ইসলামী হুকুমাতের শাসক-প্রশাসকের গুণাবলী
[ইসলামী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের গুরুত্ব –জরুরী গুণাবলীঃ ঈমান, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসমূহ উত্তমভাবে পালনের যোগ্যতা প্রতিভা, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তার সর্বাগ্রসর, ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা ও সুবিচার, পুরুষ হওয়া, আইন জ্ঞানে দক্ষতা পারদর্শিথা, স্বাধীনতা, জন্মসূত্রে পবিত্রতা –মানবিক ও উন্নতমানের চরিত্র।]

………………………………………………………………………………………………………………………

ইসলামে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের গুরুত্ব
মুসলিম উম্মতের জীবনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ও বিপদজ্জনক ব্যাপাদিতে সুষ্ঠু সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপরই জনগণের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য একান্তভাবে নির্ভর করে। এই কারণে ইসলামের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের ব্যাপারটি সর্বাদিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফয়সালাকারী বিষয়। তাই মুসলিম সমাজকে তাদের সামষ্টিক দায়িত্ব সুষ্ঠুরূপে পালনের জন্য একজন শাসক-প্রশাসক নিযুক্ত করা একান্তই কর্তব্য। এই উদ্দেশ্রে প্রত্যেক মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর একজন ‘ইমাম’ বা রাষ্ট্রনায়ক নিযুক্ত করা শরীয়াত ও সাহাবায়ে কিরামের আমল ‘ওয়াজিব’ (ফরয) প্রমাণ করেছে। রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সর্বপ্রথম কাজ হিসেবে সাহাবায়ে কিরাম (রা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র)-কে খলীফা নির্বাচিত করে এই কাজের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছে।

এই কারণে মুসলিম উম্মার ইতিহাসে এমন কোন সময় বা যুগ অতিবাহিত হয়নি, যখন তাদের ইমান বা সর্বোচ্চ শাসক কেউ ছিল না। আল্লামা জুরজানী এই প্রেক্ষিতেই দাবি করেছেনঃ [আরবী**********************]

‘ইমাম’ বা রাষ্ট্রনায়ক নিয়োগ মুসলমানদের কল্যাণ সাধনের পূর্ণতম ব্যবস্থা এবং দ্বীন-ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্যের সর্বাধিক মাত্রার বাস্তবায়ণ।

আল্লামা নসফী আহলিস্-সুন্নাত-ওয়াল-জামায়াতের আকীদা হিসেবে লিখেছেনঃ [আরবী*******************************]

মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য একজন ইমাম –রাষ্ট্রনায়ক –অবশ্যই থাকতে হবে –থাকা অপরিহার্য। সে আইন কানুনসমূহ কার্যকর করবে, শরীয়অত নির্দিষ্ট শাস্তিসমূহ জারি করযে, বিপদ-আপদের সকল দিক বন্ধ করবে, সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত ও সদা-প্রস্তুত করে রাখবে শত্রুর আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে। লোকদের নিকট থেকে যাকাত সাদাকাত ইত্যাদি গ্রহণ ও বন্টন করবে, বিদ্রোহী দুষ্কৃতিকারী, চোর-ঘুষখোর ও ডাকাত-ছিনতাইকারীদের কঠিন শাসনে দমন করবে। জুম’আ ও ঈদের নামাযসমূহ কায়েম ও তাতে ইমামতি করবে, লোকদের অধিকার প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ করবে (বিচার বিভাগ চালু করবে)। অভিভাবকহীন দুর্বল অক্ষম বালক-বালিকাদের বিবাহের ব্যবস্থা করবে, জাতীয় সম্পদ জনগণের মধ্যে বন্টন করবে। আর এই ধরনের বহু কাজই সে আঞ্জাম দেবে, যা কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জাম দিতে পারে না। [আরবী টীকা************]

ইমাম-রাষ্ট্রপ্রদানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের এই তালিকাই স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, মুসলিম উম্মতের সুষ্ঠু জীবনের জন্য যেমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন একজন ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের। অন্যথায় এই জরুরী কার্যসমূহ কখনই আঞ্জাম পেতে পারে না। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী আঞ্জাম দেয়ার জন্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান সেই ব্যক্তিই হতে পারে, যার মধ্যে জরুরী গুণাবলী পুরামাত্রায় অবশ্যই বর্তমান থাকবে। রাষ্ট্রপ্রধানের সেই গুণাবলী থাকা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য জরুরী শর্ত। সেই শর্তানুযায়ী গুণাবলী সম্পন্ন রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য জরুরী শর্ত। সেই শর্তানুযায়ী গুণাবলী সম্পন্ন রাষ্ট্রপ্রধান না হলে জাতীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণ রূপে বিপথগামী হওয়া, ইনসাফ ও ন্যায়পরতার সরল সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে। আর তারই পরিণতি গোটা উম্মতের চরম গুমরাহী, ব্যাপক অকল্যাণ ও মারাত্মক ক্ষতি সাধিক হওয়অ অবধারিত হয়ে পড়বে। তখন রাষ্ট্রনেতা গোটা উম্মতের চরম গুমরাহীর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং কিয়ামতের দিন মুসলিম উম্মত এই ধরণের রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট অভিযোগ করবে এই বলেঃ [আরবী*********************************]

হে পরওয়ারদিগার, এই লোকেরাই আমাদেরকে দ্বীন-ইসলাম থেকে গুমরাহ করেছিল। অতএব তুমি এদেরকে জাহান্নামের দ্বিগুণ আযাবে নিক্ষেপ কর।

বলবেঃ [আরবী************************************]

হে আমাদের রব্ব, আমরা আমাদের সরদার, বড় বড় নেতাদের অনুসরণ করেছিলাম। ফলে ওরা আমাদেরকে আসল পথ থেকে বিভ্রান্ত করেছে। হে আমাদের রব্ব তুমি আজ ওদেরকে দ্বিগুণ আযাব দাও। আর ওদের উপর বড় রকমের অভিশাপ বর্ষণ কর।

দুটি আয়াত দুইটি ভিন্ন ভ্ন্নি সূরা ও ভিন্ন ভ্ন্নি প্রেক্ষিতের হলেও মূল বক্তব্য অভিন্ন। আর তা হচ্ছে গুমরাহ, নেতৃত্বের মারাত্মক কুফল। রাষ্ট্রনেতা যদি ইসলামী আদর্শবাদী ও ইসলামের বাস্তব অনুসারী না হয়। তা যদি হয় ইসলাম বিরোধী মতাদর্শে বিশ্বাসী ও ইসলাম পরিপন্থী চরিত্রে ভূষিত, তাহলে তার অধীনে ইসলামী ও চরিত্রবান জীবন-যাপন করা কখনই সম্ভবপর হতে পারে না। তার পরিণতি হচ্ছে অধীনস্থ জনগণের চরম গুমরাহী ও পথভ্রষ্টতা। এর কুফল যে সর্বগ্রাসী ও মারাত্মক, তার বড় প্রমাণ, এই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আল্লাহর প্রতি ঈমানদার লোকেরা কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট প্রচণ্ড অভিযোগ পেশ করবে। বলবে, হে আল্লাহ! আমরা তো তোমার বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু এই নেতা বা নেতারা আমাদের তার সুযোগই দেয়নি, ওরা আমাদেরকে গুমরাহ করেছে, ভিন্নতর পথে চলতে বাধ্য করেছে।

জরুরী গুণাবলী
এই কারণে কুরআনের দৃষ্টিতে সকল পর্যায়ের নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পেশ করেছে, তাতে বিশেষভাবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের জণ্য কতগুলি জরুরী গুণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সেই গুণসমূহ যার মধ্যে পাওয়া যাবে, ইসলামী রাষ্ট্রের নেতা বা প্রধান তাকেই বানানো যেতে পারে। এখানে কতিপয় উচ্চতর গুণের উল্লেখ করে তার ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করছি।

১. ঈমান
দ্বীন ইসলামের প্রতি গভীর দৃঢ় ও পূর্ণাঙ্গ ঈমান হচ্ছে সর্বপ্রথম জরুরী গুণ। মহান আল্লাহ্ তা’আলা এই দ্বীন মানুষের সার্বিক জীবনের জন্য সর্বশেষ নবী-রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাধ্যমে নাযিল করেছেন। তা-ই হচ্ছে মানুষের একমাত্র পূর্ণঙ্গ জীবন বিধান। ব্যক্তি-জীবন ও সামষ্টিক-রাষ্ট্রীয় জীবন -জীবনের ও রাষ্ট্রের সকল দিক ও বিভাগ এই বিধান অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। আর রাষ্ট্রপ্রধানকে তার পূর্ণ শক্তি দিয়ে এই বিধানকে পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব পালন করতে হবে। দ্বীন-ইসলামই সর্বোত্তম নির্ভুল, মানব জীবনের যাবতীয় সমস্যার একমাত্র সমাধানকারী ও সর্বাধিক কল্যাণ দানকারী বিধানরূপে ঐকান্তিক ঈমান থাকতে হবে। আর এক কথায় এক একক ও অনন্য আল্লাহর প্রতি ঈমান, আল্লাহর শরীয়াতের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস।

এই শর্তের কারণে কোন কাফির ব্যক্তি মুসলিম জনগণের নেতৃত্ব ও প্রশাসকত্ব লাভ করতে পারে না। বিবেক-বুদ্ধির দিক দিয়েও এই ঈমানের শর্ত হওয়া জরুরী বিবেচিত হবে। কেননা ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শবাদী -আদর্শভিত্তিক -আদর্শ অনুসারী রাষ্ট্র। যে লোক সে আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী নয়, তার দ্বারা সে আদর্শের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন কখনই সম্ভবপর হতে পারে না। এজন্য ইসলামী জীবন-বিধানের প্রতি যথার্থ বিশ্বাসী নয় -এমন কোন ব্যক্তির মুসলিম জনগণের শাসক হওয়ার যোগ্যতা নেই, অধিকারও নেই। তাই আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করেছেনঃ [আরবী******************************]

আল্লাহ তা’আলা মু’মিন লোকদের উপর কাফির লোকদের কর্তৃত্ব করার কোন পথ-ই রাখেন নি।

২. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসমূহ উত্তমভাবে পালনের যোগ্যতা, প্রতিভা
প্রশাসনিক কর্তব্য ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সূচারুরূপে পালনের জন্য তার স্বভাবগত যোগ্যতা একান্তই অপরিহার্য। নেতৃত্ব দান ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের জন্য মৌলিক শর্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ মানের যোগ্যতা। কেননা মানুষের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শাসকদের অযোগ্যতা ও অনুপযুক্ততা বিশ্ব জাতিসমূহের -বিশেষ করে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে চরম দুর্গতি ও দুর্ভোগ।

প্রশাসকের এই গুণ থাকার শর্তটির গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। তা প্রমাণের জন্য কোন দলীল পেশ করার প্রয়োজন পড়ে না। নেতৃত্ব স্বতঃই এ শর্তের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। রাসূলে করীম (স) নিজে এ শর্তের প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ [আরবী****************************************]

সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব দান কেবল মাত্র পুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। তার জন্যও তিনটি শর্ত রয়েছেঃ এমন সততা-ন্যায়পরতা-আল্লাহ পরস্তি যা তাকে আল্লাহর নাফরমানীর কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং ধের্যস্থৈর্য, যেন তদ্ধারা সে স্বীয় ক্রোধ দমন করতে পারে। যাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে তাদের উপর উত্তম নেতৃত্ব দান, যেন তারা সবাই তার সন্তান-তুল্য হয়ে যায়।

ইসলমা তো এই শর্তও করেছে যে, প্রশাসককে প্রতিষ্টান পরিচালনায় অন্যদের তুলনায় অধিক যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে।

হযরত আলী (র) বলেছেনঃ

লোকদের উপর নেতৃত্ব দানের অধিক অধিকারী হবে সেই ব্যক্তি, যে তাদের সকলের তুলনায় অধিক দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও অধিক শক্তিশালী হবে। আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অন্যদের অপেক্ষা অধিক জ্ঞানী ও বিদ্বান, কেউ গণ্ডগোল করলে তাদে অভিযুক্ত করবে, তাতে দমিত না হলে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র কার্যক্রম গ্রহণ করবে।-[আরবী টীকা***********************]

৩. রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তায় সর্বাগ্রসর
নিছক প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ও উত্তম নেতৃত্বের গুণাবলীই ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তায় নেতাকে অন্যান্য সকলের তুলনায় অনেক বেশী অগ্রসর হতে হবে! তাহলেই তার পক্ষে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ সম্পর্কে অধিক বেশী জ্ঞানী হয়ে কাজ করা সম্ভব হবে। মানুষের অভাব-অনটন ও প্রয়োজন সম্পর্কে বেশী অবহিতি লাভ তার পক্ষে সহজ হবে। ফলে কোন জাতীয় বিষয়ে তার মত ভুল হবে না, কোন সিদ্ধান্ত ভ্রান্তিপূর্ণ হবে না। তার কোন বিষয়ে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি কম থাকবে। আর ইসলামী সমাজ তখন অতীব উন্নতমানের নেতৃত্ব পেয়ে অধিকতর ধন্য হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবে।

এই সব কারণে মুসলিম উম্মতের সর্বোচ্চ প্রশাসন সম্পর্কে একথা নির্দিষ্ট হয়ে আছে যে, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অতীব উন্নতমানের হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাহলেই তার পক্ষে মুসলিম উম্মতকে সঠিক ও নির্ভুল নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হবে এবং কালের অগ্রগতির সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে জনগণকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়া সহজতর হবে।

এজন্য তাকে সাম্প্রতিককালের আন্তর্জাতিক রাজনৈকিত অবস্থা ও উত্থান পতন পর্যায়ে উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। তাহলেই তার পক্ষে জিন জাতিকে আন্তর্জাতিক ঘাত-প্রতিঘাতের ক্ষতি রক্ষা করা সম্ভবপর হবে। কেননা বর্তমান দুনিয়ায় যে কোন সময়ের প্রেক্ষিতে কোন দেশ বা সমাজই অন্য নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারে না। চতুর্দিকের সার্বিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখেই প্রত্যেকটি জাতি জনগোষ্ঠিকে নিজস্ব লক্ষ্য পথে চলতে হয়। অজানা-অচেনা পথে চলা যেমন মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে, তেমনি সেই চলায় গতিশীলতার সৃষ্টি করা কখনই সম্ভব হয় না। আর রাষ্ট্র পরিচালনা বাস্তবিকই কোন ছেলেখেলা নয়, নয় হাস্য কৌতুকের ব্যাপার। না জেনে না বুঝে না দেখে চলতে গেলে রূঢ় বাস্তবতার কঠিন আঘাতে গোটা জাতির চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া কখনই আশংকামুক্ত হতে পারে না।

৪. ন্যায়পরতা, নিরপেক্ষতা ও সুবিচার
রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রনেতাকে অপর যে গুণে অধিক গুণান্বিত হতে হবে, তা হচ্ছে সুবিচার, ন্যায়পরতা ও নিরপেক্ষতার গুণ। অবশ্য সর্বপ্রকার গুনাহ ও নাফরমানী থেকে তো তাকে দূরে থাকতেই হবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সুবিচার ও ন্যায়পরতা উচ্চতর মহত্তর গুণের অধিকারী না হলে তার পক্ষে স্বীয় দায়িত্ব পূর্ণ সততার সাথে পালন করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি জনগণের সত্যিকার অর্থে কোন কল্যাণ সাধনও অসম্ভব। বস্তুত সুবিচার ন্যায়পরতা এক মানসিক অবস্থা বিশেষ। তা ব্যক্তিকে সর্বপ্রকারের গুনাহ থেকে যেমন দূরে রাখে তেমনি জাতীয় পর্যায়ের কার্যাবলীতে খিয়ানত, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা-প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ ও জুলুম শোষণ নির্যাতনমূলক কার্যক্রম থেকেও মুক্ত ও পবিত্র থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।

অতএব কোন ফাসিক -আল্লাহর বিধান পালনকারী ব্যক্তিকে মুসলিম উম্মতের সর্বোচ্চ -শুধু সর্বোচ্চ নয় -কোন পর্যায়ের শাসকরূপে নিয়োগ করা ইসলামের মানব কল্যাণমূলক আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সূরা হুদ এর পূর্বোদ্ধুত ১১৩ আয়াতে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা যে জালিম লোকদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে -আনুগত্য স্বীকার করতে -স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন তা এই কারণে। তিনি আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ [আরবী*********************]

যে লোকের দিল আল্লাহর স্মরণশূন্য -আল্লাহর আনুগত্যমূলক ভাবধারাহীন -এবং স্বীয় বন্ধন-নিয়ন্ত্রনহীন কামনা-বাসনার অধিকারী, আর এ কারণে যার কাজকর্ম বাড়াবাড়িপূর্ণ তুমি তার অনুসরণ কখনই করবে না।

এরূপ চরিত্রের লোকদের আনুগত্য-অধীনতা-অনুসরণ যে চরম গুমরাহীর কারণ, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। কিয়ামতের দিন এরূপ লোকদের অনুসরণকারীরা আল্লাহর নিকট যে ফরিয়াদ করবে, তার উল্লেখ করে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ [আরবী***********************]

দ্বীন-ইসলাম অমান্যকারী -কাফির -লোকেরা (কিয়ামতের দিন) বলবেঃ হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমরা তো দুনিয়ায় আমাদের সরদার, নেতা ও আমাদের অপেক্ষা পড় লোকরেই আনুগত্য করে চলেছি। ফলে তারা আমাদেরকে (তোমার আনুগত্যের) পথ থেকে গুমরাহ করে নিয়েছে।

সাধারণভাবে সকাজে যেসব লোক কর্তা, নেতা ও মাতব্বর-সরদার হয়ে তাকে, নির্বিচারে ও অন্ধভাবে তাদের আনুগত্য স্বীকার করাই এই গুমরাহীর মূলীভূত কারণ।

তারা বলবেঃ তা না করে আমরা যদি সর্বাবস্থায় কেবল আল্লাহর ও রাসূলেরই আনুগত্য করতাম, তাহলে আজকে -কিয়ামতের দিন -জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে ও তথায় চিরদিন অবস্থানের ঘোষণা শুণতে বাধ্য হতাম না। [আরবী**************]

তারা বলবেঃ হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম, আনুগত্য করতাম রাসূলের!

কিন্তু আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করা তাদের পক্ষে সম্বব হয়নি শুধু গুমরাহ সরদার-মাতব্বর-নেতৃস্থানীয় ও বড় বড় লোকদের আনুগত্য স্বীকার করার কারণে। কিয়ামতের দিন তারা তাদের দুনিয়ায় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়বে এবং আল্লাহর নিকট নিজেদের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য তাদের অনুসৃত এই নেতাদের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করে বলবেঃ [আরবী*****************************]

হে পরওয়ারদিগার! তুমি ওদেরকে দ্বিগুণ আযাব দাও এবং ওদের উপর বড় ধরনের অভিশাপ বর্ষন কর।

এসব আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে একথা সুস্পষ্ট ও অকাট্য যে, ফাসিক-ফাজির-আল্লাহদ্রোহী-আল্লাহর নাফরমান পাপী-পথভ্রষ্ট লোকদের তারা সামাজিকতার দিক দিয়ে যত বড় প্রভাবশালী ও ধনশালীই হোক -নেতৃত্ব ও কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে বা থাকলে তা সম্পূর্ণরূপে উৎখান তরা মুসলিম উম্মতের দ্বীনী ও রাজনৈতিক দায়িত্ব।

মোটকথা, আল্লাহর ভয়ে ভীত নয়, তাঁর শরীয়াতের আনুগত নয় -এমন কোন ব্যক্তির নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব মুসলিম উম্মতের কখনই মেনে নেয়া ও বরদাশত করা উচিত নয়।

মুসলিম জনগণের নেতা এমন ব্যক্তি কখনই হতে পারে না যেঃ

১. কৃপণ -কেননা সে তো তার যাবতীয় ধন-সম্পদ পেটুকের মত খেয়ে শেষ করবে।

২. মূর্খ -কেননা সে তার মূর্খতার দ্বারা সমস্ত মানুষকে গুমরাহ করবে।

৩. নির্দয়-অত্যাচারী -কেননা সে তার নির্দয়তা ও অত্যাচারে জনগণকে জর্জরিত ও অতিষ্ঠ করে তুলবে।

৪. অন্য রাষ্ট্রের ভিন্নতর আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট -কেননা এরূপ ব্যক্তি কোন সমাজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভ করলে সে সমাজের স্বাধীনতা বিদেশী শক্তির নিকট বিক্রয় করে দেবে। স্বাধীন জাতিকে পরাধীন বানিয়ে দেবে।

৫. ঘুষখোর-দূর্নীতিপরায়ণ -এরূপ চরিত্রের লোক শাসক-প্রশাসক হলে সে বিচার কার্যে ও দেশ শাসনে জনগণের অধিকার ন্যায়সঙ্গতভাবে আদায় করতে পারবে না। আল্লাহর নির্ধারিত সীমাসমূহ যথাযথভাবে রক্ষা করতে পারবে না।

৬. রাসূলের সুন্নাতকে অমান্য-উপেক্ষাকারী -কেননা এরূপ ব্যক্তি জনগণকে কখনই কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে পারবে না।

এই কারণে মুসলিম উম্মতের নেতা ও প্রশাসককে অবশ্যই আত্ম-সংযমশীল, ইসলামী শিক্ষায় পূর্ণ শিক্ষিত এবং পূর্ণ মাত্রায় ইসলামী চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে। ইসলামের বিধান কার্যত অনুসরণকারী ও বাস্তবভাবে প্রবর্তনকারী হতে হবে। নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী*************************]

সুবিচারক ন্যায়বাদী শাসকের অধীন একটি দিন চল্লিশ দিনের বৃষ্টিপাতের কল্যাণের চেয়েও অধিক উত্তম এবং পৃথিবীতে আল্লাহ নির্ধারিত একটি শাস্তি কার্যকর হওয়া এক বছরের নফল ইবাদতের তুলনায় অধিক পরিশুদ্ধতা সৃষ্টিকারী।

তিনি আরও বলেছেনঃ [আরবী********************]

কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ও আসন গ্রহণের দিক দিয়ে তাঁর সর্বাধিক নিকটবর্তী ব্যক্তি হবে সুবিচারক নেতা ও শাসক এবং সেদিন আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণ্য ও আসন গ্রহণের দিক দিয়ে অধিক দূরবর্তী হবে অন্যায়কারী-অত্যাচারী নেতা বা শাসক।

তাঁর এই হাদীসটিও স্মরণীয়ঃ [আরবী*****************]

কিয়ামতের দিন সুবিচারকারী ন্যায়বাদী শাসকরা আল্লাহ রহমানের ডান দিকে নূর-এর উচ্চাসনে আসীন হবে -আল্লাহর দুটি দিক-ই ডান -তারা সেই লোক, যারা তাদের শাসন কার্যে ও বিচার-আচারে তাদের জনগণ ও বন্ধুদের মধ্যে ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত করবে।

এই শেষোক্ত হাদীসটি যদিও বিচারকার্যে সম্পর্কীয়, তবু তা সাধারণ অর্থে দেশ শাসন ও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য। কেননা এই কাজটি বিচার বিভাগীয় কাজের মূর হোতা এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কেননা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ দায়িত্ব যে ধরনের লোকের হাতে থাকবে, তার প্রশাসনের অধীন বিচার বিভাগীয় কার্যও সেই ধরনেরই হবে, তা নিঃসন্দেহে-ই বলা যায়। এই কারণে সর্বোচ্চ প্রশাসকের মধ্যে এই গুণ সর্বাধিক মাত্রায় থাকা সবকিছুর তুলনায় অনেক বেশী প্রয়োজন।

নামাযের ইমামতির ক্ষেত্রেও এই ন্যায়পরতা ও সুবিচারের শর্ত আরোপ করা হয়েছে, অথচ নামায ইসলামী জীবন-বিধানের একটি কাজ মাত্র -যদিও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ -নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমিত। তাই গোটা ইসলামী দেশের বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগণের সর্বোচ্চ শাসককে সবচেয়ে বেশী ন্যায়বাদী, নিরপেক্ষ, সুবিচারক ও ইসলামী আদর্শের অবিচল অনুসারী হওয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কেননা গোটা উম্মতের জীবন-মরণের মূল চাবি-কাঠি তার হাতেই নিবদ্ধ।

৫. পুরুষ হওয়া
মুসলিম উম্মতের সর্বোচ্চ শাসক-প্রশাসককে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। ইসলামী জীবন-বিধানে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ এক জরুরী শর্ত। ইসলাম এ শর্ত আরোপ করে নারীদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার কিছুমাত্র লাঘব করেনি, নারীর প্রতি প্রকাশ করেনি কোন হীনতা বা ছোটত্ব। নারীর স্বভাবগত যোগ্যতা ভাবধারা ও অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নারীদের প্রকৃতিগত বিশেষত্বই এ পার্থক্য সৃষ্টির মৌল কারণ। রাষ্ট্রপ্রধান বা মুসলিম উম্মতের সর্বোচ্চ শাসককে যেসব কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়, দূরূহ সামষ্টিক সমস্যাবলীর সমাধান করতে হয়, বহু লোককে কর্মে নিযুক্ত করতে হয়, কাজ আদায় করতে হয়, বহু দেশী-বিদেশীদের সাথে কথোপকথন চালাতে হয় -তা করার জন্য যে স্বভাবগত দক্ষতা, যোগ্যতা ও সর্বাবস্থায় প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন তা নারীর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।

কেননা একথা সর্বজনস্বীকৃতব্য যে, নারী পুরুষ অপেক্ষা অধিক স্নেহপ্রবণ, বিনম্র হৃদয়, আবেগ-সংবেদনশীলতার মূর্ত প্রতীক। কঠিনতা-কঠোরতা ও অনমণীয়তা তার প্রকৃতি-পরিপন্থী। এই কারণে ইসরাম নারীকে সকল প্রকারের কঠিন-কঠোর পরিশ্রমের কাজ থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। কেননা ইসলামের স্থায়ী শাশ্বত নিয়মই হচ্ছে কারোর উপর এমন কাজের দায়িত্ব না চাপানো, যা করা তার পক্ষে স্বভাবতই কঠিন বা দুষ্কর ও কষ্টদায়ক কিংবা সাধ্যের অতীন। এ ধরনের কাজের দায়িত্ব এ কারণেই কেবল পুরুসদের উপর অর্পণ করা হয়েছে। কেননা এ ধরনের কাজের যোগ্যতা কেবল পুরুষদেরই থাকা সম্ভব। পুরুষরা জন্মগতভাবেই শক্তি-সামর্থ্য সম্পন্ন, দুর্দান্ত ও দুর্ধর্ষ। সামষ্টিক নেতৃত্ব কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কঠিন দায়িত্ব পালন নারীদের অপেক্ষা পুরুষদেরই সাধ্যায়ত্ব।

নারীদের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল কাজ হচ্ছে মাতৃত্ব। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব, লালন-পালন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুরূহ ও কষ্টসাধ্য কাজ। এ কাজ যে অবিচল ধৈর্য-সহ্য শক্তি ও অসীম-গভীর স্নেহ ও মায়া মমতার প্রয়োজন, তা পুরুষের তুলনায় নারীদেরই রয়েছে অনেক বেশী মাত্রায়। এই কারণেই এ কাজ কেবল নারীদের। এ কাজে পুরুষদের কোন অংশ নেই। নারী-পুরুষের প্রকৃতি ও স্বভাবগত পার্থক্য অনুসারেই বিশাস জীবন-ক্ষেত্রের এই কর্ম বন্টন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মানব বংশের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নারীকেই প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। পুরুষের ভূমিকা গুরুত্বহীন না হলেও তা পরোক্ষ এবং বাহ্যিক পর্যায়ের। পুরুষ বীজ বপন করেই খালাস। সে বীজ ধারণ, সংরক্ষণ, লালন, অংকুরের বিকাশ সাধন ও পূর্ণাঙ্গ মানুষরূপী একটি মহীরুপ সৃষ্টির সমস্ত কাজ নারীকেই করতে হয়। আর তা করার জন্য যে দৈহিক প্রস্তুতি একান্তই অপরিহার্য, তা নারীদেহেই বিরাজিত তার জন্ম মুহুর্ত থেকেই। এর কোন একটি কাজ করার দৈহিক প্রস্তুতি পুরুষের নেই। কেননা প্রকৃতিগতভাবেই এ কাজ পুরুষের নয়, এ কাজ একমাত্র নারীর-ই করণীয়।

কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে নারী অত্যন্ত তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল মানুষ। এইজন্য অলংকার ও প্রসাধন সামগ্রী নারীদের জন্য, পুরুষদের জন্য নয়। তাই ঝগড়া-বিবাদ, বিতর্ক ও যুদ্ধ-বিগ্রহে অগ্রবর্তী ভূমিকা পুরুষকেই পালন করতে হয়, নারী এ ক্ষেত্রে শুধু অক্ষমই নয়, ব্যর্থ-ও। তাই কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ [আরবী******************************]

নারীরা তো সেই মানুষ, যারা অলংকারে প্রতিপালিত হয়। আর তারা তর্ক-বিতর্কে-দুর্ধর্ষ প্রতিপক্ষের সাথে মুকাবিলা করায় নিজেদের বক্তব্য পূর্ণমাত্রায় স্পষ্ট করে বলত অক্ষম। -[মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা সন্তান সাব্যস্ত করত। তারই প্রতিবাদে কুরআনে এই কথাটি বলা হয়েছে যে, এ তো খুব ভালো বন্টন -তোমরা নিজেদের জন্য পুত্র সন্তান সাব্যস্ত কর আর আল্লাহর ভাগে ফেল কন্যা সন্তান, যাদের অবস্থা এই…………….।]

অলংকার ও সৌন্দর্য-উপকরণাদির প্রতি নারীদের স্বাভাবিক ঝোঁক প্রবণতা। তারা বাক-বিতণ্ডা ও শক্তির প্রতিযোগিতায় অনগ্রসর।

কুরআনে ঘোষিত নীতিতে এ স্বাভাবিক অবস্থারই প্রতিফলন। প্রতিপক্ষের সাধারণত প্রবল ও দুর্ধর্ষই হয়ে থাকে, তা যে কোন ক্ষেত্রেই হোক। রাষ্ট্রীয় ও সামষ্টিক পর্যায়ের প্রতিপক্ষের দুর্ধর্ষতা প্রশ্নাতীত। অথচ নারী সমাজ স্বভাবতই এই ক্ষেত্রে অক্ষমতার পরিচয় দিয়ে থাকে তাদের প্রকৃতিগত অক্ষমতার কারণেই। পক্ষান্তরে পুরুষরা তাদের স্বাভাবিক পৌরুষের কারণে এ ক্ষেত্রে খুবই পারঙ্গম। এ কারণে ইসলাম বিচারকার্য, বিবাদ-মীমাংসা ও বাক-বিতণ্ডার কোন দায়িত্ব নারীর উপর অর্পণ করেনি। কেননা এ কাজটি-ই নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যায়ের। এ ক্ষেত্রে যে বিপরীত দিকের চাপ অনিবার্য তার প্রতিরোধ নারীর সাধ্যাতীত। তবে ব্যতিক্রম কখনই নীতি নির্ধারণের ভিত্তি হতে পারে না।

হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর সারা রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পর্যায়ের কোন দায়িত্ব কখনই কোন নারীর উপর অর্পণ করেন নি, কোন কোন নারীর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে কিছু না কিছু মাত্রার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। শুধু তাই নয়, সমগ্র মুসলিম শাসন আমলে উমাইয়্যা-আব্বাসীয়-মোগল তুর্কী-ওসমানীয় বা আন্দালুসিয়ার শাসনের ইতিহাসে এর ব্যতিক্রম কোথাও দেখা যাবে না। যদিও খিলাফতে রাশেদার পরে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ পুরাপুরি ও যথাযথভাবে অনুসৃত হয়নি। -[ নারী বিচার বিভাগে নিযুক্ত হতে ও বিচারকার্য সম্পাদন করতে পারে কিনা, এ বিষয়ে ইসলামী মনীষীগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। প্রখ্যাত ফিকহবিদ ইবনে কুদামা তাঁর ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা দেশ শাসনের দায়িত্ব পালনে নারী যোগ্য নয়। নবী করীম (স)-এর শাসনামলে, খুলাফায়ে রাশেদীন বা পরবর্তী যুগে কোন নারীকে এই ধরনের কাজে নিযুক্ত করা হয়নি। শায়খ তুসী বলেছেন, নারী বিচারকার্যে নিযুক্ত পেতে পারে না। ইমাম শাফিঈরও সেই মত। ইমাম আবু হানিফা (র) বলেছেন, যেসব ব্যাপারে নারী সাক্ষী হতে পারে, সে সব ব্যাপারে বিচারকও হতে পারে। তা হদূ ও কিসাস ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই হতে পারে। ইবনে জরীর তাবারীও এই মতই লিখেছেন। কেননা নারীও ইজতিহাদের যোগ্যতার অধিকারী হতে পারে। আর বিচারকার্যে তারই প্রয়োজন বেশী।]

রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ [আরবী************************]

যে জনগোষ্ঠীর প্রধান কর্ত্রী হচ্ছে নারী, তারা কখনই কল্যাণ পেতে পারে না।

এই বর্ণনাটির আর একটি ভাষা হচ্ছেঃ [আরবী****************]

যে জনগোষ্ঠী কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না, যারা একজন নারীকে নিজেদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সম্পন্ন বানিয়েছে।

বর্ণনাটির অপর একটি ভাষা হচ্ছেঃ [আরবী**************************]

যে জনগণ তাদের সামষ্টিক দায়িত্ব কোন মেয়েলোকের নিকট সোপর্দ করেছে, তারা কোনক্রমেই সাফল্য লাভ করতে পারে না।

হযরত আবূ হুরাইরা (র) থেকে এ পর্যায়ের যে বর্ণনাটি উদ্ধৃত হয়েছে, তার ভাষা এইঃ [আরবী*********************************]

তোমাদের সামষ্টিক কার্যাবলীর কর্তৃত্ব যখন তোমাদের মধ্যকার অধিক দুষ্ট ও খারাপ লোকদের হাতে চলে যাবে, তোমাদের সমাজের ধনীরা যখন হবে কৃপণ এবং তোমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব কর্তৃত্ব নারীদের নিকট ন্যস্ত হবে, তখন পৃথিবীর উপরিভাগের তুলনায় অভ্যন্তর ভাগই তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর হবে (জীবনের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয় হবে)।

এসব কারণে নারীদের জন্য আযান ও নামাজের ইকামতও বলা জরুরী করা হয়নি। নারীদের জন্য ইসলাম যে সম্মান ও মর্যাদা নির্দিষ্ট করেছে, তাতে এসব কাজের দায়িত্ব তাদের জন্য সঙ্গতিসম্পন্ন হতে পারে না। বস্তুত ইসলামের পরিবার সংস্থায় সার্বিক নেতৃত্ব যেমন পুরুষের, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বেও তেমনি পুরুষদেরই অগ্রবর্তিতা। এসব নীতি কুরআনের এ আয়াতেরই পরিণতিঃ [আরবী**************************]

৬. আইন-জ্ঞানে দক্ষতা, পারদর্শিতা
ইসলামী হুকামাত যেহেতু আল্লাহর আইন-বিধান ভিত্তিক, জনগণের উপর আল্লাহর আিইন কার্যকর করণেরই অপর নাম, তাই রাষ্ট্রপ্রধান ও সর্বোচ্চ শাসককে অবশ্যই ইসলামী আইন-বিধানে যথেষ্ট মাত্রায় দক্ষ ও পারদর্শী হতে হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরতান্ত্রিক ও জালিম হওয়ার আশংকা শতকরা এক’শ ভাগ। কেননা আল্লাহর দেয়া আইন যখন তার জানা থাকবে না, তখন সে নিজে ইচ্ছুক হলেও তার পক্ষে আল্লাহর আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা এবং রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কার্যাবলীতে শরীয়াতের অনুসরণ করা কার্যত তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তখন সে নিজ ইচ্ছামত সবকিছু করতে শুরু করবে। তখন সে হয়ত নিজের মনমত কোন নীতি নির্ধারণ করে ইসলামী আইনের নাম দিয়ে তা-ই চালাতে থাকবে। এইরূপ অবস্থায় রাষ্ট্র ও মুসলিম জনগণ -উভয়ের মারাত্মক অবস্থা দেখা দেয়া অবধারিত।

৭. স্বাধীনতা
মুসলিম উম্মার নেতৃত্ব অবশ্যই এমন ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা যেতে পারে না, যার গ্রীবা দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী। তাকে অবশ্যই মুক্ত ও স্বাধীন হতে হবে। তাহলেই সে সকল মানুষকে দাসত্বের লাঞ্ছিত শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার দয়িত্ব যথার্থভাবে পালন করতে সক্ষম হবে।

বর্তমান জগতে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা মূলত স্বাধীন মানুষকে মানুষের দাসানুদাস বানাবারই ব্যবস্থা। এ পর্যায়ে পাশ্চাত্যের ধর্মহীন গণতন্ত আর কমিউনিজম-সমাজতন্ত্র অভিন্ন ভূমিকাই পালন করেছে। এসব রাষ্ট্র ব্যবস্থা দুনিয়ার যেখানে যেখানেই প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর -তা বৃটিশ বা আমেরিকান সমাজে হোক; কিংবা চীনা ও রাশিয়া এবং সে সবের পক্ষপুটে আশ্রিত সমাজেই হোক; সর্বত্রই মানুষ মানুষের দাস। এসব দেশের শাসন ব্যবস্থা শুধু নিজ দেশের কোটি কোটি নিরীহ স্বাধীন মানুষকে দাসানুদাস বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, প্রতিবেশী স্বাধীন সমাজের মানুষের উপর এই দাসত্বের অভিশাপ চাপিয়ে দিতে একবিন্দু কুণ্ঠিত হয় না। সত্যি কথা হচ্ছে, এসব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ মানবতার মুক্তির জন্য গালভরা বুলি যতই চলে ও প্রচার করে বেড়াক না কেন, শ্লোগানে ভুলিয়ে-ভালিয়ে স্বাধীন মানুষকে স্বৈর শাসনের জগদ্দল পাথরের তলায় ফেলে নির্মমভাবে নিষ্পেষিত করাই হচ্ছে এসব দেশ ও সমাজের বৈদেশিক নীতি। এ নীতি দুর্বল জাতিসমূহকে রাজনৈতিক দাসত্ব শৃঙ্খলেই বন্দী করে না, সেই সাথে -আর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিকভাবে তা সম্ভব না হলে -অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্ধী করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও মানবিক আদর্মসমূহের মধ্যে একমাত্র ইসলাম-ই বিশ্বমানবতার মুক্তিসনদ হয়ে এসেছে মহান আল্লাহর নিকট থেকে ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক ঘোষণাই হচ্ছে -মানুষ মুক্ত ও স্বাধীন, মানুষ তারই মত অন্য মানুষের -এই বিশ্ব প্রকৃতির কোন কিছুরই দাসত্ব মেনে নিতে পারে না। সব কিছুর সকল প্রকারের দাসত্বকে স্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবে অস্বীকার করে একমাত্র মহান বিশ্বস্রষ্ট্রা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করবে, কেবলমাত্র তাঁরই ঐকান্তিক দাস ও গোলাম হয়ে জীবন-যাপন করবে। বস্তুত যে লোক তা করতে সক্ষম হবে তার পক্ষেই সম্ভব হবে অন্য সব কিছুর গোলামী থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তিলাভ করা। আর যে তা পারবে না, তাকে কত শক্তির দাসত্ব করতে হবে, তার কোন ইয়ত্তাই নেই। কুরআন মজীদে বিশ্বমানবতার জন্য এই মুক্তির বাণী উদাত্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। বলা হয়েছেঃ [আরবী********************************]

হে কিতাবধারী লোকেরা! তোমরা সকলে এমন একটি মহাবাণী গ্রহণে এগিয়ে এসো, যা আমাদের ও তোমারেদ মাঝে অভিন্নভাবে সত্য ও গ্রহণীয়। আর তা হচ্ছে, আমরা কেউ-ই এক আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই দাসত্ব স্বীকার করব না, তাঁর সাথে কিছুকেই শরীক বানাব না এবং সেই আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমরা পরস্পরকেও রব্ব-প্রভু সার্বভৌম-সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী -মেনে নেব না।

ইসলাম বাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) দুনিয়ায় এসেছিলেন-ই বিশ্বমানবতাকে মানুষের দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। হযরত আলী (র)-র এ উক্তিটি এ পর্যয়ে স্মরণীয়ঃ [আরবী*******************************]

আল্লাহ তা’আলা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বলেছিলেন এ উদ্দেশ্যে যে, তিনি তাঁর বান্দাগণকে তাঁর বান্দাগণের ইবাদাত-দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তাঁর (আল্লাহর) দাসত্ব করার দিকে নিয়ে আসবেন, তাঁর বান্দাগণের সাথে কৃত চুক্তি-প্রতিশ্রুতির বাধ্যবাধকতা থেকে তাঁর (আল্লাহর) চুক্তি পালনের দিকে এবং তাঁর বান্দাগণের আনুগত্য থেকে মুক্ত করে তাঁর (আল্লাহর) আনুগত্য-অধীনতার দিকে নিয়ে আসবেন।

যাবতীয় অ-খোদা শক্তির দাসত্ব-আনুগত্যের বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য ইসলামের এ আহবান নির্বিশেষে সমস্ত বিশ্বমানবতার প্রতি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষিত হয়েছে এবং কেবলমাত্র ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার জন্য সকলকে তাকীদ করা হয়েছে। মানবতাকে মানুষের দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার এ ব্যাপারটি কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি এ মহান উদ্দেশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা না করার জন্য কুরআন মুসলিম জন শক্তিকে তিরস্কার করেছে। প্রশ্ন তুলেছেঃ [আরবী************************************]

তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছ না কেন? অথচ অবস্থা হচ্ছে এই যে, পুরুষ-নারী-শিশু -এই দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা ফরিয়াদ করছে যে, হে আমাদের পরওয়ারদিগার, এই জালিমদের দেশ থেকে আমাদেরকে মুক্তি দাও।

অন্য কথায়, মজলুম মানবতার মুক্তির জন্য যুদ্ধ ঘোষণা আল্লাহর পথে কৃত যুদ্ধ এবং তা করা প্রত্যেক মুসলিম শক্তিরই কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন না করলে আল্লাহর নিকট তিরস্কৃত হওয়া অবধারিত। এ আয়াতে মজলুম লোকদের মুক্তিদানের জন্য যুদ্ধ করার আহবান জানানো হয়েছে এজন্য যে, তারা মানুষকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী। আর এজন্যই তারা মজলুম। জালিমরা এই দুর্বল লোকদেরকে দাসানুদাস বানিয়ে তাদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার ও জুলুম চালাচ্ছে।

মোটকথা, ইসলাম মানুষের দাসত্ব বরদাশত করতে প্রস্তুত নয়। দুনিয়ার যেখানেই মানুষ মানুষের দাস হয়ে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, ইসলমী শক্তির কর্তব্য হচ্ছে, তাদের সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন হলে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে। মানবতাকে যারা নিজেদের অধীন বানিয়ে নিতান্তই গোলামের ন্যায় জীবন যাপন করতে বাধ্য করছে, তারাই ইসলামের দুশমন। কেননা তারা স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে যতক্ষণ না তারা অস্ত্র সংবরণ করছে, পরাজয় বরণ করছে এবং দাস মানুষদেরকে মুক্ত ও স্বাধীন করে দিচ্ছে। -[ পরাজিত শত্রুপক্ষের যেসব লোক যুদ্ধবন্দী হয়ে ইসলামী শক্তির হাতে আসবে, তাদের সম্পর্কে ইসলামের নীতি ভিন্নতর প্রসঙ্গে আলোচিতব্য।]

এ আলোচনা থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যে লোক দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী -গোলাম, তার পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। সে তো মজলুম, অসহায়। তার নিজের মুক্তি সাধনই তার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব।

৮. জন্মসূত্রে পবিত্রতা
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই ‘হালাল জাদাহ’ -পবিত্রজাত হতে হবে। এরূপ শর্ত করার মূলে কতিপয় স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তন্মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যভিচারের পথ বন্ধ করা। কেননা অবৈধ জন্মের ব্যক্তি তার সন্তানদের চিরন্তন ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করবে -অন্তত নৈতিকতার দিক দিয়ে। ব্যভিচার প্রসূত ব্যক্তিদের যদি মুসলিম উম্মার উচ্চতর নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে গোটা উম্মতের পক্ষেই লজ্জার কারভণভ হয়ে দাড়াবে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্মুখে মাথা উঁচু করে দাড়ানো সেই জনগোষ্ঠীর পক্ষ সম্ভব হবে না। বিশেষ করে সে জনগোষ্ঠী বিশ্ববাসীর সম্মুখে মুসলিম পরিচিতি লাভ থেকে অবশ্যই বঞ্চিত হবে। কেননা যে ইসলাম ব্যভিচারকে একটি অতি বড় (কবীরা) গুনাহ বলে দুনিয়াবাসীর নিকট ঘোষণা করছে এবং বিশ্ব জনগণকে তা থেকে বিরত থাকার আহবান জানাচ্ছে, সেই ইসলামে বিশ্বাসী হওয়ার দাবিদার উম্মতের প্রধান ব্যক্তিই হচ্ছে ব্যভিচারের ফসল। আর সেই জনগঘ মুসলিম হয়েও সেই ব্যক্তির অধীনতা ও নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে, তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। বস্তুত এর চাইতে লজ্জাকর ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।

ব্যভিচারপ্রসূত ব্যক্তি হচ্ছে হারাম পথে যৌন উত্তেজনা চরিতার্থ করার জন্য নিষ্কাশিত শুক্রকীটের ফসল। এর মনস্তাত্ত্বিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তার নিজের মনস্তত্ত্বে ও চরিত্রে প্রতিফলিত হওয়া খুবই সম্ভব। তার নিজের পক্ষেও যৌন উত্তেজনার বলগাহারা অশ্বের দাপটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।

ব্যভিচার প্রসূত ব্যক্তির পিতা-মাতা উভয়ই স্বাভাবিকতার আইন লঙ্ঘন করেছে, আল্লাহর সাথে কৃত চুক্তি বেপরোয়াভাবে ভঙ্গ করেছে। এর অনুভূতি তাদের মন-মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে থাকতে পারে। তার তীব্র কুপ্রভাব শুক্রকীটের মাধ্যমে স্বভাবগত উত্তরাধিকার নিয়মে তার নিজের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে। আর সেও জন্মগত দোষের কারণে আইন লঙ্ঘনকারী ও চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ে গড়ে উঠে থাকতে পারে। পিতা-মাতার বা তাদের একজনের স্বাভাব প্রকৃতি ও চরিত্র সন্তানের মধ্যে সংক্রমিত হওয়া এমন এক বৈজ্ঞানিক সত্য, যা কেউ-ই অস্বীকার করতে পারে না। অতএব এইরূপ ব্যক্তির হাতে মুসলিম উম্মতের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের লাগাম কখনই সপে দেয়া যায় না।

মানবিক ও উন্নতমাতের চরিত্র
এসব ব্যক্তিগত গুণ ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই উন্নত মানের মানবিক ও ইসলমী চারিত্রিক গুণে ভুষিত হতে হবে। কুরআন মজীদে এই গুণসমূহের সমন্বিত গুণ -তাকওয়ার -কথা বলা হয়েছেঃ [আরবী*************************]

আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্য থেকে সর্বাধিক সম্মানিত (সম্মানার্হ) ব্যক্তি সে, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়া সম্পন্ন।

এছাড়া হাদীসের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তিকেই উচ্চতর পদের জন্য প্রার্থী হওয়া ও ক্ষমতা লাভের জন্য লোভ করা, লালায়িত হওয়া ও নিজস্বভাবে চেষ্টা চালানোও স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। কেননা তাতে ব্যক্তির কোন সদিচ্ছার পরিচয় পাওয়া যায় না, মনে হয়, সে উচ্চ পদ বা ক্ষমতা লাভ করে নিশ্চয়ই নিজস্ব কোন বৈষয়িক স্বার্থ উদ্ধার করতে বা কোন অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। বিশেষ করে -পূর্বেই যেমন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি -এই উচ্চতর পদ ও ক্ষমতা মূলত একটি আমানত। এ আমানত যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বসাধারণের প্রতি, তেমনি সর্বসাধারণ থেকে বিশেষ ব্যক্তির প্রতি। তাই যে-লোক নিজ থেকে তা পাওয়ার জন্য উদ্যোগী ও সচেষ্ট হবে, সে নিজেকে ক্ষমতালোভী হিসেবে চিত্রিত করবে। আর ইসলামী সমাজে ক্ষমতা লোভীর কোন স্থান -কোন মর্যাদা থাকতে পারে না। বরং তা করে সে স্বীয় অযোগ্যতারই প্রমাণ উপস্থিত করে। তাই রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী***************************]

আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করব না, যে তা পাওয়ার জন্য প্রার্থী হবে, অথবা এমন কাউকেও নয়, যে তা পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে।

হাদীসটি হযরত আবূ মূসা আল-আশ’আরী (র) থেকে বর্ণিত। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবেই দেখতে পেয়েছিলেনঃ তাঁরই চাচার বংশের দুই ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাদের একজন বললঃ [আরবী*************************]

হে রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে বিরাট কাজের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন তার মধ্যের কোন কোন কাজে আমাদেরকে নিযুক্ত করুন।

অপরজনও অনুরূপ দাবি-ই পেশ করল। বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ [আরবী***********************************]

হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরাতা! তুমি নেতৃত্ব-কতৃত্ব পেতে চেও না। কেননা তা পেতে চাওয়া ছাড়াই যদি তোমাকে তা দেয়া হয়, তাহলে সে দায়িত্ব পালনে তোমাদে সাহায্য করা হবে। আর চাওয়ার পর যদি দেয়া হয়, তাহলে তোমাকে সেই কাজে অসহায় করে ছেড়ে দেয়া হবে।

হযরত আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলেছেনঃ [আরবী*******************]

তোমরা হয়ত দায়িত্ব-কতৃত্বশীল পদ পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে। আর তা-ই কিয়ামতের দিন তোমাদের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দেখা দেবে।

যে-লোক বাস্তবিকই এই কঠিন দায়িত্ব পালনে অক্ষম, দুর্বল, তাকে তা গ্রহণ করতে নিষেধ করাই শ্রেয়। হযরত আবূ যর গিফারী (রা)-কে লক্ষ্য করে যখন তিনি বলেছিলেনঃ আমাকে কোন পদে নিযুক্ত করবেন না? রাসূলে করীম (স) এই কারণেই বলেছিলেনঃ [আরবী******************************]

হে আবূ যর, তুমি দুর্বল ব্যক্তি, আর একাজ এক গুরুত্বপূর্ণ আমানত বিশেষ। এ কারণে তা তোমার জন্য কিয়ামতের দিন লজ্জা ও অপমান-লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য যে তা গ্রহণ করে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে, তার জন্য তা হবে না।

একটি হাদীসে রাসূলে কলীম (স)-এর উক্তিঃ [আরবী************************]

যে রাষ্ট্রনেতা দুর্বল, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অক্ষম, সে যদি এতদসত্ত্বেও রাষ্ট্রনেতা হয়েই থাকে তবে সে অভিশপ্ত।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি