ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ
শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দি রাজশাহী স্টুডেন্ট’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, রাজশাহী।
প্রকাশক:
দি রাজশাহী স্টুডেন্ট’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, রাজশাহী।
বিনোদপুর বাজার, রাজশাহী-৬২০৬
প্রকাশকাল: চতুর্থ সংস্করণ (পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত) এপ্রিল ২০০৫, বৈশাখ ১৪১২
প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, আশ্বিন ১৪০৩
উৎসর্গ
মানবতার মুক্তিদূত
মহানবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা (স.) কে—
চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাতায়ালার অসীম অনুগ্রহে ইসলামী অর্থনীতি: নির্বাচিত প্রবন্ধ-এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। প্রায় ছয় মাস পূর্বেই বইটির তৃতীয় সংস্করণের সব কপি শেষ হয়ে যায়। এরপর প্রকাশক বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আমার জন্যেইা এই বিলম্ব হয়ে গেল। বইটির বেশ কিছু প্রবরেন্ধর পরিমার্জনার প্রয়োজন ছিল। সেই সাথে প্রয়োজন ছিল আরও দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক ও বিভাগের চেয়ারম্যানের যৌথ দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে প্রয়োজনীয় সময় করে উঠতে পারিনি। জনসংযোগ দপ্তরের কার্যকাল শেষ হওয়ার পর কিছুটা ফুরসত পাই।
বর্তমান সংস্করণে তিনটি নতুন প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হলো: সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ এবং ইসলামী অর্থনীতি চিন্তার ক্রমবিকাশ। এছাড়া দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত, ইসলামী উন্নয়ন ব্যায়ক, ইসলামী বীমা বা তাকাফুল: বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি এবং ইসলামী অর্থনীতি পটাঠসহায়ক বই-পত্র শীর্ষক প্রবন্ধগুলোর পুনর্বিন্যাস ও বহু নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে। আশাকরি এই সংযোজন ও পরিমার্জন পাঠকদের কাজে আসবে। সারণীগুলেঅও যথাসাধ্য সংশোধিত হয়েছে। এরপরও ভুলত্রুটি থেকে যেতেই পারে। আগ্রহী পাঠক নিজগুণে তা ক্ষমা করে দেবেন।
বইটির চাহিদা ও গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে দি রাজশাহী স্টুডেন্ট’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন চতুর্থ সংস্কণ প্রকাশের জন্যে উদ্যোগ নেয়ায় তাদেরকে মুবারকবাদ জানাই। বইটিতে পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জনা ও প্রুফ সংশোধনের সময়ে পরিবারের প্রতি যথাযোগ্য মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এজন্যে তাদের জাযায়ে খায়ের দান করুন। এই সংস্করণটি পূর্বের মতোই পাঠক সমাদর পেলে এবং ইসলামী অর্থনীতি বুঝবার ক্ষেত্রে কিছুমাত্র সহায়ক হলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
১২রবিউল আওয়াল, ১৪২৬
২২ এপ্রিল, ২০০৫
প্রসঙ্গ কথা
ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে আমার প্রথম কৌতুহল সৃষ্টি হয় ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি, ছাত্রজীবনে। সে সময়ে ইসলামী অর্থনীতি প্রসঙ্গে দু-একটা বই ও প্রবন্ধ পড়লেও বিষয়টি সম্বন্ধে গভীরভাবে জানার আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। এ ব্যাপারে সত্যিকার অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠি ১৯৭০-এর দশকে, বিশেষতঃ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর। এরপর বাংলা ভাষায় যেসব বই-পত্র পাওয়া গেল সেসব পড়ে কৌতূহলে নিবৃত্ত হলা না, বরং বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হলো অনেক প্রশ্নেরও। তার উত্তরের জন্যে হাত বাড়াতে হলো অন্যত্র। কিন্তু আরবী ও উর্দূ ভাষা না জানা এক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ালো বিরাট প্রতিবন্ধক। সেই সময়ে কয়েকজন সহৃদের সৌজন্যে আধুনিক অর্থনীতির আঙ্গিকে ইংরেজী ভাষায় লেখা বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই পেলাম। সেগুলি পড়ে চমৎকৃত হলাম। বস্তুত: তখন হতেই ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে আমার সত্যিকার পড়া-লেখা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু।
ইতিমধ্যেই আমাদের চেষ্টায় গড়ে উঠলো ইসলামিক ইকনমিকস্ রিসার্চ ব্যুরো। এর মাধ্যমে আরও গভীরভাবে ইসলামী অর্থনীতি জানার ও চর্চার সুযোগ হলো। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেমিনার ও সম্মেলনে বক্তৃতার আহবান আরও পড়াশুনা ও লেখালেখির সুযোগ করে দিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৮০-১৯৮৬ সালের মধ্যে চারটি বই সমাজে সমাদৃতও হলো। এরপরও দেশের বিভিন্ন সাময়িক, মাসিক ও দৈনিক পত্রিকায় লেখাপ্রকাশিত হতে থাকলো। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীতেও কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো দেশী-বিদেশী জার্নাল ও সংকলণ গ্রন্থে।
বিগত এক যুগ ধরে প্রকাশিত সেসব প্রবন্ধ হতে নির্বাচিত তেরটি প্রবন্ধ এই বইয়ে সন্নিবেশ করা হয়েছে। িএর মধ্যে চারটি প্রবন্ধ প্রায় পূর্বের অবয়বে রয়েছে। আটটি প্রবন্ধ নতুন সংজোনসহ ব্যাপকভাবে পরিমার্জিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে। একটি প্রায় পুরোটাই নতুন করে লেখা হয়েছে। এছাড়া পূর্বের কোথাও প্রকাশিত হয়নি এমন তিনটি বড় প্রবন্ধ সংযুক্ত হলো। গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রকাশিত ইংরেজী প্রবন্ধ থেকেও একটির অনুবাদ সংযোজিত হলো। উল্লেখ্য, সকল ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক তথ্য সন্নিবেশের সাধ্যমত চেষ্টার ত্রুটি হয়নি।
এ ধরনের একটি বই প্রকাশের জন্যে আমার স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী এবং অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে নিরন্তন অনুরোধ পেয়েছি। বিশেষ করে এদেশের শিক্ষাঙ্গনে যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মী তাদের দাবী ছিল প্রবল। কিন্তু সময় ও সুযোগ, বিশেষ করে প্রকাশকের অভাব ছিল এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। শেষ পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা পূর্ণ হলো। এ জন্যে মহান রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি। বইটি দেখে যাঁরা সবচেয়ে বেশী খুশি হতেন সেই আব্বা-আম্মা আজ আর দুনিয়াতে নেই। আল্লাহ গাফুরুর রহীম তাঁদের চির শান্তি দান করুন। ইসলামী অর্থনীতির বিবিধ প্রসঙ্গ বুঝতে ও জানতে বইটি তরুণ প্রজন্মের কাজে আসলে আমার শ্রম সার্থক বিবেচনা করবো।
শাহ্ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান
১২ রবিউল আওয়াল, ১৪১৭
২৯ জুলাই, ১৯৯৬
সূচীপত্র
১. ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা ও মূলনীতি
২. ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা
৩. সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি
৪. ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ
৫. ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টন
৬. দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত
৭. সুদ: অর্থনৈতিক কুফল ও উচ্ছেদের উপায়
৮. ইসলামী ব্যাংকিং-এর রূপরেখা
৯. বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং
১০. ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক
১১. ইসলামী বীমা বা তাকাফুল: বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি
১২. ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের সমস্যা: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ
১৩. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যা ও ইসলামী সমাধান
১৪. দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামী সরকারের ভূমিকা
১৫. বাংলাদেশে ইসলামী অর্থনীতি চর্চার প্রসারে প্রতিবন্ধকতা
১৬. ইসলামী অর্থনীতির চিন্তার ক্রমবিকাশ
১৭. ইসলামী অর্থনীতি পাঠসহায়ক বই-পত্র
১৮. ইসলামী ব্যাংক, বীমা ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠান
১৯. পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম
ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা ও মূলনীতি
ইসলামী অর্থনীতি কি?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল (স) প্রদত্ত জীবন বিধানই ইসলাম। যেহেতু ইসরাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু এর অনুসারীদের জন্যে রয়েছে ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠী জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও উপযুক্ত নীতিমালা। এর মধ্যে অন্তর্বুক্ত রয়েছে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন ও বিচার প্রভৃতি। অর্থনীতি যে কোন জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যে একটি অপরিহার্য প্রসঙ্গ। ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যেও একথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে ঐ অর্থনীতিকেই বোঝায় যার আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ফল ইসলামী আকিদা মুতাবিকই নির্ধারিত হয়। এই অর্থনীতির মূলনীতি ও দিক-নির্দেশনা বিধৃত রয়েছে আল-কুরইান ও সুন্নাহতে।
ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি বা দর্শন
প্রত্যেক জাতি বা সমাজের একটি জীবন দর্শন থাকে। সেই জীবন দর্শন অনুসারেই তার জীবন তথা জাগতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। মুসলমানদরে জীবনে সেই দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। পক্ষান্তরে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে বস্তুবাদ তথা ভোগবাগ। অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি দ্বান্দ্বিক বাস্তবাদ। মুসলিম উম্মাহর আকীদা হচ্ছে এই বিশ্বচরাচরের একজন মহান স্রষ্টা আছেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান। একমাত্র তাঁরই নির্দেশিত পথে চ ললে মিলবে কল্যাণ ও মুক্তি। এই নির্দেশিত পথটি কি এবং কেমন করে সেপথে চলতে হবে তা জানাবার জন্যে সেই বিশ্বস্রষ্টাই আবার যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূলদের। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) সেই ধারায় সর্বশেষ রাসুল এবং তাঁরই মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা প্রদান করা হয়েছে।
আল্লাহর এই একত্ব ও নিরংকুশ ক্ষমতার মালিকানাকেই ইসলামে বলা হয়েছে তৌহিদ এবং তাঁর পাঠানো নবী-রাসূলদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকেই রিসালাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অধিকন্তু এই জীনই শেষ নয়, এর পরে রয়েছে এক অনন্ত জীবন বা আখিরাত। সেই জীবনে ইহকালীন সুকৃতির জন্যে রয়েছে পুরস্কার এবং দুষ্কৃতির জন্যে রয়েছে শাস্তি। তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের এই সামষ্টিক বিশ্বাস মুসলমানের ঈমানের পূর্ণতা দান করে। এর তিলমাত্র ব্যতিক্রম শুধু তার ঈমন নয়, তার সমগ্র কর্মজীবনেই এনে দেয় নানা সংশয়, সন্দেহ ও অপূর্ণতা। শয়তান সেই সন্দেহের মধ্যে দিয়ে তাকে টেনে নেয় ধ্বংসের দিকে। মুসলমানের সমগ্র জীবন ও কর্মকাণ্ড তাই তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অর্থনীতি যেহেতু সেই জীবন ও কর্মকাণ্ডেরই এক গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে সেহেতু এ ক্ষেত্রেও তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস ও তার দাবী সমভাবেই প্রযোজ্য, এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত হয় মুসলিমদের জীবনের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। গড়ে উঠে সমৃদ্ধ ও গতিশীল অর্থনীতি।
ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা
এই দার্শনিক ভিত্তিভূমিকে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ের কয়েকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ইসলামী অর্থনীতির একটি সুসংবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। সেসবের মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হলো।
ড. এস. এম. হাসানউজ্জামানের মতে- “Islamic Economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of material resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.”[ Hassanuz Zaman, S.M., “Definition of Islamic Economics”]
অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরীয়াহর বিধি-নির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ যা বস্তুগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ যেন এর ফলে মানবমণ্ডলীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ডা এম. উমার চাপরার মতে- “Islamic economics is that branch of knowledge which helps realize human wellbeing through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macroeconomic and ecological imbalabces.”[Chapra, M. Umer, What is islamic Economics? Islamic Research and Training Institute, Islamic Development Bank, Jeddah, 1996, p. 33]
অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বন্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সমষ্টি অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনের সহায়তা করে।
ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক-অর্থনীতিবিদ ডঃ এম. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকীর মত হলো- “Islamic economics is the Muslim thinkers’ response to the economic challenges of their times. In this endeavour they are aided by the Quran and the Sunnah as well as by reason and experience.” [Siddiqui, M. Nejatullah, “History of Islamic Economic Thouht” in Ausaf Ahmad and K.R. Awan (eds.), Lectures on Islamic Economic, IRTI/IDB, Jeddha, 1992 p. 69.] অর্থাৎ, সমকালীন সময়ের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাবিই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি। এই প্রয়াসে তারা কুরআন ও সুন্নাহ এবং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সহায়তা নিয়ে থাকেন।
ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম পথিকৃত ডঃ এম.এ. মান্নান তাঁর যুগান্তকারী বই Islamic Economics: Theory and Practice- এ একটি সরল অথচ কার্যকর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন- “Islamic economics is a social science which studies the economic problems of a people imbued with thevalues of Islam” [Mannan, Muhammad Abdul, Islamic Economics; Theory and Practice, TheIslamic Academy; Cambridge, (Rev. Edb.) 1986, p. 18] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা ইসলামী মূল্যবৈাধে উজ্জীবিত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে থাকে।
ইসলামী অর্থনীতির চর্চা ও বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্যে যিনি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কারে প্রথম ভূষিত হয়েছেন সেই প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- “Islamic economics represents a systematic eftort to try to understand the economic problem and man’s behaviour in relationto that problem from an Islamic perspective.”[Ahmed, Khurshid, “Nature and Significance of Islamic Economics” in Ausaf Ahmed & K.R. Awan (eds.) Lectures on Islamic Economics; Jeddah: IRTI/IDB, 1992, p. 19.] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক সমস্যা ও ঐসব সমস্যার প্রেক্ষিতে মানবীয় আচরণকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে উপলব্ধি করার এক পদ্ধতিগত প্রয়াস।
প্রখ্রাত শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও দারুল ইসহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হামিদের মতে ইসলামী অর্থনীতি হলো “ইসলামী বিধানের সেই অংশ যা প্রক্রিয়া হিসেবে দ্রব্য ও সেবা সামগ্রী উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের প্রসঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক আচরণকে সমন্বিতভঅবে অধ্যয়ন করে।” [হামিদ, েএম. এ., ইসলামী অর্থনীতি: একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ, অনুঃ শাহ্ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ২য় সং, ২০০২, পৃ. ১৯।]
কুরআন ও সুন্নাহর শাশ্বত নির্দেশাবলীর পাশাপাশি উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে ইসলামী অর্থনীতির যে মূলনীতিসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় সেগুলো সম্পর্কে পরবর্তী অংশে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এখানে গভীর পরিতাপের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং সেই সাথে প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারে রেখেছে। উপরন্তু এদেশের দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের ফলে এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানী শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে ইসলামী অর্থনীতির দর্শন, মূলনীতি, রূপরেখা বা বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রয়োগিক দিক সম্বন্ধে ধারণা প্রসার লাভ করেনি।
ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি
ইসলামী অর্থনীতির রয়েছে সাতটি অনন্যধর্মী ও কালজয়ী মূলনীতি। এই মূলনীতিগুলোর নিরিখেই ইসলামী অর্থনীতির সকল স্ট্রাটেজি বা কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মদ্যোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। এগুলো যথাক্রমে:
১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিয়া ও তাকওয়া অর্জন;
২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহর বিধান মান্যকরা;
৩. আদল (বা ন্যায়বিচার) ও ইহসান (বা কল্যাণ)-এর প্রয়োগ;
৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা;
৫. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস;
৬. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন।
১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিযা ও তাকওয়া অর্জন
আমর বিল মারুফ বা সৎকাজে আদেশ (অন্য কথায় সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার বা অন্যায় কাজে নিষেধ (অন্য কথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ) ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি। যে অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যুগপৎ সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেই সেই অর্থনীত ও সমাজ ব্যবস্থায় অসহায় ও মজলুমের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের ফরিয়াদে দিগন্ত হয়ে ওঠে সচকিত। আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বিধান নেই বলেই পুঁজিবাদ মানুষের কাংখিত কল্যাণ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সেই অর্থনীতি সচল রাখার উদ্দেশ্যে কৌশল বদলানো হচ্ছে বারবার। কখনও বা মার্কেন্টাইলিজমকে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব, কখনও বা ‘অদৃশ্য হস্ত’কে। কখনও গুরুত্ব পেয়েছে কল্যাণ অর্থনীতির (Welfare Economics) ধারণা, আবার কখনও বা প্রাধান্য পেয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতি।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। নৈতিকতা বিবর্জিত ও ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের সৃষ্ট সংকট মোচনেও দায়িত্ব শেষ অবধি রাষ্ট্রকে নিতে হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের (Structural adjustment) কথা। কিন্তু ইতিমধ্যেই এর বিপক্ষেও তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নেই সে সমাজ ধ্বঙস হয়ে গেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। এরই প্রতিবিধানের জন্যে ইসলামের সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে কঠোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে মানুষের মধ্যে, সমাজেরসকল স্তরে সত্য ও মিথ্যার যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তারই প্রতিবিধানের জন্যে সুনীতির সপক্ষে ও দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। মানুষের চূড়ান্ত কল্যাণ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের এই নির্দেশ অমোঘ ও কালজয়ী। অর্থনীতির ক্ষেত্রে একথা বেশী করে প্রযোজ্য।
এই নীতি প্রয়োগের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা। তার জীবন ও সমাজকে পবিত্র করা। খোদাভীতি বা তাকওয়া এরই ভিত্তি। কুরআন সুন্নাহর সকল বিধানের মুল লক্ষ্য হলো ইহকালীন জীবনে মানুষকে সঠিক ও সত্য পথে পরিচালনার মাধ্যমে তাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্যে তাকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ বা পবিত্র হতে হবে। খোদাভীতি এর অপরিহার্য সোপান। যার মধ্যে খোদাভীতি রয়েছে সে চারিত্রিক পরিশুদ্ধি বা তাযকিযা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তার দ্বারা দুনিয়ার কোন অকল্যাণ সংঘটিত হবে না। আখিরাতেও সে আল্লাহর বা তার রবের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম। খোদায়ী বিধানের লক্ষ্যই হলো ও পবিত্রতা ও পরিপূর্ণতা অর্জনে মানুষকে সাহায্য করা। এজন্যে খোদাভীতি বা তাকওয়া সৃষ্টি জরুরী। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো সকল অপরাধমূলক, নাশকতামূলক, হিংসাত্মক ও চরিত্রবিধ্বংসী কাজসহ খোদাদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকা যেন মানুষ মানসিক, চারিত্রিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে উসওয়াতুন হাসানা ও ইনসানে কামিলের প্রতিবিম্ব হতে পারে। তাকওয়া ছাড়া এই লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোন জাগতিক আইন, বিধি-নিষেধ এমনকি জেল যুলুমও মানুষকে অন্যায় ও কলুষতা হতে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা নিছক খেয়াল-খুশীর বশে মানুষ সৃষ্টি করেন নি। তার একটি মহৎ উদ্দেশ্য এর পিছনে অন্তর্নিহিত ছিল। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবই তার গোচরীভূত। সকল কাজের পুরস্কার বা তিরস্কারের তিনিই মালিক, এই বোধ-বিশ্বাস অন্তরে সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কাউকে অসৎ কাজ হতে স্থায়ীভাবে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এজন্যেই ইসলামে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের সঙ্গেই তাযকিয়া ও তাকওয়ার উপর এত বেশী গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, জোর দেয়া হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতর মূলনীতিসমূহের মধ্যে একটি সর্বাগ্রগণ্য স্থান পেয়েছে এ কারণেই।
২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়হা বিধান মান্য করা
ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কিছু কিছু পেশা, খাদ্য ও পানীয় এবং কর্মকাণ্ডকে হারাম বা অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐসব কাজ করা এবং খাদ্র ও পানীয়ের ভোগ উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি সকল কিছুই হারাম বা নিষিদ্ধ। অনুরূপ শরীয়াহর সীমার মধ্যে বেশ কিছু কাজকে হালাল বা বৈধ বলেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন অর্থনীতিতেই এই ধরনের বৈধ-অবৈধ বা হালাল-হারামের এই বিধান নেই। বরং সরকার বা আইন পরিষদ বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থ বা প্রয়োজনের তাগিদেই কোন কাজকে বৈধ আবার কোন কাজকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করে থঅকে। মানুষের মনগড়া মতবাদেই কেবল এই সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে একই ধরনের কাজ একবার আইনতঃ নিষিদ্ধ আবার অন্য সময়ে আইনতঃ সিদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মদ পান ও মদ বৈরী নিষিদ্ধকরণ ও পরবর্তীকালে পুনরায় অনুমোদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
ইসলামে এই ধরনের মনগড়া সিদ্ধ-নিষিদ্ধের সুযোগ রাখা হয়নি। যা সিদ্ধা বা বৈধ তা চিরকালের জন্যে ও সকলের জন্যেই বৈধ এবং যা নিষিদ্ধ বা অবৈধ তা চিরকারে জন্যে ও সকলের জন্যে অবৈধ। উদাহরণস্বরূপ পুনরায় মদের উল্লেখ করা যেতে পারে। গোটা পশ্চিমা বিশ্বে আঠারো বছর বয়সের নীচে মদপান নিষিদ্ধ। কিন্তু যদনি পরিবারের ছেলেমেয়ের কারো বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হয় সেদিন ঘটা করে মদপানের উৎসব করা হয়। এই ধরনের দ্বিমুখী আচরণ ও মানসিকতার সুযোগ ইসলামে নেই। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের অনুমতি থাকলে বা আইনের বিধান করে নিলে যেকোন সমাজবিধ্বংসী ও মানবতার জন্যে অবমাননাকর কাজও বৈধতার রূপ পেয়ে যায়। জুয়াখেলা ও পতিতাবৃত্তি এর জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ। প্রথমটি সমাজবিধ্বংসী এবং পরবর্তীটি মানবতার জন্যে অবমাননাকর। কিন্তু যথোপযুক্ত ফি দিয়ে লাইসেন্স করে নিলে কি পুঁজিবাদী অর্থনীত, কি সমাজতান্ত্রিক অর্থনতি উভয় ক্ষেত্রেই এ দুটি কাজ শুধু বৈধতা নয়, সমাজেরও অনুমোদন পেয়ে যায়। বিপরীতক্রমে যা হালাল বা বৈধ তা প্রাপ্তির বা অর্জনের চেষ্টা করা এবং যা হারামবা অবৈধ তা পরিত্যাগ বা বর্জনের চেষ্টা করা ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতির দাবী।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী যেকোন ব্যক্তি হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে ধন-সম্পদ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্যে সে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ অনুসারে যেকোন উপায় অবলম্বন করতে পারে এবং যেকোন পরিমাণ অর্থও উপার্জন করতে পারে। তার এই বৈধ মালিকানা থেকে তাকে বঞ্চিত করার কেউ নেই। তবে হারাম বা নিষিদ্ধ পন্থায় এক কপর্দকও উপার্জন করার তার অনুমতি নেই। বরং হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন থেকে আইন প্রয়োগ করেই বিরত রাখা হবে। এক্ষেত্রে অপরাধের পর্যায় বা গুরুত্ব অনুসারে তাকে অবশ্যই কারাদণ্ড ও/বা অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে; এমনকি তার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত করা যেতে পারে।
৩. আদল (ন্যায় বিচার) ও ইহসান (কল্যাণ)-এর প্রয়োগ
আদল বা ন্যায়বিচার এবং ইহসান বা কল্যাণ প্রতিষ্ঠা ইসলামের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিধান। ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তা সমভাবেই প্রযোজ্য। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন ইজমের অর্থনীতিতে সুবিচারের এই প্রসংগটি একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে বরং মানুষের স্বাভাবিকতা বা ফিতরাতের বিরোধী নীতিই কার্যকর রয়েছে। ঐ সব অর্থনীততে দুর্বলের, দরিদ্রের, বঞ্চিতের তথা সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের জন্যে স্বীকৃত কোন অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না। পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দা এবং শিল্পসমৃদ্ধ দেশসমূহের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রচণ্ড চাপের মুখে পরবর্তীকালে কিছু কিছু কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এই সমাজে একচেটিয়া কারবারী, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, ঘৃণ্য চোরাকারবারী, ধনী মজুতদার ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলার কথাই আইনের মর্যাদা পেয়ে থাকে। দেশের আইনের আশ্রয় ও আনুকূল্য তাদেরই জন্যে। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে, ধনী হচ্ছে আরও ধনী। ধনবৈষম্য হচ্ছে আরও প্রকট। ইউএনডিপির সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিলম্বে হলেও এই সত্য স্বীকার করে নেয়াহয়েছে।
অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে সমাজে জবাবদিহিতার উপস্থিতি অপরিহার্য। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনে খাত্তাবের (রা) আমলে মদীনার জনগণের মধ্যে বিলিকৃত কাপড় সকলেই পেয়েছিলেণ এক খণ্ড করে। কিন্তু তিনি কিভাবে দুখণ্ড কাপড় ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন তার জবাব দিতে হয়েছল জনতার সামনে খুতবা দেওয়ার পূর্বেই। আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাসূল (স) জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলীকে (রা) হাজির হতে হয়েছিল কাযীর এজলাসে সাধারণ নাগরিকের মতোই। বর্মের মালিকানার সেই মামলায় তিনি হেরে গিয়েছিলেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের যুগেও বিচারের এই ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ন্যায়বিচারের অন্য অর্থ সমাজ হতে অন্যায় ও জুলুমের উচ্ছেদ এবং সবল প্রতিরোধ্ ইসলামী শরীয়াহ ব্যত্যয় যুলুমকেই ডেকে আনে। তার সময়োচিত প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ না হলে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীই প্রতরিত ও নিদৃহীত এবং বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আদল বা সুবিচারের স্বার্থে আইনে তাৎক্ষনিক ও যথাযথ প্রয়োগ ইসলামী বিধানের অপরিহার্য অঙ্গ।
এই সঙ্গে ইহসান বা কল্যাণের প্রসঙ্গটি ইসলামী অর্থনীতিতে যতখানি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়ে থঅকে অন্য কোনও অর্থনীততে তা অনুপস্থিত। দুর্বলের প্রতি, অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিতের প্রতি কল্যাণের হাত প্রসারিত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মূলতঃ এই কারণেই যাকাতের মতো একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উশর, সাদাকাতুল ফিতর ও করযে হাসানা। সমাজে যারা মন্দভাগ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল তাদের সমস্যার কিছুটা হলেও সুরাহা হয় যদি যথোচিতভাবে যাকাত ও উশর আদায় ও বন্টন হয়, ফিতরা প্রদান করা হয় এবং করযে হাসানার দুয়ার উন্মুক্ত রাখা হয়। দুর্বল, বঞ্চিত, ইয়াতীম, ঋণগ্রস্ত মুসাফির, পীড়িত ও আর্তজনেরা অর্থনৈতিক এই কল্যাণ ইসলামী সমাজে পায় তাদের অধিকার হিসেবেই, দয়অর দান হিসেবে নয়।
৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা
ইসলাম ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এজন্যে বিভিন্ন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছে। আল-কুরআনে নিকট আত্মীয়দের অধিকারের বর্ণনা রয়েছে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে কোন ব্যক্তির উপার্জিত অর্থে তার নিজের ছাড়া আত্মীয়-স্বজনেরও হক রয়েছে। সমাজে কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের কেউ ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয় তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সহায়তা করা তার সামাজিক দায়িত্ব। এভাবে কোন জাতির বা দেশের এক-একটি পরিবার যদি স্ব স্ব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িযে দেয় তাহলে দেশ হতে দারিদ্র্য যেমন দূল হবে তেমনি পরমুখাপেক্ষী পরিবারের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়অত)
“তুমি আত্মীয়-স্বজন এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তোমার নিকট হতে তাদের পওনা দিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৬ আয়াত)
উপরর আয়াত দুটি হতে সুস্পষ্টভাবে এই সত্য প্রতিভাত হয় যে, বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ-সম্পদে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। বিশেষতঃ আত্মীয়-স্বজন েএবং সমাজে যারা মন্দভাগ্য তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ঈমানী দায়িত্ব। যাকাতের অর্থ প্রদান সাহেবে নিসাব ব্যক্তিদের জন্যে বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে কুরআনুল করীমের নির্দেশ অনুসারে প্রয়োজনীয ব্যয় নির্বাহের পর যাদের বঞ্চিত, ভাগ্যহত লোকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এই অর্থ ব্যয় বাধ্যতামূলক। পৃথিবীর অন্য কোনও অর্থনীতিতে সমাজের বিত্তহীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বঞ্চিতের হতাশা ও কর্মদ্যোগে তাদের অংশগ্রহণ না থাকার ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা অনেকখানি স্তিমিত হয়ে পড়ে। সমাজে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং পূর্ণ কর্মসংস্থান যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঙ্খিত লক্ষ্য সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি সমাজের নীচতলার লোকেরা সকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি বলেই। অর্থনীতির নিয়ম অনুসার যখন প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা সর্বোচ্চ হয় তখন বিনিয়োগ চাহিদা, উৎপাদন ও কর্মসংস্তান একই সংগে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখনই যখন সমাজের অধিকাংশ লোকের ক্রয়ক্ষমতা থাকে। সেই অবস্থায় সৃষ্টি হতে পারে আল্লাহ প্রদত্ত উপরের নির্দেশের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস
ইসলাম সর্বস্ব ত্যাগের বা সন্যাসের ধর্ম নয়, আকন্ঠ ভোগের বা চরম আসক্তিরও ধর্ম নয়। বরং ত্যাগ ও ভোগ-এ দুয়ের মাঝামাঝি জীবন যাপনের জন্যেই ইসলাম তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সে সংসারত্যাগী সে দুনিয়ার অর্থনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আদৌ আগ্রহ বোধ করে না। তাই দুনিয়ার লোকদের কোন উপকার করা তার সাধ্য বা ক্ষমতা বহির্ভূত। অপরপক্ষে যে ভোগী, যে কোন উপায়ে ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করাই তার একান্ত বাসনা। ভোগ করার জন্যে, নিজের বিলাস-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে সব রকম উপায়ে সে ধন-সম্পদ উপার্জনে সচেষ্ট থাকবে। এক্ষেত্রে তার কাছে ন্যায়নীতি বা বৈধতা-অবৈধতার প্রশ্ন যেমন তুচ্ছ তেমনি পরের কল্যাণে অরথ-সম্পদ ব্যয় করা তার কাছে মূর্খতা। নিজে তো সে কৃপণতা করেই অন্যকেও কৃপণতা করতে প্ররোচিত করে। কৃপণতার অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো ব্যয় সংকুচিত হওয়া, ফলে চাহিদা সংকুচিত হওয়া এবং পরিণামে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সংকুচিত হওয়া। অর্থনীতিতে এর পরিণাম নিদারুণ অশুভ।
ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের মূল বক্তব্যই হলো নিজে সৎ সুন্দরভাবে বাঁচতে চেষ্টা করা, অন্যকেও সেভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করা। প্রকৃত মুসলমান আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের জন্যে না নিজের সব মূল্যবোধ ও ঈমানী চেতনাকে বিসর্জন দেবে, না অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে। বরং কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে তার যাত্রার সহযোগী করে নেবে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের। পক্ষান্তরে ধনলিপ্সা মানুষকে অন্যায়ের পথে প্ররোচিত করে। পরিণামে ডেকে আনে নিজের ও সমাজের অশেষ অমঙ্গল। অপব্যয় ও অপচয়ের মাধ্যমে নিজের দন জাহির করা এদের অনেকেরই কুৎসিৎ অভ্যাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এসবই নিন্দিত ও ঘৃণিত।
মহান আল্লাহ তায়ালা আল্-কুরআনে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-
“সেই সব লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না যারা নিজেরা কার্পণ্য করে, অন্য লোককেও কার্পণ্য করার পরামর্শ দেয় এবং আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে যা তাদের দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে।” (সূরা আন-নিসা: ৩৭ আয়াত)
তিনি আরও বলেন- “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)
বরং তিনি ব্যয়ের ব্যাপারে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এভাবে-
“তারাই আল্লাহর নেক বান্দা যারা অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে না অপচয় ও বেহুদা খরচ করে, না কোনরূপ কৃপণতা করে। বরং তারা এই উভয়ের মাঝখানে মজবুত হয়ে চলে।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)
সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ অবশ্যই ধন-সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা করবে। নিজের ও পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব তার। সেই সঙ্গে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজনের ব্যাপারেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং অন্যান্য অবাবগ্রস্ত বা সাময়িকভাবে দুর্দশায় নিপতিত মানুষের জন্যে তার থাকবে আন্তরিক দরদ। সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ঘটবে তার বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তি নিজে যেমন উচ্ছৃংখল ও বিলাসী জীবন যাপন করবে না তেমনি পরের দুঃখেও সে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। এই দুয়ের মধ্যবর্তী আচরণই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্যেই অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের উপর ইসলাম এত বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে।
৬. মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ নিশ্চিত করা
সমাজের সকল মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পাঁচটি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এই প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে ইসলাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে যে তাগিদ দিয়েছে তার নজীর আর কোন অর্থনীতিতে নেই। মূলতঃ এই প্রয়োজন পূরণের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ববোধ থেকেই ইসলাম বায়তুল মাল হতে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাবার জন্যে ব্যয় করার বিধান রয়েছে।
ইবনে হাযম তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুহাল্লাতে বলেন- “প্রতি এলাকার ধনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় বসবাসরাত অসহায় ও নিঃসম্বলদের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধ্য। যদি বায়তুল মালে মজুদ সম্পদ এজন্যে পর্যাপ্ত না হয় তাহলে দুঃস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান বিত্তশালীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করতে পারেন।”
অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের মতো অপরিহার্য মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে একদিকে মানুষ যেমন অসুস্থ ও রুগ্ন হয়ে পড়বে তেমনি শিক্ষার অভাবে সে খাঁটি মানুষ হতে পারবে না। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরয করা হয়েছে। নবী মুস্তফা (স) বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যেকের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন মদীনার দশ জন বালক-বালিকাকে শিক্ষাদান করা। দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পরে আজ বিশ্ববাসীর কাছে গণশিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। অথচ এই প্রয়োজন পূরণের জন্যে ইসলামে কত আগেই না তাগিদ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও নির্দেশনা তো মাত্র হাল আমলের। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পদ্ধতি নিয়ে রাসূলে করীম (স) গাইড লাইন দিয়ে গেছেন সেই কতকাল আগে। অজ্ঞতার জন্যে সেসব শিক্ষা হতে আমরা বঞ্চিত রয়েছি।
যে কোন সমাজে আপামর জনসাধারণের নূ্যনতম মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলা অবচশ্যম্ভাবী। চুরি-ডাকাতি ব্যভিচার মাদকাসক্তি হতে শুরু করে এইডসের মতো ঘাত ব্যধি সমাজে ছড়িয়ে পড়বে মহামারীর মতো। লক্ষ লক্ষ বনি আদম ঠাঁই নেবে ফুটপাতে বস্তিতে। কিশোর অপরাধ হতে শুরু করে ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষন, সন্ত্রাস, হত্যা প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ ও নৈরাজ্যের সূতিকাগার এসব বস্তি। এসব সর্বনাশ হতে পরিত্রাণ পেতে হলে চাই মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যথার্থ ব্যবস্থা। ইসলাম তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে এই প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করেছে। যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তির সম্পদে সমাজের Have-nots-দের অধিকার স্বীকৃতি, সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপ একযোগে এই গ্যারান্টিই দেয়।
৭. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন
ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইহকালীন কর্মকাণ্ডের জন্যে পরকালীন মুক্তি বা শাস্তির এমন দ্ব্যার্থহীন ও দৃঢ় ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মে দুনিয়াকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে ইসলামে কর্মবীর হতে বলা হয়েছে। খৃষ্ট ধর্মে সকল পাপের ভারবহনকারী হবেন যীশু। পরকালে তিনিই হবেন পরম পরিত্রাতা। সুতরাং, তাঁর উপর বিশ্বাস ও দায়িত্ব অর্পণ করে দুনিয়ার সকল বৈধ-অবৈধ ভোগ-বিলাসে মত্তা হওয়ার যেমন বাধা নেই, তেমনি বাধ্য-বাধকতা নেই উপায়-উপার্জনের এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার। হিন্দু ধর্মে কোন সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত অর্থনৈতিক আচরণ বিধিই নেই। খৃষ্টধর্ম পুঁজিবাদকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের তো কথাই নই। রাব্বী আচার্য ও পুরোহিতরা যাই বলুক না কেন এসব ধর্মের সাধারণ অনুসারীরা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জীবন ব্যবস্থা বলে সাদরে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য ধর্মের অবস্থাও অথৈবচঃ।
এরই বিপরীতে সম্পীর্ণ ভিন্ন ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ ইসলামে অর্থনৈতিক সুকৃতি বা হালাল কাজের জন্যে ইহকালীন কল্যাণের সুসংবাদের পাশাপাশি পরলৌকিক জীবনেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় কর। তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও ব্যয় করে তাদের জন্যে রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা আল-হাদীদ: ৭ আয়াত)
অপরদিকে যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে, গরীব-দুঃখীদের উপকারে সচেষ্ট হবে না বরং হারাম কাজে অংশ নেবে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তির সংবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা: আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)
মুমিন মুসলমান অদৃশ্য বা গায়েবে বিশ্বাস করে বলেই আখিরাতে বিশ্বাস তার ঈমানের অংগ। তাই ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতিতে আখিরাতের কল্যাণ অর্জনের প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের শেষে মুনাজাতেও বান্দাহ আল্লাহর কাছে যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণই প্রার্থনা করে। আখিরাত যে মুসলমানের জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুধাবনের জন্যে রাসূলে করীমের (স) একটি মাত্র উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন- এই দুনিয়া আখিরাতের জন্যে শস্যক্ষেতস্বরূপ। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে এখানে যে যেমন বীজ বুনবে অর্থাৎ কাজ করবে আখিরাতে সে তেমন শস্য বা প্রতিফল পাবে। আখিরাতের শাস্তি ও পুরস্কার প্রাপ্তি সম্বন্ধে যার মনে এতটুকু ভয় ও আগ্রহ নেই তার দ্বারা দুনিয়ার যেকোন অকল্যাণ ও অসমঙ্গল সম্ভব। অপরপক্ষে তার দ্বারা হালালকে অর্জন ও হারামকে বর্জন, সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা-কোনটাই সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তাযকিয়া অর্জন ও তাকওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলে এবং আখিরাতকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিলে ইহকালের জীবনধারা খোদায়ী বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে বাধ্য এবং এই পথেই যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতর কল্যাণ অর্জন সম্ভব।
ইসলামী অর্থনীতির রূপরখা
যখন নৈতিকতা বিবর্জিত এবং আদল ও ইহসানবিরোধী পুঁজিবাদ আপন বিষে জর্জরিত এবং মানবতাবিরোধী সমাজতন্ত্রের শব ভূতলশায়িত তখন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব মানবের মনে প্রশ্ন জেগেছে- এখন বিকল্প কি? এই প্রশ্নের জবাব বহু শত বছর পূর্বেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রেরিত ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমেই মানবমণ্ডলীকে জানিয়ে দিয়েছেন। অনাদরে অবহেলায় সাময়িক লঅভের বা মোহের তাড়নায় বা বিবেককে চোখ রাঙানোর ফলে দিকনির্দেশনার সেই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনের শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এই অপচেষ্টায় বরাবর ইন্ধুন যুগিয়েছে সব ধরনের খোদাদ্রোহী শক্তি। কিন্তু সত্যসন্ধানী মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনদারাকে সচল ও অর্থবহ করে তোলার জন্যে পুনরায় আল-কুরআনের দিকেই ফিরে আসছে। আহ সময়ের দাবীই হচ্ছে মানবতার শাশ্বত মুক্তির পয়গাম ইসলামের আলোকে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা। ইসলামী অর্থনীতি এরই একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য দিক। বক্ষ্যমান আলোচনায় এই অর্থনীতির রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই অর্থনীতি রাসূলে করীমের (স) মদীনার জীবন হতে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফত পরবর্তী যুগেও বিশ্বের এক বিশাল ভূখণ্ডে সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর ছিল।
ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর একত্ব ও প্রভুত্ব স্বীকার করে না নেওয়া পর্যন্ত অ্থাৎ, খোদাভীতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোন কর্মকাণ্ডেই- সে অর্থনৈতিক হোক বা সামাজিক হোক—সততা ও সৃংখলা আসতে পারে না। অনুরূপভাবে দুনিয়ার এই জীবনে চলার জন্যে পথ প্রদর্শক হিসেবে তিনি যে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন তাঁদের অনুসরণ ও ইহকাল পরবর্তী জীবন অর্থাৎ আখিরাতে ইহজীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি প্রাপ্য হবে এবং এই বোধ-বিশ্বাস না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই আমরা মুসলমান বিবেচ্য হতে পারি না। মানুষের মনগড়া মতবাদ যে মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে বিপুল অকল্যাণ ডেকে এনেছে, মানবতাকে ধ্বংসেরমুখে ঠেলে দিয়েছে তা প্রমাণের জন্যে ইতিহাসের পাতা ওল্টাবার দরকার নেই। সমকালীন সময়ই এর সেরা সাক্ষী।
ইসলামী অর্থনীতির বারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নীচে সংক্ষেপে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। কোন অর্থনীতি ইসলামী অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিতহতে হলে সেই অর্থনীতিতে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা অপরিহার্য। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের সমষ্টিই ইসরামী অর্থনীতরি রূপরেখা।
১. হালাল উপায়ে উপার্জন ও হালাল পথেই ব্যয়
ইসলামী বিধানে ব্যবহারিক জীবনে কিছু কাজকে হালাল বা বৈধ এবং কিছু কাজকে হারাম বা অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপার্জন, ভোগ, বন্টন, উৎপাদন প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই ঐ বিধান প্রযোজ্য। ইসলামী বিধান অনুযায়ী যে কেউই স্বাধীন ও অবাধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে। যে সমস্ত বিষয় শরীয়াহর দৃষ্টিতে হালাল বা বৈধ সেসবের উৎপাদন ভোগ বন্টন ও সেসব উপায়ে উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের অন্যতম চালিকা শক্তি হলো আমর বিল মারুফ বা সৎকাজে আদেশ অর্থাৎ, সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং নেহী আনিল মুনকারবা অসৎ কাজে নিষেধ অর্থাৎ দুর্নীতির উচ্ছেদ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন-
“তারা (মুমিন মুসলমান) এমন ভাল লোক যে যদি আমি (আল্লাহ) তাদেরকে দুনিয়াতে ক্ষমতা দান করি তবে তার নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজ করতে নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কাজ হতে লোকদের ফিরিয়ে রাখে।” (সূরা আল-হজ্জ্ব: ৪১ আয়াত)
আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- “মুমিন নর-নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধুন। তারা ভাল কাজের উপদেশ দেয এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করে।” (সূরা আত্-তাওবা: ৭১ আয়াত)
হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে যে কেউ অর্থ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্যে সে নিজের পছন্দসই যে কোন উপায় ও পথ অবলম্বন করতে পারে। এর সাহায্যে যে কোন পরিমাণ অর্থও রোজগার করতে পারে। কিন্তু হারাম উপায় ও পদ্ধতিতে একটি পয়সাও উপার্জন করার অধিকার ইসলাম স্বীকার করেনি। ইসলামী অর্থনীতিতে সে সুযোগ কারো জন্যেই উন্মুক্ত থাকে না। যেসব সামগ্রীর ভোগ নিষিদ্ধ সেসবের উৎপাদন বিপণন ও বাণিজ্যও নিষিদ্ধ।সুদ যেমন নিষিদ্ধ মদ জুয়াও তেমনি নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে অনৈসলামী পদ্ধতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যও নিষিদ্ধ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান যুগে ইসলাম বহির্ভূত সকল মতাদর্শ বা ইজমাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উপার্জন ভোগ বন্টন উৎপাদন বিনিয়োগ প্রভৃতি কোন ক্ষেত্রেই বৈধ বিচার বা হালাল-হারামের পার্থক্য নেই। সেখানে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থাৎ লাইসেন্স করে নিলে বা উপযুক্ত ট্যাক্স দিলে সব ধরনের উপার্জনের পন্থাই বৈধ। সরকারকে ধার্যকৃত নির্ধারিত কর ফি শুল্ক ইত্যাদি প্রদান সাপেক্ষে যে কোন পরিমাণ আয়ই বৈধ গণ্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ভোগ বন্টন উপার্জন বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন শেষ সীমা বা নীত-নৈতিকতার প্রশ্ন নেই। ভোগবাদী এই ব্যবস্থায় যেসব পন্থায় উৎপাদন বা যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রম সমাজের জন্যে ক্ষতিকর বা শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং যেসব পন্থায় ভোগ সমাজের জন্যে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সেসবও সমাজ ও অর্থনীতিতে অপ্রতিহতভাবে চলতে পারে। সমাজতন্ত্রেও অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। তফাৎ এই যে, সেখানে উপার্জন ও ভোগের স্বাধীনতা বিনিয়োগ ও বন্টনের দায়িত্ব রাষ্ট্র দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন অবশ্য সেই অবস্থা আর নেই। পুঁজিবাদের বিলাসী জীবন ও ইন্দ্রিয় আসক্তির মোহের জোয়ারে সমাজতন্ত্র ভেসে গেছে। ইসলাম এই দুই ধরনের নীতির কোনটিই সমর্থন করে না। বরং ইসলামের দাবীই হলো অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে শরীয়াহর বিধান মান্য করা। যা বৈধ ও যে পরিমাণ বৈধ তা সকলের জন্যেই সমভাবে বৈধ। অনুরূপভাবে যা হারাম বা নিষিদ্ধ তা সকলের জন্যেই সমভাবে নিষিদ্ধ।
অবৈধ বা হারাম উপায়ে উপার্জন, বন্টন, বিনিয়োগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের কারণ প্রধানতঃ তিনটি। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের উদ্দেশ্যে জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুলুম চালানো হয়। দ্বিতীয়তঃ চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সমাজবিধ্বংসী কার্যক্রমসমূহ এসব অবৈধ বা হারাম অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফসল। এবং তৃতীয়তঃ অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন সম্পদ সাধারণতঃ অবৈধ কাজেই ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ব্যয়ের অর্থই হচ্ছে সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া।
২. ধন-সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বন্টন
আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উপরেই নির্ভর করে একটি জাতির বা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি। দেমের জনসাধারণের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ এবঙ সেই সাথে কারো হাতে যেন সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নির্ভর করে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। বস্তুতঃ সমাজে কি ধরনের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার উপরই নির্ভর করে আয় ও সম্পদ বন্টন সুষ্ঠু হবে, না বৈষম্যপূর্ণ হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে সমাজে আয় ও ধনবন্টন কিভাবে হবে তার মূলনীতিগুলো কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আকিদা মুতাবিক সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহরই। তিনিই এর স্রষ্টা। মানুষকে সীমিত সময়ের জন্যে তিনি এর শর্তাধীন মালিক করে দিয়েছেন। এখানে স্বেচ্ছাচারিতামূলক আয় ও ভোগের যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইচ্ছামতো ব্যয়েরও সুযোগ নেই। এই মূল দৃষ্টিভংগীর প্রেক্ষিতেই কুরআন ও হাদীসের সম্পদ উপার্জন, ব্যবহার ও বন্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয় তবে আপত্তি নেই।” (সূরা আন্ নিসা: ২৯ আয়াত)
“সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর: ৭ আয়াত)
“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)
সুতরাং, ধন-সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিমালার আলোকেই উপযুক্ত কর্মপদ্ধতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই একাধারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এবং বেইনসাফী হতে জনগণ রক্ষা পাবে।
৩. যাকাত ও উশর ব্যবস্থার বাস্তবায়ন
যাকাত আদায় ও তার যথোচিত ব্যবহার সমাজে আয় ও সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ন হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভুক্ত গণ্য করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে গরীব মিসকিন ঋণগ্রস্ত মুসাফির ক্রীতদাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নও মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্র, মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদে মুসলিম বিশ্বে আজ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাধ্যতামূলকবাবে যাকাত আদায় এবং তা বিলিবন্টনের ব্যবস্থা নেই। যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) ও তা৭দের পরবর্তী যুগেও বায়তুল মালের যাকাত অংশ পরিচালনার জন্যে আটটা দপ্তর ছিল। রাষ্ট্রের কঠোর ও নিপুণ ব্যবস্থা ছিল যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তা উপযুক্তভাবে বন্টনের জন্যে। রাসূলে করীমের (স) মৃত্যুর পর বিরাজমান দুঃসময়ে মিথ্যা বনী দাবীকারীদের বিদ্রোহীদের মুখেও ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) দৃঢ়কণ্ঢে ঘোষণা করেছিলেন- “যদি কারও কাছে উট বাধার রশি পরিমাণ যাকাত প্রাপ্য হয় আর সে তা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণার সুফল পাওয়া গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। গোটা জাযিরাতুল আরবে যাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হলো সেদিনের আরবে সর্বহারা শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটেছিল।
উশরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উশর আদায়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য যেমন হ্রাস পায় গ্রামীন জীবনে ক্ষুধা ও দারিদ্রের মাত্রাও হ্রাস পায়। এই ব্যবস্থায় কৃষি পণ্যের আয়ের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত হয়। এই পদ্ধতি এজন্যেই আরও উত্তম যে, নিসাব পরিমাণ ফসল না হলে উশর আদায় করতে হয় না। আজকের খাজনা ব্যবস্থায় বড় চাষীদের বিপুল বিত্তের মালিক হওয়ার অবাধ সুযোগ বিদ্যমান। কারণ তাদের প্রদেয় খাজনা ও উৎপন্নের সঙ্গে ব্যবধান রয়েছে দুস্তর। পক্ষান্তরে উশর আদায় পদ্ধতিতে প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদে চাষী এমনকি বর্গচাষীরাও রেহাই পায় সঙ্গতঃ কারণেই। এর ফলে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত হয়।
৪. বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা
বিভিন্ন উৎস হতে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত অর্থ-সম্পদই বায়তুল মাল হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই এতে সম্মিলিত মালিকানা স্বীকৃত। অর্থাগমের উৎস ও ব্যবহার বিধির বিচারে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা রাজকীয় ধনাগারের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালের অর্থ সম্পদের উপর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা-লিঙ্গ-এলাকা নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোন ব্যক্তি যেন তার মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ হতে বঞ্চিত না হয় সেজন্যে বায়তুল মালহতেই পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে। রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বায়তুল মালেরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) একে আরও সুসংহত করেছিলেন।
বায়তুল মালের অর্থ যেসব ক্ষেত্রে ব্যয়ের জন্যে নির্দেশ রয়েছে সেগুলো হলো;
১. সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন;
২. বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ;
৩. ইয়াতীম ও লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন;
৪. অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান;
৫. জনগণের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ;
৬. করযে হাসানা প্রদান; এবং
৭. দারিদ্র বিমোচন ও সমাজকল্যাণ।
বায়তুল মালহতে কোনক্রমেই অর্থ-সম্পদ ব্যক্তি বা শাসকের ভোগ-বিলাসের জন্যে ব্যয় করার বিধান নেই। অথচ আজ একদিকে বনি আদম ক্ষুৎপিপাসায়, বিনা চিকিৎসায়, শীতে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে, অন্য দিকে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা জনগণের দেওয়া টাকায় ভোগ-বিলাসে যা ভাসিয়ে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতি এর প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এসেছে। খলীফা হযরত উমার (রা), তাঁর গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কলমের নিব সরু করে নিতে আর কাগজের মার্জিনেও লিখতে। উদ্দেশ্য ছিল সরকারী অর্থের ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া। অথচ আজ সরকারী অর্থ তছরূপের পাশাপাশি অপচয় ও অপব্যয়ের প্রতিযোগিতা চলেছে। এর প্রতিবিধানকল্পে আক্ষরিক অর্থেই বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে জনগণের তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ অবশ্যই বাধ্যতামূলক হতে হবে যেমন ছিল খুলাফায়ে রাশেদার (রা) যুগে।
৫. ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান স্থাপন
আজকের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থা। বিশেষ করে ব্যাংকিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরাট একটা অংশ সম্পন্ন হচ্ছে। এই ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে দুশ বছরের বেশী সময় ধরে এবং সুদই হচ্ছে এর প্রধান চালিকা শক্তি। সুদ সমাজ শোষণের নীরব অথচ বলিষ্ঠ হাতিয়ার। সুদের মারাত্মক যেসব অর্থনৈতিক কুফল ইতিমধ্যেই ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ চিহ্নিত করেছেন সেসব রীতিমত ভীতিপ্রদ। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:
১. সুদের কারণে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে;
২. সামাজিক শোষণ বিস্তৃত, ব্যাপক ও অব্যাহত থাকে;
৩. ধনী-গরীবের বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়;
৪. মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পূঞ্জীভূত হয়;
৫. সম্পন্ন ও সচ্ছল কৃষকেরা সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করে পরিণামে ভূমিহীন কৃষকে রূপান্তরিত হয়;
৬. একচেটিয়া কারবারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা দুর্বল ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে;
৭. সুদের হার কখনও স্থির থাকে না, ক্রমেই এইহার বেড়ে যায়, ফলে শোষণের মাত্রাও বাড়ে;
৮. ব্যবসায় চক্র (Business Cycle) সুদেরই সৃষ্টি যার ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও সুস্থ বাজার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়;
৯. সমাজে বিলাসপ্রিয়, অকর্মণ্য ও ভোগী লোকের সৃষ্টি হয়;
১০. কর্মসংস্থান ক্রমাগত সংকুচিত হয়, সুলভে মূলধন না পাওয়ার বিনিয়োগ ও কর্মোদ্যোগে ভাটা পড়ে;
১১. মজুদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সুদ অন্যতম প্রতিবন্ধক;
১২. সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলাপী ঋণের বিপুল বোঝা শেষ অবধি জনসাধারণের কাঁধেই চাপে;
১৩. জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে;
‘৪. বৈদেশিক ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায় সুদের কারণেই;
১৫. অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার অন্যতম মুখ্য কারণ সুদ; এবং
১৬. অর্থনীতির কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকও সুদ।
এসব কারণেই রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই সুদ উচ্ছেদের জন্যে জিহাদ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে সুদ উচ্ছেদ করতে হলে অন্যতম প্রধান কাজ হবে ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আলহামদুলিল্লাহ। বিগত ত্রিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশে তো বটেই, এমনকি অমুসলিম দেশেও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা সফলতার সাথে চালূ হয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিপরীতে এই ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করে চলেছে। ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাই ইসরামী অর্থনীতি চালু করতে হলে ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন একেবারে অপরিহার্য কর্মসূচীর পর্যায়ে পড়ে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরীয়াহর আলোকে হালাল-হারামের পার্থক্য অনুসরণ, অংশীদারীত্বমূলক অংশগ্রহণ, শরীয়াহ বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া, যাকাত আদায় করা, লাভ-ক্ষতির অংশীদারীত্বের শর্তে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা এই ব্যাংক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম।
বীমার ক্ষেত্রেও ইসলামী পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। কারণ ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হলে অতি অবশ্যই ইসলামী পদ্ধতির বীমা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মানুষ তার ব্যবসায়ের, নিজের জীবনের ও পণ্যের নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তার এই প্রয়োজনকে কেনদ্র করে গড়ে উঠেছে সুদভিত্তিক বীমা ব্যবস্থা। এই অবস্থার অবসানকল্পে গড়ে উঠেছে শরীয়াহসম্মত ইসলামী বীমা বাতাকাফুল কোম্পানী।
৬. করযে হাসানা ও মুদারিবাতের প্রবর্তন
ইসলাম প্রবর্তিত বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে করযে হাসানা ও মুদারিবাত অন্যতম। বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতার দিক থেকে এ ছিল সমকালীন অর্থনীতিতে এক বলিষ্ঠ ও ভিন্নতর পদক্ষেপ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে লগ্নী কারবার বা ঋণভিত্তিক ব্যবসায়ে যত শোষণ ও যুলুমের অবকাশ রয়েছে তা দূর করার মানসেই করযে হাসানা ও মুদারিবাতের প্রবর্তন ইসলামী অর্থনীতির এক বৈপ্লবিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। রাসূলে করীমের (স) মদীনার জীবন হতে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফতের পরেও সুদীর্ঘ তিনশত বছরের বেশী এ দুটি বিষয় ইসলামী সমাজে যথাযথ চালু ছিল বলেই সুদ এই অর্থনীতির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি। এখনও সুষ্ঠুভাবে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারলে সুদ সমাজ হতে বিদায় নিতে বাধ্য।
ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়াও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, কৃষিকাজের জন্যে সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিদের নিকট হতে করযে হাসানা নেবার প্রথা চালু হয় ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শুরু হতে। এজন্যে সমাজে বিত্তশালী ব্যক্তিগণ মন-মানসিকতার দিক থেকে প্রস্তুত ছিলেন। এছাড়া বায়তুল মাল হতেও করযে হাসানা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্তক্য বা পক্ষপাতিত্ব করা হতো না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে বলেন-
“কে সেই লোক যে আল্লাহ তায়ালাকে করযে হাসানা দিতে প্রস্তুত আছে? কেউ যদি দেয় তবে আল্লাহ তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৪৫ আয়াত)
মুদারিবাত বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা ও উৎপাদন পরিচালনা ইসলামী অর্থনীতির এক অনন্য অবদান। মুদারিবাতের গুরুত্ব এজন্যে যে, এই পদ্ধতিতে ব্রবসায় বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান হতে যে মুনাফা অর্জিত হয় তা পূর্ব নির্ধারিত অংশ বা হার অনুযায়ী উভয়ের মধ্যে ভাগ হবে। কিন্তু মুনাফা না হলে কেউ কিছু পাবে না। যদি কোন কারণে লোকসান হয় তাহলে তা বহন করবে সাহিব আল-মাল বা মূলধন বিনেোগকারী। অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে যদি ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায়, কল-কারখানা গড়ে ওঠে তাহলে মূলধনের সংকট হ্রাস পাবে। ফলে সুদী ব্যাংক ও পুঁজিপতির অত্যাচার হতেও রেহাই পাওয়া যাবে। সম্প্রতিককালে মুসলিম, এমন কি অমুসলিম দেশে পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে মূলতঃ এই প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই। তবুও ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে সাধারণভাবে করযে হাসানা ও মুদারিবাতের সুযোগ থাকা আবশ্যক।
৭. ইসলামী শ্রমনীতির প্রয়োগ
শ্রমিক ও মালিক পরস্পর ভাই ভাই—এই বিপ্লবাত্মক ঘোষণাই ইসলামী শ্রমনীতির মূল উপজীব্র। “দুনিয়ার মজদুর এক হও” –শোলাগনসর্বস্ব সমাজতন্ত্রের বাধ্যতামূলক শ্রমদান এখানে যেমন অনুপস্থিত, তেমনি পুঁজিবাদের কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি জমির মালিকের অবমাননাকর শর্ত ও লাগামহীন শোষণও এখানে নেই। ইসলামী শ্রমনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. উদ্যোক্তা বা শিল্প মালিক শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে;
২. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিকক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে;
৩. কাজে নিযুক্তির পূর্বে শ্রমিকের সাথে যথারীতি চুক্তি হবে এবং তা যথাসময়ে পালিত হবে;
৪. শ্রমিকের অসাধ্য কাজ তার উপর চাপানো যাবে না;
৫. শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা বজায় রাখার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের নীচে মজুরী নির্ধারিত হবে না;
৬. উৎপন্ন দ্রব্রের অংশবিশেষ অথবা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ শ্রমিকদের দিতে হবে;
৭. পেশা বা কাজ নির্বাচন ও মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কে দর-দস্তুর করার পূর্ণ স্বাধীনতা শ্রমিকের থাকবে;
৮. অনিবার্য কারণ বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ঘটনার প্রেক্ষিতে কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে শ্রমিকের উপর নির্যাতনমূলক আচরণ করা চলবে না;
৯. মালিকপক্ষ দুর্ঘটনা ও ক্ষয়-ক্ষতি িএড়ানোর সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে;
১০. দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;
১১. অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তাদের জন্যে উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে;
১২. পেশা পরিবর্তনেরঅধিকার শ্রমিকের থাকবে;
১৩. পরিবার গঠনেরও অধিকার তার থাকবে;
১৪. স্বাধীনতভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অধিকার থাকবে;
১৫. শ্রমিকের স্থানান্তরে গমনের অধিকার থাকবে; এবং
১৬. শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসার উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এই নীতিমালার আলোকে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, ইসরামী অর্থনীতিতে মজুরের যে মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত হয়েছে এবং শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাতে শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির কোন অবকাশই থাকে না। দুইয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতার ফলে শিল্পের ক্রমাগত উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক। অন্য কোন অর্থনীতিতে এই ধরনের নীতিমালা অনুসরণ তো দূরের কথা, এই জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের বা গ্রহণেরই প্রশ্ন ওঠে না। ইসলামী অর্থনীতির সাথে এখানেই অন্যান্য অর্থনীতির মৌলিক তফাৎ।
৮. ইসলামী ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পূর্বে ভূমির মালিকানা মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষি বিপ্লবের ফলে জমির উৎপাদন যখন বৃদ্ধি পায় তখন বহু বড় শিল্পপতি হাজার হাজার একর জমি সস্তায় কিনে একই সঙ্গে ভূস্বামী হয়ে বসে। নব্য জমিদাররা বহু ক্ষেত্রেই শক্তির দ্বারা চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। কৃষি কাজে জমির পূর্ণ ব্যবহারে ক্রমশঃ ভাটা পড়ে বহু দেশেই। একই সঙ্গে ব্যারণ লর্ড মার্কুইস পীয়র মনসবদার জমিদার জায়গীরদার তালুকদার প্রভৃতি ভূস্বামীদের শোষণ বাড়তে থাকে।
এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জমির ব্যক্তি মালিকানা শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, ব্যক্তিকে জমি থেকে বল প্রয়েঅগে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সমস্ত জমি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানায় আনা হয়েছে। এজন্যে লক্ষ লক্ষ লোককে নির্বাচনে পাঠানো হয়েছে। বন্দী শিবিরবা কনসেনট্রেন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে আরও বহু সহস্রকে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ভূস্বামীকে। মালিকানা বঞ্চিত কৃষকদের রাষ্ট্রীয় ও যৌথখামারে জবরদস্তি করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিনিময়ে তাদের ভরণ-পোষণের ন্যূনতম পারিশ্রমিকও জোটেনি।
এই উভয় প্রকার ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থাই বঞ্চনামূলক ও স্বভাবরোধী। এই অবস্থা যেন আদৌ সৃষ্ট না হয় সেজন্যে ইসলাম তার অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিস্বত্ব নীতি ঘোষণা করেছিল। আল-কুরআনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন-
“জমি আল্লাহ তায়ালার। তাঁর বান্দাহদের মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারত্ব দান করে থাকেন।” (সূরা আল-আরাফ: ১২৮ আয়াত)
ইসলামী অর্থনীতিতে মাত্র এক প্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত-রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি ভূমি মালিকের সম্পর্ক। কোন প্রকার মধ্যস্বত্বের অবকাশ ইসলামী অর্থনীতিতে নেই। সে কারণে শোষণও নেই। জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি। সে জমি রাষ্ট্রেরই হোক আর ব্যক্তিরই হোক। জমির মালিক যদি বৃদ্ধ পংগু অসুস্থ শিশু বা স্ত্রীলোক হয় অথবা নিজে চাষাবাদ করতে অনিচ্চুক বা অসমর্থ হয় তবে অন্যের দ্বারা জমি চাষ করা হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীমের (স) নির্দেশ হচ্ছে-
“যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে, অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে দেবে।” (ইবনে মাজাহ)
“যে লোক পোড়ো অনাবাদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে।” (আবু দাউদ)
আজ কিছু দেশ প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার জন্যে অপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে ফসলের দাম কমে যাবার ভয়ে হাজার হাজার একর জমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা হচ্ছে। এর প্রতিবিধানের জন্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত না রাখতে ইসলামে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জমি চাষের জন্যে এতদূর হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আবাদী জমি পর পর তিন বছর চাষ না করলে তা রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রই তা পুনরায় কৃষকদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেবে। উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ইসলাম।
৯. উত্তরাধিকার বা মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন
মানবতার মুক্তিদূত মহানবী মুহাম্মাদ মুস্তাফার (স) আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বে উত্তরাধিকার আইন ছিল অস্বাভাবিক। কোন কোন দর্মে পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। হিন্দু ধর্মে চালু ছিল যৌথ পরিবার প্রথা। এই প্রথা দুটির মূর বক্তব্য হচ্ছে সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থাকবে। সম্পত্তি যেন বিভক্ত না হয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ছিল হিন্দু, খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্মের। কেননা সম্পত্তি বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পুঁজি পুঞ্জীভূত হয়ে উঠবে না বিশেষ একটি শ্রেণীর হাতে যারা অর্থ বলেই সমাজের প্রভুত্ব লাভে সমর্থ হবে। এরাই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও নানা ধরনের সমাজবিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হয়।
এরই প্রতিবিধানের জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং আল্-কুরআনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের আইন ও নীতিমালা ঘোষণা করেছেন (দ্রষ্টব্য: সূরা আন্-নিসা ১১-১২ আয়াত)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই আইন যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে না। ছলে-বলে-কৌশলে ন্যায্য প্রাপ্য সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে ইয়াতীমদের, বিধবা ভ্রাতৃবধুদের, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের, বোনদের, খালা-ফুফুদের। ফলে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে। এর প্রতিবিধান না হওয়া পর্যন্ত সমাজে যুলুম ও বঞ্চনা চলতেই থাকবে। অর্থনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত হয়ে রইবে হাজার হাজার বনি আদম। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে ইসলামী মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় তার সঠিক প্রেক্ষিতেই।
১০. ব্যবসায়িক অসাধুতা ও সব ধরনের জুয়া উচ্ছেদ
সকল প্রকার ব্যবসায়িক অসাধুতা ইসলামী অর্থনীতিতে শুধু নিন্দনীয় নয়, কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বর্তমানে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দেশের সরকার খুবই উদার মনোভাব গ্রহণ করে থাকে। কারণ এসব ব্যবসায়ীরা হয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়তা ক রে অথবা দেশের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। কোন কোন দেশে তা ব্যবসায়ীরা অবৈধ সুযোগ লাভের জন্যে সরকারকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে থাকে অথবা মোটা অংকের ঘুষ দেয়। অবস্থার আজ এতদূর অবনতি হয়েছে যে কয়েকটি দেশে অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসায়ীরা রীতিমতো ছোট-খাট সেনাবাহিনী পুষে থাকে এবং সরকারের নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়। ইসলামে মাদক দ্রব্য ও নেশার সামগ্রীর ব্যবসায় শুধু নিষিদ্ধ নয় বরং চোরাকারবারী, কালোবাজারী, মজুতদারী, মুনাফাখোরীও নিষিদ্ধ। ওজরে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি জঘন্য ধরনের অপরাধ। মজুতদারীর মাধ্যমে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয় এবং হেন বস্তু নেই যা ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই মজুত কেরে না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনগণের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বারবার। ব্যবসায়িক অসাধুতার ফলেই জনসাধারণের জীবনে নেমে আসে নিদারুণ দুর্ভোগ। এমকি বুলেটের আঘাতে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। পণ্য সামগ্রীর উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে, সরকারের রাজস্ব হ্রাস পায়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন- “যারা ওজনে কম দেয়, পরের জিনিস ওজন করে নিলে পুরো গ্রহণ করে কিন্তু অপরকে যখন ওজন করে দেয় তখন পরিমাণে কমদেয় এরা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে।” (সূরা আল-মুতাফফিফীন: ১-৩ আয়াত)
মজুতদারী থেকে ক্রমেই মুনাফাখোরীর মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়িক অসাধুতা হতেই নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে। উপরন্তু একথাও সর্বজনস্বীকৃত যে চোরাকারবার ও কালোবাজারের যোগফল যে কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে তলাহীন পাত্রের মতো করে ফেলতে সক্ষম। তাই ইসলামী অর্থনীতিতে সব ধনের ব্যবসায়ক অসাধুতা শুধু নিষিদ্ধ নয়, বরং যারা এসব গণস্বার্থবিরোধী ও সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী কাজে লিপ্ত তাদের সমুচিত শাস্তিরও বিধান রয়েছে। কেননা কেবলমাত্র এভাবেই আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হতে পারে।
অনুরূপভাবে জুয়াকে তার সর্ববিধ রূপে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্র হতে এর উচ্ছেদ না হলে ইসলামী অর্থনীতি তার প্রকৃত কল্যাণকর্মী রূপ বাস্তবায়নে পুরোপুরি সমর্থ হবে না। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-
“হে মুমিনগণ! জেনে রাখ, মদ, জুয়া, মূর্তি এবঙ (গায়েব জানার জন্যে) পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অতি অপবিত্র জিনিস ও শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা তা পরিত্যাগ কর। তবেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।” (সূরা আল মায়েদা: ৯০ আয়াত)
মূখ্যতঃ তিনটি কারণে ইসলামী অর্থনীতিতে সব রকমের জুয়া ও ফটকাবাজী (Speculation) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমতঃ জুয়ার কারণে প্রভূত অর্থের অপচয় ও মূল্যবান সময়ের অপব্যয় হয়। দ্বিতীয়তঃ জুয়া সামাজিক বিশৃংখলা ও নৈতিক অপরাধের জন্ম দেয়। শুধুমাত্র জুয়ার কারণেই মানুষের মধ্যে কলহ-বিবাদ, মারামারি এবং খুন-জখম সংঘটিত হচ্ছে এরকম উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। তৃতীয়তঃ জুয়ার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক লোককে প্রতারণা করে মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিনাশ্রমে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। সুতরাং, বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থেই ইসলামেরসকল ব্যবসায়িক অসাধুতা নিষিদ্ধ ও সব ধরনের জুয়া উচ্ছেদের জন্যে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নেহী আনিল মুনকারের এই নির্দেশ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই ইসলামী অর্থনীতি দুনিয়ার কল্যাণের সাথে সাথে আখিরাতেরও কল্যাণ ও নাযাতও নিশ্চিত করে।
১১. ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ
ইসলামী অর্থনীতির মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক সুবিচার তথা আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করা। অন্যসব অর্থনৈতিক বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার এবং আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘মারুফ’ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও ‘মুনাফা’ বা দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠার অর্থই হচ্ছে সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে সুনীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থ রক্ষা েএবং একই সঙ্গে আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক যুলূম ও শোষণের পথ রুদ্ধ করা। রাষ্ট্র এই উপায়েই সুদ ঘুষ মুনাফাখোরী মজুতদারী চোরাচালানী কালোবাজারী পরদ্রব্য আত্মসাৎ সব ধরনের জুয়া হারাম সামগ্রীর উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলিত সকল প্রকারের অসাধুতা প্রভৃতি অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সকল নিপীড়ন ও শোষণমুলক কাজ সমূলে উৎপাটন করতে পারে।
অনুরূপভাবে যে সমস্ত সম্পদের সামাজিক মালিকানা থাকলে তার ব্যবহার সর্বোত্তম হবে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই তা থেকে সুবিধা বা উপকার পাবে সে সকল উপায় উপকরণই রাষ্ট্রের জিম্মাদারীতে থাকতে পারে। রাষ্ট্র যাকাত ও উশর আদায় এবং তার উপযুক্ত বিলিবন্টন, বায়তুলমালের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকার বা মীরাসী আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, ইসলামী শ্রমনীতির যথাযথ প্রয়োগ, করযে হাসানা ও মুদারিবাত ব্যবস্থার জন্যে আইন তৈরী এবং নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় ও প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই বলিষ্ট ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একাজে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আদলও ইহসান প্রতিষ্ঠা হবে না, বরং সমাজে যুলুম ও বঞ্চনার সয়লাব বয়ে যাবে। একারণেই উপযুক্ত ক্ষেত্রে সীমিত মাত্রায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিধান রয়েছে ইসলামী অর্থনীতিতে। একই সাথে বেশ কিছু সম্পদের সামাজিক মালিকানাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে।
১২. সমাজকল্যাণ ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা
যেকোন উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচায়ক হচ্ছে তার সমাজকল্যাণ কর্মসূচী ও জনগণের আর্থিক নিরাপত্তার জন্যে গৃহতি ব্যবস্থা। প্রচলিত সমস্ত অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শসমূহে এজন্যেই সমাজকল্যাণের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সে সবের কোনটিই ইসলামী অর্থনীতির সমকক্ষ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই জনকল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাত্মক জোর এবঙ সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। দরিদ্র জনগণের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে বায়তুল মাল হতে ন্যূনতম মাসেহারা দেওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টির সাথে সাথে চিকিৎসা ও সুন্নাহতে যে নির্দেশ রয়েছে তা যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে গোটা সমাজদেহে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভবপর।
জনকল্যাণের জন্যে ইসলামে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির বাধ্যতামূলক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ব্যক্তিকেও নিজস্ব সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তির ধন-সম্পদে সমাজের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আল-কুরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চনাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)
“তুমি আত্মীয়-স্বজন েএবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তোমার নিকট হতে তাদের পাওনা দিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬ আয়াত)
“তোমাদের ধন-সম্পদে (যাকাত ছাড়াও) সমাজের অধিকার রয়েছে।” (তিরমিযী)
সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজকল্যাণের তথ্য জনসাধারণের হক আদায়ের জন্যে এই রকম জোরলো তাগিদ বা নির্দেশনা নেই। সেখানে রাষ্ট্র বা সরকার জনকল্যাণ কর্মসূচী গ্রহণ করে মর্জিমাফিক। কিন্তু ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শরীয়াহর দাবী অনুসারেই রাষ্ট্র ও জনগণ বাধ্যতামূলকভাবেই দেশ ও দশের কল্যাণের জন্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য। এই সমাজে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে যেমন বৈধ ও অবৈধের বা হালাল-হারামের প্রশ্ন তুলে সীমারেখা নির্ধারণ কর দেওয়া হয়েছে তেমনি সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে সমাজে সব বিশৃংখলা দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানও নিশ্চিত করা হয়েছে। বস্তুতঃ সমাজকল্যাণ ও আর্থিখ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন ইসলামী অর্থনীতির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বিশেষ দিকটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যৌথভাবে সরকার ও জনগণের।
উপরে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখার বারটি বিষয়ের উল্লেখ করা হলো। এ থেকে ইসলামী অর্থনীতির স্বরূপ ও প্রকৃতি বোঝা যাবে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ইসলামী অর্থনীতি কোন দেশে কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্যে সামগ্রিকভাবে ইসরামী জীবন ব্যবস্থাকে অর্থাৎ ইসলামের রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি আইন-বিচার-প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ সবকিছুই যুগপৎ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে দরকার সেই মুসলমানেরও ঈমান ও আকীদার দিক দিয়ে, তাকওয়ার দৃষ্টিকোণ হতে যার তুলনা হতে পারে একমাত্র সে নিজেই। প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় পাওয়া যায় তো তারই মধ্যে, প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে যে ঘোষণা করে:
“নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার রোযা, আমার জীবন এবং আমার মরণ সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে।” (সূরা আল-আনআম: ১৬২ আয়াত)
সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি
আমাদের সমাজে কিছু বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে সুদবিহীন অর্থনীতির বাস্তবায়নের কথা বেশ জোরে-শোরে বলে থাকেন। তারা জেনে বুঝে এমন বলেন, না এর মধ্যে কোন কূটচাল রয়েছে তা বোঝা ভারী মুশকিল। কারণ ইসলামী অর্থনীতি প্রসঙ্গে এরা রীতিমত নির্বাক। বাস্তবে সুদবিহীন অর্থনীতি কোনক্রমেই ইসলামী অর্থনীতির বিকল্প হতে পারে না। ইসরামী জীবন বিধান সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণার কারণেই সুদবিহীন অর্থনীতির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন এসব বুদ্ধিজীবীরা। ইসলাম যে এক সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং আমর বিল মা’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার যে জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তুর বা Comer Stone, তাওহীদ, রিসালাত আর আখিরাত যার মুল দর্শন, সেই মৌলিক বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকার কারণেই প্রধানতঃ চিন্তার এই দুর্বলতা বা ভ্রান্তি দেখা দেয়। যথাযথ জ্ঞানের অভাব বিশেষতঃ মূল উৎস হতে না জানার কারণে পরের শেখানো বুলি আওড়াতে এদের সংকোচ বা আড়ষ্টতা দেখা দেয় না। বরং বাহাদুরী করে নিজেদের ‘নতুন কথা’ জাহির করার প্রবণতাই এক্ষেত্রে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়।
অনেকে মনে করেন এবং জোর গলায় বলেনও- সেক্যুলার বা প্রচলিত অর্থনীতি হতে সুদ প্রত্যাহার করে নিলে ইসলামের সঙ্গে তার দূরত্ব দূর হয়ে যাবে। সুদ বিবর্জিত এই অর্থনীতিই হবে ইসলামী অর্থনীতি। এ ধরনের কথা সবচেয়ে বেশী শোনা যেত যখন সমাজতন্ত্র বেশ কয়েকটি দেশে পেশীশতির জোরে ক্ষমতায় ছিলো। কেউ কেউ আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতি প্রায় একই রকম এমনও মত প্রকাশ করতোত। তবে এসব প্রচারণা যে এক অর্থে গভীর দুরভিসন্ধিমূলক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ যুগে যুগে মুরতাদরা ও ইহাদী-খৃস্টানদের কাছে বিবেক বিক্রি করে দেওয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা েইসলামের লেবাস ধরে ভিতর থেকেই তার শিকড় কেটে তাকে তিলে তিলে দুর্বল তথা ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।
িইসলামী অর্থনীতি বলতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সামগ্রিক এক জীবন ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতি বলতে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তাহলো, প্রচলিত অর্থনীতি হতে শুধু সুদকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। অর্থনীতির অন্যান্য প্রসঙ্গে ইসলামের যে নির্দেশ তথা শরীয়াহর বিধি-নিষেদ প্রতিপালিত হবে কিনা সে ব্যাপার কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা সেখানেই নেই। তাই সেই অর্থনীতি যে প্রকৃতই ইসলামী অর্থনীতি হয়ে উঠতে অক্ষম তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই ধরা পড়বে। এই দুইধরনের অর্থনীতিরমধ্যে রয়েছে মেরুপরিমাণ ব্যবধান। নিচে সেই ব্যবধানের কারণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।
প্রথমতঃ ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তির সাথে সুদবিহীন অর্থনতির দর্শনের কোনই মিল নেই। কারণ তওহীদ রিসালাত ও আখিরাত ইসলামী অর্থনীতির মৌল দর্শন। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তারা এ ধরনের কোন দর্শনের কথা বলেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা প্রচুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সুদকে উচ্ছেদ করাই যথেষ্ট বলে মনে করেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থনীতিতে যে ভোগবাদী দর্শন সতত কার্যকর, ব্যক্তিপূজা তথা ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থতা যার সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু তা পরিত্যাগ বা উচ্ছেদের কোন কথা তারা বলেন না। পরকালনি মুক্তি অর্জনের জন্যেই যে ইহকালীন প্রচেষ্টা চালানো অতি আবশ্যক এই সত্য সম্বন্ধে তারা রহস্যজনকভাবে নীরব। বস্তুতঃ দার্শনিক ভিত্তির ভিন্নতাই দুই অর্থনীতির মধ্যে বিশাল ব্যধান সৃষ্টি করেছে। কোনভাবই এ দুয়ের মধ্যে সাযুজ্য যা যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়তঃ ইসলামী অর্থনীতির সকল কার্যক্রমের ভিত্তি হলো যুগপৎ আমর বিল মাৎ’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উচ্ছেদের সর্ববিধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। অর্থনীতির যে কোন পদক্ষেপে, কর্মমৌশলে বা নীতিমালায় এর ব্যত্যয় ঘটলে তা হবে ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যায় ও যুলুমের উচ্ছেদ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতিতে এমন বৈশিষ্ট্য আদৌ লক্ষ্য করা যায় না। শুধুমাত্র সুদ বর্জনই তার লক্ষ্য, সমাজরে সর্বস্তরে কল্যাণ ও মঙ্গলবোধের প্রতিষ্ঠা তার কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য নয়। ফলে ইসলামী অর্থনীতি যে সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলময় এবং সুবিচারপূর্ণ অর্থনীতি তথা সমাজ জীবনের পরিচয় দেয় সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও লক্ষ্য করা যায় না।
তৃতীয়তঃ বর্তমান কালের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি যে ব্যাংক ব্যবস্থা তা থেকে শুধু সুদ প্রত্যাহার করে নিলেই কাঙ্খিত কল্যাণ লাভ আদৌ সম্ভব নয়। কারণ ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারী হওয়ার কারণেই ইসলামীব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো হারাম ও সমাজবিধ্বংসী কোন কাজে অংশ নেবে না বা সে ধরনের কোন কাজে বিনিয়োগও করবে না। কিন্তু সুদবিহীন অর্থব্যবস্থায় এ ধরনর কোন নিশ্চয়তার সুযোগ নেই। ব্যাংক বা ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সুদ না নিয়েও মুনাফার অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে সিনা হল তৈরী বা মদের কারখানা পরিচালনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করলে তাতে বাধা দেবার কেউ নেই। এখানে ইসলামী অর্থনীতির সাথে সুদবিহীন অর্থনীতিরি মৌলিক তফাৎ।
চতুর্থতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে সকল ক্ষেত্রেই হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলার প্রতি দৃঢ় লক্ষ্য রাখা যায়। হালাল বা বৈধ উপায়ে উপার্জন এবং বৈধ উপায়েই তা ব্যয়ের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়ে থাকে এই অর্থনীতিতে। এই অর্থনীততে হারাম উপায়ে উপার্জন তো পরিত্যাজ্যই, সেই সঙ্গে বৈধ উপায়ের উপার্জনও হারাম পথে ব্যয়ের কোন সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতিতে সুদের উচ্ছেদই একমাত্র বিবেচ্যে বিষয়, অন্য কিছু নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ভোগ বন্টন উপার্জন বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন নীতি-নৈতিকতা বা শেষ সীমার প্রশ্ন নেই। ভোগবাদী এই ব্যবস্থায় যেসব পন্থায় উৎপাদন বা যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজরে জন্য ক্ষতিকর ও শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং যেসব পন্থায় ব্যয় বা ভোগ সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকরী সেসবও ভাববার কোন কারণ নেই। এ বিষয়ে সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের নীরবতা এক কথায় রহস্যজনক।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, অবৈধ বা হারাম উপায়ে উপার্জন বন্টন বিনিয়োগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম ইসলামী অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ প্রধানঃ তিনটি। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের উদ্দেশে জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা পদ্ধতিতে যুলুম চালানো হয়। দ্বিতীয়তঃ চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকরী ও সমাজবিধ্বংসী কার্যক্রমসমূহ মূলতঃ এ ধরনের অবৈধ বা হারাম অর্থনৈতিক কার্যক্রমেরই ফসল। তৃতীয়তঃ অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়েই ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ধন-সম্পদ ব্যবহারের অর্থই হলো সামাজিক অবিচার ও পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। পরিণামে সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে হারাম উপায়ে উপার্জন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন- হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ। তিনি আরো বলেন- হারাম রুজী হতে উৎপন্ন রক্ত ও মাংস দোজখের আগুনের খোরাক।
পঞ্চমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও দাবী হলো যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের অন্যতম। এটি যথাযথভাবে পালিত না হলে ইসলামের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্যে রাসূলে আকরামের (স) মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যখন ভণ্ড নবীদের চাপের মুখে হযরত উমার (রা) পর্যন্ত সাময়িকভাবে যাকাত আদায় রহিত করার প্রস্তাব করেছিলেন সে সময় মুসলিম উম্মাহর প্রতম আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়তার সাথে যাকাত আদায়ের অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। যাকাতের মাধ্যমে যেমন সমাজে ধনবৈষম্য হ্রাস পায় তেমনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত জনগণ সামাজিক নিরাপত্তা লাভের সুযোগ পায়। সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থার প্রবক্তরা যাকাত আদায় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোনই মন্তব্য করেননি। এর প্রবক্তারা যেন ধরেই নিয়েছেন সুদ উচ্ছেদ হলেই গোটা অর্থনীতি ইসলামী হয়ে যাবে।
ষষ্ঠতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে কৃষিনীতি, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, বর্গাচাষ ও উশর আদায় সম্বন্ধে যে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ও তাগিদ রয়েছে সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও নেই। অথচ সমাজের বৃহত্তম অংশ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যাকাতের মত উশর আদায়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ধনবৈষম্য দূরীকরণ ও দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের কল্যাণ ও আর্থিক বুনিয়াদের নিশ্চয়তা না থাকলে শুধু গ্রাম অঞ্চলে নয়, সমগ্র সমাজ কাঠামোতেই বিপত্তি নেমে আসে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তীব্রতর হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় ভারসাম্যহীন। এর উপযুক্ত প্রতিবিধান করতে হলে কৃষি জমির মালিকানা, বর্গাচাষ, ভূমি রাজস্ব এবং উশর আদায় বিষয়ে ইসলামের নীতি-নির্দেশনা মানতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে কোন প্রকার মধ্যস্বত্বের অবকাশ নেই। জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি-সে জমি রাষ্ট্রেরই হোক বা ব্যক্তিরই হোক। উন্নত কষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ইসলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুদবিহীন অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ।
সপ্তমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অপর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর ঘোষণা অনুসারে উত্তরাধিকার নীতি বাস্তবায়ন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বের উত্তরাধিকার আইন ছিলে অস্বাভাবিক। পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ। খৃস্টান ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ সকল ধর্মেই মোটামুটিভাবে একই ধরনের প্রথা বিরাজমান ছিলো। এর পিছনে যে দর্শন কাজ করতো তা হলো সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থঅকবে। তা যেন বিভক্ত হয়ে অন্য মালিকানায় চলে না যায়। এভাবে পুরুষানুক্রমে সম্পত্তি একই পরিবারের দখলে থাকায় তাদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি তথা শোষণ ও পীড়নের সুযোগ থাকতো অব্যাহত ও অটুট। উপরন্তু মহিরারা ছিলো সর্বদাই বঞ্চিত। তারা যে সমাজের দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অর্ধাংশ এই সত্যটি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে স্বীকারই করা হতো না। ইসলামই সর্বপ্রথম সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি কন্যা স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সুদবিহীন অর্থনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গে কোন দিক নির্দেশনাই নেই। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে তারা পুঁজিবাদী উত্তরাধিকার পদ্ধতিরই স্বীকৃতি দিয়েছে যা যুলুমের নামান্তর।
অনুরূপভাবে অর্থনীতিতে আদল ও েইনসাফের প্রয়োগ, শ্রমিকদের অধিকার আদায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিধি ও প্রয়োগ, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ব্যাপারেও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এমনকি জনগণের মৌলিক পাঁচটি প্রয়োজন অন্ন বস্ত্র স্বাস্থ্য বাসস্থান ও শিক্ষা বিষয়েও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন পস্তুাবনা নেই, কোন কোন নীতি নির্ধারণী কৌশল। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে কঠোর তাগিদ রয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, উপায় থাকতেও যে স্বেচ্ছায় ভিক্ষা করে, কিয়ামতের দিন তার জঠর জাহান্নামের আগুনে ভরে যাবে। এরই বিপরীতে উপায়হীন ক্ষুধাতুর মানুষের দুঃসহ যাতনার কথা মনে রেখেই দয়ার নবী মুহাম্মদ (স) বলেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চাইলে আধখানা খেজুর হলও মিসকিনের হাতে তুলে দিও। নিরন্ন-বুভুক্ষ মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রখ্যাত মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, বায়তুল মালের তহবিল হতে দরিদ্র-নিরন্ন মানুষের এই প্রয়োজন মিটানো সম্ভব না হলে ধনীদের উপর আরো কর আরোপ করতে। তাতেও সংকুলান না হলে তাদের কাছ থেকে ধার নিতে। এ দরনের সুপারিশ বা নীতিমালা গ্রহণের নির্দেশনার লেশমাত্র লক্ষ্য করা যায় না সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের লেখায়-আলোচনায়।
বস্তুতঃ কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইহকালের জীবনকে পরকালের জন্যে পাথেয় উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এই নশ্বর জীবন যেন শুধু ভোড়-বিলাসেই শেষ না হয়ে যায়, বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ইহকালীন জীবন যেন শান্তি ও সমৃদ্ধির হয় এবং পরকালে জীবনে মুক্তি লাভ ও আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃত হওয়া যায় মুমিনের এই বাসনা চরিতার্থ করাই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার কোন অর্থনীতিরই –তা সে পুঁজিবাদই হেহাক বা সেক্যুলারই হোক কিংবা হোক সুদবিহীন- এই বৈশিষ্ট্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আন্দালুশিয়া হতে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী বিশাল ভূখণ্ডে দীর্ঘ নয়শত বছর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গৌরবোজ্জ্বল যুগে ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণময় স্পর্শে তখন না ছিলো শ্রেণীবৈষম্য, না ছিলো ক্ষুধাতুর মানুষের মিছিল। আজও সেই ইসলাম রয়েছে, রয়েছে মুসলমানরাও। তাদের মোট সংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু মুষ্টিমেয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বা দিলে তারা আজ পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনের দাসানুদাস। উপরন্তু মাযহাবী ভিন্নতা ও নানা ধরনের শিরক ও বিদআত আজ ইসলামের প্রাণশক্তিকে গ্রাস করেছে। ইসলাম আজ ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। তাকে শৃংখলমুক্ত করতে পারলে আবারো মুসলিম জাহাহনে ফিরে আসবে তার হৃত গৌরব, সৃষ্টি হবে নতুন এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।
ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ
১. ইসলামী ভোক্তা কে?
“আমি তাদের পরে তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কি প্রকার আচরণ কর তা পরীক্ষা করার জন্যে।” (সূরা ইউনুস: ১৪ আয়াত)
এই আয়াতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পূর্ববর্তী জাতিসমূহকে ধ্বংস করে আর একটি জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন মূলতঃ তাদের আচরণ পরীক্ষা করার জন্যে, আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা পরীক্ষা করার জন্যে।
মানুষের পার্থিব জীবনে যত ধরনের আচরণ রয়েছে ভোগের ক্ষেত্রে আচরণ সেসবের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেককেই কিছু না কিছু ভোগ করতেই হয় তার জীবন যাপনের জন্যে। আবার তার পরিবার পরিজন রয়েছে, রয়েছে আত্মীয়-স্বজন। তাদের প্রতিও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সব মিলিয়ে তার সামষ্টিক ভোগের পরিধি বেশ বড়ই। এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে, রয়েছে শরীয়াহর আহকাম। সেসব মেনে চলাও একজন মুমিনের জন্যে মৌলিক পরীক্ষা।
ভোগ হয় রিযিক বা সাধারণ অর্থ খাদ্যবস্তু, কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার জন্যে জোর তাগিদ রয়েছে ইসলামী শরীয়াহতে। রাসূলে কারীম (স) বলেছেন- “হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ।”
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে –“আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়অ কবুলের অন্যতম শর্ত হালাল রুজীর উপর বহাল থাকা।” (মুসলিম)
একজন মুমিন ভোক্তা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে সব সময় শুধুমাত্র হালাল দ্রব্য ও সেবা ভোগ করবে এবং হারাম দ্রব্য ও সেবা বর্জন করবে। ইসলামী পরিভাষার আলোকে ঐসব দ্রব্যকে হালাল দ্রব্য বরা হয় যার নৈতিক ও আদর্শগত গুণাগুণ থাকে, যেগুলোর ভোগ উপকার ও কল্যাণই বয়ে আনে। আজকের দিনে মুসলমানরনা সাধারণভাবে হালাল রুজী বা রিযিকের তথা ভোগের উৎসের ব্যাপারে কতখানি মনোযোগী বা সতর্ক সে প্রশ্নে না গিয়ে সাহাবায়ে কিরাম এবং ইমামরা কেমন আমল করতন, কতটা সতর্ক ছিলেন এ ব্যাপারে তার দু’ একটা উদাহরণ আমাদের চোখে খুলে দিতে পারে।
সিদ্দীকে আকবর আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে একজন খাদেম দেওয়া হয়েছিলো রাষ্ট্রের পক্ষ হতে তার ব্যক্তিগত কাজে সহায়তার জন্যে। এই খাদেমের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো খলীফার খাবারের প্রতি মনোযোগ রাখা ও তা পরিবেশন করা। খলীফারও অভ্যাস ছিলো খাবার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর খাওয়া। একদিন খাবারের শুরুতে খাদেমকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলেন সেদিনের খাবার কোথা হতে কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে তিনি যখন খাদেমকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন সে জবাবে জানালো আজকের খাবারে উৎকৃষ্ট মধু ও দুধ রয়েছে। এগুলো তাকে দিয়েছে এক গোত্রের লোকেরা। কারণ হিসেবে জানালো সে যখন কাফির ছিলো তখন যাদুমন্ত্র জানতো। তাতে অনেকের উপকারও হতো। এই গোত্রের লোকেরা তার কুফরী কালের যাদুমন্ত্রে উপকৃত হয়েছিলো। তাদের সাথে আজ হঠাৎ দেখা হওয়ায় তারা কৃতজ্ঞতাবশতঃ উৎকৃষ্ট মধু ও উটের দুধ দিয়েছে উপঢৌকন হিসেবে। সেটাই সে খলীফার আজকের খাবার প্রস্তুতের কাজে লাগিয়েছে।
একথা শুনে খলীফা খুব রাগতস্বরে বললেন, তুমি তো আমাকে বরবাদ করে দিয়েছ। এরপর গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে তিনি বমি করতে চেষ্টা করলেন এবং এক সময়ে তিনি গলা থেকে রক্ত বের করে ফেললেন। এই সংবাদ হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) কাছে পৌঁছালে তিনি দেখতে এলেন আমীরুল মুমিনীনকে। সব শুনে তিনি বললেন, সন্দেহজনক খাদ্য বমি করে ফেলে দিয়েছেন সেটা ভালোই হয়েছে। কিন্তু রক্ত বের করার মতো ক্লেশ তিনি না করলেই পারতেন। তার উত্তরে হযরত আবু বকর (রা) জবাব দিয়েছিলেন “উমার তুমি কি শোন নি রাসুলে আকরাম (সা) বলেছেন হারাম খাদ্যবস্তু হতে শরীরে যে রক্ত-গোশত পয়দা হয় তা দোযখের আগুনের খোরাক।” এরপর হযরত উমার নিরুত্তর হয়ে গেলেন।
ইমামে আযম হযরত আবু হানীফঅ (রহ) একজন বড় মাপের বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। একদিন তিনি তাঁর দোকানের কর্মচারীদের একটা কাপড় দেখিয়ে বললেন সেটাতে একটা খুঁত রয়েছে। বিক্রির সময়ে সেটা নেয অবশ্যই ক্রেতাকে দেখানো হয়। দিনশেষে হিসাব নেয়ার সময়ে তিনি কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেন ঐ খুঁতযুক্ত কাপড়টিও বিক্রি হয়ে গেছে কিনা। তারা হাঁ সূচক উত্তর দিলো। তিনি জানতে চাইলেন তারা খুঁতটার কথা উল্লেখ করেছিলো কি না? তারা নিরুত্তর রইলো। হযরত আবু হানীফঅ (রহ) সেদিনের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দানি করে দিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন- খুঁতযুক্ত কাপড়টার জন্যে যে উচিৎমূল্য আদায় করা হয়েছে সেই দিরহাম কোনগুলো? যেহেতু সেগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ নেই তাই সন্দেহযুক্ত আয় পারিবারিক কাজে লাগিয়ে তিনি ঈমান ও আমল বরবাদ করতে চাননি। সত্যিকার ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ তো এটাই। আমাদের দেমের মুসলমান ব্যবসায়ীদের কতজন এই ঘটনা জানেন?
গভীর পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়, ইসলামী মূল্যবোধ বিবর্জিত ভোগলিপ্সা আজ মুসলমানদের চরম দুনিয়ামুখী করে তুলেছে। আখিরাতের চাইতে দুনিয়াতে আঁকড়ে ধরার অশুভ প্রবণতা তার ঈমানের শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই একদা যে বিশ্ব তার বশীভুত ছিল আজ সেই-ই বিশ্বের বশীভূত হয়ে পড়েছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। সেজন্যেই চাই সচেতন ও সক্রিয় উদ্যোগ। ইসলামী অর্থনীতি তথা একজন মুসলমানের অর্থনৈতক জীবনাচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন ছাড়া তা অসম্ভব।
ইসলামের দাবী হলো প্রকৃত মুসলমান সচেতনভাবেই তার সকল আচরণের দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে। এজন্যে আপাতঃ বা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ক্ষতি মনে হলেও সেতা হৃষ্টচিত্তে মেনে নেবে। সে হালাল রিযিক অর্জনের জন্যে যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে তেমনি হারাম বর্জনের জন্যেও তার মধ্যে বিরাজ করবে জিহাদী জযবা। দুনিয়ার এই নশ্বর জীবনে ক্ষণিকের সুখভোগের জন্যে সে কোনক্রমেই অনন্ত আখিরাতের জীবনকে বরবাদ করবে না। েএকমাত্র মরদুদ শয়তানের কুহকে পড়লেই সে এটা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন মুসলমানের তথা ইসলামী ভোক্তার আচরণ তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হলে তওবা করে তা থেকে ফিরে না আসলে কঠিন শাস্তিময় দোযখ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
২. ইসলামী ভোক্তার বৈশিষ্ট্য
বস্তুতঃ একজন ইসলামী ভোক্তার প্রধান ও মূল বৈশিষ্ট্য হলো তার ভোগসম্পর্কিত আচরণের মাধ্যমে সব সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা চালানো। অন্যভাবে দেখলে ভোগ আচরণকে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা পন্থা হিসেবে গণ্য করে। তার এই লক্ষ্য অর্জনে ভোগ আচরণ ইসলামী যুক্তিশীলতা (rationalism) দ্বারা পরিচালিত ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা নির্দেশিত। অপরপক্ষে একজন অমুসলমান বা পুঁজিবাদী ভোক্তার আচরণ অর্থনৈতিক যুক্তিশীলতা দ্বারা পরিচালিত, যা তার নিজ স্বার্থের দ্বারাই প্রভাবান্বিত। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ মনযের কা’ফ ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণে ভোক্তার ইসলামী মূল্যবোদকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। যথা:
(১) শেষ বিচারের দিনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস;
(২) ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাস; এবং
(৩) ইসলামী ধন-সম্পতের প্রতি বিশ্বাস।
শেষ বিচারের দিনের তথা আখিরাতের প্রতি একজন ভোক্তা যখন পূর্ণ বিশ্বাস রাখে অর্থাৎ পরকালের অনন্ত শান্তি ও পুরষ্কার প্রাপ্তি অথবা ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে তখন তার আর শরীয়াহর নির্দেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ থাকে না। ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামী সাফল্য অর্জিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে, নিছক ধন-সম্পদ অর্জনের মধ্য দিয়ে নয়। তাই ইসলামী ভোক্তার মূল লক্ষ্যই থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস। ইসলামী ধন-সম্পদের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামের ধন-সম্পদের সুনির্দিষ্ট পৃথক কিছু তাৎপর্য রয়েছে। এক হাদীসেই তার উল্লেখ রয়েছ। রাসূল (স) বলেন-
“তুমি যা খাও তা নিঃশেষ করে ফেলো, যে পোশাক পরো তা ব্যবহার কর ফরিয়ে ফেলো, আর যা দান করো তা তোমার পরকালের জন্যে সঞ্চয়। এছাড়া তুমি প্রকৃতপক্ষে আর কোন ধন-সম্পদের অধিকারী নও।” (মুসলিম)
একজন ইসলামী ভোক্তার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে তার মোট ব্যয়কে দুই অংশে ভাগ করে- পার্থিব ব্যয় ও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়। পার্থিব ব্যয় বলতে নিজের ও পরিবার-পরিজনদের জন্যে ব্যয়কে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বলতে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে ব্যয় এবং গরীব-মিসকীন অসহায় ও দুঃস্থজনদের জন্যে ব্যয়কে বুঝানো হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে বিত্তশালীদের ধন সম্পদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গরীব-দুঃখীদের হক বা অধিকার নিশ্চিত কর দিয়েছেন। তিনি বলেন-
“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)।
আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- “আত্মীয়-স্বজনদের তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত মুসাফিরকেও।” (সরা বনি ইসরাঈল: ২৬ আয়াত)
ইসলামী ভোক্তার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে সম্পদ মজুদ করে না। তাকে সংসারির ব্যয় নির্বাহের জন্যে অবশ্যেই উপার্জন করতে হবে এবং আপৎকালীন খরচ মেটাবার জন্যে তাকে সঞ্চয়ও করতে হবে। এই সঞ্চয় তাকে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগও করতে হবে। কারণ বিনিয়োগে ব্যর্থ হলে সঞ্চিত অর্থের যাকাত আদায় করতে গিয়ে তার সঞ্চয় নিসাব এর নিচে চলে আসতে পারে।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শুরুতেই মুমিন হওয়ার যে শর্তাবলী আল্লাহ উল্লেখ করেছেন সেখানেও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক হতে তারই ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (দ্রষ্টব্য: সূরা আল-বাকারাহ: ৩ আয়াত।) ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহর মোট ব্যয়ের ঐ অংশকে বোঝায় যা একজন ভোক্তা কোনও প্রকার পার্থিব সুবিধা বা প্রতিদানের আশা না করেই আল্লাহর পথে ব্যয় করে শুধুমাত্র তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে। অবশ্য এজন্য সে আখিরাতে পুরস্কৃত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ স্বয়ং আল-কুরআনে বলেছেন, তারা আল্লাহ প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীদের আহার্য দান করে। তারা বলে:
“কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” (সরা আদ দাহর: ৮-৯ আয়াত)
একজন ইসলামী যুক্তিশীল ব্যক্তি চিন্তা করবে তার নিকট যা কিছু রয়েছে তা সবই আল্লাহর দান বা আমানত। যদি সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর প্রতি ব্যয় করা হয় তবেই মাত্র তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের হক আদায় হবে। যাকাত সাদাকাহ ফিতরা ইত্যাদির বাইরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বেচ্ছাধীন দানই ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহ বলে বিবেচিত।
এর বিপরীতে একজন অমুসলিম ভোক্তার লক্ষ্য হচ্ছে: “Eat, Drink and be merry”। অর্থাৎ, খাও-দাও পান করো আর ফূর্তি করো। কারণ তার বোধ-বিশ্বাসে পরকালীন জীবনের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গই নেই। নম্বর এই জীবনে সে বোগ করবে চূড়ান্ত বাবে এবং সেখানে হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধতার প্রশ্ন নেই। ভারতীয় জীবন দর্শমেনর সাথে পাশ্চাত্যের এই জীবন দর্শনের খুব একটা অমিল নেই। সেখানেও জীবনকে আকণ্ঠ ভোগ করতে বলা হয়েছে। এমনকি ঋণ করে হলেও। ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক বলেন-
“যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেং।”
অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো, সুখেই বাঁচো, আর ঋণ করে হলেও ঘি খাও।
একজন ইসলামী ভোক্তার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো ভোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। তার আচরণ কৃপণের মতোও হবে না, আবার সে অমিতব্যয়ীও হবে না। আল্লাহ নিজেই এ সম্বন্ধে বলেন- “তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না, এবং তাদের পনথা হয় এ দুয়েল মধ্যবর্তী।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)। উপরন্তু ইসলামী ভোক্তা অপব্যয়কারীও হবে না। কারণ আল্লাহ অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (দ্রষ্টব্য: সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)
ইসলামী অর্থনীতিতে কঠোর কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন কিংবা লাগামহীন ভোগের কোন সুযোগ নেই। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
৩. ইসলামের দৃষ্টিতে অভাব ও প্রয়োজন
সনাতন অর্থাৎ অনৈসলামী ভোক্তার আচরণে ধরে নেওয়া হয় মানুষের অবাব অসীম এবং সকল ভোক্তাই তাদের সকল অবাব মেটাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। অভাবই ভোক্তার আচরণের প্রেরণা বা শক্তি যোগায়। এটা আবার উপযোগের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনো দ্রব্যের উপযোগ থাকলে মানুষতা ভোগ বা অর্জন করার চেষ্টা করে। ইসলামী অর্থনীতিতে কিন্তু অভাব ও উপযোগের এরকম ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। এখানে প্রয়োজন অভাবেরএবং মাসলাহ উপযোগের স্থান দখল করেছে। প্রয়োজন ও অভাবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো- প্রয়োজন সসীম কিন্তু অভাব অসীম। প্রয়োজন মাসলাহ দ্বারা নির্ধারিত আর অভাব উপযোগ দ্বারা নির্ধারিত। মাসলাহ শব্দটি আরবী। এর অর্থ কল্যাণ। কল্যঅণ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কল্যাণেল মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে পার্থিব ও আখিরাতের কল্যাণ।
ইমাম আল-শাতিবীর মতে এ মাসলাহই জীবনের অপরিহার্য মৌলিক উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মানুষের জীবনের অপরিহার্য পাঁচটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:
১. আল-ঈমান (বিশ্বাস)(
২. আন-নফস (জীবন);
৩. আল-মাল (সম্পদ);
৪. আল-আকল (বুদ্ধিমত্তা) এবং
৫. আল-নসল (বংশধর)
যে সমস্ত দ্রব্য ও সেবার এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান বিকাশের ক্ষমতা রয়েছে সেগুলোর মাসলাহ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই মাসলাহধর্মী দ্রব্য ও সেবাই ইসলামী অর্থনীতিতে প্রয়োজন হিসাবে চিহ্নিত।
একজন ভোক্তার কাছে কোন দ্রব্য বা সেবার মাসলাহা রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে সে নিজেই সর্বোত্তম বিচারক। উপযোগের সাথে এর পার্থক্য এই যে, একজন ভোক্তা কোন দ্রব্যের উপযোগ রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে যেসব মানদন্ডের প্রয়েঅজন তা সে নিজেই নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু মাসলাহ্র ক্ষেত্রে সেসব মানদন্ড বাছাইয়ের ক্ষমতা কোন ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এগুলো এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও স্থির। পক্ষান্তরে ব্যক্তির মাসলাহ সামাজিক মালাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরে মানব জীবনের যে পাঁচটি মৌলিক উপাদানের কথা বলা হয়েছে তা যেমন একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি তা গোটা সমাজের জন্যেও প্রযোজ্য।
সনাতন অর্থনীতিতে কোন দ্রব্যের উপযোগ অর্থাৎ পার্থিব কল্যাণ থাকলে ভোক্তারা তার অভাব অনুভব করে। পক্ষান্তরে কোনো দ্রব্যেল মাসলাহ অর্থাৎ পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ উভয়ই থাকলে একজন ইসলামী ভোক্তা তার প্রয়োজন অনুভব করে। ইমাম আল-শাতিবী ইসলামী শরীয়াহর পুংখানুপুংখু পর্যালোচনা করে প্রয়োজনকে তিন স্তরে ভাগ করেছেন। যথা-
(ক) যরুরয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়;
(খ) হাজিয়াত বা পরিপূরক, এবং
(গ) তাহসানিয়াত বা উন্নতিমূলক।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে যে বস্তুগুলো যরুরীয়াত বা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত সেগুলো হলো-
১. জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দাবী মেটানো;
২. সম্পত্তি সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয়রোধ ও অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করা থেকে বিরত রাখা;
৩. যাবতীয় নেশার সামগ্রী এবং বিচার শক্তিকে কলুষিত করে এমন সব দ্রব্যের উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ নিষিদ্ধকরণ;
৪. যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করা।
হাজিয়াতের মধ্যে ঐসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর সরবরাহ বা ব্যবনহার ব্যক্তি মানুষের জীবনকে কঠোরতা হতে কিছুটা আরাম বা স্বস্তির দিকে নিয়ে যায়। তাহসানিয়াত তার চেয়ে আরও এক ধাপ উপরে। এখানে যেসব দ্রব্যসামগ্রী ভোগ করা হয়, ব্যবহার করা হয় অথবা সেবা পাওয়া যায় তা জীবন-যাপনের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। বিশেষতঃ পেশাদারী জীবন বা বিশেষজ্ঞদের জন্যে যা হাজিয়াত বলে বিবেচ্য সাধারণ লোকের জন্যে তাই-ই তাহসানিয়াত বলে বিবেচ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এয়ারকুলার কোন গবেষণাগারের জন্য যরুরীয়াত, প্রতিষ্ঠানের জন্যে হাজিয়াত এবং বাসগৃহের জন্যে তাহসানিয়াত হিসেবেই গণ্য হবে।
মনে রাখা দরকার প্রকৃত ইসলামী ভোক্তার আচরণ ইসলামী জীবনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমাদের চরিত্রে ও বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন যত বেশী গটবে ততই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবো। হালাল রুজী উপার্জন ও মাসলাহ প্রাপ্তির মাধ্যমে আমাদের নশ্বর জীবনহোক কল্যাণময় এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির মাধ্যমে হোক চরম সফলতাময়। এজন্যে আমাদের জীবন যাপনে তথা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিফলিত হতে হবে ইসলামী ভোক্তার সঠিক স্বরূপ।
ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সস্পদ বন্টন
১.
আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উপরই নির্ভর করে একটি জাতির বা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি। দেশের জনসাধারণের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সাথে কারা হাতে যেন সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নির্ভর করেসমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। সমাজে কি ধরনের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার উপরেই নির্ভর করে আয় ও সম্পদ বন্টন সুষ্ঠু হবে, না বৈষম্যপূর্ণহ হবে। সম্পদের মালিকানার ধরন, আইনগতভাবে তার পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেতার যথাযথ নিয়ন্ত্রণের উপরে আয় ও বন্টনের সাম্য বা বৈষম্য নির্ভর করে। রাষ্ট্র শুধুমাত্র কিছু আইন প্রণয়ন ও কর আরোপ করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু খাত রাষ্ট্রের নিজস্ব জিম্মাদারীতেও থাকে। কিন্তু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সততা এবং নৈতিকতার উপর কিছুমাত্র নজর দেয় না। যেহেতু নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা এবং পরকালে আল্লাহর নিকট পুঁজিবাদী দর্শনের ভিত্তি নয় সেহেতু পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ নানা কৌশলে, সাধারণতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়-উপার্জনের চেষ্ট করে।
অপরদিকে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মালিকানার সীমারেখা খুবই সংকুচিতহ। কোন ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে আয় ও সম্পদ বন্টন পুরোপুরি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল। এই খেয়াল-খুশী যে কতখানি ব্যক্তিনির্ভর তা আজকের দুটি বৃহৎ সমাজবাদী দেশ-সোভিয়েত রাশয়া ও গণচীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই উপলব্ধি হবে। ইসলাম এই দুই চরমধর্মী প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়েছে। অর্তা, ইসলামে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকতি রয়েছে; আয়, ভোগ, বন্টন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্যের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু কোনটিই লাগামহীন নয়, নিরংকুশভাবে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পথেই সম্পদ উপার্জন ও ভোগ করবে; সমাজে আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রিত হবে, বৈধতার ভিত্তিতেই উপায়-উপার্জন করবে এবং সম্পদের মালিকানা ও বন্টন নির্ধারিত হবে।
মূলতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে উপার্জনের ফলেই সমাজে ধনবন্টন বৈষম্য দেখা দেয়। এসব অসৎ ও অবৈধ উপায়কে তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের সুযোগের মধ্যে রয়েছে মজুতদারী, মুনাফাখোরী, ঘুষ, কালোবাজারী, ফটকাবাজারী প্রভৃতি। এসব অবৈধ ও অনৈতিক উপায়ে ব্যক্তির হাতে সম্পদের পাহাড় জমে ওঠে। যে সমাজে নৈতিক দিক দিয়ে এসব অবৈধ পন্থা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই সে সমাজে শুধু আইন প্রয়োগ করে কোন সাফল্য অর্জিত হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। দ্বিতীয়তঃ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার সুযোগ। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে ধনসম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হতে না দেওয়া। সম্পদ এখানে শধুমাত্র বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে এবং সেনা-রূপা-হীরা-জহরত, বিপুল জমি, প্রাসাদোপম বাড়ী অলংকারের মাধ্যমে বিত্ত ক্রমাগত মুষ্টিমেয় লোকের হাতে মজুদ হয়। কোনক্রমেই এই সম্পদ বিত্তহীন বা কম সৌভাগ্যবান লোকদের কাজে আসে না। শোষণের ও ধনবন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির তৃতীয় যে বড় অবৈধ উপায় সমাজে বিদ্যমান তা হলো সুদ এবং মহাজনী প্রথার ঋণ। সুকৌশলে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের শোষণর সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার সুদ। সুদের কারণেই অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয়, ভারসাম্যহীনতা, মন্দা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। অথচ সুদই পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি বা Lifeblood।
২.
ইসলামী অর্থনীতি তথা ইসলামী সমাজে আয় ও ধনবন্টন কিভাবে হবে তার মূলনীতিগুলো করআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আকিদা মুতাবিক সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহরই। তিনিই এর স্রষ্টা। মানুষকে সীমিত সময়ের জন্যে তিনি শর্তাধীন মালিক করে দিয়েছেন। তাকে নিরংকুশ মালিকানা দেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটা বাড়ীর মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যের সম্পর্কের মতো। বাড়ীর মালিকই হলো প্রকৃত মালিক, ভাড়াটিয়া বা ইজারা গ্রহীতা কতকগুলো শর্তপূরণ সাপেক্ষে সেই বাড়ীর বসবাস বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। শর্তের মধ্যে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা ছাড়াও থাকতে পারে দেয়াল ভাংগা বা জানালা বদলানো যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, ছাদে বাগান করা যাবে না ইত্যাদি। অনুরূপভাবে কতকগুলো শর্ত পালন সাপেক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিনিধি মানুষ বা ইনসানকে তাঁর সম্পদ ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন।
ইসলামে স্বেচ্ছাধীনভাবে আয়ের যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইচ্ছামত ভোগ ও ব্যয়েরও কোন সুযোগ নেই। এই মূল দৃষ্টিভংগীর প্রেক্ষিতে কুরআন ও হাদীসে সম্পদ উপার্জন, ব্যবহার ও বন্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“হে ঈমানদারগণ! একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয় তবে আপত্তি নেই।” (সূরা আন-নিসা: ২৯ আয়াত)
“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)
“ইহা জীবন যাপনের ব্যবস্থা সেই মুত্তাকীনদের জন্যে যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।” (সূরা আল-বাকারা: ২-৩ আয়াত)
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা আল বাকারা: ২৭৫ আয়াত)
“সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই অবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর: ৭ আয়াত)
“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৭ আয়াত)
“তাদের ধন-সম্পদের মধ্যে প্রার্থী ও অভাবগ্রস্তদের অংশ নির্ধারিত রয়েছ।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)
অনুরূপভাবে হাদীস শরীফেও প্রচুর নির্দেশ রয়েছে। যেমন:
“যারা দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্রে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চল্লিশ দিনের বেশী মজুদ রাখে তাদের সাথে আমার (অর্থাৎ রাসূলের) কোন সম্পর্ক নেই।” (মিশকাত)
“যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট পুরে খায় সে প্রকৃত মুমিন নয়।” (বুখারী)
“যারা অন্যকে ঠকায় ও অন্যের সাথে প্রতারণা করে তাদের আমাদের (অর্থাৎ মুমিনদের) মধ্যে নেই। (বুখারী)
“বর্গাদারী প্রথায় যদি কোন পক্ষের তাদের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশাংকা থাকে তবে তা নিষিদ্ধ হবে।” (মিশকাত)
উপরোক্ত নির্দেশসমূহের আলোকে রাসুলে করীম (স) তাঁর জীবদ্দশাতেই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মহান খুলাফায়ে রাশিদূনও (রা) সেই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। সে সময়ে ইসলামী দুনিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছিল অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। সুদূর স্পেনে কর্ডোভা হতে দূর প্রাচ্রের ইন্দোচীন (আজকের ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) পর্যন্ত েইসলামের সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবািইজান, কাজাখাস্তান পার হয়ে সুদূর চীনের কাশগড়, জিনিজিয়াং, গানসু প্রভৃতি অঞ্চল পর্যন্ত ইসলামের জীবন বিধান বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই আমলে রাষ্ট্রের বিস্তৃত কর্মকাণ্ড, নতুন নতুন এলাকার বিশেষ বিশেষ অবস্থা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে ইসলামী চিন্তাবিদরা ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বিস্তৃত গবেষণা করেন। আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে যেসব মুসলিম অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আবু ইউসুফ, ইবনে তাইমিয়া, আবু ইসহাক আল-শাতিবী, নাসিরুদ্দীন তুসী, ইবনে খালদুন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৩.
আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খারাজ বইয়ে সম্পদ কিভাবে সমাজে বন্টিত হবে তার পদ্ধতি ও কর্মকৌশল সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনায় কৃষি জমির উশর ও খারাজ আদায় চাড়াও জমির মালিকানার ধরন ও পদ্ধতি বিষয়েও মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে জমি যেমন অনাবাদী রাখা যাবে না তেমনি কেউ এত বেশী জমির মালি হতে পারবে না যা তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে চাষাবাদ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া তিনি আনুপাতিক হারে কর বৃদ্ধিরও কথা বলেছেন। সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তিনি উত্তরাধিকার আইরে যথাযথ প্রয়োগের উপরও সমধিক জোর দিয়েছেন।
ইবনে তাইমিয়া তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-হিসবাহ ফি আল-ইসলাম বইয়ে জনগণের উপার্জন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের আবশ্যিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলেছেন। জনসাধারণের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে রাষ্ট্র একদিকে যেমন উপায়-উপকরণ সরবরাহ করবে তেমনি অন্যদিকে তাদেরকে কাজের উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠারও সুযোগ সৃষ্টি করবে। গর মৌসুম বা Slack Season-এ যখন ক্ষেতে-খামারে কাজ মেলে না সে সময়ে রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন রাস্তা ও সেতু তৈরী ও মেরামত, মুসাফিরখানা সংস্কার, রাস্তার ধরে গাছ লাগানো প্রবৃতি কাজের মাধ্যমে বেকার ও ছদ্মবেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। এভাবেই সমাজে সাধারণ লোকের আয়ের নিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। অনুরূপভাবে সরকার সকল অবৈধ উপায়ে আয়ের পথ রুদ্ধ করে দেবে এবং ধনী ব্যক্তি ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের উপর নজর রাখবে। প্রয়োজনে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে বন্টন ও বাজার ব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্বও সরকারেরই। ইবনে হাযমের মতে উপযুক্ত কর আরোপের মাধ্যমে ধনীদের আয়হ্রাস ও গরীবদের কল্যাণের দায়িত্বও সরকারেরই।
প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও আধুনিক ধনবিজ্ঞানের জনক হিসাবে পরিচিত ইবনে খালদূনও তাঁর সুপ্রসিদ্ধ বই আল-মুকাদ্দামা-তে সমাজে আয় আবর্তন ও সম্পদ বন্টনের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধান, কৃষিজীবিদের উৎপাদিত পণ্যের মূলের স্থিতিশীলতা ও সৈনিকদের বেতন নির্ধারণ বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ েএলাকার মধ্যে আয় বৈষম্য ও তা দূর করার উপায় সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন।
একেবারে সাম্প্রতিক কালের কথা যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে হিজরী চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগ হতে যে ইসলামী পূনর্জাগরণ শুরু হয়েছে সে ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতিবিদরাও পিছিয়ে নেই। শহীদ সাইয়েদ কুতুব হতে শুরু করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, খুরশীদ আহমদ, উমর চাপরা, নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, ইউসুফ কারযাবী, বাক্কীর আল-সদর, হাসান আবু রুকবা, মনযের কা’ফ, আনাস জারকা, এস.এন.এইচ. নকভ, িআবুল হাসান এম. সাদেক প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ তাঁদের বিভিন্ন মুখী আলোচনায় দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন যে, যতক্ষণ না আমরা হযরত মুহাম্মদ (স) প্রদর্শিত আমর বিল মারুফ (বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার (বা দুর্নীতির উচ্ছেদ) এর পথ বাস্তবিকই অনুসরণ করছি এবং উপার্জনের ও ধনবন্টনের সকল ক্ষেত্রে হালালকে গ্রহণ ও হারামকে বর্জন না করছি ততক্ষণ সমাজে শান্তি ও স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ আসতে পারে না। অর্থনতি তার স্বাভাবিক গতিধারায় চলতে পারে না।
৪.
প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার, ইসলামী অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত এবং এই অর্থনীতি একটি ব্যবস্থাপনা নির্ভর অর্থনীতি (Managed economy)। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি মূলতঃ উন্মুক্ত বা অবাধ অর্থনীতি (Open economy) এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হচ্ছে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (Totally controlled economy)। সুতরাং, আদর্শগত ও প্রয়োগগত পার্থক্যের কারণেই ইসলামী অর্থনীতির কর্মধারা এবং তার বাস্তব রূপও ভিন্নতর হতে বাধ্য। সে কারণেই সামাজিক সাম্য অরজন, ইনসাফপূর্ণ বন্টন, দরিদ্র শ্রেণীর হক আদায় ও অধিকতর মানবিক জীবন যাপনের সুযোগ প্রদান এবং ধনীদের বিলাসিতা, অপচয় ও অপব্যয় বন্ধের জন্যে আয় ও বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম যে মূলনীতিগুলোর আবেদন ও প্রয়োগ সার্বজনীন ও সর্বকালীন। ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যতদিন মুসলিম দেশসমূহ ইসলামী ভাবধারা ও নীতিমালা অনুসরণ করেছে ততদিন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে; জনজীবনে স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত হয়েছে। পক্ষান্তরে এর ব্যতিক্রম মুসলিম সমাজের পতন ডেকে এনেছে।
এতক্ষণে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইসরামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অনুসৃতব্য মূলনীতিসমূহের ভিত্তি হচ্ছে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার। বস্তুতঃ সামাজিক সাম্য অর্জনের জন্যে চাই কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বন্টন ও ব্যবহার এবং প্রকৃত আন্তরিক প্রয়াস। উপরন্তু ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে চাই ইসলামী আইন ও সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজে মানুষ যা উপার্জন করবে তা অবশ্যই বৈধ পন্থায় হবে-একথা স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবৈধ উপায়ে আয়ের তথা ভোগ বন্টনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। প্রত্যেকেই যা হালাল তা অর্জনের জন্যে যেমন সচেষ্ট থাকবে তেমনি যা হারাম তা বর্জনের জন্যেও সর্বাত্মক প্রয়াস চালাবে।
কাজে ফাঁকি দেওয়া, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া, অন্যের জমি ও সম্পদ জবরদখল করা চোরাচালান মজুতদারী মুনাফাখোরী কালোবাজারী দামে হেরফের করা কর ফাঁকিত দেওয়া, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, টেন্ডার ছিনতাই, ঘুষ ও চাঁদাবাজি প্রভৃতি সকল ধরনের অসাধুতার পথ ইসলামে সকলের জন্যেই চিরতরে বন্ধ। কিন্তু মানুষ যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল, শয়তানের প্ররোচনা নিরন্তন তাকে হাতছানি দেয়, তাড়া করে বেড়ায় তাই অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়ের প্রবণতা তার মধ্যে থাকতে পারে। এই অবস্থা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্যেই রাসূলে করীম (স) ও তাঁর পরবর্তী যুগেও হিসবাহ ও হিজর নামে দুটি প্রতিষ্ঠান কার্যকর ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্বই ছিল উপরে উল্লেখিত অসৎ কাজ হতে সমাজের লোকদের বিশেষতঃ ব্যবসায়ীদের নিরস্ত্র রাখা এবং প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠান দুটির এতদূর ক্ষমতা ছিল যে, তারা আধ ও দুর্বিনীত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারতো।
বেহুদা ব্যয় বা অপব্যয়, বিলাস-ব্যসনেও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তাই সৎ বা বৈধভাবে অর্জিত অর্থও বেহুদা ব্যয় করা নিষেধ। বেহুদা খরচ সম্পর্কে মহান খুলাফায়ে রাশিদুন (রা) েএতদূর সতর্ক ছিলেন যে, মিষরের গভর্ণর তার সরকারী বাসভবনের প্রাচীর তৈরী করালে তা ভেঙ্গে ফেলার জন্যে লোক পাঠানো হয় এবং গভর্ণরকে পদচ্যূত করা হয়। সরকারী কর্মকর্তাদের মিতব্যয়ী হতে বলা হতো, তাদেরকে কলমের নিব সরু করে নিতে এবং কাগজের মার্জিনেও লিখতে পরামরশ দেওয়া হতো। এ থেকেই বোঝা যায় তাঁরা কি অপরিসীম নিষ্ঠার সাথে বেহুদা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাতেন। অথচ আজকের সমাজে নানা সামাজিক অনুষ্ঠাননে যে অর্থ অপচ্যয় হয় তা দিয়ে কয়েকটা পরিবারের সারা মাসের খরচ নির্বাহ হতে পারে।
যে কোন সমাজে আয় ও সম্পদে বন্টনে বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশে যে সমাজে, যে অর্থনীতিতে একবার সুদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে, সে সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। ধনী-গরীবের পার্থক্য হয়েছে বিপুল আর নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষের আহাজারিতে ভরে গেছে আকাশ, বাতাস, জনপদ। সুদের বিদ্যমানতার ফলে অর্থনীতিতে যেসব প্রত্যক্ষ কুফল লক্ষ্য করা গেছে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যাবে সুধঃ অর্থনৈতিক কুফল ও উচ্ছেদের উপায় শীর্ষক প্রবন্ধ হতে।
ঐসব কুফলের জন্যেই ইসলামে সুদকে এত কঠোরভাবে হারাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই সুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন। বিদায় হজ্বের অমর বাণীতেও তিনি এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরই চেষ্টায় প্রথমে মদীনা হতে ও পরবর্তকিালে সমগ্র ইসলামী বিশ্ব হতে সুদ নির্মুল হয়ে যায়। সুদের ভয়াবহ পরিণাম ও আখিরাতে তার শাস্তি সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী হুকুমাতের পতন দশা শুরু হওয়ার পর যখন খৃস্টান শাসকগোষ্ঠী তথা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যলিপ্সু শক্তি একের পর এক মুসলিম দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে তখন তাদের সহযোগিতায় ও তাদেরই তৈরি আইনের আওতায় সুদভিত্তিক লেনদেন শুরু হয়ে যায়। অবশ্য বিলম্বে হলেও সুদনির্ভর অর্থনীতির দেশে এর মারাত্মক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কুফল সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ধনবন্টনে সাম্য স্থাপনের ক্ষেত্রে ইসলামী মীরাস বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বাঁটোয়ারা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ইসলাম-পূর্ব যুগে বিশ্বে সম্পদ বন্টনের কোন বৈজ্ঞানিক ও স্বাভাবিক পন্থা বিদ্যমান ছিল না। ইসলামের সর্ব প্রথম মৃতের সম্পদ তার আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে একদিকে যেমন তাদের তাৎক্ষণিক অসহায় অবস্থা দুল করতে সমর্থ হয়েছে তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিবিশেষের হাতে সকল সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার বিপদও দূর করেছে। উপরন্তু সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। কিভাবে ও কাদের মধ্যে স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বাঁটোয়ারা হবে সে বিষয়ে সূরা আন-নিসায় ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশনা রয়েছে। এত ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশ আর কোন ধর্ম বা ইজমে নেই।
পসঙ্গতঃ যুক্তি হিসাবে বলা যেতে পারে সম্পদের অধিকতর সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে মৃতের সম্পত্তি সর্বহারাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেত অথবা নির্দেশ দেওয়া যেত রাষ্ট্রয়াত্তব করে নেওয়ার। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের নিকট আত্মীয়দের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনায় স্বীয় জীবদ্দশাতে সব সম্পদ ব্যয় করার চেষ্টা করতো। তার ফলে সমাজে দেখা দিত আরও বেশী বিশৃংখলা। পক্ষান্তরে মৃতের সম্পত্তি তার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও নিকট আত্মীয়েরা লাভ করায় সম্পদের বন্টন যেমন সার্থক ও অর্থবহ হয় তেমনি তারাও রাতারাতি সর্বহারাদের কাতারে গিয়ে শামিল হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
এখানে উল্লেখ করা আদৌ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমাদের দেশে বেআইনী বা জবরদস্তিমূলক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করা বর্তমানে একটা রেওয়াজ বা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের জমি, ইয়াতীম ও নাবালকদের সম্পত্তি, এমন কি প্রতিবেশীর জমি-বাগান-দালান ছাড়াও শত্রু সম্পত্তি কিংবা সরকারী সম্পত্তি (খাস জমিসহ), বাড়ীঘর, প্রতিষ্ঠান জবর দখল করে, কিংবা জাল/ভূয়া দলির করে এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি বিত্তশালী (এবং একই সাথে প্রতিপত্তিশালী) হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে। এদের যেন কেউ রুখবার নেই। আইন এদের কাছে বড়ই অসহায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইসলামের দোহাই পেড়ে বা রাষ্ট্রধর্মের বরাত দিয়ে দেশে শ্রেণী বৈষম্য দূর করা কখনই সম্ভব হবে না। বরং বৈষম্যই শুধু বাড়বে না, সেই সঙ্গে বাড়বে নির্যাতন, নিপীড়ন, যার পরিণাম কোটি বনি আদমে বেদনাক্লিষ্ট ও হতাশাপূর্ণ জীবন।
৫.
যাকাত আদায় এবং তার যথোচিত ব্যবহার সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে আর একটি বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভুক্ত বা Have-notes বলা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে গরীব, মিসকীন, ঋণগ্রস্ত, মুসাফির, ক্রীতদাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নও মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় এবং তা বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা নেই। যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পরবর্তী যুগেও বায়তুল মালের যাকাত অংশ পরিচালনার জন্যে আটটা দপ্তর বা Directorate ছিল। রাষ্ট্রের কঠোর ও নিপুণ ব্যবস্থা ছিল যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তা উপযুক্ত উপায়ে বন্টনের জন্যে। সেজন্যেই গোটা জাযিরাতুল আরবে যাকাত নেবার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না সে সময়ে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হলো সেদিনের আরবে দরিদ্র শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটেছিল।
ইসলামী হুকুমাত তথা ইসলামী অর্থনীতিতে উশরের মাধ্যমেও সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা চালু ছিল। পদ্ধতি হিসাবে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিজ্ঞানসম্মতও। যে জমিতেসেচ না দিয়ে ফসল উৎপন্ন করা যায় সেই জমির এক-দশমাংশ বা ১০% এবং জে জমিতে সেচ দিয়েসফল উৎপাদন করতে হয় সেই ফসলের এক-বিংশতি অংশ বা ৫% উশর হিসেবে প্রদানের শরীয় বিধান রয়েছে। জমির মালিক হয তা সরাসরি যারা যাকাতের হকদার তাদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দেবে অথবা বায়তুল মালে জমা করে দেবে। সেই ব্যবস্থার ফলে সম্পদের, বিশেষতঃ কৃষি পণ্যের/আয়ের সুষ্টু বন্টন নিশ্চিত হতো।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এদেশে বিদ্যমান বর্গাদারী প্রথার কুফল সম্বন্ধে দু’একটি কথা উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বর্গাদারী প্রথা। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ মহাজনী ঋণ ও ব্যাংকের সুদ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদেশে ১৯৬০ সালে যেখানে ভূমিহীনদের সংখ্যা ছিল ১৭%, ১৯৭৩-৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৬% েএ। ১৯৮৭-৮৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫০% এরও বেশী। বাংলাদেশে প্রায় ৩৯% পরিবার কোন-না-কোন শর্তে বর্গাচাষ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যদিও ফসলের হিসাবে বর্গাদাররা অর্ধেক পায় প্রকৃতপক্ষে টাকার হিসাবে (খরচসহ) সহ তারা এক-চতুর্থাংশের বেশী পায় না। উপরন্তু তাদের নিজস্ব শ্রমের মুল্য যদি ধরা হয় তাহলে তাদের প্রকৃত আয় অনেক ক্ষেত্রেই ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় বর্গাদাররা কোন দিনও নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখতে পারে না।
৬.
ইসলামী অর্থনীতি সমাজ ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অন্তর্ভুক্ত। ফলে ইসলামী অর্থনতির রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নেতিবাচক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কখনও ধনবন্টনে সাম্য আসে না, আসতে পারে না। ইসলামী সোনালী দিনেও মহান খলীফারা কঠোরভাবে তদারক করতেন ইসলামী বিধি-বিধানসমূহ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা। প্রকৃত অর্থেই তাঁরা আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন।
আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের জন্যে ইসলামে সম্পদ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনারও বিধান রয়েছে। যে সমস্ত সম্পদের সামাজিক মালিকানা থাকলে তার ব্যবহার সর্বোত্তম হবে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই তা থেকে সুবিধা বা উপকার পাবে সে সকল উপায়-উপকরণই রাষ্ট্রের জিম্মাদারীতে থাকতে পারে। ব্যক্তিবিশেষ ভুলভাবে এসবের মালিক হয়ে গেলেও রাষ্ট্র তা নিজের জিম্মাদারীতে ফিরিয়ে নিতে পারে। অনুরূপভাবে আবাদী জমি ইচ্ছাকৃত ভাবে পতিত রেখে জাতীয় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটালে রাষ্ট্র তাও বরদাশত করবে না। কেননা এর ফলে সমাজে খাদ্য সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব ঘটবে। এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইসলামের মহান খলীফারা (রা) প্রকৃত চাষীদের মধ্যে প্রচুর আবাযোগ্য অব্যবহৃত জমি বিলি কর দেন। তাছাড়া স্থায়ী সামজিক মূলধন উন্নয়নের মাধ্যমেম অর্থাৎ শিক্ষা স্বাস্থ্য যাতায়া গৃহায়ন প্রভৃতি সবিধার সম্প্রসারণ ও নিশ্চয়তা বিধান করেও ধনবন্টনে অধিকতর সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব। মহান খলীফা রা এবং মুসলিম শাসকগণ তা করেছেনও। এভাবেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার স্বর্ণযুগে আয় ও সম্পদের সঞ্চালন এবং বন্টন সুনিশ্চিত হয়েছে, দারিদ্র দূর হয়েছে সমাজ হতে। পরিণামে একটি কালজয়ী সমৃদ্ধ সভ্যতা হিসাবে ইসলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে।
মৌলিক চাহিদা পূরণ সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের অন্যতম উপায়। মৌলিক কপ্রয়োজন পূরণের পথ ধরেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিশেষতঃ দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে সম্পদ আবর্তিত হতে শুরু করে। ফলে চাহিদা বৃদ্ধি- উৎাদন ও যোগান বৃদ্ধি- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি- আয় বৃদ্ধি পুনরায় চাহিদা বৃদ্ধি িএকটি কাংখিত চক্র আবর্তিত হতে শুরু করে। পরিণামে অর্থনীতিতে েএকটি স্থিতিশীল তেজীভাব সৃষ্টি হয়। এ কারণেই ইসলাম জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের গ্যারান্টির বিষয়টি সরকারের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যে সরকারী তহবিল হতে ব্যয় সংকুলান না হলে যাকাত উশর ও বর্ধিত কর সংগ্রহ ছাড়াও সম্পদশালীদের নিকট হতে বাধ্যতামুলক অর্থ সংগ্রহের এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এভাবেই ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণে ব্যবহৃত হয়ে ধনবন্টনে ভারসাম্য অর্জিত হতে পারে।
উপরন্তু দরিদ্র শ্রেণীর আয়েল নিরাপত্তা ও ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে সরকারকে মজুরী ও দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমাজে বিরাজমান ধনবৈষম্য হ্রাসের জন্যে সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালাও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং, এই নীতিমালা দরিদ্র্রদের কল্যাণেরর স্বার্থেই প্রণীত হওয়া উচিৎ। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, সরকারের গৃহীত নীতিমালার সুবিধা ও প্রাপ্তির পাল্লা সাধারণতঃ বিত্তবানদের দিকেই ঝুঁকে থাকে। এছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী ও পারিষদবর্গ এবং উচ্চপদস্থ আমলারা সরকারী অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করে থাকে নিজেদের আরাম-আয়েসে, বিলাস-ব্যসনে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও কাগুজে পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ ইসলামী নীতি অনুসারে রাষ্ট্রীয় সম্পদে কারোরই, এমনকি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানেরও অন্যের চেয়ে বেশী অধিকার ভোগের সুযোগ নেই। বরং খলীফা উমার (রা)-এর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দূর পর্বতবাসী মেষ পালককেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে তার ন্যায্য অংশ আদায় করে দেওয়ার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকারেরই।
৭.
যে-কোন সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের করণীয় কি সে বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তার পরেও কথা থেকে যায়। ইসলামের গৌলবোজ্জল দিনগুলোতে মুসলিম সমাজে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম শিরকাত আল-মিলক ইজারা বিল-বায়ই ইত্যাদি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতিতে মুসলিম সমাজে বিত্তশারী ও বিত্তহীন কিন্তু কর্মদক্ষ মানুষ, অল্পবিত্ত ও অধিক বিত্তের মানুষ যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, যে কোন নতুন কর্মদ্যোগে অংশ নিতে পারে। দুঃখের বিষয়, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর হতে মুনাফাভিত্তিক এবং লাভ-লোকসানের অংশীদারীভিত্তিক কর্মসংস্থানের ও বিনিয়োগের পথ মুসলিম দেশগুলোতে ক্রমাবলুপ্ত হয়েছে। অথচ নবীমুস্তাফার (স) যামানা হতেই মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম ইত্যাদি পদ্ধতিতে সমাজের বিত্তশালী বা ধনবান ব্যক্তিরা যারা কম বিত্তশালী বা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক যোগ্যতা রাখে তাদের সাথে একত্রে উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশীদার হতেন। এছাড়াও বহুক্ষেত্রে করযে হাসানার মাধ্যমেও ব্যক্তিবিশেষের জরুরী প্রয়োজন পূরণের সুযোগ ইসলামী সমাজে বিদ্যমান ছিল। সেই করযে হাসানার নামই এখন অনেক মুসলমানের অজানা।
এই অবস্থা নিরসনের জন্যে তথা সুদভিত্তিক ঋণেল বিকল্প ব্যবস্থা চালু করে সমাজে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের মাধ্যমে আয় ও সম্পদের সুচারু বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম দেশে সাম্প্রতিককালে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি চালু হয়েছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম। এদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয় এবং জনগণের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পায়। বিগত বছরগুলোতে এই ব্যাংকিং পদ্ধতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। পৃথিভীর যেসব দেশে ইসলামী ব্যাংক ও বিনিয়েঅগ সংস্থঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসব দেশে এই পদ্ধতিতে কর্মসংস্থঞান, উৎপাদন ও বিনিয়োগ যে জনসাধারণেল মধ্যে বিপুল সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে তা বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিককালে বার্ষিক রিপোর্টসমূহ হতে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ মিশরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই মুসলিম দেশটির ইসলামী ব্যাংকগুলো একত্রে সেদেশের মোট বিনিয়োগ ও বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের এক-চতুর্থাংশ বা ২৫% নিয়ন্ত্রণ করছে। সুদের অভিশাপ মুক্ত হয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র সাধ্য ও সামর্থ্যকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগাবার জন্যে অধুনা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি যে সুযোগ করে দিয়েছে তার ফলে সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনে একটি লক্ষ্যণীয় সুপ্রভাত অনুভব করা যাচ্ছে।
৮.
ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনে ভারসাম্য অর্জনের জন্যে যে সব উপায় বা পদধতি আলোচিত হলো সে সব বাস্তবায়নের জন্যে যুগপৎ ব্যক্তি ও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাসহ তৎপর হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই উপার্জন ও সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হতে পারে; আয় ও কর্মসংস্থানের পথ সকলের জন্যে উন্মুক্ত হতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূর হয়ে একটি সমৃদ্ধ, গতিশীল ও সুস্থ অর্থনীতি বিনির্মাণের পথ সুগম হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানসমহের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস বাদ দিলে আজকের মুসলিম বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পর্যন্ত আলোচিত উপায়সমূহের কোন একটিও পুরোপুরি অনুসৃত হচ্ছে না। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্য বিদ্যমান। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করতে হবে শাশ্বত সুন্দর ও স্থায়ী সমাধানকারী ইসলামের দিকেই। ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সত্যিকার শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সেটাই প্রকৃষ্ট উপায়।
দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত
১. ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বারংবার নামায কায়েমের পরেই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বারংবার বলা হয়েছে- “সালাত কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো।” (দ্রষ্টব্য: সূরা আল-বাকারাহ: ৪৩, ৮৩, ১১০ ও ২৭৭ আয়াত; সূরা আন-নিসা ৭৭ ও ১৬২ আয়াত; সূরা আন নুর: ৫৬ আয়াত; সূরা আল-আহযাব ৩৩ আয়াত, সূরা মুয্যামম্মিল: ২০ আয়াত)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন- “তাদের অর্থসম্পদ থেকে যাকাত উসুল করো যা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” (সূরা আত্-তাওবা: ১০৩ আয়াত)
“মুশরিকদের জন্যে রযেছে ধ্বংস, তারা যাকাত দেয় না।” (সূরা হামীম: ৬-৭ আয়াত)
“আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমরা যে যাকাত দাও মূলতঃ তা যাকাত দানকারীরই সম্পদ বৃদ্ধি করে।” (সূরা আররুম: ৩৯ আয়াত)
রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন- “তোমাদের সম্পদে যাকাত পরিশোধ করো।” (তিরমিযী, হিদায়া)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যাকাদের বিধি-নির্দেশ শুধু উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপরই নাযিল হয় নি, অতীত কালে অন্যান্য নবীদের উম্মতের উপরেও এই হুকুম ছিল আল্লাহর পক্ষ হতেই। হযরত ইসমাঈল (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) সময়েও যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। (সূরা মরিয়ম: ৩১ ও ৫ আয়াত এবং সূরা আল আম্বিয়া: ৭৩ আয়াত)।
কেন যাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় যাকাত সম্পদ বন্টনের তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্যে যাকাত অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। কিন্তু যাকাত কোন স্বেচ্ছাসেবক দান নয় বরং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্যে আল্লাহ নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অল্থ-সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ। যাকাতের সংগে প্রচলিত অন্যান্য সকল ধ রনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয ও সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু করের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নেই।
যাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রথমতঃ কর হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে প্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যার করদাতা কোন প্রত্যক্ষ উপকার প্রত্যাশা করতে পারে না। সরকারও করের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দরিদ্র ও অবাবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যয়ের জন্যে বাধ্য থাকে না। পক্ষান্তরে যাকাতের অর্থ অবশ্যই আল-কুরআনে নির্দেশিত নির্ধারিত লোকদের মধ্যেই মাত্র বিলি-বন্টন করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যাকাতের অর্থ রাষ্ট্রীয় সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু করের অর্থ যেকোন কাজে ব্যয়ের ক্ষমতা ও পূর্ণ স্বাধীনতা সরকারের রয়েছে।
তৃতীয়তঃ যাকাত শুধুমাত্র সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্যেই বাধ্যতামূরক। কিন্তু কর, বিশেষতঃ পরোক্ষ কর, সর্বসাধারণের উপর আরোপিত হয়ে থাকে। অধিকন্তু প্রত্যক্ষ করেরও বিরাট অংশ জনসাধারণের উপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
চতুর্থতঃ যাকাতের হার পূর্ব নির্ধারিত ও স্থির। কিন্তু করের হার কোনক্রমেই স্থির নয়। যেকোন সময়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী করের হার ও করযোগ্য বস্তু সামগ্রীর পরিবর্তন হয়ে থাকে। সুতরাং, যাকাতকে প্রচলিত অর্থে সাধারণ কর হিসেবে যেমন কোক্রমেই গণ্য করা যায় না। তেমনি তার সঙ্গে তুলনীয়ও হতে পারে না।
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তা বুঝতে হলে ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) সময়ের ঘটনা জানতে হবে। তিনি খলিফা হওয়ার পর পরই কিছু ভণ্ড নবীর প্ররোচনায় কয়েকটি গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। খলীফার নিকট তারা যাকাত প্রদান হতে অব্যাহতি চাইল। হযরত আবু বকর (রা) তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেণ- “যদি কারো কাছে উট বাধার রশি পরিমানও যাকাত প্রাপ্য হয় আর সে তা দিতে অস্বীকার করে তবে তার বিরুদ্ধেই আমি জিহাদ ঘোষণা করব।” ইতিহাস সাক্ষী, তিনি তা করেছিলেনও। এরই ফলশ্রুতিতে খলীফা উমর ইবন আব্দুল আযীযের সময়ে জাযিরাতুল আরবে যাকাত গ্রহণের সন্ধান পাওয়া ছিল দুর্ভল। সেই যাকাত মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আজ শুধু প্রথা হিসেবে চালু রয়েছে। সেজন্যেই মুসলিম বিশ্বের দুঃস্থ অভাবী ও নিঃস্ব লোকের সংখ্যা ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাকাতরে অর্থ ব্যয়ের বিদ্যমান প্রথায না সমাজের প্রকৃত কল্যাণ হচ্ছে, না অভাবী ও দরিদ্র জনগণের সমস্যার স্থায়ী সুরাহা হচ্ছে।
২. যাকাতের খাত ও হকদার
ইসলাম শরীয়হা অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর যাকাত দিতে হবে সেগুলো হলো-
ক) সঞ্চিত বা জমাকৃত অর্থ,
খ) সোনা, রূপা সোনা-রূপা দ্বারা তৈরী অলংকার,
গ) ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী,
ঘ) কৃষি উৎপন্ন,
ঙ) খনিজ উৎপাদন, এবং
চ) সব ধরনের গবাদি পশু
উপরোক্ত দ্রব্য সামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যখন কোন মুসলমান অর্জন করে তখন তাকে যাকাত দিতে হয়। এই পরিমাণকে ‘নিসাব’ বলে। নিসাবের সীমা বা পরিমাণ দ্রব্য হতে দ্রব্যের ভিন্নতর। একইভাবে যাকাতের হারও দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। যাকাতের সর্বনিম্ন হার শতকরা ২.৫% হতে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০.০%।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে যাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে আল-কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-
“দান খয়রাত তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন সত্যের প্রতি সম্প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাতর পথে (মুজাহিদদের জন্যে) এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরয এবং আল্লাহ সব জানেন ও সব বুঝেন।” (সূরা আত্-তাওবা: ৬০ আয়াত)
উপরের আয়াত হতে সুস্পষ্টভাবে আট শ্রেণীর লোকের জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে নির্দেশ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে:
(ক) দরিদ্র জনসাধারণ (ফকীর),
(খ) অভাবী ব্যক্তি (মিসকীন),
(গ) যাকাত আদায়ে নিযুক্ত ব্যক্তি,
(ঘ) মন জয় করার জন্যে,
(ঙ) ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি,
(চ) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি,
(ছ) আল্লাহর পথে, এবং
(জ) মুসাফির।
এই আটটি খাতের মধ্যে ছয়টিই দারিদ্রের সংগে সম্পৃক্ত। অন্য দুটি খাতও (গ ও ছ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকাত আদায় ও এর বিলিবন্টন এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এটাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। সুতরাং, তাদের বেতনও এই উৎস হতেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রসঙ্গতঃ যাদেরকে যাকাতের অর্থ-সম্পদ দেওয়া যাবে না তাদের কথাও জেনে রাখা ভাল। এদের মধ্যে রয়েছে (১) নিসাবের অধিবারী ব্যক্তি, (২) স্বামী-স্ত্রী, (৩) পুত্র-কন্যা ও তাদের সন্তান-সন্ততি, (৪) মাতা-পিতা ও তাদের উর্দ্ধতন পুরুষ, (৫)বনি হাশেমের লোকজন, (৬) উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, (৭) যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে (৮) অমুসলিম।
৩. যাকাতের নিসাব
যাকাতের নিসাব সম্পর্কেও অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। সেজন্যে সংক্ষেপে যেসব পণ্য ও সম্পদের যাকাত আদায় করার শরয়ী হুকুম রয়েছে সেসব নিসাব যাকাতের হারসহ এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ সোনা বা এর তৈরী অলংকার অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি পরিমাণ রূপা. বা তার তৈরী অলংকার অথবা সোনা-রূপা উভয়ই থাকলে উভয়ের মোট মূল্য ৫২.৫ ভরি রূপার সমান হলে তার বাজার মূল্যের উপর ১/৪০ অংশ বা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
২. হাতে নগদ ও ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের পরিমান ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যেল সমান হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
৩. ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত প্রদেয়।
৪. গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে প্রথম ৩০টির জন্যে ১ বছর বয়সী ১টা বাছুর দিতে হবে এবং উর্দ্ধের হার ভিন্ন।
৫. ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রথম ৪০টির জন্যে ১টা এবং পরবর্তী ১২০টির জন্যে ২টা ছাগল/ভেড়ার যাকাত দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: বুখারী শরীফ, যাকাত অধ্যায়]
যাকাত প্রদানের জন্যে ফল-ফসলাদি, খনিজ সম্পদ, গুপ্তধন, মধু এবং বাণিজ্যিক খামারের মাছের ক্ষেত্রে বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত প্রযোজ্য নয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য উট ও ঘোড়া পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে। খনিজ সম্পদেরও যাকাত প্রদেয। তবে বর্তমান সকল দেশেই খনিজ সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকার কারণে তার বিধান উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
যেসব সামগ্রী বা সম্পদের যাকাত দিতে হবে না সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। এসবের মধ্যে রয়েছে: (১) নিসাব অপেক্ষা কম পরিমণ অর্থ-সম্পদ, (২) নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ (৩) ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস, দোকান-পাট ও কল-কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, (৪) ব্যবহার্য সামগ্রী (কাপড়-চোপড়, আসবাপত্র, গৃহস্থালীর তৈজসপত্র, বই-পত্র, (৫) যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম, (৬) শিক্ষার সমুদয় উপকরণ, (৭) ব্যবহার্য যানবাহন (৮) পোষা পাখী ও হাঁস-মুরগী, (৯) ব্যবহারের পশু (ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, উট) ও যানবাহন এবং (১০) ওয়াক্ফকৃত সম্পত্তি।
৪. উশরের বিধান
ধনসম্পদ গবাদিপশু, স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার, ব্যবসায়িক পণ্য ও খনিজ সামগ্রীর উপর যেমন যাকাত আদায় ফরয তেমনি ফসলের উপর উশর আদায়ও ফরয। আল্-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
“তোমরা এগুলোর ফল ও ফসল খাও যখন ফল ধরে এবং আল্লাহর হক আদায় করো ফসল কাটার (বা আহরণ) করার দিন।” (সূরা আল-আনআম: ১৪১ আয়াত)
“তোমাদের জন্যে জমি থেকে যা কিভু বের করেছি তা থেকে খরচ করো (আল্লাহর পথে)”। (সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৭ আয়াত)
তাফ্সীরকারীদের মতে আল্লাহর এই নির্দেশ অলংঘনীয়। তাফসীরে তাবারী অনুযায়ী এটা আল্লাহর নির্দেশ... ফল বা শস্রের ফরয যাকাত আদায় কতেই হবে। তাফসীরে কাশশাফ অনুসারে এই আয়াতে উল্লেখিত ‘হক’ শব্দ দ্বারা কৃষিজাত ফসলের উপর ফরয যাকাতকেই বোঝানো হয়েছে।
উশরের বিধান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেন-
“যে সব জমি বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয় তাতে উশর (বা দশ ভাগের একভাগ) আর যেসব জমি সেচের সাহায্যে সিক্ত হয় তাতে নিসফ উশর (বা বিশ ভাগের একভাগ) আদায় করতে হবে।” (বুখারী, আবু দাউদ)।
সুতরাং, জমিতে ফল-ফসল উৎপন্ন হলে সেচ বা অসেচ জমিভিত্তিতে উৎপন্ন ফসলের ১০% বা ৫% যাকাত আদায় করা মুমিন মুসলমান নর-নারীর শরয়ী দায়িত্ব। যাকাতের অর্থ সম্পদ ব্যয়ের জন্যে যে আটটি খাত নির্ধারিত, উশরের ক্ষেত্রেও সেই খাতগুরো নির্ধারিত। অবশ্য যাকাতের সঙ্গে উশরের বেশ কিছু পার্থক্য বা বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। িএসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে:
১. উশর আদায়ের জন্যে ফসলের িএক বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। বরং প্রতি বছর প্রতিবার উৎপন্ন ফসলেরই উশর আদায় করতে হবে।
২. উশর আদায়ের জন্যে ঋণমুক্ত হওয়া শর্ত নয়।
৩. নাবালক ও পাগলের জমির ফসলেও উশর আদায় করতে হবে।
৪. উশর আদায়ের জন্যে জমির মালিক হওয়াও শর্ত নয়।
ফল ও ফসলের ক্ষেত্রে নিসাবের পরিমাণ হলো পাঁচ ওয়াসাক। অর্থাৎ, পাঁচ ওয়াসাক পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে উশর (বা উশরের অর্ধেক) আদায় করতে হবে। ওয়াসাকের দুটি মাপ রয়েছে- একটি ইরাকী, অপরটি হিজাযী। ইরাকী মাপ অনুসারে পাঁও ওয়াসাকের পরিমাণ ৯৮৮.৮ কেজি এবং হিজাযী মাপ অনুসারে পরিমাণ ৬৫৩.০ কেজি। এই উপমহাদেশের ওলামা-মাশায়েখগণ ইরাকী মাপটি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলেই উশর দিতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফার মতে কৃষি ফসল ও ফলে কোন নিসাব নেই। যা উৎপন্ন হবে তার উপরই উশর বা অর্ধেক উশর ধার্য হবে। (মুহাম্মাদ রুহুল আমীন-ইসলামের দৃষ্টিতে উশর: বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে: ১৯৯৯, পৃ:৩৩)
৫. যাকাত উসুল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
যাকাত উসুল ও তার বিলি-বন্টন ব্যক্তির খেয়াল খুশীর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে এর আদায় ও বন্টনের হুকুম দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলকে (স) নির্দেশ দিচ্ছেন-
“তাদের অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করো যা তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” (সূরা আত্-তাওবা: ১০৩)
আল-কুরআনে আল্লাহ আরও বলেছেন-
“আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে।... আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভাল কাজ করার, নামাজ কায়েম করার ও যাকাত আদায় করার আদেশ দিয়েছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৩)
“তারা এমন লোক যদি তাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করি তাহলে তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে।” (সূরা হজ্ব: ৪১)
উপরের আয়াতগুলো হতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে আল্লাহর অভিপ্রায়ই হলো রাষ্ট্রই যাকাত আদায় করবে এবং তা যাকাতের হকদারদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছেও দেবে। আল্লাহ যাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান করেছেন, মানুষের নেতা বানিয়েছেন অন্যান্য কাজের মধ্যে তাদের অন্যতম অপরিহার্য দায়িত্ব হলো যাকাত আদায় করা ও আদায়কৃত যাকাত তার হকদারদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। এজন্যেই রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশিদূনের (রা) সময়ে যাকাতের অর্থ, সামগ্রী ও গবাদি পশু সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্যে আট শ্রেণীর লোক নিযুক্ত ছিল এরা হলো:
ক) সায়ী= গবাদি পশুর যাকাত সংগ্রাহক
খ) কাতিব= যাকাতের খাতাপত্র লেখার করণিক,
গ) ক্বাসাম- যাকাত বন্টনকারী,
ঘ) আশির- যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী;
ঙ) আরিফ- যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী,
চ) হাসিব- যাকাতের হিসাব রক্ষক,
ছ) হাফিজ- যাকাতের অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষক,
জ) ক্বায়াল- যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়কারী ও ওজনকারী।
[দ্রষ্টব্যঃ এস. এ. সিদ্দকী (১৯৬২) পাবলিক ফিন্যান্স ইন ইসলাম, পৃ. ১৬০]
আমাদের বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে আজকের যুগেও কর আদায়ের জন্যে এত বিভিন্ন পদের লোক নিযুক্ত হয় না, অথচ প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে যাকাত আদায় ও তার বিলি-বন্টনের জন্যে কত নিখুঁত ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল।
এভাবেই তখন ধনীদের সম্পদের একাংশ গরীব ও অভাবীদের হাতে পৌঁছতো, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে খরচ হতো, মুসাফিরে কষ্ট লাঘব হতো। উপরন্তু ব্যক্তির খেয়াল খুশীর উপর উসুল নির্ভরশীল না থাকায় আদায়কৃত যাকাতরে পরিমাণ হবে যেমন বিপুল তেমনি তার দারদ্র্য বিমোচন ও মানব কল্যাণের ক্ষমতাও ছিল বিপুল। কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ পালিত না হওয়ায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের জনসাধারণ আজ দারিদ্র্যপীড়িত এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ দুরবস্থার শিকার।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি