অর্থনৈতিক জীবন
অর্থ মানে টাকা-পয়সা। দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হলে যত জিনিসপত্র দরকার সবই যোগাড় করতে টাকা-পয়সা জরুরি। তাই সব জিনিসের দাম টাকা হিসাবেই ঠিক করতে হয়।

বাঁচতে হলে খেতে হবে। খেতে হলে খাবার জিনিস যোগাড় করতে হবে। খাবার জিনিস তৈরি না হলে যোগাড় করা যায় না। জিনিস তৈরী করাকে উৎপাদন বলে। ইংরেজিতে Production বলে। জিনিস উৎপন্ন হলে আদান-প্রদানের মাধ্যমে সব জরুরি জিনিস সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এটাকে বণ্টন (Distribution) বলে।

মানুষের যত রকম জিনিস দরকার, এর উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যাপারে যা কিছু করতে হয় এবং যেসব নিয়ম চালু করতে হয়, সেসবকেই অর্থনীতি বলা হয়। এ অর্থনীতি মানুষের জীবনের বিশাল এলাকা দখল করে আছে। মানুষ অর্থনীতির বিধি-বিধানের অধীন। তাই মানুষের অর্থনৈতিক জীবন ব্যাপক এবং কোনো মানুষ এর বাঁধন থেকে মুক্ত নয়। সব মানুষ অর্থনৈতিক অবস্থার শিকার।

দেশের সরকারই অর্থনৈতিক বিধি-বিধান তৈরী ও জারি করে। সরকার যদি দেশের সকল মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ করতে চায়, তাহলে এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যে ধরণের বিধি-বিধান বা নিয়ম-কানুন দরকার, তা-ই তৈরি ও জারি করবে। কিন্তু দেখা যায় যে, দেশের অল্প কিছু লোক সবচেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করে এবং বিলাসিতা করে বিরাট অংকের টাকা উড়িয়ে দেয়। আর বেশিরভাগ লোকই কোনো রকমে বেঁচে থাকে। কিন্তু এমন অনেক লোকও থাকে, যারা ভাত-কাপড়-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা ইত্যাদি অভাবে কষ্ট পায়। এ অবস্থার জন্য দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই দায়ী। যে নীতিতে সরকার দেশ শাসন করে এবং সে নীতি দেশে যে রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে, জনগণ সে রকম সুবিধা বা অসুবিধাই ভোগ করে।

আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
দেশে এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই চালু থাকা জরুরি যাতে-

১. দেশের মানুষ ইজ্জতের সাথে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়।

২. কোনো মানুষ যাতে মৌলিক মানবীয় প্রয়োজন (ভাত-কাপড়-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা) থেকে বঞ্চিত না থাকে।

৩. কোনো মানুষকে যাতে অন্য কোনো মানুষের অর্থনৈতিকভাবে গোলাম হতে বাধ্য হতে না হয়।

৪. দেশের ধন-সম্পদ যাতে অল্প কিছু লোকের মালিকানায় চলে না যায়।

৫. সবাই যাতে নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী আয়-রোজগার করার সুযোগ পায় এবং কোনো কারণে যারা আয় করার যোগ্য নয়, তারাও যেন অভাবে কষ্ট না পায়।

এ পাঁচটি অর্থনৈতিক মহৎ উদ্দেশ্য যে খুবই যুক্তিপূর্ণ, সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। সব দেশের সরকারই দাবি করে যে তারা এ উদ্দেশ্যেই অবিরাম চেষ্টা করছেন। তাহলে বাস্তবে এ ব্যবস্থা চালু নেই কেন? এ উদ্দেশ্য ক’টি যে মহৎ ও চমৎকার তা স্বীকার করা সত্ত্বেও বাস্তবে তা সফল হচ্ছে না কেন?

এসব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হচ্ছে কেন?
এ মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ার আসল কারণঃ

১. মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি এত সামান্য যে, সবদিক দিয়ে সঠিক ও নির্ভুল কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার সাধ্য মানুষের নেই। তাই ভুল থেকে বাঁচার জন্য নতুন ব্যবস্থা তৈরী করতে বাধ্য হয়। তবুও ভুলই হতে থাকে।

২. মানবজাতির অর্থনৈতিক জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েমের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা নবীর মাধ্যমে যেসব নীতিমালা দান করেছেন, তা মানুষ মেনে চলে না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে মানুষ আল্লাহর দেওয়া নীতি অমান্য করে। জাতীয় স্বার্থেও এক জাতি অন্য জাতির প্রতি যুলুম করে।

৩. স্বার্থে অন্ধ হয়ে মানুষ অর্থনৈতিক ময়দানেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে। আল্লাহ তাআলা যেসব পথকে হারাম করেছেন, মানুষের বিবেক তা সঠিক মনে করলেও অন্যায়ভাবে স্বার্থ হাসিলের জন্য হারাম পথেই চলে। সুদ, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণার হাজারো উপায় মানুষ বের করে নেয়। সবাই সবাইকে ঠকিয়ে ধনী হতে চায়। তাই সবাইকেই ঠকের শিকার হতে হয়। যে ঘুষ খায় তাকেও বহু জায়গায় ঘুষ ‍দিতে হয়।

৪. এর আসল কারণ একটাই। তা হলো, আল্লাহ বিধান না মানা। যা মেনে চললে সকল মানুষ সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারে, সে বিধানই আল্লাহ দান করেছেন। গোটা সৃষ্টিজগতে আল্লাহর বিধান মযবুতভাবে চালু আছে। মানবসমাজকে আল্লাহ তাঁর বিধান মেনে চলতে বাধ্য করেননি। তাই মানুষ মনগড়া ভুল বিধান মেনে চলেই অশান্তি ভোগ করছে।

প্রাণিজগতের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান
কুরআন মাজীদের ১২ নং পারার ১ম আয়াতে (সূরা হূদের ৬ নং আয়াতে) আল্লাহ বলেন, ‘‘দুনিয়ায় এমন জীব নেই, যার রিয্‌কের দায়িত্ব আল্লাহর উপর নেই।’’

‘রিয্‌ক’ শব্দটি কুরআনে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে এর মর্ম ব্যাপক। কোনো জীবের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যেসব জিনিসের দরকার, সেসবই ঐ জীবের রিয্‌ক। গাছেরও প্রাণ আছে। রিয্‌কের অভাবে গাছ মরে যায়। বেঁচে থাকার জন্য গাছের যা কিছু জরুরি তা সবই গাছের জন্য রিয্‌ক। তাহলে রিয্‌ক মানে জীবনের উপকরণ।

উপরের আয়াতে আল্লাহ দাবি করেছেন, দুনিয়ার সব জীব বা প্রাণীর রিয্‌কের বন্দোবস্ত করার পূর্ণ দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। মানুষ ছাড়া কোনো প্রাণীই রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায় না। অন্যান্য প্রাণী মরে, কিন্তু রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পেয়ে মরে না।

এ দাবি যে মহাসত্য, সে কথা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। বন-জঙ্গলে যত পশু-পাখি আছে, এর কোনো একটাকেও রিয্‌কের অভাবে শুকিয়ে যেতে দেখা যায় না। মানুষ যেসব জীব পোষে (যেমন-গরু, ছাগল ইত্যাদি) এর মধ্যে হাড্ডিসার অবস্থাও দেখা যায়; কিন্তু বনে কোনো পশুকে এমন অবস্থায় দেখা যায় না।

ছোট-বড় যেসব পাখি আমরা আশপাশে উড়তে দেখি, এর কোনোটাই ধরে প্রমাণ করা যাবে না যে, ওটা না খেয়ে শুকিয়ে গেছে। আমাদের ঘরের মুরগি শুকনা হতে পারে। কারণ, এর রিয্‌কের দায়িত্ব আমরা নিয়ে থাকি। এর দায়িত্ব আল্লাহর উপর নয়।

পশু-পাখিদের মধ্যে কোনো সরকার কায়েম নেই; কিন্তু তাদের উপর আল্লাহ রাজত্ব কায়েম আছে। তিনি তাদের সবার রিয্‌কের ব্যবস্থা করছেন। ছোট্ট কোনো কীট বা কোনো পিঁপড়াও রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায় না।

মানুষ রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায় কেন?
আল্লাহ দাবি করেছেন, তিনি সকল জীবের রিয্‌কের দায়িত্ব নিয়েছেন। মানুষ কি জীব নয়? তিনি তো ঘোষণা করেছেন, মানুষ তাঁর সেরা সৃষ্টি। তাহলে মানুষ সেরা জীব। অথচ দুনিয়ার লাখ লাখ মানুষ রিয্‌কের অভাবে মারা যাচ্ছে। আমাদের আশপাশেও দেখতে পাই, অনেক লোক রিয্‌কের অভাবে আধমরা হয়ে আছে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, আল্লাহ কি মানুষের বেলায় তাঁর দায়িত্ব পালন করেন না? আল্লাহ কি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে পারেন?

অথচ সূরা বাকারা’র ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে বলেছে, ‘‘তিনি ঐ সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য দুনিয়ার সব জিনিস পয়দা করেছেন।’’ আমরা খেয়াল করলে এ কথাটি যে খুবই সত্য, তা সহজেই বুঝতে পারি।

আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য আলো, বাতাস, আগুন, পানি, পশু-পাখি, গাছ-পালা সবই তৈরী করেছেন। মানুষকে অন্য কারো প্রয়োজনে পয়দা করেননি। ঐসব জিনিস না হলে মানুষ বাঁচবে না; কিন্তু মানুষ না থাকলে ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। মানুষ না থাকলে পশু-পাখির তো সুবিধা হওয়ারই কথা।

গরু-ছাগল মরলে শেয়াল-কুকুর-শকুন তা খায়। মানুষ মরলে তার দেহকে অন্য কোনো জীবকে খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। কারণ, মানুষকে অন্য কোনো সৃষ্টির জন্য পয়দা করা হয়নি; বরং সকল সৃষ্টিকেই মানুষের জন্য পয়দা করা হয়েছে।

এটা কত বড় আজব কথা যে, অন্য কোনো জীব রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায় না। অথচ যে মানুষের জন্য সব কিছু পয়দা করা হয়েছে, সে মানুষই অভাবে ভোগে। যে পশু-পাখিকে মানুষের জন্য পয়দা করা হয়েছে, ওরা অভাবে কষ্ট পায় না, অথচ যে মানুষের জন্য ওদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে মানুষই অভাবে কষ্ট পায়। এটা কেমন কথা?

এ প্রশ্নের সঠিক জবাব
মানুষের জন্য যত জিনিস দরকার তা পরিমাণমতো পয়দা করেন বলে আল্লাহ তাআলা বার বার কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেছেন। তাই দুনিয়ার মানুষের জন্য খাবার জিনিসের অভাব নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO- Food and Agricultural Organization) প্রায়ই ঘোষণা করে, বিশ্বে যত খাদ্য-শস্য উৎপন্ন হয়, যদি তা ঠিকভাবে বিলি-বণ্টন করা হয় তাহলে একজন মানুষেরও খাবারের অভাব হওয়ার কথা নয়। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, বণ্টনব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই মানুষ রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায়। এর আসল কারণ তালাশ করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা মানুষের রিয্‌কের জন্য জরুরি সকল জিনিস উৎপন্ন করার জন্য মানুষের মধ্যে প্রেরণা দিয়েছেন। নিজেদের স্বার্থেই মানুষ রাত-দিন হাজারো জিনিস উ’পন্ন করার চেষ্টা করতে থাকে। সবাই তাদের উন্নতি চায়। তাই উৎপাদনের নতুন নতুন উপায় মানুষ বের করে। আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিজগৎকে উৎপাদনের ব্যাপারে মানুষের খিদমতে লাগিয়ে দেন। তাই মানুষের প্রয়োজন পরিমাণেই সবকিছু উৎপন্ন হয়।

কিন্তু উৎপাদিত জিনিস ইনসাফের সাথে বিলি-বণ্টনের যে নিয়ম-নীতি আল্লাহ তাআলা নবীর মাধ্যমে পাঠিয়েছেন, সে অনুযায়ী বণ্টন হয় না বলেই মানুষ রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায়। আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য বিধি-বিধান দিয়েছেন, তা জারি করার দায়িত্ব মানুষের উপরই দিয়েছেন। এটাই খিলাফতের দায়িত্ব।

রাসূল সা. ও তাঁর চারজন খলীফা আল্লাহর দেওয়া নিয়ম আল্লাহ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষ থেকে পালন করতেন। কোনো মানুষ যাতে রিয্‌কের অভাবে কষ্ট না পায়, সে উদ্দেশ্যে তাঁরা চেষ্টা করতেন। ইসলামী রাষ্ট্রের এলাকা বেড়ে যখন অনেক দেশ তাঁদের শাসনের আওতায় আসে, তখন তাঁরা সকল সম্পদ ইনসাফের সাথে বণ্টন করতেন। যার ফলে হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযের শাসনামলে যাকাত নেওয়ার মতো কোনো অভাবী পাওয়া যায়নি।

এতে প্রমাণ হয় যে, আল্লাহর বিধান চালু করার যোগ্য ঈমানদার ও নিঃস্বার্থ লোকদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলে আল্লাহর খিলাফত কায়েম থাকে এবং মানুষ রিয্‌কের অভাবে ভুগতে বাধ্য হয় না।

আজকাল দুনিয়ায় কেমন লোকদের হাতে শাসনক্ষমতা রয়েছে, তা তাদের চরিত্র ও আচরণ থেকে সহজেই বোঝা যায়। শয়তাদের খলীফাদের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা থাকা অবস্থায় কিছুতেই আশা করা যায় না যে, আল্লাহর বিধানমতো মানুষ তাদের রিয্‌ক ঠিকমতো পেতে পারে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ যে রিয্‌কের অভাবে মারা যাচ্ছে, এর জন্য আল্লাহ দায়ী নন। আল্লাহর বিধান যারা অমান্য করেছে তারাই এর জন্য দায়ী।

একটা সহজ উদাহরণ
আমাদের দেশে অনেক যৌথ পরিবার আছে। ধরুন এক বাড়িতে চার ভাই এক পাকে (এক সাথে) খায়। সবাই বিয়ে করেছে এবং তাদের ছেলে-পেলেও আছে। তাদের বাপ-মা বেঁচে আছে বলে তারা বাপ-মায়ের সাথে এক বাড়িতেই থাকে। পিতার সম্পত্তি থেকেই পরিবার চলছে। চার ভাই যা রোজগার করে তাও পিতার হাতেই তুলে দেয়। এ পরিবারে তো অভাবই থাকার কথা নয়। পিতাই পরিবারের কর্তা। সংসারের জন্য যা কিছু কিনতে হয়, কোনোটারই অভাব হয় না।

পাকঘরের মূল কর্তৃত্ব চার ভাইয়ের মায়ের হাতে। মা রেওয়াজমতো চার বৌমার মধ্যে বড়-বৌকে পাকঘরের প্রধান দায়িত্ব দেন। সব বৌ-ই কাজ করে, কিন্তু পাক করা খাবার বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব বড় বৌ-ই পালন করে। পাক করার জন্য কী পরিমাণ চাল, ডাল, তরি-তরকারি, মাছ-গোশত দরকার, বড় বৌ তা শাশুড়ি থেকে চেয়ে নেয়। মা হিসাবমতো সব জিনিস বড় বৌ-এর হাতে তুলে দেন।

কিন্তু বড় বৌ খাবার বিলি করার সময় নিজের স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের মাছের বড় বড় টুকরো, এতো বেশি পরিমাণ ভাত, তরকারি ও ডাল দিয়ে দেয় যে, তারা সব খেয়ে শেষ করতে পারে না। বাকিটা ঝুটা হিসেবে বিড়াল-কুকুরকে দিয়ে দেয়। শাশুড়ি তো সবার জন্য পরিমাণমতো জিনিস দিয়েছেন; ফেলার জন্য তো দেননি। ফলে অন্য ভাই, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য যে খাবার থাকে, তাতে তাদের পেট ভরে না।

এই যে পরিবারের অল্প কিছু লোক বেশি খেল এবং কিছু ফেলেও দিল, আর বাকি সবাই যে কম পেল-এর জন্য শাশুড়ি মোটেই দায়ী নয়। একমাত্র বড় বৌ-ই দায়ী।

দুনিয়ার সব মানুষ একই পরিবার
সকল আদমসন্তান আল্লাহর পরিবার। সারা দুনিয়া আল্লাহর সংসার। তিনি সকল দেশের মালিক। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের জন্য আলাদা আলাদা আল্লাহ নেই। সারা দুনিয়ায় যত খাদ্য উৎপন্ন হয়, তা সকল মানুষের প্রায়োজন-পরিমাণই। তবু কেন অভাব?

কোনো দেশের জন্য জরুরি সব জিনিস ঐ দেশেই উৎপন্ন হয় না। আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বিশাল এলাকায় এক বছরে যে পরিমাণ গম উৎপন্ন হয়, তা তারা তিন বছরেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না। মরুভূমির সব দেশের মানুষের জন্য যে পরিমাণ খাদ্য দরকার, এর সামান্যও সেখানে উৎপন্ন হয় না। তবে মরুভূমির দেশের বালির নিচে এত পেট্রোল রাখা হয়েছে, যা না হলে ইউরোপ ও আমেরিকা অচল হতে বাধ্য।

বাংলাদেশে যত মানুষ আছে, উৎপন্ন খাদ্যের পরিমাণ সে তুলনায় কম। আবার বাংলাদেশে যে উন্নতমানের পাট উৎপন্ন হয়, তা ইউরোপ-আমেরিকায় হয় না; কিন্তু তাদেরও পাটের দরকার আছে।

এভাবেই আল্লাহ মানুষের সকল প্রয়োজনীয় জিনিস দুনিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছেন। কোনো এক দেশে সব জিনিস উৎপন্ন হয় না। আল্লাহ চান যে, আদম সন্তানরা এক দেশের জিনিস অন্যান্য দেশের উৎপন্ন জিনিসের সাথে বিনিময় করুক এবং এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক।

সূরা আল হুজুরাতের ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন কাওম ও গোত্র বানিয়ে দিয়েছি; যাতে তোমরা একে অপরকে (ঐসব নামে) চিনতে পারো।’’

একটা গ্রামে খাঁ বংশ, সরকার বংশ, ব্যাপারি পাড়া ইত্যাদি কেবল পরিচয়ের জন্য বলা হয়; কাউকে ছোট বা কাউকে বড় মনে করে এভাবে বলা হয় না। বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলা আছে। এ সবই শুধু পরিচয়ের জন্য। কোনো জেলার নাম মন্দ মনে করে উল্লেখ করা হয় না; পরিচয়ের জন্যই উল্লেখ করা হয়। তেমনিভাবে বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, আমেরিকা ইত্যাদি নামে চিনতে হয়। সম্মান বা অসম্মানের জন্য কোনো দেশের নাম নেওয়া হয় না।

আল্লাহ চান যে মানুষে মানুষে, পাড়ায় পাড়ায়, জেলায় জেলায় সবাই সবাইকে চিনুক এবং জানুক। কেউ কাউকে মন্দ মনে না করুক। দেশে দেশে আদমসন্তানরা আল্লাহর দেওয়া সম্পদ আদান-প্রদান করে যার যার প্রয়োজন পূরণ করুক। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি ও একই আদি পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে সবাই সবাইকে ভালোবাসুক। আল্লাহর দেওয়া বিধান মেনে সবাই সুখ-শান্তি ভোগ করুক।

আল্লাহর পরিবারের কী দশা?
সারা দুনিয়ার আদমসন্তানের জন্য যা কিছু দরকার, সবই বিভিন্ন দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা নিজেই উৎপাদনে সাহায্য করছেন। এক দেশের লোকের যে পরিমাণ জিনিস দরকার, সে দেশে উৎপন্ন জিনিসের সে পরিমাণের অতিরিক্ত জিনিস অন্য কোনো দেশের প্রয়োজন। ঐ দেশের কোনো অতিরিক্ত জিনিস এদেশে প্রয়োজন। এভাবেই সব দেশের লোক তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস অন্য দেশ থেকে আমদানি করে এবং নিজেদের অতিরিক্ত জিনিস অন্য দেশে রফতানি করে। দেশে দেশে এভাবেই লেনদেন হয়।

যেমন- বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে গম কিনতে পারে। এর বদলে তারা বাংলাদেশ থেকে পাট কিনতে পারে। এ জিনিসের বদলে অন্য জিনিস বিনিময় করতে জিনিসের দাম ধরা হয়। এ দাম ধরার বেলায়ই এক দেশ আরেক দেশের প্রতি যুলুম করে। যুলুমের ধরণটা কেমন, তা উদাহরণ দিলে সহজে বুঝা যাবে।

বাংলাদেশের গম দরকার। অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ গম নিতে চায়। এর বদলে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ থেকে পাট নিতে চায়। গম ও পাটের দর ঠিক করতে গিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। যেহেতু মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য গম জরুরি, সেহেতু অস্ট্রেলিয়া বেশি দাম দাবি করল। পাট এমন জিনিস নয়, যা না নিলে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ মরবে। তাই তারা খুব কম দামে পাট কিনতে চাইল। বাংলাদেশ সমস্যায় পড়ে গেল। পাট উৎপাদন করতে যে খরচ পড়েছে এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাংলাদেশকে বাধ্য করলে অবশ্যই এটা যুলুম। অথচ গম উৎপন্ন করতে যে খরচ হয়েছে এর কয়েক গুণ বেশিদামে বাংলাদেশকে গম কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভাবখানা এমন, এ দামে গম কিনলে কিনতে পার, না কিনলে পাট খেয়ে মর গিয়ে। অনেক দেশ সাধ্যের বেশি দামে গম কিনতে না পারায় অস্ট্রেলিয়ার গুদামে এত গম জমা হয়ে রইল যে, অনেক গম তারা পশুকে খাওয়াতে বাধ্য হলো। এমনকি অনেক গম পচে গেল, যা সমুদ্রে ফেলতে হলো। এটা গল্প নয়, এমনই হচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর বের হয়।

এ একটা উদাহরণ থেকেই সমস্যাটা সহজে বুঝা যায়। কোনো কোনো দেশে গম পশুকে খেতে দেওয়া হয়, সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়, অথচ অন্য কোনো দেশে খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যায়।

উপরে শাশুড়ি ও বড় বৌ- এর ভূমিকার উদাহরণটি থেকে বিষয়টি এভাবে বুঝতে পারা যায়। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার সকল মানুষের জন্যই খাদ্য পয়দা করেন। কিন্তু ধনী দেশগুলোতে যারা বড় বৌ-এর ভূমিকা পালন করছে তাদের দোষেই লাখ লাখ আদমসন্তান না খেয়ে মরছে। তারা নিজের দেশের মানুষকে যে পরিমাণখাবার জিনিস অপচয় করতে দিচ্ছে, পশুকে পর্যন্ত খাওয়াচ্ছে এবং পচিয়ে নষ্ট করছে, সেখাদ্যটুকু পাওয়া যাদের হক ছিল তারা না খেয়ে মরছে। আল্লাহ পরিমাণমতোই পয়দা করছেন, পশুকে খাওয়ানোর জন্য বা পচানোর জন্য তো উৎপন্ন করছেন না। শাশুড়ি পরিমাণমতো সব জিনিস দিয়েছেন; কিন্তু বড় বৌ-এর দোষে পরিবারের অন্যরা খাবার কম পাচ্ছে।

ইনসাফের কথা
জাতিসংঘ কয়েকটি বড় দেশের হাতে বন্দি। ১৯১ টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের সভায় এ পর্যন্ত অনেক ইনসাফপূর্ণ প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের হাতে প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। পরিষদের ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জন বড় দেশগুলোর প্রতিনিধি। তাদের প্রত্যেককে এ ক্ষমতা দওেয়া আছে যে, যোকোনো প্রস্তাব তাদের যে কেউ নাকচ করে দিতে পারে। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের মতের বিরুদ্ধে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই জাতিসংঘ গঠন করা হয়; কিন্তু এ যুদ্ধ বন্ধ করা গেল না।

সকল স্বাধীন রাষ্ট্রই জাতিসংঘের সদস্য। এটা দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের একটা সমিতি। কিন্তু বড় কয়েকটি রাষ্ট্রের হাতে এমন ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে যে, সমিতির আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে গেছে। এ সমিতি ছোট রাষ্ট্রগুলোর উপর দাপট দেখাতে পারে। কিন্তু ৫ টি বড় রাষ্ট্রের কারণে এ সমিতি ইনসাফ করতে পারে না।

ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে এ সমিতির কোনো হুকুমই আমেরিকা জারি করতে দেয়নি। ফিলিস্তিনের পক্ষে সকল প্রস্তাবই রাশিয়া নাকচ করে ভারতকে কাশ্মীরের উপর চরম যুলুম করতে সাহায্য করেছে। এভাবে বড় কয়েকটি রাষ্ট্র দুনিয়ায় যুলুম চালু রেখেছে।

সব দেশের উৎপাদিত জিনিস যাতে ইনসাফপূর্ণ দরে সবাই নিতে পারে এবং লেনদেনে কারো উপর কেউ যুলুম করতে না পারে এমন প্রস্তাব যদি ঐ সমিতি পাস করে তাহলে যেসব দেশ অন্য দেশ থেকে খাবার জিনিস কিনতে বাধ্য হয় তারা যুলুম থেকে বাঁচতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সমিতিকে এ প্রস্তাব পাস করতে হবে যে, কোনো জিনিস উৎপন্ন করতে যে খরচ হয়, সে জিনিস শতকরা ১০ বা ১৫ ভাগ লাভে বিক্রি করতে হবে। দুনিয়ার সব দেশে এ রকম একই আইন জারি করতে পারলে কেউ যুলুমের শিকার হবে না। এ জাতীয় প্রস্তাব বাস্তবায়নে স্বার্থপর বড় রাষ্ট্রগুলো কি রাজি হবে?

দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
দুনিয়াজোড়া অর্থনৈতিক শিকলে আবদ্ধ হওয়ার কারণে ছোট দেশগুলোকে যেসব সমস্যায় পড়তে হয় সে বিষয়ে কিছু ধারণা উপরে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, আঞ্চলিক ব্যাংক ও বড় দেশগুলো সাহায্যের নামে যা দেয়, তার একটা বড় অংশ তাদের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের পেছনে খরচ হয়ে যায়। আর ধার বা ঋণ হিসেবে যা দেয় তা সুদসহ ফেরত দেওয়া বিরাট কঠিন ব্যাপার।

সরকার ঐ সব ঝামেলাসহই দেশের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যে দলই সরকারি ক্ষমতায় থাকে, তারা পরবর্তী নির্বাচনে জনগণের সমর্থনের আশায় যত কর্মসূচি গ্রহণ করে তা সঠিকভাবে বাস্তবে চালু করতে পারলে দেশ এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু যাদের হাতে তা চালু হয়, তাদের দুর্নীতির কারণে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয় না। ঈমানদার ও যোগ্য লোকের শাসন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।

আমরা ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে যা আলোচনা করছি তা জানা জরুরি বলেই লিখছি। কিন্তু সৎ লোকের শাসন কায়েম না হলে ইসলামী অর্থনীতি চালু হবে না।

দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
বর্তমান দুনিয়াতে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে, এর নাম হলো পুঁজিবাদ।

১৯১৭ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত রাশিয়ার নেতৃত্বে আরেক ধরণের অর্থনেতিক ব্যবস্থা বেশ কয়টি দেশে চালু ছিল। এর নাম সমাজবাদ বা সমাজতন্ত্র। কমিউনিজম নামেও এর পরিচয় ছিল। সমাজতন্ত্র তার জন্মভূমি রাশিয়াতেই আত্মহত্যা করেছে। ঐ অর্থনীতি অচল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে আবার পুঁজিবাদী অর্থনীতি চালু হয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ মানুষকে অর্থনৈতিক গোলাম বানায়। আর সমাজতন্ত্র জনগণকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় গোলামে পরিণত করে। সমাজতন্ত্র অর্থনৈতিক মুক্তির দোহাই দিয়ে সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি দলের হাতে তুলে দিয়ে জনগণকে সকল দিক দিয়ে দাস বানিয়েছিল, আর পুঁজিবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক মুক্তির দোহাই দিয়ে জনগণকে পুঁজিবাদীদের অর্থনৈতিক গোলাম বানিয়ে রেখেছে।

এত বড় কঠিন বিষয় জনগণের বুঝার মতো সহজ করে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সমাজতন্ত্র অনিবার্য মৃত্যুবরণ করেছে বলে সে বিষয়ে আলোচনার দরকার নেই। পুঁজিবাদ যেহেতু চালু আছে এবং আমরা এর অধীনেই আছিত সেহেতু এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা জরুরি।

পুঁজিবাদী অর্থনীতি
পুঁজি মানে উৎপাদন উপযোগী টাকা। মানুষের দরকার খাবার, কাপড় ও অন্যান্য অনেক জিনিস, যা সবাই ব্যবহার করে। কেউ টাকা খায় না, টাকা গায়ে দেয় না, টাকা সরাসরি ব্যবহার করে না। টাকা কোনো পণ্য নয়। পণ্য আদান-প্রদান বা বিনিময় করতে টাকা কাজে লাগে। ছোট একটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ

চাষী জমিতে ফসল বুনে ধান উৎপাদন করল। তাঁতী ঘরে কারখানায় কাপড় তৈরী করল। চাষী কাপড় কিনতে চায়, আর তাঁতী চাল কিনতে চায়। চাষী কি চালের বস্তা নিয়ে তাঁতীর কাছে কাপড় কিনতে যায়? তাঁতী কি কাপড়ের বস্তা নিয়ে চাষীর বাড়িতে চাল কিনতে যায়? চাল ও কাপড় বিনিময় করার এ নিয়ম মোটেই সুবিধাজনক নয়। তাই সহজ নিয়ম চালু হয়েছে যে, চাষী বাজারে চাল বিক্রি করে টাকা নেবে, তাঁতী কাপড় বেচে টাকা নেবে। ঐ টাকা দিয়ে যার যে জিনিস দরকার সে তা কিনবে। সুতরাং টাকা হলো পণ্যের বিনিময়ের মাধ্যম; টাকা কিন্তু কোনো পণ্য নয়। মানুষের পণ্য দরকার। টাকা পণ্য কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়। টাকা কোনো পণ্য বানায় না, টাকা দিয়ে পণ্য কেনা হয় মাত্র।

পুঁজিবাদের ভিত্তি হলো সুদ। যার কাছে বেশি টাকা আছে সে অন্যকে ঐ টাকা সুদের উপর ধার দেয়। অর্থাৎ টাকা দিয়ে আরও টাকা কামাই করে। পুঁজিওয়ালা নিজে টাকা কামাই করতে পারে না। যে টাকা ধার নেয় সে লোকটি কামাই করে। পুঁজিওয়ালা কোনো কিছু না করেই ঐ লোকের কামাই থেকে সুদ দাবি করে। এটা শোষণ বা যুলুম। তাই ইসলাম সুদকে জঘন্য হারাম ঘোষণা করেছে।

একজনের পুঁজি আরেকজন নিয়ে কাজে লাগিয়ে যা লাভ করল ঐ লাভের অংশ টাকাওয়ালা নিলে সুদ হবে না। যদি লাভ না হয় তাহলে কিছুই পাবে না। এ শর্তে ধার দিলেও নিলে দোষ নেই। এতে শোষণ হবে না। পূর্ব-চুক্তি মোতাবেক লাভের একটা অংশ নিলে ব্যবসায় শরীক হিসেবে লাভ পাবে। টাকা দিয়ে ব্যবসায় লাভ না হলেও সুদ নেওয়াটাই যুলুম।

টাকার মালিকরা ব্যাংকের মাধ্যমে সুদে টাকা লগ্নি করে জনগণকে শোষণ করে তাদের টাকার অংক বাড়িয়ে অন্যায়ভাবে দেশের সম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে, আর জনগণ সুদ দিতে দিতে আরও গরীব হচ্ছে। পুঁজিবাদীরা টাকাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। যারা ধার নিচ্ছে তাদের লাভ না হলেও এমনকি লোকসান হলেও সুদ আদায় করতেই হবে। বাড়ি-ঘর বেচে হলেও সুদ দিতে হবে। তাই পুঁজিবাদী অর্থনীতি চরম যুলুম ও শোষণ।

সুদের কুপ্রথা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গরীব লোকেরা উচ্চহারে সুদের উপর টাকা নিয়ে ফতুর হচ্ছে। আর টাকার গোলামরা গরীবদের রক্ত শোষণ করে চলেছে।

পুঁজিবাদ টাকাওয়ালার মধ্যে যে মনোভাব পয়দা করে, তাতে টাকাই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে যায়। টাকার অংক বাড়ানোর জন্যই তার সকল চিন্তা-ধান্দা। টাকার লোভ তাকে পেয়ে বসে। তার সুদী ব্যবসা দেশ, জাতি ও জনগণের কোনো উপকারে লাগছে কি-না সে কথা চিন্তাও করে না। পুঁজিবাদী অর্থনীতি গোটা সমাজকে লোভী ও স্বার্থপর বানায়। এ কারণেই লটারি, বহু রকমের জুয়া, ঘুষ ও অনেক রকম অসৎ উপায়ে আয় করার কু-প্রথা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী মনোভাব মানুষকে টাকার পাগল বানায়। তাই চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট, চাঁদাবজি ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। মানুষ নৈতিক চেতনা হারিয়ে টাকা ছাড়া কিছুই বুঝছে না।

ইসলামের অর্থনৈতিক ভিত্তি হলো যাকাত। সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ কুরআনের বিধান মোতাবেক দান করাকে যাকাত বলা হয়। ইসলামে যাকাত ব্যবস্থাটা মানুষকে অনেক কথা শেখায়। যেমন-

১. পয়লাই যাকাতদাতা বুঝে নেয় যে, তার কামাই করা মালের আসল মালিক সে নয়। আসল মালিক আল্লাহ; যার হুকুমে তার কামাই করা মালের একটা নির্দিষ্ট অংশ গরীবদের জন্য দিয়ে দিতে হয়। সে টাকার গোলাম নয়, আল্লাহর গোলাম।

২. হালাল কামাই থেকে যাকাত দিতে হয়। এর দ্বারা তাগিদ দেওয়া হয় যে, হারাম পথে কামাই করা যাবে না।

৩. যাকাত দেওয়ার পর তার হাতে যত টাকা আছে এর আসল মালিক যেহেতু আল্লাহ, সেহেতু এ টাকা হালাল কাজেই খরচ করতে হবে। হারাম কাজে ব্যয় করার অধিকার তার নেই।

৪. যাকাত গরীবের প্রতি যাকাতদাতার দয়া নয়; ধনীর ঘরে এটা গরীবের হক বা অধিকার, যা সরকারের হাতে তুলে দিতে হয়। এতে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে লাভ নেই। এটা আল্লাহর হুকুম, তিনি এ বিষয়ে হিসাব নেবেন।

৫. যাকাত সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধনীদের কাছ থেকে উসুল করে, যাদের হক তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে। গরীবকে ধনীর দুয়ারে এসে ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে নিতে হবে না। সরকার তার হক তার ঘরে সম্মানের সাথে পৌঁছে দেবে। এটাই ইসলামী নিয়ম।

ইসলামী সমাজে যাকাতব্যবস্থা জনগণের মাঝে এ মনোভাবই সৃষ্টি করে যে, ধন-সম্পদ হালাল উপায়ে হাসিল করতে হবে। আল্লাহকে এর আসল মালিক মনে করতে হবে, ধনীর মালে গরীবের হক রয়েছে। আল্লাহর দেওয়া মাল মানুষকে শোষণ করার জন্য ব্যবহার করা চলবে না; বরং আল্লাহকে খুশি করার জন্য অন্যদেরকে দান করতে হবে। টাকা-পয়সা ও ধনসম্পদ জীবনের আসল উদ্দেশ্য নয়; আসল উদ্দেশ্য দুনিয়ায় আল্লাহর সাচ্চা বান্দাহ হিসেবে জীবনযাপন করা, যাতে আখিরাতে সফল হওয়া যায়। এ আসল উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য টাকা-পয়সা কাজে লাগাতে হবে।

যাকাত সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করে
সমাজে কোনো না কোনো কারণে কিছু লোকের অভাব থেকে যায়। আল্লাহ এ জাতীয় লোকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য যাকাত ফরয করেছেন। সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে তিনি তাদের তালিকা দিয়েছেন। অন্য কোনো কাজে যাকাতের টাকা খরচ করা যাবে না। কুরআনে যাকাতের ৮ টি খাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছেঃ

১. ফকীর- যারা এত গরীব, অন্যের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয় তাদের জন্য।

২. মিসকীন- যারা অভাবী হলেও লজ্জায় কারো কাছে চায় না, তাদের সাহায্যের জন্য।

৩. সরকারের যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য।

৪. নতুন মুসলমান- যাদের মন জয় করা দরকার। নওমুসলিমদেরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্যও যাকাত দেওয়া যাবে।

৫. দাসদের মুক্তির জন্য বা জরিমানা আদায় না করতে পারায় যারা জেলে পড়ে আছে তাদের মুক্তির জন্য।

৬. ঋণগ্রস্থদেরকে ঋণের বোঝা থেকে উদ্ধার করার জন্য।

৭. আল্লাহ দীনকে বিজয়ী করার আন্দোলনে সাহায্য করার জন্য।

৮. মুসাফির অবস্থায় অভাবে পড়ে গেলে তার অভাব দূর করার জন্য। নিজের বাড়িতে কেউ ধনী হলেও মুসাফির অবস্থায় অসহায় হতে পারে।

সব ধরণের অভাবী লোকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার মহান উদ্দেশ্যেই আল্লাহ তাআলা যাকাত ফরয করেছেন এবং এটাকে বড় ইবাদত হিসেবে গণ্য করেন। ইসলামে ভিক্ষা করা অত্যন্ত মন্দ। এ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য যাকাত জরুরি। যারা গরীব অথচ হাত পাতে না, তাদেরকে খুঁজে বের করা সরকারের বিরাট দায়িত্ব। ধনীদের থেকে যাকাত উসুল করা ও হকদারদেরকে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য যারা কাজ করবে, তাদের বেতন যাকাত থেকেই দিতে হবে।

ইসলামী সরকারের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ
ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে হলে প্রথমে ইসলামী সরকার কায়েম করতে হবে। ইসলামী সরকারকে আল্লাহ যেসব অর্থনৈতিক নির্দেশ (হুকুম) দিয়েছেন, তা দেশে চালু করা হলে জনগণ কেমন সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারবে তা ঐ নির্দেশগুলো থেকেই বোঝা যায়। ইসলামী সরকারের জন্য আল্লাহর দেওয়া ৪ দফা কর্মসূচির প্রথম দফা হলো, জনগণের চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে নামায কায়েমের ব্যবস্থা করা। এর পরই দ্বিতীয় দফা হলো যাকাত ব্যবস্থা চালু করে সকল আদমসন্তানের রিয্‌কের অভাব দূর করে আল্লাহর খিলাফতের প্রধান দায়িত্ব পালন করা। সৃষ্টিজগতে কোনো জীবকে আল্লাহ রিয্‌ক থেকে বঞ্চিত থাকতে দেন না। আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ যদি রিয্‌কের অভাবে কষ্ট পায় তাহলে খিলাফতের আসল দায়িত্বই পালন করা হলো না।

এ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করার জন্য ইসলামী সরকারকে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবেঃ

১. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘আদমসন্তানের এ কয়টি ছাড়া আর কোনো হক নেই- থাকার মতো ঘর, সতর ঢাকার-পরিমাণ কাপড় এবং শুকনা রুটি ও পানি।’’ বাঁচার জন্য মানুষের কমপক্ষে এ তিনটি জিনিসই জরুরি- বাসস্থান, কাপড় ও ভাত। এ তিনটি প্রতিটি মানুষের হক বলে ঐ হাদীসে বলা হয়েছে। এ হক কে পৌঁছাবে? আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামী সরকারকেই তা পৌঁছাতে হবে। এ হাদীসের মর্ম হলো, এ তিনটি মানুষের হক। এর অতিরিক্ত যা মানুষ পায় তা আল্লাহর দয়া, যার হিসাব দিতে হবে। যা হক এর কোনো হিসাব দিতে হবে না। এ তিনটি হক যে পায়, আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার তার কোনো অধিকার নেই। কারণ, তার হক শুধু এটুকুই। আর সবই আল্লাহর নিয়ামত।

২. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘হালাল রুজি তালাশ করা অন্য সব ফরযের পর ফরয।’’ বৃদ্ধ ও শিশু ছাড়া সবার উপরই হালাল কামাই করা ফরয। ইসলামী সরকারকে যেমন ফরয নামায কায়েম করার জন্য ব্যবস্থা করতে হয়, তেমনি সবাইকে হালাল পথে আয়-রোজগার করার ফরযটি আদায় করার সুযোগ দেওয়ার দায়িত্বও পালন করতে হয়। সরকার দায়িত্ব পালন করলেই সবার রিয্‌ক সহজে যোগাড় হতে পারে।

সরকার যদি বাংলাদেশের সকল বেকার যুবকদেরকে অর্থকরী কাজ শেখার ব্যবস্থা করে, তাহলে অশিক্ষিত যুবকরাও দেশে-বিদেশে কাজ করে দেশকে সম্পদশালী করে দিতে পারে।

৩. সূরা বনী ইসরাঈলের ২৬ ও ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা হুকুম দিয়েছেন, ‘‘আত্মীয়-স্বজনকে তাদের হক দাও এবং গরীব ও মুসাফিরদেরকেও তাদের হক দিয়ে দাও। অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’’

আল্লাহ সব জিনিস পরিমাণমতো পয়দা করেন। যদি কেউ অপব্যয় বা অপচয় করে তাহলে অন্য লোকের অভাব অবশ্যই হবে। অপব্যয় কয়েক রকমের হয়। যেমন-

ক. কোনো জিনিস নষ্ট করা।

খ. যতটুকু জিনিস দরকার এর চেয়ে বেশি ব্যবহার করা।

গ. হারাম কাজে খরচ করা।

৪. আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা করতে যথেষ্ট খরচ করতে হয়। এসব কাজ থেকে ফিরে থাকতে কোনো খরচ হয় না। মদ খাওয়া, যিনা করা, নাচের আসর জমানো, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার আয়োজন করা ইত্যাদিতে বিপুল সম্পদের অপচয় হয়। এসব বন্ধ করা ইসলামী সরকারের কর্তব্য।

যাদের টাকা-পয়সা বেশি আছে তারাই এ জাতীয় অপব্যয় করে। যদি এসব বন্ধ করা হয়, তাহলে ঐ সম্পদ তারা এমন কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য হবে, যা উৎপাদন বাড়ায়। টাকা-পয়সা তো খেয়ে ফেলার জিনিস নয়। তা কোনো না কোনো কাজে লাগাতেই হয়। হারাম কাজের সুযোগ বন্ধ করা হলে তা উৎপাদনের লাগাতে হবে। সুদে লগ্নি করার সুযোগও থাকবে না। সুতরাং তাদের টাকা মানুষের উপকারেই লাগবে।

৫. রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘ঘুষ যে নেয় আর ঘুষ যে দেয়-দুজনই দোযখে যাবে।’’ তাই ইসলামী সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ঘুষপ্রথা চালু হতে না পারে। অর্থনৈতিক জীবনে সবচেয়ে মারাত্মক রোগ হলো ঘুষ। ঘুণ যেমন ভেতর দিয়ে কাঠকে খেয়ে শেষ করে, ঘুষ তেমনি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়। যেমন-

ক. যারা ঘুষ না পেলে কাজ করতে চায় না, তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিনা ঘুষে কাজ করে না। তাই তাদের যোগ্যতা কাজে লাগে না।

খ. ঘুষ দিতে রাজি না হলে তারা হকদারকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।

গ. ঘুষ দিলে যার হক নেই তাকেও তারা অন্যায়ভাবে অন্যের অধিকার দিয়ে দেয়।

ঘ. ঘুষ সব আইন-কানুন ও বিধি-বিধানকে অচল করে দেয়। আইন যতই ভালো হোক, ঘুষ চালু থাকলে তা জনগণের উপকারে আসতে পারে না।

বাংলাদেশে ঘুষের কুফল
দুর্নীতিপরায়ণ দেশের তালিকায় ১৯৯৯ সাল থেকেই সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশ এক নম্বর দেশ হিসেবে নিন্দিত। এর প্রধান কারণই হলো ঘুষ। সরকারি অফিস থেকে কোনো কাজ আদায় করতে হলে বিনা ঘুষে কিছুতেই তা সম্ভব নয়। বড় কর্মকর্তা থেকে পিয়ন পর্যন্ত ঘুষের নেশায় পাগল। শতকরা কতজন ঘুষ খায় না তা আল্লহই জানেন। রাজধানী ঢাকায় পর্যন্ত খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। এ সবের জন্য কঠোর শাস্তির আইন আছে; কিন্ত ঘুষের কারণে আইন অচল।

পুলিশকে টাকা দিলে খুনীর বিরুদ্ধে মামলা খারিজ হয়ে যায়। তাই খুনী খুন করার সময় আইনের পরওয়া করে না।

পুলিশ যদি ডাকাত থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়, তাহলে ডাকাতি কমে যাওয়ার বদলে বাড়বেই।

কোটি কোটি টাকার কারখানা কায়েম করতে সরকারি অনুমতি নিতে হয়। অফিসারকে এ কাজের জন্য বেতন দেওয়া হয়; কিন্ত ‍লাখ টাকা ঘুষ না দিলে অনুমতি পাওয়া যায় না।

টেলিফোনের জন্য সরকারকে ফিসের টাকা দেওয়ার পরও কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে ঘুষ দিতে হয়। এরপরও লাইনম্যানকে ঘুষ না দিলে ঘরে টেলিফোন লাইন আসে না।

ওয়াসা’র পানির বিল ঘুষ দিলে কমিয়ে দেয় এবং সরকারকে ঠকিয়ে কর্মচারী ধনী হয়।

বিদ্যুৎ চোরদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ইনস্‌পেকটর চুরি করতে দেয়। এর ফলে যারা নিয়মিত বিল আদায় করে তাদের বিলে চুরি হওয়া বিদ্যুতের বিল যোগ হয়। চুরির কারণে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যায়।

এমনকি স্কুল-মাদরাসা বোর্ডেও শিক্ষকরা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ আদায় করতে পারে না। স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের বেলায় টাকা দিতে না পারলে যোগ্য শিক্ষকও চাকরি পায় না। টাকা দিয়ে নিম্নমানের শিক্ষকও চাকরি পেয়ে যায়।

ব্যাংক থেকে সুদের উপর টাকা ধার নিলেও কর্মচারীদেরকে ঘুষ না দিলে ধারের টাকা হাতে আসে না।

বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুষের রাজত্ব। অল্প কিছু নমূনা উল্লেখ করলাম। ঘুষের দাপটে মেধা ও যোগ্যতার মূল্য নেই। একটু খেয়াল করলেই অনুভব করা যায় যে, ঘুষপ্রথা না থাকলে মানুষের জীবনে শান্তি কত বেড়ে যেতে পারে! তাই ইসলামী সরকারকে ঘুষপ্রথা খতম করতেই হবে।

সাংস্কৃতিক জীবন
আমরা এ পর্যন্ত জানতে পেরেছি যে, ইসলাম আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের জন্য কেমন চমৎকার বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিয়েছে। যারা ইসলামের শিক্ষা মেনে চলে তাদের জীবন, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি এক ধরণের হবে। যারা সে শিক্ষা গ্রহণ করবে না তারা মনগড়া নিয়মে কিংবা অন্যদের শেখানো তরীকায় চলবে। ফলে সঙ্গত কারণেই তাদের জীবন, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি আলাদা ধরণের হবে।

এ কারণেই মুসলিম ও অমুসলিমের জীবনধারা একই রকম হতে পারে না।

একজন মুসলিম সূর্য ওঠার বেশ আগে ঘুম থেকে উঠে পেশাব-পায়খানা সেরে পবিত্র হয়ে ওযূ করে, নামাযের পোশাক পরে মসজিদে গিয়ে জামাআতে ফজরের নামায আদায় করে। এরপর হয় মসজিদে বসেই সে কুরআন তিলাওয়াত করে, আর না হয় বাড়িতে এসে কুরআন পড়ে। মসজিদে আসা-যাওয়ার সময় কোনো মুসলমানের সাথে দেখা হলে ‘আস্‌সালামু আলাইকুম’ বলে শুভেচ্ছা জানায়।

একজন অমুসলিমের এত সকালে ঘুম থেকে উঠার দরকার হয় না। যখন খুশি ঘুমায়, যখন উঠা দরকার তখন উঠে পেশাব-পায়খানা করে মুখ ধুয়ে তার অভ্যাসমতো যা করার তা-ই করে। পেশাব-পায়খানার নিয়মও তার আলাদা। তার পাক-পবিত্র হওয়ার কোনো ধারণই নেই। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হয়েও তারা নাপাক থাকতে পারে।

মুসলমানের কথাবার্তা বলার ধরণও অমুসলিমের থেকে আলাদা। কেউ তাকে ‘কেমন আছে’ জিজ্ঞাসা করলে জবাবে সে বলে ‘আল্‌হামদুলিল্লাহ! ভালো আছি।’ কোনো অমুসলিম এভাবে বলে না।

একটি মুসলিম পরিবারের মেয়ে শরীর ভালোভাবে ঢেকে বাড়ির বাইরে যায়। অমুসলিম মেয়েদের মতো পোশাক পরে বাইরে যায় না। একজন মুসলিম মহিলা বাড়ির বাইরে অন্য মানুষকে তার দেহের সৌন্দর্য দেখায় না।

এ অল্প ক’টি উদাহরণই এ কতা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট যে, স্বাভাবিক কারণেই মুসলিম ও অমুসলিমদের চলা, বলা, করা, খাওয়া, পরা ইত্যাদি প্রায় সব কিছুতেই কিছু না কিছু ভিন্নতা ও পার্থক্য দেখা যায়।

আমাদের দেশে গ্রামের দিকে অশিক্ষিত মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কিছুটা তফাৎ দেখা গেলেও শহরে বিশেষ করে শিক্ষিত মহলে মুসলিমদের অনেককে অমুসলিমদের মতোই চলতে দেখা যায়। এর কারণ এটাই যে, তারা ইসলামী শিক্ষা ঠিকমতো পায়নি। কেন পায়নি সে কথাও বলা দরকার। তা না হলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। এর জন্য তারা মোটেই দায়ী নয়। তাহলে দায়ী করা?

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান মিলে এত বিশাল এলাকা যে, একে উপমহাদেশ বলা হয়। এ এলাকায় ৭০০ বছর মুসলিম শাসন ছিল। বাংলাদেশ এলাকায় এ শাসন সাড়ে ৫০০ বছর ছিল। ঐ সময় যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল, তার ফলে সকল শিক্ষিত লোকই ইসলামী শিক্ষালাভের সুযোগ পেত। ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলাদেশ দখল করার পর ঐ শিক্ষাব্যবস্থা উৎখাত করে তাদের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে; যাতে তাদের মন-মগজ-চরিত্রের অনুরূপ লোক তৈরী হয়। ১৯০ বছর আমরা ইংরেজদের গোলাম ছিলাম। ১৯৪৭ সালে আমরা ইংরেজ থেকে স্বাধীন হয়েছি। তখন থেকে এ দেশে মুসলিম শাসনেই চলছে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে যে ধরণের মন-মগজ ও চরিত্রের লোক তৈরী করেছে, সে ধরণের লোকেরাই দেশ শাসন করছেন। তারা নামে মুসলিম হলেও ইসলামী শিক্ষায় গড়ে ওঠেন নি। ১৯৪৭ সালে আমরা স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হলাম। ইংরেজরা চলে গেলেও তাদের শিক্ষাব্যবস্থাই জারি রইল ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হলেও ইসলামী সরকার কায়েম হয়নি।

১৯৭১ সালে এ দেশ পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে আলাদা হলো। যাদের হাতে বাংলাদেশ শাসন করার ক্ষমতা এলা তারা শিক্ষাব্যবস্থায় নিচের দিকে সামান্য যেটুকু ইসলামী শিক্ষা ছিল তা-ও উঠিয়ে দিলেন। বর্তমানে মাদ্‌রাসায় ইসলামের শুধু ধর্মীয় শিক্ষাটুকু আছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার সামান্য থাকলেও মূলত ইংরেজ আমলের শিক্ষাব্যবস্থাই চালু আছে।

এ অবস্থায় এ দেশের শিক্ষিত লোকদের মন-মগজ-চরিত্র ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী তৈরী হতে পারছে না। এর জন্য তারা দায়ী নয়। যারা দেশ শাসন করছেন তারাই দায়ী। তাই শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়লেও মুসলিম শিক্ষিতদের অনেকের চালচলনের ধরণ দেখতে অনেকটা অমুসলিমদের মতোই মনে হয়। অবশ্য শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামী না হওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষিত লোককে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কিংবা পারিবারিক প্রভাবে মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে দেখা যায়।

মুসলিম ও অমুসলিম জীবনে তফাৎ কোথায়?
মুসলিম ও অমুসলিম সবাই আদমসন্তান। সবাই মানুষ। সবাই ঘুমায়, ঘুম থেকে উঠে, পেশাব-পায়খানা করে, বিয়ে-শাদি করে, আনন্দ-উৎসব করে, আয়-রোজগার করে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে, মারা যায় এবং মরার পর তাদের দেহকে জীবিতরা সৎকার করে। মানুষ হিসেবে সব মানুষকেই এসব করতে হয়।

এসব কাজ মুসলিমদেরকে ইসলামের বিধান অনুযায়ী করতে হয়। অমুসলিমরা এর সবই অন্যভাবে করে। মুসলিমরা কিবলার (মক্কার কাবা শরীফ) দিকে পা দিয়ে ঘুমায় না। কিবলার দিকে মুখ করে ও পিঠ রেখে পেশাব-পায়খানা করে না। তাদের পেশাব-পায়খানার জায়গা সেদিকে খেয়াল রেখেই তৈরী করা হয়। ইসলামের দেওয়া হালাল ও হারামের বিধান মেনে তারা খাওয়া-দাওয়া করে। যেসব জিনিস খাওয়া হারাম তা খায় না। হালাল পশুও জবেহ করার সময় আল্লাহু আকবার না বললে হারাম হয়ে যায়। খাবার শুরু করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হয়। খাবার শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া জানাতে হয়।

মুসলিমদেরকে ইসলামের শেখানো নিয়মে বিয়ে করতে হয়। যেসব মহিলাকে বিয়ে করা হারাম তাদেরকে মুসলমানরা বিয়ে করে না। আয়-রোজগার করতে হালাল উপায় তালাশ করে এবং হারাম থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেলায়ও হারাম থেকে বেঁচে থাকতে হয়।

ইসলামে আনন্দ-উৎসবের বিধানও রয়েছে। ঈদ শব্দের মানেই খুশি ও আনন্দ। এ আনন্দ শুরু করতে হয় নামায দিয়ে। এর দ্বারা শেখানো হয় যে, এমন ধরণের আনন্দ ফূর্তি করা যাবে না, যা আল্লাহ অপছন্দ করেন। মুসলিমদের আনন্দবিনোদন যেন নৈতিক বিধান অমান্য না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

মারা গেলে মুসলমানদের মৃতদেহকে গোসল করিয়ে, কাফনের কাপড় পরিয়ে, সম্মানের সাথে কবরে দাফন করা হয়।

এসব কাজ অমুসলিমরাও করে। তবে মুসলমানরা যে নিয়মে করে অমুসলিমরা সে নিয়মে করে না। তারা আলাদা নিয়মে করে। হিন্দুরা একভাবে করে, খ্রিস্টানরা আরেকভাবে করে। প্রত্যেক জাতির লোক নিজ নিজ নিয়মেই ঐসব কাজ করে থাকে।

সংস্কৃতি কাকে বলে?
সকল ধর্ম ও সকল দেশের মানুষই উপরিউক্ত কাজগুলো নিজ নিজ নিয়মে করে থাকে। ঐ নিয়মগুলোই হলো সংস্কৃতি। বাংলায় কৃষ্টি শব্দটিও এ অর্থেই ব্যবহার করা হয়। ইংরেজিতে Culture, সে হিসেবেই মুসলিম কালচার, হিন্দু কালচার, খ্রিস্টান কালচার ইত্যাদি বলা হয়। দেশ হিসেবেও আমেরিকান কালচার, জাপানি কালচার, চাইনিজ কালচার ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এর দ্বারা বোঝা গেল, এক জাতি থেকে অন্য জাতির মধ্যে জীবনযাপনের নিয়মে যে তফাৎ আছে ঐ তফাৎটাই সংস্কৃতি বা কালচার। খায় সবাই। খাওয়াটা সংস্কৃতি নয়। খাওয়ার নিয়মটাই সংস্কৃতি। সব মানুষকে যা কিছু করতে হয় তা করার নিয়ম বা পদ্ধতি দেখেই বলা যায়- কে কোন্‌ কালচারের লোক, কে কোন্‌ জাতির মানুষ। এভাবেই মানুষের চালচলন থেকে তার সংস্কৃতি কী তা জানা যায়।

সংস্কৃতি কাকে বলে- এ নিয়ে শিক্ষিত মহলে বিরাট তর্ক-বিতর্ক চলে। এ বিতর্কে সাধারণ জনগণের কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। তাই অপ্রয়োজনীয় আলোচনায় যাওয়ার কোনো দরকার নেই। অতি সহজ কথায় আমরা বুঝে নিলাম, মানুষ সকল কাজ-কর্মে ও চলায়-বলায় যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলে তা-ই সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও কালচার।

যারা আল্লাহকে একমাত্র হুকুমকর্তা প্রভু, রাসূল সা.-কে একমাত্র আদর্শ নেতা, আখিরাতের জীবনে সাফল্য-লাভকেই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে বিশ্বাস করে দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম করে তারা আল্লাহ ও রাসূলের শেখানো নিয়মেই করে থাকে। এসব বিশ্বাসই সংস্কৃতির মূল। যারা এসব বিশ্বাস করে না তারা যে রকম বিশ্বাস করে তাদের কাজের নিয়ম সে রকম হওয়ার কথা। তাদের সংস্কৃতির মূল ভিন্ন। ঐ মূলটুকুকেই বলা হয় সভ্যতা বা Civilization. তাই ইসলামী সভ্যতার ভিত্তিমূল হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। এ তিনটি মূলের ভিত্তিতে যাদের জীবন গড়ে ওঠে তারাই মুসলিম জাতি। তাদের মূলকেই বলে ইসলামী সভ্যতা। এ সভ্যতার ভিত্তিতেই ইসলামী সংস্কৃতির জন্ম হয়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
শুধু বড় শহরেই নয়, ছোট শহরেও এমনকি হাটবাজারেও নাচ-গান, নাটক, কবিতা পাঠ, কৌতুক ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। সংস্কৃতি শব্দ থেকেই সাংস্কৃতির শব্দটি এসেছে।

পশুর মতো শুধু শরীরটুকু নিয়েই মানুষ নয়। মানুষের মন আছে, যা পশুর নেই। তাই মানুষ রাত-দিন পশুর মতো শুধু খেয়ে ও ঘুমিয়ে জীবন কাটায় না। মানুষের মনের খোরাকেরও দরকার হয়। পশুও দেখতে পায় যে, রাত যায় দিন আসে, আবার দিন যায় রাত আসে, সূর্য উঠে ও ডোবে। কিন্তু এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার ক্ষমতা পশুর নেই। মন আছে বলেই মানুষ যা কিছু দেখে এর চেয়েও বেশি চিন্তা করে। এ চিন্তা প্রকাশ না করলে মানুষ মনে শান্তি পায় না। বিভিন্নভাবে মানুষ ঐ চিন্তাকে প্রকাশ করে।

কেউ কবিতার মাধ্যমে তার চিন্তা প্রকাশ করে। কেউ গান গেয়ে নিজের চিন্তা প্রকাশ কলে। কেউ বই লিখে চিন্তা প্রকাশ কলে। কেউ নাটক লিখে চিন্তা প্রকাশ করে। নাটককে আবার মঞ্চে অভিনয় করে প্রকাশ করা হয়। কেউ ছবি এঁকে তার চিন্তা প্রকাশ করে। সে যা দেখে তা তুলি দিয়ে ছবি বানিয়ে অন্যকে দেখায়। কেউ পাথর খোদাই করে কোনো মূর্তি বানিয়ে তার চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। নাচের মাধ্যমেও চিন্তা প্রকাশ করা হয়।

তাই ভাষা, সুর অভিনয়, ছবি, খোদাই, নাচ ইত্যাদি হলো সংস্কৃতির বাহন। এসবের কাঁধে ভর করেই সংস্কৃতি প্রকাশ পায়।

আগেই বলা হয়েছে, সংস্কৃতির মূলভিত্তি হচ্ছে কতক বিশ্বাস। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কতক বিশ্বাস ছাড়া মানুষ মনকে বুঝ দিতে পারে না। যার বিশ্বাস যে রকম, তার সংস্কৃতি সে রকমই হতে বাধ্য।

তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যারা আয়োজন করে তাদের মৌলিক বিশ্বাস যে রকম হয় ঐ অনুষ্ঠানের সে রকম সংস্কৃতিরই প্রকাশ ঘটে।

যারা তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাসী তাদের গান, নাটক, ছবি, সাহিত্য, তাদের সবকিছু ইসলামী সংস্কৃতির পরিচয় বহন করবে। যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এটা কোন্‌ সংস্কৃতি।

বাঙালি সংস্কৃতি
দেশের অনেক শিক্ষিত লোকের মুখে ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কথাটি শোনা যায়। সংস্কৃতি কাকে বলে-এ বিষয়ে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, সে হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতি কথাটি মোটেই যুক্তিপূর্ণ নয়। যারা এ কথাটি বলেন, তারা হয়ত না বুঝেই বলেন।

যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাদেরকে বাঙালি বলা হয়। বাংলা ভাষাভাষীদের সবার জীবনজগৎ সম্পর্কে মৌলিক বিশ্বাস এক রকম নয়। বাঙালি মুসলিম এবং বাঙালি হিন্দুদের মৌলিক বিশ্বাস আলাদা। তাই মুসলিম সংস্কৃতি ও হিন্দু সংস্কৃতি কিছুতেই এক রকম হতে পারে না। তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি বলে কোনো সংস্কৃতি থাকতে পারে না। বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি বাঙালি হিন্দুদের সংস্কৃতি থেকে অবশ্যই আলাদা। বাঙালি হিসেবে উভয়ই পয়লা বৈশাখ পালন করে; কিন্তু পালন করার ধরনে পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। যারা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ কথাটি বলেন, তারা চালাকি করে হিন্দু সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি নামে চালিয়ে দিয়ে মুসলিম তরুণদেরকে মুসলিম সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চান। তাই দেখা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির নামে অনুষ্ঠান করে সেখানে হিন্দু ধর্মের কতক প্রথাকেও বাঙালি সংস্কৃতির নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক জীবন
কোনো দেশ বা রাষ্ট্র দুনিয়ার অন্য কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক কায়েম না করে আলাদা অবস্থা বেঁচে থাকতে পারে না। অর্থনীতির আলোচনায় আমরা জানতে পেরেছি, মানুষের দরকারি সব জিনিস এক দেশেই পাওয়া যায় না। এ কারণে একটি দেশকে টিকে থাকার প্রয়োজনেই আরও অনেক দেশের সাথে বিভিন্ন জিনিসের আদান-প্রদান করতে হয়। কোনো এক দেশ অন্য দেশের সম্পদ দখল করার উদ্দেশ্যে সে দেশে হামলা করে বসে। ফলে যুদ্ধ লেগে যায়। যুদ্ধে এক দেশের কতক সৈনিক অপর দেশের হাতে বন্দি হতে পারে। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে দুদেশের মধ্যে বন্দি-বিনিময় হয়ে থাকে। কোনো বড় দেশের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আশপাশের ছোট কয়েকটি দেশের মধ্যে ঐক্যের চুক্তি হয়ে থাকে। আরো অনেক উদ্দেশ্যেই এক দেশের সাথে আরেক দেশের চুক্তি হতে পারে। এভাবে এক দেশকে অনেক দেশের সাথে সম্পর্ক রাখতেই হয়। এ সম্পর্ককেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলা হয়। জাতিতে জাতিতে যে সম্পর্ক, এরই নাম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ককে এ নাম দেওয়া হয়। কারণ, রা্ষ্ট্রকে ভিত্তি করেই রাজনৈতিক জাতীয়তা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ভিত্তিতে বাংলাদেশি জাতি, জাপানের ভিত্তিতে জাপানি জাতি, চীনের ভিত্তিতে চীনা জাতি ইত্যাদি। এসব জাতির মধ্যে যে সম্পর্ক একেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলা হয়।

একটি ইসলামী রাষ্ট্র শুধু অন্যান্য ইসলামী ও মুসলিম রাষ্ট্রের সাথেই নয়, অমুসলিম রাষ্ট্রের সাথেও বিভিন্ন কারণে সম্পর্ক রাখতে পারে। এ সম্পর্কের ভিত্তিতেই এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। বাংলাদেশে অনেক দেশের রাষ্ট্রদূত আছে। ঐসব দেশে বাংলাদেশেরও রাষ্ট্রদূত আছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যেসব আদান-প্রদান হয় তা রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমেই ব্যবস্থা করা হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধরণ
সাধারণত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন-

১. পণ্য-বিনিময়। এক দেশের উৎপন্ন পণ্য অন্য দেশে রফতানি করা হয়। এর বদলে ঐ দেশের পণ্য এ দেশে আমদানি করা হয়।

২. এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে চাকরি করতে যায়। রাষ্ট্রদূত এর ব্যবস্থা করে দেন। যেমন- বাংলাদেশের বহু লোক বিদেশে চাকরি করে।

৩. এক দেশের কোনো কোম্পানি অন্য দেশে কোনো কাজের দায়িত্ব নেয়। যেমন- বিদেশি কোনো কোম্পানি বাংলাদেশে কোনো সেতু তৈরি করে, কারখানা কায়েম করে বা কোনো হাসপাতাল নির্মাণ করে দেয়। এর জন্য বাংলাদেশ ঐ কোম্পানিকে টাকা দেয়।

৪. এক দেশের কোনো কোম্পানি অন্য দেশে ব্যবসায় করার জন্য তাদের পুঁজি লগ্নি করে। যেমন- বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানি কাজ করে।

৫. দু’দেশের নির্দিষ্ট কোনো স্বার্থে চুক্তি হয়ে থাকে।

৬. দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার পর সন্ধি হলেও চুক্তি হয়ে থাকে।

এসব বিষয়ে ইসলামের বিধান হলো- ইসলামী সরকার সকল দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখবে। চুক্তির সব শর্ত মেনে চলবে। অন্যপক্ষ শর্ত ভঙ্গ না করা পর্যন্ত শর্ত পালন করবে। যদি কোনো কারণে চুক্তি বাতিল করতে হয়, তাহলে অপরপক্ষকে তা জানিয়েই তা করবে। গোপনে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না।

যুদ্ধ সম্পর্কে ইসলামী বিধান
ইসলাম সবসময় শান্তির পক্ষে। কোনো দেশের উপর ইসলামী রাষ্ট্র সামান্য যুলুমও যেন না করে। ইসলামী রাষ্ট্র গায়েপড়ে যুদ্ধ বাঁধাবে না। কিন্তু যদি ইসলামী রাষ্ট্রের উপর কোনো শক্তি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তাহলে ইসলাম যুদ্ধের ব্যাপারে ইসলামী সৈন্য বাহিনীকে কিছু বিধান মেনে চলতে বাধ্য করে। যেমন-

১. শত্রুপক্ষের সৈন্যদেরকে ছাড়া সাধারণ মানুষকে মারা নিষেধ।

২. যদি ব্যাপক মারামারি লেগে যায় তবুও মেয়ে, বুড়ো, শিশু, পঙ্গু, সাধু-সন্ন্যাসীদের হত্যা করা নিষেধ।

৩. শত্রুদেশের ফলের গাছ, খেতের ফসল ও মানুষের উপকারী কোনো সম্পদ ধ্বংস করা চলবে না, যেমন- রাস্তা, সেতু ইত্যাদি।

৪. যুদ্ধের কারণে শত্রুপক্ষের যেসব সৈন্য বা মানুষ মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে আসে, তাদের সাথে মানুষ হিসেবে ভালো ব্যবহার করতে হবে। এরা এখন নিরুপায় বলে তাদের সাথে অন্যায় ব্যবহার করা যুলুম।

৫. যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হচ্ছে-

ক. শত্রুপক্ষের হাতে মুসলিম সৈন্য বন্দি হয়ে থাকলে ঐ বন্দিদেরকে ফেরত আনার জন্য মুসলিমদের হাতে থাকা বন্দিদেরকে ফেরত দিয়ে বন্দি-বিনিময় করবে।

খ. শত্রুপক্ষ তাদের বন্দিদেরকে টাকার বিনিময়ে ফেরত নিতে পারবে।

এ সম্পর্কে সূরা মুহাম্মাদের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘যুদ্ধ সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার পর তোমরা ইচ্ছা করলে বন্দিদের প্রতি দয়া করবে অথবা ফিদ্‌ইয়া নিয়ে ছেড়ে দেবে।’’

ইসলামের প্রতি মুসলিমদের কর্তব্য
আমরা জানতে পারলাম, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো শুধু ধর্ম নয়। মানবজীবনের সব বিষয়েই ইসলাম বিধান দিয়েছে। তাই কোনো মুসলমান যদি ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও ধর্মীয় জীবনে ইসলামকে মেনে চলাই যথেষ্ট বলে ধারণা করে, তাহলে তা মারাত্মক ভুল হবে। আল্লাহর কুরআন, রাসূল সা.- এর হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের বাস্তব জীবন থেকে ঐ ধরণের ভুল ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই।

রাসূল সা. ও সাহাবাযে কেরামের জীবনের সবটুকুই ইসলাম। রাসূল সা. যা বলেছেন ও যা করেছেন তাই আসল ইসলাম। মদীনায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছেন; ঐ রাষ্ট্রের তিনিই ছিলেন সরকারপ্রধান। ঐ রাষ্ট্রে সব ব্যাপারেই তিনি আল্লাহর আইন জারি করেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যেসব বিধান কুরআনে আছে, তা কি শুধু তিলাওয়াত করার জন্য? ঐসব বিধান কি নামায-রোযার মতো ফরয নয়? ইসলামের কোনো অংশ বাদ দেওয়ার কোনো অধিকার আল্লাহ কাউকে দেননি। ইসলামের সবটুকু মেনে চলার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।

মক্কার কুরাইশ নেতারা মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রটি ধ্বংস করার জন্য বদরের ময়দানে যুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়। পরের বছর আরও বড় বাহিনী নিয়ে মদীনা আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তারা উহুদের ময়দানে হাজির হলো। মদীনার মসজিদে রাসূল সা. এর ইমামতিতে এক হাজার লোক ফজরের নামায আদায় করলেন। রসূল সা. সবাইকে নিয়ে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে উহুদ ময়দানের দিকে রওয়ানা হলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাই ৩০০ জনকে ভাগিয়ে নিয়ে মদীনায় ফিরে গেল। কুরআনে তাদেরকে ঈমানদার নয় বলে ঘোষনা করা হলো।

এ ঘটনা দ্বারা প্রমাণ হলো, নামাযে রাসূলের সাথী হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধের ময়দানে সাথী হতে রাজি না হওয়ায় তারা ঈমানের পরীক্ষায় ফেল করল। রাসূল সা. কে দুনিয়ায় পাঠানোর আসল উদ্দেশ্যই হলো ইসলামকে বিজয়ী করা। এ আসল কাজে যারা শরীক হয়নি, তারা নামাযে শরীক হওয়া সত্ত্বেও বেঈমান বলে সাব্যস্ত হলো।

রাসূল সা. কে মুলত কী দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে, সে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কুরআনের তিনটি সূরায় তিন বার ঘোষণা করেছেন। সূরা তাওবার ৩৩ নং আয়াত, সূরা ফাত্‌হের ২৮ নং ও সূরা সাফ্‌-এর ৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘তিনি সেই সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও দীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন; যাতে তিনি (এ দীনকে) অন্য সব দীনের উপর বিজয়ী করতে পারেন।’’ এ কথাটি যে সবচেয়ে জরুরি, তা বুঝানোর জন্যই একই কথা তিন-তিন বার ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহর দীন বিজয়ী না হলে আল্লাহর কোনো ফরযই ঠিকমতো জারি হতে পারে না। তাই দীনকে বিজয়ী করার কাজটি সব ফরযের বড় ফরয। এ ফরয জারি হলে আল্লাহর দেওয়া সব ফরয সহজেই জারি হতে পারে। রাসূলকে শুধু নামায কায়েমের জন্য পাঠানো হয়নি; সবটুকু ইসলামকে বিজয়ী দীন হিসেবে কায়েম করতে পাঠানো হয়েছে।

তাহলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক হলেই মুসলিমদের দায়িত্ব কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। যারাই ঈমানদার বলে দাবি করে, তাদের ঈমানের দাবি পূরণ করতে হলে দেশে মানুষের মনগড়া আইনের বদলে আল্লাহর আইন চালু করার চেষ্টা করতেই হবে। এ চেষ্টা করাটাই ঈমানদারদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। এ কাজটিকে কুরআনে ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ বলা হয়েছে।

যদি আমরা এ আসল দায়িত্বটি পালন না করি, তাহলে দেশে মানুষের মনগড়া আইনই চালু থাকবে। যতদিন তা চালু থাকবে ততদিন জনগণ রাজনৈতিক যুলুম ও অর্থনৈতিক শোষন থেকে মুক্তি পাবে না। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা চালু না হলে আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানরা খাঁটি মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবে না। ইসলামী পারিবারিক বিধানও ঠিকমতো চালু করা যাবে না। সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, যৌতুক, যিনা, ধর্ষণ ইত্যাদি থেকে মানুষ নিস্তার পাবে না। তাই যারাই আল্লাহকে একমাত্র প্রভু ও রাসূল সা. কে একমাত্র নেতা বলে মেনে চলতে চায়, তাদেরকে আল্লাহর হক দীনকে বিজয়ী করার জন্য জান ও মাল দিয়ে চেষ্টা করতে হবে।

জিহাদ
আরবী শব্দ ‘জিহাদ’ নির্গত হয়েছে ‘জুহ্‌দ’ থেকে, জুহ্‌দ মানে চেষ্টা। ‘জিহাদ’ শব্দের অর্থ হলো বিরোধীশক্তির বাধা সত্ত্বেও চেষ্টা করতে থাকা।

কুরআনে বারবার হুকুম করা হয়েছে, ‘আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে জিহাদ কর।’ এর সহজ অর্থ হলো আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার জন্য জান ও মাল কুরবানী দিয়ে চেষ্টা করতে থাকা। এ চেষ্টার পয়লা কাজ হলো মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার দাওয়াত দেওয়া। যারা দাওয়াত কবুল করে তাদেরকে খাঁটি মুমিন হিসেবে গড়ে তোলার কাজটিও জিহাদ। এ কাজের যারা বিরোধী তাদের বাধা সহ্য করাও জিহাদ। ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার গঠন করাও জিহাদ। এ রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য যদি কোনো শক্তি আক্রমণ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও জিহাদ। নিজের জীবনে নাফসকে দমনের চেষ্টা করাও জিহাদ। অর্থাৎ আল্লাহ যা পছন্দ করেন তা চালু করা ও যা অপছন্দ করেন তা উৎখাত করার জন্য যা কিছু করা হয় সবই জিহাদ।

সাধারণ মানুষ জিহাদ বললে যুদ্ধকেই বুঝে। কিন্তু কুরআনে যুদ্ধের জন্য আলাদা শব্দ ‘কিতাল’ ব্যবহার করা হয়েছে। কিতাল অর্থ একে অপরকে হত্যা করা। জিহাদ মানে কিতাল নয়। অবশ্য জিহাদের বিভিন্ন স্তর ও অবস্থার একপর্যায়ে যুদ্ধের স্তরও আসতে পারে। অর্থাৎ যুদ্ধও এক রকমের জিহাদ। কিন্তু জিহাদ বলতে শুধু যুদ্ধকে বোঝায় না। জিহাদের অর্থ অনেক ব্যাপক।

‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’- এর বাংলা সহজ অনুবাদ হলো আল্লাহর পথে জিহাদ বা ইসলামী আন্দোলন করা। রাসূল সা. ইসলামকে কায়েম করার জন্য যা কিছু করেছেন সবই জিহাদের মধ্যে গণ্য। আল্লাহ তাআলার মর্জিমতো চেষ্টা করতে থাকাই জিহাদ।

ভালো কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধ
আল্লাহ তাআলা কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ সা. হাদীসে জোর দিয়ে বলেছেন, যে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করবে তার একটা কর্তব্য হলো অন্য মানুষকে ভালো কাজ করতে আদেশ করা এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা। কুরআন-হাদীসে এ কর্তব্যের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘আম্‌র বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার’।

রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ হতে দেখবে তার কর্তব্য হলো জোর করে তা বন্ধ করা। যার এ ক্ষমতা নেই, সে যেন কথা বলে তা বন্ধ করে। যার এ সাহসও নেই, সে যেন মনে মনে এ কাজের বিরোধী হয়। এটুকু সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’’

সমাজে যদি ব্যাপকহারে মন্দ কাজ চলতে থাকে, তাহলে এর কুফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। যেমন- কেউ যদি দুর্গন্ধের জিনিস বাড়িতে জমা করে তাহলে আশপাশের সবাই এর গন্ধে কষ্ট পাবে। তাই দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে হলে এলাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এ জন্যই রাসূল সা. হুকুম দিয়েছেন, যদি কেউ কোনো খারাপ কাজ হতে দেখে, সে যেন শক্তি প্রয়োগ করে তা বন্ধ করে দেয়। এ শক্তি না থাকলে যে মন্দ কাজ করছে তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঐ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এ শক্তিও যদি না থাকে তাহলে ঐ কাজকে খারাপ মনে করতে হবে এবং ঐ কাজ বন্ধ করার জন্য মনে মনে উপায় তালাশ করতে হবে। এটুকুও যদি সে না পারে তাহলে বোঝা গেল তার ঈমানই নেই।

অন্য মানুষকে ভালো কাজের আদেশ ও পরামর্শ দেওয়া বড়ই লাভজনক কাজ। রাসূল সা. বলেছেন, ‘‘কেউ কোনো লোককে ভালো কাজের পথ দেখালে ঐ লোক কাজ করে যে সওয়াব পাবে এর সমান সওয়াব সেও পাবে।’’ অন্যকে ভালো কাজের জন্য তাগিদ দিলে নিজের মধ্যে সে কাজ করার আগ্রহ ও জযবা বাগে। ভালো কাজের মধ্যে সেরা কাজ হলো মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা।

সূরা হা-মীম আস সাজদাহ’র ৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘ঐ লোকের কথার চেয়ে আর কার কথা বেশি ভালো হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকল, নেক আমল করল এবং বলল ‘অবশ্যই আমি মুসলিম’।’’

সূরা নিসার ৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘যে ব্যক্তি ভালো কাজের সুপারিশ করবে, সে তা থেকে অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের সুপারিশ করবে, সেও তা থেকে অংশ পাবে।’’

সূরা মায়িদার ২ নং আয়াতে আরো বলা হয়েছে, ‘‘তোমরা নেকী ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা কর, কিন্তু গু্নাহ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে পরস্পর সহযোগিতা করো না।’’

রাসূল সা. কীভাবে কাজ শুরু করেছিলেন?
রাসূল সা. যেমন নামায আদায়ের পদ্ধতি এবং আল্লাহর সব হুকুমই পালন করার তরীকা বা নিয়ম শিখিয়েছেন, তেমনি ইসলামকে তিনি যে নিয়মে বিজয়ী করেছেন সেভাবেই এ বড় কাজটি করতে হবে।

প্রথমে তিনি জনগণকে একমাত্র আল্লাহর হুকুম মেনে চলার দাওয়াত দিয়েছেন। সকল নবী ও রাসূল ঐ একই কথার দিকে ডাক দিয়েছিলেন।

সূরা আ’রাফের ৮ নং রুকু থেকে ১১ নং রুকু পর্যন্ত প্রতিটি রুকুর প্রথম আয়াতে হযরত নূহ আ., হযরত হূদ আ., হযরত সালেহ আ. ও হযরত শোয়াইব আ.- এর নাম নিয়ে দেখানো হয়েছে যে, সব নবী একই কথা বলে মানুষকে ডাক দিয়েছেন। সে কথাটি হলো, ‘‘হে আমার কাওম (দেশবাসী)! একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব কর। তিনি ছাড়া তোমাদে রআর কোনো ইলাহ নেই।’’

সহজেই মানুষ এ কথার মর্ম বুঝতে পারল। এ কথাটির মর্ম হলো, ‘‘তোমাদের উপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হুকুম করার অধিকার নেই। তোমরা যেমন মানুষ, যারা তোমাদের উপর হুকুম জারি করছে তারাও তেমন মানুষ। তোমাদের উপর তারা কেন মনগড়া হুকুম চালাবে? তোমরা ও তারা সবাই একমাত্র আল্লাহর হুকুমের গোলাম। তোমরা শুধু আল্লাহর দাসত্ব কর।’’

রাসূল সা.-কে মক্কাবাসী সকলেই সবচেয়ে সত্যবাদী ও ভালো মানুষ হিসেবে জানত। তিনি ‘আল-আমীন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। তিনি যে দাওয়াত দিলেন তা খুবই চমৎকার, যুক্তিপূর্ণ ও আকর্ষণীয় বলে লোকেরা বুঝতে পেরেছিল। তাই তাঁর এ ডাকে মানুষের সাড়া দেওয়ারই কথা।

আবু জাহ্‌ল, আবু লাহাব, আবু সুফিয়ানের মতো নেতাদের হুকুমই তখন সমাজে চলছিল। তাদের শাসনই মক্কাবাসীরা মানত। রাসূল সা. এর ঐ ডাকে মানুষ সাড়া দিলে তাদের নেতাগিরি খতম হয়ে যাবে। মানুষের উপর তাদের মনগড়া শাসন আর চলবে না। তাই এ দাওয়াত তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। রাসূল সা. এ কথা জানতেন ও বুঝতেন বলেই তিনি প্রথমে গোপনে ঘনিষ্ট লোকদেরকাছে দাওয়াত দিয়েছিলেন। প্রায় তিন বছর এভাবে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং বেশ কিছু লোক রাসূল সা. এর প্রতি ঈমান আনে। আস্তে আস্তো ঈমানদারদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে।

তখন আল্লাহ তাআলার হুকুমে রাসূল সা. একদিন কাবা শরীফের পাশে সাফা পাহাড়ে উঠে মক্কাবাসীদেরকে ডাক দিলেন। তাঁর মতো সম্মানিত লোকের ডাক শুনে ঐ নেতারাসহ অনেক মানুষ একত্রিত হয়। তখন তিনি বললেন, ‘‘আমি যদি বলি, পাহাড়ের অপর পাশে একদল দুশমন তোমাদের উপর হামলা করতে এসেছে, তাহলে কি তোমরা বিশ্বাস করবে?’’ সবাই একসাথে আওয়াজ দিল, ‘‘তুমি বলে বিশ্বাস করব। কারণ, কোনো সময় তোমাকে কোনো মিথ্যা কথা বলতে আমরা শুনিনি।’’ তাঁর সত্যবাদী হওয়ার কথা সবাই স্বীকার করার পর তিনি তাঁর আসল দাওয়াত পেশ করলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ঐ তিন নেতাসহ মক্কার সব বড় লোকেরা রাসূল সা. কে গালি দিতে দিতে চলে গেল। জনগণ যাতে রাসূল সা. এর ডাকে সাড়া না দেয়, সেজন্য তারা তাঁকে পাগল, জাদুকর, ক্ষমতালোভী বলে অপপ্রচার চালাল। যারাই ঈমান আনে তাদের উপর যুলুম-নির্যাতন শুরু করল। অনেকেই ভয়ে ঈমান আনতে সাহস পেল না। দুবছর পর ৮৩ জন লোক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাসূল সা. এর অনুমতি নিয়ে পালিয়ে গেলেন। শাসকরা এ ধরণের ব্যবহার সকল নবীদের সময়ই করেছে।

এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, আল্লাহর আইন কায়েমের জন্য যে দেশেই চেষ্টা করা হয়, সে দেশে যে শাসকদের মনগড়া আইন চালু আছে, সে শাসকরা বাধা দেবেই। কারণ, আল্লাহর আইন কায়েম হলে তাদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব খতম হয়ে যাবে।

আমরা যদি নিজেদেরকে ঈমানদার বলে দাবি করি, তাহলে আমাদেরকেও জনগণের নিকট ঐ দাওয়াত পৌঁছাতে হবে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় যাবতীয় সুবিধা যারা ভোগ করছে, তারা এ দাওয়াতের বিরোধিতাই করবে। এর কোনো পরওয়া না করে আমাদেরকে অবশ্যই দাওয়াত দিতে থাকতে হবে।

রাসূল সা. মযবুত সংগঠন গড়ে তুললেন
রাসূল সা. এর ডাকে যাঁরা সাড়া দিয়ে ‘আশহাদু আল্‌ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে রাসূলের প্রতি ঈমান আনার হিম্মত করলেন, তিনি তাদেরকে নিজের নেতৃত্বে জামাআতবদ্ধ করলেন। তাঁদের মন-মগজ-চরিত্র গঠন করতে থাকলেন, যাতে তাঁদেরকে সাথে নিয়ে মানুষের মনগড়া আইন ও শাসনকে উৎখাত করে আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম করতে পারেন।

এ বিরাট কাজটি নবীর পক্ষেও একা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ কোনো অযোগ্য লোককে নবী-রাসূল হিসেবে পাঠাননি। কিন্তু তিনি যত যোগ্যই হন, একটা দেশের আইন ও শাসন বদলিয়ে দেওয়ার মতো বিরাট কাজ করতে হলে একদল এমন লোক দরকার, যারা নবীর নেতৃত্বে ঐ উদ্দেশ্যে জান দিতে প্রস্তুত। ১৩ বছরে রাসূল সা. এমন একদল লোকই তৈরী করলেন।

ইসলামের বিজয়ের জন্য আল্লাহ তাআলা দুটো শর্ত দিয়েছেন। প্রথম শর্ত হলো, এমন একদল লোক তৈরী করা। আরো একটা শর্ত রয়েছে- তা হলো, যে এলাকায় আল্লাহর দীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা চলে সেখানকার জনগণও এর পক্ষে থাকা। আর কোনো এলাকার জনগণ যদি এর সক্রিয় বিরোধী হয় তাহলে আল্লাহ তাদের উপর জোর করে দীনের নিয়ামত চাপিয়ে দেন না।

মক্কায় প্রথমে কাফির নেতাদের পক্ষে এবং ইসলামের বিপক্ষে জনগণের সমর্থন থাকায় দ্বিতীয় শর্তটি সেখানে ছিল না। তাই প্রথম শর্তটি থাকা সত্ত্বেও মক্কায় তখন ইসলামকে বিজয়ী করা গেল না। তিন বছর আগে থেকে হজ্জের মৌসুমে মদীনার অনেক লোক ‘মিনা’য় (মক্কার তিন মাইল দূরে) গোপনে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাৎ করে ঈমান আনে। তাই আল্লাহ হুকুমে তিনি ইসলামী সরকার কায়েম করার উদ্দেশ্যে মদীনায় হিজরত করেন। মক্কার নেতারা রাসূল সা. কে মেরে ফেলার জন্য যে রাতে তৈরী ছিল, সে রাতেই তিনি হযরত আবু বকর রা. কে নিয়ে গোপনে মক্কা থেকে বের হয়ে যান। মদীনার জনগণ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।

মদীনায় ইসলামী সরকার গঠন
রাসূল সা. ১৩ বছরে মক্কা, মদীনা ও আরবের অন্যান্য জায়গায় যাদেরকে গড়ে তুলেছিলেন, তাদেরকে নিয়েই মদীনায় ইসলামী সরকার কায়েম করেন। তিনি ঐ সরকারের প্রধান হন। এরপর থেকেই আল্লাহর আইন ওহীর মাধ্যমে নাযিল হতে থাকে। আর নাযিলের সাথে সাথে প্রতি আইন চালু হতে থাকল। এভাবে ১০ বছরে সব আইন জারি হয়ে গেল।

মদীনায় ইসলামী সরকার কায়েমের ৮ বছর পর বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় হয়। রাসূল সা.- এর জন্মভূমি মক্কা থেকে তিনি গোপনে মদীনায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। আট বছার পরই রাসূল সা. এক বাহিনী নিয়ে বিনা বাধায় মক্কা জয় করেন। ২১ বছর পর্যন্ত যারা রাসূল সা. এর বিরুদ্ধে চরম দুশমনি করেছে, এমনকি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও বারবার মদীনায় হামলা করেছে, সে দুশমনদেরকে হাতে মুঠোয় পেয়ে তিনি মাফ করে দিলেন। দুশমন পরাজিত হলে প্রতিশোধ না নেওয়াই ইসলামের শিক্ষা। তিনি তাদেরকে হত্যা করতে পারতেন। তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়ায় তারা রাসূল সা. এর উদারতায় মুগ্ধ হয়ে সবাই তাঁর প্রতি ঈমান এনে ইসলামের পতাকাতলে দীক্ষিত হলেন। তিনি তাঁদের অন্তরকে জয় করলেন। শাস্তি দিলে এমন মহান বিজয় হতো না। শত্রুকে বন্ধু ‍বানানোই নবীর শিক্ষা।

বাংলাদেশে কি ইসলামের বিজয় সম্ভব?
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন মানুষ মুসলমান। তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, রাসূল সা. কে মহব্বত করে এবং কুরআনকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। ইসলামী সরকার নেই বলে তারা খাঁটি মুসলিম হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না; কিন্তু তারা ইসলামের বিরোধী নয়। রাসূল সা.-এর জন্মভূমির জনগণ ইসলামের বিরোধী ছিল বলে তাঁকে মদীনায় হিজরত করতে হয়। আমাদেরকে হিজরত করতে হবে না।

ইসলামের বিজয়ের জন্য যে দুটো শর্ত রয়েছে, এর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশে আছে। জনগণ ইসলামের সমর্থক বলেই ইসলামবিরোধী দলও জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য নির্বাচনের সময় আল্লাহ-রাসূলের দোহাই দেয়। তাই বাংলাদেশে ইসলামের বিজয়ের পূর্ণ সম্ভবনা রয়েছে।

ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রথম শর্তটি পূরণ হলেই এ দেশ ইসলামী সরকার কায়েম হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তাআলা সূরা আন্‌ নূরের ৫৫ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন- ঈমানদার, সৎ ও যোগ্য একদল লোক তৈরী হলেই তিনি তাদের হাতে খিলাফতের দায়িত্ব তুলে দেবেন।

লোক তৈরী করার দায়িত্ব তিনি নেননি। লোক তৈরী হলে ইসলামী সরকার কায়েম করার দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। রাসূল সা. এর যুগে লোক তৈরীর কাজ সমাধা হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা ঐ তৈরীকৃত লোকদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেন।

আমাদের আসল দায়িত্ব হলো ঈমান, ইলম ও আমলের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ এতো বেশি সংখ্যায় লোক তৈরী করা, যাতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামী সরকার কায়েমের তাওফীক দান করেন। যাদের হাতে ক্ষমতা দিলে ইসলামকে বিজয়ী করতে পারবে, আমাদের এই বাংলাদেশে এমন একদল লোক তৈরী হলেই ইসলামী সরকার কায়েম হতে পারে।

ইসলামী সরকার মানে সৎ ও যোগ্য লোকের সরকার
ইসলামী সরকার মানে ঈমানদার, সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন। সৎ লোক যদি যোগ্য না হয়, তাহলে তার সততা কোনো কাজেই আসে না। আর যোগ্য লোক যদি অসৎ হয়, তাহলে সে যোগ্যতার সাথেই অসৎ কাজ করে। তাই যদি সরকার এমন লোকদের হাতে থাকে, যারা সৎ ও যোগ্য, তবেই জনগণ সুখ-শান্তি ভোগে করতে পারে।

সরকার বললে শুধু প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ ও এমপিগণই বোঝায় না, সকল সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারি মিলেই সরকার। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করার সময় শুধু যোগ্যতাই যাচাই করা হয়, সততা যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো এমপি বানানোর জন্য যাদেরকে নমিনেশন দেয় তারাও যোগ্যতাকেই গুরুত্ব দেয়। তারাও সৎ লোক তালাশ করে না। নমিনেশন দেওয়ার সময় প্রার্থীর ধনবল ও জনবল দেখেই বাছাই করা হয়।

সৎ লোক বা ভালো মানুষ কাকে বলে? যে লোক গোপনেও খারাপ কাজ করে না, সে-ই সৎ লোক। সাধারণ মানুষ আইনের ভয়ে, পুলিশের ভয়ে ও লোকলজ্জার ভয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে; কিন্তু ধরা পড়বে না বলে মনে করলে সুযোগ পেলেই মহাঅন্যায় করতেও পরওয়া করে না।

প্রত্যেক মানুষেরই বিবেক আছে। কোন্‌টা ভালো ও কোন্‌টা মন্দ, তা বিবেকের নিকট স্পষ্ট। যারা মন্দ কাজ করে তাদের বিবেক জানে যে, কাজটা মন্দ। তারা বিবেকের বিরুদ্ধেই চলে। নাফ্‌সের তাড়না ও দুনিয়ার লোভে তারা বিবেকের ধার ধারে না।

সৎ লোক তারাই, যারা বিবেকের বিরুদ্ধে চলে না; তারা দুনিয়ার লোভকে ত্যাগ করার ক্ষমতা রাখে। এ ক্ষমতা তাদেরই থাকে, ‍যারা আল্লাহকে ও আখিরাতের শাস্তিকে ভয় করে। এরই নাম ঈমান। ঈমান ছাড়া সততার গুণ সৃষ্টি হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঈমানদার ও সৎ লোক তৈরী করে এবং সৎ ও যোগ্য লোকদেরকে এমপি বানায়, আর সরকার যদি সৎ ও যোগ্য লোকদেরকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারি নিয়োগ করে, তবেই ইসলামী সরকার কায়েম হতে পারে।

যেসব রাজনৈতিক দল ইসলামী সরকার কায়েম করতে চায়, তারা ঈমানদার ও সৎ লোকদেরকে দলভুক্ত করে তাদেরকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলে এবং যোগ্য লোকদেরকে দলে শামিল করে তাদেরকে ঈমানদার ও সৎ বানানোর চেষ্টা করে। এভাবে চেষ্টা না করলে সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন আপনা-আপনিই কায়েম হতে পারে না। সরকার যতবারই বদল হোক, সৎ ও যোগ্য লোকের শাসন ছাড়া জনগণের কপাল বদলাবে না।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি