ব্যক্তিগত গুণাবলী
ইসলামের যথার্থ জ্ঞান
ব্যক্তিগত গুণাবলীর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ইসলামের যথার্থ জ্ঞান। যে ব্যক্তি ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে সর্বপ্রথম যে জিনিসটি কায়েম করতে চায় তা জানতে ও বুঝতে হবে। এ কাজের জন্য ইসলামের নিছক সংক্ষিপ্ত জ্ঞান যথেষ্ট নয় বরং কমবেশী বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন। আর এর স্বল্পতা ও বিপুলতা মানুষের যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। এ জন্যে এ পথের প্রত্যেকটি পথিককে এবং আন্দোলনের প্রত্যেকটি কর্মীকে মুফতি বা মুজতাহিদ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই তবে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যি ইসলামের আকীদা বিশ্বাসকে জাহেলী চিন্তা কল্পনা ও ইসলামী কর্মপদ্ধতিকে জাহেলিয়াতের নীতি-পদ্ধতি থেকে আলাদা করে জানতে হবে এবং জীবনের বিভিন্ন বিভাগে ইসলাম মানুষকে কি পথ দেখিয়েছে সে সম্পর্কে অবগত হতে হবে। এ জ্ঞান ও অবগতি ছাড়া মানুষ নজে সঠিক পথে চলতে পারে না, অন্যকেও পথ দেখাতে পারে না এবং সমাজ পরিগঠনের জন্যে যথার্থ পথে কোন কাজ করতেও সক্ষম হয় না। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান এমন পর্যায়ে থাকতে হবে যার ফলে তারা গ্রাম ও শহরের লোকদেরকে সহজ-সোজাভাবে দ্বীনের কথা বুঝাতে সক্ষম হবে। কিন্তু উন্নত বুদ্ধি-বৃত্তির অধিকারী কর্মীদের মধ্যে এ জ্ঞান অধিক মাত্রায় থাকতে হবে। তাদের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হবে। শিতি লোকদের সকল প্রকার সন্দেহ-সংশয় নিরসন করতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ ও সন্তোষজনক জবাব দিতে হবে। ইসলামের আলোকে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান করতে হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে শিক্ষা ও শিল্পকে নতুন ছাঁচে ঢালাই করে বিন্যস্ত করতে হবে। ইসলামের অনাদী ও চিরন্তন ভিত্তির ওপর একটি নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাসাদ গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক চিন্তা ও কর্মের ত্রুটিপূর্ণ অংশকে ত্রুটিহীন অংশ থেকে আলাদা করার মত সমালোচনার যোগ্যতা তাদের মধ্যে থাকতে হবে। এবং এই সঙ্গে যা কিছু ভাঙ্গার তাকে ভেঙ্গে ফেলে তদস্থলে উন্নততর বস্তু গড়ার এবং যা কিছু রাখার তাকে কায়েম রেখে একটি উত্তম ও উন্নততর ব্যবস্থায় তাকে ব্যবহার করার মত গঠনমূলক যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তাকে হতে হবে।

ইসলামের প্রতি অবিচল বিশ্বাস
এ উদ্দেশ্য সম্পাদনে ব্রতী ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞানের পর দ্বিতীয় যে অপরিহার্য গুণটি থাকতে হবে সেটি হচ্ছে, যে দ্বীনের ভিত্তিতে সে জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় তার ওপর নিজেকে অবিচল ঈমান রাখতে হবে। ঐ জীবন ব্যবস্থার সত্যতা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে তার নিজের মন নিঃসংশয় হতে হবে। সন্দেহ, সংশয় ও দোদুল্যমান অবস্থায় মানুষ এ কাজ করতে পারে না। মানসিক সংশয় এবং বিশৃখল চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তির মন দোদুল্যমান, যার চিন্তা একাগ্র নয়, চিন্তা ও কর্মের বিভিন্ন পথ যাকে বিভ্রান্ত করে অথবা করতে পারে, সে ধরণের কোন লোক এ কাজের উপযোগী হতে পারে না। যে ব্যক্তি এ কাজ সম্পন্ন করবে তাকে নিঃসংশয় চিত্তে খোদার ওপর বিশ্বাস করতে হবে এবং কুরআনে বর্ণিত খোদার গুণাবলী, ক্ষমতা ও অধিকারের ওপর অবিচল ঈমান আনতে হবে। তাকে আখেরাতের ওপর অটল বিশ্বাস রাখতে হবে এবং কুরআনে আখেরাতের চিত্র যেভাবে বর্ণিত হয়েছে হুবহু সেভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (স) প্রদর্শিত পথই একমাত্র সত্য পথ এবং তার বিরোধী বা তার সাথে সামঞ্জস্যহীন প্রত্যেকটি পথই ভ্রান্ত। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, মানুষের যে কোন চিন্তা ও যে কোন পদ্ধতি যাচাই করার একটি মাত্র মানদণ্ড আছে এবং তা হচ্ছে খোদার কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত। এ মানদণ্ডে যে উতরে যাবে সে সত্য ও অভ্রান্ত আর যে উতরে যাবে না সে বাতিল ও ভ্রান্ত। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা পরিগঠনের জন্য এ সত্যগুলোর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং চিন্তার পূর্ণ একাগ্রতা লাভ করতে হবে। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে সামান্য দোদুল্যমান অবস্থায় বিরাজ করে অথবা এখনো অন্যান্য পথের প্রতি আগ্রহশীল তার এ প্রাসাদের কারিগর হিসেবে অগ্রসর হবার আগে নিজের এ দুর্বলতার চিকিৎসা প্রয়োজন।

চরিত্র ও কর্ম
তৃতীয় অপরিহার্য গুণটি হচ্ছে, কাজ কথা অনুযায়ী হতে হবে। যে বস্তুকে সে সত্য মনে করে তার অনুসরন করবে, যাকে বাতিল গণ্য করে তা থেকে দূরে সরে যাবে, যাকে নিজের দ্বীন ঘোষণা করে তাকে নিজের চরিত্র ও কর্মের দ্বীনে পরিণত করবে এবং যে বস্তুর দিকে সে বিশ্বাসীকে আহবান জানায় সর্বপ্রথম সে নিজে তার আনুগত্য করবে। সৎ কাজে আনুগত্য এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে বাইরে কোন চাপ প্রভাবের মুখাপেক্ষী হওয়া উচিৎ নয়। কোনো কাজ করলে খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে, কেবল এতোটুকু কারণেই তার আন্তরিক আগ্রহ ও ইচ্ছা সহকারে ঐ কাজ সম্পন্ন করা উচিৎ। আবার কোন কাজ নিছক খোদার নিকট অপছন্দ হবার কারণেই সে তা থেকে বিরত থাকবে। তার এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট কেবল সাধারণ অবস্থায় হওয়া উচিৎ নয় বরং তার চারিত্রিক শক্তি এতই উন্নত পর্যায়ের হতে হবে যে, অস্বাভাবিক বিকৃত পরিবেশে তাকে সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলা করে এবং সবরকম বিরোধিতা ও প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সত্য পথে অবিচল থাকতে হবে। যার মধ্যে এ গুণ নেই সে সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনের কাজে সাহায্যকারী হতে পারে কিন্তু সে প্রকৃত কর্মী হতে পারে না। ইসলামের জন্য যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে সামান্যতম ভক্তি, শ্রদ্ধা ও দরদ রাখে সে এ কাজে সাহায্যকারী হতে পারে। এমনকি যে ব্যক্তি ইসলামের অস্বীকারকারী ও তার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে তৎপর নয় সেও অনেকটা এর সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এ ধরণের কোটি কোটি সাহায্যকারী থাকলেও কার্যতঃ ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে পারে না এবং জাহেলিয়াতের বিকাশ ও পরিপুষ্টি সাধনের গতি রুদ্ধ হতে পারে না। কার্যতঃ এ কাজ একমাত্র তখনই সম্পাদিত হতে পারে, যখন এর জন্য এমন একদল লোক সামনে অগ্রসর হবে যারা জ্ঞান ও বিশ্বাসের সাথে চরিত্র ও কর্মশক্তি সমন্বিত হবে এবং যাদের ঈমান ও বিবেক এতো বিপুল জীবনী-শক্তির ধারক হবে যার ফলে বাইরের কোন উস্কানী ছাড়াই নিজেদের আভ্যন্তরীণ তাকীদে তার দ্বীনের চাহিদা ও দাবী পূরণ করতে থাকবে। এ ধরণের কর্মীরা যদি ময়দানে নেমে আসে তাহলে মুসলিম সমাজে এমনকি অমুসলিম সমাজেও সর্বত্র যে বিপুল সংখ্যক সমর্থক ও সাহায্যকারী পাওয়া যায় তাদের উপস্থিতিও ফলপ্রসূ হতে পারে।

দ্বীন হচ্ছে জীবনোদ্দেশ্য
সমাজ সংস্কার ও পরিগঠনে ব্রতী কর্মীদের মধ্যে এ তিনটি গুণাবলীর সাথে সাথে আর একটি গুণ থাকতে হবে। তা হলো খোদার বাণী বুলন্দ করা এবং দ্বীনের প্রতিষ্ঠা নিছক তাদের জীবনের একটি আকাঙ্খার পর্যায়ভূক্ত হবে না বরং এটিকে তাদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করতে হবে। এক ধরণের লোক দ্বীন সম্পর্কে অবগত হয়, তার উপর ঈমান রাখে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম তাদের জীবনের লক্ষ্য বিবেচিত হয় না বরং সততা ও সৎকর্ম করে এবং এই সঙ্গে নিজেদের দুনিয়ার কাজ কারবারে লিপ্ত থাকে। নিঃসন্দেহে এরা সৎ লোক। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকলে এরা তার ভাল নাগরিকও হতে পারে। কিন্তু যেখানে জাহেলী জীবনব্যবস্থা চর্তুদিক আচ্ছন্ন করে রাখে এবং তাকে সরিয়ে তদস্থলে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্ন দেখা দেয় সেখানে নিছক এ ধরণের সৎলোকদের উপস্থিতি কোনো কাজে আসে না বরং সেখানে এমন সব লোকের প্রয়োজন হয় যাদের জীবনোদ্দেশ্যরুপে এ কাজ বিবেচিত হয়। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ তারা অবশ্যি করবে কিন্তু তাদের জীবন একমাত্র এ উদ্দেশ্যের চারিদিকে আবর্তন করবে। এ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য তারা হবে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। এ জন্যে নিজেদের সময়-সামর্থ, ধন-মাল ও দেহ-প্রাণের সকল শক্তি এবং মন মস্তিষ্কের পরিপূর্ণ যোগ্যতা ব্যয় করতে তারা প্রস্তুত হবে। এমন কি যদি জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাতেও তারা পিছপা হবে না। এ ধরণের লোকেরাই জাহেলিয়াতের আগাছা কেটে ইসলামের পথ পরিস্কার করতে পারে।

দ্বীনের সঠিক নির্ভুল জ্ঞান, তার প্রতি অটল বিশ্বাস, সেই অনুযায়ী চরিত্র গঠন এবং তার প্রতিষ্ঠাকে জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করা এগুলো এমন সব মৌলিক গুণ যেগুলো ব্যক্তিগতভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টারত প্রত্যেকটি ব্যক্তির মধ্যে থাকা উচিৎ। এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। অর্থাৎ এ গুনাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ছাড়া এ কাজ সম্পাদনের কল্পনাই করা যেতে পারে না।

বলাবাহুল্য, এহেন ব্যক্তিরা যদি সত্যিই কিছু করতে চায় তাহলে তাদের একটি দলভুক্ত হয়ে এ কাজ করা অপরিহার্য। তারা যে কোন দল-ভুক্ত হোক এবং যে কোন নামে কাজ করুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি জানে, নিছক ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় সমাজব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনা যেতে পারে না। এজন্যে বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা নয়, সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কাজেই একে একটি সর্ববাদী সম্মত সত্য মনে করে এখন আমরা এ ধরণের দলের মধ্যে দলীয় যে সব গুণ থাকা অপরিহার্য সেগুলোর আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি