তাল্হা ইবন উবাইদুল্লাহ (রা)
আবু মুহাম্মাদ তাল্হা তাঁর নাম। পিতা উবাইদুল্লাহ এবং মাতা সা’বা। কুরাইশ গোত্রের তাইম শাখার সন্তান। হযরত আবু বকর রা.ও ছিলেন এই তাইম কবীলার লোক। তাঁর মা সা’বা ছিলেন প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী হযরত ’আল ইবনুল হাদরামীর বোন।
হযরত তালহা ইসলামের সূচনা পর্বেই মাত্র পনেরো বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের রা. দাওয়াতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। জাহিলী যুগে আবু বকরের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের তিনি ছিলেন নিয়মিত সদস্য।
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বড় চমকপ্রদ। তিনি গেছেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলার সাথে সিরিয়া। তাঁরা যখন বসরা শহরে পৌঁছলেন, দলের অন্য কুরাইশ ব্যবসায়ীরা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাজারের বিভিন্ন স্থানে কেনা-বেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তিনি বাজারের মধ্যে ঘুরাফেরা করছেন, এমন সময় যে ঘটনাটি ঘটলো তা তালহার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি বলেনঃ
‘আমি তখন বসরার বাজারে। একজন খৃস্টান পাদরীকে ঘোষণা করতে শুনলামঃ ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়! আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোন লোক আছে কিনা। আমি নিকটেই ছিলাম। দ্রুত তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কার লোক।’ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে আহমাদ কি আত্মপ্রকাশ করেছেন?’ বললাম ‘কোন আহমাদ?’ বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তালিবের পুত্র। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুর উদ্যান বিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।’ তালহা বলেন, ‘তাঁর এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করলো। আমি আমার কাফিলা ফেলে রেখে বাহনে সওয়ার হলাম। বাড়ীতে পৌঁছেই পরিবরের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলামঃ আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু ঘটেছে কি? তারা বললোঃ ‘হ্যাঁ, মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ নিজেকে নবী বলে দাবী করেছে এবং আবু কুহাফার ছেলে আবু বকর তাঁর অনুসারী হয়েছে।’
তাল্হা বলেন, আমি আবু বকরের কাছে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ এ কথাকি সত্যি যে, মুহাম্মাদ নবুওয়াত দাবী করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন? বললেনঃ হ্যাঁ, তারপর তিনি আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি তখন খৃস্টান পাদরীর ঘটনা তাঁর কাছে খুলে বললাম। অতঃপর তিনি আমাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে গেলেন। আমি সেখানে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং রাসূলুল্লাহর সা. নিকট পাদরীর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। শুনে তিনি দারুণ খুশী হলেন। এভাবে আমি হলাম আবু বকরের হাতে ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ ব্যক্তি।
তাল্হার ইসলাম গ্রহণে তাঁর মা বড় বেশী হৈ চৈ শুরু করলেন। কারণ, তাঁর বাসনা ছিল, ছেলে হবে গোত্রের নেতা। গোত্রীয় লোকেরা তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করে দেখলো তিনি পাহাড়ের মত অটল। সোজা আংগুলে ঘি উঠবে না ভেবে তারা নির্যাতনের পথ বেছে নিল। মাসুদ ইবন খারাশ বলেনঃ ‘একদিন আমি সাফা-মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, একদল লোক হাত বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। তারপর তাকে উপুড় করে শুইয়ে তার পিঠে ও মাথায় বেদম মার শুরু করলো। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধ মহিলা চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে তাকে গালাগালি দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বললোঃ এ হচ্ছে তাল্হা ইবন উবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বনী হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। এ মহিলাটি কে? তারা বললোঃ সা’বা বিনতু আল-হাদরামী-যুবকটির মা।’
কুরাইশদের সিংহ বলে পরিচিত নাওফিল ইবন খুয়াইলিদ তালহার কাছে এলো। তাঁকে একটি রশি দিয়ে বাঁধলো এবং সেই একই রশি দিয়ে বাঁধলো আবু বকরকেও। তারপর তাদের দু’জনকে সোপর্দ করলো, মক্কার গোঁয়ার লোকদের হাতে নির্যাতন চালানো জন্য। একই রশিতে তাঁদের দু’জনকে বাঁধা হয়েছে, তাই তাঁদেরকে বলা হয় ‘কারীনান’।
ইসলাম গ্রহণের পর এভাবে তিনি আপনজন ও কুরাইশদের যুল্ম অত্যাচারের শিকার হন। দীর্ঘ তেরো বছর অসীম ধৈর্যের সাথে সবকিছু সহ্য করেন এবং একনিষ্ঠভাবে ইসলামের তাবলীগ ও প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। তিনি মক্কার আশ পাশের উপত্যকায় বিদেশী অভ্যাগতদের সন্ধান করতেন, বেদুঈনদের তাঁবু এবং শহরের পরিচিত অঅংশীবাদীদের গৃহে চুপিসারে উপস্থিত হয়ে তাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ অন্যদের মত তিনিও নিয়মিত যেতেন। ইসলাম ও মুসলমানদের এ দুঃসময়ে আল্লাহর দ্বীনের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব ধরণের চেষ্টা ও সাধনা করেছেন।
৬২২ সনের অক্টোবর মাসে আবু বকরকে সংগে করে রাসূল সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন। তাঁদের এ দুর্গম সফরের পথ প্রদর্শক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন উরায়কাত। তিনি তাঁদেরকে মদীনায় পৌঁছে দিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন এবং আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহর নিকট তাঁদের সফরের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। হযরত আবু বকরের পরিবার-পরিজন মদনিায় হিজরাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন সময় হযরত তালহা ও সুহায়েব ইবন সিনান তাঁদের সাথে যোগ দেন। তালহা হলেন সেই কাফিলার আমীর। মদীনায় উপস্থিত হয়ে তালহা ও সুহায়েব হযরত আসয়াদ ইবন যারারার বাড়ীতে অবস্থান করতে থাকেন। ইবন হাজার বলেনঃ হিজরাতের পূর্বে মক্কায় তালহা ও যুবাইরের মধ্যে রাসূল সা. ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন এব্ং হিজরাতের পর মদীনার প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু আইউব আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অবশ্য অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূল সা. কা’ব বিন মালিকের সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন এবং আপন ভায়ের মত আমরণ তাঁদের এ সম্পর্ক অটুট ছিল।
বদর যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে গণীমতের হিস্সা দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় একদল কাফির মদীনার মুসলিম জনপদের ওপর আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেছিল। রাসূল সা. তাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য তালহাকে পাঠিয়েছিলেন। তালহা ছাড়াও সাত ব্যক্তিকে রাসূল সা. বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছিলেন। এ কারণে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। তবে তাঁদেরকে বদরী হিসাবে গণ্য করা হয়।
হিজরী তৃতীয় সনে মক্কার মুশরিকদের সাথে সংঘটিত হয় উহুদের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত তালহা বীরত্ব ও সাহসিকতার নজীরবিহীন রেকর্ড স্থাপন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন উহুদ যুদ্ধের হিরো। তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনী যখন দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন যে ক’জন মুষ্টিমেয় সৈনিক আল্লাহর রাসূলকে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন, তালহা তাদের অন্যতম। এ সময় হযরত আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। কাতাদা বিন নু’মারের চোখে কাফিরের নিক্ষিপ্ত তীর লাগলে চক্ষু কোটর থেকে মণিটি বের হয়ে তাঁর গণ্ডের ওপর ঝুলতে থাকে। ’আবু দুজানা রাসূলুল্লাহর সা. দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তাঁর পুরো দেহটি ঢাল বানিয়ে নেন। এ সময় সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তীর ছুড়ছিলেন। আর তালহা এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে বর্শা নিয়ে কাফিরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনসারদের বারোজন এবং মুহাজিরদের এক তালহা ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাসূল সা. পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠলেন, এমন সময় একদল শত্রুসন্য তাঁকে ঘিরে ফেললো। রাসূল সা. তাঁর সংগের লোকদের বললেনঃ ‘যে এদের হটিয়ে দিতে পারবে, জান্নাতে সে হবে আমার সাথী।’ তালহা বললেনঃ আমি যাব ইয়া রাসূলাল্লহা। রাসূল সা. বললেনঃ না, তুমি থাম। একজন আনসারী বললোঃ আমি যাব। বললেনঃ হাঁ, যাও। আনসারী গেলেন এবং মুশরিকদেরসাথে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। এভাবে বার বার রাসূল সা. আহ্বান জানালেন এবং প্রত্যেক বারই, তালহা যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, কিন্তু রাসূল সা. তাঁকে নিবৃত্ত করে একজন আনসারীকে পাঠালেন। এভাবে এক এক করে যখন আনসারীদের সকলে শাহাদাৎ বরণ করলেন, তখন রাসূল সা. তালহাকে বললেনঃ এবার তোমার পালা, যাও।
হযরত তালহা আক্রমণ চালালেন। রাসূল সা. আহত হলেন, তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হলো এবং তিনি রক্ত রঞ্জিত হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তালহা একাকী একবার মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে একটু দূরে তাড়িয়ে দেন, আবার রাসূলের সা. দিকে ছুটে এসে তাকে কাঁধে করে পাহাড়েরে ওপরের দিকে উঠতে থাকেন এবং এক স্থানে রাসূলকে সা. রেখে আবার নতুন করে হামলা চালান। এভাবে সেদিন তিনি মুশরিকদের প্রতিহত করেন। হযরত আবু বকর বলেনঃ এ সময় আমি ও আবু উবাইদা রাসূল সা. থেকে দূরে সরে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা রসূলের সা. নিকট ফিরে এসে তাঁকে সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেনঃ ‘আমাকে ছাড়, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো’। আমরা তাকিয়ে দেখি, তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে আছে। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় এবং সারা দেহে তরবারী ও তীর বর্শার সত্তরটির বেশী আঘাত। তাই পরবর্তীকালে রাসূল সা. তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেনঃ যদি কেউ কোন মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, সে যেন তালহা ইবন উবাইদুল্লাহকে দেখে। এ কারণে তাঁকে জীবিত শহীদ বলা হতো। হযরত সিদ্দীকে আকবর রা. উহুদ যুদ্ধের প্রসংগ উঠলেই বলতেনঃ ‘সে দিনটির সবটুকুই তালহার।’ এ যুদ্ধে হযরত তালহার কাছে আল্লাহর রাসুল সা. এত প্রীত হন যে তিনি তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুসংবাদ দান করেন।
পঞ্চম হিজরী সনের যিলকাদ মাসে আরবের বিভিন্ন গোত্র ও ইহুদীদের সম্মিলিত বাহিনী মদীনা আক্রমণের তোড়জোড় শুরু করে। এদিকে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য রাসূলুল্লাহর সা. নেতৃত্বে মুসিলম বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে সালা পর্বতের পাশ দিয়ে পূর্ব পশ্চিমে পাঁচ হাত গভীর খন্দক খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ খন্দক খননের কাজে হযরত তালহাকে ব্যস্ত দেখা যায়। খন্দক খননের কাজ শেষ হতে না হতেই মক্কার কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রের সম্মিলিত বাহিনী মদীনা অবরোধ করে। এদিকে মদীনার অভ্যন্তরে ইহুদী গোত্রগুলি, বিশেষতঃ বনু কুরাইজা চুক্তি ভংগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এ সময় মুসলমানরা ভিতর ও বাইরের শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু সংখ্যক মুসলমান স্ত্রী-পুত্র পরিজনের নিরাপত্তার চিন্তায় স্বাভাবিকভাবেই একটু অস্থির হয়ে পড়েন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানের মনোবল এবং আল্লাহর প্রতি তাঁদের ঈমান অটল থাকে। তাঁরা নিজেদের জান-মাল সবকিছু আল্লাহর পথে কুরবানী করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। হযরত তালহা ছিলেন শেষোক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকুতে মুসলমানদের এ সময়কার মানসিক চিত্র সুন্দরভাবে অংকন করেছেন।
খন্দকের ধারে দাঁড়িয়ে কতিপয় মুসলমান আলাপ-আলোচনা করছে। হযরত তালহা যাচ্ছেন পাশ দিয়ে। তাঁর কানে ভেসে এলো, একজন বলছেঃ আমাদের স্ত্রী পরিজনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত তালহা একটু থমকে দাঁড়ালেন। বললেনঃ ‘আল্লাহু খায়রুন হাফিজান’- আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা বিধানকারী। যারা নিজেদের শক্তি ও বাহুবলের ওপর ভরসা করেছে, ব্যর্থ হয়েছে। লোকেরা বললোঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা তাদের উদ্দেশ্য থেকে বিরত থাকলো।
বাইয়াতে রিদওয়ান, খাইবার ও মুতাসহ সব অভিযানেই তিনি অংশগ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মক্কা বিজয়ের দিন মুহাজিরদের যে ক্ষুদ্র দলটির সাথে রাসূল সা. মক্কায় প্রবেশ করেন, তালহা ছিলেন সেই দলে এবং রাসূলুল্লাহর সা. সাথেই তিনি পবিত্র কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।
দশম হিজরী সনের ২৫শে যুলকা’দা রাসুল সা. হজ্জের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে যাত্রা শরু করেন। এটাই ছিল ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জ। রাসূলুল্লাহর সা. সফর সংগী হন তালহাও। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুলহুলায়ফা পৌঁছে ইহরাম বাঁধেন। এ সফরে একমাত্র রাসূল সা. ও তালহা ছাড়া আর কারও সংগে কুরবানীর পশু ছিলনা। (সহীহুল বুখারীঃ কিতাবুল হজ্জ)
প্রিয় নবীর ইন্তিকালে হযরত তালহা দারুণ আঘাত পান। রাসূলুল্লাহর সা. শোকে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে বলতেনঃ আল্লাহ তায়ালা সকল মুসীবতে ধৈর্য ধরার হুকুম দিয়েছেন, তাই তাঁর বিচ্ছেদে ‘সবরে জামীল’ অবলম্বনের চেষ্টা করি এবং সংগে সংগে আল্লাহর কাছে তাওফীকও কামনা করি।’
হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে তিনি তাঁর বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। চিন্তা, পরামর্শ ও কাজের মাধ্যমে সব ব্যাপারে তিনি তাঁকে সাহায্য করেন। রিদ্দার যুদ্ধের সময় অনেক বিশিষ্ট সাহাবী যাকাত আদায় করতে অস্বীকারকারী বেদুইনদের সাথে কিছুটা কোমল আচরণ করার জন্য এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা না করার জন্য প্রথমতঃ খলীফাকে পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত তালহা স্পষ্ট করে বেল দেনঃ ‘যে দ্বীনে যাকাত থাকবে না তা সত্য ও সঠিক হতে পারে না।’
হিজরী ১৩ সনের জামাদিউস সানী মাসে হযরত আবু বকর রা. অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। একদিন হযরত তালহা গেলেন তাঁকে দেখতে। তিনি উপস্থিত হলে কিছুক্ষণ নিরবতার পর উভয়ের মধ্যে নিম্নোক্ত কথা হয়ঃ
- উমারকে কি স্থলাভিষিক্ত করবো? আবু মুহাম্মাদ (তালহা), আপনার মত কি?
- সাহাবীদের মধ্যে উমার সর্বোত্তম গুণের অধিকারী তিনি সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী।
- তাঁকে আমার স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ চেয়েছি।
- তাঁর স্বভাবে কিছুটা কঠোরতা আছে এবং তিনি একটু বেশী কড়াকড়ি আরোপ করে থাকেন।
- তাঁর মধ্যে কি কি ত্রুটি আছে?
- আপনার সময়ে তিনি যখন এত কঠোর, আপনার পরে স্বীয় দায়িত্বানুভূতিতে না জানি কত বেশী কঠোর হয়ে পড়েন।
- তাঁর ওপর যখন খিলাফতের গুরু দায়িত্ব এসে পড়বে, তিনি নরম হয়ে যাবেন।
সবশেষে তালহা বললেনঃ তাঁর গুণাবলী ও যোগ্যতা যে সকলের থেকে বেশী, সে ব্যাপারে আমার দ্বিমত নেই। তাঁর স্বভাবের একটি দিক সম্পর্কে আমার যা প্রতিক্রিয়া তা ব্যক্ত করতে আমি কার্পণ্য করিনি।
হিজরী ১৩ সনে হযরত ’উমার খলীফা হলেন। তিনিও হযরত তালহাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিলেন এব সর্বদা তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করে উপকৃত হলেন।
ইরাক বিজয়ের পর সেখানকার কৃষি জমি গণীমতের মালের মত মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা হবে কি হবে না, এ প্রশ্নে সাহাবীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল। একদল বললেন, ভাগ করাই উচিত হবে। কিন্তু খলীফা সহ অন্য একটি দল ছিলেন ভাগের বিরোধী। অতঃপর মজলিসে শূরার বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর খলীফার মতই সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এ ব্যাপারে হযরত তালহা শূরার বৈঠকে দ্ব্যর্থহীনভাবে খলীফার মতকে সমর্থন করে জোরালে বক্তব্য রাখেন।
আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমারের রা. ওফাতের পূর্বে যে ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর ওপর তাঁদের মধ্য থেকে যে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে যান, তার মধ্যে হযরত তালহাও ছিলেন। কিন্তু তিনি আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজে খিলাফাতের দাবী থেকে সরে দাঁড়ান এবং হযরত উসমানের সমর্থনে নিজের ভোটটি প্রদান করেন।
হযরত উসমান রা. বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহবন্দী হলেন। একদিন তিনি ঘরের জানালা দিয়ে মাথা বের করে বিদ্রোহী গ্রুপ ও মদীনার সমবেত লোকদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখলেন। এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের মধ্যে কি তালহা আছেন? কেউ কোন উত্তর দিল না। এবাবে যখন তিনি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, তখন হযরত তালহা উঠে দাঁড়ালেন। হযরত উসমান তাঁকে লক্ষ্য করে বললেনঃ এ জনতার মধ্যে আপনার উপস্থিতি এবং তিনবার জিজ্ঞেস করার পর সাড়া দেবেন, এমন আশা আমি করিনি। আমি আপনাকে আল্লাহর নামে জিজ্ঞেস করছি, একদিন অমুক স্থানে, যখন রাসূলুল্লাহর সা. সংগে আমি ও আপনি ছাড়া আর কেউ ছিল না, রাসূল সা. আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেনঃ তালহা, প্রত্যেক নবীরই তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে জান্নাতে একজন সংগী থাকবে। উসমান উবন আফফানই হবে জান্নাতে আমার সংগী। সে কথা আপনার স্মরণ আছে? তালহা সায় দিলেন, হাঁ। তারপর তিনি জনতার ভেতর থেকে উঠে চলে গেলেন।
হযরত উসমান শহীদ হলেন। মুসলিম উম্মাহর একটি অংশ হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কিসাস দাবী করলেন। হযরত তালহা ও যুবাইর মদীনা থেকে মক্কায় গিয়ে হযরত আয়িশার রা. সাথে মিলিত হলেন। বসরার উপকণ্ঠেই তারা হযরত আলীর রা. সেনাবাহিনীর মুখোমুখী হলেন। হযরত কা’কা ইবন ’আমরের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। হযরত আলী, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা, তালহা ও যুবাইর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছলেন। উভয় পক্ষ তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারী ইহুদী ইবন সাবার লোকেরা এতে প্রমাদ গুণলো। মূলতঃ তারাই ছিল হযরত উসমানের হত্যাকারী। তারা হযরত আলীর সেনাবাহিনীর মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তারা একদিকে হযরত আয়িশার এবং অন্য দিকে হযরত আলীর সেনাবাহিনীর ওপর তীর নিক্ষেপ শুরু করলো। উভয় পক্ষের সৈন্যরা শান্তিচুক্তির সিদ্ধান্ত হওয়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতর্কিত এ আক্রমণে ঘুম থেকে জেগে তারা মনে করলো প্রতিপক্ষ আক্রমণ শুরু করেছে। ইহুদি ইবন সাবার চক্রান্ত সফল হলো। সকাল হতে না হতে তুমুল লড়াই বেঁধে গেল এবং ইতিহাসে এ লড়াই ‘উটের যুদ্ধ’ খাতে খ্যাত হলো। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় দশ মতান্তরে তের হাজার লোক নিহত হলেন। এ যুদ্ধের সূচনা লগ্নেই সাবায়ীদের নিক্ষিপ্ত একটি তীর হযরত তালহার পায়ে বিঁধে। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না দেখে হযরত কা’কা ইবন আমর তাঁকে অনুরোধ করলেন বসরার ‘দারুল ইলাজে’ (হাসপাতাল) চলে যাওয়ার জন্য। তাঁরই অনুরোধে তিনি একটি চাকরকে সংগে করে ‘দারুল ইলাজে’ চলে যান। কিন্তু ইত্যবসরে তাঁর দেহ রক্তশূণ্য হয়ে পড়ে। সেখানে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই তিনি ইনতিকাল করেন। বসরাতেই তাঁকে দাফন করা হয়।
ইবন আসাকির বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, উটের যুদ্ধের দিন মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিক্ষিপ্ত তীরে হযরত তালহা আহত হন। হিজরী ৩৬ সনের জামাদিউল আউয়াল মতান্তরে ১০ই জামাদিউস সানী ৬৪ বছর বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন।
হযরত তালহা ছিলেন একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। কিন্তু সম্পদ পুঞ্জিভূত করার লালসা তাঁর ছিলনা। তাঁর দানশীলতার বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইতিহাসে তাঁকে ‘দানশীল তালহা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একবার হাদরামাউত থেকে সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর হাতে এলো। রাতে তিনি বিমর্ষ ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী হযরত আবু বকরের রা. কন্যা উম্মু কুলসুম স্বামীর এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেনঃ
- আবু মুহাম্মদ, আপনার কী হয়েছে? মনে হয় আমার কোন আচরণে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।
- না, একজন মুসলমান পুরুষের স্ত্রী হিসেবে তুমি বড় চমৎকার। কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে আমি চিন্তা করছি, এত অর্থ ঘরে রেখে ঘুমালে একজন মানুষের তার পরওয়ারদিগারের প্রতি কিরূপ ধারণা হবে?
- এতে আপনার বিষণ্ন ও চিন্তিত হওয়ার কি আছে? এত রাতে গরীব-দুঃখী ও আপনার আত্মীয় পরিজনদের কোথায় পাবেন? সকাল হলেই বণ্টন করে দেবেন।
- আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন! একেই বলে, বাপ কি বেটী।
পরদিন সকাল বেলা ভিন্ন ভিন্ন থলি ও পাত্রে সকল দিরহাম ভাগ করে মুহাজির ও আনসারদের গরীব মিসকীনদের মধ্যে তিনি বণ্টন করে দেন। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে অপর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি হযরত তালহার নিকট এসে তাঁর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কিছু সাহায্য চাইলো। তালহা বললেনঃ অমুক স্থানে আমার একখণ্ড জমি আছে। উসমান ইবন আফফান উক্ত জমির বিনিময়ে আমাকে তিন লাখ দিরহাম দিতে চান। তুমি ইচ্ছে করলে সেই জমিটুকু নিতে পার বা আমি তা বিক্রি করে তিন লাখ দিরহাম তোমাকে দিতে পারি। লোকটি মূল্যই নিতে চাইলো। তিনি তাঁকে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দান করেন।

আবদুর রহমান ইবন ’আউফ (রা)
ইমাম বুখারীর মতে জাহিলী যুগে আবদুর রহমান ইবন ’আউফের নাম ছিল ’আবদু ’আমর। ইবন সা’দ তাঁর ‘তাবাকাতে’ উল্লেখ করেছেন, জাহিলী যুগে তাঁর নাম ছিল ’আবদু কা’বা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সা. তাঁর নাম রাখেন ‘আবদুর রহমান’। তাঁর মাতা-পিতা উভয়ে ছিলেন ‘যুহরা’ গোত্রের লোক। মাতার নাম শিফা বিনতু ’আউফ। দাদা ও নানা উভয়ের নাম ’আউফ।
ইবন সা’দ ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, তিনি ’আমূল ফীলের (হস্তীর বৎসর) দশ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। এ বর্ণনার ভিত্তিতে তিনি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বয়সে দশ বছর ছোট। রাসূল সা. ’আমুল ফীলের ঘটনায় পঞ্চাশ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু ইবন হাজার তাঁকে রাসূলুল্লাহর সা. তের বছর ছোট বলে উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথম পর্যায়ে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি তাঁদেরই একজন। মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিনই হযরত আবু বকরের বাড়ীতে বৈঠকে মিলিত হতেন। আবদুর রহমানও ছিলেন এ বৈঠকের একজন নিয়মিত সদস্য। আবু বকরের সাথে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের বাড়ীর এ বৈঠকের নিয়মিত পাঁচজন সদস্যের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়। যেমনঃ উসমান, সা’দ, তালহা, যুবাইর এবং আবদুর রহমান। তাঁদের সকলেই আবু বকরের দাওয়াতে প্রথম পর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের জন্য অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেন।
নবুওয়াতের পঞ্চম বছর রজব মাসে যে এগারজন পুরুষ ও চারজন নারীর প্রথম কাফিলাটি মক্কা থেকে হাবশায় হিজরাত করে তার মধ্যে আবদুর রাহমানও ছিলেন। আবার রাসূলের সা. মদীনায় হিজরাতের পর তিনিও মদীনায় হিজরাত করেন। যাঁরা হাবশা ও মদীনা দু’স্থানেই হিজরাত করেছিলেন তাঁদেরকে বলা হয় ‘সাহিবুল হিজরাতাইন’। মদীনায় তিনি হযরত সা’দ ইবন রাবী’ বলে আল-খাযরাজীর গৃহে আশ্রয় নেন এবং তাঁর সাথেই রাসূল সা. ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন। এ সম্পর্কে ইমাম বুখারী একাধিক সনদের মাধ্যমে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে হযরত আনাস রা. বলেনঃ ‘আবদুর রহমান ইবন ’আউফ হিজরাত করে মদীনায় এলে রাসূল সা. সা’দ ইবন রাবী’র সাথে তাঁর ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দেন। সা’দ ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের নেতা ও ধনাঢ্য ব্যক্তি। তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আনসারদের সকলে জানে আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সকল সম্পদ সমান দু’ভাগে ভাগ করে দিতে চাই। আমার দু’জন স্ত্রী আছেন। আমি চাই, আপনি তাদের দু’জনকে দেখে একজনকে পছন্দ করুন। আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিয়ে করে নেবেন।’ আবদুর রহমান বললেনঃ ‘আল্লাহ আপনার পরিজনের মধ্যে বরকত ও কল্যাণ দান করুন! ভাই, এসব কোন কিছুর প্রয়োজন আমার নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।’
ইসলামী ভ্রাতৃত্বে হযরত সা’দের এ দৃঢ় আস্থা ও অতুলনীয় উদারতার দৃষ্টান্ত ইসলামী উম্মাহ তথা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে হযরত আবদুর রহমানের মহত্ব, আত্মনির্ভরতা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্পও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
মদীনায় অবস্থানের দ্বিতীয় দিন আবদুর রহমান তাঁর আনসারী ভাই সা’দকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘বেচাকেনা হয় এমন কোন বাজার কি এখানে আছে?’’ বললেনঃ ‘‘হাঁ, ইয়াসরিবে (মদীনায়) কায়নুকার বাজার তো আছে।’’ হযরত আব্দুর রহমান এক স্থান থেকে কিছু ঘি ও পনির খরিদ করে বাজারে যান। দ্বিতীয় দিনও তিনি এমনটি করলেন। এভাবে তিনি বেচাকেনা জারি রাখেন। কিছু পয়সা হাতে জমা হলে তিনি এক আনসারী মহিলাকে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর তিনি একদিন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলেন। তাঁর কাপড়ে হলুদের দাগ দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বিয়ে করেছ?’ বললেন, ‘হাঁ’। জিজ্ঞেস করলেন কাকে?’ তিনি বললেন, ‘এক আনসারী মহিলাকে।’ রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘মোহর কত নির্ধারণ করেছ?’ তিনি বললেন, ‘কিছু সোনা।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করে নাও।’
তিনি ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছুদিন পর তার হাতে আরও কিছু অর্থ জমা হলে রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশমত ওয়ালিমার কাজটি সেরে নেন। ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হয়। মক্কার উমাইয়া ইবন খালফের সাথে একটি ব্যবসায়িক চুক্তিও সম্পাদন করেন।
হযরত আবদুর রহমান ইবন ’আউফ বদর, উহুদ ও খন্দক সহ সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ইমাম বুখারী ‘কিতাবুল মাগাজী’তে বদর যুদ্ধের একটি ঘটনা তাঁরই যবানে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘বদর যুদ্ধে, আমি সারিতে দাঁড়িয়ে। তুমুল লড়াই চলছে। আমি ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে আমার দু’পাশে দুই নওজোয়ানকে দেখলাম। তাদের ওপর আমার খুব একটা আস্থা হলো না। তাদের একজন ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করলোঃ ‘‘চাচা, বলুন তো আবু জাহল কোন দিকে?’’ বললাম, ‘‘ভাতিজা, তাকে দিয়ে কি করবে?’’ সে বলল, ‘‘আমি আল্লাহর সাথে অংগীকার করেছি, হয় আমি তাকে কতল করবো, না হয় এ উদ্দেশ্যে আমার নিজের জীবন কুরবান করবো।’’ একই কথা ফিসফিস করে আমাকে বলল অন্যজনও। আবদুর রহমান বলেন, ‘‘তাদের কথা শোনার পর আমার আনন্দ হলো এই ভেবে যে, কত মহান দু’ব্যক্তির মাঝাখানেই না আমি দাঁড়িয়ে। আমি ইশারা করে আবু জাহলকে দেখিয়ে দিলাম। অকস্মাৎ তারা দু’জন একসাথে বাজপাখীর মত আবু জাহলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে কতল করে। এ দু’নওজোয়ান ছিল ’আফরার দু’পুত্র মুয়ায ও মু’য়াওবিয।’ বদর যুদ্ধে আবদুর রহমান পায়ে আঘাত পান।
উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধেও তিনি অসম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। রাসূল সা. উহুদ পর্বতের এক কোণে আশ্রয় নিয়েছেন, উবাই ইবন খালফ এগিয়ে এলো আল্লাহর রাসূলকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে। আবদুর রহমান তাকে জাহান্নামে পাঠাবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলে রাসূল সা. তাঁকে বাধা দেন। অতঃপর রাসূল সা. নিজেই হারিস ইবন সাম্মার নিকট থেকে বর্শা নিয়ে উবাই ইবন খালফের গর্দানে ছুড়ে মারেন। সামান্য আহত হয়ে সে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে যায় এবং মক্কার পথে ‘সারফ’ নামক স্থানে নরক যাত্রা করে।
ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উহুদের যুদ্ধে আবদুর রহমান অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। বালাযুরী তাঁর ফুতুহুল বুলদান, ইবনে হাজার তাঁর আল-ইসাবা এবং ইবন খালদুন তাঁর তারীখে বর্ণনা করেছেন, এ যুদ্ধে তিনি সারা দেহে মোট একত্রিশটি আঘাত পান।
ষষ্ঠ হিজরীর শাবান মাসে রাসূল সা. মদীনা থেকে প্রায় তিন শো মাইল উত্তরে ‘দুমাতুল জান্দালে’ একটি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্ব দেন আবদুর রহমানকে। যাত্রার পূর্বে তিনি উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। রাসূল সা. নিজ হাতে আবদুর রহমানের মাথার পাগড়ীটা খুলে রেখে দিয়ে অন্য একটি কালো পাগড়ী তার মাথায় বেঁধে দেন। তারপর যুদ্ধের পলিসি সংক্রান্ত কিছু হিদায়াত দিয়ে তিনি আবদুর রহমানকে রা. বিদায় দেন।
মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ সা. মুহাজিরদের যে ছোট্ট দলটির সংগে ছিলেন, আবদুর রহমানও ছিলেন সেই দলে।
মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সা. আরব উপদ্বীপে দাওয়াতী কাজের জন্য কতকগুলি তাবলীগী গ্রুপ বিভিন্ন দিকে পাঠান। তখনও আরব গোত্রগুলি মূর্খতা ও আসাবিয়্যাতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এ কারণে রাসূল সা. তাবলীগী গ্রুপগুলিকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠলেন। যাতে প্রয়োজনে তারা আত্মরক্ষা করতে পারে। এরকম তিরিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি দলকে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে বনু খুযায়মার লোকদের নিকট পাঠানো হলো। কিন্তু হযরত খালিদ ও বনু খুযায়মার মধ্যে ভুল বুঝা-বুঝি সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে হযরত খালিদ বনু খুযায়মার ওপর হামলা করে তাদের বহু লোককে হতাহত করেন। এ ঘটনা অবগত হয়ে রাসূল সা. হযরত খালিদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তঁর ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট মাগফিরাত কামনা করেন। রাসূল সা. নিহত ব্যক্তিদের দিয়াত আদায় করেন। এমন কি কারও একটি কুকুরও মারা গিয়ে থাকলে তারও বিনিময় মূল্য আদায় করা হয।
বনু খুযায়মার এ দুর্ঘটনা নিয়ে খালিদ ও আবদুর রহমানের মধ্যে বচসা ও বিতর্ক হয়। এ কথা রাসূল সা. অবগত হয়ে খালিদকে ডেকে তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, ‘তুমি সাবেকীনে আওয়াবীন’ (প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারী) একজন সাহাবীর সাথে ঝগড়া ও তর্ক করেছ। এমনটি করা তোমার শোভন হয়নি। আল্লাহর কসম, যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনার মালিকও তুমি হও এবং তার সবই আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দাও, তবুও তুমি আমার সেসব প্রবীণ সাহাবীর একজনেরও সমকক্ষ হতে পারবে না।’ উল্লেখ থাকে যে, হযরত খালিদ আহযাবের যুদ্ধের পর ষষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
নবম হিজরীতে তাবুক অভিযানের সময় মুসলমানগণ যে ঈমানী পরীক্ষার সম্মুখীন হয় সে পরীক্ষায়ও তিনি কৃতকার্য হন। রাসূলুল্লাহর সা. আবেদনে সাড়া দিয়ে এ অভিযানের জন্য হযরত আবু বকর, উসমান ও আবদুর রহমান রা. রেকর্ড পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন। আবদুর রহমান আট হাজার দিনার রাসূলুল্লাহর সা. হাতে তুলে দিলে মুনাফিকরা কানাঘুষা শুরু করে দেয়। তারা বলতে থাকে, ‘সে একজন রিয়াকার- লোক দেখানোই তার উদ্দেশ্য।’ তাদের জবাবে আল্লাহ বলেন, ‘এ তো সেই ব্যক্তি যার উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকবে।’ (সূরা তাওবাহঃ ৭১) অন্য একটি বর্ণনায় আছে, উমার রা. তাঁর এ দান দেখে বলে ফেলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে আবদুর রহমান গুনাহগার হয়ে যাচ্ছে। কারণ, সে তার পরিবারের লোকদের জন্য কিছুই রাখেনি।’ একথা শুনে রাসুল সা. জিজ্ঞেস করেন, ‘আবদুর রহমান, পরিবারের জন্য কিছু রেখেছ কি?’ তিনি বলেন, ‘হাঁ। আমি যা দান করেছি তার থেকেও বেশী ও উৎকুষ্ট জিনিস তাদের জন্য রেখেছি।’ রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত?’ বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল যে রিযিক, কল্যাণ ও প্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন, তাই।’
এ তাবুক অভিযানকালে একদিন ফজরের নামাযের সময় রাসূল সা. প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ফিরতে একটু দেরি হয়। এদিকে নামাযের সময়ও হয়ে যায়। তখন সমবেত মুসল্লীদের অনুরোধে আবদুর রহমান ইমাম হিসাবে নামাযে দাড়িয়ে যান। এদিকে রাসুল সা. ফিরে এলেন, এক রাকায়াত তখন শেষ। আবদুর রহমান রাসূলুল্লাহর সা. উপস্থিতি অনুভব করে পেছন দিকে সরে আসার চেষ্টা করেন। রাসূল সা. তাঁকে নিজের স্থানে থাকার জন্য হাত ইশারা করেন। অতঃপর অবশিষ্ট দ্বিতীয় রাকায়াতটিও তিনি শেষ করেন এবং রাসুল সা. তাঁর পেছনে ইকতিদা করেন। ইমাম মুসলিম ও আবু দাউদ তাঁদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে এ সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছেন।
প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা. অন্তিম রোগশয্যায়। জীবনের আশা আর নেই। তাঁর পর খলীফা কে হবেন সে সম্পর্কে চিন্তাশীল বিশিষ্ট সাহাবীদের ডেকে পরামর্শ করলেন। হযরত আবদুর রহমানের সাথেও পরামর্শ করেন এবং হযরত উমারের কিছু গুণাবলী তুলে ধরে পরবর্তী খলীফা হিসাবে তাঁর নামটি তিনি প্রস্তাব করেন। আবদুর রহমান ধৈর্য সহকারে খলীফার কথা শুনার পর বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। তবে স্বভাবগতভাবেই তিনি একটু কঠোর।
হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতকালে আটজন বিশিষ্ট সাহাবীকে ফাতওয়া ও বিচারের দায়িত্ব প্রদানের সাথে সাথে অন্য সকলকে ফাতওয়া দান থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। আবদুর রহমান ছিলেন এ আটজনের একজন।
হযরত উমারও তাঁর খিলাফতকালে জ্ঞান ও বিচক্ষণতার অধিকারী সাহাবীদের ছাড়া অন্য সকলকে বিচার কাজ থেকে বিরত রাখেন। এমনকি যে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদকে তিনি ‘খাযিনাতুল ইলম’ (জ্ঞানের ভাণ্ডার) বলে অভিহিত করতেন, তিনিও যখন পূর্ব অনুমতি ছাড়াই ফাতওয়া দিতে শুরু করেন, তাঁকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। জ্ঞানের যে শাখায় যিনি বিশেষজ্ঞ ছিলেন হযরত উমার তাকেই কেবল সে বিষয়ে মতামত প্রকাশের অনুমতি প্রদান করেন। এ সম্পর্কে সিরিয়া সফরকালে ‘জাবিয়া’ নামক স্থানে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘যারা কুরআন বুঝতে চায়, তারা উবাই বিন কা’ব, যারা ফারায়েজ সম্পর্কে জানতে চায়, তারা যায়িদ বিন সাবিত এবং যারা ফিক্হ সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হতে চায়, তারা মুয়ায বিন জাবাল ও আবদুর রহমান বিন ’আউফের সাথে যেন সম্পর্ক গড়ে তোলে।’’
খলীফা হযরত উমার হযরত আবদুর রহমানকে বিশেষ উপদেষ্টার মর্যাদা দেন। রাতে তিনি যখন ঘুরে ঘুরে নগরের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন, অনেক সময সংগে নিতেন হযরত আবদুর রহমানকে এবং নানা বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন।
একদিন রাতে খলীফা উমার বের হলেন আব্দুর রহমানকে সংগে নিয়ে নগর পরিভ্রমণে। দূর থেকে তাঁরা লক্ষ্য করলেন একটি বাড়ীতে আলো। কাছে গিয়ে দেখলেন বাড়ীর দরজা-জানালা সব বন্ধ; কিন্তু ভেতর থেকে কিছু লোকের উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসছে। খলীফা উমার আবদুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ভেতর থেকে আসা আওয়ায শুনতে পাচ্ছেন?
- ‘জী হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।’
- ‘কি বলছে, তা-কি বুঝতে পারছেন?’
- ‘সমবেত কণ্ঠের আওয়ায। কেবল শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কি বলছে তা বুঝা যাচ্ছে না।’
- ‘আপনি কি জানেন বাড়ীটি কার?’
- ‘বাড়ীটি তো রাবীয়া’ ইবন উমাইয়্যার।’
উমার বলেন, ‘সম্ভবতঃ তারা মদপান করে মাতলামি করছে। আপনার কি মনে হয়?’
- ‘‘আল্লাহ আমাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তি থেকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ওয়ালা তাজাস্সাসূ (গুপ্তচর বৃত্তি করোনা) এবং ওয়ালা তাকফু মা লাইসা লাকা বিহি ইলমুন (যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না)।’’
এ কথা শুনে উমার বললেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন এবং যথাসময়ে স্মরণ করে দিয়েছেন।’- এই বলে তিনি আবদুর রহমানকে সংগে নিয়ে সামনে অগ্রসর হন। হযরত আবদুর রহমান এ ক্ষেত্রে যে আয়াতে দু’টি আমীরুল মুমিনীনকে স্মরণ করে দেন, তা হচ্ছে মুসলিম সমাজ জীবনে ব্যক্তির বুনিয়াদী অধিকারের প্রাণস্বরূপ।
১৬ হিজরী সনে ইরাক বিজয়ের ফলে ইরাকে কিসরা শাহানশাহীর পতন হয় এবং ইয়ারমুকে যুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে রোমের কাইসার সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। খলীফা জিযিয়া ও খারাজ নির্ধারণের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ, বিলাল ও আবদুর রহমানের প্রবল প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। অবশেষে মজলিসে শূরার ক্রমাগত বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর খলীফার মতামতই গৃহীত হয়।
খলীফা হযরত উমার রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের ভাতা নির্ধারণের ইচ্ছা করলেন। এ ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করলেন হযরত আবদুর রহমানের নিকট। তিনি পরামর্শ দিলেন, কুষ্ঠি বিদ্যায় পারদর্শী তিন ব্যক্তি- মাখযামা ইবন নাওফিল, খায়বর ইবন মাতয়াম এবং আকীল ইবন আবু তালিবের ওপর একটি তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণের জন্য। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী খলীফা তাঁদেরকে দায়িত্ব প্রদান করলেন। তাঁরা তালিকা প্রণয়ন করে খলীফার নিকট পেশ করতে আমীরুল মুমিনীন ও আবদুর রহমান দু’জনেই তা পরীক্ষা করেন। হযরত উমার তালিকা দেখার পর বললেন, ‘‘বর্তমান তালিকার ক্রমধারা পরিবর্তন করে আমার নিজের ও আমার গোত্রীয় অন্য লোকদের নাম রাসূলের সা. সাথে বংশগত সম্পর্কে দিক দিয়ে যখন আসবে তখন লিখবে’’। হযরত আলী ও হযরত আবদুর রহমান আপত্তি করে বললেন, ‘‘আপনি আমীরুল মুমিনীন। তালিকার সূচনা আপনার নাম দিয়েই হওয়া উচিত।’’ তিনি বললেন, ‘‘না। রাসূলুল্লাহর সা. চাচা ’আব্বাস রা. থেকে শুরু কর, তারপর আলীর রা. নামটি লিখ।’’ ভাতার পরিমাণ তিনি আবদুর রহমানের সাথে পরামর্শ করেই নির্ধারণ করেন। তারপর তা মজলিসে শূরায় পেশ করেন।
আযওয়াজে মুতাহ্হারাত (রাসূলুল্লাহর সা. সহধর্মিণীগণ) বেশ আগে থেকেই হজ্জ্ব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। তেইশ হিজরী সনে খলীফা উমার তাঁদের হজ্জ্ব আদায়ের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেন। তিনি নিজেও তাঁদের সফরসংগী হন। তাঁদের সফর ব্যবস্থাপনার যাবতীয় দায়িত্ব হযরত আবদুর রহমান ও হযরত উসমানের রা. ওপর অর্পণ করেন। সফরের সময় আবদুর রহমান কাফিলার আগে এবং উসমান পেছনে সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিয়ে চলতেন। কোন ব্যক্তিকে তাঁদের উটের কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। তাঁরা যখন কোথাও অবস্থান করতেন, এরা দু’জন তাঁবুর প্রহরায় নিয়োজিত থাকতেন।
হযরত উমার তাঁর খিলাফতের প্রথম বছর আবদুর রহমানকে আমীরে হজ্জ নিয়োগ করে মক্কায় পাঠান। আর তাঁর সাথে পাঠান নিজের পক্ষ থেকে কুরবানীর একটি পশু। এ বছর বিশ্ব মুসলিম তাঁর নেতৃত্বেই হজ্জ্ব আদায় করে।
ফলীফা হযরত উমার রা. ফজরের জামায়াতে ইমামতি করছিলেন। মুগীরা ইবন শু’বার পারসিক দাস ফিরোয তাকে ছুরিকাঘাত করে। আহত অবস্থায় সংগে সংগে তিনি পেছনে দণ্ডায়মান আবদুর রহমানের হাতটি ধরে নিজের স্থানে তাঁকে দাঁড় করে দেন এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অতপর আবদুর রহমান অবশিষ্ট নামায দ্রুত শেষ করেন।
হযরত উমার আহত হওয়ার দশ ঘন্টা পর সমবেত লোকদের বললেন, ‘আপনারা যেমন বলতেন আমিও চাচ্ছিলাম, এ উম্মাতের বোঝা বহনের ক্ষমতা রাখে এমন এক ব্যক্তিকে আমি আমীর বানিয়ে যাই। পরে আমি চিন্তা করলাম, এমনটি করলে আমার মৃত্যুর পরও এর দায়-দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাবে। এ কারণে, আমার সাহস হলো না। এ ছ’ব্যক্তি- আলী, উসমান, আবদুর রহমান, সা’দ, যুবাইর ও তালহা। আল্লাহর রাসূল সা. তাদেরকে জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাদের কোন একজনকে আপনারা আমীর নির্বাচন করে নেবেন। এ ছ’জন ছাড়া আমার পুত্র আবদুল্লাহও আছে। তবে খিলাফতের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকবে না। উল্লেখিত ছয় ব্যক্তি যদি খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে তিনজন করে সমান দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ যে দকে সমর্থন করবে সে দল থেকেই খলীফা হবে। কিন্তু আবদুল্লাহর মতামত যদি সর্বসাধারণের নিকট গৃহীত না হয় তাহলে আবদুর রহমান যে দলে থাকবেন তাঁদের মতই গ্রহণযোগ্য হবে।’ হযরত উমারের এ পরামর্শের মধ্যে আবদুর রহমান সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
হযরত উমার ইনতিকাল করলেন। আবদুর রহমান খলীফা হতে রাজি ছিলেন না। এদিকে হযরত তালহাও তখন মদীনায় ছিলেন না। অবশিষ্ট চার ব্যক্তি খলীফা নির্বাচনের পূর্ণ দায়িত্ব আবদুর রহমানের ওপর ন্যস্ত করেন।
হযরত আবদুর রহমানের ওপর অর্পিত এ দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আমানতদারীর সাথে পালন করেন। ক্রমাগত তিন দিন তিন রাত বিভিন্ন স্তরের লোকদের সাথে মত বিনিময় করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হযরত উসমানের পক্ষেই মত ব্যক্ত করেন। অবশেষে উমারের নির্ধারিত সময় তিন দিন তিন রাত শেষ হওয়ার আগে তিনি মানুষকে ফজরের জামায়াতে শরীক হওয়ার জন্য আবেদন জানান। নামায শেষে তিনি সমবেত জনমণ্ডলীর সামনে খলীফা হিসাবে হযরত উসমানের নামটি ঘোষণা করেন। হযরত উমারের ছুরিকাহত হওয়ার পর থেকে তাঁরই নির্দেশে তৃতীয় খলীফা হিসাবে উসমানের রা. নাম ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি জামায়াতের ইমামতি করেন এবং প্রশাসনের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন।
চব্বিশ হিজরী সনের মুহাররম মাসে হযরত উসমান খলীফা নির্বাচিত হন। সে বছরই তিনি আবদুর রহমানকে আমীরুল হজ নিযুক্ত করেন। মুসলিম উম্মাহ সে বছরের হজটি তাঁরই নেতৃত্বে আদায় করে।
হযরত আবদুর রহমান আমরণ খলীফা উসমানের মজলিসে শূরার সদস্য থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ দানের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর বিশেষ খিদমাত আঞ্জাম দেন। হযরত আবু বকর, উমার, উসমান রা- এ তিন খলীফার প্রত্যেকের নিকটই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ও আস্থার পাত্র।
ইবন সা’দের মতে, হযরত আবদুর রহমান হিঃ ৩২ সনে ৭৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তবে ইবন হাজারের মতে, তিনি ৭২ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। ইবন হাজার এ কথাও বলেছেন, হযরত উসমান অথবা যুবাইর ইবনুল আওয়াম তাঁর জানাযার ইমামতি করেন এবং তাঁকে মদীনার বাকী’ গোরস্থানে দাফন করা হয়। গোরস্থান পর্যন্ত তার লাশ বহনকারীদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসও ছিলেন।
পূর্বেই আমরা দেখেছি সম্পূর্ণ রিক্ত হস্তে আবদুর রহমান মদীনায় এসেছিলেন। সামান্য ঘি ও পনির কেনাবেচার মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যবসা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর একজন সেরা ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিকে পরিণত হন। রাসূল সা. তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দুআ করেছিলেন এবং সে দুআ আল্লাহর দরবারে কবুলও হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পদের প্রতি তাঁর একটুও লোভ ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়নি। রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় এবং তাঁর ইনতিকালের পরেও আমরণ তিনি সে সম্পদ অকৃপণ হাতে আল্লাহর পথে ও মানব কল্যাণে ব্যয় করেছেন।
একবার রাসূল সা. একটি অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করেছি, তোমরা সাহায্য কর।’ আবদুর রহমান এসে দৌড়ে বাড়ীতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে এ চার হাজার আছে। দু’হাজার আমার রবকে করজে হাসানা দিলাম এবং বাকী দু’হাজার আমার পরিবার-পরিজনদের জন্য রেখে দিলাম।’ রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ, তার সবকিছুতে আল্লাহ তায়ালা বরকত দান করুন।’
একবার মদীনায় শোরগোল পড়ে গেল, সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে একটি বাণিজ্য কাফিলা উপস্থিত হয়েছে। শুধু উট আর উট। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কার বাণিজ্য কাফিলা?’ লোকেরা বলল, ‘আবদুর রহমান ইবন আউফের।’ তিনি বললেন, আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছি, আমি যেন আবদুর রহমানকে সিরাতের ওপর একবার হেলে গিয়ে আবার সোজা হয়ে উঠতে দেখলাম।’ অন্য একটি বর্ণনায় আছে, হযরত আয়িশা বলেন, ‘আল্লাহ দুনিয়াতে তাকে যা কিছু দিয়েছেন তাতে বরকত দিন এবং তাঁর আখিরাতের প্রতিদান এর থেকেও বড়। আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ আবদুর রহমান হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
হযরত আয়িশার এ কথাগুলো আবদুর রহমানের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমাকে সোজা হয়েই জান্নাতে প্রবেশ করতে হবে।’ অতঃপর তিনি তাঁর সকল বাণিজ্য সম্ভার সাদকা করে দেন। পাঁচ শো, মতান্তরে সাত শো উটের পিঠে এ মালামাল বোঝাই ছিল। কেউ বলেছেন, বাণিজ্য সম্ভারের সাথে উটগুলিও তিনি সাদকা করে দেন। হযরত আবদুর রহমান ছিলেন উম্মাহাতুল মুমিনীনের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। তাঁদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তিনি আজীবন অকাতরে খরচ করেছেন। তাঁদের নিকট তিনি ছিলেন একজন বিশ্বাসী ও আস্থাভাজন ব্যক্তি। একবার তিনি কিছু ভূমি চল্লিশ হাজার দীনারে বিক্রি করেন এবং বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ বনু যুহরা (রাসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার পিতৃ-গোত্র), মুসলমান, ফকীর মিসকীন, মুহাজির ও আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের মধ্যে বণ্টন করে দেন। হযরত আয়িশার নিকট তাঁর অংশ পৌঁছলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে পাঠিয়েছে?’ বলা হলো, ‘আবদুর রহমান ইবন আওফ।’ তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ ‘আমার পরে ধৈর্যশীলরাই তোমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে।’
ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে জা’ফর ইবন বারকানের সূত্রে উল্লেখ করেছেন, আবদুর রহমান মোট তিরিশ হাজার দাস মুক্ত করেছেন। জাহিলী যুগেও মদ পানকে তিনি হারাম মনে করতেন।
হযরত আবদুর রহমান ছিলেন তাকওয়া ও আল্লাহভীতির এক বাস্তব নমুনা। মক্কায় গেলে তিনি তাঁর আগের বাড়ী-ঘরের দিকে ফিরেও তাকাতেন না। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার বাড়ী-ঘরের প্রতি আপনি এত নাখোশ কেন?’ তিনি বললে, ‘ওগুলি তো আমি আমার আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছি।’
একবার তিনি তাঁর বন্ধুদের দাওয়াত দিলেন। ভালো ভালো খাবার এলো। খাবার দেখে তিনি কান্না শুরু করে দিলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘রাসূল সা. বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেতে পাননি।’
একদিন তিনি সাওম পালন করছিলেন। ইফতারের পর তাঁর সামনে আনীত খাবারের দিকে তাকিয়ে বলরেন, ‘মুসয়াব ইবন উমায়ের ছিলেন আমার থেকেও উত্তম মানুষ। তিনি শহীদ হলে তাঁর জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তারপর আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য দুনিয়ার এ প্রাচুর্য দান করলেন। আমার ভয় হয়, আমাদের বদলা না জানি দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হয়।’ অতঃপর তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
হযরত উমার তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘আবদুর রহমান মুসলিম নেতৃবৃন্দের একজন।’ হযরত আলী একটি ঘটনা বর্ণনা প্রসংগে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন, ‘আবদুর রহমান আসমান ও যমীনের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।’
হযরত আবদুর রহমান রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সরাসরি ও উমার রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে তাঁর পুত্রগণ, যেমন ইবরাহীম, হুমায়েদ, উমার, মুসয়াব, আবু সালামা, তাঁর পৌত্র মিসওয়ার, ভাগ্নে মিসওয়ার ইবন মাখরামা এবং ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জুবাইর, জাবির, আনাস, মালিক ইবন আওস রা. প্রমুখ সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বড় পরিচয়, তিনি আশারায়ে মুবাশ্শারার একজন।

সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রা)
নাম আবু ইসহাক সা’দ, পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক। ইতিহাসে তিনি সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস নামে খ্যাত। কুরাইশ বংশের বনু যুহরা শাখার সন্তান। মাতার নাম ‘হামনা’। পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন কুরাইশ বংশের। সা’দের পিতা আবু ওয়াক্কাস ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তাঁর অন্তিম রোগশয্যায় রাসূল সা. তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। মাতা হামনাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলৈন। তবে প্রথমতঃ তাঁর পুত্র সা’দের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনে হৈ চৈ ও বিলাপ শুরু করে লেকজন জড়ো করে ফেললেন। মায়ের কাণ্ড দেখে ক্ষোভে দুঃখে হতভম্ব হয়ে সা’দ ঘরের এক কোণে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। কিছুক্ষণ বিলাপ ও হৈ চৈ করার পর মা পরিষ্কার বলে দিলেনঃ ‘সা’দ যতক্ষণ মুহাম্মাদের রিসালাতের অস্বীকৃতির ঘোষণা না ভেবে ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পান করব না, রৌদ্র থেকে বাঁচার জন্য ছায়াতেও আসব না। মার আনুগত্যের হুকুম তো আল্লাহও দিয়েছেন। আমার কথা না শুনলে অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে এবং মার সাথে তার কোন সম্পর্কও থাকবেন।’
হযরত সা’দ বড় অস্থির হয়ে পড়লেন। রাসূললের সা. খিদমতে হাজির হয়ে সব ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূললের সা. নিকট থেকে জবাব পাওয়ার পূর্বেই সূরা আল আনকবুতের অষ্টম আয়াতটি নাযিল হলঃ
‘আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তবে তারা যদি তোমার ওপর বল প্রয়োগ করে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে বলে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের মেনো না।’
কুরআনের এ আয়াতটি হযরত সা’দের মানসিক অস্থিরতা দূর করে দিল। তাঁর মা তিনদিন পর্যন্ত কিছু মুখে দিলেন না, কারো সাথে কথা বললেন না এবং রোদ থেকে ছায়াতেও এলেন না। তাঁর অবস্থা বড় শোচনীয় হয়ে পড়ল। বার বার তিনি মার কাছে এসে তাঁকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তাঁর একই কথা, তাঁকে ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। অবশেষে তিনি মার মুখের ওপর বলে দিতে বাধ্য হলেঃ ‘মা, আপনার মতো হাজারটি মাও যদি আমার ইসলাম ত্যাগ করার ব্যাপারে জিদ করে পানাহারে ছেড়ে দেয় এবং প্রাণ বিসর্জন দেয়, তবুও সত্য দ্বীন পরিত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ হযরত সা’দের এ চরম সত্য কথাটি তাঁর মার অন্তরে দাগ কাটে। অবশেষে তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। ইমাম মুসিলম তাঁর সহীহ গ্রন্থে ‘আল-ফাদায়িল’ অধ্যায়ে এ সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত সা’দের ভাই উমাইর রা. রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির কিছুদিন পরই ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। ইবন খালদুন তাঁর ‘তারীখে’ উমাইরের পর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের ইসলাম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।
হযরত আবু বকর ছিলেন সা’দের অন্তরঙ্গ বন্ধু। আবু বকরের দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইমাম বুখারী তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থে ‘আল-মানাকিব’ অধ্যায়ে সা’দের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করেছেন। সা’দ বলেনঃ ইসলাম গ্রহণের পর আমি নিজেকে তৃতীয় মুসলমান হিসেবে দেখতে পেলাম। আসলে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত প্রাপ্তির সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে; কিন্তু অনেকের মতই তখন তিনি ঘোষণা দেননি। আর একথার সমর্থন পাওয়া যায় তাঁর মা’র ঘটনা এবং সূরা আনকাবুতের আয়াতটি নাযিলের মাধ্যমে। কারণ, এ আয়াতটি নবুওয়াতের চতুর্থ বছর নাযিল হয়। সম্ভবতঃ এ সময়ই তিনি তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মায়ের নিকট প্রকাশ করেন।
নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে সুলাইম গোত্রের ’আমর ইবন ’আবাসা গোপনে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখনও প্রকাশ্য দাওয়াতের অনুমতি আল্লাহর তরফ থেকে আসেনি। ইসলাম গ্রহণের পর ’আমর শিয়াবে আলী তালিবের এক কোণে নামায আদায় করছিলেন। কুরাইশরা প্রস্তর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। তা দেখে দু’একজন মুসলমানের সাথে সা’দও এগিয়ে এলেন এবং উক্ত কুরাইশ কাফিরদের সাথে তাদের ঝগড়া ও হাতাহাতি শুরু হয়। হযরত সা’দ তাঁর চাবুকটি দিয়ে এক কাফিরকে বেদম মার দিলেন। লোকটির দেহ রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। কোন মুসলিমানের হাতে কোন মুশরিকের রক্ত ঝরানোর এ ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম।
হযরত মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুমের মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর যে চার ব্যক্তি মদীনায় হিজরাত করেন তাঁদের একজন সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস। সহীহ বুখারীতে বারা ইবন আযিব থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ ‘সর্বপ্রথম আমাদের নিকট আগমণ করেন মুসয়াব ইবন ’উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম। এ দু’ব্যক্তি মদীনাবাসীদের কুরআন শিক্ষা দিতেন। অতঃপর বিলাল, সা’দ ও আম্মার বিন ইয়াসির আগমন করেন। ইবন সা’দ ‘তাবাকাতুল কুবরা’ গ্রন্থে ওয়াকিদীর সূত্রে উল্লেখ করেছেন, সা’দ ও তাঁর ভাই উমাইর মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় এসে তাদের অন্য এক ভাই ’উতবা ইবন আবী ওয়াক্কাসের নিকট অবস্থান করেন। তার কয়েক বছর পূর্বেই ’উতবা এক ব্যক্তিকে হত্যা করে মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় নেয়।
আল্লাহর পথে জিহাদে হযরত সা’দের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বীরত্ব ও সাহসিকতা ইসলাম-দুশমনদের খুব মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। তিনিই প্রথম মুসলিম যিনি আল্লাহর পথে তীর নিক্ষেপ করেন। তিনি নিজেও বলতেন,
- ‘আমি প্রথম আরব যে আল্লাহর জন্য তীর চালনা করেছিল।’
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের পর বেশ কিছুকাল যাবত মুহাজির মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল। তাদের না ছিল খাদ্য সম্ভার, না ছিল পরিধেয় বস্ত্র এবং না ছিল সুনির্দিষ্ট জীবিকার উপায় উপকরণ। মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের চাপে মদীনায় সীমিত পরিসরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিতটি নড়ে উঠেছিল। মদীনার আনসার-মুহাজির নির্বিশেষে গোটা মুসলিম সমাজ চরম আর্থিক দুর্গতির মধ্যে নিপতিত হয়। এমন চরম দারিদ্রের মধ্যে তাঁরা ইসলামের প্রচার প্রসারের কাজ জারি রাখেন এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁদের এ চরম দারিদ্র সম্পর্কে হযরত সা’দ বলেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহর সা. সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম; অথচ তখন গাছের পাতা ছাড়া আমাদের খাওয়ার কিছুই থাকতো না। (তা খেয়েই আমরা জীবন ধারণ করতাম) আর আমাদের বিষ্ঠা হত উট ছাগলের বিষ্ঠার মত।’- (বুখারী ও মুসলিমঃ মানাকিবু সা’দ রা.)
হিজরাতের এক বছর পর সফর মাসে রাসূল সা. ষাটজন উষ্ট্রারোহীর একটি দলকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে টহল দিতে পাঠালেন। এ দলে হযরত সা’দও ছিলেন। এক পর্যায়ে ইকরিমা ইবন আবী জাহলের নেতৃত্বে কুরাইশদের বিরাট একটি দল তাঁরা দেখতে পেলেন। কিন্তু উভয় পক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে গেল। তবে কুরাইশ পক্ষের কেউ একজন হঠাৎ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে হযরত সা’দ সাথে সাথে তীর নিক্ষেপ করলেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে কাফিরদের প্রতি নিক্ষিপ্ত প্রথম তীর।
হিজরী দ্বিতীয় সনের রবিউস সানী মাসে রাসূল সা. দু’শো সাহাবীকে সংগে নিয়ে মদীনা থেকে বের হলেন। উদ্দেশ্য, মদীনার আশে পাশে দুশমনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং দুশমনদের জানিয়ে দেওয়া যে মুসলমানরা ঘুমিয়ে নেই। এ বাহিনীর পতাকাবাহী ছিলেন হযরত সা’দ রা.। বাওয়াত নামক স্থানে কুরাইশদের সাথে এবার ছোট খাট একটি সংঘর্ষও হয়। এর ছয়মাস পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বদর যুদ্ধের অল্প কয়েকদিন আগে রাসূল সা. কুরাইশ কাফিলার সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিন জনের যে দলটি পাঠান তাদের একজন ছিলেন সা’দ রা.। তাঁরা বদরের কূপের নিকট ওৎ পেতে থেকে প্রতিপক্ষের দু’জনকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট নিয়ে আসেন। রাসূল সা. তাঁদের নিকট থেকে শত্রু পক্ষের অনেক তথ্য অবগত হন।
বদরে সা’দ ও তাঁর ভাই ’উমাইর রা. অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে লড়েন। প্রত্যেকেই একাধিক কাফিরকে হত্যা করে জাহান্নামে পাঠান। এ যুদ্ধে হযরত ’উমাইর রা. শাহাদাত বরণ করেন। এবং সা’দ রা. সাঈদ ইবন আ’সকে হত্যা করে তার তলোয়ারখানি নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট সমর্পণ করেন। তিনি রাসূলের সা. নিকট তলোয়ারখানি পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জবাবে তিনি বললেনঃ এ তলোয়ার না তোমার না আমার। সা’দ রাসূলের সা. নিকট থেকে উঠে কিছুদূর যেতে না যেতেই সূরা আনফাল নাযিল হয়। অতঃপর রাসূল সা. তাঁকে ডেকে বলেনঃ ‘তোমার তলোয়ার নিয়ে যাও।’
উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদরের এক বছর পর। হযরত সা’দ এ যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। কতিপয় মুসলিম সৈনিকের ভুলের কারণে নিশ্চিত বিজয় যখন পরাজয়ে রূপান্তরিত হয়, তখন মুষ্টিমেয় যে ক’জন সৈনিক নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাসূলকে সা. ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন, সা’দ রা. ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ইমাম বুখারী এ ঘটনা সা’দের রা. যবানেই বর্ণনা করেছেনঃ
’উহুদের দিনে রাসূল সা. তাঁর তুনীর আমার সামনে ছড়িয়ে দিলেন এবং বললেনঃ
তীর মার! আমার মা-বাবা তোমার প্রতি কুরবান হোক।’ ইবন সা’দ আরও বলেছেনঃ ‘ঘটনাক্রমে একটি তুনীর ফলা ছিলনা। সা’দ রা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এটাতো খালি। বললেনঃ ওটাও ছুঁড়ে দাও।’
হযরত সা’দের এক ভাই ’উমাইর বদর যুদ্ধে শহীদ হন। উহুদের যুদ্ধে সা’দ রা. যখন কাফিরদের প্রবল আক্রমণ থেকে রাসূলকে সা. হিফাজতের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে লড়ছেন, ঠিক তখনই তাঁর অন্য ভাই নরাধম ’উতবার নিক্ষিপ্ত প্রস্তরাঘাতে প্রিয় নবীর মুখ আহত হয় এবং একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। সা’দ রা. প্রায়ই বলতেনঃ কাফিরদের অন্য কাউকে হত্যার এত প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না যেমন ছিল ’উতবার ব্যাপারে। কিন্তু যখন আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনলাম, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলের চেহারা রক্ত-রঞ্জিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর গজব আপতিত হবে, তখন তার হত্যার আকাঙ্ক্ষা আমার নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং আমার অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসে।
উহুদের যুদ্ধে তিনি এক অস্বাভাবিক দৃশ্য অবলোকন করেন। তিনি বলেনঃ ‘উহুদের দিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. ডানে ও বামে ধবধবে সাদা দু’ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম। কাফিরদের সাথে তারা প্রচণ্ড লড়ছে। এর আগে বা পরে আর কখনও আমি তাদেরকে দেখিনি।’
খন্দকের যুদ্ধ হয় উহুদের দু’বছর পর। এ যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং একজন চতুর কাফির ঘোরসওয়ারের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে তার চোখ এমনভাবে এফাঁড় ওফোঁড় করেন যে, তা দেখে রাসূল সা. হঠাৎ হেসে ওঠেন। খন্দকের যুদ্ধে সালা পর্বতের এক উপত্যকায় রাসুলের সা. জন্য একটি তাঁবু নির্মাণ করা হয়। এক ঠাণ্ডার রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে রসূল সা. একাকী শুয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর মধ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনতে পেলেন্। জিজ্ঞেস করলেনঃ কে? উত্তর পেলেনঃ সা’দ- আবী ওয়াক্কাসের পুত্র। কি জন্য এসেছ? বললেনঃ সা’দের হাজার জীবন অপেক্ষা আল্লাহর রাসূল হচ্ছেন তার প্রিয়তম। এ অন্ধকার ঠাণ্ডা রাতে আপনার ব্যাপারে আমার ভয় হল। তাই পাহারার জন্য হাজির হয়েছি। আল্লাহর নবী বললেনঃ সা’দ! আমার চোখ খোলা ছিল। আমি আশা করছিলাম আজ যদি কোন নেককার বান্দা আমার হিফাজত করত!
হিজরী দশম সনে রাসূলুল্লাহর সা. বিদায় হজ্জের সংগী ছিলেন সা’দও। কিন্তু হজ্জের পূর্বেই মক্কায় তিনি দারুণভাবে পীড়িত হয়ে পড়েন। জীবনের আশা এক প্রকার ছেড়ে দিলেন। এ সময় রাসুল সা. মাঝে মাঝে এসে তাঁর খোঁজ-খবর নিতেন। হযরত সা’দ বললেনঃ একদিন তিনি আমার সাথে কথা বলার পর আমার কপালে হাত রাখলেন। তারপর মুখমণ্ডলের ওপর হাতের স্পর্শ বুলিয়ে পেট পর্যন্ত নিয়ে গেলেন এবং দুআ করলেনঃ হে আল্লাহ, আপনি সা’দকে শিফা দান করুন, তার হিজরাতকে পূর্ণতা দান করুন। অর্থাৎ হিজরাতের স্থান মদীনাতেই তার মৃত্যুদান করুন। হযরত সা’দ বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহর সা. হাতে সেই শীতল স্পর্শ ও প্রশান্তি আজও আমার অন্তরে অনুভব করে থাকি।’ তিনি সুস্থ হয়ে আরও পঁয়তাল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন।
হযরত আবু ’উবাইদা ও মুসান্নার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী পারস্যের কিসরা বাহিনীকে পরাজিত করে ইরাক জয় করে নিয়েছে। ইরাক এখন মুসিলম বাহিনী নিয়ন্ত্রণে। কিসরার স্বজনবৃন্দ নিজেদের সকল প্রকার মতভেদ ভুলে গিয়ে ইয়াজদিগির্দকে সিংহাসনে বসিয়ে সেনাপতি রুস্তমের নেতৃত্বে নতুন করে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের জন্য বিরাট বাহিনী গড়ে তুলেছে। হযরত উমার এ প্রস্তুতির খবর পেলেন। তিনি নিজেই মুসান্নার সাহায্যে একটি বাহিনী নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। কিন্তু মজলিসে শূরার অনুমতি না পেয়ে শূরার সিদ্ধান্ত মুতাবিক সা’দকে পাঠালেন এবং তাঁকেই নিযুক্ত করলেন ইরানী ফ্রন্টের সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। হযরত সা’দ রা. মদীনা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কাদেসিয়া পৌঁছলেন। তাঁর পৌঁছার পূর্বেই মুসান্না ইনতিকাল করেন। এ কাদেসিয়া প্রান্তরে সেনাপতি সা’দের নেতৃত্বে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে এক চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বিশাল পারস্য বাহিনীর প্রতিরোধ ব্যুহ তছনছ হয়ে যায় এবং একের পর এক তারা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে।
সাসানী সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনের পথে মুসলিম বাহিনী ‘বাহ্রাসীর’ দখল করে আছে। এ বাহ্রাসীর ও মাদায়েনের মধ্যে উত্তাল তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ দিজলা নদী প্রবাহিত। হযরত সা’দ খবর পেলেন, শাহানশাহ ইয়াজদিগির্দ রাজধানী মাদায়েন থেকে সকল মূল্যবান সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছে। হযরত সা’দ সৈন্য বাহিনী নিয়ে দ্রুত মাদায়েনের দিকে অগ্রসর হলেন। দিজলা তীরে এসে দেখলেন, ইরানীরা নদীর পুলটি পূর্বেই ধ্বংস করে দিয়েছে। এ দিজলার তীরে তিনি মুসিলম মুজাহিদদের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। ভাষণটির সার সংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
‘ওহে আল্লাহর বান্দারা, দ্বীনের সিপাহীরা! সাসানী শাসকরা আল্লাহর বান্দাহদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে মিথ্যা ও বানোয়াট কথার মাধ্যমে ধোঁকা দিয়ে অগ্নি ও সূর্যের উপাসনা করতে বাধ্য করেছে। তাদের ঘামঝরা কষ্টোপার্জিত সম্পদ নিজেদের পুঞ্জিভূত করেছে। তোমরা যখন তাদের পরিত্রাণদাতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে তখন তারা পালাবার পথ ধরেছে এবং দরিদ্র জনসাধারণের ধন সম্পদ ঘোড়া ও গাধার পিঠে বোঝাই করেছে। আমরা কক্ষণো তাদের এমন সুযোগ দেব না। তাদের বাহনের ওপর বোঝাইকৃত ধন-ভাণ্ডর যাতে আমরা ছিনিয়ে নিতে না পারি এজন্য তারা পুল ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু ইরানীরা আমাদের সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তারা জানে না আল্লাহর ওপর ভরসাকারীরা, মানবতার সেবকরা, পুল বা নৌকার ওপর ভরসা করে না। আমি পরম দয়ালু-দাতা আল্লাহর নামে আমার ঘোড়াটি নদীতে নামিয়ে দিচ্ছি। তোমরা আমার অনুসরণ কর। একজনের পেছনে অন্যজন, একজনের পাশে অন্যজন সারিবদ্ধভাবে তোমরা দিজলা পার হও। আল্লাহ তোমাদের সাহায্য ও হিফাজত করুন।’
ভাষণ শেষ করে হযরত সা’দ বিসমিল্লাহ বলে নিজের ঘোড়াটি নদীর মধ্যে চালিয়ে দিলেন। অন্য মুজাহিদরাও তাঁদের সেনাপতিকে অনুসরণ করলেন। নদী ছিল অশান্ত। কিন্তু আল্লাহর সিপাহীদের সারিতে একটু বিশৃঙ্খলা দেখা দিল না। তাঁরা সারিবদ্ধভাবে নদী পার হয়ে অপর তীরে পৌঁছলেন। ইরানী সৈন্যরা একটু নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিল। তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। অবলীলাক্রমে তারা চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘দৈত্য আসছে, দানব আসছে। পালাও পালাও।’
মুসলিম মুজাহিদদের এ আকস্মিক হামলায় বাদশাহ ইয়াজদিগির্দ অগণিত ধনরত্ন ফেলে মাদায়েন ত্যাগ করে হালওয়ানের দিকে যাত্রা করে। হযরত সা’দ নির্জন শ্বেত প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। পরিবেশ ছিল ভয়াবহ। প্রাসাদের প্রতিটি কক্ষ ছিল যেন শিক্ষা ও উপদেশের স্মারক। হযরত সা’দের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো সূরা দুখানের এ আয়াতগুলিঃ
- ‘তারা পেছনে ছেড়ে গিয়েছিল কত উদ্যান ও প্রস্রবণ, কত শস্য ক্ষেত্র ও সুরম্য প্রাসাদ এবং কত বিলাস-উপকরণ, যা তাদেরকে আনন্দ দিত! এমনটি ঘটেছিল এবং আমি এ সবকিছুর উত্তরাধিকারী করেছিলাম অন্য সম্প্রদায়কে।’ (সূরা দুখানঃ ২৫-২৮)
হযরত সা’দ শ্বেত প্রাসাদে প্রবেশ করে আট রাকয়াত ‘সালাতুল ফাতহ’ আদায় করেন। তারপর তিনি ঘোষণা দেন, এ শাহী প্রাসাদে আজ জুমআর জামাআত অনুষ্ঠিত হবে। অতঃপর মিম্বর তৈরী করে জুমআর নামায আদায় করেন। এটাই ছিল পারস্যে প্রথম জুমআর নামায।
মাদায়েন বিজয়ের পর খলীফা উমার রা. সেনাপতি সা’দকে নির্দেশ দেন, তিনি নিজে যেন ইরানীদের পেছনে ধাওয়া না করেন, বরং এ কাজের জন্য অন্য কাউকে নির্বাচন করে দায়িত্ব দেন। অতঃপর খলীফার আদেশে তিনি অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা, প্রশাসনের পুনর্গঠন, ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং নও মুসলিমদের তালীম ও তারবিয়াতে আত্মনিয়োগ করেন। যে মাদায়েন ছিল শত শত বছর ধরে অগ্নি উপাসকদের কেন্দ্রভূমি এবং যে মাদায়ের কখনও শোনেনি এক আল্লাহর নাম, সেখানে প্রথম বারের মত হযরত সা’দ নির্মাণ করেন এক জামে মসজিদ। ইরানের অন্যান্য শহরেও তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন। আরব মুসলমানদের বসবাসের জন্য কুফা শহরের সম্প্রসারণ করেন। ইরাকের বসরা শহরের স্থপতিও তিনি।
খলীফা উমার হযরত সা’দকে কুফার গভর্ণর নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় কুফাবাসীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত পদ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন। কুফায় সা’দ নিজের জন্য যে প্রাসাদটি তৈরী করেছিলেন, ’উমারের রা. নির্দেশে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা মদীনা থেকে কুফা গিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেন। (মাজমূ’ ফাতাওয়া-ইবন তাইমিয়া, খণ্ড ৩৫ পৃঃ ৪০)
হযরত সা’দের বিরুদ্ধে উসামা ইবন কাতাদা নামক কুফার যে লোকটি খলীফা উমারের নিকট কসম করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিল, সা’দ তার ওপর বদ-দুআ করে তিনটি জিনিস তার জন্য আল্লাহর নিকট কামনা করেনঃ আল্লাহ যেন তাকে দীর্ঘজীবি করেন, দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত করেন এবং তার সত্তাকে ফিতনার শিকারে পরিণত করেন। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, তাঁর এ দুআ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ তিনি তো ছিলেন ‘মুজতাজাবুদ দাওয়াহ’। স্বয়ং রাসূল সা. তাঁর জন্যে দু’আ করেছেনঃ ‘হে আল্লাহ, আপনি সা’দের দু’আ কবুল করুন, যখন সে দু’আ করবে।
হযরত ’উমার রা. সা’দের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগ যে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন তা কিন্তু ঠিক নয়। তাই তিনি বলেছেঃন ‘আমি সা’দকে রাষ্ট্র প্রশাসনে অযোগ্য বা তার প্রতি আস্থাহীনতার কারণে বরখাস্ত করিনি।’ (বুখারীঃ কিতাবুল মানাকিব) হযরত সা’দ যে খলীফা উমারের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসভাজন ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্য বিশিষ্ট যে বোর্ডটি গঠন করে দিয়ে যান তাতে হযরত সা’দের অন্তর্ভুক্তির মধ্যে। সা’দ সম্পর্কে তাঁর অন্তিম বাণী ছিলঃ ‘যদি খিলাফতের দায়িত্ব সা’দ পেয়ে যান, তাহলে তিনি তার উপযুক্ত। আর তা যদি না হয়, তবে যিনি খলীফা হবেন তিনি যেন তাঁর সাহায্য গ্রহণ করেন।’ (বুখারীঃ কিতাবুল মানাকিব ও আল-ইসাবা)। হযরত উসমান তাঁর খিলাফতের প্রথম বছরেই পুনরায় সা’দকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু কিছদিনের মধ্যে কুফার কোষাধ্যক্ষ হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ ও তাঁর মধ্যে কোন একটি বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় খলীফা সা’দকে প্রত্যাহার করেন।
ইবন সাবার আনসারী হাঙ্গামাবাজরা খলীফা উসমানকে ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে মদীনায় প্রবেশ করেছে। খলীফা মসজিদে নববীতে জুমআর নামাযের খুতবার মধ্যে হাঙ্গামাবাজদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করলেন। তারাও পাথর নিক্ষেপ করে খলীফাকে আহত করে। এ সময় তাদের প্রতিরোধে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন হযরত সা’দ। তারপর অন্যান্য সাহাবীরা একযোগে উঠে তাদের হটিয়ে দেন।
বিদ্রোহীদের হাতে হযরত উসমান শহীদ হলেন। হযরত সা’দ তখন মদীনায়। মদীনাবাসীরা হযরত আলীকে খলীফা মনোনীত করে তাঁর হাতে বাইয়াত করলেন। আলীর রা. হাতে বাইয়াতের জন্য লোকেরা যখন সা’দের বাড়ীতে গেল, তিনি তাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেনঃ ‘যতক্ষণ না সব মানুষ বাইয়াত করেছে, আমি করব না। তবে আমার পক্ষ থেকে কোন বিপদের আশঙ্কা নেই।’
হযরত উসমানের হত্যাকান্ডের পর ইসলামের ইতিহাসে যে বেদনাদায়ক অধ্যায়ের সূচনা হয় তার আলোচনা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবে এ সময় হযরত সা’দের ভূমিকা বুঝার জন্য এততটুকু ইঙ্গিত প্রয়োজন যে, সে সময় ইসলামী উম্মাত তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল হযরত আলীর পক্ষে, একদল তাঁর বিপক্ষে এবং একদল নিরপেক্ষ। হযরত আলীর পক্ষে, বিপক্ষের উভয় দলেই যেমন বিশিষ্ট সাহাবীরা ছিলেন, তেমনিভাবে ছিলেন এ নিরপেক্ষ দলেও। তাঁরা কোন মুসলমানের পক্ষে বিপক্ষে তরবারি উত্তোলনকে জায়েয মনে করেননি। এ কারণে আমরা হযরত সা’দকে দেখতে পাই তিনি উট বা সিফফিনের যুদ্ধে কোন পক্ষেই যোগ দেননি, তখন তিনি মদীনায় নিজ গৃহে অবস্থান করছেন।
মোটকথা, হযরত উসমানের শাহাদাতের পর তিনি নির্জনতা অবলম্বন করেন। একবার তিনি তাঁর উটের আস্তাবলে তাঁর পুত্র উমারকে আসতে দেখে বললেনঃ ‘আল্লাহ এ অশ্বারোহীর অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন।’ অতঃপর উমার এসে পিতাকে বললেনঃ ‘আপনি উট ও ছাগলের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছেন, আর এদিকে লোকেরা রাষ্ট্রীয় ঝগড়ায় লিপ্ত।’ হযরত সা’দ পুত্রের বুকের উপর হাত দিয়ে আঘাত করে বললেনঃ ‘চুপ কর!’ আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছিঃ আল্লাহ ভালোবাসেন নির্জনবাসী, মুত্তাকী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় যে মানুষের রাগ বিরাগের পরোয়া করেনা, তাকে।
হযরত সা’দ আলীর হাতে বাইয়াত করে পুনরায় তাঁর দলত্যাগী খারেজীদের ফাসিক বলে মনে করতেন। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর তাঁর পুত্র উমার তাঁর নিকট এসে বলেনঃ খিলফাত পরিচালনার জন্য এখন উম্মাতে মুসিলমার একজন বিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন। আমাদের ধারণায় আপনিই এর উপযুক্ত। এতটুকু বলতেই তিনি বলে ওঠেনঃ ‘থাক, হয়েছে। আমাকে আর উৎসাহিত করতে হবে না।’
হযরত সা’দ মদীনা থেকে দশ মাইল দূরে আকীক উপত্যকায় কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ইনতিকাল করেন। জীবনীকারদের মধ্যে তাঁর মৃত্যুসন সম্পর্কে মতভেদ আছে। তবে হিজরী ৫৫ সনে ৮৫ বছর বয়সে তাঁর ইনতিকাল হয় বলে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি আছে। ইবন হাজার তাঁর ‘তাহজীব’ গ্রন্থে এ মতই সমর্থন করেছেন। গোসল ও কাফনের পর লাশ মদীনায় আনা হয়। মদীনার তৎকালীন গভর্ণর মারওয়ান জানাযার ইমামতি করেন। সহীহ মুসলিমের একাধিক বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর জানাযার বিষয়টি বিস্তারিত জানা যায়।
হযরত সা’দের ইনতিকালের পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত ’আয়িশা ও অন্যান্য আযওয়াজে মুতাহ্হারাহ্ বলে পাঠালেন, তাঁর লাশ মসজিদে আনা হোক, যাতে আমরা জানাযার শরীক হতে পারি। কিন্তু লোকেরা লাশ মসজিদে নেয়া যেতে পারে কিনা এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। হযরত আয়িশা রা. একথা জানতে পেরে বললেনঃ ‘তোমরা এত তাড়াতাড়িই ভুলে যাও? রাসূল সা. তো সুহাইল ইবন বায়দার জানাযা এই মসজিদে আদায় করেছেন।’ অতঃপর লাশ উম্মুহাতুল মু’মিনীনের হুজরার নিকট আনা হল এবং তাঁরা নামায আদায় করলেন।
মরণকালে হযরত সা’দ রা. বহু অর্থ-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি একটি অতি পুরাতন পশমী জুববা চেয়ে নিয়ে বলেনঃ ‘এ দিয়েই তোমরা আমাকে কাফন দেবে। এ জুব্বা পরেই আমি বদর যুদ্ধে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমার ইচ্ছা, এটা নিয়েই আমি আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হই।’
হযরত সা’দের ছেলে মুসয়াব বলেনঃ আমার পিতার অন্তিম সময়ে তাঁর মাথাটি আমার কোলের ওপর ছিল। তাঁর মুমূর্ষ অবস্থা দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ বেটা কাঁদছ কেন? বললামঃ আপনার এ অবস্থা দেখে। বললেনঃ ‘আমার জন্য কেঁদোনা। আল্লাহ কক্ষণো আমাকে শাস্তি দেবেন না, আমি জান্নাতবাসী। আল্লাহ মু’মিনদেরকে তাদের সৎকাজের প্রতিদান দেবেন এবং কাফিরদের সৎকাজের বিনিময়ে তাদের শাস্তি লাঘব করবেন।’ (হায়াতুস সাহাবা- ৩/৫৪)
রাসূল সা., খুলাফায়ে রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবীদের নিকট হযরত সা’দের মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল অতি উচ্চে। তাঁরা তাঁর মতামতকে যে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করতেন, বহু হাদীসের মাধ্যমে একথা জানা যায়। একবার সা’দ মোজার ওপর মসেহ সংক্রান্ত একটি হাদীস বর্ণনা করেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার তাঁর পিতা হযরত উমার ফারুক রা. থেকে হাদীসটির সত্যতা যাচাই করতে চাইলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হাদীসটি কি সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস থেকে শুনেছ? বললেনঃ ‘হাঁ। উমার বললেনঃ হাঁ সা’দ যখন তোমাদের নিকট কোন হাদীস বর্ণনা করে, তখন সে সম্পর্কে অন্য কারো নিকট কিছু জিজ্ঞেস করবে না।’
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে চারজন ছিলেন সর্বাধিক কঠোরঃ উমার, আলী যুবাইর, সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় হযরত বিলালের অনুপস্থিতিতে সা’দ তিনবার আযান দিয়েছেন। রাসুল সা. তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমার সংগে বিলালকে না দেখলে তুমি আযান দেবে।’ (হায়াতুস সাহাবা ৩/১১৬)
হযরত সা’দ রাসূল সা. থেকে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর তাঁর নিকট থেকে তাঁর ছেলে-মেয়েরা, যেমন, ইবরাহীম, আমের, মুসয়াব, মুহাম্মাদ, আয়িশা এবং বিশিষ্ট সাহাবীরা, যেমন, আয়িশা, ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জাবির রা. এবং বিশিষ্ট তাবেয়ীরা, যেমন, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব আবু উসমান আন-নাহদী, কায়িস ইবন আবী হাযিম, আলকামা, আহনাফ ও অন্যরা হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল-ইসাবা ৩/৩৩)
হযরত সা’দের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। প্রাচীন সূত্রগুলিতে তাঁর কিছু কবিতা সংকলিত হয়েছে। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেছেন।
হযরত সা’দের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’ অর্থাৎ জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজনের অন্যতম এবং তিনি এ দলের সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।

আবু উবাইদা ইবনুল জার্রাহ (রা)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ ‘লিকুল্লি উম্মাতিন আমীনুন, ওয়া আমীনু হাজিহিল উম্মাহ আবু উবাইদা- প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে। আর এ মুসলিম জাতির পরম বিশ্বাসী ব্যক্তি আবু উবাইদা।’
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল মুখমণ্ডল, গৌরকান্তি, হালকা পাতলা গড়ন ও দীর্ঘদেহের অধিকারী। তাঁকে দেখলে যে কোন ব্যক্তির চোখ জুড়িয়ে যেত, সাক্ষাতে অন্তরে ভক্তি ও ভালোবাসার উদয় হত এবং হৃদয়ে একটা নির্ভরতার ভাব সৃষ্টি হত। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাবী, অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক প্রকৃতির। তবে যে কোন সংকট মুহূর্তে সিংহের ন্যায় চারিত্রিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে ফুটে উঠত। তাঁর চারিত্রিক দীপ্তি ও তীক্ষ্ণতা ছিল তরবারীর ধারের ন্যায়। রাসূলের সা. ভাষায় তিনি ছিলেন উম্মাতে মুহাম্মাদীর ‘আমীন’- বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।
তাঁর পুরো নাম আমীল ইবন আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ আল –ফিহরী আল কুরাইশী। তবে কেবল আবু উবাইদা নামে তিনি সবার কাছে পরিচিত। তাঁর পঞ্চম উর্ধ পুরুষ ‘ফিহরের’ মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। তাঁর মাও ফিহরী খান্দানের কন্যা। সীরাত বিশেষজ্ঞদের মতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমারের রা. মন্তব্য হলঃ ‘কুরাইশদের তিন ব্যক্তি অন্য সকলের থেকে সুন্দর চেহারা, উত্তম চরিত্র ও স্থায়ী লজ্জাশীলতার জন্য সর্বশেষ্ঠ। তাঁর তোমাকে কোন কথা বললে মিথ্যা বলবেন না, আর তুমি তাদেরকে কিছু বললে তোমাকে মিথ্যুক মনে করবেন না। তাঁরা হলেন- আবু বকর সিদ্দিক, উসমান ইবন আফফান ও আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ।’
ইসলাম প্রচারের প্রথম ভাগেই যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন আবু উবাইদা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। হযরত আবু বকরের মুসলমান হওয়ার পরের দিনই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আবু বকরের হাতেই তিনি তাঁর ইসলামের ঘোষণা দেন। তারপর তিনি আবদুর রহমান ইবন আউফ, উসমান ইবন মাজউন, আল-আরকাম ইবন আবিল আরকাম ও তাঁকে সংগে করে রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির হন। সেখানে যারা সকলেই একযোগে ইসলামের ঘোষণা দেন। এভাবে তাঁরাই হলেন মহান ইসলামী ইমারতের প্রথম ভিত্তি।
মক্কায় মুসলিমদের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আবু উবাইদা শরীক চিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি অটল থেকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কামিয়াব হন। কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে দু’বার হাবশায় হিজরাত করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহর সা হিজরাতের পর তিনিও মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় সা’দ বিন মুয়াজের সাথে তাঁর ‘দ্বীনী মুয়াখাত’ বা দ্বীনী ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বদর যুদ্ধের দিন আবু উবাইদার পরীক্ষার কঠোরতা ছিল সকল ধ্যান-ধারণা ও কল্পনার উর্ধে। যুদ্ধের ময়দানে এমন বেপরোয়াভাবে কাফিরদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকেন যেন তিনি মৃত্যুর প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। মুশরিকরা তাঁর আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের অশ্বারোহী সৈনিকরা প্রাণের ভয়ে দিশেহারা হয়ে দিকবিদিক পালাতে থাকে। কিন্তু শত্রুপক্ষের এক ব্যক্তি বার বার ঘুরে ফিরে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। আর তিনিও তার সামনে থেকে সরে যেতে লাগলেন যেন তিনি সাক্ষাত এড়িয়ে যাচ্ছেন। লোকটি ভীড়ের মধ্যে প্রবেশ করল। আবু উবাইদা সেখানেও তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। অবশেষে সে শত্রুপক্ষ ও আবু উবাইদার মাঝখানে এসে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। যখন তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল, তিনি তাঁর তরবারির এক আঘাতে লোকটির মাথা দেহ থেকে বিচ্ছন্ন করে ফেলেন। লোকটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।
লোকটি কে? সে আর কেউ নয়। সে আবু উবাইদার পিতা আবদুল্লাহ ইবনুল জাররাহ। প্রকৃতপক্ষে আবু উবাইদা তাঁর পিতাকে হত্যা করেননি, তিনি তাঁর পিতার আকৃতিতে শিরক বা পৌত্তলিকতা হত্যা করেছেন। এ ঘটনার পর আল্লাহ তা’আলা আবু উবাইদা ও তাঁর পিতার শানে নিম্নের এ আয়াতটি নাযিল করেন।
‘তোমরা কখনো এমনটি দেখতে পাবে না যে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার লোকেরা কখনো তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করে যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সা. বিরুদ্ধাচরণ করেছে- তারা তাদের পিতা-ই হোক কিংবা তাদের পুত্র-ই হোক বা ভাই হোক অথবা তাদের বংশ-পরিবারের লোক। তারা সেই লোক যাদের দিলে আল্লাহ তা’আলা ঈমান দৃঢ়মূল করে দিয়েছেন এবং নিজের তরফ হতে একটা রূহ দান করে তাদেরকে এমন সব জান্নাতে দাখিল করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে। তাতে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও সন্তুষ্ট হয়েছেন তাঁর প্রতি। এরা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রাখ, আল্লাহর দলের লোকেরাই কল্যাণপ্রাপ্ত হবে।’ (আল মুজাদিলা- ২২)
আবু উবাইদার এরূপ আচরণে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ, আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় ঈমান, দ্বীনের প্রতি নিষ্ঠা, এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রতি তাঁর আমানতদারী তাঁর মধ্যে এমন চূড়ান্ত রূপলাভ করেছিল যে, তা দেখে অনেক মহান ব্যক্তিও ঈর্ষা পোষণ করতেন। মুহাম্মাদ ইবন জাফর বলেনঃ ‘খৃস্টানদের একটা প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে হাজির হয়ে বললো- হে আবুল কাসিম! আপনার সাথীদের মাঝ থেকে আপনার মনোনীত কোন একজনকে আমাদের সাথে পাঠান। তিনি আমাদের কিছু বিতর্কিত সম্পদের ফায়সালা করে দেবেন। আপনাদের মুসলিম সমাজ আমাদের সবার কাছে মনোপূত ও গ্রহণযোগ্য। একথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ ‘সন্ধ্যায় তোমরা আমার কাছে আবার এসো। আমি তোমাদের সাথে একজন দৃঢ়চেতা ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে পাঠাব।’ হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব বলেনঃ ‘আমি সেদিন সকাল সকাল জোহরের নামায আদায়ের জন্য মসজিদে উপস্থিত হলাম। আর আমি এ দিনের মত আর কোন দিন নেতৃত্বের জন্য লালায়িত হইনি। এর একমাত্র কারণ, আমিই যেন হতে পারি রাসূলুল্লাহর সা. এ প্রশংসার পাত্রটি।
রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সাথে জোহরের নামায শেষ করে ডানে বায়ে তাকাতে লাগলেন। আর আমিও তাঁর নজরে আসার জন্য আমার গর্দানটি একটু উঁচু করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি তাঁর চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহকে দেখতে পেলেন। তাঁকে ডেকে তিনি বললেনঃ ‘তুমি তাদের সাথে যাও এবং সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তাদের বিতর্কিত বিষয়টির ফায়সালা করে দাও।’ আমি তখন মনে মনে বললামঃ আবু উবাইদা এ মর্যাদাটি ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
আবু উবাইদা কেবল একজন আমানতদারই ছিলেন না, আমানতদারীর জন্য সর্বদা সকল শক্তি পুঞ্জিভূত করতেন। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে কুরাইশ কাফিলার গতিবিধি অনুসরণের জন্য রাসূল সা. একদল সাহাবীকে পাঠান। তাঁদের আমীর নিযুক্ত করেন আবু উবাইদাকে। পাথেয় হিসাবে তাঁদেরকে কিছু খোরমা দেওয়া হয়। প্রতিদিন আবু উবাইদা তাঁর প্রত্যেক সংগীকে মাত্র একটি খোরমা দিতেন। তাঁরা শিশুদের মায়ের স্তন চোষার ন্যায় সারাদিন সেই খোরমাটি চুষে চুষে এবং পানি পান করে কাটিয়ে দিত। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র একটি খোরমা দিতেন। তাঁর শিশুদের মায়ের স্তন চোষার ন্যায় সারাদিন সেই খোরমাটি চুষে চুষে এবং পানি পান করে কাটিয়ে দিত। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাত্র একটি খোরমাই তাঁদের জন্য যথেষ্ট ছিল। কোন কোন বর্ণনায় ঘটনাটি এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ অষ্টম হিজরীতে রজব মাসে রাসুল সা. আবু উবাইদার নেতৃত্বে উপকূলীয় এলাকায় কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য একটি বাহিনী পাঠান। কিছু খেজুর ছাড়া তাঁদের সাথে আর কোন পাথেয় ছিল না। সৈনিকদের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ছিল মাত্র একটি খেজুর। এই একটি খেজুর খেয়েই তাঁর বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করেন। অবশেষে আল্লাহতায়ালা তাঁদের এ বিপদ দূর করেন। সাগর তীরে তাঁরা বিশাল আকৃতির এক মাছ লাভ করেন এবং তার ওপর নির্ভর করেই তাঁরা মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। হয়তো এ দুটি পৃথক পৃথক ঘটনা ছিল।
উহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা যখন পরাজয় বরণ করে এবং মুশরিকরা জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মুহাম্মাদ কোথায়, মুহাম্মাদ কোথায়....’। তখন আবু উবাইদা ছিলেন সেই দশ ব্যক্তির অন্যতম যারা বুক পেতে রাসূলকে সা. মুশরিকদের তীর থেকে রক্ষা করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল রাসূলুল্লাহর সা. দাঁত শহীদ হয়েছে, তাঁর কপাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে এবং গণ্ডদেশে বর্মের দুটি বেড়ী বিঁধে গেছে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক বেড়ী দু’টিকে উঠিয়ে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি এগিয়ে এলেন। আবু উবাইদা তাঁকে বললেন, ‘কসম আল্লাহর! আপনি আমাকে ছেড়ে দিন।’ তিনি ছেড়ে দিলেন। আবু উবাইদা ভয় করলেন হাত দিয়ে বেড়ী দু’টি তুললে রাসূল সা. হয়ত কষ্ট পাবেন। তিনি শক্তভাবে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে প্রথমে একটি তুলে ফেললেন। কিন্তু তাঁরও অন্য একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। তখন আবু বকর রা. মন্তব্য করলেনঃ ‘আবু উবাইদা সর্বোত্তম ব্যক্তি।’ খন্দক ও বনী কুরাইজা অভিযানেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক চুক্তিতে তিনি একজন সাক্ষী হিসেবে সাক্ষর করেন। খাইবার অভিযানে সাহস ও বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ‘জাতুস সালাসিল’ অভিযানে হযরত আমর ইবনুল আসের বাহিনীর সাহায্যের জন্য দু’শ’ সিপাহীসহ রাসূল সা. আবু উবাইদাকে পিছনে পাঠান। তাঁরা জয়লাভ করেন। মক্কা বিজয়, তায়িফ অভিযানসহ সর্বক্ষেত্রে আবু উবাইদা শরীক ছিলেন। বিদায় হজ্জেও তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সফরসংগী ছিলেন।
ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহর সা. জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আবু উবাইদা সর্বক্ষেত্রে ছায়ার ন্যায় সর্বদা তাঁকে অনুসরণ করেন।
সাকীফায়ে বনী সায়েদাতে খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে তুমুল বাক-বিতণ্ডা চলছে। আবু উবাইদা আনসারদের লক্ষ্য করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিলেন। তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেনঃ ‘ওহে আনসার সম্প্রদায়! তোমরাই প্রথম সাহায্যকারী। আজ তোমরাই প্রথম বিভেদ সৃষ্টিকারী হয়োনা।’ এক পর্যায়ে হযরত আবু বকর আবু উবাইদাকে বলেন, আপনি হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার হাতে বাইয়াত করি। আমি রাসূলকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘প্রত্যেক জাতিরই একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি আছে, তুমি এ জাতির সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি।’ এর জবাবে আবু উবাইদা বললেনঃ ‘আমি এমন ব্যক্তির সামনে হাত বাড়াতে পারিনা যাকে রাসূল সা. আমাদের নামাযের ইমামতির আদেশ করেছেন এবং যিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইমামতি করেছেন।’ একথার পর আবু বকরের হাতে বাইয়াত করা হল। আবু বকরের খলীফা হবার পর সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সর্বোত্তম উপদেষ্টা ও সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করেন ।আবু বকরের পর হযরত উমার খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আবু উবাইদা তাঁরও আনুগত্য মেনে নেন।
হযরত আবু বকর রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর হিজরী ১৩ সনে সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেন। আবু উবাইদাকে হিমস, ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে দিমাশ্ক, শুরাহবীলকে জর্দান এবং ’আমর ইবনুল আসকে ফিলিস্তীনে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করলেন আবু উবাইদাকে। দিমাশ্ক, হিমস, লাজেকিয়া প্রভৃতি শহর বিজিত হয় আবু উবাইদার হাতে। ইয়ারমুকের সেই ভয়াবহ যুদ্ধ তিনিই পরিচালনা করেন। ’আমর ইবনুল ’আসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বায়তুল মাকদাস বিজয়ে শরীক হন। বায়তুল মাকদাসবাসীরা খোদ খলীফা ’উমারের সাথে সন্ধির ইচ্ছা প্রকাশ করলে আবু উবাইদাই সে কথা জানিয়ে খলীফাকে পত্র লেখেন। সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য খলীফা ‘জাবিয়া’ পৌঁছলে আবু উবাইদাহ তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। হিজরী ১৭ সনে হযরত খালিদ সাইফুল্লাহকে দিমাশ্কের আমীর ও ওয়ালীর পদ থেকে অপসারণ করে খলীফা উমার আবু উবাইদাকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করেন। হযরত খালিদ সাইফুল্লাহ লোকদের বলেন, ‘তোমাদের খুশী হওয়া উচিত যে, আমীনুল উম্মাত তোমাদের ওয়ালী।’
আবু উবাইদার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী সিরিয়ায় একের পর এক বিজয় লাভ করে সিরিয়ার সমগ্র ভূখণ্ড দখল করে চলেছে। এ সময় সিরিয়ায় মহামারী আকারে প্লেগ দেখা দেয় এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তার শিকারে পরিণত হয়। খলীফা হযরত উমার রা. নিজেই খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য রাজধানী মদীনা থেকে ‘সারগ’ নামক স্থানে পৌঁছুলেন। অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আবু উবাইদা সেখানে খলীফাকে অভ্যর্থনা জানালেন। প্রবীণ মুহাজির ও আনসারদের সাথে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করলেন। সবাই একবাক্যে সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্থান ত্যাগের পক্ষে মত দিলেন। হযরত উমার সবাইকে আহ্বান জানালেন তাঁর সাথে আগামী কাল মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য। তাকদীরের প্রতি গভীর বিশ্বাসী আবু উবাইদা বেঁকে বসলেন। খলীফাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘আ ফিরারুম মিন কাদলিল্লাহ- একি আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন নয়?’ খলীফা দুঃখ প্রকাশ করে বললেনঃ ‘আফসুস! আপনি ছাড়া কথাটি অন্য কেউ যদি বলতো! হাঁ, আল্লাহর তাকদীর থেকে পালাচ্ছি। তবে অন্য এক তাকদীরের দিকে। আবু উবাইদা তাঁর বাহিনীসহ সেখানে থেকে গেলেন। খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমার মদীনা পৌঁছে দূত মারফত আবু উবাইদাকে একখানা পত্র পাঠান। পত্রে তিনি লিখেনঃ ‘‘আপনাকে আমার খুবই প্রয়োজন। অত্যন্ত জরুরীভাবে আপনাকে আমি তলব করছি। আমার এ পত্রখানি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে তাহলে সকাল হওয়ার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন। আর যদি দিনের বেলা পৌঁছে তাহলে সন্ধ্যার পূর্বেই রওয়ানা দেবেন।’’ খলীফা উমারের এ পত্রখানি হাতে পেয়ে তিনি মন্তব্য করেনঃ ‘আমার কাছে আমীরুল মুমিনীনের প্রয়োজনটা কি তা আমি বুঝেছি। যে বেঁচে নেই তাকে তিনি বাঁচাতে চান। তারপর তিনি লিখলেনঃ ‘‘আমীরুল মু’মিনীন, আমি আপনার প্রয়োজনটা বুঝেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মাঝে অবস্থান করছি। তাদের ওপর যে মুসিবাত আপতিত হয়েছে তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাইনা, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেন। আমার এ পত্রখানি আপনার হাতে পৌঁছার পর আপনি আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দান করুন।’’
হযরত উমার এ পত্রখানি পাঠ করে এত ব্যাকুলভাবে কেঁদেছিলেন যে, তাঁর দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর এ কান্না দেখে তার আশেপাশের লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ ‘আমীরুল মু’মিনীন, আবু উবাইদা কি ইনতিকাল করেছেন?’ তিনি বলেছিলেনঃ ‘না। তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।’
হযরত উমারের ধারণা মিথ্যা হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্লেগে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাঁর সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে উপদেশমূলক একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। তিনি বলেনঃ ‘‘তোমাদেরকে যে উপদেশটি আমি দিচ্ছি তোমরা যদি তা মেনে চলো তাহলে সবসময় কল্যাণের পথেই থাকবে। তোমরা নামায কায়েম করবে, রমাদান মাসে রোযা রাখবে, যাকাত দান করবে, হজ্জ ও উমরা আদায় করবে, একে অপরকে উপদেশ দেবে, তোমাদের শাসক ও নেতৃবৃন্দকে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলবে, তাদের কাছে কিছু গোপন রাখবে না এবং দুনিয়ার সুখ সম্পদে গা ভাসিয়ে দেবে না। কোন ব্যক্তি যদি হাজার বছরও জীবন লাভ করে, আজ আমার পরিণতি তোমরা দেখতে পাচ্ছ তারও এই একই পরিণতি হবে।’’ সকলকে সালাম জানিয়ে তিনি বক্তব্য শেষ করেন। অতঃপর মুয়াজ ইবন জাবালের দিকে তাকিয়ে বলেনঃ ‘মুয়াজ! তুমি নামাযের ইমামতি কর।’ এর পরপরই তাঁর রূহটি পবিত্র দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরম সত্তার দিকে ধাবিত হয়। মুয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলকে লক্ষ্য করে বলেনঃ লোক সকল! তোমরা এ ব্যক্তির তিরোধানে ব্যথা ভারাক্রান্ত। আল্লাহর কসম! আমি এ ব্যক্তির থেকে অধিক কল্যাণদৃপ্ত বক্ষ, পরিচ্ছন্ন হৃদয়, পরকালের প্রেমিক এবং জনগণের উপদেশ দানকারী আর কোন ব্যক্তিকে জানিনা। তোমরা তাঁর প্রতি রহম কর, আল্লাহও তোমাদের প্রতি রহম করবেন। এটা হিজরী ১৮ সনের ঘটনা।
এরপর লোকেরা সমবেত হয়ে আবু উবাইদার মরদেহ বের করে আনলো। মুয়াজ বিন জাবালের ইমামতিতে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হল। মুয়াজ বিন জাবাল, আমর ইবনুল আস ও দাহ্হাক বিন কায়েস কবরের মধ্যে নেমে তাঁর লাশ মাটিতে শায়িত করেন। কবরে মাটিচাপা দেওয়ার পর মুয়াজ এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে তাঁর প্রশংসা করে বলেনঃ ‘‘আবু উবাইদা, আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন! আল্লাহর কসম! আমি আপনার সম্পর্কে যতটুকু জানি কেবল ততটুকুই বলবো, অসত্য কোন কিছু বলবো না। কারণ, আমি আল্লাহর শাস্তির ভয় করি। আমার জানা মতে আপনি ছিলেন আল্লাহকে অত্যধিক স্মরণকারী, বিনম্রভাবে যমীনের ওপর বিচরণকারী ব্যক্তিদের একজন। আর আপনি ছিলেন সেইসব ব্যক্তিদের অন্যতম যারা তাদের ‘রবের’ উদ্দেশ্যে সিজদারত ও দাঁড়ানোর অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করে এবং যারা খরচের সময় অপচয়ও করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং মধ্যবর্তী পন্থা অবলম্বন করে থাকে। আল্লাহর কসম; আমার জানা মতে আপনি ছিলেন বিনয়ী এবং ইয়াতিম-মিসকীনদের প্রতি সদয়। আপনি ছিলেন অত্যাচারী অহংকারীদের শত্রুদেরই একজন।’
খাওফে খোদা, ইত্তেবায়ে সুন্নাত, তাকওয়া, বিনয়, সাম্যের মনোভাব, স্নেহ ও দয়া ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একদিন একটি লোক আবু উবাইদার বাড়ীতে গিয়ে দেখতে পেল, তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। লোকটি জিজ্ঞেস করলোঃ ব্যাপার কি আবু উবাইদা, এত কান্নাকাটি কেন? তিনি বলতে লাগলেনঃ ‘‘একবার রাসূল সা. মুসলমানদের ভবিষ্যত বিজয় ও ধন-ঐশ্বর্যে্যর আলোচনা প্রসঙ্গে সিরিয়ার প্রসঙ্গ উঠালেন। বললেনঃ ‘আবু উবাইদা তখন যদি তুমি বেঁচে থাক, তাহলে তিনটি খাদেমই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। একটি তোমার নিজের, একটি পরিবার-পরিজনের এবং অন্যটি তোমার সফরে সংগী হওয়ার জন্য। অনুরূপভাবে তিনটি বাহনও যথেষ্ট মনে করবে। একটি তোমার, একটি তোমার খাদেমের এবং একটি তোমার জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য।’ কিন্তু এখন দেখছি, আমার বাড়ী খাদেমে এবং আস্তাবল ঘোড়ায় ভরে গেছে। হায়, আমি কিভাবে রাসূলুল্লাহকে সা. মুখ দেখাবো? রাসুল সা. বলেছিলেনঃ সেই ব্যক্তিই আমার সর্বাধিক প্রিয় হবে, যে ঠিক সেই অবস্থায় আমার সাথে মিলিত হবে যে অবস্থায় আমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছি।’’
খলীফা হযরত উমার সিরিয়া সফরের সময় দেখতে পেলেন, অফিসারদের গায়ে জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছদ। তিনি এতই ক্ষেপে গেলেন যে, ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং তাদের দিকে পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করতে করতে বললেনঃ তোমরা এত তাড়াতাড়ি অনারব অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছো কিন্তু আবু উবাইদা একজন সাদামাটা আরব হিসেবে খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করলেন। গায়ে অতি সাধারণ আরবীয় পোশাক, উটের লাগামটিও একটি সাধারণ রশি। খলীফা উমার রা. তাঁর বাসস্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন, সেখানে আরো বেশী সরল-সাদাসিধে জীবনধারার চিহ্ন। অর্থাৎ একটি তলোয়ার একটি ঢাল ও উটের একটি হাওদা ছাড়া তাঁর বাড়ীতে আর কিছু নেই। খলীফা বললেনঃ আবু উবাইদা, আপনি তো আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব্যবস্থা করে নিতে পারতেন।’ জবাবে আবু উবাইদা বললেনঃ আমীরুল মুমিনীন, আমাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
একবার হযরত উমার রা. উপঢৌকন হিসেবে চারশ’ দীনার ও চার হাজার দিরহাম আবু উবাইদার নিকট পাঠালেন। তিনি সব অর্থই সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। নিজের জন্য একটি পয়সাও রাখলেন না। হযরত ’উমার একথা শুনে মন্তব্য করেনঃ ‘আলহামদুলিল্লাহ! ইসলামে এমন লোকও আছে।’
তিনি এতই বিনয়ী ছিলেন যে, সিপাহসালার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ সৈনিকদের থেকে তাঁকে পৃথক করা যেত না। অপরিচিত কেউ তাকে সিপাহসালার বলে চিনতে পারতো না। একবার তো এক রোমান দূত এসে জিজ্ঞেস করেই বসে, ‘আপনাদের সেনাপতি কে? সৈনিকরা যখন আঙ্গুর উঁচিয়ে তাঁকে দেখিয়ে দিল, তখন তো সে সেনাপতির অতি সাধারণ পোশাক ও অবস্থান দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।

সাঈদ ইবন যায়িদ (রা)
নাম সাঈদ, কুনিয়াত আবুল আ’ওয়ার। পিতা যায়িদ, মাতা ফাতিমা বিন্তু বা’জা। উর্ধপুরুষ কা’ব ইবন লুই-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।
সাঈদের পিতা যায়িদ ছিলেন জাহিলী যুগের মক্কার মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন যাঁরা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই শিরক ও পৌত্তলিকতা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখেন, সব রকম পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকেন। এমন কি মুশরিকদের হাতে যবেহ করা জন্তুর গোশ্তও পরিহার করতেন। একবার নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে ‘বালদাহ’ উপত্যকায় রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহর সা. সামনে খাবার আনা হলে তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানান। যায়িদকে খাওয়ার অনুরোধ করা হলে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহকৃত পশুর গোশ্ত আমি খাইনে।’
হযরত আসমা রা. বলেনঃ একবার আমি যায়িদকে দেখলাম, তিনি কা’বার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বলছেন, ওহে কুরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর কসম, আমি ছাড়া দ্বীনে হানীফের ওপর তোমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।
জাহিলী যুগে সাধারণতঃ কন্যা সন্তান জীবন্ত দাফন করা হতো। কোথাও কোন কন্যা সন্তান হত্যা বা দাফন করা হচ্ছে শুনতে পেলে যায়িদ তার অভিভাবকের কাছে চলে যেতেন এবং সন্তানটিকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিতেন। তারপর সে বড় হলে তার পিতার কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ইচ্ছে করলে এখন তুমি নিজ দায়িত্বে নিতে পার অথবা আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিতে পার।
কুরাইশরা তাদের কোন একটি উৎসব পালন করছে। মানুষের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফায়িল তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দেখছে পুরুষেরা তাদের মাথায় বেঁধেছে দামী রেশমী পাগড়ী, গায়ে জড়িয়েছে মূল্যবান ইয়ামনী চাদর। আর নারী ও শিশুরা পরেছে মূল্যবান সাজে সুসজ্জিত করে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের দেব-দেবীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য।
তিনি কা’বার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বলরেনঃ
‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! এই ছাগলগুলি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের পান করান, যমীনে ঘাস সৃষ্টি করে তাদের আহার দান করেন। আর তোমরা অন্যের নামে সেগুলি যবেহ কর? আমি তোমাদেরকে একটি মূর্খ সম্প্রদায়রূপে দেখতে পাচ্ছি।
এ কথা শুনে তাঁর চাচা ও উমার ইবনুল খাত্তাবের পিতা আল খাত্তাব উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল-
তোর সর্বনাশ হোক! সব সময় আমরা তোর মুখ থেকে এ ধরণের বাজে কথা শুনে সহ্য করে আসছি। এখন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারপর তার গো্ত্রের বোকা লেকাদের উত্তেজিত করে তুলল তাঁকে কষ্ট দিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলতে। অবশেষে তিনি বাধ্য হলেন মক্কা ছেড়ে হিরা পর্বতে আশ্রয় নিতে। তাতেও সে ক্ষান্ত হল না। গোপনেও যাতে তিনি মক্কায় প্রবেশ করতে না পারেন, সেদিকে সর্বক্ষণ দৃষ্টি রাখার জন্য একদল কুরাইশ যুবককে সে নিয়োগ করে রাখে।
অতঃপর যায়িদ ইবন আমর কুরাইশদের অগোচরে ওয়ারাকা ইবন নাওফিল, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, উসমান ইবনুল হারিস এবং মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহর ফুফু উমাইমা বিনতু ’আবদিল মুত্তালিবের সাথে গোপনে মিলিত হলেন। আরববাসী যে চরম গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত সে ব্যাপারে তিনি তাদের সাথে মত বিনিময় করলেন যায়িদ তাঁদেরকে বললেনঃ
‘আল্লাহর কসম আপনার নিয়মিতভাবে জেনে রাখুন, আপনাদের এ জাতি কোন ভিত্তির ওপর নেই। তারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করে ফেলেছে তার বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে। আপনারা যদি মুক্তি চান, নিজেদের জন্য একটি দ্বীন অনুসন্ধান করুন।’
অতঃপর এ চার ব্যক্তি ইয়াহুদী, নাসারা ও অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুদের নিকট গেলেন দ্বীনে ইবরাহীম তথা দ্বীনে হানীফ সম্পর্কে জানার জন্য। ওয়ারাকা ইবন নাওফিল খৃস্ট ধর্ম অবলম্বন করলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ উসমান ইবনুল হারিস কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না। আর যায়িদ ইবন ’আমর ইবন নুফায়িলের জীবনে ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। আমরা সে ঘটনা তাঁর জবানেই পেশ করছি।
‘আমি ইয়াহুদী ও খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে অবগত হলাম; কিন্তু সে ধর্মে মানসিক শান্তি পাওয়ার মত তেমন কিছু না পেয়ে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। এক পর্যায়ে আমি শামে (সিরিয়া) এসে উপস্থিত হলাম। আমি আগেই শুনেছিলাম সেখানে একজন রাহিব’ ‘সংসারত্যাগী ব্যক্তি আছেন, যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন- ’ওহে মক্কাবাসী ভাই, আমার মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনে ইবরাহীম অনুসন্ধান করছেন।’
বললাম ‘হ্যাঁ আমি তাই অনুসন্ধান করছি।’
তিনি বললেনঃ ‘আপনি যে দ্বীনের সন্ধান করছেন, আজকের দিনেতো তা পাওয়া যায়না। তবে সত্য তো আপনার শহরে। আপনার আপনার কওমের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি পাঠাবেন যিনি দ্বীনে ইবরাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাকে পান তাঁর অনুসরণ করবেন।’
যায়িদ আবার মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। প্রতিশ্রুত নবীকে খুঁজে বের করার জন্য দ্রুত পা চালালেন।
তিনি যখন মক্কা থেকে বেশ কিছু দূরে, তখনই আল্লাহ তা’য়ালা নবী মুহাম্মাদকে সা. হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠালেন। কিন্তু যায়িদ তাঁর সাক্ষাৎ পেলেন না। কারণ, মক্কায় পৌঁছার পূর্বেই একদল বেদুঈন ডাকাত তাঁর উপর চড়াও হয়ে তাঁকে হত্যা করে।
এভাবে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দর্শন লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’আ করেন-
আল্লাহুম্মা ইন কুনতা হারামতানি মিন হাজাল খায়রি ফালা তাহরিম মিনহু ইবনী সাঈদান’- ‘হে আল্লাহ, যদিও এ কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি মাহরুম করবেন না।’
আল্লাহ তা’আলা যায়িদের এ দু’আ কুবল করেছিলেন। রাসূল সা. লোকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। প্রথম ভাগেই যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. ওপর ঈমান আনলেন তাঁদের মধ্যে সাঈদও একজন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সাঈদ প্রতিপালিত হয়েছিলেন এমন এক গৃহে, যে গৃহ ঘৃণাভরে প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যান করেছিল কুরাইশদের সকল কুসংস্কার ও গুমরাহীকে। তাঁর পিতা ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সারাটি জীবন অতিবাহিতত করেছিলেন সত্যের সন্ধানে। সাঈদ একাই ইসলাম গ্রহণ করেননি, সাথে তাঁর সহধর্মিনী উমার ইবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা বিনতুল খাত্তাবও ইসলাম গ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণের কারণে কুরাইশ বংশের এ যুবকও অন্যদের মত যুলুম অত্যাচারের শিকার হন। কুরাইশরা তাঁকে ইসলাম থেকে ফেরানো দূরে থাক, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে বরং কুরাইশদের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন ইসলামের মধ্যে। তিনি হলেন তাঁর শ্যালক হযরত ’উমার ইবনুল খাত্তাব রা.। তাঁদের মাধমেই আল্লাহ তা’আলা ‘উমারকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসেন।
হযরত সাঈদ তার যৌবনের সকল শক্তি ব্যয় করেন ইসলামের খিদমতে। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স বিশ বছরও অতিক্রম করেনি। একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অন্য সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিরিয়ায় থাকার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। তবে বদর যুদ্ধের গণিমতের অংশ তিনি লাভ করেছিলেন। এ হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে বদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।
পারস্যের কিসরা ও রোমের কাইসারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে তিনি মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুসলিমদের সাথে তাঁদের যতগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার প্রত্যেকটিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইয়ারমুক যুদ্ধেই তিনি তাঁর বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেন,
‘‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমরা ছিলাম ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। অন্যদিকে রোমান বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজার। তারা অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে পর্বতের মত অটল ভংগিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের অগ্রভাগে বিশপ ও পাদ্রী-পুরোহিতদের বিরাট এক দল। হাতে তাদের ক্রুশ খচিত পতাকা, মুখে প্রার্থনা সংগীত। পেছন থেকে তাদের সুরে সুর মিলাচ্ছিল বিশাল সেনাবাহিনী। তাদের সেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর তখন মেঘের গর্জনের মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল।
মুসলিম বাহিনী এ ভয়াবহ দৃশ্য ও তাদের বিপুল সংখ্যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ভয়ে তাদের অন্তরও কিছুটা কেঁপে উঠলো, সেনাপতি আবু উবাইদা তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং মুসলিম সৈন্যদের জিহাদে অনুপ্রাণিত করে এক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর বান্দারা। আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের পা’কে দৃঢ় করবেন।
আল্লাহর বান্দারা! ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য হল কুফরী থেকে মুক্তির পথ, প্রভুর রিজামন্দী হাসিলের পথ এবং অপমান ও লজ্জার প্রতিরোধ। তোমরা তীর বর্শা শানিত করে ঢাল হাতে প্রস্তুত হয়ে যাও। অন্তরে আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য সব চিন্তা থেকে বিরত থাক। সময় হলে আমি তোমাদের নির্দেশ দেব ইনশাআল্লাহ।’’
সাঈদ রা. বলেন,
তখন মুসলিম বাহিনীর ভেতর থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এসে আবু ’উবাইদাকে বলল,
‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ মুহূর্তে আমি আমার জীবন কুরবানী করব। রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছে দিতে হবে এমন কোন বাণী কি আপনার কাছে?’ আবু উবাইদা বললেন
‘হ্যাঁ, আছে। তাঁকে আমার ও মুসলিমদের সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের রব আমাদের সাথে যে অংগীকার করেছেন, তা আমরা সত্যই পেয়েছি।’
সাঈদ রা. বলেন,
‘‘আমি তাঁর কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তার তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে অগ্রসর হলাম এবং আমার বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুপক্ষের প্রথম যে ঘোড় সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি তাকে আঘাত করলাম। তারপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালাল এবং তাদেরকে পরাজিত করল।’’
দিমাশ্ক অভিযানেও সাঈদ ইবন যায়িদ অংশগ্রহণ করেন। দিমাশক জয়ের পর আবু ’উবাইদা তাঁকে সেখানকার ওয়ালী নিযুক্ত করেন। এভাবে তিনি হলেন দিমাশকের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম ওয়ালী। কিন্তু জিহাদের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এ পদ লাভ করে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি আবু উবাইদাকে লিখলেনঃ ‘আপনারা জিহাদ করবেন, আর আমি বঞ্চিত হবো, এমন আত্মত্যাগ ও কুরবানী আমি করতে পারিনে।’ চিঠি পৌঁছার সাথে সাথে কাউকে আমার স্থলে পাঠিয়ে দিন। আমি শিগ্গিরই আপনার নিকট পৌঁছে যাচ্ছি। আবু উবাইদা বাধ্য হয়ে হযরত ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ানকে দিমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন এবং হযরত সাঈদ জিহাদের ময়দানে ফিরে গেলেন।
উমাইয়া যুগে হযরত সাঈদ ইবন যায়িদকে কেন্দ্র করে এক আশ্চর্যময় ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে মদীনাবাসীদের মুখে ঘটনাটি শোনা যেত।
ঘটনাটি হল, আরওয়া বিন্তু উওয়াইস নাম্নী এক মহিলা দুর্নাম রটাতে থাকে যে সাঈদ ইবন যায়িদ তার জমির একাংশ জরবদখল করে নিজ জমির সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন। যেখানে সেখানে সে একথা বলে বেড়াতে লাগল। এক পর্যায়ে সে মদীনার ওয়ালী মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিকট বিষয়টি উত্থাপন করল। বিষয়টি যাচাই করে দেখার জন্য মারওয়ান কয়েকজন লোককে সাঈদের নিকট পাঠালেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হযরত সাঈদের জন্য বিষয়টি ছিল বেশ কষ্টদায়ক। তিনি বললেনঃ
‘‘তারা মনে করে আমি তার ওপর যুল্ম করছি। কিভাবে আমি যুল্ম করতে পারি? আমি তো রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমি যুল্ম করে নেবে, কিয়ামতের দিন সাত তবকা যমীন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ ইয়া আল্লাহ! সে ধারণা করেছে অমি তার ওপর যুল্ম করেছি। যদি সে মিথ্যুক হয়, তার চোখ অন্ধ করে দাও, যে কূপ নিয়ে সে আমার সাথে ঝগড়া করেছে, তার মধ্যেই তাকে নিক্ষেপ কর এবং আমার পক্ষে এমন আলোক প্রকাশ করে দাও যাতে মুসলিমদের মাঝে স্পষ্ট হংয়ে যায় যে আমি তার ওপর কোন যুল্ম করিনি।’’
এ ঘটনার পর কিছু দিন যেতে না যেতেই আকীক উপত্যকা এমনভাবে প্লাবিত হল যে অতীতে আর কখনো তেমন হয়নি। ফলে দু’যমীনের মাঝখানে বিতর্কিত অদৃশ্য চিহ্নটি এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল যে, মুসলিমরা তা দেখে বুঝতে পারল সাঈদ সত্যবাদী। তারপর একমাস না যেতেই মহিলাটি অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে তার যমীনে পায়চারী করতে করতে বিতর্কিত কূপটির মধ্যে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. বলেন,
‘আমরা শুনতাম লোকেরা কাউকে অভিশাপ দিতে গেলে বলতঃ আল্লাহ তোমাকে অন্ধ করুন যেমন অন্ধ করেছেন আরওয়াকে। এ ঘটনায় অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, কারণ রাসূল সা. তো বলেছেনঃ
‘তোমরা মাযলুমের দু’আ থেকে দূরে থাক। কারণ, সেই দু’আ আর আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিবন্ধক থাকে না।’ এই যদি হয় সব মাযলুমের অবস্থা, তাহলে ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ’ জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ জনের একজন সাঈদ ইবন যায়িদের মত মাযলুমের দু’আ কবুল হওয়া তেমন আর আশ্চর্য কি?
আবু নুয়াঈম, বিরাহ ইবনুল হারিস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মুগীরা ইবন শু’বা একটি বড় মসজিদে বসে ছিলেন। তখন তাঁর ডানে বাঁয়ে বসা ছিল কুফার কিছু লোক। এমন সময় সাঈদ ইবন যায়িদ নামক এক ব্যক্তি এলেন। মুগীরা তাকে সালাম করে খাটের ওপর পায়ের দিকে বসালেন। অতঃপর কুফাবাসী এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে মুগীরার দিকে মুখ করে গালি বর্ষণ করতে লাগল। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ মুগীরা, এ লোকটি কার প্রতি গালি বর্ষণ করছে? বললেনঃ আলী ইবন আবী তালিবের প্রতি। তিনি বললেনঃ ওহে মুগীরা! এভাবে তিনবার ডাকলেন। তারপর বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের আপনারা সামনে গালি দেওয়া হবে, আর আপনি তার প্রতিবাদ করবেন না, এ আমি দেখতে চাইনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূল সা. বলেছেনঃ আবু বকর জান্নাতী, ’উমার জান্নাতী, ’উসমান জান্নাতী, ’আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, যুবাইর জান্নাতী, আবদুর রহমান জান্নাতী, সা’দ ইবন মালিক জান্নাতী। এবং নবম এক ব্যক্তিও জান্নাতী, তোমরা চাইলে আমি তার নামটিও বলতে পারি। রাবী বলেনঃ লোকেরা সমস্বরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলঃ হে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী, নবম ব্যক্তিটি কে? বললেনঃ নবম ব্যক্তিটি আমি। তারপর তিনি কসম করে বললেনঃ যে ব্যক্তি একটি মাত্র যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেছে, রাসূলুল্লাহর সাথে তার মুখমণ্ডল ধূলি ধূসরিত হয়েছে, তার এই একটি কাজ যে কোন ব্যক্তির জীবনের সকল সৎকর্ম অপেক্ষা উত্তম- যদিও সে নূহের সমান বয়সই লাভ করুক না কেন। (হায়াতুস সাহাবা/ ২য়- ৪৭০ পৃঃ)
তিনি ছিলেন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীদের অন্যতম। সাঈদ ইবন হাবীব বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আবু বকর, ’উমার, উসমান, আলী, সা’দ, সাঈদ, তালহা, যুবাইর ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের স্থান ও ভূমিকা ছিল একই। যুদ্ধের ময়দানে তাঁরা থাকতেন রাসূলুল্লাহর সা. আগে এবং নামাযের জামায়াতে থাকতেন তাঁর পেছনে।
সাঈদ ইবন যায়িদের নিকট থেকে সাহাবীদের মধ্যে ইবন ’উমার, ’আমর ইবন হুরাইস, আবু আত্তুফাইল এবং আবু উসমান আন-নাহদী, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, কায়েস ইবন আবী হাযেম প্রমুখ প্রখ্যাত তাবেয়ীগণও হাদীস বর্ণনা করেছেন।
ওয়াকিদী বলেনঃ তিনি আকীক উপত্যকায় ইনতিকাল করেন এবং মদীনায় সমাহিত হন। মৃত্যুসন হিজরী ৫০। মতান্তরে হিজরী ৫১ অথবা ৫২। সত্তর বছরের ওপর তিনি জীবন লাভ করেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস তাঁকে গোসল দিয়ে কাফন পরান এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবন ’উমার নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। তবে হাইসাম ইবন ’আদীর মতে তিনি কুফায় ইনতিকাল করেন এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুগীরা ইবন শু’বা তাঁর জানাযার ইমামতি করেন।

হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা)
নাম তাঁর হামযা, আবু ইয়ালা ও আবু ’আম্মারা কুনিয়াত এবং আসাদুল্লাহ উপাধি। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. আপন চাচা। হযরত হামযার জননী হালা বিনতু উহাইব রসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার চাচাতো বোন। তাছাড়া হামযা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. দুধ ভাই। আবু লাহাবের দাসী ‘সুওয়াইবা’ তাঁদের দু’জনকে দুধ পান করিয়েছিল। বয়সে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অপেক্ষা দু’বছর মতান্তরে চার বছর বড়। ছোট বেলা থেকেই তরবারি চালনা, তীরন্দাযী ও কুস্তির প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ভ্রমণ ও শিকারে ছিল তাঁর সীমাহীন আকর্ষণ। জীবনের বিরাট এক অংশ তিনি এ কাজে ব্যয় করেন।
বেশ কিছুকাল যাবত মক্কার অলি গলিতে তাওহীদের দাওয়াত উচ্চারিত হচ্ছিলো। তবে হামযার মত সিপাহী-স্বভাব মানুষের এ দাওয়াতের প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না।
একদিন তিনি শিকার থেকে ফিরছিলেন। সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি এলে আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের এক দাসী তাঁকে ডেকে খবরটি দিল। বললোঃ ‘আবু আম্মারা, ইস্, কিছুক্ষণ আগে এসে আপনার ভাতিজার অবস্থা যদি একটু দেখতেন! তিনি কা’বার পাশে মানুষকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। আবু জাহল তাঁকে শক্ত গালি দিয়েছে, ভীষণ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু মুহাম্মদ কোন প্রত্যুত্তর না করে নিতান্ত অসহায়ভাবে ফিরে গেছে।’ একথা শুনে তাঁর সৈনিকসুলভ রক্ত টগবগ করে উঠলো। দ্রুত তিনি কা’বার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর অভ্যাস ছিল, শিকার থেকে ফেরার পথে কারো সংগে সাক্ষাৎ হলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার সংগে দু’চারটি কথা বলা। কিন্তু আজ তিনি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মাদ হয়ে পড়লেন। রাস্তায় কারো দিকে কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা কা’বার কাছে গিয়ে আবু জাহলের মাথায় ধনুক দিয়ে সজোরে এক আঘাত বসিয়ে দিরেন। আবু জাহলের মাথা কেটে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে বনু মাখযুমের কিছু লোক আবু জাহলের সাহায্যে ছুটে এলো। তারা বললোঃ ‘হামযা, সম্ভবতঃ তুমি ধর্মত্যাগী হয়েছো।’ জবাবে বললেনঃ ‘যখন তার সত্যতা আমার নিকট প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তখন তা থেকে আমাকে বিরত রাখবে কে? হ্যাঁ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। যা কিছু তিনি বলেন সবই সত্যি। আল্লাহর কসম আমি তা থেকে আর ফিরে আসতে পারিনে। যদি তোমরা সত্যবাদী হও, আমাকে একটু বাধা দিয়েই দেখ।’ আবু জাহল তার সাহায্যে এগিয়ে আসা লেকাদের বললোঃ ‘তোমরা আবু আম্মারকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম, কিছুক্ষণ আগেই আমি তাঁর ভাতিজাকে মারাত্মক গাল দিয়েছি।’
পরবর্তীকালে হযরত হামযা বলেছেন, আমি ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলি তো বলে ফেললাম; কিন্তু আমার পূর্বপুরুষ ও গোত্রের ধর্মত্যাগের জন্য আমি অনুশোচনায় দগ্ঘিভূত হতে লাগলাম। একটা সন্দেহ ও সংশয়ের আবর্তে পড়ে সারা রাত ঘুমোতে পারলাম না। কা’বায় এসে অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, যেন আমার অন্তর-দুয়ার সত্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়, অন্তর থেকে সংশয় বিদূরিত হয়। দুআর পর আমার অন্তর দৃঢ় প্রত্যয়ে পূর্ণ হয়ে যায়। তারপর আমি রাসূলুল্লাহর সা. নিকট উপস্থিত হয়ে আমার অবস্থা বর্ণনা করলাম। তিনি আমার অন্তরের স্থিতির জন্য দুআ করলেন।
এটা মুসলমানদের সেই দুঃসময়ের কথা যখন রাসূল সা. আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নিয়ে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। মুসলমান বলতে তখন ছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু নিরাশ্রয় মানুষ। এ অবস্থায় আকস্মিকভাবে হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণে অবস্থা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মুমিনদের সাথে কাফিরদের অহেতুক বাড়াবাড়ি ও বেপরোয়া ভাব অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তাঁর দুঃসাহস ও বীরত্বের কথা মক্কার প্রতিটি লোকই জানতো।
হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের পর একদিন হযরত উমার রা. তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দানের জন্য গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. নিকট। তিনি তখন হযরত আরকামের গৃহে কতিপয় সাহাবীর সাথে অবস্থান করছেন। হযরত হামযাও তখন সেখানে। হযরত উমার ছিলেন সশস্ত্র। তাঁকে দেখেই উপস্থিত সকলে প্রমাদ গুণলো। কিন্তু হযরত হামযা বলে উঠলেনঃ ‘তাকে আসতে দাও। যদি সে ভালো উদ্দেশ্যে এসে থাকে, আমরাও তার সাথে ভালো ব্যবহার করবো। অন্যথায় তারই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করা হবে।’ হযরত উমার ভেতরে ঢুকেই কালেমা তাওহীদ পাঠ করতে শুরু করেন। তখন উপস্থিত মুসলমানদের তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে। এই দুই মনীষীর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। মক্কার মুশরিকরা উপলব্ধি করে, মুহাম্মাদের সা. গায়ে আঁচড় কাটা আর সহজ হবে না।
মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর প্রিয় খাদেম যায়িদ ইবন হারিসার সাথে হামযার ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। যায়িদের প্রতি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা এত প্রগাঢ় হয় যে, যখন তিনি বাইরে কোথাও যেতেন তাঁকেই সব ব্যাপারে অসীয়াত করে যেতেন।
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরে আরো অনেকের সংগে হযরত হামযাও মদীনায় হিজরাত করলেন। এখানে তাঁর খোদা প্রদত্ত শক্তি ও সাহসিকতা প্রকাশ করার বাস্তব সুযোগ এসে যায়।
হিজরাতের সপ্তম মাসে রাসূল সা. ‘ঈস’ অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দিকে তিরিশ সদস্যের মুহাজিরদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী পাঠান। উদ্দেশ্য, কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। এ বাহিনীতে আনসারদের কেউ ছিল না। এখানে তাঁরা সমুদ্র উপকূলে আবু জাহলের নেতৃত্বে মক্কার তিনশো অশ্বারোহীর একটি বাহিনীর মুখোমুখি হন। তারা সিরিয়া থেকে ফিরছিল। কিন্তু মাজদী ইবন ’আমর জুহানীর প্রচেষ্টায় এ যাত্রা সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। মাজদীর সাথে দু’পক্ষের সন্ধিচুক্তি ছিল। মদীনা থেকে যাত্রার প্রাক্কালে রাসূল সা. হযরত হামযার হাতে ইসলামী ঝাণ্ডা তুলে দেন। ইবন আবদিল বারসহ কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, এটাই ছিল রাসূল সা. কর্তৃক কোন মুসলমানের হাতে তুলে দেওয়া প্রথম ঝাণ্ডা। (সীরাতু ইবন হিশাম)
দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাসে রাসূলুল্লাহ সা. নিজে ষাট জন সশস্ত্র সাহাবী নিয়ে কুরাইশদের বাণিজ্য চলাচল পথে ‘আবওয়া’ অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা ছিলেন পতাকাবাহী এবং গোটা বাহিনীর কমাণ্ডও ছিল তাঁর হাতে। মুসলিম বাহিনী পৌঁছার আগেই কুরাইশ কাফিলা অতিক্রম করায় এ যাত্রাও কোন সংঘর্ষ ঘটেনি। এমনিভাবে হিজরী দ্বিতীয় সনের ‘উশায়রা’ অভিযানেও হযরত হামযা মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর গৌরব লাভ করেন।
হিজরী দ্বিতীয় সনে ইসলামের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। রণক্ষেত্রে উভয়পক্ষ কাতারবন্দী হওয়ার পর কুরাইশ পক্ষের উতবা, শাইবা ও ওয়ালিদ সারি থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম বাহিনীর কাউকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। দ্বীনের সিপাহীদের মধ্য থেকে তিনজন আনসার জওয়ান তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু উতবা চিৎকার করে বলে উঠেঃ ‘মুহাম্মাদ, আমাদের সমকক্ষ লোকদের পাঠাও। এসব অনুপযুক্ত লোকদের সাথে আমরা লড়তে চাই না। রাসূলুল্লাহ সা. আদেশ দিলেনঃ হামযা, আলী ও উবাইদা ওঠো, সামনে এগিয়ে যাও।’ তাঁরা শুধু আদেশের প্রতীক্ষায় ছিলেন। এ তিন বাহাদুর আপন আপন নিযা ও বর্শা নিয়ে তাঁদের প্রতিপক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথম আক্রমণেই হযরত হামযা জাহান্নামে পাঠালেন উতবাকে। হযরত আলীও বিজয়ী হলেন তাঁর প্রতিপক্ষের ওপর। কিন্তু আবু উবাইদা ও ওয়ালিদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ধস্তাধস্তি চলতে লাগলো। অতঃপর আলীর সহযোগিতায় আবু উবাইদা তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন। শত্রুপক্ষের এ বেগতিক অবস্থা দেখে তুয়াইমা ইবন আদী’ তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। হামযার সহযোগিতায় আলী রা. তরবারির এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেন। এরপর মুশরিক বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। মুসলিম মুজাহিদরাও ঝাঁপিয়ে পড়েন। তুমুল লড়াই শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধে হযরত হামযা পাগড়ীর ওপর উটপাখির পালক গুঁজে রেখেছিলেন। এ কারণে যে দিকে তিনি যাচ্ছিলেন সুস্পষ্টভাবে তাকে দেখা যাচ্ছিল। দু’হাতে বজ্রমুষ্টিতে তরবারি ধরে বীরত্বের সাথে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ করে দিচ্ছিলেন। এ যুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. দুশমনরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। উমাইয়্যা ইবন খালাফ হযরত আবদুর রহমান ইবন ’আউফকে জিজ্ঞেস করেছিলঃ উটপাখির পালক লাগানো এ লোকটি কে? তিনি যখন বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. চাচা হামযা, তখন সে বলেছিলঃ ‘এ ব্যক্তিই আজ আমাদের সবচেয়ে বেশী সর্বনাশ করেছে।’
মদীনার উপকণ্ঠেই ছিল ইয়াহুদী গোত্র বনু কাইনুকা’র বসতি। রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আসার পর তাদের সাথে একটি মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভে তাদের হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এ চুক্তি ভংগের কারণে রাসূল সা. দ্বিতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালন করেন। এ অভিযানেও হযরত হামযা পতাকাবাহীর দায়িত্ব পালন করেন।
বদরের শোচনীয় পরাজয়ে কুরাইশদের আত্ম অভিমান দারুণভাবে আহত হয়। প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মত্ত বিশাল কুরাইশ বাহিনী হিজরী তৃতীয় সনে মদীনার দিকে ধাবিত হলো। আল্লাহর রাসূল সা. সংগীদের নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের গতিরোধ করেন। শাওয়াল মাসে যুদ্ধ শুরু হয়। কাফিরদের পক্ষ থেকে ‘সিবা’ নামক এক বাহাদুর সিপাহী এগিয়ে এসে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানায়। হযরত হামযা কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ময়দানে এসে হুংকার ছেড়ে বললেনঃ ওরে উম্মে আনমারের অপবিত্র পানির সন্তান, তুই এসেছিস আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে লড়তে? এ কথা বলে তিনি এমন প্রচণ্ড আক্রমণ চালালেন যে, এক আঘাতেই সিবার কাজ শেষ। তারপর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। হযরত হামযার ক্ষিপ্র আক্রমণে কাফিরদের ব্যুহ তছনছ হয়ে গেল। এ যুদ্ধে তিনি একাই তিরিশ জন কাফির সৈন্যকে হত্যা করেন।
যেহেতু হযরত হামযা বদর যুদ্ধে কুরাইশদের বাছাবাছা নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছিলেন, এ কারণে কুরাইশদের সকলেই তাঁরই খুনের পিয়াসী ছিল সবচেয়ে বেশী। হযরত হামযার হত্যাকারী ওয়াহশী উহুদ ময়দানে হামযার হত্যা ঘটনাটি পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন। ইবন হিশাম তাঁর ‘সীরাত’ গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন। ওয়াহশী বলেনঃ ‘আমি ছিলাম জুবাইর ইবন মুতয়িমের এক হাবশী ক্রীতদাস। বদর যুদ্ধে জুবাইরের চাচা তুয়াইম ইবন ’আদী হামযার হাতে নিহত হয়। মক্কায় ফিরে জুবাইর আমাকে বললোঃ যদি তুমি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করে আমার চাচার হত্যার বদলা নিতে পার, আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। আমাকে সে বিশেষভাবে ট্রেনিং দিল। আমি শুধু হামযাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই উহুদের দিকে রওয়ানা হলাম। যুদ্ধ শুরু হলো। একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে হামযার প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমার কাছাকাছি উপস্থিত হলে অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করলাম। তারপর আমার স্বপক্ষ সৈন্যদের নিকট ফিরে এসে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলাম। যুদ্ধে আর অংশগ্রহণ করলাম না। কারণ, আমার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে। আমি মক্কায় ফিরে এলে আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।’
এ মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের মাঝামাঝি। হযরত হামযার বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি।
হযরত হামযার শাহাদাত লাভের পর কুরাইশ রমণীরা আনন্দ সংগীত গেয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু উতবা হামযার নাক-কান কেটে অলংকার বানিয়েছিল, বুক, পেট চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে থুথু নিক্ষেপ করেছিল। একথা শুনে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করেছিলেন, সে কি তার কিছু অংশ খেয়েও ফেলেছে? লোকেরা বলেছিলঃ না। তিনি বলেছিলেনঃ হামযার দেহের কোন একটি অংশও আল্লাহ জাহান্নামে যেতে দেবেন না।
যুদ্ধ শেষে শহীদের দাফন-কাফনের পালা শুরু হলো। রাসুল সা. সম্মানিত চাচার লাশের কাছে এলেন। যেহেতু হিন্দা তাঁর নাক-কান কে বিকৃত করে ফেলেছিল, তাই এ দৃশ্য দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেনঃ কিয়ামাতের দিন হামযা হবে ‘সাইয়্যেদুশ শুহাদা’ বা সকল শহীদের নেতা। তিনি আরো বললেনঃ তোমার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আমার জানামতে তুমি ছিলে আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে অধিক সচেতন, অতিশয় সৎকর্মশীল। যদি সাফিয়্যার শোক ও দুঃখের কথা আমার মনে না থাকতো তাহলে এভাবেই তোমাকে ফেলে রেখে যেতাম, যাতে পশু-পাখী তোমাকে খেয়ে ফেলতো এবং কিয়ামাতের দিন তাদের পেট থেকে আল্লাহ তোমাকে জীবিত করতেন। আল্লাহর কসম, তোমার প্রতিশোধ নেওয়া আমার ওপর ওয়াজিব। আমি তাদের সত্তর জনকে তোমার মত নাক-কান কেটে বিকৃত করবো।’ রাসূলুল্লাহর সা. এ কসমের পর জীবরীল আ. সূরা নাহলের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টি নিয়ে অবতীর্ণ হলেনঃ
‘যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে ঠিক ততখানি করবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্যধারণ করলে, ধৈর্যশীলদের জন্য তাই-ই তো উত্তম। ধৈর্য ধারণ কর। তোমার ধৈর্য তো হবে আল্লাহরই সাহায্যে। তাদের জন্য দুঃখ করো না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুণ্ন হয়োনা।’ (সূরা নাহল/১২৬-২৭)
এ আয়াত নাযিলের পর রাসূল সা. কসমের কাফ্ফারা আদায় করেন। (তাবাকাতে ইবন সাদ)
হযরত সাফিয়্যা ছিলেন হযরত হামযার সহোদরা। ভায়ের শাহাদাতের খবর শুনে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য দৌড়ে আসেন। কিন্তু রাসূল সা. তাঁকে দেখতে না দিয়ে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে ফিরিয়ে দেন। ভায়ের কাফনের জন্য হযরত সাফিয়্যা দু’খানি চাদর পাঠান। কিন্তু হযরত হামযারই পাশে আরেকটি লাশও কাফনহীন অবস্থায় পড়ে ছিল। তাই চাদর দু’খানি দু’জনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। হযরত খাব্বাব ইবনূল আরাত রা. বলেন, একটি চাদর ছাড়া হামযাকে কাফন দেওয়ার জন্য আর কোন কাপড় আমরা পেলাম না। তা দিয়ে পা ঢাকলে মাথা এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা চাদর দিয়ে মাথা এবং ‘ইজখির’ ঘাস দিয়ে পা ঢেকে দিলাম। (হায়তুস সাহাবা- ১/১৩৬) সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত হামযাকে উহুদের ময়দানে দাফন করা হয়। ইমাম বুখারী হযরত জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. উহুদ যুদ্ধের শহীদদের দু’জন করে একটি কবরে দাফন করেছিলেন। হামযা ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশকে এক কবরে দাফন করা হয়।
ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে ‘ফাওয়ায়েদে আবিত তাহিরের’ সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত জাবির রা. বলেনঃ মুয়াবিয়া যে দিন উহুদে কূপ খনন করেছিলেন সেদিন আমরা উহুদের শহীদদের জন্য কান্নাকাটি করেছিলাম। শহীদদের আমরা সম্পূর্ণ তাজা অবস্থায় পেয়েছিলাম। এক ব্যক্তি হযরত হামযার পায়ে আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে পড়ে।
হযরত হামযার হত্যাকারী হযরত ওয়াহশী রা. মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর সা. খেদমতে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কি ওয়াহশী? জবাব দিলেনঃ হাঁ। ‘তুমিই কি হামযাকে হত্যা করেছো?’ জবাব দিলেনঃ ‘আল্লাহর রাসূল যা শুনেছেন, তা সত্য।’ রাসূল সা. বললেনঃ ‘তুমি কি তোমার চেহারা আমার নিকট একটু গোপন করতে পার?’ তক্ষুনি তিনি বাইরে বেরিয়ে যান এবং জীবনে আর কখনো রাসূলুল্লাহর সা. মুখোমুখি হননি। রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিকের রা. খিলাফত কালে ভণ্ড নবী মুসাইলামার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয। তিনিও সে অভিযানে অংশ নিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, মুসাইলামাকে হত্যা করে হযরত হামযার হত্যার কাফ্ফারা আদায় করবেন। তিনি সফল হলেন। এভাবে আল্লাহতাআলা তাঁকে দিয়ে ইসলামের যতটুকু ক্ষতি করেন তার চেয়ে বেশী উপকার সাধন করেন।
হযরত হামযার মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর তখনকার অনুভূতি তিনি কাব্যের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। সীরাতে ইবনে হিশামে ‘‘হামযার ইসলাম গ্রহণ’’ অধ্যায়ের টীকায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত হয়েছে।

আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা)
নাম আবুল ফজল আব্বাস। পিতা আবদুল মুত্তালিব, মাতা নাতিলা, মতান্তরে নাসিলা বিনতু খাব্বাব। রাসূলুল্লাহর সা. চাচা। তবে দু’জন ছিলেন প্রায় সমবয়সী। ঐতিহাসিকদের ধারণা, সম্ভবতঃ তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দুই বা তিন বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ছোট বেলায় একবার তিনি হারিয়ে যান। মা মান্নত মানেন, আব্বাস ফিরে এলে কা’বায় রেশমী গিলাফ চড়াবেন। কিছু দিন পর তিনি সহি-সালামতে ফিরে এলে অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে আবদুল মুত্তালিব তাঁর মান্নত পুরা করেন।
জাহিলী যুগে তিনি ছিলেন কুরাইশদের একজন প্রতাপশালী রঈস। পুরুষানুক্রমে খানায়ে কা’বার রক্ষণাবেক্ষণ ও হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব লাভ করেন।
রাসূলুল্লাহ সা. নবুওয়াত লাভ করলেন। মক্কায় প্রকাশ্যে তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিতে লাগলেন। হযরত আব্বাস যদিও দীর্ঘ দিন যাবত প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেননি, তবে তিনি এ দাওয়াতের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ কারণে মদীনার বাহাত্তর জন্য আনসার হজ্জের মওসুমে মক্কায় গিয়ে মিনার এক গোপন শিবিরে যে দিন রাসূলুল্লাহকে সা. মদীনায় হিজরাতের আহ্বান জানান এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন, সেই গোপন বৈঠকেও হযরত আব্বাস উপস্থিত ছিলেন। তখনও তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি। ইতিহাসে এ বাইয়াতকে আকাবার দ্বিতীয় শপথ বলা হয়। এ উপলক্ষে তিনি উপস্থিত মদীনাবাসীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেনঃ ‘খাযরাজ কাওমের লোকেরা! আপনাদের জানা আছে, মুহাম্মাদ সা. স্বীয় গোত্রের মধ্যে সম্মান ও মর্যাদার সাথেই আছেন। শত্রুর মুকাবিলায় সর্বক্ষণ আমরা তাঁকে হিফাজত করেছি। এখন তিনি আপনাদের নিকট যেতে চান। যদি আপনারা জীবন পণ করে তাঁকে সহায়তা করতে পারেন তাহলে খুবই ভালো কথা। অন্যথায় এখনই সাফ সাফ বলে দিন।’ জবাবে মদীনাবাসীগণ পরিপূর্ণ সহায়তায় আশ্বাস দান করেন। এর অল্পকাল পরেই রাসূলুল্লাহ মদীনায় হিজরাত করেন।
মক্কার কুরাইশদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে তিনি কুরাইশ বাহিনীর সংগে বদর যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. অবহিত ছিলেন, এ কারণে তিনি সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘যুদ্ধের সময় আব্বাস বা বনু হাশিমের কেউ সামনে পড়ে গেলে তাদের হত্যা করবে না। কারণ, জোরপূর্বক তাদের রণক্ষেত্রে আনা হয়েছে।’
বদর যুদ্ধে অন্যান্য কুরাইশ মুশরিকদের সাথে আব্বাস, আকীল ও নাওফিল ইবন হারিস মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। ঘটনাক্রমে, আব্বাসকে এত শক্তভাবে বাঁধা হয় যে, ব্যথায় তিনি কঁকাতে থাকেন। তাঁর সে কঁকানি রাসূলুল্লাহর সা. রাতের আরামে বিঘ্ন ঘটায়। একথা সাহাবায়ে কিরাম অবগত হলে তাঁরা আব্বাসের বাঁধন ঢিলা করে দেন। আব্বাস কঁকানি বন্ধ করে দিলেন। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ কঁকানি শোনা যায় না কেন? বলা হলোঃ বাঁধন ঢিলা করে দেওয়া হয়েছে। তখুনি রাসূল সা. নির্দেশ দিলেন সকল বন্দীর বাঁধন ঢিলা করে দাও।’
বদরের যুদ্ধবন্দীদের কাছে অতিরিক্ত কাপড় ছিল না। রাসূল সা. সকলকে পরিধেয় বস্ত্র দিলেন। হযরত আব্বাস ছিলেন দীর্ঘদেহী। কোন ব্যক্তির জামা তাঁর গায়ে লাগছিল না। আব্বাসের মত দীর্ঘদেহী ছিল মুনাফিক আবদুল্লাহ বিন উবাই। সে একটি জামা আব্বাসকে দান করে। এ কারণে মুনাফিক হওয়া সত্ত্বেও আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের মৃত্যুর পর পুত্রের অনুরোধে রাসূল সা. নিজের একটি জামা তার লাশের গায়ে পরানের জন্য দান করেন। এভাবে তিনি চাচার প্রতি কৃত ইহসান পরিশোধ করেন।
বদর যুদ্ধের কয়েদীদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আব্বাসের জননী ছিলেন মদীনার আনসার-গোত্র খাযরাজের কন্যা। এ কারণে এ গোত্রের লোকেরা রসূলুল্লাহর সা. নিকট নিবেদন করলো, আব্বাস আমাদের ভাগ্নে। আমরা তাঁর মুক্তিপণ মাফ করে দিচ্ছি। কিন্তু সাম্যের পরিপন্থী হওয়ায় এ প্রস্তাব আল্লাহর রাসূলের নিকট গ্রহণযোগ্য হলো না। পক্ষান্তরে আব্বাস সম্পদশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে রাসূল সা. তাঁর নিকট মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবী করেন। আব্বাস এত বেশী অর্থ আদায়ে অক্ষমতা প্রকাশ করে বলেনঃ অন্তর থেকে আমি আগেই মুসলমান হয়েছিলাম। মুশরিকরা এ যুদ্ধে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ অন্তরের অবস্থা আল্লাহ জানেন। আপনার দাবী সত্য হলে আল্লাহ তার বিনিময় দেবেন। তবে বাহ্যিক অবস্থার বিচারে আপনাকে কোন প্রকার সুবিধা দেওয়া যাবে না। আর মুক্তিপণ আদায়ে আপনার অক্ষমতাও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আমি জানি, মক্কায় উম্মুল ফজলের নিকট আপনি মোট অংকের অর্থ রেখে এসেছেন। বিস্ময়ের সাথে আব্বাস বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম, আমি ও উম্মুল ফজল ছাড়া আর কেউ এ অর্থের কথা জানে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আপনি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি নিজের, ভ্রাতুষ্পুত্র আকীল ও নাওফিল ইবন হারিসের পক্ষ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে মুক্তি লাভ করেন।
আব্বাসের একটা দীর্ঘ সময় মক্কায় অবস্থান এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা না দেওয়ার পশ্চাতে একা বিশেষ কারণ ছিল। তিনি সব সময় মক্কা থেকে কাফিরদের গতিবিধি রাসূলুল্লাহকে সা. অবহিত করতেন। তাছাড়া মক্কায় যেসব দুর্বল ঈমানের মুসলমান তখনো অবস্থান করছিল, তিনি ছিলেন তাদের ভরসাস্থল। এ কারণে একবার রাসূরুল্লাহর সা. নিকট হিজরাতের অনুমতি চাইলে তাঁকে এই বলে বিরত রাখেন যে, ‘আপনার মক্কায় অবস্থান করা শ্রেয়। যেভাবে আল্লাহ আমার উপর নবুওয়াত সমাপ্ত করেছেন তেমনি আপনার উপর হিজরাত সমাপ্ত করবেন।’
মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে হযরত আব্বাস হিজরাতের অনুমতি লাভ করেন। সপরিবারে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হয়ে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং স্থায়ীভাবে মদীনায় বসবাস শুরু করেন। তিনি মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হুনাইন অভিযানে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একই বাহনে আরোহী ছিলেন। তিনি বলেনঃ এ যুদ্ধে কাফিরদের জয় হলো এবং মুসলিম মুজাহিদরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো, রাসূল সা. বললেন, ‘আব্বাস, তীরন্দাজদের আওয়ায দাও।’ স্বভাবগতভাবেই আমি ছিলাম উচ্চকণ্ঠ। আহ্বান জানালামঃ আইনা আসহাবুল সুমরা’- তীরন্দাজরা কোথায়? আমার এই আওয়াযে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। তায়েফ অবরোধ, তাবুক অভিযান এবং বিদায় হজ্জেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর রাসূল সা. অসুস্থ হয়ে পড়েন। দিন দিন অসুস্থতা বাড়তে থাকে। হযরত আলী, হযরত আব্বাস ও বনী হাশিমের অন্য লোকেরা রাসূলুল্লাহর সা. সেবার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ওফাতের দিন হযরত আলী বাড়ীর বাইরে এলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলোঃ রাসূলুল্লাহর সা. অবস্থা কেমন? যেহেতু সে দিন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল, এ কারণে তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহর অনুগ্রহে একটু ভালো।’ কিন্তু হযরত আব্বাস ছিলেন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি আলীর একটি হাত ধরে বললেনঃ ‘তুমি কী মনে করেছো? আল্লাহর কসম, তিন দিন পরেই তোমরা গোলামী করতে শুরু করবে। আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি এ রোগেই অল্প দিনের মধ্যেই রাসুলুল্লাহ সা. ইনতিকাল করবেন। আমি আবদুল মুত্তালিব খান্দানের লোকদের চেহারা দেখেই তাদের মৃত্যু আন্দাজ করতে পারি।’
ঐ দিন রাসূল সা. ইনতিকাল করেন। হযরত আলী ও বনী হাশিমের অন্যান্যদের সহযোগিতায় হযরত আব্বাস কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সম্মানিত চাচা এবং বনী হাশিমের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, এ কারণে বহিরাগত লোকেরা তাঁর নিকট এসে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করতে থাকে।
হযরত রাসূলে কারীম সা. চাচা আব্বাসকে খুব সম্মান করতেন। তাঁর সামান্য কষ্টতেও তিনি দারুণ দুঃখ পেতেন। একবার কুরাইশদের একটি আচরণ সম্পর্কে হযরত আব্বাস অভিযোগ করলে রাসূল সা. অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেনঃ ‘সেই সত্তার শপথ, যর হাতে আমার জীবন! যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের জন্য আপনাদের ভালবাসেনা তার অন্তরে ঈমানের নূর থাকবে না।’
একবার রাসূল সা. এক বৈঠকে আবু বকর ও উমারের রা. সাথে কথা বলছিলেন। এমন সময় আব্বাস উপস্থিত হলেন। রাসূল সা. তাঁকে নিজের ও আবু বকরের মাঝখানে বসালেন এবং কণ্ঠস্বর একটু নীচু করে কথা বলতে লাগলেন। আব্বাস চলে যাওয়ার পর আবু বকর রা. এমনটি করার কারণ জেজ্ঞেস করলেন। রাসূল সা. বলেনঃ ‘মর্যাদাবান ব্যক্তিই পারে মর্যাদাবান ব্যক্তির মর্যাদা দিতে।’ তিনি আরো বলেনঃ ‘জিবরীল আমাকে বলেছেন, আব্বাস উপস্থিত হলে আমি যেন আমার স্বর নিচু করি, যেমন আমার সামনে তোমাদের স্বর নিচু করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।’
হযরত রাসূলে করীমের সা. পর পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীন হযরত আব্বাসের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছেন। হযরত উমার ও হযরত উসমান রা. ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে তাঁর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর সম্মানার্থে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন এবং বলতেনঃ ‘ইনি হচ্ছেন রাসূলুল্লাহর সা. চাচা।’ হযরত আবু বকর রা. একমাত্র আব্বাসকেই নিজে আসন থেকে সরে গিয়ে স্থান করে দিতেন।
হযরত আব্বাস ৩২ হিজরীর রজব/মুহাররম মাসের ১২ তারিখ ৮৮ (অষ্টাশি) বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রা. জানাযার নামায পড়ান এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. কবরে নেমে তাঁকে সমাহিত করেন। মদীনার বাকী গোরস্তানে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ৩২ বছর এবং জাহিলী যুগে ৫৬ বছর জীবন লাভ করেন।
জাহিলী যুগে হযরত আব্বাস রা. অত্যন্ত সম্পদশালী ছিলেন। এ কারণে বদর যুদ্ধের সময় রাসূল সা. তাঁর নিকট থেকে মুক্তিপণ স্বরূপ বিশ উকিয়া স্বর্ণ গ্রহণ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাঁর জীবিকার উৎস। সুদের কারবারও করতেন। মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এ কারবার চালু ছিল। দশম হিজরীর বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল সা. বলেনঃ ‘আজ থেকে আরবের সকল প্রকার সুদী কারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং সর্বপ্রথম আমি আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিবের সুদী কারবার রহিত ঘোষণা করছি।’
সুদের কারবার বন্ধ হওয়ার পর রাসূল সা. গণীমতের এক পঞ্চমাংশ ও ফিদাক বাগিচার আমদানী থেকে তাঁকে সাহায্য করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর তিনি ও হযরত ফাতিমা প্রথম খলীফার নিকট রাসূলুল্লাহর সা. উত্তরাধিকার দাবী করেন। নবীরা কোন উত্তরাধিকার রেখে যান না- এ সম্পর্কিত রসূলুল্লাহর সা. একটি বাণী হযরত আবু বকরের রা. মুখ থেকে শোনার পর তাঁরা নীরব হয়ে যান।
হযরত আব্বাস ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। অতিথি পরায়ণ ও দয়ালু। হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাস রা. বলেনঃ ‘আব্বাস হলেন আল্লাহর রাসূলের চাচা, কুরাইশদের মধ্যে সর্বাধিক দরাজ হস্ত এবং আত্মীয় স্বজনের প্রতি অধিক মনোযোগী’। তিনি ছিলেন কোমল অন্তর বিশিষ্ট। দুআর জন্য হাত উঠালেই চোখ থেকে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেত। এ কারণে তাঁর দুআয় এক বিশেষ আছর পরিলক্ষিত হতো।’
রাসূলুল্লাহ সা. আব্বাস রা. ও তাঁর সন্তানদের জন্য দুআ করেছেন। তিনি তাঁদের সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অপরাধের মাগফিরাত কামনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. থেকে তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে বহু সাহাবী ও তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করেছেন।
হযরত আব্বাসের মধ্যে কাব্য প্রতিভাও ছিল। হুনাইন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তিনি একটি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। তার কয়েকটি পংক্তি ‘আল-ইসতিয়াব’ ও ইবন ইসহাকের সীরাত গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।

বিলাল ইবন রাবাহ (রা)
আবু আবদুল্লাহ বিলাল তাঁর নাম। পিতা রাবাহ এবং মাতা হামামাহ। হাবশী বংশোদ্ভূত ক্রীতদাস। তবে মক্কায় জন্মলাভ করেছিলেন। বনু জুমাহ ছিল তাদের মনিব।
হাবশী দাস হিসাবে তাঁর বাহ্যিক রং কালো হলেও অন্তর ছিল দারুণ স্বচ্ছ। আরবের গৌরবর্ণের লোকেরা যখন আভিজাত্যের ও কৌলিণ্যের বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে হকের দাওয়াত অস্বীকার করে চলেছিল, তখনই তাঁর অন্তর ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। অল্প কিছু লোক দাওয়াতে হক কবুল করলেও যে সাত ব্যক্তি প্রকাশ্য ঘোষণার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে এ হাবশী গোলাম অন্যতম।
চিরকালই দুর্বলরা অত্যাচার উৎপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। বিলালের সামাজিক অবস্থানের কারণে তাঁর ওপর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট নেমে আসে। শাস্তি ও যন্ত্রণার নানা রকম অনুশীলনের মাধ্যমে তাঁর সবর ও ইসতিকলালের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। গলায় উত্তপ্ত বালু, পাথরকুচি ও জ্বলন্ত অংগারের ওপর তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, গলায় রশি বেঁধে ছাগলের মত শিশুরা মক্কার অলিতে গলিতে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে। তবুও তাওহীদের শক্ত রশি তিনি হাত ছাড়া করেননি। আবু জাহল তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে পিঠের ওপর পাথরের বড় চাক্কি রেখে দিত। মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপে তিনি যখন অস্থির হয়ে পড়তেন, আবু জাহল বলতোঃ ‘বিলাল, এখনো মুহাম্মাদের আল্লাহ থেকে ফিরে এসো।’ কিন্তু তখনো তার পবিত্র মুখ থেকে ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ ধ্বনি বের হতো।
অত্যাচারী মুশরিকদের মধ্যে উমাইয়্যা ইবন খালাফ ছিল সর্বাধিক উৎসাহী। সে শাস্তি ও যন্ত্রণার নিত্য নতুন কলা-কৌশল প্রয়োগ করতো। নানা রকম পদ্ধতিতে সে তাঁকে কষ্ট দিত। কখনো গরুর কাঁচা চামড়ায় তাঁকে ভরে, কখনো লোহার বর্ম পরিয়ে উত্তপ্ত রোগে বসিয়ে দিয়ে বলতোঃ ‘তোমার আল্লাহ লাত ও উয্যাহ’ কিন্তু তখনো এ তাওহীদ প্রেমিক লোকটির যবান থেকে ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ ছাড়া আর কোন বাক্য বের হতো না। মুশরিকরা বলতো, তুমি আমাদের কথিত শব্দগুলিই উচ্চারণ করো। তিনি বলতেনঃ ‘আমার যবান ঠিক মত তোমাদের শব্দগুলি উচ্চারণ করতে পারে না।’
প্রতিদিনের মত সেদিনও হযরত বিলালের ওপর ‘বাতহা’ উপত্যকায় অত্যাচারের স্টীম রোলার চলছিল। ঘটনাক্রমে হযরত আবু বকর সিদ্দীকও সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দারুণ মর্মাহত হলেন। মোটা অংকের অর্থ বিলালের মনিবকে দিয়ে তিনি তাঁকে আযাদ করে দেন। এ খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সা. বললেনঃ আবু বকর, আমাকেও তুমি এ কাজে শরীক করে নাও। তিনি আরজ করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি তো তাঁকে আযাদ করেই দিয়েছি।’
মক্কা থেকে হিজরাত করে মদীনায় তিনি হযরত সা’দ ইবন খুসাইমার রা. অতিথি হলেন। হযরত আবু রুওয়াইহা আবদুল্লাহ ইবন আবদুর রহমান খাসয়ামীর রা. সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপিত হলো। তাঁদের দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ফারুকের সময় হযরত বিলাল সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। খলীফা উমার রা. জিজ্ঞেস করলেনঃ বিলাল, তোমার ভাতা কে উঠাবে? জবাব দিলেনঃ ‘আবু রুওয়াইহা। রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের দু’জনের যে ভ্রাতৃসম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন তা কখনো বিচ্ছিন্ন হতো পারে না।’
হিজরাতের আগ পর্যন্ত মক্কায় ইসলাম ছিল দুর্বল, হিজরাতের পর মদীনায় তা সবল হয়ে দাঁড়ায়। এই মাদানী জীবনের সূচনা থেকে ইসলামী আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মুল ভিত্তির স্থাপনা শুরু হয়। মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং নামাযের জন্য আযানের প্রচলন হলো। হযরত বিলাল প্রথম ব্যক্তি, আযানের দায়িত্ব যাঁর ওপর অর্পিত হয়। বিলালের উচ্চ ও হৃদয়গ্রাহী আযান ধ্বনি শুনে নারী পুরুষ, কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কেউ ঘরে স্থির থাকতে পারতো না। মসজিদে তাওহীদের ধারক-বাহকদের ভীড় জমে উঠলে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরজায় গিয়ে আওয়ায দিতেনঃ ‘হাইয়ালাস সালা, হাইয়ালাল ফালাহ, আস্সালাহ ইয়া রাসূলাল্লাহ- হে আল্লাহর রাসূল! নামায উপস্থিত।’ রাসূল সা. বেরিয়ে আসতেন, বিলাল তাকবীর দিতেন। কোনদিন হযরত বিলাল মদীনায় উপস্থিত না থাকলে হযরত আবু মাহযুরা এবং হযরত ‘আমর ইবন উম্মে মাকতুম রা. তাঁর দায়িত্ব পালন করতেন। বিলাল রা. সাধারণতঃ সুবহে সাদিক হওয়ার আগেই ফজরের আযান দিতেন। এ কারণে সকালে দু’বার আযান দেওয়া হতো। শেষের আযান দিতেন ’আমর ইবন উম্মে মাকতুম রা.। এ জন্য রমজান মাসে হযরত বিলালের আযানের পর পানাহার জায়েয ছিল।
রাসূলুল্লাহর সা. মদীনায় অবস্থান বা সফরের সময়, উভয় অবস্থায় বিলাল ছিলেন তাঁর বিশেষ মুয়াজ্জিন। একবার রাসূলুল্লাহর সা. কোন এক সফরে পথ চলতে চলতে রাত হয়ে গেল। সাহাবাদের কেউ কেউ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এখানে কোথাও রাত্রি যাপনের জন্য তাঁবু গাড়ার হুকুম দিলে ভালো হতো। রাসূল সা. বললেনঃ ‘আমার ভয় হচ্ছে ঘুম তোমাদের নামায থেকে উদাসীন করে না দেয়।’ হযরত বিলাল সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন। রাসূলুল্লাহর সা. অনুমতি পেয়ে সবাই তাঁবু গেড়ে বিশ্রামে গা এলিয়ে দিলেন। এদিকে বিলাল রা. অধিক সতর্কতার সাথে হাওদার কাঠের সাথে হেলান দিয়ে সুবহে সাদিকের প্রতীক্ষায় থাকলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে এ অবস্থায় তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে এলো এবং গভীর ঘুমে এমন অচেতন হয়ে পড়লেন যে সূর্যোদয়ের আগে আর চেতনা ফিরে এলো না। রাসূলুল্লাহ সা. ঘুম থেকে জেগে সর্বপ্রথম বিলালকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার দায়িত্ব পালনের কি হলো? বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আজ আমি এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম যে, এমনটি আমার সাধারণতঃ হয় না। রাসূল সা. বললেনঃ ‘আল্লাহ যখন ইচ্ছা তোমাদের রূহ অধিকার করে নেন, আবার যখন ইচ্ছা তা ফিরিয়ে দেন। উঠে আযান দাও এবং লোকদের নামাযের জন্য সমবেত কর।’
হযরত বিলাল রা. প্রধান প্রধান সকল যুদ্ধেরই শরীক ছিলেন। বদর যুদ্ধে তিনি ইসলামের এক মস্তবড় দুশমন উমাইয়্যা ইবন খালাফকে হত্যা করেন। মক্কায় যাঁরা বিলালেরও ওপর নির্যাতন চালাতো, এ উমাইয়া ছিল তাদের অন্যতম। মক্কা বিজয়ের দিনে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সংগী ছিলেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তিনিও কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে কা’বার ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি আযান ধ্বনি উচ্চারণ করেন।
রাসুলুল্লাহর সা. ওফাতের পর হযরত বিলাল রা. তাঁর প্রতি সর্বাধিক ইহসানকারী ব্যক্তি হযরত সিদ্দিকে আকবরের রা. নিকট আরজ করলেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূলের খলীফা! আপনি কি আমাকে আযাদ করেছেন আল্লাহর ওয়াস্তে না আপনার সংগী বানানোর উদ্দেশ্যে? তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’। বিলাল বললেনঃ ‘আমি রাসূলুল্লাহর সা. মুখে শুনেছি, মুমিনের উত্তম কাজ হচ্ছে আল্লাহর পাথে জিহাদ করা। এ কারণে আমি চাই, এই মহান কাজটিকে আমরণ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে।’ হযরত আবু বকর রা. বললেনঃ ‘বিলাল, তুমি আমার থেকে দূরে চলে গিয়ে বিচ্ছেদ বেদনায় আমাকে কাতর করে তুলো না।’ হযরত আবু বকরের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় বিলাল কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।
হযরত আবু বকরের পর খলীফা হযরত ’উমার। বিলাল তাঁর কাছেও অনুমতি চাইলেন জিহাদে অংশগ্রহণের। প্রথম খলীফার মত দ্বিতীয় খলীফা তাঁকে ঠেকিয়ে রাখতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর অত্যধিক উৎসাহ ও অনমনীয় মনোভাব দেখে খলীফা উমার তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তিনি সিরিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন। ১৬ হিজরী সনে হযরত উমারের সিরিয়া সফরকালে অন্যান্য সামরিক অফিসারদের সাথে বিলালও ‘জাবিয়া’ নামক স্থানে খলীফাকে স্বাগত জানান এবং ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ সফরে তিনি খলীফার সংগী হন। সফরের এক পর্যায়ে একদিন খলীফা বিলালকে অনুরোধ করলেন আযান দেওয়ার জন্য। বিলাল বললেনঃ ‘যদিও আমি অঙ্গীকার করেছি, রাসূলুল্লাহর সা. পর আর কারো জন্য আযান দিব না, তবে আজ আপনার ইচ্ছা পূরণ পূরণ করবো।’ এ কথা বলে তিনি এমন হৃদয়গ্রাহী আওয়াযে আযান দিলেন যে উপস্থিত জনতার মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিল। হযরত ’উমার এত কাঁদলেন যে তাঁর বাক রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। হযরত আবু ’উবাইদা ও হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা. কান্নায় ভেংগে পড়েছিলেন। সবারই মনে তখন নবী-যুগের ছবি ভেসে উঠছিল, অন্তরে তখন এক বিশেষ অনুভূতি জেগে উঠেছিল।
সিরিয়ার সবুজ ও শস্য-শ্যামল ভূমি হযরত বিলালের খুবই মনঃপুত হয়। তিনি দ্বিতীয় খলীফার নিকট তাঁর ইসলামী ভাই আবু রুওয়াইহাসহ তাঁকে সিরিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দানের জন্য আবেদন জানান। তাঁর আবেদন মঞ্জুর হলো। তাঁরা দু’জন ‘খাওলান’ নামক ছোট একটি শহরে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের পূর্বেই এ শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু দারদা আনসারীর রা. গোত্র। এখানে তাঁরা দু’জন এ গোত্রের দু’টি মেয়ে কে বিয়ে করে তাদের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন।
দীর্ঘদিন যাবত হযরত বিলাল রা. সিরিয়ায় বসবাস করতে থাকেন। একদিন স্বপ্নে দেখলেনঃ রাসূল সা. বলছেনঃ ‘বিলাল, এমন নিরস জীবন আর কতকাল? আমার যিয়ারতের সময় কি তোমার এখনো হয়নি?’ এ স্বপ্ন তাঁর প্রেম ও ভালোবাসার ক্ষত আবার তাজা করে দিল। তখুনি তিনি মদীনা রওয়ানা হলেন এবং পবিত্র রওজা মুবারকে হাজির হয়ে জবাই করা মোরগের মত ছটফট করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহর সা. কলিজার টুকরা হযরত হাসান ও হুসাইনকে রা. জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকেন। তাঁরা দু’জন সে দিন সকালে ফজরের আযান দেওয়ার জন্য হযরত বিলালকে রা. অনুরোধ করেন। তাঁদের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। সুবহে সাদিকের সময় মসজিদে নববীর ছাদে দাঁড়িয়ে তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলছিলেন, আর সে ধ্বনি মদীনার অলিতে গলিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল। তাঁর সে আযান ধ্বনি শুনে মদীনার জনগণ তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিল।
তিনি যখন ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলাল্লাহ’ বলরেন, তখন মদীনার নারী-পুরুষ সকলের অস্থিরভাবে কাঁদতে কাদতে ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন। বর্ণিত আছে, এমন ভাব-বিহ্বল দৃশ্য মদীনায় আর কখনো দেখা যায়নি।
এ নিষ্ঠাবান রাসূলপ্রেমিক হিজরী ২০ সনে প্রায় ষাট বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। দিমাশকের ‘বাবুস সাগীরের’ কাছেই তাঁকে দাফন করা হয়।
চারিত্রিক সৌন্দর্য হযরত বিলালের রা. মর্যাদা ও সম্মানকে অত্যধিক বাড়িয়ে দিয়েছিল। হযরত উমার বলতেনঃ ‘আবু বকর আমাদের নেতা এবং তিনি আমাদের নেতা বিলালকে আযাদ করেছেন।’
হযরত রাসূলে পাকের সাহচর্য ও সেবাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। সব সময় রাসুলুল্লাহর সা. আশেপাশে উপস্থিত থাকতেন। রাসূলুল্লাহর সা. সফর সংগী হতেন। ঈদ ও ইসতিসকার নামাযের সময় বল্লম হাতে রাসূলুল্লাহর সা. আগে আগে ময়দানে যেতেন। ওয়াজ নসীহতের মজলিসেও উপস্থিত থাকতেন। শত প্রয়োজন ও দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও হাতে কিছু এলেই তার একাংশ রাসূলকে সা. উপঢৌকন পাঠাতেন। একবার উৎকৃষ্ট মানের কিছু খেজুর রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে আসেন। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ ‘বিলাল, এগুলি কোথায় পেলে? জবাব দিলেনঃ আমার কাছে কিছু নিম্নমানের খেজুর ছিল। যেহেতু আপনার খিদমতে কিছু পাঠানোর ইচ্ছা ছিল, এ জন্যই দু’ সা’য়ের বিনিময়ে এর এক সা’ খেজুর লাভ করেছি। রাসূল সা. বললেনঃ ‘হায়, হায়, এমন করোনা। এ তো এক ধরণের সুদ। যদি তোমাকে খরীদ করতেই হতো, তাহলে প্রথমে তোমার খেজুরগুলি বিক্রি করে দিতে এবং সেই অর্থ দিয়ে এগুলি খরীদ করতে।
মক্কায় যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন হযরত বিলাল সহ্য করেছিলেন, তাদ্বারাই তাঁর সহ্যশক্তি, ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। কেউ তাঁর কোন গুণের কথা বললে বলতেনঃ ‘আমি তো শুধু একজন হাবশী, কাল পর্যন্তও যে দাস ছিল।’ সততা, নিষ্কলুষতা ও বিশ্বস্ততা ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
হযরত বিলাল যেহেতু রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ মুয়ায্যিন ছিলেন এ কারণে অধিকাংশ সময় মসজিদেই কাটাতে হতো। রাত দিনের বেশী সময় ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। একবার রাসূল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কোন্ ভালো কাজটির জন্য সবচেয়ে বেশী সাওয়াবের আশা করো? বললেনঃ ‘আমি তো এমন কোন ভালো কাজ করিনি। তবে প্রত্যেক অজুর পরে নামায আদায় করেছি।’
সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারে তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। হযরত আবু বকরের কন্যার সাথে রাসূল সা. নিজে বিয়ে দিয়েছিলেন। বনু যুহরা ও আবু দারদার পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু কোন পক্ষেই তাঁর কোন সন্তান জন্ম লাভ করেনি।
সহীহ ইবন খুযাইমা গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, একদিন রাসূল সা. বিলালকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেনঃ বিলাল, কিসের বদৌলতে তুমি আমার আগেই জান্নাতে পৌঁছে গেলে? গতরাতে আমি জান্নাতে প্রবেশ করে তোমার ‘খশ্খশা’ আওয়ায শুনতে পেলাম।’ বিলাল বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কোন গুনাহ করলেই দু’রাকায়াত নামায আদায় করি। আর অজু চলে গেলে তখনি আবার অজু করে আমি দু’রাকায়াত নামায আদায় করে থাকি।’


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি