পূর্ব-কথা
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পবিত্র জীবনচরিত পর্যালোচনা করলে এর দু’টি বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়ে উঠে। প্রথমত, তাঁর জীবনধারার অন্ত-র্নিহিত বৈপ্লবিক আদর্শ – যার ছোঁয়ায় মানব জাতির সমাজ ও সভ্যতায় এসেছে বৈপ্লবিক রূপান্তর। দ্বিতীয়ত, সে আদর্শের সু্ষ্ঠু রূপায়নের জন্যে তাঁর নির্দেশিত বৈপ্লবিক কর্মনীতি – যার সফল অনুস্মৃতির মাধ্যমে একটি অসভ্য ও উচ্ছৃঙ্খল জনগোষ্ঠী পেয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সভ্যতা ও সংস্কৃতির শিরোপা।

দুঃখের বিষয় যে, আজকের মুসলিম মানস থেকে বিশ্বনবীর পবিত্র জীবনচরিতের এই মৌল বৈশিষ্ট্য দু’টি প্রায় লোপ পেতে বসেছে। আজকের মুসলমানরা বিশ্বনবীর জীবন আদর্শকে দেখছে খণ্ডিত রূপে, নেহায়েত একজন সাধারণ ধর্মপ্রচারকের জীবন হিসেবে। এর ফলে তার জীবনচরিতের সমগ্র রূপটি তাদের চোখে ধরা পড়ছে না; তার জীবন আদর্শের বৈপ্লবিক তাৎপর্যও তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। বস্তুত, আজকের মুসলিম মানসের এই ব্যর্থতা ও দীনতার ফলেই আমরা বিশ্বনবীর পবিত্র জীবনচরিত থেকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন বৈপ্লবিক রুপান্তর ঘটানোর তাগিদ অনুভব করছি না।

“রসূলুল্লাহর বিপ্লবী জীবন” আমাদের এই কুষ্ঠাহীন উপলব্ধিরই স্বাভাবিক ফসল। বিশ্বনবীর বিশাল ও ব্যাপক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি এ পুস্তকের উপজীব্য নয়। এর বিষয়বস্তু প্রধানত তার বৈপ্লবিক আদর্শ ও কর্মনীতি। এই বিশেষ দু’টি দিকের উপরই এতে আলোকপাত করা হয়েছে সবিস্তারে। এতে জীবনের চরিতের অন্যান্য উপাদান এসেছে শুধু প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে।

পুস্তকটির মূল কাঠামো তৈরি করেছেন ভারতের বিশিষ্ট লেখক আবু সলীম মুহাম্মদ আবদুল হাই। তার সাথে আমরা সংযোজন করেছি অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে স্বভাবতই পুস্তকটির কলেবর হয়েছে মূলের তুলনায় অনেক সমপ্রসারিত। এর বর্তমান সংস্করণেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অনেক মূল্যবান তথ্য। পুস্তকটির বিষয়টির প্রেক্ষিতে এর বাংলা নামকরণ করেছেন আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন মরহুম কবি ফররুখ আহমদ। এর প্রথম অধ্যায়ে উদ্ধৃত কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে দিয়েও তিনি আমায় চির ঋণপাশে আবদ্ধ করে গেছেন।

বর্তমান সংস্করণে পুস্তকটির অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পরিপাট্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কম্পিউটার কম্পোজের ফলে এ মুদ্রণই শুধু ঝকঝকে হয়নি, আগের তুলনায় এর কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬ পৃষ্ঠার মত। এছাড়াও পরিশিষ্ট পর্যায়ে “ইসলাম প্রচারে মহিলা সাহাবীদের ভূমিকা” শিরোনামে একটি নতুন অধ্যায়ও সংযোজিত হয়েছে এ সংস্করণে। এর ফলে পুস্তকটির সৌকার্য ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পুস্তকটির এ সংস্করণও পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে বিপুল ভাবে।

ঢাকা ১ জানুয়ারী, ১৯৯৩

মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

১.

ইসলামী আন্দোলন ও তার অনন্য বৈশিষ্ট্য
ইসলাম তথা হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর পয়গাম দুনিয়ার এক বিরাট সংস্কারমূলক আন্দোলন। সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে খোদা-প্রেরিত নবীগণ এই একই আন্দোলনের পয়গাম নিয়ে এসেছেন। এ কেবল একটি আধ্যাত্নিক আন্দোলনই নয়, বরং এটি মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত এক অভূতপূর্ব সংস্কার আন্দোলন। এটি একাধারে আধ্যাত্নিক, নৈতিক, সামাজিক, অর্থনীতিক ইত্যাদি সকল বৈশিষ্টের অধিকারি একটি ব্যাপক ও সর্বাত্নক আন্দোলন।মানব জীবনের কোন দিকই এ আন্দোলনের গণ্ডী-বহির্ভূত নয়।

ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্ব

দুনিয়ার সংস্কারমূলক বা বিপ্লবাত্নক আন্দোলন বহুবারই দানা বেধে উঠেছে;কিন্তু ইসলামী আন্দোলন তার নিজস্ব ব্যাপকতা এবং অনন্য বৈশিষ্ট্যের দরুণ অন্যান্য সকল আন্দোলনের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।এ আন্দোলনের সাথে কিছুটা প্রাথমিক পরিচয় ঘটলেই লোকদের মনে প্রশ্ন জাগে:কিভাবে এ আন্দোলন উত্থিত হয়েছিল?এর প্রবর্তক কিভাবে একে পেশ করেছিলেন এবং তার কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?কিন্তু এ প্রশ্নগুলোর সঠিক জবাব পাওয়া গেলে শুধু ঐতিহাসিক কৌতূহলই নিবৃত হয়না, বরং এর ফলে আমাদের মানস পটে এমন একটি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ সংস্কারমূলক আন্দোলনের ছবি ভেসে উঠে, যা আজকের দিনেও মানব জীবনের প্রতিটি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে সক্ষম।এখানেই ইসলামী আন্দোলনের আসল গুরুত্ব নিহিত।

এ আন্দোলন যেমন মানুষকে তার প্রকৃত লাভ-ক্ষতির সঠিক তাৎপর্য বাতলে দেয়,তেমনি তার মৃত্যু পরবর্তী অনন্ত জীবনের নিগূঢ় তত্ত্বও সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়।ফলে প্রতিটি জটিল ও দুঃসমাধেয় সমস্যা থেকেই মানুষ চিরতরে মুক্তি লাভ করতে পারে। বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের এসব বৈশিষ্ট্য একে ঘনিষ্ট আলোকে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করবার এবং এর সর্ম্পকে উত্থাপিত দাবিগুলোর সত্যতা নিরুপণের জন্যে প্রতিটি কৌতূহলী মনকে অনুপ্রাণিত করে।

ইসলামী আন্দোলনকে জানবার ও বুঝবার জন্যেএ পর্যন্ত অনেক বই-পুস্তকই লেখা হয়েছে এবং আগামীতেও লেখা হতে থাকবে। এসব বই-পুস্তকের সাহায্যে ইসলামী আন্দোলন সর্ম্পকে বেশ পরিষ্কার একটি ধারণাও করা চলে,সন্দেহ নেই।কিন্ত প্রদীপ থেকে যেমন আলোকরশ্মি এবং ফুল থেকে খোশবুকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না, তেমনি এ জন্যেই যখন ইসলামী আন্দোলনের কথা উঠে, তখন মানুষ স্বভাবতই এর আহ্বায়ক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনচরিত এবং এর প্রধান উৎস আল-কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জানবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠে। এ ঔৎসুক্য খুবই স্বাভাবিক।

ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

একথা সর্বজনবিদিত যে, মানুষের নৈতিক জীবনের সংশোধন, তার ক্ষতিকর বৃত্তিগুলোর অপনোদন এবং জীবনকে সঠিকভাবে কামিয়াব করে তুলবার উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি উপস্থাপনই হচ্ছে মানবতার প্রতি সবচেয়ে পবিত্র এবং এটাই হচ্ছে তার সবচেয়ে সেরা খেদমত।এই উদ্দেশ্যেই দুনিয়ার অসংখ্য মানুষ নিজ নিজ পথে কাজ করে গেছেন।কিন্তু এ ধরণের সংস্কারমূলক কাজ যাঁরা করেছেন, তাঁরা মানব জীবনের কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্রকেই শুধু বেছে নিয়েছেন এবং তার আওতাধীনে থেকেই যতদূর সম্ভব কাজ করে গেছেন।কেউ আধ্যাত্নিক ও নৈতিক দিককে নিজের কর্মকাণ্ডকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংশোধনের মধ্যে।কিন্তু মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সুষম পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছেন এমন পূর্ণাঙ্গ সংস্কারবাদী একমাত্র খোদা-প্রেরিত নবীগণকেই বলা যেতে পারে।

মানব জাতির প্রতি বিশ্বস্রষ্টার সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ এই যে, তার প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দাওয়াত ও জীবন-চরিত কে তিনি অতুলনীয়ভাবে সুরক্ষিত রেখেছেন।বস্তুত এই মহামানবের জীবনী এমন নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, দুনিয়ার অন্য কোন মহাপুরুষের জীবনী কিংবা কোন ঐতিহাসিক দলিলের লিপিবদ্ধকরণেই এতখানি সতর্কতা অবলম্বনের দাবি করা যেতে পারে না।পরন্ত ব্যাপকতার দিক দিয়ে এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে হযরত (সা )-এর কথাবার্তা, কাজ-কর্ম জীবন-ধারা, আকার-আকৃতি, উঠা-বসা চলন-বলন, লেন-দেন, আচার-ব্যবহার, এমনকি খাওয়া পরা, শয়ন-জাগরণ এবং হাসি-তামাসার ন্যায় সামান্য বিষয়গুলো পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। মোটকথা, আজ থেকে মাত্র কয়েক শো বছর আগেকার বিশিষ্ট লোকদের সম্পর্কেও যে খুঁটিনাটি তথ্য জানা সম্ভবপর নয়, হযরত মুহাম্মদ (স) সম্পর্কে প্রায় দেড় হাজার বছর পরেও সেগুলো নির্ভুলভবে জানা যেতে পারে।

হযরত মুহাম্মদ(স)-এর জীবন-চরিত পর্যালোচনা করার আগে এর আর একটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার।তাহলো এই যে, কোন কাজটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল সেই কাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনুধাবণ করা চলে। কারণ প্রায়শই দেখা যায় যে, অনুকূল পরিবেশে যে সব আন্দোলন দ্রুতবেগে এগিয়ে চলে,প্রতিকূল পরিবেশে সেগুলোই আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে।তাই সাধারণ আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,সেগুলোকে গ্রহণ করার জন্যে আগে থেকেই লোকদের ভেতর যথারীতি প্রস্তুতি চলতে থাকে।অত:পর কোন দিক থেকে হঠাৎ কেউ আন্দোলন শুরু করলেই লোকেরা স্বত:স্ফূর্তভাবে তার প্রতি সহানুভূতি জানাতে থাকে এবং এর ফলে আন্দোলনও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে।দৃষ্টান্ত হিসাবে দুনিয়ার আজাদী আন্দোলনগুলোর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।মানুষ স্বভাবতই বিদেশী শাসকদের জুলুম-পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং মনে মনে তার প্রতি ক্ষুব্ধ হতে থাকে।অত:পর কোন সাহসী ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যভাবে আজাদীর দাবি উত্থাপন করে,তাহলে বিপদ-মুসিবতের ভয়ে মুষ্টিমেয় লোক তার সহগামী হলেও দেশের সাধারণ মানুষ তার প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে পারে না।অর্থনৈতিক আন্দোলনগুলোর অবস্থাও ঠিক এইরূপ। ক্রমাগত দু:খ-ক্লেশ এবং অর্থগৃধ্‌নু ব্যক্তিদের শোষণ-পীড়নে লোকেরা স্বভাবই এরূপ আন্দোলনের জন্যে প্রস্তত হতে থাকে।এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক বিধি-ব্যবস্থার সংশোধন এবংমানুষের দুঃখ-দুর্গতি মোচনের নামে দেশের কোথাও যদি কোনো বিপ্লবাত্মক আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে লোকেরা স্বভাবতই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।কিন্তু এর বিপরীত -সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে উত্থিত একটি আন্দোলনের কথা ভেবে দেখা যেতে পারে।দৃষ্টান- হিসাবে বলা যায়, কোনো উগ্র মূর্তিপূজারী জাতির সামনে কোনো ব্যক্তি যদি মূর্তিপূজাকে নেহাত একটি অনর্থক ও বাজে কাজ বলে ঘোষণা করে, তাহলে তার ওপর কী বিপদ-মুসিবত নেমে আসতে পারে, একটু ভেবে দেখা দরকার।

বস্তুত ইসলামী আন্দোলনের আহ্বায়ক হযরত মুহাম্মদ(স) কী প্রতিকূল পরিবেশে তার কাজ শুরু করেছিলেন, তা স্পষ্টত সামনে না থাকলে তার কাজের গুরুত্ব এবং তার বিশালতা উপলব্ধি করা কিছুতেই সম্ভবপর হবে না। এ কারণেই তার জীবনচরিত আলোচনার পূর্বে তৎকালীন আরব জাহান তথা সারা দুনিয়ার সার্বিক অবস্থার ওপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার।

ইসলামী আন্দোলনের প্রাক্কালে দুনিয়ার অবস্থা

ইসলাম মানুষের কাছে যে দাওয়াত পেশ করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদ। কিন্তু এই তাওহীদের আলো থেকেই তখনকার আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র দুনিয়া ছিল বঞ্চিত।তৎকালীন মানুষের মনে তাওহীদ সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণাই বর্তমান ছিল না।এ কথা সত্যি যে হযরত মুহাম্মদ (স) এর আগেও খোদার অসংখ্য নবী দুনিয়ায় এসেছেন এবং প্রতিটি মানব সমাজের কাছেই তারা তাওহীদের পয়গাম পেশ করেছেন।কিন্তু মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে, কালক্রমে এই মহান শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে সে নিজেরই ইচ্ছা-প্রবৃত্তির দাসত্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তার ফলে চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ,দেব-দেবী, নদী-সমুদ্র, পাহপড়-পর্বত, জ্বিন-ফেরেশতা, মানুষ-পশু ইত্যাকার অনেক বস্তুকে নিজের উপাস্য বা মাবুদের মধ্যে শামিল করে নেয়।এভাবে মানুষ এ খোদার নিশ্চিত বন্দেগীর পরিবর্তে অসংখ্য মাবুদের বন্দেগীর আবর্তে জড়িয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক দিক থেকে তখন পারস্য ও রোম এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বর্তমান ছিলো। পারস্যের ধর্মমত ছিলো অগ্নিপূজা (মাজুসিয়াত)। এর প্রতিপত্তি ছিলো ইরাক থেকে ভারতের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর রোমের ধর্ম ছিলো খ্রিষ্টবাদ(ঈসাইয়াত)।এটি গোটা ইউরোপ,এশিয়া ও আফ্রিকাকে পরিবেষ্টন করে ছিলো। এ দুটি বৃহৎ শক্তি ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে ইহুদী ও হিন্দু ধর্মের কিছুটা গুরুত্ব ছিলো। এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ এলাকায় সভ্যতার দাবি করত।

অগ্নিপূজা ছাড়া পারস্যে (ইরানে) নক্ষত্রপূজারও ব্যাপক প্রচলন ছিলো। সেই সঙ্গে রাজা-বাদশা ও আমির-ওমরাগণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রজাদের খোদা ও দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলো। তাদেরকে যথারীতি সিজদা করা হত এবং তাদের খোদায়ীর প্রশস্তিমূলক সংগীত পরিবেশন করা হত।মোট কথা,সারা দুনিয়া থেকেই তাওহীদের ধারণা বিদায় নিয়েছিলো।

রোম সাম্রাজ্য

গ্রীসের পতনের পর রোম সাম্রাজ্যকেই তখন দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা শক্তি বলে বিবেচনা করা হত। কিন্তু ঈসায়ী ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে এই বৃহৎ সাম্রাজ্যই অধঃপতনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়। রাষ্ট-সরকারের অব্যাবস্থা,শত্রুর ভয়,অভ্যন্তরীন অশান্তি,নৈতিকতার বিলুপ্তি, বিলাসিতার আতিশয্য-এক কথায় তখন এমন কোন দুষ্কৃতি ছিলো না,যা লোকেদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেনি। ধর্মীয় দিক থেকে তো কিছু লোক নক্ষত্র ও দেবতার কল্পিত মূতির পূজা-উপাসনায় লিপ্ত ছিলোই;কিন্তু যারা ঈসার ধর্মের অনুসারী বলে নিজেদের দাবি করত, তারাও তাওহীদের ভাবধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলো। তারা হযরত ঈসা(আঃ) ও মরিয়মের খোদায়ী মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলো। পরন্ত তারা অসংখ্য ধর্মীয় ফির্কায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিলো এবং পরস্পর লড়াই-ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতো। তাদের মধ্যে কবর পূজার ব্যাপক প্রচলন ছিলো। পাদ্রীদের তারা সিজদা করত। পোপ ও বিভিন্ন পর্যায়ের ধর্মীয় পদাধিকারীগণ বাদশাহী,এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে খোদায়ী ক্ষমতা পর্যন্ত করায়ত্ত করে রেখেছিলো। হারাম ও হালালের মাপকাঠী তাদের হাতেই নিবদ্ধ ছিলো। তাদের কথাকে ‘খোদায়ী আইন’ বলে গণ্য করা হত। পাশাপাশি সংসারত্যাগ বা সন্ন্যাস ব্রতকে ধার্মিকতার উচ্চাদর্শ বলে মনে করা হতো এবং সকল প্রকার আরাম আয়েশ থেকে দেহকে মুক্ত রাখাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত বলে বিবেচিত হতো।

ভারতবর্ষ

ধর্মীয় দিক থেকে ভারতে তখন‘পৌরাণিক যুগ’ বিদ্যমান ছিলো। ভারতের ধর্মীয় ইতিহাসে এই যুগটিকে সবচেয়ে অন্ধকার যুগ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এ যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনরায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলো এবং বৌদ্ধদেরকে প্রায় নির্মূল করে দেয়া হয়েছিলো। এ যুগে শির্কের চর্চা মাত্রাতিরিক্ত রকমে বেড়ে গিয়েছিলো। দেবতাদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৩৩ কোটি পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। কথিত আছে যে,বৈদিক যুগে কোন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিলনা। কিন্তু এ যুগে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। মন্দিরের পুরোহিতগণ অনৈতিকতার এক জীবন্ত প্রতীক। সরল প্রাণ লোকেদের শোষাণ ও লুন্ঠন করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। সে যুগে বর্ণবাদ বা জাতিভেদ প্রথার বৈষম্য চরমে পৌছেছিল। এর ফলে সামাজিক শৃংখলা ও ব্যাবস্থাপনা ধ্বংস হয়েছিল। সমাজপতিদের খেয়াল-খুশি মতো আইন কানুন তৈরি করে নেয়া হয়েছিল বিচার ইনসাফকে সম্পূর্ণরুপে হত্যা করা হয়েছিল। বংশ-গোত্রের দৃষ্টিতে লোকেদের মর্যাদা নিরুপন করা হতো। সাধারণ্যে মদপানের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিলো। তবে খোদা প্রাপ্তির জন্য বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতে জীবন কাটানো কে অপরিহার্য মনে করা হতো। কুসংস্কার ও ধ্বংসাত্নক চিন্তাধারা চরমে পৌছেছিলো। ভূত প্রেত, শুভাশুভ গণন এ ভবিষ্যৎ কথনে বিশ্বাস গোটা মানব জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। যে কোন অদ্ভুত জিনিসকেই ‘খোদা’ বলে গণ্য করা হতো। যে কোন অস্বাভাবিক বস্তুর সামনে মাথা নত করাই ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচিত হতো। দেব-দেবী ও মূর্তির সংখ্যা গণনা তো দূরের কথা, তা আন্দাজ অনুমানেরও সীমা অতিক্রম করেছিলো। পূজারিণী ও দেবদেবীদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত লজ্জাকর অবস্থায় উপনীত হয়েছিলো। ধর্মের নামে সকল প্রকার দুষ্কর্ম ও অনৈতিকতাকে সর্মথন দেয়া হতো। এক এক জন নারী একাধিক পুরুষকে স্বামীরুপে গ্রহণ করতো। বিধবা নারীকে আইনের বলে সকল প্রকার সুখ সম্ভোগ থেকে জীবনভর বঞ্চিত করে রাখা হতো। এই ধরনের জুলুম মূলক সমাজরীতির ফলে জীবন- নারী তার মৃত স্বামীর জ্বলন- চিতায় ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পর্যন্ত স্বীকৃত হতো। যুদ্ধে হেরে যাবার ভয়ে বাপ,ভাই ও স্বামী তাদের কন্যা, ভগ্নি ও স্ত্রীকে স্বহস্থে হত্যা করে ফেলতো এবং এতে তারা অত্যন্ত গর্ববোধ করতো। নগ্ন নারী ও নগ্ন পুরুষের পূজা করাকে পূণ্যের কাজ বলে গণ্য করতো। পূজা পার্বণ উপলক্ষে মদ্যপান করে তারা নেশায় চুর হয়ে যেত। মোদ্দাকথা, ধর্মাচরণ, নৈতিকতা ও সামাজিকতার দিক দিয়ে খোদার এই ভূখন্ডটি শয়তানের এক নিকৃষ্ট লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছিলো।

ইহুদী

আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী হিসেবে কোনো সংস্কার-সংশোধন যদি প্রত্যাশা করা যেতো, তাহলে ইহুদীদের কাছ থেকেই করা যেতে পারতো। কিন্তু তাদের অবস্থাও তখন অধঃপতনের চরম সীমায় পৌছে গিয়েছিলো। তারা তাদের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন সব গুরুতর অপরাধ করেছে যে, তাদের পক্ষে কোনো সংস্কার মূলক কাজ করাই সম্ভব ছিলো না। তাদের মানসিক অবস্থা অত্যন- শোচনীয় আকার ধারণ করেছিলো। ফলে তাদের ভেতর কোনো নবীর আগমন ঘটলে তাঁর কথা শুনতে পর্যন্ত তারা প্রস্তুত ছিলো না। এজন্যে কতো নবীকে যে তারা হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা এরুপ ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত ছিলো যে, খোদার সাথে তাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে; সুতরাং কোনো অপরাধের জন্যেই তিনি তাদের শাস্তি দেবেন না। তারা এ-ও ধারণা করতো যে, বেহেস্তের সকল সুখ-সম্ভোগ শুধু তাদের জন্যেই নির্দ্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে।নবুয়্যাত ও রিসালাতকে তারা নিজেদের মীরাসী সম্পত্তি বলে মনে করতো। তাদের আলেম সমাজ দুনিয়া-পুজা ও যুগ-বিভ্রান্তিতে চরমভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। বিত্তশালী ও শাসক সম্প্রদায়ের মনোতুষ্টির জন্যে সবসময় তারা ধর্মীয়বিধি-বিধানে হ্রাস-বৃদ্ধি করতে থাকতো। খোদায়ী বিধান সমূহের মধ্যে যেগুলো অপেক্ষাকৃত সহজতর এবং তাদের মর্জি মাফিক,সে গুলোই তারা অনুসরণ করতো;পক্ষান্তরে যেগুলো কঠিন ও অপছন্দনীয়,সেগুলো অবলীলাক্রমে বর্জন করতো।

পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুন খারাবী করা তৎকালীন ইহুদীদের একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিলো। ধন-মালের লালসা তাদেরকে সীমাহীনভাবে অন্ধ করে তুলেছিলো এবং এদিক থেকে কিছুমাত্র ক্ষতি হতে পারে, এমন কোন কাজ করতেই তারা প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের নৈতিক চরিত্র অত্যন্ত দূর্বল হয়ে পড়েছিল। তাদের ভেতরে মুশরিকদের মত মূর্তিপূজাও প্রভাব বিস্তার করেছিল। যাদু-টোনা,তাবিজ-তুমার, আমল-তদবীর ইত্যাদি অসংখ্য প্রকার কুপ্রথা তাদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলো এবং তওহীদের সঠিক ধারণাকে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। এমন কি,যখন আল্লাহর শেষ নবী তওহীদের সঠিক দাওয়াত পেশ করেন। তখন এই ইহুদীরাই মুসলমানদের চেয়ে আরব মুশরিকদেরকে উত্তম বলে ঘোষণা করেন।

আরব দেশের অবস্থা

দুনিয়ার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনার পর এবার খোদ আরব দেশের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করবো। কারণ, এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-খণ্ডেই আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী তার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন এবং এখানকার পরিস্থিতিই তাকে সর্বপ্রথম মুকাবেলা করতে হয়।

আরবের একটি বিরাট অংশ- কোরা উপত্যকা, খায়বার ও ফিদাকে তখন বেশির ভাগ বাসিন্দাই ছিল ইহুদী। খোদ মদীনায় পর্যন্ত ইহুদীদের আদিপত্য কায়েম ছিল। বাকী সারা দেশে পৌত্তলিক রীতি-রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। লোকেরা মূতি,পাথর,নক্ষত্র,ফেরেশতা, জ্বিন প্রভৃতির পূজা-উপাসনা করতো।অবশ্য এক আল্লাহর ধারণা তখনও কিছুটা বর্তমান ছিল। তবে তা শুধু এই পর্যন্ত যে, লোকেরা তাকে খোদাদের খোদা বা ‘সবচাইতে বড় খোদা’ বলে মনে করত। আর এই আকিদাও এতটা দুর্বল ছিল যে কার্যত তারা নিজেদের মনগড়া ছোটখাটো খোদাগুলোর পূজা উপাসনায়ই লিপ্ত থাকতো। তারা বিশ্বাস করতো যে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এই সব ছোট খাটো খোদার প্রভাবই কার্যকর হয়ে থাকে। তাই বাস্তব ক্ষেত্রে তারা এগুলেরই পূজা উপাসনা করতো। এদের নামেই মানত মানতো ও কুরবানী করতো এবং এদের কাছেই নিজ নিজ বাসনা পূরণের আবেদন জানাতো। তারা এও ধারণা করতো এসব ছোট খাটো খোদাকে সন্তষ্ট করলেই আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তষ্ট হবেন।

এ ভ্রান্ত লোকেরা ফেরেস্থতাদেরকে খোদার পুত্র কন্যা বলে আখ্যা দিত। জ্বীনদের কে খোদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং খোদায়ীর অন্যতম শরিকদার বলে ধারণা করতো এবং এই কারণে তারা তাদের পূজা-উপাসনা করতো, তাদের কাছে সাহায্য কামনা করতো। যে সব শক্তিকে এরা খোদায়ীর শরিকদার বলে মনে করতো, তাদের মূর্তি বানিয়ে যথারীতি পূজা-উপাসনাও করতো। মূর্তি পূজার এতোটা ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিল যে, কোথাও কোন সুন্দর পাথর খন্ড দৃষ্টি গোচর হলেই তারা তার পূজা-উপাসনা শূরু করে দিত। এমনকি, একান্তই কিছু না পাওয়া গেলে মাটির একটা স্তুপ বানিয়ে তার উপর কিছুটা ছাগ-দুগ্ধ ছিটিয়ে দিত এবং তার চারদিক প্রদক্ষিণ করতো।

মোট কথা, পূজা-উপাসনার জন্য আরবরা অসংখ্য প্রকার মূর্তি নির্মান করে নিয়েছিল। এসকল মূর্তির পাশাপাশি তারা গ্রহ নক্ষত্রেরও পূজা করতো। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন নক্ষত্রের পূজা করতো। এর ভিতর সূর্য ও চন্দ্রের পূজাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা জ্বিন-পরী এবং ভূত-প্রেতেরও পূজা করতো। এদের সম্পর্কে নানা প্রকার অদ্ভূত কথা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এছাড়া মুশরিক জাতি গুলোর মধ্যে আর যে সব কুসংস্কারের প্রচলন দেখা যায়,সেসব ও এদের মধ্যে বর্তমান ছিল।

এহেন ধর্মীয় বিকৃতির সাথে সাথে পারস্পারিক লড়াই-ঝগড়া আরবদের মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। মামুলি বিষয়াদি নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হয়ে যেতো এবং বংশ পরম্পরায় তার জের চলতে থাকতো। জুয়াখেলা ও মদ্যপানে তারা এতটা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল যে, তখনকার দিনে আর কোন জাতিই সম্ভবত তাদের সমকক্ষ ছিল না।মদের প্রশস্তি এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট দুষ্কর্মগুলো প্রসংসায় তাদের কাব্য-সাহিত্য পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া সুদী কারবার, লুটপাট, চৌর্যবৃত্তি, নৃশংসতা রক্তপাত, ব্যভিচার, এবং এ জাতীয় অন্যান্য দুষ্কর্ম তাদেরকে প্রায় মানবরুপি পশুতে পরিণত করেছিল।আপন কন্যা সন্তানকে তারা অপয়া ভেবে জীবন্ত দাফন করতো। নির্লজ্জ আচরণে তারা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, পুরুষ ও নারীর একত্রে নগ্নাবস্থায় কাবা শরীফ তওয়াফ করাকে তারা ধর্মীয় কাজ বলে বিবেচনা করতো। মোটকথা,ধর্মীয়,নৈতিক,সামাজিক,ও রাজনৈতিক জীবনে তখনকার আরব ভূমি অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হয়েছিল।

ইসলামী আন্দোলনের জন্যে আরব দেশের বিশেষত্ব

আরব উপদ্বীপ তথা সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ঘোর অমানিশার অবসান ঘটিযে আল্লাহর পথভ্রষ্ট বান্দাদেরকে তারই মনোনীত পথে চালিত করার জন্যে একটি শুভ প্রভাতের যে একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই শুভ প্রভাতটির সূচনার জন্যে আল্লাহ তা’আলা সারা দুনিয়ার মধ্যে আরব দেশকে কেন মনোনীত করলেন, প্রসঙ্গত এই কথাটিও আমাদের ভেবে দেখা দরকার।

আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ(স)- কে সারা দুনিয়ার জন্যে হেদায়াত ও দিক-নির্দেশনা সর্বশেষ পয়গামসহ পাঠানোর জন্যে মনোনীত করেছিলেন। সুতরাং তার দাওয়াত সমগ্র দুনিয়ায়ই প্রচারিত হবার প্রয়োজন ছিল। স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, এই বিরাট কাজের জন্যে কোন এক ব্যক্তির জীবন-কালই যথেষ্ট হতে পারে না।এর জন্যে প্রয়োজন ছিল:আল্লাহর নবী তার নিজের জীবদ্দশায়ই সৎ ও পুণ্যবান লোকদের এমন একটি দল তৈরি করে যাবেন, যারা তার তিরোধানের পরও তার মিশনকে অব্যাহত রাখবেন। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যে যে ধরনের বিশেষত্ব ও গুণাবরীর প্রয়োজন ছিল, তা একমাত্র আরব অধিবাসীদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উন্নত মানের এবং বিপুল পরিমানে পাওয়া যেত। উপরন্ত আরবের ভৌগোলিক অবস্থানকে দুনিয়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকার প্রায় কেন্দ্রস্থল বলা চলে। এসব কারণে এখান থেকেই নবীজীর দাওয়াত চারদিকে প্রচার করা সবদিক থেকেই সুবিধাজনক ছিল।

এছাড়া আরবী ভাষারও একটি অতুলনীয় বিশেষত্ব ছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এই ভাষায় যতটা সহজে ও হৃদয়গ্রাহী করে পেশ করা যেতো, দুনিয়ার অন্য কোন ভাষায় তা সম্ভবপর ছিল না। সর্বোপরি, আরবদের একটা বড়ো সৌভাগ্য ছিল যে, তারা কোনো বিদেশি শক্তির শাসনাধীন ছিল না। গোলামীর অভিশাপে মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার যে নিদারুণ অধঃগতি সূচিত এবং উন্নত মানবীয় গুণাবলীরও অপমৃত্যু ঘটে,আরবরা সে সব দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তাদের চারদিকে পারস্য ও রোমের ন্যায় বিরাট দুটি শক্তির রাজত্ব কায়েম ছিল; কিন্তু তাদের কেউই আরবদের কে গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারেনি।তারা ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বীর জাতি; বিপদ-আপদকে তারা কোনোদিন পরোয়া করতো না। তারা ছিল স্বভাবগত বীর্যবান;যুদ্ধ-বিগ্রহকে তারা মনে করতোএকটা খেল-তামাসা মাত্র। তারা ছিল অটল সংকল্প আর স্বচ্ছ দিলের অধিকারী। যে কথা তাদের মনে জাগতো,তা-ই তারা মুখে প্রকাশ করতো। গোলাম ও নির্বোধ জাতিসমূহের কাপুরুষতা ও কপট মনোবৃত্তির অভিশাপ থেকে তারা ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত। তাদের কাণ্ডজ্ঞান,বিবেক-বুদ্ধিও মেধা-প্রতিভা ছিল উন্নত মানের। সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ কথাও তারা অতি সহজে উপলব্ধি করতে পারতো। তাদের স্মরণ শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর; এক্ষেত্রে সমকালীন দুনিয়ার কোনো জাতিই তাদের সমকক্ষ ছিল না।তারা ছিল উদারপ্রাণ, স্বাবলম্বী ও আত্ম-মর্যাদা সম্পূর্ণ জাতি। করো কাছে মাথা নত করতে তারা আদৌ অভ্যস্ত ছিল না। সর্বোপরি, মরুভূমির কঠোর জীবন-যাত্রায় তারা হয়ে ওঠেছিল নিরেট বাস্তববাদী মানুষ। কোন বিশেষ পয়গাম কবুল করার পর বসে বসে তার প্রশস্তি কীর্তন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না;বরং সে পয়গামকে নিয়ে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতো এবং তার পিছনে তাদের সমগ্র শক্তি-সামর্থ্য নিয়োজিত করতো।

আরবদের সংশোধনের পথে বাধা

আরব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, তার শক্তিশালী ভাষা এবং তার বাসিন্দাদের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সর্বশেষ নবীকে এই জাতির মধ্যে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত করেন, সন্দেহ নেই।কিন্তু এই অদ্ভূত কওম কে সংশোধন করতে গিয়ে খোদ হযরত মুহাম্ম্‌দ (স)-কে যে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়, তার গুরুত্বও কোনো দিক দিয়ে কম ছিল না। আগেই বলেছি, কোনো কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে সে কাজটির চারদিকের অবস্থা ও পরিবেশের কথা বিচার করা প্রয়োজন।এই দৃষ্টিতে বিচার করলে আরব ভূমির সেই ঘনঘোর অন্ধকার যুগে এ ইসলামী আন্দোলনের সূচনা ও তার সাফল্যকে ইতিহাসের এক নজিরবিহীন কীর্তি বলে অভিহিত করতে হয়। আর একারণেই আরবদের ন্যায় একটি অদ্ভূত জাতিকে দুনিয়ার নেতৃত্বের উপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে হযরত মুহাম্মদ(স)-কে যে সীমাহীন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে, তাকেও একটা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আরা কিছুই বলা চলে না।

কাজেই আরবদের এই বৈশিষ্ট্যেগুলো যে পর্যন্ত সামনে না রাখা হবে, সে পর্যন্ত হযরত মুহামামদ(স)- এর নেতৃত্বে সম্পাদিত বিশাল সংস্কার কার্যকে কিছুতেই উপলব্ধি করা যাবে না।এই কওমটির সংশোধনের পথে যে সমস্ত জটিলতার অসুবিধা বর্তমান ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমরা এখানে বিবৃত করছি। আরবরা ছিল একটা নিরেট অশিক্ষিত জাতি।খোদার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কিতজ্ঞান, নবুয়্যাতের স্বরূপ ও গুরুত্ব, ওহীর তাৎপর্য, আখিরাত সম্পর্কিত ধারণা, ইবাদতের অর্থ ইত্যাদি কোনো বিষয়ই তারা ওয়াকিফহাল ছিল না।পরন্ত তারা বাপ-দাদার আমল থেকেই প্রচলিত রীতিনীতি ও রসম রেওয়াজের অত্যন্ত অন্ধ অনুসারী ছিল এবং তা থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ দূরে সরতেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ ইসলামের যাবতীয় শিক্ষাই ছিল তাদের এই পৈত্রিক ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। অন্যদিকে শির্ক থেকে উদ্ভূত সকল মানসিক ব্যাধিই তাদের মধ্যে বর্তমান ছিল। অহংকার ও আত্মম্ভরিতার ফলে তাদের বিবেক-বুদ্ধি হয়ে পড়েছিল প্রায় নিস্ক্রিয়।পারস্পরিক লড়াই-ঝগড়া তাদের একটা জাতীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। এ জন্যে শান্ত মস্তিষ্কে ও গভীরভাবে কোনো কিছু চিন্তা করা তাদের পক্ষে সহজতর ছিল না।তাদের কিছু ভাবতে হলে তা যুদ্ধ-বিগ্রহের দৃষ্টিকোণ থেকেই ভাবতো, এর বাইরে তাদের আর কিছু যেন ভাববারই ছিল না।সাধারণভবে দস্যুবৃত্তি,লুটতরাজ ইত্যাদি ছিল তাদের জীবিকা নির্বাহের উপায়।এ থেকে সহজেই আন্দাজ করা চলে যে,হযরত মুহাম্মদ(স)-এর দাওয়াত তাদের ভেতর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনি যখন তাদের কে ইসলামের দিকে আহ্বান জানান, তখন তাদের কাছে তা মনে হয়েছিল একটি অভিনব দুর্বোধ্য ব্যাপার। তারা বাপ-দাদার আমল থেকে যে সব রসম-রেওয়াজ পালনে অভ্যস্ত, যে সব চিন্তা-খেয়াল তারা মনের মধ্যে পোষণ করেছিল -এ দাওয়াত ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ দাওয়াতের মূল কথা ছিল: লড়াই-ঝগড়া বন্ধ করো, শান্তিতে বসবাস করো,দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ থেকে বিরত থাকো, বদভ্যাস ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারা পরিহার করো, সর্বোপরি জীবিকার জন্যে হারাম পন্থা ত্যাগ করো। স্পষ্টতই বোঝা যায়,এ ধরণের একটি সর্বাত্মক বিপ্লবী পয়গামকে কবুল করা তাদের পক্ষে কত কঠিন ব্যাপার ছিল।

মোটকথা, তৎকালীন দুনিয়া অবস্থা, আরব দেশের বিশেষ পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট জাতির স্বভাব-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য-বিশেষত্ব -এর কোন জিনিসই ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল ছিল না।কিন্তু যখন এর ফলাফল প্রকাশ পেলো,তখনই স্পষ্ট বোঝা গেল:

“বজ্রের ধ্বনি ছিল সেথবা ছিল সে ‘সওতে হাদী’

দিল যে কাঁপায়ে আরবের মাটি রাসূল সত্যবাদী।

জাগালো সে এক নতুন লগ্ন সকলের অন্তরে,

জাগায়ে গেল সে জনতাকে চির সুপ্তির প্রান্তরে!

সাড়া পড়ে গেল চারদিকে এই সত্যের পয়গামে,

হলো মুখরিত গিরি-প্রান্তর চির সত্যের নামে।”

বস্তুত এটই ছিল ইসরামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় মু’জিজা। এই মু’জিজার কথা যখন উত্থাপিত হয়, তখন স্বভবতই হযরত মুহাম্মদ(স)- জীবনধারা আলোচনা এবং তার পেশকৃত পয়গামকে নিকট থেকে উপলব্ধিকরার জন্যে প্রতিটি উৎসুক মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এই বিষয়টি আমরা পাঠকদের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করবো।

 

২.

জন্ম ও বাল্যকাল
বংশ পরিচিতি

হযরত মুহাম্মদ(স)-এর সম্মানিত পিতার নাম আব্দুল্লাহ।তিনি ক’বার মুতাওয়াল্লী আবদুল মুত্তালিবের পুত্র ছিলেন। তার বংশ-পরম্পরা উর্ধ্ব দিকে প্রায় ষাট পুরুষ পর্যন্ত পৌঁছে ইব্রাহীম (আঃ)-তনয় হযরত ইসমাঈল(আ)-এর সাথে মিলিত হয়েছে।তার খান্দানের নাম কুরাইশ।আরব দেশের অন্যান্য খান্দানের মধ্যে এটিই পুরুষানুক্রমে সবচেয় শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত খান্দান বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। আরবদেশের ইতিহাসে এই খান্দানের অনেক বড়ো বড়ো মান্য-গণ্য ব্যক্তির নাম দেখতে পাওয়া যায়।এদের ভেতর আদনান, নাযার, ফাহার, কালাব, কুসসী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুসসী তার জামানায় কা’বা শরীফের মুতাওয়াল্লী ছিলেন।তিনি অনেক বড়ো বড়ো স্মরণীয় কাজ করে গেছেন।যেমন: হাজীদের পানি সরবরাহ করা, তাদের মেহমানদারির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তার পরেও তার খান্দানের লোকেরা এই সকল কাজ আঞ্জাম দিতে থাকে।এসব জনহিতকর কাজ এবং কা’বা শরীফের মুতাওয়াল্লী হবার কারণে কুরাইশরা সারা আরব দেশে অতীব সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ খান্দান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।সাধারণভাবে আরবে লুটতরাজ, রাহাজানি ইত্যাকার দুষ্কৃতি হিসেবে স্বীকতি প্রচলিত ছিল এবং এ কারণে রাস্তাঘাট আদৌ নিরাপদ ছিল না।কিন্তু কা’বা শরীফের মর্যাদাও হাজীদের খেদমতের কারণে কুরাইশদের কাফেলার ওপর কখনো কেউ হামলা করতো না।তারা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ব্যবসায়ের পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো।

আব্দুল মুত্তালিবের দশটি(মতান্তরে বারোটি) পুত্র ছিল।কিন্তু কুফর বা ইসলামের বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে পাঁচ জন মাত্র খ্যাতি লাভ করেন। প্রথম আব্দুল্লাহ, ইনি হযরত(স)-এর পিতা। দ্বিতীয়,আবু তালিব; ইনি ইসলাম কবুল করেননি বটে,তবে কিছুকাল হযরতের সাহায্য ও পৃষ্টপোষকতা করেছেন।তৃতীয়,হযরত হামযা(রা) এবং চতুর্থ,হযরত আব্বাস(রা)-এরা দুজনই ইসলামে সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেন এবংইসলামের ইতিহাসে অতীব উচ্চ মর্যাদা লাভ করেন।আর পঞ্চম হচ্ছে আবু লাহাব;ইসলামের প্রতি বৈরিতার কারণে ইতিহাসে যার নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। কুরাইশদের একটি গোত্রের নাম হচ্ছে জাহারা। এই গোত্রের ওহাব বিন আবদুল মানাফের কন্যা আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বিবাহ হয়। সমগ্র কুরাইশ খান্দানের ভেতর ইনি একজন বিশিষ্ট মহিলা ছিলেন।বিবাহকালে আবদুল্লাহর বয়স ছিল মাত্র সতেরো বছর।বিয়ের পর খান্দানী রীতি অনুযায়ী তিনি তিন দিন শ্বশুরালয়ে অবস্থান করেন।অতঃপর ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া গমন করেন। ফিরবার পথে মদিনা পর্যন্ত পৌঁছেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। ঐ সময় আমিনা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।

জন্ম তারিখ

ঈসায়ী ৫৭১ সালের ২০ এপ্রিল মুতাবেক ৯ রবিউল আওয়াল সোমবারের সুবহে সাদিক।এই স্মরণীয় মুহূর্তে রহমতে ইলাহীর ফয়সালা মুতাবেক সেই মহান ব্যক্তিত্ব জন্ম গ্রহণ করলেন,সারা দুনিয়া থেকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার বিদূরিত করে হেদায়েতের আলোয় গোটা মানবতাকে উদ্ভাসিত করার জন্যে যার আবির্ভাব ছির একান্ত অপরিহার্য এবং যিনি ছিলেন কিয়ামত পর্যন্ত এই দুনিয়ায় বসবাসকারী সমগ্র মানুষের প্রতি বিশ্বপ্রভুর পরম আর্শিবাদ স্বরূপ।জন্মের আগেই এই মহামানবের পিতার ইন্তেকাল হয়েছিল। তাই দাদা আবদুল মুত্তালিব এর নাম রাখলেন মুহাম্মদ(স)।

শৈশবে লালন-পালন

সর্বপ্রথম হযরত(স)- এর স্নেহময়ী জননী আমিনা তাকে দুধ পান করান। দু-তিন দিন পর আবু লাহাবের বাঁদী সাওবিয়াও তাকে স্তন্য দান করেন। সে জামানার রেওয়াজ অনুযায়ী শহরের সম্ভান- লোকেরা তাদের সন্তান-সন্ততিকে দুধ পান করানো এবং তাদের লালন -পালনের জন্য গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দিতেন।সেখানকার খোলা আলো-হাওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ভালো হবে এবং তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখতে পারবে বলে তারা মনে করতেন।কেনা, আরবের শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের ভাষা অধিকতর বিশুদ্ধ বলে ধারণা করা হতো।এই নিয়ম অনুযায়ী গ্রামের মেয়েরা শহরে এসে বড়ো বড়ো অভিজাত পরিবারের সন্তানদের লালন- পালনের জন্যে সঙ্গে নিয়ে যেতো।তাই হযরত(স)-এর জন্মের কয়েক দিন পরই হাওয়াযেন গোত্রের কতিপয় মহিলা শিশুর সন্ধানে মক্কায় আগমন করেন।এদের হালিমা সা’দিয়া নাম্নী এক মহিলাও ছিলেন। এই ভাগ্যবতী মহিলা অপর কোন বড়ো লোকের শিশু না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমিনার ইয়াতিম শিশু সন্তানকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

দু’বছর পর আমিনা তাঁর শিশু পুত্রকে ফেরত নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর মক্কায় মহামারী বিস্তার লাভ করলো। তাই আমিনা তাকে আবার গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন।সেখানে তিনি ছয় বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেন।

হযরত (স)- এর বয়স যখন ছ’ বছর, তখন আমিনা তাকে নিয়ে মদিনায় গমন করেন সম্ভবত স্বামীর কবর জিয়ারত অথবা কোন আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করার জন্যে তিনি এই সফরে বের হন।মদিনায় তিনি প্রায় এক মাস কাল অবস্থান করেন। কিন্তু ফিরবার পথে আরওয়া নামক স্থানে তিনি মৃত্যু বরণ করেন এবং সেখানেই চিরতরে সমাহিত হন।

আম্মার মৃত্যুর পর হযরত(স)-এর লালন-পালন ও দেখা শোনার ভার দাদা আবদুল মুত্তালিবের ওপর অর্পিত হয়। তিনি হামেশা তাকে সঙ্গে-সঙ্গে রাখতেন।হযরত(স)- এর বয়স যখন আট বছর,তখন দাদা আবদুল মুত্তালিবও মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি হযরত(স)-এর লালন পালনের ভার পুত্র আবু তালিবের ওপর ন্যস্ত করে যান। তিনি এই মহান কর্তব্য অতীব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করেন। আবু তালিব এবংআবদুল্লাহ (হযরতের পিতা)সহোদর ভাই ছিলেন।এদিক দিয়েও হযরত(স)- এর প্রতি আবু তালিবের গভীর মমত্ব ছিল।তিনি নিজের ঔরসজাত সন্তানদের চাইতেও হযরত(স)-কে বেশি আদায় যত্ন করতেন।শোবার কালে তিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে নিয়ে শুইতেন;বাইরে বেরুবার সময়ও তিনি তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুতেন।

হযরত(স)-এর বয়স যখন দশ-বারো বছর, তখন তিনি সমবয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ছাগলও চরান।আরবে এটাকে কোন খারাপ কাজ বলে মনে করা হতো না।ভালো ভালো সম্ভান্ত ঘরের ছেলেরাও তখন মাঠে ছাগল চরাতো।

আবু তালিব ব্যাবসায় করতেন। কুরাইশদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার তিনি সিরিয়া যেতেন।হযরত(স)-এর বয়স তখন সম্ভবত বারো বছর; এসময় একবার আবু তালিব সিরিয়া সফরের ইরাদা করলেন।সফরকালীন কষ্টের কথা স্মরণ করে তিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু হযরত(স)-এর প্রতি তার অত্যন্ত প্রগাঢ় মমতা ছিল; তাই সফরে রওয়ানা করার সময় তার সঙ্গে যাবার জন্যে হযরত(স) পীড়াপীড়ি শুরু করলে আবু তালিব তার মনে আঘাত দিতে পারলেন না।তিনি হযরত(স)-কে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

 

৩.

নবুয়্যাতের আগে
ফুজ্জারে যুদ্ধ

ইসলাম-পূর্বযুগে আরবদের মধ্যে এক সুদীর্ঘ ও অসমাপ্য ধারা বর্তমান ছিল। এর ভেতর সবচেয়ে ভয়ংকর ও মশহুর ছিল ফুজ্জারের যুদ্ধ।এই যুদ্ধ কুরাইশ ও কায়েস গোত্রসমূহের মধ্যে সংঘটিত হয়।এতে কুরাইশদের ভূমিকা ছির সম্পূর্ণ ন্যায়ানুগ;তাই হযরত(স) ও কুরাইশদের পক্ষ থেকে এতে অংশগ্রহণ করেন।কিন্তু তিনি করো ওপর আঘাত হানেন নি এ যুদ্ধে প্রথমে কায়েস এবং পরে কুরাইশরা জয়লাভ করে। শেষ অবধি সন্ধি মারফত এর পরিসমাপ্তি ঘটে।

হিলফুল ফুযুল

এভাবে অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে আরবের শত শত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল।লোকদের না ছিল দিনের বেলায় কোন স্বস্তি আর নাছিল রাত্রে কোন আরাম।ফুজ্জারের যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু কল্যাণকামী লোক এর প্রতিকারের জন্যে একটা আন্দোলন শুরু করেন।হযরত(স)-এর চাচা জুবাইর ইবনে আবদুল মুত্তালিব পরিস্থিতি দ্রুত শোধরাবার জন্যে বাস্তব ধর্মী কাজের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন।এর কিছু দিন পর কুরাইশ খান্দানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগন জমায়েত হয়ে নিম্নোক্ত চুক্তি সম্পাদন করেনঃ ১.আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করবো।

২.পথিকের জান-মালের হেফাজত করবো।

৩.গরীবদের সাহায্য করতে থাকবো।

৪.মজলুমের সহায়তা করে যাবো।

৫.কোনো জালেমকে মক্কায় আশ্রয় দেব না।

এই চুক্তিতে হযরত(স) ও অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন।নবুয়্যাতের জামানায় এ চুক্তি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন:আমাকে ঐ চুক্তির বদলে যদি একটি লাল রং-এর মূল্যবান উটও দেয়া হতো, তবু তা আমি কবুল করতাম না।আজো যদি কেউ এরুপ চুক্তির জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, তাতে সাড়া দিতে আমি প্রস্তুত।

কা’বা গৃহের সংস্কার

তখন কা’বা গৃহের শুধু চারটি দেয়াল বিদ্যমান ছিল। তার ওপর কোনো ছাদ ছিল না।দেয়ালগুলোও বড়জোর মানুষের দৈর্ঘ্য সমান উঁচু ছিল।পরন্ত গৃহটি ছিল খূব নীচু জায়গায়। শহরের সমস্ত পানি গড়িয়ে সেদিকে যেতো।ফলে পানি প্রতিরোধ করার জন্যে বাঁধ দেয়া হতো। কিন্তু পানির চাপে বাঁধ বারবার ভেঙ্গে যেতো এবং গৃহ প্রাঙ্গনে পানি জমে উঠতো। এভাবে গৃহটি দিন দিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। তাই গৃহটি ভেঙ্গে ফেলে একটি নতুন মজবুত গৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। সমগ্র কুরাইশ খান্দান মিলিতভাবে নির্মাণ কাজ শুরু করলো। কেউ যাতে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা গৃহের বিভিন্ন অংশ ভাগ করে নিলো।কিন্তু কা’বা গৃহের দেয়ালে যখন ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপনের সময় এলো তখন বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে তুমুল ঝগড়া বেধে গেলো।প্রত্যেক গোত্রই দাবি করছিল যে, এ খেদমতটি শুধু তারাই আঞ্জাম দেবার অধিকারী্‌ অবস্থা এতদূর গড়ালো যে, অনেকের তলোয়ার পর্যন্ত কোষমুক্ত হলো। চারদিন পর্যন্ত এই ঝগড়া চলতে থাকলো। পঞ্চম দিন আবু উম্মিয়া বিন মুগিরা নামক এক প্রবীণ ব্যক্তি প্রস্তাব করেন যে,আগামীকাল প্রত্যুষে যে ব্যক্তি এখানে সবার আগে হাজির হবে,এর মিমাংসার জন্যে তাকেই মধ্যস্থ নিয়োগ করা হবে। সে যা সিদ্ধান্ত করবে, তাই পালন করা হবে। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিলো।

পরদিন আল্লাহর কুদরতে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির ওপর সবার নজর পড়লো, তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মাদ(স)। ফয়সালা অনুযায়ী তিনি হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করতে ইচ্ছুক প্রতিটি খান্দান কে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে বললেন্।অতঃপর একটি চাদর বিছিয়ে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে তার ওপর রাখলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিগণকে চাদরের প্রান্ত ধরে পাথরটিকে ওপরে তুলতে বললেন। চাদরটি তার নির্দিষ্ট স্থান বরাবর পৌছলে হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এভাবে তিনি একটি সংঘর্ষের সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিলেন। এ সংঘর্ষে কতো খুন-খারাবী হতো,কে জানে!

এবার কা’বার যে নয়া গৃহ নির্মিত হলো,তার ওপর যথারীতি ছাদও দেয়া হলো;কিন্তু পুরো ভূমির গৃহ নির্মাণের উপযোগী উপকরণ না থাকায় এক দিকের ভূমি কিছুটা বাইরে ছেড়ে দিয়ে নয়া ভিত্তি গড়ে তোলা হলো। এই অংশটিকেই এখন ‘হিত্তিম’ বলা হয়।

ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ

আরবদের, বিশেষত কুরাইশদের পুরানো পেশা ছিল ব্যবসায় হযরত(স)-এর চাচা আবু তালিবও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। এ কারণেই হযরত(স)-যখন যৌবনে পদার্পন করেন, তখনও তিনি ব্যবসায় কে অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে গ্রহণ করেন।কিশোর বয়সে চাচার সঙ্গে তিনি ব্যবসায় উপলক্ষে যে সফর করেন,তাতে তার যথেষ্ঠ সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।এ ব্যাপারে তিনি লোকদের কাছে অত্যন্ত বিশ্বস্ত প্রতিপন্ন হলেন।লোকেরা তার ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ মূলধন তার কাছে জমা করতে লাগলো।পরন্ত ওয়াদা পালন,সদাচরণ ন্যায়পরায়ণতা,বিশ্বস্ততা ইত্যাদি কারণেও তিনি লোকদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা অর্জন করলেন। এমনকি, লোকেরা তাকে ‘আস-সাদিক’(সত্যবাদী) ‘আল-আমীন’(বিশ্বস্ত) বলে সাধারণভাবে অভিহিত করতে লাগলো।ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি সিরিয়া,বসরা, বাহরাইন ও ইয়েমেনে কয়েকবার সফর করেন।

খাদীজার সাথে বিবাহ

তখন খাদীজা নামে আরবে এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী মহিলা ছিলেন।তিনি হযরত(স)- এর দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন ছিলেন।প্রথম বিবাহের পর তিনি বিধবা হন এবং দ্বিতীয় বিবাহ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তার দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন এবং পুনরায় বিধবা হন।তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ও সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। লোকেরা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘তাহিরা’(পবিত্রা) বলে ডাকতো।তার আগে ধন-দৌলত ছিল। তিনি লোকদের কে পুঁজি এবং পণ্য দিয়ে ব্যবসায় চালাতেন।

হযরত(স)-এর বয়স তখন পঁচিশ বছর। ইতোমধ্যে ব্যবসায় উপলক্ষে তিনি বহুবার সফর করেছেন। তার সততা,বিশ্বস্ততা ও সচ্চরিত্রের কথা জনসমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল।তার এ খ্যাতির কথা শুনে হযরত খাদীজা তার কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান: আপনি আমার ব্যবসায়ের পণ্য নিয়ে সিরিয়া গমন করুন। আমি অন্যান্যদের কে যে হারে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকি, আপনাকেও তা-ই দেবো। হযরত(স)- তার এই প্রস্তাব কবুল করলেন এবং পণ্যদ্রব্য নিয়ে সিরিয়ার অন্তর্গত বসরা পর্যন্ত গমন করলেন।

খাদীজা হযরত(স)-এর অসামান্য যোগ্যতা ওঅতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে প্রায় তিন মাস পর তার কাছে বিয়ের পয়গাম প্রেরণ করেন। হযরত(স)-তার পয়গাম মন্‌জুর করলেন এবং বিয়ের দিন-ক্ষণও নির্ধারিত হলো। নির্দিষ্ট দিনে আবু তালিব, হযরত হামযা এবং খান্দানের অপরাপর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে হযরত(স) খাদীজার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। আবু তালিব বিয়ের খোতবা পড়লেন। পাঁচ শো তালায়ী দিরহাম (স্বর্ণ-মুদ্রা) বিয়ের মোহরানা নির্ধারিত হলো।

বিবাহকালে হযরত খাদীজার বয়স চল্লিশ বছর এবং তার পূর্বোক্ত দুই স্বামীর ঔরসজাত দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল।

অসাধারণ ঘটনাবলী

দুনিয়ায় যতো বিশিষ্ট লোকের আবির্ভাব ঘটে তাঁদের জীবনে শুরু থেকেই অসাধারণ কিছু নিদর্শনাবলী লক্ষ্য করা যায়। এ দ্বারা তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা সহজেই অনুমান করা চলে। একথা অবশ্য এমন সব লোকের বেলায়ই প্রযোজ্য,যারা পরবর্তী কালে কোন বিশেষ খান্দান,কওম বা দেশের উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধন করে থাকেন। কিন্তু যে মহান সত্তাকে কিয়ামত অবধি সারা দুনিয়ার নেতত্বের জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যাকে মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের পূর্ণ সংস্কারের জন্যে প্রেরণ করা হয়েছে,তার জীবন-সূচনায় এমন অসাধারণ নিদর্শনাবলী তো প্রচুর পরিমাণে দৃষ্টিগোচর হওয়ায় স্বাভাবিক। তাই স্বভাবই তার জীবনী গ্রন্থগুলোয় এ ধরণের নিদর্শনাবলীর প্রচুর উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু যে সকল ঘটনা প্রামাণ্য বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতসহ উল্লিখিত হয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নে উদ্ধৃত হলোঃহযরত(স) বলেছেনঃ ‘আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম, তখন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তার দেহ থেকে একটি আলো নির্গত হয়েছে এবং তাতে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে গেছে।’বহু রেওয়ায়েত থেকে এ-ও জানা যায় যে, তখন ইহুদী ও খ্রিষ্টান এক নতুন নবীর আগমন প্রতিক্ষায় ছিল এবং এ ব্যাপারে তারা নানা রকম ভবিষ্যত বাণী করেছিল।

রাসূল (স)-এর বাল্যকালের একটি ঘটনা। তখন কা’বা গৃহ কিছুটা সংস্কার কার্য চলছিল এবং এ ব্যাপারে বড়োদের সাথে ছোট ছোট ছেলেরাও ইট বহণ করে নিয়ে যাচ্ছিল।এই ছেলেদের মধ্যে হযরত (স) এবং চাচা হযরত আব্বাসও ছিলেন। হযরত আব্বাস তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ‘তোমার লুঙ্গি খূলে কাঁধের ওপর নিয়ে নাও, তাহলে ইটের চাপে ব্যথা পাবে না।’তখন তো বড়োরা পর্যন্ত নগ্ন হতে লজ্জানুভব করতো না।কিন্তু হযরত(স) যখন এরুপ করলেন, নগ্নতার অনুভূতিতে সহসা তিনি বেহঁশ হয়ে পড়লেন।তার চোখ দুটো ফেটে বের হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সম্ভিত ফিরে এলে তিনি শুধু বলতে লাগলেনঃ“আমার লুঙ্গি আমার লুঙ্গি ”। লোকেরা তাড়াতাড়ি তাকে লুঙ্গি পরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর আবু তালিব তার অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বললেনঃ‘আমি সাদা কাপড় পরিহিত এক লোককে দেখতে পাই। সে আমাকে বললো, শিগগির সতর আবৃত কর।’সম্ভবত এই প্রথম হযরত(স) গায়েবী আওয়াজ শুনতে পান।

আরবে তখন আসর জমিয়ে কিসসা বরার একটা কুপ্রথা চালু ছিল। লোকেরা রাত্রি বেলায় কোন বিশেষ স্থানে জমায়েত হতো এবং কাহিনীকাররা রাতের পর রাত তাদের নানারুপ উদ্ভট কিস্‌সা-কাহিনী শোনাতো।বাল্য বয়সে হযরত(স)একবার এই ধরণের আসরে যোগদান করার ইরাদা করেন।কিন্তু পথিমধ্যে একটা বিয়ে মজলিস দেখার জন্যে তিনি দাঁড়িয়ে যান এবং পরে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন। অতঃপর চোখ মেলে দেখেন যে ভোর হয়ে গেছে। এরুপ তার জীবনে আরো একবার সংঘটিত হয়। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাকে কুসংসর্গ থেকে রক্ষা করেন।

রাসূল(স) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, তখন মক্কা মূর্তি-পূজার সবচেয়ে বড়ো কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল।খোদ কা’বা গৃহে তখন তিন শ’ ষাটটি মূর্তির পূজা হতো এবং তার নিজ খান্দানের লোকেরা অর্থাৎ কুরাইশরাই তখন কা’বার মুতাওয়াল্লী বা পূজারী ছিলেন।কিন্তু এতদ সত্ত্বও হযরত(স) কোনদিন মূর্তির সামনে মাথা নত করেন নি এবং সেখানকার কোন মুশরিকী অনুষ্ঠানেও অংশ নেন নি। এছাড়া কুরাইশরা আর যে সব খারাপ রসম-রেওয়াজে অভ্যস্ত ছিল, তার কোন ব্যাপারে হযরত(স) কোনদিন তার খান্দানের সহযোগিতা করেন নি।

 

৪.

নবুয়্যাতের সূচনা
হযরত(স) এর বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি পৌঁছলো। তার জীবনে এবার আর একটি বিপ্লবের সূচনা হতে লাগলো। নির্জনে বসে একাকী আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা এবং আপন সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় তিনি মশগুল হয়ে পড়লেন।তিনি ভাবতে লাগলেনঃ তার কওমের লোকেরা কিভাবে হাতে-গড়া মূর্তিকে নিজেদের মা’বুদ ও উপাস্য বানিয়েছে।নৈতিক দিক থেকে তারা কত অধঃপাতে পৌঁছেছে!তাদের এই সব ভ্রান্তি কি করে দূরীভূত হবে?খোদা-পরস্তির নির্ভুল পথ কিভাবে তাদের দেখানো যাবে? এই বিশ্ব-জাহানের প্রকৃত স্রষ্টা মালিকের বন্দেগী করা উচিত? এমন অসংখ্য রকমের চিন্তা ও প্রশ্ন তার মনের ভেতর তোলপাড় করতে লাগলো। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এসব বিষয়ে তিনি গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।

হেরা গুহায় ধ্যান

মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালূন নূর-এ ‘হেরা’নামে একটি পর্বত-গুহা ছিল।হযরত(স) প্রায়শই সেখানে গিয়ে অবস্খান করতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা-ভাবনা ও খোদার ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সাধারণত খানাপিনার দ্রব্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতেন।কখনো কখনো হযরত খাদীজা(র) ও তা পৌঁছে দিতেন।

সর্ব প্রথম ওহী নাযিল

এভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেল। হযরত চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। একদা তিনি হেরা গুহার ভেতর যথারীতি খোদার ধ্যানে মশগুল রয়েছেন্‌ সময়টি তখন রমজান মাসের শেষ দশক।সহসা তার সামনে আল্লাহর প্রেরিত এক ফেরেশতা আত্নপ্রকাশ করলেন। ইনি ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ জিবরাঈল(আ)।ইনিই যুগ যুগ ধরে আল্লাহর রাসূলদের কাছে তার পয়গাম নিয়ে আসতেন।

হযরত জিবরাঈল(আ) আত্নপ্রকাশ করেই হযরত(স)-কে বললেনঃ‘পড়ো’। তিনি বললেনঃ ‘আমি পড়তে জানি না’।একথা শুনে জিবরাঈল(আ) হযরত(স)-কে বুকে জড়িয়ে এমনি জোরে চাপ দিলেন যে, তিনি থতমত খেয়ে গেলেন।অতঃপর হযরত(স)-কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেনঃ‘পড়ো’।কিন্তু তিনি আগের জবাবেরই পুনরুক্তি করলেন।জিবরাঈল(আ) আবার তাকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেনঃ‘পড়ো’। এবারও হযরত(স)জবাব দিলেনঃ‘আমি পড়তে জানি না।’পুনর্বার জিবরাঈল(আ) হযরত(স)-কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ

اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ{1} خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ{2} اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ{3} الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ{4} عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ{5}

“পড়ো তোমার প্রভুর (রব) নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন;সৃষ্টি করেছেন জমাট-বাঁধা রক্ত থেকে। পড়ো এবং তোমার প্রভু অতীব সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।”

এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী নাযিলের ঘটনা।এ ঘটনার পর হযরত(স) বাড়ি চলে গেলেন।তখন তার পবিত্র অন্তঃকরণে এক প্রকার অস্থিরতা বিরাজ করছিল।তিনি কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা (রা) কে বললেনঃ‘আমাকে শিগগির কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও’ খাদীজা(রা) তাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তিনি খাদীজা (রা)-এর কাছে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করলেন;বললেনঃ ‘আমার নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছে’ খাদীজা(রা) বললেনঃ‘না, কক্ষনোই নয়।আপনার জীবনের কোন ভয় নেই।খোদা আপনার প্রতি বিমুখ হবেন না।কেননা আত্মীয়দের হক আদায় করেন;অক্ষম লোকদের ভার-বোঝা নিজের কাঁধে তুরে নেন;গরীব-মিসকিনদের সাহায্য করেন;পথিক-মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন।মোটকথা, ইনসাফের খাতিরে বিপদ- মুসিবতের সময় আপনিই লোকদের উপকার করে থাকেন।’

এরপর খাদীজা(রা) হযরত(স)-কে নিয়ে প্রবীণ খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা অরাকা বিন নওফেলের কাছে গমন করলেন।তিনি তাওরাত সম্পর্কে খুব ভালো পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। হযরত খাদীজা(রা) তার কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন।তিনি সব শুনে বললেনঃ ‘এ হচ্ছে মূসার ওপর অবতীর্ণ সেই ‘নামূস’(গোপন রহস্যজ্ঞানী ফেরেশতা)। হায়! তোমার কওমের লোকেরা যখন তোমাকে বের করে দেবে, তখন পর্যন্ত আমি যদি জিন্দা থাকতাম! হযরত(স) জিজ্ঞেস করলেনঃ আমার কওমের লোকেরা কি আমায় বের করে দেবে? অরাকা বললেনঃ তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো, তা নিয়ে ইতঃপূর্বে যে-ই এসেছে, তার কওমের লোকেরা তার সঙ্গে দুশমনি করেছে। আমি যদি তখন পর্যন্ত জিন্দা থাকি, তাহলে তোমায় যথাসাধ্য সাহায্য করবো’ এর কিছুদিন পরই অরাকার মৃত্যু ঘটে।

এরপর কিছুদিন জিবরাঈলের আগমন বন্ধ রইলো। কিন্তু হযরত(স) যথারীতি হেরা গুহায় যেতে থাকলেন।এই অবস্থা অন্তত ছয়মাস চলতে থাকলো।এই বিরতির ফলে কিছুটা ফায়দা হলো। মানবীয় প্রকৃতির দরুণ তার অন্তরে ওহী নাযিলের ঔৎসুক্য সঞ্চারিত হলো। এমন কি, এই অবস্থা কিছুটা বিলম্বিত হলে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে জিবরাঈলের আগমন শুরু হলো। তবে ঘন ঘন নয়,মাঝে মাঝে। জিবরাঈল এসে তাকে এই বলে প্রবোধ দেন যে,আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল মনোনীত হয়েছেন। এরপর হযরত(স) শান্ত চিত্তে প্রতিক্ষা করতে লাগলেন। কিছুদিন পর জিবরাঈল ঘন ঘন আসা শুরু করলেন।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি