৩ : আন্তরিক মনোনিবেশ
কুরআন তিলাওয়াত, অধ্যয়নে আপনাকে আপনার গোটা দেহ ও মন নিয়ে পুরোপুরিভাবে জড়িত হতে হবে। কেবলমাত্র এভাবেই আপনি আপনার সত্তাকে উন্নীত করতে পারেন কুরআনের কাংখিত স্তরে, যেখানে পৌঁছলে আপয়াঙ্কে সত্যিকারের বিশ্বাসী বলে অভিহিত করা হবে।

আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা তার প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে। তার প্রতি যারা কুফরী করে, মূলতঃ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (আল-বাকারা-২ : ১২১)

হৃদয় কি?

আপনার ব্যাক্তিসত্তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আপনার অন্তরাত্মা। এই অন্তরাত্মাকেই কুরআন বলেছে ‘কল্‌ব’ বা হৃদয়। রাসূল (সা)-এর হৃদয়ই হচ্ছে কুরআনের বাণির প্রথম গ্রহীতা।

এটি হচ্ছে রাব্বুল আলামীনের করা জিনিস। একে নিয়ে তোমার দিলে আমানতদার ‘রূহ’অবতরণ করেছে, যেন তুমি সেই লোকদের মধ্যে শামিল হতে পার যারা (আল্লাহর তরফ হতে সব লোকের জন্য) সাবধানকারী।(শুয়ারা-২৬ : ১৯২-৪)

সুতরাং তখনই আপনি কুরআন পাঠের পুরো আনন্দ ও আশীর্বাদ ভোগ করতে পারেন, যখন আপনি আপনার দিলকে পরিপূর্ণরূপে এ কাজে নিয়োজিত করতে পারেন।

‘হৃদয়’ কুরআনের পরিভাষায় আপনার দেহের মাত্র একটি মাংসপিন্ড নয়। বরং হৃদয় হচ্ছে আপনার যাবতীয় আবেগ, অনুভূতি, উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা, স্মৃতি ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু।

এ হচ্ছে সেই হৃদয় যা বিচলিত হয় (আয-যুমার-৩৯ : ২৩), অথবা কঠিন এবং শক্ত হয় (আল-বাকারা-২ : ৭৪), যা অন্ধ হয় এবগ্ন সত্য প্রত্যাখ্যান করে (আল-হাজ্জ-২২ : ৪৬), এ সক্রিয় হয় যুক্তি এবং উপলব্ধির কাছে (আল-আরাফ-৭ : ১৭৯, আল-হাজ্জ-২২ : ৪৬, কাফ ৫০ : ৩৭)। এই হৃদয়ই হচ্ছে সমস্ত প্রকার ব্যাধির উৎস (আল-মায়িদা-৫ : ৩২), এ হচ্ছে সমস্ত অভ্যন্তরীন ব্যাধির আশ্রয়স্থল (আল-বাকারা-২ : ১০), হৃদয় হচ্ছে সকল ঈমান এবং মুনাফিকীর আবাসস্থল (আল-মায়িদা-৫ : ৪১, তওবা-৯ : ৭৭), হৃদয় হচ্ছে সকল ভালো ও মন্দের কেন্দ্রস্থল, সেটা তৃপ্তিই হোক আর প্রশান্তিই হোক (আর-রাদ-১৩ : ২৮), যন্ত্রণা মোকাবিলায় শক্তিই হোক (তাগাবুন-৬৪ : ১১), আর ক্ষমা (আল-হাদীদ-৫৭ : ২৭), ভ্রাতৃসুলভ ভালবাসা (আল-আনফাল-৮ : ৬৩), তাকওয়া হোক (আল-হুজুরাত-৪৯ : ৩, আল-হাজ্জ-২২ : ৩২), অথবা সন্দেহ ও দোদুল্যমানতা (তওবা-৯ : ৪৫), অনুতাপ (আলে-ইমরান-৩ : ১৫৬) ও ক্রোধই হোক (তওবা-৯ : ১৫)।

চূড়ান্তভাবে বাস্তবে হৃদয়ের আচরণের জন্যই আমাদেরকে জবাব্দিহি করতে হবে এবং একমাত্র সে ব্যাক্তিই রক্ষা পাবে, যে তার প্রভুর সামনে একটি সুস্থ হৃদয় নিয়ে হাযির হতে পারবে।

যেসব প্রতিজ্ঞা তোমরা বিনা ইচ্ছায়ই করে ফেল, সেজন্য আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দান করবেন না। কিন্তু যেসব প্রতিজ্ঞা তোমরা আন্তরিকতার সাথে করে থাক, সে সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করবেন (আল-বাকারা-২ : ২২৫)। সেই দিন না ধন-সম্পদ কোন কাজে আসবে, না সন্তান-সন্ততি। কেবল সেই ব্যাক্তি উপকৃত হবে, যে প্রশান্ত অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হবে।(আশ-শূরা-২৬ : ৮৮-৮৯)

অতএব আপনাকে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, যতক্ষণ আপনি কুরআনের সাথে আছেন আপনার হৃদয় আপনার সাথে আছে, কোন মাংস্পিন্ড নয় বরং কুরআন যাকে বলেছে ‘কল্‌ব’।

এটা কঠিন বলে প্রতীয়মান হবে না যদি কিছু ব্যাপারে আপনি সচেতন হন এবং হৃদয় ও দেহের কতিপয় ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। ইতিপূর্বে বর্ণিত সাতটি পূর্বশর্ত কুরআন অধ্যয়নে আপনার হৃদয়ে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণের ভিত্তি রচনা করে। এর সাথে আরও কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আপনার হৃদয়কে অধিকতর গভীরভাবে এবং ব্যাপকভাবে এ কাজে নিয়োজিত করা সম্ভব হবে।

আন্তরিক মনোনিবেশের গতিশীলতা

আন্তরিক মনোনিবেশের গতিশীলতা আপনাকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। আপনার অন্তরে সত্যের কতটুকু দখল আছে? প্রথমে আপনি জানুন। দ্বিতীয়ত, সত্যকে সত্য হিসেবে স্বীকৃতি দিন এওবং গ্রহণ করুন আপনার জীবনের মত। তীইতীয়ত, সত্যকে স্মরণ করুন যতবার আপনি পারেন। চতুর্থত, আপনি এটা আত্মস্থ করুন যতক্ষণ তা আপনার অন্তরের গভীরতম কোণকে সিক্ত না করে। এইভাবে সত্য আপনার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করলে তা অবশ্যই কথা এবং কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে।

এখানে এটা মনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, যা আপনি জিহবা ও অংগপ্রত্যংগ দ্বারা বাহ্যিকভাবে করেন, তা আপনার অভ্যন্তরীণ কর্মেরই প্রতিক্রিয়া। এটা সম্ভব যে, কথা ও কাজ অভ্যন্তরীণ অবস্থার মিথ্যা সাক্ষ্য হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসের মত একটি অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রকাশ নিশ্চিতভাবেই কথা ও কাজের মধ্যে প্রকাশ পাবে, যা পর্যায়ক্রমে আপনার বিবেকে জ্ঞানছাপ দিতে সাহায্য করবে এবং এটাকে একটি স্থায়ী শর্তে পরিণত করবে।

এখানে যেসব পরামর্শ দেয়া হলো, তা কর্যকর হবে যদি আপনি উপরে আলোচিত গতিশীলতা সম্পর্কে মনোযোগী হন এবং উল্লিখিত মূলনীতিসমূহ অনুসরণ করেন।

সচেতনতার অবস্থা

সচেতনতার সাতটি অবস্থা রয়েছে। কিছু বিষয় স্মরণ রেখে আত্মস্থ করে এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আপনাকে চেষ্টা চালাতে হবে।

আন্তরিক অংশগ্রহণের কুরআনিক মানদন্ড

প্রথমতঃ নিজেকেই বলুন, আমার কুরআন পাঠ সত্যিকারের তিলাওয়াত হবে না যতক্ষণ আমার অন্তরাত্মা আল্লাহ্‌ যেভাবে চান সেভাবে এতে মনোনিবেশ না করছে। আল্লাহ কি চান? কিভাবে কুরআনকে আপনার গ্রহণ করা উচিৎ? কুরআন নিজেই অনেক জায়গায় আপনাকে বিস্তারিতভাবে জানিয়েছে কিভাবে আল্লাহ্‌র নবী (সা), তাঁর সাহাবাগণ এবং ঐ সব ব্যাক্তি যাদের হৃদয় কুরআন দ্বারা সিক্ত ছিল, কুরআনকে গ্রহণ করেছিলেন। কুরআনের এই ধরনের আয়াতগুলো আপনার স্মরণ করা উচিৎ এবং অতঃপর আপনি যখন কুরআন তিলাওয়াত করেন, তখন আপনার উপর ঐ সব আয়াতের প্রতিফলন হওয়া উচিৎ। ঐ সব আয়াতের কথাগুলো হলোঃ

প্রকৃত ঈমানদার তো তারাই, যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণকালে কেঁপে ওঠে। আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের আল্লাহর উপর আস্থা ও নির্ভরতা রাখে। (আল-আনফাল-৮ : ২) আল্লাহ অতি উত্তম কালাম নাযিল করেছেন। এটি এমন এক কিতাব যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যাতে বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তা শুনে তাদের গায়ে লোমহর্ষণ দেখা দেয়। যারা নিজেদের আল্লাহকে ভয় করে। পরে তাদের দেহ ও তাদের দিল নরম হয়ে আল্লাহ্‌র স্ম্রণে উৎসাহী ও উৎসুক হয়ে ওঠে। এটি আল্লাহর হিদায়াত, এর দ্বারা তিনি হিদায়াতের পথে নিয়ে আসেন যাকে তিনি চান। আর আল্লাহই যাকে হিদায়াত না করেন, তার জন্য হিদায়াতকারী কেউ নেই। (যুমার-৩৯ : ২৩)

হে মুহাম্মদ, এই লোকদেরকে বল যে, তোমরা একে মেনে নাও বা না মান যেসব লোককে ইতিপূর্বে ইল্‌ম দেয়া হয়েছে, তাদেরকে যখন এটি শুনানো হয়, তখন তারা নতমুখে সিজদায় পরে যায়। আর এই বলে চিৎকার করে ওঠে, “পবিত্র আমাদের আল্লাহ্‌, তাঁর ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে।”আর তারা কাঁদতে কাঁদতে নতমুখে পরে যায়, আর তা শুনতে পাওয়ায় তাদের নিবিড় আনুগত্য আরও বৃদ্ধি পায়। (আলে-ইমরান-১৭ : ১০৭-১০৯)

তাদের অবস্থা এই ছিল যে, পরম করুণাময়ের আয়াত যখন তাদের শুনানো হতো, তখন কাঁদতে কাঁদতে তারা সিজদায় পরে যেত। (মরিয়ম-১৯ : ৫৮)

যখন তারা রাসূলের প্রতি অবতীর্ণ বাণী শুনতে পায়, তখন তোমরা দেখতে পাও যে, সত্যকে জানা ও চেনার প্রভাবে তাদের চক্ষুসমূহ পশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে যায়। তারা বলে ওঠে, হে আমাদের প্রভু, আমরা ঈমান এনেছি, আমাদের নাম সাক্ষীদাতাদের সঙ্গে লিখে নাও। (আল-মায়িদা-৫ : ৮৩)

আল্লাহর উপস্থিতি

দ্বিতীয়তঃ নিজেকে বলুন, আমি আল্লাহর সামনে হাযির,আল্লাহ্‌র উপস্থিতির মধ্যে। তিনি আমাকে দেখছেন।

এ বাস্তবতার প্রতি আপনাকে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে যে, যখনই আপনি কুরআন অধ্যয়ন করছেন, তখন তাঁর উপস্থিতির মধ্যেই রয়েছেন, যিনি ঐ বাণী আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। কেননা আল্লাহ সর্বাবস্থায় আপনার সাথেই আছেন, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, যাই করুন না কেন, তাঁর জ্ঞান সর্বব্যাপী।

এই পর্যায়ের সচেতনতা কিভাবে অর্জন করা যায়? এ সম্পর্কে আল্লাহ্‌ কুরআনে কি বলেছেন শুনুন। কুরআন অধ্যয়নের শুরুতে ও অধ্যয়নকালে ঐ সব আয়াত স্ম্রণ করুন, মনোযোগী হন এবং গভীরভাবে বিবেচনা করুন। শুধুমাত্র কুরআন অধ্যয়নে নয়, বরং সারা জীবন কুরআন অনুযায়ী অতিবাহিত করতে আরও বেশী যা সাহায্য করতে পারে তা হলো এ বাস্তবতাকে স্মরণ করা এবং গভীরভাবে বিবেচনা করা, যতটা বেশী বেশী পারা যায়। একাকী অথবা সমষ্টিগতভাবে, নীরবে অথবা সরবে ঘরে অথবা কার্যক্ষেত্রে, বিশ্রামে অথবা ব্যাস্ততায় বলুন, মনে মনে অথবা উচ্চস্বরে- তিনি এখানে, তিনি আমার সাথে, তিনি দেখছেন, শুনছেন, জানছেন এবং হিসাব রাখছেন। আর এই আয়াতসমূহ স্মরণ করুনঃ

তিনি তোমাদের সংগে আছেন, যেখানেই তোমরা থাক, যে কাজই তোমরা কর তা তিনি দেখছেন। (আল-হাদীদ-৫৭ : ৪)

আমরা তার গলার শিরা থেকেও অধিক নিকটবর্তী। (কাফ-৫০ : ১৬)

এমন কখনও হয় না যে, তিনজন লোকের মধ্যে কান-পরামর্শ হবে এবং তাদের মধ্যে আল্লাহ্‌ চতুর্থ হবেন না, কিংবা পাঁচজনের কান-পরামর্শ হবে আর আল্লাহ তাদের মধ্যে শষ্ঠ হবেন না। গোপন পরামর্শকারীরা এর কম হোক কি বেশী যেখানেই তারা হবে, আল্লাহ্‌ অবশ্যই তাদের সংগে থাকবেন। (আল-মুজাদালা-৫৮ : ৭)

আমি তোমাদের দু’জনের (মূসা ও হারূন) সংগে আছি, সবকিছুই শুনছি এবং দেখছি। (তাহা-২০: ৪৬)

নিঃসন্দেহে তুমি আমাদের দৃষ্টিপথে রয়েছ। (তূর-৫২ : ৪৮)

আমরা নিশ্চিতই একদিন মৃতদের জীবিত করবো, তারা যেসব কাজ করছে তার সবই আমারা লিখে যাচ্ছি। আর যা কিছু নিদর্শন তারা পিছনে রেখে যাচ্ছে, তাও আমরা সুরক্ষিত করে রাখছি। প্রত্যেকটি জিনিসই আমরা একটি উন্মুক্ত কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখছি।(ইয়াসীন-৩৬ : ১২)

আরও তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে নিম্নোকত আয়াত। এ আয়াতে শুধু জোর দিয়ে এ কথাই বলা হয়নি যে, আল্লাহ সর্বত্র হাযির থাকেন, সবকিছু দেখেন, বুরং কুরআন অধ্যয়ন সম্পর্কেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

তুমি যে অবস্থায়ই থাক না কেন এবং কুরআন থেকে যা কিছু শোনাও আর হে লোকেরা, তোমাওরা যা কিছু কর- এই সব অবস্তাহতেই আমরা তোমাদের দেখতে ও লক্ষ্য করতে থাকি। আসমান-যমীনে একবিন্দু পরিমাণ জিনিস এমন নাই- না ছোট, না বড়- যা তোমার আল্লাহর দৃষ্টি হতে লুকিয়ে রয়েছে এবং এক পরিচ্ছন্ন খাতায় লিপিবদ্ধ নয়।(ইউনুস-১০ : ৬১)

সুতরাং আল্লাহ্‌ নিজে আমাদেরকে বলছেন- আমি উপস্থিত থাকি যখন তোমরা কুরআন পাঠ কর, কখনো একতা ভুলবে না।

কুরআন তিলাওয়াত করা হচ্ছে একটি ইবাদত। সর্বোচ্চ উৎকর্ষ লাভের উপায়ই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা। এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা)বলেনঃ

আল্লাহর ইবাদত যেন তুমি আল্লাহকে দর্শন করছ, যদিও তোমার চোখ আল্লাহকে দেখতে পায় না, তুমি দেখতে পাও না যে, তিনি তোমাকে দেখছেন (মুসলিম)।

উপরন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, কেবলমাত্র তুমিই তাঁর উপস্থিতির মধ্যে নও, তিনি তোমাকে স্মরণ করেন যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকো।

আমাকে স্মরণ করো- আমি তোমাকে স্মরণ করবো। (আল-বাকারা-২ : ১৫২)

নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণ যা যিকরের সর্বোত্তম পথা হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা।

আল্লাহর নিকট থেকে শ্রবণ করা

তৃতীয়তঃ নিজেকে বলুন, আমি আল্লাহর নিকট থেকে শ্রবণ করছি।

আপনার অন্তরাত্মাকে কুরআন অধ্যয়নে নিয়োজিত করার অংশ হিসেবে আপনার এটা ভাবতে চেষ্টা করা উচিৎ যেন কুরআন আপনি শুনছেন আল্লাহর নিকট থেকে। কুরআন হচ্ছে মহান আল্লাহ পাকের অভিভাষণ। কেননা আপনি তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না যখন তিনি আপনার সাথেই রয়েছেন, আপনি তাঁর কথাও শুনতে পাচ্ছেন না যিনি এ ভাষণ দিয়েছেন। ছাপার অক্ষরের কথাগুলো এবং তিলাওয়াতকারীর কন্ঠস্বর অপসৃত হতে দিন এবং বক্তার আরও নিকটবর্তী হন। এই অনুভূতি আপনার মধ্যে আল্লাহর উপস্থিতির চেতনাকে আরও মযবুত ও শোক্তিশালী করবে।

ইমাম গাযযালী (রহ) তাঁর গ্রন্থ ইহ্‌ইয়িয়ায়ে উলুমিদ্দীন- এ এক ব্যাক্তি সম্পর্কে বলেন, আমি কুরআন পাঠ করি কিন্তু এতে কোন মজা পাই না। এরপর আমি এমনভাবে পড়ি যেন আমি নবী (সা)-এর নিকট থেকে শুনছি- যখন তিনি তাঁর সাহাবাদের তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছিলেন। অতঃপর আমি একধাপ অগ্রসর হলাম এবং কুরআন এমনভাবে পড়লাম যেন জিবরাঈল (আ)-এর নিকট থেকে শুনছি-যখন তিনি মুহাম্মাদ(সা)-এর নিকট পৌঁছাচ্ছিলেন। পুনরায় আমি আল্লাহর মেহেরবানীতে আরও একধাপ অগরসর হয়ে এমনভাবে পড়তে শুরু করলাম যেন আমি মহান আল্লাহর নিকট থেকেই তা শ্রবণ করছি।

এই ধরনের উপলদ্ধি আপনাকে সিক্ত করবে আনন্দ ও তৃপ্তিতে, যা আপনার অন্তরাত্মাকে আচ্ছাদিত করবে কুরআন দিয়ে।

আল্লার সরাসরি ভাষণ

চতুর্থঃ নিজেকে বলুন, যখন আমি কুরআন পড়ি, আল্লাহ বাণীবাহকের মাধ্যমে সরাসরি আমাকে বলছেন।

নিঃসন্দেহে ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ে কুরআন নাযিল করা হয় এবং এটি আপনি পরোক্ষভাবে বিশেষ সময়ের ব্যক্তি থেকে পেয়েছেন। কিন্তু কুরআন হচ্ছে চিরঞ্জীব আল্লাহর বাণী। এটা সর্বকালের জন্য। এর আবেদন প্রতিটি মানুষের কাছে। অতএব এসব মধ্যবর্তীদের কিছু সময়ের জন্য বাদ দিয়ে নিজেই কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করুন এমনভাবে যেন কুরআন সরাসরি আপনার সাথে কথা বলছে আপনার কালের একজন ব্যক্তি হিসেবে বা একটি সমষ্টির সদস্য হিসেবে।এভাবে সরাসরি কুরআন গ্রহণের কথা চিন্তায়ই আপনার হৃদয় জুড়ে কুরআনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রতিটি শব্দ আপনার জন্য

পঞ্চমঃ বলুন, কুরআনের প্রতিটি শব্দ আমার জন্য।

কুরআন যদি অনন্তকালের জন্য সিদ্ধ হয় এবং যদি আজকের দিনে আপনার প্রতি লক্ষ্য করে কথা বলে আপনাদের এর প্রতিটি বাণীকে এভাবেই নিতে হবে যে, তা আপনার জীবনের সাথে সম্পর্কিত – চাই সেটা কোন মূল্যবোধ বা নীতির কথাই হোক, অথবা জ্ঞানের কোন বিবৃতি হোক, কোন চরিত্র বা সংলাপ, প্রতিশ্রুতি বা সতর্কতা, আদেশ বা নিষেধই হোক।

বিষয়টির এমন উপলব্ধি আপনার কুরআন অধ্যায়নকে জীবন্ত, গতিশীল অর্থবহ করে তুলবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যেহেতু ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে, তাই একজনকে উদ্দেশ্য করে প্রদত্ত পয়গাম অন্য জনের জন্য রূপান্তরিত করতে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে আন্তরিক ও সঠিক প্রচেষ্টা চালালে এটা সম্ভব।

আল্লাহর সাথে আলাপ

ষষ্ঠঃ নিজেকেই বলুন, আমি যখন কুরআন পড়ছি, তখন আল্লাহর সাথেই কথা বলছি।

কুরআনে রয়েছে, আল্লাহর কথা আপনার উদ্দেশ্যে, আপনার জন্য নিবেদিত। যদিও বা ঐসব শব্দ আপনাদের ঠোঁটে এবং আপনাদের হৃদয়ে অংকিত রয়েছে, তথাপি ঐটি হচ্ছে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার সংলাপ। এ সংলাপ অনেক রূপ নিতে পারে। এটা সুস্পষ্টভাবেও বর্ণিত হতে পারে, আবার অন্তর্নিহিতভাবেও হতে পারে, এই অর্থে যে, আপনার বা তাঁর দিক থেকে সাড়া দানের ব্যাপারটা এর মধ্যে রয়ে গেছে।

এই অন্তর্নিহিত আলোচনা বা সংলাপ কিভাবে হয়ে থাকে? এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) হাদীসে কুদসীতে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়েছেনঃ

“আমি নামাযকে ভাগ করেছি আমার ও আমার বান্দার মধ্যে। অর্ধেক আমার, অর্ধেক তার এবং আমার বান্দা যা চাবে তা পাবে। এজন্যই যখন বান্দা বলে, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন – সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য, আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে প্রশংসিত করেছে। বান্দা যখন বলে, আর -রহমানির রাহিম – পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল, আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে উচ্চ প্রশংসায় ভূষিত করেছে। যখন বান্দা বলে, মালিকি ইয়াওমিদ্দীন-বিচার দিনের প্রভু, আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমাকে মহিমান্বিত করেছে, এটা আমার অংশ। যখন বলে, ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতাঈন – আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি, তখন তিনি বলেন, এটাই আমার ও আমার বান্দার মধ্যে ভাগ হয়েছে। তাকে তাই দেয়া হবে যা সে চাবে। যখন সে বলে, ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম – আমাদের সহজ সরল পথ দেখাও, আল্লাহ বলেন, এটা আমার বান্দার, আমার বান্দা যা চায়, তা সে পাবে। (মুসলিম, তিরমিযী, আহমাদ)

পরবর্তী সময়ে আপনারা দেখবেন যে, কিভাবে নবী (সা) আল্লাহর বাণী ও তাঁর বিভিন্ন আয়াতের বিষয়বস্তুর প্রতি সাড়া দিতেন, স্রষ্টা এবং প্রভুর সাথে আলাপ করতেন, কথা বলতেন। এই সচেতনতা আপনার কুরআন অধ্যয়নে এক অসাধারণ গভীরতা ও ঐকান্তিক সৃষ্টি করবে।

আল্লাহর পুরষ্কারের আশা পোষণ করা

সপ্তমঃ নিজেকে বলুন, আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে কুরআন অধ্যয়ন এবং তা অনুসরণ করার জন্য যত পুরষ্কারের ওয়াদা করেছেন নিশ্চিতভাবে তিনি আমাকে তা দিবেন।

কুরআনে অনেক পুরষ্কারের ওয়াদা করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে জীবনের আত্মিক গুণাবলী। যেমনঃ পথ-নির্দেশনা, ক্ষমা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, স্বস্তি, সৃতি এবং দৃষ্টিশক্তি। অনুরূপভাবে দুনিয়ার জীবনের সম্মান ও মর্যাদা, সচ্ছলতা এবং উন্নতি, সাফল্য ও বিজয়। শাশ্বত আশীর্বাদ-যেমন ক্ষমাশীলতা (মাগফিরাত), বেহেশত (জান্নাত) এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি (রিদওয়ান)-ও মওজুদ রয়েছে কুরআনের অনুসারীদের জন্য।

রাসূল (সা) আরও অনেক পুরষ্কারের কথা বলেছেন। যে কোন প্রামাণ্য হাদীস সংকলন যেমন বোখারী, মুসলিম, মিশকাত অথবা রিয়াদুস সালিহীনে কুরআন সম্পর্কিত অধ্যায় পাঠ করলে আপনি তা পাবেন। এই বইতেও কিছু পাবেন, বিশেষ করে শেষ দিকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপঃ

তোমাদের মধ্যে সে-ই সর্বোত্তম, যে কুরআন শিখে এবং শিক্ষা দেয়। (বুখারী)

কুরআন পাঠ করো, কেননা কিয়ামতের দিনে কুরআন তার সংগীর জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আবির্ভূত হবে। (মুসলিম)

কোন সুপারিশকারী কুরআনের মত মর্যাদা রাখে না। (শারহিল ইয়াহ্ইয়া)

কিয়ামতের দিন কুরআনের সংগীকে কুরআন পড়তে এবং উর্ধ্বে উঠতে বলা হবে। যে যত পড়বে তত উর্ধ্বে উঠতে থাকবে। (আবু দাউদ)

কুরআনের পঠিত প্রতিটি অক্ষরের জন্য তুমি দশগুণ পুরষ্কার পাবে। (তিরমিযী)

এ ওয়াদাগুলো আপনি জমা করতে থাকুন যতটা আপনার স্মৃতিশক্তি পারে এবং স্মরণ করুন যা আপনি পারেন এবং যখনই পারেন। আল্লাহর উপর আস্থা রাখুন, আশা করুন এবং চান।

এ পরিমাণ মেনে চলা যা হাদীসে ঈমান ও ইহতিসাব বলা হয়েছে, আপনার কর্মের অভ্যন্তরীন মূল্যমান অনেক বাড়িয়ে দিবে। এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ

চল্লিশটি সওয়াবের কাজ আছে, তার মধ্যে কেউ যদি আল্লাহর ওয়াদার উপর আস্থা ও পুরষ্কারের আশা নিয়ে একটিও সম্পাদন করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। এ সওয়াবের কাজের মধ্যে সর্বোচ্চটি হলো এত ক্ষুদ্র যেমন কেউ তার প্রতিবেশীকে সামান্য দুধ উপহার দিল। (বুখারী)

দেহ এবং আত্মার ক্রিয়া

দেহ ও আত্মার সাতটি ক্রিয়া আছে, যা আপনাকে, আপনার অন্তরকে গভীরভাবে কুরআন অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে বিরাট রকম সাহায্য করবে। এর কতক ক্রিয়া এমন আছে যা আপনি ইতোমধ্যেই করছেন। কিন্তু তা থেকে আপনি পুরোপুরি ফল লাভ করতে পারছেন না হয়তো বা এ কারণে যে, আপনি তা সঠিকভাবে করছেন না, বা তার মাধ্যমে যা অবশ্যই অর্জন করা প্রয়োজন, সে সম্পর্কে আপনি সজাগ নন। আর এমন কতক ক্রিয়া রয়েছে, যা আপনি আগে কখনও উপলব্ধি করেননি। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন অধ্যায়নের জন্য এগুলো আপনাকে জানতে হবে এবং শিখতে হবে।

উল্লিখিত কাজ বা ক্রিয়া সম্পাদনে আপনি বর্তমান কুরআনে অধ্যয়নে যে সময় দিচ্ছেন তার চাইতে কোনক্রমেই বেশী সময় লাগবে না। এসব ক্রিয়া (একশন) আপনার কাছে যা চায় তা হলো অধিকতর মনোযোগ, গভীর একাগ্রতা এবং সঠিক ও কার্যকরভাবে অধ্যয়নের সচেতনতা।

আত্মার সাড়া

প্রথমঃ কুরআন যাই বলে না কেন সে সম্পর্কে আপনার আত্মাকে সজীব ও সজাগ করতে হবে। প্রতিটি বিষয় যা কুরআনে আপনি পাঠ করেন, তাকে আপনার অন্তরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে দিন এবং তাতে নবজীবন সঞ্চারিত করতে দিন। আপনার হৃদয়কে ভক্তি ও প্রশংসা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা, বিষ্ময় ও আতংক, ভালোবাসা ও আকাংখা, বিশ্বাস ও ধৈর্য, আশা ও ভয়, আনন্দ ও বেদনা, অভিব্যক্তি ও অনুসৃতি, আত্মসমর্পন ও আনুগত্য অনুরূপ নানাবিধ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে দিন। আপনি যতক্ষণ তা না করেন, কুরআন অধ্যয়ন থেকে যে ফায়দা আপনি আহরণ করতে চান তা মুখ নাড়ানোর চাইতে বেশি কিছু হবে না।

উদাহরণ স্বরূপঃ যখন আপনি আপনার প্রভুর নাম ও গুণাবলী শ্রবণ করবেন, তখন শংকা, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও অন্যান্য যথাযথ অনুভূতিতে হৃদয় ভরে যাওয়া উচিত। যখন আপনি আল্লাহর নবী-রাসূলদের কথা পাঠ করেন, তখন তাঁদের অনুসরণ করার এক তীব্র অনুভূতি আপনার মধ্যে জাগ্রত হওয়া উচিত এবং যারা তাঁদের বিরোধিতা করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা ও বিরূপতা সৃষ্টি হওয়া উচিত। যখন আপনি শেষ বিচারের দিনের কথা পাঠ করেন, তখন আপনার অন্তরে বেহেশতের আকাংখা জাগ্রত হওয়া এবং মুহুর্তের জন্য হলেও দোযখের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার ভয়ে আপনার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠা উচিত। অবাধ্য ব্যক্তি ও জাতিসমুহ যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং শাস্তি পেয়েছিল, তাদের কথা যখন পাঠ করেন, তখন তাদের মত হওয়াটাকে আপনার অপছন্দ করা উচিত। আর যখন সৎ পথের অনুসারীদের কথা পড়েন, যাদের আল্লাহ ভালবাসেন, পুরস্কৃত করেন, আপনারও তাঁদের মত হওয়ার জন্য উদগ্রীব হওয়া উচিত।

যখন আপনি আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া এবং দুনিয়ার সম্মান ও প্রচুর্য, আখিরাতে তাঁর সন্তোষ ও নৈকট্য লাভের কথা পড়েন, তা পাওয়ার ব্যকুলতায় তার জন্য কাজ করতে ও তার যোগ্য হতে আপনার অন্তরেও উদ্দীপনা সৃষ্টি হওয়া উচিত। আর যখন ঐসব হতভাগাদের কথা পড়েন, যারা কুরআন থেকে গাফিল, যারা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যারা কুরআনকে গ্রহণ করে না, কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করে না, তখন আপনার ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া উচিত। আপনি যেন তাদের একজন না হন এবং সংকল্প নিন তা না হতে। আপনি যখন আল্লাহর নিকট আপনার প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং তার পথে সংগ্রাম করার অহবান শুনতে পান, তখন আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য নতুন করে সংকল্প গ্রহণ করা উচিত এবং সামর্থ অনুযায়ী আল্লাহর পথে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।

কোন কোন সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হৃদয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়, যখন কোন বিশেষ শব্দ বা আয়াত আপনার হৃদয়ের অভ্যন্তরে নতুন এক অনুভুতির স্ফুলিংগ প্রজ্জ্বলিত করে দেয়। আবার কখনো হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করতে সতর্ক ও দৃঢ়পদক্ষেপ নিতে হয়। আপনি যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে যথার্থ সাড়া না পান, তাহলে একটু থামুন এবং যা পড়ছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করতে থাকুন যতক্ষণ তা না পাচ্ছেন। আপনার অন্তর যদি চায়, তাহলে কোন বিশেষ আয়াত অনেকবার পুনরাবৃত্তি করার একটি আন্তরিক আগ্রহ আপনার মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি সতর্কভাবে পুনরাবৃতি করেন, একটু থেমে গভীরভাবে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন আপনার হৃদয় ত্বরিতগতিতে সাড়া দিচ্ছে।

এই গুণ অর্জন করাটা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, রাসুল (সা) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআন পাঠ করতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার হৃদয় কুরআনের সাথে একাত্ম না হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার হৃদয় এবং কুরআনের মধ্যে একাত্মতা সৃষ্টি না হবে বুঝতে হবে তোমার পড়া হচ্ছে না। সুতরাং উঠে যাও এবং পড়া বন্ধ কর। (বুখারী, মুসলিম)

ভাষার সাড়া

দ্বিতীয়ঃ কুরআনে আপনি যা পড়েন, তার যথার্থ সাড়া আপনার ভাষার শব্দে প্রকাশিত হতে দিন। শব্দগুলোও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয়ে আসা উচিত। কেননা, বিষ্ময়সূচক বাক্যগুলো সর্বদা কুরআন থেকে উৎসারিত আপনার হৃদয়ের গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। যেমন আনন্দ ও বেদনায় কান্না, ধন্যবাদ, ভালোবাসা, ভয় ও দুশ্চিন্তা ইত্যাদি আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। কিন্তু পুনরায় একথা প্রণিধানযোগ্য যে এর মধ্যে যদি স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকে, তথাপি এজন্য চেষ্টা চালাতে হবে।

এভাবেই রাসূল (সা) পবিত্র কুরআন তিলওয়াত করতেন। হুযায়ফা (রা) বলেন, এক রাতে আমি মহানবী (সা) এর পিছনে নামায পড়ি। তিনি সূরা বাকারা থেকে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন। যেসব আয়াতে মহান আল্লাহ ক্ষমান উল্লেখ করেছেন, সে সকল আয়াত পাঠকালে নবীজী ক্ষমা প্রার্থণা করলেন। শাস্তি সম্পর্কিত একটি আয়াত পাঠকালে তিনি আল্লাহর কাছে শাস্তি থেকে নাজাত চাইলেন। আল্লাহর মহিমা ও অনুপম গুণের উল্লিখিত একটি আয়াত পাঠ করার সময় তিনি সুবহানাল্লাহ বলে আল্লাহর মাহিমা প্রকাশ করলেন। (মুসলিম)

অনুরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায় আব্দুল্লা ইবনে আব্বাস (রা) থেকে। রাসূল (সা) এর স্ত্রী আব্দুল্লা ইবনে আব্বাসের ফুফু মায়মুনার গৃহে তিনি রাসূলের (সা) পিছনে নামায আদায় করেছিলেন। (বুখারী, মুসলিম)

কতকগুলো নির্দিষ্ট আয়াতের প্রতি এভাবে সাড়া দেয়া উচিত যেমস রাসূল (সা) শিক্ষা দিয়েছেন। সূরা ত্বীনের শেষ আয়াত (আল্লাহ কি সব বিচারকের চাইতে অধিক বড় বিচারক নন) পাঠ করলে তার জবাব দেওয়া উচিত এই বলে যে, ‘হ্যা, অবশ্যই আমি এর সাক্ষ্যদাতাদের একজন’। যিনি সূরা আল-মুরসালাতের শেষ আয়াত (এই কুরআনের পর আর কোন কালাম কি এমন থাকতে পারে যার প্রতি এরা ঈমান আনবে?) পাঠ করবেন, তার বলা উচিত,’আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি’ (আবু দাউদ)।

আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, তিনি জিনদের কাছে সূরা আর-রহমান পাঠকালে যখনই বলতেন, ‘ফাবিআইয়ি আলায়ি রাব্বিকুমা তুকাযযিবান’, তখন তারা বলে উঠতেন, ‘হে আমাদের প্রভু। না, আমরা তোমার কোন অনুগ্রহকেই অস্বীকার করি না। সমস্ত প্রশংসা তোমারই জন্য।’ (তিরমিযী)

এগুলো হচ্ছে মাত্র কতিপয় ঘটনা যা থেকে আমরা জানতে পারি আমাদের নবী (সা)-এর দৃষ্টান্ত ও শিক্ষাসমূহ। এসব দৃষ্টান্তের আলোকে আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবর , লাইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে অথবা অনুতাপ করে, ক্ষমা চেয়ে এবং আল্লাহর কাছে বেহেশত চেয়ে প্রশংসা, মহিমা, সম্মতি, অস্বীকৃতি এবং আবেদনের জন্য আপনার নিজস্ব জবাব ভেবে-চিন্তে বানিয়ে নেয়া আপনার জন্য কোন কঠিন কাজ নয়।

আপনার চোখের অশ্রু

তৃতীয়ঃ কুরআনে আপনি যা পড়েন, তার জবাবে ‘আনন্দ ও বেদনার অশ্রু’ আপনার হৃদয়ের সাড়া চোখ দিয়ে প্রবাহিত হতে দিন।

আপনার হৃদয়ের অবস্থা যদি যে কুরআন পাঠ করছেন তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে এটা হতে বাধ্য। আপনার হৃদয় যদি অমনোযোগী অথবা মৃত বা বন্ধ্যা হয় কেবলমাত্র সে অবস্থাতেই চক্ষু শুষ্ক থাকবে। শুধু আল্লাহর ভয়েই সর্বদা চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে উঠবে তা নয়। বরং সত্যকে পাওয়ার আনন্দে, আল্লাহর অসীম দয়ার অনুধাবন এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ হতে দেখেও বান্দার চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হবে।

তোমরা দেখতে পাও যে, সত্যকে জানা ও চেনার প্রভাবে তাদের চক্ষুসমূহ অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে যায়। (আল-মায়িদা- ৫:৮৩)

তার তারা কাঁদতে কাঁদতে নতমুখে পড়ে যায়। (আল- ইসরা – ১৭:১০৯)

আল্লাহর নবী (সা), সাহাবা কিরাম (রা) এবং তাঁদের মত যাঁরা কুরআন পাকের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতেন, তাঁরা কুরআন তিলওয়াতের সময় প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়তেন।

আল্লাহর নবী (সা) বলেছেন, নিশ্চয় কুরআনকে দুঃখের সাখে পাঠানো হয়েছে। সুতরাং তোমরা যখন কুরআন পাঠ কর নিজেকে দুঃখিত কর (আবু ইয়ালা, আবু নুয়াইম)। আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, কুরআন পাঠ কর এবং কাঁদো। যদি স্বঃস্ফূর্ত কান্না না আসে, তবুও কাঁদো। (ইবনে মাজাহ)

কুরআন কি বলছে এবং আপনার প্রতি কি নির্দেশ করছে, তা যদি একবার আপনি গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং ভাবেন, তাহলে আপনার গাল গড়িয়ে থেমে থেমে অশ্রুধারা নেমে আসতে খুব বেশী সময় নিবে না। কুরআন আপনার প্রতি যে ভালো খবর, কঠোর দায়িত্বের বোঝা ও সতর্কবাণী বহন করে এনেছে, তার চিন্তা করে আপনি নিজেই কাঁদতে পারেন।

আপনার চালচলন

চতুর্থঃ চালচলনের এমন একটি ভঙ্গি আপনি গ্রহণ করুন, যা আপনার প্রভুর বাণীর প্রতি আপনার হৃদয়ের পবিত্রতা, নিষ্ঠা ও আত্মসমর্পনই প্রতিফলিত করবে।

এমন আচরণের কথা কুরআন অনেক জায়গাতেই উল্লেখ করেছেঃ সত্যিকারের বিশ্বাসীগণ ‘নতমুখে পড়ে যাবে’, ‘নিজেরাই মস্তক অবনত করবে’, ‘নিস্তব্ধতা ও মনোযোগের সাথে কুরআন শুনবে এবং শিহরিত হয়ে শরীর কাঁপতে থাকবে’। কুরআনে যা পাঠ করছেন দেহে তার কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত কতক আয়াত পাঠে সিজদা করার বাধ্যবাধকতা তারই একটি নির্দেশিকা। এই দৈহিক ভঙ্গি বা চালচলন কেন গুরুত্বপূর্ণ? একজন মানুষের দৈহিক অবস্থার উপর তার মানসিক অবস্থার গভীর প্রভাব রয়েছে। দেহের অস্তিত্বই হৃদয়ের অস্তিত্ব বজায রাখে। একটি সাধারণ বই পড়া ও কুরআন অধ্যাযনের মধ্যে দৈহিক ভঙ্গিমায় অনেক ব্যাপক পার্থক্য হতে হবে। অতএব কুরআন পাঠের অনেক আদব-কায়দা ও শিষ্ঠাচার শিখানো হয়েছে।

ইমাম গাযযালী (রহ) বলেন, প্রথমে উযু কর, শান্তশিষ্টভাবে কেবলামুখী হয়ে বসো, মাথা নত করে রাখো, ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বসো না, কিন্তু এমন ভাবে বসো যেন তুমি তোমার প্রভুর সামনে বসেছ। ইমাম নববী তাঁর ‘কিতাবুল আযকার’ গ্রন্থে আরও কিছু বেশী উল্লেখ করেছেন। ‘মুখ পরিষ্কার হতে হবে, বসার জায়গা পবিত্র হতে হবে, মুখ কেবলার দিকে থাকতে হবে, দৈহিক বিনয় প্রকাশ হতে হবে।’

তারতীলের সাথে পড়া

পঞ্চমঃ তারতীল সহকারে কুরআন পাঠ করুন।

ইংরেজী ভাষার কোন একটি শব্দ দ্বারা তারতীলের অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আরবীতে এর অর্থ হচ্ছে ভাষা, দেহ ও মনের পরিপূর্ণ ঐক্যতান বজায় রেখে আস্তে আস্তে, থেমে থেমে, স্পষ্টভাবে, শান্তভাবে পরিমিত স্বরে, চিন্তা ভাবনা করে পড়া।

এটাই হচ্ছে কুরআন পাঠের কাংখিত পদ্ধতি, যা আল্লাহ তাআলা শুরুতেই শিক্ষা দিয়েছেন। আর এটাই তিনি অনুসরণ করতে বলেছিলেন আল্লাহর নবী (সা) কে যখন রাত্রের অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে নামায ও কুরআন মাজীদ পড়তে আদেশ করেছিলেন (আল মুযযাম্মিল-৭৩:৪)। আস্তে আস্তে ও পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল করার কারণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

এভাবে তোমাদের হৃদয়কে যেন আমরা মযবুত করতে পারি। (আল ফুরকান- ২৫:৩২)

হৃদয় ও কুরআন অধ্যায়নের মধ্যে মিলন ঘটানোর জন্য এবং মযবুতি ও গভীরতা সৃষ্টির জন্য ‘তারতীল’ একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান। বকবক করে দ্রুত পড়ার চাইতে তারতীলের সাথে পড়া বিষ্ময় ও শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটায়, বুঝতে ও চিন্তা করতে সাহায্য করে এবং আত্মার উপর এক অনপনেয় ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।

আব্দুল্লা ইবনে আব্বাস বলেছেন, তারতীলের সাথে সূরা বাকারা ও আলে ইমরান পাঠ করাকে আমি দ্রুত সমগ্র কুরআন পড়ার চাইতে আমার জন্য উত্তম মনে করি। অথবা তারতীলের সাথে সূরা যিলযাল ও আল কারীয়া পাঠকে সূরা বাকারা ও আলো ইমরান অপেক্ষা উত্তম।

তারতীল বলতে শুধুমাত্র নীরাবতা, স্পষ্টতা, বিরতি ও ভাবনা, দেহ ও হৃদযের ঐক্যতান বুঝায় না, বরং কিছু শব্দ ও আয়াতের বাধ্যতামূলক পুনরাবৃত্তি বুঝায়। একটি বিশেষ আয়াত দ্বারা হৃদয় একবার বিশেষিত হলে যতবার আপনি পাঠ করবেন ততবারই নতুন মজা ও আনন্দ পাবেন তা থেকে। বারবার পাঠ করায় হৃদয় ও যা আপানি পাঠ করছেন তার মধ্যে এক ঐক্যতানের সৃষ্টি হয়।

রাসূল (সা) সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, একবার তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম (পরম করুণাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে) বিমবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। একবার রাসূল (সা) সারা রাত পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেনঃ ‘এখন আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনার বান্দাহ, আর যদি মাফ করে দেন, তবে আপনি তো সর্বজয়ী, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান’ (৫:১১৮)। সাইদ ইবনে জুবাইর এই আয়াতটি পড়তে থাকলেন, ‘হে অপরাধীরা, তোমরা আজ (বিচারের দিন) আলাদা হয়ে যাও’ (ইয়াসিন) আর কাঁদতে থাকলে এবং চোখের পানি ফেলতে থাকলেন। (ইহ্য়িয়াউ উলুমিদ্দীন)

পবিত্রতা অর্জন

ষষ্ঠঃ নিজেকে পবিত্র করুন যতটা পারেন।

আপনারা জানেন যে, পবিত্রতা ছাড়া কেউই কুরআন স্পর্শ করতে পারে না। (আল ওয়াকিয়া- ৫৬:৭৯)। এই আয়াতে উদারভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝানো হয়েছে ধর্মীয় পরিচ্ছন্নতা। অর্থাৎ আপনাকে ধর্মীয় বিধান মতে উযুর মাধ্যমে পবিত্র হতে হবে। একথা সম্পূর্ণরূপে অনেক হাদীস ও ইজমার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দেহ, পোশাক ও জায়গার পরিচ্ছন্নতা ছাড়া পবিত্রতার আরও অনেক দিক রয়েছে।

আপনারা এটাও দেখেছেন যে, নিয়ত ও উদ্দেশ্যের পবিত্রতার গুরুত্ব কত বেশী। যে পাপ আল্লাহর ক্রোধের কারণ হতে পারে, সে পাপ থেকে হৃদয় ও অংগসমূহের পবিত্র থাকা সমান গুরুত্বের অধিকারী। কোন মানুষই পাপ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না। কিন্তু যতটা সম্ভব আপনি পাপ কাজ বর্জন করে চলতে পারেন। যদি আপনি কিছু করেই ফেলেন, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসুন এবং তওবা করুন, ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আপনাকে এ সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে যে, যখন কুরআন পাঠ করছেন, আপনি হারাম খাদ্র গ্রহণ করছেন না, হারাম কাপড় পরিধান করছেন না, হারাম উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ করছেন না। আপনি যত পবিত্রতম হবেন, আপনার হৃদয় তত বেশী আপনার সাথে থাকবে, হৃদয় যত বেশী আল-কুরআনের নিকট উন্মুক্ত হবে, আপনি তত বেশী বুঝ ও ফায়দা হাসিল করতে পারবেন এ থেকে। আর আপনি তত বেশী তাদের মত হতে পারবেন, যারাই শুধুমাত্র স্পর্শ করার অধীকারী এই মহান কুরআন, যা লিপিবদ্ধ রয়েছে এক সুরক্ষিত গ্রন্থে। (আল ওয়াকিয়া- ৫৬:৭৭-৭৮)

আল্লাহর সাহায্য চাওয়া (দুআ)

সপ্তমঃ যখন কুরআন পাঠ করেন, তখন আল্লাহর করুণা, ক্ষমা, হিদায়াত ও নিরাপত্তার জন্য দুআ করুন। এটা চাইতে হবে হৃদয় দিয়ে, কথা দিয়ে, কর্ম দিয়ে। কুরআনের আলোকে পথ চলতে গেলে আপনাকে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থাশীল হতে হবে। এই নির্ভরশীলতার অনুভূতিতে অতিমাত্রায় উচ্ছাসিত হওয়া উচিত নয়, বরং এটা অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে। আপনার চলার পথের প্রতিটি পদক্ষেপেই তাঁর সাথে আপনার সাক্ষাত করতে হবে। তাঁর কাছে আপনার সাহায্য চাওয়া উচিত যাতে করে আপনার হৃদয়কে সক্রিয় রাখতে পারেন, কুরআন বুঝতে এবং অনুসরণ করতে। আপনার দূর্বলতা ও অযোগ্যতার জন্যও তাঁর ক্ষমা প্রার্থনা করুন।

আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হলে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবা এবং আল্লাহর প্রতি ঔদাসীন্য প্রদর্শন থেকে সতর্ক থাকুন। এগুলো মহাপাপ। আপনার যা দরকার তা হলো, অহংকারের বদলে বিনয়, স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে তাওয়াক্কুল।

যা আপনি চাবেন, তা দেয়া হবে-সর্বদাই আপনার মধ্যে এই আশাবাদ, বিশ্বাস ও নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এটা ছাড়া আপনার দুআ আপনার জন্য খুব একটা উপকারে আসবে না। এটি হচ্ছে কুরআনের একটি অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। নিন্মোক্ত আয়াতসমূহের প্রতি লক্ষ্য করুনঃ

হে পরওয়ারদিগার। তুমি আমার প্রতি যে কল্যাণই নাযিল করবে আমি তার মুখাপেক্ষী। (আল কাসাস- ২৮:২৪)

নিজের আল্লাহর রহমত থেকে তো কেবল কেবল গোমরাহ লোকেরাই নিরাশ হয়ে থাকে। (আল হিজন- ১৫:৫৬)

তোমাদের রব বলেনঃ

আমাকে ডাক, আমিই তোমাদের দুআ কবুল করবো। যেসব লোক গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে আমার ইবাদত করা হতে বিমুখ থাকে, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত, অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে দাখিল হবে। (মু’মিন – ৪০:৬০)

আমি তাদের অতি নিকটে। আমাকে যে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং উত্তর দিয়ে থাকি। কাজেই আমার ডাকে সাড়া দেয়া এবং আমার প্রতি ঈমান আনা তাদের কর্তব্য। এসব কথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও। হয়তো তারা প্রকৃত সত্যপথের সন্ধান পাবে। (বাকার- ২:১৮৬)

আসুন, আমরা আরও কতিপয় কথার প্রতি দৃষ্টিপাত করি, যার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া উচিত।

আল্লাহর হিফাযত

আমি প্রত্যাখাত শয়তান হতে আল্লাহর পানাহ চাই। আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানিররাজীম।

ইতোমধ্যে আমরা এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছি যে, শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া কত বেশী গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে এটা কুরআনেই নির্দেশ করা হয়েছে (আন নহল- ১৬:৯৮)। শুধুমাত্র এই শব্দগুলোকে একটি শাস্ত্রীয় বা ম্যাজিক ফর্মুলা হিসেবে উচ্চারণ করবেন না। আপনাকে অনুধাবন করতে হবে যে, আপনার কাজে আপনাকে বিরাট বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। শয়তান আপনার সবচাইতে বড় দুশমন। আপনাকে আপনার পরিশ্রমের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করার জন্য যা করা সম্ভব তার সবকিছুই সে করবে। আল্লাহ এবং কেবলমাত্র আল্লাহই পারেন আপনাকে শয়তানের এ ষড়যন্ত্র থেকে হিফাযত করতে।

মাঝে মধ্যে আল্লাহর আশ্রয় প্রর্থনার জন্য কুরআন থেকে পাওয়া (আল মুমিনুন- ২৩:৯৯) অথবা রাসূল (সা) শিক্ষা দিয়েছেন যে শব্দগুলো, তা মাঝে মধ্যে ব্যবহার করতে পারেন অথবা কুরআনের দুই ফালাক ও নাস পড়তে পারেন।

আপনার হৃদয় সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সময়ে সময়ে আপনার উচিত আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

হে আমাদের প্রভু। তুমিই যখন আমাদের সঠিক সোজা পথে চালিয়ে দিয়েছ, তখন তুমি আমাদের মনে কোন প্রকার বক্রতা ও কুটিলতার সৃষ্টি করে দিও না। আমাদেরকে তোমার মেহেরবানীর ভান্ডার হতে অনুগ্রহ দান কর, কেননা প্রকৃত দাতা তুমিই। (আলে ইমরান- ৩:৮)

কুরআন অধ্যায়নের শুরুতেই আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা অপরিহার্য হলেও কুরআনের বক্তব্য এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এটা একটি অব্যাহত কাজ হওয়া উচিত।

আল্লাহর নামে

পরম দয়ালু ক্ষমাশীল আল্লাহর নামেঃ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। পবিত্র কুরআনের ১১৪ টি সূরার মধ্যে একটি মাত্র সূরা বাদে সবগুলোর শুরুতে এই আয়াতটি রয়েছে। তাঁর নামে শুরু করা এই তাৎপর্য বহন করে যে, কুরআনের এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার জন্য যিনি সব ধরনের সাহায্য দান করেছেন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

কুরআনের আর্শীবাদ প্রার্থনা

আরও কতগুলো নির্দিষ্ট দুআ রয়েছে, সেগুলো আপনার শিখা উচিত।

হে আমার প্রভু। আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও। (তাহা – ২০:১১৪)

আল্লাহ তায়ালা যখন কুরআন গ্রহণে রাসূল (সা) কে ধৈর্যশীল ও অটল থাকার জন্য সতর্ক করেন, তখন তাকে তাঁর এই শব্দগুলো দিয়ে প্রার্থনা করতে শিখিয়েছেন- ‘এবং কুরআনের সাথে তাড়াহুড়া করো না, শীঘ্র এর প্রত্যাদেশ তোমার প্রতি সম্পূর্ণ হবে’। কুরআনের অর্থের সাথে আঁকড়িয়ে থাকতে চাইলে আল্লাহর নামে ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্যই বিভ্রান্তি দূর করতে পারে, জট খুলে দিতে পারে এবং কেউ কুরআনের বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারে।

আরেকটি চমৎকার দুআ

হে আমার প্রভু! আমি তোমার দাস, তোমার দাসের সন্তান, তোমার দাসীর সন্তান, আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার অধীন, আমার ললাট তোমার হাতে। তোমার প্রতিটি নির্দেশ আমার ব্যাপারে চূড়ান্ত। তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্ত সঠিক এবং ইনসাফপূর্ণ। হে প্রভু! তোমাকে ডাকি তোমার সমস্ত নামে, যত নামে তুমি তোমাকে আখ্যায়িত করেছ, বা তোমার সৃষ্টিকে শিখিয়েছ, যা তুমি তোমার পবিত্র কিতাবে নাযিল করেছ, অথবা যা তুমি তোমার মধ্যে গোপন রেখেছ। হে আমার প্রভু! কুরআনকে আমার হৃদয়ের সমস্ত প্রেরণা-উৎস, আমার অন্তরের জ্যোতি, আমার দুঃখ নিবারণকারী, উদ্বেগ ও চিন্তা উপশমকারী বানিয়ে দাও। (আহমাদ, রুজাইন)

নিন্মোক্ত দুআটি সাধারণ ভাবে সমস্ত কুরআন পাঠ সমাপ্ত করার পর পাঠ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এর মর্ম এত ব্যাপক যে, ঘন ঘন এইসব শব্দের মাধ্যমে আল্লাহকে ডাকা হলে আল্লাহ নিশ্চিতই বিরাট আর্শীবাদ বর্ষণ করবেন। ‘হে আমার প্রভু! মহান গ্রন্থ কুরআনের মাধ্যমে আমার উপর করুণা বর্ষণ কর। কুরআনকে আমার জন্য নেতা, আলোকবর্তিকা, পথ-প্রদর্শক ও রহমত বানিয়ে দাও। হে আল্লাহ! যা আমি ভুলে গিয়েছি, কুরআনের মাধ্যমে তা আমাকে স্মরণ করার তওফীক দান কর এবং শিখিয়ে দাও। দিনে ও রাতে আমাকে এটি তিলাওয়াত করার শক্তি দান কর। হে দুনিয়া জাহানের মালিক। আমার পক্ষে কুরআনকে একটি প্রমাণ বানিয়ে দাও।’

কুরআন পাঠের আগে, কুরআন পাঠকালে এবং কুরআন পাঠ শেষে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করুন যে ভাষায় হোক আর যেভাবে আপনি পছন্দ করেন। এ সম্পর্কে কুরআনের তিনটি বর্ণনা আপনি পাবেন সূরা আলে ইমরানে (৩:১৬), আল মুমিনুন (২৩:১১৮) এবং আলে ইমরানে (৩:১৯৩)।

সাধারণ প্রার্থণা

উপরে উল্লিখিত এসব নির্দিষ্ট দুআ ছাড়াও আপনি আপনার নিজের ভাষায় কুরআন থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থণা করুন। যেমনঃ ‘আমার দৃষ্টি খুলে দাও, সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে দেখার শক্তি দাও, সেই আলোকশিখা দাও যা দিয়ে আমি তোমার পথ চিনতে পারি, আমার প্রচেষ্টায় সহায়তা দান কর, আমার ইচ্ছাশক্তি বিনয়ী করে দাও, তোমার ক্ষমা ও হিদায়াত পেয়ে আমাকে আনন্দ লাভ করার তওফীক দান কর, আমার উৎকণ্ঠা, আমার সিদ্ধান্ত ও আমার সকল ব্যাপারে আমাকে পথ প্রদর্শন কর, সমস্ত প্রলোভনের বিরুদ্ধে আমাকে প্রতিরোধ ক্ষমতা দান কর, সব দায়িত্ব পালন করার শক্তি দান কর, আমার অলসতা ও জড়তা দূর করে দাও, তোমার বাণী আমার চিন্তা ও কর্মকে উজ্জীবিত করুক ও আমার প্রতিটি পয়োজন পূরণ করুক, আমাকে শান্ত করে দাও যখন আমি অশান্ত, প্রশান্তি দাও যখন আমি বিপন্ন, আমাকে অধ্যয়ন করতে এবং বুঝতে সাহায্য কর, তোমাকে এবং তোমার হিদায়াত জানার ও বুঝার তওফীক দান কর, আমাকে ধৈর্য্য দাও, আমাকে সম্মান ও মর্যাদা দান কর, আমাকে গ্রহণ করার এবং পালন করার শক্তি দান কর, যা আমি শিখি তদনুযায়ী জীবন যাপন করার তওফীক দান কর, কুরআন যে মিশন আমাকে দিয়েছে তা পরিপূর্ণ করার সামর্থ আমাকে দান কর।’

উপলব্ধি সহকারে অধ্যয়ন

কি পড়ছেন এই উপলব্ধি আপনাকে গভীরভাবে কুরআন অধ্যায়নে নিয়োজিত করবে। কুরআন অধ্যায়নে এটি শেষ কিন্তু কোনক্রমেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর পন্থা হতে পারে।

কুরআনের বাণী হৃদয়ে গভীরভাবে প্রবিষ্ট হওয়ার পূর্বে কুরআন কি বলছে তা বুঝা সবার জন্য অপরিহার্য হলেও এটা কোন চূড়ান্ত শর্ত নয় যা ব্যতীত কুরআন থেকে আদৌ কোন আশীর্বাদ লাভ করা যাবে না। অনেকে এমন আছেন, যারা কুরআনের প্রতিটি শব্দ বুঝে থাবেন কিন্তু তথাপি তাদের হৃদয়ের দরজা কুরআনের জন্য বন্ধ থাকে। আবার এমন অনেকে আছেন, যারা একটি শব্দও বুঝেন না, তথাপি অত্যান্ত গভীর একাগ্রতা, আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক, ভালোবাসা ও আকাংখা, আল্লাহর নৈকট্য ও আনুগত্য লাভ করে থাকেন। এটা এ কারণে যে, কুরআনের সাথে সম্পর্ক অনেক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যে এমন অসংখ্য লোক থাকবেন, যারা কখনও আরবী ভাষা শিখবেন না, অনুবাদ পড়তে সক্ষম হবেন না আর না এ জন্য প্রচেষ্টা চালাতে সময় পাবেন। তথাপি তাদের হতাশ হবার কোন কারণ নেই। যে পর্যন্ত না তারা কুরআন বুঝার উপায় খুঁজে পাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন, যে পর্যন্ত না তারা কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী চলার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবেন, সে পর্যন্ত অবশ্যই তাদের কুরআন পড়তে হবে যদি তারা এর অর্থ নাও বুঝেন এবং তাদের অবশ্যই কুরআনের আশীর্বাদ পাওয়ার আশাও পোষণ করতে হবে।

এতদসত্ত্বেও কুরআন আপনাকে যা বলেছে, তা অনুধাবনের অপরিসীম গুরুত্ব কোনক্রমেই বিন্দুমাত্র কমতে পারে না। এখানে ‘অনুধাবন’ ব্যবহার করা হয়েছে কুরআনে যা বলা হয়েছে তা সরাসরি জানার অর্থে। চিন্তা-ভাবনা, অনুসৃতির অন্যান্য স্তর পরিপূর্ণ অর্থে বুঝে পাওয়া, এটাকে আমাদের চিন্তার সাথে সমন্বিত করা ইত্যাদি সম্পর্কে আমরা পরবর্তী সময়ে আলোকপাত করবো।

কেন সরাসরি অর্থ অনুধাবন করা প্রয়োজন? প্রথমত, কুরআনের সরাসরি অর্থের উপর কনসেনট্রেশন বা আপনার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে, সচেতনতার বিভিন্ন অবস্থা উদ্দীপ্ত করতে, আপনার আন্তরাত্মাকে কুরআনের মুখোমুখি আনার জন্য দেহ ও আত্মার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিতে বিরাট রকমের সাহায্য করবে। দ্বিতীয়তঃ কেবলমাত্র অনুধাবনের মাধ্যমেই আপনি আপনার বিশ্বাসকে গভীর করতে পারবেন, যা প্রকৃতপক্ষে আপনাকে ঈমান এবং কুরআনের শিক্ষার সাথে বেঁচে থাকার দিকে পরিচালিত করবে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি