অভিযোগ এবং তার জবাব
ভদ্র মহোদয়গণ! এই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য ও কার্যসূচি। এমন কাজ সস্পর্কে যে কোন মুসলমান আপত্তি তুলতে পারে তা আমরা ধারণাও করতে পারিনি। কিন্তুু যেদিন থেকে আমরা এ পথে পা বাড়িয়েছি, সেদিন থেকেই প্রশ্ন ও আপত্তির এক অপ্রতিরোধ্য সয়লাব আসছে। অবশ্য সব আপত্তিই ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয় আর একই বৈঠকে সব কথার জবাব দান করা সম্ভবও নয়। তবে যেসব আপত্তিকে আপনাদের এই শহরে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে, এখানে আমি সেগুলো সস্পর্কে কিছু বলতে চাই।

নতুন ফিরকা
বলা হয় যে, আমাদের জামায়াত মুসলমানদের মধ্যে একটি নতুন ফিরকার গোড়া পত্তন করেছে। এ ধরনের কথা যারা প্রচার করে থাকেন, সম্ভবত ফিরকা সৃষ্টির মূল কারণগুলোই তাদের জানা নেই, সেগুলোকে মোটামুটি চার, ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথমতঃ দীনের সাথে সম্পর্কহীন কোন বস্তুকে আসল দীনের মধ্যে শামিল করে নিয়ে তাকেই কুফর ও ঈমান অথবা হিদায়াত ও গোমরাহীর মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা।

দ্বিতীয়তঃ দীনের কোন বিশেষ মাসয়ালাকে কুরআন ও সুন্নাহর চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তাকেই উপদল সৃস্টির ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা।

তৃতীয়তঃ ইজতিহাদী বিষয়াদিতে বাড়াবাড়ি করা এবং ভিন্ন মত পোষনকারীদের উপর ফাসিক ও কুফরীর অপবাদ চাপিয়ে দেয়া কিংবা অন্তত তাদের সাথে স্বতন্ত্র আচার পদ্ধতি অবলম্বন করা।

চতুর্থতঃ নবী করীম (স.) -এর পর কোন বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ করা এবং তার সম্পর্কে এমন কোন মর্যাদা দাবী করা যা মানা বা না মানার উপর লোকদের ঈমান কিংবা কুফর নির্ভরশীল হতে পারে অথবা কোন বিশেষ দলে যোগদান করলেই সত্যপন্থী হয়ে যাবে এবং তার বাইরে অবস্থানকারী মুসলমানরা হবে বাতিলপন্থী এমন কোন দাবী উত্থাপন কারা।

এখন আমি জিজ্ঞেস করতে চাই যে, উপরোক্ত চারটি ভুলের কোনটি আমরা করেছি? কোন ভদ্রলোক যদি দলিল-প্রমাণসহ স্পষ্টভাবে বলে দিতে পারেন যে, আমরা অমুক ভুলটি করেছি তবে তৎক্ষণাৎ আমরা তওবা করবো এবং নিজেদের সংশোধন করে নিতে আমরা মোটেই দ্বিধাবোধ করবো না। কেননা-আমরা আল্লাহর দীন কায়েম করার উদ্দেশ্যেই সংঘবদ্ধ হয়েছি, দলাদলি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু আমাদের কার্যকলাপ দ্বারা যদি উক্তরূপ ভুল প্রমাণিত না হয়, তবে আমাদের সম্পর্কে ফিরকা সৃষ্টির আশংকা কিভাবে করা যেতে পারে?

আমরা শুধু আসল ইসলাম এবং কোন কাটছাট না করে পূর্ণ ইসলামকে নিয়েই দাড়িয়েছি, আর মুসলমানদের কাছে আমাদের আবেদন শুধু এই যে, আসুন আমরা সবাই মিলে একে কার্যত প্রতিষ্ঠিত করে দুনিয়ার সামনে এর সত্যতার সাক্ষ্য দান করি।

বস্তুত দীনের কোন একটি বা কয়েকটি বিষয়কে নয় বরং পরিপূর্ণ দীন ইসলামকে আমরা সংগঠন ও সম্মিলনের বুনিয়াদ হিসেবে স্থির করে নিয়েছি।

ইজতিহাদী বিষয়ে আমাদের অভিমত
ইজতিহাদী বিষয়াদির ব্যাপারে যেসব মাযহাব ও মতবাদকে শরীয়তের নীতির ভেতরে থেকে মেনে নেয়ার অবকাশ রয়েছে, তার সবগুলোকেই আমরা সত্য বলে স্বীকার করি। আমরা প্রচলিত মাযহাব ও মতামতগুলোর মধ্যে নিজ নিজ ইচ্ছা ও অভিরুচি অনুযায়ী আমল করার ব্যাপারে সবার অধিকার স্বীকার করি এবং বিশেষ কোন ইজতিহাদী মতের ভিত্তিতে ফিরকা সৃষ্টি করাকে অসংগত বলে মনে করি।

গোড়ামি পরিহার
আমরা নিজেদের জামায়াত সম্পর্কেও কোনরূপ গোড়ামি করিনি অথবা কখনো এমনকথা বলিনি যে, সত্য কেবল আমাদের জামায়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আমরা পুরোপরি দায়িত্ব সচেতন হয়েই এ কাজের জন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি এবং আমাদের সাথে উঠে দাঁড়াবেন, কি নিজেরাই স্বতন্ত্রভাবে দায়িত্ব পালন করবেন কিংবা অন্য কোন দায়িত্ব পালনকারীর সাথে মিলে কাজ করবেন, তা আপনাদেরই বিবেচ্য।

আমীরের মর্যাদা সম্পর্কেও আমরা কোনরূপ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হইনি। আমাদের আন্দোলন ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেনি, এখানে কারো জন্যে বিশেষ কোন মর্যাদার দাবী করা হয়নি, কারো ব্যক্তিগত আকীদা -বিশ্বাসের উপর জামায়াদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়নি, বরং উদ্ভট দাবী – দাওয়া, স্বপ্ন, কাশফ, কিরামাত ও ব্যক্তি বিশেষের পবিত্রতার কাহিনী প্রচার থেকে আমাদের আন্দোলন সর্বতোভাবে মুক্ত ও পবিত্র।

আদর্শবাদী আন্দোলন
এখানে কোন ব্যক্তিবর্গের দিকে আহবান জানান হয় না, পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মুসলমানের যা জীবন লক্ষ্য, যে মূলনীতিসমূহের সমষ্টিকে বলা হয় ইসলাম, আমাদের আহবান হচ্ছে তারই প্রতি। যারা এই উদ্দেশ্য এবং মূলনীতির ভিত্তিতে আমাদের সাথে মিলিত হয়ে কাজ করতে প্রস্তুত হয়, তারাই নির্বিশেষে আমাদের জামায়াতের সদস্য হয়ে থাকে।

আমীর নির্বাচন
অতঃপর এই সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে আমীর নির্বাচিত করেন। আমীরের পদে কারো ব্যক্তিগত প্রাপ্য অধিকার স্বীকৃত নয়, বরং সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হলে জামায়াতের একজন প্রধান থাকা দরকার বলেই একজনকে আমীর নির্বাচিত করা হয়। এই নির্বাচিত আমীরকে পদচ্যুত করে তদস্থলে জামায়াতের অন্য কাউকে আমীর নির্বাচিত করা যেতে পারে। পরন্তু কেবল আমাদের এই জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরই তাঁর আনুগত্য করতে হয়। যারা তাঁর আনুত্যের শপথ গ্রহণ না করবে, তারা জাহেলী মৃত্যু বরণ করবে, এরূপ কোন ধারণা আমরা কোন দিনই পোষণ করিনি।

এবার আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে বলুন, এমনি পদ্ধতিতে কাজ করা সত্ত্বেও আমাদের আন্দোলনের ফলে মুসলিম জাতির মাঝে কেমন করে একটি নতুন ফিরাকর সৃষ্টি হতে পারে? বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, যারা নিজেরাই ফিরকাবন্দী ও উপদলীয় কোন্দলে জড়িত, যারা হামেশা স্বপ্ন, কাশফ, কিরামাতের চর্চা করে থাকেন, যাদের সমস্ত কাজ- কর্ম কোন ‘হযরত’-এর ব্যক্তিগত আকীদা -বিশ্বাসের মর্যাদার দাবী করে থাকেন, খুঁটিনাটি ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদ ও বিতর্ক -মনাযারায় লিপ্ত হন, আমাদের সম্পর্কে অপবাদ রটাতে তাদেরকেই দেখা যায় সর্বাধিক তৎপর। তাই কারো বিরক্তির পরোয়া না করেই আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, আমাদের সম্পর্কে এসব ভদ্রলোকগণ যেসব কথা প্রচার করেন, যে কারণে এরা আমাদের উপর বীতশ্রদ্ধ, আমাদের প্রকৃত মতাদর্শ তা নয় বরং দীন ইসলামের যে আসল কাজটি তাদের মনঃপূত নয়, আমরা সেই দিকেই লোকদের আহবান জানাচ্ছি। আর এ কাজের জন্য যে কর্মপন্থা আমরা গ্রহণ করেছি তা দ্ধারা তাদের অনুসৃত কর্মনীতির ভ্রান্তিগুলো অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এ কারণেই তারা আমাদের উপর বীতশ্রদ্ধ।

পৃথক দল গঠনের প্রয়োজন
আমাদের প্রশ্ন করা হয় যে, এ কাজ করাই যখন তোমাদের উদ্দেশ্য ছিল তখন করতে, কিন্তু পৃথক নাম নিয়ে একটি স্থায়ী জামায়াত গঠন করলে কেন? এ দ্বারা মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। বস্তুত এ হচ্ছে এক অভিনব প্রশ্ন। আমি ভেবে আশ্চর্য হই যে, ধর্মহীন ও ধর্মবিরোধী রাজনীতি, অনৈসলামিক শিক্ষা, মাযহাবী কোন্দল সৃষ্টি অথবা নিরেট দুনিয়াবী উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পাশ্চাত্য গণতন্ত্র কিংবা ফ্যাসিস্ট পন্থায় যদি মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র নামের বিভিন্ন সমিতি ও দল -উপদল গড়ে ওঠে, তবে সেগুলোকে দ্ধিধাহীন চিত্তেই বরদাশত করা হয়। কিন্তু দীন ইসলামের আসল কাজের উদ্দেশ্যে যদি খালিস ইসলামী নীতির ভিত্তিতে কোন জামায়াত গড়ে ওঠে, তবে হঠাৎ মুসলিম জাতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দেয় এবং একটি মাত্র জামায়াতই তাদের কাছে অসহ্য হয়ে পড়ে। এ থেকে এ কথাই মনে হচ্ছে যে, প্রশ্নকর্তাগন আসলে জামায়াত বা দল গঠনের বিরোধী নন, বরং দীনের আসল কাজের উদ্দেশ্যে দল গঠনেই তাদের যত আপত্তি। যাই হোক, তাদের কাছে আমার নিবেদন হচ্ছে এই যে, দল গঠনের অপরাধ আমরা সাগ্রহে নয় বরং একান্ত বাধ্য হয়েই করেছি।

সবাই জানেন যে, এই জামায়াত গঠন করার পর্বে ক্রমাগত কয়েক বছর আমি একাকী মুসলমানদেরকে এই বলে আহবান জানিয়েছি যে, “তোমরা এ কোন্ পথে নিজেদের শক্তি -সামর্থ্য ও চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করছো? তোমাদের আসল কাজ হচ্ছে এই। এর প্রতি সমগ্র চেষ্টা-সাধনা কেন্দ্রীভূত করাই তোমাদের কর্তব্য”। তখন সমস্ত মুসলমন যদি এ আহবান গ্রহণ করতো, তবে কিছুই বলার ছিল না। তখন মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন জামায়াত গঠিত হওয়ার পরিবর্তে সকল মুসলমান মিলে একটি জামায়াতের বর্তমান ভিন্ন জামায়াত গঠন করা ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নিষিদ্ধ অন্তত পাক-ভারতে গঠিত হতো।

পক্ষান্তরে মুসলমানদের কোন বিশেষ দলও যদি আমাদের সে আহবান কবুল করে নিত, তবুও আমরা সন্তুষ্ট চিত্তে তাতে শামিল হতাম। কিন্তু আমরা ক্রমাগত আহবান জানিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়া সত্ত্বেও যখন কেউ তার প্রতি কর্ণপাত করলো না, তখন এ কাজকে যারা সত্য এবং অপরিহার্য কর্তব্য বলে বিশ্বাস করতেন, তারা নিজেরাই সমবেত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহনে বাধ্য হন। এখন জিজ্ঞাসা এই যে, আমরা যদি এ -ও না করতাম, তাহলে আমাদের পক্ষে আর কি-ই বা করার ছিল? আপনারা যদি এ কাজকে ফরজ বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন তো নিজেদের দাবীর সপক্ষে প্রমাণ পেশ করুণ। অথবা বলুন, আমাদের সমিতি ও দল-উপদলগুলো কি বাস্তবিকই এ দায়িত্ব পালন করে চলছে? যদি তা না হয়, তবে বলবো যে, আপনাদের অবস্থা এমনি পর্যায়ে এসে গেছে যে, যারা সচেতনভাবে দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়েছে আপনারা উল্টো তাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে চাচ্ছেন।

আমীর বনাম নেতা
আমাদেরকে এ প্রশ্ন করা হয় যে তোমরা আপন জামায়াতের নেতার জন্যে আমীর’ শব্দটি বেছে নিলে কেন? আমীর’ বা ‘ইমাম’ তো কেবল স্বাধীন ক্ষমাতাশালী ও সার্বভৌম শক্তির অধিকারী ব্যক্তিই হতে পারেন। তারা এ কথার সমর্থনে কিছু হাদীস পেশ করে এই যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন যে, ‘ইমামত’ (নতৃত্ব) শুধু ইসলামের ইমামত, নামাযের ইমামত, কিংবা যুদ্ধ – বিগ্রহের ইমামই হতে পারে। এ ছাড়া তো আর কোন প্রকারের ইমামত নেই। এ ধরনের প্রশ্ন যারা করেন, তারা কেবল ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন ইমামতের প্রতিষ্ঠাকালীন ফিকাহ ও হাদীস সম্পর্কেই খোজ-খবর রাখেন। কিন্তু মুসলমানদের জামায়াত নেতৃত্বচ্যুত হলে, স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হলে এবং ইসলামের জামায়াতী নিয়ম-শৃঙ্খলা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সে সম্পর্কে তারা মোটেই ওয়াকিফহাল নন। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই যে, এরূপ পরিস্থিতিতে কি মুসলামানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে এবং কোন সার্বভৌম শক্তির অধিকারী ‘ইমাম’ পাঠানোর জন্যে আল্লাহর কাছে দু’আ করবে? না তাদেরকে এমনি ইমাম কায়েম করার জন্যে কোন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাও চালাতে হবে? তারা যদি স্বীকার করেন যে, এজন্যে সমবেত প্রচেষ্টা চালাতে হবে, তবে তারা অনুগ্রহনপূর্বক বলুন, জামায়াত গঠন না করে কিভাবে সমবেত প্রচেষ্টা চালানো সম্ভব? তারা যদি জামায়াত গঠনের অপরিহার্যতা স্বীকার করেন তো বলুন কোন নেতা, কোন প্রধান, কোন আদেশদাতা ছাড়া কোন জামায়াত চলতে পারে কি? তারা যদি এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন, তবে ইসলামী কাজের উদ্দেশ্যে যে ইসলামী জামায়াত গঠিত হবে, তার নেতার জন্য ইসলামের কি পরিভাষা নির্ধারিত রয়েছে তা তারাই আমাদের বলে দিন। যে কোন পরিভাষাই তারা বলুন না কেন, তা যদি ইসলামী হয় তবে তা -ই আমরা গ্রহণ করবো। আর যদি এ- ও তারা না পারেন তবে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিন যে, ক্ষমতা লাভের পরবর্তী অবস্থার জন্যে তো ইসলামের অনেক পথ- নির্দেশ মওজুদ রয়েছে কিন্তু ক্ষমতাহীন অবস্থায় কি করে তা অর্জন করতে হবে, সে সম্পর্কে ইসলাম কোন পথ- নির্দেশ দেয়নি। এ কাজ যারা করবে, তাদেরকে অনৈসলামিক পন্থায় এবং অনৈসলামিক ফরিভাষা অনুযায়ী করতে হবে। তাদের অভিপ্রায় যদি এ না হয়ে থাকে, তবে সভাপতি, লীডার, নেতা, কায়েদ ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহারে যাদের আপত্তি নেই, তারা কেন ‘আমীর’ -এর পরিভাষা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠেন, এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা এক দুরূহ ব্যাপার।

সাধারণত এ ব্যাপারটি অনুধাবন করতে লোকদের কিছুটা অসুবিধা দেখা দেয়। এর কারণ এই যে, নবী করীম (সা.) এর যুগে যখন ‘আমীর’ বা ‘ইমাম’ এর পরিভাষা ব্যবহার করা হতো, তখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর যতদিন পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ততদিন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) ই রাসূল হিসেবে দীন-ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। কাজেই ‘আমীর বা ‘ইমাম’ – এর পরিভাষা ব্যবহারের কোন অবকাশই তখন ছিল না।

ইসলামের প্রকৃতি
কিন্তু ইসলামের গোটা ব্যবস্থাপনার উপর দৃষ্টিপাত করলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই দীন-ইসলাম মুসলমানদের প্রতিটি সম্মিলিত কাজের নিয়ম-শৃঙ্খলার দাবী করে। আর এই নিয়ম-শৃঙ্খলার পদ্ধতি হচ্ছে এই যে, কাজ জামায়তবদ্ধ হয়ে করতে হবে এবং একজনকে হতে হবে তার ‘আমির’। অনুরূপভাবে নামায পড়তে হলে একজনকে ‘ইমাম’ নিযুক্ত করে জামায়াতের সাথে পড়তে হবে। হজ্জ করতে হলে সুশৃঙ্খল পন্থায় একজনকে আমীরে হজ্জ করতে হবে। এমনকি তিনজন লোক যদি সফরে বের হয়, তবে তাঁদের মধ্য হতে আমীর নির্বাচিত করে সুশৃঙ্খল পন্থায়ই সফর করতে হবে। (টিকা: ·মসনাদে আহমদ-এ হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা·) থেকে এরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছেঃ

لايحل لثلاثة يكونوا بفلاة من الارض الا امروا عليهم احدهم .

অর্থঃ “তিনজন লোক জংগলে থাকলেও নিজেদের মধ্যে একজকে আমীর নিযুক্ত না করা জায়িয নয়।”

এ থেকে এ কথাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শুধু সফরকালেই নয়, বরং সর্বাবস্থায়ই মুসলমানদেরকে সুশৃঙ্খলভাবে জীবন যাপন করতে হবে এবং তাদের কোনো সামগ্রিক কাজই ‘জামায়াত’ ও ‘ইমারত’ ছাড়া সম্পাদিত হওয়া উচিত নয়।)

اذا خرج ثلاثة فى سفر فليؤمروا عليهم احدهم .

“ইযা খারাজা সালাসাতু ফি সাফারিন ফাল ইউআম্মারু আলাইহিম আহাদুহুম।”

ইসলামী শরীয়তের এ মূল ভাবধারাটিই হযরত উমর (রা.) এর নিম্নোক্ত বাণীতে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছেঃ

لااسلام الا بجماعة ولاجماعة الا مارة ولاامارة الا بطاعة . (جامع بيان العلم لابن عبد البر)

“জামায়াতবিহীন ইসলাম, ইমারতবিহীন জামায়াত ও আনুগত্যবিহীন ইমারাত বলতে কোন জিনিস নেই।”

এ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, দীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা বা সত্যের সাক্ষ্যদানের চেষ্ট-সাধনার উদ্দেশ্যে যে জামায়াত গঠন করা হবে, তার নেতার জন্যে ‘আমীর’ বা ‘ইমাম’ শব্দের ব্যবহার সর্বোতভাবে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ইমাম শব্দের সাথে যেহেতু বিশেষ অর্থ জড়িত হয়ে পড়েছে, কাজেই আমরা নানা জামেলা থেকে বাঁচার জন্যে এ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আমীর’ শব্দটি গ্রহণ করেছি।

যাকাত আদায়ের অধিকার
এখানে এসে আমি আর একটি অভিনব প্রশ্ন শুনতে পেলাম তা হলো এই যে, যে ব্যক্তি এ ধরনের জামায়াতের নেতা নির্বাচিত হবেন, যাকাত আদায় করার কোন অধিকার তার নেই। কেননা, যাকাত শুধু ইসলামী রাষ্ট্রেও আমীরই আদায় করতে পারেন। প্রশ্নকর্তাগণ সম্ভবত আমাদের যাকাত আদায়ের পন্থা সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিফহাল নন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সাধারণ মুসলমানদের কাছে কখনও জামায়াতের বায়তুল-মালে যাকাত জমা দেয়ার দাবী জানাইনি। অথবা কখনও এমন কোন কথাও বলিনি যে, যারা আমাদের তহবিলে যাকাত জমা দেবেন না তাদের যাকাতই আদায় হবে না। আমরা শুধু জামায়াতের রুকনদের কাছেই নিজেদের বায়তুল মালে যাকাত আদায়ের দাবী জানিয়ে থাকি।এ দ্বারা মুসলমানদেরকে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসাওে সম্মিলিতভাবে যাকাত দেয়া ও ব্যায় করার ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তোলাই হচ্ছে আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য। এখন জিজ্ঞাসা এই যে, আমাদের এ কাজের ফলে শরীয়াতের দৃষ্টিতে কী দোষটা হলো? জনসাধারণকে যদি ঘরে বসে পৃথক পৃথকভাবে নামায পড়ার চেয়ে জামায়াতের সাথে নামায পড়তে বলার অধিকার থাকে, তাহলে যাকাত ব্যক্তিগতভাবে আদায় না করে সম্মিলিতভাবে আদায় করতে বলার অধিকার কেন থাকবে না? লোকদের কাছ থেকে চাঁদা গ্রহণ কিংবা ভর্তি ও সদস্য পদের ফি গ্রহণ জায়িয কিন্তু আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত ফরয আদায় করার আহ্বান জানানো নাজায়িজ, এটা কেমন আজব কথা।

বায়তুলমাল
এখানে এর চেয়েও অভিনব প্রশ্ন শোনা গেল। তা হলো এই যে, তোমরা ‘বায়তুলমাল’ কেন বানিয়েছ। বস্তুত এ ধরণের প্রশ্নাবলী শুনে মনে হয় যে, ইসলামী পরিভাষাগুলোর সংগেই প্রশ্নকর্তাদের কিছুটা শত্রুতা রয়ে গেছে। এ কথা সুস্পষ্ট যে, সম্মিলিত কাজে অর্থ ব্যয় করার সুবিধার্থে প্রত্যেক দল বা সংগঠনেরই একটি অর্থ তহবিল থাকে। আমরা তাকে বায়তুলমাল বলে থাকি। কেননা, এটাই হচ্ছে একমাত্র ইসলামী পরিভাষা। আমরা যদি এর নাম অর্থ ভান্ডার রাখতাম, তাহলে তাদের কোন আপত্তি থাকত না। অথবা যদি ট্রেজারী বলতাম, তাহলেও হয়ত তারা সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু আমরা একটি ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করার কারণেই তারা এটাকে বরদাশত করতে পারছে না।

প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ প্রশ্নই এমনি নিরর্থক যে, এগুলোর জাবাব দান করে শ্রোতাবৃন্দের সময় নষ্ট করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু তবু আমি নমুনা স্বরূপ কয়েকটি প্রশ্নের জাবাব দান করলাম এ জন্যে যে, যারা নিজেরাও দায়িত্ব পালন করতে চান না, বরং অন্যকেও তা করতে দিতে প্রস্তুত নন, তারা কি ধরণের বাহানা, কুটিল প্রশ্ন এবং সন্দেহজনক বিষয় খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং নিজেরা যেমন আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকেন, তেমনি করে অন্যকেও কিভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।

বস্তুত অহেতুক ঝগড়া -বিবাদ এবং বিতর্ক-মুনাযারায় লিপ্ত হওয়া আমাদের কাজের পন্থা নয়। যদি কেউ সহজ-সরলভাবে আমাদের কথা বুঝতে চান, তো তাকে বুঝানোর জন্যে আমরা সদা প্রস্তুত। আর যদি কেউ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমাদের ভূল -ভ্রান্তি ধরিয়েদিতে চান তা-ও আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু কেউ বিতর্ক সৃষ্টি করলে এবং আমাদের তাতে জড়িত করতে চাইলে আমরা তার সম্মুখীন হতে মোটেই সম্মত নই। বিরুদ্ধবাদিগণ যতক্ষণ ইচ্ছা এ খেল চালু রাখতে পারেন।

— সমাপ্ত —


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি