তৃতীয় অধ্যায়
পরিবার সংরক্ষণ
পূর্ববর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করেছি –ইসলামের পরিবার গঠন সম্পর্কে। দ্বিতীয় পর্বে আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে পরিবার সংরক্ষণ। বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার গঠন যত না গুরুত্বপূর্ণ, পরিবার সংরক্ষণ তার চাইতে শতগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার পবিত্রতা, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্থায়িত্ব রক্ষার জন্যে পরিবারের লোকদের ব্যক্তিগতভাবে কতক নিয়ম-নীতি পালন করে চলতে হবে। আর কতগুলো নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে সমষ্টিগতভাবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের অবশ্য পালনীয় নিয়ম-নীতি প্রথম পেশ করা হচ্ছে।

স্বামী-স্ত্রীর লজ্জাশীলতা।

পরিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও সুস্থতা রক্ষার জন্যে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বপ্রথম পালনীয় নিয়ম হচ্ছে প্রত্যেকের সহজতা লজ্জা-শরমকে যথাযথভাবে জাগ্রত রাখা।

স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই পবিত্র লজ্জা-শরমের ভূষণে ভূষিত হওয়া আবশ্যক। কেননা স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত জীবনধারার গতি অব্যাহত রাখা –উভয়কে উভয়ের জন্যে সুরক্ষিত ও পবিত্র রাখবার জন্যে এ জিনিস একান্তই অপরিহার্য। স্বামীর যদি লজ্জা-শরম থাকে, তবে তার নৈতিক চরিত্রের দুর্গ-প্রাকার চিরদিন দুর্ভেদ্যই থাকতে পারে, কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না ভেদ করে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে কলুষ ঢুকিয়ে দেয়া, ভাঙ্গন ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করা। স্ত্রীর বেলায়ও একথাই সত্য।

পারিবারিক জীবনের বন্ধনকে অটুট রাখার জন্যে এ লজ্জা-শরম বস্তুতই মহামূল্য সম্পদ। এসম্পদ যথাযথভাবে বর্তমান থাকলে উভয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ স্থায়ীভাবে বর্তমান থাকবে। স্বামী-স্ত্রীর অতলান্ত প্রেম-মাধুর্যে দেখা দেবে না কোনো ছিদ্র-ফাটল। একজন অপরজনের প্রতি বিরাগভাজন হবে না কখনো। এ কারণেই ইসলামে লজ্জা-শরমের গুরুত্ব অপরিসীম। নবী করীম (ষ) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

নিশ্চিতই সত্য, লজ্জা-শরম ঈমানেরই বিষয়।

ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিজে লজ্জা-শরম এমন একটি বিশেষ গুণ, যা মানুষকে সকল প্রকার গর্হিত ও মানবতা-বিরোধী কাজ পরিহার করতে এবং তা থেকে পুরো মাত্রায় বিরত থাকতে উদ্ধুদ্ধ করে। এজন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)))

লজ্জা-শরম বিপুল কল্যাণই নিয়ে আসে, তা থেকে কোনো অকল্যাণের আশংকা নেই।

মানুষের কাজে-কর্মে, চলায়-বলায়, জীবনের সব স্তরে ও সব ব্যাপারেই এ হচ্ছে এক অতি প্রয়োজনীয় গুণ। এ গুণই হচ্ছে মানুষে ও পশুতে পার্থক্যের ভিত্তি। এ গুণ না থাকলে মানুষে পশুতে কোন পার্থক্য থাকে না, কার্যত মানুষ পশুর স্তরে নেমে আসে। পশুর মতই নির্লজ্জ হয়ে কাজ করতে শুরু করে। রাসূলে করীম (স) এ লজ্জাহীনতার মারাত্মক পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

লজ্জাই যদি তোমার না থাকল, তাহলে তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার।

অপর এক হাদীসে এ কথাটির গুরুত্ব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************************)))

লজ্জা-শরম নিতান্তই ঈমানের ব্যাপার। আর ঈমান বেহেশতে যাওয়ার চাবিকাঠি। পক্ষান্তরে লজ্জাহীনতা হচ্ছে জুলুম, আর জুলুমের কারণেই একজনকে দোযখে যেতে হয়।

মোটকথা, পারিবারিক জীবনে এ অত্যন্ত জরুরী গুণ। এ গুণ না থাকলে এ ছিদ্রপথ দিয়ে চরিত্র-বিরোধী বহু রকমের অসচ্চরিত্রতা ও বদ-অভ্যাস প্রবেশ করে দাম্পত্য জীবনের কিশতীর যে কোন সময়ে ভরাডুবি ঘটিয়ে দিতে পারে সংসারের মহাসমুদ্রে।

দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ

স্বাভাবিক লজ্জা-শরমের অনিবার্য ফল হচ্ছে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ। চোখের দৃষ্টি এমন একটি হাতিয়ার, যার দ্বারা যেমন ভালকাজও করা যায়, তেমনি নিজের মধ্যে জমানো যায় পাপের পুঞ্জীভূথ বিষবাষ্প। দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীক্ষ্ণ-শানিত তীর যা নারী বা পুরুষের অন্তর ভেদ করতে পারে। প্রেম-ভালবাসা তো এক অদৃশ্য জিনিস, যা কখনো চোখে ধরা পড়ে না, বরং চোখের দৃষ্টিতে ভর করে অপররের মর্মে গিয়ে পৌঁছায়। বস্তুত দৃষ্টি হচ্ছে লালসার বহ্নির দখিন হাওয়া। মানুষের মনে দৃষ্টি যেমন লালসাগ্নি উৎক্ষিপ্ত করে, তেমনি তার ইন্ধন যোগায়। দৃষ্টি বিনিময় এক অলিখিত লিপিকার আদান-প্রদান, যাতে লোকদের অগোচরেই অনেক প্রতিশ্রুতি –অনেক মর্মকথা পরস্পরের মনের পৃষ্ঠায় জ্বলন্ত আখরে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

ইসলামের লক্ষ্য যেহেতু মানব জীবনের সার্বিক পবিত্র ও সর্বাঙ্গীন উন্নত চরিত্র, সেজন্যে দৃষ্টির এ ছিদ্রপথকেও সে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে, দৃষ্টিকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্যে দিয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশ। কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেঃ

(আরবী******************************************************************)

মু’মিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রিত করে রাখে এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে, এ নীতি তাদের জন্যে অতিশয় পবিত্রতাময়। আর তারা যা কিছু করে, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় অবহিত।

কেবল পুরুষদেরকেই নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম মহিলাদের সম্পর্কেও বলা হয়েছেঃ

(আরবী*******************************************************************)

মু’মিন মহিলাদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করে।

দুটি আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে –দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ এবং লজ্জাস্থানের পবিত্রতা সংরক্ষণ, কিন্তু এ একই কথা পুরুষদের জন্যে আলাদাভাবে এবং মহিলাদের জন্যে তার পরে স্বতন্ত্র একটি আয়াতে বলা হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে এই যে, এ কাজটি স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই সমানভাবে জরুরী। এ আয়াতদ্বয়ে যেমন রয়েছে আল্লাহর নৈতিক উপদেশ, তেমনি রয়েছে ভীতি প্রদর্শন। উপদেশ হচ্ছে এই যে, ঈমানদার পুরুষই হোক কিংবা স্ত্রীই, তাদের কর্তব্যই হচ্ছে আল্লাহর হুকুম পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা। কাজেই আল্লাহর বিধান মুতাবিক যার প্রতি চোখ তুলে তাকানো নিষিদ্ধ, তার প্রতি যেন কখনো তাকাবার সাহস না করে। আর দ্বিতীয় কথা, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা ওতপ্রোতবাবে জড়িত। দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ হলে অবশ্যই লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা পাবে কিন্তু দৃষ্টিই যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পরপুরুষ কিংবা পরস্ত্রী দর্শনের ফল হৃদয় মনের গভীর প্রশস্তি বিঘ্নিত ও চূর্ণ হবে, অন্তরে লালসার উত্তাল উন্মাদনার সৃষ্টি হয়ে লজ্জাস্থানের পবিত্রতাকে পর্যন্ত ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। কাজেই যেখানে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত নয়, দেখাশোনার ব্যাপারে যেখানে পর, আপন মুহাররম-গায়র মুহাররমের তারতম্য নেই, বাছ-বিচার নেই, সেখানে লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষিত হচ্ছে তা কিছুতেই বলা যায় না। ঠিক এজন্যই ইসলামের দৃষ্টিকে –পরিভাষায় যাকে (আরবী*************) ‘প্রেমের পয়গাম বাহক’ বলা হয়েছে, -নিয়ন্ত্রিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপদেশের ছলে বলা হয়েছেঃ (আরবী*******************) এ-নীতি তাদের জন্যে খুবই পবিত্রতা বিধায়ক অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত রাখলে চরিত্রকে পবিত্র রাখা সম্ভব হবে। আর শেষ ভাগে ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ

মু’মিন হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী-পুরুষ যদি এ হুকুম মেনে চলায় রাজি না হয়, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিশ্চয়ই এর শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি তাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে পুরোমাত্রায় অবহিত রয়েছেন।

এ ভীতি যে কেবল পরকালের জন্যেই, এমন কথা নয়। এ দুনিয়ায়ও দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ ও পবিত্রতা রক্ষা না করা হলে তার অত্যন্ত খারাপ পরিণতি দেখা দিতে পারে। আর তা হচ্ছে স্বামীর দিল অন্য মেয়েলোকের দিকে আকৃষ্ট হওয়া এবং স্ত্রীর মন সমর্পিত হওয়া অন্য কোনো পুরুষের কাছে। আর এরই পরিণতি হচ্ছে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনে আশু বিপর্যয় ও ভাঙ্গন। দৃষ্টিশক্তির বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাও মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

তিনি দৃষ্টিসমূহের বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যক্রম সম্পর্কে এবং তারই কারণে মনের পর্দায় যে কামনা-বাসনা গোপনে ও অজ্ঞাতসারে জাগ্রত হয় তা ভালোভাবেই জানেন।

এ আয়াত খণ্ডের ব্যাখ্যায় ইমাম বায়যাহবী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

বিশ্বাসঘাতক দৃষ্টি –গায়র-মুহাররম মেয়েলোকের প্রতি বারবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মতোই, তার প্রতি চুরি করে তাকানো বা চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করা অথবা দৃষ্টির কোনো বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণ।

দৃষ্টি বিনিময়ের এ বিপর্যয় সম্পর্কে ইমাম গাযালী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

অতঃপর তোমার কর্তব্য হচ্ছে দুটি নিয়ন্ত্রণ করা, গায়র-মুহাররমকে দেখা থেকে চোখকে বাঁচানো –আল্লাহ তোমাকে ও আমাদের এ তওফীক দান করুন –কেননা এ হচ্ছে সকল বিপদ-বিপর্যয়ের মূলীভূত কারণ।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

চোখ নিয়ন্ত্রণ ও নীচু করে রাখায় চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়।

দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের জন্যে আলাদা আলাদাভাবে পুরুষ ও স্ত্রী উভয়কেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার কারণ এই যে, যৌন উত্তেজনার ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী ও পুরুষের প্রায় একই অবস্থা। বরং স্ত্রীলোকের দৃষ্টি পুরুষদের মনে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করে থাকে। প্রেমের আবেগ-উচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের প্রতিকৃতি অত্যন্ত নাজুক ও ঠুনকো। কারো সাথে চোখ বিনিময় হলে স্ত্রীলোক সর্বাগ্রে কাতর এবং কাবু হয়ে পড়ে, যদিও তাদের মুখ ফোটে না। এ তার স্বাভাবিক দুর্বলতা –বৈশিষ্ট্যও বলা যেতে পারে একে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এর শত শত প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। এ কারণে স্ত্রীলোকদের দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এমন হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, কোনো সুশ্রী স্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন যুবকের প্রতি কোনো মেয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল, আর অমনি তার সর্বাঙ্গে প্রেমের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল, সৃষ্টি হলো প্রলয়ঙ্কর ঝড়। ফলে তার বহিরাঙ্গ কলঙ্কমুক্ত থাকতে পারলেও তার অন্তর্লোক পঙ্কিল হয়ে গেল। স্বামীর হৃদয় থেকে তার মন পাকা ফলের বৃস্তচ্যুতির মতো একেবারেই ছিন্ন হয়ে গলে, তার প্রতি তার মন হলো বিমুখ, বিদ্রোহী। পরিণামে দাম্পত্য জীবনে ফাটল দেখা দিলো, আর পারিবারিক জীবন হলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন।

কখনো এমনও হতে পারে যে, স্ত্রীলোক হয়ত বা আত্মরক্সা করতে পারল, কিন্তু তার অসতর্কতার কারণে কোনো পুরুষের মনে প্রেমের আবেগ ও উচ্ছ্বাস উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। তখন সে পুরুষ হয়ে যায় অনমনীয় ক্ষমাহীন। সে নারীকে বশ করবার জন্যে যত উপায় সম্ভব বা অবলম্বন করতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। শেষ পর্যন্ত তার শিকারের জাল হতে নিজেকে রক্ষা করা সেই নারীর পক্ষে হয়ত সম্ভবই হয় না। এর ফলেও পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

দৃষ্টির এ অশুভ পরিণামের দিকে লক্ষ্য করেই কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াত নাযিল করা হয়েছে, আর এরই ব্যাখ্যা করে রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেন অসংখ্য অমৃত বাণী। এখানে কয়েকটি জরুরী হাদীসের উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ

একটি হাদীসের একাংশঃ

(আরবী*********************************************************************) ]

চক্ষুদ্বয়ের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রী দর্শন। কর্ণদ্বয়ের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর রসাল কথা লালসা উৎকষ্ঠিত কর্ণে শ্রবণ করা। রসনার জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীর সাথে রসল কণ্ঠে কথা বলা, হস্তের জ্বেনা হচ্ছে পরস্ত্রীকে স্পর্শ করা –হাত দিয়ে ধরা এবং পায়ের জ্বেনা হচ্ছে যৌন মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্ত্রীর কাছে গমন। প্রথমে মন লালসাক্ত হয়, কামনাতুর হয়, যৌন অঙ্গ তা চরিতার্থ করে কিংবা ব্যর্থ করে দিয়ে তার প্রতিবাদ করে। (মুসলিম)

আল্লামা খাত্তাবী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

দেখা ও কথা বলাকে জ্বেনা বলার কারণ এই যে, দুটো হচ্ছে প্রকৃত জ্বেনার ভূমিকা –জ্বেনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর। কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্বোধক আর জিহবা হচ্ছে বাণী বাহক, যৌন অঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার –সত্য প্রমাণকারী।

হাফেজ আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেনঃ

দৃষ্টিই হয় যৌন লালসা উদ্বোধক, পয়গাম বাহক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌন অঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদঙ্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই হচ্ছে তার সব কিছুর মূল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়, আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা-বিভ্রমে নিমজ্জিত করে আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে, বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোনো বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোনো উপায় থাকে না। (আরবী**********************************)

অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি চালনার কুফল সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

অনিয়ন্ত্রিত দৃষ্টি ইবলিসের বিষাক্ত বাণ বিশেষ।

আল্লামা ইবনে কাসীর এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

দৃষ্টি হচ্ছে এমন একটি তীর, যা মানুষের হৃদয়ে বিষের উদ্রেক করে।

দৃষ্টি চালনা সম্পর্কে রাসূলের নির্দেশ

রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

তোমাদের দৃষ্টিকে নীচু করো, নিয়ন্ত্রিত করো এবং তোমাদের লজ্জাস্থানের সংরক্সণ করো।

এ দুটো যেমন আলাদা আলাদা নির্দেশ, তেমনি প্রথমটির অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে শেষেরটি অর্থাৎ দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হলেই লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ সম্ভব। অন্যথায় তাকে চরম নৈতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হতে হবে নিঃসন্দেহে।

নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

হে আলী, একবার কোনো পরস্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি পড়লে পুনরায় তার প্রতি চোখ তুলে তাকাবে না। কেননা তোমার জন্যে প্রথম দৃষ্টিই ক্ষমার যোগ্য, দ্বিতীয়বার দেখা নয়।

এর কারণ সুস্পষ্ট। আকস্মিকভাবে কারো প্রতি চোখ পড়ে যাওয়া আর ইচ্ছাক্রমে কারো প্রতি তাকানো সমান কথা নয়। প্রথমবার যে চোখ কারো ওপর পড়ে গেছে, তার মূলে ব্যক্তির ইচ্ছার বিশেষ কোনো যোগ থাকে না; কিন্তু পুনর্বার তাকে দেখা ইচ্ছাক্রমেই হওয়া সম্ভব। এ জন্যেই প্রথমবারের দেখার কোনো দোষ হবে না; কিন্তু দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ তুলে তাকানো ক্ষমার অযোগ্য।

বিশেষত এজন্যে যে, দ্বিতীয়বারের দৃষ্টির পেছনে মনের কলুষতা ও লালসা পংকিল উত্তেজনা থাকাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের দৃষ্টি দিয়েই পরস্ত্রীকে দেখা স্পষ্ট হারাম।

তার মানে কখনো এ নয় যে, পরস্ত্রীকে একবার বুঝি দেখা জায়েয এবং এখানে তার অনুমতি দেয়া হচ্ছে। আসলে পরস্ত্রীকে দেখা আদপেই জায়েয নয়। এজন্যেই কুরআন ও হাদীসে দৃষ্টি নত করে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ ‘পরস্ত্রীর প্রতি আকস্মিক দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে আপনার কি হুকুম’? তিনি বললেনঃ

(আরবী************) –তোমার দৃষ্টি সরিয়ে নাও।

অপর এক বর্ণনায় কথাটি এরূপঃ

(আরবী************************************) –তোমরা চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও।

দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়া কয়েকভাবে হতে পারে। আসলে কথা হচ্ছে পরস্ত্রীকে দেখার পংকিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র রাখা। আকস্মিকভাবে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি কারো প্রতি দৃষ্টি পড়ে যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নীচু করা, অন্যদিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ঈমানদার ব্যক্তির কাজ।

(আরবী****************************************) –মেয়েলোকদের জন্যে ভালো কি?

প্রশ্ন শুনে সকলেই চুপ মেরে থাকলেন, কেউ কোনো জবাব দিতে পারলেন না। হযরত আলী এখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বাড়ি এসে ফাতিমা (রা) কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেনঃ

(আরবী*******************************************************)

ভিন পুরুষরা তাদের দেখবে না। (এটাই তাদের জন্যে ভালো ও কল্যাণকর)।

অপর বর্ণনায় ফাতিমা (রা) বলেনঃ

(আরবী****************************************************************)

বস্তুত ইসলামী সমাজ জীবনের পবিত্রতা রক্ষার্থে পুরুষদের পক্ষে যেমন ভিন মেয়েলোক দেখা হারাম, তেমনি হারাম মেয়েদের পক্ষেও ভিন পুরুষদের দেখা। কুরআন মজীদে এ সম্পর্কে যেমন পাশাপাশি দুটো আয়াতে রয়েছে –পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে –তেমনি হাদীসেও এ দুটো নিষেধবাণী একই সঙ্গে ও পাশাপাশি উদ্ধৃত রয়েছে। হযরত উম্মে সালমা বর্ণিত এক হাদীসের ভিত্তিতে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

পুরুষদের দেকা মেয়েদের জন্য হারাম, ঠিক যেমন হারাম পুরুষদের জন্য মেয়েদের দেখা।

এর কারণস্বরূপ তিনি লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

কেননা মেয়েলোক মানব জাতির অন্তর্ভূক্ত একটা প্রজাতি। এজন্য পুরুষের মতোই মেয়েদের জন্য তারই মতো অপর প্রজাতি পুরুষদের দেখা হারাম করা হয়েছে। এ কথার যথার্থতা বোঝা যায় এ দিক দিয়েও যে, গায়র-মুহাররমের প্রতি তাকানো হারাম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে যৌন বিপর্যয়ের ভয়। আর মেয়েদের ব্যাপারে এ ভয় অনেক বেশি। কেননা যৌন উত্তেজনা যেমন মেয়েদের বেশি, সে পরিমাণে বুদ্ধিমত্তা তাদের কম। আর পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কারণেই অধিক যৌন বিপর্যয় ঘটে থাকে।

নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে এ কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়। একদিন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মকতুম (রা) রাসূল করীম (স)-এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন রাসূলের কাছে বসে ছিলেন হযরত মায়মুনা ও উম্মে সালমা –দুই উম্মুল মু’মিনীন। রাসূলে করীম (স) ইবনে উম্মে মকতুমকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার পূর্বে দুই উম্মুল মু’মিনীনকে বললেনঃ (আরবী**************) অর্থাৎ তোমরা দুজন ইবনে উম্মে মকতুমের কারণে পর্দার আড়ালে চলে যাও।

তাঁরা দুজন বললেনঃ

(আরবী*********************************************)

হে রাসূল, ইবনে মকতুম কি অন্ধ নয়? ….তাহলে তো সে আমাদের দেখতেও পাবে না আর চিনতেও পারবে না, তাহলে পর্দার আড়ালে যাওয়ার কি প্রয়োজন?

তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*******************************************)

সে অন্ধ, কিন্তু তোমরা দুজনও কি অন্ধ নাকি? সে তোমাদের দেখতে না পেলেও তোমরা কি তাকে দেখতে পাবে না?

তার মানে একজন পুরুষের পক্ষে ভিন মেয়েলোকদের দেখা যে কারণে নিষিদ্ধ, মেয়েলোকদের পক্ষেও ভিন পুরুষদের দেখায় ঠিক সে কারণই বর্তমান। অতএব তাও সমানভাবে নিষিদ্ধ।

বস্তুত আল্লাহর বান্দা হিসেবে সঠিক জীবন যাপন করার জন্য দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ জরুরী। যার দৃষ্টি সুনিয়ন্ত্রিত নয় –ইতস্তত নারীর রূপ ও সৌন্দর্য দর্শনে যার চোখ অভ্যস্ত, আসক্ত, তার পক্ষে আল্লাহর বন্দেগী করা সম্ভব হয় না। নবী করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

যে মুসলিম ব্যক্তি প্রথমবারে নারীর সৌন্দর্য দর্শন করে ও সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, আল্লাহ তার জন্যে তারই ইবাদত-বন্দেগীর কাজে বিশেষ মাধুর্য সৃষ্টি করে দেবেন।

তাহলে যাদের দৃষ্টি নারী সৌন্দর্য দেখতে নিমগ্ন থাকে, তাদের পক্ষে ইবাদতে মাধুর্য লাভ সম্ভব হবে না। হাফেয ইবনে কাসীর একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম (স) বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন সমস্ত চোখ ক্রন্দনরত থাকবে; কিন্তু কিছু চোখ হবে সন্তুষ্ট; আনন্দোজ্জ্বল। আর তা হচ্ছে সে চোখ, যা আল্লাহর হারাম করে দেয়া জিনিসগুলো দেখা হতে দুনিয়ায় বিরত থাকবে, যা আল্লাহর পথে অতন্দ্র থাকার কষ্ট ভোগ করবে এবং যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বর্ষণ করবে। (আরবী*************************)

মোটকথা, গায়র মুহাররম স্ত্রী-পুরুষের পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময় কিংবা একজনের অপরজনকে দেখা, লালসার দৃষ্টি নিক্ষেপ ইসলামে নিষিদ্ধ। এতে করে পারিবারিক জীবনে শুধু যে পংকিলতার বিষবাষ্প জমে উঠে তাই নয়, তাতে আসতে পারে এক প্রলয়ংকর ভাঙন ও বিপর্যয়। মনে করা যেতে পারে, একজন পুরুষের দৃষ্টিতে কোনো পরস্ত্রী অতিশয় সুন্দরী ও লাস্যময়ী হয়ে দেখা দিল। পুরুষ তার প্রতি দৃষ্টি পথে ঢেলে দিল প্রাণ মাতানো মন ভুলানো প্রেম ও ভালবাসা। স্ত্রীলোকটি তাতে আত্মহারা হয়ে গেল, সেও ঠিক দৃষ্টির মাধ্যমেই আত্মসমর্পণ করল এই পর-পুরুষের কাছে। এখন ভাবুন, এর পরিণাম কি? এর ফলে পুরুষ কি তার ঘরের স্ত্রীর প্রতি বিরাগভাজন হবে না? হবে নাকি এই স্ত্রী লোকটি নিজের স্বামীর প্রতি অনাসক্ত, আনুগত্যহীনা। আর তাই যদি হয়, তাহলে উভয়ের পারিবারিক জীবনের গ্রন্থি প্রথমে কলংকিত ও বিষ-জর্জর এবং পরে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হতে বাধ্য। এর পরিণামই তো আমরা সমাজে দিনরাতই দেখতে পাচ্ছি।


পর্দার ব্যবস্থা
ঠিক এ কারণে ইসলামে পর্দার ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। ইসলামে পর্দা ব্যবস্থা পরিবারের পবিত্রতা ও স্থায়িত্ব বিধানের জন্যে একান্তই অপরিহার্য। শুধু তাই নয়, পর্দা ব্যবস্থা বাস্তবায়িত না হলে পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও শান্তিপূর্ণ স্থিতি ধারণাতীত।

ইসলামের এই পর্দা ব্যবস্থার দুটি পর্যায় রয়েছে। একটি হচ্ছে ঘরের আর অপরটি বাইরের। ঘরের অভ্যন্তরে থাকাকালীন পর্দা ব্যবস্থা পালন করা যেমন মুসলিম নারীর পক্ষে কর্তব্য তেমনি ঘরের বাইরের ক্ষেত্রে। এ উভয় ক্ষেত্রের জন্যে যে পর্দা ব্যবস্থা, তাই হচ্ছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পর্দা ব্যবস্থা। এখানে পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হচ্ছে।

প্রথম পর্যায়

পর্দা ব্যবস্থার প্রথম পর্যায় হচ্ছে ঘরোয়া জীবনে, ঘরের অভ্যন্তরে পালন ও অনুসরণের নিয়ম-বিধান। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত কর্মকেন্দ্র হচ্ছে তার ঘর। ঘরকেই আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করা বরং স্থায়ীভাবে ঘরের অভ্যন্তরে অবস্থান করাই হচ্ছে মুসলিম নারীর কর্তব্য। কুরআন মজীদে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে দুনিয়ার মুসলিম নারী সমাজকে –বলা হয়েছেঃ

(আরবী*********************************************************************************)

এবং তোমা তোমাদের ঘরের অভ্যন্তরে স্থায়ীভাবে বসবাস করো এবং পূর্বকালীন জাহিলিয়াতের মতো নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ও যৌনদীপ্ত দেহাঙ্গ দেখিয়ে বেড়িও না।

আয়াতটির দুটো অংশ। প্রথম অংশ পর্দা ব্যবস্থার প্রথম পর্যায় সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় অংশ তার দ্বিতীয় পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।

আয়াতটির প্রথমাংশে বলা হয়েছে যে, নারীর আসল স্থান হচ্ছে ঘর; অতএব ঘরে অবস্থান করাই তার কর্তব্য। আয়াদের শব্দ প্রয়োগ পদ্ধতি প্রমান করছে যে, প্রত্যেক নারীর জন্যে একখানা ঘর থাকা উচিত। এমন একখানা ঘর থাকা উচিত, যেখানে তার বসবাসের স্থান নির্দিষ্ট ও সর্বজন পরিচিত। দ্বিতীয়ত, তার এ ঘরই হবে তার অবস্থানের জায়গা ও কর্মকেন্দ্র। নারী-জীবনের যা কিছু করণীয়, তা প্রধানত এ ঘরকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হবে এবং যে সব কাজ সে নিজের ঘরে বসে সম্পন্ন করতে পারে, তাই হচ্ছে তার পক্ষে শোভনীয় কর্মসূচী। অন্য কথায়, প্রধানত তার বসবাসের ঘরকে কেন্দ্র করেই রচিত হবে তার জন্যে কর্মসূচী।

আল্লামা ইবনে কাসীর এ আয়াতাংশের তাফসীরে লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

তোমাদের ঘরকে তোমরা আঁকড়ে থাকো এবং বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে কখনো বের হবে না।

আল্লামা আবূ বাকর আল-জাসসাস এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

এ আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করছে যে, মেয়েরা ঘরকে আঁকড়ে থাকার জন্যে নির্দিষ্ট এবং বাইরে বের হওয়া থেকে নিষেধকৃত।

আল্লামা ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

ঘরেই বসবাস করো, বাইরে দৌড়াদৌড়ি করো না এবং ঘর ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে যেও না।

আল্লামা শওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

এ আয়াতাংশের অর্থ হচ্ছে, এতে মেয়েদেরকে তাদের নিজেদের ঘরে ধীরস্থীরভাবে বসবাসের আদেশ করা হয়েছে।

আল্লামা আলুসী এ আয়াতাংশের তরজমা লিখেছেন এ ভাষায়ঃ

(আরবী*******************************************************************************)

তোমরা তোমাদের মন তথা নিজেদের সত্তাকে ঘরের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত করে রাখ।

আল্লামা আলুসী আয়াতাংশের বহু প্রকারের পাঠ-পদ্ধতির উল্লেখ করার পর এর সামগ্রিক তাৎপর্য লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী***************************************************************************************)

সকল প্রকার পাঠ-রীতিতেই এর মানে হচ্ছে এই যে, আয়াতে মেয়েদেরকে ঘরকে আঁকড়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর সব মেয়েদের প্রতিই এ হচ্ছে ইসলামের দাবি।

এক হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ঘোষণা উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ

তাদের ঘরই তাদের জন্যে সুখ-শান্তি ও সার্বিক কল্যাণের আকর।

হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, কিছু সংখ্যক মহিলা রাসূলে করীম (স)-এর খেদমতে হাজির হয়ে নিবেদন করলেনঃ

(আরবী************************************************************************)

হে রাসূল, পুরুষরা তো আল্লাহর প্রদত্ত বিশিষ্টতা ও আল্লাহর পথে জিহাদ প্রভৃতি দ্বারা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে গেছে। আমরা কি এমন কোনো কাজ করতে পারি, যা করে আমরা আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদা লাভ করব? এ প্রশ্নের জবাবে নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

যে মেয়েলোক তার ঘরে অবস্থান করল, সে ঠিক আল্লাহর পথে জিহাদকারীর কাজ সম্পন্ন করতে পারল।

রাসূলের কথা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের জন্যে আল্লাহর দেয়া বিশিষ্টতা মেয়েরা লাভ করতে পারে না কোনোক্রমেই। কেননা তা জন্মগত ব্যাপার। পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই তার এ বিশিষ্টতা। আর মেয়েরা তা পেতে পারে না এজন্যে যে, মেয়ে হয়েই তাদের জন্ম। আর পুরুষও আল্লাহরই তো সৃষ্টি। তবে নৈতিক মান মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে কোনো তারতম্য নেই, মেয়েরাও তা লাভ করতে পারে পুরুষদের মতোই –যদিও ঠিক একই কাজ দ্বারা নয়। কাজের স্বরূপ, ধরন, ক্ষেত্র বিভিন্ন হলেও কাজের ফল হিসেবে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করার ব্যাপারে মেয়ে-পুরুষ সমান।

রাসূলের কথা থেকে এ কথাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মেয়েদের প্রকৃত কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর আর পুরুষদের কর্মক্ষেত্র বাইরে। জিহাদের সওয়াব পাবার জন্যে পুরুষদের তো যুদ্ধের ময়দাতে যেতে হবে, দ্বীনের শত্রুদের সাথে কার্যত মুকাবিলা করতে হবে, জীবন-প্রাণ কঠিন বিপদের সম্মুখে ঠেলে দিতে হবে, ঘর-বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে যেতে হবে। কিন্তু মেয়েদের জিহাদ তার ঘরকে কেন্দ্র কেই সম্পন্ন হবে এবং ঘরের দায়িত্ব পালন করলেই পুরুষদের জিহাদের সমান মর্যাদা ও সওয়াব লাভ করতে পারবে। জিহাদ স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই করতে হবে। কিন্তু পুরুষদের করতে হবে তা বাইরের ক্ষেত্রে, যুদ্ধের ময়দানে। কেননা তা করার যোগ্যতা ক্ষমতা তাদেরই দেয়া হয়েছে। আর মেয়েদের তা করতে হবে ঘরে বসে। কেননা ঘর কেন্দ্রিক জিহাদ করার যোগ্যতাই মেয়েদের দেয়া হয়েছে, বাইরের জিহাদের নয়।

প্রসঙ্গত ‘মেয়েদের নিজেদের ঘর’ কথাটির বিশ্লেষণ হওয়া আবশ্যক। কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘরকে ‘স্ত্রীদের ঘর’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে (আরবী****************) –‘তোমাদের নিজেদের ঘরে’। হাদীসেও তাই বলা হয়েছে। তার মানে স্ত্রীদের নিজস্ব ঘর থাকা আবশ্যক –যেমন পূর্বে বলেছি –এবং এ গরই হবে তার কর্মকেন্দ্র, জীবন-কেন্দ্র। এ জন্যেই নবী করীম (স) তাঁর এক-একজন বেগমের জন্যে এক-একটি হুজরা –ছোট কক্ষ –নির্মাণ করে দিয়েছিলেন এবং যে বেগম যে হুজরায় বসবাস করতেন, তিনিই ছিলেন তার মালিক-ব্যবস্থাপনা-পরিচালনার কর্ত্রী। নবী করীম (স)-এর উপস্থিতিতেও তিনি তাতে মালিকানা কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতেন।–[আহলি সুন্নাহ আল-জামায়াত-এর মতে এ মালিকানা এমন ছিল না, যার ওপর মিরাসের আইন কার্যকর হতে পারত এবং রাসূলের পরও তার মালিক হয়ে থাকতে পারতেন।]

এরই ভিত্তিতে ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

যে লোক তার স্ত্রীর বসবাসের জন্যে কোনো ঘর নির্মাণ করবে এবং তার পরিচালন অধিকার তারই হস্তে অর্পন করবে, সে যেন তার স্ত্রীকে একখানি ঘর সম্পূর্ণ হেবা করে দিলো। তারই কাছে তা হস্তান্তর করে দিলো। ফলে সেই ঘরের মালিকানা স্ত্রীর হয়ে যাবে।

উপরোক্ত আয়াতে এ ঘরকেই আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকবার জন্যে সমস্ত মুসলিম মহিলাকে আদেশ করা হয়েছে। এমন কি জামা’আতে নামায পড়া ওয়াজিব করা হয়েছে কেবলমাত্র পুরুষদের জন্যে, মহিলাদের পক্ষে সে নামাযের জামা’আতের উদ্দেশ্যেও ঘর থেকে বের হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

মেয়েদের ঘরের কোণই হচ্ছে তাদের জন্যে উত্তম মসজিদ।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************************)

মেয়েরা তাদের ঘরে নামাযের জন্যে এমন একটি স্থান নির্দিষ্ট করে নেবে, যেখানে তাকে কেউ দেখতেও পাবে না, আর তার কোনো শব্দও কেউ শুনতে পাবে না।

উম্মে হুমাইদ নামে পরিচিতা এক মহিলা রাসূলে করীমের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলঃ

(আরবী********************************************************************************)

হে রাসূল, আমি আপনার সাথে জামা’আতে মসজিদে নামায পড়তে ভালবাসি।

তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

হ্যাঁ আমি জানতে পারলান তুমি আমার সাথে জামা’আতে নামায পড়া খুব পছন্দ করো। কিন্তু মনে রেখ, তোমার শয়নকক্ষে বসে নামায পড়া তোমার জন্য বৈঠকখানায় নামায পড়া অপেক্ষা ভালো, বৈঠকখানায় নামায পড়া ঘরের আঙ্গিনায় নামায পড়া অপেক্ষা ভালো, ঘরের আঙ্গিনায় নামায পড়া ঘরের কাছাকাছি মহল্লার মসজিদে নামায পড়া অপেক্ষা ভালো আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামায পড়া আমার এই মসজিদে এসে নামায পড়া অপেক্ষা ভালো।

হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

অতঃপর সেই মেয়েলোকটির আদেশে তার ঘরের দূরতম ও অন্ধকারতম কোণে নামাযের জায়গা বানিয়ে দেয়া হয় এবং সে মৃত্যু পর্যন্ত এখানেই নামায পড়েছিল।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, সকল ব্যাপার এমন কি নামাযে ও আল্লাহর সব বন্দেগীর কাজে পূর্ণ মাত্রায় পর্দা গ্রহণ মেয়েদের জন্যে আবশ্যক। আর ঘরের সবচেয়ে গোপন কোণে নামায পড়ায় অধিকতর ও পূর্ণতর সওয়াব বলে নবী করীম (স) মেয়ে লোকটিকে তার ঘরের অধিক গোপন ও লোকদৃষ্টি থেকে দূরবর্তী জায়গায় নামায পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন।

হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ রাসূলে করীম (স) মেয়েলোকদেরকে মসজিদে যেতে চাইলে নিষেধ করতে মানা করেছেন একথা ঠিক; কিন্তু

(আরবী********************************************************************************)

তিনি যদি আজকের দিনের মেয়েদের অবস্থা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই মেয়েদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

মেয়েরা তার ঘরে বসে আল্লাহর যে ইবাদত সম্পন্ন করে, সে রকম ইবাদত আর হয় না।

তিনি আরো বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

আল্লাহর কাছে মেয়েলোকের সেই নামায সবচেয়ে বেশি প্রিয় ও পছন্দনীয়, যা সে তার ঘরের অন্ধকারতম কোনে পড়েছে।

ঠিক এ দৃষ্টিতেই রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে জানাযার সঙ্গে কবরস্থানে যেতে নিষেধ করেছেন। হযরত উম্মে আতীয়াতা (রা) বলেনঃ

(আরবী************************************************************************)

জানাযা অনুসরণ করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, যদিও রাসূলে করীম (স) এ ব্যাপারে আমাদের প্রতি কঠোরতা প্রয়োগ করেন নি।

অপর এক হাদীসে হযরত উম্মে আতীয়াতার কথাটি নিম্নরূপঃ

(আরবী*******************************************************)

রাসূলে করীম (স) আমাদেরকে জানাযায় বের হতে নিষেধ করেছেন।

হযরত উম্মে আতীয়াতার প্রথমোক্ত কথা থেকে মনে হয়, রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে জানাযায় বের হতে ও কবরস্থান পর্যন্ত গমন করতে নিষেধ করেছেণ বটে; যদিও সে নিষেধ হারাম পর্যায়ে নহে। কেননা এ ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি দেখান নি, খুব তাগিদ করে নিষেধ করেন নি। শুধু অপছন্দ করেছেন।

ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

উম্মে আতীয়াতার হাদীস থেকে বাহ্যত মনে হয় যে, এ নিষেধ নৈতিক শিক্ষাদানমূলক –সব ইসলামবিদই এ মত গ্রহণ করেছেন।

সওরী বলেছেনঃ

(আরবী***************************) –মেয়েদের জানাযায় গমন করা বিদআত।

ইমাম আবূ হানীফা (রহ) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

এ কাজ মেয়েদের শোভা পায় না।

ইমাম শাফেয়ী এ কাজকে মাকরূহ মনে করেছেন হারাম নয়। (ঐ)

মনে রাখা আবশ্যক, জামা’আতের সাথে নামায পড়তে মসজিদে যাওয়া এবং জানাযার সাথে কবরস্থানে গমন করতে নিষেধ করা হয়েছে রাসূলে করীম ও সাহাবীদের ইসলামী সমাজের সোনালী যুগে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয় –সেকালেও যদি এ দুটো কাজে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, অপছন্দ করা হয়ে থাকে, তাহলে এ যুগে কি তা সমর্থনযোগ্য হতে পারে কোনক্রমে? উপরন্তু ঠিক যে যে কারণে এ নিষেধবাণী উচ্চারিত হয়েছিল, সে কারণ কি সে যুগের তুলনায় এ যুগে অধিকতর তীব্র আকার ধারণ করে নি?

ঘরের অভ্যন্তরে পর্দা

ঘরের অভ্যন্তরেও নারী-পুরুষের জন্যে পর্দার ব্যবস্থা রয়েছে। এ পর্যায়ে নারী-পুরুষের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের একটি সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************)

বাবা, চাচা-মামা, নিজ সন্তান, সহোদর ভাই, ভাই-পো, বোন-পো, মুসলিম মহিলা ও দাসদাসীদের সাথে দেখা দেয়ার কোনো দোষ নেই।

এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা আলুসী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

এ আয়াতে যাদের থেকে পর্দা করা ওয়াজিব নয়, তাদের কথা বলা হয়েছে।

লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

বাহ্যত এর অর্থ হচ্ছে এদের পর্দা না করলে কোনো দোষ নেই।

মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

এর অর্থ এই যে, আয়াতে উদ্ধৃত ব্যক্তিদের সামনে মুখাবরণ উন্মুক্ত করলে ও সৌন্দর্যের অলংকারাদি জাহির করলে কোনো দোষ হবে না।

সূরা আন-নূর-এ একথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

(আরবী**************************************************************)

এবং মেয়েলোকেরা –তাদের স্বামী, পিতা, স্বামীর পিতা, গর্ভজাত ছেলে-সন্তান, স্বামীর পুত্র, সহোদর ভাই, ভাই-পো, বোন-পো, বোন-পো, মেলা-মেশার মেয়েলোক, দাস, মেয়েদের প্রতি কোনো প্রয়োজন রাখে না। এমন সব পুরুষ এবং যেসব ছেলেপেলে এখনও মেয়েদের লজ্জাস্থান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ও সচেতন হয়নি –এদের ছাড়া আর কারো সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না।

আয়াদের প্রত্যেকটি শব্দই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।

মেয়েরা তাদের নিজ নিজ স্বামীকে দেখা দিতে পারবে, নিজের রূপ-সৌন্দর্য দেখাতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, স্বামীর পক্ষে তার সমগ্র দেহকে –দেহের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখা সম্পূর্ণ জায়েয। নারী রূপ-সৌন্দর্য যৌবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্যই তাই। তারী তার স্বামীকে তা দেখাতে –দেখতে দিতে বাধ্য। দেখতে দিতে না চাইলে স্বামী বল প্রয়োগ করার অধিকার রাখে। যদিও স্ত্রীর যৌন অঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত কারো মতে অশোভন, কারো মতে মাকরূহ আর কারো মতে হারাম।

২. কেবল বাবাকেই নয়, বাবার বাবা, তার বাবার ভাই, মায়ের ভাই ইত্যাদিকেও দেখা দেয়া জায়েয। কেবল নিজের বাবা-দাদাই নয়, মায়ের বাবাকেও দেখা দিতে পারে। দুধ বাবাকেও দেখা দেয়া জায়েয। হযরত আয়েশার দুধবাপ ছিল আবূ কুয়াইস। সে হযরত আয়েশার ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইরে তিনি বললেনঃ

(আরবী**************************************************************)

তাঁর সাথে দেখা দেয়ার ব্যাপারে রাসূলের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার আগে আমি তাঁকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেব না।

পরে রাসূরে করীম (স)-কে তাঁর কথা বলা হলে তিনি বলেনঃ

(আরবী************************************)

হ্যাঁ, তাকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দাও, কেননা সে তো তোমার চাচা হয়। (বুখারী)

৩. স্বামীর পিতা –শ্বশুরকেও দেখা দেয়া জায়েয।

৪. নিজ গর্ভজাত ছেলে-সন্তান, তাদের ছেলে-সন্তান।

৫. আপন সহোদর ভাই, পিতার দিকে বৈমাত্রেয় ভাই, মায়ের দিকে বৈপিত্রেয় ভাই এবং দুধ-ভাইও তার মধ্যে শামিল।

৬. এসব ভাইয়ের ছেলে-সন্তান, তাদের সন্তান।

৭. বোনের ছেলে-সন্তান, তাদের সন্তান।

৮. সাধারণ মেলামেশার মেয়েলোক, যাদের সঙ্গে দিনরাত দেখা-সাক্ষাত হয়েই থাকে কিংবা যাদেরকে ঘরের ভিতরে কাজ-কর্ম করানোর উদ্দেশ্যে নিযুক্ত করা হয়েছে। কাফির ও ফাসিক মেয়েদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা মুসলিম মহিলাদের জন্যে জায়েয নয়। কেননা তাতে করে পর্দার মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে যিম্মী ও গায়র যিম্মীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিম্মী মেয়েলোক মুসলিম মহিলাকে দেখতে পারে কিনা, এ সম্পর্কে দুটি মত রয়েছে। ইমাম গাযালীর মতে, অন্য মুসলিম মহিলার মতো যিম্মী মেয়েলোকও দেখতে পারে। আর ইমাম বগবীর মতে এ দেখা জায়েয নয়। ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

খেদমত করার সময় মুসলিম মহিলাদের দেহের যে অংশ সাধারণত প্রকাশ হয়ে পড়ে তা দেখা যিম্মী মেয়েলোকের পক্ষে হারাম, এ হচ্ছে অধিক সত্য ও সহীহ মত। তবে যিম্মী মেয়েলোকেরা নিজের মুনিব মহিলাকে দেখতে পারে। সহীহ হাদীসে উম্মুল মু’মিনীনের কাছে যিম্মী মেয়েলোকের অনুপ্রবেশের যে কথা উল্লিখিত যিম্মী মেয়েলোকেরা নিজের মুনিব মহিলাকে দেখতে পারে। সহীহ হাদীসে উম্মুল মু’মিনীনের কাছে যিম্মী মেয়েলোকের অনুপ্রবেশের যে কথা উল্লিখিত হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, খেদমতের জন্যে যে অংশ প্রকাশ হয়ে পড়ে তা দেখা জায়েয।

ইমাম রাযী ও ইবনুল আরাবীর মতে যিম্মী মেয়েলোকও মুসলিম মহিলার মতোই। কুরআনের (আরবী*********) বলে সব মেয়েলোকই বোঝানো হয়েছে। কেননা মুসলিম মহিলাদের পক্ষে যিম্মী মেয়েলোকদের দেখা না দিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

আমার বিবেনায় বিশুদ্ধ মত হচ্ছে এই যে, সব মেয়েলোকদের সাথেই মুসলিম মেয়েরা দেখা-সাক্ষাত করতে পারে।

৯. দাস-দাসীদের সাথে দেখা-সাক্ষাত জায়েয, তারা কাফির হলেও নিষেধ নেই। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম শাফেয়ীর একটি কথা এই যে, মেয়ে-মালিকের দৃষ্টি ক্রীতদাস ভিন পুরুষদের মতই। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব প্রথমে বলেছিলেনঃ (আরবী*********************) মেয়ে-মালিকের পক্ষে দেখা দেয়ার ব্যাপার ক্রীতদাসীদের মতোই। কিন্তু পরে তিনি তাঁর এ মত প্রত্যাহার করেছেন এবং বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

সূরা নূর-এর আয়াত থেকে তোমাদের ভুল ধারণা হওয়া উচিত নয়, কেননা তা হচ্ছে ক্রীতদাসীদের সম্পর্কে, ক্রীতদাসদের সম্পর্কে নয়।

আর এর কারণস্বরূপ তিনি বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

ক্রীতদাসেরা তো বলদের ন্যায়। মেয়ে-মালিকের তারা স্বামীও নয়, মুহাররমও নয় অথচ যৌন উত্তেজনার উদ্রেক হওয়া খুবই স্বাভাবিক, আর মোটামুটিভবে এ নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ে তো হতেই পারে।

এতদসত্ত্বেও কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ স্পষ্টভাবে পুরুষ স্ত্রী –অন্য কথায় দাস-দাসী –উভয়ের সাথেই সমানভাবে দেখা-সাক্ষঅতের অনুমতি প্রমাণ করে। এ পর্যায়ে হযরত আনাস বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ্য। একদা রাসূলে করীম (স) একটি ক্রীতদাসসহ হযরত ফাতিমার ঘরে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখতে পেলেনঃ ফাতিমা এমন একখানি কাপড় পড়ে আছে, যা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা খুলে যায় আর পা ঢাকা হলে মাথা অনাবৃত হয়ে পড়ে। তখন নবী করীম (স) হযরত ফাতিমাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ

(আরবী*************************************************************************))

তোমার কোনো অসুবিধে নেই। এ দাসটি হচ্ছে তোমার বাবা তুল্য এবং তোমার গোলাম।

এ থেকে মেয়ে-মালিকের পক্ষে তার ক্রীতদাসকে দেখা দেয়ায় কোনো দোষ নেই বলেই স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে।

১০. মেয়েদের প্রতি যেসব পুরুষ কোনো প্রয়োজন রাখে না –এমন সব অধীনস্থ লোকের দেখা দেয়াও জায়েয। এরা হচ্ছে সে সব লোক, যারা ঘরের বাড়তি খাবার খেতে আসে, কেননা তারা নিজেরা উপার্জন করতে অক্ষম। এরা মেয়েদের দিকে কোনো যৌন প্রয়োজন বোধ করে না, বরং কাজকর্ম করে দেয়, কথাবার্তা শোনে। এরা হচ্ছে বিগত যৌবন বৃদ্ধ, আধাবৃদ্ধ লোক।

মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

মেয়েদের প্রতি প্রয়োজন রাখে না –এমন পুরুষ হচ্ছে তারা, যারা মেয়েদের ব্যাপারই বুঝে না, জানে না এমন সোজা-সোজা ও সাদাসিধে লোক।

১১. সেসব ছেলেপেলে, যারা এখনো মেয়েলোকদের যৌনত্বের কোনো বোধ লাভ করেনি, যাদের মধ্যে যৌন বোধ এখনো জাগ্রত হয়নি, যে সব কিশোরের মনে নারীদের প্রতি এখনো কোনো কৌতুহল ও ঔৎসুক্য জাগেনি, তারাও এর মধ্যে শামিল।

এসব পুরুষ লোকের সঙ্গে পর্দানশীল মেয়েরাও অবাধে দেখা সাক্ষাত করতে পারে, এদের সামনে সাজ-সজ্জা ও প্রসাধন করেও আসতে পারে। শরীয়তে তার পূর্ণ ও স্পষ্ট অনুমতি রয়েছে। কেননা পর্দানশীল মেয়েদেরও এ ধরনের পুরুষদের সাথে দিন-রাত দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর দ্বিতীয়ত এ ধরনের পুরুষদের কাছ থেকে মেয়েদের কোনো নৈতিক বিপর্যয় –কোনো অঘটন ঘটার আশংকা নেই বললেও চলে। আর আশংকা না থাকারও কারণ এই যে, এরা হচ্ছে নিতান্ত আপন লোক। আত্মীয়তা, নৈকট্য, রক্ত সম্পর্ক ইত্যাদি বিপর্যয়ের পথের প্রধানতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এদের জণ্যে সাধারণত খোলা থাকে মেয়েদের যেসব দেহাঙ্গ, তা দেখায় কোনো দোষ নেই, আর তা হচ্ছে মুখমণ্ডল, মাথা, পা-হাটু, দুই হাত। কিন্তু এদের জন্যেও বুক, পিঠ ও পেট এবং নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত এলাকার কিছু অংশ দেখা আদৌ জায়েয নয়। কেননা এসব অঙ্গ সাধারণত উন্মুক্ত থাকে না, বস্ত্রাবৃত থাকাই স্বাভাবিক এবং এসব অঙ্গই প্রধানত যৌন আবেদনকারী।

এ ব্যবস্থা দ্বারা মেয়েদের জন্যে একটি পরিবেষ্টনী নির্দিষ্ট করে দেয়া হলো। সেখানে তারা স্বাধীনভাবে ও দ্বিধা-সংকোচহীন হয়ে বিচরণ করতে পারে। বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের তাগিত যেসব পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষাত একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাতের পথে ইসলামী শরীয়তে কোনোই বাধা আরোপ করা হয়নি বরং অবাধ অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরের পুরুষদের সাথে দেখা-সাক্ষাত আদৌ জায়েয নয়; সাধারণত চার কোনো প্রয়োজনও দেখা দেয় না। আর অপ্রয়োজনীয় দেখা-সাক্ষাত নারী-পুরষের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এজন্যে তা বর্জন করা প্রত্যেক ঈমানদার মহিলার কাছেই তার ঈমান ও ইসলামী বিধানের ঐকান্তিক দাবি।

মেয়ে-পুরুষদের এ পর্দা রক্ষার্থেই সাধারণ পুরুষদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন আগাম জানান না দিয়ে অপর কারো ঘরে প্রবেশ না করে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************************************)

হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের ঘর ছাড়া অপর লোকের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের আগমন সম্পপের্ক পরিচিতি করিয়ে নেবে এবং ঘরের লোকদের প্রতি সালাম পাঠাবে। এ নীতি অবলম্বন করা তোমাদের জন্যে কল্যাণবহ, সম্ভবত তোমরা এ উপদেশ গ্রহণ করবে ও এ অনুযায়ী কাজ করবে।

এ আয়াত নাযিল হওয়ার উপলক্ষ এই ছিল যে, একজন মহিলা সাহাবী রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে হাজির হয়ে বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল, আমি আমার ঘরে এমন অবস্থায় থাকি যে, তখন আমাকে সেই অবস্থায় কেউ দেখতে পায় তা আমি মোটেই পছন্দ করিনে –সে আমার ছেলে-সন্তানই হোক কিংবা পিতা, অথচ এ অবস্তায়ও তারা আমার ঘরে প্রবেশ করে। এখন আমি কি করব? এরপরই এ আয়াতটি নাযিল হয়। বস্তুত আয়াতটিতে মুসলিম নারী-পুরুষের পরস্পরের ঘরে প্রবেশ করার প্রসঙ্গে এক স্থায়ী নিয়ম পেশ করা হয়েছে। মেয়েরা নিজেদের ঘরে সাধারণত খোলামেলা অবস্থায়ই থাকে। ঘরে প্রবেশ করার তো কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।। কেননা বিনানুমতিতে ও আগাম জানান না দিয়ে কেউ যদি কারো ঘরে প্রবেশ করে তবে ঘরের মেয়েদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখা, তাদের দেহের যৌন অঙ্গের ওপর নজর পড়ে যাওয়া খুবই সম্ভব। তাদের অঙ্গে চোখাচোখি হতে পারে। তাদের রূপ-যৌবন দেখে পুরুষ দর্শকের মনে যৌন লালসার আগুন জ্বলে ওঠতে পারে। আর তারই পরিণামে এ মেয়ে-পুরুষের মাঝে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে গোটা পরিবারকে তছনছ করে দিতে পারে। মেয়েদের যৌন অঙ্গ ঘরের আপন লোকদের দৃষ্টি থেকে এবং তাদের রূপ-যৌবন ভিন পুরুষের নজর থেকে বাঁবাচার উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে।

জাহিলিয়াতের যুগে এমন হতো যে, কারো ঘরের দুয়ারে গিয়ে আওয়াজ দিয়েই টপ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করত, মেয়েদেরকে সামলে নেবারও সময় দেয়া হতো না। ফলে কখনো ঘরের মেয়ে পুরুষকে একই শয্যায় কাপড় মুড়ি দেয়া অবস্থায় দেখতে পেত, মেয়েদেরকে দেখত অসংবৃত বস্ত্রে। এজন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছেঃ

(আরবী********************************************************************************)

তোমাদেরকে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। আর যদি তোমাদেরকে ফিরে যেতে বলা হয়, তাহলে অবশ্যই ফিরে যাবে। এ হচ্ছে তোমাদের জন্যে অধিক পবিত্রতর নীতি। তোমরা যা করো সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণ মাত্রায় অবহিত রয়েছেন।

হযরত আনাস থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

হে প্রিয় পুত্র, তুমি যখন তোমার ঘরের লোকদের সামনে যেতে চাইবে, তখন বাইরে থেকে সালাম করো। এ সালাম করা তোমার ও তোমার ঘরের লোকদের পক্ষে বড়ই বরকতের কারণ হবে।

কারো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে সালাম দেবে, না প্রথমে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইবে, এ নিয়ে দু’রকমের মত পাওয়া যায়। কুরআনে প্রথমে অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন যে, প্রথমে অনুমতি চাইবে, পরে সালাম দেবে। কিন্তু একথা ভিত্তিহীন। কুরআনে প্রথমে অনুমতি চাওয়ার কথা বলা হয়েছে বলেই যে প্রথমে তাই করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কুরআনে তো কি কি করতে হবে তা এক সঙ্গে বলে দেয়া হয়েছে। এখানে পূর্বাপরের বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। বিশেষত বিশুদ্ধ হাদীসে প্রথমে সালাম করার ওপরই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

কালদা ইবনে হাম্বল (রা) বলেনঃ আমি রাসূলের ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইলাম, কিন্তু প্রথমে সালাম করিনি বলে অনুমতিও পাইনি। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*******************************************************)

ফিরে যাও, তারপর এসে প্রথমে বলো আসসালামু আলাইকুম, তার পরে প্রবেশের অনুমতি চাও।

হযরত জাবের বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

যে লোক প্রথমে সালাম করেনি, তাকে ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি দিও না।

হযরত জাবের বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***********************) –কথা বলার পূর্বে সালাম দাও।

হযরত আবূ মূসা আশ’আরী ও হুযায়ফা (রা) বলেছেনঃ

(আরবী***************************************)

মুহাররম মেয়েলোকদের কাছে যেতে হলেও প্রথমে অনুমতি চাইতে হবে।

এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী*******************) –আমার মায়ের ঘরে যেতে হলেও কি আমি অনুমতি চাইব?

রাসূলে করীম (স) বললেনঃ অবশ্যই। সে লোকটি বললঃ আমি তো তার সঙ্গে একই ঘরে থাকি –তবুও? রাসূল (স) বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই অনুমতি চাইবে। সেই ব্যক্তি বললঃ আমি তো তার খাদেম। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*******************************************************)

অবশ্যই পূর্বাহ্নে অনুমতি চাইবে, তুমি কি তোমারমাকে ন্যাংটা অবস্থায় দেখতে চাও –তা-ই অপছন্দ করো?

তার মানে, অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে মাটে ন্যাংটা অবস্থায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সালাম করতে হবে এবং পরে প্রবেশের অনুমতি চাইতে হবে। অনুমতি না পেলে ফিরে যেতে হবে। এ ফিরে যাওয়া অধিক ভালো, সম্মানজনক প্রবেশের জন্যেকাতর অনুনয়-বিনয় করার হীনতা থেকে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হাদীসের ইলম লাভের জন্যে কোনো কোনো আনসারীর ঘরের দ্বারদেশে গিয়ে বসে থাকতেন, ঘরের মালিক বের হয়ে না আসা পর্যন্ত তিনি প্রবেশের অনুমতি চাইতেন না। এ ছিল উস্তাদের প্রতি ছাত্রের বিশেষ আদব, শালীনতা।

কারো বাড়ির সামনে গিয়ে প্রবেশ-অনুমতির জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হলে দরজার ঠিক সোজাসুজি দাঁড়ানোও সমীচীন নয়। দরজার ফাঁক দিয়ে ভিতরে নজর করতেও চেষ্টা করবে না। নবী করীম (স) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর বলেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

নবী করীম (স) যখন কারো বাড়ি বা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেন, তখন অবশ্যই দরজার দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেন না। বরং দরজার ডান কিংবা বাম পাশে সরে দাঁড়াতেন এবং সালাম করতেন।

এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের বিশেষ কক্ষপথে মাথা উঁচু করে তাকালে রাসূলে করীম (স) তখন ভিতরে ছিলেন এবং তাঁর হাতে লৌহ নির্মিত চাকুর মতো একটি জিনিস ছিল। তখন তিনি বললেনঃ

(আরবী******************************************************)

এ ব্যক্তি বাইরে থেকে উঁকি মেরে আমাকে দেখবে তা আগে জানতে পারলে আমি আমার হাতের এ জিনিসটি দ্বারা তার চোখ ফুটিয়ে দিতাম। এ কথা তো বোঝা উচিত যে, এ চোখের দৃষ্টি বাঁচানো আর তা থেকে বাঁচবার উদ্দেশ্যেই পূর্বাহ্নে অনুমতি চাওয়ার রীতি করে দেয়া হয়েছে।

এ সমএর্ক হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে স্পষ্ট, আরো কঠোর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

কেউ যদি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে তাকায় আর তুমি যদি পাথর মেরে তার চোখ ফুটিয়ে দাও, তাহলে তাতে তোমার কোনো দোষ হবে না।

অনুমতি না পাওয়া গেলে কিংবা ঘরে কোনো পুরুষ লোক উপস্থিত নেইবলে যদি ঘর থেকে চলে যেতে বলা হয় তাহলে অনুমতি প্রার্থনাকারীকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। তার সেখানে আরো দাঁড়ানো এবং কাতর কণ্ঠে অনুমতি চাইতে থাকা সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ।

তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরও যদি অনুমতি পাওয়া না যায়, তাহলেই এরূপ করতে হবে। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী একবার হযরত উমর ফারূকের দাওয়াত পেয়ে তাঁর ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হলেন এবং তিনবার সালাম করার পরও কোনো জবাব না পাওয়ার কারণে তিনি ফিরে চলে গেলেন। পরে সাক্ষাত হলে হযরত উমর ফারূক বললেনঃ

(আরবী****************) –তোমাকে দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও তুমি আমার ঘরে আসলে না কেন?

তিনি বললেনঃ

(আরবী******************************************************)

আমি তো এসেছিলাম, আপনার দরজায় দাঁড়িয়ে তিনবার সালামও করেছিলাম। কিন্তু কারো কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে আমি ফিরে চলে এসেছি। কেননা নবী করীম (স) আমাকে বলেছেন, তোমাদের কেউ কারো ঘরে যাওয়ার জন্যে তিনবার অনুমতি চেয়েও না পেলে সে যেন ফিরে যায়। (বুখারী, মুসলিম)

ইমাম হাসান বসরী বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

তিনবার সালাম করার মধ্যে প্রথমবার হলো তার আগমন সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়বার সালাম প্রবেশ অনুমতি লাভের জন্যে এবং তৃতীয়বার হচ্ছে ফিরে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা।

কেননা তৃতীয়বার সালাম দেয়ার পরও ঘরের ভেতর থেকে কারো জবাব না আসা সত্যই প্রমাণ করে যে,ঘরে কেউ নেই, অন্তত ঘরে এমন কোনো পুরুষ নেই, যে তার সালামের জবাব দিতে পারে।

আর যদি কেউ ধৈর্য ধরে ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়েই থাকতে চায়, তবে তারও অনুমতি আছে, কিন্তু শর্ত এই যে, দুয়ারে দাঁড়িয়েই অবিশ্রান্তভাবে ডাকা-ডাকি ও চিল্লচিল্লি করতে থাকতে পারবে না। একথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতাংশেঃ

(আরবী*****************************************************************)

তারা যদি ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষায় থাকত যতক্ষণ না তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ, তাহলে তাদের জন্যে খুবই কল্যাণকর হতো।

আয়াতটি যদিও বিশেষভাবে রাসূলে করীম (স)-এর প্রসঙ্গে; কিন্তু এর আবেদন ও প্রয়োজন সাধারণ। কোনো কোনো কিতাবে এরূপ উল্লেখ পাওয়া যায় যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা) –যিনি ইসলামের বিষয়ে মস্তবড় মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন –হযরত উবাই ইবনে কা’আবের বাড়িতে কুরআন শেখার উদ্দেশ্যে যাতায়াত করতেন। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতেন, কাউকে ডাক দিতেন না, দরজায় ধাক্কা দিয়েও ঘরের লোকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন না। যতক্ষণ না হযরত উবাই নিজ ইচ্ছেমতো ঘর থেকে বের হতেন, ততক্ষণ এমনিই দাঁড়িয়ে থাকতেন। (আরবী******************************)

পুরুষ উপস্থিত নেই –এমন ঘরের মেয়েদের কাছ থেকে যদি কোনো সাধারণ দরকারী জিনিস পেতে হয়; কিংবা একান্তই জরুরী কোনো কথা, কোনো সংবাদ জানতে হয়, তাহলে পর্দার আড়ালে বাইরে দাঁড়িয়েই তাঁদের নিকট চাইবে। বস্তুত এ নীতি তোমাদের ও তাদের দিলের পবিত্রতা রক্ষার পক্ষে অধিকতর উপযোগী, অনুকূল।

আয়াতটি যদিও স্পষ্ট রাসূলে করীমের বেগমদের সম্পর্কে অবতীর্ণ এবং এ নির্দেশও বিশেষভাবে রাসূলের বেগমদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু এ আয়াতেরও একটি সাধারণ আবেদন রয়েছে এবং এ নির্দেশও সাধারণ মুসলিম সমাজের মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। কেননা, তাদের কাছ থেকে কিছু পেতে হলেও তো সে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েই চাইতে হবে এবং বিনানুমতিতে তাদের ঘরেও প্রবেশ করা যাবে না।

উপরের উদ্ধৃত নির্দেশসমূহ পুরুষদের লক্ষ্য করেই বর্ণিত হয়েছে; কিন্তু তাই বলে মেয়েরা তার বাইরে নয়, তাদের পক্ষে এর কোনোটিই নয় লংঘনীয়। মেয়েদের লক্ষ্য করে আরো অতিরিক্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেন মেয়েরা তা পালন করে নিজদেদের পরপুরুষের দৃষ্টি ও আকর্ষণের পংকিলতা থেকে পূর্ণমাত্রায় রক্ষা করতে পারে।

মেয়েদের পক্ষে যদি বাইরের পুরুষদের সাথে কথা বলা একান্তই জরুরী হয়ে পড়ে এবং তা না বলে কোনো উপায়ই না থাকে, তাহলে কথা বলতে হবে বৈ কি; কিন্তু সেজন্যেও কিছুটা স্পষ্ট নিয়ম-নীতি রয়েছে, যা লংঘন করা কোনো ঈমানদার মহিলার পক্ষেই জায়েয নয়।

কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************************************)

তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ভীরু হয়ে থাক, তাহলে কস্মিনকালেও নিম্নস্বরে কথা বলবে না। কেননা সেরূপ কথা বললে রোগগ্রস্ত মনের লোক লোভী ও লালসা-কাতর হয়ে পড়বে। আর তোমরা প্রচলিত ভালো কথাই বলবেঃ

‘নিম্নস্বরে কথা বলবে না’ মানেঃ

(আরবী************************************************************)

তোমাদের কথাকে বিনয় নম্রতাপূর্ণ ও নারীসুলভ কোমল ও নরম করে বলবে না, যেমন করে সংশয়পূর্ণ মানসিকতা সম্পন্ন ও চরিত্রহীনা মেয়েলোকেরা বলে থাকে।

কেননা এ ধরনের কথা শুনলে লালসাকাতর ব্যক্তিরা খুবই আশাবাদী হয়ে পড়ে। তাদের মনে মনে এ লোভ জাগে যে, হয়ত এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। কেবল মেয়েদেরই নয়, পুরুষদেরও অনুরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

নিহায়া কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************)

নবী করীম (স) পুরুষকে তার নিজের স্ত্রী ছাড়া ভিন মেয়েলোকের খুব নরম সুরে ও লালসা পিচ্ছিল কণ্ঠস্বরে কথা বলতে নিষেধ করেছেন, যে কথা শুনে সেই মেয়েলোকের মনে কোনো লালসা জাগতে পারে।

‘মানসিক রোগাক্রান্ত লোকেরা লালসাকাতর হতে পারে’ –একথা বলার বিশেষ কারণ হচ্ছে এই যে, ভিন মেয়েলোকের কাছ থেকে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভবনার আশা করা কেবল এ ধরনের লোকদের পক্ষেই সম্ভব। ঈমানদার লোক কখনো এরূপ হয় না।

(আরবী***********************************************************************)

কেননা কামিল ঈমানদার ব্যক্তির দিল ঈমানের প্রভাবে শান্ত-তৃপ্ত-সমাহিত। সে সব সময় আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণাবলী দেখতে পায় –মনে রাখে। ফলে সে আল্লাহর হারাম করা কোনো কিছু পেতে লোভ করেনা। কিন্তু যার ঈমান দুর্বল, যার দিলে মুনাফিকী রয়েছে, সে-ই কেবল হারাম জিনিসের প্রতি লোভাতুর হয়ে থাকে।

কিন্তু যে মেয়েলোকের সাথে কথা বলা হচ্ছে, সে যদি স্পষ্ট ভাষায় ও অকাট্য শব্দে ও স্বরে কাটাকাটিভাবে জরুরী কথা কয়টি বলে দেয়, তাহলে এ মানসিক রোগাক্রান্ত লোকেরা লোভাতুর হবে না, তারা নিরাশ হয়েই চলে যেতে বাধ্য হবে। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

লোকদের সাথে কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর মিহি করে বলো না। যেমন সন্দেহপূর্ণ চরিত্রের মেয়েরা করে থাকে। কেননা এ ধরনের কথা বলাই অনেক সময় বিরাট নৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে।

শয়তান প্রকৃতির ও চরিত্রহীন লোকেরা নারী শিকারে বের হয়ে সাধারণত সেসব জায়গায়ই ঢু মারে, যেখান থেকে কিছুটা সুযোগ লাভের সম্ভাবনা মনে হয়। আর এ উদ্দেশ্যে স্বামী কিংবা বাড়ির পুরুষদের অনুপস্থিতি তারা মহা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। নারী শিকারীর এ ধরনের মৃগয়া কেবল সেখানেই সার্থক হয়ে থাকে, যেখানে নারী নিজে দুর্বলমনা, প্রতিরোধহীন, যে শিকার হবার জন্যে –পর পুরুষের হাতে ধরা দেবার জন্যে কায়মনে প্রস্তুত হয়েই থাকে। নারীদেরকে সাবধান ও সতর্ক করে তোলবার জন্যেই আল্লাহর এ নির্দেশবাণী অবতীর্ণ হয়েছে। অপরদিকে সাধারণভাবে সব পুরুষকেই রাসূলে করীম (স) স্বামী বা বাড়ির পুরুষের অনুপস্থিতিতে ঘরের মেয়েদের সাথে কথা বলতেই নিষেধ করেছেন। হযরত আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণনা করেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

নবী করীম (স) মেয়েলোকদের সাথে তাদের স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।

মেয়েরা যদি ভিন পুরুষের সাথে কতা বলতে বাধ্যই হয়, না বলে যদি কোনো উপায়ই না থাকে, তাহলে কুরআনের নির্দেশ হচ্ছেঃ

(আরবী************************) –খুব ভাল ও প্রচলিত ধরনের কথা বলবে।

এ আয়াতাংশের তাফসীরে আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

তারা বলবে সাধারণভাবে লোকদের কাছে পরিচিত ও প্রচলিত কথা, যার মধ্যে সন্দেহ-সংশয়ের লেশমাত্র থাকবে না এবং যা হবে শরীয়তের রীতিনীতি অনুযায়ী, যে কথা শুনে শ্রোতা অপছন্দও কিচু করবে না এবং পাপী ও চরিত্রহীন লোকেরা অবৈধ সম্পর্কের লোভে লালায়িতও হবে না।

সে সঙ্গে একথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, মেয়েদের সাধারণ কথাবার্তা খুবই নিম্নস্বরে হওয়া বাঞ্চনীয়। উচ্চৈস্বরে বা তীব্র কণ্ঠে কথা বলা মেয়েদের শোভা পায় না। দ্বিতীয়ত উচ্চৈস্বরে কথা বললে দূরের লোকের পর্যন্ত তার কথা শুনতে পাবে। পূর্বোক্ত আয়াতেরই ব্যাখ্যায় আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, মেয়েদের কন্ঠস্বর উচ্চ হবে না, অন্য লোকরা তাদের কণ্ঠস্বর শুতনে পাবে না –এই হচ্ছে মেয়েদের জন্যে অতি উত্তম নীতি।

বস্তুত একথা ভুল যেতে পারে না যে, মেয়েদের শরীরের ন্যায় তাদের কণ্ঠস্বরও পর্দায় রাখতে হবে। দেহকে যেমন ভিন পুরুষের সামনে অনাবৃত করা যায় না, কণ্ঠস্বরকেও তেমনি ভিন পুরুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করানো যায় না। ইমাম ইবনুল হাম্মাম বলেছেনঃ

(আরবী****************) –নিশ্চয়ই মেয়েলোকের সুরেলা কন্ঠস্বর ভিন পুরুষ থেকে লুকোবার জিনিস। ঠিক এজন্যেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

নামাযে ইমামের ভুল হলে সেই জামা’আতে শরীক পুরুষেরা তাকবীর বলবে আর মেয়েরা হাত মেরে শব্দ করবে।

এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, মেয়েদের কণ্ঠস্বর অবশ্য গোপনীয়, ভিন পুরুষ থেকে তা অবশ্যই লুকোতে হবে। (আবরী************)

এরই ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, মেয়েরা নামাযে যদি উচ্চৈস্বরে কুরআন পাঠ করে তবে তাতে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। (আরবী********************)

শুধু কণ্ঠস্বরই নয়, মেয়েদের অলংকারাদির ঝংকারও ভিন পুরুষদের কর্ণকুহর থেকে গোপন করতে হবে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************)

এবং তারা যেন নিজেদের পা মাঠির ওপর শক্ত করে না ফেলে, কেননা তাতে করে তাদের গোপনীয় অলংকারাদির ঝংকার শুনিয়ে দেয়া হবে।

আর জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা পায়ে পাথরকুচি ভরে মল পরত আর তারা যখন চলাফেরা করত, তখন শক্ত করে মাটিতে পা ফেলত। এতে পা ঝংকার দিয়ে উঠত। এ আয়াতে তা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

ইমাম বায়যাবী লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

অলংকারাদি জাহির করার ব্যাপারে একটা পূর্ণমাত্রার নিষেধ এবং মেয়েদের কণ্ঠস্বর উচ্চ করা যে নিষেধ, তাও এ থেকে প্রমাণিত।

কেননা অলংকারের ঝংকার শুনতে পেলেও ভিন পুরুসের মনে অতি সহজেই যৌন আকর্ষণ জেগে ওঠে। তাই নিখুঁত পর্দা রক্ষার জন্যে অলংকারের ঝংকারও পরপুরুষ থেকে লুকোতে হবে। আল্লামা যামাখশারী এ আয়াতের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

মেয়েদেরকে যখন অলংকারের শব্দ জাহির করতে নিষেধ করা হয়েছে, তখন জানা গেল যে, অলংকার ব্যবহারের অঙ্গসমূহ গোপন করা আরো বেশি করে নিষিদ্ধ হবে।

ভিন স্ত্রী-পুরুষের গোপন সাক্ষাতকার

পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মেয়ে পুরুষের অবাধ দেখা-সাক্ষাতের জন্যে একটা পরিসর রয়েছে এবং সে পরিসরের বাইরে মেয়ে পুরুষের দেখা-সাক্ষাত করা, কথাবার্তা বলা ও গোপন অভিসারে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম। যে আয়াতে ঘরের মেয়েলোকদের কাছে কোনো জরুরী জিনিস চাইতে হলে পর্দার আড়ালে থেকে বাইরে বসে চাইতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সে আয়াতেরই ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

এ আয়াত প্রত্যেক মু’মিন ব্যক্তির জন্যে একটি নীতি শিক্ষা দেয় এবং গায়র-মুহাররম মেয়েলোকদের সাথে গোপনে মিলিত হওয়া ও পর্দার অন্তরাল ছাড়াই পরস্পরে কথাবার্তা বলা সম্পর্কে স্পষ্ট ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।

নবী করীম (স)-ও একথাই বলেছেন নিম্নোদ্ধৃত হাদীসেঃ

(আরবী*****************************************************************))

যে সব মহিলার স্বামী বা নিকটাত্মীয় পুরুষ অনুপস্থিত, তাদের কাছে যেও না। কেননা তোমাদের প্রত্যেকের দেহের প্রতিটি ধমনীতে শয়তানের প্রভাব রক্তের মতো প্রবাহিত হয়।

অন্যত্র আরো কঠোর ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোনো ব্যক্তিই যেন এমন মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত না হয়, যার সাথে তার আপন মুহাররম কোনো পুরুষ নেই। কেননা গোপনে মিলিত এমন দুজন স্ত্রী পুরুষের সাথে শয়তান তৃতীয় হিসেবে উপস্থিত থাকে। ঠিক এ কারণেই সতীসাধ্বী স্ত্রী হওয়ার জন্য অপরিহার্য গুণ হিসেবে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

স্বামীর ঘরে তার অনুমতি ছাড়া কোনো লোককেই প্রবেশ করতে দেবে না।

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী এ হাদীসের অর্থ লিখেছেন এ ভাষায়ঃ

(আরবী******************************************************************)

অর্থাৎ স্ত্রী তার স্বামীর ঘরে স্বামীর পছন্দ নয় –এমন পুরুষ বা স্ত্রীলোককে প্রবেশ করার অনুমতি দেবে না। কেননা এতে করে খারাপ খারাপ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে এবং তার ফলে স্বামীর মনে আত্মমর্যাদাবোধ তীব্র হয়ে উঠে দাম্পত্য সম্পর্ককেই ছিন্ন করে দিতে পারে।

স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগ তার স্ত্রীর কাছে কোনো গায়র-মুহাররম পুরুষের উপস্থিতি এবং তার ঘরে প্রবেশ করা ইসলামী শরীয়তে বড়ই গুনাহের কাজ, নিষিদ্ধ এবং অভিশপ্ত। হাদীসে এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনার উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) একদা বাইরে থেকে এসে তাঁর ঘরে তাঁর স্ত্রীর কাছে বনু হাশিম বংশের কিছু লোককে উপস্থিত দেখতে পান। তিনি গিয়ে নবী করীম (স)-এর কাছে বিষয়টি বিবৃত করেন এবং বলেন যে, ঘটনা এই; কিন্তু ভালো ছাড়া খারাপ কিছু দেখতে পাইনি; তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী*****************************) –খারাবী থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্ত করেছেন।

অতঃপর তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন এবং ঘোষণা করলেনঃ

(আরবী************************************************************)

আজকের দিনের পর কোনো পুরুষই অপর কোনো ঘরের স্ত্রীর কাছে তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে কখনো প্রবেশ করবে না, যদি না তার সাথে আরো একজন বা দুইজন পুরুষ থাকে।

হযরত ফাতিমা (রা) –এর ঘরে প্রবেশ করার জন্যে হযরত আমর ইবনে আ’স (রা) একদিন বাইরে থেকে অনুমতি চাইলেন। তাঁকে অনুমতি দেয়া হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ওখানে আলী উপস্থিত আছে কি? বলা হলঃ ‘না, তিনি নেই”। একতা শুনে হযরত আমর ফিরে চলে গেলেন। পরে আবার এসে অনুমতি চাইলে হযরত আলী উপস্থিত কিনা জিজ্ঞেস করলেন। বলা হলো –তিনি ঘরে উপস্থিত রয়েছে। অতঃপর হযরত আমর প্রবেশ করলেন। হযরত আলী জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী*********************************************************************************)

আমাকে এখানে অনুপস্থিত পেয়ে তুমি ঘরে প্রবেশ করলে না কেন –কে নিষেধ করেছিল?

তখন হযরত আমর বললেনঃ

(আরবী************************************************************************)

যে মেয়েলোকের স্বামী উপস্থিত নেই, তার ঘরে প্রবেশ করতে রাসূলে করীম (স) আমাদরে নিষেধ করেছেন।

এ পর্যায়ে অধিকতর কঠোর বাণী ঘোষিত হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীসে। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

যে পুরুষ লোক স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোনো মেয়েলোকের শয্যায় বসবে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তার উপর (তার শাস্তির জন্যে) একটি বিষধর অজগর নিযুক্ত করে দিবেন।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এসব হাদীসের ভিত্তিতে লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************)

এ পর্যায়ের সমস্ত হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর কাছে কোনো একজন পুরুষের প্রবেশ করা এবং ভিন-গায়র মুহাররম মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত হওয়া সম্পূর্ণ হারাম এবং এ সম্পর্কে সকল ইসলামবিদ সম্পূর্ণ একমত।

ইমাম নববী লিখেছেনঃ দুইজন-তিনজন পুরুষের প্রবেশ জায়েয প্রমাণিত হয় যে, হাদীস থেকে তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। এজন্যে একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতিতে কোনো দুষ্কৃতির কল্পনা করা যায় না। অন্যথায়, তা সত্ত্বেও যদি দুষ্কার্য হওয়ার সম্ভাবনা দেকা দেয় তাও হারাম। (আরবী************)

স্বামীর উপস্থিতিতেও যেমন এ কাজ করা যেতে পারে না, তেমনি তার অনুপস্থিতিতেও করা যেতে পারে না। বরং স্বামীর অনুপস্থিতিতে এ কাজ এক ভয়ানক অপরাধে পরিণত হয়ে যায়।

বস্তুত স্বামীর নিকটাত্মীয় বন্ধুদের সাথে স্ত্রীর এবং স্ত্রীর নিকটাত্মীয় বান্ধবীদের সাথে স্বামীর –মুহাররম নয় এমন সব মেয়ে পুরুষের –গোপন সাক্ষাতকার বড়ই বিপদজনক হয়ে থাকে। উপরোক্ত হাদীসে মেয়েদেরকে যেমন সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলবার জন্যে, তেমনি নিম্নোদ্ধৃত হাদীসে সাবধান করে দেয়া হয়েছে পুরুষদের।

রাসূলে করীম (স) কড়া ভাষায় বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

তোমরা পুরুষেরা গায়র-মুহাররম মেয়েলোকের কাছে যাওয়া-আসা থেকে দূরে থাকো –সাবধান থাক।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

এ হাদীস থেকে যে দুটি কথা প্রমাণিত হয়, তার একটি হচ্ছে, ভিন মেয়েলোকদের সাথে পুরুষের নিরিবিলিতে গোপনবাবে মিলিত হওয়া নিষেধ; আর দ্বিতীয়তটি হচ্ছে স্বামী বা ঘরের পুরুষ উপস্থিত নেই এমন মেয়েলোকের ঘরে প্রর্বেশ করা নিষেধ।

রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশের ফলে এ দুটো কাজই হারাম। এ পর্যায়ে দেবর-ভাসুর সম্পর্কে পুরুষদের সাথে মেয়েদের একাকীত্বের সাক্ষাত সর্বাধিক বিপদজনক এবং এ ব্যাপারে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করার জন্যে স্পষ্ট নির্দেশও রয়েছে।

রাসূলে করীম (স)-এর উপরোক্ত কতা শুনে একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী***********************************************************)

হে রাসূল, দেবর-ভাসুর প্রভৃতি স্বামীর নিকটাত্মীয় পুরুষদের সম্পর্কে আপনি কি নির্দেশ দিচ্ছেন?

জবাবে তিনি বলেনঃ

(আরবী**********) –স্বামীর এসব নিকটাত্মীয়রাই হচ্ছে মৃত্যুদূত।

(আরবী*******) শব্দের অর্থ কি? –এ সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের বিভিন্ন কথা উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী বলেছেনঃ

(আরবী*************) –‘হামো’ মানে স্বামীর ভাই –স্বামীর ছোট হোক কি বড়।

ইমাম লাইস বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************)

‘হামো’ হচ্ছে স্বামীর ভাই, আর তারই মতো স্বামীর অপরাপর নিকটবর্তী লোকের যেমন চাচাত, মামাত, ফুফাত ভাই ইত্যাদি।

ইমাম নববীর মতে ‘হামো’ মানে হচ্ছেঃ

(আরবী*****************************************************************************)

স্বামীর নিকটবর্তী লোক –আত্মীয়, স্বামীর বাপ ও পুত্র সন্তান –এর মধ্যে শামিল নয়। কেননা তারা তো স্ত্রীর জন্যে মুহাররম। এদের সঙ্গে একাকীত্বে একত্রিত হওয়া শরীয়তে জায়েয। কাজেই এদেরকে মৃত্যুদূত বলে অভিহিত করা যায় না।

বরং এর সঠিক অর্থে বোঝা যায়ঃ

স্বামীর ভাই, স্বামীর ভাইপো, স্বামীর চাচা, চাচাত ভাই, ভাগ্নে এবং এদেরই মতো অন্যসব পুরুষ যাদের সাথে এ মেয়েলোকের বিয়ে হতে পারে, যদি না সে বিবাহিতা হয়। ৱ

কিন্তু নবী করীম (স) এদেরকে মৃত্যু বা মৃত্যুদূত বলে কেন অভিহিত করেছেন? এর কারণস্বরূপ বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************)

সাধারণ প্রচলিত নিয়ম ও লোকদের অভ্যাসই হচ্ছে এই যে, এসব নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়। (এবং এদের পারস্পরিক মেলা-মেমায় কোনো দোস মনে করা হয় না) ফল তাই ভাইর বউর সাথে একাকীত্বে মিলিত হয় এ কারণেই এদেরকে মৃত্যু সমতূল্য বলা হয়েছে। আল্লামা কাযী ইয়ায বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

স্বামীর এসব নিকটাত্মীয়ের সাথে স্ত্রীর (কিংবা স্ত্রীর এসব নিকটাত্মীয়ের সাথে স্বামীর) গোপন মেলামেশা নৈতিক ধ্বংস টেনে আনে।

ইমাম কুরতুবী বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************)

এ ধরনের লোকদের সাথে গোপন মিলন নৈতিক ও ধর্মের মৃত্যু ঘটায় কিংবা স্বামীর আত্মসম্মানবোধ তীব্র হওয়ার পরিণামে তাকে তালাক দেয় বলে তার দাম্পত্য জীবনের মৃত্যু ঘটে। কিংবা এদের কারোর সাথে যদি জ্বেনায় লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে সঙ্গেসার কারার দণ্ড দেয়া হয়, ফল তার জৈবিক মৃত্যুও ঘটে।

স্বামী বা স্ত্রীর নিকটাত্মীয়-আত্মীয়দের ব্যাপারে শরীয়তে যখন কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন স্বামীর পুরষ বন্ধুদের সাথে স্ত্রীর এবং স্ত্রীর বান্ধবীদের সাথে স্বামীর অবাধ মেলামেশা, বাড়িতে-পার্কে, হোটেল-রেস্তোরায় আর পথে-ঘাটে কি অফিসে-ক্লাবে গোপন অভিসার কিভাবে বিধিসম্মত হতে পারে! অথচ তাই চলছে বর্তমান সামজের সর্বস্তরে। এখনকার সমাজে শালার বউ আর বউর বোন অর্ধেক বধু। স্ত্রীর বান্ধবী আর স্বামীর বন্ধুরাই হচ্ছে নিঃসঙ্গের সঙ্গী –আসর বিনোদনের সামগ্রী, আনন্দের ফল্গুধার। ভাবীর বোন আর বোনোর ননদও এ ব্যাপারে কম যায় না। বন্ধু বাড়ীতে বন্ধুর স্ত্রীর আদর-আপ্যায়ন ও খাবার টেবিলে পরিবেশন না করলে বন্ধুত্বই অর্থহীন। শ্বশুর বাড়িতে শালার বউ আদর-যত্ন না করলে শ্বশুর বাড়িতে আর মধুর হাঁড়ির সন্ধান পাওয়া যায় না। বোনের সহপাঠিনী আর সহপাঠির বোনের তো নিত্য সহচরী, গোপন অভিসারের মধু-মল্লিকা। কিন্তু এর পরিণামটা কি হচ্ছে? নৈতিক পবিত্রতা বিলীন হচ্ছে। বিয়ের আগেই কার্যের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হচ্ছে; আর যুবক-যুবতীরা হারাচ্ছে তাদের মহামূল্য কুমারিত্ব।

নর-নারীর অবাধ মেলামেশার এ মারাত্মক পরিণতি অনিবার্য বলেই আল্লাহ তা’আলা তা চিরতরে হারাম করে দিয়েছেন। অন্যথায় এর মূলে নারী-পুরুষের প্রতি কোনো খারাপ ধারণার স্থান নেই। মানব চরিত্র ও মানুষের স্বভাবই এমন যে, তার জন্যে এরূপ নিয়ম বিধান না থাকলে জীবনই দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। শুষ্ক খড় কুটোর স্তুপের কাছাকাছি আগুন নিয়ে খেলা করতে দিয়ে যে কোনো মুহুর্তে সে আগুন লেগে সব জ্বলে ভস্ম হয়ে যেতে পারে, তাতে আর সন্দেহ কি।

ইসলামে যেহেতু মানুষের নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা এবং পারিবারিক স্থায়িত্বই হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান ও সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কোনো মূল্যে তা রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এ জন্যেই ইসলাম এমন কিছুই বরদাশত করতে রাজি নয়, যার ফলে এক্ষেত্রে ভাঙন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্যে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************)

তোমরা গায়র-মুহাররম মেয়েলোকদের সাথে গোপনে ও একাকীত্বে মিলিত হবে না। আল্লাহর শপথ, যেখানেই একজন পুরুষভিন মেয়েলোকের সাথে গোপনে মিলিত হবে, সেখানেই তাদের দুজনার মধ্যে শয়তান অবশ্যই প্রবেশ করবে ও প্রভাব বিস্তার করবে।

ব্যাপাটিকে আমরা এভাবেও বুঝতে পারি যে, ইলেকট্রিক লাইনের দুটো করে তার থাকে, একটি ‘পজিটিভ’ আর অপরটি ‘নেগেটিভ’। এ দুটোই অপরিহার্য, একটি ছাড়া অপরটি অর্থহীন। কিন্তু এ দুটো থেকেসত্যিকার আলো জ্বলা বা পাখা চলার কাজ পাওয়া যেতে পারে তখন, যখন উভয় তারকে বিশেষ এক ব্যবস্থাধীন পরস্পরের সাথে যুক্ত করা হয়। কিন্তু দুটো পাশাপাশি চলতে গিয়ে চলাবস্থাতে যদি পারস্পরিক ব্যবচ্ছেদ ছিণ্ন করে দিয়ে মিলিত হয়ে পড়ে তাহলে তাতে আলো জ্বলবে না, পাখা চলবে না, বরং এমন আগুন জ্বলে উঠবে, তার ফলে গোটা ঘর-সংসার জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।

নারী-পুরুষও নেগেটিভ-পজিটিভ দুই বিপরীতমুখী, বিপরীত গুণ-সম্পন্ন শক্তি। এ দুয়োর সমন্বয়ে যদি মানবতার কল্যাণ লাভ করতে হয় তাহলে অবশ্যই এক নির্দিষ্ট নিয়মে উভয়ের মিলন সম্পন্ন করতে হবে। ঘাটে-পথে, হাটে-মাঠে, পার্কে-ক্লাবে আর হোটেল-রেস্তোরায় যদি এদের অবাধ মেলামেশাকে সম্ভব করে দেয়া হয় তাহলে নৈতিকতা ও মনুষ্যত্যের অপমৃত্যু অনিবার্য। দাম্পত্য জীবনের পবিত্রতা আর পারিবারিক সুস্থতা ও শান্তি-তৃপ্তি নিঃশেষে ফুরিয়ে যাবে, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই। বর্তমানে ইউরোপ আমেরিকার সমাজে এ কথাই অকাট্য হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। বস্তুত যে সমাজে একটি কুমারী মেয়েও সন্ধান করে পাওয়া যায় না সে সমাজ যে মানুষের সমাজ নয়, নিতান্ত পশুর –পশুর চাইতেও নিকৃষ্টতম জীবনের সমষ্টি, তাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা সত্যিই বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

মানুষকে অতীব উত্তম মানদণ্ডে সৃষ্টি করেছি বটে; কিন্তু অতঃপর তাদের অমানবিক কার্যখলাপের দরুনই তাদের নামিয়ে দিয়েছি চরমতম নিম্ন পংকে।

ঘরের অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা সংরক্ষণ

একটি ঘরকেই কেন্দ্র করে সুষ্ঠু দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। স্বামী ও স্ত্রীর ভালোবাসা, পরস্পরের সহানুভূতি, সংবেদন ও প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে গড়ে ওঠে এক নতুন সংসার। ইসলাম এ ঘর ও সংসারের সম্ভ্রম, মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষার্থে বিবিধ ব্যবস্থা পেশ করেছে। এ উদ্দেশ্যে কতগুলো জরুরী নিয়ম বিধান –যা যথাযথভাবে পালন করলে পারিবারিক জীবনে মাধুর্যময় ও নিশ্চয়তা ভিত্তির আস্থঅ ও বিশ্বাসপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং স্বাম স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি –সকলেই সেখানে নিরবিচ্ছিন্ন আশার ও শান্তি-সুখ লাভ করতে পারে। প্রত্যেকেই পূর্ণ আযাদী, সম্ভ্রম ও পূর্ণ সংরক্ষণের মধ্যে কালাতিপাত করতে পারে।

ঘরের পরিবেশকে পবিত্রময় করে গড়ে তোলার জন্য সর্বপ্রথম কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতটির দিকে লক্ষ্য দেয়া উচিত। আল্লাহ তা’আলা নবীর বেগমদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

এবং তোমরা স্মরণ করো –স্বরণে রাখো তোমাদের ঘরে আল্লাহর যেসব আয়াত ও হিকমতের কথা তিলাওয়াত করা হয়, তা। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলা সূক্ষ্মদর্শী, অনুগ্রহসম্পন্ন ও সর্ববিসয়ে অবহিত।

রাসূলের বেগমদের লক্ষ্য করে বলা এ কথা সাধারণভাবে সব মেয়ের প্রতিই প্রযোজ্য, একথা বলাই বাহুল্য। অতএব এ নির্দেশ পালিত হওয়া উচিত সব পালিত হওয়া উচিত সব মুসলিম ঘরে ও সংসারে।

‘আল্লাহর আয়াত ও হিকমত’ বলতে বোঝানো হয়েছে কুরআন মজীদ এবং রাসূলের সুন্নাত। কেননা এ দুয়ের মধ্যেই রয়েছে জীবন ও সৌভাগ্য, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শের পূর্ণ শিক্ষা। আর যা তিলাওয়াত করা হয়, মানে –এ দুটো জিনিসের শিক্ষা, প্রচার এবং আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া ইচত প্রত্যেকটি মুসলিমের ঘরে –ঘরের স্ত্রী পুত্র পরিজন সকলের সামনে এবং সে তিলাওয়াত জীবনে একবার কি বছরে বা নামকাওয়াস্তে হলে চলবে না। হর-হামেশা পারিবারিক কার্যসূচীর অপরিহার্য অংশ হিসেবে তা রীতিমতই হওয়া কর্তব্য। বিশেষ করে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কিত আদেশ-নিষেধ, উপদেশ-নসীহত ও বিধি-বিধান এবং রীতিনীতি তো অবশ্যই আলোচিত হতে হবে। অন্যথায় পারিবারিক জীবন আল্লাহর অনাযিল ও অফুরন্ত রহমত লাভ করতে ব্যর্থ হবে।

কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলের আদেশ-উপদেশসমূহ এভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করতে নির্দেশ দেয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেমন তদনুযায়ী পারিবারিক জীবন চালিত হয়, পরিবারের প্রত্যেকটি নর-নারী বাস্তবভাবে পালন করে চলে আল্লাহ ও রাসূলের দেয়া বিধিব্যবস্থা। আর এ কাজ তখনি সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, যখন কুরআন ও হাদীসের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয় পরিবারের লোকজনকে। আর কেবল শিক্ষা দিয়েই যেন ক্ষান্ত করা না হয়, বরং নিত্যনৈমিত্তিক কার্যসূচী হিসেবে তা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।

বস্তুত ‘স্মরণ করো’ মানেই হচ্ছে আমল করো। আর আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী যে ঘরে ও পরিবারে সঠিকভাবে আমল করা হবে, তা যে বাস্তবিকই পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক ও নির্ভেজাল প্রেম-ভালোবাসায় পূর্ণ হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না।

প্রত্যেকটি পরিবারেরই এমন এক নির্ভরযোগ্য নিজস্ব পরিমণ্ডল প্রয়োজন, যার মধ্যে কেউ অধিকার প্রবেশ করতে পারবে না। যেখানে পরিবার, পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই নিজস্বতায় পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত, সেকানে যেমন প্রত্যেকটি ব্যক্তিই পূর্ণ স্বাধীনতা ও মানসম্ভ্রমসহ দিনাতিপাত করতে পারবে, তেমনি পারবে সকলের পারস্পরিক সম্প্রীতি ও নির্ভরতায় এক অখণ্ড পরিবার সংস্থা গড়ে তুলতে। এজন্যে বাইরের লোকদের যেমন বিনানুমতিতে কারো ঘরে প্রবেশ করার অধিকার দেয়া হয়নি, তেমনি একই ঘরের লোকদেরও বিশেষ কয়েকটি সময়ে একে অপরের নিজস্ব কক্ষে বিনানুমতিতে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************************************)

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমাদের ক্রীতদাস-দাসী এবং অপূর্ণ বয়স্ক ছেলেপেলেরা যেন তিনবার তোমাদের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করে তোমাদের ঘরে প্রবেশ করার জন্যে, ফযরের নামাযের পূর্বে দ্বিপ্রহরে যখন তোমরা জামা-কাপড় খুলে ফেল এবং এশার নামাযের পর। এই তিনটি সময় হচ্ছে তোমাদের জন্যে অবশ্য গোপনীয়। এ ছাড়া অন্যান্য সময় তোমাদের কাছে বিনানুমতিতে আসা-যাওয়ায় তোমাদের কোনো দোষ হবে না –তাদেরও হবে না। তোমাদের পরস্পরের কাছে তো বারবার আসা-যাওয়া করতেই হয়।

আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

এ আয়াত কয়টি হচ্ছে কাছাকাছির ও একই বাড়িতে অবস্তানরত আপন লোকদের পরস্পরের কাছে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা সম্পর্কে।

এ আয়াত একথাও প্রমাণ করে যে, ঘরের কাজকর্ম করার জন্যে দাস-দাসী যেমন নিয়োগ করা যেতে পারে তেমনি চাকর-চাকরাণীও নিয়োক করা যায়। তবে চাকরদের অবশ্য অল্প বয়স্ক –অত্যন্ত অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা বিগত যৌবনা হওয়া বাঞ্ছনীয়।

এ আয়াত তিনটি সময়কে প্রত্যেকের জন্যে একান্ত নিজস্ব করে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।

প্রথম হচ্ছে ফযরের নামাযের পূর্ব সময়। কেননা এ সময়টিতে মানুষ সাধারণত নিজেদের শয্যায় ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে থাকে। কে কি অবস্থায় ঘুমিয়ে রয়েছে, পূর্ণ শরীর ঢেকে রয়েছে, না উলঙ্গ অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে আছে তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তাছাড়া একাকী এক বিছানায় শুয়ে আছে, না স্বামী-স্ত্রীতে মিলে একান্ত নিবিড় হয়ে রয়েছে, তারও কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকবার কথা নয়। কাজেই আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে –এ সময় অপর কোনো লোক –সে যতই কাছের হোক না কেন; এমনকি দাস-দাসী আর অল্প বয়স্ক চাকর চাকরাণীই হোক না কেন –অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করবে না। কেননা বিনানুমতিতে প্রবেশ করলে কোনো অবাঞ্চিত দৃশ্য তাদের চোখে পড়া এবং তা সকলের পক্ষে লজ্জার বা অপমানের কাণ হওয়া বিচিত্র নয়।

দ্বিতীয় হচ্ছে দ্বিপ্রহরে। যখন লোকেরা –মেয়েরা পুরুষরা –কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে পারে, স্বামীতে স্ত্রীতে মিলে একান্তে শয্যাশায়ী হতে পারে। আর সে অবস্থায় অপর কারো সামনে যেতে বা কারো চোখে পড়তে কেউই রাজি হতে পারে না। আর তৃতীয় হচ্ছে এশার নামাযের পর। কেননা এ সময় লোকেরা সারা দিনের যাবতীয় কাজকর্ম চুকিয়ে দিয়ে শয্যার ক্রোড়ে একান্তভাবে ঢলে পড়ার জন্যে প্রস্তুত হয়। কে কিভাবে শুতে যায়, একাকী এক শয্যায় শয়ন করে কি স্ত্রীকে কাছে ডেকে নেয়, তা অপর কারো জানা থাকার কথা নয়। কাজেই এ সময়ও প্রত্যেক ব্যক্তির থাকা উচিত পূর্ণ স্বাধীনতা, একান্ত নিশ্চিন্ততা ও সুগভীর নিবিড়তা। বিনানুমতিতে কারো প্রবেশ তাতে অবশ্যই ব্যাঘাত জন্মাবে। এসব কারণে আল্লাহ তা’আলা এ তিনটি সময়কে বলেছেন (আরবী*********) আর ইমাম রাগিবের ভাষায় তার মানে হচ্ছেঃ

(আরবী******************************************************************)

মানুষের লজ্জা-শরম। এ শব্দটি রূপক। এর আসল অর্থ হচ্ছে শরম লজ্জা। কেননা এ এমন ব্যাপার যা প্রকাশিত হলে লজ্জা ও অপমান দেখা দিতে পারে।

বস্তুত কুরআন নির্দেশিত এ তিনটি সময়ও এমনি, যখন আকস্মিকভাবে অপর কারো নজরে পড়লে লজ্জা বা দুর্নামের কারণ ঘটতে পারে। এ তিনটি সময় ছাড়া অন্যান্য এমন, যখন কারো পক্ষেই অসতর্ক ও অসংবৃত্ত হওয়ার সাধারণত সম্ভাবনা থাকে না, সে কারণে অন্যান্য সময়ে সাধারণত ঘরে লোকদের পরস্পরের কাছে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে অনেক কাজই সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। কেননা তারা তো (আরবী********) –তোমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে, কাজ করবে এজন্যেই নিয়োজিত হয়েছে। আর চাকর-বাকরদের ব্যাপারে অনেক কিছুই এমন নয়, যা বাহ্যত আপত্তিকর হলেও সেখানে আপত্তি করা চলে না। ঠিক এ কারণেই রাসূলে করীম (স) বিড়াল-বিড়ালী সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

বিড়াল-বিড়ালী নাপাক নয়, কেননা ওরা তো তোমাদের চারপাশে সব সময় ঘোরাফেরা করতেই থাকে।

এ আয়াতটি সম্পর্কে মনে রাখা দরকার যে, তা পূর্ণ মর্যাদা সহকারে বহাল এবং তার কার্যকরতা শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, লোকেরা এ আয়াত অনুযায়ী আমল করে খুবই কম। এ আয়াতটি সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা হচ্ছেন সর্বাধিক পরিমাণে গোপনতা বিধানকারী। কাজেই তিনি গোপনতা অবলম্বনকে খুবই ভালোবাসেন, পছন্দ করেন।

ইমাম সুদ্দী বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

সাহাবীদের অনেকেই এই এই সময়ে নিজেদের স্ত্রীদের সাথে যৌন মিলনে প্রবৃত্ত হওয়া পছন্দ করতেন, যেন তারপর গোসল করে তাঁরা নামাযের জন্যে চলে যেতে পারেন। এ কারণে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের এ নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন চাকর-গোলামদের এই সময়ে বিনানুমতিতে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করতে না দেন।

নির্দিষ্ট তিনটি সময় ছাড়াও একই ঘরের নিকটাত্মীয়দের পরস্পরের শয়নকক্ষে প্রবেশ করার জন্যে অনুমতি গ্রহণ প্রয়োজন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ

(আরবী*************************************************************)

তোমাদের মা’দের কক্ষে প্রবেশ করার জন্যে পূর্বাহ্নে অনুমতি গ্রহণ তোমাদের কর্তব্য।

তাঊস তাবেয়ী বলেনঃ

(আরবী****************************************************************)

কোনো মুহাররম মেয়েলোকের লজ্জাস্তান দেখা অপেক্ষা অধিক ঘৃণার ব্যাপার আমার কাছে আর কিছু নেই।

আতা ইবনে আবূ রিবাহ হযরত আব্বাস (রা)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

আমার কয়েকটি ইয়াতিম বোন রয়েছে, যারা আমার কোলে লালিতা-পালিতা, আমার সাথে একই ঘরে বসবাস করে, তাদের সামনে যেতেও কি আমি পূর্বাহ্নে অনুমতি গ্রহণ করব?

হযরত ইবনে আব্বাস বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই অনুমতি নেবে। পরে বললেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

তুমি কি তাদরে ন্যাংটা ও উলঙ্গ দেখা পছন্দ করো?

আতা বললেনঃ না, কখনই নয়। তিনি বললেনঃ “তা হলে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করবে”।

নিজ স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ করতে হবে কিনা –এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে আতা বলেনঃ ‘না’। কিন্তু আল্লামা কাসীর লিখেছেনঃ তার মানে স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে তার কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ ‘ওয়াজিব’ নয়; অন্যথায়ঃ

(আরবী***************************************************************)

ঘরে প্রবেশের পূর্বে স্ত্রীকে জানিয়ে দেয়া ভালো যে, সে তার ঘরে প্রবেশ করছে। তার সামনে হঠাৎ করে উপস্থিত হওয়া উচিত নয়। কেননা সে হয়ত এমন অবস্থায় রয়েছে, যে অবস্থায় স্বামী তাকে দেখতে পাক –তা সে আদৌ পছন্দ করে না।

আপন মা, বোন ও স্ত্রীর ঘরে প্রবেশের পূর্বে যখন অনুমতি গ্রহণ এবং প্রবেশ সম্পর্কে আগাম জানান দেয়া সম্পর্কে এত তাগিদ, তখন ভিন ও গায়র-মুহাররম মেয়েদের –তারা যত নিকটাত্মীয়া হোক না কেন –নিকট বিনানুমতিতে প্রবেশ করাকে ইসলাম কি বরদাশত করতে পারে?

এ অনুমতি নিয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করা সম্পর্কিত নির্দেশের ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে আল্লামা যামাখশারী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

এর কারণ এই যে, অনুমতি লওয়া কেবল এ জন্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়নি যে, কোনো সহসা অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তি কোনো গোপনীয় জিনিস দেখে ফেলতে পারে এবং হালাল নয় এমন জিনিসের ওপর তার নজর পড়ে যেতে পারে। বরং এ জন্যেই তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যেন বাইরে থেকে আসা কোনো ব্যক্তি ঘরের এমন সব অবস্থাও জানতে না পারে, যা মানুষ সাধারণত অপরের কাছ থেকে গোপনই রাখতে চায় এবং অপর লোক যাতে তা জানতে না পারে, তার জন্যে চেষ্টা করে। এরূপ অবস্থায় বিনানুমতিতে প্রবেশ করলে অপর লোকের কর্তৃত্বের এলাকার ওপর অনধিকার চর্চা হয়। অতএব কারো ঘরে প্রবেশ তার অনুমতি ছাড়া হওয়া উচিত নয়।

অন্যথায় তার মনে ক্রোধ প্রবল হয়ে ওঠার ও অন্যের প্রাধান্য অস্বীকার করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠবার আশংকা রয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়

পর্দার দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে ঘরের বাইরে বেরুলে বয়স্ক নারী পুরুষকে যে পর্দা ব্যবস্থা পালন করে চলতে হবে, তা-ই। এ পর্যায়ে আমাদের আলোচনার প্রথম ভিত্তি হচ্ছে প্রথম পর্যায়ে উদ্ধৃত আয়াতের দ্বিতীয় অংশ। পূর্ব আয়াতটি আবার পাঠ করতে হচ্ছে। বলা হয়েছেঃ

(আরবী********************************************************************)

এবং তোমরা তোমাদের ঘরের অভ্যন্তরে মজবুত হয়ে স্থিতি গ্রহণ করো –স্থায়ীভাবে বসবাস করো এবং তোমরা প্রথম কালের জাহিলিয়াতের নারীদের মতো নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ও যৌবনদীপ্ত দেহাঙ্গ দেখিয়ে বেড়িও না।

আয়াতের প্রথম অংশে মেয়েলোকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন নিজেদের ঘরেই স্থায়ীবাবে দৃঢ়তা সহকারে বসবাস করে। আর দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে, ঘরের বাইরে গিয়ে জাহিলী যুগের নারীদের মতো লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ভিন পুরুষদের সামনে হেসে গলে ঢলে পড়ো না, নিজেদের রূপ সৌন্দর্য ও যৌবনদীপ্ত দেহের কান্তি দেখিয়ে বেড়িও না, আয়াতের প্রথমাংশ ঘর সম্পর্কে আর দ্বিতীয়াংশ ঘরের বাইরের সাথে সংশ্লিষ্ট।

আয়াতে ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়নি, নিষেধ করা হয়েছে জাহিলী যুগের নারীদের মতো নির্লজ্জভাবে চলাফেরা করতে।

এ আয়াতে মুসলিম নারীদের যে ঘর থেকে বের হতে চূড়ান্তভাবে নিষেধ করা হয়নি, তার প্রথম প্রমাণ এই যে, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পরও মুসলিম মহিলারা ঘরের বাইরে গিয়েছেন। মসজিদে নামায পড়তে হজ্জ করার জন্যে বায়তুল্লাহ তওয়াফ করতে পিতামাতা-নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা করতে এবং আরো অনেক অনেক কাজে। এ আয়াতে যদি ঘরের বাইরে যেতে নিষেদই করা হতো তাহলে নিশ্চয়ই রাসূলে করীম (স) এসব কিছুতেই বরদাশ করতেন না। কিন্তু রাসূলের জীবদ্দশায়, সাহাবীদের যুগে এ কাজ যখন অবাধে সম্পন্ন হয়েছে, তখন সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, এ আয়াতে মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে যেতে সম্পূর্ণরূপে ও অকাট্যভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়নি। নিষেধ করা হয়েছে অন্য কিছু, যা শরীয়তে প্রকৃতই নিষিদ্ধ।

বরং দেখা যাচ্ছে যে, কুরআনের উপরোক্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করীম (স) মুসলিম মহিলাদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

তোমাদেরকে তোমাদের প্রয়োজনের দরুন ঘরের বাইরে যেতে অনুমতি দেয়া হয়েছে।

অপর এক হাদীসে কথাটি আরো অকাট্যঃ

(আরবী*****************************************************************)

মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে বের হবার কোনো অধিকারই রাখে না, তবে যদি কেউ খুব বেশি নিরুপায় হয়ে যায় বরং তার চাকরও না থাকে তবে সে প্রয়োজনীয় কাজের জন্যে বের হতে পারবে।

আল্লামা আলূসী এ পর্যায়ে লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ ও বাইরে যাওয়ার নিষেধ অকাট্য ও শর্তহীন নয়। তা যদি হতো তাহলে নবী করীম (স) এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মহিলাদের নিশ্চয়ই হজ্জ, উমরা ইত্যাদির জন্যে কখনো ঘরের বাইরে যেতে দিতেন না, যুদ্ধে জিহাদে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন না এবং বাপ-মার সাথে সাক্ষাতের জন্যে, রোগীকে দেখার জন্যে এবং নিকটাত্মীয়দের শোকে শরীক হওয়ার জন্যে কখনো বাইরে যেতে তাদের অনুমতি দিতেন না।

তাহলে এ আয়াতের সঠিক অর্থ কি হবে? আল্লামা আলূসীর ভাষায় বলা যায়ঃ

(আরবী**************************************************************)

মেয়েদেরকে ঘরে অবস্থান করতে নির্দেশ করা হয়েছে, কেননা এরই দ্বারা তাদের মর্যাদা ও বিশিষ্টতা সাধারণত মেয়েদের ওপর প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এর সঠিক অর্থ এই যে, তারা বেশির ভাগ সময় ও সাধারণত নিজেদের ঘরেই অবস্থান করবে এবং তারা খুব বেশি বাইরে গমনকারিণী, খুব বেশি লোকজনের ভীড়ে প্রবেশকারিণী এবং ঘাটে-পথে, হাটে-বাজারে, দোকানে-বিপনীতে ও লোকদের ঘরে ঘরে যাতায়াতকারিণী হবে না।

সানাউল্লাহ পনিপত্তী লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************************)

আয়াতে ঘর থেকে বের হতে একেবারে নিষেধ করে দেয়া হয়নি –যদিও নামায, হজ্জ কিংবা অপর কোনো মানবীয় জরুরী কাজে হোক না কেন।

আয়াতে বলা হয়েছে ‘তাবাররুজ’ করো না। এ ‘তাবাররুজ’ শব্দ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আল্লামা জামালুদ্দীন আল-কাসেমী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

‘তাবাররুজ’ মানে –হাস্যলাস্য ও লীলায়িত ভঙ্গীতে চলা, রূপ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করা, ভিন পুরুষের মনে যৌন স্পৃহা জাগিয়ে তোলা, খুব পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরা –যা মেয়েদের শরীর আবৃত করে না, গলদেশ, কণ্ঠহার ও কানের দুল-বালার চাকচিক্য জাহির করা এবং এ ধরনেরই অন্যান্য কাজ। আয়াতে এসবকেই নিষেধ করা হয়েছে, কেননা এরই ফলে আসে নৈতিক বিপর্যয় আর মহাগুনাহের দিকে পদক্ষেপ।

মুবরাদ বলেনঃ

(আরবী*******************************************************)

মেয়েলোকের যে রূপ-সৌন্দর্য ঢেকে রাখা কর্তব্য, তাকে জাহির করাই হচ্ছে ‘তাবাররুজ’।

লাইস বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

কোনো মেয়েলোক যখন তার মুখ ও দেহের সৌন্দর্য প্রকাশ করে আর সেই সঙ্গে তার ডাগর চোখের সৌন্দর্যভরা দৃষ্টিও পড়ে, তখন বলা হয় মেয়েলোকটি ‘তাবাররুজ’ করেছে।

আবূ উবায়দা বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************)

মেয়েরা যখন তাদের দেহের এমন সৌন্দর্য লোকদের সামনে প্রকাশ করে, যা পুরুষদের যৌন স্পৃহা উত্তেজিত করে তুলে, তখন তারা ‘তাবাররুজ’ করে।

মুবরাদ আরো বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা স্বামী ও প্রণয়ী যুগপতভাবে গ্রহণ করত। স্বামীর জন্যে তার দেহের নিম্নার্ধ নির্দিষ্ট রাখত, আর ঊর্ধ্বাংশ ছেড়ে দিত পুরুষ বন্ধু ও প্রণয়ীর ব্যবহারে। তারা স্পর্শ, চুম্বন ও লেহন দিয়ে তাকে ভোগ করত।

আল্লামা শাওকানীও এ কথাই লিখেছেনঃ

জাহিলিয়াতের যুগে মেয়েরা তাদের দেহের অশ্লীল অঙ্গসমূহ উন্মুক্ত ও অনাবৃত করে চলত। এমনকি এক-একজন মেয়েলোক তার স্বামী ও প্রণয়ীকে নিয়ে একসঙ্গে বসত। প্রণয়ী তার বস্ত্রের উপরিভাগ নিয়ে সুখ ভোগ করত আর স্বামী পরিতৃপ্ত হত তার দেহের বস্ত্রাবৃত নিম্নভাগ ব্যবহার করে। আবার কখনো সখনো একজন অপর জনের কাছ থেকে তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশ অদল-বদল করে নিতেও চাইত।

এ সব উদ্ধৃতি থেকে জাহিলিয়াতের নারী চরিত্র ও তদানীন্তন সমাজের বাস্তব ও প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত ও উদভাসিত হয়ে উঠেছে। মেয়েরা ঘর থেকে বেরুতে পারে, আয়াতে তা নিষেধ করা হয়নি, নিষেধ করা হয়েছে বাইরে গিয়ে এসব কাজ করতে, যা উপরের উদ্ধৃতিসমূহ থেকে প্রতিভাত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ-ই হচ্ছে জাহিলিয়াত –জাহিলিয়াতের ‘তাবাররুজ’ –যার সাথে এ যুগের সভ্যতা-সংস্কৃতিসম্পন্ন নারী সমাজের পূর্ণ মিল ও সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে হাটে-বাজারে, দোকানে-বিপণীতে, পথে-পার্কে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ও ক্লাবে-মিটিং-এ। আর কুরআন মজীদে উপরোক্ত আয়াতাংশে এ সব কাজকেই নিষেধ করা হয়েছে, চিরতরে হারাম করে দেয়া হয়েছে।

ঘরের বাইরে পর্দা

উপরে আমরা এ কথা প্রমাণিত করেছি যে, মেয়েদের যে একান্তভাবে ঘরের অভ্যন্তরেই বসে থাকতে হবে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা, সারা মাস বছর, সমগ্র জীবন, আর ঘর থেকে তারা আদৌ বাইরে বেরুতেই পারবে না, নিতান্ত প্রয়োজনেও নয়, এমন কথা কুরআন মজীদে বলা হয়নি, রাসূলে করীম (স) বলেন নি। সাহাবী, তাবেয়ীন ও পরবর্তীকালের মুজতাহিদীন –কেউই সে মত প্রকাশ করেননি। তাঁরা সকলেই কুরআন থেকে একথাই বুঝেছেন যে, মেয়েদের ঘর থেকে বাইরে যেতে নিষেধ নেই। তবে নিষেধ হচ্ছে বাইরে গিয়ে তাদের পর্দা নষ্ট করা, রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং পুরুষদের মনে নিদ্রাতুর যৌন পশুকে প্রচণ্ড হুংকারে ক্ষিপ্ত করে দেয়া। এ না করলে তাদের বাইরে যেতে –প্রয়োজন মতো ঘর থেকে বের হতে, এমনকি দোকানে-বাজারে যেতে, রাস্তাঘাটে চলতে কোনোই দোষ নেই। তবে শর্ত এই যে, তা অবশ্যই বিনা কারণে আর বিনা প্রয়োজনে হবেনা; শুধু ঘুরেফিরে হাওয়া খেয়ে গাল-গল্প বেড়ানোর উদ্দেশ্যে হবে না।

প্রয়োজনে আর জরুরী কাজে ঘর থেকে বেরুতে হলে মেয়েদের সর্বপ্রথম করণীয় হচ্ছে তার সর্বাঙ্গ পূর্ণ মাত্রায় আবৃত করা। কুরআন মজীদে নিম্নোক্ত আয়াতে ঘরের বাইরে মেয়েদের অবশ্য পালনীয় হিসেবে বলা হয়েছেঃ

(আরবী***********************************************************************)

হে নবী, তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুসলিম মেয়েলোকদের বলো, তারা যেন সকলেই ঘরের বাইরে বের হওয়াকালে তাদের মাথার ওপর তাদের চাদর ঝুলিয়ে দেয়। এভাবে বের হলে তাদরে চিনে নেয়া খুব সহজ হবে। ফলে তাদের কেউ জ্বালাতন করবে না। আল্লাহ প্রকৃতই বড় ক্ষমাশীল, দয়াবান।

আয়াতে উদ্ধৃত শব্দ (আরবী*******) বহু বচন। এক বচনে (আরবী*****) ‘জিলবাব’ বলা হয়ঃ

(আরবী***********************************************)

যে কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা হয়।

আল্লামা রাগিব ইসফাহানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

জিলবাব হচ্ছে কোর্তা ও ওড়না –যা দিয়ে শরীর ও মাথা আবৃত করা হয়।

ইবনে মাসউদ, উবাদাহ, কাতাদাহ, হাসান বসরী, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, ইবরাহীম নখয়ী, আতা প্রমুখ বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************************)

ওড়নার উপরে যে চাদর পরা হয়, তাই ‘জিলবাব’।

হযরত ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

যে কাপড় উপর থেকে নিচের দিকে পরে সমস্ত আবৃত করা হয়, তাই জিলবাব।

ইবনে জুবাইর বলেছেনঃ (আরবী*******) ‘বোরকা’, কেউ বলেছেনঃ (আরবী******) চাদর, যা সমস্ত দেহ পেচিয়ে পরা হয়।

আল্লামা যামাখশারী লিখেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

‘জিলবাব’ হচ্ছে একটি প্রশস্ত কাপড় –তা উড়না-দোপাট্টা থেকেও প্রশস্ত অথচ চাদরের তুলনায় ছোট। মেয়েরা তা মাথার উপর দিয়ে পরে, আর তা ঝুলিয়ে দেয়, তার দ্বারা বক্ষদেশ আবৃত রাখে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************)

জিলবাব হচ্ছে এমন চাদর, যা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ঢেকে দেয়।

মুফাসসিরদের মতেঃ

(আরবী******************************************************************************)

মেয়েরা পরিধেয় কাপড়ের উপরে যা পরে তাই জিলবাব। এক কথায় এ কালের ‘বোরকা’।

হযরত ইবনে আব্বাস এ আয়াত সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

আল্লাহ তা’আলা মু’মিন মেয়েলোকদের নির্দেশ দিয়েছেন, তারা যখন তাদের ঘর থেকে বের হবে, তখন তাদের মাথার উপর দিয়ে চাদর দ্বারা মুখমণ্ডলকে ঢেকে নেবে এবং একটি মাত্র চোখ খোলা রাখবে –এ অত্যন্ত জরুরী।

অপর এক বর্ণণা মতে ইবনে আব্বাস ও মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী**************************************************************)

স্বাধীনা –ক্রীতদাসী নয় –এমন মেয়েলোক যখন ঘর থেকে বাইরে যাবে, তখন তাদের মুখমণ্ডল ও মাথা আবৃত করে নেবে।

আল্লামা আবূ বকর আল-জাসসাস আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*********************************************************)

এ আয়াত বলে দিচ্ছে যে, যুবতী মেয়েদেরকে ভিন পুরুষ থেকে নিজেদের মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আবূ উবায়দা বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

মু’মিন মেয়েদের আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন তাদের মুখমণ্ডল ও মাথা পূর্ণ মাত্রায় ঢেকে রাখে, তবে একটি মাত্র চোখ খোলা রাখতে পারে। এ থেকে জানা যাবে যে, তারা স্বাধীন মহিলা-ক্রীতদাসী নয়।

ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

মেয়েরা তাদের মুখমণ্ডলকে এমনভাবে ঢাকবে যে, বাম চক্ষু ছাড়া তাদের শরীরের অপর কোনো অংশ দেখা যাবে না।

অন্য আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************************************************)

এবং মেয়েরা তাদের অলংকার ভিন পুরুষের সামনে প্রকাশ করবে না, তবে যা আপনা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা প্রকাশ হতে দিতে নিষেধ নেই এবং তাদের বক্ষদেশের উপর উড়না-দোপাট্টা ফেলে রাখবে।

এ আয়াতের তরজমা ইমাম ইবনে কাসীর লিখেছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

(আরবী********************************************************************)

অর্থাৎ মেয়েরা তাদের অলংকারাদি ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করবে না, তবে যা লুকানো সম্ভব হবে না তার কথা ভিন্ন।

জীনাত কি, কাকে বলে? ইমাম কুরতুবী ও আললামা ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ

জীনাত দুরকমের। একটি হচ্ছে সৃষ্টিগত আর অপরটি উপার্জনগত। সৃষ্টিগত সৌন্দর্য বলতে বোঝায় মুখমণ্ডল চেহারা (Anearance)। কেননা তাই হচ্ছে সমস্ত রূপ ও সৃষ্টিগত সৌন্দর্যের মূল উৎস কেন্দ্র। নারী জীবনের মাহাত্ম, মাধুর্য এখানেই নিহিত। আর দ্বিতীয় হচ্ছে উপার্জিত সৌন্দর্য।

(আরবী**********************************************************************)

যা মেয়েরা তাদের সৃষ্টিগত রূপ-সৌন্দর্যকে অধিকতর সুন্দর করে তোলবার জন্যে কৃত্রিমভাবে গ্রহণ করে, যেমন কাপড়, অলংকারাদি, সুরমা মাখা চোখ, রং, খেজাব, মেহেন্দি।

এ দু’রকমের জিনাতকেই বাইরের লোক –ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। অতঃপর বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************) ‘তবে যা’ আপনা থেকে প্রকাশিত হয়। ইমাম ইবনে কাসীরের তরজমা অনুযায়ী ‘যা লুকানো সম্ভব হয় না’ –যা জাহির হতে না দিয়ে পারা যায় না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কি?

ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ প্রথমে যা প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং পরে যা প্রকাশ হতে না দিয়ে পারা যায় না বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এ দুটো এক জিনিস নয়। দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জিনিস হতে হবে, তাহলে পরবর্তী জীনাত কি, যা জাহির না করে পারা যায় না, যা গোপন রাখা সম্ভব হয় না। এ সম্পর্কে তিনটি মত রয়েছে।

এক –তা হচ্ছে কাপড়। কেননা মেয়েরা বোরকা পরেও বাইরে বের হলে অন্তত তার বোরকার বাইরের দিকটি লোকদের সামনে প্রকাশমান হবেই; তা তো আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

দুই –সুরমা ও অঙ্গুরীয়। এ হচ্ছে ইবনে আনাসের মত।

তিন –মুখমণ্ডল ও দুই হস্ত।

ইবনুল আরাবী বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মত আসলে একই। কেননা সুরমা মুখের দিকে ব্যবহার হয়, আর অঙ্গুরীয় ব্যবহার করা হয় হাতের দিকে –আঙ্গুলে।

যাঁদের মতে মুখমণ্ডল ও হস্তদ্বয় প্রকাশ নিষেধের আওতার মধ্যে গণ্য নয়, বরং এ দুটো ভিন পুরুষের সামনে প্রকাশ করা যায় বলে মনে করেন, তাঁরাও সুরমা মাখা চোখ মুখ আর অঙ্গুরীয় পরা হাত ভিন পুরুষের সামনে জাহির করা জায়েয মনে করেন না। যে মুখে ও হাতে তা না থাকবে, তাই শুধু বের করা চলবে। যদি সুরমা ও অঙ্গুরীয় ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই ভিন পুরুষের দৃষ্টি থেকে লুকোতে হবে। তখন তা প্রথম পর্যায়ের অলংকারের মধ্যে গণ্য হবে, তা লুকানো ওয়াজিব।

আর ভেতর দিকের জীনাত হচ্ছে কানবালা, কণ্ঠহার, বাজুবন্দ আর পায়ের মল ইত্যাদি। ইমাম মালিকের মতে মুখ চুলের রং বাইরের দিকে ‘জীনাত’ নয়, হাতের চুড়ি-বালা ইত্যাদি সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

তা বাহ্যিক জীনাতের মধ্যে গণ্য, কেননা তা দুই হাতে পড়া হয়।

আর মুজাহিদ বলেছেনঃ

(আরবী*******************************************************************)

তা লুকিয়ে রাখার মতো ভেতর দিকের জীনাত। কেননা, তা কব্জাদ্বয়ের বাইরের জীনাত।

আর রং যদি পায়ে লাগানো হয়, তবে তা অবশ্যই গোপনীয় জীনাতের মধ্যে গণ্য হবে। অতএব রং –আলতা পরা পা ভিন পুরুষকে দেখানো যাবে না।

মনে রাখা আবশ্যক যে, এখানে এসব জীনাত ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে নিষেধ করার মানে কেবল জীনাত না দেখানোই নয়, বরং এ সব জীনাত যেসব অঙ্গে –দেহের যে সব জায়গায় –পরা হয়, তাও ভিন পুরষের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লামা কাসেমী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

আয়াতে কেবল জীনাতের (অলংকার) উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন অঙ্গে তা পরা হয় তার উল্লেখ করা হয়নি, গোপনীয়তা ও সংরক্ষণের অধিক প্রয়োজনীয়তা বোঝাবার জন্যে মাত্র। কেননা এ অলংকারগুলো দেহের এমন সব অঙ্গে পরা হয়, যার দিকে কেবল মুহাররম পুরুষ ছাড়া আর কারো তাকানো হালাল নয়।

তার মানে এই যে, এসব অলংকারের দিকেই যখন ভিন পুরুষের নজর পড়া –নজর পড়তে দেয়া নিষেধ, তখন তা যেসব অঙ্গে পরা হয়েছে, তার দিকে তাকানো বা তাকানোর সুযোগ দেয়া আরো বেশি নিষিদ্ধ হবে।

আল্লামা সানাউল্লাহ পানিপত্তী লিখেছেনঃ

(আরবী****************************************************************);

কোন স্বাধীন –ক্রীতদাসী নয় –এমন মহিলার পক্ষে নিজ স্বামী ও মুহাররম পুরুষ ছাড়া অন্য কারো সামনে তার মুখমণ্ডল প্রকাশ করা আদৌ জায়েয নয়। কেননা নারীর সাধারণ ও আসল সৌন্দর্যই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তার মুখমণ্ডলে। এ কারণে একজন নারীর দেহ অপেক্ষা মুখমণ্ডল দেখায় নৈতিক বিপদ ঘটার সর্বাধিক আশংকা বিদ্যমান।

নবী করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী থেকেও তাই প্রমাণিত হয়। বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

নারীর আপাদমস্তক –পূর্ণাবয়বই হচ্ছে গোপন করার জিনিস। এ কারনে সে যখন ঘরের বাইরে যায়, তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে পিছু লয়।

এ হাদীসের ভিত্তিতে পানিপত্তী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

এ হাদীস থেকে প্রমাণ করছে যে, নারীর সমগ্র শরীরই হচ্ছে গোপন রাখার বস্তু। তবে নিতান্ত প্রয়োজনের সময় তা প্রযোজ্য নয়। এ ব্যাপারে সকল ইসলামবিদ সম্পূর্ণ একমত।

সে প্রয়োজন কি হতে পারে, যখন নারীর কোনো না কোনো সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়। এ সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যেতে পারে। যেমন কোনো যুবতী নারীর এমন কোনো পুরুষ নেই, যে তার হাট-বাজারের প্রয়োজন পূরণ করে দিতে পারে, জরুরী জিনিস ঘরে এনে দিতে পারে। তখন সে বোরকা পরে শুধু পথ দেখার কাজ চলে চোখের জায়গায় এমন ফাঁক রেখে ঘরের বাইরে যাবে এবং প্রয়োজনীয় জায়গায় গিয়ে দরকারী জিনিসপত্র খরিদ করে ফিরে আসবে। যদি তার বোরকা না থাকে, না থাকে তা যোগার করার সামর্থ্য, তাহলে সে যে কোনো একখানা কাপড় দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পূর্ণাবয়ব আবৃত করে নিয়ে বের হবে।

এছাড়া দুটো ক্ষেত্র আছে, যখন ভিন পুরুষের সামনে মুখমণ্ডল কিংবা দেহের কোনো না কোনো অঙ্গ প্রকাশ করতে হয়, যেমন ডাক্তার-চিকিৎসকের সামনে অথবা আদালতে উপস্থিত হয়ে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো বিষয়ে জবানবন্দী বা সাক্ষ্য দেয়ার সময়ে। তখন মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করাসর্ববাদী সম্মতভাবে জায়েয।

তাহলে আল্লাহর বাণী –‘তবে যা আপনা থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে’ কথাটির দুটো অর্থ দাঁড়াল। একটি এই যে, নারীর দেহের পূর্ণাবয়ব পর্দা, অতএব তা ভালো করে আবৃত করেইঘরের বাইরে বের হবে। তখন সে বোরকা বা যে চাদর –কাপড় দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা হলো, তার বাইরের দিক ভিন পুরুষ দেখলে কোনো দোষ হবে না। কেননা তা লুকানো তো আর সম্ভব নয়। এখন তা দেখেও যদি কোনো পুরুষ কাবু হয়ে পড়ে, তবে তাকে ‘পুরুষ’ মনে করাই বাতুলতা। অন্তত তাতে নারীর কোনো ক্ষতি নেই,তার কোনো গুনাহ হবে না।

আর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, দেহের যে অঙ্গ প্রকাশ না করে পারা যায় না, যা লুকিয়ে রাখার উপায় নেই –বিশেষ প্রয়োজনের দৃষ্টিতে, যেমন ডাক্তারের কাছে দেহের বিশেষ কোনো রোগাক্রান্ত অঙ্গ প্রকাশ করা, ইনজেকশন দেয়া, অপারেশন করা কিংবা রোগ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে তা দেখানো কোনোদোষ নেই, সে নির্দিষ্ট স্থান এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণের সীমা পর্যন্ত –তার বাইরে নয়। অথবা যেমন সাক্ষ্য দেয়া বা জবানবন্দী শোনানোর জন্যে বিচারকের কাছে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ দুটো কথাই আল্লাহর বাণী (আরবী****) ‘তবে যা জাহির হয়ে পড়া’র মধ্যে শামিল এবং তা প্রকাশ করা সম্পূর্ণ জায়েয। আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

মেয়েলোক কোন সৌন্দর্যই প্রকাশ করবে না। তার সৌন্দর্যের সব জিনিসই আবৃত করে রাখবে। প্রয়োজনের কারণে যা প্রকাশ না করে পারা যায় না, তা-ই বাদ পড়বে।

বলা বাহুল্য, এসব আলোচনাই স্বাধীনা রমনী সম্পর্কে, ক্রীতদাসীদের সম্পর্কে নয় এবং নয় বৃদ্ধা, বিগতা যৌবনা নারীদের সম্পর্কে। কুরআন মজীদেই বলা হয়েছেঃ

(আরবী**************************************************************)

যেসব মেয়েলোক ঋতুশ্রাব ও সন্তান প্রসব থেকে চূড়ান্ত অবসর গ্রহণ করেছে, যারা বিয়ের বা স্বামী সহবাসের কোনো আশা পোষণ করে না, তাদের দেহাবরণ পরিত্যাগ করলে তাতে কোনো গুনাহ হবে না। তবে সে অবস্থায়ও তাদের সৌন্দর্য আর অলংকার প্রদর্শন করে বেড়ানো চলবে না। আর তারা যদি তা থেকেও পবিত্রতা অবলম্বন করে ও তা পরিহার না করে, তবে তা তাদের পক্ষে কল্যাণকর, মঙ্গলজনক। আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।

আল্লামা আলূসীর মতে এরা হচ্ছে (আরবী******) বৃদ্ধা। আর বৃদ্ধাদের অধিক উপবেশনকারী বলাহয়েছে এ কারণে যেঃ

(আরবী*************************************************************)

কেননা তারা বার্ধক্যের কারণে বেশি সময় বসেই কাটায়।

রবী’আ বলেছেনঃ

(আবরী****************************************)

যে সব বৃদ্ধা, যাদের দেখলে পুরুষেরা ঘৃণা বোধ করে, তাদের জন্যে এ হুকুম। যাদের রূপ-সৌন্দর্য অধিক বয়স্কা হওয়া সত্ত্বেও অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের জন্যে এ আয়াত প্রযোজ্য।

আল্লামা পানিপত্তী লিখেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************************)

বৃদ্ধাদের বাইরের আচ্ছাদন পরিহার করার ব্যাপারে পুরুষদের সৌন্দর্য দেখাবার ইচ্ছা না হওয়াকে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা থেকে বোঝা গেল যে, যে বৃদ্ধা সৌন্দর্য প্রদর্শনের ইচ্ছা পোষণ করে, তার পক্ষে বাইরের আচ্ছঅদন পরিহার করা হারাম।

পর্দার নির্দেশ নাযিল হওয়ার উপলক্ষ হিসেবে মুজাহিদ সূত্রে নিম্নোক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছেঃ একবার নবী করীম (স) খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে শরীক ছিল কিছু সংখ্যক সাহাবী। হযরত আয়েশা (রা)-ও তাঁদের সঙ্গে খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তির হাত হযরত আয়েশার হাতে লেগে যায় এবং নবী করীম (স)-এর কাছে ব্যাপারটি খুবই খারাপ বিবেচিত হয়। এর পরই পর্দার আয়াত নাযিল হয়। (আরবী**********************************)

পর্দার এ নির্দেশ মেয়েলোক ও পুরুষ লোকের মাঝখানে এক স্থায়ী অন্তরাল দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ অন্তরাল ভাঙ্গতে পারা যায় প্রথমে মুহাররম সম্পর্কের দরুন আর দ্বিতীয় বিয়ের সম্বন্ধের দ্বারা। অন্যথায় এ অন্তরাল অন্য কোনভাবে ভঙ্গ করা শুধু ইসলামী শরীয়তের বিধানই নয়, মানব-মানবীর স্বভাব-প্রকৃতির ওপরও একান্তই অন্যায়-অনাচার বটে। ঘরের বাইরে পূর্ণাবয়ব আচ্ছাদিত করে বের হওয়ার সংক্রান্ত উক্ত আয়াত ও আহকাম নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল –আরবের অবাধ নীতিতে চলতে অভ্যস্ত মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে গিয়ে তাদের মাথার উপর কালো চাদর ফেলে তা দিয়ে সমস্ত মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র শরীর পূর্ণমাত্রায় আবৃত করে নিতে শুরু করে দিয়েছে। নারী সমাজে এক আদর্শিক বিপ্লবের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল। উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ আর রূপ-যৌবন প্রকাশকারী পোশাক সাধারণভাবে বর্জিত হলো, কোনো মেয়েই তা পরে ঘরের বাইরে যেতে রাজি হচ্ছিল না। উচ্ছৃঙ্খলতা ও নির্লজ্জলতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হলো। এ আয়াত অনুযায়ী সে কালে মেয়েদের আদত ছিল একটা বড় আকারের চাদর দিয়ে মাথা, মুখমণ্ডল ও সমস্ত দেহাবয়ব আবৃত করা। বলা যায়, এ চাদরই ক্রমবিবর্তনের ধারায় বর্তমান সভ্যতায় এসে বোরকা’র রূপ পরিগ্রহ করেছে। অতএব একালে কুরআনের এ নির্দেশ পালনের জন্যে মুসলিম মেয়েদেরকে বোরকা পরেই ঘর থেকে বের হতে হবে। অনাগত ভবিষ্যতে ক্রমবিবর্তনের পরবর্তী কোন স্তরে পৌঁছে বোরকা যদি এমন কোনো রূপান্তর গ্রহণ করে যা দিয়ে আরো উন্নত ও সুন্দরভাবে মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র দেহ আচ্ছাদিত করা যেতে পারে তবে তাইহ বে সে সমাজের জিলবাব এবং তা পরেই কুরআনের এ আয়াত অনুযায়ী মেয়েদেরকে প্রয়োজনে বাইরে যেতে হবে। এক কথায়, বিগতা যৌবনা নয় –এমন সব মুসলিম মেয়েকেই সব সমাজে, সব দেশে, সব রকমের আবহাওয়ায় এবং ইতিহাসের সব পর্যায় ও স্তরেই মাথা, মুখমণ্ডল ও সমগ্র দেহাবয়ব আবৃত করা না হলে মুসলিম মহিলা বলে অভিহিত হওয়ার কোনো অধিকারই তার থাকবে না এ আয়াত অনুযায়ী।

বস্তুত যেসব মেয়ে বোরকা পরে সমস্ত শরীর, মুখ ও মাথা আবৃত করে ঘর থেকে বের হয়, তাদের দেখলে বুঝতে পারা যায় যে, এরা পর্দানশীল মহিলা। দুষ্ট চরিত্রের বখাটে চরিত্রের লোকেরা তাদেরকে চরিত্রবতী ও সতীত্বসম্পন্না মেয়ে মনে করে তাদের সম্পর্কে নৈরাশ্য পোষণ করতে বাধ্য হয়। ফলে কেউ তাদের পছু নেবে না, তাদের আকৃষ্ট করার জন্যে কিংবা নিজেদেরকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলবার জন্যে চেষ্টাও করবে না।

আল্লাহর বাণীঃ

(আরবী***********************************) –অংশে একথাই বলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু যারা উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে বোরকা ছাড়াই নিজেদের মাথা, গলা, বুক ও বাহুযুগল উন্মুক্ত রেখেই রাস্তা-ঘাটে, দোকানে, পার্কে- হোটেল-রেস্তোরাঁয় চলাফেরা করে, তাদের সম্পর্কে দুষ্ট লোকদের মনে এর বিপরীত ধারণা জাগ্রত হবে। তারা এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে আলাপ পরিচয় করবে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করবে, নিজেদেরকে তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং তাদের সাথে অবাধ ও অবৈধ প্রণয় চর্চা করতে চেষ্টা করবে নিরতিশয় আগ্রহ সহকারে। কেননা তাদের উক্তরূপ অবস্থায় রাস্তায় বের হওয়ার মানেই হচ্ছে তারা অপর যে কোনো পুরুষের কাছে ধরা দিতে কিছুমাত্র অরাজি নয়। অন্তত কেউ যদি তাদের পেতে চায়, তবে তারা কিছুমাত্র আপত্তি জানাবে না। বরং স্পষ্ট মনে হয়, তারা তাদের রূপ-যৌবনের মধুকেন্দ্রের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুনিয়ার সব মধু মস্ফিকাকে। উলঙ্গভাবে চলাফেরাকারী মেয়েদের শতকরা আশিভাগের অবস্থাই যে এমনি, তা আজকের কোনো সমাজচরিত্রবিদই অস্বীকার করতে পারবে না। সমাজবিদ আবূ হায়ান একথাই বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

কেননা পূর্ণমাত্রায় পর্দা ও শালীনতা রক্ষাকারী মেয়েলোক দেখলে তার দিকে কেউই অগ্রসর হতে সাহস পাবে না। কিন্তু উলঙ্গভাবে চলা-চলকারী মেয়েদের কথা আলাদা। কেননা তাদের প্রতি তো লোকেরা বড়ই আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, হাজার দু’হাজার, কি ছ’হাজার বছর আগেকার জাহিলিয়াতে এবং এ যুগের অত্যাধুনিক (Ultra modern) জাহিলিয়াতে একাকার হয়ে একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। এ দুয়ের মাঝে মৌলিক কোনোই পার্থক্য নেই, না স্বভাব-প্রকৃতি, না বাহ্যিক প্রকাশে, অনুষ্ঠানে। আসল কথাও তাই। জাহিলিয়াতের সে যুগে আর এ যুগে যেমন কোনোই তারতম্য নেই, ইসলামেও নেই তেমনি পার্থক্য সেকালে ও একালে। অন্য কথায় ইসলামও পুরাতন, যত পুরাতন মানবতা। আধুনিক জাহিলিয়াতও তেমনি পুরাতন, যত পুরাতন শয়তানের ইবলিশী ভূমিকা। কাজেই যারা উলঙ্গভাবে যত্রতত্র চলাফেরা –অবাধ মেলা-মেশা ও যুব সম্মেলন করে ছেলে-মেয়েদের ফষ্টি-নষ্টির অবাধ সুযোগ করে দেয়া অত্যাধুনিক সভ্যতার অবদান বলে মনে করে, আর মনে মনে গৌরব বোধ করেঃ আমরা আর সেকেলে নই, মধ্যুগের ঘুণেধরা সংস্কৃতি (?) মেনে আমরা চলছি না, আমরা একান্তই আধুনিক-আধুনিকা –তারা যে কতখানি বোকা, নির্বোধ ও স্থূল জ্ঞানসম্পন্ন ও সূক্ষ্ম জ্ঞান বঞ্চিত তা জাহিলিয়াতের ইতিহাসই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। তারা অজ্ঞানতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে মোটেই বুঝতে পারছে না যে, তারা যা কিছু করছে, তার কোনোটাই নতুন নয়, নয় আনকোরা এবং এসব করে তারা মোটেই আধুনিক হওয়ার প্রমাণ দিতে পারছে না,বরং তারাও যে পুরাতন –অতি পুরাতন –ঘুণে ধরা সংস্কৃতিরই অন্ধ অনুসারী, এতটুকু বুঝবার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে পাশ্চাত্য নগ্নতার প্রতি আকর্ষণ ও ইষলামের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষ পোষনের কারণেই মাত্র –এতে কোনো সন্দেহ নেই।

নামাযের জন্যে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া

পূর্বেই আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মেয়েদের আসল স্থানই হচ্ছে তার ঘর। এমন কি নামাযের জন্যে তাদের বাইরে যাওয়াও দরকারী নয়, পছন্দনীয় নয়। তবে ঘরের মধ্যে অবরোধবাসীনী হয়ে থাকাও ইসলামের কোনো বিধান নয়। প্রয়োজন হলে, নিরুপায় হলে তারা অবশ্য ঘরের বাইরে যেতে পারে, কিন্তু যেতে হবে পূর্ণাবয়ব আবৃত করে, পুরামাত্রায় পর্দা রক্ষা করে। এখন প্রশ্ন এই, নামাযও তেমন কোনো প্রয়োজন কিনা, যার জন্যে ঘর থেকে মসজিদে কিংবা ময়দানে যাওয়া যেতে পারে। এ সম্পর্কে সম্যক আলোচনা আমরা এখানে পেশ করতে চাই।

মেয়েদের মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে তিন ধরনের হাদীস একই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে। এক ধরনের হাদীসে মেয়েদের মসজিদে যেতে নিষেধ না করতে আদেশ করা হয়েছে। তার মানে সে হাদীসসমূহ মসজিদে মেয়েদের যাওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুমতি রয়েছে। যেমন নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

তোমরা আল্লাহর বাঁদীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না।

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ আল্লাহর বাঁদীদেরকে মসজিদে গিয়ে নামায পড়তে নিষেধ করো না।

হযরত ইবনে উমর থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

কোনো ব্যক্তিই যেন তার পরিবার-পরিজনকে মসজিদে যেতে কখনোই নিষেধ না করে।

তখন আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বিলাল নামক এক পুত্র বলে উঠলঃ আমরা তো নিষেধ করবই। তখন ইবনে উমর বললেনঃ

আমি তো তোমাকে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস শোনাচ্ছি, আর তার মুকাবিলায় তুমি এ ধলনের কথাবার্তা বলছ?

(আরবী*************************************************************)

হাদীস বর্ণনাকারী বলেন যে, এ ঘটনার পর হযরত ইবনে উমর তাঁর এ পুত্রের সাথে মৃত্যু পর্যন্ত আর কথা বলেন নি।

এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*****************************************************************)

মেয়েরা মসজিদে যাওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে অনুমতি চাইলে তোমরা তাদেরকে মসজিদে যাওয়ার অধিকার ভোগ তেকে নিষেধ করো না।

হাদীসের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, মেয়েদের মসজিদে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর সে যাওয়ার অধিকার তারা ভোগ ও ব্যবহার করতে চাইলে তা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার অধিকার কারোরই নেই।

বুখারী উদ্ধৃত এক হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, বিশেষ করে রাতের বেলা যদি মেয়েরা মসজিদে যেতে চায়, তাহরে তাদের নিষেধ করা নিষেধ।

নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

তোমাদের মেয়েরা যতি রাতের বেলা মসজিদে যাওয়ার জন্যে তোমাদের কাছে অনুমতি চায়, তবে অনুমতি দাও।

অনুমতি চাইলে অনুমতি দিতে নবী করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলে করীম (স)-এর এ নির্দেশ কি অবশ্য পালনীয় –অথবা পালনীয় নয়? দ্বিতীয়ত প্রথম দিকে উল্লিখিত হাদীসসমূহে রাতের বেলার কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু বুখারী উদ্ধৃত এ হাদীসে রাতের বেলার শর্ত রয়েছে। তার মানে, রাতের বেলা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তখন মেয়েদেরকে বিশেষভাবে এ অনুমতি দিতে স্বামী বা ঘরের মুরব্বী অবশ্যই বাধা হবে।

দ্বিতীয় ধরনের হাদীস থেকে জানা যায় যে, সুগন্ধি ব্যবহার করে মেয়েদের মসজিদে যেতে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************)

কোনো মেয়েলোক সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে গেলে আল্লাহ তার নামায কবুল করবেন না, যতক্ষণ সে ফরয গোসলের মতো গোসল করে সেই সুগন্ধি দূর করে নামাযে না দাঁড়াবে অর্থাৎ সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে গেলেও নামায পড়লে সেই নামায আল্লাহর দরবারে কখনো কবুল হবে না।

এক হাদীসে মহিলাদের লক্ষ্য করে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************)

তোমাদের কেউ যখন এশার নামাযের জন্যে ঘর থেকে বের হবে, তখন সুগন্ধি স্পর্শ পর্যন্ত করবে না।

আর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী****************************************************************)

আকর্ষণীয় সুগন্ধি না দিয়ে যেন মেয়েরা ঘরের বাইরে যায়।

আর তৃতীয় ধরনের হাদীসে মেয়েদের নামাযের জন্যে মসজিদ অপেক্ষা তাদের ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুঠরীই অধিক ভালো বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যার দুটি হাদীস উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

এ সব ধরনের হাদীস সামনে রেখে মেয়েদের নামাযের জন্যে মসজিদে গমন সম্পর্কে শরীয়তের লক্ষ্য জানবার জন্যে মুহাদ্দিস ও ইসলামী মনীষীবৃন্দ চেষ্টা-গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁদের গবেষণার সারাংশ এখানে উদ্ধৃত করা যাচ্ছে।

প্রখ্যাত ‘হিদায়া’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ

(আরবী******************************************************)

নামাযের বিভিন্ন জামা’আতে মেয়েলোকদের শরীক হওয়া ‘মাকরূহ’।

কোন মেয়ের শরীক হওয়া মাকরূহ? এ গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারগণ বলেছেন, যুবতী মেয়েদের পক্ষে শরীক হওয়া মাকরূহ। আর ‘নামাযের জামা’আত’ বলতে জুম’আ, ঈদ, সূর্যগ্রহণ, ইস্তিসকা, পানির জন্য প্রার্থনা প্রভৃতি নামাযে যেসব প্রকাশ্য জামা’আত অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তা সবই এর মধ্যে শামিল। ইমাম শাফেয়ীর মত হচ্ছেঃ

(আরবী******************************************************)

নামাযের জন্যে মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়া মুবাহ।

হানাফী মাযহাবের মনীষীদের দৃষ্টিতে তা জায়েয নয়। তার কারণ দর্শাতে গিয়ে তাঁরা বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

কেননা মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াই হচ্ছে নৈতিক বিপদের কারণ, আর তাই হচ্ছে হারাম কাজের নিমিত্ত। আর যাই হারাম কাজ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়, তাই হারাম।

এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বলা যায়, যারা এ কাজকে মাকরূহ বলেছেন, সে মাকরূহ মানেই হচ্ছে হারাম –বিশেষ করে বর্তমান যুগ-সমাজে। কেননা এ সমাজে বিপদের কারণ সর্বত্র ও সর্বাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা এও বলেছেন যেঃ

(আরবী**********************************************************************)

বৃদ্ধা মেয়েলোকদের পক্ষে ফজর, মাগরিব ও এশার জামা’আতে শরীক হওয়ার জন্যে বাইরে যাওয়ার কোনো দোষ নেই। কেননা তাদের ব্যাপারে পূর্ণ নৈতিক নিরাপত্তা বিদ্যমান। আর এ মত হচ্ছে কেবল ইমাম আবূ হানীফার।

কিন্তু ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে বৃদ্ধা মেয়েরা তো সব রকমের নামাযের জামা’আতেই শরীক হতে পারে। কেননা তাদের প্রতি পুরুষ লোকদের আগ্রহ-কৌতুহল কম হওয়ার কারণে কোন বিপদের আশংকা থাকবার কথা নয়।

‘মেয়েরা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তোমরা তাদের অনুমতি দাও’ –রাসূলে করীম (স)-এর বাণীর ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

এ হাদীস প্রমাণ করে যে, মেয়েদের অনুমতি দেয়াই বাঞ্ছনীয়, যে কাজে তার ফায়দা, তা থেকে তাকে নিষেধ করা যায় না। এ কথা তখনকার জন্যে, যখন বাইরে গেলে মেয়েদের ওপর কোনো বিপদ ঘটার কিংবা মেয়েদের নিয়ে অপর কোনো বিপদ সংঘটিত হওয়ার কোনোই আশংকা বা ভয়=ভীতি থাকবে না।

এ কথারই প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে হযরত আয়েশা (রা)-এর নিম্নোদ্ধৃত বাণী। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

এ মেয়েরা কি নতুন চাল-চলন গ্রহণ করেছে, তা যদি রাসূলে করীম (স) দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি এদেরকে মসজিদে যেতে অবশ্যই নিষেধ করতেন, যেমন নিষেধ করা হয়েছিল বনী ইসরাইলের মেয়েদের।

ইমাম মালিক (রহ) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

মসজিদে যাওয়ার অনুমতি সংক্রান্ত এ হাদীসের মতো অন্যান্য হাদীসে কেবলমাত্র বৃদ্ধাদের সম্পর্কেই প্রযোজ্য।

কিন্তু ইমাম নববী বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************)

মেয়েদের জন্যে –সে বৃদ্ধাই হোক না কেন –নিজেদের ঘরের তুলনায় আর কোনো জায়গা কল্যাণকর হতে পারে না -নেই।

তিনি প্রথম প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন হযরত ইবনে মাসঊদের নিম্নোদ্ধৃত কথা। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

মেয়েদের আপাদমস্তকই পর্দার জিনিস। তাদের ঘরের গোপন কোঠায় থাকাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের পক্ষে অধিক উপযোগী। কেননা তারা যখন ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাদের পিছু নেয়।

একটি মেয়েলোক হযরত ইবনে মাসউদের কাছে জুম’আর দিন মসজিদে যাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে বললেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

তোমার বড় ঘরের অভ্যন্তরীণ কোঠায় তোমার নামায পড়া তোমার প্রশস্ত ঘরে নামায পড়া অপেক্ষা উত্তম। তোমার প্রশস্ত ঘরে নামায পড়া তোমার বাড়ির এলাকার মহল্লার মসজিদে নামায পড়া অপেক্ষা তোমার জন্যে উত্তম।

আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেছেনঃ

আজকের যুগে মেয়েদের ঈদের নামাযের জন্যে বের হয়ে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে। যদি কোনো স্ত্রীলোক বের হতেই জিদ ধরে তবে তার স্বামীর উচিত তাকে অনুমতি দেয়া এই শর্তে যে, সে তার পুরানো পোশাক পরে যাবে এবং অলংকারাদি পরে যাবে না। আর সেভাবে বের হতে রাজি না হলে সুসাজে সজ্জিতা হয়ে যেতে স্বামী নিষেধ করতে পারে। (আরবী*******************************)

আল্লামা শাওকানী এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস একসঙ্গে সামনে রেখে আলোচন্য বিষয়টি সম্পর্কে লিখেছেনঃ

এ হাদীসসমূহ একসঙ্গে প্রমাণ করে যে, দুই ঈদের নামাযে মেয়েদের ময়দানে বের হয়ে যাওয়া শরীয়তসম্মত কাজ, এতে কুমারী বা অকুমারী, যুবতী আর বৃদ্ধা মেয়েদের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই –যদি না সে ইদ্দত পালতে রত কিংবা তার বের হয়ে আসার কোনো বিপদ বা তার নিজের কোনো ওযর-অসুবিধা থাকে। (আরবী*************)

অতঃপর তিনি মুসলিম মনীষীদের এ পর্যায়ে দেয়া মত উল্লেখ করেছেন। তার একটি মত হচ্ছে এই যে, মেয়েদের বের হওয়ার জন্যে অনুমতি চাইলে পর অনুমতি দেয়া সম্পর্কে রাসূলের নির্দেশ পালন মুস্তাহাব। আর এ মুস্তাহাব বৃদ্ধ-যুবতী সব মেয়ের পক্ষেই। হাম্বলী মাযহাবের আবূ হামেদ, শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম জুরজানীও এ মত প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় মত হচ্ছে –যুবতী ও বৃদ্ধাদের মধ্যে অবশ্য পার্থক্য করতে হবে। তৃতীয় মত হচ্ছে, মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া জায়েয, মুস্তাহাব নয় –ইবনে কুদামাহ উদ্ধৃত কথার বাহ্যিক অর্থ এই। চতুর্থ, মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়া মাকরূহ। এ কথাটি ইমাম আবূ ইউসুফের এবং তা ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন সওরী ও ইবনুল মুবারক থেকে। ইবনে শায়বা নখয়ীর মত উদ্ধৃত করে বলেছেন, যুবতী মেয়েদের ঈদের নামাযে যাওয়া মাকরূহ।

পঞ্চম মতঃ

(আরবী***********************************************************)

ঈদের নামাযের জন্যে বাইরে যাওয়া মেয়েদের বিশেষ অধিকার রয়েছে।

কাযী ইয়ায হযরত আবূ বকর, হযরত আলী ও হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এ মত বর্ণনা করেছেন। ইবনে শায়বা হযরত আবূ বকর ও হযরত আলী (রা)-এর নিম্নোদ্ধৃত কথাটির উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

দুই ঈদের নামাযের জন্যে প্রত্যেক সক্ষম মেয়েলোকেরই যাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এটা ন্যায্যা অধিকার।

আল্লামা শাওকানী বলেন, যাঁরা এ কাজকে মাকরূহ বা হারাম বলেন, তাঁদের কথা মেনে নিলে সহীস হাদীসকে অযৌক্তিক মত দ্বারা বাতিল করে দেয়া হয়। কেননা সহীহ হাদীসে মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনুমতি চাইলে স্বামী বা গার্জিয়ান অনুমতি দিতে বাধ্য এবং সেজন্যে রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশ রয়েছে। আর যারা যুবতী ও বৃদ্ধা মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এবং বৃদ্ধাদের জন্যে বাইরে যাওয়া জায়েয –যুবতীদের পক্ষে জায়েয নয় বলে রায় দিয়েছেন, তাঁরাও সর্ববাদীসম্মত সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন অথচ তা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। (আরবী*****************)

ইমাম তিরমিযী উম্মে আতীয়াতা বর্ণিত হাদীসটি উদ্ধৃত করে লিখেছেনঃ

(আরবী***************************************************)

উম্মে আতীয়াতা বর্ণিত হাদীসটি অতি উত্তম এবং সহীহ সনদে বর্ণিত।

তারপর লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

মনীষীদের একদল এ হাদীস অনুযায়ী মত দিয়েছেন এবং মেয়েদেরকে দুই ঈদের নামাযের জন্যে ময়দানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আর কেউ কেউ তা অপছন্দ করেছেন।

পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের দৃষ্টিতে হযরত আয়েশার আশংকাবোধকে কোনো গুরুত্ব দেয়া যায় না, অন্তত কেবলমাত্র ঈদের নামাযের জন্যে বের হওয়ার ব্যাপারে। কেননাঃ

(আরবী***************************************************************)

হযরত আয়েশা এ কথাটি বলেছিলেন নিজস্ব ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে। এ কারণেই তাঁর কথার ধরন এমনি হয়েছে যে, রাসূল যদি এ অবস্থা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি নিষেধ করতেন। আর তাঁর নিজস্ব ধারণা-অনুমান শরীয়তের কোনো প্রমাণ হতে পারে না।

আল্লামা আহমাদুল বান্না ‘মুসনাদে আহমাদ’-এ উদ্ধৃত এ সম্পর্কিত যাবতীয় হাদীস সামনে রেখে বলেছেনঃ

এসব হাদীসই নামাযের জন্যে মসজিদে গমন মেয়েদের জন্যে জায়েয বলে প্রমাণ করে। তবে তা শর্তহীন নয়। দ্বিতীয়, এতে নিষেধও রয়েছে –যদি মেয়েরা তীব্র সংক্রামক সুগন্ধি ব্যবহার করে নামাযের জন্যে যার (তবে তা জায়েয হবে না)। তৃতীয়, যদি কোনো মেয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে কোনো না কোনো প্রয়োজনে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়, তবে তাও সে করতে পারে। আর চতুর্থ এই যে, মেয়েরা নামাযের জামা’আতে সকলের পিছনের কাতারে দাঁড়াবে এবং পুরুষদের বের হওয়ার বহু পূর্বেই তারা মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে যাবে। (আরবী******************)

বস্তুত সমাজ-চরিত্র ও সমাজ-পরিবেশ যতই খারাপ হোক না কেন, এ সব শর্তের ভিত্তিতে মেয়েদের মসজিদে যাওয়া ও ঈদের নামাযের জামা’আতে শরীক হওয়া কোনোক্রমেই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হতে পারে না।

কার কারণ এই যে, বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসে ঈদের জামা’আতে সব শ্রেণীর মহিলার উপস্থিতি হওয়া সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর স্পষ্ট নির্দেশ উল্লিখিত হয়েছে। এখঅনে ‘মুসনাদে আহমাদ’ থেকে এ পর্যায়ের কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাচ্ছেঃ

(আরবী************************************************************************)

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বলেনঃ নবী করীম (স) দুই ঈদের জামা’আতে নিজে বের হয়ে যেতেন এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকেও বের করে নিতেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ

(আরবী*************************************************************)

নবী করীম (স) তাঁর মেয়েদের ও স্ত্রীদের দুই ঈদের নামাযের জন্যে বের হয়ে যেতে হুকুম দিতেন।

উমরা বিনতে রওয়া আল-আনসারী নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************)

প্রত্যেক কোমরবন্ধ পরিহিতা মেয়েলোকেরই ঈদের ময়দানে বের হয়ে যাওয়া ওয়াজিব।

হযরত উম্মে আতীয়াতা বলেনঃ

(আরবী********************************************************************)

রাসূলে করীম (স) আমাদেরকে সব যুবতী মেয়ে পর্দানশীল ও হায়েয-সম্পন্ন মেয়েকেই ঈদের ময়দানে বের করে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ মেয়েরা কি ঈদের জামা’আতে শরীক হওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। তার নিজের কাপড় না থাকলে তার কোনো সখীর কাপড় পরে বের হবে।

এ সব হাদীস সনদের দিক দিয়ে যেমন নিঃসন্দেহ, কথার দিক দিয়েও তেমনি অকাট্য, সুস্পষ্ট। এসব হাদীস যে কোনো ঈমানদার ব্যক্তির মন কাঁপিয়ে না দিয়ে পারে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজে এসব হাদীস সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। অতএব শরীয়তের নিয়ম-নীতি পালনের মধ্যে দিয়ে ঈদের ময়দানে এক পাশে মেয়েদের জন্যে যদি পূর্ণ পর্দার ব্যবস্থা করা হয় তবে তাতে সমাজের মেয়েরা কেন শরীক হবে না বা হতে পারবে না এবং শরীক হলে তা দোষের হবে কেন –তা সত্যিই বোঝা যাচ্ছে না।

শুধু ঈদের নামাযই নয়, পর্দা রক্ষা করে মুসলিম মহিলারা সব রকমের জাতীয় কল্যাণমূলক অনুষ্ঠানে ও সভা-সম্মেলনে দাওয়াতেও শরীক হতে পারে। এ পর্যায়ে বুখারী শরীফে উদ্ধৃত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ

(আরবী***********************************************************)

যুবতী পুরাবাসিনী ও ঋতুবতী মেয়েলোক ঈদের নামাযের জন্যে অবশ্যই ঘরের বাইরে যাবে। তবে ঋতুবতী মেয়েরা নামাযে শরীক হবে না। তারা অবশ্যই উপস্থিত হবে সব রকমের জাতীয় কল্যাণমূলক কাজে ও অনুষ্ঠানে, মুসলমানদের সামগ্রিক দো’আ প্রার্থনার অনুষ্ঠানে, দাওয়াত ও যিয়াফতে।

এ হাদীসের ভিত্তিতে নববী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

সব কল্যাণকর কাজে ও সমাবেশে, মুসলমানদের সামষ্টিক দো’আ প্রার্থনা মজলিসে দ্বীনী ইলম চর্চা ও ইসলামী বিষয়ে আলোচনা সভায় মেয়েদের শরীক হওয়া যে খুবই ভালো ও পছন্দনীয় কাজ, তা এ হাদীস থেকেই প্রমাণিত হয়।

(আরবী*************************************************************)

আমাদের এমন মেয়ে, যার মুখ ঢাকা চাদর বা বোরকা নেই, সে কি করবে?

জবাবে রাসূলে করীম (স) বললেনঃ

এরূপ অবস্থায় তার কোনো বোন তার নিজের বোরকা তাকে পরিয়ে দেবে।

একথা থেকে দুটি কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি এই যে, এ ধরনের অনুষ্ঠানাদিতে সব মেয়েলোকেরই –এমন কি যারা সাধারণত ঘর থেকে বেরই হয় না, যারা পুরাবাসিনী, তাদেরও হাজির হওয়া উচিত। আর দ্বিতীয় এই যে, মেয়েরা ঘর থেকে বের হলেই তাকে মুখাবয়ব অবশ্যই ভালোভাবে ঢেকে নিতে হবে। মুখ খোলা রেখে, বুক পিঠ না ঢেকে ঘর থেকে বের হতে পারবেনা। এভাবে ঢাকবার কাপড় –বোরকা –কোনো মেয়ের যদি নাও থাকে, তাহলে অন্য মেয়েলোকের কাছ থেকে তা ধার করে নেবে। আর এক্ষেত্রে যারই বোরকা আছে –সে সময় তার প্রয়োজন না থাকলে প্রয়োজনশীল অপর বোনকে তা অবশ্যই ধার দেবে। কোনো মেয়েলোকই যাতে করে খোলা মুখে ও খোলা বুক-পিঠ নিয়ে বাইরে বের না হয়, তার জন্যেই এ ব্যবস্থা।

রাসূলে করীম (স)-এর যুগে মেয়েরা ঈদের নামাযে রীতিমত শরীক হতেন এবং তিনি মেয়েদেরকে স্বতন্ত্রভাবে একত্র করে ওয়াজ-নসীহত করতেন। হাদীসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************))))))

আমি রাসূলে করীম (স) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি খোতবা দেয়ার আগেই নামায পড়ে নিতেন। এমনি একদিন তিনি নামায পড়ালেন, পড়ে খোতবা দিলেন। পরে তিনি লক্ষ্য করলেন যে, নামাযের জন্যে সমবেত মহিলাদের তিনি স্বীয় ভাষণ শোনাতে পারেননি। তাই তিনি পরে তাদের কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাদের নসীহত করলেন –দ্বীন ইসলামের জন্যে দান করতে ও রীতিমত যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিলেন।

এ হাদীস থেকে স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছেঃ

(আরবী************************************************************************************)

মেয়েরা যখন পুরুষদের সাথে নামায কিংবা অন্য কোনো সমাবেশে উপস্থিত হতো, তখন তারা পুরুষদের থেকে খানিকটা দূরে স্বতন্ত্র স্থানে আসন গ্রহণ করত। আর তা করত কোনো নৈতিক বিপদ, চোখাচোখি কিংবা খারাপ চিন্তা উদ্ভব হওয়ার ভয় থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে।

মেয়েদের হজ্জ যাত্রা ও বিদেশ সফর

মেয়েদের পর্দার ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে উপরে যে আলোচনা পেশ করা হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, কোনো গায়র-মুহাররম পুরুষের সাথে নিবিড় একাকীত্বে মিলিত হওয়া কোনো মেয়েলোকের পক্ষেই জায়েয নয়। এ পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে –কোন মেয়েলোকের ওপর যদি হজ্জ ফরয হয়, আর তার স্বামী বা এমন কোনো মুহাররম পুরুষও না থাকে যে তাকে সঙ্গে করে হজ্জ সফরে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে তখন সে কি করবে?

আল্লামা আহমাদুল বান্নার বিশ্লেষণ এই যে, এ সম্পর্কে যত হাদীসই পাওয়া যায়, তা সবই একসঙ্গে প্রমাণ করে যে, মুহাররম সাথী ছাড়া মেয়েলোকের বিদেশ সফর আদৌ জায়েয নয়। তা হজ্জের সফরেই হোক আর অন্য কিছুর।

ইবনে দকীকুল রীদ বলেছেনঃ বিষয়টিকে দুটো পরস্পর বিরোধী সাধারণ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। একদিকে আল্লাহ বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)))))))

আল্লাহরই জন্যে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা এমন প্রত্যেক ব্যক্তির ওপরই কর্তব্য, যার সে পর্যন্ত পৌঁছবার সামর্থ্য রয়েছে।

এ সাধারণ নির্দেশ পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে সামর্থ্যবতী মেয়েলোকদের ওপরও প্রযোজ্য। যে মেয়েলোকের মক্কা গমনের সামর্থ্য রয়েছে, তাকেই হজ্জ করতে হবে –ফরয।

অপরদিকে নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

মেয়েলোক আদৌ বিদেশ সফর করবে না –তবে কোনো মুহাররম পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে করতে পারে।

এ কথাটি সব রকমের সফর প্রসঙ্গেই প্রযোজ্য, অতএব কোনো মেয়েলোকই মুহাররম পুরুষ সাথী ছাড়া আদৌ কোনো সফর করবে না, তা হজ্জের সফরই হোক না কেন।

এক্ষণে এ দুটি সাধারণ নীতির একটিকে অপরটির ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সেই অগ্রাধিকার দানের কারণ বাইরে থেকে নিতে হবে।

ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ এ পর্যায়ের হাদীসসমূহ কুরআনের উক্ত আয়াতের সাথে মোটেই সাংঘর্ষিক নয়। কেননা আয়াতে হজ্জ ফরয হওয়ার জন্যে যে সামর্থ্যের শর্ত আরোপ করা হয়েছে মেয়েদের ক্ষেত্রে একজন মুহাররম সাথী লাভ সেই শর্তেরই অন্তর্ভুক্ত। অতএব যার মুহাররম সাথী জুটছে না, হজ্জ ফরয হওয়ার শর্তও সেখানে পুরামাত্রায় পূরণ হচ্ছে না। কাজেই আয়াত ও হাদীসের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই।

এ কারণেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************************)

মুহাররম পুরুষ সাথী না পেলে মেয়েলোকের ওপর হজ্জই ওয়াজিব হয় না।

ইমাম মালিক অবশ্য ফরয সফর আদায় করার ব্যাপারে মুহাররম সাথী পাওয়াকে শর্ত হিসাবে গণ্য করতে রাজি নন। ইমাম শাফেয়ী ফরয হজ্জের সফরকে সাধারণ প্রয়োজনের সফর থেকে আলাদা করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছেন। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, সাধারণ প্রয়োজনের সফর সম্পর্কেই এ সর্ববাদীসম্মত মত যে, তা মুহাররম সাথী ছাড়া করা জায়েয নয়। অতএব ইখতিয়ারী ও ইচ্ছাকৃত সফরককে এর সমতুল্য মনে করা যেতে পারে না।

দারেকুতনী বর্ণিত এ পর্যায়ের একটি হাদীসের বিশেষ অংশ হচ্ছেঃ

(আরবী***********************************************************)

স্বামীর সঙ্গে ছাড়া কোনো মেয়েলোকই কখখনোই হজ্জ পালন করতে পারে না।

আবূ আমামা রাসূলে করীম (স)-এর নিম্নোক্ত বাণী বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

এবং মেয়েলোক স্বামীকে সঙ্গী না বানিয়ে একাকী তিন দিনের দূরত্বের পথে সফর করবে না এবং হজ্জ করতেও যাবে না।

এসব হাদীস সামনে রাখলে হজ্জের সফরকে অন্যান্য সাধারণ সফর থেকে আলাদা করে বিবেচনা করা চলে না।

ইমাম আবূ হানীফা, নখয়ী ও ইসহাক ইবনে রাওয়া প্রশ্ন তুলেছেনঃ

(আরবী*************************************************************)

মেয়েদের হজ্জ সফর প্রসঙ্গে মুহাররম সাথী হওয়া কি হজ্জ ফরয হওয়ার জন্যে শর্ত, না হজ্জ আদায় করার জন্যে? (আর এ দুটির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান।)

কেউ কেউ বলেছেনঃ মুহাররম সাথী হওয়ার শর্ত কেবল যুবতী মেয়েদের জন্যে, বৃদ্ধাদের জন্যে তা শর্ত নয়। কেননা বৃদ্ধাদের প্রতি কারোরই কোনো আগ্রহ হওয়ার কথা নয়।

রাসূলে করীম (স) এক ব্যক্তিকে বললেনঃ

(আরবী**************************************************************************************)

তুমি ফিরে যাও এবং তোমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হজ্জ করতে চলে যাও।

হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

এ হাদীসের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে কেউ কেউ মনে করেন যে, স্ত্রীর ওপর হজ্জ ফরয হলে এবং তার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে অপর কোনো মুহাররম পুরুষ যদি না পাওয়া যায়, তাহলে স্বামীকেই তার সঙ্গে যেতে হবে –যাওয়া স্বামীর পক্ষে ওয়াজিব। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এবং ইমাম শাফেয়ীরও এই মত। আর স্বামী ছাড়া অপর কোনো মুহাররম পুরুষের সাথে স্ত্রী যদি হজ্জে গমন করতে চায়, তাহলে তাকে যেতে না দেয়া স্বামীর অধিকার নেই। (আরবী************)

উপরের আলোচনার ভিত্তিতে অতি সহজেই চিন্তা করা যায় যে, হজ্জের মতো একটি ফরয আদায়ের সফর সম্পর্কে যখন এতদূর কড়াকড়ি ইসলামে রয়েছে, তখন প্রমাদ সফর, শিক্ষা সফর, সাংস্কৃতিক দৌত্যের সফর ইত্যাদি সম্পর্কে ইসলামের বিধান কি হতে পারে। ছাত্রী, শিল্পী, শিক্ষয়িত্রী কিংবা রাষ্ট্রদূত –যিনিই হোন না কেন, কারো পক্ষেই স্বামী কিংবা কোনো মুহাররম পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বিদেশ সফর আদৌ জায়েয নয় –হতে পারে না, সে সফর উচ্চশিক্ষার জন্যে হোক, উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্যে হোক, সাংস্কৃতিক চুক্তির ভিত্তিতে হোক আর রাষ্ট্রীয় দৌত্যের জন্যে হোক, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য করা যায় না এবং কোনো সফরই জায়েয নয়, একথা বলাই বাহুল্য।

মেয়েদের পোশাক প্রসাধন

মেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে শরীয়তে নিষেধ করা হনি, অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে সে অনুমতি দুটো শর্তের অধীনঃ

প্রথম শর্ত, বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে ঘুরে বেড়ানো চলবে না। প্রয়োজন –নিতান্ত অপরিহার্য প্রয়োজন থাকলেই সেই প্রয়োজন পরিমাণ সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারে।

আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, নিজের মুখ-মাথা-বুক-পিঠ এবং সমগ্র শরীর ভালোভাবে আবৃত আচ্ছাদিত করে তবে বের হওয়া চলবে। মুখ-বুক উন্মুক্ত রেখে, গায়ের বর্ণ ও যৌবনোজ্জ্বল দেহাবয়ব প্রকাশ করে ঘর থেকে বের হওয়া মেয়েদের জন্যে সুস্পষ্ট হারাম। রাসূলে করীম (স) এ পর্যায়ে বড় কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন এবং এভাবে চলার মারাত্মক পরিণামের কথাও উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেছেনঃ

(আরবী********************************************************************)

সেসব নারী যারা পোশাক পরিধান করেও ন্যাংটা, যারা নিজেদের কুকর্মকে অন্য লোকের কাছে জানান দিয়ে চলে, যারা বুক-স্কন্ধ বাঁকা করে একদিকে ঝুঁকিয়ে চলে, যাদের মাথা ষাঁড়ের চুটের মত ডান বামে ঢুলে ঢুলে পড়ে, তারা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং বেহেশতের সুগন্ধিও লাভ করতে পারবে না, যদিও তার সুগন্ধি বহুদূর থেকে পাওয়া যাবে।

‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ স্পষ্ট বলা হয়েছেঃ

(আরবী************************************************************)

বেহেশতের সুগন্ধি পাঁচশ বছর দূরত্ব থেকেও পাওয়া যাবে।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা নববী লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

মানে তারা আল্লাহর আনুগত্যের সীমা লংঘন করেছে, যা যা রক্ষা করা ও হেফাযত করা দরকার, তার হেফাযত করেছে, নিজেদের পঙ্কিল ঘৃণার্হ কাজের জানান দেয় অপর লোকদের বুক টান করে পথে-ঘাটে বীরদর্পে চলাফেরা করে, কাঁধ বাঁকা করে হাঁটে আর অসৎ মেয়েদের মতো লোকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে পথ অতিক্রম করে। এসব মেয়েলোক কখনো জান্নাতবাসী হতে পারবে না।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

এ ধরনের কাপড় যে মহিলা পরবে ও যে এভাবে চলাফেরা করবে, সে জাহান্নামী হবে এবং সে জান্নাতের সুগন্ধি পাবেনা –যদিও তা পাঁচশ বছর পথের দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে –এ বড় কঠিন ও কঠোর শাস্তির খবর। এ জিনিস প্রমাণ করে যে, হাদীসে যা করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা করা সম্পূর্ণ হারাম।

বর্তমান সময়ে মেয়েরা যেমন মাথার ওপর সবগুলো চুল চাপিয়ে বেঁধে রাখে, যা দেখলে মনে হয় (পুরষদের ন্যায়) মাথায় যেন পাগড়ি বাঁধা হয়েছে, এরূপ চুল বেঁধে রাজপথে ও বাজারে মার্কেটে চলাফেরা করা এ হাদীসে স্পষ্ট নিষেধ করা হয়েছে। এ ধরনের চুল-বাঁধা মাথাকে ষাঁড়ের পিঠে অবস্থিত চুটের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

কাপড় পরেও ন্যাংটা থাকার অর্থে বলা হয়েছেঃ

(আরবী**********************************************************************************)

মেয়েরা দেহের কতকাংশ আবৃত রাখে আর কতকাংশ রাখে খোলা, উন্মুক্ত, অনাবৃত। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য ভিন পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা অথবা অত্যন্ত পাতলা কাপড় করে, যার ফলে দেহের কান্তি বাইরে ফুটে বের হয়ে পড়ে।

এসব মেয়েলোকদের কাপড় পরেও ‘ন্যাংটা’ বলে অভিহিত করা যেমন যথার্থ, তেমনি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লামা ইবনে আবদুল বার ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************)

কাপড় পরেও ন্যাংটা থেকে যায় যেসব মেয়েলোক, যারা খুব পাতলা মিহিন কিংবা জালের ন্যায় কাপড় পরে, যার নীচের সব কিছু স্পষ্টভাবে দ্রষ্টার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। অতএব এরা কাপড় পরিহিত হয় নামে মাত্র –বাহ্যত, কিন্তু আসলে এরা ন্যাংটা-উলঙ্গ।

হযরত উসামা ইবনে যায়দ বলেনঃ রাসূলে করীম () আমাকে খুব পাতলা মিহিন এক কিবতী চাদর পরিয়ে দিলেন। আমি তা আমার স্ত্রীকে পরিয়ে দিলাম। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ কি হলো কিবতী চাদরটি তুমি পরলে না? আমি বললাম, আমি তা আমার স্ত্রীকে পরিয়ে দিয়েছি। তখন তিনি বললেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

তোমার স্ত্রীকে বলো, সে যেন সেই কাপড়ের নিচে আর একটি কাপড় পরে। কেননা আমার ভয় হচ্ছে কেবল সেই একটি কাপড় পরলেই তার দেহাবয়ব প্রকাশ হয়ে পড়বে।

এত দ্দেশের মেয়েরা মাড়ির নিচে যেমন ছাড়া পরিধান করে, এখানে ঠিক তা পরবার জন্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

আল্লামা আহমাদুল বান্না এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

অর্থাৎ মেয়েদের কাপড় যদি মোটা, অমসৃণ ও আঁটসেঁটে হয়, তাহলে দেহাবয়ব তার পূর্ণ আকার-আকৃতিসহ স্পষ্ট দেখা যাবে। আর যদি খুব পাতলা হয়, তাহলে চামড়ার কান্তি বাইরে প্রস্ফুট হয়ে পড়বে। এ কারণে দুরকমেরই কাপড় ব্যবহার করা মেয়েদের জন্যে জায়েয নয়। রাসূলের উপরোক্ত বাণীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, মেয়েদের এমন কাপড় পড়তে বলা, যা বাহ্যত কেবল কাপড়ই দেখা যাবে, তা প্রশস্ত ও ঢিলে-ঢালা হবে, মোটাহবে এবং এসব কারণে নারীদেহের কোনো অংশ প্রকাশ করবে না, যাতে চামড়ার কান্তি বাইরে থেকে দেখা যাবে।

আধুনিকা মেয়েদের টাইট পোশাক এবং গলা, পিঠ ও পেট ন্যাংটা করে অজন্তা ফ্যাশনে পরা পোশাক এজন্যেই জায়েয নয়। আবদুর রহমানের কন্যা হাফসা হযরত আয়েমার খেদমতে হাজির হয়। সে তখন খুবই পাতলা কাপড় পরিধান করেছিল। তা দেখে হযরত আয়েশা (রা) তার সে পাতলা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে দেন এবং একখানা মোটা গাঢ় কাপড় পড়িয়ে দেন। (আরবী********************)

যে সব পুরুষ তাদের ঘরের মেয়েদেরকে খুব পাতলা কাপড় পরতে দেয়, এমন কাপড় পরতে দেয় যা পরার পরেও দেহের কান্তি বাইরে ফুটে বের হয় কিংবা দেহের বিশেষ অঙ্গ অনাবৃতই থেকে যায়, হাদীসে সেসব পুরুষের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে (আরবী***********) তারা পুরুষের মতো আর তার মানেঃ

(আরবী*************************************************************************)

তারা বাহ্যত পুরুষ হলেও প্রকৃত পক্ষে তারা না নয়। কেননা যথার্থ পুরুষ মানুষ কখনো তাদের স্ত্রী-কন্যা-বোন-নিকটাত্মীয়া প্রভৃতি মেয়েদের এমন কাপড় কখনই পরতে দিতে পারে না, যা তাদের দেহকে ভালোভাবে আবৃত করে না।

বর্তমানে যাদের মেয়েরা টাইট পোশাক পরে, শাড়ি ও ব্লাউজ এমনভাবে পরে যে, বুক-পিঠ-পেট সবই থাকে উন্মুক্ত কিংবা এমন শাড়ি পরে যা দেহের সমস্ত উচ্চ-নীচ সব অঙ্গের আকার-আকৃতি দর্শকের সামনে উদঘাটিত করে তোলে এবং পুরুষের লালসা-পংকিল দৃষ্টিতে করে আকৃষ্ট, তারা যে কি ধরনের পুরুষ তা সহজেই বোঝা যায়। বস্তুত এসব পুরুষের মধ্যে পৌরুষ বা মনুষ্যত্ব নামের কোনো ‘বস্তু’ থাকলে তারা তা কিছুতেই বরদাশত করত না।

বর্তমানে কিছু কিছু মেয়েলোককে অবিকল পুরুষের পোশাকও পরতে দেখা যায়। কিন্তু ইসলামের এ যে কত বড় নিষিদ্ধ কাজ, তা নিম্নোদ্ধৃত হাদীস থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

যে মেয়েলোক পুরুষের বেশ ধারণ করবে আর যে সব পুরুষ মেয়েলোকের বেশ ধারণ করবে –তারা কেউই আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।

এ প্রসঙ্গেই রাসূল সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

যে পুরুষ মেয়েদের পোশাক পরিধান করে, আর যে মেয়েলোক পরে পুরুষের পোশাক, রাসূলে করীম (স) তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************)

যে পুরুষ মেয়েদের পোশাক পরিধান করে, আর যে মেয়েলোক পরে পুরুষের পোশাক, রাসূলে করীম (স) তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করেছেন।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

(আরবী*************************************************************************************)

নবী করীম (স) অভিশাপ বর্ষন করেছেন সেসব পুরুষের ওপর, যারা মেয়েলী পোশাক পরে এবং সেসব মেয়েলোকের ওপর, যারা পুরুষের পোশাক পরিধান করে।

আল্লামা শাওকানী এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ

(আরবী**************************************************************************)

এ পর্যায়ের যাবতীয় হাদীস প্রমাণ করে যে, পুরুষদের মেয়েলী বেশ ধারণ এবং মেয়েদের পুরুষালী বেশ ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। কেননাএ কাজে অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে, আর হারাম কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করার অভিশাপ বর্ষণ করা হয় না –সকল বিশেষজ্ঞের এই হচ্ছে সুসংহত অভিমত।

হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মেয়ে আর পুরুষ আল্লাহর দুই স্বতন্ত্র সৃষ্টি। কাজেই প্রত্যেকের জন্যে শোভনীয় বিশেষ পোশাকই তাদের পরিধান করা উচিত, তার ব্যতিক্রম করা হলে আল্লাহর মর্জির বিপরীত কাজ করা হবে। আর তাতেই নেমে আসে আল্লাহর অভিশাপ।

পোশাক সম্পর্কে একটি মূল কথা অবশ্যই সকলকে স্মরণে রাখতে হবে। সে মূল কথাটি বলা হয়েছে কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ

(আরবী************************************************************************************)

হে আদম সন্তান, নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের জন্যে এমন পোশাক নাযিল করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানকে আবৃত করে এবং ভূষণও। আর তাকওয়ার পোশাক, সে তো অতি উত্তম-কল্যাণকর। এ হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। সম্ভবত লোকের এ থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে।

প্রথমত আয়াতে গোটা মানব জাতিকে –সমস্ত আদম সন্তানদের সম্বোধন করে কথা বলা হয়েছে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষই এর মধ্যে শামিল অর্থাৎ পরবর্তী কথা সমস্ত মানুষের পক্ষেই অবশ্য পালনীয়।

দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, আল্লাহ পোশাক ও ভূষণ নাযিল করেছেন। পোশাক এমন, যা মানুষের স্ত্রী-পুরুষ –সকলের লজ্জাস্থানসমূহকে পূর্ণ মাত্রায় আবৃত করে, তার কোনো অংশই অনাবৃত-উলঙ্গ থাকে না। আল্লাহ শুধু পোশাকই নাযিল করেন নি সেই সঙ্গে ভূষণ –শোষাও মানুষের জন্যে নাযিল করেছেন। অন্য কথায়, একটা পোশাক পরাই আল্লাহর দৃষ্টিতে যথেষ্ট নয়, যবুথবুভাবে দেহাবয়ব আবৃক করলেই চলবে না, সেই সঙ্গে তাকে ভূষণ –শোভা বৃদ্ধিকারকও হতে হবে।

আল্লামা শাওকানী লিখেছেনঃ

(আরবী*************************************************************************************)

রীশ অর্থ এখানে সৌন্দর্য্যের পোশাক, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও শোভা বৃদ্ধিকারী পোশাক।

‘আল কামুস’-এ ‘রীশ’ শব্দের অর্থ লিখেছেন। (আরবী********) ‘গৌরবজনক পোশাক’।

তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়ঃ

(আরবী*******************************************************************)

আমরা নাযিল করেছি লজ্জাস্থান আবৃতকারী পোশাক এবং গৌরবমণ্ডিত পোশাক, যা পরে তোমরা শোভামণ্ডিত হবে।

আল্লামা বায়যাবীও লিখেছেনঃ (আরবী**********) রীশ মান সৌন্দর্য, শোভা।

তৃতীয় বলা হয়েছে, তাকওয়া-আল্লাহভীরুতামূলক পোশাকই উত্তম অর্থাৎ পোশাককে প্রথমত লজ্জাস্থান আবরণকারী, লজ্জা নিবারণকারী হতে হবে, দ্বিতীয়ত কেবল লজ্জা নিবারণই আল্লাহর ইচ্ছা নয়, বরং পোশাক হতে হবে শোভা বৃদ্ধিকারী। তৃতীয়, শোভাবর্ধক পোশাক যাই পরা হোক না কেন তার তাকওয়ামূলক, আল্লাহর নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে পোশাক হতে হবে। তাকওয়া-বিরোধী শোভামণ্ডিত পোশাক আল্লাহর পছন্দ নয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই আরব কবি বলেছেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

ব্যক্তি যখন তাকওয়ামূলক পোশাকই পরল না, তখন সে পোশাক পরেও উলঙ্গে পরিণত হয়ে যায়।

আয়াতের শুরুতে বনী আদম –আদম সন্তানদের সম্বোধন করা হয়েছে, যা স্পস্ট ইঙ্গিত করে বাবা আদম ও মা হাওয়া বিবস্ত্র হয়ে পড়ার ঘটনার দিকে। আর পরবর্তী আয়াতেই কথাটিকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্যে আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************************)

হে আদম সন্তান, শয়তান যেন তোমাদের বিপদে ফেলে দিতে না পারে, যেমন করে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে বিপদে ফেলেছিল। তখন সে দুজনার পোশাক টেনে ফেলে দিয়েছিল, যেন দুজনেরই লজ্জাস্থান প্রকাশিত ও দৃষ্টিগোচর হয়ে পড়ে।

শয়নাত আদম জাতিকে সর্বপ্রথম যে বিপদে ফেলেছিল, তা হলো আদম-হাওয়া –দুজনারই কাপড় খুলে পড়ে যাওয়া, উলঙ্গ হয়ে পড়া। অতএব তোমরা তাঁদেরই সন্তান বিধায় তোমাদের প্রতিও শয়তান দুশমনি দেখাবে তোমাদেরকে উলঙ্গ করে দিয়ে। অতএব তোমরা সাবধান।

এ আয়াত মানব জাতির জন্যে বড়ই সাবধান বানী, নগ্নতা, অর্ধোলঙ্গ ও কাপড় পরেও না পারার মতোই দেহের সর্বাঙ্গ দেখতে পারা শয়তানেরই প্ররোচনা। অতএব নগ্নতা আর কাপড় পরে থাকা থেকে তোমাদের সাবধান থাকতে হবে। কেননা উলঙ্গ-অর্ধোলঙ্গ হওয়ার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে গুনাহ, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়া। বস্তুত লজ্জা-শরম মানুষের প্রকৃতিগত বলেই আদম-হাওয়া সঙ্গে সঙ্গেই গাছের পাতা দিয়ে দেহাবয়ব আবৃত করতে শুরু করেন। বনী আদমেরও বর্তব্য হচ্ছে নগ্নতা ও অর্ধ নগ্নতা পরিহার করে তাকওয়ামূলক পোশাক পরিধান করা।

মেয়েদের সুগন্ধি ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা এ পর্যায়ে বিশ্লেষণ করে দেখব। বিশেষ করে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা মেয়েদের পক্ষে জায়েয নয়। এ সম্পর্কে রাসূলে করীম (স)-এর বড় কঠোর বাণী উচ্চারিত ও হাদীসের কিতাবসমূহ উদ্ধৃত হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলে করীম (স)-এর কথা নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী****************************************************************************)

যে মেয়েলোক সুগন্ধি (আতর-গোলাপ-সেন্ট ইত্যাদি) লাগিয়ে ঘরের বাইরে লোকদের কাছে যাবে এ উদ্দেশ্যে, যেন তারা সুগন্ধি শুঁকতে পারে, তবে সে ব্যভিচারী গণ্য হবে।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ

(আরবী*****************************************************************************************)

এ হাদীসে সে মেয়েলোক সম্পর্কে অত্যন্ত কঠোর ভাষা প্রয়োগ ও তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে, যে বাইরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে সুগন্ধি ব্যবহার করা, তাকে ব্যভিচারিণীও বলা হয়েছে। তার কারণ সুগন্ধির তীব্র ক্রিয়া দ্বারা সে পুরুষদের মনে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে এবং তার দিকে তাকাবার জন্যে দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। আর এ হচ্ছে কার্যত ব্যভিচারের পূর্বাভাষ।

এক হাদীসে দৃঢ় ভাষায় বলা হয়েছে, সুগন্ধি লাগিয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়লে সে নামাযও আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। নামায এবং মসজিদের জন্যে সুগন্ধি লাগানোর ব্যাপারে যখন কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তখন বাইরের হাটে-বাজারে, ক্লাবে, রেস্তোরাঁয়, মিটিং-এ পার্টিতে গমনের জন্যে সুগন্ধি ব্যবহার করা যে কতখানি অপরাধ, তা সহজেই অনুমেয়।

এ প্রসঙ্গে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস হচ্ছে এই –নবী করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

তোমরা আল্লাহর বাঁদীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না। তবে তারা খুব সাদাসিধেভাবেই ঘরের বাইরে যাবে।

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে আবদুল বার লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

মেয়েদের বাইরে যেতে নিষেধ করতে বারণ করা এবং তাদে সুগন্ধি মেখে বের হতে নিষেধ করার কারণ হলো, তাদের সুগন্ধির মাদকতায় পুরুষ লোকদের মন উতলা হয়ে উঠতে পারে।

বলা বাহুল্য, সুগন্ধি বলতে সব রকমের সুগন্ধিই বোঝায়। চোখ ঝলসানো ও চাকচিক্যপূর্ণ পোশাকও এ পর্যায়ে পড়ে।

এ কারণে নবী করীম (স) সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

সাবধান, পুরুষদের সুগন্ধ হচ্ছে এমন জিনিস, যাতে গন্ধ আছে (রং নেই), আর মেয়েদের সুগন্ধ হচ্ছে যাতে রং আছে, গন্ধ নেই।

তার মানে, চারদিকে আলোড়িত করে তোলা সুগন্ধি ব্যবহার করে ঘরের বাইরে যাতায়াত করা মেয়েদের জন্যে জায়েয নয়, এ কারণেই মেয়েদের পক্ষে মেহেন্দি, আলতা, সুরমা ইত্যাদি ধরনের ভালো সৌখিন, রূপচর্চা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির দ্রব্যাদি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া অন্য কোনো তীব্র সুগন্ধিযুক্ত জিনিস ব্যবহার করা জায়েয নয়।

এ জন্যে রাসূলে করীম (স) মেয়েদেরকে ‘খেজাব’ ব্যবহার করতে বলতেন। তিনি এক মহিলাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেনঃ

(আরবী********************************************************************)

খেজাব লাগাও, তোমরা খেজাব লাগাও না বলে তোমাদেরহাত পুরুষদের হাতের মতোই বর্ণহীন হয়ে থাকে।

হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে –এ মেয়েলোকটি অতঃপর কখনোই হয়ত খেজাব লাগান পরিত্যাগ করেনি।

এমনি অপর একটি মেয়েলোক পর্দার আড়ালে থেকে হাত বাড়িয়ে রাসূলে করীম (স)-এর নিকট একখানি চিঠি পেশ করে। নবী করীম (স) সে চিঠি না ধরে বলে উঠলেনঃ

(আরবী******************************************************)

বুঝতে পারলাম না, এ কি কোনো পুরুষের হাত, না কোনো মেয়েলোকের হাত?

মেয়েলোকটি পর্দার আড়াল থেকেই বলে উঠলঃ মেয়েলোকের হাত। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ

(আরবী***********************************************))

তুমি যদি মেয়েলোকই হতে, তাহলে তোমার হাতের নখগুলোতে অবশ্যই হেনার রঙ লাগাতে।

‘তুমি যদি মেয়েলোকই হতে’ মানে তুমি মেয়েলোক হয়ে দি মেয়েদের ভূষণ ও সাজসজ্জাকে যথারীতি পালন করে চলতে অর্থাৎ ‘নখ পালিশ’ লানাগো মেয়েদের ভূষণ ও প্রসাধনের মধ্যে গণ্য।

এ থেকে জানা যায় যে, মেয়েদের হাতে-পায়ে মেহেন্দি ও নখে হেনার (মেহেন্দি) রং লাগানো উচিত। বর্তমানে আলতা, নখ-পালিশ ও লিপিস্টিক ব্যবহারেও কোনো দোষ নেই।

বস্তুত মেয়েদের রূপ চর্চা –ইসলামে কিছুমাত্র নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে যে রূপচর্চা বাইরের লোকদের দেখাবার, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ও তাদের মনে যৌন উত্তেজনা জাগিয়ে দিয়ে তাদেরকে উন্মাদ করে তোলার উদ্দেশ্য হওয়া একেবারেই উচিত নয়। এ যদি কেউ করে তবে তার এ কাজ নিজের দেহ মনকে পর-পুরুষের কাছে সঁপে দেয়ারই শামিল হবে।

আর তাই হচ্ছে জ্বেনা। তা সবই হওয়া উচিত তার স্বামীর জন্যে, কেবলমাত্র যার পক্ষে তাকে দেখা, তার রূপ ও যৌবন উপভোগ করা ইসলামে হালাল। স্বামীর জন্যে রূপচর্চা করার ব্যাপারে কেবল চাকচিক্যপূর্ণ রঙ ব্যবহারই জায়েয নয়, তারও অধিক ঘরের মধ্যে থেকে তীব্র মন মাতানো সুগন্ধি ব্যবহার করাও জায়েয। এজন্যে উল্লিখিত আলোচনার পর আহমাদুল বান্না লিখেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

মেয়েলোক যখন স্বামীর কাছে থাকবে তখন যে কোনো জিনিস দিয়ে নিজ-ইচ্ছে ও মনোবাঞ্ছনা মতো প্রসাধন করতে পারে।

মেয়েদের পর্দা সহকারে জরুরী কাজ বাইরে বের হওয়য়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে বাইরের পথে চলাচলের একটা নিয়মও তাদের জন্যে বের করে দেয়া হয়েছে। ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের কখনো পথের মাঝখান দিয়ে ভিন পুরুষদের সাথে ঘষাঘষি করে, ভীড় ঠেলে ধাক্কা খেয়ে চলা উচিত নয়। নবী করীম (স) একটা মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে লোকদের পথ চলা লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, পথে পুরুষ ও মহিলারা পরস্পরের গা ঘেষে পাশাপাশি চলছে। তখন তিনি মেয়েদের লক্ষ্য করে বললেনঃ

(আরবী***************************************************************************)

তোমরা একটু দেরী করো, একটু পিছিয়ে পড়। কেননা পথের মাঝখান দিয়ে চলা তোমাদের উচিত নয়; বরং তোমাদের উচিত পথের একপাশ দিয়ে চলা।

হাদীসে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাসূলে করীম (স)-এর নির্দেশের পরে মহিলারা ঠিক পথের কিনারা দিয়ে প্রাচীরের পাশ ঘেষে চলতে আরম্ভ করে। ফলে এ অবস্থাও দেখা যায় যে, মেয়েদের কাপড় পথের কিনারায় প্রাচীরের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।

(আরবী*******************************************************************************)

নবী করীম (স)-এর স্থায়ী রীতি ছিল, তিনি জামা’আতের নামায সম্পূর্ণ করে পুরুষ নামাযীদের নিয়ে এতটুকু সময় দেরী করে মসজিদ থেকে বের হতেন, যার মধ্যে মেয়েরা মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে পৌঁছতে পারত। অপর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মসজিদে নববীতে মহিলা নামাযীদের প্রবেশ ও নিষ্কমণের জন্যে একটি আলাদা দরজা করে দেয়া হয়েছিল। (আবূ দাউদ)

বস্তুত মেয়েদের বাইরে পথ চলার ব্যাপারটি মোটেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা শত বোরকা পরে, শরীর-মুখ-মাথা পূর্ণমাত্রায় ঢেকেও যদি তারা ঘরের বাইরে যায়, আর যদি পথিমধ্যেই নানা পুরুষের দ্বারা দলিত মথিত ও মর্দিত হয়, তাহলে সে বোরকা আর দেহাবয়ব আচ্ছাদনের এক কানা-কড়িও মূল্য থাকে না। বিশেষত বর্তমান সময়ের মেয়েদের রাজপথে চলাচলের ধরণ দেখলে রাসূলে করীম (স)-এর এ নির্দেশের গুরুত্ব খুবই তীব্রভাবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।


মহিলাদের সামাজিক দায়িত্ব
পূর্ববর্তী আলোচনায় অকাট্য দলীল-প্রমাণাদির ভিত্তিতে একথা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, মেয়েদের প্রকৃত স্থান এবং আসল কর্মক্ষেত্র হচ্ছে তাদের ঘর। তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বও ঠিক তাই, যা তারা প্রধানত ঘরের চার-প্রাচীরের অভ্যন্তরে বসেই সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারে এবং যে কাজই মূলত ঘর কেন্দ্রিক; ঘরের নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যেই যা সীমাবদ্ধ। ঠিক এ কারণেই মহিলাদের ওপর বাইরের সামাজিক ও সামগ্রিক পর্যায়ের কোনো কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়নি।

পুরুষ নারী উভয়ই মানুষ; কিন্তু শুধু মানুষ বললে এদের আসল পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। পুরুষরা শুধু মানুষই নয়, তারা ‘পুরুষ মানুষ’ তেমনি মেয়েরাও শুধু মানুষ নয়, তারা ‘মেয়ে মানুষ’। মানুষের এ শ্রেণীবিভাগ মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কাজকে স্বভাবতই দু’পর্যায় ভাগ করে দেয়। একটি পর্যায়ের কাজ হচ্ছে ঘরে, পারিবারিক চতুঃসীমার মধ্যে, আর এক প্রকারের কাজ হচ্ছে বাইরের। এ উভয় প্রকারের কাজের স্বভাব ও ধরনের কোনো মিল নেই, সামঞ্জস্যও নেই। দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের স্বতন্ত্র প্রকৃতির কাজ বিধায় এ দুক্ষেত্রের জন্যে এ দু’ধরনের মানুষের প্রয়োজন ছিল, যা পূরণ করা হয়েছে নরও নারী সৃষ্টি করে। পুরুষকে দেয়া হয়েছে বাইরের কাজ আর তা সম্পন্ন করার জন্যে যে যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও কাঠিন্য (hardship) অনমনীয়তা, কষ্ট-সহিষ্ণুতা, দুর্ধষর্তার প্রয়োজন, তা কেবল পুরুষদেরই আছে। আর মেয়েদের আছে স্বাভাবিক কোমলতা, মসৃণতা, অসীম ধৈর্যশক্তি, সহনশীলতা, অনুপম তিতিক্ষা। ঘরের অঙ্গনকে সাজিয়ে গুছিয়ে সমৃদ্ধশালী করে তোলা, মানব বংশের কুসম-কোমল কোরকদের গর্ভে ধারণ, প্রসবকরণ, স্তন দান ও লালন পালন করার জন্যে একান্তই অপরিহার্য। তাই এ কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে মহিলাদের ওপর অর্পন করা হয়েছে। ফলৈ পুরুষেরা বাইরের কর্মক্ষেক্রের কর্তা আর মেয়েরা হচ্ছে ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ব্যাপারের কর্ত্রী। এ দুটি কর্মক্ষেত্র মিলিয়েই যেমন হয় দুনিয়ার সম্পূর্ণ ও অখণ্ড জীবন, তেমনি পুরুষ আর নারীর সমন্বয়েই মানুষ, মানুষের সম্পূর্ণতা।

ঠিক এজন্যেই ইসলামী শরীয়ত মেয়েদের ওপর ঠিক সে ধরনের কাজেরই দায়িত্ব দিয়েছে, যা তাদের ছাড়া আর কারোর করার সাধ্য নেই। সে কাজ যেন তারা অখণ্ড নির্লিপ্ততা ও নিষ্ঠাপূর্ণ মনোযোগ সহকারে সম্পন্ন করতে পারে, ইসলাম সে ধরনেরই পরিবার ও সমাজ কাঠামো পেশ করেছে, আইন বিধান দিয়েছে এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বলেছে।

এ উদ্দেশ্যেই ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অনেক বাধ্যবাধকতা থেকে নারী সমাজকে এক প্রকার মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামা’আতে শরীক হয়ে পড়া এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কিন্তু নারীদের তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে। তার মানে এ নয় যে, জামা’আতে নামায পড়ার ফযিলত ও অতিরিক্ত সওয়াব থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। বরং ঘরের নিভৃত কোণে বসে একান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে নামাজ পড়লেই তাদের সে ফযিলত লাভ হতে পারে বলে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। (আরবী*********************)

অনুরূপ কারণে জুম’আর নামাযও মেয়েদের ওপর ফরয করা হয়নি। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী**********************************************************************)

জুম’আর নামায জামা’আতের সাথে পড়া সব মুসলমানদের ওপরই ধার্য অধিকার –ফরয। তবে চার শ্রেণীর লোকদের তা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছেঃ ক্রীতদাস, মেয়েলোক, বালক ও রোগী।

আল্লামা খাত্তাবী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ

(আরবী********************************************************************************)

মেয়েলোকদের ওপর জুম’আর নামায ফরয নয়, এ সম্পর্কে সব মাযহাবের ফিকাহবিদরাই সম্পূর্ণ একমত।

জানাযার নামাযে শরীক হওয়া এবং জানাযার সাথে কবরস্থানে গমন করা থেকেও মহিলাদের বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যদিও জানাযা অনুসরণ করা মেয়েদের জন্যে হারাম নয়, মাকরূহ তানজীহী মাত্র। কাযী ইয়ায বলেছেনঃ বেশির ভাগ আলেমই মেয়েদের জানাযায় যেতে নিষেধ করেছেন। তবে মদীনার আলেমগণ অনুমতি দিয়েছেন এবং ইমাম মালিকও মনে করেন যে, অনুমতি আছে বটে, তবে যুবতী মেয়েদের জন্যে নৈতিক বিপদের আশংকায় তা অনুচিত। (আরবী**************)

হজ্জ ফরয হলেও একাকিনী হজ্জে গমন করতে মেয়েদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষেধ করা হয়েছে। এ থেকে ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা মেলে। মূলতগতভাবে মেয়েদের ওপর বাইরের কোনো কাজেরই দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। কিন্তু তাই বলে তারা যদি নিজেদের পর্দা রক্ষা করে পারিবারিক স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করার পরও সামাজিক কাজ করতে সমর্থ হয় তবে তাও নিষেধ নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে পূর্ণ ভারসাম্য Balance রক্ষা করাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত কঠিন কাজ। নারীদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ঘরে। তাই বলে ঘরের চার প্রাচীরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকবে, অবরুদ্ধ জীবন যাপন করবে, ইসলাম তা চায় না। নারদের ওপর প্রাথমিক ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের পর বাইরের সামাকি কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে ইসলাম তাতে বাধ সাধবে না। এভাবে উভয় দিকের সঙ্গে পূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই ইসলামের লক্ষ্য।

কিন্তু বর্তমানে সে ভারসাম্য ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। এ যাবত যারা কেবল ঘরের মধ্যে রয়েছে, তারা ঘরের বাইরে বের হওয়া এবং সামাজিক দায়িত্বে শরীক হওয়াকে সম্পূর্ণ হারাম বলে ধরে নিয়েছে। এক্ষণে যেসব মেয়েলোক ঘরের বাইরে আসতে শুরু করেছে, তারা পারিবারিক জীবনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চলতে আরম্ভ করেছে। এক কালে মেয়েরা যেমন ছিল নিতান্ত পুরবাসিনী, একান্তই স্বামী অনুগতা, ঘর-গৃহস্থালী করা আর সন্তান গর্ভে ধারণ ও লালন-পালনই ছিল তাদের একমাত্র কাজ। বর্তমানে তেমনি ঘর ছেড়ে দিচ্ছে, স্বামী-আনুগত্য পরিহার করছে। ঘর-গৃহস্থালী করাকে দাসীবৃত্তি –অতএব পরিত্যাজ্য বলে মনে করছে। আর সন্তান গর্ভে ধারণের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আজ গর্ভ নিরোধের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বদ্ধপরিকর হচ্ছে। পূর্ব অবস্থয় যেমন ইসলামী আদর্শের পূর্ণ স্ফূরণ হচ্ছিল না, তেমনি বর্তমান অবস্থায়ও কিছুমাত্র ইসলামী আদর্শানুরূপ নয়। দুটো অবস্থাই ভারসাম্য রহিত।

আজকের নারী ছাত্র-শিক্ষয়িত্রী, ডাক্তার-নার্স, ব্যবসায়ী-সেলসম্যান, নর্তকী-গায়িকা, রেডিও আটিষ্ট, ঘোষণাকারিণী, সমাজনেত্রী, রাজনীতি পার্টি কর্মী, সমাজ সেবিকা, উড়োজাহাজের হোস্টেস, বিদেশে রাষ্ট্রদূত, অফিসের ক্লার্ক আর কারখানার মজুর-শ্রমিক প্রভৃতি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বকাজেই অগ্রসর। কিন্তু এদিকে ঝুঁকে পড়ে তারা তাদের আসল কর্মক্ষেত্র থেকে একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। বিশেষ কোনো পুরুষের স্ত্রী হয়ে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নতুন করে এক ভারসাম্যহীন জীবনধারার সূচনা হয়ে সামগ্রিক ক্ষেত্রে এনে দিচ্ছে এক সর্বাত্মক বিপর্যয়। ইউরোপের মহিরা সমাজ সর্বাগ্রে এদিকে পদক্ষেপ করেছে। এসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা একদিকে খুইয়েছে তাদের পারিবারিক জীবন কেন্দ্রের স্থিতি, আর অপর দিকে সর্বক্ষেত্রে ভিন পুরুষদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে তারা হারিয়েছে তাদের নৈতিকতার অমূল্য সম্পদ। শুধু তাই নয়, তাদের নারীত্ব –মূলত সকল কোমলতা, মাধুর্য, শ্লীলতা-শালীনতা ও পবিত্রতা –খতম হয়ে গেছে, আর তারই ফলে গোটা মানব বংশকে তারা ঢেলে দিয়েছে এক মহাসংকটের মুখে।

প্রশ্ন হচ্ছে –নারীদেরও এসব ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া কি নিতান্তই অপরিহার্য ছিল? এমন অবস্থা কি নিশ্চয়ই দুনিয়ার কোনো দেশে কোনো সমাজেই দেখা দেয়নি যে, কর্মক্ষম পুরুসের অভাব পড়ে গেছে কিংবা কর্মক্ষম সব পুরুষের কর্মে নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে বিধায় নারীদেরও এ পথে টেনে আনতে হয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়। যেখানে যত নারীকেই বিভিন্ন সামাজিক কর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে, সেখানেই দেখা গেছে যে, যে কোনো পুরুষকে এ কাজে নিয়োগ করা যেত অতি সহজে এবং শোভনীয়ও তাই ছিল। সামাজিক ক্ষেত্রের এমন কোনো কাজটির নাম করা যেতে পারে, যা যে কোনো পুরুষের দ্বারা সম্পন্ন হতে পারে না? এতদসত্ত্বেও এসব ক্ষেত্রে নিয়োগ করে একদিকে যেমন র্কক্ষম পুরুষ শক্তির অপচয়ের কারণ ঘটানো হয়েছে, তেমনি অপরদিকে নারীদেরকে পুরুষদের কাছাকাছি ও পাশাপাশি থেকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাতে হাত ধরে কাজ করতে বাধ্য করে উভয়ের নৈতিক শ্লীলতা বোধটুকুকেও চিরতরে খতম করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।

নারী-পুরুষের এরূপ অবাধ মেলামেশার সুযোগ করে দেয়ার পর নৈতিক চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষা করে নিজস্ব পারিবারিক জীবনের স্থিতি রক্ষা করে চলা কারো পক্ষেই সম্ভব হতে পারে না। না ইউরোপ-আমেরিকায় তা সম্ভব হয়েছে, না সম্ভব হচ্ছে বর্তমান এশিয়া ও আফ্রিকায়। এ ধরনের সমাজে কেবল নৈতিক বিপর্যয়ই পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠেনি, সুষ্ঠুভাবে গঠিত এবং সম্প্রীতি ও বাৎসল্যপূর্ণ পারিবারিক জীবনও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। দুজন রেডিও আর্টিষ্ট, একজন চার সন্তানের পিতা আর একজন তিন সন্তানের জননী। রেডিও স্টেশনের পরিবেশে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্ত্রী-স্বামী ও নিষ্পাপ শিশু-সন্তানের কথা ভুলে গিয়ে নতুনভাবে মধুযামিনী যাপনে উদ্যোগী হতে দেখা গেছে। একই অফিসের দুই ক্লার্ক –নারী ও পুরুষ, পরস্পরের কাছে মজে গিয়ে নিজ নিজ পারিবারিক পবিত্র জীবনের কতা বিস্মৃত হয়েছে। এসব কাহিনীর সংখ্যা এত বেশি, যা নির্ধারণ করে সংকলিত করা সম্ভব নয়। তাই সুষ্ঠু ও নির্দোষ-নির্ভেজাল ও নির্লিপ্ত পারিবারিক জীবনের পক্ষে নারীদের ঘরের বাইরে সামাজিক কাজে-কর্মে যোগদান ও সেখানে ভিন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশার সুযোগ যে অত্যন্ত মারাত্মক, তা আজনের সমাজতত্ত্ববিদ কোনো লোকই অস্বীকার করতে পারে না।

নারীরা কি শুধু সন্তান প্রজননের যন্ত্র বিশেষ, তাদের মধ্যে কি মনুষ্যত্ব নেই? …..তা যদি হবে, তাহলে তারা কেন কেবলমাত্র স্ত্রী হয়ে ঘরের কোণে বন্দী হয়ে থাকবে –অত্যাধুনিকা নারীদের সামনে এ প্রশ্ন অত্যন্ত জোরালো হয়ে দেখা দিয়েছে এবং এ প্রশ্ন করে নারী সমাজকে ঘায়েল করা আজ খুবই সহজ। নারীরা নিছক সন্তান প্রজননের যন্ত্র বিশেষ নয়, নয় তারা মানুষ ছাড়া আর কিছু –এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাবাবেগ চালিত হওয়া বড়ই মারাত্মক। নারীরা কেবলমাত্র সন্তান প্রজননের যন্ত্র নয়, তারা আরো কিছু, সেই সঙ্গে সন্তান প্রজননের যন্ত্র যে কেবল সন্তান গর্ভে ধারণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে মানব বংশই যে লোপ পেয়ে যাবে। স্বভাবের তাগিদে সন্তান গর্ভে ধারণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে মানব বংশই যে লোপ পেয়ে যাবে। স্বভাবের তাগিদে যৌন মিলনে প্রস্তুত হওয়া যেমন সত্য, তেমনি সত্য যৌন মিলনের পরিণামে নারীদের গর্ভে সন্তানের সঞ্চার হওয়া। প্রথম ব্যাপারটিকে যদি অস্বীকার করা না যায় বা না হয়, তাহলে তার পরিণামকে অস্বীকার করা কি শুধু নারীত্বেরই নয়, মনুষ্যত্বেরও বিরোধিতা হবে না? হবে না কি তাদের অপমান? তাহলে ভাবাবেগ চালিত হয়ে এমন সব কাজে ও এমন সব ক্ষেত্রে নারীদের ঝাঁপিয়ে পড়া বা টেনে নেয়া –যেতে প্রলোভিত করা কি কখনো সমীচীন হতে পারে, যার দরুন যৌন মিলনের নিশ্চয়তা ও পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে, দেখা দিতে পারে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা এবং যার দরুন সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও পালনের সুষ্ঠুতা হবে ব্যাহত, বিঘ্নিত?

অতএব নারীকে তার আসল স্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং যারা সেখান থেকে নির্মূল হয়েছে তাদের সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে নারী কল্যাণের সর্বোত্তম ব্যবস্থা। তাই ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে “হে নারীরা! তোমরা তোমাদের ঘরকেই আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করো, তাকে কেন্দ্র করে জীবন গঠন করো, আর যত কাজই করো না কেন, তা তাকে বিঘ্নিত করে নয়, তাকে সঠিকভাবে রক্ষা করেই করবে।

অর্থোপার্জনে নারী

বর্তমান যুগ অর্থনৈতিক যুগ, অর্থের প্রয়োজন আজ যেন পূর্বাপেক্ষা অনেক গুণ বেশি বেড়ে গেছে। অর্থ ছাড়া এ যুগের জীবন ধারণ তো দূরের কথা, শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণও যেন সম্ভব নয় –এমনি এক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে। তাই পরিবারের একজন লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকা, এক ব্যক্তির উপার্জনে গোটা পরিবারের সব রকমের প্রয়োজন পূরণ করা আজ যেন সুদূরপরাহত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের লোকদের মনোভাব এমনি। তারা মনে করে, জীবন বড় কঠিন, সংকটময়, সমস্যা সংকুল। তাই একজন পুরুষের উপার্জনের ওপর নির্ভর না করে ঘরের মেয়েদের-স্ত্রীদেরও উচিত অর্থোপার্জনের জন্যে বাইরে বেরিয়ে পড়া। এতে করে একদিকে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে স্বামীর সাথে সহযোগিতা করা হবে, জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। অন্যথায় বেচারা স্বামীর একার পক্ষে সংসার তরণীকে সুষ্ঠুরূপে চালিয়ে নেয়া এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বেলাভূমে পৌঁছিয়ে দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। আর অন্যদিকে নারীরাও কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের কর্মক্ষমতার স্ফূরণ ও বিকাশ সাধনের সুযোগ পাবে।

এ হচ্ছে আধুনিক সমাজের মনস্তত্ত্ব। এর আবেদন যে খুবই তীব্র আকর্ষণীয় ও অপ্রত্যাখ্যানীয়, তাতে সন্দেহ নেই। এরই ফলে আজ দেখা যাচ্ছে, দলে দলে মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। অফিসে, ব্যবসা কেন্দ্রে, হাসপাতালে, উড়োজাহাজে, রেডিও, টিভি স্টেশনে –সর্বত্রই আজ নারীদের প্রচণ্ড ভীড়।

এ সম্পর্কে দুটি প্রশ্ন অত্যন্ত মৌলিক, একটি পারিবারিক-সামাজিক ও নৈতিক আর দ্বিতীয়টি নিতান্তই অর্থনৈতিক।

নারী সমাজ আজ যে ঘর ছেড়ে অর্থোপার্জন কেন্দ্রসমূহে ভীড় জমাচ্ছে, তার বাস্তব ফলটা যে কী হচ্ছে তা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। পরিবারের মেয়েরা নিজেদের শিশু সন্তানকে ঘরে রেখে দিয়ে কিংবা ধাত্রী বা চাকর-চাকরাণীর হাতে সঁপে দিয়ে অফিসে, বিপণীতে উপস্থিত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে –দিন রাতের প্রায় সময়ই –শিশু সন্তানরা মায়ের স্নেহমায়া থেকে বঞ্চিত থাকবে বাধ্য হচ্ছে আর তারা প্রকৃতপক্ষে লালিত-পালিত হচ্ছে ধাত্রীর হাতে, চাকর-চাকরাণীর হাতে। ধাত্রী আর চাকর-চাকরাণীরা যে সন্তানের মা নয়, মায়ের কর্তব্য সঠিকবাবে পালন করাও তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় –এ কতা যুক্তি দিয়ে বোঝাবার প্রয়োজন করে না অথচ ছোট ছোট মানব শিশুদের পক্ষে মানুষ হিসেবে লালিত-পালিত হওয়ার জন্যে সবচাইতে বেশি প্রয়োজনীয় হচ্ছে মায়ের স্নেহ-দরদ ও বাৎসল্যপূর্ণ ক্রোড়।

অপরদিকে স্বামীও উপার্জনের জন্যে বের হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে স্ত্রীও। স্বামী এক অফিসে, স্ত্রী অপর অফিসে, স্বামী এক কারখানায়, স্ত্রী অপর কারখানায়। স্বামী এক দোকানে, স্ত্রী অপর এক দোকানে। স্বামী এক জায়গায় ভিন মেয়েদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে কাজ করছে আর স্ত্রী অপর এক স্থানে ভিন পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রুজি-রোজগারে ব্যস্ত হয়ে আছে। জীবনে একটি বৃহত্তম ক্ষেত্রে স্বামী আর স্ত্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের বন্ধনে ফাঁটল ধরা –ছেদ আসা যে অতি স্বাভাবিক তা বলে বোঝাবার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে না স্বামীত্ব রক্ষা পায়, না থাকে স্ত্রীর সতীত্ব। উভয়ই অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীল এবং প্রত্যেকেরই মনস্তত্ব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবধারায় চালিত ও প্রতিফলিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। অতঃপর বাকি থাকে শুধু যৌন মিলনের প্রয়োজন পূরণ করার কাজটুকু। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভের পর এ সাধারণ কাজে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হওয়া –বিশেষত বাইরে যখন সুযোগ-সুবিধার কোনো অবধি নেই –তখন একান্তই অবাস্তব ব্যাপার। বস্তুত এরূপ অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ ক্ষীণ হয়ে আসতে বাধ্য। অতঃপর এমন অবস্থা দেখা দেবে, যখন পরিচয়ের ক্ষেত্রে তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রী হলেও কার্যত তারা এক ঘরে রাত্রি যাপনকারী দুই নারী পুরুষ মাত্র। আর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তাদের ক্ষেত্রে বিচিত্র কিছু নয়। পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি, নির্লিপ্ততা, গভীর প্রেম-ভালোবাসা শূন্য হয়ে এরা বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থোপার্জনে যন্ত্র বিশেষে পরিণত হয়ে পড়ে। এ ধরনের জীবন যাপনের এ এক অতি স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়।

একথা সুস্পষ্ট যে, যৌন মিলনের স্বাদ যদিও নারী পুরুষ উভয়েই ভোগ করে, কিন্তু তার বাস্তব পরিণাম ভোগ করতে হয় কেবলমাত্র স্ত্রীকেই। স্ত্রীর গর্ভেই সন্তান সঞ্চারিত হয়। দশ মাস দশ দিন পর্যন্ত বহু কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ সহকারে সন্তান গর্ভে ধারণ করে তাকেই চলতে হয়, সন্তান প্রসব এবং তজ্জতিন কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ও দুর্ভোগ তাকেই পোহাতে হয়। আর এ সন্তানের জন্যে স্রষ্টার তৈরী খাদ্য সন্তান জন্মের সময় থেকে কেবলমাত্র তারই স্তনে এসে হয় পুঞ্জীভূত। কিন্তু পুরুষ এসব কিছু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। জনেন্দ্রিয়ে শুক্রকীট প্রবিষ্ট করানোর পর মানব সৃষ্টির ব্যাপারে পুরুষকে আর কোনো দায়িত্বই পালন করতে হয় না। এ এক স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার, যৌন মিলনকারী কোনো নারীই এ থেকে রেহাই পেতে পারে না।–[বর্তমানে গর্ভ ধারনের এ ঝামেলা থেকে তাদের মুক্ত রাখার জন্যেই আবিস্কৃত ও উৎপাদিত হয়েছে জন্মনিরোধের যাবতীয় আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম। তার সফল ব্যবহার যেসব নারী সক্ষম হয়, কেবল তারাই গর্ভ ধারণ থেকে নিষ্কৃত পেয়ে যায়] এখন এহেন নারীকে যদি পরিবারের জন্যে উপার্জনের কাজেও নেমে যেতে হয়, তাহলে তাকে কতখানি কষ্টদায়ক, কত মর্মান্তিক এবং নারী সমাজের প্রতি কত সাংঘাতিক জুলুম, তা পুরুষরা না বুঝলেও অন্তত নারী সমাজের তা উপলব্ধি করা উচিত।

পারিবারিক জীবনের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ দুটো। একটি হচ্ছে পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ আর অপরটি হচ্ছে মানব বংশের ভবিষ্যৎ রক্ষা। দ্বিতীয় কাজটি যে প্রধানত নারীকেই করতে হয় এবং সে ব্যাপারে পুরুষের করণীয় খুবই সামান্য আর তাতেও কষ্ট কিছুই নেই, আছে আনন্দ-সুখ ও স্ফুর্তি, এ তো সুস্পষ্ট কথা। তা হলে যে নারীকে মানব বংশের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্যে এতো দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে, তাকেই কেন আবার অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব বহন করতে হবে? এটা কোন ধরনের ইনসাফ! দুটো কাজের একটি কাজ যে স্বাভাবিক নিয়মে একজনের ওপর বর্তিয়েছে, ঠিক সেই স্বাভাবিক নিয়মেই কি অপর কাজটি অপর জনের ওপর বর্তাবে না? নারীরাই বা এ দুধরনের কাজের বোঝা নিজেদের স্কন্ধে টেনে নিতে ও বয়ে বেড়াতে রাজি হচ্ছে কেন?

ইসলাম এ না-ইনসাফী করতে রাজি নয়। তাই ইসলামের পারিবারিক ব্যবস্থায় গোটা পরিবারের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব একমাত্র পুরষের। দুটি কাজ দু’জনের মধ্যে যে স্বাভাবিক নিয়মে বণ্টিত হয়ে আছে ইসলাম সে স্বাভাবিক বণ্টনকেই মেনে নিয়েছে। শুধু মেনে নেয়নি, সে বণ্টনকে স্বাভাবিক বণ্টন হিসাবে স্বীকার করে নেয়ায়ই বিশ্বমানবতার চিরকল্যাণ নিহিত বলে ঘোষণাও করেছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী মহাসম্মানিত মানুষ, তাদরে নারীত্ব হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে সম্মানার্হ। আল্লাহ তা’আলা তাদের এ সম্মান ও মর্যাদা নিহিত রেখেছেন তাদের কাছে অর্পিত বিশেষ আমানতকে সঠিকভাবে রক্ষার কাজে। এতেই তাদের কল্যাণ, গোটা মানবতার কল্যাণ ও সৌভাগ্য। নারীর কাছে অর্পিত এ আমানত সে রক্ষা করতে পারে কোনো পুরুষের স্ত্রী হয়ে, গৃহকর্ত্রী হয়ে, মা হয়ে। এ ক্ষেত্রেই তার প্রকৃত ও স্বাভাবিক বিকাশ সম্ভব। নারীকে যদি পরিবারের সুরক্ষিত ভিত্তিভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়, যদি দেয়া যায় তার সব অধিকার, সঠিক মর্যাদা যথাযথভাবে ও পরিপূর্ণ মাত্রায়, তবেই নারীর জীবন সুখ-সম্ভারে সমৃদ্ধ হতে পারে। নারী যদি সফল স্ত্রী হতে পারে, তবেই সে হতে পারে মানব সমাজের সর্বাধিক মূল্যবান ও সম্মানীয় সম্পদ। তখন তার দরুন একটা ঘর ও সংসারই শুধু প্রতিষ্ঠিত ও ফুলে ফলে সুশোভিত হবে না, গোটা মানব সমাজও হবে যারপরনাইভাবে উপকৃত।

অনুরূপভাবে নারী যদি মা হতে পারে, তবে তার স্থান হবে সমাজ-মানবের শীর্ষস্থানে। তখন তার খেদমত করা, তার কথা মান্য করার ওপরই নির্ভরশীল হবে ছেলে সন্তানদের জান্নাত লাভ। ‘মায়ের পায়ের তলায়ই রয়েছে সন্তানের বেহেশত’।

নারীকে এ সম্মান ও সৌভাগ্যের পবিত্র পরিবেশ থেকে টেনে বের করলে তার মারাত্মক অকল্যাণই সাধিত হবে, কোনো কল্যাণই তার হবে না তাতে।

তবে একথাও নয় যে, নারী অর্থোপার্জনের কোনো কাজই করতে পারবে না। পারবে, কিন্তু স্ত্রী হিসেবে তার সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার পর; তাকে উপেক্ষা করে, পরিহার করে নয়।

ঘরের মধ্যে থেকেও মেয়েরা অর্থোপার্জনের অনেক কাজ করতে পারে এবং তা করে স্বামীর দুর্বহ বোঝাকে পারে অনেকখানি হালকা বা লাঘব করতে। কিন্তু এটা তার দায়িত্ব নয়, এ হবে তার স্বামী-প্রীতির অপূর্ব দৃষ্টান্ত।

কিন্তু আবার স্মরণ করতে হবে যে, সফল স্ত্রী হওয়াই নারী জীবনের আসল সাফল্য। সে যদি ঘরে থেকে ঘরের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুরূপে চালাতে পারে, সন্তান লালন-পালন, সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষাদান, সামান্য ও সাধারণ রোগের চিকিৎসার প্রয়োজনও পূরণ করতে পারে, তবে স্বামী-প্রীতি আর স্বামীর সাথে সহযোগিতা এর চাইতে বড় কিছু হতে পারে না। স্বামী যদি স্ত্রীর দিক দিয়ে পূর্ণ পরিতৃপ্ত হতে পারে, ঘরের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় কাজ-কর্ম সম্পর্কে হতে পারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, তাহলে সে বুকভরা উদ্দীপনা আর আনন্দ সহকারে দ্বিগুণ কাজ করতে পারবে। স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতা এর চাইতে বড় আর কি হতে পারে।

নারী স্ত্রী হয়ে কেবল সন্তান উৎপাদনের নির্জিব কারখানাই হয় না, সে হয় সব প্রেম-ভালোবাসা ও স্নেহ মমতার প্রধান উৎস, স্বামী ও পুত্র কন্যা সমৃদ্ধ একটি পরিবারের কেন্দ্রস্থল। বাইরের ধন-ঐশ্বর্যের ঝংকার অতিশয় সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের চাকচিক্য আর হাস্য-লাস্যের চমক-ঠমক, গৃহাভ্যন্তরস্থ এ নিবিড় সুখ ও শান্তির তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ, অতিশয় হীন ও নগণ্য। এ দুয়ের মাঝে কোনো তুলনাই হতে পারে না।

আজকের দিনে যেসব নারী গৃহকেন্দ্র থেকে নির্মূল হয়ে বাইরে বের হয়ে পড়েছে, আর ছিন্ন পত্রের মতো বায়ূর দোলায় এদিক থেকে সেদিকে উড়ে চলেছে, আর যার কাছে হচ্ছে ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা –তারা কি পেয়েছে কোথাও নারীত্বের অতুলনীয় সম্মান? পেয়েছে কি মনের সুখ ও শান্তি? যে টুপি অল্প মূল্যের হয়েও মাথায় চড়ে শোভাবর্ধন করতে পারে, তা যদি স্থানচ্যুত হয়ে যায়, তবে ধূলায় লুণ্ঠিত ও পদদলিত হওয়া ছাড়া তার কি গতি হতে পারে?

বস্তুত বিশ্বমানবতার বৃহত্তম কল্যাণ ও খেদমতের কাজ নারী নিজ গৃহাভ্যন্তরে থেকেই সম্পন্ন করতে পারে। স্বামীর সুখ-দুঃখের অকৃত্রিম সাথী হওয়া, স্বামীর হতাশাগ্রস্থ হৃদয়কে আশা আকাংক্ষায় ভরে দেয়া এবং ভবিষ্যৎ মানব সমাজকে সুষ্ঠুরূপে গড়ে তোলার কাজ একজন নারীর পক্ষে এ ঘরের মধ্যে অবস্থান করেই সম্ভব। আর প্রকৃত বিচারে এই হচ্ছে নারীর সবচাইতে বড় কাজ। এতে না আছে কোনো অসম্মান, না আছে লজ্জা ও লাঞ্ছনার কোনো ব্যাপার। আর সত্যি কথা এই যে, বিশ্বমানবতার এতদাপেক্ষা বড় কোনো খেদমতের কথা চিন্তাই করা যায় না। এ কালের যেসব নারী এ কাজ করতে রাজি নয় আর যে সব পুরুষ নারীদের এ কাজ থেকে ছাড়িয়ে অফিসে কারখানায় আর হোটেল-রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায়, তাদের চিন্তা করা উচিত, তাদের মায়েরাও যদি এ কাজ করতে রাজি না হতো, তাহলে এ নারী ও পুরুষদের দুনিয়ায় আসা ও বেঁচে থাকাই হতো সম্পূর্ণ অসম্ভব।

তাই ইসলাম নারীদের ওপর অর্থোপার্জনের দায়িত্ব দেয়নি, দেয়নি পরিবার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের কর্তব্য। তা সত্ত্বেও যে নারী গৃহকেন্দ্র অস্বীকার করে বাইরে বের হয়ে আসে, মনে করতে হবে তার শুধু রুচিই বিকৃত হয়নি, সুস্থ মানসিকতা থেকেও সে বঞ্চিতা।

সামাজিক ও জাতীয় কাজে-কর্মে নারী-বিনিয়োগের ব্যাপারটি কম রহস্যজনক নয়। এ ধরনের কোনো কাজে নারী-বিনিয়োগের প্রশ্ন আসতে পারে তখন, যখন সমাজের পুরুষ শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে। তার পূর্বে পুরুষ-শক্তিকে বেকার করে রেখে নারী নিয়োগ করা হলে, না বেকার সমস্যা সমাধান হতে পারে, না পারে নতুন দাম্পত্য জীবনের সূচনা, নতুন ঘর-সংসার ও পরিবারের ভিত্তি স্থাপিত করতে। কেননা সাধারণত কোনো সভ্য সমাজেই নারীর রোজগার করে পুরুষদের খাওয়ায় না, পুরুষরাই বরং নারীদের ওপর ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম ও লালন-পালনের ভার দিয়ে তাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। বিশেষত পুরুষরা যদি বাইরের সমাজের কাজ না করবে, জরুরী-রোজগারের কাজে না লাগবে, তাহলে তারা করবেটা কি! স্ত্রীর রোজগারে যেসব পুরুষ বসে খায়, তারা নিষ্কর্মা থেকে কর্মশক্তির অপচয় করে। এভাবে নারীর পরিবর্তে পুরুষকে নিয়োগ করা হলে একদিকে যেমন জাতির বৃহত্তর কর্মশক্তির সঠিক প্রয়োগ হবে, বেকার সমস্যার সমাধান হবে, তেমনি হবে নতুন দম্পতি ও নতুন ঘর-সংসার-পরিবার প্রতিষ্ঠা। এক-একজন পুরুষের উপার্জনে খেয়ে পরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবে বহু নর, নারী, শিশু। এতে করে পুরুষদের কর্মশক্তির যেমন হবে সুষ্ঠু প্রয়োগ, তেমনি নারীরাও পাবে তাদের স্বভাব-প্রকৃতি ও রুচি-মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ। এভঅবেই নারী আর পুরুষরা বাস্তবভাবে হতে পারে সমাক শংকটের সমান ভারপ্রাপ্ত চাকা। যে সমাজে এরূপ ভারসাম্য স্থাপিত হয়, সে সমাজ শকট (গাড়ি) যে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ও দ্রুতগতিতে মঞ্জিলে মকসুদ পানে ধাবিত হতে পারে, পারে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির উচ্চমত প্রকোষ্ঠে আরোহণ করতে, তা কোনো সমাজ অর্থনীতিবিদই অস্বীকার করতে পারেনা।

তাই এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে যে, সামাজিক ও জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে নারীদের ভীড় জমানো কোনো কল্যাণই বহন করে আনতে পারে না –না সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিতে, না নিতান্ত অর্থনৈতিক বিচারে।

এ নীতিগত আলোচনার প্রেক্ষিতে আধুনিক ইউরোপের এক বাস্তব দৃষ্টান্ত পেশ করা কম রুচিকর হবেনা।

এক বিশেষ রিপোর্ট থেকে জানা গেছে যে, লণ্ডন শহরে ৭৫৭৩টি পানশালা রয়েছে। আর সেখানে কেবল মদ্যপায়ী পুরুষরাই ভীড় জমায় না, বিলাস-স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়া বহু নারীও সেখানে পদধুলি দিতে কসুর করে না। লন্ডনে নারী মদ্যপায়িনীর সংখ্যা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বর্তমানে তাদের জন্যে বিশেষ পানশালা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। কিন্তু নারীদের জন্যে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত এ পানশালা সমূহে কেবলমাত্র সাদাসিধে গৃহকর্ত্রীরাই এসে থাকে। বিলাসী যুবতী ও চটকদার সিক মেয়েরা কিন্তু সাধারণ পানশালাতেই উপস্থিত হয়। নারীদের মদ্যপান স্পৃহার এ তীব্রতা প্রথমে গুরুতর বলে মনে করা হয়নি। বরং মনে করা হয়েছে, তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখতে চাইরে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে। কিন্তু মদাসক্ত ও অভ্যস্ত মদ্যপায়িনী নারীদের স্বামীর এখন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। তারা তাদের স্ত্রীদের এ মদাসক্তির ফলে তাদের দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন ধ্বংশোন্মখ হতে দেখতে পাচ্ছে। তারা অনুভব করছে –পুরুষদের তুলনায় নারীরা অধিক আবেগপ্রবণ ও অটল স্বভাবের হয়ে থাকে। ফলে তারা খুব সহজেই অভ্যস্ত মদ্যপায়িনীতে পরিণত হচ্ছে। আর তাদের স্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে, পারিবারিক বাজেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে এবং সর্বোপরি ঘর-সংসারের শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।

এ মদ্যপায়ী নারীদের অধিকাংশই হচ্ছে তারা, যারা শহরের বিভিন্ন অফিসে নানা কাজে নিযুক্ত রয়েছে। তাদের অফিস গমনের ফলে অফিসের নির্দিষ্ট সময় তাদের ঘর-সংসার তাদের প্রত্যক্ষ দেখাশোনা, পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। অফিসের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সন্ধ্যার দিকে তারা পানশালায় গমন করে। আর রাতের বেশির ভাগ সময়ই তারা অতিবাহিত করে মদের নেশায় মত্ত হয়ে। ফলে না থাকে তাদের স্বামীদের প্রতি কোনো আগ্রহ আকর্ষণ ও কৌতুহল, না শিশু সন্তানদের জন্য কোনো মায়া-মমতা তাদের মনে।

এসব স্ত্রী স্বামীরই নিজেদের সন্ধ্যাকালীন ও নৈশ একাকীত্ব ও নিঃসংগতাকে ভরে তোলে, সরল ও রঙীন করে তোলে নৈশ ক্লাবে গমন করে। ফলে এদের সন্তানদের মনে মা-বাবা ও নৈতিক মূল্যমানের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাভক্তি থাকতে পারে না। বর্তমান ইউরোপের নতুন বংশধররা যে সামাজিক পারিবারিক বন্ধনের বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, শত্রু হয়ে উঠছে নৈতিকতা শালীনতা পবিত্রতার, আসলে তারা পূর্বোক্ত ধরনের মদ্যপায়ী মা-বাবার ঘরেই জন্ম গ্রহণ করেছে। বর্তমান ইউরোপ এ ধরনের নৈতিকতার সব বাঁধন বিধ্বংসী ময়লার স্রোতে রসাতলে ভেসে যাচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় সম্পদ শক্তি এটম বোমা ও হাইড্রোজেন বোমাও এ স্রোতকে রুখতে পারে না, ঠেকাতে পারে না ইউরোপ-আমেরিকার নিশ্চিত ধ্বংসকে। (দৈনিক কুহিস্তান, লাহোর, দৈনিক দাওয়াত, দিল্লী-১৩-৪-৬৫ইং)

রাজনীতি ও নারী সমাজ

রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারসমূহ মানব সমাজের জন্যে সাধারণভাবেই অত্যন্ত জরুরী এবং অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামের প্রাথমিক যুগে পুরুষদের সমান মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নারী সমাজ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অংশ গ্রহণ করেছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পরে পরে সাকীফার বনী সায়েদার অনুষ্ঠিত খলীফা নির্বাগচনী সভায় মহিলারা যোগদান করেছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। খুলাফায়ে রাশেদুনও নির্বাচনী সভায় মহিলারা যোগদান করেছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়নি। খুলাফায়ে রাশেদুনের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারাদি মীমাংসার্থে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভাসমূহেও নারী সমাজের সক্রিয়ভাবে যোগদানের কোনো উল্লেখ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দেকতে পাওয়া যায় নি। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জটিলতার বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারসমূহে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে –এমন কথাও কেউ বলতে পারবে না।

অথচ ইতিহাসে –কেবল ইতিহাসে কেন, কুরআন মজীদেও –এ কথার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে, নবী করীম (স) পুরুষদের ন্যায় স্ত্রীলোকদের নিকট থেকেও ঈমান ও ইসলামী আদর্শানুযায়ী জীবন যাপনের ‘বায়’আত’ –ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি –গ্রহণ করেছেন। মক্কা বিজয়ের দিন এরূপ এক ‘বায়’আত’ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ‘বায়’আতে’ নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অংশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু এসব কথাকে যারা ‘মেয়েরাও রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেছে’ বলে প্রমাণ হিসাবে পেশ করতে চান, তারা মরুভূমির বুকের ওপর নৌকা চালাতে চান, বলা যেতে পারে।

ইতিহাসে এ কথার উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যায় যে, রাসূলের জামানায় পুরুষদের মতোই কিছু সংখ্যক মহিলা সাহাবীও রাসূলে করীম (স)-এর অনুমতিক্রমেই যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানে তাঁরা যোদ্ধাদের পানি পান করানোর কাজ করেছেন, নানা খেদমত করেছেন। নিহত ও আহতদের বহন করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তারা তাদের সেবা-শুশ্রুষা করেছেন। রুবাই বিনত মুয়াকেয (রা) বলেনঃ

(আরবী***********************************************************************)

আমরা মেয়েরা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গে যুদ্ধে গমন করেছি। আমরা সেখানে লোকদের পানি পান করানো, খেদমত ও সেবা-শুশ্রূষা ও নিহত-আহতদের মদীনায় নিয়ে আসার কাজ করতাম।

হযরত উম্মে আতীয়াতা আনসারী বলেনঃ

(আরবী****************************************************************)

আমি রাসূলে করীম (স)-এর সাথে একে একে সাতটি যুদ্ধে যোগদান করেছি। আমি পুরুষদের পিছনে তাদের জন্তুযানে বসে থাকতাম, তাদের জন্যে খাবার তৈরী করতাম, আহতদের ঔষধ খাওয়াতাম ও রোগাক্রান্তদের সেবা-শুশ্রূষা করতাম।

হুনাইনের যুদ্ধে হযরত উম্মে সুলাইম খঞ্জর নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হযরত আনাস (রা) বলেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

উম্মে সুলাইম হুনাইন যুদ্ধের দিন খঞ্জর হস্তে ধারণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ

(আরবী**********************************************************************)

রাসূলে করীম (স) কি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে গমন করতেন?

জবাবে তিনি জানিয়েছিলেনঃ

(আরবী*********************************************************************)

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন। মেয়েরা সেখানে আহতদের ঔষধ দেয়ার কাজ করত।

অনেক সময় যুদ্ধের ময়দানের একদিকে তাঁবু ফেলা হতো এবং তাতে মেয়েরা অবস্থান করত। কেউ অসুস্থ বা আহত হলে তাকে সেখানে স্থানান্তরিত করার জন্যে রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিতেন।

ঐতিহাসিক এবং প্রামাণ্য হাদীসের কিতাবে এ সব ঘটনার সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু তা থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, ইসলামী সমাজে মহিলাদের পক্ষে প্রকাশ্য রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে যোগদান করা শরীয়তসম্মত। এ থেকে যা কিছু প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে কেবলমাত্র জরুরী পরিস্থিতিতে –যুদ্ধ জিহাদে সাধারণ ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর, গোটা সমাজ ও জাতি যখন জীবন মরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তখন পুরুষদের সঙ্গে মেয়েদেরও কর্তব তার মুকাবিলা করার জন্যে বের হয়ে পড়া। আর ঠিক এরূপ পরিস্থিতিতে এহেন কঠিন সংকটপূর্ণ সময়ে –তা যখনই যেখানে এবং ইতিহাসের যে কোনো স্তরেই হোক না কেন –নারীদের কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়া অপরিহার্য এবং ইসলামী শরীয়তেও তা জায়েয, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এ হচ্ছে নিতান্তই জরুরী পরিস্থিতির (Emergency time) ব্যাপার এবং জরুরী পরিস্থিতি হচ্ছে বিশেষ extraordinary situation) আর বিশেষ পরিস্থিতি যেমস সাধারণ পরিস্থিত নয়, তেমনি বিশেষ পরিস্থিতি যা কিছু সঙ্গত, যা করতে মানুষ বাধ্য হয়, না করে উপায় থাকে না, তা সাধারণ পরিস্থিতিতে করা কিংবা তা করার জন্যে আবদার করা কিছুতেই সঙ্গত হতে পারে না, যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।

উপরোক্ত ঐতিহাসিক দলীল থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে মুসলিম মহিলারা যোগদান করেছেন, যুদ্ধের ময়দানে তারা আলাদাভাবে পুরুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেছেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা পুরুষদের সঙ্গে দুধে-কলায় মিশে একাকার হওয়ার মতো অবস্থায় পড়েনি, পড়তে রাজি হন নি। তাঁরা রোগী ও আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেণ, ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়েছেন, ব্যান্ডেজ বেঁধেছেন আর এসবই তারা করেছেন যুদ্ধের সময়, যুদ্ধের ময়দানে, নিতান্ত জরুরী পরিস্থিতিতে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সকল কালের মুসলিম মহিলাদের পক্ষে যে বিশেষ ধরনের কাজ করা সঙ্গত, আজও এ নিয়মে কোনোরূপ রদবদল করার প্রয়োজন নেই, কোনো দিনই সে প্রয়োজন দেখা দেবে না, কেউ সে কাজ করতে নিষেধও করবে না। কিন্তু এ সময়ের দোহাই দিয়ে সাধারণভাবে মেয়েদেরকে রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক জটিল ব্যাপারাদিতে টেনে আনতে চেষ্টা করলে তা যেমন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তেমনি তার পরিণামও কখনো শুভ হতে পারে না।

আমরা এও জানি, ইসলামের প্রথম পর্যায়ে মেয়েরাও পুরুষদের ন্যায় বিরাট কুরবানী দিয়েছেন। দৈহিক, মানসিক ও আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যার কোনো তুলনা হয় না। তাঁরা মেয়ে মহলে ইসলাম প্রচারের কাজও করেছেন, এখনো করবেন –করতে কোনোই বাধা নেই; বরং এজন্যে দেয়া নির্দেশ চিরদিনই বহাল থাকবে। কিন্তু তাইবলে তাদের প্রকাশ্য রাজনীতির ময়দানে টেনে আনা, রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্ম তৎপরতায় শরীক করা কিছুতেই সমীচীন হতে পারে না। কেননা তা করতে গেলে তাদের দ্বারা পারিবারিক জীবনের গুরুদায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না। আর মেয়েদের বৃহত্তম দায়িত্ব হচ্ছে পারিবারিক দায়িত্ব পালন। যে কাজে তা যথাযথভাবে পালন করা নিশ্চিতভাবে বিঘ্নিত হবে, তা করতে যাওয়া নারী জাতির নারীত্বেরই চরম অবমাননা, সন্দেহ নেই।

রাসূলের যামানায় মেয়েরাও ঈদের জামা’আতে শরীক হয়েছে, রাসূলে করীমের ওয়ায-নসীহত শোনবার জন্যে উপস্থিত হয়েছে, -এখনো এ কাজ হতে পারে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রেই মেয়েরা যেমন পুরুষদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রয়েছে, তেমনি পর্দা ব্যাহত হতে পারে –এমনভাবে আজো করা চলবে না।

যুদ্ধের ময়দানে মেয়েরা গিয়েছে, নার্সিং, সেবা-শুশ্রূষার কাজ করেছে, ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধেছে, কিন্তু প্রত্যেক মেয়েই করেছে তার নিজস্ব মুহাররম পুরুষের। আর ভিন পুরুষের মধ্যেও তা করে থাকলে তাতে তার পর্দার হুকুম অমান্য হতে দেয়নি। আল্লামা নববী লিখেছেনঃ

(আরবী************************************************************************)

মেয়েদের এ ঔষধ খাওয়ানো বা লাগানোর কাজ হতো তাদের মুহাররম পুরুষদের জন্যে –তাদের স্বামীদের জন্যে। এদের ছাড়া আর কারো জন্যে তা করা হলে তা স্পর্শকে এড়েয় চলা হয়েছে। আর স্পর্শ করতে হলেও নিতান্ত প্রয়োজনীয় স্থানে করা হয়েছে।

একথাও ইতিহাস প্রসিদ্ধ যে, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) ‘জামাল’ যুদ্ধে এক পক্ষের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, তিনি তা করেছেন উষ্টের পৃষ্টে ‘হাওদাজের’ মধ্যে বসে পর্দার অন্তরালে থেকে। প্রকাশ্যভাবে পুরুষদের সামনে তিনি বের হন নি, তাদের সঙ্গে তিনি খোলামেলাভাবে মিলিতও হন নি।

দ্বিতীয়ত তিনি যা কিছু করেছিলেন, পরবর্তী জীবনে তিনি নিজেই সে সম্পর্কে গভীরভাবে অনুতাপ করেছেন। কেননা প্রথম নারী আর দ্বিতীয়ত রাসূলের বেগম হিসেবে তাঁর ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে বের হয়ে পড়া সঙ্গত ছিল না। এজন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোষ স্কীকার করে তওবাও করেছেন।

কাজেই তাঁর এ কাজকে একটি প্রমাণ বা দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে না এবং এর ভিত্তিতে বলা যেতে পারে না যে, মেয়েরাও রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ঝামেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কেননা এ হচ্ছে একটি দুর্ঘটনা, একটি ভুল –ভুলবশত করা একটি কাজ। আর তা থেকে কখনো সাধারন নীতি প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে না।

ইসলাম ও মুসলিম জাতির ইতিহাসে এমন সব অধ্যায়ও অতিবাহিত হয়েছে, যখন মেয়েলোক কোনো রাষ্ট্রের কর্ত্রী হয়ে বসেছেন। এঁদের অনেকে আবার তাদের স্বামীদের ওপর প্রভাব ব্সিতার করে রাজ্য শাসনের কর্তৃত্ব দখল করেছে। শিজরাতুল-দূর ও হারুন-অর রশীদের স্ত্রী জুবায়দার নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।

কিন্তু এসবও নিতান্তই আকস্মিক ও অসাধারণ ব্যাপার, সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বিশেষ। তাদের এ কাজ ইসলামী শরীয়তের দলীল হতে পারে না। কেননা প্রথমত স্বামীর ওপর প্রভাবের ফলেই তা হওয়া সম্ভব হয়েছিল, সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের ফলে নয়। অথচ আজকের দিনের রাজীনতে তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করছে। দ্বিতীয়ত কোনো মুসলিমের শরীয়ত বিরোধী কাজের অনুসরণ করতে মুসলমানরা বাধ্য নন।

এ আলোচনার ফলে এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, মুসলিম মহিলাদের রাজনীতিতে কার্যত অংশ গ্রহণ সঙ্গত নয়, সমীচীন নয়। নয় বলেই অতীত ইতিহাসে মেয়েদেরকে রাজনীতির ঝামেলা-জটিলতা পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন? ইসলাম নারীদের মর্যাদা উন্নত করেছে, পুরুষদের দাসত্ববৃত্তি থেকে তাদের চিরদিনের তরে মুক্তি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এরূপ হওয়ার কারণ কি?

ইসলাম মহিলাদের হারানো সব অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, উপযুক্ত মানবীয় মর্যাদা দিয়ে তাদের সুপ্রতিষ্টিত করেছে সমাজের ওপর, পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার দিয়েছে –এ সবই সত্য; কিন্তু এতদসত্ত্বেও ইসলামী রাজনীতির ঝামেলা-সংকুল জটিলতা থেকে মহিলাদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখাতেই নিজেদের, জাতির এবং গোটা মানব সমাজের কল্যাণ মনে করেছে। এ কারণেই তাদের ওপর অর্থোপার্জনের দায়িত্ব চাপানো হয়নি, বরং তা পিতা, ভাই, স্বামী, পুত্র ও নিকটাত্মীয় মুরব্বী গার্জিয়ানের উপর অর্পন করা হয়েছে। যদিও ক্রয়-বিক্রয় ও কামাই-রোজগার করার যোগ্যতা সম্পূর্ণভাবে তাদের রয়েছে এবং কাজ হিসেবে এগুলো কোনো অন্যায় বা নাজায়েয কিছু নয়, তবুও মেয়েদেরকে এসব ব্যাপারের দায়িত্ব দিয়ে পারিবারিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা, পবিত্র-সমৃদ্ধি বিনষ্ট করতে ইসলাম রাজি নয়। নারী পিতা ও ভাইয়ের আশ্রয়ে লালিতা-পালিতা হবে এবং স্বামীর ঘর করার জন্যে তৈরী হবে দেহ ও মনে। বিয়ের পর সে হবে স্বামীর ঘরের রাণী, কর্ত্রী, সন্তানের স্নেহের পাত্রী, আদরের ধন। আর স্বামীর ঘরের সে দয়ার পাত্রী নয় কারো। সে পালন করবে তার নিজের দায়িত্ব আর স্বামী পালন করবে তার নিজের দায়িত্ব। সে আদায় করবে স্বামীর অধিকার। ফলে তা মনিবী আর দাসত্বের ব্যাপার হয় না, হয় দুই সমান সত্তার পারস্পরিক অধিকার আদায়ের অংশীদারিত্ব। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিও এখানেই নিহিত। ঘর ত্যাগ করে বাইরে বের হয়ে অপর কারো কাছে চাকরি-বাকরি করে নির্দিষ্ট পরিমাণে কিছু টাকা মাসান্তর নিজ হাতে পাওয়াই নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হতে পারে না। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি বলতে যাঁরা এটাকে মনে করেন তাঁরা নারী হলে কঠিনভাবে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত এবং পুরুষ হলে তারা মস্তবড় প্রতারক।

ইসলাম নারীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার হরণ করেনি। তা না করেই তার মর্যাদাকে উন্নত করেছে, তার সামাজিক মান-সম্ভ্রমকে রক্সা করেছে। কিন্তু পুরুষরা যেসব কাজ করে ও যেখানে যেখানে করে সেখানে সেখানে ও সে সব কাজে যোগ দিয়ে নারীকে ঘরবাড়ি ছেড়ে দিতে বাধ্য করেনি। রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে অধিকার আদায় ও ভোগ করতে গিয়ে পারিবারিক দায়িত্বে অবহেলা জানাবার অধিকার দেয়া হয়নি। তাদের রাজনীতির নেত্রী, রাষ্ট্রের কর্ত্রী আর রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার পরিবর্তে কন্যা, বোন, স্ত্রী ও মা হওয়াই যে তাদের জীবনের কল্যাণ ও সার্থকতা নিহিত –একথা উপলব্ধি করার জন্যে ইসলাম তাদের প্রতি তাগিত জানিয়েছেন। আর তাই হচ্ছে চিরদিতের তরে বিশ্ব মুসলিম মহিলাদের অনুসরণীয় আদর্শ। তা সত্ত্বেও তারা মাতৃভূমির রাজনীতি –রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত ও উদাসীন হয়ে থাকবে, সে ব্যঅপারে তাদের কোনো সচেতনতাও থাকবে না, এমন কথা কিন্তু ইসলাম বলেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে মত জানাবার সাধারণ সুযোগকালে তাকেও স্বীয় মত জানাতে হবে। তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

ভোটদানের অধিকার

দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদসমূহের সদস্য কিংবা দেশের সর্বোচ্চ শাসনকর্তা নির্বাচনের ব্যাপারে নারীদেরও ভোটদানের অধিকার রয়েছে। এ অধিকার দান ইসলামের বিপরীত কিছু নয়। কেননা নির্বাচন শরীয়তের দৃষ্টিতে উকীল নির্ধারনের (আরবী********) মতোই। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উচ্চতর স্তরে আইন প্রণয়ন করে ও জনগণের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে এ কোনো নিষিদ্ধ কাজ নয় যে, সে একজনকে উকিল নিযুক্ত করবে, সে গিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে নারীর মতামত, ইচ্ছা-বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজন ব্যাখ্যা করবে এবং তার অধিকার রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

এ ব্যাপারে একটি মাত্র বিষয়ই দূষণীয় আর তা হচ্ছে ভোটদানরে সময় ভিন পুরুষের সাথে দেখা-সাক্ষান ও মেলা-মেশার আশংকা এবং তার ফলে পর্দা নষ্ট হওয়া। কিন্তু এ অশংকা যদি না থাকে, যদি তাদের ভোটকেন্দ্র সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কায়েম করা হয় এবং সেখানে পর্দার যাবতীয় নিয়ম-বিদান রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে পর্দা সহকারে ভোটকেন্দ্রে গমন ও নিজ ইচ্ছামতো যে কোনো প্রার্থীকে ভোট দান করায় কোনো দোষ থাকতে পারে না।

জন-প্রতিনিধি হওয়ার অধিকার

পর্দা রক্ষা করে ভোট দান করা যদি নারীদের পক্ষে দূষণীয় এবং আপত্তিকর কিছু না হয়, তাহলে সে নারীর পক্ষে বিভিন্ন পরিষদে ও নির্বাচনী সংস্থার প্রতিনিধি হওয়া কি দূষণীয় হবে?

এ প্রশ্নের জবাব দানের পূর্বে প্রতিনিধিত্ব ও জাতীয় নেতৃত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা করে নেয়া আবশ্যক।

মনে রাখা দরকার, প্রতিনিধিত্ব ও নেতৃত্বের দুটো প্রধান দায়িত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে আইন প্রণয়ন, জাতীয় শাসন-বিচার ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্যে জরুরী নিয়ম-নীতি রচনা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে পর্যবেক্ষণ, প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপ, ক্ষমতা প্রয়োগ ও জনসাধারণের সাথে তার আচার-ব্যবহার প্রভৃতি জটিল বিষয়ের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ করা।

প্রথম পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও বিদ্যা অপরিহার্য। একদিকে যেমন ব্যক্তিগতভাবে জাতির প্রত্যেকটি ব্যক্তির এবং অপরদিকে সমষ্টিগতভাবে গোটা জাতির সমস্যা, জটিলতা ও প্রয়োজনাবলী সম্পর্কে সূক্ষ্ম, নির্ভূল ও প্রত্যক্ষ জ্ঞান আবশ্যক। আর একজন নারীর পক্ষে এ জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ যেমন নয়, তেমনি কঠিন বা অসম্ভবও কিছু নয়। উপরন্তু ইসলাম নির্বিশেষে সকলকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের অধিকারই দেয় না, তা ফরয বলেও ঘোষণা করেছে। অতএব বলা যায়, নারীর পক্ষে আইন-প্রণেতা –আইন পরিষদের সদস্যা হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন বহু সংখ্যক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা কুরআন, হাদীস ফিকাহ ও ইসলামী সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেছেন।

কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ, এ কাজের সারকথা হচ্ছে “আমর বিল মারুফ ও নিহি আনিল মুনকার” –ভালো ও ন্যায়সঙ্গত কাজের আদেশ দান এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধকর। আর ইসলামে এ ব্যাপারে নারী ও পুরুষ উভয়ই সমান। আল্লাহ তা’আলা নিজেই এ সম্পর্কে বলেছেনঃ

(আরবী******************************************************************)

মু’মিন পুরুষ স্ত্রী পরস্পরের সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক; সকলে মা’রুফ কাজের আদেশ করে ও অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ করে।

এ আয়াতে মু’মিন পুরুষ ও স্ত্রীদের সমান পর্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সকলের জন্যে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত কাজের রূপ ও প্রকৃতি একই নির্ধারণ করা হয়েছে। পুরুষ ও নারীকে পরস্পরের বন্ধু, সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দ্বীন পালন, দ্বীন প্রচার ও দ্বীনের বিপরীত কার্যাদির প্রতিরোধের ব্যাপারে অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা পুরুষ ও নারীর স্থায়ী পরিচয় এবং গুণ। এ আয়াত অনুযায়ী কাজ করা পুরুষ স্ত্রী সকলেই কর্তব্য। অতএব ইসলামে এমন কোনো সুস্পষ্ট দলীল নেই, যার ভিত্তিতে মেয়েদের ‘প্রতিনিধি’ (Representative) হওয়ার অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত রাখা যেতে পারে, সে প্রতিনিধি কাজ আইন প্রণয়ন ও শাসন কার্য পরিচালন, পর্যবেক্ষণ –যাই হোক না কেন, তাদের এ কাজের যোগ্যতা নেই, তা বলারও কোনো ভিত্তি নেই।

কিন্তু বিয়ষটিকে অপর এক দৃষ্টিতে বিচার করে দেখা যায় যে, নারীর এ ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রয়োগ করার পথেই ইসলামের প্রাথমিক নিয়ম-কানুন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যোগ্যতা না থাকার কারণে এ বাধ্য নয়, বাধা হচ্ছে সামাজিক ও সামগ্রিক কল্যাণের দৃষ্টি।

নারীর স্বভাবিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে তাকে অন্যসব দিকের ছোট বড় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে থাকতে হবে এবং তার সে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কোনো প্রকার অসুবিধার সৃষ্টি করা কিছুতেই উচিত হবে না।

‘প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা নারীর আছে’ –স্বীকার করলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ কাজ করতে গিয়ে তার অপরাপর স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ পালন করা তার পক্ষে সম্ভব কি? তাকে পারিবারিক জীবন যাপন, গর্ভ ধারণ, সন্তান প্রসব, সন্তান পালন ও ভবিষ্যৎ সমাজের মানুষ তৈরীর কাজ সঠিকভাবে করতে হলে তাকে কিছুতেই প্রতিনিধিত্বের ঝামেলায় নিক্ষেপ করা যেতে পারে না। আর যদি কেউ সেখানে নিক্ষিপ্ত হয়, তবে তার পক্ষে সেই একই সময় উপরোক্ত স্বাভাবিক দায়িত্বসমূহ পালন করা সম্ভব নয়।

নারীকে এ কাজে টেনে আনলেও এ দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন করতে হলে তাকে অবশ্যই ভিন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা করতে হবে, নিরিবিলি ও একাকীত্বে সম্পূর্ণ গায়র-মুহাররম পুরুষদের সাথে একত্রিত হতে হবে। আর এ দুটো কাজই ইসলামে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ। এমন কি মুখমণ্ডল ও হাত-পা ভিন পুরুষের সামনে উন্মুক্ত করা –যা না হলে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব কিছুতেই পালন হতে পারে না –একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে। শুথু তা নয়, তাকে একাকী ভিন পুরুষদের সাথে –নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভিন্ন ও দূরবর্তী শহরেও গমন করতে হবে। কিন্তু ইসলামে তাও কিছুমাত্র জায়েয নয়।

এ চারটি ব্যাপারে ইসলামী সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত ও একান্তই মৌলিক এবং এ কারণে নারীর পক্ষে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন –হারাম না হলেও –কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। কোনো মুসলিম নারীই এসব মৌলিক নিষেধকে অস্বীকার করে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবার সাহস করতে পারে না। অতএব বলা যায়, জাতীয় প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা নারীর রয়েছে বটে; কিন্তু একদিকে নারীর স্বাভাবিক দুর্বলতা, অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা এবং অপরদিকে প্রতিনিধিত্বের স্বরূপ প্রকৃতির দৃষ্টিতে নারীকে এ কাজ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং স্বতন্ত্র করে রাখায়ই জাতীয় ও ধর্মীয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

আরো গভীরভাবে নারীর প্রতিনিধি হওয়ার পরিণাম চিন্তা ও বিবেচনা করলে দেকা যাবে, এর ক্ষতি ব্যাপক এবং অত্যন্ত ভয়াবহ।

নারী যদি প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করতে চায়, তাহলে প্রথমত তাকে তার ঘর-বাড়ি, শিশু-সন্তান ছেড়ে বাইরে যেতে হবে। এর ফলে অবহেলিত ঘর-বাড়ি ও সন্তান স্বামীর সঙ্গে অন্তর মনের দূরত্ব এক স্থায়ী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করতে পারে। এতদ্ব্যতীত স্বামীর সাথে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে পারস্পরিক কঠিন মনোমালিন্য অবশ্যম্ভাবী। আমেরিকার এক নির্বাচনে কোনো এক স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করে শুধু এ কারণে যে, স্ত্রী স্বামীর বিপরীত এক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে দলের প্রার্থী হয়েছিল এবং এজন্যে উভয়ের মধ্যে বিরাট ঝগড়া ও বিবাদের সৃষ্টি হয়। বস্তুত নারীকে স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক তৎপরতায় যোগদান করতে দিলে পারিবারিক জীবনে যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেকা দেবেই, তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।

নারীর পক্ষে এ কাজ আরো অবাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে তখন, যখন নারী হয় যুবতী ও সুন্দরী। নারীর রূপ-সৌন্দর্যকে নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে জয়লাভের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বিশেষত সেই যুবতী সুন্দরী নারী নিজেই যদি নির্বাচনে প্রার্থী হয়, তাহলে তার গুণাগুণ বিচার না করে কেবল এ রূপের জন্যে মুগ্ধ একদল যুবক কর্মী তার চারপাশে একত্রিত হয়ে যাবে, মধুর চাকার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে থাকে মৌ-পোকার দল। আর এর পরিণাম নৈতিক-রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই যে কত মারাত্মক হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

জনগণের প্রতিনিধিত্ব নারীর পক্ষে যারা সহজ কাজ বলে ধারণা করে, তারা প্রতিনিধিত্বের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে কিছুমাত্র সচেতন নয় বলে ধরা যেতে পারে। প্রতিনিধিদের একদিকে যেমন পদের দায়িত্ব পালন করতে হয় অপর দিকে তার চাইতেও বেশি নির্বাচকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ ও তাদের মন সন্তুষ্টি সাধনের প্রতি পুরাপুরি লক্ষ্য আরোপ করতে হয় অন্যথায় এ দুটো দিকই সমানভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হবে এবং এ প্রতিনিধিত্ব হবে শুধু নামে মাত্র, কার্যথ তা কিছুই হবে না। কিন্তু চিন্তার বিষয় এটা যে, নারীর পক্ষে কি এ দুটো দিকেরই দায়িত্ব সমান গুরুত্ব সহকারে একই সঙ্গে প্রতিপালিত হওয়া বাস্তবিকই সম্ভব; পার্লামেন্টের পরিসদের বৈঠক সমূহে কেবল উপস্থিত থাকাই কি তার পরবর্তী সাফল্যের জন্যে যথেষ্ট?

এতদ্ব্যতীত সবচেয় কঠিন প্রশ্ন, এহেন প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব সম্পন্ন নারীর পক্ষে কি কারো সফল স্ত্রী হওয়া এবং সন্তানের মা হওয়া সম্ভব? অন্য কথায়, সেই নারী যদি কারো স্ত্রী এবং সন্তানের মা হয়, তাহলে একদিকে ঘরের ভিতরকার বিবিধ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার দায়িত্বও পূর্ণমাত্রায় পালন করতে হবে; কিন্তু তা কি বাস্তবিকই সম্ভব হতে পারে? আর তা যদি সম্ভবই না হয়, -আর কেবল বলতে পারে যে, তা সম্ভব? –তাহলে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নারীকে কি স্ত্রী ও মা হওয়ার দায়িত্ব বা অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে? বঞ্চিত রাখা হলে তা কি তার স্বভাব-প্রকৃতির দাবির বিপরীত পদক্ষেপ হবে না? আর ঘরের এসব দায়িত্ব পালন সহকারেও যদি দশদিন এবং বছর-দুবছরে অন্তত একবার করে দশ বারো মাসের জন্যে মুলতবী রাখা হবে? কেননা নারীর জন্যে –বিশেষ করে বিবাহিতা নারীর পক্ষে এ তো একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সময় গুলো নারীর পক্ষে বড়ই সংকটের সময়। এ সময় নারীর মেজাজ প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবেই বিগড়ে যায়। প্রায় সব কাজ থেকেই তার মন মেজাজ থাকে বিরূপ, কিছুই তার ভালো লাগে না এ সময়ে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে বাইরে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালনের জন্যে বছরে কতটুকু নিরংকুশ অবসর নির্লিপ্ততার সময় পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

এতসব ঝামেলা অনিবার্য হওয়া সত্ত্বেও নারীকে রাজনীতির এ চক্রজালে জড়িয়ে দেয়ায় জাতির ও সমাজের যে কি শুভ ফল লাভ হতে পারে, তা বোঝা কঠিন। তারা কি এক্ষেত্রে এতই দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছে যে, সেই কাজ তাদের বাদ দিয়ে কেবল পুরুষদের দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়? –কী এমন সে কাজ যা পুরুষরা করতে সক্ষম নয়? ….কে এর জবাব দেবে?

কেউ কেউ বলেন, এতে করে নারীর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, নারী মানুষ হওয়ার –সমাজের, দেশের পুরুষদের সমপর্যায়ের সদস্য বা নাগরিক হওয়ার বোধ লাভ করতে পারে।

আমরা প্রশ্ন করব, নারীদের যদি প্রতিনিধিত্বের ময়দানে, রাজনীতির মঞ্চে অবতরণ থেকে বঞ্চিতই করে দেয়া হয়, তাহলে তাতে কি একথাই প্রমাণিত হবে যে, নারীর না আছে কোনো সম্মান, না মনুষত্ববোধ? প্রত্যেক জাতির পুরুষদের মধ্যেই কি একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ এমন থাকে না, যাদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ কেউই মেনে নিতে রাজি নয়? …যেমন দায়িত্বপূর্ণ সরকারী কর্মচারী এবং সৈন্যবাহিনী? তাহলে তাদের সম্পর্কে কি ধরে নিতে হবে যে, তাদের কোনো সম্মান নেই আর নেই তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ।

বস্তুত প্রত্যেক সমাজে ও প্রত্যেক জাতিরই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুতা বিধান ও যাবতীয় কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করানোর জন্যে কর্মবণ্টন নীতি অবশ্যই কার্যকর করতে নয়। এ নীতি অনুযায়ী কোনো মানব সমষ্টিকে (Group of people) কোনো বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিলে এবং এ দায়িত্ব পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে –এমন সব কাজ থেকে তাদের দূরে রাখা হলে তাতে তাদের না মানসম্মান নষ্ট হতে পারে, না তাদের মনুষ্যত্ব লোপ পেতে পারে আর না তাদের কোন হক (Right) নষ্ট বা হরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা যেতে পারে। ঠিক এ দৃষ্টিতেই নারী সমাজকে যদি তাদের বৃহত্তর ও স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে স্বামী ও সন্তানের অধিকার রক্ষার কারণে বাইরের সব রকমের দায়িথ্ব পালন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় এবং রাখা হয় সমাজ, জাতি ও বৃহত্তর মানবতার কল্যাণের দৃষ্টিতে, তবে তাকে কি কোনো দিক দিয়েই অন্যায় বা জুলুম বলে অভিহিত করা যেতে পারে? সৈনিকদের যেমন রাজনীতির ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়, কঠোর দৃঢ়তা সহকারে। সৈনিকদের রাজনীতি করতে না দেয়ায় যেমন কোনো লোকসান নেই? ঠিক তেমনিভাবে নারীদেরও যদি দূরে রাখা হয়, তবে তাতে কি জাতীয় কল্যাণের কোনো লোকসান হতে পারে।

এ পর্যায়ে যে শেষ কথাটি বলতে চাই, তা হলো এই যে, নারীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের ব্যাপারে যে উৎসাহ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ গ্রহণের ব্যাপারে যে উৎসাহ আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ, পাশ্চাত্য চিন্তাধারার মানসিক গোলামী এবং বিবেচনাহীন অযৌক্তিক আবেগ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইউরোপে তো রেনেসাঁর প্রায় একশ বছর পর নারীরা রাজনৈতিক অধিকার লাভ করেছে। জিজ্ঞেস করতে পারি কি, ইউরোপীয় সমাজে এ অভিজ্ঞতার কি ফল পাওয়া গেছে?

ইউরোপীয় সমাজ এ ব্যাপারে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লাভের এ সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে, নারীদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণের কোনো ফায়দা নেই, বরং পারিবারিক, সামাজিক, নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিতে এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহই হয়েছে ইউরোপে। সেখানে এরফলে ঘর ভেঙ্গেছে, পরিবার ভেঙ্গেছে, পথে-ঘাটে সন্তান জন্মানোর কলংকের সৃষ্টি হয়েছে, আর রাজনীতিক নারীকে নিয়ে পুরুষদের মধ্যে টানাটানি হিড়িক পড়েছে। এক্ষেত্রে বৃটেনে ক্রীষ্টান কীলারের ব্যাপারটি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা, যেখানে নারীর সরাসরি রাজনীতির হওয়ার ব্যাপারে নেই, কেবলমাত্র এক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তির সাথে অবৈধ যোগাযোগের পরিণামই বৃটিশ সরকারের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে পর ফ্রান্সের নেতৃবন্দ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারিণী ও প্রভাব-শালিনা মেয়েরাই আমাদের পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা একথা জোরের সঙ্গেই বলব, আমাদের সমাজে নারীদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনার ফলও অনুরূপ মারাত্মক হবে, এতে এক বিন্দু সন্দেহের অবকাশ নেই। জাতীয় বা জেলা পরিষদসমূহে নারীদের সদস্যপদের কার্যত কোনো সুফল হতে পারে না বলে তা যত তাড়াতাড়ি বন্ধ করা হবে, ততই মঙ্গল।

নারীর প্রতিনিধিত্বের সঠিক পন্থা

কিন্তু তাই বলে নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব নারী করবে –এ অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করার কথা আমি বলতে চাইনি। বরং তাদের এ অধিকার সুষ্ঠুরূপে কার্যকর হতে পারে তখন, যখন নারীদেরকে নারীদেরই প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেয়া হয়। আর তা হতে পারে এভাবে যে, নারী সমাজের ভোটে কিছু সংখ্যক নারীকে নির্বাচিত করে তাদের সমন্বয়ে একটি মহিলা বোর্ড গঠন করা হয় এবং তাদের দায়িত্ব এই দেয়া হয় যে, তারা সাধারণভাবে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে নারীদের সাধারণ ও নিত্য নৈমিত্তিক সমস্যা ও শিশু পালন, শিশু শিক্ষা –তথা সমাজের ভবিষ্যৎ বংশধরনের গঠন-উন্নয়ন সম্পর্কে সুপারিশ তৈরী করে জাতীয় পরিষদের সামনে তদনুযায়ী আইন রচনার উদ্দেশ্যে পেশ করবে। আমি বিম্বাস করি, জাতীয় পরিষদের সদস্য করে দেশের সাধারণ কাজ-কর্মে নারীদের যদি নিয়োগ করা হয়, তাহলে তাদের প্রতিনিধিত্বের শুভ ফল ও বিশেষ কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হতে পারে এবং এ প্রতিনিধিত্বকারী মহিলাগণ নিজেদের পারিবারিক দায়িত্ব পালন থেকেও বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হবেন না।

ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের কাজের ভিত্তি পাওয়া যায়। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা)-এর ফুফাত বোন ছিলেন হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রা)। তিনি যেমন ছিলেন বিদূষী, বুদ্ধিমতী, তেমনি ছিলেন পুরামাত্রায় দ্বীনদার। তিনি একদিন রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে এসে হাযির হয়ে আরয করলেনঃ

(আরবী*************************************************************)

আমি আমার পশ্চাতে অবস্থিত মুসলিম নারী সমাজের প্রতিনিধি, তারা সকলেই আমার কথায় একমত এবং আমি তাদের মতই আপনার কাছে প্রকাশ করছি। কথা এই যে, আল্লাহ তা’আলা আপনাকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি। আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনাকে অনুসরণ করে চলছি। কিন্তু আমরা –নারীরা –পর্দানশীল ও ঘরের অভ্যন্তরে বসে থাকি, পুরুষদের লালসার কেন্দ্রস্থল আমরা এবং তাদের সন্তানদের বোঝা বহন করি মাত্র। জুম’আ ও জানাযার নামায এবং জিহাদে শরীক হওয়ার একচ্ছত্র অধিকার পেয়ে পুরুষরা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে অথবা তারা জিহাদের জন্যে ঘরের বাইরে চলে যায়, তখন আমরাই তাদের ঘর-বাড়ি দেখাশোনা করি এবং তাদের সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব বহন করি। এমতাবস্থায় সওয়াব পাওয়ার দিক দিয়েও কি আমরা তাদের সঙ্গে ভাগীদার হতে পারব হে রাসূল? ….রাসূলে করীম (স) একথা শুনে উপস্থিত সাহাবীদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা অপর কোনো নারীকে কি এর অপেক্ষা অধিক সুন্দর করে দ্বীন-ইসলামের বিধান সম্পর্কে সওয়াল করতে পেরেছে বলে জানো? তাঁরা সকলেই বললেনঃ না, আল্লাহর শপথ হে রাসূল! অতঃপর রাসূলে করীম (স) হযরত আসমা (রা)-কে লক্ষ্য করে বললেনঃ হে আসমা, তুমি আমায় সাহায্য ও সহযোগিতা করো। যে সব নারী তোমাদের প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠিয়েছেন তাদেরকে আমার তরফ হতে একথা পৌঁছিয়ে দাও যে, ভালোভাবে ঘর-সংসারের কাজ করা, স্বামীদের সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করা এবং তাদের সাথে মিলমিশ রক্ষা করনার্থে তাদের কথা মেনে চলা –পুরুষদের যেসব কাজের উল্লেখ তুমি করেছ তার সমান মর্যাদাসম্পন্ন।

হযরত আসমা রাসূলে করীমের কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ঠি সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর করতে করতে উঠে চলে গেলেন।

ইসলামী ইতিহাসের এ বিশেষ কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ঠি সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর করতে করতে উঠে চলে গেলেন।

ইসলামী ইতিহাসের এ বিশেষ ঘটনা থেকে প্রথমত এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, সমাজের নারীদের অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া ও মনের কথাবার্তা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের কাছে সুষ্ঠুরূপে পৌঁছাবার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক এবং এ ব্যবস্থা হতে পারে তখন, যদি নারী সমাজেরই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কোনো কোনো মহিলা বোর্ড গঠন করা হয় এবং তাদের এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। এতদাপেক্ষা অপর কোনো ব্যবস্থা –জাতীয় পার্লামেন্ট পুরুষদের পাশাপাশি সকল বিষয়ে মাথা গলাবার সুযোগ বা দায়িত্ব দিয়ে তাদের আসল দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতার দৃষ্টি করা কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি