সালমান আল-ফারেসী (রা)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘সালমান নবী পরিবারেরই একজন।’
এটি একজন সত্য-সন্ধানী ও আল্লাহকে পাওয়ার অভিলাষী এক ব্যক্তির জীবন কথা। তিনি হযরত সালমান আল-ফারেসী। সালমান আল-ফারেসীর যবানেই তাঁর সেই সত্য প্রাপ্তির চমকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে। তিনি বলেনঃ
আমি তখন পারস্যের ইসফাহার অঞ্চলের একজন পারসী নওজোয়ান। আমার গ্রামটির নাম ‘জায়্যান’। বাবা ছিলেন গ্রামের দাহকান-সর্দার। সর্বাধিক ধনবান ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। জন্মের পর থেকেই আমি ছিলাম তাঁর কাছে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচে বেশি প্রিয়। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালবাসাও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কোন অমঙ্গলের আশংকায় তিনি আমাকে মেয়েদের মত ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন।
আমার বাবা-মার মাজুসী ধর্মে আমি কঠোর সাধনা শুরু করলাম এবং আমাদের উপাস্য আগুনের তত্ত্বাবধায়কের পদটি খুব তাড়াতাড়ি অর্জন করলাম। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উপাসনার সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্বটি আমার ওপর অর্পিত হয়।
আমার বাবা ছিলেন বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। তিনি নিজেই তা দেখাশুনা করতেন। তাতে আমাদের প্রচুর শস্য উৎপন্ন হতো। একদিন কোন কারণবশত তিনি বাড়িতে আটকে গেলেন, গ্রামের খামারটি দেখাশুনার জন্য যেতে পারলেন না। আমাকে ডেকে তিনি বললেনঃ
‘বেটা, তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, বিশেষ কারণে আজ আমি খামারে যেতে পারছিনা। আজ বরং তুমি একটু সেখানে যাও এবং আমার তরফ থেকে সেখানকার কাজকর্ম তদারক কর।’
আমি খামারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পথে খৃষ্টানদের একটি গীর্জার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাদের কিছু কথার আওয়ায আমার কানে ভেসে এলো। তারা তখন প্রার্থনা করছিলো। এ আওয়াযই আমাকে সচেতন করে তোলে।
দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ থাকার কারণে খৃষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞানই ছিল না। তাদের কথার আওয়ায শুনে তারা কি করছে তা দেখার জন্য আমি গীর্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। গভীরভাবে তাদেরকে আমি নিরীক্ষণ করলাম। তাদের প্রার্থনা পদ্ধতি আমার খুবই ভালো লাগলো এবং আমি তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম। মনে মনে বললামঃ আমরা যে ধর্মের অনুসারী তা থেকে এ ধর্ম অতি উত্তম। আমি খামারে না গিয়ে সে দিনটি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিলাম। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ
- এ ধর্মের মূল উৎস কোথায়?
- শামে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি বাড়িতে ফিরে আসলাম। সারাদিন আমি কি কি করেছি, বাবা তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
বললামঃ ‘বাবা কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় দেখতে পেলাম তারা তাদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছে। তাদের ধর্মের যেসব ক্রিয়াকাণ্ড আমি প্রত্যক্ষ করেছি তা আমার খুবই ভালো লেগেছে। বেলা ডোবা পর্যন্ত আমি তাদের সাথেই কাটিয়ে দিয়েছি।’ আমার কথা শুনে বাবা শংকিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেনঃ
‘বেটা, সে ধর্মে কোন কল্যাণ নেই, তোমার ও তোমার পিতৃপুরুষের ধর্ম তা থেকেও উত্তম।’ বললাম, ‘আল্লাহর শপথ, কখনো তা নয়। তাদের ধর্ম আমাদের ধর্ম থেকেও উত্তম।’
আমার কথা শুনে বাবা ভীত হয়ে পড়লেন এবং আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারি বলে তিনি আশংকা করলেন। তাই আমার পায়ে বেড়ী লাগিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখলেন।
আমি সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলাম। কিছুদিনের মধ্যেই সে সুযোগ এসে গেল। গোপনে খৃস্টানদের কাছে এই বলে সংবাদ পাঠালাম যে, শাম অভিমুখী কোন কাফিলা তাদের কাছে এলে তারা যেন আমাকে খবর দেয়।
কিছুদিনের মধ্যেই শাম অভিমুখী একটি কাফিলা তাদের কাছে এলো। তারা আমাকে সংবাদ দিল। আমি আমার বন্দীদশা তেকে পালিয়ে গোপনে তাদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম। তারা আমাকে শামে পৌঁছে দিল। শামে পৌঁছে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ
- এ ধর্মের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশী জ্ঞানী ব্যক্তি কে?
তারা বললোঃ বিশপ, গীর্জার পুরোহিত।
আমি তাঁর কাছে গেলাম। বললামঃ আমি খৃষ্টধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমার ইচ্ছা, আপনার সাহচর্যে থেকে আপনার খিদমত করা, আপনার নিকট থেকে শিক্ষালাভ ও আপনার সাথে প্রার্থনা করা। তিনি বললেনঃ ভেতরে এসো।
আমি ভেতরে ঢুকে তার কাছে গেলাম এবং তার খিদমত শুরু করে দিলাম। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমি বুঝতে পারলাম লোকটি অসৎ। কারণ সে তার সংগী সাথীদেরকে দান-খয়রাতের নির্দেশ দেয়, সওয়াব লাভের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে; কিন্তু যখন তারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার জন্য তার হাতে কিছু তুলে দেয়, তখন সে নিজেই তা আত্মসাত করে এবং নিজের জন্য পুঞ্জিভূত করে রাখে। গরীব মিসকীনদের সে কিছুই দেয় না। এভাবে সে সাত কলস স্বর্ণ পুঞ্জিভূত করে।
তার এ চারিত্রিক অধপতন দেখে আমি তাকে ভীষণ ঘৃণা করতাম। কিছু দিনের মধ্যেই লোকটি মারা গেল। এলাকার খৃষ্টান সম্প্রদায় তাকে দাফনের জন্য সমবেত হলো। তাদেরকে আমি বললামঃ তোমাদের এ বন্ধুটি খুবই অসৎ প্রকৃতির লোক ছিল। তোমাদের সে দান খয়রাতের নির্দেশ দিত এবং সেজন্য তোমাদেরকে অনুপ্রাণিত করতো। কিন্তু তোমরা যখন তা তার হাতে তুলে দিতে সে সবই আত্মসাত করতো। গরীব-মিসকীনদের কিছুই দিত না।
তারা জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি তা কেমন করে জানলে?
বললামঃ তোমাদেরকে আমি তার পুঞ্জিভূত সম্পদের গোপন ভাণ্ডার দেখাচ্ছি।
তারা বললোঃ ঠিক আছে, তাই দেখাও।
আমি তাদেরকে গোপন ভাণ্ডারটি দেখিয়ে দিলে তারা সেখান থেকে সাত কলস সোনা-চান্দি উদ্ধার করে। এ দেখে তারা বললোঃ
- আল্লাহর কসম আমরা তাকে দাফন করবো না।
তাকে তারা শুলিতে লটকিয়ে পাথর মেরে তার দেহ জর্জরিত করে দিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা অন্য এক ব্যক্তিকে তার স্থলাভিষিক্ত করলো। আমি তাঁরও সাহচর্য গ্রহণ করলাম। এ লোকটি অপেক্ষা দুনিয়ার প্রতি অধিক উদাসীন, আখিরাতের প্রতি অধিক অনুরাগী ও রাতদিন ইবাদতের প্রতি বেশী নিষ্ঠাবান কোন লোক আমি এর আগে দেখিনি। আমি তাঁকে অত্যধিক ভালোবাসতাম। একটা দীর্ঘ সময় তাঁর সাথে আমি কাটালাম। যখন তাঁর মরণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমি তাঁকে বললামঃ
- জনাব, আপনার মৃত্যুর পর কার সাহচর্যে কাটাবার উপদেশ দিচ্ছেন আমাকে?
বললেনঃ বেটা আমি যে সত্যকে আঁকড়ে রেখেছিলাম, এখানে সে সত্যের ধারক আর কাউকে আমি জানিনা। তবে মাওসেলে এক ব্যক্তি আছে, নাম তাঁর অমুক, তিনি এ সত্যের এক বিন্দুও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করেননি। তুমি তঁঅর সাহচর্য অবলম্বন করেঅ্
আমার সে বন্ধুটির মৃত্যুর পর মাওসেলে গিয়ে তাঁর বর্ণিত লোকটিকে আমি খুঁজে বের করি। আমি তাঁকে আমার সব কথা খুলে বলি। একথাও তাঁকে আমি বলি যে, অমুক ব্যক্তি তাঁর অন্তিম সময়ে আমাকে আপনার সাহচর্য অবলম্বনের কথা বলে গেছেন। আর তিনি আমাকে একথাও বলে গেছেন যে, তিনি যে সত্যের ওপর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, আপনি সে সত্যকেই গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছে থাক।
আমি তাঁর কাছে থেকে গেলাম। তাঁর চালচলন আমার ভালোই লাগলো। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন। তাঁর মরণ সময় নিকটবর্তী হলে আমি তাঁকে বললামঃ
- জনাব, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, আল্লাহর ফায়সালা আপনার কাছে এসে গেছে। আর আমার ব্যাপারটি তো আপনি অবগত আছেন। এখন আমাকে কার কাছে যাওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন?
বললেনঃ বেটা, আমরা যে জিনিসের ওপর ছিলাম, তার ওপর অটল আছে এমন কাউকে তো আমি জানিনা। তবে ‘নাস্সিবীনে’ অমুক নামে এক ব্যক্তি আছেন, তুমি তাঁর সাথে মিলতে পার।
তাঁকে কবর দেওয়ার পর আমি নাস্সিবীনের সেই লোকটির সাথে সাক্ষাত করলাম এবং আমার সমস্ত কাহিনী তাঁকে খুলে বললাম। তিনি আমাকে তাঁর কাছে থেকে যেতে বললেন। আমি থেকে গেলাম। এ ব্যক্তিকেও পূর্ববর্তী দু’বন্ধুর মত নিষ্কলুষ চরিত্রের দেখতে পেলাম। আল্লাহ কি মহিমা, অল্পদিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। অন্তিম সময়ে তাঁকে আমি বললামঃ আমার সম্পর্কে আপনি মোটামুটি সব কথা জানেন। এখন আমাকে কার কাছে যেতে বলেন?
তিনি বললেনঃ অমুন নামে ‘আম্মুরিয়াতে’ এক লোক আছেন, তুমি তাঁরই সুহবত অবলম্বন করবে। এছাড়া আমাদের এ সত্যের ওপর অবশিষ্ট আর কাউকে তো আমি জানিনা। তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে আমি আমার সব কথা বললাম।
আমার কথা শুনে তিনি বললেনঃ আমার কাছে থাক। আল্লাহর কসম, তাঁর কাছে থেকে আমি দেখতে পেলাম তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের মত একই মত ও পথের অনুসারী। তাঁর কাছে থাকাকালেই আমি অনেকগুলি গরু ও ছাগলের অধিকারী হয়েছিলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পূর্ববর্তী সংগীদের যে পরিণতি দেখেছিলাম, সেই একই পরিণতি তাঁরও ভাগ্যে আমি দেখতে পেলাম। তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে আমি তাঁকে বললামঃ আমার অবস্থা তো আপনি ভালোই জানেন। এখন আমাকে কি করতে বলেন, কার কাছে যেতে পরামর্শ দেন?
বললেনঃ বৎস! আমরা যে সত্যকে ধরে রেখেছিলাম, সে সত্যের ওপর ভূ-পৃষ্ঠে জন্য কোন ব্যক্তি অবশিষ্ট আছে বলে আমার জানা নেই। তবে, অদূর ভবিষ্যতে আরব দেশে একজন নবী আবির্ভূত হবেন। তিনি ইবরাহীমের দ্বীন নতুনভাবে নিয়ে আসবেন। তিনি তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বড় বড় কালো পাথরের যমীনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট কিছু নিদর্শনও তাঁর থাকবে। তিনি হাদিয়ার জিনিস তো খাবেন; কিন্তু সাদকার জিনিস খাবেন না। তাঁর দু’কাঁধের মাঝখানে নুওয়াতের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।
এরপর তিনি মারা গেলেন। আমি আরো কিছুদিন আম্মুরিয়াতে কাটালাম। একদিন সেখানে ‘কালব’ গোত্রের কিছু আরব ব্যবসায়ী এলো। আমি তাদেরকে বললামঃ আপনারা যদি আমাকে সংগে করে আরব দেশে নিয়ে যান, বিনিময়ে আমি আপনাদেরকে আমার এ গরু ছাগলগুলি দিয়ে দেব। তাঁরা বললেনঃ ঠিক আছে, আমরা তোমাকে সংগে করে নিয়ে যাব।
আমি তাঁদেরকে গুরু-ছাগলগুলি দিয়ে দিলাম। তাঁরা আমাকে সংগে নিয়ে চললেন। যখন আমরা মদীনা ও শামে’র মধ্যবর্তী ‘ওয়াদী আল-কুরা’ নামক স্থানে পৌঁছলাম, তখন তাঁরা আমার সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করে এক ইহুদীর কাছে আমাকে বিক্রি করে দিল। আমি তার দাসত্ব শুরু করে দিলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বনী কুরাইজা গোত্রের তার এক চাচাতো ভাই আমাকে খরীদ করে এবং আমাকে ‘ইয়াসরিবে’ (মদীনা) নিয়ে আসে। এখানে আমি আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত সেই খেজুর গাছ দেখতে পেলাম এবং তিনি স্থানটির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সে অনুযায়ী শহরটিকে চিনতে পারলাম। এখানে আমি আমার মনিবের কাছে কাটাতে লাগলাম।
নবী সা. তখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কিন্তু দাস হিসাবে সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বা আলোচনা আমার কানে পৌঁছেনি। কিছুদিনের মধ্যে রাসূল সা. মক্কা থেকে হিজরাত করে ইয়াসরিবে এলেন। আমি তখন একটি খেজুর গাছের মাথায় উঠে কি যেন কাজ করছিলাম, আমার মনিব গাছের নীচেই বসে ছিলো এমন সময় তার এক ভাতিজা এসে তাকে বললোঃ
আল্লাহ বনী কায়লাকে (আউস ও খাজরাজ গোত্র) ধ্বংস করুন। কসম খোদার, তারা এখন কুবাতে মক্কা থেকে আজই আগত এক ব্যক্তির কাছে সমবেত হয়েছে, যে কিনা নিজেকে নবী বলে মনে করে।
তার কথাগুলি আমার কানে যেতেই আমার গায়ে যেন জ্বর এসে গেল। আমি ভীষণভাবে কাঁপতে শুরু করলাম। আমার ভয় হলো, গাছের নীচে বসা আমার মনিবের ঘাড়ের ওপর ধপাস করে পড়ে না যাই। তাড়াতাড়ি আমি গাছ থেকে নেমে এলাম এবং সেই লোকটিকে বললামঃ
- তুমি কি বললে? কথাগুলি আমার কাছে আবার বলো তো।
আমার কথা শুনে আমার মনিব রেগে ফেটে পড়লো এবং আমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললোঃ
- এর সাথে তোমার সম্পর্ক কি? যাও, তুমি যা করছিলে তাই কর।
সেদিন সন্ধ্যায় আমার সংগৃহীত খেজুর থেকে কিছু খেজুর নিয়ে রাসূল সা. যেখানে অবস্থান করছিলেন সেদিকে রওয়ানা হলাম। রাসূলের সা. নিকট পৌঁছে তাঁকে বললামঃ
- আমি শুনেছি আপনি একজন পূর্ণবান ব্যক্তি। আপনার কিছু সহায়-সম্বলহীন সঙ্গী-সাথী আছেন। এ সামান্য কিছু জিনিস সদকার উদ্দেশ্যে আমার কাছে জমা ছিল, আমি দেখলাম অন্যদের তুলনায় আপনারাই এগুলি পাওয়ার অধিক উপযুক্ত। এ কথা বলে খেজুরগুলি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি সঙ্গীদের বললেনঃ তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজের হাতটি গুটিয়ে নিলেন, কিছুই খেলেন না। মনে মনে আমি বললামঃ এ হলো একটি।
সেদিন আমি ফিরে এলাম। আমি আবারও কিছু খেজুর জমা করতে লাগলাম। রাসূল সা. কুবা থেকে মদীনায় এলেন। আমি একদিন খেজুরগুলি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বললামঃ ‘আমি দেখেছি, আপনি সদকার জিনিস খাননা। তাই এবার কিছু হাদিয়া নিয়ে এসেছি, আপনাকে দেয়ার উদ্দেশ্যে।’ এবার তিনি নিজে খেলেন এবং সঙ্গীদের আহ্বান জানালেন তাঁরাও তাঁর সাথে খেলেন। আমি মনে মনে বললামঃ এ হলো দ্বিতীয়টি।
তারপর অন্য একদিন আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছে গেলাম। তিনি তখন ‘বাকী আল-গারকাদ’ গোরস্থানে তাঁর এক সঙ্গীকে সঙ্গীকে দাফন করছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি গায়ে ‘শামলা’ (এক ধরণের ঢিলা পোশাক) জড়িয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর আমি তাঁর পেছনের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলাম। আমি খুঁজতে লাগলাম, আমার সেই আম্মুরিয়ার বন্ধুটির বর্ণিত নবুওয়াতের মোহরটি।
রাসূলসা. আমাকে তাঁর পিঠের দিকে ঘন ঘন তাকাতে দেখে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি তাঁর পিঠের চাদরটি সরিয়ে নিলেন এবং আমি মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি তখন পরিস্কারভাবে তাঁকে চিনতে পারলাম এবং হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাঁকে চুমুতে ভরে দিলাম ও কেঁদে চোখের পানিতে বুক ভাসালাম। আমার এ অবস্থা দেখে রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ
- তোমার খবর কি?
আমি সব কাহিনী খুলে বললাম। তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন এবং আমার মুখ দিয়েই এ কাহিনীটা তাঁর সংগীদের শোনাতে চাইলেন। আমি তাঁদেরকে শোনালাম। তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন, খুবই আনন্দিত হলেন।
দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে সালমান রা. রাসূলুল্লাহর সা. সাথে বদর ও উহুদের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ফলে তিনি খুবই মর্মজ্বালা ভোগ করতে থাকেন। সালমান বলেনঃ ‘একদিন রাসূল সা. আমাকে ডেকে বললেনঃ তুমি তোমার মনিবের সাথে মুকাতাবা (চুক্তি)কর। আমি চুক্তি করলাম, তাকে আমি তিন শ’ খেজুরের চারা লাগিয়ে দেব এবং সেই সাথে চল্লিশ ‘উকিয়া স্বর্ণও দেব। আর বিনিময়ে আমি মুক্তি লাভ করবো। আমি রাসূলুল্লাহর সা. এ চুক্তির কথা অবহিত করলাম। তিনি সাহাবীদেরকে ডেকে বললেনঃ তোমরা তোমাদের এ ভাইকে সাহায্য কর। তারা প্রত্যেকেই আমাকে পাঁচ, দশ, বিশ, ত্রিশটি করে যে যা পারলেন চারা দিলেন। এভাবে আমার তিনশ’ চারা সংগ্রহ হয়ে গেল। তারপর আমি রাসূলের সা. নির্দেশে গর্ত খুড়লাম। তিনি নিজেই একদিন আমার সাথে সেখানে গেলেন। আমি তঁঅর হাতে একটি করে চারা তুলে দিলাম, আর তিনি সেটা রোপন করলেন। আল্লাহর কসম, তাঁর একটি চারাও মারা যায়নি। (ঐতিহাসিকরা বলছেন, সালামান রা. একটি মাত্র চারা রোপন করেছিলেন, আর সেটাই মারা যায়। বাকী সবগুলিই রাসূলসা. রোপন করেছিলেন এবং সবগুলিই বেঁচে যায়।।) এভাবে আমি আমার চুক্তির একাংশ পূরণ করলাম, বাকী থাকলো অর্থ।
একদিন রাসূল সা. আমাকে ডেকে মুরগীর ডিমের মত দেখতে স্বর্ণজাতীয় কিছু পদার্থ আমার হাতে দিয়ে বললেন, যাও, তোমার চুক্তি মুতাবিক পরিশোধ কর। আমি বললাম, এত েকি তা পরিশোধ হবে? তিনি বরলেনঃ ‘ধর, আল্লাহ এতেই পরিশোধ করবেন।’ আল্লাহর কস, আমরা ওজন করে দেখলাম তাতে চল্লিশ উকিয়াই আছে।
এভাবে সালমান রা. তার চুক্তি পূরণ করে মুক্তিলাভ করেন। গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে হযরত সালমান রা. মুসলমানদের সাথে বসবাস করতে থঅকেন। তখন তঁঅর কোন ঘর-বাড়ী চিল না। রাসুলসা. অন্যান্য মুহাজিরদের মত প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আবু দারদার রা. সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা ভ্রাতু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন। গোলামীর কারণে হযরত সালমান রা. বদর ও উহুদ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার পর খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয। এ যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পূর্ববর্তী দু’টি যুদ্ধে অনুপস্থিতির ক্ষতি পুষিয়ে নেন। সারা আরবের বিভিন্ন গোত্র কুরাইশদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে রাসূল সা. সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন। অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেন। হযরত সালমান বলেন, পারস্যে পরিখা খনন করে নগরের হিফাজত করা হয়। মদীনার অরক্ষিত দিকে পরিখা খনন করে নগরীর হিফাজত করা সমীচীন। এ পরামর্শ রাসূলুল্লাহর সা. মনঃপূত হয়। মদীনার পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে সুদীর্ঘ পরিখা খনন করে বিশাল কুরাইশ বাহিনীর আক্রমণ সহজে প্রতিরোধ করা হয়। রাসুল সা. নিজেও এই পরিখা বা খন্দক খননের কাজে অংশগ্রহণ করেন। কুরাইশ বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে এসে এ অপূর্ব রণ-কৌশল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ২১/২২ দিন মদীনা অবরোধ করে বসে থাকার পর শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। খন্দকের পর যত যুদ্ধ হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে হযরত সালমান অংগ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকালের পর হযরত সালমান বেশ কিছুদিন মদনিায় অবস্থান করেন। সম্ভবতঃ হযরত আবু বকরের রা. খিলাফতের শেষে অথবা হযরত ’উমারের খিলাফতের প্রথম দিকে তিনি ইরাকে এবং তাঁর দ্বীনী ভাই আবু দারদা রা. সিরিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তিনি হযরত উমারের যুগে ইরান বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। মুসিলম মুজাহিদদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন। জালুলু বিজয়েও তিনি অংশগ্রহণ করেন। হযরত উমার রা. তঁঅকে মাদায়েনের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। হযরত উসমানের খিলাফতাকলে ইনতিকাল করেন।
ইসলম গ্রহণের পর হযরত সালমানের জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত হয় রাসূলুল্লাহর সা. সুহবতে। এ কারণে তিনি ইলম ও মা’রেফাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। হযরত আলীকে রা. তাঁর ইল্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বলেনঃ ‘সালমান ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে লুকমান হাকীমের সমতুল্য।’ অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি বলেনঃ ‘ইলমে আউয়াল ও ইলমে আখের সকল ইলমের আলিম ছিলেন তিনি।’ ইলমে আখের অর্থ কুরআনের ইলম। আরবে তার কোন আত্মীয় ও খান্দান ছিল না, তাই রাসূল সা. তাঁকে আহলে বাইতের সদস্য বলে ঘোষণা করেন। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল, যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম ও মুজতাহিদ সাহাবী, বলেনঃ চার ব্যক্তি থেকে ইলম হাসিল করবে। সেই চারজনের একজন সালমান।
হযরত সালমান থেকে ষাটটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি মুত্তাফাক আলাইহি, একটি মুসলিম ও তিনটি বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন। আবু সাঈদ খুদরী, আবুত তুফাইল, ইবন আব্বাস, আউস বিন মালিক ও ইবন আজযা রা. প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর ছাত্র ছিলেন।
হযরত সালমান সেইসব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা রাসূলুল্লাহর সা. বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত আয়িশা রা. বলেনঃ ‘রাসূল সা. যেদিন রাতে সালমানের সাথে নিভৃতে আলোচনা করতে বসতেন, আমরা তাঁর স্ত্রীরা ধারণা করতাম সালমান হযতো আজ আমাদের রাতের সান্নিধ্যটুকু কেড়ে নেবে।’
যুহুদ ও তাকওয়ার তিনি ছিলেন বাস্তব নমুনা। ক্ষণিকের মুসাফির হিসেবে তিনি জীবন যাপন করেছেন। জীবনে কোন বাড়ী তৈরী করেননি। কোথাও কোন প্রাচীর বা গাছের ছায়া পেলে সেখানেই শুয়ে যেতেন। এক ব্যক্তি তাঁর কাছে ইজাযত চাইলো, তাঁকে একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার। তিনি নিষেধ করলেন। বার বার পীড়াপীড়িতে শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ঘর বানাবে? লোকটি বললোঃ এত ছোট যে, দাঁড়ালে মাথায় চাল বেঁধে যাবে এবং শুয়ে পড়লে দেয়ালে পা ঠেকে যাবে। এ কথায় তিনি রাজী হলেন। তাঁর জন্য একটি ঝুপড়ি ঘর তৈরী করা হয়। হযরত হাসান রা. বলেনঃ ‘সালমান যখন পাঁচ হাজার দিরহাম ভাতা পেতেন, তিরিশ হাজার লোকের উপর প্রভুত্ব করতেন তখনও তাঁর একটি মাত্র ‘আবা’ ছিল। তার মধ্যে ভরে তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন। ঘুমানোর সময় আবাটির এক পাশ গায়ে দিতেন এবং অন্য পাশ বিছাতেন।’
হযরত সালমান রা. যখন অন্তিম রোগ শয্যায়, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রা. তাঁকে দেখতে যান। সালমান রা. কাঁদতে শুরু করলেন। সা’দ বললেনঃ আবু আবদিল্লাহ, কাঁদছেন কেন? রাসুল সা. তো আপনার প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাউজে কাওসারের নিকট তাঁর সাথে আপনি মিলিত হবেন। বললেনঃ আমি মরণ ভয়ে কাদঁছিনে। কান্নার কারণ হচ্ছে, রাসূল সা. আমাদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমাদের সাজ-সরঞ্জাম যেন একজন মুসাফিরের সাজ-সরঞ্জাম থেকে বেশি না হয়। অথচ আমার কাছে এতগুলি জিনিসপত্র জমা হয়ে গেছে। সা’দ বলেনঃ সেই জিনিসগুলি একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা ও একটি পনির পাত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।

উসামা ইবন যায়িদ (রা)
হিজরাতের পূর্বে মক্কায় নবুওয়াতের সপ্তম বছর চলছে। রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবীরা তখন কুরাইশদের চরম বাড়াবাড়ির শিকার। ইসলামী দাওয়াতের কঠিন দায়িত্ব ও বোঝা পালন করতে গিয়ে পদে পদে তিনি নানা রকম দুঃখ বেদনা ও মুসীবতের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমন সময় তাঁর জীবনে একটু খুশির আলোক আভা দেখা দিল। সুসংবাদ দানকারী খুশীর বার্তা নিয়ে এলো, ‘উম্মু আয়মন’ একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সেই সৌভাগ্যবান নবজাতক, যার ধরাপৃষ্ঠে আগমণ সংবাদে আল্লাহর রাসূল সা. এত উৎফুল্ল হয়েছিলেন, তিনি উসামা ইবন যায়িদ।
শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে রাসূলুল্লাহর সা. এত উৎফুল্ল হওয়াতে সাহাবীরা কিন্তু বিস্মিত হননি। কারণ, রাসূলুল্লাহর সা. নিকট শিশুটির মাতা-পিতার স্থান সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। শিশুটির মা ‘বারাকা আল হাবাশিয়্য’- যিনি ‘উম্মু আয়মন’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. জননী হযরত আমিনার দাসী। তাঁর জীবনকালে এবং ওয়াফাতের পরও এ মহিলা রাসূলুল্লাহকে সা. প্রতিপালন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. দুনিয়াতে চোখ মেলে তাঁকেই মা বলে বুঝতে শেখেন। অত্যন্ত গভীর ও অকৃত্রিমভাবে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে ভালোবাসতেন। প্রায়ই তিনি বলতেনঃ ‘আমার মায়ের পর ইনিই আমার মা এবং আমার আহলদের অবশিষ্ট ব্যক্তি। এ সম্মানিত মহিলাই হচ্ছেন এ নবজাতকের গৌরবান্বিত মা।
শিশুটির পিতা হলেন রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহভাজন, ইসলাম-পূর্ব যুগের ধর্মপুত্র, বিশ্বস্ত সংগী, ইসলামের পর রাসূলুল্লাহর সা. সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি- যায়িদ ইবন হারিসা রা.।
রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মক্কার সমগ্র মুসলিম সমাজ শিশুটির ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে উৎফুল্ল হয়েছিল। শিশুর পিতাকে যেমন তারা উপাধি দিয়েছিল ‘হিববু রাসুলিল্লাহ’, তেমনি তারা তাকে উপাধি দিল ‘ইবনুল হিব্ব’ বা রাসূলুল্লাহর সা. প্রীতিভাজনের পুত্র। তাদের এ উপাধি দান কিন্তু যথার্থই হয়েছিল। রাসূল সা. তাকে এত অধিক ভালোবেসেছিলেন যে, তা দেখে বিশ্ববাসীর ঈর্ষা হয়। উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. দৌহিত্র হাসান ইবন ফাতিমার সমবয়সী। হাসান ছিলেন তাঁর নানা রাসূলুল্লাহর সা. মত দারুণ সুন্দর। আর উসামা ছিলেন তাঁর হাবশী মা’র হাবশী মা’র মত কালো ও খাঁদা নাক বিশিষ্ট। কিন্তু রাসূল সা. তাদের দু’জনকে স্নেহ ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে মোটেই কম বেশী করতেন না। তিনি উসামাকে বসাতেন এক উরুর ওপর এবং হাসানকে অন্য উরুর ওপর। তারপর দু’জনকে একসাথে বুকের মাঝে চেপে ধরে বলতেনঃ ‘হে আল্লাহ, আমি তাদের দু’জনকে ভালোবাসি, তুমিও তাদের উভয়কে ভালোবাস।’
শিশু উসামার প্রতি রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা কত গভীর ও প্রবল ছিল তা বুঝা যায় একটি ঘটনা দ্বারা। শিশু উসামা একবার দরজার চৌকাঠে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। তার কপাল কেটে রক্ত বের হতে লাগলো। রাসুল সা. প্রথমে হযরত আয়িশাকে রা. রক্ত মুছে দিতে বললেন। কিন্তু তাতে স্বস্তি পেলেন না। তিনি নিজেই উঠে গিয়ে রক্ত মুছে ক্ষতস্থানে চুমু দিতে লাগলেন এবং মিষ্টি মধুর ও দরদ মিশ্রিত কথা বলে তাকে শান্ত করতে লাগলেন।
শৈশবের মত যৌবনেও উসামা রাসূলুল্লাহর সা. ভালোবাসা লাভ করেন। একবার কুরাইশদের অন্যতম নেতা হাকীম ইবন হিযাম ইয়ামনের ‘যী ইয়াযিন’ বাদশার একখানা মূল্যবান চাদর ইয়ামন থেকে পঞ্চাশ দীনার দিয়ে খরীদ করেন। চাদরখানি তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. উপহার দিতে চাইলে তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, হাকীম তখনও মুশরিক ছিলেন। তবে রাসূল সা. তাঁর নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে চাদরখানি খরিদ করেন। এক জুমআর দিন একবার মাত্র সে চাদরখানি রাসূল সা. পরেন। তারপর তিনি তা উসামার গায়ে পরিয়ে দেন। উসামা সে চাদরখানি প’রে তার সমবয়সী মুহাজির ও আনসার যুবকদের সাথে সকাল সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতেন।
যৌবনে উসামার মধ্যে এমন সব চারিত্রিক সৌন্দর্য ও গুণাবলী বিকশিত হলো যা সহজেই রাসূলুল্লাহর সা. স্নেহ ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়। তীক্ষ্ণ মেধা, দুঃসাহস, বিচক্ষণতা, পূতঃপবিত্র চরিত্র এবং তাকওয়া ও পরহিযগারী ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উহুদ যুদ্ধের দিন উসামা তাঁর সমবয়সী আরো কতিপয় কিশোর সাহাবীর সাথে উপস্থিত হলেন রাসূলুল্লাহর সা. সামনে। তাদের সবার ইচ্ছা জিহাদে অংশগ্রহণ করা। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে নির্বাচন করলেন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে অন্যদের ফিরিয়ে দিলেন। উসামা প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাড়ীতে ফিরছেন। চোখ দু’টি তাঁর পানিতে টলমল। তাঁর ব্যথা, রাসূলুল্লাহর সা. পতাকাতলে জিহাদের সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন।
খন্দকের যুদ্ধ সমুপস্থিত। উসামাও হাজির। তাঁর সাথে আরো কয়েকজন কিশোর সাহাবী। রাসূলুল্লাহ সা. সৈনিক বাছাই করছেন। উহুদের মত এবারো তাঁকে ছোট বলে বাদ দেওয়া না হয়, এজন্য পায়ের আাঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর আগ্রহ দেখে রাসূলুল্লাহর সা. অন্তর নরম হলো। তাকে নির্বাচন করলেন। তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে উসামা চললেন জিহাদে। তিনি তখন ১২/১৩ বছরের এক কিশোর।
কোন কোন বর্ণনায় বলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে প্রথম পর্যায়ের অভিযান সমূহে তিনি অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। ‘হারকা’ অভিযানে তিনি সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করেন। সাত অথবা আট হিজরীতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। তখন তাঁর বয়স চৌদ্দ। কিন্ত তাঁর সীমাহীন যোগ্যতার কারণে রাসূল সা. তাঁকে অভিযানের নেতৃত্ব দান করেন। এ অভিযানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ ‘রাসূল সা. আমাদেরকে ‘হারকা’র দিকে পাঠালেন। শত্রুরা পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করলো। আমি এক আনসারী সিপাহীর সাথে পলায়নরত এক সৈনিকের পিছু ধাওয়া করলাম। যখন সে আমাদের নাগালের মধ্যে এসে গেল, জোরে জোরে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে উঠলো। তার এ ঘোষণায় আনসারী হাত গুটিয়ে নিল; কিন্তু আমি বর্শা ছুড়ে তাকে গেঁথে ফেললাম। সে মারা গেল। অভিযান থেকে ফেরার পর বিষয়টি রাসূলুল্লাহর সা. কর্ণগোচর হলো। তিনি আমাকে বললেনঃ উসামা, কালিমা তাইয়্যেবা পড়ার পর তুমি একটি লোককে হত্যা করেছ। আমি বললাম, প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে এমনটি করেছে। তিনি আমার কথায় কান দিলেন না। একই কথা বার বার আওড়াতে লাগলেন। আমি তখন এত অনুতপ্ত হলাম যে, মনে মনে বললাম, ‘হায়! আজকের পূর্বে যদি আমি ইসলাম গ্রহণ না করতাম।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা. তাঁকে বলেনঃ ‘তুমি তার অন্তর ফেঁড়ে দেখলে না কেন?’
হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়ে পালাতে লাগলো। উসামা তখন রাসূলুল্লাহর সা. চাচা আব্বাস, আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিসসহ মাত্র ছ’জন সাহাবীর সাথে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে অটল হয়ে রুখে দাঁড়ালেন। বীর বিশ্বাসীদের ক্ষুদ্র এই দলটির সাহায্যে রাসূলুল্লাহ সা. সেদিন নিশ্চিত পরাজয়কে বিজয়ের রূপদান করেন এবং পলায়নরত মুসলিম বাহিনীকে মুশরিক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেন।
মক্কা নিজয়েও উসামা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. সংগী। রাসূলুল্লাহর সা সাথে একই বাহনে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে উসামা, বিলাল ও উসমান ইবন তালহা এ তিন ব্যক্তিই সেদিন কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এ চারজনের পরই কা’বার দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
উসামা তাঁর পিতা সেনাপতি যায়িদ ইবন হারিসার সাথে মুতা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন তার বয়স আঠারো বছরেরও কম। এ যুদ্ধে তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন পিতার শাহাদাত। তবে তিনি মুষড়ে পড়েননি। পিতার শাহাদাত বরণের পর যথাক্রমে জা’ফর ইবন আবী তালিব ও আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহার নেতৃত্বে বাহাদুরের মত লড়াই করেন। যায়িদের মত এ সেনাপতিও শাহাদাত বরণ করলে তিনি সেনাপতি খালিদ ইবন ওয়ালিদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন এবং মুসলিম বাহিনীকে রোমান বাহিনীর পাঞ্জা থেকে উদ্ধার করেন। মূতার প্রান্তরে পিতা যায়িদের মরদেহ আল্লাহর হাওয়ালা করে যে ঘোড়ার ওপর তিনি শহীদ হয়েছিলেন, তার ওপর সওয়াব হয়ে তিনি মদীনায় ফিরে এলেন।
একাদশ হিজরীতে রাসূল সা. রোমান বাহিনীর সাতে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবু বকর, ‘উমার, সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ প্রমুখ প্রথম কাতারের সমর বিশারদ সাহাবী এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হলেন। রাসূল সা. উসামা বিন যায়িদকে এ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেন। তখন তাঁর বয়স বিশের কাছাকাছি। রাসূল সা. গাযা উপত্যকার নিকটবর্তী ‘বালকা’ ও ‘দারুম আল কিলয়ার’ আশে পাশে সীমান্তে ছাউনি ফেলার নির্দেশ দিলেন।
বাহিনী যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো। এদিকে রাসূল সা. পীড়িত হয়ে পড়লেন। রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাহিনীসহ তিনি যাত্রাবিরতি করে মদীনার উপকণ্ঠে ‘জুরুফ’ নামক স্থানে প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সেখান থেকে প্রতিদিন তিনি রাসূলুল্লাহকে সা. দেখতে আসতেন। উসামা বলেন ‘রাসূলুল্লাহর সা. রোগ বৃদ্ধি পেলে আমি দেখতে গেলাম। আরো অনেকে আমার সংগে ছিলেন। ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম, রাসূল সা. চুপ করে আছেন। রোগের প্রচণ্ডতায় তিনি কথা বলতে পারছেন না। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি আসমানের দিকে হাত উঠালেন, তারপর আমার শরীরের ওপর হাত রাখলেন। আমি বুঝলাম, তিনি আমার জন্য দু’আ করছেন।’
রাসূলুল্লাহর সা. ইনতিকাল হলো। খবর পেয়ে তিনি মদীনায় ছুটে এলেন এবং কাফন দাফনে অংশগ্রহণ করলেন। রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র মরদেহ কবরে নামানোর সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন।
হযরত আবু বকর রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন। তিনি উসামাকে যাত্রার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু আনসারদের ছোট্ট একটি দল মনে করলেন এ মুহূর্তে বাহিনীর যাত্রা একটু বিলম্ব করা উচিত। এ ব্যাপারে খলীফার সাথে কথা বরার জন্য তাঁরা হযরত উমারকে রা. অনুরোধ করলেন। তাঁরা উমারকে এ কথাও বললেন, যদি তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে অন্ততঃ তাঁকে অনুরোধ করবেন, উসামা থেকে একজন অধিক বয়সের লোককে যেন আমাদের সেনাপতি নিয়োগ করে।
হযরত আবু বকর বসে ছিলেন। হযরত ’উমারের রা. মুখে আনসারদের বক্তব্য শোনার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং ফারুকে আযমের দাড়ি মুট করে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেনঃ ‘ওহে খাত্তাবের পুত্র! আপনার মা নিপাত যাক! আপনি আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন রাসূলুল্লাহর সা. নিয়োগ করা ব্যক্তিকে অপসারণ করতে? আল্লাহর কসম, আমার দ্বারা কক্ষণো তা হবেনা।’
’উমার রা. ফিরে এলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, সমাচার কি? বললেনঃ তোমাদের সকলের মা নিপাত যাক! তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের খলীফার নিকট থেকে অনেক কিছুই আমাকে শুনতে হলো।
যুবক কমাণ্ডারের নেতৃত্বে বাহিনী মদীনা থেকে রওয়ানা হলো। খলীফা আবু বকর রা. চললেন কিছুদূর এগিয়ে দিতে। উসামা ঘোড়ার পিঠে, খলীফা পায়ে হেঁটে। উসামা বললেনঃ ‘হে রাসূলুল্লাহ সা. খলীফা! আল্লাহর কসম, হয় আপনি ঘোড়ায় উঠুন, না হয় আমি নেমে পড়ি।’ খলীফা বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, তুমিও নামবে না, আমিও উঠবো না। কিছুক্ষণ আল্লাহর পথে আমার পদযুগল ধুলিমলিন হতে দোষ কি?’ তারপর উসামাকে বললেনঃ ‘তোমার দ্বীন, তোমার আমানতদারী এবং তোমার কাজের সমাপ্তি আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করলাম। রাসূলুল্লাহ সা. যে নির্দেশ তোমাকে দিয়েছেন, তা কার্যকর করা উপদেশ তোমাকে দিচ্ছি।’ তারপর উসামার দিকে একটু ঝুঁকে বললেনঃ ‘তুমি যদি ’উমারের দ্বারা আমাকে সাহায্য করা ভালো মনে কর, তাকে আমার কাছে থেকে যাওয়ার অনুমতি দাও।’ উসামা আবু বকরের আবেদন মঞ্জুর করলেন। উমারকে মদীনায় খলীফার সংগে থাকার অনুমতি দিলেন।
উসামা রাসূলুল্লাহর সা. আদেশ অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেন। মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী ফিলিস্তিনের ‘বালকা’ ও ‘কিলায়াতুত দারুম’ সীমান্ত পদানত করে। ফলে এ অঞ্চল থেকে মুসলমানদের জন্য রোমান ভীতি চিরতরে দূরীভূত হয় এবং গোটা সিরিয়া, মিসর ও উত্তর আফ্রিকাসহ কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিজয়দ্বার উন্মুক্ত হয়।
এ অভিযানে তিনি তাঁর পিতার হত্যাকারীকে হত্যা করে পিতৃহত্যার প্রাতিশোধ নেন। যে ঘোড়ার ওপর তাঁর পিতা শহীদ হয়েছিলেন, তার পিঠে বিপুল পরিমাণ গণিমাতের ধন সম্পদ বোঝাই করে তিনি বিজয়ীর বেশে মদীনায় ফিরে এলেন। খলীফা আবু বকর রা. মুহাজির ও আনসারদের বিরাট একটি দল সহ মদীনার উপকণ্ঠে তাঁকে স্বগত জানান। উসামা মদীনায় পৌঁছে মসজিদে নববীতে দু’রাকায়াত নামায আদায় করে বাড়ী যান। ঐতিহাসিকরা তাঁর এ বিজয় সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ ‘উসামার বাহিনী অপেক্ষা অধিকতর নিরাপদ ও গণিমাত লাভকারী অন্য কোন বাহিনী আর দেখা যায়নি।’
রাসূলুল্লাহর সা. অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য উসামা মুসলিম সমাজের ব্যাপক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার রা. নিজ পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার অপেক্ষা উসামার ভাতা বেশী নির্ধারণ করেন। হযরত আবদুল্লাহ ক্ষব্ধ হয়ে অভিযোগ করেনঃ ‘আব্বা, উসামার ভাতা চার হাজার, আর আমার ভাতা তিন হাজার। আমার পিতা অপেক্ষা তাঁর পিতা অধিক মর্যাদাবান ছিলেন না এবং আমার থেকেও তাঁর মার্যাদা বেশী নয়।’ জবাবে হযরত উমার বলেনঃ ‘আফসোস! তোমার পিতার চেয়ে তার পিতা রাসূলুল্লাহর সা. অধিক প্রিয় ছিলেন এবং তোমার থেকেও সে রাসূলুল্লাহর সা. বেশী প্রিয় ছিল।’ হযরত আবদুল্লাহ রা. আর কোন উচ্চবাচ্য করেননি।
উসামার সাথে খলীফা ’উমারের দেখা হলেই বলতেনঃ ‘স্বাগতম, আমার আমীর।’ এমন সম্বোধনে কেউ বিস্মিত হলে তিনি বলতেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ সা. তাকে আমার আমীর বা নেতা বানিয়েছিলেন।
হযরত উসমানের রা. খিলাফতকালে ফিতনা-ফাসাদের আশংকায় রাষ্ট্রীয় কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। তবে হিতাকাংখী মুসলিম হিসাবে সর্বদা খলীফাকে সৎ পরামর্শ দিতেন এবং গোপনে গণ-অসন্তোষের বিষয়ে খলীফার সাথে আলোচনা করতেন।
হযরত উসমানের শাহাদাতের পর যখন বিশৃংখলা দেখা দিল, তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করলেন। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার বিরোধ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলেন। এ সময় হযরত আলীকে একবার তিনি বলে পাঠালেন, ‘আপনি যদি বাঘের চোয়ালের মধ্যে ঢুকতেন, আমিও সন্তুষ্টচিত্তে ঢুকে যেতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে অংশগ্রহণের আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’ মুসলমানদের রক্তপাতের ভয়ে যদিও তিনি এ দ্বন্দ্বে জড়াতে চাননি, তবে তিনি আলীকে রা. সত্যপন্থী বলে মনে করতেন। এ কারণে, আলীকে সাহায্য না করার জন্য শেষ জীবনে তাওবাহ করেছেন।
হযরত উসামা প্রতিপালিত হয়েছিলেন নবীগৃহে। এ কারণে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া তাঁর উচিত ছিল। রাসূলুল্লাহর সা. ওয়াফাতের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আঠারো বছর। বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহর সা. দীর্ঘ সাহচর্য লাভের সুযোগ তিনি পাননি। এ কারণে, এ ক্ষেত্রে তিনি আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবন উমার প্রমুখ বিদ্বান সাহাবীদের মত আশানুরূপ সাফল্য লাভ করেননি। তা সত্ত্বেও যা তিনি অর্জন করেছিলেন তা মোটেও অকিঞ্চিৎকর নয়। তিনি নবীর সা. বহু বাণী স্মৃতিতে সংরক্ষণ করেছিলেন। বিশিষ্ট সাহাবীরাও মাঝে মাঝে শরীয়াতের নির্দেশ জানার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে শরীয়াতের কোন নির্দেশ না পেয়ে উসামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তাউন’ বা প্লেগ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট থেকে কিছু শুনেছেন কি? তিনি এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর সা. একটি বাণী সা’দের নিকট বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সর্বমোট একশ’ আটাশটি। তন্মধ্যে পনেরটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে বর্ণনা করেছেন। হযরত হাসান, মুহাম্মাদ ইবন আব্বাস, আবু হুরাইরা, কুরাইব, আবু উসমান নাহদী, ’আমর ইবন উসমান, আবু ওয়ায়িল, আমের ইবন সা’দ, হাসান বসরী রা. প্রমুখ সাহাবী ও তাবঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।
যেহেতু নবীগৃতে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁর যাতায়াত ছিল অবাধ, এ কারণে নবীর সা. শিক্ষার যথেষ্ট প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল। অধিকাংশ সফরে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে একই বাহনে আরোহী হওয়ার সৌভাগ্য তিনি লাভ করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহর সা. খিদমাতের সুযোগও বেশী পরিমাণে লাভ করেন। অজু ও পাক পবিত্রতার পানি তিনিই অধিকাংশ সময় এগিয়ে দিতেন।
অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। ইফ্ক বা হযরত আয়িশার রা. প্রতি মুনাফিকদের বানোয়াট ও অশালীন উক্তি ছড়িয়ে পড়লে রাসূল সা. ঘনিষ্ঠ যে দু’ব্যক্তির সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন, তারা ছিলেন হযরত আলী ও উসামা রা.।
এ মহান সেনানায়ক হযরত মুয়াবিয়ার খিলাফত কালের শেষ দিকে হিজরী ৫৪ সনে ৬০ বছর বয়সে মদীনায় ইনতিকাল করেন।

আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রা)
মুয়ায্যিনুর রাসূল হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম সেই মহান সাহাবী যাঁর জন্য সপ্তম আকাশের ওপর থেকে নবী করীমকে সা. তিরস্কার করা হয়েছে এবং যাঁর শানে আল্লাহর নিকট থেকে হযরত জিবরীল আ. অহী নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট অবতরণ করেছেন। তিনি সেই গর্বিত মহাপুরুষ যাঁর সম্পর্কে আল-কুরআনের সর্বমোট ষোলটি আয়াত নাযিল হয়েছে।
মদীনাবাসীরা তাঁকে ডাকতেন আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বলে। তবে ইরাকীদের নিকট তিনি ‘উমার ইবন উম্মে মাকতুম’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের সন্তান। রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল। তিনি ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজা বিনতু খুওয়ালিদের মামাতো ভাই। তাঁর পিতা কায়েস বিন যায়িদ ও মাতা আতিকা বিনতু আবদিল্লাহ। আবদুল্লাহকে অন্ধ অবস্থায় প্রসব করেনে, এ কারণে মা ‘আতিকা উম্মু মাকতুম’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। মাকতুম অর্থ অন্ধ এবং উম্মু মাকতুম- অন্ধের মা।
বাহ্যিক চক্ষু তাঁর ছিল না। তবে একটি তীক্ষ্ণ অন্তর্চক্ষু তিনি লাভ করেছিলেন। মক্কায় ইসলামের আলোকরশ্মি আত্মপ্রকাশের সূচনা কালটি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্তর্চক্ষু উন্মুক্ত করে দেন। তিনি ঈমান আনেন। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের প্রথম পর্বের বিশ্বাসীদের অন্যতম। মক্কার মুসলমানদের কুরবানী, ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার অংশীদার ছিলেন তিনিও। অন্যদের মত তিনিও শিকার হয়েছিলেন কুরাইশদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের। তাদের হাজারো জুলুম-অত্যাচারে তিনি একটুও দমেননি, একটুও সাহসহারা হননি, অথবা বলা যায়, তাঁর ঈমান কখনো দুর্বল হয়ে পড়েনি। তাদের জুলুম-অত্যাচার যতই বৃদ্ধি পেয়েছিল, তিনিও তত বেশী করে আল্লাহর-দ্বীনকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর সংগে সংগে আল্লাহর কিতাবের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল, শরীয়াতের সমঝও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং রাসূলুল্লাহর সা. নিকট তাঁর সময় অসময়ে যাতায়াতও বেড়ে গিয়েছিল।
রাসূলুল্লাহর সা. প্রতি তাঁর ভক্তি-ভালোবাসা ও পবিত্র কুরআন হিফ্জ করার প্রতি তাঁর আগ্রহ এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, এ ব্যাপারে প্রতিটি সুযোগকে তিনি গনিমত মনে করতেন এবং প্রতিটি মুহূর্তে কাজে লাগাতেন। আগ্রহের আতিশয্যের কারণে অনেক সময় রাসূলুল্লাহর সা. নিজের জন্য এমনকি অন্যের জন্য নির্ধারিত সময়টুকুতেও তিনি ভাগ বসাতেন।
এটা সেই সময়ের কথা যখন রাসূলুল্লাহর সা. মক্কার কুরাইশ নেতৃবর্গের ভীষণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তাদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি দারুণ আগ্রহী। একদিন তিনি মিলিত হলেন, ‘উতবা ইবন রাবীয়া, শায়বা ইবন রাবীয়া, আমর ইবন হিশাম উরফে আবু জাহল, উমাইয়া ইবন খালফ এবং খালিদ সাইফুল্লাহর পিতা ওয়ালিদ ইবন মুগীরার সাথে। তিনি একেক জনের কাছে যাচ্ছেন, শলাপরামর্শ করছেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন। তিনি আশা করছেন, তারা তাঁর দাওয়াত কবুল করুক অথবা কমপক্ষে তাঁর সংগী-সাথীদের ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন থেকে বিরত থাকুক। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনি ব্যস্ত, এমন সময় সম্পূর্ণ অনাহূতভঅবে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে হাজির। বললেনঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার কিছু আমাকে শিখিয়ে দিন। রাসূল সা. তাঁর কথায় বিশেষ একটা গুরুত্ব না দিয়ে কুরাইশ নেতৃবর্গের পতি মনোযোগী থাকলেন। এই আশা ও বিশ্বাস নিয়ে যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাতে আল্লাহর দ্বীনের সম্মান বৃদ্ধি পাবে ও দাওয়াতী কাজের সুবিধা হবে। রাসূলুল্লাহ সা. তাদের সাথে আলোচনা-পরামর্শ শেষ করে যেইনা গৃহের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছেন অমনি আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পাকড়াও করলেন। তিরস্কার করে অহী নাযিল করলেনঃ
‘সে ভ্রু কুঞ্চিত করলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি এলো। তুমি কেমন করে জানবে- সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো। ফলে উপদেশ তার উপকারে আসতো। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করেনা, তুমি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছো। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তোমার কোন দায়িত্ব নেই। অন্যদিকে যে তোমার দিকে ছুটে এলো, আর সে সশংকচিত্ত, তাকে তুমি অবজ্ঞা করলে। না, এরূপ আচরণ অনুচিত। এ তো উপদেশবাণী। যে ইচ্ছে করবে স্মরণ রাখবে। তা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূত-চরিত্র লিপিকর হস্তে লিপিবদ্ধ।’ (আবাসাঃ ১-১৬)
এই অন্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমের শানে মোট ষোলটি আয়াত সহ হযরত জিবরীল আল-আমীন সেদিন অবতরণ করেছিলেন রাসূলুল্লাহর সা. অন্তঃকরণে। আয়াতগুলি আজ পর্যন্ত পঠিত হয়ে আসছে এবং যতদিন এ ধরাপৃষ্ঠে মানব জাতির জীবনধারা অব্যাহত থাকবে ততদিন তা পঠিত হবে। সেই দিন থেকে রাসূল সা. আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমকে বিশেষ সমাদর করতেন। তিনি এলে ডেকে কাছে বসাতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন এবং তাঁর কিছু প্রয়োজন থাকলে তা পূরণ করতেন। হযরত আয়িশা রা. তাঁকে লেবু ও মধুর সরবত বানিয়ে পান করাতেন, তিনি বলেনঃ ‘আয়াত নাযিল হওয়ার পর এ ছিল তাঁর জন্য নির্ধারিত।’ এত আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, তিনি তো সেই ব্যক্তি যাঁর কারণে সপ্তম আকাশের ওপর থেকে তাঁকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে।
রাসূল সা. ও মুসলমানদের ওপর কুরাইশদের কঠোরতা ও অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমা ছেড়ে গেল, আল্লাহ তা’আলা মুসলমানদেরকে হিজরাতের অনুমতি প্রদান করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন তাঁদেরই একজন যারা খুব দ্রুত দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি এবং হযরত মুসয়াব ইবন ’উমাইর রা. সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম মক্কা থেকে মদীনায় উপনীত হন। আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম মদীনায় পৌঁছে বন্ধু মুসয়াব ইবন উমাইরকে সংগে নিয়ে মানুষের বাড়ীতে যেয়ে যেয়ে কুরআন ও আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দিতে শুরু করেন। হযরত বাররা ইবন আবিব রা. বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরাত করে মদীনায় আমাদের নিকট আসনে মুসয়াব ইবন উমাইর ও ইবন উম্মে মাকতুম রা.। তাঁরা মদীনায় এসেই আমাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।’
রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে এলেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ও বিলাল ইবন রাবাহকে মুসলমানদের মুয়ায্যিন নিয়োগ করেন। তাঁরা দু’জন ছিলেন মুসলিম উম্মাতের প্রথম মুয়ায্যিন। এভাবে তাঁরা প্রতিদিন পাঁচবার কালেমাতুত তাওহীদের প্রচার, মানুষকে সৎকর্মের দিকে আহ্বান ও কল্যাণের প্রতি উৎসাহদানের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। বিলাল আযান দিতেন, আর ইবন উম্মে মাকতুম দিতেন ইকামাত। মাঝে মাঝে আযান দিতেন ইবন উম্মে মাকতুম, আর ইকামাতে দিতেন বিলাল রা.। রমযান মাসে তাঁরা অন্য একটি কাজও করতেন। মদীনার মুসলমানরা তাঁদের একজনের আযান শুনে সেহরী খাওয়া শুরু করতেন এবং অন্যজনের আযান শুনে খাওয়া বন্ধ করতেন। বিলালের আযান শুনে লোকেরা সেহরীর জন্য জেগে উঠতো। এদিকে আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম প্রতীক্ষায় থাকতেন সুবহে সাদিকের সুবহে সাদিক হওয়ার সাথে সাথে তিনি আযান দিতেন, আর সে আযান শুনে লোকেরা খাওয়া বন্ধ করতো।
রাসূলুল্লাহর সা. হিজরাতের যুদ্ধ-বিগ্রহের পালা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ইবন উম্মে মাকতুম স্বীয় অক্ষমতার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণে অপারগ ছিলেন। বদর যুদ্ধের পর আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবীর ওপর কিছু আয়াত নাযিল করেন। আয়াতগুলি মুজাহিদদের সুমহান মর্যাদা ও জিহাদ থেকে বিমুখ হয়ে যারা গৃহে অবস্থান করেন, তাদের ওপর মুজাহিদদের প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়। আয়াতগুলির বিষয়বস্তু ইবন উম্মে মাকতুমের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুজাহিদদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে তিনি ভীষণ ব্যথিত হন। যখন এ আয়াত নাযিল হলোঃ
‘গৃহে অবস্থানকারী মু’মিনগণ এবং আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদগণ সমমর্যাদার অধিকারী হবে না।’ রাসূলুল্লাহ সা. কাতিবে অহী হযরত যায়িদ বিন সাবিতকে রা. আয়াতটি লিখতে বললেন। এমন সময় ইবন উম্মে মাকতুম সেখানে পৌঁছলেন। আরজ করলেনঃ ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, সক্ষম হলে আমিও তো জিহাদে অংশগ্রহণ করে মুজাহিদদের মর্যাদা লাভ করতে পারতাম।’
তারপর অত্যন্ত বিনীতভঅবে আল্লাহর নিকট দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ আমার অপারগতা সম্পর্কে অহী নাযিল করুন, হে আল্লাহ আমার ওজর সম্পর্কে অহী নাযিল করুন।’ তাঁর এ আকাঙ্ক্ষা আল্লাহর নিকট এতই মনঃপূত হয়েছিল যে, সংগে সংগে অহী নাযিল করে অনন্তকালের জন্য জগতের সকল অক্ষম ব্যক্তিদের জিহাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দান করেন।
নাযিল হয়ঃ
لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
‘ওজরগ্রস্তরা ছাড়া যেসব মুসলমান গৃহে অবস্থান করে, মর্যাদায় তারা তাদের সমকক্ষ নয়, যারা জান মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে।’ এখানে [غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ ] বাক্যাংশ দ্বারা সকল অক্ষম ব্যক্তিকে জিহাদের হুকুম থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে এই হুকুমের কারণে তাঁর জিহাদে গমনের উৎসাহ কমার পরিবর্তে আরো বৃদ্ধি পেল। তাঁর মহান অন্তঃকরণ অক্ষমদের সাথে ঘরে বসে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মহান অন্তঃকরণ সর্বদাই মহৎ কাজ ছাড়া পরিতুষ্ট হতে পারে না। ইবন হাজার আসকিলানী ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে বলেনঃ অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও কখনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। মানুষকে তিনি বলতেন, ‘আমার হাতে পতাকা দিয়ে তোমরা আমাকে দু’সারির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দাও। আমি অন্ধ, পালানোর কোন ভয় নেই।’
হযরত ইবন উম্মে মাকতুম যদিও অক্ষমতার কারণে জিহাদের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত ছিলেন, তবে তার থেকে বড় গৌরব ও সম্মান তিনি অর্জন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা. যখন নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারদের সংগে নিয়ে মদীনার বাইরে কোন অভিযানে গমন করতেন, তখন ইবন উম্মে মাকতুমকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। এ সময় তিনি মসজিদে নববীতে নামাযের ইমামতির দায়্ত্ব পালন করতেন। সুতরাং আবওয়ার, বাওয়াত, যুল আসীর, জুহাইনা, সুয়াইক, গাতফান, হামরাউল আসাদ, নাজরান, যাতুর রুকা প্রভৃতি অভিযানের সময় মোট তের বার এ গৌরব তিনি অর্জন করেন। বদর যুদ্ধের সময় কিছুদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরে হযরত আবু লুবাবাকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতের পর থেকে হযরত উমারের রা. খিলাফত কালের শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মুসলিম বাহিনীর পতাকা সমুন্নত রেখেছিলেন। ঐতিহাসিক ওয়াকিদীর মতে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। তবে ইবন সা’দ তাঁর ‘তাবাকাতে’ যুবাইর ইবন বাককারের সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কাদেসিয়ার যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। অধিকাংশ সীরাত লেখক এই বর্ণনাকে অধিকতর সহীহ মনে করেছেন।
চতুর্দশ হিজরী সনে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা. সিদ্ধান্ত নিলেন পারস্য বাহিনীর সাথে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধের। তিনি বিভিন্ন প্রদেশের ওয়ালীদের লিখলেনঃ
‘যার একখানা হাতিয়ার, একটি ঘোড়া বা উষ্ট্রী অথবা বুদ্ধিমত্তা আছে, এমন কাউকে বাদ দিবে না। তাদের প্রত্যেককে আমার নিকট জলদি পাঠিয়ে দেবে।’
মুসলিম জনগণ হযরত ফারুকে আজমের এ আহ্বানে ব্যাপকভাবে সাড়া দিল। চতুর্দিক থেকে মানুষ বন্যার স্রোতের ন্যায় মদীনার দিকে আসতে লাগলো। অন্ধ আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমও ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি মুজাহিদদের কাতারে শামিল হয়ে চলে এলেন মদীনায়। খলীফা উমার রা. এই বিশাল বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করলেন হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে রা.। যাত্রাকালে খলীফা তাঁকে নানা বিষয়ে উপদেশ দান করে বিদায় জানালেন।
মুসলিম বাহিনী যখন কাদেসিয়ায় পৌঁছলো, হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম বর্ম পরে যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সামনে এলেন এবং মুসলিম বাহিনীর আলাম বা পতাকা বহনের দায়িত্বটি তাঁকে দেয়ার আহ্বান জানালেন। বললেনঃ হয় এ পতাকা সমুন্নত রাখবো, নয় মৃত্যুবরণ করবো।
এই কাদেসিয়া প্রান্তরে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে যে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয় বিশ্বের সমর ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুব কমই আছে। অবশেষে চূড়ান্ত যুদ্ধের তৃতীয় দিনে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য ও সর্বাধিক গৌরবময় সিংহাসনের পতন ঘটে। আর সেইসাথে তাওহীদের পতাকা পত্ পত্ করে উড়তে থাকে এই সুবিশাল পৌত্তলিক ভূমিতে। অসংখ্য শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এ মহাবিজয় অর্জিত হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাকতুমও ছিলেন সেই অগনিত শহীদদের একজন। যুদ্ধশেষে দেখা গেল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তিনি মুসলমানদের পতাকাটি জড়িয়ে ধরে মাটিতে পড়ে আছে।
ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন অন্ধ। মসজিদে নববী থেকে তাঁর বাড়ীটিও ছিল একটু দূরে। পথে নালা নর্দমা ঝোপ জংগল পড়তো। সব সময়ের জন্য কোন সাহায্যকারীও তাঁর ছিলনা। এত অসুবিধা সত্ত্বেও নিয়মিত মসজিদে নববীতে এসে নামায আদায় করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেনঃ একদিন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি একজন অন্ধ, আমার বাড়ীটিও মসজিদ থেকে বেশ দূরে, আমাকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য একজন লোকও আছে তবে সে আমার মনঃপূত নয়। এমতাবস্থায় আপনি আমাকে ঘরে নামায পড়ার অনুমতি দেবেন কি? তিনি বললেনঃ ‘তুমি আযান শুনতে পাও?’ বললামঃ হ্যাঁ। বললেনঃ তোমার জন্য আমি কোন অনুমতির পথ দেখতে পাচ্ছিনা। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে। তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাড়ী ও মসজিদের মধ্যে খেজুর বাগান ও ঝোপ-জংগল রয়েছে। সব সময় পথ দেখানো লোকও আমি রাখতে পারিনে। এমতাবস্থায় আমি কি ঘরে নামায আদায় করতে পারি? তিনি বললেনঃ তুমি কি ইকামাতে শুনতে পাও? বললামঃ হ্যাঁ, রাসূল সা. বললেনঃ তা হলে তুমি মসজিদে এসেই নামায আদায় করো। (হায়াতুস সাহাবা, ৩য়, ১২১) আযান ও ইকামতের আওয়াজ তাঁর ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতো এ কারণে তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঘরে নামায আদায়ের অনুমতি পাননি। হযরত উমার রা. তাঁর খিলাফতকালে তাঁকে একজন রাহনুমা (পথ প্রদর্শক) দিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। হযরত আনাস ও যার বিন জাইশ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তাহজীবুল কামাল, ২৮৯)

তুফাইল ইবন ’আমর আদ-দাওসী (রা)
নাম তাঁর তুফাইল। ‘যুন-নূর’ উপাধি। ‘দাওস’ গোত্রের সন্তান হওয়ার কারণে দাওসী বলা হয়। কবীলা-দাওস ইয়ামনে বসবাসকালী একটি শক্তিশালী গোত্র। তিনি ছিলেন এ গোত্রের ‘রয়িস’ বা সরদার। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাঁর পেশা। এ কারণে মাঝে মধ্যে তাঁকে মক্কায় আসা-যাওয়া করতে হতো।
তুফাইল ছিলেন জাহিলী যুগের আরবের সম্ভ্রান্ত ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। তাঁর চুলো থেকে হাঁড়ি কখনো নামতো না। অতিথির জন্য তাঁর বাড়ীর দরজা থাকতো সর্বদা উন্মুক্ত।
তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সহজাত কাব্য প্রতিভা ও সূক্ষ্ণ অনুভূতির অধিকারী। ভাষার মধুরতা, তিক্ততা ও ভাষার ইন্দ্রজাল সম্পর্কে তিনি ছিলেন সুবিজ্ঞ।
একবার তুফাইল ইবন ’আমর ব্যবসা উপলক্ষে তাঁর গোত্রের আবাসস্থল তিহামা অঞ্চল থেকে মক্কায় উপস্থিত হলেন। মক্কায় তখন রাসূলুল্লাহ সা. ও কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। দু’টি দলই নিজ নিজ মতের সমর্থক সংগ্রহে তৎপর। একদিকে রাসূল সা. আহ্বানে জানাচ্ছেন মানুষকে তাঁর প্রভূর দিকে। অন্যদিকে কাফিররা সব ধরণের উপায়-উপকরণ প্রয়োগ করে মানুষকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বলা চলে, তিনি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেতভাবে এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেন। কারণ, তিনি তো এ উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেননি। ইতিপূর্বে মুহাম্মাদ ও কুরাইশদের এ দ্বন্দ্বের কথা তাঁর মনে একবারও উদয় হয়নি। এ সংঘাতের সাথে তাঁর জীবনের এক অভিনব কাহিনী জড়িত আছে। তিনি বলেন, ‘আমি মক্কায় প্রবেশ করলাম। কুরাইশ নেতৃবৃন্দ আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে সর্বোত্তম সম্ভাষণে আমাকে স্বগত জানালো। আমাকে তারা তাদের সর্বাধিক সম্মানিত বাড়ীতে আশ্রয় দিল। তারপর তাদের নেতৃবৃন্দ ও জ্ঞানী-গুণীরা আমার কাছে এসে বললোঃ ‘তুফাইল, আপনি এসেছেন আমাদের এ আবাসভূমিতে। এ লোকটি, যে নিজেকে একজন নবী বলে মনে করে, আমাদের সকল ব্যাপারে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে। আমাদের ভয় হচ্ছে, আপনিও তার কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে পড়েন এবং আপনার নেতৃত্বে আপনার গোত্রেও আমাদের মত একই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে না উঠে। সুতরাং আপনি এই লোকটির সাথে কোন রকম আলাপ-আলোচনা করবেন না, তার কোন কথায় কান দেবেন না। কারণ, তার কথা যাদুর মত কাজ করে। সে বিভেদ সৃস্টি করে দেয় পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।’
তুফাইল বলেন, ‘আল্লাহর কসম, তারা আমার কাছে রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে অভিনব কাহিনী ও তাঁর নানা রকম আশ্চর্য কার্যাবলী বর্ণনা করে আমাকে ও আমার গোত্রকে সতর্ক করে দিল। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তাঁর কাছে আমি ঘেঁষবোনা, তাঁর সাথে কথা বলবো না বা তাঁর কোন কথাও শুনবো না। সে সময় আমরা কা’বার তাওয়াফ করতাম এবং সেখানে রক্ষিত মূর্তিসমূহের পূজাও করতাম। যখন আমি কা’বার তাওয়াফ ও মূর্তি পূজার জন্য মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম, আমার দু’কানে ভালো করে তুলো ভরে নিলাম যাতে কোনভাবেই মুহাম্মাদের সা. কথা আমার কানে প্রবেশ করতে না পারে।
মাসজিদুল হারামে ঢুকেই আমি দেখতে পেলাম তিনি কা’বার পাশেই নামাযে দাঁড়িয়ে। তবে তাঁর সে নামায আমাদের নামাযের মত, তাঁর সে ইবাদাত আমাদের ইবাদাতের মত ছিল না। এ দৃশ্য আমাকে পুলকিত করলো, তঁঅর সে ইবাদাত আমাকে আন্দোলিত করলো। আমার ইচ্ছে হলো তাঁর নিকটে যাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এক পা দু’পা করে তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। আল্লাহর ইচ্ছে ছিল তাঁর কিছু কথা আমার কানে পৌঁছে দেয়া। তাই, কানে তুলো ভরা সত্ত্বেও তাঁর কিছু উত্তম বাণী আমি শুনতে পেলাম। মনে মনে বললামঃ ‘তুফাইল, তোর মা নিপাত যাক, তুই একজন বুদ্ধিমান কবি। ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা তোর আছে। এ লোকটির কথা শুনতে তোর বাধা কিসে? যদি সে ভালো কথা বলে, গ্রহণ করবি, আর মন্দ হলে প্রত্যাখ্যান করবি।’
তুফাইল বলেন, আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। নামায শেষ করে রাসূলুল্লাহ সা. বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলেন। আমিও তঁঅকে অনুসরণ করে তাঁর বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলাম। বললামঃ ইয়া মুহাম্মাদ, আপনার কাওমের লোকেরা আপনার সম্পর্কে এইসব কথা আমাকে বলেছে। তারা আমাকে আপনার সম্পর্কে এত ভয় দেখিয়েছে যে আপনার কোন কথা যাতে আমার কানে ঢুকতে না পারে সেজন্য আমি কানে তুলো ভরে নিয়েছি। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা আপনার কিছু কথা না শুনিয়ে ছাড়লেন না। যা শুনেছি, ভালোই মনে হয়েছে। আপনি আপনার ব্যাপারটি আমার কাছে একটু খুলে বলুন। তিনি তাঁর বক্তব্য সুষ্ঠুভাবে বলার পর সূরা ইখলাস ও সূরা আল-ফালাক তিলাওয়াত করে আমাকে শুনালেন। সত্যি কথা বলতে কি, এর থেকে সুন্দর কথা ও অনুপম বিষয় আর কখনো আমি শুনিনি। সেই মুহূর্তে আমার হাত তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিলাম এবং কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পাঠ করে ইসলামের ঘোষণা দিলাম।
ইসলাম গ্রহণের পর মক্কার কুরাইশরা তাঁকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে। তখন তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে সুন্দর একটি কবিতা রচনা করেন। কুরাইশদের নিন্দা, আল্লাহর একত্ব ও রাসূলুল্লাহর সা. প্রশংসা- এই ছিল সেই কবিতার বিষয়বস্তু। ইবন হাজার ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে গ্রন্থে তার কয়েকটি চরণ সংকলন করেছেন।
তুফাইল বলেন, তারপর আমি মক্কায় বেশ কিছুদিন অবস্থঅন করে ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা করলাম, সাধ্যানুযায়ী কুরআনের কিছূ অংশও হিফজ করলাম। আমি আমার গোত্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমার প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে আমার বৃদ্ধ পিতা দৌঁড়ে এলেন। আমি বললামঃ আব্বা, আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন। আমি আপনার কেউ নই বা আপনি আমার কেউ নন।
এ কথা শুনে তিনি বললেনঃ এ কথা কেন, বেটা? বললামঃ আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, মুহাম্মাদের সা. দ্বীনের অনুসারী হয়েছি। বললেনঃ বেটা, তোমার দ্বীনই আমার দ্বীন। বললামঃ যান, গোসল করে পবিত্র পোশাক পরে আমার কাছে আসুন। যা আমি শিখেছি, আপনাকে শেখাবো। তিনি চলে গেলেন। গোসল করে পবিত্র পোশাক পরে আমার কাছে ফিরে এলে আমি তাঁর কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলাম। তিনি সাথে সাথে ইসলাম কবুল করলেন। তারপর এলো আমার সহধর্মিনী। তাকেও আমি দূরে সরে যেতে বললাম। ‘আপনার প্রতি আমার মা-বাবা কুরবান হোক’- এ কথা বলে সে এর কারণ জানতে চায়। আমি বললামঃ ইসলাম তোমার ও আমার মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। আমি ইসলাম গ্রহণ করে দ্বীনে মুহাম্মাদীর অনুসারী হয়েছি। সে বললোঃ তাহলে আপনার দ্বীনই আমার দ্বীন। বললামঃ যুশশারা ঝর্ণার পানি দিয়ে গোসল করে পবিত্র হয়ে এসো। (‘যুশ-শারা’ দাওস গোত্রের দেবী-মূর্তি। তার পাশেই ছিল পাহাড় থেকে প্রবাহিত একটি ঝর্ণা) সে বললোঃ আমার মা-বাবা আপনার প্রতি কুরবান হোক, ধর্ম ত্যাগের ব্যাপারে আপনি কি যুশ-শারাকে একটুও ভয় পাচ্ছেন না? বললামঃ ‘যুশ-শারা ও তুমি নিপাত যাও। যাও, সেখানে গিয়ে মানুষের ভীড় থেকে একটু দূরে থেকে গোসল করে এসো। এই বধির প্রস্তর-মূর্তি তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, সে যিম্মাদারী আমি নিলাম। সে চলে গেল একটু পরে গোসল সেরে ফিরে এলো। আমি তার সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলাম। সে সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করলো। তারপর আমি দাওস গোত্রের সকল মানুষের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলাম। কিন্তু একমাত্র আবু হুরাইরা ছাড়া প্রত্যেকেই ইতস্ততঃ ভাব প্রকাশ করলো। দাওস গোত্রের মধ্যে একমাত্র তিনিই খুব তাড়াতাড়ি ইসলাম গ্রহণ করেন।
তুফাইল রা. বলেন, ‘অতঃপর আমি মক্কায় রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলাম। এবার আমার সংগে আবু হুরাইরা। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেঃ তুফাইল, তোমার পেছনের খবর কি? বললামঃ ‘তাদের অন্তরে মরচে পড়ে গেছে, তারা মারাত্মক কুফরীতে লিপ্ত। দাওস গোত্রের ওপর পাপাচার ও নাফরমানী ভর করে বসেছে।’
আমার এ কথা শোনার পর রাসূলুল্লাহ সা. উঠে দাঁড়ালেন তারপর অজু করে নামায আদায় করলেন এবং আকাশের দিকে হাত উঠালেন। আবু হুরাইরা বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহকে সা. এমনকি করতে দেখলাম, আমার ভয় হলো এই ভেবে যে, তিনি হয়তো আমার গোত্রের ওপর বদদুআ করবেন, আর তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। মনে মনে আমি বললামঃ আল্লাহ আমার কাওমকে হিফাজত করুন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে আমি রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনলামঃ ‘হে আল্লাহ, দাওস কবীলাকে তুমি হিদায়াত দান কর’, এভাবে তিনি তিনবার বললেন। তারপর তুফাইলের দিকে ফিরে বললেনঃ এবার তুমি তোমার কাওমের কাছে ফিরে যাও। তাদের সাথে কোমল আচরণ কর এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দাও।’
রাসুল সা. যখন দাওস গোত্রের জন্য হাত উঠিয়ে দুআ করছিলেন, তুফাইল বললেনঃ ‘আমি এমনটি চাইনে।’ এ কথা শুনে রাসূল সা. বললেনঃ তোদের মধ্যে তোমার মত আরো অনেক লোক আছে।’ কথিত আছে, জুনদুব ইবন ’আমর আদ-দাওসী জাহিলী যুগেই বলতেনঃ এ সৃষ্টি জগতের একজন স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, তবে তিনি কে, তা আমরা জানিনে। রাসূলুল্লাহর সা. আবির্ভাবের খবর শুনে তিনি ৭৫ জন লোকসহ মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
তুফাইল বলেন, আমি ফিরে এসে দাওস কবীলায় ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। এ দিকে রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করলেন। একে একে বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। তারপর আমি রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হলাম, আমার সংগে তখন দাওস কবীলার আশিটি পরিবার। তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমাদের দেখে রাসূল সা. ভীষণ খুশী হলেন এবং খাইবারের গণীমতের অংশও তিনি আমাদের দিলেন। আমরা বললাম, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, এখন থেকে যত যুদ্ধে আপনি অংশ নেবেন, দক্ষিণ ভাগের দায়িত্ব থাকবে আমাদের ওপর।’ তুফাইল বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সংগে থেকে গেলাম। অবশেষে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় মক্কা বিজয় হলো।
তুফাইল রা. তার গোত্রের উপাস্য যুল-কাফ্ফাইন মূর্তিটি ভস্মিভূত করে দেন। সাথে সাথে দাওস গোত্রের অবশিষ্ট শিরকও নিঃশেষ হয়ে যায়, তাদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে। এদিকে রাসূল সা. তায়িফ অভিযানে রওয়ানা হয়েছে। তুফাইল রা. তাঁর গোত্রের আরো চারশ’ সশস্ত্র লোককে সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তায়িফে মিলিত হন। তুফাইল ছিলেন তাঁর দলটির অধিনায়ক। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পতাকাবাহী হবে কে?’ তিনি বললেন, ‘নুমান ইবন রাবিয়া যেহেতু দীর্ঘকাল যাবত এ দায়িত্ব পালন করে আসছে, তাই এ ক্ষেত্রেও সে এ দায়িত্বটি পালন করবে।’ রাসূল সা. তাঁর এ যুক্তি পছন্দ করলেন।
এরপর থেকে রাসূলুল্লাহ সা. যতদিন জীবিত ছিলেন তুফাইল ইবন আমর তার সার্বক্ষণিক সংগী হিসেবে ছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের খিলাফাতকালে তিনি তাঁর জীবন, তরবারি ও সন্তান-সন্ততি সবই খলীফার আনুগত্যে উৎসর্গ করেন। রিদ্দার যুদ্ধের আগুন চারদিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে তিনি ভণ্ডনবী মুসাইলামা আল-কাজ্জাবের বিরুদ্ধে প্রেরিত একটি বাহিনীর অগ্রসৈনিক হিসেবে পুত্র আমরকে সংগে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তিনি যখন ইয়ামামার পথে, তখন একটি স্বপ্ন দেখলেন। সংগী-সাথীদের কাছে তিনি এর ব্যাখ্যা চাইলেন। সংগীরা জিজ্ঞেস করলে, ‘কি দেখেছো?’ তিনি বললেন, ‘দেখেছি, আমার মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে, একটি পাখী আমার মুখ থেকে বের হয়ে গেল, আমার স্ত্রী আমাকে তাঁর পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল, আমার পুত্র আমর আমাকে দ্রুত টেনে বের করতে চাইলো; কিন্তু তার ও আমার মধ্যে প্রাচীর খাড়া হয়ে গেল।’
তাঁরা মন্তব্য করলেন, ‘স্বপ্নটি ভালো।’ তুফাইল বলেন, ‘তবে আমি স্বপ্নের তাবীর করলাম এভাবেঃ ন্যাড়া মাথার অর্থ ঘাড় থেকে আমার মাথা বিচ্ছিন্ন হবে। মুখ থেকে পাখী বের হওয়ার অর্থ আমার রূহটি বের হয়ে যাবে। স্ত্রীর পেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার অর্থ মাটি খুড়ে কবর তৈরী করে আমাকে দাফন করা হবে। আমার প্রবল বাসনা, আমি যেন শহীদের মৃত্যু বরণ করতে পারি। আর আমার পুত্র ’আমর, সেও আমার মত শাহাদাত চাইবে; কিন্তু একটু দেরীতে সে তা লাভ করবে।’ তাঁর এ ব্যাখ্যা সত্যে পরিণত হয়েছি। হিজরী ১১ সনে ইয়ামামার যুদ্ধে এই মহান সাহাবী বীরত্বের সাথে লড়াই করেন এবং যুদ্ধের ময়দানেই শাহাদাত বরণ করেন। এ যুদ্ধে তাঁর একমাত্র পুত্র ’আমরের ডান হাতে কব্জিটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। এভাবে তিনি যুদ্ধের ময়দানে নিজের হাতটি ও পিতাকে হারিয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের রা. খিলাফাতকালে একবার ’আমর ইবন তুফাইল এলেন তাঁর কাছে। খরীফার জন্য খাবার উপস্থিত হলে তিনি তাঁর কাছে উপবিষ্ট সকলকে আহ্বান জানালেন খাবারের জন্য। সকলে সাড়া দিলেও ’আমর সাড়া দিলেন না। খলীফা তাঁকে বললেন, ‘তোমার কী হলো? সম্ভবতঃ হাতে জন্য লজ্জা পাচ্ছ?’ ’আমর বললেন, ‘হ্যা, তাই।’ খলীফা বললেন, ‘আল্লাহর কসম, তোমার ঐ কাটা হাতটি দিয়ে এ খাবার ঘেঁটে না দেওয়া পর্যন্ত আমি মুখে দেবনা। আল্লাহর কসম, একমাত্র তুমি ছাড়া মুসিলম উম্মাহর মধ্যে এমন আর কেউ নেই যার এক অংশ জান্নাতে। অর্থাৎ তোমার হাতটি।’ পিতার মৃত্যুর পর সব সময় তিনি শাহাদাতের স্বপ্ন দেখতেন। অবশেষে হিজরী ১৫ সনে রোমান বাহিনীর সাথে ইয়ারমুকের প্রান্তরে মুসলমানদের যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেখানে তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। এভাবে বাপ-বেটা দু’জনেই শাহাদাতের গৌরব অর্জন করেন।
মক্কায় রাসূলুল্লাহ সা. ও মুসলমানদের ওপর যখন যুলুম-অত্যাচারের মাত্রা চরমে পৌঁছে, তখন একদিন তুফাইল প্রস্তাব দিলেন রাসূলকে সা. তাঁদের গোত্রে হিজরাত করে তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. হিফাজতের পূর্ণ যিম্মাদারীর আশ্বাসও তাঁকে দান করেন। কিন্তু এ গৌরব আল্লাহ তায়ালা মদীনার আনসারদের ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তাই তিনি তুফাইলের আহ্বানে সাড়া দেননি।
ইসলাম গ্রহণের পর স্বীয় গোত্রে ইসলামী দাওয়াত ও তাবলীগে ব্যস্ত থাকায় রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্যে দীর্ঘদিন কাটাবার সুযোগ তিনি পাননি। তবে তাঁরই চেষ্টায় গোটা দাওস গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

সাঈদ ইবন ’আমের আল-জুমাহী (রা)
ঐতিহাসিকরা বলেছেনঃ সাঈদ ইবন ’আমের এমন ব্যক্তি যিনি দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত খরিদ করে নেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সা. অন্য সব কিছুর ওপর প্রাধান্য দান করেন।
তাঁর পিতার নাম ’আমের এবং মাতা আরওয়া বিনতু আবী মুয়ীত। খাইবার বিজয়ের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
মক্কার কুরাইশরা ধোঁকা দিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী খুবাইব ইবন আদীকে রা. বন্দী করে মক্কায় নিয়ে আসে এবং সমবেত জনমণ্ডলীর সামনে প্রকাশ্যে জীবিত অবস্থায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে তাঁকে শুলবিদ্ধ করে। এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য মক্কায় ঢেড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য দেখার জন্য মক্কার তানয়ীম এলাকা থেকে আগত লোকদের মধ্যে সাঈদ ইবন ’আমের আল-জুমাহীও ছিলেন।
তাঁর ধমনীতে তখন যৌবনের টগবগে রক্ত। মানুষের ভীড় ঠেলে তিনিও চলেছেন সামনের দিকে। এক সময় তিনি এসে দাঁড়ালেন প্রথম সারির কুরাইশ নেতৃবৃন্দ- আবু সুফিয়ান ইবন হারব, সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা প্রমুখের পাশাপাশি। কুরাইশদের বন্দীকে তিনি দেখলেন বেড়ী লাগানো অবস্থায়। নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বণিতা তাঁকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর আংগিনার দিকে। তঁঅর হত্যার মাধ্যমে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের বদলা নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। তাই তারা পৈশাচিক উল্লাসে মাতোয়ারা।
বন্দীকে সংগে নিয়ে অগনিত মানুষ বধ্যভূমিতে উপস্থিত হল। দীর্ঘদেহী যুবক সাঈদ ইবন ’আমের দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। নারী ও শিশুদের চীৎকার ও শোরগোলের মধ্যে তাঁর কানে ভেসে এল খুবাইবের দৃঢ় ও শান্ত কণ্ঠস্বর। বলছেঃ ‘আমাকে শূলীতে চড়াবার পূর্বে তোমরা যদি অনুমতি দাও, আমি দা’ রাকা’আত নামায আদায় করে নিতে পারি।’ তারা অনুমতি দিল।
সাঈদ ইবন ’আমের দেখলেন, তিনি কা’বার দিকে মুখ করে দু’ রাকা’আত নামায আদায় করলেন। সে নামায কতই না সুন্দর, কতই না চমৎকার! তারপর কুরাইশ নেতৃবৃন্দের দিকে ফিরে তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম! তোমরা যদি মনে না করতে, আমি মরণ-ভয়ে নামায দীর্ঘ করছি, তাহলে আমি নামায আরও দীর্ঘ করতাম।’
অতঃপর সাঈদ ইবন ’আমের স্বচক্ষে দেখলেন, তাঁর গোত্রের লোকেরা জীবিত অবস্থায় খুবাইবের দেহ থেকে একটার পর একটা অংগ কেটে ফেলছে। আর তাঁকে জিজ্ঞেস করছেঃ ‘তোমার স্থানে মুহাম্মাদকে আনা হোক, আর তুমি মুক্তি পেয়ে যাও, তা কি তুমি পছন্দ কর?’
তাঁর দেহ থেকে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে, আর তিনি বলছেনঃ
‘আল্লাহর কসম, আমি আমার পরিবার ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে নিরাপদে অবস্থান করি, আর বিনিময়ে মুহাম্মাদের সা. গায়ে একটি কাঁটার আঁচড় লাগুক তাও আমার মনঃপুত নয়।’ একথা শুনে চতুর্দিক থেকে লোকেরা হাত ওপরে উঠিয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলঃ ‘হত্যা কর, ওকে হত্যা করা।’
অতঃপর সাঈদ ইবন ’আমর দেখলেন, শূলীকাষ্ঠের ওপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলছেনঃ
‘আল্লাহুম্মা আহসিহিম আদাদা-ওয়াকতুলহুম বাদাদা ওয়ালা তুগাদির মিনহুম আহাদা-ইয়া আল্লাহ, তাদের সংখ্যা তুমি গুণে রাখ, তাদেরকে তুমি এক এক করে হত্যা কর এবং কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।’ এই ছিল তাঁর অন্তিম দু’আ। তারপর তরবারি ও বর্শার অসংখ্য আঘাতে তাঁর দেহ জর্জরিত করা হয়।
কিছুদিনের মধ্যে কুরাইশরা বড় বড় ঘটনাবলীতে লিপ্ত হয়ে খুবাইব ও তাঁর শূলীর কথা ভুলে গেল। কিন্তু যুবক সাঈদ ইবন ’আমের আল জুমাহীর অন্তর থেকে খুবাইবের স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য দূরীভূত হলনা। ঘুমালে স্বপ্নের মধ্যে, জেগে থাকলে কল্পনায় তিনি খুবাইবকে দেখতেন। তিনি যেন দেখতে পেতেন, খুবাইব শূলীকাষ্ঠের সামনে অত্যন্ত ধীর-স্থির ও প্রশান্তভাবে দু’রাকাআত নামায আদায় করছেন। কুরাইশদের ওপর অন্তিম বদ-দু’আর বিনীত সুরও যেন তিনি দু’কান দিয়ে শুনতে পেতেন। তাঁর ভয় হত এখনই হয়ত তাঁর ওপর বজ্রপাত হবে অথবা আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষিত হবে।
তাছাড়া খুবাইবের নিকট থেকে তিনি এমন কিছু শিক্ষালাভ করেন, এর পূর্বে যা তিনি জানতেন না। যেমনঃ বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের পথে আমরণ জিহাদই হচ্ছে প্রকৃত জীবন। মজবুত ঈমান অনেক অভিনব ও অলৌকিক বিষয় সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া একজন মানুষ যাঁকে তাঁর সংগীরা এত গভীরভাবে মুহাব্বাত করতে পারে, তিনি আল্লাহ প্রেরিত নবী ছাড়া আর কিছু নন।
সেই সময় থেকে আল্লাহ তা’আলা সাঈদ ইবন আমেরের অন্তরকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। একদিন তিনি জনমণ্ডলীর সামনে উঠে দাঁড়িয়ে কুরাইশদের দেব-দেবী ও মূর্তির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্নকরে ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। খাইবার যুদ্ধের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
সাঈদ ইবন আমের হিজরাত করে মদীনায় এলেন এবং সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর সা. সাহচর্য অবলম্বন করেন। তিনি খাইবারসহ পরবর্তী সব যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন।
রাসূলুল্লাহর সা. তিরোধানের পর তাঁর দা’খলীফা আবু বকর রা. ও উমারের রা. খিলাফতকালে সাঈদ ইবন ’আমের উন্মুক্ত তরবারি হাতে তাঁদের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেন। হযরত উমারের রা. খিলাফতকালে সেনাপতি আবু উবাইদা রা. ইয়ারমুক যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত সৈন্য সাহায্য তলব করেন। খলীফা মদীনা থেকে সাঈদের নেতৃত্বে এক বাহিনী পাঠিয়ে দেন। ইয়ারমুকে সাঈদ রা. উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাতকে ক্রয় ক’রে এবং আল্লাহর রিজামন্দীকে অন্তর ও দেহের সকল কামনা বাসনার ওপর প্রাধান্য দান ক’রে এবং আল্লাহর রিজামন্দীকে অন্তর ও দেহের সকল কামনা বাসনার ওপর প্রাধান্য দান ক’রে মুসলিমদের জন্য তিনি এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রাসূলুল্লাহর সা. প্রথম দু’খলিফা সাঈদ ইবন ’আমেরের সততা আল্লাহ-ভীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এ কারণে সব সময় তাঁরা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করতেন।
খলীফা হযরত ’উমারের রা. খিলাফতকালের প্রথম পর্ব তখন চলছে। একদিন সাঈদ ইবন আমের খলীফাকে বললেনঃ
‘‘ওহে উমার, আমি আপনাকে মানুষের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দান করছি। তবে আল্লাহর ব্যাপারে মানুষকে ভয় করবেন না। আপনার কথা আপনার কাজের পরিপন্থী যেন না হয়। কারণ, কর্মদ্বারা সত্যায়িত কথাই সর্বোৎকৃষ্ট কথা।
ওহে উমার, দূর ও নিকটেই যে মুসলিম উম্মার শাসক আল্লাহ আপনাকে বানিয়েছেন, তাদের ব্যাপারে সর্বদা আপনি সজাগ থাকবেন। আপনার নিজের ও পরিবার বর্গের জন্য যা আপনি পছন্দ করবেন তাদের জন্যও তা আপনি পছন্দ করবেন। আপনার নিজের ও পরিবার বর্গের জন্য যা অপছন্দ করবেন তাদের জন্যও তা অপছন্দ করবেন। সত্যে উপনীত হওযার জন্য সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করবেন। আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় আপনি করবেন না।’’
উমার জিজ্ঞেস করলেন,
‘সাঈদ, এ কাজ করতে সক্ষম কে?’
তিনি বললেনঃ ‘আপনার মত ব্যক্তি। আল্লাহ যাঁকে উম্মাতে মুহাম্মাদীর কর্তৃত্ব দান করেছেন এবং আল্লাহ ও আপনার মাঝে অন্য কোন প্রতিবন্ধক নেই।’
তখনই তিনি সাঈদের নিকট আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমার ওপর এ বিপদ চাপাবেন না, আমাকে এ দুনিয়ার দিকে টেনে আনবেন না।’
উমার রেগে গিয়ে বললেন,
‘আপনাদের ধ্বংস হোক! খিলাফতের এ দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে এখন আমার থেকে দূরে থাকতে চান? আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে ছাড়বো না।’ একথা বলে তিনি সাঈদকে হিমসের ওয়ালী নিযুক্ত করেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার ভাতা নির্ধারণ করে দেব কি?’ সাঈদ বললেন, ‘আমীরুল মু’মিনীন, আমি তা দিয়ে কি করব? বাইতুল মাল থেকে যে ভাতা আমি লাভ করে থাকি তাইতো আমার প্রয়োজনের তুলনায় বেশী হয়ে যায়।’ সাঈদ হিমসে চলে গেলেন।
কিছুদিন পর আমীরুল মু’মিনীন উমারের কতিপয় বিশ্বস্ত লোক হিমস থেকে মদীনা এল। উমার তাদেরকে বললেনঃ
‘তোমাদের গরীব মিসকিনদের একটা তালিকা তোমরা আমাকে দাও। আমি তাদের কিছু সাহায্য করব। তারা একটি তালিকা প্রস্তুত করে ’উমারকে দিল। তাতে অন্যান্যের সংগে সাঈদ ইবন আমেরর নামটিও ছিল। খলীফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ সাঈদ ইবন আমের কে?’ তারা বলল, ‘আমারের আমীর।’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের আমীরও কি এতো গরীব?’
তারা বললঃ ‘হ্যাঁ। আল্লাহর কসম। একাধারে কয়েকদিন যাবত তাঁর বাড়ীতে উনুনে হাড়ি চড়ে না।
একথা শুনে খলীফা ’উমার এত কাঁদলেন যে, চোখের পানিতে তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। তারপর এক হাজার দিনার একটি থলিতে ভরে বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম জানিয়ে বলবে; আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণের জন্য আমীরুল মু’মিনীন এ অর্থ পাঠিয়েছেন।’
দিনার ভর্তি থলি নিয়ে তারা সাঈদের নিকট উপস্থিত হল। থলির মুখ খুলেই তিনি দেখতে পেলেন তাতে দিনার। অমনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলতে বলতে থলিটি এমনভাবে দূরে সরিয়ে দিলেন যেন তাঁর ওপর বড় ধরণের কোন বিপদ আপতিত হয়েছে। তাঁর স্ত্রী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন।
‘সাঈদ, কি হয়েছে আপনার? আমীরুল মু’মিনীন কি ইন্তিকাল করেছেন?’
তিনি বললেন, ‘না। বরং তার থেকেও বড় কিছু।’
‘মুসলিমদের ওপর কি কোন বিপদ আপতিত হয়েছে?’
তিনি বললেন, ‘না। তাঁর থেকেও বড় কিছু।’
স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই বড় জিনিস কি?’
তিনি বললেন, ‘আমার পরকালের সর্বনাশের জন্য দুনিয়া আমার কাছে ঢুকে পড়েছে। আমার ঘরে বিপদ এসে পড়েছে।’
স্ত্রী বললেন, ‘বিপদ দূর করে দিন।’ তখনও তিনি দিনারের ব্যাপারটি জানতেন না।
সাঈদ বললেন, ‘এ ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করবে?’
স্ত্রী জবাব দিলেন, ‘নিশ্চয়ই।’
তারপর দিনারগুলি কয়েকটি থলিতে ভরে তিনি গরীব মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন।
কিছুদিন পর হযরত উমার ইবনুল খাত্তার রা. স্বচক্ষে সিরিয়ার অবস্থা দেখার জন্য হিমসে এলেন। সেকালে হিমসকে বলা হত ‘কুয়াইফা’। কারণ কুফাবাসীদের মত হিমসবাসীরাও তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে সব সময় অতিরিক্ত অভিযোগ উত্থাপন করতো। তাই বলা হত হিমসও যেন ছোট-খাট একটি কুফা। যাই হোক, খলীফার আগমনের পর হিমসবাসীর তাঁকে সালাম জানাতে এলে তিনি জি্জ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের আমীরকে কেমন পেলে?’
তারা আমীরের (সাঈদ) চারটি কাজের কথা উল্লেখ করে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করল। গুরুত্বের দিক দিয়ে সে চারটি কাজের প্রত্যেকটি সমান।
’উমার বলেন, ‘আমি হিমসবাসী ও তাদের আমীরকে একসাথে উপস্থিত হতে বললাম। আল্লাহর কাছে আমি দু’আ করলাম,তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা যেন হতাশাব্যঞ্জক না হয়। কারণ তাঁর প্রতি ছিল আমার দারুণ বিশ্বাস।’
হিমসবাসী ও তাদের আমীর আমার নিকট এলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোমাদের আমীরের বিরুদ্ধে তোমাদের অভিযোগ কি?’
তারা বলল, ‘বেশ খানিক বেলা না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাদেরকে দেখা দেন না।’
উমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাঈদ, এ অভিযোগ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?’
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘‘আল্লাহর কসম! বিষয়টি কারও কাছে প্রকাশ করা আমার পছন্দনীয় নয়। তবে না বললেই নয়, তাই বলছি। আমার পরিবারের জন্য কোন চাকর-বাকর নেই। সকালে বাড়ীর সব কাজই আমাকে নিজ হাতে করতে হয়। আটা মাখা ও রুটি তৈরীর কাজও আমি করে থাকি। তারপর হাত মুখ ধুয়ে মানুষকে সাক্ষাৎ দিই। তখন খানিকটা বেলা হয়ে যায়।’’
উমার জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমাদের আরও অভিযোগ আছে কি?’
তারা বলল,
‘তিনি রাতের বেলা কাউকে সাক্ষাৎ দান করেন না।
’উমার জিজ্ঞেস করলেন,
‘সাঈদ, এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি?’
তিনি বললেন,
‘আল্লাহর কসম! এ বিষয়টিও প্রকাশ করা আমার মনঃপূত নয়। তবুও বলছি, আমি দিন মানুষের জন্য ও রাত আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করেছি।’
’উমার জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমাদের আর কি অভিযোগ?’
তারা বলল,
‘মাসে একটে দিন তিনি কাকেও সাক্ষাৎ দান করেন না।’
উমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাঈদ বিষয়টি কি?’
তিনি বললেন, ‘‘আমীরুল মুমিনীন, আমার কোন খাদেম নেই। পরনের এ কাপড় ছাড়া অন্য কোন কাপড়ও আমার নেই। মাসে একবার আমি নিজ হাতে তা পরিষ্কার করি এবং শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করি। এজন্য দিনের প্রথম ভাগে লোকদের সাক্ষাৎ দিতে পারিনা। তবে শেষ ভাগে সাক্ষাৎ দিই।’
উমার আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগ আছে?’
তারা বলল,
‘মজলিসে মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।’
উমার জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপার কি সাঈদ?’
তিনি বললেন,
‘‘আমি মুশরিক অবস্থায় খুবাইব ইবন আদীকে শূলীতে চড়ানোর দৃশ্য দেখেছিলাম। আমি আরও দেখেছিলাম কুরাইশরা তাঁর অংগ-প্রত্যংগ এক এক করে কেটে ফেলছে। সে সময় কুরাইশরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘তোমার স্থানে মুহাম্মাদকে সা. আনা হোক তা কি তুমি পছন্দ কর?’
উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ ‘আল্লাহ কসম, আমি আমার পরিবার বর্গ ও সন্তান সন্ততির মাঝে নিরাপদে ফিরে যাই, আর এর বিনিময়ে মুহাম্মাদের সা. গায়ে কাঁটার একটি আঁচড়ও লাগুক তাও আমার মনঃপূত নয়। আল্লাহর কসম! যখনই আমার সে দিনটির স্মৃতি মনে পড়ে এবং কেন আমি সেদিন তাঁকে সাহায্য করিনি- এ অনুভূতি আমার মধ্যে জেগে ওঠে, তখন আমি চেতনা হারিয়ে ফেলি। আমার মনে হয়, আল্লাহ আমার এ অপরাধ ক্ষমা করবেন না।’
উমার তখন বললেন, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমার ধারণাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেননি। তারপর তিনি সাঈদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য এক লাখ দিনার পাঠালেন। তাঁর সহধর্মিনী দিনারগুলি দেখে বলে উঠলেনঃ
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে আপনার সেবা গ্রহণ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। যান, আমাদের জন্য খাদ্য-খাবার কিনে আনুন এবং একটি চাকর রাখুন।’
একথা শুনে তিনি স্ত্রীকে বললেনঃ
‘এর থেকে উত্তম কিছু লাভ কর তাকি তমি চাওনা? স্ত্রী বললেন, ‘সেই উত্তম বস্তু কী?’’
তিনি বললেন, ‘আমরা এ দিনারগুলি আল্লাহকে করজে হাসানা দিয়ে দিই। তিনি আমাদের উত্তম বিনিময় দান করবেন, আমরা তো সেই বিনিময়ের সর্বাধিক মুখাপেক্ষী।’
স্ত্রী বললেন, ‘হাঁ, তা দিন। আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।’
সেই মজলিসে বসে তিনি দিনারগুলি কয়েকটি থলিতে ভরলেন। তারপর পরিবারের প্রত্যেকে সদস্যের হাতে একটি করে থলি দিয়ে তিনি বললেনঃ অমুক বিধবা, অমুক ইয়াতিম, অমুক গোত্রের মিসকীন এবং অমুক গোত্রের অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বিলি করে এস।
নিজের প্রয়োজন সত্ত্বেও অন্যকে যাঁরা প্রাধান্য দেয়, সাঈদ সেই মহান ব্যক্তিদের একজন।
হিমসের ওয়ালী থাকা অবস্থায় খলীফা হযরত ’উমার রা. তাঁকে একবার মদীনায় ডেকে পাঠান। তিনি মদীনায় এলেন। হাতে তাঁর একটি লাঠি এবং খাওয়ার জন্য একটি মাত্র পিয়ালা। খলীফা জিজ্ঞেস কেরলেন, তোমার সাজ-সরঞ্জামত এতটুকুই? জবাব দিলেন এর চেয়ে বেশী জিনিসের প্রয়োজন কি জন্য? পিয়ালায় খাই এবং লাঠিতে সাজ-সরঞ্জাম ঝুলিয়ে নিই।
ইবন সা’দের মতে, হিমসের ওয়ালী থাকা অবস্থায় হিজরী ২০ সনে তিনি ইনতিকাল করেন। আবু উবাইদার মতে তাঁর মৃত্যু সব হিজরী ২১।

সুরাকা ইবন মালিক (রা)
কুরাইশদের মাঝে যখন এ কথাটি ছড়িয়ে পড়লো যে, মুহাম্মাদ সা. মক্কায় নেই তখন একদিকে যেমন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ খবরটি বিশ্বাসই করত পারছিলনা, অন্য দিকে মক্কায় একটি ভীতির ভাবও ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে তারা বনু হাশিমের প্রতিটি বাড়ীতে তল্লাশী শুরু করে দেয়। মুহাম্মাদের সা. ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের বাড়ী-ঘর তল্লশী করতে করতে তারা আবু বকরের বাড়ীতে উপস্থিত হয়। তাদের সাড়া পেয়ে আবু বকরের মেয়ে আসমা বেরিয়ে আসেন। কুরাইশ নেতা আবু জাহল তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার আব্বা কোথায়?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘তিনি এখন কোথায় তাতো আমি জানিনা।’
নরাধম আবু জাহল আসমার গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলে তাঁর কানের দুলটি ছিট্কে পড়ে এবং তিনিও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
কুরাইশদের যখন স্থির বিশ্বাস হলো যে, মুহাম্মাদ সা. সত্যি সত্যি মক্কা থেকে চলে গেছেন, তখন তাদের অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। তারা একদল পদচিহ্ন বিশারদকে পদচিহ্ন অনুসরণ করে তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য লাগিয়ে দেয়। পদচিহ্ন বিশারদরা ‘সাওর’ পর্বতের গুহার কাছে এসে কুরাইশদের বললেো আল্লাহর কসম, তোমাদের সাথী মুহাম্মাদ সা. এ গুহা ছেড়ে এখনও কোথাও যায়নি।’ আসলে তাদের এ অনুমান সঠিক ছিল। মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথী আবু বকর তখনও সেই গুহার মধ্যে। আর কুরাইশরা তাঁদের মাথার ওপরে। এমন কি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. গুহার ওপরের দিকে তাদের মাথার ওপর বিচরণকারী কুরাইশদের পা-ও দেখতে পাচ্ছিলেন। তাঁর চোখ দু’টি পানিতে ঝাপসা হয়ে গেল। ভালোবাসা, দরদ ও ভর্ৎসনা মিশ্রিত দৃষ্টিতে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর দিকে তাকালেন। ফিস ফিস করে আবু বকর বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, আমার নিজের জানের ভয়ে নয়, আপনার প্রতি তাদের কোন দুর্ব্যবহার আমাকে দেখতে হয়, এ ভয়ে আমি কাঁদছি”। তাঁকে আশ্বস্ত করে রাসূল সা. বললেন, ‘আবু বকর, দুশ্চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’
আল্লাহ তায়ালা আবু বকরের অন্তরে প্রশান্তি দান করলেন। তবে তিনি বার বার মাথার ওপর চলাচলরত কুরাইশদের পায়ের দিকে তাকাতে লাগলেন। এক সময় তিনি রাসূলকে সা. বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, তাদের কেউ তার দু’পায়ের পাতার দিতে তাকালেই আমাদের দেখে ফেলবে।’ জবাবে রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি কি মনে করেছো আমরা মাত্র দু’জন? তৃতীয় একজন, আল্লাহও আমাদের সাথে আছেন।’
সেই মুহূর্তে তাঁরা দু’জন কুরাইশদের এক যুবককে বলতে শুনলেন, ‘তোমরা সবাই গুহার দিকে এসো, আমরা একটু ভেতরটা দেখবো।’ উমাইয়্যা ইবন খালফ তাকে একটু বিদ্রুপ করে বললো, ‘গুহার মুখে এই মাকড়সা ও তার বাসা দেখতে পাওনা? এগুলি মুহাম্মাদের জন্মেরও আগে থেকে এখানে আছে।’ তবে আবু জাহল বললো, লাত ও উজ্জার শপথ, আমার মনে হচ্ছে তারা আমাদের ধারে কাছে কোথাও আছে। আমাদের কথা তারা শুনছে এবং আমাদের কার্যকলাপও তারা দেখছে। কিন্তু তার ইন্দ্রজালেও আমাদের দৃষ্টিশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না।’
যা হোক, কুরাইশরা মুহাম্মাদকে সা. খুঁজে বের করার ব্যাপারে একেবারে হাত গুটিয়ে নিলনা এবং তাঁর পিছু ধারওয়া করার সিদ্ধান্তেও তাদের কোন নড়চড় হলো না। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে বসবাসরত গোত্রগুলিতে তারা ঘোষণা করে দিল, কোন ব্যক্তি মুহাম্মাদকে জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় ধরে দিতে পারলে তাকে একশ’টি উন্নত জাতের উট পুরস্কার দেয়া হবে।
সুরাকা ইবন মালিক আল-মাদলাজী তখন মক্কার অনতিদূরে ‘কুদাইদ’ নামক স্থানে তার গোত্রের একটি আড্ডায় অবস্থান করছিল। এমন সময় কুরাইশদের একজন দূত সেখানে উপস্থিত হয়ে মুহাম্মাদকে সা. জীবিত বা মৃত অবস্থায় ধরে দেয়ার ব্যাপারে কুরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের কথা প্রচার করলো।
একশ’ উটের কথঅ শুনে সুরাকার মধ্যে লালসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। কিন্তু অন্যের মধ্যেও এ লালসা সঞ্চার হতে পারে এ ভয়ে সে কোন কথা না বলে নিজেকে সামলে নিল।
সুরাকা আড্ডা থেকে ওঠার আগেই সেখানে তার গোত্রের অন্য একটি লোক এসে বললো, ‘আল্লাহর শপথ, আমার পাশ দিয়ে এখনও তিন জন লোক চলে গেল, আমার ধারণা তারা মুহাম্মাদ, আবু বকর ও তাদের গাইডই হবে।’
সুরাকা বললো, ‘না, তা না। তারা হচ্ছে অমুক গোত্রের লোক। তাদের উট হারিয়ে গেছে তাই তারা তালাশ করছে।’ ‘তা হতে পারে’- এ কথা বলে লোকটি চুপ করে গেল।
আড্ডা থেকে সংগে সংগে উঠে গেলে অন্যদের মনে সন্দেহ হতে পারে, এ কারণে সে আরও কিছুক্ষণ সেখানে বসে থাকলো। আড্ডায় উপস্থিত লোকেরা অন্য প্রসঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হলে এক সুযোগে সে চুপে চুপে বেরিয়ে গেল। আড্ডা থেকে বেরিয়েই সে বাড়ীর দিকে গেলো। বাড়ীতে পৌঁছেই দাসীকে বললো, ‘তুমি চুপে চুপে মানুষে না দেখে এমনভাবে আমার ঘোড়াটি অমুক উপত্যকায় বেঁধে রাখবে।’ আর দাসকে বললেো ‘তুমি এ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়ীর পিছন দিক থেকে এমনভঅবে বেরিয়ে যাবে যেন কেউ না দেখে এবং ঘোড়ার আশে পাশে কোন একস্থানে রেখে দেবে।’
সুরাকা বর্ম পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো এবং মুহাম্মাদকে পাকড়াও করার জন্য দ্রুত ঘোড়া হাঁকালো, যাতে মুহাম্মাদকে সা. ধরে দিয়ে অন্য কেউ এ পুরস্কার ছিনিয়ে নিতে না পারে। সে ছিল তার গোত্রের দক্ষ ঘোড় সওয়ারদের অন্যতম। সে ছিল দীর্ঘদেহী, বিশাল বপুধারী, পদচিহ্ন বিশারদ ও বিপদে দারুণ ধৈর্যশীল। সর্বোপরি সে ছিল একজন বুদ্ধিমান কবি। তার ঘোড়াটি ছিল উন্নত জাতের।
সুরাকা সামনে এগিয়ে চললো। কিছুদূর যাওয়ার পর ঘোড়াটি হোঁচট খেলো এবং সে পিঠ থেকে দূরে ছিট্কে পড়লো। এটাকে সে অশুভ লক্ষণ মনে করে বলে উঠলো, ‘একি? ওরে ঘোড়া, তুই নিপাত যা।’ এই বলে সে আবার ঘোড়ার পিঠে উঠলো। কিছু দূর যেতে না যেতেই ঘোড়াটি আবার হোঁচট খেলো। এবার তার অশুভ লক্ষণের ধারণা আরও বেড়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলো; কিন্তু এক শ’ উটের লোভ তাকে এ চিন্তা থেকে বিরত রাখলো।
দ্বিতীয়বার ঘোড়াটি যেখানে হোঁচট খেয়েছিল সেখান থেকে সামান্য দূরে সে দেখতে পেল মুহাম্মাদ সা. তাঁর দু’সঙ্গীকে, সংগে সংগে সে তার হাত ধনুকের দিকে বাড়ালো; কিন্তু সে হাতটি যেন একেবারে অসাড় হয়ে গেল। সে দেখতে পেল তার ঘোড়ার পা যেন শুকনো মাটিতে দেবে যাচ্ছে এবং সামনে থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়া উঠে ঘোড়া ও তার চোখ আচ্ছন্ন করে ফেলছে। সে দ্রুত ঘোড়াটি হাঁকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘোড়াটি এমন স্থির হয়ে গেল, যেন তার পা লোহার পেরেক দিয়ে মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে।
অতঃপর সুরাকা রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের দিকে ফিরে অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘ওহে’ তোমরা তোমাদের প্রভুর দরবারে আমার ঘোড়ার পা মুক্ত হওয়ার জন্য দুআ করো। আমি তোমাদের কোন অকল্যাণ করবো না।’ রাসূল সা. দুআ করলেন। তার ঘোড়া মুক্ত হয়ে গেল। সংগে সংগে তার লালসাও আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সে তার ঘোড়াটি আবার রাসূলের সা. দিকে হাঁকালো। এবার পূর্বের চেয়েও মারাত্মকভাবে তার ঘোড়ার পা মাটিতে আটকে গেল। এবারও সে রাসূলের সা. সাহায্য কামনা করে বললেো ‘আমার এ খাদ্য সামগ্রী, আসবাবপত্র ও অস্ত্রশস্ত্র তোমরা নিয়ে নাও। আমি আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি, মুক্তি পেলে আমি আমার পেছনে ধাবমান লোকদের তোমাদের থেকে অন্য দিকে হটিয়ে দেব।’
তাঁরা বললেন, ‘তোমার খাদ্য সামগ্রী ও আসবাবপত্রের প্রয়োজন আমাদের নেই। তবে তুমি লোকদের আমাদের থেকে দূরে হটিয়ে দেবে।’ অতঃপর রাসূল সা. তার জন্য দুআ করলেন। তার ঘোড়াটি মুক্ত হয়ে গেল। সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাসূল সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে ডেকে বললো, ‘তোমরা একটু থাম, তোমাদের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই। আল্লাহর কসম, তোমাদের কোন অকল্যাণ আমি করবো না।’
রাসূল সা. ও আবু বকর উভয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের কাছে কী চাও?’ সে বললো, ‘আল্লাহ কসম, হে মুহাম্মাদ, আমি নিশ্চিতভাবে জানি শিগগিরই তোমার দ্বীন বিজয়ী হবে। আমার সাথে তুমি ওয়াদা কর, আমি যখন তোমার সাম্রাজ্যে যাব, তুমি আমাকে সম্মান দেবে। আর এ কথাটি একটু লিখে দাও।’
রাসূল সা. আবু বকরকে লিখতে বললেন। তিনি একখন্ড হাড়ের ওপর কথাগুলি লিখে তার হাতে দিলেন সুরাকা ফিরে যাবার উপক্রম করছে, এমন সময় রাসূল সা. তাকে বললেন, ‘সুরাকা, তুমি যখন কিসরার রাজকীয় পোশাক পরবে তখন কেমনে হবে?’
বিস্ময়ের সাথে সুরাকা বললো, ‘কিসরা ইবন হুরমুয?’ রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ, কিসরা ইবন হুরমুয।’
সুরাকা পেছন ফিরে চলে গেল। ফেরার পথে সে দেখতে পেল লোকেরা তখনও রাসূলকে সা. সন্ধান করে ফিরছে। সে তাদেরকে বললো, ‘তোমরা ফিরে যাও।’ আমি এ অঞ্চলে বহুদূর পর্যন্ত তাকে খুঁজেছি। আর তোমরা তো জান পদ-চিহ্ন অনুসরণের ক্ষেত্রে আমার যোগ্যতা কতখানি। তার এ কথায় লোকেরা ফিরে গেল।
মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়ের খবর সে সম্পূর্ণরূপে চেপে গেল। যখন তার স্থির বিশ্বাস হলো এত দিনে তাঁরা মদীনায় পৌছে কুরাইশদের শত্রুতা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেছেন, তখন সে তার ঘটনাটি প্রচার করলো। রাসূলুল্লাহর সা. সঙ্গে সুরাকার ভূমিকা ও আচরণের খবর যখন আবু জাহলের কানে গেল সে তার ভীরুতা ও সুযোগের সদ্ব্যবহার না করার জন্য ভীষণ তিরস্কার করলো। উত্তরে সে তার স্বরচিত দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলোঃ
‘আল্লাহর শপথ, তুমি যদি দেখতে আবু হিকাম,
আমার ঘোড়ার ব্যাপারটি, যখন তার পা ডুবে যাচ্ছিল, তুমি জানতে
এবং তোমার কোন সংশয় থাকতো না, মুহাম্মাদ প্রকৃত রাসূল-
সুতরাং কে তাঁকে প্রতিরোধ করে?’
ইবন হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে শ্লোক দু’টি উল্লেখ করেছেনর।
সময় দ্রুত বয়ে চললো। একদিন যে মুহাম্মাদ সা. মক্কা থেকে রাতের অন্ধকারে গোপনে সরে গিয়েছিলেন, আবার তিনি বিজয়ীর বেশে হাজার হাজার সশস্ত্র সঙ্গীসহ প্রবেশ করলেন সেই মক্কা নগরীতে। অত্যাচারী ও অহংকারী কুরাইশ নেতৃবৃন্দ, যাদের দৌরাত্মে সর্বদা প্রকম্পিত থাকতো মক্কা, ভীত-বিহ্বল চিত্তে হাজির হলো মুহাম্মাদের সা. নিকট করুণা ভিক্ষার জন্য।
মহানুভব নবী সা. তাদের বললেন, ‘যাও তোমরা সবাই মুক্ত স্বাধীন।’
সুরাকা ইবনমালিক চললো রাসূলুল্লাহর সা. কাছে তার ইসলামের ঘোষনা দানের জন্য। সে সঙ্গে নিল দশ বছর পূর্বে প্রদত্ত রাসূলুল্লাহর সা সেই অঙ্গীকার পত্রটি। পরবর্তীকালে সুরাকা বর্ণনা করেছেনঃ
‘আমি জি’রারা (মক্কার নিকটবর্তী একটি স্থান) থেকে রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আসলাম। আনসারদের একদল সৈনিকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে তারা আমাকে তীরের বাট দিয়ে পিটাতে শুরু করে এবং বলতে থাকে, ‘দূর হও, দূর হও, কি চাও?’ তবুও আমি তাদের সারির মধ্যে ঢুকে পড়লাম এবং রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গেলাম। তিনি তখন তার উটনীর ওপর সওয়ার। আমি সেই অঙ্গীকার পত্রটিসহ হাত উঁচু করে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি সুরাকা ইবন মালিক। আর এই হলো আপনার অঙ্গীকার পত্র।’
রাসূল সা. বললেন, ‘সুরাকা, আমার কাছে এসো, আজ প্রতিশ্রুতি পালন ও সদ্ব্যবহারের দিন।’
আমি রাসূলুল্লাহর সা. কাছাকছি গিয়ে তাঁর সামনে ইসলামের ঘোষনা দিলাম। এভাবে আমি তাঁর কল্যাণ ও বরকত লাভে ধন্য হলাম।’
রাসূলুল্লাহর সা. ওফাতে হযরত সুরাকা রা. ব্যথিত ও শোকাভিভূত হন। একশটি উটের লোভে যেদিন রাসূলুল্লাহকে সা. হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে দিনটির কথা ঘুরে ফিরে তাঁর স্মৃতিতে ভেসে উঠতে থাকে। এখন পৃথিবীর সকল উটও রাসূলুল্লাহর সা. একটি নখাগ্রেরও সমান নয়। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. সেই প্রশ্নটি বার বার আওড়াতেন, ‘সুরাকা, যেদিন তুমি কিসরার পোশাক পরবে, কেমন হবে?’ কিসরার পোশাক যে সত্যি তিনি পরবেন সে ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা।
সময় বয়ে চললো। ইসলামী খিলাফাতের দায়িত্ব হযরত উমার ফারুকের রা. হাতে ন্যস্ত হলো। তাঁর গৌরবমসয় যুগে মুসলিম সেনাবাহিনী ঝড়ের গতিতে পারস্য সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলো। তাঁর পারস্যের দুর্গসমূহ তছনছ করে দিয়ে তাদের বাহিনীকে পরাজিত করে পারস্য-সিংহাসন দখল করলো।
হযরত উমারের রা. খিলাফাতকালের শেষ দিকে পারস্য জয়ের সুসংবাদ নিয়ে সেনাপতি সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের দূত পৌঁছলেন মদীনায়। তিনি সংগে নিয়ে এলেন পারস্যের গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ। গনীমাতের ধন-দৌলত উমারের সামনে স্তূপীকৃত করা হলে তিনি বিস্ময়ের সাথে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মধ্যে ছিল কিসরার মণি-মুক্তা খচিত মুকুট, সোনার জরি দেয়া কাপড়, মুক্তার হার এবং তার এমন চমৎকার দু’টি জামা যা ইতিপূর্বে আর কখনও হযরত উমার দেখেননি। তাছাড়া আর ছিল বহু অমূল্য জিনিস। হযরত উমার হাতের লাঠিটি দিয়ে এই মূল্যবান ধন-রত্ন উল্টাতে লাগলেন। তারপর চারপাশে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যারা এসব জিনিস থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে জমা দিয়েছে, নিশ্চয় তারা অত্যন্ত বিশ্বাসভঅজন।
হযরত আলী রা., তিনি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন, বলেন, আমীরুল মু’মিনীন, আপনি বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি, আপনার প্রজারাও ভঙ্গ করেনি। আপনি যদি অন্যায়ভাবে খেতেন, তাহলে তারা খেত।
অতঃপর হযরত উমার রা. সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে নিজ হাতে তাঁকে কিসরার জামা, পাজামা, জুতো ও অন্যান্য পোশাক পরালেন। তাঁর কাঁধে ঝুলালেন কিসরার তরবারি, কোমরে বাঁধলেন বেল্ট, মাথায় রাখলেন মুকুট এবং তাঁর হাতে পরালেন বালা। কতই না চমৎকার!
হযরত উমার রা. সুরাকাকে পরাচ্ছেন কিসরার পোশাক, আর এ দিকে মুসলমানদের মুহূর্মুহু তাকবীর ধ্বনিতে মদীনার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে।
কিসরার পোশক পরা শেষ হলে সুরাকার দিকে ফিরে হযরত উমার রা. বললেন, ‘সাবাশ, সাবাশ, মুদলাজ গোত্রের ক্ষুদে এক বেদুঈনের মাথায় শোবা পাচ্ছে শাহানশাহ কিসরার মুকুট এবং হাত বালা।’ তারপর তিন আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহ, এ সম্পদ তুমি রাসূলুল্লাহকে সা. দাওনি, অথচ তিনি ছিলেন তোমার কাছে আমার থেকে অধিক প্রিয় সম্মানিত। তুমি দাওনি এ সম্পদ আবু বকরকেও। তিনিও ছিলেন তোমার নিকট আমার থেকেও অধিকতর প্রিয় মর্যাদাবান। আর তা দান করেছো আমাকে পরীক্ষার জন্য। আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’ অতঃপর তিনি সূরা মুমিনূনের নিম্নোক্ত আয়াত দু’টি পাঠ করলেন, ‘তারা কি মনে করে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি তা দ্বারা তাদের সকল প্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? না, তারা বুঝে না।’ (সূরা মু’মিনূনঃ ৫৫-৫৬)
সকল সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন না করা পর্যন্ত তিনি সে মজলিস ত্যাগ করলেন না।
হযরত সুরাকা ইবন মালিকের এ কাহিনী ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদও আল-বারা ইবন আযিব ও আবু বকর সিদ্দীকের সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
আবু আমর বলেন, সুরাকা ইবন মালিক খলীফা ’উসমানের খিলাফতকালে ২৪ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। কেউ কেউ বলেছেন, হযরত উসমানের পরে তিনি ইনতিকাল করেন।

ইকরিমা ইবন আবী জাহল (রা)
রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর সম্পর্কে বলেনঃ ‘শিগগিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে (আবু জাহল) গালি দেবেনা। কারণ মৃতকে গালি দিলে জীবিতদের মনোকষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছেনা।’
নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন ইকরিমার বয়সের তৃতীয় দশকটি শেষ হতে চলেছে। কুরাইশদের মধ্যে বংশের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন সর্বাধিক সম্মানিত ও ধনশালী। মক্কার সম্ভ্রান্ত গৃহের সন্তান সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস, মুস’য়াব ইবন উমাইর প্রমুখে রমত তাঁরও উচিত ছিল প্রথম স্তরেই ইসলাম গ্রহণ করা। কিন্তু তাঁর পিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
তাঁর পিতা আবু জাহল ছিল মক্কার সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাচারী, প্রথমযুগের মুশরিকদের নেতা ও কঠোর অত্যাচারী। আল্লাহতা’আলা তা অত্যাচার-উৎপীড়নের মাধ্যমে মু’মিনদের ঈমান পরীক্ষা করেছেন এবং সে পরীক্ষায় তাঁর সফলকাম হয়েছেন। তার ধোঁকার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্যতা যাচাই করেছেন এবং তাতে তাঁরা সফলকাম হয়েছেন। তার ধোঁকার মাধ্যমে বিশ্বাসীদের সত্যতা যাচাই করেছেন এবং তাতে তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।
পিতার নেতৃত্বে ইকরিমা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সা. শত্রুতায় আত্মনিয়োগ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত কঠোর। তঁঅর অত্যাচারে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছিল। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাঁর এ নিষ্ঠুরতা দেখে তঁঅর পিতা আবু জাহল পরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করতো।
তাঁর পিতা বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের নেতৃত্ব দেয়। সে লাত ও উজ্জার নামে শপথ করে যে, মুহাম্মাদের একটা হেনস্তা না করেমক্কায় ফিরবে না। বদরে ঘাঁটি গেড়ে দিন তিন অবস্থান করলো। উট জবেহ করলো, মদ পান করে মাতাল হলো এবং গালক-গায়িকাদের নিয়ে নাচ-গানে মত্ত হলো। আবু জাহল যখন এ যুদ্ধ পরিচালনা করছিল, ইকরিমা তখন তার ডান হাত-প্রধান সহযোগী। কিন্তু লাত ও উজ্জা এ যুদ্ধে আবু জাহলের ডাকে সাড়া দেয়নি, এ দু’টি উপাস্য মূর্তি তাকে কোন সাহায্য করতে পারেনি। পারা সম্ভবও ছিলো না।
বদরের ময়দানে আবু জাহল মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো। ইকরিমা নিজ চোখেই দেখলেন কিভাবে মুসলমানদের তীরের ফলা তাঁর পিতার রক্ত পান করছে এবং তিনি নিজ কানেই শুনতে পেলেন তাঁর পিতার মুখের অন্তিম চিৎকার ধ্বনিটি।
কুরাইশ নেতা আবু জাহলের মৃতদেহটি বদরে ফেলে রেখে ইকরিমা মক্কায় ফিরে এলেন। শোচনীয় পরাজয় তাঁকে পিতার লাশটি দাফনের সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। মুসলমানরা বদরে নিহত অন্যান্য মুশরিক সৈন্যদের সাথে তারও লাশটি ‘কালীব’ নামক কূপে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দেয়। এভাবেই এ অহঙ্কারী অত্যাচারী কুরাইশ নেতার দর্প চূর্ণ হয়।
এ দিন থেকেই ইসলামের সাথে ইকরিমার আচরণ নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ যাবত তিনি পিতার মান-মর্যাদা রক্ষার্থে ইসলামের সাথে দুশমনী করে এসেছেন। আর এখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন পিতার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের। বদরে অন্য যারা পিতৃহারা হয়েছিল, তিনি তাদের সাথে সম্মিলিতভাবে মুহাম্মাদের সা. বিরুদ্ধে মুশরিকদের অন্তরে শত্রুতার আগুন জ্বালিয়ে দিতে শুরু করলেন এবং তাদেরকে বদরে নিহতদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। এভাবেই উহুদের যুদ্ধটি সংগঠিত হয়।
ইকরিমা ইবন আবু জাহল উহুদের দিকে যাত্রা করলেন। সংগে তাঁর স্ত্রী উম্মু হাকীমও বদরে স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রহারা নারীদের সাথে চললেন। উদ্দেশ্য, তারা সেখানে যুদ্ধরত সৈনিকদের পশ্চাতে অবস্থঅন করে বাদ্য বাজাবে, কুরাইশদেরকে যুদ্ধে উৎসাহ দেবেন এবং পলায়ন উদ্যত সৈনিকদেরকে সাহস ও শক্তি যোগাবেন।
কুরাইশরা তাদের অশ্বারোহী সৈনিকদের ডান দিকে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও বাম দিকে ইকরিমা ইবন আবী জাহলকে নিয়োগ করলো। সেদিন তারা দু’জন সাহসিকতা ও রণকৌশলের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। তাঁরা মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সাথীদের হাত থেকে বিজয়ের গৌরব ছিনিয়ে এনে কুরাইশদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাই সেদিনকার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বলতে পেরেছিলেনঃ ‘এটা বদরের দিনের প্রতিশোধ।’
এরপর এলো খন্দকের যুদ্ধ। মুশরিক সৈন্যরা কয়েকদিন যাবত মদীনা অবরোধ করে রেখেছে। ইকরিমার ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে, তিনি তিক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠছেন। অবশেষে তিনি দেখতে পেলেন খন্দকের এক স্থানে সংকীর্ণ একটা পথ। তার মধ্য দিয়ে অতি কষ্টে তিনি তাঁর ঘোড়াটি ঢুকিয়ে দিলেন এবং খন্দক পার হয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে খন্দক পার হলো আরো কিছু মুশরিক সৈনিক। মুসলিম সৈনিকরা তাদেরকে তাড়া করে। ইকরিমা তাঁর অন্য সংগীদের সাথে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান, কিন্তু তাঁর একজন সংগী আমর ইবনু আবদে উদ্দ আল-আমিরী মুসলিম সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারায়।
মক্কা বিজয়ের দিন কুরাইশরা বুঝতে পেল মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথীদের বাধা দেওয়া কোনভাবেই সম্ভব হবে না। তারা মুসলমানদের পথ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মুহাম্মাদ সা. ঘোষনা করলেনঃ মক্কাবাসীদের যারা মুসলিম সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে, কেবল তাদের সাথেই যুদ্ধ করা হবে। তাছাড়া অন্য সকলকে ক্ষমা করা হবে।
ইকরিমা ইবনে আবী জাহল এবং আরো একদল সৈনিক কুরাইশদের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খাড়া করেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম সৈনিকদের ছোট্ট একটি দল তাদের এ প্রতিরোধ ব্যুহ তছনছ করে দেয়। তাঁর তাদের অনেককে হত্যা করে এবং অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এ পলায়নকারীদের মধ্যে ইকরিমা ইবন আবী জাহলও ছিলেন।
মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের পর ইকরিমা ইবন আবী জাহল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। তিনি এই প্রথম বারের মত তাঁর শক্তি মদমত্ততা থেকে সম্বিত ফিরে পেলেনে। তিনি বুঝতে পারলেন মক্কা আর তাঁর জন্যে নিরাপদ নয়। এদিকে রাসূল সা. মক্কাবাসীদের সকলের অতীত আচরণ ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে তাদেরকে এ ক্ষমার আওতা থেকে ব্যতিক্রম ঘোষণা করেন। কা’বার গিলাফের নীচে পাওয়া গেলেও তিনি তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দেন। হত্যার নির্দেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষস্থানে ইকরিমার নামটি। তিনি কোন উপায়ান্তর না দেখে গোপনে মক্কা থেকে বের হয়ে ইয়ামনের দিকে যাত্রা করেন।
এদিকে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম ও হিন্দা বিনতু উতবা গেলেন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে। তাদের সাথে গেলেন আরো অনেক মহিলা। উদেদ্শ্য তাঁদের, রাসূলুল্লাহর সা. হাতে বাইয়াত হওয়া। তাঁরা যখন রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছলেন, তখন তার কাছে বসা ছিলেন তাঁর দু’স্ত্রী, কন্যা ফাতিমা ও বনী আবদুল মুত্তালিবের আরো বহু মহিলা। মাথা ও মুখ ঢাকা অবস্থায় হিন্দা কথা বললেন রাসূলুল্লাহর সা. সাথে। হিন্দা ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমীর মুয়াবিয়ার মা। উহুদের যুদ্ধে হযরত হামযার রা. কলিজা চিবিয়েছিলেন ইনিই। তাই মক্কা বিজয়ের দিনে লজ্জা ও অনুশোচনায় মাথা ও মুখ ঢেকে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দরবারে উপস্থিত হন।
‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর মনোনীত দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন। আপনার ও আমার মাঝে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে সে সূত্রে আমি আপনার নিকট ভালো ব্যবহার আশা করি। এখন আমি একজন ঈমানদার ও বিশ্বাসী নারী’ এ কথা বলেই তিনি তাঁর অবগুণ্ঠন খুলে পরিচয় দেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি হিন্দা বিনতু উতবা’। রাসূল সা. বললেন, ‘খোশ আমদেদ।’ হিন্দা বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর কসম, হেয় ও অপমানিত করার জন্য আপনার বাড়ী থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয় বাড়ী ধরাপষ্ঠে এর আগে আর ছিলনা। আর এখন আপনার বাড়ী থেকে অধিক সম্মানিত বাড়ী আমার নিকট দ্বিতীয়টি নেই।’
রাসুল সা. বললেনঃ আরো অনেক বেশী।
এরপর ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়িয়ে ইসলাম গ্রহণের স্বীকৃতি দিলেন। তারপর বললেনঃ ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি ইকরিমাকে হত্যা করতে পারেন, এ ভয়ে সে ইয়ামনের দিকে পালিয়ে গেছে। আপনি তাকে নিরাপত্তা দিন আল্লাহ আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন। রাসুল সা. বললেন, ‘সে নিরাপদ’।
সেই মুহূর্তে উম্মু হাকীম তঁঅর স্বামী ইকরিমার সন্ধানে বের হলেন। সংগে নিলেন তাঁর এক রূমী ক্রীতদাস। তারা দু’জন রাস্তায় চলছেন। পথিমধ্যে দাসটির মনে তার মনিবের প্রতি অসৎ কামনা দেখা দিল। সে চাইলো তাঁকে ভোগ করতে, আর তিনি নানা রকম টালবাহানা করে সময় কাটাতে লাগলেন। এভাবে তারা একটি আরব গোত্রে পৌঁছলেন। সেখানে উম্মু হাকীম তাদের সাহায্য কামনা করলেন। তারা তাঁকে সাহায্যের আশ্বাস দিল। তিনি তাঁর দাসটিকে তাদের জিম্মায় রেখে একাকী পথে বের হলেন। অবশেষে তিনি তিহামা অঞ্চলে সমুদ্র উপকূলে ইকরিমার দেখা পেলেন। সেখানে তিনি এক মাঝির সাথে কথা বলছেন তাঁকে পার করে দেওয়ার জন্য, আর মাঝি তাকে বলছেনঃ
- ‘সত্যবাদী হও’
ইকরিমা তাকে বললেন,
- ‘কিভাবে আমি সত্যবাদী হবো?’
মাঝি বললেন,
- ‘তুমি বলো, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।’
- ‘আমি তো শুধু এ কারণেই পালিয়েছি।’ তাদের দু’জনের এ কথোপকথের মাঝখানেই উম্মু হাকীম উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁর স্বামীকে লক্ষ্য করে বললেনঃ
‘হে আমার চাচাতো ভাই, আমি সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম ব্যক্তির নিকট থেকে আসছি। আমি তাঁর কাছে তোমার জন্য আমার চেয়েছি। তিনি তোমার আমার মঞ্জুর করেছেন। সুতরাং এরপরও তুমি নিজেকে ধ্বংস করোনা।’
এ কথা শুনে ইকরিমা জিজ্ঞেস করলেনঃ
- ‘তুমি নিজেই তাঁর সাথে কথা বলেছো?’
তিনি বললেনঃ
- ‘হাঁ, আমিই তাঁর সাথে কথা বলেছি, এবং তিনি তোমাকে আমান দিয়েছেন’- এভাবে বার বার তিনি তাঁকে আমানের কথা শুনাতে লাগলেন ও তাঁকে আশ্বাস দিতে লাগলেন। অবশেষে আশ্বস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীর সাথে ফিরে চললেন।
পথে চলতে চলতে উম্মু হাকীম তাঁর দাসটির কাণ্ড-কারখানার কথা স্বামীকে খুলে বললেন। ফেরার পথে ইসলাম গ্রহণের পূর্বেই ইকরিমা দাসটিকে হত্যা করেন।
পথিমধ্যে তাঁরা এক বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেন। ইকরিমা চাইলেন একান্তে তাঁর স্ত্রীর সাথে মিলিত হতো। কিন্তু স্ত্রী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
- ‘আমি একজন মুসলিম নারী এবং আপনি এখনও একজন মুশরিক। স্ত্রীর কথা শুনে ইকরিমা অবাক হয়ে গেলেন।
তিনি বললেন,
- ‘তোমার ও আমার মিলনের মাঝখানে যে ব্যাপারটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা তো খুব বিরাট ব্যাপার!’
এভাবে ইকরিমা যখন মক্কায় নিকটবর্তী হলেন, তখন রাসূল সা. তাঁর সাহাবীদের বললেনঃ ‘খুব শিগ্গিরই ইকরিমা কুফর ত্যাগ করে মুমিন হিসেবে তোমাদের কাছে আসছে। তোমরা তার পিতাকে গালি দেবে না। কারণ মৃতকে গালি দিলে তা জীবিতদের মনে কষ্টের কারণ হয় এবং মৃতের কাছে তা পৌঁছে না।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইকরিমা তাঁর স্ত্রীসহ রাসূলুল্লাহর সা. কাছে উপস্থিত হলেন। রাসুল সা. তাঁকে দেখেই আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন এবং চাদর গায়ে না জড়িয়েই তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর রাসুল সা. বসলেন। ইকরিমা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেনঃ
- ‘ইয়া মুহাম্মাদ, উম্মু হাকীম আমাকে বলেছেন, আপনি আমাকে আমান দিয়েছেন।’
নবী সা. বললেন, ‘সে সত্যই বলেছে। তুমি নিরাপদ।’
ইকরিমা বললেন, ‘মুহাম্মাদ, আপনি কিসের দাওয়াত দিয়ে থাকেন?’
রাসূল সা. বললেন, ‘আমি তোমাকে দাওয়াত দিচ্ছি তুমি সাক্ষ্য দেবে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই এবং আমি আল্লাহর বান্দাহ ও তাঁর রাসুল। তারপর তুমি নামায কায়েম করবে, যাকাত দান করবে।’ এভাবে তিনি ইসলামের সবগুলি আরকান বর্ণনা করলেন।
ইকরিমা বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আপনি একমাত্র সত্যের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন এবং কল্যাণের নির্দেশ দিচ্ছেন।’ তারপর তিনি বলতে লাগলেনঃ
- ‘এ দাওয়াতের পূর্বেই আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী এবং সবচেয়ে সৎকর্মশীল।’ তারপর একথা বলতে বলতে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন এবং বলেন, ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্নাকা আবদুহূ ওয়া রাসূলুহু।’ একথার পর তিনি বলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি বলতে পারি, এমন কিছু ভাল কথা আমাকে শিখিয়ে দিন।’
রাসূল সা. বললেন, ‘তুমি বলো, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদান্ আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’
রাসূল সা. বললেন, ‘‘তুমি বলেো ‘উশহিদুল্লাহা ওয়া উশহিদু মান হাদারা আন্নি মুসলিমুন মুজাহিদুন মুহাজিরুন’- আল্লাহ ও উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে আমি বলছি, আমি একজন মুসলিম, মুজাহিদ ও মুহাজির।’’
ইকরিমা তা-ই বললেন। এ সময় রাসুল সা. তাঁকে বললেন, ‘অন্য কাউকে আমি দিচ্ছি, এমন কোন কিছু আজ যদি আমার কাছে চাও, আমি তোমাকে দেব।’
ইকরিমা বললেন, ‘আমি আপনার কাছে চাচ্ছি, যত শত্রুতা আমি আপনার সাথে করেছি, যত যুদ্ধে আমি আপনার মুখোমুখি হয়েছি এবং আপনার সামনে অথবা পশ্চাতে যত কথাই আমি আপনার বিরুদ্ধে বলেছি- সবকিছুর জন্য আপনি আল্লাহর কাছে আমার মাগফিরাত কামনা করুন।’ তক্ষুণি রাসূল সা. তাঁর জন্য দু’আ করলেনঃ ‘হে আল্লাহ, যত শত্রুতাই সে আমার সাথে করেছে, তোমার নূরকে নিভিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে যত পথই সে ভ্রমণ করেছে, সবকিছু্ই তাকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা অগোচরে আমার মানহানিকর যত কথাই সে বলেছে, তা-ও তুমি ক্ষমা করে দাও।’
আনন্দে ইকরিমার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃস্টির জন্য যতকিছু আমি ব্যয় করেছি তার দ্বিগুণ আমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবো এবং আল্লাহর রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি উদ্দেশ্যে যত যুদ্ধ আমি করেছি, আর দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর রাস্তায় করবো।’
এ দিন থেকেই তিনি দাওয়াতের মিছিলে প্রবেশ করলেন। তিনি হলেন যুদ্ধের ময়দানে দুঃসাহসী অশ্বারোহী, মসজিদে সর্বাদিক ইবাদতকারী, রাত্রি জাগরণকারী ও আল্লাহর কিতাব পাঠকারী। পবিত্র কুরআন মুখের ওপর রেখে তিনি বলতেনঃ ‘কিতাবু রাব্বি কালামু রাব্বি- আমার রবের কিতাব, আমার প্রভুর কালাম।’ একথা বলতেন, আর আকুল হয়ে কাঁদতেন।
রাসূলুল্লাহর সা. কাছে ইকরিমা যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানরা যত যুদ্ধই করেছে, তার প্রত্যেকটিকে তিনি অংশ নেন এবং যত অভিযানেই তারা বের হয়েছে তিনি থাকেন তার পুরোভাগে।
ইয়ারমুকের যুদ্ধে গ্রীষ্মের দুপুরে পিপাসিত ব্যক্তি যেমন ঠাণ্ডা পানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি তিনি শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধের কোন এক পর্যায়ে মুসলমানদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হলো, তিনি তখন ঘোড়া থেকে নেমে তরবারি কোষ-মুক্ত করেন এবং রোমান বাহিনীর অভ্যন্তরভাগে ঢুকে পড়েছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ তাঁর দিকে ছুটে যান এবং বলেন, ‘ইকরিমা এমনটি করোনা। তোমার হত্যা মুসলমানদের জন্য বিপজ্জনক হবে।’
জবাবে তিনি বললেনঃ
‘খালিদ আমাকে ছেড়ে দাও। রাসুলের সা. ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে তুমি আমার থেকে অগ্রগামী। আমার পিতা ও আমি ছিলাম রাসূলুল্লাহর সা সবচেয়ে বড় শত্রু আমাকে আমার অতীতের কাফফারা আদায় করতে দাও। অনেক যুদ্ধেই আমি রাসূলুল্লাহর সা. বিরুদ্ধে লড়েছি। আর আজ আমি রোমান বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে যাব? এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ একথা বলে তিনি মুসলমানদের কাছে আবেদন জানালেন, ‘মৃত্যুর ওপর বাইয়াত করতে চায় কে?’ তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিলেন তাঁর চাচা হারিস ইবন হিশাম, দিরার ইবনুল আযওয়ার ও আরো চার শ’ মুসলিম সৈনিক। তাঁরা খালিদ ইবন ওয়ালিদের তাঁবুর সম্মুখভাগ থেকেই তুমুল লড়াই চালিয়ে ইয়ারমুকের ময়দানে বিরাট বিজয় ও সম্মান বয়ে এনেছিলেন। এই ইয়ারমুকের ময়দানেই হারিস ইবন হিশাম, আয়য়াশ ইবন আবী রাবিয়া ও ইকরিমা ইবন আবী জাহলকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। পিপাসায় কাতর হারিস ইবনে হিশাম পানি চাইলেন। যখন তাঁকে পানি দেওয়া হলো, ইকরিমা তখন তাঁর দিকে তাকালেন। এ দেখে তিনি বললেন, ‘ইকরিমাকে দাও।’ পানির গ্লাসটি যখন ইকরিমার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আয়য়াশ তার দিকে তাকালেন। তা দেখে ইকরিমা বললেন, ‘আয়য়াশকে দাও।’ আয়য়াশের কাছে পানির গ্লাসটি নিয়ে যাওয়া হলে দেখা গেল, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তারপর গ্লাসটি হাতে নিয়ে একে একে তার অপর দুই সাথীর কাছে গিয়ে দেখা গেল তাঁরাও তারই পথের পথিক হয়েছেন। আল্লা তা’আলা তাঁদের সকলের প্রতি রাজী ও খুশী থাকুন। আমীন!

আসমা বিনতু আবী বকর (রা)
ঐতিহাসিকরা বলেন, ‘হযরত আসমা রা. একশ’ বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটি দাঁতও পড়েনি বা তাঁর সামান্য বুদ্ধিভ্রষ্টতাও দেখা যায়নি।’
এ মহিলা সাহাবী সর্বদিক দিয়েই সমমান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্নি, স্বামী ও পুত্র সকলেই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী। একজন মুসলমানের এর চাইতে বেশী সম্মান, মর্যাদা, ও গৌরবের বিষয় কি হতে পারে?
পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালের বন্ধু, ওফাতের পর তাঁর প্রথম খলীফা। মাতা কুতাইলা বিনতু আবদিল ’উয্যা। পিতামহ হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা বা আবু আতীক। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা রা. তাঁর বোন। রাসূলুল্লাহর সা. হাওয়ারী বিশেষ সাহায্যকারী যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. তাঁর স্বামী ও সত্য এবং ন্যায়ের পথে শহীদ হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর পুত্র। এ হলো হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। হিজরাতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথম যুগেই যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, আসমা রা. তাঁদেরই একজন। মাত্র সতেরো জন নারী পুরুষ ব্যতীত আর কেউ তাঁর আগে এ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। তাঁকে ‘জাতুন নিতাকাইন’- দু’টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হয়। কারণ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় তিনি রাসূল সা. ও তাঁর পিতার জন্য থলিতে পাথেয় ও মশকে পানি গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ বাঁধার জন্য ধারে কোন রশি খুঁজে পেলেন না। অবশেষে নিজের কোমরের নিতাক বা বন্ধনী খুলে দু’টুকরো করে একটা দ্বারা থলি ও অন্যটি দ্বারা মশকের মুখ বেঁধে দেন, এ দেখে রাসুল সা. তাঁর জন্য দু’আ করেনঃ আল্লাহ যেন এর বিনিময়ে জান্নাতে তাঁকে দু’টি ‘নিতাক’ দান করেন। এভাবে তিনি ‘জাতুন নিতাকাইন’ উপাধি লাভ করেন।
যুবাইর ইবনুল আওয়ামের সাথে যে সময় তার বিয়ে হয় তখন যুবাইর অত্যন্ত দরিদ্র ও রিক্তহস্ত। তাঁর কোন চাকর-বাকর ছিলনা এবং একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোন সম্পদও ছিলনা। তবে যুবাইর একজন পূর্ণবতী ও সৎকর্মশীলা স্ত্রী লাভ করেছিলেন। তিনি স্বামীর সেবা করতেন, নিজ হাতে তাঁর ঘোড়াটির জন্য ভুষি পিষতেন ও তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে প্রাচুর্য দান করেন এবং তাঁরা অন্যতম ধনী সাহাবী পরিবার হিসাবে পরিগণিত হন।
হযরত আসমা রা. বর্ণনা করেছেন। যুবাইর রা. যখন আমাকে বিয়ে করেন তখন একটি ঘোড়া ছাড়া তাঁর আর কিছু ছিলনা। ঘোড়াটি আমিই চরাতাম ও ভূষি খাওয়াতাম। খেজুরের আটি পিষে ভূষি বানাতাম। আমি যুবাইরের ক্ষেত থেকে- যে ক্ষেত রাসুল সা. তাঁকে দিয়েছিলেন মাথায় করে খেজুরের আটি নিয়ে আসতাম। ক্ষেতটি ছিল পৌনে এক ফারসাখ দূরে। একদিন আমি খেজুরের আটি মাথায় করে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দেখা। তাঁর সাথে তখন আরও কয়েকজন লোক ছিল। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং তাঁর বাহনের পিঠে উঠে বসার জন্য বললেন। কিন্তু আমি লজ্জা পেলাম এবং যুবাইর ও তার মান-মর্যাদার কথা মনে করলাম। রাসূল সা. চলে গেলেন। বাড়ী ফিরে আমি এ ঘটনার কথা যুবাইরকে বললাম। এরপর পিতা আবু বকর রা. আমার জন্য একটি চাকর দেন। সে-ই তখন ঘোড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে যেন আমাকে মুক্তি দিল। (সিয়ারু আ’লাম আন নুবালা- ২/২৯০-২৯১, তাবাকাত- ৮/২৫০, মুসনাদে আহমাদ- ৬/৩৪৭,৩৫২)
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় ঘনিয়ে এলো। তিনি তখন পূর্ণ অন্তঃসত্তা, আবদুল্লাহ তাঁর গর্ভে। তা সত্ত্বেও এ কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণে ভয় পেলেন না, আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়লেন। কুবা পৌঁছার পরই তিনি প্রসব করেন আবদুল্লাহকে। এ আবদুল্লাহ ছিলেন মদীনার মুহাজিরদের গৃহে, মদীনায় আসার পর জন্মগ্রহণকারী প্রথম সন্তান। এ কারণে মুসলমানরা তাঁর জন্মের খবর শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে। তাঁর মা আসমা সদ্য প্রসূত সন্তানটিকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর কোলে তুলে দেন। রাসুল সা. নিজের জিহ্বা থেকে কিছু থু থু নিয়ে শিশুটির মুখে দেন এবং তার জন্য দু’আ করেন। তাই পার্থিব কোন জিনিস তার পেটে প্রবেশ করার পূর্বে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র থু থু তার পেটে প্রবেশ করেছিল।
হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের মধ্যে সততা, দানশীলতা, মহত্ব ও প্রখর বুদ্ধি মত্তার মত এমন সব সুষম চারিত্রিক গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল যা ছিল বিরল। তাঁর দানশীলতা তো একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি আমার মা আসমা ও খালা আয়িশা থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তবে তাঁদের দু’জনের দান প্রকৃতির মধ্যে প্রভেদ ছিল। আমার খালার স্বভাব ছিল প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট পরিমাণে জমা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই গরীব মিসকীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মার স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।’
আসমা রা. ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী। তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন সংকটের সময়ে। ইবন হিশামের বর্ণনা থেকে জানান যায়, রাসূল সা. ও আবু বকরের হিজরাতের খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়লে পরদিন আবু জাহল ও আরো কতিপয় কুরাইশ নেতা আবু বকরের বাড়ীতে আসে এবং আসমাকে সামনে পেয়ে তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বাবা আবু বকর কোথায়?’ আসমা বলতে অস্বীকৃতি জানালে নরাধম আবু জাহল তাঁর গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ফলে তাঁর কানের দুল দু’টি ছিটকে পড়ে যায়।
হিজরাতের সময় রাসূল সা. ও আবু বকরের রা. সাওর পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে রাতের অন্ধকারে আসমা তাঁদের জন্য খাবার ও পানীয় নিয়ে যেতেন।
তাঁর পিতা আবু বকর রা. হিজরাতের সময় যাবতীয় নগদ অর্থ সাথে নিয়ে যান। দাদা আবু কুহাফা তা জানতে পেরে বলেন, ‘সে জান ও মাল উভয় ধরণের কষ্ট দিয়ে গেল।’ আসমা দাদাকে বললেন, ‘না, তিনি অনেক সম্পদ রেখে গেছেন।’ একথা বলে আবু বকর রা. যেখানে অর্থ-সম্পদ রাখতেন সেখানে অনেক পাথর রেখে দিলেন। তারপর আবু কুহাফাকে ডেকে এসে বললেনঃ ‘দেখুন, এসব রেখে গেছেন।’ আবু কুহাফা অন্ধ ছিলেন। তিনি আসমার কথায় বিশ্বাস করেন। আসমা বলেনঃ ‘আবু কুহাফাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি এমনটি করেছিলাম। আসলে সেখানে কিছুই ছিল না।’
আসমা বিনতু আবু বকরের ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। তবে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর সাথে জীবনের শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক বল ও ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দেন, ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হিজায, মিসর, ইরাক ও খুরাসানসহ সিরিয়ার বেশীর ভাগ অঞ্চলের লোকেরা আবদুল্লাহকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু উমাইয়া রাজবংশ তা মেনে নিতে পারেননি। তারা তাঁকে দমনের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে বিরাট এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠায়। দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, এবং তাতে আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পরিশেষে তাঁর সংগী সাথীরা বিজয়ের কোন সম্ভাবনা না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তের অনুসারীদের নিয়ে কা’বার হারাম শরীফে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে উমাইয়া সেনাবাহিনীর সাথে চূড়ান্ত সংঘর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি তার মা আসমার সাথে শেষবারের মত সাক্ষাত করতে যান। হযরত আসমা রা. তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। মাতা-পুত্রের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপঃ
- মা, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্ভ
- আবদুল্লাহ, ওয়া আলাইকাস সালাম। হাজ্জাজ-বাহিনীর মিনজানিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার বাহিনীর ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে, মক্কার বাড়ী-ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে, এমন চরম মুহূর্তে তোমার উপস্থিতি কি উদ্দেশ্যে?
- উদ্দেশ্য আমাদের সাথে পরামর্শ।
- পরামর্শ! কি বিষয়ে?
- হাজ্জাজের ভয়ে অথবা তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে লোকেরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এমনকি আমার সন্তান এবং আমার পরিবারের লোকেরাও আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন আমার সাথে অল্প কিছু লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহসিকতা যত বেশীই হোকনা কেন, দু’ এক ঘন্টার বেশী তারা কোন মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়ারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে খলীফা বলে স্বীকার করে নেই এবং অস্ত্র ফেলে দিয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হই তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইবো তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন। আসমা রা. একটু উচ্চস্বরে বলেনঃ
- ব্যাপারটি একান্তই তোমার নিজস্ব। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশী জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের ওপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকেই আহ্বান করছো, তাহলে তোমার পতাকাতলে যারা অটল থেকে শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের মত তুমিও অটল থাকো। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদেরকে ধ্বংস করেছো।
- তাহলে আজ আমি নিশ্চিতভাবে নিহত হবো।
- স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং বনী উমাইয়াদের ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়াই উত্তম।
- আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার হাত-পা কেটে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।
- নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জবেহ করা ছাগলের চামড়া তোলার সময় সে কষ্ট পায় না?
একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরো কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবলমাত্র এ কথাগুলি শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভীত হননি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি, তা কোন জাগতিক সুখ সম্পদ ও মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণে নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষনা করার প্রতি আমার ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবকিছুই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।’
- যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়ের ওপর নিহত হও তাহলে আমি ব্যথিত হবো।
- আম্মা, আপনি বিশ্বাস রাখুন, আপনার এ সন্তান কখনও অন্যায় অশ্লীল কাজ করেনি, আল্লাহর আইন লংঘন করেনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কোন মুসলমান বা জিম্মীর ওপর যুলুম করেনি এবং আল্লাহর রিজামন্দী অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কোন কিছু এ দুনিয়ায় তার কাছে নেই। এ কথা দ্বারা নিজেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমার সম্পর্কে আল্লাহই বেশী ভালো জানেন। আপনার অন্তরে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি হোক- কথাগুলি শুধু এ জন্যই বলছি। জবাবে আসমা রা. বললেনঃ
- আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী জা’আলাকা আলা মা ইউহিব্বু ওয়া উহিব্বু- সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর ও আমার পছন্দনীয় কাজের ওপর তোমাকে অটল রেখেছেন। বৎস! তুমি আমার কাছে একটু এগিয়ে এসো, আমি শেষবারের মত একটু তোমার শরীরের গন্ধ শুকি এবং তোমাকে একটু স্পর্শ করি। কারণ, এটাই আমার ও তোমার ইহজীবনের শেষ সাক্ষাৎ।
আবদুল্লাহ উপুড় হয়ে তাঁর মার হাত-পা চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে লাগলেন, আর মা তার ছেলের মাথা, মুখ ও কাঁধে নিজের নাক ও মুখ ঠেকিয়ে শুকতে ও চুমু দিতে লাগলেন এবং তাঁর শরীরে নিজের দু’টি হাতের পরশ বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি একথা বলতে বলতে তাঁকে ছেড়ে দিলেনঃ
- আবদুল্লাহ তুমি এ কী পরেছো?
- আম্মা, এ তো আমার বর্ম।
- বেটা, যারা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষী এটা তাদের পোশাক নয়।
- আপনাকে খুশী করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এ পোশাক পরেছি।
- তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহসিকতা ও আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এমনটিই। তাছাড়া এটা হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার পক্ষেও সহজতর। এ পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।
মায়ের কথামত আবদুল্লাহ তাঁর বর্ম খুলে পাজামা পরলেন এবং এ কথা বলতে বলতে হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন- ‘আম্মা, আমার জন্য দু’আ করতে ভুলবেন না।’
সাথে সাথে তাঁর মা হযরত আসমা রা. দু’টি হাত আকাশের দিকে তুলে দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ, রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন তার জেগে জেগে দীর্ঘ ইবাদত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, রোযা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, পিতামাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষন করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই কাছে সোপর্দ করেছি, তার জন্য আপনি যে ফায়সালা করবেন তাতেই আমি রাজী, এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।’
সেদিন সূর্য অস্ত যাবার আগেই হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর মহাপ্রভুর সাতে মিলিত হন। তাঁর শাহাদাতের কিছুদিনের মধ্যেই হিজরী ৭৩ সনে হযরত আসমাও রা. ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল এক শ’ বছর। মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা- ২/২৮৮)
হযরত আবদুল্লাহকে রা. হত্যার পর হাজ্জাজ তাঁর লাশকে শূলিতে লটকিয়ে রেখেছিল। তাঁর মা আসমা এলেন ছেলের লাশ দেখতে । লটকানো লাশের কাছে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, ‘এ সওয়ারীর এখনো ঘোড়া থেকে নামার সময় হলো না?’ জনতার ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে নেওয়ার জন্য হাজ্জাজ লোক পাঠায়। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানান। সে আবারো লোক মারফত বলে পাঠায়, এবার না এলে, তাঁর চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হবে। হযরত আসমা হাজ্জাজের ভয়ে ভীত হলেন না। তিনি গেলেন না। এবার হাজ্জাজ নিজেই এলো। তাদের দু’জনের মধ্যে নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো। হাজ্জাজ বললোঃ
- ‘বলুন তো আমি আল্লাহর দুশমন ইবন যুবায়েরের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি?’ আসমা বললেন, ‘তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো। আর সে তোমার পরকাল নষ্ট করেছে। আমি শুনেছি, তুমি নাকি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ তনয় বলে ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’। আমি একটি নিতাক দিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. ও আবু বকরের রা. খাবার বেঁধেছি। আরেকটি নিতাক আমার কোমরেই আছে। মনে রেখ, নবী করীমের সা. কাছ থেকে আমি শুনেছি, সাকীফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন যালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদীকে তো আগেই দেখেছি। (আল-মুখতার) আর যালিম তুমিই।’ হাজ্জাজ এ হাদীস শুনে নীরব হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিমঃ ২য় খণ্ড)।
হযরত আসমা থেকে ৫৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তেরোটি মুত্তাফাক আলাইহি এবং বুখারী পাঁচটি ও মুসলিম চারটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বহু বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ তাঁর দুই ছেলে- আবদুল্লাহ ও ’উরওয়া, পৌত্র আবদুল্লাহ ইবনে ’উরওয়া, প্রপৌত্র ’উব্বাদ ইবন আবদিল্লাহ, ইবন আব্বাস, আবু ওয়াকিদ আল-লাইসী, সাফিয়্যা বিনতু শায়বা, মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির, ওয়াহাব ইবন কায়সান, আবূ নাওফিল মুয়াবিলা ইবন আবী আকবার, আল-মুত্তালিব ইবন আবদুল্লাহ ইবন হানতাব, ফাতিমা বিনতুল মুনজির ইবনুয যুবাইর, ইবন আবী মুলাইকা, ’উব্বাদ ইবন হামযা ইবন আবদুল্লাহ এবং আরও অনেকে। (সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা ২/২৮৮)

মুসয়াব ইবন ’উমাইর (রা)
নাম মুসয়াব, কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ। ইসলাম গ্রহণের পর লকব হয় মুসয়াব আল-খায়ের। পিতা ’উমাইর এবং মাতা খুনাস বিনতু মালিক। পিতা-মাতার পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ বিলাসের মধ্যে তাঁকে প্রতিপালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যত রকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহর সা. সামনে কোনভাবে তাঁর প্রসংগ উঠলে বলতেনঃ ‘মক্কায় মুসয়াবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না।’ (তাবাকাত) ঐতিহাসিকরা বলেছেনঃ ‘তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।’
সৌন্দর্য্য, সুরুচি ও সৎ স্বভাবের সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা তাঁর অন্তরটি দারুণ স্বচ্ছ করে তৈরী করেছিলেন। তাওহীদের একটি মাত্র ঝলকেই তিনি শিরকের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠেন এবং হযরত রাসুলে পাকের দরবারে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সেই সময়ের কথা যখন রাসূল সা. হযরত আরকামের বাড়ীতে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চলেছিলেন এবং মুসলমানদের সামনের মক্কার মাটি সংকীর্ণ হয়ে উঠেছিলো।
মক্কার অলিতে-গলিতে, কুরাইশদের আড্ডায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলোচনা- মুহাম্মাদ আল আমীন ও তঁঅর নতুন দ্বীন আল ইসলাম। কুরাইশদের এই আদুরে দুলাল এসব আলোচনা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি হতেন কুরাইশদের সকল বৈঠক ও মজলিসের শোভা ও মধ্যমণি। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সবার কাম্য হতো তাঁর উপস্থিতি। তীক্ষ্ণ মেদা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য তাঁর হৃদয়ের সকল দ্বার, সকল অর্গল উন্মুক্ত করে দেয়।
তিনি শুনতে পেলেন, রাসূল সা. ও তাঁর প্রতি বিশ্বাসীরা কুরাইশদের সকল অর্থহীন কাজ ও তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে দূরে থেকে সেই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল আরকাম ইবন আবিল আরকামের বাড়ীতে সমবেত হন। সব দ্বিধা সব দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধ্যায় তিনি হাজির হলেন দারুল আরকামে। রাসুল সা. সেই দিনগুলিতে সেখানে তাঁর সাথীদের সংগে মিলিত হতেন, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন এবং তাদের সাথে নামায আদায় করতেন।
মুসয়াব ইবন উমাইর দারুল আরকামে বসতে না বসতেই কুরআনের আয়াত নাযিল হলো। রাসূলের সা. যবান থেকে সে আয়াত বের হয়ে তা যেন সকল শ্রোতার কর্ণকুহরে ও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। সেই বরকতময় সন্ধ্যায় ইবন ’উমাইরও হয়ে গেলেন এক বিশ্বাসী অন্তঃকরণের অধিকারী। খুশী ও আনন্দে তিনি হয়ে পড়েন আত্মহারা। রাসুল সা. তাঁর একটি পবিত্র হাত বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াবের বুকের ওপর। দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন মুসয়াব। মুহূর্তে তিনি তঁঅর বয়সের তুলনায় বহুগুণ বেশী হিকমত ও জ্ঞান লাভ করলেন এবং এমন দৃঢ়তা অর্জন করলেন যে হাজারো বিপদ মুসীবাত তাঁর আর কোনদিন বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।
মুসয়াবের মা খুনাস বিনতু মালিক ছিলেন এক প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। মুসয়াব তাকে যমের মত ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র তাঁর মা ছাড়া আর কারো ভয় পেতেন না। কুরাইশ ও তাদের দেব-দেবীসহ সকল শক্তি তাঁর কাছে তুচ্ছ মনের হলো। কিন্তু মায়ের ভয় তিনি দূর করতে পারলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চেপে যাওয়ার দারুল আরকামে যাতায়াত চলতে লাগলো। রাসূলুল্লাহর সা. মজলিসে বসতে লাগলেন। কিন্তু তার মা কিছুই জানতে পেলেন না।
একদিন গোপনে তিনি দারুল আরকামে প্রবেশ করছেন, উসমান ইবন তালহা তা দেখে ফেললো। আরেক দিন তিনি মুহাম্মাদের সা. মত নামায পড়ছেন, সেদিনও তা উসমানের চোখে পড়ে যায়। বাতাসের আগে খবরটি মক্কার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর মায়ের কানেও খবরটি পৌঁছে গেল।
মুসয়াবকে তাঁর মা, গোত্রের লেকাজন ও মক্কার নেতৃবৃন্দের সামনের কাঠগড়ায় তাঁর করানো হলো। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্তে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন কুরআনের সেই মহাবাণী যার ওপর তিনি ঈমান এনেছেন। মা তাঁর গালে থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিতে চাইলেন। বকাঝকা, মারপিট চললো। তারপর তাঁকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হলো।
তিনি বন্দী অবস্থায় কাটাতে লাগলেন। রাত্রিদিন চব্বিশ ঘন্টা তাঁকে পাহারা দেয়া হয়। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন, তাঁরই মত কিছু মুমিন মুসলমান হাবশায় হিজরাত করছেন। তিনি মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।
একদিন মুসলমানদের একটি দল রাসূলুল্লাহর সা. পাশে বসে আছেন। এমন সময় পাশ দিয়ে তারা মুসয়াবকে যেতে দেখলেন। তাঁকে দেখেই বৈঠকে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হলো। তাঁদের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। কারো কারো চোখে পানি এসে গেল। কারণ, মুসয়াবের গায়ে তখন শত তালি দেওয়া জীর্ণ শীর্ণ একটি চামড়ার টুকরো। তাতে মারাত্মক দারিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। তাঁদের সকলের মনে তখন তাঁর ইসলাম পূর্ব জীবনের ছবি ভেসে উঠলো। তখনকার পরিচ্ছদ হতো বাগিচার ফুলের মত কোমল চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধিময়। এ দৃশ্য দেখে একটু মুচকি হেসে রাসূল সা. বললেনঃ ‘মক্কায় আমি এ মুসয়াবকে দেখেছি। তার চেয়ে পিতামাতার বেশী আদরের আর কোন যুবক মক্কায় ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মুহাব্বতে সবকিছু সে ত্যাগ করেছে।’
কিছুদিন হাবশায় থাকার পর তিনি মক্কায় ফিরে এলেন। তারপর রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে আরেকটি দলকে সংগে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু মুসয়াব উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি মক্কায়, হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন, জীবন তাঁর নতুন-রূপ ধারণ করেছে। তাঁর একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ ব্যক্তি মুহাম্মাদ সা. এবং একমাত্র কাম্য মহাপ্রভু আল্লাহর সন্তুষ্টি।
তাঁর মা নতুন দ্বীন থেকে ফিরাতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে সবকিছু দেওয়া বন্ধ করে দিল। যে ব্যক্তি তাঁদের দেব-দেবীকে ছেড়ে দিয়েছে, তাদের গালাগাল করে, তা সে নিজের পেটের ছেলেই হোকনা কেন, তাকে সে কোন মতেই খেতে পরতে দিতে পারে না।
মুসয়াব হাবশা থেকে ফিরে আসার পর তার মা আবারো তাকে বন্দী করতে চাইলো। তিনি মায়ের মুখের ওপর কসম খেয়ে বললেনঃ যদি তুমি এমনটি কর এবং যারা তোমার এ কাজে সাহায্য করবে তোমাদের সবাইকে আমি হত্যা করবো। মা তার এই বেয়াড়া ছেলেকে জানতো। তাই কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় দিল, আর তিনিও মাকে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিলেন।
বিদায় মুহূর্তে মা যেমন কুফরীর ওপর ছেলেও তেমনি ঈমানের ওপর অটল। প্রাণ-প্রিয় ছেলেকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে বের করে দিতে দিতে মা বলছেঃ ‘তোমার যেখানে খুশী যাও। আমাকে আর মা বলে ডেক না।’ ছেলে একটু মায়ের দিকে এগিয়ে বললেনঃ ‘মা আমি আপনাকে ভালো কথা বলছি, আপনার প্রতি আমার দারুণ মমতা রয়েছে। আপনি একবার একটু বলুন, আশহাদু আন্-লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।’ মা উত্তেজিত হয়ে নক্ষত্ররাজির নামে কসম খেয়ে বললেনঃ ‘আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ কবো না। তোমার দ্বীন গ্রহণ করলে আমার মতামত ও বুদ্ধি বিবেক দুর্বল বলে মনে করা হবে।’ এভাবে কুরাইশদের সেই চরম আদুরে ও বিলাসী যুবক মুসয়াব বাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখন তিনি মোটা শতচ্ছিন্ন তালিযুক্ত পোশাক পরেন। একদিন খাবার জুটলে অন্যদিন অভূক্ত কাটান। কিন্তু বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত তাঁর অন্তরটি।
হজ্জের সময় মদীনা থেকে কতিপয় লোক মক্কায় এসে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে গোপনে আকাবায় সাক্ষাৎ করলো এবং তাঁর ওপর ঈমান এনে বাইয়াত করলো। তারা মদীনায় ফিরে গেল। তাদেরকে দ্বীনের তালীম দেওয়ার এবং অন্যদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, এবং মদীনাকে হিজরাতের জন্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে রাসূল সা. মুসয়াবকে দূত হিসাবে মদীনা পাঠালেন। এভাবে তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দূত।
মক্কায় তখন মুসয়াবের চেয়েও বয়সে ও মর্যাদায় বড় অনেক সাহাবী ছিলেন। তা সত্ত্বেও এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য রাসূল তাঁকেই নির্বাচন করেন। মুসয়াব তাঁর খোদাপ্রদত্ত বুদ্ধি, মেধা ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে এ কঠিন দাযিত্ব পালন করেন। কঠোর সাধনা, নিষ্ঠা ও মহত্বের সাহায্যে তিনি মদীনাবাসীদের হৃদয়ের সাথে সংলাপ করেন। ফলে দলে দলে তারা আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করে।
মুসয়াব মদীনায় এলেন। এর আগে মদীনার মাত্র বারো জন লোক আকাবায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি মদীনায় আসার পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বহু মানুষ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মদীনাবাসী মুসলমানদের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধিদল তাদের ধর্মীয় শিক্ষক ও নবীর দূত মুসয়াবের সাথে মক্কায় এলো এবং আকাবায় আবার রাসূলুল্লাহর সা. সাথে মিলিত হলো।
মুসয়াব তাঁর দায়িত্ব এবং সে দায়িত্বের সীমা সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তিনি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী এবং আল্লাহর এমন এক দ্বীনের সুসংবাদ দানকারী যা মানবসমাজকে হিদায়াত ও সরল সোজা পথের দিকে আহ্বান জানায়। তাঁর ওপর এ দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন দায়িত্ব নেই।
মুসয়াব মদীনায় পৌঁছে আসয়াদ ইবন যারারার অতিথি হলেন। তাঁরা দু’জন মদীনার বিভিন্ন গোত্রে, বিভিন্ন বাড়ীতে এবং সমাবেশে এক আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে লাগলেন। নানারক বাধারও সম্মুখীন হলেন। কিন্তু বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের সাথে সব বাধা তাঁরা অতিক্রম করলেন।
একদিন তিনি কিছু লোককে দাওয়াত দিচ্ছেন। হঠাৎ বনী আবদিল আশহালের নেতা উসাইদ ইবন হুদাইর সশস্ত্র অবস্থায় দারুণ উত্তেজিতভাবে উপস্থিত হল। তার ভীষণ রাগ সেই ব্যক্তিটির ওপর যে কিনা মুহাম্মাদরে দূত হিসাবে এখানে এসেছে এবং মানুষকে তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহিত করছে। সে তাদের উপাস্য দেব-দেবীকে গালাগালও করছে। উসাইদের এ রণমূর্তি দেখে মুসয়াবের পাশে বসা মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু না, মুসয়াব ভয় পেলেন না, সহাস্যে উসাইদকে স্বাগতম জানালেন। হাসতে হাসতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উসাইদ তখন তাঁকে ও আসয়াদ ইবন যারারাকে লক্ষ্য করে বলছেঃ তোমরা আমাদের গোত্রীয় এলাকায় এসে এভাবে আমাদের দুর্বল লোকদের লেকাদের বোকা বানাচ্ছো কেন? যদি তোমাদের মরার সখ না থাকে তাহলে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যাও।
হাসতে হাসতে মুসয়াব তাকে বললেনঃ আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন না? আমার কথা শুনুন। ভালো লাগে মানবেন, ভালো না লাগলে আমরা চলে যাব।
উসাইদ ছিল একজন বুদ্ধিমান লোক। মুসয়াবের কথা তার মনে লাগলো। এ তো বুদ্ধিমানের কথা। শুনতে আপত্তি কিসের! সে অস্ত্র ফেলে মাটিতে বসে কান লাগিয়ে মুসয়াবের কথা শুনতে লাগলো।
মুসয়াব পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে নবী মুহাম্মাদ সা. যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন তার ব্যাখ্যা করছেন, আর এদিকে উসাইদের মুখমণ্ডল একটু একটু করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। মুসয়াব তাঁর বক্তব্য এখনও শেষ করতে পারেননি, এর মধ্যে উসাইদ ও তাঁর সংগী লোকটি বলে বসলোঃ এ তো খুব চমৎকার ও সত্য কথা। তোমাদের দ্বীনে প্রবেশ করতে গেলে কি করতে হয়? মুসয়াব বললেনঃ শরীর ও পোশাক পবিত্র করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই সাক্ষ্য দিতে হয়।
উসাইদ উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এল তখন তার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আশহাদু আন্ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।’ এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, সাদ ইবন মুয়াজ ও সাদ ইবন উবাদা ছুটে এলেন মুসয়াবের নিকট। তাঁরা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এসব নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণের পর সাধারণ মদীনাবাসী বলাবলি করতে লাগলো, আমরা পেছনে পড়ে থাকবো কেন। চল যাই মুসয়াবের কাছে ইসলাম গ্রহণ করি।
এভাবে আল্লাহর রাসূলের প্রথম দূত এমনভাবে সফল হলেন যে, তার কোন তুলনা ইতিহাসে নেই। সময় দ্রুত গতিতে বয়ে চললো। রাসূলুল্লাহ সা ও তাঁর সংগী সাথীরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে এসেছেন। হিংসায় কুরাইশরা জ্বলতে লাগলো। মদীনা থেকেও তাদেরকে সমূলে উৎপাটিত করার ষড়যন্ত্র করলো। বদরে তারা এমন শিক্ষাই পেল যে, তাদের হিংসা প্রতিশোধস্পৃহায় রূপান্তরিত হলো। তারা আবার উহুদে মুসলমানদের মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে রাসূল সা. মুসলিম বাহিনীর মাঝখানে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। চিন্তা করছেন কার হাতে আজ ইসলামের ঝাণ্ডাটি দেওয়া যায়। গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মুসয়াবকে ডাকলেন তাঁরই হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে দিলেন।
তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কুরাইশ বাহিনী পরাজয়ের মুখোমুখি। এমন সময় মুসলিশ তীরন্দাজ বাহিনী রাসূলুল্লাহর সা নির্দেশে ভুলে গিয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে কুরাইশদের পিছু ধাওয়া করলো। কিন্তু তাদের এ কাজ মুসলিম বাহিনীর সুনিশ্চিত বিজয় নস্যাৎ করে দিয়ে পরাজয় বয়ে নিয়ে এলো। মুসলিম তীরন্দায বাহিনীর ছেড়ে যাওয়া গিরিপথ দিয়ে কুরাইশ বাহিনী অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বহিনীকে আক্রমণ করে বসলো। মুসলিম বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লো। এই সুযোগে কুরাইশ বাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে রাসূলুল্লাহকে সা. ঘিরে ফেললো।
মুসয়াব ইবন উমাইর বিপদের ভয়াবহতা উপলব্ধি করলেন। যতটুকু সম্ভব তিনি ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরলেন, গলা ফাটিয়ে নেকড়ের মত হুঙ্কার ছাড়তে এবং জোরে জোরে তাকবীর দিতে লাগলেন। আর সেইসাথে লম্ফ ঝম্ফ মেরে আস্ফালন দেখাতে লাগলেন। তাঁর উদ্দেশ্য হলো শত্রুদের দৃষ্টি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে ফিরিয়ে নিজের প্রতি নিবদ্ধ করা। এভাবে সেদিন তিনি নিজের একটি মাত্র সত্তাকে একটি বাহিনীতে পরিণত করেন। অত্যন্ত আমানতদারীর সাথে একহাতে ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরেন এবং অন্য হাতে প্রচণ্ড বেগে তরবারি চালাতে থাকেন। শত্রুবাহিনী তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাঁর দেহের ওপর দিয়ে তারা রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছার চেষ্টা করে। হযরত মুসয়াবের অন্তিম অবস্থা সম্পর্কে ইবন সাদ বর্ণনা করে, ‘‘উহুদের দিনে মুসয়াব ইবন উমাইর ঝাণ্ডা বহন করেন। মুসলমানরা যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে মুসয়াব তখন অটল হয়ে রুখে দাঁড়ান। অশ্বারোহী ইবন কামীয়া তাঁর দিকে এগিয়ে এসে তরবারির এক আঘাতে তাঁর ডান হাতটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসয়াব তখন বলে ওঠেনঃ ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল, কাদ খালাত মিন কাবলিহির রুসুল- মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে আরো বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।’ মুসয়াব বাম হাতে ঝাণ্ডাটি তুলে ধরেন। তরবারির অন্য একটি আঘাতে তাঁর বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। আবারো তিনি ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল’ এ কথাটি বলতে বলতে ঝান্ডর ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই বাহু দ্বারা সেটি তুলে ধরেন। তারপর তাঁর প্রতি বর্শা নিক্ষেপ করা হয়। পতাকাসহ তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হযরত মুসয়াব শাহাদাতে পূর্বে যে বাক্যটি বার বার উচ্চারণ করছিলেন তখনও কিন্তু সেটি কুরআনের আয়াত হিসেবে নাযিল হয়নি। উহুদের এ ঘটনার পরই ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল....’ এ আয়াতটি নিয়ে হযরত জিবরীল আ. উপস্থিত হন।’’
যুদ্ধ শেষে হযরত মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পাওয়া গেল। রক্ত ও ঘূলোবালিতে একাকার তাঁর চেহারা। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল সা. অঝোরে কেঁদে ফেললেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত বলেনঃ ‘আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে হিজরাত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের এ কাজের প্রতিদান মোটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তাঁদের একজন মুসয়াব ইবন উমাইর।
উহুদে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। তাঁকে কাফন দেওয়ার জন্য একপ্রস্থ চাদর ছাড়া আর কোন কাপড় পাওয়া গেল না। তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেষ রাসূল সা. আমাদের বললেনঃ চাদর দিয়ে মাথার দিক দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে দাও, বাকী পায়ের দিকে ‘ইযখীর’ ঘাস দাও। রাসূল সা. মুসয়াবের লাশের পাশে দিাঁড়িয়ে পাঠ কররেনঃ মিনাল মু’মিনীনা রিজানুল সাদাকু আহাদুল্লাহ আলাইহি..... মুমিনদের এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তারপর তাঁর কাফনের চাদরটির প্রতি তাকিয়ে বলেনঃ আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারো ছিল না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধুলি মলিন অবস্থায় পড়ে আছ। তিনি আরো বলেনঃ ‘আল্লাহর রাসুল সা. সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যদানকারী হবে।’ তারপর সংগীদের দিকে ফিরে তিনি বলেনঃ ‘ওহে জনমণ্ডলী, তোমরা তাদের যিআরত কর, তাদের কাছে এস, তাদের ওপর সালাম পেশ কর। যাঁর হাতে আমার জীবন সেই সত্তার শপথ, কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ তাঁদের ওপর সালাম পেশ করবে তারা সেই সালামের জওয়াব দেবে।’
হযরত মুসয়াবের ভাই আবু রাওম ইবন উমাইর, আমের ইবন রাবীয়া এবং সুয়াইত ইবন সাদ তাঁকে কবরে নামিয়ে দাফন কাজ সম্পন্ন করেন।
হযরত মুসয়াব ছিলেন প্রখর মেধাবী, উদার ও প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। যে দ্রুততার সাথে ইয়াসরিবে (মদীনা) ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল তাতেই তাঁর এসব গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর শাহাদাত পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিল, তিনি মুখস্থ করেছিলেন। মদীনায় সর্বপ্রথম তিনিই জুময়ার নামায কায়েম করেন। মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা যখন একটু বেড়ে গেল তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অনুমতি নিয়ে হযরত সাদ ইবন খুসাইমার রা. বাড়ীতে জুময়ার নামাযের সূচনা করেন। তিনিই ইমামতি করেন। নামাযের পর একটি ছাগল যবেহ করে মুসল্লীদের আপ্যায়ন করা হয়। (তাবাকাত)

........ প্রথম খণ্ড সমাপ্ত ........

গ্রন্থপঞ্জি
১. ইবন সা’দ- তাবাকাত,
২. ইবন হাজার আসকিলানী- আল ইসাবা,
৩. ইবন হিশাম- আস-সীরাহ,
৪. ইবন কাসীর- আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া,
৫. ইবন আবদিল বার- আল-ইসতিয়াব,
৬. আজ-জাহাবী- তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ,
৭. তাবারী- তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক,
৮. আজ-জাহাবী- তারীখুল ইসলাম
৯. ইবন ’আসাকির- তারীখু দিমাশ্ক আল-কাবীর,
১০. ইউসুফ কান্ধালুবী- হায়াতুস সাহাবা,
১১. খালিদ মুহাম্মদ খালিদ- রিজালুন হাওলার রাসূল,
১২. ড. আবদুর রহমান রাফত আল-বাশা- সুওয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা,
১৩. মুহাম্মদ আল-খিদরী বেক- তারীখুল উম্মাহ্ আল-ইসলামিয়্যা
১৪. মাওলানা মুঈনুদ্দীন নাদবী- মুহাজিরীন (উর্দু),
১৫. দায়িরাতুল মায়ারিফ আল-ইসলামিয়্যা,
১৬. হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থসমূহ।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি