আমাদের কথা 

ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের এমন কোন দিক নেই যেখানে ইসলামের কোন দিক-নির্দেশনা নেই। মানব জীবনের সকল স্তরে ইসলামের সুনির্দিষ্ট অনুশাসন বিদ্যমান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, চারিত্রিক প্রভৃতি অঙ্গনে ইসলামী আদর্শের একটি সুবিন্যস্ত ছাপ রয়েছে। গায়রুল্লাহর গোলামী ও মানুষের মনগড়া মতবাদের চোখ ধাঁধানো শৃঙ্খল থেকে ইসলাম মানব জাতির মুক্তি ঘোষণা করেছে এবং সর্বযুগ উপযোগী অবকাঠামো উপহার দিয়েছে। ইসলামী অনুশাসনমালার ব্যবহারিক দিক হচ্ছে শরীয়ত। শরীয়ত নির্ধারিত সীমানা বা চৌহদ্দীর মধ্যেই মুসলমানদের বিচরণ করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার অধিকার তাদের নেই। যদি কেউ এর বাইরে চলে যায় অর্থাৎ সীমানা লঙ্ঘন করে তাহলে সে আল্লাহ্‌দ্রোহী বলে গণ্য হবে।
মানব জীবনের বৃহত্তর বিচরণ ক্ষেত্র ইসলামী আদর্শের বলয়ভুক্ত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পদ্ধতিও এর বাইরে নয়। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে অদ্যাবদি রাষ্ট্র প্রশাসনকে কেন্দ্র করে যত মতবাদের জন্ম হয়েছে তা মানব মস্তিস্ক প্রসূত। একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা এর ব্যতিক্রম। এর রচয়িতা এবং নিয়ন্ত্রণকারী স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা’আলা। তাই এটা নিঃসন্দেহে নির্ভুল। জীবন পথের বন্ধুর পথ-পরিক্রমায় ধাপে ধাপে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা যেখানে প্রবল, সেখানে মানব রচিত মতবাদ যথার্থ অবদান রাখতে পারে না। কেননা তাতে ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনা প্রচুর। আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নির্ভুল বিধিমালার অনুসরণই মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। আর এর প্রকৃষ্টতম উপহার হচ্ছে শরীয়ত অনুমোদিত অনুশাসন পদ্ধতি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আলিম (মুহাদ্দিস, ফকীহ) ও মশহূর মুজাদ্দিদ (সংস্কারক)। শিরক ও বিদ’আত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম মিল্লাতকে তাওহীদের মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত করে আল্লাহ্‌ তা’আলার খাঁটি বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর লেখনী ছিল অত্যন্ত ক্ষুরধার। রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থায় অনৈসলামিক ভাবধারার মূলোৎপাটন করে তিনি মুসলিম সমাজকে নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শের নিরিখে অবগাহিত করতে চেয়েছিলেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর লেখা *****(আরবী) নামক গ্রন্থটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থের বাংলা তরজমাই হচ্ছে ‘শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা’। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক মওলানা জুলফিকার আহ্‌মদ কিস্‌মতী-এর অনুবাদক। জনাব কিস্‌মতী সাহেব একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং চার-পাঁচ ভাষায় ব্যুৎপত্তিশালী, বহু মূল্যবান গ্রন্থের প্রণেতা, অনুবাদক ও সম্পাদক। তাঁর অনুবাদ বেশ প্রাঞ্জল ও সাবলীল।
বর্তমান সংস্করণে অনুবাদক প্রন্থটি পুনঃসম্পাদনা করায় অনুবাদটি আরও সমৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে মৌলিক পুস্তকের অভাবকে অস্বীকার করা যায় না। শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও দন্ডবিধির মৌলবিধান সম্বলিত গ্রন্থটি এ দেশের মুসলমানদের বহু দিনের প্রতিক্ষিত একটি অভাব দূরীকরণে যথেষ্ট অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। পাঠক সমাজের হাতে এ জাতীয় একটি পুস্তক তুলে দিতে পেরে পরম করুণাময় আল্লাহ্‌র দরবারে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। আল্লাহ্‌ আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করুন। -আমীন।
মুহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশক

সূচিপত্র
 লেখকের ভূমিকা
 অনুবাদকের কথা
 ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
1. শরীয়তী শাসন কর্তৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য
2. ক্ষমতা ও শাস্ন কর্তৃত্বের যোগ্যতা
3. জনদরদি সাহসী নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব
4. ইসলামে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের লক্ষ্যঃ
কুরআন সুন্নাহ্‌র শিক্ষা, আইন-কানুন বাস্তবায়ন
5. মাল সম্পদ, ঋণ, যৌথ ব্যবস্থা, মুজারাবাত, আল্লাহ্‌র নির্দেশিত মোকদ্দামার ফয়সালা ইত্যাদি
6. রাষ্ট্রীয় সম্পদ তিন প্রকার
7. যাকাতের খাতসমূহ
8. গনীমতের মালের আলোচনা এবং কর্মকর্তাদের অবৈধ কমিশন প্রশঙ্গ
9. সরকারী আয়ের খাতসমূহ
10. ন্যায় বিচারঃ অপরাধের খোদায়ী দন্ডবিধি
11. ডাকাত-ছিনতাইকারীদের সাজা এবং যুদ্ধকালীন সময় সামরিক বাহিনীর যেসব কাজ নিষিদ্ধ
12. সরকার বা রাষ্ট্র প্রধান হত্যাকারীদের শাস্তি প্রসঙ্গ
13. সাক্ষ্য কিংবা নিজ স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে চোরের হাতকাটা প্রসঙ্গ
14. ব্যভিচারি ও সমকামীদের প্রস্তরঘাতে সাজা
15. মদ্যপায়ীদের সাজা
16. অপবাদের শাস্তি
17. যেসব অপরাধের সাজা অনির্ধারিত এবং শাসক ও বিচারকের ইচ্ছাধীন
18. যে ধরনের কোড়া দ্বারা অপরাধীকে শাস্তি দেবে এবং যেসব অঙ্গে কোড়া মারা যাবে না
19. শাস্তি ও শাস্তি প্রাপ্তদের শ্রেণী বিভাগ
20. ফরয-ওয়াজিবের উপর আমল ও হারাম থেকে রক্ষার জন্যেই শাস্তি
21. অশ্লীলতা, হত্যাকান্ড, নিকটাত্মীয়, দুর্বল, পর সম্পদ জবর দখল থেকে দূরে থাকা
22. জখমের কিসাস ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কিসাস
23. বিভিন্ন ধরনের মানহানির কিসাস
24. যিনা-ব্যভিচারের অপবাদ দানকারীর শাস্তি প্রসঙ্গে
25. স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার
26. ধন-সম্পদের মীমাংসায় ন্যায়দন্ড বজায় রাখা
27. দেশ পরিচালনায় পরামর্শ ভিত্তিক ব্যবস্থা
28. ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসন পরিচালনা মহাদীনী কাজ

লেখকের ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা সেই মহান সত্তার জন্য, যিনি তাঁর নবী-রসূলগণকে সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণাদি সহকারে মানব জাতির নিকট প্রেরণ করেছেন। যিনি মানুষের জন্য সরল সোজা পথে চলার উদ্দেশ্যে এবং ন্যায়-নীতির অনুসারী হবার লক্ষ্যে নবী-রসূলগণের সাথে কিতাব এবং মীযান তথা ন্যায়ের মানদন্ড পাঠিয়েছেন। (সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য) যিনি লোহা ও লৌহজাত বস্তু প্রেরণ করেছেন, যার মধ্যে একদিকে রয়েছে কঠিন শক্তি ও ভীতি, অপরদিকে রয়েছে মানব কল্যাণের অসংখ্য উপকরণ।
আল্লাহ্‌ তা’আলাই এ ব্যাপারে সব চাইতে বেশী অবগত যে, কার সাহায্য করা এবং কাকে পয়গম্বর বানানো উচিত। তিনিই একক শক্তিমান, প্রবল পরাক্রমশালী সত্তা, যিনি হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে নবুয়্যত ধারার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং তাঁকে শেষ নবী বানিয়েছেন।
*****(আরবী)
“আল্লাহ্‌ তা’আলা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পথ-নির্দেশক বিধি-বিধানসমূহ এবং সত্য জীবন ব্যবস্থা দিয়ে এজন্যে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি সকল মনগড়া জীবন ব্যবস্থা ও ধর্ম মতাদর্শের উপর এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেন”। (সূরা ফাতাহঃ ২৮)
মহানবীর মদদকল্পে তিনি পাঠিয়েছেন “ সাহায্যকারী বলিষ্ঠ দলীল,” জ্ঞান-প্রজ্ঞা, কলম, হিদায়াত,যুক্তি-প্রমাণ,ক্ষমতা, শক্তি-সামর্থ্য, প্রভাব প্রতিপত্তিও (শক্তির প্রতীক) তরবারী। বলাবাহুল্য, মান-মর্যাদা ও অন্যায়-অসত্যের উপর বিজয়ের জন্যে এ সকল গুণ অত্যাবশ্যক। আমি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত মা’বূদ হবার যোগ্য অপর কোন সত্তা নেই, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর কোন সহকর্মী ও সমকক্ষ নেই। এ সাথে আরও ঘোষনা করছি যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) আল্লাহ্‌র একজন বান্দা ও রাসূল। তাঁর প্রতি আল্লাহ্‌র অসংখ্য রহমত বর্ষিত হোক। রহমত বর্ষিত হোক তাঁর বংশধর ও সকল সাহাবীর উপর। তাঁদের উপর নেমে আসুক শান্তি, করুণার অফুরন্ত ধারা। আমার এই ঘোষণা ও সাক্ষ্যদান হোক সেই মর্যাদার অধিকারী, যদ্দারা ঘোষণাকারী সকল সময়ের জন্যে খোদায়ী নিরাপত্তা ও তত্ত্বাবধানে চলে যায়।
গ্রন্থটি লেখার মূল প্রেরণা
মূলতঃ এটি একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ হলেও তাতে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত রাজনৈতিক বিধি-ব্যবস্থা এবং মহানবীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়সমূহ পরিপূর্ণরুপে বিবৃত হয়েছে। এ থেকে সকল শাসক, শাসিত, রাজা-প্রজা কারও পক্ষেই কোন অবস্থায় আপন দায়িত্বের প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন বা তা থেকে অব্যাহতি লাভের কোন অবকাশ নেই। এ গ্রন্থ রচনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রী সকল কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা এবং দেশের নীতি নির্ধারক, পরিচালকবৃন্দকে এমন উপদেশ বা পথ নির্দেরশনা প্রদান করা, যা আল্লাহ্‌ তা’আলা ঐসব শাসক-পরিচালকের উপর অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*****(আরবী)
“তিনটি কাজে আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন। (১) তোমরা একমাত্র আল্লাহ্‌রই দাসত্ব করবে, (২)তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করবে না, (৩) সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহ্‌র রজ্জুকে দৃঢ় হস্তে ধারণ করবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না আর আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে যাদের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন, তাদেরকে সদোপদেশ প্রদান করবে”।
“আস্‌সিয়াসাতুশ্‌ শারইয়্যা” বা শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রন্থটির মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ্‌র কিতাবের যে সকল আয়াত, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে-
******(আরবী)
“ (মুসলমানগণ!) আল্লাহ্‌ তোমাদের নির্দেশ করেছেন যে, তোমরা আমানতসমূহ অর্থাৎ মানুষের অধিকারসমূহ ঐগুলোর মালিক তথা হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। তোমরা যখন জনগণের পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নাও, তখন ন্যায়-নীতির মধ্য দিয়ে তা ফয়সালা করো। আল্লাহ্‌ তোমাদের যে উপদেশ প্রদান করেন, সেটা তোমাদের জন্যে কতই না উত্তম। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ্‌ সব কিছুই অধিক শুনেন, অধিক দেখেন। (হে মুসলমানগণ!) তোমরা আল্লাহ্‌র নির্দেশ মেনে চলো এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ মেনে চলো আর মেনে চলো তোমাদের (রাষ্ট্রীয়) দায়িত্বশীল নেতাদের নির্দেশও। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন প্রকার মতবিরোধ দেখা যায়, আল্লাহ্‌ তা’আলা এবং আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের শর্ত হচ্ছে, বিরোধীয় বিষয়টির ফয়সালা আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের হাওলা করো। এটা যেমন তোমাদের জন্য উত্তম, তেমনি পরিণামের জন্য অতি শ্রেয়”। (সূরা নিসাঃ ৫৮-৫৯)
শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলিমদের অভিমত হলো, প্রথমোক্ত আয়াতটি ****(আরবী) রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারক কর্মকর্তা এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তারা যেন জনগণের অধিকারসমূহ তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন এবং মামলা-মোকদ্দমা ও জনগণের অন্যান্য অভিযোগের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
দ্বিতীয় আয়াতটির ****(আরবী) মধ্যদিয়ে প্রজা সাধারণ ও বিভিন্ন বাহিনীর লোকদের বলা হয়েছে, তারা যেন নিজ নিজ নেতা ও কর্মকর্তাদের কথা মেনে চলেন। এসব কর্মকর্তাই সরকারী সম্পদ বণ্টন এবং যুদ্ধের নির্দেশসমূহ জারি করেন, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদিতে কাজ করেন। তবে যে স্তরের নেতাই হোন তিনি আল্লাহ্‌র অবাধ্য হওয়ার নির্দেশ দিলে তা মানা যাবে না এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশের পরিপন্থী কোন আইন বা হুকুম করলে কখনও তা পালন করবে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন যে,
****(আরবী)
“ স্রষ্টার অবাধ্যজনিত কাজের হুকুম করা হলে তা মানা জায়েয নেই”।
অতএব,যখন কোন ব্যাপারে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, তখন তোমরা মনোনিবেশ করো কুরআন ও সুন্নাহ কি বলে সে দিকে অতঃপর সে অনুযায়ীই ফয়সালা করো। বিবাদমান ব্যক্তিরা যদি এভাবে বিরোধ নিস্পত্তি না করে, তখন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর ফরয হলো উপরোল্লেখিত আয়াতের নির্দেশ অনুসারে কাজ করা এবং আল্লাহ্‌র নির্দেশকেই কার্যকর করা। আল্লাহ্‌র নির্দেশ হলোঃ
****(আরবী)
“ কল্যাণ এবং সংযমী হবার কাজে তোমরা একে অপরের সহযোগিতা করো এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে অপরকে সহযোগীতা করো না”। (সূরা মায়িদাঃ ২)
এ আয়াত অনুযায়ী কাজ করা হলে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা হবে এবং তাদের হকও যথারীতি আদায় হবে।
উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে আমানত আদায় করা ও হকদারের হকসমূহ তার কাছে যথাযথ পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমানত আদায় তথা জনগণের অধিকার প্রদান করা ও তাতে ন্যায়-নীতির অনুসরণ- এ দু’টি বিষয়ই হচ্ছে ন্যায়-নীতির শাসন, সৎ নেতৃত্ব এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এর মধ্যদিয়েই আমানত আদায় হবে।
অনুবাদকের কথা
ইসলাম এবং রাজনীতি বিষয়ক এ গ্রন্থখানা ৭ম ও ৮ম হিজরীর বিশ্ব বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, সংস্কারক শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সুবিখ্যাত গ্রন্থ – “আস্‌সিয়াসাতুশ্‌ শারঈয়া”- এর বঙ্গানুবাদ “শরীয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা”। পাঠক-পাঠিকাদের খিদমতে বাংলা ভাষায় এই মূল্যবান গ্রন্থখানা পেশ করতে পেরে আল্লাহ্‌র অশেষ শুকরিয়া আদায় করছি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এ গ্রন্থখানা এমন এক যুগে লিখেছিলেন যখন গোটা মুসলিম বিশ্ব তার রাজনৈতিক দৃঢ়তা, স্থিতিশীলতা প্রায় হারিয়ে ফেলে। মুসলমানদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। পরস্পর বিরোধী বহু মতবাদের প্রসার ঘটে। ইসলামী রাষ্ট্র দিনের পর দিন প্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে।
মূলত হিজরী সপ্তক শতক ছিল মুসলমানদের জন্য একটি পরীক্ষার যুগ। এ অধঃপতনের প্রধান কারণ ছিল চরিত্র ও কর্মে কুরআন ও সুন্নাহর মৌল নীতিমালার অনুসরণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার সাধারণ ব্যাধি, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা আল্লাহ্‌র আযাবের রূপ ধরে গোটা জাতির উপর আপতিত হয়েছিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর কাছে এ দৃশ্য ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি শেষ পর্যন্ত আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে মসী ও অসি উভয় প্রতিরোধের অস্ত্র ধারণ করলেন। জাতির সামনে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য রাখলেন। তাঁর সত্য ভাষণ অনেকের স্বার্থে আঘাত হানলো, অনেক সংকীর্ণ ও স্থুল চিন্তার লোক বিরুদ্ধাচরণ শুরু করলো। তিনি কোন প্রকার বিরোধিতাকে পরোয়া না করেই নির্ভীকচিত্তে ন্যায় ও সোঁতের বাণী বলে যেতে লাগলেন। অবশেষে এক পর্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য-সংহতির ভাব জাগ্রত হতে থাকলো।
বর্তমানে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে অনৈক্য, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও হীনমন্যতা লক্ষ্য করা যায়। হিজরী সপ্তম শতকের তুলনায় তা কিছুমাত্র অধিক নয়। এটা ঠিক যে, এখন প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলমানরা রাজনৈতিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তার প্রধান কারণ হলো, ঐ সকল মৌল নীতিমালা থেকে তাদের বিচ্যুতি, যেগুলোকে ইসলাম “আশ্‌সিয়াসাতুশ্‌ শারঈয়া” বলে উল্লেখ করা থাকে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) তাঁর এ গ্রন্থে ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ কুরআন ও সুন্নাহ্‌র আলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি এ বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, মানব জীবনের সকল বিভাগ- চাই সেটা প্রশাসনিক হোক, কি নৈতিক বা ব্যবহারিক, অর্থনৈতিক- এজন্য ইসলাম যে ব্যবস্থা দিয়েছে, সেটাই শাশ্বত ও চূড়ান্ত। ইসলামের প্রদত্ত এসব নীতিমালার অনুসরণ ছাড়া সমাজকে দুর্নীতি মুক্ত রাখা, এর উন্নতি, অগ্রগতি ও শ্রীবৃদ্ধি যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সরকারী প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে কলুষমুক্ত, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল রাখাও অসম্ভব।
“আস্‌সিয়াসাতুশ্‌ শারঈয়া”-এর লেখক শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এমন এক বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, যাঁর পরিচয়ের অপেক্ষা রাখে না। তিনি যে বিষয় বস্তুর উপর কলম ধরেছেন, সে বিষয়েরই চূড়ান্ত আলোচনা করেছেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থরাজির সব চাইতে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, তাঁর বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। বিশেষ করে তিনি বুখারী এবং মুসলিম থেকে অধিক প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। ছোট বড় বহু গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন।
“আসসিয়াসাতুশ শারঈয়া” গ্রন্থটি অধিক বড় না হলেও এর মধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক মৌলজ নীতিমালাসমূহ কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে স্পষ্ট তুলে ধরেছেন।
পরিতাপের বিষয় যে, আজকের মুসলিম মিল্লাতের সামনে এ মূল্যবান গ্রন্থ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও হীনমন্যতা ও অজ্ঞাতবশতঃ মুসলমানদের কেউ কেউ রাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে অপরের দ্বারে ধর্ণা দেয়। অথচ ইসলাম রাজনৈতিক যে সকল মৌল বিধান নীতিমালার উপর দেশ শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার ভিত্তি স্থাপন করেছে, এর সাহায্যে গোটা মুসলিম দুনিয়া পুনরায় নিজের মধ্যে ইসলামের সেই প্রাণসত্তা খুঁজে পেতে পারে, যা ইসলামের সোনালী যুগে ছিল। বিশ্বের মানব রচিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তসার শূন্যতা ও মানব সমাজে শান্তি আনয়নে ব্যর্থতার দাবী হলো, ইসলামী মূল্যবোধ-এর সুমহান নীতিমালার ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন-প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলা।
পৃথিবীর সকল শাসক, প্রশাসক বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়ার রাষ্ট্র প্রধান ও প্রশাসনযন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনে গ্রন্থটি এমন এক পথনির্দেশক গ্রন্থ, তাঁরা যদি এটি গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন, তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁদের সামনে সুষ্ঠু রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনকল্যাণ রাষ্ট্র উপহার দানের লক্ষ্যে ইসলামী রাজনীতির এক বাস্তব ছবি ফুটে উঠবে। এর ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দ্বারা তাঁরা জন-সমস্যাবলীর সমাধান, তাদের জীবনমানের উন্নতি বিধানে সকলের হৃদয় জয় করতে পারেন-শান্তি পিয়াসী জগদ্বাসীকে দিতে পারেন সার্বিক শান্তি, কল্যাণ, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির নতুন পথনির্দেশনা।
গ্রন্থটির যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, সেখানে এ গ্রন্থের বিশিষ্ট ভাষ্যকার আবুল আলা মুহাম্মদ ইসমাইলের বক্তব্যকে টীকারুপে ব্যবহার করে এর গুরুত্বকে আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর লিখিত আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার এ সুপ্রাচীন মূল্যবান গ্রন্থখানার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করায় “আহসান পাবলিকেশনের” প্রতি জানাই আন্তরিক শুকরিয়া ও মুবারকবাদ।
ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুজাহিদ আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) মানব কল্যাণের যে সুমহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ গ্রন্থখানা রচনা করেছেন, এর বঙ্গানুবাদের পেছনেও অভিন্ন লক্ষ্যই সক্রিয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নাগরিক চরিত্রকে অপরাধ প্রবণতা মুক্ত করা, সকল প্রকার দুর্নীতির উচ্ছেদ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য চাই খোদায়ী নিরপেক্ষ আইন। শ্রেণী বৈষম্যমুক্ত এই আইন ও ব্যবস্থার অনুপস্থিতিই সমাজে আইন অন্যায় অবিচারজনিত অপরাধ প্রবণতার জন্ম দেয়। অবশেষে ঐ অপরাধ প্রবণতা সমাজ চরিত্রে আরও হাজারো অপরাধ প্রবণতাকে উস্‌কে দেয়। প্রত্যেক কাজে জবাবদিহিতার চেতনা সম্বলিত এই খোদায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ সবের অবকাশ নেই বলেই সৎ নেতৃত্বের অধীন এই ব্যবস্থা সমাজে, রাষ্ট্রে শান্তি কল্যাণ ও জনসমৃদ্ধি আনতে সক্ষম। “আল্লাহ্‌র দীনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে” এ গ্রন্থ সহায়ক হোক, এই গ্রন্থ পাঠে রাষ্ট্রীয় নীতি আদর্শের ব্যাপারে সকল বিভ্রান্তির অবসান ঘটুক, আল্লাহ্‌র কাছে এই মুনাজাতই রইল। - জুলফিকার আহ্‌মদ কিস্‌মতী

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
মুসলিম জাতিকে অনুকূল প্রতিকূল উভয় অবস্থার মধ্যদিয়েই সামনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। খৃষ্টীয় তের এবং চৌদ্দ শতকের মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস ছিল বড় করুণ ও মর্মান্তিক। সর্বত্র অশান্তি, অস্থিরতা ও ভাঙনের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। তাদের সকল ঐতিহাসিক বীরত্বের কাহিনী যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। ভীরুতা, নিষ্ক্রিয়তা মুসলমানদের আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল।
ঠিক সে সময় অর্থাৎ তের শতকের প্রারম্ভে মঙ্গোলিয়ার মরুচারী তাতারিয়া গোষ্ঠী প্রগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য বর্বরদের অনুকরণে তাদের দলপতি চেংগীজ খানের নেতৃত্বে মুলসিম জাহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম আজকের রুশ অধিকৃত বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা সুলতান মুহাম্মদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জীহুন নদীর উত্তরে এক বিশাল প্রান্তরে সুলতানের চার লাখ আট হাজার সৈন্য চেংগীজ বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং প্রথম দিনের যুদ্ধেই এক লাখ ৬০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এভাবে পরবর্তী যুদ্ধে সুলতান মুহাম্মদের সৈন্যরা নির্মমভাবে পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর মঙ্গোলীয় তাতার সৈন্যরা মুসলিম রাজ্যগুলো একের পর এক ধ্বংস করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অন্য দিক থেকে সুসমৃদ্ধ দামেশক ও তৎকালীন মুসলিম দুনিয়ার রাজধানী বাগদাদ নগরীও তাতারীদের অত্যাচার ও ধ্বংসের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।
রাজনৈতিক এ পতনের সাথে সাথে মুসলমানরা ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রেও অধঃপতনের শেষ প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়। তৎকালীন সময় শিক্ষিত বলতে সমাজের আলিমদেরকেই বুঝাতো। আলিমগণের মধ্যে ইখতিলাফ ও মতবিরোধ চরমে উঠে। সাধারণ বিষয়কে কেন্দ্র করেও একদল মুসলমান আরেক দলকে নির্মমভাবে হত্যা করতে ও তিরস্কারবানে জর্জরিত করতে দ্বিধা করতো না। আলিমদের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ দলাদলির ফলে মুসলিম সমাজ শতধাবিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের সেই অনৈক্যের সুযোগে দুশমনরা এ জাতির সব তছনছ করে ফেলে।
অপরদিকে ইসলামের প্রাণসত্তাকে নিঃশেষকারী বিদ’আত, শিরক,পীর পূজা, কবর পূজা ইত্যাদি কুসংস্কার মারাত্মকরূপে বিস্তার লাভ করে। তাওহীদের বাস্তব সংজ্ঞা এক রকম বিলুপ্ত হবার পথে। কুরআন, সুন্নাহ্‌র শিক্ষা অনুসরণের চাইতে বিদ’আতী পীর-মাশায়েখের বক্তব্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে। ইসলামের বিশুদ্ধ ধারণা ও এর নির্মল জ্যোতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। অজ্ঞতার অন্ধকার যখন এভাবে মুসলমানের ঈমানী জ্যোতিকে প্রায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই দামেশকের আকাশে এক উজ্জ্বল সূর্যের উদয় ঘটলো। তিনিই হলেন আল্লামা তাকিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবদুল হালীম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইবনে কাসিম শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া আল হাওয়ানী আল দামেশকী।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হয়ে বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি এ সবের বিরুদ্ধে এক রকম জিহাদ ঘোষণা করেন। জিহাদী প্রেরণাদিপ্ত তাঁর এই সংস্কারধর্মী আন্দোলন ছিল বহুমুখী। লেখা, বক্তৃতা ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ সকল উপায়ে তাঁর এই প্রতিরোধ চলে। সকল প্রকার বিরোধিতা ও অজ্ঞতার মধ্যেই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। ন্যায় এবং সত্যের বাণীকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে তাঁকে অনেক দুঃখ কষ্টেরই সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বন্দী জীবন যাপন করেন। কারা-জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা তিনি ঈমানী শক্তি বলে সহ্য করেন।
শাসকবৃন্দ রাজা-বাদশাহ, আমীর-উমারাদের অনৈসলামিক ভূমিকার প্রতিবাদ ও বিরোধিতার কারণেই তিনি তাদের রোষানলে পড়েন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) সততা, নিঃস্বার্থতা ও আল্লাহ্‌র পথে ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দিতে গিয়ে যেই জুলুম-নিপীড়ন ও ভ্রুকুটি সহ্য করেছেন, তার নজির অতি বিরল । দীনের জন্যে আত্মত্যাগের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যদি “আফজালুল জিহাদ” তথা “অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ”-এর চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সংগ্রামের পথ দেখিয়ে না যেতেন, তাহলে পরবর্তী যুগে বিভ্রান্ত অত্যাচারী মুসলিম শাসক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মারমুখো ব্যক্তিদের সামনে হক কথা বলার লোকের অভাব দেখা দিত। সংগ্রামী ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গোটা কর্ম জীবনের প্রতি তাকালে তাঁর সম্পর্কিত এ সকল বক্তব্যকে অতিশয়োক্তি বলার কোন উপায় নেই। প্রায় আটশ বছর অতীত হয়ে যাবার পরেও তাঁর লিখিত মূল্যবান গ্রন্থসমূহের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। মিসর,হেজাজ, ইরান প্রভৃতি দেশের অসংখ্য লাইব্রেরীতে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গ্রন্থাবলী সংশ্লিষ্ট সমাজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে আছে। বার্লিন, লন্ডন, ফ্রান্স ও রোমের বহু পাঠাগারের শোভাবর্ধন করছে এ সংগ্রামী মনীষীর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থাবলী।
তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা একদিকে ইসলামের “সীরাতুল মুস্তাকীম”কে যাবতীয় আবিলতা মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন, অপরদিকে সকলকে যাবতীয় বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে আল্লাহ্‌র শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুগে যে তাগুতী শক্তি ইসলাম এবং মুসলমানদের চলার পথকে অবরোধ করে এগিয়ে এসেছিল, তিনি তার বিরুদ্ধে তরবারীও ধারণ করেন। ফলে চেংগীজী বর্বরদের পাশবিক বিক্রমকেও এর সামনে প্রতিরুদ্ধ হতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) যেভাবে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গেছেন, পরবর্তী যুগে সঠিকভাবে প্রতিটি মুসলিম দেশের ইসলামী নেতৃত্ব যদি সেই জিহাদী ভাবধারা অনুসরণ করতে পারতেন, তাহলে মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস অন্যভাবে গড়ে উঠতো। তা না হওয়াতেই মুসলমানরা আজ সর্বত্র তাগুতী শক্তির করুণার পাত্র।
জন্ম
৬৬১ হিজরী সালে রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ হাররান নামক এক শহরে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর জন্ম হয়। তাঁর সাত বছর বয়সে যখন এ শহরটি তাতারীদের আক্রমণের শিকার হয়, তিনি তখন তাঁর পিতার সাথে জন্মভূমি ত্যাগ করে দামেশকে চলে যান। কুরআন হিফজসহ অন্যান্য প্রাথমিক শিক্ষা তিনি ঘরেই লাভ করেন। অতঃপর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র দামেশকের বড় বড় সুদক্ষ উস্তাদদের কাছে তিনি ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

তাঁর জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা ও কর্ম-কৌশলের কথা অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর পান্ডিত্ব এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, জনগণ এই বলে বলাবলি করতো, “ইমাম তাইমিয়া যে হাদীসকে হাদীস বলে জানেনা, তা আদৌ হাদীস নয়”। ইবনে তাইমিয়া সকল সমস্যার সমাধান কুরআনের আয়াতের আলোকে পেশ করতেন। তিনি পূর্ববর্তী যুগের তাফসীরকারকদের কোন ভ্রান্তি থাকলে, তা পরিস্কার ভাষায় তুলে ধরতেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে, তিনি এই জ্ঞান বৈদগ্ধ ও দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর, সরস ও মিষ্ট; ঐতিহাসিক ইবনে কাসীরের মতে “ইবনে তাইমিয়া (র)-এর উপদেশপূর্ণ অপূর্ব ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে অনেক বড় বড় পাপী, আল্লাহ্‌দ্রোহীও তওবা করে সৎপথের অনুসারী হয়েছে”। শেখ সালেহ তাজুদ্দীন বলেনঃ আমি ইবনে তাইমিয়া (র)-এর অধ্যাপনা কক্ষে রীতিমতো হাযির হতাম। তিনি বন্যার গতিতে ছুটতেন, খরস্রোতা নদীর মত প্রবাহিত হতেন। শ্রোতামন্ডলী চোখ মুদে স্তব্ধ বসে থাকতো। অধ্যাপনা শেষে তাঁকে অধিক গম্ভীর ও ভয়ঙ্কর মনে হতো অথচ তিনি ছাত্রদের সাথে স্নিগ্ধ হাসি ও খোশ মিজাযে কথা বলতেন। অধ্যাপনার সময় তাঁকে মনে হতো, তিনি এক অদৃশ্য জগতে বিচরণ করেছেন এবং পর মুহূর্তে দুনিয়ার বাস্তব জগতে ফিরে এসেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কারা-প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করলেও তাঁর স্বল্পকালীন শিক্ষকতার যুগে ছাত্রদের সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর কয়েকজন ছাত্র যারা ছিলেন বিদ্যায়, জ্ঞানে, প্রতিভায়, কর্মদক্ষতায় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। যেমন, আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম, আল্লামা যাহবী, হাফিজ ইবনে কাসীর, হাফিজ ইবনে কুদামাহ, কাযী শরফুদ্দীন, শায়খ শরফুদ্দীন প্রমুখ মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আরবী ভাষায় গ্রীক দর্শনের অনুবাদ শুরু হয় হিজরী দ্বিতীয় শতকে। তখন থেকে মুসলিম সমাজের উপর গ্রীক দর্শনের বস্তুবাদী মর্মবাদের প্রভাব পড়ে। ফলে মানুষ খাঁটি ইসলামী জীবন দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সকল কিছু চিন্তা করতে শুরু করে। আব্বাসীয় রাজত্বের শুরুতে এ যুক্তিবাদী আন্দোলন অন্ধ আবেগের রূপ নেয়। এই মু’তাযিলাবাদ “খালকে কুরআনের” ন্যায় তুমুল ঝগড়ার উৎপত্তি করে। মুতাযিলাবাদ কুরআন পন্থীদেরকে গ্রীক দর্শনের দুর্জয় প্রভাবে পরাজিত করেছিল। “কালাম শাস্ত্র” মুসলিম সমাজকে সূক্ষ্ম মানতিকী আলোচনায় ব্যস্ত রেখে বাস্তব কর্মজগত থেকে একেবারে গাফিল করে দিচ্ছিল।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) মুসলিম দুনিয়াকে এ অবাঞ্ছনীয় অর্থহীন গুমরাহীর পথে ধাবিত হতে দেখে এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেন। ৬৯৮ হিজরীতে তিনি একটি কিতাব লিখে “মুতাকাল্লেমীন”-এর আকীদা ও ধ্যান-ধারণার তীব্র সমালোচনা করেন এবং একে বাতিল প্রমাণ করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্ভেজাল আদর্শকে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ গ্রন্থ ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের বুকে তীরের আঘাত হানে। এ কিতাবের দ্বারা তিনি চিন্তা জগতে এক নতুন বিপ্লব নিয়ে আসেন। এর কারণেই তাঁর নির্যাতনমূলক জীবনের সূচনা ঘটে।
ইমামের মতবাদ সম্পর্কে মিসরের শাসনকর্তা নাসের শাহের নিকট বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হলে ৭০৫ হিজরীতে তিনি দামেশকের গভর্নরকে স্থানীয় আলিমদের একটি মজলিস ডাকার ও ইমামের মতবাদ পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেন। একাধিক বৈঠকে ইমামের মতই প্রাধান্য লাভ করে।
সূফীদের নাম ভাঙ্গিয়ে ভন্ডপীর-ফকীর-দরবেশের পেশাধারী একশ্রেণীর লোক যেমন আজকাল অর্থোপার্জন করে এবং তাদের কাছে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়, তৎকালেও মুসলিম সমাজ এ ফিত্‌নায় কম ভারাক্রান্ত ছিল না। আহ্‌মদিয়া ও নিসারিয়া ফকীর সম্প্রদায় দুটির একটি যুক্ত দল ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর বিরুদ্ধে দামেশকের গভর্নরের কাছে তিক্ত সমালোচনা করলে, তিনি তাঁকে ডেকে পাঠান। ইমাম অকুতভয়ে জবাব দেন, এ ফকীরদের দু’তি দল রয়েছে- (১) একটি পরহিযগারী, সাধুতা, নৈতিকতা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রশংসার যোগ্য। তবে এদের অধিকাংশই ভন্ড ফকীর। শিরক, বিদ’আত ও কুফুরী ধারণার পংকিলতায় নিমজ্জিত। ইসলামের মৌল শিক্ষা কুরআন-হাদীসকে পরিত্যাগ করে মিথ্যা ও প্রতারণাকেই জীবনের সম্বল করে নিয়েছে। এরা দুনিয়ার মূর্খ মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে নানা প্রকার বিদ’আত, শিরকের জালে জড়িত করে। নিজেদের পকেট ভর্তির জন্য সদাসর্বদা সাধুতার ভান করে থাকে। নিজেদের চারি পাশে এমন এক বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে নেয় যে, যারাই তাদের সংস্পর্শে যেতো, তাদের মানসিক গোলামে পরিণত হতো। নিজেদের পকেট উজাড় করে সেই বিদ’আতী ফকীরদের পদমূলে সর্বস্ব ঢেলে দিত।
ইমামকে মিসরে তলব
ইমামদের সত্য ভাষণে গভর্নর নিরব থাকলেও অন্যদের পক্ষ থেকে গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে ভীষণ চক্রান্ত চলে। নাসরুল্লাহ মুঞ্জী মিসরের রাজন্যবর্গকে ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাঁরা দামেশকের গভর্নরের কাছে লিখে পাঠায় যেন ইমামকে মিসরে পাঠানো হয়। গভর্নর জবাবে বললেনঃ তাঁর সাথে দু’বার আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু তাঁর মতবাদে কোন দোষ পাইনি। অবশ্য পরবর্তীতে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো, “ভালো চাওতো শাহী ফরমান অনুযায়ী কাজ করতে দ্বিধা করো না”। গভর্নর মজবূর হয়ে ইমামকে মিসর পাঠান।
৭০৫ হিজরীতে ১২ই রমযান সোমবার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) দামেশক থেকে বের হলে শহরবাসী তাঁর পেছনে পেছনে তিন মাইল পর্যন্ত গিয়েছিল। বিদায় সম্বর্ধনা আগত অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমামের প্রতি তাকিয়ে থাকে।
মিসরে পৌঁছে তিনি কায়রো শহরে শুক্রবার দিন একটি কেল্লার অভ্যন্তরে প্রধান বিচারপতি ও রাজদরবারীদের এক সমাবেশে তাঁর মতামত নির্ভীকচিত্তে বর্ণনা করেন। কিন্তু তারপরও তিনি রেহাই পাননি। অন্য মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে আটক রাখা হয়। ৭০৭ হিজরীতে তিনি মুক্তি পান। অতঃপর তিনি জামেয়াতুল হিকাম-এর মসজিদে জুমার নামায পড়ান এবং প্রায় ৪ ঘন্টা- ‘ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’- (অর্থাৎ “একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি আর একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি”।) আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করেন। এভাবে মিসরে কিছু দিন থেকে তিনি তাঁর মতাদর্শ (ইসলাম) প্রচার করতে থাকেন এবং যাবতীয় ভ্রান্ত মতবাদের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে লাগলেন। মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর অদ্বৈতবাদের ভ্রান্তি স্বপ্রমাণ তুলে ধরতে লাগলেন। কিন্তু বিরুদ্ধাবাদীদের জন্যে এটা ছিল অসহ্য। সূফী তাজুদ্দীন সাধারণ মানুষকে সভা-সমিতির মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তুলে তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ আনেন এবং সরকারের নিকট তাঁর শাস্তি বিধানের দাবী তোলেন। সরকার তখন তাঁকে প্রথমে নজরবন্দী এবং পরে কারাগারেই আবদ্ধ করে রাখেন। কারা-জীবনেও তিনি বসে থাকেননি। নানান প্রকার অবৈধ খেল-তামাশা ও লক্ষ্যহীন জীবনবোধে লিপ্ত কয়েদীদের মধ্যে তিনি ইসলামের শিক্ষা দান কাজ শুরু করেন। তাদের নামাযী ও চরিত্রবান করে তোলেন। এতে জেলখানার পথহারা মানুষগুলো মনুষ্যত্বের সন্ধান পায়।
কারা প্রকোষ্ঠে ইমাম ইবনে তাইমিয়া
শত্রুরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর এ কাজের টের পেয়ে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে আলেকজান্দ্রিয়ার জেলে স্থানান্তর করে। এখানে একটি দুর্গে ১৮ মাস থাকাকালে একাধিকবার তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যাতে মুসলিম জাহানের লোকেরা কেঁদে কেঁদে অস্থির হতো। ৭০৯ হিজরীতে বাদশাহর হুকুমে তিনি মুক্তি পেয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো রওনা দিলে স্থানীয় জনগন এক বিরাট মিছিল করে তাঁকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন। কায়রোর মাশহাদ-এ তিনি অবস্থান কালে কুরআন-হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় (৭১১ হিঃ) জামে মসজিদে প্রতিপক্ষীয় একদল লোক এসে ইমামের উপর হামলা করে এবং তাঁকে এক নির্জন ঘরে আটক করে নির্মমভাবে প্রহার করে। শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর নিকট লোকজন দলে দলে দৌড়ে আসে এবং অভিপ্রায় ব্যক্ত করে যে, হুযূর অনুমতি দিলে গোটা মিশর সহর জ্বালিয়ে দেব। কিন্তু তিনি কোনরূপ প্রতিশোধ না নিয়ে বরং বললেনঃ আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। এরপরও তিনি অনেক দিন মিসরে থেকে পরে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করে স্বদেশ ভূমি দামেশকে ফিরে আসেন। জনগণ আনন্দে মিছিল করে তাঁর আগমন সম্বর্ধনা জানায়।
স্বদেশ ভূমি দামেশকে প্রত্যাবর্তন
দামেশকে আসার পর তিনি দীনী শিক্ষা বিস্তার, গ্রন্থ প্রণয়ন ও মানব সেবামূলক কাজে হাত দেন। তাঁর নির্ভীক কর্মতৎপরতা ও স্পষ্ট ভাষণে কায়েমী স্বার্থবাদী কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের গা-জ্বালার সৃষ্টি হয়। তারা আবার সরকারের কাছে অভিযোগ আনলে এ মর্মে সরকারী ফরমান জারী হয় যে, ইবনে তাইমিয়া আর কোন ফতোয়া জারী করতে পারবেন না।
কিন্তু ইমাম বললেন, “ সত্য গোপন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। তাঁর পক্ষ থেকে সরকারী ফরমানের এহেন বিরুদ্ধাচরণে ৭২০ হিজরীতে ‘দারুস্‌ সাদাত’ –এ অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে ইমামকে পুনরায় বন্দী করার সরকারী ফরমান জারী হয়। তখন তিনি পাঁচ মাস আঠার দিন পর্যন্ত দুর্গে বন্দী ছিলেন। এক বছর পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি সেই পুরাতন কাজ শুরু করেন। ইমাম জ্ঞান প্রসারের কাজে নিমগ্ন হন। তিনি দেখলেন, বহু বুযুর্গের কবর পূজা হচ্ছে। মকসূদ হাসিলের জন্য হাজার হাজার মানুষ কবরে শায়িত বুযুর্গদের কাছে প্রার্থনা জানাবার জন্যে দলে দলে ছুটে আসছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ৭২৬ সনে ফতোয়া জারী করলেন যে, “ কবর যিয়ারত করার নিয়তে দূর দেশ সফর করা জায়েয নয়। এ ফতোয়া জারীর পর তাঁর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিরুদ্ধবাদীরা বড় বড় সভা করে তাঁর বিরুদ্ধে আগুন ঝরা বক্তৃতা দেয়। মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। কেউ বলে জিহ্বা কেটে দিতে হবে, কেউ বলে চাবুক মারতে হবে। কারও মত হলো যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে। একদল মিসরের বাদশাহ্‌র কাছে দাবী তুলল, তাঁকে যেন কতল করা হয়। পরে সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেফতারকারি পুলিশ তাঁর নিকট গেলে তিনি সহাস্যে তাদের সাথে কারাগারে চলে যান। বাগদাদে এ খবর পৌঁছুলে সেখানকার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ আলিমগণ ইমামের ফতোয়াকে ইসলামের মূল ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে তাঁর প্রতি সমর্থন জানায়। তাঁরা বাদশাহর কাছে দু’খানা চিঠি পাঠান। ঐ সকল চিঠির সারমর্ম হলোঃ ইমাম ইবনে তাইমিয়া যুগশ্রেষ্ঠ শতাব্দীর মুজতাহিদ ইসলামী মিল্লাতের নেতা, পৃথিবীর সাত একলীমের ধনভান্ডারও তাঁর মূল্য দিতে অক্ষম। আশ্চর্যের বিষয় যে, জাতির এ কর্ণধার যেখানে রাজপ্রাসাদের থাকার কথা, তাঁকে রাখা হয়েছে কারাগারে। তাঁর প্রতি ভিত্তিহীন দোষারোপ করা হয়েছে। তাঁকে আশু মুক্তি দেয়া উচিত।
ইরাকীরা ইমামের কারা-নির্যাতনের কথা শুনলে সারা দেশে অন্তর্বেদনার প্রচন্ড আগুন জ্বলে উঠে। আলিমদের সম্মিলিত এক ঘোষণায় বলা হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। সুতরাং শায়খুল ইসলামকে দীনের খিদমতের জন্য মুক্তি দেয়া হোক। তাতে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করা হবে। বাগদাদের শ্রেষ্ঠ ওলামা-এ-কিরামের এ চিঠি মিসর বাদশাহ্‌র দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি কিংবা পৌঁছুলেও তা এমন সময় যে, তখন ইসলামী দুনিয়ার শতাব্দীর এ উজ্জ্বল সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুজাহিদ শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া চিরদিনের তরে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) জীবনের শেষ দিনগুলো কারাগারে ইবাদত বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ও এর গবেষণাইতেই কাটাতেন। শেষবারে ইমাম দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস কালেরও বেশি দিন কারারুদ্ধ ছিলেন। কারাগারের এ নিষ্ঠুর বন্দী জীবনও কেটেছে তাঁর অসংখ্য মৌলিক ও মূল্যবান গ্রন্থ রচনায়।
ইসলামের শিক্ষা আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের উপর আল্লাহ্‌র গযব রূপে তাতারীদের যেই হামলা আসে, তখনও মুসলিম বিশ্বে অসংখ্য আলিম ছিলেন, পীর-মাশায়েখ ছিলেন। কিন্তু আরাম-আয়েশ বাদ দিয়ে এ মহাবিপিওদের মুকাবিলা করা এবং মুসলিম জনতাকে সংগঠিত করার মতো লোক খুব কমই ছিল। উদ্ভাবনী জ্ঞান দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)। ইসলাম মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে এসেছে- বাতিলের সাথে মিতালি করে চলার জন্যে নয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়া অসহ্য কষ্ট-নির্যাতনের মধ্যদিয়ে তারই প্রমাণ রেখে গেছেন। আল্লাহ্‌র দীন প্রতিষ্ঠাকল্পে বাতিলের বিরুদ্ধে লেখা, বক্তৃতা ও প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করেছেন এবং কষ্ট ত্যাগের মধ্যদিয়েও কি করে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সংগ্রামী জীবন উন্মুক্ত গ্রন্থতুল্য এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
******(আরবী)
[এক]
শরীয়তী শাসন কর্তৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য
প্রথম পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু হলোঃ নেতৃত্বের অধিকারী, পৌর কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় প্রশাসকবৃন্দ, বিচারকমন্ডলী, বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, অর্থবিভাগীয় কর্মকর্তাগণ, মন্ত্রীবর্গ, মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ, সাদকা-খয়রাত ও সরকারী যাকাত আদায়কারীগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত আলোচনা।

দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারটি দুই প্রকার। (১) কর্তৃত্ব এবং নেতৃত্ব। মহানবী (সা) যখন মক্কা জয় করেন, তখন তিনি কা’বা শরীফের চাবিসমূহ বনী শাইবা থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা আব্বাস (রা) এ সকল চাবি চেয়ে বসলেন যেন হাজীদের পানি পান করানোর ব্যবস্থাপনা এবং একই সাথে কা’বার অভিভাবকত্ব লাভ ও কা’বার খেদমতের দায়িত্ব নিজে পেতে পারেন। কিন্তু তাঁর এই আগ্রহ আল্লাহ্‌ পছন্দ করেননি। তিনি আয়াত নাযিল করলেন এবং কা’বা শরীফের কার্যসমূহ পূর্ববর্তী খাদেম বনী শাইবার লোকদেরকেই প্রদান করার নির্দেশ দিলেন। অতএব এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, নেতার জন্যে ফরয (কর্তব্য) হচ্ছে মুসলমানদের কোন কাজকে এমন ব্যক্তিদের হাতে সোপর্দ করা, যারা ঐ কাজের জন্যে অধিক যোগ্যতার অধিকারী। যেমন মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন,
*******(আরবী)
“মুসলমানদের কোন কাজে কেউ কর্তৃত্ব লাভ করার পর যদি সে এমন এক ব্যক্তিকে শাসক নির্বাচন করে, যার চাইতে সেই এলাকায় অধিক যোগ্যতর মুসলমান রয়েছে, তাহলে সে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো”।
********(আরবী)
যে (রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা) সেনাবাহিনীতে এমন ব্যক্তিকে নেতা নির্ধারণ করে, যার চাইতে জাতীয় সেনাবাহিনীতে আরও যোগ্যতর ব্যক্তি রয়েছে, সে আল্লাহ্‌ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। বিশ্বাসঘাতকতা করলো মুসলমানদের সাথে। (আল হাকিম তাঁর সহীহ হাদীস সংকলনে এটি রেওয়ায়েত করেছেন।)
কোন কোন আলিম এটিকে হযরত উমরের (রা) বাণী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, হযরত উমর (রা) একথাটি তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন। উমরের (রা) ছেলেই একথার বর্ণনাকারী। হযরত উমর (রা) বলেন,
*********(আরবী)
“যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোন ব্যাপারে (নির্বাহীর) দায়িত্ব পেয়ে (যোগ্যতর লোককে বাদ দিয়ে) এমন ব্যক্তিকে কর্মকর্তা নিযুক্ত করে, যার সঙ্গে তার স্নেহের সম্পর্ক আছে কিংবা সে তার স্বজন, তবে সে আল্লাহ্‌, আল্লাহ্‌র রাসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো”।
বিষয়টির ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করা শাসনকর্তাদের প্রথম কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে কোন্‌ লোক প্রকৃত যোগ্য, শহর ও পৌর এলাকাসমূহে (এবং স্থানীয়) প্রশাসনে কি ধরনের সরকারী প্রতিনিধি বা কর্মকর্তা নিয়োগ বাঞ্ছনীয়, এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও পরামর্শ করা অপরিহার্য। কারণ, যারা সেনা ইউনিটের কমান্ড অফিসার হবে, যারা ছোট বড় ইসলামী সেনাদলের নেতৃত্ব দেবে, যারা মুসলমানদের নিকট থেকে নানা প্রকার শুল্ক কর আদায় করবে, যারা জনগণের অর্থ ব্যবস্থার নিয়োজিত থাকবে, তারাই এসবের নিয়ন্ত্রক। সরকারী প্রশাসনিক কাজ কর্মের পরিচালকও তারা। এজন্যে উচ্চ কর্মকর্তা ও প্রধান শাসকের জন্যে একান্ত অপরিহার্য বিষয় হলো, এমন সব লোককে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ দান ক্রা, যারা মুসলমানদের জন্য উত্তম এবং যোগ্য বলে গণ্য। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যোগ্য লোক থাকতে যাতে কোন অযোগ্য ব্যক্তি নিয়োগপত্র পেয়ে না যায়। এ নীতি রাষ্ট্রীয় সকল প্রশাসনিক বিভাগে অবশ্যই পালনীয়। যেমন, নামাযে ইমাম ও মুয়ায্‌যিন, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক, হজ্জ অনুষ্ঠানে খতীব বা কর্মকর্তা, খাবার পানির ব্যবস্থাপক, (নদ-নদী, খাল) ঝর্ণার তত্ত্বাবধায়ক রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সংরক্ষক, সেনানিবাসের প্রহরী, সেখানকার অস্ত্রনির্মাতা, অস্ত্রাগারে পাহারাদার, ছোট বড় বিভিন্ন বাহিনীর পরিচালক, বাজারের শূল্ক আদায়কারী, গ্রামীণ তথা স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এদের প্রত্যেকের নিয়োগে সততা ও যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
কেউ মুসলিম সমাজের নেতা ও শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হলে তাঁর দায়িত্ব হলো নিজের অধীনস্থ এমন সব লোককে কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করা, যারা সৎ বিশস্ত এবং সংশ্লিষ্ট কাজের ব্যাপারে দক্ষ, পারদর্শী। এমন সব ব্যক্তিকে কিছুতেই সামনে এগিয়ে দেয়া উচিত নয়, যারা নিজেরাই কর্তৃত্ব পাবার খাহেশ পোষণ করে কিংবা পদের দাবী করে। বরং যারা পদলোভী, উক্ত পদ পাবার প্রশ্নে তাদের এই লোভই হচ্ছে বড় অযোগ্যতা। সহীহ আল বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে,
******(আরবী)
রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত আছে যে, একদা তাঁর দরবারে কিছু লোক উপস্থিত হয়ে তাঁর পক্ষ থেকে শাসন কর্তৃত্ব প্রাপ্তির অনুরোধ জানালো। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যারা স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব চায়, আমরা এমন লোককে কোন কিছুর কর্তৃত্ব দেই না। (বুখারী-মুসলিম)
আবদুর রাহমান ইবনে সুমারা কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
*******(আরবী)
“ হে আবদুর রহমান! নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব চেয়ে নিও না। অপ্রার্থিতভাবে যদি তোমার হাতে নেতৃত্ব আসে, তাহলে তুমি দায়িত্ব পালনে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে সাহায্য পাবে আর যদি তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নাও, তাহলে সেটার (ভালমন্দের) পুরো দায়িত্ব তোমার উপরই বর্তাবে (এবং তুমি আল্লাহ্‌র সাহায্য পাবে না”।)
মহানবী (সা) বলেছেন,
*****আরবী
“যে ব্যক্তি বিচরকের পদ চায় আর এজন্য কারুর সাহায্য প্রার্থনা করে, তার উপর সে কাজের (ভালমন্দ) সোপর্দ করা হবে। আর যে বিচারকের পদ দাবী না করে এবং এজন্যে কারুর সাহায্য না চায়, তা হলে আল্লাহ্‌ তা’আলা তার জন্য একজন ফেরেশতা পাঠান। ঐ ফেরেশতা তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে”। (আহলুস সুন্নাহ)
অতএব প্রধান শাসক যদি দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলেন এবং অধিক সৎ যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে বন্ধুত্ব, স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বদেশীকতা যেমন ইরানী, তুর্কী, রোমী কিংবা অপর কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন, তাহলে সেটা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। ঠিক তেমনিভাবে উৎকোচ অথবা অপর কোন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে কিংবা এ জাতীয় অন্য কোন সংকীর্ণ স্বার্থ যদি কারও নিয়োগের কারণ হয় অথবা যোগ্য সৎ ব্যক্তির প্রতি কপটতা ও বৈরিতার কারণে তাকে বাদ দিয়ে অযোগ্য অসাধু ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটাও অবশ্যই আল্লাহ্‌, তাঁর রাসূল ও সাধারণ মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বৈ কিছু নয়। আল্লাহ্‌ তা’আলা এহেন বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে নিষেধ করে বলেছেন-
*******আরবী
“হে মুমিনগণ ! জেনে শুনে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানত সম্পর্কেও না”। (সূরা আনফালঃ ২৭)
অতঃপর আল্লাহ্‌ ইরশাদ করেন,
******আরবী
‘জেনে রেখো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি হচ্ছে একটি ফিৎনা বা পরীক্ষা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র নিকটই রয়েছে বিরাট প্রতিদান।(সূরা আনফালঃ২৮)
মহান আল্লাহ্‌র একথা বলার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, মানুষ অনেক সময় নিজ সন্তান ও আপনজনদের ভালবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে বসে। অযোগ্যকে ক্ষমতার অধিকারী বানিয়ে দেয়। এটা অবশ্যই আল্লাহ্‌র আমানতে খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। এমনিভাবে সম্পদের প্রাচুর্য ও অর্থের পাহাড় গড়ে তোলার ব্যাপারে তার আগ্রহের শেষ থাকে না। তার এই সম্পদপ্রীতি তাকে অযোগ্য ব্যক্তিকে প্রাধান্য দিতে এবং অন্যায়ের প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করে। সে অন্যায়, অবৈধ পন্থায় সম্পদ লাভ করতে গিয়ে জনগণকে শোষণ করে। কোন কোন এলাকার আঞ্চলিক শাসক বা বড় সরকারী কর্মকর্তা এমন চরিত্রের হয়ে থাকে যে, সে ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিকে তোষণে পারদর্শী। ফলে তোষামোদী লোকদেরকে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আপন লোকদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে বসে। এহেন ব্যক্তি নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও আমানতের খেয়ানত করে।
দায়িত্বপূর্ণ সরকারী ব্যক্তি যদি আল্লাহ্‌কে ভয় করে লোভ সংবরণ করতে পারে এবং নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়, তাহলে আল্লাহ্‌ তাকে ন্যায়নীতির উপর অটল থাকতে সাহায্য করে। তাকে সকল প্রতিকূলতা থেকে হেফাযত করেন।
যে শাসক নিজ প্রবৃত্তির দাস, আল্লাহ্‌ তাকে শাস্তি দেন। তার উদ্দেশ্য ও আশা আকাংখার স্বপ্নসৌধকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেন। তার সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজনকেও অসম্মানজনক অবস্থায় রাখেন। সে হারায় তার অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদসমূহ।

এ সম্পর্কে একটি বিখ্যাত ঘটনা আছে যে, একবার আব্বাসী শাসকদের একজন আলিমদের ডেকে বললেন, আপনারা নিজেদের দেখা কিংবা শোনা কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করুন। একবার উমর ইবনে আবদুল আযীযকে (রহ) আমি দেখেছি, জনৈক ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বললো,” আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আপনার সন্তানদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে দূরে রেখেছেন। তাদেরকে ফকীর ও অসহায় অবস্থায় রেখে যাবার পথ করেছেন। তাদের জন্যে আপনি কিছুই রেখে যাচ্ছে না”। উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি বললেন, ঠিক আছে, সন্তানদেরকে আমার সামনে হাজির করো। তাদের সকলকে সামনে হাজির করা হলো। খলীফার সন্তান সংখ্যা ছিল উর্ধ্বে। তাদের সকলেই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। সন্তানদের দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, বৎসগণ! তোমাদের যা হক ছিল তা আমি তোমাদের পুরোপুরি দিয়ে দিয়েছি-কাউকে বঞ্চিত করিনি। এছাড়া জনসাধারণের কোন সম্পদ আমি তোমাদের দিতে পারবো না। তোমাদের প্রত্যেকের অবস্থা তো এই যে, হয় তোমরা সৎ সাধু ব্যক্তি হবে আর আল্লাহ্‌ তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী, নয় তোমরা অসৎ ও অসাধু হবে। আমি অসৎ ও অসাধু ব্যক্তিদের জন্যে কিছুই রেখে যেতে চাই না। কারণ ঐ অবস্থায় তারা আল্লাহ্‌র অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে। *****আরবী “যাও, সকলে এবার আমার নিকট থেকে যেতে পারো, এটুকুনই আমার কথা”।
অতঃপর তিনি বলেন, মহাপ্রাণ উমর ইবনে আবদুল আযীযের সেই সন্তানদেরকেই আমি পরবর্তীকালে দেখেছি, তাদের কেউ কেউ শত শত ঘোড়ার অধিকারী ছিলেন, সেগুলো আল্লাহ্‌র রাস্তায় দান করেছেন। ইসলামের মুজাহিদগণ সেগুলোর উপর সওয়ার হয়ে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করতেন।
অতঃপর সেই আব্বাসী খলীফা বললেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহ) ছিলেন “খলীফাতুল মুসলিমীন”।
পূর্বে তুর্কীদের দেশ এবং পশ্চিমে মরক্কো ও স্পেন তাঁর শাসনাধীন, সাইপ্রাস দ্বিপ, সিরীয় সীমান্তবর্তী এলাকা, তরসূস ইত্যাদিতে তাঁর শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। দক্ষিণে ইয়ামেনের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছিল তাঁর শাসনের। এতদসত্ত্বেও তাঁর সন্তানরা পৈত্রিক উত্তরাধিকার থেকে অতি সামান্য কিছুরই মালিক হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তাঁর পরিত্যক্ত সম্পদের পরিমান যা ছিল তা সন্তানদের মাথা পিছু বিশ দেরহামের চাইতেও কম ছিল।১ ( আল্লাহ্‌ নেক বান্দাদের সাহায্য করেন, যেমন ‘উমর ইবনে ‘আবদুল আযীযের (রহ) সন্তানদের করেছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে তারা তেমন কিছু পায় নাই। কিন্তু আল্লাহ্‌ তাদের এমন সাহায্যই করেছিলেন যে, প্রত্যেকই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ “আমার অভিভাবক তো আল্লাহ্‌ যিনি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনিই সৎকর্মপরায়ণদের অভিভাবকত্ব করে থাকেন।(৭:১৯৬)-সম্পাদক ) অথচ ঐ সময়ই আমি খলীফাদের মধ্যে এমন সব শাসকও দেখেছি, যারা এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ রেখে গিয়েছিল যে, তাঁদের মৃত্যুর পর যখন সন্তানরা সেগুলো নিজের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করছে, তখন প্রত্যেকের ভাগে ৬শ’ কোটি পর্যন্ত ‘আশরাফী’ পড়েছে। তারপরও ঐ সকল সন্তানের কেউ কেউ শেষে ভিক্ষা করতো। এ সম্পর্কে অসংখ্য কাহিনী, চাক্ষুষ ঘটনাবলী এবং পূর্ববর্তীদের শ্রুত অনেক অবস্থার কথা বিক্ষিপ্তভাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। সেগুলোকে জ্ঞানবানদের জন্য বহু কিছু শিক্ষার আছে।
নবী জীবনের আদর্শ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাও একটি আমানত, এই আমানত যথাযথভাবে রক্ষা করা ‘ওয়াজিব’।
বিভিন্নভাবে পূর্বাহ্নেই এ বিষয়ে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। আবু যর গিফারী (রা)-কে মহানবী (সা) নেতৃত্ব সম্পর্কে বলেছেন,
*******আরবী
“ নেতৃত্ব হচ্ছে একটি আমানত। এ নেতৃত্ব (ক্ষেত্র বিশেষে) কিয়ামতের দিন লজ্জা ও অনুতাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে যিনি ন্যায়-নীতি ভিত্তিক নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন এবং এর হক সঠিকভাবে পালন করেছেন, তার কথা আলাদা”। (মুসলিম)
ইমাম বুখারী (রহ) কর্তৃক সহীহ বুখারীতে হযরত আবু হুরায়রার (রা) একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে যে,
************আরবী
মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন, “আমানত নষ্ট (তথা খেয়ানত) হতে থাকলে তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো”। বলা হলো, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! “আমানত নষ্ট” বলতে কি বুঝায়? হযরত বললেন, যখন শাসন ক্ষমতা ও নেতৃত্ব কর্তৃত্বের আসনে অযোগ্য ব্যক্তিদের আগমন ঘটে, তখন তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো। (বুখারী)
আমানতের এই অর্থের প্রেক্ষিতেই এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ্‌র ‘ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ইয়াতীমের অভিভাবক বা অসী, ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক এবং কোন দায়িত্বে নিয়োজিত ইনচার্জ বা প্রতিনিধির যদি সংশ্লিষ্ট মালিকের সম্পদ থেকে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন উত্তম পদ্ধতিতে তা ব্যয় করবে ( অর্থাৎ স্বীকৃত পরিমাণের বেশী ব্যয় করবে না এবং কোনরূপ আত্মসাৎ করবে না।) যেমন আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেছেন ,
********আরবী
“ইয়াতীম বয়োঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সদুদ্দেশ্য ছাড়া তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হইও না”।
শাসক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা হচ্ছেন বকরীর রাখালের ন্যায় জনগণের রক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক। যেমন, মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“ তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের রক্ষক। প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের যিনি নেতা, তাঁকে তাঁর অধীনস্থ জনগণের কার্যবলী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীগৃহের রক্ষক। উক্ত গৃহে যা তার কর্তৃত্বাধীন সে ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সন্তান তার পিতৃ সম্পদের রক্ষক, সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। দাস ভৃত্য তার মনিবের মাল-সম্পদের রক্ষক। তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। সাবধান! মনে রেখো, তোমাদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের জন্য রক্ষক। সকলকে নিজ নিজ অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে”।
মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেন যে,
*******আরবী
“ আল্লাহ্‌ যাদেরকে অপরের উপর রক্ষণা বেক্ষণের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছেন, সে যদি তার দায়িত্ব পালনে উদাসীন থেকে মারা যায়, আল্লাহ্‌ তার জন্যে বেহেশতের গন্ধও হারাম করে দেবেন”। (মুসলিম)
একবার আবু মুসলিম খাওলানী (রহ) হযরত মুআবিয়া (রা) ইবনে আবু সুফিয়ানের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন,
******আরবী
“(হে মজুর! তোমার প্রতি সালাম )”
দরবারে সভাসদগণ বললেন – ‘আইউহাল আজীর’ না বলে **আরবী বলুন। তিনি অতঃপর বললেন, ******আরবী পুনরায় বলা হলো “আইউহাল আমীর” বলুন। কিন্তু আবু মুসলিম খাওলানী একই বাক্যের তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। উপস্থিত লোকজন বার বার তাঁকে ‘আইউহাল আমীর’ বলতে স্মরণ করিয়ে দেন। অবশেষে আমীর মু’আবিয়া বললেন, আবু মুসলিমকে তোমরা বলতে দাও। তাঁর কথার অর্থ তিনিই ভাল জানেন। অতঃপর আবু মুসলিম বললেন, হে মু’আবিয়া! তুমি একজন মজুর। এই বকরীর দলের দেখা শোনা করার জন্যে তোমাকে বকরীর প্রভু মজুরীর ভিত্তিতে নিয়োগ করেছেন। তুমি যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরীরসমূহের তত্ত্বাবধান কর এবং রুগ্ন বকরীগুলোর চিকিৎসা করে সেগুলোর রক্ষণা বেক্ষণ কর, তাহলে বকরীর মালিক তোমাকে এর মজুরী দেবেন। আর যদি চর্ম রোগাক্রান্ত বকরীগুলোর খোঁজখবর না নাও, রুগ্ন বকরীসমূহের চিকিৎসা না কর এবং সেগুলোর রক্ষণা বেক্ষণে যথাযথ দায়িত্বের পরিচয় না দাও, তাহলে এগুলোর মালিক তোমাকে শাস্তি দেবেন”।
একজন শাসকের উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের জন্যে এ ঘটনাটিই যথেষ্ট। কারণ, গোটা মানবজাতিই হচ্ছে আল্লাহ্‌র বান্দা। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ হচ্ছেন আল্লাহ্‌র বান্দাদের পরিচালনার জন্যে তাঁরই প্রতিনিধি। জনগণের জানমাল মানসম্ভ্রম সবকিছুর হেফাযতের দায়িত্ব তাঁদের উপর ন্যস্ত।
দেশের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং কৃষি ফসল উৎপাদনদের উৎসভূমি সংক্রান্ত ব্যাপারে যোগ্য ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও এসব ব্যাপারে অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য কোন ব্যক্তিকে ঐ পদের নিয়োগ প্রদান করা অবশ্যই খেয়ানত ও বিশ্বাসঘাতকতার কাজ। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এমন কাজ করলে তিনি খেয়ানতকারী হবেন। কারণ দেশের অর্থনীতি ও এর প্রাণসত্তা কৃষি শিল্প বাণিজ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ব্যক্তি ব্যবসায়ে পণ্য উপকরণাদি অন্যায্য দামে বিক্রি করে দেবে। ভাল এবং সাধু খরিদদার, যিনি অতিরিক্ত বা ন্যায্য মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, হুমকি, বন্ধুত্ব ও নিকটাত্মীয়তার দরুন তাকে ন্যায্য মূল্যে পণ্য সামগ্রী না দেওয়া খেয়ানত ছাড়া কিছু নয়। তাতে পণ্য সামগ্রীর মালিক অবশ্যই তার প্রতি বিদ্বিষ্ট হবেন এবং নিন্দা জ্ঞাপন করবেন।
কাজেই রাষ্ট্রীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফরয হলো, কোন খেয়ানকারী ব্যক্তিকে প্রতিনিধি বা শাসন পরিচালক না করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতি কিংবা ভূমি ইত্যাদির ব্যাপারে ভাল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে সরকারী প্রতিনিধি বা শাসক নিয়োগ করা।
[দুই]
ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্বের যোগ্যতা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় হলোঃ যোগ্যতর ব্যক্তিকেই ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব দেয়া উচিত। যোগ্যতর ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেও যোগ্য ব্যক্তিকেই ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব প্রদান। প্রশাসনিক প্রত্যেক স্তরের বিভিন্ন পদের আদর্শ ব্যক্তিকে ক্ষমতাসীন ও প্রতিনিধি করা। শাসন কর্তৃত্বের জন্যে শক্তি ও বিশ্বস্ততার অপরিহার্য, যেন শরীয়তি বিধানের প্রয়োগ ও জনগণের অধিকার আদায়ের কাজ সহজ হয়। বিচারকের প্রকারভেদ।
উপরোক্ত আলোচনার পর এখন এটা অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, নেতার উপর কি ফরয? সংক্ষেপে বলতে গেলে তা হলো, তিনি এমন সব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, কর্মকর্তা কিংবা দেশের কোন এলাকার শাসক নিযুক্ত করবেন, যারা সৎ ও যোগ্য। তবে কোন কোন সময় এমন অবস্থা দেখা দেয় যে, কাজের জন্য ইপ্সিত যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পাওয়া যায় না। সে সময় নেতার কর্তব্য হলো আপেক্ষিক যোগ্যতার ভিত্তিতে ঐ কাজে লোক নিয়োগ করা। প্রত্যেক পদের জন্য তুলনামূলক বিচারে যে যোগ্য, তাকেই সে পদে বসানো। পূর্ণ নিরপেক্ষতা, সততা ও বিচার বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে যদি নেতা এ কাজটি সমাধা করেন, তাহলে তিনি তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করলেন। আর তখনই তাঁকে ন্যায়পরায়ণ নেতা বলা যাবে। মহান আল্লাহ্‌র কাছেও তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসকরূপে বিবেচিত হবেন। অবশ্য তারপরও বিভিন্ন কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা দেবে না, এমনটি জোর দিয়ে বলা যায় না। তবুও এছাড়া আর করারই বা কি থাকবে। আল্লাহ্‌ তায়ালাও সম্ভাব্য চেষ্ঠার কথাই বলেছেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছেঃ
********আরবী
“ হে মুসলমানগণ! তোমাদের দ্বারা যতটুকুন সম্ভব তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় করে চলো”। (সূরা তাগাবুনঃ ১৬)
********আরবী
“ আল্লাহ্‌ কারুর উপর তার সাধ্যাতীত বোঝা অর্পণ করেন না। (সূরা বাকারাঃ ২৮৬)
জেহাদের নির্দেশ দিতে গিয়ে আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ
****আরবী
“তোমরা আল্লাহ্‌র পথে দুশমনদের সাথে লড়ো। তোমরা আপন সত্তা ব্যতীত অপর কারুর দায়িত্ব তোমরা উপর নেই। তবে হাঁ, অন্যান্য মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করো। (সূরা নিসাঃ৮৪)
আল্লাহ্‌ আরও ইরশাদ করেনঃ
*******আরবী
“ হে মুমিনগণ! তোমরা নিজের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন থাকো। তোমরা সঠিক পথে থাকলে, গোমরাহ্‌ ব্যক্তিরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না”। (সূরা মায়েদাঃ ১০৫)
এতএব প্রশাসনিক সকল পর্যায়ে যেই শাসক বা কর্তৃপক্ষ সৎ লোক নিয়োগ সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করবেন না এবং আপন কর্তব্য পালনে পূর্ণ সচেষ্টা হবেন, তাতে ধরে নেয়া যাবে যে, তিনি হেদায়েত বা সঠিক পথের অনুসারী।
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
********আরবী
“ আমি যখন তোমাদের কোন কাজের নির্দেশ দেই, তখন তোমরা তা নিজেদের সাধ্যানুযায়ী করো”। (বুখারী-মুসলিম)
তবে কোন ব্যক্তি যদি শরীয়তের অসমর্থিত অক্ষমতার অজুহাত দেখিয়ে উক্ত কাজে ত্রুটি করে, তাহলে সেটা খেয়ানত হবে। তাকে সেই কর্তব্য অবহেলাজনিত খেয়ানতের শাস্তি প্রদান করা হবে। কাজেই তার কর্তব্য হলো, যোগ্যতর দক্ষ ও কল্যাণকর কোনটি, তা ভালোভাবে জেনে নেয়া এবং প্রত্যেক পদের জন্য যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা। কারণ, কোন কিছুর কর্তৃত্ব-ক্ষমতার দুটি স্তম্ভ রয়েছে, একটি শক্তি, অপরটি আমানত বা বিশস্ততা। যেমন কুরআন মজীদের ইরশাদ হচ্ছে-
*******আরবী
তোমার ভৃত্য হিসাবে সেই-ই অতি উত্তম ব্যক্তি হবে, যে সবল ও বিশস্ত। (সূরা কিসাসঃ২৬)
মিসর সম্রাট হযরত ইউসুফ (আ)-কে বলেছিলেনঃ
*******আরবী
“ আজ থেকে তুমি আমাদের মধ্যে অতি সম্মানিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব”।
হযরত জিবরাঈল (আ)-এর মর্যাদা ও গুণ বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ
******আরবী
“ নিশ্চয় কুরআন মজীদ এক অতি সম্মানিত ফেরেশতা কর্তৃক পৌঁছানো বাণী, যিনি ওহীর গুরুভার বহনে সক্ষম এবং আরশের অধিকারী সত্তার কাছে রয়েছে তাঁর উচ্চ মর্যাদা। তিনি সেখানে গণ্যমান্য সত্তা এবং বিশ্বস্ত। (সূরা তাকভীরঃ ১৯-২১)
প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং শাসন কর্তৃত্বের মূল শক্তি হচ্ছে দেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা। রণাঙ্গনে যুদ্ধ-নেতৃত্বের শক্তি হলো সেনাপতির বীরত্ব ও সাহস। তাকে সকল প্রকার রণকৌশল সম্পর্কে অবগত ও দক্ষ হতে হবে। দুশমনের ধোকাবাজি ও চাল সম্পর্কে তাকে থাকতে হবে সচেতন। কেননা ***আরবী “লড়াইর অপর নাম হচ্ছে প্রতারণ”। যুদ্ধ পরিচালককে রণকৌশল জানতে হবে। সে অনুযায়ী কাজ করার জন্যে তাকে হতে হবে পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী। (তৎকালীন সময়) যুদ্ধ পরিচালককে তীর নিক্ষেপ করা ও মারার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হতো, যেন শত্রু বাহিনীকে উপযুক্ত আঘাত হানতে পারে। তাকে হতে হবে দক্ষ ঘোড়সওয়ার।
যেমন আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“মুসলমানগণ! সামরিক শক্তি-উপকরণ সঞ্চয় এবং অধিক পরিমাণে যুদ্ধের ঘোড়া সংগ্রহের মধ্যদিয়ে তোমরা কাফেরদের মোকাবেলায় যথাসাধ্য রণ প্রস্তুতি নিয়ে থাকো। (সূরা আনফালঃ ৬০)
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“ তোমরা তীর চালানো শেখো এবং সওয়ারীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করো। আমার কাছে সওয়ারীর চাইতে তীর চালানো অতি প্রিয়। যে ব্যক্তি তীর চালানো শিক্ষা করে অবহেলা করে তা পরে ভুলে যায়, সে আমার দলভুক্ত নয়”। অপর এক রেওয়ায়েতে আছে, ******আরবী
“ তীর চালানো (তথা সামরিক যোগ্যতা অর্জন) একটি নেয়ামত। যে তা ভুলে গেল সে এই নেয়ামতকে অস্বীকার করলো”। (মুসলিম)
এসব বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সমাজে জ্ঞান প্রজ্ঞা, ন্যায়বিচার ও খোদায়ী বিধান প্রতিষ্ঠার অন্তরায়সমূহ দূরীকরণে মুসলমানদের সামরিক যোগ্যতাসহ যাবতীয় শক্তিমত্তার অধিকারী হবার উপরই জোর দেয়া হয়েছে। যার তাগিদ রয়েছে খোদ কুরআন ও সুন্নায়।
১.আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা হচ্ছে খোদাভীতি নির্ভর একটি গুণ।
২.পার্থিব সামান্য সম্পদের বিনিময়ে হক্কুল্লাহকে বিসর্জন দেয়া সঙ্গত নয়।
৩. অন্তর থেকে মানুষের ভয় সম্পূর্ণ বের করে দেবে।
প্রত্যেক শাসনকর্তা, নেতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ্‌ তায়ালা এই তিনটি মহৎ গুণ অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন।
কুরআন মজীদে আল্লাহ্‌ ঘোষণা করেছেনঃ
*******আরবী
“তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আমার আয়াতসমূহকে হীন স্বার্থে ব্যবহার করো না। আল্লাহ্‌র বিধান মুতাবেক যারা জনগণকে শাসন করে না তারাই কাফের (অবাধ্য)১। (সূরা মায়েদাঃ৪৪) ( ১.তার পূর্বে বলেছেন, ফাসিক ও জালিম।)
এর ভিত্তিতে মহানবী (সা) শাসক ও বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করেছেন। তন্মধ্যে দু’ভাগকেই জাহান্নামী বলেছেন। এক শ্রেণীর বিচারককেই শুধু জান্নাতী বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*********আরবী
“কাযী শাসক ও বিচারক তিন শ্রেণীর। দু’শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী এবং এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী। অতএব যেই ব্যক্তি সত্যকে অনুধাবন করে ন্যায় বিচার করবে, সে জান্নাতী হবে”। (আহলুল সুন্নাহ)
বিবদমান দু’দলের মধ্যে যারা ফয়সালা করে দেয়, তাদেরই কাযী বা বিচারক বলা হয়। বিচারক এ দু’পক্ষকে নির্দেশ দিবেন। তাই এদের মধ্যে কেউ খলীফা হোক কি বাদশাহ, কিংবা ওয়ালী ও হাকিম কিংবা এমন কেউ যিনি রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন, এমনকি যিনি শিশুদের লেখাপড়ার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত, সকলেই একই হুকুমের শামিল। মহানবীর সম্মানিত সঙ্গি-সাথীগণ বিষয়টি এভাবেই উল্লেখ করেছেন। তাঁরাও তাই করতেন আর এটাই স্বাভাবিক।

 

 


[তিন]
জনদরদি সাহসী নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব

যার চরিত্রে ক্ষমতা ও বিশ্বস্ততা- এ দুটি মহৎ গুণের সমন্বয় ঘটেছে, এমন লোকের সংখ্যা আজকের দুনিয়ায় খুব কমই দেখা যায়। এমন দু’জন ব্যক্তি যাদের একজন বিশ্বস্ত অপরজন শক্তিমান-এ দু’জনের মধ্যে তাকেই কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দেয়া উচিত যার দ্বারা দেশ ও জাতি ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। ইমাম আহমদ (রহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এমন দু’জন লোক যাদের একজন সাহসী ও রণনিপুণ কিন্তু কাজে পাপাচারী, অপরজন সৎ ও সাধু কিন্তু ভীরু এবং সাহসহীন, কার সাথে থেকে জেহাদ করা বাঞ্ছনীয়? তিনি জবাবে বলেছিলেন, রণনিপুণ সবল ব্যক্তি ‘ফাজের’ হলেও তার সাথে থেকেই জেহাদ করবে। কেননা, তার শক্তি এখানে মুসলমানদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে আর তার পাপ তার নিজের জীবনের জন্যে। সৎ সাধু ব্যক্তির ব্যাপারটি সম্পূর্ণ তার বিপরীত।
শক্তি সাহস ও বিশ্বস্ততা এ দু’টি মহৎ গুণের অধিকারী ব্যক্তির সংখ্যা আজকাল নেহায়েত কম। এ কারণেই হযরত উমর (রা) দু’আ করতেনঃ
*********আরবী
“হে আল্লাহ্‌! তোমার কাছে পাপাচারীর নিষ্ঠুরতা এবং ভীরুতা অক্ষমতার অভিযোগ জানাচ্ছি। (এ দুয়ের হাত থেকেই রক্ষা করুন”।)
অতএব যে কোন দেশ ভূখণ্ডের জন্যে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা হিসাবে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব অনুসন্ধান করা উচিত। কোন দেশের নেতা যদি শাসনকর্তা বা প্রশাসক নিয়োগের ইচ্ছা করেন, তখন তার কর্তব্য হবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা দেশের সব চাইতে উত্তম ব্যক্তিকে এ দায়িত্ব প্রদান করা আর যদি এমন দু’জন থাকে যাদের একজন বিশ্বস্ত অপরজন শক্তিধর সাহসী, তখন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগের ব্যাপারে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোন অঞ্চল বা রাজ্যের শাসন প্রশাসনে এ গুণদ্বয়ের ভারসাম্যপূর্ণ কর্তৃত্বের দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ জাতির এবং ক্ষতির মাত্রা হ্রাস পাবে।
সুতরাং সমর নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকেই মনোনীত করা উচিত যিনি বা যারা শক্তি সাহস ও বীরত্বের অধিকারী। তুলনামূলকভাবে তার আমল কিছুটা কম হলেও দুর্বল সমরনেতৃত্বের চাইতে সাহসী ব্যক্তিকেই যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এমন দু’জন ব্যক্তি আছে উভয়ই লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের একজন ‘ফাজের’ তথা পাপাচারী তবে সে অধিক শক্তি সাহসের অধিকারী আর অপরজন সৎ সাধু বটে কিন্তু দুর্বলমনা। এমতাবস্থায় উভয়ের মধ্যে কার নেতৃত্বে লড়াই করা উচিত। তিনি জবাবে বলেন, ফাজেরের বলিষ্ঠতা ও শক্তিমত্তা মুসলমানদের কল্যাণর্থে আর তার ‘ফুজুর’ বা পাপাচার নিজ জীবনের জন্যে। সৎ সাধু ব্যক্তি দুর্বল হলে তার সেই সততা ও সাধুতা তার জন্য নিজের কিন্তু দুর্বল হওয়ার কারণে সে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় দুর্বলতার নিমিত্ত হবে।
অতএব শক্তিধর সমরানায়ক ‘ফাজের’ হলেও তার সাথে থেকেই জিহাদ করা উচিত।
রাসূলুল্লাহ (সা) এর ইরশাদঃ
********আরবী
“আল্লাহ্‌ তায়ালা ‘ফাজের’ লোক দ্বারাও তাঁর দীনের সাহায্য নেন”। (অপর এক রেওয়ায়েতে ****আরবী এর স্থলে *****আরবী আছে, অর্থাৎ “এমন সব ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে দিয়েও তাঁর দীনের সাহায্য করান, যাদের নেক কাজে অংশ নেই।)
সুতরাং যখন নির্ভীক কোন সমরনায়ক না পাওয়া যায় এবং তার স্থলাভিষিক্ত করার মতো এমন কোন সেনাপতি না মিলে, তখন দীনী দিক থেকে অধিক যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিকেই উক্ত পদে নিয়োজিত করবে। মহানবী (সা) খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে (রা) ইসলামের সেনাধ্যক্ষ করেছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মহানবী (সা) বলতেন-
******আরবী
“খালিদ এমন এক তরবারী যা আল্লাহ্‌ মুশরিকদের নিপাত করার জন্যে উন্মুক্ত করেছেন”।
তা সত্ত্বেও হযরত খালিদ (রা) কর্তৃক এমন দু’একটি ঘটনা ঘটেছে যা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অপছন্দনীয় ছিল। যেমন একবার আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) আসমানের দিকে হাত উত্তোলন করে বলেছিলেনঃ
*******আরবী
“ হে আল্লাহ্‌! খালিদ (যুদ্ধ ক্ষেত্রে) যা কিছু (বাড়াবাড়ি)করে ফেলেছে, আমি এ ব্যাপারে অব্যাহতি চাই”।
মহানবী (সা) এ দোয়াটি তখন উচ্চারণ করেছিলেন, যখন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) জুযায়মা গোত্রের লোকদের ঈমান সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে সেখানকার কিছু লোককে হত্যা করে ফেলেছিলেন আর তাদের অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে এনেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ। তাঁর সাথে অপরাপর যেসব সম্মানিত সাহাবী ছিলেন-তাঁরা হযরত খালিদকে তা করতে বারণ করেছিলেন। মহানবী (সা) খোদ গিয়ে জুযায়মা গোত্রের লোকদের কাছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। রণাঙ্গনে তাদের পরিত্যাক্ত অর্থ-সম্পদ ফেরত দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অথচ এহেন ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) সকল সময় হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদকেই ইসলামী ফৌজের সেনাধ্যক্ষের পদে বহাল রেখেছেন। তা করার একমাত্র কারণ ছিল এই যে, তিনি রণনিপুনতা ও সমর কুশলতায় অন্যান্যের তুলনায় অধিক যোগ্য ছিলেন। ঘটনার সাধারণ মূল্যায়ন তিনি ভুল করে ফেলতেন। পক্ষান্তরে সত্যের সৈনিক আবু যর (রা) ছিলেন সততা ও সাধুতার অধিক যোগ্য। কিন্তু এ সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে বলেছেনঃ
*******আরবী
“ হে আবু যর! আমি তোমাকে দুর্বল দেখতে পাচ্ছি। তোমার ব্যাপারে আমি তাই পছন্দ করি, যা আমার নিজের ব্যাপারে পছন্দ করি। তুমি কোন সময় দু’জন ব্যক্তিরও নেতা হয়ো না। ইয়াতীমের মালের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিও না”। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবু যরকে নেতৃত্ব এবং অভিভাবকত্ব গ্রহণে নিষেধ করেছেন। অথচ তাঁরই সততা ও সুমহান চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসায় মহানবী (সা) বলেছেনঃ
******আরবী
“ আবু যর সত্যবাদিতার উত্তুঙ্গচূড়ায় সমাসীন ছিলেন। [এখানে ‘খাযরা’ এবং ‘গাবরার’ উপমাসূচক প্রবাদের ব্যবহার ও বিশেষণে নেই।]
হযরত আমর ইবনুল আস (রা)-কে রাসূল (সা) ‘যাতেসালাসিল’-এর যুদ্ধে এজন্যে প্রেরণ করেছিলেন যে, সেখানে তাঁর নিকটাত্মীয়রা বসবাস করতো। তাঁর প্রতি রাসূল (সা) অনুগ্রহসূচক আচরণ করতে চেয়েছেন। তাঁর চাইতে উত্তম লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকেই সেখানে পাঠিয়েছেন অপর কাউকে পাঠাননি।
উসামা ইবনে যায়দকে একবার রাসূলুল্লাহ (সা) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রধান করেছিলেন।
মোটকথা, বিশেষ জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রেক্ষিতে কোন কোন ব্যক্তিকে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে তাকে গভর্নর, প্রশাসক বা সেনাধ্যক্ষ নিয়োগ করা হতো। অথচ ধার্মিকতা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও ঈমানের দিক থেকে হয়তো তাদের চাইতেও যোগ্য লোক বিদ্যমান থাকতো।
এমনিভাবে প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-এর শাসনামলে যখন ‘মুরতাদ’ ফিৎনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, তা দমানোর জন্যে তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে (রা) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। ইরাক এবং সিরিয়ার জিহাদেও তাঁকেই সেনানায়ক করে পাঠানো হয়। অথচ হযরত খালিদ (রা) কর্তৃক অনেক সময় অবাঞ্চিত কাণ্ড-কারখানা ঘটতো। কথিত আছে যে, তাঁর এসব কার্যকলাপে অনেক সময় ব্যক্তিগত ঝোঁক প্রবণতা কাজ করতো। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাঁকে সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হতো না বরং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে হটাৎ ঈষৎ ভর্তসনা করে ছেড়ে দেয়া হতো এবং ‘ক্ষতিকর দিকে’র চাইতে তাঁর ‘কল্যাণকর দিক’কেই প্রাধান্য দেয়া হতো।১ (১.সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন ***আরবী ন্যায়পরায়ণ। তাঁদের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল হয়ত হয়ে যেতো, কিন্ত তাতে ব্যক্তিগত স্বার্থের ছোঁয়া ছিল না। খালিদকে হযরত উমর পদচ্যুত করেছিলেন, তা সত্ত্বেও খালিদ সাধারণ সৈনিক হিসাবে জিহাদ করে আনুগত্যের চরম ইসলামী দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। -সম্পাদক ) তাঁর স্থলে অপর কাউকে স্থলাভিষিক্ত করার চিন্তা করা হতো না।
এছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা অর্থাৎ খলীফার মধ্যে যদি কঠোরতা কম থাকে,তাঁর স্থলাভিষিক্তের মধ্যে কঠোরতা থাকার দরকার হয় বৈ কি। তেমনি রাষ্ট্রের প্রধান কর্মকর্তা যদি বেশী কঠোর স্বভাবের হন, তাঁর অধীনস্থ প্রতিনিধির নমনীয় স্বভাবের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। খলীফা হবার পূর্বে হযরত ওমর (রা) সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)-কে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করার পক্ষপতি ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা)-কে সেনাপতি পদে নিয়োগ করতে। কারণ হযরত খালিদের স্বভাবেও ছিল কঠোরতা। অপরদিকে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর চরিত্রেতো কঠোরতা ছিলই। আবু উবায়দা ছিলেন নরম স্বভাবের মানুষ। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ছিলেন নম্রতার জ্বলন্ত প্রতীক। ঐ সময় আবু বকর যা করেছিলেন তাই সঠিক ছিল। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ হযরত আবু বকরের যুগে ইসলামী ফৌজের প্রধান ছিলেন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে ইসলামী সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ত্বে ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ। এভাবেই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত থাকে। মহানবী (সা) নিজ ব্যক্তি সত্তার ব্যাপারে বলে গেছেনঃ
********আরবী
“ আমি রহমতের নবী, আমি যুদ্ধবিগ্রহের নবী”। অর্থাৎ প্রয়োজনে আত্মরক্ষার্থে শক্তি প্রয়োগও আমার কর্ম। মহানবী (সা) ইরশাদ করেছেনঃ
*******আরবী
“ (ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠায়) আমি সহাস্যবদনে যুদ্ধকারী আর আমার উম্মত হচ্ছে মধ্যমপন্থী”। সাহাবায়ে কেরামের শানে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
**********আরবী
“কাফেরদের মুকাবেলায় তারা বড় কঠোর; কিন্ত পরস্পর সহানুভূতিশীল। তুমি তাদের দেখতে পাবে কখনও রুকূ করছে এবং কখনও সিজদা করছে-আল্লাহ্‌র দান এবং সন্তুষ্টি কামনায় তারা রত আছে”। (সূরা ফাতাহঃ২৮)
********আরবী
“মুসলমানদের সাথে নরম এবং কাফের তথা আল্লাহ্‌র অবাধ্যদের প্রতি কড়া”। (সূরা মায়েদাঃ ৫৪)
এ কারণেই হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছিল পরিপূর্ণ। তাঁদের কর্তৃত্ব সুষ্ঠু পন্থায় পরিচালিত হতো এবং তাতে ছিল ভারসাম্য। মহানবী (সা)-এর যুগে এ দুই মহান ব্যক্তিত্ব হযরতের দুই বাহুরুপে বিবেচিত ছিল। একজন ছিলেন নরম দিল নরম স্বভাবের, অপরজন ছিলেন কঠোর হৃদয় এবং কঠোর স্বভাবের। খোদ মহানবী (সা)-এ দু’জন সম্পর্কে ইরশাদ করেছেনঃ
********আরবী
“আমার পরে তোমরা আবু বকর এবং উমরের আনুগত্য করো”।
তাই দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ‘মুরতাদ’দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এমন বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন যে, হযরত উমর (রা) পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) থেকে এরূপ সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা তিনি কখনও প্রত্যাশা করেননি। অন্যান্য সকল সাহাবীও এ ব্যাপারে অনবহিত ছিলেন। তাঁরা বলতেন, শুধু যাকাত অস্বীকারে আপনি কিভাবে তাদের সাথে জিহাদ করবেন?
অতএব ব্যাপার যদি এমন হয় যে, সেখানে সততা সাধুতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি গুণের সাথে সাথে কঠোরতা ও বলিষ্ঠতারও প্রয়োজন, তাহলে সেক্ষেত্রে কঠোর নেতৃত্বকেই এগিয়ে দেবে। যেমন, অর্থ-সম্পদের হেফাযতের প্রশ্নে কঠোর স্বভাব বিশিষ্ট লোকের প্রয়োজন। কেননা, অর্থ-সম্পদ উসূল ও তার সংরক্ষণের জন্যে শক্তি ও বিশ্বস্ততা উভয়েরই প্রয়োজন হয় বৈ কি। এজন্যে সেখানে স্থানীয় প্রশাসক ও কর্মকর্তাকে কঠোর ও শক্তিমান হতে হবে, যেন তার কড়াকড়ির ফলে অর্থ আদায়ে গড়িমসি প্রশ্রয় না পায়। সচিব, কেরানী ও কোষাধ্যক্ষকে যোগ্য ও বিশ্বস্ত হতে হবে। তাদের যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার দ্বারাই অর্থ-সম্পদের যথাযথ হেফাযত হওয়া সম্ভব। যুদ্ধ ক্ষেত্রের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের প্রশ্নেও একই অবস্থা এবং একই বিধান। প্রাজ্ঞ ও ধার্মিক ব্যক্তিদের পরামর্শের ভিত্তিতে যুদ্ধ পরিচালক নিযুক্ত করবে। তাতে উভয় প্রকার যোগ্যতা ও গুণ বৈশিষ্ট্যের প্রতিই লক্ষ্য রাখা হবে। বস্তুতঃ প্রশাসনিক সকল কর্তৃত্ব ও সকল প্রকার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একই দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধানই অনুসরণ যোগ্য।
কোন একক ব্যক্তিত্বের দ্বারা যদি কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য ও কল্যাণকারিতা পূর্ণ না হয়, তাহলে দুই, তিন অথবা তারও অধিক ব্যক্তি একই কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। তবে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেবে। একের দ্বারা কাজ না চললে প্রয়োজনে একাধিক গভর্নর ও কর্মকর্তা নিযুক্ত করবে এবং সর্বাবস্থায়ই যোগ্যতর ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেবে।
বিচার কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অধিক জ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ খোদাভীরু, যোগ্য লোককে দেবে। যদি একজন অধিক জ্ঞানী এবং অপরজন অধিক মুত্তাকী ও খোদাভীরু হয় তাহলে লক্ষ্য করতে হবে যে, দ্বিধাদ্বন্দের ক্ষেত্রে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং অধিক মুত্তাকী ব্যক্তির আগ্রহ-আখাঙ্খা সংশ্লিষ্ট বিধান প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে না তো?
কেননা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে,
*********আরবী
“(সিদ্ধান্ত গ্রহণে) দ্বিধা-সন্দেহের মুহূর্তে দূরদর্শী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারীকে আল্লাহ্‌ তায়ালা ভালবাসেন, আর ভালবাসেন ঐ বুদ্ধিমত্তাকে যা কোন ব্যাপারে আগ্রহ-আকাঙ্খার প্রাবল্যের মুহূর্তে ভারসাম্য বজায় রাখতে সমর্থ”।
কাযী (বিচারক) কে যুদ্ধবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা, সেনাধ্যক্ষ কিংবা সাধারণ প্রশাসনিক প্রধানের সমর্থনপুষ্ট হওয়া বাঞ্চনীয়, তবে তা জরুরী নয়। বিচারকের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষা ও জ্ঞান বিষয়ক বৈশিষ্ট্য থাকা এবং ধার্মিকতার গুণকে প্রাধান্য দিতে হবে, যদি জ্ঞান ও ধার্মিকতার মুকাবেলায় শক্তি সামর্থ্যের প্রয়োজন অধিক দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী ও স্বাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেবে।
কোন কোন ‘আলিম তথা ইসলামী জ্ঞান বিশেষজ্ঞদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, বিচারের ফয়সালার জন্যে কোন যোগ্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না, গেলেও সে ফাসিক আলিম কিংবা জাহিল দ্বীনদার। এ দু’য়ের মধ্যে কাকে প্রাধান্য দিতে হবে? তারা জবাব দিয়েছিলেন, ঐ ব্যক্তির মধ্যে সত্য এবং কল্যাণের পথ থেকে দূরে থাকার ভাব-প্রবণতা অধিক হলে দ্বীনের কাজে ত্রুটি দেখা দেয়া স্বাভাবিক বিধায় দ্বীনদার ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। শাসকদের অবহেলার দরুন দ্বীনের কাজের ত্রুটি হতে থাকলে আলিমকেই সে ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবে। অধিকাংশ আলিম ব্যক্তি দ্বীনদারকেই এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেবার পক্ষে মত দিয়েছেন। কারণ, এ ব্যাপারে সকল ইমাম মুজতাহিদ একমত যে, কর্মকর্তা, আমীর এমন ব্যক্তিকে হতে হবে যিনি ন্যায় বিচারক এবং সাক্ষ্যদানের যোগ্য।
‘ইলমের শর্তের বেলায় মত পার্থক্য রয়েছে যে, কি ধরনের আলিমকে কোন ব্যাপারে কর্মকর্তা করা হবে? সে আলিমকে মুজতাহিদ হতে হবে, না মুকাল্লিদ, অথবা যে ধরনের পাওয়া যাবে তাকেই নিয়োগ করা। এ ব্যাপারে অনত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার অবকাশ খুব কম। তবুও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হলো পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিচারপূর্বক আপেক্ষিক কর্মযোগ্য ব্যক্তিকে প্রয়োজনে শাসক-কর্মকর্তা বানানো বৈধ। কারণ, পরিস্থিতি ও পরিবেশের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখাও কর্তব্য যাতে মন্দকে যথাসম্ভব নির্মূল করা যায়। কোনো ব্যক্তি হয়তো জ্ঞান প্রজ্ঞার দিক থেকে অধিকতর যোগ্য কিন্তু কোন বিশেষ এলাকার আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে হয়তো দুর্বল। সে ক্ষেত্রে কম প্রজ্ঞাশীল হলেও শক্ত লোক দরকার।
সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হচ্ছে জনগণের প্রয়োজনে। সে প্রয়োজন কিভাবে পূরণ হবে তা দেখতে হবে। যেমন, সমাজের অস্বচ্ছল নাগরিকদের গৃহীত নিজ নিজ ঋণের টাকা পরিশোদ করা কর্তব্য। কিন্তু বর্তমানে তার থেকে এ পরিমাণেরই তাগাদা দেয়া উচিত, সে যে পরিমাণ আদায় করতে সক্ষম। যেমন, জিহাদের তৈরির জন্যে শক্তি সঞ্চয় এবং এ জন্যে অধিক ঘোড়ার ব্যবস্থা (তথা সমরোপকরণ জোগাড়) রাখার নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু অক্ষমতা ও অসমর্থতার সময় কোনো নাগরিকদের উপর এ হুকুম রহিত হয়ে যায়। তখন তার যদ্দুর সাধ্যে কুলায়, তাই তার জন্য ফরয হয়ে দাঁড়ায়। ফরয আদায় করাটাই তখন তার কর্তব্য। অবশ্য হজ্জ এবং অন্যান্য ইবাদতের কথা ভিন্ন। সেক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়। বরং হজ্জ ইত্যাদি পালন তার ওপর ফরয ।
*******আরবী
“যার হজ্জে যাবার ক্ষমতা ও সামর্থ্য রয়েছে”। (সূরা আলে ইমরানঃ ৯৭)
এটা ফরয নয় যে, সে বিশেষভাবে ক্ষমতা ও সামর্থ্য সৃষ্টিতে লেগে যাবে। কেননা, হজ্জ তখনই ফরয হয় যখন তার মধ্যে স্বাভাবিক উপায় সামর্থ্য আসে, এ জন্যে বিশেষ কায়দায় সামর্থ্য সৃষ্টি করা ফরয নয়।


[চার]
ইসলামে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের লক্ষ্যঃ
কুরআন সুন্নাহ্‌র শিক্ষা, আইন-কানুন বাস্তবায়ন
যোগ্যতর ব্যক্তির পরিচয়, শাসন-কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিচিত, কর্তৃত্বের লক্ষ্য দীনের লক্ষ্য দীনের প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োজনীয় সংস্কার, জুমুআ ও জামায়াতের সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠা, জনগণের দীনী সংশোধন-এই পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয়।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলতেন, আমি এজন্য তোমাদের নিকট কোনো শাসক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেরণ করি, তারা যেন তোমাদেরকে মহাপ্রভু আল্লাহ্‌র কিতাব এবং নবীর আদর্শ শিক্ষা দেয় আর দীন তথা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সক্রিয় ও স্থায়ী রাখে।
সর্বাধিক যোগ্যতর ব্যক্তির পরিচয় তখন জানা যাবে, যখন শাসন কর্তৃত্বের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যে পৌঁছার পদ্ধতি জানা যাবে। তোমার কাছে যখন লক্ষ্য স্পষ্ট হবে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছার পদ্ধতি জানা হয়ে যাবে, তখন মনে করবে যে, তোমার করণীয় বিষয়টি তুমি পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পেরেছো।
রাজা-বাদশাহ তথা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে যদি বৈষয়িক স্বার্থ প্রাধান্য পায় আর তারা ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ ত্যাগ করে বসে, তখন শাসক কর্তৃপক্ষ শাসন যন্ত্রে এমন সব লোককেই পদোন্নতি দেন, যাদের দ্বারা তাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য-লক্ষ্যই অধিক হাসিল হয়। সে শাসক নিজ ব্যক্তি স্বার্থের জন্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রত্যাশী, সে নিয়োগ-বদলিতে ঐ ব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেবে, যে তার রাষ্ট্র, কর্তৃত্ব পদ বহাল রাখতে সহায়ক। মহানবী (সা)-এর রাজনৈতিক আদর্শে আমরা দেখতে পাই, শাসন ক্ষমতা ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও সেনাপতিগণ যারা রাষ্ট্র প্রধানের প্রতিনিধি এবং ফৌজী সিপাহ্‌সালার, তারা মুসলমানদের জুমআর নামায এবং জামাআতের ইমামত করতেন। জনগণের সামনে মূল্যবান বক্তৃতা দান করতেন। এ জন্যেই রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর তিরোধানের প্রাক্কালে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে নামাযের ইমামতের দায়িত্বে পদোন্নতি দিয়েছিলেন। মুসলিম মিল্লাতে সমর নেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও তাঁকেই অগ্রগামী রাখতেন।
মহানবী (সা) যখন কাউকে সেনাপতি নিয়োগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করতেন, সর্বপ্রথম তাঁকে প্রদত্ত সরকারী অর্ডারে নামায কায়েমের হুকুম করতেন। এমনিভাবে যখন কাউকে কোনো শহর জনপদের শাসনকর্তা করে পাঠাতেন, প্রথমে তাকে জামাআতের সাথে নামায পড়বার নির্দেশ দিতেন। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) আত্তাব ইবনে উসায়দ (রা)-কে মক্কার শাসনকর্তা করে পাঠিয়েছিলেন। তেমনি উসমান ইবনে আবিল আস (র)-কে পাঠিয়েছিলেন তায়েফের শাসনকর্তা করে। হযরত আলী (রা) হযরত মুয়ায (রা) এবং হযরত আবু মূসা (রা)-কে ইয়ামেনের শাসনকর্তারূপে পাঠিয়েছিলেন। আমর ইবনে হাযম (রা)-কে পাঠিয়েছিলেন নাজরানের শাসনকর্তা করে। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে নায়েব বা প্রতিনিধি হিসাবে জামাআতের নামাযে ইমামত করতেন এবং শরী’য়াতী শাসন তথা হুদূদ ইত্যাদি কায়েম করতেন। যুদ্ধের সেনাপতিও ঠিক একই কাজ করতো। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইনতিকালের পর ইসলামী রাষ্ট্রে তাঁর স্থলাভিষিক্ত খলীফাগণও একই নিয়মে এসব রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতেন। বনী উমাইয়া-র বাদশাহগণ এবং দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আব্বাসী শাসকগণও তাই করেছেন। এটা এজন্যে করা হতো যেহেতু দীন ইসলাম সবচাইতে গুরুত্তপূর্ণ বিষয় হলো নামায এবং জিহাদ।
এ কারণেই বহু হাদীসে নামায এবং জিহাদকে একই সাথে বর্ণনা করা হয়েছে।
তিনি কোনো রুগীর শুশ্রুসায় গেলে বলতেন-
********আরবী
“ হে আল্লাহ্‌ তোমার এ বান্দাকে আরোগ্য দান করো, যেন সে নামাযে হাজির হতে পারে এবং তোমার দুশমনদের মোকাবেলা করতে পারে”।
*******আরবী
“হে মুআয! আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামায”।
আঞ্চলিক শাসক ও কর্মচারীদের কাছে হযরত উমরের নির্দেশনামাঃ
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কর্মচারী ও গভর্নরের উদ্দেশ্যে যে সরকারী ফরমান লিখে পাঠাতেন। ঐগুলোতে লিখা থাকতো-
*******আরবী
“আমার কাছে তোমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নামায। যে ব্যক্তি নামাযের হেফাজত করলো, সে দীনের হেফাজত করলো। যে নামায নষ্ট করলো সে অন্যান্য কাজও বেশী নষ্ট করবে”।
হযরত উমরের এ কথার তাৎপর্য হলো, রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,
****আরবী
“নামায হচ্ছে দীনের স্তম্ভ”। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যখন এই স্তম্ভটির হেফাজত করবে, তখন নামায তাকে অশ্লীলতা এবং সকল গর্হিত কাজ ও দুর্নীতি থেকে রক্ষা করবে এবং অন্যান্য ইবাদতের কাজে নামায তার সাহায্যকারী হবে। (“কারণ ********আরবী নামায গর্হিত-অবাঞ্ছিত কাজ থেকে বিরত রাখে”।)
আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ
******আরবী
“(দীনের উপর) অটল-অবস্থান এবং নামাযের দ্বারা (আল্লাহ্‌র) সাহায্য কামনা কর আর (মনে রেখো) নামায অত্যন্ত ভারি জিনিস। তবে যারা আল্লাহ্‌কে ভয় করে তাদের জন্যে এটি ভারি নয়”। (সূরা বাকারাঃ ৪৫)
********আরবী
“হে মুসলমানগণ, (সকল সময় তোমরা দীনের উপর অটল অবস্থান নিয়ে) ধৈর্য ও নামাযের দ্বারা (আল্লাহ্‌র) সাহায্য কামনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ ধৈর্যধারণকারীদের সাথে থাকেন”। (সূরা বাকারাঃ ১৫৩)
আল্লাহ্‌ তায়ালা রাসূল (সা)-কে সম্বোধন করে বলেছেনঃ
*******আরবী
“(হে নবী!) নিজের পরিবারস্থ লোকদের নামাযের তাগিদ করো। নিজেও পাবন্দির সাথে নামাযে রত থাকবে। আমি তা তোমাদের নিকট কোন রিযিক চাই না বরং আমি নিজেই তোমাদের রিযিক দেই। উত্তম পরিণতি তো তাকওয়া তথা আল্লাহ্‌ভীতি পূর্ণ সাবধানী জীবন অবলম্বনেই রয়েছে”। (সূরা ত্ব-হাঃ১৩২)
*******আরবী
“জিন এবং ইনসানকে আমি একমাত্র আমার ইবাদত তথা নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও দাসত্ব করার জন্যেই সৃষ্টি করেছি। তাদের থেকে আমি কোন রিযিকের প্রত্যাশী নই। আর তাদের কাছে এটাও চাইনা যে তারা আমাকে খাবার দিক। আল্লাহ্‌ নিজেই তো অধিক রিযিকদাতা, প্রচন্ড শক্তিধর এক মহাসত্তা”। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬-৫৮)
অতএব এটা বুঝা গেল যে, কর্তৃত্ব নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের সেবা করা এবং তাদের সংশোধন করা। মানুষ যদি দীনকে পরিত্যাগ করে তাহলে তারা কঠিন দুর্গতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে, আর তাদেরকে যেসব পার্থিব নেয়ামত সুযোগ-সুবিধা ও উপভোগ্য জিনিস দান করা হয়েছে, সেগুলো তাদের জন্যে কখনও কল্যাণকর হবে না। বৈষয়িক সেই কাজের দ্বারা তাদের যেই দীনী কল্যাণ সাধিত হতো, তা হবে না।
বৈষয়িক যেই জিনিসের দ্বারা মানুষ দীনী কল্যাণ লাভ করতে পারে, তা দু’প্রকার। এক, সম্পদকে তার হকদারের কাছে পৌঁছানো। দুই, বাড়াবাড়ি এবং অন্যায়ভাবে সম্পদ হস্তগতকারীকে শাস্তি প্রদান। সুতরাং যে ব্যক্তি সীমা অতিক্রম ও বাড়াবাড়ি করে না, জেনে রেখো, সে তার দীনের কাজে অভ্যস্ত হয়েছে। এজন্যে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা) বলতেনঃ
*****আরবী
“ হে জনগণ, আমি আমার কর্মচারী ও গভর্ণদেরকে এজন্যে তোমাদের কাছে পাঠাই, যেন তারা তোমাদেরকে তোমাদের প্রভুর কিতাব এবং নবীর আদর্শ শিক্ষা দেয় আর তোমাদের মধ্যে দীন কায়েম রাখে”।
বর্তমানে যেহেতু শাসক-শাসিত উভয়ের মধ্যে বিকৃতি ঘটেছে, যদ্দরুন সকল ক্ষেত্রের কার্যকলাপেই বিকৃতি দেখা দিয়েছে, এজন্যে সংশোধনও একটি কষ্ট সাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িঁয়েছে বৈ কি। তাই যেসব সম্ভাব্য সকল উপায়ে জনগণের দীন-দুনিয়া উভয়টির কল্যাণার্থেই কাজ করবে, সেসব ব্যক্তি যুগশ্রেষ্ঠ এবং উত্তম মুজাহিদ হিসাবে গণ্য হবে। যেমন, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা নেতার একটি দিন ৬০ বছরের ইবাদতের চাইতে উত্তম”।
মুসনাদের ইমাম আহমদ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, তিনি ইরশাদ করেছেন-
******আরবী
“মানুষের মধ্যে আল্লাহ্‌র অতি প্রিয় ব্যক্তি হচ্ছে ন্যায়পরায়ণ নেতা। আর আল্লাহ্‌র রোষে অধিক নিপতিত ব্যক্তি হচ্ছে জালিম নেতা”।
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হযরত আবু হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
***********আরবী
“ আল্লাহ্‌র ছায়া ছাড়া যেদিন আর কোন ছায়া থাকবে না, তখন সাত শ্রেণীর লোককে আল্লাহ্‌ তায়ালা নিজের রহমতের ছায়াতলে স্থান দেবেন। (১) ন্যায়পরায়ণ নেতা, (২) ইবাদতগুযার যুবক, (৩) ঐ ব্যক্তি যিনি নামায শেষে মসজিদ থেকে বের হবার পরও পুনরায় কখন মসজিদে যাবেন তার অন্তর সে ভাবনায় মগ্ন থাকে, (৪) সেই দুই ব্যক্তি যাদের বন্ধুত্ব একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যে-ঐ বন্ধুত্বের ভিত্তিতেই তারা মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হলেও ঐ কারণেই বিচ্ছিন্ন হয়, (৫) যে ব্যক্তি একান্তে মানুষের অগোচরে আল্লাহ্‌র যিকির করে এবং চোখের পানি ছেড়ে দেয়, (৬) যে ব্যক্তিকে কোনো অভিজাত সুন্দরী রমণী কামাচারের আহ্বানে জানালে সে এই বলে জবাব দেয় যে, বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনকে আমি ভয় করি, (৭) যে ব্যক্তি এমন গোপনে দান খয়রাত করে যে, ডান হাতে খরচ করলে তার বাম হাত জানে না”। (বুখারী ও মুসলিম)
সহীহ মুসলিম শরীফে হৈয়াদ ইবনে হাম্মাদ (রহ) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন-
*********আরবী
“ তিন প্রকারের লোক বেহেশতী। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান (২) দয়ালু ব্যক্তি, নিকটাত্মীয় এবং মুসলমানদের সহমর্মিতায় যার হৃদয় বিগলিত, (৩) সেই ধনী ব্যক্তি, যিনি চরিত্রবান এবং দানশীল”।
সুনানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি হাদীস উল্লেখিত আছে যে-
********আরবী
“ দান খয়রাতের কাজে নিষ্ঠাবান সচেষ্ট ব্যক্তি হচ্ছে আল্লাহ্‌র রাস্তার মুজাহিদের মতো। তবে দান হতে হবে লোক দেখাবার জন্যে নয়”।
আল্লাহ্‌ তায়ালা জুলুম-অন্যায়ের ধ্বজাধারী সন্ত্রাসী, আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন- ********আরবী
“ যতদিন (সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষের বিরুদ্ধে) ফিৎনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান না ঘটবে এবং (সমাজে) একমাত্র আল্লাহ্‌র দ্বীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হবে, তোমরা (মানবতার বিরোধী ঐ প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্ভাব্য সকল উপায়ে) লড়ে যেতে থাকো”। (সূরা বাকারাঃ ১৯৩)
একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খেদমতে আরয করা হলো যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মানুষ কোন সময় আপন বীরত্ব দেখাবার জন্যে লড়াই করে, কখনও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রেরণা তাদের লড়াইর পেছনে অনুপ্রেরণা যোগায়, আবার কখনো লড়াইর পেছনে দেখানো ভাবও সক্রিয় থাকে। এহেন অবস্থার কোনটিকে “ আল্লাহ্‌র রাস্তায় জিহাদ” বলা যাবে? হযরত রাসূল (সা) ইরশাদ করলেন-
********আরবী
আল্লাহ্‌র বাণীকে সমুন্নত রাখার জন্যে যে ব্যক্তি লড়াই করবে, সেটিই হবে “জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহ্‌র পথে জিহাদ”। (হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত।)
অতএব বুঝা গেল, জিহাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সর্বত্র আল্লাহ্‌র শ্রেণী বৈষম্যমুক্ত ন্যায় বিধান তাঁর দীনেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা এবং তাঁর বাণীকে সমুন্নত করা। *****আরবী তথা “আল্লাহ্‌র বাণী” কথাটি ব্যাপক অর্থবোধক। এর দ্বারা আল্লাহ্‌র বিধান গ্রন্থ কালামুল্লাহ্‌কেও বুঝানো হয়ে থাকে।
এভাবে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেছেন-
********আরবী
“ আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট দলীল দিয়ে প্রেরণ করেছি। তাদের মাধ্যমে প্রেরণ করেছি ‘কিতাব’ ও ‘মীযান’ (ন্যায়দন্ড), যেন তাঁরা (ইসলামের) ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে”। (সূরা হাদীদঃ২৫)
বিভিন্ন পয়গম্বর এবং কিতাব প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো মানুষ যেন আল্লাহ্‌র হক এবং বান্দার হকসমূহ ইনসাফ ও ন্যায়নীতি সহকারে প্রতিষ্ঠিত করে।
অতঃপর আল্লাহ্‌ তায়ালা ইরশাদ করেন-
********আরবী
“ আমি লোহা সৃষ্টি করেছি। তাতে রয়েছে বিরাট ভীতিপূর্ণ উপাদান। মানুষের কল্যাণও তাতে নিহিত আছে। আর তাতে অন্য এক উদ্দেশ্য এটাও নিহিত যে, আল্লাহ্‌ তায়ালা প্রত্যক্ষভাবে জানতে চান যে, এর মাধ্যমে কারা তাঁকে ও তাঁর রাসূলদের সাহায্যে এগিয়ে আসে”। (সূরা হাদীদঃ২৫)
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র কিতাবের বিধানসমূহ ও এর নীতি-আদর্শ বাদ দিয়ে ভিন্ন মতাদর্শ ও নীতির অনুসরণ করে চলে, আল্লাহ্‌র অভিপ্রায় হলো, সে প্রতিরোধ এগিয়ে এলে তাকে লোহা উপকরণ দ্বারা গঠিত হাতিয়ার দ্বারা হলেও অন্যায় পথ থেকে ফেরানো উচিত। কারণ, দীনের প্রতিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব আল্লাহ্‌র কিতাব এবং (শক্তির প্রতীক) তরবারীর উপরও ক্ষেত্র বিশেষে নির্ভরশীল। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন ******আরবী অর্থাৎ “আমরা যেন সেই অগ্রগামী ব্যক্তির প্রতি তরবারী তথা উপযুক্ত অস্ত্রের আঘাত হানি যে ব্যক্তি কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে এর অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করতে এগিয়ে আসে।
সুতরাং উদ্দেশ্য যখন এই, তখন ‘আকরাব ফাল আকরাব’ (নিকটতর অতঃপর নিকটস্থ) এ পন্থায় লক্ষ্য হাসিল করা বাঞ্ছনীয়। কর্তৃত্ব-নেতৃত্বের প্রশ্নে এমন দুই ব্যক্তিকে বেছে নেবে এবং লক্ষ্য করবে যে, উভয়ের মধ্যে কে লক্ষ্যের অতি নিকটতর? উভয়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের যোগ্যতার দিক থেকে যে শ্রেষ্ঠ, তাকেই কর্মকর্তা বা শাসনকর্তা নিযুক্ত করবে।
নেতৃত্বের প্রশ্নে কাকে অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়? এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন- ********আরবী
“ (ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে) জাতির ইমামত বা নেতৃত্ব সে ব্যক্তিই করবে, যে আল্লাহ্‌র আইনের কিতাব অধিক পাঠ ও মর্মার্থ অনুধাবনকারী। তাতে যদি একাধিক ব্যক্তির যোগ্যতা সমপর্যায়ের হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে হযরতের সুন্নাত-নীতি আদর্শ সম্পর্কে যে ব্যক্তি বিশেষভাবে অবগত, তাকেই প্রাধান্য দেবে। তাতেও সকলে সমপর্যায়ের হলে ঐ ব্যক্তিই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবেন, যিনি হিজরত গমনে অগ্রবর্তী ছিলেন। যদি হিজরত গমনের যোগ্যতাও সকলের সমান সমান হয়, তাহলে যে বয়সে অপেক্ষাকৃত বড়, তাকে নেতা নির্ধারণ করবে। তাঁর প্রভাব বলয়ের মধ্যে অপর কোন ব্যক্তি নেতৃত্ব করবে না এবং তাঁর মর্যাদার আসনে অনুমতি ছাড়া বসবে না”। (মুসলিম)
একাধিক ব্যক্তির মধ্যে যদি সমযোগ্যতা থাকে এবং তাদের মধ্যে কে যে অধিক যোগ্য তা জানা না যায়, তখন ‘কোরা’ বা লটারির মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করবে। যেমন সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা) কাদেসিয়ার যুদ্ধে করেছিলেন। কে আযান দেবে, তা নিয়ে সেনাবাহিনীতে বিরাট বাক-বিতন্ডার সূত্রপাত ঘটে। এমনকি পরস্পর সংঘর্ষের উপক্রম দেখা দেয়। সকলেই বলছে ‘আমি আযান দেবো’। অনেকেই অগ্রাধিকার প্রাপ্তির যৌক্তিকতা তুলে ধরে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিম্নোক্ত নির্দেশের অনুসরণ করা হয়।
*******আরবী
“মানুষ আযান এবং নামাযের সামনের সারির সওয়াবের গুরুত্ব বুঝার ফলে যদি লটারীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে তাই করবে”।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি