মুহাম্মাদ কুতুব মধ্যপ্রচ্যের ইসলামী আন্দোলন ইখওয়ানুল মুসলেমুনের বিশিষ্ট নেতা সাইয়েদ কুতুব শহীদের ভাই। এক সময়ে তিনি মিসরে প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি ইসলাম সম্পর্কে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হন এবং আধুনিক শিক্ষিত যুব মানসে যেসব জিজ্ঞাসা তিনি লক্ষ্য করেন, ‘ভ্রান্তির জেড়াজালে ইসলাম’ তারই জবাব। প্রাঞ্জল ভাষায়, যুক্তি ও তথ্য সহকারে তিনি ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে ইসলামের শ্রেষ্টত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেন। এক দিকে ইসলামী ও ইতিহাস সম্পর্কে শতাব্দীকালের অজ্ঞতা, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, অন্যদিকে সমকালীন পাশ্চাত্য সভ্যতার সর্বগ্রাসী সয়লাব ইসলাম সম্পর্কিত বিভ্রান্তির মূল কারণ।

বর্তমান বইটি আরবী ভাষায় ১৯৬৪ সালে কায়রো হতে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৭ সালে কুয়েত সরকার এর ইংরেজী সংস্করণ প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে আমরা এই বইটির যে অনুবাদ প্রকাশ করে আসছিলাম তা ছিল কুয়েত সরকার কর্তৃক প্রকাশিথ ইংরেজী সংস্করণের অনুবাদ। এতে সম্পাদক মূল কপি হতে কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়েছেন।

বর্তমানে বইটির মূল আরবী কপি হতে সরাসরি অনুবাদ ও কোন রকম কাটছাট না করা উত্তম বিবেচিত হওয়ায় এবং অনেক বিজ্ঞ পাঠকের পরামর্শ পাওয়ায় আমরা বইটির মূল আরবী থেকে বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম।

বিশিষ্ট ইসলামী শিক্ষাবিদ সুসাহিত্যিক এবং গবেষক অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক বর্তমান সংস্কারণের অনুবাদ করেছেন। আশা করি বইটি পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করবে।

মহান আল্লাহ পুস্তকুটির সাথে সম্পৃক্ত সকলের খেদমতকে কবুল করুন।

-প্রকাশক

ভূমিকা
আধুনিক শিক্ষিত লোকদের অধিকাংশই একটা কঠিন ধর্মীয সংকটে আবর্তিত হচ্ছেন। তাদের বক্তব্য হলো: “ধর্ম কি মানব জীবনের জন্যে সত্যি অপরিহার্য? অতীতে হয়ত তা-ই ছিল। কিন্তু বর্তমানে যখন বিজ্ঞান মানব জীবনের সমগ্র ধারাকে পরিবর্তিত করে দিয়েছে এবং বাস্তব জীবনের বৈজ্ঞানিক সত্য ছাড়া অন্য কিছুর আদৌ কোন স্থান নেই তখন উক্ত দাবী সংগত হতে পারে কি? ধর্ম কি মানুষের জন্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন? –না এটা তাদের ব্যক্তিগত রুচি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে যে, কেউ এটা গ্রহণ করছে, আবার কেউ এটাকে প্রত্যাখ্যান করছে? এতে করে কি প্রমাণিত হয় না যে, ধর্মকে মানা অথবা না মানার কারণে মানুষের কার্যকলাপে তেমন কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না? আর আমরা মানুষের যে আচরণ ও কর্মতৎপরতাকে ‘কুফর (আল্লাহদ্রোহিতা)’ বা ‘ঈমান’ নামে অভিহিত করি বাস্তবতার নিরিখে তাতে কোন ত ফাৎ নেই?

তারা যখন ইসলাম সম্বন্ধে কথা বলেন তখন তাদের এই মানসিক দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। যখন তাদেরকে বলা হয়: ইসলাম শুধু কিছু প্রত্যয় ও আকীদার নাম নয়। শুধু আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অথবা মানুষের কল্যাণমূলক শিষ্টাচার বা নিয়ম-শৃংখলার মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটা হচ্ছে এমন একটি সর্বাত্মক ও সুসম্বিত পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে একটি সুবিচার ভিত্তিক অর্থনৈতিক জীবনাদর্শ, ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, দেওয়ানী-ফৌজদারী ও আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, একটি বিশেষ জীবনদর্শন এবং দৈহিক প্রশিক্ষণ ও প্রতিপালনের সুষ্ঠু বিধান। আর এর সবকিছুই উহার মৌল বিশ্বাস এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারা থেকেই উৎসারিত তখন এরা খুব বিব্রত ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কেননা তাদের একমাত্র বক্তব্যই হলো: ইসলাম বহু পূর্বেই উহার শৌর্য ও কল্যাণকার ভূমিকা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ কারণেই যখনই তাদেরকে বলা হয়: ইসলাম কেন মৃত ধর্মের নাম নয়। বরং উহা এক অপরাজেয় দুর্বার শক্তি, পাতায়-পল্ববে, ফুলে সুশোভিত এক জীবন পদ্ধতি যাতে কার্যকর রয়েছে এমন এমন শক্তিশালী উপাদান যার দৃষ্টান্ত না সমাজতন্ত্র পেশ করতে পেরেছে, না সাম্যবাদ উহার কল্পনা করতে সক্ষম হয়েছে, না অন্য কোন মতবাদ উহার বিকল্প তুলে ধরেতে পেরেছে তখন তারা অধৈর্য হয়ে পড়েন এবং আমাদেরকে প্রশ্ন করতে থাকেন : “আপনারা কি সেই ধর্ম সম্বন্ধে এই কথাগুলো বলছেন যা দাস প্রথা, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদকে সমর্থন করে? –যা নারীকে পুরুষের অর্ধেক বলে মনে করে এবং তাকে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করে রেখে দেয়? – যা পাথর মেরে মেরে মানুষ হত্যা, হাত-পা কেটে ফেলা এবং কোরা লাগাবার ন্যায় পাশবিক শাস্তির বিধান দেয়?- যা উহার অনুসারীদেরকে দান-খয়রাতের পয়সা দিয়ে জীবনযাপন করতে শেখায়? –যা তাদেরকে নানা শ্রেণীর বিভক্ত করে দেয় যাতে করে কিছু লোক অন্যদের ধন-সম্পদ শোষণ করতে সক্ষম? –যা শ্রমিকদেরকে সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের কোন নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে না? আর যে ইসলাম সম্পর্কে আপনারা এটা-ওটা বলছেন তা কি আপনারা নিজেরা পালন করে থাকেন? এর উন্নতি বিধান ও ভবিষ্যত সাফল্যের নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরে থাক, আমাদের দৃষ্টিতে এর অস্তিত্বই এখন চারদিক থেকে বিপন্ন হয়ে পড়েছে –আজকের বিশ্বে যখন বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদের আদর্শিক সংঘাত তুঙ্গে উঠেছে তখন ইসলামেরন্যায় একটি বস্তাপচা ধর্মের ক্ষীণকণ্ঠ ও সাফল্যের কথা কোন আলোচ্য বিষয় বলেও পরিগণিত হতে পারে না।”

আরো সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে, আসুন এই সন্দেহবাদী আধুনিক শিক্ষিতদের প্রকৃত পরিচয় আমরা জেনে নেই। -পর্যালোনা করে দেখি, তাদেরকে এই সন্দেহ ও সংশয়ের মূল সূত্র ও উৎস কোথায়? তাদের এই চিন্তাধারা কি তাদের নিজস্ব ও স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণের ফল, না অন্যদের অন্ধ অনুসরণের ফসল?

প্রকৃত অবস্থা এই যে, এরা ইসলামের বিপক্ষে যে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করে থাকেন তা তাদের স্বাধীন চিন্তা ও নিরপেক্ষ বিচার বিবেচনার ফসল নয়। বরং এটা তা অন্যদের নিকট থেকে গ্রহণ করেছেন। এর মূল উৎস জানতে হলে আধুনিক যুগের ইতিহাসের প্রকৃত দৃকপাত করতে হবে।

মধ্য যুগে ইউরোপ এবং ইসলামী বিশ্বের মধ্যে ক্রুসেড নামে কয়েকবারই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অতপর উভয় পক্ষের মধ্যে বাহ্যিকভাবে সন্ধি স্থাপিত হলেও আন্তরিকভাবে কোন মৈত্রী স্থাপিত হয়নি। ফলে পারস্পরিক বৈরিতারও কোন অবসান হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজরা যখন যেরুজালেম দখল করে নেয় লর্ড এলেন বি (Allen By) প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন : আজই ক্রুসেডের অবসান হল।”

এই সংগে আমাদের একথাও স্বরণ রাখতে হবে যে, বিগত দু’শ’ বছর ধরে ইউরোপ সাম্রাজ্য ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে একটি বিরতিহীন সংঘর্ষ চলছে। তওফীক পাশার ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ইংরেজরা মিসরে প্রবেশ করার সুযোগ লাভ করে। মিসরে আরাবী পাশার নেতৃত্বে সংগটিত ১৮৮২ খৃস্টাব্দের গণবিপ্লবকে এই তওফীক পাশার সাহায্যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। অতপর তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যে কোন পন্থায়ই হোক না কেন নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী থাকা বিস্তার করে ইসলামের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করে তুলতে হবে এবং সম্ভাব্য যাবতীয উপায়-উপাদান ব্যবহার করে, নিজেদের ক্ষমতাকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামী আন্দোলন ও উহার দুর্বার চেতনাকে পর্যদস্তু করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্মরণীয় যে, ভিক্টোরিয়া যুগের ‍বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ গ্লাডস্টোন একবার এক জিলদ কুরআন টাক হাতে নিয়ে ‍বৃটিশ কমন্‌স্‌ সভায় (House of Commns) সদস্যগণকে বলেছিলেন: “মিসরীয়দের নিকট যতদিন এই গ্রন্থ বর্তমান থাকবে ততদিন মিসরের বুকে আমরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে অবস্থান করতে পারবো না।

এ কারণেই ইংরেজরা মুসলমানদেরকে ইসলাম সম্পর্কে বিমুখ ও উদাসীন করে তোলার উদ্দেশ্যে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠানকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে এবং ইসলামের এক জঘন্য ও কদর্য রূপ উপস্থাপিত করতে শুরু করে- যাতে করে মিসরের উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী বন্ধর দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হতে থাকে এবং তাদের পৈশাচিক উদ্দেশ্যসমূহ সফল হতে থাকে।

মিসরে তারা যে শিক্ষানীতি প্রবর্তন করে তাতে প্রকৃত অর্থে মুসলমান শিক্ষার্থীদেরকে তাদের দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের কোন সুযোগই দেয়া হয়নি; এমনকি তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষায়তন থেকে সর্বোচ্চা ডিগ্রী হাসিল করার পরেও কেউ ইসলামের প্রকৃত মর্ম সম্পর্কে অবহিত হতে পারেনি। সে সকল শিক্ষায়তনে তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞান দান করা হতো তার সারকথা ছিল এই যে, কুরআন পাক আল্লাহর কিতাব। কেবলমাত্র বরকত ও সওয়াব লাভের জন্যেই উহা পাঠ করা হয়। আর ইসলামের অন্যান্য ধর্মের ন্যায় মানুষকে ভালো মানুষ রূপে গড়ে তোলার জন্যে ণৈতিক চরিত্রকে উন্নত করার প্রেরণা দেয় এবং ঐ সকল ধর্মের ন্যায় ইহাও ইবাদাত-বন্দেগী, অযীফা-যিকর, কাশফ-কারামাত এবং দরবেশী ও তাসাউফের একটি সমষ্টি মাত্র। ইসলামের পরিধি এতটুকুই। এছাড়াও ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্তা, রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন-কানুন এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতি মানুষের নিকট যে অন্যান্য সঞ্জীবনী শক্তির সন্ধান দেয় সে সম্পর্কে শিক্ষার্তীদেরকে শুধু যে অন্ধকারে ফেলে রাখা হয় তাই নয়, বরং তথাকথিত প্রাচ্যবীদদের প্রচারিত ভ্রান্ত চিন্তাধারা ফেলে রাখা হয় তাই নয়, বরং তথাকথিত প্রাচ্যবীদদের প্রচারিত ভ্রান্ত চিন্তাধারা এবং ধ্বংসাত্মক সংশয়ের অনুসারী করে তোলা হয়। আর একমাত্র লক্ষ্য থাকে মেধা ও চিন্তাধারাকে বিকৃত করে তাদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।

এই সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদেরকে শুধু শেখানো হয়েছে যে, সমগ্র বিশ্বে ইউরোপের জীবন ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযুক্ত ও সর্বশ্রেষ্ঠ; সর্বোৎকৃষ্ট অর্থনীতি ইউরোপীয় চিন্তাবীদদের সর্বাত্মক গবেষণার সুফল। আধুনিক যুগের সবচেয়ে উপযুক্ত ও নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতি ইউরোপীয় পণ্ডিতগণই শত শত বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচনা করেছেন। শিক্ষার্তীদেরকে আরো বুঝানো হয়েছে : মৌলিক অধিকার সর্বপ্রথম ফরাসী বিপ্লবই মানুষকে দিয়েছে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক জীবনধারার বিস্তার ও জনপ্রিয়তার সবটুকুই ইংল্যাণ্ডের গণতান্ত্রিক বিকাশের সুফল। আর সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রকৃত বুনিয়াদ রোমান সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। মোটকথা এই শিক্ষাব্যবস্থা ইউরোপ ও ইউরোপীয়দের এক আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর চিত্র তুলে ধরেছে। উহা দেখা মাত্রই এরূপ বিশ্বাস জন্মে যে, ইউরোপ একটি গর্বিত অথচ মহান শক্তি; বিশ্বের কোন শক্তিই উহার মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়; উহার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পথে কোন শক্তিই কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। আর এর বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের সম্মুখে প্রাচ্যকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অবমাননাকর বলে উপস্থাপিত করা হয়েছে, ইউরোপের সম্মুখে প্রাচ্যেল যেন কোন মূল্যই নেই, বরং প্রাচ্যের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণরূপেই ইউরোপীয় লোকদের উপর নির্ভরশীল; সভ্যতা ও সংস্কৃতি বলতে প্রাচ্যের নিকট কিছুই নেই, যতটুকু যা আছে তা এতদূর নিম্ন মানের যে, উহা পাশ্চাত্যের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির মূল্যবোধের ছিটে-ফোটা নিয়েই কোন রূপে বেঁচে আছে।

সাম্রাজ্যবাদীদের এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র একদিনস ফল হলো। মিসরীয় মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বকীয় সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিত্ববোধ থেকে বঞ্চিত হলো। ইউরোপ ও উহার সভ্যতা তাদের মন-মানসিকতা ও ধীশক্তিকে একেবারেই আচ্ছন্ন করে ফেলল। না তারা নিজেদের চোখ দিয়ে দেখতে পারত, না তাদের প্রজ্ঞা ও ধীশক্তি রহিত হয়ে গেল; ইউরোপীয় প্রভুদের সন্তুষ্টি বিধানই তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল।

এই ঐতিহাসিক পটভূমি বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদরে অস্তিত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি বিরাট অবদান, তাদের গোপনীয় ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার সবচাইতে বড় দলীল। মুসলিম সমাজে এই শিক্ষিত শ্রেণীর চিন্তাধারা ও কর্মমাণ্ড সাম্রাজ্য-বাদীদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সুস্পষ্ট দর্পণ।

ইসলাম সম্পর্কে এই বেচারাদের জ্ঞান খুবই সীমিত ও অসম্পূর্ণ এবং তাদের পাশ্চাত্যের শিক্ষকদের নিকট থেকে গৃহীত। অনুরূপভাবে সাধারণ ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ধ্যান-ধারণাও ইউরোপীয়দের আপত্তি ও সন্দেহের প্রতিধ্বনি মাত্র। বরা বাহুল্য প্রভুদের দেখাদেখিই তারা ইসলাম সম্পর্কে নানারূপ ভিত্তিহীন প্রশ্নের অবতারণা করে। কখনো বলে: রাষ্ট্রীয় ও সরকারী কার্যকলাপে ইসলামের কোন স্থান থাকতে পারে না; আবার কখনো তারা এই বলে ঢাক-ঢোল পিটাতে থাকে যে, ইসলাম ও বিজ্ঞান পরস্পর বিরোধী, একটির সাথে আরেকটির মিল নেই।

কিন্তু মুর্খতা আর কাকে বলে? হয়ত তারা অবগত নয় যে, গোটা ইউরোপ যে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল তার নাম ইসলাম ছিল না, বরং তা ছিল ইসলাম থেকে ভিন্নতর অন্য ধর্ম। একথাও তারা ভুলে যায় যে, যে অবস্থা এ ঘটনাবলী ইউরোপীয়দেরকে নিজেদের ধর্মর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তুলেছিল তা শুধু ইউরোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্বের অন্য কোন এলাকায় এর কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যায় না। নূন্যকল্পে ইসলামী ইতিহাসের এমন কোন অবস্থা ও ঘটনাবলীর কোন সন্ধান মিলে না। এমনকি ভবিষ্যতেও এরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ইউরোপের এই অন্ধ অনুসারীরা কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই নিজেদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের মতে ইসলামকে বর্জন করার একমাত্র কারণ হল এই যে, ইউরোপীয়রা ধর্মের প্রতি রুষ্ট এবং রুষ্ট বলেই উহাকে দেশ থেকে চিরতরে বিদায় দিয়েছে।

ইউরোপে ধর্ম ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সংঘর্ষের মূলে ছিল ধর্মযাজকদের নির্বুদ্ধিতা। তারা কোনরূপ বিচার-বিশ্লেষণ না করেই গ্রীসদের পরিত্যক্ত কিছু বৈজ্ঞানিক ধারণাকে ধর্মের অংগীভূত করে উহাকে পবিত্রতার লেবাস পরিয়ে দেয়। ফলে উক্ত ধারণার অস্বীকৃতি ও নিরংকুশ সত্য বা ধর্মের অস্বীকৃতি বলে বিবেচিত হয়। অতপর সুষ্ঠু চিন্তা ও সঠিক গবেষণার মাধ্যমে যখন উক্ত ধারণার ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া হয় তখনও তাদের চৈতন্য উদয় হল না। বরং জ্বলজ্যান্ত ভুলকেও নির্ভুল ও অকাট্য সত্যরূপে গ্রহণ করার বিধান চালু রাখা হয়। এই পরিবেশ গোটা ইউরোপে গীর্জা ও ধর্মযাজকদের মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে ম্লান করে দেয়। ধর্ম ও বিজ্ঞানের এই দ্বন্দ্ব ক্রমেই এক ধ্বংসাত্মক রূপ গ্রহণ করে এবং জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় জুলুম ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া শুরু হয়্ এরপর যখন ধর্মযাজকগণ তাদের ‘খোদায়ী শক্তি’কে অভাবনীয় নিষ্ঠুর পন্থায় ব্যবহার করতে শুরু করে তখন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকল মানুষই ধর্মের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। ধর্মযাজকগণ নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইউরোপবাসীদের সম্মুখে ধর্মের যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে তা ছিল অতিশয় জঘন্য ও বর্বরোচিত। তাদের ধর্ম হয়ে উঠলো এক শক্তিশালী দানব। এই দানবের ভয়ে দিবাভাগে যেমন মানুষ এক মুহূর্তেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারত না। তেমনি রাতের অন্ধকারেও তারা তার খপ্পর থেকে রেহাই পেত না। ধর্মযাজকরা ধর্মের নামে যে অর্থ জনসাধারণের কাছ থেকে আদায় করে তিন তার ফলে তারা কার্যতই তাদের দাসে পরিণত হল। ধর্মযাজকরা নিজেদেরকে এই জমিনের বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি বলে মনে করত এবং তাদের দাবী ছিল: তাদের যে কোন কথা বা উদ্ভট বক্তব্যকে চিরন্তন সত্য বলে অবনত মস্তকে স্বীকার করতে হবে। এ কারণে যে সকল বৈজ্ঞানিক তাদের কোন রায়ের সাথে একমত হতে পারেননি তাদের জন্যে তারা নিষ্ঠুরতম দৈহিক শাস্তির ব্যবস্থা করেছে এবং নামমাত্র খুঁটিনাটি কথার জন্যেও তাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় পড়িয়ে মেরেছে। যে বৈজ্ঞানিক পৃথিবীকে গোলাকার বলে রায় দিয়েছিলেন তার করুণ কাহিনীই এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ।

মোটকথা ধর্মযাজকদের এই নিষ্পেষণ ও অন্যান্য আচরণ ইউরোপের সকল বিবেকবান ও চিন্তাশীল মানুষকে অস্থির করে তুলল। তখন তারা এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, ধর্মনামধারী এই বিরাট দৈত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে; হয় তাকে চিরতরে নির্মূল করে দিতে হবে, নইলে অন্তত পক্ষে এতখানি দুর্বল করে দিতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতে কাউকে কোনদিন নির্যাতন করতে না পারে এবং নিজের ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড দিয়ে একথা প্রমাণ করতে না পারে যে, মিথ্যা ও প্রবঞ্চনার নামই হচ্ছে ধর্ম।

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ইউরোপবাসী ও ধর্মের মধ্যে যে সম্পর্ক মুসলমান ও ইসলামের মধ্যেও কি সেইরূপ সম্পর্ক বর্তমান? যদি না হয়ে থাকে, তাহলে ইসলাম ও বিজ্ঞানের বৈরিতা সম্পর্কে এত হুড়-হাঙ্গামা কেন? বাস্তব সত্য তো এই যে, ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। না আজ পর্যন্ত এমন কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা বলা হয়েছে যা মেনে নিলে ইসলামের কোন সত্য ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে এমন কোন সময় আসেনি যখন বৈজ্ঞানিকগণকে পাশবিক অত্যাচারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের সমগ্র ইতিহাসই আজ আমাদের সামনে বর্তমান। এর বিভিন্ন অধ্যায়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রের বড় বড় পণ্ডিত অতীত হয়েছেন, কিন্তু তাদের এমন একটি ঘটনার কথাও কেউ বলতে পারবে না যে, অমুককে তার বৈজ্ঞানিক রায় বা চিন্তাধারার জন্যে নিগৃহীত করা হয়েছে। এই মুসলিম বিজ্ঞানীদের কেউই ইসলাম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে কোন দূরত্ব বা বৈপরীত্য খুঁজে পাননি। এরূপে মুসলিম শাসকমণ্ডলীও তথাকথিত ধর্মযাজকদের ন্যায় বিজ্ঞানীদের কখনো শত্রু বলে মনে করেনিনি। এবং করেননি বলেই ইসলামের ইতিহাসে না কোন বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, না কাউকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, না কাউকে অন্যরূপ শাস্তি দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এ সত্ত্বেও কিছু লোক ইসলাম ও বিজ্ঞানকে পরস্পর বিরোধী প্রমাণ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। এরা ইসলামের কোন জ্ঞান হাসিল না করেই ইসলামের দোষ-ত্রুটি আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। বস্তুত সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের শিরা-উপশিরায় যে তীব্র হলাহল ঢুকিয়ে দিয়েছে তারই অনিবার্য ফল স্বরূপ এরা এই সমস্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। অথচ এরা কখনো এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে না।

এদের প্রতি লক্ষ্য করে আমি এই বই লিখিনি। কেননা আমার মতে তাদেরকে কিছু বলার সময় এখনো আসেনি। তাদের সঠিক পথে ফিরে আসার জন্যে আমাদের সেই শুভ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে যখন তাদের পশ্চিমা প্রবুরা নাস্তিক্যবাদী সভ্যতা সম্পর্কে হতাশ হয়ে এমন এক জীবন পদ্ধতির জন্যে পাগলপারা হয়ে উঠবে যাতে থাকবে জীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুষ্ঠু সমাধান- যাতে থাকবে দেহ ও মন এবং ঈমান ও আমল সংক্রান্ত যাবতীয় দিকনির্দেশনা। ঠিক তখনই আশা করা যায়, তাদের দেখা-দেখি এই শ্রেণীর শিক্ষিত লোকেরা সঠিক পথ অবলম্বন করবে।

এই বই আমি তাদের জন্যেই লিখেছি যারা আলোকপ্রাপ্ত বিবেকের অধিকারী এবং সত্যিকার নিষ্ঠাবান, যারা একান্ত ধীরস্থিরভাবেই প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধানী। অথচ নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে এবং মিথ্যা প্রচারণা তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী চক্রান্তকারীদের কেউই একথা কামনা করে না যে, এরা ইসলামের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করুক- প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সম্মান ও মর্যাদার অদ্বিতীয় পথ অবলম্বন করুক।

আমি এই শ্রেণীর যুবক বন্ধুদের হাতে এই বইখানি তুলে দিচ্ছি এবং দোয়া করছি এর সাহায্যে ইসলাম সম্বন্ধে তাদের যাবতীয় সন্দেহ ও সংশয় দূরীভূত হোক। আমীন।

-মুহাম্মাদ কুতুব

ইসলাম কি এ যুগে অচল?
আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সাফল্য পাশ্চাত্যের লোকদেরকে এমনভাবে মুগ্ধ করেছে যে, তাদের সকলের মধ্যেই এই মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে যে, বিজ্ঞান ধর্মকে চিরতরেই অচল করে দিয়েছে। উহার কোন কার্যকারিতাই বর্তমান নেই। প্রখ্রাত মনস্তত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের প্রায় সকলেই এই অভিমত পোষণ করেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, ইউরোপের প্রসিদ্ধ মনস্তাত্বিক ফ্রয়েড ধর্মের পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টাকে ব্যাংগ করে লিখেছেন: “মানুষের জীবন স্পষ্ট রূপেই তিনটি মনস্তাত্বিক যুগ অতিক্রম করে এসেছে। কুসংস্কারের যুগ, ধর্মের যুগ এবং বিজ্ঞানের যুগ। এখন চলছে বিজ্ঞানের যুগ। সুতরাং ধর্মীয কথাবার্তার এখন আর কোন গুরুত্ব নেই; উহা বাসী হয়ে গেছে, উহার মর্যাদা ও মূল্য বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই।”

ধর্মবিরোধিতার মূল কারণ

ইতিপূর্বে ভূমিকায় বলা হয়েছে যে, ধর্ম সম্পর্কে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের যাবতীয বিরোধিতার মূল কারণ ছিল ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে তাদের বিরতিহীন সংগ্রাম। এই সংঘর্ষে ধর্মযাজকরা যে কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তাতে এরা যুক্তিসংগত কারণেই ভাবতে শুরু করে যে, ধর্ম হচ্ছে রক্ষণশীলতা, বর্বরতা, উদ্ভট ধ্যান-ধারণা, অর্থহীন চিন্তা-ভাবনা এবং অযৌক্তিক কর্মতৎপরতার সমষ্টি মাত্র। এ কারণেই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হল: ধর্মের জ্ঞানকে চিরতরেই শেষ করে দেয়া হোক এবং তদস্থলে বিজ্ঞানকে অগ্রসর করে দেয়া হোক; তাহলেই বিজ্ঞানের আলোকে মানবতা এবং মানবীয় সভ্যতার উৎকর্ষ ও ক্রমবিকাশের ধারা অব্যাহত থাকার সুযোগ লাভ করবে।

ইউরোপের অন্ধ অনুসরণ

ধর্মের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের শত্রুতার মূল কারণ ছিল ইহাই। কিন্তু মুসলমান নামধারী কিছু সংখ্যক ধর্মবিরোধীদের অবস্থা হল এই যে, না তারা এই বিরোধিতার মূল কারণ বুঝতে সক্ষম, না পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অবস্থা ও পরিবেশের পার্থক্য নির্ণয় করতে সমর্থ। অথচ ধর্মের বিরোধিতা করতে থাকে নিরলসভাবে। তাদেই এই বিরোধিতা কোন গভীর চিন্তা বা বিচার-বিশ্লেষণের ফল নয়, বরং ইউরোপের অন্ধ অনুসরণের বাস্তব ফসল। তাদের নিকট ইউরোপের লোকেরা যে পথ অনুসরণ করছে তা-ই হচ্ছে উন্নতি ও সমৃদ্ধির একমাত্র পথ। – তারা যেহেতু ধর্মের পেছনে ছুটে চ লে না, সেহেতু আমাদেরও কর্তব্য হল ধর্মের অনুসরণ না করা। নইলে লোকেরা আমাদেরকে রক্ষণশীল ও কুসংস্কারপন্থী বলে বিদ্রূপ করতে থাকবে।

দুর্ভাগ্য যে, এরা ভুলে যান যে, ধর্মের সাথে শত্রুতা করার ক্ষেত্র ইউরোপীয় চিন্তাবিদগণ না অতীতে কোন সময়ে একমত ছিলেন, না বর্তমানে একমত রয়েছেন। তাদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিন্তাবিদই নাস্তিক্যবাদী সভ্যতার ঘোর বিরোধী; তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, ধর্ম হল মানুষের এক অপরিহার্য মনস্তাত্বিক ও যৌক্তিক প্রয়োজন।

ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের সাক্ষ্য

ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশারদ মিঃ জেমস জীন্‌স (James Jeans)। একজন নাস্তিক ও সংশয়বাদী যুবক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু স্বী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর সবশেষে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ধর্ম মানবীয় জীবনের একটি অপরিহার্য প্রয়োজন; কেননা আল্লাহর প্রতি ঈমান না এনে বিজ্ঞানের মৌলিক সমস্যাসমূহের সমাধান করা সম্ভবপর নয়। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী জীন্‌স ব্রীজ (Jeans Bridge) ধর্মকে সমর্থন করতে গিয়ে এতদূর অগ্রসর হয়েছেন যে, তিনি জড়বাদ ও আধ্যাত্মিক- তার সংমিশ্রণে বিশ্বাস ও আমলের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি রচনা কালে প্রাণ খোলাভাবেই ইসলামের প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমারসেট মম (Somerset Maugham) ধর্ম সম্বন্ধে আধুনিক ইইরোপের নেতিবাচক ভূমিকা বলেন:

“ইউরোপ একজন নতুন খোদা-বিজ্ঞান-সৃষ্টি করেছে এবং পুরানো খোদা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।”

ইউরোপের নতুন খোদা

কিন্তু ইউরোপের এই নতুন খোদা এক চরম পর্যায়ে বহুরূপী। প্রতি মুহূর্তেই এর রূপকে পাল্টে দেয়া হচ্ছে। এর বক্তব্য ও ভূমিকা এক অব্যাহত পরিবর্তনের নির্মম শিকার। এই খোদা আজ যে বিষয়টিকে বলছে চরম সত্য, কাল আবার সেই বিষয়টিকেই বলছে নির্ভেজাল মিথ্যা, স্পষ্ট ধোঁকা বা সম্পূর্ণরূপেই বাতিল। পরিবর্তনের এই চক্র এমনিই চলছে, উহা কখনো বন্ধ হচ্ছে না। ফলে উহার পুঁজারী ও উপাসকদের উদ্বেগ ও অস্থিরতাও হর-হামেশাই চলছে। এই প্রকার বহুরূপী ও সদা পরিবর্তনশীল খোদার নিকট তারা কি-ই বা আশা করতে পারে? আধুনিক পাশ্চাত্য জগতের উপর আজ যে উৎকণ্ঠার মেঘ পুঞ্জিভূত হয়ে উঠেছে এবং যে নানাবিধ মনস্তাত্বিক ও স্নায়ু যুদ্ধে (Cold War) তারা জড়িয়ে পড়ছে তা তাদের আভ্যন্তরীণ মরণ ব্যধির প্রকাশ্য নিদর্শন ব্যতীত অন্য কিছুই নয়।

বিজ্ঞানের নতুন জগত

বিজ্ঞানকে খোদার আসনে বসিয়ে দেয়ার কারণে আরেকটি ফল হয়েছে এই যে, আমরা-আপনারা যে জগতে বসবাস করছি তা আজ সম্পূর্ণরূপেই অসার ও লক্ষ্যহীন বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। তার না আছে কোন মহৎ উদ্দেশ্য, না আছে কোন স্পষ্ট ব্যবস্থাপনা; সর্বোপরি এমন কোন স্বত্তা বা শক্তিও বর্তমান নেই যা তাকে পথপ্রদর্শন করতে সক্ষম। তার উপর চলছে শুধু পরস্পর বিরোধী শক্তিসমূহের বিরতিহীন দ্বন্দ্ব। তার প্রতিটি বিষয়ই রদবদলের শিকার। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাই হোক, সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কই হোক- এর প্রতিটি জিনিসই বদলে যায়, এমনকি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। একথা সুস্পষ্ট যে, এই অন্ধকার ও ভয়ানক জগতের মানুষ স্থায়ী উৎকণ্ঢা ও অস্থিরতা ছাড়া কিছুই লাভ করতে পারছে না। বিশেষ করে যখন তার পরিমণ্ডলে সর্বোচ্চ কোন স্বত্তার সাথে তার কোন পরিচয় থাকে না তখন ভয়ানক মসিবতের দিনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে এমন কেউ থাকে না যার আঁচলে সে আশ্রয় নিতে পারে- যার সান্ত্বনায় সে নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারে।

শান্তির একমাত্র পথ

ধর্ম এবং কেবলমাত্র ধর্মই মানুষকে তার হারানো শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিতে পারে। উহা মানুষের অন্তরে সততার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়ে অন্যায় ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে তোলে; উহা তাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়: ‘যদি সত্যিকার অর্থেই স্বীয় রব এবং প্রকৃত প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাও তাহলে তোমাকে বাতিলের দাপট ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মূর্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে হবে এবং গোটা বিশ্বে কেবল তোমার প্রভুর হুকুমতই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; এই পথে যত অন্তরায় ও বিপদ আসুক না কেন ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তার মোকাবেলা করতে হবে। আর এ জন্যে শুধু আখেরাতের পুরস্কারের প্রতিই লক্ষ্য রাখতে হবে। তাহলে আজকের দুনিয়ার জন্যে শান্তি ও নিরাপত্তার- অন্য কথায়- ধর্মের প্রয়োজন নেই কি?

ধর্মকে বাদ দিলে

ধর্মকে বাদ দিলে জীবনের অর্থ বা সারবত্তা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ধর্মের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, এই বিশ্বাসের ফলে মানুষের জীবনে নিত্য-নতুন অবকাশের পরশ লেগে যায় এবং আর সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার দিগন্তও উন্মোচিত হয়। নইলে সে হীনমন্যতার (Inferiosity Complex) যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির নির্মম শিকারে পরিণত হয়। পারলৌকিক জীবনকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে: মানুষের সমগ্র আয়ুর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে সম্পূর্ণরূপেই বাদ দেয়া এবং উহাকে অন্ধ প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনার হাত ছেড়ে দেয়া। এর ফলে মানুষ প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজেই সম্পূর্ণরূপে মশগুল হয়ে যায়। তখন তার যাবতীয় কর্মতৎপরতার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়: আরামে-আয়েশের যত উপায় উপাদান হস্তগত করা তার পক্ষে সম্ভবপর তার সবটুকুই সে করবে, আর এ ক্ষেত্রে কেউ তার সাথে ভাগ বসাক তা সে কখনো বরদাস্ত করবে না। বস্তুত এখান থেকেই যাবতীয় শত্রুতা ও পাশবিক সংঘর্ষের সূচনা হয়। কেননা যারা প্রবৃত্তির দাস তারা এই দুনিয়ার ভালো-মন্দ যে কোন বাধাকেই অপসারিত করার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠে এবং অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে অধিক হতে অধিকতর স্বার্থ হাসিলের জন্যে অস্থির হয়ে যায়। তার মনে কোন উপরস্থ স্বত্তার ভীতি বলতে কিছুই বর্তমান থাকে না। কেননা পূর্ব থেকেই সে বিশ্বাস করে যে, এই পৃথিবীর কোন খোদাও নেই এবং বিচার করে শাস্তি বা পুরস্কার দেয়ার কোন ব্যবস্থাপনাও নেই।

সংকীর্ণ দৃষ্টি ও নিরুৎসাহিতা

পরকাল অস্বীকার করার কারণে মানুষ তার আশা-আকাংখা ও চিন্তা-ভাবনার নিম্নতম স্তরে নেমে যায়। তার যাবতীয় ধ্যান-ধারণার উৎকর্ষ ও ক্রমোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়- তার লক্ষ্য ও কর্মপন্থা সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়। গোটা মানবতাই চিরন্তন গৃহযুদ্ধের এক আখড়ায় পরিণত হয়। এমনি করে তার হাতে এতটুকুও সময় থাকে না যে, জীবনের কোন মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। এই নতুন জগতের স্নেহ-মমতা সহানুভূতি বা সৌহার্দ্যের কোন স্থান থাকে না; বস্তুগত আরাম-আয়েশের সন্ধান এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার নেশা এ সকল কথা চিন্তা করারই অবকাশ দেয় না। এবং দেয় না বলেই জীবনের উচ্চতর মূল্যবোধ এবং মহত্তসূচক আশা-আকাংখার প্রতি সে শ্রদ্ধাশীল হতে পারে না।

জড়বাদিতার কুফল

একথা নিশ্চিত যে, জড়বাদী মানুষ বস্তুগত উপকারও লাভ করে থাকে, কিন্তু জড়বাদ (Materialism) এমন এক অভিশাপ যে, উহার কারণে এই বস্তুগত উপকারটুকুও বিনষ্ট হয়ে যায়। মানুষ এই বস্তুগত ভোগ-বিলাসে এতদূর অন্ধ হয়ে যায় যে, বিনা কারণে অন্যান্য মানুষের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রবৃত্তির লোভ-লালসা এবং ঘৃণা ও অবজ্ঞার প্রবল সয়লাবকে বিন্দুমাত্রও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না- উহার দুর্বার গ্রাস থেকে নিজেকে কখনো মুক্তও করতে পারে না। যে সকল জাতি এই জড়বাদকে অনুসরণ করছে তারা এক সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব ও গৃহবিবাদের করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে তাদের জীবনের সকল প্রকার ব্যবস্থাপনা ও রূপ কাঠামো চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কৃত মারণাস্ত্রগুলো মানবজাতিকে শান্তি দেয়ার পরিবর্তে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সংকীর্ণতার প্রতিকার

জড়বাদ মানুষের সংকীর্ণ দৃষ্টিরই একটি দিকমাত্র। উহার কুফল থেকে বাঁচতে হলে মানবিক চিন্তার দিগন্তকে আরো প্রসারিত করতে হবে। কিন্তু এই লক্ষ্য একমাত্র ধর্মের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। একমাত্র ধর্মই মানুষকে নতুন সম্ভাবনা ও মহৎ চিন্তা-ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারে। কেননা ধর্মের দৃষ্টিতে জীবন শুধু এই জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং উহার পরেও অনন্তকাল পর্যন্ত এই জীবন চলবে। – এই বিশ্বাস মানুষের মনে আশা-আকাংখার নতুন আলো প্রজ্জলিত করে রাখে; তাকে অন্যায়, অনাচার, জুলুম ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ যুদ্ধ করার প্রেরণা যোগায় এবং তাকে জানিয়ে দেয়: পৃথিবীর সকল মানুষই তার ভাই। স্নেহ-মমতা, পারস্পরিক সহানুভূতি ও সমবেদনা এবং বিশ্বজনীন এই ভ্রাতৃত্বের শিক্ষাই মানুষকে শান্তি, নিরাপত্তা, স্বস্তি ও উৎকর্ষতা প্রদান করতে সক্ষম। এই সকল সত্যের বিপক্ষে কে এমন উক্তি করতে পারে যে, মানুষের ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই? অথবা শত শত বছর পূর্বে ধর্মের যেমন প্রয়োজন ছিল এ যুগে তেমন প্রয়োজন নেই? বস্তুত একটি সর্বাংগ সুন্দর জীবনের জন্যে ধর্ম মানুষকে যেভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম তেমনিভাগে গড়ে তোলা পৃথিবীর অন্য কোন শক্তির পক্ষে সম্ভবপর নয়।

আলোক স্তম্ভ

ধর্ম মানুষকে নিজের জন্যে বাঁচার স্থলে অন্যের জন্য বাঁচতে শিক্ষা দেয়, তার সম্মুখে একটি মহান ও পবিত্র লক্ষ্য উপস্থাপিত করে এবং সেই লক্ষ্য হাসিল করার জন্যে যে কোন দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদকে হাসিমুখে বরণ করতে শেখায়। মানুষ যদি ধর্ম প্রদত্ত এই ঈমান ও নিশ্চিত বিশ্বাস থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় তাহলে সে নিজের ব্যক্তি সত্তা ছাড়া অন্য কারুর প্রতি দৃষ্টি দিতে পারে না। ফলে তার সমগ্র জীবনই জঘন্য স্বার্থপরতার এক এলবামে পরিণত হয়। তখন তার ও হিংস্র পশুর মধ্যে বিন্দুমাত্রও পার্থক্য থাকে না। ইতিহাসে এমন অসংখ্য মানুষ অতীত হয়েছেন যারা সত্যের জন্যে সংগ্রাম করেছেন এবং নিজেদের জানও কুরবান করেছেন। অথচ তাদের এই কুরবানী ও সংগ্রামের সুফল তারা দুনিয়াতে লাভ করতে পারেননি। তাই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেন তারা এমন এক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেছেন যার ফলস্বরূপ দুনিয়াতে তো তারা কোন বস্তুগত সুবিধা ভোগ করতে পারেননি, বরং আগে থেকে তাদের নিকট যে ধন-সম্পদ বর্তমান ছিল তাও তারা হারাতে বাধ্য হয়েছেন? এর উত্তর কেবল একটিই এবং তাহলো ‘ঈমান’। এই সকল মহৎ ব্যক্তিদের অস্তিত্ব ঈমানের সামান্যতম ঝলক মাত্র। পক্ষান্তরে লোভ-লালসা, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, হীনতা-স্বার্থপরতা, ঘৃণা-অবজ্ঞা ইত্যাদি এমন নিকৃষ্ট স্বভাব যে, উহার মাধ্যমে সত্যিকার ও স্থায়ী সাফল্য অর্জিত হতে পারে না। উহার চাকচিক্য একান্তই বাহ্যিক ও অস্থায়ী। উহার সাহায্যে মানুষ শুধু নগদ কিছু পাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠে। ফলে কোন মহান বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তার মাধ্যমে সাধিত হয় না। এবং সে জীবনের লক্ষ্য অর্জনের জন্যে পার্থিব স্বার্থের কথা চিন্তা না করে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে দীর্ঘকাল ধরে প্রাণপণ জিহাদ করার শক্তিও অর্জন করতে পারে না।

ঘৃণার উপাসক

কিছু সংখ্যক নামকরা সংস্কারবাদী ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পক্ষপাতী। ঘৃণাই তাদের সবকিছু। ঘৃণাই তাদের শক্তি ও পুষ্টি আহরণের কেন্দ্রবিন্দু। এবং উহার আশ্রয় নিয়েই যাবতীয দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদ-আপদের সময়ে সাহস ও দৃঢ়তার সাথে তাদের সংস্কার-অভিযান অব্যাহত রাখেন। এই ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু কখনো হয় কোন বিশেষ দল, কখনো হয় বিশ্বের সকল মানুষ, আবার কখনো হয় বিশ্ব ইতিহাসের কোন বিশেষ যুগের মানুষ। মানবতা বিমুখ সংস্কারবাদীদের এই দলটি বাহ্যত কিছু উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করেন। চরম উত্তেজনা, নির্দয় ব্যবহার ও অগ্নিমূর্তি দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ শিকারের আশায় দৃঢ়পদ থাকার মহড়াও দেখাতে পারেন এবং নানাবিধ প্রবঞ্চনাও মেনে নিতে পারেন। কিন্তু যে বিশ্বাসের ভিত্তিমূল হচ্ছে ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা তার সাহায্যে মানবতার কোন কল্যাণ হতে পারে না। তার মাধ্যমে সমাজের কিছু প্রচলিত অন্যায় ও বে-ইনসাফী বন্ধ হতে পারে, কিন্তু মানবতা বিধ্বংসী এই সকল কর্মকাণ্ডের স্থায়ী ও অব্যর্থ চিকিৎসা তাতে বর্তমান নেই। এ কারণেই সমাজের অন্যায়-সুবিচার দূর করার নামে যে সংস্কারমূলক পন্থা-পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে তাতে করে উহার নিয়ন্ত্রিত বা কমে যাওয়ার পরিবর্তে বহু গুণে বেড়েই চলেছে। তাই কবির ভাষায় বলা যায়:

“ঔষধ বাড়ছে যত রোগ বাড়ছে তত।”

আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক

পক্ষান্তরে যে বিশ্বাসের আশু বস্তুগত লাভের কামনা করা হয় না, নিছক ঘৃণা ও শত্রুতার সাথেও যার কোন সম্পর্ক নেই এবং যা মানুষের অন্তরে প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা, ত্যাগ ও পরার্থপরতা-এমনকি সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণের উদ্দেশ্যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করার দুর্বার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে, প্রকৃতপক্ষে সেই বিশ্বাসী মানুষকে সত্যিকার ও স্থায়ী নেয়ামত দ্বারা সৌভাগ্যশালী করতে পারে এবং ভবিষ্যতের সুখী ও সমুন্নত জীবনের নিশ্চয়তা দিতেও সক্ষম। এই বিশ্বাসের মৌল উপাদান হল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবংতার অকৃত্রিম ভালোবাসা। উহা ব্যক্তিগত জীবনকে পবিত্র করে তোলে এবং প্রত্যেকটি মানুষকে তার নৈকট্যলাভের সুযোগ দেয়। কিন্তু আখেরাতের প্রতি আস্থা না থাকলে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তাকে ভালোবাসার কোন অর্থই থাকে না। আখেরাতের ধারণা মানুষকে নিশ্চয়তা দেয়। ফলে তার এই অটল বিশ্বাস জন্মে যায় যে, দৈহিক মৃত্যুর সাথে সাথে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে না, তার পার্থিব জীবনের বিরতিহীন জিহাদও নিষ্ফল হয়ে যায় না। বরং ইহলৌকিক জীবনে কোন পুরস্কার না পেলেও পরবর্তী পরলৌকিক জীবনে তা সে অবশ্যই লাভ করবে।

এই অকল্পনীয় ফল কেবল আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের কারণেই লাভ হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলাম শুধু এতটুকু করেই ক্ষান্ত হয় না, উহা মানুষকে আরো অনেক কিছু দান করে, সে কথা এর চেয়েও সুন্দর ও আকর্ষণীয়।

ইসলাম সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা

যারা ইসলামকে একটি অতীত কাহিনী বলে মনে করে এবং বর্তমান যুগে উহার প্রয়োজন ও কার্যকারিতাকে সম্পূর্ণরূপেই অস্বীকার করে তারা মূল ইসলামের প্রকৃত মর্ম সম্পর্কেই অজ্ঞ এবং উহার মূল মিশন ও লক্ষ্য কি তাও অবগত নয়। শৈশব থেকে সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টরা পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে তাদেরকে যা কিছু শিখিয়েছে সেই পঠিত বিষয়কেই তারা বারবার উচ্চারণ করে চলেছে। তাদের ধারণায়, ইসলাম আগমনের একমাত্র লক্ষ্য হল মানুষকে মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করা ও আরব গোত্রগুলোর পারস্পরিক শত্রুতাকে নির্মূল করে তাদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা, তাদেরকে মদ্য পান, জুয়া, কন্যা হত্যা এবং এই ধরনের নীতি বিগর্হিত কাজ থেকে রক্ষা করা। কার্যত ইসলাম আরবদের পারস্পরিক গৃহযুদ্ধকে বন্ধ করে তাদের শক্তিকে বিনষ্ট হতে দেয়নি এবং সেই শক্তিকে সমগ্র দুনিয়ায় স্বীয় পয়গামকে প্রচার করার কাজে ব্যবহার করেছে। মুসলমানদের এই উদ্দেশ্যে বহু জাতির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ফলে বর্তমান সীমারেখার মধ্যে বিশ্বের মানচিত্রে এক বিরাট ভূখণ্ডে একটি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ ছিল এক ঐতিহাসিক মিশন। ইহা এখন পূর্ণাংগ রূপ পরিগ্রহ করেছে; দুনিয়া থেকে মূর্তিপূজা বিদায় নিয়েছে, আরব গোত্রগুলো এখন বড় বড় জাতিতে পরিণত হয়েছে। তাই এখন ইসলামের আর প্রয়োজন নেই, জুয়া ও মদ্য পানের যে ব্যাপারটুকু রয়েছে বর্তমান কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যুগে তার উপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না। মোটকথা, তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম এক বিশেষ যুগের জন্যেই একটি উপযুক্ত জীবনব্যবস্থা হিসেবে কার্যকর ছিল, কিন্তু দুনিয়া আজ এতদূর এগিয়ে গেছে যে, উহার নিকট থেকে দিকনির্দেশনা নেয়ার আর কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। এ কারণে দিক-নির্দেশনা কিংবা আলো গ্রহণের জন্যে আমাদের উহার প্রতি তাকাবার কোন আবশ্যকতা নেই; বরং আধুনিক মতাদর্শ ও জীবনদর্শন থেকে দিক নির্দেশনা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। এর মধ্যেই মুক্তি ও কল্যাণ নিহিত।

পাশ্চাত্যের ও প্রাচ্যের শিষ্যগণ উস্তাদের মুখস্থ করানো কথাগুলোকে বারবার উচ্চারণ করে একান্ত অজ্ঞতসারে নিজেদের অদূরদর্শিতা ও মূর্খতাকে ফঅঁ করে দিচ্ছে। এই হতভাগারা না ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, না তারা জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এ ক ারণে আরো অগ্রসর হওয়ার পূর্বে ইসলামের মর্ম এবং উহার দাওয়াত ও পয়গাম সম্বন্ধে আলোচনা করা প্রয়োজন।

ইসলামের বৈপ্লবিক মর্ম

এক বাক্যেই একথা বলা যায় যে, মানবতার উৎকর্ষতার পথে অন্তরায় হতে পারে এবং সততা ও কল্যাণের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে এরূপ সবকিছুর দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করাই হচ্ছে ইসলাম। যে অন্যায়-উৎপীড়ন ও বল্গাহীন স্বৈরাচারী শক্তি মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-সম্ভ্রম ও আত্মপ্রত্যয়কে লুণ্ঠন করে নেয় তা থেকে আজাদী হাসিল করাই ইসলাম। ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয়; আল্লাহ এবং একমাত্র আল্লাহই যাবতীয প্রশাসনিক ক্ষমতার একমাত্র মালিক; তিনিই মানুষের প্রকৃত হুকুমদাতা। নিখিল জাহানের সমস্ত মানুষই তার জন্মগত প্রজা, তিনিই মানুষের তকদিরের মালিক; তার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কেউ কারুর উপকার করতে পারে না কিংবা দুঃখ-দুর্দশাও দূর করতে পারে না। কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ের সকল মানুষকে তার দরবারে একত্র করা হবে এবং তিনি প্রতিটি ব্যক্তির সারা জীবনের কার্যকলাপের হিসাব গ্রহণ করবেন। -ইসলামের এই শিক্ষা মানুষকে ভয়-ভীতি জুলুম-নিপীড়ন, অত্যাচার-অবিচার এবং শোষণ-লুণ্ঠন থেকে মুক্তিদান করে।

প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি

এখানেই শেষ নয়, ইসলাম আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে রিপুর দাসত্ব থেকেও মানুষকে মুক্ত করে দেয়; এমনকি জীবনের মায়া থেকেও মানুষকে নিস্পৃহ ও উদাসীন করে দেয়। বস্তুত জীবনের মায়া এমন এক মানবীয দুর্বলতা যে, উহার কারণেই স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে থাকে এবং অন্য মানুষকে তাদের গোলাম ও দাসানুদাস বানাতে থাকে। মানুষের মধ্যে যদি এই দুর্বলতা না থাকত তাহলে কখনো সে অন্যের দাসত্ব করতে রাজী হতো না এবং স্বৈরাচারী দানবকে ইবলীসী নর্তন-কুর্দন দখাবারও সুযোগ দিত না। স্বৈরাচার (Dictatorship) ও অন্যান্য উৎপীড়নের বিরুদ্ধে মস্তক অবনত করার পরিবর্তে দুর্বার সাহস ও বীর বিক্রমে উহার মোকাবেলা করার শিক্ষা দিয়ে ইসলাম মানুষকে মহাকল্যাণের পথে পরিচালিত করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

(আরবী**************)

“হে নবী! আপনি বলে দিন: যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের সেই ব্যবসায়- যা মন্দা পড়ার ভয়ে তোমরা ভীত এবং তোমাদের সেই বাসস্থল- যা নিয়ে তোমরা সন্তুষ্ট –তোমাদের নিকট আল্লাহ ও তাঁর রসূল এবং তাঁর পথে জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয় তাহলে অপেক্ষা করতে থাক যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা নিয়ে তোমাদের নিকট আসেন। আর আল্লাহ অন্যায়কারী লোকদেরকে পথপ্রদর্শন করেন না।” –(সূরা আত তাওবা: ২৪)

জীবনের মূল শক্তি

সম্প্রীতি, সৌহার্দ, নিষ্টা, সততা এবং জীবনের মহান ও পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্যে আল্লাহর পথে জিহাদ এবং যাবতীয় লোভ-লালসার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে উহাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে যে সাধনার প্রয়োজন তার মূলে একমাত্র কার্যকরী শক্তি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। ইসলাম এই ভালোবাস বৃদ্ধির শিক্ষাই মানুষকে দান করে। এর সাহায্যে মানুষ বল্গাহীন কামনা-বাসনাকে সংযত রাখতে সক্ষম হয় এবং গোটা জীবনে কেবলমাত্র আল্লাহর ভালোবাসাকে পরম ও চরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতঃ উহাকেই অব্যর্থ শক্তি হিসেবে দেখতে চায়। যে ব্যক্তি এই মহান সম্পদ থেকে বঞ্চিত সে মুসলমানই হতে পারে না।

দুনিয়ার উপাসকদের ভুল ধারণা

হতে পারে, লোভ-লালসা বা কুপ্রবৃত্তির অনুসারীদের কেউ স্বীয় অদূরদর্শিতার কারণে এরূপ ভাবতে পারে যে, অন্য লোকদের তুলনায় তার জীবন অধিকতর সফল এবং সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরপুর। কিন্তু অনতিবিলম্বেই তাকে এই সংকীর্ণতার শাস্তি ভোগ করতে হয়; যখন তার আলস্যের স্বপ্ন ভেংগে যায় তখনই সে দেখতে পায় যে, সে কুপ্রবৃত্তির গোলাম ছাড়া আর কিছুই নয়; তার অদৃষ্টে প্রবঞ্চনা, দুর্ভাগ্য, অস্থিরতা এবং ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়; তার অদৃষ্টে প্রবঞ্চনা, দুর্ভাগ্য, অস্থিরতা এবং ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নেই। কেননা মানুষ একবার যদি তার প্রবৃত্তির হাতে আত্মসমর্পণ করে তাহলে পুনরায় আর কোনদিন সে উহাকে কাবুল করতে পারে না। কেননা যতই সে পেতে থাকে ততই তার লোভও বাড়তে থাকে। এমনি করে মানুষ পশুত্বের সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যায় এবং আনন্দ ও ভোগ-বিলাসের সাগরে এমনভাবে ডুবে যায় যে, অন্য কিছুর হুঁশ বলতে কিছুই থাকে না। অনস্বীকার্য যে, মানবীয় জীবন এবং উহার বহুমুখী সমস্যা সম্পর্কে এই গতিবিধি বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক উন্নতির ক্ষেত্রে কোন অবদান রাখতে পারে না। কেননা বস্তুগত বা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে সর্বপ্রথম শর্তে হচ্ছে প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করা। এই শর্ত পালিত হলেই বিজ্ঞান, কলা ও ধর্মীয় জগতে উন্নতি করা সম্ভব।

দুনিয়া সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিকোণ

ইসলাম প্রবৃত্তির দাসত্ব পরিহার করার জন্যে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করলেও এ জন্যে তার অনুসারীদেরকে একদিকে যেমন বৈরাগ্য অবলম্বন করার অনুমতি দেয় না, তেমনি অন্যদিকে পবিত্র ও নির্দোষ দ্রব্যাদি থেকে উপকৃত হতেও নিষেধ খরে না। উহা এই দুই চরম অবস্থা পরিত্যাগ করে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করার জন্যে নির্দেশ দেয়। উহার দৃষ্টিতে এই দুনিয়ায় যা কিছু পাওয়া যায় তার সমস্তই কেবল মানুষের উপকারের জন্যে ‍সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম মানুষকে জানিয়ে দেয় : “জগত তোমার জন্যে, তুমি জগতের জন্যে নও।” এ কারণেই উহার নিছক আনন্দ উপভোগ ও প্রবৃত্তির দাসত্বকে মানুষের মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। দুনিয়ার এই দ্রব্যসামগ্রী মানুষকে কেবল এ জন্যে দেয়া হয়েছে যে, মানুষ যেন এর সাহায্যে তার মহান লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষের জীবনের লক্ষ্য হল আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা। আর মানবতাকে পূর্ণতা দান করার জন্য এই হল একমাত্র পথ।

ইসলামের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য

জীবনে ইসলামের দৃষ্টিতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় উদ্দেশ্য রয়েছে। ব্যক্তি জীবনের পরিমণ্ডলে উহা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য এত পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী ও উপায়-উপাদানের ব্যবস্থা করতে চায় যাতে করে সে একটি সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপন করতে সমর্থ হয়। আর সমষ্টিগত জীবনের অংগন উহার লক্ষ্য হলো: এমন একটি সমাজ গড়ে উঠুক যার যাবতীয় শক্তিই মানুষের সামগ্রিক উন্নতি ও কল্যাণের জন্য ব্যয়িত হতে পারে, ইসলামী জীবন দর্শনের আলোকে যেন গোটা মানব সভ্যতার অগ্রসর হতে পারে এবং ব্যষ্টি ও সমষ্টি –তথা ব্যক্তি ও সমাজের ভারসাম্য যেন এমনভাবে সংরক্ষিত হয় যাতে করে কারুর প্রাপ্য ও অধিকার কখনো ভুলুণ্ঠিত না হয়।

মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা

ইসলাম মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দান করে একটি কার্যকর শক্তির ব্যবস্থা করেছে। উহা নিছক খেয়াল-খুশী ও কুসংস্কারমূল চিন্তাধারাকে কখনো সমর্থন করে না। ইতিহাসে চিন্তা ও আমলের যে বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতার কারণে মানুষ যুগে যুগে হাবুডুবু খেয়েছে তার মধ্যে কতক ছিল মানুষের উদ্ভট চিন্তার বাস্তব ফসল। নিজ নিজ যুগের এই পরিস্থিতির কথা মানুষ অবশ্যই জানত। কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্তির ধারায় এমন কিছু কথাও বর্তমান ছিল যার কুষ্টিনামায তাদের মনগড়া দেবদেবীর নির্বুদ্ধিতামূল কার্যকলাপের স্পষ্ট সন্ধান পাওয়া যায়। মোটকথা, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে মানুষের চিন্তা এক বিভ্রান্তির অন্ধকারে আঘাতের উপর আঘাত খেয়ে চলছিল। ইসলাম এসে উহাকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে পূর্ণতা ও পরিপক্কতা দান করে এবং সেই সকল উদ্ভট ধারণা ও কুহেলিকা থেকে উহাকে আজাদ করে দেয় যা তাদের মনগড়া দেবদেবীর কল্প-কাহিনী, ইসরাঈলী ও খৃষ্টীয় কাহিনীর অপরিপক্ক ভূঁৎয়া দর্শন ও অলীক চিন্তাধারা সারা দুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলাম এরূপে গোটা মানবজাতিকে তাদের প্রকৃত দ্বীন ও প্রকৃত প্রভুর সমীপে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেয়।

ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব

ইসলামের আকেরটি বৈশিষ্ট্য হলো উহার বক্তব্য ও শিক্ষা অত্যন্ত সহজ ও সরল। জটিলতা বা প্যাঁচ বলতে উহাতে কিছুই নেই। উহাকে হৃদয়ঙ্গম করা যেমন সহজ, তেমনি সহজ উহাকে নিশ্চিত সত্য বলে বিশ্বাস করা। ইসলাম চায়: মানুষকে যে যোগ্যতা দান করা হয়েছে তারা তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তাদের পারিপার্শিক জীবন ও জগত সম্পর্কে অধিক হতে অধিকতর জ্ঞান লাভ করুক এবং তাদের চতুর্দিকের আসমান-জমিনের রহস্যও উন্মোচন করুক। কেননা ইসলাম মানবীয় জ্ঞান ও ধর্ম- তথা বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে অযৌক্তিক সমঝোতা এবং মৌল উপাদানগত বৈপরীত্যকে কখনো স্বীকার করে না। খৃষ্ট ধর্মের ন্যায় উহা মানুষকে দুর্বোধ্য জ্ঞান, গোলমেলে বিশ্বাস এবং অযৌক্তিক দর্শনের উপর ঈমান আনার জন্যে বাধ্য করে না। এবং ঐ সকল বিষয়ের প্রতি ঈমান আনাকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্যে অপরিহার্য শর্ত বলে ঘোষণা দেয় না। এবং আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করা ছাড়া যে সকল বৈজ্ঞানিক সত্যকে (Facts) সমর্থন করা যায় না তা মেনে নেয়ার জন্যেও উহা মানুষকে কখনো হুকুম দেয় না। এখানেই শেষ নয়, ইসলাম মানুষকে পরিষ্কার-ভাবে জানিয়ে দেয়: এই পৃথিবীতে যে সকল দ্রব্যসামগ্রী মানুষ লাভ করছে এবং প্রতাশ্য ও অপ্রকাশ্য যে সকল শক্তি দিবারাত মানুষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে তার সবকিছুই পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ও অযাচিত স্নেহের উপহার ছাড়া অন্য কিছুই নয়। ‍সুতরাং বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও অনুসন্ধান চালিয়ে মানুষ যে নতুন নতুন সম্পদ আবিষ্কার করছে তাও প্রকৃত প্রস্তাবে সেই দয়ালূ প্রবুর অপরিমেয় স্নেহের এক বহিঃপ্রকাশ। এ কারণে তাদের অবশ্য কর্তব্য হলো, তারা তার কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে থাকবে এবং অধিক হতে অধিকতর প্রস্তুতি, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সাথে তার দাসত্ব করবে। ইসলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে মন্দ, ঈমানের বরখেলাফ বা বিরোধী বলে মনে করে না। বরং উহাকে আল্লাহর প্রতি ঈমানের অপরিহার্য অংগ বলে মনে করে।

ইসলামের প্রয়োজনীয়তা

যে সমস্যাগুলোর কথা এতক্ষণ আলোচনা করা হলো উহার সমাধানের জন্যে মানুষ এখনো ব্যস্ত রয়েছে। মানুষের উচ্চ আশা ও মহান উদ্দেশ্য এখনো অর্জিত হয়নি। এখনো মানুষ নানাবিধ নির্বুদ্ধিতা ও প্রবঞ্চনার শিকার। উশৃংখল ও স্বৈরাচারী শাসন এখনো পুরোদমে চলছে। উহার নির্মম নিষ্পেষণে মানুষ এখনো ধুকে দুকে মরছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানবতার উপর পশুত্বের রাজত্ব চলছে। তাহলে একথা অস্বীকার করা যায় কি যে দুনিয়ার জন্যে এখন ইসলামের অপরিহার্য প্রয়োজন? –মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্যে এখনই ইসলামকে তার ভাস্বর ভূমিকায় অগ্রসর হতে হবে?

মূর্তিপূজার অভিশাপ

আজ দুনিয়ার অর্ধেক লোকই প্রাচীন যুগের লোকদের ন্যায় মূর্তিপূজার অভিশাপে আক্রান্ত। ভারত, চীন এবং দুনিয়ার আরো কয়েকটি দেশকে এর দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়। অবশিষ্ট দুনিয়ার অধিকাংশ জনপদ অন্য এক বাতিল স্বরূপ উল্লেখ করা যায়। অবশিষ্ট দুনিয়ার অধিকাংশ জনপদ অন্য এক বাতিল খোদার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই বাতিল খোদা মানবীয় চিন্তা ও ধ্যান-ধারণাকে প্রাচীন যুগের মূর্তিপূজার চেয়ে কোন অংশেই কম বিকৃত করে দেয়নি। আজকের মানুষকে সহজ-সরল পথ থেকে বিচ্যূত করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অপরিসীম। আজকালকার পরিভাষায় এই বাতিল খোদার নাম হচ্ছে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’।

পাশ্চাত্যের লোকদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগি

সৃষ্টিজগতের রহস্য অবগত হওয়ার মাধ্যম হিসেবে বিজ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে উহার কীর্তিসমূহের তালিকাও বড় বিস্ময়কর। কিন্তু পাশ্চাত্যের লোকেরা যখন উহাকে খোদার আসনে বসিয়ে দিয়েছ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্যের একমাত্র কেন্দ্রে পরিণত করেছে তখন উহার যাবতীয সাফল্য ও কৃতিত্ব অভাবনীয় অনুতাপ ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। পাশ্চাত্যের লোকদের এই দুঃখজনক ‍ভুলের পরিণতি এই হয়েছে যে, তারা পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা নির্ভর বিজ্ঞানের (Empirical Science) অভিজ্ঞতা ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সীমাবদ্ধ মাধ্যম ছাড়া অন্যান্য জ্ঞানলাভের মাধ্যম থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করে ফেলেছে। ফলে মানবতা আজ মঞ্জিলে মকসুদের নিকটবর্তী হওয়ার পরিবর্তে অধিকতর দূরে সরে গেছে। মানুষের সামনে উৎকর্ষ ও প্রচেষ্টার যে অপরিসীম সম্ভাবনা বর্তমান ছিল তা পাশ্চাত্যের লোকদের সংকীর্ণ দৃষ্টি ও জড়বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে রহিত হয়ে গেছে। কেননা যে বিজ্ঞান কেবল যুক্তির পাখায় ভর করে চলে তা মানবতার গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। উহা যুক্তি ও রূহ উভয়ের সাহায্যই গ্রহণ করে থাকে এবং যখন এরূপ গ্রহণ করবে কেবল তখনই স্রষ্টার নৈকট্য এবং তার সৃষ্ট সবকিছুর মূল স্বরূপ উদঘাটন করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

বিজ্ঞানের উপর সীমাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ

বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদারা একথাও বলে থাকে যে, কেবলমাত্র বিজ্ঞানই মানুষের জীবন ‍ও সৃষ্টিজগতের যাবতীয রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম। এ কারণে বিজ্ঞান যা সমর্থন করবে একমাত্র তাকেই প্রকৃত সত্য বলে গ্রহণ রতে হবে। অন্যান্য সবকিছুকে একান্তই বাজে ও অর্থহীন বলে সাব্যস্ত করতে হবে। অথচ আবেগের বশবর্তী হয়ে তারা ভুলে যায় যে, বহু বিস্ময়কর আবিষ্কার সত্ত্বেও বিজ্ঞান এখনও উহার প্রাথমিক যুগ অতিক্রম করতে পারেনি। এখনো এমন অসংখ্য বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে বিজ্ঞানের তথ্যাদি অসম্পূর্ণ এবং আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা সে সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আওতাই সীমিত, উহার অভিজ্ঞতাও অগভীর; উহার এতদূর যোগ্যতাই নেই যে, উহার গভীর স্তরে উপনীত হতে পারে। কিন্তু এসব দেখেশুনেও তারা দাবী করছে যে, ‘রূহ’ নামে কোন জিনিসের অস্তিত্বিই নেই। তাদের মতে ইন্দ্রিয় জগতের বাইরে অদৃশ্য জগতের কোন কিছুর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কোন মাধ্যম মানুষের কাছে নেই; স্বপ্ন যেমন কোন মাধ্যম নয়, তেমনি ‘টেলিপ্যাথি’ও (দূর অভিজ্ঞান) [দূর অভিজ্ঞান বা Telepathy-কে বর্তমান যুগে একটি বাস্তব সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু হঠধর্মিতার পরাকাষ্ঠা হলো এই যে, আধুনিক বিজ্ঞানীরা মানবীয় রূহের সাথে এর কোন সম্পর্ক স্বীকার করতেই নারাজ। তারা একে স্মৃতির বিরতি অথচ এক অজ্ঞাত উপলব্ধি বা শক্তি বলে সাব্যস্ত করেন। দূর অভিজ্ঞানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হলো হযরত (রা)-এর একটি বিশেষ ঘটনা। একদিন জুম’আর খুৎবা দেয়ার সময়ে হঠাৎ তার বক্তব্য বন্ধ করে শত শত মাইল দূরে অবস্থানকারী তার প্রেরিত সেনাবাহিনী কমান্ডার হযরত ‘সারিয়া’ (রা)-কে লক্ষ্য করে হুকুমম দিলেন : হে সারিয়া। পাহাড়েরর দিকে, হে সারিয়া। পাহাড়ের দিকে।” শত শত মাইল দূর থেকে হযরত সারিয়া এই শব্দ শ্রবণ করেন এবং সংগে সংগেই পাহাড়েরর দিকে মোড় পরিবর্তন করেন এবং এরূপে তার সেনাবাহিনী ঘাপটি মারা শত্রুসৈন্যের হাত থেকে রক্ষা পান।”] কোন বাহন নয়। আধুনিক যুগে রূহকে অস্বীকার করার ভিত্তি কোন প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা নয়। বরং উহার ‍মূল ভিত্তি হচ্ছে জড়বিজ্ঞানের অপর্যাপ্ত ও অনুপযুক্ত যন্ত্রপাতির ক্ষমতা বহির্ভূত হওয়া। বস্তুত এ কারণেই ইহা বিশ্বপ্রকৃতির রহস্র উদঘাটনের বহুলাংশেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। হয়ত বা উচ্চস্তরের অনেক তত্ত্ব ও তথ্যকে মানবীয় জ্ঞানের বাইরে রেখে দেয়ার মধ্যে মানবীয় কল্যাণ নিহিত আছে বলে স্রষ্টার ইচ্ছাক্রমেই মানুষ এভাবে ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের নির্বুদ্ধিতার ফলে ইহাই তাদের বিভ্রান্তি ও অস্বীকৃতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের খেয়াল-খুশী মতই ধরে নিয়েছে যে, ‘রূহ’ নামে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।

বর্তমান যুগের জ্ঞানের বহর

মোটকথা জ্ঞানের এই মূর্খতার রাজ্যেই বর্তমান যুগের মানুষ আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এতে করে সহজেই অনুমান করা যায় যে, আজ ইসলামের কত বড় প্রয়োজন। কেননা একমাত্র ইসলামের কারণেই মানুষ আধুনিক ও প্রাচীনকালের অযৌক্তিক ও উদ্ভট চিন্তাধারা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। মানুষের নির্বুদ্ধিতা সর্বপ্রথম মূর্তিপূজার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর এখন তা বিজ্ঞান পূজার মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। প্রাচীন ও আধুনিক যুগের সর্বাধিক অযৌক্তিক চিন্তাধারা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের বুদ্ধি ও আত্মা কখনো প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে না। আর ইহা লাভ করার মাধ্যম মাত্র একটিই এবং তা হচ্ছে ইসলাম। কেবল এই স্থানেই ইসলাম মানবতার একমাত্র ভরসার স্থল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইসলামই ধর্ম ও বিজ্ঞানের কল্পিত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে সক্ষম। এবং এরূপেই পাশ্চাত্যের লোকদের নির্বুদ্ধিতার ফলে বিপন্ন বিশ্ব যে শান্তি ও নিরাপ্তা হারিয়ে ফেলেছে তা লাভ করে সৌভাগ্যশালী হতে পারে।

ইউরোপ ও প্রাচীন গ্রীস

সভ্যতার ক্ষেত্রে আধুনিক ইউরোপ প্রাচীন গ্রীসের উত্তরাধিকারী। রোম সাম্রাজ্যের মাধ্যমে এই উত্তরাধিকার ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছেছে। গ্রীক মিথলজিতে মানুষ এবং দেবতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত ভয়ংকর। তারা একে অন্যের বিরোধী এবং শত্রু। তাদের মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ এবং দ্বন্দ্ব-কলহ সর্বদাই চলছে। এ কারণে বিশ্বপ্রকৃতির গুপ্ত রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে মানুষ যতটুকু সাফল্য অর্জন করছে উহা দেবতাদের পরাজয় ও ব্যর্থতার ফসল ছাড়া অন্য কিছুই নয়; মানুষ যেন উহা প্রাণপণ যুদ্ধ করে কোনমতে দেবতাদের কাছ থেকে উদ্ধার করছে। এই হিংসুটে অসহায় দেবতারা পরাজিত না হলে মানুষকে রহস্য উদঘাটন বা আবিষ্কারের কোন সুযোগই দিত না এবং প্রকৃতির যে সম্পদ ও অবদানের সাহায্যে মানুষ উপকৃত হচ্ছে তা থেকেও তারা বঞ্চিত হত। গ্রীক চিন্তাধারার এই দৃষ্টিতে বিজ্ঞানের প্রতিটি সাফল্য হিংসুটে দেবতাদের বিরুদ্ধে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিসয়লাভের এক একটি স্পষ্ট প্রমাণ।

ইউরোপীয় সভ্যতার প্রাণ

গ্রীক সভ্যতার এই ন্যক্কারজনক প্রাণই ইউরোপীয় সভ্যতার মূলে অবচেতনভাবে কাজ করে চলেছে। কখনো এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বৈজ্ঞানিক সত্য ও ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আবার কখনো ঘটছে আল্লাহ সম্পর্কে ইউরোপীয় চিন্তাধারায়। এ কারণেই আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা তাদের বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বকে এমনভাবে তুলে ধরছে যে, উহা যেন তারা কোন অধিকতর বড় শক্তির নিকট থেকে যুদ্ধ করে হস্তগত করেছে। আর উহার অনিবার্য ফল-স্বরূপ প্রকৃতির সব শক্তিকেই তারা অধীন করে ফেলেছে। এক অদৃশ্য স্রষ্টার সামনে মানুষ যে দুর্বলতা ও বিনয় প্রকাশ করে এসেছে উহার মূল কারণ ছিল দুর্বলতার অনুভূতি। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে বিজ্ঞান যে সাফল্য লাভ করছে তার ফলে মানুষের উক্ত দুর্বলতার অনুভূতি স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং পরিশেষে এমন একদিন আসবে যখন তুমি নিজেই নিজের খোদা হয়ে বসবে। কিন্তু এর জন্যে প্রয়োজন হলো জীবন মৃত্যুর যাবতীয রহস্য তাকে জানতে হবে এবং নিজেদের পরীক্ষাগারে জীবনকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বস্তুত এ কারণেই আজকের বিজ্ঞানীরা তাদের পরীক্ষাগারে জীবন সৃষ্টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করছে। কেননা তাদের ধারণায় এই কার্যে সাফল্য লাভ করলে তাদের এবং অদৃশ্য খোদার মধ্যে কোন পার্থক্যই থাকবে না এবং অন্যান্য কারুর সম্মুখে মাথানত করার কোন আবশ্যকতাই থাকবে না।

আশার ক্ষীণ রেখা

আধুনিক পাশ্চাত্য জগত যে আভ্যন্তরীণ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে তার মধ্যে উপরোক্ত ব্যধিই সবচেয়ে বিপজ্জনক। উহা গোটা জীবনকেই ভয়ঙ্কর আযাব দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। মানবতাকে বিভেদ-বৈষম্য ও অরাজকতার জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করেছে। মানুষ পারস্পরিক শত্রুতায় মারাত্মকভাবে লিপ্ত হয়েছে। তাদের জীবনে না আছে শান্তি ও নিরাপত্তা; না আছে কোন স্বস্তি ও সৌন্দর্য। এমতাবস্থায় আশার একমাত্র ক্ষীণরেখা হচ্ছে ‘ইসলাম’। খোদাহীন পাশ্চাত্যবাসীদের সৃষ্ট ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচার জন্যে আল্লাহর আইনের আনুগত্য ছাড়া অন্য কোন পন্থা নেই। ইসলামই মানুষকে জীবনের একটি সুষ্ঠু দৃষ্টিভংগী প্রদান করতে সক্ষম। ইসলাম তাকে বলে দেয়: দুনিয়ায় তুমি যে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক কৃতিত্ব অর্জন করছ উহা প্রকৃতপক্ষে তোমাদের দয়ালু ও স্নেহশীল প্রভুরই অযাচিত দান। তোমরা যদি একে মানব সেবার মাধ্যম হিসেবে চালু রাখ তাহলে তিনি তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন এবং তোমাদের পুরুস্কৃত করবেন। তোমাদের প্রভু তোমরা যতই জ্ঞান লাভ কর না কেন- কিংবা প্রকৃতির রহস্য যত অধিকমাত্রায় আবিষ্কার কর না কেন, তাতে তিনি কখনো অসন্তুষ্ট হন না। কেননা তার এরূপ আশংকা নেই যে, তার কোন সৃষ্ট জীব জ্ঞান অর্জন করে কস্মিনকালেও তার খোদায়িত্বের জন্যে বিপদের কারণ হতে পারে। তিনি অসুন্তুষ্ট হন না। কেননা তার এরূপ আশংকা নেই যে, তার কোন সৃষ্ট জীব জ্ঞান অর্জন করে কস্মিনকালেও তার খোদায়িত্বের জন্যে বিপদের কারণ হতে পারে। তিনি অসন্তুষ্ট হন কেবল তখনই এবং একমাত্র তাদের উপরই যারা তাদের জ্ঞান-গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতাকে মানবজাতির কল্যাণ ও শান্তির পরিবর্তে তাদের পতন ও ধ্বংসের কাজে প্রয়োগ করে।

আধুনিক যুগের নতুন খোদা

চরিত্র ও আমলের দিক থেকে বর্তমান দুনিয়া আজ যেখানে অবস্থান করছে, আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বেও সেখানেই অবস্থান করছিল। তখন একমাত্র ইসলামই তাকে বাতিল উপাস্য এবং মিথ্যা খোদার অকটোপাস থেকে মুক্তি দিয়েছিল। আজকের মিথ্যা খোদার হাত থেকেও ইসলামই মানুষকে নাজাত দিতে সক্ষম। মিথ্যা খোদারা আজ স্বৈরাচার, রাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পোশাক পরিধান করেছে। একদিকে একজন পুঁজিবাদী নিঃস্ব শ্রমিকের রক্ত চুষে চুষে ফুলে উঠছে। আর অন্যদিকে প্রোলেটারিয়েট ডিরেকটরশীপের নামে কিছু লোক খোদায়ী শান-শওকাত নিয়ে বসে আছে। এরা গণ-আযাদীর নামে মানুষের স্বাধীনতাকে পদদলিত করছে। অথচ বড় গলায় চিৎকার করছে যে, তারা জনসাধারণের আশা-আকাংখা পূরণ করে চলেছে।

একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

ইসলাম যখন মানুষকে প্রকৃত স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছে তখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, তাহলে আজ সমগ্র ইসলামী দুনিয়াকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করছে এবং ইসলামের নামে মুসলমানদের লাঞ্চিত ও পদদলিত করছে তাদের দুঃস জুলুম ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে ইসলাম মানুষকে কেন রক্ষা করতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তর হলো: শাসকরা ইসলামের নাম ব্যবহার করছে বটে, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, তাদের সরকারী ব্যবস্থাপনার কোথাও এই ইসলমের কোন স্থান নেই; এমনকিব তাদের বাস্তব জীবন এবং উহার আশেপাশেও ইসলামের কোন চিহ্ন নেই। বরং এই নামজাদা মুসলমান শাসকরা সেই সকল লোকের সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছেন যাদের প্রসংগ উত্থাপন করে আল্লাহ পাক বলেন:

(আরবী**********)

“এবং যে লোকেরা আল্লাহর নাযিলকৃত আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারা জালিম।” –(সূরা আল মায়েদা: ৪৫)

(আরবী***********)

(“না, হে মুহাম্মাদ!) তোমার প্রভুর শপথ, এরা কখনো মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ না তাদের পারস্পরিক মতানৈক্যের স্থলে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ করবে; অতপর তুমি যা ফয়সালা করবে সে সম্পর্কে কোন দ্বিধা না করবে, বরং উহাকে শিরোধার্য করে নেবে।”

বর্তমান মুসলমান ডিকটেটর

যে ইসলামের প্রতি আমরা মানুষকে আহ্বান জানাই এবং যে ইসলামকে জীবনের একমাত্র পথপ্রদর্শক রূপে গ্রহণ করার আবেদন জানাই সেই ইসলামের সাথে এই ইসলামের দূরতম সম্পর্কও বর্তমান নেই যাকে প্রাচ্যের আধুনিক মুসলমান শাসকগণ নিজেদের ইসলাম হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এই শাসকদের অন্তরে আল্লাহর আইনের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ নেই; তারা যখন তখন এই আইনের প্রতি বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে থাকে। এতে তাদের অন্তরাত্মা বিন্দুমাত্রও কেঁপে উঠে না। জীবনের যাবতীয় কার্যকলা, লেনদেনের ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন থেকে সাহায্য গ্রহণের কোন প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। বরং যা তাদের ভালো লাগে তাকেই তারা গ্রহণ করছে- চাই উহা ইউরোপের কোন দেশের মনগড়া আইন হোক কিংবা ইসলামী শরীয়াতের কোন বিধান হোক; আর যা তাদের নিকট খারাপ লাগছে কিংবা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে হচ্ছে তা তারা প্রত্যাখ্যান করছে।– তারা না মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ, না আল্লাহর প্রতি। তারা মানুষ এবং আল্লাহ উভয়ের সাথেই গোস্তাখি করার অপরাধে অপরাধী। কেননা তাদের গ্রহণ-বর্জনের মাপকাঠি হক ও সততা নয়। বরং তা হচ্ছে তাদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা এবং কুপ্রবৃত্তির অনুকরণ।

আমরা যে ইসলামের সাথে পরিচিত তা অহঙ্কারী বাদশা ও স্বৈরাচারী জালিম শাসকদের অস্তিত্বকে বিন্দুমাত্রও বরদাশত করে না। শুধু তা-ই নয়, উহা জনসাধরণকে যেভাবে আল্লাহর আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রিত করে ঠিক তেমনিভাবে এই সকল শাসককেও আবদ্ধ করে রাখে। আর যদি এরা এ জন্যে প্রস্তুত না হয় তাহলে চিরকালের জন্যে এদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। কেননা:

(আরবী************)

“যা খড়কুটা তা অবিলম্বেই উড়ে যায় আর যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর তা পৃথিবীতে থেকে যায়।” –(সূরা আর রা’দ: ১৭)

ইসলামী সরকার

অন্য কথায় বলা যায়, ইসলামী সরকারের ডিক্টেটর বা স্বৈরাচারীর কোন স্থান নেই। কেননা ইসলাম স্বৈরাচারী শাসন বা রাজতন্ত্রকে আদৌ সমর্থন করে না। এমনকি ইহা কোন ব্যক্তিকে অন্য মানুষের উপর আল্লাহ ও রাসূলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের মনগড়া আইন চাপিয়ে দেয়ার অধিকারও দেয় না। ইসলামী সরকারের শাসকমণ্ডলীকে আল্লাহ এবং জনসাধারণ উভয়ের নিকটই জবাবদিহি করতে হয়। এই জবাদিহির দাবীই হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে তাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর আইন প্রবর্তন করতে হবে। এ কর্তব্যে যদি তারা অবহেলা করে তাহলে জনগণকে আদেশ-নিষেধ করার অধিকার তাদের থাকে না। এবং এরপর আইনসংগতভাবেই তারা জনতার আনুগত্য লাভের কোন দাবী করতে পারে না। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) তাঁর সর্বপ্রথম ভাষণে এই বিষয়টির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করে বলেন:

“তোমরা আমার আনুগত্য করবে যতক্ষণ আমি আল্লাহর আনুগত্য করি। কিন্তু যদি আল্লাহর আনুগত্যের সীমালংঘন করি তাহলে আমার আনুগত্য করা তোমাদের কর্তব্য নয়।”

এতে করে প্রমাণিত হয় যে, সরকারী কোষাগার এবং আইন রচনার ক্ষেত্রে শাসকমণ্ডলীর অধিকার একজন সাধারণ নাগরিকের চেয়ে কোন অংশেই বেশী নয়। এছাড়া একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মুসলিম সমাজের সদস্যরা সম্পূর্ নিরপেক্ষভাবে স্বাধীন, পক্ষপাতহীন এবং সর্বপ্রকার শঠতা ও প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে এবং নির্বাচন চলাকালীণ সময়ে ইনসাফ ও শালীণতার ভেতর দিয়ে কাউকে নেতৃত্বের উপযুক্ত বলে রায় না দিলে ইসলামের দৃষ্টিতে কোন নেতাই জনগণকে শাসন করার অধিকার অর্জন করতে পারে না।

শ্রেষ্ঠত্ব ও বীরত্বের ধর্ম

ইসলামী রাষ্ট্র উহার নাগরিকবৃন্দকে কেবল আভ্যন্তরীণ স্বৈরাচারী শাসকদের হাত থেকেই রক্ষা করে না, বরং বাইরের সকল প্রকার আক্রমণ থেকেও হেফাযত করে। চাই সে আক্রমণ সাম্রাজ্রবাদী শোষণ (Exploitation) রূপে হোক কিংবা অন্য কোন পন্থায় হোক। এর কারণ হলো: ইসলাম স্বয়ং একটি বীরত্ব, বাহাদুরী ও শক্তির ধর্ম। মানুষ তার সুউচ্চ আসন থেকে পতিত হয়ে মিথ্যা ও বাতিল খোদা তথা সাম্রাজ্যবাদের সামনে অপদস্থ হোক- ইসলাম ইহা কখনো বরদাশত করতে পারে না। ইসলাম মানুষকে জীবনযাপনের একটি সহজ-সরল পদ্ধতি অবলম্বন প্রদান করেছে। এবং তাকে এই বলে উৎসাহিত করে যে, স্বীয় প্রভুর সন্তুষ্টি হাসিল করার জন্যে পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে তার পথে জিহাদে অবতীর্ণ হও। নিজের আশা-আকাংখাকে তার মহান ইচ্ছার অধীন করে দাও। নিজের যাবতীয় মাধ্যম ও উপায়-উপাদানকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদ (Imperialism) উপনিবেশবাদ (Colonialism) ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার গতিতে ঝাপিয়ে পড়।

সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তিলাভের পথ

এ জন্যে আসুন। আমরা সবাই একতাবদ্ধ হয়ে ইসলামের অনুসরণ করি। এর পতাকা তলে সমবেত হয়েই আমরা সাম্রাজ্যবাদের সকল চিহ্নকে নির্মূল করে দিতে পারি। সাম্রাজ্যবাদের যে দানব এখনো পর্যন্ত সমস্ত দুনিয়াকে তার শক্তি পরীক্ষার লক্ষ্যস্থলে পরিণত করে রেখেছে তার হিংস্র থাবা থেকে মানুষকে রক্ষা করার এই একটি পথই এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এখান থেকেই প্রকৃত স্বাধীনতার সূচনা হতে পারে। অতপর কেউ কারুর দাসানুদাস হবে না; সকল মানুষের চিন্তা প্রত্যয়, আমল-আখলাক, উপায়-উপার্জন ও নীতি-নৈতিকতার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হবে। সকলের ইজ্জত-আবরু ও মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কেননা স্বয়ং সরকারই এর হেফাযতের পরিপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবে। কেবল এরূপেই আমরা সঠিক অর্থে মুসলমান এবং আমাদের রবের কৃতজ্ঞ বান্দা বলে পরিগণিত হতে পারি- সেই রবের যিনি একমাত্র ইসলামকে আমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করেছেন:

(আরবী************)

“আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্যে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামত তোমাদের জন্য সমাপ্ত করলাম। আর তোমাদের জন্যে ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মঞ্জুর করে নিলাম।” –(সূরা আল মায়েদা: ৩)

বিশ্বজনীন সংশোধন কর্মসূচী

ইসলামের বৈপ্লবিক সংশোধন কর্মসূচীর গণ্ডি কেবল মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিজস্ব প্রকৃতির দিক থেকেই ইহা একটি বিশ্বজনীন সংশোধনী প্রোগ্রাম। আজকের যে বিপন্ন দুনিয়া পারস্পরিক যুদ্ধ ও বিবাদ-বিসম্বাদের নির্মম শিকার এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশংকায় প্রকম্পিত তার জন্যে ইহা একটি অপ্রত্যাশিত নেয়ামত ছারা আর কিছুই নয়।

বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের দু’টি শিবির

গোটা বিশ্ব আজ পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র নামক দু’টি বিপরীত শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। উভয় শিবিরই একটি আরেকটির বিরুদ্ধে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান। প্রত্যেকটিরই লক্ষ্য হলো সমগ্র দুনিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করা এবং বিশ্বের বাজার ও সামরিক কৌশলগত (Stratagic) ঘাটিগুলো হস্তগত করা। কিন্তু সমস্ত মতাণৈক্য সত্ত্বেও একটি বিষয়ে তারা সম্পূর্ণরূপেই এক। আর সেটি হলো তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি। উভয় শিবিরই একইভাবে বিশ্বের সকল দেশ ও জাতিকে তাদের আজ্ঞাবহ গোলামে পরিণত করতে চায়। বস্তুত এই লক্ষ্যেই তারা অধিক হতে অধিক মাত্রায় মানবীয় এবং বস্তুগত উপায়-উপাদান নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যথেষ্ট। দুনিয়ার অন্যান্য মানুষের মর্যাদা তাদের দৃষ্টিতে বোবা প্রাণীর চেয়ে কোন অংশেই অধিক নয়। অথবা বড়জোর তারা তাদের কাজের হাতিয়ার; কেননা তাদের মাধ্যমেই তারা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়।

একটি তৃতীয় ব্লক

ইসলামী বিশ্ব যদি সাম্রাজ্যবাদের এই বর্বরোচিত আধিপত্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হতে পারে তাহলে আন্তর্জাতিক যে শত্রুতা ও হানাহানি বিশ্ব শান্তিকে বিপন্ন করে তুলেছে তার হাত থেকে বহুলাংশেই রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। মুসলিম দেশগুলো একই কাতারে সামিল হতে পারলে অতি সহজেই একটি তৃতীয়-মুসলিম ব্লক-গঠিত হতে পারে। এই প্রকারের কোন ব্লক সৃষ্টি হলে উহা বিশ্ব রাজনীতিতে একটি কেন্দ্রীয় শক্তির গুরুত্ব লাভ করতে পারে। কেননা ভৌগলিকভাবে এই মুসলিম দেশগুলো আধুনিক ও প্রাচীন পৃথিবীর একেবারে মাঝে অবস্থিত। এই ভৌগলিক অবস্থানের কারণে মুসলিম দেশগুলো স্বীয় কল্যাণের তাগিতে একেবারেই স্বাধীনভাবে যে কোন শিবিরের সাথে মিলিত হতে পারে এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের বৃহত্তর যৌথ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারে।

সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন

ইসলাম মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। এর উপরই তার ভবিষ্যত নির্ভরশীল। বর্তমান চিন্তাধারা ও আদর্শিক দ্বন্দ্বের আবর্তে ইসলামী আদর্শের সাফল্যই মানুষকে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম। আর ইসলামের বিজয় কোন মরিচীকা বা অসম্ভব ব্যাপার নয়। সকল মুসলমানই যদি উহার অনুসারী হয়ে যায় তাহলে প্রথমে যেমন ইসলামের প্রতিষ্ঠান সম্ভবপর ছিল আজও তেমনি সম্ভব। শুধু মুখে মুখে উহার আনুগত্যের কথা না বলে আজই তারা শপথ গ্রহণ করুক: দুনিয়ার বুকে ইসলামকে বিজয়ী ও সফল না করা পর্যন্ত তারা ক্ষ্যান্ত হবে না। ইনশাআল্লাহ, এ জন্যে তাদের বাইরের কোন শক্তির সাহায্যও গ্রহণ করতে হবে না। ইসলামের এই বিজয়ের ফলে আধুনিক মানুষের নিকট উন্মুক্ত হবে উন্নতি ও সমৃদ্ধির এক নতুন দুয়ার। যে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আশংকায় তারা শংকিত তার অবান হবে চিরতরে, বিশ্বব্যাপী স্নায়ু যুদ্ধ, বিভেদ-বৈষম্য, রোগব্যাধি ও মানসিক দ্বন্দ্বের কোন চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না- অন্য কথা আনন্দ, সন্তুষ্টি, নিরাপত্তায় ভরপুর হয়ে উঠবে মানুষের জীবন।

পাশ্চাত্যের উন্নতির স্বরূপ

সমস্যার আরেকটি দিক আমরা পর্যালোচনা করে দেখি। পাশ্চাত্য জগত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অপরিমেয় সাফল্য লাভ করেছে বটে, কিন্তু মানবতার ক্ষেত্রে এখনো উহা দারুণ পশ্চাতে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিজ্ঞান তাদেরকে বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ দান করেছে ঠিকই, কিন্তু আদর্শ মানুষ উপহার দিতে পারেনি। মানবতার উৎকর্ষ থেমে গিয়েছে; মহৎ গুণাবলীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তাদের অন্তর থেকে মুছে গিয়েছে। আধুনিক সভ্যতা রূহ বা মনের চেয়ে বস্তুর প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে অধিক, আধ্যাত্মিকতার চেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে প্রাধান্য দিয়েছে বেশী। ফলে সমষ্টিগত মহান উদ্দেশ্যের পরিবর্তে ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ ও স্বার্থসিদ্ধির চিন্তাকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ কারণেই আধুনিক যুগের লোকেরা দৈহিক আনন্দ ও ভোগ-বিলাসের পেছনেই অন্ধের মত ছুটে চলেছে। অনস্বীকার্য যে, এই অবস্থাকে মানুষের উন্নতি বা মানবতার উৎকর্ষ নামে অভিহিত করা যায় না। কেননা মানুষের বা মানবতার উন্নতির অর্থ নিছক বস্তুগত বা বৈজ্ঞানিক উন্নতিই হতে পারে না। বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় ও পশু প্রবৃত্তির নাগপাশ থেকে পরিপূর্ণ আযাদীও এই অর্থে অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত এই স্থানেই ইসলাম আমাদের সহায়তা করে। কেননা ইসলামই মানুষকে সত্যিকার উন্নতি ও উৎকর্ষের পথে পরিচারিত করতে সক্ষম।

প্রকৃত ‍উন্নতির মাপকাঠি

দ্রুতগামী উড়োজাহায, আণবিক বোমা, রেডিও, টেলিভিশন, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাল্‌বকে উন্নতি বলা হয় না; ঐগুলোকে উন্নতির সামর্থ মনে করা মারাত্মক ভুল। কেননা মানবীয় উন্নতি পরিমাপ করার কোন ক্ষমতা ঐগুলোর নেই। প্রকৃত উন্নতি অনুধাবন করতে হলে দেখতে হবে যে, মানুষ কি তার পাশবিক প্রবৃত্তি ও স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, না সে এখনো পর্যন্ত ঐগুলোর খেলনা মাত্র? এখনো যদি সে স্বীয় কুপ্রবৃত্তির সামনে একান্ত অসহায় ও দুর্বল এবং উহার প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কোন কথা চিন্তা করতে অক্ষম হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, সে প্রকৃত উন্নতি হতে এখনো অনেক দূরে। এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে এখনো সে অনুগ্রহের পাত্র। -তাকে উন্নত বা সাফল্যের অধিকারী বলার তো কোন প্রশ্নই উঠে না।

উন্নতির এই মাপকাঠি বাহির থেকে আমদানী করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া ধর্ম বা নীতিশাস্ত্রের মনগড়া কোন মাপকাঠি নয়। কোন কল্পনা-বিলাসও নয়- বরং একান্ত বাস্তব ঘটনা। স্বয়ং ইতিহাসই এর সাক্ষী। ইহা একটি অকাট্য ঐতিহাসিক সত্য যে, নৈতিক ও মানবীয় মাপকাঠি পরিহার করে যখন কোন জাতি আরাম-আয়েশ ও বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়ে যায় তখন অতীতের শক্তি-সামর্থ, সম্ভ্রম ও মর্যাদা এবং বীরত্ব ও বাহাদুরীকে ধরে রাখতে পারে না এবং মানুষের সমষ্টিগত কল্যাণ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কোন অবদান রাখতে পারে না। প্রাচীন গ্রীস, ইরান বা রোমক সাম্রাজ্যের ধ্বংসের কথাই বলুন কিংবা আব্বাসী যুগের শেষ ভাগে স্বয়ং মুসলমানদের শৌর্য-বীর্যের পতনের কথাই বলুন-সর্বত্রই এই আনন্দ-উল্লাস বা ভোগ-বিলাসের বিষাক্ত ছোবল সবকিছুকেই নির্মূল করে দিয়েছে। নগ্নতা ও ব্যভিচারের জঘন্য দৃষ্টান্ত-ভোগবাদী ফরাসী জাতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যি নির্লজ্জ ভূমিকা রেখেছে তা কেউ ভুলতে পারে কি? শত্রুদের সম্মুখে সমর্পণ করতে তাদের বিন্দুমাত্রও দেরী হয়নি; সামান্য আঘাতেই তারা মাথা নত করে দিয়েছে, শত্রুদের একবার আঘাতও তারা সহ্য করতে পারেনি। কেননা তাদের লোকগুলোর জাতি ও দেশ রক্ষার যতটুকু চিন্তা ছিল তার চেয়ে অধিক চিন্তা ছিল স্ব স্ব জান-মাল ও আরাম-আয়েশের। জাতীয় গৌরব, সম্মান ও খ্যাতির চেয়ে এই চিন্তায়ই তারা অস্থির হয়ে পড়েছিল যে, তাদের পাপ কেন্দ্র রাজধানী প্যারিস এবং উহার নাচঘরগুলো যেন শত্রুর বোমাবর্ষণ থেকে কোন মতে বেঁচে যায়।

আমেরিকার দৃষ্টান্ত

অনেকে এই প্রসংগে আমেরিকার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। তাদের বক্তব্য হলো: আমেরিকার লোকেরা ভোগ-বিলাসে মত্ত; অথচ পৃথিবীর একটি মহাশক্তি হিসেবে পরিগনিত এবং উৎপাদনের দিক থেকেও তাদের স্থান অনেক উপরে। কথাগুলো নিশ্চয়ই ঠিক। কিন্তু আমাদের বন্ধুরা ভুলে যায় যে, বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক পর্যায়ে আমেরিকা এখনো একটি তরুণ শক্তি। আর অনস্বীকার্য যে তরুণদের গোপনীয় রোগগুলো প্রচ্ছন্ন অবস্থায়ই বিরাজ করতে থাকে; উহার কোন নিদর্শন বাহ্যিকভাবে গোচরীভূত হয় না। কেননা সামাজিক ব্যবস্থাপনার প্রতিরক্ষা শক্তি এতদূর মজবুত যে, আভ্যন্তরীণ ব্যধির আলামতগুলোকে স্পষ্ট হতে দেয় না। বস্তুত কোন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি কোন সমাজের বাহ্যিক স্বাস্থ্য ও চাকচিক্য দেখে ধোকা খেতে পারে না এবং চিত্রাকর্ষক পোষাকে আবৃত মারাত্মক ব্যধির আভাস থেকেও অসতর্ক থাকতে পারে না। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, চরিত্র ও নৈতিকতার পর্যায়ে আমেরিকার অবস্থা পাশ্চাত্যের অন্যান্য জাতির চেয়ে কোন দিক থেকে উন্নত নয়। নিম্নলিখিত দু’টি সংবাদ দিয়েই ইহা সহজে প্রমাণিত হয়। আরো প্রমাণিত হয় যে, বহুবিধ সাফল্য ও কৃতিত্ব সত্ত্বেও বিজ্ঞান এখনো মানবীয় প্রকৃতির মৌলিক পরিবর্তন ও উন্নতি সাধন করতে সক্ষম নয়। স্বয়ং বিজ্ঞানও আল্লাহর আইনের একটি অংশমাত্র। -আল্লাহর আইন যাবতীয পরিবেশ ও ঘটনা থেকে চিরমুক্ত। অবিচল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ বলে:

(আরবী********) “তাই তোমরা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তনশীল পাবে না।” (সুরা ফাতের: ৪৩)

দু’টি সংবাদ

কিছুকাল পূর্বে সংবাদপত্রের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩৩জন কর্মচারীকে আপত্তিকর নৈতিক অপরাধ এবং নিজ দেশের গোপনীয় তথ্যাদি শত্রুর দেশের নিকট ফাঁস করার অভিযোগে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে।

দ্বিতীয় সংবাদ হলো : আমেরিকার সৈন্যদের মধ্যে পলাতক কাপুরুষ সৈন্যের সংখ্যা হলো ১ লাখ ২০ হাজার। আমেরিকার মোট সৈন্যদের মধ্যে এই সংখ্যাটি যে বিরাট তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ জাতি হিসেবে আমেরিকানরা এখনো তরুণ এবং বিশ্বের মোড়ল হওয়ার স্বপ্নও তারা দেখছে। কিন্তু এতো কেবল শুরু। ভোগ-বিলাস ও বস্তুবাদী জীবনধারা থেকে নিবৃত্ত না হলে পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের মতই তাদেরকে ধ্বংস হতে হবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা এই হলো প্রকৃতির আমোঘ বিধান।

আমেরিকার অন্ধকার দিক

আমেরিকার অন্য দিকটির প্রতিও আমরা দৃকপাত করি। অভাবনীয় উৎপাদন, অসংখ্য উপায়-উপাদান ও প্রচুর ধন-সম্পদ সত্ত্বেও মহত্ব ও নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে আমেরিকাবাসীরা আজ বন্ধ্যা। জাতি হিসেবে তারা আজ বস্তুগত লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাস এবং নগ্নতা ও নির্লজ্জতার সাগরে নিমজ্জিত। নিরেট পশুত্বের স্তর অতিক্রম করে কোন কিছু বিচার-বিশ্লেষণের সৌভাগ্য তাদের খুব অল্পই হয়। কৃষ্ণাঙ্গই আমেরিকানদের সাথে যে অমানুষিক ও পাশবিক ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমেরিকানদের সেই বর্বরোচিত ও নির্লজ্জ চরিত্রেরই সুস্পষ্ট দর্পণ- যা দেখলে সত্যিই মানুষের দয়ার উদ্রেক হয়। মানবতার উপর পশুত্বের এই যে বিজয়- এ পাশবিকতার মধ্যেই যেন আনন্দ, এ পাশবিকতার দাসত্বেই যেন শান্তি- একি মানবতার লাঞ্ছনা নয়? এই চরিত্র নিয়ে তারা সত্যিকার উন্নতি লাভ করতে পারবে কি?

সততা ও কল্যাণের পথ

সমগ্র দুনিয়া আজ অন্ধকার। তবে মুক্তিলাভের একটি পথ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। সেটি হচ্ছে ইসলামের পথ। যেভাবে চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বে ইহা মানুষকে পাশবিক প্রবৃত্তির হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল তেমনিভাবে আজও ইহা মানুষের সহায়তা করতে পারে। আজও ইহা প্রবৃত্তির অক্টোপাস থেকে মুক্ত করে তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম- এমন মানুষ যে তার আধ্যাত্মিক মানবে অধিক হতে অধিকতর উন্নত করার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে যাতে করে গোটা জীবনই সৎ ও কল্যাণকর কর্মতৎপরতায় ভরে উঠবে এবং সর্বত্রই উহার অনুশীল অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে।

ইসলামের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনের সম্ভাবনা

কেউ হয়ত ব লতে পারে: ইসলামের পুনরুজ্জীবন এক অসম্ভব ব্যাপার এবং উহার জন্যে চেষ্টা করাও নিষ্ফল। কিন্তু তাদের ভুয়ে যাওয়া উচিত নয় যে, অতীতে যেমন প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে উহা মানুষের পাশবিক চরিত্রকে নির্মূল করতে পারে তেমনিভাবে আজও উহা ইতিহাসের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। কেননা মানবীয় প্রকৃতিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়নি; ইহা অতীতে যেমন ছিল আজও ঠিক তেমনি আছে। ইসলামের যখন আবির্ভাব ঘটে তখন দুনিয়ার নৈতিক ও ধর্মীয অবস্থা তেমনি শোচনীয় ছিল যেমনটি আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। প্রাচীন ও আধুনিক এই দুরাবস্থার মধ্যে বাহ্যিক রূপ ছাড়া অন্য কোন ব্যবধান নেই। নৈতিক পথভ্রষ্টতার ক্ষেত্রে প্রাচীন রোম আধুনিক লণ্ডন, প্যারিস এবং আমেরিকার শহরগুলোর চেয়ে পেছনে ছিল না। একই রূপে আজকের সমাজতন্ত্রী দেশসমূহে যে ধরনের যৌন অরাজকতা (Sexual Anarchy) বর্তমান ঠিক সেই ধরনের উচ্ছৃংখলতাই চালু ছিল প্রাচীন ইরানে। বস্তুত এরূপ ঐতিহাসিক পটভূমিতেই ইসলমের আগমন ঘটে। আর উহা অনতিবিলম্বেই স্বীয় অনুসারীদের নৈতিক জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করে- ভোগ লালসার গভীর তলদেশ থেকে তাদেরকে উদ্ধার করে। তাদের জীবনের এক মহান লক্ষ্য স্থির করে দেয়, তাদের আচরণ ও কর্মতৎপরতায় এক দুর্বার চেতনার সৃষ্টি করে দেয়। সততা ও কল্যঅণের পথে আমরণ জেহাদের প্রেরণা জাগ্রত করে দেয়, মানুষের সম্মুখে শান্তি ও সমৃদ্ধির দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় এবং ইলম ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে এমন এক আন্দোলনের সূচনা করে যা সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জগতকে প্রভাবিত করেছে। ফলে গোটা বিশ্ব চিন্তারাজ্যের এক মহাবিপ্লবের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে এবং ইসলামী বিশ্ব সারা বিশ্বের উন্নতি-সমৃদ্ধিদ ও দিকনির্দেশনা লাভের অদ্বিতীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, ইসলাম এরূপে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে বিশ্ববাসীকে পথ দেখিয়েছে। কিন্তু সুউচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের এই দীর্ঘ ইতিহাসে ইসলামী বিশ্ব বস্তুগত কিংবা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে কখনো পেছনে থাকেনি। কেননা নৈতিক পথভ্রষ্টতা, যৌন অরাজকতা এবং নাস্তিক্যবাদকে ইসলাম কখনো বরদাশত করে না, এমনকি উহার সূচনা বা বিকাশলাভেরও কোন সুযোগ দেয় না। বস্তুত তৎপরতার সকল ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল জাতিকে দিকনির্দেশনা দেয়ার গৌরব একমাত্র মুসলমানরাই অর্জন করেছিল এবং তাদের জীবনধারাই সকল মানুষের জন্যে আদর্শ জীবনধারা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। কিন্তু দুখের বিষয়, এরপর তারা ক্রমে ক্রমে ইসলামের মূলনীতি থেকে সরে যেতে থাকে। এরূপে এমন এক সময় এসে গেল যে, তাদের জীবনে মহান লক্ষ্য ও মৌলনীতির কোন আভাস অবশিষ্ট রইল না এবং তারা জৈবিক ভোগ-লালসা ও পশুপ্রবৃত্তির দাসানুদাসে পরিণত হলো। ফলে আল্লাহর অটল বিধান অনুযায়ী দুনিয়াতেই তাদের শাস্তি ভোগ করতে হলো এবং তাদের বীরত্ব ও সৌভাগ্যের সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল।

আধুনিক ইসলামী আন্দোলন

আধুনিক ইসলামী আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ইহা অতীত থেকে আধ্যাত্মিক পুষ্টি হাসিল করছে। বর্তমান কালের যাবতীয নিষ্কলুষ ও বৈধ উপায়-উপাদানসমূহ কাজে লাগাচ্ছে এবং দূর ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মঞ্চিলে মকসুদে উপনীত হওয়ার জন্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল ও দীপ্তিমান; তার মাধ্য্রমে সেই অলৌকিক ঘটনারই (Miracle) পুনরাবির্ভাব হতে পারে যা একবার অতীতে হয়েছিল। এরপর মানুষ আর পাশবিক লোভ-লালসার দাস বলে পরিগণিত হবে না। বরং দুনিয়ার ঝঞ্ঝাটে মশগুল এবং হয়রান হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীন মানুষের ন্যায় মাথা উঁচু করে চলতে পারবে। কেননা তখন তার লক্ষ্যস্থল পার্থিব ভোগ-বিলাস বা আনন্দ-উল্লাস নয়। বরং তার পরম ও চরম লক্ষ্য হলো সাত আসমামনেরও অনেক ঊর্ধে।

একটি পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা

এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম নিছক একটি আধ্যাত্মিক প্রত্যয় কিংবা কোন নীতিশাস্ত্র অথবা আসমান-জমিন সংক্রান্ত একটি গবেষণামূলক তত্ব। বরং ইসলাম হচ্ছে জীবন যাপনের একটি বাস্তব পদ্ধতি। দুনিয়ার সকল দিক ও বিভাগের সব সমস্যার সমাধানই এর মধ্যে বর্তমান। উহার আওতা থেকে কোন কিছুই বাদ পড়েনি। উহা মানব জীবনের যাবতীয সম্পর্ককে- চাই উহা রাজনৈতিক হোক কিংবা অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় হোক অথবা সামাজিক- সুবিন্যস্ত করে দেয় এবং উহার জন্যে সুষ্ঠু আইন-কানুন রচনা করে পরিপূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত করে তোলে। ইসলামের এই কর্মতৎপরতার সর্বাধিক প্রশংসনীয় বিষয় হলো: উহা ব্যষ্টি ও সমষ্টি, ব্যক্তি ও সমাজ, যুক্তি ও ধারণাজ্ঞান, আমল ও ইবাদাত, আসমান ও জমিন এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে এমন এক ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য এনে নিয়েছে যে, জীবনের এই বহুমুখী দিক ‍ও বিভাগগুলো একটি সুসমন্বিত এদের বিভিন্ন অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছে।

বর্তমান অধ্যায়ে ইসলামের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। অবশ্য পরবর্তী অধ্যায়সমূহে প্রাচ্যবিদদের (Orientalists) প্রচারিত ভ্রান্ত চিন্তাধারা আলোচনা প্রসংগে ইসলামী জীবনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টম্ভ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হবে। তবুও পাঠকদের সুবিধার জন্যে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই।

ইসলামের প্রথম বৈশিষ্ট্য

ইসলাম সম্পর্কে সর্বপ্রথমেই একথা নিশ্চিতরূপে বুঝে নিতে হবে যে, ইহা নিছক কিছু চিন্তা (বা ধর্মমত) নয়। বরং ইসলাম হচ্ছে একটি বাস্তব জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার একটিকেও ইহা বাদ দেয়নি। বরং যেগুলো মেটাবার জন্যে সমস্ত কার্যই তাদের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

ইসলামের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য

মানব জীবনের প্রকৃত চাহিদা মেটাবার জন্যে ইসলাম জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুবিচার ও ভারসাম্য স্থাপন করতে চায়। কিন্তু তাই বলে উহা মানব প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাকে কখনো উপেক্ষা করে না। উহা সংশোধনের যাত্রা ব্যক্তি জীবন থেকেই শুরু করে এবং সমগ্র জীবনে দেহ ও আত্মা এবং বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির চাহিদাগুলোর ভেতর এমন সামঞ্জস্য বিধান করে যাতে উহার কোনটিই তার বৈধ সীমা অতিক্রম করে অগ্রবর্তী না হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার উন্নত সোপানে আরোহণ করার জন্যে ইসলাম মানুষের জৈবিক চাহিদাগুলোকে যেমন চাপা দেয়নি, তেমনি ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তি লালসা চরিতার্থ করার অবাধ সুযোগ দিয়ে মানুষকে একদম পশু হয়ে যাওয়ার সুযোগও দেয়নি। কার্যত উহা দেহ ও আত্মা উভয়েরই যথার্থ মূল্যায়ণ করে পারস্পরিক সামঞ্জস্যের ব্যবস্থা করে এবং উহার বৈধ চাহিদাগুলো মেটাবার সুযোগ করে দেয়। দেহ ও আত্মার এই সামঞ্জস্যের ফলে মানবীয় ব্যক্তিত্ব যাবতীয বিভেদ, বৈষম্য এবং পারস্পরিক সংঘর্ষশীল উন্মাদনার হাত থেকে বেঁচে যায়। মানুষের ব্যক্তি জীবন এভাবে সুস্থ ও সর্বাংগ সুন্দর হওয়ার পর ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের চাহিদাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে তৎপর হয়ে উঠে। উহা কোন ব্যক্তিকে অন্যান্য ব্যক্তি কিংবা সমাজের বিরুদ্ধাচরণ করার অবকাশ দেয় না এবং সমাজকেও কোন ব্যক্তির অধিকার হরণ করার সুযোগ দেয় না। এমনকি কোন দল বা জাতি অন্য কোন দল বা জাতির উপর প্রবুত্ব স্থাপন করুক- ইহাও ইসলাম সমর্থন করে না। মোটকথা ইসলাম সমাজের সংঘর্ষশীল শক্তিগুলোর নিয়ণ্ত্রণ ক্ষমতা নিজ হস্তেই রেখে দেয়; উহার পারস্পরিক দ্বন্দ্বের যাবতী সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়ে উহার মধ্যে এমনভাবে সামঞ্জস্য বিধান করে যে, ঐগুলো মিলিতভাবে মানবতার অকল্পনীয় কল্যাণ সাধন করতে পারে।

সামাজিক শক্তিসমূহের সামঞ্জস্যতা

ইসলামই একই সাথে জৈবিক ও আত্মিক, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও মানবীয় শক্তিসমূহের মধ্যে এক অভাবনীয় সামঞ্জস্যতা এনে দেয়। ইসলাম কমিউনিজমের ন্যায় জীবনযাপনের জন্যে মানবীয় কার্যকরণের চেয়ে অর্থনৈতিক কার্যকরণকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে নারাজ। আবার ‘মানবীয জীবনের ব্যবস্থাপনা কেবল দর্শনের কল্পনা-বিলাসের উপরই নির্ভরশীল’ –এরূপ চিন্তাধারাকেও ইসলাম কোন স্বীকৃতি দেয় না। কেননা উহা সমাজকে উহাদের কোন একটির কিংবা কোন অংশের সমার্থক বলে সমর্থন করে না। বরং সমাজের জন্যে ইসলাম উহার প্রত্যেকটিকেই সমান গুরুত্ব দেয় এবং ঐগুলোকে সুবিন্যস্ত করে মানবতার সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করে।

ইসলামের তৃতীয বৈশিষ্ট্য

সর্বদাই স্মরণ রাখতে হবে যে, একটি সমাজদর্শন এবং একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে ইসলামের একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু শাখা-প্রশাখায় বাহ্যিকভাবে কিছু মিল থাকলেও না কমিউনিজমের সাথে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে, না পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার সাথে। উভয় ব্যবস্থাপনার মধ্যে যা কিছু কল্যাণকর তার সবটুকুই এর মাঝে বর্তমান, কিন্তু উহাদের ত্রুটি ও দুর্বলতা থেকে ইহা সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত। ইহা আধুনিক পাশ্চাত্যের ন্যায় ব্যক্তিকে এতদূর শক্তিশালী করতে নারাজ যাতে করে গোটা সমাজই তার হাতে আবদ্ধ হয়ে যায়। সমাজ সেখানে তার আযাদীকে বিন্দুমাত্রও খর্ব করতে পারে না। ব্যক্তির এই অবাধ ও নিরংকুশ স্বাধীনতা আধুনক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার প্রধান ভিত্তি। এই বল্গাহীন স্বাধীনতা অন্যদের জন্যে –এমন কি যে সমাজহ তাকে ঊর্ধে তুলে দিয়ে যথেচ্ছ স্বাধীনতার সুযোগ দিয়েছে তার জন্যেও মারাত্মক বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সমাজ জীবনকে বিশ্লেষণ করে ইসলাম সমাজের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতেও ইচ্ছুক নয়। যদিও বর্তমান যুগে পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে সমাজরে প্রতি এরূপ গুরুত্ব বলতে যা আছে তা একমাত্র সমাজেরই। উহাই জীবনের একমাত্র ভিত্তি। উহার বিপক্ষে ব্যক্তির কোন স্থান বা গুরুত্ব নেই। সমাজ থেকে পৃথক করে তার অস্তিত্বের ধারণা করাও এক অসম্ভব ব্যাপার। এর অনিবার্য ফল হয়েছে এই যে, ঐ সকল রাষ্ট্রে একমাত্র সমাজই সকল শক্তি ও স্বাধীনতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি সেখানে সমাজের প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জও করতে পারছে না এবং তার চাহিদা ও অধিকার সম্পর্কেও কিছু বলতে পারছে না। এই মতাদর্শের ক্রোড় থেকেই জন্মগ্রহণ করেছে সমাজতন্ত্র। তার দাবী হলো: সকল ব্যক্তির ভাগ্যের মালিক একমাত্র রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই নাগরিকদের উপর অপরিসীম ও সমস্ত শক্তির অধিকারী, উহার খেয়াল-খুশি অনুসারেই তাদের চলতে হবে।

সমাজ জীবনের ভিত্তি

সমাজতন্ত্র ‍ও পুঁজিবাদের এউ দুই চরম চিন্তাধারা ইসলাম দিয়েছে এক ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যবর্তী অবস্থা। ইহা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কেই সমান গুরুত্ব মনে করে এবং এউ দু’টির মধ্যে এমন সামঞ্জস্য বিধান করে যে, একদিকে ব্যক্তির যোগ্যতা বৃদ্ধি এবং গুণপনা বিকাশের সর্বাধিক স্বাধীনতার সুযোগ দেয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য ব্যক্তিদের অধিকার হরণ কিংবা তাদের উপর সামান্যতম জুলুম করার অবকাশ দেয়া হয় না। আর অন্যদিকে জীবনের সকল দিক ও বিভাগের ভারসাম্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সমাজকে- তথা উহার পরিচালনা কাঠামো অর্থাৎ রাষ্ট্রকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণের ব্যাপক অধিকার প্রদান করা হয়। ইসলামের এই সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি। -সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত অসন্তোষ বা শ্রেণী সংগ্রামের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

ওহী ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা

এখানে এ সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে যে, ইসলামের এই অনন্য জীবনব্যবস্থার ভিত্তি কোন অর্থনৈতিক পরিবেশ বা কারণ নয়; বিভিন্ন শ্রেণী বা দলীয় স্বার্থের সংগ্রামের ফসলও ইহা নয়। -বরং ইহা একটি ওহী ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। বিশ্বব্যাপী ইহা এমন এক সময়ে লাভ করেছে যখন তাদের জীবনে অর্থনৈতিক কারণের (Factors) কোন গুরুত্ব ছিল না এবং সামাজিক সুবিচারের বর্তমান ধারণার সাথেও কোন পরিচয় ছিল না। বস্তুত মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দৃষ্টিতে বিচার করলে দেখা যায়, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ উভয়ই অনেক পরবর্তীকালে ফসল। ইতিহাসের দিক থেকে ইসলামী জীবনব্যবস্থাই বিশ্বের সর্বপ্রথম জীবনব্যবস্থা হওয়ার একমাত্র গৌরবের অধিকারী।

জীবনের মৌলিক প্রয়োজন

দৃষ্টান্ত স্বরূপ মানুষের জীবনের মৌলিক প্রয়োজনের কথাই ধরুন। সচরাচর বলা হয় যে, কালমার্কসই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আহার, বাসস্থান এবং যৌন তৃপ্তির ব্যবস্থাকে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারের জন্যে অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন যে, সকল নাগরিকের এই প্রয়োজন অবশ্য অবশ্যই মেটাতে হবে। কালমার্কসের এই ঘোষণাকে মানবীয় চিন্তাজগতে এক বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কালমার্কসের জন্মের তের শ’ বছর পূর্বে ইসলামের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী এই বৈপ্লবিক ঘোষণার কথা জানতে পেরেছে। ইসলামের পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদ (সা) ঘোষণা করেছেন:

“যে ব্যক্তি আমাদের (অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের) কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে তার স্ত্রী না থাকলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তার বাসস্থান না থাকলে বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে হবে, তার চাকর না থাকলে চাকরের এবং সওয়ারীর প্রাণ না থাকলে সওয়অরীরও ব্যবস্থা করতে হবে।” এই ঐতিহাসিক ঘোষণায় শুধু পরবর্তী সময়ে কালমার্কসের ঘোষিত মানুষের মৌলিক অধিকারের কথাই বলা হয়নি, বরং আরো কিছু অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম এই অধিকার প্রদানের জন্যে সমাজতন্ত্রের ন্যায় শ্রেণীবিদ্বেষ, রক্তক্ষীয় সংঘর্ষ এবং মানবীয় মূল্যবোধ অস্বীকৃতির মাধ্যমে গোটা সমাজকে জাহান্নামে পরিণত করেনি এবং কেবলমাত্র আহার-বাসস্থান ও যৌন বিহারের বেড়াজালে মানুষকে পশুর ন্যায় বন্দী করে রাখেনি।

স্থায়ী জীবনব্যবস্থা

ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম এমন একটি সর্বাত্মক নীতি ও বিধানের সমন্বিত রূপ যে, মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগের সুখ ও সমৃদ্ধির সর্বাধিক অবকাশই এতে বর্তমান। উৎসাহ-আবেগের কথাই বলুন, চিন্তা-ভাবনা বা কর্মতৎপরতার কথাই বলুন, ইবাদাত বন্দেহী বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথাই বলুন, সামাজিক সম্পর্ক বা আধ্যাত্মিক আচরণের কথাই বলুন- সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। এই বিভিন্নমুখী দিকগুলোকে সুসমন্বিত করে ইসলাম একটি সর্বাংগীন সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ ও অনন্য জীবনব্যবস্থা মানুষকে উপহার দিয়েছে। এরূপ সর্বাত্মক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার প্রয়োজন থেকে মানুষ কোন যুগে মুক্ত থাকতে পারে কি? বাস্তব জীবনে এর মুখাপেক্ষী না হয়ে পারে কি? নিশ্চয়ই পারে না। কোন দিনই ইহা পুরানো বা অচল হতে পারে না। কেননা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক থেকে ইহা জীবনের সমার্থকও নয়, বরং ইহা নিজেই জীবন। এই বিশ্বের বুকে যতদিন পর্যন্ত মানবজীবনের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন এই ব্যবস্থাও বর্তমান থাকবে; স্থায়িত্বের এই নিদর্শন কস্মিনকালেও মুছে যাবে না।

বর্তমান যুগের প্রয়োজন

বর্তমান যুগের পরিস্থিতি ও সমস্যাটির প্রেক্ষাপটে কোন বিবেকবান ব্যক্তি একথা সমর্থন করতে পারে না যে, আধুনিক যুগের মানুষ কোন যুক্তিসংগত কারণে ইসলামী জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার যুগে মানুষ যে সকল অন্যায়-অনাচারে মশগুল ছিল আজকের এই বিংশ শতাব্দীতেও মানুষ সেই পথই অনুসরণ করে চলেছে। আলোপ্রাপ্ত চিন্তাধারার এই উন্নত যুগেও মানুষ জঘন্যতম বর্ণবিদ্বেষের করুণ শিকার। দৃষ্টান্তের প্রয়োজন হলে আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি তাকিয়ে দেখুন। নৈতিক চরিত্র, সংস্কৃতি ও মানবতার বিশাল ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর মানুষকে ইসলামের নিকট থেকে এখনো অনেক কিছুই শিখতে হবে। ইসলাম তো বহু পূর্বেই জাতিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ এবং গোত্রীয় বৈষম্য থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিয়েছিল এবং আজও একমাত্র উহাই এই অভিশপ্ত ঘৃণার হাত থেকে সমগ্র বিশ্ববাসীকে রক্ষা করতে পারে। কেননা ইসলাম শুধু সাম্য ও মৈত্রীর একটি সুন্দর নীল নকসা পেশ করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং বাস্তব কর্মতৎপরতার ভেতর দিয়েও এই সাম্যকে পূর্ণাংগভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছে। সে সাম্যের কোন নযীল বিশ্ব ইতিহাসে নেই। ইসলামের সেই সোনালী যুগে রক্ত, বর্ণ বা গোত্রীয় ভিত্তিতে জীবনের কোন ক্ষেত্রেই কোন শ্বেতাংগ কৃষ্ণাংগের চেয়ে অধিক মর্যাদা পায়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বলাভের একমাত্র ভিত্তি হচ্ছে ন্যায়-পরায়ণতা ও আল্লাহভীতি। এ কারণেই ইসলাম দাস প্রথা বিলুপ্ত করে দাসদেরকে শুধু দাসত্বের অভিশাপ থেকেই মুক্তি দেয়নি। বরং সামগ্রিক প্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্যলাভের সকল সম্ভাবনার দ্বারই তাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এমনকি দাসদের জন্যে সরাসরি রাষ্ট্র ও সমাজের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে সমাসীন হওয়ার অধিকারও দান করেছে। হযরত বিশ্বনবী (স) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন:

“নেতার আদেশ শ্রবণ কর এবং তার আনুগত্য কর। সে হাবশী ক্রীতদাস হলেও তার আনুগত্য কর- যতক্ষণ সে তোমাদেরকে আল্লাহর আইন মোতাবেক পরিচালিত করবে।”

নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদধা প্রদর্শন

আরো একটি দিক থেকেও আজকের বিশ্ব ইসলাম থেকে উদাসীন থাকতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের যাঁতাকলে পৃথিবীর মানুষ আজ যেভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে এবং যে হিংস্রতা ও বর্বরতার নাগপাশে ধুকে ধুকে মরছে তা থেকে বাঁচার জন্যে ইসলাম ব্যতীত আর অন্য কোন পথ খোলা নেই। একমাত্র ইসলামই তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। কেননা একমাত্র ইহাই সাম্রাজ্যবাদ ও উহার অবাধ লুণ্ঠন কার্যের ঘোর বিরোধী। ইসলামের উন্নতির যুগে মুসলমানগণ তাদের বিজিত জাতির সাথে যে মহৎ, উদার ও ভদ্রতাসূচক ব্যবহার দেখিয়েছে তার কথা আধুনিক ইউরোপের লোকেরা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারে না। এই পর্যায়ে হযরত উমর (রা)-এর একটি বিচারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। একজন কিবতীকে বিনা কারণে প্রহার করার অপরাথে তিনি মিসরের প্রখ্যাত বিজয়ী বীর হযরত আমর বিন আছের ছেলেকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দিয়েছিলেন।– এমনকি স্বয়ং পিতাকেও শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। এই একটি মাত্র ঘটনা দ্বারাই অনুমান করা যেতে পারে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কত অধিকমাত্রায় নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করত।

পুঁজিবাদের অভিশাপ

আজকাল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে অভিশাপ সারা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং যা সমগ্র মানবীয জীবনকে বিষাক্ত করে তুলেছে তা থেকে মুক্তি পেতে হলেও ইসলাম ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই। সুদ গ্রহণ ও সম্পদ লুণ্ঠনের যে ভিত্তির উপর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম তার ঘোর বিরোধী। ইসলাম উহাকে নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, উহার সহায়ক মাধ্যমগুলোকেও নির্মূল করার ব্যবস্থা করেছে। এক কথায়, বর্তমান দুনিয়া থেকে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকে একমাত্র ইসলামই দূল করতে সক্ষম।

সমাজতন্ত্রের মূল উৎপাটন

ঠিক একই রূপে জড়বাদী তথা নিরীশ্বরবাদী সমাজতন্ত্রের মূলোৎপটনের জন্যেও ইসলামই হচ্ছে একমাত্র কার্যকরী হাতিয়ার। কেননা উহা পরিপূর্ণ রূপে সামাজিক সুবিচারই প্রতিষ্ঠা করে না, বরং উহার সংরক্ষণের জন্যেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এবং একই সংগে মহৎ মানবীয় গুণাবলী এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। উহার সমাজতন্ত্রের ন্যায় কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগির শিকার না হওয়ার কারণে উহা নিছক ইন্দ্রিয়জগৎ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু নিজ্ব এই বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও ইসলাম উহার অনুসরণের জন্যে অন্যদের উপর কোন শক্তি প্রয়োগ করে না। কেননা বিশ্বাস ও ধর্মীয় ব্যাপারে উহা কোন জবরদস্তিকে আদৌ সমর্থন করে না। এবং করে না বলেই প্রোলেতারী স্বৈরাচারী শাসনেরও সে পক্ষপাতী নয়। এ পর্যায়ে মূলনীতি হলো:

(আরবী*********)

“দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। সঠিক বিষয়কে ভ্রান্ত চিন্তাধারা থেকে পৃথক করে দেয়া হয়েছে।” –(সূরা আল বাকারা: ২৫৬)

বর্তমানে সমগ্র জগতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে ঘনঘটা চলছে তার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলেও ইসলাম ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু ইহা তখনই সম্ভবপর যখন সমগ্র মানবজাতি একমাত্র ইসলামকেই তাদের জীবনের দিশারী হিসেবে গ্রহণ করবে এবং প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ অবলম্বন করার জন্যে এগিয়ে আসবে।

মোটকথা, ইসলামের যুগ এখনো শেষ হয়নি; বরং প্রকৃতপক্ষে সেই যুগের সূচনা হয়েছে মাত্র। ইহা কোন নিষ্প্রাণ মতাদর্শ নয়; বরং ইহা একটি বৈপ্লবিক জীবনবিধান। ইহার অতীত যেমন গৌরবময় ও উজ্জ্বল তেমনি উহার ভবিষ্যতও ভাস্বর ও দীপ্তিমান। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা ও মূঢ়তার গভীর অন্ধকারে হাতড়িয়ে ফিরছিল তখন গোটা বিশ্ব ইসলামের আলোকেই সমুদ্ভাসিত হয়ে উন্নতির শীর্ষ শিখরে আরোহণ করেছিল।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি