গ্রন্থকারের কথা
প্রায় দেড় যুগ পূর্বে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়। কথা ছিল বাংলায় মুসলমানদের প্রথম আগমন থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পর্যন্ত এ সুদীর্ঘ কালের ইতিহাস লেখার। তবে বিশেষভাবে বলা হয় যে, ইংরেজদের শাসন ক্ষমতা হস্তাগত করার পর মুসলমানদের প্রতি বৃটিশ সরকার ও হিন্দুদের আচরণ কেমন ছিল তা যেন নির্ভরযোগ্য তথ্যাদিসহ ইতিহাসে উল্লেখ করি। Government of India Act-1935 পর্যন্ত ইতিহাস লেখার পর আর কলম ধরার ফুরসৎ মোটেই পাইন। সম্প্রতি কয়েক বছরের শ্রম ও চেষ্টা সাধনার ইতিহাস লেখার কাজ সমাপ্ত করতে পেরেছি বলে আল্লাহ তা’য়ালার অসংখ্য শুকরিয়া জানাই।
এ ইতিহাসের কোথাও কণামাত্র অসত্য, স্বকপোলকল্পিত অথবা অতিরঞ্জিত উক্তি করিনি। অনেকের কাছে তিক্ত হতে পারে, কিন্তু আগাগোড়া সত্য ঘটনাই লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি।
আমি ইতিহাসের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলাম বলে তখন থেকেই সত্য ইতিহাস জানা ও লেখার প্রবণতা মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের বিএ চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে আকবর ও আওরংজেবের উপরে ইংরেজীতে এক গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করি। কিছু বিরোধিতা ও বাধা সত্ত্বেও প্রবন্ধটি কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
শিক্ষা জীবন শেষ করার পর সরকারী ও বেসরকারী চাকুরীতে জীবন পঁচিশটি বছর কেটে যায়। ইতিহাসের উপর কোন গবেষণামূলক কাজ করার সুযোগ থেকে একেবারে বঞ্চিত হই। বরঞ্চ ইতিহাসই ভুলে যেতে থাকি। দেড় যুগ পূর্বে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নতুন করে ইতিহাস চর্চার সুযোগ হয়েছে।
ইতিহাস একটা জাতির মধ্যে জীবনীশক্তি সঞ্চার করে। কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার অতীত ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে হবে অথবা বিকৃত করে পেশ করতে হবে। একজন তথাকথিত মুসমলমান যদি ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের সুযোগ না পায় এবং তার জাতির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, তাহলে তার মুখ থেকে এমন সব মুসলিম ও ইসলাম বিরোধী কথা বেরুবে যেসব কথা একজন অমুসলমান মুখ থেকে বের করতে অনেক সাতপাঁচ ভাববে। এ ধরনের হস্তীমূর্খ মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে এবং মুসলমানদের জাতশত্রুগণ তাদেরকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করছে।
মুসলিশ জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে তাদের সঠিক অতীত ইতিহাসের সাথে ইসলামেরও সঠিক জ্ঞান ও ধারণা নতুন প্রজন্মের মধ্যে পরিবেশনের ব্যাপন উদ্যোগ গ্রহণ একেবারে অপরিহার্য। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে প্রসংগক্রমে ইসলামের মূলনীতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে। আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে হলে ইতিহাসের পর্যালোচনা ও ইসলামী সংস্কৃতিক মর্মকথঅ সর্বস্তরে তুলে ধরতে হবে।
মুসলমানী জীবনটাই এক চিরন্তন সংগ্রামী জীবন। সংগ্রাম বিমুখতার ইসলামে কোন স্থান নেই। তাই ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অগ্রগামীর ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা জাতিকে শক্রর নির্যাতনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে।
‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসে’ প্রায় দু’শ’ বছর যাবত মুসলমানদেরপ্রতি হিন্দুদের উৎপীড়ন অবিচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অতীতের কথা কেউ কেউ মনগড়া মতে করতে পারেব। বর্তমান সময়ে ভারতে কি হচ্ছে তা কি তাঁরা দেখছেন না? সেখানে প্রতিনিয়ত সংঘটিত লোমহর্ষক গাংগায় যে মুসলমানদেরকে নির্মূল করা হচ্ছে তা কি তাঁদের চোখে পড়েনা? সম্প্রতি বোম্বাইয়ে সংঘটিত দাংগার জন্য যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার রায় প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের রায়ে দাংগাকারিদের সহযোগীতা করার জন্য পুলিশকে দায়ী করা হয়েছে। রাজ্য সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর বৈষম্যমূলক আচরণেরও সমালোচনা করা হয়েছে। এরপর উগ্র মুসলিম বিদ্বেষীদের দেশ ভারতে মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়? ভবিষ্যতে হয়তো এসবের সঠিক ইতিহাস প্রণীত হবে।
পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে জাতির নতুন প্রজন্মকে তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ রাখা হয়েছে। এ ষড়যন্ত্রের ভূত বিভাগোত্তর কালের পাকিস্তানী শাসকদের ঘাড়েও শক্ত করে চেপে বসেছিল। পাকিস্তান কি কারণে হয়েছিল, এর আদর্শিক পটভূমি কি ছিল, কেন সুদীর্ঘ সাত বছর নিরলস ও আপোষহীনভাবে পাকিস্তান আন্দোলন করা হলো, কেন লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু খুনের দরিয়া সাঁতার দিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল, তার কোন কিছুই নতুন প্রজন্মকে জানানো হয়নি।
আমাকে ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তখনকার পাঠ্য ইতিহাসে পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসের কোন উল্লেখ ছিলনা। যার ফলে পাকিস্তানের ভিত আরও নানা কারণে দুর্বল হতে থাকে। পাকিস্তান ও তার শাসকদের প্রতি জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়তে থাকে যার পরিণামে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে।
অত্র ইতিহাসটিতে মুসলিম জাতির গৌরবময় অতীত ইতিহাসের দিকে নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মুসলিম জাতির ইতিহাস কালের কোন এক বিশেষ সময় থেকে শুরু হয়ে কোন এক বিশেষ সময়ে গিয়ে শেষ হয়নি। এ ইতিহাসের সূচনা দুনিয়ায় প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ) এর আগমন থেকে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এ ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে চলে এসেছে সময়, কাল ও পরিবেশ পরিস্থিতির চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে এবং চলতে থাকবে যতোদিন দুনিয়া বিদ্যমান থাকবে। মুসলমানদেরকে অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে।
এ ইতিহাস লেখার জন্য বহু খ্যাতনামা ঐতিহাসিকের গ্রন্থ থেকে মালমশলা সংগ্রহ করেছি। তার জন্য তাঁদের সকলের নিকটে চির কৃতজ্ঞ রইলাম। অতঃপর বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার গ্রন্থখানার প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছেন বলে এর ডাইরেক্টর আমার পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধু অধ্যাপক এ কে এম নাজির আহমদ সাহেবকে জানাই আমার অশেষ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ এ গ্রন্থ থেকে কিছু শিক্ষা ও ইসলামী প্রেরণা লাভ করতে পারলে আমার কয়েক বছরের অধ্যবসায় ও শ্রম সার্থক হয়েছে মনে করব। আল্লাহ তায়ালা এ গ্রন্থখানা কবুল করুন –আমীন।
ঢাকা, ১৫ই জমাদিউল আউয়াল
১৭ই কার্তিক
পয়লা নভেম্বর ১৯৯৩ সাল।
গ্রন্থকার

বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস
প্রথম অধ্যায়
বাংলায় মুসলমানদের আগমন
বাংলায় সর্বপ্রথম মুসলমানদের আগমন কখন হয়েছিল, তার সন তারিখ নির্ধারণ করা বড়োই দুঃসাধ্য কাজ। প্রাচীন ইতিহাসের ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত স্তুপ থেকে তা উদ্ধার করা বড়ো কষ্টসাধ্য কাজ সন্দেহ নেই। তবুও ইতিহাসবেত্তাদের এ কাজে মনোযোগ দেয়া বাঞ্ছনীয় মনে করি।
তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে বহির্জগত থেকে যেসব মুসলমান আগমন করেছিলেন, তাদেরকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক শ্রেণীর মুসমলনা ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যপদেশে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আগমন করে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেন। কতিপয় অলী দরবেশ ফকীহ শুধুমাত্র ইসলামের দাওয়াত ও তবলিগের জন্যে আগমন করেন এবং এ মহান কাজে সারা জীবন অতিবাহিত করে এখানেই দেহত্যাগ করেন।
আর এক শ্রেণীর মুসলমান এসেছিলেন –বিজয়ীর বেশে দেশজয়ের অভিযানে। তাঁদের বিজয়ের ফলে এ দেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। বলা বাহুল্য ৭১২ খৃষ্টাব্দে ভারতের সিন্ধু প্রদেশে সর্বপ্রথম মুহাম্মদ বিন কাসিম আগমন করেন বিজয়ীর বেশে এবং এটা ছিল ইসলামের বিরাট রাজনৈতিক বিজয়। তাঁর বিজয় সিন্ধুপ্রদেশ পর্যন্তই সীমিত থাকেনি। বরঞ্চ তা বিস্তার লাভ করে পাঞ্জাবের মূলাতন পর্যন্ত। আমরা যথাস্থানে তার বর্ণনা সন্নিবেশিত করব।
অপরদিকে বাংলায় মুসলমানদের আগমন দূর অতীতের কোন এক শুভক্ষণে হয়ে থাকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়েছিল –হিজরী ৬০০ সালে অর্থাৎ ১২০৩ খৃষ্টাব্দে। তৎকালীন ভারত সম্রাট কুতুবুদ্দীন আইবেকের সময়ে মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, বলতে গেলে অলৌকিকভাবে, বাংলায় তাঁর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাব করেন। মুসলমানদের এ উভয় রাজনৈতিক বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এসবের অনে পূর্বেই যে এ দেশে ইসলামের বীজ বপন করা হয়েছিল এবং সে উপ্ত বীজ অংকুরিত হয়ে পরবর্তীকালে তা যে একটি মীরুহের আকার ধারণ করেছিল, তাও এক ধ্রুব সত্য –কিন্তু তার সময়কাল নির্ধারণটাই হলো আসল কাব যা ইতিহাসের প্রতিটি অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের জন্যে একান্ত বাঞ্ছনীয়। আসুন ঐতিহাসিক দিকচক্রবাল থেকে কোন দিগদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা তা একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরববাসী শুধু বর্বর, কলহপ্রিয় ও রক্তপিপাসু জাতিই ছিল না। বরঞ্চ তাদের মধ্যে যারা ছিল অভিজাত ও বিত্তশালী, তারা জীবিকার্জনের জন্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। মরুময় দেশে জীবন ধারণের জন্যে খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আবহমান কাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হতো। যে বণিক দল হযরত ইউসূফকে (আ) কূপ থেকে উদ্ধার করে মিশরের জনৈক অভিজাত রাজকর্মচারীর কাছে বিক্রয় করে, তারা ছিল আরববাসী। অতএব আরববাসীদের ব্যবসায় পেশা ছিল অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিস্তৃত ছিল দেশ-দেশান্তর পর্যন্ত।
স্থলপথ জলপথ উভয় পথেই আরবগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। উটের সাহায্যে স্থলপথে এবং নৌযানের সাহায্যে তারা বাণিজ্য-ব্যপদেশে দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ করতো। প্রাক ইসলামী যুগেই তারা একদিকে সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সসুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসায় ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল। আরব থেকে সুদূর চীনের মাঝপথে তাদের কয়েকটি সমুদ্রতীরবর্তী একটি জেলা। ভৌগোলিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ উপদ্বীপটিকে মালাবার নামে অভিহিত করা হয়। আরব ভৌগোলিকগণের অনুলিখনে একে মালিবার (আরবী****) বলা হয়েছে।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেনঃ
“আধুনিক গ্রীকদের মলি (MALI) শব্দে বর্তমান মালাবার নামের উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ ‘মালাবার’ নাম আরববাসী কর্তৃক প্রদত্ত হয় –বিশ্বকোষ সম্পাদকের এই সিদ্ধান্তটা খুবই সংগত। আমাদের মতে মালাবার, আরবী ভাষার শব্দ –মলয়+আবার= মালাবার। আরবী অনুলিখনে (আরবী***) মলয়+আবার। মলয় মূলতঃ একটি পর্বতের নাম, আবার অর্থ কুগপুঞ্জ, জলাশয়। আরবরা এদেশকে মা’বারও (আরবী*****) বলিয়া থাকেন। উহার অর্থ, অতিক্রম করিয়া যাওয়ার স্থল, পারঘাট। আজাকালকার ভূগোলে পূর্বঘাট ও পশ্চিমঘাট। যেহেতু আরব বণিক ও নাবিকরা এই ঘাট দুইটি পার হইয়া মাদ্রাজে ও হেজাজ প্রদেশে যাতায়াত করিতেন, এবং মিশর হইতে চীনদেশে ও পথিপার্শ্বস্থ অন্যান্য নগরে বন্দরে যাতায়াত করিতেন। এই নাম দুইটি হইতে ইহাও জানা যাইতেছে, এই দেশের সহিত তাহাদের পরিচয় অতি পুরাতন এবং সম্বন্ধ ছিল অতি ঘনিষ্ঠ”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, পৃঃ ৪৭-৪৮)।
নবী মুহাম্মদ মুস্তাফার (সা) দুনিয়ায় আগমনের বহুকাল পূর্বে বহুসংখ্যক আরব বণিক এদেশে (মালাবারে) আগমন করেছিলেন। তারা হরহামেশা এ পথ দিয়ে অর্থাৎ মালাবাদের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীন দেশে যাতায়াত করতেন। এভাবে বাংলার চট্টগ্রাম এবং তৎকালীন আসামের সিলেটও তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। এর থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, প্রাক ইসলামী যুগেই মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট প্রভৃতি স্থানে আরবদের বসতি গড়ে উঠেছিল।
খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে নভী মুস্তাফা (সা) আরবের মক্কা নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং চল্লিশ বৎসর বয়সে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে দ্বীন ইসলামের প্রচার কার্য শুরু করেন। তাঁর প্রচার আন্দোলন ছিল অত্যন্ত বিপ্লবাত্মক। এ বিপ্লবের ঢেউ আরব বণিকদের মাধ্যমে মালাবার, চট্টগ্রাম, সিলেট ও চীনদেশেও –যে পৌঁছেছিল, তা না বল্লেও চলে। নবী মুহাম্মদের (সা) বিপ্লবী আন্দোলনের যেমন চরম বিরোধিতা করেছে একদল, তেমনি এ আন্দোলনকে মনেপ্রাণে গ্রহণও করেছে এক দল। মালাবারের আরববাসীগণ খুব সম্ভব হিজরী সনের প্রারম্ভেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, সপ্তম শতক পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল আরব বণিকদের দ্বারাই।
মালাবারে যেসব আরব মুহাজির ইসলাম গ্রহণ করার পর স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা মোপলা নামে পরিচিত। ছোটো বড়ো নৌকার সাহায্যে মাছ ধরা এবং মাল ও যাত্রী বহন করা ছিল তাদের জীবিকার্জনের প্রধান পেশা। অনেক সময়ে তাদেরকে জীবিকার্জন ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের জণ্য ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আরব দেশে যাতায়াত করতে হতো। এভাবেই তারা ইসলামের বিপ্লবী দাওয়াতের সংস্পর্শে এসেছিল।
মোপলাদের সম্পর্কে পরবর্তী কোন এক অধ্যায়ে আলোচনার বাসনা রইলো। এখানে, তাদের সম্পর্কে শুধু এতটুকু বলে রাখতে চাই যে, তারা ছিল অত্যন্ত কর্মঠ ও অধ্যাবসায়ী। সুন্দর ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিল তারা। সাহসিকতায় এরা চিরপ্রসিদ্ধ। এর দাড়ি রাখে এবং মাথায় টুপি পরিধান করে, এদের মধ্যে অনেকেই ধীবর জাতীয় এবং ধীবরদের মধ্যে ইসলামের বাণী প্রচার করা ছিল এদের প্রধান কাজ।
মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যেও ধীরে ধীরে ইসলামের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সেকালে ভারতে বৌদ্ধ এবং জৈন মতাবলম্বীদের উপরে হিন্দু ব্রাক্ষণ্যবাদের নিষ্ঠুর ও অমানুষিক নির্যাতন চলছিল। এসব নির্যাতন উৎপীড়নের মুখে মুসলমান সাধুপুরুষের সাহচর্য ও সান্নিধ্য তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে।
মালাবারের অনারব অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের দ্রুত বিস্তার লাভের প্রধান কারণ মালাবারের স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণ। মালাবার-রাজের ইসলাম গ্রহণের চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণিত আছে।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর পূর্ব বর্ণিত গ্রন্থে বলেনঃ
“হিন্দু সমাজের প্রাচীন শাস্ত্রে ও সাহিত্যে মালাবার সম্বন্ধে কিছু কিছু উল্লেখ দেখা যায়। বিশ্বকোষের সম্পাদক মহাশয় তাহার অনেকগুলি উদ্ধৃত করিয়াছেন। সেগুলির অধিকাংশই মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে মহাভারত ও পুরাণাদি পুস্তক হইতে উদ্ধৃত পরশুরামের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে কতকগুলি উদ্ভট উপকথা ছাড়া আর কিছুই নহে। তবে এই কোষকার নিজে মালাবারের হিন্দুরাজা সম্বন্ধে একটা বিশেষ ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিতেছেনঃ পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরর রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ অভিলাষে মক্কা গমন করেন –(বিশ্বকোষ-১৪:২৩৪)।
শেখ যয়নুদ্দিন কৃত তোহফাতুল মুজাহেদীন পুস্তকেও একজন রাজার মক্কা গমন, তাঁহার হযরত রসূলে করীমের খেদমতে উপস্থিত হওয়া এবং স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে। তাহার এই বর্ণতা হইতে জানা যাইতেছে যে, মালাবারের রাজা-যে মক্কায় সফর করিয়াছিলেন এবং হযরতের খেদমতে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট ইসলামের বয়আত গ্রহণ করিয়াছিলেন, স্থানীয় মুসলমানদিগের মধ্যে ইহাই মশহুর ছিল”।
মওলাতা তাঁর উক্ত গ্রন্থে আরও মন্তব্য করেনঃ
“স্থানকালাদির খুঁটিনাটি বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও এবং সেগুলিকে অবিশ্বাস্য বলিয়া গৃহীত হইলেও রাজার মক্কায় যাওয়ার, হযরতের খেদমতে উপস্থিত হওয়ার এবং কিছুকাল মক্কায় অবস্থান করার পর দেশে ফিরিয়া আসার জন্য সফর করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার কোন কারণ নাই। মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে একটা দেশের সমস্ত অধিবাসী আবমান কাল হইতে যে ঐতিহ্যকে সমবেতভাবে বহন করিয়া আসিতেছে তাহাকে অনৈতিহাসিক ও ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কোনও মতে বিবেচিত হইতে পারে না। এই প্রসংগে বিশেষভাবে বিবেচ্য হইতেছে বিশ্বকোষের বিবরণটি। কোষকার বলিতেছেনঃ ‘পুরাবৃত্ত পাছে জানা যায় যে, চেরার (মালাবার) রাজ্যের শেষ রাজা চেরুমল পেরুমল ইচ্ছাপূর্বক সিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণাবিলাষে মক্কা নগরীতে গমন করেন’। সুতরাং মালাবার রাজ্যের রাজার স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সিংহাসন ত্যাগ করা এবং হযরতের নিকট উপস্থিত হইয়া ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করার বিবরণকে ভিত্তিহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া আদৌ সংগত হইতে পারে না”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)
এখন শেখ যয়নুদ্দীন প্রণীত তোহফাতুল মুজাহেদীন গ্রন্থের বিবরণ, বিশ্বকোষের বিবরণ, মালাবারের মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকল অধিবাসীর আবহমান কালের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজার ইসলাম গ্রহণ ব্যাপারটি সত্য বলে গ্রহণ করতে দ্বিধাসংকোচ থাকার কথা নয়। কিন্তু তথাটি একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে রয়ে যায়। তা হচ্ছে এই যে, এত বড়ো একটি ঘটনা হাদীসের কোন গ্রন্থে বর্ণিত হয়নি কেন? অবশ্য শেখ যয়নুদ্দীন তাঁর বিবরণে কতিপয় রাবীর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীসবেত্তাদের মতে তা ‘সন্দেহমুক্ত নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসল ব্যাপারটি তাহলে কি ছিল? ঘটনাটিকে একেবারে ভিত্তিহীন বলে গ্রহণ করলে হাদীসগ্রন্থে তার উল্লেখের কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এমন হওয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয় যে, মালাবারের আরব মুহাজিরগণ যেমন হিজরী প্রথম সনে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেন, সম্ভবতঃ মালাবারের রাজা সিংহাসত ত্যাগ করতঃ এসব আরব মুহাজিরগণের সংগে ইসলাম গ্রহণ করেন। সিংহাসন ত্যাগের পর তাঁর পরিচয় গোপন করাটাও অসম্ভব কিছু নয় –আর এই কারণেই হয়তো তাঁর ইসলাম গ্রহণ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোন কৌতুহলের উদ্রেক করেনি। তথাটি তোহফাতুল মুজাহেদীনের গ্রন্থকার কতিপয় হাদীসের ও রাবীর উল্লেখ করেছেন।
মালাবারের আরব মুহাজিরগণের এবং স্থানীয় রাজার ইসলাম গ্রহণের পর স্থানীয় মালাবারবাসীগণও ইসলাম আকৃষ্ট হয় এবং তারা দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হয়। তারপর মালাবরে পরপর দশটি মসজিদ নির্মিত হয়। প্রথম মসজিদ পেরুমলের রাজধানী কর্ণক্রোর (কোড়ঙ্গনূর) বা ক্রাঙ্গানুরে নির্মাণ করেন মালেক ইবনে দীরান। এভাবে ত্রিবাংকোরের অন্তর্গত কুর্কবে, মঈলোর নগরে, ধর্মপত্তন নগরে, চালিয়াম নগরে, সুরুকুন্ডপুরমে, পন্থারিণীতে এবং কঞ্জরকোটে মসজিদ নির্মিত হয়।
“বিশ্বকোষ প্রণেতা বলেনঃ মসজিদ প্রতিষ্ঠার সংগে সংগেই যে এদেশে মুসলমান প্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নেই। এই সকল মসজিদের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক সম্পত্তিও প্রদত্ত হইয়াছিল। ঐ সময়ে উপকূলবাসী মুসলমানগণের এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত দেশীয় অধিবাসীদিগের সংখ্যায় পরিবৃদ্ধি হইয়াছিল। ক্রমে তাহারা রাজ্য-মধ্যে প্রভাব সম্পন্ন হইয়া উঠে”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)
উপরের আলোচনায় এ সত্য প্রকট হয়ে যায় , খৃষ্টীয় সপ্তম শতকেই ভারতের মালাবার মুসলমানদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল। তাদের ছিল না কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামের প্রচার ও প্রসার ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য।
মালাবারের পরেই মুসলিম আরব মুহাজিরদের বাণিজ্য পথের অন্যান্য মনযিল চট্টগ্রাম ও সিলেটের কথা আসে। মালাবারে আরব মুহাজিরদের স্থায়ী বসবাসের পর তাদের অল্পবিস্তর বসতি গড়ে উছে। এটাই ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, মালাবারে যেমন প্রথম হিজরী শতকেই ইসলাম দানা বেধেঁছিল, চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার কি সমসাময়িক কালেই হয়েছিল, না তার অনেক পরে। এ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য পরিবেশন করা সম্ভবপর নয়। তবে খৃষ্টীয় অষ্টম-নবম শতকে আরবের মুসলমান বণিকদের চট্টগ্রামের সাথে যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল তা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে।
ডক্টর আবদুল করিম তাঁর ‘চট্টগ্রামের সংগে আরবীয় মুসলমান বণিকদের যোগাযোগ ছিল। পরবর্তকালে চট্টগ্রামে আরব ব্যবসায়ীদের আনা-গোনার আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। আরব বণিককেরা চট্টগ্রামে স্বাধীন রাজ্যগঠন না করলেও আরবদের যোগাযোগের ফলে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে তাদের প্রভাব এখনও পরিলক্ষিত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় প্রচুর আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রামী ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহারও আরবী ভাষার প্রভাবের ফল। অনেক চট্টগ্রামী পরিবার আরব বংশদ্ভুত বলে দাবী করে। চট্ট্রগামী লোকের মুখাবয়ব আরবদের অনুরূপ বলেও অনেকে মনে করেন। তাছাড়া চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকা যেমন, আলকরণ, সুলুক বহর, (সুলুক-উল-বহর), বাকালিয়া ইত্যাদি এখনও আরবী নাম বহন করেন। আগেই বলা হয়েছে যে, কো কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, আরবী শব্দ শৎ ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, চট্টগ্রাম পৃঃ-১)।
চট্টগ্রামে কয়েক শতাব্দী যাবত মুসলমান বসবাস করলেও তারা কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেননি। তাদের কাজ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচার। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বাংলায় মুসলমান শাসন কায়েমের অনেক পরে সোনার গাঁয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯ খৃঃ) সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করে তা মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত করেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়
বিজয়ীর বেশে মুসলমান
সাধারণভাবে এ কথা সর্বজন বিদিত যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুরাজ দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে সিন্ধু প্রদেশে ইসলামের বিজয়-পতাকা উড্ডীন করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু প্রদেশ পর্যণ্ত সামরিক অভিযান পরিচালনার কাজ বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়। হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে সিন্ধু অভিযানের সূচনা হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পূর্বে কয়েকবার সিন্ধু প্রদেশের বিরুদ্ধে মুসলমানদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের পূর্বে মুসলমানগণ এখানে কোন স্থায়ী প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি। সিন্ধুরাজের সহায়তায় জলদস্যু কর্তৃক মুসলিম বণিকগণ বার বার লুণ্ঠিত হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধে তাদেরকে পরাজিত করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির পুনরুদ্ধার ও বন্দী বণিকদের মুক্ত করার পর মুসলমনাগণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
পঞ্চদশ হিজরীতে হযরত ওমরের (রা) খেলাফত আমলে উসমান ইবনে আবুল আবী সাকাফী বাহরাইন ও ওমানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। উসমান আপন ভাই হাকামকে বাহরাইনে রেখে নিজে ওমান চলে যান। সেখান থেকে তিনি একটি সেনাবাহিনী ভারত সীমান্তে প্রেরণ করেন। উক্ত অভিযানের পর পুনরায় তিনি তাঁর ভ্রাতা মুগীরাকে সেনাবাহিনীসহ দেবল (বর্তমান করাচী) অভিমুখে প্রেরণ করেন। মুগীরা সিন্ধুর জলদস্যু ও তাদের সহায়ক শক্তিকে পরাজিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তণ করেন।
হযরত আলীর (রা) খেলাফতের সময় ৩৯ হিজরীর প্রারম্ভে হারীস ইবনে মুররা আবদী সিন্ধু সীমান্তে অভিযান পরিচালনা করে জয়ী হন। বহু শত্রুসেনা বন্দী করেন এবং প্রচুর গণীমতের মাল হস্তগত করেন।
আমীর মুয়াবিয়ার (রা) শাসনামলে মুহাল্লাব ইবনে আবু সুফরা সিন্ধুর সীমান্ত আক্রমণ করেন এবং মুলতান ও কাবুলের মধ্যবর্তী স্থান বান্না ও আহওয়াজ পর্যন্ত অগ্রসর হন।
খলিফা ওয়ালিদের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইরাকের গভর্ণর নিযুক্ত হলে তিনি সিন্ধু অভিযানের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ইবনে হারুন নসিরী, উবাইদুল্লাহ ইবনে নবহান এবং বুদায়েল ইবনে তোহফা বজলীকে পর পর প্রেরণ করেন। অবশেষে ৯৩ হিজরীতে মুহাম্মদ বিন কাসিম জল ও স্থল উভয় পথে অভিযান পরিচালনা করে সিন্ধু জয় করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক চূড়ান্তভাবে সিন্ধু প্রদেশ বিজিত হবার বহু পূর্বে তদানীন্তন ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও জারী করা হয়েছিল। তার প্রমাণ এই যে, রাজা দাহির যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সমগ্র সিন্ধু প্রদেশ মুসলমানদের করতলগত হয়। সেখানে শাসন শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করার পর মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্মুখে অগ্রসর হওয়া কালে তাঁকে সাওয়ান্দারবাসীদের সম্মুখীন হতে হয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আক্রান্ত জনপদের অধিবাসী ছিল মুসলমান। স্বভাবতঃই তাদের সাথে একটা মিটমাট করার পর অন্যান্য বহু স্থান জয় করে মুহাম্মদ বিন কাসিম পাঞ্জাবের মূলতান নামক স্থানে উপনীত হন। মূলতানও তাঁর করতলগত হয়।
বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা
মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে এ দেশে মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। এ সময় থেকে ক্রমাগত অব্যাহত গতিতে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল, আফগানিস্তান, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে অসংখ্য মুসলমান বাংলায় আগমন করতে থাকেন। অধিকাংশ এসেছিলেন সৈনিক হিসাবে, অবশিষ্টাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য, ইসলাম প্রচার ও আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্যে। এভাবে বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা হয়ে পড়ছিল ক্রমবর্ধমান।
মুহাম্মদ বিন বখতিয়ারে বাংলা বিজয় ছিল এক অতি বিস্ময়কর ব্যাপার। বলতে গেলে এ মানুষটিই ঐতিহাসিক বিস্ময়। তিনি ছিলেন তুর্কিস্তানের খালজ বংশসম্ভূত। তাই তাঁর বংশ পরিচয়ের জন্যে তাঁর নামের শেষে খালজী বা খিলজী শব্দ যুক্ত করা হয়। তাঁর পূর্ব পুরুষদের আবাসভূমি ছিল সীমান্তের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত গারামসীর অথবা দাশতে মার্গো। ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খালজী জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করে গজনী এবং অতঃপর ভারতের বাদাউনে আগমন করেন। তাঁর দেহ ছিল খর্ব ও হস্তদ্বয় অস্বাভাবিক রকমের দীর্ঘ। সম্ভবতঃ এ কারণেই গজনী ও দিল্লীর সামরিক বাহিনীতে তাঁর চাকুরীর আবেদন গৃহীত হয়নি। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে অসীম সাহসিকতা ও দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনার যোগ্যতা ছিল তা বুঝতে পেরে বাদাউনের সিপাহসালার তাঁকে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেন। এখান থেকেই তাঁর ভাগ্যোন্নয়ন শুরু হয়। তিরৌরী বা তরাইনের যুদ্ধের পর বখতিয়ারের চাচা, মুহাম্মদ-ই-মাহমুদ নাগাওরীর শাসনকর্তা আলী নাগাওরীর নিকট থেকে কষমন্ডী বা কষ্টমন্ডীর অধিকার লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর বখতিয়ার তার অধিকার লাভ করেন। কিছুকাল পর তিনি অযোধ্যার মালিক মুয়াজ্জাম হিসাবউদ্দীনের নিকট গমন করেন। এ সময়ে তিনি অশ্ব ও অস্ত্রশস্ত্রাদি সংগ্রহ করেন। গ্রাম দুটি কারো মতে ভগবৎ ও ডোইলী, কারো মতে সহলন্ড ও সহিলী অথবা কম্পিলা ও পতিয়ালি ছিল। গোলাম হোসেন সলিমীর ‘রিয়াযুস সালাতীনে’ এ গ্রাম দুটির নাম বলা হয়েছে কম্বালা ও বেতালি।
এখান থেকে মুহাম্মদ বখতিয়ার বিহারের দিকে অগ্রসর হয়ে কয়েকস্থানের ভূস্বামী বা প্রধানদেরকে পরাজিত করে প্রচুর মালে গণীমত হস্তগত করেন। তার দ্বারা তিনি বহু অশ্ব ও অস্ত্রশস্ত্রাদি সংগ্রহ করতে থাকেন। তাঁর বীরত্বের খ্যাতিও চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঘোর, গজনী, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চলে বার বার বিদ্রোহ, যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত সংঘটিত হতে থাকার তথাকার বহুসংখ্যক অধিবাসী দেশত্যাগ করে ভারতে আগমন করে ভাগ্যের অন্বেষণে ঘুরাফেরা করতে থাকে। বখতিয়ারের সুনাম সুখ্যাতি শ্রবণ করে তারা দলে দলে তাঁর সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। এভাবে বখতিয়ার হয়ে ওঠেন প্রবল শক্তিশালী।
তৎকালীন দিল্লীর সুলতান কুতবউদ্দীন আইবেক বখতিয়ারের অসীম বীরত্বের কথা জানতে পেরে তাঁর সম্মানের জন্যে ‘খিলাত’ প্রেরণ করেন এবং এতে করে বখতিয়ারের শক্তি ও সাহস বহুগুণে বেড়ে যায়। তারপর তিনি সমগ্র বিহার প্রদেশে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। অতঃপর তাঁর অভিযান বাংলার দিকে পরিচালিত হয় এবং ১২০৩ খৃষ্টাব্দে বাংলার রাঢ় ও বরিন্দ অঞ্চল অধিকার করেন।
বাংলা আক্রমণকালে এর শাসক ছিলেন রায় লক্ষ্মণ সেন। রাজধানী ছিল নদিয়া। রাজধানীসহ এ অঞ্চলটিকে লক্ষ্মণাবতী বলা হতো। ‘তাবাকাতে নাসিরী’তে এ সম্পর্কে এক মজার কাহিনী বিবৃত হয়েছে।
রাজ দরবারের গণক ব্রাক্ষ্মণের দল এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন যে, এ দেশ অচিরেই তুর্কী মুসলমানদের হস্তগত হবে। দেশ আক্রান্ত হলে রাজাকে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় দেশবাসীকে প্রচুর রক্তপাত ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হবে।
রাজা ব্রাক্ষ্মণ-পন্ডিতগণকে জিজ্ঞাসা করেন যে, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ এহেন মুসলিম অভিযানকারীর কোন চিহ্ন বর্ণনা করা হয়েছে কিনা, যা দেখে তাকে যথাসময়ে চিনতে পারা যায়। তাঁরা বলেন যে, সে তুর্কী সেনা সোজা দন্ডায়মান হলে তাঁর হস্তদ্বয় হাঁটু পর্যন্ত লম্বিত হবে। রাজা রায় লক্ষ্মণ সেন এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাবার জন্যে একদল বিশ্বস্ত লোক নিযুক্ত করেন। তাঁরা অনুসন্ধানের পর রাজাকে বলেন যে, মুহাম্মদ বখতিয়ারের মধ্যে উপরোক্ত চিহ্ন বিদ্যমান। এদিকে মুহাম্মদ বখতিয়ারের দুঃসাহসিক অভিযান ও তাঁর জয়জয়কার কারো অজ্ঞাত ছিল না। ব্রাক্ষণ পন্ডিতগণ, সম্মানী ও জ্ঞানী-গুণী, ভূস্বামী ও প্রধান প্রধান ব্যক্তি দেশ-পরিত্যাগ করে জগন্নাথ, কামরূপ এবং অন্যান্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজা তখনো তাঁর রাজধানী পরিত্যাগ করা সমীচীন মনে করেননি। হঠাৎ এক সময় মুহাম্মদ বখতিয়ার নদিয়া আক্রমণ করে রাজধানীতে প্রবেশ করলে, রাজা রাজ-প্রাসাদের পশ্চাদ্বার দিয়ে পলায়ন করে বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এভাবে সমগ্র লক্ষণাবতী বখতিয়ারের করতলগত হয়- বিস্ময়ের ব্যাপারে এই যে, মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহীসহ মুহাম্মদ বখতিয়ার নদিয়া আক্রমণ ও জয় করেন।
অতঃপর তাঁর অভিযান বিস্তার লাভ করে এবং নবদ্বীপ ও গৌড় তাঁর করতলগত হয়। ‘তারিখে ফেরেশতা’য় বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মদ বখতিয়ার বাংলাদেশে রংপুর নামে এক নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বাংলার শুধু পূর্বাঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিম ও উত্তর বংগ তাঁর শাসনাধীন হয়েছিল। রায় লক্ষ্মণ সেন বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করলেও তাঁর পশ্চাদানুসরণ বখতিয়ার করেননি। যার ফলে বাংলার পূর্বাঞ্চল ছিল তাঁর শাসনের বাইরে। এক শতাব্দীকাল পর ১৩৩০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মদ তোগলোক শাহ পূর্বাঞ্চল জয় করেন এবং সাতগাঁও ও সোনারগাঁও-এ যথাক্রমে রাজধানী স্থাপন করেন।
যাহোক, মোহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের ফলে বহিরাগত মুসলমান দলে দলে এ দেশে বসতিস্থাপন করেন। ব্যবসা বাণিজ্য, সেনাবাহিনীতে চাকুরী ও অন্যান্য নানাবিধ উপায়ে জীবিকার্জনের নিমিত্ত অসংখ্য মুসলমান এ দেশে আগমন করেন এবং এ আগমনের গতিধারা অব্যাহতভাবে চলতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত।
মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলা বিজয়ের পর থেকে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলামী প্রান্তরে মুসলিম রাজ্যের পতন পর্যন্ত পাঁচ শত চুয়ান্ন বৎসরে একশত একজন বা ততোদিক শাসন বাংলায় শাসন পরিচালনা করেন।
বাংলার মুসলিম শাসনকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
বাংলা- খিলজীদের অধীনে- ১২৩০-১২২৭ খৃঃ
বাংলা- দিল্লীর অধীনে- ১২২৭-১৩৪১ খৃঃ
বাংলা- ইলিয়াস শাহী বংশের অধীনে (প্রথম ধারা)- ১৩৪২-১৪১৩ খৃঃ
বাংলা- গনেশ জালাল উদ্দীনের অধীনে- ১৪১৪-১৪৪১ খৃঃ
বাংলা- ইলিয়াস শাহী বংশের অধীনে (দ্বিতীয় ধারা)- ১৪৪২-১৪৮৭ খৃঃ
হাবশী শাসনাধীন বাংলা- ১৪৮৭-১৪৯৩ খৃঃ
হুসেনশাহী বংশের অধীনে বাংলা- ১৪৯৩-১৫৮৩ খৃঃ
পাঠানদের অধীনে (শের শাহ ও সূর বংশ) বাংলা- ১৫৩৮-১৫৬৪ খৃঃ
কররাণী বংশের অধীনে বাংলা ১৫৬৫-১৫৭৬ খৃঃ
মোগল শাসনাধীন বাংলা- ১৫৭৬-১৭৫৭ খৃঃ
সাড়ে পাঁচশত বৎসরাধিক কাল যাঁরা বাংলার মসনদে সমাসীন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কিছুসংখ্যক এমন ছিলেন যাঁরা আপন বাহুবলে বাংলার সিংহাসনে আরোহন করে দিল্লীর সম্রাটের অনুমোদন লাভ করেন । কিছুসংখ্যক শাসক ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন। আর অবশিষ্টাংশ দিল্লীর দরবার থেকে নিয়োগপত্র লাভ করে গভর্ণর অথবা নাজিম হিসাবে বাংলা শাসন করেন।
মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে এ দেশে আগমন করার পর এ দেশকে তাঁরা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন, এ দেশকে স্থায়ী আবাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করেন এবং এ দেশের অমুসলিম অধিবাসীর সাথে মিলে মিশে বাস করতে চেয়েছেণ। শাসক হিসাবে শাসিতের উপরে কোন অন্যায়-অবিচার তাঁরা করেননি। জনসাধারণও তাঁদের শাসন মেনে নিয়েছিল। মুহাম্মদ বখতিয়ার বাংলা বিজয়ের পর অভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি মুসলমানাদের জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করলেও অমুসলিমদের প্রতি উদানীতি অবলম্বন করেন। তিনি ইচ্ছা করলে পলাতক লক্ষ্মণসেনের পশ্চাদানুসরণ করে তাকে পরাজিত করতে পারতেন। কিন্তু সে কথা তিনি মনে আদৌ স্থান দেননি। যদুনাথ সরকার তাঁর ‘বাংলার ইতিহাসে’ বলেনঃ
“……কিন্তু তিনি রক্তপিপাসু ছিলেন না। নরহত্যা ও প্রজাপীড়ন তিনি পছন্দ করতেন না। দেশে এক ধরনের জায়গীর প্রথা বা সামস্ততান্ত্রিক সরকার কায়েমের দ্বারা আভ্যন্তরীণ প্রশাসন ও সামরিক প্রধানদের সন্তুষ্টি সাধন করতেন”।…
-(History of Bengal Vol. 2,Mislim period p. 9)
বাংলার শাসনকর্তাগণ দিল্লীর সমসাময়িক সম্রাট
১২০৩-৬ খৃঃ মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী কুতুব উদ্দীন আইবেক
১২০৬-৮ খৃঃ মালিক ইজ্জদীন মুহাম্মদ শিরীন খিলজী ঐ
১২০৮-১০ খৃঃ হুসাম উদ্দীন ইওয়াজ ঐ
১২০১০-১৩ খৃঃ আলী মর্দান (সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী) ঐ
১২১৩-২৭ খৃঃ সুলতান গিয়াস উদ্দীন-ইওয়াজ খিলজী আরাম শাহ (কুতুব উদ্দীন আইবেকের পুত্র)
বাংলার স্বাধীন সুলতানগণ
সমগ্র বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ছিলেন শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ। অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লী সম্রাট ফিরোজশাহ তোগলোক যুদ্ধযাত্রা করে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে প্রত্যাবর্তণ করেন। ১৩৫৮ খৃষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করে দিল্লীর সম্রাটের প্রীতি অর্জনের উদ্দেশ্যে পঞ্চাশটি হাতী উপঢৌকন স্বরূপ দিল্লী প্রেরণ করেন। এ সময় থেকে ১৪০৯ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত যাঁরা বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা হলেন-
সিকান্দার শাহ (১ম) ১৩৫৮-৯১ খৃঃ
গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ ১৩৯১-৯৬ খৃঃ
সাইফুদ্দীন হামজা শাহ ১৩৯৬-১৪০৬ খৃঃ
শামসুদ্দীন ১৪০৬-১৪০৯ খৃঃ

রাজা গনেশ
পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে বাংলায় হিন্দুজাতির পুনরুত্থান আন্দোলন শুরু হয়। মুহাম্মদ বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর হতে চতুর্দশ শতকের শেষ অবধি মুসলমান শাসকগণ কখনো দিল্লী সুলতাদের নিযুক্ত গভর্ণর হিসাবে, কখনো স্বাধীন সুলতান হিসাবে এবং কখনো উপঢৌকনাদির মাধ্যমে দিল্লী দরবারকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রেখে বাংলার শাসনকার্য পরিচালনাকরেন। এ দুই শতকের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় –মুসলমানগণ নিশ্চিত মনে শান্তিতে রাজত্ব করতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে আত্মকলহ ও বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের প্রবল আকাংখাই ছিল সে শান্তি বিনষ্টের কারণ। কিন্তু তাই বলে মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক হিন্দুজাতি দলন ও প্রজাপীড়ন হয়টি কখনো। ফলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রজাগণ সুখ-শান্তি ও জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছিল। বখতিয়ার খিলজীর পূর্বে এদেশে বহু স্বাধীন হিন্দু রাজা বাস করতেন। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তা তাঁরা মনে প্রাণে মেনে না নিলেও মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে আসা সমীচীন মনে করেননি। তার দুটি মাত্র কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ এই যে, বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল মুসলমানদের হাতে এবং বখতিয়ারের পর থেকে ক্রমাগত বহির্দেশ থেকে অসংখ্য মুসলমান বাংলায় আসতে থাকে। মুসলিম ধর্ম প্রচারক অলী ও দরবেশগণ এদেশে আগমন করতঃ ইসলামের সুমহান বাণী, ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রচার করতে থাকেন। ফলে ব্রাক্ষণ্যবাদের দ্বারা নিষ্পেষিত হিন্দু জনসাধারণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। তথাপি এখানকার বর্ণহিন্দুরা মুসলমান শাসকদের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও আত্মকলহের সুযোগে বিদ্রোহ ঘোষণাকরতে পারতো। কিন্তু তা করেনি। তার কারণও আছে।
“দ্বিতীয় কারণ এই যে, তারা এক দীর্ঘ পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছিল। তা হলো মুসলিম শাসকদের বিরাগভাজন না হয়ে বরঞ্চ শাসন কার্যের বিভিন্ন স্তরে এরা নিজেদের স্থান করে নিয়ে কোন এক মুহূর্তে আত্মপ্রকাশ করবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাদে তারা তাদের এ পরিকল্পনায় পূর্ণ সাফল্য লাভ করেছিল। তবে সে সময়ে নিজেরা ক্ষমতালাভ না করে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করে ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করেছিল। পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভে তাদের সাফল্য স্থায়ী না হলেও এ ছিল তাদের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার প্রথম প্রকাশ।
এ সময়ে বাংলার একজন হিন্দু জমিদার প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেন। ফার্সি ভাষায় লিখিত ইতিহাসে তার নাম ‘কানস’ বলা হয়েছে। কানস প্রকৃতপক্ষে ‘কংস’ অথবা ‘গণেশ’ ছিল। তিনি গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে রাজস্ব ও শাসন বিভাগের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ‘রিয়াযুস সালাতীনে’র বর্ণনা অনুসারে গণেশ শামসুদ্দীনের পৌত্র গিয়াসউদ্দীন আজম শাহকে হত্যা করেন। অতঃপর গিয়াসউদ্দীনের পৌত্র শামসুদ্দীনকেও তিনি হত্যা করে গৌড় ও বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন।

ইলিয়াস শাহী বংশ
শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৩৯-৫৮ খৃঃ)

সিকান্দার শাহ (১৩৫৮-৮৯ খৃঃ)

গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-৯৬ খৃঃ)

সাইফউদ্দীন হামজা শাহ (১৩৯৬-১৪০৬ খৃঃ)

শামসুদ্দীন (১৪০৬-১৪০৯ খৃঃ) শাহাবুদ্দীন বায়েজিদ শাহ (১৪০৯-১৪ খৃঃ)
ব্লকম্যান (Blockman) বলেন যে, গণেশ নিজে সিংহাসনে আরোহন করেননি। তবে তিনি শামসুদ্দীনকে হত্যা করে তাঁর ভ্রাতা শাহাবুদ্দীন বায়েজিদ শাহকে ক্রীড়াপুত্তলিকা স্বরূপ রেখে স্বয়ং রাজদন্ড পরিচালনা করতেন। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় তাঁর বাংলার ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ডে ১৪০৯-১৪১৪ খৃঃ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসনে দু’জন শাসনকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন। যথা, শাহাবুদ্দীন বায়েজীদ শাহ ও গণেশ।
রাজ গণেশ বাঙ্গাল বরেন্দ্র বাক্ষ্মণ ছিলেন। উত্তর বংগের (দিনাজপুর) ভাটুরিয়া পরগণার শক্তিশালী রাজা গণেশ তাঁর নিজস্ব একটি সেনাবাহিনী রাখতেন। দুর্ধর্ষ সংগল গোত্র থেকে তিনি তাঁর সৈন্য সংগ্রহ করতেন। তাঁর প্রভাব পতিপত্তির কারণে তাঁকে বাংলার সুলতানের অধীনে চাকুরীতে নিযুক্ত করা হয় এবং ক্রমশঃ তিনি রাজ্যের খাজাঞ্চিখানার একচ্ছত্র মালিক মোখতার (সাহেব-ই-ইখতিয়ার-ই-মুলক ও মাল) হয়ে পড়েন। এ পদমর্যাদার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি প্রথমে গিয়াস উদ্দীন আজম শাহকে হত্যা করেন এবং কয়েক বৎসর পর শামসুদ্দীন শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ৱ
গণেশের বাংলার সিংহাসনে আরোহণ দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও গভীর ষড়যন্ত্রের ফল। গণেশ ও তাঁর সমমনা হিন্দু সামস্তবর্গ বাংলায় মুসলমানদের শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। যদিও বিগত দুই শতকের ইতিহাসে মুসলিম শাসকগণ কর্তৃক অমুসলমানদের প্রতি কোনপ্রকার উৎপীড়নের নজীর পাওয়া যায়না, তথাটি মুসলিম শাসনকে তারা হিন্দুজাতির জন্যে চরম অবমাননাকর মনে করতেন। তাই গণেশ সিংহাসনে আরোহণ করার পর মুসলিম দলনে আত্মনিয়োগ করেন। এভঅবে মুসলমানদের প্রতি তাঁর বহুদিনের পুঞ্জিভূত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
বুকানন হ্যামিল্টন কর্তৃক লিখিত দিনাজপুর বিবরণীতে আছে যে, জনৈক শায়খ বদরে ইসলাম এবং তদীয় পুত্র ফয়জে ইসলাম গণেশকে অবনত মস্তকে সালাম না করার কারণে তিনি উভয়কে হত্যা করেন। শুধু তাই নয়, বহু মুসলমান অলী দরবেশ, মনীষী, পন্ডিত ও শাস্ত্রবিদকে গণেশ নির্মমভাবে হত্য করেন। একদা শায়খ মুঈনুদ্দীন আব্বাসের পিতা শায়খ বদরুল ইসলাম বিধর্মী রাজা গণেশকে সালাম না করার কারণে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। অতঃপর একদিন তিনি উক্ত শায়খকে দরবারে তলব করেন। তাঁর কামরায় প্রবেশের দরজা এমন সংকীণৃ ও খর্ব করে তৈরী করা হয় যে, প্রবেশকারীকে উপুড় হয়ে প্রবেশ করতে হয়। শায়খ রাজার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে প্রথমে তাঁর দু’খানি পা কামরার ভিতরে রাখেন এবং মস্তক অবনত না করেই প্রবেশ করেন। কারণ, ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী কোন মুসলমানই আল্লাহ ব্যতীত আর কারো সামনে মস্তক অবনত করতে পারেন না। রাজা গণেশ তাঁকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করেন এবং অন্যান্য আলেমগণকে একটি নৌকায় করে নদী-গর্ভে নিমজ্জিত করে মারেন।
মুসলিম নিধনের এ লোমহর্ষক কাহিনী শ্রবণ করে শায়খ নূরে কুতুবে আলম মর্মাহত হন এবং জৌনপুরের গভর্ণর সুলতান ইব্রাহীম শার্কীকে বাংলায় আগমন করতঃ ইসলাম ধর্ম রক্ষার জন্যে আবেদন জানান। সুলতান ইব্রাহীম বিরাট বাহিনীসহ বাংলা অভিমুখে যাত্রা করে সরাই ফিরোজপুরে শিবির স্থাপন করেন। রাজা গণেশ জানতে পেরে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কুতুবে আলমের শরণাপন্ন হন। কুতুববে আলম বলেন, তিনি এ শর্তে সুলতাম ইব্রাহীমকে প্রত্যাবর্তনের পরামর্শ দিতে পারেন, যদি গণেশ ইসলাম গ্রহণ করেন। গণেশ স্বীকৃত হলেও তার স্ত্রী তাঁকে বাধা দান করেন। অবশেষে তাঁর পুত্র যদুকে ইসলামে দীক্ষিত করে গণেশের স্থলে তাকে সিংহাসন ছেড়ে দেয়ার জন্যে বলা হয়। গণেশ এ কথায় স্বীকৃত হন। যদুর মুসলমানী নাম জালাল উদ্দীন রেখে তাঁকে বাংলার সুলতান বলে ঘোষণা করা হয়। সুলতান ইব্রাহিম অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ মনে প্রত্যাবর্তণ করেন। তাঁর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পাওয়া মাত্র গণেশ জালালউদ্দীনের নিকট থেকে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। সরলচেতা কুতুবে আলম গণেশের ধূর্তুমি বুঝতে পারেনি। তাই পুত্রকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চাইলে পিতার নরহত্যার অপরাধ ক্ষমা করেন।
গণেশ সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার পর সুবর্ণধেনু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মচ্যুত যদুর শুদ্ধিকরণ ক্রিয়া সম্পাদন করেন। অর্থাৎ একটি নির্মিত সুবর্ণধেনুর মুখের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে তার মল ত্যাগের দ্বার দিয়ে হিন্দু শাস্ত্রের বিশেষ ধর্মীয় পদ্ধতিতে বহির্গত হওয়াই হলো শুদ্ধিকরণ পদ্ধতি।
এ শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠানের পর গণেশ দেশ থেকে মুসলমানদের মূলোৎপাটনের কাজ শুরু করেন। তিনি পূর্বের চেয়ে অধিকরত হিংস্রতার সাথে মুসলিম নিধনকার্য চালাতে থাকেন। তিনি কুতুবে আলমের পুত্র শায়খ আনওয়ার ও পৌত্র শায়খ জাহিদকে বন্দী অবস্থায় সোনারগাঁও পাঠিয়ে দেন। অতঃপর তাঁদের পিতা-পিতামহের ধনসম্পদের সন্ধান দেয়ার জন্যে তাঁদেরকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার করা হয়। পরে শায়খ আনওয়ারকে হত্যা করা হয়। এমনিভাবে গণেশ সাত বৎসর যাবৎ বাংলায় এক বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেন এবং মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন।
গণেশের মৃত্যুর পর পুনরায় জালালউদ্দীন (যদু) সিংহাসনে আরোহণ করেন।

হিন্দুজাতির পুনরুত্থান
রাখালদাস বন্দোপাধ্যয় তাঁর বাংলার ইতিহাস ২য় খন্ডে লিখেছেন, “গণেশ নব প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুবর্ণধেনু ব্রত দ্বারা যদুর প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা তাহার কিঞ্চিৎ প্রমাণাবাস মাত্র। রাজা গণেশের সময় হইতে গৌড়ে ও বংগে সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হইয়াছিল। সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ রচনাও আরম্ভ হইয়াছিল এবং বাংলা ভাষার উন্নতির সূচনা হইয়াছিল। এই সকল কারণের জন্য গণেশ বাংলার ইতিহাসে, ভারতের ইতিহাসে ও ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে উচ্চাসন লাভ করিয়াছিলেন”। (উক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৩৫-৩৬)
গণেশের জ্যেষ্ঠ পুত্র মুসলমান হয়েছিলেন তাঁর মুসলমান হওয়ার প্রকৃত কারণ কি ছিল তা অবশ্য বলা কঠিন। তবে একজন প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রাক্ষ্মণ হিন্দুজাতির পক্ষে চরম অবমাননাকর মনে করে অনেক কল্পিত কাহিনী রচনা করেছেন।
রাখালদাস তাঁর উক্ত ইতিহাসে বলেন, “বরেন্দ্রভূমিতে প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে যদু ইলিয়াস শাহের বংশজাতা কোন সম্ভ্রান্ত মুসলমান রমণীর রূপে মোহিত হইয়া স্বধর্ম বিসর্জন দিয়াছিলেন”।
রাখালদাস স্বজাতির গ্লানি অপর ধর্মাবলম্বীর উপর চাপিয়ে বলেন-
“ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট (Stewart) অনুমান করেন যে, যদু বা জালালউদ্দীন গণেমের মুসলমান উপপত্মীর গর্ভজাত পুত্র”।
কিভাবে মুসলিম জাতির ইতিহাস কলংকিত করা হয়েছে, উপরের বর্ণনা তাঁর এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে, তৎকালে মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন এতখানি হয়নি যে, মুসলমান রমণীগণ তখন বেশ্যাবৃত্তি শুরু করেছে অথবা কোন অমুসলমানের স্বামীত্ব গ্রহণ করেছে। অথবা বর্তমান কালের মতো মুসলমান রমণীগণ বেপর্দায় পর-পুরুষের সামনে চলাফেরা করতো যার ফলে গণেশপুত্র যদু কোন সুন্দরী মুসলমান যুবতীর প্রেমাসক্ত হয়ে তাঁর পাণি গ্রহণের জন্যে মুসলমান হয়েছে। ইতিহাস একথার সাক্ষ্যদান করে যে, সে সময়ে দলে দলে মুসলমান ফকীর দরবেশ এদেশে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করতেন এবং তাঁদের অনেকে শাসনকার্যেও অংশগ্রহণ করেছেন। শাসকগণের উপর ছিল তাঁদের বিরাট প্রভাব।
গণেশের আমলের কথাই ধরা যাক। বিখ্যাত অলী নূরে কুতুবে আলম, তাঁর পুত্র শায়খ আনওয়ার গণেশের সমসাময়িক লোক। তাঁদের প্রভাব শুধু বাংলার মুসলমান ও শাসকদের উপরেই ছিলনা, বরঞ্চ অযোধ্যার গভর্ণর সুলতান ইব্রাহীম শার্কীর উপরেও ছিল। যার উল্লেখ উপরে করা হয়েছে। তাঁদের আচার আচরণ, নির্মল চরিত্র ও তাঁদের মুখনিঃসৃত ইসলামের অমিয় বাণী শ্রবণ করে বহু হিন্দু স্বেচ্ছায় ও সন্তুষ্টচিত্তে ইসলাম গ্রহণ করে –যাদের মধ্যে গণেশপুত্র যদু একজন। সমাজে তাঁদের এতখানি প্রভাব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মুসলমান নারী বেশ্যাবৃত্তি করবে অর্থাৎ কোন পুরুসের অপপত্মী হবে, অথবা বল্গাহীনভাবে চলাফেরার করণে কোন হিন্দু প্রেমাসক্ত হবে; এ একেবারে কল্পনার অতীত। অতএব গণেশের মুসলিম উপপত্নী রাখা এবং যদুর মুসলিম রমণীর প্রেমাসক্ত হওয়া একেবারে স্বকপোলকল্পিত এবং দুরভিসন্ধিমূলক। নিজের গ্লানি অপরের ঘাড়ে চাপাবার হাস্যকর প্রয়াস মাত্র।
আর একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তা হলো এই যে, মুসলমান এদেশে এসেছিল বিজয়ীর বেশে। স্বভাবতঃই বহিরাগত বিজয়ী মুসলমানদের মধ্যে ছিল শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি (Superiority Complex)। সম্ভ্রান্ত মুসলমান বলতে বহিরাগত মুসলমানকেই বুঝাত। তাঁদের কোন রমণী হিন্দুর স্বামীত্ব গ্রহণ করবে –এ চিন্তার অতীত।
তারপর কথা থাকে এই যে, নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুজাতির ইসলাম গ্রহণের পর তাদের কোন রমণী গণেশকে স্বামীত্ব বরণ করেছে, এটাও ছিল অবাস্তব। কারণ গণেশ ছিলেন ব্রাক্ষ্মণ এবং উগ্র ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের ধারক-বাহক। যে হিন্দু ইসলাম গ্রহণের পর যবন ও স্লেচ্ছ হয়েছে তাঁদের ঘরে বিবাহ করা গণেশের পক্ষে ছিল এক অচিন্তনীয় ব্যাপার। অতএব এসব কাহিনী- যে অলীক কল্পনাপ্রসূত মাত্র, তাতে সন্দেহ নেই।
কেউ কেউ বলেন, যদু রাজ্যলোভে মুসলমান হয়েছিলেন। আমাদের একথাও সত্য নয়। অবশ্য সুলতান ইব্রাহীম শার্কীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে গণেশ তদীয় পুত্রকে নূরে কুতুবে আলমের হস্তে ইসলাম গ্রহণের জন্যে সমর্পণ করেন। যদুর ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করার পর সুলতান ইব্রাহীম শার্কী বাংলা আক্রমণ না করে প্রত্যাবর্তণ করেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই গণেশ পুনরায় যদুকে অসারিত করে নিজে সিংহাসনে পুনঃ আরোহণ করেন। তারপর হিন্দুমতে যদুর প্রায়শ্চিত্ত করা হয়। গণেশ প্রবল পরাক্রমসহ সাত বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁকে কোনক্রমেই সিংহাসনচ্যুত করা যায়নি। যদু যদি শুধুমাত্র রাজ্যলাভেই ইসলাম গ্রহণ করে থাকতেন, তাহলে তাঁর প্রায়শ্চিত্ত ও সুবর্ণধেনুর শুদ্ধিকরণের পরনির্বিঘ্নে হিন্দু হিসাবে পিতার সিংহাসনে আরোচন করতে পারতেন। কিন্তু যদু ইসলাম ত্যাগ করেননি।
অতঃপর মানুষের মধ্যে থাকে একটি বিবেক যার দ্বারা সত্য ও মিথ্যাকে উপলব্ধি করতে পারা যায়। তার সাথে মানুষের মধ্যে থাকে একটা নৈতিক অনুভূতি। গণেশের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতা দেখে বাংলার সুলতান তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত করেন।
কিন্তু ষড়যন্ত্র ও হত্যাকান্ডের মাধ্যমে তিনি বাংলার সিংহাসন দখল করেন। প্রথমতঃ তিনি প্রভুম প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা প্রদর্শন করেন এবং অতঃপর নিরীহ মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন। কিন্তু তথাপি তাঁর পুত্র ইসলাম গ্রহণের কারণে তাঁর সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করেন নূরে কুতুবে আলম। শায়খ নূরে কুতুবে আলমের আচরণ, ইসলামের সহনশীলতা ও উদারতার প্রতি অবশ্য যদু মুগ্ধ হয়ে থাকবেন। পিতার বিশ্বাঘাতকতা, কৃতঘ্নতা ও নিষ্ঠুরতা অবশ্য অবশ্যই যদুসেনের মনের গভীরে দাগ কেটে থাকবে। উপরন্তু, কামেল অলীর সংস্পর্শে যদুর অত্যন্ত সত্য সত্যই ইসলামের নূরে উদ্ভাসিত হয়েছিল। এটাই আমাদের ধারণা। তা মোটেই অযৌক্তিকও নয় এবং অসম্ভবও নয়।
এখন মুসলিম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকগণের মতে, যদু যখন ইসলামে অবিচললিত ছিলেন, তখন তাঁকে নানাভাবে কলংকিত করতেই হবে। প্রথমতঃ তাঁকে একন মুসলমান উপপত্মীর সন্তান বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের বক্তব্য এই যে, আসলে তিনি হিন্দুই ছিলেন না জারজ (?) সন্তান।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ইতিহাসে এ সময়ের একটি চমকপ্রদ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর ইতিহাসের (বাংলার ইতিহাস ২য় খণ্ড) ১৩৭ পৃষ্ঠায় বলেন- “গণেশ অথবা যদু যাহা করিতে পারেন নাই, অথবা করিতে ভরসা করেন নাই আর একজন বাঙ্গালী হিন্দুরাজা কর্তৃক তাহা স্বচ্ছন্দে সম্পাদিত হইয়াছিল।
তাহার নাম দনুজমর্দন দেব”।
অতঃপর তিনি উক্ত গ্রন্থের ১৩৯ পৃষ্ঠায় কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন- “গণেশ অথবা যদু যাহা করিতে পারেন নাই, আর্যাবর্তে কোনও হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই, তাহাই সাধন করিয়াছিলেন বলিয়াদনুজমর্দন দেব ও মহেন্দ্র দেবের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে”।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, গণেশ-যদুকি করতে পারেননি, আর দনুজমর্দন দেব কি করেছেন তার কোন উল্লেখই তাঁর গ্রন্থে নেই।
এ সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার বলেন-
“In this very year we find coins with Bengali lettering issued from Pandua and Chatgaon by a king named Mahendra Dev- exactly resembling those of Danujmardan Dev. He was most probabely the younger son of Ganesh, who has remained a Hindu and to whome his elder brother Jadusen Jalaluddin had offered to leave the patemal throne on case he was not permitted of embrace Islam. Mahendra was evidently set up on the throne by Hindu ministers just after the death of Ganesh. I believe that Mahendra (then not more than 12 years old) was a mere puppet in the hands of a selfish ministerial foaction… The attempt of the Kingmakaers was shortlived and ended on their speedy defeat, as no coin was struck in Mahendra’s name after that one year 1418 A.D
“ঠিক এ বৎসরেই পান্ডুয়া ও চাটগাঁও থেকে বাংলা অক্ষরে মহেন্দ্র দেবের নামাংকিত মুদ্রা আমরা দেখতে পাই। এগুলো দেখতে অবিকল দনুজমর্দন দেবের মুদ্রার ন্যায়। খুব সম্ভব তিনি ছিলেন গণেশের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি হিন্দুই রয়ে গিয়েছিলেন এবং যদুসেন জালাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, যদি তাঁকে মুসলমান হতে দেয়া না হয় তাহলে যেন পিতার সিংহাসন ছেড়ে দেন। গণেশের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু মন্ত্রীবর্গ মহেন্দ্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। আমার বিশ্বাস মহেন্দ্র (যার বয়স বার বছরের বেশী ছিলনা) একটা স্বার্থান্ধ মন্ত্রীচক্রের কাষ্ঠপুত্তলিকা ছিলেন মাত্র। এ সকল মন্ত্রীবর্গের রাজা বানাবার প্রচেষ্টা বেশীদিন চলতে পারেনি এবং অচিরেই তাঁদের পরাজয় ঘটেছে। কারণ এই একটি বছর ১৪১৮ খৃষ্টাব্দের পর মহেন্দ্রের নামে আর কোন মুদ্রা অংকিত হয়নি”।
যদুনাথ সরকার আরও বলেন-
“Hanesh placed his son, a led of twelve only, under protective watch in his harem and ruled in his iwn account under the proud title of Danujmaradan Dev.”
“গণেশ তাঁর বার বৎসর বয়স্ক পুত্রকে হারেমের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক পাহারায় রেখে স্বয়ং গৌরবজনক ‘দনুজমর্দন দেব’ উপাধি ধারণ করে ইচ্ছামতো শাসক চালান”।
এর থেকে বুঝা গেল গণেশই আষেল ছিলেন দনুজমর্দন দেব। অথবা দনুজমর্দন ছিল তাঁর উপাধি যা তিনি তাঁর জন্যে এবং গোটা হিন্দুজাতির জন্যে গৌরবজনক মনে করতেন।
রাখালদাস এখানেই ভুল করেছেন। তিনি দনুজমর্দনকে ভিন্ন ব্যক্তি মনে করে তাঁর অসীম গুণগান গেয়েছেন।
এখন আসুন, আমরা দেখি দনুজমর্দন শব্দের অর্থ কি। দনুজমর্দন শব্দের অর্থ ‘দৈত্যদলন’। উগ্র হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠাকামী গণেশ মুসলশান ও মুসলিম শাসন কিছুতেই বরদাশত করতে পারেননি। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল মুসলমানদেরকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে উগ্র হিন্দুরাজ কায়েম করা। বহিরাগত মুসলমানদেরকে গণেশের ন্যায় হিন্দুগণ ‘যবন-স্লেচ্ছা’ মনে করতেন। কিন্তু মুসলমানগণ হিন্দুদের তুলনায় শারীরিক গঠন ও শৌর্যবীর্যে বলিষ্ঠতর ছিলেন। তাই তাঁদেরকে যবন ও স্লেচ্ছ দৈত্যের মতো মনে করা হতো। এই দৈত্য স্বরূপ যবন ও স্লেচ্ছদের দলন ও নিধনই ছিল গণেশের ব্রত। ইব্রাহিম শার্কীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর গণেশ পূর্ব থেকে শতগুণে এ দলন ও নিধন কার্য চালিয়েছেন। দনুজমর্দনের মুসলিম নিধন কার্যকলাপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে রাখালদাস বলেছেন, “আর্যাবর্তে কোনও হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই তাহাই সাধন করিয়াছিলেন বলিয়া দনুজমর্দন দেব ও মহেন্দ্র দেবের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে”।
গণেশের মৃত্যুর পর পরই তাঁর নিযুক্ত হিন্দু মন্ত্রীবর্গ তাঁর বর বৎসর বয়স্ক পুত্র মহেন্দ্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে গণেশেরই পদাংক অনুসরণে মুসলিম-দলন কার্য অব্যাহত রাখেন। তাই দনুজমর্দন গণেশ ও তদীয় পুক্র মহেন্দ্রের ক্রিয়াকলাপে আনন্দে গদগদ হয়ে রাখালবাবু তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মহেন্দ্রের শাসন ছিল অল্প দিনের জন্য।

গশেণের বংশ
গণেশ দনুজমর্দন

যদুসেন ওরফে জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৪-৩১ খৃঃ) মনেন্দ্র

শাসসুদ্দীন আহমদ শাহ (‌১৪১৩-৪২ খৃঃ)

ইলিয়াস শাহী বংশের পুনরুত্থান
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের দু’জন সুলতানকে হত্য করে সিংহাসন দখল করেন। গণেশ পৌত্র শামসুদ্দীন আহমদ শাহকে হত্যা করে পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশ বাংলার মসনদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
নাসীর উদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-৫৯ খৃঃ)
রুকন উদ্দীন বাররাক শাহ (১৪৫৯-৭৪ খৃঃ)
শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮২ খৃঃ)
দ্বিতীয় সিকান্দার শাহ (১৪৮২ খৃঃ)
জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮২-৮৬ খৃঃ)

বাংলার মসনদে হাবশী সুলতান
কিছুকাল যাবত আবিসিনিয়াবাসীগণ বাংলায় আগমন করতে থাকে। বাররাক শাহ ও ইউসুফ শাহ তাঁদেরকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন। এদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ফতেহ শাহ তাঁদেরকে দমন করার চেষ্টা করলে তিনি নিহত হন এবং জনৈক সুলতান শাহজাদা বাররাক নামে সিংহাসনে আরোহন করেন।
সুলতান শাহজাতা বাররাক (১৪৮৬-৮৭ খৃঃ)
সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৪৮৭-৯০ খৃঃ)
নাসীরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৯০-৯১ খৃঃ)
শামসুদ্দীন মুজাফফর মাহ (১৪৯১-৯৩ খৃঃ)
আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খৃঃ)
উপরে বর্ণিত চতুর্থ হাবশী সুলতান শাসসুদ্দীন মুজাফফর মাহ,হোসেন নামে এক অজ্ঞাত কুলশীল ব্যক্তিকে তাঁর সরকারের অধীনে চাকুরীতে নিযুক্ত করেন। ক্রমশঃ তাঁর পদোন্নতি হতে থাকে এবং অবশেষে মুজাফফর শাহের প্রধানমন্ত্রীর আপন প্রভুকে নিহত করে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি বাংলার ইতিসাহে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ শরীফ মক্কী নামে পরিচিত। পরে তিনি ‘খলিফাতুল্লাহ’ উপাধিও ধারণ করেন।

হোসেন শাহ
ইতিহাসের এক অতি বিস্ময় এ হোসেন শাহ। তাঁর পঞ্চমুখ প্রশংসায় বিরাট বিরাট গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। কিন্তু বর্তশান কালে ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু ছাত্রের মনে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগে। সেসব জবাব ইতিহাস থেকে খুঁজে বের করতে হবে।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে হোসেন শাহের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
“সুলতান হোসেন শাহ নামে পরিচিত এই ভদ্রলোকটির জাতি, ধর্ম, পূর্বাসন এবং তাঁতার উপাধি সম্বন্ধে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বহু অনুসন্ধান সত্ত্বেও আমরা এ পর্যন্ত খুঁজিয়া পাই নাই”।
প্রকৃতপক্ষে তাঁর সম্পর্কে কিছু ইতিহাস, কিছু কিংবদন্তী এবং কিছু অলীক কাহিনীর জগাখিঁচুড়ি তৈরী হয়ে আছে।
স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর ‘দি হিষ্ট্রী অব বেঙল’-এ বলেন-
“প্রায় সব ঐতিহাসিক বিবরণে তাঁকে একজন আরব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁর পিতাসহ বাংলায় এসে বসবাস করতে থাকেন। তাঁর প্রথম জীবনের ঘটনাবলী বহু লোককাহিনী ও উপাখ্যানের বিষয়বস্তু হয়ে পড়েছে। তার অধিকাংশ ঘটনাকেন্দ্র হচ্ছে মুশিদাবাদ জেলার জংগীপুর মহকুমার একটি গ্রাম যাকে বলা হয়- ‘একআনি চাঁদপাড়া নামে একটি রাঢ় গ্রামে স্থানীয় মুসলমান কাজীর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন। কাজী অতিথির বংশ পরিচয় জানতে পেরে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হোসেনের সাথে আপন কন্যার বিয়ে দেন। অতঃপর বিদ্যাশিক্ষা করার পর হোসেন গৌড়ে হাবশী সুলতান মুজাফফর শাহের অধীনে একটি সামান্য চাকুরী গ্রহণ করেন। এ ধরনের কাহিনী সলিম লিপিবদ্ধ করেন একটি বেনামী পুস্তিকার বরাত দিয়ে।
এ ধরনের গল্পও তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত আছে যে, বাল্যকালে হোসেন একজন স্থানীয় ব্রাক্ষণের অধীনে চাকুরী করতেন। এ বালক ভবিষ্যতে এক বিরাট ব্যক্তি হবে এরূপ অলৌকিক লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়ে উক্ত ব্রাক্ষণ তাঁকে গৌড়ে নিয়ে যান।
পরবর্তীকালে হোসেন বাংলার সুলতান হলে সেই ব্রাক্ষণকে মাত্র এক আনা খাজনার বিনিময়ে চাঁদপাড়া গ্রাম দান করেন। এ গল্পটি হুবহু হাসান গাংগু বাহমানীর বাল্যজীবনের কাহিনীর অনুরূপ। তবে বিনা বিচারে একে সত্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে না। সামান্য ব্যক্তি থেকে কেউ একটি রাজ্যের মালিক মোখতার হয়ে বসলে তার সম্পর্কে নানান ধরনের আজগুবি কাহিনী তৈরী করা হয়ে থাকে। হোসেন শাহ সম্পর্কেও তা-ই হয়েছিল বলে আমাদের ধারণা।
কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, হোসেনের পিতা সাইয়েদ আশরাফ মক্কার শরীফ ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘকাল তিরমিজে বাস করেন। বুকানন হ্যামিল্টন বলেন, হোসেন রংপুর জেলার অধিবাসী ছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। গোবিন্দগঞ্জ থেকে ষোল মাইল দূরে অবস্থিত দেবনগর গ্রামে তাঁর জন্ম। কোন কোন ঐতিহাসিক আবার তাঁকে গৌড়ের সুলতান ইব্রাহীম শাহের প্রপৌত্র বলেও উল্লেখ করেছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে তাঁর বংশপরিচয় ও জন্মস্থান দিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যেও যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে।
ঐতিহাসিকগণের কেউ কেউ বলেন, তিনি শুধু আরবই ছিলেন না, ছিলেন সাইয়েদ বংশীয়। তারপর কিছুটা কল্পনার রং দিয়ে হোসেনের বংশমর্যাদা রঞ্জিত করার চেষ্টা করে বলা হয়েছে যে, তাঁর পিতা সাইয়েদ আশরাফ ছিলেন মক্কার শরীফ। ভাগ্য অন্বেষণের জন্য তিনি তাঁর দুই পুত্রহ বাংলায় আগমন করেন।
এখন অতি ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, হোসেনের পিতা মক্কার শরীফ হওয়াতো দূরের কথা, মোটেই আরববাসী ছিলেন কিনা। হোসেনের সাইয়েদ হওয়া কেন, মুসলমান হওয়াটাও সন্দেহমুক্ত নয় বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর আচরণ ও কার্যকলাপই তার সাক্ষ্য দান করে।
প্রথমতঃ তাঁর বংশ পরিচয়ের কথাই ধরা যাক। তাঁর পিতা সাইয়েদ আশরাফ মক্কার অধিবাসী ও শরীফ ছিলেন –এর কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। উপরন্তু মক্কার শরীফ তাঁর দুই পুত্রসহ ভাগ্য অন্বেষণের জন্যে বাংলায় আগমন করেন, এ এক অলীক কল্পনা মাত্র। তিনি কি কো কারণে শরীফের পদমর্যাদা থেকে অপসারিত হয়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন যার জন্যে তাঁকে বাংলায় আসতে হয়েছিল অন্ন বস্ত্রের অনুসন্ধানে? কেউ কেউ আবার তাঁকে তিরমিজের অধিবাসীও বলেছেন। তাহলে কোনটাকে সত্য বলে গ্রহণ করা যাবে? উল্লেখ্য যে, মক্কার শরীফ ছিলেন সেকালে হেজাজের সর্বময় কর্তা, একচ্ছত্র বাদশাহ, বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক, অতুলনীয় রাজপ্রসাদের ভোগদখলকারী। ইতিহাসে এমন কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না যে, মক্কার কোন শরীফ কোন কালে তাঁর মসনদ ত্যাগ করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে স্ত্রীপুত্রসহ বাংলায় এসে অপরের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন। সম্ভবতঃ সুচতুর ও প্রতারক হোসেন নিজকে সাইয়েদ বংশীয় ও শরীফপুক্র বলে পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের ভক্তিশ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিলেন।
তারপর মজার ব্যাপার এই যে, সিংহাসন লাভের পর হোসেন চাঁদপাড়া গ্রামের কাজী সাহেবকে (তাঁর শ্বশুর), মতান্তরে তাঁর বাল্যজীবনের প্রভু জনৈক ব্রাক্ষ্মণ ঠাকুরকে মাত্র একআনা রাজস্বের বিনিময়ে গোটা গ্রাম দান করলেন, পরে সে গ্রাব বা মৌজা ‘একআনি চাঁদপাড়া’ নামে অভিহিত হয়। কিন্তু হতভাগ্য পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অন্ন সংস্থানের কোন ব্যবস্থা হোসেন করেছেন কিনা, তাঁর বিবরণ ইতিহাসে কোথাও নেই।
তারপর আবার লক্ষ্য করুন, হোসেনের কথিত পিতা সাইয়েদ আশরাফ মুর্শিদাবাদের জংগীপুর মহকুমার চাঁদপুর গ্রামের জনৈক কাজীর বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কাজী সাহেব সাইয়েদ বংশীয় লোক দেখে তাড়াতাড়ি হোসেনকে তাঁর কন্যা দান করে বসেন। আবার একথা সমানভাবে প্রচলিত আছে যে, হোসেন চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক ব্রাক্ষ্মণের অধীনে রাখালের চাকুরী করেন। এ সময়ে একদিন কোন গুরুতর অপরাধে ব্রাক্ষ্মণ তাঁকে বেদম বেত্রাঘাত করেন। আবার কখনো হোসেনকে বলা হচ্ছে রংপুর জেলার দেবনগর গ্রামের অধিবাসী। এসব বিপরীতমুখী বিবরণ থেকে একথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হোসেন প্রকৃতপক্ষে ছিলেন অজ্ঞাত কুলশীল। একজন অজ্ঞাত কুলশীলের স্বার্থের খাতিরে সুযোগ বুঝে মুসলমান না হলেও মুসলমান বলে পরিচয় দেয়াটাও আশ্চর্যের কিছু নয়। মোটকথা ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার মাধ্যমে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর বংশ পরিচয় ও বাল্যজীবন সম্পর্কে নানান কল্পিত কাহিনী রচনা করা হয়। কল্পনাবিলাসী গল্পকারগণ হয়তো হোসেনের কথিত পিতার কোন সমাধি আবিষ্কার করে তৎপার্শ্বে হোসেন কর্তৃক বিরাট মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপনের উল্লেখ করতে পারতেন, কিন্তু তাঁরা বাংলার পরম পরাক্রমশালী বাদশাহ হোসেনের কাহিনী রচনায় এত মশগুল ছিলেন যে, হতভাগ্য পিতা ও ভ্রাতার কথা তাঁরা বেমালুম ভুলে গেছেন।
কিভাবে হোসেন ক্ষমতা লাভ করেন এবং ক্ষমতা লাভের পর তাঁর কার্যকলাপ কি ছিল তারও বিশদ আলোচনা করে দেখা যাক।
হাবশী শাসক মুজাফফর শাহ হোসেনকে প্রথমতঃ সামান্য চাকুরীতে নিযুক্ত করেন। অতঃপর প্রখন বুদ্ধি বলে হোসেন তাঁর প্রভুকে প্রীত ও সন্তুষ্ট করে অবশেষে প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ লাভ করেন। সুচতুর হোসেন বুঝতে পেরেছিলেন হাবশী শাসকগণ বাংলার লোকের কাছে ছিলেন অনভিপ্রেত। অতএব আপন প্রভুকে সেনাবাহিনী, অমাত্যবর্গ ও জনসাধারণের কাছে অধিকতর অপ্রিয় করে তুলে হোসেন স্বয়ং ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তিনি তাঁর প্রভু মুজাফফর শাহকে নানাভাবে কুপরামর্শ দিতে থাকেন।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যয় বলেন- “সৈয়দ হোসেন শরীফ মক্কী মুজাফফর শাহের উজির ও প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার পরামর্শ অনুসারে মুজাফফর শাহ সৈনিকদিগের বেতন হ্রাস করিয়া অর্থ সঞ্চয়ে মনঃসংযোগ করিয়াছিলেন”। (বাংলার ইতিহাস, ২য় খণ্ড পৃঃ ১৮৭)।
রিয়াযুস সালাতীন ও তারিখে ফেরেশতায় বলা হয়েছে যে, হোসেন উজির হওয়ার পর জনসাধারণের সাথে সদ্ব্যাবহার করতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে একথাও বলতে থাকেন যে, মুজাফফর শাহ অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির লোক এবং বাদশাহ হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। হোসেন শাহের পরামর্শে মুজাফফর শাহ অবাঞ্চিত কাজ করতেন। ফলে হোসেন তাঁকে জনসাধারনের কাছে দোষী ও হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ পেতেন। এভাবে তিনি সেনাবাহিনী, আমীর-ওমরা ও জনগণকে মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলেন। অবমেষে তাঁর নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী মুজাফফর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঐতিহাসিকগণ বলেন, যুদ্ধে উভয়পক্ষের এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য নিহত হয়। সেকালে এতবড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়েছে বলে জানা যায় না।
যুদ্ধে মুজাফফর শাহ নিহত হন। কেউ বলেন, হোসেন প্রসাদ রক্ষীকে হাত করার পর প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্বহস্তে আপন প্রভুকে হত্যা করেন।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে বিশ্বকোষের বরাত দিয়ে বলেন,
“সকল শ্রেণীর মুসলমান সামন্ত এবং হিন্দুরাজগণ তাঁহাকেই (সৈয়দ হোসেন) রাজ সিংহাসনের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিয়া রাজপদে অভিষিক্ত করেন। তিনিও তাঁহাদের মনোরঞ্জনার্থ নির্দিষ্ট সময়মত গৌড় রাজধানী লুণ্ঠনের আদেশ দেন। ঐ সময়ে গৌড় নগরে অনেক ধনশালী হিন্দু প্রজা সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন”।
মজার ব্যাপার এই যে, হোসেনেরই আদেশে যার লুণ্ঠন করেছিল, তাদেরকে আবার হোসেনের আদেশেই হত্যা করা হয়। এদের সংখ্যা ছিল বার হাজারেরও বেশী। হোসেন তাঁর আপন হীনস্বার্ত চরিতার্থ করার জন্যে লক্ষ লক্ষ লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেন। হয়তো লুণ্ঠনের আদেশ কিছু সংখ্যক মুসলমান হত্যার বাহানা মাত্র।
এত গণহত্যার পর, যার মদ্যে ছিল সেনাবাহিনীর লোক, আমীর ওমরা, অমাত্যবর্গ, জ্ঞানীগুণী প্রভৃতি, হোসেনের বিরুদ্ধে টু শব্দ করার আর কেউ রইলো না। ফলে তিনি হয়ে পড়েন দেশের সর্বময় কর্তা।
সাইয়েদ হোসেন মক্কী (?) সিংহাসন লাভেল পর কোন ভূমিকা পালন করেন তা পাঠকগণের কৌতূহল সঞ্চার না করে পারবে না। রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি তাঁর মন্ত্রীপরিষদ নতুন করে ঢেলে সাজালেন। তাঁর উজির ও প্রধান কর্মকর্তা হলেন –গোপীনাথ বসু ওরফে পুরন্দর খান, রাজ চিকিৎসক মুকুন্দ দাস, প্রধান দেহরক্ষী কেশব ছত্রী, টাকশাল প্রধান অনুপ। নানা শাস্ত্র বিশারদ ও বৈষ্ণব চূড়ামনী শ্রীরূপ ও সনাতনও তাঁর মন্ত্রী হলেন। স্যার যদুনাথ সরকার বৈষ্ণব লেককদের বরাত দিয়ে বলেন যে, শ্রীচৈতন্য যে অবতার ছিলেন, হোসেন শাহ তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। চৈতন্য গৌড় নগরে আগমন করলে হোসেন তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং রাজকর্মচারীগণের প্রতি ফরমান জারী করেন যেন প্রভু চৈতন্যকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ও তাঁর ইচ্ছামত যত্রতত্র ভ্রমণের সুযোগ-সুবিধা করে দেয়া হয়।
শ্রদ্ধেয় আকরাম খাঁ তাঁর উপরেক্ত গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় বলেনঃ
“হিন্দু লেখকগণের মতে হোসেন শাহের সিংহাসন আরোহণের পর হইতে গৌড় দেশে ‘রামরাজ্য’ আরম্ভ হইয়া গেল। মাননীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় এ বিষয়ের ভূমিকা হিসাবে বলিতেছেনঃ মুসলমান ইরান, তুরান প্রভৃতি স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণ বাঙালী হইয়া পড়িলেন। মসজিদের পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাম, দোল উৎসব চলিতে লাগিল।… এহেন পরিস্থিতির মধ্যে সুলতান হোসেনের অভ্যুদয় ঘটিল। তিনি রাজকীয় ঝামেলা হইতে মুক্ত হইয়া খুব সম্ভব সর্বপ্রথম চৈতন্যদেবের খেদমতে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহার ভক্ত শ্রেণীভুক্ত হইয়া গেলেন। ‘চৈতন্য চরিতামৃতে’ লিখিত আছে যে, ইনি (হোসেন) শ্রীচৈতন্যের একজন ভক্ত হইয়াছিলেন”।
সুলতান হোসেন ও শ্রীচৈতন্য ছিলেন সমসাময়িক এবং চৈতন্যের সাথে হোসেনের গভীর সম্পর্ক এক ঐতিহাসিক সত্য। অতএব শ্রীচৈতন্যের কিঞ্চিৎ আলোচনা এখানে অপ্রাসংগিক হবেনা নিশ্চয়।

শ্রীচৈতন্য
শ্রী চৈতন্যকে বৈষ্ণব সমাজ শ্রকৃষ্ণের অবতার রূপে, এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। গোটা হিন্দু সমাজের মধ্যে শ্রীচৈতন্য এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন।
স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ
“এ এমন এক সময় যখন প্রভু গৌরাংগের প্রতীক স্বরূপ বাংগালীর মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রেম ও ক্ষমার বাণী সমগ্র ভারতকে বিমোহিত করে। বাংগালীর হৃদয়মন সকল বন্ধন ছিন্ন করে রাধাকৃষ্ণের লীলা গীতিকার দ্বারা সম্মোহিত হয়। বৈষ্ণব ধর্মের আবেগ অনুভূতিতে, কাব্যে, গানে, সামাজিক সহনশীলতা এবং ধর্মীয় অনুরাগে মনের উচ্ছ্বাস পরবর্তী দেড় শতাব্দী যাবত অব্যাহত গতিতে চলে। এ হিন্দু রেনেসাঁ এবং হোসেন শাহী বংশ ওতপ্রোত জড়িত। এ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের এবং বাংলা সাহিত্যের যে উন্নতি অগ্রততি হয়েছিল তা অনুধাবন করতে গেলে গৌড়ের মুসলমান প্রভুর উদার ও সংস্কৃতি সম্পন্ন শাসনের কথা অবশ্যই মনে পড়ে”।
‘যদুনাথ সরকার, দি হিষ্ট্রী অব বেঙল, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৭)
প্রকৃতপক্ষে চৈতণ্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কি ছিল, তা তাঁর নিজের কথায় আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি। চৈতন্য চরিতামৃত আদি লীলা, ১২০ পৃষ্ঠায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন-
“পাষণ্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার।
পাষণ্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার”।
এখন বুঝা গেল পাষণ্ডি সংহার করাই তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, মুসলমানগণ বাংলা অধিকার করার সময় বৌদ্ধ মতবাদ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের যে বিপুলসংখ্যক লোক এদেশে বাস করতো, ব্রাক্ষ্মণগণ তাদেঁরকে ধর্মের আশ্রয়ে আনতে অস্বীকার করেন। তার ফলে তারা বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করতে থাকে। তাহলে এদেশে হিন্দু, বৈষ্ণব সমাজ ও মুসলমান ব্যতীত সে সময়ে আর কোন ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে পাষণ্ডি ছিল কারা যাদের সংহারের জন্যে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল?
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর উপরে বর্ণিত গ্রন্থে বলেনঃ
“মনুরম মতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অহিন্দু মাত্রই এই পর্যায়ভুক্ত (সরল বাংলা অভিধান)। আভিধানিক সুবল চন্দ্র মিত্র তাঁহার Beng-Eng Dictionary তে পাষন্ডি শব্দের অর্তে বলিতেছেন- “Not conforming himself to the tenets Vedas: Atheistic. Jaina or Buddha. A non-Hindu –বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী এবং অহিন্দু –পাষন্ডির এই তিনটি বিশ্লেষণ সর্বত্র প্রতত্ত হইয়াছে”।
এখন পাষন্ডি বলতে যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই বুঝায়, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সত্য সত্যই=কি চৈতন্য পাষন্ডি তথা মুসলমানদেরকে এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন? আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা যায়, চৈতন্যের সমসাময়িক সুলতান হোসেন শাহের পরেও এদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যণ্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হোসেন শাহ কর্তৃক চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৈষ্ণব সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাসের মধ্যে শির্ক বিদয়াতের যে আবর্জনা জমে উঠেছিল তা-ই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ হয়।
‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রণেতা বলেন-
“প্রকৃত কথা এই যে, বৌদ্ধ সমাজ ও বৌদ্ধ ধর্মকে তাহাদের মাতৃভূমি হইতে সমূলে উৎখাত করার পর তাঁহাদের নেকনজর পড়িয়াছিল মুসলমান সমাজের উপর। তাই যুগপৎভাবে তাঁহারা চেষ্টা করিতে লাগিলেন ‘যবন’ রাজাদিগকে রাজনৈতিক কৌটিল্যের মাধ্যমে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিতে। পক্ষান্তরে ধর্মের নামে একটা মোহজাল বিস্তার করিয়া মুসলমান সমাজকে আত্মবিস্মৃত ও সম্মোহিত করিয়া রাখিতে। পূর্বে বলিয়াছি, ইহাই তৎকালের অবতার ও তাঁহার ভক্ত ও সহকারীদের চরম ও পরম উদ্দেশ্য”।
সত্য নারায়ণের পূজা পদ্ধতির উল্লেখ হিন্দু পুরাণে আছে। হিন্দুর প্রায় অতি ঘরে ঘরে এই পূজার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। কিন্তু মুসলমানকে দিয়ে এ সত্য নারায়ণের পূজা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই হিন্দু মুসলমানের বিভেদ মিটাবার মহান (?) উদ্দেশ্য সুলতান হোসেন সত্যপীরের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর পূজা পদ্ধতির প্রবর্তণ করেন। প্রকৃতপক্ষে সত্যপীরের দরগাহ প্রতিষ্ঠা, সত্যপীরের নামে মানৎ ও শির্ণি বিতরণ, ঢাক-ঢোলের বাদ্য-বাজনাসহ সত্যপীরের দরগায় অনুষ্ঠানাদি পালন প্রকৃতপক্ষে সত্যনারায়ণ পূজারই মুসলিম সংস্করণ যার প্রবর্তন ছিলেন হোসেন শাহ। এসব কারণেই হোসেন শাহতে অবতার বলে মান্য করে হিন্দু সমাজ।
নৃপতি হুসেন শাহ হয়ে মহামতি।
পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি।।
অস্ত্রশস্ত্রে সুপন্ডিত মহিমা অপার।
কহিকালে হবু যেন কৃষ্ণ অবতার।।
(‘বংগভাষা ও সাহিত্য’ দীনেশ চন্দ্র সেন)।
দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বংগভাষা ও সাহিত্যে’ বলেনঃ
“কবীন্দ্র পরমেশ্বর ইহাকে (হোসেন শাহ) কৃষ্ণের অবতার বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবতে দৃষ্ট হয়, তিনি চৈতন্যপ্রভুকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়অ স্বীকার করিয়াছিলেন। যে গুণে আকবর ভারত ইতিহাসের কণ্ঠে কণ্ঠহার হইয়া আছেন, সেই গুণে হোসেন শাহ বংগের ইতিহাসে উজ্জ্বল রত্ম বলিয়া গণ্য হইবেন”।
হিন্দুদের সাধারণ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী চৈতন্য শ্রীকৃষ্ণের অবতার। অথবা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এজন্যে তাঁর ভক্তবৃন্দ অতি মারাত্মকভাবে কৃষ্ণলীলায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ধর্মের নামে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের মধ্যে যে অতি আবেদনমূলক প্রেমলীলার পরিপূর্ণ অনুকরণ। এসনের পূর্ণ বিবরণ বহু হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থে দেখা যায়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার প্রসারের ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে যৌন অনাচারের মাধ্যমে যে সর্বনাশটা হয়েছে তা হিন্দু সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ স্বীকার করেন। পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, বাংলার একজন শক্তিশালী মুসলিম বাংলার লক্ষ লক্ষ লোকও এ সমস্ত নোংরা ও অশ্লীল আচার অনুষ্ঠানকে তাদের জীবনের আদর্শরূপে গ্রহণ করে মুসলিম সমাজকে অভিশপ্ত ও অধঃপতিত করেছে। এভাবেই শ্রীচৈতন্য পাষন্ডি সংহারে পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছেন বল্লে অত্যুক্তি হবে না।
এখান আমরা রাখালসাদ বন্দোপাধ্যয়ের উক্তির পুনরাবৃত্তি করে তার মধ্যে কিছু সংশোধনীসহ বলতে চাই-
‘দনুজমর্দণ দেব –গণেশ যাহা করিতে পারেন নাই, আর্যাবর্তের কোনও হিন্দু রাজা যাহা করিতে পারেন নাই তাহাই সাধন করিয়াছিলেন বলিয়া সুলতান হোসেন শাহের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকিবে”।
এত আলোচনার পর এখন হোসেন শাহের বংশ ও জাতিধর্ম সম্বদ্ধে সন্দেহ অধিকতর ঘনীভূত হচ্ছে। হতে পারে যে, হোসেন শাহ আদৌ মুসলমান ছিলেন না। একজন সাইয়েদ বংশীল মুসলমান হিসাবে পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের ভক্তি শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে প্রতারণার মাধ্যমে ক্রমশঃ উচ্চতম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। অথবা বাংলারই অজ্ঞাত কুলশীল হিন্দু অথবা মুসলমান কোন নিরাশ্রয় বালককে মুর্শিদাবাদের চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক ব্রাক্ষ্মণ আশ্রয় দান করে রাখালের কাজে নিযুক্ত করেন। উক্ত ব্রাক্ষ্মণ এ বালকের মধ্যে এক বিরাট প্রতিভা দেখতে পান এবং ‘পাষন্ডি সংহার নিমিত্ত’ তাঁকে প্রশিখ্ষণ দিয়ে মুজাফফর শাহের দরবারে পরিচয় দেয়া হয়। মুজাফফর শাহের অনুগ্রহে তাঁর ভাগ্যের দ্রুত পরিবর্তন শুরু হয়। তাঁর গোটা জীবন, তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরোধী বিবরণ, তাঁর পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাস, কার্যকলাপ ও আচার-আচরণ, অসংখ্য প্রতিভাবান মুসলমান হত্য করে হিন্দু ও বৈষ্ণব সমাজের লোকদের দ্বারা তায়র মন্ত্রীসভা ও রাজদরবারের শোভাবর্ধন, প্রভৃতি লক্ষ্য করার পর তাঁর জাতিধর্ম সম্পর্কে উপরোক্ত ধারণা পোষণ করণে কি ভুল হবে?
মোটকথা, হোসেন শাহ মুসলমানই হন, আর যা-ই হন, অসংখ্য অগণিত মুসলমান সৈন্য, আমীর ওমরা ও সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের হত্যার পর শক্তিশালী হিন্দু সামন্ত প্রভুদের তুষ্টি সাধন করে মুসলিম সমাজের কোন্ সর্বনাশটা করেছেন, তা চিন্তা করার অবকাশ তাঁর ছিল কোথায়? ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে এমনি এক একজন মুসলমানকে কাষ্ঠপুত্তলিকা সাজিয়ে ইসলাম বৈরীগণ তাঁদের অভীষ্ট সিদ্ধ করেছেন। সেজন্যে অমুসলিম ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকগণকে আমরা হোসেন শাহের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেখতে পাই।
তাঁর আমলে বাংলা ভাষার মাধ্যমে হিন্দু জাতির রেনেসাঁ আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। বাংলা গ্রন্থ প্রণেতা মালাধর বসু, বিপ্রদাস, বিজয়গুপ্ত এবং যশোরাজ খান তাঁদের সাহিত্যে হোসেন শাহের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাসহ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। মালাধর বসু ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ক ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ নামক একখানি বাংলা মহাকাব্য রচনা করেন। হোসেন প্রীত হয়ে তাঁকে ‘গুণরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বলেন-
“নিগুণ অধম মুঞি নাহি কোন ধান
গৌড়েশ্বর দিল নাম গুণরাজ খান”।
মালাধর বসুর ভ্রাতা গোপীনাথ বসু ওরফে পুরন্দর খান শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ে কৃষ্ণমংগল নামক একখানি মহাকাব্য রচনা করেন। ব্রাক্ষ্মণ বিপ্রদাস মনসামংগল কাব্য রচনা করেন। পরাগল খাঁকে হোসেন চট্টগ্রামে বিরাট ভূসম্পত্তি দান করেন।
এসব গ্রন্থাদি ও মহাকাব্য রচিত মনসামংগল কাব্য মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর এতখানি প্রভাব বিস্তার করে যে পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজে মনসাপূজা প্রচলিত হয়। পাঠকগণের অবগতির জন্যে মওলানা আকরাম খাঁ’র গ্রন্থের কিঞ্চিৎ এখানে সন্নিবেশিত করছি।
“মহাভারত ও দেবী ভাগবতে আমরা মনসার আংশিক বিবরণ দেখিতে পাই। তাহার জন্মবৃত্তান্ত সম্পর্কে মতভেদ থাকিলেও আমরা তাহাকে শিবের কন্যা বলিয়া ধরিয়া লইতে পারি। ভাষার শালীনতা রক্ষা করিয়া মনসার কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভব নহে। মোদ্দাকথা, জন্মের পর মুহুর্তেই তিনি পরিপূর্ণ যৌবনবতী হইয়া উঠেন এবং শিব বা মহাদেব তাঁহাকে স্বগৃহে লইয়া যান। শিবের পত্নী চন্ডী বা দুর্গা যে কারণেই হউক তাঁহাকে দেখা মাত্র আক্রোশে ফাটিয়া পড়েন। ফলে দুই দেবীর মধ্যে যে সংঘর্ষ বাধে তাহাতে মনসা তাঁহার একটি চক্ষু হারান। মনসা দুর্গার প্রতি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। শিবও তাঁহার রোষ হইতে বাদ পড়িলেন না। (সাপ নাচানো বর্ণনা এখানে আমরা বাদ দিতেছি- মনসা কিন্তু সাপের দেবী হিসাবে পূজিত হন)। মনসা প্রতিজ্ঞা করিলেন যে তাঁহার এই অপমানের প্রতিশোধ না লইয়া ছাড়িবেন না। তাঁহার সহচরী নেত্রবতীর সহিত পরামর্শ করিয়া তিনি শিব ও দুর্গা-ভক্তদের মনসা পূজায় বাধ্য করিবেন বলিয়া স্থির করিলেন। এই উদ্দেশ্য লইয়া বাংলাদেশে তিনি এক বিশেষ রূপে আবির্ভূত হইলেন এবং অতি অল্পায়াসে ধীরে ধীরে রাখাল, জেলে ও গরীব মুসলমানদের তাহার পূজার প্রবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন। (বাংলা সাহিত্যের কথা-১৬ পৃষ্ঠা)
চাঁদ সওদাগরের স্ত্রী একজন মনসাভক্ত নারী ছিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বামী কোনক্রমেই মনসার পূজা করিতে রাজী হইলেন না। রগান্বিত হইয়া মনসা তাঁহাকে নানা বিপদ ও ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ফেলিতে লাগিলেন। কিন্তু সাতটি সন্তান ও প্রচুর ধনসম্পদসহ তাঁহার সমুদয় জাহাজ সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও সওদাগর নিজের মতে অটল রহিলেন। অবশেষে কঠোর সতর্কথা সত্ত্বেও তাঁহার একমাত্র জীবিত পুত্র লখিন্দর সর্পাঘাতে নিহত হয় এবং লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা তাহার প্রগাঢ় ভক্তি ও মনসার দয়ায় তাহাকে পুনর্জীবিত করিতে সক্ষম হয়। চাঁদ সওদাগরের হারানো সকল পুত্র ও ধনৈশ্বর্য পুনরায় তাঁহাকে ফিরাইয়া দেওয়া হয়। এই মনসা পূজা এবং ইহার সহিত সম্পর্কযুক্ত বেহুলার ভাসান বিংশতি শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত যশোহর, খুলনা ও বচ্চিশ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলশানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস-পৃঃ ৭৮-৭৯)
শুধু দক্ষিণ বংগেরই নয় বাংলার প্রায় সকল অঞ্চলের একশ্রেণীর মুসলমান উপরোক্ত শির্ক ও কুফরী ধারণা পোষণ করে গ্রামে গ্রামে বেহুলার ভাসান বা ভাসান যাত্রা উৎসাহ উদ্যম সহকারে অনুষ্ঠিত করতো।
এখন আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই যে, হোসেন শাহ ও তাঁর বংশধরগণের সাহায্যে কিভাব পৌত্তলিকতার বিষবাষ্প মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সংক্রমিত করেছিল। যার ফলে পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতিকে এক ও অভিন্ন করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চলেছে।

হোসেন শাহী বংশ
আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খৃঃ)

দানিয়াল নাসির উদ্দীন নসরৎ শাহ গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ
(১৫১৯-৩২ খৃঃ (১৫৩২-৩৮ খৃঃ)

আলাউদ্দীন ফিরোজশাহ (১৫৩২ খৃঃ)
বাংলার ইতিহাস আলেচনা করলে জানা যায় যে, সর্বপ্রথম হোসেন শাহী আমলেই মুসলমানদের আচার-আচরণ ও ধর্ম বিশ্বাসে পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। শ্রীচৈতন্য ও বৈষ্ণব সমাজের বিরাট প্রভাব যে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস কলুষিত করেছিল তাতে সন্দেহ নেই। হোসেন শাহ কর্তৃক লক্ষ লক্ষ সম্ভ্রান্ত মুসলমান আমীর-ওমরা, ধার্মিক ও পীর-অলী নিহত হওয়ার এবং হোসেন শাহের স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার কারণে মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ সহজতর হয়েছিল।
এম আর তরফদার তাঁর Husain Shahi Bengal গ্রন্থে বলেনঃ
“Some of the influential Muslims used to worship the snake goddess. Mannasa. Out of fear for snake bite. It is probabely the result of the Hindu influence on the Muslims. Nasrat Shah constructed a building in order to Prophet. But the preservation of the Prophet’s footprint does not find support in Orthodox Islam”
(Husain Shahi Bengal, M.R. Tarafdar. P. 164, 166, 167, 89-91)
“কোন কোন প্রভাবশালী মুসলমান মনসা বেদীর পূজা করতো সর্পদংশনের ভয়ে। এ ছিল সম্ভবতঃ মুসলমানদের উপর হিন্দু প্রভাবের ফল। নসরৎ শাহ অট্টালিকা নির্মণ করেন। নবীর পদচিহ্নের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সত্যিকার ইসলাম সমর্থন করেনা”।
ডাঃ জেসম ওয়াইজ বলেন, গয়ার ব্রাক্ষ্মণগণ তীর্থ যাত্রীদেরকে বিষ্ণুপদ (বিষ্ণুর পদচিহ্ন) দেখিয়ে প্রচুর রোজগার করে। তাদের অনুরকণে মুসলমান সমাজে কদম রসূলের পূজার প্রচলন শুরু হয় হোসেন শাহী বাংলায়।
হোসেন শাহী বংশ পঁয়তাল্লিশ বৎসর বাংলার শাসন পরিচালনা করার পর আর তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তরপর শের শাহ, সুর ও কররানী বংশ ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত থাকে। অতঃপর দিল্লীর মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে নিযুক্ত গভর্নরগণ বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর কর্তৃক মানসিংহ দ্বিতীয়বারের জন্যে বাংলার গভর্ণর নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শান্তির সঙ্গে বাংলায় শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব হয়নি। বাংলার মোগল আধিপত্য বার বার প্রতিহত ও বিপন্ন হয়। মানসিংহের পর জাহাঙ্গীর কুতুবউদ্দীন খান কোকাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। ১৬০৭ খৃষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর কুলী খান এবং ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত আরও নয়জন বাংলার সুবাদার গভর্ণর হিসাবে শাসন পরিচালনা করেন। ১৬৩৯ সাল যুবরাজ সুজা বাংলার গভর্ণর নিযুক্ত হওয়ার পর সর্বপ্রথম ইংরেজগণ ব্যবসায়ীর বেশে বাংলায় আগমন করে এবং ১৭৫৭ সালে তারা চিরতরে মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে বাংলা বিহারের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে পড়ে।
যুবরাজ মুহাম্মদ সুজার পর ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত যাঁরা বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা হলেনঃ
যুবরাজ মুহাম্মদ সুজা -১৬৩৯-৬০ খৃঃ
মুয়াজ্জাম খান মীর জুমলা -১৬৬০-৬৩ খৃঃ
দিলির খান-দাউদ খান -১৬৬৩-৬৪ খৃঃ
শায়েস্তা খান (মুমতাজ মহলের ভ্রাতা) -১৬৬৪-৭৮ খৃঃ
ফিদা খান আজন খান কোকা -১৬৭৮ খৃঃ
যুবরাজ মুহাম্মদ আজম -১৬৭৮-৭৯ খৃঃ
শায়েস্তা খান -১৬৭৯-৮৮ খৃঃ
খানে জাহান -১৬৮৮-৮৯ খৃঃ
ইব্রাহীম খান -১৬৮৯-৯৮ খৃঃ
যুবরাজ আজীম উদ্দীন -১৬৯৮-১৭১৭ খৃঃ
মুর্শিদ কুলী খান -১৭১৭-২৭ খৃঃ
সুজাউদ্দীন মুহাম্মদ খান -১৭২৭-৩৯ খৃঃ
সরফরাজ খান -১৭৩৯-৪০ খৃঃ
আলীবর্দী খান -১৭৪০-৫৬ খৃঃ
সিরাজদ্দৌলা -১৭৫৬-৫৭ খৃঃ

তৃতীয় অধ্যায়
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলায় আগমন
যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে ইংরেজগণ শতাধিক বৎসরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধ্য সাধনার ব্যবসায়ী থেকে শাসকে পরিণত হয়েছিল, সাড়ে পাঁচশত বৎসরব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে এ দেশবাসীকে গোলামীর শৃখলে আবদ্ধ করেছিল, তাদের এ দেশে আগমন ও পরবর্তী কার্যকলাপ আমাদের ভালো করে জেনে রাখা দরকার।
বোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৫৯৯ খৃঃ) কতিপয় ব্যবসায়ী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্ম হয়। রাণী এলিজাবেথের অনুমোদনক্রমে তারা ভারতের সাথে ব্যবসা শুরু করে। ১৬১২ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে সনদ লাভ করে এ কোম্পানী সর্বপ্রথম সুরাট বন্দরে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে।
প্রথম প্রথম তাদেরকে খুব ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে চলতে হয় বলে ব্যবসা বাণিজ্যে বেশী সুবিধা করতে পারে না। ১৬৪৪ সালে বাদশাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে তাঁর কন্যা আগুনে দগ্ধিভূত হয়। তার চিকিৎসার জন্যে সুরাটের ইংরেজ-কুঠির অধ্যক্ষ কর্তৃক প্রেরিত সুদক্ষ সার্জন ডাঃ গ্যাব্রিল বাউটন তাকে নিরাময় করেন। তাঁর প্রতি বাদশাহ শাহজাহান অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং বাউটনের অনুরোধে ইংরেজ বণিকগণ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ১৬৪৪ সালে তারা যখন বাদশাহর ফরমানসহ বাংলায় উপস্থিত হয়, তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবাদার ছিলেন যুবরাজ মুহাম্মদ শাহসুজা।
কোম্পানীর পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, শাহ সুজার পরিবারের জনৈক সদস্যের চিকিৎসার ভার ডাঃ বাউটনের উপর অর্পিত হয় এবং এখানেও তিনি চিকিৎসয় সুনাম অর্জন করেন। অতএব শাহ সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা সালামীর বিনিময়ে ইংরেজদেরকে বাংলায় অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দান করেন। বাদশাহ শাহজাহান ও তদীয় পুত্র ইংরেজদের প্রতি যে চরম উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন সেই উদারতা ও অনুগ্রহ প্রদর্শনকে অকৃতজ্ঞ ইংরেজ বণিকগণ পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যের ও বাংলা বিহারের স্বাধীনতার মৃত্যুপরোয়ানা হিসাবে ব্যবহার করে।
শাহ সুজার ফরমানবলে ইংরেজ বণিকগণ হুগলীতে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে এবং পাটনায় এজেন্সি স্থাপন করে।

মীর জুমলা থেকে সিরাজদ্দৌলা
শাহ সুজার পর আওরংজেবের সেনাপতি মীর জুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। বিচক্ষণ মীর জুমলা ইংরেজদের গতিবিধির প্রতি তিক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন। একবার পাটনা থেকে হুগলীগামী কয়েকখানি মাল বোঝাই নৌকা মীর জুমলা আটক করেন। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হুগলীর ইংরেজ কুঠিয়াল জনৈক মুসলমানের মাল বোঝাই নৌকা আটক করে পণ্যদ্রব্যাদি হস্তগত করে। তার এ ঔদ্ধত্যের জন্যে মীর জুমলা হুগলীর কুঠি অধিকার করার আদেশ জারী করেন। কুঠিয়াল বেগতিক দেখে আটক নৌকা ও মালপত্র মালিককে ফেরৎ দিয়ে মীর জুমলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

নবাব শায়েস্তা খান
মীর জুমলার পর শায়েষ্তা খান বাংলার নবাব সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। শায়েস্তা খানের জন্যে ইংরেজগণ সর্বত্র সন্ত্রস্ত থাকতো। তাদের ঔদ্ধত্যের জন্যে শায়েস্তা খান পূর্ববর্তী ফরমানগুলি বাতিল করে দেন। তারা তাদের আচরণের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী হলে এবং সততার সাথে ব্যবসা করার প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্বতন ফরমানগুলি পুনর্বহালা করা হয়। অতঃপর শায়েস্তা খান বাংলা ত্যাগ করেন।

ফিদা খান ও যুবরাজ মুহাম্মদ আজম
শায়েস্তা খানের পর ফিদা খান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবজার মুহাম্মদ আজম পর পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৭৮ সালে মুহাম্মদ আজম সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর কোম্পানী তাদের হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্যে মুহাম্মদ আজমকে একুশ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করে। সম্রাট আওরংজেত তা জানতে পেরে তাকে পদচ্যুত করে পুনরায় শায়েস্তা খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। এ সময়ে ইংরেজদের ঔদ্ধতা চরমে পৌঁছে। আকবর নামক জনৈক ব্যক্তি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ইংরেজগণ তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। শায়েস্তা খান এ ষড়যন্ত্র জানতে পেরে পাটনা কুঠির অধিনায়ক মিঃ পিকককে কারারুদ্ধ করেন। কোম্পানীর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডন থেকে ক্যাপ্টেন নিকলসনের নেতৃত্বে কয়েকখানি যুদ্ধ জাহাজ ভারতে প্রেরণ করা হয় এবং চট্টগ্রাম অধিকারের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন নিকলসন বিফল মনোরথ হন। ইংরেজদের এহেন দুরভিসদ্ধির জন্যে নবাব শায়েস্তা খান তাদেরকে সুতানটি থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬৮৭ সালে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান জব চার্ণক নবাব প্রদত্ত সকল শর্ত স্বীকার করে নিলে পুনরায় তাদেরকে ব্যবসায় অনুমতি দেয়া হয়। নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলি জব চার্ণক কর্তৃক মেনে নেয়ার কথা ইংলন্ডে পৌঁছলে কোম্পানীর কর্মকর্তাগণ এটাকে অবমাননাকর মনে করে। অতঃপর তারা ক্যাপ্টেন হীথ নামক একজন দুর্দান্ত নাবিকের পরিচালনাধীনে ‘ডিফেন্স’ নামক একটি রণতরী বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে প্রেরণ করে। হীথ সুতানটি পৌঁছে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য কোম্পানীর লোকজনসহ বালেশ্বর গমন করে। এখানে তারা জনগণের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। অতঃপর হীথ বালেশ্বর থেকে চট্টগ্রাম গমন করে আরাকান রাজের সাহায্য প্রার্থনা করে। এখানেও সে ব্যর্থ হয় এবং নিরাশ হয়ে মাদ্রাজ চলে যায়। তাদের এসব দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র জানতে পেরে বাদশাহ আওরংজেব ইংরেজদের মসলিপট্টম ও ভিজেগাপট্টমের বাণিজ্য কুঠিসমূহ বাজেয়াপ্ত করেন। এভঅবে কোম্পানী তাদের দুষ্কৃতির জন্যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।

সুবাদার ইব্রাহীম খান
শায়েস্তা খানের পর অল্পদিনের জন্যে খানে জাহান বাংলার সুবাদার হন এবং ১৬৮৯ সালে ইব্রাহীম খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। এ দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারকল্পে কোম্পানীর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয়। অতঃপর উড়িষ্যার বন্দী ইংরেজদেরকে মুক্তিদান করে জব চার্ণককে পুনরায় বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। জব চার্ণক পলায়ন করে মাদ্রাজ অবস্থান করছিল। ধূর্ত জব চার্ণক অনুমতি পাওয়া মাত্র ১৬৯১ সালে ইংরেজ বণিকদেরকে নিয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তণ করে এবং কোলকাতা নগরীর পত্তন করে নিজেদেরকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যে, এর সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজগণ বাংলা তথা সমগ্র ভারতভূমিতে তাদের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ অক্ষুণ্ণ রাখে।
এ সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্ব অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কনস্টান্টিনোপলের শায়খুল ইসলাম বাদশাহ আওরংজেবকে জানান যে, ইংরেজরা ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ যবক্ষার সংগ্রহ করে তা ইউরোপে রপ্তানী করা হয় এবং তাই দিয়ে গোলাবারুদ তৈরী করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। আওরংজেব যবক্ষার ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু গোপনে তারা যবক্ষার পাচার করতে থাকে। অতঃপর ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসা নিষিদ্ধ করে বাদশাহ আওরংজেব এক ফরমান জারী করেন। হুগলী কুঠির অধ্যক্ষ বাংলার সুবাদারেরপৃপাপ্রার্থী হলে তিনি এ নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা হ্রাস করে দেন।

সুবাদার আজিমুশশান
ইব্রাহীম খানের অযোগ্যতার কারণে সম্রাট আওরংজেব তাঁর স্থলে স্বীয় পৌত্র আজিমুশশানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন।
আজিমুশশান ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও অর্থলোভী। তার সুযোগে ইংরেজগণ তাঁকে প্রভূত পরিমাণে উপঢৌকনাদি নজর দিয়ে সুতানটি বাণিজ্যকুঠি সুরক্ষিত করার অনুমতি লাভ করে। তারপর পুনরায় ষোল হাজার টাকা নজরানা ও মূল্যবান উপহাদারিদ দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম তিনটি লাভ করে।
১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যুর পর আজিমুশশানের পিতা বাহাদুর মাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে পুনরায় আজিমুশশান বাংলা,বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। অযোগ্য, অকর্মণ্য ও আরামপ্রিয় সুবাদারকে রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে মুর্শিদ কুলী খানকে দেওয়ান নিযুক্ত করে বাংলায় পাঠানো হয়।

মুর্শিদ কুলী খান
বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে ফরোখশিয়ার কর্তৃক আজিমুশশান নিহত হন এবং ফরোখশিয়ার মুর্শিদ কুলী খানকেই বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। মুর্শিদ কুলী খান ইংরেজদের হাতের পুতুল সাজার অথবা অর্থদ্বারা বশীভূত হবার পাত্র ছিলেন না। অতএব তাঁর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভে ইংরেজগণ ব্যর্থ হয়। অবস্থঅ বেগতিক দেখে তারা সম্রাটের নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে হ্যাটিল্টন নামে একজন সুদক্ষ চিকিৎসক ছিল। বাংলার সুবাদার ছিলেন ইংরেজদের প্রতি বিরাগভাজন। তাঁর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে সম্রাট ছিলেন নারাজ। কিন্তু এখানে একটি প্রেমঘটিত নাটকের সূত্রপাত হয় যার ফলে ইংরেজদের ভাগ্য হয় অত্যন্ত সুপ্রসন্ন।
উদয়পুরের মহারাণা সিংহের এক পরম রূপসী কন্যার প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন যুবক সম্রাট ফরেখশিয়ার। বিবাহ স্থিরীকৃত হওয়ার পর হঠাৎ তিনি ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হন। বিবাহ অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত হয়ে যায়। কোন চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যাটিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যামিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর মহারাণার কন্যার কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
প্রিয়তমাকে লাভ করার পর সম্রাট ফরোখশিয়ার ডাঃ হ্যামিল্টনের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ইংরেজ বণিকদিগকে কোলকাতার দক্ষিণে হুগলী নদীর উভয় তীরবর্তী আটত্রিশটি গ্রাম দান করেন। তার নামমাত্র বার্ষিক খাজনা র্নিধারিত হয় মাত্র আট হাজার একশ’ একুশ টাকা। সম্রাটের নিকটে এতকিছু লাভ করার পরও মুর্শিদ কুলি খানের ভয়ে তারা বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেনি।

সুজাউদ্দীন
১৭২৫ সালে মুর্শিদ কুলীর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদ অলংকৃত করেন। তাঁর আমলে ইংরেজরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ উন্নতি করে এবং তাদের ঔদ্ধত্যও বহুগুণে বেড়ে যায়। হুগলীর ফৌজদার একবার ন্যায়সংগত কারণে ইংরেজদের একটি মাল বোঝাই নৌকা আটক করেন। একথা জানতে পেরে ইংরেজরা একদল সৈন্য পাঠিয়ে প্রহরীদের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নিয়ে যায়। তাদের এ ঔদ্ধত্যের জন্যে সুবাদার জানতে পেরে তাড়াতাড়ি অপরাধ স্বীকার করে মোটা রকমের জরিমান দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এভাবে তারা রক্ষা পায়।

সরফরাজ খান
সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান সুবাদার নিযুক্ত হন। নাদির শাহের ভারত আক্রমণ তাঁর সময়ে হয়েছিল।

আলীবর্দী খান।
সরফরাজ খান ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বলচিত্ত। তাঁর সেনাপতি আলীবর্দী খানের সংগে সংঘর্ষে নিহত হন এবং আলীবর্দী খান ১৭৪১ সালে বাংলার সুবাদার হন।
আলীবর্দী খানের সময় বার বার বাংলার উপর আক্রমণ চলে বর্গী দস্যুদের। তাদের দৌরাত্ম্য থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে তিনি কয়েকবার ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেন। দেশের আর্থিক উন্নতিকল্পে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দান করতেন।
বহু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা সত্ত্বেও বর্গীদস্যুরা একবার প্রবেশ করে লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ড চালায়। জলপথে আগমনকারী বর্গীদস্যুদের দমন করার জন্যে আলীবর্দী খান ইংরেজদের সাহায্য সহযোগীতার প্রয়োজনবোধ করছিলেন। কারণ নৌশক্তি বলতে বাংলার কিছুই ছিলনা। পক্ষান্তরে ইংরেজদের ছিল শক্তিশালী নৌবহর। আলীবর্দীর প্রধান সেনাপতি একবার ইংরেজদের মতো ক্রমবর্ধমান এক অশুভ শক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পরামর্শ দেন। তদুত্তরে বৃদ্ধ আলীবর্দী বলেন যে, একদিকে বর্গীরা স্থলপথে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। আবার ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করলে তারা সমুদ্রপথে আগুন জ্বালাবে যা নির্বাপিত করার ক্ষমতা বাংলার নেই। আলীবর্দীর বার্ধক্য এবং পরিস্থিতির নাজুকতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা পাকাপোক্ত হয়ে বসে এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠালাভের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার পরিসমাপ্তি ঘটে পনেরো বৎসর পরে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে।

সিরাজদ্দৌলা
সতেরোশত ছাপ্পান্ন খৃষ্টাব্দে সুদীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর আলীবর্দী মৃত্যুবরণ করেন এবং সিরাজদ্দৌলা তাঁর উত্তরাধিকারী হন। তাঁর সিংহাসন আরোহণের পর আলীবর্দী-কন্যা ঘেসেটি বেগম ও তাঁর দৌহিত্র পুর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জং-এর সকল ষড়যন্ত্র তিনি দক্ষতার সাথে বানচাল করে দেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ করার সাথে সাথেই ঘেসেটি বেগম বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন এবং মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সিরাজদ্দৌলা ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগমের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বেগমকে রাজপ্রসাদে বন্দী করেন। অপরদিকে শওকত জং নিজেকে বাংলার সুবাদার বলে ঘোষণা করলে যুদ্ধে সিরাদ্দৌলা কর্তৃক নিহত হন।
ঘেসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহে নওয়াজেশ মুহাম্মদের দেওয়ান রাজবল্লভ ইন্ধন যোগাচ্ছিল। সিরাজদ্দৌলা তা জানতে পেরে রাজবল্লভের কাছে হিসাবপত্র তলব করেন। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেশ মুহাম্মদের অধীনে দেওয়ান হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার তার উপরে ছিল। আদায়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিল বলে হিসাব দিতে অপারগ হওয়ায় নবাব সিরাজদ্দৌলা রাজবল্লভের ঢাকাস্থ ধনসম্পদ আটক করার আদেশ জারী করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভাবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদ সহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজদ্দৌলা ধনরত্মসহ পলাতক কৃষ্ণবল্লভকে তাঁর হাতে অর্পণ করার জন্যে কোলকাতার গভর্ণর মিঃ ড্রেককে আদেশ করেন। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও রাজ্যের মধ্যে অতি প্রভাবশালী হিন্দুপ্রধান মাহতাব চাঁদ প্রমুখ অন্যান্য হিন্দু বণিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজদ্দৌলার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তারপর অকৃতজ্ঞ ক্ষমতালিপ্সু ইংরেজগণ ও তাদের দালাল হিন্দু প্রধানগণ সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরদিরে জন্যে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয় –পলাশীর ময়দানে। পলাশীর যুদ্ধ, তার পটভূমি ও সিরাজদ্দৌলার পতন সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার তৎকালে বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা কি ছিল।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি