চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা ও তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য
ইসলাম পারস্পারিক সম্পর্কেও যে মান নির্ধারণ করেছে তাকে কায়েম ও বজায় রাখার জন্যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল পারস্পারিক অধিকার ও মর্যাদার ভিত্তিতে একটি বিধ-বিধানও তৈরী করে দিয়েছেন। সেই বিধি-বিধানকে অনুসরণ করে এ সম্পর্ককে অনায়াসে দ্বীন-ইসলামের অভীষ্ট মানে উন্নীত করা যেতে পারে। এ বিধি-বিধানের ভিত্তি কতিপয় মৌলিক বিষয়ের ওপর স্থাপিত। এগুলো যদি মানুষ তার নৈতিক জীবনে গ্রহণ করে ও অনুসরণ করে তাহলে ঐ অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কিত প্রতিটি জিনিসই এই মৌলিক গুণরাজির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে প্রকাশ পেতে থাকবে। অন্য কথায় বলা যায়, এই গুণরাজি এক একটি কর্তব্য পালন এবং এক একটি মর্যাদা লাভের জন্যে মানুষের ভেতর থেকে ক্রমাগত তকিদ ও দাবী জানাতে থাকবে। এর ফলে প্রতি পদেেপই সদুপদেশ বা সতর্কবাণীর প্রয়োজন হবে না। এই গুণরাজির মধ্যে সবচেয়ে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে কল্যাণ কামনা।

১. কল্যাণ কামনা
হাদীস শরীফে কল্যাণ কামনার জন্যে ‘নছিহত’ (نصخت) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। এ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থপূর্ণ। এ কারণে নবী করীম (সঃ) এ পর্যন্ত বলেছেন الدين النصيحة (ثلاثا) ‘দ্বীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা’। (এ বাক্যটি তিনি এক সঙ্গে তিনবার উচ্চারন করেছেন)-মুসলিম।

এরপর অধিকতর ব্যাখ্যা হিসেবে যাদের প্রতি কল্যাণ কামনা করা উচিত, তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের কথাও উল্লেখ রয়েছে। এভাবে একবার মহানবী (সঃ) তাঁর কতিপয় সাহাবীদের কাছ থেকে সাধারণ মুসলমানদের জন্যে কল্যাণ কামনার (নছিহত) বাইয়াত গ্রহণ করেন। আভিধানিক অর্থের আলোকে এ শব্দটির তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, সম্পর্কের ভেতর কোন ভেজাল বা ত্র“টি না থেকে যায়। অন্যকথায় এ গুণটি আমরা এভাবে নির্ধারণ করতে পারি যে মানুষ তার ভাইয়ের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তায় সর্বদা প্রভাবান্বিত থাকবে; তারই মঙ্গল সাধনের জন্যে প্রতিটি মুহূর্ত উদ্গ্রীব থাকবে, তারই উপকার করার জন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করবে, তার কোন তি বা কষ্ট স্বীকার করবে না। বরং দ্বীন ও দুনিয়াবী যে কোন দিক দিয়ে সম্ভব তার সাহায্য করার প্রয়াস পাবে। এ কল্যাণ কামনার প্রকৃত মন্দণ্ড হচ্ছে যে মানুষ তাঁর নিজের জন্যে যা পছন্দ করবে, তার ভাইয়ের জন্যেও ঠিক তা পছন্দ করবে। কারণ মানুষ কখনো আপন অকল্যাণ কামনা করতে পারে না। বরং নিজের জন্যে সে যতটুকু সম্ভব ফায়দা, কল্যাণ ও মঙ্গল বিধানেই সচেষ্ট থাকে। নিজের অধিকারের বেলায় সে এতোটুকু তি স্বীকার করতে পারে না, নিজের ফায়দার জন্যে সময় ও অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য করে না, নিজের অনিষ্টের কথা সে শুনতে পারে না, নিজের বে-ইজ্জতি কখনো বরদাশ্ত করতে পারে না বরং নিজের জন্যে সে সর্বাধিক পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পেতে আগ্রহী। অতঃএব কল্যাণ কামনার মানে হচ্ছে এই যে, মানব চরিত্রে উল্লেখিত গুণসমূহ পয়দা হতে হবে এবং সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করবে, তার ভাইয়ের জন্যেও ঠিক তাই পছন্দ করবে। এমনি ধারায় তার আচার-আচরণ বিকাশ লাভ করতে থাকবে।

মু’মিনের এ চারিত্রিক বৈশিষ্টকেই রাসূলে কারীম (সঃ) ঈমানের এক আবশ্যিক শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন:

والذى نفسى بيده لا يؤمن عبد حتى يحب لاخيه ما يحب لنفسه –

‘যে মহান সত্তার হাতে আমার জান নিবদ্ধ তার কসম! কোন বান্দাহ্ ততোণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না, যতোণ না সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করবে তার ভাইয়ের জন্যেও তাই পছন্দ করবে।’ (বুখারী ও মুসলিম-আনাস)

এভাবে এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে; তার মধ্যে এ কল্যাণ কামনাকে একটি হাদীসে নিম্নোক্তরূপে বিবৃত করা হয়েছে:

وينصح له اذا غاب او شهد –

অর্থাৎ ‘সে আপন ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করে, সে উপস্থিত থাকুক আর অনুপস্থিত।’ (বুখারী-আবু হুরায়রা)

অন্য এক হাদীসে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মুসলমানের প্রতি মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে, তার একটি হচ্ছে:

ويحب له ما يخب لنفسه –

‘সে নিজের জন্যে যা পছন্দ করে, তার জন্যেও তা-ই পছন্দ করে।’ (তিরমিযি, ফাবিসী-আলী রা.)

আরো সামনে এগিয়ে আমরা দেখতে পাবো, কল্যাণ কমনার এ গুণটির ভেতর কতো অধিকার ও মর্যাদা নিহিত রয়েছে, যা সরাসরি এর অনিবার্য দাবী হিসেবে এসে পড়ে।

২. আত্মত্যাগ (ايثار)
একজন মুসলমান যখন তার ভাইয়ের জন্যে শুধু নিজের মতোই পছন্দ করে না বরং তাকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, তখন তার এ গুণটিকেই বলা হয় ايثر বা আত্মত্যাগ। এটি হচ্ছে দ্বিতীয় মৌলিক গুণ। ايثار শব্দটি اثر থেকে নির্গত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে পা ফেলা বা অগ্রাধিকার দেয়া। অর্থাৎ মুসলমান তার ভাইয়ের কল্যাণ ও মঙ্গল চিন্তাকে নিজের কল্যাণ ও মঙ্গলের উপর অগ্রাধিকার দেবে। নিজের প্রয়োজনকে মূলতবী রেখে অন্যের প্রয়োজন মেটাবে। নিজে ুধার্ত থেকে অন্যের ুন্নিবৃত্তি করবে। নিজের জন্যে দরকার হলে স্বভাব-প্রকৃতির প্রতিকূল জিনিস মেনে নেবে, কিন্ত স্বীয় ভাইয়ের দিলকে যথাসম্ভব অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে রা করবে।

বস্তুত এ হচ্ছে উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এটা সবার কাছ থেকে আশা করা যায় না। কারণ এর ভিত্তিমূলে কোন অধিকার বা কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। অবশ্য এর ভিত্তিতে অপরিসীম চারিত্রিক মহত্ত্বের কথা বিবৃত হয়েছে।

এ আত্মত্যাগ সর্বপ্রথম প্রয়োজন-সীমার মধ্যে হওয়া উচিত। তারপর আরাম আয়েশের ক্ষেত্রে এবং সর্বশেষ স্বভাব-প্রকৃতির ক্ষেত্রে। এ সর্বশেষ জিনিসটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ স্বভাবতই বিভিন্ন প্রকৃতির, সেহেতু তাদের আকাঙ্খা ও চাহিদাও বিভিন্ন রূপ। এমতাবস্থায় প্রতিটি মানুষ যদি তার প্রকৃতির চাহিদার ওপর অনড় হয়ে থাকে তাহলে মানব সমাজ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে বাধ্য। পান্তওে সে যদি অন্যের রুচি, পছন্দ, ঝোঁক-প্রবণতাকে অগ্রাধিকার দিতে শিখে তাহলে অত্যন্ত চমৎকার ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।

এ আত্মত্যাগেরই উচ্চতর পর্যায় হচ্ছে, নিজে অভাব-অনটন ও দূরাবস্থার মধ্যে থেকে আপন ভাইয়ের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের চাইতে অগ্রাধিকার দেয়া। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গী-সাথীদের জীবন এ ধরণেরই ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ। আল কুরআনেও তাদের এ গুণটির প্রশংসা করা হয়েছে:

ويوثرون على انفسهم ولو كان بهم خصاصة –

‘এবং তারা নিজের উপর অন্যদের (প্রয়োজনকে) অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা রয়েছে অনটনের মধ্যে।’ – (সূরা হাশর-৯)

বস্তুত নিজেদের অভাব-অনটন সত্ত্বেও আনসারগণ যেভাবে মুহাজির ভাইদের অভ্যর্থনা করেছে এবং নিজেদের মধ্যে তাদেরকে স্থান দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আত্মত্যাগের আদর্শ দৃষ্টান্ত। উপরোক্ত আয়াতের শানে নূযুল হিসেবে, হযরত আবু বকর তালহা আনসারীর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়। ঘটনাটি থেকে এর একটি চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায়:

“একদিন রাসূলে কারীম (সঃ)-এর কাছে একজন ুধার্ত লোক এলো। তখন তাঁর গৃহে কোন খাবার ছিলো না। তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি আজ রাতে এ লোকটিকে মেহমান হিসেবে রাখবে, আল্লাহ তার প্রতি করুণা বর্ষণ করবেন। হযরত আবু তালহা লোকটিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ঘরে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারলেন যে, ঘরে শুধু মেহমানের পেট ভরার মতো খাবারই আছে। তিনি বললেনঃ ছেলে-মেয়েদের খাইয়ে বাতি নিভিয়ে দাও। আমরা উভয়ে সারা রাত অভূক্ত থাকবো। অবশ্য মেহমান বুঝতে পারবে যে, আমরাও খাচ্ছি। অবশেষে তারা তা-ই করলেন। সকালে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খেদমতে হাজির হলে তিনি বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমার এ সদাচরণে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন এবং সেই সঙ্গে এই আয়াতটি পড়ে শুনালেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

এ তো হচ্ছে আর্থিক অনটনের মধ্যে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। কিন্তু এর চাইতেও চমৎকার ঘটনা হচ্ছে এক জিহাদের, যাকে আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা বলা যায়। ঘটনাটি হচ্ছে:

“যুদ্ধের ময়দানে একজন আহত লোকের কাছে পানি নিয়ে যাওয়া হলো। ঠিক সে মুহূর্তে নিকট থেকে অপর একজন লোকের আর্তনাদ শোনা গেল। প্রথম লোকটি বললোঃ ঐ লোকটির কাছে আগে নিয়ে যাও। দ্বিতীয় লোকটির কাছে গিয়ে পৌঁছলে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো এবং সে মুমূর্ষাবস্থায়ও লোকটি নিজের সঙ্গীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিলো। এভাবে ষষ্ট ব্যক্তি পর্যন্ত একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটলো এবং প্রত্যেকেই নিজের ওপর অন্যের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে লাগলো। কিন্তু ষষ্ট ব্যক্তির কাছে গিয়ে দেখা গেল, তার জীবন প্রদীপ ইতিমধ্যে নিভে গেছে। এভাবে প্রথম লোকটির কাছে ফিরে আসতে আসতে একে একে সবারই জীবনাবসান হলো।”

আত্মত্যাগের অন্য একটি অর্থ হচ্ছে, নিজে অপোকৃত নিম্নমানের জিনিসে তুষ্ট থাকা এবং নিজের সাথীকে উৎকৃষ্ট জিনিস দান করা। একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দু’টি মেসওয়াক কাটলেন, তার একটি ছিলো সোজা এবং অপরটি বাঁকা। তাঁর সঙ্গে একজন সাহাবী ছিলো। তিনি সোজা মেসওয়াকটি তাঁকে দিলেন এবং বাঁকাটি রাখলেন নিজে। সাহাবী বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, ‘এটি ভালো এবং আপনার জন্যে উত্তম’। তিনি বললেনঃ কেউ যদি কোন ব্যক্তির সঙ্গে একঘন্টা পরিমাণও সংশ্রব রাখে, তবে কিয়ামতের দিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এ লোকটি কি সংশ্রবকালীন হক আদায়ের প্রতি ল্য রেখেছে কিংবা তাকে নষ্ট করেছে? (কিমিয়ায়ে সায়াদাত) বস্তুত আত্মত্যাগ যে সংশ্রবেরও একটি হক এদ্বারা তার প্রতিই ইশারা করা হয়েছে।

৩. আদল (সুবিচার)
চরিত্রের দু’টো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গুণ হচ্ছে আদল ও ইহসান। মু’মিন যদি এ গুণ দুটো অনুসরণ করে, তাহলে শুধু সম্পর্কচ্ছেদেও কোন কারণই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না তাই নয়, বরং সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর হয়েও উঠবে। তাই এগুণ দুটো সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আদেশসূচক ভঙ্গিতে ইরশাদ করেছেন:

ان الله يأمر بالعدل والاحسان –

‘আল্লাহ তায়ালা আদল ও ইহসানের উপর অবিচল থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন।’ -(সূরা নাহল-৯)

এখানে ‘আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন’ -এ বাচন-ভঙ্গিটি বিশেষভাবে ল্যনীয়। আদল সম্পর্কিত ধারণার মধ্যে দু’টো মৌলিক সত্য নিহিত রয়েছে। প্রথমতঃ লোকদের অধিকারের বেলায় সমতা ও ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ প্রত্যেকের দাবী এই যে, প্রতিটি লোকের নৈতিক, সামাজিক, তামাদ্দুনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আউনগত প্রাপ্য অধিকারকে পূর্ণ ঈমানদারীর সাথে আদায় করতে হবে। অর্থাৎ একজন মুসলমান তার ভাইয়ের সকল শরীয়ত সম্মত প্রাপ্যধিকার আদায় করবে, শরীয়াতের ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করবে, শরীয়াতের নির্দেশ অনুসারে ব্যবহার করবে। কেননা, শরীয়াতের মধ্যেই আদলের সমস্ত বিধি-বিধান পরিপূর্ণ এবং সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে:

وانزلنا معهم الكتاب والميزان ليقوم الناس بالقسط –

“এবং আমি তাদের (রাসূলদের) সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও মানদণ্ড, ন্যায়নীতি-যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” – (হাদীদ-২৫)

অনুরূপভাবে শরীয়াত এটাও দাবী করে যে, কারো কাছ থেকে অনিষ্টকারিতার বদলা নিতে হলে যতোটুকু অনিষ্ট করা হয়েছে ততোটুকুই নেবে। যে ব্যক্তি এর চাইতে সামনে অগ্রসর হলো সে আদলেরই বিরুদ্ধচারণ করলো। আদলের বিস্তৃত ব্যাখ্যা ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা নবী কারীম (সঃ)-এর একটি হাদীসে বিবৃত হয়েছে। উক্ত হাদীসে আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশিত নয়টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তার একটি হচ্ছে এই:

كلمة العدل فى الغضب والرضاء –

‘গজবের অবস্থা হোক আর সন্তুষ্টির, যে কোন অবস্থায় আদলের বাণীর ওপর কায়েম থাকো।’

প্রকৃতপে পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের বুনিয়াদী লণ এই যে, মানুষের অন্তঃকরণের অবস্থা যাই হোক সে আদলের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। তার ভেতর এতোটা চরিত্রবল থাকতে হবে যে, তার ভাইয়ের সাথে তার যতোই মনোমালিন্য বা মন কষাকষি থাকুক না কেন, নিজের কায়-কারবার ও আচার-ব্যবহারকে সে শরীয়াতের মানদন্ড থেকে বিচ্যুত হতে দেবে না। এ আদলেরই পরবর্তী জিনিস হচ্ছে ইহ্সান। এটি আদলের চাইতে বাড়তি একটা জিনিস।

৪. ইহ্সান (সদাচরণ)
পারস্পারিক সম্পর্কেও ক্ষেত্রে ইহ্সানের গুরুত্ব আদলের চাইতেও বেশী। আদলকে যদি সম্পর্কের ভিত্তি বলা যায় বতে ইহ্সান হচ্ছে তার সৌন্দর্য ও পূর্ণতা। আদল যদি সম্পর্ককে অপ্রীতি ও তিক্ততা থেকে রা করে তবে ইহ্সান তাতে মাধুর্য ও সম্প্রীতির সৃষ্টি করে। বস্তুত প্রত্যেক পই কেবল সম্পর্কের নুন্যতম মানটুকু পরিমাপ করে দেখতে থাকবে আর প্রাপ্যধিকারে এতোটুকু কম ও অন্যের দেয়া অধিকারে এতোটুকু বেশীদিন টিকে থাকতে পারে না। এমন সাদাসিদা সম্পর্কের ফলে সংঘর্ষ হয়তো বাঁধবে না; কিন্তু ভালোবাসা, আত্মত্যাগ, নৈতিকতা ও শুভকাঙ্খার যে, নিয়ামতগুলো জীবনে আনন্দ ও মাধুর্যের সৃষ্টি করে, তা থেকে সে বঞ্চিত হবে। কারণ এ নিয়ামতগুলো অর্জিত হয় ইহ্সান তথা সদাচরণ, অকৃপণ ব্যবহার, সহানুভূতিশীলতা, শুভাকাঙ্খা, খোশমেজাজ, মাশীলতা, পারস্পারিক শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, অন্যকে অধিকারের চাইতে বেশী দেয়া এবং নিজে অধিকারের চাইতে কম নিয়ে তুষ্ট থাকা ইত্যাকার গুণরাজি থেকে।

এই ইহ্সানের ধারণাও নয়টি বিষয় সমন্বিত হাদীসে তিনটি বিষয়কে পূর্ণাঙ্গ ও সুস্পষ্ট করে তোলে:

ان اصل من قطعنى واعطى من حرمنى واعفو عمَّن ظلمنى –

‘যে ব্যক্তি আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, আমি তার সঙ্গে যুক্ত হবো; যে আমাকে (অধিকার থেকে) বঞ্চিত করবে, আমি তাকে (তার অধিকার) বুঝিয়ে দেবো এবং যে আমার ওপর জুলুম করবে আমি তাকে মার্জনা করে দেবো।’ (সূরা-রা’দ-২২)

অর্থাৎ চরিত্রের এ গুণটি দাবী করে যে, মানুষ শুধু তার ভাইয়ের ন্যায় ও পূণ্যের বদলা অধিকতর ন্যায় ও পূণ্যের দ্বারাই দেবে তাই নয়, বরং সে অন্যায় করলেও তার জবাব ন্যায়ের দ্বারাই দিবে।

ويدرون بالحسنة السيّئة –

‘তারা অন্যায় ও পাপকে ন্যায় ও পূণ্যের দ্বারা নিরসন করে থাকে।’ (সূরা কাসাস-৫৪)

৫. রহমত
এ চারটি গুণের পর পঞ্চম জিনিসটির জন্যে আমি ‘রহমত’ শব্দটি ব্যবহার করবো। অবশ্য এর জন্যে আরো বহু পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।

আমি রহমত শব্দটি এ জন্যে ব্যবহার করছি যে, খোদ আল্লাহ তায়ালাই মুসলমানদের পারস্পারিক সম্পর্কের চিত্র আঁকবার জন্যে এ শব্দটি বেছে নিয়েছেন। এটা তার অর্থের ব্যাপকতার দিকেই অংগুলি নির্দেশ করে:

محمد الرسول الله والذين معه أشداء على الكفار رحماء بينهم –

“আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং তাদের মধ্যে পরস্পরে রহমশীল।” (সূরা ফাতহ-২৯)

এ গুণটিকে সহজভাবে বুঝবার জন্যে আমরা একে হৃদয়ের নম্রতা ও কোমলতা বলে উল্লেখ করতে পারি। এর ফলে ব্যক্তির আচরণে তার ভাইয়ের জন্যে গভীর ভালোবাসা, স্নেহ-প্রীতি, দয়া-দরদ ও ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়ে থাকে। তার দ্বারা তার ভাইয়ের মনে অনু পরিমাণ কষ্ট বা আঘাত লাগবার কল্পনাও তার পে বেদনাদায়ক ব্যাপার। এ রহমতের গুণ ব্যক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং সাধারণ লোকদেরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে। রাসূলের (সঃ) প্রধান গুণরাজির মধ্যে এটিকে কুরআন একটি অন্যতম গুণ বলে উল্লেখ করেছে এবং দাওয়াত ও সংগঠনের ব্যাপার এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে।

لقد جاءكم رسول من انفسكم عزيز عليكم ما عنتُّم حريص عليكم بالمؤمنين رؤف رَّحيم –

“নিঃসন্দেহে তোমাদের ভেতর থেকেই নবী এসেছেন। তোমরা কোন কষ্ট পেলে ভরাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তোমাদের কল্যাণের জন্যে তিনি সর্বদা উদগস্খীব এবং মু’মিনের প্রতি অতীব দয়াশীল ও মেহেরবান।” (সূরা তাওবা-১২৮)

সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছে যে, আপনার হৃদয় যদি কোমল না হতো তাহলে লোকেরা কখনো আপনার কাছে ঘেঁষতো না। আর দিলের এ কোমলতা আল্লাহ তায়ালারই রহমত।

فبما رحمة من الله لنت لهم ولو كنت فظا غليظ القلب لا نفضُّيوا حولك –

“আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্যে নরম দিল ও সহৃদয়বান হয়েছেন। যদি বদমেজাজী ও কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে লোকেরা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেতো।” (আলে ইমরান-১৫৯)

ঈমানের স্বতঃস্ফূর্ত পরিণতিই প্রেম-প্রীতি। আর প্রেম-প্রীতি ও কঠিন হৃদয় কখনো একত্রিত হতে পারে না। তাই একজন মু’মিন যথন প্রেমিক হয়, তখন স্বভাবতই সে নম্র স্বভাবের হয়। নতুবা তার ঈমানে কোন কল্যাণ নেই। এ সত্যের প্রতিই রাসূলে কারীম (স) নিম্নরূপ আলোকপাত করেছেন:

المؤمن مالف ولا خير فيمن لا يألف ولا يولف – (احمد وبيهقى – ابو هريرة)

“মু’মিন হচ্ছে প্রেম ভালোবাসার উজ্জল প্রতিক। যে ব্যক্তি না কাউকে ভালোবাসে আর না কেউ তাকে ভালোবাসে, তার ভেতর কোন কল্যাণ নেই।” (আহমাদ, বায়হাকী-আবু হুরায়রা রাঃ)

আর এ জন্যেই বলা হয়েছেঃ

من يحرم الرفق يحرم الخير –

“যে ব্যক্তি কোমল স্বভাব থেকে বঞ্চিত, সে কল্যাণ থেকেও বঞ্চিত।” (মুসলিম)

এ কথারই বিস্তৃত ব্যাখ্যা হচ্ছে এইঃ

من اعطى حظه من الرفق اعطى حظه من خير الدنيا والاخرة –

“যে ব্যক্তি নম্র স্বভাব থেকে তার অংশ দেয়া হয়েছে তাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ থেকেও তার অংশ দেয়া হয়েছে।” (শরহে সুন্নাহ-আয়েশা রাঃ)

একবার মহানবী (সঃ) তিনজন জান্নাতী লোকের ভিতর থেকে একজনের কথা উল্লেখ করেন। লোকটি তার আত্মীয়-স্বজন এবং সাধারণ মুসলমানদের প্রতি অতীব দায়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল ছিলো।

رحيم رفيق القلب لكل ذى قرب وَّ مسلم – (مسلم )

বস্তুত যে ব্যক্তি দুনিয়ার মানুষের প্রতি রহম করে না, তার চেয়ে হতভাগ্য আর কেউ নয়। কারণ, আখিরাতে সে খোদার রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। পান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দাহদের প্রতি রহম করে, তার জন্যে আল্লাহর রহমত ও অনিবার্য হয়ে যায়। মুহাম্মাদ (সঃ) তাই বলেছেন:

لا تنزع الرحمة الا من شقىٍّ –

“রহমত কারো থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় না, কেবল হতভাগ্য ছাড়া।”

আরো বলেছেন:

الرحيمون يرحمهم الرحمن – ارحم من فى الارض يرحمكم من فى السماء –

“যারা রহম করে, রহমান তাদের প্রতি রহম করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীর প্রতি রহম করো, যেন আসমানবাসী তোমাদের প্রতি রহম করেন।” – (আবু দাউদ, তিরমিযি-ইবনে ওমর রাঃ)

এ রহমত ও নম্রতারই দুটো ভিন্ন দিকের প্রকাশ ঘটে ছোটদের প্রতি স্নেহ ও বড়দের প্রতি সন্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে। এ দুটো জিনিস উল্লেখ করা হয়েছে। নিন্মোক্ত ভাষায়:

ليس منا من لم يرحم صغيرنا ولم يوقر كبيرنا –

“যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের প্রতি রহম (স্নেহ) এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না সে আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয়।” (তিরমিযি-ইবনে আব্বাস রাঃ)

একজন মুসলমান তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নম্রপ্রকৃতির হয়ে থাকে এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার দিলকে খুশি রাখা, তাকে কষ্ট পেতে না দেয়া এবং তার প্রতিটি ন্যায় সঙ্গত দাবী পূরণ করার জন্যে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। এ বিষয়টিকে রাসূলে কারীম (সঃ) নিম্নোক্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা বৃঝিয়েছেন:

المؤمنون هينون لينون كلجمل ان قيد انقاد وان أنيخ على صخرة استنا خ –

“মু’মিন সেই উটের ন্যায় সহিষ্ণু ও সহৃদয় হয়ে থাকে, যার নাকে পতর পরিহিত, তাকে আকর্ষণ করলে আকৃষ্ট হয় আর পাথরের ওপর বসানো হলে বসে পড়ে।” – (তিরমিযি)

কুরআন মজীদ অত্যন্ত সংেেপ এ সমগ্র বিষয়টি বর্ণনা করেছে:

اذلة على المؤمنين –

“তারা মু’মিনদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে।” – (সূরা মায়েদা-৫৪)

প্রকৃতপে এ রহমতের গুণটিই মানবিক সম্পর্কের ভেতর নতুন প্রাণ-চেতনার সঞ্চার করে, তার সৌন্দর্য ও সৌকর্যকে পূর্ণত্ব দান করে। এক ব্যক্তি যদি একবার এ রহমতের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারে, তবে তার দিলকে ঐ সম্পর্ক যার মাধ্যমে সে এ নিয়ামত লাভ করেছে ছিন্ন করার জন্যে সম্মত করানো খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে পড়ে।

৬. মার্জনা (عفوٌّ)
মার্জনা অর্থ মা করে দেয়া। অবশ্য এ অর্থের ভেতর থেকে পৃথক পৃথকভাবে অনেক বিষয় শামিল হয়ে থাকে। যেমন-ক্রোধ-দমন, ধৈর্য-স্থৈর্য, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি। কিন্তু এ গুণটির সাথে ওগুলোর যেহেতু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তাই ওগুলোকেও আমরা এরই অন্তর্ভূক্ত করে নিচ্ছি। যখন দু’জন লোকের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন প্রত্যেকের দ্বারা স্বভাবতঃই এমন কিছু না কিছু ব্যাপার ঘটে যা অন্যের পে অপ্রীতিকর, তিক্ত, কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক। এর কোনোটা তার মনে ক্রোধের সঞ্চার করে, আবার কোনোটা তাকে আইনসঙ্গত প্রতিশোধেরও অধিকার দেয়। কিন্তু এমনি ধরণের পরিস্থিতিতে, ভালোবাসাই বিজয়ী হোক, প্রতিশোধ গ্রহণের মতা থাকা সত্ত্বেও তা থেকে তারা বিরত থাকুক এবং তারা মার্জনা ও মাশীলতার নীতি অনুসরণ করুক-একটি প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক তার স্থিতিশীলতার জন্যে এটাই দাবী করে। এটা ছিলো রাসূলে কারীম (সঃ)-এর বিশেষ চরিত্রগুণ। এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বহু জায়গায় নছিহত করেছেন: خذ العفو –

“নম্রতা ও মাশীলতার নীতি অবলম্বন করো।” – (সূরা আ’রাফ-১৯৯)

فاعف عنهم واستغفرلهم –

“তুমি তাদের মা করে দাও, তাদের জন্যে মাগফেরাত কামনা করো।” – (আলে ইমরান-১৫৯)

মুসলমানদের তাকওয়ার গুণাবলী শিখাতে গিয়ে এও বলা হয়েছে:

والكاظمين الغيظ والعافين عن الناس –

“যারা নিজেদের রাগকে সংবরন করে আর মানুষের প্রতি মা প্রদর্শন করে।” – (আলে ইমরান-১৩৪)

কোন মানুষ যখন কষ্ট পায় অথবা তার কোন তি সাধন হয়, তখন সর্বপ্রথম ক্রোধই তার মন-মগজকে আচ্ছন্ন করার প্রয়াস পায়। আর ক্রোধ যদি তার দিল-দিমাগকে অধিকার করতে পারে, তাহলে মার্জনা তো দূরের কথা, সে এমন সব অস্বভাবিক কাণ্ড করে বসে যে, ভবিষ্যতে সুস্থ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের আশাই তিরোহিত হয়ে যায়। এ কারণেই সর্বপ্রথম নিজের ক্রোধকে হজম করার বিষয়েই প্রত্যেকের চিন্তা করা উচিত। মানুষ যতি এ সম্পর্ককে শান্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করার অবকাশ পায় আর তারপর মার্জনা করার নীতি অনুসরণ নাও করে তবু অন্তত সে আদলের সীমা লংঘন করবে না। রাসূলে কারীম (সঃ) ক্রোধের অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে একে দমন করবার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:

ان الغضب ليقسد الايمان كما يفسد الصبر العسل –

“নিশ্চয় ক্রোধ ঈমানকে এমনিভাবে নষ্ট করে দেয়, যেমন বিষাক্ত ওষুধ মধুকে নষ্ট করে।” – (বায়হাকী-ইবনে ওমর রাঃ)

ما تجرع عبد افضل عند الله عز وجل من جرعة غيظ يكظمها ابتغاء وجه الله تعالى –

“আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে যে ক্রোধের ঢোক গলাধঃকরণ করা হয়, আল্লাহর দৃষ্টিতে তার চাইতে কোন শ্রেষ্ঠ ঢোক বান্দাহ গলাধঃকরণ করে না।” (আহমত-ইবনে ওমর রাঃ)

অনুরূপভাবে রাসূলে কারীম (সঃ) সবরের (ধৈর্য) শিা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, সম্পর্কচ্ছেদ করার চাইতে দুঃখ কষ্টে সবর অবলম্বন করা ও মিলে মিশে থাকাই হচ্ছে মানুষের শ্রেষ্ঠ আচরণ। তিনি বলেছেন:

المسلم خالط الناس ويصبر على اذاهم افضل من الذى لا يخالطهم ولا يصبر على اذاهم –

“যে মুসলমান লোকদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের দেয়া দুঃখ-কষ্টে সবর অবলম্বন করে, সে তার চাইতে শেষ্ঠ, যে ব্যক্তির মেলামেশা ছেড়ে দেয় এবং দুঃখ-কষ্টে সবর করে না।” (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ-ইবনে ওমর রাঃ)

একবার হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-কে নছিহত করতে গিয়ে অন্যান্য কথার সঙ্গে তিনি বলেন:

عبدا ظلم بظلمة فيغضى عنها لله عز وجل الا امر الله بنصره –

“কোন বান্দাহ্র ওপর জুলুম করা হলে সে যদি শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই নীরব থাকে তবে আল্লাহ্ তার বিরাট সাহায্য করেন।” (বায়হাকী- আবু হুরায়রা রাঃ)

সবরের পরবর্তী জিনিস হচ্ছে-বদলা ও প্রতিশোধ নেবার মতা থাকা সত্ত্বেও আপন ভাইকে হৃষ্টচিত্তে মা করে দেয়া। নবী (সঃ) বলেছেন: হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করেন, বান্দাহ্র ভেতর কে তোমার কাছে প্রিয়। এর জবাবে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

من اذا قدر عذر –

“যে ব্যক্তি প্রতিশোধের মতা থাকা সত্ত্বেও মাফ করে দেয়া।” (বায়হাকী- আবু হুরায়রা রাঃ)

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মা কবুল না করবে, তাকে নবী কারীম (সঃ)-এ দুঃসংবাদ দিয়েছেন:

من اعتذر الى اخيه فلم يعتذره او لم يقبل عذره كان عليه مثل خطيئة صاحب مكسٍ –

“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কাছে নিজ অন্যায়ের জন্য মা চাইলো এবং সে তাকে মা মনে করলো না অথবা তার মা কবুল করলো না, তার এতোখানি গোনাহ্ হলো যতোটা (একজন অবৈধ) শুল্ক আদায়কারীর হয়ে থাকে।” (তিরমিযি-সাহল বিন মায়াজ)

আর যে ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তার ভাইকে মা করে দিলো তার জন্যে আখিরাতেও রয়েছে শ্রেষ্ঠতম প্রতিফল। তাই নবী কারীম (সঃ) বলেছেন:

من كظم غليظا وهو يقدر على ان ينقذه دعاه الله على رئوس الخلائق يوم القيامة حتى يخيره فى اى الحور شاء –

“যে ব্যক্তি ক্রোধ চরিতার্থ করার মতা থাকা সত্ত্বেও তাকে হজম করে ফেললো, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সমস্ত সৃষ্টির সামনে ডাকবেন এবং যে হুরকে ইচ্ছা তাকে মনোনীত করার ইখতেয়ার দিবেন।” (তিরমিযি-সাহল বিন মায়াজ)

যারা দুনিয়ার জীবনে মা করে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের দোষ-ত্র“টি মা করে দিবেন।

وليعفوا وليصفحوا الا تحبون ان يغفرالله لكم والله غفور رَّحيم -

“তাদের মা ও মার্জনার নীতি গ্রহণ করা উচিত। তোমরা কি পছন্দ করো না যে, আল্লাহ তোমাদের মা করে দিন? বস্তুত আল্লাহ মার্জনাকারী ও দয়া প্রদর্শনকারী।” (সূরা আন্ নূর-২২)

অবশ্য অন্যায়ের সমান অন্যায় দ্বারা প্রতিশোধ গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু যে ব্যক্তি মা করে দেয়, তার প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। <> وجزاؤ اسيّئة سيّئة مّثلها – فمن عفا واصلح فاجره على الله انه لا يحب الظالمين –

“অন্যায়ের বদলা সমান পরিমাণের অন্যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি মা করে দিলো এবং আপোষ-রফা করলো, তার প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে; তিনি জালিমদেরকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আশ্ শুরা-৪০)

মার্জনার এ গুণটি অর্জন করা কোন সহজ কাজ নয়। এ বড় সাহসের কাজ।

ولمن صبر وغفر ان ذالك من عزم الامور-

“যে ব্যক্তি সবর করলো এবং মা করে দিলো তো এক বিরাট সাহসের কাজ (করলো)।” (সূরা আশ্ শুরা-৪৩)

কিন্তু এ জিনিসটাই সম্পর্কের ভেতর অত্যন্ত মহত্ব ও পবিত্রতার সৃষ্টি করে। এ জন্যে এটা নিত্যান্তই একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ।

এ প্রসঙ্গে আরো দুটো গুণের উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। একটি হচ্ছে পারস্পারিক আস্থা বা নির্ভরতা, আর দ্বিতীয়টি মূল্যোপলব্ধি।

৭. নির্ভরতা
নির্ভরতা পূর্ণাঙ্গ ধারণার মধ্যে বন্ধুত্ব শব্দটিও। কুরআন যাকে মুসলমানদের পারস্পারিক রূপ নির্ণয়ের জন্যে ব্যবহার করেছে, নিহিত রয়েছে। প্রকৃতপে যে ব্যক্তি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য, যার কাছে মানুষ তার সমস্ত গোপন বিষয়াদি পূর্ণ নিশ্চিন্ততার সাথে প্রকাশ করতে পারে, তাকেই বলা হয় বন্ধু। আর মানুষ তার সঙ্গীর ওপর নির্ভর করবে এবং জীবনের তাবৎ বিষয়ে তাকে বরাবর শরীক করবে, ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এটাই তো দাবী করে।

৮. মূল্যোপলব্ধি
এ সর্বশেষ জিনিসটির ল্য হচ্ছে এই যে, মানুষ তার এ সম্পর্কের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে এতোটুকু অবহিত হবে, যাতে করে এর সঠিক মূল্যটা সে উপলব্ধি করতে পারে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন মানুষ কোনক্রমেই তার এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে সম্মত হবে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি