও মুখ দ্বারা এতদিন যে ফারুকের প্রশংসায় অগ্রগণ্য ছিল এখন তাকেই “ঘৃণার পাত্র” ও “হত্যার উপযুক্ত” প্রভৃতি বিশেষণ লাগাতে শুরু করে।
এই মহত্ব ও নীচতা
বিপ্লবের প্রারম্ভে এই শরীফ ও খান্দানী সাহিত্যিকগণের লক্ষ্য বস্তু ছিল ফারুক। কিন্তু যখন জামাল আবদুল নাসের ও ইখওয়ানের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তখন কামানের নল একেবারে ঘুর যায়। এখন ইখওয়ানের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নিয়ে খেলা এই সাহিত্যিকগণেল পেশায় পরিণত হয়। নাসেরের এই ধামাধরা গোষ্ঠী বাতাসের গতি এমনভাবে ফিরিয়ে দেয় যে, তাকে আকাশের উচ্চতারও উপরে নিয়ে যায়। আবার নাসের যখনই চক্ষু মুদিত করেন তখন এই সম্ভ্রান্তরাও তাদের নৃত্যের তাল পরিবর্তন করেন। এখন তাদের কাছে মিসরের ইতিহাসের অন্ধকারময় ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। নাসেরের শাসনকাল। এই লোকদের এতটুকুও লজ্জা শরম নেই যে গতকাল পর্যন্ত যার গুণ-কীর্তন করেছে আজই তার কবরের ওপর জুতোর আঘাত করছে সবটুকু শক্তি দিয়ে।
সাদাতের ক্ষমতার দন্ড হাতে নেয়ার পর এই চাটুকদাররা তাদের চিরাচারিত অভ্যাস অনুযায়ী তার প্রশংসা বর্ণনায় তাদের কলমের পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে। তারা তাকে একেবারে হিরো বানিয়ে দেয় এবং ইতিহাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব ও উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এই পুরো সময়কালে ইখওয়ান প্রত্যেক শাসকের হাতেই জুলুমের চাকায় পিষ্ট হতে থাকে।
ফেরেশতা থেকে শয়তান
সাদাতের বিবেক ও কান্ডজ্ঞানেরই বা কি হয়েছিলো যে, সে তার পূর্ববর্তীদের আচরণ ও পরিণাম স্বচক্ষে দেখার পরও সেই ধোঁকা ও প্রতারণার জালে জড়িয়ে পড়ে। অথচ তার ভালভাবেই জানা ছিল এই চিত্র শিল্পীগণ যারা প্রতিটি উদীয়মান সূর্যের পূজারী, আবার যখনই কোন তারকার ওপর কোন প্রকার বিপদের পাহাড় ভেংগে পড়ে তখন তাকে কঠোর ভাষায় গালি দিতেও তাদের কোন প্রকার দ্বিধা হয় না। আফসোস ও দুঃখ হয় এ জন্য যে, যদি তারা সতর্কতার সাথে কাজ করতো এবং শিক্ষা গ্রহণ করতো কিন্তু ক্ষমতার লোভ ও গদীর নেশায় বিবেক ও অনুভূতিই লোপ পেয়ে থাকে। অতএব সাদাতও তার পূর্ববর্তী শাসকগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং তাদের পরিণতিই বরণ করতে বাধ্য হয়। এসব সাহিত্যিকদের লিখনী ও মুখ “হাতিয়া”র কলমও মুখের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ফলে সাদাত “ফেরেশতা” থেকে হঠাৎ শয়তানে পরিণত হয়। (‘হাতিয়া’ আরবী ভাষার এমন এক কুখ্যাত কবি যার চেহারাও ছিল কদাকার ও বিশ্রী। অন্যের সমালোচনা ও দোষ বর্ণনায় সে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর অন্যায় সমালোচনার কারণে হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) তাকে কিছুদিনের জন্য নজর বন্দীও করেছিলেন। সে যে কোন ব্যক্তির দোষ বর্ণনায় সদা প্রস্তুত থাকতো। এমন কি হতভাগা তার নিজেরও সমালোচনা করতে অভ্যস্ত কঠোরভাবে। নিজের দোষত্রুটি বর্ণনায় সে এমন সব কথাবার্তা বর্ণনা করতো যা আদৌ বর্ণনাযোগ্য নয়।)
বিপ্লবের প্রাথমিক গতি
২৫শে জুলাই-এর বিপ্লব দিবসের আগমনে জাতি পরিবর্তনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। আযাদ ফৌজি অফিসারগণকে জনসাধারণ আনন্দের সাথে স্বাগত জানায়। এই ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিল। কারণ এটা শুধু একজন মন্ত্রীর পদচ্যুতি ও অন্য একজনের ক্ষমতা গ্রহণ করার একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র ছিল না। বরং একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় মনে তরঙ্গায়িত হচ্ছিলো। আবদুন নাসের তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রারম্ভেই ইখওয়ান ও মিসরের যুবক কয়েদীদের সকলকেই মুক্তি দিলেন। জনগণ তার এই পদক্ষেপে খুই উল্লাস প্রকাশ করল। সর্বসাধারণ একে একটা শুভ লক্ষণ বলে মনে করলো এবং সবার মাঝে এই ধারণা সৃষ্টি হলো যে, এই পরিবর্তন সম্পর্কে আযাদ অফিসারগণ ও ইখওয়ানের মধ্যে পরিপূর্ণ সহযোগিতা ও বুঝাপড়া রয়েছে। সাধারণ মানুষের উল্লাসের মৌলিক কারণ এই ছিল যে, ইখওয়ানের ওপর ছিল তাদের অবিচল আস্থা, যাদের কথা ও কাজের মধ্যে ছিল পুরোপুরি সামঞ্জস্য। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মিসর এবার তার হৃত গৌরব ফিরে পাবে। ইখওয়ান সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতো যে, তারা শুধু মুখে দাবী করার লোক নয় বরং কাজের লোক।
রাজনৈতিক উপলব্ধি
আমার জীবনে ইতিপূর্বেও কয়েকটি রাজনৈতিক ঘটনার উদ্ভব ঘটেছিল। আমি প্রত্যহ নিয়মিতভাবে সংবাদপত্র পাঠ করতাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর হাতে মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের পিটুনির খবর আমার জন্য বিশেষ আগ্রহের কারণ ছিল। প্রখ্যাত জার্মান জেনারেল হিন্ডনবার্গ এবং তার সামরিক দক্ষতার প্রশংসায় আমি ছিলাম পঞ্চমুখ। রাশিয়ান ফ্রন্টে তার হাতে প্রায় দশ লক্ষ রুশ সৈন্যের পরাজয় ও বন্ধীত্ব বরণ তার রণদক্ষতা ও যোগ্রতার উজ্জল প্রমাণ। স্বভাবগতভাবে আমার সহানুভূতি ছিল জার্মানদের সাথে। কারণ তাদের দুশমন ইংরেজদের আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম না। আমাদের দেশের ওপর তাদের উপনিবেশবাদী আগ্রাসন এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের নীতি আমি কিভাবে সহ্য করতে পারি। সেই সময় খুবই মজার মজার সংবাদ পর্যালোচনা ও খবরাদি ছাপা হতো। যেমন যেসব দেশ কার্যত বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি তাদের সম্পর্কে এই পর্যালোচনা যে, “নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী কিন্তু মিত্রবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল।” আমরা একে অন্যেল সাথে রসিকতা করতাম এবং এ ধরনের উক্তি ব্যবহার করে যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করতাম।
সংবাদপত্র পাঠ
আমি মিসর থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্র সংবাদপত্র আল আহরাম, আস্ সিয়াসাহ, আল জিহাদ এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা যেমন আল মুসাওয়ির, আত্ তায়েফ, আস্ সিয়াহ, আল জিহাদ এবং আহ তিজারাহ সবগুলোর নিয়মিত পাঠক ছিলাম। আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলো পৃষ্ঠা পড়তাম। স্কুল বন্ধ থাকলে তো বেশ অবকাশ পাওয়া যেতো এবং মন-মস্তিষ্কও চাংগা হয়ে উঠতো। পড়াশুনা ছাড়াও ফুটবল খেলার প্রতি ছিল আমার বিশেষ অনুরাগ। প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নিয়মিত ও গুরুত্বের সাথে যেতাম যদিও আমি নিজে খেলোয়ার হতে পারিনি।
আলো ছায়া
আমার আরো একটা স্থায়ী অভ্রাস হচ্ছে আমি কথা বলি কম এবং শুনি বেশী। যদি আমার সাধ্যে কুলাতো তাহলে শুধু শুনেই যেতাম বলা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতাম। আমার মাধ্যমিক ও ইউনিভার্সিটি শিক্ষা জীবনে দেশে বড় বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই সময় পুরো মন্ত্রী সভার রদবদল এবং উজীর আযমের উত্থান পতন আমি আমার নিজ চোখে দেখেছি। তখনকার সময়ে প্রধান মন্ত্রীকে “নাজেরুন নাজ্জার” (চীপ ট্রাস্টি) বলা হতো। আমি সা’দ জগলুল, ইসমাঈল সিদ্কী, মুহাম্মদ মাহমুদ, (ইস্পাত কঠিন হস্তধারী) তাওফিক নাসীম, ইউসুফ দাহবা, মুহাম্মাদ সায়ীদ ও আহমদ যিওর প্রমুখকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পার্লামেন্টে আবদুল হামীদ, আবদুল হক ও সুলাইমান গান্নামের ভূমিকা ও ভাষণ বিশেষ আকর্ষণ ও মনোযোগ সহকারে শুনতাম ও পড়তাম। সেই সময় পুরো এসেম্বলিতে অফ্দ পার্টির দুইজন মাত্র সদস্য ছিলেন। অনুরূপ সিনেটে অফদের একজন মাত্র সদস্য ছিলেন উস্তাদ আল জুনদী। সিনেটের অধিবেশনে উস্তাদ আল জুনদীর বক্তৃতা বিবৃতি অত্যন্ত জোরালো ও সাবলীল।
জনসাধারণে রেফারেন্ডাম
আমার এই চক্ষুদ্বয় এমন স্মরণীয় দৃশ্যও দেখেছে যখন শাহ্ ফুয়াদ বেলজিয়ামের একজন উপদেষ্টার নিকট তার মতামত চেয়েছিলেন। উদ্ভূত সমস্যা ছিল এই যে, উচ্চ পরিষদের সদস্য নিয়েঅগের ব্যাপারে শাহ্ এবং সা’দ জগলুল পাশা (জাতির জনক)-এর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিলো। বাদশাহর কাছে নতি স্বীকার করার পরবির্তে সা’দ জগলুল মোকাবিলা করার নীতি গ্রহণ করেন। গোটা জাতি ছিল সা’দ-এর পক্ষে। সুতরাং একটা বিশাল ও জনাকীর্ণ মিছিল শাহী মহল “আবেদীন প্রাসাদ”-এর সম্মুখে সা’দ-এর পক্ষে জোরালো বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আমিও এই মিছিলে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের সাথে শামিল ছিলাম। গগণ বিদারী শ্লোগান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। শ্লোগানের প্রতিধ্বনি শুনে বেলজিয়ান উপদেষ্টা মহলের একটা জানালঅ খুলে ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাদশাহকে বলতে থাকেন “আলমপনা! আমার নিকট থেকে আর কি মতামত নেবেন। গোটা জাতি তার রায় প্রকাশ করে দিয়েছে।” প্রত্যেক ব্যক্তির মুখে একই শ্লোগান “সা’দ জগলুল অথবা বিপ্লব”।
আইন কলেজের শিক্ষা সমাপনী
এসব ঘটনা আমার আবেগ ও আদর্শিক মন-মানসিকতার সাথে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আমি ঐসব তৎপরতার সাথে কার্যত অংশ গ্রহণ করা সত্ত্বেও কোন সময় পড়া লেখায় কোন প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে দিইনি। আমি নিয়মিত পড়াশোনা করে যেতে থাকি, এমনকি আইন কলেজে অধ্যয়ন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তা চালিয়ে যাই। এটা ১৯৩১ সালের কথা। এ বছর আইনের গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভকারীদের মোট সংক্যা ছিল প্রায় সাত শত। আমার খুব ভালভাবে মনে আছে যে, ইসলামী আইন বিষয়ক পত্রে আমি সর্বাধিক নাম্বার পেয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষা ছাড়াও মৌখিক পরীক্ষাও অনুষ্টিত হতো। আমার আজও মনে আছে যে, আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিল আহমদ জায়িদ বেগ ও আহমদ ইবরাহীম বেগ নামের দুইজন শিক্ষক। তারা আমাকে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কিত দু’টা প্রশ্ন করেন। আমি দু’টি প্রশ্নেরই অত্যন্ত সন্তোষজনক জবাব দেই। তারা সন্তুষ্ট হয়ে যান। আমি বলে, “আরো জিজ্ঞেস করুন।”
আমি দু’টো কারণে একথা বলেছিলাম। প্রথমত, আমার মহান ওস্তাদ আহমদ বেগ ইবরাহীম এরূপ কথায় খুবই সন্তুষ্ট হতেন। দ্বিতীয়ত, উলূমে শরীয়াতের বিষয়ে আল্লাহর রহমতে আমার জ্ঞানের ব্যপ্তি ছিল ঈর্ষা করার মত। অন্যান্য বিষয়ে খুব কষ্ট করেই পার পেতাম।
যৌবনকাল ও দুরন্তপনা
আমার ছাত্র জীবনের কতিপয় কৌতুকপ্রদ ঘটনা আজও আমার মনে পড়ে। হাসান পাশা সিদকী শিশিনী আইন কলেজে আমাদেরকে রাজনৈতিক অর্থনতি বিষয় পড়াতেন। রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগের ক্লাস রুম ছিল এমন স্থানে যেখানে সিকো রেল হাউস অবস্থিত ছিল। এই বৃহদায়তন ইমারতের কোন কোন কামরা এই বিভাগের সম্মুখেই ছিল। একদিন এক পিরিয়ড চলা কালে জনাব উস্তাদ হাসান পাশা দেখেন যে, ক্লাসে সকল ছাত্র জানালা দিয়ে সিকো রেল হাউসের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে। অগত্যা তিনিও সে দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং অদূরে একটি জানালায় দুইজন যুবতী মেয়েকে দন্ডায়মান দেখতে পান। উস্তাদ ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছেন জেনে সমস্ত্র ছাত্র অত্যন্ত লজ্জিত হয়। কিন্তু হাসান পাশা সাহেব শুধু এতটুকু বলেন যে, “হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে, এবার এসো আমরা পাঠের প্রতি মনোযোগী হই।” কলেজে আমাদের শিক্ষকগণের সবাই ছিলেন সুপন্ডিত ও পি এইচ ডি ডিগ্রীধারী। কোন কোন শিক্ষকের নামতো এখন স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে। কিন্তু জনাব আবদুল হামিদ আবু হাইফ, জনাব আহমদ আমীন, জনাব আল আশমাভী, জনাব শিশিনী, জনাব আল খাইয়াল, জনাব আবদুল মুতাওয়াল, জনাব ওয়াহীদ রাফাত, জনাব আমদ ইবরাহীম, জনাব কামিল মুরসী, জনাব উস্তাদুন নাহুরী এবং জনাব মুহাম্মদ সাদেক ফাহমী প্রমুখরন নাম আজও আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত আছে।
আইন কলেজের মর্যাদা
আমাদের সময়ে আইন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ সমস্ত কলেজ ও বিভাগসমূহের নেতৃত্ব প্রদান করতো। ছাত্রদের সমাবেশ, মিছিল ও প্রদর্শনীতে এই কলেজের ছাত্রগণই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মেরুদন্ডের হাড়ছিল ছাত্র সমাজ। সেকালে কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত সমস্ত মন্ত্রী উকীলদের মধ্য থেকেই নিয়োগ পেতেন। এই কারণে আইন কলেজে শুধুমাত্র প্রবেশাধিকার লাভই ছাত্রদের জন্য গৌরবের কারণ হতো। একথা শুনে আপনি হয়ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত মন্ত্রীগণের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধপ্রতীম সম্পর্ক থাকতো বিরাজমান। অনুরূপভাবে সেইসব সাংবাদিক যারা মন্ত্রীবর্গের কোন কোন পলিসির কঠোর সমালোচনা করতেন। ব্যক্তিগতভাবে সেই মন্ত্রীগণের সাথে তাদের খুবই সৌহার্দ ও বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মন্ত্রী আবদুল হামীদ আবদুল হক তার মন্ত্রীত্বের আমলে সংবাদপত্র সেবীদের সাথে অধিকাংশ সময় সাক্ষাত ও প্রেস কনফারেন্স করতেন। এসব অনুষ্ঠানে তার নিজরে পার্টি অফ্দ-এর পৃষ্ঠপোষক এবং হিযবের বিরোধী শিবিরের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সাংবাদিকগণও উপস্থিত থাকতেন। তিনি নির্বিশেষে সকল সাংবাদিকদের সাথে একান্ত ঘনিষ্ট হয়ে সম্প্রীতি সৌহার্দের ভংগীতে মত বিনিময় করতেন।
সাহিত্য রসিকতা
আবদুল হামীদ আবদুল হকের মিসরের উচ্চ এলাকার গ্রামীন বাচনভংগী এবং স্বভাব জাত প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বড় বড় বিস্ময়কর কৌতুকপ্রদ কাহিনী সৃষ্টি করতো। সাংবাদিকগণের সাথে কোন শব্দের অর্থ নিয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে বলতেন, “লাদাইকুম আজুল” (তোমাদের কাছে কি গাভীর বাছুর আছে?) মূলত আজুল শব্দ দ্বারা তিনি উকুল বুঝাতেন অর্থাৎ তোমাদের কি বিবেক ও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? কিন্তু আঞ্চলিক বাচনভংগীর পার্থক্যের কারণে মাহফিলে যেন আনন্দ ও সুগন্ধির যোয়ার বয়ে যেত, তথাপি শব্দ নিয়ে বিতর্ক হতো। তিনি শব্দটির অর্থের ওপর অটল থাকতেন। সাংবাদিক জিজ্ঞেসা করতেন, আপনি যে অর্থ প্রকাশ করছেন উহার কোন প্রমাণ? প্রতুত্বরে তিনি তৎক্ষণাৎ বলতেন, “আল-জামুছ” (মহিষ) এখানে “আল-কামুস” (লেগাত বা ডিক্সনারী) কে তিনি তার আঞ্চলিক ভাষায় “আল-জামুস” বলে রসিকতা সৃষ্টি করতেন। সেই যুগে আমি কোন দিন মতামতের বিভিন্নতাকে দুশমনি ও শত্রুতার রূপ পরিগ্রহ করতে দেখিনি। বিশেষত সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং পত্রিকার সাংবাদিকগণের মধ্যে তো নয়ই।
অবসর গ্রহণ ও অধ্যয়ন
আমার যৌবনকাল বেশ শান্তি ও নিরাপদের মধ্যে কেটেছে। যৌবনের প্ররম্ভেই আমার বিয়ে হয়েছিলো এটাই হয়তো এর মূল কারণ। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা যা নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তাতে কল্যাণ আর মংগলই নিহিত ছিল। ছোট শহরগুলোতে আইনজীবিদের দপ্তর রাতের বেলায় খোলা রাখা হতো না। বরং সকাল আটটা থেকে দুপুর দু’টো পর্যন্তই কাজ হতো এবং তার পরই অবরসর। তাই অফিসের সময়ের পর অধ্যয়ন অনুশীলনের জন্য আমি পর্যাপ্ত সময় হাতে পেয়ে যেতাম। আমি খুব পড়াশুনা করতাম। দাবা খেলার প্রতিও এক সময় আমার কিছুটা আগ্রহ ছিল। কিন্তু আল্লাহর তায়ালার শোকর যে, তিনি এই বাজে ও অনর্থক খেলা থেকে রক্ষা করেছেন। কেননা শাবিনুল কানাতির থেকে আমি কায়রোতে চলে আসি এবং এমনভাবে কাজের মধ্যে ডুবে যাই যে, এই খেলা প্রায় পুরোপুরি ভুলে গেছি।
দ্বীনি বই-পুস্তকের প্রতি অনুরাগ
ইত্যবসরে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে এই সময় আমি মৌলিক বই-পুস্তকগুলো পুড়ে ফেলি। যেসব লোক আমার মত পরিবেশে জীবন যাপন করে তাদের অধিকাংশেরই এসব বই-পুস্তক পাঠের সময় ও সুযোগ কমই হয়ে থাকে। কিন্তু আমার প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। এসব বই-পুস্তক প্রকৃতই দ্বীন ইসলামের উৎস। এসব গ্রন্থ আমার মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করেছে যা আজ আমার মধ্যে আছে। যে ব্যক্তিই তার দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি লাভ করতে চায় তার জন্য এসব গ্রন্থ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুরুচি
আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিফলন তার বান্দাদের মধ্যে দেখতে চান। অতএব আমিও আমার চলাফেরা, চাল-চলন, আচার-আচরণ ও বেশ-ভূষায় আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ করতাম। আমার গৃহীত পেশার মাধ্যমে এতটুকু হালাল রিযিক আমার হস্তগত হচ্ছিলো যা দিয়েই সহজেই আমর সকল প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হতো। তাই পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত রুচির পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারে আমি ছিলাম প্রবাদ বাক্যের মত।
আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে একই রংয়ের স্যুট, সার্ট, টাই, রুমাল, মোজা ও বুট জুতা ব্যবহার করতাম। যেন প্রত্যেক স্যুটের সাথে অন্যান্য আনুসংগিক সামগ্রী, সাইজ ও রংয়ের পুরোপুর ম্যাচিং করে। সবার কাছে একথা সুস্পষ্ট থাকা দরকার যে, মুসলমান কঠোরভাবে হালাল হারামের সীমার মধ্যে অবস্থান করেও তার জাঁকজমক ও পরিচ্ছন্নতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারে। ইখওয়ানী নওজোয়ানগণ কখনো কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর শিকার হয়ে থাকেনি। তারা রাতের বেলায় থাকে তাহাজ্জুদে সিজদাবনত। আর দিনের বেলায় ঘোড়ার পিঠে। আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত ও তাঁর নৈকট্যলাভের জন্য তারা নরম ও আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে রাতে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকেন। এবং দিনের বেলায় আল্লাহর দ্বীনের পতাকা তুংগে তুলে ধরার ও ইসলামের সামগ্রিক বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন জিহাদে লিপ্ত থাকেন।
আমি কোন জুমআর সমাবেশে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেলে মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলতাম এই সুন্দর দুনিয়া অমুসলিমদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। পোশাক-পরিচ্ছদ, পানাহার, আরাম-আয়েশ ও জীবন যাত্রার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতের মধ্যে যা কিছু হালাল ও পবিত্র আমি তা পুরোপুরি ভোগ ও ব্যবহারের প্রবক্তা। হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পসন্দ করতেন। সাইয়েদেনা ওমর (রা) বিন খাত্তাব এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আমীরুল মু’মিনীন! আমি (সিরিয়াতে) এমন লোকদের পাশে থাকি যাদের ওপর আমার বাহ্যিক জাঁকজমকের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে। এতসব সত্ত্বেও যদি আপনি নির্দেশ দেন তাহলে আমি এই জীবন পদ্ধতি বাদও দিতে পারি।” মুত্তাকী ও সাধক আমীরুল মু’মিনীন বলেন, “আমি এই ব্যাপারে তোমাকে আযাদী দিচ্ছি।”
চুপ থাকাই কল্যাণকর
আমার যৌবন বড় সৌভাগ্যের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। আমার স্বভাব বড়ই খোলামেলা এবং হৃদয়-মন বড় উদার। আমি হাসি মুখে থাকা ও রসিকতা পসন্দ করি। কিন্তু কখনো নির্থক তর্ক, বিতর্কে সময় নষ্ট করি না। কেউ আমার ওপর অত্রাচার করলেও প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে আমি তার ব্যাপারটা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দেই। কোন বিষয়ে কখনো আলোচনার সময় মতপর্থক্য হয়ে গেলে আমি একগুঁয়েমি ও হঠকারিতার পরিবর্তে নিশ্চুপ হয়ে যাই। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, আমি-ই সত্যের পক্ষে রয়েছি। যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমি আমার প্রতিপক্ষকে পরাভূতও করতে পারি। কিন্তু তার অনমনীয়তা ও পক্ষপাত দেখে আমি আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ানোকেই শ্রেয় মনে করি। তাছাড়া স্বভাবগতভাবেই আমি বলার চেয়ে অধিক শুনার পক্ষপাতি।
হালাল রিযিক
অধিকাংশ লোক যৌবনের প্রারম্ভেই কিছু একটা লক্ষ্য ও আদর্শ স্থির করে নেয় এবং তা লাভ করার চেষ্টা-সাধনায় মেতে ওঠে। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বৈধ-অবৈধ প্রতিটি উপায় অবলম্বন তাদের কাছে বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে যৌবনেও আমার ক্ষেত্রে এ নিয়মের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ঘটেছে। আমি দ্বীনি বই-পুস্তক অধ্যয়ন করেছিলাম যাতে আমি ইবাদাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারি এবং তদনুযায়ী আমলী জীবনও গঠন করতে পারি। আমি আমার পেশাগত জীবনেও পুরোপুরি সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। যাতে আমার আয়-উপার্জন হালাল হয়। আমি মানুষের সীমালংঘনের বিনিময়ে প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তা বিবেচনা করে থাকি যাতে আমার ও অন্যান্য লোকদের মাঝে দুরত্ব ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি না হয়।
সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রলোভন
সম্ভবত আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিযে, সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে সরকারী উকিল হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে এবং বিচার বিভাগেও পদ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি দু’টি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেছি। এটা ১৯৩৬ সালের কথা, আমার এ দু’টি পদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ এই ছিল না যে, আমি এই দু’টি পদকে ঘৃণা বা গুরুত্বহীন মনে করতাম। বরং এজন্য যে, কোন সরকারী পদ গ্রহণ করতে আমার স্বাধীনতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছিলাম না। আমি দু’ দু’বার পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম এবং দু’বারই অকৃতকার্য হয়েছিলাম। এসব নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পশ্চাতে আমার উদ্দেশ্য শুধু এই ছিল যে, সত্যের পতাকা সুমন্নত করার জন্য আমি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফরম ব্যবহার করতে পারবো। অন্যথায় মন্ত্রীত্ব ও পদের কোন খেয়াল কখনো আমার অন্তরে স্থান পায়নি।
ওকালতির পেশা প্রশস্ত ময়দান
আমি লোকদের সম্মান করি কিন্তু কাউকে ভয় পাই না। আমি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সমতা ও মানবিক সাম্যের ভিত্তিতে কাজ কারবার করার পক্ষপাতি। আমার প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল বলেই আমি ওকালতির পেশা গ্রহণ করেছি। কেননা এই পেশার সাহায্যে মানুষের কাছে এমন সব বিষয় উন্মোচিত হয়ে থাকে যা অন্য কোন পেশার দ্বারা সম্ভব নয়। ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণীর একটা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র থাকে। অথচ ওকীলদের সামনে থাকে বিশাল জগত। আইনজীবী তার পেশার প্রয়োজনে জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানার সুযোগ পায়। কারণ, আদালতে বিভিন্ন মোকদ্দমা চলাকালে হরেক রকমের শৈল্পিক ও পেশাভিত্তিক রিপোর্ট তাকে দেখতে হয়।
দ্বীনের দাবী
আমি আমার কর্ম জীবনে যথার্থভাবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি তখন থেকে যখনই ইখওয়ানের হকের পথের কাফেলার সহযাত্রী হই। এটা ছিল এমন একটি সময় যখন আমার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে, আমার দ্বীন আমার নিকট দাবী করে যে, তার সাহায্য ও প্রচার প্রসারের জন্য আমার সমস্ত শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতার ব্যয় করা দরকার এজন্য যদি অলিগলি ও রাজপথের সর্বত্র হামাগুড়ি দিয়েও চলতে হয়। সেদিন আমার নিকট এই রহস্য উন্মোচিত হয় যে, কুরআন মজীদ কেবল মাত্র তাবীজ তুমার ও সওয়াব এবং বরকত হাসিলের গ্রন্থ নয়। এ গ্রন্থ নাযিল করার উদ্দেশ্য কখনো এ নয় যে, একে বরকতের জন্য পকেটে রেখে দেয়া হবে অথবা সুগন্ধি মেখে ভ্রান্তির তাকের ওপর সাজিয়ে রাখা হবে। কিংবা হিফাজতের জন্য এর কপি মোটর গাড়ীতে রেখে দেয়া হবে। এসব উদ্দেশ্য তো নিসন্দেহে হাসিল হয়েই থাকে। কারণ, তা যাবতীয় কল্যাণের উৎস, এবং নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু তা থেকেও বড় মর্যাদা বা সম্মান যা এ গ্রন্থের অবতীর্ণকারী একে প্রদান করেছেন তা হচ্ছে, একে জীবনদর্শন ও জীবন ব্যবস্থা বানাতে হবে। আকীদা ও রাজনীত, অর্থনীতি ও সমাজ, আখলাক ও আদাব, যুদ্ধ ও সন্ধি, ক্রয়-বিকয়, কৃষি ও বাণিজ্য, চিকিৎসা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান মোটকথা মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলেই এই বিজ্ঞানময় মহাগ্রন্থ মানুষের ইহকালীন কল্যঅণ ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে। মুসিলম উম্মাহ যতদিন এর হিদায়াত ও নির্দেশনার ওপর আমল করেছেন ততদিনেই তারা দুনিয়ার সর্বাধিক শক্তিধর ও সম্মানিত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আমীরুল মু’মিনীনের মুখ নিঃসৃত এক একটি অক্ষরের গুরুত্ব পৃথিবীর প্রতিটি কোণে উপলব্ধি করা হতো। এই জাতিই কুরআনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে এবং তার নির্দেশনার ওপর আমল করার পরিবর্তে তা দ্বারা শুধুমাত্র বরকত হাসিল করার নীতি অবলম্বন করে তখনই তাদের উন্নতি অবনতিতে রূপান্তরিত হলো এবং মর্যাদার স্থলে অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের ললাটের লিখন হয়ে গেলে খিলাফতের অবসান ঘটলো এবং তার কল্যাণও তিরোহিত হলো। অতপর আমরা অধপতনের এমন অতল গহ্বরে পৌঁছে গেলাম যে সম্পর্কে সবাই অবহিত। এখন আমাদের থাকা আর না থাকা সমান। উম্মতের এই অধপতন সম্পর্কে আমি অনবহিত ছিলাম না। কিন্তু ভাবছিরাম এর প্রতিকার করা যাবে কিভাবে? ইখওয়ানের দাওয়াত কবুল করার পর এই সমস্যার সমাধান আমি খুঁজে পেয়েছি। তখন আমি জানতে পারলাম যে, আমাদের গৌরবোজ্জল অতীত আবারও প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সোনালী রংগে রংগীন হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা কুরআন, সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের শিক্ষার ওপর আমল করতে পারি। এবং সালফে সালেহীন ও ফুকাহায়ে ইসলামের ইজমার অনুসরণ করি। এটাই ইখওয়ানের দাওয়াতের মূল কথা। আর এর মধ্যেই রয়েছে উম্মাতে মুসলিমার দোজাহানের কল্যাণ নিহিত।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি