কোন বংশে সেই সোনার মানুষঃ আল আমীন থেকে আর রাসূল
নবী পরিবারের পরিচয়

নবী করিম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধারাকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম অংশের নির্ভুলতার ব্যাপারে সীরাত রচয়িতা এবং বংশধারা বিশেষজ্ঞরা একমত। দ্বিতীয় অংশ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতার মাঝে কিছু মতভেদ রয়েছে। কেউ সমর্থন করেছেন কেই বিরোধিতা করেছেন কেউ আবার ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। এটি আদনার থেকে ওপরের দিকে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত। তৃতীয় অংশে নিশ্চিত কিছু ভুল রয়েছে, এটি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে হযরত আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে। নীচে তিনটি অংশ সম্পর্কে মোটামুটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাচ্ছে।

প্রথম অংশ

মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, ইবনে আবদুল মোত্তালেব (শায়বা) ইবনে হাশেম(আমর) ইবনে আবদ মান্নাফ (মুগীরা) ইবনে কুসাই(যায়েদ) ইবনে কেলার ইবরে মাররা, ইবনে কাব ইবনে লোয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফাহার, (এর উপাধিই ছিল কোরাইশ গোত্র নামেই পরিচিত) ইবনে মালেক ইবনে নযর কায়েস ইবনে কেনানা ইবনে খোযায়মা ইবনে মাদরেকা(আমের) ইবনে ইলিয়াস ইবনে মোদান ইবনে নাযার ইবনে মাআদ ইবনে আদনান। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ২০, তালকীহে ফুহমে আহলুল আছার পৃ-৫, ৬, রহমাতুললিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ-১১, ১৪, ৫২)

দ্বিতীয় অংশ

আদনান থেকে ওপরের দিকে। অর্থাৎ আদনান ইবনে হামিছা ছালামান ইবনে আওছ ইবনে পোজ, ইবনে কামোয়াল ইবনে উবাই আওয়ায ইবনে নাশেদ ইবনে হাজা ইবনে বালদাস ইবনে ইয়াদলাফ ইবেন তারেখ ইবনে জাহেম ইবনে নাহেশ, ইবনে মাখি, ইবনে আয়েয, ইবনে আকবার, ইবনে ওবায়েদ, ইবনে আদদায়া, ইবনে হামদান, ইবনে সুনবর, ইবনে ইয়াসরেবী, ইবনে ইয়াহাজান, ইবনে ইয়ালহান ইবনে আরউই ইবনে আই ইবনে যায়শান ইবনে আইশার ইবনে অফনাদ ইবনে আইহাম ইবনে মাকছার ইবনে নাহেছ ইবনে জারাহ ইবনে সুমাই ইবনে মাযি ইবনে আওযা ইবনে আরাম ইবনে কায়দার ইবনে ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। (আল্লামা মনুসরপুরী গবেষণার পর এ অংশ ঐতিহাসিক কালবি এবং ইবনে সাদ এর বর্ণনা থেকে সংযোজিত করেছেন। রহমাতুল্লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-১৪-১৭। এ অংশের ব্যাপারে ঐতিহাসিক তথ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। )

তৃতীয় অংশ

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম থেকে ওপরের দিকে। ইবরাহিম ইবনে তারাহ (আযর) ইবনে নাহুর ইবনে ছবেদা (সারুগ) ইবনে রাউ ইবনে ফালেজ ইবনে আবের ইবনে শালেখ ইবনে আরফাখশাদ ইবনে সাম ইবনে নুহ আলাইহিস সালম ইবনে লামেক ইনে মাতুশালাখ ইবনে আখনুখ (মতান্তরে হযরত ইদরিস আলাইহিস সালাম) ইবনে মাহলায়েল ইবনে কায়নান ইবনে আনুশা, ইবনে শীশ ইবনে আদম আলাইহিস সালাম। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ ২, ৪. তালাকীহুল ফুহুম পৃ-৬ খোলাছতিুছ সীয়ার. পৃ-৬.)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাঁর পরদাদা হাশেম ইবনে আবদে মান্নাফের পরিচয়ে হাশেমী বংশোদ্ভূত হিসাবে পরিচিত। কাজেই হাশেম এবং পরবর্তী কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা জরুরী।

এক) হাশেম, ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি বে বনু আবদে মান্নাফ এবং বনু আবদুদ দায়ের মধ্যে পদমর্যাদা বণ্টনের ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। এই সমঝোতার প্রেক্ষিতে আবদে মান্নাফের বংশধররা হাজীদের পানি পান করানো এবং মেহমানদের আতিথেয়তার মেজবানি লাভ করেন। হাশেম বিশিষ্ট সম্মানিত এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মক্কার হাজীদের সুরুয়া রুটি খাওয়ানের প্রথা চালু করেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আমর কিন্তু রুটি ছিড়ে সুরুয়ায় ভেজানোর কারণে তাঁকে বলা হতো হাশেম। হাশেম অর্থ হচ্ছে যিনি ভাঙ্গেন। হাশেমেই প্রথম মানুষ যিনি কোরাইশদের গ্রীষ্ম এবং শীতে দুবার বাণিজ্যিক সফরের ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রশংসা করে কবি লিখেছেন, তিনি সেই আমর যিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত দুর্বল স্বজাতিকে মক্কায় রুটি ভেঙ্গে ছিঁড়ে সুরুয়ায় ভিজিয়ে খাইয়েছিলেন এবং শীত ও গ্রীষ্মে সফরের ব্যবস্থা করেছেন।

হাশেম বা আমরেরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই যে, তিনি ব্যবসার জন্য সিরিয়া সফরে গিয়েছিলেন। যাওয়ার পথে মদিনায় পৌঁছে বনি নাজ্জার গোত্রের সালমা বিনতে আমরের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন। গর্ভবতী হওয়ার পর স্ত্রীকে পিত্রালয়ে রেখে তিনি সিরিয়ায় রওয়ানা হন। ফিলিস্তিনের গাযা শহরে গিয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। এদিকে সালমার গর্ভ থেকে একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এটা ৪৯৭ ঈসায়ী সালের ঘটনা। শিশুর মাথার চুলে ছিল শুভ্রতার ছাপ, এ কারণে সালমা তার নাম রাখেন শায়রা (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড. পৃ-১৩৭, রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.২৬, ২য় খন্ড পৃ-২৪)। ইয়াসরেব বা মদিনায় সালমা তার পিত্রালয়েই সন্তানের প্রতিপালন করেন। পরবর্তীকালে এই শিশুই আব্দুল মোত্তালেব নামে পরিচিত হন। দীর্ঘকাল যাবত হাশেমী বংশের লোকেরা এ শিশুর সন্তান পায়নি। হাশেমের মোট চার পুত্র পাঁচ কন্যা ছিল। এদের নাম নিম্নরূপ : আসাদ, আবু সায়ফি, নাযলা, আবদুল মোত্তালেব। কন্যাদের নাম, শাফা, খালেদা, যঈফা, রোকাইয়া এবং যিন্নাত। (ঐ ১ম খন্ড, পৃ-১০৭)।

(দুই) আব্দুল মোত্তালেব, ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, হাজীদের পানি পান করানো এবং মেহমানদারী করার দায়িত্ব হাশেমের পর তাঁর ভাই মোত্তালেব পেয়েছিলেন। তিনিও ছিলেন তাঁর পরিবার ও কওমের অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন। তিনি কোন কথা বললে সে কথা কেউ উপেক্ষা করতো না। দানশীলতার কারণে কোরাইশরা তাঁকে ফাইয়ায উপাধি দিয়েছিলেন। শায়বা অর্থাৎ আব্দুল মোত্তালেব এর বয়স যখন দশ বারো বছর হয়েছিল তখন মোত্তালেব তার খবর পেয়েছিলেন। তিনি শায়বাকে নিয়ে আসার জন্য মদিনায় গিয়েছিলেন। মদিনায় অর্থাৎ ইয়াসরেবের কাছাকাছি পৌছার পর শায়বার প্রতি তাকালে তাঁর দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এরপর নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। কিন্তু শায়বা তার মায়ের অনুমতি না নিয়ে মক্কায় যেতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব যখন শায়বার মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন তখন শায়বার মা সালমা অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। মোত্তালেব বললেন ওতো তার পিতার হুকুমত এবং আল্লাহর ঘরের দিকে যাচ্ছে। একথা বলার পর সালমা অনুমতি দিলেন। মোত্তালেব তাকে নিজের উটের পেছনে বসিয়ে মক্কায় নিয়ে এলেন। মক্কায় নিয়ে আসার পর প্রথমে যারা দেখলো তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলো ভ্রাতুষ্পুত্র, হাশেমের ছেলে। এরপর থেকে শায়বা মোত্তালেব কাছে বড় হতে থাকেন এবং এক সময় যুবক হন। পরবর্তীকালে মোত্তালেব ইয়েমেনে মারা যায়। তাঁর পরিত্যক্ত পদমর্যাদা শায়বা লাভ করেন। আব্দুল মোত্তালেব তাঁর স্বজাতীয়দের মধ্যে এতো বেশী সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছিলেন যে, ইতিপূর্বে অন্য কেউ এতোটা লাভে সক্ষম হয়নি। স্বজাতির লোকেরা তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো এবং তাঁকে অভূতপূর্ব সম্মান দিতো। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৩৭-১৩৮)

মোত্তালেবের মৃত্যুর পর নওফেল আবদুল মোত্তালেবের কিছু জমি জোর করে দখল করে নেই। আব্দুল মোত্তালেব কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাহায্য জান। কিন্তু তারা এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করেন যে, আপন চাচার বিরুদ্ধে আমরা আপনার পাশে দাঁড়াতে পারব না। অবশেষ আব্দুল মোত্তালেব বনি নাজ্জার গোত্রে তাঁর মামার কাছে কয়েকটি কবিতা লেখে পাঠান। সেই কবিতায় সাহায্যের আবেদন জানানো হয়েছিল। জবাবে তাঁর মামা আবু সাদ ইবনে আদী আশি জন সওয়ান নিয়ে রওয়ানা হয়ে মক্কার নিকটবর্তী আবতাহ নামক জায়গায় অবতরণ করেন। আবদুল মোত্তালেব তাঁতে ঘরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু আবু সাদ বললেন, না আমি আগে নওফেলের সাথে দেখা করতে চাই। এরপর আবু সাদ নওফেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। নওফেল সে সময় মক্কার কয়েকজন বিশিষ্ট কোরাইশ এর সাথে বসে কথা বলছিলেন। আবু সাদ তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললেন, এই ঘরের প্রভুর শপথ, যদি তুমি আমার ভাগ্নের জমি ফিরিয়ে না দাও তবে এই তলোয়ার তোমার দেহে ঢুকিয়ে দেব। নওফেল বললেন, আচ্ছা নাও, আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি। আবু সাদ কোরাইশ নেতৃবৃন্দকে সাক্ষী রেখে আব্দুল মোত্তালেবকে তাঁর জমি ফিরিয়ে দিলেন। এরপর আবু সাদ আব্দুল মোত্তালেবের ঘরে গেলেন এবং সেখানে তিনদিন অবস্থানের পর ওমরাহ পালন করে মদিনায় ফিরে গেলেন।

এর পর নওফেল বনি হাশেমের বিরুদ্ধে বনি আবদে শাসমের সাথে সহায়তার অঙ্গীকার করলো।

এদিকে বনু খোজায়া গোত্র লক্ষ করলো যে, বনু নাজ্জার আবদুল মোত্তালেবকে এভাবে সাহায্য করলো, তখন তারা বলল, আবদুল মোত্তালেব তোমাদের যেমন তেমনি আমাদেরও সন্তান। কাজেই আমাদের ওপর তার সাহায্য করার অধিক অধিকার রয়েছে। এর কারণ ছিল এই যে, আবদে মান্নাফের মা বনু খোজায়া গোত্রের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ কারণে বনু খোজায়া দারুন নাদওয়ায় গিয়ে বনু আবদে শামস এবং বনু নওফেলের বিরুদ্ধে বনু হাশেমের নিকট সাহায্যের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলো। এই প্রতিশ্রুতিই পরবর্তী সময়ে ইসলামী যুগে মক্কা বিজয়ের কারণ হয়েছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করো হবে। (মুখতাছার সীরাতে রাসূল, শায়খুল ইসলাম মোহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ-৪১-৪২)

কাবাঘরের সাথে সম্পর্কিত থাকার কারণে আবদুল মোত্তালেব সাথে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। একটি যমযম কুপ খনন অন্যটি হাতী যুদ্ধের ঘটনা।

যমযম কুপের খনন কাজ

এই ঘটনার সারমর্ম এই যে, আব্দুল মোত্তালেব স্বপ্নে দেখলেন যে, তাঁকে যমযম কুপ খননের জন্য আদেশ দেয়া হচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যেই তাকে জায়গাও দেখিয়ে দেয়া হলো। ধুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর তিনি যমযম কুপ খনন শুরু করলেন। পর্যায়ক্রমে দুটি জিনিস আবিষ্কৃত হলো। এগুলো হচ্ছে জোরহাম গোত্র মক্কা থেকে চলে যাওয়ার সময় যমযমের ভেতর ফেলে দিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে তলোয়ার, অলংকার এবং সোনার দুটি হরিণ। আবদুল মোত্তালেব উদ্ধারকৃত তলোয়ার দিয়ে দরোজা লাগালেন। সোনার দুটি হরিণও দরোজার ফিট করলেন এবং হাজীদের যমযম কুপের পানি পান করানোর ব্যবস্থা করলেন।

যমযম কূপ আবিষ্কৃত হওয়ার পর কোরাইশরা আবদুল মোত্তোলেবের সাথে ঝগড়া করতে শুরু করলো। তারা দাবী করলো যে, আমাদেরও খনন কাজের সাথে যুক্ত করা হোক। আব্দুল মোত্তালেব বললেন, আমি সেটা করতে পানি না। আমাকেই এ কাজের জন্য নিদিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কোরাইশরা মানতে চাইলো না। অবশেষে ফয়সালার জন্য সবাই বনু সাদ গোত্রের একজন জ্যোতিষী মহিলার নিকট গেলো। কিন্তু যাওয়ার পথে তারা কিছু বিস্ময়কর নিদর্শন দেখলো। এতে তারা বুঝতে পারলো যে, কুদরতী ভাবেই যমযম কুপ খননের দায়িত্ব আবদুল মোত্তালেবকে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বিবাদকারী কোরাইশরা পথ থেকেই ফিরে এলো। এই সময় আব্দুল মোত্তালেব মানত করেছিলেন যে, আল্লাহ পাক যদি তাকে দশটি পুত্র দেন এবং তার নিজেদের রক্ষা করার মতো বয়স উন্নীত হয় তবে একজন সন্তানকে আল্লাহর নামে কাবার পাশে কোরবাণী করবেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৪২-১৪৭)

হস্তী যুদ্ধের ঘটনা

দ্বিতীয় ঘটনার সারমর্ম এই যে, আবিসনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর পক্ষ থেকে আবরাহা সাবাহ হাবশী ইয়েমেনের গভর্নর জেনারেল ছিল। আবরাহা লক্ষ্য করলো যে, আরবের লোকেরা কাবাঘরে হজ্জ পালনের জন্য যাচ্ছে। এটা দেখে সে সনয়ায় একটি গীজা তৈরী করলো। সে চাচ্ছিল যে, আরবের লোকেরা হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় না গিয়ে সনয়ায় যাবে। এ খবর জানার পর বনু কেনানা গোত্রের একজন লোক আবরাহার নির্মিত গির্জার ভেতরে প্রবেশ করে গির্জায় মেহরাবে পায়খানা করে এলো। আবরাহা এ খবর পেয়ে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলো এবং ষাট হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্য নিয়ে কাবাঘর ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হলো। নিজের জন্য সে একটি বিশাল হাতী ব্যবস্থা করলো। তার বাহিনীতে মোট নয়টি অথবা তেরোটি হাতী ছিল। আবরাহা ইয়েমেন থেকে মোগাম্মাস নামক জায়গায় পৌছলো এবং সেখানে বিন্যস্ত করলো। মক্কায় প্রবেশের পর মোযদালেফা এবং মিনার মধ্যবর্তী মোহাসসের প্রান্তরে পৌছলে হাতী সব বসে পড়লো। অনেক চেষ্টার পরও কাবার দিকে যাওয়ার জন্য হাতীকে উঠানো সম্ভব হলো না। চেষ্টা করলেই হাতি বসে পড়তো। এ সময় আল্লাহ পাক এক পাল চড়ুই পাখি প্রেরণ করলেন। পাখিরা মুখে ছোট ছোট পাথর বহন করেছিল। এ সব পাথর তারা সৈন্যদের ওপর নিক্ষেপ করলো। এর মাধ্যমে আবরাহার সেনাদল ভুষির মতো নাস্তানাবুদ হয়ে গেল। চড়ুই পাখিগুলো ছিল আবাবিলের মতো। প্রতিটি পাখি তিনটি পাথর বহন করেছিল। একটি মুখে অন্য দুটি দুই পাখার নীচে। পাথরগুলি ছিল মটর শুটির মত। যার গায়ে সে পাথর পড়তো তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খসে পড়তে গুরু করতো এবং সে মরে যেতো। প্রত্যেকের গায়ে এ পাথর পড়েনি। সেনাদলের মধ্যে এমন আতঙ্ক এবং বিভীষিকা সৃষ্টি হলো যে সবাই এলোপাতাড়ি পালাতে শুরু করলো। এরপর তারা এখানে সেখানে পড়ে মরতে লাগলে। এদিকে আবরাহার ওপর গযব নাযিল হরলেন যে তার হাতের আঙ্গুল খসে পড়তে শুরু করলো। সনয়ায় পৌছতে পৌছুতে তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো। কলিজা ফেটে বাইরে এসে মর্মান্তিকভাবে সে মৃত্যুবরণ করলো।

আবরাহার এ হামলার সময় মক্কার অধিবাসীরা প্রাণভয়ে পাহাড়ে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়লো এবং পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করলো। সেনাদলের ওপর আল্লাহর আযাব অবতীর্ণ হলে তারা নিশ্চিন্তে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেল। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-৪৩, ৫৬)

উল্লিখিত ঘটনা অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার অভিমত অনুযায়ী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পঞ্চাশ অথবা পঞ্চান্ন দিন আগে ঘটেছিল। সে সময় ছিল মহররম মাস। ৫৭১ ঈসায়ী সালের ফেব্রুয়ারি শেষ দিকে অথবা মার্চের শুরুতে এ ঘটনা ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপাক তাঁর নবী এবং পবিত্র ঘর কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে এর ভূমিকা স্বরূপ এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। যেমন ৫৮৭ সালে বখতে নসর মাকদেস দখল করে তা অধিকার করেছিল। এর আগে ৭০ সালে রোমকরা বায়তুল মাকদেস অধিকার করেছিল। পক্ষান্তরে কাবার ওপর খৃষ্টানরা কখনোই আধিপত্য বিস্তার করতো পারেনি। অথচ সে সময় ঈসায়ী বা খৃস্টানরা ছিল আল্লাহর বিশ্বাসী মুসলমান এবং কাবার অধিকারীরা ছিল পৌত্তলিক।

হস্তীযুগের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরপরই অল্প সময়ে মধ্যেই তদানীন্তন উন্নত দেশ হিসাবে পরিচিতি রোম এবং পারস্য এ খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কেননা মক্কার সাথে রোমকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অন্যদিকে রোমকদের ওপর পারসিকদের সব সময় নযর থাকতো । রোমক এবং তাদের শত্রুদের যাবতীয় ঘটনা পারস্য বা পারসিকরা পর্যবেক্ষণ করতো। এ কারণেই দেখা যায় য়ে, আবরাহার পতনের পর পরই পারস্যবাসীরা ইয়েমেন দখল করে নেয়। সে সময়কার বিশ্বে পারস্য এবং রোম যেহেতু উন্নত ও সভ্য দেশ হিসাবে পরিচিত ছিল এ কারণে বিশ্ব মানবের দৃষ্টি কাবার প্রতি নিবদ্ধ হলো। কাবাঘরের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ তারা প্রত্যক্ষ করলো। তারা বুঝতে পারলো যে, এই ঘরকে আল্লাহ পাক পবিত্র ঘর হিসাবে মনোনীত করেছেন। কাজেই মক্কার জনপদ থেকে নবুয়তের দাবীসহ কারো উত্থান অবশ্য সমীচীন। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী পৌত্তলিকদের আল্লাহ কেন সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহ রসূলের আবির্ভাবের কথা চিন্তা করলে সে কথা বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয় না।

আবদুল মোত্তালেবের পুত্র সংখ্যা ছিল দশজন। তাদের নাম ছিল হারেস, যোবায়ের, আবু তালেব, আবদুল্লাহ, হামযা, আবু লাহাব, গাইদাক, মাকহুম, সাফার এবং আব্বাস। কেউ কেউ বলেছেন, এগারোজন। একজনের নাম ছিল কাছাম। কেউ বলেছেন, তেরোজন। একজনের নাম ছিল আবদুল কাবা অন্যজনের নাম ছিল হোজাল। যারা দশজন পুত্র বলে উল্লেখ করেছেন তারা বলেন, মুকাওআমের আরেক নাম ছিল আবদুল কাবা আর গাইদাকের আরেক নাম ছিল হোজাল। কাছাম নামে আবদুর মোত্তালেবের কোন পুত্র ছিল না। আবদুল মোত্তালেবের কন্যা ছিল ছয়জন। তাদের নাম উম্মুল হাকিম, এর অন্য নাম ছিল বায়জা, বায়রা , আতেকা, সাফিয়া, আরোয়া, উমাইমা। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৮, ৯, রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ-৫৬, ৬৬)

তিন) আবদুল্লাহ ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা। আবদুল্লাহর মায়ের নাম ছিল ফাতেমা। তিনি ছিলেন আমর ইবনে আবেদ ইবনে এমরান ইবনে মাখযুম ইবনে ইয়াকজা ইবনে মাররার কন্যা। আবুর মোত্তালেবের সন্তানদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন সুদর্শন, সচ্চরিত্রে এবং স্নেহভাজন। তাঁকে বলা হতো যবীহ বা যবাইকৃত। এরূপ বলার কারণ ছিল এই যে, আবদুল মোত্তালেবের পুত্রদের সংখ্যা দশ হয়ে যাওয়ার পর এবং তারা নিজেদের রক্ষায় সমর্থ মতো বয়সে উন্নীত হওয়ার পর আবদুল মোত্তালেব তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানান। এরপর আবদুল মোত্তালেব ভাগ্য পরীক্ষার তীরের গায়ে তাদের সকলের নাম লিখলেন। লেখার পর হোবাল মূর্তির তত্বাবধায়কের হাতে দিলেন। তত্বাবধায়ক লটারি করার পর আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মোত্তালেব আবদুল্লাহর হাত ধরলেন, ছুরি নিলেন এবং যবাই করার জন্য কাবাঘরের পাশে নিয়ে গেলেন। কিন্তু কোরাইশ বিশেষত আবদুল্লাহর ভাই আবু তালেব বাধা দিলেন। আবদুল মোত্তালেব বললেন, তোমরা যদি বাধা দাও তবে আমি মানত পূর্ণ করব কিভাবে? তারা পরামর্শ দিলেন যে, আপনি কোন মহিলা সাধকের কাছে গিয়ে এর সমাধান চান। আবদুল মোত্তালেব এক মহিলা সাধকের কাছে গেলেন। সেই সাধক আবদুল্লাহর এবং দশটি উটের নাম লিখে লটারি করার পরামর্শ দিলেন। তবে বললেন যে যদি আবদুল্লাহ নাম না উঠে তবে দশটি করে উট বাড়াতে থাকবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ খুশি না হন। এরপর যতোটি উটের নাম লটারিতে উঠবে ততটি উট যবাই করবেন। আবদুল মোত্তালেব ফিরে গিয়ে কোরা অর্থাৎ লটারি করতে শুরু করলেন। প্রথম দশটিতে আবদুল্লাহর নাম এলো না। এরপর দশটি করে বাড়তে লাগলো। একশত উট হওয়ার পর আবদুল্লাহর নাম উঠলো। আবদুল মোত্তালেব একশত উট যবাই করলেন এবং সেখানেই ফেলে রাখলেন। মানুষ এবং পশু কারো জন্য বাধা ছিল না। এ ঘটনার আগে পর্যন্ত কোরাইশ এবং আরবদের মধ্যে রক্ত ঋণের পরিমাণ ছিল দশটি উট। কিন্তু এই ঘটনার পর তার পরিমাণ বাড়িয়ে একশত উট করা হলো। ইসলামও এই পরিমাণ অব্যাহত রাখে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি দুইজন যবীহের সন্তান । একজন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম অন্যজন আমার পিতা আবদুল্লাহ। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৫১-১৫৫, রহমাতুল্লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-৮৯, ৯০, মুখতাছার সীরাতে রাসুল শেখ আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ-২২, ২৩)

আবদুল মোত্তালেব তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর বিয়ের জন্য আমেনাকে মনোনীত করেন। আমেনা ছিলেন ওয়াহাব ইবনে আবদে মান্নাফ ইবনে যোহরা ইবনে কেলাবের কন্যা। এরা বংশ মর্যাদার দিক থেকে কোরাইশদের মধ্যে সর্বোত্তম বলে বিবেচিত হতো। আমেনার পিতা বংশ মর্যাদা এবং অভিজাত্যের দিক থেকে বনু যোহরা গোত্রের সদার ছিলেন। বিবি আমেনা বিয়ের পর পিত্রালয় থেকে বিদায় নিয়ে স্বামীগৃহে আগমন করেন। কিছুদিন পর আবদুল মোত্তালেব আবদুল্লাহকে খেজুর আনয়নের জন্য মদিনায় পাঠান। আবদুল্লাহ সেখানে ইন্তেকাল করেন।

কোন কোন সীরাতে রচয়িতা লিখেছেন যে, আবদুল্লাহ ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গিয়েছিলেন। কোরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সাথে মক্কায় ফিরে আসার সময় অসুস্থ হয়ে মদিনায় অবতরণ করেন এবং সেখানে ইন্তেকাল করেন। নাবেগা যাআদীর বাড়িতে তাঁকে দাফন করা হয়। সে সময় তাঁর বয়স ছিল পঁচিশ বছর। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে আল্লাহর রসুল তখনো জন্মগ্রহণ করেননি। কারো কারো মতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লামের জন্ম তার পিতার ইন্তেকালের দুই মাস আগে হয়েছিল। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৫৬, ১৫৮, ফেকহুস সিয়ার মোহাম্মদ গাযালী, পৃ-৪৫, রহমাতুল লিল আলামিন, ২য় খন্ড, পৃ-৯১)

স্বামী মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর আমেনা বেদনা মথিত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, বাতহার যমীন হাশেমের বংশধর থেকে খালি হয়ে গেছে। মৃত্যু তাকে এক ডাক দিয়েছে এবং তিনি আমি হাযির বলেছেন। তিনি রাঙ্গ ও খুরুশের মধ্যবর্তী এক জায়গায় শায়িত রয়েছেন। মৃত্যু এখন ইবনে হাশেমের মতো কোন লোক রেখে যায়নি। সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে যখন তাঁকে লোকেরা খাটিয়ায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যু যদিও তাঁর অস্তিত্ব মুছে দিয়েছে কিন্তু তাঁর কীর্তি মুছে দিতে পারবে না। তিনি ছিলেন বড় দাতা এবং দয়ালু (তাবাকাতে ইবনে সাদ ১ম খন্ড, পৃ-৬২)।

মৃত্যুকালে যেসব জিনিস রেখ গিয়েছিলেন সেসব হচ্ছে পাঁচটি উট, এক পাল বকরি, একটি হাবশী দাসী। সেই দাসীর নাম ছিল বরকত, কুনিয়াত ছিল উম্মে আয়মন। তিনি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে দুধ খাইয়েছিলেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ, পৃ-১২ তালকিহুল ফুহুম, পৃ-১৪, সহীহ মুসলিম ২য় খন্ড পৃ-১৬)।
আল্লাহর রসুলের আবির্ভাব ও পবিত্র জীবনের চল্লিশ বছর
তাঁর জন্ম মোবারক

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় বনি হাশেম বংশে ৯ই রবিউল আওয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। সেই বছরেই হাতী যুদ্ধের ঘটনাটি ঘটেছিল। সে সময় সম্রাট নওশেরওয়ার সিংহাসনে আরোহণের চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছিল। জন্ম তারিখ ছিল ২০ অথবা ২২ শে এপ্রিল। ৫৭১ ঈসায়ী সাল। সাইয়েদ সোলায়মান নদভী, সালমান মনসুরপুরী এবং মোহাম্মদ পাশা ফালাকি গবেষণা করে এ তথ্য প্রদান করেছেন। (তারিখে খাযরাম, ১ম খন্ড, পৃ-৬২, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ-৩, ৩৯)

ইবনে সাদ এর বর্ণনায় রয়েছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাতা বলেছেন যখন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন তখন দেহ থেকে এটি নুর বের হলো, সেই নুর দ্বারা শামদেশের মহল উজ্জ্বল হয়ে গেল। ইমাম আহমদ হযরত এরবাজ ইবনে ছারিয়া থেকে প্রায় একই ধরনের একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ-১২)

কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবুয়তের পটভূমি হিসেবে আল্লাহর রাসুলের জন্মের সময় কিছু কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল। কিসরার রাজ প্রাসাদের চৌদ্দটি পিলার ধসে পড়েছিল অগ্নি উপাসকদের অগ্নিকুণ্ডে নিভে গিয়েছিল বহিরার গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল বায়হাকির বর্ণনা। কিন্তু মোহাম্মাদ গাযযালী এ বর্ণনা সমর্থন করেননি। (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ-১২)

জন্মের পর তাঁর মা তাঁর দাদা আবদুল মোত্তালেবের কাছে পৌত্রের জন্মের সুসংবাদ দিলেন। তিনি খুব খুশি হলেন এবং সানন্দভাবে তাঁকে কাবাঘরে নিয়ে গিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। এ সময় তিনি তাঁর নাম রাখলেন মোহাম্মদ। এ নাম আরবের নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে খৎনা করলেন। মায়ের পর তাঁকে আবু লাহাবের দাসী ছা্ওবিয়া দুধ পান করান। সে সময় ছাওবিয়ার কোলের শিশুর নাম ছিল মাছরুহ। ছাওবিয়া তাঁর আগে হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এবং তাঁর পরে আবু সালমা সামা ইবনে আবদুল আছাদ মাখজুমিকে দুধ পান করিয়েছিলেন। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৪, মুখতাছারুছ সীরাত শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৩)

বনি সাদ গোত্রের অবস্থান

আরবের শহুরে নাগরিকদের রীতি ছিল যে, তারা নিজেদের শিশুদের শহরের অসুখ বিসুখ থেকে ভালো রাখার জন্য দুধ পান করানোর কাজে নিয়োজিত বেদুইন নারীদের কাছে পাঠাতেন। এতে শিশুদের দেহ মজবুত এবং শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠতো। এ ছাড়া এর আরেক উদ্দেশ্য ছিল যেন সেই দুধ পানের সময়েই যেন তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিক্ষা করতে পারে। এই রীতি অনুযায়ী আবদুল মোত্তালেব ধাত্রীর খোঁজ করলেন এবং তাঁর দৌহিত্রকে হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের হাতে দিলেন। এই মহিলা ছিলেন বনি সাদ ইবনে বকরের অন্তর্ভুক্ত। তার স্বামীর নাম ছিল হারেস ইবনে আবদুল ওযযা, ডাক নাম ছিল আবু কাবশা। তিনিও ছিলেন বনি সাদ গোত্রের মানুষ।

হারেসের সন্তানরা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্কের কারণে তাঁর দুধ ভাই ও বোন ছিল। তাদের নাম হলো আবদুল্লাহ, আনিসা, হোযাফা বা জোযামা। হালিমর উপাধি ছিল শায়মা এবং এই নামেই তিনি বেশী বিখ্যাত ছিলেন। তিনি আল্লাহর রাসুলকে বুকের দুধ খাওয়াতেন। এবং তিনি ছাড়া আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইবনে আবদুল মোত্তালেব, যিনি রসুলুল্লাহর চাচাতো ভাই ছিলেন. তিনিও হালিমার মাধ্যমে তাঁর দুধ ভাই ছিলেন। তাঁর চাচা হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেবও দুধ পানের জন্য বনু সাদ গোত্রের একজন মহিলার কাছে ন্যস্ত হয়েছিলেন। বিবি হালিমার কাছে থাকার সময়ে এই মহিলাও একদিন আল্লাহর রসুলকে দুধ পান করিয়েছিলেন। এই হিসাবে তিনি এবং হামযা উভয়ে দুই সুত্রে রেযায়ী ভাই বা দুধ ভাই ছিলেন (একদিকে ছাওবিয়ার সূত্রে অন্যদিকে বনু সাদ গোত্রের এই মহিলার সূত্রে)(যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-১৯)।

দুধ পান করানোর সময় হযরত হালিমা নবী করীম রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতের এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যে, বিস্ময় হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ তাঁর মুখেই শোনা যাক। ইবনে ইসহাক বর্ণনামতে হযরত হালিমা বলেন আমি আমার স্বামীর সাথে আমাদের দুগ্ধ পোষ্য শিশুসহ বনি সাদ গোত্রের কয়েকজন মহিলার সঙ্গে নিজেদের শহর ছেড়ে বের হলাম। সেটা ছিল দুর্ভিক্ষের বছর। চারিদিকে অভাব অনটন। আমি একটি মাদী গাধার পিঠে সওয়ার ছিলাম। আমাদের কাছে একটি উটনিও ছিল। কিন্তু সেই উটনি এক ফোটাও দুধ দিত না। ক্ষুধার জ্বালায় দুধের শিশু ছটফট করতো। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমার বুকেও দুধ ছিল না। উটনিও দুধ দিত না। বৃষ্টি এবং স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। মাদী গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় গাধা এতো ধীরে চলতে লাগলো যে, কাফেলার সবাই বিরক্ত হয়ে গেল। দুধ পান করানোর জন্য শিশুর সন্ধানে মক্কায় গেলাম। আমাদের কাফেলার যতো মহিলা ছিল সকলের কাচেই আল্লাহর রাসুলকে গ্রহণ করার জন্য পেশ করা হলো, কিন্তু পিতৃহীন অর্থাৎ এতিম হওয়ায় সবাই তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলো। কেননা সবাই সন্তানের পরিবার থেকে ভালো পারিশ্রমিকের আশায় করছিল। একজন বিধবা মা কি আর দিতে পারবে? এ কারণেই আমরা কেউ তাঁকে নিতে রাজি হইনি।

এদিকে আমাদের কাফেলার প্রত্যেক মহিলাই কোন না শিশু পেয়ে গেল। আমি কোন শিশুই পেলাম না। ফেরার সময় স্বামীকে বললাম, খালি হাতে ফিরে যেতে ভালো লাগছে না। আমি বরং সেই শিশুকেই নিয়ে যাই। স্বামী রাজি হলেন, বললেন, হয়তো ওর ওছিলায় আল্লাহ পাক আমাদের বরকত দেবেন। এরপর আমি গিয়ে তাঁকে গ্রহণ করলাম।

হযরত হালিমা রাদি আল্লাহু আনহা বলেন, শিশুকে নিয়ে আমি যখন ডেরায় ফিরে এলাম তখন আমার উভয় স্তন ছিল দুধে পূর্ণ, শিশুটি পেট ভরে দুধ পান করল। তার সঙ্গে দুধ ভাইও পেট ভরে দুধ পান করলো। এরপর উভয়ে স্বস্তির সাথে ঘুমি পড়লো। অথচ এর আগে আমার সন্তান ক্ষুধার জ্বালায় ঘুমাতে পারত না। এদিকে আমার স্বামী উটনি দোহন করতে গিয়ে লক্ষ্য করল তার স্তন দুধে পরিপূর্ণ। তিনি এতো দুধ দোহন করলেন যে, আমরা তৃপ্তির সাথে পান করলাম। বড় আরামে আমরা রাত কাটালাম। সকালে আমার স্বামী বললেন, খোদার কসম, হালিমা তুমি একটি বরকত সম্পন্ন শিশু গ্রহণ করেছ। আমি বললাম, আমারও তাই মনে হয়।

হালিমা বলেন, এরপর আমাদের কাফেলা রওয়ানা হলো। আমি দুর্বল গাধার পিঠে সওয়ার হলাম। শিশুটি ছিল আমার কোলে। গাধা এতো দ্রুত পথ চললো যে সব গাধাকে সে ছাড়িয়ে গেল। সঙ্গিনী মহিলারা অবাক হয়ে বলল, ও আবু যোবায়েরের কন্যা, এটা কি আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের দিকে একটু তাকাও। যে গাধার সওয়ার হয়ে তুমি এসেছিলে এটা সেই গাধা? আমি বললাম হ্যাঁ সেটিই। তারা বলল, এর মধ্যে নিশ্চয়ই বিশেষ কোন ব্যাপার রয়েছে।

এরপর আমরা বনু সাদ গোত্রে নিজেদের ঘরে চলে এলাম। আমাদের এলাকার চেয়ে বেশি অভাবগ্রস্ত দুর্ভিক্ষ কবলিত অন্য কোন এলাকা ছিল কিনা অমি জানতাম না। আমাদের ফিরে আসার পর আমাদের বকরিগুলো চারণভূমিতে গেলে ভরা পেটে ভরা স্তনে ফিরে আসতো। আমরা দুধ দোহন করে পান করতাম। অথচ সে সময় অন্য কেউ দুধই পেতো না। তাদের পশুদের স্তনে কোন দুধই থাকতো না। আমাদের কওমের লোকেরা রাখালদের বলতো, হতভাগ্যের দল তোমরা তোমাদের বকরি সেই এলাকায় চরাও যেখানে যোবায়েরের কন্যা বকরি চরায়। কিন্তু তবুও তাদের বকরি খালি পেটেই ফিরে আসতো। একফোঁটা দুধও তাদের স্তনে পাওয়া যেতো না। অথচ আমার বকরিগুলো ভরাপেটে ভরা স্তন ফিরে আসতো। এমনি করে আমরা আল্লাহ পাকের রহমত ও বরকত প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। শিশুর বয়স দুই বছর হওয়ার পর আমরা তার দুধ ছাড়ালাম। অন্যান্য শিশুদের চেয়ে এই শিশু ছিলেন অধিক হ্নষ্টপুষ্ট এবং মোটাসোটা। এরপর আমরা শিশুটিকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলাম। আমরা তার কারণে বরকত প্রত্যক্ষ করেছিলাম তাই চাচ্ছিলাম যে শিশ আমাদের কাছেই থাকুক। শিশুর মায়ের কাছে আমি এ ইচ্ছার কথা জানালাম। বার বার আবেদন নিবেদন জানাতে বিবি আমেনা পুনরায় শিশুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬২, ১৬৩, ১৬৪)

সিনা চাকের ঘটনা

দুধ ছাড়ানোর পরও শিশু মোহাম্মদ বনু সাদ গোত্রই ছিলেন। তাঁর বয়স যখন চার অথবা পাঁচ বছর তখন সিনাচাক এর ঘটনাটি ঘটে। (অধিকাংশ সীরাত রচয়িতা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইবনে ইসহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিন বছর বয়সে এ ঘটনা ঘটেছিল। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৬৪.১৬৫ )

এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণীত রয়েছে। বর্ণীত আছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আগমন করলেন। এ সময় আল্লাহর রসুল শিশুদের সাথে খেলা করছিলেন। জিবরাইল তাঁকে শুইয়ে বুক চিরে দিল বের করলেন, তারপর দিল থেকে একটি অংশ বের করে বললেন, এটা তোমার মধ্যে শয়তানের অংশ। এরপর দিল একটি তশতরিতে রেখে যমযম কাপের পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেন। তারপর যথাযথ স্থানে তা স্থাপন করলেন। অন্য শিশুরা ছুটে গিয়ে বিবি হালিমার কাছে বলল, মোহাম্মদকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরিবারের লোকেরা ছুটে এলো। এসে দেখলো তিনি বিবর্ণমুখে বসে আসেন। (সহীহ মুসলিম, আল আসরা অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৯২)

মায়ের স্নেহে ও দাদার আদরে

এ ঘটনার পর বিবি হালিমা ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি শিশুকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। ছয় বচর বয়স পর্যন্ত তিনি মায়ের স্নেহ ছায়ায় কাটালেন। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৭ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ১৬৮)

এদিকে হযরত আমেনার ইচ্ছে হলো যে, তিনি পরলোকগত স্বামীর কবর যেয়ারত করবেন। পুত্র মোহাম্মদ, দাসী উম্মে আয়মন এবং শশুর মোত্তালেবকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রায় পাঁচ শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মদিনায় পৌঁছলেন। একমাস সেখানে অবস্থানের পর মক্কার পথে রওয়ানা হলেন। মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি আবওয়া নামক জায়গায় এসে বিবি আমেনা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্রমে এই অসুখ বেড়ে চললো। অবশেষে তিনি আবওয়ায় ইন্তেকাল করেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৮, তালকিছুল তুহুম, পৃ-৭, ফেকহুছ সীরাত, গাযযালী, পৃ-৫০)

বৃদ্ধ আবদুল মোত্তালেব পৌত্রকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় পৌঁছলেন। পিতৃ-মাতৃহীন পৌত্রের জন্য তাঁর মনে ছিল ভালোবাসার উত্তাপ। অতীতের স্মৃতিতে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। পিতৃ-মাতৃহীন পৌত্রকে তিনি যতোটা ভালোবাসতেন এতো ভালোবাসা তাঁর নিজে পুত্র কন্যা কারো জন্যই ছিলনা। ভাগ্যের পরিহাস, বালক মোহাম্মদ সে অবস্থায় ছিলেন একান্ত নি:সঙ্গ কিন্তু আবদুল মোত্তালেব তাঁকে নি:সঙ্গ থাকতে দিতেন না, তিনি পৌত্রকে অন্য সকলের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। ইবনে হিশাম লিখেছেন, আবদুল মোত্তালেবের জন্য কাবাঘরের ছায়ায় বিছানা পেতে দেয়া হতো। তাঁর সব সন্তান সেই বিছানার চারিকে বসতো। কিন্তু মোহাম্মদ গেলে বিছানায়ই বসতেন। তিনি ছিলেন অল্প বয়স্ক শিশু। তাঁর চাচা তাঁকে বিছানা থেকে সরিয়ে দিনে কিন্তু আবদুল মোত্তালেব বলতেন, ওকে সরিয়ে দিয়ো না। ওর মর্যাদা অসাধারণ। এরপর তাকে নিজের পাশে বসাতেন। শুধু বসানোই নয় তিনি প্রিয় দৌহিত্রকে সব সময় নিজের সাথে রাখতেন। বালক মোহাম্মদ কাজকর্ম তাঁকে আনন্দ দিতো। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৬৮)

বয়স আট বছর দুই মাস দশদিন পর তাঁর দাদার স্নেহের ছায়াও উঠে গেল। তিনি ইন্তেকাল করলেন। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের পুত্র আবু তালেবকে ওসিয়ত করে গেলেন, তিনি যেন তার ভ্রাতুষ্পুত্রর বিশেষভাবে যত্ন নেন। আবু তালেব এবং আবদুল্লাহ ছিলেন একই মায়ের সন্তান। (তালকিহুল ফুহুম, পৃ-৭, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৪৯)

চাচার স্নেহ বাৎসল্যে

আবু তালেব তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে গভীর স্নেহ-মমতার সাথে প্রতিপালন করেন। তাঁকে নিজ সন্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। বরং নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন, চল্লিশ বছরের বেশী সময় পর্যন্ত ভ্রাতুষ্পুত্রকে সহায়তা দেন। আবু তালেব প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রর স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই মানুষের সাথে শত্রুতা মিত্রতার বন্ধন স্থাপন করতেন।

আল্লাহর রহমতের সন্ধানে

ইবনে আসকের জলাহামা ইবনে আরাফাতের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, আমি মক্কায় এলাম। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টির ফলেই এর সৃষ্টি হয়েছে। কোরাইশ বংশের লোকেরা বৃষ্টির আশায় দোয়া করার জন্য আবু তালেবের কাছে আবেদন জানালো। আবু তালেব একটি বালককে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। বালকটি কে খে মেঘে ঢাকা সূর্য মনে হচ্ছিল। আশে পাশে অন্যান্য বালকও ছিল। আবু তালেব সেই বালককে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘরের সামনে গেলেন। বালকের পিঠ কাবার দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিলেন। বালক তাঁর তাতে আঙ্গুল রাখলো। আকাশে এক টুকরা মেঘও ছিল না। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সমগ্র আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল এবং মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। শহরে প্রান্তর সজীব উর্বর হয়ে গেল। পরবর্তীকালে আবু তালেব এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, তিনি সুদর্শন তার চেহারা থেকে বৃষ্টির করুণা প্রত্যাশা করা হয়। তিনি এতিমদের আশ্রয় তিনি বিধবাদের রক্ষাকারী। (মুখতাছারু সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৫-১৬)

পাদ্রী বুহাইরা

নবী মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের বয়স যখন বারো বছর মতান্তরে বারো বছর দুই মাস দশদিন হলো (তালকিহুল ফুহুম, ইবনে জওযি, পৃ-৭) তখন আবু তালেব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়ার রওয়ানা হলেন। বসরায় পৌছার পর এক জায়গায় তাঁবু স্থাপন করলেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী সেরা ছিল। সেই শহরে জারজিস নামে একজন পাদ্রী ছিলেন। তিনি বুহাইরা নামে পরিচিত ছিনে। কাফেলা তাঁবু স্থাপনের পরর বুহাইরা গির্জা থেকে বের হয়ে কাফেলার লোকদের কাছে এলেন এবং তাদের মেহমানদারী করলেন। অথচ পাদ্রী বাহাইরা কখনো তার গির্জা থেকে বের হতেন না। তিনি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনে ফেললেন এবং তাঁর হাত ধরে বললেন, তিনি সাইয়েদুল আলামিন। আল্লাহ পাক এঁকে রহমাতুল্লিল আলামিন হিসাবে প্রেরণ করবেন। আবু তালেব বুহাইরাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এটা কিভাবে বুঝলেন? তিনি বললেন, আপনারা এই এলাকায় আসার পর এই বালকের সম্মানে এখানকার সব গাছপালা এবং পাথর সেজদায় নত হয়েছে। এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করেনা। তাছাড়া মোহরে নবুয়তের দ্বারা আমি তাঁকে চিনত পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে নরম হাড়ের পাশে এটি সেব ফলের মতো মজুদ রয়েছে। তাঁর উল্লেখ আমরা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে দেখেছি।

এরপর পাত্রী বুহাইরা আবু তালেবকে বললেন, ওকে মক্কায় ফেরত পাঠিয়ে দিন। সিরিয়ার নেবেন না। ইহুদীরা ওর ক্ষতি করতে পারে। এ পরামর্শ অনুযায়ী আবু তালেব কয়েকজন ভৃত্যের সঙ্গে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-১৬, ইবনে হিশাম, পৃ-১৬, তিরমিযি সহ অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি হযরত বেলালের সাথে মক্কায় ফিরে যান, কিন্তু এটা ভুল। বেলালের তখনো জন্মই হয়নি। জন জন্ম হয়ে থাকলেও তিনি আবু বকরের সাথে পরিচিত ছিলেন না। যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ-১৭)।

ফুজ্জারের যুদ্ধ

নবী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বয়স যখন পনের বছর তখন ফুজ্জারের যুদ্ধ শুর হয়। ওই যুদ্ধে একদিকে কোরাইশ এবং তাদের সাথে ছিল বনু কেনানা অন্যদিকে ছিল কয়সে আয়নাল। কোরাইশ এবং কেনানার প্রধান ছিল হারব ইবনে উমাইয়া। বয়স এবং বংশ মর্যাদার কারণে কোরাইশদের নিকট সে সম্মানের পাত্র ছিল। বনু কেনানাও তাকে সম্মান করতো। যুদ্ধের প্রথম প্রহরে কেনানার ওপর কয়েসের পাল্লা ভারি ছিল। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই কয়েসের ওপর কেনানার পাল্লা ভারি হয়ে গেল। এই যুদ্ধকে ফুজ্জারের যুদ্ধ এ কারণেই বলা হয়, যেহেতু এই যুদ্ধ হরম এবং হারাম মাস উভয়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর চাচাদের হাতে তীর তুলে দিতেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৮৪-১৮৬. কলবে জাযিরাতুল আরব, পৃ-৩৬০, তারিখে খাযরামি, ১ম খন্ড, পৃ-৬৩)

হেলফুল ফুযুল

ফুজ্জারের যুদ্ধের পর নিষিদ্ধ ঘোষিত জিলকদ মাসে হেলফুল ফুযুল সংঘটিত হয়। কয়েকটি গোত্র যেমন কোরাইশ অর্থাৎ বনি হাশেম, বনি মোত্তালেব, বনি আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা, বনি যোহরা ইবনে কেলাব এবং বনু তাইম ইবনে মোররা এর ব্যবস্থা করেন। এর সবাই আবদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাইমের ঘরে একত্রিত হন। এরা বয়সে এবং আভিজাত্যে ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। এরা পরস্পর এ মমে অঙ্গীকার করলেন, যে মক্কায় সংঘটিত যে কোন প্রকার জুলুম অত্যাচার প্রতিরোধ করবেন।

হোক মক্কার অধিবাসী বা বাইরের কেউ-অত্যাচারিত হলে তার অত্যাচারের প্রতিকার করে তার অধিকার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ সমাবেশে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত ছিলেন। নবুয়ত পাওয়ার পর এ ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলতেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে এমন চুক্তিতে শরিক ছিলাম যার বিনিময়ে লাল উটও আমার পছন্দ নয়। ইসলামী যুগে সেই চুক্তির জন্য যদি আমাকে ডাকা হতো তবে আমি অবশ্যই হাযির হতাম। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৩৩-১৩৫, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ-৩০-৩১)

এ চুক্তির মূলে ছিল জাহেলী যুগের যাবতীয় বেইসনাফী দূরীকরণ। এ চুক্তির কারণ এটাই বলা হয়েছে যে, যোবায়েরের একজন লোক কিছু জিনিস নিয়ে মক্কায় এসেছিল আস ইবনে ওয়ায়েল তার নিকট থেক সেই জিনিস ক্রয় করে, কিন্তু তার মূল্য পরিশোধ করেনি। আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট জিনিস বিক্রেতা আবদুদ দার, মাখজুস, জামিহ, ছাহাম এবং আদীর আছে সাহায্যের আবেদন জানায়। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি। এরপর সেই লোকটি আবু কুরাইস পাহাড়ের উঠে উচ্চ স্বরে কয়েকটি কবিতা আবৃত্ত করলো সে কবিতায় তার প্রতি অত্যাচারের বর্ণনা করা হয়েছিল।

এতে যোবায়ের ইবনে আবদুল মোত্তালেব ছুটাছুটি শুরু করেন এবং বলেন, এই লোকটির প্রতি কোন সাহায্যকারী নেই কেন? তার চেষ্টায় উল্লেখিত কয়েকটি গোত্র একত্রিত হলো। প্রথমে তারা চুক্তি করলো এরপর আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট থেতে বিক্রীত পণ্যের মূল্য আদায় করে দিল। (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ-৩০-৩১)

সংগ্রামী জীবন যাপন

তরুণ বয়সে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের নিদিষ্ট কোন কাজ ছিল না। তবে বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তিনি বকরি চরাতেন। তিনি বনি সাদ গোত্রের বকরি চরাতেন। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-৬২, ১৬৬)

কয়েক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কার বিভিন্ন লোকের বকরিও তিনি চরাতেন। ()(সহীহ বোখারী, ১মৃ খন্ড, পৃ-৩০১) পঁচিশ বছর বয়সে তিনি হযরত খাদিজা রাদি আল্লাহু আনহার বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। ইনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, খাজিদা বিনতে খোয়াইলেদ একজন অভিজাত ধনবতী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন লোককে পণ্য কিনে দিতেন এবং সে সব পণ্য বিক্রি করতেন। লাভের একটা অংশ তিনি গ্রহণ করতেন। সমগ্র কোরাইশ গোত্রই ব্যবসা করতো। বিবি খাদিজা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামের সততা, সচ্চরিত্রতা এবং নম্রতার কথা শুনে তাঁকে ব্যবসায় নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠালেন। তিনি তাঁর ত্রীতদাস মায়ছারাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিলেন বিবি খাদিজা একথাও বললেন যে অন্য লোকদের যে পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লামকে তার চেয়ে বেশি পারিশ্রমিক দেবেন। আল্লাহর রাসুল এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং বিবি খাদিজার ব্যবসায়িক পণ্য তাঁর ক্রীতদাস মায়ছারাকে সাথে করে সিয়িয়া গেলেন। (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৮৭, ১৮৮)।

বিবি খাদিজার সাথে বিয়ে

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম বাণিজ্যিক সফর থেকে মক্কা ফিরে আসার পর বিবি খাদিজা লক্ষ্য করলেন, অতীতের চেয়ে এবার তাঁর অনেক বেশী হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ভৃত্য মায়ছারার কাছে আল্লাহর রসূলের উন্নত চরিত্র, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদির ভূয়সী প্রশংসা শুনলেন। এসব শুনে মনে মনে তিনি আল্লাহর রসুলকে ভালোবেসে ফেললেন। এর আগে বড় বড় সদার এবং নেতৃস্থানীয় লোক বিবি খাদিজাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু কোন প্রস্তাবই তিনি গ্রহণ করেননি। মনের গোপন ইচ্ছার কথা বিবি খাদিজা তাঁর বান্ধবী নাফিসা বিনতে মনব্বিহর কাছে ব্যক্ত করলেন। নাফিসা গিয়ে আল্লাহর রসুলের সাথে কথা বললেন। আল্লাহর রসুল রাযী হলেন এবং তার চাচার সাথে পরামর্শ করলেন। তাঁর চাচারা খাদিজার চাচার সাথে আলোচনা করনে এবং বিয়ের পয়গাম পাঠালেন। এরপর হয়ে গেল। এ বিয়েতে বনি হাশেম এবং মুজার গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।

সিরিয়া থেকে বাণিজ্যিক সফর শেষ করে ফিরে আসার দুই মাস পর এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আল্লাহর রসূল বিয়ের মোহরানা হিসাবে বিশটি উট দিয়েছিলেন। বিবি খাদিজার বয়স সে সময় ছিল চল্লিশ বছর। তিনি বিবেক বুদ্ধি, সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ, বংশ মর্যাদার ছিলেন শ্রেষ্ঠ নারী। বিবি খাদিজার সাথে আল্লাহর রসুলের এটা ছিল প্রথম বিবাহ। বিবি খাদিজা বেঁচে থাকা অবস্থায় আল্লাহর রসুল অন্য কারো সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৮৯, ১৯০, ফেকহুছ রীরাত পৃ-৫৯, তালকিছুল ফুহুম, পৃ-৭)

ইবরাহীম ব্যতীত রসুলুল্লাহ আলাইহিস ওয়াসাল্লামের সকল সন্তানে ছিল বিবি খাদিজার গর্ভজাত। সব প্রথম কাসেম জন্ম গ্রহণ করেন। এ কারণে আল্লাহর রসুলকে বলা হতো আবুল কাসেম বা কাসেমের পিতা। কাসেমের পর যয়নব, রোকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা এবং আবদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল্লাহর উপাধি ছিল তাইয়েব এবং তাহের। পুত্র সন্তান সকলেই শৈশবে ইন্তেকাল করেন। কন্যারা ইসলামের যুগে পেয়েছিলেন। তারা সকলেই ইসলাম গ্র্হণ করেন এবং হিজরতের গৌরব অর্জন করেন। হযরত ফাতেমা ছাড়া অন্য সকলেই রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর আব্বা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুমুখে পতিত হন। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ১৯০-১৯১, ফেকহুছ সীরাত পৃ, ৬০, তহুল বারী, সপ্তম খন্ড, পৃ-১০৫, ঐতিহাসিক তথ্যে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। যে তথ্য নির্ভুল মনে হয়েছে সে তথ্যই আমি উল্লেখ করেছি। )

কাবার নির্মাণ এবং হাজরে আসওয়াদের বিরোধ মীমাংসা

নবী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স যখন পঁয়ত্রিশ বছর সে সময় কোরাইশরা নতুন করে কাবাঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এ উদ্যোগের কারণ ছিল এই যে, কাবাঘর মানুষের উচ্চতার চেয়ে সামান্য বেশী উচ্চতা বিশিষ্ট চার দেয়ালে ঘেরা ছিল। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের জমানায়ই এসব দেয়ালের উচ্চতা ছিল নয় হাত এবং উপরের কোন ছাদ ছিল না। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত চোর ভেতরের সম্পদ চুরি করে। তাছাড়া নির্মাণের পর দীর্ঘকাল কেটে গেছে। ইমারত পুরনো হয়ে পড়েছিল এবং দেয়ালে ফাটল ধরেছিল। এদিকে সে বছর প্রবল প্লাবনও হয়েছিল, সেই প্লাবনের তোড় ছিল কাবাঘরের দিকে। এসব কারণে কাবারে যে কোন সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল কাবাঘরের দিকে। এসব কারণে কাবাঘর যে কোন সময় ধসে পড়ার আশংকা ছিল। তাই কোরাইশরা কাবাঘর নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো।

এ পর্যায়ে কোরাইশরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, কাবাঘরের নির্মাণ কাজে শুধু বৈধ উপায়ে অজিত অথই ব্যবহার করা হবে। এ সবের মধ্যে পতিতার উপার্জন, সুদের অর্থ এবং অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা কোন অর্থ সম্পদ ব্যবহার করা যাবে না।

কাবাঘর নতুন করে নির্মাণের জন্য পুরনো ইমারত ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কেউ ঘর ভাঙ্গার সাহস পাচ্ছিল না। অবশেষে ওলীদ ইবনে মুগিরা মাখযমি প্রথমে ভাঙ্গতে শুরু করলো। সবাই যখন লক্ষ্য করলো যে, ওলীদের ওপর কোন বিপদ আপতিত হয়নি তখন সবাই ভাঙ্গার কাজে অংশগ্রহণ করলো। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিমিত অংশও ভাঙ্গার পর নতুন করে নির্মাণ শুরু করলো। নির্মাণ কাজে প্রত্যেক গোত্রের অংশ নির্ধারিত ছিল এবং প্রত্যেক গোত্র কাজ শুরু করলো। বাকুম নামে এক রোমক স্থপতি নির্মাণ কাজ তদারক করছিল। ইমারত যখন হাজারে আসওয়াদ পর্যন্ত উঁচু হলো তখন বিপদ দেখা দিল য, এ পবিত্র পাথর কে স্থাপন করবে। এটা ছিল একটা পবিত্র বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত কাজ। চার পাঁচ দিন যাবত এ ঝগড়া চলতে থাকলো। এ ঝগড়া মারাত্মক রূপ ধারণ করলো যে খুন খারাবি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল। আবু উমাইয়া মাখজুমি এ বিবাদ ফয়সালার একটা উপায় এভাবে বের করলেন যে, আগামীকাল প্রত্যুষে মসজিদে হারামের দরোজা দিয়ে যিনি প্রবেশ করবেন তার ফায়সালা সবাই মেনে নেবে। এ প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করলো। পরদিন প্রত্যুষে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম কাবাঘরে প্রবেশ করলেন। এরপর তাঁকে বিচারক মনোনীত করা হলো। আল্লাহর রসুল একখানি চাদর মাটিতে নিজ হাতে সে চাদরের ওপর পাথর রাখলেন, তারপর বিবদমান গোত্রসমুহের সে চাদরের অংশ ধরে পাথর যথাস্থানে নিয়ে যেতে বললেন। তারা তাই করলেন। নির্ধারিত জায়গায় চাদর নিয়ে যাওয়ার পর আল্লাহর রসুল নিজ হাতে পাথর যথাস্থানে স্থাপন করলেন। এ ফায়সালা ছল অত্যন্ত বিবেক সম্মত এবং বুদ্ধিদীপ্ত। বিবদমান সকলেই এতে সন্তুষ্ট হলো। কারো কোন অভিযোগ রইল না।

এদিকে কোরাইশদের কাছে বৈধ অর্থের অভাব দেখা দিল। এ কারণে তারা উত্তর দিকে কাবার দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় হাত কমিয়ে দিল। এই অংশকে হেজর এবং হাতীম বলা হয়। এ পর্যায়ে কোরাইশরা কাবার দরোজা বেশ উঁচু করে দিলো যাতে একমাত্র তাদের অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তিই কাবাঘরে প্রবেশ করেতে পারে। দেয়াল সমহু পনের হাত উঁচু হওয়ার পর ভেতরে ছয় খুঁটি দাঁড় করিয়ে ওপর ছাদ ঢালাই করা হলো। নির্মাণ শেষে কাবাঘর চতুষ্কোণ আকৃতি লাভ করলো। বর্তমানে কাবাঘরের উচ্চতা পনের মিটার। যে অংশে হাজরে আসওয়াদ রয়েছে সে অংশের দেয়াল এবং তার সামনের অর্থাৎ উত্তরও দক্ষিণ অংশের দেয়াল দশ দশ মিটার উচ্চতা সম্পন্ন। হাজরে আসওয়াদ মাটি থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। যে দিকে দরোজা রয়েছে সেদিকের দেয়ার এবং সামনের দিকের অংশ পূব ও পশ্চিম দিকের দেয়াল থেকে বারো মিটার উচ্চ। দরোজা মাটি থেকে দুই মিটার উঁচু দেয়ালের ঘেরাও এর নীচে চারিদিক থেকে চেয়ারের আকৃতিবিশিষ্ট ঘেরাও রয়েছে। এর উচ্চতা পঁচিশ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ত্রিশ সেন্টিমিটার। এটাকে শাজরাওয়ান বলা হয়। এটাও প্রকৃতপক্ষে কাবাঘরের অংশ কিন্তু কোরাইশরা এ অংশের নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখে। (বিস্তারিত বিবরণের জন্য ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-১৯২, ১৯৭, ফেকহুস সীরাত ৬২, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-১, ২, , ১৫)

নবুওয়তের আগের জীবন

বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যেসব গুণ বৈশিষ্ট্য বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায় রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে এককভাবেই সেই সব গুণবৈশিষ্ট ছিল। সেগুলো ছিলো দূরদর্শিতা, সত্যপ্রিয়তা এবং চিন্তাশীলতার এক সুউচ্চ মিনার। চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, পরিপক্বতা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পবিত্রতা তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। দীঘ সময়ের নীরবতায় তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর সাহায্য পেতেন। পরিচ্ছন্ন মাজিত সুন্দর বুদ্ধি, উন্নত স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মানুষের জীবন সম্পর্কে বিশেষত জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে ধ্যান করেছিলেন। এ ধ্যানের মাধ্যমে মানুষকে যে সকল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত দেখলেন, এতে তাঁর মন ঘৃণায় ভরে উঠল। তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হলেন। পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত মানুষ থেকে তিনি নিজেকে দুরে রাখলেন। মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেয়ার পর মানব কল্যাণ যতোটা সম্ভব অংশগ্রহণ করতেন বাকি সময় নিজের প্রিয় নির্জনতার ভুবনে ফিরে যেতেন। তিনি কখনো মদ স্পর্শ করেন নি, আস্তানায় যবাই করা পশুর গোশত খাননি, মূর্তির জন্য আয়োজিত উৎসব, মেলা ইত্যাদিতে কখনোই অংশগ্রহণ করেননি।

শুরু থেকে তিনি মূর্তি নামের বাতিল উপাস্যদের অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। এতো বেশি ঘৃণা তাঁর অন্য কিছুর প্রতি ছিল না। লাত এবং ওযযার নামে শপথও তিনি সহ্য করতেন পারতেন না। (বুহাইরার ঘটনায় এর প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১২৮)

তকদীর তাঁর ওপর হেফাযতের ছায়া ফেলে রেখেছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। পার্থিব কোন কিছু পাওয়ার জন্য যখন মন ব্যাকুল হয়েছে, অথর্ব অপছন্দনীয় রুসম রেওয়াজের অনুসরণের জন্য মনে ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে তখন আল্লাহ পাক তাঁকে সেসব থেকে দুর সরিয়ে রেখেছিলেন।

ইবনে আছিরের এক বর্ণনায় রয়েছে রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করতো, দুবারের বেশি কখনো সেসব কাজ করার ইচ্ছে আমার হয়নি। সেই দুটি কাজেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে।

এরপর সে ধরনের কাজের ইচ্ছা কখনোই আমার মনে জাগেনি। ইতিমধ্যে আল্লাহ পাক আমাকে নবুয়তের গৌরবান্বিত করেছেন। মক্কার উপকণ্ঠে যে বালক আমার সাথে বকরি চরাতো একদিন তাকে বললাম, তুমি আমার বকরিগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য রাখতে তবে আমি মক্কায় গিয়ে অন্য যুবকদের মতো রাত্রিকালের গল্প গুজবের আসরে অংশ নিতাম। রাখাল রাযী হলো। আমি মক্কার দিকে রওয়ানা দিলাম। প্রথম ঘরের কাছে গিয়ে বাজনার আওয়াজ শুনলাম। জিজ্ঞাসা করায় একজন বলল, অমুকের সাথে অমুকের বিবাহ বিবাহ হচ্ছে। আমি শোনার জন্য বসে পড়লাম। আল্লাহ পাক আমার কান বন্ধ করে দিলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রোদের আঁচ গায়ে লাগার পর আমার ঘুম ভাঙ্গলো। আমি তখন মক্কার উপকণ্ঠে সেই রাখালের কাছে ফিরে গেলাম। সে জিজ্ঞাসা করার পর সব কথা খুলে বললাম। আরো একদিন একিই রকমের কথা বলে রাখালের নিকট থেকে মক্কায় পৌঁছলাম কিন্তু প্রথমোক্ত রাতের মতই ঘটনা ঘটলো। এরপর কখনো ঐ ধরনের ভুল ইচ্ছা আমার মনে জাগ্রত হয়নি (হামেম যাবাবি এ হাদিসকে সহীহ বলেছেন, ইবনে কাছির তাঁর রচিত আল বেদয়া ওয়ান নেহায়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ২৮৭ পৃষ্টায় এই হাদিসকে যঈফ অর্থাৎ দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন)।

সহীহ বুখারী শরীফে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বনিত আছে যে, কাবাঘর যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন নবী করিম রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আব্বাস পথর ভাঙ্গছিলেন। হযরত আব্বাস আল্লাহর রসুলকে বললেন, তহবন্দ খুলে কাঁধে রাখো, পাথরের ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সাথে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তারপর আকাশের প্রতি তাকালেন এবং বেহুশ হয়ে গেলেন, খানিক পরেই হুশ ফেরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ আমার তহবন্দ। এরপর তাঁর তহবন্দ তাঁকে পরিয়ে দেয়া হয়। এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, এ ঘটনার পর আর কখনো তাঁর লজ্জাস্থান দেখা যায়নি। (সহীহ বোখারী, বাবে বুনিয়ানুল কাবা, ১ম খন্ড, পৃ.৫৪০)

নবী করিম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসনীয় কাজ, উন্নত সুন্দর চরিত্র এবং মাধুর্য মণ্ডিত স্বভাবের কারণে স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন সেকলের চেয়ে অধিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, উন্নত চরিত্রের অধিকারী, সম্মানিত প্রতিবেশী, সর্বাধিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন, সকলের চেয়ে অধিক সত্যবাদী, সকলের চেয়ে কোমল প্রাণ পবিত্র পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী। ভালো কাজে ভালো কথায় তিনি ছিলেন সকলের চেয়ে অগ্রসর এবং প্রশংসিত। অঙ্গীকার পালন ছিলেন সকলের চেয়ে অগ্রণী। আমানতদারীর ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়। স্বজাতির লোকেরা তার নাম রেখেছিলেন আল-আমিন। তিনি ছিলেন প্রশংসনীয় গুণ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়। হযরত খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা সাক্ষ্য দিয়েছেন য, তিনি বিপদ গ্রস্তদের বোঝা বহন করতেন, দু:খী দরিদ্র লোকদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতেন, মেহমানদারি করতেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করতেন। (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৩)

(আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে ওহী পাঠিয়ে বললেন) হে কম্বল আবৃত (মোহাম্মদ), উঠো তোমার শয্যা ছেড়ে দুনিয়ার মানুষদের ঈমান না আনার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করো এবং তুমি নিজে তোমার মালিকের মাহাত্য বর্ণনা করো। (সুরা মোদ্দাসসের-১-৩)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি