লেখকের কথা
আধুনিক যুগটাকে অনেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। বিজ্ঞানের অসাধারণ শক্তিশালী ও বিস্ময়কর আবিষ্কার বস্তুগতভাবে মানবজাতিকে ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশের অনেক কিছুই দিয়েছে। বলা হচ্ছে, সভ্যতা উন্নতির এক চরম শিখরে আরোহণ করেছে। পৃথিবীটা এখন মানুষের মুঠোর মধ্যে; যদিও সৃষ্টিজগতের অনেক রহস্যই মানব সন্তানের পক্ষে এখনও উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। পৃথিবীতে মানবজাতি অনেক কিছু লাভ করা সত্ত্বেও একটি অভাব বোধ মানুষকে তাড়িয়ে ফিরছে।

মানুষের সত্যিকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মানুষে মানুষে বৈষম্য, বঞ্চনা, মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য অব্যাহত রয়েছে। দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে হানাহানি সংঘাত-সংঘর্ষ মানুষের শান্তি স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে। যুদ্ধোন্মাদনা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক শক্তি মানব সভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলেছে। কেউ বলছেন, বিশ্বের গোটা মানবসমাজ আজ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। কেউ বলছেন, এটা মানবজাতির এক ক্রান্তিকাল। কেউ বলছেন, বর্তমান সময়টা বড় দুঃসময়। অনেকের মন্তব্য, এটি একটি কালো সময়। এসব মন্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলতঃ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে মানুষের এক ধরণের হতাশাবাদই ব্যক্ত হয়েছে। মানুষ এ অবস্থাটা উত্তরণ করতে চায়। অর্থাৎ এর একটি বিকল্প মানব জাতির কাম্য। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, এ বিপন্ন অবস্থার হাত থেকে মানুষ বাঁচার জন্য আজ পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নেই মানব গোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। পৌনে এক শতাব্দী কাল যাবত কমিউনিজমের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আবার মানুষের মোহভঙ্গ হলো। ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের যতসব সোনালী স্বপ্ন। কমিউনিস্ট ব্যবস্থাপনার অন্তঃসারশূণ্যতা নব্বই-এর দশকের ঊষালগ্নে নিয়ে এলো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের বিপ্লব। কমিউনিস্ট বিপ্লবের হাতছানিতে আন্দোলিত মানবগোষ্ঠী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করলো কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রকে। গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বব্যাপী গণজাগরণকে কমিউনিস্টরা পর্যন্ত লুফে নিয়েছে। গণতন্ত্রকে বুর্জোয়া ব্যবস্থা বলে গালি দেয়া ছাড়া যারা কিছুই বুঝতো না তারাই আজ গণতন্ত্রগত প্রাণ। এটি যে তাদের প্রতারণার এক নতুন কৌশল বৈ আর কিছু নয় তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? একথা কারো বুঝতে বাকী নেই যে, রাতারাতি তাদের গণতন্ত্রী সাজা একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই যে ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল সেই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাথে কিভাবে খাপ খাওয়াবে সে প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়। একশ’ বছরের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্রের কার্যকারিতা প্রমাণিত হলেও অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে অবাধ পুঁজিবাদের বিকাশের কারণেই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মানবতা মুক্তি পায়নি। শিল্প, ব্যবসায় বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হওয়া সত্ত্বেও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করা যায়নি। উপরন্তু ধনী ও গরীবের বৈষম্য হ্রাস পায়নি। ফলে বিংশ শতকের প্রথমভাগেই হতাশাগ্রস্ত মানব সমাজের এক বিরাট অংশ সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব পৌনে এক শতাব্দীতে মানবজাতিকে তেমন কিছুই দিতে পারেনি। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। পশ্চিমা গণতন্ত্র মানুষের জীবনে যে অর্থনৈতিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ তার ধারে কাছেও যেতে পারেনি। অন্যদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। অবাধ পুঁজিবাদকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও পুঁজিবাদী সমাজ ভোগবাদ ও বস্তুতান্ত্রিকতার ঊর্ধে উঠতে পারেনি। মানুষের সত্যিকার মর্যাদা ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারেনি। এহেন এক পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্রের পতনের মাধ্যমে বিশ্বময় আবার গণতন্ত্রের যে জাগরণের সূচনা হয়েছে তা কি সত্যিকার অর্থে মানবজাতির মুক্তির পথ নির্দেশ করতে পারবে? পশ্চিমা গণতন্ত্র তো এক পরীক্ষিত ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা নতুন করে বিশ্ববাসীকে আর কি দিবার শক্তি রাখে? পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র এ দুই প্রান্তিক ব্যবস্থার মাঝামাঝি এক ভারসাম্যপূর্ণ বিধান যা মানবজাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারে। তত্ত্বগতভাবে একথা আজ আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। আজকের যুগের প্রয়োজন হলো তাত্ত্বিক বক্তব্যের পরিবর্তে কিভাবে ইসলামী ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার পদক্ষেপ গ্রহণ। কি করে ইসলামের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা যেতে পারে তাই আজ বিবেচনার বিষয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি ইসলাম কিভাবে অর্জন করতে পারে সেটাই এখন মূখ্য বিষয় হওয়া উচিত। ইসলামের তত্ত্বগত শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনার চাইতে ইসলামের বাস্তবায়ন; রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ইসলামী ব্যবস্থার বাস্তবায়নের আলোচনা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

সুতরাং ইসলামের রাষ্ট্র বিপ্লব কিভাবে সংঘটিত হতে পারে নিঃসন্দেহে এটিই হওয়া উচিত ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের সর্বাধিক বিবেচ্য বিষয়। ইসলামী ব্যবস্থায় উত্তরণ কিভাবে সম্ভব, বর্তমান ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে কিভাবে ইসলামের খেলাফতি ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়; এর পথ ও পন্থা কি এ নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বিভিন্ন ধারণা আছে বা থাকাটাই স্বাভাবিক। কারও হয়তো স্পষ্ট ধারণা আছে। আবার কেউ হয়তো এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা খুব একটা করেন না। তবে কিভাবে এ লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব তা নিয়ে অস্থিরতা যে নেই তা বলা যায় না। ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর সন্তোষ ও রেজামন্দি হাসিল। আর দুনিয়াবী জীবনে ইসলামকে বিজয়ী করার কথা তো আল্লাহ তায়ালা নিজেই পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন। দুনিয়ায় সকল মতবাদ, ব্যবস্থার উপর আল্লাহর দেয়া বিধান ইসলামকে বিজয়ী করতে হবে। আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসূল ও আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ) এর মিশন ছিল তাই।

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ

‘‘তিনিই তাঁর রাসূলকে (সা) প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য, যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে।’’ (সূরা আস্‌ সাফঃ ৯)

هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَىٰ وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ ۚ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ شَهِيدًا

‘‘তিনি তাঁর রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন অপর সমস্ত দ্বীনের উপর তাকে জয়যুক্ত করার জন্য। স্বাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট।’’ (সূরা ফাতহঃ ২৮)

আল্লাহর দ্বীনেকে অন্যসব ব্যবস্থার উপর জয়যুক্ত করতে হলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। এ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন আনতে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে তাকেই বিপ্লব বলা যেতে পারে। মোদ্দাকথা এই যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের দেশ পরিচালনার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এ দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারটা কিভাবে হবে? স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কাজ করে জনগণের মধ্যে পরিবর্তন আনয়নের জন্য সচেতনতা সৃ্ষ্টি করে জনগনের ইচ্ছায় ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব। অন্য কোন পন্থায় সম্ভব নয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক কিংবা গণজাগরণের মাধ্যমেই হোক জনগনের সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামী বিপ্লব সম্ভব নয়।

এ গ্রন্থে ইসলামী বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য, পূর্বশর্ত, স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সংগঠন, নেতৃত্বসহ বিভিন্ন উপাদানের গুরুত্ব, বিপ্লব সাধনের পথ, তাছাড়া সশস্ত্র সংগ্রাম, সামরিক শাসন, গণঅভ্যুত্থান ও নির্বাচন এসব পন্থার মধ্যে কোন কোনটি সঠিক ইত্যাদি নিয়ে অতি সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে। বিপ্লবের প্রক্রিয়া সম্পর্কেই সাধারণ বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে, মতপার্থক্যের কারণ ঘটে প্রক্রিয়া নিয়েই। যেহেতু ইসলামী বিপ্লব পর্দার অন্তরালের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, কিংবা আঁতাত ও ষড়যন্ত্র ঘৃণা করে এবং যেহেতু মানুষের মুক্তি ও কল্যাণই এর লক্ষ্য, যে জনপদে বিপ্লব সংঘটিত হবে সেই জনপদের জনমণ্ডলীকে ঐ বিপ্লবের জন্য ত্যাগ ও কোরবানী স্বীকার করতে হবে এবং যেহেতু ঐ জনপদের জনগোষ্ঠীর সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে সেহেতু এ বিপ্লব গোপন কৌশলের ব্যাপার নয় বরং খোলামেলা ও প্রকাশ্য কৌশল। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বিভিন্ন দেশের কৌশল গৃহীত হবে। তবে সাধারণ কিছু বিষয় আছে যা সর্বত্রই প্রযোজ্য বলে ধরে নেয়া যায়। এ গ্রন্থে একটি সাধারণ আলোচনাই করার চেষ্টা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে কিছু বিশেষ দিক সংযোজিত হয়েছে। খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লবের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ধারণা নেয়া সম্ভব হতে পারে। গ্রন্থটি পাঠ করে সম্মানিত পাঠকবর্গ যদি দয়া করে ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্দেশ করেন কিংবা পরামর্শ বা কোন বক্তব্য এ লেখককে জানান তাহলে তা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করা হবে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামী আন্দোলনের সাথে আমার দীর্ঘ দিনের সাহচর্য ও বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার লেখার উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে। এ দীর্ঘ সময়ে এ আন্দোলনের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের সংস্পর্শে যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের অগ্রগতি, সমস্যা, সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করার কিংবা সে সম্পর্কে অন্যভাবে জানারও সুযোগ আমার হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রের মূল্যবান গ্রন্থাদির সহযোগিতা তো আছেই। দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত যুব মানসের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে। এ সবের পাশাপাশি ইসলামী বিপ্লবের রংয়ে পৃথিবীকে রাঙিয়ে দেয়ার যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা আমার হৃদয়ে বিদ্যমান তার কারণেই সম্ভবতঃ আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব কিভাবে সংঘটিত হতে পারে এমন একটি অতীব জটিল বিষয়ে লিখার সাহস পেয়েছি। অন্যথায় এমন একটি অতীব জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়ে কোন কিছু লেখার বা মন্তব্য করার যোগ্যতা বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। আমার এ লেখা থেকে যদি ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সামান্যও উপকৃত হন তাহলে আমার শ্রম স্বার্থক হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। এ লেখাটি তৈরী ও বই হিসাবে তা প্রকাশের ব্যাপারে নানাভাবে যারা আমাকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত ও সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে আল্লাহ তায়ালা যথাযোগ্য পুরস্কৃত করুন। আমীন।

বিনীত

মুহাম্মদ কামারুজ্জামান

ঢাকা, ১৭-১২-৯০ ইং


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি