পূর্ণতাদানকারী গুণাবলী
এ পর্যন্ত আমরা সমাজ সংশোধন ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিগঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠনের অপরিহার্য গুণাবলী আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে যেসকল বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিছক প্রারম্ভিক ও মৌলিক গুণাবলীর পর্যায়ভুক্ত। কোন ব্যবসা শুরু করতে হলে যেমন একটা সর্বনিন্ম পুঁজির প্রয়োজন হয়, যা না হলে ঐ ব্যবসা শুরু করাই যেতে পারে না। তেমনি এ গুণাবলী হচ্ছে ব্যক্তির সর্বনিম্ন নৈতিক পুঁজি, এগুলো ছাড়া সমাজ সংশোধন ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা পরিগঠনের কাজ শুরু করাই যেতে পারে না। বলাবাহুল্য যেসব লোক নিজেরা ইসলাম সম্পর্কে অবগত নয় বা এ ব্যাপারে মানসিক নিশ্চিন্ততা ও একাগ্রতা লাভ করতে পারেনি অথবা তাকে নিজেদের চরিত্র, কর্ম ও বাস্তব জীবনের ধর্মে পরিণত করতে সক্ষম হয়নি বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নিজেদের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করেনি, তাদের দ্বারা কোন ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তাই করা যায় না। অনুরূপভাবে যদি অভিপ্সীত গুণাবলী সমন্বিত ব্যক্তিবর্গের নিছক সমাবেশ হয় কিন্তু তাদের দীল পরস্পরের সাথে সংযুক্ত না হয়, তাদের মধ্যে সহযোগীতা শৃঙ্খলা ও সংগঠন না থাকে, তারা এক সাথে মিলেমিশে কাজ করার রীতিতে অভ্যস্ত না থাকে এবং পারস্পারিক পরামর্শ ও সমালোচনার যথার্থ পদ্ধতি সম্পর্কে যদি তারা অজ্ঞ থাকে, তাহলে তাদের নিছক সমাবেশ কোন প্রকার ফলপ্রসূ হতে পারে না। কাজই এ কথা ভালোভাবে অনুধাবন করা উচিৎ যে, ইতিপূর্বে আমি যে চারটি ব্যক্তিগত ও চারটি সামষ্টিক গুণাবলীর উল্লেখ করে এসেছি সেগুলোই হচ্ছে এ কাজা শুরু করার প্রাথমিক পুঁজি এবং একমাত্র এ প্রেক্ষিতেই সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ কাজের বিকাশ ও সাফল্যের জন্য নিছক এতটুকু নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পুঁজি যথেষ্ট-এ ধারণা যথার্থ নয়। এখন আমরা অপরিহার্য গুণাবলীর আলোচনা করবো।

খোদার সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা
এ গুণাবলীর মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খোদার সাথে সম্পর্ক ও আন্তরিকতা। দুনিয়ার অন্যান্য কাজ ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র, জাতি বা দেশের জন্যে করা যেতে পারে, ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভের যাবতীয় দিক সম্ভাবনা সহকারে সম্পাদন করা যেতে পারে, খোদা বিশ্বাসই নয়, খোদাকে অস্বীকার করেও করা যেতে পারে এবং এর ভেতর সব রকম পার্থিব সাফল্য লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েম করা একটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ। যে পর্যন্ত মানুষের সম্পর্ক খোদার সাথে যথার্থ শক্তিশালী ও গভীর না হয় এবং সে একমাত্র খোদার জন্যে কাজ করতে মনস্থ না করে সে পর্যন্ত এ কাজে কোন প্রকার সাফল্য সম্ভব নয়। কারণ এখানে মানুষ খোদার দ্বীনকে কায়েম করতে চায়। আর এ জন্যে সবকিছু খোদার জন্যে করা প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কাজে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টিই কাম্য হতে হবে। একমাত্র খোদাপ্রীতিই এ কর্মের মূল প্রেরণা হতে হবে। তাঁর সাহয্য ও সমর্থনের ওপর পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে। তাঁরই নিকট থেকে পুরস্কারের আশা থাকতে হবে। এবং তাঁরই নিকট জবাবদিহীর ভয়ে সমগ্র মন আচ্ছন্ন থাকতে হবে। এছাড়া আর কোন ভয়, লোভ-লালসা প্রীতি ও আনুগত্যের মিশ্রণ এবং অন্য যে কোন স্বার্থের অন্তর্ভুক্তি এ কাজকে যথার্থ পথ থেকে বিচ্যুত করবে এবং এর ফলে অন্যকিছু কায়েম হতে পারে কিন্তু খোদার দ্বীন কায়েম হতে পারে না।

আখেরাতের চিন্তা
এ প্রথোমোক্ত গুণটির সাথে নিকট সম্পর্কযুক্ত দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে, আখেরাতের চিন্তা। যদিও দুনিয়াই মু’মিনের কর্মস্থল এবং সবকিছু তাকে এখানেই করতে হয়। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে এ দুনিয়ার জন্যে কাজ করে না বরং আখেরাতের জন্যে করে এবং দুনিয়ার ফলাফলের দিকে তার ল্য থাকে না বরং তার লক্ষ্য থাকে আখেরাতের ফলাফলের প্রতি। যেসব কাজ আখেরাতে লাভজনক সেসব তাকে করতে হবে এবং যেসব কাজের ফলে আখেরাতের কোন লাভ হবে না সেগুলো তাকে ত্যাগ করতে হবে। দুনিয়ার যেসব লাভ আখেরাতে ক্ষতিকর সেগুলো তাকে বর্জন করতে হবে আর দুনিয়ার যেসব ক্ষতি আখেরাতে লাভজনক সেগুলো তাকে গ্রহণ করতে হবে। তাকে একমাত্র আখেরাতের শাস্তি ও পুরস্কারের চিন্তা করতে হবে। দুনিয়ার কোন শাস্তি ও পুরস্কারের গুরুত্ব তার চোখে থাকা উচিৎ নয়। এ দুনিয়ায় তার চেষ্টা ফলপ্রসূ হোক বা না হোক, সে সফলতা বা ব্যর্থতা যারই সম্মুখীন হোক, সকল অবস্থায় তাকে এ বিশ্বাস নিয়ে কাজ করা উচিৎ যে, যে খোদার জন্যে সে এ পরিশ্রম করছে তাঁর দৃষ্টি থেকে কিছুই প্রচ্ছন্ন নেই এবং তাঁর নিকট আখেরাতের চিরন্তন পুরস্কার পাওয়া থেকে সে কোনক্রমেই বঞ্চিত হবে না এবং সেখানকার সাফল্যই হচ্ছে আসল সাফল্য। এ মানসিকতা ছাড়া এ পথে মানুষের পক্ষে নির্ভুল লক্ষ্য এর দিকে এক পা অগ্রসর হওয়াও সম্ভব নয়। দুনিয়ার স্বার্থের সামান্যতম মিশ্রণ এর মধ্যে থাকলে এখানে পদস্খলন ছাড়া গত্যন্তর নেই। যে ব্যক্তি দুনিয়ার সাফল্যকে চুড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত করে অগ্রসর হয় খোদার পথে একটি না হলেও দু’চারটি আঘাতেই সে হিম্মতহারা হয়ে পড়ে। দুনিয়ার স্বার্থ যার মনে স্থান লাভ করে এ পথের যে কোন সাফল্য কোন না কোন পর্যায়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনে।

চরিত্র মাধুর্য
চরিত্র মাধুর্য উপরোক্ত গুণটির প্রভাবকে কার্যতঃ একটি বিরাট বিজয়ী শক্তিতে পরিণত করে। খোদার পথে যারা কাজ করে তাদের উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী হতে হবে, সৃষ্টির প্রতি সহানুভুতিশীল ও মানবতার দরদী হতে হবে। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাবসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্টসহিষ্ণু, মিষ্টভাষী ও সদালাপী। তাদের দ্বারা কোন ক্ষতি হবে এমন কোন ধারণাও যেন কেউ পোষন করতে না পারে এবং তাদের নিকট থেকে কল্যাণ ও উপকার সবাই কামনা করবে। তারা নিজেদের প্রাপ্যের চাইতে কমের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে এবং অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশী দিতে প্রস্তুত থাকবে। তারা মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেবে অথবা কমপক্ষে মন্দ দিয়ে দেবে না। তারা নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করবে এবং অন্যের গুণাবলীর কদর করবে। তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেবার মত বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষ-ত্রুটি ও বাড়াবাড়ি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর উপর প্রতিশোধ নেবে না। তারা অন্যের সেবা গ্রহণ করে নয় বরং অন্যকে সেবা করে আনন্দিত হবে। তারা নিজের স্বার্থে নয় বরং অন্যের ভালোর জন্য কাজ করবে। কোন প্রকার প্রশংসার অপেক্ষা না করে এবং কোন প্রকার নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাবে। খোদা ছাড়া আর কারো পুরস্কারের প্রতি দৃষ্টি দেবে না। তাদেরকে বল প্রয়োগে দমন করা যাবে না। ধন-সম্পদের বিনিময়ে ক্রয়করা যাবে না কিন্তু সত্য ও ন্যায়ের সামনে তারা নির্দ্বিধায় ঝুঁকে পড়বে। তাদের শত্রুরাও তাদের ওপর এ বিশ্বাস রাখবে যে, কোন অবস্থায় তারা ভদ্রতা ও ন্যায়-নীতি বিরোধী কোন কাজ করবে না। এ চারত্রিক গুণাবলী মানুষের মন জয় করে নেয়। এগুলো তলোয়ারের চাইতে ধারালো এবং হীরা, মণি-মুক্তার চাইতেও মূল্যবান। যে এহেন চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনকারী সে তার চারপাশের জনবসতির ওপর বিজয় লাভ করে। কোন দল পূর্ণাঙ্গরূপে এ গুণাবলীর অধিকারী হয়ে কোন মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে দেশের পর দেশ তার করতলগত হতে থাকে এবং দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় না।

ধৈর্য
এই সঙ্গে আর একটি গুণও সংযুক্ত আছে, তাকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলা যায়। সেটি হচ্ছে ধৈর্য। ধৈর্যের বহু অর্থ হয় এবং খোদার পথে যারা কাজ করে তাদের এর প্রত্যেকটি অর্থের প্রেক্ষিতেই ধৈর্যশীল হতে হয়।

ধৈর্যের একটি অর্থ হচ্ছে তাড়াহুড়ো না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বড়িৎ ফল লাভের জন্যে অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি সারাজীবন একটি উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে অনবরত পরিশ্রম করতে থাকে এবং একের পর এক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েও পরিশ্রম থেকে বিরত হয় না। মানুষের সংশোধন ও পরিগঠনের কাজ অন্তহীন ধৈর্যের মুখাপেক্ষী। বিপুল ধৈর্য ছাড়া কোন ব্যক্তি এ কাজ সম্পাদনে সক্ষম হয় না। এটা নিছক ছেলের হাতের মোয়া নয়।

ধৈর্যের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। ধৈর্যশীল ব্যক্তি একবার ভেবেচিন্তে যে পথ অবলম্বন করে তার ওপর অবিচল থাকে এবং একাগ্র ইচ্ছা ও সংকল্পের পূর্ণ শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।

ধৈর্যের আর একটি অর্থ হচ্ছে বাঁধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবেলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা। ধৈর্যশীল ব্যক্তি যে কোন ঝড়-ঝন্ঝার পর্বত প্রমাণ তরঙ্গাঘাতে হিম্মতহারা হয়ে পড়ে না।

দুঃখ-বেদনা, ভরাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়াও ধৈর্যের একটি অর্থ। যে ব্যক্তিকে সমাজ সংশোধন ও পরিগঠনের খাতিরে কিছু অপরিহার্য ভাঙ্গার কাজও করতে হয়, বিশেষ করে যখন দীর্ঘকালের বিকৃত সমাজে তাকে এ কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়, তখন অবশ্যি তাকে বড়ই নিম্নস্তরের হীন ও বিশ্রী রকমের বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়। যদি সে গাল খেয়ে হাসবার ও নিন্দাবাদ হজম করার ক্ষমতা না রাখে এবং দোষারোপ ও মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডাকে নির্বিবাদে এড়িয়ে গিয়ে স্থির চিত্তে ও ঠান্ডা মস্তিষ্কে নিজের কাজে ব্যস্ত না থাকতে পারে, তাহলে এ পথে পা না বাড়ানোই তার জন্যে বেহতর কারণ এ পথে কাঁটা বিছানো। এর প্রত্যেকটি কাঁটা এই দৃঢ় মনোবল নিয়ে মুখ উঁচিয়ে আছে যে, মানুষ অন্য যে কোনদিকে নির্বিঘ্নে অগ্রসর হতে পারে কিন্তু এ দিকে তাকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসতে দেয়া হবে না। এ অবস্থায় যে ব্যক্তি কাপড়ের প্রত্যেকটি কাঁটা ছাড়াতে ব্যস্ত হবে সে কেমন করেই বা অগ্রসর হবে? এ পথে এমন সব লোকের প্রয়োজন যারা নিজেদের কাপড়ে কোন কাঁটা বিধলে কাপড়ের সে অংশটি ছিড়ে কাঁটাগাছের গায়ে রেখে দিয়ে নিজের পথে এগিয়ে যেতে থাকবে। কেবল বিরোধীদের মোকাবেলায় এ ধৈর্যের প্রয়োজন হয় না বরং অনেক সময় এ পথের পথিকের নিজের সহযোগীদের তিক্ত ও বিরক্তিকর বাক্যবাণেও বিদ্ধ হতে হয় এবং তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় না দিলে সমগ্র কাফেলা পথভ্রষ্ট হতে পারে।

ধৈর্যের এক অর্থ হচ্ছে, সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খায়েশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। হারাম থেকে দুরে থাকা ও খোদার নির্দেশিত সীমার মধ্যে অবস্থান করা, গোনাহর পথে যাবতীয় আরাম-আয়েশ, লাভ প্রত্যাখান করা এবং নেকী ও সততার পথে সকল প্রকার ক্ষতি ও বঞ্চনাকে সাদরে বরণ করা। দুনিয়াপুঁজারীদের আরাম-আয়েশ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেও তার প্রতি লোভ না করা এবং এজন্যে সামান্য আপেক্ষা না করা। দুনিয়ার স্বার্থ উদ্ধারের পথ প্রশস্ত দেখে এবং সাফল্যের সুযোগ-সুবিধা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও পূর্ণ মানসিক নিশ্চিন্ততার সাথে একমাত্র নিজের লক্ষ্য অর্জনের পথে লব্ধ দানের ওপর সন্তুষ্ট থাকার নাম ধৈর্য।

উপরোক্ত সকল অর্থেই ধৈর্য হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি। কাজেই আমাদের কাজের মধ্যে যে কোন দিক দিয়ে ধৈর্যহীনতা দেখা দিলে অবশ্য আমাদেরকে তার কুফলের সম্মুখীন হতে হবে।

প্রজ্ঞা
এসব গুণের পাশাপাশি আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে প্রজ্ঞা। কাজের বেশী সাফল্য এরই ওপর নির্ভরশীল। দুনিয়ায় যেসব জীবনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে উন্নত পর্যায়ের বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাশীল লোকেরাই সেগুলো চালাচ্ছে। তাদের পেছনে ব্যক্তিগত উপায়-উপকরণের সাথে সাথে বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষমতাও কাজ করছে। এগুলোর মোকাবেলায় আর একটি জীবনব্যবস্থা কায়েম করা এবং সাফল্যের সাথে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নেহায়েত ছেলেখেলা নয়। নিছক বিসমিল্লাহর গম্বুজে যাদের বসবাস এ কাজ তাদের দ্বারা সাধিত হওয়া সম্ভব নয়। সরলমনা, চিন্তা ও তীক্ষবুদ্ধি বিবর্জিত লোকেরা যতই সৎ নেক-দীল হোক না কেন, এ কাজ তাদের দ্বারা সম্পাদিত হবার সম্ভাবনা নেই। এ জন্যে গভীর দৃষ্টি, চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনা শক্তির প্রয়োজন। এ কাজ একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্পাদিত হতে পারে যারা পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, বিচার-বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতা রাখে এবং জীবন সমস্যা বুঝার ও সমাধানের যোগ্যতা রাখে। এসব গুণকেই এক কথায় প্রজ্ঞা বলা যায়। বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও প্রকাশের ওপর এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি হচ্ছে মানবিক মনস্তত্ব অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী মানুষের সাথে ব্যবহার করা, এবং মানুষের মনের ওপর নিজের দাওয়াতের প্রভাব বিস্তার করে তাকে লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত করার পদ্ধতি অবগত হওয়া। প্রত্যেক ব্যক্তিকে একই পেটেন্ট ওষুধ না দিয়ে বরং প্রত্যেকের মেজাজ ও রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা। প্রত্যেককে একই লাঠি দিয়ে হাঁকিয়ে না দিয়ে বরং প্রত্যেক ব্যক্তি, শ্রেণী ও দলের বিশেষ অবস্থা অনধাবন করে সেই অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করা।

নিজের কাজ ও তা সম্পাদন করার পদ্ধতি জানা এবং তার পথে আগত যাবতীয় বাঁধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা-বিরোধীতার মোকাবেলা করাও প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি। তাকে নির্ভুলভাবে জানতে হবে যে, যে উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে সে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা সফল করার জন্যে তাকে কি করতে হবে, কিভাবে করতে হবে এবং কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করতে হবে।

পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখা, সময়-সুযোগ অনুধাবন করা এবং কোন সময়ে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, এসব জানাও প্রজ্ঞারই পরিচয়। অবস্থা না বুঝেই অন্ধের মত পা বাড়িয়ে দেয়া, অসমায়োচিত কাজ করা, কাজের সময় ভুল করা গাফেল ও বুদ্ধিবিবেচনাহীন ব্যক্তির কাজ। এ ধরণের লোকেরা নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে যতই সততা ও সৎ সংকল্পের সাথে কাজ করুক না কেন তারা কোন ক্রমেই কামিয়াব হতে পারে না।

দ্বীনের ব্যাপারে সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞান ও দুনিয়ার কাজ-কারবারের ক্ষেত্রে তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টি রাখাই হচ্ছে সবচাইতে বড় প্রজ্ঞার পরিচয়। নিছক শরীয়তের বিধি-নিষেধ ও মাসায়েল অবগত হয়ে উপস্থিত ঘটনাবলীকে সে দৃষ্টিতে বিচার করা মুফতির জন্যে যথেষ্ঠ হতে পারে। কিন্তু বিকৃত সমাজের সংশোধন ও জীবনব্যবস্থাকে জাহেলিয়াতের ভিত্তি থেকে সমূলে উৎপাটিত করে দ্বীনের ভিত্তিতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যথেষ্ঠ হতে পারে না। এ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে বিধি-নিষেধের খুঁটিনাটি দিকের সাথে তার মূলগত দিকের (বরং পরিপূর্ণ দ্বীনি ব্যবস্থার) ওপর নজর রাখতে হবে। উপরন্তু বিধি-নিষেধের সাথে সাথে সেগুলোর কারণ, যৌক্তিকতা ও ফলাফল সম্পর্কেও ওয়াকিফহাল হতে হবে এবং যেসব সাময়িক পরিস্থিতি ও সমস্যাকে সে দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে সেগুলোও বুঝতে হবে।

অভিপ্সীত গুনাবলীর এ বিরাট ফিরিস্তি দেখে আপাতঃ দৃষ্টিতে মানুষ ভীত হয়ে পড়ে এবং চিন্তা করতে থাকে যে, আল্লাহর কামেল বান্দাহ ছাড়া তো এ কাজ আর কারোর দ্বারা সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এতো বিচিত্র ও বিপুল গুণের সমাবেশ কেমন করে সম্ভব। এ ভুল ধারণা নিরসনের জন্যে অবশ্যই একথা জানা প্রয়োজন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি গুণ পরিপূর্ণরুপে পাওয়া সম্ভব নয় এবং কোন ব্যক্তির মধ্যে প্রথম পদেক্ষেপই তা পূর্ণ অনুশীলিত আকারে বিদ্যমান থাকাও জরুরী নয়। আমি একথা বলে বুঝাতে চাচ্ছি যে, যারা এ কাজ করতে অগ্রসর হবে তারা নিছক জাতি সেবার একটি কাজ মনে করে গতানুগতিক পদ্ধতিতে অগুসর হবে না বরং নিজের মনোজগত পর্যোলচনা করে কাজ সম্পাদনের জন্যে যে গুনাবলীর প্রয়োজন তার উপাদান তার মধ্যে আছে কি-না তা জানার চেষ্টা করবে। উপাদান থাকলে কাজ শুরু করার জন্যে যথেষ্ঠ। তাকে লালণ করা ও নিজের সামর্থ অনুযায়ী যথাসম্ভব অধিক উন্নত করা পরবর্তী পর্যায়সমূহের সাথে সম্পর্কিত। বীজ থেকে অঙ্কুরিত একটি ছোট্ট চারাগাছ মাটির গভীরে শিকড় পৌঁছিয়ে দেবার পর ধীরে ধীরে খাদ্য সংগ্রহ করে বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়। কিন্তু যদি বীজেরই অস্তিত্ব না থাকে তাহলে সেখানে কিছুই হতে পারে না। অনুরূপ ভাবে অভিপ্সীত গুণাবলীর উপাদান যদি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে তাহলে উপযুক্ত প্রচেষ্টা সাধনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কিন্তু যদি আদতে উপাদানই না থাকে তাহলে প্রচেষ্টা সাধনার মাধ্যমে কোন প্রকার গুণাগুণ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়।

এ পর্যন্ত যা কিছু বলা হলো তার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, সংশোধন ও পরিগঠনের জন্যে একটি নির্ভুল কর্মসূচীর যতটা প্রয়োজন তার চাইতে কয়েকগুণ বেশী প্রয়োজন এ কাজের উপযোগী নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন কর্মীদের। কারণ, কোন কর্মসূচীর দফাসমূহকে নয় বরং যেসব লোক কর্মেক্ষেত্রে কাজ করার জন্যে অগ্রসর হয় তাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক চরিত্রকেই অবশেষে সমাজ এবং সমষ্টির সাথে সংঘর্ষশীল ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। তাই কোন কর্মসূচী ও প্রোগ্রাম স্থির করার পূর্বে কাজের জন্যে কোন ধরণের কর্মীর প্রয়োজন, তাদের কোন গুণাবলী সমন্বিত হতে হবে ও কোন ত্রুটিমুক্ত হতে হবে এবং এ ধরণের কর্মী তৈরীর উপায় কি, এ সম্পর্কে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর আমি অভিপ্সীত গুণাবলীকে তিন অংশেঃ প্রথমতঃ কাজের ভিত্তি হিসেবে এ কাজে অংশ গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে যে সব গুণ থাকা উচিৎ সেগুলো হচ্ছেঃ

১) দ্বীনের নির্ভুল জ্ঞান;

২) তার প্রতি অটুট বিশ্বাস;

৩) সে অনুযায়ী চরিত্র গঠন ও কর্ম সম্পাদন;

৪) তাকে প্রতিষ্ঠিত করাকে নিজের জীবনোদ্দেশ্যে পরিণত করা।

দ্বিতীয়তঃ যে দল এ কাজ সম্পাদনে অগ্রসর হয় তার মধ্যে যে সব গুণ থাকা উচিৎ সেগুলো হচ্ছেঃ

১) পারস্পারিক ভালোবাসা, পরস্পরের প্রতি সুধারণা, আন্তরিকতা, সহানুভূতি, কল্যাণ কামনা ও পরস্পরের জন্যে ত্যাগ স্বীকার।

২) সংগঠন, শৃঙ্খলা, সুসংবদ্ধতা, নিয়মানুবর্তিতা, সহযোগীতা ও টীম স্প্রীরীট;

৩) সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা, এ সমালোচনা হতে হবে ভদ্রতার সাথে, যুক্তিসংগত পদ্ধতিতে, যার ফলে দলের মধ্যে সৃষ্ট অসৎ গুণাবলী বৃদ্ধি পাওয়ার পরিবর্তে যথাসময়ে তার অপনোদন সম্ভব হবে।

তৃতীয়তঃ দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে নির্ভুল পথে পরিচালিত করার ও তাকে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছাবার জন্যে যে সব গুণ অপরিহার্য সেগুলো হচ্ছেঃ

১) আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও তার সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করা;

২) আখেরাতের জবাবদিহীকে স্মরণ রাখা এবং আখেরাতের পুরস্কার ভিন্ন অন্য কিছুর প্রতি নজর না দেয়া;

৩) চরিত্র মাধুর্য;

৪) ধৈর্য;

৫) প্রজ্ঞা।

এখন আমি এ মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনে ব্রতী ব্যক্তিবর্গকে যেসব অসৎ গুণ থেকে মুক্ত হওয়া উচিৎ সেগুলো আলোচনা করবো।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি