গোড়ার কথা
তোমাদের নিকট যদি প্রশ্ন করি আমরা কোন দেশের নাগরিক? তোমরা দেরি না করে ঝট করে বলে ফেলবে, কেন বাংলাদেশের নাগরিক? অর্থাৎ আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। কিন্তু এদেশের পূর্ব ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা নেই। তোমরা জান ১৭৫৭ সালে পলাশীর আমবাগানে ইংরেজ কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা সূর্য ডুবে গিয়েছিল। ইংরেজরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে কেড়ে নেয় তাঁর রাজ্য। তারপর থেকে তার উপমহাদেশে প্রায় দু’শ বছর চালায় তাদের অত্যাচারের স্টীম রোরার। আর এ অত্যাচার মূলতঃ ছিল মুসলমানদের ওপর। এর কারণ স্বরূপ বলা যায় ইংরেজ এদেশ শাসন করার আগে মুসলমানরা প্রায় সাত’শ বছর ধরে এই বিশাল উপমহাদেশে রাজত্ব করেন। আর ইংরেজরা, ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলও মুসলমানদের নিকট থেকে, তাই তারা মুসলমানদেরই আসল শত্রু মনে করতো। হিন্দুরা এর ভেতর-বাইরে ছিলনা। তাদের ব্যাপার হলো শুধুমাত্র শাসক পরিবর্তন। মুসলমানরা এতদিন শাসন করেছে এখন ইংরেজরা, এতে আর অসুবিধা কি? বরঞ্চ হিন্দুরা সুযোগ পেল, তারা মুসলমানদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি ইংরেজ প্রভুদের সামনে তুলে ধরে নিজেদেরকে তাদের হিতৈষী বন্ধুরূপে প্রমাণ করতে সবরকম চেষ্টা চালাল। সত্যিকার অর্থে লাভবান হলো তারাই। শিক্ষা দীক্ষায় মুসলমানরা একশো বছর পিছিয়ে গেল।

এই সময়ই ইংরেজ শাসিত ভারতে সাম্রাজ্যবাদী ছত্র ছায়ায় একশ্রেণীর গোড়া হিন্দু ও খ্রীষ্টীয় প্রচারক এদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা অভিযানে অবতীর্ণ হয়। ঠিক এই সময়ই মুসলমানদের তথা ইসলামের রক্ষক হিসেবে যশোর শহর থেকে মাত্র চার মাইল দূরে ছাতিয়ানতলা গ্রামে একজন বিপ্লবী সৈনিকের আবির্ভাব হয়।

তোমরা মনে করছ, না জানি এই বিপ্লবী সৈনিক সামরিক দিক থেকৈ কত পারদর্শী ছিল? তার অস্ত্রখানায় কত অস্ত্র ছিল! কামান, বন্দুক, মেশিনগান, শেল, মর্টার ইত্যাদি ইত্যাদি অথবা কতনা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিক ছিল তার অধীনে! আসলে কিন্তু তেমন কোন কিছুই ছিলনা তাঁর। হ্যাঁ। তবে একটা জিনিস তাঁর ছিল। যার কাছে দুনিয়ার সবকিছুই হার মেনেছে। সেটা হল তাঁর ঈমানের অমীয় তেজ। যার বলেই তিনি প্রতিহত করেছিলেন তৎকালীন খ্রীষ্টান মিশনারী তৎপরতা।

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো কার কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যাঁ! তিনিই অস্ত্রহীন বিপ্লবী সৈনিক মুনসী মহম্মদ মেহেরউল্লা।

মেহেরউল্লার উপাধি
মুনসি মেহেরউল্লার প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে অনেকগুলি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। যেমন, বাগ্মীকুলতীলক, সমাজ সংস্কারক, ইসলাম প্রচারক, জাতির ত্রাণকর্তা, বঙ্গবন্ধু, মুসলিম বাংলার রামমোহন, বাংলার মার্টিন লুথার, কর্মবীর, যশোরের চেরাগ, দীনের মশাল, ধর্ম-বক্তা প্রভৃতি।

তাকে বাগ্মীকুলতীলক উপাধিতে এ জন্য ভূষিত করা হয় যে, তৎকালীন সময়ে বাংলায় তাঁর সমকক্ষ কোন বক্তা ছিলেন না।

হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন এবং বিজয়ীও হয়েছিলেন। এ জন্য তাকে ‘সমাজ সংস্কারকের’ সম্মান দেয়া হয়।

তিনি লেখালেখি, বক্তৃতা ইত্যাদির মাধ্যমে মূলত ইসলামের দাওয়াতী কাজটাই করতেন তাই তাঁর উপাধি দেয়া হয় ‘ইসলাম প্রচারক’ হিসাবে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে বাংলার মুসলমানদের অবস্তা ছিল খুবই নাজুক। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক তথা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তারা প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় থেকে পিছিয়ে পড়ছিল, উপরন্তু খ্রীষ্টান মিশনারীরা এ সুযোগে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে ধর্মান্তরিত করছিল। মুনসী মেহেরউল্লা বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায়কে এ লজ্জাকর অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। এ জন্য তাঁকে ‘জাতির ত্রাণকর্তা’ বলে।

তিনি বাংলার মানুষের সার্বিক কল্যাণ কামনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি যত কিছু করেছেন অপরের জন্যই করেছেন। সত্যিকার অর্থে নিজের জন্য কিছুই করেননি। তাই তৎকালীন সময়ের পণ্ডিত সমাজ ও সাধারণ মানুষ মুনসী সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

রাজা রামমোহন যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতরকার কুসংস্কারগুলো ঝেটিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করেছিলেন মুনসী মেহেরউল্লাও তেমনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজ থেকে কুসংস্কার উচ্ছেদ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তাই তাঁকে বলা হতো ‘মুসলিম বাংলার রামমোহন’।

কাজ ছাড়া মুনসী মেহেরউল্লা কিছুই বুঝতেন না। তিনি দিন-রাত ছুটে বেড়াতেন অধঃপতিত মুসলিম জাতির প্রকৃত কল্যাণ কামনায়। এমনকি তাঁর অকাল মৃত্যুও হয়েছিল অতিরিক্ত কাজের কারণে। আর এ জন্য তাঁকে বলা হতো ‘কর্মবীর’।

তাঁর সম্পর্কে মৌলানা আকরাম খাঁ বলেছেন, “কর্মজীবনের প্রারম্ভে স্ব-সমাজের দৈন্য দুর্দশার যে তীব্র অনুভূতি আমার মন ও মস্তিষ্ককে বিচলিত করিয়া তুলিয়াছিল, আপনাদের এই যশোহরেরই একজন ক্ষণজন্ম মুসলমান কর্মবীরের (মুনসী মেহেরউল্লার) সাধনার আদর্শ তাহার মূলে অনেকটা প্রেরণা যোগাইয়া দিয়াছিল’।

আপন ধর্মের জন্য তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর কথা ও কাজে ছিল এক। তাই তাকে ‘দীনের মশাল’ বলা হতো।

তিনি ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলো খুব সহজ করে মানুষকে বোঝাতেন বলে তাকে ‘ধর্ম-বক্তা’ বলা হতো।

মুনসী মেহেরউল্লা যশোরের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ জন্য তাকে ‘যশোহরের চেরাগ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের কারণে তৎকালীন সময়ের খৃষ্টানগণ তাঁকে মুসলমান সমাজের ‘মার্টিন লুথার’ নামে অবিহিত করে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি