চতুর্থ অধ্যায়
বাংলার মুসলিম শাসন বিলুপ্তির পশ্চাৎ পটভূমি
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পর ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে নেমে এসেছিল চরম দুর্যোগ। নামেমাত্র একটি কেন্দ্রীয় শাসন দিল্লীতে অবশিষ্ট থাকলেও তা ছিল অত্যন্ত দুর্বল যার সুযোগে বিভিন্ন স্থানে মুসলমান শাসকগণ একপ্রকার স্বাধীনতা ভোগ করছিলেন। তাঁরা জমিদার-জায়গীরদার ও ধনিক-বণিক শ্রেণীর সন্তুষ্টি সাধনের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ফলে তাঁরা হয়ে পড়েছিলেন স্বভাবতঃই হীনমন্যতার শিকার। সুযোগ সন্ধানী বিজিত জাতি এ সুযোগে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস ও তামাদ্দুনিক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের সাহস পায়। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদ, প্রচার ও প্রসার, শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তন, বৈষ্ণব সমাজের নোংরা, অশ্লীল ও যৌন উত্তেজনামূলক ক্রিয়াকলাপ মুসলমান সমাজকে অধঃপতনের অতল তলে নিমজ্জিত করে দেয়। শত্রুকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করার উপায় না থাকলে তার ধর্মবিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারলে তাকে সহজেই পরাজিত করা যায়। ভারতের এবং বিশেষ করে বাংলার সুচতুর হিন্দুজাতি তাদের কয়েক শতাব্দীর পুঞ্জিভূত বিক্ষোভের প্রতিশোধ এভাবেই নিয়েছে। উপরন্তু ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে তারা মুসলিম জাতির অধঃপতন ত্বরান্বিত করে তাদের অভীষ্ট সাধনের জন্যে তাদেরই একান্ত মনঃপূত নামধারী একজন মুসলমানকে নির্বাচন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে। এই কাষ্ঠপুত্তলিকার দ্বারা তারা তাদের স্বার্থ ষোলআনা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। তার সাথে ইসলমী ঈমান আকীদাহর মধ্যে কুফর ও পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ এবং মুসলিম সংস্কৃতির উপর হিন্দুজাতির প্রাধান্য মুসলমানদেরকে তাদের মানসিক গোলামে পরিণত করেছে। তার অতি স্বাভাবিক পরিণাম যা হবার তাই হয়েছে।
ডঃ এ, আরব, মল্লিক তাঁর গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ
“Thus long years of association with a non-Muslim people who far outnumbered them, cut off from original home of Islam, and living with half converts from Hinduism, the Muslims had greatly deviation from the faith and had become Idianised. This deviation from the faith apart, the Indian Muslims in adopting the caste system of the Hindus, had given a disastraous bloe to the Islamic conception of brotherhood and equality in which their strength had rested in the past and presented thus in the 19th century the picture of a distrupted society, degenerated and weakened by division and sub-division to a degree, in seemed, beyond the possibility of repair. No wonder, Sir Mohammad Iqbal said, surely we have out-Hindued the Hindu himself, -we are suffering and social caste system –religios caste system, sectarian and social caste system –which we have either learned or inherited from the Hindus. This is one of the quiet ways on which the conquered nation revenged themselves on their conquerors.” (British Policy and the Muslims in Bengal –A.R. Mallick)
-“মুসলমানগণ ইসলামের মূল উৎসকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের আধা ধর্মান্তরিত মুসলমানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ অমুসলমানদের সাথে বহু বৎসর যাবত একত্রে বসবাস করে মূল ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে পড়েছিল এবং হয়ে পড়েছিল ভারতীয়। অধিকন্তু এই ভারতীয় মুসলমানগণ হিন্দুদের বর্ণপ্রথা অবলম্বন করে- অতীতের যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধ্যে তাদের শক্তি নিহিত ছিল –তার প্রতি চরম আঘাত হানে। ফলে উনবিংশ শতাব্দীতে তারা বহু ভাগে বিভক্ত, ছিন্নভিন্ন ও অধঃপতিত জাতি হিসাবে চিত্রিত হয়, যার সংশোধনের কোন উপায় থাকে না। তাই স্যার মুহাম্মদ ইকবালের এ উক্তিতে বিস্ময়ের কিছু নেইঃ
নিশ্চিতরূপে আমরা হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে গেছি। আমরা দ্বিগুণ বর্ণপ্রথার রোগে আক্রান্ত –ধর্মীয় বর্ণপ্রথা, ফের্কা-উপফের্কা এবং সামাজিক বর্ণপ্রথা, যা আমরা শিক্ষা করেছি, অথবা হিন্দুদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। যেসব নীরব পন্থায় বিজিতাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকে, এ হলো তার একটি”।
এ এক অনস্বীকার্য সত্য যে, বাংলা তথা ভারতের হিন্দুজাতি মুসলিম শাসন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা মুসলিম সংহতি সমূলে ধ্বংস করার জন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নীরবে কাজ করে গেছে। তাদের প্রচেষ্টায় তারা পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। মুসলমানদেরকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে ও তাদের তাহজিব তামাদ্দুনে পৌত্তলিকতার কলুষ কালিমা লেপন করেছে। তাদেরকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত না করে হিন্দু ভাবাপন্ন মুসলমান বানিয়ে তাদের দ্বারা হিন্দুস্বার্থ চরিতার্থ করা যে অতিসহজ –এ তত্বজ্ঞান তাদের ভালো করেই জানা ছিল এবং এ কাএজ তারা সাফল্য অর্জণ করেছে পুরাপুরি।

মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা
বাংলার মুসলমানদের অধঃপতন কোন কোন পথে নেমে এসেছিল এবং রংগমঞ্চের অন্তরাল থেকে কোন অশুভ শক্তি ইন্ধন যোগাচ্ছিল, তা সম্যক উপলব্ধি করতে হলে আমাদের জানতে হবে তৎকালে তাদের ধর্মবিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতি কতখানি বিকৃত হয়ে পড়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে বাংলার মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাস, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলার শাসনকর্তা আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময় থেকে। হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলনের ধারক ও বাহকদের দ্বারা পরিপূর্ণ ও পরিবেষ্টিত মন্ত্রীসভার দ্বারা পরিচালিত হোসেন শাহ শ্রীচৈতন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণের বর্ণিত এ কথা সত্য হলে অতঃপর হোসেন শাহের তৌহিদের প্রতি বিশ্বাস কতটুকু ছিল তা সহজেই অনুমেয়। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষ্ণববাদের প্রবল প্লাবন বাংলার মানক সমাজকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানকে সহজেই আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করেছিল হিন্দু তান্ত্রিকদের অপরাধমূলক অশ্লীল ও জঘন্য সাধন পদ্ধতি, বামাচারীদের পঞ্চতত্ত্ব অর্থাৎ যৌনধর্মী নোংরা আচার অনুষ্ঠান, বৈষ্ণবদের প্রেমলীলা প্রভৃতি। এসব আচার অনুষ্ঠান ও প্রেমলীলা হিন্দু সমাজের পবিত্রতা, রুচিবোধ ও নৈতিক অনুভূতি বহুলাংশে বিনষ্ট করলেও নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভংগের এ অস্ত্র ধর্মবিশ্বাসে ঘুণ ধরিয়েছিল এ সময়ের মুসলিম নামধারী কবি-সাহিত্যিকগণ যাদের কাষ্ঠপুত্তলিকা হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, বাংলা ভাষার উন্নয়নের নামে প্রকৃতপক্ষে হিন্দু রেনেসাঁ আন্দোলনের ধ্বজাবাহীগণ। দ্বিতীয় যুগের হিন্দু কবিগণকে আর্দশ হিসাবে গ্রহণ করে এসব মুসলিম কবিগণ হিন্দু দেব-দেবীর স্তূতিমূলক কবিতা, পদাবলী ও সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়। তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রণয়লীলা, যৌন আবেদনমূলক কীর্তন, মনসার ভাসান সংগীত, দুর্গা ও গঙ্গার স্তোত্র ও হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনের বহু পুঁথিপুস্তক রচনা করে।
শেখ ফয়যুল্লাহ ‘গোরক্ষ বিজয়’ নামক একখানি মহাকাব্য রচনা করে বাংলার নাথ সম্প্রদায় ও কোলকাতা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠাতা গোরক্ষ নাথ ও তার নাথ অনুরক্ত হয়ে সংস্কৃত ভাষায় গঙ্গাস্তোত্র রচনা করে- (বঙ্গভাষা ও সাহিত্যঃ দীনেশ চন্দ্র সেন)। অনুরূপভাবে আবদুস শুকুর ও সৈয়দ সুলতান শৈব ও তান্ত্রিক মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে সাহিত্য রচনা করে। (গোলাম রসূল কর্তৃক প্রকাশিত শুকুর মাহমুদের পাঁচালি দ্রষ্টব্য)।
কবি আলাউল ও মীর্জা হাফেজ যথাক্রমে শিব ও কালীর স্তবস্তুতি বর্ণনা করে কবিতা রচনা করে (বঙ্গভাষা ও সাহিত্যঃ দীণেশ চন্দ্র সেন)। সৈয়দ সুলতান নবী বংশের তালিকায় ব্রক্ষ্ম, বিষ্ণু, শিব এবং কৃষ্ণকে সন্নিবেশিত করে- (ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমানঃ এ আর মল্লিক)। হোসেন শাহের আমলে সত্য নারায়ণকে সত্যপীর নাম দিয়ে মুসলমানগণ পূঝা শুরু করে। পূর্বে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরোক্ত কবি-সাহিত্যিকগণের ধর্মমত ও জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে কিছু জানবার উপায় নেই। সাহিত্যক্ষেত্রে শুধু তাদের নাম পাওয়া যায়। হয়তো তারা ধর্মান্তরিত মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে মাত্র এবং পরিপূর্ণ হিন্দু পরিবেশে তাদের জীবন গড়ে উঠেছে। অথবা মুসলমান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে হরিদাসের ন্যায় মুরতাদ হয়ে গেছে। তবে তাদের কবিতা সাহিত্য পাঁচালি সংগীত প্রভৃতি তৎকালীন মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
পরবর্তীকালে ইসলাম-বৈরীগণ বাদশাহ আকবরকে তাদের অভীষ্ট সাধনে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। জয়পুরের রাজা বিহারীমলের সুন্দরী রূপসী কন্যা যোধবাই আকবরের মহিষী হিসাবে মোগল হারেমের শোভাবর্ধণ করে। আকবরের একাধিক হিন্দু পত্নী ছিল বলে জানা যায়। তৎকালে হিন্দু রাজাগণ আকবরের কাছে তাদের কন্যা সম্প্রদান করে তাঁকে তাঁদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এসব হিন্দু পত্নীগণকে রাজপ্রাসাদের মধ্যে মূর্তিপূজা ও যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়। মুসলমান মোগল বাদশাহের শাহী মহল মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজার মন্দিরে পরিণত হয়। এভাবে আকবরের উপরে শুধু হিন্দু মহিষীগণই নয়, হিন্দু ধর্মেরও বিরাট প্রভাব পড়েছিল। এসব মহিষীর গর্ভে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করে এহেন পরিবেশে জ্ঞানচক্ষু খুলেছে, পালিত-বর্ধিত হয়েছে, তাদের মনমানসিকতার উপরে পৌত্তলিকতার প্রত্যক্ষ প্রভাব কতখানি ছিল তা অনুমান করা কঠিন নয়। এর স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবে আমরা দেখতে পাই, হিন্দু মহিষীর গর্ভজাত সম্রাট জাহাঙ্গীর দেওয়ালী পূজা করতেন এবং শিবরাত্রিতে ব্রাক্ষ্মণ পন্ডিত ও যোগীদেরকে তাঁর সাথে একত্রে নৈশভোজে নিমন্ত্রিত করতেন। তাঁর শাসনের অষ্টম বৎসরে আকবরের সমাধি সৌধ সেকেন্দ্রায় হিন্দু মতানুসারে পিতার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালন করেন।
শাহজাহান পুত্র দারা শিকোহ তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘মাজমাউল বাহরাইনে’ হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাবে আলীবর্দী খানের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহামত জংগে এবং সাওলান জং মতিঝিল রাজপ্রাসাদে সাতদিন ধরে হোলিপূজার অনুষ্ঠান পালন করেন। এ অনুষ্ঠানে আবির ও কুমকুম স্তূপীকৃত করা হয়। মীর জাফরও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ হোলির অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। কথিত আছে যে, মীর জাফর মৃত্যুকালে কীরিটেশ্বরী দেবীর পদোদক (মূর্তি ধোয়া পানি) পান করেন। (‘ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমান’ : এ আর মল্লিক; ‘মুসলেম বংগের সামাজকি ইতিহাস’ : মওলানা আকরাম খাঁ)
হোলি বলতে গেলে শ্রকৃষ্ণের দোল উৎসর। শ্রীকৃষ্ণের অবতার শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণববাদ প্রতিষ্ঠিতক করেন। তাদের পূজা অনুষ্ঠানের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের দোলউৎসব অন্যতম। অতএব বৈষ্ণববাদের প্রভাব যে মুসলিম সমাজের মূলে তখন প্রবেশ করেছিল, উপরের বর্ণনায় তা স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়।
মুসলিম সমাজের এহেন ধর্মীয় অধঃপতনের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, মুসলিম সমাজে পৌত্তলিক ভাবধারা অনুপ্রবেশের প্রধানতম কারণ হলো ভারতীয় নও-মুসলিমদের পৌত্তলিক থেকে অর্ধমুসলমান (Half-Conversion) হওয়া। অর্থাৎ একজন পৌত্তলিক ইসলামকে না বুঝেই মুসলমান হয়। অতঃপর তার কোন ইসলামী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি। হয়নি তার চিন্তাধারার পরিশুদ্ধি। পৌত্তলিকতার অসারতা ও তার বিপরীত ইসলামের সত্যতা ও সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভের সুযোগ তার হয়নি। ইসলামী পরিবেশের মদ্যে জীবনযাপন করে আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ও মনমানসিকতার পরিবর্তন ও সংমোধন হয়নি। তাই এ ধরনের মুসলমান হিন্দুর দুর্গোৎসবের অনুকরণে শবে বরাতে আলোকসজ্জা ও বাজীপোড়ানো প্রভৃতির মাধ্যমে হয়তো কিছুটা আনন্দ লাভের চেষ্ট করে। আকবর, জাহাঙ্গীর ও বাংলার পরবর্তী শাসকগণ প্রকাশ্যে হিন্দু পূজার অনুষ্ঠানে যোগদান করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
ঐতিহাসিক এম. গ্রাসিন ডি ট্যাসিন বলেন, মহররমের তাজিয়া অবিকল হিন্দু দুর্গাপুজার অনুকরণ। দুর্গোৎসব যেমন দশ দিন ধরে চলে এবং শেষ দিন ঢাক-ঢোল বাদ্যবাজনাসহ পূজারিগণ প্রতিমাসহ মিছিল করতঃ তাকে নদী অথবা পুকুরে বিসর্জন দেয়, মুসলমানগণও অনুরূপভাবে দশ দিন ধরে মহররমের উৎসব পালন করে। মেষ দিন দুর্গা বিসর্জনের ন্যায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মিছিল করে তাজিয়া পানিতে বিসর্জন দেয়া হয়।
ডাঃ জেমস ওয়াইজ মহররম উৎসবকে হিন্দুদের রথযাত্রা উৎসবের অনুরূপ বলে বর্ণনা করেছেন। মিসেস এইচ আলী বলেন, দীর্ঘনিদ হিন্দুনের সংস্পর্শে থেকে মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলিকে হিন্দুদের অনুকরণে মিছিলের আকারে বাহ্যিক জাঁক-জমকপূর্ণ করে তুলেছে। ইউরোপীয়দের ন্যায় বিদেশী মুসলমানগণ বাংলার মুসলমানদের এ ধরনের ধর্মীয় উৎসবাদিকে ইসলামের বিকৃতকরণ ও অপবিত্রকরণ মনে করেছেন। (বৃটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমানঃ এ আর মল্লিক)।
ইসলাম ও মুসলমানদের এহেন পতন যুদে পীরপূজা ও কবরপূজার ব্যাধি মুসলমান সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক এম টি টিটাসের মতে এ কুসংস্কার আফগানিস্তান, পারস্য ও ইরাক থেকে আমদানী করা হয়। হিন্দুদের প্রাচীন গুরু-চেলা পদ্ধতি এবং স্থানীয় বহু দেব-দেবীর পূজায় তাদের অদম্য বিশ্বাস মুসলিম সমাজকে এ কুসংস্কারে লিপ্ত হতে প্রেরণা যোগায়। তিনি বলেন, ইসলামের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান অপেক্ষা বহুগুণ উৎসাহ উদ্যম সহকারে তারা পীরপূজা করে। অতীতে যে সকল অলীদরবেশ ইসলামের মহান বাণী প্রচার করে গেছেন, পরবর্তীকালে অজ্ঞ মুসলমান তাঁদেরই কবরের পূজার কেন্দ্র বানিয়েছে।
একমাত্র বাংলায় যেসব অলীদরবেশের কবরে মুসলমানগণ তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য ফুলশির্ণি ও নজর-নিয়াজ দিত, তার সংখ্যা ডাঃ জেমস ওয়াইজ নিম্নরূপ বলেনঃ
সিলেটের শাহ জালাল, পাঁচ পীর, মুন্নাশাহ দরবেশ, সোনার গাঁয়ের খোন্দকার মুহাম্মদ ইউসূফ, মীরপুরের শাহ আলী বাগদাদী, চট্টগ্রামের পীর বদর, ঢাকার শাহ জালাল এবং বিক্রমপুরের আদম শহীদ। চট্টগ্রামে বায়েজিদ বুস্তামীর দরগাহ বলে কথিত, হয়তো একেবারে কল্পিত একটি দরগাহ আছে তা সম্ভবতঃ ডাঃ জেমস ওয়াইজের পরবর্তীকালে আবিস্কৃত হয়েছে।
বাংলা বিহারে এ ধরনের বহু দরগার উল্লেখ –ব্লকম্যানের গ্রন্থে আছে।
সোনার গাঁয়ের হিন্দু মুসলমান উভয়ে পূজাপার্বণ করতো বলে কথিত আছে। কৃষক ভালো ধান্য-ফসল লাভ করতে কয়েক আঁটি ধান দরগায় দিয়ে আসতো। সকল প্রকার ব্যাধি ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে দরগায় চাউল ও বাতাস দেয়া হতো।
ঢাকা শহরের পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে একটি দরগায় কালো রঙ্গের একটি প্রস্তর রাখা ছিল যাকে বলা হতো কদম রসূল (নবীর (সা) পদচিহ্ন)। অদ্যাবধি তা বিদ্যমান আছে বলে বলা হয়। ডাঃ জেমস ওয়াইজ বলেন, গয়ার ব্রাক্ষ্মণগণ তীর্থযাত্রীদেরকে বিষ্ণুপদ (বিষ্ণুর পদচিহ্ন) দেখিয়ে প্রচুর অর্থ রোজগার করে। অনুরূপভাবে দরগার মুতাওয়াল্লী গ্রামের অজ্ঞ ও বিশ্বাসপ্রবণ লোকদেরকে কদমরসূল দেখিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে।
আজমীরে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহ) মাজারের গিলাফ সরিয়ে বেহেশতের দরজা (?) দেখিয়ে মাজারের দালালগণ জিয়ারতকারীদের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ রোজগার করে।
এ ধরনের অসংখ্য অগণিত কবর ও দরগাহ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা পরিপূর্ণ করে দেয় এক শ্রেণীর ভণ্ড পীর-ফকীরের দল। এমনকি ধর্মের নামে তারা বৈষ্ণব ও বামাচারী তান্ত্রিকদের অনুকরণে যৌন অনাচারের আমদানীও করে। মুসলমান নামে তারা যে মত ও পথ অবলম্বন করে তার উৎস যেহেতু বাংলার বৈষ্ণববাদ, সেজন্যে বৈষ্ণবদের আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ এখানে প্রয়োজন মনে করি। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর গ্রন্থ থেকে কিঞ্চিৎ পাঠকগণকে পরিবেশন করছি।
“চৈতন্যদেব হইতেছেন বাংলার বৈষ্ণবদের চৈতন্য সম্প্রদায়ের পূজিত দেবতা। হিন্দুদের সাধঅরণ বিশ্বাস অনুযায়ী চৈতন্য শ্রীকৃষ্ণের একজন অবতার অথবা পরিপূর্ণ অর্থেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। এই কারণেই তাঁহার ভক্তগণ, তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার সত্তা হইতে মানুষ চৈতন্যকে বাদ দিয়া তাঁকাকে সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণচৈতন্যে উন্নীত করে এবং অতি মারাত্মকভাবে কৃষ্ণের প্রেমলীলার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে। ধর্মের নামে নেড়া-নেড়ী তথা মুন্ডিত কেশ বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের মধ্যে যে জঘন্য যৌন অনাচারের শ্রোত বহিয়া চলে, তাহা পুরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের যৌন আবেগমূলক প্রণয়লীলার পুনরাবৃত্তি বা প্রতিরূপ ব্যতীত কিছুই নহে।
তান্ত্রিক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দিতেছেন যে, কলিকালে (বর্তমান যুগে) মদ্যপান শুধু সিদ্ধই নহে বরং মদ্যপারেন রীতি প্রচলিত ছিল, তেমনি এই কলি যুগেও বর্ণধর্ম নির্বিশেষে তোমরা ইহা পান করিবে- (মহানির্বাণতন্ত্র, ৪র্থ উল্লাস, ৫৬ শৎ শ্লোক)”।
‘মহাদেব গোরীকে বলিতেছেনঃ পাথবে বীজ বপন করিলে তাহার অংকুরিত হওয়া যেমন অসম্ভব, পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত পূজা উপাসনাও তেমনি নিষ্ফল। অধিকন্তু পঞ্চতত্ত্ব ব্যতীত পূজা উপাসনা করিলে পূজারীকে নানা বিপদ আপদ ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হইতে হয়- (মহানির্বাণতন্ত্র, ৫ম উল্লাস, ২৩-২৪ শ্লোক)’।
মহাদেবের নিজমুখে এ পঞ্চতত্ত্ব রহস্যের ব্যাখ্যা শ্রবণ করিতে আমরা পাঠকগণকে আমন্ত্রণ জানাইতেছিঃ
‘হে আদ্যে, শক্তিপূজা পদ্ধতিতে অপরিহার্য্য করণীয় হিসেবে মদ্যপান মাংস, মৎস্য ও মুদ্রাভক্ষণ এবং সংগরেম নির্দেশ দেয়া যাইতেছে’।
(মদ্যং মাংসর ততো মৎস্যং মৈথুনে মেরচ শক্তিপূজা বিবাবাদ্যে পঞ্চতত্ত্বং প্রকৃতিতম –মহানির্বাণতন্ত্র, ৫ম উল্লাস, ২২ শ্লোক)।
“আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ বামাচারী তান্ত্রিকদের এই পূজা পদ্ধতি সম্পর্কে লিখিতেছেনঃ বামাচারীগণ বেদবিরুদ্ধ এই সকল মহা অধর্মের কার্যকে পরম ধর্মরূপে গ্রহণ করিয়াছে। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও যৌন সংগমের এক বিস্বাদ মিশ্রণকে তাহারা বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করে। পঞ্চতত্ত্ব অর্থাৎ যৌন সংগমের ব্যাপারে প্রত্যেক পুরুষ নিজেকে শিব ও প্রত্যেক নারীকে পার্বথী কল্পনা করিয়া… মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবেই সংগমে লিপ্ত হইতে পারে। ঋতুবতী স্ত্রীলোকের সহিত সংগম শাস্ত্রে নিষিদ্ধ আছে। কিন্তু বামাচারীগণ তাহাদিগকে অর্থাৎ রজস্বলা স্ত্রীলোকদিগকে অতি পবিত্র জ্ঞান করেন।
“বামাচারীদের শাস্ত্র রুদ্রমংগলতন্ত্রে বলা হইয়াছেঃ রজস্বলার সহিত সংগম পুকুরে স্নাসতুল্য, চন্ডালী সংগম কাশীযাত্রার তুল্য, চর্মকারিনীর সহিত সংগম প্রয়াগে স্নানের তুল্য, রজকী সংগম মথুরা যাত্রার তুল্য এবং ব্যাধ কন্যার সহিত সংগম অযোধ্যা তীর্থ পর্যটনের তুল্য”।
“যখন বামাচারীরা ভৈরবী চক্রে (নির্বিচারে অবাধে যৌনসম্ভোগের জন্য মিলিত নরনারীদের একটি চক্র) মিলিত হয়, তখন ব্রাক্ষ্মণ-চন্ডালের কোন ভেদ থাকেনা। একদল নরনারী অন্যলোকের অগম্য একটি নির্জনস্থানে মিলিত হইয়া ভৈরবীচত্র নামে একটি চক্র রচনা করিয়া উপবেশন করে অথবা দন্ডায়মান হয়। এই কামুকদের সকল পুরুষ একজন স্ত্রীলোককে বাছিয়া লইয়া তাহাকে বিবস্ত্র করিয়া তাহার পূজা করে। অনুরূপ সকল নারী একজন পুরুষকে বাছিয়া বাহির করে এবং তাহাকে উলংগ করিয়া পূজা করে। পূজাপর্ব শেষ হওয়ার পর শুরু হয় উদ্দাম মদ্যপানের পালা। মদ্যপারেন ফলে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পাইলে পরিধানের সকল বস্ত্র ছুড়িয়া ফেলিয়া তাহারা সম্পূর্ণ উলংগ হইয়া পড়ে এবং যাহাকে যাহার ইচ্ছা তাহার সহিত এবং যতজনের সংগে সম্ভব ততজনের অবাধ যৌন সংগমে মাতিয়া উঠে –যৌন সংগী যদি মাতা, ভগ্নি অথবা কন্যাও হয় তাহাতেও তাহাদের কিছু যায় আসেনা। বামাচারীদের তন্ত্রশাস্ত্রে এইরূপ বিধান করা হইয়াছে যে, একমাত্র মাতা ব্যতীত যৌন সংগম হইতে অবশ্যই অন্য কোন নারীকে বাদ দিবেনা এবং কন্যা হউক অথবা ভগ্নি হউক আর সকল নারীর সংগেই যৌন কার্য করিবে। (জ্ঞান সংকলনীতন্ত্রঃ মাতৃং যোনিং পরিত্যাজ্য বিহারেং সর্বষোনীষু)। -এসব বৈষ্ণবতান্ত্রিক বামাচারীদের আরও এত জঘন্য অশ্লীল ক্রিয়াকলাপ আছে যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়”। -(মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস, মওলানা আকরাম খাঁ)।
উপরে বর্ণিত জঘন্য ও নোংরা পরিবেশের প্রভাবে বাংলার তৎকালীন মুসলিম সমাজ ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতন এবং সামাজিক ও তামাদ্দুনিক বিশৃংখলার এক অতি শোচনীয় স্তরে নেমে আসে। এ অধঃপতনের চিত্র পাঠন সমাজে পরিস্ফুট করে তুলে ধরতে হলে এখানে মুসলমান নামধারী মারফতী বা নেড়ার পীর-ফকীরদের সাধন পদ্ধতির উল্লেখ প্রয়োজন। এ ভন্ড ফকীরের দল বিভিন্ন সম্পদ্রায় ও উপসম্পদ্রায়ে বিভক্ত ছিল। যথা আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুলি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।
এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। মদ্য পান, নারীপুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্পদায়েরই সাধনপদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল। তবে বাউলগণ উপরে বর্ণিত তান্ত্রিক বামাচারীদের ন্যায় যৌনসংগমকে যৌনপূজা বা প্রকৃত পূজা রূপে জ্ঞান করে। তাদের এ যৌনপূজার মধ্যে ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ নামে একটি অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। একে তারা একটি অনিবার্য পবিত্র মনে করে। তাদের মতে মানুষ এ চাচিচন্দ্র বা মানব দেহের নির্যাস যথা রক্ত, বীর্য, মল ও মুত্র পিতার অন্ডকোষ ও মাতার গর্ভ থেকে লাভ করে থাকে। অতএব এ চারিচন্দ্র সাধনের সাথে ‘পঞ্চরস সাধন’ও করে থাকে। পঞ্চরস হচ্ছে তাদের ভাষায় কালো সাদা লাল হলুদ ও মুর্শিদবাক্য। এ চারবর্ণ যথাক্রমে মদ, বীর্য, রজঃ ও মলের অর্থজ্ঞাপক। আপন স্ত্রী অথবা পরস্ত্রীর সাথে সংগমের পর তারা মুর্শিববাক্য পালনে এ চারবর্ণের পদার্থ ভক্ষণ করে থাকে।
শ্রদ্ধেয় মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর উপরে বর্ণিত গ্রন্থে এসব বাউলদের সম্পর্কে বলেনঃ
“কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মূলতত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাওসার’ বলিতে তারা বেহেশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুশ্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এ ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করেন –এই অর্থে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে।
“এই মুসলিম ভিক্ষোপবীজী নেড়ার ফকীরর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। যখন পীর তাহার মুরীদানের বাড়ী তশরীফ আনে, তখন গ্রামের সকল যুবতী ও কুমার উত্তম বসনে সজ্জিত হইয়া, বৃন্দাবনের গোপিনীদের অনুকরণে একটি গৃহকক্ষে পীরের সহিত মিলিত হয়। নাটকের প্রথম অংকে এই সকল স্ত্রীলোক নৃত্যগীত শুরু করে। নিম্নে এই সখীসংগীতের গদ্যরূপ প্রদত্ত হইলঃ
ও দিদি যদি শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসিতে চাও,
আর আত্মপ্রতারণা না করিয়া শীঘ্র আস,
আঁখি তোল, তাহার প্রতি তাকাও
গুরু আসিয়াছে তোমাদের উদ্ধারের জণ্য
এমন গুরুত আর কোথাও পাইবে না।
হ্যাঁ, গুরুর যাহাতে সুখ
তাহা করিতে লজ্জা করিও না-।
‘গানটি গীত হইলে পর এ সমস্ত নারী তাহাদের গাত্রাবরণ খুলিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণ উলংগ হইয়া পড়ে এবং ঘুরিয়া ঘুরিয়া আনন্দে নৃত্য করিতে থাকে। পীর এখানে কৃষ্ণের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং শ্রীকৃষ্ণ যেমন গোপিনীদের বস্ত্র হরণ করিয়া বৃক্ষে তুলিয়া লইয়া গৃহের একটি উচুঁ তাকে রক্ষা করে। এই পীর কৃষ্ণের যেহেতু বাঁশী নাই, তাই সে নিম্নোক্তভাবে মুখে গান গাহিয়াই এইসব উলংগ রমনীগিগকে যৌনভাবে উত্তেজিত করিয়া তোলেঃ
‘হে যুবতীগণ। তোমাদের মোক্ষের পথ ভক্তকুলের পুরোহিতকে অর্ঘস্বরূপ দেহদান কর’।
কোনরূপ সংকোচ বোধ না করিয়া পীরের যৌন লালসা পরিতৃপ্ত করাই ইহাদের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য, তাহা বলাই বাহুল্য”। (মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস)।
যৌনক্রিয়া, আনন্দদায়ক ও সুখকর বস্তু সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষ অবৈধ যৌনসংগমে ভীত শংকিত হয়, লজ্জাসংকোচ অনুভব করে –পাপের ভয়ে, ধর্মের ভয়ে। কিন্তু ধর্ম স্বয়ং যদি ঘোষণা করে যে, এ কাজ পাপের নয়, পুণ্যের এবং এতেই মোক্ষলাভ হয়ে তাকে, তাহলে মানুষ এ পথে আকৃষ্ট হবে না কেন? একশ্রেণীর লম্পট পাপাচারী লোক ধর্মের নামে এভাবে অজ্ঞমূর্খ মানুষকে ফাঁদে ফেলে প্রতারিত ও বিপথগামী করেছে।
উপরে বর্ণিত ভন্ড পীর-ফকীর দলের আরও বহু অপকীর্তি ও অশ্লীল ক্রিয়াকান্ড আছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উপরে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো। এর থেকে তৎকালীন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও নৈতিক অধঃপতন পাঠকবর্গ উপলব্ধি করতে পারবেন সন্দেহ নেই। যদিও গোটা মুসলিম সমাজের অধঃপতন এতটা হয়েছিল না, কিন্তু সমাজে পৌত্তলিক ও বৈষ্ণব মতবাদের প্রবল বন্যা যে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে ভাসিয়ে নিয়ে তাদের সাথে একাকার করে দিচ্ছিল, তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মুসলিম সমাজের ছিল না। কারণ, তৎকালীন মুসলিম শাসকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছিল পৌত্তলিকতাবাদ ও বৈষ্ণববাদের প্রতি। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ-প্রাচীর গড়ে তুলেছিল সাইয়েদ আহমদ শহীদের (রহ) ইসলামী আন্দোলন, ইতিহাসে যার ভ্রান্ত নাম দেয়অ হয়েছে ‘ওহাবী আন্দোলণ’। যথাস্থানে সে আলোচনা আসবে। সাইয়েদ তিতুমীর এবং হাজী শরিয়তুল্লাহও ওসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তথাপি ওসব গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার বিষক্রিয়া বিংশতি শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত মুসলিশ সমাজের একটা অংশকে জর্জরিত করে রেখেছিল। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় ঈসায়ী ১৯১১ সালের আদমশুমারীর রিপোর্টে বলা হয় যে, লোক গণনার সময় এমন কিছু সম্প্রদায়ের দেখা পাওয়া গেছে, যারা নিজেরা স্বীকারোক্তি করেছে যে, তারা হিন্দুও নয় এবং মুসলমানও নয়। বরঞ্চ উভয়ের সংমিশ্রণ। (Census of India Report, 1911 A.D.)
কিন্তু কিছু সংখ্যক মুসলমানের পৌত্তলিক ভাবধারার রস এখনো সঞ্জীবিত রেখেছে বাংলা ভাষার কতিপয় বৈষ্ণববাদ ভক্ত ও পৌত্তলিক ভাবাপন্ন মুসলিম কবি। ভক্ত কবি লাল মামুদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বৈষ্ণববাদের প্রতি এতটা বিশ্বাসী হয়ে পড়েন যে, একটি বট বৃক্ষমূলে তুলসী বৃক্ষ স্থাপন করে রীতিমত সেবা-পূজা করতে থাকেন। যেদিন গোস্বামীপ্রভু লালুর আশ্রমে উপস্থিত হন, সেদনি নিম্নোক্ত গান গেয়ে প্রভুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
দয়াল হরি কই আমার
আমি পড়েছি ভব কারাগারে, আমায় কে করে উদ্ধার।
শত দোষের দোষী বলে, জন্ম দিলে যবন কুলে
বিফলে গেল দিন আমার।
তারপর আসে কবি লালন শাহের কথা। তাঁর কয়েকটি গান নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ ‘পার কর, চাঁদ গৌর আমায়, বেলা ডুবিল
আমার হেলায় হেলায় অবহেলায় দিনত বয়ে গেল।
আছে ভব নদীর পাড়ি
নিতাই চাঁদ কান্ডারী।
ও চাঁদ গৌর যদি পাই, ও চাঁদ গৌর হে,
কুলে দিয়ে ছাই
ফকীর লালন বলে শ্রীচরণের দাসী হইব’।
উপরে কবি লাল মামুদ আক্ষেপ করে বলেন যে, মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে তাঁর জীবন বিফল হলো। লালন শাহ বলেন, গৌর নিতাইকে পেলে মুসলমানী ত্যাগ করে তাঁর শ্রীচরণের সেবায় রত হবেন।
লালন শাহের কৃষ্ণপ্রেম সম্পর্কীয় গানঃ
কৃষ্ণপ্রেম করব বলে, ঘুরে বেড়াই জনমভরে
সে প্রেম করব বলে ষোলআনা
এক রতির সাধ মিটল নারে।
রাধারাণীর ঋনের দায়
গৌর এসেছে নদিয়ায় বৃন্দাবনের কানাই আর বলাই
নৈদে এসে নাম ধরেছে গৌর আর নিতাই।
মুসলিম সমাজের একশ্রেণীর পৌত্তলিকমনা লোক লালন শাহের মতবাদকে মুসলিম সমাজে সঞ্জীবিত রাখার চেষ্টায় আছে।
মুসলিম সমাজের এহেন অধঃপতনের কারণ বর্ণনা করে ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেনঃ
“পৃথিবীর অন্যঅন্য জাতিসমূহ যেমন বিজিত জাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তেমন ভারতীয় মুসলমানগণও বিজিত হিন্দুজাতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আচার-আচরণ, জীবনের দৃষ্টিভংগী এবং এমনকি বিশ্বাসের দিক দিয়েও এ প্রভাব এখনো সুস্পষ্ট। ইসলাম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বেগ মুসলিম শাসন আমলে চলেছে। বিভিন্ন সময়ে এ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বেগ মুসলিম শাসকদের উদারনীতির ফলে বর্ধিত হয়েছে। তার ফলস্বরূপ উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ভারতে ইসলাম এমন এক রূপ ধারণ করে যার জন্যে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ভারতীয় মুসলমানগণ, বিশেষ করে বাংলা ও বিহারের মুসলমান তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে এমন সব কুফরী আচার-আচরণ অবলম্বন করেছে, তা ছিল অন্যান্য দেশেল মুসলমানদের মধ্যে বিরল। বাংলা-বিহারে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল যেমন বিরাট, তাদের রীতিনীতি ও আচার-আচরণও ছিল তেমনি ধর্মহীন ও নীতি বিগর্হিত”।–(ব্রিটিশ পলিসি ও বাংলার মুসলমান’: এ আর মল্লিক)।
ভারতীয় ইসলামের মধ্যে অনৈসলামিক রীতিপদ্ধতি অনুপ্রবেশের কারণ হচ্ছে এই যে, অমুসলমানদের ধর্মান্তরগ্রহণ ছিল অপূর্ণ”। (‘ভারতের ইতিহাস’-ইলিয়ট ও ডাউসন) ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থঅর এক চিত্র উপরে বর্ণনা করা হলো। তৌহিদের অনুসারী মুসলমান যখন এমনি বিকৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ এবং তখন ভিতর ও বাইন থেকে যে বিরুদ্ধ শক্তি তাদেরকে পরাভূত ও নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়, সে আক্রমণ প্রতিহত করার কোন প্রাণশক্তি তখন বিদ্যমান ছিল না। যাদের মাত্র সতেরো জন এককালে বাংলার উপরে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল, কয়েক শতাব্দী পরে তাদের লক্ষ লক্ষ জন মিলেও সে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা রক্ষা করতে পারলো না।

বাংলার পতনের রাজনৈতিক কারণ
অষ্টাদশ শতাব্দীর পঞ্চম দশকে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয় ও বাংলার পতন কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার ফল নয়। যেসব রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের ফল স্বরূপ পলাশীর বিযোগান্ত নাটকের সমাপ্তি ঘটে, তা সত্যানুসন্ধিৎসু পাঠকবর্গের অবশ্য জেনে রাখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে মোগল সাম্রাজ্যের পতন গোটা উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন ডেকে আনে। ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে বাহশাহ আওরংজেরবর মৃত্যুর পর থেকে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত পঞ্চাশ বৎসরে কমপক্ষে সাত জন দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কারো এ যোগ্যতা ছিল না যে পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। অবশ্য কতিপয় অবিবেচক ঐতিহাসিক আওরংজেবকে মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের জন্যে দায়ী করেন। ইতিহাসের পুংখানুপুংখ যাচাই-পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ধ্বংসের বীজ বহু পূর্বেই স্বয়ং বাদশাহ আকবর কর্তৃক বপন করা হয়েছিল এবং তা ধীরে ধীরে একটি বিরাট বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করছিল। আওরংজেব সারাজীবন ব্যাপী তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে সে ধ্বংসকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ যদি তাঁর মতো শক্তিশারী ও বিচক্ষণ হতেন –তাহলে সম্ভবতঃ ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো। শ্রদ্ধেয় আকরাম খাঁ তাঁর ‘মুসলেম বংগের সামাজিক ইতিহাস’ গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ
“আকবরের রাজত্বকালের সকল অপকর্মের পরিণাম ভোগ তাঁহার মৃত্যুর সাথেই শেষ হইয়া যায় নাই। মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাঁহার সকল উত্তরাধিকারীকে জীবনের যথাসর্বস্ব দিয়া এই অপকর্মের ফল ভোগ করিতে হইয়াছিল। ভারদের দশ কোটি মুসলমান আজ পর্যন্ত আকবরের অপকর্মের দরুন ক্ষতিপূরণের অবশিষ্ট উত্তরাধিকার দায়িত্ব হইতে অব্যাহতি পায় নাই। মুসলমান পাঠকদের নিকট এই উত্তরাধিকারের প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত কোন আলোচনার প্রয়োজন আছে বলিয়া আমরা মনে করিনা”।
বলতে গেলে আকবর ছিলেন নিরক্ষর অথবা অতি অল্প শিক্ষিত। পনেরো-ষোল বৎসর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। একটি নিরক্ষর বালক যুবরাজের পক্ষে শত্রু পরিবেষ্টিত দিল্লীর রাজশাসন পরিচালনা কিছুতেই সম্ভব হতো না, যদি অতি বিচক্ষণ ও পারদর্শী বাইরাম খান, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য না করতেন। সৎ সংসর্গ লাভের অভাবে আকবর বিরাট সাম্রাজ্য লাভের পর স্বভাবতঃই ভোগ বিলাস, উচ্ছৃংখলতা ও নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে নিমজ্জিত হন। বাইরাম খান তাঁকে সকল প্রকার চেষ্টা করেও সুপথে আনতে পারেননি। মদ্যপান ও তার স্বাভাবিক আনুষংগিক পাপাচার এবং তাঁর আশাতীত রাজনৈতিক সাফল্য তাঁর চরিত্র গঠন বা সংশোধনের কোন সুযোগই দেয়নি। কিন্তু তার এই ব্যধিগ্রস্থ প্রতিভা তাঁর ভবিষ্যৎ বংশধর বীজ বপন করে গেছে। মুসলমানদের তামাদ্দুনিক ও রাজনৈতিক জীবনের সকল শক্তি নিঃশেষ করে দিয়ে তাদেরকে অপরের রাজনৈতিক ও মানসিক গোলামে পরিণত করে যাচ্ছিল, আকবরের তীক্ষ্ণ অথচ অসুস্থ প্রতিভা তার পূর্ণ সহায়ক হয়েছে। ভারতে তাঁর রাজনৈতিক শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে আকবর হিন্দুদের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েই ক্ষান্ত হননি, বরঞ্চ তাদের মনস্তুষ্টির জন্য ‘দ্বীনে এলাহী’ নামে এক উদ্ভট ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্ম ও তামাদ্দুনকে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আকবরনানায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়।
মজার ব্যাপার এই যে, বিভিন্ন রাজনৈতকি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রয়োজন আকবরের জীবনের বৃহত্তম স্বপ্নসাধ এই স্বকপোলকল্পিত ‘দ্বীনে এলাহী’ হিন্দু জাতিকে মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। একমাত্র বীরবল ব্যতীত কেউ এ নবধর্মমত গ্রহণে সম্মত হননি। তাঁর দরবারের নবরত্নের মধ্যে অন্যতম রত্নাবলী মানসিংহ ও তোডরমল এ ধর্মমত প্রত্যাখান করেছেন। আকবর কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা জড়িত করে চন্দন চর্চিত দেহে হিন্দু সন্যাসীর বেশে দরবারে উপস্থিত হলে হিন্দুপন্ডিত ও সভাসদগণ ‘দিল্লীশ্বরো’ বা ‘জগতীশ্বরো’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করতেন এবং ভারতে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে তাঁর প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য প্রদর্শন ও শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও তাঁর উদ্ভট ধর্মের প্রতি কণামাত্র আনুগত্য প্রকাশ করেননি। অতএব কোন এক চরম অশুভ শক্তি শুধুমাত্র মুসলমানদের তৌহিদী আকীহাদ বিশ্বাস ও ইসলামী তামাদ্দুন ধ্বংসের জন্যে আকবরের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছে, তা বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই সহজে উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু আকবর তাঁর জীবনের স্বপ্নসাধ বাস্তবায়িত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন।
এ তো গেল তাঁর জীবনের একদিক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও এসেছিল চরম ব্যর্থতা ও নৈরাশ্যের গ্লানি।
আকবর ভারতের তদানীন্তন পাঠানশক্তি তথা দুর্ধর্ষ মুসলিম সামরিক শক্তি ধ্বংস করেছিলেন। এ বিধ্বস্ত সামরিক শক্তির বিকল্প কোন মুসলিম শক্তি গড়ে তোলা তো দূরের কথা, যা অবশিষ্ট ছিল তাও দুর্বল ও নিঃশেষ করে ফেলেন। বাইরাম খান, আহসান খান, মুয়াজ্জাম খান প্রভৃতির হত্যাকান্ডের মধ্যে আকবরের এ ধ্বংসাত্মক নীতির প্রকাশ পাওয়া যায়। এমনকি বহিরাগত বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বিরুদ্ধেও তিনি দমনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। এমনিভাবে শত্রুর ইংগিতে তিনি আপন গৃহ স্বহস্তে আগুন লাগিয়ে ভষ্মীভূত করেন। মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বিপদের সময় কাজে লাগতে পারে এরূপ সকল শক্তি ও প্রতিভাকে ধ্বংস করে দেয়ার ফলে তিনি ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, পাশ্চাত্যের খৃষ্টান জাতিগুলি দ্রুত তাদের রাজনৈতকি ক্ষমতা বিস্তার করে চলেছিল এবং তাদের অশুভ তৎপরতার ঢেউ মোগল সাম্রাজ্যের সীমান্তে এসে আঘাত করছিল। যে ইষলামের ধ্বংস করেছেন। অতএব খৃষ্টানদের রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে অসম্মানকর সন্ধি স্থাপনে এবং তাদের ধর্মের প্রতি সশ্রদ্ধ আনুগত্য করেও মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথ রুদ্ধ করতে পারলেন না।
বৈদেশিক বিধর্মী শক্তির ন্যায় দেশের অভ্যন্তরেও যে হিন্দুশক্তি দ্রুত মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, তাও আকবরের দৃষ্টির অগোচরে ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দিক দিয়ে তিনি হয়ে পড়েছিলেন ভারতের হিন্দুশক্তির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অতএব তাদেরকে তুষ্ট করার বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেন। হিন্দু নারীগণকে মহিষীরূপে শাহীমহলে এনে তথায় মূর্তিপূজা ও অগ্নিপূজার নিয়মিত অনুষ্ঠান করেও মোগল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারলেন না। সর্বশক্তিমান সত্তা পৃথিবী ও আকাশমন্ডলীর খোদাকে পরিত্যাগ করে অন্যান্য বিভিন্ন খোদার আশ্রয়প্রার্থী হয়েও কোন লাভ হলোনা।
ইসলাম ধর্মকে পুরাপুরি পৌত্তলিকতার ছাঁচে ঢেলে এবং হিন্দুধর্ম অক্ষুণ্ণ রেখে ‘দ্বীনে এলাহী’ নামে নতুন এক ধর্মের ছায়াতলে ভারতের হিন্দু মুসলমানকে একজাতি বানাবার হাস্যকর পরিকল্পনাও তাঁর ব্যর্থ হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে তিনি যে মনমানসিকতার সৃষ্টি করে অশুভ উত্তরাধিকার রেখে গেলেন তা শুধু তার সুযোগ্য পুত্র জাহাঙ্গীরই আঁকড়ে ধরেনন বরঞ্চ বিংশতি শতাব্দীর শেষার্ধেও এক শ্রেণীর মুসলমান সে উত্তরাধিকার দ্বারা লালিত পালিত হচ্ছেন।
মুসলিম ধর্মীয়, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক অধঃপতনের এ এক চরম বেদনাদায়ক নিদর্শন সন্দেহ নেই।
জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্য ধ্বংস ত্বরান্বিত করেন। ১৬০৯ খৃষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন কহিন্স আগ্রায় আগমন করলে তাকে রাজকীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। সম্রাট জাহঙ্গীর তাকে ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে গ্রহণ করেন, খেতাব ও বৃত্তিদান করেন। বিবাহ করে ভারতে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করলে শাহী মহলের একজন শ্বেতাংগী তরুণীর বিবাহের প্রস্তাব দেন।
শাহী মহলে খৃষ্টধর্মের এতখানি প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, কয়েকজন শাহজাদা খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং হকিন্সের নেতৃত্বে অন্যান্য খৃষ্টান প্রবাসীদের সাথে পঞ্চাশ জন অশ্বারোহী পরিবেষ্টিত মিছিল সহকারে গীর্জায় গমন করতেন। জাহাঙ্গীর তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুবান্ধবসহ সারারাত্রি শাহী মহলে মদ্যপানে বিভোর হয়ে থাকতেন। মোগল সাম্রাজ্যের সমাধি রচনার কাজ আকবর নিজেই করেছিলে, তা আগেই বলা হয়েছে। অতঃপর তাঁর আদর্শহীন মদ্যপায়ী পুত্র জাহাঙ্গীর, স্যার টমাস রো ও তাঁর উপদেষ্টা ও গুরু সুচতুর কুটনীনিবিদ রেভারেন্ড ই. ফেবী মিলে এ সমাধি রচনার কাজ ত্বরান্বিত করেন। টমাস রো তাদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া মঞ্জুর করে নিতে জাহাঙ্গীরকে সম্মত করেন। সুরাটে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটির দ্বারা ইংরেজগণ শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা লাভেরই সুযোগ পায়নি, বরঞ্চ এ কারখানাটি তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শাহী সনদের শর্ত অনুযায়ী শুধু সুরাটেই নয়, মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও, যথা আগ্রা, আহমদাবাদ ও ব্রুচে ইংরেজদের কারখানা তথা সামরিক ঘাঁটি গড়ে উঠে। এভাবে আকবর নিজেই করেছিলেন, তা আগেই বলা হয়েছে। অতঃপর তাঁর আদর্শহীন আদর্শহীন মদ্যপায়ী পুত্র জাহাঙ্গীর, স্যার টমাস রো ও তাঁর উপদেষ্টা ও গুরু সুচতুর কূটনীতিবিদ রেভারেন্ড ই. ফেবী মিলে এ সমাধি রচনার কাজ ত্বরান্বিত করেন। টমাস রো তাদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া মঞ্জুর করে নিতে জাহাঙ্গীরকে সম্মত করেন। সুরাটে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটি তাদের একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। শাহী সনদের শর্ত অনুযায়ী শুধু সুরাটেই নয়, মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানেও যথা আগ্রা, আহমদাবাদ ও ব্রুচে ইংরেজদের কারখানা তথা সামরিক ঘাঁটি গড়ে উঠে। এভাবে আকবর ও জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে খাল খনন করে দূরদেশ থেকে সর্বগ্রাসী কুম্ভীর আমদানি করেন।
একদিকে বিদেশী শক্তি ইংরেজ ভারতে উড়ে এসে জুড়ে বসলো, অপরদিকে ভারতের হিন্দুশক্তিও প্রবল হয়ে উঠলো। রাজপুত এবং মারাছা শক্তি মোগল সাম্রাজ্যের পরম শত্রু হয়ে দাঁড়ালো। আকবর যে মুসলিম শক্তির ধ্বংস সাধন করেছিলেন, আওরংজেব পাদশাহ গাজী সেই লুপ্ত শক্তির পুনরুদ্ধারের আজীবন সংগ্রাম করেন। মারাঠা ও রাজপুত শক্তি দমনে তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তাঁর পর যদি তাঁর উত্তরাধিকারীগণ শক্তিশালী ও বিচক্ষণ হতেন, তাহলে হয়তো পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা যেতো। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় এই যে, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আরম্ভ করে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত যাঁরাই দিল্লীর সিংহাসন অলংকৃত করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন শাসন কার্য পরিচালনার অযোগ্য, বিলাসী ও অদূরদর্শী।
একথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ মোগল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের জন্যে একমাত্র আওরংজেবকেই দায়ী করেন। বাংলার হোসেন শাহ ও সম্রাট আকবরের উচ্চ প্রশংসায় যতটা তাঁরা পঞ্চমুখ, ততটা আওরংজেবের চরিত্রে কলংক লেপনে তাঁরা ছিলেন সোচ্চার। তাঁকে চরম হিন্দু বিদ্বেষী বলে চিত্রিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাঁর অনুসৃত হিন্দু স্বার্থের পরিপন্থী শাসননীতি এবং বিশেষ করে জিজিয়া প্রথার পুনঃপ্রবর্তন ভারতের হিন্দুজাতিকে মোগলদের শত্রুতা সাধনে বাধ্য করে। কিন্তু এ অভিযোগগুলি নিছক কল্পনাপ্রসূত ও দুরভিসন্ধিমূলক। ইতিহাস থেকে এর কোন প্রমাণ পেশ করা যাবে না। সত্য কথা বলতে গেলে, রাজপুত এবং মারাঠাগণ ভারতের মুসলিম শাসনকে কিছুতেই মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও শত্রুতার মনোভাব লক্ষ্য করে আকবর তাদেরকে তুষ্ট করার জন্যে অতিশয় উদারনীতি অবলস্বন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠাগণ আওবংজেবের চরম বিরোধিতা করেন। তিনি জিজিয়া কর প্রবর্তিত করার এক বৎসর পূর্বে, ১৬৭৯ খৃষ্টাব্দে শিবাজী মৃত্যুবরণ করেন। অতএব জিজিয়া করই হিন্দুজাতির বিরোধিতার কারণ ছিল, একথা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, তৎকালীন ভারতের ইতিহাস যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা সকলেই বলতে গেলে ছিলেন মুসলমান। তাই সে সময়ের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে অধ্যয়নের প্রয়েঅজন হবে বাদাউনী, আকবরনামা, কাফীখান, তারিখে ফেরেশতা, মা’য়াসিলে আলমগীরী প্রভৃতি। কিন্তু ইউরোপীয় খৃষ্টান ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের বহু ঘটনাকে বিকৃত করে পেশ করেছেন। পরবর্তীকালে অর্ধপৃথিবী জুড়ে তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল। সর্বত্র তাঁদের সাম্রাজ্য জুড়ে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রচলিত ছিল ইংরেজী ভাষা। এ ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় মুসলমানদের ইতিহাসের এক বিকৃত ও কল্পিত রূপ তাঁরা তুলে ধরেছেন ইংরেজী ভাষার ইতিহাসের ছাত্রদের সামনে। ভারতে ইংরেজদের দু’শ বছরের শাসনকালে এ বিকৃত ও ভ্রান্ত ইতিহাস ছাত্রদের মসমস্তিষ্কে বদ্ধমূল করে দেয়া হয়েছিল।
এ বিকৃতকরণের কারণও ছিল। বাদশাহ আওরংজেবের কথাই ধরা যাক। বাদশাহ আকবর ও জাহঙ্গীর কর্তৃক ইংরেজদেরকে অন্যায়ভাবে অতিমাত্রায় প্রশ্রয় দানের ফলে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে তারা একটা শক্তি হিসাবে গড়ে উঠছিল। বাদশাহ আওরংজেব তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর আমলে বাংলার মীর জুমলা ও নবাব শায়েস্তা খান বার বার ইংরেজদের ঔদ্ধত্য দমিত ও প্রশমিত করেছেন। ব্যবসায় দুর্নীতি, চোরাচালান, মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রভৃতির কারণে তাদেরকে বার বার শস্তিও দেয়া হয়েছে, তাদের কুঠি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক পর্যায়ে বাদশাহ আওরংগজেব ইউরোপীয়দের সাথে তাদের সকল ব্যবসা নিষিদ্ধ করে এক ফরমান জারী করেন। আকবর যে মুসলিম সামরিক শক্তি ধ্বংস করে মোগল সাম্রাজ্যকে শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন, বাদশাহ আওরংগজেব সেই মুসলিম সামরিক শক্তি পুনর্গঠনে আজীবন চেষ্টা করেন। খৃষ্টান ও হিন্দুজাতির কাছে উপরোক্ত কারণে আওরংগজেব ছিলেন দোষী। তাই তাঁর শাসনকালকে কলংকময় করে চিত্রিত করতে এবং তাঁর নানাবিধ কুৎসা রটনা করতে তাঁরা তৎপর হয়ে উঠেন। অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ স্বার্থ প্রণোদিত হয়ে আলমগীর আওরংগজেবের চরিত্রে যেসব কলংক আরোপ করেছেন, ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদির দ্বারা তার সবটাই খন্ডন করেছেন শিবলী নো’মানী তাঁর “আওরংগজেব আলমগীর পর এক নজর” গ্রন্থে। এ সংক্ষিপ্ত অথট তথ্যবহুল গ্রন্থখানিতে তিনি আওরংগজেবের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলির সমুচিত জবাব দিয়েছেন।
অতএব ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, আওরংগজেবের বিরুদ্ধে আরোপিত অভিযোগের মধ্যে সত্যতার লেশমাত্র নেই। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্যে তাঁকে কণামাত্র দায়ী করা যেতে পারে না। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আকবর কর্তৃক দুর্ধর্ষ মুসলিম সেনাবাহিনীর বিলোপ সাধনের পর ভারতের হিন্দু মারাঠা রাজপুতদের উপর তাঁর নির্ভরশীলতা, বৈদেশিক ও বিধর্মী ইংরেজদের ব্যবসার নামে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়, মুসলিম শাসন উৎখানের জন্যে হিন্দু ও ইংরেজদের মধ্যে অশুভ আঁতাত এবং তার সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধঃপতন প্রভৃতি বাংলা তথা ভারত থেকে মুসলিম শাসনের বিলোপ সাধন করেছিল। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি কিভাবে পলাশী ক্ষেত্রে বাংলা-বিহারের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়ে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন করে।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে তোলার পিছনে বিরাট রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুক্কায়িত ছিল। ব্যবসা বাণিজ্য করতে এসে একটা বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক মোখতার হয়ে পড়া কোন আকষ্মিক বা অলৌকিক ঘটনার ফল নয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ভৌগলিক আবিষ্কারের ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসার পথ উন্মুক্ত হয় এবং ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঔপনিবেশিক ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। ফলে আমেরিকায় স্পেন সাম্রাজ্য, মশলার দ্বীপে ওলন্দাজ সাম্রাজ্য, দক্ষিণ পূর্ভ এশিয়ায় ফরাসী সাম্রাজ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইংলন্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে অগ্রগতির নীতি (Forward Policy) অবলম্বন করে এবং যেসব বাণিজ্যিক এলাকায় তাদের প্রতিনিধিগণ বাস করতো তারা একটা রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হোক এ ছিল তাদের একান্ত বাসনা। ১৬৮২ খৃষ্টাব্দে ইংরেজগণ ওলন্দাজদের নিকটে ইন্দোনেশিয়ায় মার খেয়ে সেখান থেকে পাততাড়ি গুটায়। পর বৎসর (১৬৮৩ খৃঃ) ইংলন্ডের রাজদরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে যে সনদ দান করা হয় তার বলে তারা ভারতের যেকোন শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, সন্ধি করতে অথবা যেকোন চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারতো। দ্বিতীয় জেমস কর্তৃক প্রদত্ত সনদে তাদেরকে অধিকতর ক্ষমতা দান করা হয়। এর ফলে তারা ১৬৮৬ খৃষ্টাব্দে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পরাজয় বরণ করে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্যাপ্টেন হীথের নেতৃত্বে ‘ডিফেন্স’ নামক রণতরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে পাঠানো হয়। হীথ সুতানটি থেকে যুদ্ধের জন্যে অগ্রসর হয়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়। এর ফলে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ কিছুটা দমে গেলেও ভারতে অবস্থানকারী প্রতিনিধিগণ নতুন উৎসাহ উদ্যমে কাজ করে যায়। তাদের দৃষ্টি এবার ফরাসী বণিকদের উপর নিবদ্ধ হয়। ফরাসীদের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র ছিল পন্ডিচেরী এবং তার অধীনে মুসলিপট্টম, কারিকল, মাহে, সুরাট প্রভৃতি স্থানে তাদের কারখানা প্রতিষ্ঠিত ছিল। পক্ষান্তরে ইংরেজদের বাণিজ্যিক হেড কোয়ার্টার ছিল মাদ্রাজে এবং তার অধীনে বোম্বাই ও কলকাতায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা ছিল। এদের মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং শেষ পর্যন্ত তা যুদ্দের আকার ধারণ করে। ফরাসীগণ তাদের মনোনীত ব্যক্তি মুজাফফর জং ও চান্দা সাহেবকে যথাক্রমে হায়দরাবাদ ও কর্ণেটিকের সিংহাসন লাভে সাহায্য করে। ১৭৫১ খৃষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ কর্ণাটকের রাজধানী আরকট দখল করে। এভাবে ইংরেজ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠে।

বাংলায় ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের উচ্চভিলাষ
বাংলার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ইংরেজগণ কোলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ ব্যাপকভাবে চালাতে থাকে। বাংলার নবাব আলীবর্দী খান তখন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং এই দুর্বলতার সুযোগে সুচতুর ইংরেজগণ তাদের দুর্গ নির্মানের কাজ দ্রুততার সাথে করে যাচ্ছিল। আর তাদের এ কাজে সাহস ও উৎসাহ যোগাচ্ছিল বাংলার হিন্দু শেঠ ও বেনিয়া শ্রেণী। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত বাংলায় ইংরেজদের যে ব্যভসা দান বেঁধে উঠেছিল, তার দালাল ও কর্মচারী হিসাবে কাজ ক’রে একশ্রেণীর হিন্দু প্রভূত অর্থশালী ও প্রভাবশালী হয়ে পড়েছিল। উপরন্তু তারা নবাব আমলে রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদেও অধিষ্ঠিত ছিল। সুদী মহাজনী ও ব্যাংক ব্যবসার মাধ্যমেও তারা অর্থনীতি ক্ষেত্রে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা মুসলিম শাসন মনে প্রাণে মেনে নিতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের সাহসও তাদের ছিলনা এবং এটাকে তারা অবস্থার প্রেক্ষিতে সংগতও মনে করতোনা। তাই মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে হলে ইংরেজদের সাহায্য সহযোগীতা ব্যতীত গত্যন্তর ছিলনা। ইংরেজরা এ সুবর্ণ সুযোগ ভালোভাবেই গ্রহণ করে। প্রশাসন ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে হিন্দুদের এতটা প্রভাব হয়ে পড়েছিল যে, তারা হয়ে পড়েছিল বাংলার নবাবদের ভাগ্যবিধাতা (Kingmakers)। ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুর পর তাঁর পৌত্র সরফরাজ খানকে উত্তরাধিকার মনোনিত করা হলে হিন্দু প্রধানগণ বাধা দান করে। কারণ তাঁকে তারা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করতো। তারা সরফরাজ খানের পিতা সুজাউদ্দীনকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর শাসন কালে (১৭২৭-৩৯ খৃঃ) এ সকল হিন্দু শেঠ বেনিয়াগণ প্রকৃতপক্ষে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্ত হয়ে পড়ে। তাদের দলপতি আলম চাঁদ ও জগতশেঠ হয়ে পড়েছিল দেশেল প্রকৃত শাসক (Defactoruler)।
সুজাউদ্দীনের মৃত্যুরপর এ ষড়যন্ত্রকারী দলটি উড়িষ্যার নায়েব নবাব আলীবর্দী খানকে বাংলার সিংহাসন লাভে সাহায্য করে। তাঁর আমলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চরমে পৌঁছে। এ অবস্থার সুযোগে মারাঠাগণ বার বার বাংলার উপর চড়াও করে। বেগতিক দেখে আলীবর্দী খান এসব প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে পড়েন। তিনি তাঁদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। ফলে রায় দুর্লভ রায়, মাহতাব রায়, স্বরূপ চাঁদ, রাজা জানকী রায়, রাজা রাম নারায়ণ, রাজা মানিক চাঁদ প্রভৃতির নেতৃত্বে এ দলটি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। মুর্শিদকুলী খানের পর সম্ভ্রান্ত মুসলিম রাজকর্মচারীর সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে পেতে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে এবং এ সময়ে কার্যতঃ তাদেরকে যবনিকার অন্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। জগনশেঠ-মানিকচাঁদ দলটি শুধু নবাবের অধীনে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করতে পারতো। অতএব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সংগে যোগসাজসে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটাতে পারলেই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিহিংসার বহ্নি নির্বাপিত হয়।
জগৎশেঠ-মানিকচাঁদ চক্রের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দুজাতির দু’টি লক্ষ্য ছিল। একটি রাজনৈতিক –অপরটি অর্থনৈতিক। বাংলার শাসন পরিবর্তণ বা হস্তান্তরের দ্বারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থকরণ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভ। এ দু’টি লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে কোম্পানীর সংগে মৈত্রীবদ্ধ হতে তারা ছিল সদাপ্রস্তুত ও অত্যন্ত আগ্রহশীল।
পক্ষান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও তাদের ব্যবসায় প্রসার ও উন্নতিকল্পে হিন্দুদের কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ ছিল। কারণ তাদের ব্যবস বাণিজ্য হিন্দু দালাল গোমস্তা ও ঠিকাদারদের সাহায্য ব্যতীত কিছুকেই চলতে পারতো না। উপরন্তু ১৭৩৬-৪০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কোলকাতায় তাদের মূলধন বিনিয়োগে ৫২ জন স্থানীয় বণিকদের অংশ ছিল এবং তারা সকলেই হিন্দু। কাশিমবাজারের কারখানা স্থাপনে ২৫ জন হিন্দু বণিকের অংশ ছিল এবং তারা সকলেই হিন্দু। কাশিমবাজারের কারখানা স্থাপনে ২৫ জন হিন্দু বণিকের সাথে ছিল তারা সংশ্লিষ্ট। শুধু ঢাকায় তাদের ১২ জন অংশীদারের মধ্যে দু’জন ছিল মাত্র মুসলমান। (সিরাজউদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী)
কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গের সামরিক ইঞ্জিনিয়ার কর্ণেল স্কটের নিকট লিখিত এক পত্রে চার্লস এফ. নোবল বলেন যে, -হিন্দু রাজাগণ ও অধিবাসীবৃন্দ মুসলিম শাসরে প্রতি ছিল অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ। এ শাসনের অবসান কিভাবে ঘটানো যায় –এ ছিল তাদের গোপন অভিলাষ। ইংরেজদের দ্বারা কোন বিপ্লব সংঘটন সম্ভব হলে তারা তাদের সাথে যোগদান করবে বলে অভিমত প্রকাশ করে।
নোবল বলেন, -“উর্মিচাঁদ আমাদের বিরাট কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি। হিন্দু রাজা ও জমসাধারণের উপর পুরোহিত নিমু গোঁসাই –এর যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিরাট সংখ্যার সশস্ত্র একটি দল তার একান্ত অনুগত। সন্যাসী দলকেও আমরা আমাদের কাজে লাগাতে পারি। নিমু গোঁসাই –এর দ্বারা এ কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস আছে”।
নিমু গোঁসাই কর্ণেল স্কটকে দেশের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর ও পরামর্শ দিত এবং বলতো যে –দরকার হলে ইংরেজদের সাহায্যে সে মাত্র চার দিনের মধ্যে এক হাজার সশস্ত্র লোক হাজির করতে পারবে। (সিরাজদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী, পৃঃ ১১)
মনে রাখতে হবে যে, হিন্দু জাতির পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ফলে বাংলায় সন্যাসী আন্দোলনের নামে গোপনে একটি সশস্ত্র দলগঠন করা হয়েছিল এবং তারাও মুসলিম শাসন অবসানে সহায়ক হয়েছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল কোলকাতায় দুর্গ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করে। অপরদিকে বাংলার নবাবের নিকটে যে জমিদারী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী লাভ করে তার উপরে সার্বভৌম অধিকারও তারা প্রতিষ্ঠিত করে। দেশের আইনে অপরাধীগণ শাস্তি এড়াবার জন্যে কোম্পানীর জমিদারীর অধীনে আশ্রয় লাভ করতে থাকে। এ সকল অপরাধী সকলেই ছিল হিন্দু। চোরাচালানের অপরাধে দোষী রামকৃষ্ণ শেঠ নামক জনৈক ব্যবসায়ীকে কোম্পানী আশ্রয় দান করে এবং নবাবের হাতে তাকে সমর্পণ করার নির্দেশ কোম্পানী অমান্য করে। এমনি নবাবের আরও বহু আইনসম্মত নির্দেশ তারা লংঘন করে। তাছাড়া তারা ব্যবসা সংক্রান্ত বহু চুক্তি লংঘন করে।
ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কুকর্ম ও হীন আচরণ নবাব আলীবর্দীর জানা ছিলনা তা নয়। তবে শয্যাশায়ী মরণোন্মুখ নবাবের কিছু করার ক্ষমতা ছিলনা। তাঁর ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজদ্দৌলা ইংরেজদের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে চেয়েছিলেন বলে তিনি তাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। আলীবর্দীর পর দু’জন বাংলার সিংহাসনের দাবীদার হয়ে পড়েন। আলীবর্দীর বিধবা কন্যা ঘেসেটি বেগম এবং পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জং। ইংরেজগণ ঘেসেটি বেগমের দাবী সমর্থন করে। বেগম ও তার দেওয়ান রাজবল্লভ তাদের যাবতীয় ধসম্পদ নিরাপদে সঞ্চিত করার জন্যে কোলকাতায় কোম্পানীর তত্ত্বাবধানে রাখেন। রাজবল্লভকে কোম্পানীর আশ্রয়ে প্রেরণ করে। কৃষ্ণবল্লভবে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজগণ নবাবের সংগে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং ঘেসেটি বেগমের বিশ হাজার সৈন্যসহ সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্যে উদ্ধুদ্ধ করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করে। এ সবকিছুই জানার পর সিজার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন না করে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হন। কিন্তু তাঁর কোন কতায় কর্ণপাত করতে ইংরেজগণ প্রস্তুত ছিলনা।
জনৈক ইংরেজ কারখানার মালিক William Tooke বলেন যে, প্রাচ্যের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজাভিষেকের পর বিদেশী নাগরিকগণ বিভিন্ন উপঢৌকনাদিসহ নতুন বাদশাহ বা নবারের সাথে সাক্ষাৎ করে থাকে। কিন্তু এই প্রথমবার তারা এ প্রথা লংঘন করে। তিনি আরও বলেন, কৃষ্ণবল্লভকে আশ্রয় দান এবং তাকে নবাবের হাতে সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি এটাই প্রমাণ করে যে, সিরাজদ্দৌলার রাজনৈতিক শত্রুর সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর গভীর যোগসাজস ছিল যার জন্যে তারা এতটা ঔদ্ধত্য দেখাতে সাহস করে। (হিলের ইতিহাস, ১ম খন্ড ও সিরাজউদ্দৌলার পতন –ডঃ মোহর আলী)
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বাংলা সরকারের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের অনুরূপ। সিরাজদ্দৌলা তাদের সাথে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার সকল প্রকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত করেন। তিনি এ ব্যাপারে হুগলীর জনৈক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজেদকে যে পত্র দেন (১লা জুন, ১৭৫৬) তার মর্ম নিম্নরূপঃ
প্রধানতঃ তিনটি কারণে ইংরেজদেরকে এ দেশে আর থাকার অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা। প্রথম কারণ এই যে, তারা দেশের আইন লংঘন ক’রে কোলকাতায় একটি সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেছে। দ্বিতীয়তঃ তারা ব্যবসায় চুক্তি ভংগ করে অসদুপায় অবলম্বন করেছে এবং ব্যবসা-কর ফাঁকি দিয়ে সরকারের প্রভূত আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে। তৃতীয়তঃ একজন সরকারী তহবিল আত্মসাৎকারীকে আশ্রয় দিয়ে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে।
তেসরা জুন সিরাজদ্দৌলা কাশিমবাজারস্থ ইংরেজদের কারখানা দখল করে একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে চাপ দেন। কারখানা দখলের পর তিনি একটা উদারতা প্রদর্শন করেন যে, কারখানাটি তালাবদ্ধ করে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেন যাতে করে তা লুণ্ঠিত হতে না পারে। উইলিয়ম ওয়াটস এবং ম্যাথু কলেট ছিলেন এ কারখানার পরিচালক এবং তাঁরাই উপরোক্ত মন্তব্য করেন- (হিলের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড)
কাশিমবাজার কারখানার সমুদয় কর্মচারীকে সিরাজ মুক্ত করে দেন। শুধুমাত্র ওয়াটস এবং কলেটকে সাথে করে কোলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার পূর্বে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে বার বার পত্র লিখেন। কিন্তু তারা মোটেই কর্ণপান করেনা। বরঞ্চ একটা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার জন্যে তারা সদাপ্রস্তুত থাকে। দাক্ষিণাত্য থেকে সাকরিক সাহায্য লাভের পর তাদের সাহস অনেকখানি বেড়ে যায়। নবাবের কোলকাতা পৌঁছাবার এক সপ্তাহ পূর্বে হুগলী নদীর নিম্নভাবে অবস্থিত থানা দুর্গ এবং হুগলী ও কোলকাতার মধ্যবর্তী সুখ সাগর দখলের জন্যে ড্রেক সৈন্য প্রেরণ করে। নবাব কর্তৃক প্রেরিত অগ্রবর্তী দল উভয়স্থানে ইংরেবদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ১৬ই জুন ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ সিরাজ ফোর্ট উইলিয়ামের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। দু’দিন ধরে যুদ্ধের পর ড্রেক তার মূল সেনাবাহিনীসহ ফলতায় পলায়ক করে। পলায়নের সুবিধার জন্যে হলওয়েলকে যুদ্ধে নিয়োজিত রাখা হয় এবং বলা হয় যে-পরদিন সেও যেন তার মুষ্ঠিমেয় সৈন্যসহ ফলতায় আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু, হলওয়েল নবাবের সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির সামনে উইলিয়াম টুক (William Tokke) যে সাক্ষ্য দান করে তাতে বলা হয় যে, আত্মসমর্পণকারী ইংরেজ সৈন্যদের প্রতি কোন প্রকার দুর্ব্যবহার করা হয়নি। (হিলের ইতিহাস ১ম খন্ড)। রাত্রি বেলায় প্রচুর মদ্যপানের পর কিছু সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করলে তাদেরকে ১৮” ১৪” মাপের একটি কক্ষে আবদ্ধ রাখা হয়। অবাধ্য ও দুর্বিনীত সৈন্যদের আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যেই কক্ষটি তাদেরই দ্বারা নির্মিত হয়েছিল; চল্লিশ থেকে ষাট জনকে এতে আবদ্ধ রাখা হয়। যুদ্ধে অত্যধিক পরিশ্রান্ত হওয়ার কারণে জন বিশেক সৈন্য প্রাণত্যাগ করে। এ ঘটনাকে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত করে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান দেয়া হয়েছে। এ কাল্পনিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বিজয়ী শাসকগণ হলওয়েল মনুমেন্ট নামক একটি স্মৃতিস্তম্ভ কোলকাতায় ডালহাউসি স্কোয়ারে স্থাপন করে। এ স্তম্ভটি নবাব একটি স্মৃতিস্তম্ভ কোলকাতায় ডালহাইসি স্কোয়ারে স্থাপন করে। এ স্তম্ভটি নবাব সিরাজদ্দৌলার কাল্পনিক কলংক-কালিমা বহন করে বিংশতি শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। উদ্দেশ্যমূলক ও নিছক বিদ্বেষাত্মক প্রচারনার উৎস এ স্তম্ভটি তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৯৩৭ সালের পুর্বেই ভেঙে দেয়া হয়।
যাহোক, হলওয়েল এবং অন্য তিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্যান্য সকলের মুক্তি দেয়া হয়। ২৪মে জুন মানিক চাঁদকে কোলকাতার শাসনকার্যে নিয়োজিত করে সিরাজদ্দৌলা হলওয়েল ও তার তিনজন সাথীসহ মুর্শিদাবাদ প্রত্যাবর্তণ করেন। ২৬শে জুন অবশিষ্ট ইংরেজ সৈন্যগণ কোলকাতা থেকে ফলতা গমন করে।
৩০শে জুন সিরাজদ্দৌলা ফোর্ট সেন্টজর্জের গভর্ণর জর্জ পিগটকে পত্র লিখেন। তার মর্ম ছিল এই যে, ইংরেজগণ যদি একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় উপনীত হয় এবং রাজনৈতিক ক্ষমতালাভেল উচ্চাভিলাষ পরিত্যাগ করে ব্যবসার শর্তাবলী মেন চলতে থাকে, তাহলে তাদেরকে বাংলায় ব্যবসায় পূর্ণ ব্যবসার পূর্ণ সুযোগ দেয়া হবে।

ফলতার ইংরেজগণ
সিরাজদ্দৌলা আন্তরিকতার সাথে চেয়েছিলেন ইংরেজদের সংগে একটা ন্যায়সংগত মীমাংসায় উপনীত হতে। কিন্তু তাদের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ফলতার বসে স্থানীয় হিন্দু প্রধানদের সাথে যে ষড়যন্ত্র জাল বিস্তার করা হচ্ছিল তার থেকে তাদের মনোভাব ব্যক্ত হয়।
মাদ্রাজ থেকে যে সামরিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল, রজার ড্রেক তার প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকে। এদিকে নবাবকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ৬ই জুলাই একটা মীমাংসার জন্যে তারা কথাবার্তা শুরু করে। কিন্তু এর মধ্যে ছিলনা কোন আন্তরিকতা। মাদ্রাজ থেকে সামরিক সাহায্য এলেই তারা পুনরায় শক্তি পরীক্ষায় লেগে যাবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রধানগণ ও বণিকশ্রেণী সকল প্রকারে ইংরেজদেরকে উৎসাহিত করতে থাকে। বিশেষ করে খাজা ওয়াজেদের প্রধান সহকারী শিব বাবু নামক জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি সর্বদা ইংরেজদেরকে একথা বলতে থাকে যে, নবাব সিরাজদ্দৌলা আর তাদেরকে কিছুতে ব্যবসায় সুযোগ সুবিধা দিবার পাত্র নন। কোলকাতায় পরাজয় বরণ করার পর কোন মীমাংসায় উপনীত হওয়া তাদের জন্যে কিছুতেই সম্মানজনক নয়। গোবিন্দরাম নামে অন্য একটি লোক সিরাজদ্দৌলার কোলকাতা অভিযানের সময় পথে বৃক্ষ উৎপাটন করে রেখে বাধার সৃষ্টি করেছিল। সে এখন ইংরেজদের পক্ষে গোপন তথ্য সরবরাহের কাজ শুরু করে। কোলকাতার শাসনভার যে মানিকচাঁদের উপর অর্পিত হয়েছিল, সে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফলতায় অবস্থিত ইংরেজদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করতে থাকে। সে নবারের কাছে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য পেশ করতে থাকে যে ইংরেজরা একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আসার জন্যে লালায়িত। অল্প সৈন্য নিয়ে কিছু করা যাবেনা চিন্তা করে মেজর কিলপ্যাট্রিক আপাততঃ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে এবং মাদ্রাজ থেকে বৃহত্তর সামরিক সাহায্য ও নৌবহর তলব করে। ১৭৫৬ সালের ১৫ই আগষ্ট বিলপ্যাট্রিক নবাবকে জানায় যে, তারা তাঁর অনুগ্রহপ্রার্থী। অপরদিকে ইংরেজদেরকে সর্বতোভাবে সাহায্য করার জন্য মানিক চাঁদ, জগতশেঠ ও অন্যান্য হিন্দু প্রধানদেরকে অনুরোধ করে পত্র লিখে।
মানিক চাঁদের মিথ্যা আশ্বাসবাণীতে নবাব বিভ্রান্ত হন এবং বলেন যে, ইংরেজরা যুদ্ধ করতে না চাইলে তাদেরকে ব্যবসায় সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয় হবে। নবাবের বলতে গেলে নৌশক্তি বলে কিছুই ছিলনা। বিদেশী বণিকদেরকে বাংলার ভূখন্ড থেকে বিতাড়িত করে দিলেও, সমুদ্র উপকূল থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করার ক্ষমতা নবাবের ছিলনা। ইংরেজগণ এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। দ্বিতীয়তঃ সিরাজদ্দৌলার সামনে নতুন এক বিপদ দেখা দেয়। পুর্নিয়ার শওকত জং মোগল সম্রাটের নিকট থেকে এক ফরমান লাভ করতে সমর্থ হয় –যার বলে তাকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়। ইংরেজগণ শওকত জং-এর পক্ষ অবলম্বন করে তার বিজয়ের আশা পোষণ করছিল। কিন্তু ৬ই আগষ্টের যুদ্ধে শওকত জং নিহত হওয়ায় তাদের সে আশা আপাততঃ ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
আগষ্টের মাঝামাঝি ড্রেক এবং কিলপ্যাট্রিক কর্তৃক কোলকাতার পতন সম্পর্কে লিখিত পত্রের জবাবে যথেষ্ট পরিমাণে সামরিক সাহায্য ইংলন্ড থেকে মাদ্রাজ এসে পৌঁছে। সেপ্টেম্বরে কোম্পানীর দুটি জাহাজ চেষ্টারফিল্ড ও ওয়ালপোল মাদ্রাজ পৌঁছে যায়। অক্টোবরে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল রবার্ট ক্লাইভ এবং এডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভিযান বাংলায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত করে। বাংলায় পৌঁছাবার পরপরই প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু করার জন্যে কর্ণেল ক্লাইভকে নির্দেশ দেয়া হয়। ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ঢাকা, পুর্ণিয়া এবং কটকের ডিপুটি নবাবদেরকে ক্লাইভের সাথে সহযোগিতা করার অনুরোদ জানিয়ে পত্র দেয়া হয়। অপরদিকে ইংরেজদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে নবাবকেও পত্র দেয়া হয়। উক্ত কাউন্সলের গভর্ণর জর্জ পিগটের পত্রে বলা হয়ঃ আমি একজন শক্তিশালী সর্দার পাঠাচ্ছি যার নাম ক্লাইভ। সৈন্য ও পদাতিক বাহিনীসহ সে যাচ্ছে এবং আমার স্থলে শাসন চালাবে। আমাদের যে ক্ষতি করা হয়েছে তার সন্তোষজনক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আপনি নিশ্চয় জেনে থাকবেন যে, আমরা যুদ্ধে সর্বত্রই জয়ী হয়েছি। (হিলের ইতিহাস, ১ম খন্ড)
এ পত্রের মর্ম পরিস্কার যে, মীমাংসার আর কোন পথ রইলোনা। ১৫ই ডিসেম্বর ক্লাইভ ফলতায় পৌঁছে। মানিকচাঁদ কোম্পানীর প্রতি যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সাহায্য সহযোগিতা করে, তার জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানি সেইদিনই ক্লাইভ তাকে পত্র লিখে। ক্লাইভের নিরাপদে পৌঁছার আনন্দ প্রকাশ করে মানিকচাঁদ পত্রের জবাব দান করে। সে আরও জানায় যে, সে কোম্পানীর যথাসাধ্য খেদমতে আত্মনিয়োগ করবে। উপরন্তু গোপন তথ্য আদান প্রদানের জন্যে সে রাধাকৃষ্ণ নামক এক ব্যক্তিকে ক্লাইভের নিকট প্রেরন করে। বাংলার বিরুদ্ধে বাংগালীর এর চেয়ে অধিকতর বিশ্বাসঘাতকতা আর কি হতে পারে?

পঞ্চম অধ্যায়
ইংরেজদের আক্রমণ ও নবাবের পরাজয়
উনত্রিশে ডিসেম্বর ক্লাইভের রণতরী হুগলী নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে বজবজ দখল করে। তার চার দিন আগে ক্লাইভ মানিকচাঁদের মাধ্যমে নবাবকে যে পত্র লিখে তাতে বলা হয়, নবাব আমাদের যে ক্ষতি করেছেন, আমরা এসেছি তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে, আমরা ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসিনি তাঁর কাছে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্যে আমাদের সেনাবাহিনীই যথেষ্ট। মানিকচাঁদ পত্রখানি নবাবকে দিয়েছিল কিনা জানা যায়নি। হয়তো দেয়নি। দিলে নবাব নিশ্চয়ই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতেন। মানিকচাঁদ সর্বধা নবাবকে বিভ্রান্ত রেখেছে। তার ফলে বিনা বাধায় ক্লাইব ৩১শে ডিসেম্বর থানা ফোর্ট এবং ১লা জানুয়ারী, ১৭৫৭ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরুদ্ধার করে। মানিকচাঁদ ইচ্ছা করলে নবাবের বিরাট সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে ইংরেজদের আত্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারতো। সে তার কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ ইংরেজদের দ্বারা তার একং তার জাতির অভিলাষ পূর্ণ হতে দেখে সে আনন্দলাভই করছিল। এমনটি এ সকল স্থান ইংরেজ-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার সংবাদটুকু পর্যন্ত সে নবাবকে দেয়া প্রয়োজন বোধ করেনি।
ইংরেজদের হাতে বলতে গেলে, ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ তুলে দিয়ে সে হুগলী গমন করে এবং হুগলী ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে পরিবেশ সৃষ্টি করতে থাকে। ক্লাইভ হুগলীতে তার নামে লিখিত পত্রে অনুরোধ জানায় যে, পূর্বের মতো সে যেন এখানেও বন্ধুত্বের পরিচয় দেয়। দু’দিন পর হুগলী আক্রমণ করে ক্লাইভ সহজেই তা হস্তগত করে। ইংরেজ কর্তৃক এতসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অধিকৃত হওয়ার পর মানিকচাঁদ নবাবকে জানায় যে, ইংরেজদের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। হুগলী অধিকারের পর ইংরেজ সৈন্যগণ সমগ্র শহরে লুটতরাজ অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্ম ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিরাট সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
হুগলীর পতন ও ধ্বংসলীলার সংবাদ পাওয়া মাত্র সিরাজদ্দৌলা বিরাট বাহিনীসহ ২০শে জানুয়ারী হুগলীর উপকন্ঠে হাজির হন। ইংরেজগণ তখন তড়িৎগতিতে হুগলী থেকে পলায়ক করে কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করে।
নবাব সিরাজদ্দৌলা একটা মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্যে তাদেরকে বার বার অনুরোধ জানান। অনেক আলাপ আলোচনার পর ৯ই ফেব্রুয়ারী নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতিহাসে তা আলীনগরের সদ্ধি বলে খ্যান। এ সন্ধি অনুযায়ী ১৭১৭ সালের ফরমান মুতাবেক সকল গ্রাম ইংরেবদেরকে ফেরত দিতে হবে। তাদের পণ্যদ্রব্যাদি করমুক্ত হবে এবং তারা কোলকাতা অদিকতর সুরক্ষিত করতে পারবে। উপরন্তু সেখানে তারা একটা নিজস্ব টাকশাল নির্মাণ করতে পারবে।
সিরাজদ্দৌলাকে এ ধরনের অসম্মানজনক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তার প্রথম কারণ হলো মানিক চাঁদের মতো তাঁর অতি নির্ভরযোগ্য লোকদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা। দ্বিতীয়তঃ আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণ এবং বাংলা অভিযানের সম্ভাবনা।
অপরদিকে ধূর্ত ক্লাইভের নিকটে এ সন্ধি ছিল একটা সাময়িক প্রয়োজন মাত্র। ইংরেজরা একই সাতে প্রয়োজনবোধ করেছিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার এবং ফরাসীদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করার। এতদুদ্দেশ্যে ক্লাইভ ওয়াটস এবং উমিচাঁদকে সিরাজদ্দৌলার কাছে পাঠিয়ে দেয় এ কথা বলার জন্যে যে, তারা ফরাসী অধিকৃত শহর চন্দরনগর অধিকার করতে চায় এবং তার জন্যে নবাবকে সাহায্য করতে হবে। এ ছিল তাদের এক বিরাট রণকৌশল (Strategy)। নবাব ভীষণ সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি তাঁর রাজ্যমদ্যে সর্বদা বিদেশী বণিকদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে আসছিলেন। এ নীতি কি করে ভংগ করতে পারেন? কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে, ইংরেজদের সাহায্য না করলে তারা এটাকে তাদের প্রতি শত্রুতা এবং ফরাসীদের প্রতি মিত্রতা পোষণের অভিযোগ করবে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরপেক্ষ নীতিতেই অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত করেন। তদনুযায়ী তিনি সেনাপতি নন্দনকুমারকে নির্দেশ দেন যে, ইংরেজরা যদি চন্দরনগর আক্রমণ করে তাহলে ফরাসীদের সাহায্য করতে হবে। অনুরূপভাবে ফরাসীরা যদি ইংরেজদেরকে আক্রমণ করে তাহলে ইংরেজদেরকে সাহায্য করতে হবে। ক্লাইভ দশ-বারো হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে নন্দকুমারকে হাত করে। সে একই পন্থায় নবাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানকেও বশ করে। এভাবে ক্লাইভ চারদিকে উৎকোচ ও বিশ্বাসঘাতকতার এমন এক জাল বিস্তার করে যে, সিরাজদ্দৌলা কোন বিষয়েই দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারেন না। উপরন্তু হিন্দু শেঠ ও বেনিয়াগণ এবং তাঁর নিমকহারাম কর্মচারীগণ, যারা মনে প্রাণে মুসলিম শাসনের অবসান কামনা করে আসছিল, সিরাজদ্দৌলাকে হরহামেশা কুপরামর্শই দিতে থাকে। তারা বলে যে, ইংরেজদেরকে কিছুতেই রুষ্ট করা চলবে না। ওদিকে বাংলা-বিহার রক্ষার উদ্দেশ্যে বিরাট সেনাবাহিনী সেদিকে প্রেরণ করার কুপরামর্শ দেয়। এভাবে ইংরেজদের অগ্রগতির পথ সুগম করে দেয়া হয়।
ইতিমদ্যে ৫ই মার্চ ইংলন্ট থেকে সৈন্যসামন্তসহ একটি নতুন জাহাজ ‘কাম্বারল্যান্ড’ কোলকাতা এসে পৌঁছায়। ৮ই মার্চ ক্লাইভ চন্দরনগর অবরোধ করে। নবাব রায়দুর্লভ রাম এবং মীর জাফরের অধীনে একটি সেনাবাহিনী চন্দরনগর অভিমুখে প্রেরণ করেন। কিন্তু তাদের পৌঁছাবার পূর্বেই ফরাসীগণ আত্মসমর্পণ করে বসে। তারা চন্দরনগর ছেড়ে যেতে এবং বাংলায় অবস্থিত তাদের সকল কারখানা এডমিরাল ওয়াটসন এবং নবাবের হাতে তুলে দিয়ে যেতে রাজী হয়। অতঃপর বাংলার ভূখন্ড থেকে ফরাসীদের মূলোচ্ছেদ করার জন্যে ক্লাইভ নবাবের কাছে দাবী জানায়। উপরন্তু পাটনা পর্যন্ত ফরাসীদের পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে কোম্পানীর দু’হাজার সৈন্য স্থলপথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নবাবের অনুমতি প্রার্থনা করে। নবাব এ অন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। এতে ফরাসীদের সাহায্য করা হয়েছে বলে নবাবের প্রতি অভিযোগ আরোপ করা হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল কমিটি ২৩শে এপ্রিল নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা আরও অভিযোগ করে যে, নবাব আলীনগরের চুক্তি ভংগ করেছেন।
নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে পাকাপোক্ত ষড়যন্ত্র করে, সিরাজেরই তথাকথিত আপন লোক রায়দুর্লভ রাম, উমিচাদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের সাথে। তাদেরই পরামর্শে নবাবের বখশী (বেতনদাতা কর্মচারী) মীর জাফরকে নবাবের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা হয়। ইংরেজ ও মীর জাফরের মধ্যেও সকল বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। শুধু উমিচাঁদ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে। সে নবাবের যাবতীয় ধন-সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ দাবী করে বসে। অন্যথায় সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেয়। ক্লাইভ উমিচাঁদকে খুশী করার জন্যে ওয়াটসনের জাল স্বাক্ষরসহ এক দলিল তৈরী করে। মীর জাফরের সংগে সম্পাদিত চুক্তিতে সে আলীনগরের চুক্তির সকল শর্ত পুরাপুরি পালন করতে বাধ্য থাকবে বলে স্বীকৃত হয়। উপরন্তু সে স্বীকৃত হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ কোম্পানীকে দিতে হবে এক কোটি টাকা, ইউরোপীয়ানদেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানদেরকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনিয়ানদেরকে সাত লক্ষ টাকা। কোলকাতা এবং তার দক্ষিণে সমুদয় এলাকা চিরদিনের জন্যে কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হবে।
সুচতুর ক্লাইভ নবাবের সন্দেহ নিরসনের জন্যে চন্দরনগর থেকে সৈন্য অপসারণ করে। মীর জাফর পরিকল্পিত বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে ক্লাইভকে অতিরিক্ত বায়ান্ন লক্ষ টানা পুরস্কার স্বরূপ দিতে সম্ত হয়।
আহমদ শাহ আবদালীর ভারত ত্যাগের পর সিরাজদ্দৌলা মীর জাফরকে একটি সেনাবাহিনীসহ পলাশী প্রান্তরে ইংরেজদের প্রতিহত করার আদেশ করেন যদি তারা ফরাসীদের অনুসরণে উত্তরদিকে অগ্রসর হয়। ক্লাইভ সিরাজদ্দৌলাকে জানায় যে, যেহেতু আলীনগর চুক্তি পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেহেতু ব্যাপারটির পর্যালোচনার জন্যে মীর জাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ রাম, মীর মদন এবং মোহনলালকে দায়িত্ব দেয়া হোক। কিন্তু ওদিকে সংগে সংগে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তার সৈন্য প্রেরণ করে। সিরাজ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সৈন্যদের সম্মুখীন হন। নবাবের সৈন্য পরিচালনার ভার ছিল মীর জাফর, রায়দুর্লভ রাম প্রভৃতির উপর। তারা চরম মুহুর্তে সৈন্য পরিচালনা থেকে বিরত থাকে। ফলে ক্লাইভ যুদ্ধ না করেও জয়লাভ করে। হতভাগ্য সিরাজ যুদ্ধের ময়ধান থেকে পলায়ন করেন, কিন্তু পথিমধ্যে মীর জাফরপুত্র মীরন তাকে হত্যা করে। এভাবে পলাশীর বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের যবনিকাপাত হয়।
পলাশী যুদ্ধেল পটভূমির বিশদ বিবরণ থেকে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
এক. বাংলার জমিদার প্রধান, ধনিক বণিক ও বেনিয়া গোষ্ঠী দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে হলেও মুসলিম শাসনের অবসানকল্পে ইংরেজদের সংগে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
দুই. ইংরেজগণ হিন্দু প্রধানদের মনোভাব বুঝতে পেরে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যে হিন্দুদের পুরাপুরি ব্যবহার করে।
তিন. নবাবের সকল দায়িত্বপূর্ণ পদে যারা অধিষ্ঠিত ছিল তারা সকলেই ছিল হিন্দু এবং তাদের উপরই তাঁকে পুরাপুরি নির্ভর করতে হতো। কিন্তু যাদের উপরে তিনি নির্ভর করতেন তারাই তাঁর পতনের জন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
চার. পলাশীর যুদ্ধকে যুদ্ধ বলা যায় না। এ ছিল যুদ্ধের প্রহসন। ইংরেজদের চেয়ে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক গুণ বেশী। নবাবের সৈন্যনাবাহিনী যুদ্ধ করলে ইংরেজ সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো এবং ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। অথবা সিরাজদ্দৌলা যদি স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলেও তাঁকে পরাজয় বরণ করতে হতো না।
পাঁচ. যাদেরকে সিরাজ দেশপ্রেমিক ও তাঁর শুভাকাংখী মনে করেছিলেন –তারা যে দেশের স্বাধীনতা বিক্রয় করে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করবে, একথা বুঝতে না পারা তাঁর মারাত্মক ভুল হয়েছে। অথবা বুঝতে পেরেও তাঁর করার কিছুই ছিল না। তাঁর এবং তাঁর পূর্ববর্তী শাসকদের দ্বারা দুধ-কলা দিয়ে পোষিত বর্ধিত ও পালিত কালসর্প অবশেসে তাঁকেই দংশন করে জীবনের লীলা সাংগ করলো।

পলাশীর মর্মন্তুদ নাটকের পর
পলাশী প্রান্তরে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় শুধুমাত্র এক ব্যক্তির পরাজয় নয়। বাংলা-বিহার তথা গোটা ভারত উপমহাদেশের পরাজয়। এ পরাজয় দ্বারা উন্মোচন করে দেয় ভারতের উপরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের। শুধু তাই নয়। এশিয়ার ইউরোপের কাছে, প্রাচ্যের প্রতীচ্যের কাছে। পরবর্তী ধারাবাহিক ঘটনাপুঞ্জ এ কথারই সাক্ষ্য দান করে। নিদেনপক্ষে ভারত উপমহাদেশের উপরে ব্রিটিশ আধিপত্য ও প্রভুত্ব চলেছিল একশ’ নব্বই বছর ধরে।
পলাশীর এ বেদনাদায়ক রাজনৈতিক নাটকের পরিচালক কে বা কারা ছিল, বাংলা-বিহার তথা ভারত উপমহাদেশের গলায় দু’শ বছরের জন্যে পরাধীনতার শৃংখল কে বা কারা পরিয়ে দিয়েছেন, ইতিহাস তাদেরকে খুঁজে বের করতে ভোলেনি। অতীব ঘৃণিত ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, উৎকোচের মাধ্যমে মস্তক ক্রয় এবং কাল্পনিক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিশোধ গ্রহণের হিংস্র নীতি অবলম্বনে, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র পরিচালনা না করেই, ক্লাইভ ও তার গোত্র-গোষ্ঠী সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত ও নিহত করে এ দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৃতকার্য হয়েছিল।
সিরাজদ্দৌলার পতনের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। ১৭৫৭ সালের পর যাদের বিজয় নিনাদ প্রায় দু’শ বছর পর্যন্ত ভারত তথা এশিয়ার বিশাল ভূখন্ডে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল এবং এ বিজয় লাভে সহায়ক শক্তি হিসাবে যাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তাদেরই মনোপৃত মনগড়া ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলাকেই দায়ী করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার ইতিহাস কি তাই?
বিরাট মোগল সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হ’য়ে পড়েছিল –ভারতের বিভিন্ন স্থানে স্বাদীন আধা স্বাধীন শাসক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। মারাঠাশক্তি উত্তর ও মধ্য ভারতকে গ্রাস করার পরিকল্পনা নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু আহমদ শাহ আবদালী পানি পথের তৃতীয় যুদ্ধে (১৭৬১) তাদের শক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। বাদশাহ আকবর ভারতের দুর্ধর্ষ মুসলিম সামরিক শক্তির বিনাশ সাধন করেছিলেন। বিকল্প কোন সামরিক শক্তি গঠিত হ’তে পারেনি। নৌশক্তি বলতে মুসলমানদের কিছুই ছিলনা বল্লেও চলে। ইংরেজ বণিকগণ এদেশে এসেছিল দ্বিবিধ উদ্দেশ্য নিয়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ, নৌবহর-স্থাপন, স্বদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী আমদানি প্রভৃতিরক দ্বারা ক্রমশঃ শক্তিশালী হ’য়ে উঠেছিল। তাদের এ উদ্দেশ্য সাধনে সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছিল বাংলার দেশপ্রেমিক (?) বাংগালী হিন্দু ধনিক বণিক শ্রেণী।
বাংলায় মুর্শিদকুলী খাঁর সময় থেকে সকল প্রশাসনক্ষেত্র থেকে মুসলমানদেরকে অপসারিত করে তথায় বাংলার হিন্দুদের জন্যে স্থান করে দেয়া হয়েছিল। এ ছিল অতীব স্বদেশপ্রীতি ও একদেশদর্শী উদারতার ফল। যদিও পরবর্তীকালে তার মাশুল দিতে হয়েছে কড়ায় গণ্ডায়। আলীবর্দীর সময় থেকে তারাই হ’য়ে পড়ে রাজ্যের সর্বেসর্বা। বাংলার মসনদ লাভ ছিল তাদেরই কৃপার উপরে একান্ত নির্ভরশীল। তারা ছিল বাংলার রাজস্রষ্টা (King-Makers)।
সিরাজদ্দীলা নবাব আলীবর্দীর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত হওয়ার সময় জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দ, মানিক চাঁদ, দুর্লভ রাম প্রভৃতি এমন শক্তিশালী ছিল যে, তাদের বিরাগভাজন হয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা সিরাজের পক্ষে ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এসব শক্তিশালী রাজকর্মচারীবৃন্দ রাজকোষ দ্বারা লালিত-পালিত হওয়া সত্ত্বেও প্রভুর প্রতি কণামাত্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মনোভাব পোষণ করেনি। তারা সর্বধান সিরাজকে কুপরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরঞ্চ ভিতরে ভিতরে কোম্পানীর সাথে একাত্মতাই পোষণ করেছে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সিরাজের পতনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে এদেশে ইংরেজ শাসন পত্তন করতে।
সিরাজদ্দৌলা শুধু একজন দেশপ্রেমিকই ছিলেন না। তিনি একজন অত্যন্ত সাহসী বীরপুরুষও ছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি যেরূপ ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহ দমন করেন, তাতে তাঁর সৎসাহস ও বিচক্ষণতারই পরিচয় পাওয়া যায়। কয়েকবার ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষেও তাঁর বিজয় সূচিত হয়। আলম চাঁদ, জগৎশেঠ প্রভৃতি হিন্দু প্রধানগণ যদি চরম বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা পালন না করতো, তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। মীর জাফরের ভূমিকাও কম নিন্দনীয় নয়। কিন্তু পলাশী নাটকের সবচেয়ে ঘৃণিত ও অভিশপ্ত ব্যক্তি করা হয়েছে তাকে। কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়মের যুদ্ধে ইংরেজদেরকে শোষনীয়ভাবে পরাজিত করার পর নবাব সিরাজদ্দৌলা কোলকাতা শাসনের ভার অর্পণ করেন মানিক চাঁদের উপর। মানিক চাঁদ ইংরেজদেরকে কোলকাতা ও হুগলীতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্তা হয় রায় দুর্লভ রাম, উমিচাঁদ ও জগৎশেঠ ভ্রাতৃবৃন্দের পরামর্শে। এ কাজের জন্যে মীর জাফর যে দোষী ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ হীন ষড়যন্ত্রে তার অংশ কতটুকুই বা ছিল? বড়োজোর এক আনা। কিন্তু তার দুর্ভাগ্যের পরিহাসই বলতে হবে যে, ইতিহাসে তার চেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি আর কেউ নেই। তাই সকল সময়ে বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তির নামের পূর্বে ‘মীর জাফর’ শব্দটি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়।
দেশপ্রেমিক সিরাজদ্দৌলা বাংলা বিহারের স্বাদীনতা বিদেশী শক্তির হস্তে বিক্রয় না করার জন্যে মীর জাফরসহ হিন্দু প্রধানগণের কাছে বার বার আকুল আবেদন জানান। কিন্তু তাঁর সকল নিবেদন আবেদন অরণ্যে-রোদনে পরিণত হয়।
বিশ্বাসঘাতকের দল তাদের বহুদিনের পুঞ্চিভূত আক্রোশের প্রতিশোধ গ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে। এতেও তাদের প্রতিহিংসা পুরাপুরি চরিতার্থ হয়নি। সিরাজদ্দৌলাকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করেই তারা তাদের প্রতিহিংসার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি নির্বাপিত করে।
সিরাজদ্দৌলাকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে অপসারিত করে অন্য কাউকে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত করা –ইংরেজদের উদ্দেশ্যে ছিল না। তারা চেয়েছিল এদেমে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। মীর জাফর তাদের ক্রমবর্ধমান অন্যায় দাবী মিটাতে সক্ষম হয়নি বলে তাকেও অবশেষে সরে দাঁড়াতে হয়। হিন্দু প্রধানদের নিকটে শুধু সিরাজদ্দৌলাই অপ্রিয় ছিলেন না। যদি তাই হতো, তাহলে তাঁর স্থলে কাসিক তাদের অপ্রিয় হতো না। তাদের একান্ত কামনার বস্তু ছিল মুসলিম শাসনের অবসান। তাই নিজের দেশের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে মুসলিম শাসনের পরিবর্তে বিদেশী শাসনের শৃংখল স্বেচ্ছায় গলায় পরিধান করতে তারা ইতস্ততঃ করেনি। মীর জাফরের পর মীর কাসিক আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন করতে এবং তার সংগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তিনিও ইংরেজদের অদম্য ক্ষুধার খোরাক যোগাতে পারেননি বলে বাংলার রাজনৈতিক অংগন থেকে তাঁকেও বিদায় নিতে হয়। (হিল, যদুনাথ সরকার; ম্যালিসন, ডঃ মোহর আলী)
বাংলা বিহার তথা ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দু’শ’ বছরে দেশের জনগণের ভাগ্যে যা হবার তাই হয়েছে। অবশ্য কিছু বৈষয়িক মংগল সাধিত হলেও পরাধীনতার অভিশাপ, লাঞ্ছনা-অপমান জাতিকে জর্জরিত করে মুসলমানদের উপরে যে শোষণ নিষ্পেষণ চলেছিল তার নজির ইতিহাসে বিরল। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দারিদ্র, দেশকে গ্রাস করে ফেলে। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে পরবর্তী অধ্যায়ে।

সিরাজদ্দৌলার পতনের পর বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
পলাশী ও বকসারের যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লির নামমাত্র মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী মঞ্জুর করার পর এ অঞ্চলের উপরে তাদের আইনগত অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলার যে চিত্র ফুটে উঠে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নৈরাশ্যজনক। পলাশী যুদ্ধের পর মীর জাফর প্রভৃতি নামমাত্র নবাব থাকলেও সামরিক শক্তির নিয়স্তা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। ১৭৬৫ সালের পর দেশের অর্থনীতিও সম্পূর্ণ তাদেরই নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সর্বাপেক্ষা ও সর্বদিক দিয়ে।
সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে উমিচাঁদ-মীর জাফরের সাথে কোম্পানীর যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবী পূরণ করতে দিয়ে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। পূর্বে বলা হয়েছৈ যে, এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানীকে ভূয়া ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয় একশ’ লক্ষ টাকা। ইউরোপীয়দেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনীয়দেরকে সাত লক্ষ টাকা। বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বেই ক্লাইভকে দিতে হয় বায়ান্ন লক্ষ টাকা (Fall of Sirajuddowla-Dr. Mohar Ali)।
মীর জাফরের ভূয়া নবাব হিসাবে বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর কোম্পানীর দাবী উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। মীর জাফর, তাদেরকে প্রীত ও সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য হয়। রাজস্ব বিভাগ কোম্পানীর পরিচালনাধীন হওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্যে হিন্দু ও ইংরেজ আদায়কারীগন অতিমাত্রায় শোষণ নিষ্পেষণের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে কোম্পানীর রাজকোষে পূর্ণ করতে থাকে। ইতিপূর্বে প্রজাদের নিকট থেকে আদায়কৃত সকল অর্থ দেশের জনগণের মধ্যে তাদেরই জন্যে ব্যয়িত হতো। তখন থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাংকে ও ব্যবসা কেন্দ্রগুলিতে স্থানান্তরিক হতে থাকে।
১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণত্যাগ করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় কোন প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শিত হয়নি। দুর্ভিক্ষ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পূর্বের বৎসরের তুলনায় ছয় লক্ষ টাকা অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা ও বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। মানব সন্তানেরা যখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল, তখন তাদের রক্ত শোষণ করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিল ইংরেজ ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণ। এসব রাজস্ব আদায়কারী ছিল কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ, সুদী মহাজন ও ব্যবসায়ীগণ। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কি হতে পারে? (Baden Power-Land system etc. –British Policy & the Muslim in Bengal-A.R Mallick)।
আর এক ঘৃণিত পন্থায় এদেশের অর্থসম্পদ লুণ্ঠন করা হতো। কোম্পানী এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশী তাদে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র আট-ন’ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী-বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো।
আবদুল মওদুদ বলেনঃ
পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী দল কী মহামূল্য দিয়ে ব্রিটিশ রাজদন্ড এ দেশবাসীর জন্য ক্রয় করেছিল, তার সঠিক খতিয়ান আজও নির্ণীত হয়নি। হওয়া সম্ভব নয়। কারণ –কেবল লিখিত বিবরণ থেকে তার কিছুটা পরিমাণ জ্ঞাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু হিসাবের বাইরে যে বিপুল অর্থ সাগর পারে চালান হয়ে গেছে, কিভাবে তার পরিমাপ করা যাবে?
ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো –সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামোটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংলন্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা (I.O Miller, quoted by Misra, p.15)।
মুর্শিদাবাদের খাযাঞ্চিখানা থেকে পাওয়া গেল পনর লক্ষ পাউন্ডের টাকা, অবশ্য বহুমূল্য মণিমাণিক্য দিয়ে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ স্থলসেনা ও নৌসেনা পেলো চার লক্ষ পাউন্ড; সিলেক্ট কমিটির ছয়জন সদস্য পেলেন নয় লক্ষ পাউন্ড; কাউন্সিল মেম্বররা পেলেন প্রত্যেকে পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার পাউন্ড; আর খোদ ক্লাইভ পেলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড, তাছাড়া ত্রিশ হাজার পাউন্ড বার্ষিক আয়ের জমিদারীসহ বাহশাহ প্রদত্ত উপাধি ‘সাবাত জং’। অবশ্য পলাশী বিজয়ী ক্লাইভের ভাষায় ‘তিনি এতো সংসম দেখিয়ে নিজেই আশ্চর্য’। মীর কাসিম দিয়েছেন নগদ দু’লক্ষ পাউন্ড কাউন্সিলের সাহায্যের জন্যে। মীর জাফর নন্দন নজমদ্দৌলা দিয়েছেন এক লক্ষ উনচল্লিশ হাজার পাউন্ড। এছাড়া সাধারণ সৈনিক, কুঠিয়াল ইংরেজ কত লক্ষ মুদ্রা আত্মসাৎ করেছে, বলা দুঃসাধ্য। বিখ্যাত জরিপবিদ জেমস রেনেল ১৭৬৪ সালে বাইশ বছর বয়সে বার্ষিক হাজার পাউন্ডে নিযুক্ত হন, এবং ১৭৭৭ সালে বিলাত ফিরে যান ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার পাউন্ড আত্মসাৎ করে। এ থেকেই অনুমেয়, কোম্পানীর কর্মচারীরা কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করতেন। তারা এ দেশে কোম্পানী রাজ্যের প্রতিভূ হিসেবে এবং চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর হোমে প্রত্যাগত হয়ে এরূপ রাজসিক হালে বাস করতেন যে, তাঁরা ‘ইন্ডিয়ান নেবাবস’ রূপে আখ্যাত হতেন।
…ক্লাইভ নিজেই স্বীকর করেছেন, “আমি কেবল স্বীকার করতে পারি, এমন অরাজকতা বিশৃংখলা, উৎকোচ গ্রহণ, দুর্নীতি ও বলপূর্বক ধনাপহরণের পাশব চিত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও দৃষ্ট হয়নি”। অথচ নির্লজ্জ ক্লাইভই এ শোষণ যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। (মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, আবদুল মওদুদ, পৃঃ ৬০-৬২)।

৬ষ্ঠ অধ্যায়
মুসলিম সমাজের দুর্দশা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা বিনষ্ট হওয়ার পর মুসলিম সমাজের যে সীমাহীন দুর্দশা হয়েছিল, তা নিম্নের আলোচনায় সুস্পষ্ট হবে।
পলাশী যুদ্ধের পূর্বে সামরিক ও বেসামরিক চাকুরীক্ষেত্রে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের প্রাধান্য ছিল। কোম্পানী ক্ষমতা হস্তগত করার পর প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের প্রথম ধাপেই মুসলিম সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়া হয়। তার ফলে কিছু উচ্চশ্রেণীর কর্মচারীই বেকার হয়ে পড়ে। ফলে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকারত্ব ও দারিদ্রের মুখে ঠেলে দেয়া হয়।
দ্বিতীয়তঃ দেশের গোটা রাজস্ব বিভাগকে ইংলন্ডের পদ্ধতিতে পুনর্গঠিত করার ফলে বহুসংখ্যক মুসলমান কর্মচ্যুত হয়। সরকারের ভূমি রাজস্ব নীতি অনুযায়ী বহু মুসলমান জমিদার তাদের জমিদারী থেকে উচ্ছেদ হয়। ১৭৯৩ সালে গ্রাম্য পুলিম প্রথা রহিতকরণের ফলেও হাজার হাজার মুসলমান বেকার হয়ে পড়ে। এভাবে এ দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে উচ্চশ্রেণীর মুসলমান শুধু সরকারী চাকুরী থেকেই বঞ্চিত হয়নি, জীবিকার্জনের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়।
নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের পেশা ছিল সাধারণতঃ কৃষি ও তাঁতশিল্প। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ থেকে মানচেষ্টারের মিলজাত বস্ত্রাদি প্রচুর পরিমাণে আমদানীর ফলে, বাংলার তাঁতশিল্প ধ্বংস হয় এবং লক্ষ লক্ষ তাঁতীও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। তারপর শুধু কৃষির উপর নির্ভর করে জীবন যাপন করা তাদের জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
কোম্পানী এ দেশে আগমনের পর থেকেই কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ তাদের অধীনে চাকুরী-বাকুরী করে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদেরকে বলা হতো ‘গোমস্তা’। পলাশী যুদ্ধের পর নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এদের হয়েছিল পোয়াবারো। কোম্পানীর একচেটিয়া লবণ ব্যবসায় এবং আভ্যন্তরীণ অন্যাণ্য ব্যবসা-বাণিজ্যে এসব গোমস্তাগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ক’রে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। কিনউত এতদ্দেশীয় ব্যবসা ধ্বংস করে জনগণকে চরম, দুর্দশাগ্রস্ত ক’রে ফেলে। কোম্পানীর দেশী-বিদেশী কর্মচারীগণ ইংলন্ড থেকে আমদানীকৃত দ্রব্যাদি অত্যধিক উচ্চমূল্যে খরিদ করতে এবং দেশের উৎপন্ন দ্রব্যাদি অতি অল্পমূল্যে বিক্রয় করতে জনসাধারণকে বাধ্য করে। তাদের উৎপীড়ন-নির্যাতনের বিবরণ দিতে হলে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন। কোম্পানীর অত্যাচার-উৎপীড়নে পূর্ণ সহায়তা করে বাংলার হিন্দু কর্মচারীগণ। ১৭৮৬ সালে কালীচরণ নামে জনৈক গোমস্তার জুলুম-নিষ্পেষণে ত্রিপুরা অঞ্চলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার অপরাধে তাকে সেখান থেকে অপসারিত ক’রে চট্টগ্রামে রাজস্ব বিভাগের দেওয়ান বা ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়। এক বৎসরে সে চট্টগ্রামের জমিদারের নিকট থেকে অন্যায়ভাবে ত্রিশ হাজার টাকা আদায় করে। লর্ড কর্ণওয়ালিসের নিকটে বিষয়টি উপস্থাপিত করলে, চট্টগ্রামের রাজস্ব কন্ট্রোলার মিঃ বার্ড বলেন, কালীচরণকে চাকুরী থেকে অপসারিত ক’রে তার স্থলে তার গোমস্তা নিত্যানন্দনকে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু কোলকাতার অতি প্রভাবশালী গোমস্তা জয় নারায়ণ গোসাই-এই হস্তক্ষেপের ফলে বিষয়টির এখানেই যবনিকাপাত হয় এবং কালীচরণ তার পদে সসম্মানে বহাল থাকে।
এ একটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় যে, কোম্পানীর হিন্দু কর্মচারীগণ গ্রামবাংলার ধ্বংস সাধনে কোন সর্বনাশা ভূমিকা পালন করেছিল। জনৈক ইংরেজ মন্তব্য করেনঃ ইংরেজ ও তাদের আইন-কানুন যে একটি মাত্র শ্রেণীকে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করেছিল তা হলো, তাদের অধীনে নিযুক্ত এতদ্দেশীয় গোমস্তা-দালাল প্রতিনিধিগণ। এসব লোক পংগপালের মতো যেভাবে দ্রুতগতিতে গ্রামবাংলাকে গ্রাস করতে থাকে তাতে করে তারা ভারতের অস্তিত্বের মূলেই আঘাত করছিল। -(Muinuddin Ahmad Khan, Muslim Struggle for Freedom in Bengal, pp. 8)।
ইংরেজদের পলিসি ছিল, যাদের সাহায্যে তারা এ দেশের স্বাধীনতা হরণ ক’রে এখানে রাজনৈতিক প্রভুত্ব লাভ করেছে, তাদেরকে সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত ক’রে মুসলমানদেরকে একেবারে উৎখাত করা, যাতে ক’রে ভবিষ্যতে তারা আর কখনো স্বাধীনতা ফিরে পাবার কোন শক্তি অর্জন করতে না পারে। হ্যাস্টিংসের ভূমি ইজারাদান নীতি ও কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দুরা মুসলমান জমিদারদের স্থান দখল করে। নগদ সর্বোচ্চ মূল্যদাতার নিকটে ভূমি ইজারাদানের নীতি কার্যকর হওয়ার কারণে প্রাচীন সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদারগণ হঠাৎ সর্বোচ্চ মূল্য নগদ পরিশোধ করতে অপারগ হয়। পক্ষান্তরে হিন্দু বেনিয়অ শ্রেণী, সুদী মহাজন, ব্যাংকার ও হিন্দু ধনিক-বণিক শ্রেণী এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। প্রাচীন জমিদারীর অধিকাংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে এসব ধনিক-বণিকদের কাছে অচিরেই হস্তান্তরিত হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান জমিদারদের অধীনে নিযুক্ত হিন্দু নায়েব-ম্যানেজার প্রভৃতির স্বীকৃতি দান। ১৮৪৪ সালের Calcutta Review-তে যে তথ্য প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয় এক ডজন জমিদারীর মধ্যে, যাদের জমিদারীর পরিধি ছিল একটি ক’রে জেলার সমান, মাত্র দু’টি পূর্বতন জমিদারদের দখলে রয়ে যায় এবং অবশিষ্ট হস্তগত হয় প্রাচীন জমিদারদের নিম্নকর্মচারীর বংশধরদের। এভাবে বাংলার সর্বত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীর পত্তন হয়, যারা হয়ে পড়েছিল নতুন বিদেশী প্রভুদের একান্ত অনুগত ও বিশ্বাসভাজন।
হান্টার তাঁর The Indian Mussalmans গ্রন্থে বলেনঃ যেসব হিন্দু কর আদায়কারীগণ ঐ সময় পর্যণ্ত নিম্নপদের চাকুরীতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয়। নয়া ব্যবস্থা তাদেরকে জমির উপর মালিকানা অধিকার এবং সম্পদ আহরণের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। অথচ মুসলমানেরা নিজেদের শাসনামলে এ সুযোগ সুবিধাগুলো একচেটিয়াভাবে ভোগ করেছে। -(Hunter, The Indian Mussalmans: অনুবাদ আনিসুজ্জামান, পৃঃ ১৪১)।
মুসলিম শাসনামলে আইন ছিল যে, জমিদারগণ সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতিকারী ও দস্যু-তস্করের প্রতি কড়া নজর রাখবে। ধরা পড়লে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদিসহ তাদেরকে সরকারের নিকটে সমর্পণ করবে। ১৭৭২ সালে কোম্পানী এ আইন রহিত করে। ফলে, নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করকে ধীরয়ে দেয়ার পরিবর্তে তাদের প্রতিপালন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির অংশীদার হতে থাকে। এটা অনুমান করতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, এসব দস্যু-তষ্কর কারা ছিল, এবং কারা ছিল গ্রামবাংলার লুণ্ঠিত হতভাগ্যের দল। ১৯৪৪ সালে Calcutta Review-প্রকাশিত তথ্যে বলা হয় যে, এসব নতুন জমিদারগণ দস্যু-তষ্করদেরকে প্রতিপালন করতো ধন অর্জনের উদ্দেশ্যে। ১৭৯৯ সালে প্রকাশিত ঢাকা-জালালপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্টেও এসব দুষ্কৃতি সত্য বলে স্বীকার করা হয়।
-(Muinuddin Ahmad Khan –Muslim Struggle for freedom in India –oo.10)।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মুসলমান জমিদারদের উৎখাত ক’রে শুধুমাত্র এক নতুন জমিদার শ্রেণীরই পত্তন করেনি, নতুনভাবে জমির খাজনা নির্ধারণেরও পূর্ণ অধিকার তাদেরকে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে তারা চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেয়। এসব জমিদার সরকারী রাজস্বের আকারে অতি উচ্চহারে ঠিকাদার তথা পত্তনীদারদের নিকটে তাদের জমিদারীর ভারার্পণ করতো। তারা আবার চড়া খাজনার বিনিময়ে নিম্নপত্তনীদারদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করতো। অতএব সরকারের ঘরে যে রাজস্ব যেতো, তার চতুর্গুণ –দশগুণ প্রজাদের নিকটে জোর-জবরদস্তি করে আদায় করতো। বলতে গেলে, এ নতুন জমিদার শ্রেণী রায়তদের জীবন-মরণের মালিক-মোখতার হয়ে পড়েছিল।
ফরিদপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট আপিস থেকে এমন কিছু সরকারী নথিপত্র পাওয়া যায়, যার থেকে এ তথ্য প্রকাশিত হয় যে, অন্ততঃপক্ষে তেইশ প্রকার ‘অন্যায় ও অবৈধ’ আবওয়াব রায়তদের নিকট থেকে আদায় করা হতো। বুকানন বলেন, “রায়তদেরকে বাড়ী থেকে ধরে এনে কয়েকদিন পর্যন্ত আবদ্ধ রেথে মারপিট করে খাজনা আদায় করা তো এক সাধারণ ব্যাপার ছিল। উপরন্তু নিরক্ষর প্রজাদের নিকট থেকে জাল রসিদ দিয়ে জমিদারের খাজনা আদায় করে আত্মসাৎ করতো”। (M. Martin –The History, Antiquities, Topography & Statistics of Eastern India, London-1838, Vol. 2).
হিন্দু জমিদারদের অমানুষিক অত্যচার কাহিনী, তিতুমীরের জমিদার বিরোধী আন্দোলন যথাস্থানে আলোচিত হবে।
সামগ্রিকভাবে বাংলার মুসলিম সমাজের অবস্থা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কেমন ছিল, তার একটা নিখুঁত চিত্র অংকন করতে হলে জানতে হবে এ সমাজের তিনটি প্রধান উপাদান বা অংগ অংশে কোন অবস্থা বিরাজ করছিল। সমাজের সে তিনটি অংগ অংশ হলো –নবাব, উচ্চশ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়।

১. নবাব
পলাশী যুদ্ধের পর বাংলার হয়ে পড়েছিলেন কোম্পানীর হাতের পুতুল। চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম কোম্পানীকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদেরকে একচেটিয়া অধিকার দেয়া হয়। উপরন্তু কোম্পানী ও তাদের সাদা-কালো কর্মচারীদেরকে মোটা উপঢৌকনাদি দিতে হতো। মীর জাফর যেসব উপঢৌকনাদি দিয়েছিল, কোম্পানীর ১৭৭২ সালের সিলেক্ট কমিটির হিসাব অনুযায়ী তার মূল্য ছিল বার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড। ১৮৬৫ সালের পর নবাবকে বার্ষিক ভাতা দেয়া হয় ৫৩,৮৬,০০০ টাকা। ১৭৭০ সালে তা হ্রাস করে করা হয় বত্রিশ লক্ষ এবং ১৭৭২ সালে মাত্র ষোল লক্ষ টাকা। পূর্বে নবাবগণ তাঁদের অধীনে বহু মুসলমানকে চাকুরীতে নিয়োজিত করতেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারসমূহকে প্রচুর আর্থিক সাহায্য, জায়গীর প্রভৃতি দান করতেন। তা সব বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁরা চরম দুর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। কিছু সংখ্যক বাংলাদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান তাঁদের ভাগ্যান্বেষণের জন্যে এবং অবশিষ্ট দারিদ্রে নিষ্পেষিত হতে থাকেন।

২। সম্ভ্রান্ত বা উচ্চশ্রেণীর মুসলমান
সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণ বিজয়ীর বেশে অথবা দুঃসাহসী ভাগ্যন্বেষী হিসাবে বিভিন্ন সময়ে এ দেশে আগমন করেন। অতঃপর এ দেশেকে তাঁরা মনেপ্রাণে ভালোবেসে এটাকেই তাঁদের চিরদিনের আবাসভূমিরূপে গ্রহণ করেন। বিজয়ী হিসাবে স্বভাবতঃই তাঁরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার অধিকার রাখতেন। হান্টার বলেন, একটি সম্ভান্ত মুসলমান পরিবার তিনটি প্রধান সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ করতো –সামরিক বিভাগের নেতৃত্ব, রাজস্ব আদায় এবং বিচার বিভাগ ও প্রশাসন ক্ষেত্রে চাকুরী।
প্রথম সূত্রটি, বলতে গেলে, ছিল তাদের একেবারে একচেটিয়া। মীর জাফর স্বয়ং আশি হাজার সৈন্য চাকুরী থেকে অপসারিত করে। নজমুদ্দৌলা তার আপন মর্যাদা রক্ষার্থে যে পরিমানসংখ্যক সৈন্যের প্রয়োজন হতো তাই রাখতে পারতো। ফলে, বাংলা বিহারের কয়েক লক্ষ মুসলমান বেকারত্ব ও দারিদ্যে নিষ্পেষিত হতে থাকে।
হান্টার বলেন, জীবিকার্জনের সূত্রগুলির প্রথমটি হচ্ছে, সেনাবাহিনী। সেকানে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হ’য়ে যায়। কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান আর আমাদের সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করতে পারে না। যদিও কদাচিৎ আমাদের সামরিক প্রয়োজনের জন্যে তাদেরকে কোন স্থান দেয়অ হতো, তার দ্বারা তার অর্থোপার্জনের কোন সুযোগই থাকতো না।
তাদের অর্ত উপার্জনের দ্বিতীয় সূত্র ছিল –রাজস্ব আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু উপরে বর্ণিত হ’য়েছে কিভাবে নিম্নপদস্থ হিন্দু রাজস্ব আদায়কারীগণ কোম্পানীর অনুগ্রহে এক লাফে মুসলমানদের জমিদারীর মালিক হ’য়ে বসে।
লর্ড মেটকাফ ১৮২০ সালে মন্তব্য করেনঃ দেশের জমি-জমা প্রকৃত মালিকের নিকট থেকে কেড়ে নিয়ে একশ্রেণীর বাবুদের নিকটে হস্তান্তরিত করা হয় –যারা উৎকোচ ও চরম দুর্নীতির মাধ্যমে ধনশালী হয়ে পড়েছিল। এ এমন এক ভয়াবহ নির্যাতনমূলক নীতির ভিত্তিতে করা হয় যার দৃষ্টান্ত জগতে বিরল।
-(E. Thompson The life of Charls Lord Metcalfe; A.R. Mallick : British Policy and the Muslims of Bengal).
ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই রাজস্ব বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত মুসলমান কর্মচারী ও ভুমির প্রকৃত মালিকের স্থান অধিকার করে বসে ইংরেজ ও হিন্দুগণ।
আবহমান কাল থেকে ভারতের মুসলমান শাসকগণ জনগণের শিক্ষা বিস্তারকল্পে মুসলিম মনীষীদেরকে জায়গীর, তমঘা, আয়মা, মদদে-মায়াশ প্রভৃতি নামে লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি দান করতেন। বুকাননের
মতে একমাত্র বিহার ও পাটনা জেলার একুশ প্রকারের লাখেরাজ ভূমি দান করা হয়েছিল বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। ইংরেজ আমলে নানান অজুহাত এসব লাখেরাজদারকে তাদের মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বর্ধমারে স্পেশাল ডিপুটি কলেক্টর মিঃ টেইলার একদিনে ৪২৯ জন লাখেরাজদারের বিরুদ্ধে তাদের অনুপস্থিতিতে রায় দান করেন।
ইংরেজ সরকারের Tribunals of Resumption-এর অধীনে লাখেরাজ সম্পত্তি সরকারের পুনর্দখলে নেয়া হয়। চট্টগ্রাম বোর্ড অব রেভেনিউ-এর জনৈক অফিসার নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ সরকারের নিয়তের প্রতি লাখেরাজদারগণ সন্দিগ্ধ হ’য়ে পড়লে তাতে বিস্ময়ের কিছুই থাকবে না। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৪৬৩টি মামলার মধ্যে সব কয়টিতেই লাখেরাজদারদের অনুপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ তিক্ত অভিজ্ঞতার পর Tribunals of Resumption-এর প্রতি তাদের আস্থাহীন হবারই কথা (Comment by Smith in Harvey’s Report of 19th June 1840; A.R. Mallick British Policy and the Muslims of Bengal).
মুসলমান লাখেরাজদারদের ন্যায্যা ভূমির মালিকানা থেকে উচ্ছেদ করার জন্যে নানাবিধ হীনপস্থা অবলম্বন করা হতো এবং ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে এ ব্যাপারে এক বিদ্বেষদুষ্ট মানসিকতা বিরাজ করতো। লাখেরাজদারদের সনদ রেজেষ্টী নাক রার কারণে বহু লাখরাজ বাজেয়াপ্ত করা হয়। জেলার কালেকটরগণ ইচ্ছা করেই সময় মতো সনদ রেজেষ্ট্রী করতে গড়িমসি করতো। তার জণ্যে চেষ্টা করেও লাখেরাজদারগণ সনদ রেজেষ্ট্রী করাতে পারতেন না।
চট্টগ্রামে লাখেরাজদারদের কোর্টে হাজির হবার জন্যে কোন নোটিশই দেয়া হতো না। অনেকক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে, মামলার ডিক্রী জারী হবার বুহ পূর্বেই সম্পত্তি অন্যত্র পত্তন করা হয়েছে। ১৮২৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সমগ্র বাংলা বিহারে লাখেরাজদারদের মিথ্যা তথ্য সংগ্রহের জন্যে চর, ভূমা সাক্ষী ও রিজাম্পশন অফিসার পংগপালের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মুসলমানদেরকে মামলায় জড়িত করে। এসব মামলায় সরকার ছাড়াও তৃতীয় একটি পক্ষ বিরাট লাভবান হয়। যারা মিথ্যা সাক্ষদান করে এবং যারা সরকারী কর্মচারীদের কাছে কাল্পনিক তথ্য সরবরাহ করে –তারা প্রভূত অর্থ উপার্জন করে। পক্ষান্তরে, মুসলিম উচ্চম্রেণী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার ফলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হ’য়ে যায়।
পন্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেনঃ
ইংরেজরা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বহু ‘মুয়াফী’ অর্থাৎ লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তির অস্তিত্ব ছিল। তাদের অনেক ছিল ব্যক্তিগত, কিন্তু অধিকাংশই ছিল শিক্ষায়তনগুলির ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে ওয়াকফকৃত। প্রায় সকল প্রাইমারী স্কুল, মকতব এবং বহু উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান এসব ‘মুয়াফীর’ আয় নির্ভর ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিলাতে তাদের অংশীদাগণকে মুনাফা দেয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি টাকা তোলার প্রয়োজনবোধ করে। কারণ কোম্পানী ডিরেক্টরগণ এজন্যে খুব চাপ দিচ্ছিল। তখন এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ‘মুয়াফী’র ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নীতি গৃহীত হয়। এসব ভূ-সম্পত্তির সপক্ষে কঠিন সাক্ষ্যপ্রমাণ পেম করার হুকুম জারী করা হয়।
কিন্তু পুরানো সনদগুলি ও সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র ইতিমধ্যে হয় কোথাও হারিয়ে গেছে, নয় পোকায় খেয়ে ফেলেছে। অতএব প্রায় সকল ‘মুয়াফী’ বা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হলো। বহু বনেদী ভূম্যাধিকারী স্বত্বচ্যুত হলেন। বহু স্কুলে কলেজের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে বহু জমি সরকারের খাস দখলে আসে আর বহু বনেদী বংশ উৎখান হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপরোক্ত ‘মুয়াফী’র আয় নির্ভর ছিল, সেগুলি বন্ধ হয়ে গেল। বহু সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগীয় কর্মচারী বেকার হ’য়ে পড়লেন। -(Pandit Jawhellal Nehru: The Discovery of India, pp. 376-77)
উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মুসলমানদের জীবিকার্জনের তৃতীয় অবলম্বন ছিল সরকারের অধীনে চাকুরী –বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগগুলিতে। কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পরও প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবত তাঁরা চাকুরীতে বহাল ছিলেন। কারণ তখন পর্যন্ত সরকারী ভাষা ছিল ফারসী। কিন্তু হঠাৎ আকস্মিকভাবে ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীকে সরকারী ভাষা করা হয়। মুসলমানগণ তার জন্যে পূর্ব থেকে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। ১৮৩২ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে ক্যাপ্টেন টি ম্যাকাম প্রস্তাব পেশ করেন যে, ক্রমশঃ ইংরেজী ভাষার প্রচলন করা হোক এবং মুস্যলমান কর্মচারীদেরকে অন্ততঃ পাঁচ/ছ’বছরের অবকাশ দিয়ে নোটিশ দেয়া হোক। হন্ট ম্যাকেঞ্জীও অনুরূপ প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, জেলাগুলিতে ক্রমশঃ এবং পর পর ইংরেজীর প্রচলন করা হোক। কিন্তু সহসা সর্বত্র ও পরিবর্তন সাধিত হওয়ার ফলে হাজার হাজার মুসলমান কর্মচারী চাকুরী থেকে অপসারিত হন যাদের জীবিকা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতো একমাত্র চাকুরীর উপর। ১৮২৯ সালে সবরকম শিক্সার বাহন হিসাবে স্কুল-কলেজে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। ১৮৩৭ সালের ১লা এপ্রিল থেকে (তৎকালীন আর্থিক বৎসরের প্রথম দিন) সহসা সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজীর প্রবর্তন হয়।
হান্টার সাহেবও এসব সত্য স্বীকার করে বিদ্রুপ করে বলেছেনঃ
“এখন কেবলমাত্র জেলখানায় দু’একটা অধঃস্তন চাকুরী ছাড়া আর কোথাও ভারতের এই সাবেক প্রভুরা ঠাঁই পাচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে কেরানীর চাকুরীতে, আদালতের দায়িত্বশীল পদে, এমনটি পুলিশ সার্ভিসের উর্ধ্বতন পদগুলিতে সরকারী স্কুলের উৎসাহী হিন্দু যুবকদেরকে নিযুক্ত করা হচ্ছে”।
এ পরিবর্তনের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় পূর্ণ সুফল ভোগ করে। বিভিন্ন কলেজ থেকে ইংরেজী ভাষা শিক্ষা করে তারা সর্বথ্র সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক অগনে পট পরিবর্তনের ফলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারসমূহ জীবিকার্জনের সকল সুযোগ-সুবিধা তেকে বঞ্চিত হ’য়ে দারিদ্র্য, অনাহার ও ধ্বংসের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়।

৩। নিম্নশেণীর মুসলমানঃ কৃষক ও তাঁতী
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষককুলের যে চরম দুর্দশা হ’য়েছিল তার কিঞ্চিত আভাস উপরে দেয়া হয়েছে।
একথারও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জমিদার এবং প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে আরও দুটি স্তর বিরাজ করতো। যথা পত্তনীদার ও উপপত্তনীদার। জমিদারের প্রাপ্য খাজনার কয়েকগুণ বেশী এ দুই শ্রেণীর মাধ্যমে রায়তদের কাছ থেকে আদায় করা হতো এবং তাতে করে রায়ত বা কৃষকদের শোষণ-নিষ্পেষণের কোন সীমা থাকতো না। জমিদার-পত্তনীদারদের উৎপীড়নে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়তো। বাধ্য হয়ে তাদেরকে হিন্দু মহাজনদের দ্বারস্থ হতে হতো। শতকরা ৩৭ টাকা থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত হারে সুদে তাদেরকে টাকা কর্জ করতে হতো। উপরন্তু তাদের গরু/মহিষ মহাজনের কাছে বন্ধক রাখতে হতো। অভাবের দরুন মহাজরেন কাছে অগ্রিম কোন শস্য গ্রহণ করতে হলে তার দ্বিগুণ পরিশোধ করতে হতো। আবার উৎপন্ন ফসল যেতেতু মহাজনের বাড়ীতেই তুলতে হতো, এখানেও তাদেরকে প্রতারিত করা হতো। মোটকথা হতভাগ্য কৃষকদের জীবন নিয়ে এসব জমিদার মহজনরা ছিনিমিনি খেলে আনন্দ উপভোগ করতো।
কৃষকদের এহেন দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায়ও ছিল না। কারণ তা ছিল অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। উপরন্তু জমিদার ও তাদের দালালগণ উৎকোচ ও নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে খরচ কয়েকগুণে বাড়িয়ে দিত। পরিণাম ফল এই হতো যে, জমিদার মহাজন তাদেরকে ভিটেমাটি ও জমিজমা থেকে উচ্ছেদ করে পতের বিভারীতে পরিণত করতো।
কৃষক সম্প্রদায় ধান ও অন্যান্য শস্যাদি উৎপন্নের সাথে সাথে নীলচাষও করতো। এই নীলচাষের প্রচলন এদেশে বহু আগে থেকেই ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারত থেকে নীল রং সর্বপ্রথম ইউরোপে রপ্তানী হয়। ব্রিটিশ তাদের আমেরিকান ও পশ্চিম ভারতীয় উপনিবেশগুলিতে নীলচাষের ব্যবস্থা করে। এগুলি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবার পর বাংলা প্রধান নীল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়। ১৮০৫ সালে বাংলায় নীলচাষের পরিমাণ ছিল ৬৪,৮০৩ মণ এবং ১৮৪৩ সালে তার পরিমাণ হ’য়ে পড়ে দ্বিগুণ। বাংলা, বিহার এবং বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, নদিয়া, মুশিদাবাদ প্রভৃতি মুসলিম অধ্যুষিত জেলগুলিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশের তত্বাবধানে ব্যাপক আকারে নীলচাষ করা হয়। কিন্তু বিদেশী শাসকগণ নীলের এমন নিম্নমূল্য বেঁধে দেয় যে, চাষীদের বিঘাপ্রতি সাত টাকা ক’রে লোকসান হয় যা ছিল বিঘাপ্রতি খাজনার সাতগুণ। তথাপি চাষীদেরকে নীলচাষে বাধ্য করা হতো। বাংলার নীলচাষীদের উপরে শাসকদের অমানুষিক অত্যাচার উৎপীড়নের মর্মন্তুদ ও লোমহর্ষক কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ক্ষমতা মদমত্ত শাসক ও তাদের দালালদের মানবতাবোদ সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল। নতুবা তাদের নিষ্পেষণের দরুন কৃষক সমাজের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মর্মন্তুদ হাহাকারে বাংলার আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতো না।
দরিদ্র ও দুঃস্থ কৃষকগণ বেঁচে থাকার জন্যে নীলচাষের মাধ্যমে কিছু অর্থ উপার্জনের আশা করতো। তাদের দারিদ্র্য ও অসহায়তার সুযোগে ইংরেজ নীলকরগণ কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হ’তে তাদেরকে বাধ্য করতো। অনেক সময় অনিচ্ছুক কৃষকদের ধরে আগুন লাগিয়ে দিত। এতেও সম্মত করতে না পারলে জাল চুক্তিনামার বলে তাদের জমাজমি জবরদখল ক’রে নীলকরগণ তাদের কর্মচারীদের দ্বারা সেসব জমিতে নীলচাষ করাতো। কখনো কখনো অত্যাচারী জমিদার তার প্রজাকে শাস্তি দেবার জন্যে তার কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে নীলকরদেরকে দিয়ে দিত। একবার অ্যাশলী ইডেন নীল কমিশনের সামনে ১৮৬০ সালে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, বিভিন্ন ফৌজদারী রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, ঊনপঞ্চাশটি ঘটনা এমন ঘটেছে, যেখানে নীলকরগণ দাংগা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি, লুটতরাজ এবং বলপূর্বক অপহরণ প্রভৃতি গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকে। তার বহু বৎসর পূর্বে জনৈক ম্যাজিস্ট্রেট একজন খৃষ্টান মিশনারীর সামনে মন্তব্য করেন যে, মানুষের রক্তে রঞ্জিত হওয়া ব্যতীত একবাক্স নীলও ইংলন্ডে প্রেরিত হয় না। (১৮৬১ সালের নীল কমিশন রিপোর্ট এবং ক্যালকাটা খৃষ্টান অবজার্ভার, নভেম্বর, ১৮৫৫ সাল)।
নীল চাষীদের দুঃখ-দুর্দশার কোন প্রতিকারের উপায় ছিল না। চৌকিদার-দফাদারের সামনে চাষীদের উপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হলেও চৌকিদারদের ঘৃণাক্ষরেও সেকথা প্রকাশ করার সাধ্য ছিল না। একবার নিষ্ঠুর নীলকরগণ একটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করলে তা নির্বাপিত করার জন্যে এক ব্যক্তি চীৎকার ক’রে লোকজন জড়ো করে। তার জন্যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করে আহত অবস্থায় একটি অন্ধকার কামরায় চার মাস আটক রাখা হয়। ও দিকে আবার নীলকরগণ পুলিশকে মোটা ঘুষ দিয়ে বশ করে রাখতো। (নীল কমিশন রিপোর্ট ১৮৬১)।
হতভাগ্য অসহায় কৃষকগণ ম্যজিস্ট্রেটের নিকট থেকে কোন প্রকারের প্রতিকার ও ন্যায় বিচারের আশা করতে পারতো না। উক্ত নীল কমিশন রিপোর্টে বলা হয়ে ছে যে, সাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেটগণ আপন দেশবাসীদের পক্ষই অবলম্বন করতো। ফৌজদারী আইন-কানুন এমনভাবে তৈরী করা হয়েছিল যে, ইংরেজ প্রজাকে শাস্তি দেয়া ছিল অসম্বব ব্যাপার। একজন দরিদ্র প্রজা সূদুর প্রত্যন্ত এলকার তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে ফেলে কোলকাতায় গিয়ে মামলা দায়ের করার সাহস রাখনো না। কারণ তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের জানমাল ইয্যৎ-আবরু নীলকরদের দ্বারা বিনষ্ট হতো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলিতে অধিক পরিমানে নীলচাষ করা হতো। ফলে নিম্নশ্রেণীর মুসলমান নীলকরদের চরম নির্যাতন-নিপীড়নের সার্বক্ষণিক শিকারে পরিণত ছিল।

তাঁতী
কৃষক শ্রেণীর মতো এদেশ তাঁতী শ্রেণীও চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়। বাংলা-বিহারের লক্ষ লক্ষল মুসলমান তাঁতশিল্প দ্বারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ হবার পূর্ভেই লাভজনক ব্যবসা হিসাবে তাঁত শিল্পের মৃত্যু ঘটেছিল। তথাটি উপায়ান্তর না থাকায় যেসব মুসলমান তখন পর্যন্ত তাঁতশিল্প আঁকড়ে ধরে ছিল, ১৮৯১ সালের আদশুমারী অনুযায়ী তাদের সংখ্যা বিহার প্রদেশ ও বাংলার কয়েকটি জেলায় ছিল ৭,৭১২৩৭। নদিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, নোয়াখালী, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের তাঁতীগণ ছির এ সংখ্যার বাইরে। অতএব কোম্পানী আমলের প্রথমদিকে সমগ্র বাংলা ও বিহারে মুসলমান তাঁতীর সংখ্যা অন্ততঃপক্ষে উপরোক্ত সংখ্যার যে দশগুণ ছিল তা বিনা দ্বিধায় বলা যেতে পারে। এসব তাঁতী ব্যবসায়ীদের কিভাবে সর্বনাশ করা হয়েছিল, তার কিঞ্চিৎ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশে আগমনের পূর্বে এদেশের তাঁতশিল্প চরম উৎকর্ষ সাধন করেছিল। প্রতিট জেলায় বিশিষ্ট ধরনের অতি উৎকৃষ্ট তাঁতবস্ত্র নির্মিত হতো। চাহিতা মেটাবার জন্যে প্রচুর পরিমাণে কার্পাস আমদানী করা হতো। এসব তাঁতশিল্প থেকে মোটা ও মিহি উভয় প্রকারের বস্ত্র তৈরী হতো। ভারত ছিল মোটা বস্ত্রের বাজার এবং সূক্ষ্ম ও অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী করা হতো। মুসলমান শাসকদের সাহায্য সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার রেশমজাত অতিসূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানী করা হতো। মুসলমান শাসকদের সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার রেশমজাত অতিসূক্ষ্ম ‘মসলিন’ বস্ত্র দু’শতাব্দী ব্যাপী ইউরোপীয় বাজারে বিরাট আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল। মোটা বস্ত্র হোক, অথবা অতিসূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্র উভয় বস্ত্রই ছিল মুসলমান তাঁতশিল্পীদের বিরাট অবদান। উইলিয়াম বোল্ট নামক জনৈক ইংরেজ বণিক, কোম্পানী কর্তৃক তাঁতীদের উপর অকথ্য নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, সকল ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কোম্পানীদের একচেটিয়া অধিকার। ইংরেজ এবং তাদের অধীনস্ত হিন্দু বেনিয়অ ও গোমস্তাগণ আপন খুশী খেয়াল মতো কাপড়ের দর বেঁধে দিয়ে সে দরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বস্ত্র সরবরাহ করতে তাঁতীদের বাধ্য করতো। নীলকরদের মতো তাঁতীদের স্বার্ত-বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতেও তাদেরকে বাধ্য করা হতো। নির্দিষ্ট কোয়ালিটির বস্ত্র নির্দিস্ট পরিমাণে তাদেরই বেঁধে দেয়া দরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে তাঁতীদেরকে বাধ্য করা হতো –ওসব চুক্তি বলে। তাদের বেধেঁ দেয়া দর আবার বাজার দর থেকে শতকরা পনেরো থেকে চল্লিশ ভাগ কম হতো। কোম্পানী ও তার অত্যাচারী দালালদের মনস্তুষ্টি সাধন করতে না পারলে তাঁতীদেরকে বেত্রাঘাত করা হতো। এ যেন জ্যান্ত চামড়া খুলে মানুষের মাংস ভক্ষণ করা। আদিম যুদে অরণ্য নিবাসী অসভ্য বর্বর মানুষ প্রয়োজনবোধে নর-নারীর মাংসে ক্ষুধা নিবৃত্তি করতো বলে শুনা যায়। কিন্তু তাদের চেয়ে এসব তথাকথিত সভ্য ইংরেজ ও তাদের দালালগণ কোন দিক দিয়ে উৎকৃষ্টতর ছিল?
পরবর্তীকালে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ বাংলার বস্ত্রশিল্পে চরম আঘাত হানে। তারা বাংলা থেকে তৈরী বস্ত্র ইংলন্ডে আমদানী না করে কাঁচামাল হিসেবে কার্পাস ও রেশম আমদানী করতে থাকে। অতঃপর তারা সুপারিশ করে যে, রেশমী বস্ত্রের কারিগরগণকে নিজেদের তাতেঁ কাজ করার পরিবর্তে কোম্পানীর নিজস্ব কলকারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হোক। পরিণামে এ শিল্পপ্রধান দেশটি ইংলন্ডের বস্ত্র নির্মাতাদের কাঁচামালের বাজারে পরিণত হয়। ১৭৮৯ সালের পর থেকে ঢাকার সূক্ষ্ম রেশমী বস্ত্রের রপ্তানী হ্রাস পেতে থাকে। ১৭৯৯ সালে শুধুমাত্র ঢাকা থেকে বস্ত্র রপ্তানী হয়েছিল ১২ লক্ষ টাকার। সেকালের বার লক্ষকে এখনকার টাকার মূল্যমানে অনায়াসে বার কোটি বলা যেতে পারে। ১৮১৩ সালে রপ্তানী হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় তিন লক্ষ টাকায়। ১৮১৭ সালে ঢকার উৎপন্ন বস্ত্রের রপ্তানী একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
মোটকথা বাংলা বিহারের বস্ত্রশিল্প ধ্বংস করে উপার্জনহীন তাঁতী সম্প্রদায়ের রক্তমাংসে গড়ে উঠে মানচেষ্টারের বস্ত্রশিল্প। ক্রমে রপ্তানীকারী দেশ আমদানীকৃত মালের বাজারে পরিণত হয়। ১৭৮৬ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত এদেশে বার্ষিক বস্ত্র আমদানী হতো বার লক্ষ পাউন্ড মূল্যের। ১৮০৯ সালেতার পরিমাণ দাঁড়ায় এক কোটি চৌরাশি লক্ষ পাউন্ড মূল্যের। ব্রিটিশের নীতিই ছিল ধীরে ধীরে এদেশের তাঁতী সম্প্রদায়কে নির্মূল করা যারা ছিল প্রায়ই মুসলমান। (আবদুল মওদুদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ)।
তাঁতীদের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্র এঁকেছেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর The Discovery of India গ্রন্থে। তিনি বলেন, এসব তাঁতীদের পুরানো পেশা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। নতুন কোন পেশার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। উন্মুক্ত ছিল শুধু মৃত্যুর দ্বার। মৃত্যুবরণ করলো লক্ষ লক্ষ। লর্ড বেন্টিংক ১৮৩৪ সালের রিপোর্টে বলেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশার তুলনা নেই বাণিজ্যের ইতিহাসে। ভারতের পথঘাট পূর্ণ হয়েছে তাঁতীদের অস্থিতে। -(Pandit Nehru: The Discovery of India, p. 352)।
মোটকথা, পলাশীর যুদ্ধে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেয়ার পর থেকে একশত বছরের সঠিক ইতিহাস ও বিভিন্ন তথ্যাবলী থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, এ সময়কালের ইতিহাস বাংলার মুসলমানদের শোষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন-নিষ্পেষণ, প্রতারণা-প্রবঞ্চনা ও হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস। আর এ কাজে ইন্ধন যুগিয়েছে, সর্বপ্রকারে সাহায্য সহযোগিতা করেছে কোম্পানী সরকারের অনুগ্রহপুষ।ট দেশীয় ‘বাদুদের’ দল। দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার মূল্যও তারা লাভ করে পূর্ণমাত্রায়। আর তা হলো এই যে, দেশের সমুদয় জমিদারী, জোতদারী প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসব ‘বাবুদের’ দেয়া হয়েছে চিরকালের জন্যে পুত্র-পৌত্রাধিক্রমে ভোগের জন্যে। আর এরা অগাধ ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হ’য়ে পড় উৎকোচ ও দুর্নীতির মাধ্যমে। -(E. Thompson: The life of Charles Lord Metcalfe; A. R. Mallic: British Policy & the Muslims of Bengal).
শোষণ-নিষ্পেষণের মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত হলো এই যে, ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে’ বাংলার লোক মরেছে তিনভাগের একভাগ, চরম অবনতি ঘটেছে চাষবাসের। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস হিসাব কষে ও কড়া চাপে নির্ধারিত রাজস্বেরও বেশী টাকা আদায় করেছেন মুমূর্ষু কৃষকদের দুঃখ মোচনের জন্যে খরচ করেননি। বরঞ্চ বাখরগঞ্জ জেলার ৩৩,৯১৩ মণ চাউল বিক্রয় ক’রে ৬৭,৫৯৩ টাকা মুনাফা লুটেছেন। ঢাকার ৪০,০০০ মণ চাউল বাঁকীপুরের সেনানিবাসে গুদামজাত করেছেন, বলেছেন আবদুল মওদুদ তাঁর ‘মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ’ গ্রন্থে (পৃ: ৬৩)।
আবদুল মওদূদ আরও বলেন, যে তাজমহলকে স্থপতিরা পৃথিবীর বুকে স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসাবে উল্লেখ করেন, যার নির্মাণকর্মে ২৩ কোটি ডলার ব্যয়িত হয়েছিল এবং যার পরিকল্পনা মানস সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিজয়ীর মানসকেও ম্লান করে লজ্জা দেয়, সেই তাজমহলটিকে ভেঙে তার মাল-মসলা আত্মসাৎ করার জন্যে ভারতে অন্যতম পরম দয়ালু ও কল্যাণসাধক বড়লাট হিসাবে নন্দিত লর্ড বেন্টিংক একবার একজন হিন্দু কন্ট্রাক্টরকে মাত্র দেড় লক্ষ ডলারে বিক্রয় করারও চুক্তি করেছিলেন। (The Round the World Traveller, Loreng: p. 379)। ওয়ারেন হেস্টিংস দেওয়ান-ই-খাসের হাম্মামখানাটি উপড়ে নিয়ে বিলাতে চতুর্থ জর্জকে উপহার পাঠিয়েছিলেন এবং লর্ড বেন্টিংক প্রাসাদটির অন্যান্য অংশ বিক্রয় করে ভারতের রাজস্ব বৃদ্ধি করেছিলেন (India: Chirol-p.54; The Story of Civilization, Our Oriental Heritage by Will Durant, pp. 609-10)।
এমনি, মহামূল্য লুণ্ঠিত ‘কোহিনুর’ এখনো ইংলন্ডের শাহীমহলের মোভা বর্ধন করছে। এহেন লুণ্ঠনকার্যের দ্বারা শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতা-ভব্যতার গর্বিত ইংরেজদের চরম হীন প্রবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
এডমন্ড বার্ক সত্যিই নিমর্শ উক্তি করেছেনঃ আমাদের আজ যদি ভারত ছাড়তে হয়, তাহলে ওরাংওটাং বা বাঘের চেয়ে কোন ভালো জানোয়রের অধিকারে যে এদেশ চিল তার প্রমাণ করবার কিছুই থাকবে না। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃঃ ৬৪)
কোম্পানীর শাসন আমল সমাপ্তির পূর্বক্ষণে জন ব্রাইট বলেছিলেন, “ভারতের নিরীহ জনগণের উপর এক শ’ বছরের ইতিহাস হলো অকথ্য অপরাধসমূহের ইতিহাস (Oxford History of India: p. 680).

হিন্দু মুসলিম সম্পর্কঃ ধর্ম ও সংস্কৃতি
মুসলমানরা, মধ্যযুদের প্রারম্ভকাল থেকে আরব, তুরস্ক, ইরান-তুরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। অতঃপর এ দেশকে তারা ভালোবেসেছে মনে-প্রাণে, তাদের চিরন্তত আবাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করেছে এ দেশকে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের হিন্দুর সাথে পাশাপশি বসবাস করে এসেছে। কিন্তু ঐতিহাসিক নির্মম সথ্য এই যে, হাজার বছরেরও বেশী কাল হিন্দু-মুসলমান একত্রে পাশাপাশি বাস করে, একই আকাশের নীচে একই আবহাওয়ায় পালিত বর্ধিত হয়েও এ দু’টি জাতি যে শুধু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি, তাই নয়, বরঞ্চ তাদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য এ সুদীর্ঘকালের মধ্যে তারা উভয়ে কখনো কখনো মিলেমিশে কাজ-কর্ম করেনি, একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়নি, তা নয়। তবে তা বিশেষ স্থান, কাল ও ক্ষেত্র বিশেষে –জাতি হিসাবে নয়, প্রতিবেশী হিসাবে। সেও আবার সামরিকভাবে। তাদের মধ্যে সৌহার্দ ও একাত্মতার স্থায়ী শিকড় বদ্ধমূল হতে পারেনি কখনো। এই যে পাশাপাশি বসবাস করেও উভয়ের মধ্যে দূরত্ব অক্ষুণ্ণ রইলো এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেনঃ
এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস ও সমাজবিধান সম্পূর্ণ বিপরীত… হিন্দুরা বাংলা সাহিত্যের প্রেরণা পায় সংস্কৃত থেকে আর মুসলমানরা পায় আরবী-ফারসী থেকে। মুসলমানদের ধর্মের গোঁড়ামিও মুসলমানদেরকে তাদের প্রতি সেরূপ বিরূপ করেছিল। … হিন্দুরা যাতে মুসলমান সমাজের দিকে বিন্দুমাত্র সহানুভূতি দেখানে না পারে, তার জন্যে হিন্দু সমাজের নেতাগণ কঠোর বিধানের ব্যবস্থা করেছিলেন। (রমেশ চন্দ্র মজুমদারঃ বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, পৃঃ ২৪২-৪৩ ও ৩৩৪-৫০)।
উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ব্যবধান, তা দূরীভূত হয়ে আত্মীক সম্পর্ক গড়ে না উঠার কারণ বর্ণতা করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বলেনঃ
“সকলের চেয়ে গভীর আত্মীয়তার ধারা নাড়ীতে বয়, মুখের কথায় বয় না। যাঁরা নিজেদের এক মহাজাত বলে কল্পনা করেন, তাঁদের মধ্যে নাড়ীর মিলনের পথ ধর্মের শাসনে চিরদিনের জন্য যদি অবরুদ্ধ থাকে, তাহলে তাঁদের মিলন কখনই প্রাণের মিলন হবে না। -[রবীন্দ্র রচনাবলী (শতবার্ষিকী সংস্করণ), ১৩’শ খন্ড-পৃঃ ৩০৮]
অতএব দেখা যাচ্ছে এই যে পার্থক্য এবং দূরত্ব এ শুধু বাহ্যিক ও কৃত্রিম নয়। এর গভীর মূলে রয়েছে উভয়ের পৃথক পৃথক ও বিপরীতমুখী ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতি। ভারতের এককালীন বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা H.V. Hodson ভারতের হিন্দু-মুসলমান দু’টি জাতি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি বলেনঃ
“…..এখানে বিরাট দু’টি সম্প্রদায় আছে যারা বসবাস করে একই দেশে বলতে গেলে এই গ্রামে, এই সুখ-দুঃখের অংশিদার হয়ে এবং একই সরকারের অধীনে। মূল জাতির দিক দিয়ে আলাদাও নয়। কারণ অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমান তাদের প্রতিবেশী হিন্দুর উর্ধ্বতন পূর্ব পুরুষদেরই বংশস্ভূত। তথাপি পৃথক ও স্বতন্ত্র। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিত-পদ্ধতির দিক দিয়েই স্বতস্ত্র নয়, বরঞ্চ জীবনের সামগ্রিক বিধান ও মানসিক দৃষ্টিভংগীর দিক দিয়েও স্বতন্ত্র। প্রত্যেক দল বা সম্প্রদায় স্থায়ী বংশভিত্তিক। না তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাহের প্রচলন আছে, আর না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা”। -(H.V. Hodson the Great Divide, p. 10)।
বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান আবহমানকাল থেকে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে চলেছে। ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেনঃ
“মুসলমানেরা মধ্যযুগের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যণ্ত স্থানবিশেষে ১৩০০ হইতে ৭০০ বৎসর হিন্দুরা সংগে পাশাপাশি বাস করিয়াও ঠিক পূর্বের মতো আছে। … অষ্টম শতাব্দীর আরম্ভে মুসলমানেরা যখন সিন্দুদেশ জয় করিয়া ভারতে প্রথম বসতি স্থাপন করে, তখনও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদগুলি ছিল, সহস্র বর্ষের পরেও এক ভাষার পার্থক্য ছাড়া ঠিক সেইরূপই ছিল। ….বর্তমান শতান্দীর প্রথম হইতে আমাদের দেশে একটি মতবাদ প্রচলিত হইয়াছে যে, মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতিরক মিশ্রণের ফলে উভয়েই স্বাতন্ত্র্য হারাইয়াছে। এবং এমন একটি নতুন সংস্কৃতি গঠিত হইয়াছে যাহা হিন্দু সংস্কৃতি নহে, ইসলামীর সংস্কৃতি নহে –ভারতীয় সংস্কৃতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে রাজা রামমোহন রায়, দ্বারিকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি এবং শেষভাগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় প্রভৃতি বাংলার তদানীন্তন শ্রেষ্ট নায়কগণ ইহার ঠিক বিপরীত মতই পোষণ করিতেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য এই বিপরীত মরেই সমর্থন করে। ১২০০ খৃষ্টাব্দে হিন্দুসমাজ ও হিন্দুধর্ম যাহা ছিল, আর ১৮০০ খৃষ্টাব্দে হিন্দুধর্ম ও সমাজ যাহা হইয়াছিল, এই দুয়ের তুলনা করিলেই সত্যতা প্রামণিত হইবে। -(রমেশ চন্দ্র মজুমদারঃ বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ, পৃঃ ২৪২-৪৩ ও ৩৩৪-৫০)।
মুসলমান ভারতে আসার পর হতে সহস্রাধিক বৎসর হিন্দুদের সাথে বসবাস করারপর উভয়ে মিলে এক জাতি গঠনের পরিবর্তে উভয়ের স্বাতন্ত্র্য অধিকতর সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় হয়েছে। কে. এম. পান্নিকর তাঁর Survey of India History গ্রন্থে মন্তব্য করেনঃ “ভারতে একটি ধর্ম হিসাবে ইসলাম প্রবর্তনের প্রধান সামাজিক পরিণামফল দাঁড়ালো এই যে, সমাজ দেহকে খাড়াভাবে দু’ভাগে বিভক্ত করা হলো। তের শতকের পূর্বে হিন্দু সমাজে যেসব বিভাগ দেখা দিয়াছিল, সেগুলির প্রকৃতি ছিল কিছুটা আনুভূতিক। তখন বৌদ্ধধর্মের পক্ষে এসব উপধর্মগুলিকে হজম করা সম্ভব ছিল এবং কালেবদ্রে এর হিন্দুধর্মের পরিসীমার মধ্যে আপন আপন আঞ্চলিক আবাস গড়ে নিয়েছিল। পক্ষান্তরে ইসলাম ভারতীয় সমাজকে আগাগোড়া স্পষ্ট দু’ভাগে বিভক্ত করে। এবং আজকের দিনরে ভাষায় আমাদের নিকট যা দুই তাত্বি বলে পরিচিত হয়েছে, তা সেই প্রথম দিনেই জন্মগ্রহণ করে। এরপর থেকে একই ভিত্তির উপর দু’টি সমান্তরাল সমাজ খাড়াভাবে বিভক্ত অবস্থায় বিরাজ করতে থাকে। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দু’টি সমাজ পৃথক ও স্বতন্ত্র হয়ে গেল এবং পৃথকভাবেই আত্মপ্রকাশ করলো। উভয়ের মধ্যে কোনরূপ সামাজিক সম্পর্ক-সম্বন্ধ বা জীবনের ক্ষেত্রে আদান-প্রদান রইলো না। অবশ্য হিন্দুত্ব থেকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ অবিরাম চলতে থাকলো। কিন্তু সংগে সংগে নতুন মতবাদ ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব এবং নতুন প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তার মনোভাব সৃষ্টি হলো। ফলে হিন্দু সমাজদেহ ক্রমশঃ অধিকতর শক্তিশালী হয়ে দেখা দিল”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর শিক্ষাপ্রাপ্ত পন্ডিতপ্রবর ডক্টর সৈয়দ মুজতাব আলী যে নির্মম সত্যউক্তি করেছেন, তা পাঠকবর্গকে পরিবেশন করা যেতে পারে। তিনি বলেনঃ
“বড় দর্শন নির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্র-পৌত্রেরা মুসলমান আগমনের পর শত শত বৎসর ধরে আপন আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিনউত পাশ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় শত শত বৎসর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিয়-প্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু-আলী সিনা, আলগাজ্জালী, আবু রুশদ ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চা হলো, তার কোন সন্ধানই পেলেন না। এবং মুসলমান মওলানাও কম গাফলতি করলেন না –তিনি একবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুস্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। …শ্রীচৈতন্য নাকি ইসলামের সংগে পরিচিত ছিলেন …কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নব-যৌবনের পথে নিয়ে যাওয়ার। ….মুসলমান যে জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন এনেছিলেন এবং পরবর্তী যুদে বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরংজেব পর্র্যন্ত মগোল জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র করি-পন্ডিত-ধর্মজ্ঞ-দার্শনিক এ দেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব-পান্ডিত্য উজাড় করে দিলেন, তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত দার্শনিকেরা কনামাত্র লাভবান হননি… হিন্দু পন্ডিতের সংগে তাঁদের কোনও যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি”। -(বড়বাবু, সৈয়দ মুজতাব আলী)।
ইসলামী তৌহিদের চিত্তচাঞ্চল্যকর বিপ্লবী বাণী, স্রষ্টা সমীপে সর্বস্ব নিবেদন ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও প্রেম, তার সাম্যের বাণী ও সুবিচার, তার গণতান্ত্রিক আদর্শ মানুষের মনে যে আবেদন-পুলক সৃষ্টি করে তা ছিল অপ্রতিরোধ্য। ফলে দলে দলে হিন্দুগণ ইসলামের সুশীতল ছায়ায়, আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। তারপর হিন্দুধর্মের কাজ হলো আত্মরক্ষার। ইসলামের বাণীর মুখে আত্মরক্ষা তেমন সহজও ছিলনা। তাই ভারতের এখানে সেখানে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণী প্রচারিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছে যুগে যুগে –রামানন্দ, একলব্য, দাদু, নানক কবীর প্রভৃতি সাধক-প্রচারকদের আবির্ভাবে। ইসলামের অদ্বৈতবাদকে ভিত্তি করে তারা হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে চেয়েছিলেন ইসলাম থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। অথবা ইসলাম ধর্মে হিন্দুত্বের প্রভাব ও অনুপ্রবেম ঘটিয়ে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের মতো ইসলামকে সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বের মুখে ঠেলে দেয়ার প্রচেষ্টা করেছেন মাত্র।
এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদ বলেনঃ
“এ আন্দোলনগুলি অবশ্য বিশ শতকের রাজনীতিক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধায় আসে এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ নামাংকিত করে হিন্দু রাজনীতিকেরাই এক ভারতীয় সংস্কৃতির ধূঁয়া তোলে, তাছাড়া অনতিকাল মধ্যে এগুলো ইসলাম ও দন্ডধর মুসলিম শক্তিকে বাধা দেবার ও সম্ভব হলে বিতাড়িত করবার সত্রিয় প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে উঠে। তখন তাদের রাজনীতিক ভূমিকা ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন এসব সমন্বয় সাধনার বুলি স্পষ্ট হয়ে উঠে। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ২৫)।
আবদুল মওদূদ, আহমদ শরীফ প্রণীত ‘মুসলিম পদ সাহিত্য’ (সাহিত্য পত্রিকা, বর্ষা সংখ্যা, ১৩৬৭) –এর বরাত দিয়ে বলেনঃ
“শিক বা বৈষ্ণব আন্দোলনে যে এ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল –তার বহু প্রমাণ আছে। রাষ্ট্রীক প্রয়োজনে বাদশাহ আকবর থেকে গান্ধীর কাল পর্যন্ত সমন্বয় সাধনের পথ অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর ‘রামধুন’ সংগীত ও নজরুলের কয়েকটি কবিতাকে শেষ প্রয়াস ধরে নেয়া যেতে পারে”।
অতঃপর তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে এগুলো ছিল সর্বগ্রাসলোভী ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের অভিনব প্রয়াস –এ পথেই অঝগরের মতো ইসলামকে লীন করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। রাষ্ট্রীক প্রয়োজনে এ ধর্মসমন্বয় ও সংস্কৃতির ঐক্যের মহামন্ত্র অতীতে উদগীত হয়েছিল এবং এখনও হয়ে থাকে। (আবদুল মওদূত-ঐ-পৃঃ২৫)।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, নিছক রাজনৈতিক কারণে সম্রাট আকবর থেকে আরম্ভ করে বিংশতি শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ে জগাখিচুড়ি তৈরী করে এক ভারতীয় জাতি ও সংস্কৃতি অথবা এক বাঙ্গালী জাতি ও সংস্কৃতি বলে চালাবার যে হাস্যকর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তা জাল ও অচল মুদ্রার মতো সত্যনিষ্ঠদের দ্বারা প্রত্যাখ্যান হয়েছে। কারণ তা ছিল অস্বাভাবিক, অবান্তর ও অসম্ভব।

সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ
বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ জাতি হিন্দু ও মুসলমান দু’টি স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির ধারক বাহক –এ দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, দু’টি স্বতন্ত্র ধর্মবিশ্বাসী একই দেশে মিলেমিশে, শান্তিতে ও নির্বিবাদে বসবাস করতে পারলোনা কেন। পৃথক ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সদ্ভাব, সৌহার্দ ও মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি কেন? এর জন্য দায়ী কে? তারা কি উভয়ে না কোন একটি দল? এর সঠিক জবাব ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হবেনা নিশ্চয়।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সংঘর্ষের মূল কারণ যে প্রধানতঃ রাজনৈতিক তাতে সন্দেহ নেই। এ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে জন্যে ধর্মের নামে স্বজাতিকে ডাক দেয়া হয়েছে, প্রতিপক্ষকে ধর্ম বিনষ্টকারী পরস্বাপহরণকারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিদেশী-হানাদার, নরসন্তা, নারী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিপক্ষকে বিদেশী-হানাদার, নরহন্তা, নারী ধর্ষণকারী, প্রতিমা ও মন্দির ধ্বংসকারী বলে চিত্রিত করে স্বজাতির মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ উপমহাদেশে হিন্দুশাসনের পরিবতর্থে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা হিন্দুজাতি মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। অষ্টম শতকের পর থেকে পরবর্তী কয়েক শতক পর্যন্ত মুসলিম সামরিক শক্তির, বলতে গেলে যৌবন-জোয়ার জলতরংগ দেশদেশান্তর ব্যাপী প্লাবন এনে দিচ্ছিল। এ অপ্রতিহত শক্তির মুখে ভারতীয় রাজনৈতিক শক্তি টিকে থাকতে পারেনি বলে মুসলিম শাসন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাই বলে এ দেশের বিজিত হিন্দুগণ হৃত রাজ্যের জন্য দুঃখ-অপমানে-লজ্জায় মুসলিম শাসন অন্তর দিয়ে মেনেও নিতে পারেনি। তাদের অন্তরাত্মা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছিল। বহু শতকের পুঞ্জিভূত বিক্ষোভ ও প্রতিহিংসার বহ্নির বিস্ফোরণ ঘটেছিল মধ্যভারতে রাজপূত, মারাঠা, শিখদের বিদ্রোহের মাধ্যমে এবং তা সার্থক হয়েছিল ১৭৫৭ সালে সিরাজদৌলার পতনে। তারপর থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত দেড় শতাব্দী যাবত মুসলমানদের জীবনে নেমে এসেছিল চরম দুর্দিন। হিন্দু ও ইংরেজদের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে তাদেরকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে উৎখাত করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা ও কৌশল অবলম্বন করা হয়। এ সময়কালে হিন্দুজাতি ইংরেজদের ভূয়সী প্রশংসা ও বিগত মুসলিম শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে অকথ্য কুৎসা রটনা করেছে। বাংলা সাহিত্য ও কবিতা ইসলাম ও মুসলমানদের কাল্পনিক কুৎসা রটনায় ভরপুর হয়ে আছে। কবি ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রংগলাল বন্দোপধ্যয়, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যয়, নবীনচন্দ্র এবং সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় থেকে শুরু করে ছোটো-বড়ো সকল হিন্দু কবি সাহিত্যিকগণ ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন ইসলাম ও মুসলমানদের চরিত্রে কলংক আরোপ করাকে। অনেকের ধারণা মুসলমানদের চরিত্র বিকৃতকরণের ব্যাপারে শরৎপন্দ্র চট্টোপাধ্যয় সকলের পিছনে, কিন্তু তথাপি তাঁর কলমও কম বিষোদগার করেনি।
ভারত উপমনাদেশে হিন্দু মুসলমানের মিলনের জন্য কম চেষ্টা-সাধনা হয়নি। এ ধরনের মিলনের প্রচেষ্টা যখন চলছিল, সে সময়ে শরৎবাবুর লিখনী মুসলমানদের খোঁচা দিতে ভুল করলো না, তিনি তাঁর ‘দিক কয়েকের কাহিনী’ শীর্ষক প্রবন্ধের এক স্থানে বলেন-
“…শুনিতে পাইলাম হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি একদিন জাতীয় সহাসভার মধ্যে সুসম্পন্ন হইয়া গেল। সবাই বাহিরে আসিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বলিতে লাগিল –যাক বাঁচা গেল, চিন্তা আর নাই। নেতারা হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান করিয়া দিলেন, এবার শুধু কাজ, শুদু দেশোদ্ধার। প্রতিনিধিরা ছুটি পাইয়া মুখে দলে দলে টাঙ্গা, এক্কা এব মোটর ভাড়া করিয়া প্রাচীন কীর্তিস্তম্ভ সকল দেখিতে ছুটিলেন। সে ত আর এক আধটা নয়, অনেক। সংগে গাইড, হাতে কাগজ-পেন্সিল –কোন কোন মসজিদ কয়টা হিন্দু মন্দির ভাঙ্গিয়া তৈয়ার হইয়াছে, কোন ভগ্নস্তূপের কতখানি হিন্দু ও কতখানি মোসলেম, কোন বিগ্রহের কে কবে নাক এবং কান কাটিয়াছে ইত্যাদির বহু তথ্য ঘুরিয়া ঘুরিয়া সংগ্রহ করিয়া ফিরিতে লাগিলেন। অবশেষে শ্রান্ত দেহে দিনের শেষে গাছতলায় বসিয়া পড়িয়া অনেকেরই দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সহিত মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিতে লাগিল –উঃ হিন্দু-মোসলেম ইউনিটি”। -(বিজলী ২৫ আশ্বিন, ১৩৩০)।
চট্টোপাধ্যয় মহাশয় আরও বলেন,
-ইংরেজেরদ আর যাহাই দোষ থাক, -যে মন্দিরের প্রতি তাহার বিশ্বাস নাই তাহারও চূড়া ভাঙে না, যে বিগ্রহের সে পূজা করে না, তাহারও নাক কান কাটিয়া দেয় না। অতএব যে কোন দেবায়তনের মাথার দিকে চাহিলেই বুঝা যায় ইহার বয়স কত। স্বামীজী দেখাইয়া দিলেন –‘ওটি অমুক জিউর মন্দির –সম্রাট আওরাংজেব ধ্বংস করিয়াছেন, ওটি অমুক জিউর মন্দির –অমুক বাদশাহ ভূমিসাৎ করিয়াছেন, ওটি অমুক দেবায়তন ভাঙিয়া মসজিদ তৈয়ার হইয়াছে (ইংরেজ কর্তৃক), ইত্যাদির পুণ্যময় কাহিনীতে চিত্ত একবারে মধুময় করিয়া আমরা অকেন রাত্রে আশ্রমে ফিরিয়া আসিলাম।
-(বিজলী, ২৩ কার্তিক, ১৩৩০ সাল)
একই কলমের দ্বারা ইংরেজদের প্রশংসাসহ পুষ্পবর্ষণ করা হচ্ছে এবং অতীতের মুসলমান শাসকদের মুন্ডপাত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, হিন্দুমন্দিরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হচ্ছে। তাহলে বলতে হবে হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা প্রহসন মাত্র, তার মধ্যে ঐকান্তিকতার লেশমাত্র নেই।
কবি হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যয় ইংরেজ প্রভুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় গেয়ে উঠলেন-
“না থাকিলে এ ইংরাজ
ভাত অরণ্য আজ –কে শেখাতো, কে দেখাতো
কে বা পথে লয়ে যেতো
যে পথ অনেক দিন করেছ বর্জন”।
-(শতাব্দী পরিক্রমা, ডঃ হাসান জামান সম্পাদিত, পৃঃ ২৮৪)
ঊনবিংশ শতকের প্রথম পাদে হিন্দু জমিদার ও কোম্পানী শাসনের দ্বারা বাংলার মুসলমান নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ও জর্জরিত হচ্ছিল এবং তার প্রতিবাদে বাংলায় ফারায়েজী আন্দোলন ও সাইয়েদ তিতুমীরের আন্দোলন প্রচন্ড আকার ধারণ করে। পরবর্তীকালে সাইয়েদ আহমদ শহীদের জিহাদী আন্দোলন সারা ভারতে এক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অতঃপর ভারতের প্রথম আযাদী আন্দোলন শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। এ সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার ফলে ভারতীয় মুসলমান ইংরেজদের কোপানলে পড়ে কোন অসহনীয় জীবন যাপন করছিল, তা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে। জেল, ফাঁসী, দ্বীপান্তর, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং ইংরেজ কর্তৃক অন্যান্য নানাবিধ অমানুষিক-পৈশাচিক অত্যচারে মুসলিম সমাজদেহ যখন জর্জরিত, সে সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় লিখনীর নির্মম আঘাত শুরু করেন মুসলিম জাতির জর্জরিত দেহের উপর। তিনি তাঁর আনন্দমঠ, রাজসিংহ, দুর্গেশনন্দিনী, দেবী চৌধুরী প্রভৃতি উপন্যাসগুলিতে মুসলমানদের বিরুদ্দে যে বিষোদগার করেছেন তাতে পাঠকের শরীর রোমাঞ্চিত হবারই কথা। তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং তাঁর বর্ণনামতে মুসলমান কর্তৃক ‘হিন্দু মন্দির ধ্বংস’, ‘হিন্দু নারী ধর্ষণ’ প্রভৃতি উক্তির দ্বারা হিন্দুজাতির প্রতিহিংসা বহ্নি প্রজ্জলিত করার সার্থক চেষ্টা করা হয়েছে। ১৮৯৮ সালে মুসলিম এডুকেশান সোসাইটি অধিবেশনে নবাব নবাব আলী চৌধুরীর উদ্যোগ বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারণার তীব্র প্রতিবাদ করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত করে হিন্দু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে দেয়া হয়। কোন পত্রিকায় তা ছাপা হয়নি, শুধুমাত্র ‘ভারতী’ পত্রিকায় বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করা হয়। -(Bengali Muslim Public Opinion as reflected in the Bengal Press-1901-30: Mustafa Nural Islam PP.141-42).
সাহিত্যের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারণার দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু উদ্ধৃতি নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
“রাজপুত্রী বলিলেন –আমি এই আলমগীর বাদশাহের চিত্রখানি মাটিতে রাখিতেছি সবাই উহার মুখে এক একটি বাঁ পায়ের লাতি মার। কার লাতিতে উহার নাক ভাঙ্গে দেখি”। -[রাজসিংহ (১ম খন্ড( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে চিত্রদলনা।]
“ঔরঙ্গজেবের দুই ভগিনী- জাহানারা ও রওশনারা। জাহানারা শাহজাহাঁর বাদশাহীর প্রধান সহায়। …তিনি পিতার বিশেষ হিতৈষিনী ছিলেন। কিন্তু তিনি যে পরিমাণে এ সকল গুনবিশিষ্টা ছিলেন, ততোধিক পরিমাণে ইন্দ্রিয় পরায়ণা ছিলেন। ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য অসংখ্য লোক তাঁহার অনুগতির পাত্র ছিল। সেই সকল লোকের মধ্যে ইউরোপীয় পর্যটকেরা এমন এক ব্যক্তির নাম করেন যে, তাহা লিখিয়া লেখনী কলুসিত করিতে পারিলাম না!” –(রাজসিংহ, ২য় খন্ড, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ জেবউন্নিসা।)
“ঔরঙ্গজেবের তিন কন্যা। …জ্যেষ্ঠ জেব-উন্নিসা বিবাহ করিলেন না। পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মত পুষ্পে মধু পান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন”। -(রাজসিংহ, ২য় খন্ড দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ জেব-উন্নিসা।)
সতীসাধ্বী মুসলিম রমীণদের চরিত্রে কতকানি কলংক আরোপ করা হয়েছে তা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই স্বীকার করবেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘লেখনী কলুষিত করিতে পারিলেন না’। -বলে খেদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একজন লোকের নিছক মুসলিম বিদ্বেষের কারণে, বিবেক ও রুচি কতখানি বিকৃত ও ব্যাধিগ্রস্থ হলে কোন অন্তঃপরবাসিনী পর্দানশীল সতীসাধ্বী দ্বীনদার খোদাভীরু মুসলিম রমণীর চরিত্র তিনি এমনভাবে কলংকিত করতে পারেন, তা পাঠকের বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়।
পূণ্যবতী জেব-উন্নিসার চরিত্র অধিকতর জঘন্যভাবে চিত্রিত করতে বঙ্কিম কণামাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। না করবারই কথা। মুসলমানের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষে আগাগোড়া বাদশাহ আওরংজেব-আলমগীর ও তাঁর বিদূষী কন্যা জেন-উন্নিসার চরিত্র জঘন্যরূপে বিকৃত করে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর মনের সাধ মিটিয়েছেন।
‘দুর্গেশনন্দিনী’ গ্রন্থে জগৎসিংহের সাথে আয়েশা নাম্নী এক কল্পিতা মুসলিম মহিলার অবৈধ প্রণয় কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। স্যার যদুনাথ সরকার ‘দুর্গেশনন্দিনী’ সম্পর্কে বলেনঃ “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে সত্য ইতিহাস কতটুকু আছে? মানসিংহ, জগৎসিংহ, কুৎলু খাঁ, খাজা ইসা, উসমান –ইহারা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ ….ইহা ভিন্ন ‘দুর্গেশনন্দিনী’র আর সব কথা কাল্পনিক।….
আয়েশা, তিলোত্তমা, বিমলা সকলেই কাল্পনিক। এগুলি আসিয়োছে ঐতিহাসিক নামজাদা একজন ঘোর কাল্পনিক হাসেবের লেখা হইতে, তিনি কাপ্তান আলেকজান্ডার ডাও (Alexnder Dow)। এই সাহেবটি ফিরিশতা রচিত হিন্দুস্থানের ইতিহাস ইংরাজীতে প্রায়শঃ অনুবাদ করিয়া দিতেছেন বলিয়া এবং নিজ গ্রন্থের নামপত্রে ফিরিশতার নাম সংযোগ করিয়া দিয়া অপর্যাপ্ত মেকী কথা চালাইয়াছেন, যাহা ফিরিশতাতো লেখেন নাই, এমনটি, কোনও পারসিক লেখকের পক্ষে সেরূপ সম্ভব ছিল না”। -[কঙ্কিম রচনাবলী, ষষ্ঠ প্রকাশ ১৩৮২ (উপন্যাস প্রসংগ) পৃঃ ২৯-৩০।]
একথা সত্য যে, মুসলমানদের ইতিহাস ও চরিত্র বিকৃতকরণে ইংরেজ এবং হিন্দু উভয়েই বাকপটুতা প্রদর্শন করেছেন। তবে এ ব্যাপারে কে কতখানি অগ্রগামী তা বলা কঠিন।
‘আনন্দমঠে’ বঙ্কিমচন্দ্র মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে বলছেনঃ “দেখ যত দেশ আছে মগধ, মিথিলা, কাশী, কাঞ্চী, দিল্লী, কাশ্মীর, কোন দেশের এমন দুর্দশা, কোন দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে ঘাস খায়? কাঁটা খায়? উইমাটি খায়? বনের লতা খায়? কোন দেশে মানুষ শিয়াল-কুকুর খায়, মড়া খায়? কোন দেশের মানুষের সিন্দুকে টাকা রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, সিংহাসনে শালগ্রাম রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঘরে ঝি-বউ রাখিয়া সোয়াস্তি নাই, ঝি-বউদের পেটে ছেলে রাখিয়া সোয়াস্তি নাই? পেট চিরে ছেলে বার করে। ….আমাদের মুসলমান রাজা রক্ষা করে কই? ধর্ম গেল, জাতি গেল, মান গেল, কুল গেল, এখন ত প্রাণ পর্যন্ত যায়। এ নেশাখোর নেড়েরদের না তাড়াইলে আর কি হিন্দুর হিন্দুয়ানী থাকে?’ –(‘আনন্দমঠ’, প্রথম খন্ড, দশম পরিচ্ছেদ।)
বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর মন্ত্রশিষ্যগণ তাঁদের সাহিত্যে, কবিতায়, প্রবন্ধে মুসলমানদের নামের পূর্বে ‘নেড়ে’, ‘পাতি নেড়ে’, ‘স্লেচ্ছ’ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার না করে লেখনী ধারণ করা পাপ মনে করতেন। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে জগৎসিংহ ও কল্পিত আয়েশাকে পরস্পর প্রণয়াবদ্ধরূপে দেখানো হয়েছে। তবুও আয়েশাকে যবনী বরে আত্মতৃপ্তি লাভ করা হয়েছে। দ্বাবিংশতিতম পরিচ্ছেদে সমাপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘আয়েশা যবনী হইয়াও তিলোত্তমা আর জগৎসিংহের অধিক স্নেহাবশত সহচরীবর্গের সহিত দুর্গান্তঃপুরবাসিনী হইলেন”।
আল্লাহ, কোরআন শরীফ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে উপহাস করে ‘আনন্দমঠে’র চতুর্থ খন্ড, পঞ্চম পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে-
মুসলমানেরা বলিতে লাগিল, ‘আল্লা-আকবর! এতনা রোজের পর কোরআন শরীফ বেবাক কি বুটা হলো? মোরা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ করি, তা এই তেলককাটা হিঁদুর দল ফতে করতে নারলাম?”
বিপিন চন্দ্র পাল ‘আনন্দমঠ’ সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ
“আনন্দমছে তিনি দেশমাতৃকাকে মহাবিষ্ণুর বা নারায়ণের অংশে স্তাপন করিয়া আমাদের দেশপ্রীতি ও স্বদেশ সেবাব্রতকে সাধারণ মানবপ্রীতি এবং বিশ্বমানবের সেবার সঙ্গে মিলাইয়া দিয়াছেন। মহাবিষ্ণুকে বা নারায়ণকে বা বিশ্বমানবকে ছাড়িয়া দেশমাতৃকার পূজা হয় না। এ কথাটা আনন্দমঠের একটা অতি প্রধান কথা”। -(নবযুগের বাংলা সাহিত্য, পৃঃ ১০৯)
রমেশচন্দ্র দত্ত ‘ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা’র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় শীর্ষক প্রবন্ধে (১১’শ সংস্করণ, ষষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ১১০) বলেনঃ
“আনন্দমঠের’ সারকথা হলো ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি গ্রহণ করে উৎপীড়নমূলক মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানো। …শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, ভারতে একটি হিন্দুরাজ্য স্থাপনের আদর্শে ‘আনন্দমঠ’ উদ্দীপ্ত”।
মোটকথা, বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ লিখে একদিকে মুসলমান জাতির বিরুদ্ধে তাঁর স্বজাতিকে ক্ষিপ্ত করে তুলোছেন এবং ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের মাধ্যমে ধর্মের নামে –দেবী দেশমাতৃকার নামে হিন্দুজাতির মধ্যে পুনর্জাগরণের প্রেরণা সৃষ্টি করেছেন। এ পুনর্জাগরণ সম্ভব মুসলিম দলনে এবং ব্রিটিশ শাসনকে এদশে স্বাগতঃ জানিয়ে এবং সুপ্রতিষ্ঠিত করে –এ ভাবধারা আনন্দমঠের ছত্রে ছত্রে প্রবাহিত। ‘আনন্দমঠের’ বন্দেমাতরম মন্ত্রের সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বংগভংগ রদ আন্দোলনে।
বংগভংগ ও বংগভংগ বিরোধী আন্দোলন যথাস্থানে আলোচিত হবে। তবে এখানে ‘বন্দোমাতরমের’ ভাবাদর্শে যে সন্ত্রাসবাদ জন্মলাভ করেছিল তার কিঞ্চিৎ আভাস দিয়ে রাখি।
আবদুল মওদূদ বলেনঃ
সন্ত্রাসবাদ বাংলার মাটিতে আসন খুঁজে পায়নি উনিশ শতকে এবং ভদ্রলোকদের সহানুভূতিও লাভ করেনি। ১৯০৩ সালের পূর্বে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ লন্ডন থেকে কোলকাতায় প্রত্যাগমন করে উত্তেজনা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন, কিন্তু কোন সহানুভূতি পাননি।
….বিফল হ’য়ে তিনি বরোদায় বড়দানা অববিন্দ ঘোষের নিকট গমন করেন। অরবিন্দ ইংলন্ডে উচ্চশিক্ষিত। তিনি তখন গায়কোয়াড় কলেজের ভাইসপ্রেসিডেন্ট ছিলেন। বারীন্দ্র বরোদায় বসে অনুধাবন করেন, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একাঙ্গীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ হবে না। এ জণ্যে তিনি গীতাপাঠের সঙ্গে রাজীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে ‘অনুশীলন সমিতি’র পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষ করতে থাকেন।
“সুযোগ মিললো ১৯০৪ সালে, অরবিন্দ এসে যোগ দিলেন ১৯০৫ সালে। বাংলা বিভাগ কার্যকর হলো, বাঙালী হিন্দু শিক্ষিত সস্প্রদায় বিক্ষেভে ফেটে পড়লো। ‘বংগমাতার’ অংগচ্ছেদ বলে বিভাগটার ধর্মীয় রূপ দেয়া হলো এবং সমগ্র হিন্দু বাংলা আন্দোলনে মেতে উঠলো”। -(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতি রূপান্তর, পৃঃ ২০২।)
‘আনন্দমঠের’ বন্দেমাতরম মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ কেই বাংলার মাটিতে সন্ত্রাসবাদ জন্মলাভ করে। অরবিন্দ ঘোষের স্বীকৃতিই তার প্রমাণ। ১৯০৭ সালের ১৬ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্রের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ লিখেন। তার থেকে কিঞ্চিত উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হলোঃ
“The earlier Bankim was only a poet and stylist –the latr Bankim was a saint and a nation-builder”.
অর্থাৎ, ‘প্রথম দিককার বঙ্কিম একজন কবি ও শিল্পী –শেষ দিককার বঙ্কিম- ঋষি ও জাতি গঠনকারী’। তিনি আরও বলেন-
“It was thirty two years ago that Banking wrote his great song The Maitra had been given and in a Single Day a whole people had been converted to the religion of patriotism. The mother had revealed herself A great nation which has had that vision can never again be placed under the foot of the conqueror”.
অর্থাৎ “বত্রিশ বছর বঙ্কিম তাঁর বিখ্যাত ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত রচনা করেছিলেন। মন্ত্র ফুঁকে দেয়া হলো, আর একদিনেই গোটা জাতি দেশমাতৃকার ধর্মে দীক্ষিত হ’য়ে গেল। দেশমাতা আত্মপ্রকাশ করলেন ….সেই স্বপ্নসাধ পোষণ করতো যে এক বিরাট জাতি, সে আর বিজেতার পদতলে লুণ্ঠিত হবে না”। -[শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগাল-(বঙ্কিম রচনাবলী গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্কিম পরিচিতি লেখক), পৃঃ ২৫-২৬।]
বঙ্কিম সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের প্রতি বিষোদগীরণের বিরুদ্ধে বিংশতি শতকের প্রথম পাদে মুসলিম পত্র-পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। বরঞ্চ হিন্দুদের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবাদ ও হিংস্রতা ক্রমশঃ বেড়েই চলছিল। কোলকাতা থেকে প্রকাশিক মাসিক পত্রিকা ইসলাম প্রচার-এর বাংলা ১৩১৪ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায় (১৯০৭ খৃঃ) নিম্নের চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়ঃ
“ইংরেজ এবং মুসলমানদের উৎখাত করার সংকল্প নিয়ে সর্বশ্রেণীর হিন্দুদেরকে –উচ্চশিক্ষিত থেকে স্কুলের ছাত্র পর্যন্ত –লাঠিখেলা ও কুস্তি শিক্ষার জন্যে দলে দলে ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের ভয়াবহ গতিবিধি সারা বাংলার বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে। এসব ঠগেরা কুমিল্লায় একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে, জামালপুরে দু’জনকে জবাই করেছে এবং হিন্দু ও মুসলমান ফকীর সন্যাসীদের ছদ্মবেশে সারা বাংলায় আতংক ছড়াচ্ছে। মৌলভীর ছদ্মবেশে তারা হিন্দুদের লুন্ঠন করার, হিন্দু বিধবাদের বিবাহ করার, এবং হিন্দু নারী ধর্ষণের জন্যে মুসলমানদেরকে প্ররোচিত করছে এই বলে যে, এ ব্যাপারে সরকার এবং ঢাকার নবাবের কাছ থেকে নিশ্চিত সাহায্য পাওয়া যাবে।
‘ইসলাম প্রচারকের’ এই সংখ্যায় আরও সংবাদ পরিবেশিত হয় যে, পাঞ্জাবে হিন্দুদের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা এবং বিশেষ করে আর্যসমাজী কংগ্রেসী টাউটদের তৎপরতার বিরুদ্ধে মুসলিম সমিতিগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন যে, এসব হিন্দু সন্ত্রাসবাদ ও অরাজকতার সাথে মুসলমানদের কোনই সংস্রব সম্বন্ধ নেই।
এ অধ্যায়ে আমাদের আলোচ্য বিষয়বস্তু ‘সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ’। এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের মূল উৎস কঙ্কিম সাহিত্য। বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলমানদেরকে ‘যবন’, ‘স্লেচ্ছ’, ‘নেড়ে’, ‘পাতি নেড়ে’ প্রভৃতি ইতর ভাষায় আখ্যায়িত করে এ যবন ও স্লেচ্ছ নিধন হিন্দুজাতির ব্রত ও পূণ্যকর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে। ‘বন্দোতরম’ মন্ত্র এ যবন নিধনে তাদেরকে প্রেরণা যোগায়। কিন্তু বিংশতি শতাব্দীর প্রথম পাদে একদিকে যখন হিন্দু-মুসলিম মিলনের গান হচ্ছিল সারা দেশে, তখন হিন্দু-মুসলিমের যুক্ত বৈঠক ও সভাসমিতিতে অনিবার্যরূপে গাওয়া হতো ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত। মুসলমানের বহু আপত্তি ও প্রতিবাদ সত্বেও তাঁরা নিবৃত্ত হননি।
মাসিক পত্রিকা ‘শরিয়তে ইসলাম’ বাংলা ১৩৩৫ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় (১৯২৮ খৃঃ) হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সভায় ‘বন্দোমাতরম’ সংগীত বন্ধ কররা দাবী জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন। The Mussalman-এর সম্পাদক মৌলভী মজিবর রহমান কংগ্রেসের জাতীয় কমিটির নিকটে সভাসমিতিতে ‘বন্দোমাতরম’ নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু এতেও কোনই ফল হয়নি।
হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের আর একটি কারণ হলো মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার এবং হিন্দু জমিদারীর অধীনে ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলমানদের গো-কোরবানীতে বাধা দান। এ নিয়ে বহু বাদ-প্রতিবাদের কোন লাভ হয়নি।
মুসলিম ভারতের উপরে চরম আঘাত হানে আর্য সমাজীদের ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ আন্দোলন। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা লালা হরদয়াল কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতিতে বলা হয়, যা ১৯২৫ সালের ২৫শে জুলাই Times of India-তে প্রকাশিত হয়ঃ
“হয় মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করতে হবে, নতুমা জীবন ও মানসম্মানসহ ভারত পরিত্যাগ করতে হবে”। আর্য সমাজের স্বামী শ্রদ্ধানন্দের প্রধান শিষ্য সত্যদেব একই সময়ে ঘোষণা করেনঃ
“আমরা শক্তি অর্জন করার পর মুসলমানদের নিকটে এ শর্তগুলি পেশ করব, ‘কোরআনকে আর ঐশী গ্রন্থ হিসাবে চলবে না, মুহাম্মদকে খোদার নবী বলে স্বীকার করা চলবে না, মুসলমানী অনুষ্ঠান পর্বাদি পরিত্যাগ কের হিন্দু পর্ব পালন করতে হবে। মুসলমানী নাম পরিত্যাগ করে রামদ্বীন, কৃষ্ণখান, ইত্যাদি নাম রাখতে হবে। আরবী ভাষায় উপাসনার পরিবর্তে হিন্দী ভাষায় উপাসনা করতে হবে”। A History of the Freedom Movement পৃঃ ২৬২ থেকে গৃহীত। -(Mustafa Nurul Islam: Bengali Muslim Public Opinion as refcted in the Bengal Press 1901-1930, 0=p. 125)।
রাজনৈতিক হাংগামার প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল বোম্বাইয়ে যখন হিন্দুনেতা বালগঙ্গাধর তিলক দুটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসবকে প্রাধান্য দিয়ে হিন্দু জনমত ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত করতে থাকেন। এ দুটি উৎসবের একটি হলো ‘গণেশের’ পূজা আর দ্বিতীয়টি ‘শিবাজী’ উৎসব। স্কুল কলেজের যুবকদের সামরিক শিক্ষা দিয়ে, এ দুটি উৎসবকে কেন্দ্র করে, হিন্দু ক্ষাত্র শক্তিকে জাগ্রত করা হয়। তিলক শিবাজী উৎসবে পৌরহিত্যকালে ভগবদগীতার উদ্ধৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন যে, আত্মকারণে না হলে জাতি বা দেশমাতার কারণে গুরু ও আত্মীয় হত্যায় কোন পাপ হয় না। তাঁর শিক্সায় স্কুল কলেজের ছাত্র শিক্ষক উদ্দীপ্ত ও উত্তেজিত হয়ে গুপ্ত সমিতি গঠন করতে থাকে হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য।
বংগবংগের পর ১৯০৬ সালে এ আন্দোলন হঠাৎ জোরদার হয়ে উঠে এবং সারা ভারতব্যাপী ‘শিবাজী উৎসব’ পালন করে হিন্দুধর্ম পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা হতে থাকে। এ উৎসবে সকল প্রখ্যাত হিন্দু সমাজনেতা, রাজনীতিবিদ, কবি সাহিত্যিক সানন্দে যোগদান করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ‘শিবাজী উৎসব’ লিখে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনে প্রত্যক্ষ যোগদান করেন। তিনি ‘শুভশঙ্খনাদে জয়তু শিবাজী’ উচ্চারণ করে এ ‘ধ্যানমন্ত্রে’ দীক্ষা গ্রহণ করেনঃ
ধ্বজা করি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরী বসন-
দরিদ্রের বল।
‘এক ধর্ম রাজ্য হবে এ ভারতে’ এ মহাবচন
করিল সম্বল।
(Indian Sedition Committee Report, 1918, p. 2; B.B. Misra: the Indian Middle class: Their growth, আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ দ্রষ্টব্য)।
বাংলা তথা সারা ভারতে রাজনীতি ও হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলন একাকার হয়ে গেল। ধর্মীয় উন্মুত্ততা রাজনীতির আবহাওয়াকে করলো বিষাক্ত ও কলুষিত এবং ফলে চারদিকে শুরু হলো হিন্দু-মুসলিম বিরোধ ও সংঘর্ষ। একে অপরের রক্তে হাত রঞ্জিত করতে লাগলো।
খেলাফত আন্দোলন চলাকালে সাময়িকভাবে হলেও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতি সাধিত হয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে হিন্দুজাতি একরকম বলতে গেলে ‘মুসলিম আতংকের’ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ ব্যাধি ছড়াচ্ছিলেন প্রধানতঃ বিপিনচন্দ্র পাল, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, লালা লাজপৎ রায় এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। এ চার ব্যক্তি ছিলেন, ‘শুদ্ধি সংগঠন’ আন্দোলনের উদ্যোক্ত, এবং সংগ্রেসের জাতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্বের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় এঁদের অবদান ছিল সর্বাধিক। উপরন্তু এঁরা সারা ভাবতে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দীভাষা প্রবর্তনেরও জোরাদার ওকালতি করেন।
রিয়াজুদ্দীন আহমদ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সম্পাদিত কোলকাতার সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সুলতানে’ ১৯২৩ সালের জৈষ্ঠ্য মাসে ‘রবীবাবুর আতংক’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে আক্ষেপ করে বলা হয়ঃ
“রবীন্দ্র ঠাকুর পর্যন্ত এ ব্যাধিতে আক্রান্ত বলে আমরা দুঃখিত। তাঁকে এরূপ বলতে শুনা গেছে, ‘ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম শাসন কায়েম হবে। সেজন্য হিন্দুদের মারাত্মক ভুল হবে –খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়া। মহাত্মা গান্ধীকে মুসলমানেরা পুতুলে পরিণত করেছে। তুরস্ক ও খেলাফতের সাথে হিন্দুস্বার্থের কোনই সংস্রব নেই”।
উপসংহারে ‘সুলতান’ বলেন, “অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে আমরা একজন কবি খ্যাতনামা কবি, বিশ্ববিখ্যাত কবি হিসাবে মানি …কিন্তু নিতি রাজনীতিক নন ভারতে মুসলিম শাসনের কল্পিত আতংকে তিনি আতংকিত”।
-(Mustafa Nurul Islam Bengali Muslim Public Opinion as reflected in the Bengali press 1901-1930, pp. 147-48)।
বলতে গেলে, খেলাফত আন্দোলনে কংগ্রেসের যোগদানে ঐকান্তিকতা ছিলনা মোটেই, মুসলমানেরা মনে করেছিল এবার হয়তো হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের অবসান ঘটবে। কিন্তু তা হয়নি।
এস কে মজুমদার তাঁর ‘জিন্নাহ ও গান্ধী’ গ্রন্থে বলেনঃ
“খেলাফত আন্দোলনকালে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কোন জোরদার বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুসলমানদের কাছে এটা ছিল একটা ধর্মীয় আন্দোলন, ভারত স্বাধীন করার কোন চিন্তা এতে ছিলনা। পক্ষান্তরে গান্ধী এটাকে গ্রহণ করেছিলেন নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে। গান্ধীজী বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি কেলাফত আমাদের দু’জনের নিকটে কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল- মওলানা মুহাম্মদ আলীর নিকট এটা তাঁর ধর্ম। আর আমার নিকট হ্ছে, খেলাফতের জন্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে গো-নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নির্ভয় করছি। অর্থাৎ আমার ধর্মকে মুসলমানের ছুরিকা থেকে রক্ষা করছি’।
‘ধর্ম’ বলতে এখানে গান্ধীজী যে ‘গোধর্মই’ বুঝিয়েছেন, তা না বললেও চলে। মুসলমানের ছুরিকা থেকে ‘গোধর্ম’ বা গোজাতিকে রক্ষা করার অর্থ হলো ভারতভূমিতে মুসলমানের গো-কোরবানী চিরতরে বন্ধ করা।
১৮৭০ সাল থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানে যত দাংগা হয়েছে তার খতিয়ান বিবেচনা করলে জানা যাবে যে এসবের প্রত্যক্ষ কারণ (Immediate cause) হচ্ছে এই যে, প্রথম চার বছর হিন্দুর দূর্গাপূজা আর মুসলমানের কোরবানী একই সময়ে, বলতে গেলে, একই দিনে হতো। কথা যদি এই হতো যে, ঠিক আছে, উভয়ে উভয়ের উভয়ের উৎসব পালন করুক –হিন্দুরা দূর্গাপূজা করুক, মুসলমান কোরবানী করুক। কিন্তু তা নয়। মুসলমানরা গো কোরবানী করতেই পারবে না। আর হিন্দু দুর্গাপূজা ত করবেই। বরঞ্চ বিসর্জনের দিনে মসজিদের সামনে দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাজনা বাজিয়ে মিছিল করে যাবে। ফলে দাংগা হাংগামা ত অনিবার্য। গায়ে পড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, দাংগা-হাংগামা বাধিয়ে মুসলমানকে খুনী আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রায় দেয়া হবে- “বাবা, এখন জানমাল ও মান-সম্মান নিয়ে যে দেশ থেকে এসেছিলে, সেখানে চলে যাও”। এসব পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হচ্ছিল, এ কথা মনে করার সংগত কারণও আছে। পরবর্তীকালে আর্য সমাজীরা এবং হিন্দু মহাসভার নেতাগণ এ কথাই বারবার বলেছেন। কঙ্কিম ‘আনন্দমঠে’ বন্দোমাতরম মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন ‘যবন-স্লেচ্ছ’ নিধনযজ্ঞের আর এদের কথা হলো, ‘হত্যাযজ্ঞের পরে যারা তোমরা বেঁচে আছ, ভারত ত্যাগ করা’।
পরিকল্পিত দাংগা-হাংগামায় হিন্দুপক্ষ সমর্থনের বড়ো সাধ ইংরেজদেরও ছিল। কারণ উনবিংশতি শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মুসলমান চিল তাদের চোখের বালি। ১৮৮৩ সালে জন ব্রাইট লন্ডনে ইন্ডিয়ান কমিটি নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এবং পঞ্চাশ জন ইংরেজ এম পিকে এর সভ্য করেন। ১৮৮৫ সালে অ্যালেন হিউম ভারতীয় সংগ্রেস গঠন করেন। হিউম বাংলা প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। তিনজন ইংরেজ এই কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং তাঁরাই ইংলন্ডে কংগ্রেসের প্রচারকার্য চালিয়ে কংগ্রেসকে একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইংলন্ডবাসীর কাছে পরিচিত করেন। ১৮৮৮ সালে চার্লস ব্রাডল সংগ্রেসের সার্বক্ষণিক বেতনভুক্ত কর্মচারী নিযুক্ত হন। লন্ডনে সংগ্রেসের প্রচারকার্যে নিয়োজিন হন উইলিয়ম ডিগবী। কংগ্রেসের প্রচারকার্যে ১৮৮৯ সালে ব্যয়িত হয় ২৫০০ পাউন্ড। ডিগবী প্রচার করতেন, সংগ্রেস ভারতের সব জাতি, সম্প্রদায় ও শ্রেণীর একমাত্র মুখপাত্র। এমনটি মুসলমানেরও।
হিন্দু-মুসলিম দাংগায় ভারতভূমি যখন রক্তরঞ্জিত হচ্ছিল, সে সময়ে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার না কোন ব্যক্তি, আর না কোন প্রতিষ্ঠান ছিল। ক্নিুত ব্রিটেনের ইন্ডিয়া কমিটি কংগ্রেসকেই সমর্থন করে বলতো, -“ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রীতি অক্ষুণ্ণ আছে”।
ব্রিটেনের ১৯০৫ সালের নির্বাচনে ভারতফেরত বেশ কিছুসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস অফিসার হাউস অব কমন্সের সদস্য হন। তাঁরা ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারী কমিটি গঠন করেন। স্যার হেনরী কটন ছিলেন তার একজন সদস্য। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয়দের আশা আকাংখা তুলে ধরার দায়িত্ব পালনে গৌরব বোধ করেন তিনি। তিনি প্রচার করতেন, “জাতি ধর্ম নির্বিমেষে সকল ভারতীয় এক জাতীয়তায় গৌরব বোধ করে”। লাহোর, কার্ণাল প্রভৃতি স্থানে যখন প্রচন্ড সাম্প্রদায়িক দাংগা চলছিল এবং বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা লুঠতরাজ দ্বারা বিভীষিকা সৃষ্টি করছিল, তখন হেনরী কটন বলতেন, “মুসলমানদের স্বার্থ হিন্দু সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমর্থিত হয় না”। বংগভংগ রদের ব্যাপারে সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোথাও সমর্থিত হয় না”। বংগভংগ রদের ব্যাপারে হিন্দুদের দোসর ইংরেজ সাহেবদের আচরণ কি ছিল তা পূর্ববর্তী অধ্যায় আলোচিত হয়েছে।
উপরে বলা হয়েছে যে, খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বংগভংগের পর বাংলা তথা সারা ভারতে হিন্দুজাতির মানসিকতা যেভাবে সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে, তারপর –খেলাফত আন্দোলনে তার উপরে যে একটা কৃত্রিম প্রলেপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল তাও ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে। এ সময়ের সবচেয়ে মর্মন্তুদ ও লোমহর্ষক ঘটনা হলো মুসলিম মোপলা সম্প্রদায়ের উপর অমানুষিক ও পৈশাচিক নির্যাতন নিষ্পেষণের।
এ সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী সংবাদ ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু পত্র-পত্রিকা ও নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে হিন্দু মহাসভা ও আর্য সমাজের নেতাগণ প্রকৃত ঘটনাকে অতিমাত্রায় অতিরঞ্জিত করে হিন্দুভারতকে দাংগা-হাংগামার সূত্রপাত হয়। ১৯২২ সালে অমৃতসর থেকে ‘দাস্তানে জুলম’ নামে পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সাহারনুর থেকে ‘মালাবার কি খুনি দাস্তান’ নামে আর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এ পুস্তিকা দু’টির অধিকাংশ সংবাদ অতিরঞ্জিত, কল্পিত ও অনির্ভরযোগ্য সূত্রে গৃহীত।
প্রথম পুস্তিকায় যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় তার সারাংশ হচ্ছেঃ
মালাবারের সশস্ত্র মোপলা সম্প্রদায় হত্যা লুন্ঠন, নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক হিন্দদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ প্রভৃতি কাজে লিপ্ত রয়েছে। বলা হয়েছে যে, একজন পুরুষ হিন্দুকে প্রথমতঃ তারা গোসল করিয়ে দেয়। তারপর মুসলমানী কায়দায় তার চুল কেটে দেয় হয়, অতঃপর মুসলমানী কালেমা পড়তে বাধ্য করা হয়। মেয়েদেরকে মোপলাদের পোষাক পরিয়ে দেয়ার পর কান ছিদ্র করে ইয়ারিং পরিয়ে দেয়া হয়।
দ্বিতীয় পুস্তিকায় বলা হয় যে, মালাবারের মুসলমানরা হিন্দুদেরকে খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করতে এবং মুসলমান হতে বাধ্য করছে। সম্মত না হলে তাকে ঘরে আবদ্বধ করে তার মুখে গরুর গোশত গুঁজে দেয় হয়। তার আপনজন ও আত্মীয় স্বজনকে তার চোখের সামনে মারধর করা হয়। এতেও মুসলমান হতে রাজী না হলে, তাকে হত্যা করে খন্ড বিখন্ড করে কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং তার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মন্দির ধ্বংস করা হচ্ছে, প্রতিমা চূর্ণ বিচূর্ণ করা হচ্ছে। হিন্দু সন্যাসীদেরকে গরুর কাঁচা চামড়া পরিধান করতে বাধ্য করা হচ্ছে। -(A. Hamid Muslim Scparalismin India, pp. 158-159): (দাস্তানে জুলম –সেক্রেটারী, মালাবার হিন্দু সহায়ক সভা, অমৃতশহর, ১৯২২)।
হিন্দুজাতির কাছে এই বলে উদাত্ত আহবান জানানো হতোঃ
“হিন্দুজাতি জাগ্রত হও। তেমাদের নিদ্রা তোমাদের মৃত্যু ডেকে আনবে। আত্মরক্ষার জন্যে বদ্ধপরিকর হও। তোমাদের দুর্বলতা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে। লাঞ্ছিত জীবন যাপন অপেক্ষা মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়। তোমাদের ভাইয়ের দুঃখ দুর্দশা তোমাদের নিজেদেরই”। -(A. Hamid Muslim Separation in India, p. 159, দাস্তানে জুলম, ঐ)।
প্রকৃত ঘটনা জানার জন্যে কেন্দ্রীয় খেলাফত সংগঠনের পক্ষ থেকে গঠিত একটি কমিটির উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে যে রিপোর্ট পেশ করে তার সারাংশ নিম্নরূপঃ সরকারী ঘোষণার যে মালাবারের ঘটনাবলীকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়,তা সঠিক নয়। অবস্থা স্বাভাবিক এবং বিদ্রোহের চিহ্নমাত্র নেই। ভারতের অন্যান্য স্থানের মুসলমানের ন্যায় মোপলাগণও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে। কিন্তু স্থানীয় খেলাফত কমিটির সেক্রেটারীকে ধরে এনে একটি গাছের সাথে বেঁধে ফেলা হয়। তার স্ত্রীকে সেখানে এনে তার চোখের সামনে তার চামড়া খুলে ফেলা হয়। তারপর ট্রাফিক আইন ভংগ করার তুচ্ছ অপরাধে মোপলাদের জনৈক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে একজন পুলিশ কনস্টেবল মুখে থাপ্পড় দেয়। অন্য একজন খেলাফত কর্মীকে অন্যায়ভাবে অস্ত্র নির্মাণ অপরাধে জড়িত করা হয়। অবশেষে পুলিশ মোপলাদের গৃহে বলপূর্বক ঢুকে পড়ে তাদের যথাসর্বস্ব লুন্ঠন করে এবং গৃহের মালিকদের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার করে। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে পুলিশ তাদের উপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণ করে। মোপলা সম্প্রদায় অসীম সাহসী ও যোদ্ধা ছিল। ফলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তারা জয়ী হয়। ক্ষিপ্ত মোপলারা অতঃপর টেলিগ্রাফ তার ও রেল লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ পর্যন্ত হিন্দুদের সাথে তাদের পূর্ণ সদ্ভাব বজায় ছিল। কারণ খেলাফত কর্মী হলেও তারা ছিল কংগ্রেসী। তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচার করে বেড়ায় এবং হিন্দু মহল্লা ও তাদের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। -(A. Hamid Muslim Separation in India, p. 159-160: কাশফে হাকীকতে মালাবার-বাদাউন, ১৯২৩)।
দু’সপ্তাহ পর বহুসংখ্যক পুলিশ ও সৈন্য বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে এবং পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। ‘বিদ্রোহী’ মোপলাদের সংবাদ সরবরাহ করার জন্যে অধিকাংশ হিন্দু গুপ্তচরের কাজ শুরু করে। এর ফলে মোপলাগণ হিন্দুদের প্রতি রুষ্ট হ’য়ে পড়ে। পুলিশ হিন্দুদেরকে মোপলাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। আর্য-সমাজী কর্মীগণও তাদেরকে সাহায্য করে। পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী মিলিতভাবে মোপলাদের প্রতিশোধ গ্রহণে প্রবৃত্ত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অমানুষিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাদেরকে কাটাতে হয়। শত শত মোপলা বাস্তুহারা ও নিঃস্ব হয় পড়ে। শত শত লোক কারাবরণ করেন এবং দুইশত জনেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় –(A. Hamid: do, p. 160 কাশফে হাকীকতে মালাবার)।
Indian Annual Register-এ বর্ণিত হয়েছে যে, পুলিশ ও সরকারী প্রশাসন বিভাগকে পরাজিন তরে মোপলাগণ খেলাফত কায়েম করে এবং শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। হিন্দুদের পাইকারীভাবে ধর্মন্তরকরণের সংবাদ ভিত্তিহীন। মোপলাগণ বনে জঙ্গলে আত্মগোপন ক’রে গেরিলা তৎপরতা চালায়।
উক্ত রেজিষ্টারে একটি তুলনাহীন বর্বরতার উল্লেখ করা হয়। তা হচ্ছে এবই যে, একশত বন্দী মোপলাদেরকে একটি রেলের মালগাড়ীতে ভর্তি করে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে অন্যত্র পাঠানো হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবার পর দরজা খোলা হলে দেখা যায় ৬৬ জন মৃত্যুবরণ করেছে এবং অবশিষ্ট মুমূর্ষু অবস্থায়। উক্ত রেজিস্টার মন্তব্য করেঃ এ সময়ের মালাবার ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়ের কত যে অমানুষিক লোমহর্ষক ঘটনা অজ্ঞাত আছে, তা একমাত্র ভবিষ্যতেই প্রকাশ করতে পারে –(A, Hamid : Muslim Senaratism in India, p. 160: Indian Annual Register 1922, p. 266)।
এ ঘটনাগুলি সারা ভারতের হিন্দু-মুসলমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুসলিম ভারতে মর্মাহত হয়ে পড়ে এবং মোপলাদের সাহায্যের জন্যে আবেদন জানায়। চতুর্দিক থেকে অপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে হিন্দু সংবাদপত্র ও নেতৃবৃন্দ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে হিন্দুদেরকে উত্তেজিত করতে থাকেন।
সারাদেশে নতুন করে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রথম মহররম উৎসবকে কেন্দ্র করে। ১৯২৩ সালে তার পুনরাবৃত্তি, ঘটে এবং প্রচন্ড সংঘর্ষ ঘটে সাহারানপুরে। এখান নিহতের সংখ্যা তিনশতের অধিক বলা হয়েছে। পরবর্তী বৎসরে আঠারোটি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ৮৬ জন নিহত এবং ৭৭৬ জন আহত হয়। চরম সংঘর্ষ ঘটে কোহাটে। জনৈক হিন্দুকর্তৃক ইসলাম বিরোধী কবিতা প্রকাশনাই এর মূল কারণ। দু’দিন ধরে যে দাঙ্গা চলে তাতে ৩৬ জন নিহত এবং ১৪৫ জন আহত হয়, দোকান-পাট লুণ্ঠিত হয়, এবং প্রায় সত্তর হাজার টাকার ধনসম্পদ বিনষ্ট করা হয়। পর বৎসর ১৯২৫ সালে অবস্থা কিছুটা শান্ত হলেও ১৯২৬ সালে আবার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। এ বৎসর সারাদেশে মোট ৩৬টি দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। যার ফলে দু’হাজার লোক নিহত হ। এ বৎসর দাঙ্গার সূত্রপাত হয় কোলকাতা শহর থেকে মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাদ্যবাজনাকে কেন্দ্র করে। পরিস্থিতি আয়ত্তাধীন হবার পূর্বে দু’শ দোকান লুন্ঠিত হয়, বারটি পবিত্র গৃহ ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ১৫০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংঘটিত হয় এবং হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় সাড়ে চৌদ্দশ’
১৯২৭ সালে সারাদেশে একত্রিশটি দাঙ্গা সংঘটিত হয়ে পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এবার হতাহতের সংখ্যা এক হাজার ছয়’শ। নিতহের সংখ্যা একশ চল্লিশ।
১৯২৮ সালে অবস্থা কিছুটা প্রশমিত হয়। কিন্তু ১৯২৯ সালের ফেব্রুয়ারী থেমে মে মাসের মধ্যে বোম্বাই শহরে দাঙ্গা সংঘটিত হয় যার ফলে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়ায় এগার শ’। বিগত কোলকাতা দাঙ্গার ন্যায় এখানেও দোকান-পাট লুণ্ঠিত হয়। ১৯৩১ সালে কানপুরে প্রচন্ড দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয় এবং তিনি দিন পর্যণ্ত হত্যা, লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগ চলতে থাকে। জনৈক হিন্দু হত্যাকারীর সম্মানে বলপূর্বক দোকানপাট বন্ধ করতে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হয় বহুসংখ্যক মসজিদ মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং বহু ঘর-বাড়ী অগ্নিদগ্ধ হয়। -(A. Hamid Muslim Srparation in India. P. 162; Cumming Political India, p. 114-17)।
হিন্দু ও মুসলমানের পক্ষ থেকে এসব সংঘর্ষের বিবরণ গান্ধীজীর নিকটে বিবৃত করা হলে তিনি মুসলমানদের ঘাড়েই দোষ চাপান। গান্ধীজী মন্তব্য করেনঃ আমার মনে কোনই সন্দেহ নেই যে, অধিকাংশ কলহে হিন্দুদের স্থান দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়ে। আমার এ মন্তব্য আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ যে, মুসলমানরা স্বভাবতঃই বন্ডা প্রকৃতির এবং হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই ভীরু। আর, যেখানেই ভীরু লোক বিরাজ করে সেখানে সর্বদাই থাকবে, ষন্ডাদল।
(The Indian Quarterly Register, p. 647; A. Hamid: Separation in India, p. 105).
মিঃ গান্ধী হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য ও কলহ দমনে সহায়ক হলেন না। বরঞ্চ তাঁর উপরোক্ত মন্তব্য মুসলমানদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং এটা হিন্দু দাঙ্গাকারী একটা শক্তিশালী সনদ হয়ে পড়ে।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে হিন্দু মুসলিম অনৈক্য অথবা কলহ-কোন্দল যে অন্তরায় একথা বুঝতে পেরে মিঃ গান্ধী যে বিব্রত হয়ে পড়েননি, তা নয়। তবে হিন্দু মুসলিম মিলনের সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানকল্পে তাঁর কোন চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়নি।
তিনি একবার বলেন যে, একমাত্র চুক্তি বা প্যাক্টের ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিমের স্থায়ী মীমাংসা হতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি বলেন, “প্যাক্টের দ্বারা ঐক্য হতে পারে। কিন্তু তার দ্বারা এক হওয়া যায় না।প্যাক্ট যদি এক হওয়ার ভিত্তি হয়, তাহলে তা হবে একেবারে অর্থহীন, বরঞ্চ তার চেয়েও খারাপ। প্যাক্টের স্বভাবই হলো বিচ্ছিন্নতাবাদ। প্যাক্ট একে অপরকে নিকটে টানবার বাসনা জাগ্রত করে না, এর দ্বার ত্যাগের মনোভাব সৃষ্টি হয় না, আর তা দালগুলিকে মূল লক্ষ অর্জনে একত্রে বাঁধতেও পারে না। একে অপরকে নিকটে টানার পরিবর্তে চুক্তির অধীন দলগুলি একে অপরের কাছ থেকে যতটা সম্ভব আদায় করবার চেষ্টা করে। সকলের অভিন্ন স্বার্থোদ্ধারের জন্যে ত্যাগ স্বীকারের পরিবর্তে চুক্তির অধীন দলগুলি সর্বধা রক্ষ্য করে যে, একদলের ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা অন্য দলের মঙ্গল সাধিত যেন না হয়। …হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে অন্তরের মিল ব্যতীত ‘স্বরা’ শুধুমাত্র স্বপ্নই রয়ে যাবে”।
কিন্তু পরক্ষণেই আবার তিনি বলেন “ ‘স্বরাজ’ সমস্য অপেক্ষাগো-সমস্যা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতোক্ষণ পর্যন্ত না আমরা গোরক্ষা করতে সক্ষমহবো আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারব না”। গান্ধীর এসব উক্তি এটাই প্রমাণ করে যে, ভারতীয় স্বাধীনতা হিন্দুত্বের সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলেরই অপর নাম। লাহোরে একটি ঐক্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি পাঞ্জাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার আতংক প্রকাশ করেন। অদূর ভবিষ্যতে পাঞ্জাব একটি রণদক্ষ জাতির আবাসভূমি হয়ে পড়লে উপমহাদেশের শাস্তি বিনষ্ট হবে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। -(মুহাম্মদ আমীন যুবেরী, সিরাসতে মিল্লিয়া, পৃঃ ১৭৫-৮৪)।
দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হিন্দু ও মুসলিম সমাজদেহ যখন রক্তাক্ত তখন তিনি তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবকে উভয়ের কল্যাণমূলক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তৎপরিবর্তে তিনি রানীতি থেকে দূরে সরে পড়ে আহমদাবাদের নিকটবর্তী সবরমতী আশ্রমে নির্জনবাস শুরু করেন এবং ভারতীয় রাজনীতির নিরপেক্ষ দর্শক হিসাবে দিন কাটাতে থাকেন। তবে একেবারে চুপচাপ বসে না থেকে খাদি ও স্বহস্তে নির্মিত বস্ত্রের মহত্ব, ছাগ-দুগ্ধের উপকারিতা, টিকা-ইনজেকশনের অপকারিতা, সোয়াবিনের খাদ্যপ্রাণ প্রভৃতি সম্পর্কে প্রবন্ধাদি লিখেন, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি মুখ বন্ধ করে থাকেন। (মুহাম্মদ আমীন যুবেরীঃ সিরাসতে মিল্লিয়া, পৃঃ ১৭০)।
ভারতীয় জাতীয় সংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতের হিন্দুজাতির প্রকৃত মুখোশ খুলে গেল ১৯৩৭ সালের পর, যখন ১৯৩৫ সালের পর, যখন ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া এ্যাক্টের অধীন ভারতের প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে মন্ত্রীত্ব গঠিত হলো, মুসলমান প্রদেশগুলিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে মন্ত্রীত্ব গঠিত হলো, মুসলমান চারটি প্রদেশে এবং হিন্দু সাতটি প্রদেশে মন্ত্রীত্ব গঠনের দায়িত্ব লাভ করে। ভারতীয় সংগ্রেস –ভারতের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনক্ষমতা একমাত্র কংগ্রেসের উপরেই অর্পণ করতে হবে। পক্ষান্তরে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগ এ আশংকা প্রকাশ করে আসছে যে, কংগ্রেসের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে ভারতীয় মুসলমানদের সকল স্বার্থ দলিত-মথিত হবে এবং মুসলিম জাতিকে তাদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও তাহজীব তামাদ্দুন বিসর্জন দিয়ে হিন্দুর গোলামে পরিণত হতে হবে।
১৯৩৭ সালের পর কংগ্রেসের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং মুসলমানদের আশংকা সত্যে পরিণত হয়। কংগ্রেস মাদ্রাজ, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, বোম্বাই ও উত্তর-পশ্চিম-সীমান্ত প্রদেশে তাদের সংখ্যগরিষ্ঠ মন্ত্রীসভা গঠন করে।
নির্বাচনের পূর্বে এরূপ আশা করা গিয়েছিল যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদশেগুলিতে, বিশেষ করে ইউ পি এবং বোম্বাই-এ মুসলিম লীগ সদস্যদেরকে নিয়ে কংগ্রেস কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। গভর্ণরদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, মন্ত্রীসভায় শামিল করা উচিত। ইউ পিতে মুসলমান ছিল মোট লোকসংখ্যার ছয় ভাগের একভাগ। সেখাতে তাদের তুলনায় তাদের প্রভাব ও ঐক্য ছিল অনেক বেশী এবং এ কারণে সংগ্রেস ও মুসলিম লগের মধ্যে এরূপ একটি অলিখিত বুঝাপড়া হয়েছিল যে, অন্ততঃ দু’জন মন্ত্রী মুসলিম লীগ থেকে নেয়া হবে। কিন্তু ইউ পি এবং বোম্বাই-এ মুসলিম লীগের কোন সদস্যকে মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়া হয়নি। কংগ্রেস এখানেই মারাত্মক ভুল করে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় যে, একমাত্র কংগ্রেসই সারা ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে। মুসলমানদের নিকটে এটা ছিল হিন্দু শাসনের কাছে নতিস্বীকার করা। ফলে ‘ইসলাম বিপন্ন’ ধ্বনি উথিত হয় এবং ‘কংগ্রেসরাজ’ ব্রিটিশরাজ থেকে অনেক খারাপ বলে বিবেচিত হয়। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ও মিঃ জিন্নাহর মধ্যে ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে নেহরু ও মিঃ জিন্নাহর মধ্য ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে যে পত্র বিনিময় হয় তাতে নেহরুর দাবী হলো ধর্মনিরপেক্ষ যুক্ত ভারতের এবং মিঃ জিন্নাহর দাবী হলো লীগকে কংগ্রেসেরই সমমর্যাদাশীল বলে মেনে নেয়ার। কোন ফরমূলা বা সমঝোতার ভিত্তিতে এর মীমাংসা সম্ভব হলো না –(H.V. Hodson: The Great Divide, p. 63, pp. 66-67)।
ভারতে কংগ্রেস শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সকল শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার করা হবে, সংখ্যলঘুদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, ইত্যাদি ধরনের কংগ্রেসের বড়ো বড়ো বুলি ১৯৩৭ সালের পর মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেসের আড়াই বৎসরের শাসন ‘হিন্দু রামরাজ’ বলে কুখ্যাতি লাভ করে এবং মুসলমানরেদ প্রতি অন্যায় অবিচার, তাদের ধর্ম-তাহজিব-তামাদ্দুন বিলুপ্তির প্রচেষ্টা প্রভৃতির দ্বারা কংগ্রেস সারা ভারতের মুসলমানদের আস্থা একেবারে হারিয়ে ফেলে। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে পাটনায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতির সকল আশা ভরসা ‘কংগ্রেস ফ্যাসিবাদের’ দ্বারা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ভারতের সর্বত্র মুসলমানদের পক্ষ থেকে অত্যাচারী কংগ্রেস শাসনের অবসান দাবী করে বিক্ষোভ প্রদশিত হতে থাকে।
কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের প্রতি কৃত অন্যায় অবিচারের তদন্তের জন্যে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেত তা, ‘পীরপুর রিপোর্ট’ নামে খ্যাত। ‘বিহারের মুসলমানদের অভাব-অভিযোগ’ –শীর্ষক একটি রিপোর্ট পেশ করেন বিহার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্তৃক গঠিত কমিটি। একে ‘শরীফ রিপোর্ট’ বলে অভিহিত করা হয়। ‘পীরপুর রিপোর্টের’ পর ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে ‘শরীফ রিপোর্ট’ পেশ করা হয়। অতঃপর ডিসেম্বর মাসে বাংলার প্রধানমন্ত্রী মিঃ এ কে ফজলুল হক ‘কংগ্রেস শাসনে মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশা’ নামে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। হিন্দু পত্র-পত্রিকা রিপোর্টগুলিতে বর্ণিত অভিযোগগুলি অস্বীকার করে এবং বিহার সরকার ‘পীরপুর রিপোর্ট’ প্রত্যাখ্যান করেন।
H.V. Hodson : তার The Great Divide গ্রন্থে বলেনঃ
“ভারতের ইতিহাসের এ এক সুবিদতি ঘটনা যে, যখন থেকে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করা শুরু করেছে, তখন থেকেই কিছুটা ধর্মীয় উত্তেজান বিরাজ করে আসছে। যেমন ধরুন গো-পূজা, নামাজের আজানে বাধা প্রদান, মসজিদ অপবিত্রকরণ, নারী ধর্ষণ, নারী হরণ প্রভৃতি ব্যক্তিগত আক্রমণ। অপরদিকে, রাজনৈতিক ও শাসন সংক্রান্ত নতুন নতুন অভিযোগ বিরাজ করছে, বিশেষ করে যেসব বর্ণিত হয়েছে যুক্তিপূর্ণ ‘পীরপুর রিপোর্টে’। হিন্দীর সপক্ষে উর্দুকে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে; পুলিশ ও ম্যাজিষ্ট্রেট পক্ষপাতিত্ব করছেন; সরকারী চাকুরীতে মুসলমানদেরকে তাদের ন্যায্যা অংশ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা থেকে তারা কোন প্রকার ন্যায়পরতা আশা করে না; কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক অনুরূপ পালটা সরকার চলতে দেয়া হচ্ছে; কংগ্রেস শাসন অর্থাৎ হিন্দু শাসন; যেমন সর্বত্র কংগ্রেস পতাকা উড়ানো হচ্ছে, ইসলাম বিরোধী ‘বন্দোতরম’ সংগীত জাতীয় সংগীত হিসাবে গীত হচ্ছে এবং ‘ওয়ার্ধা স্কীম’ অনুযায়ী গ্রাম্য শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তন করা হচ্ছে। এ হচ্ছে মিঃ গান্ধীর কল্পনাপ্রসূত আদর্শ যার ভিত্তি হচ্ছে অহিংসা, সূতা প্রস্তুতকরণ ও বয়ন শিল্প এবং ধর্ম থেকে নিবৃত্তি। এর বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিদ্রোহ করতে হয়। কারণ তাদের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল সকল সময়ে কোরআন ভিত্তিক”। -(H.V. Hodson The Great Divine, pp. 73-74)।
মিঃ হডসন আরও বলেনঃ
“কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলির ব্রিটিশ গভর্নরগণ সাধারণতঃ এ ধরনের মত পোষন করতেন যে, তাঁদের মন্ত্রীগণ যদিও বা অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার দিক দিয়ে দল নিরপেক্ষ থাকবার চেষ্টা করেন, কিনউত জেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেসীদেরকে ক্ষমতা প্রবণতা তাদেরকে ঔদ্ধত্য ও উত্তেজনাকর আচরণে লিপ্ত করে। মোট কথা, ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্র দ্বারা তা পরিচালিত হবে। আর এর পশ্চাতে এমন একটি সংগঠন থাকবে যে কখনো বিরোধিতা বরদাশত করবে না এবং কাউকে তাদের ক্ষমতার অংশীদার করতেও স্বীকৃত হবে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ১৯৩৭ থেকে ও ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরের প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দ্বিজাতিত্ব-মতবাদ প্রচার ও পাকিস্তান আন্দোলনের কারণ”। -(H.V. Hodson: The Great Divide, pp. 74)
ভারতের হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ ও বিরোধ সমাধানকল্পে কবি ইকবাল ১৯৩৭ সালের ২১শে জুন আঙিনা ভাগ করার পরামর্শ দেন। ৭ই জুলাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলম ছাত্র সমাজক লক্ষ্য করে বলেনঃ
ওই সর্বনাশটাকে ধর্মের দামেতে করো দামী
ঈশ্বরের করো অপমান
আঙিনা করিয়া ভাগ দুই পাশে তুমি আর আমি
পূজা করি কোন শয়তানে?
তারপর দশ বছর হয়েছে অধিকতর বিরোধ ও সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে। আড়াই বছরের কুখ্যাত কংগ্রেস শাসনের ইংগিত উপরে করা হয়েছে। ১৯৩৯ সালের ১৭ই অক্টোবর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকারীন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতি যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য সহযোগিতার আহবান জানিয়ে ভারতের বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো এক বিবৃতি প্রদান করেন। মুসলমানদের বিক্ষোভের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে নয়, বড়োলাটের বিবৃতির সাথে একমত হতে না পেরে সংগ্রেস হাই কমান্ড মন্ত্রীসভাগুলিকে এস্তেফাদানের নির্দেশ দেয়। তাঁরা নীরবে এ নির্দেশ পালন করেন এবং সাতটি প্রদেশ থেকে কংগ্রেস কুশাসনের অবসান ঘটে। এর জন্যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানগণ সারাদেশে ‘নাজাত দিবস’ পালন করেন।
মুসলিম লীগের উদ্যোগে সারাদেশে ‘নাজাত দিবস’ পালন ন্যায়সঙ্গত তোক বা না হোক, কিনউত একটি জিনিস দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, এ দেমে শাসনক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও মিলন আর কিছুতেই সম্ভব নয়। অতএব আল্লামা ইকবালের পরামর্শ অনুযায়ী আঙিনা ভাগ করা ব্যতীত স্থায়ী সমাধানের আর অন্য কোন পথ রইলো না। কিন্তু আঙিনা ভাগ করতে মোটেই রাজী নয়। তাই এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে অধিকতর সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে আঙিনা ভাগ হলো দশটি রক্তাক্ত বছরের পর। অর্থাৎ ভারতের আঙিনা ভাগ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট মুসলমানের জন্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। কিন্তু ভারতের আঙিনায় যেসব মুসলমান রয়ে গেল, আঙিনা ভাগ করতে চাওয়ার অপরাধে তাদেরকে চড়া মাশুল দিতে হয়েছে বহু বছর ধরে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি