নির্বাচনী ইশতেহার ১৯৭০
লেখকঃ পাঠাগার ডট কম কালেকশন
প্রকাশনীঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী
জামায়াতে ইসলামী শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় অথবা সংস্কারবাদী' প্রতিষ্ঠান নয়, বরং ব্যাপক অর্থে এ একটা আদর্শবাদী দল (Ideological party) এ জামায়াত গােটা মানব জীবনের জন্য ইসলামের ব্যাপক ও সর্বাত্মক জীবনাদর্শে বিশ্বাসী এবং একে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যতঃ জারী করতে ইচ্ছক। এ জামায়াতের দৃষ্টিতে দুনিয়ার সার্বিক অশান্তির প্রকৃত কারণ হচ্ছে আল্লাহ ও আখেরাত সম্পর্কে ঔদাসীন্য এবং রসূলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। দুনিয়ায় যখন, যেখানে এবং যে ক্ষেত্রেই বিকৃতি দেখা দিয়েছে, তার মূলে এ বুনিয়াদী কারণটিই ক্রিয়াশীল রয়েছে। কাজেই আল্লাহর আনুগত্য, আখেরাতে জবাবদিহীর অনভূতি এবং রসুলের নেতৃত্বকে জীবন ব্যবস্থার বুনিয়াদ রুপে গ্রহণ
করা পর্যন্ত দুনিয়ার কোনাে সংস্কারই সম্ভবপর নয়। এছাড়া কোনাে বস্তুবাদী আদর্শের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার কায়েমের যত চেষ্টাই করা হবে, তা এক নতুন জুলুমের রুপই পরিগ্রহ করবে।
এ জামায়াত কোনাে জাতীয়তাবাদী কিংবা স্বাদেশিকতাবাদী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এর জীবনাদর্শ বিশ্বজনীন, গােটা মানব জাতির কল্যাণই এর লক্ষ্য। কিন্তু এর দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, যতক্ষণ আমরা নিজেদের দেশকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অনুকরণীয় আদর্শ রুপে গড়ে না তুলবাে যতক্ষণ এই মহান সত্যকে নিজেদের জীবনে অনুসরণ করে এর প্রতি আমাদের ঈমানের দাবির বাস্তব প্রমাণ না দেবে এবং যতক্ষণ আমাদের নিজ দেশে একে অনুসরণ করার বাস্তব সফল দেখিয়ে দিতে না পারবাে, ততক্ষণ দুনিয়াকে এর সত্যতায় বিশ্বাসী করে তুলতে আমরা সমর্থ হবে না।
এ জামায়াতের দৃষ্টিতে পাকিস্তানে মুলতঃ আল্লাহ, আখেরাত ও নবুয়্যতে বিশ্বাসী লােকদের সংখ্যায় কোনাে কমতি নেই, বরং আসল কমতি এই যে, এখানকার অধিকাংশ জনগণ যে ঈমান ও আদশে আস্থাশীল, তা কার্যতঃ এখানে জারী করা হয়নি এবং দেশের গােটা জীবন ব্যবস্থা এর ওপর প্রতিষ্ঠিতও নয়। এ কারণেই আমাদের দেশ একটি ইসলামী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের নেয়ামত, বরকত ও সফলগুলাে থেকে নিজে যেমন উপকৃত হচ্ছেনা, তেমনি দুনিয়ার সামনেও ইসলামের সত্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারছে না। | জামায়াতে ইসলামী এই অভাব মােচন করার জন্যে সকল সম্ভাব্য উপায় অবলম্বন করছে। ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান-বিস্তার, প্রাচীন ও নবীন জাহেলিয়াতগুলোর সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূরীকরণ, অমাদের দৈনন্দিন সমস্যাবলীর, ইসলামী সমাধান সম্পর্কে চিন্তাশীল ও সমজদার লােকদেরকে অবহিত করা এবং জন-চরিত্র সংশােধনের প্রচেষ্টা চালানাে জামায়াতের স্থায়ী কর্মসূচীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর ভিত্তিতে জামায়াত গত ২৮ বছর ধরে কাজ করে আসছে। কিন্তু এর সাথে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংশােধনও মূলতঃ একটি অনিবার্য প্রয়ােজন। বিশেষ করে, বর্তমান যুগে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র রাষ্ট্রের আওতাধীনে আসায় এবং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে তার ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত হওয়ায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংশোধন ছাড়া যেমন লােকদের ব্যক্তিচরিত্র সংশােধন হতে পারে না, তেমনি সমাজ জীবনেও ন্যায়বিচার কায়েম করা সম্ভব নয়। একটি কলুষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই সংস্কার ও সংশােধনের পথে সব চাইতে বড় বাধা হয়ে থাকে এবং কলুষ
সৃষ্টিকারী সমস্ত লোক ও উপকরণের পৃষ্ঠপােষক হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই যারা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকামী, তারা অরাজনৈতিক পন্থায় আপন লক্ষ্যের জন্যে যতই চেষ্টা করুক না কেন, এরপ অবস্থায় তারা কিছুতেই সাফল্যলাভ করতে পারে না। পরন্তু যারা দেশকে পজিবাদ, কমনিজম (সমাজতন্ত্র) কিংবা অন্য কোনাে অনৈসলামী জীবন পদ্ধতির দিকে ঠেলে দেয়ার জন্যে দেশের সমস্ত উপায়-উপকরণ, আইন-কানুন ও গােটা প্রশাসন শক্তিকে ব্যবহার করছে, তাদের হাতে রাষ্ট্রের চাবিকাঠি নিবদ্ধ থাকা পর্যন্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করা সদ্য নয়।
এ কারণেই জামায়াতে ইসলামী শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ইচ্ছুক।
এর লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করাঃ
০ যা কোরআন ও সুন্নাহর পর্ণ অনুগত এবং খিলাফতে রাশেদার আদর্শের অনুসারী হকে যেখানে ইসলামের মূলনীতি ও বিধিব্যবস্থা পুরােপুরি ক্রিয়াশীল হবে।
০ যা অন্যায় ও দুস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করবে, নেকী ও সুকৃতিকে বিকাশ দান করবে এবং দুনিয়ায় আল্লাহর কালেমা সমুন্নত করবে।
o যা জলম, পীড়ন, শােষণ, বাসন ও নৈতিক উচ্ছংখলতার বিনাশ সাধন করবে, ইসলামী মূল্যবােধের ভিত্তিতে সমাজের পুনগঠন করবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার কায়েম করবে। | ০ যা একটি খাঁটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হবে, প্রতিটি নাগরিককে মৌলিক প্রয়ােজন (খাদ্য, পােষাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা) মিটানাের নিশ্চয়তা দেবে, হালাল জীবিকার দরজা খুলে দেবে, হারাম উপার্জনের বার বন্ধ করে দেবে, সমস্ত বৈধ উপায়ে দেশের সম্পদ বাড়বে এবং সে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের ব্যবস্থা করবে।
০ যা লােকদের চেচামেচির পূর্বেই তাদের প্রয়ােজন বুঝবে এবং ফরিয়াদ জানানাের পুর্বেই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
0 যা প্রকৃতই জনগণের শুভাকাংখী হবে এবং জনগণ হবে তার শুভাকাংখী এবং যেখানে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার পুরােপুরি নিরাপদ থাকবে।
০ যা প্রকৃত অর্থে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, যেখানে জনগণের স্বাধীন ইচ্ছানরপ ও পসন্দ অনুযায়ী লােকেরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারবে এবং জনগণ যাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইবে, তাদেরকে নির্বাচনের মাধ্যমে সহজেই ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে।
এই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যারা এই লক্ষ্যের সাথে একমত, তাদেরকে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের সাথে সহযােগিতা করতে আহন জানাই।