ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচন, দায়িত্ব ও ক্ষমতা
[ রাষ্টপ্রধানকে নির্বাচিত হতে হবে -পদপ্রার্থী খিয়ানতকারী -মুসলিম জনগণ রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করবে -রাষ্ট্রপ্রধানের অভিষেক, ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও অধিকার -ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য -রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য -রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার।]

………………………………………………………………………………………………………………………

রাষ্ট্রপ্রধানকে নির্বাচিত হতে হবে
ইসলমী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে। কোন লোক নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে নিলে বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার দাবি করলেই কেউ রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে না, তাকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে মেনে নেয়া যেতে পারে না। মসজিদের নিযুক্ত ইমাম -যার প্রতি নামাযীগণ আস্থা রেখে তারই ইমামতিতে নিয়মিত নামায পড়ে আসছে -কে গায়ের জোরে সরিয়ে দিয়ে কেউ ইমাম হয়ে দাড়ালে তার এ ইমামত জায়েয নয়, জায়েয নয় তার ইমামতিতে নামায পড়া। ঠিক তেমনি জনমতের ভিত্তিতে ও সমর্থনে কর্মরত কোন রাষ্ট্রপ্রধানকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বা জোরের বলে সরিয়ে দিয়ে কেউ যদি রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে বসে, তাহলে তার এই রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া যেমন সম্পূর্ণ হারাম, তাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নেয়া ও তার শাসনকে সমর্থন জানানোও ঠিক তেমনই হারাম।

রাসূলে করীম (স)-এর পর চারজন খলীফা -খুলাফায়ে রাশেদুন -জনগণের মতের ও সমর্থনের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপ্রধান -খলীফা -নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাদের একজনও এই পদের দাবিদার ছিলেন না, পদ পাওয়ার জন্য চেষ্টাকারী ছিলেন না, তার কামনা-বাসনাও তাদের মনে কখনও জাগেনি। সেই সময়ের ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগগত অবস্থার প্রেক্ষিতে যতটা সম্ভব ছিল জনগণের মত ও সমর্থন-ই ছিল খলীফা নির্বাচনের প্রধান উপায়।

পদপ্রার্থী খিয়ানতকারী
কেননা রাষ্ট্রপ্রধান সমগ্র জনগণের সামষ্টিক কাজের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল, জাতীয় ধন-সম্পদের উপর কর্তৃত্ব চালানোর অধিকারী। কোন লোককে এই পদে অধিষ্ঠিত হতে হলে তা শুধু তার পক্ষেই সম্ভব, যার প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে। আসলে এটা শাসক ও শাসিত -আমানতদার ও আমানত অর্পণকারীদের মধ্যকার একটি চুক্তির ব্যাপার। এ চুক্তি উভয় পক্ষের স্বতঃস্ফুর্ত ইচ্ছা, আগ্রহ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতেই সম্পাদিত হতে পারে। যার প্রতি পূর্বহ্নে এই ইচ্ছা, আগ্রহ ও আস্থা পাওয়া যায়নি বা জানা যায়নি, আছে বলে প্রকাশ হয়নি, তার কোন অধিকার থাকতে পারে না একমাত্র নিজের ইচ্ছায় এই পদ দখল করে বসার। এ জন্যই রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ [আরবী**********************]

তোমাদের মধ্য থেকে যে লোক এই দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্য নিজ থেকে আগ্রহী হবে -পেতে চাইবে, চেষ্টা করবে, সে আমাদের মতে তেমাদের মধ্যকার সবচেয়ে খিয়ানতকারী ব্যক্তি।

এর অর্থ, প্রথমত সে এই পদ চেয়েই খিয়ানতকারীর অপরাধে অপরাধী হয়েছে। আর দ্বিতীয়, সে যেভাবে স্ব-ইচ্ছায়-স্বচেষ্টায় এই পদ দখল করেছে, তাতে সে এই বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ আমানতের হক্ আদায় করতে, রাষ্ট্র পরিচালন পরিচালন ও জাতীয় অর্থ-সম্পদ ব্যয়-ব্যবহারে জনগণের বিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম হবে না। সে জাতীয় শক্তি ও সম্পদে বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ করবেই। তার নিজস্বভাবে প্রার্থী হওয়াই তার অকাট্য প্রমাণ। স্পষ্ট মনে হচ্ছে, সে এ পদের কঠিন ও গুরুদায়িত্বের কথা অনুভবই করতে পারেনি। সে এটাকে নেহাত ছেলে-খেলা মনে করেছে। অতএব খলীফা-রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্তিতে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত রায়ই হতে হবে প্রধান অবলম্বন।

আর এই জনমতের ভিত্তিতে যখন একজন নির্বাচিত হচ্ছে, জনগণ তার নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদহীন জীবন যাপন করছে, তখন জোরপূর্বক তাকে পদচ্যুত করে যে লোক ক্ষমতা কেড়ে নেয় একমাত্র নিজস্ব পরিকল্পনার ভিত্তিতে, ইসলামের দৃষ্টিতে সে ডাকাত, পরস্বাপরহরণকারী, ছিনতাইকারী, ক্ষমতা লোভী, নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। এরূপ অবস্থার প্রেক্ষিতে মুসলিম জনগণের কর্তব্যের কথা রাসূলে করীম (স) বলেছেন এ ভাষায়ঃ [আরবী********************************]

তোমরা যখন কোন ব্যক্তির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ, তখন যদি কেউ তোমদের নিকট সেই নেতৃত্ব দখল করার উদ্দেশ্যে আসে এবং সে তোমাদের শক্তিকে প্রতিহত করতে চায় ও তোমাদের ঐক্যবদ্ধ সমাজকে ছিন্ন ভিন্ন করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে তোমরা তাকে হত্যা কর।

মুসলিম জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বান ও জ্ঞানী (the greatest among the men of learning in the world of Islam) ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭) লিখেছেনঃ

The legislature must then decree in his law that if someone secedes and lays claim to the Caliphate by virtue of power or wealth. Then it become the duty of every citizen to fight and kill him. If the citizen are incapable of doing so. Then they disobey God and commit an act of unbelief

(Ibn Sena, Healing Metaphysics in Learner and Mahdi op cit pp 104-105 and The political Economy of the Islamic State p-18-19)

বস্তুত ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান -মুসলিম উম্মতের সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার যোগ্য কেবলমাত্র সেই ব্যক্তি, যার মনোভাব হবে প্রথম নির্বাচিত খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (র)-এর মনোভাবের মত। রাসূলে করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর তিনি খলীফা নির্বাচিত হয়ে যে ভাষণসমূহ দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে একটি ভাষণে তিনি তা অকপটে ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেনঃ [আরবী*************************************]

হে জনগণ! তোমরা যদি ধারণা করে থাক যে, আমি নিজ আগ্রহের ভিত্তিতে তোমাদের এই খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, অথবা ইচ্ছা করে, নিজেকে তোমাদের ও অন্যান্য সব মুসলমানদের উপর প্রাধান্য প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তাহলে মনে রাখবে, এ কথা কিছুমাত্র সত্য নয়। যার হাতে আমার প্রাণ-জীবন, সেই আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি তা নিজ আগ্রহে গ্রহণ করিনি, নিজেকে তোমাদের বা কোন একজন মুসলমানের তুলনায় বড় মনে করে -বড় করে তোলার উদ্দেশ্যে তা গ্রহণ করিনি। আমি কখখনই তা পাওয়ার লোভ করিনি -না কোন দিনে, না রাতে। এজন্য আল্লাহর নিকটও কখনও প্রার্থনা করিনি, না গোপনে, না প্রকাশ্যে। আসলে একটা অনেক বড় বোঝা বহনের জন্য আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে। যা বহন করার কোন সাধ্যই আমার নেই। তবে একমাত্র ভরসা আল্লাহ যদি সাহায্য করেন। আমি বরং মনে মনে কামনা করছি, এ দায়িত্ব রাসূলে করীম (স)-এর অপর কোন সাহাবীর উপর অর্পিত হোক, তিনি এ কাজে ন্যায়পরতা অবলম্বন করবেন। তাহলে এই খিলাফত তোমাদের নিকটই ফেরত যাবে, তখন আমার হাতে করা এই বায়’আত তোমাদের উপর বাধ্যতাপূর্ণ থাকবে না। তোমরা তা তখন তোমাদের পছন্দ করা কোন লোকের উপর অর্পণ করবে। আর আমি তোমাদের মধ্যেরই একজন সাধারণ মানুষ হয়েই থাকব।

তিনি রাসূলে করীম (স)-এর মিম্বারের উপর দাড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেনঃ [আরবী***************]

তোমাদের মধ্যে আমার খিলাফত অপছন্দ করে এমন কেউ আছে কি?……….

থাকলে আমি তার সাথে কথা বলে তা দূর করতে চেষ্টা করব।

পর পর তিনবার এই কথাটি বললেন।

তখন হযরত আলী (র)-ও দাড়িয়ে বললেনঃ [আরবী********************************]

না, আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমরা আপনাকে এ দায়িত্ব থেকে সরে যেতে দেব না, কাউকে তা করতেও দেব না। স্বয়ং রাসূলে করীম (স)-ই আপনাকে অগ্রবর্তী করেছেন। আপনাকে পেছনে ফেলতে পারে এমন কে কোথায় আছে?

মুসলিম জনগণ রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচন করবে
বস্তুত এ-ই হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগের মৌলিক দর্শন। মুসলিম জনগণই তাকে নিজেদের সন্তুষ্টি ও স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা-উদ্যোগের ভিত্তিতে নিয়োগ করবে। এ ছাড়া কারোর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বা নিয়োগের অপর কোন পন্থা থাকতে পারে না। এই পন্থা ছাড়া অপর কোন ভাবে -উপায়ে বা পন্থায় রাষ্ট্রপ্রধানের পদে আসীন হওয়ার কোন অধিকারই কারোর থাকতে পার না। কেননা আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মতের কার্য সম্পাদনের স্থায়ী-নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছেনঃ

[আরবী********************************]

মুসলিম জনগণের তাৎপর্য হচ্ছে, মুসলিম জনগণের জাতীয় ও সামষ্টিক ব্যাপারাদি পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।

আয়াতটির তাৎপর্য হচ্ছে, মুসলিম জনগণের জাতীয় ও সামষ্টিক কোন কাজ-ই কোন এক ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী সম্পন্ন হয় না। কোন এক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা ও কল্পনার ভিত্তিতে কোন নীতি-আদর্শ, পন্থা বা দফা -যা-ই নির্ধারণ করুক, তা মুসলিম জনগণ মানতে বাধ্য নয়। কেননা তারা তো সেই লোক যারা রাব্বুল আলামীনের আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁরই অধীনতা মেনে নিয়েছে। আর সেই আল্লাহরই অধীনতা -আনুগত্য স্বীকার করে তারা সালাত কায়েম করে (আয়াতটির প্রথম অংশ)। কাজেই আল্লাহ যেসব সামষ্টিক ব্যাপারে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কোন বিধান দেন নি, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ও দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই তাদের উপর অর্পণ করেছেন -সে সব ব্যাপারে মুসলিম জনগণ পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, যাতে মুসলিম জনগণের সুচিন্তিত ও স্বতঃস্ফূর্ত মতের প্রতিফলন ঘটবে। আর তাদের রাষ্ট্রপ্রধান নিয়োগ যে তাদের সামষ্টিক কার্যাবলীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাতে কারোরই একবিন্দু সন্দেহ থাকতে পারে না। অতএব সে কাজ জনমতের ভিত্তিতেই সুসম্পন্ন হতে হবে।

রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে জনমতের অংশ গ্রহণ কুরআনী বিধান অনুযায়ী অপরিহার্য স্বৈরতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্টব্যবস্থার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্যের এ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই কারণে নবী করীম (স) ঘোষণা করেছেনঃ [আরবী******************************]

মুসলিম জনগণের সাথে পরামর্শ না করে তাদের মত জেনে না নিয়ে কেউ কাউকে নেতা হিসেবে বায়’আত করলে বা মেনে নিলে তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু বাস্তবে তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?…….. এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, একটি দেশের পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ-নারী -সকল নাগরিকই হবে ভোটদাতা। সারাটি দেশ হবে একটি মাত্র নির্বাচনী এলাকা (Constituency)। নির্দিষ্ট দিনে প্রত্যেক ভোটদাতা নিজ ইচ্ছা ও পছন্দমত কাজের গুরুত্ব ও দায়িত্বের বিরাটত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করার তীব্র অনুভূতি সহকারে -ভোট প্রদান করবে। কেউ প্রার্থী নেই, কোন ক্যানভাসার নেই। ভোটের জন্য কারোর প্রলোভন বা ভয়-ভীতির সম্মূখীন হতে হবে না কোন ভোটদাতাকে! এর ফলে সারা দেশে যার পক্ষে সর্বাধিক ভোট পড়বে, সে-ই রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হলো বলে ঘোষিত হবে।

কোন দেশে বিশেষ অবস্থার কারণে এইরূপ হওয়া সম্ভব মনে না করা হলে প্রথমে জাতীয় সংসদের পার্লামেন্টের নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত করে তাদের ভোটে দুই বা ততোধিক নামের একটা প্যানেল তৈরী করা যেতে পারে এবং তারই মধ্য থেকে একজনকে ভোট দেয়ার অবাধ সযোগ সর্বসাধারণ ভোট দাতাদের দেয়া যেতে পারে। এ ভাবে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনেও জনমতের প্রতিফলন হবে বলে তাকে ইসলামসম্মত মনে করায় কোনই অসূবিধা থাকতে পারে না। বিশেষ করে যখন তা ইসলামের সুস্পষ্ট মানদন্ডের ভিত্তিতে এবং আল্লাহর নিকট জবাবদিহির অনুভূতি সহকারে ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে করা হবে।

রাষ্ট্রপ্রধানের অভিষেক, ক্ষমতা-ইখতিয়ার ও অধিকার
ইসলামরে আনুগত্য স্বীকারের প্রতীক স্বরূপ হাতে হাত দিয়ে বায় ‘আত গ্রহণের রীতি প্রথম দিন থেকেই কার্যকর হয়ে এসেছে। স্বয়ং রাসূল করীম (স) ই এই পদ্ধতি চালু করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বায় ‘আত অনুষ্ঠিত হয় মক্কায় হিজরতের পূর্বে মদীনার কতিপয় আনসার দ্বীন-ইসলাম কবুল করলে এই বায় ‘আত অনুষ্ঠিত হয়। তা বায় ‘আতে আকাবা’ বা আকাবা ‘র বায় ‘আত নামে পরিচিত। মিনা অঞ্চলের একটি নির্জন পর্বত গুহায় গভীর রাতে একান্ত গোপনে এ কাজটি করা হয়। সে বা’আত হয়েছিল আনন্দ-খুশী দর্বলতা-অবসন্নতা অভাব-অনটন ও সচ্ছলতা-উভয় প্রকারের অবস্থায়ই রাসূলে করীমের আনুগত্য করার এবং দ্বীনের জন্য অর্থ ব্যয় করা, ভালো কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ না করা-করতে নিষেধ করা এবং আল্লাহর-আল্লাহর দ্বীন রক্ষা ও প্রচার-প্রতিষ্ঠায় সকল প্রকারের ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে বুক উচু করে দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপর। আনসারগণ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ দায়িত্বের বোঝা নিজেদের স্বন্ধে গ্রহণ করেছিলেন।

রাসূলে করীম (স)- কে দ্বীন-প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে সাহায্য সহযোগিতা করা এবং নিজেদের ও আপন স্ত্রী-পরিজনের ন্যায় তাকেও রক্ষণাবেক্ষণ করার এ বায়’আত-ই ইসলামে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের প্রথম ভিত্তি রচনা করেছিল। অতঃপর খুলাফায়ে রাশেদুনের ক্ষেত্রে এই বায়’আতকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়েছে। এ বায়’আতের পরই রাষ্ট্রপ্রধান তার দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হয়েছে এবং জনগণের জন্য তার আনুগত্য করা সর্বাধিক কর্তব্য হয়ে দাড়িয়েছে।

রাষ্ট্রীয় আনুগত্য স্বীকারের জন্য হাতে হাত দিয়ে এই বায়’আত করা একটি সুন্নত হিসেবে গণ্য হলেও তা কোন চিরন্তন আদর্শ বা পদ্ধতি রূপে অনুসৃত হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে তার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আধুনিক কালে ব্যালটের মাধ্যমেও এ বায়’আতের কাজ সুসম্পন্ন হতে পারে এবং সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হতে পারে।

পূর্বে যেমন বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব দ্বিবিধঃ ইসলাম কায়েম ও কার্যকর করা এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ইসলামের আদর্শ ও রীতি-নীতি অনুযায়ী আঞ্জাম দেয়া। অবশ্য রাষ্ট্রপ্রধানকে শু’রার পরামর্শ গ্রহণ এবং মজলিসে শু’রার সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা ওহী গ্রহণকারী স্বয়ং নবী করীম (স) কে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন।[আরবি………………..]

তোমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারাদি পারস্পরেক পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হলে তোমাদের জীবন মৃত্যূর তুলনায় শ্রেয়।

রাসূলে করীম (স)- এর প্রতি এই নির্দেশ যে আয়াতটিতে দেয়া হয়েছে, তার শুরুতে বলা হয়েছেঃ তুমি আল্লাহর রহমতে অত্যন্ত নরম দিল। তুমি যদি রুঢ়-কর্কশ পাষাণ-রিদয় হতে তাহলে লোকেরা তোমার চারপাশে থেকে সরে যেত। অতএব তুমি তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন কর এবং তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা কর। অতঃপর বলা হয়েছেঃ আর জাতীয়-সামষ্টিক ব্যাপারাদিতে তাদের সাথে পরামর্শ কর। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে-সমাজের লোকদের সাথে সামষ্টিকভাবে পরামর্শ করা ইসলামী সমাজের একটা বিশেষত্ব। এ বিশেষত্ব না থাকলে ইসলামী সমাজ হতে পারে না। অতএব ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ করতে হবে,জনমত জানতে হবে এবং সম্মুখবর্তী সামষ্টিক ব্যাপারে জনগণ নির্বাচিত মজলিসে শু’রা যে বিষয়ে পরামর্শ দেবে,রাষ্ট্রপ্রধান তা অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

এই পর্যায়ে দু’টি মত স্পষ্ট। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছেঃ [আরবি…………………]

তুমি যখন কোন কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহর উপর পূর্ণ নির্ভরতা গ্রহণ করে সে কাজটি করে ফেল।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংকল্প করা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণককি পরামর্শ গ্রহণ বা শু’রার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তিতে হবে কিংবা শু’রার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করেই নিদ্ধান্ত বা সংকল্প গ্রহণের অধিকার রাষ্ট্র প্রধানের রয়েছে?

কিছু সংখ্যক মনীষীর মত-শু’রার সিদ্ধান্ত ছাড়াও রাষ্ট্রপ্রধানের নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ও কল্যাণ চিন্তার ভিত্তিতে একান্ত নিজস্বভাবে সংকল্প ও পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান শু’রার পরামর্শ বা সিদ্ধান্তের অধীন নয় এবং সে তা মেনে নিতে একান্তভাবে বাধ্যও নয়। এমন নয় যে, শু’রার সিদ্ধান্তের সামান্য বিরুদ্ধতা করারও তার ইখতিয়ার থাকবে না। সে পরামর্শ নেবে; কিন্তু প্রকৃত সিদ্ধান্ত ও সংকল্প গ্রহণের অধিকার রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তার এটা কর্তব্যও।

কিন্তু এ মতের একটি মারাত্বক দিক হচ্ছে, এরূপ ইখতিয়ার ও অধিকার থাকলে রাষ্ট্রপ্রধানের স্বৈরতান্ত্রিক ভূমিকা অবলম্বন অনিবার্য পরিণতি কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র-দর্শনে এই ভূমিকা অবলম্বনের কোন অবকাশ নেই।

তাই অন্যান্য মনীষীদের মত হচ্ছে, চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও কার্যত পদক্ষেপ গ্রহণ রাষ্ট্রপ্রধানেরই কাজ এবং দায়ীত্ব। তবে তাকে তা করতে হবে মজলিসে শু’রার পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে, তা বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে নীয়।

ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য
ইসলামী রাষ্ট্র রাষ্ট্রের সমস্ত জনগণের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে। জনগণের বৈষয়িক জীবনকে সুষ্ঠুরূপে পরিচালনার এবং তাদের পরকালীন জীবনে মুক্তি ও সাফল্যের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব হিসেবে দু’টি কথার উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে,দ্বীন-ইসলামকে পূর্ণরূপে কার্যকর ও সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা। ইসলামের আইন বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করা। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, ইসলামের রীতি-নীতি অনুযায়ি গোটা রাষ্ট্রকে পরিচালিত করা। এক কথায় বলা যায় দ্বীন-ইসলামকে বাস্তবায়িত করাই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ কারণে ফিকাহবিদগণ ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এই ভাষায়ঃ[আরবি…………..]

ইসলামী রাষ্ট্র হচ্ছে দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় ব্যাপারের দিকে সাধারণ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব।

আর রাষ্ট্রপ্রধানের পনিচিতিস্বরূপ বলা হয়েছেঃ [আরবি…………………………]

দ্বীন কায়েম করা ও মুসলিম মিল্লাতের আদর্শ ও মান রক্ষা করার কাজে রাসূলের প্রতিনিধিত্ব করা-এ কারণেই তার অনূসরণ করা সমগ্র উম্মতের কর্তব্য।

আল্লামা মাওয়ার্দী ইসলামী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ [আরবি……………………..]

দ্বীনের পাহারাদারী, সংরক্ষণ ও দুনিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনে নবুয়্যাতের প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্যেই তা প্রুতষ্ঠিত।

আর আল্লামা ইবনে খালদূন সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ [ আরবি…………………………]

জনগণের পরকালীন ও বৈষয়িক কল্যাণ-যার পরিণতি সেই পরকাল-শরীয়াতের দাবি অনুযায়ী-সাধনের সর্বাত্নক দায়িত্ব গ্রহণ। কেননা শরীয়াত দাতার দৃষ্টিতে দুনিয়ার সমস্ত অবস্থা প্রকৃত পক্ষেই পরকালের কল্যাণের দৃষ্টিতে সম্পন্ন হতে হবে। তাই তা হচ্ছে দ্বীনের সংরক্ষণ ও দ্বীণের সাহায্যে বিশ্বব্যবস্থা সংগঠন ও পরিচালনে শরীয়াতদাতার প্রতিনিধিত্ব। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন বিরাট তেমনি মহান। তাই দুইটি কারণে রাষ্ট্রপ্রধান তার এই পদের অযোগ্য প্রমাণিত হয়।

একটি তার ব্যক্তিগত সততা-বিশ্বস্ততা ক্ষুন্ন হওয়া। আর দ্বিতীয়টি, তার দৈহিক বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গত ত্রুটি ও অক্ষমতা।

ব্যক্তিগত সততা ও বিশ্বস্তা ক্ষুন্ন হওয়ার অর্থ রাষ্ট্রপ্রধানের ‘ফাসিক’–শরীয়াতের সীমালংঘনকারী প্রমাণিত হওয়া। এর দু’টি দিক। একটি লালসা-কামনা চরিতার্থ করা। আর দ্বিতীয়টির সম্পর্ক তার ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক।

প্রথমটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গজনিত ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট। আর তা হচ্ছে তার কোন হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া, শরীয়াতে ঘৃণিত-নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হয়ে পড়া। যৌন-লালসার দ্বারা চালিত হয়ে কোন জঘন্য কাজ করা। যেমন যিনা-ব্যাভিচার, মদ্যপান, সীমাতিরিক্ত ক্রোধ। এ চরিত্রগত দোষ থাকলে তার পক্ষে ইসলামী রাষ্টের রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হওয়ার পর এই ধরনের অপরাধ করলে সে যেমন নিজেকে উক্ত পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য প্রমাণ করে, তেমনি সেই উচ্চতর পদটিরও করে চরম অপমান।

দ্বিতীয় প্রকারের সীমালংঘনমূলক কাজের সম্পর্ক আকীদা-বিশ্বাসের সাথে। আকীদা-বিশ্বাসে ‘ফিসক’ দেখা দিলে তা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা শরীয়াত লংঘনের মতই অপরাধ। অতঃপর সে রাষ্ট্রপ্রধান পদে নিযুক্ত থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলে। কেননা আকীদায় ‘ফিসক’ দেখা দিলে তা কুফর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া অসম্ভব নয়।

এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি হচ্ছে হযরত উবাদাতা উবাদাতা ইবনুস্ মাসিত (রা) বর্ণিত একটি হাদীস। তিনি বলেছেনঃ

(আরবী………………….)

আমরা রাসূলে করীম (স)-এর নিকট বায়’আত করেছি, আমাদের আনন্দ অসুন্তুষ্টি, কঠিনতা বিপদ ও সুবিধা এ আমাদের স্বর্থ –সর্বাবস্থায়ই আমরা শুনব ও মানব –অনুগত থাকব। আর দায়িত্বশীলের সাথে কোন ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করব না। তবে এমন কুফরি যদি দেখতে পাই যা স্পষ্ট ও প্রকাশ্য –সর্বজনবিদিত এবঙ যা’র কুফর হোয়ার একাট্য দলীল আল্লাহর নিকট থেকে থাকবে, তাহলে শুনা ও মানা –আনুগত্যের উক্ত শপথ কার্যকর নয়।

রাষ্ট্রপ্রধানের এ রূপ চারিত্রিক পতনের দরুন তাকে পদচ্যুত করা কিংবা তার আনুগত্য করতে অস্বীকার করার অধিকার মুসলিম জনগণের সংরক্ষিত বলে বহু ফিকহবিদ মত প্রকাশ করেছেন।

দৈহিক আঙ্গিক ক্রটি ও অক্ষমতা পর্যায়ে ইন্দ্রিয়নিচয়ের অক্ষমতাও গণ্য। দায়িত্ব পালনে আঙ্গিক অসামর্থ বা পংগুত্ব এ পদের পথে মারাত্মক ধরনের বাধা। (ঐ)

ইসলামী ফিকহবিদ মনীষীদের ব্যাখ্যানুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব এ কর্তব্য নিম্নরূপ;

১. দ্বীন-ইসলাম সংরক্ষণ মুসলিম উম্মতের আদর্শ ও ঐতিহ্য অনুযায়ী, সময়োপযোগী ব্যাখ্যা সহকারে;

২. বিবদমান পক্ষমূহের উপর আল্লাহর আইন কার্যকরকরণ, ঝগড়া বিবাদ ইসলামী আইন অনুযায়ী মীমাংসা করার ব্যবস্থাকরণ;

৩. প্রত্যেকটি নাগরিকের বৈধ দখলী স্বত্ব জবরদখল বা বেআইনী দখল থেকে রক্ষা করা, উদ্ধার করা, যেন প্রত্যেকে নিজ দখলের উপর স্বীয় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারে, তারা কোন বেআইনী বাধা-প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হয় ও নিশ্চিন্ত নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন যাপন সকলের পক্ষেই সম্ভব হয়। এক কথায় শান্তি-শৃঙ্খলা (Law and order) স্থাপন ও সংরক্ষণ;

৪. শরীয়াত ঘোষিত ‘হদ্দ’ ও ‘কিসাস’ কার্যকরকরণের নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করা, যেন আল্লাহর হারাম ঘোষিত কোন কাজ হতে না পারে, সকলের অধিকার সকল প্রকারের আঘাত ও লুটতরাজ থেকে পূর্ণরূপে রক্ষা পেতে পারে। কোন লোকই স্বীয় ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। (দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন –দুর্বলকে শক্তিশালী করা ও সবলদের সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করা –সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা ও অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করাও এর মধ্যে পণ্য);

৬. ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা। অবশ্য প্রথমে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দান ও জিযিয়ার বিনিময়ে বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব পেশের পর সবশেষ উপায় হিসেবে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইসলামী শরীয়াতের এটাই স্থায়ী বিধান;

৭. কর, খাজনা ও অন্যান্য সরকারী পাওনা সঠিকরূপে আদায় করার ব্যবস্থা করা। তা শরীয়াতের স্থায়ী নীতি অনুযায়ী হতে হবে এবং এ ব্যাপারে কোনরূপ নির্দয়তার প্রশয় দেয়া চলবে না;

৮. বায়তুলমাল সংরক্ষণ। তা থেকে যাকে যা দেয়ার তার পরিমাণ নির্ধারণ ও যথাযথ দিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা, তাতে বাড়াবাড়ি না করা, অপচয় না করা, আর পাওনা পরিমাণেও হ্রাস-বৃদ্ধি না করা, যথাসময়ে দিয়ে দেয়া –বিলম্ব না করা;

৯. দয়িত্বশীল কর্মচারী নিয়োগ করা, তাদের কাজের সুযোগ করে দেয়া, তাদের নিকট থেকে কাজ বুঝে নেয়া –তাদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করা;

১০. সমস্ত জাতীয় ও সামষ্টিক ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হওয়া, পরিস্থিতি অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও তদানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ, যেমন সার্বিকভাবে গোটা উম্মত রক্ষা পায় এবং মিল্লাত সংরক্ষিত থাকে।

আল্লামা আল-গাররা তাঁর ‘আল-আহকামুস্ সুলতানীয়া’ গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় এবং আল্লামা মাওয়ার্দী তাঁর ‘আল-আহকামুস্-সুলতানীয়া’ গ্রন্থের ১৫ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলি উদ্বৃত করেছেন। আমি মনে করি, মনীষীগণ এর কোন একটি কথাও কল্পনা করে লিখেন নি; বরং কুরআন মজীদের আয়াত থেকেই তা নিঃসৃত। এ পর্যায়ের দু’টি আয়াত আমি এখানে উদ্বৃত করছিঃ

(আরবী……………………)

তোমাদের মধ্য থেকে যারাই ঈমান আনবে ও ইমান অনুযায়ী নেক আমল করবে, তাদের জন্য আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে খলীফা –রাষ্ট্র পরিচালক –বানাবেন যেমন করে তাদের পূর্ববর্তীদের তিনি খলীফা বানিয়েছিলেন এবং যেন তাদের জন্য তাঁর পছন্দ করা দ্বীনকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তাদের ভয়-ভীতি-আশঙ্কার কেবলমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব করবে, তাঁর সাথে একবিন্দু জিনিসকেও শরীক করবে না।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, আল্লাহর খিলাফত –ইসলামী রাষ্ট্রের মৌল উদ্দেশ্যই হচ্ছে দ্বীন ইসলামকে সুদৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্টিত করা, দ্বীনকে পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত করা, দ্বীনের মান-মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং সেখানকার জনগণের জীবনকে সকল প্রকারের ভয়-ভীত ও বিপদ আশঙ্কা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করে স্বাধীন নির্বিঘ্ন জীবন যাপনের নির্ভরযোগ্য সুযোগ করে দেয়া। বস্তুত দুনিয়ার প্রত্যেক দেমের আপামর জনগণের তা-ই তো কাম্য এবং তা সবকিছুই পূর্ণ মাত্রায় বাস্তবায়িত হতে পারে কেবলমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানই এইসব কাজ করার জন্য প্রধান দায়িত্বশীল।

আর দ্বিতীয় আয়াতঃ

(আরবী…………………)

এবং তোমরা শত্রুপক্ষের মুকাবিলা করার লক্ষ্যে যথাসাধ্য শক্তি ও যানবাহন সংগ্রহ ও প্রস্তুত কর। তদ্দারাতোমরা আল্লাহর দুশমনদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবে –তোমাদের নিজেদের শত্রুদেরও। এদের ছাড়া আরও অনেক শত্রু আছে যাদের তোমরাজান না, আল্লাহ তাদের জানেন।

উভয় আয়াতে বলা কথা ও কাজ যদিও সামষ্টিকভাবে মুসলিম উম্মতের জন্য কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানই যেহেতু মুসলিম উম্মতের প্রতিনিধি, সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল, তাই রাষ্ট্রপ্রধানকেই এ কাজসমূহ করতে হবে।

কুরআনের ঘোষণাহলো

(আরবী………………..)

রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী……………..)

‘ইমাম’ রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ

(আরবী……………..)

রাষ্ট্রপ্রধান মিথ্যাবাদী বা কাফির হলে তার আনুগত্য করা যাবে না।

কুরআনের নির্দেশঃ

(আরবী…………)

রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার
রাষ্ট্রপ্রধান তার উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করলে তার দুইটি প্রধান অধিকার অবশ্য স্বীকৃতব্য হয়ে পড়েঃ একটি জনগণের উপর তার অধিকার এবং দ্বিতীয়টি, জনগণের ধান-মালে তার অধিকার। বলাবাহুল্য, এ অধিকার ব্যক্তিগতভাবে নয়, কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বসমূহ পালনার্থে।

১. জনগণের উপর রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার হচ্ছে, জনগণ তাকে মান্য করবে, তার আনুগত্য স্বীকার করবে। এ অধিকার নিশ্চয়ই নিরংকুশ ও শর্তহীন নয়। এ অধিকার তার নিজের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা এবং আল্লাহ ও রাসূলের আইন-বিধানের সীমার মধ্যে থকে তাকে মেনে চলতে জনগণকে বলার মধ্য সীমিত। এর বাইরে কারোরই কোন আনুগত্য থাকতে পারে না।

২.রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার গৃহীত নীতি বা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিরোধ হওয়া সম্ভব। জনগণ তার সাথে মতবিরোধ করতে পারে, করার অধিকার স্বয়ং আল্লাহই তাদেরকে দিয়েছেন। এ অধিকার হরণ করে নেয়ার কোন অধিকার রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার –কারোরই নেই এবঙ মতবিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা হতে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নয়, বরং মতবিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা হতে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নয়, বরং তা হবে আল্লাহ ও রাসূল অর্থা….. কুরআন ও সুন্নাতের ভিত্তিতে, যা মেনে নিতে উভয় পক্ষ সমানভাবে বাধ্য। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের আনুগত্যের সীমা রাসূলে করীম (স) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। বলেছেনঃ

(আরবী…………)

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নাফরমানী করে কারোরই আনুগত্য করা যায়না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর আনুগত্য করা যেতে পারে ততক্ষণ এবং সেসব কাজে, যতক্ষণ এবং যেসব কাজে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী হবে না।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি