মাছওয়ালা নবী ইউনুস (আঃ)

“আর ইউনুস ছিলো অবশ্যই রাসুলদেরই একজন।” (আল কুরান-৩৮ ; ১৩৯)

হযরত ইউনুস বিন মাত্তা (আঃ)-এর কথা পবিত্র কুরআনের মোট ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুন-নূন’ এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত’ বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। সামনে তা বিবৃত হবে।

ইউনুস কোন দেশের নবী?

হযরত ইউনুস (আঃ) একজন সম্মানিত নবী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে সরাসরি কুরআনে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। হাদিস, তাফসির ও ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি সিরিয়ার লোক ছিলেন এবং ইসরাইল বংশের লোক ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আসিরিয়াবাসীদের হিদায়াতের জন্যে ইরাকে যেতে নির্দেশ দেন। সে হিসেবে তিনি ইরাকে গিয়ে আসিরিয়াবাসীকে আল্লাহর পথে আনবার চেষ্টা সংরামে লিপ্ত হন। ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ (نينوى) জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

“অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম” (সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।

ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।

মাছের পেটে ইউনুস

আল্লাহ বলেন,

“আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন”। “যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল”। “অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হ’ল”। “অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী” (সূরা ছাফফাত, আয়াত ১৩৯-১৪২)।

আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।

ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) এক ঘণ্টা ছিলেন (২) তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন (৩) ৩ দিন ছিলেন (৪) ৭ দিন ছিলেন (৫) ২০ দিন ছিলেন (৬) ৪০ দিন ছিলেন। আসলে এইসব মতভেদের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এসবের রচয়িতা হ’ল ইহুদী গল্পকারগণ। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহ ভাল জানেন।

ইউনুস কেন মাছের পেটে গেলেন?

এ বিষয়ে জনৈক আধুনিক মুফাসসির বলেন, রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি ঘটায় এবং সময়ের পূর্বেই এলাকা ত্যাগ করায় তাকে এই পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল। আর নবী চলে যাওয়ার কারণেই তার সম্প্রদায়কে আযাব দানে আল্লাহ সম্মত হননি’। অথচ পুরা দৃষ্টিকোণটাই ভুল। কেননা কোন নবী থেকেই তাঁর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটির কল্পনা করা নবীগণের নিষ্পাপত্বের আক্বীদার ঘোর বিপরীত। বরং তিনদিন পর আযাব আসবে, আল্লাহর পক্ষ হ’তে এরূপ নির্দেশনা পেয়ে তাঁর হুকুমেই তিনি এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। আর তার কওম থেকে আযাব উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের আন্তরিক তওবার কারণে, নবী চলে যাওয়ার কারণে নয়।

ইউনুস মুক্তি পেলেন

আল্লাহ বলেন,

“অতঃপর যদি সে আল্লাহর গুণগানকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হ’ত” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩)। ‘তাহ’লে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’?। ‘অতঃপর আমরা তাকে একটি বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’। ‘আমরা তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’। ‘এবং তাকে লক্ষ বা তদোধিক লোকের দিকে প্রেরণ করলাম’। ‘তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩-১৪৮)।

আলোচ্য আয়াতে ‘ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত সে মাছের পেটেই থাকত’-এর অর্থ সে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারতো না। বরং মাছের পেটেই তার কবর হ’ত এবং সেখান থেকেই ক্বিয়ামতের দিন তার পুনরুত্থান হ’ত।

অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম, আয়া ৪৮-৫০)।

‘যদি আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’-এর অর্থ আল্লাহ যদি তাকে তওবা করার তাওফীক্ব না দিতেন এবং তার দো‘আ কবুল না করতেন, তাহ’লে তাকে জীবিত অবস্থায় নদী তীরে মাটির উপর ফেলতেন না। যেখানে গাছের পাতা খেয়ে তিনি পুষ্টি ও শক্তি লাভ করেন। বরং তাকে মৃত অবস্থায় নদীর কোন বালুচরে ফেলে রাখা হ’ত, যা তার জন্য লজ্জাষ্কর হ’ত।

‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন’ অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আল্লাহ ইউনুসকে মনোনীত করেননি; বরং এটা হ’ল বর্ণনার আগপিছ মাত্র। কুরআনের বহু স্থানে এরূপ রয়েছে। এখানে এর ব্যাখ্যা এই যে, ইউনুস মাছের পেটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাকে পুনরায় কাছে টানলেন ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

অন্যত্র ইউনুসের ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

“এবং মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮)।

ইউনুস (আঃ)-এর উক্ত দো‘আ ‘দো‘আয়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

‘‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক মকছূদ হাছিলের নিমিত্তে) উক্ত দো‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

‘’তোমরা আল্লাহর নবীগণের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য করো না। আর কোন বান্দার জন্য এটা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস বিন মাত্তার চাইতে উত্তম’’। কুরতুবী এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটা এজন্য বলেছেন যে, তিনি যেমন (মি‘রাজে) সিদরাতুল মুনতাহায় আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছিলেন, নদীর অন্ধকার গর্ভে মাছের পেটের মধ্যে তেমনি আল্লাহ ইউনুস-এর নিকটবর্তী হয়েছিলেন (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)। বস্ত্ততঃ এটা ছিল রাসূলের নিরহংকার স্বভাব ও বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

উপরোক্ত আয়াত সমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকার পরে আল্লাহর হুকুমে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। মাছের পেটে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা তিনি খেয়েছিলেন, যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজ কওমের নিকটে চলে যান। যাদের সংখ্যা এক লক্ষ বা তার বেশী ছিল। তারা তাঁর উপরে ঈমান আনলো। ফলে পুনরায় শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ দেন।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

(১) বিভ্রান্ত কওমের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাজ সংস্কারকের উচিত নয়।

(২) আল্লাহ তার নেক বান্দার উপর শাস্তি আরোপ করবেন না, যেকোন সংকটে এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।

(৩) আল্লাহর পরীক্ষা কিরূপ হবে, তা পরীক্ষা আগমনের এক সেকেন্ড পূর্বেও জানা যাবে না।

(৪) কঠিনতম কষ্টের মুহূর্তে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।

(৫) খালেছ তওবা ও আকুল প্রার্থনার ফলে অনেক সময় আল্লাহ গযব উঠিয়ে নিয়ে থাকেন। যেমন ইউনুসের কওমের উপর থেকে আল্লাহ গযব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

(৬) আল্লাহ ইচ্ছা করলে যেকোন পরিবেশে ঈমানদারকে রক্ষা করে থাকেন।

(৭) পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা ও জলচর প্রাণী সবাই আল্লাহর হুকুমে ঈমানদার ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়। যেমন মাছ ও লতা জাতীয় গাছ ইউনুসের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিল।

(৮) বাহ্যদৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত খারাব মনে হ’লেও নেককার ব্যক্তির জন্য আল্লাহ উত্তম ফায়ছালা করে থাকেন। যেমন লটারীতে নদীতে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিজের জন্য অতীব খারাব মনে হ’লেও আল্লাহ ইউনুসের জন্য উত্তম ফায়ছালা দান করেন ও তাকে মুক্ত করেন।

(৯) আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত দো‘আ কবুল হয় না। যেমন গভীর সংকটে নিপতিত হবার আগে ও পরে ইউনুস আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। ফলে আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করেন।

১০) আল্লাহর প্রতিটি কর্ম তার নেককার বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। যা বান্দা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে। যেমন ইউনুস পরে বুঝতে পেরে আল্লাহর প্রতি অধিক অনুগত হন এবং এজন্য তিনি আল্লাহর প্রতি অধিক প্রত্যাবর্তনশীল বলে আল্লাহর প্রশংসা পান।

কুরআনে উল্লেখ

কুরআন মাজীদে হযরত ইউনুস (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ৬ বার। এর মধ্যে চার বার ইউনুস আর দুইবার মাছওয়ালা বলে উল্লেখ হয়েছে। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে জেনে নিন ; সূরা আন নিসা ১৬৩। আল আনয়াম ৮৬। ইউনুস ৯৮। আস সাফফাত ১৩৯। আল আম্বিয়া ৮৭। আল কলম ৪৮।

২২।

যাকারিয়া
(আঃ)

শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন

হযরত যাকারিয়ার নাম আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্ববাসীর উপর যাদের সম্মানিত করেছেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। তাছাড়া তিনি সেইসব নবী রাসুলদেরও একজন, মানুষকে সত্য পথে আসার আহবান করার কারনে যাদেরকে আল্লাহর দুশমনরা যাদের হত্যা করেছিলো। তাই তিনি একজন শহীদ নবী। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসুল। হযরত ইবরাহীম ও ইয়াকুবের বংশধর তিনি। শুনুন আল্লাহর বানী –

“আর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি, যা দেখিয়েছিলাম ইতোপূর্বে নুহকে। একই পথ দেখিয়েছি আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা, হারুণকে। মুহসিন লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। আমি একই পথ দেখিয়েছি যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ইলিয়াস ও ঈসা কে। এরা সবাই ছিলো সংস্কারক। সেই পথই দেখিয়েছি আমি ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে। এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম ৮৪-৮৬)

দীনি নেতৃত্ব

বনি ইসরাইলের দীনি কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল বাইতুল মাকদাস। বনি ইসরাইলের মধ্যে হযরত হারুন (আঃ) এর বংশধর একটি গোত্রের উপর দায়িত্ব ছিল বাইতুল মাকদাসের রক্ষনাবেক্ষনের। হযরত যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন এ গোত্রের প্রধান। গোত্রীয় প্রধান হিসেবে তিনিই ছিলেন এই মহান দীনি কেন্দ্রের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। তাকেই লরতে হত এই ঘরের সেবা ও পরিচর্যা। দীনের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রচার এবং সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় অসৎ কাজ থেকে বারন ও বাধা দানই ছিলো তাঁর দীনি মিশনের মূল কাজ। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত দাস এবং সত্য সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।

একটি ছেলে দাও আল্লাহ

কিন্তু হযরত যাকারিয়া এই দীনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নিয়ে ছিলেন খুবই চিন্তিত। তাঁর বংশে এমন কোন যোগ্য লোক ছিলো না তাঁর মৃত্যুর পর যে এই মহান দীনি দায়িত্ব পালন করতে পারতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পরবর্তী দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই ছিলেন চিন্তিত। এখন তাঁর বয়েস প্রায় একশো বছর। চিন্তা তাঁর বেড়েই চললো। হঠাৎ ঘটে গেলো একটি ঘটনা। ঘতনাতির আছে একটি পূর্ব কথা, শুনুন তবে সে কথাটি –

হযরত ঈসা (আঃ) এর নানী আল্লাহর কাছে মানত করলেন, হে আল্লাহ, আমার এখন যে সন্তানটি হবে, আমি ওকে তোমার জন্যে নজরানা দিলাম। ও তোমার জন্যে উৎসর্গিত হবে। তুমি এই নজরানা কবুল করে নাও। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর একটি ছেলে হবে এবং তিনি ওকে বাইতুল মাকদাসে দীনের কাজের জন্যে বিশেষভাবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হয় না। আল্লাহ যা চান তাই হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর একটি মেয়ে হলো। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন মরিয়ম। মরিয়ম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মানত অনুযায়ী ওকে তিনি পৌঁছে দিলেন বাইতুল মাকদাসে। এখন প্রশ্ন দেখা দিলো, সেখানে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবে কে? মরিয়মকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন অনেকে। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে এলেন হযরত যাকারিয়া। আরো এগিয়ে এলেন অন্যান্য গোত্রের ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই দাবী করলেন এ মহৎ সেবা প্রদানের। নিজের দাবী ত্যাগ করছেননা কেউই। ফলে অনুষ্ঠিত হলো কোরা (লটারি)। লটারিতে কার নাম উঠেছে জানেন? যাকারিয়া, হ্যাঁ, হযরত যাকারিয়ার নাম। তিনি দেখাশুনা শুরু করতে লাগলেন মরিয়মকে, এদিকে তিনি মরিয়মের খালু হন। হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী এবং মরিয়মের মা সহোদর বন। ফলে মরিয়মের সেবা ও আদর যত্ন হতে লাগলো সুন্দর ও নিখুঁতভাবে। মরিয়ম ই’তেকাফ ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে নিজের আত্মার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। একদিনের ঘটনা। হযরত যাকারিয়া বাইতুল মাকদাসের সেই নির্দিষ্ট ঘরে দেখতে এলেন মরিয়মকে। কক্ষে ঢুকেই তিনি অবাক। দেখলেন মরিয়মের সামনে সাজানো রয়েছে অনেক সুস্বাদু ফল। এইসব ফল এই মওসুমের ফল নয়। জেরুজালেমে তো এখন এই ফল পাওয়া যায়না। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মরিয়ম এ ফল তুমি কোথায় পেলে?

মরিয়ম – আল্লাহ পাঠিয়েছেন।

এ জবাব শুনে হযরত যাকারিয়ার অন্তরে আশার উদয় হলো। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ মরিয়মকে বেমওসুমের ফল দিতে পারেন, তিনি ইচ্ছে করলে তো আমাকেও বড়ো বয়েসে ছেলে দিতে পারেন। তিনি দু’হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। একটি ছেলে চাইলেন আল্লাহর দরবারে। তাঁর সেই দোয়া কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

“প্রভু, তোমার বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো। তুমি তো অবশ্যি দোয়া স্রবণকারী। ” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭-৩৮)

“যাকারিয়া চুপে চুপে তাঁর প্রভুকে ডাকলো। সে বললো – প্রভু, আমার হাড়গুলো পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। মাথা বার্ধক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রভু। তোমার কাছে কিছু চেয়ে আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি। আমি আমার পড়ে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকার আশংকা করছি। এদিকে আমার স্ত্রী হলো বন্ধ্যা। তাই তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। যে হবে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী। আর হে প্রভে, তুমি ওকে তোমার পছন্দনীয় মানুষ বানিয়ো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২-৬)

“আর যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো। যখন সে তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিল, প্রভু, আমাকে একাকী ছেড়ে দিও না আর সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী তো তুমিই।” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯)

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি কিছু করতে চাইলে বলেন, ‘হও’ আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তিনি তাঁর দাস ও রাসুল যাকারিয়ার দোয়া কবুল করলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা আর বন্ধ্যা মায়ের ঘরে সন্তান দান করলেন। একটি সুপুত্র। নাম তাঁর ইয়াহিয়া। তিনি হযরত যাকারিয়ার শুধু একটি সুপুত্রই ছিলেন না, সেই সাথে আল্লাহ তাঁকে রিসালাতও দান করেন।”

হত্যা করা হলো তাঁকে

এ যাবত পরার পর আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন হযরত যাকারিয়া কোন সময়কার নবী? হ্যাঁ, তিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর লাগভাগ পূর্বেকার নবী। তাঁর বয়েসের শেষ আর হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন প্রায় একই সময়। আর এসময়টা ছিল এখন থেকে মাত্র দুই হাজার বছর পূর্বে। এসময় ফিলিস্তিনের ইহুদীরা প্রকাশ্যে যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীল কাজ করতো। যে দু চারজন ভালো মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন নির্যাতিত। পাপ ও পাপিষ্ঠদের সমালোচনা করলে জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না।

কিন্তু হযরত যাকারিয়া ছিলেন তো আল্লাহর নবী। মানুষকে অন্যায় অপ্রাধের কাজ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাই নবীর কাজ। নবী ও নবীর সত্যিকারের অনুসারী ঈমানদারেরা কখনো অত্যাচার ও নির্যাতনকে ভয় পান না। তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে বিরত রাখার এবং সঠিক পথে ডাকার কাজ করে যান।

হযরত যাকারিয়া বনী ইসরাইলকে মন্দো কাজ করতে নিষেধ করেন। পাপের পথে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহর পথে তথা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজের বাধাদানকে পাপিষ্ঠ শাসক আর সমাজের অপরাধী নেতারা বরদাশত করতে পারেনি। তারা হযরত যাকারিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারনে ইহুদী রাষ্ট্রের রাজা ইউআসের নির্দেশে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়াকে ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানিতে পাথর মেরে হত্যা করে। এভাবে বনী ইসরাইল হত্যা করেছে বহু নবীকে। তাঁদের এইসব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন –

“যখনই তোমাদের প্রবৃত্তির কামনার বিপরীত কোন জিনিস নিয়ে আমার কোন রাসুল তোমাদের কাছে এসেছে, তখনই তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচারন করেছো, কাউকেও মিথ্যা বলেছো আর কাউকেও হত্যা করেছো।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৭)

কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল।

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়া

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়াকে অতি উচ্চ মর্যাদার নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সাতবার। যেসব সূরা ও আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ –

সূরা আলে ইমরানে ৩৭ নং আয়াতে দুইবার। একই সূরা আয়াত ৩৮। সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৫। সূরা মরিয়ম, আয়াত ২ ও ৭। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯।

হযরত যাকারিয়া (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন- সূরা আলে ইমরানে ৩৫-৪১ আয়াত। সূরা মরিয়ম ১-১৫ আয়াত। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯-৯০।

কি শিক্ষা পেলাম?

আল কুরাআনের আলোকে আমরা হযরত যাকারিয়ার জীবনী থেকে কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা লাভ করতে পারি। সেগুলো হলো –

১। পুত পবিত্র জীবন যাপন।

২। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিনয়।

৩। যা কিছু চাওয়ার কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।

৪। আল্লাহকে সর্বশক্তিমান জানতে হবে।

৫। আল্লাহর কাছে সৎ ও নেক্কার সন্তান প্রার্থনা করতে হবে।

৬। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে।

৭। মন্দ কাজে প্রতিবাদ করতে হবে এবং বাধা দিতে হবে।

৮। ধৈর্য ও দ্রঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অটল থাকতে হবে।

৯। প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

২৩।

শহীদ ইয়াহইয়া (আঃ)
তাঁর জন্ম আল্লাহর একটি নিদর্শন

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত ক্ষমতার উৎস ও মালিক। এই পৃথিবীর সব তাঁর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সব কিছুই তাঁর বেধে দেয়া নিয়ম ও বিধানের অধীন। কোনো কিছুতে তাঁর বেধে দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয়ে যায় ধ্বংস। তাঁর বেধে দেয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মেই জন্ম হয় সব মানুষের। নিয়ম যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করলে তিনিই করতে পারেন, আর কেউ নয়। কখনো কখনো তিনি মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। বাবা মা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন আদম ও হাওয়াকে। বাবা ছাড়া শুধু মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন হযরত ঈসা (আঃ) কে। আবার প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা ইবরাহীম এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতা হযরত সারাহকে দান করেছেন পুত্র ইসহাককে। এই একইরকম ঘটনা ঘটেছে হযরত ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা হযরত যাকারিয়া এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন হযরত ইয়াহিয়া (আঃ)।

আপনারা হয়তো যাকারিয়ার জীবনীতে দেখেছেন, তাঁর কোন সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে বন্ধ্যা স্ত্রীর ঘরে তিনি আল্লাহর কাছে আল্লাহর পছন্দনীয় সন্তান প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কিবুল করে বলেন, তুমি সন্তান পাবে। আল্লাহ তাঁকে সুসুংবাদ দেন এভাবে –

“যাকারিয়া যখন মেহরাবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেছিলো তখন ফেরেস্তারা তাঁকে ডেকে বললো – আল্লাহ আপনাকে ইয়াহিয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। সে (অর্থাৎ ঈসা আঃ) আল্লাহর একটি হুকুমকে সত্যায়িত করবে। সে হবে একজন নেতা, সততার প্রতীক এবং একজন সংস্কারক নবী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৯)

সূরা মরিয়মে বলা হয়েছে – “হে যাকারিয়া, তোমার প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তাঁর নাম হবে ইয়াহিয়া। এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭)

সূরা আল আম্বিয়াতে বলা হয়েছে –

“আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছি আর তাঁকে ইয়াহিয়াকে দান করেছি আর এজন্যে তাঁর স্ত্রীকে যোগ্য করে দিয়েছিলাম গর্ভ ধারন করার জন্যে। কারন তারা কল্যাণের কাজে আপ্রান চেষ্টা করতো, ভয় আর আশা নিয়ে আমাকে ডাকতো এবং আমার প্রতি ছিলো তারা অবনত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯০)

এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ কুদরতে বৃদ্ধ পিতা মাতার ঘরে জন্মের ব্যবস্থা করেন হযরত ইয়াহিয়ার। আল কুরআন থেকে আমরা একথাও জানতে পারলাম যে, ইয়াহিয়া নামটি সরাসরি আল্লাহর দেয়া নাম। মহান আল্লাহই পিতা যাকারিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর পুত্রের নাম যেন ইয়াহিয়া রাখা হয়।

ইয়াহিয়া ও ঈসা

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এর তিন বা ছয় মাসের বড়। তারা ছিলেন নিকটাত্মীয় এবং পরস্পরের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বয়স ত্রিশ বছর হবার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) কে নবুয়্যত দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সত্তপন্থী, আল্লাহভীরু এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যায়নকারী। হযরত ঈসা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নির্দেশ (কালেমা)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন মোট প্রকাশ করতে থাকে। হযরত ইয়াহিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসার বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন আল্লাহর নির্দেশে বিনা বাপেই ঈসার জন্ম হয়েছে। তিনি আল্লাহর দাস ও রাসুল। আপনারা ঈসাকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে গ্রহন করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন।

পাঁচটি কাজের নির্দেশ

হযরত ইয়াহিয়া ছোট বেলা থেকেই সব সময় আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। আল্লাহর প্রতি বিনয়, আনুগত্য ও ইবাদাতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে অনেক উন্নত করেন। এরি মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ দেন-

“হে ইয়াহিয়া, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২)

এখানে আল্লাহর কিতাব বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে তাওরাতের বিধান কায়েম করতে এবং মানুষকে এ কিতাবের বিধান মতো জীবন যাপন করবার আহবান জানাতে নির্দেশ দেন।

তিরমিযি, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমাদে হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে হুকুম দিয়েছিলেন মানুষকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে। এ হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন –

“আল্লাহ তায়ালা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়াকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই পাঁচটি কাজ যেন তিনি নিজে করেন এবং বনী ইসরাইলকে করবার নির্দেশ দেন। কোন কারনে বনী ইসরাইলকে এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে তাঁর বিলম্ব হয়। ফলে হযরত ঈসা তাঁকে বললেন – আল্লাহ পাক আপনাকে পাঁচটি কাজ করতে এবং বনী ইসরাইলকে করবার জন্যে নির্দেশ দিতে বলেছেন। সে নির্দেশ কি আপনি তাঁদের পৌছাবেন না আমি পৌছাবো? ইয়াহিয়া বললেন- হে ভাই, আমার আশংকা হয়, আপনি যদি আমার আগে পৌঁছান তাহলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন বা জমিনের নীচে ধসিয়ে দেবেন।

অতপর তিনি বনী ইসরাইলকে বাইতুল মাকদাসে সমবেত করলেন। মানুষে মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তিনি মসজিদের মিম্বরে উঠলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুনাবলী করলেন এবং বললেন – হে জনগন, আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আমি নিজে সেগুলো পালন করি এবং তোমাদেরকেও সেগুলো পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনো সেগুলো হলো –

১। তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য এবং দাসত্ব করবে। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবেনা।

২। তোমাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সালাত কায়েম করতে।

৩। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াম পালন করতে।

৪। তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন দান করতে।

৫। তিনি তোমাদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর স্মরণে তোমাদের জবানকে সিক্ত রাখতে। (এতোটুকু বলার পরে আমাদের প্রিয় নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন) আমিও তোমাদের পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেগুলো হলো –

১। সব সময় জামায়াত বদ্ধ থাকবে।

২। নেতার নির্দেশ স্রবণ করবে।

৩। নেতার নির্দেশ পালন করবে।

৪। হিজরত করবে (অর্থাৎ মন্দ কাজ ত্যাগ করবে বা এমন আবাসভূমি ত্যাগ করবে যেখানে বসে আল্লাহর হুকুম পালন করা সম্ভব নয়)।

৫। আল্লাহর পথে যিহাদ করবে। (অতপর তিনি বলেন) সাবধান, যে ব্যাক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘত সরে যাবে, সে মূলত নিজের গলা থেকে ইসলামের রশিই খুলে ফেলবে। তবে পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসলে ভিন্ন কথা।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

বেশ হয়েছে, হযরত ইয়াহিয়ার পাঁচটি নির্দেশের সাথে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর আরো পাঁচটি নির্দেশও পেয়ে গেলাম। আসলে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) অত্যন্ত মানব দরদী নবী। আল কুরআনে তাঁর একটি মহৎ গেনের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন –

“আমি নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে দান করেছি হৃদয়ের কোমলতা।” (আল কুরআন ১৯ ; ২৩)

দাওয়াত দান, পাপ কাজে বাধাদান ও শাহাদাৎ

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাইলকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় মন্দ কাজ ত্যাগ করার দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁদেরকে শুধু এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে এবং সততার সাথে চলতে আহবান জানাতে থাকেন। তিনি ট্রান্স জর্ডান এলাকায় তাঁর দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারন করেন। মানুষকে তিনি পাপ কাজ থেকে তওবা করাতেন এবং যারা তওবা করতেন তাঁদেরকে ব্যাপটাইজ বা গোসল করাতেন। সেজন্যে তিনি ব্যাপটিষ্ট ইয়াহিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত ইয়াহিয়ার সময় ইহুদীদের শাসক ছিলো হিরোদ এন্টিপাস। হিরোদ ইহুদী সমাজে রোমীয় নগ্ন সভ্যতার সয়লাব বিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে যিনা, ব্যাভিচার, নগ্নতা, বেহায়াপনতা ও চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটানো হতে থাকে। হিরোদ নিজেই ব্যাভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। হযরত ইয়াহিয়া তাঁর অনৈতিক পাপাচারের প্রতিবাদ করতে থাকেন। হিরোদ নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ফেলে রাখে। চরিত্রহীনরা দেখলো, হযরত ইয়াহিয়া মানুষের মাঝে সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাপনের যে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ফলে মানুষ তাঁদের চরমভাবে ঘৃণা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে মানুষের ক্ষোভ। কারন মানুষ দেখলো, আল্লাহর নবীকে আটকে রাখা হয়েছে কারাগারে আর পাপিষ্ঠদের লালন করছে সরকার। এমতাবস্থায় শাসক হিরোদ তাঁর এক পালিত নর্তকীর আবদারে হত্যা করলো আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহিয়া –কে। তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে উপহার দিলো নর্তকীকে। এভাবেই বনী ইসরাইলের বদবখত লোকেরা একের পর এক আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। এদের সম্পর্কেই আল কুরআনে বলা হয়েছে –

“যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করে আল্লাহর নবীদেরকে আর ঐ সব লোকদেরকে যারা ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দেয়, এসব অপরাধীদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২১)

আমাদের নবীর সাথে সাক্ষাত

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর যখন মে’রাজ হয়, তখন তাঁর সাথে হযরত ইয়াহিয়ার সাক্ষাত হয়। হযরত জিবরীলের সাথে প্রিয় নবী আকাশ পেরিয়ে উপরে উঠছিলেন।

তিনি বলেন –

“অতপর যখন দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম দেখলাম, সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা। তারা দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই। জিবরীল আমাকে বললেন – এরা ইয়াহিয়া ও ঈসা এদের সালাম করুন। আমি তাঁদের সালাম করলাম। তারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন- মারহাবা-স্বাগতম হে আমাদের মহান ভাই ও মহান নবী।” (সহীহ বুখারী)

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ হয়েছে পাঁচবার। যেসব আয়াতে উল্লাখ হয়েছে সেগুলো হল- সূরা আলে ইমরান ; ৩৯। সূরা আল আনয়াম ; ৮৫। সূরা মরিয়ম ; ৭, ১২। সূরা আল আম্বিয়া ; ৯০। কুরআন মাজীদে হযরত ইয়াহিয়ার মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

“আমি শৈশবেই তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছি এবং দান করেছি নিজের পক্ষ থেকে কোমলতা ও পবিত্রতা। সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু আর বাবা মার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সে উদ্যত ছিলনা আবার অবাধ্যও ছিলনা। তাঁর প্রতি সালাম যেদিন তাঁর জন্ম হয় যেদিন তাঁর মরন হয় এবং যেদিন উঠানো হবে তাঁকে জীবিত করে। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২-১৫)

২৪।

ঈসা রুহুল্লাহ
(আঃ)

হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ‘ইনজীল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরপর থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি। এই সময়টাকে ‘রাসূল আগমনের বিরতিকাল’ বলা হয়। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত কাল পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরী‘আত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর সাথে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা দেওয়া অত্যন্ত যরূরী বিবেচনা করে আল্লাহ পাক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাঁকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। অন্যদিকে ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ, আয়াত ৩০) বানিয়েছে’। বরং ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, তিনি হ’লেন তিন আল্লাহর একজন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারিয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলে ঘোষণা করেছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭২-৭৩)। কুরআন তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এখন সেদিকে মনোনিবেশ করব।

উল্লেখ্য যে, হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতেবর্ণিত হয়েছে।

ঈসার মা ও নানী

ঈসা (আঃ)-এর আলোচনা করতে গেলে তাঁর মা ও নানীর আলোচনা আগেই করে নিতে হয়। কারণ তাঁদের ঘটনাবলীর সাথে ঈসার জীবনের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের শরী‘আতে প্রচলিত ইবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহর নামে সন্তান উৎসর্গ করার রেওয়াজও চালু ছিল। এসব উৎসর্গীত সন্তানদের পার্থিব কোন কাজকর্মে নিযুক্ত করা হ’ত না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ঈসার নানী অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মানত করলেন যে, তাকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন যে পুত্র সন্তান হবে। কিন্তু যখন তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি’? (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি উক্ত কন্যাকেই কবুল করে নেন। বস্ত্ততঃ ইনিই ছিলেন মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৩৭)।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৪)।

ঈসার জন্ম ও লালন-পালন

এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:

(হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া, আয়াত ৯১ ; তাহরীম, আয়াত ১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)।

অতঃপর আল্লাহ বলেন,

‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম, আয়াত ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম, আয়াত ২২-২৬)।

উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম, আয়াত ১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম, আয়াত ২৬)।

আলোচনা

(১) যেহেতু ঈসা (আঃ)-এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অলৌকিক, তাই তার গর্ভধারণের মেয়াদ স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত ছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নয় মাস দশদিন পরে সন্তান প্রসব শেষে চল্লিশ দিন ‘নেফাস’ অর্থাৎ রজঃস্রাব হ’তে পবিত্রতার মেয়াদও এখানে ধর্তব্য না হওয়াই সমীচীন। অতএব ঈসাকে গর্ভধারণের ব্যাপারটাও যেমন নিয়ম বহির্ভূত, তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরা ঘটনাটাই নিয়ম বহির্ভূত এবং অলৌকিক। আর এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে দশ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এই নিয়ম ভেঙ্গে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হ’ল আদমের মত। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও ব্যস হয়ে গেল’। ‘যা তোমার প্রভু আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’’ (আলে ইমরান, আআয়ত ৫৯-৬০)। অর্থাৎ আদমকে যেমন পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই শুধু মায়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উপরোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, যে বনু ইস্রাঈলের নবী ও রাসূল হয়ে ঈসা (আঃ)-এর আগমন ঘটলো, সেই ইহুদী-নাছারারাই আল্লাহর উক্ত ঘোষণাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছে। অথচ এই হতভাগারা মারিয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের ক্বিবলা বানিয়েছে।

(২) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মারিয়ামকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নীচে পতিত হয়। এটাতে বুঝা যায় যে, ওটা ছিল তখন খেজুর পাকার মৌসুম অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। আর খৃষ্টানরা কথিত যীশু খৃষ্টের জন্মদিন তথা তাদের ভাষায় X-mas Day বা বড় দিন উৎসব পালন করে থাকে শীতকালে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে। অথচ এর কোন ভিত্তি তাদের কাছে নেই। ইসলামে কারু জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালনের বিধান নেই।

(৩) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, খেজুর গাছের গোড়া ধরে নাড়া দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বিশেষ করে একজন সদ্য প্রসূত সন্তানের মায়ের পক্ষে। এর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নেকীর কাজে আল্লাহর উপরে ভরসা করে বান্দাকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। যত সামান্যই হৌক কাজ করতে হবে। আল্লাহ তাতেই বরকত দিবেন। যেমন তালূত ও দাঊদকে আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং যেমন শেষনবী (ছাঃ)-কে আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন বিশেষভাবে হিজরতের রাত্রিতে মক্কা ত্যাগের সময়, হিজরতকালীন সফরে এবং বদর ও খন্দক যুদ্ধের কঠিন সময়ে। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে, মারিয়ামের গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও প্রসব পরবর্তী পবিত্রতা অর্জন সবই ছিল অলৌকিক এবং সবই অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

এর পরের ঘটনা আমরা সরাসরি কুরআন থেকে বিবৃত করব। আল্লাহ বলেন,

‘‘অতঃপর মারিয়াম তার সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হ’ল। তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি একটা আশ্চর্য বস্ত্ত নিয়ে এসেছ’। ‘হে হারূণের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৭-২৮)। কওমের লোকদের এ ধরনের কথা ও সন্দেহের জওয়াবে নিজে কিছু না বলে বিবি মারিয়াম তার সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। অর্থাৎ একথার জবাব সেই-ই দিবে। কেননা সে আল্লাহর দেওয়া এক অলৌকিক সন্তান, যা কওমের লোকেরা জানে না। আল্লাহ বলেন,

‘‘অতঃপর মারিয়াম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলব’?। ঈসা তখন বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে’। ‘এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৯-৩৩)।

ঈসার উপরোক্ত বক্তব্য শেষ করার পর সংশয়বাদী ও বিতর্ককারী লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,

‘‘ইনিই হ’লেন মারিয়াম পুত্র ঈসা। আর ওটাই হ’ল সত্যকথা (যা উপরে বর্ণিত হয়েছে), যে বিষয়ে লোকেরা (অহেতুক) বিতর্ক করে থাকে’। ‘আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন অতিভক্ত খৃষ্টানরা বলে থাকে যে, ঈসা ‘আল্লাহর পুত্র’)। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! ব্যস, হয়ে যায়’। ‘ঈসা আরও বলল, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। (মনে রেখ) এটাই হ’ল সরল পথ’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৪-৩৬)।

কিন্তু সদ্যপ্রসূত শিশু ঈসার মুখ দিয়ে অনুরূপ সারগর্ভ কথা শুনেও কি কওমের লোকেরা আশ্বস্ত হ’তে পেরেছিল? কিছু লোক আশ্বস্ত হ’লেও অনেকে পারেনি। তারা নানা বাজে কথা রটাতে থাকে। তাদের ঐসব বাক-বিতন্ডার প্রতি ইঙ্গিত করেই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন,

‘‘অতঃপর তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল বিভিন্ন (মত ও পথে) বিভক্ত হয়ে গেল (দুনিয়াতে যার শেষ হবে না)। অতএব ক্বিয়ামতের মহাদিবস আগমন কালে অবিশ্বাসী কাফিরদের জন্য ধ্বংস’। ‘সেদিন তারা চমৎকারভাবে শুনবে ও দেখবে, যেদিন তারা সবাই আমাদের কাছে আগমন করবে। কিন্তু আজ যালেমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে রয়েছে’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৭-৩৮)।

মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য

আল্লাহ পাক নিজেই মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,

‘‘তিনি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ হ’তে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাব সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল এবং সে ছিল বিনয়ীদের অন্যতম’’ (তাহরীম, আয়াত ১২)।

মারিয়ামের বৈশিষ্ট্য সমূহ

(১) তিনি ছিলেন বিশ্ব নারী সমাজের শীর্ষস্থানীয়া এবং আল্লাহর মনোনীত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব (আলে ইমরান, আয়াত ৪২)।

(২) তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহর উপাসনায় রত, বিনয়ী, রুকু কারিনী ও সিজদাকারিনী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৩)।

(৩) তিনি ছিলেন সতীসাধ্বী এবং আল্লাহর আদেশ ও বাণী সমূহের বাস্তবায়নকারিনী (তাহরীম, আয়াত ১২)।

(৪) আল্লাহ নিজেই তার নাম রাখেন ‘মারিয়াম’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অতএব তিনি ছিলেন অতীব সৌভাগ্যবতী।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

(১) মারিয়াম ছিলেন তার মায়ের মানতের সন্তান এবং তার নাম আল্লাহ নিজে রেখেছিলেন।

(২) মারিয়ামের মা দো‘আ করেছিলেন এই মর্মে যে, আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে এবং আল্লাহ সে দো‘আ কবুল করেছিলেন উত্তমরূপে। অতএব মারিয়াম ও তার পুত্র ঈসার পবিত্রতা সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই।

(৩) মারিয়াম আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে রত ছিলেন এবং তাকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ফল-ফলাদির মাধ্যমে খাদ্য পরিবেশন করা হ’ত (আলে ইমরান, আয়াত ৩৭)। এতে বুঝা যায় যে, পবিত্রাত্মা মহিলাগণ মসজিদের খিদমত করতে পারেন এবং আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের জন্য যেকোন স্থানে খাদ্য পরিবেশন করে থাকেন।

(৪) মারিয়ামের গর্ভধারণ ও ঈসার জন্মগ্রহণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাক নিয়মের স্রষ্টা এবং তিনিই নিয়মের ভঙ্গকারী। তাকে কোন বিষয়ে বাধ্য করার মত কেউ নেই। তিনি পিতা-মাতা ছাড়াই আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পিতা ছাড়াই শুধু মাতার মাধ্যমে ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন।

(৫) ঈসার জন্ম গ্রীষ্মকালে হয়েছিল খেজুর পাকার মওসুমে। খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা মতে ২৫শে ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতের সময়ে নয়।

(৬) ফেরেশতা মানবাকৃতি ধারণ করে অথবা অদৃশ্য থেকে নেককার বান্দাকে আল্লাহর হুকুমে সাহায্য করে থাকেন। যেমন জিব্রীল মানবাকৃতি ধারণ করে মারিয়ামের জামায় ফুঁক দিলেন। অতঃপর অদৃশ্য থেকে আওয়ায দিয়ে তার খাদ্য ও পানীয়ের পথ নির্দেশ দান করলেন।

(৭) বান্দাকে কেবল প্রার্থনা করলেই চলবে না, তাকে কাজে নামতে হবে। তবেই তাতে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। যেমন খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নাড়া দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সুপক্ক খেজুর সমূহ পতিত হয়।

(৮) বিশেষ সময়ে আল্লাহর হুকুমে শিশু সন্তানের মুখ দিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য সমূহ বের হ’তে পারে। যেমন ঈসার মুখ দিয়ে বের হয়েছিল তার মায়ের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য। বুখারী শরীফে বর্ণিত বনু ইস্রাঈলের জুরায়েজ-এর ঘটনায়ও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

(৯) ঈসা কোন উপাস্য ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অন্যদের মত আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী ও কিতাবধারী রাসূল।

(১০) ঈসা যে বিনা বাপে পয়দা হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, কুরআনের সর্বত্র তাঁকে ‘মারিয়াম-পুত্র’ বলা হয়েছে (বাক্বারাহ, আয়াত- ৮৭, ২৫৩ ; আলে ইমরান, আয়াত ৪৫ প্রভৃতি)। পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে হয়তবা তাঁকে কেবল ঈসা বলেই সম্বোধন করা হ’ত, যেমন অন্যান্য নবীগণের বেলায় করা হয়েছে। অথচ মারিয়ামকে তার পিতার দিকে সম্বন্ধ করে ‘মারিয়াম বিনতে ইমরান’ ‘ইমরান-কন্যা’ বলা হয়েছে (তাহরীম, আয়াত ১২)।

(১১) একমাত্র মারিয়ামের নাম ধরেই আল্লাহ তাঁর সতীত্বের সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন (তাহরীম, আয়াত ১২)। যা পৃথিবীর অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে করা হয়নি। অতএব যাবতীয় বিতর্কের অবসানের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তাছাড়া আল্লাহ তাঁকে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ অর্থাৎ কথায় ও কর্মে ‘সত্যবাদীনী’ আখ্যা দিয়েছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৫)। যেটা অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে দেওয়া হয়নি।

ঈসা (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ

(১) তিনি ছিলেন বিনা বাপে পয়দা বিশ্বের একমাত্র নবী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (২) আল্লাহ স্বয়ং যার নাম রাখেন মসীহ ঈসা রূপে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৩) তিনি শয়তানের অনিষ্টকারিতা হ’তে মুক্ত ছিলেন (ঐ,আয়াত ৩৬-৩৭)। (৪) দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি ছিলেন মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর একান্ত প্রিয়জনদের অন্যতম (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৫) তিনি মাতৃক্রোড়ে থেকেই সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন (মারিয়াম, আয়াত ২৭-৩৩; আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (৬) তিনি বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯) এবং শেষনবী ‘আহমাদ’-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (ছফ, আয়াত ৬)। (৭) তাঁর মো‘জেযা সমূহের মধ্যে ছিল- (ক) তিনি মাটির তৈরী পাখিতে ফুঁক দিলেই তা জীবন্ত হয়ে উড়ে যেত (খ) তিনি জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন (গ) তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন (ঘ) তিনি বলে দিতে পারতেন মানুষ বাড়ী থেকে যা খেয়ে আসে এবং যা সে ঘরে সঞ্চিত রেখে আসে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯; মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

(৮) তিনি আল্লাহর কিতাব ইনজীল প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। তবে তওরাতে হারামকৃত অনেক বিষয়কে তিনি হালাল করেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)। (৯) তিনি ইহুদী চক্রান্তের শিকার হয়ে সরকারী নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ফলে আল্লাহ তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫২, ৫৪-৫৫; নিসা, আয়াত ১৫৮)। শত্রুরা তাঁরই মত আরেকজনকে সন্দেহ বশে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে এবং তারা নিশ্চিতভাবেই ঈসাকে হত্যা করেনি’ (নিসা, আয়াত ১৫৭)। (১০) তিনিই একমাত্র নবী, যাকে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে তিনি পুনরায় সশরীরে দুনিয়াতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জাল, ক্রুশ, শূকর প্রভৃতি ধ্বংস করবেন। অতঃপর ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন।

হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী

সাধারণতঃ সকল নবীই ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছেন। তবে ঈসা (আঃ) সম্ভবতঃ তার কিছু পূর্বেই নবুঅত ও কিতাব প্রাপ্ত হন। কেননা বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আকাশে তুলে নেবার সময় তাঁর বয়স ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল। তিনি যৌবনে আকাশে উত্তোলিত হয়েছিলেন এবং পৌঢ় বয়সে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিবেন।

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত

ঈসা (আঃ) নবুঅত লাভ করার পর স্বীয় কওমকে প্রধানতঃ নিম্নোক্ত ৭টি বিষয়ে দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের নিকটে আগমন করেছি (১) আল্লাহর রাসূল হিসাবে (২) আমার পূর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যায়নকারী হিসাবে এবং (৩) আমার পরে আগমনকারী রাসূলের সুসংবাদ দানকারী হিসাবে, যার নাম হবে আহমাদ’… (ছফ, আয়াত ৬)। তিনি বললেন, ‘(৪) নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। এটাই সরল পথ’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৬)।

তিনি বললেন, ‘আমার আনীত এ কিতাব (ইনজীল) পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতকে সত্যায়ন করে এবং এজন্য যে, (৫) আমি তোমাদের জন্য হালাল করে দেব কোন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর (৬) আমি তোমাদের নিকটে এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সহ। অতএব (৭) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)।

এটার ব্যাখ্যা এসেছে অন্য আয়াতে যে,

‘‘বস্ত্ততঃ ইহুদীদের পাপের কারণে আমরা তাদের উপরে হারাম করেছিলাম বহু পবিত্র বস্ত্ত, যা তাদের জন্য হালাল ছিল। এটা ছিল (১) আল্লাহর পথে তাদের অধিক বাধা দানের কারণে’। ‘এবং এ কারণে যে, (২) তারা সূদ গ্রহণ করত। অথচ এ ব্যাপারে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, (৩) তারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করত। বস্ত্ততঃ আমরা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি’’ (নিসা, আয়াত ১৬০-১৬১)। তিনি আরও বলেন,

‘‘এবং ইহুদীদের জন্য আমরা (১) প্রত্যেক নখবিশিষ্ট পশু হারাম করেছিলাম এবং (২) ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমরা তাদের জন্য হারাম করেছিলাম। কিন্তু ঐ চর্বি ব্যতীত যা পৃষ্ঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী’’ (আন‘আম, আয়াত ১৪৬)।

ঈসা (আঃ)-এর পেশকৃত পাঁচটি নিদর্শন

তাওহীদ ও রিসালাতের উপরে ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়ার পরে তিনি বনু ইস্রাঈলকে তাঁর আনীত নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। (যেমন-) (১) আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুঁক দেই, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। (২) আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং (৩) ধবল-কুষ্ঠ রোগীকে। (৪) আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। (৫) আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯)।

উল্লেখ্য যে, যখন যে দেশে যে বিষয়ের আধিক্য ও উৎকর্ষ থাকে, তখন সেই দেশে সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যুৎপত্তি সহ নবী প্রেরণ করা হয়। যেমন মূসার সময় মিসরে ছিল জাদুবিদ্যার প্রাদুর্ভাব। ফলে আল্লাহ তাঁকে লাঠির মো‘জেযা দিয়ে পাঠালেন। অনুরূপভাবে ঈসার সময়ে শাম বা সিরিয়া এলাকা ছিল চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা। সেকারণ ঈসাকে আল্লাহ উপরে বর্ণিত অলৌকিক ক্ষমতা ও মো‘জেযা সমূহ দিয়ে পাঠান। যেমন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সময়ে আরবরা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ অলংকারে ভূষিত ছিল। ফলে কুরআন তাদের সামনে হতবুদ্ধিকারী মো‘জেযা রূপে নাযিল হয়। যাতে আরবের স্বনামখ্যাত কবিরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।

দাওয়াতের ফলশ্রুতি

ঈসা (আঃ)-এর মো‘জেযা সমূহ দেখে এবং তাঁর মুখনিঃসৃত তাওহীদের বাণী শুনে গরীব শ্রেণীর কিছু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হ’লেও দুনিয়াদার সমাজ নেতারা তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণ তাওহীদের সাম্য বাণী সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের স্বার্থেই প্রথম আঘাত হেনে থাকে। শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে তারা ঈসা (আঃ)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।

বিগত নবীগণের ন্যায় বনু ইস্রাঈলগণ তাদের বংশের শেষ নবী ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। তারা প্রথমেই ঈসা (আঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, (হে ঈসা!) ‘‘যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত কিছুই নয়’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

উক্ত অপবাদে ঈসা (আঃ) ক্ষান্ত না হয়ে বরং আরও দ্বিগুণ বেগে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন। তখন বিরোধীরা বেছে নেয় অতীব নোংরা পথ। তারা তাঁর মায়ের নামে অপবাদ রটাতে শুরু করে। যাতে ঈসা (আঃ) অত্যন্ত ব্যথা পেলেও নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবকিছু নীরবে সহ্য করতে থাকেন। ফলে ঈসা (আঃ)-এর সমর্থক সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে, অবিশ্বাসী সমাজ নেতাদের চক্রান্ত ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবার তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং সেজন্য দেশের বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করল। তারা অনবরত বাদশাহর কান ভারি করতে থাকে এই মর্মে যে, লোকটি আল্লাহ দ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে অবশেষে বাদশাহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। তখন ইহুদীদের এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য আল্লাহ স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন এবং ঈসা (আঃ)-কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।

ইহুদীদের উপর প্রেরিত গযব ও তার কারণ সমূহ

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে আল্লাহ ইহুদী কাফিরদের উপরে নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন। তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে বিষয়ে অনেকগুলি কারণের মধ্যে আল্লাহ বলেন,

‘‘তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল (১) তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, (২) অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যা করার কারণে এবং (৩) তাদের এই উক্তির কারণে যে, ‘আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন’…। ‘আর (৪) তাদের কুফরীর কারণে এবং (৫) মারিয়ামের প্রতি মহা অপবাদ আরোপের কারণে’। ‘আর তাদের (৬) একথার কারণে যে, ‘আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল। বরং তাদের জন্য ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বস্ত্ততঃ তারা এ ব্যাপারে নানাবিধ কথা বলে। তারা এ বিষয়ে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। শুধুমাত্র ধারণার অনুসরণ করা ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই। আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ হ’লেন মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’’ (নিসা, আয়াত ১৫৫-১৫৮)।

ইহুদীদের অভিশপ্ত হওয়ার ১০টি কারণ

সূরা নিসা ১৫৫-৬১ আয়াতে ইহুদীদের ইপর আল্লাহর গযব নাযিলের ও তাদের অভিশপ্ত হওয়ার যে কারণ সমূহ বর্ণিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

(১) তাদের ব্যাপক পাপাচার (২) আল্লাহর পথে বাধা দান (৩) সূদী লেনদেন (৪) অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ (৫) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা (৬) নবীগণকে হত্যা করা (৭) আল্লাহর পথে আগ্রহী না হওয়া এবং অজুহাত দেওয়া যে, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন (৮) কুফরী করা (৯) মারিয়ামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (১০) ঈসাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার মিথ্যা দাবী করা।

ঈসা (আঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও তাঁর ঊর্ধ্বারোহন

তৎকালীন রোম সম্রাট ছাতিয়ূনুস-এর নির্দেশে (মাযহারী) ঈসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ও ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে।

ইহুদী-নাছারারা কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়েই নানা কথা বলে এবং ঈসাকে হত্যা করার মিথ্যা দাবী করে। আল্লাহ বলেন, ‘‘এ বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি’(নিসা, আয়াত ১৫৭)। বরং তার মত কাউকে তারা হত্যা করেছিল।

উল্লেখ্য যে, ঈসা (আঃ) তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা ও অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়।

আল্লাহর পাঁচটি অঙ্গীকার

ইহুদীদের বিপক্ষে হযরত ঈসা (আঃ)-কে সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ পাঁচটি ওয়াদা করেছিলেন এবং সবক’টিই তিনি পূর্ণ করেন। (১) হত্যার মাধ্যমে নয় বরং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে (২) তাঁকে ঊর্ধ্বজগতে তুলে নেওয়া হবে (৩) তাকে শত্রুদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা হবে (৪) অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে ঈসার অনুসারীদেরকে ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী রাখা হবে এবং (৫) ক্বিয়ামতের দিন সবকিছুর চূড়ান্ত ফায়ছালা করা হবে। এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,

‘‘আর স্মরণ কর যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে ওফাত দিব এবং তোমাকে আমার কাছে তুলে নেব এবং তোমাকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করব। আর যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদেরকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করে রাখবো। অতঃপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের মধ্যকার বিবাদীয় বিষয়ে ফায়ছালা করে দেব’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫৫)।

উক্ত আয়াতে বর্ণিত অর্থ ‘আমি তোমাকে ওফাত দিব’। ‘ওফাত’ অর্থ পুরোপুরি নেওয়া। মৃত্যুকালে মানুষের আয়ু পূর্ণ হয় বলে একে ‘ওফাত’ বলা হয়। রূপক অর্থে নিদ্রা যাওয়াকেও ওফাত বা মৃত্যু বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের প্রাণ নিয়ে নেন তার মৃত্যুকালে, আর যে মরেনা তার নিদ্রাকালে’ (যুমার, আয়াত ৪২)। সেকারণ যাহহাক, ফাররা প্রমুখ বিদ্বানগণ مُتَوَفِّيْكَ وَرَافِعُكَ إِلىَّ -এর অর্থ বলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেব এবং শেষ যামানায় (পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে) স্বাভাবিক মৃত্যু দান করব। এখানে বর্ণনার আগপিছ হয়েছে মাত্র’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। যা কুরআনের বহু স্থানে হয়েছে। ঈসার অবতরণ, দাজ্জাল নিধন, পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে ছহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীছ সমূহ বর্ণিত হয়েছে। প্রায় সকল বড় বড় নবীই হিজরত করেছেন। এক্ষণে পৃথিবী থেকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া, অতঃপর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু দান করা- এটা ঈসা (আঃ)-এর জন্য এক ধরনের হিজরত বৈ কি! পার্থক্য এই যে, অন্যান্য নবীগণ দুনিয়াতেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে হিজরত করেছেন। পক্ষান্তরে ঈসা (আঃ) দুনিয়া থেকে আসমানে হিজরত করেছেন। অতঃপর আসমান থেকে দুনিয়াতে ফিরে আসবেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী।

অতঃপর ঈসার অনুসারীদের ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী করে রাখার অর্থ ঈমানী বিজয় এবং সেটি ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারীদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ঈমানী বিজয়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিজয় যেমন খেলাফত যুগে হয়েছে, ভবিষ্যতে আবারও সেটা হবে। এমনকি কোন বস্তিঘরেও ইসলামের বিজয় নিশান উড়তে বাকী থাকবে না। সবশেষে ক্বিয়ামত প্রাক্কালে ঈসা ও মাহদীর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিজয় সংঘটিত হবে এবং সারা পৃথিবী শান্তির রাজ্যে পরিণত হবে।

‘হাওয়ারী’ কারা?

حَوارِىّ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হ’ত। কেউ বলেছেন যে, নাবাত্বী ভাষায় হাওয়ারী অর্থ ধোপা। ঈসার খাঁটি অনুসারীগণ ধোপা ছিলেন, যারা কাপড় ধৌত করতেন। পরে তারা ঐ নামেই পরিচিত হন। অথবা এজন্য তাদের উপাধি ‘হাওয়ারী’ ছিল যে, তারা সর্বদা সাদা পোষাক পরিধান করতেন। কোন কোন তাফসীরবিদ তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলেছেন। ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে যেমন ‘হাওয়ারী’ বলা হয়; শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে তেমনি ‘ছাহাবী’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে ছাহাবী অর্থ সাথী বা সহচর হ’লেও পারিভাষিক অর্থে রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্যদের সাথীগণকে ‘ছাহাবী’ বলা হয় না। কেননা এই পরিভাষাটি কেবল ঐসকল পবিত্রাত্মা ব্যক্তিগণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন কোন সময় শুধু ‘সাহায্যকারী’ বা আন্তরিক বন্ধু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর একজন ‘হাওয়ারী’ অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে। তেমনি আমার ‘হাওয়ারী’ হ’ল যুবায়ের’।

ঈসা (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? একথাটিই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে-

‘‘যখন ঈসা বনু ইস্রাঈলের কুফরী অনুধাবণ করলেন, তখন বললেন, কারা আছ আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষ্য থাকুন যে আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সেই সব বিষয়ের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যা তুমি নাযিল করেছ এবং আমরা রাসূলের অনুসারী হয়েছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫২-৫৩)

অন্যত্র এসেছে এভাবে-

‘‘হে বিশ্বাসী গণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন মারিয়াম-তনয় ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ আল্লাহর জন্য আমাকে সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের একটি দল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং অন্যদল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর আমরা বিশ্বাসীদের সাহায্য করলাম তাদের শত্রুদের উপরে। ফলে তারা বিজয়ী হ’ল’’ (ছফ, আয়াত ১৪)।

অবশ্য হাওয়ারীদের এই আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেমন তিনি বলেন,

‘‘আর যখন আমি হাওয়ারীদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১১)। এখানে হাওয়ারীদের নিকট ‘অহি’ করা অর্থ তাদের হৃদয়ে বিষয়টি সঞ্চার করা বা জাগ্রত করা। এটা নবুঅতের ‘অহি’ নয়।

বস্ত্ততঃ শত্রুদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহবান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বার জন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। অতঃপর তারাই ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পরে ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে বহু ভেজাল ঢুকে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আজও বিশ্ব খৃষ্টান সমাজ রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত। যাদের রয়েছে অসংখ্য উপদল। আর এরা সব দলই ভ্রান্ত।

ইমাম বাগাভী (রহঃ) সূরা ছফ ১৪ আয়াতের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খৃষ্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ’ বলে। একদল তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহর দাস ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মুমিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। বলা বাহুল্য মুমিন ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হ’ল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। যারা ঈসা ও মুহাম্মাদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয়ী হয়েছেন।

আসমান থেকে খাঞ্চা ভর্তি খাদ্য অবতরণ

মূসা (আঃ)-এর উম্মতগণের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে মান্না ও সালওয়ার জান্নাতী খাবার নামিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আঃ)-এর নিকটে অনুরূপ দাবী করে বসলো। বিষয়টির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ-

‘‘যখন হাওয়ারীরা বলল, হে মারিয়াম-পুত্র ঈসা! আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দেবেন? তিনি বললেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে আল্লাহকে ভয় কর’। ‘তারা বলল, আমরা তা থেকে খেতে চাই, আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে এবং আমরা জেনে নেব যে, আপনি সত্য বলেছেন ও আমরা সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাব’। ‘তখন মরিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন। তা আমাদের জন্য তথা আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ হ’তে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদের রূযী দান করুন। আপনিই শ্রেষ্ঠ রূযীদাতা’। ‘আল্লাহ বললেন, নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করব। অতঃপর যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতে অপর কাউকে দেব না’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)।

উল্লেখ্য যে, উক্ত খাদ্য সঞ্চিত রাখা নিষিদ্ধ ছিল। তিরমিযীর একটি হাদীছে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত খাদ্যভর্তি খাঞ্চা আসমান হ’তে নাযিল হয়েছিল এবং হাওয়ারীগণ তৃপ্তিভরে খেয়েছিল। কিন্তু লোকদের মধ্যে কিছু লোক তা সঞ্চিত রেখেছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদের কুফরী এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে ঈসা (আঃ)-এর কথোপকথন

ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহনের ফলে ঈসায়ীদের মধ্যে যে আক্বীদাগত বিভ্রান্তি দেখা দেয় এবং তারা যে কুফরীতে লিপ্ত হয়, সে বিষয়ে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন ঈসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

‘‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন, আপনি মহাপবিত্র। আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই তা জানেন। বস্ত্ততঃ আপনি আমার মনের কথা জানেন, কিন্তু আমি জানি না কি আপনার মনের মধ্যে আছে। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত’। ‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, কেবল সেকথাই বলেছি যা আপনি বলতে বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। বস্ত্ততঃ আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগত’। ‘এক্ষণে যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞ’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১৬-১১৮)।

উপরোক্ত ১১৭নং আয়াতে বর্ণিত فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِيْ বাক্যটিতে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর দলীল তালাশ করার এবং তাঁর ঊর্ধ্বারোহনের বিষয়টিকে অস্বীকার করার প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করার কোন সুযোগ নেই। কেননা এ কথোপকথনটি ক্বিয়ামতের দিন হবে। যার আগে আসমান থেকে অবতরণের পর দুনিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যাবে।

ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতী জীবন থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ জানতে পারি। যেমন-

(১) পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশের হাযার হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। তাঁর পূর্বেকার সকল নবী এবং তিনি নিজে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের একমাত্র নবী এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূল বনু ইস্রাঈল তথা স্ব স্ব গোত্রের প্রতি আগমন করলেও শেষনবী প্রেরিত হয়েছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতি বিশ্বনবী হিসাবে। অতএব ঈসা (আঃ)-এর প্রতিশ্রুত শেষনবী ‘আহমাদ’ বা মুহাম্মাদ-এর অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীই হ’ল ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারী ও প্রকৃত উত্তরসুরী। নামধারী খৃষ্টানরা নয়।

(২) মু‘জেযা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে ভয় দেখানো যায় বা চুপ করানো যায়। কিন্তু হেদায়াতের জন্য আল্লাহর রহমত আবশ্যক। যেমন ঈসা (আঃ)-কে যে মু‘জেযা দেওয়া হয়েছিল, সে ধরনের মু‘জেযা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁর জন্মটাই ছিল এক জীবন্ত মু‘জেযা। কিন্তু তা সত্ত্বেও শত্রুরা হেদায়াত লাভ করেনি।

(৩) সবকিছু মানবীয় জ্ঞান দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। বরং সর্বদা এলাহী সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসী ও আকাংখী থাকতে হয়। যেমন মারিয়াম ও তৎপুত্র ঈসার জীবনের প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।

(৪) যারা নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কাজ করেন ও পরকালীন মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করেন, স্বার্থপর ও দুনিয়া পূজারী সমাজ নেতারা তাদের শত্রু হয় এবং পদে পদে বাধা দেয়। কিন্তু সাথে সাথে একদল নিঃস্বার্থ সহযোগীও তারা পেয়ে থাকেন। যেমন ঈসা (আঃ) পেয়েছিলেন।

(৫) দুনিয়াবী সংঘাতে দুনিয়াদারদের পার্থিব বিজয় হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তাদের পরাজয় হয় এবং তারা ইতিহাসে সর্বাধিক নিন্দিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে নবী ও সমাজ সংস্কারকগণ নির্যাতিত হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই বিজয়ী হন এবং সারা বিশ্ব তাদেরই ভক্ত ও অনুসারী হয়। ঈসা (আঃ)-এর জীবন তারই অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

আল কুরআনে উল্লেখ

আল কুরআনে শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলগনের সাথে হযরত ঈসা (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদার রাসুল। আল কুরআনে রাত নাম উল্লেখ হয়েছে ২৫ বার। যে সব সূরায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হল –

আল বাকারা, আয়াত ৮৭, ১৩৬, ২৫৩। আলে ইমরান ; ৪৫, ৫২, ৫৫, ৫৯, ৮৪। আন নিসা ; ১৫৭, ১৬৩, ১৭১। আল মায়িদা ; ৪৬, ৭৮, ১১০, ১১২, ১১৪, ১১৬। আল আনয়াম ; ৮৫। মরিয়ম ; ৩৪। আল আহযাব ; ৭। আশ শুরা ; ১৩। যুখরুফ ; ৬৩। আল হাদিদ ; ২৭। আস সফ ; ৬, ১৪।

হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে আল কুরআনের নিম্নোক্ত সূরাগুলো পড়বেন –

সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৬০। সূরা আন নিসা, আয়াত ১৫৩-১৬৫ ও ১৭১-১৭৩। সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৪৬-৫১, ৬৩-৭৮, ১০৯-১৬০। সূরা মরিয়ম, আয়াত ১৬-৪০। সূরা যুখরুফ, আয়াত ৫৭-৬৫। সূরা আস সফ, আয়াত ৬, ১৪।

হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রকৃত অনুসারী হলেন তারা, যারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর প্রতি ঈমান এনে তাঁর অনুসরন এবং আনুগত্য করেছেন।

২৫।

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ
(সাঃ)

নবুয়্যতের ধারা একটি কড়ির মালার মতো। এ মালার প্রথম কড়ির নাম আলম এবং শেষ কড়ির নাম মুহাম্মাদ। এ দুইটি কড়ির মাঝে রয়েছে শত শত হাজার হাজার কড়ি।

১। অনন্য তিন বৈশিষ্ট্য

অন্যসব নবী রাসুলের মতই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন একজন মানুষ, একজন নবী ও একজন রাসুল। তবে মহা বিশ্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্যসব নবী রাসুলদের দান করেননি। সে তিন বৈশিষ্ট্য হলো –

এক। সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত ও রিসালাতের ধারা শেষ করেছেন। তাঁর নবুয়্যতী আদর্শই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরনীয়।

দুই। বিশ্বনবী। মহান আল্লাহ তাঁকে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের নবী ও রাসুল নিযুক্ত করেছেন।

তিন। সমগ্র মানব জাতির জন্যে রহমত ও আশীর্বাদ। তাঁকে পাঠানো হয়েছে রহমত, আশীর্বাদ ও অনুকম্পা স্বরূপ সমগ্র মানব জাতির জন্যে। এ তিনটি বিষয়ের প্রমান হল আল কুরআনের নিম্নোক্ত তিন আয়াত। -

১। মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০)

২। আমরা অবশ্যি তোমাকে রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। তবে অধিকাংশ মানুষই এলেম রাখেনা। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)

৩। হে মুহাম্মাদ, আমরা তোমাকে রাসুল মনোনীত করে পাঠিয়েছি সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত (অনুকম্পা ও আশীর্বাদ) হিসেবে। (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

২। জীবনকাল

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল পূর্বকালের নবীগনের জীবনকালের মতো অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট নয়। ইতিহাসে তাঁর জীবনকাল জ্ঞাত ও সুস্পষ্ট। ঈসা (আঃ) এর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। ঈসা (আঃ) এর জন্ম সাল থেকে খ্রিষ্ট সাল চালু হয়েছে। মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনকালের হিসাব রাখা হয়েছে চন্দ্রমাসের হিসেবে। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা সেটাকে খৃষ্ট বর্ষের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম তারিখ হল ৯ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ২২ শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। তবে পুরাবের মতটাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সঠিক। এই পার্থক্যটা হয়েছে পরবর্তীকালে চন্দ্র মাসের হিসাবকে খৃষ্ট সনের সাথে মিলাতে গিয়ে এবং চান্দ্র বর্ষ ও সূর্য বর্ষের মধ্যে আত/দশ দিন ফারাক থাকার কারনে। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস ষোলো দিন, তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন। এটা ছিলো ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। চন্দ্রমাস ছিল রমযান। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।

তাঁর অফাত বা মৃত্যু হয়েছিলো সোমবার। এটা ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল ছিল ৬৩ বছর। নবুয়্যত ছিল ২৩ বছর। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ছিল ৪০ বছর। ফলে তাঁর জীবনকাল একেবারেই সুস্পষ্ট।

৩। জন্ম কোথায়, কোন বংশে?

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্মস্থান মক্কায়। এটি একটি প্রাচীন শহর। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। এটি লোহিত সাগরের পূর্ব তীরের জেদ্দা নদী বন্দর থেকে পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বের মক্কা ছিলো তরুলতা বিহীন পাহাড় টিলা আর পাথর কংকরময় এক মরু শহর। তখন তাঁদের প্রধান ফসল ছিল খেজুর, কোন কোন এলাকায় আঙ্গুর ও যব। শহরটি প্রধানত ছিল ব্যবসা ও আমদানী নির্ভর। এছাড়া এখানকার লোকেরা উট ও মেষ পালন করতো। আর ঘোড়া ছিল তাঁদের বাহাদুরীর প্রতীক।

খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও কিছু আগের কথা। তখন মক্কায় কোন মানুষ বসবাস করতোনা। এটি ছিল জনমানবহীন পাথর পর্বতের এক ভুতুরে নির্জনভূমি। তখন মহানবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দুই পুত্রের এক পুত্রকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল ইসমাঈল (আঃ)।

অতপর আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) মক্কার বুকে নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ইসমাঈলের বংশধর। বাইরের কিছু লোকও এই শহরের আসে পাশে এসে বসবাস করতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশধরেরা পরবর্তীতে কুরাইশ বংশ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু হাশেম। বনু হাশেমই কুরাইশদের নেতৃত্ব দান করতো। এই বনু হাশেম বংশেই কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে এবং মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)। সুতরাং মুহাম্মাদ (সঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর শ্রেষ্ঠ বংশধর।

৪। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ও শৈশব

বিশ্বনবী (সঃ) মাতৃগর্ভে। এসময় তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি পথিমধ্যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা হয়ে পড়েন মা আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই ইয়াতিম হয়ে পড়েন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সঃ)।

তাঁর জন্মকালে জীবিত ছিলেন কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিব, বড় চাচা আবু তালিব, অন্যান্য চাচা এবং ফুফুরা। কুরাইশদের বংশীয় রীতি অনুযায়ী জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই লালন পালন ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে ন্যস্ত করা হয় বেদুইন ধাত্রী মা হালিমার দায়িত্বে। ছয় বছর বয়েস হলে হালিমা তাঁকে মায়ের কোলে ফেরত দিয়ে যান। মা আমিনা ফিরে পান বুকের ধন মুহাম্মাদকে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় নাতী মুহাম্মাদ। চাচা এবং ফুফুদের কাছেও সর্বাধিক প্রিয়। শিশুকাল থেকেই সবাই হয়ে পড়েন তাঁর গুনমুগ্ধ। সুন্দরতম গুনাবলী আর মহোত্তম আচরনে তিনি শিশুকাল থেকেই সবার সেরা। ফলে সবার প্রিয় মুহাম্মাদ। ভবিষ্যতে নেতা এবং সেরা মানুষ হবার সব গুনাবলীই ফুতে উঠেছে শিশু মুহাম্মাদের চরিত্রের মধ্যে। মুহাম্মাদের বয়েস ছয় কি আট। এ সময় মা আমিনা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দেখাতে মদীনায় নিয়ে যাবেন ওর মাতুলালয়ে। তাছাড়া ওর বাবার কবরও ওখানে। দেখিয়ে আনবেন বাবার কবরও। ফলে তারা মদিনায় এলেন। থাকলেন মাস খানেক। তারপর—তারপর ফিরে চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর আক্রমন করলো মা আমিনাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পথেই মারা গেলেন। সাথে ছিলেন মায়ের সেবিকা উম্মে আয়মান। মায়ের মতই তিনি মুহাম্মাদকে লালন পালন করেছেন সারাজীবন। তিনি মুহাম্মাদকে কোলে জড়িয়ে ফিরে এলেন মক্কায়। দাদা আব্দুল মুত্তালিব পরম আদর যত্নে গড়ে তুলছিলেন নাতি মুহাম্মাদকে। কিন্তু এরি মধ্যে দুই বছরের মাথায় তিনিও ইহকাল ত্যাগ করেন। পরিবর্তন হয় অভিভাবক। এবার মুহাম্মাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন বড় চাচা আবু তালিব। আবু তালিব নিজ সন্তানদের চেয়েও অধিক স্নেহ এবং আদর যত্ন করতেন এতিম ভাতিজা মুহাম্মাদকে। আবু তালিব একবার বারো বছর বয়সে মুহাম্মাদকে বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় নিয়ে যান। এ সফরে আবু তালিব মুহাম্মাদের মধ্যে প্রতক্ষ করেন অনেক অলৌকিকত্ব। এভাবে তিনি উপযুক্ত অভিভাবকের অধিনেই বেড়ে ওঠেন ছোট বেলা থেকে। এ প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন –

“তিনি কি তোমায় ইয়াতিম পাননি? তারপর আশ্রয় দেননি।” (আল কুরআন ; ৯৩-৬)

৫। নবুয়্যত পূর্বজীবন ; যৌবনকাল

এরি মধ্যে মুহাম্মাদ নিজেকে দক্ষ ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপরদিকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সেবার মাধ্যমে তিনি মক্কার জনগণের নয়নমণিতে পরিনত হন। জনগন তাঁকে উপাধি দেয় ‘আল আমিন’ ও ‘আস সাদিক’। এর মানে পরম বিশ্বস্ত ও মহা সত্যবাদী। পঁচিশ বছর বয়েসে বিয়ে করেন খাদিজাকে। তিনি ছিলেন খাদিজা তাহিরা- পবিত্র নারী খাদিজা। রূপে গুনে এবং সহায় সম্পদে তিনি ছিলেন মক্কার সেরা নারী। মক্কার সেরা নেতা ও ধনীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নেন ভবিষ্যতের মহাপুরুষ মুহাম্মাদকে। খাদিজার গর্ভে জন্ম হয় বিশ্বনবীর চারকন্যা – উম্মে কুলসুম, যয়নব, রুকাইয়া এবং ফাতিমা। প্রথমে কাসেম নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাসেম মারা যান। ইতোমধ্যে সামাজিক বিবাদ ফায়সালায়ও মুহাম্মাদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব সবার কাছে সমাদৃত হয়। জনগন তাঁকে তাঁদের ভবিষ্যতের নেতা ভাবতে থাকে। তাছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নযায়পরায়নতা ও মহৎ মানবীয় গুনাবলীর দিক থেকে জনগন এমন সেরা মানুষ আর কখনো দেখেনি।

৬। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ

সেকালে মানব সমাজ ছিল সকল দিক থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা ডুবে ছিল অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অটল গহবরে। তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিলো চরিত্রহীনতা ও নৈতিক অধঃপতন। গোত্রীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ছিল তারা পর্যদুস্ত। কুসংস্কারের বলীতে তারা ছিলো ধংসোন্মুখ। তাঁদের উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অধিকাংশ মানুষ ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায় ও মর্যাদাহীন। ভাস্কর্য পূজা তাঁদের নামিয়ে দিয়েছিলো মানবতার সর্বনিম্নস্তরে। এমতাবস্থায় মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসার প্রয়োজন ছিল এক সাহায্যপ্রাপ্ত মহাবীর মুক্তিদুত। এতিম মুহাম্মাদকেই মহান আল্লাহ গড়ে তুলছিলেন সেই মুক্তিদুত হিসেবে।

৭। নবুয়্যত লাভ

এদিকে তাঁর বয়েস যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে নির্জনতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কা’বা থেকে মাইল তিনেক পূর্বদিকের একটি পাহাড়। এর বর্তমান নাম ‘জাবালুন্নুর’ বা জ্যোতির পাহাড়। এ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে পশ্চিমমুখী বা কাবা মুখী একটি গুহা। গুহাটির নাম হেরা। জাবালুন নুরের চুড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সঃ) নীরবে নির্জনে ধ্যান করতে থাকেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মানব সমাজের মুক্তির জন্যে তিনি এক আল্লাহর কল্যাণমুখী হন। ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর মহিমা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর সমস্ত মন মস্তিস্কে এক আল্লাহর ধ্যান এবং ভাবনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস, তখন রমযান মাসের এক শুভরাত্রে তাঁর কাছে আগমন ক্রেন আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমিন। তখনো তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত। জিবরীল এসে তাঁকে বললেন- ‘পড়ুন’। তিনি বললেন- ‘আমি পড়তে জানিনা’। এবার জিবরীল তাঁকে প্রচণ্ড জোরে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলেন – ‘পড়ুন’। জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সাথে সাথে তিনি পড়তে শুরু করলেন – “ইকরা বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম।” অর্থ “ পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শক্তভাবে আটকে থাকা শিশু থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রভু বড়ই দয়াবান, মহিমা মণ্ডিত। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।”

এ অংশটি পরে রাসুল (সঃ) আল কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হিসেবে সংকলন করেন। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর প্রতি এটিই ছিল কুরআন নাযিল হবার সুচনা। এটাই ছিল তাঁর নবুয়্যতী জীবনের সূচনা। আর এটা ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। ফেব্রুয়ারী মাস। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ কোন অভিনব নবী ছিলেন না। তাঁর পূর্বেও বিগত হয়েছেন বহু নবী রাসুল। ইতোপূর্বে আমরা চব্বিশজন নবী রাসুলের জীবনী আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়্যতী মালার সর্বশেষ কড়ি। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন আসমানী সর্বশেষ কিতাব। তাঁর রিসালাত ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন চিরন্তর এবং সার্বজনীন।

৮। আল্লাহর দিকে আহবানের গুরু দায়িত্ব

নবুয়্যত ও রিসালাত হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান দায়িত্ব। এ হলো, মানব সমাজের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব। এ হলো মানব সমাজকে এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে আহবান করার দায়িত্ব। তাই, মুহাম্মাদ (সঃ) মানব সমাজের জন্যে মহান আল্লাহর নিযুক্ত –

১। বার্তাবাহক (রাসুল)।

২। আল্লাহর দিকে আহবায়ক (দায়ী ইলাল্লাহ)।

৩। সুসংবাদদাতা (বাশীর)।

৪। সতর্ককারী (নাযির)।

৫। সত্যের সাক্ষী (শাহেদ)।

৬। সর্বোত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) এবং

৭। মহাসত্যের অনাবীল আলো বিতরণকারী এক সমুজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনিরা)।

এ দায়িত্বগুলো তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে। গুহায় বসে ধ্যান করার দিন শেষ। মানবতার মুক্তির যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক দিশা এবং নির্দেশিকা এবার তিনি পেয়ে গেছেন। তাই এবার মানব সমাজকে ধংসের হাত থেকে মুক্তির লক্ষে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে।

তাঁকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন-

হে মুহাম্মাদ, বলো- হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর বার্তাবাহক। (আল কুরআন ৭ ;১৫৮)
গোটা মানবজাতির জন্যে আমরা তোমাকে বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছি। (আল কুরআন ৪ ; ৭৯)
যাতে করে রাসুল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। (আল কুরআন ২ ; ১৪৩)
হে নবী, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে আর আলো বিতরণকারী সমুজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (আল কুরআন ৩৩ ; ৪৫-৪৬)
এসব দায়িত্ব পালনে তিনি নিজেকে এতোটাই নিবেদিত করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতিও অনেকটা বেপরোয়া বা বেখেয়াল হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করেন-

“তারা এ বানীর প্রতি ঈমান আনেনা বলে সম্ভবত দুঃখে শোকে আর হতাশায় তুমি নিজেকেই বিনাশ করে ছাড়বে।” (আল কুরআন ১৮ ;৬)

৯। মানব সমাজকে মুক্তি ও সাফল্যের দিকে আহবান

মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) কে রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করার পর তিনি মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি আহবানব করেন এবং যেসব বার্তা তাঁদেরকে পৌঁছান, সংক্ষেপে তা হলো –

১। মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই মহান আল্লাহ। মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও মানুষ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবার প্রভু। তিনিই মহাজগৎ মহাবিশ্বের প্রতিপালক, পরিচালক ও শাসক।

২। তিনি এক ও একক। তিনি সন্তান গ্রহন করেননা। তিনিও কারো সন্তান না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। কোন বিষয়েই তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন বিষয়েই কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ও সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। সবাই ও সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।

৩। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁকে একটি সময়ের জন্যে এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর হুকুম ও বিধান মতো জীবন যাপন করার জন্যেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীকে তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করার জন্যে মানুষেরই উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

৪। তিনি বিবেক বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী বানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি এবং নৈতিক প্রবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। পাশবিক প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে বিবেক বুদ্ধি তথা নৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করতে বলেছেন।

তাঁকে আল্লাহর বিধান ও নৈতিক শক্তিতে হয়ে পার্থিব জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন।

৫। পার্থিব জীবনের কার্যক্রমের জন্যে মানুষের বিচার হবে। আল্লাহর বিধান এবং মহৎ মানবীয় নৈতিক গুনাবলীর ভিত্তিতে সে তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেছে কিনা, সেটাই হবে বিচারের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে। বিচারে সাফল্য অর্জনকারী লোকদের তিনি অনন্তকালের জন্যে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। অপরদিকে বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে তাঁদেরকে নিমজ্জিত করা হবে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির মধ্যে।

৬। হে মানুষ, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছেন। তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসুল মেনে নাও। আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কিছুই বলছিনা। আমি তোমাদের কাছে কেবল আল্লাহর বার্তা ও নির্দেশাবলীই পৌঁছে দিচ্ছি।

৭। হে মানুষ, তোমরা আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান মেনে নাও। তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। তাঁর সাথে কাউকেও এবং কোন কিছুকেই শরিক করো না। তোমরা তোমাদের মহৎ মানবীয় ও নৈতিক গুনাবলীকে উন্নত ও বিকশিত করে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা অর্জন করো। তোমরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসো। সারাজীবন সমস্ত কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে করো। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করো। পরকালীন সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করো। সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ, পাপ, পংকিলতা ও যুলুম অবিচার পরাহার করো। এটাই তোমাদের মুক্তি ও সাফল্যের একমাত্র পথ।

১০। মক্কায় তের বছর দাওয়াত ও আহবান

উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াত ও আহবানের মূল বক্তব্য। মক্কায় তের বছর তিনি মানুষকে এই মূল বিষয়গুলোর দিকেই আহবান করেন। সর্বোত্তম পন্থা আর মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান করেন। তাঁর আহবানের উপকরন ছিল আল কুরআন। এই তের বছর তাঁর কাছে কুরআন নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়গুলোকে চমৎকার যুক্তি, উপমা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত সহকারে বাস্তব ও আকর্ষণীয় ভংগীতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবান হিসেবে মানুষের কাছে হুবহু উপস্থাপন করেন আল্লাহর বার্তা আল কুরআন। যারা তাঁর আহবান গ্রহন করেন, তাঁদের তিনি জামায়াতবদ্ধ করেন। তাঁদের মাঝে কুরআনের আলো বিতরন করেন। তাঁদেরকে আল কুরআন শিক্ষা দেন। তাঁদের মানবিক গুনাবলী উন্নত ও বিকশিত করেন। তাঁদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করেন। তাঁদের মাধ্যমে গঠন করেন একটি নতুন সমাজ। মূলত তাঁর দাওয়াত ও আহবানের ছিলো পাঁচটি স্তর। সেগুলো হলো-

১। মানুষের জীবন লক্ষের পরিবর্তন।

২। মানুষের ধ্যান ধারনা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন।

৩। মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন।

৪। সমাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।

৫। নেতৃত্বের পরিবর্তন।

কুরআনের আলো বিতরন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষন, দৃষ্টান্ত স্থাপন, এক আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য এবং সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও সাথীদের মাঝে এসব পরিবর্তন সাধন করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-

“এমনি করে আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের মাঝে পাঠিয়েছি একজন রাসুল। সে তোমাদের প্রতি তেলাওয়াত করে আমাদের আয়াত, তোমাদের জীবনকে করে উন্নত ও বিকশিত, তমাদেওর শিক্ষা দেয় আল কুরআন ও হিকমাহ। আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানতেনা।”(আল কুরআন, ২ ; ১৫১, ৩ ; ১৬৪, ৬২ ; ০২)

তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবানের তালিকায় নিয়ে এসেছিলেন –

১। প্রতিভাবান যুবসমাজকে।

২। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদেরকে।

৩। মজলুম ও সুবিধাবঞ্চিত মানুসদেরকে।

৪। নারী সমাজকে। এবং

৫। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিদেরকে। তিনি তাঁর এই দাওয়াত ও আহবানের কাজের সায়াহ্নের সেই মরু পথিকের মতই মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, যে পথিক সূর্যাস্তের পূর্বেই পেরেশান হয়ে পৌছতে চায় মানব বসতিতে। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন –

১। তাঁর বন্ধুদেরকে বন্ধুতার ভালোবাসায়।

২। দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়স্বজনকে আত্মীয়তার হোক আদায়ে।

৩। দাওয়াত দিয়েছেন ব্যাক্তি পর্যায়ে ব্যাক্তিগত যোগাযোগ করে।

৪। দাওয়াত দিয়েছেন হাট-বাজারে জনসমষ্টিকে সম্বোধন করে।

৫। দাওয়াত দিয়েছেন মেলায় গিয়ে, পূজা পার্বণে গিয়ে।

৬। দাওয়াত দিয়েছেন হজ্জে আগত হাজীদেরকে।

৭। দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায় আগত বনিক ও পর্যটকদেরকে।

১১। দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া

সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবানের প্রতিক্রিয়া আছে। সমস্ত নবী রাসুল মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন এবং তাঁদের আহবানের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াতেরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নিম্নরূপ-

১। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিবর্গ, বিশেষ করে যুবক যুবতীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তারা ঈমান এনে রাসুলের সাথে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

২। কিছু লোক এই দাওয়াতকে সত্য বলে জেনেও অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকায় ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।

৩। সমাজের কর্ণধাররা, ধর্মীয় পুরোহিতরা এবং অর্থনৈতিক শোষকরা কোমর বেধে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে।

৪। অধিকাংশ মানুষ নিরবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

৫। আর কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিরুদ্ধবাদীদের শিকলে আটকা থাকায় গোপনে ঈমান আনে এবং ঈমান আনার বিষয়টি সময় সুযোগের অপেক্ষায় গোপন রাখে।

প্রতিক্রিয়া যদিও এই পাঁচটি ধারায় বিভক্ত ছিলো, তবু এর মূল ধারা ছিলো দুইটি। অর্থাৎ

১। ঈমান এনে রাসুলের সাথীত্ব গ্রহনকারী ধারা। এবং

২। বিরুদ্ধবাদী ধারা।

এই তের বছরে তিন শতাধিক নারী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান এনে ইসলামী কাফেলায় শরীক হয়ে যান। এরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে ইসলামের পথে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দিকেই ঈমান আনেন খাদিজা তাহেরা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারিসা, সায়ীদ বিন যায়িদ, ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, যুবায়ের, সা’দ বিনাবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন আফফান, আব্দুর রহমান, জাফর বিন আবু তালিব, আবু সালামা, উম্মে সালামা, আবু উবায়দা, তালহা, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান, উমর বিন খাত্তাব, আবু যর, হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব, বিলাল বিন রিবাহ, মুসআব, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব, আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, সুহায়েব রুমী, উসমান বিন মাযঊন, উম্মে শুরাইক, রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মু কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, নঈম বিন আব্দুল্লাহ, লুবাইনা, উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হাশমা, তাঁর স্বামী আমের বিন রাবীয়া, তোফায়েল দাওসী এবং আরো অনেকে রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

অপরদিকে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবানের এই মহোত্তম কাজের বিরোধীতায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করে স্বয়ং রাসুল (সঃ) এর চাচা আবু লাহাব, তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, আবু জাহেল, হাকাম বিন আস, উকবার বিন আবু মুয়িত, উতবা, শাইবা, আবুল বুখতরি, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ, হিন্দা, আবু সুফিয়ান, সুহায়েল, আমর ইবনু আস, আকরামা, খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং আরো অনেকে। অবশ্য এদের মধ্যে কয়েকজন পরে ইসলাম কবুল করে আল্লাহর সৈনিক হয়ে যান। তবে তাঁদের অনেকেই বদর যুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। তবে সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবকরাই বেশীরভাগ ইসলাম গ্রহন করেন। অবশ্য নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যাক্তিই রাসুল (সঃ) ও তাঁর সত্যের দাওয়াতের বিরধীতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমানে দীক্ষিত তাঁদের যুবক ছেলে মেয়েদের, আত্মীয়-স্বজনদের এবং দাস-দাসীদের উপরে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসুল (সঃ) এর নির্দেশে তাঁর আশির অধিক সাহাবী নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।

১২। বন্দী জীবন

কিন্তু রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীরা ইসলামের পথ এবং দাওয়াত ও আহবানের কাজ ত্যাগ না করায় কাফির নেতারা আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রাসুল, তাঁর সাথীবৃন্দ এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করে। ফলে তারা শি’বে আবু তালিব নামক পার্বত্য উপত্যকায় অন্তরীন হয়ে পড়েন। এখানে চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। চরম খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা গাছের ছাল আহার করেন। তারা ক্ষুধা এবং রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। নবুয়্যতের সপ্তম বর্ষ থেকে দশম বছরের সূচনা পর্যন্ত তিন বছর তারা এখানে বন্দী থাকেন। অতপর পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে বাধ্য হয়ে বিরোধী নেতারা রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। এই তিন বছরের নিপীড়নের ফলে এ বছরই অর্থাৎ নবুয়্যতের দশম বর্ষেই ইহকাল ত্যাগ করেন রাসুল (সঃ) এর অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং প্রেরনাদায়িনী স্ত্রী খাদিজা তাহেরা। এখন থেকে রাসুল (সঃ) নিরংকুশভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যান।

১৩। তায়েফে দাওয়াত

মক্কার পরেই তায়েফ ছিলো অধিকতর প্রভাবশালী শহর। মক্কার লোকদের আর ঈমান আনার লক্ষন ক্ষীন দেখে রাসুল (সঃ) তায়েফের সর্দারদের কাছে মহাসত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তাঁদের দাওয়াত দেন আল্লাহর দিকে। মক্কার নেতারা তাঁর দাওয়াত গ্রহন না করায় এবং বিরোধিতা করায় তাঁরাও তাঁর দাওয়াত গ্রহন করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় তারা আল্লাহর রাসুল্কে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে তাঁর পিছনে বখাটে যুবকদের লেলিয়ে দেয়। তারা রাসুল (সঃ) কে চরমভাবে নির্যাতন করে, লাঞ্ছিত করে। তাঁর সাথে গিয়েছিলেন তাঁর সেবক যায়েদ। অতপর তিনি যায়েদকে নিয়ে ফিরে আসেন মক্কায়।

১৪। মে’রাজ

চরম নির্যাতনের ফলে রাসুল (সঃ) এঁর একজন মহিলা সাহাবীসহ দুই তিনজন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসুল (সঃ) তায়েফের দিক থেকেও নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজের রাসুল নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি তাঁর রাসুলগনকে এবং রাসুলদের সাথীদেরকে সবসময় বিরোধিতা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাইতো আল্লাহ পাক মুহাম্মাদ (সঃ) কেও বলে দিয়েছেন –

“তোমার পূর্বেও বহু রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের মোকাবেলায় তারা অটল থেকেছে।” (সূরা ৬ আয়াত ৩৪)

এ সময় আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে সামনে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে যাচ্ছিলেন তাঁর মূলনীতিগুলো জানিয়ে দিতে চাইছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে মে’রাজ করান। দশম নবুয়্যত বর্ষে মে’রাজ সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে ইসলামী সমাজের মূলনীতি প্রদান করেন। এসময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতের জন্যে পাচ ওয়াক্ত নামাজও ফরয করে দেন। তাছাড়া আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দেন তাঁর কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রার্থনা করার জন্যে। মে’রাজ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে সূরা বনী ইসরাইল। তখনকার প্রাসঙ্গিক উপদেশ ও মূলনীতিগুলো মওজুদ রয়েছে এই সূরা বনী ইসরাইলে।

১৫। মদিনায় ইসলামের আলো

মক্কায় রাসুল (সঃ) এর নবুয়্যতী জীবনের তের বছরের শেষ পর্যায়। নবুয়্যত বর্ষ বারো। হজ্জ উপলক্ষে মদিনা থেকে আগত ১২ জন লোক গোপনে রাসুল (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা ঈমান আনার ঘোষণা দেন এবং মদিনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যান। রাসুল (সঃ) তাঁর সাহাবী মুসআব –কে মদিনার লোকদেরকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান এবং সেখানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পরের বছর হজ্জ উপলক্ষে ৭৫ জন লোক এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে রাসুল (সঃ) এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। তারা রাসুল (সঃ) কে মদিনায় হিজরত করার দাওয়াত দিয়ে যান। মদিনা আক্রান্ত হলে জান-মাল দিয়ে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়ে যান।

১৬। হিজরতের প্রস্তুতি

সাহাবীগনের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। রাসুল (সঃ) মনে মনে মদিনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সে হিসেবে সাহাবীদেরকে যার যেভাবে সম্ভব গোপনে হিজরত করে মদিনায় চলে যাবার অনুমতি দেন। ফলে যাদেরই হিজরত করার সামর্থ্য ছিলো, তারা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। থেকে যান আবুবকর। রাসুল (সঃ) তাঁকে নিজের হিজরতের সাথী বানানোর কথা জানিয়ে দেন।

১৭। হত্যার ষড়যন্ত্র

নবুয়্যতের তের বছর মাত্র পূর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী হিজরত করে মক্কা ছেড়েছেন। এসময় ইসলামের শত্রুরা আল্লাহর রাসুলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে এসে তারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে বের হলেই তাঁকে হত্যা করা হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

“স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দী করার, কিংবা হত্যা করার, অথবা দেশ থেকে বহিস্কার করার ষড়যন্ত্র করছিলো। তারা লিপ্ত ছিল তাঁদের চক্রান্তে। এদিকে আল্লাহও তাঁর পরিকল্পনা পাকা করে রাখেন। আল্লাহই সবচে’ দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)

মহান আল্লাহ তাঁদের চক্রান্তের খবর আগেই তাঁর রাসুলকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁদের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন হিজরতের উদ্দেশ্যে। ব্যর্থ হয়ে যায় আল্লাহর রাসুলকে হত্যার ষড়যন্ত্র।

১৮। রাসুলুল্লাহর হিজরত

রাসুলুল্লাহ (সঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে প্রিয় সাথী আবুবকরের বাড়িতে আসেন। আবু বকরও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এবার দু’জনে বেড়িয়ে পড়লেন মদানার উদ্দেশ্যে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে হলেও তারা প্রথমে রওয়ানা করেন দক্ষিন দিকে। কয়েক মাইল দক্ষিনের সওর নামক পাহাড়ের গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। তিন দিন পর সেখান থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এদিকে তার রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে খুজেও তাঁর নাগাল পায়নি। তারা তাঁকে ধরার জন্যে শত উট পুরস্কার ঘোষণা করে।

১৯। মদিনায় রাসুলুল্লাহ

রাসুলুল্লাহ (সঃ) আসছেন এ খবর আগেই পৌঁছে গেছে মদিনায়। আনন্দে মাতোয়ারা মদিনা। সম্বর্ধনার বিরাট আয়োজন। মদিনার আবাল বৃদ্ধ জনতা সানিয়াতুল বিদা উপত্যকা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তাঁকে সম্বর্ধনা জানায়। মক্কা ত্যাগ করে। মদিনা তাঁকে বরন করে নেয়। তিনিও বরন করে নেন মদিনাকে। মক্কা বিজয়ের পরেও তিনি ত্যাগ করেননি মদিনা।

২০। মদিনার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু

মদিনার পূর্ব নাম ছিলো ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহর আগমনের ফলে পাল্টে যায় ইয়াসরিবের নাম। তখন থেকে এ শহরের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা। মদিনায় আগমনের পরপরই তিনি এখানে ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন। যেমন –

১। প্রথমে চৌদ্দ দিন কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
২। তারপর আসেন মূল অবস্থানের জায়গায়। এখানে জমি ক্রয় করেন। কেন্দ্রীয় মসজিদ ‘মসজিদে নববী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
৩। এই মসজিদকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্র ঘোষণা করেন। এখান থেকেই তিনি পরিচালনা করেন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।
৪। হিজরত করে আসা সহায় সম্বলহীন মুসলিম এবং মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ফলে মুহাজিররা আনসারদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়।
৫। ‘মদিনা সনদ’ নামক খ্যাত মদিনার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদেরকে, মদিনায় অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্র ও কবিলাকে এবং সেখানকার ইহুদী গোত্রগুলোকে। এদের সবাইকে একটি ভৌগোলিক জাতি ঘোষণা করেন। শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সবাই মুহাম্মাদ (সঃ) এর নেতৃত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়।
২১। ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যক্রম

মুহাম্মাদ (সঃ) মহান ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এ রাষ্ট্রের আদর্শকে ভবিষ্যতের বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপদানের কার্যক্রম তিনি হাতে নেন। এ মহান রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রধান প্রধান মূলনীতি ও কার্যক্রম হলো। -

১। তিনি এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এক আল্লাহর সার্বভৌম বিধানের ভিত্তিতে।
২। এ রাষ্ট্রের আদর্শ, প্রেরনা ও আইনের উৎস ছিল আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।
৩। এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল জনগনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্য।
৪। এ রাষ্ট্রের সরকার ও নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব ছিলো স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন এবং সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালন।
৫। এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মসূচী ও কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি ছিল জননিরাপত্তা, সুবিচার ও মানবকল্যাণ।
৬। এ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্মসূচী ছিলো – ১। রাষ্ট্র ও জনগনের নিরাপত্তা প্রদান, ২। এক আল্লাহর ইবাদাত প্রবর্তন ও সালাত কায়েম। ৩। শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থার প্রচলন ও যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ৪। পরামর্শ ভিত্তিক শাসন পরিচালনা। ৫। সততা, সুনীতি, সৎকর্ম ও সদাচারের সম্প্রসারন। ৬। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের অপসারন। ৭। ভালো কাজে প্রেরনা ও সহযোগিতা প্রদান। ৮। মন্দ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। ৯। জনগনের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যাপক সম্প্রসারন। ১০। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান ও গণপূর্ত।
৭। বিশ্বব্যাপী মানবসমাজকে শান্তি ও কল্যাণের দিকে আহবান।
২২। কুরাইশদের আশংকা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি

মুহাম্মাদ (সঃ) হিজরত করে মদিনায় চলে আসার কারনে কুরাইশরা নিজেদেরকে বড় ধরনের বিপদের ঝুকির মধ্যে অনুভব করছিলো। তারা চিন্তা ভাবনা করে দেখলো –

১। মদিনায় থেকে মুহাম্মাদ স্বাধীনভাবে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়ে গেলো।
২। মুহাম্মাদ গোটা আরবে তাঁর ধর্ম ছড়িয়ে দেবে এবং সব গোত্র ও কবিলার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে।
৩। মুহাম্মাদ রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করবে।
৪। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
৫। সুযোগ মতো মুহাম্মাদ মক্কা আক্রমন করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করবে এবং আমাদের মক্কা থেকে উৎখাত করবে।
এসব ভেবে কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর ভিত মজবুত হবার আগেই মদিনা আক্রমন করে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

২৩। রাসুলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধ

এদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমন হতে পারে এ কথা রাসুল (সঃ) নিজেও ভেবে রেখেছেন।

বদর যুদ্ধ – কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। তাঁদের কাছে ছিল ঘোড়া এবং আধুনিক সব সমরাস্ত্র।

রাসুল (সঃ) তাঁদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনশো তের জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন। বাহিনীর কাছে অশ্ব এবং আধুনিক অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলোনা। দ্বিতীয় হিজরির ১২ বা ১৭ রমযান বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছিলো এক ঐতিহাসিক আদর্শিক যুদ্ধ। –

১। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো তাগুতের পক্ষে, মিথ্যা বাতিলকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেএবং নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিলের পথ নিরাপদ রাখতে।
২। এক পক্ষ নির্ভর করেছিলো আল্লাহর সাহায্যের উপর। অপর পক্ষ নির্ভর করেছিলো নিজেদের সমর শক্তির উপর।
৩। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো জীবন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করার জন্যে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো নিজেদের জীবন রক্ষা করার জন্যে।
৪। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিল প্রতিরক্ষামূলক। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিলো আগ্রাসী।
৫। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিলো ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিল ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ রক্ষার লক্ষে।
অবশেষে এ যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী বিজয়ী হয়। আগ্রাসী কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে আগ্রাসী কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। এদিকে ২২ জনজন মুসলিম সেনা শাহাদাৎ বরন করেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়।

উহুদ যুদ্ধ- কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পরের বছর তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে আবার মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। এবার তারা তাঁদের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে নেয়। তারা তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। যুবকদের আগ্রহের কারনে তিনি মদিনার বাইরে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের কাছে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সাতশো জানবাজ সাহাবীর বাহিনী নিয়ে তিনি উহুদে এসে পৌঁছান। উহদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রাসুল (সঃ) যুদ্ধ লড়ার স্থান নির্ধারণ করেন। পেছনের আইনান পাহাড়ে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো। শত্রু বাহিনী এ সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে তাঁদের পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারে এ আশংকায় রাসুল (সঃ) সুড়ঙ্গ মুখে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী নিযুক্ত করেন। তাঁদের নির্দেশ দেন, যুদ্ধে আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমরা কোন অবস্থাতেই এ স্থান ত্যাগ করবেনা। যুদ্ধ শুরু হল। মুসলিম বাহিনীর আক্রমনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে কুরাইশ বাহিনী তাঁদের সাজ সরঞ্জাম ফেলে পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী তাঁদের চরম তাড়া করে। এদিকে সুড়ঙ্গ মুখে নিয়োজিত লোকেরা ভাবলো, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়েছে। ফলে তাড়া তাঁদের সেনাপতি আব্দুল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মূল বাহিনীর সাথে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। আব্দুল্লাহ মাত্র বারো জন তীরন্দাজ নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। এদিকে শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী দলের প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ সুড়ঙ্গ পথ অরক্ষিত পেয়ে এখান দিয়ে ঢুকে পড়েন। আব্দুল্লাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁদেরকে প্রতিহত করার প্রানপন চেষ্টা করে শাহাদাৎ বরন করেন। খালিদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে। মুসলিম বাহিনী এদের প্রতিহত করার জন্যে পেছনমুখী হলে পলায়নপর শত্রু বাহিনী ঘুরে দাড়ায়। শুরু হয় দ্বিমুখী আক্রমন। ফলে মুসলিম বাহিনী হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে রাসুল (সঃ) সবাইকে একত্রিত করেন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুপক্ষকে তাড়া করেন এবং তারা মক্কায় ফিরে যায়। এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। আহত হন অনেকে। কয়েকজন সৈনিক কর্তৃক সেনাপতির নির্দেশ লংঘনের ফলে মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে এই বিরাট বিপর্যয়।

খন্দকের যুদ্ধ – পঞ্চম হিজরি সন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হতে না পারলেও কুরাইশরা ভালোভাবেই বুঝেছিল, তাঁরাও বিজয়ী হতে পারেনি। ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বের অবস্থায়ই সদর্পে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারা বিশাল প্রস্তুতি নেয়। আশেপাশের সব মিত্র গোত্রের যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তারা অগ্রসর হয় মদিনার দিকে। এদিকে রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। এবার তিনি এক অভিনব কৌশল গ্রহন করেন। তাহলো, মদিনায় প্রবেশের গোটা এলাকা জুড়ে তিনি পরীখা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে এবং সক্ষম সকল সাহাবীরাই পরীখা খননের কাজে অংশ নেন। দশ গজ চওড়া, পাঁচ গজ গভীর সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরীখা তারা খনন করে ফেলেন। এতে প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়ে রাসুল (সঃ) মাত্র পনের দিনে এ বিশাল যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করেন। এতেই বুঝা যায়, তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। মাথা প্রতি প্রায় এক হাজার বর্গগজের চাইতে বেশী মাটি কাটতে ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই কম বেশী দশ হাজার বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে কুরাইশরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কিন্তু অভিনব কৌশলের পরিখা দেখে তাঁদের মাথায় হাত। তবে মদিনার ঘরের শত্রু ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে গপনে হাত মিলিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিমদের বাড়ি ঘরগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে কুরাইশ বাহিনী দীর্ঘ এক মাস মদিনা অবরোধ করে রেখেও কোন সুবিধা করতে পারে নি। এ সময় এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড় কুরাইশদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের বাহিনী পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারেই তারা মদিনা অবরোধ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই রাসুল (সঃ) মদিনা সনদ ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে চরমভাবে শায়েস্তা করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন সূরা আহযাবের ৯-২৭ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন-

“হে মুমিনরা, স্মরণ করো তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের এখানে এসে পড়েছিলো, তখন আমরা তাঁদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম ঝরো হাওয়া আর এমন এক বাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।” (আহযাব, আয়াত ৯)

কুরাইশরা চলে যাবার পড়ে রাসুল (সঃ) ঘোষণা দিলেন- “কুরাইশরা আর কখনো মদিনা আক্রমন করতে পারবেনা। ”

এগুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধ, এ ছাড়াও আরো অনেক ছোট খাটো অভিযান পরিচালিত হয়েছে।

২৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং এর সুফল

ষষ্ঠ হিজরি সন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্নে হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার নির্দেশ পান। জেনে রাখা ভালো, নবীদের স্বপ্নও অহী। সে অনুযায়ী তিনি এবছর যিলকদ মাসের শেষ দিকে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে করে নেন কুরবানীর উট। হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের বাধা দেয়া মক্কার সনাতন ধর্মেও নিষেধ ছিলো। কিন্তু কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর কাফেলাকে মক্কার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে এসে বাধা দেয়। তিনি উসমান (রা) –কে মক্কায় পাঠান তাঁদের নেতাদের একথা বলার জন্যে যে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসিনি। আমরা হজ্জ, উমরা, কুরবানী ও যিয়ারত শেষে চলে যাবো। আমরা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনেনি। তারা তাঁকে আটকে রাখে। উসমানকে অর্থাৎ রাসুলের দূতকে আতক করার সংবাদ শুনে সাহাবীগন উসমানকে উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা এ উদ্দেশ্যে রাসুল (সঃ) এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহন করেন। এ শপথে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ সাহাবীদের প্রসঙ্গে বলেন –

“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত ১৮)

অবশ্য পরে কুরাইশরা উসমান (র) কে ছেড়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন। তারা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে। রাসুল (সঃ) তাঁদের আরোপিত শর্তানুযায়ী সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সন্ধির অধিকাংশ শর্তই ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক। কিন্তু তাতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার একটি ধারা ছিল। সাহাবীগন মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া সত্যেও রাসুল (সঃ) এই ধারাটিকে লুফে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এ বছর উমরা না করে পরের বছর উমরা করার একটি শর্ত ছিলো। সে অনুযায়ী রাসুল (সঃ) কাফেলা নিয়ে ফিরে চললেন মদিনার দিকে। পথিমধ্যেই নাযিল হল সূরা আল ফাতাহ। এ সুরার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে-

“হে নবী, আমরা তোমাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দিলাম।’’

সত্যিই এ ছিলো এক সুস্পষ্ট বিজয়। রাসুল (সঃ) সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারন করতে থাকলেন। দুই বছরের মধ্যেই কুরাশরা বন্ধুহীন হয়ে পড়লো। খালিদ বিন অয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস সহ কুরাইশদের অনেক বড় বড় সেনাপতি এরই মধ্যে ইসলাম গ্রহন করেন।

২৫। মক্কা বিজয়

হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যে অন্যায় শর্তাবলী দিয়ে চুক্তি সম্পাদিত করেছিল, সেগুলো তাঁদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দাড়ায়। ফলে সে চুক্তি তারা নিজেরাই ভংগ করে। অপরদিকে রাসুল (সঃ) নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন। ইসলামী জনবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আরবের অধিকাংশ গোত্রই পর্যায়ক্রমে কুরাইশদের সাথে মিত্রতা ত্যাগ করে। যাই হোক, চুক্তি ভংগের কারনে রাসুল (সঃ) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম হিজরি সনের ১০ রমযান। রাসুল (সঃ) দশ হাজার জিন্দাদিল ইসলামী সেনাদল সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন মক্কা অভিমুখে। ২০ রমযান মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মক্কায়। আজ আর তাঁকে বাধা দেয়ার কোন শক্তি কারো ছিলো না। সম্পূর্ণ বিনা বাধায় আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে তিনি এবং তাঁর সাথীরা মক্কার হারাম শরীফে প্রবেশ করেন।

ভেঙ্গে ফেলেন আল্লাহর ঘরে রাখা ৩৬০ টি ভাস্কর্য মূর্তি। তাঁকে চরম কষ্ট দিয়ে থাকলেও তিনি ক্ষমা করে দেন মক্কার লোকদের। তিনি তাঁদের বলেন- ‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মক্কার আশেপাশের গোত্রগুলোতে রক্ষিত মূর্তিগুলোও নির্মূল করা হলো। মক্কা ভূমি থেকে উৎপাটিত করা হলো শিরকের শিকড়। ঘোষণা করা হলো আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর রাসুল (সঃ) কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান করেন। এখান থেকে গিয়ে অভিযান চালিয়েই জয় করেন, হাওয়াযীন ও বনু সাকিফ। হোনায়েন প্রান্তরে যুদ্ধ হয় এদের সাথে। তারা চরমভাবে পরাজিত হয়। এ সময় তিনি তায়েফও অধিকার করেন। মক্কা বিজয় উপলক্ষে রাসুল (সঃ) উনিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধের পর ফিরে আসে মদিনায়।

২৬। ইসলামের ছায়াতলে জনতার ঢল

মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহনের জন্যে জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে মদিনার অভিমুখে। আরব উপদ্বীপের ছোট বড় সব গোত্র তাঁদের প্রতিনিধি দল পাঠাতে থাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে তাঁদের ইসলামের ছায়াতলে আগমনের সংবাদ জানাবার জন্যে। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী বছর বড় ছোট শতাধিক প্রতিনিধিদল মদিনায় এসে তাঁদের এবং তাঁদের গোত্রের ইসলাম গ্রহনের ঘোষণা দেয়। ইসলামের ছায়াতলে এই জনস্রোতের আগমনের কথা মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন –

“যখন এসেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি দেখতে পাচ্ছো, লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দীনে। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো তাঁর কাছে। অবশ্যি তিনি পরম ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সূরা আন নাসর)

২৭। তাবুক যুদ্ধ

রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক সবচেয়ে বড় অভিযান ছিলো তাবুক অভিযান। এ অভিযান ছিলো বর্তমান সিরিয়া ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন বৃহৎশক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অভিযানের রয়েছে পূর্ব ঘটনা। তাহলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সঃ) মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে গোটা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠান। এছাড়া সর্দার ও শাসকদের কাছে পত্র মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে দূত পাঠান। সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি তাঁর একটি পনের সদস্যের দাওয়াতী প্রতিনিধিদলকে খ্রিষ্টানরা হত্যা করে। প্রানে বেঁচে আসে শুধুমাত্র দলনেতা কাব বিন উমায়ের গিফারী। একই সময় রাসুল (সঃ) বুসরার গভর্নরের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠিয়েছিলেন হারিস বিন উমায়েরকে। কিন্তু রোম সম্রাটের অনুগত এই খৃষ্টান সর্দার আল্লাহর রাসুলের দূতকে হত্যা করে। রোম সাম্রাজ্যের এসব অন্যায় ও অপরাধমূলক আগ্রাসী থাবা থেকে আরব অঞ্চলকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে অষ্টম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে রাসুল (সঃ) হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে পাঠান। কিন্তু এই সেনাদলটি মাআন নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন, বুসরার গভর্নর শুরাহবিল এক লাখ সৈন্য নিয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। সামনে অগ্রসর হয়ে মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখ সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তিন হাজার জিন্দাদিল মুসলিম এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্যাপক হতাহত হয় শুরাহবিল বাহিনী। এ যুদ্ধে বারোজন মুসলিম সেনাও শহীদ হন। এই বারো জনের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতিও অন্তর্ভুক্ত। তারা হলেন- যায়িদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা)। পরের বছর নবম হিজরিতে রোম সম্রাট কাইজার মুসলমানদের থেকে মুতা যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া এবং তাঁদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সীমান্তে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। জানা যায়, তারা সীমান্তে দুই লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। আরব ভূখণ্ডের দিকে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই রাসুল (সঃ) তাঁদেরকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ অভিযান ছিল ব্যাপক দূরত্বের অভিযান। ছিলো গরমের মওসুম, অর্থনৈতিক সমস্যা, ফসল পাকার মওসুম, সোয়ারীর অভাব। তা সত্যেও রাসুল (সঃ) বৃহৎ শক্তির হামবড়া ভাব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। নবম হিজরির রযব মাসে তিনি ত্রিশ হাজার জিন্দাদিল মুজাহিদকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন সিরিয়া সীমান্তের দিকে। এদিকে রোম সম্রাট ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বনবী (সঃ) তাবুক নামক স্থানে পৌঁছে খবর পান, কাইজার সিরিয়া সীমান্ত থেকে তাঁর বাহিনী গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে সিরিয়া প্রবেশ না করে রাসুল (সঃ) বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। আরব ভূখণ্ডে কাইজারের যেসব ছোট ছোট করদ রাজ্য ছিলো, তিনি সেগুলোর সর্দারদের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট বাহিনী পাঠান। এতে করে তারা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে আল্লাহ পাক স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রভাব সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সূরা আত তওবার ৩৮-৭২ নং আয়াত তাবুক যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এবং ৭৩ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত আয়াতগুলো তাবুক থেকে ফিরে আসার পরে নাযিল হয়। এ আয়াতগুলোতে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে উৎসাহ প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূরা তাওবার এ আয়াতগুলো পড়লে তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া যাবে।

২৮। বিদায় হজ্জ

হজ্জ ফরয হওয়ার পর রাসুল (সঃ) একবারই হজ্জ করেন। আবার এ হজ্জেই তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সে কারনে এ হজ্জকে বিদায় হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিদায়ী হজ্জ। দশম হিজরি সন। এ বছর বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা মুহাম্মাদ (সঃ) হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্তকার গোটা মুসলিম মিল্লাতকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, রাসুলুল্লাহর হজ্জে যাবার খবর। সব গোত্র ও কবিলার সামর্থ্যবান মুসলিমরা হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চতুর্দিকে বইয়ে চলছে আনন্দের বন্যা। দশ হিজরি সনের ২৬ জিলকদ তারিখে আল্লাহর রাসুল (সঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ৫ জিলহজ্জ তারিখে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ শেষে ১৪ যিলহজ তারিখে ফিরে রওয়ানা করেন মদিনা অভিমুখে। এ হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ প্রদান করেন। একটি আরাফার ময়দানে অপরটি মিনায়। তাঁর এ ভাষণ ছিলো ইসলামী রাষ্ট্রের মেনিফেস্টো। এক লাখ চব্বিশ হাজার, কোন কোন বর্ণনায় এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে হজ্জে শরীক হয়েছিলেন। তাঁর এ হজ্জই মুসলিম উম্মাহর জন্যে হজ্জের মডেল।

২৯। বিদায় হজ্জের ভাষণ

হজ্জ উপলক্ষে রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ৯ যিলহজ্জ তারিখে আরাফার ময়দানে। অপরটি ১০ যিলহজ্জ তারিখে মিনায়। এ দুটি ভাসনে তিনি অনেকগুলো মৌলিক নির্দেশনা তিনি প্রদান করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—

১। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও রাসুল।
২। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদাত ও উপাসনা করবে।
৩। তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। পরস্পরের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ করা হলো।
৪। আমানাত তাঁর প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেবে।
৫। সুদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।
৬। জাহেলী যুগের সমস্ত কুসংস্কার রহিত করা হলো।
৭। খুনের প্রতিশোধ যুদ্ধ রহিত করা হলো।
৮। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যার দণ্ড একশো উট।
৯। তোমরা শয়তানের আনুগত্য করোনা।
১০। তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার হলো তারা স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে যৌনাচার করবেনা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা তাঁর অর্থসম্পদ খরচ করবেনা।
১১। স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো, তারা পবিত্র জীবন যাপন করলে স্বামী প্রচলিত উত্তম পন্থায় তাঁদের জীবন সামগ্রী প্রদান করবে।
১২। একজনের অপরাধের জন্যে আর একজনকে দণ্ড দেয়া যাবেনা।
১৩। তোমাদের নেতা কোন নাক বোঁচা হাবশি হলেও সে যদি আল্লাহর কিতাবের আনুগত্য করে, তবে তাঁর আদেশ পালন করবে।
১৪। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই।
১৫। সমস্ত মানুষের স্রষ্টা একজন। সবার পিতাও একজন। সুতরাং কোন মানুষের উপর অপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
১৬। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও ন্যায়নীতিবান।
১৭। তোমাদের অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হও। তাঁদের প্রতি অন্যায় করোনা। তাঁদের আঘাত করোনা। তোমরা যা খাবে, পরবে, তাদেরকেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
১৮। বিবাহিত ব্যাভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
১৯। উত্তরাধিকার কে কতটুকু পাবে, স্বয়ং আল্লাহ তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্যে আর অসিয়ত করা যাবেনা।
২০। মনে রেখো, ঋণ অবশ্যি পরিশোধ করতে হবে।
২১। মনে রেখো, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা। (দলাদলি ও কট্টরপন্থা অবলম্বন করবেনা।)
২২। আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতোদিন এ দুতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা বিপথগামী হবেনা। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং অপরটি হলো সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ।
যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা এ ফরমানগুলো অনুপস্থিতদের কাছে, পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দেবে।

৩০। মুহাম্মাদ (সঃ) এর মৃত্যু

কোন নবী রাসুলই চিরজীবী হননি। সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অবধারিত। মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কেও আল্লাহ বলেন – “হে মুহাম্মাদ, তুমিও মরনশীল, তাঁরাও মরনশীল।” (আল কুরআন ৩৯ ; ৩০)

হজ্জ শেষে রাসুল (সঃ) যিলহজ মাসের শেষার্ধেই মদিনায় ফিরে আসেন। এরপর মহররম মাস মোটামুটি ভালোভাবেই অতিবাহিত করেন। সফর মাস থেকে তাঁর অসুস্থতা দেখা দেয়। ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেন আখিরাতের দিকে। মৃত্যুর চার পাচদিন আগে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লোকেরা তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন তিনি সাহাবীগনের মজলিশে সর্বশেষ একটি ছোট্ট ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন-

“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাঁদের নবী ও পুণ্যবান লোকদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছিল। তোমরা এমনটি করোনা। আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরকে সিজদা ও উপাসনার জায়গা বানিয়ো না। যারা নবী ও পুণ্যবানদের কবর পূজা করবে, তাঁদের উপর আল্লাহর গযব। আমি তোমাদেরকে একাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বানী পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।”

৩১। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা

মুহাম্মদ (সঃ) এর মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলো নবী রাসুল আগমনের সিলসিলা। পৃথিবীতে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। তাই মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ উপলক্ষে আরাফার ভাষণের সময় মহান আল্লাহ অহী নাযিল করে এ সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করেন। তিনি বলেন-

“আজ আমি তোমাদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (কুরআন) এবং তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।” (আল কুরআন ৫ ; ৩) এ ছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআন মজীদে আরো বলে দিয়েছেন-

১। “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দ্বীন হলো ইসলাম।” (আল কুরআন ৩ ; ১৯)
২। “যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (ধর্ম, মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতি) গ্রহন করবে, তাঁর থেকে তা গ্রহন করা হবেনা। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল কুরআন ৩ ; ৮৫)
৩। “আল্লাহ কাউকেও সঠিক পথে চলার তৌফিক দিতে চাইলে ইসলামের জন্যে তাঁর হৃদয়কে উম্নুক্ত করে দেন। আর তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তাঁর অন্তরকে করে দেন সংকীর্ণ। তখন তাঁর কাছে ইস্লামে প্রবেশ করাটা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে উঠার মতই কষ্টসাধ্য মনে হয়। যারা ঈমান আনেনা, আল্লাহ এভাবেই তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।” (আল কুরআন ৬ ; ১২৫)
৪। “আল্লাহ যার হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন ইসলামের জন্যে এবং যে রয়েছে তাঁর প্রভুর প্রদত্ত আলোর মধ্যে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যার অবস্থান এরকম নয়?” (আল কুরআন ৩৯ ; ২২)
৫। “ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় যালিম আর কে? যাকে ইসলামের দিকে ডাকা হলে সে মিথ্যা রচনা করে আল্লাহর দিকে আরোপ করে? ’’(আল কুরআন ৬১ ; ৭)
৬। “আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলোকবর্তিকা (মুহাম্মাদ সাঃ) এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব (আল কুরআন)। এর মাধ্যমে আল্লাহ সে সব লোকদের সালামের (ইসলামের, শান্তির ও নিরাপত্তার) পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষী। আর তিনি নিজ অনুমতিক্রমে তাঁদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং তাঁদের পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।”
(আল কুরআন ৫ ; ১৫-১৬)

সমাপ্ত


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি