যে সমষ্টিগত পরিবেশে ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ক যথার্থ নৈতিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় একমাত্র সেখানেই ইসলামের চাহিদা অনুযায়ী কর্তৃত্ব ও আনুগত্য যথাযথভাবে প্রবর্তিত হতে পারে। এই নৈতিক ভিত্তিগুলিকে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সা) দ্বারা যথাযথভাবে নির্ধারণ করেছেন। বিশেষ করে সূরায়ে হুজরাতে এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করা হয়েছে। ইসলামী সমাজ ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এগুলি সম্মুখে রাখা প্রয়োজন। এইখানে আমি সংক্ষেপে এর উল্লেখ করছিঃ

১. সমাজ জীবনকে ত্রুটিশূন্য রাখার জন্য প্রথম নির্দেশ হচ্ছেঃ

يــَااَيـهـاَ الـَّذِيـنَ اَمَنـُوا اِن جــاَءَكُـم فــاَسـِقٌ بـِـنَـبـاَءٍ فَـتـَبـيـَنـُوا اَن تَـًصِيـبُوا قـَومـأً بِـجـَهـأَ لَـةٍ فـَتـُصـبـِحـُوا عَـلـىَ مَـا فـَعَـلـتـُم نَـدِمـِيـنَ-

“হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসেক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে, তাহলে (সে সম্পর্কে চিন্তা গ্রহণের পূর্বে) অনুসন্ধান করো, যাতে করে তোমরা অজ্ঞাতে (বিক্ষুদ্ধ হয়ে) কোন দলের ওপর আক্রমন না করো এবং পরে এ জন্য পস্তাতে না হয়।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ ৬)

কোন খবর বা বিবরণ শুনার পর সঙ্গে সঙ্গেই সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অনেক সময় মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। এই ধরণের ভুলের কারণে পরে লজ্জিত হতে হয়। এ নির্দেশটি অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামী সমাজের সদস্যদের এর ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকা উচিত। ফাসেকদের প্রদত্ত খবরে পরস্পরের সম্পর্কে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।

২. দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছেঃ

اِنَّـمـاَ المُـؤمِنـُونَ اِخوأَةٌ فَـاَصـلِحـُوا بَـيـنَ اَخَـوَيـكَـُم-

“ঈমানদারেরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইদের মধ্যে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠিত করো।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১০)

এ নির্দেশটির উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিস্কার। মুসলিম সমাজের সদস্যদের মধ্যে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি কখনো মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ দেখা দেয়, তাহলে ফেতনাকে আরো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা অন্য ভাইদের কাজ নয়। বরং তাদের কাজ হচ্ছে সন্দেহ-সংশয় দূর করা, বিবাদমান পক্ষদ্বয়কে নিকটতর করা এবং উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য চেষ্টা চালানো, যার ফলে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক পুনর্বহাল হতে পারে। কেননা এই ভ্রাতৃত্ব ছাড়া ইসলামী দলের শৃঙ্খলা কোন দিন মজবুত হতে পারে না।

৩. তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছেঃ

يـَاَ يـُّهـاَ الـّذِيـنَ اَمَـنـُوا لأَ يَـسـخَـر قـَومٌ مِّـن قـَومٍ عَـسـىَ اَن يـَّكُـونـُوا خَـيـراً مـِّنـهـُم- وَلاَ نـِسـأءٌ مِّـن نـِسـأءٍ عَـسـىَ اَن يـَّكُـنَّ خَـيـراً مـَّنـهـُنَّ- وَلاَ تَـلمِزُوا اَنـفـُسـَكُـم وَلاَ تَـنـاَ بَـزُوا بـِالاَلـقَـَابِ- بـِئـس الاَِ سـمُ الغُـسـُوقُ بـَعـدَ الاِيـمـأَنِ- وَ مَـن لَّـم يَـتـُب فَـاُولــئـكَ هـُمُ الظاَّلِـمـُونَ-

“হে ঈমানদারগন! তোমাদের একদল যেন অন্য দলের প্রতি বিদ্রুপ না করে, কেননা হতে পারে তারা এদের তুলনায় ভালো লোক। আর তোমাদের মেয়েরা যেন অন্য মেয়েদের বিদ্রুপ না করে, কেননা হতে পারে তারা এদের তুলনায় ভালো । আর তোমরা পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়িয়ো না, পরস্পরের জন্য অসম্মান জনক নাম ব্যবহার করো না। কেউ ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা গোনাহ্ । এসব কাজ থেকে যারা তওবা করে না তারা জালেম।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১১)

এ নির্দেশের মাধ্যমে বিদ্রুপ করা, পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো এবং অসম্মানজনক নাম ব্যবহার করা থেকে মুসলমানকে বিরত রাখা হয়েছে এবং এজন্য সতর্কবাণী শুনানো হয়েছে যে, যারা এ অভ্যাস পরিত্যাগ করবে না তারা সৎ মুমিনদের দলভুক্ত হবে না, বরং তারা হবে জালেমদের দলভুক্ত। এ দোষগুলি সমাজদেহে ঘুণ ধরিয়ে দেয়। এই ছোট দোষগুলি মনে ভাঙ্গন ধরায়। যে দলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ, কটাক্ষ, মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা, অসম্মান করা প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি হয় সে দল কখনো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের উন্নততর পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। আমাদের প্রত্যেক কর্মীর এই রোগসমূহ খেকে মুক্ত থাকার জন্য চেষ্টা করা উচিত।

৪. চতুর্থ নির্দেশ হচ্ছেঃ

يـَاَ يـُّهـاَ الـّذِيـنَ اَمَـنـُوا اِجـتَنـِبـُوا كــثـَيـِراً مِّنَ الـظَّـنِّ- اِنَّ بَـعـضَ الـظّـنِّ اِثـمٌ- وَلاَ تـَجَـسّـَسُـوا وَلاَ يـَغـتـَب بـَعـضُـكُـم بـَعـضاـً أيـُبُّ اَحـَدُكُـم اَن يّـَأكُـلُ لَـحـمَ اَخِـيـهِ مـَيـتاً فَـكَـرِهـتـُمُوهُ- وَاتَـقُـوااللهَ- اِنَّ اللهَ تَوَّابٌ رَّحِـيـمٌ-

“হে ঈমানদারগণ! খুব বেশী কু-ধারণা পোষন থেকে বিরত থাক। কেননা অনেক কু-ধারণা গোনাহর নামন্তর। অন্যের অবস্থা জানার জন্য গোয়েন্দাগীরি করো না এবং কারুর গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? (না, করবে না) বরং তোমরা তা ঘৃণা করো। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াময়।“ (সূরা হুজরাত, আয়াতঃ১২)

এ আয়াতটির প্রথম দাবী হচ্ছে এই যে, মুসলিম দলের সদস্যদের পরস্পরের সম্পর্কে কু-ধারণা করা যাবে না। মনের মাটিতে সন্দেহ-সংশয়ের বীজ বপন করা যাবে না। পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা এবং এদিক-ওদিক থেকে শুনে শুনে কারুর বিরুদ্ধে দোষের পাহাড় গড়ে তোলা যাবে না, কেননা প্রত্যেকটি ভিত্তিহীন সন্দেহ-সংশয় ও দোষারোপ আসলে একটি গোনাহ।

এর দ্বিতীয় দাবী হচ্ছে এই যে, পরস্পরের গোপনীয়তা জানার জন্য গোয়েন্দাগিরি করা যাবে না। গোয়েন্দাগিরির অর্থ এই যে, পরস্পরের দোষ খুঁজে বেড়ানো বা গোপন কথা জানার জন্য সর্বত্র ঢু-মারা অথবা বিভিন্ন মজলিসের ভেতরের কথা জানার জন্য তৎপর থাকা। এগুলি অত্যন্ত দোষনীয় এবং শৃঙ্খলার জন্য ধ্বংসকর।

এর তৃতীয় দাবী হচ্ছে এই যে, একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যের দোষ বর্ণনা করে আনন্দ উপভোগ করা যাবে না। কেননা এটা মারাত্মক অপরাধ। এটা হচ্ছে যে ব্যক্তির গীবত করা হয় তার গোশত কেঁটে খাওয়ার তুল্য ঘৃণ্য অপরাধমূলক কাজ। এই দাবীগুলোর প্রতি যত অধিক নজর রাখা হবে ততই আন্দোলনের ঐক্য ও সহযোগীদের ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হবে এবং কর্তৃত্ব ও আনুগত্য ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে।

দলীয় চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত আরো কতিপয় বিষয় সূরায়ে হুজরাতে আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে সেগুলি সম্পর্কেও চিন্তা করতে পারেন। এখানে মাত্র কতিপয় সুস্পষ্ট নৈতিক দাবী পেশ করা হলো।

পরিশেষে বলা যায়, যদি আমরা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কায়েমের যথাযথ ব্যবস্থা করে দলীয় নীতি ও শৃঙ্খলার আনুগত্য করি এবং উল্লেখিত নৈতিক গুনাবলী নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তাহলে ইনশাল্লাহ আমাদের ব্যর্থতার সামান্যতম সম্ভবনাও নেই। আল্লাহ যদি আমাদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার তিনটি সুযোগ দেন তাহলে বিশ্বাস করুন, আমরা ব্যবসায় যে পুঁজি খাটাচ্ছি তা কয়েকগুণ অধিক মুনাফা দানে সক্ষম হবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি