প্রথম অধ্যায়
পরিবার

পরিবার রাষ্ট্রের প্রথম স্তর, সামগ্রিক জীবনের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর (First Foundation Stone)। পরিবারেরই বিকশিত রূপ রাষ্ট্র। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি, মাতা-পিতা, ভাই-বোন প্রভৃতি একান্নভুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে পরিবার। বৃহদায়তন পরিবার কিংবা বহু সংখ্যক পরিবারের সমন্বিত রূপ হচ্ছে সমাজ। আর বিশেষ পদ্ধতিতে গঠিক সমাজেরই অপর নাম রাষ্ট্র। একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রের মূলে নিহিত রয়েছে সুসংগঠিত সমাজ রাষ্ট্র, সমাজ। ও পরিবারের ওতপ্রোত এবং পারস্পরিকভাবে গভীর সম্পর্কযুক্ত। এর কোন একটিকে বাদ দিয়ে অপর কোনো একটির কল্পনাও অসম্ভব।

পরিবার সমাজেরই ভিত্তি। রাষ্ট্র সুসংবদ্ধ সমাজের ফলশ্রুতি। পরিবার থেকেই শুরু হয় মানুষের সামাজিক জীবন। সামাজিক জীবনের সুষ্ঠুতা নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুষ্ঠুতার ওপর। আবার সুষ্ঠু পারিবারিক জীবন একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রের প্রতীক। পরিবারকে বাদ দিয়ে যেমন সমাজের কল্পনা করা যায় না, তেমনি সমাজ ছাড়া রাষ্ট্রও অচিন্তনীয়। তিন তলাবিশিষ্ট প্রাসাদের তৃতীয় তলা নির্মাণের কাজ প্রথম ও দ্বিতীয় তলা নির্মাণের পরই সম্ভব, তার পূর্বে নয়।

একটি প্রাসাদের দৃঢ়তা ও স্থায়ীত্ব তার ভিত্তির দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল। তাই সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রাথমিক ভিত্তি এই পরিবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও সমাজের সুসংবদ্ধ দৃঢ়তার উপর রাষ্ট্রের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব তেমনি নির্ভরশীল।

পরিবারের অপরিহার্যতা

মানুষ সামাজিক জীব। পরিবারের মধ্যেই হয় মানুষের এ সামাজিক জীবনের সূচনা। মানুষ সকল যুগে ও সকল কালেই কোনো না কোনোভাবে সামাজিক জীবন যাপন করেছে। প্রাচীনতমকাল থেকেই পরিবার সামাজিক জীবনের প্রথম ক্ষেত্র বা প্রথম স্তর হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সোজা কথায় বলা যায়, বর্তমান যুগে রাষ্ট্রের যে গুরুত্ব, প্রাচীনতম কালে –মানুষের প্রথম পৃথিবী পরিক্রমা যখন শুরু হয়েছিল, মানবতার সেই আদিম শৈশবকালে পরিবার ছিল সেই গুরুত্বের অধিকারী। বংশ ও পরিবার সংরক্ষণ এবং তার সাহায্য-সহায়তার লক্ষ্যে দুনিয়ার বড় বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে। উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনও চিরকাল সুনাম-সুখ্যাতি ও গৌরবের বিষয়রূপে গণ্য হয়ে এসেছে। আর নীচ বংশে ও নিকৃষ্ট পরিবারে জন্মগ্রহণ বা আত্মীয়তা লাভ মানুষের হীনতা ও কলংকের চিহ্নরূপে গণ্য হয়েছে চিরকাল। যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের হেফাযত, উন্নতি বিধান ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, সে চিরকালই বংশের গৌরব, -Hero রূপে সম্মান ও শ্রদ্ধা লাভ করতে সমর্থ হয়েছে পরিবারস্থ প্রত্যেকটি মানুষের নিকট।

পরিবারের ভিত্তি

প্রাচীকাল থেকেই পরিবার দু’টি ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়ে এসেছে। একটি হচ্ছে মানুষের প্রকৃতি-নিহিত স্বভাবজাত প্রবণতা। এই প্রবণতার কারণেই মানুষ চিরকাল পরিবার গঠন করতে ও পারিবারিক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছে এবং পরিবারহীন জীবনে মানুষ অনুভব করেছে বিরাট শূন্যতা ও জীবনের চরম অসম্পূর্ণতা। পরিবারহীন মানুষ নোঙরহীন নৌকা বা বৃন্তচ্যুত পত্রের মতোই স্থিতিহীন।

আর দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে সমসাময়িককালের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় পরিবার ছিল বিশাল বিস্তৃত ক্ষেত্র। সমাজ ও জাতি গঠনের জন্যে তা-ই ছিল একমাত্র উপায়। এ কারণে প্রাচীনকালের গোত্র ছিল অধিকতর প্রশস্ত; এতদূর প্রশস্ত যে, নামমাত্র রক্তের সম্পর্কেও বহু এক-একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে পারত। এমন কি বাইরে থেকে যে লোকটিকে পরিবারের মধ্যে শামিল করে নেয়া হতো, তাকেও সকলেই উক্ত পরিবারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে নিত। পরিবারের নিজস্ব একান্ত আপন লোকদের জান-মাল ও ইযযতের যেমন রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো, সেই বাইরে থেকে আসা লোকটিরও হেফাযত করা হতো অনুরূপ গুরুত্ব সহকারে। ইসলাম পূর্ব আরব সমাজে ‘মুতাবান্না’ –পালিত পুত্র গ্রহণের রীতি ছিল, একথা সর্বজনবিদিত। ইউরোপে এই সেদিন পর্যন্তও পালিত পুত্রকে আইন সম্মতভাবেই বংশোদ্ভূত সন্তানের সমপর্যায়ভুক্ত মনে করা হতো। রোমান সভ্যতার ইতিহাস এর চেয়েও অগ্রসর। সেখানে জন্তু-জানোয়ারকে পর্যন্ত পরিবারের অংশ বলে মনে করা হতো; মর্যাদা তার যত কমই হোক না কেন। এ থেকে এ সত্য জানতে পারা যায় যে, প্রাচীনকালে অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও পরিবারের পরিধি অধিকতর প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল।

সেকালে জীবন-জীবিকার বেশির ভাগই নির্ভরশীল ছিল চতুষ্পদ জন্তু ও কৃষি উৎপাদনের ওপর। এজন্যে প্রত্যেকটি পরিবারই এক বিশেষ ভূখণ্ডের ওপর প্রাচীন নির্মাণ করে নিজেদের এলাকা নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত করে রাখত। সে সীমার মধ্যে অপর কোনো পরিবারের লোক বা জন্তু-জানোয়ার পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারত না। এর ফলে বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-কলহের সৃষ্টি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর তাদের বিশেষ কোনো স্থানে একত্রিত ও সম্মিলিত হওয়ার মতো কেন্দ্র বলতে কিছুই ছিল না। তাদের মধ্যে ঐক্যের কোনো সূত্র বর্তমান থাকলেও উপায়-উপাদানের অভাব ও গোত্রীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এদিকে অগ্রসর হওয়ার পথে কঠিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াত। এমনকি এক ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে যে-সব গোত্র বাস করত এবং যাদের মধ্যে জীবনের মূল্যমান ছিল এক ও অভিন্ন, তারাও পরস্পরের শত্রু এবং যুধ্যমান ও দ্বন্দ্ব-সংগ্রামশীল হয়ে থাকত। প্রতিটি গোত্র অপর গোত্রকে চরম শত্রুতার দৃষ্টিতে দেখত, পরস্পরের ক্ষতি সাধনের জন্যে সম্ভাব্য সকল প্রকার চেষ্টাই তারা চালাত। মানবতার এই প্রাথমিক স্তরে নিজেও নিজ পরিবার-গোত্রের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কোনো বিষয় ও সমস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব হত না কারো পক্ষে। আর চিন্তা ও কর্মের শত-সহস্র যোজন পার হয়ে আসার পর আজ মানুষও পারছে না আন্তর্জাতিক ও বিশাল মানবতার দৃষ্টিতে চিন্তা করার অভ্যাস করতে।

মানুষের নিকট নিজের জান ও মাল চিরকালই অত্যন্ত প্রিয় সম্পদ। এসবের জন্যেই মানুষ চেষ্টা ও শ্রম করত; সকল প্রকার বিপদ ও ঝুঁকির মুকাবিলা করত এবং তার সংরক্ষণের জন্যে সম্ভাব্য সকল রক্ষা-ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হতো। তাদের প্রিয় জান-প্রাণ সুরক্ষিত রাখার সব উপায় ও পথ অবলম্বন করা হতো। আর এবাবেই তাদের ধন-সম্পদ ও জীবন-জীবিকার দ্রব্য সামগ্রী সংরক্ষিত হতো।

মানুষ যখন দেখতে পায় যে, তার জান মালে সংরক্ষণ তার পরিবার ও পারিবারিক জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিপদ-মুসিবতে ভারাক্রান্ত সমগ্র পরিবেশের মধ্যেতার পরিবারই হচ্ছে তার একমাত্র আশ্রয় –এ পরিবারই তাকে সর্বতোভাবে সংরক্ষণ করছে, শত্রুদের মুকাবিলায় সব সময়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করছে, তার দুঃখ-দরদ ও বিপদ-মুসিবতের বেলায় তার সাথে সমানভাবে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তখন তার পক্ষে পরিবারের সাথে পূর্ণমাত্রায় জড়িত ও একাত্ম হয়ে থাকাই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এক আরব কবি এ কারণেই বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

বিপদ-মুসিবতে তার ভাই যখন ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে, আওয়াজ তোলে, তখন সে তার এ কাজের কোনো যুক্তি খুঁজে বেড়ায় না।

তখন শুধু বলেঃ

(আরবী****************************************************************)

আমি নিকটাত্মীয়তার হক আদায় করেছি, তোমার ভাগ্যের শপথ, যখন কোনো বিপদের ব্যাপার ঘটবে, তখন আমি অবশ্যই উপস্থিত থাকব।

(আরবী*********************************************************)

কোনো কঠিন বিপদকালে আমাকে ডাকা হলে আমি তোমার মর্যাদা রক্ষাকারীদের মধ্যে থাকব, শত্রু তোমার ওপর হামলা করলে আমি তোমার পক্ষে প্রতিরোধ করব।

গোত্র ও পরিবারের এক-একটি ব্যক্তি যখন তার এতখানি সাহায্যকারী ও সংরক্ষক হয়, তখন সে নিজেও পরিবার ও পরিবারের প্রত্যেকের জন্য নিজের সব কিছু কুরবান করতে প্রস্তুত না হয়ে কিছুতেই পারে না। তার বিপদের সময় নিজের জীবন ও প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে অবশ্যই প্রস্তুত হবে। আর এ ভাবধারা থেকেই গোত্র ও পারিবারিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার ভাবধারা উৎসারিত হয়; আপন ও পরের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়; তখন নিজ পরিবারের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সুখ্যাতি প্রচার করা হয়; এ হচ্ছে মনের স্বাভাবিক ভাবধারার মূর্ত প্রকাশ। তাদের কীর্তিকলাপ নিয়ে গৌরব করা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করাক নিজের সৌভাগ্যের বিষয় বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানকালের রাজনৈতিক ও দলীয় নেতার প্রতি যেরূপ আনুগত্য ও ভক্তি-শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি ঘটে, তারই তাগিদে তাদের কীর্তিগাঁথাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তাদের ভুল-ভ্রান্তিকে ভালো অর্থে গ্রহণ করে তাকে সুন্দর ব্যাখ্যার চাকচিক্যময় বেড়াজালে লুকিয়ে রাখার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করা হয়; সেকালে বংশীয় নেতা ও গোত্রপতিদের সম্পর্কেও গ্রহণ করা হতো অনুরূপ ভূমিকা। কেননা তাদের স্বপ্ন-সাধের বাস্তব প্রতিফলন তারা তাদের মধ্যেই দেখতে পেত। তাদের সাথে বন্ধন স্থাপন করেই তারা নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রূপায়িত করে তুলত।

এক কথায় বলা যায়, প্রাচীনকালে পরিবার ছিল এ কালের এক-একটি রাজনৈতিক দলের মতোই। এজন্যে সেকালের রাষ্ট্রনীতির বিস্তারিত রূপ আমরা দেখতে পাই সেকালের এক-একটি পরিবার-সংস্থার মধ্যে। সেকালের পরিবার অপর কোনো উচ্চতর উদ্দেশ্য পালনের বাহন ছিল না; বরং পরিবারই ছিল সেখানে মুখ্যতম প্রতিষ্ঠান। মানুষের পরস্পরের মধ্যে সেখানে সম্পর্ক স্থাপিত হতো ‘রেহেম’ ও রক্ত ন্যায়ের ভিত্তি ছিল বংশীয় সম্পর্ক, সেখানে বংশ ও পরিবারের গুরুত্ব যে কত দূর বেশী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা চলে। এরূপ অবস্থায় মানুষ নিজেকে রক্ষা করার জন্যে আলোচ, পানি ও হাওয়ার মতো পরিবার ও পারিবারিক জীবনের সাথে জড়িত হয়ে থাকতে বাধ্য হবে –এটাই স্বাভাবিক। অন্যথায় সে হয় নিজেকে আপন লোকেরই জুলুম-নির্যাতনের তলে নিষ্পিষ্ট করবে অথবা অপর লোকদের দ্বারা হবে সে নির্যাতিত, নিগৃহীত এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে চিরবঞ্চিত।

কিন্তু সভ্যতার যখন ক্রমবিকাশ সংঘটিত হলো, জীবন-জীবিকা ও জীবনযাত্রা নির্বানের জন্য অপরিহার্য অন্যান্যা উপায়-উপাদান ও দ্রব্য-সামগ্রী যখন মানুষ করায়ত্ত করতে সমর্থ হলো তখন বিভিন্ন পরিবার ও গোত্রের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা স্থাপনের নানা পথ ও উপায় উদ্ভাবিত হলো। বিভিন্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে বংশ ও রক্তের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের একই কেন্দ্রে মিলিত ও একত্রিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হলো। এ অবস্থায় মানুষের মধ্যে একতা ও ঐক্য বিধানের জন্যে কেবল আত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কই একমাত্র ভিত্তি হয়ে থাকল না, স্বাভাবিক ও জৈবিক উপায় উপাদানের ঐক্য, ভৌগোলিক সীমা, ভাষা ও বর্ণের অভিন্নতা প্রভৃতি তার স্থান দখল করে বসল। ফলে পরিবার ও গোত্র সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণা তলিয়ে যেতে লাগল, আর তার স্থানে জাতীয়তার বীজ বপিত ও অংকুরিত হয়ে ক্রমশ তা বর্ধিত হতে থাকল। পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। জাতি ও স্বদেশের প্রতি মানুষের লক্ষ্য আরোপিত হলো। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং ঘৃণা শত্রুতার মানদণ্ডও তখন পুরাপুরিভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেল।

এ কারণে পরিবার আজকের দুনিয়ার সমাজ-বিজ্ঞানীদের নিকট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, পরিবারের বাস্তবিকই কোনো গুরুত্ব আছে কি? আর গুরুত্ব থাকলেও তা কতখানি?

মূলত এ প্রশ্ন অত্যন্ত গভীর সমাজতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত। এর জবাব না পাওয়া গেলে সমাজের অন্যান্য সমস্যারও কোনো সমাধান লাভ করা সম্ভব হতে পারে না। কাজেই বিষয়টিকে নিম্নোক্তভাবে কয়েকটি দিক দিয়ে বিবেচনা করে দেখতে হবেঃ

১. সমাজের সাফল্য ও উন্নতি লাভের জন্যপরিবার কি সত্যিই জরুরী?

২. পুরুষ ও নারীর মাঝে সম্পর্কের সাধারণ রূপ কি এবং উভয়ের কর্মক্ষেত্রের সীমা কতদূর প্রসারিত?

৩. পরিবারের ক্ষেত্রই বা কতখানি প্রশস্ত?

৪. পরিবারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?

সমাজ পরিসরে পরিবারের গুরুত্ব

পরিবার গঠন ও রূপায়ণ এবং তার সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি মৌলিক প্রশ্নের মীমাংসা করে নিতে হবে; আর তা হচ্ছে সমাজ ও সামাজিক জীভনের সাফল্যের জন্যে পরিবার কি সত্যই অপরিহার্য? সুষ্ঠু রীতি-নীতির ভিত্তিতে পরিবার গঠন না করে সামগ্রিক কল্যাণের পথে অগ্রসর হওয়া কি সমাজের পক্ষে –সমাজের ব্যক্তিদের পক্ষে সম্ভব? পারিবারিক জীবন ও পারিবারিক জীবনের সমস্যা কি আমাদের জীবনে এতই গভীর ও জটিল যে, তাকে উপেক্ষা করলে জীবন মহাশূন্যতায় ভরে যাবে? ….কিংবা এ বিষয়গুলো তেমন গুরুতর কিছু নয়; এবং সহজেই তাকে উপেক্ষা করা চলে? পরিবার ভেঙ্গে দেয়ার পর রাষ্ট্র ও সরকার কি সুষ্ঠু সামাজিক জীবন গঠনের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারবে?

যেহেতু সমাজের উন্নতি কিংবা পতনের ব্যাপারে পরিবার ও পারিবারিক জীবন যদি সত্যিই কোনো অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। আর যদি সমাজের সাফল্য ও সামাজিক জীবনের কল্যাণ লাভের ওপর নির্ভরশীলই হয়ে থাকে, তাহলে তাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করা গোটা সমাজের পক্ষেই মারাত্মক। কাজেই প্রশ্নটির জবাব নির্ধারনের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী –স্বামী ও স্ত্রী –সঠিক মর্যাদা ও স্থান নির্ধারন-ও এ প্রশ্নের জবাবের ওপরই নির্ভরশীল।

মানব জীবনের লক্ষ্য

শান্তি, সুখ, তৃপ্তি, নিশ্চিন্ততা ও নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ লাভই হচ্ছে মানব-জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য, মানব মনের ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা। এদিক দেয় সব মানুষই সমান। উচ্চ-নীচ, ছোট-বড়, গরীব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং পুরুষ ও নারীর মধ্যে এদিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। সিংহাসনারূঢ় বাদশাহ আর ছিন্নবস্ত্র পরিহিত দীনাতিদীন কুলি-মজুর সমানভাবে দিন-রাত্রি এ উদ্দেশ্যেই কর্ম নিরত হয়ে রয়েছে। কর্মপ্রেরণার এ হচ্ছে উৎসমূল। এ জিনিস যদি কেউ সত্যিই লাভ করতে পারে তাহলে মনে করতে হবে, সে জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ লাভ করেছে। তার জীবন সত্যিকারভাবে সাফল্য ও চরম কল্যাণ লাভে ধন্য হয়েছে।

নারী ও পুরুষ

সমাজের নারী এ সম্পদ লাভ করতে পারে একমাত্র পুরুষের নিকট থেকে, আর পুরুষ তা পেতে পারে কেবল মাত্র নারীর নিকট থেকে। দুই ব্যক্তির পারস্পরিক বন্ধুত্ব-ভালোবাসা, দুই সঙ্গীর সাহচর্য, দুই পথিকের মতৈক্য, দুই জাতির মৈত্রীবন্ধন, ব্যক্তির মনে তার মতবাদ-বিশ্বাসের প্রতি প্রেম, পেশা ও শিল্পের প্রতি মনোযোগিতা প্রভৃতি –যে সব জিনিস জীবন সংগঠনের জন্যে অত্যন্ত জরুরী এর কোনটিই মানুষকে সে শান্তি, সুখ ও নিবিড়তা-নিরবচ্ছিন্নতা দান করতে পারে না, যা লাভ করে নারী পুরুষের কাছ থেকে এবং পুরুষ নারীর নিকট থেকে। এজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে অতি স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক অতীব গভীর আকর্ষণ বিদ্যমান। এ আকর্ষণ চুম্বকের চাইতেও তীব্র। স্বতঃস্ফুর্তভাবেই একজন অপরজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রত্যেকেই নিজের সে হারানো সম্পদ অপর প্রতিক্ষায় উন্মুখ হয়ে কাটিয়েছে যুগের পর যুগ। প্রত্যেক নারীর মধ্যে পুরুষের জন্যে অপরিসীম ভালোবাসা ও আবেগ উদ্বেলিত প্রেম-প্রীতির অফুরন্ত ভাণ্ডার সিঞ্চিত হয়ে আছে। তেমনি আছে প্রত্যেক পুরুষের মধ্যে স্ত্রীর জন্য। এ এমন এক মহামূল্য নেয়ামত, যার তুলনা এই বিশ্ব প্রকৃতির বুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

সুখ-দুঃখের সাথী

এ দুনিয়া এক বিরাট-বিশাল কর্মক্ষেত্র। এখানে বসবাসের জন্যে গতি, কর্মোদ্যম ও তৎপরতা-একাগ্রতা একান্তই প্রয়োজনীয়। এ ক্ষেত্রে মানুষ কখনো আনন্দ লাভ করে, কখনো হয় দুঃখ-ব্যথা-বেদনার সম্মুখীন। আর মানুষ যেহেতু অতি সূক্ষ্ম ও অনুভূতিসম্পন্ন সেজন্যে আনন্দ কিংবা দুঃখ তাকে তীব্রভাবে প্রভাবান্বিত করে। ফলে তার প্রয়োজন হচ্ছে সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সঙ্গী ও সাথীর, যেন তার আনন্দে সে-ও সমান আনন্দ লাভ করে আর তার দুঃখ-বিপদেও যেন সে হয় সমান অংশীদার। নারী কিংবা পুরুষ উভয়ই এ দিক দিয়ে সমান অভাবী। প্রত্যেকেরই সঙ্গী ও সাথীর প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে নারীই হতে পারে পুরুষের সত্যিকার দরদী বন্ধু ও খাঁটি জীবন-সঙ্গিনী। আর পুরুষ হতে পারে নারীর প্রকৃত সহযাত্রী, একান্ত নির্ভরযোগ্য ও পরম সান্ত্বনা বিধায়ক আশ্রয়।

স্থায়ী সম্পর্ক

মানুষের জীবনে সুখ ও দুঃখের এ আবর্তন সব সময়ই ঘটতে পারে –ঘটে থাকে। ফলে তার প্রয়োজন এমন সঙ্গী ও সাথীর, যে সব সময়ই –জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সকল সময় ও সব রকমের অবস্থায়ই তার সহচর হয়ে থাকবে ছায়ার মতো এবং অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে করবে সব দায়িত্ব পালন। মানুষের জীবনব্যাপী সংগ্রাম অভিযানের ক্ষেত্রে এ এক স্থায়ী, মৌলিক ও অপরিহার্য প্রয়োজন।

এ প্রয়োজন পূরণের জন্যেই নারী ও পুরুষের মাঝে স্থায়ী বন্ধন সংস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরফলে নারী ও পুরুষ উভয়ই জীবনের তরে পরস্পরের সাথে যুক্ত হতে পারে, যুক্ত হয়ে থাকে। আজীবন এ বন্ধনের সুযোগেই নারী ও পুরুষের জীবন সার্থক হতে পারে এবং তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য হতে পারে কার্যকর। বিয়ের বন্ধনই হচ্ছে এক অকাট্য দৃঢ় সূত্র। এ বন্ধন ব্যতীত আর কোনো প্রকার সংযোগে এ উদ্দেশ্য লাভ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু যে সম্পর্কের পিছনে শুধু ক্ষণস্থায়ী হৃদয়াবেগই হয় একমাত্র ভিত্তি, যার পশ্চাতে কোনো নৈতিক, সামাজিক –তথা আইনানুগ শক্তির অস্তিত্ব থাকে না, তা অনিশ্চিত, ক্ষণ-ভঙ্গুর। যে কোন মুহুর্তে তা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। নিছক আবেগ-উচ্ছ্বাস, পানি-স্রোতের ওপরে পুঞ্জিভূত ফেনারাশি মাত্র, দমকা হাওয়ার মসৃণ চাপেও তা নিমেষে চূর্ণ হতে পারে, উড়ে যেতে পারে, মহাশূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে প্রণয়-প্রেমের এ বন্ধুত্ব। কেননা নিছক আবেগ উচ্ছাসের বশে সাময়িক উত্তেজনা চরিতার্থ করার জন্যে কোনো নারী কিংবা পুরুষকে চিরদিতের তরে গলগ্রহ করে রাখা মানব স্বভাবের পরিপন্থী।

তামাদ্দুনিক প্রয়োজনে নারী-পুরুষের স্থায়ী সম্পর্ক

আরো এক দৃষ্টিতে বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রেম-ভালোবাসা এবং ঘৃণা-উপেক্ষার দুই বিপরীত ভাবধারা বিদ্যমান। মানুষ কাউকে ভালোবাসে সাদরে বুকে জড়িয়ে ধরে; আবার কাউকে ঘৃণায় প্রত্যাখ্যান করে দূরে ঠেলে দেয়। কারো জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত হয়, আবার কারো নাম পর্যন্ত শুনতে রাজি হয় না। মানুষের এ স্বভাব এবং এ স্বাভাবিক ভাবধারার ফলেই মানুষের সমাজ ও সভ্যতা গড়ে ওঠে, ক্রমবিকাশ লাভ করে। মানব প্রকৃতির মধ্যে এমন সব উপাদান রয়েছে, যা থেকে মানুষের প্রকৃতি নিহিত এ ভাবধারা আলোড়িত ও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

নারী ও পুরুষ উভয়ের এ স্ববাবসম্মত ভাবধারার সংযোগ কেন্দ্র হয়ে থাকে। একজন অপরজনকে ভালোবাসে, আর একজনের মনে অপরজনের কারণে অন্য কারো বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার উদ্রেক হয়। পুরুষ নারীকে নিয়ে ঘর বাঁধে আর নারী হয় পুরুষের গড়া এ ঘরের কর্ত্রী। উভয়ই উভয়ের কাছ থেকে লাভ করে পারস্পরিক নির্ভরতা, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট থেকে পায় কর্মের প্রেরণা এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজে অগ্রসর হয়ে যায় উদ্যমপূর্ণ গতিতে। নারী ও পুরুষের এ সংযোগ ব্যতীত মানবতার অগ্রগতি আদৌ সম্ভব নয়।

 

পরিবার ও বর্তমান সভ্যতা
বর্তমান পাশ্চাত্য প্রভাবিত সমাজ ও সভ্যতায় নারী ও পুরুষ সম্পর্ক মানবীয় নয়, নিতান্ত পাশবিক। পাশবিক উত্তেজনা ও যৌন-লালসার পরিতৃপ্তিই হচ্ছে তথায় সাধারণ নারী-পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি। এর ফলে বর্তমান সমাজ ও সভ্যতা বিপর্যয় ও ব্যর্থতার সম্মুখীন। অথচ নারী-পুরুষের মিলন ও একাত্মতাকে সভ্যতার অগ্রগতির কারণ ও বাহনরূপে গণ্য করা হয়েছে চিরকাল। সেজন্যই দেখতে পাই, নারী-পুরুষের মিলনে জীবনে যে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ হওয়া বাঞ্ছনীয় বর্তমান মানুষ তা থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত। বর্তমান সভ্যতা পরিবারকে চূর্ণ করে, পরিবারের গুরুত্ব হ্রাস করে দিয়ে তার স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে রাষ্ট্রকে। অথচ পরিবার হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। দ্বিতল বা চারতল প্রাসাদ গড়ে তোলা, -তা নির্মাণ না করেই উপরের তলা নির্মাণের চেষ্টা পাগলামী ছাড়া আর কিছুই নয়। ঠিক তেমনি বর্তমান সভ্যতা সভ্যতার প্রথম স্তর অর্থাৎ পরিবারকে প্রায় অস্বীকার করেই, তার গুরুত্ব হ্রাস করেই গড়ে উঠতে চাচ্ছে। কিন্তু হাওয়ার ওপর যেমন প্রাসাদ গড়া যায় না, তেমনি পরিবারকে ভিত্তি না করে –ভিত্তি হিসেবে পরিবারকে গড়ে না তুলে –সত্যিকারভাবে স্থায়ী কোনো সভ্যতা কিংবা মজবুত কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। সুস্থ চিন্তার অধিকারী প্রত্যেকটি মানুষের নিকট একথা অত্যন্ত প্রকট।

বর্তমানে ব্যক্তির কাছেও পরিবারের গুরুত্ব যেন অনেকখানিই কমে গেছে। পরিবারের প্রতি কোনো আকর্ষণই সে বোধ করে না। স্বামী স্ত্রীর, স্ত্রী স্বামীর, পুত্র পিতার, পিতা পুত্রের, ভাই ভাইয়ের, ভাই বোনের, বোন ভাইয়ের প্রতি কোনো দরদ অনুভব করছে না। কেউ কারোর ধার ধারে না, পরোয়া করে না। অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে সমাজ জীবনের যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা শুধু সভ্যতাকেই ধ্বংস করছে না, মনুষ্যত্ব ও মানবতাকেও দিচ্ছে প্রচণ্ড আঘাত।

পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত দার্শনিক অধ্যাপক সরোকিন বর্তশান দুনিয়ায় পরিবারের গুরুত্ব কম হওয়ার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেনঃ

আমরা বর্তমানে খাবার খাই হোটেল রোঁস্তোরায়, আমাদের রুটি বেকারী-কনফেকশনারী থেকে তৈরী হয়ে আসে আর আমাদের কাপড় ধোয়া হয় লণ্ড্রীতে। পূর্বে মানুষ আনন্দলাভ ও চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেত পরিবারের নিভৃত আশ্রয়ে; কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার জন্যে চলে যায় সিনেমা-থিয়েটার, নাচের আসর ও ক্লাব ঘরের গীতমুখর পরিবেষ্টনীতে। পূর্বে পরিবার ছিল আমাদের আগ্রহ ঔৎসুক্য ও আনন্দ-উৎফুল্লতার কেন্দ্রস্থল, পারিবারিক জীবনেই আমরা সন্ধান করতাম শান্তি, স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দের নির্মলতা; কিন্তু এখন পরিবারের লোকজন হয়ে গেছে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত। কিছু লোক একত্রে বাস করলেও তার মূল উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়ে গেছে, হারিয়ে ফেলেছে সকল প্রীতি, মাধুর্য, অকৃত্রিমতা, আন্তরিকতা ও পবিত্রতা। দিনের বেশির ভাগ সময়ই মানুষ জীবিকার চিন্তায় অতিবাহিত করে, রাত্রিবেলা অন্তত পরিবারের সব লোক একত্রিত হতো। কিন্তু এখন তারা রাত্রি যাপন করে বিচ্ছিন্নভাবে, যার যেখানে ইচ্ছে –সেখানে। এখন আমাদের ঘর আমাদের আরাম বিশ্রামের স্থান নয়, ঘরে রাত্রিদিন অতিবাহিত করার তো এ যুগে কোনো কথাই উঠতে পারে না। একটি গোটা রাত্রি এখন লোকেরা নিজেদের ঘরে যাপন করবে, তা কেউই পছন্দ করে না।

সরোকিনের একথা কেবল পুরুষ ও যুবকদের সম্পর্কেই সত্য নয়, অবিবাহিতা যুবতী ও বিবাহিতা বয়স্কা নারীরাও এক্ষেত্রে কিছুমাত্র কম যায় না।

পরিবার-বিরোধী যুক্তিধারা

যারা পরিবার ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব অস্বীকার করে, তারা কিছু কিছু যুক্তিও তার অনুকূলে পেশ করে থাকে। সে যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ

১. মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তাই সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তিই তার স্বাভাবিক দাবি –স্বভাবের প্রবণতা। পরিবারের সুদৃঢ়-সুরক্ষিত পরিবেষ্টনীতে বন্দী করে তার এ আযাদীর অধিকার হরণ করা জুলুম বৈ কিছুই নয়।

২. পরিবার মানুষের স্বভাবের দাবি নয়। পারিবারিক জীবনে স্ত্রীকে পুরুষের অধীন হয়ে প্রায় ক্রীতদাসী হয়ে থাকতে হয়, অথচ স্বাধীনভাবে থাকা তার মানবিক অধিকার। পারিবারিক জীবনে তা নির্মমভাবে হরণ করা হয়। একমাত্র পুরুষই সেখানে উপার্জন করে, স্ত্রীকে তার জীবন-জীবিকার জন্যে পুরুষের মুখাপেক্ষী –তথা গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়।

৩. আগের কালে রাষ্ট্র বর্তমানের ন্যায় সর্বাত্মক ও ব্যাপক ভিত্তিক ছিল না। তখন মানুষের পরিবারের মুখাপেক্ষী ছিল, মানুষের জন্যে তা ছিল প্রয়োজনীয়। এখন রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা থেকেই তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। কাজেই আগের কাছে পরিবারের প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে তা ফুরিয়ে গেছে।

৪. পূর্বে সম্মিলিত পারিবারিক জীবন (Joint family life) থাকার কারণে পিতা-মাতার আত্মীয়-স্বজনের গুরুত্ব অসাধারণ, কিন্তু এখন সে অবস্থা বদলে গেছে। এখন শিশু পালনের জন্যে নার্সারী হোম ও কিন্ডারগার্টেন এবং কর্মক্ষেত্র হচ্ছে কারখারা ও অফিস। কাজেই আজ পারিবারিক সম্বন্ধ অপ্রয়োজনীয়। এবং

৫. বর্তমানে রাষ্ট্র শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাত্রার জন্যে যেরূপ সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছে, পিতা-মাতার পক্ষে তা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই আজ পরিবার ভেঙ্গে গেলে রাষ্ট্র থেকেই সব প্রয়োজন অনায়াসেই পূরণ করা যেতে পারে। এতে মানুষের কোনোরূপ অনিষ্ট হওয়ার আশংকা থাকতে পারে না।

পরিবারের গুরুত্ব অস্বীকার করতে গিয়ে মোটামুটি এই কথাগুলোই বলা হয়ে থাকে। আমাদের পরবর্তী আলোচনা এসব কথারই বিস্তারিত জবাব সম্বলিত। তাতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে যে, এ সব কথা একবারেই মূল্যহীন ও অন্তঃসারশূন্য।

 

পরিবার-বিরোধী যুক্তির জবাব
পরিবার-বিরোধীদের উক্ত রূপ কথাগুরোর বিস্তারিত জবাব তো এ গ্রন্থের প্রতি পৃষ্ঠায়ই দেয়া হবে।তবে এখানে একত্রে ও সংক্ষেপে এক-একটি যুক্তির জবাব দেয়া হচ্ছে।

১.প্রথম যুক্তি হিসেবে বলা কথাগুলো প্রকৃত ব্যাপার ভুল দৃষ্টি-ভঙ্গিতে পর্যবেক্ষণের মারাত্মক ফল, সন্দেহ নেই। নিজেরই ঘর ও পরিবারের কাজে-কর্মে ব্যতিব্যস্ত থাকা যে নারীর অসহায়তার প্রমাণ নয়, তা সকলেই বুঝতে পারেন। এজন্যে সমাজ-পরিবেশে নারীর কোনো লাঞ্ছনা হতে পারে না, না এজন্যে তাকে ঘৃণা করা যেতে পারে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে যেমন রুজী-রোজগারের উদ্দেশ্যে চেষ্টা করতে বাধ্য, অনুরূপভাবে তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, তৃপ্তি ও নিশ্চিন্ততা সুষ্ঠু নিরবচ্ছিন্ন জীবন যাপন ও উপার্জিত ধন-সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যয়-বণ্টন করতে পারার ওপর নির্ভরশীল। এক ব্যক্তি কেবল উপার্জন করতে সক্ষম, কিন্তু সে উপার্জিত অর্থ ব্যয় করার সঠিক নিয়ম সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, অবুঝ। আর এক ব্যক্তির অর্থ উপার্জন করার কোনো যোগ্যতাই নেই। পরিণামের দৃষ্টিতে দু’জনার মধ্যে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ব্যক্তি যেমন উপার্জনহীন হওয়ার কারণে নিজের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম, প্রথম ব্যক্তিও ঠিক তেমনি স্বীয় অযোগ্যতা ও কু-অভ্যাসের কারণে বিপদ আপনের সম্মুখীন হতে বাধ্য।

পরিবার সংস্থা মূলত নারী ও পুরুষের সম্মিলিত ও পরস্পরের সম-অধিকারসম্পন্ন এক যৌথ প্রতিষ্ঠান। এখানে উভয়ই একত্রে সম্মিলিত জীবন যাপন করে। এ সম্মিলিত জীবনে পুরুষ ঘরের বাইরের কাজ-কর্মের জন্য দায়িত্বশীল, আর স্ত্রী ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক –ঘরের রানী। এখানে একজনের ওপর অপরজনের মৌলিক শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। একটি প্রাসাদ রচনার জন্যে যেমন দরকার ইঁটের, তেমনি প্রয়োজন চুনা-সুরকি বা সিমেন্ট-বালির। যদি বলা যায়, ইঁট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান; তাহলে জিজ্ঞাস্য হবে, কেবল ইঁটই কি পারবে বিরাট বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করতে? …..পারিবারিক জীবন প্রাসাদ রচনায় নারী ও পুরুষের ব্যাপারটি ঠিক এমনি। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে যেমন পুরুষের যোগ্যতা-কর্মক্ষমতার একান্ত প্রয়োজন, তেমনি অপরিহার্য নারীর বিশেষ ধরনের যোগ্যতা ও কর্ম-প্রেরণার –যা অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যাবে না।

২. দ্বিতীয় যুক্তি সম্পর্কে বলা যায়, যে-সমাজ নারীর পক্ষে অর্থোপার্জনের সকল দ্বারই চিররুদ্ধ কেবল সে-সমাজ সম্পর্কেই একথা খাটে। কেননা সেখানে নারীর অস্তিত্ব কেবলমাত্র পুরুষের পাশবিক বৃত্তির চরিতার্থতার উদ্দেশ্যই একান্তভাবে নিয়োজিত থাকে। নারী সেখানে না কোনো জিনিসের মালিক হতে পারে, না পারে কোনো ব্যাপারে নিজের মত খাটাতে। কিন্তু এখানে আমরা যে সমাজ-পরিবারের ব্যবস্থা পেশ করতে যাচ্ছি, তার সম্পর্কে একথা কিছুতেই সত্য ও প্রযোজ্য হতে পারে না। কেননা ইসলাম নারীকে ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার দেয়, মীরাসের অংশও সে আইনত লাভ করে থাকে। কিন্তু নারীর দৈহিক গঠন ও মন-মেজাজের বিশেষ রূপ ও ধরন রয়েছে, যা পুরুষ থেকে ভিন্নতর। এ কারণে অর্থোপার্জনের মতো কঠিন ও কঠোর কাজের দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করা হয়নি। পুরুষই তার যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে দায়ী হয়ে থাকে। বিশেষত ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় নারী এক দায়িত্বপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিতা। অর্থোপার্জনের চিন্তা-ভাবনা ও খাটা-খাটনীর সাথে তার কোনো মিল নেই, শুধু তাই নয়, তা করতে গেলে নারী তার আসল দায়িত্ব পালনেই বরং ব্যর্থ হতে বাধ্য।

অন্য এক দিক দিয়েও বিষয়টির পর্যালোচনা করা যেতে পারে। প্রকৃত ব্যাপারকে ভুল দৃষ্টিতে বিচার করলে সঠিক ফল লাভ সম্ভব হতে পারে না। অতীতে নারী অর্থনৈতিক ব্যাপারে পুরুষের মুখাপেক্ষী ছিল বলেই যে সে পুরুসের অধীন বা দাসী হয়ে থাকতে বধ্য হতো এমন কথা বলা আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয় –পারিবারিক জীনের বহুতর ঘটনা এর তীব্র প্রতিবাদ করছে।

চিন্তা করা যায়, যে নারীর স্বামী পঙ্গু, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পরিবারের প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জনের সম্পূর্ণ অক্ষম, তাকে কোন জিনিস প্রেম-ভালোবাসা ওসেবা-যত্নের বন্ধনে বেঁধে রাখে? কেন সে এমন অপদার্থ স্বামীকে ফেলে চলে যায় না, এ হেন স্বামীর জন্যকেন সে নিজ জীবনের আরাম আয়েশপূর্ণ উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে পর্যন্ত অকাতরে কুরবান করছে? একটি নারী দুনিয়ার সব ধন-দৌলত, সুখ-সম্ভোগ ও আরাম-আয়েশের ওপর পদাঘাত করেও বিয়ে সম্পর্ককে কেন বাঁচিয়ে রাখে, স্বামীকেই গ্রহণ করে? যে-সমাজ নারীকে আনন্দ স্ফুর্তি সুখ-সম্ভোগের গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়ার সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধে করে দিচ্ছে, সেখানেও কেন এরূপ ঘটনা সাধারণভাবেই ঘটছে? –কি তার ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে?

বাস্তব দৃষ্টিতে চিন্তা করলে দেখা যাবে, স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের তত বেশী ভূমিকা নেই, যত আছে অন্যান্য কার্যকারণের। তা না হলে দাম্পত্য জীবনে এমন সব ঘটনা নিত্য ঘটছে, যার দরুন এ সম্পর্কই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে অর্থনৈতিক ভিত্তিতে দুজনকে একত্রিত করার কোনো কারণই দৃষ্টিগোচর হয় না বলে সে দাম্পত্য জীবন অটুটই থেকে যায়।

স্বামী-স্ত্রীর মিলনের আসল কারণ হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা, অন্তরের স্বতঃস্ফুর্ত দরদ ও প্রণয়-প্রীতি, যা স্বভাবতই দুজনার মধ্যে বিরাজ করছে। স্বামী ও স্ত্রী উভয় পরস্পরের জন্যে যে অপরিসীম ভালোবাসাও তীব্র আকর্ষণ বোধ করে, পারিবারিক জীবন-সংস্থা তারই স্থিতিস্থাপকতা বিধান করে। তারা এ জিনিসকে সাময়িকভাবে একত্রিত হওয়ার ভিত্তি বানাতে কখনো রাজি হতে পারে না। বরং তাদের জীবনে এমন কতগুলো লক্ষ্যও উদ্দেশ্য উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হতে থাকে, যার পরিপূরণের জন্যে তাদের সমগ্র জীবনকে অকাতরে ও ঐকান্তিকভাবে লাগিয়ে দেয়। তারা একটি নবতর বংশ সৃষ্টি করাই দায়িত্বই পালন করে না, তাদের লালন-পালন ও শিক্ষাদীক্ষা দান করে, সমাজের একটা কল্যাণকর অংশে পরিণত করার কাজও তারা-ই করে। এসব উদ্দেশ্য স্বামী-স্ত্রীকে নিছক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক ঊর্ধ্বে চিন্তা করতে বাধ্য করে।

৩. তৃতীয় যুক্তিটি মানবীয় অনুভূতি ও আন্তরিক ভাবধারার ভুল ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল। সন্তানের প্রতি স্নেহ-বাৎসল্যের পশ্চাতেও কোন অর্থনৈতিক স্বার্থবোধ নিহিত রয়েছে বলে ধরে নিলে বলতে হয়, ধনী লোকদের মনে সন্তান কামনা বলতে কিছুই থাকা উচিত নয়। আর সন্তান হলে তাদের জন্যে কোন স্নেহ-মায়াও থাকা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তো তা নয়। যে শিশু পঙ্গু, অন্ধ, যার থেকে কোনো প্রকারের অর্থনৈতিক স্বার্থ লাভের একবিন্দু আশা থাকে না, বরং বাপ-মায়ের ওপর যে কেবল বোঝা হয়েই রয়েছে, এমন সন্তানকে বাপ-মা কেন বুকে জড়িয়ে রাখে? তার খবরাখবরের জন্যে তার সেবা-শুশ্রূসা ও তাকে আদর-যত্ন করার জন্যে পিতা মাতা কেন সতত উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে? সে অনেক টাকা রোজগার করে বাপ-মাকে সাহায্য করবে, এমন কোন আশা কেউ পোষণ করে কি? –বিবেকের কাছে এ যুক্তিটি আদৌ টিকে না।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, সৃষ্টিকর্তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানব বংশকে ও গোটা সৃষ্টিলোককে বাঁচিয়ে রাখতে চান, এজন্যে প্রত্যেকটি সৃষ্টির মধ্যেই এমন কিছু স্বাভাবিক দাবি ও প্রবণতা রেখেছেন, যা তাকে আত্মসচেতন করে বাঁচিয়ে রাখে এবং তার নিজের ধ্বংসের পূর্বেই তার স্থলাভিষিক্ত, তার বংশধর তৈরী করতে তাকে বাধ্য করে। এই স্বাভাবিক ভাবধারা নিঃশেষ হয়ে গেলে কোনো সৃষ্টিকেই তার চূড়ান্ত নিশ্চিহ্নতা থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। শূন্যলোকের স্বাধীন মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায় যে পাখি, তাকেও এই স্বভাবগত দাবির জন্যেই খড়কুটো আহরণ করে নীড় রচনা করতে হয় এবং স্বাভাবিক কারণেই স্বীয় বংশধরের জন্যে আবাসকেন্দ্র গড়ে তুলতে সাধ্য হতে হয়। তার পরও তাকে সে বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখা –লালন পালন করার জন্যে, শত্রুদের হামলা থেকে তাদের রক্ষা করার জন্যে সতত ব্যস্ত হয়ে থাকতে হয়। গোটা সৃষ্টিলোকেরই এই অবস্থা। আর এই সবই যদি নিতান্ত স্বভাবগত প্রবণতার কারণেই হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের এ স্বাভাবিক প্রবণতা ও তৎপ্রসূত কাজকে অর্থনৈতিক কারণমূলক মনে করা হবে কেন, -কোন যুক্তিতে?

৪. চতুর্থ যুক্তির জবাবে বলতে হচ্ছে, পারিবারিক ব্যবস্থা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। এ উদ্দেশ্যের বাস্তবিকই যদি কোন গুরুত্ব থেকে থাকে আর মানবতার কল্যাণের জন্যেই তার বাস্তবায়ন জরুরী হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় যেসব অবস্থা, তা মানবতার পক্ষে কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না। কোনো প্রতিষ্ঠান (Institution) কায়েম করাই কোনো উদ্দেশ্য হতে পারে না, মানবতার দুঃখ-দরদ ও যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা বিদূরণই হচ্ছে আসল লক্ষ্য। কোনো প্রতিষ্ঠান এ উদ্দেশ্যের প্রতিবন্ধক হলে তার মূলোৎপাটনই বাঞ্ছনীয়। সন্তান ও পিতা-মাতার পারস্পরিক সম্পর্ক ছিন্ন করা ও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ এনে দেয়ার জন্যে আজ যে-সব প্রতিষ্ঠান দাঁড় করা হয়েছে, পারিবারিক ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে কায়েম রেখে সে সব প্রতিষ্ঠানকে কল্যাণকর ভূমিকায় নিয়োজিত করা যায় কিনা, তাও তো গভীরভাবে ভেবে দেখা আবশ্যক। এ যদি সম্ভবই না হয়, তাহলে বলতে হবে, মানুষ প্রথমে পরিবারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তারপরে তার কৃত্রিম বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে –শূন্যস্থান পূরণের জন্যে মাত্র –এসব প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানো হয়েছে। বস্তুত পরিবার ব্যবস্থাকে যথাযথ কায়েম রেখেও এসব প্রতিস্ঠানকে ভবিষ্যৎ মানব বংশের জন্যে কল্যাণকর বানানো যেতে পারে –কিংবা পরিবার ব্যবস্থার অনুকূলে এ ধরনের নবতর আরো অনেক প্রতিষ্ঠান কায়েম করা যেতে পারে –তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

৫. পঞ্চম যুক্তিটি এমন যা পেশ করতে আধুনিক যুগের লজ্জাবনত হওয়া উচিত বলেই মনে করি। বর্তমান যুগে যেভাবে শিশু-সন্তানদের লালন-পালন করা হচ্ছে, তার বীভৎস পরিণতি দুনিয়ার সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষকে প্রকৃত মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে দেয়ার পরিবর্তে নিতান্ত পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। আজকের মানুষের হিংস্রতা ও বর্বরতা জঙ্গলের রক্তজীবী পশুকেও লজ্জা দেয়। আজকের মানব সমাজ জাহান্নামে পর্যবসিত হয়েছে। তার একটি মাত্রই কারণ এবং তা হচ্ছে এই যে, মানুষকে ভালোবাসা, দরদ, প্রীতি, সহানুভূতি প্রভৃতি সুকোমল ভাবধারা থেকে বঞ্চিত করে দিলে তখন আর মানুষ মানুষ থাকবে না, জংগলের হিংস্র জন্তু ও তার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না –এই কথাটি আজ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত। অথচ মানুষের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না –এই কথাটি আজ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত। অথচ মানুষের স্বভাবগত এই প্রেম-ভালোবাসা, দরদপ্রীতি স্বাভাবিকভাবে লালিত-পালিত হলে তা মানুষকে ফেরেশতার চেয়েও অধিক মহিমান্বিত বানিয়ে দিতে পারে। আইনের কঠোর শাসন দিয়ে মানুষকে বন্দী জানোয়ার তো বানানো যেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়। মায়ের মমতা ও স্নেহময় ক্রোড়ই তা জাগাতে পারে। মা তার মমতাসিক্ত দৃষ্টি দিয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে মনুষ্যত্বের এমন উচ্চতর জ্ঞান শিক্ষা দিতে পারে, এমন সব মহৎ গুণে তাকে ভূষিত করতে পারে, যা এখনকার কোনো ট্রেনিং কেনদ্র আর কোনো গবেষণাগারও করতে পারবে না। বস্তুত মা শিশুকে কেবল স্তনই দেয় না, প্রতি মুহুর্তের সাহচর্যে অলক্ষ্যে এমন সব ভাবধারা মগজে বসিয়ে দেয়, যার দরুন এক ক্ষীণ, দুর্বলপ্রাণ শিশু জীবিত থাকে, লালন-পালনে ক্রমশ বর্ধিত হয়ে ওঠে। মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শিশুর চোখে কেবল ঘুমই এনে দেয় না, শত্রুতা, ঘৃণা, হিংসা ও মানসিক কুটিলতাকেও স্নেহ-মমতার নির্মল স্রোতধারায় ভাসিয়ে দেয়।

আজকের মা-বাপ খুব ব্যস্ত –এতদূর ব্যস্ত যে, নিজ ঔরসজাত আর গর্ভজাত সন্তানেরও লালন-পালন করার একবিন্দু অবসর পায় না –এ একটি ভিত্তিহীন কথা। মানুষ আজ প্রকৃতই ব্যস্ত নয়, ব্যস্ততার বিলাসিতায় দিগভ্রান্ত মাত্র, যার কারনে মানুষের আসল কর্তব্য আজ উপেক্ষিত হচ্ছে, পাশ কাটাতে চেষ্টা করা হচ্ছে নিতান্ত অবহেলায়। মানুষ আজ দুনিয়ায় অমূলক ভোগ-সম্ভোগের গড্ডালিকা প্রবাহে নিরুদ্দেশের পানে ছুটে চলছে। সকলকে বঞ্চিত করে সকলের ভাগের সব কিছু একাই লুটে পুটে নেয়ার উদ্দাম নেশায় আজকের মানুষ দিশেহারা। ফলে তার আসল মানবীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য অন্যায়ভাবে বর্জিত, অবহেলিত। পরিবার ও পারিবারিক জীবনের প্রতি আজকের মানুষের বিরাগের মূল কারণই হচ্ছে এই। বিবাহিত হয়ে দায়িত্বশীল জীবনের বোঝা আজকের মানুষ মন-মেজাজের কাছে যেন একান্তই দুর্বহ হয়ে পড়েছে। তাই সে পরিবারের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আযাদ ও মুক্ত দিনাতিপাত করতেই অধিকতর আগ্রহী। এজন্যেই সে নিজ ঔরসজাত –গর্ভজাত সন্তানকে নার্সারী হোমে পাঠিয়ে দিয়ে সব ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছে। একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার দায়িত্ব না নিয়ে রক্ষিতা আর পতিতা দ্বারা –পাশবিক বৃত্তি চরিতার্থ করে যাচ্ছে।

একটু সহজ দৃষ্টিতে বিচার করলেই দেখা যাবে, পরিবার অতি ক্ষুদ্র ও হালকা একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র। তার অবশ্য কিছু বাধ্যবাধকতা আছে, আছে কিছু দাবি ও দায়দায়িত্ব। লালন-পালন ও সংগঠনের জন্যে তার নিজস্ব কতগুলো বিশেষ নিয়ম-প্রণালীও রয়েছে। যারা পারিবারিক জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত, তারা সেসব সহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম। আর তারাই সেসবের মনস্তাত্ত্বিক ও অভ্যন্তরীণ ভাবধারাকে যথাযথ রক্সা করে তার লালন-পালনের কর্তব্যও সঠিকভাবে পালন করতে পারে। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ব্যাপক বড় ও ভারী প্রতিষ্ঠান, যাকে প্রধানত আইন ও শাসনের ভিত্তিতেই চলতে হয়। এখন পরিবারকে ভেঙ্গে দিয়ে যদি গোটা রাষ্ট্রকে একটি পরিবারে পরিণত করে দেয়া হয়, তাহলে পরিবারের লোকদের মধ্যে পারস্পরিক যে আন্তরিকতা ও দরদ-প্রীতির ফল্গুধারা প্রবাহিত তা নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে। রাষ্ট্র পরিবারের আইন-বিধানের প্রয়োজন তো পূরণ করতে পারে; কিন্তু নিকটাত্মীয় ও রক্ত সম্পর্কের লোকদের পারস্পরিক আন্তরিক ভাবধারার বিকল্প সৃষ্টি করতে সক্ষম নয় কোনক্রমেই।

মানুষের প্রকৃতিই এমনি যে, তাকে যতদূর সীমাবদ্ধ পরিবেশের মধ্যে রেখে লালন-পালন করা হবে, তার অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা-প্রতিভা তত বেশী বিকাশ স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা লাভ করতে সক্ষম হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়েই মানুষ বৃহত্তর দায়িত্ব পালনের যোগ্য হতে পারে। পরিবার ব্যবস্থাকে খতম করে দিয়ে মানব সন্তানকে যদি রাষ্ট্রের বিশাল উন্মুক্ত পরিবেশে সহসাই নিক্ষেপ করে দেয়া হয়, তাহলে তার পক্ষে সঠিক যোগ্যতা নিয়ে গ ওঠা কখনই সম্ভব হবে না। পরন্তু পরিবারকে রাষ্ট্রীয় প্রভাবের বাইরে যথাযথভাবে রক্ষা করা হলে তা মানব বংশের জন্যে এক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র (Training centre) হতে পারে, যার ফলে উত্তরকালে তারাই রাষ্ট্রের বিরাট দায়িত্ব পালনের যোগ্যতায় ভূষিত হবার সুযোগ পাবে।

 

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার
পূর্বের আলোনা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিবার হচ্ছে একিট ছোট্ট সমাজ-সংস্থা (Small Community)। কেননা বৃহত্তম সমাজ-সংস্থার পৌরহিত্যে সাধারণ জীবনের সাথে মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করে দেয় এই পরিবার। এর ফলেই সাধারণ ঐতিহ্য ও সাধারণ ভাবধারাকে বৃহত্তর সমাজে উপস্থাপিত করার সুযোগ হয়ে থাকে।

সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পরিবার হচ্ছে একটি যৌন সংস্থা (association of sex), সন্তান প্রজননের একটি স্থায়ী কারখানা। আর তা সংস্থাপিত রয়েছে বিয়ে সম্বন্ধের (Contract of marriage) ওপর। তার অর্থ, পরিবার একই সঙ্গে একটি সম্প্রদায় (Community) এবং একটি মহাসম্মিলন (association)। অন্তত এ দুয়ের মাঝখানে পরিবার হচ্ছে একটি অপরিহার্য সোপান (Bridge)।

পরিবার –স্থায়ী সংস্থা

পরিবার কি কোনো কৃত্রিম ও ইচ্ছানুক্রমে উদ্ভাবিত প্রতিষ্ঠান? তার কি অক্ষয় ও স্থায়ী হয়ে থাকা উচিত? তার কি একটি বিশ্বজনীন, সর্বদেশের ও সর্বকালের প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত নয়? বস্তুত মানব ইতিহাসের অতিপ্রাচীন কালেও এ পরিবারের অস্তিত্ব দেখা গেছে এবং মানুষ যদ্দিন এ ধরিত্রীর বুকে থাকবে, তদ্দিন পরিবার অবশ্যই টিকে থাকবে। কালের কুটিল গতি তাকে কিছুতেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে পারবে না। প্লেটো থেকে এইচ.জি. ওয়েলস পর্যন্ত দার্শনিকদের প্রস্তাব অনুযায়ী সন্তান-সন্ততিকে বাপ-মা’র সংস্পর্শে ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা যেতে পারে বটে, কিন্তু এ পদ্ধতিতে সত্যিকার মানুষ তৈরীর জন্যে কোনো সফল প্রচেষ্টা আজো কার্যকর হতে দেখা যায়নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, পরিবার হচ্ছে এক স্থায়ী ও অক্ষয় মানবীয় সংস্থা (Human institution) এবং এর এই স্থিতিস্থাপকতার কারণ মানব প্রকৃতির গভীর সত্তায় নিহিত। অন্য কথায় পরিবার স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যবর্তী কোনো ক্ষণস্থায়ী যোগাযোগের ব্যাপারে আদৌ নয়।

প্লেটোর অভিমত

দার্শনিক প্লেটো পরিবারকে একটি স্বাভাবিক (natural institution) বলে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। তাঁর মতে পরিবারই হচ্ছে সমাজ জীবনের সব অনৈক্যের (Discord) মূলীভূত কারণ। কেননা এই পরিবারই মানুষকে শিক্ষা দেয়ঃ আমি ও তুমি, আমার ও তোমার। অতএব, তাঁর মতে পরিবার প্রথার উচ্ছেদই বাঞ্ছনীয়। তখন সব নারী-পুরুষ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাধীন ব্যারাকে বসবাস করবে এবং রাষ্ট্রকর্তাদের পর্যবেক্ষণাধীন শ্রেষ্ঠ নর শ্রেষ্ঠ নারীকে গ্রহণ করবে তাদের যৌন-লালসা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। তাদের এই যৌন মিলনের ফলে যখন কোনো নারীর সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তখন-তখনই সে সন্তানকে সরকারী নার্স অন্যত্র তুলে নিয়ে যাবে, যেন সে সন্তান তার পিতামাতাকে জানতে না পারে এবং পিতামাতাও যেন চিনতে না পারে তাদের ঔরসজাত –গর্ভজাত সন্তানকে। এরূপ কার্যক্রমের সর্বশেষ ফল দাঁড়াবে এই –এক দিনে প্রসূত সকল সন্তানকে সব বাবা-মায়ের নিজের সম্মিলিত সন্তান বলে মনে করতে থাকবে। আর কোনো পিতামাতা কোনো সন্তানকেই নিজের সন্তান বলে দাবি করার এবং অন্যদের থেকে পৃথক করে দেখবার সুযোগ পাবে না। এর ফলে রাষ্ট্র সর্ব দিক থেকেই সুরক্ষিত থাকতে পারবে। অন্যথায়, প্রত্যেকটি পরিবারের প্রয়োজন নির্বাহের জন্যে আলাদা আলাদা সম্পত্তি সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেবে এবং রাষ্ট্রের সমগ্র এলাকা ‘আমার’ ও ‘তোমার’ মধ্যে বণ্টিত ও খণ্ডিত হয়ে পড়বে। কিন্তু প্রস্তাবিত পন্থায় পরিবারও যেমন নির্ভুল হবে, তেমনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বিলুপ্ত হবে। আর এর দরুন সমাজের সব বিভেদ ও অনৈক্য বিদূরিত হবে এবং সব অসামঞ্জস্যও বিলীন হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এর দরুন গোটা রাষ্ট্রই পরিণত হবে একটি মাত্র পরিবারে, আর সে পরিবারের সদস্যরূপে গণ্য হবে দেশের সমস্ত মানুষ।

এ্যারিস্টটলের অভিমত

কিন্তু এ্যারিস্টটল প্লেটোর সাথে এ ব্যাপারে মোটেই একমত নন। তাঁর মতে পরিবার একটি অতি স্বাভাবিক মানবীয় সংস্থা। কেননা এর মূল নিহিত রয়েছে মানুষের নৈত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনের গভীর তলে। কোনো মানুষই ব্যক্তিগতভাবে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনাবলী পরিপূরণের জন্যে তার প্রয়োজন একজন সহকারীর, সাহায্যকারীর, সহকর্মীর। আর স্ত্রী-ই যে হতে পারে তার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রকার সহকারী, সাহায্যকারী, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। এ কারণে নারী পুরুষ পরস্পরের যোগাযোগে আসে কেবল পছন্দের মাধ্যমেই নয়, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ আবেগের তাড়নায়ও। অতএব গার্হস্থ্য সমাজ –অন্য কথায় পরিবার হচ্ছে প্রথম স্বাভাবিক সমাজ, জনসম্মিলন। কেননা এই সম্মিলন স্ত্রী-পুরুষের অন্তঃস্থিত স্বাভাবিক তৃপ্তির অনুভূতির ফলশ্রুতি।

দ্বিতীয়ত, কেবল সন্তান লাভের কামনায়ই নারী-পুরুষ পরস্পরের সংস্পর্শে আসে না, গার্হস্থ্য জীবনের প্রথম প্রয়োজন –খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয়ের দাবি পূরণের জণ্যেও তাদের এই সম্মিলন কাম্য। কাজেই দৈনন্দিন আর্থিক প্রয়োজন পূরণের তাড়নাও গড়ে তোল পরিবার, পারিবারিক জীবন। আর উভয়ের থাকে এই পারিবারিক জীবনে।

তৃতীয়ত, মানুষ স্বভাবের দিক দিয়েই সামাজিক জীব এবং নর ও নারী নিজ নিজ প্রজাতির গুণের কারণে একত্রিত ও সম্মিলিত জীবন যাপনে বাধ্য। এ কারণেই তাদের মিলন অস্থায়ীও যেমন নয়, তেমনি নিছক কার্যকারণ ঘটিতও নয়; বরং এ হচ্ছে একান্তই স্থায়ী ও স্বাভাবিক ব্যবস্থা। এজন্যে পরিবারকে বলা যায়ঃ

A Moral Friendship rejoicing in each other’s goodness. পরস্পরের কল্যাণ কামনাপূর্ণ নৈতিক বন্ধুত্ব।

বস্তুত স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা সৃষ্টি করে এক সুখ ও পরিতৃপ্তি সমাজের প্রথম ধাপ। আর সন্তান লাভ হচ্ছে এ সুখী সমাজের চতুর্থ স্তর। এ কথা প্রমাণ করে যে, পরিবার কেবল যৌন ও পাশবিক জৈবিক জীবন রক্ষার জন্যেই প্রয়োজনীয় নয়, স্বভাবতই এর লক্ষ্য হচ্ছে এক উন্নত নৈতিক পবিত্র ও নির্দোষ জীবন যাপন।

এ সব বাস্তব (Natural) কারণ ছাড়াও –এ্যারিস্টটল বলেনঃ প্রকৃত প্রেম ভালোবাসা ও প্রীতি-প্রণয় অল্প সংখ্যক মানুষের খুবই ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ পরিবেষ্টনীর মধ্যেই উৎকৃষ্ট ও বিকশিত হতে পারে। পরিবেশের লোকসংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে, ভালোবাসার মাত্রাও ঠিক সেই অনুপাতে হ্রাস (decreases) প্রাপ্ত হবে। এ কারণেই বলা যায়, পরিবারের একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে ভালোবাসা বেশ দানা বেঁধে, ফুলে ফলে সুশোভিত ও শাখায়-প্রশাখায় বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। আর তারই ফলে সাধারণ স্বার্থের ব্যাপারে তা-ই হতে পারে একটি বৃহত্তম ও শক্তিসম্পন্ন মানসিকতা (Strong sentiment)। এখানে প্রেম-ভালোবাসার এ জন্মভূমিকেই যদি –প্লেটোর মত অনুযায়ী –বিনষ্ট করে দেয়া হয়, তাহলে গোটা সমাজ সংস্থাই বিশ্লিষ্ট ও শিথিল হয়ে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত সাধারণ জীবনের অনুকূলে কোনো জোরালো মানসিকতা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন কি, মানসিকতার যে পবিত্র সুকুমার ও সুন্দরতম অনুভূতি তাও নিঃশেষে মিলিয়ে যাবে।

এ প্রসঙ্গে শেষ কথা এই যে, পরিবার ভেঙ্গে দিলে মানব-সন্তান তার নৈতিক উর্দ্বতন হারিয়ে ফেলবে। কেননা তারা পিতামাতার স্বাভাবিক স্নেহ-বাৎসল্য থেকে হবে বঞ্চিত। একজন নার্স বা ধাত্রী কি কোনো দিক দিয়েই মা’র স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, -যে মা দশমাস কাল যাবত স্বীয় গর্ভে বত্রিশ নাদী দিয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার সন্তানকে! আর বড় কষ্ট ও মর্মান্তিক বেদনা-যন্ত্রণা ভোগ করে তাকে প্রসব করেছে? –এসব কারণে মা সন্তানের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই যতখানি দরদ ও রক্তের টান অনুভব করবে, ধাত্রী বা নার্স কি তার এক লক্ষ ভাগের একভাগও অনুভব করতে পারে? –অথচ মানব শিশুর মানুষ হয়ে গড়ে উঠবার জন্যে তা একান্তই অপরিহার্য।

তাছাড়া প্রত্যেকটি মানুষই স্বাভাবিকভাবে নিজস্ব সম্পত্তি গড়ে তুলতে চেষ্টিত হয়ে থাকে। এ তার নিজেরই স্বার্থ, নিজেরই উৎসাহ-উদ্দীপনা। তা যদি সাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়, তাহলে তার প্রতি সাধারণের অযত্ন ও অনাসক্তি হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। শিশু সন্তানদের ব্যাপারেও একথা অনস্বীকার্য। তাই বলতে হচ্ছে, প্লেটোর কল্পিত সমাজে শিশু-সন্তান যখন কারো নিজস্ব হবে না, হবে সকলের সর্বসাধারণের সমান আপন(?) তখন প্রকৃতপক্ষে সে শিশু কারোরই নিজের হবে না। তাদের প্রতি সকলের ও সর্বসাধারণের অবজ্ঞা ও অবহেলা হওয়াই স্বাভাবিক। এভাবে একটি মহামূল্যে সেবা ও দানের কাজ তার সব মূল্য ও মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে। সকলেরই ‘আপন’ বানাবার চেষ্টা কারোই ‘আপন’ বানাবে না, মনস্তত্ত্বের এ সত্য কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যায় না।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পৌরবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও বলা যায়, একটি সুষ্ঠু পরিবার সুস্থ নাগরিক জীবন গড়ে তোলার জন্যে অপরিহার্য। বরং বলা যায়, সুষ্ঠু নাগরিক জীবনের জন্যে পরিবারই হচ্ছে প্রথম স্বাভাবিক জীবকেন্দ্র। এর ফলে যদিও একজন নাগরিক পরিবারকেন্দ্রিক এবং সাধারণ সমাজ বিমুখ হয়ে পড়তে পারে; কিন্তু তবুও তার ক্ষতির পরিমাণ পরিবার ধ্বংস করার অনিবার্য পরিণতির তুলনায় নিশ্চয়ই অনেক কম। সত্য বলতে কি মায়ের বাৎসল্যপূর্ণ চুম্বন এবং পিতার স্নেহপূর্ণ সেবাযত্নের পবিত্র পরিবেশেই জন্ম নিতে পারে মানুষের ভবিষ্যৎ সমাজ। নাগরিকত্বের প্রথম শিক্ষা মায়ের ক্রোড়ে আর বাবার স্নেহছায়াতেই হওয়া সম্ভব। যে দেশে পরিবার নেই কিংবা নেই পারিবারিক শৃঙ্খলা পবিত্রতা সেখানকার বংশধর বা ভবিষ্যত সমাজ যে কতখানি উচ্ছৃঙ্খল ও চরিত্রহীন –অতএব দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে গড়ে উঠেছে, বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকা তথা চীন ও রাশিয়া তার সুস্পষ্ট নিদর্শন। এ দৃষ্টান্ত দেখার পরও যারা পরিবারকে অস্বীকার করার দুঃসাহস করে, তাদেরকে মানবতার শত্রু বলাই শ্রেয়।

 

পরিবার ও বিশ্বপ্রকৃতি
একজন পুরুষ ও একজন নারী বিবাহিত হয়ে যখন একসঙ্গে জীবন যাপন করতে শুরু করে, তখনি একটি পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানে পুরুষ হয় স্বামী আর নারী হয় স্ত্রী। এ দুয়ের সম্মিলিত ভালোবাসাপূর্ণ যৌন জীবনকেই বলা হয় দাম্পত্য জীবন।

নারী-পুরুষের এ দাম্পত্য জীবনের উদগাতা হলো বিয়ে। এর প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য, নির্দিষ্টভাবে স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তির অবাধ ও নিঃশংক চরিতার্থতা। স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরকি নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও ঐকান্তিকতা দাম্পত্য জীবনের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। মনের মিল ও পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি এ বন্ধনকে দুশ্ছেদ্য করে তোলে। এর দ্বিতীয় মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে বংশের ধারা অব্যাহত রাখা –উত্তরাধিকারী উৎপাদন। পূর্ব পুরুষের মৃত্যু ও উত্তর পুরুষের মধ্যবর্তীকালে নিজেকে জীবন্ত করে রাখার স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষকে এজন্যে সর্বতোভাবে উদ্যোগী ও তৎপর বানিয়ে দেয়। তখন এ হয় এক চিরন্তন সত্য, এক চিরস্থায়ী বংশ-প্রতিষ্ঠান।

বিয়ে ও দাম্পত্য জীবন বিশ্বপ্রকৃতির এক স্বভাবসম্মত বিধান। এ এক চিরন্তন ও শাশ্বত ব্যবস্থা, যা কার্যকর হয়ে রয়েছে বিশ্ব প্রকৃতির পরতে পরতে, প্রত্যেকটি জীব ও বস্তুর মধ্যে! আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী****************************************)

প্রত্যেকটি জিনিসকেই আমি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি।

বস্তুত সৃষ্ট জীব, জন্তু ও বস্তুনিচয় জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করার তাৎপর্যই এই যে, সৃষ্টির মূল রহস্য দুটো জিনিসের পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকাতেই নিহিত রয়েছে। যখনই এভাবে দুটো জিনিসের মিলন সাধিত হবে, তখনই তা থেকে তৃতীয় এক জিনিসের উদ্ভব হতে পারে। সৃষ্টিলোকের কোনো একটি জিনিসও এ নিয়মের বাইরে নয়, একটি ব্যতিক্রমও কোথাও দেখা যেতে পারে না। তাই কুরআন মজীদে দাবি করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************)

মহান পবিত্র সেই আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিলোকের সমস্ত জোড়া সৃষ্টি করেছেন –উদ্ভিদ ও মানবজাতির মধ্য থেকে এবং এমন সব সৃষ্টি থেকে, যার সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না।

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, ‘বিয়ে’ ও ‘সম্মিলিত জীবন যাপন’ এবং তার ফলে তৃতীয় ফসল উৎপাদন করার ব্যবস্থা কেবল মানুষ, জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ গাছপালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এ হচ্ছে গোটা বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত এক সূক্ষ্ম ও ব্যাপক ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক জগতের কোনো একটি জিনিসও এ থেকে মুক্ত নয়। গোটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থাই এমনিভাবে রচিত যে, এখানে যত্রতত্র যেমন রয়েছে পুরুষ তেমনি রয়েছে স্ত্রী এবং এ দুয়ের মাঝে রয়েছে এক দুর্লংঘ্য ও অনমনীয় আকর্ষণ, যা পরস্পরকে নিজের দিকে প্রতিনিয়ত তীব্রভাবে টানছে। প্রত্যেকটি মানুষ –স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যেও রয়েছে অনুরূপ তীব্র আকর্ষণ এবং এ আকর্ষণই স্ত্রী ও পুরুষকে বাধ্য করে পরস্পরের সাথে মিলিত হতে –সম্মিলিত ও যৌথ জীবন যাপন করতে। মানুষের অন্তর –অভ্যন্তরে যে স্বাভাবিক ব্যাকুলতা, আকুলতা ও সংবেদনশীলতা রয়েছে বিপরীত লিঙ্গের সাথে একান্তভাবে মিলিত হওয়ার জন্যে, তারই পরিতৃপ্তি ও প্রশমন সম্ভবপর হয় এই মধু মিলনের মাধ্যমে। ফলে উভয়ের অন্তরে পরম প্রশান্তি ও গভীর স্বস্তির উদ্রেক হয় অতি স্বাভাবিকভাবে।

মানুষের অন্তর্লোকে যে প্রেম ভালোবাসা প্রীতি ও দয়া-অনুগ্রহ, স্নেহ-বাৎসল্য ও সংবেদনশীলতা স্বাভাবিকভাবেই বিরাজমান, তার কার্যকারিতা ও বাস্তব রূপায়ণ এই বৈবাহিক মিলনের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে। এজন্যে হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************)

আল্লাহ বলেছেনঃ আমিই আল্লাহ, আমারই নাম রহমান, অতীব দয়াময়, করুণা নিধান, আমিই ‘রেহেম’ (রক্ত সম্পর্কমূলক আত্মীয়তা) সৃষ্টি করেছি এবং আমার নিজের নামের মূল শব্দ দিয়েই তার নামকরণ করেছি।

অন্য কথায়, প্রেম-প্রীতি, দয়া-সংবেদনশীলতা ও স্নেহ-বাৎসল্য মানব-প্রকৃতির নিহিত এক চিরন্তন সত্য। আর এ সত্যের মুকুর পুষ্পাকৃতি লাভ করতে পারে না এবং এ পুষ্প উন্মুক্ত উদ্ভাসিত হতে পারে না মানব-মানবীর মিলন ব্যতিরেকে। এ মিলনই সম্ভব হতে পারে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে।

পরিবারের ইতিবৃত্ত

বস্তুত বিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে এমন এক একত্ব ও একাত্মতা স্থাপন করে, যা ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত হয়ে থাকে। এ ঐক্য (Unification) ও একাত্মতার ভিত্তি হচ্ছে নারী পুরুষের যৌন সম্পর্ক। বিয়ের মাধ্যমেই নারী পুরুষের মাঝে এ একত্ব ও একাত্মতা বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। তখন নারী-পুরুষের মাঝে কেবল দৈহিক মিলনই অনুষ্ঠিত হয় না, মন ও প্রাণেরও গভীর সূক্ষ্ম মিলনসূত্র গ্রথিত হয়। মন, প্রাণ ও দেহ –এ তিনের মিলন ও একাত্মতা ব্যতীত ‘বিবাহ’ কিংবা পারিবারিক জীবন কল্পনাতীত। আর দৈহিক মিলন ব্যতীত মন ও প্রানের একাত্মতা সৃষ্টি হতে পারে না, পারে না তা পূর্ণত্ব লাভ করতে। অন্য কথায় দৈহিক মিলন অর্থ যৌন জীবনের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব। নারী ও পুরুষের যৌন-জীবন নির্ভুল রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী কায়েম না হলে কিংবা এ ব্যাপারে পারস্পরিক যৌন ক্ষুধা ও পিপাসা অতৃপ্ত থেকে গেলে না দৈহিক মিলন সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে, না মানসিক ও আত্মিক মিলন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে।

আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান –যার উৎপত্তি হয়েছে নাস্তিকতাবাদী ইউরোপীয় সমাজে –বিয়ের ও পারিবারিক জীবনের এক অদ্ভূত ইতিহাস উপস্থাপিত করেছে। এ ইতিহাস অনুযায়ী অতি প্রাচীনকালে মানব সমাজে বিয়ের আদৌ কোনো প্রচলন ছিল না। মানুষ নিতান্ত পশুর স্তরে ছিল এবং পশুদের ন্যায় জীবন যাপন করত। তখনকার মানুষের একমাত্র লক্ষ্য ছিল খাদ্য সংগ্রহ ও যৌন প্রবৃত্তির পরিতৃপ্তি লাভ। যৌন মিলন ছিল নিতান্ত পশুদের ন্যায়। তখনকার সমাজে বিষয়-সম্পত্তির ওপর ছিল না ব্যক্তিগত স্বত্ত্বাধিকার, ছিল না কোনো বিশেষ নারী বিশেষ কোনো পুরুষের স্ত্রী বলে নির্দিষ্ট। ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির জন্যে তাদের সম্মুখে ছিল খাদ্য পরিপূর্ণ বিশাল ক্ষেত্র, তেমনি যৌন প্রবৃত্তির নিবৃত্তির জন্যে ছিল নির্বিশেষে গোটা নারী সমাজ। উত্তরকালে মানুষ যখন ধীরে ধীরে সভ্যতা ও সামাজিকতার দিকে অগ্রসর হলো, বিস্তীর্ণ ও ব্যাপক হতে থাকল তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনাশক্তি; তখন নারী পুরুষের মাঝে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনের এবং বিশেষ পুরুষের জন্যে বিশেষ নারীকে নির্দিষ্ট করার প্রম্ন দেখা দিল। সন্তান প্রসব, লালন-পালনের ও সংরক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই নারীদের ওপর বর্তে সেজন্যে সেই প্রাথমিক যুগে নারীর গুরুত্ব অনুভূত এবং সমাজ ক্ষেত্রে এক বিশেষ মর্যাদা স্বীকৃত হলো। সেকালে সন্তান পিতার পরিবর্তে মা’র নামে পরিচিত হতো। কিন্তু এ রীতি অধিক দিন চলতে পারেনি। নারীদের সম্পর্কে পুরুষদের মনোভাব ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। নারীদের স্বাভাবিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুরুষরা তাদের স্থাবর সম্পত্তির ন্যায় দখল করে বসল এবং দখলকৃত বিত্ত-সম্পত্তির উপযোগী আইন-কানুন নারীদের ওপরও চালু করল। কিন্তু সমাজ যখন ক্রমবিবর্তনের ধারায় আরো কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে গেল, তখন পরিবার ও গোত্রের ভিত্তি স্থাপিত হলো। রাষ্ট্র ও সরকার সংস্থা গড়ে উঠল। আইন ও নিয়ম-নীতি রচিত হলো। তখন বিয়ের জন্যে নারীদের তার পিতা-মাতার অনুমতিক্রমে কিংবা নগদ মূল্যের বিনিময়ে লাভ করার রীতি শুরু হল। যদিও মূল্যদানের সে আদিম রীতি আজকের সভ্য সমাজেও কোনো না কোনো রূপ নিয়ে চালু হয়ে আছে। বস্তুত পাশ্চাত্য সমাজতত্ত্বে মানুষকে পশুরই অধঃস্তন মনে করে নেয়া হয়েছে, তাই মানব জীবন ও সমাজের এই পাশবিক সূচনার ইতিহাসও সম্পূর্ণ মনগড়াভাবে রচনা করে নিতে হয়েছে! কিন্তু তাই মানুষের প্রকৃত ইতিহাস হবে –এমন কথা সত্য নয়।

একজন স্ত্রী স্বামীর প্রতি চরম মাত্রার অভিমানে বিক্ষুব্ধ নিজ স্বামী ও সন্তানদের পরিত্যাগ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েও তার সেই স্বামী সন্তান ও সংসারের একান্ত নিজস্ব পরিমণ্ডলের মায়ায় সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা এবং পুনরায় স্বামী সন্তান নিয়ে স্ত্রীত্ব ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার –এবং অনুরূপ কারণে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে পুনরায় গৃহে ফিরিয়ে আনার নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনাবলী অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়েই প্রকৃতিগতভাবে পারিবারিক জীবন যাপনে একান্তভাবে আগ্রহী। বাইরের অন্যান্য ব্যস্ততার আকর্ষণ যত তীব্র ও দুর্দমনীয় হোক, স্ত্র বা স্বামীর সন্তান ও সংসারের বিনিময়ে তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত হওয়া কোনো সুস্থ প্রকৃতির নারী বা পুরুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, চিন্তনীয়ও নয়।

কিন্তু কুরআন মজীদে মানব-সৃষ্টি ও সমাজ-সভ্যতার ইতিহাস যেমন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে পেশ করা হয়েছে, বিয়ে ও পারিবারিক জীবনের সূচনা সম্পর্কেও তার উপস্থাপিত ইতিহাস চলেছে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায়। আধুনিক ইতিহাস যাকে সূচনা ও আদিম বলে ধরে নিয়েছে এবং যা কিছু ভালো ও কল্যাণময়, তাকে ক্রমবিবর্তনের ফলে রূপে তুলে ধরেছে, ইসলামের পারিবারিক ইতিহাস যেহেতু তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, এজন্যে সে সূচনা ও আদিকে পরবর্তী কালের কোনো মনুষ্যত্ববোধহীন এক স্তরের ব্যাপার বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু তা-ই যে একমাত্র সূচনা ও আদি, তা স্বীকার করে নেয়া সম্ভব নয়।

কুরআন অনুযায়ী প্রথম মানব যেমন আদম তেমনি মানব জাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল আদম ও হাওয়াকে কেন্দ্র করে। উত্তরকালে তাদের সন্তানদের মধ্যে ও এ পরিবারিক জীবন পূর্ণ মাত্রায় ও পূর্ণ মর্যাদা সহকারেই প্রচলিত ছিল। এই প্রথম পরিবারের সদস্যদ্বয় –স্বামী ও স্ত্রীকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ তা’আলা বলেছিলেনঃ

(আরবী**********************************************)

হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে একত্রে বসবাস গ্রহণ করো এবং যেখান থেকে মন চায় তোমরা দুজনে অবাধে পানাহার করো।

বস্তুত মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম পরিবার যেমন সর্বতোভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার ছিল, তেমনি তাতে ছিল পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ এবং তার ফরে সেখানে বিরাজিত ছিল পরিপূর্ণ তৃপ্তি, শান্তি, স্বস্তি ও আনন্দ। এ সূচনাকালের পরও দীর্ঘকাল ধরে এ পারিবারিক জীবন-পদ্ধতি ও ধারা মানব সমাজে অব্যাহত থাকে। অবশ্য ক্রমবিবর্তনের কোনো স্তরে মানব-সমাজের কোনো শাখায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি, তেমন কথা বলা যায় না। বরং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় কোনো স্তরে মানব জাতির কোনো কোনো শাখায় পতনযুগের অমানিশা ঘনীভূত হয়ে এসেছে এবং সেখানকার মানুষ নানাদিক দিয়ে নিতান্ত পশুর ন্যায় জীবন যাপন করতে শুরু করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে এসেতারা ভুলেছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানবীয় কর্তব্য। নবীগণের উপস্থাপিত জীবন-আদর্শকে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ধাবিত হয়েছে এবং একান্তভাবে নফসের দাস ও জৈব লালসার গোলাম হয়ে জীবন যাপন করেছে। তখন সব রকমের ন্যায়নীতি ও মানবিক আদর্শকে যেমন পরিহার করা হয়েছে, তেমনি পরিত্যাগ করেছে পারিবারিক জীবনের বন্ধনকেও। এই সময় কেবলমাত্র যৌন লালসার পরিতৃপ্তিই নারী-পুরুষের সম্পর্কের একমাত্র বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ অবস্থা ছিল সাময়িক। বর্তমান সময়েও এরূপ অবস্থা কোথাও-না-কোথাও বিরাজিত দেখতে পাওয়া যায়। তাই মানব সমাজের সমগ্র ইতিহাস যে তা নয় যেমন ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা পেশ করেছেন, তা বলাই বাহুল্য। বর্ণিত অবস্থাকে বড় জোর সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমই বলা যেতে পারে। অথচ এই ব্যতিক্রমের কাহিনীকেই ইউরোপীয় ইতিহাসে গোটা মানব সমাজের ইতিহাস নয়, তা হলো ইতিহাসের বিকৃতি, মানবতার বিজয় দৃপ্ত অগ্রগতির নিরবচ্ছিন্ন ধারবাহিকতায় নগণ্য ব্যতিক্রম মাত্র।

বস্তুত ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার এবং পারিবারিক জীবন হচ্ছে সমাজ জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর। এখানেই সর্বপ্রথম ব্যষ্টি ও সমষ্টির সম্মিলন ঘটে এবং এখানেই হয় অবচেতনভাবে মানুষের সামাজিক জীবন যাপনের হাতেখড়ি। ইসলামের শারীর-বিজ্ঞানে ব্যক্তি দেহে ‘কলব’ (আরবী**********) এর যে গুরুত্ব, ইসলামী সমাজ জীবনে ঠিক সেই গুরুত্ব পরিবারের, পারিবারিক জীবনের। তাই কলব সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর বাণীঃ

(আরবী**********************************************************)

দেহের মধ্যে এমন একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে, তা যখন সুস্থ ও রোগমুক্ত হবে, সমস্ত দেহ সংস্থাও হবে সুস্থ ও রোগশূন্য। আর তা যখন রোগাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, তখন সমগ্র দেহ জগত চরমভাবে রোগাক্রান্ত ও বিষ-জর্জরিত। তোমরা জেনে রাখ যে, তাই হলো কলব বা হৃদপিণ্ড।

পরিবার সম্পর্কেও একথা পুরোপুরি সত্য। তাই সমাজ জীবনে, সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগকে সুস্থ করে তোলা যাদের লক্ষ্য, পারিবারিক জীবনকে সুস্থ ও সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলা তাদের নিকট সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অন্যথায় সমাজ সংস্কার ও আদর্শিক জাতি গঠনের কোনো প্রচেষ্টাই সফল হতে পারে না। সুস্বাস্থ্য ও আয়ুর দৃষ্টিতেও বিবাহিত ও পারিবারিক জীবনের গুরুত্ব সর্বজনস্বীকৃত। ১৯৫৯ সনের ৬ই জুনের পত্রিকায় জাতিসংঘের একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিলঃ বিবাহিত নারী পুরুষ অবিবাহিতদের তুলনায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁচে থাক না কেন।

নদীর যে কেন্দ্রস্থল থেকে বহু শাখা-প্রশাখা নানাদিকে প্রবাহিত, সেই সঙ্গম-স্থলের পানি যদি কর্দমাক্ত হয়, যদি হয় বিষাক্ত ও পংকিল, তাহলে সে পানি প্রবাহিত হবে যত উপনদী, ছোট নদী ও খাল-বিলে তা সবই সে পানির সংস্পর্শে তিক্ত ও বিষাক্ত হবে অনিবার্যভাবে। অতএব পারিবারিক জীবন যদি আদর্শভিত্তিক, পবিত্র ও মাধুর্যপূর্ণ না হয়, তাহলে সমগ্র জীবন –জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগও বিপর্যস্ত, বিষাক্ত ও অশান্তিপূর্ণ হবে, এটাই স্বাভাবিক এবং এর সত্যতার কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।

দুনিয়ার ইতিহাসে বিভিন্ন সমাজ ও জাতির ধ্বংস ও বিপর্যয় সংঘটিত হওয়ার যেসব কাহিনী লিখিত রয়েছে, তার যে-কোনটিরই বিশ্লেষণ ও তত্ত্বানুসন্ধান করে দেখলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে যে, পরিবার ও পারিবারিক জীবনের বিপর্যয়-ই হচ্ছে তার মূলীভূত কারণ। মুসলিম জাতি সংগঠনকালীন ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সুস্থ ও সুন্দর পরিবার গড়ে তোলার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল এবং উত্তরকালে মুসলিম জাতির যে অভ্যুদয় ঘটে তার মূলেও ছিল পারিবারিক দৃঢ় ভিত্তি ও পারিবারিক জীবনের সুস্থতা, পবিত্রতা। মুসলিম জাতির বর্তমান দুর্বলতা ও অধোগতির মূল কারণও যে এই পরিবার ও পারিবারিক জীবনই হলো ইসলামী সমাজের রক্ষাদুর্গ। এ দুর্গের অক্ষুণ্ন ও সুরক্ষিত থাকার ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করে ইসলামী সমাজ ও জাতীয় জীবনের পবিত্রতা, সুস্থতা এবং বলিষ্ঠতা ও স্থিতি। মুসলিম জাতির এ দুর্গ এখনো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় নি, যদিও ঘুণে ধরে একে অন্তঃসারশূন্য করে দিয়েছে অনেকখানি। উপরন্তু পাশ্চাত্যের নাস্তিকতাবাদ, নগ্ন ও নীতিহীন সভ্যতার ঝঞ্ঝা বায়ু এর উপর প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে প্রচণ্ডভাবে। আল্লাহ না করুন, এ দুর্গও যদি চূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে মুসলিম জাতির সামষ্টিক অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী সন্দেহ নেই। এ প্রেক্ষিতে এ পর্যায়ের আলোচনা, গবেষণা ও বিচার বিশ্লেষণ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য।

 

যৌন স্পৃহার সুষ্ঠু পরিতৃপ্তি ও বিয়ে
বিবাহিত হয়ে পারিবারিক জীবন-যাপন ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষের জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য। এতে যেমন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপন সম্ভব, তেমনি যৌন মিলনের স্বাভাবিক অদম্য ও অনিবার্য স্পৃহাও সঠিকভাবে এবং পূর্ণ শৃঙ্খলা, নির্লিপ্ততা ও নির্ভেজাল পরিতৃপ্তি সহকারে পূরণ হতে পারে কেবলমাত্র এ উপায়ে।

বস্তুত মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যে যৌন মিলনের স্পৃহা বিদ্যমান, তার পরিপূরণ ও চরিতার্থতার সুষ্ঠু ব্যবস্থা হওয়া একান্তই আবশ্যক। বর্তমান দুনিয়ায় যৌন মিলন স্পৃহা পরিপূরণের জন্যে বিয়ের বাইরে নানাবিধ উপায় অবলম্বিত হতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও হস্তমৈথুন গ্রহণ করা হয়েছে এবং স্বীয় হস্তদ্বয়ের সাহায্যে নিজের যৌন উত্তেজনা প্রশমিত করার দিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। আধুনিক সভ্য সমাজের এক বিরাট অংশ আজ এ মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এর ফলে ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রকারের অভিনব যৌন ও মানসিক রোগ। এ রোগ একবার যাকে ভালোভাবে পেয়ে বসে, তার পক্ষে এ থেকে নিষ্কৃতি লাভ যেমন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তেমনি বিয়ে করে সাফল্যজনকভাবে পারিবারিক জীবন-যাপন করা তার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভবপর হয় না। কেননা তার অন্যান্য বহু রকমের রোগের সঙ্গে দ্রুত বীর্য-বীর্য-স্খলনের রোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে সে কোনো দিনই স্বীয় স্ত্রীকে যৌন তৃপ্তি দিতে সক্ষম হতে পারে না। আর তা না হলে কোনো স্ত্রীই তার সঙ্গে বিবাহিতা হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি হবে না।

কোথাও কোথাও দেখা যায়, যৌন মিলন স্পৃহা পরিপূরনের জন্যে সমমৈথুন (homo sexuality) বা পুংমৈথুনের পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। এর ফলে নারী বা পুরুষ তারই সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার স্ত্রী-পুরুষ উভয় শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই এই রোগ বর্তমানে মারাত্মক ও সংক্রামক হয়ে দেখা দিয়েছে। আমেরিকার ডঃ কিনসে এ সম্পর্কে দীর্ঘকালীন গবেষণা ও অনুসন্ধান পরিচালনার পর ১৯৪৮ সনে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তাতে তিনি বলেনঃ আমেরিকার পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশেরও অধিক লোকদের মধ্যে এ রোগ অতি সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বৃটেনে তো এই কুকর্মকে আইনসিদ্ধই করে নেয়া হয়েছে প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে।

বস্তুত ছোট বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যদি উচ্ছৃঙ্খল যৌন লালসা দেখা দেয়, তাহরে তারা স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনাসক্ত হয়ে পড়ে। বরং তার প্রতি তাদের মনে জাগে ঘৃণা ও বিরাগ। আর সমলিঙ্গের প্রতি তারা হয় আকৃষ্ট। ধীরে ধীরে এ রোগই উৎকর্ষ হয়ে সমমৈথুনের মারাত্মক কুঅভ্যাস শক্তভাবে গড়ে ওঠে। সূচনায় যদিও তা এক বালকসূলভ চপলতা মাত্র, কিন্তু ক্রমে তা দৃঢ়মূল অভ্যাসে পরিণত হয়। আর তাই শেষ পর্যন্ত এক অবাঞ্ছিত সামষ্টিক রোগের রূপ পরিগ্রহ করে।

এসব রোগের মনস্তাত্ত্বিক কারণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকগণ বলেছেন, যে সব ছেলে মায়ের অসদাচরণ দেখতে পায়, স্ত্রী জাতির প্রতি তাদের মনে তীব্র অশ্রদ্ধা ও ঘৃণার উদ্রেক হয়। এ কারণে তারা সমলিঙ্গের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। মা বাপকে কিংবা কোনো নিকটাত্মীয় পুরুষ স্ত্রীলোককে তার যা কিছু করতে দেখে অথবা করে বলে তাদের মনে ধারণা জন্মে, তারা তাই সমলিঙ্গের ছেলেমেয়েদের সাথে করতে শুরু করে। ফলে এরা কোনোদিনই বিবাহিত হয়ে বিপরীত লিঙ্গের সাথে স্থায়ী যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয় না। বরং বহু দিনের এ কুঅভ্যাসের ফলে বিপরীত লিঙ্গ সম্পর্কে তাদের মনে এক প্রকারের ভীতির সঞ্চার হয়। বিয়ে করা তাদের পক্ষে আর কখনও সম্ভব নয় না কিংবা বিয়ে করে দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়া তাদের ভাগ্যে জুটে না।

প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সিগমণ্ড ফ্রয়েড তাঁর Psychology of Everyday Life গ্রন্থে লিখেছেনঃ

এই সমমৈথুন নিষ্ফল ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র। এর ফলে মানুষের মনুষ্যত্ব চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়, মানুষের জীবনীশক্তি ও প্রজনন ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়। যে উদ্দেশ্যে মানুষকে নারী ও পুরুষ করে সৃষ্টি করা হয়েছে, এসব কাজে তা বিনষ্ট ও ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ধরনের কাজে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে নিতান্ত পশুতে পরিণত হয়ে যায়। বিবাহিত হয়ে সুস্থ পবিত্র জীবন যাপন করা ও স্থায়ী যৌন মিলন ব্যবস্থায় পরিতৃপ্ত হওয়া এ কুঅভ্যাসের লোকদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিয়ে করে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণ করাকে তারা অবাঞ্ছিত ঝামেলা মনে করে থাকে। বর্তমান জগতে এ ধরনের স্ত্রী-পুরুষের সংখ্যা কিছুমাত্র কম নয়।

ঠিক এই কারণেই ইসলামে এ সব কাজ –যৌন স্পৃহা পূরণের এসব অন্ধকারাচ্ছন্ন গলি খুঁজা ও বাঁকা চোরা পথ অবলম্বন –চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে। সমমৈথুন সম্পর্কে কুরআন শরীফে কঠোর বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। লুত নবীর সময়কার এ বদ-অভ্যাসের লোকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************************)

তোমরা পুরুষেরা দুনিয়ায় পুরুষদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছ, আর পরিত্যাগ করছ তোমাদের জন্যে সৃষ্ট তোমাদের স্ত্রীদের? –তোমরা হচ্ছ সীমালংঘনকারী লোক।

এ আয়াত পুরুষদের দ্বারা পুরুষদের (এবং মেয়েদের দ্বারা মেয়েদের)-কে যৌন উত্তেজনা পরিতৃপ্ত করা (লেওয়াতাত)-কে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করে দিয়েছে। যৌন উত্তেজনা পরিতৃপ্তির জন্য আল্লাহ তা’আলা স্ত্রী-পুরুষ প্রত্যেকের জন্যে বিপরীত লিঙ্গের সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্যে নির্দিষ্ট স্থান বা দেহাংশ রয়েছে। আর এ উদ্দেশ্যে কেবল তাই গ্রহণ করা কর্তব্য, উভয়ের পক্ষে বাঞ্ছনীয়। এ হচ্ছে সকলের প্রতি আল্লাহ তা’আলার বিশেষ নেয়ামত। এ নেয়ামত গ্রহণ না করে যারা এর বিপরীত সমমৈথুন মনোযোগ দেয় তারা বাস্তবিকই আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমা লংঘন করে, তারা মানবতার কুলাংগার। কুরআন মজীদে এজন্যে কঠোর দণ্ডের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************)

তোমাদের মধ্যে যে দুজন পুরুষ (বা স্ত্রী) এ অন্যায় কাজ করবে, তাদের দুজনকেই শাস্তি দাও। তার পরে যদি তারা তওবা করে ও নিজেদের চরিত্র সংশোধন করে নেয়, তবে তাদের ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব তওবা কবুলকারী দয়াবান।

অর্থাৎ দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ একজন নারী অথবা দুজনই নারী যদি চরিত্রহীনতার কাজ করে বসে, তবে সে দুজনকেই কঠোর শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সদুপদেশ ও ভারো নসীহতও করতে হবে। এ আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন (হিজরীর তৃতীয়-চতুর্থ বছর পর্যন্ত) যিনা ও লেওয়াতাত উভয়-রকম পাপেরই শাস্তি ছিল এই। জ্বিনার শাস্তির হুকুম পরে নাযিল হয়; কিন্তু লেওয়াতাতের শাস্তিস্বরূপ অন্য কিছু নাযিল হয়নি। ফলে কুরআনবিদদের মধ্যে আয়াতটির প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ে কিছুটা মতভেদের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন দেখা দেয়, জ্বিনার এই শাস্তি লেওয়াতাতের ব্যাপারে প্রযোজ্য, না পূর্বশাস্তিই এ ব্যাপারে বহাল রাখা হয়েছে! এর অপরাধীকে কেবল হত্যা করা হবে, না অপর কোনো রকম শাস্তি দেয়া হবে? –অনেক এ আয়াতকে যিনার ব্যাপারেই প্রযোজ্য বলেছেন, অনেকে বলেছেন, লেওয়াতাতের ব্যাপারে প্রযোজ্য। আবার অনেকে এই উভয় প্রকারের অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে এ আয়াত প্রযোজ্য বলে মনে করেছেন।

হাদীস শরীফে এ অপরাধের দণ্ড হিসাবে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************)

যে দুজনকেই তোমরা লেওয়াতাতের (সমমৈথুন) কাজ করতে দেখতে পাবে, তাদেরকেই তোমরা হত্যা করবে।

লেওয়াতাতকারী বিবাহিত কোন কি অবিবাহিত, ইমাম মালিক, ইমাম শাফয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় ও অন্যান্য ফিকাহবিদের মতে তাদের ওপর রজম –পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার দণ্ড –কার্যকর করতে হবে। হাসান বসরী, ইবরাহীম নখয়ী, আতা ও আবূ রিবাহ প্রমুখ মনীষী বলেছেনঃ

(আরবী************) –জ্বিনাকারীর জন্যে দণ্ডই লেওয়াতাতকারীর দণ্ড।

সুফিয়ান সওরী ও কুফার ফিকাহবিদদের মতও এই। (তিরমিযী, ১ম খণ্ড, ১৮৯ পৃঃ)

(আরবী*************************************)

আমার উম্মতদের সম্পর্কে যেসব বিষয় আমি আশংকা বোধ করি ও ভয় পাচ্ছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশংকার বিষয় হচ্ছে লেওয়াতাতের পাপে লিপ্ত হওয়া।

বস্তুত তিরমিযী শরীফের এক হাদীসের ঘোষণানুযায়ী লেওয়াতাতকারী আল্লাহর অভিশপ্ত, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। হযরত আলী (রা) লেওয়াতাতকারী দুই ব্যক্তিকে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা করেছিলেন। নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘নারী যখন অপর নারীর সংস্পর্শে যৌন তৃপ্তি গ্রহণ করে, তখন তারা দুজনই ব্যভিচারিণী’।

হস্তমৈথুনকারী সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ হস্তমৈথুনকারী অভিশপ্ত।

এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌন স্পৃহা পরিতৃপ্তির জন্যে আল্লাহ তা’আলা সুষ্ঠু ও পবিত্র পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর সে পথ হচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী-পুরুষের মিলিত হওয়া। এ ছাড়া অন্য যত পথই রয়েছে –মানুষ ব্যবহার করছে –সবই স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ, মনুষ্যত্বের পক্ষে অন্য সব পথই হচ্ছে সর্বতোভাবে মারাত্মক। এজন্যে আল্লাহ তা’আলা নারী-পুরুষের নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে সাবধান ও সতর্ক হতে বলে বিয়ের একমাত্র পথ পেশ করেছেন এবং বিয়ে ছাড়া অন্যান্য সব পথকেই সীমালংঘনকারী বলে ঘোষণা করেছেন। বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

আর সফলকাম হবে সে-সব মু’মিন, যারা তাদের যৌন-স্থানকে পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে। তারা নিষ্কলংকের সাথে যৌন সম্ভোগ করে কেবলমাত্র তাদের বিয়ে করা স্ত্রীদের সঙ্গে কিংবা ক্রীতদাসীদের সঙ্গে। আর যারা এ নির্দিষ্ট ছাড়া অন্য পথে যৌন অঙ্গের ব্যবহার করবে, তারা নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা গেল যে, বান্দার কল্যাণ নির্ভর করে তার যৌন অঙ্গের সংরক্ষণ ও ঠিক ব্যবহারের ওপর। এ না হলে বান্দাহর কল্যাণ লাভের আর কোন পথ বা উপায় নেই।

এ আয়াত মোটামুটি তিনটি কথা প্রমাণ করে। যে লোক স্বীয় যৌন অঙ্গের সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবহার করে না, সে কখনই কল্যাণ প্রাপ্ত হতে পারে না। সে অবশ্যই ভৎসিত ও ধিকৃত হবে, সে হবে সীমালংঘনকারী। আর সীমালংঘনকারী মাত্রই কল্যাণ থেকে হবে বঞ্চিত। বরং সে সীমালংঘনের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হবে।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেছেনঃ

(আরবী********************************************)

নরহত্যার পর জ্বিনা-ব্যভিচার অপেক্ষা বড় গুনাহ আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) একদা নবী করীম (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবী**********) –সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? রাসূলে করীম (স) বললেনঃ (আরবী********) –আল্লাহ একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে কাউকে মেনে নেয়াই হলো সবচেয়ে বড় গুনাহ’। তিনি আরো বললেনঃ তারপরে সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে খাদ্যাভাবের ভয়ে সন্তান হত্যা করা এবং তার পরের বড় গুনাহ হচ্ছেঃ (আরবী*********) –তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে তোমাদের ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।

এ থেকে জানা গেল, জ্বিনা মূলতই কবীরা গুনাহ। তবে প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে তা করা সবচেয়ে বড় গুনাহ। (আরবী***********)

সূরা আহযাব-এর এক আয়াতাংশৈ যৌন অঙ্গের হেফাযত করা –জায়েয পথে তার ব্যবহার করা এবং অন্য পথে তার ব্যবহার না করা সম্পর্কে অনুরূপ তাগিদ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন।

(আরবী********************************************)

যারা নিজেদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে, তারা পুরুষ হোক কি স্ত্রীলোক –আর যারা খুব বেশী আল্লাহর স্মরণ করে স্ত্রীলোক কি পুরুষ –আল্লাহ তাদের জন্যে বহু বড় সওয়াবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

যৌন অঙ্গের অর্থনৈতিক চরিত্রকে পবিত্র রাখা এবং যৌন অঙ্গকে খারাপ পথে ও হারামভাবে ব্যবহার না করা। এ চরিত্র যারা গ্রহণ করবে আর যেসব নারী-পুরুষ স্বামী-স্ত্রী –আল্লাহর স্মরণ করবে, বিশেষ করে যৌন অঙ্গের ব্যবহারের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ পালন করবে তাদের জন্যে আল্লাহ তা’আলা বড় পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন। ইসলামে নৈতিক চরিত্রের যা মূল্যমান, দুনিয়ার পাপের কোনো ধর্ম বা জীবন বিধানেই তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং বলা যায়, অন্য কোন মানবিক বিধানেই তার দৃষ্টান্ত নেই। এ কারণে রাসূলে করীম (স) সব সময়ই নও-মুসলিম নারীর নিকট থেকে যিনা না করার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করতেন। কুরআন মজীদের সূরা ‘আল-মুমতাহিনা’য় এই প্রতিশ্রুতির কথা নিন্মোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ

(আরবী************************************)

এবং তারা প্রতিশ্রুতি দিত এই বলে যে, তারা ব্যভিচার করবে না আর তাদের সন্তান হত্যা করবে না।

 

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ
দুনিয়ার বিভিন্ন ধর্মে, মতাদর্শে, সমাজে ও সভ্যতায় নারী ও পুরুষকে কি দৃষ্টিতে দেখা হয় –বিশেষত নারী সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করা হয়, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা একান্ত জরুরী। এই পর্যায়ে প্রথমে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী পেশ করা হচ্ছে। পরে অন্যান্য দিক নিয়েও পর্যালোচনা করা হবে।

নারী-পুরুষের একত্ব

ইসলামে নারী ও পুরুষ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়, তা কুরআন মজীদে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই আর্লাহকে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক জীবন্ত সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জুড়ি। আর এই উভয় থেকেই অসংখ্য পুরুষ ও নারী (সৃষ্টি করে) ছড়িয়ে দিয়েছেন।

এ আয়াতে সমগ্র মানবতাকে সম্বোধন করা হয়েছে, তার মধ্যে যেমন রয়েছে পুরুষ, তেমনি নারী। এ উভয় শ্রেণীর মানুষকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, পুরুষ ও নারী একই উৎস থেকে প্রবাহিত মানবতার দুটি স্রোতধারা। নারী ও পুরুষ একই জীবন-সত্তা থেকে সৃষ্ট, একই অংশ থেকে নিঃসৃত। দুনিয়ার এই বিপুল সংখ্যক নারী ও পুরুষ সেই একই সত্তা থেকে উদ্ভুত। নারী আসলে কোনো স্বতন্ত্র জীবসত্তা নয়, না পুরুষ। নারী পুরুষের মতোই মানুষ, যেমন মানুষ হচ্ছে এই পুরুষেরা। এদের কেউ-ই নিছক জন্তু জানোয়ার নয়। মৌলিকতার দিক দিয়ে এ দুয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। পুরুষের মধ্যে যে মানবীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, নারীর মধ্যেও তা বিদ্যমান। এ সব দিক দিয়েই উভয়ে উভয়ের একান্তই নিকটবর্তী, অতীব ঘনিষ্ঠ। এজন্যে তাদের যেমন গৌরব বোধ করা উচিত, তেমনি নিজেদের সম্মান ও সৌভাগ্যের বিষয় বলেও একে মনে করা ও আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া কর্তব্য।

প্রথম মানবী হাওয়াকে প্রথম মানব আদম থেকে সৃষ্টি করার মানেই হচ্ছে এই যে, আদম সৃষ্টির মৌলিক উপাদান যা কিছু তাই হচ্ছে হাওয়ারই। আয়াতের শেষাংশ থেকে জানা যায়, মূলত নারী-পুরুষ জাতির বোন আর পুরুষরা নারী জাতির সহোদর কিংবা বলা যায়, নারী পুরুষেরই অপর অংশ এবং এ দুয়ে মিলে মানবতার এক অভিন্ন অবিভাজ্য সত্তা।

সূরা আল-হুজরাত-এ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন গোত্র ও বংশ-শাখায় বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় লাভ করতে পার।

তবে একথা নিশ্চিত যে, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহ ভীরু ব্যক্তিই হচ্ছে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানার্হ।

এ আয়াত থেকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে বড় বড় যে কয়টি কথা জানা যায়, তা হচ্ছে এইঃ

১. দুনিয়ার সব মানুষ–সকল কালের, সকল দেশের, সকল জাতের ও সকল বংশের মানুষ-কেবলমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি।

২. আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে দুনিয়ার সব মানুষ সমান, কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়; কেউ উচ্চ নয়, কেউ নীচ নয়। সৃষ্টিগতভাবে কেউ শরীফ নয়, কেউ নিকৃষ্ট নয়। উভয়ের দেহেই একই পিতামাতার রক্ত প্রবাহিত।

৩. দুনিয়ার সব মানুষই একজন পুরুষ ও একজন নারীর যৌন-মিলনের ফল হিসেবে সৃষ্ট। দুনিয়ার এমন কোনো পুরুষ নেই, যার সৃষ্টি ও জন্মের ব্যাপারে কোন নারীর প্রত্যক্ষ দান নেই কিংবা কোনো নারী এমন নেই, যার জন্মের ব্যাপারে কোনো পুরুষের প্রত্যক্ষ যোগ অনুপস্থিত। এ কারণে নারী-পুরুষ কেউই কারো ওপর কোনোরূপ মৌলিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে না এবং কেউই অপর কাউকে জন্মগত কারণে হীন, নীচ, নগণ্য ও ক্ষুদ্র বলে ঘৃণা করতেও পারে না। মানবদেহের সংগঠনে পুরুষের সঙ্গে নারীরও যথেষ্ট অংশ শামিল রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে নারীর অংশই বেশি থাকে প্রত্যেকটি মানব শিশুর দেহ সৃষ্টিতে।

নারী ও পুরুষ যে সবদিক দিয়ে সমান, প্রত্যেকেই যে প্রত্যেকের জন্যে একান্তই অপরিহার্য –কেউ কাউকে ছাড়া নয়, হতে পারে না, স্পষ্টভাবে জানা যায় নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় থেকেঃ

(আরবী*********************************************************)

নিশ্চয়ই আমি নষ্ট করে দেই না তোমাদের মধ্যে থেকে কোন আমলকারীর আমলকে, সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তোমরা পরস্পর পরস্পর থেকে –আসলে এক ও অভিন্ন।

তাফসীরকারগণ ‘তোমরা পরস্পর থেকে, আসলে এক ও অভিন্ন’ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, এ বাক্যটুকু ধারাবাহিক কথার মাঝখানে বলে দেয়া একটি কথা। এ থেকে এ কথাই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এখানে আল্লাহ তা’আলা যে বিষয়ের ওয়াদা করেছেন, তাতে পুরুষদের সাথে নারীরাও শামিল। কেননা পরস্পর পরস্পর থেকে হওয়ার মানেই হচ্ছে এই যে, এরা সবাই একই আসল ও মূল থেকে উদ্ভূত এবং তারা পরস্পরের সাথে এমনভাবে জড়িত ও মিলিত যে, এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যের প্রাচীর তোলা কোনোক্রমে সম্ভব নয়। দ্বীনের দৃষ্টিতে তারা সমান, সেই অনুযায়ী আমল করার দায়িত্বও দু’জনার সমান এবং সমানভাবেই সে আমলের সওয়াব পাওয়ার অধিকারী তারা। এক কথায় নারী যেমন পুরুষ থেকে, তেমনি পুরুষ নারী থেকে কিংবা নারী-পুরুষ উভয়ই অপর নারী-পুরুষ থেকে প্রসূত।

(আরবী**************************************************)

মেয়েরা হচ্ছে পুরুষদের পোশাক, আর তোমরা পুরুষরা হচ্ছ মেয়েদের পরিচ্ছদ।

এ আয়াতেও নারী ও পুরুষকে একই পর্যায়ে গণ্য করা হয়েছে এবং উভয়কেই উভয়ের জন্যে ‘পোশাক’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আয়াতে উল্লিখিত ‘লেবাস’ (আরবী******) শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘লেবাস’ মানে পোশাক, যা পরিধান করা হয়, যা মানুষের দেহাবয়ব আবৃত করে রাখে। প্রখ্যাত মনীষী রবী ইবনে আনাস বলেছেনঃ স্ত্রীলোক পুরুষদের জন্যে শয্যাবিশেষ আর পুরুষ হচ্ছে স্ত্রীলোকদের জন্য লেপ। স্ত্রী পুরুষকে পরস্পরের ‘পোশাক’ বলার তিনটি কারণ হতে পারেঃ

১. যে জিনিস মানুষের দোষ ঢেকে দেয়, দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখে, দোষ প্রকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাই হচ্ছে পোশাক। স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের দোষ-ত্রুটি লুকিয়ে রাখে –কেউ কারো কোনো প্রকারের দোষ দেখতে বা জানতে পারলে তার প্রচার বা প্রকাশ করে না –প্রকাশ হতে দেয় না। এজন্যে একজনকে অন্যজনের ‘পোশাক’ বলা হয়েছে।

২. স্বামী-স্ত্রী মিলন শয্যায় আবরণহীন অবস্থায় মিলিত হয়। তাদের দুজনকেই আবৃত রাখে মাত্র একখানা কাপড়। ফলে একজন অন্যজনের পোশাকস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। এদিক দিয়ে উভয়ের গভীর, নিবিড়তম ও দূরত্বহীন মিলনের দিকের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।

৩. স্ত্রী পুরুষের জন্যে এবং পুরুষ স্ত্রীর জন্যে শান্তিস্বরূপ। যেমন অপর এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************)

এবং তার থেকেই তার জুড়ি বানিয়েছেন যেন তার কাছ থেকে মনের শান্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারে।

ইবনে আরাবী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

পুরুষের জন্য স্ত্রীরা কাপড় স্বরূপ। একজন অপর জনের নিকট খুব সহজেই মিলিত হতে পারে। তার সাহায্যে নিজের লজ্জা ডাকতে পারে, শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতে পারে।

তিনি আরো বলেছেন যে, এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, স্বামী-স্ত্রীর কেউ নিজেকে অপর জনের থেকে সম্পর্কহীন করে ও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না, কেননা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মিল-মিশ ও দেখা-সাক্ষাত খুব সহজেই সম্পন্ন হতে পারে।

অন্যরা বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

প্রত্যেকেই অপরের সাহায্যে স্বীয় চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখতে পারে। স্ত্রী ছাড়া অপর কারো সামনে বিবস্ত্র হওয়া হারাম বলে এ অসুবিধা থেকেও এই স্ত্রীর সাহায্যেই রেহাই পেতে পারে।

রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************)

মেয়েলোকেরা যে পুরুষদেরই অর্ধাংশ কিংবা সহোদর এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বস্তুত নারী ও পুরুষ যেন একটি বৃক্ষমূল থেকে উদ্ভূত দুটি শাখা।

অন্যান্য ধর্মমত –অন্যান্য মতাদর্শ

কিন্তু দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মমত ও মতাদর্শের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের এ সমান মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃত।

ইহুদী ধর্মে নারীকে ‘পুরুষের প্রতারক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ওল্ড টেষ্টামেন্ট (আদি পুস্তক)-এ হযরত আদম ও হাওয়ার জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হওয়ার ব্যাপারটিকে এভাবে পেশ করা হয়েছেঃ

তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ডাকিয়া কহিলেন, তুমি কোথায়? তিনি কহিলেন, আমি উদ্যানে, তোমার রব শুনিয়া ভীত হইলাম। কারণ আমি উলঙ্গ, তাই আপনাকে লুকাইয়াছি। তিনি কহিলেন, তুমি যে উলঙ্গ উহা তোমাকে কে বলিল? যে বৃক্ষের ফল ভোজন করিতে তোমাকে নিষেধ করিয়াছিলাম, তুমি কি তাহার ফল ভোজন করিয়াছ? তাহাতে আদম কহিলেন, তুমি আমার সঙ্গিনী করিয়া যে স্ত্রী দিয়াছ, সে আমাকে ঐ বৃক্ষের ফল দিয়াছিল, তাই খাইয়াছি। তখন সদাপ্রভু ঈশ্বর নারীকে কহিলেন, তুমি এ কি করিলে? নারী কহিলেন, সর্প আমাকে ভুলাইয়াছিল, তাই খাইয়াছি। (আদি পুস্তক –মানব জাতির পাপের পতন ১০-১১ ক্ষেত্র)

এর অর্থ এই হয় যে, বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হওয়া আদম তথা মানব জাতির পক্ষে অভিশাপ বিশেষ এবং এ অভিশাপের মূল কারণ হচ্ছে নারী –আদমের স্ত্রী। এজন্যে স্ত্রীলোক সে সমাজে চিরলাঞ্ছিত এবং জাতীয় অভিশাপ, ধ্বংস ও পতনের কারণ। এজন্যে পুরুষ সব সময়ই নারীর ওপর প্রভুত্ব করার স্বাভাবিক অধিকারী। এ অধিকার আদমকে হাওয়া বিবি কর্তৃক নিষিদ্ধ ফল খাওয়ানোর শাস্তি বিশেষ এবং যদ্দিন নারী বেঁচে থাকবে, ততদিনই এ শাস্তি তাকে বোগ করতে হবে।

ইহুদী সমাজে নারীকে ক্রীতদাসী না হলেও চাকরানীর পর্যায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বাপ নিজ কন্যাকে নগদ মূল্যে বিক্রয় করতে পারত, মেয়ে কখনো পিতার সম্পত্তি থেকে মীরাস লাভ করত না, করত কেবল তখন, যখন পিতার কোনো পুত্র সন্তানই থাকত না।

প্রাচীনকালে হিন্দু পণ্ডিতরা মনে করতেন, মানুষ পারিবারিক জীবন বর্জন না করলে জ্ঞান অর্জনে সমর্থ হতে পারে না। মনু’র বিধানে পিতা, স্বামী ও সন্তানের কাছ থেকে কোনো কিচু পাওয়ার মতো কোনো অধিকার নারীর জন্যে নেই। স্বামীর মৃত্যু হলে তাকে চির বৈধব্যের জীবন যাপন করতে হয়। জীবনে কোনো স্বাদ-আনন্দ-আহলাদ-উৎসবে অংশ গ্রহণ তার পক্ষে চির নিষিদ্ধ। নেড়ে মাথা, সাদা বস্ত্র পরিহিতা অবস্থায় আতপ চালের বাত ও নিরামিষ খেয়ে জীবন যাপন করতে হয় তাকে।

প্রাচীন হিন্দু ভারতীয় শাস্ত্রে বলা হয়েছেঃ

মৃত্যু, নরক, বিষ, সর্প, আগুন –এর কোনোটিই নারী অপেক্ষা খারাপ ও মারাত্মক নয়।

যুবতী নারীকে দেবতার উদ্দেশ্যে –দেবার সন্তুষ্টির জন্যে কিংবা বৃষ্টি অথবা ধন-দৌলত লাভের জন্যে বলিদান করা হতো। একটি বিশেষ গাছের সামনে এভাবে একটি নারীকে পেশ করা ছিল তদানীন্তন ভারতের স্থায়ী রীতি। স্বামীর মৃত্যুর সাথে সহমৃত্যু বরণ বা সতীদাহ রীতিও পালন করতে হতো অনেক হিন্দু নারীকে।

অনেক সমাজে নারীকে সকল পাপ, অন্যায় ও অপবিত্রতার কেন্দ্র বা উৎস বলে ঘৃণা করা হতো। তারা বলত, এখনকার নারীরা কি বিবি হাওয়ার সন্তান নয়? আর হাওয়া বিবি কি আদমকে আল্লাহর নাফরমানীর কাজে উদ্ধুদ্ধ করেনি? –পাপের কাজকে তার সামনে আকর্ষনীয় করে তোলেনি? ধোঁকা দিয়ে পাপে লিপ্ত করেনি? আর মানব জাতিকে এই পাপ পংকিল দুনিয়ার আগমনের জন্যে সেই কি দায়ী নয়? সত্যি কথা এই যে, হাওয়া বিবিই হচ্ছে শয়তান প্রবেশের দ্বারপথ, আল্লাহর আনুগত্য ভঙ্গ করার কাজ সেই সর্বপ্রথম শুরু করেছে। এ কারণে তারই কন্যা বর্তমানের এ নারী সমাজেরও অনুরূপ পাপ কাজেরই উদগাতা হওয়া স্বাভাবিক। তাই নারীরা হচ্ছে শয়তানের বাহন, নারীরা হচ্ছে এমন বিষধর সাপ, যা পুরুষকে দংশন করতে কখনো কসুর করেনি।

এসব মতের কারণে দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজ ও সভ্যনায় নারী জাতির মর্মান্তিক অবস্তা দেখা গিয়েছে। এথেন্সবাসীরা হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্রাচীনতম জাতি। কিন্তু সেখানে নারীকে পরিত্যক্ত দ্রব্য-সামগ্রীর মতো মনে করা হতো। হাটে-বাজারে প্রকাশ্যভাবে নারীর বেচা-কেনা হতো। শয়তান অপেক্ষাও অধিক ঘৃণিত ছিল সেখানে নারী। ঘরের কাজকর্ম করা এবং সন্তান প্রসব ও লালন-পালন ছাড়া অন্য কোনো মানবীয় অধিকারই তাদের ছিল না। স্পার্টাতে আইনত একাধিক স্ত্রী গ্রহন নিষিদ্ধ থাকলেও কার্যত প্রায় প্রত্যেক পুরুষই একাধিক স্ত্রী রাখত। এমনকি নারীও একাধিক পুরুষের যৌন ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে সেখানে বাধ্য হতো। সমাজের কেবল নিম্নস্তরের মেয়েরাই নয়, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা-বৌ’রা পর্যন্ত এ জঘন্য কাজে লিপ্ত থাকত। রুমানিয়ায়ও এর রেওয়াজ ছিল ব্যাপকভাবে। শাসন কর্তৃপক্ষ দেশেল সব প্রজা-সাধারনের জন্য একাধিক বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সমাজের কোনো লোক –পাদ্রী-পুরোহিত কিংবা সমাজ-নেতা কেউই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজ তুলেনি।

ইহুদী সমাজে নারীদের অবস্থা আরো মারাত্মক। মদীনার ‘ফিতুম’ নামক এক ইহুদী বাদশাহ আইন জারী করেছিলঃ “যে মেয়েকেই বিয়ে দেওয়া হবে, স্বামীর ঘরে যাওয়ার আগে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে এই রাত্রি যাপন করতে হবে”। (আরবী**********************)

খ্রিষ্টধর্মে তো নারীকে চরম লাঞ্ছনার নিম্নতম পংকে নিমজ্জিত করে দেয়া হয়েছে। পোলিশ লিখিত এক চিঠিতে বলা হয়েছেঃ নারীকে চুপচাপ থেকে পূর্ণ আনুগত্য সহকারে শিক্ষালাভ করতে হবে। নারীকে শিক্ষাদানের আমি অনুমতি দেই না; বরং সে চুপচাপ থাকবে। কেননা আদমকে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পরে হাওয়াকে, আদম প্রথমে ধোঁকা খায় নি, নারীই ধোঁকা খেয়ে গুনাহে লিপ্ত হয়েছে।

জনৈক পাদ্রীর মতে নারী হচ্ছে শয়তানের প্রবেশস্থল। তারা আল্লাহর মান-মর্যাদার প্রবিন্ধক, আল্লাহর প্রতিরূপ, মানুষের পক্ষে তারা বিপজ্জনক। পাদ্রী সন্তান বলেছেনঃ নারী সব অন্যায়ের মূল, তার থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। নারী হচ্ছে পুরুষের মনে লালসা উদ্রেককারী, ঘরে ও সমাজে যত অশান্তির সৃষ্টি হয়, সব তারই কারণে। এমন কি, নারী কেবল দেহসর্বস্ব, না তার প্রাণ বলতে কিছু আছে, এ প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দে বড় বড় খ্রীষ্টান পাদ্রীদের এক কনফারেন্স বসেছিল ‘মাকুন’ নামের এক জায়গায়।

ইংরেজদের দেশে ১৮০৫ সন পর্যন্ত আইন ছিল যে, পুরুষ তার স্ত্রীকে বিক্রয় করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে একন একটি স্ত্রীর দাম ধরা হয়েছিল অর্ধশিলিং। এক ইটালীয়ান স্বামী তার স্ত্রীকে কিস্তি হিসেবে আদায়যোগ্য মূল্যে বিক্রয় করেছিল। পরে ক্রয়কারী যখন কিস্তি বাবদ টাকা দিতে অস্বীকার করে, তখন বিক্রয়কারী স্বামী তাকে হত্যা করে।

অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে ফরাসী পার্লামেন্টে মানুষের দাস প্রথার বিরুদ্ধে যে আইন পাস হয়, তার মধ্যে নারীকে গণ্য করা হয় নি। কেননা অবিবাহিতা নারী সম্পর্কে কোনো কিছু করা যেতো না তাদের অনুমতি ছাড়া। (আরবী*****************************) ৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বহু চিন্তা-ভাবনা, আলোচনা-গবেষণা ও তর্ক-বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, নারী জন্তু নয় –মানুষ। তবে সে এমন মানুষ যে, পুরুষের কাজে নিরন্তর সেবারত হয়ে থাকাই তার কর্তব্য। কিন্তু তাই বলে তাকে শয়তানের বাহন, সব অন্যায়ের উৎস ও কেন্দ্র এবং সার সাথে সম্পর্ক রাখা অনুচিত প্রভৃতি ধরনের যেসব কথা বলা হয় তার প্রতিবাদ বা প্রত্যাহার করা হয়নি। কেননা এগুলো ছিল তার স্থির ও মজ্জাগত আকীদা।

(আরবী*****************************************)

গ্রীকদের দৃষ্টিতে নারীর মর্যাদা কি ছিল, তা তাদের একটা কথা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখানে বলা হতোঃ

আগুনে জ্বলে গেলে ও সাপে দংশন করলে তার প্রতিবিধান সম্ভব; কিন্তু নারীর দুষ্কৃতির প্রতিবিধান অসম্ভব।

পারস্যের ‘মাজদাক’ আন্দোলনের মূলেও নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা পুঞ্জীবূত ছিল। এ আন্দোলনের প্রভাবাধীণ সমাজে নারী পুরুষের লালসা পরিতৃপ্তির হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। তাদের মতে দুনিয়ার সব অনিষ্টের মূল উৎস হচ্ছে দুটি –একটি নারী দ্বিতীয়টি ধন-সম্পদ। (আরবী******************)

প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা অন্যান্য সমাজের তুলনায় অধিক নিকৃষ্ট ছিল। প্রাচীন ভারতের প্রখ্যাত আইন রচয়িতা মনু মহারাজ নারী সম্পর্কে বলেছেনঃ

‘নারী –নাবালেগ হোক, যুবতী হোক আর বৃদ্ধা হোক –নিজ ঘরেও স্বাধীনভাবে কোন কাজ করতে পারবে না’।

‘মিথ্যা কথা বলা নারীর স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য। মিথ্যা বলা, চিন্তা না করে কাজ করা, ধোঁকা-প্রতারণা, নির্বুদ্ধিতা, লোভ, পংকিলতা, নির্দয়তা –এ হচ্ছে স্বভাবগত দোষ’।

ইউরোপে এক শতাব্দীকাল পূর্বেও পুরুষগণ নারীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাত। পুরুষের অত্যাচার বন্ধ করার মতো কোনো আইন সেখানে ছিল না। নারী ছিল পুরুষের গোলাম। নারী সেখানে নিজ ইচ্ছায় কোনো কাজ করতে পারত না। নিজে উপার্জন করেও নিজের জন্যে তা ব্যয় করতে পারত না। মেয়েরা পিতামাতার সম্পত্তির মতো ছিল। তাদের বিক্রয় করে দেয়া হতো। নিজেদের পছন্দসই বিয়ে করার কোন অধিকার ছিল না তাদের।

প্রাচীন আরব সমাজেও নারীর অবস্থা কিছুমাত্র ভালো ছিল না। তথায় নারীকে অত্যণ্ত ‘লজ্জার বস্তু’ বলে মনে করা হতো। কন্যা-সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পিতামাতা উভয়ই যারপর নাই অসন্তুষ্ট হতো। পিতা কন্যা-সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করে ফেলত। আর জীবিত রাখলেও তাকে মানবোচিত কোনো অধিকারই দেয়া হতো না। নারী যতদিন জীবিত থাকত, ততদিন স্বামীর দাসী হয়ে থাকত। আর স্বামী মরে গেলে তার উত্তরাধিকারীরাই অন্যান্য বিষয় সম্পত্তির সাথে তাদেরও একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসত। সৎমা –পিতার স্ত্রীকে নিজের স্ত্রী বানানো সে সমাজে কোনো লজ্জা বা আপত্তির কাজ ছিল না। বরং তার ব্যাপক প্রচলন ছিল সেখানে। আল্লামা আবূ বকর আবুল জাসসাস লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

জাহিলিয়াতের যুগে পিতার স্ত্রী –সৎ মা বিয়ে করার ব্যাপক প্রচলন ছিল।

সেখানে নারীর পক্ষে কোনো মীরাস পাওয়া একেবারেই অসম্ভব ছিল। আধুনিক সভ্যতা নারীমুক্তির নামে প্রাচীন কালের লাঞ্ছনার গহবর থেকে উদ্ধার করে নারী স্বাধীনতার অপর এক গভীর গহবরে নিক্ষেপ করেছে। নারী স্বাধীনতার নামে তাকে লাগামহীন জন্তু জানোয়ার পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে। আজ সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিল্পের নামে নারীর লজ্জা-শরম-আবরু ও পবিত্রতার মহামূল্য সম্পদকে প্রকাশ্য বাজারে নগণ্য পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে। পুরুষরা চিন্তার আধুনিকতা উচ্ছলতা ও শিল্পে অগ্রগতি ও বিকাশ সাধনের মোহনীয় নামে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে এবং ক্লাবে, নাচের আসরে বা অভিনয় মঞ্চে পৌঁছিয়ে নিজেদের পাশবিক লালসার ইন্ধন বানিয়ে নিয়েছে। বস্তুত আধুনিক সভ্যতা নারীর নারীত্বের সমাধির ওপর লালসা চরিতার্থতার সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেছে। এ সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে নারীকে দেয়নি কিছুই, যদিও তার সব অমূল্য সম্পদই সে হরণ করে নিয়েছে নির্মমভাবে।

বিশ্বনবীর আবির্ভাবকালে দুনিয়ার সব সমাজেই নারীর অবস্থা প্রায় অনুরূপই ছিল। রাসূলে করীম (স) এসে মানবতার মুক্তি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে বিপ্লবী বাণী শুনিয়েছেন, তাতে যুগান্তকালের পংকিলতা ও পাশবিকতা দূরীভূত হতে শুরু হয়। নারীর প্রতি জুলুম ও অমানুষিক ব্যবহারের প্রবণতা নিঃশেষ হয়ে গেল। মানব সমাজে তার সম্মান ও যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলো। জীবনক্ষেত্রে তার গুরুত্ব যেমন স্বীকৃত হয়, তেমনি তার যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদাও পুরাপুরি বহাল হলো। নারী মানবতার পর্যায়ে পুরুষদের সমান বলে গণ্য হলো। অধিকার ও দায়িত্বের গুরুত্বের দিক দিয়েও কোনো পার্থক্য থাকল না এদের মধ্যে। নারী ও পুরুষ উভয়ই যে বাস্তবিকই ভাই ও বোন, এরূপ সাম্য ও সমতা স্বীকৃত না হলে তা বাস্তবে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

নারী ও পুরুষ পিতামাতার উত্তরাধিকারের দিক দিয়েও সমান। একটি গাছের মূল কাণ্ড থেকে দুটি শাখা বের হলে যেমন হয়, এও ঠিক তেমনি। কাজেই যারা বলে যে, নারী জন্মগতভাবেই খারাপ, পাপের উৎস, পংকিল –তারা সম্পূর্ণ ভুল কথা বলে। কেননা বিবি হাওয়া স্ত্রী পুরুষ সকলেই আদি মাতা, তার বিশেষ কোনো উত্তরাধিকার পেয়ে থাকলে দুনিয়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই তা পেয়েছে। তা কেবল স্ত্রীলোকেরাই পেয়েছে, পুরুষরা পায় নি –এমন কথা বলাতো খুবই হাস্যকর। আর বেহেশত আল্লাহর নিষিদ্ধ গাছের নিকট যাওয়া ও তার ফল খাওয়ায় দোষ কিছু হয়ে থাকলে কুরআনের দৃষ্টিতে তা আদম ও হাওয়া দুজনেরই রয়েছে। শুরুতে দুজনকেই নির্দেশ দেয়া হয়েছিলঃ

(আরবী**************************************************************)

হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং সেখান থেকে তোমরা দুজনে প্রাণভরে পানাহার করো –যেখান থেকেই তোমাদের ইচ্ছা। আর তোমরা দুজনে এই গাছটির নিকটেও যাবে না –গেলে তোমরা দুজনই জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।

পরবর্তী কথা থেকেও জানা যায়, আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার কারণে তাঁদের যে ভুল হয়েছিল, তা এক সঙ্গে তাঁদের দুজনেরই হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর দুজনই সেজন্যে আল্লাহর নিকট তওবা করে পাপঙ্খালন করেছিলেন। একথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াত কয়টিতেঃ

(আরবী*****************************************************************)

অতঃপর তারা দুজনই যখন সে গাছ আস্বাদন করল, তাদের দুজনেরই লজ্জাস্থান প্রকাশিত হয়ে পড়ল। এবং তারা দুজনই বেহেশতের গাছের পাতা নিজেদের গায়ে লাগিয়ে আবরণ বানাতে থাকে এবং তাদের দুজনের আল্লাহ তাদের দুজনকে ডেকে বললেনঃ আমি কি তোমাদের দুজনকেই তোমাদের (সামনের) এই গাছটি সম্পর্ক নিষেধ করিনি? আমি বলিনি যে, শয়তান তোমাদের দুজনেরই প্রকাশ্য দুশমন? তখন তারা দুজনে বললঃ হে আমাদের রব্ব, আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি রহমত নাযিল না করো, তাহলে আমরা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।

কুরআন মজীদের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে নারী সম্পর্কে যাবতীয় অমানবিক ও অপমানকর ধারণা ও মতাদর্শের ভ্রান্তি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। বস্তুত দুনিয়ায় কুরআনই একমাত্র কিতাব, যা নারীকে যুগযুগ সিঞ্চিত অপমান-লাঞ্ছনা ও হীনতা-নীচনার পূঞ্জীভূত স্তূপের জঞ্জাল থেকে চিরদিনের জন্যে মুক্তি দান করেছে এবং তাকে সঠিক ও যথোপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুছে দিয়েছে তার ললাটস্থ সহস্রাব্দকালের মসিরেখা।

ইসলাম নারীকে সঠিক মানবতার মূল্য দান করেছে। নারী স্বাভাবিক সুকুমার বৃত্তি ও সহজাত গুণাবলীর বিকাশ সাধনই ইসলামের লক্ষ্য। এজন্যে ইসলাম নারীকে ঘরের বাইরে মাঠে-ময়দানে হাটে-বন্দরে, অফিসে-বাজারে, দোকানে-কারখানায়, পরিষদে-সম্মেলনে, মঞ্চে-নৃত্যুশালায়-অভিনয়ে টেনে নেয়ার পক্ষপাতী নয়। কারণ এসব যোগ্যতা সহকারে পুরোমাত্রায় অংশ গ্রহণের জন্যে যেসব স্বাভাবিক গুণ ও কর্মক্ষমতার প্রয়োজন, তা নারীকে জন্মগতভাবেই দেয়া হয়নি। নারীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা দান করা হয়েছে এবং ইসলাম নারীর জন্যে যে জীবন-পথ ও যে কাজের দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে, তা সবই ঠিক এ দৃষ্টিতেই করা হয়েছে। ইসলাম নারীর স্বাভাবিক যোগ্যতার সঠিক মূল্য দিয়েছে, দিয়েছে তা ব্যবহার করে তার উৎকর্ষ সাধনের জন্যে প্রয়োজনীয় বিধান ও ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় নারীদের দ্বারা যে সব কাজ করানো হচ্ছে কিংবা যেসব কাজ করতে তাদের নানাভাবে বাধ্য করা হচ্ছে, তা সবই তার প্রকৃতি পরিপন্থী, প্রলোভন বা জোর জবরদস্তিরই পরিণতি মাত্র। সে সব কাজের জন্যে মূলতই নারীদের সৃষ্টি করা হয়নি, তা নিঃসন্দেহেই বলতে চাই। ইসলামের দৃষ্টিতে পারিবারিক জীবন যাপনই হচ্ছে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যে চিরকল্যাণের উৎস। এ জীবনের বিস্তারিত ব্যবস্থার যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণই এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য।


ইসলামে নারী ও পুরুষের আদর্শ
ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কেই যেমন সৃষ্টিকুলের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত মর্যাদায় ভূষিত করেছে তেমনি নারী ও পুরুষের মধ্যে বিশেষ কতগুলো গুণের বর্তমানতাও ইসলামের দৃষ্টিতে কাম্য। এ গুণগুলোই তাদের পূর্ণ আদর্শবাদী বানিয়ে দেয় এবং এ আদর্শবাদ চিরউজ্জ্বল ও বাস্তবায়িত রাখতে পারলেই ইসলামের দেয়া সে মর্যাদা নারী ও পুরুষ পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করতে পারে। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও তাদের পারিবারিক জীবনের বিস্তারিত বিধান পেশ করার পূর্বে আমরা এখানে সে বিশেষ গুণাবলী সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করতে চাই। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

আল্লহার অনুগত পুরুষ ও স্ত্রীলোক, ঈমানদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্য ন্যায়বাদী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, সত্যের দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক, দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক, রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক, আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক –আল্লাহ তা’আলা এদের জন্যে স্বীয় ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন। কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার স্ত্রীলোকের জন্যে –আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনো বিষয়ে চূড়ান্তভাবে ফায়সালা করে দেন, তখন সেই ব্যাপারে তার বিপরীত কিছুর ইখতিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করার কোনো অধিকার নেই। আর যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে লিপ্ত হয়।

এই দীর্ঘ আয়াত থেকে যে গুণাবলী প্রমাণিত হচ্ছে –সেসব গুণাবলী নর-নারীর মধ্যে বর্তমান থাকলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হতে পারে –তা এখানে খানিকটা ব্যাখ্যাসহ সংখ্যানুক্রমিক উল্লেখ করা যাচ্ছে, যেন পাঠকগণ সহজেই সে গুণাবলী সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন।

১. মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম স্ত্রীলোক। ‘মুসলিম’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্য, বাধ্য। আর কুরআনী পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণকারী, আল্লাহর অনুগত ও বাধ্য। ব্যবহারিকভাবে আল্লাহর আইন পালনকারী।

২. মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন মঞিলা। ‘মু’মিন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ঈমানদার। ঈমান অর্থ কোনো অদৃশ্য সত্যে বিশ্বাস স্থাপন, আর কুরআনী পরিভাষায় কুরআনের উপস্তাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহকে সত্য বলে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে নেওয়াই হচ্ছে ঈমান। এই অনুযায়ী মু’মিন হচ্ছে সে পুরুষ ও স্ত্রী, যারা কুরআনের উপস্থাপিত অদৃশ্য বিষয়সমূহের প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসী। মুসলিম-এর পরে মু’মিন বলার তাৎপর্য এই যে, দুনিয়ার মানুষকে কেবল আল্লাহর বাহ্যিক আইন পালনকারী হলেই চলবে না, তাকে হতে হবে তাঁর প্রতি মন ও অন্তর দিয়ে ঐকান্তিক বিশ্বাসী।

৩. আল্লাহর দিকে মনোযোগকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। এর অর্থ সেসব লোক, যারা সর্বপ্রকার মিথ্যাকে পরিহার করে আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর হুকুম পালন করে চলে। ফলে তাদের আমলে কোনো প্রকার রিয়াকারী বা দেখানোপনা থাকে না।

৫. সত্যের পথে দৃঢ়তা প্রদর্শনকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক। মূল শব্দ (আরবী*******) সবর। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিজেকে বেঁধে রাখা, ধৈর্য ধারণ করা। এখানে সেসব পুরুষ-স্ত্রীলোককে বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহর দ্বীন পালন ও তাঁর বন্দেগী অবলম্বন করতে গিয়ে সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট অকাতরে সহ্য করে, তার ওপর দৃঢ় হয়ে অচল অটল হয়ে থাকে। শত বাধা-প্রতিকূলতার সঙ্গে মুকাবিলা করেও দ্বীনের ওপর মজবুত থাকে এবং কোনোক্রমেই আদর্শ বিচ্যুত হয় না।

৬. আল্লাহর নিকট বিনীত নম্র পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা অন্তর, মন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সব কিছু দিয়ে আল্লাহর বিনীত বন্দেগী করে। মূল শব্দটি হচ্ছে (আরবী**********) ‘খুশূয়ূন’, অর্থ প্রশান্তি, স্থিতি, প্রীতি, শ্রদ্ধা-ভক্তি, বিনয়, ভয়মিশ্রিত ভালোবাসা এবং আল্লাহর প্রতি আগ্রহ-উৎসাহ।

৭. দানশীল পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা গরীব-দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি অন্তরে দয়া অনুভব করে উদ্ধৃত্ত মাল ও অর্থ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অভাবগ্রস্ত লোকদের দেয়।

৮. রোযাদার পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা আল্লাহর হুকুম-মুতাবিক রোযা রাখে, যে রোযার ফল হচ্ছে তাকওয়া পরহেযগারী লাভ এবং যার মাধ্যমে ক্ষুৎপিপাসার জ্বালা ও যন্ত্রণা অনুভব করা যায় প্রত্যক্ষভাবে ও তার জন্যে ধৈর্য ধারনের শক্তি অর্জন করতে পারেন।

৯. লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যারা নিজেদের লজ্জাস্থান অন্য লোকদের সামনে প্রকাশ করে না –তাতে লজ্জাবোধ করে এবং নিজেদের লিঙ্গস্থানকে হারামভাবে ও হারাম পথে ব্যবহার করেনা। ঢেকে রাখার যোগ্য দেহে –দেহের কোন অঙ্গকে ভিন-পুরুষ-স্ত্রীর সামনে উন্মুক্ত করে না।

১০. আল্লাহকে অধিক মাত্রায় স্মরণকারী পুরুষ ও স্ত্রীলোক অর্থাৎ যাঁরা আল্লাহকে কস্মিনকালেও এবং মুহুর্তের তরেও ভুলে যায় না, আর মুখ ও কলব ক্ষেত্রেই আল্লাহকে চিরস্মরণীয় রাখে।

এই দশটি মৌলিক গুণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হোক এবং এ গুণধারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হোক, কুরআনের এ ভাষণের মূল লক্ষ্য তাই। এ মৌলিক গুণাবলী নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই কাম্য। কেবল পুরুষদেরই নয়, নারীদেরও এই গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। আর তা হতে পারলেই এই পুরুষ ও নারী সমন্বয়ে গঠিত হবে আদর্ম সমাজ যা কুরআন গড়ে তুলতে চায়।

কুরআনের অপর একটি ছোট্ট আয়াতে বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*********************************)

অতএব যারা নেককার স্ত্রীলোক, তারা তাদের স্বামীদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম পালনকারী এবং স্বামীদের অনুপস্থিতিতে গোপনীয় বা রক্ষণীয় বিষয়গুলোর হেফাযতকারী হয়ে থাকে; কেননা আল্লাহ নিজেই তার হেফাযত করেছেন। (যদি কেউ সে-সবের হেফাযত করতে চায়, তবে তার পক্ষে তা সম্ভব ও সহজ হবে)।

এ আয়াতের তাফসীরে লেখা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

অর্থাৎ নারীদের জন্যে কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে যে, তারা তাদের স্বামীদের অধিকার রক্ষা করবে এর বিনিময়ে যে, আল্লাহ নিজেই তাদের অধিকার তাদের স্বামীদের ওপর সংস্থাপন ও তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এজন্যেই তিনি স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়নীতি ও সুবিচার স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন পুরুষদেরকে। তাদেরকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে বলেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন পুরুষদেরকে তাদের মোহরানা আদায় করতে।

ইসলামের দৃষ্টিতে আদর্শ নারী

কুরআন মজীদে মহিলাদের দুটি আদর্শ নারীর চরিত্র পেশ করা হয়েছে এবং দুনিয়ার ঈমানদার নারীদেরকে তাদের আদর্শ চরিত্রের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

তার মধ্যে একটি আদর্শ হচ্ছে ফিরাঊনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম। ফিরাঊন ছিল আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রকাশ্য দুশমন। কিন্তু তার স্ত্রী ছিলেন আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি পূর্ণ ও মজবুত ঈমানদার। ফিরাঊনের ন্যায় প্রচণ্ড প্রতাপশালী সম্রাটের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এবং অত্যন্ত কুফরী পরিবেশে থেকেও তিনি আন্তরিক নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহকে ভয় করতেন, তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন করে চলতেন। এত বড় সম্রাটের স্ত্রী হওয়াকে তিনি নিজের জন্যে সামান্য গৌরবের বিষয় বলেও মনে করতেন না। বরং রাতদিন আল্লাহর নিকট এই আল্লাহ-বিরোধী সম্রাটের আধিপত্য থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে কাতর কণ্ঠে দো’আ করতে থাকতেন। ফিরাঊনের নাফরমানীর কারণে গোটা জাতির ওপর আল্লাহর যে গজব ও অভিশাপ বর্ষিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল, তা থেকেও তাঁর নিকট পানাহ চাইতেন। কুরআন মজীদে এই আল্লাহ বিশ্বাসী মহিলাকে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছেঃ

(আরবী**************************************)

আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার লোকদের জন্যে ফিরাঊনের স্ত্রীকে দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করেছেন। সে (স্ত্রী) দো’আ করলঃ ‘হে আল্লাহ! আমার জন্যে তোমার নিকট জান্নাতে একখানি ঘর নির্মাণ করো এবং ফিরাঊন ও তার কার্যকলাপ থেকে আমাকে মুক্তি দাও, মুক্তি দাও জালিম লোকদের নির্যাতন থেকে’।

এ দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************)

মু’মিন লোকদের প্রকৃত অবস্থা কি হতে পারে তা দেখার ও তার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা ফিরাঊনের স্ত্রীকে দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করেছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহর আনুগত্যে দৃঢ়তা দেখানো, দ্বীন ইসলামকে সর্বাবস্থায় আঁকড়ে ঘরে থাকার এবং কঠোর দুর্বিষহ অবস্থায়ও ধৈর্য ধারণ করার উৎসাহ দান করা হয়েছে এ উপমা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। পরন্তু দেখানো হয়েছে যে, কুফরী শক্তির যতই দাপট ও প্রতাপ হোক, তা ঈমানদার লোকদের একবিন্দু ক্ষতি করতে পারবে না, যেমন ফিরাঊনের মতো একজন বড় কাফেরের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও সে তার স্ত্রীর একবিন্দু ক্ষতি করতে পারে নি, বরং তিনি আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান সহকারেই নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে চলে যেতে পেরেছেন।

দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে, হযরত মরিয়মের চরিত্র। তিনি ছিলেন পবিত্রতা, সতীত্ব এবং আল্লাহ-ভীরুতার জ্বলন্ত প্রতীক। আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইমরান-কন্যা মরিয়মের কথা। সে তার সব শংকাপূর্ণ স্থান (যৌন অঙ্গ) সমূহের পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। তখন আমি (আল্লাহ) তার মধ্যে আমার থেকে রূহ ফুঁকে দিলাম এবং সে তার আল্লাহর সব কথা ও তাঁর কিতাবসমূহের সত্যতা মেনে নিয়েছে। বস্তুত সে ছিল তার আল্লাহর আদেশ পালনকারী বিনয়ী লোকদের অন্তর্ভুক্ত।

আল্লাহর হুকুম পালন, বিনয় ও আল্লাহ-ভীরুতার বাস্তব প্রতীক হিসেবে ওপরের আয়াতদ্বয়ের যেমন দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে, অনুরূপভাবে উপদেশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে দুটি খারাপ চরিত্রের নারীর দৃষ্টান্তও উল্লেখ করা হয়েছে অপর আয়াতে। তাদের এক দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে হযরত নূহ ও হযরত লতু নবীর স্ত্রীদ্বয়ের উল্লেখ হয়েছে। দুজনের প্রতিই আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ ছিল, দুজনকেই আল্লাহর বিধান মুতাবেক জীবন যাপন করতে এবং তাদের স্বামীদ্বয় যে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাতে যদি তারা তাঁদের সাহায্য ও সহযোগিতা করত –সব রকমের দুঃখ-কষ্টে তাঁদের অকৃত্রিম সহচারী ও সঙ্গিনী হত, তাহলে তাদের স্বামীদ্বয়ের মতো আল্লাহর নিকট তাদেরও মর্যাদা হতো। কিন্তু তারাতা করেনি। তারা বরং এ ব্যাপারে নিজ নিজ স্বামীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাদের কাজকে তারা অতি হীন ও নগণ্য মনে করেছে। তাদের দুশমনদের সাথে তারা গোপনে হাত মিলিয়েছে। ফলে নবীদ্বয়ের দুঃখ ও বেদনার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই কারণে জাতির ফাসিক-ফাজির লোকেরা আল্লাহর যে আযাবে নিমজ্জিত হয়েছে, তারাও সেই আযাবে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************)

আল্লাহ কাফেরদের অবস্থা বোঝাবার জন্যে নূহ ও লুতের স্ত্রীদ্বয়ের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছেন। এই দুজন মেয়েলোক ছিল আমার দুই নেক বান্দার স্ত্রী। তারা দুজনই নিজ নিজ স্বামীর সাথে খেয়ানতের অপরাধ করেছে। কিন্তু নেক স্বামীদ্বয় তাদের জন্যে আল্লাহর আযাবের মুকাবিলায় কোনো উপকারে আসেনি। বরং তাদে দুজন (স্ত্রীদ্বয়)-কেও আদেশ করা হলোঃ তোমরা অন্যান্যদের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করো।

কুরআন মজীদে এ পর্যায়ে তৃতীয় যে দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা হয়েছে, তা হলো আবূ লাহাবের স্ত্রীর কথা। আবূ লাহাব ছিল ইসলাম-বিরোধী কুফরী আদর্শের একজন বড় নেতা। আর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের সে ছিল অতি বড় দুশমন। তার স্ত্রী ছিল বড় খবীস প্রকৃতির, হীন ও নিকৃষ্ট চরিত্রের এক দুর্দান্ত মেয়েলোক। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে রাসূলে করীম (স)-এর বিরোধিতা করত প্রাণপণে। তাদের এ বিরোধীতা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণের ওপর ভিত্তিশীল ছিল না, ছিল না কোনো নীতির ভিত্তিতে। বরং এ বিরোধিতা ছিল অনেকটা ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও আক্রোশ পর্যায়ে। অপরদিকে আবূ লাহাবের স্ত্রী ছিল অত্যন্ত আধুনিক। তার বিলাস-ব্যসনের জন্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে দেয়ার জন্যে সে স্বামীর ওপর প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করত। আবূ লাহাব নিতান্ত বোকার মতো স্ত্রীর যাবতীয় দাবি-দাওয়া পূরণের জন্যে ন্যায়-অন্যায় নির্বিচারে নানাবিধ উপায় অবলম্বন করত। এতবড় একজন সমাজপতি হওয়া সত্ত্বেও হাজীদের পরিচর্যার জন্যে সংগৃহিত অর্থ বিনষ্ট ও আত্মসাত করত। এমন কি, আল্লাহর ঘরে রক্ষিত স্বর্ণ চুরি করত বলে অনেকেই তার প্রতি সন্দেহ পোষণ করত। তার এসব অসদাচরণের একমাত্র কারণ ছিল তার প্রিয়তমা স্ত্রীর অবাঞ্ছিত বিলাস-ব্যসনের আবদার রক্ষা। এ ধরনের একটি নারী গোটা জাতির পক্ষেও বিপজ্জনক হতে পারে। এ কারণে কুরআন মজীদে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে এ নারীর উল্লেখ করা হয়েছে। আর তার দুষ্কৃতকারী স্বামীর মর্মান্তিক পরিণতির ব্যাপারে তাকেও সমানভাবে অংশীদার বানানো হয়েছে। কুরআনে তার নির্মম পরিণতির যে চিত্র অংকন করা হয়েছে, তা হচ্ছে এমন এক নারী, যে গলায় রশি ঝুলিয়ে বনে-জঙ্গলে কাষ্ঠ আহরণ করে বেড়াচ্ছে এবং সে ইন্ধন সংগ্রহ করে আগুনকে দ্বিগুণভাবে তেজস্বী করে জ্বালিয়েছে। এ আগুনেই জ্বলছে তার নিজের স্বামী। কেননা আবূ লাহাবের জাহান্নামে যাওয়ার যাবতীয় কারণ এ দুনিয়ায় সেই উদ্ভাবন করেছিল। কুরআনে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************)

আবূ লাহাব ধ্বংস হোক, -আর তার সব ক্ষমতা প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হলো সে নিজে ধ্বংস হলো। না তার ধন-সম্পদ তাকে রক্ষা করতে পারল, না তার হারাম-হালাল উপার্জন। সে শীঘ্রই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবে। তার স্ত্রীও তারই সঙ্গে –যার কাজ ছিল কেবল ইন্ধন সংগ্রহ করা –তার গলদেশে ঝুলতে থাকবে মোটা পাকানো রশি।

অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে হরণ করে এবং খেয়ানত করে আব লাহাব যে সব মূল্যবান অলংকার বানিয়ে তার স্ত্রীকে দিত, কিয়ামতের দিন তা-ই তার গলায় বড় বড় রশি হয়ে ঝুলতে থাকবে। বস্তুত মরণকালেও যে পাকানো রশি দ্বারা জালানী কাঠ বেঁধে আনতো তার গলায় ঐ রশির ফাঁস লেগে তার মৃত্যু হয়েছিল।

কুরআন মজীদে উল্লিখিত বিভিন্ন নারীর এ দৃষ্টান্ত দুনিয়ার নারীকুলের জন্যে যেমন বিশেষ অনুসরণীয় ও উপদেশ গ্রহণের স্থল, তেমনি দুনিয়ার স্বামীকুলের জন্যেও এর মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, রয়েছে উপদেশ গ্রহণের উন্নত শিক্ষা। এ আলোচনার মাধ্যমে কুরআন নারীকুরের সামনে নৈতিকতার একটি মান –একটি নৈতিক লক্ষ্য সংস্থাপন করেছে। যে সব মহিলা দ্বীনদার, কিন্তু স্বামীরা ফাসেক-ফাজের –দ্বীন-ইসলামের বিরোধী কিংবা তার পক্ষে নয়, তাদের জন্যেও যেমন এখানে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত রয়েছে, তেমনি সব কাফের, চরিত্রহীন ও আল্লাহ-দ্রোহী নারীদের জন্যেও এতে রয়েছে নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে চিন্তা করে কল্যাণের পথ এ দুনিয়ায়ই গ্রহণ করার উপযুক্ত শিক্ষা, যাদের স্বামীরা বড় দ্বীনদার পরহেযগার। দুনিয়ার স্বামীকুল সম্পর্কেও এই একই কথা।

স্বামী যদি বেঈমান হয়, আর স্ত্রী হয় ঈমানদার, আল্লাহভীরু, তাহলে এ কারণেই স্বামীর পক্ষে পরকালীন মুক্তি লাভ সম্ভব হবে না। আর এরূপ অবস্থায়ও যে স্ত্রীলোকদের পক্ষে দ্বীন পালন করা উচিত, স্বামীর অন্যায় কাজের সমর্থন করতে গিয়ে নিজেদেরকেও জাহান্নামী করা স্ত্রীর পক্ষে উচিত কাজ নয়, আর তা যে সম্ভব, তার বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুরআনে উল্লিখিত ফিরাউনের স্ত্রী –আছিয়া।

পক্ষান্তরে বেঈমান স্ত্রীদের স্বামীরা যদি নবীও হয়, তবু কেবলমাত্র এই বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রেহাই দেবেন –এরূপ ধারণা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়।


ইসলামে নারীর মর্যাদা
ইসলামে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া হয়েছে। নারীকে প্রথম মর্যাদা দেয়া হয়েছে কন্যারূপে। দ্বিথীয় মর্যাদা দেয়া হয়েছে বধুরূপে, তৃতীয় মর্যাদা ‘মা’ রূপে এবং চতুর্থ সমাজ-সংস্থার সমান গুরুত্বপূর্ণ সদস্যারূপে।

কন্যা-রূপে নারী

পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, কন্যারূপে নারীর বড়ই অমর্যাদা ছিল আরব জাহিলিয়াতের সমাজে। সেখানে কন্যা-সন্তানকে অকথ্যভাবে ঘৃণা করা হতো। তাকে জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। কন্যা-সন্তানের মুখ দেখতেও রাযি হতো না স্বয়ং কন্যার পিতা। কুরআন মজীদে এ নারী অপমানের চিত্র অংকন করা হয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী************************************************************)

সে সমাজের কাউকে তার কন্যা-সন্তান জন্ম হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হলে সারাদিন তার মুখ কালো হয়ে থাকত। সে ক্ষুব্ধ হতো এবং মনে মনে দুঃখ অনুভব করত। এ সুসংবাদেরলজ্জার দরুন সে অন্য লোকদের থেকে মুখ লুকিয়ে চলত। সে চিন্তা করত, অপমান সহ্য করে মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখবে, না তাকে মাটির তলায় প্রোথিত করে ফেলবে! –কতই না খারাপ সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করত!

ইসলাম মানবতা-বিরোধী ভাবধারার প্রতিবাদ করেছে। এ কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং কন্যা সন্তানকে পুরুষ ছেলের মতো জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। আর কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা হলে কিয়ামতের দিন যে তার পিতাকে আল্লাহর দরবারে কঠোরভাবে জবাবাদিহি করতে হবে, তা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************)

জীবন্ত প্রোথিত কন্যা-সন্তানকে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে –কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল?

এ কারণে নবী করীম (স) বলেছেনঃ যে লোকের কোনো কন্যা-সন্তান রয়েছে এবং সে তাকে জীবন্ত প্রোথিত করেনি এবং তাকে ঘৃণার চোখেও দেখেনি, তার ওপর নিজের পুত্র সন্তানকে অগ্রাধিকারও দেয়নি, তাকে আল্লাহ তা’আলা বেহেশত দান করবেন। (আবূ দাউদ, কিতাবুল আদব)

আরব জাহিলিয়াতের সমাজে নারী ও কন্যাকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চরমভাবে পঙ্গু করে রাখা হতো। তাকে পিতার মীরাস লাভের অধিকার মনে করা হতো না। বরং সেখানে মীরাস দেয়া হতো সেসব পুত্র-সন্তানকে, যারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর সঙ্গে মুকাবিলা করতে পারত। নারীদের মীরাসের অংশ দেয়া তো দূরের কথা, স্বয়ং এই নারীদেরও মীরাসের মাল মনে করা হতো এবং পুরুষরা তাদের নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিত। কন্যা-সন্তানের প্রতি চরম অমানবিক অবজ্ঞা এই বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও সভ্যতার চরম উন্নতির যুগেও যত্রতত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আধুনিক চীনের দুজন নারীকে আত্মহত্যঅ করতে হয়েছে শুধু এ অপরাধে যে, তারা কেবল কন্যা সন্তানই প্রসব করেছে, স্বামীকে কোনো পুত্র সন্তান উপহার দিতে পারেনি।

কিন্তু ইসলাম মানবতার পক্ষে এই চরম অবমাননাকর রীতি চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। কুরআনে নারীকে –কন্যাকেও পুরুষদের মতোই মীরাসের অংশীদার করে দেয়া হয়েছে। যদিও পুরুষদের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কম বলে পুরুষদের অপেক্ষা তাদের অংশ অর্ধেক রাখা হয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***************************************)

আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে তোমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক বিধান দিচ্ছেন। তিনি আদেশ করেছেন, একজন পুরুষ দুজন মেয়েলোকের সমান অংশ পাবে। কেবল মেয়ে-সন্তান দুজন কিংবা ততোধিক হলে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি মাত্র একজন কন্যা হয়, তাহলে সে মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে।

এ আয়াতে মেয়েদেরকেও পুরুষ ছেলেদের সমান সম্পত্তির অংশীদার বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সাধারণ লোক এ আইনকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা বলল, এদের মধ্যে কেউ তো এমন নয় যে, যুদ্ধে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতে পারে। এ মনোভাবের প্রতিবাদ করে কুরআন উপরিউ্কত আয়াতে কন্যা-সন্তানকে বিয়ের পূর্বেই এমন পরিমাণ মীরাস লাভের অধিকার দেয়া হয়েছে, যা তার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে।

পিতা জীবিত থাকলে ছেলের বালেগ হওয়া পর্যন্ত তার লালন-পালন করা যেমন পিতার কর্তব্য, মেয়ের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত তার জন্যেও পিতার অনুরূপ কর্তব্য রয়েছে। উপরন্তু ছেলে বড় হলে পিতা তাকে কামাই-রোজগার করার জন্যে বাধ্য করতে পারে; কিন্তু কন্যা সন্তানকে তা পারে না।

স্ত্রী-রূপে নারী

তদানীন্তন আরব সমাজের স্ত্রী হিসেবেও নারীদের চরম অমর্যাদা ও অপমান ভোগ করতে হত। তাদেরকে স্বামীর ঘরে যথাযোগ্য মর্যাদা বা অধিকার দেয়া হতো না। তাদেরকে হীন, নগণ্য ও দয়ার পাত্রী মনে করা হতো। নিতান্ত দাসী-বাঁদীর মতো ব্যবহার করা হতো তাদের সাথে।

ইসলাম স্ত্রী হিসেবে নারীদের এ অপমান দূর করে তাদেরকে সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। প্রথমত ঘোষণা করা হয়েছে, তারা নারী বলে মৌল অধিকারের দিক দিয়ে পুরুষদের তুলনায় কিছুমাত্র কম নয়। বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************************************)

স্ত্রীদেরও তেমনি অধিকার রয়েছে যেমন স্বামীদের রয়েছে তাদের ওপর এবং তা যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।

অন্য কথায়, স্ত্রী ও স্বামী উভয়েই আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ সমান। তাদের অধিকারও অভিন্ন এবং দুয়ের মাঝে এক্ষেত্রে কোনোই পার্থক্য করা যেতে পারে না। মৌল অধিকারের দিক দিয়ে কেউ কম নয়, কেউ বেশী নয়।

আরব সমাজে স্ত্রীদের ওপর নানাভাবে অকথ্য জুলুম ও পীড়ন চালান হতো। কোনো কোনো স্বামী তাদের মাঝখানে ঝুলিয়ে রাখত, না পেত তারা স্ত্রীত্বের পূর্ণ অধিকার, না পেত তাদের কাছ থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি। স্বামী একদিকে যেমন তাদের পুরাপুরি স্ত্রীর মর্যাদা ও অধিকার দিত না, অন্যদিকে তেমনি তালাক দিয়ে মুক্ত করে অন্য স্বামী গ্রহণের সুযোগও দিত না। বরং এভাবে আটকে রেখে তাদের নিকট থেকে নিজেদের দেয়া ধন-সম্পদ ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালাত এবং সেজন্যে নানা কৌশল অবলম্বন করত। কুরআন মজীদ এর প্রতিবাদ করেছে তীব্র ভাষায়। বলেছেঃ

(আরবী**************************************************)

তোমরা –হে স্বামীরা –তাদের (স্ত্রীদের) বেঁধে আটকে রাখবৈ না এ উদ্দেশ্যে যে, তাদের নিকট থেকে তোমাদের দেয়া ধন-সম্পদের কিছু অংশ কেড়ে নেবে।

সেকালে স্ত্রীদের ঘরের অন্যান্য মাল-সামানের মতোই অস্থাবর সম্পত্তি বলে মনে করা হতো এবং স্বামী মরে গেলে তার স্ত্রীকেও পরিত্যক্ত মাল-সম্পত্তির ন্যায় উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হতো।এ প্রথা প্রথমকালে মুসলমানদের মধ্যেও চালু ছিল মনে হয়। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে ঈমানদার লোকদের সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************)

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা মেয়েদেরকে অন্যায় জবরদস্তি করে নিজেদের মীরাসের সম্পদ বানিয়ে নিও না-তা তোমাদের পক্ষে আদৌ হালাল হবে না।

নবী করীম (স) বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বলেছিলেনঃ

(আরবী*****************************************************)

তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করে চলবে। তোমাদের মনে রাখতে হবে যে তোমা তাদের গ্রহণ করেছ আল্লাহর নামে এবং এভাবেই তাদের হালাল মনে করেই তোমরা তাদের উপভোগ করেছ।

এই পর্যায়ে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর একটি কথা উল্লেখ্য। তিনি বলেছিলেনঃ

(আরবী*****************************************************)

আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা মেয়েলোকদের কিছুই মনে করতাম না –কোনোই গুরুত্ব দিতাম না। পরে যখন আল্লাহ তা’আলা তাদের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট অকাট্য বিধান নাযিল করলেন এবং তাদের জন্যে মীরাসের অংশ নির্দিষ্ট করে দিলেন, তখন আমাদের মনোভাব ও আচরণের আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো।

মা-রূপে নারী

ইসলামে মা হিসেবে নারীকে যে উঁচু মর্যাদা ও সম্মান দেয়া হয়েছে, দুনিয়ার অপর কোনো সম্মানের সাথেই তার তুলনা হতে পারে না। নবী করীম (স) ঘোষণা করেছেনঃ

(আরবী***********************************************)

বেহেশত মা’দের পায়ের তলে অবস্থিত।

অর্থাৎ মাকে যথাযোগ্য সম্মান দিলে, তার উপযুক্ত খেদমত করলে এবং তার হক আদায় করলে সন্তান বেহেশত লাভ করতে পারে। অন্য কথায় সন্তানের বেহেশত লাভ মা’য়ের খেদমতের ওপর নির্ভরশীল। মা’য়ের খেদমত না করলে কিংবা মা’র প্রতি কোনোরূপ খারাপ ব্যবহার করলে, মা’কে কষ্ট ও দুঃখ দিলে সন্তান যত ইবাদত বন্দেগী আর নেকের কাজই করুক না কেন, তার পক্ষে বেহেশত লাভ করা সম্ভবপর হবে না।

হযরত আনাস (রা) বর্ণনা করেছেনঃ নবী করীম (স)-এর সময়ে আল-কামা নামক এক যুবক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। তার রোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত সেবা-শুশ্রূষাকারীরা তাকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ কালেমা পাঠ করার উপদেশ দেয়। কিন্তু শথ চেষ্টা করেও সে তা উচ্চারণ করতে পারে না। রাসূলে করীম (স) এই আশ্চর্য ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে জিজ্ঞেস করলেনঃ তার মা কি জীবিত আছে? বলা হলো, তার পিতা মারা গেছে, মা জীবিত আছে, অবশ্য সে খুবই বয়োবৃদ্ধা। তখন তাকে রাসূল (স)-এর দরবারে উপস্থিত করা হলো। তার নিকট তার ছেলের এ অবস্থার উল্লেখ করে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। সে বলল, আল-কামা বড় নামাযী, বড় রোযাদার ব্যক্তি এবং বড়ই দানশীল। সে যে কত দান করে, তার পরিমাণ কারো জানা নেই। রাসূলে করীম (স) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সাথে তার সম্পর্ক কিরূপ?’ উত্তরে বৃদ্ধা মা বলল, ‘আমি ওর প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট’। তার কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলল, ‘সে আমার তুলনায় তার স্ত্রীর মত যোগাত বেশী, আমার ওপর তাকেই বেশী অগ্রাধিকার দিত এবং তার কথামতোই কাজ করত’। তখন রাসূলে করীম (স) বললেন, ‘ঠিক এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা তার মুখে কালেমার উচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছেন’। অতঃপর রাসূলে করীম (স) হযরত বিলালকে আগুনের একটা কুণ্ডলি জ্বালাতে বললেন এবং তাতে আল-কামাকে নিক্ষেপ করার আদেশ করলেন।

আল-কামার মা একথা শুনে বলল, ‘আমি মা হয়ে তা কেমন করে হতে দিতে পারি! সে যে আমার সন্তান, আমার কলিজার টুকরা’।

রাসূলে করীম (স) বললেন, “তুমি যদি চাও যে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন তাহলে তুমি তার প্রতি খুশী হয়ে যাও। অন্যথায় আল্লাহর শপথ, তার নামায, রোযা ও দান-খয়রাতের কোনো মূল্যই হবে না আল্লাহর দরবারে।

অতঃপর আল-কামার জননী বললো, “আমি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে মাফ করে দিলাম”। এরপর খবর নিয়ে জানা গেল যে, আল-কামা অতি সহজেই কালেমা উচ্চারণ করতে সমর্থ হয়েছে।

এ একটি ঘটনা এবং নির্ভুল বর্ণনাভিত্তিক বলে এর সত্যতায় কোনোই সন্দেহ নেই। যদিও বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিতে এর সত্যতা স্বীকৃত নয় এবং এ সব ঘটনার কোনো মূল্যও নেই। কিন্তু ইসলাম যে নৈতিক ও আদর্শিক বিধান উপস্থাপিত করেছে, তাতে এ ধরনের ঘটনা মানুষের চোখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

সমাজ-সংস্থার সদসা হিসেবে নারী

নারী কেবল কন্যা, বধু এবং মা’ই নয়, ইসলামের সমাজ-সংস্থায় সে সমাজ মর্যাদা সম্পন্না একজন সদস্যাও বটে। ইসলামে পুরুষের মর্যাদা যেমন স্বীকৃত, তেমনি তার ওপর অনেক গুরু দায়িত্বও অর্পিত। অনুরূপভাবে নারীকে সমাজ ক্ষেত্রে যেমন মর্যাদা দেয়া হয়েছে, তেমনি তারও রয়েছে অনেক মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। দ্বীনী আমল-আখলাকের নিয়ম-কানুন পালন করা যেমন পুরুষের কর্তব্য, তেমনি নারীরও এবং কর্তব্য পালনের ফল লাভের অধিকারও উভয়ের সম্পূর্ণ সমান। ইসলামে এ ব্যাপারে নারী-পুরুষের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।

কুরআন মজীদের ঘোষণা হলঃ

(আরবী*********************************************************)

পুরুষ বা স্ত্রী –যে লোকই নেক আমল করবে ঈমানদার হয়ে, সে-ই বেহেশতে দাখিল হতে পারবে এবং এদের কারো উপর একবিন্দু জুলুম করা হবে না।

বস্তুত ইসলামী শরীয়ত নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান সামাজিক মর্যাদা এবং অধিকার দিয়েছে। অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, জ্ঞান অর্জন ও চর্চা –প্রভৃতি মানসিক, জ্ঞানগত ও বুদ্ধিগত, শারীরিক ও দ্বীনী কল্যাণ সম্পর্কিত যাবতীয় ক্ষেত্রেই উভয়ের মাঝে পূর্ণ সমতা স্থাপন করেছে। কোনো নারী যদি আশ্রয়হীন বা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে তাহলে সে তার জীবন-জীবিকার প্রয়োজন পূরণ ও স্বীয় সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার্থে যে-কোন হালাল উপায়ে কামাই-রোজগার করতে পারে। এজন্যে সব রকমের বিধিসম্মত উপায়ও সে অবলম্বন করতে পারে। কিন্তু তার এ দায়িত্ব খতম হয়ে যায় তখন, যখন তার এ দায়িত্ব পালনের জন্যে কোনো পুরুষ স্বামী হিসেবে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তখন এ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোটা পারিবারিক দায়িত্ব ভাগ হয়ে যাবে। একটি গোটা পরিবারে একদিকে যেমন আয় করার ব্যবস্থা থাকতে হবে, তেমনি অপরদিকে সে আয়ের সুষ্ঠু বণ্টন ও বিলি-ব্যবস্থার প্রয়োজন। পরিবারে কর্মবণ্টন এভাবে হতে পারে যে, পুরুষ আয় করবে, স্ত্রী তা ব্যয় করে ঘরের ব্যবস্থাপনা চালাবে। এর ফলে উভয়ের সামাজিক মর্যাদা সমান ও অভিন্ন থাকে।

বস্তুত নারী জীবনের আবাহন, পুলকের সঙ্গীত, পবিত্র স্নেহ-মমতার প্রতীক, প্রতিমূর্তি, বিশ্ব নিখিলের প্রাণ-সম্পদ। আল্লামা ইকবাল নারীর প্রশংসায় বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************)

বিশ্ব নিখিলের ছবিতে যা কিছু চাকচিক্য তা সবই কেবলমাত্র নারীর কারণেই।

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বন্ধুত্ব, প্রেম-প্রীতি, সহানুভূতি আত্মদানই হচ্ছে নারীর ভূষণ-বৈশিষ্ট্য। অনন্তকাল পর্যন্ত নারীর এ ভূষণ স্থায়ী থাকবে। সে মৃত মনে নব জীবনের স্পন্দন জাগিয়েছে সতত –সর্বত্র। বিপদ-কাতর ব্যক্তিকে সে দিয়েছে জীবনের মন্ত্র, ভীরু কাপুরুষের মধ্যে জাগিয়েছে সাহস, বিক্রম ও বীরত্ব। বিপদের প্রচণ্ড ঞঞ্ঝা-বাত্যায় বৃক্ষের কচি শাখার মতোই সে রয়েছে অটুট স্থায়ী সামান্য আনন্দেই তার আননে খেলেছে হাসির উদ্বিতল লহরী, দুঃখ ভারাক্রান্ত মানসে জ্বালিয়েছে আশার আলো।

বিশ্বের বড় বড় ব্যক্তি, তারা সবাই নারীর গর্ভে অস্তিত্ব লাভ করেছে, নারী কর্তৃক প্রসবিত এবং নারীর ক্রোড়েই লালিত-পালিত হয়েছে। মানব জাতির মর্যাদা সে বাড়িয়েছে। পুরুষের মনোরাজ্যে সে স্থাপন করেছে স্বীয় সিংহাসন, বিস্তার করেছে রাজত্ব –পুরুষের সমগ্র জীবনব্যাপী। গোটা মানবতাই নারীর কাছে ঋণী। তাই নারীর গুরুত্ব ও মর্যাদা কেউ অস্বীকার করতে পারে না, পারেনি, পারবেও না কোনো দিন। জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ মূল্যমান নারীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। পবিত্রতা, সতীত্ব ও প্রেম-ভালোবাসা প্রভৃতি শব্দ তারই জন্যে হয়েছে রচিত। এ সব রক্ষা করার মাধ্যমে কন্যা, বধূ ও জননীর ভূমিকায় সার্থকভাবে দায়িত্ব পালন করবে সে, ইসলামী আদর্শের তাই একমাত্র লক্ষ্য।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি