মহাবিজয়ের দার প্রান্তেঃ আজ কোনো প্রতিশোধ নয়
মক্কা বিজয়

ইমাম ইবনে কাইয়েম লিখেছেন, এটা সেই মহান বিজয়, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দ্বীনের আমানতদারদের মর্যাদা দান করেছেন। এছাড়া তাঁর শহর ও ঘর-যে ঘরকে দুনিয়ার মানুষের হেদায়তের মাধ্যম করেছিলেন, সেই ঘরকে কাফের, মোশরেকদের হাত থেকে মুক্ত করেন। এই বিজয়ের দরুন আকাশের অধিবাসীদের মধ্যে আনন্দের ঢল বয়ে যায়। এই বিজয়ের ফলে আল্লাহর দ্বীনে মানুষ দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে এবং বিশ্বজগতের চেহারা খুশীতে চক চক করে ওঠে।১[যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ.১৬০]

অভিযানের কারণ

হোদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কিত আলোচনায় একথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সন্ধির একটি ধারা এরূপ ছিলো যে, যে কেউ ইচ্ছা করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা কোরায়শদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হতে পারবে।

যিনি যে দলে যুক্ত হবেন তিনি সেই দলের অংশ বলেই বিবেচিত হবেন। কেউ যদি হামলা বা অন্য কোন প্রকার বাড়াবাড়ি করে তা সে দলের ওপর হামলা বলে গণ্য হবে।

এই চুক্তির মাধ্যমে বনু খোজাআ গোত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো। আবু বকর গোত্র আবদ্ধ হয়েছিলো কোরায়শদের মিত্রতার বন্ধনে। এমনি করে উভয় গোত্র পরস্পর থেকে নিরাপদ হয়েছিলো। কিন্তু আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় থেকেই উভয় গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিবাদ বিসম্বাদ চলে আসছিলো। পরবর্তীকালে ইসলামের আবির্ভাব এবং হোদায়বিয়ার সন্ধির পর বিবদমান উভয় গোত্র পরস্পরের ব্যাপারে নিরাপদ ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো। বনু বকর গোত্র এই চুক্তির সুযোগকে গণীমত মনে করে বনু খোযাআ গোত্রের ওপর থেকে পুরানো শত্রুতার প্রতিশোধ গ্রহণে প্রস্তুত হলো। নওফেল ইবনে মাবিয়া দয়লি বনু বকরের একটি দলের সাথে শাবান মাসের ৮ তারিখে বনু খোযাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়। সেই সময় বনু খোযাআ গোত্রের লোকেরা ওয়াতের নামে একটি জলাশয়ের পাশে অবস্থান করছিলো। আকস্মিক হামলায় বনু খোযাআ গোত্রের কয়েকজন লোক মারা যায়। উভয়ের মধ্যে পরে সংঘর্ষ ও হয়। কোরায়শরা এই হামলায় বনু বকর গোত্রকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। কোরাইশদের কিছু লোক রাতে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে বনু বকর গোত্রের সাথে মিশে গিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলাও করে। আততায়ীরা বনু খোযাআ গোত্রের লোকদের তাড়িয়ে হরমের কাছাকাছি নিয়ে যায়। সেখানে বনু বকর গোত্রের লোকেরা বললো, হে নওফেল, এবার তো আমরা হরম শরীফে প্রবেশ করবো। তোমদের মাবুদ, তোমাদের ইবাদত। একথার জবাবে নওফেল বললো,‘আজ কোন মাবুদ নেই। তোমাদের প্রতিশোধ নিয়ে নাও। আমার বয়সের কসম তোমরা হরম শরীফে চুরি করতে পারো, তবে কি নিজেদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারো না?

এদিকে বনু খোজাআ গ্রোত্রের লোকেরা মক্বায় পৌঁছে বুদায়েল ইবনে ওরাকা, খোযায়ী এবং তার একজন মুক্ত করা ক্রীতদাস রাফের ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করলো। আমর ইবনে সালেম খাযায়ী সেখান থেকে বেরিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই সময় তিনি মসজিদে নববী সাহাবাদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। আমর ইবনে সালেম বললেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে তাঁর চুক্তি এবং তাঁর পিতার প্রাচীন অঙ্গীকারের ২[বনু খোজাআ এবং বনু আবদুল মুত্তালবের মধ্যে বহু পূর্ব থেকে চলে আসা অঙ্গীকারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে] দোহাই দিচ্ছি। হে রসূল, আপনারা ছিলেন সন্তান আর আমর ছিলাম জন্মদানকারী। ৩[এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আবদে মান্নাফের মা অর্থাৎ কুসাই এর স্ত্রী হাব্বি ছিলেন বুন খোজাআ গোত্রের মেয়ে। এ কারণে সমগ্র নবী পরিবারকে বনু খোজাআ গোত্রের সন্তান বলা হয়েছে ।] এরপর আমরা আনুগত্য গ্রহণ করেছি এবং কখনো অবাধ্যতা প্রদর্শন করিনি। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে হেদায়াত দান করুন। আপনি সর্বাত্মক সাহায্য করুন, আল্লাহর বান্দাদের ডাকুন, তার সাহায্যের জন্যে আসবে। এদের মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও থাকবেন, উদিত চতুর্দশীর চাঁদের মতো সুন্দর। যদি তাঁর ওপর অত্যাচার করা হয়, তবে তাঁর চেহারা রক্তিম থমথমে হয়ে যায়। আপনি এমন এক দুর্ধর্ষ বাহিনীর মধ্যে যাবেন, যারা ফেনিল উচ্ছ্বাস সমুদ্রের মতো তরঙ্গায়িত থাকবে। নিশ্চিত জেনে রাখুন, কোরায়শরা আপনদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বরখেলাফ করেছে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। তারা আমার জন্যে কোদা নামক জায়গায় ফাঁদ পেতেছে এবং ধারণা করেছে যে, আমি কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকব না। অথচ তারা বড়ই কমিনা এবং সংখ্যায় অল্প। তারা আতর নামক জায়গায় রাতের অন্ধকারে হামলা করেছে এবং আমাদেরকে রুকু সেজদারত অবস্থায় হত্যা করেছে। অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, অথচ আমদের হত্যা করা হয়েছে।

রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অভিযোগ শোনার পর বললেন, হে আমর ইবনে সালেম, তোমায় সাহায্য করা হয়েছে। এরপর আকাশে এক টুকরো মেঘ দেখ গেলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই মেঘ বনু কা’ব এর সাহায্যের সুসংবাদ স্বরূপ আবির্ভূত হয়েছে।

এরপর বুদাইল ইবনে ওরাকা খোযায়ীর নেতৃত্বে বনু কোযাআ গোত্রের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানাই, কারা কারা নিহত হয়েছে। তারা আরো জানায় যে, কিভাবে কোরায়শরা বনু বকর গোত্রকে সাহায্য করেছে। এরপর তারা মক্কায় ফিরে যায়।

সন্ধি নবায়নের চেষ্টা

কোরায়শ এবং তার মিত্ররা যা করেছিলো সেটা ছিলো হোদায়বিয়ায় সন্ধির সুস্পষ্ট লংঘন এবং বিশ্বাসঘাতকতা। এর কোন বৈধতার অজুহাত দেখানো যাবে না। কোরায়শরাও সন্ধির বরখেলাফ করার কথা খুব শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলো। তারা এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম চিন্তা করে এক পরামর্শ সভা আহ্বান করলো। সেই সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা তাদের নেতা আবু সুফিয়ানকে হোদায়বিয়ার সন্ধির নবায়নের জন্যে মদীনায় পাঠাবে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোরায়শদের সন্ধি লংঘন পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে সাহাবাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে, আবু সুফিয়ান সন্ধি পোক্ত এবং মেয়াদ বাড়ানোর জন্যে মদীনায় এসে পৌঁছেছে।

এদিকে আবু সুফিয়ান মদীনার উদ্দেশ্যে ওসফান নামক জায়গায় পৌঁছার পর বুদাইল ইবনে ওরাকার সাথে তার দেখা হলো। বুদাইল মদীনা থেকে মক্বা যাচ্ছিলো।

আবু সুফিয়ান ভেবেছিলো বুদাইল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে আসছে। তবু জিজ্ঞাসা করলো, কোথা থেকে আসছো বুদাইল? বুদাইল বললেন, আমি খোযাআর সাথে ওই উপকূলে গিয়েছিলাম। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাস করলো, ‘তুমি কি মোহাম্মদের কাছে যাওনি?’ বুদাইল বললেন,‘না তো।‘ বুদাইল মক্কার পথে যাওয়ার পর আবু সুফিয়ান বললো, বুদাইল যদি মদীনায় গিয়ে থাকে, তবে তো তার উটকে মদীনার খেজুর খাইয়েছে। এরপর আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট বসানোর জায়গায় গিয়ে উটের পরিত্যক্ত মল ভেঙ্গে সেখানে মদীনার খেজুরের বীচি দেখতে পেলো। এরপর বললো, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, বুদাইল মোহাম্মদের কাছে গিয়েছিলো।

মোটকথা আবু সুফিয়ান মদীনায় গেলো এবং তার কন্যা উম্মে হাবিবার ঘরে গিয়ে উঠলো। আবু সুফিয়ান রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় বসতে যাচ্ছিলো। এটা লক্ষ্য করে হযরত উম্মে হাবিবা (রা.) সাথে সাথে বিছানা গুটিয়ে ফেললেন। আবু সুফিয়ান বললো, মা, তুমি আমাকে এ বিছানার উপযুক্ত মনে করোনি না এ বিছানাকে আমার উপযুক্ত মনে করোনি? আমার কাছ থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছো।

হযরত উম্মে হাবিবা (রা.)বললেন, এটি হচ্ছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানা আর আপনি হচ্ছেন একজন নাপাক মোশরেক। আবু সুফিয়ান বললেন, খোদার কসম, আমার কাছে থেকে আসার পর তুমি খারাপ হয়ে গেছো।

এরপর আবু সুফিয়ান সেখান থেকে বেরিযে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোন জবাব দিলেন না। আবু সুফিয়ান হযরত আবু বকরের কাছে গিয়ে তাকে অনুরোধ করলো, তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাতে আলোচনা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) অসম্মতি প্রকাশ করলেন। আবু সুফিয়ান হযরত ওমর (রা.)-এর কাছে গিয়ে তাকে বললো তিনি যেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের ব্যাপারে কথা বলেন। হযরত ওমর (রা.) বললেন, আমি কেন তোমাদের জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সুপারিশ করবো। আল্লাহর শপথ, যদি আমি কাঠের টুকরো ছাড়া অন্য কিছু নাও পাই তবু ও সেই কাষ্টখন্ড দিয়ে তোমদের সাথে জেহাদ করবো। আবু সুফিয়ান এরপর হযরত আলীর (রা.) কাছে গেলেন । হযরত ফাতেমা (রা.) সেখানে ছিলেন। হযরত হাসানও ছিলেন। তিনি ছিলেন তখন ছোট। হাঁটাচলা করছিলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, হে আলী, তোমার সাথে আমার বংশগত সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আমি একটা প্রয়োজনে এসেছি। হতাশ হয়ে এসেছি, হতাশ হয়ে ফিরে যেতে চাইনা। তুমি আমার জন্যে মোহাম্মদের কাছে একটু সুপারিশ করো। হযরত আলী (রা.) বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে আফসোস হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প করেছেন, এ ব্যাপারে আমরা তাঁর সাথে কোন কথা বলতে পারি না। আবু সুফিয়ান বিবি ফাতেমার (রা.) প্রতি তাকিয়ে বললেন, তুমি কি তোমার এ সন্তানকে এ মর্মে আদেশ করতে পারো যে, সে লোকদের মধ্যে আশ্রয়দানের ঘোষণা দিয়ে সব সময়ের জন্য আরবদের সর্দার হবে? হযরত ফাতেমা (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমার সন্তান লোকদের মধ্যে নেতা হওয়ার মতো ঘোষণা দেয়ার যোগ্য হয়নি। তাছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপস্থিতিতে কেউ আশ্রয় দিতে পারে না।

সকল চেষ্টার ব্যর্থতার পর আবু ‍সুফিয়ানের দু’চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেলো। তিনি সংশয় দোলায়িত চিত্তে কম্পিত কন্ঠে হযরত আলীকে (রা.) বললেন, আবুল হাসান আমি লক্ষ্য করছি যে, বিষয়টা জটিল হয়ে পড়েছে। কাজেই আমাকে একটা উপায় বলে দাও। হযরত আলী (রা.) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি তোমার জন্যে কল্যাণকর কিছু জানি না। তুমি বনু কেনানা গোত্রের নেতা। ‍তুমি দাঁড়িয়ে লোকদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করে দাও, এরপর নিজের দেশে ফিরে যাও। আবু সুফিয়ান বললেন, তুমি কি মনে করো যে, এটা আমার জন্যে কল্যাণকর হবে? হযরত আলী (রা,) বললেন না, আমি তা মনে করি না। তবে, এছাড়া অন্য কোন উপায়ও আছে বলে মনে হয় না। এরপর আবু সুফিয়ান মসজিদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হে লোকসকল, আমি তোমাদের মধ্যে নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করছি। এরপর নিজের উটের পিঠে চড়ে মক্কায় চলে গেলেন।

কোরায়শদের কাছে গেলে তারা তাকে ঘিরে ধরে এবং মদীনার খবর জানতে চাইল। আবু সুফিয়ান বললেন, কথা বলেছি কিন্তু তিনি কোন জবাব দেননি। আবু কোহাফার পুত্রের কছে গেছি তার মধ্যে ভাল কিছু পাইনি। ওমর ইবনে খাত্তাবের কাছে গেছি, তাকে মনে হয়েছে সবচেয়ে কট্টর দুশমন। আলীর কাছে গেলাম, তাকে সবচেয়ে নরম মনে হলো। তিনি আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন আমি সে অনুযায়ী কাজ করলাম। জানিনা সেটা কল্যাণকর হবে কিনা? লোকেরা জানতে চাইল সেটা কি? আবু সুফিয়ান বললেন, আলী পরামর্শ দিলেন আমি যেন নিরাপত্তার কথা ঘোষণা করি, অবশেষে আমি তাই করলাম।

কোরায়শরা বললো, মোহাম্মদ কি তোমার নিরাপত্তার ঘোষণাকে কার্যকর বলে ঘোষণা করেছে? আবু সুফিয়ান বললো, না তা করেনি। কোরায়শরা বললো তোমার সর্বনাশ হোক। আলী তোমার সাথে স্রেফ রসিকতা করেছে। আবু সুফিয়ান বললো, আল্লাহর শপথ, এছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।

মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি তিবরানির বর্ণনা থেকে জানা যায়, কোরায়শদের বিশ্বাসঘাতকতার খবর আসার তিনদিন আগেই রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.) –কে তাঁর সাজ-সরঞ্জাম প্রস্তুত করতে বলেছিলেন। তবে, বিষয়টি গোপন রাখার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত আয়েশার (রা.) কাছে বললেন, মা এ প্রস্তুতি কিসের? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, আমি জানি না আব্বা। হযরত আবু বকর বললেন, এটাতো রোমকদের সাথে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন দিকে যাওয়ার ইচ্ছা করেছেন? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন, আমি জানিনা আব্বা। তৃতীয় দিন সকালে হযরত আমর ইবনে সালেম খাযায়ী ৪০ জন সওয়ারসহ এসে পৌঁছলেন। তিনি কয়েক লাইন কবিত আবৃতি করলেন। এতে শ্রোতারা বুঝতে পারলেন যে, কোরায়শরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরপর বুদাইল এলেন। এরপর এলো আবু সুফিয়ান। এর ফলে সাহাবারা পরিস্থিতি উপলব্ধি করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, মক্কায় যেতে হবে। সাথে সাথে এ দোয়া করলেন, হে আল্লাহ তায়ালা গোয়েন্দা এবং কোরায়শদের কাছে আমাদের যাওয়ার খবর যেন পৌঁছাতে না পারে, তুমি তার ব্যবস্থা করো। আমরা যেন মক্কাবাসীদের কাছাকাছি যাওয়ার আগে তারা যেন বুঝতে না পারে, জানতেও না পারে।

গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীর রমজান মাসে হযরত আবু কাতাদা ইবনে রাবঈর নেতৃত্বে আটজন সাহাবীকে এক ছারিয়্যায় বাতনে আযাম নামক জায়গায় প্রেরণ করেন। এই জায়গা যি-খাশাব এবং যিল মাররার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এর দূরত্ব মদীনা থেকে ৩৬ মাইল।

এই ক্ষুদ্র সেনাদল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, যারা বোঝার তার বুঝবে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত জায়গায় যাবেন। চারিদিকে এই খবরই ছড়িয়ে পড়বে। এ ক্ষুদ্র সেনাদল উল্লিখিত জায়গায় পৌঁছার পর খবর পেলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অভিমুকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। এ খবর পাওয়ার পর তারাও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কাফেলার সাথে গিয়ে মিলিত হলো।৪[এটি সেই ছারিয়্যা যার সাথে আমের ইবনে আজবাতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমের ইসলামী রীতি অনুযায়ী সালাম করেছিলেন। কিন্তু পূর্বতন কোন শত্রুতার কারণে মাহলাম ইবনে জাশামা আমেরকে হত্যা করেন এবং তার উট ও অন্যান্য জিনিস আত্মসাৎ করেন। এরপর কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়, ‘যে তোমাকে সালাম করে, তাকে বলো না যে, তুমি মোমেন নও।’ এরপর সাহবায়ে কেরাম আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের মাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের কাছে মাহলাম ইবনে জাশামের নাগফেরাতের দোয়া করার আবেদন জানান। আল্লাহর রসূলের সামনে মাহলাম হাযির হলে তিনি বলে, হে আল্লাহ পাক, মাহলাম যেন ক্ষমা না পায়। তিনি এ কথা তিনবার উচ্চারণ করেন। এ কথা শুনে মাহলাম কাপড়ে চোখ মুছে উঠে পড়েন। ইবনে ইসহাক বলেন, মাহলামের গোত্রের লোকেরা বলেছে, পরবর্তীকালে আল্লাহর রসূল মাহলামের জন্য মাগফেরাতের দোয়া করেছিলেন। দেখুন, যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ.১৫১]

এদিকে হাতেব ইবনে আবু বালতাআ কোরায়শদের এক খানি চিঠি লিখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা জানানোর চেষ্টা করেন। সেই চিঠি মক্কায় কোরায়শদের হাতে পৌঁছানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে একজন মহিলাকে নিয়োগ করেন। সেই মহিলা খোঁপার ভেতর চিঠিখানি লুকিয়ে মক্কায় রওয়ানা হন। এদিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় রসূলকে এ খবর জানিয়ে দেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী, হযরত মেকদাদ,হযরত যোবয়ের এবং হযরত আবু মারছাদ গুনুবিকে ডেকে বলেন, তোমরা চারজন রওজা খাখ-এ যাও। সেখানে উঠের পিঠে আরোহণকারিনী একজন মহিলাকে পাবে। তার কাছে একখানি চিঠি পাবে। সেই চিঠি কোরায়শদের কাছে পাঠানো হয়েছে। চারজন সাহাবী রওযা খাখ-এ পৌঁছে সেই মহিলাকে পেলেন। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করা হলো তোমার কাছে কি কোন চিঠি আছে? মহিলা অস্বীকার করলো। সাহবারা উটের হাওদাজে খুঁজে দেখলেন কিন্তু চিঠি পেলেন না। এরপর হযরত আলী (রা.) বললেন, আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও মিথ্যা বলেননি, আমরা ও মিথ্যা বলছি না। তুমি হয়তো চিঠি দাও, না হয় আমরা তোমাকে উলঙ্গ করবো। একথা শুনে মহিলা বললো, আচ্ছা আপনারা একটু ঘুরে দাঁড়ান। সাহাবার ঘুরে দাঁড়ালে মহিলা তার খোঁপা খুলে চিঠি বের করে সাহাবদের হাতে দিলেন। তারা চিঠি নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গেলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিঠিখানা পড়িয়ে দেখলেনে যে, ‘ওতে লেখা রয়েছে, হাতেব ইবনে আবু বালতাআর পক্ষ থোকে কোরায়শদের প্রতি।’ এতে কোরায়শদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা অভিযানের কবর দেয়া হয়েছিল।৫[ইমাম সোহায়লী বিভিন্ন যুদ্ধের ঘটনার উল্লোখ করেছেন। তিনি চিঠির বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করেছেন। চিঠিতে লেখা ছিল, আম্মা বাদ, হে কোরায়শরা, আল্লাহর রসূল তোমাদের উদ্দেশ্যে সৈন্যসহ হাযির হচ্ছেন। যদি তিনি একা ও হাযির হন তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সাহায্যে করবেন এবং তাঁকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবেন। কাজেই তোমরা নিজেদের ব্যাপারে চিন্তা করো। ওয়াসসালাম।

ওয়াকেদী লিখেছেন, হাতেব সোহায়েল ইবনে আমর সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং একরামার কাছে একথা লিখেছেন যে, আল্লাহর রসূল লোকদের মধ্যে যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছেন। বুঝতে পরি না তোমাদের উদ্দেশ্যে যাবেন, নাকি অন্য কোথাও। আমি চাই ডে, তোমাদের প্রতি এটা আমার এহসান হিসাবে গণ্য হবে।]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হাতেব, এটা কি? হাতেব বললেন, আমার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর ররসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর আমার ঈমান রয়েছে। আমি মোরতাদ হয়ে যাইনি বা আমার মধ্যে কোন পরিবর্তনও আসেনি। কথা হচ্ছে যে, আমি কোরায়শ বংশের লোক নই। আমি তাদের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলাম। বর্তমানে আমার পরিবার-পরিজন তাদের কাছে রয়েছে। কোরায়শদের সাথে আমার এমন কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, যে কারণে তারা আমার পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধান করবে। তাই আমি চিন্তা করলাম যে, তাদের একটা উপকার করবো এর ফলে তারা আমার পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবে। আমি ছাড়া আপনার সঙ্গে অন্য যারা রয়েছেন মক্কায় তাদরে প্রত্যেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। সেসব আত্মীয়-স্বজন তাদের পরিবার-পরিজনের হেফাজত করবেন। হযরত ওমর (রা.) হযরত হাতেবের কথা শুনে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি অনুমতি দিন, আমি তার শিরশ্চেদ করবো। এই লোকটি আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেয়ানত করেছে। সে মোনাফেক হয়ে গেছ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম বললেন, দেখো, সে বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। হে ওমর (রা.) তুমি কি করে জানবে, এমনও হতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এসে বলবেন, তোমরা যা ইচ্ছা করো, আমি তোমাদের মাফ করে দিয়েছি। একথা শুনে হযরত ওমরের (রা.) দু’চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.৪২২]

এমনি করে আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামীন গুপ্তচরদের ধরিয়ে দিলেন। ফলে মুসলমানদের যুদ্ধ প্রস্তুতির কোন খবরই কোরায়শদের কাছে পৌঁছুতে পারেনি।

মক্কা অভিমুখে মুসলিম বাহিনী

অষ্টম হিজরীর ১০ই রমযান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১০ হাজার সাহাবা। মদীনার তত্ত্বাবধানের জন্যে আবু রাহাম গেফরীকে নিযুক্ত করা হয়।

জাহাফা বা তার আরো কিছু এগিয়ে যাওয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের চাচা হযরত আব্বাসের সাথে দেখা। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সপরিবারে মদীনায় হিজরত করে যাচ্ছিলেন। আবওয়া নামক জায়গায় পৌঁছে তাঁর চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এবং ফুফাতো ভাই আবদুল্রাহ ইবনে উমাইয়ার সাথে দেখা হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরা উভয়ে তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছিলো এবং কবিতা রচনা করে তাঁর নিন্দা করে বেড়াতো। এ অবস্থা দেখে হযরত উম্মে সালমা (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমকে বললেন, আপনার চাচাতো ভাই ফুফাতো ভাই আপনার কাছে সবচেয়ে খারাপ হবে এটা সমীচীন নয়।

হযরত আলী (রা.) আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়াকে বললেন, তোমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লমের কাছে যাও এবং হযরত ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা যে কথা বলেছিলেন সে কথা বলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম নিশ্চয় এট পছন্দ করবেন না যে, অন্য কারো জবাব তাঁর চেয়ে উত্তম হবে। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয় আপনাকে আমাদের ওপর প্রধান্য দিয়েছেন এবং আমরা নিশ্চয় অপরাধী ছিলাম।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৯১)

আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস তাই করলেন। এই আয়াত শুনে রসূল আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস এরপর কয়েক লাইন কবিতা আবৃতি করলেন, তার অর্থ হচ্ছে, ‘তোমার বয়সের শপথ, আমি যখন লাত-এর শাহ সওয়ারকে মোহাম্মদের শাহ সওয়ারের ওপর বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে পতাকা তুলেছিলাম সে সময় আমার অবস্থা ছিলো রাতের পথহারা পথিকের মত। কিন্তু এখন আমাকে হেদায়াত দেয়ার সময় এসেছ, এখন আমি হেদায়াত পাওয়ার উপযুক্ত হয়েছি। আমার প্রবৃত্তির পরিবর্তে একজন হাদী আমাকে হেদায়াত দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে আল্লাহর পথ দেখিয়েছেন। অথচ এই পথকে আমি ইতিপূর্বে সব সময় উপেক্ষা করেছিলাম।’

একথা শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবেগে আবু সুফিয়ানের বুকে চাপড় মেরে বললেন, তুমি আমাকে সব ক্ষেত্রে উপেক্ষা করেছিলে।৭[পরবর্তীকালে আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস একজন ভালো মুসলমান হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে ইসলাম গ্রহণের পর লজ্জার কারণে তিনি রসূলের প্রতি চোখ তুলে তাকাননি। আল্লাহর রসূল ও তাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে বেহেশেতের সুসংবাদ দিতেন। তিনি বলতেন, আমি আশা করি আবু সুফিয়ান হামজার মতো হবে। ইন্তেকালের সময় উপস্থিত হলে বললেন, আমার জন্য কেঁদো না। ইসলাম গ্রহণের পর আমি পাপ হ্ওয়ার মতো কোন কথা বলিনি।(যাদুল মায়াদ ২য় খন্ড, পৃ.১৬২-১৬৩)]

মাররুজ যাহারানে মুসলিম সেনাদলঃ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সফর অব্যাহত রাখলেন। তিনি এবং সাহবায়ে কেরাম সকলেই রোযা রেখেছিলেন। আসফান কোদায়দের মধ্যবর্তী কোদায়েল জলশায়ের কাছে পৌঁছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙ্গে ফেললেন।৮[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড] তাঁর দেখাদেখি সাহাবায়ে কেরাম ও রোযা ভাঙ্গলেন।

এরপর পুনরায় তাঁরা সফর করতে শুরু করেন। রাতের প্রথম প্রহরে তাঁরা মারুরুজ জাহারান অর্থাৎ ফাতেমা প্রান্তরে গিয়ে পৌঁছলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে সাহাবারা পৃথকভাবে আগুন জ্বালালেন। এত দশ হাজার চুলায় রান্না হচ্ছিলো। আল্লাহর রসূল পাহারার কাজে হযরত ওমরকে (রা.) নিযুক্ত করলেন।

আল্লাহর রসূলের সমীপে আবু সুফিয়ানঃ

মাররুজ জাহরানে অবতরণের পর হযরত আব্বাস (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরের পিঠে আরোহণ করে ঘোরাফেরা করতে বেরোলেন। তিনি চাচ্ছিলেন যে, কাউকে পেলে মক্কায় খবর পাঠাবেন, যাতে করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কায় প্রবেশের আগেই কোরায়শরা তাঁর কাছে এসে নিরাপত্তার আবেদন জানান।

এদিকে আল্লাহ তায়ালা, কোরায়শদের কাছে কোন প্রকার খবর পৌঁছা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কারণে মক্কাবসীরা কিছুই জানতে পারেনি। তবে তারা ভীতি-বিহ্বলতার মধ্যে এবং আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল। আবু সুফিয়ান বাইরে এসে কোন নতুন খবর জানা যায় কিনা সে চেষ্টা করছিলো। সে সময় তিনি হাকিম বিন হাজাম এবং বুদাইল বিন ওরাকাকে সঙ্গে নিয়ে নতুন খবর সংগ্রহের চেষ্টায় বেরিয়েছিলেন।

হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি হযরত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরের পিঠে সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আবু সুফিয়ান এবং বুদাইল ইবনে ওরাকার কথা শুনতে পেলাম। আবু সুফিয়ান বলছিলেন, আল্লাহর শপথ, আমি আজকের মতো আগুন এবং সৈন্যবাহিনী অতীতে কখনো দেখিনি। বুদাইল ইবনে ওরাকা বললো, আল্লাহর শপথ, ওরা হচ্ছে বনু খোযাআ। যুদ্ধ ওদের লন্ড ভন্ড করে দিয়েছে। আবু সুফিয়ান বললেন, এতো আগুন এবং এতো বিরাট বাহিনী বনু খোযাআর থাকতেই পারে না।

হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি আবিু সুফিয়ানের কন্ঠস্বর শুনে বললাম, আবু হানজালা নাকি? আবু সুফিয়ান আমার কন্ঠস্বর চিনে বললেন , আবুল ফযল নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ। আবু সুফিয়ান বললেন, কি ব্যাপার? আমার পিতামাতা তোমার জন্যে কোরবান হোক। আমি বললাম,রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদলবলে এসছেন। হায়রে কোরায়শদের সর্বনাশা অবস্থা। আবু সুফিয়ান বললেন, এখন কি উপায়? আমার পিতামাতা তোমার জন্যে কোরবান হোক। আমি বললাম, ওরা তোমাকে পেলে তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবে। তুমি এই খচ্চরের পিছনে উঠে বসো। আমি তোমাকে বললাম,রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাবো। তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেবো। আবু সুফিয়ান তখন খচ্চরে উঠে আমার পিছনে বসলেন। তার অন্য দু’জন সাথী ফিরে গেলো।

হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে চললাম, কোন জটলার কাছে গেলে লোকেরা বলতো, কে যায়? কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরের পিঠে আমাকে দেখে বলতো, ইনি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা, তাঁরই খচ্চরের পিঠে রয়েছেন। ওমর ইবনে খাত্তাবের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বললেন , কে? একথা বলেই আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমার পিছনে আবু সুফিয়ানকে দেখে বললেন, আবু সুফিয়ান? আল্লাহর দুশমন? আল্লাহর প্রশংসা করি, কোন প্রকার সংঘাত ছাড়াই আবু সুফিয়ান আামদের কবযায় এসে গেছে। একথা বলেই হযরত ওমর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে গেলেন। আমিও খচ্চরকে জোরে তাড়িয়ে নিলাম। খচ্চর থেকে নেমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। ইতিমধ্যে হযরত ওমর (রা.) এলেন। তিনি এসেই বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ওই দেখুন আবু সুফিয়ান। আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি সুফিয়ানকে নিরাপত্তা দিয়েছি। পরে আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথা স্পর্শ করে বললাম, আল্লাহর শপথ, আজ রাতে আমি ছাড়া আপনার সাথে কেউ গোপন কথা বলতে পারবে না। আবু সুফিয়ানকে হত্যা করার অনুমতির জন্যে হযরত ওমর বারবার আবেদন জানালে আমি বললাম, থামো ওমর। আবু সুফিয়ান যদি বনি আদী ইবনে কা’ব এর লোক হতো, তবে এমন কথা বলতে না। হযরত ওমর বললেন, আব্বাস থামো। আল্লাহর শপথ, তোমার ইসলাম গ্রহণ আামর কাছে আামর পিতা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক পছন্দনীয় এবং এর একমাত্র কারণ এই যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তোমার ইসলাম গ্রহণ আমার পিতা খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণের চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আব্বাস, আবু সুফিয়ানকে তোমার ডেরায় নিয়ে যাও। সকালে আমার কাছে নিয়ে এসো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মতো আমি আবু সুফিয়ানকে আমার তাঁবুতে নিয়ে গেলাম। সকাল বেলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আবু সুফিয়ানকে নিয়ে গেলাম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে আফসোস, তোমার জন্যে কি এখনো একথা বোঝার সময় আসেনি যে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত কোন মাবুদ নেই? আবু সুফিয়ান বললো, আমার পিতামাতা আপনার জন্যে কোরবান হোন, আপনি কতো উদার, কতো মহানুভব, কতো দয়ালু। আমি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ থাকলে এই সময়ে কিছু কাজে আসতো।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু সুফিয়ান, তোমার জন্যে কি এখনো একথা বোঝার সময় আসেনি যে, আমি আল্লাহ রাসূল? আবু সুফিয়ান বললো, আমার পিতামাতা আপনার ওপর নিবেদিত হোন। আপনি কতো মহৎ, কতো দয়ালু আত্মীয়-স্বজনের প্রতি কতো যে সমবেদনশীল। আপনি যে প্রশ্ন করলেন, এ সম্পর্কে এখনো আমার মনে কিছু খটকা রয়েছে। হযরত আব্বাস (রা.) বললেন, আরে শিরশ্চেদ হওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার আগে ইসলাম কবুল করো। একথা সাক্ষী দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত এবাদতের যোগ্য কেউ নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। হযরত আব্বাস (রা.)-এর একথা বলার পর আবু সুফিয়ান ইসলাম কবুল করে এবং সত্যের সাক্ষী হলেন।

হযরত আব্বাস বললেন, হে আল্লাহর রসূল, আবু সুফিয়ান মর্যাদাবান লোক, কাজেই তাকে কোন মর্যাদা দেয়ার আবেদন জানাচ্ছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেলেন, ঠিক আছে, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। যে ব্যক্তি নিজের ঘরে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ রাখেবে সে নিরাপদ, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ।

মক্কা অভিমুকে ইসলামী বাহিনীঃ

অষ্টম হিজরীর ১৭ই রমযান সকাল বেলা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররুজ জাহারান থেকে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, আবু সুফিয়ানকে যেন প্রন্তরের পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড় করিয়ে রখে। এতে সেপথ অতিক্রমকারী আল্লাহর সৈনিকদের আবু সুফিয়ান দেখতে পাবে। হযরত আব্বাস (রা.) তাই করলেন। এদিক বিভিন্ন গোত্র তাদের পতাকা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কোন গোত্র অতিক্রমের সময় আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করতেন, আব্বাস এরা কারা? জবাবে হযরত আব্বাস (রা.) যেমন বলতেন, ওরা বনু সালিম। আবু সুফিয়ান বলতেন, বনু সালিমের সাথে আমার কি সম্পর্ক? অন্য কেউ সেই পথ অতিক্রমের সময় আবু সুফিয়ান বলতেন, এরা কারা? হযরত আব্বাস যেমন বলতেন, এরা মোযায়না গোত্র। আবু সুফিয়ান বলতেন, মাজনিয়াহ গোত্রের সাথে আমার কি সম্পর্ক? একে একে সকল গোত্র আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে অতিতক্রম করলো্। যে কোন গোত্র যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং পরিচয় জানার পর বলতেন, ওদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? এর পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মোহাজের ও আনসারদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে দেখা যাচ্ছিল শুধু লৌহ শিরস্ত্রাণ। আবু সুফিয়ান বললেন, সুবহানাল্লাহ, এরা কারা? হযরত আব্বাস বললেন, আনসার ও মোহাজেরদের সঙ্গে নিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছেন। আবু সুফিয়ান বললেন, এদের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি কার আছে? আবুল ফযল, তোমার ভাতিজার বাদশাহী তো জবরদস্ত হয়ে গেছে। হযরত আব্বাস বললেন, আবু সুফিয়ান এটা হচ্ছে নবুয়ত। আবু সুফিয়ান বললেন, হাঁ এখন তো তাই বলা হবে।

এ সময় আরো একটা ঘটনা ঘটলো। আনসারদের পতাকা হযরত সা’দ (রা.) বহন করছিলেন। আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হযরত সা’দ (রা.) বললেন, আজ রক্তপাত এবং মারধর করার দিন। আজ হারামকে হালাল করা হবে। আল্লাহ তায়ালা আজ কোরায়শদরে জন্যে অবমাননা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সা’দ যা বলেছে, আপনি কি সে কথা ‍শুনেছেন? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন যে, সা’দ কি বলেছে? আবু সুফিয়ান বললেন, এই এই কথা বলেছে। একথা শুনে হযরত ওসমান এবং হযরত আবদুর রহমান আওফ বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমরা আশঙ্কা করছি যে, সা’দ কোরায়শদের মধ্যে খুন-খারাবি শুরু না করে? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না আজতো এমন দিন যে, কাবার তাযিম করা হবে। আজ এমন দিন যে, আল্লাহ তায়ালা কোরায়শদের সম্মান দেবেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন সাহাবীকে পাঠিয়ে হযরত সা’দ এর হাত থেকে পতাকা নিয়ে এলেন এবং তাঁর পুত্র কয়েস এর হাতে দিলেন। এতে মনে হলো পতাকা যেন হযরত সা’দ এর হাতেই রয়ে গেছে। অন্য বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পতাকা হযরত যোবয়ের (রা.) এর হতে দিয়েছিলেন।

কোরায়শদের দোরগোড়ায়ঃ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে যাওয়ার পর হযরত আব্বাস (রা.) বললেন, আবু সুফিয়ান, এবার তুমি কওমের কাছে যাও। আবু সুফিয়ান দ্রুত মক্কায় গিয়ে পৌঁছলো এবং উচ্ছ কন্ঠে বললো, হে কোরায়শরা, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের কাছে এতো সৈন্য নিয়ে এসেছেন যে, মোকাবেলা করা অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানে ঘরে প্রবেশ করবে, সি নিরাপত্তা পাবে। একথা শুনে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতব উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এসে আবু সুফিয়ানে গোঁফ নেড়ে বললো, তোমরা এই বুড়োকে মেরে ফেলো। খারাপ খবর নিয়ে আসা এই বুড়োর অকল্যাণ হোক।

আবু সুফিয়ান বললেন, তোমাদের সর্বনাশ হোক। দেখো তোমাদের জীবন বাঁচানেরা ব্যাপারে এই মেয়েলোক তোমাদের যেন ধোঁকায় না ফেলে। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতো বিরাট বাহিনী নিয়ে এসছেন যার মোকাবেলা করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কাজেই, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, তারা নিরাপদ। লোকেরা বললো, আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করুন। আমরা কয়জন তোমার ঘরে যেতে পারবো? আবু সুফিয়ান বললেন, যারা নিজের ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখবে, তারা ও নিরাপত্তা পাবে। যারা মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে, তারাও নিরাপত্তা পাবে। একথা শুনে লোকেরা নিজেদের ঘর এবং মসজিদে হারাম অর্থাৎ কাবাঘরের দিকে দৌড়াতে লাগলো। তবে মতলববাজ কোরায়শরা কিছু সংখ্যক মাস্তানজাতীয় উচ্ছৃঙ্খল লোককে লেলিয়ে দিয়ে বললো, তবে আমরা এদের সমেনে ঠেলে দিলাম। যদি কোরায়শরা কিছুটা সাফল্য লাভ করে, তবে আমরা এদের সাথে গিয়ে মিলিত হব। যদি এরা আহত হয়, তবে আমদের কাছে তারা যা কিছু চাইবে, আমরা তাই দেবো। মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে কোরায়শদরে যেসব মাস্তান ও উচ্ছৃঙ্খল লোকেরা প্রস্তুত হলো সেসব নির্বোধ লোকের নেতা মনোনীত করা হলো একরামা ইবনে আবু জেহেল, সফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং সোহায়েল ইবনে আমরকে। এ তিনজনের নেতৃত্বে একদল কোরায়শ খান্দামায় সমবেত হলো। এদের মধ্যে বনু বকর গোত্রের হাম্মাস ইবনে কায়েস নামে একজন লোকও ছিলো। এর আগে সে অস্ত্র মেরামতের কাজ করতো। একদিন নিজ অস্ত্র মেরামতের সময় তার স্ত্রী বললো, তোমার এ প্রস্তুতি কিসের গো? হাম্মাস বললো, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি। একথা শুনে স্ত্রী বললো, আল্লাহর শপথ, মোহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। হাম্মাস বললো, আল্লাহর শপথ, আমি আশা করি যে, তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে আমি তোমার দাস হিসেবে হাযির করতে পারব। ওরা যদি আজ মোকাবেলার জন্যে আসে, তবে ওদের মোকাবেলার জন্যে আমার কোন অজুহাত থাকবে না। পূণাঙ্গ হাতিয়ার রয়েছে। ধারালো বর্শা, দু’ধারি তলোয়ার। খান্দামার যুদ্ধে এ লোকটিও উপস্থিত হয়েছিলো।

যি-তুবায়

এদিকে রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররাজ জাহরান থেকে রওয়ানা হয়ে যি-তুবায় পৌঁছলেন। এ সময়ে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মর্যাদার কারণে বিনয় ও কৃতজ্ঞতায় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা নীচু করে রেখেছিলেন। যি-তুবায় তিনি সৈন্য সমাবেশ করলেন। খালেদ ইবনে ওলীদকে নিজের ডানদিকে রাখলেন। এখানে আসলাম, সোলায়েম, গেফার, মোজাইনা এবং কয়েকটি আরব গোত্র ছিলো। খালেদ ইবনে ওলীদকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন মক্কার ঢালু এলাকায় প্রবেশ করেন। খালেদকে বললেন, যদি কোরাইশদের কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে হ্ত্যা করবে। এরপর তুমি সাফায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করবে।

হযরত যোবয়ের ইবনে আওয়ামকে বামদিকে রাখলেন। তাঁর হাতে ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ দিলেন, তিনি যেন মক্কার উঁচু এলাকা অর্থাৎ কোদায় প্রবেশ করেন এবং হাজুনে তাঁর দেয়া পতাকা স্থাপন করে তাঁর আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

পদব্রজে যারা এসেছিলেন তাদের পরিচালনা দায়িত্ব পালন করছিলেন হযরত আবু ওবায়দা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ দিলেন, তিনি যেন প্রান্তরের প্রান্তসীমার পথ অগ্রসর হন এবং মক্কায় তাঁরা অবতরণ করেন।

ইসলামী বাহিনীর মক্কায় প্রবেশঃ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পাওয়ার পর সেনাপতিরা নিজ নিজ সৈন্যদের নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেলেন।

হযরত খালেদ এবং তাঁর সঙ্গীদের পথে যেসব পৌত্তলিক আসছিলো, তাদের সাথে মোকাবেলা করে তাদের হত্যা করা হলো। হযরত খালোদের সাথী কারয ইবনে জাবের ফাহরি এবং খুনায়েস ইবনে খালেদ ইবনে রবিয়া শাহাদাত বরণ করেন। এরা দু’জন সেনাদল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের হত্যা করা হয়। খান্দামায় হযরত খালেদ এবং তাঁর সঙ্গীদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল কোরায়শরা মুখোমুখি হলো। কিছুক্ষণ উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হলো। এতে ১২ জন পৌত্তলিক নিহত হলো। এ ঘটনায় কোরায়শদের মনে আতঙ্ক ছেয়ে গেলো। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে সংকল্পবদ্ধ হাম্মাস ইবনে কয়েস দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার স্ত্রীকে বললো, দরোজা বন্ধ রাখো, খুলবে না। তার স্ত্রী বললো, আপনার সেই বাগাড়ম্বর গেলো কোথায়? হাম্মাস ইবনে কয়েস বললো, হায়রে, সফওয়ান আর একরামা ছুটে পলায়ন করলো। নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করা হলো। সেই তলোয়ার গলা এবং মাথা এমনভাবে কাটছিলো যে, নিহতদের হৃদয়বিদারক চিৎকার এবং হৈহল্লা ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।

হযরত খালেদ (রা.) খান্দামায় শত্রুদের মোকাবেলার পর মক্কার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সাফায় ‍গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হলেন।

এদিকে হযরত যোবয়ের (রা.) সামনে অগ্রসর হয়ে হাজুল-এর মসজিদে ফতেহ-এর কাছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা স্থাপন করলেন এবং তাঁর অবস্থানের জন্যে একটি কোব্বা তৈরী করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করলেন।

বায়তুল্লায় প্রবেশ এবং মূর্তি অপসারণঃ

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মোহজেরদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে হারাম-বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করলেন। প্রথমে তিনি হাজরে আসওয়াদ চম্বুন করলেন। এরপর কাবাঘর তওয়াফ করলেন। সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে একটি ছড়ি ছিলো।

কাবাঘরের আশেপাশে এবং ছাদের ওপর সেই সময় তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে সেসব মূর্তিকে গুঁতো দিচ্ছিলেন আর উচ্চারণ করছিলেন, সত্য এসছে, অসত্য চলে গেছে, নিশ্চয় অসত্য চলে যাওয়ার মতো।

পবিত্র কোরআনের এই আয়াতও তিনি উচ্চারণ করছিলেন, ‘সত্য এসেছে এবং অসত্যের চলাফেরা শেষ হয়ে গেছে।’

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটনীর উপর বসে তওয়াফ করলেন এবং এহরাম অবস্থায় না থাকার কারণে শুধু তওয়াফই করলেন। তওয়াফ শেষ করার পর হযরত ওসমান ইবনে তালহা (রা.)-কে ডেকে তাঁর কাছে থেকে কাবা ঘরের চাবি নিলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে কাবাঘর খোলা হলো। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন অনেকগুলি ছবি। এ সব ছবির মধ্যে হযরত ইবরাহীম এবং হযরত ইসমাইলের ছবিও ছিলো। তাঁদের হাতে ছিলো ভাগ্য গননার তীর। এ দৃশ্য দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তায়ালা এই সব পৌত্তলিককে ধ্বংস করুন। আল্লাহর শপথ, এই দুই জন পয়গম্বর কখনোই গণনায়-এর তীর ব্যবহার করেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবাঘরের ভেতর কাঠের তৈরী একটি কবুতর ও দেখলেন। নিজ হাতে তিনি সেটি ভেঙ্গে ফেললেন। তাঁর নির্দেশে ছবিগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো।

কাবাঘরে নামায আদায় এবং কোরায়শদের উদ্দেশ্যে ভাষণঃ

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভেতর থেকে কাবাঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। হযরত উসামা এবং হযরত বেলাল ভেতরেই ছিলেন। দরজা বন্ধ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দরজার মুখোমুখি দেয়ালের কাছে গিয়ে দেয়াল থেকে তিন হাত দূরে দাঁড়ালেন। এ সময় দুটি খাম্বা ছিলো বাম দিকে। একটি খাম্বা ছিলো ডানদিকে। তিনটি খাম্বা ছিলো পেছনে। সেই সময়ে কাবাঘরে ছয়টি খাম্বা বা খুঁটি ছিলো। এরপর তিনি সেখানে নামায আদায় করলেন। নামায শেষে তিনি কাবাঘরের ভেতরের অংশ ঘুরলেন। সকল অংশে তকবীর এবং তাওহীদের বাণী উচ্চারণ করলেন। এরপর পুনরায় কাবা ঘরের দরজা খুলে দিলেন। কোরায়শরা সামনে অর্থাৎ মসজিদে হারামে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলো। তারা অপেক্ষা করছিলো যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি করেন। দুহাতে দরজার দুই পাল্লা ধরে তিনি কোরায়শদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে তিনি বললেন, ‘আল্লহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছেন। তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে তিনি একাই সকল বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাজিত করেছেন। শোনো, কাবাঘরের তত্ত্বাবধান এবং হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া অন্য সকল সম্মান বা সাফল্য আমার এই দুই পায়ের নীচে। মনে রেখো, যে কোন রকমের হত্যাকান্ডের দায়িত্ব বা ক্ষতিপূরণ একশত উট। এর মধ্যে চল্লিশটি উট হতে গর্ভবতী।

হে কোরায়শরা, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের মধ্যে থেকে জাহেলিয়াত এবং পিতা ও পিতামহের অহংকার নিঃশেষ করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদমের সন্তান আর আদম মাটি থেকে তৈরী। এরপর তিনি এই আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘হে মানুষ,আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে করে, তোমরা এক অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যানাসম্পন্ন, যে অধিক মোত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।

আজ কোন অভিযোগ নেইঃ

এরপর তিনি বললেন, হে কোরায়শরা, তোমাদের ধারণা, আমি তোমদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো? সবাই বললো, ভালো ব্যবহার করবেন, এটাই আমদের ধারণা। আপনি দয়ালু। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। এরপর তিনি বলেন, তাহলে আমি তোমাদেরকে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের বলেছিলেন, ‘লা তাছরিবা আলাইকুমুল ইয়াওমা।’ আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত।

কাবাঘেরের চাবিঃ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর মসজিদে হারামে বসলেন। হযরত আলীর হাতে ছিলো কাবাঘরের চাবি। তিনি বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হাজীদের পানি পান করানোর মর্যাদার পাশাপাশি কাবাঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও আমাদের ওপর ন্যস্ত করুন। আল্লাহ তায়ালা আপনার ওপর রহমত করুন। অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী এই আবেদন হযরত আব্বাস জানিয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওসমান ইবনে তালহা কোথায়? তাঁকে ডাকে হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওসমান এই নাও চাবি। আজকের দিন হচ্ছে আনুগত্যের দিন। তবাকতে ইবনে সা’দ-এর বর্ণনা অনুযায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই চাবি সব সময়ের জন্যে নাও। তোমাদের কাছ থেকে এ চাবি সেই কেড়ে নেবে যে যালেম। হে ওসমান (রা.), আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে তার ঘরের তত্ত্বাধায়ক নিযুক্ত করেছেন। কাজেই রায়তুল্লাহ থেকে যা কিছু পাও, তা ভক্ষণ করবে।

কাবার ছাদে বেলালের আযানঃ

নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলালকে কাবার ছাদে উঠে আযান দেয়ার আদেশ দিলেন। সে সময় আবু সুফিয়ান ইবনে হরব, আত্তাব ইবনে আছিদ এবং হাবেছ ইবনে হেশাম কাবর আঙ্গিনায় বসেছিলো। সেখানে অন্য কেউ ছিলো না। আত্তাব বললো, আল্লাহ তায়ালা আছিদকে এ মর্যাদা দিয়েছেন যে, তাকে এই শুনতে হয়নি। নতুবা তাকে এক অপ্রতীকর জিনিস শুনতে হতো। একথা শুনে হারেস বললো শোনো, আল্লাহর শপথ, যদি আমি শুনতে পারি যে, তিনি সত্য তবে তার আনুগত্যকারী হয়ে যাব। আবু সুফিয়ান বললেন, দেখো, আমি কিছু বলব না। যদি কিছু বলি আল্লাহর শপথ, তবে এই পাথরের টুকরোগুলো ও আমার সম্পর্কে কবর দেবে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সামনে হাযির হয়ে বললেন, এ মাত্র তোমরা যা বলেছ, আমি সব জানি। এরপর তিনি তাদের কথা তাদের শোনালেন। এ বিস্ময়কর ঘটনায় হারেছ এবং আত্তাব বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিতেছি যে, আপনি আল্লাহর রসূল। আল্লাহর শপথ, আমাদের কথা শোনার মতো কেউ আমাদের সঙ্গে ছিলো না। আমরা বলছি যে, আপনাকে আমাদের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিজয় বা শোকরানার নামাযঃ

সেদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানি বিনতে আবু তালেবের ঘরে গিয়ে গোসল করলেন। এরপর সেখানে আট রাকাত নামায আদায় করলেন।

তখন ছিলো চশত-এর সময়। এ কারণে কেউ কবললো, এটা চাশত-এর নামায, কেউ বললো, ফতেহ বা বিজয়ের পর শোকরানার নামায। উম্মে হানি তার দু’জন দেবরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উম্মে হানি, তুমি যাদের আশ্রয় দিয়েছো, তাদের আমিও আশ্রয় দিলাম। একথা বলার কারণ ছিলো এই যে, উম্মে হানির দুই দেবরকে হযরত আলী (রা.) হত্যা করতে চাচ্ছিলেন। উম্মে হানি ছিলেন হযরত আলীর বোন। উম্মে হানি তার দুই দেবরকে লুকিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গেলে উম্মে হানি তকে দেবরদের সমস্যা সম্পর্কে বললে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত মন্তব্য করেন।

চিহ্ণিত কয়েকজন শত্রুঃ

মক্কা বিজয়ের দিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয়জন কুখ্যাত চিহ্নিত অপরাধীকে হত্যা তালিকায় অন্তভূক্ত করলে এদের ব্যাপারে বলা হয় যে, এরা কাবাঘরের পর্দার নীচে আত্মগোপন করলেও যেন হত্যা করা হয়। এরা হলো:

১. আবদুল ওজ্জা ইবনে খাতাল ২. আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবু ছারাহ ৩. একরামা ইবনে আবু জেহেল ৪. হারেছ ইবনে নুফায়েল ইবনে ওয়াহাব ৫. মাকিছ ইবনে ছাবাবা ৬. হাব্বার ইবনে আসওয়াদ ৭. ইবনে খাতালের দুই দাসী, যারা কবিতার মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদনাম রটাতো ৯. সারাহ সে ছিলো আবদুল মোত্তালেবের সন্তানদের একজন দাসী। সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুৎসা রটনা করতো অধিকিন্তু তার কাছেই মক্কায় প্রেরিত হাতেবের চিঠি পাওয়া গিয়েছিলো।

আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ ইবনে আবু ছারাহকে হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে তার প্রাণ ভিক্ষার সুপারিশ করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণভিক্ষা দিয়ে তার ইসলাম গ্রহণ মেনে নিলেন। কিন্তু এর আগে তিনি কিছুক্ষণ নীরব ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলিনে যে, ইতিমধ্যে কোন একজন সাহবী আবদুল্লাহকে হ্ত্যা করুক। কেননা এই লোকটি আগেও একবার ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং হিজরত করে মদীনায় গিয়েছিলো কিন্তু পরে মোরতাদ অর্থাৎ ধর্মান্তরিত হয়ে মক্কায় পালিয়ে এসেছিলো। দ্বিতীয়বার ইসলাম গ্রহণের পর অবশ্য তিনি ইসলামের ওপর অটল অবিচল ছিলেন।

একরামা ইবনে আবু জেহেল ইয়েমেনের পথে পালিয়ে গিয়েছিলো। তার স্ত্রী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মঞ্জুর করলেন। এরপর সেই মহিলা স্বামীর পথের অনুসরণ করে তাকে ফিরিয়ে আনলো। একরামা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং তার ইসলাম খাঁটি ইসলামই প্রমাণিত হয়েছিলো।

ইবনে খাতাল কাবাঘরের পর্দা ধরে ঝুলছিলো। একজন সাহবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস খবর দিলেন। তিনি বললেন, ওকে হত্যা করো। সেই সাহবী গিয়ে তাকে হত্যা করলেন।

মাকিছ ইবনে ছাবাবাকে হযরত নোমাইলা ইবনে আবদুল্লাহ হত্যা করলেন। মাকিছ প্রথমে মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ধর্মান্তরিত হয় এবং একজন আনসার সাহবীকে হত্যাও করে। এরপর মক্কায় মোশরেকদের কাছে ফিরে যান।

হারেছ মক্কায় রসূলকে নানাভবে কষ্ট দিতো। হযরত আলী (রা.) তাকে হত্যা করেন।

হাব্বাব ইবনে আসওয়াদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা হযরত যয়নব (রা.)-কে তাঁর হিজরতের সময় এমন জোরে ধাক্কা মেরেছিলেন যে, তিনি হাওদায থেকে শক্ত প্রান্তরে গিয়ে পড়ে যান। এতে তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের দিন এ লোকটি পালিয়ে যায়। পরে মুসলমান হয়ে ফিরে আসে। পরবর্তীতে তার ইসলামও যথার্থ প্রমাণিত হয়েছিল।

ইবনে খাতালের দুইজন দাসীর মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়। অন্যজনের জন্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রাণভিক্ষা করা হয় এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে।

হাতেবের পত্রবাহক সারাহর জন্যেও প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয় এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে।

বাকি পাঁচজনের প্রাণভিক্ষা দেয়া হয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে।

 ইবনে হাজার লিখেছেন, যাদেরকে হত্যা তালিকায় রাখা হয়েছিলো তাদের প্রসঙ্গে আবু মা’শাব আরো একজনের নাম উল্লেখ করেন। সে হচ্ছে হারেস ইবনে তালাল খযায়ী। হযরত আলী (রা.) তাকে হত্যা করেন।  ইমাম হাকেম এই তালিকায় কা’ব ইবনে যুহাইর-এর নামও উল্লেখ করেন। কা’ব এর ঘটনা বিখ্যাত। তিনি পরে এসে ইসলাম গ্রহণ করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসায় কবিতা রচনা করেন।  এই তালিকায় ওয়াহশী ইবনে হারব এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দ বিনতে ওতবার নামও ছিলো। তারা পরে ইসলাম গ্রহণ করেন।  ইবনে খাতালের দাসী আরনবকে হত্যা করা হয়।  উম্মে সা’দকেও হত্যা করা হয়। ইবনে ইসহাক এরূপ উল্লেখ করেছেন। এই হিসাবে পুরুষদের সংখ্যা আট এবং মহিলাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়। এমনও হতে পারে যে, আরনব এবং উম্মে সা’দ একই দাসীর নাম। লকব এবং কুনিয়তের ক্ষেত্রেই শুধু পার্থক্য রয়েছে।

 সফওয়ান ইবনে উমাইয়াকে যদিও হত্যা তালিকায় রাখা হয় নাই কিন্তু বিশিষ্ট কোরায়শ নেতা হিসাবে তার মনে নিজের জীবনের আশঙ্কা ছিলো। এ কারণে সে পালিয়ে গিয়েছিলো। ওমায়ের ইবনে ওহাব জুহমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাযির হয়ে তার নিরাপত্তার আবেদন জানান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিরাপত্তা দেন। নিরাপত্তার ‍নিদর্শন স্বরূপ তিনি ওমায়েরকে নিজের পাগড়ি প্রদান করেন। উল্লেখ্য মক্কায় প্রবেশের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পাগড়ি মাথায় দিয়েছিলেন। ওমায়ের সওয়ানের কাছে গেলেন। সে সময় সফওয়ান জেদ্দা থেকে থেকে ইয়েমেনে সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে নৌকায় আরোহণ করতে যাচ্ছিলেন। ওমায়ের সেখান থেকে সফওয়ানকে নিয়ে এলেন। রসূলুল্লাহর কাছে এসে সফওয়ান দুই মাসের সময় চাইলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চার মাস সময় দিলেন। এরপর সফওয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার স্ত্রী আগেই মুসলমান হয়েছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কে প্রথম বিয়ের ওপর অটুট রাখলেন।

 ফোযালা ছিলো অপরাধী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তওয়াফ করার সময় সে তাঁকে হত্যার কুমতলবে তাঁর কাছে এসে দাঁড়ায়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার মনের ষড়যন্ত্রের কথা বলে দিলেন। এতে ফোযালার বিস্ময়ের সীমা রইল না। সাথে সাথে সে পাঠ করলো লা-ইলাহা ইল্লাহল্লাহু মোহাম্মদুর রসূলুল্লাহ।

মক্কা বিজয়ের পরদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষণঃ

মক্কা বিজয়ের পরদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দেয়ার জন্যে দাঁড়লেন। তিনি আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা করার পর বললেন, ‘হে লোকসকল, আল্লাহ তায়ালা যে তারিখে আসমান যমিন সৃষ্টি করেছিলেন সেদিনই মক্কাকে মর্যাদা সম্পন্ন শহর হিসেবে নির্ধারণ করেন। একারণে এই শহরের মর্যাদা কেয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে। আল্লাহ তায়ালা এবং রোজ কেয়ামতের ওপর বিশ্বাসী কোন মানুষের জন্যেই এই শহরে রক্তপান করা বা কোন গাছ কাটা বৈধ নয়। যদি কেউ প্রশ্ন তোলে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে রক্তপাত করেছেন তবে তাকে বলবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলকে অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তোমাদের সে অনুমতি দেয়া হয়নি। আর আমার জন্যে নির্দিষ্ট সময়েই রক্তপাত বৈধ করা হয়েছিলো। অতীতের যেমন এখানে রক্তপাত খুন খারাবি নিষিদ্ধ ছিলো ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। যারা এখানে উপস্থিত রয়েছে তারা অনুপস্থিতিদের এ খবর জানিয়ে দেবে।

এক বর্ণনায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, এখানের কাঁটা যেন কাটা না হয়, শিকার যেন তাড়ানো না হয়, পথে পড়া পরিত্যক্ত জিনিস যেন তোলা না হয়। তবে, সেই ব্যক্তি তুলতে পারবে, যে সেই জিনিসের পরিচয় করাবে। এখানে ঘাস যেন তোলা না হয়। হযরত আব্বাস (রা.) ইযখির ঘাসের প্রসঙ্গ তুললে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ ইযাখির ঘাস তোলা যাবে। বনু খাযাআ গোত্রের লোকেরা সেদিন বনু খযাআ গোত্রের একজন লোককে হত্যা করেছিলো। রসূলে খোদা এ সম্পর্কে বললেন, খাযাআ গোত্রের লোকেরা তোমরা হত্যাকান্ড থেকে নিজেদের বিরত রাখো। হত্যাকান্ড যদি কল্যাণকর প্রমাণিত হতো, তবে আগেই হতো। অনে হত্যাকান্ড ঘটেছে। তোমরা এমন একজন লোককে হত্যা করেছো, যার ক্ষতিপূরণ অবশ্যই আমি আদায় করবো। এখন থেকে কেউ যদি লোককে হত্যা করে তবে নিহত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজন ইচ্ছা করলে ঘাতকদের কাউকে হত্যা করতে পারবে আর ইচ্ছা করলে ক্ষতিপূরণ নিতে পারবে।

এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ঘোষণার পর আবু শাহ নামে ইয়েমেনের একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার এই ঘোষণা আমার জন্যে লিখিয়ে দিন। তিনি লিখে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ১০[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.২২,২১৬]

আনসারদের সংশয়ঃ

মক্কা বিজয়ের পর আনসাররা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাতৃভূমি অধিকার করার পর কি মক্কায় থাকবেন? সে সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতে হাত তুলে দোয়া করছিলেন। দোয়া শেষ করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে কি কথা বলাবলি করছিলে?’ আনসাররা অস্বীকার করলেন। বার বার জিজ্ঞাসার পর তারা নিজেদের সংশয়ের কথা জানালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর পানাহ, এখন জীবন মরণ তোমাদের সাথে।

বাইয়্যাতঃ

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানদের মক্কা বিজয় দেয়ার পর মক্কার অধিবাসীদের সামনে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারা বুঝতে পারলো যে, ইসলাম ব্যতীত সাফল্যের কোন পথ নেই। এ কারণে ইসলামের অনুসারী হওয়ার উদ্দেশ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে বাইয়াতের জন্যে হাযির হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফার ওপরে বসে লোকদের কাছ থেকে বাইয়াত নিতে শুরু করলেন। হযরত ওমর (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নীচে ছিলেন এবং লোকদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করছিলেন। উপস্থিত লোকেরা এ মর্মে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হলো যে, তারা যতোটা সম্ভব তাঁর কথা শুনবে এবং মেনে চলবে।

তাফসীরে মাদারেকে উল্লেখ রয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের পর মহিলাদের কাছ থেকেও বাইয়াত নেন। হযরত ওমর (রা.) নীচে ছিলেন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশে বাইয়াত নিচ্ছিলেন, মহিলাদের তাঁর কথা শোনাচ্ছিলেন।

সে সময় আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দা ভিন্ন পোশাকে হাযির হলেন। আসলে হযরত হামযার (রা.) লাশের সাথে তিনি যে আচরণ করেছিলেন সে কারণে ভীত ছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনে ফেলেন কিনা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে বাইয়াত নিচ্ছিলেন যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। হযরত ওমর (রা.) সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে বললেন, মহিলারা তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমরা চুরি করবে না। একথা বলার পরই হেন্দা বললো, আবু সুফিয়ান আস্ত কৃপণ, আমি যদি তার ধন-সম্পদ থেকে কিছু নেই , তখন কি হবে? আবু সুফিয়ান সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন, তুমি যা কিছু নেবে সেসব তোমার জন্যে হালাল। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসলেন। এরপর বললেন, আচ্ছা তুমি কি হেন্দা? আবু সুফিয়ানের স্ত্রী বললো, হাঁ, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যা কিছু হয়ে গেছে, সেসব মাফ করে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মার্জনা করুন।’

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যেনা করবে না। একথা শুনে হেন্দা বললেন, স্বাধীন কোন নারীর কি যেনা করতে পারে? এরপর তিনি বললেন, নিজের সন্তানকে হত্যা করবে না। হেন্দা বললেন, শৈশবে আমি তাদের লালন-পালন করেছি, বড় হওয়ার পর আপনার লোকেরা তাদের হত্যা করেছে। কাজেই তাদের বিষয়ে আপনি এবং তারা ভালো জানেন।

উল্লেখ্য, হেন্দার পুত্র হানযালা ইবনে ইবু সুফিয়ান বাদরের যুদ্ধের দিনে নিহত হয়েছিলো। হেন্দার কথা শুনে হযরত ওমার (রা.) হেসে কুটি ‍কুটি হলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- ও হাসলেন।

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কারো নামে অপবাদ দেবে না। হেন্দা বললেন, আল্লাহর শপথ, অপবাদ বড় খারাপ জিনিস। আপনি প্রকৃতই হেদায়ত এবং উন্ন চরিত্রের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোন স্তিরিকৃত বিষয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাফরমানি করবেন না। হেন্দা বললেন, আল্লাহর শপথ, এই মজলিসে আমি মনে এমন ভাব নিয়ে বসিনি যে, আপনার নাফরমানী করবো।

এরপর ফিরে এসে হেন্দা তার বাড়ীর মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেললো। মূর্তি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হেন্দা বলছিলেন, ‘তোমাদরে ব্যাপারে আমরা ধোঁকার মধ্যে ছিলাম।’১১[মাদাবেকুত তানযিল।]

মক্কায় নবী (স.)-এর অবস্থানঃ

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় উনিশ দিন অবস্থান করেন। এই সময়ে ইসলাম শিক্ষা, তাকওয়া ও হেদায়াত সম্পর্কে পথ নির্দেশ দিচ্ছিলেন। সেই সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে আবু উছয়েদ খাযারি (রা.) নতুন করে হরম শরীফের খুঁটি স্থাপন করলেন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লিখিত সময়ে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ছারিয়্যা অর্থাৎ ছোট ধরনের সেনাদল প্রেরণ করলেন। এমনি করে সকল মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে একজন ঘোষণা করলেন যে, কেউ যদি আল্লাহ তায়ালা এবং আখেরাতের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন নিজের ঘরে মূর্তি না রাখে, বরং মূর্তি যেন ভেঙ্গে ফেলে।

সেনাদল এবং প্রতিনিধি দল প্রেরণঃ

১. মক্কা বিজয়ের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ম হিজরীর রমযানের ২৫ তারিখে খালেদ ইবনে ওলীদ (রা.)-এর নেতৃত্বে একটি ছারিয়্যা প্রেরণ করেন। ওযযা নির্মূল করতে এ অভিযান প্রেরণ করা হয়। ওযযা ছিলো নাখালায়। কোরায়শ এবং সমগ্র বনু কেনানা গোত্র এ মূর্তির পূজা করতে। এটি ছিলো তাদের সবচেয়ে বড় মূর্তি। বনু শায়বান গোত্র এ মূর্তির তত্ত্বাবধান করতো। হযরত খালেদ ত্রিশ জন সওয়ারী সৈন্যসহ নাখলায় গিয়ে এ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। ফিরে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কিছু দেখেছ? তিনি বলেন, কই না তো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তো তুমি মূর্তিই ভাঙ্গতে পারোনি?

হযরতে খালেদ পুনরায় নাঙ্গা তলোয়ার উঁচিয়ে গেলেন। এবার তিনি দেখলেন তাঁর দিকে এক কালো নগ্ন মাথা ন্যাড়া মহিলা এগিয়ে আসছে। হযরত খালেদ এরপর তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। এতে সেই মহিলা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হযরত খালেদে এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসে খবর দিলেন। তিনি বলেলেন, হাঁ সেই ছিলো ওযযা। এবার সে তোমাদের দেশে পূজার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।

২. এরপর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোয়া নামক অন্য একটি মূর্ত ধ্বংস করতে আমর ইবনু আসকে পাঠালেন। এটা ছিলো মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে। রেহাত এলাকায় বনু হোযাইল গোত্র এর পূজা করতো। হযরত আমর সেখানে যাওয়ার পর পুরোহিত বললো, তুমি কি চাও? তিনি বলেলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে এ মূর্তি ধ্বংস করতে এসেছি। পুরোহিত বললো, তুমি সেটা পারবে না। তিনি বললেন, কেন? পুরোহিত বললো, অদৃশ্য থেকে তোমাকে বাধা দেয়া হবে। তিনি বললেন, তোমার জন্যে আফসোস। এই মূর্তি কি দেখতে পায়? শুনতে পায়? তুমি এখনো মিথ্যার ওপর রয়েছো? এরপর তিনি মূর্তি ভেঙ্গে সঙ্গীদের মূর্তিঘরে অনুসন্ধান চালাতে বললেন। কিন্তু কোন জিনিস পাওয়া গেলো না। হযরত আমরের নির্দেশে মূর্তিঘরও ধ্বংস করে দেয়া হলো। এরপর তিনি পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলেন কি, কেমন বুঝলে, পুরোহিত বললো, আমি লা শারিক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম।

৩. সেই মাসেই হযরত সা’দ ইবনে যায়েদ আশহালির নেতৃত্বে বিশজন সৈন্য প্রেরণ করা হলো। এরা মানাত মূর্তি ধ্বংস করতে গেলেন। কোদায়েদের কাছে মাশাল নামক এলাকায় এ মূর্তি ছিলো। গাসসান, আওস এবং খাযরাজ গোত্রে এর পূজা করতো। হযরত সা’দ সেখানে পৌছার পর পুরোহিত বললো, কি চাও? তিনি বললেন মানাতকে ধ্বংস করতে চাই।

পুরোহিত বললো, তুমি জানো আর তোমার কাজ জানে। হযরত সা’দ লক্ষ্য করলেন, বীভৎস চেহারার কালো ন্যাড়া মাথা এক মহিলা বেরিয়ে এসেছে। সে বুক চাপেড়াতে চাপড়াতে সে হায় হায় করছিলো। পুরোহিত বললো, মানাত তোমার কিছু নাফরমানকে ধারো। ইত্যবসরে হযরত সা’দ তলোয়ার দিয়ে মানাতকে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। এরপর মূর্তিঘর ধ্বংস করা হলো। কিন্তু সেখানে কোন কিছু পাওয়া গেলো না।

৪. ওজ্জা ধ্বংস করে ফিরে আসার পর সেই মাসেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত খালেদ (রা.) কে বনু জাজিমার কাছে পাঠালেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল। হযরত খালেদ (রা.) মোহজের আনসার এবং বনু সালিম গোত্রের সাড়ে তিন শত লোক নিয়ে রওয়ান হলেন। বনু জাজিমা গোত্রের কাছে পৌঁছে তারা ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তার ‘আসলামনা ’ অর্থাৎ আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম বলার পরিবর্তে বললো, ছাব্বানা ছাব্বানা অর্থাৎ আমরা নিজেদের দ্বীন ত্যাগ করলাম। এতে হযরত খালেদ তাদের হত্যা এবং গ্রেফতার শুরু করলেন। তারপর একজন করে বন্দীকে নিজের প্রত্যেক সঙ্গীর কাছে দিয়ে তাদের হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এবং তাঁর সঙ্গীরা সেনাপতির আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এস এ ঘটনা উল্লেখ করা হলো । তিনি দুই হাত আকাশের দিকে তুলে দুই বার বললেন, ‘হে আল্লাহ তায়ালা খালেদ যা ‍কিছু করেছে, আমি তা থোকে তোমার কাছে পানাহ চাই।’ ১২[সহীহ বোখারী, ১ম, খন্ড, পৃ.৪৫০]

হযরত খালেদের নির্দেশে বনু সালিম গোত্রের লোকেরা নিজেদের বন্দীদের হত্যা করেন। আনসার এবং মোহাজেররা তাদের বন্দীদের হত্যা করেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনার পর হযরত আলী (রা.)-কে পাঠিয়ে নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং তাদের অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করেন। এই ঘটনায় হযরত খালেদ এবং হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)-এর মধ্যে তীব্র কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। এ খবর শোনার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, খালেদ, থামো, আমার সাথীদের কিছু বলা থেকে বিরত হও। আল্লাহর শপথ, যদি ওহুদ পাহাড় সোনা হয়ে যায় এবং তার সবটুকু ‍তুমি আল্লাহর পথে ব্যয় করো তবু আমার সাথীদের মধ্যে কারো এক সকাল বা এক বিকেলের এবাদাতের সমমর্যাদাতেও তুমি পৌঁছুতে পারবে না। ১৩[ইবনে হিশাম, সহীহ বোখারী, ফতহুল বারী, সহীহ মুসলিম, যাদুল মায়াদ।]

মক্কা বিজয়ের যুদ্ধই ছিলো প্রকৃত মীমাংসা কারী যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয়ই ছিলো প্রকৃত বিজয়, যা মোশরেকদের শক্তিমত্তা ও অহংকারকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিলো। আরব উপদ্বীপে শেরক বা মূর্তিপূজার আর কোন অবকাশই থাকলো না। কেননা মুসলমান ও মোশরেক ছাড়া সাধারণ শ্রেণীর মানুষরা অত্যন্ত কৌতুহলের সঙ্গে ব্যাপারটি দেখতে চাচ্ছিল যে, এই সংঘাতের পরিণতিটা কি রূপ নেই। সাধারণ মানুষ এটা ভালভাবেই জানতো যে, যে শক্তি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, কেবলমাত্র সেই শক্তির কাবার ওপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সক্ষম হবে। তাদের বিশ্বাসকে অধিক বলীয়ান করেছিলো অর্ধশতাব্দী পূর্বে সংঘটিত আবরাহা ও তার হস্তী বাহিনীর ঘটনা। আল্লাহর ঘরের ওপর আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে অগ্রসরমান হস্তীবাহিনী কিভাবে ধ্বংস নিচিহ্ন হয়েছিলো তা তৎকালীন আরববাসীরা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলো।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, হোদায়বিয়ার সন্ধি ছিলো মক্কা বিজয়ের সূচনা বা ভূমিকা স্বরূপ। এ সন্ধির ফলে শান্তি ও নিরাপত্তার ঝর্ণা চারিদেকে প্রবাহিত হচ্ছিলো। মানুষ একে অন্যের সাথে খোলাখুলি আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছিলো। ইসলাম সম্পর্কে তারা মতবিনিময় ও তর্ক বিতর্ক করছিলো। মক্কায় যেসব লোক গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তারাও দ্বীন সম্পর্কে মত বিনিময়ের সুযোগ পেলো। ফলে বহু লোক ইসলামে দীক্ষিত হলো। ইতিপূর্বে বিভিন্ন যু্দ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশী ছিলো না। অথচ মক্কা বিজয়ের সময় তাদের সংখ্যা ছিলো ১০ হাজার।

এ সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে লোকদের দৃষ্টি খুলে গেলো। তাদের চোখের ওপর পড়ে থাক সর্বশেষ পর্দাও অপসারিত হলো। দ্বীন ইসলাম গ্রহণের পথে আর কোন বাধাই রইল না। মক্কা বিজয়ের পর মক্কার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আকাশে মুসলমানদের সূর্য চমকাতে লাগলো। দ্বীনী কর্তৃত্ব দুনিয়াবী অধিপত্য উভয়েই পুরোপুরি মুসলমানদের হাতে এসে গেলো।

হোদয়বিয়ার সন্ধির ফলে মুসলমানদের যে অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো মক্কা বিজয়ের পর তা পূর্ণতা লাভ করলো। পরবর্তী অধ্যায় ছিলো শুধু মুসলমানদের জন্যে এবং পরিস্থিতি ছিলো মুসলমানদের একক নিয়ন্ত্রণে। এরপর আরবদের বিভিন্ন গোত্রের সামনে একটা পথই খোলা ছিলো তারা প্রতিনিধিদলসহ গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর বাস্তবে পরবর্তী দু’বছর ধরে একাজই চলেছিলো।

তৃতীয় পর্যায়ঃ হোনায়েনের যুদ্ধ
এটা ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তী জীবনের শেষ পর্যায়। প্রায় তেইশ বছরের শ্রম সাধনায় তিনি যে কষ্ট করেছিলেন তাঁর জীবনের এই পর্যায় ছিলো সেই স্বীকৃতি।

এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে মক্কা বিজয় ছিলো নবী (সাঃ) এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। এ বিজয়ের ফলে পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন হয় এবং আরবের পরিবেশ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এ বিজয় ছিলো পূর্বাপর সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন। আরব জনগণের দৃষ্টিতে কোরায়াশ ছিলো দ্বীনের হেফাজতকারী ও সাহায্যকারী। সমগ্র আরব ছিলো এ ক্ষেত্রে তাদের অধীনস্থ। কোরায়শদের পরাজয়ের অর্থ হচ্ছে এই যে, সমগ্র আরব ভূখন্ড মূর্তিপূজা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে চিরদিনের জন্যে।

উল্লিখিত শেষ পর্যায়টি দুইভাগে বিভক্ত। এক. মোজাহাদ ও যুদ্ধ। দুই. ইসলাম গ্রহণের জন্যে বিভিন্ন কওম ও গোত্রের ছুটে আসা। এ উভয় অবস্থা পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

হোনায়েনের যুদ্ধ

আকস্মিক অভিযানে মক্কা ‍বিজয় সংঘটিত হয়েছিলো। এতে আরবের জনগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশী গোত্রসমূহের মধ্যে এ অপ্রতাশিত অভিযানের মোকবেলা করার শক্তি ছিলো না। এ কারণে শক্তিশালী অহংকারী উচ্ছৃঙ্খল কিছু গোত্রসমূহ এবং বনু বেলালের কিছু লোক শামিল হয়েছিলো। এসব গোত্রের সম্পর্ক ছিলো কাইসে আইলানের সাথে। মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করা তারা আত্মমর্যাদার পরিপন্থী মনে করছিলো। তাই তারা মালেক ইবনে আওফ নসরীর কাছে গিয়ে মুসলমানদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নিলো।

শত্রুদের রওয়ানা এবং আওতাস-এ উপস্থিতি

সিদ্ধান্তের পর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে মালেক ইবনে আওফের নেতৃত্বে সকল সমবেত সকল অমুসলিম রওয়ানা হলো। তারা তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপাল নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চললো। আওতাস প্রান্তরে তারা উপস্থিত হলো। আওতাস হচ্ছে হোনায়েনের কাছে বনু হাওয়ানে এলাকার একটি প্রান্তর। কিন্তু এ প্রান্তর হোনায়েন থেকে পৃথক। হোনয়েন একটি পৃথক প্রান্তর। এটি যুল মাজাজ-এর সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাত হয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলের বেশী। ১[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ.২৭,৪২]

শত্রুদের সৈন্য সমাবেশ

আওতাস-এর অরতরণের পর লোকেরা কমান্ডার মালেক ইবনে আওফের সামনে হাযির হলো। এদের মধ্যে প্রবীণ সমর বিশারদ দুরাইদ ইবনে ছোম্মাও ছিলো। এই লোকটি বয়সের ভারে ছিলো ন্যুজ। বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিলো তার। এক সময় সে ছিলো বীর যোদ্ধা। এখন অভিজ্ঞতা বর্ণনা এবং সে আলোকে পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। সে মালেককে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমরা কোন প্রান্তরে রয়েছো? তাকে বলা হলো, আওতাস প্রান্তরে। সে বললো, এটা সৈন্য সমাবেশের উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু গাধা, উট, ঘোড়ার ডাকাডাকি, শিশু সন্তানের কান্না মেয়েদের গলার আওয়ায পাচ্ছি। তাকে জানানো হলো যে, কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ সৈন্যাদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন এবং পশুপালও নিয়ে এসেছে। দুরাইদ এর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হলো যে, প্রত্যেক যোদ্ধা তার কাছে মজুদ স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পশুপালের আকর্ষণে বীরত্বের সাথে লড়াই করবে।

মালেক ইবনে আওফের এ জবাব শুনে দুরাইদ বললো, আল্লাহর কসম, তুমি ভেড়ার রাখাল। পরাজিত ব্যক্তিকে কোন কিছু কি ধরে রাখতে পারে? দেখো, যুদ্ধে যদি তুমি জয়ী হও, তবে তলোয়ার এবং বর্শা দ্বারাই উপকৃত হবে। আর যদি পরাজিত হও তবে অপমানিত হবে। কারণ পরাজিত যোদ্ধার স্ত্রী, পুত্র, পরিবার এবং পশুপাল কিছুই নিরাপদ থকবে না। দুরইদ বিভিন্ন গোত্রের সর্দারদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। সব কথা শোনার পর কমান্ডারকে বললো, হে মালেক, তুমি বনু হাওয়াযেন গোত্রের পরিবার-পরিজন ও পশুদল নিয়ে এসে ভাল কাজ করোনি। তাদেরকে নিজ জিন এলাকর নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দাও। পেরে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তোমরা বে-দ্বীনের সাথে লড়াই করো। যদি তুমি জয়লাভ করো তবে পেছনের যারা থাকবে তারা এসে তোমাদের সথে মিলিত হব্। যদি পরাজিত হও, তবে ওরা নিরাপদ থাকবে।

কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বললো, খোদার কসম, আমি তা করতে পারি না। তুমি বুড়ো হয়েছো তোমার বুদ্ধিও বুড়ো হয়ে গেছে। হয়তো হাওয়াযেন গোত্র আমার আনুগত্য করবে আমি তলোয়ারের ওপর হেলান দিয়ে আত্মহত্যা করবো। মোটকথা, দুরাইদের নাম বা তার পরামর্শ এ যুদ্ধে শামিল হোক, এটা মালেক পছন্দ করলো না। হাওয়াজেন গোত্রের লোকেরা বললো, আমরা তোমার আনুগত্যে অটল রয়েছি। দুরাইদ বললো, আমি এ যুদ্ধের সাথে নাই। এ যুদ্ধের কোন দায়দায়িত্ব আমার নাই। হায়, আজ যদি আমি জওয়ান হতাম, যদি আমার ছুটোছুটি করার মতো বয়স থাকতো, তাবে আমি লম্বা পশমের মাঝারি সাইজের বকরির মতো ঘোড়ার নেতৃত্ব করতাম

শত্রুদের গুপ্তচর

মুসলমানদের খবর সংগ্রহে মালেক ইবনে আওফ দু’জন গুপ্তচর পাঠালো। তারা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই ফিরে এলো। তারা ছিলো চলৎশক্তিহীন। কমান্ডারের কাছে তাদের হাযির করার পর কমান্ডার বললো, তোমাদের সর্বনাশ হোক, এ অবস্থা হলো কেন? তারা বললো, আমরা কয়েকটি চিত্রল ঘোড়া এবং মানুষ দেখেছি, এরপরই আমাদের এ অবস্থা হয়েছে।

একদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের নান রকম খবর পাচ্ছিলেন। তিনি আবু হাদরাদ আসলামিকে বললেন, তুমি যাও, শত্রুদের মাঝে গিয়ে অবস্থান করে তাদের খবরাখবর এনে দাও। তিনি তাই করলেন।

মক্কা থেকে হোনায়েনের পথ যাত্রা

অষ্টম হিজরীর ৬ই শাওয়াল রোববরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে হোনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ান হলেন। এটা ছিলো তাঁর মক্কায় আগমনের উনিশতম দিন। তাঁর সঙ্গে ছিল ১২ হাজার সৈন্য। এদের মধ্যে ১০ হাজার মদীন থেকে মক্কায় এসেছিলেন, বাকি ২ হাজার মক্কা থেকে রওয়ান হন। মক্কার ২ হাজারের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নও মুসলিম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে অস্ত্রসহ একশত বর্ম ধার নিলেন। আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করলেন।

দুপুরের পরে একজন সাহাবী এসে বললেন, আমি অমুক পাহাড়ে উঠে দেখেছি বনু হাওয়াযেন সপরিবারে ‍যুদ্ধ করতে এসেছে। তারা নিজেদের পশুপালও সঙ্গে এনেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল এগুলো মুসলমানদের গনীমতের মাল হবে। রাতের বেলা হযরত আনাস ইবনে মারছাদ প্রহরীর দায়িত্ব পালন করলেন।

পথে সাহাবারা যাতে আনওয়াত নামে একটি কূল গাছ দেখলেন। মক্কার মোশরেকরা এ গাছের সাথে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। এর পাশে পশু যবাই করতো এবং এর নীচে মেলা বসাতো। কয়েকজন সহযোদ্ধা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ওদের যেমন যাতে-আনওয়াত নামে গাছ রয়েছে আপনি আমাদের জন্যেও ওরকম একটি গাছ তৈরী করে দিন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবর, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তোমরাতো সেই রকম কথা বলেছো , যে রকম কথা হযরত মুসার কওম তাঁকে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, ‘এজআল লানা এলাহান কামা লাহুম আলেহাতুন।’ অর্থাৎ আমাদের জন্যে একজন মাবুদ বানিয়ে দিন, যেমন ওদের জন্যে মাবুদ রয়েছে। তোমরা তো দেখছি পূর্ববর্তীদের তরিকার ওপরই উঠে পড়েছো। ৩[তিরমিযি, ফেতান, মোসনাদে আহমদ ৫ম খন্ড, ২৮১]

কিছু লোক সৈন্য সংখ্যার আধিক্য দেখে বললেন, আমরা আজ কিছুতেই পরাজিত হব না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথাটিও পছন্দ করলেন না।

মুসলমানদের আকস্মিক হামলাঃ

১০ই শাওয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ইসলামী বাহিনী হোনয়েনে পৌঁছুলো। মালেক ইবনে আওফ আগেই এ জায়গায় পৌঁছে রাতের অন্ধকারে তার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে গোপনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলো। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে, মুসলমানরা আসা মাত্র তাদের ওপর তীর নিক্ষেপ করবে এবং কিছুক্ষণ পর একজোটে হামলা করবে।

এদিকে খুব প্রত্যুষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। খুব ভোরে মুসলিম সৈন্যরা হোনায়েনের প্রান্তরে পদার্পন করলেন। শত্রুসৈন্য সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। শত্রুরা যে ওঁৎ পেতে রয়েছে এ সম্পর্কে অনবহিত মুসলমান সৈন্যরা নিশ্চিন্তে অবস্থান নেয়ার সময় হঠাৎ করে তাদের ওপর তীরবৃষ্টি শুরু হলো। কিছুক্ষণ পরই শত্রুরা একযোগে মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। মুসলমানরা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলেন। এটা ছিলো সুস্পষ্ট পরাজয়। নও মুসলিম আবু সুফিয়ান বললেন, ওরা সমুদ্রপারে না গিয়ে থামবে না। জাবালা অথবা কালদা ইবনে জোনায়েদ বললো, দেখো আজ যাদু বাতিল হয়ে গেছে। ইবনে ইসহাক এটা বর্ণনা করেছেন। বারা ইবনে আযেব বলেন, সহীহ বোখারীতে উল্লেখ রয়েছে যে, বনু হাওয়াযেন ছিলো তীরন্দাজ, আমরা হামলা করলে তারা পালিয়ে গেলো। এরপর আমরা গনীমতের মাল সংগ্রহ করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে শত্রুরা তীর বৃষ্টি দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ৪[সহীহ বোখারী, ইয়ওমে হোনায়েন অধ্যায়]

সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত আনাস বলেন, আমরা মক্কা জয় করেছি। পরে হোনায়েনে অভিযান চালিয়েছি। মোশরেকরা চমৎকার সারিবদ্ধভাবে এসেছিলো। অমন সুশৃঙ্খল অবস্থা আমি কখনো দেখিনি। প্রথম সওয়ারদের সারি, এরপর পদব্রজীদের সারি, তাদের পেছনে মহিলারা এর পেছনে পেছনে ভেড়া বকরি, তারপর পশুপাল। আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক। আমাদের সৈন্যদের ডানদিকে ছিলেন হযরত খালেদ (রা.)। কিন্তু আমাদের সওয়ার আমাদের পেছনে আত্মগোপন করতে লাগরেন, কিছুক্ষণ পর তারা পলায়ন করলেন। আরবরাও পলায়ন করলো। ওরাও পলায়ন করলো, যাদের সম্পর্কে তোমরা জানো। ৫[ফতহুর বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৮]

সাহবারা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডানদিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, হে লোক সকল, তোমরা আমার দিকে এসো, আমি আবদুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ। সেই সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন মোহজেরে এবং তাঁর বংশের সাহাবারা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। ৬[ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের সংখ্যা চিলো নয় বা দশজন। নবীজি বলেন, আল্লাহ রসূলের সাথে বারোজন দৃঢ়পদ ছিলেন। সাহাবার নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য চলে গিয়েছিলেন। আল্লাহর রসূলের সঙ্গে আশিজন দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেন। আমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিনি। তিরমিযি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বর্ণিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি দেখলাম, নিজের লোকেরা হোনায়েনের দিনে পৃষ্ট করলো। আল্লাহর রসূলের সাথে একশ জন সাহাবীও ছিলেন না।]

সেই নাযুক সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নযিরবিহীন বীরত্ব ও সাহসিকাতার পরিচয় দিলেন। তিনি শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং উচ্চস্বরে বলছিলেন, আনান্নবিউল লা কাযেব আনা ইবনু আবদুল মোত্তালেব অর্থাৎ আমি নবী, আমি মিথ্যাবাদী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র।

সেই সময় আবু সুফিয়ান এবং হযরত আব্বাস রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খচ্চর ধরে রেখেছিলেন যাতে করে খচ্চর সামনের দিকে ছুটে যেতে না পারে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচা হযরত আব্বাসকে বললেন, লোকদের যেন তিনি উচ্চস্বরে ডাকতে শুর করেন। হযরত আব্বাসের ছিলো দরাজ গলা। হযরত আব্বাস বলেন, আমি উচ্চ কন্ঠে ডাকলাম, কোথায় তোমরা বৃক্ষওয়ালা, বাইয়াতে রেদওয়ানওয়ালা। সাহাবার আমার কন্ঠ শুনে এমনভাবে ছুটে আসতে শুরু করলেন যেমন গাভীর আওয়ায শুনে বাছুর ছুটে আসে। সাহাবারা বললেন, আমরা আসছি। ৭[সহীহ মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ-১০০]

সাহাবারা ছুটে আসতে শুরু করলে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে একশত সাহাবী সমবেত হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুর মোকাবেলা করলেন। যুদ্ধ শুরু হলো।

এরপর আনসারদের ডাকা হলো। ক্রমে বনু হারেস ইবনে খাযরাজের মধ্যে এই ডাক সীমিত হয়ে পড়লো। এদিকে সাহাবারা রণাঙ্গণ থেকে যেভাবে দ্রুত চলে গিয়েছিলেন, তেমনি দ্রুত ফিরে আসতে লাগলেন। দেখতে দেখতে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রণাঙ্গনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার চুলো গরম হয়েছে। এরপর একমুঠো ধুলো তুলো ‘শাহাতুল উজুহ’ বলে শত্রুদের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করলেন। এর অর্থ হচ্ছে চেহারা বিগড়ে যাক। নিক্ষিপ্ত ধুলোর ফলে প্রত্যেক শত্রুর চোখ ধুলি ‍ধুসরিত হলো। তারা পৃষ্ট প্রদর্শন করে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করলো।

শত্রুদের পরাজয়

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধুলো নিক্ষেপের পরই যুদ্ধের চেহারা পাল্টে গেলো শত্রুরা পরাজিত হলো। ছাকিফা গোত্রের ৭০ জন কাফের নিহত হলো। তাদের নিয়ে আসা অস্ত্র ধন-সম্পদ, রসদ, সামগ্রী, নারী, শিশু, পশুপাল সবকিছু মুসলমানদের হস্তগত হলো।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ সম্পর্কে বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে হোনায়নের যুদ্ধের দিনে, যখন তোমাদেরকে উৎফুল্ল করেছিলো তোমাদের সংখ্যাধিক্যে এবং তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্তেও পৃথিবী তোমদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং পরে তোমরা পৃষ্ট প্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর কাছ থেকে তাঁর রসূল এবং মোমেনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটা কাফেরদের কর্মফল।‘(সূরা তাওবা, আয়াত ২৫-২৬)

শত্রুদের গমন পথে ধাওয়াঃ

উভয় পক্ষে কিছুক্ষণ মোকাবেলার পরই মোশরেকরা পলায়নের পথ ধরলো। পরাজয়ের পর একদল শত্রু তায়েফের পথে অগ্রসর হলো। একদল নাখলার দিকে এবং একদল আওতাসের পথে অগ্রসর হলো। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবু আমের আশআরী (র.)শাহদাত বরণ করেন। তিনি একটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন।

একদল সহাবী নাখলার পথে গমনকারী অমুসলিমদের ধাওয়া করলেন। দুরাইন ইবনে ছোম্মাকে পাকড়াও করা হলো। হযরত রাবিয়া ইবনে রফি তাকে হত্যা করলেন।

পরাজিত শত্রুদের সবচেয়ে বড় দল তায়েফের দিকে অগ্রসর হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল জমা করার পর তায়েফের পথে রওয়ানা হলেন।

গনীমত

গনীমতের মালের বিবরণ নিম্মরূপ। যুদ্ধবন্দী ৬ হাজার, উট ২৪ হাজার। বকরি ৪০ হাজারের বেশী। চাঁদি ৪ হাজার উকিয়া। অর্থাৎ ১ লাখ ৬০ হাজার দিরহাম। এর ওজন ৬ কুইন্টালের চেয়ে কয়েক কিলো কম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমুদয় মালামাল জমা করার নির্দেশে দিলেন। যেরানা নামক জায়গায় সমুদয় সম্পদ একত্রিত করে হযরত মাসউ ইবনে আমর গেফারী (রা.)-এর নিয়ন্ত্রণে রাখলেন। তায়েফ যুদ্ধ থেকে অবসর না পাওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্ট করা হয়নি।

বন্দীদের মধ্যে শায়মা বিনতে হারেস সাদিয়াও ছিলেন। ইনি ছিলেন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূধবোন। তাঁকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে এসে তাঁর পরিচয় দেয়ার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চিহ্নের দ্বারা তাকে চিনতে পারেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন। নিজের চাদর বিছিয়ে তাকে বসতে দেন। সাদিয়ার মতামত অনুসারে তার প্রতি অনুগ্রহ দেখিয়ে তিনি তাকে নিজের গোত্রের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন।

তায়েফের যুদ্ধ

এ যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে হোনায়েনের যুদ্ধেরই অংশ। হাওয়াযেন ও ছাকিফ গোত্র পরাজিত লোকদের অধিকাংশই তাদের কমান্ডার মালেক ইবনে আওফ নসরীর সাথে তায়েফে চলে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলো তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের পথে রওয়ান হলেন।

প্রথমে খালিদ ইবনে ওলীদের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য পাঠানো হয়, এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রওয়ান হন। পথে নাখলা, ইমানিয়া এবং মনযিল অতিক্রম করেন। লিয়াহ নামক জায়গায় মালেক ইবনে আওফের একটি দুর্গ ছিলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সেই দুর্গ ধ্বংস করে দেয়া হয়। এরপর সফর অব্যাহত রেখে তয়েফ পৌঁছার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফ দুর্গ অবরোধ করেন।

অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আনাসের (রা.) বর্ণনা অনুযায়ী এই অবরোধ ৪০ দিন স্থায়ী হয়। কোন কোন সীরাত রচয়িতা ২০ দিন বলেও উল্লেখ করেছেন। কেউ ১০, কেউ ১৫ আবার কেউ ১৮ দিন উল্লেখ করেছেন। ৮[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড,পৃ-৪৫]

অবরোধকালে উভয় পক্ষের মধ্যে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। মুসলমানদের প্রথম অবরোধকালে তাদের ওপর লাগাতার তীর নিক্ষেপ করা হয়। প্রথম অবস্থায় মুসলমানরা অবরোধ শুরু করলে দূর্গের ভেতর থেকে তাদের ওপর এতো বেশী তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিলো যে মনে হয়েছিলো পঙ্গপাল ছায়া বিস্তার করেছে। এতে কয়েকজন মুসলমান আহত এবং ১২ জন শহীদ হন। ফলে মুসলমানরা তাঁবু সরিয়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যান।

এর পরিস্থিতি মোকাবেলায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ যন্ত্র স্থাপন করেন এবং দূর্গ লক্ষ্যে করে কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করেন। এতে দেয়ালে ফাটল ধরে ছিদ্র হয়ে যায়। সাহাবারা সেই ছিদ্র দিয়ে তাদের প্র্রতি পাথর নিক্ষেপ করেন। কিন্তু শত্রুদের পক্ষ থেকে বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করা হয়, এতে কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদের কাবু করতে কৌশল হিসাবে আঙ্গুর গাছ কেটে পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এতে বিচলিত ছকিফ গোত্র আল্লাহ তায়ালা এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের দোহাই দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার আবেদন জানালো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা মঞ্জুর করলেন।

অবরোধের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করলো যে, ক্রীতদাস দূর্গ থেকে নেমে আমাদের কাছে আসবে, সে মুক্ত। এতে ত্রিশজন লোক দূর্গ থেকে এসে মুসলমানদের সাথে শামিল হয়। ৯[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-২৬০]

আগত ক্রীতদাসদের মধ্যে হযরত আবু বকরাহও ছিলেন। দুর্গের দেয়ালে উঠে ঘূর্ণায়মান চরকার মাধ্যমে তিনি নীচের দিকে ঝুলে পড়েন এবং মুসলমানদের কাছে এস আত্মসমর্পণ করেন। আবরবী ভাষায় ঘারাবিকে বকরাহ বলা হয়। এ কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগন্তুক এ ক্রীতদাসের উপাধি দিলেন আবু বকরাহ। কথঅ অনুযায়ী মুসলমানের কাছে এস আত্মসমর্পণকারী ক্রীতদাসদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুক্ত করে দিলেন এবং তাদেরকে ত্রিশজন সহাবীর দায়িত্বে দিয়ে বললেন, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে দাও। এ ঘটনা দুর্গের শত্রুদের জন্যে বড়োই মারাত্মক হয়ে দাঁড়ালো।

অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়লো এবং শত্রদের আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তারা বছরের খাদ্য দুর্গের ভেতরে মজুদ করে রেখেছিলো। এ সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নওফেল বিনে মাবিয়া দয়লির সাথে পরামর্শ করেন। নওফেল বলেন, শৃগাল তার গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। যদি আপনি অবরোধ দীর্ঘায়িত করেন, তবে তাদের পাকড়াও করতে পারবেন। আর যদি ফিরে যান, তবে তারা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবরোধ অবসানের সিদ্ধান্ত নিলেন। হযরত ওমর (রা.) সাহাবাদের মধ্যে ঘোষণা প্রচার করলেন যে, ইনশা আল্লাহ আগামীকাল আমরা ফিরে যাব । সহাবারা এ ঘোষণার সমালোচনা করলেন। তারা বললেন, এটা কেমন কথা? তায়েফ জয় না করে আমরা ফিলে যাব? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহবাদের ভিন্নমত শুনে বললেন, আচ্ছা কাল সকালে যুদ্ধে চলো। পরদিন সাহাবারা যুদ্ধে গেলেন, কিন্তু আঘাত খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোন লাভ হলো না। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা আল্লাহ আগামী আমরা ফিরে যাবো। সর্বস্তরের সাহাবারা এ সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারা চুপচাপ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করলেন। এ অবস্থা দেখে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু হাসতে লাগলেন।

সাহবায়ে কেরাম ফিরে যাওয়ার পথে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আয়েবুনা তায়েবুন আবেদুনা লেরাব্বেনা হামেদুন।’ অর্থাৎ তোমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, এবাদাতগুজার এবং তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রশংসা করতে থাকো।

সাহাবারা বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাকিফের লোকদের জন্যে বদদোয়া করুন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা ছাকিফকে হেদায়াত করুন এবং তাদের নিয়ে আসুন।

যেরানায় গনীমতের মাল বন্টন

তায়েফ থেকে অবরোধ তুলে আসার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেরানায় সঞ্চিত গনীমতের মাল ভাগ বাটোয়ারা করা থেকে বিরত থাকলেন। এ দেরীর কারণ ছিলো এই যে, তিনি চাচ্ছিলেন, হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা ফিরে এসে তওবা করলে তিনি তাদের সবকিছু ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু অপেক্ষা করার পরও কেউ আসল না। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল বন্টন করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন গোত্রের সর্দার এবং মক্কার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিগণ গনীমতের মাল পাওয়ার আশায় উন্মুখ ছিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সকল নবদীক্ষিত মুসলমানদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে গনীমতের মাল প্রদান করলেন। ১০[ যাতে তারা ইসলামের ওপর দৃঢ় থাকে]

আবু সুফিয়ান ইবনে হারবকে ৪০ উকিয়া অর্থাৎ প্রায় ৬ কিলো রূপা অর্থাৎ চাঁদি এবং একশত উট দেয়া হলো। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র ইয়াযিদ? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াযিদকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। আবু সুফিয়ান বললেন, আমার পুত্র মুয়াবিয়া? রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকেও অনুরূপ প্রদান করলেন। মোটকথা একমাত্র আবু সুফিয়ান এবং তার দুই পুত্রকে প্রদান করা হলো ১৮ কিলো চাঁদি এবং তিনশত উট।

হারেছ ইবনে কালদাকে একশত উট দেয়া হল। কোরায়শ এবং কোরায়শ নয় এমন সকর গোত্রীয় নেতাকে কাউকে একশত, কাউকে পঞ্চাচ এবং কাউকে চল্লিশটি করে উট দেয়া হলো। লোকদের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লো যে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতো এতো দান করেন যে, তিনি দারিদ্রের আশঙ্কা করেন না। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বেদুইনরা এসে আল্লাহর রসূলকে ঘিরে ধরলো এবং তাঁকে একটি গাছের কাছে নিয়ে গেলো। তাদের ভিড়ের চোটে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাদর গাছের মধ্যে থেকে গেলো। তিনি বললেন, হে লোক সকল আমার চাদর দিয়ে দাও।

সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রান রয়েছে, যদি তোহামার বৃক্ষরাজির সংখ্যার সমান চতুষ্পদ জন্তুও আমার কাছে থাকে, তবুও আমি সব বন্টন করে দেবো। এরপর তোমরা দেখবে, আমি কৃপণ নই, ভীত নই, মিথ্যাবাদী নই। ১১[আশশেফা, কাযী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৮৬]

এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের উটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার কয়েকটি লোম তুলে নিয়ে দেখিয়ে বললেন, হে লোক সকর, তোমাদের ‘ফাঈ’ মালামালের মধ্যে থেকে আমার জন্যে কিছু নেই। এমনকি এই যে উটের পশম দেখছো, এই পরিমাণও নেই শুধুমাত্র খুমুস রয়েছে, অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মাথাপিছু বন্টনে এক পঞ্চামাংশের অংশ বিশেষ সেই খুমুস ও তোমাদের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

নবদীক্ষিত মুসলমানদের দেয়া হলো, যাদেরকে কোরআনে ‘মোয়াল্লেফাতুল কুলুব’ বলা হয়েছে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত যায়েদ ইবনে ছাবেতকে বললেন, তিনি যেন গনীমতের মাল এবং সৈন্যদের এক জায়গায় করে বন্টনের হিসাব করেন। তিনি তাই করলেন। এতে প্রত্যেক সৈন্যের ভাগে চারটি উট এবং ৪০টি বকরি পড়লো। বিশিষ্ট যোদ্ধারা পেলেন ১২টি করে উট এবং ১২টি করে বকরি।

এ বন্টনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন। কেননা, পৃথিবীতে বহু লোক এমন রয়েছে যারা নিজের বিবেকের পথে নয় বরং পেটের পথে চলে। পশুর সামনে একমুঠো তাজা ঘাস ঝুলিয়ে পিছনে সরে গিয়ে তাকে যেমন নিরাপদ ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া যায় তেমনি উল্লিখিত সম্পদ বন্টনের দ্বারা নবদীক্ষিত মুসলমানদের মন জয়ের চেষ্ট করা হয়েছে, যাতে তারা ঈমান শেখার সুযোগ পায় এবং ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত হয়। ১২[ মোঃ গাযালী, ফেকহুস সিরাহ, পৃ-২৯৮-২৯৯]

আনসারদের মানসিক অবস্থা

যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিতরণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাজনৈতিক কৌশল প্রথমে বোঝা যায়নি। এ কারণে কিছু লোক সমালোচনা করছিলেন। বিশেষত আনসারদের মন খারাপ হয়েছিলো। কেননা তাদেরকে কিছুই দেয়া হয়নি। অথচ সঙ্কটকারে তাদের ডাকা হয়েছিলো এবং তারা দ্রুত হাযির হয়েছিলেন। তার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে, দৃশ্যমান পরাজয় বিজয়ে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু গনীমতের মাল বন্টনের ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য করলেন যে, সঙ্কটের সময় পলায়নাকরীদের হাত পরিপূর্ণ, অথচ তাদের হাত খালি। ১৩[একই গ্রন্থ একই পৃষ্টা}

ইবনে ইসহাক আবু সাইদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোরয়েশ এবং আরবের গোত্রীয় নেতাদের অধিক দান করলেন অথচ আনসারদের কিছুই দিলেন না, তখন তাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। তারা নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করলেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, আল্লাহর কসম, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন। হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা (রা.)রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে আপনি যা করেছেন, এতে আনসাররা খুশি হয়নি। তারা সমালোচনা করছে। তারা বলছে, আপনি শুধু নিজের কওমের মধ্যেই সম্পদ বন্টন করেছেন। আবর গোত্রদের বিশেষভাবে দান করেছেন। অতচ আনাসরদের কিছুই দেননি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, হো সা’দ, এ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? তিনি বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমিও তো আমার কওমেরই একজন। প্রিয় নবী বললেন, যাও তোমার কওমের লোকদের এক জায়গায় একত্রিত করো। সা’দ তাই করলেন। কয়েকজন মোহজের এলেন, তাদেরও বসতে দেয়া হলো। অন্য কিছু লোক এলো, তাদের ফিরিয়ে দেয়া হলো। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এরপর জানানো হলো যে, ওরা হাযির হয়েছেন। তিনি তখন তাদের কাছে গেলেন।

আল্লাহ যথোচিত প্রশংসা করার পর প্রিয়নবী বললেন, ‘হে আনসাররা, তোমাদের অসন্তোষ তোমাদের সমালোচনার কারণ কি? আমি কি তোমদের কাছে এমন অবস্থায় যাইনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? আল্লাহ তায়ালা এরপর তোমাদের হেদায়াত দিলেন। তোমরা ছিলে পরমুখাপেক্ষি, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন। তোমাদের পরস্পর অন্তর জোড়া লাগিয়ে দিয়েছেন। এসব কি ঠিক নয়? তারা বললেন, হাঁ, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি ঠিক বলেছেন। আমাদের ওপর আল্লাহ তায়াল এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক দয়া। তিনি বললেন, আনসাররা জবাব দিচ্ছ না কেন? তারা বললেন আমরা কি জবাব দেবো? আল্লাহ তায়াল এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক বড় দয়া আমাদের ওপর। তিনি বললেন, যদি তোমরা ইচ্ছা করো তবে একথা বলতে পারো যে, আপনি আমাদের কাছে এমন সময়ে এসেছিলেন যখন আপনাকে অবিশ্বাস করা হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আপনাকে বন্ধুহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল, সে সময় আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। আপনাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল, আমরা আপনাকে ঠিকানা দিয়েছি। আপনি মোহতাজ ছিলেন, আমরা আপনার দুঃখ লাঘব করেছি।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আনসাররা, তোমরা দুনিয়ায় তুচ্ছ একটা জিনিসের জন্যে মনে মনে নাখোশ হয়েছো। সেই জিনিসের মাধ্যমে আমি কিছু লোকের মনে প্রবোধ দিয়েছি, যেন তারা মুসলমান হয়ে যায়। তোমাদেরকে তোমাদের গৃহীত ইসলামের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। হে আনসাররা, তোমরা কি এতে খুশি নও যে, অন্যরা উট বকরি নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফিরবে? সেই যাতে-পাকের শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, যদি হিজরতের ঘটনা ঘটতো, তবে আমিও একজন আনসার হতাম। যদি সব লোক এক পথে চলে, আর অন্য পথে চলে, তবে আমি আনসারদের পথেই চলবো। হে আল্লাহ তায়াল, আনসারদের ওপর, তাদের সন্তানদের ওপর এবং তাদের পৌত্র-পোত্রীদের প্রতি রহমত করুন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভাষণ শুনে লোকেরা এতোবেশী কান্নাকাটি করলেন যে, তাদের দাড়ি ভিজে গেলো। তারা বলতে লাগলেন, আমাদের অংশে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থাকবেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে গেলেন এবং সাহবারা নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন। ১৪[ ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৪৯৯-৫০০, সহীহ বোখারী ২য় খন্ড, পৃ-৬২০-৬২১[

হাওয়াযেন প্রতিনিধি দলের আগমন

গনীমতের মালামাল বন্টনের পর হাওয়াযেন গোত্রের একদল প্রতিনিধি মুসলমান হয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলেন। তারা ছিলেন চৌদ্দজন। যোহায়ের ইবনে ছুরাদ ছিলেন তাদের নেতা। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেজায়ী চাচা আবু বারকানও তাদের মধ্যে ছিলেন। তারা এসে যুদ্ধবন্ধী এবং মালামাল ফেরত চাইলেন। তারা এমনভাবে কথা বললেন যে, সকলের মন নরম হয়ে গেলো।১৫[ইবনে ইসহাক বলেন, প্রতিনিধিদলের গোত্রের ৯ জন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করেন, বাইয়াত করেন এবং আল্লাহ-রসূলের সাথে কথা বলেন। তারা বলেন, যে, হে আল্লাহর রসূল, আপনি যাদের বন্দী করেছেন, এদের মধ্যে আমাদের মা বোন রয়েছেন, ফুফু খালা রয়েছেন। এটা আমাদের কওমের জন্যে অবমননাকর। (ফতহুল বারী ৮ম খন্ড, পৃ-৩৩)। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মা বোন ইত্যাদির দ্বারা আল্লাহর রসূলের রেজায়ী মা-খালা-ফুফু-বোন বুঝানো হয়েছে। প্রতিনিধি দলের পক্ষে কথা বলছিলেন যোবায়ের ইবনে ছুরাদ। আবু বারকানের মধ্য মতভেদ হয়েছে। কেউ কেউ আবু মারওয়ান এবং আবু ছারওয়ান বলে উল্লেখ করেছেন]। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমাদের সাথে যেসব লোক রয়েছে, তোমরা তাদের দেখতে পাচ্ছো। সত্য কথা আমি বেশী পছন্দ করি। সত্যি করে বলো, তোমরা নিজের সন্তান-সন্তনিকে বেশী ভালোবাসো নাকি ধন-সম্পদ?

তারা বললেন, পারিবারিক মর্যাদার মূ্ল্যই আমাদের কাছে বেশী। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, আমি যোহরের নামায আদায়ের পর তোমরা উঠে বলবে যে, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মোমেনীনদের পক্ষে সুপারিশকারী এবং মোমেনীনদের রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে সুপারিশকারী বানাচ্ছি। কাজেই আমাদের কয়েদীদের ফিরিয়ে দিন।

যোহরের নামাযের পর তারা সেকথা বললেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার নিজের এবং বনু আবুদল মোত্তালেবের অংশ তোমাদের জন্যে । আমি এখনই অন্য লোকদের জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। সাথে সথে আনসার এবং মোহাজেররা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমাদের যা কিছু রয়েছে, সেইসবও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে। এরপর আকরা ইবনে হাবেস উঠে দাঁড়িয়ে বললো, যা কিছু আমার এবং বনু তামিমের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। উত্তায়না বিন হিস্ন বললো, যা কিছু আমার এবং বনু ফাজরাদের রয়েছে সেসব আপনার জন্যে নয়। আব্বাস ইবনে মায়দাস বললো, যা কিছু আমার এবং বনু সালিমের সেসবও আপনাদের জন্যে নয়। বনু সালিম গোত্রের লোকের দাঁড়িয়ে বললো, জ্বী না; বরং যা কিছূ আমাদের রয়েছে, সেসবই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে। একথা শুনে আব্বাস ইবনে মারদাস বললো, তোমরা আমাকে অপমান করেছো।

রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দেখো ওরা মুসলমান হয়ে এসেছে। এ কারণে আমি তাদের বন্দীদের বন্টনে দেরী করেছি। কাজেই যাদের কাছে বন্দী রয়েছে তারা যেন ফিরিয়ে দেয়। এটা খুব ভালো হবে। যে ব্যক্তি নিজের প্রাপ্য অংশ রাখতে চায়, সেও যেন কয়েদীদের ফিরিযে দেয়। ভবিষ্যতে যখান ‘ফাঈ’- এর মাল পাওয়া যাবে, এর বিনিময়ে তাদের ছযগুন দেয়া হবে। লোকেরা বললো, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে সব কিছু সানন্দে দিতে রাযি আছি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি জানতে পারিনি-কারা রাযি , কারা কারা নারায।

এরপর বললেন, আপনারা বরং ফিরে যান, আপনাদের নেতাকে পাঠিয়ে দিন। এরপর সাহাবারা বন্দী শিশু ও মহিলাদের ফেরত দিলেন। উয়াইনা ইবনে হাসানের ভাগে একজন বৃদ্ধা পড়েছিলেন, তিনি তাকে ফিরিয়ে দিতে রাযি হলেন না, পরে তিনিও ফেরত দিলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক বন্দীকে একখানি করে কিবতি চাদর উপহার দিয়ে বিদায় করলেন।

ওমরাহ এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গনীমতের মাল বন্টন শেষে যেরানা থেকে ওমরাহর জন্যে এহরাম বাঁধেন এবং ওমরাহ আদায় করেন। এরপর আত্তাব ইবনে আছিদকে মক্কার গভর্নর করেন।।

মোহাম্মদ গাযালী বলেন, এই বিজয়ের সময় যখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর মাথায় ফতহে আযিমের মুকুট পরালেন, এই সময়ে এবং আট বছর আগে এই শহরে আসার সময়ের মধ্যে কতো ব্যবধান।

তিনি এই শহরে এমনভাবে এসেছিলেন যে, তিনি ছিলেন নিরাপত্তার প্রত্যাশী। সেই সময় তিনি ছিলেন অচেনা, অপরিচিত, সংশয় ছিলো তাঁর মনে। সে সময় স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁকে মর্যাদা দিয়েছিলো আশ্রয় দিয়েছিলো, সাহায্য করেছিলো, তিনি যে নূর সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তারা সেই নূরের আনুগত্য করেছিলো। শুধু তাই নয় তার জন্যেই তারা অন্যদের সব রকমের শত্রুতা তুচ্ছ মনে করেছিলো। আট বছর আগে এই মদীনায় হিজরত করার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো তারাই আজ পুনরায় সম্বর্ধনা দিচ্ছে। আজ মক্কা তাঁর করতলগত, তাঁর নিয়ন্ত্রণে। মক্কার জনগণ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মূর্খতা দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পদতলে বিসর্জন দিয়েছে। তিনি তাদের অতীত দিনের সকল অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে গৌরব ও সাফল্য দান করেছেন।

আল্লাহ তায়াল কোরআনে হাকিমে বলেন, ‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি সত্যবাদিতা এবং ধৈর্য অবলম্বন করে, তবে আল্লাহ তায়ালা পুন্যশীলদের বিনিময় নষ্ট করেন না। ’১৬[ ফেকহুস সিরাহ পৃ-৩০৬, মক্কা বিজয় এবং তায়েফের যুদ্ধ বিস্তারিত জানার জন্যে দেখুন যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-১৬০-২০১,ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৩৮৯-৫০১, সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬১২-৬২৩, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-৩-৮৫]

মক্কা বিজয়ের পরবর্তী ছারিয়্যাসমূহ

এই দীর্ঘ এবং সফল সফরের পর মদীনায় ফিরে এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় বেশ কিছুকাল অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি বিভিন্ন প্রতিনিধিদলকে অভ্যর্থনা জানান, প্রশাসন পরিচালনার জন্যে কর্মকর্তা প্রেরণ করেন এবং দ্বীনের প্রচারের জন্যে দাঈ প্রেরণ করেন।

এছাড়া, যারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হওয়ার পরও তা মেনে নিতে পারেননি, বরং নানাভাবে ঔদ্ধত্য ও হঠকারিতার পরিচয় দিচ্ছিলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মোকাবেলা করেন। নিচে সেসব বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।

যাকাতের জন্যে তহশিলদার প্রেরণ

ইতিপূর্বের আলোচনায় এট স্পষ্ট হয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮ম হিজরীর শেষদিকে মদীনায় ফিরে আসেন। নবম হিজরীতে মহররমের চাঁদ ওঠার পর পরই নবী মোস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন গোত্র থেকে যাকাত আদায়ের জন্যে তহশীলদার প্রেরণ করেন। নিচে তাদের তালিকা দেয়া হলো।

তহশীলদারের নামগোত্রের কাছে পাঠানো হয়

১উয়ইনা ইবনে হাসানবনু তামিম

২ইয়াযিদ ইবনে হোসাইনআসলাম ও গেফার

৩ওব্বাদ ইবনে বশীর আশহালিসোলাইম ও মুযাইনা

৪রাফে ইবনে মাকিছযুহাইনা

৫আমর ইবনুল আসবনু ফাযারাহ

৬যাহহাক ইবনে সুফিয়ানবনু কেলাব

৭ বশীর ইবনে সুফিয়ানবনু কা’ব

৮ইবনুল লুতবিয়াহ আযদিবনু যাবিয়ান

৯মোহজের ইবনে আবু উমাইয়াসনআ শহর

১০যিয়াদ ইবনে লবিদহাদরামাউত

১১আদী ইবনে হাতেমতাঈ এবং বনু আছাদ

১২মালেক ইবনে নোয়ইরাহবনু হানযালা

১৩যবরকান ইবনে বদরবনু সা’দ এর একটি অংশ

১৪কাইস ইবনে আসেমবনু সা’দ এর অন্য অংশ

১৫আলা ইবনে হাদরামিবাহরাইন

১৬আলী ইবনে আবু তালেবনাযরান

এসকল সাহাবাকে তহশীলদারের দায়িত্ব দিয়ে নবম হিজরীর মহররম মাসে প্রেরণ করা হয়। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার গোত্রের লোকের ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মহররম মাসের প্রথম দিকে অনোকে এবং পরে অনেকে রওয়ানা হয়ে যান। এর দ্বারা হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে ইসলামের দাওয়াতের সাফল্যের ব্যাপকাত সম্পর্কে ধারণা করা যায়। মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে শুরু করেন।

এ সময়কার কয়েকটি ছারিয়্যা

বিভিন্ন গোত্রের কাছে যাকাত আদায়ের জন্যে তহশীলদার প্রেরণ করা হয়। কিন্তু জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা সত্তেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখঅ দেয়। সেসব দমনে সৈন্য প্রেরণ করা হয়। নীচে এমন কিছু ছারিয়্যার বিবরণ উল্লেখ করা যাচ্ছে।

(১) ছারিয়্যা উয়াইনা ইবনে হাসান ফাজারি

নবম হিজরীর মহররম মাস

উয়াইনাকে ৫০ জন সওয়ারের নেতৃত্ব দিয়ে বনু তামিম গোত্রের কাছে প্রেরণ করা হয়। কারণ হচ্ছে যে, বনু তামিম বিভিন্ন গোত্রকে উস্কানি দিয়ে জিযিয়া আদায় থেকে বিরত রেখিছিলো। এ অভিযানে কোন মোহাজের বা আনসার ছিল না।

উয়াইনাকে ইবনে হানান রাত্রিকালে পথ চলতেন এবং দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতেন। এভাবে চলার পর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে বনু তামিম গোত্রের লোকদের ধাওয়া করলেন। তারা ঊর্ধশ্বাসে ছুটে পালালো। তবে, ১১জন পুরুষ ২১জন নারী এবং ৩০টি শিশুকে মুসলমানরা গ্রেফতার করলেন। এদের মদীনায় নিয়ে এনে রামলা বিনতে হারেসের ঘরে আটক রাখা হলো।

পরে বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে বনু তামিম গোত্রের ১০ জন সর্দার এলেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজায় গিয়ে এভাবে হাক দিলেন হে মোহাম্মদ, আমাদের কাছে আসুন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাইরে এলেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে লাগলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে কাটালেন। ইতিমধ্যে যোহরের নামাযের সময় হলো। তিনি নামায পড়ালেন। নামায শেষে মসজিদের আঙ্গিনায় বসলেন। বনু তামিমের সর্দাররা নিজেদের গর্ব অহংকার প্রকাশক বিতর্কের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাদের বক্তা আতা ইবনে হাজেবকে সামনে এগিয়ে দিলেন। তিনি বক্তৃতা করলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মোকাবেলার জন্যে খতীব ইসলাম হযরত ছাবেত ইবনে কায়েস শাম্মাসকে আদেশ দিলেন। তিনি জবাবী বক্তৃতা দিলেন। বনু তামিম সর্দাররা এরপর তাদের গোত্রের কবি জায়কাল ইবনে বদরকে সামনে এগিয়ে দিলেন। তিনি অহংকার প্রকাশক কিছু কবিতা আবৃতি করলেন। শায়েরে ইসলাম হযরত হাস্সান ইবনে ছাবেত তার জবাব দিলেন।

উভয় বক্তা ও কবি বক্তৃতা ও কবিতা আবৃতি শেষ করলে আকরা ইবনে হাবেছ বললেন, ওদের বক্তা আমাদের বক্তার চেয়ে জোরালো বক্তৃতা এবং ওদের কবি আমাদের কবির চেয়ে ভালো কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ওদের বক্তা এবং কবির আওয়ায আমদের বক্তা ও কবির আওয়াযের চেয়ে বুলন্দ। এরপর আগন্তুক বনু তামিম সর্দাররা ইসলাম গ্রহণ করেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে দাসী উপহার প্রদান করেন এবং বন্দি নারী ও শিশুদের ফিরিয়ে দেন। ১[ যুদ্ধ বিষয়ে বিশারদ লেখকরা বর্ণনা করেছেন যে, নবম হিজরীর মহররম মাসে এ ঘটনা ঘটে। এতে বোঝা যায় যে, আকরা ইবনে হাবেছ সে সময়েই মুসলমান হন। কিন্তু সীরাত রচয়িতরা লিখেছেন, আল্লাহর রসূল বনু হাওয়াযেন গোত্রের বন্দীদের ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। তখন আকরা ইবনে হাবেছ বলেন, আমি এবং বনু তামিম ফিরিয়ে দেব না। এ দ্বারা বোঝা যায় যে, আকরা ইবনে হারেছ নবম হিজরীর মহররম মাসের আগেই মুসলমান হয়েছিলেন।]

২. ছারিয়্যা কুতবাহ ইবনে আমের

নবম হিজরীর সফর মাস

এই ছারিয়্যা তোরবার কাছে তাবালা এলাকায় খাশআম গোত্রের একটি শাখার দিকে রওয়ান হয়েছিলো। কোতবা ২০ জন লোকের সমন্বয়ে যাত্রা করেন। ১০টি ছিলো উট। পর্যায়ক্রমে সেসব উটে এরা সওয়ার হন। মুসরমানরা আকস্মিক হামলা করেন। এতে প্রচন্ড সংঘর্ষ শুরু হয়। উভয় পক্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়। কোতবা অন্য কয়েকজন সঙ্গীসহ নিহত হন। তবুও মুসলমানর ভেড়া, বকরি এবং শিশুদের মদীনায় নিয়ে আসেন।

৩. ছারিয়্যা যাহহাক ইবনে সুফিয়ান কেলাবী

নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস

এই ছারিয়্যা বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে রওয়ানা করা হয়েছিলো। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে যুদ্ধ শুরু হয়। মুসলামনরা তাদের পরাজিত করে তদের একজন লোককে হত্যা করেন।

৪. ছারিয়্যা আলকামা ইবনে মজবের মাদলাযি

নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস

আলকামাকে তিনশত সৈন্যের সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে জেদ্দা উপকূলের দিকে প্রেরণ করা হয়। কারণ ছিলো এই যে, কিছু সংখ্যক হাবশী জেদ্দা উপকূলের কাছে সমবেত হয়েছিলো। তারা মক্কার জনগণের ওপর ডাকাতি রাহাজানি করতে চাচ্ছিলো। আলকামা সমুদ্রে অভিযান চালিয়ে একটি দ্বীপ পর্যন্ত অগ্রসর হন। হাবশীরা মুসলমানদের আগমন সংবাদ পেয়ে পলায়ন করে। ২[ ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-৫৯[

৫. ছারিয়্যা আলী ইবনে আবু তালেব

নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস

হযরত আলী (রা.)-কে তাঈ গোত্রের কালাস বা কলিসা নামের একটি মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে প্রেরণ করা হয়েছিলো। হযরত আলীর নেতৃত্বে একশত উট এবং পঞ্চাশটি ঘোড়াসহ দেড়শত সৈন্য রওয়ান হন। তারা সাদা কালো পতাকা বহন করেন। ফজরের সময় মুসলমানরা হাতেম তাঈয়ের মহল্লায় হামলা চালিয়ে কালাস মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। এরপর বহু লোক, চতুষ্পদ জন্তু এবং ভেড়া,বকরি আটক করা হয়। এসব বন্দীর মধ্যে হাতেম তাঈয়ের কন্যাও ছিলেন। হাতেমের পুত্র আদী ইবনে হাতেম সিরিয়ার পথে পালিয়ে যায়। মুসলমানরা কালাস মূর্তির ঘরে তিনটি তলোয়ার এবং তিনটি বর্ম পান। ফেরার পথে গনীমতের মাল বন্ট করা হয়। হাতেম তাঈয়ের কন্যাকে কারো ভাগে দেয়া হয়নি।

মদীনায় পৌঁছার পর হাতেম তাঈয়ের কন্যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দয়ার আবেদন জানিয়ে বললেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এখানে যে আসতে পারতো, সে আজ নিখোঁজ। পিতা মারা গেছেন। আমি বৃদ্ধা। খেদমত করার শক্তি নাই। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দয়া করবেন। নবী মোস্তাফা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার জন্যে কে আসতে পারতো? বললেন, আমার ভাই আদী ইবনে হাতেম। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে লোক-যে আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। একথা বলে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলেন। তিনদিন একই প্রশ্নোত্তর হলো। তৃতীয় দিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দয়া করে হাতেমের মেয়েকে আযাদ করে দিলেন। সে সময় সেখানে একজন সাহাবী ছিলেন, সম্ভবত হযরত আলী, তিনি মহিলাকে বললেন, দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সওয়ারীর জন্যেও আবেদন জানাও। মহিলা তাই করলেন। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতেমের কন্যার জন্যে সওয়ারীর ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিলেন।

হাতেমের কন্যা মদীনা থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা সিরিয়ায় চলে যান। ভাইদের সথে দেখা করে তিনি বলেন, দয়াল নবী এমন দয়া দেখিয়েছেন, যে দয়া তোমার বাবাও দেখাতে পারতেন না। তাঁর কাছে তুমি ভয় এবং আশার সাথে যাও। এরপর আদী ইবনে হাতেম মদীনায় গিয়ে সরাসরি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করলেন। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সামনে বসিয়ে বললেন, তুমি কোথায় পালাচ্ছ? আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল থেকে পালাচ্ছ? যদি তাই হয়ে থাকে তবে বলো আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কোন উপাস্যের কথা তুমি কি জানো? তিনি বললেন, জানি না। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, শোনো ইহুদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ রয়েছে, খৃষ্টানরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট। আদী বললেন, তবে আমি একজন একরোখা মুসলমান। একথা শুনে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা খুশীতে চিকচিক করে উঠলো। তিনি হাতেমের পুত্রকে একজন আনসারীর বাড়ীতে রাখলেন। এরপর আদী ইবনে হাতেম সকাল বিকাল নবী মোস্তফার কাছে হাযির হতেন। ৩[যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড, পৃ-২০৫]

ইবনে ইসহাক আদী ইবনে হাতেম থেকে বর্ণানা করেছেন, নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরে তাঁর সামনে আদী ইবনে হাতেমকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আদী ইবনে হাতেম, তুমি কি পুরোহিত ছিলে না? আদী বলেন, আমি বলেছিলাম জ্বী তাই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তোমার কওমের গনীমতের মাল এক চতুর্থাংশ গ্রহণ করতে না? আমি বলেছিলাম, জ্বী হাঁ তাই। তিনি বললেন, অথচ এটা তোমাদের দ্বীনে হালাল নয়। আমি বললাম, হাঁ তাই। সেই সময়েই আমি বুঝেছিলাম যে, তিনি হাদী বরহক, তিনি আল্লাহর প্রেরিত রসূল। কারণ, তিনি এমন বিষয় আমাকে বলেছেন, যা তার পক্ষে জানা স্বাভাবিক ছিলো না। ৪[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৫৮১]

মোসনাদে আহমদ-এর বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে আদী, ইসলাম গ্রহণ করো শান্তিতে থাকবে। আমি বললাম, আমি তো একটা দ্বীন অনুসরণ করি। তিনি বললেন, তোমার দ্বীন সম্পর্কে আমি তোমার চেয়ে বেশী জানি। আমি বললাম, আপনি আমার দ্বীন সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশী জানেন? তিনি বললেন, হাঁ। এটা কি ঠিক নয় যে, তুমি পুরোহিত ? তুমি তোমার কওমের গনীমতের মাল এক চতুর্থাংশ ভোগ-ব্যবহার করো? আমি বললাম, হাঁ, তাই। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা তো তোমাদের ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল নয়। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথায় আমার মাথা নত হয়ে গেলো। ৫[ মোসনাদে আহমদ, সপ্তম খন্ড, পৃ-২৫৮-২৭৮]

সহীহ বোখারী শরীফে হযরত আদী ইবনে হাতেম থেকে বর্ণিত আছে যে, আমি নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে বসেছিলাম। এমন সময় একজন লোক এসে তার ক্ষুধার্ত অবস্থার কথা জানালো। অন্য একজন এসে ডাকতি রাহাযানির অভিযোগ করলো। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আদী, তুমি হীরা শহর দেখেছো? যদি তোমার আয়ু বেশী হয়, বেশীদিন বাঁচো, তবে দেখতে পাবে যে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে একজন মহিলা হীরা থেকে আসবে এবং কাবাঘর তাওয়াফ করবে। এ সময়ে আল্লাহর ভয় ছাড়া তার অন্য কোন ভয় থাকবে না। যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে তোমরা কেসরার ধনভান্ডার অধিকর করবে। যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে দেখবে, আঁচল ভরে সোনা বিতরণের জন্যে নেয়া হবে, কিন্তু গ্রহণ করার লোক পাওয়া যাবে না। সেই বর্ণনা শেষে রয়েছে যে, আদী বলেন, আমি দেখেছি, হাওদাজে চড়ে আসা একজন মহিলা হীরা থেকে এসে কারাঘর তাওয়াফ করেছে কিন্তু আল্লাহ ছাড়া তার অন্য কারো ভয় ছিলো না। কেসরার ধন ভান্ডার যার জয় করেছিলেন, আমি নিজেই ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। তোমরা যদি দীর্ঘজীবী হও, তবে আবুল কাসেমের সেই কথার সত্যতার প্রমাণও পাবে। তিনি যে বলেছেন, আঁচল ভরে বিতরণের জন্যে সোনা নেয়া হবে, কিন্তুতা গ্রহণের লোক পাওয়া যাবে না। ৬[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৫০৭]


তবুকের যুদ্ধ
মক্কা বিজয় ছিলো সত্য ও মিথ্যার মধ্যে এক সিদ্ধান্ত মূলক অভিযান। এ অভিযানের পর মক্কা বাসীদের মনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও রেসালাত সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ অবশিষ্ট ছিলো না। তাই পরিস্থিতির বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছিলো। জনগণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিলো। প্রতিনিধি দল প্রেরণ শীর্ষক অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করবো। বিদায় হজ্জের সময়ে উপস্থিত মুসলমানদের সংখ্যা থেকে ও এ বিষয়ে আন্দাজ করা যায়। মোট কথা অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান প্রায় হয়েগিয়েছিলো বিধায়, মুসলামনর ইসলামী শরীয়তের শিক্ষা সার্বজনীন করা এবং ইসলমের প্রচার প্রসারে ঐকান্তিকভাবে মনোযোগী হয়ে পড়েছিলো।

যুদ্ধের কারণ

ওই সময়ে এমন একটি শক্তি মদীনার প্রতি দৃষ্টি দিয়েছিলো, যারা কোন প্রকার উস্কানি ছাড়াই মুসলামনদের গায়ে বিবাদ বাধাতে চাচ্ছিলো। এরা ছিলো রোমক শক্তি। সমকালীন বিশ্বে এরা ছিলো সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ শক্তি। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বিবাদের ভূমিকা তৈরী হয়েছিলো শেরহাবিল ইবনে আমর গাস্সানির হাতে। এই ব্যক্তি নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দূত হারেস ইবনে আযদিকে হত্যা করেছিলো। বসরা গভর্নরের কাছে সে দূত পাঠানো হয়েছিলো। এরপর হযরত যায়েদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। ফলে রোমক ভূমিতে মূতার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মুসলিম বাহিনী শত্রুদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। তবু এ অভিযান কাছে ও ‍দূরবর্তী আরব অধিবাসীদের মনে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলো।

কায়সারে রোম এ সকল প্রভাব প্রতিক্রিয়া এবং এর পরিমাণ উপেক্ষা করতে পারেনি। মুসলিম অভিযানের ফলে আরেবের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে স্বাধীনতা চেতনা মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিলো। এটা ছিলো তার জন্যে একট বিপজ্জনক অবস্থা। অথচ জনগণের স্বাধীনতার চেতনা সীমান্তবর্তী এলাকায় রোমকদের জন্যে চ্যলেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বিশেষ করে সিরিয়ার সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ কারণে কায়সারে রোম ভাবলো যে, মুসলমানদের শক্তি বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই দমন ও নিশ্চিহ্ণ করে দিতে হবে। এতে করে রোমের সাথে সংশ্লিষ্ট আরব এলাকাসমূহে ফেতনা ও হাঙ্গামা মাথাচড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না।

এসব যুদ্ধের কারণে মূতার যুদ্ধের পর এক বছর যেতে না যেতেই কায়েসারে রোম, রোমের অধিবাসী এবং রোমের অধীনস্ত আরব এলাকাসমূহ থেকে সৈন্য সমাবেশ শুরু করলেন। এটা ছিলো মুসলমানদের সাথে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পূর্ব প্রস্তুতি।

রোম ও গাসসানের প্রস্তুতির সাধারণ খবর

এদিকে মদীনায় পর্যায়ক্রমে খবর আসছিলো যে, রোমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সিদ্ধান্তমূলম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। এ খবর পেয়ে মুসলমানরা অস্বস্তি এবং উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোন শব্দ শুনলেই তারা চমকে উঠতেন। তারা ভাবতেন, রোমকরা বুঝি এসে পড়েছে। নবম হিজরীতেস একটি ঘটনা ঘটলো। এ ঘটনা থেকেই মুসলমানদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার পরিচয় যায়। এ সময়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে ঈলা১[নারীর কাছে না যাওয়ার কসম করা। এই কসম চার মাস বা তার চেয়ে কম মেয়েদের জন্যে শরীয়ত অনুযায়ী এর জন্যে কোন বিধান প্রযোজ্য হবে না। আর যদি চার মাসের বেশী মেয়াদের জন্যে কসম করা হলে চার মাস পুরো হওয়ার সাথে সাথে শরয়ী আদালতে বিষয়টি রুজু হবে এবং আদালত বলবে যে, আপনি হয় স্ত্রীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিন অথবা তাকে তালাক দিন। অবশ্য কোন কোন সাহাবার মতে চার মাস কেটে যাওয়ার পর আপন আপনি তালাক হয়ে যায়।] করে তাঁদের ছেড়ে একটি পৃথক ঘরে উঠেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম প্রথম দিকে কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। তারা ভেবেছিলেন, নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। এতে সহাবাদের মধ্যে গভীর চিন্তা ও মনোবেদনা ছড়িয়ে পড়েছিলো। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এ ঘটনা করতে গিয়ে বলেন, আমার একজন আনসার সঙ্গী ছিলো। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আমি অনুপস্থিত থাকলে তিনি আমার কাছে খবর নিয়ে আসতেন, যখন তিনি অনুপস্থিত থাকতেন, তখন আমি তার কাছে খবর নিয়ে আসতাম। এরা দু’জন মদীনার উপকন্ঠে বসবাস করতেন। একজন অন্যজনের প্রতিবেশী ছিলেন। পর্যায়ক্রমে নবী (আ.)-এর খেদমতে হাযির হতেন। হযরত ওমর বলেন, সেই সময়ে গাস্সান অধিপতির ব্যাপারে আমরা আশঙ্কা করছিলাম। আমাদের বলা হয়েছিলো যে, গাস্সান রাজ আমাদরে ওপর হামলা করতে পারেন। এ কারণে সব সময় উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাতাম। আমার আনসার সাথী একদিন হঠাৎ এসে দরজায় করাঘাত করে বললেন, খোলো খোলো। আমি বললাম, গাস্সানী কি এসে পড়েছে? তিনি বললেন, না, বরং তার চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাঁর স্ত্রীদের থেকে আলাদ হয়ে গেছেন। ২[সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৭৩০]

অপর এক বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত ওমর (রা.) বলেন, আামদের মধ্যে এ মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, গাস্সান সম্রাট আমাদের ওপর হামলা করতে ঘোড়া প্রস্তুত করেছেন। আমার সাথে নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে একদিন এসে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে লাগলেন। তিনি বাইরে থেকে বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি? আমি উৎকন্ঠিতভবে বাইরে এলাম। তিনি বললেন, বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললাম, কি হয়েছে? গাস্সান কি এসে পড়েছে? তিনি বললেন, না এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। ৩[সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-৩৩৪]

এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, সে সময় মুসলমানদের ওপর রোমকদের হামলার হুমকি ছিলো কতো মারাত্মক। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম মদীনায় পৌঁছার পর মোনাফেকরা রোমকদের যুদ্ধ প্রস্তুতির অতিরঞ্জিত খবর মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করছিলো। কিন্তু মোনাফেকরা লক্ষ্য করছিলো যে, সব ক্ষেত্রেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম সফল হচ্ছেন এবং তিনি বিশ্বের কোন শক্তিকেই ভয় পান না। তাঁর সামনে যে কোন বাধা এলেই তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। এসব সত্তেও মোনাফেকরা মনে মনে আশা করছিলো যে, মুসলমানরা এবার আর রক্ষা পাবে না, তারা নাকানি চুবানি খাবেই। সেই প্রত্যাশিত তামাশা দেখার দিন আর বেশী দূরে নয়। এরূপ চিন্তা-ভাবনার প্রেক্ষিতে তারা একটি মসজিদ তৈরী করলো, যা ‘মসজিদে দেরার’ নামে পরিচিত।। উক্ত মসজিদে মোনাফেকরা বসে আড্ডা দিত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র করতো। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, মুসলিম উম্মার ঐক্যে ফাটল ধরানো এবং শত্রুদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার লক্ষ্যেই এটি তৈরী করা হয়েছিলো। অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সেই মসজিদে তারা শুধু ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত থেকেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং সে মসজিদে নামায আদায়ের জন্যে নবী (স.)-কে আবেদন জানিয়েছিলো। এর মাধ্যমে মোনাফেকরা সরল প্রাণ মুসলমানদের ধোঁকা দিতে চাচ্ছিল। নবী (স.) যদি একবার নামায আদায় করেন, তাহলে সাধারণ মুসলমানরা মোনাফেকদের প্রতিষ্ঠিত সেই মসজিদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে না। তাঁরা ধারণাও করতে পারবেন না যে, মসজিদ নামের এ ঘরে বসে তাদের বিরুদ্ধে কিরূপ ভয়ানক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া এ মসজিদে কারা যাতায়াত করছে মুসলমানরা সেদিকেও লক্ষ্য রাখবে না। এ মসজিদ এমনি করে মোনাফেক এবং তাদের বাইরের মিত্রদের ষড়যন্ত্রের একটা আখড়ার পরিণত হবে। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম সেই মসজিদে সাথে সাথে নামায আদায় করতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ইনশাআল্লাহ যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেই মসজিদে নামায আদায় করবো। সে সময়ে তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু মোনাফেকরা তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালা তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এস নবী শ্রেষ্ঠ সেই মসজিদে নামায আদায়ের পরিবর্তে সেটি ধ্বংস করে দেন।

রোম ও গাস্সানের প্রস্তুতির বিশেষ খবর

এ সময়ে সিরিয়া থেকে তেল আনতে যাওয়া নাবেতিদের ৪[এরা নাবেত ইবনে ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। এক সময় এরা পাটরা এবং হেজাযের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছিলে। কিন্তু কালক্রমে শক্তিহীন হয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীতে হয় পরিণত হয়] কাছে হঠাৎ জানা গেলো যে, হিরাক্লিয়াস ৪০ হাজার দুর্ধর্ষ সৈন্যের এক বহিনী তৈরী করেছেন এবং রোমের এক বিখ্যাত যোদ্ধা সেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব করছেন। সেই কমান্ডার তার অধীনে খৃষ্টান গোত্র লাখাম জাযাম প্রভৃতিকে সমভেত করেছে এবং অগ্রবর্তী বাহনিী বালকা নামক জায়গায় পৌঁছে গেছে। এমনিভাবে এক গুরুতর সমস্যা মুসলমানদের সামনে দেখা দিলো ।

পরিস্থিতির নাযুকতা

সেই সময় প্রচন্ড গরম পড়েছিলো। দেশে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং দুর্ভিক্ষপ্রায় অবস্থা বিরাজ করছিলো। এ কারণে অনেকেই ছায়ায় এবং ফলের কাছাকছি থাকতে চাচ্ছিলো। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ যেতে চাচ্ছিলেন না। তদুপরি পথের দূরত্ব ছিলো, পথ ছিলো দুর্গম ও বন্ধুর। সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি ছিলো বড়োই নাযুক।

তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত

আল্লাহর নবী এ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, এমন সঙ্কট সময়ে যদি রোমকদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শৈথিল্য ও অলসতার পরিচয় দেয়া হয় তাহলে রোমকরা মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকাসমূহে প্রবেশ করবে। ফলে ইসলামের দাওয়াত, প্রচার এবং প্রসারে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মুসলমানরা সামরিক শক্তির স্বাতন্ত্র হারাবে। হোনায়েনের যুদ্ধে পর্যুদস্ত, বাতিল ও কুফুরী শক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। বাইরের শক্তির সাথে গোপনে যোগাযোগ রক্ষাকারী মোনাফেকরা যারা সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছিলো তারা মুসলমানদের পিঠে ছুরিকাঘাত করবে। পেছনে থাকবে শত্রুদল মোনাফেক আর সামনে থাকবে বিধর্মী রোমক সৈন্যদল। এতে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত শ্রম-সাধনা ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে পড়বে। নবী এবং সাহাবাদের দীর্ঘদিনের কষ্ট বিফলে যাবে। অনেকক কষ্টে অর্জিত সাফল্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। অথচ এই সাফল্যের পেছনে মুসলমানদের ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাস বড়োই দীর্ঘ।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব সম্ভাবনা ভালোভাবে অনুধাবন করছিলেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, মুসলিম অধিকৃত ও অধ্যুষিত এলাকায় বিধর্মীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার তো দূরে থাক বরং ওদের এলাকায় গিয়েই আঘাত করা হবে।

রোমকদের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতির ঘোষণা

উল্লিখিত বিষয়সমূহ পর্যালোচনার পর নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের মধ্যে যুদ্ধ প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। মক্কাবাসী এবং আরবের বিভিন্ন গোত্রকেও যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। অন্য সময়ে নবী শ্রেষ্ঠ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন গন্তব্যের কথা গোপন রাখতেন। কিন্তু এবার তা করলেন না। প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের সাথে যুদ্ধ হবে।

মুসলমানরা যেন যুদ্ধের জন্যে ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারেন। এ জন্যেই প্রকাশ্যে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। যুদ্ধের জন্যে মুসলামনদের প্রস্তুতিতে উদ্ধুদ্ধ করতে সূরা তাওবার একাংশও নাযিল হয়েছিলো। সাথে সথে তিনি সদকা খয়রাত করার ফযিরত বর্ণনা করেন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ে মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্যে মুসলামনদের প্রচেষ্টা

সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ পাওয়ার পরই যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি শুরু করেন। মদীনার চারিদিক থেকে আগ্রহী মুসলমানরা আসতে থাকেন। যাদের মনে মোনাফেকী অর্থাৎ নেফাকের অসুখ রয়েছে, তারা ছাড়া কেউ এ যুদ্ধ থেকে ‍দূরে থাকার কথা ভাবতেই পারেননি। তবে তিন শ্রেণীর মুসলামন ছিলেন পৃথক। তাদের ঈমান ও আমলে কোন প্রকার ত্রুটি ছিলো না। গরীব ক্ষুধাতুর মুসলামনরা আসছিলেন এবং যানবাহনের ব্যবস্থা করার আবেদন জানাচ্ছিলেন। কিন্তু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অক্ষমতা প্রকাশ করছিলেন। সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ওদের কোন অপরাধ নেই, যারা তোমার কাছে বহনের জন্যে এলে ‍ তুমি বলেছিলে, ‘তোমাদের জন্যে কোন বাহন আমি পাচ্ছি না। ওরা অর্থ ব্যয়ে অসামর্থতাজনিত দুঃখে অশ্রু বিগলিত চোখে ফিরে গেলো।’

মুসলমানরা সদকা-খয়রাতের দিক থেকে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন । হযরত ওসমান (রা.) সিরিয়ায় ব্যবসার জন্যে প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কাফেলা তৈরী করেছিলেন। এতে সুসজ্জিত দুইশত উট ছিলো। দুশো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো রৌপ্য ছিলো তিনি এইসবই সদকা করে দিলেন। এরপর পুনরায় একশত উট সুসজ্জিত অবস্থায় দান করলেন। তিনি এক হাজার দীনার অর্থাৎ প্রায় ৫ কিলো সোনা নিয়ে এলেন এবং তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেসব উল্টেপাল্টে দেখছিলেন আর বলছিলেন, আজকের পর থেকে ওসমান যা কিছুই করুক না কেন, তার কোন ক্ষতি হবে না। ৫[জামে তিরিমিয, মানাকের ওসমান ইবনে আফফান, ২য় খন্ড, পৃ-২১১] এরপরও হযরত ওসমান (রা.) সদকা করেন। সব মিলিয়ে দেখা গেলো যে, তাঁর সদকার পরিমাণ নগদ অর্থ ছাড়াও ছিলো নয়শত উট এবং একশত ঘোড়া।

এদিকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) দু’শো উকিয়া অর্থাৎ প্রায় সাড়ে উনত্রিশ কিলো চাঁদি নিয়ে আসেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর ঘরের সবকিছু নিয়ে আসেন এবং ঘরে শুধু আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলকে রেখে আসেন। তাঁর সদকার পরিমাণ ছিলো চার হাজার দিরহাম। তিনিই প্রথমে তার সদকা নিয়ে হাযির হয়েছিলেন। হযরত ওমর (রা.) তার অর্ধেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন। হযরত আব্বাস (রা.) তাঁর বহু ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন। হযরত তালহা হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা এবং মোহাম্মদ ইবনে মোসলমাও অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে হাযির হন। হযরত আসেম ইবনে আদী নব্বই ওয়াসক অর্থাৎ সাড়ে ১৩ হাজার কিলো বা সোয়া তের টন খেজুর নিয়ে আসেন। অন্যান্য সাহাবারাও সাধ্যমত সদকা নিয়ে আসেন। কেউ এক মুঠো কেউ দুই মুঠোও দেন, তাদের এর বেশী দেয়ার সামর্থ ছিলো না।

মহিলারা তাদের হার, বজুবন্দ, ঝুমকা, পা-জেব, বালি, আংটি ইত্যাদি সাধ্যমাফিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কেদমতে প্রেরণ করেন। কেউ বিরত থাকেননি, কেউ পিছিয়ে থাকেননি। কৃপনতার চিন্তা কারো মনে আসেনি। বেশী বেশী যারা সদকা দিচ্ছিলেন, মোনাফেকরা তাদের খোঁটা দিচ্ছিলো যে, ওরা একটি দু’টি খেজুর দিয়ে কায়সারের দেশ জয় করতে চলেছে। কোরআনের সূরা তাওবায় এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মোমেনদের মধ্যে যারা স্বতস্ফূর্তভাবে সদকা দেয় এবং যারা নিজ শ্রম ব্যতীত কিছুই পায় না, তাদেরকে যারা দোষারোপ ও বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তায়ালা তাদরে বিদ্রূপ করেন, ওদের জন্যে আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’

তবুকের পথে মুসলিম সেনাদল

বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে ইসলামী বাহিনী প্রস্তুত হলো। প্রিয় নবী এরপর মোহাম্মদ ইবনে মোসলামা মতান্তরে ছাবা ইবনে আরফাতাকে মদীনর গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্যে হযরত আলীকে (রা.) মদীনায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। কিন্তু মোনাফেকরা সমালোচনা করে। এর ফলে হযরত আলী (রা.) মদীনা থেকে বেরিয়ে পড়েন এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিলিত হন। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে পুনরায় মদীনায় ফেরত পাঠান তিনি বলেন, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মূসা এবং হারুনের সম্পর্কের মতো। অবশ্য, আমার পরে কোন নব আসবে না।

নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যবস্থাপনার পর উত্তরদিকে রওয়ান হন। নাসাঈ- এর বর্ণনা অনুযায়ী সেদিন ছিলো শনিবার। গন্তব্য ছিলো তবুক। মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা ছিলো ত্রিশ হাজার। ইতিপূর্বে এতো বড় সেনাদল তৈরী হয়নি। এতো বড় সৈন্যদলে জন্যে মুসলামানদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও পুরো সাজ-সজ্জা সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। যানবাহন এবং পাথেয় ছিলো অপ্রতুর। প্রতি আঠার জন সৈন্যের জন্যে ছিলো একটি উট, সেই উটে উক্ত আঠারো জন পর্যায়ক্রমে সওয়ার হতেন। খাদ্য সামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে অনেক সময় গাছের পাতা খেতে হচ্ছিলো এবং উটের সংখ্যা কম হওয়া সত্তেও ক্ষুধার প্রয়োজনে উট যবাই করতে হচ্ছিলো। এ সব কারণে এ বাহিনীর নাম হয়েছিলো ‘জায়েশ উছরত’ অর্থাৎ অভাব অনটনের বাহিনী।

তবুক যাওয়ার পথে ইসলামী বাহিনী ‘হেজ’ অর্থাৎ সামুদ জাতির অবস্থান এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সামুদ জাতি ‘ওয়াদিউল কোরার’ ভেতরে পাথর খুঁড়ে বাড়ী তৈরী করেছিলো। সাহাবায়ে কেরাম সেখানে কূপ থেকে পানি উত্তোলন করেন। পানি তুলে রওয়ানা হওয়ার সময় নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম , ‘তোমরা এ জায়গায় পানি পান করো না এবং সে পানি ওযুর জন্যেও ব্যবহার করো না। তোমরা সেই কূপ থেকে পানি নাও, যে কূপে হযরত সালেহ (আ.)-এর উটনী পান পান করতো।’

বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেজর অর্থাৎ দিয়ারে সামুদ অতিক্রমের সময় বলেলেন, সে যালিমদের অবস্থান স্থলে প্রবেশ করো না, তাদের ওপর যে বিপদ এসেছিলো সে বিপদ তোমাদরে ওপর যেন না আসে। তবে হাঁ, কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করতে পারো। এরপর তিনি নিজের মাথা আবৃত করে দ্রুত সেই স্থান অতিক্রম করে গেলেন। ৬[ সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৬৩৭]

পথে পানির ভীষণ সমস্যা দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত সাহাবারা নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন জানালেন। তিনি দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালা মেঘ পাঠিয়ে দিলেন। প্রচুর বৃষ্টি হলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন এবং প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণও করলেন।

তাবুকের কাছাকাছি পৌঁছার পর নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইনশা -আল্লাহ আগামীকাল তোমরা তবুকের জলাশয়ের কাছে পৌঁছে যাবে। তবে চাশত-এর সময়ের আগে পৌঁছুতে পারবে না। যারা আগে পৌঁছুবে তারা যেন আমি না যাওয়া পর্যন্ত ওখানের পানিতে হাত না দেয়।

হযরত মায়া‘য (রা.) বলেন, তবুকে আমরা পৌঁছে দেখি আমাদের দু’জন সঙ্গী আগেই সেখানে পৌঁছলেন। ঝর্ণা থেকে অল্প অল্প পানি উঠছিলো। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানের পানিতে হাত লাগিয়েছো? তারা বললো, হাঁ। নবী একথা শুনে আল্লাহ তায়ালা যা চেয়েছিলেন তাই বললেন। এরপর ঝর্ণা থেকে আজলার সামন্য পানি নিলেন। ধীরগতিতে আসা পানি হাতের তালুতে জমা হওয়ার পার সে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুলেন তারপর সে পানিও ঝর্ণায় ফেলে দিলেন। এরপর ঝর্ণায় প্রচুর পানি উঠতে লাগলো। সাহাবারা তৃপ্তির সাথে সে পানি পান করলেন। এরপর নবী আমাকে বললেন, হে মায়া’য যদি তুমি দীর্ঘজীবী হও, তবে দেখতে পাবে যে, এখানে বাগান সজীব হেয় উঠেছে। ৭[মুসরিম শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ-২৪৬]

তবুক যাওয়ার পথে মতান্তরে তবুক পৌঁছার পর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আজ রাতে প্রচন্ড ঝড় হবে, তোমরা কেউ উঠে দাঁড়াবে না। যাদের কাছে উট থাকবে তার উটের রশি শক্ত করে ধরে রাখবে। রাতে প্রচন্ড ঝড় হলো। একজন সাহাবী উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, ঝড়ের তান্ডব তাকে উড়িয়ে নিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝখানে ফেলে দিয়েছিলো।১{ঐ]

এই সফরের সময় নবী যোহর ও আছরের নামায একত্রে এবং মাগরেবের ও এশার নামায একত্রে আদায় করতেন। জমে তাকদিম জমে তাখির দু’টোই করেছিলেন। জমে তাকদিম অর্থাৎ কখনো যোহর ও আছরের নামায যোহরের সময়েই আদায় করতেন এবং মাগরেব এশার নামায মাগরেবের সময়েই আদায় করতেন। জমে তাখির অর্থ কখনো যোহর ও আছরের নামায আছরের সময় আদায় করতেন। কখনো মাগরেব ও এশার নামায সময়ে আদায় করতেন।

তবুকে ইসলামী বাহিনী

ইসলামী বাহিনী তবু অবতরণের পর তাঁবু স্থাপন করলেন। তারা রোমক সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলেন। নবী আল-আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেজস্বিনী ভাষায় সাহাবাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সে ভাষণে তিনি দুনিয়া ও আখরাতের কল্যাণের জন্যে সাহাবাদের অনুপ্রাণিত করালেন, সুসংবাদ দিলেন। এই ভাষণে সৈন্যদের মনোবল বেড়ে গেলো। কোন কিছুর অভাবই তাদের মুখ্য মনে হলো না। অন্যদিকে রোম এবং তাদের বাহিনীর অবস্থার এমন হলো যে, তারা বিশাল মুসলিম বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে ভীত হয়ে পড়লো, সামনে এগিয়ে মোকাবেলা করার সাহস করতে পারল না। তারা নিজেদের শহরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো। বিধর্মীদের এ পিছুটান মুসলামনদের জন্যে কল্যাণকর প্রমাণিত হলো। আরব এবং আরবের বাইরে মুসলানদের সামরিক শক্তির শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা হতে লাগলো। এ অভিযানে মুসলানরা যে রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করে রোমকদের সাথে যুদ্ধ করলে সেই সাফল্য অর্জন সম্ভব হতো না।

বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আায়েলার শাসনকর্তা ইয়াহানা ইবনে রওবা নবী আল-আমিনের কাছে এসে জিজিয়া আদয়ের শর্ত মেনে নিয়ে সন্ধি চুক্তি করলেন। জাররা এবং আজরুহ-এর অধিবাসীরাও হাযির হয়ে জিজিয়া দেয়ার শর্ত মেনে নিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিলেন, তারা সেটি কাছে রাখলো। আয়েলোর শাসনকর্তাকে লিখে দেয়া একটি চুক্তি বা সন্ধিপত্র ছিল নিম্মরূপ, পরম করুনাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। এ শান্তি পরওয়ানা আল্লাহ এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে ইয়াহনা ইবনে রওবা এবং আয়েলার অধিবাসীদের জন্যে লেখা হচ্ছে। জলেস্থলে তাদের কিশতি এবং কাফেলার জন্যে আল্লাহর জিম্মা এবং নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জিম্মা এবং এই জিম্মা সেইসব সিরীয় ও সমুদ্রের বাসিন্দাদের জন্যে যারা ইযাহনার সাথে থাকবে। তবে হাঁ, এদের মধ্যে যদি কেউ গোলমাল পাকায়, তবে তার অর্থ-সম্পদ তার জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে মোহাম্মদ পারবে না। এ ধরনের ব্যক্তির ধন-সম্পদ যে কেউ গ্রহণ করবে, সেটা গৃহীতার জন্যে বৈধ হবে। ওদের কোন কূপে অবতরণ এবং জলেস্থলে কোন পথে চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধ করা যাবে না।’

এছাড়া রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত খালেদ ইবনে ওলীদকে ৪২০ জন সৈন্যের একটি দল দিয়ে দওমাতুল জন্দলের শাসনকর্তা আকিদের –এর কাছে পাঠালেন। খালেদকে বলে দেয়া হলো যে, তুমি দেখবে যে, সে নীল গাভী শিকার করছে। হযরত খালেদ গেলেন। শাসনকর্তার দুর্গ যখন দেখা যাচ্ছিলো হঠাৎ একটি নীল গাভী বের হলো এবং দুর্গের দরজায় গুঁতো মারতে লাগলো। আকিদের সেই গাভী শিকারে বের হলেন। হযরত খালেদ (রা.) তাঁর সৈন্যসহ আকিদেরকে গ্রেফতার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে নিয়ে এলেন। তিনি আকিদরে প্রাণ ভিক্ষা দিলেন এবং দুই হাজার উট, আটশত ক্রীতদাস, চারশত বর্ম এবং চারশত বর্শা পাওয়ার শর্তে চুক্তি করলেন।

আকিদের জিজিয়া দেয়ার পাওয়ার দেয়ার কথাও স্বীকার করলেন। নবী আকিদের-সাথে ইয়াহনাসহ দওমা, তবুক, আয়লা এবং তায়মার শর্তে সন্ধি স্থাপন করলেন।

এ অবস্থা দেখে রোমকদের ক্রীড়নক গোত্র সমূহ বুঝতে পারলো , রোমকদরে পায়ের তলায় আর মাটি নেই।এবার প্রভু বদল হয়ে গেছে। রোমকদের আনুগত্যের প্রয়োজন নেই, তাদরে কর্তৃত্বের দিন শেষ। এ কারণে তারাও মুসলামনদের মিত্র হয়ে গেলো। এমনি করে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোমক সীমান্তের সাথে মিলিত হলো এবং রোমকদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বহুলাংশে লোপ গেল।

মদীনায় প্রত্যাবর্তন

ইসলামী বাহিনী তবুক থেকে সফল ও বিজয়ীর বেশে ফিরে আসে। কোন সংঘর্ষ হয়নি। যুদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ছিলেন মোমেনীদের জন্যে যথেষ্ট। পথে এক জায়গায় একটি ঘাঁটিতে ১২জন মোনাফেক নবী আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার চেষ্টা করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলেন হযরত আম্মার (রা.)। তিনি উটের রশি ধরে এগুচ্ছিলেন। পেছনে হযরত হোযায়ফা ইবনে ইয়ামান (রা.)। তিনি উট হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্য সাহাবারা তখন ছিলেন দূরে। মেনাফেক কুচক্রীরা এ সময়কে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে নাপাক ইচ্ছা চরিতার্থ করতে সামনে অগ্রসর হলো। ‍নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সফরসঙ্গী দুইজন সাহাবী মোনাফেকদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেন। ১২জন মোনাফেক নিজেদের চেহারা ঢেকে অগ্রসর হচ্ছিল। প্রিয় নবী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। তিনি হযরত হোযায়ফা পাঠালেন। হযরত হোযায়ফা পেছনের দিকে গিয়ে মোনাফেকদের বাহন উটগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগলেন। এই আঘাতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রভাবিত করলেন। তারা দ্রুত পেছনের দিকে গিয়ে সাহাবায়ে কেরামের সাথে মিশে গেলো। এর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নাম প্রকাশ করে চক্রান্ত ফাঁস করে দিলেন। এ কারণ হযরত হোযায়ফাকে বলা হয় ‘রাযদান ’অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষাকারী। এ ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অ হাম্মু বেমা লাম ইয়া নালু’ অর্থাৎ তারা এ কাজের জন্যে ইচ্ছা করেছিলো কিন্তু তারা তা করতে পারেনি।

সফরের শেষ পর্যায়ে নবী আল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূর থেকে মদীনা দেখে বললেন, ওই হচ্ছে তাবা ওই হচ্ছে ওহুদ। এটি সেই পাহাড় যে পাহাড় আমাকে ভালোবাসে এবং যে পাহাড়কে আমিও ভালোবাসি। এদিকে তার আগমন সংবাদ মদীনায় ছড়িয়ে পড়লে আবাল বৃদ্ধ বনিতা বেরিয়ে পড়ে বিপুল উষ্ণতায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো। তারা তখন গাইছিলো ৯[এটি ইবনে কাইয়েমের কথা। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে] ‘আমাদের ওপর ছানিয়াতুল বেদা থেকে চতুর্দশীর চাঁদের উদয় হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহকে যারা ডাকার তারা ডাকবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত শোকর করা আমাদের জন্যে ওয়াজেব। ’

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তবুকের উদ্দেশ্যে রজব মাসে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং রমযান মাসে ফিরে এসেছিলেন। এই সফরে পুরো ৫০ ‍দিন সময় অতিবাহিত হয়েছিলো। তন্মধ্যে ২০দিন তিনি তবুকে ছিলেন আর ৩০দিন লেগেছিলো যাওয়া আসায়। জীবদ্দশায় সশরীরে উপস্থিত থেকে এটাই ছিলো নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ জেহাদ।

বিরোধীদের বিবরণ

তবুকের যুদ্ধ ছিলো বিশেষ অবস্থার কারণে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষা। এর মাধ্যমের ঈমানদার এবং অন্য লোকদের পার্থক্য প্রমাণিত হয়েছিলো। এ ধরণের কঠিন সময়ে আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের পরীক্ষা করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-ইমরানের বলেন, ‘অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছো আল্লাহ তায়ালা মোমেনদের সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। অদৃশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অবহিত করার নন। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন ’

এই যুদ্ধে সকল মোমেনীন সাদেকীন অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধে অনুপস্থিতি নেফাকের নিদর্শনরূপে বিবেচিত হয়। কেউ পেছনে থেকে গেলে তার সম্পর্কে নবী আল আমিনের কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেছিলেন, ওর কথা ছাড়ো। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থাকে তবে আল্লাহ শীঘ্র তাকে তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবেন আর যদি না থাকে তবে, অচিরেই তার থেকে তোমাদরে নাজাত দেবেন। মোটকথা এই যুদ্ধ থেকে দুই শ্রেণীর লোক দূরে ছিলো। এক শ্রেণীর লোক মা’যুর বা অক্ষম, অন্য শ্রেণী মোনাফেক। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনার দাবীতে ছিলো মিথ্যা, তারাই ছিলো মোনাফেক, তারা মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার জন্যে ওযর খাড়া করেছিলো। এদের কেউ কেউ যুদ্ধে না যাওয়ার জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতিও নেয়নি। তবে এদর মধ্যে তিনজন ছিলেন পাক্কা মোমেন এবং ঈমানদার। তারা যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ ছাড়াই যুদ্ধ থেকে দূরে ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাদের তওবা কবুল করেন।

এ ঘটনার বিবরণ এই যে, যুদ্ধ থেকে নবী মুরসলিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভ্যাস মোতাবেক প্রথমে মসজিদে নববীতে গিয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। এরপর তিনি সেখানে বসলেন। মোনফেকদের সংখ্যা ছিল ৮০ বা এর চেয়ে কিছু বেশী। ১০[ওয়াকেদী লিখেছেন, এই সংখ্যা মদীনার মোনাফেকদের । এছাড়া বনু গেফার এবং অন্যান্য গোত্রের মোনাফেকদের সংখ্যা ছিল ৮২। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার অনুসারীদের হিসাব এর মধ্যে ধরা হয়নি। তাদের সংখ্যাও ছিল অনেক। দেখুন ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-১১৯] তারা মসজিদের নববীতে এসে যুদ্ধে যেতে না পারার ওযর বর্ণনা এবং কসমের পর কসম করছিলো।

নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বাইরে অভিব্যক্তি গ্রহণ করে বাইয়াত গ্রহণ করলেন, তাদের জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করেন এবং তাদের ভেতরের অবস্থা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিলেন।

তিনজন মোমেনীন সাদেকীনের প্রসঙ্গ বাকি থাকলো। এর হচ্ছেন কা’ব ইবনে মালেক মারারা ইবনে রবি এবং হেলাল ইবনে উমাইয়া। তারা সত্যতার সাথে বললেন, আমাদের যুদ্ধে না যাওয়ার মতো কোন কারণ ছিলো না। এ কথা শুনে নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের বললেন, তারা যেন ওদের সাথে বাক্যলাপ না করেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বয়কট করা হলো। চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলেন, যমিন ভয়ানক হয়ে উঠলো, পৃথিবী তার প্রশস্ততা সত্তেও সংকীর্ণ হয়ে গেলো। তাদরে জীবন মারাত্মক সঙ্কটের সম্মুখীন হলো। কঠোরতা এমন বেড়ে গেলো যে, ৪০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাদের তওবা কবুল করলেন। সূরা তাওবার এই আয়াত নাযিল হলো ‘এবং তিনি ক্ষমা করলেন, অপর তিনজনকেও তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিলো, যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্তেও যাদের জন্যে সঙ্কুচিত হয়েছিলো এবং তারা উপলদ্ধি করেছিলো যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নেই। পরে তিনি ওদের প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ হলেন, যাতে ওরা তওবা করে। আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ঘোষণায় সাধারণভাবে সকল মুসলামন এবং বিশেষভাবে উক্ত তিনজন সাহাবা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। সাহাবারা ছুটোছুটি করে পরস্পরকে এ খবর দিতে লাগলেন। একে অন্যকে মিষ্টি খাওয়াতে লাগলেন, দান খয়রাত করতে লাগলেন। প্রকৃতপক্ষে এই আয়াত নাযিলের দিন ছিলো তাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দ এবং সৌভাগ্যের দিন।

যেসব লোক অক্ষমতা ও অপারগতাহেতু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা দুর্বল যার পীড়িত তাদের অবিমিশ্র আনুগত্য থাকে। যারা সৎ কর্মপরায়ণ, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন কারণ নেই। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালূ।’

এদের সম্পর্কে নবী মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার কাছে পৌঁছে বলেছিলেন, ‘মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, তোমরা যেখানেই করেছো এবং যেখানেই গিয়েছো তারা তোমাদের সঙ্গে ছিলো। অপরাগতার কারণ অর্থাৎ সঙ্গত ওযরের কারণে তারা যুদ্ধে যেতে পারেনি।’ সাহাবারা বলেলেন, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তারা মদীনায় থেকে বুঝি আমাদের সঙ্গে ছিলেন? নবী মুরসালিন বললেন, ‘হাঁ, মদীনায় থেকে ও তারা তোমাদের সঙ্গে ছিলেন।’

এ যুদ্ধের প্রভাব

তবুক যুদ্ধ জাযিরাতুল আরবের ওপর মুসলমানদের প্রভাব বিস্তার এবং শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলো। জনসাধারণ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলো যে, এখন থেকে জাযিরাতুল আরবে ইসলাম ছাড়া অন্য কোন শক্তির অস্তিত্ব থাকেবে না। পৌত্তলিক এবং মোনাফেকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের প্রত্যাশিত যে সুযোগের স্বপ্ন দেখছিলো সে স্বপ্নও ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিলো। কেননা তাদের আশা-আকাঙ্খার মূল কেন্দ্র ছিলো রোমক শক্তি। এ যুদ্ধের ফলে সে আশাও ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। এতে কাফের মোনাফেকদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। তারা সুস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছিলো যে, ইসলাম থেকে পলায়ন বা নিস্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় নেই।

এমতাবস্থায় মোনাফেকদের সাথে নরম ব্যবহার করার কোন প্রয়োজনীয়তা মুসলমানদের ছিলো না। মোনফেকদের সাথে কঠোর ব্যবহার করতে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিলেন। এমনকি তাদের দেয় দান-খয়রাত গ্রহণ, তাদর জানাযায় নামায আদায়, তাদরে জন্যে মাগফেরাতের দোয়া এবং তাদের কবর যেয়ারত করতে ও নিষেধ করা হলো। মসজিদের নামে তার ষড়যন্ত্রের যে আখড়া তৈরী করেছিলো, সেটিও ধ্বংষ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। মোনাফেকদের সম্পর্কে এমন আয়ানত নাযিল হলো যে, এত তারা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়লো। তাদের চিনতে আর কোন অসুবিধাই রইলো না।

তবুকের যুদ্ধের প্রভাব এ থেকেও বোঝা যায় যে, মক্ক বিজয়ের পর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল মদীনায় আসতে শুরু করলেও এ যুদ্ধের পর সে সংখ্যা বহুগুন বেড়ে গেলো।১১[এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ যেসব গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে সেগুলোর নাম, ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৫১৫-৫৩৭, যাদুল মায়াদ তয় খন্ড, পৃ-২-১৩, সহীহ বোখারী, ২য় খন্ড, পৃ-৩১৩-৩৩৭, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-১১০-১২৬ ও তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, সূরা তাওবা]

এই সম্পর্কে কোরআনের আয়াত

এই যুদ্ধ সম্পর্কে সূরা তাওবায় বহুসংখ্যক আয়াত নাযিল হয়েছিলো। কিছু হয়েছে যুদ্ধে রওয়ান হওয়ার আগে এবং কিছু কিছু মদীনায় ফিরে আসার পরে। এসব আয়াতে যুদ্ধের অবস্থা বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছিলো। মোনাফেকদের পর্দা উন্মোচন করে দেয়া হয়েছিলো। মোমেনীন এবং সাদেকীন যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যারা করেননি, তাদের তওবা কবুল করার কথা বলা হয়েছে।

এই সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা

নবম হিজরীতে ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিলো।

(১) তবুক থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার পর উওয়ায়মের আজলানি তার স্ত্রীর মধ্যে ‘লেআন’ হয়েছিলো। উল্লেখ্য স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া হয় অথচ সাক্ষী নেই, তাকে লেআন বলে।

(২) যেনাকারিনী একজন মহিলা নবী মুরসালিনের দরবারে এসে নিজের পাপের কথা স্বীকার করে শাস্তির আবেদন জানিয়েছিলেন। তাকে সন্তান প্রসবের পর আসতে বলা হয়েছিলো। সন্তানের দুধ ছাড়ানোর পর তাকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা অর্থাৎ রজম করা হয়।

(৩) হাবশার সম্রাট আসহামা নাজ্জাশী ইন্তেকাল করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেন।

(৪) নবী নন্দিনী উম্মে কুলসুম (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালে প্রিয় নবী শোকে কাতর হয়ে পড়েন। তিনি হযরত ওসমানকে (রা.) বলেছিলেন, যদি আমার তৃতীয় কোন মেয়ে থাকতো তবে তাকেও আমি তোমার সাথে বিয়ে দিতাম।

(৫) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তবুক থেকে ফিরে আসার পর মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নবী তার জন্যে মাগফেরাতের দোয়া করেন এবং হযরত ওমর (রা.)-এর নিষেধ সত্তেও তার জানাযার নামায আদায় করেন। এরপর কোরআনের আয়াত নাযিল হয় তাতে এবং হযরত ওমরা (রা.)-এর বক্তব্যের সমর্থনে মোনাফেকদের জানাযা নিষেধ করা হয়।

হযরত আবু বকরের (রা.) নেতৃত্বে হজ্জ পালন

নবম হিজরীতে ‍যিলকদ বা যিলজ্জ মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকরকে (রা.) আমিরুল হজ্জ করে মক্কায় প্রেরণ করেন।

এরপর সূরা তাওবার প্রথামংশ নাযিল হয়। এতে মোশরেকদের সাথে কৃত অঙ্গীকার সমতার ভিত্তিতে শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ নির্দেশ আসার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকে (রা.) এ ঘোষণা প্রকাশের জন্যে প্রেরণ করেন। আরবদের মধ্যে অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে এটাই ছিলো রীতি। হযরত আবু বকরের (রা.) সাথে হযরত আলীর সাক্ষাৎ হয়েছিল দাজনান মতান্তরে আরজ প্রান্তরে। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন তুমি আমীর না মামুর? হযরত আলী (রা.) বললেন, মামুর। এরপর উভযে সামনে অগ্রসর হন। এরপর উভয়ে সামনে অগ্রসর হন। হযরত আবু বকর লোকদের হজ্জ করান। ১০ই যিলহজ্জ অর্থাৎ কোরবানীনর দিনে হযরত আলী (রা.) হাজীদের পাশে দাঁড়িয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ অনুযায়ী ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সকল প্রকার অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সমাপ্তির কথা ঘোষণা করেন। চার মাসের সময় দেয়া হয়। যাদের সাথে কোন অঙ্গীকার ছিলো না, তাদেরকেও চার মাস সময় দেয়া হয় তবে মুসলমানদের সাথে যেসব মোশরেক অঙ্গীকার পালনে ক্রুটি করেনি এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যদের সাহায্যে করেনি, তাদের চুক্তিপত্র নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়।

হযরত আবু বকর (রা.) কয়েকজন সাহাবাকে পাঠিয়ে এ ঘোষণা করান যে, ভবিষ্যতে কোন মোশরেক হজ্জ করতে এবং নগ্নাবস্থায় কেউ কাবাঘর তাওয়াফ করতে পারবে না।

এ ঘোষণা ছিলো প্রকৃতপক্ষে জাযিরাতুল আরব থেকে মূর্তি পূজার অবসানের চূড়ান্ত পদক্ষেপ। অর্থাৎ এ বছরের পর থেকে মূর্তি পূজার উদ্দেশ্যে আসার জন্যে কোন সুযোগই আর থাকলো না। ১[বিস্তারিত জানার জন্য দ্রষ্টব্য, সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ-২২০, ৪৫১, ২য় খন্ড ৬২৬, ৬৭১, যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড, পৃ- ৫৪৩-৫৪৬, তাফসীর গ্রন্থাবলী সূরা বারাআতের প্রথামাংশ]

যুদ্ধসমূহের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাঃ
রসূলে করিম হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতুত্বে সংঘটিত যুদ্ধসমূহের প্রতি লক্ষ্য করলে যে কেউ একথা স্বীকার করতে নৈতিকভাবে বাধ্য হবে যে, তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সফল সামরিক কমান্ডার। পরিবেশ পরিস্থিতি,পটভূমি প্রসঙ্গিক লক্ষণসমূহ এবং পরিণতি ইত্যাদি বিবেচনায় তিনি ছিলেন অতুলনীয় মেধার অধিকারী। তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা ছিলো নির্ভূল এবং বিবেকের জাগ্রতাবস্থায় ছিলো গভীর তাৎপর্যমন্ডিত। নবুয়ত ও রেসালাতের গুলে তিনি ছিলেন সাইয়েদুল মুরসালিন বা প্রেরিত সকল নবীর নেতা। অন্যদিকে সামরিক নেতৃত্বের গুনবৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন অসাধারণ এবং অদ্বিতীয়। যে সকল যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বা অন্যদের প্রেরণ করেছিলেন সব ক্ষেত্রেই তিনি কার্যকারণ পরিবেশ পরিস্থিতি ও পর্যালোচনা করে সঠিক কৌশল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হন। তাঁর দক্ষতাসমর কুশলতা,সাহসিকতা ছিলো অনন্য। সৈন্য সমাবেশ,যুদ্ধ পরিকল্পনা,অবস্থান নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁকে কেউ ডিঙ্গিয়ে যেতে পারেনি। তাঁর সমরকুশলতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিশ্বের সেরা যুদ্ধ বিশারদেরচেয়েও তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তার যুদ্ধ পরিকল্পনায় পরাজয় বরণের কোন সম্ভাবনায় ছিলো না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, ওহুদ এবং হোনায়েনের যুদ্ধে যা কিছু ঘটেছিলো এর কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিকল্পনার ক্রটি বা ভূল নয়। কিছু সংখ্যক মুসলিম সৈন্যের ব্যক্তিগত দূর্বলতাই দায়ী। আর ওহুদের যুদ্ধে তো তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ও সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হয়েছিলো।

উভয় যুদ্ধেই মুসলমানরা পরাজয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিলো। সে সময়ে তিনি যে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তার উদাহরণ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি শত্রু বেষ্টনীতে ও ছিলেন অটল অবিচল এবং তুলনাহীন সমর কুশলতায় শত্রুদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। ওহুদের যুদ্ধে এ ধরণের ঘটনা ঘটেছিলো। এ ছাড়া হোনায়েনের যুদ্ধে তাঁর সমর কুশলতায় মুসলমানদের পরাজয় চূড়ান্ত বিজয়ে পরিণত হয়েছিলো। অথচ ওহুদের মতের বিপজ্জনক পরিস্থি এবং হোনায়েনের মতো লাগামহীন ভয়কাতরতা ও অস্থিরতা সেনানায়কদের সিদ্ধন্ত গ্রহণের শক্তি লোপ করে দেয়। তাঁদের স্নায়ুর ওপর এতো বেশী চাপ সৃষ্টি হয় যে, তথন আত্মরক্ষার চেষ্টাই বড় হয়ে দেখা দেয়।

এটা তো হচ্ছে উল্লিখিত যুদ্ধের সামরকি দিক। অন্য একটি দিক আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। ফেতনা ফাসাদের আগুন নিভিয়ে দেন। ইসলাম ও পৌত্তলিকতার সংঘর্ষে শত্রুর শক্তি-সামর্থ্য ও অহংকার নস্যাৎ করে দেন। ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগ সম্বর্কে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা এবং সিদ্ধন্ত গ্রহণের জন্য তাদের বাধ্য করেন। এছাড়া এসব যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি শত্রু মিত্র চিনেছেন। প্রকৃত মুসলমান এবং মোনাফেকদের পার্থ্য নির্ণিত হয়।

সামরিক অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম মুসলিম সেনানায়কদের এক অপারেজয় শক্তি গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্ট সেনাদল ইরাক, সিরিয়ায়, পারস্য ও রোমে যুদ্ধ করে এবং যুদ্ধ পরিকল্পনা ও কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বড় বড় যুদ্ধবাযদের হার মানিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় শত্রুদের তাদের ভূখন্ড, ধন-সম্পদ,ক্ষেত-খামার, বাগান, জলাশয় ইত্যাদি থেকে ও বহিষ্কার করে। এইসব যুদ্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের জন্যে বাসস্থান, ক্ষেত-খামার এবং করর্মসংস্থানের মতো প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করেন। বাস্তুহীন ও ঠিকানাহীন উদ্বাস্তুদের সমস্যার সমাধান করেন। অস্ত্র, ঘোড়া, সামারিক সরাঞ্জামের বহুবিধ উপকরণের ব্যবস্থা করেন। অথচ প্রতিপক্ষের ওপর কোন প্রকার অত্যাচার উৎপীড়ন এবং বাড়াবাড়ি না করেই তিনি এসব কিছু করেছিলেন।

অন্ধকার যুগের যেসব কারণে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠতো, প্রিয় নবী সেসব কারণও পরিবর্তন করেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতে যুদ্ধ মানো ছিলো লুট-তরায,হত্যা-ধ্বংস,যুলুম-অত্যাচার, জনপদ বিরান করা, বাড়ীঘর,অট্টালিকা ভেঙ্গে ফেলা, মহিলাদের সম্মান নষ্ট করা, শিশু ও বৃদ্ধদের সাথে নিষ্ঠুর নৃশংস ব্যবহার করা। এছাড়া ক্ষেত-খামারের ফসল নষ্ট এবং পশুপালহত্যা করা মোটকথা সর্বাত্মক ক্ষতি ও ধ্বংস ছিলো সেসব যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। ইসলাম যুদ্ধের এসব ঘৃণ্য কার্যকলাপ প্রতিরোধ করে যুদ্ধকে এক পবিত্র জেহাদরে পরিণত করেছে। যুক্তসঙ্গত ও ন্যায্য কারণে এ যুদ্ধ শুরু করা হয় এবং তার ফলাফল হয় সকল কালের মনুষের জন্য কল্যাণকর। পরবর্তী সকল কালে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। এসব জেহাদের পরে মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, জেহাদ হচ্ছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়া, জুলুম-অত্যাচার নির্যাতন থেকে থেকে বের করে এনে ন্যায় ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার সশস্ত্র প্রচেষ্ট। অর্থাৎ একটা ব্যবস্থা করা যাতে শক্তিশালীরা দূর্বলদের ওপর অত্যাচার নাকরতে পারে বরং সেসব স্বৈরাচারী ও অত্যাচারীদের দূর্বল করে উৎপীড়িত ও দরিদ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এমনি করে ইসলামের জেহাদের অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, সেইসব দূর্বল নারী-পুরুষ শিশুকে রক্ষা করতে হবে যারা এই বলে দোয়া করেন, হে প্রতিপালক,তুমি আমাদরেকে এই জনপদ থেকে বের করো, যেখানের অধিবাসীরা অধিবাসীরা অত্যাচারী। তুমি তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য নেতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রেরণ করো এবং নেতা এবং তার মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করো। এছাড়া মুসলমানদের যুদ্ধের অর্থ এই দাঁড়িয়েছে যে আল্লাহর যমিনকে খেয়নত,যুলুম-অত্যাচার,পাপাচার থেকে মুক্ত করে তা স্থলে শান্তি-নিরাপত্তা, দয়াশীলতা ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করা হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য উন্নত নীতিমালা প্রণয়ন করেন। মুসলিম সৈন্য এবং সেনাপতিদেরকে সেই নীতিমালার বাইরে যেতে দেননি। হযরত সালমান ইবনে যোয়ইদা বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন ব্যক্তিকে সেনাপতির দায়িত্ব দিতেন তখন তাকে তাকওয়া পরহেজগারী এবং মুসলমান সঙ্গীদের সাথে উত্তম ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। এবপর বলতেন আল্লাহর নামে, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। লড়াই করো,খেয়ানত করো না, অঙ্গীকার লংঘন বা বিশ্বাসঘাতকতা করো না, কারো নাক, কান ইত্যাদি কেটে না, কোন শিশুকে হ্ত্যা করো না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনোনীত সেনাপতিকে আরো উপদেশ দিতেন যে, সহজ সরল ব্যবহার করবে,কঠোরতার আশ্রয় নেবে না,মানুষকে শান্তি দেবে,কাউকে ঘৃণা করবে না।১[সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, পৃ.৮২-৮২]

রাত্রিকালে কোন এলাকায় পৌছার পর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল হওয়ার আগে হামলা করতেন না। তাছাড়া তিনি আগুন লাগানো অর্থাৎ কোন জিনিসে অগ্নিসংযোগ করতে ভাবে নিষেধ করতেন। কাউকে বেঁধে হত্যা করা, মহিলাদের প্রহার করা এবং তাদের হত্যা করতেও তিনি নিষেধ করেন। লুট-তরায করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেনে, লুটের মাল মৃতজন্তুর চেয়ে বেশী হালালল নয়, ক্ষেত-খামার ধ্বংস করা, চতুষ্পদ জন্তু হত্যা করা এবং গাছপালা কেটে ফেলতেও তিনি নিষেধ করেন। তবে বিশেষ প্রযোজন দেখা দিলে সেটা ভিন্ন কথা।

মক্কা বিজয়ের সময় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, কোন আহত ব্যক্তির ওপর হামলা করবে না,কেনা পলায়নকরী ব্যক্তিকে ধাওয়া করবে না, কোন বন্দীকে হত্যা করবে না। তিনি এ রীতিও প্রবর্তন করেন যে, কোন দূতকে হত্যা করা যাবে না,তিনি একথাও বলেছেন যে, কোন অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করা যাবে না। এমনকি তিনি একথাও বলেছেন যে, কোন অমুসলিম নাগরিককে বিনা কারণে হত্যা করবে, সে বেহেশতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ বেহেশেতের সুবাস চল্লিশ বছরের পথের দুরত্ব থেকে ও পাওয়া যায়।

উল্লেখিত কারণ সমূহ এবং আরো অনেক উন্নততর বীতিনীতি ছিলো যার কারণে যুদ্ধ জাহেলিয়াত যুগের নোংরামী থেকে পাকসাফ হয়ে পবিত্র জেহাদে পরিবর্তিত হয়েছে।

দলে দলে মানুষদের আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে চিরতরে যে, মক্কা বিজয়ের ঘটনা ছিলো একটি সিদ্ধান্তমূলক অভিযান। এর ফলে মূর্তি পূজার অসারতা আরববাসীদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে এবং মূর্তিপূজার অবসান ঘটে। সমগ্র আরবদের জন্য সত্য ও মিথ্যা চিহ্নিত হয়ে যায়। তার দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করেন। হযরত আমর ইবনে সালমা (রা.) বলেন, আমর একটি জলাশয়ের ধারে বাস করতাম। সেই জলাশয়ের পাশ দিয়ে লোক চলাচল করতো। পথচারীদের আমরা সেই ব্যক্তির অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতাম। পথচারীরা বলতো, তিনি মনে করেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে পয়গাম্বর করে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে ওহী পাঠানো হয় এবং সেই ওহীতে আল্লাহ তায়াল এরূপ এরূপ বলেছেন। ইযরত আমর ইবনে সালমা (রা.) বলেন, আমি সেসব কথা শুনতাম এবং ওহীতে বর্নিত কথাগুলো মনো রাখতাম। আরবের লোকেরা ইসলাম গ্রহণের পর মক্কা বিজয়ের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা বলতো, ওকে এবং তার কওমকে ছেড়ে দাও। যদি তিনি নিজের কওমের ওপর জয়লাভ করেন তাহলে বোঝা যাবে যে, তিনি সত্য নবী। অতপর মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটলো।

সকল কওম ইসলাম গ্রহণের জন্য অগ্রসর হলো। আমার পিতাও আমার কওমের কাছে ইসলাম শিক্ষা নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, আমি সত্য নবীব কাছ থেকে এসছি। নবী বলেছেন, অমুক অমুক সময়ে অমুক অমুক নামাজ আদায় করো। নামাযের সময় হলে তোমাদের মধ্যে থেকে একজন আযান দেয়। এরপর তোমাদের মধ্যেকার যে ব্যক্তি বেশী পরিমাণ কোরআন জানেন তিনি যেন ইমামতি করেন।

এই হাদীস থেকে স্পস্টত বোঝা যায় যে, মক্কা বিজয়ের ঘটনা পরিস্থিতির পরিবর্তনে ইসলামকে শক্তিশিালী করার ব্যাপারে, আরববাসীদের ভূমিকা নির্ধারণে এবং ইসলামের সামনে তাদের উৎসর্গীকৃত করার ব্যাপারে কতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাবুকের যুদ্ধের পর এ অবস্থা আরো চরম রূপ নেয়। এ কারনে আমরা দেখতে পাই যে, সেই দুই বছরে অর্থাৎ নবম ও দশম হিজরীতে মদীনায় বহু প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটেছিলো। সেই সময়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। ফলে মক্কা বিজয়ের সময়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো দশ হাজার, অথচ এক বছরের ও কম সময়ের মধ্যে তবুকের যুদ্ধের সময় সেই সংখ্যা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।

বিদায় হজ্জের সময় দেখা যায় যে, মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার মতান্তরে ১ লাখ ৪৪ হাজার। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চারপাশে তাঁরা লাব্বায়েক ধ্বনি দিচ্ছিলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের প্রশংসা ধ্বনিতে তাঁরা আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলছিলেন। পাহাড়-পর্বতে মাঠে-প্রান্তরেন তাওহীদরে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।

প্রতিনিধি দলের আগমন

ঐতিহাসিকগণ ৭০টির বেশী প্রতিনিধিদলের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। এ কারণে আমরা শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদল সম্পর্কে আলোকপাত করছি। পাঠকদের এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, মক্কা বিজয়ের পরই যদিও বিভিন্ন প্রতিনিধিদল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসলে শুরু করেছিলো কিন্তু কিছু কিছু গোত্রর প্রতিনিধিদল মক্কা বিজয়ের আগেও মদীনায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাযির হয়েছিলেন। নীচে আমরা সেসব গোত্রের পরিচয় ও আগমনের ঘটনা উল্লেখ করছি।

(১) আবদুল কায়েসের প্রতিনিধি দলঃ এ গোত্রের প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়েছিলো, প্রথমবার পঞ্চম হিজরীতে এবং দ্বিতীয়বার নবম হিজরীতে। প্রথমবার উক্ত গোত্রের মুনকেজ ইবনে হাব্বান নামক এক ব্যক্তি বাণিজ্যিক সরঞ্জাম নিয়ে মদীনায় এসেছিলেন। এরপরও তিনি কয়েকবার মদীনয় যাওয়া-আসা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরতের পর তিনি মদীনায় আসেন এবং ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন এবং ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেন ইসলাম গ্রহণের পর নবী করিমের (রা.) তরফ থেকে এককানি চিঠি নিয়ে তিনি নিজ গোত্রের লোকদের কাছে যান। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার গোত্রের লোকেরাও ইসলাম গ্রহণ করেন।

এরপর উক্ত গোত্রের তোরো-চৌদ্দজনের একটি প্রতিনিধি দল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হন। এই প্রতিনিধি দল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঈমান এবং পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন আল আশাজ্ব আল আসরি।২[মারাআতুল মাফাতিহ, প্রথম খন্ড,পৃ.৭১]। এই ব্যক্তি সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করেছিলেন, তোমার মধ্যে দু’টি গুন রয়েছে যা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। একটি হচ্ছে দূরদর্শিতা ও অন্যটি সহিষ্ণুতা।

দ্বিতীয়বার এই গোত্রের প্রতিনিধিদল নবম হিজরীতে মদীনায় এসেছিলেন। এতে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন চল্রিশ জন। এদের মধ্যে আলা ইবনে জারুদ আবদী নামে একজন খৃষ্টান এসেছিলেন। তিনি মদীনয় এসে মুসলমান হন এবং পরে ইসলামের বিশেষ খেদমত করেন।৩[সরহে সহীহ মুসলিম, প্রথম খন্ড, পৃ.৩৩, ফতহুন কারী ৮ম খন্ড, পৃ.৮৫-৮৬]।

(২)দাওস প্রতিনিধিদলঃ সপ্তম হিজরীর শুরুতে্ এই প্রতিনিধিদল মদীনায় আসে।সেই সময় নবী (সঃ) খযবরে ছিলেন। ইতিপূর্বে উল্লখ করা হয়েছে যে, তোফায়েল ইবনে আমর দাওসী (রা.) মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি নিজ কওমের প্রতি গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু তাঁর কওম টালবাহান করতে থাকে। হতাশ হয়ে তিনি নবী করিম(সঃ)এর দরবারে এসে আবেদন করেন যে, হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমার কওমের জন্যে বদদোয়া করুন। নবী (সঃ) বদদোয়া না করে বললেন, হে আল্লাহ তায়ালা দাওস কওমকে হেদায়াত দান করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই দোয়ার পরই দাওস কওমের সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতপর হযরত তোফায়ের (রা.) তাঁর কওমের সত্তর অথবা আশিটি পরিবারের লোকদের নিয়ে সপ্তম হিজরীর শুরুতে মদীনায় হিজরত করেন। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খয়বরে ছিলেন। হযরত তোফায়েল (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে খয়বরে সাক্ষাৎ করেন।

(৩) ফারওয়াই ইবনে আমর জোযামির পয়গাম প্রেরণঃ ফারওয়াহ রোমক সৈন্যদরে মধ্যে একজন আরব কমান্ডার ছিলেন। রোমক সম্রাট তাকে অধিকৃত আরব এলাকার গবর্নর নিযুক্ত করেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানী ছিলো জর্দানের দক্ষিণের মা’আন নামক জায়গায়। অষ্টম হিজরীতে সংঘঠিত মূতার যুদ্ধে মুসলমানদের অসাধারণ বীরত্ব দেখে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। একজন দূত পাঠিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের ইসলাম গ্রহণের খবর জানান এবং সেই সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যে একটি সাদা খচ্চর উপহার হিসাবে প্রেরণ করেন। রোমক সম্রাটের উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের নিযুক্ত গভর্নরের ইসলাম গ্রহণের খবর ত্রুদ্ধ হয়। তার হযরত ফারাওয়াহকে গ্রেফতার করে পরে ইসলাম ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। অন্যথায় তাকে হত্যা করা হবে কলে হুমকি দেয়। হযরত ফারওয়াহ ইসলাম ত্যাগ করার চেয়ে শহীদ হওয় সমীচীন মনে করেন। অতপর ফিলিস্তিনের আফরা নামক জায়গায় একটি ঝর্ণার তীরে শূলীকাষ্ঠে তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ৪[যাদুল মায়াদ, তৃতীয় খন্ড,পৃ.৪৫]

(৪) ছাদা প্রতিনিধি দলঃ অষ্টম হিজরীতে এই প্রতিনিধিদল জেরান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার পার তাঁর কাছে হাযির হন। তাঁর আসার কারণ ছিলো এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চাশত মুসলমানের একটি বহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন ইয়েমেনের সেই এলাকায় গিয়ে অভিযান চালায় যেখানে ছাদা গোত্র বসবাস করে। মুসলিম বহিনী কানাত প্রান্তরে পৌঁছে তাঁবু স্থাপন করেছিলো, সেই সময় হযরত যিয়াদ ইবনে হারেশ (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছুটে এস বললেন, আমার পেছনে যারা আসছে আমি তাদের নেতা হিসাবে হাযির হয়েছি কাজেই আপনি মুসলিম বাহিনীকে ফিরিয়ে আনুন। আমার কওমের লোকদের জন্য আমি যামিন হচ্ছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিম বাহিনীকে মদীনায় ফিরিয়ে আনলেন। এরপর হযরত যিয়াদ (রা.) তাঁর কওমের কাছে হাযির হয়ে বললেন, আপনার কয়েকজন আমার সথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে চলুন। অতপর সব কথা তাদের খুলে বললেন। হযরত যিয়াদের (রা.) কথা শোনার পর তাঁর কওমের পনের জন লোকের একটি প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তারা নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে দ্বীনের তাবলীগ করলেন এবং ইসলাম প্রচার করলেন। বিদায় হজ্জের সময় এই কওমের একশত জন মুসলমান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হন।

(৫) কা’ব ইবনে যুহাইর ইবনে আবি সালমার আগমনঃ কা’ব ছিলো কবি পরিবারের সন্তান এবং আরবের বিশিষ্ট কবি। সে ছিলো কাফের। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুৎসা রটনা করতো। ইমাম হাকেম-এর বর্ণনা মতে কা’ব সেইসব অপরাধীদের তালিকভূক্ত ছিলো, যাদের সম্পর্কে মক্কা বিজয়ের সময় নির্দেশ ছিলো যে, যদি তারা কাবা ঘরের পর্দা আঁকড়ে ধরা অবস্থায়ও থাকে তবু তাদের হত্যা করতে হবে। কিন্তু কা’ব পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তায়েফের যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর কা’ব এর ভাই রুজাইর ইবনে যুহাইর এক চিঠি লিখলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কুৎসা রটনাকারী কয়েক ব্যক্তিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেই নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছে। কোরয়শ বংশের স্বল্পসংখ্যক কবি এদিকে সেদিকে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। যদি জীবনের জন্যে তোমার মায়া থাকে, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরবারে আসো, কেননা তিনি তওবাকারীদের হত্যা করেন না। যদি আমার এই প্রস্তাব তোমার পছন্দ না হয়, তবে যেখানে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে মনে করো সেখানে পালিয়ে যাও। এ চিঠির পর উভয় ভাইয়ের মধ্যে একাধিক পত্র বিনিময় হয়েছে। মোটকথা কা’ব নিজের জীবনাশঙ্কা উপলব্ধি করে মদীনায়ে এসে পৌঁছলেন এবং জুহাইনা নামক এক ব্যক্তির মেহমান হলেন। পরদিন সকালে সেই ব্যক্তির সাথে ফজরের নামাজ আাদায় করলন। নামাজ শেষে জুহাইনা কা’বকে ইশারায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে চিনিয়ে দিলেন কা’ব তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে বসে তাঁর হাতে নিজের হাত রাখলেন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’বকে চিনতেন না। কা’ব বললেন হে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’ব ইবনে যুহাইর যদি তওবা করে মুসলমান হয়, নিরাপত্তার আবেদন জানায় এবং আমি যদি তাকে আপনার কাছে হাযির করি তবে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। কা’ব বললেন, আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর। একথা শুনে একজন আনসারী ছুটে এসে কা’বকে ঝাপটে ধরে তাকে হত্যা করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুমতি চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সাহাবীকে বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। সে তওবা করেছে এবং অতীতের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হয়েছে।

এরপর সে জায়গাতেই কা’ব ইবনে যুহাইর তাঁর বিখ্যাত কাসীদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠ করে শোনান। সেই কাসীদায় কা’ব নিজের অতীতের কৃতকর্মের জন্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করেন। কবিতার অর্থ নিম্মরূপ-

‘ছোয়াদ দূর হয়ে গেছে, কাজেই এখন আমার মনে অস্থিরতা বিদ্যমান। মনের পেছনে শিকল বাঁধ। এর ফিদিয়া দেয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে হুমকি দিয়েছেন। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে ক্ষমার প্রত্যাশা রয়েছে। আপনি স্থির থাকুন, চোগলখোরদের কথা কানে তুলবেন না। সেই সত্তা আপনাকে পথ প্রদর্শন করুন, যিনি আপনাকে উপদেশপূর্ণ এবং বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত কোরআন দিয়েছেন। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথাই বলা হয়েছে, কিন্তু আমি অপরাধ করিনি। আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এবং এমন সব কথা শুনতে পাচ্ছি এবং এমন অবস্থা দেখছি যে, যদি আমার জায়গায় একটা হাতী দাঁড়ানো থাকতো তবে সেই হাতী থমকে দাঁড়াতো। অবশ্য যদি আল্লাহর অনুগ্রহে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতি হতো সেটা ছিলো ভিন্ন কখা। আমি নিজের হাত অকপটে সেই সম্মানিত ব্যক্তিত্বের হাতে রেখেছি যাঁর প্রতিশোধ গ্রহনের পূর্ণ শক্তি রয়েছে এবং যার কথাই সবার ওপরে। অথচ আমাকে বলা হয়েছে তোমার নামে এরূপ এরূপ নালিশে রয়েছে এবং তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। নিশ্চয় রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনি একটি নূর, যে নূর থেকে আলো পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহর তলোয়ারসমূহের মধ্যে একটি তলোয়ার।’

এরপর কা’ব ইবনে যুহাইর কোরায়শ মোহাজেরদের প্রশংসা করেন। কেননা কা’ব এর আসার পর কোন মোহাজের তাঁকে বিরক্ত করেননি। মোহাজেরদের প্রশংসা করার সময় কা’ব আনসারদের প্রতি শ্লেষাত্মাক মন্তব্য করেন। কেননা একজন আনসার কা’বকে হত্যা করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কা’ব তাঁর কবিতায় বললেন, কোরায়শরা সৌন্দর্যমন্ডিত উঠের মতো চলাচল করেন এবং ধারালো তলোয়ার তাদেরকে সেই সময় রক্ষা করে, যখন বেটে-খাটে কালো কুৎসিত লোক পথ ছেড়ে পালায়।

কা’ব মুসলমান হওয়ার পর একটি কবিতায় আনসারদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি সেই কবিতায় লিখলেন, ‘যে ব্যক্তি সম্মানজনক জীবন পছন্দ করে, সে যেন সব সময় আনসারদের কোন বাহিনীর মধ্যে থাকে। আনসাররা উত্তরাধিকার সূত্রে সৌন্দর্য লাভ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তারাই ভালো লোক, যারা ভালো লোকের সন্তান।’

(৬) আজরা প্রতিনিধ দলঃ নবম হিজরীতে এই প্রতিনিধি দল মদীনায় আসেন। তারা ১২ জন ছিলেন। এদের মধ্যে হামযা ইবনে নোমানও ছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বললেন, আমরা বনু আজরা, কুসইদের সথে আমদের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা কুসাইদের সাহায্য করেছি এবং খাজাআ বনু বকরকে মক্কা থেকে বের করেছিলাম। এখানে আমাদরে আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। এই পরিচয় জানার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাগত জানান এবং সিরিয়া বিজিত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেন। তদেরকে জ্যোতিষী মহিলাদের কাছ থেকে কোন তথ্য জানতে নিষেধ করেন। এছাড়া শেরেক করার সময়ে ওরা যে সকল পশু যবাই করে খেতো সেই সব পশু যবাই করতে নিষেধ করেন। এই প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করেন এবং কয়েকদিন মদীনায় অবস্থানের পর মক্কায় ফিরে যান।

(৭) বিলি প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই প্রতিনিধিদল মদীনায় আসে এবং ইসলাম গ্রহণের পর তিনদিন অবস্থান করেন। এই সময়ে প্রতিনিধদলের নেতা আবু জারির জিজ্ঞাসা করেন যে, যেয়াফতের মধ্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন হ্যাঁ। কোন বিত্তবান বা গরীবের সাথে ভালো ব্যবহার করা হলে সেই ব্যবহার সদকা হিসাবে গণ্য করা হবে। তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন যে, যেয়াফতের মেয়াদ কতদিনের হতে হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনদিন। তিনি বললেন, কোন লোক যদি নিরুদ্দেশ কোন বকরি পায় তথন সেই বকরির ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে বকরি তোমার, তোমার ভাইদের বা নেকড়ের জন্যে। এরপর সেই লোক হারানো উট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,সেই উটের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ওকে ছেড়ে দাও, মালিক তাকে পেয়ে যাবে।

(৮) সাকীফ প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীর রমযান মাসে এই প্রতিনিধিদল তবুক থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রত্যাবর্তনের পর হাযির হন। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অষ্টম হিজরীতে যিলকদ মাসে তায়েফ যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময়ে তাঁর মদীনায় পৌঁছার আগেই এই প্রতিনিধিদলের সর্দার ওরওয়া ইবনে মাসউদ নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তারা নিজ গেত্রে ফিরে গিয়ে লোকদের ইসলামের দাওয়াত দেন। গোত্রের লোকেরা তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতো। শোনা যায় তারা নিজ সন্তান এবং পরিবার-পরিজনের চেয়ে ওরওয়াকে বেশী পছন্দ করতো।ওরওয়া ধরণা করেছিলেন যে,তার দেয়া ইসলামের দাওয়াত সবাই গ্রহণ করবে এবং তার কথা মেন নেবে। কিন্তু তার এ ধারণা ভূল প্রমানিত হলো। ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পরই তার গোত্রের লোকেরা চারিদিক থেকে তার প্রতি তীর নিক্ষেপ করলো এবং মারাত্মকভাবে যখম করার পর তাকে হত্যা করলো। কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর গোত্রের লোকরা উপলব্ধি করলো যে, চারিদিকে মুসলমানদের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে এতে তাদের নিরাপদ থাকা সম্ভব হবে না। মুসলমানদের মোকাবেলা করাও তাদরে সম্ভব নয়। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো যে, নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে একজন লোক পাঠাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবদে ইয়লিল ইবনে আমরকে মদীনায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো কিন্তু ওরওয়ার পরিণাম প্রত্যাক্ষ করায় আবদে ইয়ালিল মদীনায় যাওয়ার শর্ত আরোপ করলেন। তিনি বললেন, আমার সাথে আরো কয়েকজনকে দিতে হবে, আমি একা যেতে রাযি নই। গোত্রের লোকেরা প্রস্তাব অনুযায়ী পাঁচজনকে সঙ্গে দিলেন। অবশেষে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মদীনায় রওয়ানা হলেন। এদের মধ্যে ওসমান ইবনে আবুল আস সাকফী ছিলেন সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ। এই প্রতিনিধি দল মদীনায় পৌঁছার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে নববীর এক কোণে তাদের থাকতে দিলেন যাতে করে তারা সাহাবাদের কোরআন পাঠ শুনতে পারে এবং নামাজ আদায় দেখতে পারে। মসজিদে অবস্থানের সময় তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাওয়া আসা শুরু করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। একদিন তাদের নেতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, আপনি সকীফ এবং আপনার মধ্যে এ মর্মে একটি চুক্তিপত্র লিখে দিন যাতে ব্যভিচার, মদপান, সুদ খাওয়া, তাদের মাবুদ লাতকে পূজার অধিকার, নামায থেকে মুক্তি এবং তাদের মূর্তিকে তাদের হাতে না ভাঙ্গার কথা উল্লেখ থাকবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উল্লিখিত শর্তাবলীর একটিও গ্রহণ করলেন না। প্রতিনিধিদল এরপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিলো না। তারা তাই করলো এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিলো। তবে পুনরায় শর্তারোপ করলো যে, তাদের মূর্তি লাতকে তারা নিজের হাতে ভাঙ্গতে পারবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শর্ত মেনে নিলেন এবং এই মর্মে লিখে দিলেন। তিনি ওসমান ইবনে আবুল আস সাকফীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নিযুক্ত করলেন। কেননা ইসলামের প্রতি তার আগ্রহই ছিলা সবার চাইতে বেশী। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রতিদিন সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে যেতো কিন্তু ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে যেতো না। দুপুরে অন্যরা যখন বিশ্রাম করতো সেই সময় হযরত ওসমান (রা.)নবী করিমের দরবারে যেতেন এবং ইসলাম সম্পর্কে খুঁটিনাটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘুমে যদি দেখতেন তখন হযরত ওসমান (রা.) দ্বীন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞাসা করতেন। হযরত ওসমানের (রা.) গভর্নন হিসাবে দায়িত্ব পালন ছিলো খুব বরকতপূর্ণ। হযরত আবু বকরের (রা.) খেলাফতের সময় কিছু লোক ধর্মান্তরিত হয়ে যায়, সেই সময় ছকিফ গোত্রের লোকেরাও ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। হযরত ওসমান ইবনে আবুল আস (রা.) সেই নাযুক সময়ে তাদের সম্বোধন করে বললেন, ছাকিফ গোত্রের লোকেরা শোনো, তোমরা সকলের শেষে ইসলাম গ্রহণ করেছ কাজেই সবার আগে মুরতাদ হয়ো না। একথা শুনে ছকিফ গোত্রের লোকেরা ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করা থোকে বিরত থাকে এবং ইসলামের ওপর অবিচল থাকে।

মোটকথা প্রতিনিধিদল নিজ কওমের কাছে ফিরে এসে প্রকৃত সত্য গোপন করে রাখে। তারা দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে বলে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি দাবী করেছেন তারা যেন ইসলাম গ্রহণ করে এবং ব্যভিচার করা, মদ পান করা, সুদ খাওয়া ছেড়ে দেয়। যদি তা না করে তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা হবে। ছকিফ গোত্রের লোক একথা শুনে যুদ্ধ করার কথা দু’তিন দিন যাবত চিন্তা ভাবনা করলো। পরে আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তর পরিবর্তন করে দিলেন, তারা ইসলাম গ্রহণের জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। প্রতিনিধিদলকে তার বললো যে, তোমরা মদীনায় ফিরে যাও এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলো যে, আমরা তাঁর শর্তাবলী মেনে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি আছি। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা তথন নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানালেন এবং গোত্রের লোকদের ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিলেন। ছকিফ গোত্রের লোকেরা তখনই ইসলাম গ্রহণ করলো।

এদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘লাত’ মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদের (রা.) নেতৃত্বে কয়েকজন সাহাবীকে সাকিফ গোত্রে প্রেরণ করলেন। হযরত মুগিরা ইবনে শোবা (রা.) মূর্তি ভাঙ্গার জন্যে লৌহ নির্মিত গদা দুলে সঙ্গীদের বললেন, আমি একটু রসিকতা করে আপনাদের হাসাবো। একথা বলে মূর্তিকে আঘাত করেই তিনি হাঁটু ধরে বসে পড়লেন। কৃত্রিম এ দৃশ্য দেখে তায়েফের সাকীফ গোত্রের লোকেরা প্রভাবিত হলো। তারা বললো, আল্লাহ তায়ালা মুগিরাকে ধ্বংস করুর, ‘লাত’ দেবী তাকে মেরে ফেলেছে। হযরত মুগিরা (রা.) গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অমঙ্গল করুন, ওই মূর্তিতো পাথর আর মাটি দিয়ে তৈরী। এরপর হযরত মুগিরা (রা.) দরজায় আঘাত করলেন এবং মূর্তি ভেঙ্গে ফেললেন। হযরত মুগিরা (রা.)এরপর উঁচু দেয়ালে আরোহণ করলেন। কয়েকজন সাহাবীও উঁচু দেয়ালে আরোহণ করলেন। মূর্তি ভেঙ্গে মাটিতে মিশিয়ে দিলেন এরপর মাটি খুঁড়ে মূর্তিকে দেয়া অলঙ্কার এবং পোষাক বের করলেন। এ দৃশ্য দেখে সাকীফ গোত্রের লোকেরা বিস্মিত এবং বিচলিত হলো। হযরত খালেদ (রা.) মূর্তির অলঙ্কার ও পোশাক মদীনায় নিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে হাযির করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবকিছু সেইদিনই বন্টন করে আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ৫[যাদউল মায়াদ,৩য় খন্ড, পৃ.২৬-২৮।

(৯) সাকীফ ইয়েমেনের বাদশাহের চিঠিঃ তবুক থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসার পর ইয়েমেনের বদশাহর চিঠি লিখলেন। হারেস ইবনে আবদে কালাল, নঈম ইবনে আবদে কালাল, রাঈন এবং হামদন ও মাআফের এর শাসনকর্তা নোমান ইবনে কাইলের চিঠি এলো। সকলের পক্ষ থেকে মালেক ইবনে মারয়া পত্র প্রেরণ করেন। এ সকল বাদশাহ ইসলাম গ্রহণ এবং শেরেক ও কুফুরী পরিত্যাগের কথা উল্লেখ করে পত্র প্রেরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জবাব পাঠিয়ে ইয়েমেনবাসীদের অধিকার এবং তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য উল্লেখ করেন। যারা ইসলাম গ্রহণ করবে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রসূল তাদের যিম্মাদর হবেন বলেও তিনি পত্রে উল্লেখ করেন। তবে শর্ত এই যে, তাদেরকে জিজিয়া পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মায়া‘য ইবনে জাবালে (রা.) নেতৃত্বে কয়েকজন সাহাবকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন।

(১০) হামদান প্রতিনিধিদলঃ এই প্রতিনিধিদল তবুক থেকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে আসার পর তাঁর খেদমতে হাযির হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিধি দলের কওমের জন্যে একটি নির্দেশ সম্বলিত পত্র লিখে তারা যা কিছু চেয়েছিলো তা প্রদান করেন। মালেক ইবনে নামতকে আমীর নিযুক্ত করা হয় এবং তাকে তার কওমরে ইসলাম গ্রহণকারীদের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। অন্য লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্যে হযরত খালেদ ইবনে ওলীদকে (রা.) প্রেরণ করেন। তিনি ছয়মাস হামদানে অবস্থান করে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরর হযরত আলীকে (রা.) হামদানে প্রেরণ করেন এবং হযরত খালেদকে (রা.)ফেরত পাঠাতে বলে দেন। হযরত আলী (রা.) হামদান গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিঠি পড়ে শোনান এবং ইসলামের দাওয়াত দেন। এতে সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। হযরত আলী (রা.) রসূল (স.)-এর দরবারে এই খবর পাঠিয়ে দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুসংবাদ সম্বলিত চিঠি পড়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন এবং হামদনের উপর সালাম, হামদানের উপর সালাম।

(১১) বনি ফাজার প্রতিনিধিদলঃ নবম হিজরীদতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তবুক ফেরার পর এই প্রতিনিধিদল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করে। এই প্রতিনিধিদলে দশজন অন্তভূক্ত ছিলো। তারা তাদের এলাকায় দুর্ভিক্ষের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে উঠে উভয় হাত উপরে তুলে মোনাজাত করেন যে, হে আল্লাহ তায়ালা নিজের সৃষ্ট যমিন এবং চতুষ্পদ প্রাণীদরে পরিতৃপ্ত করো। তোমার রহমত প্রসারিত করো। তোমার মৃত শহরকে জীবিত করো। হে আল্লাহ তায়ালা, আমাদের ওপর এমন বৃষ্টি বর্ষণ করো, যে বৃষ্টি আমাদের কাম্য। সেই বৃষ্টি দ্বারা আমাদের শান্তি দান করো আরাম দান করো। প্রসারিত কালোমেঘ যেন তাড়াতাড়ি আসে-দেরী না করে। সেই বৃষ্টি না হয়। ধ্বংসকর যেন না হয়, ক্ষতিকর না হয়। হে আল্লাহ তায়ালা, রহমতের বৃষ্টি যেন আযাবের বৃষ্টি না হয়। ধ্বংসকর যেন না হয়। হে আল্লাহ তায়ালা,আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করো এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করো।৬[যাদু-উল মা’দ,৩য় খন্ড, পৃ.৪০]

(১২) নাজরান প্রতিনিধিদলঃ মক্কা থেকে ইয়েমেনে যাওয়ার পথে এই এলাকার অধিবাসীরা বসবাস করে। ৭৩টি জনপদ অর্থাৎ বসতি নিয়ে এই নাজরান সম্প্রদায়। একজন দ্রুতগামী ঘোড়া সওয়ার পুরো একদিন সময়ে সমগ্র জনপদ প্রদক্ষিণ করতে পারে।৭(ফতহুল বারী,৮ম খন্ড, পৃ.৯৪] এই এলাকায় একলাখ যোদ্ধা পুরুষ ছিলো এরা সবাই ছিলো খৃস্টান ধর্মের অনুসারী।

নাজরান প্রতিনিধ দলও নবম হিজরীতে আসে। এতে ষাট ব্যাক্তি অন্তভূক্ত ছিলো। এদের মদ্যে চব্বিশজন ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর। তিনজন ছিলেন নাজরানবাসীদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা। আবদুল মসীহ নামে এক ব্যক্তি সরকার প্রধান,শারহাবিল নামে এক ব্যক্তি রাজনীতি বিষয়কক উপদেষ্টা পালন করতেন।

প্রতিনিধিদল মদীনায় পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। তারাও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। এরপর নবী (স.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং কোরআন পাঠ করে শোনান। কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করেনি।

তারা জিজ্ঞাসা করেলে, আপনি মসীহ (আ.) সম্পর্কে কি ধরণা পোষণ করেন? তার সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিন এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ওহী নাযিল করলেন।

‘অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ঈসা (আ.) এর দৃষ্টান্ত আদমের সদৃশ। তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছিলেন অতঃপর তাকে বলেছিলেন হও, ফলে সে হয়ে গেলো। এই সত্য তোমার প্রতিপালকের কাছে হতে সুতরাং সংশয়বাদীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না। তোমার কাছে জ্ঞান আসবার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বল, এসো আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রৃদের,আমাদের নারীদের এবং তোমাদের নারীদের, আমাদরে নিজেদের এবং তোমাদের নিজেদের। অতপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দেই আল্লাহর লানত।’ (সূরা আলে ইমরান,আয়াত ৫৯-৬১)

সকাল বেলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত আয়াতে কারিমার আলোকে আগন্তুকদের হযরত ঈসা (আ .) সর্ম্পকে অবহিত করলেন।কিন্তু তারা হযরত ঈসা (আ .) সর্ম্পকে নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। তারা তাদের এ অস্বীকৃতির ওপর অটল থাকলো। পরদিন সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওদেরকে মোবাহালার অর্থাৎ দুই পক্ষের পরস্পরের জন্যে বদদোয়ার প্রস্তাব জানালেন। এই আহ্বান জানানোর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মোবাহালার জন্যে প্রস্তুত দেখে নিভৃতে গিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো। নিজেদের মধ্যে পরামর্শে এক পক্ষ বললো, মোবাহেলার ঝুঁকি নিয়ে ঠিক হবে না। আল্লাহর শফথ এই হচ্ছেন নবী। যদি আমার তাঁর সাথে মোবাহেলা করি তবে আমরা এবং আমাদের সন্তান কিছুতেই সফল হতে পারবে না। আমরা সবংশে নির্মূল হয়ে যাব। পরামর্শক্রমে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজেদের ব্যাপারে সালিশ মানলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারা বলালো, আপনার দাবী মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এ প্রস্তাবের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ থেকে জিযিয়া গ্রহণ করতে রাযি হলেন। দু’হাজার জোড়া কাপড়ের ওপর সমঝোতা হলো। এক হাজার জোড়া রজব মাসে এবং অন্য এক হাজার জোড়া সফর মাসে তারা দিতেও সম্মত হলো। এর বিনিময়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদরেকে আল্লাহতায়ালা এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যিম্মায় গ্রহণ করলেন। ধর্মীয় ব্যাপারে তারা ছিলো স্বাধীন। উল্লিখিত বিষয়ে তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চুক্তি সম্পাদন করলেন। প্রতিনিধিদল দাবী করলো যে, তাদের সাথে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে যেন প্রেরণ করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তি অনুযায়ী মালামাল সংগ্রহের জন্যে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহকে প্রেরণ করলেন।

অতপর নাজরা গোত্রে ইসলামের বিস্তার ঘটতে থাকে। সীরাত রচয়িতরা লিখেছেন প্রতিনিধিদলের নেতা এবং তার অনুসারীরা নাজরান যাওয়ার পর ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলো। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদাকাত এবং জিজিয়া গ্রহণ করতে হযরত আলীকে (রা.) প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য যে, সাদাকা মুসলমানদের থেকেই উসূল করা হয়।৮[ফতহুল বারী,৮ম খৃন্ড,পৃ.৯৪-৯৫। যাদুল মায়াদ, তয় খন্ড, পৃ.৩৮-৪১। নাজরন প্রতিনিধিদলের বিস্তারিত বর্ণনায় উল্লেখ রায়েছে যে, নাজর প্রতিনিধিদল এ ২য়বার মদীনায় গমন করলে কেউ কেউ এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেননি।]

(১৩) বনি হানিফা প্রতিনিধি দলঃ এ প্রতিনিধিদল নবম হিজরীতে মদীনায় আগমন করে। এতে মোসায়লামা ইবনে কাযযাবসহ সতের ব্যক্তি ছিলেন।৯[ফতহুল বারঅ, ৮ম খন্ড, পৃ.৮৭] মোসায়লামার বংশধারা এরূপ মোসাইলাম ইবনে ছামামা ইবনে কারিব ইবনে হাবিব ইবনে হারেস।

এ প্রতিনিধিদল একজন আনসার সাহাবীর বাসভবনে গিয়ে ওঠেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন । তবে মোসায়লামা কাযযাব সম্পর্কে ভিন্ন কথা জানা যায়। সকল বর্ণনার প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় মোসায়লামা হঠকারিতা ও অহংকার এবং ক্ষমতা পাওয়ার লোভ প্রকাশ করে। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের সাথে সে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়নি। পরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে গেলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শান্ত ও মধুর স্বরে থাকে ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু লক্ষ্য করলেন যে, তার মধুর ব্যবহার কোন শুভ প্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বুঝতে পারলেন যে, এ লোকটির কোন কল্যাণ হবে না। তার মনের ভিতর পঙ্কিলতা ও কালিমা রয়েছে।

এর আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাতে স্বপ্নে দেখেন যে, সমগ্র বিশ্বের ধনভান্ডার তার দরবারে এনে রাখা হয়েছে। হঠাৎ সে ধন ভান্ডার থেকে দুটি সোনার কাঁকন তার হাতে উড়ে এসে পড়লো। কাঁকন দু’খানি ছিলো বেশ ভারি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিব্রত বোধ করছিলেন। এসময় হযরত জিবরাঈলের (আ.)মাধ্যমে ওহী এলা যে, কাঁকন দুখানিতে ফুঁ দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুঁ দিনলেন। সাথে সাথে কাঁকন দু’খানি উড়ে চলে গেলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই স্বপ্নের ব্যাখ্য করলেন যে, তার পরে দুজন লোক নবুয়তের মিথ্যা দাবীদার হবে। মোসায়লামা কাযযাবের দুর্বিনীত ব্যবহার দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিরক্ত হলেন। সে দুর্বৃত্ত বলছিলো, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি শাসন ক্ষমতা তার পরবর্তী সময়ে আমাকে ন্যস্ত করেন তবে আমি তার আনুগত্য করতে প্রস্তুত রয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোসায়লামার কাছে গেলেন। সে সময় তার হাতে একটি খেজুর গাছের শাখা ছিলো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখপাত্র হযরত ছাবেত ইবনে কয়েস ইবনে শামাস (রা.) তার সাথে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার শিয়রের কাছে গিয়ে হাযির হলেন। মোসায়লাম বললো, যদি আপনি রাজি থাকেন, তবে শাসনক্ষমতার ব্যাপারে আমি আপনাকে ছাড় দিতে রাজি আছি। কিন্তু ক্ষমতার ব্যাপারে আপনার উত্তরাধিকারী আমাকে মনোনীত করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের খেজুর শাখার প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, যদি তুমি আমার কাছে এটি চাও এটিও আমি তোমাকে দেবো না, তোমার ব্যাপারে আল্লাহর যে ফয়সালা রয়েছে তুমি তার বাইরে যেতে পারবে না। যদি তুমি পৃষ্টপ্রদর্শন করে চলে যাও তবে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করে দেবেন। আল্লাহর শপথ, আমার মনে হয় তুমিই সেই ব্যক্তি যার ব্যাপারে আমাকে স্বপ্নে দেখানে হয়েছে। ছাবেত ইবনে কয়েস এখনো রইলো সে তোমাকে আমার পক্ষ থেকে জবাব দেবে একথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এলেন। ১০[সহীহ বোখারী, বনি হানিফা এবং আসওাদ আনাসির কিস্সা বিষয়ক অধ্যায়। ২য় খন্ড, পৃ. ৬২৭,৬২৮ এবং ফতহুল বারী ৮ম খন্ড ৮৬-৯৩]

অবশেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাই সত্য প্রমাণিত হলো । মোসায়লাম কাযযাব ইয়ামামা ফিরে গিয়ে প্রথমে কযেকদিন নিজের সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলো। তারপর হঠাৎ দাবী করলো যে, নবুয়তের ক্ষেত্রে মোহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাকেও অংশীদার করা হয়েছে। অতপর সে প্রকাশ্যে নবুয়তের দাবী প্রচার করতে লাগলো। স্বজাতির লোকদের জন্যে সে ব্যভিচার এবং মদ্যপান বৈধ বলে প্রচার করলো।

মোসায়লাম কাযযাব দশম হিজরীতে নবুয়ত দাবী করেছিলো। দ্বাদশ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে হযরত আবু বকর সিদ্দিকের (রা.) খেরাফতের সময়ে ইয়ামামায় সে নিহত হয়। হযরত হামযার (রা.) হত্যাকরী হযরত ওয়াহশী (রা.)মোসায়লাম কাযযাবকে হত্যা করেন।

নবুয়তের একজন দাবীদারের পরিণাম জানা গেলো। অন্য একজন দাবীদার আসওয়াদ আনাসী ইযেমেনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে রেখেছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের একরাত একদিন আগে হযরত ফিরোজ (রা.) এই ভন্ড নবীকে হত্যা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহীর মাধ্যমে এ হত্যাকান্ডের খবর জেনে সাহবাদের জানিয়ে দেন। এরপর ইয়েমেন থেকে হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে যথারীতি খবর এস পৌছায়। ১৩[ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৯৩]

(১৪) বনি আমের সা’সাআ প্রতিনিধিদলঃ প্রতিনিধিদলে আল্লাহর দুশমন আমের ইবনে তোফায়েল হযরত লাবিদের বৈমাত্রেয় ভাই আরবাদ ইবনে কয়েস, খালেদ ইবনে জাফর এবং জব্বার ইবনে আসলাম অন্তভূক্ত ছিলেন। এরা নিজ নিজ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং শয়তান স্বভাব সম্পন্ন ছিলো। আমের ইবনে তোফায়েল নামক এক ব্যক্তি বে’র মাউনায় সত্তরজন সাহাবীকে শহীদ করিয়েছিল। এই প্রতিনিধিদল মদীনা আসার ইচ্ছা করার সময়ে আমের ইবনে এবং আরবাদ ষড়যন্ত্র করেছিলো যে, তারা ধোকা দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আকস্মিকভাবে হত্যা করবে।

এ প্রতিনিধিদল মীনায় পৌঁছার পর আমের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আলাপ করছিলো। এ সময়ে আরবাদ ঘুরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে গেলো এবং তলোয়ার বের করতে লাগলো। কিন্তু তলোয়ার এক বিঘতের বেশী বের করতে সক্ষম হলো না, আল্লাহ তায়ালা তার হাত অসাড় করে দিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবীকে হেফাজত করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয় দুর্বৃত্তের জন্যে বদদোয়া করলেন। ফলো ফেরার পথে আরবাদের উপর বজ্রপাত হলো। সাথে সাথে উটসহ এই কাফের মৃত্যু ররণ করলো। এদিকে আমের একজন সেলুলিয়া মহিলার ঘরে আশ্রয় নিলো। সেখানে তার ঘাড়ে গলগন্ড রোগ দেখা দিলো। এ রোগেই সেখানে তার মৃত্যু হল। মৃত্যুর সময় আমরে বলেছিলো হায উটের ঘাড়ের মতো গলগন্ড রোগ আর সেলুলিয়ার মহিলার ঘরে মৃত্যুবরণ?

সহীহ বোখারীর রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে আমের বললো, আপনাকে আমি তিনটি শর্ত দিচ্ছি, এর যে কোন একটি মেনে নিন (১) উপত্যকার অধিবাসীরা আপনার উৎপন্ন দ্রব্য আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।(২) আমি আপনার পরে খলীফা হবো। (৩) বনি গাতফান গোত্রের এক হাজার নর এবং এক হাজার মাদী ঘোড়াসহ আপনার বিরুদ্ধে লেলিযে দেবো।

অতপর সে এক মহিলার ঘরে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হলো। সে সময় গভী হতাশায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে সে বললো, হায় উুটের ঘাড়ের মতো গলগন্ড রোগ। তাও অমুক গোত্রের মহিলার ঘরে? তারপর বললো, আমার কাছে আমার ঘোড়া নিয়ে এসো। ঘোড়া নিয়ে আসা হল। ঘোড়ার পিঠে অতপর আল্লহর এ দুশমন মৃত্যুবরণ করলো।

(১৫) তাজিব প্রতিনিধি দলঃ এই প্রতিনিধিদল নিজেদের গোত্রের গরীব লোকদের মধ্যে বন্টনের পর অবশিষ্ট সাদাকা নিয়ে মদীনায় হাযির হলো। এ প্রতিনিধিদলের মোট তেরো ব্যক্তি ছিলেন। এর কোরআন সুন্নাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাদের শিক্ষা করতেন। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিছু কথা জিজ্ঞেস করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সেসব কথা লিখে দিলেন। এর বেশীদিন মদীনায় অবস্থান করেনি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিনিধি দলের সদস্যদের কিছু জিনিস উপঢৌকন হিসাবে প্রদান করেন। যাওয়ার পর ওরা পেছনে পড়ে থাকা একজন সঙ্গী যুবককে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রেরণ করলো। যুকব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে হাযির হয়ে বললো, হুজুর আল্লাহর শপথ, আমি নিজের এলাকা থেকে অন্য উদ্দেশ্যে আসিনি, শুধু এ উদ্দেশ্যে এসেছি যে, আপনি আমার জন্যে সর্বশক্তিমান পরম করুনাময় আল্লহার কাছে দোয়া করুন। তিনি যেন আমাকে রহমত এবং তাঁর দ্বীনের অবিচল থাকার শক্তি দান করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবকের জন্যে দোয়া করলেন। পরবর্তীকালে বহু নওমুসলিম ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলেও এ যুবক ইসলামের ওপর ছিলো অটল অবিচল। নিজ কওমের লোকদের কাছে সে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে ওয়ায নসিহত করলো। ফলে তার কওমের লোকেরাও ইসলামের ওপর অবিচল থাকলো। দশম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সময় এই প্রতিনিধিদল পুনরায় নবী সাল্লাল্লাহু আলা্ইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করলো।

(১৬) তাঈ প্রতিনিধিদলঃ এই প্রতিনিধিদল আরবের বিখ্যাত যায়েদ আল খায়েলও ছিলেন। এরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আলাচনায় মিলিত হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা ইসলাম গ্রহণ করে খুব ভালো মুসলমান হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ আল খায়েল এর প্রশংসা করলেন, তিনি বললেন, আরবের যে কোন লোকের প্রশাংসাই আমার কাছে করা হয়েছে, তারা আমার সামনে আসার পর বাস্তবে আমি তাদের খ্যাতির চেয়ে কমেই পরিচয় পেয়েছি। কিন্তু যায়েদ তার ব্যতিক্রম।তার গুন বৈশিষ্ট্য তার খ্যাতির চেয়ে অধিক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নাম করণ করলেন যায়েদ আল খায়ের।

একই নিয়মে নবম এবং দশম হিজরীতে বহু সংখ্যক প্রতিনিধি দল আগমন করে সীরাত রচয়িতারা ইয়মান,আযাদ,কোযাআর বনু সা’দ,হোযাইম বনু আমের ইবনে কয়েস,বনু আসাদ, বাহরা, খাওলান, মাহারেব, বনু হারেস ইবনে কা’ব, গামেদ, বনু মোনতাফেতক, সালমান, বনি আবাস,মাজিনা, মোরাদ, জোবায়েদ, কুন্দাহ, জি-মাররাহ, গাস্সান, বু আয়েশ এবং নাখ প্রতিনিুধিদলের কথা উল্লেখ করেছেন। নাখ-এর প্রতিনিধি দল এসছিলো সর্বশেষে। একাদশ হিজরীর মহররহম মাসে এ প্রতিনিধি দল মদীনায় আসে।

এতে দু’শো ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অন্য প্রায় সকল প্রতিনিধিদল নবম এবং দশম হিজরীতে আগমন করেন। অল্প কয়েকটি প্রদিনিধি দল একাদশ হিজরীতে আগমন করে।

উল্লিখিত প্রতিনিধিদলসমূহের মদীনায় আগমনের ঘটনায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের প্রচার প্রসার কতোটা হয়েছিলো। এছাড়া এটাও বোঝা যায় যে, আরব জনগণের দৃষ্টিতে মদীনার গুরুত্ব ছিলো কত বেশী। মদীনায় গিয়ে আত্মসমর্পন ব্যতীত তারা অন্য কোন উপায় দেখতে পায়নি। প্রকৃতপক্ষে মদীনা জাযিরাতুল আরবের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিলো। মদীনাকে উপেক্ষা করা কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলো না। তবে, আমরা এমন কথা বলতে পারব না , আগন্তুকদের সকলের মনেই ইসলামের প্রভাব পড়েছিলো এবং বিশেষভাবে রেখাপাত করেছিলো। কেননা উল্লিখিত প্রতিনিধিদলসমূহের সদস্যদের মধ্যে বহু আরব বেদুইন এমন ও ছিলো যারা নিজেদের গোত্র সর্দারের আনুগত্য করতে মুসলমান হয়েছিলো। হত্যা,লুটতরাজ ইত্যাদি অভ্যাস তারা তখনো পুরোপুরি ত্যাগ করতে সক্ষম হয়নি। এবং ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য্যের কারণে তারা সভ্য মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতেও পারেনি। সূরা তওবায় এ ধরণের লোকদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কুফুরী ও কপটতায় মক্কাবাসীরা কঠোরতর এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তারা সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা এদের অধিক। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। মরুবাসীদের কেউ কেউ যা তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তা অর্থদন্ড বলে গণ্য করে এবং তোমদের ভাগ্য বিপর্যয়ের প্রতিক্ষা কর। মন্দ ভাগ্যচক্র ওদেরই হোক। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।’

তবে কিছু সংখ্যক লোকের প্রশংসাও করা হয়েছে। সূরা তওবায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মরুবাসীদের কেউ কেউ আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবিকই তা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়। আল্লাহ তাদেরকে নিজ রহমতে দাখিল করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।’

মক্কা, মদীনা, ছাকিফ,ইয়েমেন এবং বাহরাইনের বহু নাগরিক অন্তকরণে ইসলাম দৃঢ়ভাবে গেঁথে গিয়েছিলো। তাঁদের অনেকেই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবা এবং পূণ্যশীল মুসলমান। ১৪[খাযরামি তাঁর মোহযেরাত গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ১৪৪ পৃ. একথা লিখেছেন। যেসব প্রতিনিধি দলের কথা উল্রে করা হয়েছে এবং যেসব প্রতিনিধিদল সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, সেসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখূন সহীহ বোখারী, ১ম খন্ড, পৃ.১২, ২য় খন্ড, পৃ. ৬২৬-৬৩০। ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড পৃ. ৫০১-৫০৩। ৫৩৭-৫৪২, ৫৬০-৬০১। যাদুল মায়াদ ৩য় খন্ড, পৃ.২৬-৬০, ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ.৮৩-১০৩। রহমতুল লিল আলামীন ১ম খন্ড, পৃ.১৮৪-২১৭]।

রসূলের দাওয়াতের ব্যাপক সফলতা

এবার আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জীবনের শেষ দিক সম্পর্কে আলোচনা করবো। কিন্তু সেদিকে অগ্রসর হওয়ার আগে নবী জীবনের অনন্য সাধারণ কার্যাবলীর প্রতি একটুখানি আলোকপাত করা দরকার। মূলত সেটাই হচ্ছে নবী জীবনের সারকথা। সেই বৈশিষ্টের কারণেই তিনি সকল নবী-পয়গাম্বরের মধ্যে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আল্লাহ রব্বুলর আলীমীন তাঁকে সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ এর অনন্য মর্যাদার মুকুট দান করেছেন। নবীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘হে বস্ত্রাবৃত, রাত্রি জাগরণ কর, কিছু অংশ ব্যতীত’। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, হে বস্ত্রাচ্ছাদিত, উঠ, সতর্ক বাণী প্রচার কর।’

এরপর কি হয়েছে? রসূল রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠলেন, নিজ কাঁধে বিশ্বজগতের সবচেয়ে বড় আমানতের বোঝা তুলে নিলেন এবং একাধারে দাঁড়িয়ে রইলেন। সমগ্র মানবতার বোঝা সকল আকিদার বোঝা এবং বিভিন্ন ময়দানে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার বোঝা।

তিনি মানুষের বিবেকের ময়দানে জেহাদের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন এসব বিবেক ছিলো অজ্ঞতার যুগের কল্পনা এবং নানাবিধ উদ্ভট ধারণায় নিমজ্জিত।

মানুষের বিবেক সে সময় পৃথিবীর নানা আকর্ষনীয় বস্তুর কারণে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিলো। মানুষের বিবেক খাহেশাতে নফসানীর শেকল ও ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কতিপয় নিবেদিত প্রাণ সাহাবার সহযোগীতায় জাহেলিয়াত এবং বিশ্বজগতের আকর্ষণ থেকে মানুষের বিবেককে মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন করার পর অন্য একটি সংগ্রাম শুরু করলেন। বরং একটির পর আরেকটি সংগ্রাম শুরু হলো। অর্থাৎ দাওয়াতে এলাহীর সেসব শত্রু যারা দাওয়াত এবং তার প্রতি বিশ্বাসীরদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, দাওয়াতের পবিত্র চারাগাছকে মাটির নিচে শেকড় বিস্তারের আগে শূন্যে শাখা প্রশাখা বিস্তারের এবং ফলে ফুলে সুশোভিত হবার আগেই নিশ্চিহ্ণ করে দিতে চাচ্ছিলো। দাওয়াতের এ সকল শত্রুর সাথে নবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংগ্রাম শুরু করলেন। জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রোমক সাম্রাজ্য এ নয়া জাতিকে নিশ্চিহ্ণ করার সীমান্তে প্রস্তুতি শুরু করে।

অবশেষে সকল সংগ্রাম শেষ হলো কিন্তু বিবেকের সংগ্রাম সংঘাত শেষ হয়নি। কারণ এটি হচ্ছে চিরস্থায়ী সংঘাতের বিষয়। এতে শয়তানের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। শয়তান মানব মনের গভীরে প্রবেশ করে তার তৎপরতা অব্যাহত রাখে এবং মুহুর্তের জন্যেও তা বন্ধ করে না। মোহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত থেকে বিভিন্ন ময়দানে যথোচিত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দুনিয়া তাঁর চরণে এসে লুটিয়ে পড়েছিলো কিন্তু তিনি দুঃখকষ্ট এবং দারিদ্রের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলেন। ঈমানদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারিপাশে শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়া বিস্তার করে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি দুঃখ দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের পথে সাধনা অব্যাহত রাখেন। যে কোন অবস্থায় দুঃখ কষ্টের মধ্যে তিনি অভূতপূর্ব ধৈর্যধারণ করছিলেন। রাত্রিকালে তিনি নামাযে দাঁড়াতেন। প্রিয় প্রতিপালকের এবাদাত এবং পবিত্র কোরআন ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করতেন। সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর প্রতি তিনি মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য তাঁকে এ রকম করতে নির্দেশও প্রদান করা হয়েছিলো।১[সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, ২৯তম খন্ড, পৃ-১৬৮-১৬৯]।

**এমনিভাবে সুদীর্ঘ বিশ বছরের সময় যাবত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংগ্রাম চালিয়ে যান। এই সময়ের মধ্যে একটি কাজে আত্মনিয়োগ করে অন্য কাজ তিনি ভুলে থাকেননি। পরিশেষে ইসলামী দাওয়াত এমন ব্যাপক সাফল্য লাভ করলো যে, সাবইকে অবাক হতে হলো। সমগ্র জাযিরাতুল আরব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগত হলো। আরবে দিগন্ত থেকে জাহেলিয়াতের মেঘ কেটে গেলো। অসুস্থ বিবেকসমূহ সুস্থ হয়ে গেলো। এমনকি মূর্তিসমূহকে তারা ছেড়ে দিল বরং ভেঙ্গে ফেলল। তওহীদের আওয়াযে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। ঈমানের তেজে নতুন জীবনীশক্তি লাভ করে মরু বিয়াবার আযানের সুমধুর ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো। দিক দিগন্তে আল্লাহ আকবর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো। কোরআনের ক্বারীরা প্রবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম কায়েম করতে উত্তর দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়লেন।

বিচ্ছিন্ন গোত্রসমূহ একত্রিত হলো, মানুষ মানুষের দাসত্ব ছেড়ে আল্লাহর দাসত্বে আত্মনিয়োগ করলো। এখন আর কেউ শোষক নয়,কেউ শোষিত নয়,কারো রক্তচক্ষু কাউকে এখন আর ভীতসন্ত্রস্ত করে না, কেউ যালেম নয়, কেউ মযলুম নয়, কেউ মালিক নয়, কেউ গোলাম নয়, কেউ শাসক নয়, কেউ শাসিত নয় বরং সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পর ভাই ভাই। তারা একে অন্যাকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্য থেকে জাহেলিয়াতের সময়ের গর্ব অহংকার এবং পিতা পিতামহের নামে আত্মম্ভরিতার অবসান ঘটালেন। এখন আর অনারবদের ওপর আরবদের এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতঙ্গদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এখানে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। অন্যথায় সকল মানুষ আদমের সন্তান। আর আদম হচ্ছে মাটির তৈরী।

মোটকথা এই দাওয়াতের ফলে আরব ঐক্য মানবীয় ঐক্য সম্মিলিত ন্যায়নীতি ও সুবিচার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। মানব জাতি দুনিয়ার বিভিন্ন সমস্যা এবং আখেরাতের বিভিন্ন কাজে সৌভাগ্যের পথের সন্ধান পেলো। অন্য কথায় ইতিহাসের ধারাই পাল্টে গেলো।

এই দায়ওয়াতের আগে পৃথিবীতে জাহেলিয়াতের জয়-জয়কার চলছিলো। মানুষের বিবেক অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আত্মা দুগন্ধময় হয়ে পড়েছিলো। মূলোবোধে চরম অবক্ষয় ঘটেছিলো। অত্যাচার এবং দাসত্বের প্রবল প্রতাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। উচ্ছৃঙ্খলাতপূর্ণ এবং লজ্জাকর সাচ্ছন্দ্য এবং ধ্বংসাত্মক বঞ্চনার ঢেউ বিশ্বকে অবনতির অতলে পৌঁছে দিয়েছিলো। এর ওপর কুফুরী এবং পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে মোটা পর্দা হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। অথচ সময় ও আসমানী মাযহাব এবং ধর্ম বিশ্বাস বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু মানুষ সেসবকে বিকৃত করে দিয়েছিলো। ফলে ধর্ম বিশ্বসের ক্ষেত্রে দূর্বলতা চরমে পৌঁছে গিয়েছিলো। ধর্মের বন্ধন ছিলো শিথিল। ধর্ম হয়ে পড়েছিলো প্রাণহীণ দেহের মতো দূর্বল এবং অল্পকিছু আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব।

উল্লিখিত দাওয়াত যখন মান জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করলো, তখন মানবাত্মা অলীক ধ্যান-ধারণা, প্রবৃত্তির দাসত্ব নোংরামি, অন্যায়, অত্যাচার,নৈরাজ্য এবং অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভ করলো। মানব সমাজকে যুলুম, অত্যাচার, হঠকারিতা, ঔদ্ধত্য, ধ্বংস, শ্রেণী বৈষম্য, শাসকদের অত্যাচার, জ্যোতিষীদের অবমাননাকর ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে মুক্তি দান করলো। বিশ্ব তখন দয়া, ক্ষমা, বিনয়, নম্রতা, আবিষ্কার, নির্মাণ, স্বাধীনতা, সংস্কার, মারেফাত, ঈমান, ন্যায়পরায়ণতা,সুবিচার এবং আমালের ভিত্তিতে জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি এবং হকদারের অধিকার লাভের নিশ্চয়তার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো। ২[সাইয়েদ কুতুব শহীদ, তাফসীর ফি যিলালিল কোরআন, ১ম খন্ড, পৃ-১৪]।

এসকল পরিবর্তনের কারণে জাযিরাতুল আরব এমন একটি বরকতপুর্ণ জনবসতিতে পরিণত হলো যার উদাহরণ মানব ইতিহাসের কোন যুগে অথবা কোন দেশে দেখা যায়নি এবং যাবেও না। জাযিরাতুল আরব তার ইতিহাসে এমন জৌলুসপূর্ণ এবং ঝলমলে হয়ে উঠলো যে, এর আগে কখনোই, কোথাও ওরকম দেখা যায়নি। 
বিদায় হজ্জ
দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ পূর্ণ হয়েছে। আল্লাহর রবুবিয়ত এবং অন্য সকল মতাদর্শের বিলোপ সাধন করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেন রেসালতের ভিত্তিতে একটি নতুন সমাজ গঠন করা হয়েছে। এরপর যেন অদৃশ্য ঘোষক রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিন্ত ও চেতনার এ ধারণা বদ্ধমূল করেছিলো যে, পথিবীতে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মায়া’য (রা.)-কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণ করার সময় অন্যান্য প্রয়োজনীয় কথার পর বললেন, হে মায়া’য সম্ভবত এই বছরের পর আমার সাথে তোমার আর সাক্ষাৎ আর হবে না। হয়তো এরপর তুমি আমার মসজিদ এবং কবরের কাছে দিয়ে অতিক্রম করবে। হযরত মায়া’য (রা.) একথা শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চিরবিদায়ের কথা ভেবে কাঁদতে শুরু করলেন।

প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা চাচ্ছিলেন যে, তাঁর রসূলকে দীর্ঘ বিশ বছরের দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতনের সুফল প্রত্যক্ষ করাবেন। হজ্জের সময় মক্কার বিভিন্ন এলাকা থেকে জনসাধারণ এবং জন প্রতিনিধিদলল মক্কায় সমবেত হবেন এরপর তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছ থেকে এ মর্মে সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন যে, আমি আমার ওপর অর্পিত আমানত পূর্ণ করেছি, আল্লাহর পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং উম্মতের কল্যাণের হক আদায় করেছি। আল্লাহর এইরূপ ইচ্ছা অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে ঐতিহাসিক হজ্জের তারিখ ঘোষণা করলেন তখন নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে মুসলমান মক্কায় পৌঁছুতে শুরু করলেন। সমবেত সকলেই মনে-প্রাণে চাচ্ছিলেন যে, তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ গ্রহণ করে তাঁর আনুগত্য মেনে নেবেন।১[এই হাদীস সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে। দ্রষ্টব্য প্রথম খন্ড,পৃ=৩৯৪, হুজ্জাতুল নবী অধ্যায়।]

অতপর শনিবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার পথে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। যিলকদ মাসের তখনো চারদিন বাকি ছিলো। ২[হাফেজ ইবনে হাজর এ ব্যাপারে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। কোন কোন বর্ণনায় জিলকদ মাসের ৫ দিন বাকি থাকার যে কথা রয়েছে তা সংশোধন করেছেন।দ্রষ্টব্য ফতহুল বারী, ৮ম খন্ড, পৃ-২০৭।] তিনি মাথায় তেল দিলেন, চুল আঁচড়ালেন. তহবন্দ পরেলেন,চাদর গায়ে জড়ালেন, কোরবানীর পশুকে সজ্জিত করলেন এবং যোহরের পর রওয়ানা হলেন। আছরের আগেই তিনি যল হুলাইফা নামক জায়গায় পৌঁছুলেন। সেখানে আছরের দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। রাত যাপনের জন্যে তাঁবু স্থাপন করলেন। সেখানে রাত কাটালেন। সকালে তিনি সাহাবাদের বললেন, রাতে আমার পরওয়াদেগারের কাছ থেকে একজন আগন্তুক এসে বলেছে, হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পবিত্র প্রান্ত-

রে নামায আদায় করুন এবং বলুন যে, হজ্জের মধ্যে ওমরাহ রয়েছে। ৩[রোখারী শরীফে হযরত ওমর (রা.) থেকে এই বর্ণনা সঙ্কলিত হয়েছে। ১ম খন্ড, পৃ-২০৭]

এরপর যোহর নামাযের আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এহরামের জন্যে গোসল করলেন। হযরত আয়েশ (রা.) নিজ হাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র দেহে জারিরা ও মেশক খুশবু লাগালেন। খুশবুর চমক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিথি এবং পবিত্র দাড়িতে দেখা যাচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই খুশবু ধৌত করেননি। যেমন ছিলো তেমনই রেখে দিলেন। এরপর তিনি তহবন্দ চাদর পরিধান করলেন। যোহরের দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। পরে মোসল্লায় বসেই হজ্জ এবং ওমরাহর একত্রে এহরাম বেঁধে লাব্বায়েক আওয়াজ দিয়ে বাইরে এলেন। পরে উটনীতে আরোহণ করে দু’বার লাব্বায়েক বললেন। উটনীতে চড়ে খোলা ময়দানে গিয়ে সেখানেও লাব্বায়েক ধ্বনি দিলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরপর তাঁর সফর অব্যাহত রাখলেন। এক সপ্তাহ পর তিনি এক বিকেলে মক্কার কাছে পৌঁছে যি-তুবা নামক জায়গায় অবস্থান করলেন এবং ফজরের নামায আদয়ের পর গোসল করলেন। এরপর মক্কায় প্রবেশ করলেন। সেদিন ছিলে দশম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের চার তারিখ রোববার। মদীনা থেকে রওয়ানা হওয়ার পর পথে আট রাত অতিবাহিত হয়েছিলো। স্বাভাবিক গতিতে পথ চললে এরূপ সময়ই প্রয়োজন হয়। মসজিদে হারামে পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে কাবাঘর তওয়াফ করেন। এরপর সাফা মারওয়ার মধ্যবর্তী জায়গায় সাঈ করেন। কিন্তু এহরাম খোলেননি। কেননা তিনি হজ্জ ও ওমরাহর এহরাম একত্রে বেঁধেছিলেন।

নিজের সাথে কোরবানীর পশুও নিয়ে এনেছিলেন। তওয়াফ এবং সাঈ শেষে তিনি মক্কার হাজ্জন নামক স্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু দ্বিয়ীয় হজ্জের তওয়াফ ছাড়া কোন তওয়াফ করেননি।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আসা যে সকল সাহাবা কোরবানীর পশু সঙ্গে নিয়ে আসেননি তিনি তাদের আদেশ দিলেন, তারা যেন নিজেদের এহরাম ও ওমরায় পরিবর্তিত করে দেয় এবং কাবাঘর তও্য়াফ, সাফা মারওয়ার সাঈ শেষ করে পুরোপুরি হালাল হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজে হালাল হননি, এ কারণে সহাবার সংশয়াচ্ছন্ন হয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি যা পরে জেনেছি, সেটা যদি আগে জানতাম, তবে আমি কোরবানীর পশু সঙ্গে নিয়ে আসতাম না। যদি আমার সাথে কোরবানীর পশু না থাকতো, তবে আমিও হালাল হায়ে যেতাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একথা শোনার পর সাহাবারা আনুগত্যের মাথা নত করলেন। যাদের কাছে কোরবানী পশু ছিলো না তারা হালাল হয়ে গেলেন।

যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় গমন করলেন। সেখানে ৯ই যিলহজ্জ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করলেন। যোহর, আছর, মাগরিব, এশা এবং ফযর এই পাঁচ ওয়াক্ত নামায সেখানে আদায় করে সেখানে সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। পরে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে দেখে নেমরাহ প্রান্তরে তাঁবু প্রস্তুত রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপবেশন কররলেন। সূর্য ঢলে পড়লে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ উটনীর পিঠে আসন লাগানো হলো। তিনি প্রান্তরের মাঝামাঝি স্থানে গমন করলেন। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চারিদিকে এক লাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার মানুষের সমুদ্র বিদ্যামন ছিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জেসমবেত জনসমুদ্রের উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন,‘ হে লোক সকল, আমার কথা শোনো, আমার কথা শোনো, আমি জানি না, এবারের পর তোমাদের সাথে এই জায়গায় আর মিলিত হতে পারবো কি না।’৪[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড,পৃ-৬০৩]

তোমাদের রক্ত এবং ধন-সম্পদ পরস্পরের জন্যে আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং বর্তমান শহরের মতোই নিষিদ্ধ। শোনো, জাহেলিয়াতের সময়ের সবকিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহেলিয়াতের খুন ও খতম করে দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যেকার যে প্রথম রক্ত আমি শেষ করছি তা হচ্ছে, রবিয় ইবনে হারেসের পুত্রের রক্ত। এই শিশু বনি সা’দ গোত্রে দুধ পান করছিলো সেই সময়ে হোযাইল গোত্রের লেকেরা তাকে হত্যা করে। জাহেলী যুগের সুদ খতম করে দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যকার প্রথম যে সুদ আমি খতম করছি তা হচ্ছে আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালেবের সুদ। এখন থেকে সকল প্রকার সুদ শেষ করে দেয়া হলো।

মেয়েদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আামনতের সাথে গ্রহণ করেছে এবং আল্লহর কালেমার মাধ্যমে হালাল করেছ। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে, তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে আসতে দেবে না যাদের তোমরা পছন্দ করো না। যদি তারা এরূপ করে তবে তোমারা তাদের প্রহার করতে পারো। কিন্তু বেশী কঠোরভাবে প্রহার করো না। তোমদের ওপর তাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তোমরা তাদের ভালোভাবে পানাহার করাবে এবং পোশাক দেবে।

তোমাদের কাছে আমি এমন জিনিস রেখে যাচ্ছি যে, যদি তোমর তা দৃঢ়ভাবে ধারন করে থাকো তবে এরপর কখানো পথভ্রষ্ট হবে না। সেই জিনিস হচ্ছে আল্লাহর কেতাব।৫[সহীহ মুসলিম, হুজ্জতুল নবী অধ্যায়।১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭] হে লোক সকল মনে রেখো আমার পরে কোন নবী নেই। তোমদের পরে কোন উম্মত নেই। কাজেই নিজ প্রতিপালকের এবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। রমযান মাসে রোযা রাখবে। সানন্দ চিত্তে নিজের ধন-সম্পদের যাকাত দেবে। নিজ পরওয়ারদেগারের ঘরে হজ্জ করবে। নিজের শাককদের আনুগত্য করবে। যদি এরূপ করো তবে তোমাদের পরওয়ারদেগারের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।৬[ইবনে মাজা, ইবনে আসাকের, রহমতুল লিল আলমিন,১ম খন্ড, পৃ-২৬৩]

তোমাদরে সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে। তোমরা তথন কি বলবে? সাহবারা বললেন, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি তাবলীগ করেছেন, পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। কল্যাণকারিতার ব্যাপারে ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।

একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাহাদাত আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে এরপর লোকদের দিকে ঝুঁকিয়ে তিনবার বললেন, ইয়া রাব্বুল আলামীন, তুমি সাক্ষী থেকো।৭[সহীহ মুসরিম, ১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বানীসমূহ রবিয়া ইবনে উামইয়া ইবনে খালফ উচ্চকন্ঠে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলেন।৮[ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬০৫]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ শেষ করার পর আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন। ‘আজ তোমদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদরে দ্বীন মনোনীত করলাম।’(সূরা মায়েদা,আয়াত -৩)

হযরত ওমর (রা.) এই আয়াত শুনে কাঁদতে শুরু করেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন, কাঁদছি এ জন্যে যে, পূর্ণতার পর অপূর্ণতাই শুধু বাকি থাকে। ৯[বোখারী, ইবনে ওমরের (রা.) বর্ণনা দ্রষ্টব্য। ১ম খন্ড, পৃ-২৬৫]

নবী করিমের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণের হযরত বেলাল (রা.) আযান ও একামত দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের নামাজ পড়ালেন। এরপর হযরত বেলাল একামত দিলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আছরের নামাজ পড়ালেন। উল্লিখিত উভয় নামাযের মাঝামাঝি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য কোন নামায আদায় করেননি।এরপর সওয়ারীতে আরোহণ করে তাঁর অবস্থানস্থলে গমন করলেন। সেখানে তিনি উটনীর পিঠেই অপেক্ষা করলেন, কিছুক্ষণ পর সূর্যাস্ত হলো। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উসামাকে (রা.) পেছনে বসালেন এবং সেখানে থেকে রওয়ান হয়ে মোযদালেফা গমন করলেন। সেখানে মাগরেব ও এশার নামায এক আযানের দুই একামতে আদায় করলেন। মাঝখানে কোন নফল নামায আদায় করেননি। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয়ন করলেন। ফজরের নামাযের সময় হওয়া পর্যন্ত তিনি শায়িত থাকলেন। ফজরের সময় হওয়ার পর আযান ও একামতের সাথে ফজরের নামায আদায় করলেন। এরপর উটনীতে সওয়ার হয়ে ‘মাশআরে হারামে’ গমন করে কেবলার দিকে ফিরে আল্রাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহর নামে তাকবীর ধ্বনি দিলেন এবং তওহীদের কালেমা উচ্চারণ করলেন। সেখানে সকালে চারিদকে ভালোভাবে ফর্সা হওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। এরপর সূর্য ওঠার আগে আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এবার হযরত ফযল ইবনে আব্বাসকে নিজের পেছনে বসালেন।‘বাৎনে মোহচ্ছার’ (আবরাহার সৈন্যদের ওপর গযব আসার জায়গায়) পৌঁছে সওয়ারীকে জোর ছোটালেন। জামরায়ে কোবরার পথে রওানা হয়ে সেখানে পৌঁছুলেন। সেই আমলে সেখানে একটি গাছ ছিলো। সেই গাছের পরিচয়েও জামরায়ে কোবরার পরিচিতি ছিলো। জামরায়ে কোবরারকে জামরায়ে আকাবা এবং জামরায়ে উলাও বলা হয়ে থাকে। এর পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। প্রতিবারের পাথর নিক্ষেপের সময় তিনি তাকবির ধ্বনি দিচ্ছিলেন। ছোট ছোট পাথরের টুকরো ছিলো সেগুলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এসব পাথর নিক্ষেপ করেন।

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বধ্যভূমিতে গমন করে তাঁর পবিত্র হাতে ৬৩টি উট যবাই করেন। এরপর বাকি ৩৭টি উট হযরত আলী (রা.)-কে যবাই করতে দেয়া হয়। এভাবে একশত উট কোরবানী করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলীকেও তাঁর কোরবানীর মধ্যে শামিল করে নেন। এরর তাঁর আদেশে প্রত্যেক উট থেকে এক টুকরো করে গোশত নিয়ে একটি হাড়িতে রান্রা করা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আলী সেই গোশত কিছু আহার করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু সুরুয়াও পান করেন।

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কা মোয়াযযমায় গমন করলেন। বায়তুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করলেন। এই তওয়াফকে বলা হয় তওয়াফে এফাযা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় যোহরের নামায আদায় করলেন। যমযক কূপের কাছে বনু আবদুল মোত্তালেবের কাছে গমন করলেন। তারা হাজীদের যমযমের পানি পান করাচ্ছিলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে বনু আবদুল মোত্তালেব তোমরা পানি উত্তোলন করো। যদি এ আশঙ্কা পোষণ না করতাম যে পানি উত্তোলনের কাজে অন্য লোকেরা তোমাদরে পরাজিত করে দেবে তবে আমিও তোমাদরে সাথে পানি উত্তোলন করতাম। অর্থাৎ সাহাবারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পানি তুলতে দেখলে সবাই পানি তোলার জন্যে চেষ্টা করবেন। এর ফলে হাজীদের পানি পান করানোর যে গৌরব এককভাবে বনু আবদুল মোত্তালেবের রয়েছে তা আর থাকবে না। অতপর বনু আবদুল মোত্তালেবের লোকেরা নবী (রা.)-কে এক বালতি পানি দিল এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই পানি প্রয়োজন মতো পান করলেন। ১০[মুসলিম শরীফে ও হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে। হুজ্জাতুন নবী অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-৩৯৭-৪০০]

আজ কোরবানী দিন। যিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আজও চাশ্ত এর সময়ে একটি খোতবা প্রদান করেন। সেই সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খচ্চরের পিঠে আরোহণ করেছিলেন। হযরত আলী (রা.)নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্তব্য সমবেত সাহাবাদের শোনাচ্ছিলেন। সাহাবাদের মধ্যে কেউ বসেছিলেন কেউ দাঁড়িয়েছিলেন। ১১[আবু দাউদ, ইয়াওমে নহর অধ্যায়, ১ম খন্ড, পৃ-২৭০] আজকের ভাষণেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগের দিনের বক্তব্যের কিছু কিছু পুনরুল্লেখ করেন। সহীহ বোখারী এবং সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু বকরের (রা.) এই বর্ণনা সঙ্কলিত রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সইয়াওমে নহর অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্জ তারিখে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেন, ‘যুগের আবর্তনের সময় এসে পৌঁছে গেছে । এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা আসমান যমিন সৃষ্টি করেছেন। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চার মাস হচ্ছে মাহে হারাম। তিনটি মাস পর্যায়ক্রমে আসে। যথা যিলকদ, যিলহজ্জ এবং মহররম। অন্য একটি মাস হচ্ছে জমাদিউস সানি এবং শাবান মাসের মাঝামাঝি। সেই মাসের নাম রযব।’

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বললেন যে, এটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জনেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নীরব রইলেন। আমরা তখন বুঝলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মাসের অন্য কোন নাম রাখবেন।কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি কি যিলহজ্জ মাস নয়? আমরা বললাম, কেন নয়? তিনি বললেন এটা কোন শহর? আমরা বললাম, আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। আমরা ভাবলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শহরের অন্য কোন নাম রাখবেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি কি মক্কা শহর নয়? আমরা তখন বললাম, কেন নয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এই দিনের পরিচয় কি? আমরা বললাম,আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রসূলই ভালো জানেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। আমরা ভাবলাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দিনের অন্য নাম রাখবেন। কিন্তু তিনি বললেন, এই দিন কি ইয়ওমুন নহর অর্থাৎ কোরবানীর দিন নয়? অর্থাৎ ১০ যিলহজ্জ নয়? আমরা বললাম, কেন নয়? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আচ্ছা তবে শোনো, তোমাদরে রক্ত, তোমাদরে অর্থ-সম্পদ এবং তোমাদরে ইযযত আবরু পরস্পরের জন্যে এরূপ নিষিদ্ধ ও সম্মানীয়, যেমন তোমাদের এ শহর তোমাদের এ মাস এবং তোমাদের আজকের দিন তোমাদের জন্যে সম্মানীয়। তোমরা তোমাদের পরওয়ারদেগাদেরর সাথে শীঘ্রই মিলিত হবে এবং তোমাদেরকে তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। কাজেই লক্ষ্যে রেখো, আমার পরে তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ো না।’

‘এমন পথভ্রষ্ট হয়ো না যে, একে অন্যের ঘাড় মটকাতে শুরু করবে। বলো, আমি কি তাবলীগ করেছি? সাহাবারা বললেন, হাঁ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থেকো। যে ব্যক্তি এখানে উপস্থিত রয়েছে তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে। কেননা উপস্থি অনেকের চেয়ে অনুপস্থিত ব্যক্তি আমার এ বক্তব্যের অধিক গুরুত্ব দেবে এবং সত্য বলে মনে করবে। ১২[সহীহ বোখারী, খোত্তবাতে আইয়ামে মিন অধ্যায়। ১ম খন্ড, পৃ-২৩৪]

এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই ভাষণে একথাও বলেছেন যে, স্মরণ রয়েছে রেখো অপরাধ করে তারা নিজের ওপরই অপরাধ করে। অর্থাৎ সে নিজেই সে জন্যে দায়ী হবে। স্মরণ রেখো, কোন অপরাধী পুত্র নিজের পিতার ওপর বা কোন অপরাধী পিতা নিজের পুত্রের ওপর অপরাধ করতে পারে না। অর্থাৎ পিতার অপরাধের জন্যে পুত্রকে একং পুত্রের অপরাধের জন্যে পিতাকে পাকড়াও করা হবে না। স্মরণ রেখো, শয়তান এ মর্মে হতাশ হয়ে গেছে যে, এই শহরে আর কখনো তার উপাসনা করা হবে না। তবে নিজেদের যেসব কাজকে তোমরা তুচ্ছ মনে করবে সেই সব ধারণার মাধ্যমে শয়তানের আনুগত্য সম্পন্ন হবে তার দ্বারাই শয়তান সন্তুষ্টি লাভ করবে। ১৩[ তিরমিযি ,২য় খন্ড, পৃ-৩৮,১৩৫। ইবনে মাজা কিতাল রজ্জম, মেশকাত ১ম খন্ড, পৃ-২৩৪]

এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে তাশরীক অর্থাৎ ১১,১২, ও ১৩ই যিলহজ্জ তারিখে মিনায় অবস্থান করেন। এই সময়ে তিনি হজ্জের রীতিসমূহও পালন করছিলেন। সেই সাথে জনসাধারণকে শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও শিক্ষা দিচ্ছিলেন। আল্লাহর যেকেরও করছিলেন। মিল্লাতে ইবরাহীমের সুন্নতসমূহেও কায়েম করছিলেন। শেরেকের নিদর্শনসমূহ নির্মূল করছিলেন। আইয়ামে তাশরীকে অর্থাৎ উল্লিখিত তিনদিনের একদিনে একটি ভাষণ দেন। আবু দাউদে ‘হাছান’ সনদসহ এই বর্ণানা রয়েছে যে, হযরত ছারা বিনতে বিনহাম (রা.)বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রউসের দিনে ১৪[অর্থাৎ ১২ যিরহাজ্জ। আউনুল মা’বুদ ২য় খন্ড, পৃ-১৪৩] আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং বলেন, এই দিন আইয়ামে তাশরীকের মাঝখানের নয়। ১৫[আবু দাউদ ইয়াওমু ইয়াখতাবু বে মিনা, ১ম খন্ড, পৃ-২৬৯]। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আজকের ভাষণও ছিলো গতকালের অর্থাৎ কোরবানীর দিনের ভাষণের অনুরূপ। এই ভাষণ সূরা নসর নাযিল হওয়ার পর দেয়া হয়েছিলো।

সর্বশেষ সামরিক অভিযান

সুবিস্তৃত রোমক সাম্রাজ্যের শাসকবর্গ ইসলাম এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের বেঁচে থাকার অধিকার মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না। এ কারণে রোমক সাম্রাজ্যের নিয়নিন্ত্রত এলাকার কারো ইসলাম গ্রহণ করা ছিলো বিপজ্জনক। রোমক গভর্নর হযরত ফারওয়াহ ইবনে আমর জোযামীর ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা ছিলো অন্যদের জন্যেও প্রবল।

রোমক সাম্রাজের শসকদের এ ধরণের ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কারপূর্ণ আচরণের প্রেক্ষিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাদশ হিজরীর সফর মাসে এক বিরাট বাহিনী তৈরীর কাজ শুর করলেন। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা.)-কে সেই বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্ত করে তিনি আদেশ দিনলেন যে, বালকা এলাকা এবং দারুমের ফিলিস্তিনি ভূখন্ড সওয়ারদের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করে এসো। রোমকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে করে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসকারী আরব গোত্রসমূহের মনে সাহস সঞ্চার করাই ছিলো এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য। এর ফলে কেউ একথা ভাবতে পারবে না যে, গীর্জার বাড়াবাড়ি ও স্বেচ্ছাচারিতার সামনে কথা বলার কেউ নেই। তাছাড়া একথাও কেউ মনে করতে পারবে না যে, ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে নিজের মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো।

হযরত উসামা (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করার কেউ কেউ সমালোচনা করে এ অভিযানের প্রস্তুতিও অংশগ্রহণে ইতস্তত করলেন। এ অবস্থা করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা যদি উসামার সেনাপতিত্বের প্রশ্নে সমালোচনা মুখর হও তবে তো বলতেই হয় যে, ইতিপূর্বে তার পিতাকে সেনাপতি নিযুক্ত করায় তোমরা সমালোচনা মুখর হয়েছিলো। অথচ আল্লাহর শপথ, যায়েদ ছিলো সেনাপতি হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন। এছাড়া সে ছিলো আমার প্রিয় ভাজনদের অন্যতম। উসামাও যায়েদের পর আমার প্রিয় ভাজনদের অন্যতম।১[সহীহ বোখারী, উসামাকে প্রেরণ অধ্যায়, উসামা ২য় খন্ড, পৃ-৬১২]

তখন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) হযরত উসামা (রা.)-এর আশপাশে সমবেত হয়ে তার সেনাবাহিনীতে শামিল হলেন। এই সেনাবাহিনী রওয়ানা হয়ে মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে মাকামে যরফ নামক স্থানে গ্রহণ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসুখ সম্পর্কে উদ্বেগজনক খবর পেতে থাকায় তারা সামনে অগ্রসর হননি। আল্লাহর ফয়সালার অপেক্ষায় তারা সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন। আল্লাহর ফয়সালা ছিলো এই যে, হযরত আবু বরক ছিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতের প্রথম সামরিক অভিযান হিসাবে এটি আখ্যায়িত হবে। ২[সহীহ বোখারী, এবং ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃ-৬০৬-৬৫০]।

মোহাম্মদ তো রসূল ছাড়া কিছুই নয়, তার আগেও বহু রসূল

গত হয়ে গেছে। সে যদি মরে যায় অথবা তাকে যদি কেউ

মেরে ফেলে, তাহলে কি (তার আদ র্শ থেকে)

মুখ ফিরিয়ে নেবে? (জেনে রেখো) যে

ব্যক্তিই (এভাবে) মুখ ফিরিয়ে নেয়

সে আল্লাহর কোন ক্ষতি

সাধন করতে পারবে না।

(সূরাঃ আল ইমরান-১৪৪)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি