নিজ ঘরে তিনি পরদেশীঃ যুলুম নিপীড়নের তের বছর
দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায়

রিসালাতের ছায়ায় হেরাগুহার অভ্যন্তরে

মোহাম্মদ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স চল্লিশ বছরের কাছাকাছি হলো। তাঁর পরিচ্ছন্ন অনমনীয় ব্যক্তিত্বের কারণে স্বজাতীয়দের সাতে মানসিক ও চিন্তার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেল। এ অবস্থায় রসুল নিঃসঙ্গতা প্রিয় হয়ে উঠলেন। ছাতু এবং পানি নিয়ে তিনি মক্কা থেকে দুই মাইল দুরে অবস্থিত হেরা পাহাড়ের গুহা গিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। এটি একটি ছোট গুহা, এর দীর্ঘ চার গজ প্রস্ত পৌনে দুই গজ। নীচেরদিকে গভীর নয়। ছোট একটি পথের পাশে ওপরের প্রান্তরের সঙ্গমস্থলে এ গুহা অবস্থিত। প্রিয় রসুল এই গুহায় যাওয়ার পর বিবি খাদিজাও তাঁর সঙ্গে যেতেন এবং নিকটবর্তী কোন জায়গায় অবস্থান করতেন। প্রিয় রসুল পুরো রমযান মাস এই গুহায় কাটাতেন। জগতের দৃশ্যমান এবং এর পেছনে কাজকর্ম কুদরতের কারিশমা সম্পর্কে চিন্তা করতেন। স্বজাতির লোকদের মূর্তি পূজা এবং নোংরা জীবন যাপন দেখে তিনি শানিত পেতেন না। কিন্তু তাঁর সামনে সুস্পষ্ট কোন পথ সুনির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি, প্রচলিত অবস্থার বিপরীত কোন কর্মসূচী ছিল না যার ওপর জীবন কাটিয়ে তিনি মানসিক স্বস্তি ও শান্তি লাভ করতে পারেন। (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম, খন্ড, পৃ৪৭, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ-২৩৫, ২৩৬, তাফসির ফি যিলালিল কোরআন-সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পৃ-২৯, ৬৬) রসুলের এ নিঃসঙ্গ প্রিয়তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পাকের হেকমতের একটি অংশ। এমনি করে আল্লাহ পাক তাঁকে ভবিষ্যতের গুরুদায়িত্বের জন্য তৈরি করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধান দিয়ে যিনি জীবন ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হবেন, তিনি পারিপার্শ্বিক হৈ চৈ হট্টগোল থেকে দুরে নির্জনতায় কোলাহলমুক্ত পরিবেশ কিছুকাল থাকবেন এটাই স্বাভাবিক।

এই নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহ পাক ধীরে তাঁর প্রিয় রসুলকে আমানতের বিরাট বোঝা বহনের এবং বিশ্ব মানবের জীবন ধারায় পরিবর্তনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য তৈরি করছিলেন। তাঁকে আমানতের জিম্মাদারি অর্পণের তিন বছর আগে নিজনে ধ্যান করা তাঁর জন্য আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। এই নির্জনতায় কখনো এক মাস পর্যন্ত তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আধ্যাত্মিক রূহানী সফরে তিনি সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতেন, গবেষণা করতেন, যাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পেলে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। (তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, পারা ২৯, পৃ-১৬৬-১৬৭, স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে এটা তাফসীরের আরবী সংস্করণের পৃষ্ঠা। বাংলাদেশ আল কোরআন একাডেমী লন্ডন এর যে বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন তার পৃষ্ঠা এর সাথে নাও মিলতে পারে। )

ওহী নিয়ে জিবরাইলের আগমন

চল্লিশ বছর বয়স হচ্ছে মানুষের পূর্ণতার পরিপক্বতার বয়স। পয়গম্বররা এই বয়সেই ওহী লাভ করে থাকেন। প্রিয় রাসুলের বয়স চল্লিশ হওয়ার পর তাঁর জীবনের দিগন্তে নবুয়তের নিদর্শন চমকাতে লাগলো। এই নিদর্শন প্রকাশ পাচ্ছিল স্বপ্নের মাধ্যমে। এ সময় প্রিয় রসুল যে স্বপ্ন ই দেখতেন সেই স্বপ্ন শুভ্র সকালের মতো প্রকাশ পেতো। এ অবস্থায় ছয়মাস কেটে গেল। এ সময়টুকু নবুয়তের সময়ের ৪৬তম অংশ এবং নবুয়তের মোট মেয়াদ হচ্ছে তেইশ বছর। হেরা গিরি গুহার নির্জন বাসের তৃতীয় বছরই আল্লাহ পাক জগতবাসীকে তাঁর করুনাধারায় সিঞ্চিত করতে চাইলেন। আল্লাহ পাক তখন তাঁর প্রিয় রসুলকে নবুয়ত দান করলেন। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত নিয়ে হাযির হলেন। (হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী লিখেছেন, বায়হাকী উল্লেখ করেছেন যে, স্বপ্ন দেখার মেয়াদ ছিল ছয় মাস। অর্থাৎ ছয় মাস যাবত বিভিন্ন সময়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন। কাজেই স্বপ্নের মাধ্যমে নবুয়তের সূচনা চল্লিশ বছর পূর্তির পর রবিউল আওয়াল মাসে হয়েছিল। এ মাস ছিল প্রিয় রসুলের জন্মের মাস। জাগ্রতাবস্থায় তাঁর কাছে প্রথম ওহী এসেছিল রমযান মাসে। (ফতহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃ-২৭)

ইতিহাসের যুক্তি প্রমাণ এবং কোরআনসহ বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, প্রথম ওহী এসেছিল রমযান মাসের ২১ তারিখ সোমবার রাতে। চান্দ্র মাসের হিসাব মোতাবেক সে সময় রসুল করিম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বয়স ছিল ৪০ বছর ৬ মাস ১২দিন।

ওহী নাযিলের সময়ে তাঁর বয়স

প্রিয় নবী কি মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। অধিকাংশ রীরাত রচয়িতার মতে প্রিয় রসল রবিউল আউয়াল মাসে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। কেই কেউ বলেছেন রমযান মাসে আবার কেউ কেউ বলেছেন রজব মাসে। দেখুন মুখতাছারুছ সিরাত, রচনা শেখ আবদুল্লাহ ১ম খন্ড, পৃ. ৭৫। আমার বিবেচনায় তা ছিল রমযান মাসে। ওহী নাযিল হওয়া অর্থাৎ নবুয়ত লাভ করার কথাই ঠিক। কেননা কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন, রমযান মাসেই কোরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ পাক আরো বলছেন, শবে কদরে কোরআন নাযিল করো হয়েছে। শবে কদর তো রমযান মাসেই হয়ে থাকে। আল্লাহ পাক আরো বলেছেন, আমি একটি বরকতময় রাতে কোরআন নাযিল করেছি এবং আমি লোকদের আযাবের আশঙ্কা সম্পর্কে অবহিত করি। রমযান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার পক্ষে এ যুক্তিও রয়েছে যে, রসুল হেরা গুহায় রমযান মাসে ধ্যান করতেন। হযরত জিবরাইল (আ:)হেরা গুহায়ই এসেছিলেন।

যারা রমযান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ার উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রমযানের কতো তারিখে কোরআন নাযিল হয়েছিল এ ব্যাপারে আবার মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন সাত তারিখ, কেউ বলেন আঠারো তারিখ (মুখতাছারুস সীরাত ১ম খন্ড পৃ. ৭৫. রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড পৃ. ৪৯ দেখুন, আল্লামা হাযরামি লিখেছেন, সতের তারিখেই নির্ভুল।

(তারিখে হাযরামি ১ম খন্ড, পৃ-৬৯, এবং তারিখে আতৃতাশারিহ আল ইসলামী পৃ.৫, ৬, ৭ দেখুন।) আমি এ ব্যাপারে ২১ শে রমযান তারিখকে প্রাধান্য দিয়েছি। অথচ কে ২১শে রমযান কোরান নাযিল শুরু বলে উল্লেখ করেননি। আমার যুক্তি হচ্ছে যে, অধিকাংশ সীরাত রচয়িতার মতে রসুলের আবির্ভাব ঘটেছিল সোমবার দিনে। হযরত কাতাদা রা: বর্ণীত একটি হাদিসেও এর প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রিয় রসুলকে সোমবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এই দিনে আমাকে নবুয়ত দেয়া হয়েছে। সহি মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ-৩৬৮ মুসনাদে আহমদ ৫ম খন্ড, পৃ-২৯৭, ২৯৯, বায়হাকী ৪থ খন্ড, পৃ. ২৮৬, ৩০০ হাকেম ২য় খন্ড, পৃ-২, ৬। সেই বছর রমযান মাস সোমবার পড়েছিল। ৭, ১৪, ২১ এবং ৮ তারিখে। সহীহ বর্ণনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শবে কদর রমযান মাসের বেজোড় রাতে হয়ে থাকে এবং বেজোড় রাতেই আবর্তিত হয়। আল্লাহ পাক বলেছেন, শবে কদরে কোরআন নাযিল হয়েছে, যে, বছর তিনি নবুয়ত পেয়েছেন সে বছরের সোমবারসমুহ পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত পৌছা যায় যে, তিনি ২১শে রমযান সোমবার জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তারিখেই নবুয়ত লাভ করেন।

আসুন, হযরত আয়েশার (রা) যবানীতে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শোনা যাক। কোরআন নাযিল ছিল এক অলৌকিক আলোকে শিখার আবির্ভাব, সেই আলোকে শিখার সফল গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকার তিরোহিত হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের গতিধারা এই ঘটনায় বদলে গিয়েছিল।

হযরত আয়েশা (রা) বলেন, প্রিয় রসুলের ওপর নাযিলের সূচনা স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছিল। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন সে স্বপ্ন শুভ্র সকালের মত প্রকাশ পেতো। এরপর তিনি নির্জনতা প্রিয় হয়ে যান। তিনি হেরা গুহায় এবাতদ বন্দেগীতে কাটাতে কাটাতে থাকেন এবং এ সময় একাধারে কয়েকদিন ঘরে ফিরতেন না। পানাহার সামগ্রী শেষ হয়ে গেলে সেসব নেয়ার জন্য পুনরায় বাড়িতে ফিরতেন। এমনি করে এক পর্যায়ে হযরত জিবরাইল (আ:) তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, পড়ো। তিন বললেন, আমি পড়তে জানিনা। ফেরেশতা তাঁকে বুকে জড়িয়ে থরে সজোরে চাপ দিলেন, পড়ো। তিন বলেন, আমার সব শক্তি যেন নিংড়ে নেয়া হলো। এরপর ফেরেশতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো। তিনি বললেন, আমি তো পড়তে জানি না। পুনরায় ফেরেশতা আমাকে বুকে জড়িয়ে চাপ দিলেন।

এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ো, তৃতীয়বার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, পড়ো ইকরা বে-ইসমে রারিব্বকাল্লাযি খালাক। (আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়ালাম পর্যন্ত নাযিল হয়েছিল। ) অর্থাৎ পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।

এই আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর প্রিয় নবী ঘরে ফিরে এলেন। তার বুক ধুকধুক করছিল। স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদকে বললেন, আমাকে চাদর গিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। বিবি খাদিজা প্রিয় নবীকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। তার ভয় কেটি গেল।

এরপর বিবি খাদিজাকে সব কথা খুলে বলে প্রিয় রসুল বললেন, আমার কি হয়েছে? নিজের জীবনের আমি আশংকা করছি। বিবি খাদিজা তাঁকে অভয় দিয়ে বললেন, আল্লাহ পাক আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করেন, বিপদগ্রস্ত লেকদের সাহায্য করেন মেহমানদারী করেন, সত্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করন।

বিবি খাদিজা এরপর প্রিয় নবীকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে নিয়ে গেলেন। ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আবদুল ওযযা আইয়ামে জাহেলিয়াতে ঈসায়ী ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় লিখতে জানতেন। যতোটা আল্লাহ পাক তওফিক দিতেন হিব্রু ভাষায় ততোটা ইঞ্জিল তিনি লিখতেন। সে সময় তিন ছিলেন বয়সের ভোরে ন্যুজ এবং দৃষ্টিহীন। বিবি খাদিজা বললেন, ভাইজান, আপনি আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা বললেন, ভাতিজা তুমি কি দেখেছ?

রসূল (সা.) যা যা দেখেছেন সব তাকে খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, তিনি সেই দূত যিনি হযরত মুসার (আ) কাছে এসেছিলেন। হায় যদি আমি সেই সময় বেঁচে থাকতাম যখন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রসুল অবাক হয়ে বললেন, তবে কি আমার কওম আমাকে সত্যি সত্যিই বের করে দেবে, ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ তুমি যে ধরনের বাণী লাভ করেছো এ ধরনের বাণী যখনই কেউ পেয়েছে তার সাথে শত্রুতা করা হয়েছে। যদি আমি বেঁচে থাকি তবে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো। এর কিছুকাল পরই ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন। এরপর হঠাৎ ওহীর আগমন বন্ধ হয়ে যায় [সহীহ বোখারীতে কিভাবে ওহী নাযিল হয়েছিল, (১ম খন্ড, পৃ-২, ৩) অধ্যায়ে ঈষৎ পরিবর্তিতভাবে এই বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে]

তাবারী এবং ইবনে হিশামের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ওহী নাযিল বন্ধ হওয়ার সময়েও তিনি হেরা গুহায় কিছুকাল অবস্থান করেন এবং নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করেন এরপর মক্কায় ফিরে যান। তাবারীর বর্ণনায় রসুলের ঘর থেকে বের হওয়ার ওপরও আলোকপাত করা হয়েছে। এ বর্ণনা নিম্নরূপ।

ওহী আসার পরের মানসিক অবস্থা আলোচনা কেরতে গিয়ে রসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর মখলুকের মধ্যে কবি এবং পাগল ছিল আমার সবচেয়ে ঘৃণিত। প্রচণ্ড ঘৃণার কারণে এদের প্রতি চোখ তুলে তাকাতেও আমার ইচ্ছা হত না। ওহী আসার পর আমি মনে মনে বললাম, কোরাইশরা আমাকে কবি বা পাগল বলবেন তো? এরূপ চিন্তার পর আমি পাহাড় চুড়ার উঠে নীচে নামিয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তা করলাম। এমনকি এক পাহাড়ে উঠলামও। পাহাড়ের মাঝামাঝি ওঠার পর হটাৎ আসমান থেকে আওয়াজ এলো, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল। আমি জিবরাঈল। প্রিয় রসুল বলেন এই আওয়াজ শোনার পর আকাশের প্রতি তাকালাম। দেখলাম জিবরাঈল মানুষের আকৃতি ধরে দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, হে মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল, আমি জিবরাঈল বলছি। রসুল বলেন, আমি থমকে দাঁড়িয়ে সেখানে যেতে পারছিলাম না পেছনে ও যেতে পারছিলাম না। আকাশের যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম সেদিকেই জিবরাঈলকে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যে খাদিজা আমার খোজে লোক পাঠালেন। খুঁজে তিনি মক্কায় ফিরে এসেছেন।

জিবরাঈল চলে যাওয়ার পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এলাম। খাদিজার উরুর পাশে হেলান দিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, আবুল কাশেম, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনার খোঁজে আমি একজন লোক পাঠিয়েছি যে মক্কায় গিয়ে খুঁজে এসেছে আপনাকে পায়নি। আমি তখন যা কিছু দেখেছিলাম খাদিজাকে সে কথা বললাম। তিনি বললেন, হে আমার চাচাতো ভাই, আপনি খুশি হোন এবং দঢ়পদ থাকুন, আমার আশা আপনি এই উম্মতের নবী হবেন। এরপর তিনি ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে গেলেন। তাঁকে সব কথা শোনালেন। তিনি সব শুনে বললেন, সেই সত্তার শপথ যাঁর হাতে ওয়ারাকার প্রাণ রয়েছে, তাঁর কাছে সেই ফেরেশতা এসেছেন, যিনি হযরত মুসার আ) কাছে এসেছিলেন। মোহাম্মদ এই উম্মতের নবী। তাঁকে বলবে তিনি যেন দঢ়পদে থাকেন।

এরপর হযরত খাদিজা ফিরে এসে রসুলকে ওয়ারাকার কথা শোনালেন। প্রিয় নবী, হেরা গুহায় তাঁর অবস্থানের মেয়াদ পূর্ণ করে মক্কায় আসেন। এ সময় ওয়ারাকা ইবনে নওফেল তাঁর প্রাণ রয়েছে, আপনি হচ্ছেন এই উম্মতের নবী। আপনার কাছে সেই বড় ফেরেশতা এসেছেন যিনি হযরত মুসার (আ ) কাছে এসেছিলেন। (হিযাব, পৃ-২০৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ২৩৭, ২৩৮, এ বর্ণনা সত্যতা সম্পর্কে আমি অবশ্য দ্বিধান্বিত। ওয়ারাকার সাথে আলোচনার ঘটনা ওহী আসার পরই ঘটেছিল। বোখারী কণিত হাদিসে পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্ত পৌছতে হয় যে, ওয়ারাকার সাথে আলোচনা মক্কায় ওহী প্রাপ্তির পরই হয়েছিল। )

সাময়িকভাবে ওহীর আগমন স্থগিত

ঐ সময়ে ওহীর আগমন কতদিন যাবত স্থগিত ছিল? এ সম্পর্কে ইবনে সাদ হযরত ইবনে আব্বাসের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এতে উল্লেখ রয়েছে যে, ওহী কয়েকদিনর জন্য স্থগিত ছিল। সবদিক বিবেচনা করলে এ বর্ণনাই যথার্থ মনে হয়। একটা কথা বিখ্যাত রয়েছে যে, আড়াই বছর বা তিন বছর ওহী স্থগিত ছিল, এই বিবরণ সত্য নয়। এ সম্পর্কিত যুক্তি প্রমাণ সম্পর্কে এখানে আলোচনার দরকার নেই। (১১ নং টীকায় এ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। )

ওহী স্থগিত থাকার সময়ে প্রিয় রসুল বিষণ্ণ এবং চিন্তাযুক্ত থাকতেন। তিনি মানসিক অস্থিরতা এবং উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। সহীহ বোখারী শরীফের কিতাবুত তাবীর এর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, ওহীর আগমন স্থগিত হওয়ার পর প্রিয় রসুল এতোটা অস্থিরতা এবং চিন্তার মধ্যে ছিলেন যে কয়েকবার উচু পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছিলেন যেখান থেকে লাফিয়ে নীচে পড়বেন। কিন্তু পাহাড় ওঠার পর জিবরাঈল আসতেন এবং বলতেন হে, মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর প্রিয় রসুল। এ কথা শোনার পর তিনি থমকে দাঁড়াতেন? তাঁর উদ্বেগ অস্থিরতা কেটে যেতো। প্রশান্ত মনে তিনি ঘরে ফিরে আসতেন। পুনরায় ওহী ন আসার কারণে তিনি স্থির হয়ে উঠতেন। সেখানে জিবরাঈল এসে হাযির হতেন এবং বলতেন হে মোহাম্মদ আপনি আল্লাহর রসুল। (সহীহ বোখারী কিতাবুত তাবির, রুইয় সালেহা ২খ খণ্ড, পৃ-১০৩৪। )

ওহী নিয়ে পুনরায় জিবরাঈলের আগমন

হাফেজ ইবনে হাজার লিখেছেন ওহী কিছুকাল স্থগিত থাকার কারণ ছিল এই যে, তিনি যে ভয় পেয়েছিলেন সই ভয় যেন কেটে যায় এবং পুনরায় ওহী প্রাপ্তির আগ্রহ এবং প্রতীক্ষা যেন তাঁর মনে জাগে। (ফতহুল বারী, ১ম খন্ড, পৃ-২৭)

বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাওয়ার পর, বাস্তব অবস্থা তার সামনে প্রকাশ পেলো, তিনি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন যে, তিনি আল্লাহ পাকের নবী হয়েছেন। তিন আরো বুঝতে সক্ষম হলেন যে, তাঁর কাছে যিনি এসেছিলেন তিনি ওহীর বাণী বহনকারী, আসমানী সংবাদবাহক। এইরূপ বিশ্বাস তাঁর মনে দৃঢ় হওয়ায় পর তিনি আগ্রহের সাথে ওহীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাঁকে দৃঢ় হয়ে থাকতে হবে এবং এ দায়িত্ব বহন করতে হবে। মানসিক অবস্থার এ পর্যায়ে হযরত জিবরাঈল (আ ) পুনরায় এসে হাযির হলেন। সহীহ বোখারী শরীফে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি প্রিয় নবীর মুখে ওহী স্থগিত হওয়ার বিবরণ শুনেছেন। রসুলে বলেছেন, আমি পথ চলছিলাম, হটাৎ আকাশ থেকে একটি আওয়াজ শোনা গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ফেরেশতা যিনি হেরা গুহায় আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আসমান জমিনের মাঝখানে একখানি কুর্সিতে বসে আসেন। আছেন। আমি ভয় পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এরপর বাড়ীতে এসে আমার স্ত্রীর কাছে বললাম, আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও। স্ত্রী আমাকে চাদর জড়িয়ে শুইয়ে দিলেন। এরপর আল্লাহ পাক সুরা মোদদাসসের এর ‘অররুজযা ফাহজুর’ পর্যন্ত নাযিল করেন এ ঘটনার পর থেকে ঘন ঘন ওহী নাযিল হতে থাকে। (সহীহ বোখারী কিতাবুত তাফসীর অধ্যায় ওয়ার রুজযা ফাহজুর ২য় খন্ড পৃ-৭৩৩। এ বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, রসুল বলেছেন, আমি হেরা গুহায় এতেকাফ করেছি। এতেকাফ পূর্ণ করার পর নীচে এলাম। এরপর আমি যখন প্রান্তর ধরে অগ্রসর হচ্ছিলাম তখন আমাকে ডাকা হলো। ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই ফেরেশতা। —-। সীরাত রচয়িতাদের সকল বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রসুল তিনি বচর রমযান মাসে হেরা গুহায় এতেকাফ করেন। তৃতীয় রমযানে তাঁর কাছে জিবরাঈল ওহী নিয়ে আসেন। তিনি রমযানের পুরো মাস এতেকাফ করে১ম শাওয়াল খুব ভোরে মক্কায় ফিরে আসতেন। উল্লেখিত রেওয়োতের সাথে এ বিবরণ সংযুক্ত করলে এ সিদ্ধান্তে পৌছা যায় যে, সুরা মোদ্দাসসেরের প্রথম অংশের ওহী-প্রথম ওহীর দশদিন পর নাযিল হয়েছিল। অর্থাৎ ওহী স্থগিত থাকার মেয়াদ দিল দশদিন)

ওহীর বিভিন্ন রকম

প্রিয় নবীর ওপর ওহী নাযিল হওয়ার পর অর্থাৎ তিনি নবুয়ত পাওয়ার পর তাঁর যে জীবন শুরু হয় সে আলোচনায় যাওয়ার আগে ওহীর বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে অলোকপাত করা দরকার। এতে রিসালাত ও নবুয়ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়া যাবে। আল্লামা ইবনে কাইয়মে নিম্নোক্ত কয়েক প্রকারের ওহীর কথা উল্লেখ করেছেন,

এক. সত্য স্বপ্ন-স্বপ্নের মাধ্যমে রসুলের ওহী নাযিল।

দুই. ফেরেশতা তাঁকে দেখা না দিয়ে তাঁর মনে কথা বসিয়ে দিতো। যেমন প্রিয় নবী বলেছেন যে, রুহুল কুদুস আমার মনে একথা বসিয়ে দিলেন যে, কোন মানুষ তার জন্য নির্ধারিত রেযেক পাওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করে না। কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং ভালো জিনিস তালাস করো। রেযেক পেতে হলে আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে রেকে তালাক করোনা। কেননা আল্লাহর কাছে যা কিছু রয়েছে সেটা তাঁর আনুগত্য ছাড়া পাওয়া যায় না।

তিন. ফেরেশতা মানুষরে আকৃতি ধরে তাকে সম্বোধন করতেন। তিনি যা কিছু বলতেন প্রিয় রসুল সেসব মুখস্থ করে নিতেন। এ সময় কখনো কখনো সাহাবিরাও ফেরেশতাদের দেখতে পেতেন।

চার. রসুলের কাছে ওহী ঘণ্টাধ্বনির মতো টন টন শব্দ আসতো। এটি ছিল ওহীর সবচেয়ে কঠোর অবস্থা। এ সময় ফেরেশতা তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং প্রচণ্ড শীতের মওসুম হলেও প্রিয় নবী ঘেমে যেতেন। তাঁর কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়তো। তিনি উটের ওপর সওয়ার থাকলে মাটিতে বসে পড়তেন। একবার হযরত যায়েদ ইবনে সাবেতের উরুর ওপর তাঁর উরু থাকা অবস্থায় ওহী এলো, হযরত যায়েদ এতো ভারি বোধ করলেন যে, তাঁর উরু থেঁতলে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।

পাঁচ. তিনি ফেরেশতাকে তার প্রকৃত চেহারায় দেখতেন। সেই অবস্থায়ই আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর ওপর নাযিল হতো। দুবার এরূপ হয়েছিল। পাক সুরা নাজম এ আল্লাহ পাক সেকথা উল্লেখ করেছেন।

ছয়. মেরাজের রাতে নামায ফরয হওয়া এবং অন্যান্য বিষয়ক ওহী আকাশে নাযিল হয়েছিল। প্রিয় নবী তখন আকাশে ছিলেন।

সাত. ফেরেশতার মাধ্যমে ছাড়া আল্লাহ পাকের সরাসরি কথা বলা। হযরত মুসা (আ) সাথে আল্লাহ পাক যেমন কথা বলেছিলেন। হযরত মুসার সাথে আল্লাহর কথা বলার প্রমাণ কোরআনে রয়েছে। প্রিয় নবীর সাথে আল্লাহর কথা বলার প্রমাণ মেরাজের হাদিসে রয়েছে।

আট. একটি প্রকার কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। এটি হচ্ছে আল্লাহ পাকের মুখোমুখি পর্দা বিহীন অবস্থায় কথা বলা। কিন্তু এ ব্যাপারে মত পার্থক্যের অবকাশ রয়েছে (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ-১৮)।

তাবলীগের নির্দেশ

সুরা মোদ্দাসসের-এর প্রথম কয়েকটি আয়াতে প্রিয় নবীকে যেসব নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে এসব নির্দেশ দৃশ্যত সংক্ষিপ্ত এবং সহজ সরল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব নির্দেশ খুবই সুদূর প্রসারী এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তব জীবনের ওপর এসব নিদেশের কার্যকারিতা ও প্রভাব অসামান্য

এক. ভয় প্রদর্শন করার জন্য যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এই নিদেশের শেষে মনযিল হচ্ছে এই যে.বিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে সব কাজ হচ্ছে তার মারাত্মক পরিণাম সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দেয়া। সেই ভয় এমনিভাবে দেখাতে হবে যাতে আল্লাহ পাকের আযাবের ভয়ে মানুষের মনে মগজে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।

দুই. রব এর বর্ণনার শেষ মনযিল হচ্ছে আল্লাহর যমীনে শুধুমাত্র তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব অটুট থাকবে, অন্য কারোর শ্রেষ্ঠত্ব বহাল থাকতে দেয়া যাবে না বরং অন্য সব কিছুর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য নস্যাৎ করে দিতে হবে। ফলে আল্লাহর যমীনে একমাত্র তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই শুধু প্রকাশ পাবে এবং স্বীকৃত হবে।

তিন. পোশাকের পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতার শেষ মনযিল হচ্ছে এই যে, প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল প্রকার পাক সাফ রাখতে হবে এ অবস্থা এমন পর্যায়ে হতে হবে যাতে করে আল্লাহ পাকের রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া যায়। এটা শুধুমাত্র তারই হেদায়েত ও নুরের দ্বারা সম্ভব হতে পারে। উল্লেখিত পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জনের পর অন্তর আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমাই অন্তরে জাগ্রত হবে। এরফলে সমগ্র বিশ্বের মানুষ বিরোধিতা অথবা আনুগত্যে তাঁর কাছাকাছি থাকবে। তিনিই হবেন সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।

চার. কারো প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ করার পর অধিক বিনিময়ে প্রত্যাশা না করার শেষ মনযিল এই যে, নিজের কাজ কমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা যাবেনা, বেশী গুরুত্ব দেয়া যাবে না। বরং একটির পর অন্য কাজের চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। বড় রকমের ত্যাগও কোরবানী করেও সেটাকে তুচ্ছ মনে করতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর সামনে জবাবদিহির ভয়ের ব্যাপারে অনুভূতির সামনে নিজের চেষ্টা সাধনাকে ক্ষুদ্র ও সামান্য মনে করতে হবে।

পাঁচ. শেষ আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দাওয়াতের কাজ শুর হওয়ার পর শত্রুরা বিরোধিতা, হাসিঠাট্টা, উপহাস বিদ্রূপ ইত্যাদির মাধ্যমে কষ্ট দেবে এবং প্রিয় নবীকে এবং তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। তাঁকে এসব কিছুর সাথে মোকাবেলা করতে হবে। এমতাবস্থায় তাঁকে দৃঢ়তার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এই ধৈর্য মনের শান্তির জন্য নয় বরং আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং তাঁর দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য। কেননা আল্লাহ পাক বলেছেন, ওয়া লেরাব্বেকা ফাছবের অর্থাৎ তোমার প্রতিপালকের জন্য ধৈর্য ধারণ করবে।

কী চমৎকার! এসকল নির্দেশ প্রকাশ্য ভাষায় কতো সহজ সরল এবং সংক্ষিপ্ত। শব্দ চয়ন কতো হালকা এবং কাব্যধর্মী কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কতো ব্যাপক কতো তাৎপর্যমন্ডিত। এই কয়েকটি শব্দের প্রকৃত প্রয়োগের ফলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যাবে এবং বিশ্বর দিকদিগন্তের মানুষের মদ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধন স্থাপিত হবে।

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে দাওয়াত ও তাবলীগের উপাদানও বিদ্যমান রয়েছে। বনি আদমের কিছু আমল এমন রয়েছে যার পরিণাম মন্দ। এ কথা সবাই জানে যে, মানুষ যা কিছু করে তার সব কিছুর বিনিময়ে এ পৃথিবীতে তাকে দেয়া হয় না এবং দেয়া সম্ভব হয় না। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা দিন থাকা দরকার যেদিন সব কাজের পুরোপুরি বিনিময়ে দেয়া হবে। সেইদিনের নাম হচ্ছে কেয়ামত। সেদিন বিনিময়ে দেয়ার একটা অনিবার্য প্রয়োজন এই যে, আমরা এ পৃথিবীতে যে জীবন যাপন করছি এর চেয়ে পৃথক একটা জীবন থাকা দরকার।

অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের কাছে নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী হওয়ার দাবী জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বান্দা যেন তার সব ইচ্ছা আকাংখা আল্লাহ পাকের ওপরই ন্যস্ত করে। প্রবৃত্তির খায়েশ এবং মানুষের অন্যান্য ইচ্ছার ওপর সে যেন আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া। এমনি করে দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব সম্পন্ন হতে পারে। এসব শুত নিম্নরূপ।

ক. তাওহীদ।

খ. পরকালের প্রতি বিশ্বাস।

গ. তাযকিয়ায়ে নফস এর ওপর গুরুত্বারোপ। অর্থাৎ সকল প্রকার অশ্লীলতা ও পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। পুণ্য কাজ বেশী করে করা এবং পুণ্য কাজের ওপর অটল থাকার চেষ্টা।

ঘ. নিজের সকল কাজ আল্লাহ পাকের ওপর ন্যস্ত করা।

ঙ. এসব কিছু প্রিয় নবীর নবুয়ত ও রেসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন এবং অসাধারণ নেতৃত্বের অনুসরণের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

এসব আয়াতে আসমানী নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় নবীকে এক মহান কাজের জন্য এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। ঘুমের আরাম পরিত্যাগ করে জেহাদের কষ্টকর ময়দান অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা মোদ্দাসসেরের প্রথম কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ পাক যেমন বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের জন্য বাঁচবে শুধু সেইতো আরামের জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু যার ওপর বিশাল মানবগোষ্ঠীর পথনির্দেশের দায়িত্বের বোঝা সে কি করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে? উঞ্চ বিছানার সাথে আরামদায়ক জীবনের সাথে তার কি সম্পর্ক? তুমি সেই মহান কাজের জন্য বেরিয়ে পড়ো যে কাজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তোমার জন্য প্রস্তুত বিরাট দায়িত্বের বোঝা তোলার জন্য এগিয়ে এসো। সংগ্রাম করার জন্য এগিয়ে এসো। কষ্ট করো। ঘুম এবং আরামের সময় অতিবাহিত হয়ে গেছ। এখন সময় বিনিদ্র কাটানোর সময় দীঘ পরিশ্রমের। তুমি একাজ করার জন্য তৈরি হও।

এ নির্দেশ বিরাট তাৎপর্য মণ্ডিত। এই নির্দেশ প্রিয় নবীকে আরামের জীবন থেকে বের করে তরঙ্গ সঙ্কুল অথৈ সমুদ্রে নিক্ষেপ করে দিয়েছে। মানুষের বিবেকের সামনে এবং জীবনের বাস্তবতার সামনে এনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এরপর আল্লাহর প্রিয় রসুল উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং সুদীর্ঘ বিশ বছরের বেশী সময় যাবত দাঁড়িয়েই থেকেছেন। এই সময় তিনি ছিলেন জীবন সংগ্রামে অটল অবিচল। আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করেছেন, নিজের এবং পরিবার পরিজনের সুখ-শান্তি আরাম বিসর্জন দিয়েছেন। উঠে দাঁড়ানোর পর তিনি সেই অবস্থায়ই ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়া। কোন প্রকার চাপ ছাড়াই এ দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এই দায়িত্ব ছিল পৃথিবীতে আমানতে কোবরা অর্থাৎ বিরাট আমানতের বোঝা। সমগ্র মানবতার বোঝা, সমগ্র আকীদা বিশ্বাসের বোঝা। বিভিন্ন ময়দানে জেহাদের বোঝা। বিশ বছরেরও বেশী সময় তিনি এই সংগ্রাম মুখর জীবন যাপন করেছেন। আসমানী নিদেশে পাওয়ার পর থেকে কখনোই তিনি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থা সম্পর্কে অমনোযোগী বা উদাসীন ছিলেন না। আল্লাহ পাক তাকে আমাদের পক্ষ থেকে এবং সমগ্র মানব জাতির পক্ষ থেকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। (তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ সুরা মোযাম্মেল, সুরা মোদদাসসের, পারা-২৯, পৃ-১৬৮, ১৬৭, ১৭২)(মূল আরবী খন্ড)।
প্রথম পর্যায়ঃ ব্যক্তিগত উদ্যোগ
গোপনীয় দাওয়াতের তিন বছর

মক্কা ছিল আরব দ্বীপের কেন্দ্রস্থল। এখানে কাবাঘরের পাসবান বা তত্ত্বাবধায়ক ছিল। আরবরা মূর্তির নেগাহবানও ছিল। তারা যাদেরকে সমগ্র আরবের লোকেরা মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতো। এ কারণে অন্য সব স্থানের চেয়ে মক্কায় সংস্কার প্রচেষ্টা সফল হওয়া ছিল অধিক কষ্টকর। এখানে এমন দৃঢ় চিত্ততার প্রয়োজন ছিল যাতে কোন প্রকার দুখ কষ্ট এবং বিপদ বাধা বিন্দুমাত্র সরাতে না পারে বরং বিপদ বাধায় অটল অবিচল থাকা যায়। কাজেই কৌশল হচ্ছে যে, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ প্রথমে গোপনীয়ভাবে সম্পন্ন করতে হবে। যাতে করে মক্কাবাসীদের মধ্যে হঠাৎ করে কোলাহল সৃষ্টি না হয়।

ইসলামের প্রথম পর্যায়ের কিছু সৈনিক

রসুল সর্বপ্রথম তাদের কাছেই দ্বীনের দাওয়াত দেবেন যারা তার নিকটাত্মীয়, যাদের সাথে রয়েছে তাঁর গভীর সম্পর্ক, এটাই স্বাভাবিক। নিজের পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের আগে দাওয়াত দেবেন। প্রিয় নবী প্রথমে তাই এসব লেকদের দাওয়াত দেন। এবং নমনীয়তার ছাপ তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি যাদের সম্পর্কে জানতেন যে তারা তাঁকে সত্যবাদী এবং ন্যায়-নীতিপরায়ণ সৎ মানুষ হিসাবে জানে এবং শ্রদ্ধা করে।

আল্লাহর রসুলের দাওয়াত কয়েকজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা প্রিয় রসুলের সততা, সত্যবাদিতা মহানুভবতা সম্পর্কে কখনোই কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করতেন না। ইসলামের ইতিহাসে এরা সাবেকীনে আউয়ালীন নামে পরিচিত। এদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন রসুলের সহধর্মিনী উম্মুল মোমেনীন খাদিজা বিনতে খোয়াইলেদ, তাঁর মুক্ত করা ক্রীতদাস যায়েদ বিনে সাবেত ইবনে শরাহবিল কালবি। (তিনি এসেছিলেন যুদ্ধে বন্দী দাস হয়ে। পরে হযরত খাজিদা তাঁর মালিক হন এবং স্বামীর জন্যে তাকে দান করে দেন। এরপর তাঁর পিতা ও চাচা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন কিন্তু পিতা ও চাচাকে ছেড়ে তিনি প্রিয় রসুলের সাথে থাকতে পছন্দ করেন। এরপর রসুল তাঁর ভৃত্য যায়েদকে আরব দেশীয় রীতি অনুযায়ী পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। এ ঘটনার পর তিনি যায়েদ মোহম্মদ নামে পরিচিত হন। ইসলামের আগমনে পালক পুত্রের আরবদেশীয় রীতির অবসান ঘটে। ) তাঁর চাচাতো ভাই হযরত আলী ইবনে আবু তালেব, যিনি সে সময় তাঁর পরিবারে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহ্নদ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু আনহুম আজমাইন। এরা সবাই প্রথম দিনের ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড পৃ-৫০)

ইসলাম গ্রহণের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছিলেন সর্বজন প্রিয় নরম মেজাজ উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এবং উদার মনের মানুষ। তাঁর চমৎকার ব্যবহারের কারণে সব সময় তাঁর কাছে মানুষ যাওয়া আসা করতো। এ সময় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোকদের কাছে হযরত আবু বকর (রা) দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। আওফ, হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস হযরত তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা ছিলেন ইসলামের প্রথম সারির সৈনিক।

প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে হযরত বেলাল (রা.)ও ছিলেন একজন। তাঁর পরে আমীন উম্মত হযরত আবু ওবায়দা, আমের ইবনে সালমা ইবনে আবদুল আছাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরাকম ওসমান ইবনে মাজউন, এবং তার দুই ভাই, কোদামা ও আবদুল্লাহ এবং ওবয়দা ইবনে হারেস, মোত্তালেব ইবনে আব্দুল মান্নাফ, সাঈদ ইবনে যায়েদ এবং তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ ওমরের বোন ফাতেমা বিনতে খাত্তাব, খাব্বাব ইবনে আরত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। এর সম্মিলিতভাবে কোরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। ইবনে হিশাম লিখেছেন, এদের সংখ্যা ছিল চল্লিশের বেশী। (দেখুন ১ম খন্ড, পৃ-২৪৫-২৬২)। এদের মধ্যে কয়েকজনকে সাবেকীনে আউয়ালীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, উল্লিখিত ভাগ্যবানদের ইসলাম গ্রহণের পর দলে দলে লোক ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। মক্কার সর্বত্র ইসলামের আলোচনা চলেতে থাকে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, -২৬২)

এরা গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। প্রিয় নবী এদেরকে ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য এদের পথ নির্দেশ দেয়ার জন্য গোপনে এদের দেখা করতেন। কেননা তাবলীগের কাজ কখনো বিচ্ছিন্নভাবে এবং গোনে চলছিল। সুরা মোদদাসসের এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হওয়ার পর ঘন ঘন ওহী নাযিল হতে থাকে। এ সময় ছোট আয়াত থাকতো চিত্তাকর্ষক গীতিধর্মিতা এবং কাব্যময়তা। পরিবেশের সাথে সেইসব আয়াত পুরোপুরি খাপ খেয়ে যেতো। এসব আয়াত তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মার শুদ্ধি ও সৌন্দর্য এবং দুনিয়ার মায়াজালে জড়িয়ে যাওয়ার কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়া বেহেশত ও দোযখের বিবরণ এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেন চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। এসকল আয়াত এমন সব স্থান পরিভ্রমণ করিয়ে আনছিল যা ছিল পরিবেশ সম্পূর্ণ নতুন।

নামাযের আদেশ

প্রথমে যা কিছু নাযিল হয়েছিল এর মধ্যে নামাযের আদেশ ও ছিল। মোকাতেল ইবনে সোলায়মান বলেন, ইসলামের শুরুতে আল্লাহ পাক দুরাকাত নামায সকালে এবং দুরাকাত নামায সন্ধ্যার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। কেননা আল্লাহ পাক বলেন, সকাল এবং সন্ধ্যায় তোমরা প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তার সেজদা করো।

ইবনে হাজার বলেন, প্রিয় রসুল এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম মেরাজের ঘটনার আগেই নামায আদায় করতেন। তবে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আগে অন্য কোন নামায ফরয ছিল কিনা। কেউ কেউ বলেন, সূর্য উদয় হওয়ার আগে এবং অস্ত যাওয়ার আগে এক এক নামায ফরয ছিল।

হারেস ইবনে ওসামা হযরত যায়ে ইবনে হারেসা থেকে এই হাদিসে বর্ণনা করেছেন যে, প্রিয় নবীর কাছে প্রথম যখন ওহী এসেছিল সেই সময় জিবরাইল এসে তাঁকে প্রথমে ওযুর নিয়ম শিক্ষা দেন। ওযু শেষ করার পর এক আঁজলা পানি লজ্জাস্থানে ছুড়ে মারেন। ইবনে মাজাও এ ধরনের হাদিস বর্ণনা করেছেন। বাবা ইবনে আযেব এবং ইবনে আব্বাস থেকেও এ ধরনের হাদিস বর্ণিত রয়েছে। ইবনে আব্বাসের বর্ণিত হাদিসে রয়েছে যে, এই নামায ছিল প্রথম দিকেরে ফরযের অন্তর্ভুক্ত। (মুখতাছারুছ ছিরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ-৮৮। )

ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন যে, প্রিয় রসুল এবং সাহাবয়েকেরাম নামাযের সময়ে পাহাড়ে জলে যেতেন এবং গোপনে নামায আদায় করতেন। একবার আবু তালেব রসুল এবং হযরত আলীকে (রা) নামায আদায় করতে দেখে ফেলেন। তিনি এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তাঁকে জানানোর পর তিনি বলেন, এই অভ্যাস অব্যাহত রেখো। (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ-১৪৭)।

কোরাইশদের সংবাদ প্রদান

বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সময়ে তাবলীগের কাজ যদিও গোপনভাবে করা হচ্ছিল কিন্তু কোরাইশরা কিছু কিছু বুঝতে পারছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারটিকে কোনপ্রকার গুরুত্ব দেয়নি।

ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন যে, কোরাইশরা মুসলমানদের তৎপরতার খবর পাচ্ছিল কিন্তু তারা এর প্রতি কোন গুরুত্ব দেয়নি। সম্ভবত তারা মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মনে করেছিল যারা বৈরাগ্যবাদ এবং সংসার বিরাগী হওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা বলে থাকেন। আরব সমাজে এ ধরনের লোক ছিল যেমন, উমাইয়া ইবনে আবু ছালত, কুস ইবনে সাদাহ আমর তোফায়েল প্রমুখ। তবে কোরাইশরা এটা লক্ষ্য করেছিল যে, তার তৎপরতা যেন একটু বেশী এবং ভিন্ন ধরনের। সময়ের গতিধারার সাথে সাথে কোরাইশরা প্রিয় নবীর ধর্মীয় তৎপরতা এবং তাবলীগের প্রতি ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। (ফেকহুস সিরাত, পৃ-৭৬)

তিন বছর যাবত দ্বীনের কাজ গোপনভাবে চললো। এসময় ঈমানদারদের একটি দল তৈরি হয়ে গেল। এরা ভ্রাতৃত্ব এবং সহায়তার ওপর কায়েম ছিল। তারা আল্লাহ পাকের পয়গাম পৌঁছচ্ছিল এবং এ পয়গামকে একটা পর্যায় উন্নীত করার জন্য চেষ্টা করছিল। এরপর আল্লাহ পাক ওহী নাযিল করেন এবং এ পয়গামকে একটা পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা করছিল। এরপর আল্লাহ পাক ওহী নাযিল করেন এবং তাঁর কওমকে নির্দেশ প্রদান করেন। দ্বীনের দাওয়াতের সাথে সাথে কোরাইশদের বাতিল শক্তির সাথে সংঘাত এবং তাদের মূর্তির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরারও নির্দেশ দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ প্রকাশ্য তাবলীগ
দাওয়াতের প্রথম নির্দেশ

এ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আল্লাহ পাক এ নির্দেশ নাযিল করেছিলেন যে, হে নবী তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদান করো। এটি হচ্ছে সুরা শোয়াবার একটি আয়াত। এ সূরায় সর্ব প্রথম হযরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা ব্যক্ত করা হয়। অর্থাৎ বলা হয়, কিভাবে হযরত মুসা আলাইহিস সালাম নবুয়ত পেয়েছিলেন এবং বনি ইসরাইলসহ হিজরত করে ফেরাউন এবং ফেরাউনের জাতি এবং তার সঙ্গী সাথীদের নীল নদে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অন্য কথায় এ সূরায় হযরত মুসা আলাইহিস সালাম, ফেরাউন এবং বনি ইসরাইলীদের নিকট যেভাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন সেই দাওয়াতের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে।

আমার ধারণা রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর কওমের মধ্যে প্রকাশ্য তাবলীগের নির্দেশ বলে দেয়ার পর হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘটনা এ কারণেই বলা হয়েছে যাতে একটা উদাহরণ তার সামনে থাকে। প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছিল এবং যে ধরনের বাড়াবাড়ি তাঁর সাথে করা হয়েছিল রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের সামনে যেন তার একটা নমুনা সব সময় বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে এ সূরায় যেসব সম্প্রদায় নবীদের মিথ্যাবাদী বলেছিল, যেমন ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়, নূহের সম্প্রদায়, আদ, সামুদ, ইবরাহীমের সম্প্রদায়, লুতের সম্প্রদায়, আইকার অধিবাসীসহ এদের সবার পরিণাম কিরূপ হয়েছিল সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। সম্ভবত এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে যেসব লোক আল্লাহর রসূলকে মিথ্যাবাদী বলবে তারা যেন বুঝতে পারে যে, এ ধরনের আচরণের ওপর অবিচল থাকলে তাদের পরিণাম কিরূপ হবে। তারা আল্লাহর কিরূপ পাকড়াও এর সম্মুখীন হবে। এছাড়া ইমানদাররাও বুঝতে পারবে যে, উত্তম পরিণাম তাদেরই জন্য রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা নবীকে মিথ্যাবাদী বলে তাদের পরিণাম ভালো হবে না।

নিকটাত্মীয়দের মধ্যে তাবলীগ

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বনু হাশেমদের সমবেত করলেন। তাদের সাথে বনু মোত্তালেব ইবনে আবদে মান্নাফের একটি দলও ছিল। তারা ছিল মোট পঁয়তাল্লিশ জন। আবু লাহাব কথা লুফে নিয়ে বলল, দেখো এরা তোমার চাচা এবং চাচাতো ভাই। কথা বলো তবে মূর্খতার পরিচয় দিয়োনা এবং মনে রেখো তোমার খান্দান সমগ্র আরবের সাথে মোকাবিলা করতে পারবে না। আমই তোমাকে পাকড়াও করার বেশী হকদার। তোমার জন্য তোমার পিতৃকুলের লোকেরাই যথেষ্ট। যদি তুমি তোমার কথার ওপর অটল থাকো তাহলে কোরাইশদের সমগ্র গোত্র ও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এরপর কি হবে ? তোমার পিতৃকুলের মধ্যে তুমিই হবে সবচেয়ে বেশী ধ্বংসাত্মক কাজের মানুষ। এ সব কথা শুনে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর পুনরায় তাদের সমবেত করলেন এবং বললেন, আল্লাহ পাকের জন্য সকল প্রশংসা। আমি তাঁর প্রশংসা করছি এবং তাঁর কাছেই সাহায্য চাচ্ছি। তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করছি। তাঁর ওপর ভরসা করছি। আমি এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত এবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন শরিক নেই। এরপর আল্লাহর রসুল বললে, পথ প্রদর্শক তার পরিবারের লোকদের নিকট মিথ্যা কথা বলতে পারেনা। সেই আল্লাহর শপথ যিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, আমি তোমাদের প্রতি বিশেষভাবে এবং অন্য সব মানুষের প্রতি সাধারণভাবে আল্লাহর রসূল। আল্লাহর শপথ, তোমরা যেভাবে ঘুমিয়ে থাকো সেভাবে একদিন মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ঘুম থেকে যেভাবে তোমরা জাগত হও, সেভাবে একদিন তোমাদের উঠানো হবে। এরপর তোমাদের থেকে তোমাদের কৃতকর্মের হিসাব নেয়া হবে। এরপর রয়েছে চিরকালের জন্য হয়তো জান্নাত অথবা জাহান্নাম।

একথা শুনে আবু তালেব বললেন, তোমাকে সহায়তা করা আমার কতো যে পছন্দ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তোমার উপদেশ গ্রহণ যোগ্য। তোমার কথা আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি। এখানে তোমার পিতৃকুলের সকলে উপস্থিত রয়েছে আমিও তাদের একজন। কাজেই তুমি আমার মন আবদুল মোত্তালেবের দ্বীন ছাড়ার পক্ষপাতী নয়। আবু লাহাব বলল, আল্লাহর শপথ এটা মন্দ কাজ। অন্যদের আগে তুমি তার হাত ধরেছ? আবু তালেব বললেন, আল্লাহর শপথ, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন আমি তার হেফাজত করতে থাকব (ফেকহুছ সীরাত পৃ. ৭৭, ৮৮,ইবনুল আছির রচিত)।

সাফা পাহাড়ের ওপর তাবলীগ

নবী আরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে,আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগের ক্ষেত্রে আবু তালেব তাঁকে সহায়তা করবেন তখন তিনি একদিন সাফা পাহাড়ের ওপর উঠে আওয়ায দিলেন যে, ইয়া সাবাহ অর্থাৎ হায় সকাল (তখনকার দিনে কোন ভয়াবহ সংবাদ দেয়ার দরকার হলে মানুষরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ইয়া সাবাহ ইয়া সাবাহ হায় সকাল বলে চীৎকার করতে থাকতো)। এই আওয়ায শুনে কোরাইশ গোত্রসমূহ তাঁর কাছে সমবেত হলো। তিনি তাদেরকে আল্লাহ পাকের তাওহীদ, তাঁর রেসালত এবং রোজ কেয়ামতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিলেন। এ ঘটনার একটি অংশ সহীহ বোখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে।

হে নবী তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করো। কোরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা পাহাড়ের ওপর আরোহণ করে আওয়ায দিলেন, হে বনি ফিহর, হে বনি আদী, এই আওয়ায শুনে কোরায়েশদের সকল নেতৃস্থানীয় লোক একত্রিত হলো। যিনি যেতে পারেননি তিনি একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন কি ব্যাপার সেটা জানার জন্য। কোরাইশরা এসে হাজির হল, আবু লাহাবও তাদের সাথে ছিলেন। এরপর তিনি বললেন, তোমরা বলো যদি আমি তোমাদের বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড় সওয়ার আত্মগোপন করে আছে, ওরা তোমাদের ওপর হামলা করতে চায়, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে ? সবাই বলল, হ্যাঁ বিশ্বাস করব, কারণ আপনাকে আমরা কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শোনো আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। আবু লাহাব বলল, তুমি ধ্বংস হও। তুমি আমাদেরকে একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছ ? আবু লাহাবের একথা বলার পর আল্লাহ পাক সূরা লাহাব নাযিল করেন। এতে বলা হয় আবু লাহাবের দুটি হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক ( সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৭০৬, ৭৪৩ সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড.পৃ. ১১৪)।

এই ঘটনার আরেক অংশ ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু হোরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করো, এই আয়াত নাযিল হওয়ার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আওয়ায দিলেন। সাধারণভাবে এবং বিশেষভাবে। তিনি বললেন, হে কোরাইশ দল, তোমরা নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। হে বিন কাব, নিজেদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। হে মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমা, নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করো। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষার ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি। যেহেতু তোমাদের সাথে আমার আত্মীয়তা রয়েছে, কাজেই এ সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে যথাসম্ভব সজাগ করবো (সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড পৃ. ৩৮৫)।

দাওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা

এই আওয়াযের স্পন্দন এখনো মক্কার আশে পাশে শোনা যাচ্ছিল এমন সময় আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযিল করেন, তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে সেটা খোলাখুলি তুমি ঘোষণা করো এবং মোশরেকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও (১৫, ৯৪)।

এরপর রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৌত্তলিকতার নোংরামি ও অকল্যাণসমূহ প্রকাশ্যে তুলে ধরেন এবং মিথ্যার পর্দা উন্মোচিত করেন। তিনি মূর্তিসমূহের অন্তঃসারশূন্যটা, মূল্যহীনতা তুলে ধরেন এবং তাদের স্বরূপ উদঘাটন করেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে দিয়ে বোঝাতে থাকেন যে, মূর্তিসমূহ নিরর্থক এবং শক্তিহীন। তিনি আরো জানান যে, যারা এসব মূর্তিপূজা করে এবং নিজের ও আল্লাহর মধ্যে এদেরকে মাধ্যম হিসাবে স্থির করে তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে।

পৌত্তলিকদের এবং মূর্তির উপাসকদের পথভ্রষ্ট বলা হয়েছে একথা শোনার পর মক্কার অধিবাসীরা ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়লো। তাদের ওপর যেন বজ্রপাত হলো, তাদের নিরুদ্বেগ শান্তিপূর্ণ জীবনে যেন ঝড়ের তাণ্ডব দেখতে পেলো। এ কারণ কোরাইশরা অকস্মাৎ উৎসারিত এ বিপ্লবের শেকড় উৎপাটনের জন্য উঠে দাঁড়াল। কেননা এ বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের পৌত্তলিক রসম রেওয়াজ নির্মূল হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

কোরাইশরা কোমর বেঁধে উঠে দাঁড়ালো। কারণ তারা জানতো যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে মাবুদ হিসাবে অস্বীকার কারা এবং রেসালাত ও আখিরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হচ্ছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে রেসালাতের হাতে ন্যস্ত করা এবং তার কাছে নিঃশর্ত-ভাবে আত্মসমর্পণ। এতে করে অন্যদের তো প্রশ্নই আসে না নিজের জানমাল সম্পর্কে পর্যন্ত নিজের কোন স্বাধীন অধিকার থাকেনা। এর অর্থ হচ্ছে যে, আরবের লোকদের ওপর মক্কার লোকদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব ছিল সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর পলে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের ইচ্ছা ও মর্জিই হবে চূড়ান্ত, নিজেদের ইচ্ছা মতো তারা কিছুই করতে পারবেনা। নিচু শ্রেণীর লেকদের ওপর তারা যে অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আসছিল, সকাল সন্ধ্যা তারা যেসব ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত ছিল সে সব থেকে তাদের দুরে থাকতে হবে। কোরাইশরা এর অর্থ ভালোই বুঝতে পারছিল, এ কারণ তাদের দৃষ্টিতে অবমাননাকর এরূপ অবস্থা তারা মেনে নিতে পারছিলরা। কিন্তু এটা কোন কল্যাণের বা মঙ্গলের প্রত্যাশায় নয় বরং আরো বেশী মন্দ কাজে নিজেদের জড়িত করাই এর উদ্দেশ্য। আল্লাহ পাক বলেন, বরং এ জন্য যে মানুষ চায় ভবিষ্যতেও মন্দ কাজে তারা লিপ্ত হবে (৫,৭৫)।

কোরাইশরা এসব কিছুই বুঝতে পারছিল, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে, তাদের সামনে এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যিনি ছিলেন সত্যবাদী এবং বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন আদর্শের উত্তম দৃষ্টান্ত। দীর্ঘকাল যাবত মক্কার অধিবাসীরা পূর্ব পুরুষদের মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টান্ত দেখেনি শোনেওনি, এমন এক ব্যক্তিত্বের সাথে তারা কিভাবে মোকাবেলা করবে সেটাও ভেবে ঠিক করতে পারছিলনা। তারা ছিল অবাক তারা ছিল বিস্মিত, এভাবে বিস্মিত হওয়ার মূলত কিছু কারণও ছিল।

কোরাইশরা অনেক চিন্তা ভাবনার পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, তারা প্রিয় নবীর চাচা আবু তালেবের কাছে যাবে এবং তাকে অনুরোধ করবে, তিনি যেন নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখেন। নিজেদের দাবীকে যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য তারা এ দলিল তৈরী করলো যে, তাদের উপাস্যদের পুরিতৗাগ করার দাওয়াত দেয়া এবং তারা যে ভালো মন্দ কোন কিছুই করার শক্তি রাখেনা এ কথা বলা প্রকৃত পক্ষে তাদের উপাস্যদের প্রতি অবমাননা এবং মারাত্মক গালি।

তাছাড়া এটা হচ্ছে আমাদের পিতা ও পিতামহ অর্থাৎ আমাদের পূর্ব পুরুষদের নির্বোধ এবং পথভ্রষ্ট আখ্যায়িত করার শামিল। কেননা বর্তমানে আমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের ওপর রয়েছি তারাও এই ধর্ম বিশ্বাসের ওপর জীবন যাপন করেছিলেন। কোরাইশদের এসব কথা বোঝানোর পর তারা সহজে বুঝাতে পারছিলো এবং দ্রুত এতে সাড়া দিল।

আবু তালেব সমীপে কোরাইশ প্রতিনিধি দল

ইবনে ইসহাক লিখেছেন, কোরায়েশদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন লোক আবু তালেবের নিকট গেল এবং বলল যে আবু তালেব, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের উপাস্যদের গালাগাল করছে, আমাদের দ্বীনকে পথভ্রষ্টতা বলছে এবং আমাদের বিবেককে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে। আমাদের পিতা ও পিতামহদের পথভ্রষ্ট বলে আখ্যায়িত করছে। কাজই হয়তো আপনি ডাকে বাধা দিন, অথবা তাঁর এবং আমাদের মাঝখান থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের মতোই একই ধর্মে বিশ্বাসী। তার সাথে বোঝাপড়ার জন্য আমরা নিজেদের যথেষ্ট মনে করি।

এ আবেদনের জবাবে আবু তালেব নরম ভাষায় কথা বললেন এবং মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করলেন। ফলে তারা ফিরে গেল। আল্লাহর রসূল একই নিয়মে অব্যাহতভাবে দ্বীনের তাবলীগ করতে লাগলেন এবং দ্বীনের প্রচার প্রসারে মনোনিবেশ করলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫)।

হাজীদের বাধা দেয়ার জন্যে জরুরী বৈঠক

সেই সময়ে কোরায়েশদের সামনে আরো একটি সমস্যা এসে উপস্থিত হলো। প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এসে পড়লো হজ্জের মৌসুম। কোরাইশরা জানতো যে, আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদল এ সময় মক্কায় আসবে। এ কারণে তারা দরকার মনে করলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে এমন কথা বলবে যাতে আরবের লোকদের মনে আল্লাহর রসুলের তাবলীগের কোন প্রভাব না পড়ে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তারা ওলীদ ইবনে মুগীরার কাছে গিয়ে একত্রিত হলো। ওলীদ বললো, প্রথমে তোমরা সবাই একমত হবে, একজনের কথা অন্যজন মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে এমন অবস্থা যেন না হয়। তোমাদের মধ্যে কোন প্রকার মত পার্থক্য থাকতে পারবেনা। আগন্তুকগণ বলল আপনি আমাদের বলে দিন, আমরা কি বলব। ওলীদ বলল, তোমরা বলো, আমি শুনব। এরপর কয়েকজন বলল, আমরা বলব যে, তিনি একজন জ্যোতিষী। ওলীদ বলল, না তিনি জ্যোতিষী নন, আমি জ্যোতিষীদের দেখেছি, তার মধ্যে জ্যোতিষীদের মতো বৈশিষ্ট্য নেই, জ্যোতিষীরা যেভাবে অন্তঃসারশূন্য কথা বলে থাকে তিনি সেভাবে বলেন না। এ কথা শুনে আগন্তুকরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন পাগল। ওলীদ বলল, না তিনি পাগলও নন। আমি পাগলও দেখেছি, পাগলের প্রকৃতিও দেখেছি। তিনি পাগলের মতো আচরণও করেন না পাগলের মতো উল্টাপাল্টা কথাও বলেন না। লোকেরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি। ওলীদ বলল, তিনি কবিও নন। কবিত্বের বিভিন্ন রকম আমার জানা আছে তাঁর কথা কবিতা নয়। লোকরা বলল, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন যাদুকর। ওলীদ বলল, না তিনি যাদুকরও নন। আমি যাদুকর এবং তাদের যাদু দেখেছি। তিনি ঝাড়ফুঁক করেননা এবং যাদু-টোনাও করেননা। আগুন্তুকরা বলল, তাহলে আমরা কি বলব ? ওলীদ বলল, আল্লাহর শপথ তার কথা বড় মিষ্টি। তার কথার তাৎপর্য অনেক গভীরতাপূর্ন। তোমরা যে কথা বলবে শ্রোতারা সবাই মিথ্যা মনে করবে। তবে তার সম্পর্কে একথা বলতে পারো যে, তিনি একজন যাদুকর। তিনি যে সব কথা পেশ করেছে সেসব কথা স্রেফ যাদু। তাঁর কথা শোনার পর পিতা পুত্রের মধ্যে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়। পরিশেষে কোরাইশ প্রতিনিধিদল একথার ওপর একমত হয়ে ওলীদের নিকট থেকে ফিরে এলো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৭১)।

কোন কোন বর্ণনায় বিস্তারিত ভাবে একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, ওলীদ যখন আগন্তুকদের সব কথা প্রত্যাখ্যান করলো তখন তারা বলল, তাহলে আপনি সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। এ কথা শুনে ওলীদ বলল, আমাকে একটুখানি চিন্তা করার সময় দাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ওলীদ উপরোক্ত মন্তব্য করেছিল (তাফসীর ফি যিলাযিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পারা,২৯, পৃ.১৮৮)।

উল্লিখিত ঘটনার প্রেক্ষিতে ওলীদ সম্পর্কে আল্লাহ পাক সূরা মুদ্দাসসেরের ষোলটি আয়াত নাযিল করেন। এসব আয়াতে ওলীদের চিন্তার প্রকৃতির চিত্ররূপ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ পাক বলেন, সে তো চিন্তা করলো এবং সিদ্ধান্ত করলো। অভিশপ্ত হোক সে কেমন করে সে এ সিদ্ধান্ত করলো। আরো অভিশপ্ত হোক, সে কেমন করে সে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সে আগে চেয়ে দেখলো। অতঃপর সে ভ্রু-কুঞ্চিত করলো এবং মুখ বিকৃত করলো। অতঃপর সে পেছন ফিরলো এবং দম্ভ প্রকাশ করলো এবং ঘোষণা করলো, এটাতো লোক পরস্পরায় প্রাপ্ত যাদু ভিন্ন আর কিছু নয়, এটাতো মানুষেই কথা ( আয়াত ১৮- ২৫)।

উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কয়েকজন পৌত্তলিক হ্জ্জ যাত্রীদের আসার বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের সতর্ক করে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড,২৭১ পৃ)।

এ কাজে সবার প্রথম ছিল আবু লাহাব। হজ্জের সময়ে সে হজ্জ-যাত্রীদের ডেরায়, ওকায, মাজনা এবং যুল মায়াযের বাজারে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে লেগে থাকে। নবী (সা:) আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করছিলেন, আর আবু লাহাব পেছনে থেকে বলছিল, তোমরা ওর কথা শুনবে না, সে হচ্ছে মিথ্যাবাদী এবং বেদ্বীন (তিরমিযি মোসনাদে আহমদ তৃতীয় খন্ড ৪৯২)।

এ ধরনের ছুটোছুটি র ফল এই হলো যে, হজ্জ যাত্রীরা ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় জানতে পারলো যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত দাবী করেছেন। মোটকথা হজ্জ-যাত্রীদের মাধ্যমে সমগ্র আরব জাহানে আল্লাহর রসূলের আলোচনা ছড়িয়ে পড়ল।

সম্মিলিত প্রতিরোধ

কোরাইশরা যখন লক্ষ্য করলো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে তাবলীগে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার কৌশল কাজে আসছে না তখন তারা নতুন করে চিন্তা করলো। দ্বীনের দাওয়াত চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্য ভিন্ন পদ্ধতি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলো। সে পন্থা ও পদ্ধতির সারমর্ম নিম্নরূপ,

প্রতিরোধের প্রথম ধরন

এক হাসি ঠাট্টা, বিদ্রূপ উপহাস এবং মিথ্যাবাদী বলে তাকে অভিহিত করা। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মনোবল নষ্ট করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য পৌত্তলিকরা নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অহেতুক অপবাদ এবং গালাগাল দিতে শুরু করে। কখনো তারা প্রিয় নবীকে পাগল বলতো। যেমন আল্লাহপাক বলেন, ওসব কাফেররা বলল, যার ওপর কোরআন নাযিল হয়েছে নিশ্চয়ই সে একটা পাগল (৬-১৫)।

কখনো তাঁর ওপর যাদুকর এবং মিথ্যাবাদী হওয়ার অপবাদ দেওয়া হতো। যেমন আল্লাহ পাক বলেন, ওরা বিস্ময় বোধ করছে যে, ওদের কাছে ওদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী এলেন এবং কাফেররা বলে এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী (৪-৩৮)।

কাফেররা আল্লাহর রসূলের সামনে দিয়ে পেছনে দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে চলাচল করতো এবং রোষ কষায়িত চোখে তাঁর প্রতি তাকাতো। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন, কাফেররা যখন কোরআন শ্রবণ করে তখন তারা যেন ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা তোমাকে আছড়িয়ে ফেলে দেবে এবং বলে এতো পাগল ( ৫১-৬৮)।

নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোথাও যেতেন এবং তাঁর সামনে পেছনে দুর্বল ও অত্যাচারিত সাহাবায়ে কেরাম থাকতেন তখন পৌত্তলিকরা ঠাট্টা করে বলতো, আল্লাহ কি তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করলেন? (৫৩, ৬)

তাদের এ উক্তির জবাবে আল্লাহ বলেন, আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত নন? (৫৩,৬)

সাধারণভাবে কাফেরদের অবস্থা যেরূপ চিল কোরআনে আল্লাহ পাক তার চিত্র এভাবে অঙ্কন করেছেন, যারা অপরাধী তারা তো মোমেনদের উপহাস করতো এবং ওরা যখন মোমেনদের কাছ দিয়ে যেতো তখন চোখ টিপে ইশারা করতো এবং যখন ওদের কে দেখতো তখন বলতো এরা তো পথভ্রষ্ট। এদেরকে তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি (২৯,৩৩,৮৩)।

প্রতিরোধের দ্বিতীয় ধরন

আল্লাহর রসূলের শিক্ষাকে বিকৃত করা, সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করা, মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করা,দ্বীনের শিক্ষা এবং দ্বীন প্রচারকারীদের ঘৃণ্য সমালোচনা করা ছিল তাদের নৈমিত্তিক কাজ। এসব কাজ তারা এতো বেশী করতো যাতে জনসাধারণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করার সুযোগ না পায়। পৌত্তলিকরা পবিত্র কোরআন সম্পর্কে বলতো, ওরা বলতো, এগুলোতো সে কালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে, এগুলো সকাল সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয় (৫, ২৫)।

কাফেররা বলে, এটা মিথ্যা ব্যতীত কিছুই নয়, সে এটা উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে (৪,২৫)।

পৌত্তলিকরা এ কথাও বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় এক মানুষ (১০৩, ১৬)।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর তাদের অভিযোগ ছিল এই, ওরা বলে, এ কেমন রসূল যে আহার করে এবং হাটে বাজারে চলাফেরা করে (৭, ২৫)।

কোরআন শরীফের বহু জায়গায় পৌত্তলিকদের অভিযোগসমূহ খণ্ডন করা হয়েছে, কোথাও তাদের অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে কোথাও করা হয়নি।

প্রতিরোধের তৃতীয় ধরন

পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনাবলী এবং কাহিনী উল্লেখ করে কোরআন তার অবিশ্বাসীদের মোকাবেলা করেছে। নযির ইবনে হারেসের ঘটনা এই যে, একবার সে কোরায়েশদের বলল, হে কোরাইশরা, আল্লাহর শপথ, তোমাদের ওপর এমন আপদ এসে পড়েছে যে, তোমরা এখনো তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় বের করতে পারোনি। মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যে বড় হয়েছেন, তোমাদের সবচেয়ে পছন্দনীয় মানুষ ছিলেন, সবার চেয়ে বেশী সত্যবাদী এবং সবচেয়ে বড় আমানতদার ছিলেন। আজ তাঁর কানের কাছে চুল যখন সদা হয়েছে তখন তিনি তোমাদের কাছে কিছু কথা নিয়ে এসেছেন অথচ তোমরা বলছো তিনি যাদুকর। আল্লাহর শপথ তিনি যাদুকর নন। আমি যাদুকর দেখেছি এবং তাদের যাদু টোনাও দেখেছি। তাদের উল্টাপাল্টা কথাও শুনেছি। তোমরা বলছো তিনি কবি, আল্লাহর শপথ তিনি কবিও নন।। আমি কবিদের দেখেছি এবং তাদের কবিতা শুনেছি। তোমরা বলছো তিনি পাগল, না, আল্লাহর শপথ তিনি পাগলও নন। আমি পাগল দেখেছি, পাগলের পাগলামিও দেখেছি। তাঁর মধ্যে কোন প্রকার পাগলামির চিহ্ন নেই। কোরাইশদের লোকরা, তোমরা গভীরভাবে চিন্তা করো, তোমাদের ওপর বিরাট আপদ এসে পড়েছে।

এরপর নযর ইবনে হারেস হীরায় গেল এবং সেখানে বাদশাহদের বিভিন্ন ঘটনা বিশেষত রুস্তম এবং আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলো। এরপর সে মক্কায় ফিরে এলো। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন মজলিসে বসে আল্লাহর কথা বলতেন এবং তাঁর শাস্তি সম্পর্কে লোকদের ভয় দেখাতেন তখন সে সেখানে যোত এবং বলতো, আল্লাহর শপথ, মোহাম্মদের কথা আমার খতার চেয়ে ভালো নয়। এরপর বলতো, মোহাম্মদের কথা আমার কথার চেয়ে কি কারণে ভালে হবে? (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.২৯৯, ৩০০, ৩৫৮, মুখতাছুছ ছিয়ার, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ. ১১৭, ১১৮)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনা থেকে এ কথাও জানা যায় যে, নযর ইবনে হারেস কয়েকজন দাসী ক্রয় করে রেখেছিল। যখন সে শুনতো যে কোন মানুষ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে তখন তার ওপর একজন দাসীকে লেলিয়ে দিতো। সেই দাসী সেই লোককে পানাহার করাতো, তাকে গান শোনাতো। একপর্যায়ে সেই লোকের ইসলামের প্রতি কোন আকর্ষণ অবশিষ্ট থাকতো না। এ সম্পর্কে আল্লাহ পাক এই আয়াত নাযিল করেন, কিছু লোক এমন রয়েছে যারা ক্রীড়ার কথাবার্তা ক্রয় করে যাতে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরানো যায় (ফাতহুল কাদির, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ২৩৬)।

প্রতিরোধের চতুর্থ ধরন

কোরাইশরা একপর্যায়ে এ রকম চেষ্টা করেছিল যে, ইসলাম এবং জাহেলিয়াতের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করবে। অর্থাৎ পরস্পর পরস্পরকে কিছু ছাড় দিবে। আল্লাহর রসুল পৌত্তলিকদের কিছু গ্রহণ করবেন এবং পৌত্তলিকরা আল্লাহর রসূলের কিছু আদর্শ গ্রহণ করবে। আল্লাহ পাক কোরআনে এ সম্পর্কে বলেন, ওরা চায় যে, আপনি নমনীয় হবেন তাহলে তারাও নমনীয় হবে (৯, ৬৮) ইবনে জরির এবং তিবরানির একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, পৌত্তলিকরা আল্লাহর রসলের নিকট এ মর্মে প্রস্তাব দিল যে, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের উপাসনা করুন, আর এক বছর আমরা আপনার প্রভুর উপাসনা করবো। আবদ ইবনে হোমায়েদের একটি বর্ণনায় রয়েছে, যে পৌত্তলিকরা বললো, আপনি যদি আমাদের উপাস্যদের মেনে নেন, তবে আমরাও আপনার খোদার এবাদত করবো (ফাতহুল কাদির, শাওকানি রচিত, ৫ম খন্ড, পৃ. ৫০৮)।

ইবনে ইসহাক বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের তওয়াফ করছিলেন এমন সময় আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল ওযযা, ওলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া ইবনে খালফ ও আসা ইবনে ওয়ায়েল ছাহমী তাঁর কাছে এলো। এরা ছিল নিজ নিজ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তি। এরা বললো এসো মুহাম্মদ, তুমি যার পূজা করছো, আমরা তার পূজা করবো। আর আমরা যাকে পূজা করছি, তুমিও তার পূজা করবে। এতে আমরা উভয়ে সমপর্যায়ে উন্নীত হবো। যদি তোমাদের মাবুদ আমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে আমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে আর যদি আমাদের মাবুদ তোমাদের মাবুদের চেয়ে ভালো হন তবে তোমরা তার কাছ থেকে কল্যাণ লাভ করবে। তাদের এ হাস্যকর কথার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কাফেরূন নাযিল করেন। এতে ঘোষণা করা হয় যে, তোমরা যাদের উপাসনা আমি তাদের উপাসনা করতে পারি না (ইবনে হাশিম ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬২)।

এ সিদ্ধান্তমূলক জবাবের মাধ্যমে পৌত্তলিকতার হাস্যকর বক্তব্যের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনার সম্ভাব্য কারণ এই যে, এ ধরনের চেষ্টা সম্ভবত বার বার করা হয়েছে।

যুলুম নির্যাতন

নবুয়তের চতুর্থ বছরে ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত বন্ধ করতে পৌত্তলিকরা যেসব কাজ করেছে তার বিবরণ ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব অপ-তৎপরতা পৌত্তলিকরা পর্যায়ক্রমে এবং ধীরে ধীরে চালিয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি মাসের পর মাস অতিরিক্ত কিছু করেনি। কিন্তু তারা যখন লক্ষ্য করলো যে, তাদের তৎপরতা ইসলামের দাওয়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা পুনরায় সমবেত হয়ে পঁচিশজন কাফেরের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলো। এরা ছিল কোরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ কমিটির প্রধান ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাচা। পারস্পরিক পরামর্শ ও চিন্তা ভাবনার পর কমিটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবাদের বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাব অনুমোদন করলো। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, ইসলামের বিরোধিতা করতে যেয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেওয়া এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের নির্যাতন করার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতার পরিচয় দেওয়া হবে না।(রহমাতুল্লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৫৯-৬০)

পৌত্তলিকরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পর সর্বাত্মকভাবে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলো। মুসলমান বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের ক্ষেত্রে পৌত্তলিকতার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষেত্রে ছিলো কঠিন। কেননা তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসাধারণ মানুষ। সবাই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তাঁর কাছে সম্মানজনকভাবেই যাওয়া সহজ ছিলো। তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননাকর ও ঘৃণ্য তৎপরতা বর্ব ও নির্বোধদের জন্য ছিল মানানসই। ব্যক্তিত্বের এবং স্বাতন্ত্র্য এবং প্রখরতা ছাড়াও আবু তালিবের সাহায্য তিনি পাচ্ছিলেন। মক্কায় আবু তালিবের প্রভাব ছিল অনতিক্রম। ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে এ প্রভাব অতিক্রম করা এবং তার সাথে কৃত অঙ্গিকার ভঙ্গ করার সাহস কারো ছিল না। এ পরিস্থিতিতে কুরাইশরা দারুণ মর্মপীড়ার মধ্যে দিয়ে দিন যাপন করছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, দিনের প্রচার প্রসার তাদের ধর্মীয় আধিপত্য এবং পার্থিব নেতৃত্ব কর্তৃত্বের শিকড় কেটে দিচ্ছিলো। সে দ্বীনের ব্যাপারে আর কতকাল তারা ধৈর্য্যধারন করবে। পরিশেষে পৌত্তলিকরা আবু লাহাবের নেতৃত্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নির্যাতন শুরু করলো। প্রকৃতপক্ষে প্রিয় নবীর সাথে আবু লাহাবের শত্রুতামূলক আচরণ আগে থেকেই ছিল। কোরাইশরা আল্লাহর রাসূলের উপর নির্যাতনের কথা চিন্তা করারও আগে আবু লাহাব চিন্তা করছিলো। বনি হাশেমের মজলিস এবং সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এই দূর্বৃত্ত্ব যা বলেছিল, ইতিপূর্বে সেসব কথার উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার পর নবী মোহাম্মদ (সঃ) মারার জন্য আবু লাহাব একটি পাথর তুলেছিলো। (তিরমিযি)

রসূলের নবুয়ত পাওয়ার আগে আবু লাহাব তার দুই পুত্র ওতবা ও ওতাইবাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই কন্যা রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত পাওয়ার পর এবং দ্বীনের দাওয়ার প্রচারের শুরুতে আবু লাহাব নবীর দুই কন্যাকে তালাক দিতে তার দুই পুত্রকে বাদ্য করেছিলো। (তাফসীর ফি জিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ ৩য় খন্ড, পৃ, ২৮২ তাফসীর তাফহীমূল কোরআন, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ষষ্ট খন্ড, ৫৫২(উর্দু সংস্করণ))

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহ ইন্তেকালের পর আবু লাহাব এতো খুশি হয়েছিলো যে, তার বন্ধুদের কাছে দৌড়ে গিয়ে গদ গদ করে বলছিলো যে, মোহাম্মদ অপুত্রক হয়ে গেছে।[তাফসীর তাফহীমূল কোরআন, ষষ্ট খন্ড, পৃ.৪৯০ (উর্দু সংস্করণ)]

ইতিপূর্বে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ্জ মৌসুমে আবু লাহাব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে বাজার এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে তাঁর পেছনে লেগে থাকতো তারেক ইবনে আবদুল্লাহ মুহাবেরীর বর্ণনা থেকে জানা যায় আবু লাহাব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুধু ব্যস্ত থাকত না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করতো এতে তার পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যেতো (জামে তিরমিযি)।

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলের প্রকৃত নাম ছিলো আবওয়া সে ছিলো হারব ইবনে উমাইয়ার কন্যা এবং আবু সুফিয়ানের বোন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে সে তার স্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিলোনা নবী (সা) যে পথে চলাফেরা করতেন, ঐ পথে এবং তার দরজায় সে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং ঝগড়াটে ছিলো এ নোংরা মহিলা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল দেয়া এবং কুটনামি নানা ছুতোয় ঝগড়া, ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছিলো তার কাজ, এ কারণে কোরআন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, এবং তার স্ত্রীও সে ইন্ধন বহন করে।

আবু লাহাবের স্ত্রী যখন জানতে পারলো যে, তার এবং তার স্বামীর নিন্দা করে আয়াত নাযিল হয়েছে, তখন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁজে খুঁজে কাবা শরীফের কাছে এলো, প্রিয় নবী সে সময় কাবাঘরের পাশে অবস্থান করছিলেন, তার সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)ও ছিলেন, আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে ছিলো এক মুঠি পাথর, আল্লাহ রাসূলের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে আল্লাহ তায়ালা তার দৃষ্টি কেড়ে নেন, সে আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পায়নি, হযরত আবু বকরকে দেখতে পাচ্ছিলো, হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমার সাথী কোথায়? আমি শুনেছি তিনি আমার নামে নিন্দা করেছেন, আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে পেয়ে যাই তবে তার মুখে এ পাথর ছুড়ে মারব, দেখো আল্লাহর শপথ, আমিও একজন কবি, এরপর সে এ কবিতা শোনালো, মোযাম্মাম (পৌত্তলিকরা নবী করিম (স.) কে মোহাম্মাদ না বলে মোযাম্মাম বলতো। মোহাম্মদ অর্থ প্রশংসিত, অথচ মোযাম্মাম শব্দের অর্থ এর বিপরীত অর্থাৎ নিন্দিত) আছাইনা ওয়া আমরাহ আবাইনা ওয়া দ্বীনাহু কালাইনা, অর্থাৎ মোযাম্মামের অবাধ্যতা করেছি, তার কাজকে সমর্থন করিনি এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, তার কাজকে সমর্থন করিনি এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি, এরপর সে চলে গেলো।

আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? তিনি বললেন, না দেখেতে পায়নি, আল্লাহ তায়ালা আমার ব্যাপারে তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩৫-৩৩৬)।

আবু বকর রাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তিনি এটুকু সংযোজন করেছেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রী হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে একথাও বলেছিলো যে, আবু বকর, আপনার সঙ্গী আমার নিন্দা করেছেন, আবু বকর বললেন, একথা ঠিক নয়, এই ঘরের প্রভুর শপথ, তিনি কবিতা রচনা করেন না এবং কবিতা মুখেও উচ্চারণ করেন না, আবু লাহাবের স্ত্রী বললো, আপনি ঠিকই বলেছেন।

আবু লাহাব ছিলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিবেশী এবং চাচা, তার ঘর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের কাছাকাছি ছিলো, অন্য প্রতিবেশীরাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতো।

ইবনে ইসহাক বলেন, যেসব লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘরের মধ্যে কষ্ট দিতো তাদের নাম হলে আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আবুল আস ইবনে উমাইয়া, ওকবা ইবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা, ছাকাফি ইবনুল আছদা হুজালি প্রমুখ, এরা সবাই ছিলো তার প্রতিবেশী।

এদের মধ্যে হাকাম ইবনে আবুল আস (তিনি ছিলেন উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে হাকামের পিতা) ব্যতীত অন্য কেউ মুসলমান হয়নি এদের কষ্ট দেয়ার পদ্ধতি ছিলো এ রকম যে, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায আদায় করতেন তখন এদের কেউ বকরির নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে ছুড়ে মারতো যে সেসব গিয়ে তার গায়ে পড়তো, আবার উনুনের ওপর হাড়ি চাপানো হলে বকরির নাড়ি ভুড়ি এমনভাবে নিক্ষেপ করতো যে, সেগুলো গিয়ে সেই হাড়িতে পড়তো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরে নিরাপদে নামায আদায়ের জন্যে ঘরের ভেতর একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর এসব নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপের পর তিনি সেগুলো একটি কাঠির মাথায় নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে বলতেন, হে বনি আবদে মান্নাফ, এটা কেমন ধরনের প্রতিবেশী সুলভ ব্যবহার? এরপর সেসব নাড়িভুঁড়ি ফেলে দিতেন(ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১৬)।

ওকবা ইবনে আবু মুঈত ছিলো জঘন্য দূর্বৃত্ত্ব ও দুস্কৃতিতে ওস্তাদ সহীহ বোখারিতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের পাশে নামায আদায় করছিলেন আবু জেহেল এবং তার কয়েকজন বন্ধু সেখানে বসেছিলো, এমন সময় একজন অন্যজনকে বললো, সক আছো অমুকের উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মোহাম্মাদ যখন সেজদায় যাবে, তখন তার পিঠে চাপিয়ে দিতে পারবে? এরপর ওকবা ইবনে আবু মুঈত (বোখারী শরীফের অন্য এক বর্ণনায় এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৪ দেখুন) উটের নাড়িভুঁড়ি এনে অপেক্ষা করতে লাগলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় যাওয়ার পর সেই নাড়িভুঁড়ি তার উভয় কাঁধের দুদিকে ঝুলিয়ে দিল আমি সব কিছু দেখছিলাম, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না কি যে ভালো হতো হায় যদি আমার মধ্যে তাকে রক্ষা করার শক্তি থাকতো।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এরপর দুর্বৃত্তরা হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়ছিলো, এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় পড়ে রইলেন, মাথা তুললেন না হযরত ফাতেমা (রা.) খবর পেয়ে ছুটে এসে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে ফেললেন এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা থেকে মাথা তুললেন এরপর তিনবার বললেন, আল্লাহুমা আলাইকা বে কোরাইশ অর্থাৎ হে আল্লাহ তায়ালা কোরাইশদের দায়িত্ব তোমার ওপর এই বদদোয়া শুনে তারা নাখোশ হলো, কেননা তারা একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো যে, এই শহরে তার দোয়া কবুল হয়ে থাকে, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাম ধরে বদদোয়া করলেন, হে আল্লাহ আবু জেহেলকে পাকড়াও করো, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ এবং ওকবা ইবনে আবু মুঈতকেও পাকড়াও করো।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্ভবত আরো কয়েকজনের নাম বলেছিলেন, কিন্তু বর্ণনাকারী সেই নাম ভুলে গেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব কাফেরের নাম উচ্চারণ করে বদদোয়া করেছিলেন, আমি দেখেছি বদরের কুয়োয় তাদের সবার লাশ পড়ে আছে (সহীহ বোখারী কিতাবুল ওযু ১ম খন্ড, পৃ. ৩৭)।

উমাইয়া ইবনে খালফ এর অভ্যাস ছিলো যে, সে যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতো তখনই নানা কটূক্তি করতো এবং অভিশাপ দিতো, আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল করেন, ওয়ায়লুল লেকুল্লি হুমাযাতিল লুমাযাহ, অর্থাৎ সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগাল নিন্দা করে, ইবনে হিশাম বলেন, হুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগাল দেয় এবং চোখ বাঁকা করে ইশারা করে, লুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয় যে, পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয় (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৫৬, ৩৫৭)।

উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ছিলো ওকবা ইবনে আবু মুঈতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ওকবা একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসে ইসলামের কিছু কথা শুনেছিলো, উবাই একথা শুন ওকবাকে সমালোচনা করলো এবং নির্দেশ দিলো যে, যাও, তুমি গিয়ে মোহাম্মাদের গায়ে থুথু দিয়ে এসো। ওকবা তাই করলো। উবাই ইবনে খালফ একবার একটি পুরনো হাড় গুড়ো করলো, এরপর সেই গুড়ো বাতাসে ফু দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি উড়িয়ে দিল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬১-৩৬২)

আখলাস ইবনে শোরাইক ছাকাফিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দেয়ার কাজে উৎসাহী ছিলো, কোরআনে করিমে তার নয়টি বদঅভ্যাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এ থেকেই তার কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ধারনা করা যায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, এবং অনুসরণ করো না তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, পশ্চাতে নিন্দাকারী, একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, কল্যাণের কাজে বাধা প্রদান করে, সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ়স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত, (১০-১৩, ৬৮)।

আবু জেহেল কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে কোরআন শুনতো, কিন্তু শোনা পর্যন্তই, সে ঈমানও আনতো না ইসলামের শিক্ষাও গ্রহণ করতো না এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি আনুগত্যের পরিচয়ও দিতো না, বরং সে নিজের কথা দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতো এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করতো, এরপর নিজের এ কাজের জন্যে গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে নিতো, মনে হতো যে বড় ধরনের কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে ফেলেছে, পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে নাযিল করেছেন (তাফসীরে ফী যিলালিল কোরআন, ২৯ খন্ড) আল্লাহ বলেন, যে বিশ্বাস করেনি এবং নামায আদায় করেনি, বরং যে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো এরপর সে তার পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে গিয়েছিলো দম্ভ ভরে, দুর্ভোগ তোমার জন্য দুর্ভোগ (৩১-৩৫, ৭৫)।

আবু জেহেল প্রথম দিনেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তাকে নামায থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, একবার নবী (সা.) মাকামে ইবরাহীমের কাছে নামায আদায় করছিলেন, আবু জেহেল সে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সে বললো, মোহাম্মাদ আমি কি তোমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করিনি? সাথে সাথে সে হুমকিও দিলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও হুমকি দিয়ে জবাব দিলেন এরপর আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ আমাকে কেন ধর্মক দিচ্ছো? দেখো এই মক্কায় আমার মজলিস হচ্ছে সবচেয়ে বড়, আবু জেহেলের এর উদ্ধত কথায় আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, আচ্ছা সে যেন মজলিসকে ডাকে (তাফসীরে ফী যিলালিল কোরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, পারা ৩০, পৃ.২০৮) আমিও শাস্তি দেয়ার ফেরেশতাদের ডাক দিচ্ছি।

এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু জেহেলের চাদর গলার কাছে ধরে বললেন, দুর্ভোগ, তোমার জন্য দুর্ভোগ, আবার দুর্ভোগ, তোমার জন্য দুর্ভোগ (ঐ)

একথা শুনে আল্লাহর দুশমন আবু জেহেল বললো, হে মোহাম্মাদ আমাকে হুমকি দিচ্ছো? খোদার কসম, তুমি এবং তোমার পরওয়ারদেগার আমার কিছুই করতে পারবে না, মক্কার উভয় পাহাড়ের মাঝে চলাচলকারীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত মানুষ।

পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হুমকি সত্বেও আবু জেহেল তার নির্বুদ্ধিতামূলক আচরণ থেকে বিরত থাকেনি, বরং তার দুস্কৃতি আরো বেড়ে গিয়েছিলো, সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, কোরাইশ সর্দারের কাছে একদিন আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ আপনাদের সামনে নিজের চেহারা ধুলায় লাগিয়ে রাখে কি? কোরাইশ সর্দাররা বললো, হাঁ, আবু জেহেল বললো, লাত এবং ওযযার শপথ, আমি যদি তাকে এ অবস্থায় দেখি, তবে তার ঘাড় ভেঙ্গে দেবো, তার চেহারা মাটিতে হেচড়াবো, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তার ঘাড় মটকে দেয়ার জন্য সে অগ্রসর হলো, কিন্তু সবাই দেখলো যে, আবু জেহেল চিৎকার হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে, বাচাও, বাচাও, পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, আবুল হাকাম, তোমার কি হয়েছে? আবু জেহেল বললো, আমি দেখলাম যে, আমার এবং মোহাম্মাদের মাঝখানে আগুনের একটি পরিখা, ভয়াবহ সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে বললেন, যদি সে আমার কাছে আসতো, তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিড়ে ফেলতো (সহীহ মুসলিম)।

একদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ধরনের যুলুম অত্যাচারমূলক ব্যবহার করা হচ্ছিলো অন্যদিকে তার প্রতি মক্কার যে সাধারণ মানুষের গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা ছিলো, তারা তাকে তার মহান ব্যক্তিত্বের কারণে অসাধারণ মর্যাদা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতো, উপরন্তু তারা চাচা আবু তালিবের সমর্থন ও সহায়তা তার প্রতি ছিলো, তা সত্ত্বেও তার প্রতি এসব অত্যাচার করা হচ্ছিল, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদের প্রতি, বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতন ছিলো আরো ভয়াবহ, প্রত্যেক গোত্র তাদের গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিচ্ছিল, যারা মক্কার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না তাদের ওপর উচ্ছৃঙ্খল এবং নেতৃস্থানীয় লোকেরা নানা প্রকার অত্যাচার নির্যাতন চালাতো, সেসব অত্যাচারের বিবরণ শুনলে শক্ত মনের মানুষও অস্থির হয়ে উঠতো।

কোন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে আবু জেহেল তাকে গালমন্দ ও অপমান করতো, এছাড়া সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত কারার হুমকি দিতো, কোন দুর্বল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ধরে প্রহার করতো এবং অন্যদেরও প্রহার করতে অন্যদের উৎসাহিত করতো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২০)।

হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তার চাচা তাকে খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধুয়ো দিত (রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ.৫৭)।

হযরত মাসয়াব ইবনে ওমায়ের (রা.) এর মা তার ইসলাম গ্রহণের খবর শোনার পর পুত্রের পানাহার বন্ধ করে দেয় এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়, হযরত মাসয়াব ছোট বেলা থেকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়েছেন, পরিস্থিতির কারণে তিনি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে, তার গায়ের চামড়া খোলস ছাড়ানো সাপের গায়ের মতো হয়ে গিয়েছিলো (ঐ পৃ. ৫৮)।

হযরত বেলাল (রা.)ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস, ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া হযরত বেলাল (রা.)কে গলায় দড়ি বেধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত, বালকেরা তাকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতো, এ রকম করায় তার গলায় দড়ির দাগ পড়ে যেতো, উমাইয়া নিজেও তাকে বেধে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করতো, এরপর উত্তপ্ত বালির ওপর জোর করে শুইয়ে রাখতো, এ সময়ে তাকে অনাহারে রাখা হতো, পানাহার কিছুই দেয়া হতো না, কখনো কখনো দুপুরের রোদে মরু বালুকার ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখতো, এ সময় বলতো, তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখা হবে তবে বাচতে চাইলে মোহাম্মাদের পথ ছাড়ো, কিন্তু তিনি এমনি কষ্টকর অবস্থাতেও বলতেন, আহাদ, আহাদ, তার ওপর নির্যাতন চলতে দেখে হযরত আবু বকর (রা.) একদিন খুবই ব্যথিত হলেন, তিনি হযরত বেলাল (রা.)কে একটি কালো ক্রীতদাসের পরিবর্তে মতান্তরে দুশো দিরহামের পরিবর্তে ক্রয় করে মুক্তি দেন (রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, তালাকিহে ফুহুম, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩১৮)।

হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা.) ছিলেন বনু মাখযুমের ক্রীতদাস, তিনি এবং তার পিতামাতা ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করা হলো, আবু জেহেলের নেতৃত্বে পৌত্তলিকরা তাদেরকে উত্তপ্ত রোদে বালুকাময় প্রান্তরে শুইয়ে কষ্ট দিতো, একবার তাদের এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিলো, এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি বললেন, হে ইয়াসের পরিবার, ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত।

অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হযরত ইয়াসের (রা.) ইন্তেকাল করেন, তার স্ত্রী হযরত আম্মারের মা হযরত ছুমাইয়া (রা.) এর লজ্জাস্থানে দুর্বৃত্ত আবু জেহেল বর্শা নিক্ষেপ করে, এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন, তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ, হযরত আম্মারের ওপর তখনো অব্যাহতভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিল, তাকে কখনো উত্তপ্ত বালুকার ওপর শুইয়ে রাখা হতো, কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো পানিতে চেপে ধরা হতো, পৌত্তলিকরা তাকে বলতো যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মোহাম্মাদকে গালি না দেবে এবং লাত ওযযা সম্পর্কে প্রশংসনীয় কথা না বলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাকে ছাড়তে পারব না, হযরত আম্মার (রা.) বাধ্য হয়ে তাদের কথা মেনে নেন, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কাঁদতে কাঁদতে হাযির হন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তখন পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন, কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফুরির জন্যে হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্যে আছে সহজ শাস্তি কিন্তু তার জন্যে নয়, যাকে কুফুরির জন্যে বাধ্য করা হয়, কিন্তু তার চিত্ত ইমানে অবিচলিত থাকে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩২০, ফেকহুছ সীরাত, মোহাম্মাদ গাযযালি, পৃ.৮২, আওফি হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এর কিছু অংশ বর্ণনা করেছেন, দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসির)।

হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক মহিলার ক্রীতদাস ছিলেন পৌত্তলিকরা তার ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো তাকে মাটির ওপর টানতো (রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭. এজাযুত তানযিল পৃ. ৫৩) তার মাথার চুল ধরে টানতো এবং ঘাড় মটকে দিতো, কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপর তাকে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে তিনি উঠতে না পারেন (ঐ, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, তালকিহুল ফহুম পৃ. ৬০)।

যিন্নীরাহ (যিন্নিরাহ মিসকিনার ওবনে অর্থাৎ ওই শব্দের মতোই হবে এ শব্দের উচ্চারণ) নাহদিয়া এবং তাদের কণ্যা এবং উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতদাসী, এরা ইসলাম গ্রহণ করে পৌত্তলিকদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করেন, শান্তির কিছু দৃষ্টান্ত ওপরে তুলে ধরা হয়েছে বনু আদী গোত্রের একটি পরিবার বনু মোযাম্মেলের একজন দাসী ইসলাম গ্রহন করেছিলেন, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) তখনো ইসলাম গ্রহন করেননি, তিনি সেই দাসীকে অস্বাভাবিক প্রহার করে বিরতি দিয়ে বলতেন, তোমার প্রতি দয়ার কারণে নয় বরং নিজে ক্লান্ত হয়েই ছেড়ে দিলাম (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৩১৯)

পরিশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত বেলাল এবং আমের ইবনে ফোহায়রার মতোই এসব দাসীকেও ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩১৮-৩১৯)।

পৌত্তলিকরা বীভৎস উপায়েও ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিতো, তারা কোন কোন সাহাবীকে উট এবং গাভীর কাচা চামড়ার ভেতর জাড়িয়ে বেধে রোদে ফেলে রাখতো, কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখতো, কারো ইসলাম গ্রহণের খবর পেলে দুর্বৃত্ত পৌত্তলিকরা নানা উপায়ে তার ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চালাতো, মোট কথা আল্লাহর মনোনীত দ্বীন গ্রহণকারীদের ওপর যে সব নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিলো তার তালিকা খুবই দীর্ঘ এবং বড়োই বেদনাদায়ক (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৮)।

দারে আরকাম

অত্যাচারের এবং নির্যাতনের ভয়াবহ এ অবস্থায় কৌশল হিসাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের বলেছিলেন যে, প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা নতুন মুসলমানরা যেন প্রচার না করেন, তাছাড়া দেখা সাক্ষাত এবং মেলামেশার ব্যাপারে মুসলমানরা যেন গোপনীয়তার আশ্রয় নেন, কেননা আল্লাহর রাসূলের সাথে মুসলমানদের দেখা সাক্ষাতের কথা যদি অমুসলিমরা শোনে তাহলে তারা ইসলামের শিক্ষা দীক্ষার প্রসারে বাধা সৃষ্টি করবে, ফলে উভয়ের পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠবে, নবুয়তের চতুর্থ বছরে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল, ঘটনাটি হচ্ছে, সাহাবায়ে কেরাম ঘাটিতে একত্রিত হয়ে নামায আদায় করতেন, একবার সে অবস্থায় তাদের একদল পৌত্তলিক দেখে ফেলে, এ সময় তারা মুসলমানদের গালাগাল করতে শুরু করে এবং লড়াই ঝগড়া শুরু করে, এ পর্যায়ে হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.)একজন লোককে এমনভাবে প্রহার করলেন যে তাতে, রক্ত গড়িয়ে গেলো, ইসলামে এটা ছিলো রক্তপাতের প্রথম ঘটনা (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৩ মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ আবদুল ওয়াহাব)।

এ ধরনের সংঘর্ষ বারবার ঘটলে এবং দীর্ঘায়িত হলে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, এ কারণে গোপনীয়তার কৌশল অবলম্বন করা ছিলো অত্যাবশ্যক, এই কৌশল অনুযায়ী সাধারণ সাহাবায়ে কেরাম তাদের ইসলাম গ্রহণ, এবাদত বন্দেগী, তাবলীগ, পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ মেলামেশা সবই গোপনভাবে করতেন, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাবলীগে দ্বীন এবং এবাদত সব কিছুই প্রকাশ্যে করতেন, কোন বাধাই তাকে এ কাজ থেকে বিতর রাখতে পারেনি, তবুও তিনি মুসলমানদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতেন, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম মাখযমীর ঘর সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছিলো, এখানে পৌত্তলিক বিদ্রোহীরা আসত না একারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়তের পঞ্চম বছর থেকে দারে আরকামকে দ্বীনের দাওয়াত এবং মুসলমানদের সাথে মেলামেশার কেন্দ্র রূপে নির্ধারণ করেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদী পৃ. ৬১)।
আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত
যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনের এ ধারা নবুয়তের চতুর্থ বছরের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে শুরু হয়েছিল, প্রথমদিকে ছিলো মামুলি কিন্তু দিনে দিনে এর মাত্রা বেড়ে চললো, নবুয়তের পঞ্চম বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা চরমে পৌছলো, মক্কায় অবস্থান করা মুসলমানদের জন্যে অসম্ভব হয়ে উঠলো, সেই সঙ্কটময় এবং অন্ধকার সময়ে সূরা কাহাফ নাযিল হলো, এতে পৌত্তলিকদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়েছে, তাতে বর্ণিত তিনটি ঘটনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মোমেন বান্দাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত দেয়া হয়েছে, আসহাবে কাহাফের ঘটনায় এ শিক্ষা মজুদ রয়েছে যে, দ্বীন ঈমান যখন আশঙ্কার সম্মুখীন হয় তখন কুফুরী এবং যুলুম-অত্যাচারের কেন্দ্র থেকে সশরীরে হিজরত করতে হবে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যখন ওদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করে তাদের কাছ থেকে তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহন কর, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্যে তাঁর দয়া বিস্তার করবেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করার ব্যবস্থা করবেন, (১৬, ১৮)।

হযরত মূসা (আ.) এবং হযরত খিযির (আ.) এর ঘটনা থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, পরিণাম সব সময় প্রকাশ্য অবস্থা অনুযায়ী নির্ণীত হয় না, বরং কখনো কখনো প্রকাশ্য অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীতও হয়ে থাকে, কাজেই এ ঘটনায় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধ বর্তমানে যেসব যুলুম অত্যাচার হচ্ছে, তার পরিণাম হবে সম্পূর্ণ বিপরীত, এসব পৌত্তলিক ও উদ্ধত বিদ্রোহী ঈমান না আনলে একদিন তারা পরাজিত হয়ে বাধ্য হবে মুসলমানদের সামনে মাথা নত করতে এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য মুসলমানদের সামনে আত্মসমর্পণ করবে,।

যুলকারনাইনের ঘটনায় নীচে উল্লিখিত কয়েকটি শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,

এক. যমীনের মালিকানা আল্লাহর, তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তার অংশীদার করেন।

দুই. সাফল্য একমাত্র ঈমানের পরে রয়েছে কুফুরীর পথে নেই।

তিন. আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে বান্দাদের মধ্যে থেকে এমন মানুষদের উত্থান ঘটান যারা যুলুম ও উৎপীড়িত মানুষদের সেই কাফের ইয়াজুজ মাজুজদের কবল থেকে মুক্তি দেন।

চার. আল্লাহর পুণ্যশীল বান্দারা যমীনের অংশীদার হওয়ার সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত।

সূরা কাহাফের পর আল্লাহ তায়ালা সূরা ঝুমার নাযিল করেন, এতে হিজরতের প্রতি ইশারা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যমিন সংকীর্ণ নয়, আল্লাহ তায়ালা বলেন, বলো, হে আমার মোমেন বান্দারা, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ভয় কর, যারা এ দুনিয়ায় কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্য আছে কল্যাণ, প্রশস্ত আল্লাহর পৃথিবী, ধৈর্যশীলকে তো অপরিমিত পুরস্কার দেয়া হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিলো যে, হাবশার বাদশাহ আসহামা নাজ্জাশী একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক, তার রাজ্যে কারো ওপর কোন যুলুম অত্যাচার করা হয় না, এ কারণে আল্লাহর রাসূল মুসলমানদেরকে তাদের দ্বীনের হেফাজতের জন্য হাবশায় হিজরত করার আদেশ দিলেন, এরপর পরিকল্পিত কর্মসূচী অনুযায়ী রজব মাসে সাহাবায়ে কেরামের প্রথম দল হাবশার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, এ দলে বারো জন পুরুষ এবং চারজন মহিলা ছিলেন, হযরত ওসমান (রা.) ছিলেন দলনেতা, তার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা হযরত রোকাইয়া (রা.) ও ছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেন, হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং হযরত লুত (আ.) এর পর আল্লাহর পথে হিজরতকারী এরা প্রথম দল (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আমানুল্লাহ)।

রাতের অন্ধকারে চুপিসারে এরা গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হয়, কোরাইশদের জানতে না দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের সতর্কতার ব্যবস্থা করা হয় প্রথমে তারা লোহিত সাগরের শুরাইবা বন্দরের দিকে অগ্রসর হন, সৌভাগ্যক্রমে সেখানে দুটি বাণিজ্যিক নৌকা পাওয়া গিয়েছিলো, সেই নৌকায় আরোহণ করে তারা নিরাপদে হাবশায় গমন করেন, তারা চেল যাওয়ার পর কোরাইশরা তাদের যাওয়ার খবর পায়, তারা খবর পাওয়ার পরই সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত ছুটে যায়, কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আগেই চলে গিয়েছিলেন, এ কারণে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, ওদিকে মুসলমানরা হাবশায় পৌছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন (রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৬১ যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ২৪)।

সেই বছরই রমযান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম শরীফে গমন করেন, সেখানে নেতৃস্থানীয় কোরাইশরা সমবেত হয়েছিলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে সূরা নাজম তেলাওয়াত শুরু করেন, একত্রে এতো পৌত্তলিক এর আগে কখনও কোরআন শোনেনি, কেননা তাদের সিদ্ধান্ত ছিলো এ রকম যে, কখনো কোরআন শোনা যাবে না, কোরআনের ভাষায়, কাফেররা বলে, তোমরা এই কোরআন শ্রবণ করো না, এবং তা যখন তেলাওয়াত করা হয়, তখন শোরগোল করো যাতে, তোমরা জয়ী হতে পারো (২৬, ৪১)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হঠাৎ করে মধুর স্বরে কোরআন তেলাওয়াত শুরু করলে পৌত্তলিকরা মোহিত হয়ে পড়ে তারা কোরআনের লালিত্য ভাষার মাধুর্যে ছিলো মুগ্ধ ও বিমোহিত, কারো মনে সে সময় অন্য কোন চিন্তাই আসেনি, সবাই এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিলো, সূরার শেষ দিকের এই আয়াত তিনি তেলাওয়াত করলেন, আল্লাহর জন্যে সেজদা করো এবং তার এবাদত করো, এই আয়াত পাঠ করার পরই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদায় চলে গেলেন, সাথে সাথে পৌত্তলিকরাও সেজদা করলো, সত্যের প্রভাব এবং মাধুর্য অমুসলিমদের অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছিলো, তারা কেউই নিজের মধ্যে ছিলো না এ কারণে নিজের অজ্ঞাতেই সেজদায় নত হয়েছিল (সহীহ বোখারী শরীফে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে)।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তারা অবাক হয়ে গেলো, যে দ্বীনকে নিশ্চিহ্ন করতে তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেই কাজেই তাদের নিয়োজিত হতে দেখে সেখানে অনুপস্থিত পৌত্তলিকরা তাদের তিরস্কার করলো, তিরস্কারের কবল থেকে রক্ষা পেতে তারা তখন বললো, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মূর্তিগুলোর কথা সম্মানের সাথে উল্লেখ করছেন, নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তারা বললো, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওরা সব উচ্চমার্গের দেবী এবং তাদের শাফায়াতের আশা করা যেতে পারে।

অথচ এটা ছিল সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সেজদা করে তারা যে ভুল করেছিলো, তার একটা যুক্তিসঙ্গত ওযর পেশ করতে এ গল্প তৈরি করেছিলো। বলা বাহুল্য, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সব সময় মিথ্যাবাদী বলে রটনা করে, তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা কুৎসা রটায় তারা আত্মরক্ষার জন্য এ ধরনের বানোয়াট কথার আশ্রয় নেবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই (উল্লিখিত বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর বিশেষজ্ঞরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন)।

কোরাইশদের এই সেজদা করার খবর হাবসায় হিজরতকারী মুসলমানরাও পেয়েছিল, কিন্তু তারা ভুল খবর পেয়েছিলেন, তারা শুনেছেন যে, কোরাইশ নেতারা মুসলমান হয়ে গিয়েছে, এ খবর পাওয়ার পর শাওয়াল মাসে তারা মক্কায় ফিরে আসার জন্য হাবসা ত্যাগ করেন, মক্কা থেকে একদিনের দূরত্বে থাকার সময় তারা প্রকৃত খবর পেলেন, এরপর কেউ কেউ হাবসায় ফিরে গেলেন, আবার কেউ কেউ চুপিসারে অথবা কোরাইশদের কোন লোকের আশ্রিত হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেন (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ২৪, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৪, হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬৪)।

আবিসিনিয়ায় দ্বিতীয় হিজরত

এরপর সেই হিজরতকারী মোহাজেরদের উপর, বিশেষভাবে মুসলমানদের উপর সাধারণভাবে পৌত্তলিকদের অত্যাচার আরো বেড়ে গেল, পরিবারের অমুসলিমরা মুসলমানদের নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো কেননা কোরাইশরা খবর পেয়েছিলো যে, নাজ্জাশী মুসলমানদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন, এবং হাবসায় মুসলমানরা খুব ভালোভাবে দিন কাটিয়েছেন, এ খবর তাদের অন্তরজ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছিলো, কোরাইশদের অত্যাচার নির্যাতন বাড়িয়ে যাওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় হাবসায় হিজরত করতে সাহাবাদের পরামর্শ দিলেন, তবে প্রথম বারের হিজরতের চেয়ে এটা ছিল কঠিন, কোরাইশ পৌত্তলিকরা এবারে ছিল সতর্ক, তাদের ফাকি দিয়ে মুসলমানরা অন্যত্র চলে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করবে এটা তারা ভাবতেই পারছিলো না, কিন্তু মুসলমানরা অমুসলমানদের চেয়ে অধিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়ায় আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য হাবসায় যাওয়ার পথ সহজ করে দিলেন, ফলে হিজরতকারী মুসলমানরা কোরাইশদের নিয়ন্ত্রনে যাওয়ার আগেই হাবসার বাদশার কাছে পৌঁছে গেলেন, এবার বিরাশি বা তিরাশিজনের একটি দল হিজরত করনে, হযরত আম্মার (রা.) এর হিজরতের চেয়ে ভিন্ন ঘটনা, এ হিজরতে আঠারো উনিশজন মহিলা ছিল (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ১৪০, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৬০) আল্লামা মনসুরপুরী মহিলাদের সংখ্যা আঠারো বলে উল্লেখ করেছেন (রহমাতুল লিল আলামিন)।

আবিসিনিয়ায় কোরাইশদের ষড়যন্ত্র

মুসলমানরা জীবন ও ঈমান নিয়ে এক জায়গায় চলে গেছে এটা ছিলো কোরাইশদের জন্য মারাত্মক মনোবেদনার কারণ, অনেক আলোচনার পর তারা আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে হাবসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল।

এই দুজন তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি, এরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিলেন, হাবসার বাদশাহকে দেওয়ার জন্য কোরাইশরা এই দুজন দূতের জন্য মূল্যবান উপঢৌকন পাঠালো, এরা প্রথম বাদশাহকে উপঢৌকন দিলেন, এরপর সেসব যুক্তি এবং কারণ ব্যাখ্যা করলেন, যার ভিত্তিতে তারা মুসলমানদের জন্য মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান, তারা বললো, হে বাদশাহ, আপনার দেশে আমাদের কিছু নির্বোধ যুবক পালিয়ে এসেছে, তারা স্বজাতির ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছে, কিন্তু আপনি যে ধর্মে বিশ্বাস পোষণ করেন সেই ধর্ম বিশ্বাসও তারা গ্রহণ করেনি, বরং তারা এক নব আবিস্কৃত ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণ করেছ, এ ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আমরাও কিছু জানিনা আপনারাও কিছু জানেন না, ওদের পিতা মাতা ও আত্মীয়স্বজন আমাদেরকে ওদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন, তারা চান না যে, আপনারা তাদের নির্বোধ লোকদের আমাদের সাথে ফিরিয়ে দেবেন, তারা নিজেদের লোকদের ভালো মন্দ সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝেন, দরবারের সভাসদরাও চাচ্ছিলেন যে, বাদশাহ যেন মুসলমানদের ফিরিয়ে দেন।

নাজ্জাশী ভাবলেন যে, এ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সব দিক ভালভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে, তিনি মুসলমানদের তার দরবারে ডেকে পাঠালেন, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা নির্ভয়ে সত্য কথা বলবে, এতে পরিণাম যা হয় হবে, মুসলমানরা দরবারে আসার পর নাজ্জাশী জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা যে ধর্ম বিশ্বাসের কারণে নিজেদের স্বজাতীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ সেটা কি? তোমরা তো আমার অনুসৃত ধর্ম বিশ্বাসে প্রবেশ করোনি, মুসলমানদের মুখপাত্র হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (রা.) বলেন হে বাদশাহ, আমরা ছিলাম মূর্তি পূজায় লিপ্ত একটি মূর্খ জাতী, আমরা মৃত পশুর মাংস খেতাম, পাপ কাজে লিপ্ত থাকতাম, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম, আমাদের মধ্যে শক্তিশালীরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতো, আমরা যখন এরূপ অবস্থায় ছিলাম, তখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের মধ্যে একজনকে রসূলরূপে পাঠান, তাঁর উচ্চ বংশ মর্যাদা, সত্যবাদিতা, সচ্চরিত্রতা, আমানতদারী, ও বিশ্বস্ততা, সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই জানতাম, তিনি আমাদেরকে আল্লাহর পথে ডেকে বুঝিয়েছেন যে, আমরা যেন এক অদ্বিতীয় কে মানি এবং তার ইবাদত করি, যেসব মূর্তি ও পাথরকে আমাদের পিতামহ পূজা করতেন সেসব যেন পরিত্যাগ করি, তিনি আমাদের সত্য বলা, আমানত আদায় করা, নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, পাপ না করা, রক্তপাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, অশ্লীল কাজে লিপ্ত, মিথ্যা বলা, এতিমের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা এবং সতী পুণ্যশীলা মহিলার নামে অপবাদ না দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি বলেছেন, আমরা যেন শুধু আল্লাহর ইবাদত করি, তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করি, তিনি আমাদের নামাজ আদায়, রোজা রাখা, যাকাত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, হযরত জাফর (রা.)ইসলামের এসব পরিচয় এভাবে তুলে দেওয়ার পর বললেন, আমরা সেই পয়গম্বরকে সত্য বলে মেনেছি, তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন, আনীত দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য করেছি, আমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করেছি এবং তার সাথে অন্য কাউকে শরিক করেনি, সেই পয়গম্বর সেসব জিনিস নিষিদ্ধ বলেছেন, সেগুলোকে আমরা নিষিদ্ধ মনে করেছি, যেগুলোকে হালাল বা বৈধ বলেছেন, সেগুলোকে হালাল বলে মনে করেছি, এ সব কারণে স্বজাতীয় লোকেরা আমাদের ওপর নাখোশ হয়েছে, তারা আমাদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পূর্ববর্তী ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে, তারা চায়, আমরা যেন আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজার প্রতি ফিরে যাই, যেসব নোংরা জিনিস ইতিপূর্বে হারাম মনে করেছিলাম, সেসব কিছুকে যেন হালাল মনে করি, ওরা যখন আমাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বহুলাংশে বাড়িয়ে, পৃথিবীকে আমাদের জন্য সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছে এবং তারা আমাদের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমরা আপনার দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি এবং অন্যদের তুলনায় আপনাকে প্রাধান্য দিয়ে আপনার আশ্রয়ে থাকা পছন্দ করেছি, আমরাও আশা পোষণ করেছি যে, আপনারা এখানে আমার উপর কোন প্রকার জুলুম অত্যাচার করা হবে না।

নাজ্জাশী বললেন, আমাকে তোমাদের রসূলের আনীত গ্রন্থ থেকে একটু পড়ে শোনাও।

হযরত জাফর (রা.) সূরা মরিয়মের প্রথম অংশের কয়েকটি আয়াত পাঠ করলেন, তা শুনে নাজ্জাশীর মন পরিবর্তন হলো, তিনি অবিরাম কাঁদতে থাকলো, তাঁর দাড়ি অশ্রুতে ভিজে গেলো, তাঁর ধর্মীয় উপদেষ্টারাও এতো বেশী কাঁদলেন যে, তাদের সামনে মেলে রাখা ধর্মীয় গ্রন্থের উপর অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, নাজ্জাশী এরপর বললেন, এই বাণী হযরত মূসা (আ.) আনীত বাণী একই উৎস থেকে উৎসারিত, এরপর নাজ্জাশী আমর ইবনুল আস এবং আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াহকে বললেন, তোমরা চলে যাও, আমি ঐ সব লোককে তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারবে না, এখানে তাদের কোন প্রকার কারসাজি আমি সহ্য করবো না।

বাদশাহর নির্দেশের পর কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধি দরবার থেকে বেরিয়ে এলো, এরপর আমর ইবনুল আস আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়াকে বললো, আগামীকাল ওদের বিরুদ্ধে বাদশাহর কাছে এমন কথা বলবো যে, ওদের সব চালাকি ছুটিয়ে দেব, আবদুল্লাহ ইবনে রবিয়া বললেন, না তার দরকার নেই, ওরা যদিও আমার ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করেছি, কিন্তু ওরা তো আমার গোত্রের লোক, তবুও আমর ইবনুল আস তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।

পরদিন আমর ইবনুল আস বাদশাহর দরবারে গিয়ে বললেন, হে বাদশাহ, ওরা ঈসা ইবনে মারিয়াম (রা) সম্পর্কে এক অদ্ভুত কথা বলে, এ কথা শুনে নাজ্জাশী পুনরায় মুসলমানদের ডেকে পাঠালেন, তিনি হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে মুসলমানদের মতামত জানতে চাইলেন, মুসলমানরা এবার ভয় পেয়ে গেলেন, তবু তারা ভাবলেন, আল্লাহর উপর ভরসা, যা হবার হবে, তারা কিন্তু সত্য কথা বলে।

নাজ্জাশীর প্রশ্নের জবাবে হযরত জাফর (রা.) বললেন, আমরা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে সেই কথাই বলে থাকি, যা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা, তাঁর রসূল, তাঁর রূহ এবং তাঁর কালেমা, তাকে আল্লাহ তায়ালা কুমারী সতী সাধ্বী হযরত মরিয়ম (আ.) এর উপর ন্যস্ত করেছেন।

এ কথা শুনে নাজ্জাশী মাটি থেকে একটি কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে বললেন, খোদার কসম, তোমরা যা কিছু বলেছ, হযরত ঈসা (আ.) এই কাঠের টুকরোর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না, এ কথা শুনে ধর্মীয় উপদেষ্টাগণ হুঁ হুঁ শব্দ উচ্চারণ করে বিরক্তি প্রকাশ করলেন, বাদশাহ বললেন, তোমরা হুঁ হুঁ বললেও আমি যা বলছি এ কথা সত্য।

এরপর নাজ্জাশী মুসলমানদের বললেন, যাও, তোমরা আমার দেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ, যারা তোমাদের উপর গালি দেয়, তাদের উপর জরিমানা ধার্য করা হবে, আমি চাইনা কেউ তোমাদের কষ্ট দিক, আর তার পরিবর্তে আমি সোনার পাহাড় লাভ করি।

এরপর নাজ্জাশী তার ভৃত্যদের বললেন, মক্কা থেকে আগত প্রতিনিধিদের আনীত উপঢৌকন তাদের ফিরিয়ে দাও, এগুলোর কোন প্রয়োজন নেই, আল্লাহর শপথ, তিনি যখন আমাকে আমার দেশে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আমার কাছ থেকে কোন ঘুষ নেন নি, আমি কেন তাঁর পথে ঘুষ নেব, এছাড়া তিনি অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমার ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা গ্রহণ করেন নি, আমি কেন আল্লাহর ব্যাপারে অন্য লোকদের কথা মানবো?

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, কোরাইশদের উভয় প্রতিনিধি এরপর তাদের আনীত উপঢৌকনসহ অসম্মানজনকভাবে দেশে ফিরে এলো, আমরা নাজ্জাশীর দেশে একজন ভালো প্রতিবেশীর ছত্রছায়ায় অবস্থান করতে লাগলাম (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৩৪-৩৩৮)।

উল্লেখিত ঘটনার বর্ণনা ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন অন্যান্য সীরাত রচয়িতারা লিখেছেন, নাজ্জাশীর দরবারে হযরত আমর ইবনুল আস বদরের যুদ্ধের পর গিয়েছিলেন, কেউ কেউ উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য লিখেছেন, মুসলমানদের ফিরিয়ে আনার জন্যে আমার ইবনুল আস নাজ্জাশীর দরবারে দুবার গিয়েছিলেন, কিন্তু বদরের যুদ্ধের পরে নাজ্জাশী এবং হযরত জাফরের মধ্যেকার কথোপকথনের যে বিবরণ ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন, সেটা হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরবর্তী সময়ের কথোপকথনের অনুরূপ, তাছাড়া নাজ্জাশীর প্রশ্নের ধরন দেখে বোঝা যায় যে, তার সাথে মুসলমানদের কথাবার্তা একবারই হয়েছিলো আর সেটা হয়েছিলো হাবশায় মুসলমানদের হিজরতের পরপরই।

মোটকথা পৌত্তলিকদের কৌশল ব্যর্থ হলো, তারা বুঝতে পেরেছিলো যে, শত্রুতামূলক আচরণ যতোটা করার, সেটা নিজেদের সীমানার মধ্যেই করতে হবে, তবে, এসময় তারা একটা মারাত্মক বিষয় ভাবতে শুরু করলো, তারা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলে যে, এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তাদের দুটি পথ খোলা রয়েছে, হয় শক্তি প্রয়োগে আল্লাহর রাসূলের দ্বীনি তাবলীগ বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তার অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে, কিন্তু দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ ছিল না, কারণ স্বয়ং আবু তালেব ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিম্মাদার, তিনি পৌত্তলিকদের সঙ্কল্পের সামনে লৌহ যবনিকার মতো দাঁড়িয়েছিলেন, এমতাবস্থায় তারা পুনরায় আবু তালেবের সাথে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করলো।

আবু তালেবের প্রতি হুমকি

এ প্রস্তাবের পর কোরাইশ নেতারা আবু তালেবের কাছে গিয়ে বললেন, হে আবু তালেব আপনি আমাদের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী, আমরা আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে ফিরিয়ে রাখুন, কিন্তু আপনি রাখেননি, আপনি মনে রাখবেন, আমাদের পিতা-পিতামহকে গালাগাল দেয়া হবে এটা সহ্য করতে পারব না, আমাদের বুদ্ধি বিবেক বিচার বিবেচনাকে নিবুদ্ধিতা বলা হবে এবং উপাস্যদের দোষ বের করা হবে, এটাও আমাদের সহ্য হবে না, আপনি তাকে বাধা দিন এবং বিরত রাখুন, যদি এতে ব্যর্থ হন, তবে আপনার এবং আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে এমন লড়াই বাধিয়ে দিব যে, এতে বহু প্রাণহানি ঘটবে।

এ হুমকিতে আবু তালেব প্রভাবিত হলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে বললেন, ভাতিজা, তোমার কওমের লোকেরা আমার কাছে এসে এসব কথা বলে গেছে, কাজেই, তুমি এবার আমার এবং তোমার নিজের প্রতি দয়া করো, তুমি এ বিষয়ে আমার ওপর এমন বোঝা চাপিও না, যা আমি বহন করতো পারবো না।

একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝতে পারলেন যে, এবার তার চাচাও তাকে পরিত্যাগ করবে, তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে তিনিও দুর্বল হয়ে পড়েছেন, এ কারণে তিনি বললেন, চাচাজান, আল্লাহর শপথ, যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিয়ে কেউ বলে একাজ ছেড়ে দাও, তবুও আমি তা ছাড়তে পারব না, হয়তো একাজের পূর্ণতা বিধান করে আমি একে জয়ী করবো অথবা এ কাজ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যাব।

একথা বলে আবেগের আতিশয্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেঁদে ফেললেন, এরপর চলে যেতে লাগলেন, চাচা আবু তালেবের মন কেঁদে উঠলো, তিনি ভাতিজাকে ডেকে বললেন, যাও ভাতিজা, তুমি যা চাও, তাই করো, আল্লাহর শপথ, আমি কোন অবস্থায় কখনো তোমাকে ছাড়তে পারবো না (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫, ২৬৬)।

খোদার শপথ তোমার কাছে যেতে ওরা, পারবে না তো দলে দলে,

যতদিন না দাফন হবো আমি মাটির তলে

বলতে থাকো তোমার কথা খোলাখুলি করো না আর কোন ভয়

দুচোখ তোমার শীতল হোক আর, খুশী হোক তোমার হৃদয় (মোখতারুস সীরাত, শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব নজদী, পৃ. ৬৮)।

আবু তালেবের কাছে পুনরায় কোরাইশ প্রতিনিধি দল

মারাত্মক রকমের হুমকি সত্ত্বেও কোরাইশরা যখন দেখলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তারা বুঝতে পারলো যে, আবু তালেব তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে পরিত্যাগ করতে পারবে না, বরং প্রয়োজনে তিনি কোরাইশদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন এবং শত্রুতার জন্যেও প্রস্তুত আছেন, এরূপ চিন্তা করে কোরাইশ নেতারা ওলীদ ইবনে মুগীরার পুত্র আম্মারকে সঙ্গে নিয়ে আবু তালেবের কাছে হাযির হয়ে বললো, হে আবু তালেব, আম্মারকে নিয়ে এলাম আম্মারা কোরাইশ বংশের সুদর্শন যুবক, আপনি ওকে গ্রহণ করুন সে আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে আপনি ওকে নিজের পুত্র সন্তান হিসাবে গ্রহণ করুন, সে আপনার হবে আর আপনি নিজের ভাতিজা মোহাম্মাদকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনা পিতা-পিতামহের দ্বীনের বিরোধিতা করছে, আপনার জাতিকে ছিন্নভিন্ন করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছে আমরা তাকে হত্যা করবো ব্যস এটা একজন লোকের পরিবর্তে একজন লোকের হিসাব হবে।

আবু তালেব বললেন, কি চমৎকার সওদা করতো তোমরা আমার কাছে এসেছো নিজেদের পুত্রকে তোমরা আমার কাছে নিয়ে এসেছো, আমি তাকে পানাহার করাবো লালন পালন করে বড় করবো, আর আমি নিজের পুত্রকে তোমাদের হাতে দিবো তোমরা তাকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবে, আল্লাহর কসম, এটা হতে পারে নেই।

একথা শুনে নওফেল ইবনে মাতয়ামের পুত্র আদী বললেন, খোদার কসম, হে আবু তালেব, তোমরা সাথে তোমার কওম ইনসাফের কথা বলেছে এবং তুমি কল্যাণকর অবস্থা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছো, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি যে, তুমি তাদের কোন কথাই গ্রহন করতে চাচ্ছ না।

জবাবে আবু তালেব বললেন, খোদার শপথ, তোমরা আমার সাথে ইনসাফের কথা বলেনি, বরং তোমরাও আমার সঙ্গ ছেড়ে আমার বিরুদ্ধে লোকদের সাহায্য করতে উদ্যত হচ্ছে ঠিক আছে, যা ইচ্ছা করো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ২৬৬ ২৬৭)।

সীরাতে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করেও উল্লিখিত উভয় কথোপকথনের সময় জানা যায় না, কিন্তু সাক্ষ্য প্রমাণ এবং ইঙ্গিত ইশারা থেকে মনে হয়, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বেশী নয়, উভয় কথোপকথন ষষ্ঠ হিজরির মাঝামাঝি কোন এক সময়ে হয়েছিলো।

আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার হীন প্রস্তাব

কোরাইশ নেতাদের উল্লিখিত উভয় আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের আক্রোশ বেড়ে গেলো অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়লো সে সময় কোরাইশ নেতাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরো নতুন মাত্রা যোগ হলো তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার প্রস্তাব করলো, কিন্তু সেই সময়ে দুই বিশিষ্ট কোরাইশ নেতা হযরত হামযা (রা.) এবং হযরত ওমর (রা.)এর ইসলাম গ্রহণ ইসলামের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে বরং এই দুই বীর কেশরী আল্লাহর রাসূলের কাছে আত্মসমর্পণ করে ইসলামেরই শক্তি বাড়িয়ে দেন।

আল্লাহর রাসূলের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতনের দুটি উদাহরণ পেশ করছি।

একদিন আবু লাহাবের পুত্র ওতাইবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, ওয়াননাজমে ইযা হাওয়া এবং ছুম্মা দানা ফাতাদাল্লারি, সাথে আমি কুফর করছি, সূরা নাজম এর দুটি আয়াতের অর্থ হচ্ছে, শপথ নক্ষত্রের যখন তা অস্তমিত হয়, অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো অতি নিকটবর্তী, এরপর ওতাইবা আল্লাহর রসূলের ওপর অত্যাচার শুরু করলো, তাঁর জামা ছিড়ে দিল এবং পবিত্র চেহারা লক্ষ্য করে থুথু নিক্ষেপ করলো, কিন্তু থুথু তাঁর চেহারায় পড়েনি, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বদদোয়া দিলেন, তিনি বলেছেন হে আল্লাহ তায়ালা ওর ওপর তোমার কুকুর সমূহের কুকুর হতে একটি কুকুর লেলিয়ে দাও, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বদদোয়া নাযিল হয়েছিলো, ওতবা একবার কোরাইশ বংশের কয়েকজন লোকের সাথে এক সফরে সিরিয়া যাচ্ছিল, যারকা নামক স্থানে তাঁরা একদা রাত্রি যাপনের জন্য তাঁবু স্থাপন করলো, সে সময় একটি বাঘকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল, ওতাইবা বাঘ দেখে বললো, হায়রে, আমার ধ্বংস অনিবার্য খোদার কসম, এই বাঘ আমাকে খাবে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার উপর বদদোয়া করেছেন, দেখো আমি সিরিয়ায় রয়েছি, অথবা তিনি মক্কায় বসে আমাকে মেরে ফেলেছেন, সতর্কতা হিসাবে সফরসঙ্গীরা তখন ওতাইবাকে নিজেদের মাঝখানে রেখে শয়ন করলো, রাত্রিকালে বাঘ এলো, সবাইকে ডিঙ্গিয়ে ওতাইবার কাছে গেলো এবং তার ঘাড় মটকালো (মুখতাছারুছ সিয়ার, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১৩৫, ১ম খন্ড, এস্তিয়ার দালায়েলূন নবুয়ত, আর ফওযুল আনফ)।

ওকবা ইবনে আবু মুঈত ছিলো একজন প্রখ্যাত পৌত্তলিক, একবার এক দুর্বৃত্ত নামাজে সেজদা দেয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘাড় এতো জোরে পেঁচিয়ে ধরলো, মনে হচ্ছিলো যেন, তাঁর চোখ বেরিয়ে যাবে (ঐ, মুখতাছারুছ সিয়ার, পৃ. ১১৩)।

ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় কোরাইশদের চক্রান্ত সম্পর্কে জানা যায়, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত চক্রান্ত করেছিলো, উক্ত বর্ণনায় বলা হয়েছে যে একবার আবু জেহেল বলেছিলো, হে কোরাইশ ভাইয়েরা, আপনারা লক্ষ্য করছেন যে, মোহাম্মদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা এবং আমাদের উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না, আমাদের পিতা পিতামহকে অবিরাম গালমন্দ দিয়েই চলেছে, এ কারণে আমি আল্লাহর সাথে অঙ্গিকার করছি যে, আমি একটি ভারি পাথর নিয়ে বসে থাকবো, মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে.তখন সেই পাথর দিয়ে মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবো, এরপর যে কোন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত, ইচ্ছে হলে আপনারা আমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় রাখবেন অথবা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন, এরপর বনু আবদে মান্নাফ আমার সাথে যেরূপ ইচ্ছা ব্যবহার করবে, এতে আমার কোন পরোয়া নেই, কোরাইশরা এ প্রস্তাব শোনার পর বললো, কোন অবস্থায়ই আমরা তোমাকে বান্ধবহীন অবস্থায় ফেলে রাখবো না, তুমি যা করতে যাও, করতে পারো।

সকালে আবু জেহেল একটি ভারি পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অপেক্ষায় বসে থাকলো, কোরাইশরা একে একে সমবেত হয়ে আবু জেহেলের কর্মতৎপরতা দেখতে উৎকন্ঠিত হয়ে রইলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যথারীতি হাযির হয়ে নামায আদায় করতে শুরু করলেন তিনি যখন সেজদায় গেলেন তখন আবু জেহেল পাথর নিয়ে অগ্রসর হলো, কিন্তু পরক্ষণে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এলো, এবং তার হাত পাথরের সাথে যেন আটকে রইল, কোরাইশের কয়েকজন লোক তার কাছে এসে বললো আবুল হাকাম তোমার কি হয়েছে? সে বললো, আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম সেটা করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু কাছাকাছি পৌছুতেই দেখতে পেলাম, মোহাম্মাদ এবং আমার মাঝখানে একটি উট এসে দাঁড়িয়েছে খোদার কসম আমি কখনো অতো বড়, অতো লম্বা ঘাড় ও দাঁত বিশিষ্ট উট দেখিনি, উটটি আমার ওপর হামলা করতে চাচ্ছিলো।

ইবনে ইসহাক বলেন, আমাকে জানানো হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, উটের ছদ্মবেশে তিনি ছিলেন হযরত জিবরাঈল (আ.) আবু জেহেল যদি কাছে আসতো তবে তাকে পাকড়াও করা হতো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৮ ২৯৯)।

এরপর আবু জেহেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এমন ব্যবহার করছিলো যে সেটা দেখে হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন সে সম্পর্কে কিছুক্ষণ পরে আলোচনা করা হবে।

কোরাইশের অন্যান্য দুর্বৃত্তরাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলো হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে একবার পৌত্তলিকরা কাবার সামনে বসেছিলো, আমিও সেখানে ছিলাম তারা আল্লাহর রাসূলের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললো, এই লোকটি সম্পর্কে আমরা যেরূপ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি তার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, প্রকৃতপক্ষে তার ব্যাপারে আমরা অতুলনীয় ধৈর্যধারণ করেছি এ আলোচনা চলার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত হলেন তিনি প্রথমে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন এরপর কাবাঘর তাওয়াফ করার সময়ে পৌত্তলিকদের পাশ দিয়ে গেলেন, তারা খারাপ কথা বলে তাকে অপমান করলো, আল্লাহর রাসূলের চেহারায় সে অপমানের ছাপ ফুটে উঠলো তাওয়াফের মধ্যে পুনরায় তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে তারা পুনরায় একইভাবে অপমানজনক কথা বললো, সে অপমানের প্রভাব আমি তার চেহারায় লক্ষ্য করলাম তৃতীয়বারও একই রকম ঘটনা ঘটলো এবার আল্লাহর রাসূলের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেলো, তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কোরাইশের লোকেরা শোনো, সেই আল্লাহর শপথ তার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, আমি তোমাদের কাছে কোরবানির পশু নিয়ে এসেছি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথায় কোরাইশরা দারুণ প্রভাবিত হলো, তারা সবাই নীরব হয়ে গেলো, কঠোর প্রাণের লোকেরাও তার প্রতি নম্র নরম ভাষা ব্যবহার করতো লাগলো, তারা বলেছিলো, আবুল কাশেম, আপনি ফিরে যান, আল্লাহর শপথ আপনি তো কখনো নির্বোধ ছিলেন না।

পরদিনও কোরাইশরা একইভাবে সমবেত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রসঙ্গ আলোচনা করছিলো, এমন সময় তিনি এলেন, তিনি কাছে আসতেই তারা একযোগে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, একজন তার চাদর গলায় জড়িয়ে শ্বাসরোধ করতে চাচ্ছিল, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছিলেন, তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, তোমরা কি এমন একজন বলছিলেন, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছো, যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? দুর্বৃত্তরা এরপর তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, কোরাইশদের অত্যাচারের ঘটনাসমুহের মধ্যে আমার দেখা এ ঘটনাটি ছিলো সবচেয়ে মারাত্মক (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৮৯-২৯০)।

সহীহ বোখারী শরীফে হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সবচেয়ে বর্বরোচিত যে ব্যবহার করেছিলো তার বিবরণ আমাকে বলুন, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবার হাতীমে নামায আদায় করছিলেন এমন সময় ওকবা ইবনে আবু মুঈত এসে হাযির হলো সে এসেই নিজের চাদর আল্লাহর রাসূলের গলায় পেঁচিয়ে তার শ্বাসরোধ করতে চাইলো, এমন সময় হযরত আবু বকর (রা.) এলেন এবং ওকবার দুই কাঁধ ধরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন এরপর বললেন, তোমরা এমন একজন মানুষকে হত্যা করত চাও যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪)।

হযরত আসমা (রা.) বলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এ চিৎকার শুনতে পেলেন যে, তোমাদের সঙ্গীকে বাচাও এ চিৎকার শোনা মাত্র তিনি আমাদের কাছ থেকে দৌড়ে গেলেন তার মাথায় চারটি বেণী ছিলো, তিনি একথা বলতে বলতে ছুটে গেলেন যে, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করত চাও যিনি বলেন যে, আমার প্রভু আল্লাহ? পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ছেড়ে হযরত আবু বকরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, তিনি বাড়ী ফিরে আসার পর আমরা তার মথায় চুলের যেখানেই হাত দিচ্ছিলাম চুল আমাদের হাতে উঠে আসছিল।

হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণ

মক্কার পরিবেশ এমনি ধরণের যুলুম অত্যাচারে আচ্ছন্ন থাকার সময়ে হঠাৎ করে আলোর ঝলক দেখা গেলো, হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহন করলেন আল্লাহর রাসূলের নবুয়ত লাভের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ্জ মাসে এ ঘটনা ঘটে।

হযরত হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিলো এই যে আবু জেহেল একদিন সাফা পাহাড়ের কাছাকাছি জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালমন্দ করে এবং তাকে কষ্ট দেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব রইলেন, কোন কথা বললেন না দুর্বৃত্ত আবু জেহেল এরপর আল্লাহর রাসূলের মাথায় এক টুকরো পাথর নিক্ষেপ করলো এতে মাথা ফেটে রক্ত বের হলো, আবু জেহেল এরপর কাবার সামনে কোরাইশদের মজলিশে গিয়ে বসলো আব্দুল্লাহ ইবনে জুদায়াণের একজন দাসী এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলো হযরত হামযা শিকার করে ফিরছিলেন সেই দাসী তাকে সব কথা শোনালো হযরত হামযা ক্রোধে অধীর হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন কোরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক, তিনি দেরী না করে সামনে পা বাড়িয়ে বললেন, আবু জেহেলকে যেখানেই পাব সেখানেই আঘাত করব, এরপর তিনি সোজা কাবাঘরে প্রবেশ করে আবু জেহেলের সামনে গিয়ে বললেন, ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিচ্ছিস, অথচ আমিও তো তার প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী, একথা বলে হাতের ধনুক দিয়ে আবু জেহেলের মাথায় এতো জোরে আঘাত করলেন যে, মাথায় মারাত্মক ধরনের জখমে হয়ে গেল, এ ঘটনার সাথে সাথে আবু জেহেলের গোত্র বানু মাখযুম এবং হযরত হামযা (রা.) এর গোত্র বানু হাশেমের লোকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে উঠলো, আবু জেহেল এই বলে সবাইকে থামিয়ে দিল যে, আবু আমারাকে কিছু বলো না, আমি তার ভাতিজাকে আসলেই খুবই খারাপ গালি দিয়েছিলাম(মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, পৃ. ৬৬, রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, ৬৮, ইবনে হিশাম, ১১ ১ম খন্ড, পৃ. ২৯২)।

প্রথমদিকে নিজের আত্মীয়কে গালি দেয়ার ধৈর্যহারা হয়ে হযরত হামযা (রা.) রাসূল (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট হন, পরে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তর খুলে দেন, তিনি ইসলামের বলিষ্ঠ প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, তার কারণে মুসলমানরা যথেষ্ট শক্তি এবং স্বস্তি অনুভব করেন (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ, পৃ. ১০১)।

হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহন

যুলুম অত্যাচার নির্যাতনের কালোমেঘের সেই গম্ভীর পরিবেশে আলোর আরো একটি ঝলক ছিল হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা, হযরত হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের তিনদিন পর নবুয়তের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ্জ মাসেই এ ঘটনা ঘটেছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ইসলাম গ্রহণের জন্যে দেয়া করেছিলেন (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ১১)।

ইমাম তিরমিযি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেছে এ ঘটনাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন, ইমাম তিবরানি হযরত ইবনে মাসউদ এবং হযরত আনাস (রা.) থেকে এ ঘটনা বর্ণনা করেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ ওমর ইবনে খাত্তাব এবং আবু জেহেলের মধ্যে তোমার কাছে যে ব্যক্তি বেশী পছন্দনীয় তাকে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দাও এবং তার দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করো।

আল্লাহ তায়ালা এ দোয়া কবুল করেন এবং হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন, উল্লিখিত দুজনের মধ্যে আল্লাহর কাছে হযরত ওমর (রা.) ছিলেন অধিক প্রিয় (তিরমিযি, মানাকেবে আবু হাফ ওমর ইবনে খাত্তাব ২য় খন্ড, পৃ. ২০৯)।

হযরত ওমর (রা.) এর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত সকল বর্ণনার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ বিচারে প্রমাণিত হয় যে, তার মনে পর্যায়ক্রমে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছিলো, সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে হযরত ওমর (রা.) এর মন মেজাজ ও ধ্যান ধারনার প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত দেয়া জরুরী মনে করছি।

হযরত ওমর (রা.) তার রুক্ষ মেজাজ এবং কঠোর স্বভাবের জন্যে পরিচিত ছিলেন দীর্ঘকাল যাবত মুসলমানরা তার হাতে নানাভাবে নির্যাতন ভোগ করেন, মনে হয় তার মধ্যে বিপরীতধর্মী স্বভাবের সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো, একদিকে তিনি নিজের পিতা পিতামহের আবিষ্কৃত রসম রেওয়াজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, খেলাধুলার প্রতিও তার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল, অন্যদিকে ঈমান ও আকীদার প্রতি মুসলমানদের দৃঢ়টা এবং অত্যাচার নির্যাতনের মুখেও মুসলমানদের ধৈর্য সহিঞ্চুতা তিনি আগ্রহের দৃষ্টিতে দেখতেন, বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে তিনি মাঝে মাঝে ভাবতেন যে, ইসলাম ধর্মে যে বিষয়ে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে সম্ভবত সেটা সত্য, অধিক পবিত্র ও উন্নত, এ কারণে হঠাৎ ক্ষেপে গেলেও শান্ত হয়ে যেতেন (হযরত ওমর সম্পর্কে এ পর্যালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন ইমাম গাযযালী, ফেকহুছ সীরাত, পৃ. ৯২ ৯৩ দেখুন)।

হযরত ওমর (রা.)-এর ইসলামের গ্রহন সম্পর্কিত সকল বর্ণনার মূলকথা নিম্নরূপ,

একবার হযরত ওমর (রা.) কে বাইরে দিন কাটাতে হয়েছিলো, তিনি হারাম শরীফে গমন করেন এবং কাবাঘরে পর্দার ভেতরে প্রবেশ করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সময় নামাজ আদায় করছিলেন, তিনি সূরা আল হাক্ক তেলাওয়াত করছিলেন হযরত ওমর (রা.) কোরআন শুনতে লাগলেন এবং কোরআনের রচনাশৈলীতে মুগ্ধ ও অভিভূত হলেন, মনে মনে বললেন এই ব্যক্তি দেখছি কবি, কোরাইশদের কথাই ঠিক, এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করলেন, নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানিত রসূলের কাছে বহন করে আনা বার্তা, এটা কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো, হযরত ওমর (রা, ) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তি দেখছি জ্যোতিষী, এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করলেন, এটা কোন গণকের কথা নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করেন, এটি জগতসমূহের প্রতিপালকের কাছ থেকে অবতীর্ণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরার শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেন।

হযরত ওমর (রা.) বলেন, সেই সময়ে আমার মনে ইসলাম রেখাপাত করে (তারীকে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ৬, সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২৬-৩৪৮), কিন্তু তখনো তার মনে পূর্ব-পুরুষদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা ছিলো অটুট, এ কারণেই হৃদয়ের গোপন ও গভীরে ইসলামের প্রতি ভালোবাসার বীজ রোপিত হলেও ইসলামের বিরোধীতার প্রকাশ্য কাজকর্মে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

তাঁর স্বভাবের কঠোরতা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শত্রুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, একদিন তলোয়ার হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন, পথে নঈম ইবনে আবদুল্লাহ নাহহাম আদবীর (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৪) বনি যোহরা (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব, আল জওযি, পৃ. ১৭) বনি মানজুমের (মুখতাছারুছ সীরাত, পৃ. ১০২) কোন এক লোকের সাথে তাঁর দেখা হলো, সেই লোক তাঁর রুক্ষ চেহারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ওমর, কোথায় যাচ্ছ? তিনি বলেন, মোহাম্মদ কে হত্যা করতে যাচ্ছি, সেই লোক বললেন, মোহাম্মদকে হত্যা করে বনু হাশেম এবং বনু যোহরার হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? তিনি বললেন, মনে হয় তুমিও পূর্বপুরুষদের ধর্ম ছেড়ে বেদ্বীন হয়ে পড়েছো? সেই লোক বললেন, ওমর একটা বিস্ময়কর কথা শোনাচ্ছি, তোমার বোন এবং ভগ্নীপতিও তোমাদের দ্বীন ছেড়ে বেদ্বীন হয়ে গেছে, একথা শুনে হযরত ওমর ক্রোধে দিশেহারা হয়ে সোজা ভগ্নীপতির বাড়ী অভিমুখে রওনা হলেন, সেখানে গিয়ে দেখলেন, তারা হযরত খাব্বাব ইবনে আরতের কাছে সূরা তা-হা লেখা একটি সহীফা পাঠ করছেন, কোরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য হযরত খাব্বাব (রা.) সে বাড়ীতে যেতেন, হযরত ওমর এর পায়ের আওয়াজ শুনে সবাই নীরব হয়ে গেলেন, হযরত ওমরের বোন সূরা লেখা পাতাটি লুকিয়ে ফেললেন, কিন্তু ঘরের বাইরে হযরত ওমর খাব্বাব (রা.) এর কোরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনেছিলেন, তিনি তাই জিজ্ঞাসা করলাম, কিসের আওয়াজ শুনছিলাম? তারা বললেন কই কিছু নাতো, আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম, হযরত ওমর (রা.) বললো, সম্ভবত তোমরা উভয়ে বেদ্বীন হয়ে গেছ, তার ভগ্নীপতি বললেন, আচ্ছা ওমর, সত্য যদি তোমাদের দ্বীন ছাড়া অন্য ধর্ম সত্য থাকে তখন কি হবে? হযরত ওমর (রা.) এ কথা শোনা মাত্র ভগ্নীপতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে মারাত্মকভাবে প্রহার করলেন, তাঁর বোন ছুটে গিয়ে স্বামীকে ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, এক সময় তাকে সরিয়ে দিলেন, হঠাৎ হযরত ওমর (রা.)তার বোন কে এতো জোরে চড় মারলেন যে তার চেহারা রক্তাক্ত হয়ে গেল, ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে , তাঁর মাথায় আঘাত লেগেছিলো, তার বোন ক্রুদ্ধভাবে বললেন, ওমর, যদি তোমাদের দ্বীন ছাড়া অন্য ধর্ম সত্য থাকে তখন কি হবে? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, আর মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল, এ কথা শুনে হযরত ওমর (রা.) হতাশ হয়ে পড়লেন বোনের চেহারায় রক্ত দেখে তাঁর লজ্জাও হলো, তিনি বললেন, আচ্ছা, তোমরা যা পাঠ করছিলে, আমাকে একটু পড়তে দাওতো, তার বোন বললো, তুমি নাপাক, এই কিতাব শুধু পাক পবিত্র লোকই স্পর্শ করতে পারে, যাও গোসল করে এসো, হযরত ওমর গিয়ে গোসল করে এলেন, এরপর কিতাবের সেই বিশেষ অংশ হাতে নিয়ে বসলেন এবং পড়লেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, এরপর বললেন, এতো বড় পবিত্র নাম।

হযরত খাব্বাব (রা.) হযরত ওমর (রা.) মুখে এ কথা শুনে ভেতর থেকে বাইরে এলেন এবং বললেন, ওমর খুশি হও, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে যে দোয়া করেছিলেন এটা তারই ফল, এ সময়ে রাসূল (স.) সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী এক ঘরে অবস্থান করছিলেন।

একথা শুনে হযরত ওমর (রা.) তলোয়ার হাতে সেই ঘরের সামনে এসে দরোজায় কশাঘাত করলেন, একজন সাহাবী দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, তলোয়ার হাতে হযরত ওমর, আশে পাশে সবাই একত্রিত হলেন, হযরত হামজা (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার? তাঁকে বলা হলো যে, ওমর এসেছেন, তিনি বললেন, ওমর এসেছে, দরজা খুলে দাও, যদি ভালোর জন্য এসে থাকে তবে ভালোই হবে, আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এসে থাকে তাহলে তাহলে আমরা তার তলোয়ার দিয়ে তাকে শেষ করে দেব, এ দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভিতরে ছিলেন, তাঁর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিলো, ওহী নাযিল হওয়ার পর তিনি এদিকে কামরায় ওমরের কাছে এলেন এবং তাঁর পরিধানের পোশাক এবং তলোয়ারের একাংশ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ওমর, তুমি কি ততক্ষণ পর্যন্ত বিরত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তোমার উপর ওলীদ ইবনে মুগীরার মত অবমাননাকর শাস্তি নাযিল না করবেন? হে আল্লাহ ওমর ইবনে খাত্তাবের দ্বারা দ্বীনের শক্তি ও সম্মান দান করো, একথা বলার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল, একথা শুনে ঘরের ভিতর যারা ছিলেন তারা এতো জোরে আল্লাহ আকবার ধ্বনি দিলেন যে, কাবাঘরের মধ্যে যারা ছিলেন, তারাও সেই আওয়াজ শুনতে পেলেন (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব প. ৭, ১০, ১১, সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৩, ৩৪৪) আরবে কেউ তার মোকাবেলা করার সাহস পেতো না, এ কারণে তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদে পৌত্তলিকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেলো, তারা মারাত্মক সঙ্কট এবং অবমাননার সম্মুখীন হলো, অন্য দিকে তার ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের গৌরব, শক্তি, মর্যাদা সাফল্য ও আনন্দ বেড়ে গেল, ইবনে ইসহাক তার সনদে হযরত ওমর (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমি যখন মুসলমান হলাম, তখন ভাবলাম, মক্কায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? এরপর মনে মনে বললাম, সে হচ্ছে আবু জেহেল, এরপর আমি আবু জেহেলের বাড়ী গেলাম, ঘরের দরজায় করাঘাত করলে আবু জেহেল বেরিয়ে এলো, সে আমাকে দেখে বললো, স্বাগতম সুস্বাগতম কি কাজে এসেছ ওমর? আমি বললাম তোমাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি, তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তার ওপরও বিশ্বাস পোষণ করেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার ওপরও বিশ্বাস পোষণ করেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করছি একথা শুনে আবু জেহেল দরোজা বন্ধ করে দিতে দিতে বললো, আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছ, তারও মন্দ করুন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৪৯ ২৫০)।

ইমাম ইবনে জওযি হযরত ওমর ফারুক (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কেউ যখন ইসলাম গ্রহণ করতো, তখন কোরাইশ কাফেররা তাদের পেছনে লেগে যেতো, তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতো, প্রহৃত ব্যক্তিও প্রহার করতেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার মামা আদী ইবনে হাশেমের কাছে গিয়ে তাকে জানালাম, তিনি কোন কথা না বলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন, এরপর কোরাইশের একজন বিশিষ্ট লোকের কাছে গেলেন সম্ভবত আবু জেহেলের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, আমার মামা আদী কোরাইশের সেই লোককে খবর দেয়ার পর সেও ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো (তারীখে ওমর ইবনে খাত্তাব পৃ. ৮)।

ইবনে হিশাম এবং ইবনে জওযি বর্ণনা করেছেন যে হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর জামিল ইবনে মোয়াম্মার মাহমির কাছে গেলেন কোন কথা প্রচারের ক্ষেত্রে কোরাইশদের মধ্যে এ লোক ছিল বিখ্যাত, হযরত ওমর (রা.)তাকে জানালেন যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি, একথা শোনার সাথে সাথে সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলো, যে খাত্তাবের পুত্র বেদ্বীন হয়ে গেছে, হযরত ওমর (রা.)বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো, আমি মুসলমান হয়েছি, মোটকথা, লোকেরা হযরত ওমরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, এবং তাকে প্রহার করতে লাগলো, হযরত ওমর প্রহৃত হচ্ছিলেন আবার নিজেও প্রহার করছিলেন, এক সময় সূর্য মাথার ওপর এলে ক্লান্ত হয়ে তিনি বসে পড়লেন, এরপর বললেন, যা খুশি করো আল্লাহর কসম, যদি আমরা সংখ্যায় তিনশজনও হতাম, তাহলে মক্কায় হয় তোমরা থাকতে অথবা আমরা থাকতাম (ঐ পৃ. ৮ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৮ ৩৪৯)।

পৌত্তলিকরা এরপর হযরত ওমর (রা.) কে প্রাণে মেরে ফেলার জন্যে তারে বাড়ীতে চড়াও হলো, সহীহ বোখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর (রা.) ভীত বিহ্বল হয়ে ঘরের ভেতর ছিলেন, এমন সময় আবু আমর আস ইবনে ওয়ায়েল ছাহমি এলেন, তিনি কারুকাজ করা ইয়েমেনী চাদর এবং রেশমি পোশাক পরিহিত ছিলেন, তিনি ছিলেন ছাহাম গোত্রের অধিবাসী, সেইকালে তিনি ছিলেন আমাদের মিত্র গোত্রের লোক, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, এত হল্লা কিসের? হযরত ওমর (রা.) বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি একারণে ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়, আস বললেন, এটা সম্ভব নয় আস এর একথা শুনে আমি স্বস্থিবোধ করলাম, বহু লোক সে সময় আমার বাড়ীর আশে পাশে ভীর করে আছে, আস ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা সবাই কোথায় চলেছ? সবাই বললো, ওমর বেদ্বীন হয়ে গেছে, তার কাছে যাচ্ছি, আস বললেন, সেদিকে যাওয়ার কোন পথ নেই, একথা শুনে সবাই ফিরে চলে গেল (সহীহ বোখারী, ওমর ইবনে খাত্তাব অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ.৫৪৫), ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা এমনভাবে সমবেত হয়েছিল, মনে হচ্ছিলো যেন তারা একই পোশাকের মধ্যে সবাই প্রবেশ করছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৪৯)।

হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর পৌত্তলিকদের অবস্থা ছিলো এরূপ যে ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলমানদের অবস্থার ধারণা এ ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়, মোজাহেদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি ওমর ইবনে খাত্তাবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, কি কারণে আপনার উপাধি ফারুক হয়েছে? তিনি বললেন, আমার ইসলাম গ্রহণের তিন দিন আগে হযরত হামযা (রা.) ইসলাম গ্রহন করেন, এরপর হযরত ওমর হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, এরপর আমি ইসলাম গ্রহন করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, মরে যাই বা বেচে থাকি, আমরা কি হক এর ওপর বিদ্যমান নেই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেন নয়? সেই সত্ত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা বেচে থাকো, বা মরে যাও, নিশ্চয়ই তোমরা হক এর উপর রয়েছো, হযরত ওমর (রা.) বলেন, এরপর আমি বললাম, তাহলে আমরা কেন পালিয়ে বেড়াবো? সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, নিশ্চয়ই আমরা বাইরে বের হবো, এরপর আমরা দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে মিছিল করে আল্লাহর রাসূলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হলাম, এক কাতারে ছিলেন হযরত হামযা, অন্য কাতারে আমি, আমাদের চলার পথে যাতার পেষা আটার মতো ধুলো উড়ছিলো, আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করলাম, হযরত ওমর (রা.) বলেন কোরাইশরা আমাদের দেখে মনে এত বড় কষ্ট পেলো, যা ইতিপূর্বে পায়নি, সেই দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ফারুক উপাধি দিলেন (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি, পৃ. ৬, ৭)।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, এর আগে আমরা কাবাঘরের কাছে নামায আদায়ে সক্ষম ছিলাম না (মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আব্দুল্লাহ পৃ. ১০৩)।

হযরত যোহায়ের ইবনে সেনান রূমী (রা.) বলেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.) মুসলমান হওয়ার পর ইসলাম পর্দার বাইরে এলো, এবং ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে দেয়া শুরু হলো, আমরা কাবাঘরের সামনে গোল হয়ে বসতে লাগলাম এবং কাবাঘর তওয়াফ করতে লাগলাম, যারা আমাদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছিলো, তাদের উপর প্রতিশোধ নিলাম এবং অত্যাচারের জবাব দিলাম (তারীখে ওমর ইবনুল খাত্তাব, ইবনে জওযি পৃ. ১৩)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে পরবর্তীকালে আমরা শক্তিশালী এবং সম্মানিত ছিলাম (সহীহ বোখারী, বাবে ইসলাম ওমর ইবনে খাত্তাব, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৫)।

হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মোত্তালেব এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের ওপর পাইকারি নির্যাতন কমে গেলো, বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে পৌত্তলিকরা উদ্যোগী হলো, তারা চিন্তা করলো যে, ইসলামের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা পেতে চান সেই প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তা পূরণের মাধ্যমে তাকে হয়তো তার কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে, কিন্তু তারা জানতো না রাসূলে খোদার দ্বীনের দাওয়াতের মোকাবেলায় সমগ্র বিশ্বজগতও সম্পূর্ণ মূল্যহীন, কাজেই, তাদের চেষ্টায় তারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হলো।

ইবনে ইসহাক ইয়াজিদ ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে মোহাম্মাদ ইবনে কাব কারাযির এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমাকে জানানো হয়েছে, কওমের নেতা ওতবা ইবনে রবিয়া স্বজাতীয়দের সামনে একদিন নতুন একটা প্রস্তাব দিল, সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারামের এক জায়গায় একাকী ছিলেন ওতবা বললো, মোহাম্মাদের সাথে আলোচনা করে এর ব্যবস্থা নাও, তার সামনে কয়েকটা প্রস্তাব পেশ করো, হয়তো তিনি কোন একটা প্রস্তাব মেনে নেবেন, তিনি যে দাবী করবেন, সেই দাবী আমরা পূরণ করবো, হামযা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি দেখে তারা নিজেদের মধ্যে এ পরামর্শ করলো।

কোরাইশরা বললো, আবুল ওলীদ তুমি যাও, তুমি গিয়ে তার সাথে কথা বলো, এরপর ওতবা উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসলো, ওতবা বললো, ভাতিজা আমাদের কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা রয়েছে সে কথা সবাই জানে তুমি উচ্চ বংশের মানুষ তুমি এমন একটা বিষয় প্রচার করছো, যার কারণে কওমের মধ্যে বিভেদ বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখা দিয়েছে তুমি কওমের নেতৃস্থানীয় লোকদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছো, তাদের উপাস্যকে নানাভাবে সমালোচনা করছো, তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে বাতিল করে দিচ্ছো, তাদের পূর্ব পুরুষদের কাফের বলে অভিহিত করছো, আমার কথা শোনো আমি তোমাকে কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছি তুমি এ প্রস্তাব সম্পর্কে চিন্তা কর হয়তো যে কোন একটা প্রস্তাব তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন বল আবুল ওলীদ আমি শুনবো।

ওতবা ওরফে ওলীদ বললো ভাতিজা তুমি যা প্রচার করছো যদি এর বিনিময়ে ধন-সম্পদ চাও তবে আমরা তোমাকে এতো এত ধন সম্পদ দেব যা তুমি হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি যদি তুমি মর্যাদা চাও তাও বলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা হিসাবে বরণ করে নেব, তোমাকে ছাড়া কোন ফয়সালা করা হবে না যদি তুমি বাদশাহ হতে চাও তাও বল আমরা তোমাকে বাদশাহ হিসাবে মেনে নেবো যদি তোমার কাছে আসা জিনিস জ্বীন ভূত হয়ে থাকে তাও বলো তুমি দখ অথচ তাড়াতে পারছো না আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করব, যত টাকা লাগে লাগুক আমরা তোমার চিকিৎসা করাবো, কখনো কখনো এমন হয় যে, জ্বীন ভূতেরা মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে সে অবস্থায় মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনর পর বললেন, আবুল ওলীদ তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমার কথা শোনো, এরপর রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা হা-মীম সাজদার প্রথম থেকে তেলাওয়াত শুরু করলেন পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি, হা-মীম এই কেতাব দয়াময় পরম দয়ালুর কাছ থেকে অবতীর্ণ এটি এক কেতাব বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে এর আয়াতসমূহ আরবী ভাষায় কোরআনরূপে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে, কিন্তু ওদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে কাজেই ওরা শুনবে না ওরা বলে তুমি যার প্রতি আমাদের আহ্বান করছো সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ আচ্ছাদিত, কানে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে কাজ করে অন্তরাল সুতরাং তুমি তোমার কাজ করো, এবং আমরা আমাদের কাজ করি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলাওয়াত করে যাচ্ছিলেন আর ওতবা দুহাত পেছনের দিকে মাটিতে রেখে আরাম করে বসে শুনছিলো সেজদার আয়াত তেলাওয়াত করার পর রাসূল উঠে সেজদা করলেন এরপর বললেন আবুল ওলীদ তুমি কিছু শুনতে চেয়েছিলে আমি শুনিয়েছি এবার তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে।

ওতবা উঠলো এবং নিজের সঙ্গীদের কাছে গেল তাকে দেখে তার সঙ্গীরা বলাবলি করতে লাগলো যে, খোদার কসম, আবুল ওলীদ যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলো সে চেহারা নিয়ে কিন্তু ফিরে আসছে না ওতবা বসার পর সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করলো যে কি খবর নিয়ে এসেছো? সে বলল খবর হচ্ছে আমি এমন কালাম শুনেছি যা অতীতে কোনদিনই শুনিনি, খোদার কসম সেটা কবিতাও নয় জাদুমন্ত্র ও নয়, তোমরা আমার কথা শোন, ওকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও যে কালাম আমি শুনেছি ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটবে, এরপর যদি ওকে আরবের লোকেরা মেরে ফেলে তবে তোমাদের কাজ অন্য কেউ করবে যদি তিনি আরবের ওপর জয়লাভ করেন তবে তার সম্মান হবে তোমাদের সম্মান তার বাদশাহি হবে তোমাদের বাদশাহি তার অস্তিত্ব তোমাদের জন্য সৌভাগ্যরে কারণ হবে।

কোরাইশরা বললো আবুল ওলীদ সে কালামের যাদু তোমাকেও প্রভাবিত করেছে ওতবা বলল, তার ব্যাপারে আমি যা বুঝেছি বলেছি এখন তোমরা যা ভালো মনে করো তা করো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯৩-২৯৪)।

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন যে, তবুও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল আমি তো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির যা আদ ও সামুদের শাস্তির অনুরূপ এই আয়াত তেলাওয়াতের সাথে সাথে ওতবা উঠে দাড়াল এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, আমি আপনাকে আল্লাহ এবং নিকট আত্মীয়দের দোহাই দিয়ে বলছি যে, আপনি এরূপ করবেন না ওতবা আশংকা করছিল যে ওরকম শাস্তি তার ওপর এসে না পড়ে এরপর সে উঠে তার সঙ্গীদের কাছে গিয়ে উল্লিখিত কথা বলল (তাফসীরে ইবনে কাসির, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃ. ১৫, ১৬০, ১৬১)।

বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবদের সাথে আবু তালেবের বৈঠক

ইতিমধ্যে পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে আবু তালেব তখনও ছিলেন শঙ্কিত, পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে তিনি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের ব্যাপারে আশঙ্কা বোধ করছিলেন তিনি এযাবৎ সংঘটিত ঘটনাবলী পর্যালোচনা করছিলেন পৌত্তলিকরা তাকে মোকাবেলার হুমকি দিয়েছিল আম্মারা ইবনে ওলীদের বিনিময়ে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার প্রস্তাব করেছিল আবু জেহেল একটা ভারি পাথর দিয়ে তার ভাতিজার মস্তক চূর্ণ করার চেষ্টা করছিল ওকবা ইবনে আবু মুঈত গলায় চাদর পেঁচিয়ে তার ভাতিজাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চেয়েছিল খাত্তাবের পুত্র খোলা তলোয়ার হাতে তাকে হত্যা করতে বেরিয়েছিল পর্যায়ক্রমে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করে আবু তালেব এমন গুরুতর বিপদের আশঙ্কা করলেন যে, তার বুক কেপে উঠলো।

তিনি ভালভাবে বুঝতে পারলেন যে, পৌত্তলিকরা তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এমতাবস্থায় কোন কাফের যদি তার ভাতিজার ওপর হঠাৎ করে হামলা চালায় তাহলে বিচ্ছিন্নভাবে হযরত হামযা বা হযরত ওমর বা অন্য কেউ কি তাকে রক্ষা করবে?

আবু তালেব এ আশঙ্কা অমূলক ছিল না কেননা পৌত্তলিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল, তাদের এ সঙ্কল্পের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ওরা কি কোন ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? আমিই তো সিদ্ধান্তকারী (৭৯, ৪৩)

প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আবু তালেবের কি করা উচিত ? তিনি যখন দেখলেন যে পৌত্তলিকরা চারিদিক থেকে তার ভাতিজাকে নাজেহাল করতে উঠে লেগেছে তখন তিনি তার পিতামহের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হাশেম এবং মোত্তালেবের বংশধরদের একত্রিত করলেন তিনি সেই সমাবেশে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানালেন, তিনি আবেগজড়িত কন্ঠে বললেন, যে দায়িত্ব এতদিন আমি একা পালন করেছি, এবার এসো আমরা সবাই মিলে সে দায়িত্ব পালন করি আবু তালেবের এ আহবানে তার দুই পূর্ব পুরুষের বংশধররা সাড়া দিলেন আবু তালেবের ভাই আবু লাহাব শুধু ভিন্নমত পোষণ করল, সে অস্বীকৃতি জানিয়ে পৌত্তলিকদের সাথে মিলিত হলো, (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৯, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১০৬)।

সর্বাত্মক বয়কট

চার সপ্তাহ বা তার চেয়ে কম সময়ের ভেতর পৌত্তলিকরা চারটি বড় ধরনের ধাক্কা খেলো, হযরত হামযা এবং হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করা, সর্বোপরি বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেব একত্রিত হয়ে আল্লাহর রাসূলকে রক্ষার ব্যাপারে একমত হলো পৌত্তলিকরা এতে অস্থির হয়ে উঠলো অস্থির হবে না কেন, কারণ তারা বুঝতে পেরেছিলো যে এখন যদি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে তাহলে তাকে রক্ষা করতে যে রক্তপাত হবে এতে মক্কার প্রান্তর লাল হয়ে যাবে তাদের নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, এ কারণে আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে পৌত্তলিকরা অত্যাচার নির্যাতনের একটি নতুন পথ আবিষ্কার করলো, এটি ছিলো ইতিপূর্বে গৃহীত সব পদক্ষেপের চেয়ে আরো বেশী মারাত্মক।

ইবনে কাউয়েম লিখেছেন যে, বলা হয়ে থাকে এই দলিল মনসুর ইবনে একরামা ইবনে আমের ইবনে হাশেম লিখেছিলেন কারো কারো মতো নযর ইবনে হারেস লিখেছিল, কিন্তু সঠিক কথা হচ্ছে এই দলিল বোগাইজ ইবনে লিখেছিল এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য বদদোয়া করায় তার হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৯)।

লেখার পর দলিল কাবাঘরে টাঙ্গিয়ে দেয়া হল, তাতে আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের মুসলিম অমুসলিম নারী পুরুষ শিশু সবাই শাবে আবু তালেব নামক স্থানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন এটা ছিলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবী হিসাবে আবির্ভাবের সপ্তম বছরের ঘটনা।

শাবে আবু তালেবে তিন বছর

এ বয়কটে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠলো, খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্দ হয়ে গেল, যা ও বা মক্কায় আসতো পৌত্তলিকরা তাড়াতাড়ি সেগুলো কিনে নিতো, ফলে অবরুদ্ধ মুসলিম অমুসলিম কারো কাছে কোন কিছু স্বাভাবিক উপায়ে পৌছুতো না, তারা গাছের পাতা এবং চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কাতর কান্না শাবে আবু তালেব বা আবু তালেব ঘাটির বাইরে থেকে শোনা যেত তাদের কাছে কোন খাদ্যসামগ্রী পৌছার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ যা কিছু পৌছুতো সে সব গোপনীয়ভাবেই পৌছাত, নিষিদ্ধ মাসসমূহ ছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তারা ঘাটির বাইরে বেরও হতেন না বাইরে থেকে মক্কায় আসা জিনিস কেনার চেষ্টা করেও অনেক সময় তারা সক্ষম হতেন না কারণ পৌত্তলিকরা সেসব জিনিসের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত।

হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন হযরত খাদিজা (রা.) এর ভ্রাতুষ্পুত্র মাঝে মাঝে তিনি ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন একবার গম পাঠানোর উদ্যোগ নিতেই আবু জেহেল বাধা দিল, কিন্তু আবুল বাখতারি হাকিম ইবনে হাজেমের পক্ষাবলম্বন করে গম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।

এদিকে আবু তালেব সব সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে বলতেন যাও, তুমি এবার তোমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়, তিনি একথা এ জন্যই বলতেন যাতে কোন গোপন আততায়ী থাকলে বুঝতে পারে যে, তিনি কোথায় শয়ন করেছেন এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালেব তার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের শোয়ার স্থান বদলে দিতেন ভ্রাতুষ্পুত্রের বিছানায় নিজের পুত্র ভাই বা অন্য কাউকে শয়ন করাতেন রাত্রিকালে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র আল্লাহর রাসূল মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্য কাটাতেন।

এ ধরনের কঠিন অবরোধ সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য মুসলমান হজ্জের সময় বাইরে বের হতেন এবং হজ্জের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, এ সময় আবু লাহাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলমানদের সাথে যেরূপ আচরণ করতো, ইতোপূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে, (আবু তালেবের মৃত্যু হয়েছিলো দলিল ছিন্ন করার ছয়মাস পর, সঠিক তথ্য হচ্ছে যে, তাঁর মৃত্যু রজব মাসে হয়েছিলো, যারা বলে যে, তার মৃত্যু রমজান মাসে হয়েছিলো, তারা এও বলে যে, তার মৃত্যু দলিল ছিন্ন করার ঘটনার আটমাস কয়েকদিন পর হয়েছিলো, উভয় অবস্থায় এটা প্রমাণিত হয় যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল মহররম মাসে)।

দলিল ছিন্ন করার ঘটনা

এ অবস্থায় পুরো তিন বছর কেটে যায়, এরপর নবুয়তের দশম বর্ষে মহররম মাসে দলিল ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে, এতে অত্যাচার নির্যাতনের অবসান ঘটে, কোরাইশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ব্যবস্থার বিরোধী থাকার তারা অবরোধ বাতিল করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে।

এই অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলীল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হেশাম ইবনে আমের নামক একজন ব্যক্তি, হেশাম রাত্রিকালে চুপিসারে খাদ্য দ্রব্য পাঠিয়ে আবু তালেব ঘাঁটির অসহায় লোকদের সাহায্য করতো, প্রথমে হেশাম যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া মাখযুমির কাছে যান, যুহাইয়ের মা আতেকা ছিলেন আবদুল মোত্তালেবের কন্যা, অর্থাৎ আবু তালেবের বোন, হেশাম তাকে বললেন, যুহাইর তুমি কি চাও যে, তোমরা মজা করে পানাহার করবে আর, অথচ তোমার মামা ও অন্যেরা ধুকে ধুকে মারা যাবে, তারা কি অবস্থায় রয়েছে সেটা কি তুমি কি জান না? যুহাইর বললো, আফসোস, আমি একা কি করতে পারি? যদি আমার সাথে আর কেউ এগিয়ে আসে তবে আমি দলিল বিনষ্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, হেশাম বললেন, অন্য একজন রয়েছেন, যুহাইর বললেন, তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি, যুহাইর বললেন, আচ্ছা তবে তৃতীয় কাওকে খুঁজে বের করো, এ কথা শুনে হেশাম মোতায়ম ইবনে আদিরের কাছে গেলেন এবং বনু হাশেম ও বনু মোত্তালেবের অবস্থার কথা উল্লেখ করে তার সাহায্য চাইলেন, ওরা যে তাঁর নিকটাত্মীয় সে কথা বললেন, মোতয়াম বললেন, আমি একা কি করতে পারি? হেশাম বললেন আরো একজন আছেন, মোতয়াম জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কে? হেশাম বললেন, আমি, মোতয়াম বললেন, আচ্ছা তৃতীয় একজন খুঁজে নাও, হেশাম বললেন সেটাও করেছি, মোতয়াম বললেন তিনি কে? হেশাম বললেন, তিনি বললেন যুহাইর ইবনে উমাইয়া, মোতায়ম বললেন, আচ্ছা চতুর্থ একজন তালাশ কর, এরপর হেশাম আবুল বখতিয়ারের কাছে গেলেন, এবং তার সাথে মোতায়ামের কাছে যেভাবে বলেছেন, সেভাবে বললেন, আবুল বখতিয়ার জানতে চাইলেন, এ ব্যাপারে সমর্থক কেউ আছে কি না? হেশাম বললেন হ্যাঁ আছে, এরপর তিনি যুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া, মোতায়ম ইবনে আদি এবং নিজের কথা বললেন, আবুল বখতিয়ার বললেন, আচ্ছা তবে বিশ্বস্ত একজন লোক খোজ করো, এরপর জাময়া ইবনে আছওয়াদ ইবনে মোত্তালেব ইবনে আছাদের কাছে গেলেন, তার সাথে বনু হাশেম এবং বনু মোত্তালেবের দুরবস্থার বিষয়ে আলোচনা করে সাহায্য চাইলেন, তিনি জানতে চাইলেন অন্য কোন সহায়তাকারী আছে কি না? হেশাম বললেন হ্যাঁ আছে, এরপর সকলের নাম জানালেন, পরে উল্লেখিত সবাই হাজুন নামক জায়গায় একত্রিত হয়ে দলিল বিনষ্ট করার ব্যাপারে অঙ্গীকার বদ্ধ হলেন, যুহাইর বললেন, প্রথমে আমি কথা তুলবো।

সকাল বেলা নিয়মানুযায়ী সবাই মজলিসে একত্রিত হলো, যুহাইর দামী পোশাক পরিধান করে সেজে গুজে উপস্থিত হলো, প্রথমে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করে সবাইকে সম্বোধন করে বললো, মক্কাবাসীরা শোন আমরা পানাহার করবো, পোশাক পরিধান করবো, আবু বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে, তাদের কাছে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে কেনাও হচ্ছে না খোদার কসম, এ ধরনের অমানবিক দলিল বিদ্যমান থাকা অবস্থায় আমি নীরব হয়ে থাকতে পারি না, আমি চাই এ দলিল বিনষ্ট করে ফেলা হোক।

আবু জেহেল এ কথা শুনে বলল, তুমি ভুল বলছো, খোদার কসম, এ দলিল ছিন্ন করা যাবে না।

জাময়া ইবনে আসওয়াদ বললেন, খোদার কম, তুমি ভুল বলছ, এ দলিল যখন লেখা হয়েছিল, তখনো আমি রাজি ছিলাম না, আমি এটা মানতে প্রস্তুত নাই এরপর মোতয়াম ইবনে আদী বললেন তোমরা দুজনে ঠিকই বলছো, আমরা এ দলিলে যা কিছু লেখা রয়েছে, তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।

হেশাম ইবনে আমরও এ ধরনের কথা বললেন।

এ অবস্থা দেখে আবু জেহেল বললো, হুহু বুঝেছি রাত্রিকালেই এ ধরনেরও ঐক্যমত্য হয়েছে এ পরামর্শ এখানে নয় বরং অন্য কোথাও করা হয়েছে।

সে সময় আবু তালেবও অদূরে উপস্থিত ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জানিয়েছিলেন যে, দলিল বিনষ্ট করতে আল্লাহ তায়ালা এক রকম পোকা পাঠিয়েছেন তারা যুলুম অত্যাচারের বিবরণসমূহ কেটে ছারখার করে ফেলেছে, শুধু যেখানে যেখানে আল্লাহর নাম রয়েছে সেসব অবশিষ্ট রয়েছে।

আবু তালেব কোরাইশদের বললেন, আমার ভাতিজা আমাকে আপনাদের কাছে এ কথা বলতে পাঠিয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়েছেন যে, আপনাদের অঙ্গীকার পত্রটি আল্লাহ তায়ালা এক রকম পোকা পাঠিয়ে নষ্ট করে দিয়েছেন শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামটুকু সেখানে অবশিষ্ট আছে, এ কথা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে আমি তার ও আপনাদের মাঝ থেকে সরে দাঁড়াব এবং আপনারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন আর সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে বয়কটের মাধ্যমে আমাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছেন তা থেকে বিরত থাকবেন এতে কোরাইশরা সম্মত হলো।

এ নিয়ে আবু জেহেল ও অন্যান্যদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শেষ হলে মুতয়াম বিন আদী অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়তে গিয়ে দেখলেন যে, আল্লাহর নাম লেখা অংশ বাদে বাকি অংশ সত্যি সত্যি পোকা খেয়ে ফেলেছে পরে অঙ্গীকারপত্র ছিড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হল এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) ও অন্য সকলে শাবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন, কাফেররা এ বিস্ময়কর নিদর্শনে আশ্চর্য হল, কিন্তু তাদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হল না, আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর যদি তারা কোন মোজেজা দেখে, তখন টালবাহানা করে এবং বলে এ তো যাদু।

আরবের পৌত্তলিকরা নবুয়তের বিস্ময়কর এ নিদর্শন থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিল এবং নিজেদের কুফুরীর পথে আরো কয়েক কদম অগ্রসর হলো (বয়কটের বিবরণ নিম্নোল্লিখিত গ্রন্থগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ২১৬, ৫৪৮ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৩৫০-৩৫১, ৩৪৭, ৩৭৭, রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৭০ মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ৬, ১০ ১১০, মুখতাছারুছ সীরাত মোহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব, পৃ. ৬৮, ৭৩)।

আবু তালেব সকাশে কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধি দল

শাবে আবু তালেব থেকে বেরোবার পর রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করলেন, বয়কট শেষ হলেও পৌত্তলিক দুর্বৃত্তরা ইসলাম প্রচারে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল, এদিকে আবু তালেব তার ভাতিজাকে রক্ষা করার দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন বয়সের ভারে ন্যুজ্ব তার বয়স আশি বছর ছাড়িয়ে গিয়েছিল, ক্রমাগত কয়েক বছর যাবত দুঃখ দুর্দশা বিপদ মুসিবতে তার স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল, বিশেষ করে গিরিবর্তে অবরোধ তার শক্তি সামর্থ্য নিঃশেষ করে দিয়েছিল, সেখান থেকে বেরোবার কয়েকমাস পরই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এ সময় পৌত্তলিকরা চিন্তা করলো যে, আবু তালেব দ্রুত অসুস্থ হচ্ছেন যে কোন সময় তার জীবনের দিন শেষ হতে পারে তার মৃত্যুর পর যদি আমরা তার ভাতিজার ওপর কোন বাড়াবাড়ি করি, তখন আমাদের দুর্নাম হবে, লোকে বলাবলি করবে যে, অভিভাবক নেই দেখে এখন সুযোগ নিচ্ছে, একারণে তারা আবু তালেবের জীবদ্দশাতেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে একটি ফয়সালায় উপনীত হতে চাচ্ছিলো এক্ষেত্রে ছাড় দিতে তারা রাজি ছিল না, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার পর একটি প্রতিনিধিদল আবু তালেবের কাছে হাযির হল, এটা ছিল তার কাছে কোরাইশদের শেষ প্রতিনিধি দল।

ইবনে ইসহাক প্রমুখ বর্ণনা করেছেন যে, আবু তালেব অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কোরাইশরা আশঙ্কা করেছিল যে, হঠাৎ করেই আবু তালেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, দেখ হামযা, ওমর মুসলমান হয়ে গেছে এবং মুহাম্মদের ধর্ম কোরাইশদের সব গোত্রে বিস্তার লাভ করেছে, কাজেই চল, আবু তালেবের কাছে যাই, তিনি যেন তার ভাতিজাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখেন, এতে আমরা তার ব্যাপারে একটা চুক্তিতে উপনীত হতে পারব, আমরা আশঙ্কা করছি যে, সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কোন বাড়াবাড়ি করলে সাধারণ লোকেরা আমাদের সমালোচনা করবে তারা বলাবলি করবে আবু তালেব বেচে থাকতে কোন কিছু করার সাহস ছিলনা এখন সুযোগ পেয়েছে।

মোট কথা কোরাইশ প্রতিনিধি দল আবু তালেবের কাছে গিয়ে আলোচনা করলো, কোরাইশদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত ছিল, এরা হলো আবু জেহেল ইবনে হেশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এবং অন্যান্য সংখ্যায় এরা ছিল পঁচিশজন তারা বলল, হে আবু তালেব আমাদের কাছে আপনার যে মর্যাদা রয়েছে, সেটা আপনার অজানা নয়, বর্তমানে আপনি যে অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, সেটাও আপনি জানেন আমরা আশঙ্কা করছি যে, আপনার জীবনের দিন দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে, আপনার ভাতিজার সাথে আমাদের বিরোধ আপনার অজানা নয়, আমরা চাই আপনি তাকে ডেকে তার সাথে আমাদের একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করুন, আমরা তার সাথে কিছু অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে এবং তাকেও কিছু অঙ্গীকারে আবদ্ধ করতে চাই, আমরা তাকে তার দ্বীনের উপর ছেড়ে দেব, তিনিও যেন আমাদেরকে আমাদের দ্বীনের ওপর ছেড়ে দেন।

এ সব কথা শোনার পর আবু তালেব তার প্রিয় ভাতিজা মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে আনালেন, তিনি আসার পর বললেন দেখ ভাতিজা ওরা তোমার কওমের সম্মানিত লোক, তোমার জন্যই ওরা একত্রিত হয়েছে, তোমার কাছ থেকে ওরা কিছু অঙ্গীকার নিতে চায়, এরপর আবু তালেব ওদের উত্থাপিত প্রস্তাব পেশ করলেন যে ওরা চায়, তুমি তাদের ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না এবং ওরাও তোমার ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।

একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরাইশ প্রতিনিধিদলকে বললেন আপনারা বলুন আমি যদি এমন কোন কথা পেশ করি, যে কথা গ্রহন করলে আপনারা আরবের বাদশাহ হবেন এবং অনন্যারাও আপনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তখন আপনারা কি করবেন? অন্য বর্ণণায় রয়েছে যে, তিনি আবু তালেবকে সম্বোধন করে বললেন, আমি তাদের কাছে এমন একটি কথার স্বীকারোক্তি চাই যদি সেই স্বীকারোক্তি করে, তবে সমগ্র আরব তাদের অধীনস্থ হবে এবং অন্যরাও তাদের যিযিয়া দেবে, বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেছেন চাচা আপনি ওদের একটা বিষয়ের প্রতি ডাকুন, এতে ওদের ভালো হবে, আবু তালেব জিজ্ঞাসা করলেন ওদের তুমি কোন বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাও? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি ওদের এমন একটা বিষয়ের প্রতি ডাকতে চাই, যদি ওরা সেটা গ্রহণ করে, তবে সমগ্র আরব তাদের অনুগত হয়ে যাবে এবং অনারবের ওপরও তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আপনারা শুধু একটি কথা মেনে নিন এর ফলে আপনার আরবের বাদশাহ হয়ে যাবেন এবং অনারব আপনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

মোট কথা এই প্রস্তাব শোনার পর কোরাইশ প্রতিনিধিদল থমকে গেল, তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল যে, মাত্র একটি কথা মেনে নিলে এত বড় লাভ যদি হয়, তবে সেটা কিভাবে উপেক্ষা করা যায়? আবু জেহেল বললো, বলো সেই কথা, তোমার পিতার শপথ, এ ধরনের কথা একটি কেন দশটি বললেও আমরা মানতে প্রস্তুত রয়েছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আপনারা বলুন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নাই, অন্য সকলের আনুগত্য উপাসনা পরিত্যাগ করুন একথা শুনে কোরাইশরা হাতে তালি দিয়ে বলল, মোহাম্মাদ, আমরা এক খোদা মানব? আসলেই তোমার ব্যাপার স্যাপার বড় অদ্ভুত।

এরপর তারা একে অন্যকে বলল, খোদার কসম, এই লোক তোমাদের কোন কথাই মানতে রাজি নয়, কাজেই এসো আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর অটল থাকি, এরপর আল্লাহ ওর এবং আমাদের মধ্যে একটা ফয়সালা করে দেবেন একথা বলে তারা উঠে চলে গেল, এ ঘটনার পর ওদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন, শপথ উপদেশপূর্ণ কোরআনের তুমি অবশ্যই সত্যবাদী, কিন্তু কাফেররা ঔদ্ধত্য এবং বিরোধিতায় ডুবে আছে, এদের পূর্বে আমি কত জনগোষ্ঠী ধ্বংস করেছি, তখন ওরা আর্ত চিৎকার করছিল, কিন্তু তখন পরিত্রাণের কোন উপায় ছিল না, এরা বিস্ময় বোধ করছে যে, এদের কাছে এদেরই মধ্যে থেকে একজন সতর্ককারী আসলো এবং কাফেররা বললো, এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী, সে কি বহু ইলাহের পরিবর্তে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? এটাতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার, ওদের প্রধানেরা সরে পড়ে এই বলে তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের দেবতাগুলোর পূজায় অবিচল থাক, নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক, আমরা তো অন্য ধর্মাদর্শে এরূপ কথা শুনিনি, নিশ্চয়ই এটা একটি মনগড়া উক্তি মাত্র (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ৭, ৪, ৪১৯, মুখতাছারুছ সীরাত শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ৯১) (১-৭, ৩৮)।
দুঃখ বেদনার বছর
আবু তালেবের ইন্তেকাল

আবু তালেবের অসুখ বেড়ে গেল এবং এক সময় তিনি ইন্তিকাল করলেন, আবু তালেব ঘাটিতে অবরোধ থেকে মুক্ত হওয়ার ছয়মাস পর নবুয়তের দশ বর্ষে রজব মাসে তার মৃত্যু হয়েছিল (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮) অন্য এক বর্ণনায় একথা উল্লেখ রয়েছে যে, বিবি খাদিজার ইন্তেকালের তিনদিন আগে রমযান মাসের তিনি ইন্তিকাল করেন।

সহীহ বোখারীতে হযরত মোসায়েব থেকে বর্ণিত আছে যে, আবু তালেবের ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে যান সেখানে আবু জেহেলও উপস্থিত ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন চাচাজান আপনি শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলুন এই স্বীকারোক্তি করলেই আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্যে সুপারিশ করতে পারব, আবু জেহেল এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া বলল, আবু তালেব আপনি কি আবদুল মোত্তালেবের মিল্লাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন? এরপর এরা দুজন আবু তালেবের সাথে কথা বলতে লাগল, আবু তালেব শেষ কথা বলেছিলেন যে, আবদুল মোত্তালেবের মিল্লাতের উপর, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি আপনারে জন্যে মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকব, এরপর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাযিল করেন আত্মীয়স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মোমেনদের জন্য সঙ্গত নয় যখন এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ওরা জাহান্নামী (১১৩, ৯)।

আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতও নাযিল করেন, তুমি যাকে ভালোবাসো (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮) ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন এবং তিনিই ভালো জানেন সৎপথ অনুসারীদেরকে (৫৬, ২৮)।

আবু তালেব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিরূপ সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রকৃতপক্ষে মক্কায় কোরাইশ নেতা এবং নির্বোধ লোকদের ইসলামের ওপর হামলার মুখে তিনি ছিলেন একটি দুর্গের মত, কিন্তু তিনি নিজে তার পূর্ব পুরুষদের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর অটল অবিচল ছিলেন এ কারণে বোখারীতে হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আপনি আপনার চাচার কি কাজে আসলেন? তিনি তো আপনাকে হেফাজত করতেন, আপনার জন্য অন্যদের সাথে ঝগড়া বিবাদ শত্রুতার ঝুঁকি নিতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তিনি জাহান্নামের সবচেয়ে গভীর গহ্বরে থাকতেন (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮)।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একবার তার চাচার প্রসঙ্গ আলোচনা করা হলে তিনি বললেন, কেয়ামতের দিন আমার শাফায়ত হয়তো তার কিছু উপকারে আসবে, তাকে জাহান্নামের একটি উঁচু জায়গায় রাখা হবে, যা শুধু তার উভয় পায়ের হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছুবে (সহীহ বোখারী আবু তালেবের কিসসা অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৮)।

হযরত খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকাল

জনাব আবু তালেবের ইন্তেকালের দু, মাস অথবা শুধু তিন দিন পর উম্মুল মুমিমিন খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ইহলোক ত্যাগ করেন, নবুয়তের দশম বর্ষের রমজান মাসে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছিলো, সেই সময় তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স যখন ৫০শে পড়ছিলো, (রমজান মাসে ইন্তেকাল সম্পর্কে ইবনে জওযি তালকিহুল ফুহুম গ্রন্থের সপ্তম পাতায় এবং আল্লামা মনসুরপুরী তাঁর রহমাতুললিল আলামীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য হযরত খাদিজা ছিলেন আল্লাহর একজন বিশিষ্ট নিয়ামত, সিকি শতাব্দী যাবত তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনসঙ্গী ছিলেন, এ সময় দুঃখ কষ্ট ও বিপদের সময় প্রিয় স্বামীর জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠতো, বিপদের সময় তিনি তোকে ভরসা দিতেন, তাবলীগে দ্বীনের ক্ষেত্রে তার সঙ্গী থাকতেন, নিজের জানমাল দিয়েও তার দুঃখকষ্ট দূর করতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে সময় মানুষ আমার কুফরি করেছিলো সে সময় খাদিজা আমার উপর ঈমান এনেছিলেন, যে সময় লোকেরা আমাকে অবিশ্বাস করেছিলো সে সময় খাদিজা আমাকে সত্যবাদী বলে গ্রহণ করেছেন, যে সময় লোকেরা আমাকে বঞ্চিত করেছিলো, সে সময় তিনি আমাকে নিজের ধন-সম্পদের অংশীদার করেছেন, তাঁর গর্ভ থেকে আল্লাহ আমাকে সন্তান দিয়েছেন, অন্য স্ত্রীদের গর্ভ থেকে আমাকে কোন সন্তান দেওয়া হয়নি, (মুসনাদে আহমদ ষষ্ট খন্ড, পৃ.১১৮)।

সহীহ বোখারীতে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাঈল (আ.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, দেখুন খাদিজা আসছেন, তাঁর কাছে একটি বরতন রয়েছে, সেই বরতনে আগুন, খাবার, অথবা পানীয় রয়েছে, তিনি আপনার কাছে এলে আপনি তাকে তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সালাম জানাবেন, এবং জান্নাতে একটি মতি মহলের সুসংবাদ দেবেন, সেই মহলে কোন শোরগোল থাকবে না, এবং ক্লান্তি ও অবসন্নতাও কাউকে গ্রাস করবে না, (সহীহ বোখারী, তাজবিজুল নবী অধ্যায় ১ম খন্ড, পৃ. ৫৩৯)।

দুঃখ, দুশ্চিন্তা ও মনোবেদনা

উল্লেখিত দু, টি দুর্ঘটনা কয়েক দিনের মধ্যেই সংগঠিত হয়েছিল, এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শোকে দুঃখে কাতর হয়ে পড়লেন, এছাড়া তাঁর স্বজাতীয়দের পক্ষ থেকেও নির্যাতন নিষ্পেষণ নিপীড়ন চলছিলো, কেননা আবু তালেবের ওফাতের পর তাদের সাহস বেড়ে গিয়েছিলো, তারা খোলাখুলিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিতে লাগলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরূপ অবস্থায় তায়েফ গেলেন, মনে মনে আশা করছিলেন যে, সেখানকার জনসাধারণ হয়তো তাঁর প্রচারিত দ্বীনের দাওয়াত কবুল করবে, তাঁকে আশ্রয় দেবে এবং তাঁর স্বজাতীয়দের বিরুধীতার মুখে তাঁকে সাহায্য করবে।

কিন্তু সেখানে কোন সাহায্যকারী বা আশ্রয়দাতা তো পাওয়াই গেলো না, বরং তাঁর উপর উল্টো তাঁর ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানো হলো, তাঁর সাথে এমন দুর্ব্যবহার করা হলো যে, তাঁর কওমের লোকেরা এ যাবত ওরকম ব্যবহার করেনি, এ সম্পর্কিত বিবরণ পরে উল্লেখ করা যাবে।

এখানে একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মক্কার অধিবাসীরা যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়েছিলো, তাঁর বন্ধুদের ওপরও একই রকম অত্যাচার চালিয়েছিলো, আল্লাহর রসূলের প্রিয় সহচর হযরত আবু বকর (রা.) সেই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাবসা অভিমুখে রওনা হলেন, মক্কার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ইবনে দাগানার সাথে পথে দেখা হলো, তিনি হযরত আবু বকর (রা.) কে নিজের আশ্রয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়ে মক্কায় ফিরিয়ে আনলেন, (আকবর শাহ নযীবাবাদী উল্লেখ করেছেন যে, এই ঘটনা সেই বছরেই ঘটেছিলো, দেখুন, তারীখে ইসলাম ১ম খন্ড ৩৭২-৩৭৩, বোখারী১ম খন্ড পৃ.৫৫২-৫৫৩)।

ইবনে ইসহাক উল্লেখ করেছেন যে, আবু তালেবের ইন্তেকালের পর কোরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর এতো বেশী নির্যাতন চালিয়েছিলো যা তাঁর জীবদ্দশায় চিন্তাও করতে পারে নি, কোরাইশের এক বেকুব সামনে এসে আল্লাহর রসূলের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করলো, তাঁর এক মেয়ে ছুটে এসে সে মাটি পরিষ্কার করলো।

মাটি পরিষ্কার করার সময় তিনি শুধু কাঁদছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সে সময় সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, তিনি বলছিলেন মা তুমি কেঁদো না, আল্লাহ তায়ালা তোমার আব্বাকে হেফাজত করবেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বলছিলেন যে, কোরাইশরা আমার সাথে এমন কোন খারাপ ব্যবহার করে নি যে, মা যাতে আমার খারাপ লেগেছে, এমন পরিস্থিতিতে আবু তালেব ইন্তেকাল করেন(ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড পৃ.৪১৬)।

পর্যায়ক্রমে এ ধরনের অত্যাচার নির্যাতনের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বছরের নাম রেখেছিলেন আমূল হোযন অর্থাৎ দুঃখের বছর, সেই বছরটিতে এ নামেই ইতিহাসে বিখ্যাত।

হযরত সাওদার সাথে বিবাহ

সেই বছর অর্থাৎ নবুয়তের দশম বর্ষে শওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাওদা বিনতে জামআর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, হযরত সাওদা নবুয়তের প্রথম দিকেই মুসলমান হয়েছিলেন, দ্বিতীয় হিজরিতে তিনি হাবশায় হিজরতও করেছিলেন, তার স্বামীর নাম ছিল ছাকরান ইবনে আমর তিনিও প্রথম দিকে মুসলমান হন হযরত সাওদা তার সঙ্গে হাবশায় হিজরত করেন কিন্তু তিনি হাবশাতেই মতান্তরে মক্কায় ফেরার পথে ইন্তেকাল করেন এরপর হযরত সাওদার ইদ্দত শেষ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হযরত খাদিজা (রা.) এর ওফাতের পর তিনিই ছিলেন আল্লাহর রাসূলের স্ত্রী কয়েক বছর পর তিনি নিজের পালা হযরত আয়েশাকে হেবা করে দেন (রহমাতুল লিল আলামিন ২য় খন্ড, পৃ. ১৬৫ তালকিহুল ফুহুম পৃ. ৬)।
প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা
সেই নিদারুণ দুঃসময়েও মুসলমানরা কিভাবে অটল অবিচল থাকতে সক্ষম হলেন ? একথা ভেবে শক্ত মনের মানুষও অবাক হয়ে যান কি নির্মম নির্যাতনের মুখে মুসলমানরা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছিলেন অত্যাচার নির্যাতনের বিবরণ পাঠ করে দেহ মন শিউরে ওঠে, কি সেই সম্মোহনী শক্তি, যার কারণে মুসলমানরা এতটা অবিচলিত ছিলেন? এ সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাচ্ছে।

এক. ঈমানের সৌন্দর্য

সর্ব প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে আল্লাহর ওপর ঈমান এবং তার সঠিক পরিচয় জানা ঈমানের সৌন্দর্য ও মাধুর্য পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়েও অটল থাকে যার ঈমান এ ধরনের মজবুত এবং শক্তিশালী, তিনি যে কোন অত্যাচার নির্যাতনকে সমুদ্রের ওপরে ভাসমান ফেনার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন না এ কারনেই মোমেন বান্দা ঈমানের মিষ্টতা এবং মাধুর্যের সামনে কোন বিপদ বাধাকেই পরোয়া করেন না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, যা আবর্জনা তা ফেলে দেয়া হয় এবং যা মানুষের উপকারে আসে, তা জমিতে থেকে যায় (১৭, ১৩)।

দুই. আকর্ষণীয় নেতৃত্ব

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন উম্মতে ইসলামিয়া বরং সমগ্র মানব জাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, তার শারীরিক সৌন্দর্য মানসিক পূর্ণতা প্রশংসনীয় চরিত্র চমৎকার ব্যক্তিত্ব পরিশীলিত অভ্যাস ও কর্মতৎপরতা দেখে আপনা থেকেই তাকে ভালবাসার ইচ্ছা জাগতো, তার জন্যে মন উজাড় করে দিতে ইচ্ছা হত, মানুষ যেমন গুণ বৈশিষ্ট্য মনে প্রাণে পছন্দ করে, সেসব তার মধ্যে এত বেশী ছিল যে, এতোগুলো গুণ বৈশিষ্ট্য একত্রে অন্য কাউকেই দেয়া হয়নি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মর্যাদা শ্রেষ্ঠত্ব আভিজাত্য ও চারিত্রিক সৌন্দর্যে সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, ক্ষমাশীলতা আমানতদারী সততা সত্যবাদিতা সহিষ্ণুতা ইত্যাদি গুণ এত বেশি ছিল যে, তার স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে শত্রুরাও কখনো সন্দেহ পোষণ করেনি, তিনি যে কথা মুখে একবার উচ্চারণ করতেন তার শত্রুরাও জানতো যে, সে কথা সত্য এবং তা বাস্তবায়িত হবেই হবে বিভিন্ন ঘটনা থেকে একথার প্রমাণও পাওয়া যায়।

একবার কোরাইশদের তিনজন লোক একত্রিত হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই গোপনে কোরআন তেলাওয়াত শুনেছিল, কিন্তু কারো কাছে তারা সে কথা প্রকাশ করেনি, এদের মধ্যে আবু জেহেলেও ছিল একজন অন্য দুজনের একজন আবু জেহেলকে জিজ্ঞাসা করলো যে মোহাম্মাদের কাছে যা কিছু শুনেছো বলতো সে সম্পর্কে তোমার মতামত কি? আবু জেহেল বলল, আমি কি শুনেছি? আসলে কথা হচ্ছে যে, আমরা এবং বনু আবদে মান্নাফ আভিজাত্য ও মর্যাদার ব্যাপারে একে অন্যের সাথে মোকাবেলা করতাম তারা গরীবদের পানাহার করালে আমরাও তা করতাম, তারা দান খয়রাত করলে আমরাও করতাম, ওরা এবং আমরা ছিলাম পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা ছিলাম রেসের ঘোড়ার দুই প্রতিযোগীর মত, এমনি অবস্থায় আবদে মান্নাফ বলতে শুরু করল যে, আমাদের মধ্যে একজন নবী আছেন, তার কাছে আকাশ থেকে ওহী আসে বলতো আমরা কিভাবে ওরকম ওহী পেতে পারি? খোদার কসম, আমি ঐ ব্যক্তির ওপর কখনো বিশ্বাস স্থাপন করবো না, এবং কখনো তাকে সত্যবাদী বলে স্বীকৃতি দেব না (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ২১৬)।

ইতিপূর্বে এ ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে যে, পৌত্তলিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একদিন গালাগাল করছিল, পরপর তিনবার এরূপ করল, তৃতীয়বার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থমকে দাড়িয়ে বললেন, হে কোরাইশদের আমি তোমাদের কাছে জবাইর পশু নিয়ে এসেছি, একথা শোনার সাথে সাথে কাফেররা আল্লাহর রাসূলকে ভালো ভালো কথা বলে খুশী করার চেষ্টা করতে লাগলো, ইতিপূর্বে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা দেয়ার সময় কয়েকজন কাফের তার ঘাড়ের ওপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল, নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের কাজ যারা করেছে তাদেরকে বদ দোয়া দিলেন, সেই বদ দোয়া শুনে কাফেরদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, তারা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল, কেননা তারা নিশ্চিতভাবে জানতো যে, এবার আর তারা রেহাই পাবে না।

এ ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু লাহাবের পুত্র ওতাইবাকে বদদোয়া করার পর সে বুঝেছিল যে, এর পরিণাম থেকে সে রক্ষা পাবে না, সিরিয়া সফরের সময় বাঘ দেখেই সে বলেছিল আল্লাহর কসম মোহাম্মাদ মক্কায় থেকেই আমাকে হত্যা করেছেন।

উবাইন ইবনে খালফের ঘটনায় রয়েছে , এই লোকটি বারবার যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার হুমকি দিত, এ ধরনের হুমকির জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছিলেন, তুমি নও বরং আমিই তোমাকে হত্যা করব ইনশাআল্লাহ, এরপর ওহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য একজন সাহাবীর হাত থেকে একটি বর্শা নিয়ে উবাইয়ের প্রতি নিক্ষেপ করেন এতে তার ঘাড়ের কাছে সামান্য জখম হয়েছিল পরে উবাই বারবার বলছিল মোহাম্মাদ মক্কায়ই বলেছিলেন আমি তোমাকে হত্যা করব, তিনি যদি আমাকে থুথুও নিক্ষেপ করতেন তবুও আমার প্রাণ বেরিয়ে যেত (ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ. ৮৪) এর বিস্তারিত বিবরণ পরে উল্লেখ করা হবে।

একবার হযরত সাদ ইবনে মায়ায মক্কায় উমাইয়া ইবনে খালফকে বলেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি যে, মুসলমানরা তোমাকে হত্যা করবে একথা শুনে উমাইয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এ ভয় সব সময়েই তার ছিল, সে প্রতিজ্ঞা করছিল যে মক্কার বাইরে কখনো যাবে না, বদরের যুদ্ধের সময় আবু জেহেলের পীড়াপীড়িতে উমাইয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সবচেয়ে দ্রুতগামী উট ক্রয় করল, যাতে বিপদের আশঙ্কায় সময় দ্রুত পালিয়ে আসতে পারে, যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সময় তার স্ত্রী তাকে বলেছিল আবু সফওয়ান আপনার ইয়াসরেবী ভাই যে কথা বলেছেন আপনি কি সে কথা ভুলে গেছেন? উমাইয়া বলল, না ভুলিনি আমি তো ওদের সাথে অল্প কিছু দূরে যাব (সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৬৩)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুদের অবস্থা ছিল এরকম তার সঙ্গী এবং সাহাবাদের অবস্থা তো এমন ছিল যে, তারা মনে প্রাণে প্রিয় নবীর প্রতি নিবেদিত ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি সাহাবাদের ভালবাসা এতো তীব্র ছিল যেন তা পাহাড়ি ঝর্ণার পানির ধারা, লোহা যেমন চুম্বকের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সাহাবারাও তেমনি আল্লাহর রাসূল (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট হতেন।

কবি বলেন, তার চেহারা সব মানব দেহের জন্য অস্তিত্ব স্বরূপ তার অস্তিত্ব ছিল প্রতিটি অন্তরের জন্য চুম্বকের মত।

এ ধরনের ভালবাসা এবং নিবেদিত চিত্ততার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূলের ওপর কারো আঁচড় এবং তার পায়ে কাটা বিদ্ধ হওয়াও সহ্য করতে পারতেন না এর বিনিময়ে তারা নিজেদের মাথা কাটিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকতেন।

দুর্বৃত্ত ওতবা ইবনে রবিয়া একদা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে মারাত্মকভাবে প্রহার করলো, তাঁর চেহারা রক্তাক্ত করে দেওয়া হলো, তীব্র প্রহারের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, খবর পেয়ে তাঁর গোত্র বনু তাইমের লোকেরা তাঁকে কাপড়ে জড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিল, তাঁর বাঁচার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছিলো, দিনের শেষে তাঁর জ্ঞান ফিরে এলো, তিনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন? একথা শুনে বনু তাইম গোত্রের যারা সেখানে উপস্থিত ছিলো, তারা বিরক্তি প্রকাশ করলো, তারা উঠে যাওয়ার সময় হযরত আবু বকরের মাকে বললো, ওকে কিছু খাওয়াতে পারেন কিনা দেখুন, আবু বকর (রা.) তাঁর মা উম্মুল খায়েরের কাছে আল্লাহর রসূলের খবর জানতে চাইলেন, তিনি বললেন আমি তো জানি না বাবা, হযরত আবু বকর (রা.) বললেন মা আপনি উম্মে জামিল বিনতে খাত্তাবের কাছে যান, তাঁর কাছ থেকে আমাকে আল্লাহর রসূলের খবর এনে দিন, উম্মুল খয়ের উম্মে জামিলের কাছে গেলেন, তাঁকে বললেন, আবু বকর তোমার কাছে মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ সম্পর্কে জানতে চাইছেন, উম্মে জামিল বললেন, আমি আবু বকরকে জানিনা, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহকে জানিনা, তবে আপনি যদি চান, তাহলে আমি বকরের কাছে যেতে পারি, উম্মুল খায়ের উম্মে জামিলকে তাঁর পুত্রের কাছে নিয়ে এলেন, হযরত আবু বকরের অবস্থা দেখে উম্মে জামিল চিৎকার দিয়ে উঠলেন, বললেন যে কওমের লোকেরা আপনার এ দুরবস্থা করেছে, নিঃসন্দেহে তারা দুর্বৃত্ত ও কাফের, আমি আশা করি, আল্লাহ তায়ালা আপনার পক্ষে ওদের উপর প্রতিশোধ নেবেন, হযরত আবু বকর (রা.) আল্লাহর রসূলের খবর জানতে চাইলেন, উম্মে জামিল উম্মুল খায়েরের প্রতি ইশারা করলেন, হযরত আবু বকর (রা.) বললেন অসুবিধা নেই, উম্মে জামিল বললেন তিনি ভালো আছেন, এবং ইবনে আকরামের ঘরে আছেন, হযরত আবু বকর (রা.) বললেন আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আমাকে আল্লাহর রসূলের কাছে না নেওয়া পর্যন্ত আমি কোন কিছুই পানাহার করবো না, উম্মুল খায়ের ও উম্মে জামিল অপেক্ষা করতে লাগলেন, সন্ধ্যার পর লোক চলাচল কমে গেলে এবং অন্ধকার গাঢ় হয়ে এলে হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর মা উম্মুল খায়ের এবং উম্মে জামিলের কাঁধে ভর দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাযির হলেন (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ৩য় খন্ড, পৃ.৩০)।

ভালোবাসা এবং নিবেদিত চিত্ততার আরো কিছু বিস্ময়কর ঘটনা এবং বইয়ের বিভিন্ন স্থান বিশেষত ওহুদের যুদ্ধের ঘটনায় এবং হযরত যোবায়র (রা.) ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

তিন. দায়িত্ব সচেতনতা

সাহাবায়ে কেরাম ভালোভাবে জানতেন যে, মাটির মানুষের উপর যেসব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে দায়িত্ব যত কঠিন হোক না কেন উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই, কেননা সে দায়িত্ব উপেক্ষার পরিণাম হবে আরো ভয়াবহ, এতে সমগ্র মানব জাতির ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেই ক্ষতির তুলনায় এ জুলুম অত্যাচার বিপদ মুসিবতের কোন গুরুত্ব নেই।

চার. পরকালের উপর বিশ্বাস

আখিরাত বা পরকালের জীবনের উপর বিশ্বাস উল্লেখিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁদের কঠোর সংযমী ও সহিষ্ণু হতে অনুপ্রাণিত করেছে সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে সুদৃঢ় ও অবিচল আস্তা পোষণ করতেন যে, তাদেরকে একদিন রাব্বুল আলামিন আল্লাহর দরবারে দাড়াতে হবে সেখানে জীবনের ছোট বড় সকল কাজের হিসাব দিতে হবে এরপর হয়তো নেয়ামতপূর্ণ জান্নাত অথবা ভয়াবহ শাস্তিভরা জাহান্নামে প্রবেশ করান হবে, এ বিশ্বাসের বলে সাহাবায়ে কেরাম আশা ও আশঙ্কায় পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন, প্রিয় প্রভু আল্লাহর রহমতের আশা পোষণ করতেন এবং তার আযাবকে ভয় করতেন তাদের অবস্থার কথা পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এভাবে উল্লেখ করেন তারা যা কিছু সম্পাদন করে সেটা করে অন্তরে ভয়ভীতির সঙ্গে একারণে করে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।

তারা একথাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এ পৃথিবীর সকল আরাম আয়েশ সুখ স্বাচ্ছন্দ এবং দুঃখ কষ্ট পরকালের তুলনায় একটি মশার একটি পাখার সমান মূল্যও রাখে না এ বিশ্বাস তাদের এতো অবিচল এবং অটুট ছিলো যে, এর মোকাবেলায় দুনিয়ার সব বিপদ আপদ তিক্ততা দুঃখ কষ্ট ছিল তুচ্ছ।

পাঁচ. কঠিন থেকে কঠিনতর সে অবস্থা

কোরআনের যেসব আয়াত পর্যায়ক্রমে নাযিল হচ্ছিল, তাতে ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা ও আদর্শ আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল, কোরআনের সেসব আয়াতে মানব জাতির সামনে সবচেয়ে সম্মানজনক ও বৈশিষ্টমন্ডিত ইসলামী সমাজের ঈমানের সজীবতা এবং দৃঢ়তাকে আরো শক্তিমান করে তোলা হচ্ছিল, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন উদাহরণ পেশ করছিলেন এবং হেকমত বা কৌশল মুসলমানদের শিক্ষা দিচ্ছিলেন যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে যদিও এখনো তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের অবস্থা আসেনি এবং তারা ভীত ও কম্পিত হচ্ছিল, এমনকি রাসূল ও তার সাথে ঈমান আনয়নকারীরা বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? হা আল্লাহর সাহায্য কাছেই (২১৪, ২)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, আলিফ লাম মীম মানুষ কি মনে করে আমরা ঈমান এনেছি একথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেয়া হবে? আমি তো তাদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী (১-৩, ২৯)।

পাশাপাশি এমন সব আয়াত নাযিল হচ্ছিল সেসব আয়াতে কাফের মুশরিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হচ্ছিল, তাদের কোন অজুহাতেই ধোপে টেকার মত ছিল না, সুস্পষ্ট ভাষায় তাদের বলে দেয়া হয়েছিল যে, যদি তারা তাদের পথভ্রষ্টতা এবং হঠকারিতার ওপর অটল থাকে তবে পরিণাম হবে মারাত্মক, উহাদরহণ হিসাবে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের এমন সব ঘটনা এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে যে, ওতে আল্লাহর রাসূল এবং কাফেরদের সম্পর্কে আল্লাহর নীতি ব্যক্ত করা হয়েছে একই সাথে দয়া ও ক্ষমার কথাও বলা হয়েছে এবং পথনির্দেশ ব্যক্ত করা হয়েছে এসব বলা হয়েছে এ জন্যে যে, অবিশ্বাসীরা যেন নিজেদের পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহি থেকে বিরত থাকে।

প্রকৃতপক্ষে পবিত্র কোরআন মুসলমানদের এক ভিন্ন পৃথিবী ভ্রমণ করিয়ে এনেছে তাদের সামনে বিস্ময়কর সব উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে যাতে তারা হতোদ্যম হয়ে না পড়ে কোন বাধা বা প্রতিকূলতাই যেন তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ থেকে ফিরিয়ে রাখতে না পারে।

এ সকল আয়াতে মুসলমানদের এমন সব কথাও বলা হয়েছে যার দ্বারা মুসলমানরা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতের সুসংবাদ পেতে পারে আর অবিশ্বাসীদের চিত্র এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যাতে তারা আল্লাহর দরবারে ফয়সালার জন্য হাজির করার কথা জানতে পারে তাদের পার্থিব জীবনের পুণ্যের কোন স্থান পাবে না বরং তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে এবং বলা হবে, এবার দোযখের স্বাদ গ্রহন কর চিরদিন ধরে।

ছয়. কঠোর ধৈর্য

এসব কথা ছাড়াও মুসলমানরা অত্যাচারিত হওয়ার কেবল শুরু থেকেই নয়, বরং তার আগে থেকেই এটা জানতো, যে ইসলাম গ্রহণের অর্থ এই নয়ে যে, চিরস্থায়ীভাবে দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে বরং ইসলামের দাওয়াতের মূল কথাই ছিল জাহেলী যুগের অবসান সকল প্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন ইসলামের দাওয়াতের একটা লক্ষ্য এটাও ছিল যে, মুসলমানরা পৃথিবীতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবে এবং রাজণৈতিকভাবে এমন বিজয় অর্জন করবে, যাতে সকল মানুষকে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করা যায় মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে প্রবেশ করানো যায়।

কোরআনে করীমের এসব সুসংবাদ কখনো ইশারা এবং কখনো খোলাখুলিভাবে নাযিল হচ্ছিল, একদিকে অবস্থান এমন ছিল যে, প্রশস্ত হওয়া সত্বেও পৃথিবী মুসলমানদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল, তাদের টিকে থাকাই ছিল কঠিন তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করতে একদল লোক ছিল সদা সক্রিয়, অন্যদিকে মুসলমানদের শক্তি সাহস ও মনোবল বাড়াতে এমন সব আয়াত নাযিল হচ্ছিলো যাতে পূর্বকালের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, পূর্ববর্তী সময়ে নবীদের অবিশ্বাস করা হয়েছে এবং তাদের ওপরও অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়েছে সেসব আয়াতে যে চিত্র অঙ্কন করা হচ্ছিল তার সঙ্গে মক্কার মুসলমানে ও কাফেরদের অবস্থার হুবহু সাদৃশ্য ছিল, পরিশেষে একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইতিপূর্বে অবিশ্বাসীরা কিভাবে ধ্বংস এবং আল্লাহর পুণ্যশীল বান্দাদের তার জমিনের উত্তরাধিকারী করা হয়েছ পরিণামে মক্কার অবিশ্বাসীরাই ব্যর্থ ও পরাজিত ও মুসলমান এবং ইসলামের দাওয়াতের সাফল্যই অর্জিত হবে সেই সময়য়ে এমন সব আয়াতও নাযিল হয়েছে যেসব আয়াতে ঈমানদারদের বিজয়ের সুসংবাদ স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, আমার প্রেরিত বান্দাদের সম্পর্কে আমার এ বাক্য পূর্বেই স্থির হয়েছে যে, অবশ্যই তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে এবং আমার বাহিনী হবে বিজয়ী, অতএব কিছুকালের জন্য তুমি ওদেরকে উপেক্ষা কর তুমি ওদের পর্যবেক্ষণ কর, শীঘ্রই ওরা প্রত্যক্ষ করবে।

ওরা কি আমার শাস্তি ত্বরান্বিত করতে চায়? তাদের আঙ্গিণায় যখন শাস্তি নেমে আসবে তখন সতর্কীকৃতদের প্রতিফল ভয়াবহ ও জঘন্য হবে (১৭১, ১৭৭, ৩৭)।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, এই দলতো শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে (৪৫, ৫৪)।

বহু দলের এই বাহিনীও সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পরাজিত হবে (১১, ৩৮)।

হাবশায় হিজরতকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

যারা অত্যাচারিত হওয়ার পর আল্লাহর পথে হিজরত করেছে, আমি অবশ্যেই দুনিয়ায় তাদের উত্তম আবাস দেব এবং আখিরাতের পুরস্কারই তো শ্রেষ্ঠ, হায় ওরা যদি সেটা জানতো (৪২.১৬)।

অবিশ্বাসীরা আল্লাহর রাসূলকে হযরত ইউসুফ (আ.) এর ঘটনা জিজ্ঞাসা করার পর আল্লাহ তায়ালা বলেন, জিজ্ঞাসুদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে (৭, ১২) অর্থাৎ মক্কাবাসীরা আজ হযরত ইউসূফ (আ.) এর ঘটনা জিজ্ঞাসা করছে এবং ঠিক সে রকই ব্যর্থ হবে, যেমন ব্যর্থ হয়েছিল হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা এদের পরিণাম হবে হযরত ইউসুফের ভাইয়ের পরিণামের মতই, কাজেই হযরত ইউসূফ এবং তার ভাইদের ঘটনা থেকে মক্কাবাসীদের শিক্ষা গ্রহন করা উচিত তাদের বোঝা উচিত যে, অত্যাচারীদের পরিণাম কি ধরনের হয়ে থাকে, এক জায়গায় পয়গাম্বরদের প্রসঙ্গ আলোচনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন কাফেররা তাদের রাসূলদের বলেছিল, আমরা তো তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে অবশ্যই বহিষ্কার করব, অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতেই হবে অতঃপর রাসূলদের প্রতি তাদের প্রতিপালক ওহী প্রেরণ করলেন, জালেমদেরকে আমি অবশ্যই বিনাশ করব (১৩-১৪, ১৪)।

পারস্য এবং রোমে যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলছিল কাফেররা চাচ্ছিল পারস্যবাসী যেন জয়লাভ করে, মুসলমানরা চাচ্ছিল রোমকরা যেন জয়লাভ করে কেননা রোমকরা আল্লাহ তায়ালা, পয়গাম্বর, ওহী আসমানী কেতাবে বিশ্বাসী বলে দাবী করতো, পারস্যবাসীরা জয়যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে আল্লাহ এ সুসংবাদ প্রদান করেন যে, কয়েক বছর পর রোমকরা জয়লাভ করবে শুধু এ সুসংবাদই দেয়া হয়নি, বরং আল্লাহ তায়ালা এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, রোমকদের বিজয়ের সময় আল্লাহ তায়ালা মোমেনদেরও বিশেষভাবে সাহায্য করবেন এই সাহায্য পেয়ে তারা খুশি হবে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর সেদিন মোমেনরা হর্ষে উৎফুল্ল হবে আল্লাহর সাহায্যে (৪৫, ৩০) পরবর্তী সময়ে বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ও সাফল্যের দ্বারা আল্লাহর বাণীর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল।

কোরআনের ঘোষণা ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদেরকে এ ধরনের সুসংবাদ শোনাতেন হজ্জের সময় ওকায, মাযনা, এবং যুলমাজাযের বাজারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কাছে তার নবুয়তের কথা প্রচার করতেন, হে লোক সকল, তোমরা বল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, এতে তোমরা সফলকাম হবে এর বদৌলতে তোমরা হবে আরবের বাদশাহ এবং অন্যরাও তোমাদের পদানত হবে আর মরণের পরও তোমরা জান্নাতের ভেতর বাদশাহ হয়ে থাকবে (জামে তিরমিযি)।

ইতিপূর্বে এ ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওতবা ইবনে রবিয়া যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পার্থিব ভোগ বিলাস এবং ঐশ্বর্যের লোভ দেখাচ্ছিল এবং জবাবে তিনি হা-মীম সেজদা সূরার কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শুনিয়েছিলেন তখন ওতবা ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত মুসলমানরাই জয় লাভ করবে।

আবু তালেবের কাছে কোরাইশদের সর্বশেষ প্রতিনিধিদল দেখা করতে এলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জবাব দিয়েছিলেন ইতিপূর্বে সেই জবাব উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেও পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, তোমরা আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন কর, এর ফলে সমগ্র আরব তোমাদের অধীনস্থ হবে এবং অনারবের ওপরও তোমাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

হযরত খাব্বাব ইবনে আরত (রা.) বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হলাম তিনি কাবাঘরের ছায়ায় একটি চাদরকে বালিশ বানিয়ে শায়িত ছিলেন সে সময় আমরা পৌত্তলিকদের হাতে অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছিলাম, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেই পারেন এ কথা শুনে তিনি উঠে বসলেন তার চেহারা রক্তিম হয়ে উঠল, তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী সময়ে ঈমানদারদের অবস্থা এমনও হয়েছিল যে, লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের গোশত খুলে নেয়া হত, দেহে থাকত শুধু হাড়, এরূপ অত্যাচারও তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের ওপর বিশ্বাস থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি, এরপর বললেন, আল্লাহ তায়ালা দ্বীনকে পূর্ণতা প্রদান করবেন একজন ঘোড় সওয়ার সানয়া থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত সফর করবে, এ সময়ে আল্লাহর ভয় ছাড়া তার অন্য কোন ভয় থাকবে না তবে হ্যাঁ বকরিদের ওপর বাঘের ভয় তখনো থাকবে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৩)।

একটি বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছ (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১)।

স্মরণ রাখা দরকার যে, এসব সুসংবাদ কোন গোপনীয় বিষয় ছিল না, এসব কথা ছিল সর্বজনবিদিত, মুসলমানদের মতই কাফের অবিশ্বাসীরাও এসব কথা জানত, আসওয়াদ ইবনে মোত্তালেব এবং তার বন্ধুরা সাহাবায়ে কেরামকে দেখলেই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত তোমাদের কাছে সারা দুনিয়ার বাদশাহ এসে পড়েছে ওরা খুব শীঘ্রই কেসরা কায়সারকে পরাজিত করবে এসব কথা বলে তারা শিশ মারতো এবং হাততালি দিত (ফেকহুস সীরাত পৃ. ৮২)।

মোটকথা সাহাবায়ে কেরামের ওপর সে সময় যেসব যুলুম অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হত, সেসব কিছু বেহেশত পাওয়ার নিশ্চিত বিশ্বাস এবং সুসংবাদের মোকাবেলায় ছিল তুচ্ছ, এসব অত্যাচারকে সাহাবায়ে কেরাম মনে করতেন এক খন্ড মেঘের মত, যে মেঘ বাতাসের এক ঝাপটায় দূর হয়ে যাবে।

এছাড়া ঈমানদারদের ঈমানের পরিপক্কতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা দিয়ে নিয়মিতভাবে সাহাবিরা রূহানী খাবার সরবরাহ করতেন কোরআন শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে তাদের মানসিক পরিশুদ্ধতা ব্যবস্থা করতেন ইসলাম সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ রূহানী শক্তির ব্যবস্থা মানসিক পরিচ্ছন্নতা চারিত্রিক সৌন্দর্যের শিক্ষা সাহাবাদের মনোবল বাড়িয়ে দিচ্ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের ঈমানের নিভু নিভু স্ফুলিঙ্গকে উজ্জ্বল শিখায় পরিণত করতেন অন্ধকার থেকে বের করে তাদেরকে হেদায়েতের আলোকে পৌঁছে দিতেন এর ফলে সাহাবাদের দ্বীনি শিক্ষা ও বিশ্বাস বহুগুণ উন্নত হয়ে গিয়েছিল, প্রবৃত্তির দাসত্ব ছেড়ে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথে অগ্রসর হতেন, জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার আগ্রহ, জ্ঞান লাভের আকাঙ্খা এবং আত্ম সমালোচনায় তারা উদ্যোগী হয়েছিলেন এসব কারণে বিধর্মী পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতন তাদেরকে লক্ষ্য পথ থেকে দূরে সরাতে পারেনি, ধৈর্য সহিষ্ণুতায় তারা ছিলেন অটল অবিচল, বিশ্ব মানবের জন্য তারা প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিলেন এক একজন উজ্জ্বল আদর্শ।
তৃতীয় পর্যায়ঃ মক্কার বাইরে ইসলামের দাওয়াত
তায়েফে আল্লাহর রাসূল

নবুয়তের দশম বর্ষের (মাওলানা নজীবাদী তারীখে ইসলাম ১ম খন্ডে ১২২ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন আমার মতে এ তারিখটিই নির্ভুল) শুরুর দিকে ৬১৯ ঈসায়ী সালের মে মাসের শেষ দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ গমন করেন তায়েফ মক্কা থেকে ষাট মাইল দূরে অবস্থিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাওয়া আসার পথ একশত বিশ মাইল দূরত্ব পায়ে হেটে অতিক্রম করেছিলেন আল্লাহর রাসূলে সাথে তার মুক্ত ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ছিলেন, তায়েফ যাওয়ার পথে পথে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন, কিন্তু কেউ তার দাওয়াত গ্রহন করল না, তায়েফ পৌছার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাকিম গোত্রের তিনজন সর্দারের কাছে যান, এরা পরস্পর ভাই এদের নাম ছিল আবদে ইয়ালিল, মাসউদ এবং হাবিব এদের পিতার নাম ছিল আমর ইবনে ওমায়ের ছাকাফি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে পৌঁছে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং ইসলামের সাহায্য করার আহবান জানান, জবাবে একজন টিপ্পনির সুরে বলল, কাবার পর্দা সে ফেড়ে দেখাক যদি আল্লাহ তাকে রাসূল করে থাকেন (উর্দু ভাষায় এ পরিভাষার সাথে একথা মিলে যায় যে, যদি তুমি পয়গম্বর হও, তবে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করুন একথা দ্বারা এটাই বোঝানো হয় যে, তোমার মত লোকের পয়গাম্বর হওয়া অসম্ভব যেমন কাবাঘরের ওপর হামলা করা অসম্ভব)।

অন্য একজন বলল, আল্লাহ তায়ালা কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পেলেন না? তৃতীয়জন বলল আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলতে চাই না, কেননা তুমি যদি নবী হয়ে থাক, তাহলে তোমার কথা রদ করা আমার জন্য বিপজ্জনক হবে আর তুমি যদি আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা রটাও তবে তা তোমার সাথে আমার কথা বলাই উচিত নয় এসব শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন তোমরা যা করছ তবে বিষয়টা গোপন রেখ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফে দশদিন অবস্থান করেন, এ সময়ে তিনি তায়েফের সকল নেতৃস্থানীয় লোক অর্থাৎ গোত্রীয় সর্দারদের কাছে যান এবং প্রত্যেককে দ্বীনের দাওয়াত দেন কিন্তু সবাই এক কথা বলল যে, তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও, শুধু এ কথা বলেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং উচ্ছৃংখল বালকদের উস্কানি দিয়েছিল, তিনি ফেরার সময় ওসব দুর্বৃত্ত বালক তার পেছনে লেগে গেল, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল করছিল, হাততালি দিচ্ছিল ও হৈ চৈ করছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে এত বালক এবং দুর্বৃত্ত লোক জড় হল যে, পথের দুধারে লাইন লেগে গেল, এরপর গালাগাল দিতে এবং ঢিল ছুড়তে লাগল, এতে তার দুপা রক্তাক্ত হয়ে তার জুত রক্তে ভরে গেল, এদিকে হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)ঢাল হিসাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আগলে রাখছিলেন ফলে নিক্ষিপ্ত ঢিল তার গায়ে পড়ছিল, তার মাথায় কয়েক জায়গায় কেটে গেল হৈ চৈ করতে করতে দুর্বৃত্তরা আল্লাহর রাসূলের পিছু নিয়েছিলেন এক সময় তিনি মক্কার ওতবা, শায়বা এবং রবিয়াদের একটি বাগানে আশ্রয় নিলেন, এ বাগান ছিল তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাগানে আশ্রয় নেয়ার পর দুর্বৃত্তরা ফিরে গেল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি দেয়ালে হেলান দিয়ে আঙ্গুর গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন, কিছুটা শান্ত হওয়ার পর এই দোয়া করলেন যা দোয়ায়ে মোসতাদয়েফিন নামে বিখ্যাত এ দোয়ার প্রতিটি শব্দ দ্বারা বোঝা যায় যে, তায়েফবাসীদের খারাপ ব্যবহার এবং একজন লোকেরও ঈমান না আনার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতটা মনকষ্ট পেয়েছিলেন তার দুঃখ ও মনোবেদনা ছিল কত গভীর এই দোয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হে আল্লাহ তায়ালা আমি তোমার কাছে আমার দুর্বলতা, অসহায়তা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতা সম্পর্কে অভিযোগ করছি দয়ালু দাতা, তুমি দুর্বলদের প্রভু, তুমি আমারও প্রভু, তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করেছ? আমাকে কি এমন অচেনা কারো হাতে ন্যস্ত করছো যে আমার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করবে, নাকি কোন শত্রুর হাতে ন্যস্ত করছো যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছো? যদি তুমি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোন দুঃখ নেই, আফসোসও নেই, তোমার ক্ষমাশীলতা আমার জন্য প্রশস্ত ও প্রসারিত কর, আমি তোমার সত্তর সেই আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূর হয়ে আলোয় চারিদিক ভরে যায়, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় তোমার হাতে ন্যস্ত, তুমি আমার ওপর অভিশাপ নাযিল করবে বা ধর্মকাবে, যে অবস্থায় তোমার সন্তুষ্টি কামনা করি, সকল ক্ষমতা ও শক্তি শুধু তোমারই তোমার শক্তি ছাড়া কারো কোনো শক্তি নেই।

রবিয়ার পুত্ররা আল্লাহর রাসূলের অবস্থা দেখে তার প্রতি দয়া পরবশ হল, নিকট আত্মীয়তার কথা ভেবে তাদের মন নরম হয়ে গেল, নিজেদের খৃষ্টান ক্রীতদাস আদাসের হাতে এক থোকা আঙ্গুর দিয়ে বলল, লোকটিকে দিয়ে এস, ক্রীতদাস আদাস আঙ্গুরের থোকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়ার পর তিনি বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করলেন।

আদাস বলল, খাওয়ার সময় এ ধরনের কথা তো এখানের লোকজনরা বলে না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কোথাকার অধিবাসী? তোমার ধর্ম কি ? সে বলল, আমার বাড়ী নিনোভায়, ধর্ম ঈসায়ী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তুমি পুণ্যশীল বান্দা হযরত ইউসুফের এলাকার অধিবাসী, আদাস বলল, আপনি ইউসুফকে কি করে চেনেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তিনি ছিলেন আমার ভাই, তিনি ছিলেন নবী, আমি নবী, একথা শুনে আদাস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঝুঁকে পড়ল, এবং তার মাথা হাত ও পায়ে চুম্বন করল।

এ অবস্থা দেখে রবিয়ার দুই পুত্র নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, এই লোক এবার আমাদের ক্রীতদাসদের মাথা বিগড়ে দিয়েছে, মনিবদের কাছে ফিরে গেলে তারা আদাসকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে কি ব্যাপার? আদাস বলল, আমার বিবেচনায় পৃথিবীতে এই লোকের চেয়ে ভাল লোক আর নেই, তিনি আমাকে এমন একটি কথা বলেছেন যে কথা নবী ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, রবিয়ার পুত্ররা বলল, দেখ আদাস, এই লোক যেন তোমাকে তোমার ধর্ম বিশ্বাস থেকে সরাতে না পারে তোমার ধর্ম এ লোকের ধর্মের চেয়ে ভাল।

কিছুক্ষণ অবস্থানের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাগান থেকে বেরিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হলেন মানসিকভাবে তিনি ছিলেন বিপর্যস্ত, কারণে মানায়েল নামক জায়গায় পৌছার পর আল্লাহর নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ.) এলেন, তার সাথে পাহাড়ের ফেরেশতারাও ছিলেন, তারা আল্লাহর রাসূলের কাছে অনুমতি চাইতে এসেছিলেন যে, যদি তিনি বলেন, তবে এর অধিবাসীদেরকে দুটি পাহাড়ের মধ্যে পিষে দেবেন।

এ ঘটনার বিবরণ বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওহুদের দিনের চেয়ে মারাত্মক কোন দিন আপনার জীবনে এসেছিল কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন তোমার কওম থেকে আমি যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ দিন ছির তায়েফের দিন আমি আবদে ইয়ালিস ইবনে আবদে কুলাল সন্তানদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলাম কিন্তু তারা আমার দাওয়াত গ্রহন করেনি, আমি দুঃখ কষ্ট ও মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় কারোন ছাআলেবে পৌঁছে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম, সেখানে মাথা তুলে দেখি মাথার ওপরে এক টুকরো মেঘ, ভালভাবে তাকিয়ে দেখি সেখানে হযরত জিবরাঈল (আ.) তিনি আমাকে বললেন, আপনার কওম আপনাকে যা যা বলেছে আল্লাহ তায়ালা সবই শুনেছেন, আপনা কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাদের পাঠানো হয়েছে, এরপর পাহাড়ের ফেরেশতারা আমাকে আওয়াজ দিলেন, সালাম জানালেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল হা এ কথা সত্যই, আপনি যদি চান তবে আমরা ওদেরকে দুই পাহাড়ের মধ্যে পিষে দেব (এখানে সহীহ বোখারীতে আখশাবিন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে মক্কার দুটি বিখ্যাত পাহাড় আবু কোবায়েস এবং কাযাইকাযান সম্পর্কে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়, এ দুটি পাহাড় কাবাঘরের উত্তর ও দক্ষিণে মুখোমুখি অবস্থানে অবস্থিত সেই সময়ে মক্কার জনসাধারণ এই দুটি পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় বসবাস করত)।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না আমি আশা করি আল্লাহ তায়ালা ওদের বংশধরদের মধ্যে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন যারা শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না (সহীহ বোখারী কেতাবে বাদায়াল খালক ১ম খন্ড, পৃ. ৪৫৮)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই জবাবে তার দূরদর্শিতা বিচক্ষণতা, অনুপম ব্যক্তিত্ব ও উত্তম মানবিক চেতনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, মোটকথা, আসমানের ওপর থেকে আসা গায়েবী সাহায্য তার মন শান্ত হয়ে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার পথে পা বাড়ালেন, ওয়াদীয়ে নাখলা নামক জায়গায় এসে তিনি থামলেন, এখানে তার অবস্থানের মত জায়গা ছিল দুটি, এক জায়গার নাম আসসাইলোল কাবির, অন্য জায়গা হলো জায়মা, উভয় জায়গার পানি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সজীবতা বিদ্যমান ছিল, এ দুটি জায়গার মধ্যে তিনি কোথায় অবস্থান করছিলেন সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায়নি।

নাখলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকদিন কাটান সেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিনদের দুটি দল তার কাছে প্রেরণ করেন পবিত্র কোরআনের দুই জায়গায় সূরা আহকাফ এবং সূরা জিন এ এদের কথা উল্লেখ রয়েছে।

সূরা আহকাফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে যারা কোরআন পাঠ শুনছিল, যখন ওরা তার কাছে উপস্থিত হল, ওরা একে অপরকে বলতে লাগলো চুপ করে শ্রবণ কর, যখন কোরআন পাঠ সমাপ্ত হল ওরা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এক একজন সতর্ককারীরূপে এমন এক কেতাবের পাঠ শ্রবণ করেছি যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসা (আ.)এর উপর, এটি পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে, হে আমাদের সম্প্রদায়, আমাদের দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন এবং মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন (২৯-৩১, ৪৬)।

সূরা জিন এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, বল আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে আমরা তো এক বিস্ময়কর কোরআনে শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থির করব না, সূরা জিন এর পনেরটি আয়াত পর্যন্ত এর বর্ণনা রয়েছে।

উল্লিখিত আয়াতসমুহের বর্ণনাভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিনদের আসার কথা প্রথম দিকে জানতেন না কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে জানানোর পর আল্লাহর রাসূল এ সম্পর্কে অবহিত হন কোরআনের আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, এটা ছিল জিনদের প্রথম আগমন, বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, পরবর্তী সময়ে তাদের যাতায়াত চলতে থাকে।

জিনদের আগমন এবং ইসলাম গ্রহন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল দ্বিতীয় সাহায্য আল্লাহর অদৃশ্য ভাণ্ডার থেকে তিনি এ সাহায্য লাভ করেন এ ঘটনার বর্ণনা সম্পর্কিত অন্যান্য আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় রাসূলকে দ্বীনি দাওয়াতের সাফল্যের ব্যাপারে সুসংবাদ দিয়েছেন এবং একথা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীর কোন শক্তিই দ্বীন ইসলামের দাওয়াতের সাফল্য অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে টিকতে পারবে না, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পাবে না, এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারীও থাকবে না, ওরাই সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে রয়েছে (৩২, ৪৬)।

আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের উক্তির কথা বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা আল্লাহকে যমিনে অসহায় করতে পারব না, এবং আমরা পালিয়ে গিয়েও তাকে অসহায় করতে পারব না (১২, ৭২)।

এই সাহায্য এবং সুসংবাদের সামনে তায়েফের খারাপ ব্যবহারজনিত দুঃখ কষ্ট, মনের কালো মেঘ দূর হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহর রাসূল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, মক্কায় তাকে ফিরে যেতে হবে এবং নতুন উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে, এ সময় হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি করে মক্কায় যাবেন, মক্কার অধিবাসীরা তো আপনাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে, তিনি বললেন, হে যায়েদ, তুমি যে অবস্থা দেখছ, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় আল্লাহ তায়ালা বের করে দেবেন, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তার দ্বীনকে সাহায্য এবং তার নবীকে জয়যুক্ত করবেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাখলা থেকে রওয়ানা হয়ে মক্কার অদূরে হেরা গুহায় অবস্থান করলেন, সেখান থেকে খাজায়া গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে আখনাস ইবনে শোরাইককে এ পয়গাম পাঠালেন যে, আখনাস যেন তাকে আশ্রয় দেন, আখনাস একথা বলে অক্ষমতা প্রকাশ করল যে, আমি তো মিত্রপক্ষ, মিত্রপক্ষ তো কাউকে আশ্রয় দেয়ার মত দায়িত্ব নিতে পারে না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর সোহায়েল ইবনে আমরের কাছেও একই পয়গাম পাঠালেন কিন্তু সেই লোকও এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলো যে, বনু আমরের দেয়া আশ্রয় বনু কাব এর ওপর প্রযোজ্য নয়, এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর কাছে পয়গাম পাঠালেন মোতয়াম বললেন হ্যাঁ, আমি রাজি আছি এরপর তিনি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে নিজের সন্তান এবং গোত্রের লোকদের ডেকে একত্রিত করলেন সবাই একত্রিত হওয়ার পর বললেন, তোমরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে কাবাঘরের সামনে যাও, কারণ আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি, এরপর মোতয়াম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খবর পাঠালেন যে আপনি মক্কার ভেতরে আসুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর পাওয়ার পর যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন মোতয়াম ইবনে আদী তার সওয়ারীর ওপর দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, কোরাইশের লোকেরা শোন আমি মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আশ্রয় দিয়েছি কেউ যেন এরপর তাকে বিরক্ত না করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং দুরাকাত নামায আদায় করলেন নামায আদায়ের পর তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন এ সময় মোতয়াম ইবনে আদী এবং তার সন্তানেরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘিরে রাখল, আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তারা তার সঙ্গে ছিল।

বলা হয়ে থাকে যে, এ সময় আবু জেহেল মোতয়াকে জিজ্ঞাসা করছিল, তুমি শুধু তাকে আশ্রয় দিয়েছ, না তার অনুসারী অর্থাৎ মুসলমান ও হয়ে গেছ? মোতয়াম বললেন, আমি শুধু আশ্রয় দিয়েছি।

এতে আবু জেহেল বলল, তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছ আমরাও তাকে দিলাম (তায়েফ সফরের এ ঘটনার বিবরণসমূহ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪২৯-৪২২, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৬-৪৭, রহমাতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৭১-৭৪, তারীখে ইসলাম নযীরাবাদী, ১ম খন্ড, পৃ. ১২৩-১২৪)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোতয়াম ইবনে আদীর এ উপকার কখনো ভোলেননি, বদরের যুদ্ধের পর মক্কার কাফেররা বন্ধী হয়ে আসার পর কয়েকজন বন্দীর মুক্তির সুপারিশ নিয়ে মোতয়ামের পুত্র হযরত হোবায়ব (রা, )রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হলেন তিনি বলেছিলেন, মোতায়ম ইবনে আদী যদি আজকে বেচে থাকতো এবং আমার কাছে এসব দুর্গন্ধময় লোকদের ব্যাপারে সুপারিশ করতো, তবে তাদের খাতিরে আমি এদের সবাইকে মুক্ত করে দিতাম (সহীহ বোখারী ৩য় খন্ড, পৃ.৫৭৩)।

বিভিন্ন গোত্র ও ব্যক্তির কাছে ইসলামের দাওয়াত

নবুয়তের দশম বর্ষে যিলকদ মাসে অর্থাৎ ৬১৯ ঈসায়ী সালের মে মাসের শেষ বা জুনের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ থেকে মক্কায় আগমন করেন, সেখানে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোত্রের কাছে নতুন উদ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন, এ সময় হজ্জের মৌসুম হওয়ায় দূরে কাছে সর্বত্র থেকে হজ্জ পালনের জন্য পায়ে হেঁটে এবং সওয়ারীতে করে বহু লোক হজ্জ পালনের জন্য আসেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সময় তাদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন, নবুয়তের চতুর্থ বছর থেকে তিনি এ ধরনের দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন।

ইমাম যুহরী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল গোত্রের কাছে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, তারা হচ্ছে, বনু আমের ইবনে সায়া, সায়া মোহারেব ইবনে খাছফা, ফাজারাহ, নাসসান, মায়রা, হানিফা, সালিম, আবাস, বনু নছর, বনু আলবাকা, কেলাব, হারেছ ইবনে আজারাহ ও হাজারেমা, কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি (তিরমিযি, মুখতাছারুছ সীরাত, শেখ আবদুল্লাহ, পৃ.১৪৯)।

ইমাম যুহরীর উল্লিখিত এ সকল গোত্রের কাছে একবার বা এক বছরের হজ্জ মৌসুমেই শুধু ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়নি বরং নবুয়তের চতুর্থ বছর থেকে শুরু করে হিজরত পূর্ববর্তী শেষ হজ্জ মৌসুম অর্থাৎ দশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে তাদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো (রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৭৪)।

ইবনে ইসহাক কয়েকটি গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করে, এবং তাদের জবাবের প্রতিকৃতি ও উল্লেখ করেছেন, নীচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা হলো।

এক) বনু কেলাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই গোত্রের কাছে একটি শাখা বনু আবদুল্লাহর কাছে গমন করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহ এবং তার রসূলের প্রতি আহবান জানান, কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, হে বনু আবদুল্লাহ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পিতামহের চরম নাম রেখেছিলেন, কিন্তু এই গোত্রের লোকেরা আল্লাহর রসূলের দেওয়া দাওয়াত গ্রহণ করে নি।

দুই) বনু হানিফা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের বাড়িতে গমন করেন তাদেরকে কে দাওয়াত দেন কিন্তু তারা যে জওয়াব দিয়েছিলো, সে রকম জবাব আরবের কেউ প্রদান করেনি।

তিন) আমের ইবনে সায়া’ সায়া’, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এদের কাছেও দাওয়াত দিয়েছিলেন, জবাবে এ গোত্রের বুহায়রাহ বিন ফারাস নামক এক ব্যক্তি বলেছিলো, আল্লাহর শপথ যদি আমি কোরাইশদের এক যুবককে সঙ্গে রাখি, তবে সমগ্র আরবকে খেয়ে ফেলবো, এরপর সে বললো একটা কথার জবাব দিন, যদি আমরা আপনার দ্বীন গ্রহণ করি, এবং আপনি প্রতিপক্ষের উপর জয়লাভ করেন, এরপর কি নেতৃত্ব আমাদের হাতে আসবে, ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নেতৃত্ব কর্তৃত্ব তো আল্লাহর হাতে, তিনি যেখানে ইচ্ছা করেন সেখানে রাখবেন, একথা শুনে সেই লোক বললো, চমৎকার কথা, আপনার নিরাপত্তার জন্য আমরা নিজেদের বুককে আরবদের নিশানা করবো অথচ আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন নেতৃত্ব কর্তৃত্ব থাকবে অন্যদের হাতে, এটা হয় না, আপনার দ্বীন আমাদের প্রয়োজন নেই।

এরপর বনু আমের গোত্র তাদের এলাকায় চলে যাওয়ার পর একজন বৃদ্ধা এ ঘটনা শুনলেন, বার্ধক্যের কারণে তিনি হজ্জে যেতে পারে নি, সব কথা শুনে তিনি দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে বললেন, মারাত্মক ভুল করেছ তুমি, হে বনু আমের গোত্রের লোকেরা, সেই লোককে কি খুঁজে পাওয়ার কোন উপায় আছে? সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, হযরত ইসমাইলের কোন বংশধর মিথ্যা নবুয়তের দাবী করতে পারেনা, অতীতেও করেনি, তোমাদের বুদ্ধি চলে গিয়েছিলো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৪৪৩-৪৪৮)।

মক্কার বাইরে ইসলামের আলো

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্র ও প্রতিনিধিদলকেই শুধু নয়, বহু ব্যক্তিকেও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, এদের অনেকে ভালো জবাবও দিয়েছিলেন, হজ্জ মৌসুমের অল্পকাল পর কিছু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেন, নীচে সম্পর্কিত একটি সংক্ষিপ্ত রোয়েদাদ পেশ করা হচ্ছে,

এক) সুয়াইদ ইবনে সামেত, এই লোক ছিলো কবি ও যথেষ্ট বুদ্ধি বিবেচনা রাখতো, সে ছিলো ইয়াছরিবের অধিবাসী, বুদ্ধিমত্তা কাব্যচর্চা, আভিজাত্য, এবং বংশমর্যাদার কারণে তার কওমের লোকেরা তাকে কামেল উপাধিতে ভূষিত করেছিলো, এই লোকটি হজ্জ বা ওমরাহ করার জন্য মক্কায় এসেছিলো, আল্লাহর রসূল তাকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন, সে বললো, আমার কাছে যে জিনিষ আছে, সম্ভবত আপনার কাছে সে জিনিষ আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার কাছে কি রয়েছে? সে বললো, লোকমানের হেকমত, আল্লাহর রসূল বললেন শোনাওতো, সুয়াইদ শোনাল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ বাণী উত্তম কিন্তু আমার কাছে যা রয়েছে সেটা এর চেয়েও উত্তম, আমার কাছে রয়েছে কোরআন, এই কোরআন আল্লাহ আমার উপর নাযিল করেছেন, এটি হচ্ছে হেদায়েতের নূর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর লোকটিকে কোরআনের কিছু অংশ শোনালেন, এরপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করে বললেন, এটা তে চমৎকার কালাম, নবুয়তের একাদশ বর্ষের প্রথমদিকে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, ইসলাম গ্রহণের পর সুয়াইদ মদিনায় ফিরে এলে বুআস যুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধে তিনি শহীদ হন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ.৪২৫-৪২৭ রহমাতুললিল আলামিন, ১ম খন্ড পৃ.৭৪)।

দুই) ইয়াসি ইবনে মায়াজে, এই ব্যক্তি ছিলো ইয়াসরিবের অধিবাসী, বয়সে ছিলেন যুবক, নবুয়তের একাদশ বর্ষে বুআস যুদ্ধের কিছু কাল আগে আওসের একটি প্রতিনিধিদল খাজরাজের বিরুদ্ধে কোরাইশদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশায় মক্কায় আসে, ইয়াশও তাদের সঙ্গে ছিলেন, সে সময় উভয় গোত্রের মধ্যে শত্রুতার আগুন জ্বলে উঠেছিলো, আওসের লোকসংখ্যা ছিলো খাজরাজের চেয়ে কম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রতিনিধিদলের আগমন সংবাদ শোনার পর দেখা করতে গেলেন, তাদের মাঝখানে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললে, আপনারা যে উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন এর চেয়ে ভালো কোন জিনিষ গ্রহনে রাজি আছেন কি? তারা বললেন কি সেই জিনিষ ? আল্লাহর রসূল বললেন আমি আল্লাহর রসূল, আল্লাহ তায়ালা আমাকে তার বান্দাদের কাছে এ দাওয়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেছেন, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে এবং তার সাথে কাওকে শরীক না করে, আল্লাহ তায়ালা আমার উপর কিতাব নাযিল করেছেন, এরপর তিনি ইসলামের কথা উল্লেখ করে কোরআন তেলাওয়াত করেন।

ইয়াস ইবনে মায়াজ বললেন, হে কওম আপনারা যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন, এই দাওয়াত তার চেয়ে উত্তম, প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য আবুল হাছির আনাস ইবনে রাফে একমুঠো খড় ইয়াসের মুখে ছুড়ে দিয়ে বললো এসব কথা ছাড়ো, আমার বয়সের শপথ এখানে আমরা অন্য উদ্দেশ্যে এসেছি, এরপর ইয়াস আর কোন কথা বলেন নি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও উঠে চলে গেলেন, এদিকে প্রতিনিধিদল কোরাইশদের সাথে মৈত্রী ও সহযোগীতা চুক্তি করতেও সক্ষম হয়নি, তারা ব্যর্থ হয়ে মদিনায় ফিরে এলো।

তিন) আবু যর গিফারী, এক ব্যক্তি শহর থেকে দুরে এক জায়গায় বসবাস করতেন, সুয়াইদ ইবনে সামেত এবং ইয়াশ ইবনে মায়জের কাছ থেকে আবু যর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের খবর পেয়েছিলেন, এ খবরই ছিলো তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণ (একথা আকবর নদীরাবাদী লিখেছেন, তারীখূল ইসলাম, ১ম খন্ড, পৃ.১২৮ দেখুন) তার ইসলাম গ্রহণের বুখারী শরীফে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা মতে আবু যর বলেন, আমি ছিলাম গেফার গোত্রের লোক, আমি শুনলাম এমন একজন লোক আবির্ভূত হয়েছেন যিনি নিজেকে নবী বলে দাবী করেছেন, এ খবর শুনে আমার ভাই কে মক্কায় পাঠালাম, তাকে বলে দিলাম, তুমি সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করবে।

এরপর আমার কাছে তার খবর নিয়ে আসব, আমার ভাই মক্কায় থেকে ফিরে এলে জিজ্ঞাসা করলাম, কি খবর এনেছো? সে বললো, খোদার কসম, আমি এমন একজন মানুষ দেখেছি, যিনি সৎ কাজের আদেশ দিয়ে থাকেন এবং খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখেন, আমি বললাম তুমি স্বস্তি পাওয়ার মতো খবর দিতে পারোনি, এরপর আমি কিছু পাথেয় সম্বল করে মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে সেখানে হাযির হলাম, কিন্তু সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পারলাম না, কারো কাছে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পেলাম না, যমযমের পানি পান করে মসজিদে হারামে পড়ে রইলাম, হযরত আলী (রা.) দেখে বললেন, আপনাকে অচেনা মনে হচ্ছে, আমি বললাম জ্বী হ্যাঁ, তিনি বললেন, আমার ঘরে চলুন, আমি তার সাথে গেলাম তিনি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না, আমিও কিছু বললাম না।

সকালে আবার মসজিদে হারামে গেলাম, আশা ছিলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবো, কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ আমাকে কিছু বললো না, সন্ধ্যায় হযরত আলী (রা.) এসে আমাকে দেখে বললেন, এই লোকটি এখনো নিজের ঠিকানা জানতে পারেনি? আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই, এখনো পারেনি, তিনি বললেন, চলুন, আমার সাথে চলুন, এরপর তিনি বললেন, কি ব্যাপার আপনার বলুন তো? আপনি এ শহরে কেন এসেছেন? আমি বললাম, আপনি যদি কথাটা গোপন রাখেন, তবে বলতে পারি, তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি বললাম এখানে একজন লোক নিজেকে নবী বলে দাবী করেছেন বলে আমি খবর পেয়েছি, খবর পাওয়ার পর আমি আমার ভাইকে পাঠিয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে বিস্তারিত কোন খবর জানাতে পারেনি, এ কারণে নিজেই এসেছি, হযরত আলী (রা.) বললেন, আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন, আমার সাথে চলুন, সেখানে আমি প্রবেশ করবো, আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন, যাওয়ার পথে যদি কোন লোকের কারণে আপনা আশঙ্কার কারণ দেখা দেয় তবে আমি দোকানের কাছে যাব এবং জুতো ঠিক করার ভান করবো, সে সময়ে আপনি পথ চলতে থাকবেন, এরপর হযরত আলী (রা.) রওয়ানা হলেন আমিও তার সাথে রওয়ানা হলাম, অবশেষে তিনি ঘরে প্রবেশ করলে আমিও তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলাম, তাকে বললাম, আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিন, আল্লাহর রাসূল আমার কাছে ইসলাম পেশ করলেন, আমি ইসলাম গ্রহন করে মুসলমান হয়ে গেলাম, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবু যর, তোমার ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখ এবং তোমার এলাকায় চলে যাও, আমরা প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করেছি, এ খবর শোনার পর আমাদের সাথে এসে দেখা করবে, আমি বললাম, সেই সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি কাফেরদের সামনে প্রকাশ্যে আমার ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করবো, এ কথা বলার পর আমি কাবাঘরের সামনে এলাম, কোরাইশরা সেখানে উপস্থিত ছিলো, আমি তাদের সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

এই ঘোষণার পর কোরাইশরা পরস্পর বলাবলি করলো যে, ওঠো তোমরা এই বেদ্বীনের খবর নাও, এরপর তারা আমাকে এমনভাবে প্রহার করলো যে, ভেবেছিলাম মরেই যাবো, এ অবস্থায় হযরত আব্বাস (রা.)এসে আমাকে বাঁচালেন, তিনি একটুখানি ঝুঁকে আমাকে দেখলেন, এরপর কোরাইশদের বললেন, এই লোক তো গেফার গোত্রের তোমরা এ গোত্রের এলাকার ওপর দিয়েই ব্যবসা করতে যাও, এ কথা শুনে পৌত্তলিক কোরাইশরা আমাকে ছেড়ে দিলো, পরদিনও আমি সেখানে গেলাম এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো, এবারও হযরত আব্বাস (রা.) এসে আমাকে উদ্ধার করলেন (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫)।

৪) তোফায়েল ইবনে আমর দাওসি, এই লোক ছিলেন কবি, বুদ্ধি বিবেচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তার গোত্রের সর্দার, এই গোত্র ইয়েমেনের কিছু এলাকায় শাসন ক্ষমতার অধিকারী ছিলো, নবুয়তের একাদশ বর্ষে তিনি মক্কায় গেলে মক্কায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে নালিশ করে, তারা বলে যে, এই লোক আমাদের জটিল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে, তার কথায় রয়েছে যাদুর মতো প্রভাব, এতে ভাই ভাইয়ের মধ্যে এবং স্বামীর স্ত্রীর মধ্যে, পিতা পুত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা আশঙ্কা করছি, যে বিপদে আমরা পড়েছি, আপনিও সেই বিপদে পড়েন কিনা, কাজেই আপনার কাছে আবেদন এ লোকের সাথে কোন কথাই বলবেন না।

হযরত তোফায়েল (রা.) বলেন, কোরাইশ পৌত্তলিকরা আমাকে নানাভাবে বোঝালো, এক সময় আমি সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম যে, আল্লাহর রাসূলের সাথে কথাও বলবো না তার কোন কথাও শুনবো না, সকালে, মসজিদে হারামে যাওয়ার পর কানে তুলো গুজে দিয়েছিলাম যাতে আল্লাহর রাসূলের কোন কথা আমার কানে না যায়, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু কথা আমাকে শোনানর ইচ্ছা করেছিলেন, এরপর আমি কিছু ভালো কথা শুনলাম, মনে মনে বললাম, আমি তো বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ, খ্যাতনামা কবি, ভালমন্দ কোন কিছুই তো আমার কাছে গোপন থাকতে পারে না, কন আমি ভালো কথা শুনবো না? যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে গ্রহণ করবো, মন্দ হলে গ্রহণ করবো না, এ কথা ভেবে চুপচাপ থাকলাম, আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরতে শুরু করলে তার পিছু নিলাম, তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন, আমি প্রবেশ করলাম, এরপর লোকেরা আমাকে তার ব্যাপারে যে সতর্ক করেছিলো, এবং সতর্কতা হিসেবে নিজের কানে যে তুলো গুজে দিয়েছিলাম, সেসব কথা তাকে শোনালাম, এরপর বললাম, আপনি সবাইকে যে কথা বলে থাকেন আমাকেও বলুন, আল্লাহর রাসূল আমাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কোরআন পাঠ করে শোনালেন, আমি সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করলাম, আল্লাহর শপথ, আমি এর চেয়ে ভালো কথা আগে কখনো শুনিনি, আমি সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করে সত্যের সাক্ষ্য দিলাম, এর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করলেন।

হযরত তোফায়েল (রা.) কে যে নিদর্শন দেয়া হয়েছিল, সেটা এই যে, তিনি তার কওমের কাছাকাছি পৌছার পর তার চেহারা চেরাগের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিলো, তিনি বললেন, হে আল্লাহ অন্য কোথাও এ আলো স্থানান্তর করে দিন, অন্যথায় চেহারা বিকৃত হওয়ার অপবাদ দিয়ে ওরা আমারে সমালোচনা করবে, এরপর সেই আলো আমার হাতের লাঠির মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায়, হযরত তোফায়েল (রা.) তার পিতা এবং স্ত্রীর কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন, এতে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তবে তার কওমের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে দেরী করে, কিন্তু হযরত তোফায়েল (রা.) ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যান, খন্দকের (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫) যুদ্ধের পর তিনি যখন হিজরত করেন সে সময় তার কওমের সত্তর বা আশি পরিবার তার সঙ্গে ছিলো, হযরত তোফায়েল (রা.)ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, ইয়ামামার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন (মেশকাতুল মাসাবিহ)।

৫) জেমাদ আযদি, এই ব্যক্তি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী এবং আযদ শানওয়াহ গোত্রের মানুষ, ঝাড়ফুঁক এবং ভূত প্রেত তাড়ানোর কাজ করতেন, মক্কায় এসে সেখানকার নির্বোধদের কাছে শুনতে পান যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাগল, আল্লাহর রাসূলের কাছে তিনি এ উদ্দেশ্যে গেলেন যে, হয়তো আল্লাহর রাসূল তার হাতে ভালো হয়ে যাবেন, আল্লাহর রাসূলের সাথে দেখা করে তিনি বললেন, আমি ঝাড় ফুক জানি, আপনারর কি এর প্রয়োজন আছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, আমি তার প্রশংসা করি এবং তার কাছেই সাহায্যে চাই, আল্লাহ তায়ালা যাকে হেদায়াত করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না, আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন কেউ তাকে হেদায়েত দিতে পারে না, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয় তার কোন শরীক নেই, আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বান্দা ও রাসূল,

জেমাদ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, আপনার কথাগুলো আমাকে পুনরায় শুনিয়ে দিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথাগুলো তিনবার শোনালেন, জেমাদ বললেন, আমি যাদুকরদের জ্যোতিষীদের কথা শুনেছি, কিন্তু আপনি যেসব কথা বললেন, এ ধরনের কথা কোথাও শুনিনি, আপনার কথামতো সমুদ্রের অতলস্পর্শী গভীরতা থেকে উৎসারিত, দিন আপনার হাত বাড়িয়ে দিন আমি আপনার হাতে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করবো, এরপর জেমাদ আযদি ইসলাম গ্রহণ করেন (সহীহ মুসলিম, মেশকাতুল মাসাবিহ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫২৫)।

মদিনায় ছয়জন পুণ্যশীল মানুষ

নবুয়তের একাদশ বর্ষে অর্থাৎ ৬২০ ঈসায়ী সালে জুলাই মাসের হজ্জ মওসুমে ইসলামের দাওয়াতের ফলপ্রসূ বিস্তার ঘটে, এ সময়ে সে দাওয়াত একটি মহীরুহে পরিণত হয়, সেই গাছের ঘন পত্র-পল্লবের ছায়ায় মুসলমানরা দীর্ঘদিনের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তি লাভ করেন, মক্কার অধিবাসীরা আল্লাহর রাসূলকে অবিশ্বাস করা এবং লোকদের আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলো তা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কৌশলের আশ্রয় নেন, এ সময় তিনি রাত্রিকালে বিভিন্ন গোত্রের কাছে গিয়ে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতেন, তাই মক্কার পৌত্তলিকরা তার পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি,

এ কৌশলের একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং হযরত আলী (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে একরাতে মক্কার বাইরে বনু যোহাল এবং বনু শায়বান ইবনে ছালাবা গোত্রের লোকদের বাড়ীতে গিয়ে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেন, জবাবে তারা আশাব্যঞ্জক কথা বলে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সাড়া দেয়নি, এ সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক এবং বনু যোহাল গোত্রের একজন লোকের মধ্যে বংশধারা সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক প্রশ্নোত্তর ঘটে, উভয়েই ছিলেন বংশধারা বিশেষজ্ঞ (সহীহ বোখারী, যমযমের কাহিনী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৯ আবূ জারের ইসলাম গ্রহণ অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৪৪-৫৪৫)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর মিনার পাহাড়ী এলাকা অতিক্রমের সময় কয়েকজন লোককে আলাপ করতে শোনেন (রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.৮৪) তিনি সোজা তাদের কাছে যান এরা ছিলো মদিনার ছয়জন যুবক, এরা ছিলো খাযরাজ গোত্রের সাথে সম্পর্কিত তাদের নাম ও পরিচয় এই,

১. আসয়াদ ইবনে যোরারাহ বনু নাজ্জার

২. আওন ইবনে হারেস ইবনে রেফায়া (ইবনে আফরা) বনু নাজ্জার

৩. রাফে ইবনে মালেক ইবনে আযলান বনু যোরায়েক

৪. কোতবা ইবনে আমের ইবনে হাদিদা বনু সালামা

৫. ওকবা ইবনে আমের ইবনে নাবি বনু হারাম ইবনে কাব

৬. হারেস ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রেআব বনু ওবায়েদেইবনে গানাম

এসব যুবক তাদের প্রতিপক্ষ মদিনার ইহুদীদের কাছে শুনতো যে, সেই যুগে একজন নবী আসবেন তার একথাও শুনেছিলো যে, তিনি সহসা আবির্ভূত হবেন (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫০, ইবনে সালাম ১ম খন্ড, ৪২৯-৫৪১)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে গিয়ে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন তারা বললো, আমরা খাযরাজ গোত্রের লোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইহুদীদের প্রতিপক্ষ? তারা বলল, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসূল বললেন, তোমরা একটু বসো আমি কিছু কথা বলি, তারা বসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে দ্বীন শোনালেন সেই ছয়জন যুবক পরস্পরকে বললো, এই তো মনে হয় সেই নবী, যার কথা উল্লেখ করে ইহুদীরা আমাদের ধর্মক দিয়ে থাকে, ইহুদীরা যেন আমাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার না করতে পারে আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে, এরপর সেই ছয় ভাগ্যবান যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত কবুল করে ইসলাম গ্রহণ করেন

এই ছয়জন ছিলেন মদিনার বিবেকসম্পন্ন মানুষ, এর কিছুদিন আগে মদিনায় একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, সেই যুদ্ধের ধোয়া তখনো মিলিয়ে যায়নি, সেই যুদ্ধ এদেরকে তছনছ করে দিয়েছিলো, এ কারণে তারা সঙ্গত কারণেই আশা করেছিল যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত যুদ্ধ সমাপ্তির হিসেবে প্রমাণিত হবে, তারা বললেন আমরা আমাদের কওমকে এমন অবস্থায় রেখে এসেছি যে, তারা শত্রু পরিবেষ্টিত অন্য কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের শত্রুতা আছে বলে মনে হয় না, আমরা আশা করি যে, আপনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্যে মৈত্রী বন্ধন সৃষ্টি করবেন, মদিনায় ফিরে গিয়ে আমরা তাদেরকে আপনার প্রচারিত দ্বীনের পথে আহবান জানাবো, আমরা আপনার কাছ থেকে যে দ্বীন গ্রহণ করেছি, এই দ্বীন গ্রহণ করার জন্য তাদেরও দাওয়াত দেবো, যদি আল্লাহ তায়ালা আপনার মাধ্যমে তাদের ঐক্যবদ্ধ করেন, তবে আপনার চেয়ে সম্মানিত অন্য কেউই হবে না

এই ছয়জন নও মুসলিম মদিনায় ফিরে যাওয়ার সময় ইসলামের দাওয়াত সাথে নিয়ে গেলেন, এদের মাধ্যমে মদিনার ঘরে ঘরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাব ও দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়লো (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪২৮-৪৪৩)।

হযরত আয়েশা (রা.) এর সাথে বিয়ে

সেই বছরেই অর্থাৎ নবুয়তের একাদশ বর্ষের শাওয়াল মাসের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, হযরত আয়েশার বয়স ছিলো তখন মাত্র ছয় বছর, হিজরতের আগের বছর শাওয়াল মাসে হযরত আয়েশা (রা.) স্বামী গৃহে গমন করেন, সেই সময় তার বয়স ছিলো নয় বছর (তালকিহুল হুকুম, পৃ. ১০, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৭)।

মেরাজের ঘটনা

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত ও তাবলীগের সাফল্য এবং তার ইসলামের অনুসারীদের প্রতি অত্যাচার নির্যাতন মাঝামাঝি পর্যায়ে চলেছিলো, দূর দিগন্তে মিটিমিটি জ্বলছিলো তারার আলো, এমনি সময়ৈ মেরাজের রহস্যময় ঘটনা ঘটলো, এই মরাজ কবে সংঘটিত হয়েছিলো? এ সম্পর্কে সীরাত রচয়িতাদের মতামতের বিভন্নতা রয়েছে, যেমন-

এক) তিবরানী বলেছেন যে বছর নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে নবুয়ত দেয়া হয়, সে বছরই।

দুই) ইমাম নবব এবং ইমাম কুরতুবী লিখেছেন নবুয়তের পাচ বছর পর।

তিন) হিজরতের ১৬ মাস আগে অর্থাৎ নবুয়তের পাচ বছর পর।

চার) নবুয়তের দশ বর্ষে ২৭ শে রজব আল্লামা মানসুরপুরী এ অভিমত গ্রহণ করেছেন।

পাঁচ) হিজরতের এক বছর দুই মাস আগে অর্থাৎ নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের মহররম মাসে।

ছয়) হিজরতের এক বছর আগে অর্থাৎ নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আউয়াল মাসে।

উল্লেখিত বক্তব্যসমূহের মধ্যে তিনটি বক্তব্যকে সঠিক বলে মেনে নেয়া যায় পাঞ্জেগানা নামায ফরয হওয়ার আগে হযরত খাদিজা (রা.)এর ইন্তেকাল হয়েছিল, আর এ ব্যাপারে সবাই একম যে, পাঞ্জেগানা নামায মেরাজের রাতে ফরজ করা হয় এর অর্থ হচ্ছে যে, হযরত খাদিজার মৃত্যু মেরাজের আগেই হয়েছিলো তার মৃত্যু নবুয়তের দশ বর্সের রমযান মাসে হয়েছিলো বলে জানা যায় কাজেই মেরাজের ঘটনা এর পরেই ঘটেছে, আগে নয় শেষোক্ত তিনটি ব্ক্তব্যের কোনটিকে কোনটির ওপর প্রাধান্য দেয়ার মত তার কোন প্রামণ পাওয়া যায়নি কোরআন হাদীসে বর্ণিত এ সম্পর্কিত বিবরণ উল্লেখ করব (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৪৯)।

ইবনে কাউয়েম লিখেছেন সঠিক বর্ণনা অনুযায়ী জানা যায় যে নবী সাইয়েদুল মুরসালিনকে স্বশরীরে বোরাকে তুলে হযরত জিবরাঈল (আ.) এর সঙ্গে মসজিদে হারাম থেকে প্রথমে বায়তুল মাকদেস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়, প্রিয় নবী সেখানে মজিদের দরজায় খুটির সাথে বোরাক বেধে যাত্রা বিরতি করেন এবং সকল নবীর ইমাম হয়ে নামায আদান করেন।

এরপর সেই রাতেই তাকে বায়তুল মাকদেস থেকে প্রথম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় হযরত জিবরাঈল (আ.) দরজা খোলেন প্রিয় নবী সেখানে হযরত আদম (আ.) কে দেখে সালাম করেন, হযরত আদম (আ.) তাকে মারহাবা বলে সালামের জবাব দেন, তার নবুয়তের স্বীকারোক্তি করেন সে সময়ে আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.) এর ডানদিকে নেককার এবং বামদিকে পাপীদের রূহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখান এরপর তিনি দ্বিতীয় আসমানে যান দরজা খুলে দেয়া হয় প্রিয় নবী সেখানে হযরত ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এবং হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) কে দেখ সালাম করেন তারা সালামের জবাব দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়তের কথা স্বীকার করেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর যান চতুর্থ আসমানে সেখানে তিনি হযরত ইদরিস (আ.) কে দেখে সালাম করেন, তিনি সালামের জবাবে তাকে মোবারকবাদ দেন এবং তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

এরপর তাকে পঞ্চম আসমানে নেয়া হয় সেখানে তিনি হযরত হারুন (আ.)কে দেখে সালাম দেন, তিনি সালামের জবাবে মোবারকবাদ দেন এবঙ তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর নেয়া হয় ষষ্ঠ আসমানে সেখানে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হয় তিনি সালাম করেন হযরত মূসা (আ.) মারহাবা বলেন এবং নবুয়তের কথা স্বীকার করেন নবী মুরসালিন সামনে অগ্রসর হলেন, এ সময় হযরত মূসা (আ.) কাদতে লাগলেন এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, একজন নবী যিনি আমার পরে আবির্ভূত হয়েছেন তার উম্মেতেরা আমার উম্মতদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী বেহেশতে যাবে।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর নিয়ে যাওয়া হয় সপ্তম আসমানে সেখানে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সাথে তার দেখা হয়তিনি তাকে সালাম করেন তিনি জবাব দেন মোবারকবাদ দেন এবং তার নবুয়তের কথা স্বীকার করেন।

এবার প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয় তিনি আল্লাহর এতো কাছাকাছি পৌছেন যে, উভয়ের মধ্যে দুটি ধনুক বা তারও কম ব্যবধান ছিল, সেই সময় আল্লাহ তায়ালা তার যা কিছু দেয়ার দিয়ে দেন, যা ইচ্ছা ওহী নাযিল করেন এবং পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেন ফেরার পথে হযরত মূসা (আ.) এর সাথে দেখা হলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কি কাজের আদেশ দিয়েছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায়ের আদেশ দিয়েছেন, হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনার উম্মত এতো নামায আদায় করার শক্তি রাখে না, আপনি আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে নামায কমিয়ে দেয়ার আবেদন করুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈল (আ.) এর দিকে তাকালেন, তিনি ইশারা করলেন এরপর ফিরে গিয়ে নামাযের সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার আবেদন জানালেন, হযরত মূসা (আ.) এর সাথে আবার ফেরার পথে দেখা তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর কাছ থেকে কি আদেশ নিয়ে যাচ্ছেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পয়তাল্লিশ ওয়াক্ত নামাযের কথা বললেন হযরত মূসা (আ.) বললেন, আপনি ফিরে যান, এমনি করে বারবার ফিরে যাওয়ার এবং নামায কম করার হার এক পর্যায়ে সংখ্যা দাড়ালো পাচ, এই পাচ ওয়াক্ত নামাযও হযরত মূসা (আ.) বেশী মনে করলেন এবং আরো কমিয়ে আনার আবেদন জানানোর জন্যে ফিরে যেতে বললেন, হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার ভীষন লজ্জা লাগছে, আমি আর যেতে চাই না, আমি আল্লাহর এই আদেশের ওপরই মাথা নত করলাম ফেরার পথে কিছুদুর আসার পর আওয়ায হলো আমি আমার ফরয নির্ধারন করে দিয়েছি এবং আমার বান্দাদের জন্য কমিয়ে দিয়েছি (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, ৪৭-৪৮)।

আল্লামা িইবনে কাইয়েম এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন, তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, নবী কি আল্লাহ তায়ালাকে দেখেছেন? ইমাম ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন চোখে দেখার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কোন সাহাবী এ কথা বর্ণনাও করেননি, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে চোখ এবং অন্তর দ্বারা দেখার যে কথা উল্লেখ রয়েছে, তার মধ্যে প্রথম বর্ণনা দ্বিতীয় বর্ণনার বিপরীত নয়, ইমাম ইবনে কাউয়েম যে নৈকট্য এবঙ নিকটতর হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন এটি মেরাজের সময়ের চেয়ে ভিন্ন সময়ের কথা, সূরা নাজম-এ হযরত জিবরাঈল (আ.) এর নৈকট্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, হযরত আয়েশা (রা.) সে কথাই বর্ণনা করেছেন, পক্ষান্তরে মেরাজের হাদীসে যে নৈকট্যের কথা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা হচ্ছেেএই যে, এটা আল্লাহরই নৈকট্য, সূরা নাজম-এ এ সম্পর্কে কোন ব্যাপক আলোচনা নেই বরং সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দ্বিতীয়বার সেদরাতুল মোনতাহার কাছে দেখেছেন যাকে দেখেছেন তিনি জিবরাঈল (আ.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈলকে তার আসল চেহারায় দুবার দেখেছেন, একবার পৃথিবীতে এবং অন্যবার সেদরাতুল মুনতাহার কাছে (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭, ৪৮, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০, ৪৫৫, ৪৫৬, ৪৭০, ৪৭১, ৪৮১, ৫৪৮, ৫৪৯, ৫৫০, ২য় খন্ড, ৬৮৪, মুসলিম ১ম খন্ড, পৃ. ৯১, ৯১, ৯৩)।

এ সময়েও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাককুস সদর বা সিনা চাক এর ঘটনা ঘটেছিলো, এ সফরের সময় তাকে কয়েকটি জিনিস দেখানো হয়েছিল তাকে দুধ এবং মদ দেয়া হয়েছিল তিনি দুধ গ্রহণ করলেন, এটা দেখে হযরত জিবরাঈল (আ.) বললেন আপনাকে ফেতরাত বা স্বভাবের ফল দেখানো হয়েছে যদি আপনি মদ গ্রহন করতেন তবে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।

আল্লাহর রাসূল ৪ টি নহর দেখলেন ৪ টি যাহেরী আর ৪ টি বাতেনী প্রকাশ্য নহর ছিল নীল এবং ফোরাত এর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, তার রেসালত নীল এবং ফোরাত সজীব এলাকা সমূহে বিস্তার লাভ করবে অর্থাৎ এখানের অধিবাসীরা বংশ পরম্পরায় মুসলমান হবে এমন নয় যে, এদুটি নহরের পানির উৎস জান্নাতে রয়েছে।

জাহান্নামের দারোগা মালেককে তিনি দেখলেন তিনি হাসেন না, তার চেহারায় হাসিখুশীর কোন ছাপও নেই। আল্লাহর রাসূলকে বেহেশত ও দোযখও দেখানো হল।

এতিমের ধনসম্পদ যারা অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের অবস্থাও দেখান হয়, তাদের ঠোট ছিল উটের ঠোটের মত, তারা নিজেদের মুখে পাথরের টুকরোর মতো অঙ্গার প্রবেশ করাচ্ছে আর সেই অঙ্গার তাদের গুহ্যদ্বার দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদখোরদেরও দেখছিলেন তাদের ঠোট এতো বড়ছিলো যে তারা নড়াচড়া করতে পারছিল না ফেরাউনের অনুসারীদের জাহান্নামের নেয়ার সময় তারা এসব সুদখোরকে মাড়িয়ে যাচ্ছিলো।

যেনাকারীদেরও তিনি দেখছিলেন তাদের সামনে তাজা গোশত এবং দুর্গন্ধময় পচা গোশত ছিল অথচ তারা তাজা গোশত রেখে পচা গোশত খাচ্ছিল।

যেসব নারী স্বামী থাকা সত্ত্বেও নিজ গর্ভে অন্য পুরুষের সন্তান ধারণ করেছিল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরও দেখছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, ওসব মহিলার বুক বড় বড় কাটা বিধিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

তিনি মক্কার একটি কাফেলাকে দেখছিলেন সেই কাফেলার একটি উট পালিয়ে গিয়েছিল তিনি তাদেরকে সেই উটের সন্ধান বলে দিয়েছিলেন ঢেকে রাখা পাত্রে পানি ছিলো তিনি সেই পানি থেকে পান করেছিলেন সে সময় কাফেররা সকলে ঘুমচ্ছিল, মেরাজের রাতের পরদিন সকালে এই বিবরণ তার দাবীর সত্যতার একটি প্রমাণ হয়েছিল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৯ ৪০২, ৪০৬ তাফসীরে গ্রন্থাবলীতে সূরা বনি ইসরাইলের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য) বলে দিলেন যে, অমুক সময়ে সেই কাফেলা ফিরে আসবে কাফেলা থেকে পালিয়ে যে উটটি মক্কার দিকে আসছিলো তিনি সেই উটটির বিবরণও পেশ করলেন পরবর্তী সময়ে তার বর্ণিত সব কথাই সত্য প্রমাণিত হলো, কিন্তু এতোকিছু সত্ত্বেও কাফেরদের ঘৃণা আরো বেড়ে গেল এবং তারা তার কথা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল (যাদুল মায়াদ, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮, এছাড়া দেখুন সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ. ৬৮৪ সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড পৃ. ৯৬, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪০২, ৪০৩)।

বলা হয় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে নবীজি সেই সময়ই সিদ্দিক উপাধি দিয়েছিলেন কেননা অন্য সবাই যখন অবিশ্বাস করেছিল তিনি তখন সব কিছুই বিশ্বাস করেছিলেন (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৬৯৯)।

মেরাজের বিবরণ আল্লাহ তায়ালা কোরআনে উল্লেখ করেছেন।

নবীদের ব্যাপারে এটাই হচ্ছে আল্লাহর সুন্নত আল্লাহ তায়ালা বলেন এবং এভাবেই আমি ইবরাহীমকে আসমান যমীনের রাজ্য ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছি যাতে সে বিশ্বাসীদের অন্তুর্ভক্ত হয়ে যায়।

আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আ.) কে বলেছিলেন তাহলে আমি তোমাকে আমার বড় কিছু নিদর্শন দেখাব।

এসব দেখানোর উদ্দেশ্যে হচ্ছে তারা যেন বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, এ কথাও আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন নবীরা আল্লাহর নিদর্শন সরাসরি প্রত্যক্ষ করায় তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় ফলে তারা আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দিতে গিয়ে এমন সব দুঃখ এবং কষ্ট নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করতে পারেন, যা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয় তাদের দৃষ্টিতে পার্থিব জগতের যাবতীয় শক্তিই মনে হয় তুচ্ছ এ কারণে তারা কোন শীক্তকে পরোয়া করেন না মেরাজের ঘটনায় ছোট খাট বিষয় এবং এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে শরীয়তের বড় বড় কেতাবে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে তন্মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েটি বিষয় উল্লেখ করা যাচ্ছে।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, আল্লাহ তায়ালা কোরআনে মাত্র একটি আয়াতে মেরাজের ঘটনা উল্লেখ করেই ইহুদীদের দুস্কৃতির কথা বর্ণনা করেছেন এরপর তাদের জানিয়েছেন যে, এই কোরআন সেই পথেরই হেদায়াত দিয়ে থাকে, যে পথ সঠিক এবং সরল কোরআন পাঠকারীদের মনে হতে পারে যে, উভয় কথা সম্পর্কহীন কিন্তু আসলে তা নয় আল্লাহ তায়ালা তার বর্ণনাভঙ্গিতে এই ইশারাই দিয়েছেন যে, এখন থেকে ইহুদীদের মানব জাতির নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে দেয়া হবে কেননা এইসব ইহুদী এমন ভয়াবহ অপরাধ করেছে যে, নেতৃত্বের যোগ্যতা তাদের আর নেই কাজেই এই দায়িত্ব ও মর্যাদা এখন থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করা হবে এবং দুঃসাহসী দাওয়াতের উভয় কেন্দ্রকে তার নিয়ন্ত্রণাধীন করা হবে, অন্য কথায় বলা যায় যে, রূহানী নেতৃত্ব এক উম্মত থেকে অন্য উম্মতের কাছে স্থানান্তর করা হবে যুলূম অত্যাচার এবং বিশ্বাসঘাতকতায় কলঙ্কিতি ইতিহাসের অধিকার িএকটি উম্মতের কাছ থেকে নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে এমন একটি উম্মতকে দেয়া হবে, যাদের মাধ্যমে কল্যাণের ঝর্নাধারা উৎসারিত হবে এই উম্মতের পয়গাম্বর ওহীর মাধ্যমে কোরআনে করিম পেয়েছেন কোরআন মানব জাতিকে সর্বাধিক হেদায়াত দান করেছে।

কিন্তু এই নেতৃত্বর পূর্ণতা কিভাবে সাধিত হবে? ইসলামের নবী তো মক্কার পাহাড়ে লোকদের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এটি একটি প্রশ্ন এই প্রশ্ন অন্য একটি সত্যের পর্দা উম্মোচন করেছে ইসলামের দাওয়াত একটা পর্যায় অতিক্রম করার কাছে পৌছেছে বর্তমানে অন্য একটি পর্যায় প্রবেশ করবে এই ধারা হবে অন্য ধারা থেকে ভিন্ন এ কারণে দেখা যায় যে, কোন কোন আয়াতে পৌত্তলিকদের সুস্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এবং কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি যখন কোন জনপদ ধ্বংস করতে চাই, তখন তার সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের সৎ কাজ করতে আদেশ করি, কিন্তু তারা সেখানে অসৎ কাজ করে, তারপর তাদের প্রতি দন্ড প্রদান ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমি সেটা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত ১৬)।

আল্লাহ তায়ালা উক্ত সূরায় আরো বলেন, নূহের পর আমি কত মানব গোষ্ঠি ধ্বংস করেছি তোমার প্রতিপালকই তার বান্দাদের পাপাচারের সংবাদ রাখা এবং পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত ১৭)।

এ সকল আয়াতের পাশাপাশি এমন কিছু আয়াতও রয়েছে যাতে মুসলমানদের ভবিষ্যত ইসলামী সমাজের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে তারা এমন এক ভূখন্ডে নিজেদের ঠিকানা তৈরী করেছে, যেখানে সবকিছু তাদের নিজের হাতে ন্যাস্ত, উল্লিখিত আয়াতে এমন ইশারা রয়েছে যে আল্লাহর রাসূল শীঘ্রই এমন নিরাপদ জায়গা পেয়ে যাবেন যেখানে দ্বীন ইসলাম যথাযথভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করবে।

মেরাজের রহস্যময় ঘটনার এমন সব বিষয় রয়েছে যার সাথে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান এ কারণে সেসব বর্ণনা করা দরকার আমরা এ সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছি যে, মেরাজের ঘটনা হয়তো বাইয়াতে আকবার কিছুকাল আগে ঘটেছিল অথবা প্রথম ও দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার মাঝামাঝি সময়ে ঘটেছিল আল্লাহ তায়ালাই সব কিছু ভালো জানেন।

প্রথম বাইয়াতে আকাবা

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবুয়তের দশ বর্ষে হজ্জ মওসুমে ইয়াসরেবের ছয়জন মানুষ ইসলাম গ্রহন করেছিলেন তারা আল্লাহর রাসূলের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, নিজেদের কওমের কাছে ফিরে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের তাবলীগ করবেন (সংকীর্ণ গিরিপথ বলা হয় আকাবা, মক্কা থেকে মিনায় আসার পথে মিনায় পশ্চিম পাশে একটি সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে হয়, এই গিরিপথ আকাবা নামে বিখ্যাত, দশই যিলহজ্জ তারিখে যে জামরাতে কংকর নিক্ষেপ করা হয় তা এ সুড়ঙ্গ পথের মাথায় অবস্থিত বলে একে জামরায়ে আকাবা বলা হয়, এর দ্বিতীয় নাম জামরায়ে কুবরা অন্য দুটি জামরা এ স্থান থেকে কিছু পূর্ব দিকে মিনা ময়দান এ তিনটি জামরার পূর্ব দিকে, এ কারণে জনসমাগম এদিকে লেগেই থাকে, পাথর নিক্ষেপের পর এদিকে আর লোক চলাচল থাকে না, তাই নবী করিম রাসূলুল্লাহ (সা.) যে বাইয়াত করেন বলা হয় বাইয়াতে আকাবা বর্তমানে এখানে পাহাড় কেটে প্রশস্ত রাস্তা তৈরী করা হয়ছে)।

এর ফলে পরবর্তী হজ্জ মওসুমে ১৩ জন লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসেন এদের মধ্যে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ ছাড়া অন্য ৫ জন ছিলেন যারা গত বছরও এসেছিলেন এরা ছাড়া বাকি সাতজনের নাম পরিচয় নিম্নরূপ

১. মায়ায ইবনে হারেস ইবনে আফরা বনি নাজ্জার খাযারাজ

২. যাকওয়ান ইবনে আবদুল কয়েস বনি যুরাইক খাযারাজ

৩. ওবাদা ইবনে সামেত বনি গানাম খাযারাজ

৪. ইয়াযিদ ইবনে ছালাবা বনি গানামের মিত্র খাযারাজ

৫. আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে নাযলাহ বনি সালেম খাযারাজ

৬. আবুল হায়ছাম ইবনে তাইহান বনি আবদে আশহাল, আওস

৭. ওযাইম ইবনে সায়েদাহ বনি আমার ইবনে আওফ, আওস

এদের মধ্যে শেষোক্ত দুজন ছিলেন আওস এবং বাকি সবাই খাযরাজ গোত্রের (রহমতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ.৮৫, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৩১-২৩৩)।

এরা সবাই মিনায় আকাবার কাছে আল্লাহর রাসূলের কাছে কয়েকটি বিষয়ে বাইয়াত নেন, পরবর্তীতে হোদায়বিয়ার সন্ধির পর এবং মক্কা বিজয়ের সময়ে এই সব কথার ওপরেই মহিলাদের কাছ থেকেও বাইয়াত গ্রহন করা হয়, আকবার এই বাইয়াতের বিবরণ বোখারী শরীফে ওবাদা ইবনে সামেতের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন এসো আমার কাছে এ মর্মে বাইয়াত কর যে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেন না, চুরি করবে না, যেনা করবে না, নিজের সন্তানকে হত্যা করবে না, মনগড়া কোন অপবাদ কারো উপর দেবে না, ভালো কাজে আমার অনুসরণ করবে, কোন প্রকার অবাধ্যতা করবে না, যে ব্যক্তি এসব কিছু পালন করবে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে, আর যে ব্যক্তি এসব এবিষয়ের কোন কিছু অমান্য করবে, যদি তাকে সেই অবাধ্যতার জন্যে শাস্তি দেয়া হয় তবে তার শাস্তি তার পাপের কাফফারা হবে যদি কেউ অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহ যদি তার পাপ গোপন রাখেন তাহলে তার কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল তিনি ইচ্ছে করলে শাস্তি অথবা ক্ষমা করে দেবেন।

হযরত ওবাদা বলেন, এ সব বিষয়ে আমরা আল্লাহর রাসূলে কাছে বাইয়াত গ্রহন করলাম (বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫০, ৫৫১)।

মদিনায় রাসূলের দূত ও তার ঈর্ষনীয় সাফল্য

বাইয়াত শেষ হয়ে গেল এবং হজ্জ ও শেষ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগত লোকদের সাথে মদিনায় তার প্রথম দূত পাঠালেন মুসলমানদের ইসলামের শিক্ষা প্রদান এবং যারা এখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি তাদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানই ছিল এ এই দূত প্রেরণের উদ্দেশ্য প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী যুবক মসআব ইবনে ওযায়ের আবদারি (রা.) কে আল্লাহর রাসূল মদিনায় প্রেরণ করেন।

হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) মদিনায় পৌছে হযরত আসআদ ইবনে যুরারা (রা.) এর ঘরে অবস্থান করেন, এরপর উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উভয়ে মদীনাবাসীদের ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন, এ সময় হযরত মসআব মুরকিউন উপাধি লাভ করেন এর অর্থ শিক্ষক বা মোয়াল্লেম।

দ্বীনের তাবলীগ করার ক্ষেত্রে তার সাফল্যর একটি বিস্ময়কর ঘটনা রয়েছে যোরারাকে একটি বাগানে মারক নামে একটি জলাশয়ের কিনারায় বসেন তাদের কাছে কয়েকজন মুসলমানও সমবেত হন বনি আশহাল গোত্রের সর্দার ছিলেন সাদ ইবনে মায়ায এবং উছায়েদ ইবনে খাযাযের তারা কখনো ইসলাম গ্রহন করেননি তারা নবাগত মুসলমানদের আগমনের খবর পেলেন হযরত সাদ অপর সর্দার উছায়েদ ইবনে খোযায়েরকে বললেন তুমি গিয়ে দেখ এসো ব্যাপারটা কি ওদের বলবে যে, তোমরা কি আমাদের দুর্বল লোকদের বেকুব বানাতে চাও তাদের ধর্মক দেবে এবং আমাদের মহল্লায় আসতে নিষেধ করবে, আসয়াদ ইবনে যোরারা আমার খালাতো ভাই, এ কারণেই তোমাকে পাঠাচ্ছি না হলে আমি নিজেই যেতাম

উছায়েদ নিজের বর্শা তুলে উভয়ের কাছে গেলেন হযরত আসয়াদ তাকে আসতে দেখে হযরত মসআবকে বললেন কওমের একজন সর্দার তোমার কাছে আসছে তার ব্যাপারে আল্লাহর রহমত মনে মনে কামনা কর, হযরত মসআব বললেন, তিনি যদি বসেন তবে আমি তার সাথে কথা বলব, উছায়েদ পৌছেই ক্ষেপে গেলেন বললেন, আপনারা কেন আমাদের এলাকায় এসেছেন? আপনারা কি আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চায়? প্রাণের মায়া থাকলে কেটে পড়ুন হযরত মসআব বললেন আপনি আমাদের কাছে বসুন, কিছু কথা শুনুন পছন্দ হলে গ্রহন করবেন পছন্দ না হলে করবেন না হযরত উছায়েদ বললেন কথা তো ঠিকই এরপর তিনি নিজের বর্শা মাটিতে পুতে বসে পড়লেন হযরত মসআব (রা.) ইসলামের কথা বলতে শুরু করলেন কোরআন তেলাওয়াত করলেন পরে তিনি বলেছেন উছায়েদ কিছু বরার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামের চমক লক্ষ্য করেছি সব কথা শুনে উছায়েদ বললেন, কথা খুব ভালো আপনারা কাউকে ইসলামে কিভাবে দীক্ষিত করেন? মসআব বললেন, আপনাকে গোসল করে পাক কাপড় পরতে হবে এরপর কালেমা তাইয়্যেবার সাক্ষ্য দিতে হবে এবং দুরাকাত নামায আদায় করতে হবে উছায়েদ সবই করলেন এরপর বললেন, আমাদের গোত্রে আরো একজন সর্দার রয়েছেন তিনি যদি ইসলামে দীক্ষা নেন তবে আমাদের গোত্রের আর কেউই বাদ থাকবে না আমি তাকে এখনই আপনাদের কাছে পাঠাচ্ছি

এরপর হযরত উছায়েদ তার বর্শা নিয়ে সাদ ইবনে মায়ায এর কাছে গেলেন সাদ উছায়েদকে দেখে বললেন, এই লোকটি যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিল তার চেয়ে অন্য রকম চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে উছায়েদকে সাদ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি করেছ? উছায়েদ বললেন আমি তাদের সাথে আলাপ করেছি কিন্তু আপত্তিকর কিছুই পাইনি তবে আমি তাদের নিষেধ করেছি তারা বলেছে আপনারা যা চান, আমরা তাই করবো আমি শুনেছি বনি হারেছা গোত্রের লোকেরা আসআদ ইবনে যোরারাকে হত্যা করতে চায় এর কারণ হচ্ছে যে, তিনি আপনার খালাত ভাই ওরা আপনার সাথে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে চায় এর কারণ হচ্ছে যে, তিনি আপনার খালাত ভাই, ওরা আপনার সাথে করা অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে চায় এ কথা শোনামাত্র সাদ ক্রোধে অধীর হয়ে বর্শা হাতে ওদের কাছে পৌঁছলেন গিয়ে দেখেন দুজনই নিশ্চিন্তে বসে আছেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে, উছায়েদ চেয়েছে যে, আমি দুজন আগন্তুকের সাথে কথা বলি সাদ তাদের সামনে গিয়ে রুক্ষ ভাষায় বললেন তোমরা আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাতে চাও? এরপর আস সাদকে বললেন, খোদার কসম হে আবু আনাস তোমার এবং আমার মধ্যে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক না থাকতো, তবে তুমি এমন কাজ করতে পারতে না, আমাদের এলাকায় এসে তোমরা এমন কাজ করছো, যা আমাদের পছন্দনীয় নয়

হযরত আসয়াদ হযরত মসআবকে আগেই বলেছিলেন যে, এমন একজন লোক আসছেন যিনি তার গোত্রের প্রভাবশালী নেতা যদি তিনি তোমার কথা শোনেন, তবে তার পেছনে কেউ বাদ থাকবে না এ কারণে হযরত মসআব হযরত সাদকে বললেন, আপনি বসুন কিছু কথা শুনুন ভালো না লাগলে শুনবেন না হযরত সাদ বললেন ঠিকই তো একথা বলে তিনিও বর্শা মটিতে পুতে বসে পড়লেন হযরত মসআব তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াত করলেন হযরত মসআব পরে বলেছেন সাদ বলার আগেই আমি তার চেহারায় ইসলামের চমক লক্ষ্য করেছি সাদ বললেন, তোমরা ইসলাম গ্রহণের পর কি করো? মসআব বললেন আপনি গোসল করুন, এরপর পাক কাপড় পরুন, এরপর কালেমা শাহাদাতের সাক্ষ্য দিবেন তারপর দুরাকাত নামায আদায় করবেন তারপর সাদ ইবনে মায়ায তাই করলেন

ইসলাম গ্রহণের পর প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে হযরত সাদ নিজের গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে গেলেন লোকেরা বলল, আপনি ভিন্ন চেহারায় ফিরে এসেছেন মনে হচ্ছে হযরত সাদ বললেন, তোমরা আমাকে কেমন লোক মনে কর, হে বনি আবদুল আশহাল? সবাই বলল আপনি হচ্ছেন আমাদের নেতা, বুদ্ধি বিবেচনার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে বেশী সাদ ইবনে মায়ায বললেন আচ্ছা তবে শোন তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তার প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান না আনবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্য হারাম, বিকেল পর্যন্ত গোত্রের নারী পুরুষ সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন উসাইরেম নামে একজন লোক সে সময় ঈমান আনেননি, তিনি ওহুদের যুদ্ধের দিনে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন তিনি কোন নামাযও আদায় করেননি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন অল্প আমল করে সে অনেক বেশী পুরস্কার পেয়েছি

হযরত মসআব ও হযরত আসআদ ইবনে যোরারার ঘরে অবস্থান করেই ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেন এই দাওয়াতে আনসারদের প্রত্যেক পরিবারেই কয়েকজন করে নারী পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করলেন, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার আগে হযরত মসআব ইবনে ওমায়ের (রা.) সাফল্যের সুসংবাদ নিয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে মক্কায় হাজির হন, তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ইয়াসরেবের গোত্রসমূহের অবস্থা তাদের যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার কৌশল এবং অন্যান্য যোগ্যতা সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৩৫, ২য় খন্ড পৃ. ৯০ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫১)।

দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা

নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ ঈসায়ী সালের জুন মাসে মদিনা থেকে ৭০ জন মুসলমান হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় আগমন করেন এরা নিজ কওমের পৌত্তলিক হাজীদের সঙ্গে মক্কায় আসছিলেন মদিনায় থাকার সময়েই অথবা মক্কায় আসার পথে তারা পরস্পরকে বললেন, কতদিন পর্যন্ত প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমরা মক্কায় এভাবে কষ্টকর অবস্থায় ফেলে রাখব? তিনি মক্কায় যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন, সে সম্পর্কেও তারা আলোচনা করলেন

মক্কায় পৌছার পর গোপনে তারা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গোপনে যোগাযোগ করলেন এবং সিদ্ধান্ত হলো যে, উভয় দল আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি (জিলহজ্জ মাসের ১১, ১২, ১৩ তারিখকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়) ১২ই জিলহজ্জ তারিখে মিনার জামারায়ে উলায় অর্থাৎ জামরায়ে আকাবার ঘাটিতে একত্রিত হয়ে রাতের অন্ধকারে গোপন আলোচনা করবেন

এই সম্মেলন ইসলাম ও মূর্তিপূজার সংঘাতের মধ্যে সময়ের গতিধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল, একজন আনসার নেতার মুখে সেই সম্মেলনের বিবরণী উল্লেখ করা যাচ্ছে

হযরত কাব ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমরা হজ্জ এর জন্যে বেরিয়েছিলাম প্রিয় নবী আইয়ামে তাশরিকের মাঝে আকাবায় আমাদের সাথে কথা বলার সময় নির্ধারণ করলেন, অবশেষে সেই রাত এলো, যে রাতে কথা বলার তারিখ ছিল, আমাদের সাথে আমাদের সম্মানিত নেতা আবদুল্লাহ ইবনে হারামের সাথে আমরা আলোচনা করে তাকে বললাম, হে আবু জাবের আপনি আমাদের একজন সম্মানিত নেতা আপনার বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা আপনাকে বের করতে চাই অনন্তকাল দোযখের আগুন থেকে আপনি মুক্তি লাভ করবেন এটাই আমরা চাই এরপর আমরা তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আমাদের আলোচনার বিষয় তাকে জানালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আমাদের সাথে আকাবায় গেলেন, তাকে নকিব মনোনীত করা হল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪০)।

হযরত কাব (রা.) ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, সেই রাতে আমরা নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ডেরায় শুয়ে পড়লাম রাতের এক তৃতীয়াংশ কেটে যাওয়ার পর আল্লাহর রাসূলের সাথে পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হলাম, চড়ুই পাখী যেমন চুপিসারে তার বাসা থেকে বের হয়, আমরাও ঠিক সেভাবেই ডেরা থেকে বের হয়েছিলাম, এক সময় আমরা আকাবায় সমবেত হলাম সংখ্যায় ছিলাম আমরা ৭৫জন ৭৩জন পুরুষ এবং ২জন মহিলা দুইজন হচ্ছেন বনু মাজেন ইবনে নাজ্জার গোত্রের উম্মে আম্মারা নাছিবা বিনতে কাব এবং বনু সালমা গোত্রের উম্মে মানীঈ আসমা বিনতে আমর

আমরা সবাই ঘাটিতে পৌঁছে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য অপেক্ষা করছিলাম এক সময় তিনি এসে পৌঁছলেন তার সাথে তার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেব ছিলেন তিনি তখনো যদিও ইসলাম গ্রহন করেননি, তবুও ভ্রাতুষ্পুত্রের হিতাকাঙ্খী ছিলেন সর্বপ্রথম কথা বার্তা তিনিই শুরু করেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪০)।

পরিস্থিতির নাজুকতা ব্যাখ্যা

সম্মেলন শুরু হল, দ্বীনি এবং সামরিক সহায়তাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে আলোচনা শুরু হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা আব্বাস প্রথমে কথা বললেন, তিনি চাচ্ছিলেন যে, পরিস্থিতির আলোকে দায়িত্বের প্রতি আলোকপাত করবেন, সেই গুরুদায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত হতে যাচ্ছিল তাদের সম্বোধন করে তিনি বললেন মোহাম্মাদ মোস্তফার যে মূল্য ও মর্যাদা রয়েছে সেটা তোমরা জান, আমাদের কওমের মধ্যে মোহাম্মাদ প্রবর্তিত ধর্ম বিশ্বাস যারা সমর্থন করে না, মোহাম্মাদকে তাদের কাছ থেকে আমরা দূরে রেখেছি, নিজ শহরে স্বজাতীয়দের মধ্যে তিনি নিরাপদ রয়েছেন, তিনি বর্তমানে তোমাদের কাছে যেতে চান তোমাদের সাথে মিশতে চান, যদি তোমরা তার নিরাপত্তা দিতে এবং বিরোধী পক্ষের হামলা থেকে তাকে হেফাজত করতে পারো তবে কিছু বলার নেই, তোমরা যে দায়িত্ব নিয়েছ সে সম্পর্কে তোমরাই ভালো জান, কিন্তু যদি তাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে থাক, তবে এখনই চলে যাও, কেননা তিনি স্বাজাতীয়দের মধ্যে নিজ শহরে নিরাপদেই আছেন, তার সম্মানও এখানে রয়েছে

হযরত কাব (রা.) বলেন, আমরা হযরত আব্বাসকে বললাম যে, আপনার কথা আমরা শুনেছি হে আল্লাহর রাসূল এবার আপনি কথা বলুন আপনি নিজের এবং আপনার প্রতিপালকের জন্য আমাদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার নিতে চান তাই নিন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪১-৪৪২)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা শুরু করলেন তিনি প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত করলেন আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দিলেন এরপর বাইয়াত হল,

বাইয়াতের দফাসমূহ

বাইয়াতের ঘটনা ইমাম আহমদ হযরত জাবের (রা.) থেকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, হযরত যাবের (রা.) বলেন, আমরা বললাম হে আল্লাহর রাসূল আমরা আপনার কাছে কি কি বিষয়ের উপর বাইয়াত করবো? তিনি বললেন নিন্মোক্ত বিষয়াবলীর ওপর।

১. ভালোমন্দ সকল অবস্থায় আমার কথা শুনবে এবং মানবে।

২. সচ্ছলতা অস্বচ্ছলতা উভয় অবস্থায়ই ধন সম্পদ ব্যয় করবে।

৩. সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।

৪. আল্লাহর পথে উঠে দাঁড়াবে এবং আল্লাহর ব্যাপারে কারো ভয়ভীতি প্রদর্শনে পিছিয়ে যাবে না।

৫. তোমাদের কাছে যাওয়ার পর আমাকে সাহায্য করবে এবং নিজেদের প্রাণ ও সন্তানদের হেফাজতের মতোই আমার হেফাজত করবে এতে তোমাদের জন্যে জান্নাত রয়েছে (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল হাছান সনদের সাথে এ বর্ণনা করেছেন, ইমাম হাকেম ও ইবনে হাব্বান বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন, বনে হিশাম, ১ম খন্ড দেখুন)।

ইবনে ইসহাক উল্লেখিত হযরত কাব এর বর্ণনা শুধু পঞ্চম দফায় উল্লেখ রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরআন তেলাওয়াত দ্বারা আল্লাহর প্রতি দাওয়াত এবং ইসলামের প্রতি তাকিদ দিয়ে বললেন, আমি তোমাদের কাছে এ মর্মে বাইয়াত নিচ্ছি যে, তোমরা যে জিনিস দ্বারা নিজেদের সন্তানদের হেফাজত করে থাক, সেই জিনিস দ্বারা আমারও হেফাজত করবে এ কথা শুনে হযরত কাব ইবনে মারুর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ধরে বললেন, হা সেই জাতের শপথ যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন আমরা অবশ্যই সেই জিনিস দ্বারা আপনার হেফাজত করব, যা দ্বারা নিজেদের সন্তানদের হেফাজত করি, কাজেই হে আল্লাহর রাসূল আপনি আমাদের কাছে বাইয়াত নিন খোদার কসম, আমরা যুদ্ধের পুত্র, (অর্থাৎ যুদ্ধের ছায়ায় আমরা জন্ম লাভ করেছি) হাতিয়ার হচ্ছে আমাদের খেলনা এবং পূর্ব পুরুষের সময় থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে।

হযরত কাব বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলছিলেন এ সময়ন আবুল তায়াহাল ইবনে তাইহান বললেন, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদীদের সাথে চুক্তি রয়েছে আমরা তার রজ্জু কেটে ফেলব, আমরা ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম এরপর আল্লাহ তায়ালা আপনাকে জয়যুক্ত করলে আপনি আমাদের ছেড়ে স্বজাতীয়দের কাছে ফিরে আসবেন না তো?

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হেসে বললেন না, তা হবে না তোমাদের রক্ত আমার রক্ত এবং তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস হিসেবে গণ্য হবে, আমি তোমাদের অন্তর্ভুক্ত আর তোমরা আমার অন্তর্ভুক্ত তোমরা যাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমিও তাদের সাথে যুদ্ধ করব, তোমরা যাদের সাথে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।

বাইয়াতের বিপজ্জনক অবস্থার বিবরণ

বাইয়াতের শর্তাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর উপস্থিত লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে বাইয়াতের ইচ্ছা করলেন এ সময় দুজন মুসলমান উঠে দাঁড়ালেন তারা নবুয়তের একাদশ ও দ্বাদশ বছরের মাঝামাঝির হজ্জের মৌসুমে ইসলাম গ্রহন করেছিলেন তারা নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিত ভালোভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে চাইলেন তারা চাচ্ছিলেন যে বিষয়টির সব দিক যথাযথভাবে তুলে ধরে তারপর বাইয়াত করবেন তারা এটাই জানতে ও বুঝতে চাচ্ছিলেন যে, কওমের লোকেরা কতটা আত্মত্যাগে প্রস্তুত রয়েছে।

ইবনে ইসহাক লিখেছেন লোকেরা বাইয়াতের জন্যে সমেবেত হওয়ার পর হযরত আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে নাযলা বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে তার সাথে কিসের ব্যাপারে বাইয়াত করছ? সবাই বললেন হা জানি, হযরত আব্বাস বললেন, তোমরা কালো এবং লাল লোকদের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে তার হাতে বাইয়াত করছ, যদি তোমরা এরূপ মনে করে থাক যে, তোমাদের ধন-সম্পদ ব্যয়িত হলে এবং তোমাদের নেতৃস্থানীয় লোকেরা নিহত হলে তোমরা তাকে পরিত্যাগ করবে তবে এখনই তাকে পরিত্যাগ কর, কেননা তাকে নিয়ে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ অবস্থায় পরিত্যাগ করা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য অবমাননাকর হবে যদি তোমরা মনে কর যে, ধন-সম্পদ কোরবানী দেয়ার পর নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হওয়ার পরও তার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পালন করবে, যেদিকে তোমাদের ডাকা হচ্ছে সেদিকে যাবে, তবে তোমরা তাকে নিয়ে যাও আল্লাহর শপথ, এতে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল রয়েছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪২)।

এসব কথা বলার পর সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন ধন-সম্পদ কোরবানী করব এবং নেতৃস্থানীয় লোকদের নিহত হওয়ার ঝুঁকি নেব কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি পাব? আমরা আমাদের অঙ্গীকার যথাযথ পালন করব, কিন্তু আমাদের বিনিময় কি হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন জান্নাত, সবাই তখন হাত বাড়ালেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হাত বাড়ালেন, বাইয়াত হয়ে গেল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৬)।

হযরত জাবের (রা.) বলেন, সমবেত লোকের মধ্যে আসআদ ইবনে যোরারা ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সের আসআদ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ধরে বললেন মদীনাবাসীরা একটু থামো, আমরা তার কাছে উটের বুক শুকানো দূরত্ব অতিক্রম করে এ কারণেই হাজির হয়েছি, যেহেতু তিনি আল্লাহর রাসূল, আজ তাকে মক্কা থেকে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে সমগ্র আরবের সাথে শত্রুতা তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের নিহত হওয়া ও তলোয়ারের ঝনঝনানি কাজেই এসব কিছু সহ্য করতে পার তবেই তাকে নিয়ে যাও তোমাদের একাজের বিনিময় আল্লাহর কাছে রয়েছে আর যদি নিজেদের প্রাণ তোমাদের কাছে প্রিয় হয়ে থাকে, তবে তাকে এখনই ছেড়ে দাও এটা হবে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ওযর (মোসনাদে আহমদ)।

বাইয়াতের পূর্ণতা

বাইয়াতের দফাসমূহ আগেই নির্ধারিত ছিল, পরিস্থিতির গুরুতর অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে এরপর অতিরিক্ত তাকিদ দেয়ায় সবাই সমস্বরে বললেন, আস আদ ইবনে যোরারা তোমার হাত সরাও আল্লাহর শপথ আমরা এই বাইয়াতকে ছাড়তেও পারি না, নষ্টও করতে পারি না (মোসনাদে আহমদ)।

এই জবাব পেয়ে হযরত আসআদ ভালভাবে বুঝতে পারলেন যে, তার স্বজাতীয় লোকেরা দৃঢ় সংকল্প তারা জীবন দিতে প্রস্তুত মুসআব ইবনে ওমায়ের ছিলেন মদিনায় দ্বীনের বিশিষ্ট মোবাল্লেগ এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিলেন বাইয়াতকারীদের ধর্মীয় নেতা তাই সর্ব প্রথম আস আদ ইবনে যোরারা বাইয়াত করেন ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, বনু নাজ্জার বলেছে, আবু উমাশা আসআদ ইবনে যোরার প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন (ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, বনু আশহাল বলেছেন সর্ব প্রথম আবুল হায়হাম ইবনে তায়হান বাইয়াত করেছেন, হযরত কাব ইবনে মালেক বলেন, সর্ব প্রথম বাইয়াত করেছিলেন বারা ইবনে মারুর, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৭ আমার ধারণা বাইয়াতের আগে আবুল হায়ছাম এবং বারার কথাকেই বাইয়াত বলে ধরা হয়েছে অন্যথায় সে সময় সবার সামনে তো ছিলেন হযরত আসআদ ইবনে যোরারা তাই তার নামই আগে বর্ণণা করার কথা), এরপর অন্য সবাই বাইয়াত করেন হযরত জাবের (রা, ) বলেন, আমরা একজন করে উঠলাম, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের একজন কাছে বাইয়াত নিলেন বিনিময়ে তিনি আমাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন (মোসনাদে আহমদ)।

সেই সম্মেলনে উপস্থিত দুজন মহিলা মৌখিকভাবে বাইয়াত করছিলেন প্রিয় রাসূল কখনোই কোন অপরিচিতা মহিলার সাথে করমর্দন করেন নি (সহীহ মুসলিম বাইয়াতুল নেসা, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩১)।

বারোজন নকীব ও তাদের নাম

বাইয়াত সম্পন্ন হওয়ার পর প্রিয় নবী প্রস্তাব করলেন যে, বারোজন নেতা মনোনীত করা হোক, এরা হবে তাদের কওমের নকীব এরা বাইয়াতের শর্তাবলী নিজ নিজ কওমের লোকদের দ্বারা পূরণ করার দায়িত্ব পালন করবে প্রিয় নবী উপস্থিত লোকদেরই বারোজনের নাম জানাতে বললেন, তার একথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই ১২জন নকীব মনোনীত করা হল, এদেরে মধ্য ৯জন খাযরাজ ও ৩জন আওস গোত্রের ছিলেন

১. আসআদ ইবনে যোরারা ইবনে আদাছ ২. সাদ ইবনে রবিয়া ইবনে আমর ৩. আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা ইবনে সালাবাহ ৪. রাফে ইবনে মালেক ইবনে আযলান ৫. বারা ইবনে মারুর ইবনে ছাখার ৬. আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম ৭. ওবাদা ইবনে সামেত ইবনে কায়েস ৮. সাদ ইবনে ওবাদা ইবনে অইম

৯. মুনযের ইবনে আমর খোনাইস এরা ছিলেন খাযরাজ গোত্রের

অন্য দিকে

১. উছায়েদ ইবনে খুজায়ের ইবনে ছাম্মাক ২. সাদ ইবনে খায়ছামা ইবনে হারেছ ৩. রেফায়া ইবনে আবদুল মুনেযের ইবনে যোবায়র ছিলেন আওস গোত্রের (কেউ কেউ যোবাইর এর পরিবর্তে যোনাইর উল্লেখ করেছেন কোন কোন সীরাত রচয়িতা রেফায়ার পরিবর্তে আবুল হায়ছাম ইবনে তাইহানের নাম সংযোজন করেছেন)।

১২ জন নকীব নিযুক্ত হওয়ার পর তাদর কাছ থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় আরো একটি অঙ্গীকার নিলেন কেননা এরা ছিলেন অধিক দায়িত্বশীল তিনি বললেন আপনারা স্বজাতীয়দের সকল বিষয়েরই জন্যেই দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার, হাওয়ারিয়া (১২ জন) হযরত ঈসা (আ.) এর পক্ষ থেকে যেমন দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার ছিলেন, আপনারাও ঠিক তেমনি আমি মুসলমানদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার সবাই সমস্বরে বললেন, জ্বী হ্যাঁ

শয়তান কর্তৃক চুক্তির তথ্য ফাঁস

চুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ার পর সবাই চলে যাওয়ার উপক্রম করছিলেন এমন সময় শয়তান সম্মেলনের বিষয়ে জেনে গেল, কোরাইশদের কাছে খবর পৌঁছানোর সময় ছিল না, যদি পৌছাত তবে তারা সংঘবদ্ধভাবে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, এ কারণে শয়তান উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে উচ্চস্বরে বলল, মিনাবাসীরা মোহাম্মাদকে দেখ, বে-দ্বীন লোকেরা বর্তমানে তার সঙ্গে রয়েছে তোমাদের সাথে লড়াই করার জন্য তারা সমবেত হয়েছে

প্রিয় নবী বললেন, ওটা হচ্ছে ঘাটির শয়তান, ওরে আল্লাহর দুশমন, শুনে রাখ, খুব শীঘ্রই আমি তোর জন্য সময় পাচ্ছি, এরপর তিনি লোকদের বললেন তারা যেন নিজ নিজ তাবুতে ফিরে যায় (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫১)।

শয়তানের আওয়াজ শুনে হযরত আব্বাস ইবনে ওবাদা ইবনে সাজলা বললেন, সেই জাতের কসম যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন যদি আপনি চান তবে আগামীকালই আমরা মিনাবাসীদের ওপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে এখনো এ কাজের আদেশ দেয়া হয়নি, তোমরা তোমাদের আস্তানায় ফিরে যাও, এরপর সবাই গিয়ে শুয়ে পড়লেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮)।

মদিনার নেতাদের সাথে কোরাইশদের কথা কাটাকাটি

কোরাইশরা এ খবর পাওয়ার পর দিশেহারা হয়ে পড়ল, কেননা এ ধরনের বাইয়াতের সুদূর প্রসারী ফলাফল সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল, পরদিন সকালে কোরাইশদের একদল বিশিষ্ট লোক মদীনাবাসী আগন্তুকদের তাঁবুর সামনে গিয়ে গত রাতের সম্মেলনের এবং বাইয়াতের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলো, তারা বলল, ওহে খাযরাজের লোকেরা আমরা শুনলাম তোমরা আমাদের এই লোককে আমাদের কাছ থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাও, তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে তার হাতে বাইয়াত করছ, অথচ তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা অন্যসব আরব গোত্রের সাথে যুদ্ধ করার চেয়ে আমাদের কাছে অপছন্দনীয় (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮)।

মক্কার কোরাইশরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করার পর মদিনা থেকে আসা অমুসলিম তীর্থযাত্রীরা বলল, তোমাদের কথা ঠিক নয়, তারা কসম করে বলল, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে না আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলল, আমার কওমের লোকেরা আমাকে বাদ দিয়ে এত বড় কাজ করবে, এটাতো চিন্তাই করা যায় না আমি তো এখন মক্কায় যদি আমি মদিনায় থাকতাম, তবুও তারা আমার সাথে পরামর্শ না করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করত না।

সম্মেলন এবং বাইয়াত রাতের আধারে হয়েছিল বিশ্বাস করার মত নয়, এ কারণে মদিনায় অমুসলিম তীর্থ যাত্রীদের কথাই মক্কার অমুসলিমরা বিশ্বাস করলো, মুসলমানরা একে অন্যের প্রতি আড়চোখে তাকালেন তারা ছিলেন চুপচাপ।

তারা হা বা না কিছুই বললেন না এক সময় কোরাইশ নেতারা বুঝলো যে আশঙ্কা করার মত কিছু আসলে ঘটেনি অবশেষে তারা হতাশ হয়ে ফিরে গেল।

বাইয়াতকারীদের ধাওয়া

মক্কায় কোরাইশ নেতারা এ বিশ্বাসের সাথে সাথে ফিরে এলো যে, তারা যা শুনেছে, সেটা সত্য নয় তবে যেহেতু সন্দেহ ছিল, এ জন্যে তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য অধীর হয়ে উঠলো, শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারল যে, ঘটনা সত্য, বাইয়াতের ঘটনা আসলেই ঘটেছে নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে কিন্তু এ খবর নিশ্চিতভাবে যখন তারা পেল তখন মদিনার হজ্জ যাত্রীরা রওয়ানা হয়ে গেছেন কিছুসংখ্যক অমুসলিম মদিনায় যাত্রীদের পিছু ধাওয়া করল, কিন্তু সুযোগ ততক্ষণে হাতছাড়া হয়ে গেছে, দ্রতগামী ঘোড় সওয়াররা সাদ ইবনে ওবাদা এবং মুনযের ইবনে আমরকে দেখতে পেল, মুনযের দ্রুত এগিয়ে গেলেন, সাদ ধরা পড়লেন তাকে মক্কায় বেধে নিয়ে আসা হল, তাকে প্রহার কার হল, মক্কায় নেয়ার পর মাতয়াম ইবনে আদী এবং হারেছ ইবনে হবর উমাইয়া তাকে ছাড়িয়ে দিলেন কেননা এই দুজনের বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় সাদ ইবনে ওবাদার তত্ত্বাবধানে যাতায়াত করত, এদিকে মদিনায় হজ্জ যাত্রীরা তাদের সফরসঙ্গী সাদ ইবনে ওবাদার গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তারা মক্কায় ফিরে গিয়ে কাফের কোরাইশদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু মক্কার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই তারা লক্ষ্য করলেন যে, সাদ ইবনে ওবাদা ফিরে আসছেন এরপর কাফেলার সবাই নিরাপদে রওয়ানা হয়ে নিরাপদে মদিনা পৌঁছলেন (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫১-৫২, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৪৮-৪৫০)।

এটি হচ্ছে দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা এটাকে বাইয়াতে আকাবা কোবরাও বলা হয় এই বাইয়াত এমন এক পরিবেশে হয়েছিল যে ঈমানদারদের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা সহযোগিতা বিশ্বাস বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রেরণা এখানে জাগরূক ছিল, মদিনার ঈমানদারদের অন্তর মক্কার দুর্বল ভাইদের প্রতি ভালবাসায় ছিল পরিপূর্ণ, সাহায্য করার উদ্দীপনায় মনে ছিল দুর্বার সঙ্কল্প, অত্যাচারী বিধর্মীদের জন্যে অন্তরে ছিল ক্রোধ ও ঘৃণা না দেখেও যাদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ভাই হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে তারা ছিল প্রকৃতপক্ষেই দ্বীনি ভাই।

এ ধরনের প্রেরণা বাহ্যিক কোন আকর্ষণের কারণে ছিল না, সময়ের স্রোতধারায় এ ভালবাসার প্রেরণা মুছে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না, বরং এ ভালবাসার মূলে ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান ও আল্লাহর কোরআনের প্রতি ঈমান, এই ঈমান কোন প্রকার যুলুম নির্যাতন অত্যাচার ও শক্তির সামনে দুর্বল ও নষ্ট হওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না, এই ঈমান বা অদৃশ্য বিশ্বাসের দৃঢ়তার পরিচয় আমলের মাধ্যমে পাওয়া যায়, এই ঈমানের কারণেই মুসলমানরা পৃথিবীতে বিস্ময়কর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিল, সেই কৃতিত্বের উদাহরণ অতীতের পৃথিবীতে যেমন পাওয়া যায়নি ভবিষ্যতের পৃথিবীতেও পাওয়ার তেমনি সম্ভাবনা নেই।

হিজরতকারী মুসলমানদের শঙ্কিত প্রতিনিধিদল

দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম, কুফুরী ও মূর্খতার অন্ধকারের মধ্যে নিজের জন্যে একটি আবাসভূমির বুনিয়াদ রাখতে সক্ষম হল, দাওয়াতের শুরু থেকে এটা ছিল ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের অনুমতি দিলেন তারা যেন নিজেদের নতুন দেশে হিজরত করে চলে যায়।

হিজরত অর্থ হচ্ছে সব কিছু পরিত্যাগ করে শুধু প্রাণ রক্ষার জন্য কোথাও চলে যাওয়া, তবে এই প্রাণও শঙ্কামুক্ত নয়, যাত্রা শুরু থেকে গন্তব্য পৌছা পর্যন্ত যে কোন জায়গায় প্রাণ সংহার হয়ে যেতে পারে, যাত্রা শুরু হচ্ছে এক অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ভবিষ্যতে কি ধরনের বিপদ মুসিবতের সম্মুখীন হতে হবে, সে সম্পর্কে আগে ভাগে কিছুই বলা যায় না।

এসব কিছু জেনে বুঝেই মুসলমানরা হিজরত শুরু করেন এদিকে পৌত্তলিকরা মুসলমানদের যাত্রা পথে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল, কারণ পৌত্তলিকরা বুঝতে পেরেছিল যে, মুসলমানদের হিজরতের পর ভবিষ্যতে তাদের জন্য অনেক আশঙ্কা ও বিপদ দেখা দেবে নীচে হিজরতের কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা যাচ্ছে।

এক. প্রথম মোহাজের ছিলেন হযরত আবু সালমা (রা.) ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার এক বছর আগে তিনি হিজরত করেন স্ত্রী এবং সন্তানরাও তার সাথে ছিলেন, তিনি রওয়ানা হতে শুরু করলে তার শ্বশুরালয়ের লোকেরা বলল, আপনার নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমাদের চেয়ে আপনার বেশী রয়েছে, কিন্তু আমাদের মেয়ের কি হবে? আপনি তাকে শহরে শহরে ঘোরাবেন এটা জানার পরও কিভাবে তাকে আপনার সাথে যেতে দিতে পারি? সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়, আবু সালমর স্ত্রীকে তার মা-বাবা রেখে দিলেন, এ খবর পাওয়ার পর আবু সালমার মা-বাবা ক্ষেপে গেলেন তারা নিজেদের পৌত্রকে কেড়ে নিয়ে এলেন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে এক ধাত্রীর কাছে প্রতিপালনের জন্য দেয়া হল এর আগে এক জায়গায় শিশুকে উভয় পক্ষ টানাটানি করায় শিশুর হাতে ব্যথা পেল, মোটকথা হযরত আবু সালমা (রা.) একা মদিনায় চলে গেলেন এদিকে স্বামী সন্তান ছেড়ে উম্মে সালমা পাগলিনীর মত হয়ে গেলেন যেখানে তার স্বামী বিদায় নিয়েছিলেন এবং তার সন্তানকে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, সেই জায়গার নাম ছিল আবত্তাহ প্রতিদিন সকালে তিনি আবত্তাহ যেতেন এবং সারাদিন বিলাপ করতেন, এভাবে এক বছর কেটে গেল, অবশেষে উম্মে সালমর একজন আত্মীয় উম্মে সালমার মা-বাবাকে বলল, বেচারিকে কেন আপনারা স্বামীর কাছে যেতে দিচ্ছেন না? এরপর তার মা বাবা তাকে বললেন তুমি ইচ্ছা করলে স্বামীর কাছে যেতে পার, উম্মে সালমা তখন শ্বশুরালয়ে গিয়ে সন্তানকে ধাত্রীর কাছ নিয়ে নিলেন এবং একাকী সন্তানসহ মদিনা রওয়ানা হলেন, মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব পাঁচশত কিলোমিটার, তানঈম নামক জায়গায় পৌছার পর ওসমান ইবনে আবু তালহার সাথে দেখা হল, উম্মে সালমা তাকে সব কথা খুলে বললেন, সব শুনে ওসমান তাকে সঙ্গে নিয়ে মদিনায় রওয়ানা হলেন কোবার জনপদ দূরে থেকে দেখে বললেন এ জনপদে তোমার স্বামী রয়েছে তুমি সেখানে চলে যাও আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন এর ওসমান মক্কায় ফিরে এলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৬৯, ৪৭০)।

দুই) হযরত সোহায়ব (রা.) মদিনায় হিজরত করার ইচ্ছা করলে কোরাইশ পৌত্তলিকরা বলল, তুমি আমাদের কাছে যখন এসেছিলে তখন তুমি ছিলে নিঃসঙ্গ কাঙ্গাল, এখানে আসার পর তোমার অনেক ধন সম্পদ হয়েছে তুমি অনেক উন্নতি করেছ এখন তুমি সেসব নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়তে চাও? সেটা কিছুতেই সম্ভব নয় হযরত সোহায়েব বললেন আমি যদি ধন-সম্পদ সব ছেড়ে যাই তবে কি তোমরা আমাকে যেতে দেবে? তারা বলল হ্যাঁ দেব, হযরত সোহায়েব বললেন ঠিক আছে তাই হোক, সব কিছু তোমাদের কাছে রেখে গেলাম প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ খবর পাওয়ার পর মন্তব্য করলেন, সোহায়েব লাভবান হয়েছে, সোহায়েব লাভবান হয়েছে (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৭৭)।

তিন) হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব, আইয়াশ ইবনে আবি রবিয়া এবং হিশাম ইবনে আস ইবনে ওয়ায়েল পরস্পর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে অমুক জায়গায় সকাল বেলা একত্রিত হয়ে সেখান থেকে মদিনায় হিজরত করবেন, এরপর হযরত ওমর এবং আইয়াশ নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে সক্ষম হলেন কিন্তু হিশাম পৌছুতে পারলেন না, তাকে বন্দী করে রাখা হল।

উল্লিখিত দুজন হিজরত করে কোবায় পৌছার পর আইয়াশের কাছে আবু জেহেল এবং তার ভঅই হারেস পৌছলো, তিনজন ছিলেন এক মায়ের সন্তান উভয় ভাই আইয়াশকে বলল মা প্রতিজ্ঞা করেছে যে তোমাকে না দেখা পর্যন্ত মাথার চুল আঁচড়াবে না, রোদ থেকে ছায়ায় যাবে না, একথা শুনে মায়ের জন্য আইয়াশের মন কেঁদে উঠল, হযরত ওমর (রা.) এ অবস্থা দেখে আইয়াশকে বললেন, শোন আইয়াশ, ওরা তোমাকে তোমার দ্বীনের ব্যাপারে একটা ফেতনায় ফেলতে চায়, কাজেই তুমি সাবধান হও, খোদার কসম তোমার মায়ের মাথায় যখন উকুন কামড়াবে তখন তিনি নিশ্চয়ই মাথায় চিরুনি দেবেন, মক্কায় কড়া রোদ অসহ্য হলে তিনি ঠিকই ছায়ায় যাবেন, কিন্তু আইয়াশ সেকথা কানে তুললেন না, তিনি মায়ের কসম পুরো করার জন্য জন্য ভাইদের সাথে মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, হযরত ওমর (রা.) বললেন, যেতেই যখন চাও, আমার এ উটনী নিয়ে যাও, এর পিঠ থেকে নামবে না মায়ের সাথে দেখা দিয়েই চলে আসবে যদি সন্দেহজনক কোন আচরণ দেখ দ্রুত মদিনায় ফিরে আসবে।

আইয়াশ উটনীর পিঠে চড়ে দুই ভাইয়ের সাথে মক্কা অভিমুখে ফিরে চললেন কিছুদূর যাওয়ার পর আবু জেহেল আইয়াশকে বলল, ভাই আমার উট খুব ধীরে চলে, তোমার উটনীটা কিছুক্ষণের জন্য বদল করবো, আইয়াশ উটনী বসানোর সাথে সাথে দুই ভাই মিলে আইয়াশকে রশি দিয়ে বেধে বাধা অবস্থায় দিনের বেলায় মক্কায় নিয়ে গেল, মক্কায় নেয়ার পর সবাইকে শুনিয়ে বলল, ওহে মক্কার অধিবাসীরা তোমরা তোমাদের বেকুবদের সাথে ঠিক এরূপ ব্যবহার কর, আমরা আমাদের এই বেকুবের সাথে যেমন ব্যবহার করেছি (হিশাম এবং আইয়াশ কাফেরদের হাতে বন্দী ছিল, রাসূল হিজরত করার পর একদিন বললেন, কে আছ যে আমার জন্য হিশাম এবং আইয়াশকে ছাড়িয়ে আনতে পারো, ওলীদ ইবনে ওলীদ এ দায়িত্ব নিলেন, গোপনে তিনি মক্কায় গেলেন, ওদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া এক মহিলাকে অনুসরণ করে তাদের ঠিকানা জেনে নিলেন, ছাদ বিহীন একটি ঘরে উভয়কে আটকে রাখা হয়েছিল, গভীর রাতে ওলীদ দেয়াল বেয়ে উঠে ঘরের ভেতরে গেলেন তারপর বাধান কেটে দিয়ে বের করে নিজের উটে বসিয়ে উভয়কে মদিনায় নিয়ে এলেন, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৭৪-৪৭৬ হযরত ওমর (রা.) ২০ জন সাহাবীর একটি দলসহ মদিনায় হিজরত করেন, সহীহ বোখারী ১ম খন্ড)।

হিজরত করার জন্য কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে এ খবর পাওয়ার পর পৌত্তলিকরা তাদের সাথে যেরূপ ব্যবহার করত, এখানে তার তিনিটি নমুনা তুলে ধরা হল, কিন্তু এত বাধা সত্বেও ঈমানের সম্বল বুকে নিয়ে মুসলমানরা হিজরত করতে থাকেন দ্বিতীয় বাইয়াতে আকবার দুই মাস কয়েক দিন পর মক্কায় প্রিয় নবী হযরত আবু বকর এবং হযরত আলী (রা.) ছাড়া অন্য কোন মুসলমান ছিলেন না, এরা দুজন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী মক্কায় রয়ে গেলেন, কয়েকজন মুসলমান এমন ছিলেন যে, তাদেরকে পৌত্তলিকরা জোর করে আটকে রেখেছিল, রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরতের প্রস্তুতি নিয়ে আল্লাহর নির্দেশেরে অপেক্ষায় ছিলেন আর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সফরের সাজ সরঞ্জাম বেধে রেখে দিয়েছিলেন (যাদুল আয়অদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।

সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের বললেন, আমাকে তোমাদের হিজরতের স্থান দেখানো হয়েছে এটি হচ্ছে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি এলাকা এরপর মুসলমানরা মদিনায় হিজরত শুরু করেন, হাবশায় যারা হিজরত করেছিলেন তারাও মদিনায় আসতে শুরু করেন, হযরত আবু বকর (রা) ও মদিনায় সফরের প্রস্তুতি নেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, অপেক্ষা কর, আমি ধারনা করছি যে, আমাকেও হিজরতের নির্দেশ দেয়া হবে হযরত আবু বকর (রা.) বললেন, আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি কি হিজরতের আশা করছেন? প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হা, এরপর হযরত আবু বকর (রা.) অপেক্ষা করতে লাগলেন, তিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী হবেন এ আশায় ছিলেন তার কাছে দুটি উটনী ছিল, তাদেরকে চার মাস যাবত ভালো করে বাচলা গাছের পাতা খাওয়ানো হল (সহীহ বোখারী, হিজরতে নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩)।

দারুন নোদওয়ায় কোরাইশদের বৈঠক

মক্কার পৌত্তলিকরা যখন দেখলো যে সাহাবায়ে কেরামরা পরিবার পরিজন ও ধন সম্পদ ফেলে রেখে আওস ও খাযরাজদের এলাকায় গিয়ে পৌঁছেছে, তখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়ল, ক্রোধে তারা অস্থির হয়ে উঠলো, ইতিপূর্বে তারা এ ধরনের বিপদজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন কখনো হয়নি, এ পরিস্থিতি ছিল তাদের মূর্তি পূজা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর মারাত্মক আঘাত এবং চ্যালেঞ্জ স্বরূপ।

পৌত্তলিকরা ভাল করেই জানতো যে, হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এর মধ্যে নেতৃত্ব ও পথ নির্দেশের যোগ্যতা এবং তার প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি বিদ্যমান রয়েছে একই সাথে তার সাহাবাদের মধ্যে আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার যে প্রেরণা রয়েছে সেটাও তাদের অজানা ছিল না, আওস ও খাযরাজ গোত্রের রণ কৌশল, যোদ্ধা বা লড়াকু হিসাবে সুনাম সুখ্যাতিও ছিল সর্বজনবিদিত উভয় গোত্রের মধ্যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যেসব নেতা রয়েছেন তাদের অসাধারণ প্রজ্ঞাও সকলের জানা ছিল, তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী যেমন লড়াই করতে জানেন, তেমনি প্রয়োজনে সন্ধি সমঝোতাও করতে জানেন, বহু বছর গৃহযুদ্ধের তিক্ততার পর আওস এবং খাযরাজ গোত্র বর্তমানে প্রয়োজনে সন্ধি এবং মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে এ খবরও কোরাইশদের অজানা ছিল না।

পৌত্তলিক কোরাইশরা এটা জানতো যে, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত লোহিত সাগরের উপকূল দিয়ে সে পথ রয়েছে সেই পথেই চলাচল করে কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা সে পথ মদিনা থেকে বেশী দূরে নয়, কাজেই অর্থনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে মদিনা অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সিরিয়া থেকে মক্কাবাসীদের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল (সেই সময়ের হিসাব অনুযায়ী) আড়াই লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার সমপরিমাণ, তাবেরা এবং অন্যান্য এলাকার বাণিজ্যিক হিসাব ছিল এর অতিরিক্ত কাজেই বাণিজ্যিক পথ নিরাপদ থাকার নিশ্চয়তার মাধ্যমেই যে এ বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা হতে পারে এটা তারা ভালো করেই বুঝতো।

এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, মদিনায় ইসলামী দাওয়াতের বুনিয়াদ দৃঢ় হওয়া এবং মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে মদীনাবাসীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিণাম কত মারাত্মক পৌত্তলিকরা এসব আশঙ্কা সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত ছিল, এবং তারা বুঝতে পারছিল যে, সামনে কঠিন সময় ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে এ কারণে তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কার্যকর প্রতিষেধক সম্পর্কে চিন্তা করতে শুরু করল, তারা জানতো যে, এসব বিশৃঙ্খলা এবং অশান্তির মূলে রয়েছেন ইসলামের পতাকাবাহী মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজে।

দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবার প্রায় আড়াই মাস পর ২৬ শে সফর ১২ ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের শুক্রবার (আল্লামা মনসুরপুরী সংযোজিত তথ্যের আলোকে এ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, রহমতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫, ৯৭, ১০২, ২য় খন্ড, পৃ. ৪৭১)। সকালে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় (প্রথম প্রহরে অর্থাৎ সকাল বেলায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রমাণ ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে এতে তিনি বলেছেন, হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রিয় রাসূল (সা.) এর কাছে এ বৈঠকের খবর নিয়ে আসেন এবং তাকে হিজরতের অনুমতি প্রদান করেন, সহীহ বোখারীতে হযরত আয়েশা (রা.) এর বর্ণনা উল্লেখ রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল (সা.) দুপুর বেলায় হযরত আবু বকর (রা.) এর কাছে এসে বলেন, আমাকে মদিনা রওয়ানা হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখ করা হবে) মক্কার পার্লামেন্ট দারুন নোদওয়ায় ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্য এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, এ বৈঠকে মক্কার কোরাইশদের সকল গোত্রের প্রতিনিধি যোগদান করেন আলোচ্য বিষয় ছিলো এমন একটি পরিকল্পনা উদ্ভাবন করা যাতে ইসলামী দাওয়াতের নিশানবরদারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ইসলামের আলো চির দিনের জন্য নিভিয়ে দেয়া যায়।

এ জঘন্য বৈঠকে যেসব গোত্রের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলো তাদের পরিচয়

১. আবু জেহেল ইবনে হিশাম বনি মাখযুম গোত্র

২. যোবায়ের ইবনে মুতয়েম তুয়াইমা ইবনে বনি নওফেল ইবনে আবদে মান্নাফ

আদী এবং হারেস ইবনে আমের

৩. শায়বা ইবনে রবিয়া, ওতবা ইবনে রবিয়া

এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারব বনি আবদে শামস ইবনে আবদে মান্নাফ

৪. নযর ইবনে হারেস বনি আবদুদ দার

৫. আবুল বুখতারি ইবনে হিশাম

জামআ ইবনে আসোয়াদ এবং

হাকিম ইবনে হেযাম বনি আসাদ ইবনে আবদুল ওজ্জা

৬. নবীহ ইবনে হাজ্জাজ এবং বনি ছাহাম

মুনাব্বাহ ইবনে হাজ্জাজ

৭. উমাইয়া ইবনে খালফ জুমাহ

পূর্ব নির্ধারিত সময়ে প্রতিনিধিরা দারুন নদওয়ায় পৌছে গেল, এ সময় ইবলিশ শয়তান একজন বৃদ্ধের রূপ ধারণ করে সভাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হল, তার পরিধানে ছিল জোব্বা, প্রবেশদ্বারে তাকে দেখে লোকেরা বলল, আপনি কি? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না, শয়তান বলল, আমি নজদের অধিবাসী একজন গেলো, আপনাদের কর্মসূচী শুনে হাজির হয়েছি, কথা শুনতে চাই, কিছু কার্যকর পরামর্শ দিতে পারব আশা করি, পৌত্তলিক নেতারা শয়তানকে যত্ন করে সসম্মানে নিজেদের মধ্যে বসালো।

আল্লাহর রাসূলকে হত্যা করার নীল নকশা

সবাই হাজির হওয়ার পর আলোচনা শুরু হল, দীর্ঘক্ষণ আলোচনার পর নানা প্রকার প্রস্তাব পেশ করা হল, প্রথমে আবুল আসওয়াদ প্রস্তাব করল যে, তাকে আমরা আমাদের মধ্যে থেকে বের করে দেবো, তাকে মক্কায় থাকতে দেব না, আমরা তার ব্যাপারে কোন খবরও রাখব না যে, তিনি কোথায় যান কি করেন এতেই আমরা নিরাপদে থাকতে পারব এবং আমাদের মধ্যে আগেরে মতো সহমর্মিতা ফিরে আসবে।

শেখ নজদী রূপী শয়তান বলল, এটা কোন কাজের কথা নয় তোমরা কি লক্ষ্য করনি যে, তার কথা কত উত্তম কত মিষ্টি তিনি সহজেই মানুষের মন জয় করেন যদি তোমরা তার ব্যাপারে নির্বিকার থাক তবে তিনি কোন আরব গোত্রে গিয়ে হাজির হবেন এবং তাদেরকে নিজের অনুসারী করার পর তোমাদের ওপর হামলা করবেন এরপর তোমাদের শহরেই তোমাদেরকে নাস্তানাবুদ করে তোমাদের সাথে যেমন খুশী আচরণ করবেন কাজেই তোমরা অন্য কোন প্রস্তাব চিন্তা কর।

আবুল বুখতারী বলল, তাকে লোহার শেকলে বেধে আটকে রাখা হোক বাইরের থেকে দরজা বন্ধ করে একটা বন্ধ ঘরে রাখা হোক, এতে করে সেই ঘরে তার মৃত্যু হবে কবি যোহাইর এবং নাবেগার এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল।

শেখ নজদী রূপী শয়তান বলল, এ প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য নয়, তোমরা যদি তাকে আটক করে ঘরের ভেতরে রাখ, তবে যেভাবে হোক, তার খবর তার সঙ্গীদের কাছে পৌঁছে যাবে এরপর তারা মিলিতভাবে তোমাদের ওপর হামলা করে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে এরপর তার সহায়তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে তোমাদের ওপর হামলা করবে সেই হামলায় তোমাদের পরাজয় অনিবার্য, কাজেই অন্য কোন প্রস্তাব নিয়ে চিন্তা কর।

উল্লিখিত দুটি প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর তৃতীয় একটি প্রস্তাব পেশ করা হল, মক্কার সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী আবু জেহেল এ প্রস্তাব উত্থাপন করল, সে বলল, তার সম্পর্কে আমার একটিই প্রস্তাব রয়েছে আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, এখনে কেউ সে প্রস্তাবের ধারে কাছে পৌঁছেনি, সবাই বলল, বল আবুল হাকাম কি সেই প্রস্তাব? আবু জেহেল বলল, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন যুবককে বাছাই করে তাদের হাতে একটি করে ধারালো তলোয়ার দেয়া হবে এরপর সশস্ত্র শক্তিশালী যুবকরা একযোগে তাকে হত্যা করবে এমনভাবে হামলা করতে হবে দেখে যেন মনে হয় একজন আঘাত করছে এতে করে আমরা এই লোকটির হাত থেকে রেহাই পাব, এমনিভাবে হত্যা করা হলে তাকে হত্যার দায়িত্ব সকল গোত্রের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে, বনু আবদে মান্নাফ সকল গোত্রের সাথে তো যুদ্ধ করতে পারবে না ফলে তারা হত্যার ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে রাজি হবে আমরা তখন তাকে হত্যার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব (হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮০-৪৮২)।

শেখ নজদী রূপী শয়তান এ প্রস্তাব সমর্থন করল, মক্কার পার্লামেন্ট এ প্রস্তাবের ওপর ঐকমত্যে উপনীত হল, সবাই এ সঙ্কল্পের সাথে ঘরে ফিরলো যে, অবিলম্বে এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হবে।

আল্লাহর রাসূলের হিজরত

রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জঘন্য প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর হযরত জিবরাঈল (আ.) ওহী নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে হাজির হন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোরাইশদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করে বলেন যে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন, হিজরত করার সময় জানিয়ে হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন আপনি আজ রাত আপনার বাসভবনের বিছানায় শয়ন করবেন না (হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮০-৪৮২, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।

এ খবর পাওয়ার পর নবী ঠিক দুপুরের সময় হযরত আবু বকর (রা.)এর বাড়ীতে গেলেন তাকে সঙ্গে নিয়ে হিজরতের পরিকল্পনা তৈরি করাই ছিল তার উদ্দেশ্য, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন ঠিক দুপুরের সময় আমরা আবু বকর (রা.) এর ঘরে বসেছিলাম, এমন সময় একজন আবু বকরকে বললেন, আল্লাহর নবী মাথা ঢেকে এদিকে আসছেন, এই সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখন আসতেন না, আবু বকর (রা.) এ খবর শুনে বললেন, আমার মা বাবা তার জন্য কোরবান হউন, নিশ্চয়ই তিনি গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে এসেছেন।

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় নবী এলে ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, অনুমতি দেয়া হলে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন এরপর আবু বকরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন তোমার কাছে যারা রয়েছে তাদের সরিয়ে দাও, আবু বকর (রা.) বললেন শুধু আপনার স্ত্রী রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন আমাকে রওয়ানা হওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আবু বকর (রা.)রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন সঙ্গে আমি? হে রাসূল আপনার ওপর আমার মা বাবা কোরবান হউন, হে আল্লাহর রাসূল, প্রিয় রাসূল বলেন হা (যাদুল মায়াদ ১য় খন্ড)।

এরপর হিজরতের কর্মসূচী তৈরি করে তিনি নিজের ঘরে ফিরে রাত্রির অপেক্ষা করতে লাগলেন (সহীহ বোখারী হিজরতে নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩)।

আল্লাহর রাসূলের বাসভবন ঘেরাও

এদিকে কোরাইশদের নেতৃস্থানীয় অপরাধীরা মক্কার পার্লামেন্ট দারুন নোদওয়ার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী সারা দিনব্যাপী প্রস্তুতি গ্রহণ করল, জঘন্য অপরাধীদের মধ্যে তেকে এগারজন সর্দারকে বাছাই করা হল, এদের নাম হচ্ছে,

১. আবু জেহেল ইবনে হিশাম

২. হাকাম ইবনে আস

৩. ওকবা ইবনে আবু মুয়াইত

৪. নযর ইবনে হারেছ

৫. উমাইয়া ইবনে খালফ

৬. জামআ ইবনে আসওয়াদ

৭. তুয়াইমা ইবনে আদী

৮. আবু লাহাব

৯. উবাই ইবনে খালফ

১০. নুবাইহ ইবনে হাজ্জাজ

১১. মুনাব্বাহ ইবনে হাজ্জাজ (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ৫২)

ইবনে ইসহাক বলেন, রাতের আধার ঘন হয়ে এলে ১১জন দুর্বৃত্ত নবী (সা.) এর বাসভবনের চারিদিকে ওৎ পেতে রইল, তারা অপেক্ষা করছিল যে, তিনি শুয়ে পড়লে একযোগে হামলা করবে।

দুর্বৃত্তরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অবশ্যই সফল হবে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২) আবু জেহেল তার সঙ্গীদের সঙ্গে ঠাট্টা মস্কারা করে বলছিল মোহাম্মাদ বলে যে, তোমরা যদি তার ধর্ম মতে দীক্ষা নিয়ে তার অনুসরণ কর, তবে আরব অনারবের বাদশাহ হবে এরপর মৃত্যু শেষে পুনরুজ্জীবিত হলে তোমাদের জন্য জর্দানের বাগানের মত জান্নাত থাকবে, যদি তোমরা তাকে না মার, তবে তারা তোমাদের জবাই করবে এবং মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত হলে তোমাদের আগুনে পোড়ানো হবে (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩)।

ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল রাত বারোটার পর, এ কারণে নির্ঘুম চোখে নির্ধারিত সময়ের প্রতীক্ষায় তারা অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছাই সফল করে থাকেন তিনি আসমান যমীনের বাদশাহ, তিনি যা চান তাই করেন তিনি যাকে বাচাতে চান কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না যাকে পাকড়াও করতে চান কেউ তাকে বাচাতে পারে না এই সময়েও আল্লাহ তায়ালা যা ইচ্ছা করেছিলেন তাই করলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে তিনি বলেন স্মরণ কর, কাফেররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বন্দী করার জন্য হত্যা করার জন্য নির্বাসিত করার জন্য তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও কৌশল করেন আর আল্লাহরই কৌশলীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)।

আল্লাহর রাসূলের গৃহত্যাগ

কোরাইশ কাফেররা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত প্রস্তুতি এবং সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও সফল হতে পারেনি, এমনি এক নাজুক পরিস্থিতিতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী (রা.) কে বললেন তুমি আমার এই সবুজ হাদরামি (দক্ষিণ ইয়েমেনের হাদরামাউতে নির্মিত চাদরকে হাদরামি চাদর বলা হয়) চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাক, ওদের হাতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না, প্রিয় নবী এই চাদর গায়ে দিয়ে রাতে ঘুমোতেন (ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২, ৪৮৩)।

আল্লাহর রাসূল এরপর বাইরে এলেন একমুঠো ধুলো নিয়ে কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করলেন, এতেই আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্ধ করে দিলেন, তারা আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পেল না, সে সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাক কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করছিলেন, আমি ওদের সামনে প্রাচীর ও পশ্চাতে প্রাচীর স্থাপন করেছি এবং ওদেরকে আবৃত্ত করেছি, ফলে ওরা দেখতে পায় না (সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৯)।

প্রতিটি পৌত্তলিকের মাথায় নিক্ষিপ্ত ধূলি গিয়ে পড়লো, এরপর তিনি হযরত আবু বকরের বাড়ীতে গেলেন, সেই ঘরের একটি জানালা পথে বেরিয়ে উভয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে ইয়েমেনের পথে যাত্রা করলেন, রওয়ানা হওয়ার পর কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ছুর পাহাড়ের একটি গুহায় তারা যাত্রা বিরতি করলেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩ যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫২)।

এদিকে অবরোধকারীরা নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগেই তারা নিজেদের ব্যর্থতার কথা জেনে ফেলল, অপরিচিত একজন লোক এসে দুর্বৃত্তদের বলল, আপনারা এখানে কার জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, মোহাম্মাদের জন্য, সেই লোক বলল, আপনাদের ইচ্ছা পূরণ হবে না, আল্লাহর কসম মোহাম্মাদ আপনাদের মাথায় ধূলি নিক্ষেপ করে আপনাদের সামনে দিয়ে নিজের কাছে চলে গেছেন, তারা একথা শুনে বলল, কই আমরা তো তাকে দেখলাম না তারা সবাই নিজের মাথায় হাত দিয়ে ধূলি দেখতে পেল, তারা এরপর ধুলো ঝেড়ে সবাই উঠে দাড়ালো।

এরপর তারা প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের ভেতর উকি দিয়ে দেখলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় কেউ শুয়ে আছেন ওরা হযরত আলীকেই আল্লাহর রাসূল মনে করে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করল, সকালে হযরত আলী (রা.) কে শয্যা ত্যাগ করতে দেখে দুর্বৃত্তরা চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে পড়ল, তারা হযরত আলী (রা.) কে জিজ্ঞাসা করল, আল্লাহর রাসূল কোথায়? হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি জানি না (যাদুল মায়াদ ১ম খন্ড, পৃ. ৫২ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৩)।

ঘর থেকে গারে ছূরে

প্রিয় রাসূল ২৭ শে সফর মোতাবেক ১২ ও ১৩ ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১২ ই সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে হিজরত করেন, তার সফরসঙ্গী ছিলেন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সাথী হযরত আবু বকর (রা.) তারা সূর্যোদয়ের আগেই মক্কার সীমানা অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চললেন (রহমতুল লিল আলামিন ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫ সফরের এ মাস নবুয়তের চতুর্দশ বর্ষ হিসাবে গণ্য হবে যদি মহররম মাস থেকে বর্ষ শুরুর হিসাব করা হয়, যদি নবুয়ত পাওয়ার মাস থেকে বর্ষ শুরুর হিসাব ধরা হয়, তাহলে সফর মাস হবে নবুয়তের ত্রয়োদশ বছর সীরাত রচয়িতাদের অধিকাংশ মহররম মাস থেকেই বর্ষ শুরুর হিসাব করেছেন কেউ কেউ উভয় রকমের হিসাব গ্রহণ করেছেন এ কারণে হিজরতের তারিখ নির্ধারণে তারা এলোমেলো করে দেখেছেন আমরা মহররম মাস থেকেই বর্ষ শুরুর হিসাব উল্লেখ করেছি)।।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন যে, কোরাইশ দুর্বৃত্তরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় তাকে খুঁজবে এবং স্বাভাবিকভাবে মদিনা অভিমুখী পথের দিকেই অগ্রসর হবে এ কারণে প্রিয় নবী উল্টো দিকে ইয়েমেনের পথে অগ্রসর হলেন, মদিনার পথ হচ্ছে মক্কা থেকে উত্তর দিকে আর ইয়েমেনের পথ দক্ষিণ দিকে পাঁচ মাইল অতিক্রমের পর প্রিয় নবী একটি পাহাড়ের পাদদেশে পৌছলেন, সেই পাহাড় ছুর পাহাড় নাম পরিচিত, একটি সুউচ্চ পাহাড় এই পাহাড়ে ওঠা খুব কষ্টকর এখানে বহু পাথর রয়েছে সেই পাথর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরণ যুগল রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল, বলা হয়ে থাকে যে, পায়ের ছাপ গোপন রাখার জন্য তিনি পায়ের গোড়ালি দিয়ে হাটছিলেন, এ কারণে তার পা জখম হয়ে যায়।

হযরত আবু বকর (রা.) প্রথমে পাহাড়ের কিছু অংশে উঠে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ওপরে উঠতে সহায়তা করেন, এরপর উভয়ে পাহাড় চুড়ার একটি গুহায় আশ্রয় নেন এই গুহা ইতিহাসে গারে ছূর নামে বিখ্যাত (রহমতুল লিল আলামিন, ১ম খন্ড, পৃ. ৯৫, মুখতাছারুছ সিরাহ শেখ আবদুল্লাহ পৃ. ১৬৭৭, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮২)।

ছূর পর্বতের গুহায়

গুহার কাছে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু বকর (রা.) বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, গুহায় কোন কিছু থাকলে তার মোকাবেলা আমার সাথেই যা হবার হবে, এরপর তিনি গুহায় প্রবেশ করে পরিষ্কার করলেন, কয়েকটি গর্ত ছিল, যেগুলো তহবন্ধ ছিড়ে বন্ধ করলেন, দুটি গর্ত বাকি ছিল, সেগুলোতে পা চাপা দিয়ে প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভেতরে আসার আহ্বান জানালেন, প্রিয় নবী ভেতরে গেলেন এবং আবু বকরের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন, ইতিমধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) কে কিসে যেন দংশন করল, কিন্তু প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে এ আশঙ্কায় তিনি নড়াচড়া করলেন না, বিষের কষ্টে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো, বেখেয়ালে এক ফোটা অশ্রু প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারায় পড়তেই তিনি জেগে গেলেন, আবু বকর (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি হয়েছে? কিসে যেন আমাকে দংশন করেছে ।

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খানিকটা থুথু নিয়ে দংশিত স্থালে লাগিয়ে দিলেন সাথে সাথে বিষের যাতনা দূর হয়ে গেল (এই বক্তব্য ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.)থেকে বর্ণনা করা হয়েছে এ বর্ণনায়, একথাও রয়েছে যে, পরবর্তী সময়ের সেই বিষের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং সেই বিষের প্রভাবেই তিনি ইন্তিকাল করেন, দেখুন মেশকাত, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫৬, মানাকের আবু বকর শীর্ষক অধ্যায়)।

এখানে উভয়ে শুক্র, শনি ও রবিবার এ তিনদিন অবস্থান করেন (ফতহুল বারী, ৭ম খন্ড, পৃ. ৩৩৬) এ সময়ে হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহও একই সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন আবদুল্লাহ ছিল খুব বুদ্ধিমান যুবক, সে শেষ রাতে উভয়ের কাছে থেকে চলে আসতো কিন্তু মক্কায় তাকে সকাল বেলাই দেখা যেত, যে কেউ দেখে ভাবত রাতে সে মক্কাতেই ছিল, সারাদিন উভয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের যেসব কথা শুনতো, সন্ধ্যায় অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সেসব খবর নিয়ে গারে ছূরে চলে যেত।

এদিকে হযরত আবু বকরের ক্রীতদাস আমের ইবনে যোহায়রা বকরি চরাতেন রাতের আধার গভীর হলে তিনি বকরি নিয়ে তাদের কাছে যেতেন এবং দুধ দোহন করে দিতেন, উভয়ে তৃপ্তির সাথে দুধ পান করতেন খুব ভোরে আমের বকরি নিয়ে রওয়ানা হতেন তিন রাতেই তিনি এরূপ করেছিলেন (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩-৫৫৪) এ ছাড়া আমের ইবনে যোহায়রা আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকরের মক্কা যাওয়ার চিহ্ন সেই পথে বকরী তাড়িয়ে মুছে দিতেন (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৬)।

কোরাইশদের অভিযান

কোরাইশদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা যখন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছেন, তখন তারা যেন উম্মাদ হয়ে গেল, প্রথমে তারা হযরত আলীর ওপর তাদের ক্রোধ প্রকাশ করল, তাকে টেনে হিঁচড়ে কাবাঘরে নিয়ে গেল এবং কথা আদায়ের চেষ্টা করলো (রহমতুল লিল আলামীন 1ম খন্ড, পৃ. ৯৯) কিন্তু এতে কোন লাভ হল না, এরপর তারা হযরত আবু বকরের বাড়ীতে গেল, দরজা খুললেন হযরত আসমা বিনতে আবু বকর, তাকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, তোমার আব্বা কোথায়? তিনি বললেন আমি তো জানি না এ জবাব শুনে দুর্বৃত্ত আবু জেহেল আসমাকে এত জোরে চড় দিল যে, তার কানের বালি খুলে পড়ে গেল (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৭)।

এরপর কোরাইশ নেতারা এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে গ্রেফতার করার জন্য সর্বাত্মক অভিযান চালাতে হবে, মক্কা থেকে বাইরের দিকে যাওয়ার সকল পথে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করল, সেই সাথে ঘোষণা করা হল যে, যদি কেউ হযরত মোহাম্মাদ (সা.) এবং আবু বকর (রা.) কে বা দুজনের একজনকে জীবিত বা মৃত হাজির করতে পারে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪) এ ঘোষণা সর্বসাধারণ্যে প্রচারিত হবার পর চারিদিকে বহু লোক বেরিয়ে পড়ল, পায়ের চিহ্ন বিশারদরাও উভয়কে তালাশ করতে লাগল, পাহাড়ের প্রান্তরে ও উঁচু নিচু এলাকায় সর্বত্র চষে বেড়াতে লাগল, কিন্তু এত কিছু করেও কোন লাভ হল না।

অনুসন্ধানকারীরা ছুর পাহাড়ের গুহার কাছেও পৌঁছল, কিন্তু সারা দুনিয়ার বাদশাহ আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছাকেই পূর্ণতা দান করেন, সহীহ বোখারীতে হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে গুহায় ছিলাম, মাথা তুলতেই দেখি, লোকদের পা দেখা যাচ্ছে, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ওরা কেউ যদি একটুখানি নিচু হয়ে এদিকে তাকায় তবেই আমাদের দেখতে পারবে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবু বকর চুপ কর, আমরা এখানে দুজন নই বরং আমাদের সাথে তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা, অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন আবু বকর এমন দুজন সম্পর্কে তোমার কি ধারনা, যাদের তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬ ৫৫৮ এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, হযরত আবু বকরের অস্থিরতা নিজের জীবন রক্ষার জন্য ছিল না, তিনি প্রিয় নবী (সা.) এর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন, তিনি দুর্বৃত্তদের পা দেখতে পাচ্ছিলেন, সে সময় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন এবং বললেন, যদি আমি মারা যাই তবে একজন আবু বকর মারা যাবে, কিন্তু আপনি মারা গেলে সমগ্র উম্মত বরবাদ হয়ে যাবে, এ সময়ে রাসূল বলেছিলেন ভয় পেয়ো না, আবু বকর আল্লাহ পাক আমাদের সঙ্গে রয়েছেন)।

মোটকথা অনুসন্ধানকারীরা তখনই চলে গেল, যখন আল্লাহর রাসূল ও দুর্বৃত্তদের মধ্যে ব্যবধান ছিল খুব কম মাত্র কয়েক কদম।

মদিনার পথে

মক্কার কোরাইশদের নেতৃত্বে পুরস্কারলোভী লোকদের অনুসন্ধান তৎপরতা নিষ্ফল প্রমাণিত হল, ক্রমাগত তিনদিন অনুসন্ধান করে তারা ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ল, তাদের অনুসন্ধান উৎসাহ স্তিমিত হয়ে এলো, এ অবস্থা লক্ষ্য করে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) মদিনার পথে রওয়ানা হলেন, বিভিন্ন পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত লাইছির সাথে আগেই চুক্তি হয়েছিল যে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এই দুইজনকে মদিনায় পৌঁছে দেবেন, কোরাইশদের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর থাকলেও এ লোকটি ছিল বিশ্বস্ত, এ কারণে তাকে সওয়ারীও দেয়া হয়েছিল, তাকে বলা হয়েছিল যে, তিনদিন পর সে দুটি সওয়ারীসহ ছুর গুহার সামনে যাবে, সোমবার রাতে ১লা রবিউল আউয়াল মোতাবেক ১৬ই সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের সোমবার রাতে আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত সওয়ারী নিয়ে এলেন হযরত আবু বকর (রা.) এসময় তার দুটি উটনী দেখিয়ে বললেন, হে রাসূল আপনি এ দুটির মধ্যে একটি গ্রহণ করুন, রাসূল বললেন, হা, তবে মূল্যের বিনিময়ে

এদিকে আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) উটের ওপর বিছানোর বিছানা নিয়ে এলেন কিন্তু বাধার দড়ি আনতে ভুলে গিয়েছিলেন, রওয়ানা হওয়ার সময় হযরত আসমা উটের পিঠে বিছানা রাখার পর দেখা গেল বাধার দড়ি রেখে এসেছেন, তিনি তখন নিজের কোমরবন্দ খুলে সেটি দুভাগ করে ছিড়ে বিছানা উঠের পিঠের সাথে বেধে দিলেন অন্য অংশ নিজের কোমরে বাধলেন, এ কারণে তার উপাধি হয়েছিল যাতুন নেতাকাইন (সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৩-৫৫৫, ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৮৬)।

এরপর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.)রওয়ানা হলেন, আমের ইবনে যোহায়রাও সঙ্গে ছিলেন, রাহবার আব্দুল্লাহ ইবনে আরিকত উপকূলীয় পথে মদিনা রওয়ানা হলেন।

গারে ছুর থেকে বেরবার পর আবদুল্লাহ প্রথমে ইয়েমেনের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিকে বহুদূর অগ্রসর হলেন এরপর পশ্চিমাভিমুখী হয়ে সমুদ্রোপকূল ধরে যাত্রা করলেন, পরে এমন এক পথে চলতে লাগলেন যে পথ সম্পর্কে সাধারণ লোকেরা কেউ অবহিত ছিল না, সে পথে উত্তর দিকে অগ্রসর হলেন লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী এ পথে খুব কম সময়েই লোক চলাচল করত।

আল্লাহর রাসূল এ পথে যেসব স্থান অতিক্রম করেছেন ইবনে ইসহাক তার উল্লেখ করেছেন তিনি বলেছেন পথ প্রদর্শক যখন তাদের নিয়ে বের হলেন, তখন মক্কার নিম্ন ভূমি এলাকা দিয়ে অতিক্রম করলেন, উপকূল দিয়ে চলার পর আসফানের নিচু এলাকায় বাক ঘুরলেন, সানিয়াতুল মুররা দিয়ে তারপর লকফ হয়ে লকফের বিস্তীর্ণ ভূমি অতিক্রম করলেন এরপর হেজাজের বিস্তীর্ণ ভূমিতে পৌঁছে এবং সেখান থেকে মুজাহের মোড় দিয়ে শস্যশ্যামল ভূমিতে গমন করেন তারপর যি কেশরার মাঠে প্রবেশ করে জুদাজাদের দিকে যান এবং সেখান থেকে আজদে পৌছেছেন, এরপর তাহানের বিস্তীর্ণ এলাকার পাশ দিয়ে যুযালাম অতিক্রম করেন, সেখান থেকে আবাদি, তারপর ফাজা অভিমুখে রওয়ানা হন তারপর অবতরণ করেন আজরে পরে রকুবার ডান পাশ দিয়ে লানিয়াতুল আযেরে গেলেন এবং রিম উপত্যকায় অবতরণ করেন সবশেষে কোবায় গিয়ে পৌঁছলেন ইবনে হিশাম (ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯১, ৪৯২)।

পথের কয়েকটি ঘটনা

এক) সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন গারে ছুর থেকে বেরিয়ে আমরা সারারাত ধরে পথ চলেছি পরদিন দুপুর পর্যন্তও চলেছি ঠিক দুপুরের রাস্তায় কোন পথচারী ছিল না, আমরা এ সময় একটা লম্বালম্বি প্রান্তর দেখতে পেলাম এখানে রোদ নেই আমরা সেখানে অবতরণ করলাম নিজের হাতে আমি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করলাম, এরপর সেখানে চাদর বিছালাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আপনি শয়ন করুন, বিশ্রাম নিন, আমি আশেপাশে খেয়াল রাখছি, নবীজি শুয়ে পড়লেন, আমি চারিদিকে নজর রাখলাম হঠাৎ দেখি একজন রাখাল কিছু সংখ্যক বকরি নিয়ে এদিকেই আসছে, সে প্রান্তরের ছায়ায় আসছিল, আমি তাকে বললাম, তোমার বকরির কি কিছু দুধ হবে? সে বলর হ্যাঁ, আমি বললাম, দোহন করতে পারি? সে বলল হ্যাঁ, এ কথা বলে সে একটি বকরি ধরে আনল, আমি বললাম মাটি খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলান একটু পরিষ্কার করে দাও, পরিষ্কার করার পর একটি পেয়ালায় কিচু দুধ দোহন করে দিল, আমার কাছে ছিল একটি চামড়ার পাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওযু এবং পানি পান করার জন্য সেটি রেখেছিলাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দেখি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন তাকে জাগানো সমীচীন মনে করলাম না, কিছুক্ষণ পর তিনি ঘুম থেকে জাগলেন, দুধের সাথে কিছু পানি মেশালাম, এতে পাত্রের নীচের অংশ ঠান্ডা হয়ে গেল, তাকে বললাম আপনি এ দুধটুকু পান করুন তিনি পান করে খুশী হলেন, এরপর বললেন, এখনো কি রওয়ানা হওয়ার সময় আসেনি? আমি বললাম কেন নয়? এরপর আমরা আবার রওয়ানা হলাম (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।

দুই) এ সফরের সময় হযরত আবু বকর (রা.)রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে বসতেন, পথচারীদের দৃষ্টি তার দিকেই প্রথমে যেত, কারণ তার চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ ছিল, তার তুলনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কমবয়সী মনে হচ্ছিল, পথচারীদের কেউ যখন জিজ্ঞাসা করত যে, আপনার সামনে উনি কে? হযরত আবু বকর (রা.) জবাব দিতেন যে, উনি আমাকে পথ দেখান, প্রশ্নকারী বুঝতো যে মরুভূমিতে পথ দেখাচ্ছেন, প্রকৃতপক্ষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নেকী ও কল্যাণের পথের কথাই বোঝাতেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।

তিন) এই সফরের সময় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে মাবাদ খোযায়ার তাবুতে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা বিরতি করেন, এই মহিলা খুব বুদ্ধিমতী নিজের বাড়ীতে আঙ্গিনায় তিনি বসেছিলেন, যাতায়াতকারী পথচারীদের সাধ্যমত পানাহার করাতেন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে? মহিলা বললেন, যদি কিছু থাকতো তবে আপনাদের মেহমানদারিতে ত্রুটি করতাম না, কয়েকটি বকরি আছে, যগুলো দূরে চারণভূমিতে রয়েছে, এখন দুর্ভিক্ষের সময় চলছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লক্ষ্য করলেন যে, বাড়ীর এক পাশে একটি বকরি বাধা আছে, তিনি বললেন, উম্মে মাবাদ, এ বকরি এখানে কেন? উম্মে মাবাদ বললেন, এ বকরি খুব দুর্বল, হাটতে পারে না, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অনুমতি যদি দাও, তবে ওর দুধ দোহন করি? মহিলা বললেন, হা, যদি দুধ দেখতে পান, অবশ্যই দোহন করুন একথার পর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বকরির ওলানে হাত লাগালেন আল্লাহর নাম নিলেন এবং দোয়া করলেন বকরি সাথে সাথে পা প্রসারিত করে দাড়াল, তার ওলানে ভরা দুধ, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি বড় পাত্র নিয়ে সেই পাত্রে দুধ দোহন করলেন, সেই পাত্র ভর্তি দুধ এক দল লোক তৃপ্তির সাথে পান করতে পারতো, দুধ দোহনের পর পাত্রে ফেনা ভরে গেল, সঙ্গীদের পান করালেন উম্মে মাবাদ নিজে পান করলেন, এরপর সেই পাত্রে পুনরায় দুধ দোহন করলেন, সেই পাত্র ভর্তি দুধ উম্মে মাবাদের ঘরে রেখে আল্লাহর রাসূল গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলেন।

কিছুক্ষণ পর মহিলার স্বামী বকরির পাল নিয়ে বাড়ী ফিরলো, সেসব বকরিও দুর্বল, পথ চলতে ক্লান্তিতে হাঁপিয়ে ওঠে উম্মে মাবাদের স্বামী আবু মাবাদ দুধ দেখে তো অবাক! জিজ্ঞাসা করলেন, দুধ পেলে কোথায়? সব দুগ্ধবতী বকরি তো আমি চারণ ভূমিতে নিয়ে গেছি, ঘরে তো দুধ দেয়ার মত বকরি ছিল না, উম্মে মাবাদ বললেন, আমাদের কাছে একজন বরকত সম্পন্ন মানুষ এসেছিলেন তার কথা ছিলো এমন এবং তার অবস্থা ছিল এমন, সব শুনে আবু মাবাদ বললেন, এই তো মনে হয় সেই ব্যক্তি, যাকে কোরাইশরা খুঁজে বেড়াচ্ছে, আচ্ছা তুমি তার আকৃতি প্রকৃতি একটু বল, উম্মে মাবাদ অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিচয় বর্ণনা করলেন, সে বর্ণনা ভঙ্গি শুনে মনে হয় শ্রোতা যেন তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, গ্রন্থের শেষ দিকে এইসব বিবরণ উল্লেখ করা হবে, আগন্তুকের ভূয়সী প্রশংসা শুনে সে বলল, আল্লাহর শপথ এই হচ্ছে কোরাইশদের সেই ব্যক্তি, যার সম্পর্কে লোকেরা না কথা বর্ণনা করেছে, আমার ইচ্ছা হতে তার প্রিয় সঙ্গীদের একজন হব, যদি কোন পথ পাই তবে অবশ্যই এটা করবো।

এদিকে মক্কার বাতাসে কবিতার ছন্দে কিছু কথা ভেসে আসছিল, যিনি কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, তাকে দেখা যাচ্ছিল না, কবিতার অর্থ নিম্নরূপ,

আল্লাহর পুরস্কার লাভ করুন সেই দুজন

উম্মে মাবাদের বাড়ীতে যারা করলেন পদার্পণ

ভালোয় ভালোয় থেমেছিলেন, যাত্রা করলেন, ফের সফলকাম হয়েছেন

তিনি সঙ্গী যিনি মোহাম্মাদের

হায় কুসাই তোমাদের থেকে

নজিরবিহীন সাফল্য এবং নেতৃত্ব নিলেন আল্লাহ কেড়ে

বুন কাব এর সেই মহিলা আহা কি যে ভাগ্যবান

মোবারক হোক মোমেনিনের জন্য সেই বাসস্থান

বকরির কথা পাত্রের কথা মহিলার কাছে জানতে চাও

সেই বকরিও সাক্ষী দেবে, তোমরা বকরির কাছে যাও

হযরত আসমা (রা.) বলেন আমাদের জানা ছিল না যে, আল্লাহর রাসূল কোনদিকে গেছেন হঠাৎ একটি জিন মক্কায় এসে এসব কবিতা শোনাল, উৎসাহী জনতা সেই জিনকে পাচ্ছিল না, তারা শব্দের পেছনে ছুটে যাচ্ছিল, শব্দ শুনছিল এক সময় সেই শব্দ মক্কার উঁচু এলাকায় মিলিয়ে গেল, সেই কবিতা শুনে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনদিকে গেছেন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তিনি মদিনার পথে রয়েছেন (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৩ ৫৪ বনু খোজাআ গোত্রের অবস্থানের কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এ ঘটনা প্রিয় নবী (সা.) এর মদিনা রওয়ানা হওয়ার দ্বিতীয় দিনে ঘটেছিল)।

চার) পথে ছোরাকা ইবনে মালেক প্রিয় নবী এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে অনুসরণ করেছিলেন ছোরাকার বর্ণিত ঘটনা নিম্নরূপ, আমি আমার কাওম বনি মুদলেজের এক মজলিসে বসেছিলাম এমন সময় একজন লোক এসে আমাদের কাছে দাড়াল, কিছুক্ষণ পর বসল, সেই লোকটি বলল, ওহে ছোরাকা একটু আগে আমি উপকূলের কাছে কয়েকজন লোক দেখলাম, আমার ধারনা তিনি মোহাম্মাদ এবং তার সাথী ছোরাকা বলল, আমি বুঝতে পারলাম যে এরাই তারা কিন্তু যে লোকটি খবর দিয়েছিল, তার কাছে মনোভাব গোপন রাখার জন্য বললাম না না ওরা তারা নয় তুমি যাদের দেখেছ তাদের তো আমরাও দেখেছি তারা আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গেছে, এরপর আমি মজলিসে কিছুক্ষণ বসে কাটালাম, তারপর ঘরের ভেতর গিয়ে আমার দাসীকে আমার ঘোড়া বের করতে বললাম, ঘোড়া বের করার পর তাকে বললাম, টিলার পেছনে নিয়ে যাও এবং সেখানে অপেক্ষা কর, আমি আসছি, এরপর আমি তীর নিলাম, ঘরের পেছন দিয়ে বাইরে বের হলাম, তীরের এক প্রান্ত ধরে অপর প্রান্ত মাটিতে হেঁচড়ে আমি ঘোড়ার কাছে গেলাম ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলে ঘোড়া আমাকে নিয়ে ছুটতে লাগল, এক সময় আমি উপকূলীয় এলাকায় তাদের কাছে এসে পৌঁছলাম, হঠাৎ ঘোড়া লাফাতে শুরু করল, আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলাম, পুনরায় আমি ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করলাম এবং তূন এর দিকে হাত বাড়ালাম এবং পাশার তীর বের করে জানতে চাইলাম, তাকে বিপদে ফেলতে পারব কিনা, কিন্তু যে তীর বের হল সেটি আমার অপছন্দনীয় আমি লক্ষ্য করলাম যে, আল্লাহর রাসূল নির্বিকারভাবে একাগ্রচিত্তে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন, কোনদিকেই তার খেয়াল নেই, আবু বকর সিদ্দিক পেছন ফিরে আমাকে দেখছিলেন হঠাৎ আমার ঘোড়ার সামনের পা দুখানি মাটিতে দেবে গেল, হাঁটু পর্যন্ত দেবে গেল এক সময় আমি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলাম, ঘোড়াকে শাসন করলাম ঘোড়া উঠতে চাইল, অনেক কষ্টে ঘোড়া নিজের পা উপরে তুলল, ঘোড়া পা তুললে তার পায়ের নিশানা থেকে ধোয়ার মতো ধুলো উড়ছিল, আমি তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করলাম, এবার ও এমন তীর বের হল, যা আমি চাইনি, এরপর আমি স্বাভাবিক কন্ঠে তাদের ডাক দিলাম, তারা থামলেন, ঘোড়ার পিঠে করে আমি তাদের কাছে পৌঁছলাম যখনই আমি তাদের থামালাম, তখনিই হঠাৎ আমার মনে হল আল্লাহর রাসূলই বিজয়ী হবেন, আমি তখন আল্লাহর রাসূলকে বললাম, আপনার স্বজাতীয়রা আপনার জীবনের পরিবর্তে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, সাথে সাথে মক্কার লোকদের সংকল্প সম্পর্কেও আমি তাকে অবহিত করলাম, তাকে পথের কিছু সম্বলও দিতে চাইলাম কিন্তু তিনি কিছুই নিলেন না এবং আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসাও করলেন না, শুধু বললেন আমাদের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা কর, তাকে বললাম, আপনি আমাকে নিরাপত্তা পরোয়ানা লিখে দিন, আল্লাহর রাসূল তখনই আমের ইবনে ফোহায়রাকে আদেশ দিলেন আমের নিরাপত্তার পরোয়ানা স্বরূপ এক টুকরো চামড়ায় কিছু কথা লিখে আমাকে দিলেন, এরপর আল্লাহর রাসূল সামনে অগ্রসর হলেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪, বনি মুদলেজদের জন্মস্থান ছিল বাবেগের কাছে ছোয়াক যে সময় অনুসরণ করছিল, সে সময় প্রিয় নবী (সা.) কোদায়েদ থেকে উপরের দিকে উঠছিলেন, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৩ গারে ছুর থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে এ ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে হয়)।

এ ঘটনা সম্পর্কে হযরত আবু বকরের একটি বর্ণনা রয়েছে তিনি বলেন, আমরা রওয়ানা হওয়ার পর কওমের লোকেরা আমাদের তালাশ করছিল, কিন্তু ছোরাকা ইবনে মালেক ইবনে জুশুম ছাড়া কেউ আমাদের দেখতে পায়নি ছোরাকা ঘোড়ায় চড়ে এসেছিল, আমি বললাম, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি লোক আমাদের পিছু লেগেছে, সে কাছাকাছি এসে পড়েছে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে সাথে বললেন, লা তাহযান ইন্নাল্লাহ মাআনা অর্থাৎ ভয় পেয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬)।

ছোরাকা মক্কায় ফিরে এসে দেখতে পেল তখনো অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, আল্লাহর রাসূলকে সে যে পথে দেখেছে, সেদিকে কিছু লোককে দেখে ছোরাকা বলল, ওদিকে তোমাদের যে কাজ ছিল সেটা হয়ে গেছে, দিনের শুরুতে যে লোক ছিল সন্ধানকারীদের একজন দিনের শেষে সেই ব্যক্তিই হয়ে গেল আমানতদার (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫১৬)।

পাঁচ) পথে বুরাইদা আসলামির সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ হল, এই লোক ছিল তার কওমের সর্দার, কোরাইশদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে এই লোকও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) এর সন্ধানে বের হয়েছিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলার সাথে সাথে তার মনে ভাবান্তর হল, তিনি নিজ গোত্রের ৭০জন লোকসহ সেখানেই ইসলাম গ্রহণ করলেন এরপর পাগড়ি খুলে বর্শায় বেধে দোলাতে দোলাতে সুসংবাদ শোনালেন যে, শান্তির বাদশাহ, সমঝোতার পথিকৃৎ, পৃথিবীকে ন্যায় বিচার ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করার অগ্রপথিক আগমন করছেন (রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ.১০১)।

ছয়) মদিনা যাওয়ার পথে হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়ামের (রা.) সাথে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখা হল, তিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া থেকে ফিরছিলেন, তিনি প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আবু বকর (রা.) কে কিছু জিনিস উপহার দেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৪)।

কোবায় অবস্থান

নবুয়তের চতুর্দশ বছরের ৪ই রবিউল আউয়াল অর্থাৎ ১লা হিজরি মোতাবেক ২৩শে সেপ্টেম্বর ৬২২ ঈসায়ী সালের সোমবার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোবায় অবতরণ করেন (রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২ সেই তারিখে প্রিয় রাসূল (সা.) এর বয়স পুরোপুরি তেপ্পান্ন বছর পূর্ণ হয়েছিল, যারা হস্তী যুদ্ধের ঘটনার বছর হিসেবে ৯ই রবিউল আউয়াল ৪১ সালের হিসাবে নবুয়তের হিসাব করেন, তাদের হিসাব মতে এ তারিখে নবুয়তের ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছিল, আর যারা হস্তী যুদ্ধের ঘটনার হিসাব ৪৯ সালের রমযান মাসে তার নবুয়তের শুরু মনে করেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী এ তারিখে তার নবুয়তের বয়স ১২ বছর ৫ মাস ১২ দিন বা ২২ দিন)।

হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, মদিনার মুসলমানরা মক্কা থেকে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওয়ানা হওয়ার খবর জেনেছিলেন এ কারণে মদিনার বাইরে হাররার নামক স্থানে এসে প্রতিদিন তারা অপেক্ষা করতেন দুপুরের রোদ অসহ্য হয়ে উঠলে ফিরে যেতেন একদিন এমনি করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সবাই ঘরে ফিরে গেছেন এ সময় একজন ইহুদী ব্যক্তিগত কাজে একটি টিলার উপর উঠেছিল, হঠাৎ সে সাদা কাপড়ের তৈরি চাঁদোয়া লক্ষ্য করল, আনন্দের আতিশয্যে সে চিৎকার করে বলতে লাগল, শোন মুসলমানরা, শোন, তোমরা যার জন্যে প্রতিদিন অপেক্ষা করছিলে, তিনি আসছেন একথা শোনা মাত্রই মুসলমানরা ছুটে এল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বেরিয়ে পড়ল (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫)।

ইবনে কাইয়েম বলেন, ঘোষণার সাথে সাথে বনি আমর ইবনে আওফের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল এবং তকবির ধ্বনি শোনা গেল, মুসলমানরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অভ্যর্থনা জানালো এবং চারপাশে ভিড় করতে লাগল, সে সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন নীরব, তার ওপর তখন কোরআনের এই আয়াত নাযিল হচ্ছিল, কিন্তু তোমরা যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে একে অপরের পৃষ্ঠপোষকতা কর, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ তায়ালাই তার বন্ধু, জিবরাঈল ও সৎকর্মপরায়ন মোমেনরা উপরন্তু অন্যান্য ফেরেশতারাও তার সাহায্যকারী, (সুরা তাহরীম, আয়াত ৪)।

হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়ের (রা.) বলেন, লোকদের সাথে মিলিত হওয়ার পর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে ডানদিকে অগ্রসর হলেন এবং বনি আমর ইবনে আওফের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলেন, এ দিন ছিল সোমবার, মাস ছিল রবিউল আউয়াল, হযরত আবু বকর (রা.) আগন্তুকদের অভ্যর্থনা জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, আর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপচাপ বসেছিলেন।

আনসারদের মধ্যে যারা ইতিপূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেননি তারা হযরত আবু বকর (রা.) কে সালাম করছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গায়ের উপর ঢলে পড়া সূর্যের কিরণ এসে পড়লে হযরত আবু বকর (রা.) একখানি চাদর দিয়ে তাকে ছায়া করে দাঁড়ালেন, এতে সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে চিনতে পারলেন(সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যর্থনার জন্য মদিনায় জনতার ঢল নামলো, এটি ছিল এক ঐতিহাসিক দিন মদিনার মাটি এ ধরনের দৃশ্য অতীতে কোনদিন দেখেনি, ইহুদীরাও প্রতিশ্রুত নবীর আগমন প্রত্যক্ষ করল, বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ দক্ষিণ দিক থেকে তার আগমন ঘটাবেন এবং যিনি পবিত্র, তিনি ফারান পর্বত থেকে আগমন করবেন(বাইবেল হাবকুক অধ্যায় পৃ. ৩)।

রাসূল মদিনায় কুলসুম ইবনে হাদাম, মতান্তরে সায়াদ ইবনে খায়ছামার ঘরে অবস্থান করেন তবে প্রথম তথ্যটি অধিক নির্ভরযোগ্য।

ইতিমধ্যে হযরত আলী (রা.) মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে মানুষের আমানতসমূহ বুঝিয়ে দিয়ে মদিনায় আসেন(যাদুল মায়াদ, ১য় খন্ড, পৃ. ৫৪ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৩, রহমতুল লিল আলামিন)।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোবায় মোট চারদিন (এটা ইবনে ইসহাকের বর্ণনা, ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৪ দেখুন, এই বর্ণনাই আল্লামা মনসুরপুরী গ্রহন করেছেন, রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২, কিন্তু সহীহ বোখারীর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, প্রিয় রাসূল সেখানে ২৪ রাত অবস্থান করেন, ১ম খন্ড, পৃ. ৬১, অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে ১০ রাতের চেয়ে কিছু বেশীর কথা রয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫ তৃতীয় এক বর্ণনায় ১৪ রাতের কথা রয়েছে, ১ম খন্ড, পৃ. ৫৬০ ইবনে কাউয়েম শেষোক্ত বর্ণনা গ্রহন করেছেন, কিন্তু ইবনে কাউয়েম ব্যাখ্যা করেছেন যে, প্রিয় নবী সোমবার কোবায় পৌঁছেছেন এবং শুক্রবার সেখান থেকে রওয়ানা হয়েছেন, যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫৪-৫৫ সোমবার ও শুক্রবার যদি পৃথক দুই সপ্তাহের নেয়া হয় তবে পথের দিনগুলো ছাড়া মোট ১০ দিন হয়, পথের সময়সহ ১২ দিন এমতাবস্থায় ১৪ দিন কি করে হবে?) সোম, মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার অবস্থান করেন, কারো কারো মতে ১০ দিন কারো কারো মতে রওয়ানা ও পথের কয়েকদিন ছাড়া কোবায় ২৪ দিন অবস্থান করেন এ সময়ে তিনি মসজিদে কোবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন এবং সেই মসজিদে নামায আদায় করেন, নবুয়ত প্রাপ্তির পর এটি ছিলো প্রথম মসজিদ, তাকওয়ার ওপর এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল, পঞ্চম, দ্বাদশ বা ২৬ তম দিনের শুক্রবারে তিনি আল্লাহর নির্দেশে সওয়ারীর ওপর আরোহণ করেন, রওয়ানা হওয়ার আগে তিনি তার মামার গোত্র বুন নাজ্জাহকে খবর পাঠালে তারা তলোয়ার সজ্জিত হয়ে হাজির হল, তিনি তাদের সাথে নিয়ে মদিনার পথে রওয়ানা হলেন, বনু সালেম ইবনে আওফের জনপদে পৌছার পর জুমার নামাযের সময় হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকালয়ে জুমার নামায আদায় করলেন, জুমার জামাতে একশ মুসল্লি হাযির হয়েছিলেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৫, ৫৬০ যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫ ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৯৪ রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০২), এখনো সেখানে এ মসজিদ রয়েছে।

রাসূলুল্লাহর মদিনায় প্রবেশ

জুমার নামায আদায়ের পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা গমন করেন, সেদিন থেকে ইয়াসরেবের নাম হয়েছে মদীনাতুর রাসূল, বা শহরে রাসূল সংক্ষেপে মদিনা এই দিন ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় দিন চারদিকে আল্লাহর প্রশংসা ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল আনসার শিশুরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এ গান গাইছিল,

দক্ষিণের সেই পাহাড় থেকে, উদয় হল মোদের ওপর চতুর্দশীর চাঁদ

শোকরিয়া আদায় করা আল্লাহর, কর্তব্য মোদের সকলের

তোমার আদেশ পালন আর আনুগত্য, কর্তব্য মোদের সকলের, পাঠিয়েছেন তোমায় আল্লাহ সর্বশক্তিমান (কবিতার এ তরজমা আল্লামা মনসুরপুরী করেছেন আল্লামা ইবনে কাইয়েম লিখেছেন এই কবিতা তবুক থেকে রাসূলের ফেরার সময় আবৃত্তি করা হয়েছিল, যিনি বলেন যে, মদিনায় নবী (সা.) এর প্রবেশের সময়েই শুধু এ কবিতা পড়া হয়েছে একথাকে তিনি ভুল বলেছেন, যাদুল মায়াদ, ৩য় খন্ড, পৃ.১০ তবে আল্লামা ইবনে কাইয়েম ভুল বললেও নির্ভরযোগ্য যুক্ত প্রমাণ দিতে পারেন নি, পক্ষান্তরে আল্লামা মনসুরপুরী একথাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন যে, এ কবিতা মদিনায় প্রবেশের সময় পড়া হয়েছিল, তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য যুক্ত প্রমাণও রয়েছে দেখুন রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০৬)।

আনসাররা ধনী বা বিত্তশালী ছিলেন না, কিন্তু সবাই চাচ্ছিলেন যে, নবী তার বাড়ীতেই অবস্থান করবেন, যে এলাকা দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন সেখানের লোকেরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটের রশি ধরে তার বাড়ীতে আসার আবেদন জানাতেন, কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে দিলেন যে, উটনীর পথ ছেড়ে দাও, সে আল্লাহর তরফ থেকে আদেশ পেয়েছে এরপর উটনী ইচ্ছামত চলতে লাগলো এবং বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী রয়েছে সেখানে গিয়ে থামল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনী থেকে নামলেন না, উটনী সামনে কিছুদূরে এগিয়ে গেল, এরপর পুনরায় ঘুরে আগের জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়ল এটা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নানাদের মহল্লা অর্থাৎ বনু নাজ্জারদের মহল্লা উটনীকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়ায় সে বনু নাজ্জার এলাকায় থেমে নানাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মনে মনে এটাই চাচ্ছিলেন এবার বনু নাজ্জার গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়ীতে নিয়ে তাকে যাওয়ার জন্য আবেদন নিবেদন শুরু করল, আবু আইয়ুব আনসারী এগিয়ে এসে উটের লাগাম ধরলেন এবং তার বাড়ীতে নিয়ে গেলেন, এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মানুষ তার উটের পালানের সঙ্গে রয়েছে এরপর হযরত আসআদ ইবনে যোরারাহ এসে উটনীর লাগাম ধরলেন উটনী তখন থেকেই তার নিয়ন্ত্রণেই থাকল (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. রহমাতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ. ১০৬)।

সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের মধ্যে কার ঘর সবচেয়ে কাছে? হযরত আবু আইয়ুব আনসারী বললেন, আমার ঘর হে আল্লাহর রাসূল, এই হচ্ছে আমার ঘর, আর এই আমার দরজা, আল্লাহর রাসূল বললেন যাও আমাদের জন্য কাইলুলা অর্থাৎ মধ্যাহ্নর বিশ্রামের ব্যবস্থা কর, আবু আইয়ুব বললেন, আপনারা উভয়ে আসুন, আল্লাহ তায়ালা বরকত দেবেন (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৫৬)।

কয়েকদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী উম্মুল মোমেনীন হযরত সাওদা, দুই কন্যা ফাতেমা ও উম্মে কুলসুম, ওসামা ইবনে যায়েদ এবং উম্মে আরমানও এসে পড়লেন, এদের সবাইকে হযরত আবু বকরের পরিবারের সাথে আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর মদিনায় নিয়ে আসেন, হযরত আয়েশা (রা.) ও এদের সঙ্গে ছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক কন্যা হযরত যয়নব হযরত আবুল আস এর কাছে রয়ে গেলেন, তিনি তখন আসতে দেননি, তিনি বদরের যুদ্ধের পর আগমন করেন (যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ. ৫৫)।

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, প্রিয় রাসূল (সা.) মদিনায় আসার পর হযরত আবু বকর এবং হযরত বেলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হলেন, আমি তাদের কাছে গিয়ে বললাম, আব্বাজান আপনি কেমন আছেন? বেলাল (রা.) আপনি কেমন আছেন? হযরত আবু বকরের জ্বর এলে তিনি এ কবিতা আবৃতি করতেন,

পরিবারের সদস্যদের সবাই বলে সুপ্রভাত

কেই ভাবে না জুতোর ফিতার চেয়েও তার মরণ কাছে

হযরত বেলাল (রা.) কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তার সুরেলা কন্ঠে আবৃত্তি করলেন,

জানতাম যদি রাত্রি যাপন করবো আমি মক্কার প্রান্তরে চারিপাশে রবে ইযখিরও জালির (ঘাস), মার্জিন্নার ঝর্ণার ধারে যেতে পারব কিনা জানি না, সামা আর তোফায়েল পাহাড় দেখতে কি পাব?

হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছাকাছি গিয়ে এ খবর দিলাম, তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা, মক্কা যেমন আমাদের কাছে প্রিয় ছিল, মদিনাকেও তেমন প্রিয় করে দাও, বরঞ্চ মদিনার পরিবেশ ও আবহাওয়া তার চেয়ে বেশী স্বাস্থ্যকর করে দাও, এখানে শস্যের মধ্যে বরকত দাও, এখান থেকে অসুখ জাহফায়ে সরিয়ে নাও (সহীহ বোখারী ১ম খন্ড, পৃ. ৫৮৮-৫৮৯) আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীর দোয়া কবুল করলেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হল।

এ পর্যন্ত প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের এক অংশ এবং ইসলামী দাওয়াতের মক্কী যুগ পূর্ণ হয়ে গেল।

আমি যদি এদের (আমার) জমিনে (রাজনৈতিক) প্রতিষ্ঠা দান করি, তাহলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে, (অবশ্য) সব কাজের চূড়ান্ত পরিণাম কিন্তু আল্লাহ তায়ালাই এখতিয়ার ভূক্ত (সূরা হজ্জ ৪১)।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি