প্রকাশকের কথা
ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা আজ সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের সবচাইতে বড় আকাংখার বিষয়। পশ্চিমের গোলামী ও তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি জ্ঞান বিজ্ঞানের মাধ্যমে যে শিক্ষার সাথে মুসলমানরা পরিচিত হয়েছে তা তাদের হৃদয়ের মূল্যবান সম্পদ ঈমানের উপরই আক্রমণ চালিয়েছে বেশী। অন্যদিকে শত বছরের অনাদরে লালিত প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক সমাজ ও মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না। এক্ষেত্রে মুসলমানরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যাশী যা একদিকে তাদের হৃদয়ে সৃষ্টি করবে বলিষ্ঠ ঈমানী ভিত্তি এবং অন্যদিকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোকে ইসলামী জীবনাদর্শের মানদন্ডে যাচাই করে এক বলিষ্ঠ ও উন্নত মুসলিম জীবনক্ষেত্র নির্মাণে সক্ষম হবে।

বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী এই গ্রন্থে ইসলামী শিক্ষার এমনিধারায় একটি অবয়ব দাঁড় করিয়েছেন। আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে লিখিত হলেও বিষযবস্তুর মৌলিকত্ব এখনো সমগ্র বইটিকে তরতাজা রেখেছে। ইসলামী শিক্ষার দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক গ্রন্থ। এ ধরনের একটি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পেরে ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি তার ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করছে।

বিষয়বস্তুর অতি মৌলিকত্ব ও ইসলামী শিক্ষা দর্শনের জটিল তত্ত্বের অবতারণার কারণে মূল বইটি বেশ কঠিনই বলতে হবে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ অনুবাকদ্বয় অধ্যাপক মোজাম্মেল হক ও জনাব আকরাম ফারূক যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। অধ্যাপক মোজাম্মেল হক (রিসার্চ স্কলার-ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি) অনুবাদের সাথে সাথে সমগ্র পান্ডুলিপি সম্পাদনা করে বিষয়বস্তুর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার ব্যবস্থা করেছেন।

ইসলামী শিক্ষানুরাগী পাঠকবর্গের হাতে এ ধরনের একটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বই তুলে দিতে পেরে আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছি বলে মনে করি।

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুর রব

পরিচালক

ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটি

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটি
আজ হতে প্রায় ২৮ বছর পূর্বে সম্ভবতঃ ১৯৩৫ সনে এই প্রশ্নটি বেশ জোরালোভাবেই উত্থাপিত হয়েছিল যে, মুসলমানদের নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নাস্তিক; নাস্তিকতা ভাবাপন্ন এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাসী ও তার প্রচারক এত অধিক সংখ্যায় বের হচ্ছে কেন? বিশেষ করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অভিযোগ ছিলো, এখান থেকে সনদপ্রাপ্ত শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থীই কেন নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের পূজারী? বিষয়টি নিয়ে সর্বত্রই যখন জল্পনা কল্পনা এবং দেশের পত্র-পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু হলো, তখন এ অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং এর প্রতিকারের উপায় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার উদ্দেশ্যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে একটি কমিটি নিয়োগ করা হলো। কমিটি অনেক চিন্তা ভাবনা ও বিচার বিশ্লেষণের পর এ মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, প্রচলিত সিলেবাসে ইসলামী উপাদান আগের তুলনায় কিছু বাড়িয়ে দিলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নাস্তিকতা ও প্রকৃতিবাদের সয়লাবের মুখে প্রতিরোধ সৃষ্টি করা সম্ভব।

১৯৩৬ সনের আগষ্ট সংখ্যা তরজামনুল কুরআনে মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ) এ অবস্থার প্রতিকারের নিমিত্তে গৃহীত কর্মপন্থা পর্যালোচনা করেন এবং তখনকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করে তা দূর করার প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিগত এপ্রিল ১৯৩৬ সনের বার্ষিক অধিবেশনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন যা অনেক দিন থেকেই দৃষ্টি দেয়ার মতই গুরুত্ববহ। অর্থাৎ দীনিয়াত বা ইসলামী বিষয়গুলোর ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতির সংশোধন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী জ্ঞান ও ভাবধারার স্ফূরণ।

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গেলে একথা বলতে হয় যে, সরকার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এসব বিষয় শিক্ষাদানের অতি উত্তম ব্যবস্থা বর্তমান। অন্ততপক্ষে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের তো বটেই। সুতরাং এ উদ্দেশ্যেই মুসলমানদের আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। যে কারণে মুসলমানদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ধারণা গড়ে উঠেছিল এবং যে কারণে তা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল তা শুধু এই যে, মুসলমানগণ আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুবিধা লাভের সাথে সাথে মুসলমান হিসেবেও বেঁচে থাকতে হয়। সরকারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালসমূহের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই এজন্য প্রয়োজন মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। যদি তাদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ও এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, সেখান থেকেও এমন সব গ্রাজুয়েট বের হয় যেমন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হতে বের হয়, যদি সেখান থেকেও স্বদেশী সাহেব অথবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী অথবা সমাজতন্ত্রী নাস্তিক সৃষ্টি হয়, তাহলে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং তা পরিচালনা করার এমন কি বিশেষ প্রয়োজন থাকতে পারে?

এটি এমন একটি বিষয়, যার প্রতি শুরুতেই যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল। যে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা-ভাবনা চলছিল তখন সর্বপ্রথম ভেবে দেখা উচিত ছিল যে, তাদের একটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন কেন? আর এ প্রয়োজন পূরণ করার পন্থাই বা কি? হ্যাঁ, বর্তমান যুগের মুসলমান সম্পর্কে কোন একজন সমালোচক হয়তো যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, “এরা কাজ করে আগে এবং পরে ভাবে।” যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনায় মগ্ন ছিলেন তাদের মন মগজে এ সম্পর্কে কোন পরিকল্পনাই ছিল না। একটা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হবে এবং কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় তার কোন নকশা বা ধ্যান ধারণাই তাদের মন মগজে ছিল না। এই পরিকল্পনাহীন কাজের ফলশ্রুতিতে আলীগড়েও ঠিক আরেকটি এমন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো যার একটি ইতিপূর্বে আগ্রায়, দ্বিতীয়টি লাখনৌতে এবং তৃতীয়টি ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মুসলিম শব্দটির প্রতি লক্ষ্য রেখে দ্বীনিয়াত বিষয়টি পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হলো। যাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম করণে মুসলিম শব্দটির সংযোজনের কারণ কেউ জানতে চাইলে তার সামনে ‘কুদুরী’ ‘মুনিয়াতুল মুসাল্লী’ এবং ‘হিদায়ার’ নাম ইসলামিয়াত বিষয়ের সনদ হিসেবে পেশ করা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন কোন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেল না যার ভিত্তিতে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্বতন্ত্র হতে পারতো এবং প্রকৃত অর্থেই একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতো। হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অদম্য উৎসাহের কারণে এর সঠিক ও যথাযখ রূপরেখা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশ পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পনেরটি বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে; এ সময়ের মধ্যেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কর্ণধারগণ একবারও অনুধাবন করতে পারলেন না, তাদের আসল লক্ষ্য কি ছিল? আর তাদের কাফেলা তা পেছনে ফেলে কোন লক্ষ্যের পেছনে ছুটে চলছে? প্রথম থেকেই অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছিলো, যে ঢংয়ে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চলা উচিত এটি সেভাবে চলছে না, আর যে ফলাফল আশা করা গিয়েছিলো তাও অর্জিত হচ্ছে না। একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ইসলামী চরিত্র, ইসলামী স্পিরিট এবং ইসলামী কর্মপদ্ধতি ও আচরণ তাদের চরিত্রে একেবারেই অনুপস্থিত। তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও ইসলামী মন মানসিকতা একেবারেই দুর্লভ। যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে একজন ‍মুসলমানের মত দৃষ্টিভঙ্গি এবং একজন মুসলমানের মতো জীবনোদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদীক্ষা যাদেরকে এতটুকু যোগ্যতাসম্পন্ন করেছে যে, জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তারা ইসলামী মিল্লাতের মধ্যে নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে পারতো, কিংবা কমপক্ষে তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে স্বজাতির জন্য কোন উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিতে পারতো, এমন ছাত্রের সংখ্যা হয়তো শতকরা একজনও নয়। ফলাফল শুধু নেতিবাচক হলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় হতে সনদপ্রাপ্ত এবং শিক্ষারত ছাত্রদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এমন, যাদের অস্তিত্বই ইসলামী তাহযীব এবং মুসলিম জাতির জন্য কল্যাণবহ নয় বরং ক্ষতিকর। এরা ইসলামী প্রাণশক্তি সম্পর্কে শুধু অজ্ঞই নয়, বরং পুরোপুরি বিরুদ্ধমনা। তাদের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে শুধু উদাসীনতাই নয় বরং ঘৃণার ভাবও সৃষ্টি হয়েছে। এমনভাবে তাদের মষ্তিষ্ক ধোলাই করা হয়েছে যে, তা সন্দেহের সীমা ডিঙ্গিয়ে অস্বীকৃতির পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। যেসব মূলনীতিমালার উপর ইসলামের ভিত্তি, তারা এখন তার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করছে।

সম্প্রতি খোদ মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হতে সনদপ্রাপ্ত একজন ছাত্র যিনি জন্মগতভাবে সত্যনিষ্ঠ হওয়ার কারণে মুরতাদ হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন-তার এক ব্যক্তিগত পত্রে প্রসংগক্রমে সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে কিছু ইংগিত দিয়েছেন। পত্রখানা প্রকাশ করার জন্য নয় এবং তা বিশেষ করে আলীগড়ের অবস্থা বর্ণনা করার জন্যও লেখা হয় নি। তাই আমরা মনে করি তাতে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সঠিক চিত্র। পত্রলেখক তার মানসিক বিবর্তনের ঘটনাক্রম এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

“আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে ইসলামী দুনিয়ার বাইরের ফিতনা এবং ফিরিংগীপনার বিবর্তিত সর্বশেষ স্তর কম্যুনিজমের সাথে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমি প্রথম প্রথম পাশ্চাত্যপনাকে ভয়ানক কিছু মনে করতাম না। কিন্তু আলীগড়ে লব্ধ অভিজ্ঞতা আমাকে বাস্তব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। ই যসলামী ভারতের এই কেন্দ্রে বেশ কিছু সংখ্যক এমন লোকও আছে যারা ইসলামকে বর্জন করে কম্যুনিজমের প্রচার ও প্রসারে একনিষ্ঠভাবে আত্মনিয়োগ করেছে। কম্যুনিজমের সেবক শিক্ষকরা সব মেধাবী ও ধী-শক্তি সম্পন্ন ছাত্রদেরকে তাদের দলে ফাঁদে আটকিয়ে ফেলেন। তারা এজন্য কম্যুনিজম গ্রহণ করেন নি যে, গরীব কৃষক এবং শ্রমিকদের সাহায্য সহযোগিতা করবেন। কেননা তাদের ব্যয় বাহুল্য ভরা বাস্তব জীবনে এসব গাল ভরা বুলির অন্তঃসার শূণ্যতাই প্রমাণ করে। বরং তাদের কম্যুনিজম গ্রহণ করার কারণ হলো, তারা চায় একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের ছত্র-ছায়ায় অবস্থান করে নিজেদের নৈতিক দুর্বলতা, নাস্তিক্যবাদী মন-মানসিকতা এবং নৈতিকতা বর্জিত কাজ কর্মকে (Loose thinking) যুক্তি সিদ্ধ (Justify) বলে প্রমাণ করা। কমকককম্যকম্যুনিজম প্রথমে আমাকেও ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, এটা ইসলামেরই একটা অনোনুমোদিত (Unauthorized) সংস্করণ। কিন্তু গভীরভাবে পর্যালোচনা করার পর জানতে পারি যে, মৌলিক লক্ষ্যের দিক থেকে ইসলাম এবং কম্যুনিজমের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ।”

এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ত্রুটিপূর্ণই নয় বরং স্যার সাইয়েদ আহমদ খান, মুহসিনুল মুলক, ভিকারুল মুলক ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যে সব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং যে জন্য মুসলমানেরা তাদের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি উৎসাহের সাথে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকে স্বাগত জানিয়েছিল, সেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উল্টো ফলাফলই এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। এরূপ একজন ইঞ্জিনিয়ার সম্পর্কে আপনার মতামত কেমন হবে যার তৈরী মোটর গাড়ি সামনে চলার পরিবর্তে পেছনের দিকে চলে? আর আপনার দৃষ্টিতে এমন একজন ইঞ্জিনিয়ারকে কেমন বিশেষজ্ঞ বলে মনে হবে, যে তার তৈরী মোটরগাড়িকে একের পর এক এলোপাথাড়ি চলতে দেখেও উপলব্ধি করতে পারে না যে, তার পরিকল্পিত নকশায় নিশ্চয়ই কোন ত্রুটি আছে। এরূপ কোন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আপনি আদৌ দেখতে পাবেন না। তবে আপনার জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ইঞ্জিনিয়াররা কিরূপ দক্ষ এই বাস্তব ঘটনা হতে তার পরিমাপ করতে পারবেন যে, তারা শিক্ষাব্যবস্থার একটি মেশিন তৈরি করেছেন যার উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা। কিন্তু এজন্য তারা যে মেশিন তৈরি করেছেন তা সম্পূর্ণ উল্টো দিকে এগিয়ে চলতে শুরু করলো এবং এভাবে ক্রমাগত পনেরো বছর পর্যন্ত চললো। কিন্তু একদিনের জন্যও তারা অনুভব করতে পারলেন না যে, এর যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি আছে বরং আদৌ ত্রুটি আছে কিনা তাও বুঝতে পারলেন না।

অনেক অঘটন সংঘটিত হওয়ার পর এখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছেন যে, ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী স্পিরিট বা প্রাণ-শক্তি সৃষ্টি করা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্যসমূহের একটি।

আর এ উদ্দেশ্যে এখন তারা সাত ব্যক্তির সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন যে, সঠিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করতে হবে এবং দ্বীনিয়াত ও ইসলামী বিষয়সমূহ শিক্ষার জন্য এমন আধুনিক ও উন্নত উপকরণ ব্যবহারের সুপারিশ করতে হবে যা সময়ের দাবী পূরণ করতে সক্ষম এবং যা দ্বারা শিক্ষণীয় ইসলামী বিষয়সমূহ অধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা যাবে।

অত্যন্ত খুশীর কথা, অতীব কল্যাণকর কথা, সকালের পথহারা যদি সন্ধ্যায় ফিরে আসে তবে তাকে পথহারা বলা চলে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নির্মাতারা এখনও যদি অনুভব করতে পারেন যে, তাদের শিক্ষাযন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনে নির্মিত হয়েছে এবং যে উদ্দেশ্যে তারা এ যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন তার উল্টো ফলাফল দানের মূল কারণ কোন দৈব দূর্ঘটনা নয় বরং মূল ডিজাইন ও তা বাস্তবায়নের কারণেই হচ্ছে, তাহলে আমরাও বলব, যা হওয়ার হয়েছে এখন এসো, পূর্বের ডিজাইনের ত্রুটি কি তা ভাল করে দেখে নাও এবং আরেকটি নির্ভুল ডিজাইন অনুসারে যন্ত্রটি পুনরায় নির্মাণ করো। কিন্তু আমাদের সন্দেহ, এখনও এসব ব্যক্তিবর্গ ত্রুট উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি। এখনও তারা এ বিষয়টি মানতে রাজি নন যে, তাদের ডিজাইনে মৌলিক গলদ রয়েছে। শুধুমাত্র ফলাফলের ভয়াবহ বাহ্যিক অবস্থা দেখেই তারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং হালকাভাবেই অবস্থা অবলোকন করছেন।

খোদা করুন, আমাদের এ সংশয় ভুল প্রমাণিত হোক। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতার কারণে আমরা এরূপ সন্দেহ না করে পারছি না। দুই শতাব্দীর ক্রমাগত অধঃপতনের কারণে বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন তা একটি রাজনৈতিক বিপ্লবরূপে আত্মপ্রকাশ করলো তখন মুসলমানদের ডুবন্ত জাহাজকে সামলানোর জন্য গায়েবী সাহায্যে কয়েকজন সুদক্ষ নাবিক জন্ম নিলেন। সময়টা খুব একটা চিন্তা ভাবনা করে কাজ করার মত ছিল না। ভাঙ্গা ও জীর্ণ জাহাজের স্থলে নতুন ডিজাইন অনুসারে নতুন ও স্থায়ী জাহাজ নির্মাণ করে নেয়া যায়, এরূপ চিন্তার অবকাশই বা কোথায় ছিল? তখন সামনে একটিই মাত্র প্রশ্ন ছিল। তা’হলো এই ডু্বন্ত জাতিকে ধ্বংসের হাত হতে কিভাবে রক্ষা করা যায়? এই সব নাবিকের একটি অংশ তৎক্ষণাৎ তাদের সেই পুরাতন জাহাজটির মেরামত আরম্ভ করে দিলেন। এর পুরনো তক্তাগুলোই জোড়া দেয়া হলো, ফাটল ও ছিদ্রসমূহ বন্ধ করা হলো এবং ছেড়া ফাটা পাল রিপু করে যেমন তেমনভাবে হাওয়া লাগানোর ব্যবস্থা করা হলো। নাবিকদের অন্য দলটি একলাফে একটা নতুন বাষ্প শক্তি চালিত জাহাজ ভাড়া করলেন এবং ডুবন্ত মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তাতে উঠিয়ে নিলেন। এভাবে উভয় দলই তাৎক্ষণিক এই বিপদকে দূর করতে আপাতত সক্ষম হলেন। কিন্তু তারা এ দুটি ব্যবস্থার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ডুবন্তদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন মাত্র। এর অধিক তারা কিছু করতে পারেন নি। তাদের এ কাজে যে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল ছিল তা শুধু এতটুকুই। তাই এ অবস্থা দূরীভূত হওয়ার পরে এখনো যারা এ দু’টো ব্যবস্থাকে হুবহু বহাল রাখতে চান তাদের কর্মপদ্ধতি বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার পরিপন্থী। পুরনো পালের জাহাজখানাও এমন নয় যে, এতে আরোহণ করে মুসলমানরা সেই সব জাতির সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারে যাদের কাছে এর চেয়েও হাজার গুণ গতিসম্পন্ন যান্ত্রিক জাহাজ রয়েছে। আবার ভাড়া করা বাষ্পীয় শক্তিচালিত জাহাজখানাও এমন নয় যে, এতে আরোহণ করে মুসলমানরা তাদের মনযিলে মকসুদে পৌছতে পারে। কারণ যদিও এর সাজ সরঞ্জাম নতুন, গতি দ্রুত এবং যান্ত্রিকও বটে তথাপিও তা তো অন্যদের জাহাজ। এর ডিজাইনও তাদের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এর গতি নিয়ন্ত্রক ও নাবিক তারাই। সুতরাং এ জাহাজ দ্বারাও আমরা আশা করতে পারি না যে, তা আমাদের মনযিলে মকসুদে পৌছিয়ে দিবে। বরং দ্রুত গতি সম্পন্ন হওয়ায় এ আশংকা আছে যে, তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমাদের বিপরীত দিকে নিয়ে যাবে এবং মনযিলে মকসুদ থেকে আমাদের দুরত্ব প্রতিদিনই বাড়তে থাকবে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের জন্য যারা পুরনো জাহাজ মেরামত করে নিয়েছিলেন তাদের ভূমিকা যথার্থ ভূমিকাই ছিল। আবার যারা ভাড়া করা জাহাজে আরোহণ করে প্রাণ বাঁচালেন তারাও কিন্তু ভুল করেন নি। তবে যারা এখনো পুরনো জাহাজের উপর জেঁকে বসেছেন, তারাও ভুল করেছেন আবার যারা ভাড়া করা জাহাজ ছাড়তে রাজি নন তারাও ভুল করেছেন।

প্রকৃত নেতা ও সমাজ সংস্কারকের পরিচয় হলো, তিনি চিন্তা ভাবনা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে কাজ করেন এবং স্থান কাল ভেদে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে গৃহীত কোন ব্যবস্থাকে কেউ যদি সময় অতীত হওয়ার পরেও অনুসরণ করতে চায় তাহলে তাদেরকেই বলে অন্ধ সমর্থক। সময়ের দাবী অনুসারে সে যে কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যারা চোখ বন্ধ করে সেই পদ্ধতি গ্রহণ করে এবং এতটুকুও উপলব্ধি করতে পারে না যে, অতীতে যা উপযোগী ছিল বর্তমানে তা-ই অনুপযোগী। বিগত শতাব্দীর নেতাদের তিরোধানের পর তাদের অনুসারীগণ আজও তাদের পথ আঁকড়ে ধরে চলতে চায়; অথচ তারা যে সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য ঐ সব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন সে সময় অতীত হয়ে গিয়েছে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো চিন্তা ভাবনা ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে নতুন পন্থা অবলম্বন করা।

দুর্ভাগ্যবশত দুটি দলের কোনটিতেই আমরা একজন মুজাহিদও দেখতে পাই না। পুরনো জাহাজের আরোহীদের কেউ খুব সাহস করে ইজতিহাদ করলেও তা এতোটুকু মাত্র যে, ঐ পুরনো জাহাজেই কয়েকটি বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগিয়ে নেন এবং কিছু নতুন ডিজাইনের আসবাবপত্র সংগ্রহ করে নেন এবং একটি ক্ষুদ্র স্টীম ইঞ্জিন খরিদ করে নেন; যার কাজ শুধু হুইসেল বাজিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেয়া যে, এ জাহাজ এখন একদম নতুন হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে নতুন জাহাজের আরোহীরা যদিও অন্যের জাহাজে আরোহণ করে দ্রুতগতিতে বিপরীত দিকে চলছে তথাপি কয়েকটি পুরনো পাল নিয়ে বিংশ শতাব্দীর এই আপটুডেট জাহাজে খাটিয়েছেন। যাতে তারা জাহাজটিকে ইসলামী জাহাজ বলে নিজেদেরকে এবং মুসলমানদেরকে প্রতারিত করছেন এবং ভায়া লন্ডন হজ্জের জন্য পথ অতিক্রম করছেন।

উপমার ভাষা ছেড়ে এখন আমি স্পষ্ট করে বলব, স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের (আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন) নেতৃত্বে আলীগড় হতে যে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানরা যেন সেই নতুন সময়ের চাহিদার আলোকে নিজের পার্থিব স্বার্থ রক্ষা করার মত যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে উঠে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে ধ্বংসের হাত হতে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং দেশের আইন কানুন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা হতে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে অন্য জাতি হতে পশ্চাদপদ থেকে না যায়। সেই সময় হয়তো এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার অবকাশই ছিলো না। যদিও এই আন্দোলনে লাভের পাশাপাশি ভয়ংকর দিকও ছিল। কিন্তু তখন চিন্তা ভাবনা করে ক্ষতিমুক্ত সার্বিকভাবে কল্যাণকর কোন সুষ্ঠু শিক্ষানীতি গ্রহণ করার মত অবকাশ ছিলো না। তখন এমন কোন উপায় উপকরণও ছিলো না যা দিয়ে এ ধরনের শিক্ষানীতি অনুসারে কাজ করা সম্ভব হতো। সুতরাং তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণার্থে মুসলমানদেরকে ইতিপূর্বেই দেশে চালু হয়ে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হলো। তবে এর বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের স্বল্প পরিমাণ এমন কিছু উপকরণও এতে রাখা হলো, আধুনিক শিক্ষানীতি ও প্রশিক্ষণের সাথে যার আদৌ কোন সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল একটা সাময়িক পদক্ষেপ যা আকস্মিক বিপদের মোকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে যে সময়ে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, সে সময় এখন অতীত হয়ে গিয়েছে। এ পদক্ষেপের আকাংখিত সুফলও তখন পাওয়া গিয়েছে এবং যে বিপদ তখন ছিল আশংকা আকারে এখন তা রূঢ় বাস্তব হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ আন্দোলন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের পার্থিব ও বৈষয়িক স্বার্থ হাসিলে সহায়ক হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে আমরা পার্থিব স্বার্থ যতটা উদ্ধার করেছি, আমাদের দ্বীনকে তারচেয়ে অনেক গুণে বেশি বিকৃত করে ফেলেছি। এ ভাবেই আমাদের মধ্যে কৃষ্ঞবর্ণের ফিরিংগীদের আবির্ভাব ঘটেছে। এংলো মোহামেডান ও এংলো ইন্ডিয়ান জন্ম লাভ করেছে তাও আবার এমন যাদের মানসিকতায় “মোহামেডান” ও “ইন্ডিয়ান” হওয়ার অনুপাত নামে মাত্র বিদ্যমান।

যে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদেরকে আমাদের সমাজের মেরুদন্ড বলা চলে, এ শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে শুধুমাত্র কয়েকটা পদ ও খেতাবের বিনিময়ে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকেই ইউরোপের বস্তুবাদী সভ্যতার গোলামে পরিণত করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ শিক্ষানীতি কি স্থায়ীভাবে আমাদের শিক্ষানীতি হয়ে থাকবে? এটাই যদি স্থায়ীভাবে আমাদের শিক্ষানীতি হয়ে থাকে তাহলে এখন আর আলীগড়ের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ, ভারতবর্ষের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি করে এ ধরনের আলীগড় রয়েছে, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত ‘এংলো মোহামেডান’ ও ‘এংলো ইন্ডিয়ান’ তৈরি হয়ে বের হচ্ছে। উপরন্তু এ ধরনের বিষাক্ত ফসল উৎপাদন করার জন্য আমাদের খামার ভূমি রাখার প্রয়োজনীয়তাই বা কি? যদি প্রকৃতই এ অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা আমাদের লক্ষ্য হয়, তাহলে একজন চিকিৎসকের দৃষ্টি নিয়ে দেখুন, বিকৃতির মূল কারণগুলি কি এবং তা সংশোধনের উপায়ই বা কি?

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তা ইসলামের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ উল্টো। সুতরাং আমরা যদি তা হুবহু গ্রহণ করি এবং আমাদের নবীন বংশধরদের এর আলোকে গড়ে তুলি তাহলে চিরদিনের জন্য তাদেরকে হারিয়ে ফেলবো।

যে দর্শন আল্লাহকে বাদ দিয়ে বিশ্ব সমস্যা সমাধানের প্রয়াসী, আপনি সে দর্শনশাস্ত্রই তাদেরকে শেখাচ্ছেন, যে বিজ্ঞান যুক্তিকে পরিহার করে শুধুমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের দাস হয়ে গিয়েছে, আপনি তাদেরকে সেই বিজ্ঞানই পড়াচ্ছেন। আপনি তাদেরকে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ও সমাজ বিজ্ঞানের এমন সব বিষয় শিক্ষা দিচ্ছেন যা মূল বিষয় হতে নিয়ে শাখা প্রশাখা এবং তত্ত্বগত পর্যায় থেকে নিয়ে বাস্তব কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত ইসলামের তত্ত্ব ও সমাজ বিজ্ঞানের মৌলিক নীতির বিরোধী। আপনি এমন একটি সভ্যতার ছত্রছায়ায় তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছেন যা মূল স্পিরিট, লক্ষ্য এবং কাঠামোগত দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী সভ্যতার বিরোধী। এ সত্ত্বেও কিসের উপর নির্ভর করে আপনি আশা পোষণ করেন যে, এর দৃষ্টিভঙ্গি হবে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, এর চরিত্র হবে ইসলামী চরিত্র এবং এর জীবন হবে ইসলামী জীবন? প্রাচীন পদ্ধতিতে কুরআন হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষাদান এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে একেবারেই বেমানান। এ ধরনের শিক্ষা হতে উত্তম কোন ফল লাভ করা যাবে না। একটি ফিরিংগী স্টীমারকে এর উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যেতে পারে, যাতে শুধু দেখানোর উদ্দেশ্যে একটি পাল রাখা হয়েছে। এই ফিরিংগী স্টীমার কিয়ামত পর্যন্ত কোনদিনও ইসলামী স্টীমারে রূপান্তরিত হবে না।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিই যতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান হুবহু শিক্ষা দান প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করুন। এসব জ্ঞান বিজ্ঞান অবিকল গ্রহণ করাটাই ঠিক নয়। প্রচলিত বর্তমান পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর সরল মানসপটে এটি এমনভাবে অংকিত হয়ে যায় যে, তারা পাশ্চাত্যের সব কিছুর উপরই দৃঢ় আস্থা স্থাপন করে বসে। তাদের মধ্যে ভাল এবং মন্দ যাচাই করার যোগ্যতাই সৃষ্টি হয় না। আর সৃষ্টি হলেও তা হাজারে একজনের মাঝে মাত্র। তাও আবার এখান হতে শিক্ষা সমাপনান্তে বহু বছরের গভীর পড়াশোনার পর যখন তারা জীবনের শেষ সীমায় পৌছে যায় এবং বাস্তবে কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া দরকার। পাশ্চাত্যের সব জ্ঞান বিজ্ঞানকে শিক্ষার্থীদের সামনে সমালোচনার আলোকে উপস্থাপন করা দরকার। এই সমালোচনা হবে নিখাদ ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে যাতে শিক্ষার্থীরা প্রতি পদক্ষেপে এর ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো পরিহার করতে পারে এবং কার্যকর দিকগুলো গ্রহণ করতে পারে।

এর সাথে সাথে একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ইসলামের প্রাচীন গ্রন্থাবলী হতে হুবহু গ্রহণ করা ঠিক হবে না। বরং এসব জ্ঞান বিজ্ঞানে শেষ যুগের পন্ডিতগণ যে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন ইসলামের স্থায়ী মূলনীতি, সঠিক আকীদা-বিশ্বাস এবং অপরিবর্তনীয় আইন কানুনকে তা থেকে ঝেড়ে মুছে গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মন মগজে ইসলামের প্রকৃত স্পিরিট এবং ধ্যান ধারণা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য রেডিমেড কোন সিলেবাস আপনি কোথাও পাবেন না। সব কিছু একেবারে নতুন করে তৈরি করতে হবে। কুরআন এবং রাসূলের (সাঃ) সুন্নাতের শিক্ষা সবচাইতে অগ্রগামী হবে। তবে এর পাঠদানকারী শিক্ষকবৃন্দ হবেন এমন, যিনি কুরআন সুন্নাহকে যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছেন। ইসলামী আইনশাস্ত্রও অবশ্যই শিক্ষা দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রেও প্রাচীন গ্রন্থাবলী বড় একটা কাজে আসবে না। অর্থনীতি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামী দর্শনের মতবাদসমূহ, ইতিহাস শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইতিহাস দর্শনের মর্মকথা এবং এভাবে প্রতিটি বিষয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামী উপাদানসমূহকে ফলপ্রসূ, যুক্তি নির্ভর ও প্রাধান্য বিস্তারকারী উপাদান হিসেবে অংগীভূত করতে হবে।

শিক্ষক স্টাফ হতে যে সব নাস্তিক ও ফিরিংগীপনা শিক্ষক অনুপ্রবেশ করেছে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। সৌভাগ্যবশত ভারতবর্ষে এখন এমন একদল লোক তৈরি হয়েছে যারা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে অভিজ্ঞ হওয়ার সাথে সাথে মন-মস্তিষ্ক ও ধ্যান ধারণার দিক হতেও পুরোপুরি মুসলমান। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব জ্ঞানী লোকদেরকে একত্রিত করুন যাতে তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ইসলামী ডিজাইন অনুযায়ী একটি নতুন জাহাজ নির্মাণ করে দিতে পারেন।

আপনি হয়তো বলবেনঃ ইংরেজ সরকার এরূপ একটি জাহাজ নির্মাণ করার অনুমতি দিবেন না। কথাটা যদিও কতকটা সত্য কিন্তু আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, একজন খাটি মুসলমান এবং একজন খাঁটি কমিউনিস্ট এর মধ্যে কাকে সে বেশী ভাল মনে করবে? দুটির মধ্যে যে কোন একটি তাকে গ্রহণ করতেই হবে। ১৯১০ সালের ‘এংলো মোহামেডান’ ধরনের মুসলমান এখন আর বেশিদিন পাওয়া যাবে না। মুসলমানদের নবীন বংশধরদেরকে যদি তুমি কম্যুনিষ্ট হিসেবে দেখতে চাও তাহলে তোমার চিরন্তন মুসলিম দুশমনী চালিয়ে যাও। ফল অবশ্যই দেখতে পাবে। আর যদি তা পছন্দ না হয় এবং কম্যুনিজমের ক্রমবর্ধমান সয়লাব রোধ করতে হয়, তাহলে শুধু একটি শক্তি তা করতে পারে সেটি হলো ইসলাম।

(তরজামুল কুরআন, আগষ্ট, ১৯৩৬; জমাদিউল উলা-১৩৫৬ হিজরি)।

 

মুসলমানদের জন্য নতুন শিক্ষানীতি ও কর্মসূচী
(এই প্রবন্ধটি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীনিয়াত পাঠ্যসূচী সংস্কার কমিটি কর্তৃক প্রচারিত ও বিলিকৃত প্রশ্নমালার জবাব হিসেবে লিখে পাঠানো হয়েছিল। বাহ্যতঃ যদিও এটা আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে উদ্দেশ্য করেই লিখিত, তথাপি মুসলমানদের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই এর লক্ষ্য। এ প্রবন্ধে যে শিক্ষানীতির ব্যাখ্যা করা হয়েছে তা গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য্য। আলীগড় হোক, দেওবন্দ হোক, নদওয়া হোক কিংবা জামেয়া মিল্লিয়া হোক সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মপদ্ধতিই এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান যদি তা পুনর্বিবেচনা না করে তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতা নিঃসন্দেহে হারিয়ে যাবে।)

মৌলিক উদ্দেশ্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টির প্রতি নজর দিয়ে এবং তা কার্যকরী করার জন্য কমিটি নিয়োগ করে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব মুসলমানদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কার্যালয় থেকে এতদসংক্রান্ত যেসব কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে আমি খুব মনোযোগ সহকারে তা দেখেছি। দ্বীনিয়াত ও ইসলামী বিষয়সমূহ শিক্ষাদানের পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় তা আদৌ সম্মানজনক নয়। যে পাঠ্যসূচী অনুযায়ী বর্তমানে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু কমিটির সম্মানিত সদস্যদের পক্ষ থেকে যে প্রশ্নমাল তৈরী করে পাঠানো হয়েছে তা পাঠ করে মনে হয় কমিটির কাছে বর্তমানে পাঠ্যসূচী সংশোধনের বিষয়টিই বিবেচ্য এবং সম্ভবত মনে করা হচ্ছে যে, কয়েকখানা বই বাদ দিয়ে নতুন কিছু বই পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করলেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টি করা যাবে। আমার অনুমান যদি সত্য হয় তাহলে আমি বলবো এটি প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ ধারণা নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদেরকে আরো গভীরে প্রবেশ করে দেখা দরকার যে, কুরআন, হাদীস, ফিকহ ও আকায়েদের যে শিক্ষা বর্তমানে দেয়া হচ্ছে তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী উদ্দীপনা সৃষ্টি না হওয়ার কারণ কি? যদি শুধুমাত্র দ্বীনিয়াতের পাঠ্যসূচীর ত্রুটিই এর কারণ হয়ে থাকে তাহলে এর কুফল হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাঠ্যসূচীর ত্রুটি দূর করাই যথেষ্ট হবে। কিন্তু এর কারণ যদি আরো ব্যাপক হয়, অর্থাৎ গোটা শিক্ষানীতিতেই যদি কোন মৌলিক ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে শোধরানোর জন্য শুধুমাত্র দ্বীনিয়াতের পাঠ্যসূচীর সংশোধন কোনক্রমেই যথেষ্ট হতে পারে না। এর জন্য আপনাকে সংশোধন ও সংস্কারের ক্ষেত্রও ব্যাপক করতে হবে- তা যতই আয়াসসাধ্য এবং সমস্যাসংকুল হোক না কেন। সমস্যাটি সম্পর্কে এই দৃষ্টিকোণ হতে চিন্তাভাবনা করে আমি যা বুঝেছি তা যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্তাকারে পেশ করছি।

আমার এই কথাগুলো তিনটি অংশে বিভক্ত হবে। প্রথমাংশে সমালোচনার দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষানীতির মৌলিক ত্রুটিগুলো ব্যাখ্যা করা হবে এবং মুসলমানদের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষার জন্য বর্তমানে আমাদের শিক্ষানীতি কি হওয়া উচিত তা দেখানো হবে। দ্বিতীয়াংশে সংস্কারমূলক প্রস্তাবালী পেশ করা হবে। আর তৃতীয়াংশে ঐসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের উপায় ও পন্থা সম্পর্কে আলোচনা হবে।

বর্তমানে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে তা আধুনিক শিক্ষা এবং ইসলামী শিক্ষার একটি শংকর রূপমাত্র। এতে কোন সমন্বয় বা মিল নেই। দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ও সামঞ্জস্যহীন শিক্ষা উপাদানকে সংশ্লেষণহীনভাবে হুবহু একসাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। কোন একটি কালচারের সৃষ্টি ও লালনের মত শক্তিশালী করে এ দুটি পদ্ধতির সমন্বয়ে কোন সংশ্লেষ তৈরি করা হয় নি। একই স্থানে একই সাথে জুড়ে দেওয়া সত্ত্বেও দুটি উপাদান যে শুধু পৃথক পৃথক রয়ে গিয়েছে তাই নয় বরং একটি আরেকটির বিরুদ্ধে দ্বন্ধমুখর হয়ে শিক্ষার্থীদের মন মষ্তিষ্কেও দুটি বিপরীত মেরুর দিকে আকর্ষণ করছে। ইসলামী দৃষ্টিকোণের কথা বাদ দিয়ে যদি নিছক শিক্ষার দৃষ্টিকোণ হতেই বিচার করা যায়, তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, শিক্ষা ব্যবস্থার এ ধরনের বিপরীত ও পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটানো মূলতঃই ত্রুটিপূর্ণ এবং এভাবে কল্যাণকর কোন ফল লাভ করা আদৌ সম্ভব নয়।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে এই সংমিশ্রণ আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হলো, প্রথমত শিক্ষা ব্যবস্থায় এ ধরনের সংমিশ্রণই ঠিক নয়। উপরন্তু আরো ক্ষতিকর দিক হলো এই সংমিশ্রণও অনুপাত ঠিক রেখে করা হয় নি। এতে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপাদানকে অত্যন্ত শক্তিশালী করা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষার উপাদানকে অত্যন্ত দুর্বল করা হয়েছে। পাশ্চাত্য উপাদানটির পয়লা সুবিধা হলো তা এমন একটি যুগোপযোগী উপাদান বার পেছনে রয়েছে যুগের গতিধারার আনুকুল্য আর যাকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী একটি শক্তিশালী সভ্যতা। অধিকন্তু তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় ঠিক ততটা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী করে গ্রহণ করা হয়েছে; যতটা পাশ্চাত্য কালচারের লালনের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে আছে এবং থাকা দরকার। এখানে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে যে, পাশ্চাত্যের আদর্শ ও মতবাদসমূহ সরলমনা মুসলমান ছেলেদের মানসপটে দৃঢ় বিশ্বাস রূপে ক্ষোদিত হয়ে যায় এবং তাদের মানসিকতা পুরোপুরি পাশ্চাত্য ধাঁচে গড়ে ওঠে।

তখন তারা পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে শুরু করে এবং পাশ্চাত্যের মগজ দিয়ে সবকিছু চিন্তা করে। সংগে সংগে তাদের মনে এ বিশ্বাসও বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, দুনিয়াতে যুক্তিসংগত ও গ্রহণযোগ্য কিছু থাকলে তা অবশ্যই পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণা ও আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এরপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যত যেসব শিক্ষা দেয়া হয় তা তাদের অনুভূতি ও উপলব্ধিকে আরো শক্তিশালী করে। পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, আদব-লেহাজ, চলন-বলন, খেলা-ধূলা মোটকথা এমন কিছু কি আছে যার ওপর পাশ্চাত্য তাহযীব তমদ্দুন এবং পাশ্চাত্যপনার আধিপত্য নেই? পুরনো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ শতকার পঁচানব্বই ভাগ সন্দেহাতীতভাবে পাশ্চাত্যের। আর এ ধরনের পরিবেশের প্রভাব ও ফলাফল যা হতে পারে এবং হয়ে থাকে তা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে অক্ষম। পক্ষান্তরে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামী উপাদানকে একান্তই দুর্বল করে রাখা হয়েছে। একে তো তা স্বীয় সভ্যতা ও রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে স্বতঃই দুর্বল হয়ে পড়েছে, তদুপরি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যেসব বইয়ের সাহায্যে এই শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে তা এখন হতে কয়েকশ বছর পূর্বে লেখা হয়েছিলো। এর ভাষা, এর বিন্যাস এবং এর রচনাশৈলী বর্তমান যুগের মন মগজকে আবেদন করতে পারে না। এসব গ্রন্থে ইসলামের শাশ্বত স্থায়ী নীতিগুলোকে যেসব অবস্থা ও বাস্তব সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে তার অধিকাংশই এখন আর বর্তমান নেই। আর বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে নীতিগুলোকে সে ক্ষেত্রে প্রয়োগেরও চেষ্টা নেই। অধিকন্তু এই শিক্ষার পিছনে কোন প্রশিক্ষণ, জীবন্ত কোন পরিবেশ, কোন বাস্তব প্রয়োগ এবং প্রচলনও নেই। এভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার সাথে ইসলামী শিক্ষার সংমিশ্রণ আরো বেশী অকার্যকর ও প্রভাবহীন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের অসম সংমিশ্রণের স্বাভাবিক ফল হলো শিক্ষার্থীদের মন-মগজে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপাদানটি আরো দৃঢ়মূল হয়ে যাওয়া এবং ইসলামী শিক্ষার উপাদানটি একেবারেই তুচ্ছ হয়ে যাওয়া কিংবা খুব বেশী হলে অতীত যুগের স্মৃতিচিহ্নের মর্যাদা নিয়ে অবশিষ্ট থাকা।

আমি সাফ সাফ কথা বলছি বলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আমি যা কিছু দেখতে পাচ্ছি তা হুবহু তুলে ধরা নিজের কর্তব্য বলে মনে করছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বীনি এবং দুনিয়াবী শিক্ষার সমন্বয়টা সামগ্রিকভাবে এমন, যেন আপনি এক ব্যক্তিকে আপাদমস্তক অমুসলিম হিসেবে গড়ে তুলেছেন, এরপর তার বগলে এক বান্ডিল দ্বীনি বই গুঁজে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য আপনি তাকে অমুসলিম হিসেবে গড়ে তুলছেন কেউ যেন এ অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে। আর যদি সে ঐ ধর্মীয় পুস্তকের বান্ডিল বগল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, (যার মূল কারণ আপনার শিক্ষা ব্যবস্থা) তাহলে তাকেই যেন এজন্য অভিযুক্ত করা হয়। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুসলমান সৃষ্টি হবে বলে যদি আপনি আশা করেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি অলৌকিক ও অতি অস্বাভাবিক কিছু আশা করে বসে আছেন। কারণ আপনার সরবরাহকৃত উপায় উপকরণ দ্বারা স্বাভাবিক নিয়মে এরূপ ফলাফল আশা করা যেতে পারে না। শতকার এক দু’জন শিক্ষার্থীর (আকীদা ও আমলের ব্যাপারে) পূর্ণ মুসলমান থেকে যাওয়া এ শিক্ষাব্যবস্থার বা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার কোন প্রমাণ নয়। বরং এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এখনো যারা ঈমান আকীদা ও ইসলামকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হলো তারা আসলে ইব্রাহীমী স্বভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল। এ ধরনের ব্যতিক্রম যেমন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে দেখা যায় তেমনি ব্যতিক্রম ভারতের অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় তথা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ থেকে সনদপ্রাপ্তদের মধ্যেও দেখা যায় যাদের পাঠ্যসূচীতে আদৌ কোন ইসলামী উপাদান নেই।

এখন যদি আপনি এই পরিস্থিতি ও শিক্ষা পদ্ধতি অবিকল অক্ষুণ্ন রাখেন এবং শুধু দ্বীনিয়াতের বর্তমান পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করে আরো বেশী শক্তিশালী পাঠ্যসূচী অন্তর্ভুক্ত করেন তাহলেও যে ফলাফল দাঁড়াবে তা হলো ইসলাম ও ফিরিংগীপনার মধ্যে সংঘাত আরো তীব্রতর হবে। তাতে প্রতিটি ছা্ত্রের মন মস্তিষ্ক হয়ে উঠবে এক একটি যুদ্ধক্ষেত্র যাতে পরস্পরবিরোধী দুটি শক্তি পূর্ণ শক্তিতে নিরন্তর যুদ্ধরত থাকবে এবং পরিণামে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়বে।

এক গোষ্ঠী এমন হবে যাদের ওপর পূর্ণমাত্রায় ফিরিংগীপনার প্রভাব থাকবে। সে ফিরিংগীপনা বিলেতী সাহেবদের ঢংয়েও হতে পারে, ভারতীয় স্বদেশ পূজার ঢংয়েও হতে পারে কিংবা নাস্তিকতাবাদী সমাজতন্ত্রের রূপ নিয়েও হতে পারে।

দ্বিতীয় গোষ্ঠী হবে এমন যাদের ওপর পূর্ণ প্রভাব থাকবে ইসলামের। তা ইসলামের প্রভাব গভীরভাবে প্রভাবিত হতে পারে অথবা ফিরিংগীপনার প্রভাব দুর্বলও হতে পারে।

তৃতীয় আরেক গোষ্ঠী হবে এমন-যারা না হবে পুরোপুরি মুসলমান, না হবে পুরোপুরি ফিরিংগী। আর এটা স্পষ্ট যে, শিক্ষাব্যবস্থার এই ফলাফল কোন সন্তোষজনক ফলাফল নয়। নিরেট শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকেও এ দুটি পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণকে কল্যাণপ্রসূ বলা যেতে পারে না। আর জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার অস্তিত্ব বৈধ প্রমাণ করতে পারে না যার অর্জিত ফলাফলের দুই তৃতীয়াংশ জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এবং জাতীয় তাহজীব তমদ্দুনের সমূহ ক্ষতিরই নামান্তর। অন্তত গরীব মুসলমান কওমের জন্য তা খুবই দুর্মূল্য। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এমন একটি টাকশাল চালু করা হলো যার থেকে সবসময় শতকার তেত্রিশ ভাগ অচল মুদ্রা তৈরী হয়ে আসে, আর তেত্রিশ ভাগ আমাদের ব্যয়ে তৈরি হয়ে অন্যের ঝুলিতে চলে যায়-তথা চূড়ান্তভাবে আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়।

উপরোক্ত আলোচনা হতে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথমত শিক্ষার ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধী উপাদানের সংমিশ্রণ কোন ভাবেই ইসলামী স্বার্থের জন্য কল্যাণকর নয়। তা এ পর্যন্ত যা হয়ে আসছে, সে ধরনের অসম সংমিশ্রণ হলে কল্যাণকর নয়। আবার যা করার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে সে ধরনের সুষম সংমিশ্রণ হলেও কল্যাণকর নয়।

এসব বিষয় বিশ্লেষণ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষানীতি কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে চাই।

এটা সর্বজন বিদিত যে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কোন না কোন কালচারের লালন করে থাকে। কোন উদ্দেশ্য বা পদ্ধতি নেই এমন নিরেট শিক্ষা আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়নি এবং এখনো হচ্ছে না। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে দেয়া হয়ে থাকে। বিশেষ কালচারের লালন ও প্রতিপালনের জন্য তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গভীর চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি নিরূপিত হয়। এখন প্রশ্ন হলো আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কালচার সংস্কৃতির লালন ও বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? যদি তা পাশ্চাত্যের কালচার হয়ে থাকে তাহলে এটিকে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বলা ঠিক হবে না, কিংবা এর সিলেবাসের কিছু অংশে দ্বীনিয়াত শিক্ষার ব্যবস্থা রেখে শিক্ষার্থীদের মানসিক দ্বন্ধ বাড়ানো যাবে না। আর যদি ইসলামী কালচার হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই পরিবর্তন হওয়া দরকার। আর গোটা সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমনভাবে পুণর্গঠন করা দরকার যেন সামগ্রিকভাবে উক্ত সংস্কৃতির মেজাজ ও ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর তা যেন ইসলামী সংস্কৃতির রক্ষকই না হয় বরং এর উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য একটি উত্তম সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

বর্তমান অবস্থায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী সংস্কৃতির নয় বরং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সেবা করে যাচ্ছে। আমি আগেই একথা প্রমাণ করেছি। এই অবস্থায় দ্বীনিয়াতের বর্তমান সিলেবাস বদলিয়ে একটু উন্নত করলে এবং শিক্ষার অন্যান্য বিভাগসমূহে পাশ্চাত্যপনা পুরোপুরি বহাল রাখলে শুধু এতটুকু পরিবর্তনের দ্বারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ইসলামের সেবক হতে পারবে না। ইসলামের বুনিয়াদী বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করলে আপনা থেকেই একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পার্থিব ও দ্বীনি শিক্ষাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা এবং প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে সংমিশ্রণ তৈরী করা একেবারেই নিরর্থক। খৃষ্টধর্মের মত ইসলাম নিছক এমন ধর্ম নয় যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে বর্তমান। দুনিয়াকে দুনিয়াদারদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ইসলাম শুধু আকীদা বিশ্বাস ও নৈতিকতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে না। এ কারণে খৃষ্টধর্মের ধর্মীয় বিষয়গুলোর মত ইসলামে দ্বীনি বিষয়গুলোকে দুনিয়াবী বিষয় হতে আলাদা করা যায় না। ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মানুষকে দুনিয়ায় টিকে থাকতে এবং দুনিয়ার সমুদয় কাজ আঞ্জাম দিতে এমন এক পদ্ধতি গড়ে তোলা যা এই পার্থিব জীবন থেকে নিয়ে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত প্রসারিত এবং সেটিই নিরাপত্তা, মর্যাদা ও মহত্ত্বের সোপান। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারাকে পরিশুদ্ধ করে, তার নৈতিক মূল্যবোধসমূহ পরিশীলিত করে, তার জীবনধারাকে একটি বিশেষ ছাঁচে ঢেলে নির্মাণ করে, তার অধিকার ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দেয় এবং সামাজিক জীবনের জন্য একটি বিশেষ বিধান রচনা করে দেয়। ব্যক্তির চিন্তাগত ও বাস্তব প্রশিক্ষণ, সমাজের বিনির্মাণ ও সংগঠন এবং জীবনের সকল বিভাগের প্রশিক্ষণ ও ভারসাম্যের জন্য ইসলামের মূলনীতি ও আইন কানুন অন্য যে কোন বিধান থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা। এসব মূলনীতি ও আইন কানুনের কারণে ইসলামী সভ্যতা একটি স্বতন্ত্র ও অনুপম সভ্যতার রূপ পরিগ্রহ করে। একটি জাতি হিসেবে মুসলমান জাতির বেঁচে থাকা এই সব মূলনীতি ও আইন-কানুনকে মেনে চলার ওপর নির্ভরশীল। যদি জীবন ও জীবনের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার সাথে এর সম্পর্কই না থাকে, তা হলে সেক্ষেত্রে ইসলামী দ্বীনিয়াত পরিভাষাটি একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে। যে সব আলেম এবং পন্ডিত ইসলামের ‘আকায়েদ’ এবং মূলনীতিসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কিন্তু তার সাহায্যে জ্ঞান ও কর্মের জগতে এগিয়ে যেতে পারেন না এবং জীবনের প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশ ও সমস্যায় যেগুলো প্রয়োগ করতে জানেন না, ইসলামী সংস্কৃতির সেবা ও লালনে সেসব আলেম ও পন্ডিতবর্গ একেবারেই অযোগ্য। তেমনি যারা পার্থিব জ্ঞান সমৃদ্ধ, যারা অন্তরে ইসলামী সভ্যতার প্রতি ঈমান পোষণ করে কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক অ-ইসলামী নীতির ভিত্তিতেই এর বিন্যাস ঘটায়, পার্থিব জ্ঞানে সমৃদ্ধ সেই সব আলেম এবং পন্ডিতবর্গও ইসলামী সাংস্কৃতির লালন ও সেবায় অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমজাতির মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে শুধু এই দুই ধরনের পন্ডিত ও বিদ্বানই তৈরী হচ্ছে। তাই ইসলামী কৃষ্টি ও সভ্যতার এমন অধঃপতন ঘটেছে। এ কারণে ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে পার্থিব জ্ঞান বিজ্ঞানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। আজ আবার যদি আমরা চাই যে, ইসলামী কালচার পুনরায় তারুণ্য লাভ করুক এবং যুগের পেছনে পেছনে না চলে তা আগে চলুক তাহলে এই ছিন্ন সম্পর্ক আবার বহাল করতে হবে। পুনর্বহাল করার পন্থা এটা নয় যে, শিক্ষারূপ দেহের গলায় তা হারের মত লটকিয়ে দিবেন কিংবা ঘন্টির মত কোমরে ঝুলিয়ে দিবেন। কোন অবস্থাতেই তা যথেষ্ট হবে না। বরং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে তা এমনভাবে অন্তর্লীন করে দিবেন যাতে তা তার রক্তপ্রবাহ, প্রাণ চাঞ্চল্য, দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, অনুভূতি উপলব্ধি ও চিন্তা ভাবনায় অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং সাথে সাথে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প কলার উত্তম উপাদানগুলো আত্মস্থ করে স্বীয় তাহযীবের অংগীভূত করতে থাকে। এভাবে মুসলিম দার্শনিক, মুসলিম বৈজ্ঞানিক, মুসলিম অর্থনীতিবিদ, মুসলিম আইনবিদ, মুসলিম প্রশাসক, মোটকথা জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সকল অঙ্গনের জন্য মুসলিম বিশেষজ্ঞ তৈরী করা সম্ভব হবে যারা জীবনের সব সমস্যার সমাধান ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে করবে। তারা আধুনিক সভ্যতার অন্যতম উপায় উপকরণকে ইসলামী সভ্যতার সেবায় নিয়োজিত করবে এবং ইসলামী ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও জীবন যাপনের আইন কানুন ও নিয়ম নীতিকে যুগ চাহিদার আলোকে পুনর্বিন্যস্ত করবে। এমনকি জ্ঞান ও কর্মক্ষেত্রে আলোর সন্ধান দিতে ইসলাম পুনরায় নেতৃত্বের আসীনে সমাসীন হবে-যার তার সৃষ্টির অভিষ্ট লক্ষ্য।

এটাই মুসলমানদের নতুন শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। স্যার সাইয়েদ আহমদ আমাদেরকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন যুগ সেখান থেকে আরো বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। এখন কথা হলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত যদি আমরা এখানেই অবস্থান করি তাহলে মুসলিম জাতি হিসেবে আমাদের উন্নতি তো দূরের কথা বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

ইসলামী শিক্ষানীতির মূল বিষয় যা আমি উপরে বর্ণনা করেছি তাকে কিভাবে বাস্তবে রূপ দেয়া যেতে পারে আমি এখন সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।

(১) মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দী থেকে ফিরিংগীপনার মূলোৎপাটন একান্ত জরুরী। আমরা যদি আমাদের জাতীয় তাহযীব-তমদ্দুনকে নিজ হাতে ধ্বংস করতে না চাই তাহলে ফিরিংগীপনার প্রতি আমাদের নতুন বংশধরদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সৃষ্টি করার কারণ নির্ণয় ও তার দ্বার রুদ্ধ করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য। এই আগ্রহ ও আকর্ষণ প্রকৃতপক্ষে আমাদের গোলামী মানসিকতা ও প্রচ্ছন্ন হীনমন্যতা বোধের সৃষ্টি। কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ, সামাজিকতা, আচার আচরণ, চলন বলন এবং সামগ্রিকভাবে গোটা সামাজিক পরিবেশে বাস্তবে যখন এর প্রকাশ ঘটে তখন তা বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিক থেকে আমাদের মন মানসিকতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং জাতীয় মর্যাদাবোধ আর নামমাত্রও অবশিষ্ট থাকে না। এমতাবস্থায় ইসলামী সভ্যতার পক্ষে বেঁচে থাকা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোন সভ্যতাই নিছক তার মূলনীতি এবং মৌলিক ধ্যান ধারণার তাত্ত্বিক অস্তিত্ব থেকে জন্মলাভ করে না বরং তা ব্যবহারিক আচরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং এভাবেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যদি তার কোন অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সেই সভ্যতা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে এবং তত্ত্বগতভাবেও টিকে থাকতে পারবে না। সুতরাং সর্বপ্রথম যে সংস্কার প্রয়োজন তা হলো বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে একটি প্রাণবন্ত ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা। এখানে শিক্ষাদান এমনভাবে হওয়া উচিত যা মুসলমানদের নবীন বংশধরদেরকে নিজেদের জাতীয় সভ্যতা নিয়ে গর্ব করতে শেখাবে। তাদের মধ্যে জাতীয় বৈশিষ্ঠ্যের প্রতি মর্যাদাবোধ বা গভীর অনুরাগের সৃষ্টি করবে। তাদের মধ্যে ইসলামী চরিত্র ও উন্নত জীবনবোধের প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি করবে, তাদেরকে এমন যোগ্য করে গড়ে তুলবে যা তাদেরকে জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পরিশীলিত চিন্তা শক্তি দ্বারা নিজের জাতীয় তমদ্দুনকে রুচি ও শিষ্ঠাচারের উচ্চতম শিখরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

(২) শিক্ষাঙ্গনে ইসলামী চেতনা ও প্রাণপ্রবাহ সৃষ্টি বেশীরভাগ নির্ভর করে শিক্ষকদের জ্ঞান ও তার বাস্তব অনুশীলনের ওপর। যে শিক্ষকের নিজের মধ্যেই এ চেতনা নেই বরং সে চিন্তা ও কর্মে এর বিরোধী, এরূপ শিক্ষকের অধীনে থেকে শিক্ষার্থীর মন মগজে কি করে ইসলামী চেতনা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে পারে? আপনি বিল্ডিংয়ের নকশা বা প্ল্যান তৈরি করতে পারেন মাত্র, কিন্তু আসল নির্মাতা তো আপনি নন। আসল নির্মাতা হলেন শিক্ষক স্টাফের সদস্যগণ। ফিরিংগী রাজ মিস্ত্রিরা ইসলামী নকশা অনুযায়ী বিল্ডিং তৈরি করবে এ আশা করা উচ্চে গাছে আঙ্গুর গুচ্ছ আশা করারই নামান্তর। অন্যান্য বিষয় শিক্ষাদানের জন্য অ-মুসলিম বা অ-ইসলামী চিন্তাধারার অধিকারী মুসলিম নামধারী শিক্ষক নিয়োগ করে শুধু দ্বীনিয়াত পড়ানোর জন্য কয়েকজন মৌলবী নিয়োগ করা একেবারেই নিরর্থক। কারণ ঐসব শিক্ষক জীবন ও তার সমস্যা ও বাস্তব কাজকর্মের ক্ষেত্রে ছাত্রদের ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরিয়ে দিবে এবং শুধু দ্বীনিয়াতের কোর্স সংযোজন দ্বারা এ বিষের বিষনাশক সরবরাহ করা যাবে না। সুতরাং দর্শন কিংবা বিজ্ঞান হোক, অর্থনীতি বা আইন হোক, ইতিহাস বা অন্য কোন বিষয় হোক, মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার জন্য কোন ব্যক্তির বিশেষজ্ঞ হওয়াই যথেষ্ট নয় বরং তার পাকা মুসলমান হওয়া জরুরী। বিশেষ অবস্থার কারণে যদি কোন অমুসলিম বিশেষজ্ঞ এর সাহায্য নিতেও হয় তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু সাধারণ নীতি এমন হবে যাতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ বিশেষজ্ঞ হওয়া ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য তথা ইসলামী সংস্কৃতির জন্য ধ্যান ধারণা ও কাজ কর্ম উভয় বিচারেই উপযুক্ত বিবেচিত হন।

(৩) আরবী মুসলিম সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রতীক ভাষা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় আরবীকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইসলামের মূল উৎসের সাথে যোগাযোগের জন্য এটাই একমাত্র মাধ্যম। মুসলমানদের শিক্ষিত শ্রেণী যতদিন পর্যন্ত কোন মাধ্যম ছাড়াই কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান আহরণ করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত তারা ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারবে না। তাদের পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি লাভ ও সম্ভব হবে না। সুতরাং সব সময়ই তাদেরকে অনুবাদক ও টীকাকারদের উপর নির্ভর করতে হবে।

এভাবে তারা সরাসরি সূর্য হতে সূর্যের আলো লাভ করতে পারবে না। বরং বিভিন্ন প্রকার রঙ্গিন গ্লাসের মাধ্যমে সূর্যের আলো পেতে থাকবে। বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ইসলামী বিষয়ে এমন সব ভুল ভ্রান্তি করছেন যা দেখে বুঝা যায়, তারা ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানও রাখেন না। এর কারণ হলো সরাসরি কুরআন এবং সুন্নাহ হতে জ্ঞান আহরণের কোন সুযোগ তাদের নেই। ভবিষ্যতে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসিত অর্জিত হলে ভারতবর্ষের আইনসভা আইন প্রণয়নের জন্য অধিক ব্যাপক এখতিয়ার লাভ করবে এবং সামাজিক পুনর্গঠনের জন্য নতুন নতুন আইন কানুন রচনার প্রয়োজন হবে, তখন যদি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং পাশ্চাত্যের নৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী ও আস্থাবান লোক আইন সভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে তাহলে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মুসলমানদের সামাজিক পুনর্গঠনের পরিবর্তে বরং উল্টো সামাজিক বিকৃত ঘটবে এবং মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা তার মূলনীতি থেকে আরো দূরে সরে যাবে। সুতরাং আরবী শিক্ষাদানের বিষয়টিকে শুধু ভাষা শিক্ষাদানের ব্যাপার মনে করা যাবে না। বরং মনে করতে হবে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত। আর যা মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সম্পৃক্ত তা শেখানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষা করা যেতে পারে না। বরং তার জন্য সর্বাবস্থায় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি