আঁধার ঘেরা এই পৃথিবীঃ সোবহে সাদিকের প্রতীক্ষায়
আরবের ভৌগলিক পরিচয় এবং বিভিন্ন জাতির অবস্থান

সীরাতে নববী প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর শেষ পয়গম্বরের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব জাতির সামনে তা উপস্থাপন করেছিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ পাক মানুষকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোয় এবং বান্দাদের বন্দেগী থেকে বের করে আল্লাহর বন্দেগীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহর পয়গাম তথা পয়গমে রব্বানী অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ের অবস্থার তুলনামূলক আলোচনা ছাড়া সীরাতুন্নবীর পরিপূর্ণ চিত্ররূপ তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই মূল বিষয়ের আলোচনা শুরুর আগে ইসলামপূর্ব আরবের বিভিন্ন সম্প্রদায় এবং এবং তাদের জীবনযাপনের অবস্থা বর্ণনা করা একান্ত প্রয়োজন। এতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবকালের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক একটা ধারনা পাওয়া যাবে।

‘আরব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সাহারা বা বিশুষ্ক প্রান্তর বা অনুর্বর জমিন। প্রাচীনকাল থেকে এ শব্দটি জাযিরাতুল আরব এবং তার অধিবাসীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে আসছে।

আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং সায়না উপদ্বীপ, পূব দিকে আরব উপসাগর, দক্ষিণে ইরাকের বিরাট অংশ, দক্ষিণে ইরাকের বিরাট অংশ এবং আরো দক্ষিণে আরব সাগর। এটি প্রকৃতপক্ষে ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ। উত্তরে সিরিয়া এবং উত্তর ইরাকের একাংশ। এর মধ্যে কিছু বিতর্কিত সীমানাও রয়েছে। মোট আয়তন দশ থেকে তেরো লাখ বর্গ মাইল।

দ্বীপসদৃশ এই আরব দেশটি প্রাকৃতিক এবং ভৌগলিক দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আভ্যন্তরীণ ও বহির্দিক থেকে এটি বহু প্রান্তর এবং মরুভূমিতে ঘেরা। এ কারণেই এ অঞ্চলটি এমন সংরক্ষিত। অন্যরা এ অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব সহজে বিস্তার করতে পারে না। তাই লক্ষ্য করা গেছে যে, জাযিরাতুল আরবের মূল ভূখন্ডের অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের সকল কাজে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ আরবের এসব অধিবাসীরা ছিল তদানীন্তন বিশ্বের দু’টি বৃহৎ শক্তির প্রতিবেশী। এই প্রাকৃতিক বাধা না থাকলে সেই দুটি শক্তির হামলা প্রতিহত করার সাধ্য আরবদের কোনদিনই হতো না।

বাইরের দিক থেকে জাযিরাতুল আরব ছিল প্রাচীনকালের সকল মহাদেশের মাঝখানে। স্থলপথ এবং জলপথ ইভয় দিক থেকেই বাইরের বিশ্বের সাথে আরবের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সহজ। জাযিরাতুল আরবের উত্তর পশ্চিম অংশ হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশ বা তোরণদ্বার। উত্তর পূব অংশে ইউরোপের জাতি। পূর্বদিকে ইরান, মধ্য এশিয়া এবং দুর প্রাচ্যের প্রবেশ পথ। এ পথে চীন এবং ভারত পর্যন্ত যাওয়া যায়। এমনিভাবে প্রতিটি মহাদেশই আরব দেশের সাথে সম্পৃক্ত। এসকল মহাদেশগামী জাহাজ আরবের বন্দরে সরাসরি নোঙ্গর করে।

এ ধরনের ভৌগলিক অবস্থানের কারণ জাযিরাতুল আরবের উত্তর ও পশ্চিম অংশ বিভিন্ন জাতির মিলনস্থল এবং ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।

আরব জাতিসমূহ

ঐতিহাসিকরা আরব জাতিসমূহকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।

এক. আরব বারেরা

আরব বারেবা বলতে আরবের সেইসব প্রাচীন গোত্র এবং সম্প্রদায়ের কথা বোঝানো হয়েছে যারা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এসব গোত্র ও সম্প্রদায় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিস্তারিত তথ্য এখন আর জানা যায় না। যেমন আদ, সামুদ, তাছাম, জাদিছ আমালেকা প্রভৃতি জাতি।

দুই, আরব আবেরা

এ দ্বারা সেসব গোত্রের কথা বোঝানো হয়েছে যারা ছিল ইয়ারুব ইবনে ইয়াশজুব ইবনে কাহতানের বংশধর। এদেরকে কাহতানি আরবও বলা হয়।

তিন. আরবে মোস্তারেবা

এরা যেসব গোত্র, যারা হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশধর। এদেরকে আদনানী আরব ও বলা হয়।

আরবে আবেরা অর্থাৎ কাহতানি আরবদের প্রকৃত বাসস্থান ছিল ইয়েমেনে। এখানেই এদের পরিবার এবং গোত্রের বিভিন্ন শাখা প্রসার লাভ কর। এদের মধ্যে দুটি গোত্র বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। যথা:

(ক) হেমইয়ার: এদের বিখ্যাত শাখার নাম হচ্ছে যাইদুল যমহুর কোজাআহ এবং যাকাসেক।

(খ) কাহতান: এদের বিখ্যাত শাখার নাম হচ্ছে হামদান, আনমার, তাঈ, মাযহিজ, কেন্দাহ, লাখম, জুযাম আযদ, আওস খাজরায এবং জাফনার বংশধর। নিজস্ব এলাকা ছেড়ে এরা সিরিয়ার আশে পাশে বাদশাহি কায়েম করেছিল। এরপর এরা গাস্সান নামে পরিচিতি লাভ করে।

সাধারণ কাহতানি গোত্রসমূহ পরবর্তীকালে ইয়েমেন ছেড়ে দেয় এবং আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। এরা নেই সময় দেশত্যাগ করেছিল, যখন রোমকরা মিসর ও সিরিয়া অধিকার করার পর ইয়েমেনবাসীদের জলপথের বাণিজ্যের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং স্থলপথের বাণিজ্যও অধিকারে এনেছিল। এর ফলে কাহতানিদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

এমনও হতে পারে, কাহতানি এবং হেমইয়ারি গোত্রসমুহের মধ্যে বিবাদ -বিসম্বাদ দেখা দেয়র ফলে কাহতানিরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এরূপ মনে করার এটাই কারণ যে, কাহতানি গোত্রসমুহ দেশত্যাগ করেছিল, কিন্তু হিমইয়ারী গোত্রসমুহ তাদের জায়গায় অটল ছিল।

যেসব কাহতানি গোত্র দেশ ত্যাগ করেছিল তাদের চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

এক) আযাদ: এরা তাদের সর্দার এমরান ইবনে আমর মুযাইকিয়ার পরামর্শে দেশত্যাগ করে। প্রথমে এরা ইয়েমেনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয় এবং অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য বিভিন্ন দল পাঠাতে থাকে। এরপর এরা উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বসতি স্থাপন করে। এদের বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ,

ছালাবা ইবনে আমর : এই ব্যক্তি প্রথমে হেজায অভিমুখে রওয়ানা হয়ে ছালাবা এবং জিকার এর মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করেন। তার সন্তানরা যখন বড় হলে এবং খান্দান শক্তিশালী হয় তখন মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হন এবং মদিনাতেই বসবাস শুরু করেন। এই ছালাবার বংশ থেকেই আওস এবং খাজরাযের জন্ম। আওস এবং খাজরায ছিল ছালাবার পুত্র হারেছার সন্তান।

হারেস ইবনে আমর : তিনি ছিলেন খোজাআর সন্তান। এই বংশধারার লোকেরা হেজায ভূমির বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরার পর মাররায যাহরানে অবস্থান নিয়ে পরে মদিনায় হামলা করে। মক্কা থেকে বনি জুরহুম গোত্রের লোকদের বের করে দিয়ে নিজেরা মক্কায় বসতি স্থাপন করে।

এমরান ইবনে আমর : এই ব্যক্তি এবং তার সন্তানরা আম্মানে বসবাস করেতে থাকেন। এ কারণে এদেরকে আজাদ আম্মান বলা হয়ে থাকে।

নাসর ইবনে আযাদ : এই ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত গোত্রসমুহ তোহামায় অবস্থান করে। এদের আযাদ শানুয়াতে বলা হয়ে থাকে। জাফনা ইবনে আমর: এই ব্যক্তি সিরিয়ায় চলে যান এবং সেখানে সপরিবারে বসবাস করেন। তিনি ছিলেন গাস্সানী বাদশাহদের প্রপিতামহ। সিরিয়ায় যাওয়ার আগে এরা হেজাযে গাস্সান নামক একটি জলাশয়ের কাছে কিছুদিন অবস্থান করেন।

দুই) লাখম জুযাম গোত্র, লাখমের বংশধরদের মধ্যে নসর ইবনে রবিয়া ছিলেন অন্যতম। তিনি হীরায় রাজত্বকারী শাসনকর্তাদের (যাদের বলা হতো আলে মোনযের) পূর্বপুরুষ ছিলেন।

তিন) বনু তাঈ গোত্র, এই গোত্র বনু আযাদের দেশ ত্যাগের পর উত্তর দিকে রওয়ানা হয় এবং আজা ও সালমা নামে দুটি পাহাড়ের মাঝখানে বসবাস করতে শুরু করে। তাঈ গোত্রের কারণে এই দুটি পাহাড় বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

চার) কিন্দা গোত্র, এ গোত্রের লোকেরা প্রথমে বাহরাইনের বর্তমান আল আহমা নামক স্থানে বসতি স্থাপন করে। কিছুকাল পর তারা হাদরামাউত চলে যায়। কিন্তু সেখানেও তারা টিকতে পারেনি। অবশেষে তারা নাজদে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সে সরকার ও স্থায়ী হয়নি। কিছুকালের মধ্যেই তাদের নাম নিশানা মুছে যায়।

কাহতান ছাড়া হেম্ইয়ারের আর একটি গোত্র ছিল, সে গোত্রের নাম ছিল কাজাআ। এ গোত্রের নাম হেমিরি হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এরা ইয়েমেন থেকে চলে গিয়ে ইরাকের বাদিয়াতুল সামাওয়াতে বসবাস করতে থাকে (এ সকল গোত্র এবং তাদের দেশত্যাগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তারিখুল ইমামিল ইসলামিয়া ১ম খন্ড, পৃ ১১-১৩ আল জাযিরাতুল আরব পৃ: ২৩১-২৩৫। দেশ ত্যাগের ঘটনাবলীর ব্যাপারে সময় নির্ণয়ের মতভেদ রয়েছে। নানা দিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য তথ্য আমরা উল্লেখ করেছি। )

আরবে মোস্তারেবা: এদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন সাইয়েদেনা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে ইরাকের উয শহরের অধিবাসী। এ শহর ফোরাত নদীর পশ্চিম উপকুল কুফার কাছে অবস্থিত ছিল। ফোরাত নদী খননের সময়ে পাওয়া নিদর্শনসমূহ থেকে এ শহর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা গেছে। হযরত ইবরাহীম পরিবার এবং উয শহরের অধিবাসী ও তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কেও এতে অনেক তথ্য উদঘাটিত হয়েছে।

হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম দ্বীনের তাবলীগের জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে ছুটোছুটি করেন। একবার তিনি মিসরে যান। হযরত ইবরাহীমের স্ত্রী সারার কথা শোনার পর ফেরাউনের মনে মন্দ ইচ্ছা জাগে। অসৎ উদ্দেশ্যে সে হযরত সারাকে নিজের দরবারে ডেকে নেয়। তারপর অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। হযরত সারা আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। তার দোয়ার বরকতে আল্লাহ পাক ফেরাউনকে এমনভাবে পাকড়াও করেন যে, ফেরাউন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করে। এতে সে বুঝতে পারে যে, সারা আল্লাহর খুবই প্রিয়পাত্রী এবং পুণ্যশীলা রমণী। হযরত সারার এ বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে ফেরাউন তার কন্যা হাজেরাকে (হযরত হাজেরা দাসী ছিলেন বলে ভিন্ন গ্রন্থে বলা হয়, আসলে তিনি ছিলেন ফেরাউনের কন্যা। রহমতুল্লিল আলামিন, ২য় খন্ড.পৃ ৩৬-৩৭ দেখুন। ) হযরত সারার হাতে তুলে দেন। হযরত সারা হযরত হাজরাকে তাঁর স্বামী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে বিবাহ দেন (ঐ ২য় খন্ড, পৃ ৩৪, ঘটনার বিস্তারিত বিবরণের জন্য সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড. পৃ-৪৮৪ দেখুন)।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম হযরত সারা এবং হযরত হাজেরাকে সঙ্গে নিয়ে ফিলিস্তিন ফিরে যান। এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীমকে হযরত হাজেরার গর্ভ থেকে একটি সন্তান দান করেন। উল্লেখ্য, হযরত সারা ছিলেন নি:সন্তান। ভূমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয় ইসমাইল। আস্তে আস্তে হযরত সারা হযরত হাজেরার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেন এবং নবজাত শিশুসহ হযরত হাজেরাকে নিবাসন দিতে হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে বাধ্য করেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে একথা মানতে হয় এবং তিনি হযরত হাজেরা এবং ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় গমন করেন। বর্তমানে যেখানে কাবা ঘর রয়েছে, সেই ঘরের কাছে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্ত্রী পুত্রকে রেখে আসেন। সে সময় কাবাঘর ছিল না। একটি টিলার মতো কারা ঘরের স্থানটি উঁচু ছিল। প্লাবন এলে সেই টিলার দুপাশ দিয়ে পানি চলে যেত। সেখানে মসজিদুল হারামের উপরিভাগে-পাশেই যমযমের কাছে একটি বড় বৃক্ষ ছিল। হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সেই গাছের পাশে স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইলকে রেখে আসেন। সে সময় মক্কায় পানি এবং মানব বসতি কিছুই ছিল না। একারণে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম একটি পাত্রে কিছু খেজুর এবং একটি মশকে কিছু পানি রেখে আসেন। এরপর তিনি ফিলিস্তিন ফিরে যান। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই সে খেজুর ও পানি শেষ হয়ে যায়। কঠিন দু:সময় দেখা দেয়। সেই করুন দু:সময়ে আল্লাহ পাকের রহমতের ঝর্ণাধারা যমযমরূপে প্রকাশ লাভ করে এবং দীর্ঘদিন যাবত বহু মানুষের জীবন ধারণের উপকরণরূপে ব্যবহৃত হয়। এর বিস্তারিত বিবরণ মোটামুটি সবার জানা (সহীহ বোখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, ১ম খন্ড, পৃ: ৪৭৪-৪৭৫)। কিছুকাল পরে ইয়েমেন থেকে একটি গোত্র মক্কায় আসে। ইতিহাস এ গোত্র জুরহুম সানি বা দ্বিতীয় জুরহাম নামে পরিচিত। এ গোত্র ইসমাইল আলাইহিস সালামের মায়ের অনুমতি নিয়ে মক্কায় বসবাস শুরু করে। বলা হয় থাকে যে, এ গোত্র আগে মক্কার আশে পাশের এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। উল্লেখ্য রয়েছে যে, এই গোত্রের লোকেরা হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের আগমনের পরে এবং তাঁর যুবক হওয়ার আগে যমযমের জন্য মক্কায় আসে। এ পথে তারা আগেও যাতায়াত করছিল। (এই গ্রন্থ ১ম খন্ড, পৃ: ৪৭৫)।

হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্ত্রী-পুত্রের দেখাশোনার জন্য মাঝে মাঝে মক্কায় যেতেন। তবে কতোবার তিনি এভাবে যাতায়াত করেছিলেন সেটা জানা যায়নি। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে চারবার যাওয়া আসার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এক) পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা এ মর্মে স্বপ্ন দেখান যে তিনি তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইলকে জবাই করেছন। এ স্বপ্ন ছিল আল্লাহ পাকের এক ধরনের নির্দেশ। পিতা পুত্র উভয়ই এ নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হন। উভয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় কাছে আত্মসমর্পণ করার পর পিতা তার পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিলেন এবং জবাই করতে উদ্যত হলেন। এ সময় আল্লাহ পাক বললেন, হে ইবরাহিম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়েছ। আমি পুণ্যশীলদেরকে এভাবে বিনিময় দিয়ে থাকি। নিশ্চিতই এটা ছিল একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আল্লাহ পাক এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কারস্বরুপ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে কোরবানির মহান গৌরব দান করেন। (সুরা আস সাফফাত পৃ-১০৩-১০৭)।

বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের চেয়ে তেরো বছরের বড় ছিলেন। কোরআনের বর্ণনা রীতি থেকে বোঝা যায়, এ ঘটনা ঘটেছিল হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের জন্মের আগে। কেননা সমগ্র ঘটনা বর্ণনা করার পর এখানে হযরত ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের যুবক হওয়ার আগে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কমপক্ষে একবার মক্কায় সফর করেছিলেন। বাকি তিন বারের সফরের বিবরণ বোখারী শরীফের একটি দীঘ বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড. পৃ ৪৭৫-৪৭৬)।

দুই) হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম যুবক হলেন। জুরহাম গোত্রের লোকদের নিকট আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। গোত্রের লোকেরা হযরত ইসমাইলের সাথে তাদের এক কন্যাকে বিবাহ দেন। এ সময় হযরত হাজেরা আলাইহিস সালাম ইন্তেকাল করেন। এদিকে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর স্ত্রী পুত্রকে দেখার জন্য মক্কায় আসেন। কিন্তু হযরত ইসমাইলের সাথে দেখা হয়নি। পুত্রবধূর সাথে দেখা হলে তিনি অভাব অনটনের কথা ব্যক্ত করেন। হযরত ইবরাহিম পুত্রবধূকে বলে এলেন যে, ইসমাইল এলে তাকে বলবে সে যেন ঘরের চৌকাঠ পাল্টে ফেলে। পিতার এ উপদেশের তাৎপর্য হযরত ইসমাইল বুঝে ফেললেন। তিনি স্ত্রীকে তালাক দেন এবং অন্য একজন মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন জুরহাম গোত্রের সরদার মাজায ইবনে আমরের কন্যা (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ:-২৩৩)।

তিন) হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের দ্বিতীয় বিয়ের পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুনরায় মক্কায় আগমন করেন। কিন্তু এবারও পুত্রের সাথে তাঁর দেখা হয়নি। পুত্রবধূর কাছে ঘর সংসারের অবস্থা জিজ্ঞাসা করার পর তিনি আল্লাহ পাকের প্রশংসা করেন। পুত্রবধূর মুখে আল্লাহর প্রশংসা শোনার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পুত্রবধূকে বলেন যে, ইসমাইল এলে তাকে বলবে সে যেন তার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখে। এরপর হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ফিলিস্তিন ফিরে যান।

চার) চতুর্থবার হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মক্কায় এসে দেখতে পান তাঁর পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালাম যমযমের তীরে বসে তীর তৈরি করছেন। পরস্পরকে দেখা মাত্র আবেগে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘকাল পর কোমল হদয় পিতা এবং অনুগত পুত্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই সময়েই পিতাপুত্রে মিলিতভাবে কাবাঘর নির্মাণ করেন। মাটি খুড়ে দেয়াল তোলেন এবং হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সমগ্র বিশ্বের মানুষকে হজ্ব পালনের আহবান জানান।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন মাজাজ ইবনে আমরের কন্যার গর্ভে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে বারটি পুত্র সন্তান দান করেন (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ:২৩০)। তাঁদের নাম ছিল ১) নাবেত বা নিয়াবুত (২) কায়দার (৩) আদবাইল (৪) মোবশাম (৫) মেশমা (৬) দুউমা (৭) মাইশা (৮) হাদদ (৯) তাইমা (১০) ইয়াতুর (১১) নাফিস ও (১২) কাইদমান।

এই বারোজন পুত্রের মাধ্যমে বারোটি গোত্র তৈরি হয়। এরা সবাই মক্কাতেই বসবাস করেন। ইয়েমেন, মিসর এবং সিরিয়ায় ব্যবসা করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। পরবর্তীকালে এসব গোত্র জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন এলাকায় এবং আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এদের অবস্থা সম্পর্কিত বিবরণ মহাকালের গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। শুধু নাবেত এবং কাইদার বংশধরদের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়।

নাবেতিদের সংস্কৃতি হেজাযের উত্তরাংশে বিকাশ লাভ করে। তারা একটি শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং আশেপাশের লোকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। বাতরা ছিল তাদের রাজধানী। তাদের মোকাবেলা করার মতো শক্তি কারো ছিল না। এরপর আসে রোমকদের যুগ। রোমকরা নাবেতিদের পরাজিত করে। মওলানা সাইয়েদ সোলায়মান নদভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি দীর্ঘ গবেষণা ও আলোচনার পর প্রমাণ করেছেন যে, গাসসান বংশের লোকেরা এবং আনযারনি অর্থাৎ আওস ও খাজরায কাহতানিরা আরব ছিলেন না। বরং এ এলাকায় ইসমাইলের পুত্র নাবেতের অবশিষ্ট বংশধর বসবাস করতো (তারিখে আবদুল কোরআন ২য় খন্ড, পৃ:৭৭-৮৬)।

হযরত ইসমাইলের পুত্র কাইদারের বংশের লোকেরা মক্কায় বসতি স্থাপন করতে থাকে এবং কালক্রমে এদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। পরবর্তী কালে আদনান এবং তৎপুত্র মা আদ-এর যমানা আসে। আদনানী বংশধারা সঠিকভাবে এ পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে।

আদনান ছিলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উনিশতম পূর্ব পুরুষ। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম তাঁর বংশধারা বর্ণনা করার সময় আদনান পর্যন্ত পৌঁছে থেমে যেতেন। তিনি বলতেন, বংশধারা বিশেষজ্ঞরা ভুল তথ্য পরিবেশন করে থাকে। (তিবরি, উমাম অল মুলুক, ২য় খন্ড.পৃ: ১৯১-১৯৪ আল আলাম পৃ-৫-৬)। তবে এসব র্পূবপুরষদের সব বংশধারাও বর্ণনা করা সম্ভব । অনেকে উপরোক্ত বর্ণনাকে যঈফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল ওলামাদের মতে আদনান এবং হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মধ্যে চল্লিশ পুরুষের ব্যবধান রয়েছে।

মোটকথা মাআদ এর পুত্র নাজার থেকে কয়েকটি পরিবার জন্ম নেয়। এদের সম্পর্কে বলা হয় যে, উল্লিখিত মাআদ এর পুত্র ছিল মাত্র একজন, তার নাম ছিল নাজার। নাজার এর পুত্র সংখ্যা ছিল চার এবং প্রত্যেক পুত্রের বংশধর থেকে একটি করে গোত্র গড়ে ওঠে। সেই চার পুত্রের নাম ছিল ইয়াদ, আনমার, রবিয়া এবং মোদার। শেষোক্ত অর্থাৎ রবিয়া ও মোদার গোত্রের বহু শাখা প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। রবিয়া থেকে আসাদ ইবনে রবিয়া, আনযাহ, আব্দুল কায়স ওয়ায়েল, বকর, তাগলাব এবং বনু হানিফের বহু গোত্র বিস্তার লাভ করে।

মোদার এর বংশধররা দুটি বড় গোত্রে বিভক্ত হয়েছিল (এক) কাইস আইনাম ইবনে মোদার (২) ইলিয়াস ইবনে মোদার।

কাইস আইলাম থেকে বনু সুলাইম বনু হাওয়াজেন, বনু গাতফান, গাতফান থেকে আরাস, জুরিয়ান, আশজা এবং গানি বিন আস্থর এর গোত্রসমুহ বিস্তার লাভ করে।

ইলিয়াস ইবনে মোদার থেকে তামিম ইবনে মাররা, বুদাইন ইবনে মাররেকা, বনু আসাদ ইবনে খুজাইমা এবকং কেনানা ইবনে খুজাইমার গোত্রসমুহ বিস্তার লাভ করে। কেনানা থেকে কোরাইশ গোত্র অস্তিত্ব লাভ করে। এ গোত্রের লোকেরা ছিল দেহের ইবনে মালেক, ইবনে নজর, ইবনে কেনানার বংশধর।

পরবর্তী সময়ে কোরাইশরা ও বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কোরাইশ বংশের বিখ্যাত শাখাগুলোর নাম নিম্নরূপ-জমেহ, ছাহমা, আদী, মাখজুম, তাইম, কোহরা। কুসাই ইবনে ফেলারের পরিবার অর্থাৎ আবদুদ দার, আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা এবং আবদে মান্নাফ। এ তিনজন ছিলেন কসাইয়ের পুত্র। এদের মধ্যে আবেদে মান্নাফের পুত্র ছিল চারজন। সেই চার পুত্র থেকে নিম্নোক্ত চারটি গোত্রের উৎপত্তি হয়। আবদে শামস, নওফেল, মোত্তালেব এবং হাশেম। হাশেমের বংশধর থেকে আল্লাহ পাক আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেন (মোহাদেরাতে খাযরামি ১ম খন্ড. পৃ-১৪-১৫)।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে থেকে ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেন। এরপর ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে থেকে কেনানাকে মনোনীত করেন। কেনানার বংশধরদের থেকে কোরাইশকে মনোনীত করেন। এরপর কোরাইশ বংশধরদের মধ্য থেকে বনু হাশেমকে মনোনীত করেন। বনু হাশেম থেকে আমাকে মনোনীত করেন (সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ;-২৪৫, জামে তিরিমিযি)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন, আল্লাহ পাক মাখলুক সৃষ্টি করোর পর আমাকে সর্বোত্তম দলের মধ্যে সৃষ্টি করেন। এরপর পরিবার বাছাই করেন এবং আমাকে সবচাইতে ভালো পরিবার সৃষ্টি করেন। কাজেই আমি গোত্রর দিক থেকে উৎকৃষ্ট গোত্রজাত এবং পরবার বা খান্দানের দিক থেকে ও সর্বোত্তম (তিরিমিযি ২য় খন্ড, পৃ:২৩১)।

মোটকথা, আদনানের বংশ যখন বিস্তার লাভ করে তখন তারা খাদ্য পানীয়ের সন্ধানে আরবের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। আবদে কাইস গোত্র, বকর ইবনে ওয়ায়েলের কয়েকটি শাখা এবং বনু তামিমের পরিবারসমুহ বাহরাইন অভিমুখে রওয়ানা হয় এবং সেই এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। বনু হানিফা ইবনে সব ইবনে আলী ইবনে বকর ইয়ামামা গমন করে এবং ইয়ামামার কেন্দ্রস্থল হেজর নামক জায়গায় বসবাস শুরু করে।

বকর ইবনে ওয়ায়েলের অবশিষ্ট শাখাসমুহ ইয়ামামা থেকে বাহরাইন, কাজেমার উপকুল ইরাক উপদ্বীপের আশেপাশে, ইবলা এবং জিয়াত পর্যন্ত এই এলাকায় বসতি স্থাপন করে।

বনু তাগলাব ফোরাত উপদ্বীপে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তবে তাদের কয়েকটি শাখা বনু বকরের সাথে বসবাস করেতে থাকে।

বনু সালিম মদিনার নিকটে বসতি গড়ে তোলে। ওয়াদ্লি কোরা থেকে শুর করে তারা খয়বর মদিনার পূর্বাঞ্চল হয়ে হাররায়ে বনু সোলাইমের সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি পাহাড় পর্যন্ত ছিল তাদের বসতি এলাকা।

বনু ছাকিফ গোত্রের লোকেরা তায়েফকে বসতি স্থাপন করে। বনু হাওয়াজেন মক্কার পূর্বদিকে আওয়াস প্রান্তরের আশেপাশে বসতি গড়ে তোলে। তাদের বাসস্থান ছিল মক্কা-বসরা রাজপথের দুই পাশে।

বনু আসাদ তাইমার পূর্বদিকে এবং কুফার পশ্চিম দিকে বসবাস করতে থাকে। এদের এবং তাইমার মধ্য বনু তাঈ গোত্রের একটি পরিবার বসবাস করতো। এ পরিবারের লোকদের বলা হতো বোহতার। বনু আসাদের বাসস্থান এবং কুফার মধ্যেকার দূরত্ব ছিল পাঁচ দিনের পথ।

বনু জুবিয়ান তাইমার কাছে হাওয়ায় বসবাস করতো।

বনু কেনানা পরিবার তোহামায় বসবাস করতে থাকে। এদের মধ্যে কোরাইশী পরিবারসমুহ মক্কা ও তার আশেপাশে বসবাস করতো। এরা বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে জীবন যাপন করতো। পরবর্তীকালে কুসাই ইবনে কেলার আবির্ভূত হন এবং তিনি কোরাইশদের ঔক্যবদ্ধ করে মর্যাদা গৌরব এবং শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেন (মোহাদেরাতে খাযরামি, ১ম খন্ড পৃ:১৫-১৬)।

আরবের প্রশাসনিক অবস্থা
ইসলাম পূর্বকালের আরবের অবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে আরবের প্রশাসনিক অবস্থা, সর্দারি এবং ধর্মীয় আদর্শ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। এতে ইসলামের আবির্ভাবে আরবের অবস্থা সহজে বোঝা যাবে।

জাযিরাতুল আরবে যে সময় ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সে সময় আরবের দুধরণের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল। প্রথমত মুকুটধারী বাদশাহ, এরা ও আবার পরিপূর্ণ স্বাধীন ছিল না। দ্বিতীয়ত গোত্রীয় সর্দার। এরা মুকুটধারী বাদশাহদের মতোই ক্ষমতা প্রয়োগ করত তবে এরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন ছিল। প্রকৃত বাদশাহ ছিল ইয়েমেনের বাদশাহ, সিরিয়ার গাসসান বংশের বাদশাহরা ও ইরাকের হীরার বাদশাহরা। এছাড়া আরবে অন্য কোন মুকুটধারী বাদশাহ ছিল না।

ইয়েমেনের বাদশাহী

‘আরবের আরেবার’ মধ্যে প্রাচীন ইয়েমেনী গোত্রের নাম ছিল কওমে সাবা। ইরাকে আবিষ্কৃত প্রাচীন শিলালিপি থেকে জানা যায়, খৃষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে সাবা জাতির এখানে বসতি ছিল। তবে এ জাতির উন্নতি অগ্রগতির সূচনা হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব একাদশ শতাব্দীতে। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক সময়কাল নিম্নরূপ-

এক) খৃষ্টপূর্ব ৬৫০ সালের পূর্বেকার সময়। সেই সময়ে সাবার বাদশাহদের উপাধি ছিল মাকরাবে সাবা। এদের রাজধানী ছিল সরওয়াহ নামক জায়গায়। এই রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ মা-আবের থেকে পশ্চিমে একদিনের পথের দূরত্ব পাওয়া যায়। সেই জায়গায় বর্তমান নাম খারিবা। সেই যুগে মা-আরেবের বিখ্যাত বাঁধের ভিত্তি স্থাপনকরা হয়েছিল। ইয়েমেনে ইতিহাসে এটা এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই সময়ে সাবার বাদশাহদের শাসনামলে বহুলোক আরবের ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন স্থানে নতুন বসতি স্থাপন করেছিল।

দুই) খৃষ্টপূর্ব ৬৫০ থেকে খৃষ্টপূর্ব ১১৫ সাল। এ সময়ে সাবার বাদশাহরা মাকরাব উপাধি পরিত্যাগ করে বাদশাহ উপাধি ধারণ করে এবং সরওয়াহ এর পরিবতে মায়ারেবকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করে নেই। এই শহরের ধ্বংসাবশেষ এখনো সান-আ থেকে ৬০ মাইল পূব দিকে পাওয়া যায়।

তিন) খৃষ্টপূর্ব ১১৫ থেকে ৩০০ সাল। এ সময়ে সাবার বাদশাহদের ওপর হেমইয়ার গোত্র অধিপত্য বিস্তার করে এবং তারা মা-আরেবের পরিবতে রাইদানকে নিজেদের রাজধানী মনোনীত করে। পরবর্তী সময়ে রাইদানের নাম পরিবর্তন করে জেফার রাখা হয়। এর ধ্বংসাবশেষ এখনো ইয়েমেনের কাছাকাছি একটি পাহাড়ে পাওয়া যায়।

এক যুগে সাবা জাতির পতন শুরু হয়। প্রথমে নাবেতিরা হেজাজের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং সাবার নতুন জনবসতি উৎখাত করতে শুরু করে। এরপর রোমকরা মিসর, সিরিয়া এবং হেজাজের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে তাদের বাণিজ্যের স্থলপথে ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয় যায়। এদিকে কাহতানি গোত্রসমূহ নিজেরাও ছিল আর্থিক দিক থেকে দুর্দশাগ্রস্ত। এমন পরিস্থিতিতে কাহতানি গোত্রসমূহ নিজেদের দেশ ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।

চার) খৃষ্টাব্দ ৩০০ থেকে ইসলামের সূচনাকাল পর্যন্ত। এ সময়ে ইয়েমেনে ক্রমাগত বিভেদ বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ, বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ চলতে থাকে। এমনি করে এক পর্যায়ে ইয়েমেনের স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়া হয়। এই সময়ে রোমকরা আদনের ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের সাহায্য হাবশী অর্থাৎ আবিসিনিয়ার হেমইয়ার ও হামাদান গোত্রের পারস্পরিক সংঘাত থেকে লাভবান হয়ে ৩৪০ সালে প্রথমবার ইয়েমেন দখল করে নেই। এই দখল ৩৭৮ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ থাকে। এরপর ইয়েমেন স্বাধীনতা লাভ করে বটে কিন্তু মাআরেবের বিখ্যাত বাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। ৪৫০ বা ৪৫১ সালে এই বাঁধ ভেঙ্গে যায়। পবিত্র কোরআনে এই ভাঙ্গনকে বাঁধভাঙ্গা বন্যা বলে অভিহিত করা হয়েছিল। সুরা সাবায় এর উল্লেখ রয়েছে। এটা ছিল বড় ধরনের একটা দুর্ঘটনা। এ বন্যার ফলে বহু জনপদ বিরান জনশূন্য হয়ে পড়েছিল এবং বহু গোত্র বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।

৫২৩ ঈসায়ী সালে আরেকটি বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে। বাদশাহ জুনুয়াস ইয়েমেনের ঈসায়ীদের ওপর হামলা করে তাদের কে খৃষ্টধর্ম ত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা করে। তারা রাজি না হওয়ায় তাদেরকে পরিখা খনন করে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। পবিত্র কোরআনের সুরা বুরুজে ‘ধ্বংস হয়েছিল কুণ্ডের অধিপতিরা বলে এই লোমহর্ষক ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠ। আবিসিনিয়রা রোমকদের সমর্থন পেয়ে ৫১৫ সালে আরিয়াতের নেতৃত্বে ৭০ হাজার সৈন্যসহ পুনরায় হামলা চালায়। এবং ইয়েমেন অধিকার করে নেয়। অধিকারের পর আবিসিনিয়ার সম্রাটের গভর্নর হিসাবে আরিয়াত ইয়েমেন শাসন করতে থাকেন। কিছুকাল পর আরিয়াতের সেনাবাহিনীর এক অধিনায়ক আরিয়াতকে হত্যা করে ক্ষমতা গ্রহণ করে। এ অধিনায়কের নাম ছিল আবরাহা। ক্ষমতা গ্রহণের পর আবরাহা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আবিসিনিয়ার সম্রাটকে ও তার বশ্যতা স্বীকারে রাজি করায়। এই আবরাহাই পরবর্তীকালে কাবাঘর ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করেছিল। দুর্ধর্ষ একদল সৈন্য এবং কয়েকটি হাতী নিরয় আবরাহা মক্কা অভিযানে পরিচালনা করেছিল। এই অভিযানকে ‘আসহাবে ফীল’ নামে কোরআনে সুরা ফীলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আসহাবে ফীলের ঘটনায় আবিসিনীয়দের যে ক্ষতি হয়েছিল তার প্রেক্ষিতে ইয়েমেনের অধিবাসীরা পারস্য সরকারের নিকট সাহায্য চায়। তারা আবিসিনীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং সাইফে যী ইয়াযান ইময়ারীর পুত্র মাদি কারাবের নেতৃত্বে আবিসিনীয়দের দেশ থেকে বের করে দেয়। এরপর তারা একটি স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসাবে মাদিকারাবকে ইয়েমেনের বাদশাহ বলে ঘোষণা করে। এটা ছিল ৫০৫ সালের ঘটন।

স্বাধীনতার পর মাদিকারাব তার সেবার জন্য এবং রাজকীয় বাহিনীর সৌন্দর্যের জন্য কিছু সংখ্যক হাবশী অর্থাৎ আবিসিনীয়দের রেখে দেয়। তার এ পথ বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়। কর্মরত হাবশীরা একদিন ধোঁকা দিয়ে বাদশাহ মাদিকারাবকে হত্যা করে। এর ফলে যী ইয়াযান পরিবারের রাজত্ব চিরতরে শেষ হয়ে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য এগিয়ে আসেন পারশ্যের সম্রাট কিসরা। তিনি সন্‌য়া’য় পারশ্য বংশোদ্ভূত একজন গভর্নর নিয়োগ করে ফরাসী গভর্নর নিযুক্ত হতে থাকেন। সর্বশেষ গভর্নর বাযান ৬২৮ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। এর ফলে ইয়েমেনে পারস্য আধিপত্য লোপ পায় এবং ইয়েমেন ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয় (মাওলানা সেইয়েদ সোলায়মান নদভী তারীখে আরদুল কোরআন গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ১৩৬ পৃষ্ঠা থেকে গ্রন্থের শেষ পযন্ত ঐতিহারিসক তথ্য সংরক্ষনের আলোকে সারা জাতি সম্পকে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। মওলানা আবুল আলা মওদুদী তাফহিমুল কোরআনের চতুথ খন্ডের ১৫৮-১৯৮ পৃষ্টায় ও এ পযায় কিছু কিছু তথ্য সন্নীবেশিত করেছেন)।

হীরার বাদশাহী

ইরাক এবং তার আশেপাশের এলাকায় কোরোশ কাবির অথবা সায়রাম যুল কারনাইনের (খৃষ্টপূর্ব ৫৭৫ থেকে ৫২৯ সাল পর্যন্ত) সময় থেকেই পারস্যদের রাজত্ব চলে আসছিল। ফরাসীদের মোকাবেলা করার মতো শক্তি কারো ছিলনা। খৃষ্টপূর্ব ৩২৬ সালে সিকান্দার মাকদুনি প্রথম রাজিত করে পারস্য শক্তি নস্যাৎ করেন। এর ফলে পারস্য সাম্রাজ্য খন্ড খন্ড হয়ে যায়। এ বিশৃংখলা অবস্থা ২৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময় কাহতানী গোত্রসমুহ দেশত্যাগ করে। ইরাকের এক বিস্তীর্ণ সীমান্ত থেকে যেসব আদনানীরা দেশত্যাগ করে গিয়েছিল তারা এ সময় কারিলায় ফিরে আসে এবং প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করে ফোরাত নদীর উপকুল ভাগের একাংশে নিজেদের বসতি স্থাপন করে।

এদিকে ২২৬ সালে আদের্শির সাসানি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর ধীরে ধীরে পারশ্য শক্তি সংহত হতে শুরু করে। আদের্শির পারস্যদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং তার দেশের সীমান্তে বসবাসকারী আরবদের প্রতিহত করেন। এর ফলে কোযাআ গোত্র সিরিয়ার পথে রওয়ানা হন। পক্ষান্তরে হীরা এবং আনবারের আরব অধিবাসীরা বশ্যতা স্বীকারে সম্মতি জ্ঞাপন করে।

আর্দেশিরের শাসনামলে হীরা, বাদিয়াতুল ইরাক এবং উপদ্বীপের ওপর রবিয়ী গোত্রর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। মোদারী গোত্রসমূহের ওপর জাযিরাতুল ওয়াযযাহদের শাসন ছিল। মনে হয়, আর্দেশিয়রা বুঝতে পেরেছিলো যে, আরব অধিবাসীদের ওপর সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করা এবং সীমান্তে তাদেরকে লুটতরাজ থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয় বরং ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে এমন কোন আরব নেতাকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করাই হবে বুদ্ধিমত্তার কাজ। এর ফলে একটা লাভ এই হবে যে, প্রয়োজনের সময় রোমকদের বিরুদ্ধে এসব আরবের সাহায্য নেয়া যাবে এবং সিরিয়ার রোমকপন্থী আরব শাসকদের মোকাবেলায় ইরাকের এসব শাসনকর্তাকে দাড় করানো যাবে। হীরার বাদশাহদের অধীনে পারশ্য সৈন্যদের একটি ইউনিট আবিসিনিয়ায় থাকতো। এদের দ্বারা বিভিন্ন স্থানে আরব বিদ্রোহীদের দমন করা হতো।

২৬৮ সালে, জাযিমা মৃত্যু বরণ করেন এবং আমর ইবনে আদী ইবনে নসর লাখামী হাদরামি তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন লাখাম গোত্রর প্রথম শাসনকর্তা। শাপুল কোবাজ ইবনে ফিরোজের যুগ পর্যন্ত একাধারে হীরার ওপর লাখমিদের শাসন চলতে থাকে। কোবাজের সমসাময়িককালে মোজদকের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন সংস্কারবাদের প্রবক্তা। কোবাজ এবং তার বহুসংখ্যক অনুসারী বাদশাহ মোনযার ইবনে মাউসসামাকে বাতা পাঠালেন যে, তুমিও এ ধর্ম গ্রহণ করো। মোনযার ছিল বড়ই দুরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ, তিনি অস্বীকার করে বসলেন। ফলে কোবাজ তাকে বরখাস্ত করে তার স্থলে মোজদাকি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা হারেস ইবনে আমর ইবনে হাযার ফিন্দীর হাতে হীরার শাসনভার ন্যস্ত করলেন।

কোবাজের পরে পারস্যের শাসনক্ষমতা কিসরা নওশেরওয়ার হাতে আসে। তিনি এ ধর্মকে প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। তিনি মোজদাক এবং তার বহু সংখ্যক সমর্থকে হত্যা করেন। মোনযারকে পুনরায় হীরার শাসনভার ন্যস্ত করেন এবং হারেস ইবনে আমরকে নিজের কাছে ডেকে পাঠান। কিন্তু হারেস বনু কেনায়ের এলাকায় পালিয়ে গেলেন এবং তিনি সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেন।

মোনযার ইবনে মাউসসামার পরে নোমান ইবনে মোনাযের কাল পর্যন্ত হীরার শাসনক্ষমতা তার বংশধরদের মধ্যে আবর্তিত হয়। এরপর যায়েদ ইবনে আদী এবাদী কিসরার কাছে নোমান ইবনে মোনযারের নামে মিথ্যা অভিযোগ করে। কিসরা নওশেরওয়া এতে ক্ষেপে যান এবং নোমানকে তার কাছে ডেকে পাঠান। নোমান প্রথমেই হাযির না হয়ে চুপিসারে বনু শায়বানের সদার হানি ইবনে মাসুদের কাছে যান এবং পরিবার -পরিজন, ধন-সম্পদ সবকিছু তার কাছে রেখে কিসরার দরবারে হাযির হন। কিসরা তাকে বন্দী করেন এবং বন্দী অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়।

এদিকে কিসরা নোমানকে বন্দী করার পর তার স্থলে ইয়াস ইবনে কোবায়সা তাঈকে কীরার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং হানি ইবনে মাসুদের কাছে নোমানের জামানত চাওয়ার জন্য ইয়াসকে নির্দেশ দেন। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হানি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ইয়াস কিসরার সৈন্যদের নিয়ে এবং মুরযবনদের দল নিয়ে রওয়ানা হন। জিকার ময়দান উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বনু শায়বান জয়লাভ করেন এবং ফরাসীরা লজ্জাকরভাবে পরাজিত হয়। এই প্রথম আরবরা অনারবদের ওপর জয়লাভ করেন। এ ঘটনা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের জন্মের কিছুকালে পরে ঘটেছিল। হীরায় ইয়াস এর শাসন পরিচালনার অষ্টম মাসে রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহিস সালাম জন্ম গ্রহণ করেন।

ইয়াস এর পরে কিসরা হীরায় একজন ফরাসী গভর্নর নিয়োগ করেন। কিন্তু ৬৩২ সালে লাখমিদের ক্ষমতা পুনর্বহাল হয় এবং মোনযের ইবনে মারুর নামে এক ব্যক্তি শাসন ক্ষমতা দখল করেন। শাসনকার্য পরিচালনার আট মাস পরেই হযরত খালেদ রাদি আল্লাহু আনহু ইসলামের শক্তির পতাকা নিয়ে হীরায় প্রবেশ করেন।

সিরিয়ার বাদশাহী

আরব গোত্রসমূহের হিজরত যে সময় চলছিল সে সময় কোযায়া গোত্রের কয়েকটি শাখা সিরিয়া সীমান্তে এসে বসবাস শুর করে। বনু সোলাইম ইবনে হুলওয়ানের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল। এদের একটি শাখা ছিল বনু জাজআন ইবনে সোলাইম। এর জাজায়েমা নামে খ্যাতি লাভ করেছিল। কোজাআর এই শাখাকে রোমানরা আরবের মুর বেদুইনদের লুটতরাজ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং পারস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য কাছে টেনে নিয়েছিল। এই গোত্রর একজনের ওপর শাসনভার ন্যস্ত করার জন্য কাছে টেনে নিয়েছিল। এই গোত্রের একজনের ওপর শাসনভার ন্যস্ত করা হয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন যাবত তাদের শাসন চলতে থাকে। এদের বিখ্যাত বাদশাহ ছিলেন যিয়াদ ইবনে হিউলা। ধারনা করা হচ্ছে যে, জাযায়েমার শাসনকাল দ্বিতীয় খৃষ্টীয় শতকের পুরো সময়ব্যাপী পরিব্যাপ্ত ছিল। এরপর গাসসান বংশের আবির্ভাব গটে এবং জাযায়েমাদের শাসনামলের অবসান ঘটে। গাসসান বংশের লোকেরা বনু জাযায়েমাদের পরাজিত করে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। এ অবস্থা দেখে রোমকরা গাসসানী বংশের শাসকদের সিরিয়ার আরব অধিবাসীদের শাসনকর্তা হিসাবে মেনে নেয়। গাসসান বংশের রাজধানী ছিল দওমাতুল জন্দল। রোমকরা শক্তির ক্রীড়ানক হিসাবে সিরিয়ায় দীর্ঘকাল তাদের শাসন ক্ষমতা অটুট থাকে। ফারুক খেলাফতের সময় ত্রয়োদশ হিজরতে ইয়ারমুকের যুদ্ধে সংঘটিত হয় এ সময় গাস্সান বংশের সর্বশেষ শাসনকর্তা জাবলা ইবনে আইহাম ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু অহংকারের কারণে এই লোকটি বেশীদিন ইসলামের ওপর টিকে থাকতে পারেনি পরে সে ধর্মান্তরিত বা মুরতাদ হয়ে যায়।

হেজাযের নেতৃত্ব

হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম থেকেই মক্কায় মানব বসতি গড়ে ওঠে। তিনি ১৩৭ বছর বেঁচে ছিলেন (বাইবেল, জন্ম শীষক অধ্যায় পৃ”-১৭-২৫)। যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন মক্কার নেতা এবং কাবাঘরের মোতাওয়াল্লী (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-২৩০-২৩৭)। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নাবেত এবং কাইদার মক্কায় শাসনভার পরিচালনা করেন।

এই দুজনের মধ্যে কে আগে এবং কে পরে ক্ষমতাসীন ছিলেন এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন প্রথমে নাবেত ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং পরে কাইদার । কেউ বলেন প্রথমে কাইদার ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং পরে নাবেত। এদের পরে এদের নানা মাজাজ ইবনে জোরহামি ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এমনি করে মক্কার শাসন ক্ষমতা জোরহামিদের হাতে চলে যায়। দীর্ঘদিন এ ক্ষমতা তাদের কাছে থাকে। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম যেহেতু তাঁর পিতার সাথে কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন একারণে তাঁর বংশধরদের একটি সম্মানজনক অবস্থান ছিল, কিন্তু ক্ষমতা ও নেতৃত্ব পরবর্তী সময়ে তাদের অংশ ছিলনা (ইবনে হিশাম ১ম খন্য, পৃ-১১১-১১৩, ইবনে হিশাম, হযরত ইসমাইলের বংশধরদের মধ্যে শুধুমাত্র নাবেতের ক্ষমতাসীন থাকার কথা উল্লেখ করেছেন)।

বছরের পর বছর কেটে যায় কিন্তু হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশধরগণ অজ্ঞাত পরিচয় অবস্থা থেকে বাইরে আসতে পারেননি। বখতে নসরের আবির্ভাবের কিছুকাল আগে বনু জোরহামের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কায় রাজনৈতিক গগনে আদনানীদের রাজনৈতিক নক্ষত্র চমকাতে শুরু করে। এর প্রমাণ এই যে, যাতে ইরক নামক জায়গায় বখতে নসর আরবদের সাথে যে যুদ্ধ করেন সেই যুদ্ধে আরব সেনাদলের অধিনায়কদের মধ্যে জোরহাম গোত্রের কেউ ছিলেন না (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-২৩০)।

খৃষ্টপূর্ব ৫৮৭ সালে বখতে নসরের দ্বিতীয় অভিযানের সময়ে বনু আদনান ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। সে সময়ে বনি ইসরাইলের নবী ছিলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তিনি আদনানের পুত্র মাআদকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ায় যান। বখতে নসরের দাপট হ্রাস পাওয়ার পর মায়াদ মক্কায় ফিরে আসেন। এ সময় তিনি লক্ষ্য করেন যে, মক্কায় জোরহাম গোত্রর জোরশাম নামে শুধু একজন লোক রয়েছেন। জোরশাম ছিলেন জুলহামার পুত্র। মায়াদ তখন জোরশামের কন্যা মায়ানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার গর্ভ থেকে নাযার জন্মগ্রহণ করেন (রহমতুন লিল আলামিন,২য় খন্ড পৃ-৪৮)।

যে সময় মক্কায় জোরহামের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। দারিদ্রের নিষ্পেষণে তারা ছিল জর্জরিত। এর ফলে তারা কাবা ঘরে তাওয়াফ করতে আসা লোকদের ওপর বাড়াবাড়ি করে এমনকি কাবাঘরের অর্থ সম্পদ আত্মসাৎ করতেও দ্বিধা বোধ করেনি। (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-২৩১)। বনু আদনান বনু জোরহামের এসব কাচে ভেতরে ভেতরে ছিল দারুন অসন্তুষ্ট। ফলে বনু খোজাআ মাররাজ জাহরানে অভিযানের সময় আদনান বংশের লোকদের লোভকে কাজে লাগায়। বনু খোজাআ আদনান গোত্রের বনু বকর ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে কেনানাকে সঙ্গে নিয়ে বনু জোরহামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বনু জোরহাম পরাজিত হয়ে মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়। এ ঘটনা ঘটেছিল খৃষ্টীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়।

মক্কা ছেড়ে যাওয়ার সময় বনু জোরহাম যমযম কুপ ভরাট করে দেয়। এ সময় তারা যমযমে কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন নিক্ষেপ করে তা প্রায় ভরাট করে ফেলে। মোহাম্মদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন , আমর ইবনে হারেস মায়ায জোরহামি (হযরত ইসমাঈলের ঘটনায় উল্লেখিত মাযাযে জোরহামী এবং এই লোক এক ব্যক্তি নন)। কাবাঘরের দুটি সোনার হরিণ (মাসুদ লিখেছেন, পারস্যবাসী কাবাঘরের জন্য মূল্যবান সম্পদ এবং উপঢৌকন পাঠাতেন। যায়েদ ইবনে বাক সোনার তৈরি দুটি হরিণ, মনি-মুক্তা, তলোয়ার এবং বহু সোনা প্রেরণ করেছিলেন। আমর এসব কিছু যমযম কুপে নিক্ষেপ করেন। মুরাও অযজাহাব ১ম খন্ড, পৃ:২ও৫)। এবং কাবার কোণে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদকে বের করে যমযম কুপে প্রোথিত করে। এরপর তারা জোরহাম গোত্রের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেন জলে যায়। বনু জোরহাম মক্কা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার এবং ক্ষমতা হারানোর ব্যথা ভুলতে পারছিল না। জোরহাম গোত্রের আমর নামক এক ব্যক্তি এ সম্পর্কে রচিত কবিতায় বলেছেন,

আজুন থেকে সাফা পর্যন্ত মিত্র কেউ নেই, রাতের মহফিলে নেই গল্প বলার কেউ। নেই কেন? আমরা তো এখানের অধিবাসী, সময়ের আবর্তনে ভাঙ্গা কপাল, হায়রে হায় আজ আমাদের করে দিয়েছে সর্বহারা। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১১৪-১১৫)।

হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের সময়কাল ছিলো খৃষ্টপূর্ব প্রায় দুহাজার বছর আগে। এ হিসেবে অনুযায়ী মক্কার জোরহাম গোত্রের অস্তিত্ব ছিল দুই হাজার একশত বছর। প্রায় দুহাজার বছর তারা রাজত্ব করেছিল।

বনু খোজাআ মক্কায় তাদের আধিপত্য বিস্তারের পর বনু বকরের বাদ দিয়েই শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। তবে তিনটি মর্যাদাসম্পন্ন পদে মোদীর গোত্রের লোকদের অধিষ্ঠিত করা হয়। সে তিনটি পদ নিম্নরূপ,

এক) হাজীদের আরাফাত থেকে মোযদালেফায় নিয়ে যাওয়া এবং ইয়াওমুন নাহারে হাজীদের মিনা থেকে রওয়ানা হওয়ার পরোয়ানা প্রদান। ১৩ই জিলহজ্জ হচ্ছে ইয়াওমুন নাফার, এই দিন হচ্ছে হজ্জের শেষদিন। এই মর্যাদা ইলিয়াস ইবনে মোদারের পরিবার বনু সাওম ইবনে মারবার অধিকারে ছিল। এদেরকে সোফা বলা হতো। সোফার একজন লোক পাথর নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত ১৩ই জিলহজ্জ হাজীরা পাথর নিক্ষেপ করতে পারতেন না। হাজীদের পাথর নিক্ষেপ এবং মিনায় রওয়ানা হওয়ার সময় সোফার লোকেরা মিনার একমাত্র পথ আকাবার দুপাশে দাড়িয়ে থাকতো। তাদের যাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন হাজী সে পথ অতিক্রম করতে পারত না। তাদের যাওয়ার পর অন্য লোকদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো। সোফাদের পর এই বিরল সম্মান বনু তামিমের একটি পরিবার বনু সাদ ইবনে যায়েদ মানাত লাভ করে।

দুই) ১০ই জিলহজ্জ সকালে মোযদালেফা থেকে মিনা যাওয়ার সম্মান বনু আদনানের অধিকার ছিল।

তিন) হারাম মাসসমূহের আগে এগিয়ে নেয়া ও পিছিয়ে দেয়া। বনু কেনানাহ গোত্রের একটি শাখা বনু তামিম ইবনে আদী এই মর্যাদার অধিকারী ছিল। (ইবনে হিশাম ১ম খন্য, পৃ-১১৯-১২২। )

মক্কার ওপর বনু খোজাআ গোত্রের আধিপত্য তিনশত বছর যাবত স্থায়ী ছিল। (ইয়াকুত, সাদ্দা, মক্কা)

এই সময়ে আদনানী গোত্রসমুহ মক্কা এবং হেজায থেকে বের হয়ে নজদ, ইরাকের বিভিন্ন এলাকায়, বাহরাইন এবং অন্যান্য জায়গায় প্রসারিত হয়। মক্কার আশেপাশে কোরাইশদের কয়েকটি শাখা অবশিষ্ট থাকে। এরা ছিল বেদুইন। এদের পৃথক পৃথক দল ছিল এবং বনু কেনানায় এদের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পরিবার বসবাস করছিল। মক্কার শাসন পরিচালনা এবং কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণে এদের কোন ভূমিকা ছিল না। এরপর কুসাই ইবনে কেলাবের আবির্ভাব ঘটে। (মোহাদেরাতে খাযরামি, ১ম খন্ড, পৃ:-৩৫ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃ-১১৭)।

কুসাই সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, মায়ের কোলে থাকার সময়েই তার পিতার মৃত্যু হয়। এরপর তার মা বনু ওজরা গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামীর গোত্র যেহেতু সিরিয়ায় থাকতো এ কারণে কুসাইয়ের মা সিরিয়ায় চলে যান। কুসাইকেও তিনি সঙ্গে নিয়ে যান। যুবক হওয়ার পর কুসাই মক্কায় ফিরে আসেন। সে সময় মক্কার গভর্নর ছিলেন হোলাইল ইবনে হাবশিয়া খোযায়ী। কুসাই হোলাইলের কন্যা হোবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।

হোলাইল সে প্রস্তাব গ্রহণ করে হোবাকে বিবাহ দেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ:১১৭-১১৮) হোলাইলের মৃত্যুর পর মক্কা ও কাবাঘরের ওপর আধিপত্যর বিষয় নিয়ে খোযায়ী এবং কোরাইশদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে জয় লাভ করে কুসাই শাসন ক্ষমতা এবং কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার লাভ করেন।

এ যুদ্ধের কারণ কি ছিল? এ সম্পর্কে তিনটি বিবরণ পাওয়া যায়।

প্রথমত, কুসাইয়ের বংশধরদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধন সম্পদের প্রাচুর্য আসার পর কুসাইয়ের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। এদিকে যখন হোলাইলের মৃত্যু হয়। তখন কুসাই চিন্তা করলেন যে বনু খোযাআ এবং বনু বকরের পরিবতে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মক্কার শাসন পরিচালনার জন্য আমিই উপযুক্ত। তিনি এ কথাও চিন্তা করেছিলেন যে, কোরাইশরা নির্ভেজাল ইসমাইলি বংশোদ্ভূত আরব এবং অন্যান্য ইসমাইলিদের সদার। কাজেই নেতৃত্ব কর্তৃত্বের অধিকার শুধু তাদেরই রয়েছে। এসব কথা চিন্তা করে কুসাই কোরাইশ এবং বনু খোযাআ গোত্রের কয়েকজন লোকো সাথে আলোচনা করেন। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বনু খোযাআ গোত্রের বনু বকরকে মক্কা থেকে বের করে না দেয়ার কোন চুক্তি আছে কি? সবাই তার সাথে ঐক্যমত্য প্রকাশ করলো এবং তাকে সমর্থন জানালো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ:১১৭-১১৮)।

দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর সময়ে কুসাইয়ের শ্বশুর হোলাইল অসিয়ত করেছিলেন যে, কুসাই কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং মক্কার ওপর শাসন কাজ পরিচালনা করবেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ: ১১৮)।

তৃতীয়ত, হোলাইল তার ক্যা হোবাকে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। আবু গিবশান খোযায়ীকে উকিল নিযুক্ত করা হয়। হোবার প্রতিনিধি হিসাবে আবু গিবশান কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব করতেন। হোলাইলের মৃত্যুর পর কুসাই এক মশক মদের বিনিময়ে আবু গিবশানের নিকট কাবার রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা ক্রয় করেন। কিন্তু খোযাআ গোত্র এ ক্রয় বিক্রয়ের অনুমোদন করেনি। তারা কুসেইকে কাবাঘরে যেতে বাধা দেয়। এর ফরে কুসাই বনু খোযাআদের মক্কা থেকে বের করে দেয়ার জন্য কোরাইশ এবং বনু কেনানাদের একত্রিত করে। কুসাইয়ের ডাকে সবাই সাড়া দেয় এবং বনু খোযাআদের মক্কা থেকে বের করে দেয়া হয়(রহমাতুল লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ: ৫৫)।

মোটকথা, কারণ যা কিছুই হোক না কেন ঘটনাধারা ছিল এরূপ যে হোলাইলের মৃত্যুর পর সোফা গোত্রের লোকেরা ইতিপূর্বে যা করতো তাই করতে চাইলো। এ সময়ে কুসাই কোরাইশ এবং কেনানা গোত্রের লোকদের একত্রিত করেন। আকাবার পথের ধারে সমবেত লোকদের কুসাই বললেন, তোমার চেয়ে আমরা এ সম্মানের অধিক যোগ্য (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ ১১৭)। এ কথার পর উভয়ে পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয় এবং কুসাই সোফাদের নিকট থেকে মর্যাদা ছিনিয়ে নেন। এ সময়ে বনু খোজাআ এবং বনু বকর গোত্রের লোকেরা কুসাইয়ের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার পরিবতে তার বিরোধিতা করে। এতে কুসাই তাদের হুমকি দেন। ফিলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ বেধে যায় এবং বহু লোক মারা যায় (কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-২৩২)। যুদ্ধের পর সন্ধির শত অনুযায়ী কুসাই মক্কার প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করেন। মক্কার বিভিন্ন এলাকা থেকে কোরাইশদের ডেকে এনে তাদেরকে প্রশাসনের সাথে যুক্ত করেন। এ ছাড়া তিনি প্রত্যেক কোরাইশ পরিবারের রমযানের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে বরাদ্দ করেন। মাসের হিসাব গণনাকারী, আল সফওয়ানদের বনু আদওয়ান এবং বনু মাররা ইবনে আওফকে তাদের পদমর্যাদায় টিকিয়ে রাখেন। কুসাই মনে করতেন এটাও ধমের অংশ, এতে রদবদলের অধিকার কারো নেই (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড পৃ: ১২৪-১২৫)।

কারা ঘরের উভয় দিকে দারুন নোদওয়া প্রতিষ্ঠা করা কুসাইয়ের অন্যতম কীর্তি। এর দরোজা ছিল মসজিদের দিকে। দারুন নোদওয়া ছিল প্রকৃতপক্ষে কোরাইশদের সংসদ ভবন। কোরাইশদের সামাজিক জীবন দারুন নোদওয়ার গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল অসামান্য। এই প্রতিষ্ঠান ছিল কোরাইশদের ঐক্যের প্রতীক। সমাজের বহু জটিল সমস্যার সমাধান এখানে হতো। (ঐ ১ম খন্ড, পৃ: ১২৫, মোহাযেরাতে খাযরমি ১ম খন্ড, পৃ-৩৬)

কুসাই নিন্মেল্লিখিত মর্যাদার ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

এক) দারুন নোদওয়ার সভাপতি। এখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ হতো। যুবক যুবতীদের বিয়েও এখানে অনুষ্ঠিতে হতো।

দুই) লেওয়া, অর্থাৎ যুদ্ধের পতাকা কুসাইয়ের হাতে বেঁধে রাখা হতো।

তিন) হেজাবাত, কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণে। এর মানে হচ্ছে কাবাঘরের দরোজা কুসাই খুলতেন এবং কাবা ঘরের যাবতীয় খেদমত এবং রক্ষণাবেক্ষণ তার তদারকিতেই সম্পন্ন হতো।

চার) সেকায়া, পানি পান করানো। কয়েকটি হাউজে হাজীদের পানি ভরে রাখা হতো। এরপর সোই পানিতে খেজুর এবং কিসমিস মিশিয়ে পানি মিঠা করা হতো। হজ্জ যাত্রীরা মক্কায় এলেই সেই পানি পান করতেন। (মোহাদেরাতে খাযরমি, ১ম খন্ড, পৃ-৩৬)।

পাঁচ) রেফাদা, হাজীদের মেহমানদারী। এর অর্থ হচ্ছে হাজীদের মেহমানদারীর জন্য খাবার তৈরি করা। এ উদ্দেশ্যে কোরাইশদের ওপর কুসাই নির্ধারিত পরিমাণ চাঁদা ধার্য করে দিতেন। সেই অর্থ হজ্জ মৗসুমে কুসাইদের কাছে জমা দিতে হতো। কুসাই জমাকৃত অর্থে হাজীদের জন্য খাবার তৈরি করাতেন। দরিদ্র, নিঃস্ব হাজীদেরকে যেসব খাবার পরিবেশন করা হতো। যেসব হাজীর কাছে বাড়ী ফিরে যাওয়ার অর্থ সম্বল থাকতো না তাদের সাহায্য করা হতো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ:-১১)।

কুসাই উল্লিখিত সকল প্রকার পদমর্যাদার অধিকারী ছিলেন। কুসাই এর জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম ছিল আবদুদ দার। দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল আবদে মান্নাফ। দ্বিতীয় পুত্র কুসাইয়ের জীবদ্দশায়ই নেতৃত্ব কর্তৃত্বের উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। এ কারণে কুসাই তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আবদুদ দারকে বলেছিলেন, ওরা যদিও তোমাকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু আমি তোমাকে তাদের সমমর্যাদায় উন্নীত করবো। এরপর কসাই সকল পদমর্যাদার ব্যাপারে আবদুদ দারকে উত্তরসূরি করে অসিয়ত কর যান। অর্থাৎ দারুন নোদওয়ার সভাপতি, কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ করানো যুদ্ধের পতাকা বহন, হাজীদের পানি পান করানো, হাজীদের মেহমানদারী সব কিছুই তিনি আবদুদ দারকে ন্যস্ত করেন। জীবদ্দশায় কুসাই এর কোন কথা এবং কাজের কেউ প্রতিবাদ করতো না বরং সব কিছু সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতো, এ কারণে মৃত্যুর পরে তার সব সিদ্ধান্ত সবাই বিনা সমালোচনায় মেনে নিয়েছিল। কুসাইয়ের সন্তানরা পিতার অসিয়তের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করেন। আবদে মান্নাফের মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা চাচাতো ভাইদের সাথে উল্লিখিথ বিষয় গুলোতে দরকষাকষি শুরু করে। চাচতো ভাইদের একক পদমর্যাদার সমালোচনা করে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে। এর ফলে কোরাইশরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ আপোষ নিষ্পত্তির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে এবং বিভিন্ন পদমর্যাদা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এরপর হাজীদের পানি পান করানো এবং হাজীদের আতিথেয়তার দায়িত্ব বনু আবদে মান্নাফের ওপর ন্যস্ত করা হয়। দারুন নোদওয়ার নেতৃত্ব এবং কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আবদুদ দারের সন্তানদের হাতে থাকে। অর্জিত পদ মর্যাদার ব্যাপারে আবদে মান্নাফের সন্তানরা কোরা অর্থাৎ লটারির ব্যবস্থা করেন। কোরায় আবদে মান্নাফের পুত্র হাশেমের নাম ওঠে। এর ফলে হাশেম সারা জীবন হাজীদের পানি পান করানো এবং হাজীদের মেহমানদারীর দায়িত্ব পালন করেন। হাশেমের মৃত্যুর পর তার ভাই মোত্তালেবের এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মোত্তালেবের পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র আব্দুল মোত্তালেবের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তিনি ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাদা। আবদুল মোত্তালেবের পুত্র আব্বাস এ দায়িত্ব লাভ করে। (ঐ ১ম খন্ড পৃ: ১২৯, ১৩২, ১৭৮, ১৭৯)।

এছাড়া আরো কিছু পদমর্যাদা ছল, যেসব কোরাইশরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এসব পদমর্যাদার মাধ্যমে কোরাইশরা একটি ছোটখাটো সরকার গঠন করে রেখেছিলেন। সে সরকারের ব্যবস্থাপনা ছিল অনেকটা বর্তমান কালের সংসদ পদ্ধতির মতো। পদমর্যাদার রূপরেখা ছিল নিম্নরূপ-

ক) ঈসার, অর্থাৎ ফালগিরি। ভাগ্য জানার জন্য মূর্তিদের কাছে যে তীর রাখা হতো সে তাও রক্ষণাবেক্ষণ এই মর্যাদা ছিল বনু জমহের নিকট।

খ) অর্থ ব্যবস্থাপনা, মূর্তিদের নৈকট্য লাভের জন্য যেসব উপঢৌকন, নযরানা এবং কোরবানী পেশ করা হতো তার ব্যবস্থাপনা। এছাড়া ঝগড়া বিবাদের ফয়সালা করার দায়িত্বও বনু সাহাম দেয়া হয়েছিল।

গ) শুরা, এ সম্মান বনু আছাদের কাছে ছিল।

ঘ) আশনাক, ক্ষতিপূরণ এবং জরিমানা র অর্থ আদায় ও বণ্টন। বনু তাঈম গোত্র এ মর্যাদার অধিষ্ঠিত ছল।

ঙ)উকাব, জাতীয় পতাকা বহন । এ মর্যাদা বনু উমাহিয়া গোত্রের ওপর ন্যস্ত ছিল।

চ) কুব্বা, সামরিক ছাউনির ব্যবস্থাপনা এবং সৈন্যদের অধিনায়কত্ব। এ সম্মান বনু মাখযুমের অধিকার ছিল।

ছ) সাফায়াত, সফর সম্পর্কিত বিষয় তত্ত্বাবধান। দায়িত্ব বনু আদী গোত্র পালন করতো। (তারীখে আবদুল কোরআন ২য় খন্ড, পৃ: ১০৪, ১০৫, ১০৬)।

আরবের অন্যান্য অংশের প্রশাসনিক অবস্থা

ইতিপূর্বে কাহতানি এবং আদনানী আরবের দেশ ত্যাগের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমগ্র দেশ আরবের এসব গোত্রের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এরপর তাদের নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বের অবস্থা এরূপ ছিল যে, কাবার আশেপাশে যেসব গোত্র বসবাস করতো তাদেরকে হীরার অধীনস্থ মনে করা হতো। কিন্তু এটা ছিল নামকাওয়াস্তে, বাস্তবে সেরূপ ছিল না। উল্লেখিত দুটি জায়গা বাদে অন্যান্য এলাকার আরবরা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন।

এ সকল গোত্রের মধ্যে মর্যাদা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। গোত্রের লোকেরই নিজেদের মর্যাদা নিযুক্ত করতো। এ সকল সর্দারদের জন্য গোত্র হতো একটি ছোট খাট সরকার। রাজনৈতিক অস্তিত্বের নিরাপত্তার ভিত্তি, গোত্রীয় বিবাদ বিশৃঙ্খলা নিরসন এবং নিজেদের ভূখণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিরক্ষার স্বার্থ এর দ্বারা করা হতো।

সর্দারদের মর্যাদা ছিল তাদের সমাজের বাদশার মতো। যুদ্ধ সন্ধির ব্যাপারে সর্দারদের ফয়সালা হতো চূড়ান্ত। এ অবস্থায় কোন পরিবর্তন কোন অবস্থায়ই হতো না। একজন একনায়কের যেরূপ ক্ষমতা থাকা দরকার এসব গোত্রীয় সর্দারের ক্ষমতা তার চেয়ে কোন অংশ কম ছিলনা, কোন কোন সর্দারের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা সব দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী হতেন। একজন কবি একথা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের মধ্যে তোমার জন্য গণিমতের মালে এক চতুর্থাংশ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে নির্বাচিত ধন-সম্পদ। তুমি ফয়সালা করে দেবে, সে সম্পদেও রয়েছে তোমার মালিকানা। পথে যা কুড়িয়ে পাওয়া যাবে এবং যা বণ্টন না হয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে সে সম্পদের মালিকও তুমি।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি

জাযিরাতুল আরবরে সরকার পদ্ধতি এবং শাসনকর্তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, কাজেই রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করাই সমীচীন হবে।

জাযিরাতুল আরবের তিনটি সীমান্ত এলাকার জনগণ ছিল ভিন্ন দেশের প্রতিবেশী। যে তিনটি দেশে অশান্তি বিশৃঙ্খলা রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। মানুষরা দাস এবং প্রভু এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা, নেতাদের, বিশেষত্ব বিদেশী শাসকদের করতলগত ছিল। সকল বোঝা ছিল দাসদের মাথায়। সুস্পষ্ট ভাষায় বললে বলা যায় যে, প্রশাসন ছিল খেত খামারের মতো। তারা সরকারের আয়ের ইৎস হিসাবে পরিগণিত হতো। শাসকবর্গ সেই অর্থ সম্পদ নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ঐশ্বর্য এবং বিলাসিতায় ব্যয় করতো। জনগণ অন্ধকার হাত পা ছুড়তো। শাসকরা জনগণের ওপর সকল প্রকার যুলুম-অত্যাচার চালিয়ে যেতো, জনগণ সেসব মুখ বুজে নির্বিচারে সহ্য করতো। কোন প্রকার অভিযোগ করার তাদের উপায় ছিল না। অসম্মান অবমাননা অত্যাচার তাদের সহ্য করতে হতো। শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তরা ডিক্টেটরে মতো আচরণ করতো। মানুষের অধিকার বলতে কোন কিছুই ছিলনা।

এ সকল এলাকার পাশে বসতি স্থাপনকারী প্রতিবেশীরা সিদ্ধান্তহীনতার ভুগতো। এ সব গোত্রের রোকেরা পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতো। কখনো তারা ইরাকীদের প্রতি সমর্থন জানাতো আবার কখনো সিরীয়দের সুরে মেলাতো।

আরবের ভেতরে বসবাসকারী গোত্র সমূহও ছিল শতধা বিচ্ছিন্ন। চারিদিকে ঝগড়া বিবাদ, কলহ কোন্দল বংশগত ধর্মীয় বিভেদ বিশৃংখলা চলছিল।

এ সব অশান্তির মধ্যেও বিভক্ত বিচ্ছিন্ন লোকেরা প্রয়োজন নিজেদের গোত্রের প্রতিই সমর্থন দিতো। এক্ষেত্রে ন্যায় -অন্যায়ের ধার ধারতো না। একটি গোত্রের মুখপাত্র একজন কবি বলেন,

আমি তো গাযিরা গোত্রের একজন মানুষ। ওরা যদি ভুল পথে চলে তবে অমি ভুল পথে চলবো, ওরা যদি সঠিক পথে চলে তবে আমিও সঠিক পথে চলবো।

আরেবের ভেতরে এমন কোন বাদশাহ ছিল না, যিনি যিনি জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতো। কারো কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। দু:খ কষ্ট সমস্যা সংকট আপদে বিপদে বিশ্বাস এবং নির্ভরতার মতো কেউ ছিল না।

হেজাজের শাসককে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো এবং কেন্দ্রীয় হিসাবে তাকে সম্মান করা হতো। হেজাযের শাসক ছিলো প্রকৃতপক্ষে দুনিয়াবি এবং দ্বীনি নেতা। দমীয় নেতা হিসাবে আরবদের ওপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। কাবাঘর এবং আশেপাশের এলাকায় তার শাসন বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া হতো। কাবাঘর জেয়ারতের জন্য যারা আসতো তাদের দেখাশোনা, তাদের প্রয়োজন পূরণ, শরীয়াতের বাস্তবায়ন, সংসদীয় পদ্ধতির লালন ও বিকাশ ইত্যাদি কাজ সেই শাসনকর্তার ওপর ন্যস্ত থাকতো। কিন্তু সেই শাসকরা এমন দুর্বল হতেন যে, আরবের আভ্যন্তরীণ সমস্যার বোঝা মাথায় নেয়া অর্থাৎ যাবতীয় সমস্যার সমাধান করার শক্তি তার থাকতো না। আবিসিনীয়দের হামলার সময় এই দুর্বলতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।

আরবদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় মতবাদ
হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের দাওয়াত ও তাবলীগের কারণে আরবের সাধারণ মানুষ দ্বীনে ইবরাহীমীর অনুসারী ছিল। তারা একমাত্র আল্লাহর এবাদত করত এবং তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু যতোই দিন যেতে লাগলো ততোই তারা দ্বীনের শিক্ষা ভুলে যেতে থাকলো। তবুও তাদের মধ্যে তাওহীদের আলো এবং হযরত ইবরাহীমের শিক্ষা কিছু কিছু অবশিষ্ট ছিল। ইতিমধ্যে বনু খোযাআ গোত্রের সদার আমর ইবনে লোহাই দৃশ্যপটে এলো। ছোটবেলা থেকে এ লোকটি ধর্মীয় পুণ্যময় পরিবেশ প্রতিপালিত হয়েছিল। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল অসামান্য। সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসার চোখে দেখতো। নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ মনে করে তারা তার অনুসরণ করতো। এক পর্যায়ে এই লোকটি সিরিয়া সফর করে। সেখানে যে মূর্তিপূজা করা হচ্ছে সে মনে করলো এটাও বুঝি আসলেই একটা ভালো কাজ। সিরিয়ায় অনেক নবী আবির্ভাব হয়েছেন এবং আসমানী কেতাব নাযিল হয়েছে। কাজেই সিরিয়ার জনগণ যা করছে সেটা নিশ্চয়ই ভালো এবং পুণ্যের কাজ। এরূপ চিন্তা করে সিরিয়া থেকে ফেরার পথে সে হোবাল নামের এক মূর্তি নিয়ে এলো। এবং সেই মূর্তি কাবা ঘরের ভেতর স্থাপন করলো। এরপর সে মক্কাবাসীদের সেই মূর্তিপূজার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে শেরেক করার আহবান জানালো। মক্কার লোকেরা ব্যাপকভাবে তার ডাকে সাড়া দিল। মক্কার জনগণকে মূর্তিপূজা করতে দেখে আরবের বিভিন্ন এলাকার লোক তাদের অনুসরণ করলো। কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণ কারদের বৃহত্তর আরবের লোকেরা মরে করতো ধর্মগুরু। (মুখতাছারুস সীরাত শেখ মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ ১২)। এ কারণে তারা মূর্তিপূজায় মক্কার লোকদের অনুসরণ করলো। এমনি করে আরবের মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হলো।

হোবল ছাড়াও আরবের প্রাচীন মূর্তি ছিল মানাত। এ মূর্তি লোহিত সাগরের ঊপকুলে কোদাইদ এলাকার মুসল্লাল নামক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছিল । (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-২২২) এরপর তায়েফ লাত নামে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। নাখলা নামক স্থানে ওযযা নামে একটি মূর্তি রেখে তার পূজা করা হয়। এ তিনটি ছিল আরবের সবচেয়ে বড় মূর্তি।

এসব মূর্তির অনুসরণ অল্পকালের মধ্যে হেজাযের শেরকের আধিক্য এবং মূর্তি স্থাপনের হিড়িক পড়ে যায়। বলা হয়ে থাকে যে, একটি জিন আমর ইবনে লোহাইয়ের অনুসারী ছিল। সে আমরকে জানালো যে, নুহের জাতির মূর্তি অর্থাৎ ওয়াদ্দা, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক এবং নাসর জেদ্দায় প্রোথিত রয়েছে।

এ খবর জানার পর আমর ইবনে লোহাই জেদ্দায় গেল এবং এ সকল মূর্তি খুড়ে বের করলো। এরপর সে সব মূর্তি মক্কায় নিয়ে এলো। হ্জ্জ মৌসুমে সেসব মূর্তি বিভিন্ন গোত্রের হাতে তুলে দেয়া হলো। গোত্রগুলো নিজ নিজ এলাকায় সেসব মূর্তি নিয়ে গেল। এমনিভাবে প্রত্যেক গোত্রে এবং পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক ঘরে মূর্তি স্থাপিত হলো।

পালাক্রমে পৌত্তলিকরা কাবাঘরকে মূর্তির ঘড়ে পরিপূর্ণ করলো। মক্কা বিজয়ের ঘটনার সময় কাবাঘরে তিনশত ষাটটি মতি ছিল। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম নিজ হাতে সেসব মূর্তি ভাঙ্গন। তিনি একটি ছড়ি দিয়ে গুঁতো দিতেন, সাথে সাথে সে মূর্তি নীচে পড়ে যেতো। এরপর তাঁর নির্দেশ সব মূর্তি কাবাঘর থেকে বাইরে বের করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। (মুখতাছারুস সীরাত, শেখ মোহাম্মদ ইবনে আব্দুলওয়াহাব নজদী, পৃ-১৩, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৪) মোটকথা শেরক এবং মূর্তিপূজা ছিল আইয়ামে জাহিলিয়াতে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় কাজ। মূর্তিপূজা করে তারা মনে করতো যে, তারা হযরত ইবরাহীমের দ্বীনের ওপর রয়েছে।

পৌত্তলিকদের মধ্যে মূর্তিপূজার বিশেষ কিছু নিয়ম কানুন প্রচলিত ছিল। এর অধিকাংশই ছিল আমর ইবনে লোহাই এর আবিষ্কার। আমরের এ সকল কাজকে মক্কার লোকেরা প্রশংসার চেখে দেখতো। ইবরাহীমের দ্বীনে পরিবর্তন নয় বরং এ সবকে তারা মনে করতো বেদআতে হাসানা। নীচ পৌত্তলিকদের মূর্তি পূজার কয়েকটি রেওয়াজ তুলে ধরা হচ্ছে-।

এক) আইয়ামে জাহিলিয়াতে পৌত্তলিকরা মূর্তির সামনে নিবেদিত চিত্তে বসে থাকতো এবং তাদের কাছে আশ্রয় চাইতো। তাদের জোরে জোরে ডাকতো এবং প্রয়োজন পূরণের জন্য, মুশকিল আসান বা সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের কাছে সাহায্য চাইতা। তারা বিশ্বাস করতো যে, মূর্তিরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের উদ্দেশ্যে পূরণ করিয়ে দেবে।

দুই) মূর্তিগুলোর উদ্দেশ্যে হ্জ্জ এবং তাওয়াফ করা হতো। তাদের সামনে অনুনয় বিনয় করা হতো তাদের সেজদা করা হতো।

তিন) মূর্তিগুলোর জন্য উপঢৌকন এবং নযরানা পেশ করা হতো। কোরবানীর পশু অনেক সময় মূর্তির আস্তানায় নিয়ে জবাই করা হতো। তবে সেটা করা হতো মূর্তির নামে। জবাইয়ের এই উভয় রকমের কথা কোরআনে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন। সেই পশুও হারাম করা হয়েছে যা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেয় হয়।

আল্লাহ পাক আরো বলেন, ওসব পশুর গোশত খেয়োনা যার ওপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি অর্থাৎ গায়রুল্লাহর নামে জবাই করা হয়েছে এমন কিছুই আহার করো না।

চার) মূর্তির সন্তুষ্টি লাভের একটা উপায় এটাও ছিল যে পৌত্তলিকরা তাদের পানাহারের জিনিস, উৎপাদিত ফসল এবং চতুষ্পদ জন্তুর একাংশ মূর্তির জন্য পৃথক করে রাখতো। মজার বিষয় হচ্ছে তারা আল্লাহর জন্যও একটা অংশ রাখতো। এরপর বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহর জন্য রাখা অংশ মূর্তির কাছে পেশ করতো কিন্তু মূর্তির জন্য রাখা অংশ কোন অবস্থায়ই আল্লাহর কাছে পেশ করতো না।

যেমন আল্লাহ পাক বলেন, আল্লাহ যেসব শস্য ও পশু সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নিদিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের দেবতাদের জন্য। যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এবং আল্লাহর অংশ তা তাদের কাছে পৌছায়। তারা যা মীমাংসা করে তা বড়ই নিকৃষ্ট।

পাঁচ) মূর্তিদের সন্তুষ্টি পাওয়ার একটা উপায় তারা নির্ধারণ করেছিল যে, পৌত্তলিকরা উৎপাদিত ফসল এবং চতুষ্পদ পশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানত করতো। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, তারা তাদের ধারনা অনুসারে বলে, এসব গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত্র নিষিদ্ধ, আমরা যাকে ইচ্ছা করি সে ছাড়া কেউ এসব আহার করতে পারবে না এবং কতক গবাদি পশুর পিঠে আরোহণ নিষিদ্ধ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয়া না।

ছয়) এসব পশুর মধ্যে ছিল বাহিরা, সায়েবা, ওয়াসিলা এবং হামী। ইবনে ইসহাক বলেছেন, বাহিরা সায়েবার কন্যা শাবককে বলা হয়। সাবেরা সেই উটনীকে বলা হয় যার পর্যায়ক্রমে দশবার মাদী বাচ্চা হয়। এর মধ্যে কোন নর বাচ্চা হয় না। এ ধরনের উটনীকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই উটনীর পিঠে সওয়ার করা হয় না। তার পশম কাটা হয় না। মেহমান ছাড়া অন্য কেউ তার দুধ পান করে না। এগারবারের সময় এই উটনী যে বাচ্চা দেয় সেই বাচ্চাকে মায়ের সাথে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। তার পিঠে আরোহণ করা হয় না। তার বাচ্চা হলে সায়েবা।

ওয়াছিলা সেই বকরিকে বলা হয় যে বকরি দুটি করে পাঁচবার পর্যায়ক্রমে মাদী বাচ্চা প্রসব করে। অর্থাৎ পাঁচবার দশটি মাদী বাচ্চা দেয় এর মধ্যে কোন নর বাচ্চা না দেয়। এরপর এসব বকরি ষষ্ঠবারে যে বাচ্চা প্রসব করে সে বাচ্চা শুধু পুরুষরা পাবে, মহিলাদের জন্য সবাই খেতে পারে।

হামী সেই পুরুষ উটকে বলা হয় যার বীর্য থেকে পরপর দশটি মাদী বাচ্চা জন্ম নেয়। এর মাঝে কোন নর বাচ্চা জন্ম নেয় না। এ ধরনের উটের পিঠে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। এদের পিঠে কাউকে আরোহণ করতে দেয়া হয় না, গায়ের পশম কাটা হয় না। উটের পালের মধ্যে এ উটকে স্বাধীনভাবে বিচরণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া এদের দিয়ে অন্য কোন প্রকার কাজ নেয়া হয় না। আইয়ামে জাহিলিয়াতে প্রচলিত এসব প্রকারের মূর্তি পূজার এবং রীতিনীতির প্রতিবাদ করে আল্লাহ পাক কোরআনে বলেন, ‘বাহিরা, সায়েব ওয়াসিলা এবং হামী আল্লাহ স্থির করেননি কিন্তু কাফেররা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাদের অধিকাংশ উপলব্ধি করে না।

আল্লাহ পাক কোরআনে আরো বলেন, ওরা আরো বলে, এসব গবাদি পশুর যা রয়েছে তা আমাদের পুরুষদের জন্য নিদিষ্ট এবং সেটা আমাদের স্ত্রীদের জন্য অবৈধ, আর সেটি যদি মৃত হয় তবে নারী পুরুষ সবাইই ওতে অংশীদার। তাদের এরূপ বলার প্রতিফল তিনি তাদের দেবেন। তিনি প্রজ্ঞানয় ও সর্বজ্ঞ।

চতুষ্পদ পহুদের উল্লিখিত শ্রেণী বিন্যাস অর্থাৎ বাহিরা, সায়েরা, প্রভৃতির অন্য অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ৮৯-৯০)। ইবনে ইসহাকের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত ব্যাখ্যার সাথে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে।

হযরত সাঈদ ইবনে মাসাইয়াব রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, এ সব পশু হচ্ছে ওদের তাগুদদের জন্য। (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৪৯৯)। সহীহ বোখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, মূর্তির নামে পশু সর্বপ্রথম আমর ইবনে লোহাই ছেড়েছিল। (ঐ)

আরবের লোকেরা এ বিশ্বাসের সাথে এসব আচার অনুষ্ঠান পাল করতো যে, মূর্তি তাদেরকে আল্লাহর কাছাকাছি পৌঁছে দেবে এবং তাদের জন্য আল্লাহ কাছে সুপারিশ করবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, পৌত্তলিকরা বলতো, আমরাতো এদের পূজা এজন্য করি, যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্য এনে দেবে।

আল্লাহ পাক কোরআনে আরো বলেন, ওরা আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করে তা ওদের ক্ষতিও করে না উপকারও করেনা। ওরা বলে এগুলো আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য সুপারিশকারী। (১৮,১০)

মক্কার পৌত্তলিকরা আযলাম অর্থাৎ ফাল এর তীর ব্যবহার করতো। আযলাম হচ্ছে যালামুন শব্দের বহুবচন। যালাম সেই তীরকে বলা হয় যে, তীরে পালক লাগানো থাকেনা। ফালগিরির জন্য ব্যবহার করা এই তীর তিন প্রকারের হয়ে থাকে। এক প্রকারের তীরে হ্যাঁ এবং না লেখা থাকে। এ ধরনের তীর সফর, বিয়ে ইত্যাদি কাচে ব্যবহার করা হয়। ফালে যদি হ্যাঁ প্রকাশ পায় তবে পরিকল্পিত কাজ করা হয় যদি না লেখা থাকে তবে এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়। পরের বছর পুনরায় সে কাজ করার জন্য ফাল এর তীর ব্যবহার করা হয়। ফালগিরির দ্বিতীয় শ্রেণীর তীরে মধ্যে পানি, দীয়ত বা ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি শব্দ উৎকীর্ণ থাকতো।

তৃতীয় প্রকারের তীরের মধ্যে লেখা থাকতো তোমাদের মধ্যে থেকে অথবা তোমাদের বাইরে থেকে। এ ধরনের তীরের কাজ ছিল যে, কারো বংশ পরিচয়ের ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকলে তাকে একশত উটসহ হোবাল মূর্তির সামনে হাযির করা হতো।

সেসব উট তীরের মালিক সেবায়েতকে দেয়া হতো। সে এসব তীর একসাথে মিলিয়ে ঘোরাতো। এলোমেলো করতো। এরপর একটি তীর বের করতো। যদি সেই লেখা থাকতো যে, তোমাদের মধ্যে থেকে, তবে সেই ব্যক্তি গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হতো। যদি সেই তীরে লেখা থাকতো যে, তোমাদের বাইরের লোক। তবে সেই ব্যক্তিকে শত্রুপক্ষের লোক মনে করা হতো না। তাকে গোত্রের মধ্যে পুবের মধ্যে পুবের মতোই সাধারণভাবে জীবন যাপনের অধিকার দেয়া হতো। (মোহাদেরাতে খাযরামি, ১ম খন্ড, পৃ-৫৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ১০২, ১০৩)

পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রয় একই ধরনের আরো একটি রেওয়াজ চালু ছিল। সেটা হচ্ছে জুয়া খেলা এবং জুয়ার তীর। এ তীরের চিহ্নিতকরণ অনুযায়ী উট জবাই করে সেই উটের গোশত বণ্টন করা হতো। (এই নিয়ম ছিল এবং যে ব্যক্তি জুয়া খেলতো সে একটি উট জবাই করে দশ অথবা আটাশ ভাগ করতো। এরপর তীর দিয়ে লটারী করা হতো। কোন তীরে জয়ের চিহ্নই থাকত না। যার নামের ওপর জয় সূচক তীর বের হতো তাকে বিজয়ী করা হতো এবং উটের গোশত সে বিনামূল্যে পেতো। যে ব্যক্তির নামে চিহ্ন বিহীন তীর উঠতো তাকে গোশতের মূল্য দিতে হতো। )

আরব পৌত্তলিকরা যাদুকর জ্যোতিষীদের কথার ওপর বিশ্বাস রাখতো। এরা ভবিষ্যতের ভালোমন্দ সম্পর্কে কথা বলতো। কেউ দাবী করতো যে, তার অনুগত একটি জ্বীন রয়েছে সেই জিন তাকে খবর এনে দিচ্ছে। কেউ দাবী করতো যে, তার মধ্যে খোদা প্রদত্ত মেধা এবং বিচক্ষণতা রয়েছে, এই মেধা বিচক্ষণতার কারণে সে নির্ভুল ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারে। এদের মধ্যে আররাফ নামে একটা শ্রেণী ছিল। এরা চুরির ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতো। চোরাই মাল উদ্ধার এবং চুরির জায়গা এরা সনাক্ত করতো। জ্যোতিষী সেসব লোককে বলা হতো যারা নক্ষত্রের গতি সম্পর্কে গবেষণা করতো এবং হিসাব নিকাশ করে বিম্বের ভবিষ্যৎ ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করতো। (মেরাতুল মাফাতিহ, শরহে মেশকাতুল মাছাবিহ ২য় খন্ড, পৃ২.৩, লাক্ষ্নৌর সংস্কার। )

জ্যোতিষীর কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা প্রকৃতপক্ষে নক্ষত্রের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের শামিল। মক্কার পৌত্তলিকরা নক্ষত্রের ওপর বিশ্বাস রাখতো এবং বলতো অমুক অমুক নক্ষত্র থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। (সহীহ মোসলেহ, শরহে নববী, কিতাবুল ঈমান। ১ম খন্ড পৃ-৯৫)

একই ধরনের অন্য কাজ তারা ভালোমন্দ নিরূপণের জন্য করতো। সেটা হচ্ছে খরগোশের হাঁটুর একখানি হাড় ঝুলিয়ে দিতো। কিছুদিন, মাস, কিছু নর এবং কিছু নারীকে তারা অশুভ মনে করতো। অসুস্থ লোকদের স্পর্শ থেকে তারা দুরে থাকতো এবং তার দেখাকে ক্ষতিকর মনে করতো। রুহ বেরিয়ে যাওয়ার পর উল্লুকে পরিণত হয় বলে তারা ধারনা করতো। নিহত ব্যক্তির আততায়ীর নিকট থেকে বদলা নেয়া না হলে নিহত ব্যক্তির রুহ শান্তি পায় না বলে তারা বিশ্বাস করতো। নিহত ব্যক্তির আত্মা পাহাড়ে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় এবং পিপাসা আমাকে পান করাও বলে চিৎকার করতে থাকে বলে তারা বিশ্বাস করতো। হত্যার ক্ষতিপূরণ নেয়া হলে নিহত ব্যক্তির রুহ শান্তি পায় বলে তারা বিশ্বাস করতো। (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৮৫১, ৮৫৭)।

দ্বীনে ইবরাহীমীতে কোরাইশদের বিবাদ

আইয়ামে জাহেলিয়াতে লোকদের চিন্তা বিশ্বাস কাজ সম্পর্কে মোটামুটি আলোকপাত করা হলো। এসব কিছুর পাশাপাশি দ্বীনে ইবরাহীমীও তারা আংশিকভাবে পালন করতো। অর্থাৎ ইবরাহীমী দ্বীন তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। তারা কাবাঘর তাওয়াফ করতো, কাবাঘরের সম্মান করতো, হজ্জ এবং ওমরাহ পালন করতো, আরাফাহ এবং মোযদালেফায় অবস্থান করতো এবং হাদীর পশু কোরবানী করতো। তবে দ্বীনে ইবরাহীমীতে তারা বেশ কিছু বেদয়াত যুদ্ধ করেছিল। নীচে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।

কোরাইশদের একটি বেদয়াত ছিল এই যে, তারা বলতো, আমরা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সন্তান। কাবার পাসবান বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, কাবাঘরের তত্বাবধায়ক এবং মক্কার বাসিন্দা, আমাদের সমমর্যাদার কেউ নেই। আমাদের সমতুল্য অধিকার কারো নেই। এ কারণে তারা নিজেদের নামকরণ করতো হুস্‌ম। অর্থাৎ বাহাদুর এবং গরমজোশ। তারা বলতো, আমাদের এত অসাধারণ মর্যাদা রয়েছে, কাজেই কাবাঘরের সীমানার বাইরে যাওয়া আমাদের শোভনীয় নয়। হজ্জের সময়ে তারা আরাফাতে যেতো না এবং নিয়ম অনুযায়ী সেখানে থেকে প্রত্যাবর্তন করতো না। বরং মোযদালেফায় অবস্থান করে সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করতো। আল্লাহ পাক এই বেদয়াতকে সংশোধন করে বলেন, অতঃপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তোমরাও সেই স্থান থেকে প্রত্যাবর্তন করবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৯৯, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ-২২৬)

পৌত্তলিকদের একটি বেদয়াত ছিল এইযে, তারা বলতো, হুমস অর্থাৎ কোরাইশদের জন্য এহরাম বাঁধা অবস্থায় পনির এবং ঘি তৈরি করা বৈধ নয়। পশমওয়ালা ঘরে অর্থাৎ কম্বলের তাবুতে প্রবেশ হওয়া বৈধ নয়। এটাও নয় যে, ছায়া চামড়ার তাঁবু ছাড়া অন্য কোথাও ছায়া লাভ করবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-২০২)

তাদের একটি বেদয়াত এটাও ছিল যে, মক্কার বাইর থেকে যারা হজ্জ বা ওমরাহ করার জন্য আসবে তাদের নিয়ে আসা খাদ্য পানীয় খাওয়া বৈধ নয়। (ঐ)

একটি বেদয়াত এই ছিল যে, তারা মক্কার বাইরে অধিবাসীদের আদেশ দিয়ে রেখেছিল যে, তারা হরমে আসার পর প্রথম যে তাওয়াফ করবে সেই তওয়াফ হুমসে অর্থাৎ কোরাইশদের থেকে নেয়া কাপড় করতে হবে। যদি কাপড় না পেতো তবে পুরুষেরা উলঙ্গ হয়ে তওয়াফ করতো এবং মহিলারা সব পোশাক খুলে ফেলে একটি ছোট খোলা জামা পরিধান করে তওয়াফ করতো। তওয়াফের সময় তারা এ কবিতা আবৃত্তি করতো,

‘লজ্জাস্থানের কিছুটা বা সবটুকু খুলে যাবে আজ। যেটুকু যাবে দেখা ভাবব না অবৈধ কাজ।

এই অশ্লীল আচরণ বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযির করেন, হে বনি আদম, প্রত্যেক নামাযের সময় সুন্দর পরিচ্ছেদ পরিধান করবে। (৩১, ৭)

যদি মক্কার বাইরে থেকে আসা কোন পুরুষ বা নারী মক্কার বাইরে থেকে নিয়ে আসা পোশাক তওয়াফ করতো তবে তওয়াফ শেসে সেই পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হতো। সে পোশাক নিজেও ব্যবহার করতো না অন্য কেউ ও ব্যবহার করতো না (ঐ ১ম খন্ড, পৃ২০২, ২০৩, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড পৃ-২২৬)।

কোরাইশদের একটি বেদয়াত এই ছিল যে, তারা এহরাম বাঁধা অবস্থায় ঘরের দরোজা দিয়ে প্রবেশ করতো না বরং ঘরের পেছনের দিকে একটা ছিদ্র করে নিয়ে, সেই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করতো এবং বাইরে বের হতো।

এ ধরনের উদ্ভট কাজকে তারা পুণ্যের কাজ মনে করতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক তাদেরকে এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ পাক বলেন, পেছন দিক দেয় তোমাদের গৃহে প্রবেশ করতে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ যদি তাকওয়া অবলম্বন করে। সুতরাং তোমরা দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে সফলকাম হতে পার।

এই ছিল পৌত্তলিকদের ধর্মীয় জীবনের রূপরেখা।

এছাড়া জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন ইহুদী, খৃস্টান, মাজুসিয়াত বা অগ্নিপূজক এবং সাবেয়ী মতবাদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। নীচে এসব মতবাদ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা যাচ্ছে। জাযিরাতুল আরবে ইহুদীদের ছিল দুটি যুগ। প্রথম যুগ ছিল সেই সময় যখন বাবেল ও আশুর সরকার ফিলিস্তিন জয় করেছিল। এ সময় ইহুদীরা স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সেই সরকারের কঠোর নির্যাতন নিষ্পেষণ এবং ইহুদী জনবসতির ধ্বংস সাধনের ফলে বহুসংখ্যক ইহুদী হেজায ছেড়ে ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল (কলবে জাযিরাতুল আরব পৃ ২৫১)।

দ্বিতীয় যুগ ছিল সেই সময় যখন ৭০ ঈসায়ী সালে টাইটাস রুমীর রোমকরা ফিলিস্তিন অধিকার করে। সেই সময় রোমকদের ইহুদী নির্যাতন এবং তায়মাসে বসতি গড়ে তোলে এবং দুর্গ নির্মাণ করে। এ সব দেশত্যাগী ইহুদীদের সাথে মেলামেশার ফলে আরব অধিবাসীদের মধ্যে ইহুদী ধর্ম চিন্তার প্রসার ঘটে। এর ফলে ইসলামের আবির্ভাবের আগে এবং পরে বিভিন্ন সময়ে ইহুদীরা ও উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হয়। ইসলামের আবির্ভাবের সময় বিখ্যাত যেসব ইহুদী গোত্র ছিল সে গুলো হচ্ছে খয়বর, নাযির, মোস্তালেক, কোরায়যা, কায়নুকা সামহুদী। অফা ওয়া অফা গ্রন্থের ১১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন যে, এসময় ইহুদী গোত্রর সংখ্যা ছিল বিশ এর বেশী। (ঐ)

ইয়েমেনও ইহুদীরা ছিল বেশ শক্তিশালী। তাবান আসাদ আবু কারাব নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ইয়েমেন ইহুদী মতবাদ প্রসার লাভ করে। যুদ্ধ করতে করতে এই ব্যক্তি ইয়াসরেব পৌঁছে।

ইয়াসরেব যাওয়ার পর সে ইহুদী মতবাদের দীক্ষা নেয় এবং বনু কোরায়যার দুজন ইহুদী ধর্ম বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেন পৌঁছে। এদের মাধ্যমে ইয়েমেনে ইহুদী মতবাদ প্রচার প্রসার লাভ করে। আবু কারারের পর তার পুত্র ইউসুফ জুনুয়াস ইয়েমেনের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। ইহুদী মতবাদের জোশে এই ব্যক্তি নাযরানের খৃস্টানদের ওপর হামলা চালায় এবং জোর করে তাদেরকে ইহুদী ধমে দীক্ষিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে তারা অস্বীকৃতি জানায় ক্রুদ্ধ জুনুয়াস বিরাট গত খনন করিয়ে সে গতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তারপর দাউ দাউ করে প্রজ্জ্বলিত আগুনে নারী পুরু, শিশু-বৃদ্ধ ইত্যাদি সব শ্রেণীর মানুষকে সেই গর্তে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় বিশ থেকে চব্বিশ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। ৫২৩ ঈসায়ী সালের অক্টোবর মাসে এ ঘটনা ঘটে। পবিত্র কোরআনের সুরা বুরুজে এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ( ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ২০, ২১, ২২, ২৭, ৩১, ৩৫, ৩৬)।

আরব দেশসমুহে ঈসায়ী বা খৃষ্টধর্ম আবিসিনীয় এবং রোমক বিজয়ীদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল। ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়েমেনের ওপর আবিসিনিয়রা প্রথমবার ৩৪০ সালে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ৩৭৮ সাল পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় ছিল। এ সময়ে ইয়েমেনে খৃস্টান মিশনারি কাজ করতে থাকে। সেই সময়ে ফেমিউন নামে একজন বিশিষ্ট সাধক নাযরান পৌঁছেন এবং স্থানীয় লোকদের মধ্যে ঈসায়ী বা খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করেন। নাযরানের অধিবাসীরা খৃস্টান ধমে সত্যতার প্রমাণ পাওয়ার পর খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪)

জুনুয়াসের হত্যাকাণ্ডের ক্ষতচিহ্ন মুছে যায়নি। এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে হাবশীরা পুনরায় ইয়েমেন অধিকার করে এবং আবরাহা ক্ষমতা দখল করে। এই ব্যক্তি ইয়েমেনে একটি মন্দির তৈরি করে। সে চাচ্ছিল যে, ধর্মপ্রাণ মানুষরা মক্কার কাবাঘরে না গিয়ে তার তৈরি মন্দিরে যাবে। এ দুরাচার এ উদ্দেশ্যে মক্কায় কাবাঘর ধ্বংস করে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ঘৃণ্য দুঃসাহস দেখানোর ফলে আল্লাহ পাক তাকে এমন শাস্তি দিলেন যে সে ঘটনা পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঘটনা হয়ে রইল।

অন্যদিকে রোমকরা অধিকৃত এলাকার প্রতিবেশী হওয়ার কারণে আলে গাসসান, বনু তাগলাব, বনু তাঈ প্রভৃতি আরব গোত্রের মধ্যে খৃষ্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করে। হীরার কয়েকজন আরব শাসক ও খৃষ্টান ধমে দীক্ষিত হন।

মাজুসী ধর্ম বা অগ্নিপুজকদের অধিকাংশ বসবাস করতো পারস্যের প্রতিবেশী আরব দেশসমুহে। যে, ন ইরাক, বাহরাইন ও আরব উপসাগরের উপকূলীয় এলাকা। এ ছাড়া ইয়েমেনে পারস্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বিচ্ছিন্নভাবে বহু লোক মাজুসী ধর্ম গ্রহণ করেছিল।

সাবী বা সাবেয়ী ধর্ম। ইরাক এবং অন্যান্য স্থানে প্রাচীন নিদর্শনসমুহ খনন করে উদ্ধার করার সময় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, সাবী ছিল কালদানি জাতির ধর্ম। এরা ছিল হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধর। প্রাচীনকালে সিরিয় এবং ইয়েমেনের বহু অধিবাসী এ ধমের অনুসারী ছিল। কিন্তু ইহুদী এবং খৃস্টান ধর্মের জয় জয়জয়কার শুরু হলে এ ধমের বিলুপ্তি ঘটে। তবুও মাজুসিদের সাথে মিশ্রিতভাবে বা তাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে ইরাক এবং আরব উপসাগরীয় এলাকায় এ ধমের কিছু অনুসারী অবশিষ্ট ছিল। (তারীখে আরদুল কোরআন, ২য় খন্ড, পৃ ১৯৩-২০৮)

সাধারণ ধর্মীয় অবস্থা

ইসলামের আবির্ভাবের সময় উল্লেখিত কয়েকটি ধর্ম আরবে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ সকল ধর্মমত ছিল ভাঙ্গনের মুখে। পৌত্তলিকরা যদিও নিজেদের দ্বীনে ইবরাহীমের অনুসারী মনে করতো কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা দ্বীনে ইবরাহীমের আদেশ নিষেধ থেকে বহু দরে অবস্থান করতো।

দ্বীনে ইবরাহীমী উন্নত চরিত্র গঠনের লক্ষে যেসব শিক্ষা দিয়েছিল তার সাথে পৌত্তলিকদের দূরতম সম্পর্ক ও ছিল না। তারা পাপের পাঁকে ছিল নিমজ্জিত। দীর্ঘকাল থেকে তাদের মধ্যে মূর্তিপূজার মাধ্যমে সৃষ্ট পাপাচার অনাচার কদাচার বিদ্যমান ছিল। এসব কারণে তাদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবন দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।

ইহুদী ধমের অনুসারীদের ছিল আকাশছোঁয়া অহংকার। ইহুদী পুরোহিতরা আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে নিজরাই প্রভু হয়ে বসেছিল। তারা মানুষের ওপর নিজেদের ইচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দিতো। তারা মানুষের চিন্তা ভাবনা ধ্যান ধারণা এবং মুখের কথা নিজেদের মজির অধীন করে দিয়েছিল। তারা সর্বতোভাবে ক্ষমতা এবং অর্থ সম্পদ উপার্জনে নিয়োজিত ছিল। যে কোন মূল্যে এসব কিছু করায়ত্ত করতেই তারা ছিল সতত উদগ্রীব। ধর্ম নষ্ট করে হলেও ক্ষমতা এবং ধন সম্পদ তারা পেতে চাইতো। পৌত্তলিকরা কুফুরী, খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত ছিল। এসব অপকর্ম তাদের ইচ্ছা পূরণের সঙ্গী ছিল। আল্লাহ পাকের নির্দেশ তারা উপেক্ষা করতে এতটুকু ইতস্তত করতো না।

খৃষ্টধর্ম ছিল এক উদ্ভট মূর্তিপূজার ধর্ম। তারা আল্লাহ তায়ালা এবং মানুষকে বিষ্ময়করভাবে একাকার করে দিয়েছিল। আরবের যেসব লোক এ ধমের অনুসারী ছিল তাদের ওপর এ ধর্মের প্রকৃত কোন প্রভাব ছিল না। কেননা দ্বীনের শিক্ষার সাথে তাদের ব্যক্তি জীবনের কোন শিল ছিল না। কোন অবস্থায়ই তারা নিজেদের ভোগ সর্বস্ব জীবন-যাপন পরিত্যাগ করতে রাজি ছিল না। পাপের পঙ্কে ছিল তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন নিমজ্জিত।

আরবের অন্যান্য ধমের অনুসারীদের জীবন ছিল পৌত্তলিকদের মতো। কেননা তাদের ধমের মধ্যে বিভিন্নতা থাকলেও মনের দিক থেকে তারা ছিল একই রকম। শুধু মনের দিকে থেকেই নয় জীবনাচার এবং রেওয়াজের ক্ষেত্রেও তারা ছিল অভিন্ন।

জাহেলী সমাজের কিছু খন্ড চিত্র
জাযিরাতুল আরবের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করার পর এবার সেখানকার সামগ্রিক অর্থনৈতিক এবং চারিত্রিক অবস্থার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরা হচ্ছে।

সামগ্রিক অবস্থা

আরবের জনগণ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতো। প্রতিটি শ্রেণীর অবস্থা ছিল অন্য শ্রেণীর চেয়ে আলাদা। অভিজাত শ্রেণীতে নারী পুরুষের সম্পর্ক ছিল যথেষ্ট উন্নত। এ শ্রেণীর মহিলাদের স্বাধীনতা ছিল অনেক। এদের কথার মূল্য দেয়া হতো। তাদের এতোটা সম্মান করা হতো এবং নিরাপত্তা দেয়া হতো যে, এরা পথে বেরোলে এদের রক্ষের জন্য তলোয়ার বেরিয়ে পড়তো এবং রক্তপাত হতো। কেউ যখন নিজের দানশীলতা এবং বীরত্ব প্রসঙ্গ নিজের প্রশংসা করতো তখন সাধারণত মহিলাদের সম্বোধন করতো। মহিলা ইচ্ছে করলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং রক্তপাতের আগুন জ্বালিয়ে দিতো। এসব কিছু সত্ত্বেও পুরুষদেরই মনে করা হতো পরিবারের প্রধান এবং তাদের কথা গুরুত্বের সাথে মান্য করা হতো। এ শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের মধ্যেকার সম্পর্ক বিয়ের মাধ্যমে নির্ণীত হতো এবং মহিলাদের অভিভাবকদের মাধ্যমে এ বিয়ে সম্পন্ন হতো। অভিভাবক ছাড়া নিজের বিয়ে করার মতো কোন অধিকার নারীদের ছিল না।

অভিজাত শ্রেণীর অবস্থা এরকম হলেও অন্যদিকে অন্যান্য শ্রেণীর অবস্থা ছিল ভিন্নরূপ। সে সব শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের যে সম্পর্ক ছিল সেটাকে পাপাচার, নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং ব্যভিচার ছাড়া কিছু বলা যায় না। হযরত আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, আইয়ামে জাহিলিয়াতে বিয়ে ছিল চার প্রকার।

প্রথমটা ছিল বর্তমান কালের অনুরূপ। যেমন একজন মানুষ অন্য একজনকে অধীনস্থ মেয়ের বিয়ের জন্য পয়গাম পাঠাতো। সে পয়গাম মঞ্জুর হওয়ার পর মোহরানা আদায়ের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হতো।

দ্বিতীয়টা ছিল এমন, বিবাহিত মহিলা রজস্রাব থেকে পাক সাফ হওয়ার পর তার স্বামী তাকে বলতো, অমুক লোকের কাছে পয়গাম পাঠিয়ে তার নিকট থেকে তার লজ্জাস্থান অধিকার করো। অর্থাৎ তার সাথে ব্যভিচার করো, এসময় স্বামী নিজ স্ত্রীর নিকট থেকে দুরে থাকতো, স্ত্রীর কাছে যেতোনা । যে লোকটাকে দিয়ে ব্যভিচার করানো হচ্ছির তার দ্বারা নিজ স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর কাছে যেতো না। গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর স্বামী ইচ্ছে করলে স্ত্রীর কাছে যেতো। এরূপ করার কারণ ছিল যাতে সন্তান অভিজাত এবং পরিপূর্ণ হতে পারে। এ ধরণের বিয়েকে বলাহয় ‘এসতেবজা’ বিবাহ। ভারতেও এ বিয়ে প্রচলিত আছে।

তৃতীয়ত, দশজন মানুষের চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ কোন এক জায়গায় একজন মহিলার সাথে ব্যভিচার করতো। সেই মহিলা গর্ভবতী হওয়ার পর সেই মহিলা সে সব পুরুষকে কাছে ডেকে আনতো। এ সময় কারো অনুপস্থিত থাকার উপায় ছিল না। সকলে উপস্থিত হলে সেই মহিলা বলতো, তোমার যা করেছো সে তো তোমার জান, এখন আমার গর্ভে থেকে এ সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। হে অমুক, এ সন্তান তোমার। সেই মহিলা ইচ্ছেমতো যে কারো নাম নিতে পারতো এবং যান নম নেয়া হতো নবজাত শিশুকে তান সন্তান হিসাবে সবাই মেনে নিতো।

চতুর্থত, বহুলোক একত্রিত হয়ে একজন মহিলার কাছে যেতো। সেই মহিলা কোন ইচ্ছুক পুরুষকেই বিমুখ করতো না বা ফিরিয়ে দিতো না। এরা ছিল পতিতা। এরা নিজেদের ঘরের সামনে একটা পতাকা স্থাপন করে রাখতো। এর ফলে ইচ্ছে মতো যে বিনা বাধায় তাদের কাছে যেতে পারতো। এ ধরনের মহিলা গর্ভবতী হলে এবং সন্তান প্রসব করলে যারা তার সাথে মিলিত হয়েছিল তারা সবাই হাযির হতো এবং একজন বিশেষজ্ঞকে ডাকা হতো। সেই বিশেষজ্ঞ তার অভিমত অনুযায়ী সন্তানটিকে কারো নামে ঘোষণা করতো। পরবর্তী সময়ে সেই শিশু ঘোষিত ব্যক্তির সন্তান হিসাবে বড় হতো এবং কখনো সে ব্যক্তি সন্তানটিকে অস্বীকার করত পারতো না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পর আল্লাহ পাক জাহেলি সমাজের সকল প্রকার বিবাহ প্রথা বাতিল করে দিলেন এবং বর্তমানে প্রচলিত ইসলামী বিবাহ প্রথা প্রচলন করলেন। (সহীহ বুখারী, কেতাবুন নেকাহ, ২খন্ড, পৃ৭৬৯, আবু দাউদ, বাবে ওজনু নেকাহ বিস্তারিত বিবরণের জন্য তাফসীর তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন ১৪ নং খন্ড দেখুন)

আরবে নারী পুরুষের সম্পর্ক অনেক সময় তলোয়ার ধারের মাধ্যমে নির্ণীত হতো। গোত্রীয় যুদ্ধে বিজয়ীরা পরাজিত গোত্রের মহিলাদের বন্দী করে নিয়ে নিজেদের হারেমের অন্তরীন করে রাখতো। এ ধরনের বন্দিনী নারীর গর্ভজাত সন্তানেরা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। তারা সব সময় আত্মপরিচয় দিতে লজ্জা অনুভব করতো।

জাহেলি যুগে একাধিক স্ত্রী রাখা কোন দোষণীয় ব্যাপার ছিল না। সহোদর দুই বোনকেও অনেকে একইসময়ে স্ত্রী হিসাবে ঘরে রাখতো। পিতার তালাক দেয়া স্ত্রী অথবা পিতার মৃত্যুর পর সন্তান তার সৎ মায়ের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। তালাকের অধিকার ছিল শুধু পুরুষের এখতিয়ার। তালাকের কোন সংখ্যা নিদিষ্ট ছিল না। (আবু দাউদ, তাফসীর গ্রন্থাবলী, আত তালাক মাররাতান, দ্রষ্টব্য)

ব্যভিচার সমাজের সর্বস্তরে প্রচলিত ছিল। কোন শ্রেণীর নারী পুরুষেই ব্যভিচার কদর্যতা পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত ছিল না। অবশ্য কিছু সংখ্যক নারী-পুরুষ এমন ছিল যারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার কারণে এ নোংরামি থেকে নিজেদের বিরত রাখতো। এছাড়া স্বাধীন মহিলাদের অবস্থা তুলনামুলকভাবে দাসীদের চেয়ে ভালো ছিল। দাসীদের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। জাহেলি যুগের অধিকাংশ পুরুষ দাসীদের সাথে মেলামেশায় দোষ এবং লজ্জা মনে করতো না। সুনানে আবু দাউদে উল্লেখ রয়েছে যে, একদা একজন লোক দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসুল, অমুক আমার পুত্র সন্তান। জাহেলি যুগে আমি তার মায়ের সাথে মিলিত হয়েছিলাম। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলামে এ ধরনের দাবীর কোন সুযোগ নেই। এখন তো সন্তান সেই ব্যক্তির মালিকানাধীন, যার স্ত্রী বা স্বামী হিসাবে সেই মহিলা পরিচিতা আর ব্যভিচারীর জন্য রয়েছে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুর শাস্তি। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিআল্লাহু আনহু এবং আবদ ইবনে জাময়ার মধ্যে জাময়ার দাসীর পুত্র আব্দুর রহমান ইবনে জাময়ার বিষয়ে যে ঝগড়া হয়েছিল সেটা তো সর্বজনবিদিত (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৯৯৯, ১০৬৫)। জাহেলি যুগে পিতা পুত্রের সম্পর্কও ছিল বিভিন্ন রকমের। কিছু লোক এমন যারা বলতো, আমাদের সন্তান আমাদের সন্তান আমাদের কলিজার মতো যারা মাটিতে চলাফেরা।

অন্যদিকে কিছু লোক এমন ছিল যারা অপমান এবং দারিদ্রের ভয়ে সন্তানকে জীবিত মাটিতে প্রোথিত করতো। শিশু সন্তানদের প্রোথিত করতো। শিশু সন্তানদের শৈশবেই মেরে ফেলতো।

পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে (সূরা আনআম, আয়াত ১০১, সুরা নাহল আয়াত ৫৮-৫৯. সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১, ৮১, সুরা আনফাল)। এ অবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল কিনা তা বলা মুশকিল। কেননা আরবের লোকেরা শত্রুদের মোকাবেলা এবং আত্মরক্ষার জন্য অন্যান্য জাতির চেয়ে বেশিসংখ্যাক জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতো। এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সচেতন ছিল বলা যায়।

সহোদর ভাইয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক, চাচাতো ভাইয়ের সাথে এবং গোত্রের অন্যান্য লোকদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত ছিল। কেননা আরবের লোকেরা গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্ব এবং গোত্রীয় অহমিকার জোরেই বাঁচতো এবং মরতো। গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। গোত্রীয় সম্পর্কের ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত ছিল।

তারা এ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতো যে, ভাইয়ের সাহায্য করো, সে অত্যাচারী বা অত্যাচারিত যা কিছুই হোক। পরবর্তীকালে ইসলাম অত্যাচারীকে তার অত্যাচার থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রভুত্ব ও সর্দারির চেষ্টায় কোন গোত্রের একজন লোকের সমর্থনে গোত্রের অন্য সব লোক যুদ্ধের জন্য বেরিয়ে পড়তো। উদাহরণস্বরূপ আওস খাযরাজ আবস-জুবয়ান, বকর-তাগলাব প্রভৃতি গোত্রর ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্পর্কের এতো অবনতি হয়েছিল যে, গোত্রসমুহের সমস্ত শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যয়িত হতো। দ্বীনি শিক্ষার কিছুটা প্রভাব এবং সামাজিক রুসম-রেওয়াজের কারণে অনেক সময় যুদ্ধের সময় যুদ্ধের বিভীষিকা ও ভয়াবহতা কম হতো। অনেক সময় সমাজে প্রচলিত কিছু নিয়ম কানুনের অধীনে বিভিন্ন গোত্র মৈত্রী বন্ধনেও আবদ্ধ হতো। এছাড়া নিষিদ্ধ মাসসমুহে পৌত্তলিকদের জীবনে শান্তি স্থাপনে এবং তাদের জীবিকা অর্জনে বিশেষ সহায়ক প্রমাণিত হতো।

মোটকথা সামগ্রিক অবস্থা ছিল চরম অবনতিশীল। মূর্খতা ছিল সর্বব্যাপী। নোংরামী, পাপাচার ছিল চরমে। মানুষ পশুর মতো জীবন যাপন করতা। মহিলাদের বেচাকেনার নিয়ম প্রচলিত ছিল। মহিলাদের সাথে অনেক সময় এমন আচরণ করা হতো যেন তারা মাটি অথবা পাথর। পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল দুর্বল এবং ভঙ্গুর। সরকার বা প্রশাসন নামে যা কিছু ছিল তা প্রজাদের নিকট থেকে অর্থ সম্পদ সংগ্রহ করে কোষাগার পূর্ণ করার কাজে এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশের কাজে নিয়োজিত থাকতো।

অর্থনৈতিক অবস্থা

অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল সামগ্রিক সামাজিক অবস্থার অধীন। আরবদের জীবিকার উৎসের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে, ব্যবসা বাণিজ্যেই ছিল তাদের জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহের প্রধান মাধ্যম। বাণিজ্যিক আদান প্রদান সম্ভব ছিল না। জাযিরাতুল আরবের অবস্থা এমন ছিল যে, নিষিদ্ধ মাসসমুহে ছাড়া শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ অন্য কোন সময় বিদ্যমান ছিল না। এ কাননেই জানা যায় যে, নিষিদ্ধ মাসসমুহেই আরবের বিখ্যাত বাজার ওকায, যিল মায়ায, মাযনা প্রভৃতি মেলাগুলো বসতো।

শিল্পক্ষেত্রে আরবরা ছিল বিশ্বের অন্য সকল দেশের পেছনে। কাপড় বুনন, চামড়া পাকা করা ইত্যাদি যেসব শিল্পের খবর জানা যায় তার অধিকাংশই হতো প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে। সিরিয়া, হীরা বা ইরাকে। আরবের খেত খামার এবং ফসল উৎপাদনের কাজ চলতো। সমগ্র আরবে মহিলারা সুতা কাটার কাজ করতো। কিন্তু মুশকিল ছিল এই যে, সুতা কাটার উপকরণ থাকতো যুদ্ধের বিভীষিকায় দুর্লভ। দরিদ্রতা ছিল একটি সাধারণ সমস্যা। প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য এবং পোশাক থেকে মানুষ পায়ই বঞ্চিত থাকতো।

চারিত্রিক অবস্থা

এটা স্বীকৃত সত্য যে আরবের লোকদের মধ্যে ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় অভ্যসসমুহ পাওয়া যেতো এবং এমন সব কাজ তারা করতো যা বিবেক বুদ্ধি মোটেই অনুমোদন করত না। তবে তাদের মধ্যে এমন কিছু চারিত্রিক গুণও ছিল যা রীতিমত বিস্ময়কর। নীচে গুণাবলীর কিছু বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।

এক) দয়া ও দানশীলতা। এটা ছিল আরবদের একটা বিশেষ গুণ। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব লক্ষ্য করা যতো। এ গুণের ওপর তারা এতো গর্ব করতো যে, আরবের অর্ধেক মানুষই কবি হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে কেউ নিজের প্রশংসা করতো, কেউ অন্য কারো প্রশংসা করতো। কখনো এমন হতো যে, প্রচন্ড শীতে এবং অভাবের সময়েও হতো কারো বাড়িতে মেহমান এলো। সেই সময় গৃহস্বামীর কাছে একটা মাত্র উটই ছিল সম্বল। গৃহস্বামী আতিথেয়তা করার জন্য সেই পশুই জবাই করে দিতো। দয়া এবং উদারতার কারণেই তারা মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ করে নিতো এবং সে ক্ষতিপূরণ যথারীতি আদা করতো। এমনিভাবে মানুষকে ধ্বংস এবং রক্তপাত থেকে রক্ষা করে অন্যান্য ধনী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে গর্ব করতো।

এ ধরনের দানশীলতার কারণেই দেখা যেতো যে, তারা মদ পান করায় গর্ব অনুভব করতো। মদ পান প্রকৃতপক্ষে কোন ভাল কাজ ছিল না, কিন্তু মদ পানের ফলে তারা উদার হতে পারতো এবং দান-খয়রাত করা তাদের জন্য সহজ হতো। কেননা নেশার ঘোরে অর্থ সম্পদ ব্যয় করা মানুষের জন্য কষ্টকর হয় না। এ কারণে আরবের লোকেরা মদ তৈরির উপকরণ আঙ্গুরের গাছকে করম এবং মদকে বিনতুল করম বলে অভিহিত করতো। জাহেলি যুগের কবিদের কবিতার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় তারা গর্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগী ছিল।

আনতারা ইবনে শাদ্দাস আবসী তার রচিত মোয়াল্লাকায় লিখেছেন, দুপুরের প্রখর রোদ কমে যাওয়ার পর আমি একটি কারুকার্য খচিত পীত রঙের পাত্র থেকে মদ পান করলাম। যখন আমি মদ পান করি তখন আমার অর্থ সম্পদ দান করে ফেলি। কিন্তু এ সময়ও আমি নিজর ইজ্জত আব্রু সম্পর্কে সচেতন থাকি। ওতে কোন দাগ রাখতে দেই না। জ্ঞান ফিরে আসার পরও আমি দানশীলতার ক্ষেত্রে কোন কার্পণ্য করি না। আমার চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং দয়া সম্পর্কে তোমাদের কি আর বলবো, সেটাতো তোমাদের অজানা নয়।

দয়াশীলতার কারণেই আরবরে লোকেরা ঢালাওভাবে জুয়া খেলতো। তারা মনে করতো যে, এটা দানশীলতার একটা পথ। কেননা জুয়া খেলার পর জুয়াড়িরা যা লাভ করতো অথবা লাভ থেকে খরচের পর যা বেঁচে যেতো সেসব তারা গরীব দুঃখীদের মধ্যে দান করে দিতো। একারণেই পবিত্র কোরআনে মদ এবং জুয়ার উপকারের কথা অস্বীকার করা হয়নি বরং বলা হয়েছে যে, এ দুটোর উপকারের চেয়ে অপকার বেশি। আল্লাহ পাক বলেন, লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, বল, উভয়ের মধ্যে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে কিন্তু এদের পাপ উপকারের চাইতে বেশী। (২১৯, ৬)

দুই) অঙ্গীকার পালন। আরবের লোকেরা অঙ্গীকার পালনকে ধমের অংশ বলে মনে করতো। অঙ্গীকার পালন বা কথা র রাখতে গিয়ে তারা জানমালের ক্ষতিকেও তুচ্ছ মনে করতো। এটা বোঝার জন্য হানি ইবনে মাসুদ শায়বানী সামোয়াল ইবনে আদীয়া এবং হাজের ইবনে জারারার ঘটনাগুলোই যথেষ্ট।

তিন) আত্মমর্যাদা সচেতনতা। যুলুম অত্যাচার সহ্য করেও নিজের মর্যাদা বজায় রাখা ছিল জাহিলি যুগের পরিচিতি একটি চারিত্রিক গুণ। এর ফলে বীরত্ব বাহাদুরি প্রকাশ করতো। তাদের ক্রোধ ছিল অসামান্য হঠাৎ করেই তারা ক্ষেপে যেতো। অবমাননার সামান্য লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া গেলেও তারা অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়তো এবং রক্তপাত ঘটাতো। এব্যাপারে তারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করতো।

চার) জাহেলী যুগের লোকদের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে, কোন কাজ করার জন্য প্রতিজ্ঞা করলে সে কাজ থেকে তারা কিছুতেই দুরে থাকতো না। কোন বাধাই তারা মানত না। জীবন বিপন্ন হলেও সে কাজ তারা সম্পাদন করতো।

পাঁচ) সহিষ্ঞুতা এবং দুরদর্শীতামুলক প্রজ্ঞা। এটাও আরবের লোকদের একটা মহৎ গুণ। কিন্তু বীরত্ব এবং যুদ্ধের জন্য সব সময় তৈরি থাকার কারণে গুন তাদের মধ্যে ছিল দুর্লভ।

ছয়) বেদুইন সুলভ সরলতা। তারা সভ্যতার উপকরণ থেকে দুরে অবস্থান করতো এবং এক্ষেত্রে তাদের অনীহা ছিল। এই ধরনের সাদাসিধে সহজ সরল জীবন যাপনের কারণে তাদের মধ্যে সত্যবাদিতা এবং আমানতদারী পাওয়া যেতো। প্রতারণা, অঙ্গীকার ভঙ্গ এসবকে তারা ঘৃণা করতো।

আমরা মনে করি যে জাযিরাতুল আরবের সাথে সমগ্র বিশ্বের যে ধরনের ভৌগলিক অবস্থান ছিল সেটা ছাড়া উল্লেখিত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণেই তাদেরকে মানব জাতির নেতৃত্ব এবং নবুয়তের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। এ সব গুণাবলীর কারণে হঠাৎ করে যদিও তারা ভয়ংকর হয়ে উঠতো এবং অঘটন ঘটাতো তবুও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এসব গুণাবলী ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় প্রকৃত মানবিক গুণ। সামান্য সংশোধনের পর এ সব গুণ মানুষের জন্য মহাকল্যাণকর প্রমাণিত হতে পারে। ইসলাম সেই কাজ সম্পাদন করেছে।

সম্ভবত উল্লেখিত চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে অঙ্গীকার পালনের পর আত্মমর্যাদাবোধ এবং প্রতিজ্ঞা পালন ছিল সবচেয়ে মূল্যবান এবং প্রশংসনীয়। এইসব গুণাবলী এবং চারিত্রিক শুক্তি ছাড়া বিশৃঙ্খলা অশান্তি ও অকল্যাণ দুর করে ন্যায়নীতি ও সুবিচারমুলক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

জাহেলী যুগে আরবের লোকদের মধ্যে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক গুণ ছিল কিন্তু এখানে সবগুলো আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।

তিনিই সেই মহান সত্বা, যিনি তাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে তাদেরই একজনকে রসুল করে পাঠিয়েছেন। সে তাদের আল্লাহর আয়াতসমুহ পড়ে শোনাবে, তাদের জীবনকে (জাহেলিয়াত থেকে) পবিত্র করবে, সর্বোপরি তাদের (দ্বীনের) কৌশল শিক্ষা দেবে, অথচ এই লোকগুলোই (সে আসার) আগে (পর্যন্ত) এক সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিমজ্জিত ছিলো। (সুরা জুমুয়া ২)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি