সপ্তম অধ্যায়
মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাদীক্ষা
মুসলমানগণ চিরদিনই বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি অসীম গুরুত্ব দি এসেছে। কারণ এ চিল তাদের নবীর নির্দেশ। যতোই ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য হোক না কন, এবং প্রয়েঅজন হলে দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়েও বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে হবে –এ ছিল ইসলামের নবী মুহাম্মদ মুস্তাফার (সা) সুস্পষ্ট নির্দেশ। মুসলিম জাতি অতীতে এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তারাই এক সময় জ্ঞানে মশাল প্রজ্জ্বলিত করে তমসাচ্ছন্ন ইউরোপকে শিক্ষাদিক্ষা ও জ্ঞানের জগতের উদ্ভাসিত করেছে। এ এক ঐতিহাসিক সত্য। জ্ঞানী ব্যক্তিকে মুসলিম জগতের সর্বত্রই বিশেষ সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। একজন মুসলিম পিতা তার সন্তানকে শিক্ষাদীক্ষা দানের সাধ্যমতো চেষ্টা করে থাকে এবং এটাকে সে মনে করে তার ধর্মীয় কর্তব্য ও অনুশাসন।
ভারতীয় মুসলমানদের অতীত ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায় যে, যখন কোন সন্তাদের বয়স চার বৎসর ও চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার বিদ্যাশিক্ষার সূচনা করা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শুনানো হতো এবং শিশু তা পুনরাবৃত্তি করতো। এ চিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা। (A.R. Mallick Br. Policy & the Muslims in Bengal, p. 149, M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & Eng. Education P. I: L.F Smith Appendix to Chahar Darvesh, p. 253)।
মিঃ স্মিথ এ অনুষ্ঠান ১৮০১ সালে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে স্বচক্ষে দেখেছেন যা তিনি তাঁর ‘চাহার দরবেশ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
ভারতের মুসলিম শাসকগণ বিধ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জনকে নানানভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং এর জন্যে প্রভূত অর্থ বরাদ্দ করেছেন। রাজ দরবারে জ্ঞানীগুণী ও পন্ডিতগণ বিশেষভাবে সমাদৃত হতেন। বিদ্যাশিক্ষার জন্যে রাজ্যের বিভিন্নস্থানে প্রভূত পরিমাণে লাখেরাজ ভূসম্পদ দান করা হতো। এমন কোন মসজিদ অথবা ইমামবাড়া ছিল না যেখানে আরবী ও ফার্সী ভাষায় অধ্যাপকগণ অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন না।
যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল বেশী, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে মক্তব খোলা হতো এবং মুসলিম শিশুগণ সেখানে আরবী, ফার্সী ও ইসলামী শিক্সা লাভ করতো। বিশেষ করে বাংলার সুলতানগণ বিদ্যাশিক্ষার প্রতি অধিকতর অনুরাগী ছিলেন এবং শিক্ষা প্রসারের জন্যে তাঁরা সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জমিদার, লাখেরাজদার, আয়মাদার প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত মুসলিম প্রধানগণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় মক্তব, মাদরাসা কায়েম করতেন এবং এসবের ব্যয়ভার বহনের জন্যে প্রভূত ধনসম্পদ ও জমিজমা দান করতেন।
বাংলার প্রথম সুলতান মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী এবং তিনি দিল্লীসম্রাট কুতবউদ্দীন আইবেকের অনুকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমজিদ, কলেজ এবং দরগাহ (কোরআন হাদীসের শিক্ষাকেন্দ্র) স্থাপন করেন। (S.M. Jaffar Education in Muslim India. 1935. p. 66: N.N Laww Promotion of Learning in India during Muhammadan Rulr. Pp. 19.22)।
প্রথম গিয়াসউদ্দীন (১২১২-২৭ খৃঃ) বাংলার মসনদে আরোহণ করার পর পরই বাংলার রাজধানী লাখনৌতে বা লক্ষ্মণাবতীতে একটি অতীব সুন্দর মসজিদ, একটি কলেজ এবং একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দীন (১৩৬৭-১৩৭৩) নিজে একজন খ্যাতনামা কবি ছিলেন। তিনি ওমরপুর গ্রামে নিকটবর্তী দরসবাড়ীতে একটি কলেজ স্থাপন করেন। (M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education. P. 4)। হোসেন শাহ, নসরৎ শাহ প্রমুখ সুলতানগণের আমলেও শিক্ষার বিরাট উন্নতি সাধিত হয়েছে।
মুর্শিদকুলী খান অতি বিদ্বান ও সুসাহিত্যিক ছিলেন এবং জ্ঞানী ও গুণীদের সর্বদা সমাদর করতেন। তিনি প্রায় দু’হাজার আলেম ও বিদ্বানমন্ডলীর ভরণপোষণ করতেন। তাঁরা সর্বদা পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ধর্মীয় শিক্ষাদিক্ষা ও ক্রিয়া অনুষ্ঠানাদিতে নিয়োজিত থাকতেন। গোলাম হোসেন তাঁর ইতিতহাসে বর্ণনা করেছেন যে, মুর্শিদকুলী খাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বীরভূমের আসাদুল্লাহ নামক জনৈক জমিদার তাঁর আয়ের অর্ধাংশ জ্ঞানী ব্যক্তিদের ভরণপোষণ এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন। গোলাম হোসেন আরও বলেন, আলীবর্দী খাঁ ভরতের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শিক্ষিত বিদ্বানমন্ডলীকে মুশিদাবাদে বসবাসের উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে মোটা ভাতার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা সাথে করে নিয়ে আসনে এত বেশী সংখ্যক মূল্যবান গ্রন্থাদি যে, একমাত্র জনৈক মীর মুহাম্মদ আলীর লাইব্রেরীতেই ছিল দু’হাজার বা ততোধিক গ্রন্থাদি। -(M. Fazlur Rahman: The Bengali Muslims & English English Education, p. 5; Ghulam Husain Seiyere- Mutakherin Vol 2, p. 63, 69, 70 & 165)।
মুসলিম শাসন আমলে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্যে যেসব অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মক্তব, মাদরাসা, কলেজ প্রভৃতি ছিল, তার সঠিক বিবরণ পাওয়া বড়োই দুষ্কর। মুসলিম শাসনের অবসানের পর সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ছিটে ফোঁটা যা বিদ্যমান ছিল তার কিঞ্চিৎ বিবরণ পাওয়া যায় বুকানন হ্যামিল্টন ও ডব্লিউ অ্যাডাম কর্তৃক প্রণীত শিক্ষা সম্পর্কিত রিপোর্টে যা তাঁরা প্রণয়ন করেন যথাক্রমে ১৮০৭ থেকে ১৮১৪ সালের মধ্যে এবং ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে। W. Adam বলেন, রাজশাহী জেলার কসবা বাঘাতে বিয়াল্লিশটি গ্রাম দান করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনসেবামূলক কাজের জন্যে। (Adam, Second Report, p. 37)। কসবা বাঘার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্র পড়াশুনা করতো তাদের যাবতীয় খরচপত্রাদি, যথা বাসস্থান, আহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, বইপুস্তক, খানা-পেন্সিল, কালি-কলম, প্রসাধন প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহন করা হতো। -(A.R. Mallik Br. Policy & Muslims in Bengal, p. 150)।
কোরআন এবং হাদীস থেকে বিদ্যাশিক্ষার প্রেরণা লাভ করে সমাজের বিত্তশারী ব্যক্তিগণ দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করতেন। ধনবান সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে এ প্রথাও বিদ্যমান ছিল যে, তাঁরা উপযুক্ত গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে তাঁদের সন্তানাদির বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। দরিদ্র ছাত্রগণগও বিনাপয়সায় তাদের নিকটে শিক্ষা লাভ করতো। পান্ডুয়াতে এ নিয়ম প্রচলিত চিল যে, মুসলিম ভূস্বামীগণ তাঁদের নিজেদের খরচে প্রতিবেশী দরিদ্র ছাত্রদের বিদ্যাশিক্ষার জন্যে শিক্ষক নিযুক্ত করতেন। এমন কোন বিত্তশালী ভূস্বামী অথবা গ্রামপ্রধান ছিলেন না, যিনি উক্ত উদ্দেশ্যের জন্যে কোন শিক্ষক নিযুক্ত করেননি। -Adam, First Report, p. 55; M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims and English Education, p. 6)।
কোরআন হাদীস ও ইসলামী শিক্ষাদান পূণ্যকাজ বলে বিবেচনা করা হতো এবং প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সমুদয় ব্যয়ভার এক এক ব্যক্তি বহন করতেন, সরাসরিভাবে অথবা দান, ওয়াকফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে। শিক্ষকদের বেতন তাঁরা দিতেন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তার গৃহাদি প্রভৃতির যাবতীয় খরচপত্র তাঁরা বহন করতেন। সেকালে পাঠ্যবই ছিল না বলে অবৈতনিক শিক্ষা দেয়া হতো। শিক্ষকগণ প্রায় স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করতেন –মসজিদের ইমাম হিসাবে অথবা কোন ছোট খাটো সরকারী চাকুরীর মাধ্যমে। তার ফলে বিনা বেতনে তাঁরা ছাত্রদেরকে শিক্ষা দান করতেন। এভাবে মুসলমানদের বহু বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যেসবের ব্যয়ভার বহন করতেন –বিত্তশালী ও দানশীল ব্যক্তিগণ। শিক্ষকমন্ডলী ও এসব মহানুভব দানশীল ব্যক্তিদের এ দৃষ্টিভংগী বিশেষকরে লক্ষ্য করা যেতো যে, শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য জীবিকার্জন ছিল না। বরঞ্চ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে জাতির ধর্মীয় ও নৈতিক মান উন্নয়ন করা। -(M.Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education pp. 7,8)।
W. Adam-এর রিপোর্টে এ কথাও সুস্পষ্টরূপে জানা যায় যে, সেকালে অতি সুলভে এমনকি, বলতে গেলে বিনে পয়সায় শিক্ষালাভ করা যেতো। প্রতিটি মসজিদ ছিল মুসলিম জনগণের কেন্দ্রীয় আকর্ষণস্থল এবং মসজিদে মসজিদে যেসব মাদ্রাসা ছিল, সেখানে যেকোন ছেলে বিনে পয়সায় লেখাপড়া শিখতে যেসব মাদ্রাসা ছিল, সেখান যেকোন ছেলে বিনে পয়সায় লেখাপড়া শিখতে পারতো। যেহেতু ছাপানো কোন পাঠ্যপুস্তক ছিল না, সে জন্যে বই পুস্তক কেনার কোন খরচই ছিল না। কালি-কলম নিজের ঘরে তৈরী করা যেতো। অবশ্য উচ্চশিক্ষার জন্যে কিছু বেতন দিতে হতো। কিন্তু তাও ছিল অতি সামান্য। ইংরেজদের আগমনের পর খৃষ্টান মিশনারী স্কুলসমূহে ইংরাজী শিক্ষা দেয়া হতো। সেখানে কেউ বিনা বেতনে পড়াশুনা করতে পারতো না। কেউ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলে –তার সন্তানাদির বিনা বেতনে পড়াশুনার সুযোগ দেয়া হতো। মুসলমানদের এই যে বিনে পয়সায় অথবা অতি অল্প খরচে বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ ছিল –তার একমাত্র কারণ হলো মুসলমান শাসনগণ এবং বিত্তশালী মুসলমানগণ বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশ্যে অকাতরে ধনসম্পদ জমিজমা প্রভৃতি দান করতেন। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education. P.11)।

ইংরেজদের আগমনের পর
যে কোন জাতির শিক্ষাদীক্ষা ও সংস্কৃতিক উন্নয়নের পেছনে থাকে আনুকূল্য ও সাহায্য সহযোগিতা। বলা বাহুল্য, পলাশীর ময়দানে বাংলার মুসলিম শাসন বিলুপ্ত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’ ভেঙে পড়ে, গোটা দেশ দারিদ্র্য ও দুঃখ দুর্দশা কবলিত হয়ে পড়ে এবং বিশেষ করে মুসলমানদের জাতীয় জীবনে নেমে আসে ধ্বংসের ভয়াবহতা। কোম্পানী শাসনের প্রথম দিকেই বাংলার মুসলমানগণ বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোন দায়িত্ব ব্যতিরেকেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার (Power without responsibility) জন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যে ‘দেওয়ানীর’ সনদ লাভ করে তার সীমাহীন অত্যাচার উৎপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হতে থাকে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর তাদের জীবিকার্জনের সকল পথ বন্ধ হতে থাকে যার ফলে সামাজিক কাঠামো ছিন্ন ভিন্ন হয় যায় এবং বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধও ছিন্ন হয় যায়। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education p. 14)।
মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার ফলে, মুসলমানগণ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে যতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ততোটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের শিক্ষাদীক্ষা। উপরে বর্ণিত হয়েছে, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নির্ভর করতো সরকারী সাহায্য এবং মুসলিম প্রধানগণের দান, ওয়াকঠ সম্পত্তি, ট্রাস্ট প্রভৃতির উপর। শিক্ষার প্রচার ও প্রসারকে মুসলমানগণ মনে করতো অত্যন্ত পুণ্যময় ধর্মীয় কাজ এবং এর জন্যে তারা অকাতরে দান করতো প্রভুত অর্থ সম্পদ ও জমিজমা। বহুস্থানে ধর্মীয় ট্রাস্ট বা সংস্থার মাধ্যমে বিনা বেতনে ও বিনা খরচায় –ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের সন্তান বিদ্যাশিক্ষা করতে পারতো। রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পর মুসলমানদের এহেন শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মুসলমানগণ সরকারের ছোটো বড়ো সকল চাকুরী থেকে অপসারিত হয়, মুসলমান সামরিক প্রধানগণ অন্যদেশে চলে যান অথবা জীবিকা অন্বেষণের জন্যে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গমন করেন –যেখানে আধুনিক অর্থাৎ ইংরেজী ও হিন্দুদের মধ্যে বিতরণ করা হয় –যার ফলে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিলুপ্ত হয় এবং নতুন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। অতএব এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, একটি মুসলিম সরকার, উচ্চপদস্থ সরকারী মুসলিম কর্মচারী ও মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভাবে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে বিনষ্ট হবারই কথা এবং তা হয়েছিল।
মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা তা দূরের কথা, সত্য কথা বলতে কি, ইংরেজ শাসনের পর এক শতাব্দী যাবত, মুসলমান জাতির অস্তিত্বই ছিল প্রকৃতপক্ষে বিপন্ন। যেখানে তাদের শুধু বেঁচে থাকার প্রশ্ন, সেখানেত তারা তাদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষাদীক্ষার চিন্তা করবে কি করে।
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার হিন্দু ধনিক-বণিক, বেনিয়া শ্রেণী, ব্যাংকার প্রভৃতির সাথে এক গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটায়। বলা বাহুল্য, এতে উভয়ের স্বার্থ সমানভাবে জড়িত ছিল। একদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতা অভিলাষী কোম্পানীর ক্ষমতা লাভ, অপরদিকে মুসলিম শাসনের অবসান কামনাকারী হিন্দুদের কোম্পানীর নিকট থেকে বৈষয়িক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভ। কোম্পানী ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হিন্দুগণ তাদের নিকট-সম্পর্কে আসে। তাদের অধীনে চাকুরী-বাকুরী এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্যে তারা প্রয়োজন বোধ ক’রে ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করে।
কোলকাতা একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল এবং সেখানকার অধিবাসী বলতে গেলে প্রায় ছিল হিন্দু। হিন্দু বণিক, ব্যাংকার, বেণিয়া ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই কোলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করেই তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কোম্পানীর অধীনে চাকুরী বাকুরী ও ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্যে তারা মনে করেছিল ‘English is money’ –ইংরেজী ভাষার অপর নাম অর্থ এবং এজন্যে তারা যতটুকুই ইংরাজী ভাষা রপ্ত করতে পারুক না কেন, তার জন্যে প্রবল আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে সেখানে, কোলকাতা ও তার আশে পাশে ইংরাজী স্কুল গড়ে উছে এবং হিন্দুরা এসব স্কুল থেকে কাজ চালবার মতো ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করে।
অপরদিকে মুসলমানদের অবস্তা কি ছির তারও কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক। w.w. Hunter তাঁর গ্রন্থে বলেন, “শত শত প্রাচীর মুসলিম পরিবারধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। ফলে লাকেরাজ ভূসম্পত্তির দ্বারা মুসলমানদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল তাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে”। -(W.W. Hunter: The Indian Mussalmans, Bangladesh Edition 1975, p.167)।
সাধারণ মুসলমান ত দূরের কথা, ইংরেজদের আগমনের পর তারা মুসলিম সমাজের প্রতি যে বর্বর উৎপীড়নমূলক আচরণ করেছে, যার ফলে নবাবের বংশধরদের কোন মর্মন্তুদ পরিণতি হয়েছিল তার একটি করুণ চিত্র এঁকেছেন খোদ হান্টার সাহেব তাঁর গ্রন্থে-
“প্রতিটি জেলায় সাবেক নবাবদের কোন না কোন বংশধর ছাদবিহীন ভগ্ন প্রসাদে অথবা শেওলা-শৈবালে পূর্ণ জরাজীর্ণ পুকুর পাড়ে অন্তর্জ্বালায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এরূপ পরিবারের অনেকের সাথেই আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে। এদরে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালান কোঠায় তাদের বয়স্ক ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী, ভাইপো-ভাইঝি গিজ গিজ করছে এবং এসব ক্ষুধার্ত বংশধরদের কারো কোন সুযোগ নেই জীবনে কিছু করার। তারা জীর্ণ বারান্দায় অথবা ফুটো ছাদযুক্ত বৈঠকখানায় বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গুণছে আর নিমজ্জিত হচ্ছে ঋনের গভীর গহ্বরে। অবশেষে প্রতিবেশী হিন্দু মহাজন তাদের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে যে, হঠাৎ তাদেরকে তাদের যথাসর্বস্ব ঋণের দায়ে বন্ধক দিতে হচ্ছে। এভাবে ঋণ তাদেরকে গ্রাস করে ফেলছে এবং প্রাচীন মুসলিম পরিবারগুলির অস্তিত্ব দুনিয়ার বুক থেকে মুছে যাচ্ছে”। -(W. W.Hunter The Indian Mussalmans. Dhaka Edition, 1975, p. 138)।
ইংরেজদের আগমনের পর তৎকারীন ভারতের গোটা মুসলিম জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলার মুসলমাণ।
হান্টার বলেন- “এ প্রদেশের ঘটনাবলীর সাথেই আমি বিশেষভাবে পরিচিত। তার ফলে আমি যতদূর জানি, তাতে করে ইংরেজ আমলে সর্বাদিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখানকার মুসলমান অধিবাসীগণ”। -(W.W Hunter The Indian Mussalmans. pp. 140-141)।
সে সময়ে বাংলা বলতে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যাকে বুঝাতো। তৎকালে উড়িষ্যার মুসলমানদের পক্ষ থেকে বিভাগীয় কমিশনার মিঃ ই, ডব্লিউ সলোনী, সি এস এর নিকটে প্রেরিত একটি আবেদনপত্রে তাদের করুণ অবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। আবেদনপত্রে বলা হয়েছেঃ-
“মহামান্য দয়াবতী মহারাণীর অনুগত প্রজা হিসাবে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থার সকল চাকুরীতে আমাদের সমান অধিকার আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, উড়িষ্যার মুসলমানদেরকে ক্রমশঃ দাবিয়ে রাখা হচ্ছে এবং মাথা তুলে দাঁড়াবার কোন আশাই তাদের নেই। সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করলেও জীবিকার্জনের পথ রুদ্ধ বলে আমর দরিদ্র হয়ে পড়েছি এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের অবস্থা হয়েছে পানি থেকে ডাঙায় উঠানো মাছের ন্যায়। মুসলমানদের এই করুণ দুর্দশা আপনার সামনে তুলে ধরছি এই বিশ্বাসে যে, আপনি উড়িষ্যা বিভাগে মহারাণীর প্রতিনিধি এবং আশা করি আপনি বর্ণ ও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর প্রতি সুবিচার করবেন। সরকারী চাকুরী থেকে বঞ্চিত হয়ে আমরা কপর্দকহীন হয়ে পড়েছি। আমাদের অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে, আমরা দুনিয়ার যেকোন প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে রাজী আছি –তা হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত চূড়াই হোক অথবা সাইবেরিয়ার জনবিরল প্রান্তরই হোক –যতি আমরা এ আশ্বাস পাই যে, এভাবে দেশ তেকে দেশান্তরে ভ্রমণের ফলে প্রতি হপ্তায় মাত্র দশ শিলিং বেতনে কোন সরকারী চাকুরী আমাদের মিলবে”। -(W. W.Hunter The Indian Mussalmans, PP. 158-159)।
মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারের যাঁরা বিভিন্ন সরকারী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ইংরেজদের আগমনের পর চাকুরী থেকে বঞ্চিত হয়ে শুধুমাত্র এসব পরিবারই দারিদ্র্য কবলিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল তাই নয়, বরঞ্চ, বাংলার সাধারণ মুসলিম পরিবারগুলির অবস্থাও তদনুরূপ হয়েছিল। বাংলার কৃষক ও তাঁতী সমাজও চরম দুর্দমার সম্মুখীন হয়েছিল।
কোম্পানী শাসনের প্রথম দিকে মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার অন্ত ছিল না। ‘দায়িত্ব ব্যতিরেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত’ (Power without responsibility) দেওয়ানীর অত্যাচার উৎপীড়নে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়। দেওয়ানী লাভের পূর্বে জমির কাজনা অতটা কঠোরতার সাথে আদায় করা হতো না –যতোটা এখন হচ্ছে। তারপর, পূর্বে রাষ্ট্রীয় আয় যেভাবেই হোক এদেশের মধ্যেই ব্যয় করা হতো যার ফলে এদেশের অধিবাসী কোন না কোন প্রকারে উপকৃত হতো। ভারতীয় কবির ভাষায়, রাজা কর্তৃক আদায়কৃত কর ভূমির আর্দ্রতার ন্যায়। সে আর্দ্রতা রৌদ্রতাপে শুষ্ক হয়ে পুনরায় উর্বরতা দানকারী বৃষ্টিধারা হয়ে ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু বর্তমানে ভারত।ভুমি থেকে যে আর্দ্রতা উত্তোলিত হচ্ছে তা তদ্রুপ বৃষ্টিধারার আকারে অবতরণ করছে অন্য দেশে, ভারতভূমিতে নয়। (R.C. Dutt Economic Hist. of India, p. 11, 12)। ইংরেজ আগমনের পর মোট আয়ের একতৃতীয়াংশ পাঠানো হচ্ছিল ইংলন্ডে। রাজ কোষাগার আর ‘বায়তুলমাল’ রইলো না যার থেকে জনগণ বিপদকালে সাহায্য পেতে পারতো। রাজস্বও দ্বিগুণ বর্ধিত করা হয়েছিল। বাংলার তথাকথিত শেষ নবাব তাঁর শেষ বৎসবে (১৭৬৪) ৮,১৭,৫৫৩ পাউন্ড রাজস্ব আদায় করেন পরবর্তী কালে মাত্র ত্রিশ বৎপর পর, ইংরেজরা আদায় করে ২৬,৮০,০০০ পাউন্ড। (R.C. Dutt Economic History of India. P.9; M. Fazlur Rahman The Bengalu Muslims & English Education. P. 14)।
পলাশী যুদ্ধের পরবর্তী কয়েক বৎসরে এবং পরে কৃষক সমাজ যে চরম ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিল তা কারো অজানা নেই। একদিকে ক্রমাগত দেশের ধনদৌলত ক্রমবর্ধমান আকারে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছিল, অপরদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকদের প্রতি নতুন জমিদারদের অমানুষিক অত্যাচার চলছিল। ফলে তারা ভাগ্যোন্নয়ন কিছুতেই করতে পারেনি এবং অদ্যবধি তারা ক্রীতদাসের ন্যঅয় জমিদারদেরই স্বার্থে কৃষিকাজ করে চলেছে। (M. Fazlur Rahman The Bengalu Muslums & Eng. Education. P.20; R.C. Dutt p.27)।
পাশাপাশি হিন্দু সমাজের ভাগ্য কতখানি সুপ্রসন্ন হয়েছিল, তারও কিঞ্চিত আলোচনা করা যাক। ব্যবসা বাণিজ্যের ন্যায় ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও তারা ছিল অত্যন্ত ভাগ্যবান। কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমানদের প্রায় সব জমিদারী হিন্দুদের দখলে চলে যায়। কিন্তু কোন হিন্দুর কোন জমিদারী হাতছাড়া হয়নি। অবশ্যি প্রাচীন হিন্দু জমিদারী কোন কোন ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে বটে, কিন্তু সেসবের ব্যবস্থাপনা নতুন প্রিয়পাত্র হিন্দুদের এবং ভূঁইফোড়াদের উপর অর্পণ করা হয়। প্রাচীন অািভজাত সম্প্রদায়ের স্থলে এক নতুন ধনাঢ্য শ্রেণী গজিয়ে উঠে। হিন্দু সমাজের উন্নয়ন ও সম্প্রদায়ের স্থলে এক নতুন ধনাঢ্য শ্রেণী গজিয়ে উঠে। হিন্দু সমাজের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের এ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পক্ষান্তরে মুসলমানদের বেলায় তা ছিল শূণ্যের কোঠায়। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education, p.25)।
চাকুরী বাকুরী, জমিদারী, জায়গীরদারী, কুটীর শিল্প প্রভৃতি থেকে মুসলমানদেরকে উৎখান করে ক্রমবর্ধমান হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী পত্তন করা হলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলার ইতিহাসই হলো এবই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ইতিহাস। আর এ শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছিল ব্যবসায়ী হিন্দু শ্রেণী থেকে। অতএব তারা যে সরকারের পুরাপুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education, p.118)।
এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্মলাভ সহজ করে দিয়েছিল হিন্দু জাতির বর্ণপ্রথা। কারণ এ বর্ণপ্রথাই তাদের একটি বিশেষ শ্রেণীকে ব্যবসাবাণিজ্যের দ্বারা জীবিকার্জনের জন্যে পৃথক করে দিয়েছিল। এই শ্রেণীর লোকেরা এই নতুন ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আগ্রহান্বিত। তারা কোম্পানীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট চিল বলে এবং ব্যবসার দালাল ও সরকারের নিম্নপদস্থ চাকুরীতে নিয়োজিত ছিল বলে, নতুন শাসকদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। দেশের প্রশাসন সম্পর্কে প্রাথমিক কর্মচারী ও মিশনারীগণ যেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিকা লিখেছিলেন তা পাঠ করলে জানা যায় যে, সরকার বার বার এই হিন্দু ভদ্রলোকদের (মধ্যবিত্ত শ্রেণী) উল্লেখ করতো এবং তাদের মনোরঞ্জন ও অবস্থার উন্নতির জন্যে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। এ ব্যাপারে সরকার অন্য কতগুলি কারণেও প্রভাবান্বিত হয়েছিল। প্রথম কারণ এই যে, তারা মুসলিম শাসনকে মনে করতো বৈদেশিক আধিপত্যবাদ যার অধীনে এদেশের লোক অর্থাৎ হিন্দুগণ উৎপীড়িত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ যে সময়ে অবস্থার উন্নতিকল্পে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছিল, তখন দুর্দশাগ্রস্ত মুসলমানগণ শহর ছেড়ে জীবন ধারণের জন্যে প্রত্যন্ত এলাকায় গমন করেছিল। ফলে তারা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
তৃতীয়তঃ মুসলমানদের ব্যাপারে সরকার এক চরম অবাধ নীতি (Laisez faire policy) গ্রহণ করেছিল, কারণ যাদের কাছ থেকে তারা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়, তাদের প্রতি একটা স্বাভাবিক অবিশ্বাস-অনাস্থা তাদের ছিল। পক্ষান্তরে বাংলার হিন্দুগণ এবং ইংরেজদের দখলকৃত অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দুগণ সরকারের দৃষ্টি এমনভাবে আকর্ষণ করেছিল যাতে করে তারা তাদের মনোরঞ্জনের দিকেই মনোযোগ দেয়। উপরন্তু খৃষ্টান মিশনারীগণ খৃষ্টীয় মতবাদ ও প্রচার-প্রচারণার প্রতি মুসশলানদের চেয়ে হিন্দুদেরকে অধিক সংবেদনশীল পেয়েছিল এবং ফলে তারা হিন্দুদের প্রতি ইংরেজ শাসকদের অতিমাত্রায় দৃষি।ট নিদেনপক্ষে ভাসাভাসা ইংরেজী ভাষায় জ্ঞান লাভের জন্যে উদগ্রীব হয়ে পড়ে। এদিক দিয়ে মুসলমানদের কোন সুযোগই ছিল না। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এই যে, মুসলমানদের মধ্যে কোন মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিদ্যমান ছিল না যারা তাদের দাবী উত্থাপন করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কোন সুযোগ সুবিধা লাভ করতে পারতো। পরবর্তীকালে সরকার কতৃক গঠিত General Committee of Public Instruction সত্য সত্যই মন্তব্য করেছেন যে, যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল তাদের ‘জাতীয় ধনাঢ্য, শক্তিশালী এবং প্রকৃত অভিভাবক’ –তা তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না বলে শিক্ষাদীক্ষা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তারা গ্রহণ করতে পরেনি। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education, pp.25-27) C.E. Trevelyan On the Education of the people of India, pp. 4-8)।

খৃস্টান মিশনারী ও ইংরেজী শিক্ষার সূচনা
মুসলিম শাসন আমলে তাদের নিজস্ব শিক্ষঅ পদ্ধতি অনুযায়ী সর্বত্র যে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিল, তা কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো তা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ইংরাজী ভাসায় প্রচলন করা হয়। এটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ভালো করেই উপলব্ধি করেছিল হিন্দু শ্রেণী এবং সেজন্যেতারা ইংরাজী ভাষা শিক্ষার জন্যে দ্রুত অগ্রসর হয়। মুসলশানরা মোটেই তা যে উপলব্ধি করেনি, তা নয়। ক্নিতু নতুন শিক্ষা তথা ইংরাজী শিক্ষা গ্রহণে কি কি অন্তরায় ছিল এবং অনেক সময়ে এ ব্যাপারে বহু চেষ্টা-সাধনা করেও তারা কেন সফল হয়নি, সে সম্পর্কেই আমরা এখানে কিছু আলোচনা করতে চাই।
প্রকৃতপক্ষে বাংলা তথা ভারতে ইংরাজী ভাষা শিক্ষাদানের সম্পর্ক রয়েছে ব্রিটিশ মিশনারীদের যীমুর বাণী বা সুসমাচার প্রচারের সাথে। কোর্ট অব ডিরেক্টর্স ১৬৫৯ সালে একটি বার্তায় সকল সম্ভাব্য উপায়ে যীশুর বানী-প্রচারের গভীর অনুগ্রহ প্রকাশ করে। মিশনারীদেরকে তাদের জাহাজে করে ভারত ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হতো এবং এখানে এসে দরিদ্র ও অজ্ঞ লোকদের মধ্যে যীমুর বানী প্রচারের উদ্দেশ্যে এ দেশের মাতৃভাষা শিক্ষা করার জন্যে তাদেরকে উৎসাহিত করা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে প্রদত্ত ১৬৯৮ সালের সনদে এ কথার উপর জোর দেয়া হয় যে, কোম্পানী যেখানে বসবাস করবে সেখানকার মাতৃভাষা তাদেরকে শিখতে হবে যাতে করে তারা তাদেরকে গড়ে নিতে পারে। কারণ তারা হবে কোম্পানীর চাকর বা দাস অথবা প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্মে তাদের প্রতিনিধি। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & Eng.Education, p. 28; Shap, p.3, Parochial Annals of Bengal bi H. B. Hyde; Court of Directors’ letter to Fort St. George, 25 February, 1695; LAW: promotion of Learning in India by Early European Serrlers, p. 19)।
বাংলার গভর্ণর জেনারেল স্যার জন শোর বলেন যে, ধর্মীয় কারণ অপেক্ষা রাজনৈতিক কারণে এ দেশবাসীকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দান অধিকতর প্রয়োজন।
যতোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রজাবৃন্দ আমাদের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রাণবন্ত না হয়েছে, ততোক্ষণ আমাদের অধিকৃত রাজ্য বহিরাক্রমণ ও আভ্যন্তরীণ আন্দোলন-উত্তেজনা থেকে নিরাপদ হবে না। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education, p. 34; Sharp Review of Bukanan’s Ireatise. Vol. 1. p. 113)।
এখন একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, বাংলা ও ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যে তারা প্রয়োজনবোধ করে এ দেশবাসীর ভাষা শিক্ষা করার যাতে করে খৃষ্টীয় মতবাদ এ দেশবাসীর নিকটে তারা সহজেই প্রচার করতে পারে।
এ দেশে ইংরেজদের শিক্ষা বিস্তারের ধারা চিল পর্যায়ক্রমিক। প্রথম পর্যায়ে খৃষ্টান মিশনারীগণ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বাংলা ভাষার স্কুল স্থাপন করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য তাহজীব তামাদ্দুন শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে ইংরাজী ভাষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করে।
মিশনারীগণ বৎসরের পর বৎসর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যায়। তারা হুগলী শ্রীরামপুরে একটি ছাপাখানা স্থাপন করে তার মাধ্যমে বাংলা ভাসার বহু পুস্তক প্রকাশ করে। তারা তাদের প্রচার অভিযানে কোন বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয় না, বরং উৎসাহ লাভ করে। এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৮১৫ সালের মধ্যে তারা একমাত্র কোলকাতার আশেপাশেই ২০২টি স্কুল স্থাপন করে। এর বহু পূর্বে ১৭৯৪ সালে জনৈক ক্যারী ফ্রী বোর্ডিংসহ মালদাহতে একটি স্কুল স্থাপন করেন। তিনি বাংলায় এসে একটি নীলচাষ খামারে ওভারশিয়ারের কাজ শুরু করেন। তাঁর স্থাপিত উক্ত স্কুলে সংস্কৃত, ফার্সী ও বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়অ হয়। এতদসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানদান ও খৃষ্টীয় মতবাদও শিক্ষাদান করা হয়। জনৈক মিঃ আর্চার ১৭৮০ সালে বালকদের জন্যে একটি স্কুল এবং অল্পদিন পর বালক-বালিকা উভয়ের জন্যে একটি স্কুল স্থাপন করেন। আর একটি স্থাপন করেন John Stranshenow । তবে ব্রাউনের স্থাপিত স্কুলের বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, তা স্থাপিত হয়েছিল হিন্দু-যুবকদের জন্যে।
-(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & Eng. Education p.30; Calcutta Review-1913: ‘Old Calcutta’: Its Schoolmaster by K.N. Dhas pp.338)।
খৃষ্টীয় মতবাদ প্রচারের জন্যে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় কতকগুলো সমিতি ইংলন্ডে স্থাপিত হয়। তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো SPCK (Society for Promotion of Christian Knowledge), S. P. G. (Society for the Propagation of the Gospel), CMS (Church Missionary Society) প্রভৃতি। বাংলায় খৃষ্টীয় মতবাদ প্রচারে এদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলার মিশনারীগণ তাদের স্ব স্ব সমিতিগুলোর নিকটে নিম্নোক্ত রিপোর্ট পেশ করেঃ
“ব্যবসা-বাণিজ্য এক নতুন চিন্তাধারা ও কর্মশক্তি উন্মোচন করে দিয়েছে। যদি আমরা দক্ষতার সাথে অবৈতনিক শিক্ষাদান করতে পারি –তাহলে শত শত ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করার জন্যে ভীড় জমাবে। আশা করি তা আমরা এক সময়ে করতে সক্ষম হবো এবং এর দ্বারা যীশুখৃষ্টের বাণী প্রচারের এক আনন্দদায়ক পথ উন্মুক্ত হবে”। -(M. Fazlur Rahman, Bengali Muslims & Eng. Education, p: 35; Mussalmans-Vol.1, pp.130-131)।
খৃষ্টান মিশনারীগণ বাংলা ও ইংরাজী স্কুল স্থাপনের নাম করে খৃষ্টীয় মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে ইসলাম ও তার মহান নবীর বিরুদ্ধে প্রচারণা করতে কুন্ঠিত হয়নি। কর্ণওলালিশ প্রকাশ্য রাজপথে ও গ্রামে খৃষ্টধর্মের প্রচার নিষিদ্ধ করে দেন (Beveridge: Hist. of India. Vol.2. pp850-51)।
তথাপি তারা এ কাজ চালাতে থাকে। সবশেষে মিন্টো তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ইসলাম ও নবী মুহাম্মদের (সা) প্রতি অশোভন ও অবান্তর উক্তি সম্বলিত পুস্তিকা প্রকাশের অপরাধে মিমনারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাবলম্বন করেন। -(M. Fazlur Rahman, Bengali Muslims & Eng. Education, p: 36: Lethbridge-p.59)।
উইলিয়াম ক্যারীর সভাপতিত্বে ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর (হুগলী) কলেজ স্থাপিত হ। এ কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞানদান করা এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে এদেশের লোককে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা শ্রীরামপুর কলেজ সেকালে এশিয়ার মধ্যে একমাত্র ডিগ্রি কলেজ। -(Mc. Cully. P.41: M. Fazlur Rahman, Bengali Muslims & Eng. Education, p: 39-40)।
শ্রীরামপুর কলেজের, যেমন আগে বলা হয়েছে; প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো ভারতে খৃষ্টধর্মের প্রচার ও প্রসার, তার জন্যে প্রয়োজন ছিল এদেশীয় খৃষ্টানদের দেয়া যারা খৃষ্টীয় মতবাদ বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশনার কাজও চালাবে। এতদুদ্দেশ্যে অখৃষ্টানদের জন্যে এ কলেজের দ্বার অবারিত ছিল এবং প্রভাবশালী স্থানীয় লোকদের খৃষ্টীয় মতবাদ প্রচারে সাহায্য সহযোগিতার জন্যে অনুপ্রাণিক করা হতো। ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা গেল এ কলেজে সর্বমোট ১০১ জন ছাত্রের মধ্যে অখৃষ্টান ছাত্র রয়েছে মাত্র ৩৪ জন। এরা ছিল শ্রীরামপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বংশের সন্তান (Mc. Cully pp. 64, 65)।
দুটি কারণে এতে কোন মুসলমান ছাত্র ছিল না। প্রথমতঃ এ কলেজের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ছিল খৃষ্টধর্মের প্রচার এবং দ্বিতীয়তঃ এতে এমন বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়া হতো যে বাংলা ভাষা মুসলশানদের জন্যে ছিল অবোধগম্য। কারণ, সে বাংলা ভাষা ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণ-জ্ঞান লব্ধ যা মুসলমানদের মোটেই জানা থাকবার কথা নয়। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 140)।
মিশনারীগণ কর্তৃক স্থাপিত স্কুল কলেজগুলিতে এবং সরকার কর্তৃক স্থাপিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে (১৮০০) হিন্দু শিক্ষকদের সহযোগিতায় সংস্কৃত ভাষার প্রণালীতে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে থাকে আর এ দরনের বাংলা ভাষা মুসলমানদের কাছে অপরিচিত ছিল। যদিও নিম্ন বংগের মুসলমান বাংলা বলতো। কিন্তু তাদের বাংলা ছিল আরবী ফার্সী মিশ্রিত। D.H.H. Wilson ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন যে, বাংলা ও হিন্দীর সংস্কৃতের সাথে নিকট সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর মতে Shakiespear’s Hindustanee Dictionary-তে ৫০০ শব্দের মধ্যে ৩০৫ টি সংস্কৃত শব্দ। বাংলা ‘হিতোপদেশ’ নামক কলেজের পাঠ্য পুস্তকে প্রথম ১৪৭টি শব্দের মধ্যে মাত্র ৫টি শব্দ এমন, যা সংস্কৃত নয়। [A.R. Mallik: Br. Policy and the Muslims in Bengal, p. 156: Sixth Report, Select Committee (HC). 1853. Minutes ofEvidence, p.9 উইলসন একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সংস্কৃত সম্পর্কে কিছু জ্ঞান না থাকলে কোন লোক বাংলা বুঝতে পারবে না।]
মাতৃভাষার স্কুলগুলিতে সংস্কৃত শব্দবহুল বাংলা পড়ানো হতো –এসব স্কুলের দ্বার মুসলমানদের জন্য রুদ্ধ ছিল। আবার বিহারে হিন্দী ভাষা –দেবনাগরী বর্ণমালায় শিখানো হতো এবং সেটাও ছিল মুসলমানদের কাছে একেবারে অপরিচিত। -(Report of Bengal Provicial Committee, Education Commission, p. 215. Evidence of Abdul Latif in reply ro Q1)।
উপরন্তু দক্ষিণা, অমর সিংহ, চাণক্য, সরস্বতী বন্দনা, মানভঞ্জন, কলংক ভঞ্জন প্রভৃতি।
হিন্দু বই যথা, দান লীলা, দধি লীলা প্রভৃতি যা ছিল কৃষ্ণের বাল্যকালের প্রেমলীলা সম্পর্কে লিখিত। বিহারে প্রতদ্ব্যতীত পড়ানো হতো সুদাম চরিত, রাম যমুনা প্রভৃতি। -(A.R. Mallick: British Policy and the Muslims in Bengal, p. 156)।
এসব তথ্য থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদেরকে শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত রাখার জন্যে খৃষ্টান মিশনারী, ইংরেজী শাসক এবং এতদ্দেশীয় দালালদের এ চিল এক ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা। আলেকজান্ডার ডাফ (Alexander Duff) ইংরেজী শিক্ষার জন্যে কোলকাতায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে –যা ডাফের প্রচেষ্টায় একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল শুধুমাত্র নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের জন্যে এবং তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের সহযোগিতায়। ইচ্ছাকৃতভাবেই এ স্কুলটি একটি হিন্দু মহল্লায় এবং এমন প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয় যেখানে একদা গড়ে উঠেছিল হিন্দু কলেজ। ডাফ কোন মুসলমান এলাকায় কোন স্কুল প্রতিষ্ঠার কোন চেষ্টাই করেননি। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 41, N. Chattaerhce : Life of Mahatma Raja Rammohan Roy (Bengali), p.394)।
আঠারো শ’ সাত থেকে ১৮১৪ সালের মধ্যে ডঃ ফ্রান্সিস বুকানন বাংলা ও বিহারের জেলাগুলি সরকারের নির্দেশে সার্ভে করেন। ১৯৩৮ সালে তাঁর রিপোর্ট তিন খন্ডে আর, এস, মার্টিন কর্তৃক প্রকাশিত হয়। লর্ড বেন্টিংকের আমলে ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৮ সালের মধ্যে ডবলিউ অ্যাডাম বুকাননের কাগজপত্রের ভিত্তিতে তিনটি রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। তৃতীয় রিপোর্টটি ১৯৩৮ সালে প্রণীত হয়- সরজমিনে তাঁর নিজের পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের পর। তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষাক্ষেত্রের তুলনামূলক খতিয়ান পেশ করেন, তা নিম্নরূপঃ

হিন্দু মুসলমান
(ক) দেশীয় প্রাথমিক স্কুল ১১ ১৬
(খ) উচ্চ বিদ্যালয় ৩৮ ০
(গ)যেসব পরিবারে পিতামাতা অথবা বন্ধুবান্ধবের
দ্বারা ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা দেয়া হতো ১২৭৭ ৩১১
উপরের খতিয়ান দৃষ্টান্তস্বরূপ রাজশাহী জেলার নাটোর থানার দেয়অ হয় যেকানে তৎকালে হিন্দুর জনসংখ্য ছিল ৬,৫৬,৫৫৮ এবং মুসলমান ১২৯৬৪০১। এমন একটি মুসলিম অধ্যুষিত থানায় মুসলমানদের শিক্ষার অনুপাত ছিল এত নগণ্য যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। উক্ত খতিয়ানে মোট শিক্ষকের সংখ্যা বলা হয়েছে, যার মধ্যে মুসলমান শিক্ষক ছিল মাত্র একজন।
মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে এহেন অবস্থার কারণ বর্ণনা করে বলেন যে, আর্থিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট জীবন যাপন করছিল। তিনি আরও বলেন যে, এ অবস্তায় তাদেরকে বিদ্যাশিক্ষার জন্যে উপদেশ দেয়ার অর্থ হলো, মই লাগিয়ে স্বর্গে আরোহণ করা যা সম্পূর্ণ এক অসম্ভব ও অবান্তর ব্যাপার। অ্যাডাম বলেন, সমগ্র রাজশাহী জেলার মধ্যে মুসলমানদের শিক্ষার জন্যে একটিমাত্র বিদ্যালয় ছিল বিলমারিয়া থানার কসবাবাঘাতে যা কয়েকশত বছরের পুরাতন এবং স্থাপিত হয়েছিল বাংলার মুসলমান সুলতান ও মহানুভব মুসলিম প্রধানদের পৃষ্ঠপোষকতায়
W Adam তাঁর তৃতীয় রিপোর্ট প্রণয়ন করেন (১৮৩৮) বাংলা-বিহারের ৫টি জেলা পরিদর্শনের পর। তার ভিত্তিতে তিনি যে খতিয়ান প্রণয়ন করেন তা নিম্নরূপঃ
খতিয়ান নং-১: আরবী-ফার্সী স্কুল, তাদের সংখ্যা ও ছাত্র সংখ্যা, হিন্দু ও মুসলমান।

জেলা ফার্সী আরবী স্কুল হিন্দু ছাত্র মুসলিম ছাত্র মোট
মুর্শিদাবাদ ১৭ ২ ৬২ ৪৭ ১০৯
বর্ধমান ৯৩ ৮ ৪৭৭ ৪৯৪ ৯৭১
বীরভূম ৭১ ২ ২৪৫ ২৪৫ ৪৯০
তিরহুৎ ২৩৪ ৪ ৪৪৫ ১৫৩ ৫৯৮
দক্ষিণ বিহার ২৭৯ ১২ ৮৬৭ ৬১৯ ১৪৮৬
মোট ৬৯৪ ২৮ ২০৯৬ ১৫৫৮ ৩৬৫৪
মজার ব্যাপার এই যে, আরবী-ফার্সী স্কুলে যোগদানকারী হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা ৪ এর তিন অনুপাতে অধিক। তারপর সংস্কৃত স্কুলে যোগদানকারী হিন্দু ছাত্রের সংখ্যা ধরলে তাদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৬৫১ এবং মুসলিম সংখ্যা ১৫৫৮। খতিয়ান নং-২: মাতৃভাষার স্কুল –তাদের সংখ্যা, ছাত্রসংখ্যা ও হিন্দু মুসলমান।

জেলা বাংলা স্কুল হিন্দী স্কুল হিন্দু ছাত্র মুসলিম ছাত্র অন্যান্য মোট
মুর্শিদাবাদ ৬২ ৫ ৯৯৮ ৮২ ০ ১০৮০
বর্ধমান ৬৩০ ০ ১২৪০৮ ৭৬৯ ১৩ ১৩১৯০
বীরভূম ৪০৭ ০ ৬১২৫ ২৩২ ২৬ ৬৩৮৩
তিরহুৎ ০ ৮০ ৫০২ ৫ ০ ৫০৭
দক্ষিণ বিহার ০ ২৮৬ ২৯১৮ ১৭২ ০ ৩০৯০
মোট ১০৯৯ ৩৭৬ ২২৯৫১ ১২৬০ ৩৯ ২৪২৫
উপরোক্ত খতিয়ান থেকে একথা জানা যায় যে, মুসলমানরা মাতৃবাষা শিক্ষায় হিন্দুদের থেকে অনেক পেছনে পড়ে থাকে। তার কারণও অতি সুস্পষ্ট। প্রথমতঃ সংস্কৃতবহুল বাংলাভাষা তাদের জন্যে অবোধগম্য এবং দ্বিতীয়তঃ পাঠ্যপুস্তকের বিষয়গুলি ছিল পৌত্তলিকতাপূর্ণ প্রবন্ধাদি ও গল্পকাহিনীতে পরিপূর্ণ। তৃতীয়তঃ হিন্দী স্কুলের পরিবর্থে স্কুল না থাকায় মুসলমারা শিক্ষায় পশ্চাৎপদ রয়ে যায়। ডবলিউ অ্যাডাম মুসলমানদের জন্যে উর্দু স্কুল খোলার জন্যে এবং মুসলমানদের উপযোগী বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্যে সুপারিশ করেন। কিন্তু সরকার এদিকে কোন দৃষ্টি দেননি।
[দ্রঃ A.R Mallick British Policy and Muslims in Bengal. Pp.161-65)
খৃষ্টান মিশনারী সোসাইটির (C.M.S) কোলকাতা শাখার উদ্যোগে বর্ধমানে ১৮১৯ সালে হিন্দুদের জন্যে একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপিত হয়। কোলকাতা শাখার প্রতিনিধি M r. Shew এবং Mr. Thompson নিয়মিত স্কুলটি প্রাঙ্গনে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন ছাত্রদেরকে খৃষ্টীয় ধর্মে দীক্ষিত করা হবে এ আশংকায় স্কুলটি নষ্ট হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ১৮৩২ সালে বিশপ কোরী (Corrie) কোলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কলিংগতে একটি ইংরাজী স্কুল স্থাপন করেন। ক্নিতু যখন তার পাশে একটি গীর্জা নির্মাণ করা হলো, তখন অধিক সংখ্যক মুসলিম ছাত্র স্কুল পরিত্যাগ করে। মিঃ টমসন তাঁর রিপোর্টে ছাত্র সংখ্যা হ্রাসের কারণ বর্ণনা করে বলেন (১৮৪১) যে, হিন্দুরা পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যেমন অনুরাগী, মুসলমানরা তেমন নয়। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 44-45; Long: Handvook of Bengal Mission, p. 125)।
মিঃ টমসন প্রকৃত কারণটি গোপন রেখে মুসলমানদের উপরেই দোষ চাপিয়েছেন প্রকৃত কারণ এই যে, পাশ্চাত্যের ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পাশ্চাত্যের ধর্মের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিশনারী স্কুলে যেতে নিজেকে মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করা মুসলমানদের জন্যে যতোটা কষ্টকর চিল, হিন্দুদের ততোটা ছিল না। খৃষ্টধর্মের প্রতি মুসলমানদের ছিল বীতশ্রদ্ধা এমনকি ঘৃণাও বলা যেতে পারে। কারণ মুসলমানগণ খৃষ্টধর্মকে নাকচ করে তাদের ধর্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে। পক্ষান্তরে হিন্দুদের এমন কোন পূর্বজ্ঞান ছিল না, সে জন্যে তারা সহজেই খৃষ্টধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হতো।
মিশনারীদের জানা ছিল যে, তাদের যোগাযোগের ফলে বেশী সংখ্যক হিন্দু খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। সে জন্য তাদের সকল প্রচেষ্টা হিন্দুদের প্রতি নিয়োজিত ছিল। ১৮৫৮ সালে জনৈক মিশনারী তাঁর লিখিত একখানি পুস্তিকায় মন্তব্য করেন যে, মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে সত্যিকারভাবে কোন আন্তরিক প্রচেষ্টাই চালানো হয়নি। যেসব ইউরোপীয়ানদেরকে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিদর্শনের কাজে লাগানো হতো তাঁরা মুসলমানদের ভাষা, চরিত্র ও আচার-আচরণ সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখতেন না। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 46; India Office Tract. 242)।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মুসলিম শাসনের অবসান এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভ ইংরেজদেরকে বলতে গেলে এদেশের সর্বেসর্বা বানিয়ে দেয়। ফলে কোলকাতাকে কেন্দ্র করে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য শতগুণে বর্ধিত হতে থাকে। কোলকাতায় বিরাট বিরাট অট্টালিকা গড়ে উঠতে থাকে। যে হিন্দুদের সাহায্য সহযোগিতায় এ দেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল, তাঁরা কোম্পানীর অধীনে চাকুরী-বাকুরী করার, তাদের ব্যবসায় অংশীদার হওয়ার অথবা ব্যবসার দালাল হিসাবে কাজ করার জন্যে দলে দলে অগ্রসর হয়। তার জন্যে ইংরাজী ভাষা শিক্ষার আশু প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করে। সেজন্যে ইংরাজ স্কুল স্থাপনের প্রথম পদক্ষেপ তাদের পক্ষ থেকেই গৃহীত হয়। হিন্দু ব্যবসায়ী ও ধনিক-বণিকগণ তাদের ইউরোপীয় বণিক বন্ধুদের সাহায্য সহযোগিতায় বিভিন্ন স্থানে বেসরকারী পর্যায়ে ইংরাজী স্কুল স্থাপন করে। অষ্টাদশ শতদের ন’য়ের দশকে কোলকাতার কলুটোলায় এ ধরনের একটি স্কুল স্থাপন করেন জনৈক নিত্যানন্দ সেন।
আর একটি কথা এখানে বিশেষ উল্লেখ্য। এ দেশে মিশনারীগণ বাংলা ভাষার স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে খৃষ্টধর্ম প্রচারে ব্রতী হয়। এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করতে থাকলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তাদের কার্যকলাপের উপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু Charter Act of 1813 তাদের প্রতি আরোপিত বাধা-নিষেধ রহিত করে। এ আইনের বলে ভারতে বিশপতন্ত্র (Episcopacy) প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। ১৮১৪ সালে বিশপ মিডল্টন (Middleton) কোলকাতায় আসেন। তাঁর উৎসাহ উদ্যমে মিশনারীগণ পূর্ণ্যোদ্যমে কাজ শুরু করে। কোলকাতার বিশাপ কলেজে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। তাঁর অনুরোধে এ কলেজের জন্যে গভর্ণর জেনারেল বাষট্টি বিঘা জমি দান করেন। পরবর্তীকালে এর জন্যে অধিকতর সরকারী সাহায্য দান করা হয়। বিশট মিডল্টন নিজে কলেজের গীর্জা স্থাপনের উদ্দেশ্যে পাঁচশত পাউন্ড এবং পাঁচশত পুস্তক কলেজ লাইব্রেরীতে দান করেন।
মিশনারীদের কাজে সাহায্য সহযোগিতার জন্যে ইউরোপীয় বণিকগণ এগিয়ে আসে এবং বাংলার প্রকৃতপক্ষে ইংরাজী শিক্ষার গোড়াপত্তন তাদের দ্বারাই হয়। তাদেরই প্রচেষ্টায়, বিশেষ করে মিঃ ডেভিড হেয়ার এবং স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্টের সাহায্য সহযোগিতায় হিন্দু যুবকদের শিক্ষার জন্যে ১৮১৭ সালে কোলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮১৬ সালের ২৭ আগষ্ট স্যার এডওয়ার্ডের বাসভবনে হিন্দুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সাধারণ সভায় এ প্রস্তাবিত কলেজের গঠনতন্ত্র ও নিয়মনীতি প্রণীত হয়। বলা হয় যে, সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদেরকে ইংরাজ ও ভারতীয় ভাষা এবং ইউরোপ এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া এ প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। -(M. Fazlur Rahman The Bengali Muslims & English Education p. 48-51, Quoted from the Rules approved by the Subscribes and general meeting held on 27 August, 1816, Calcutta Christian Observer, July 1832, p.72)।
এ হিন্দু কলেজটি ১৮৩২ সালে একটি সরকারী কলেজে পরিণত হয়। এভাবে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। সাধারণতঃ মুসলমানদের প্রতি এ অপবাদ আরোপ করা হয়ে থাকে যে, তারা ইংরাজী ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ ছিল। এমনকি বাংলাভাষার প্রতিও তারা ছিল উদাসীন। উপরে বলা হয়েছে যে, মুসলমানদেরকে শিক্ষার অংগন থেকে দূরে রাকার জন্যে কিভাবে বাংলাভাষাকে সংস্কৃতবহুল করা হয়েছিল। এটাই ছিল প্রকৃত কারণ যার জন্যে মুসলমানরা কি সত্যি সত্যিই ইংরাজী ভাষা শিক্ষা করতে তাদের অস্বীকৃতি জানিয়েছিল? এমন ধারণা করলে তাদের প্রতি অবিচারই করা হবে। ইংরাজী স্কুল কলেজে অধ্যয়ন করা ছিল অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ এবং মুসলমানরা ছিল দরিদ্র জর্জরিত। ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ী মহাজণ তাদের ইংরেজ বন্ধুদের সাহায্য সহযোগিতায় নিজেরা প্রাইভেট ইংরাজী স্কুল স্থাপন করে, সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকেই, নিজেদের সন্তানাদির ইংরাজী শিক্ষার পথ প্রশস্ত করে নিয়েছিল। মুসলমানদের জন্যে এসব প্রচেষ্টা ছিল অসম্ভব ও অবাস্তব। একথা নিঃসংকোচে বলা যেতে পারে যে, মুসলমানরা জন্মগতভাবে, জাতিগতভাবে এবং তাদের ধর্মের দিক দিয়ে যে কোন জাতি অপেক্ষা অধিকতর শিক্ষানুরাগী ছিল। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ায় শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। ইংরাজী শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতিও তারা অনুরাগী ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা সরকারের কণামাত্র সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পারেনি। মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে সরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ১৭৮০ সালে ওয়ারেন হ্যাস্টিংস কর্তৃক কোলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৭৮০ থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত চল্লিম বৎসরের এ মাদ্রাসার ইতিহাস অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ প্রতিষ্ঠানটিকে মুসলমানদের জন্যে ইংরাজী ও পাশ্চাত্য শিক্ষাসহ একটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে সরকার দাঁড় করাতে পারতেন। কিন্তু তা তাঁরা করেননি। কোলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজী ক্লাস খোলার উপর্যুপরি দাবী সত্ত্বেও সরকার গড়িমসি করে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন। হিন্দুদের উচ্চশিক্ষার জন্যে হিন্দু কলেজ ছাড়াও বহু ইংরাজী স্কুল হিন্দু, ইংরেজ, মিশনারী এবং কোলকাতা স্কুল সোসাইটির দ্বারা স্থাপিত হয়। কিন্তু কোথাও মুসলমানদের প্রবেশ করার কোন উপায় ছিল না। অ্যাডাম সাহেবের বর্ণনামতে কোলকাতা আপার সার্কুলার রোড এবং বড় বাজারে জনৈক খৃষ্টান এবং জনৈক হিন্দু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দু’টি স্কুল ছিল। তাঁরা স্কুলে শিক্ষকতাও করতেন। আর একটি শোভাবাজারে। এখানে তিনশত ছাত্র অধ্যয়নরত ছিল। এ স্কুলটিও একজন খৃষ্টান ও একজন হিন্দু পরিচালনা করতেন। এসব স্কুল যেহেতু বেসরকারী ছিল, সেজন্যে ছাত্রদের নিকট পরিচালনা করতেন। এসব স্কুল যেহেতু বেসরকারী চিল, সেজন্যে ছাত্রদের নকিট থেকে মোটা বেতন আদায় করা হতো। মুসলমানদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে থাকলেও তারা অর্থাভাবে তাদের সন্তানকে সেখানে পাঠাতে পারতো না সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। Calcutta Review (1850) এ ধরনের আরও কতকগুলি স্কুলের উল্লেখ করেছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো Oriental Seminery। ১৮২৩ সালে স্কুলটি স্থাপিত হয়। ১৮৫০ সালে এর ছাত্রসংখ্যা ছিল ৫৮৫। হিন্দু কলেজের পরেই ছিল এর স্থান। বলা হয় যে, জনৈক গৌর মোহন আদ্দী স্কুলটি তাঁর দেশবাসীর জন্যে স্থাপন করেন এবং এর অধ্যাপনা কার্যে জনৈক মিঃ চার্নবুল এবং জনৈক ব্যারিষ্টার Herman Geoffery-কে নিযুক্ত করেন। খুব সম্ভবতঃ এখানেও মুসলমান ছাত্রদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এসব ছাড়াও খৃষ্টানদের সন্তানদের জন্যে কিছু বিশেষ স্কুল স্থাপন করা হয় যেখানে হিন্দু ও মুসলমানদের প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছিল। এগুলি হলো –The Calcutta High Schoo, The Parental Academic Institution, The Philanthropy-Academy, The Verulam Academy প্রভৃতি। প্যারেন্টাল একাডেমী এমন স্থানে অবস্থিত ছিল যেখানে সামর্থবান মুসলমানরা তাদের ছেলেদেরকে পাঠাতে পারতো। সম্ভ্রান্ত ও সামর্থবান মুসলমান তাদের সন্তানদেরকে সেন্ট পলস স্কুলে এবং প্যারেন্টাল এ্যাকাডেমীতে পাঠাতো। এ দু’টিতে পাঠাবার কারণ এই ছিল যে, এখানে ছেলেরা ইংরাজী ভাষায় দক্ষতা লাভ করতো এবং এ দু’টি মিশনারী ধরনের স্কুল ছিল না। এ দু’টি স্কুলে মুসলমানদের যোগদান করার কারণ বর্ণনা করে মিঃ মুয়াত (Mouat 1952)-[F.j Mouat. Secretary to the Committee of Education.] বলেন যে, যেহেতু কোলকাতা মাদ্রাসায় পড়াশুনা ভালো হতো না এবং আরও কিছু দোষ-ত্রুটি ছিল, যার জন্যে তাদেরকে অন্যত্র যেতে হয়েছে। -(M. Fazlur Rahman: The Bengali Muslims & English Education p. 57-58. Calcutta Review 1850.p.457: Adam, op,cit pp.37,41)।
মুসলমানদের শিক্সার জন্যে ১৭৮০ সালে যে কোলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয় ,তার প্রতি কোম্পানী এবং ব্রিটিশ সরকার এমন অবহেলা প্রদর্শন করেন যে, মনে হয়, শিক্ষার পরিবর্তে অশিক্ষা ও কুশিক্ষা দেয়াই ছিল কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য। এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন বোধ করছি।
বেশ কিচু সংখ্যক খ্যাতনামা মুসলিম শিক্ষাবিদের আবেদনে হ্যাস্টিংস ১৭৮০ সালে মুসলমানদের শিক্ষার জন্যে কোলকাতা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। সে সময় পর্যন্ত ফৌজদারী-দেওয়ানী আদালতগুলিতে এবং পুলিশ বিভাগে মুসলমানগণ বিভিন্ন দায়িত্বে চিল এবং প্রশাসনক্ষেত্রে ফার্সী ভাষা প্রচলিত ছিল বলে আপাততঃ শাসনকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের জন্যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখা কোম্পানী সরকারেরও প্রয়োজন ছিল। মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। কিন্তু ১৭৮০ সাল থেকে ১৭৯১ পর্যন্ত মাদ্রাসার কোনই অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। মজদুদ্দীনের পরিচালনায় ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়ে এবং অপসারিত করে জনৈক মুহাম্মদ ইসরাইলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মাদ্রাসা কমিটি পুনর্গঠিত হয় নিম্নলিখিত পাঠ্যসূচী প্রণীত হয়ঃ
প্রকৃতি দর্শন (Natural Philosophy) ফেকাহ শাস্ত্র, আইন শাস্ত্র, জ্যোতিঃ শাস্ত্র, জ্যামিতি, গণিত, তর্ক শাস্ত্র এবং ব্যাকরণ। কিন্তু ১৯২২ সাল পর্যন্ত অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। অতএব মাদ্রাসা কমিটির জনৈক প্রভাবশালী সগস্য ডাঃ ল্যামসডেন (Lamsden) তাঁর রিপোর্টে একজন ইউরোপিয়ান অধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশ করেন। সরকার সে সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেন, তবে Lamsdan) তাঁর রিপোর্টে একজন ইউরোপিয়ান অধ্যক্ষ নিয়োগের সুপারিশের অনুরোধ জানান। ১৮১৮ সালে কমিটি একজন ইউরোপিয়ান সেক্রেটারী নিয়োগের প্রস্তাব করেন। সরকার এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন কিন্তু আর্থিক দায়িত্ব কমিটির উপরে অর্পণ করেন যাতে করে সরকারী রাজস্বের রাজস্বের উপর কোন চাপ না পড়ে। দুঃখের বিষয় এই যে, Dr. M. Lamsden পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের বইপুস্তক আরবী ও ফার্সীতে অনুবাদ, মাদ্রাসায় ইংরাজী শিক্ষা প্রচলন ও মুসলমান ছাত্রদেরকে ইংরাজী শিক্ষাদানের জন্যে যে প্রস্তাব দেন, তা সরকার প্রত্যাখ্যান করেন অথবা বহু বৎসর যাবত গড়িমসি করতে থাকেন। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 68-70; A.R. Mallick British Policy & the Muslims of Bengal. P.176)।
কমিটির একজন দায়িত্বশীল সদস্য (Dr.M. Lamsden) যখন মাদ্রাসায় ইংরাজী ক্লাস খোলার প্রস্তাব দেন, তখন নিশ্চয়ই বুজতে হবে যে, মুসলমান ছাত্র এবং অভিভাবকগণ ইংরাজী শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ছিল। নতুবা তারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করতো। একথা স্মর্তব্য যে, বেনারস সংস্কৃত কলেজে ইংরাজী ক্লাস খোলার জন্যে ১৮১৫ সালে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। মাদ্রাসা কমিটি এ ব্যাপারে পেছনে পড়ে থাকেন। অপরদিকে ১৮১৬ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয় এবং ইংরাজীতে শিক্ষাদান শুরু হয়। ১৮৫৪ সালে মুসলমানদের আবেদন নিবেদনে এ হিন্দু কলেজটি প্রেসিডেন্সী কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর দ্বার সকল ধর্ম ও গোত্রের ছাত্রদের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। (আবদুল মওদূদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৯৪, শতাব্দী পরিক্রমাঃ ডাঃ হাসান জামান, অধ্যাপক আবদর রহীম, পৃঃ ২৩৯)।
যাহোক Lamsden-এর প্রস্তাবানুযায়ী ক্যাপ্টেন ইরভিন মাসিক তিনশত টাকা বেতনে কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত হয়। ১৮২১ সালের আগষ্ট মাসে নতুন বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং পরীক্ষায় ফল হয় সন্তোষজনক। পরবর্তী দু’বৎসরের ফলও ভালো হয়। ১৮২৩ সালে মিঃ জন অ্যাডাম কর্তৃক জনশিক্ষার সাধারণ কমিটি (General Committee of Public Instruction) গঠিত হয়। কমিটি ১৮২৪ ও ১৮২৫ সালের পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক বলে মন্তব্য করেন। ল্যামসডেন (Lamsden) পুনর্বার প্রস্তাব করেন যে, ছাত্রদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষার প্রেরণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ইংরাজী পাঠ্যপুস্তক আরবী ও ফার্সীতে অনুবাদ করা হোক। তিনি মাদ্রাসার প্রাথমিক শিক্ষাকে উন্নতমানের করার উদ্দেশ্যে একটি প্রস্তুতিমূলক (Preparatory) স্কুলে স্থাপনের আবশ্যকতার উপরে বিশেষ জোর দেন। কিন্তু ইউরোপীয়ানদের দ্বারা প্রভাবিত মাদ্রাসা কমিটি ল্যামসডেনের সকল প্রস্তাব মেনে নেন। কিন্তু ইউরোপীয় শিকআস বিস্তারের দফাটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। অধিকাংশ সদস্য এ মত প্রকাশ করেন যে, ইংরাজী বা ইউরোপীয় শিক্ষা প্রচলন করলে যে উদ্দেশ্যে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল তা ব্যর্থ হবে। (Board’s Collection, 909, p.321. pp.365-67,909. p.322; Lamsden to Madrasah Committee, 30 May, 1823; Madrasah Committee to Governor-General, 3 July 1832)। ফলে কমিটির এ অস্বীকৃতি মুসলমান ছাত্রদের ইংরাজী শিক্ষার পথে চরম বাধার সষ্টি করে। অপরদিকে জনশিক্ষা কমিটি কোলকাতা সংস্কৃত কলেজে ইংরাজী ক্লাস খোলার প্রস্তাবটি উৎসাহ সহকারে বিবেচনা করেছিলেন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্যে হিন্দু কলেজটি কমিটির হাতে নেন। Dr. H. H. Wilson-কে এ কলেজের সরকারী পরিদর্শক হিসাবে কমিটির সেক্রেটারী পদে নিয়োগ করেন। এর জন্যে প্রভৃত পরিমাণে সরকারী অর্থও বরাদ্দ করা হয়। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসয় ইংরাজী শিক্ষা চালু করার জন্যে বার বার দাবী জানানো সত্ত্বেও তার প্রতি সরকার কোন গুরুত্ব আরোপ করেন না। অথচ বেসরকারী হিন্দু কলেজের প্রতি সরকারের অনুকম্পা, সাহায্য সহানুভূতি ও দান উপচে পড়ছিল। এর তেকে স্পষ্টই বুঝতে পারা যায় যে, মুসলমানদের প্রতি এবং বিশেস করে তাদের ইংরাজী শিক্ষার প্রতি সরকার কতখানি উদাসীন ছিলেন। এর তেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানরা ইংরাজী শিক্ষা বর্জন করেছিল বলে তাদের প্রতি যে অভিযোগ করা হয়, তাও ভিত্তিহীন। একটি বিশেষ শ্রেণীর বলে তাদের প্রতি যে অভিযোগ করা হয়, তাও বিত্তিহীন। একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্যে পক্ষাপাতিত্বের অপরাধ ঢাকার জনেইই মুসলমানদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়। হিন্দুদের মধ্যে খৃষ্টান মিশনারীদের কর্মতৎপরতা ও খৃষ্টধর্ম প্রচারের ইতিহাস, এমনকি হিন্দুদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিন্দু কলেজের ইতিহাস যাঁর ভালো করে জানা আছে, তিনি অবশ্যই স্বীকার করবেন যে, ইংরাজী শিক্ষার প্রতি হিন্দুদের ঘৃণা বা অনীহা যতোখানি ছিল, মুসলমানদের ততোখানি ছিল না। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. ৭৩-৭৪)।
১৮২৫ সালের মাদ্রাসার বার্ষিক পরীক্ষার পর পরীক্ষকগণ, মিঃ মিল ও মিঃ টমসন পরীক্ষায় ছাত্রদের প্রশংসনীয় সাফল্য লক্ষ্য করে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁদের প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে ল্যামসুডেম মাদ্রাসায় ইংরাজী শিক্ষা প্রবর্তনের চাপ দেন। তিনি কমিটির নিকটে তাঁর প্রেরিত প্রতিবেদনে বলেন যে, মুসলমান ছাত্র ও জনসাধারণের সংগে দীর্ঘনিদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ সম্পর্কের ফলে তাঁর এ ধারণা জন্মেছে যে, ইংরাজী ভাষাকে যদি শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জ্ঞানাজর্ননের বাহন হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে এতে মুসলমানদের কোন আপত্তি থাকবে না, বরঞ্চ তা সাগ্রহে গ্রহণ করবে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে যদি বাইবেল প্রচারের পথ সুগম করা হয়, অথবা যদি মুসলমাদের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করা হয়, তাহলে আপত্তি উত্থাপিত হবারই কথা। -(M Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p.74; Board’s Collection, 909, pppp. 713; Lamsden to General Commutee. 19 February 1825)। Lamsden আরও প্রস্তাব দেন যে, ইংরাজী শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্যে প্রত্যেক ছাত্রকে আট টাকার একটি করে বৃত্তি মঞ্জুর করা হোক। ম্যাকলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং প্রস্তাবটি প্রত্যাখাত হয়।
মাদ্রসায় ইংরাজী ক্লাস খোলা না হলেও ইংরাজী শিক্ষার জন্যে এতটা আগ্রহান্বিত হয় পড়েছিল যে, তারা যৎসামান্য পারিম্রমিক দিয়ে শিক্ষকদের কাছে কিছু ইংররাজী শিখতে থাকে। তাতে করে তারা ভালো ইংরাজীও শিখতে পারছে না। ল্যামসডেন এবার কমিটির নিকটে একজন ইংরাজী ভাষার শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করেন। তাতেও কোন ফলোদয় হয় না। এভাবে মুসলমানদের দোষে নয়, বরং কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমূলক আচরণ ও মুসলমানদের শিক্ষা বিস্তারে তাঁদের আন্তরিকতার অভাবেই মাদ্রসার ছাত্রগণ ইংরাজী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে।
এদিকে অত্যন্ত প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ Dr. H. H. Wilson. হিন্দু কলেজের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তিনি সে কলেজের উত্তরোত্তর উন্নতিকল্পে অধিকতর সরকারী সাহায্যের দাবী জানান। শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল মিঃ হল্ট ম্যাকেঞ্জি একটি বিশেষ শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের বেসরকারী কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এর জন্যে প্রচুর অর্থ ব্যায় হবে বলে তা সরকার প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রত্যাখ্যান হিন্দু কলেজের জন্যে হলো একটি বিরাট আশীর্বাদ। এখন থেকে কমিটির গোটা সুনজর পড়লো এই হিন্দু কলেজের উপর এবং এটাকেই ইংরাজী শিক্ষার একমাত্র পাদপীঠ হিসাবে স্থান দেয়া হলো। ১৮২৫ সালের এ কলেজ সম্পর্কিত রিপোর্টে জেনারেল কমিটি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রসংখ্যা একশ’ থেকে দু’শ হয়েছে এবং যদি এত সংখ্যক ছাত্রকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও ইংরাজী ভাষায় প্রশিক্ষণ দেয়া যায়, তাহলে কোলকাতা শহরের প্রধান ও অগ্রগণ্য অধিবাসীবৃন্দের (Principal Inhabitants of Calcutta) বুদ্ধিবৃত্তি সংক্রান্ত গুণাবলীর বিকাশ ও উন্নতি নিঃসন্দেহে আশা করা যেতে পারে। এখানে কোলকাতা শহরে প্রধান ও অগ্রগণ্য অধিবাসী কথাটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এ কথার দ্বারা একমাত্র কোলকাতার ‘হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী’-কেই বোঝানো হচ্ছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এ কথাটির দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের প্রকৃত মনোভাবটি পরিস্ফুট হয়ে গেছে।
প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ শাসকদের শিক্ষা সম্পর্কিত পলিসি বা নীতি ছিল, পরিস্রাবণ নীতি (Policy fo filtration) যার দ্বারা উচ্চশিক্ষা তথা ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা সীমিত করা হয়েছিল হিন্দুদের একটি নির্বাচিত শ্রেণীর মধ্যে যাদেরকে বলা হয়েছে Principal Inhabitants of Calcutta (কোলকাতার প্রধান ও অগ্রগণ্য অধিবাসীবৃন্দ)অর্থাৎ হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তারা ইংরাজী শিক্ষা লাভ করে দেশের মধ্যে এ শিক্ষাবিস্তারে ব্রতী হবে। অর্থাৎ তাদের দ্বারা যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে তার শিক্ষকতা যেমন করবে হিন্দু, তেমনি তার শিক্ষার্থীও হবে হিন্দু। যা প্রকৃতপক্ষে হয়েছে। বলতে গেলে, প্রধানতঃ এ শিক্ষা শিক্ষার্থীও হবে হিন্দু। যা প্রকৃতপক্ষে হয়েছে। বলতে গেলে, প্রধানতঃ এ শিক্ষা আবার সীমিত ছিল –উচ্চশ্রেনীর হিন্দু অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের মধ্যে। আবার এ পরিস্রাবণ নীতির ফলভোগ করেছে হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণী। মুসলমান ত দূরের কথা, হিন্দু জাতির অন্যান্য শ্রেণীও এর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রেভারেল্ড লাল বিহাসরী দে মন্তব্য করেন, “ভারতে উচ্চশ্রেণীর পরিস্রাবক, কোন দিক দিয়েও পরিস্রাবক নয়। এ এমন এক মৃন্ময় পাত্র যার মুখ এমনভাবে বন্ধ যাতে করে বাইরের কোন আলো-বাতাসও ঢুকতে না পারে। একদিকে একজন ব্রাহ্মণ পেট ভরে তর্কশাস্ত্র, অধিবিদ্যা ও ধর্মশাস্ত্রের জ্ঞান আহার করছে, অপরদিকে কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তসহ শুদ্র অযতাই লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কখত তার প্রভুর আহারের টেবিল থেকে এক টুকরো খাদ্য তার ভাগ্যে জুটবে”। (L.B. Dey in reply to Babu Kishori Chand Meeeting of British India Association, 1868 –Quoted by H.A. Stark Verncular Education in Bengal. P.89)।
এই পরিস্রাবণ নীতি অনুযায়ী সরকার হিন্দু কলেজের প্রতি তাদের সর্বাধিক মনোযোগ প্রদান করেন। ছাত্রদেরকে ষোল টাকার আটটি বৃত্তি এবং মাসিক তিনশত টাকার সাহায্য মঞ্জুর করা হয়। অতঃপর প্রাথমিক বইপুস্তকাদি ছাপানোর জন্যে ৪৯,৩৭৬ টাকা এবং ইংলন্ড থেকে পুস্তক সংগ্রসের ৫০০০/- টাকা দেয়া হয়।
এভাবে হিন্দু কলেজকে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করার সুযোগ দিয়ে উইলসন সংস্কৃত কলেজের দিকে মন দেন। এখানে ইংরাজী ক্লাস খোলার ঘোষণার সাথে সাথে ১৩৬ জন ছাত্রের মধ্যে ৪০ জন ইংরাজী শিক্ষার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে। হিন্দু কলেজের অধ্যাপক জনৈক মিঃ টিটলারকে (Tytler) অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিয়োগ করা হয়। এসব করার পর, সরকার হয়তো লজ্জার মাথা খেয়ে, ১৮২৯ সালে কোলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজী ক্লাস খোলার সিদ্ধান্ত করেন। প্রথম বৎসর এপ্রিল মাসে রিপোর্টে জানা গেল ছাত্রসংখ্যা ১৩৬ থেকে হ্রাস পেয়ে -১০২ হয়েছে। দারিদ্রই এর প্রধান কারণ বলে বর্ণনা করা হয়। কারণ মুসলমানগণ ইংরাজী শিক্ষার জন্যে অধিকাংশ ছাত্র প্রদেমের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আগমন করে। তাদের দারিদ্যের কারেণে তারা ইংরেজ ভদ্রলোকদের খানসামাদের বাসার জায়গীর তেকে এবং সায়েবদের আর্থিক সাহায্যে পড়াশুনা করে। -(M. Fazlur Rahman Bengali Muslims & English Education p. 74-80; Hunter The India Mussalmans, p.203)।
মুসলমানদের ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা সম্পর্কে যে দীর্ঘ আলোচনা করা হলো তা দু’টি কারণে। একটি হলো ইংরেজ সরকারের মুসলমানদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ প্রমাণ করা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, মুসলমানরা ইংরাজী শিক্ষা বর্জন করেছিল –তাদের প্রতি আরোপিত এ অভিযোগ অমূলক প্রমাণ করা। আশা করি উপরের আলোচনায় এ বিষয় দু’টি সুস্পষ্ট হয়েছে। প্রমাণ স্বরূপ আরও দু’একটি কথা বলে রাখি।
লর্ড মেকলে ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন মেম্বর হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ভারতের ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেনঃ
“বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবেন। তাঁর মাংসের গড়নে ও দেহের রঙে ভারতীয় হবেন বটে, কিন্তু রুচি, মতামত, নীতিবোধ ও বুদ্ধির দিক দিয়ে হবেন খাঁটি ইংরেজ। (Woodrow Macauly’s Minutes on Education in India, 1862: আবদুল মওদূদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৯৭)।
মেকলে আরও বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি আমাদের শিক্ষানীতি কার্যকর হয় তাহলে আজ থেকে ত্রিশ বছরের মধ্যে শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত বাঙালী সমাজে কোন মূর্তিপূজকের অস্তিত্ব থাকবে না। (Trevelyan –Life and Letters of Lord Macaulay Vol.1, p.455)
মেকলে সায়েত তাঁর প্রথম উক্তিতে ত্রিশ বৎসর পর যা দেখতে চেয়েছিলেন, তা যে শুরু হয়ে গেছে, ইংলন্ডে বসে হয়তো তা তিনি দেখতে পাননি। বৃটিশ পণ্যের চাহিদা কতখানি বেড়েছে তার তথ্য সংগ্রহ করা হয় ১৮৩২ সালে। এ তথ্য বিবরণীতে বলা হয় যে, কোলকাতা মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে বিলেতী বস্ত্রেরই চাহিদা বাড়েনি। বরঞ্চ বিলেতী মদেরও চাহিদা-কদর বেড়েছে। তাদের মধ্যে বিলেতী বিলাসদ্রব্যের আকর্ষণ বেড়েছে। তাদের বিলেতী আসবাবপত্র সজ্জিত বাড়ী আছে, জুড়িগাড়ী আছে এবং তারা মদ্যপানও করছে। নেটিভরা নিশ্চয়ই বেশী মদ খায়। কারণ ফিরিংগীপনায় (মেকলের ভাষায় রুচি, মতামত ও নীতিবোধের দিক দিয়ে হবে খাঁটি ইংরেজ) তাদের অনীহা বা ঘৃণা বিদ্বেষ নেই এটাই প্রমাণ করতে চায়। তারা মদ, ব্রান্ডি, বিয়ার খায়। (Select Committee Report, House of Commons, 1831-32 মওদূদ; পৃঃ ১০)।
শিক্ষা বিষয়ে সরকারের ‘পরিস্রাবণ নীতি’ ব্যাখ্যা করে ট্রিভেলিয়ান সায়েব বলেন, “ব্যবসায়ী ধনী, শিক্ষিত সম্প্রদায় প্রথমে লাভবান হবে; একদল নতুন শিক্ষকের আবির্ভাব হবে; দেশীয় বাষায় পুস্তকাদি বেশী প্রকাশিত হবে। তখন এসবের দ্বারা আমরা শহর থেকে গ্রামে, অল্প থেকে বিশাল জনসাধারণের ঘরে ঘরে অগ্রসর হবো –প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে, তবে আমাদের সামর্থ সীমিত, অথচ লক্ষ লক্ষ লোককে শিক্ষা দিতে হবে। এজন্যেই নির্বাচনের প্রয়োজন এবং প্রথমে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীর লোকদের দিকেই লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। কারণ তারা শিক্ষিত হলে জনসাধারণের মধ্যেও সুযোগ ছড়িয়ে পড়বে”।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃঃ ৯৭-৯৮; Trevelyan p.48)।
ট্রিবেলিয়ান সায়েবের মুখ দিয়ে ইংরেজ শাসকদের মনের কথাটি বের হয়ে পড়েছে। ধনিক-বণিক ও মধ্যবিত্ত হিন্দুশ্রেণীর সহযোগিতায় তারা মুসলমানদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে তাদের সাথে এ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মিতালি ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। তাদেরকে ষোলআনা তুষ্ট রেখেই তারা এদেশে শাসন ক্ষমতা অটুট রাখতে সক্ষম হবে। অতএব তাদের অনুকম্পা ষোল আনা যে এই একটি বিশেষ শ্রেণীর উপর বর্ষিত হবে, তাতে অবিচার হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। খৃষ্টান মিশনারীগণ এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্যে প্রচেষ্টা চালায়। তবে তাদের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না মোটেই। শিক্ষার নাম করে মুসলমানদের কাছে তাদের ‘সুসমাচারের’ আহবান-আবেদন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে মুসলমানদেরকে তারা সুনজরে দেখতে পারতো না। এ ব্যর্থতা মেষ পর্যণ্ত তাদেরকে ইসলাম ও তার মহানবীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের লিপ্ত করে। অতএব মিশনারী, ইংরেজ শাসক ও তাদের দোসর হিন্দু মধ্যেবিত্ত শ্রেনী –এ তিনের চক্রে মুসলমানদের ভাগ্য নিষ্পেষিত হয়, তার শিক্ষার অঙ্গন ও জীবিকা থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হয়, এবং অন্য সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
এ দেশের লোকেরা শিক্ষা ও সুখ সুবিধার জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন তা বিলাত থেকে আনতে হতো না। এদেশের অর্থ এ এদেশের লোকের জন্যে বয় করা যেদো। এবং তা কথনো অনুগ্রহ অনুকম্পা বলেও বিবেচিত হতো না। এ ছিল এ দেশবাসীর অধিকার। কিন্তু এ অধিকার থেকে মুসলমানদেরকে করা হয়েছিল বঞ্চিত। সরকারী তহবিল থেকে মুসলমানদের শিক্ষার জন্যে ব্যয় বরাদ্দ করা ত দূরের কথা, মুসলমানদের শিক্ষার জন্যে প্রদত্ত দানকেও তাঁরা আত্মসাৎ করেছেন এবং অপাত্রে ব্যবসার করেছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দানবীর হাজী মুহাম্মদ মুহসিনের দানের কথাই ধরা যাক। এ সম্পর্কে মুসলমানদের বক্তব্য পেশ না করে যাঁদরেল ইংরেজ ও খৃষ্টান হান্টার সায়েব কি বলেছেন তাই বিধৃত করা হচ্ছেঃ
১৮০৬ সালে হুগলী জেলার এক ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত মুসলমান মৃত্যুর সময় তার বিরাট জমিদারী সৎকার্যে ব্যয়ের জন্যে দান করে যান। পরে তাঁর দু’জন ট্রাস্টীর মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। ১৮১০ সালে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে সম্পত্তি অপব্যবহারের অভিযোগ আনলে সংকট চরমে উঠে এবং জেলার ইংরেজ কালেক্টর আদালতের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে সম্পত্তির দখল নিয়ে নেন। ১৮১৬ সাল পর্যন্ত মোকাদ্দমা চলতে তাকে এবং তখন উভয় ট্রাষ্টীকে বরখাস্ত করে উক্ত জমিদারীর ব্যবস্থাপনা সরাকর নিজ হাতে গ্রহণ করেন। একজন ট্রাস্টীর দায়িত্ব সরকার নিজে গ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় জনের স্থলে নতুন একজনকে মনোনীত করেন। পরের বছর নির্ধারিত রাজস্ব প্রদানের শর্তে সমস্ত সম্পত্তি ইজারা দেয়া হয়। মামলা চলাকালীন বকেয়া পাওনাসহ ইজারা বাবদ প্রাপ্ত মোট আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৫,৭০০ স্টার্লিং পাউন্ড। (এ আয় থেকেই কলেজ বিল্ডিং এর মূল্য পরিশোধ করা হয়)। এ ছাড়াও জমিদারীরর বার্ষিক আয় থেকে এ পর্যন্ত ১২০০০ স্টার্লিং পাউন্ড অধিক উদ্ধৃত্ত হয়।
“আগেই বলেছি, জমিদারীর আয় বিভিন্ন সৎ কাজে ব্যয় করার জন্যে ট্রাস্ট গঠিত হয়। উইলে যেসব কৎকাজে ব্যয় করার কথা বলা হয়, তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় ধর্মীয় প্রচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন, হুগলী ইমামবাড়া বা বড়ো মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ, একটি গোরস্থান, কতিপয় বৃত্তি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ যোগান দেয়া ট্রাস্ট গঠনের উদ্দেশ্যের আওতায় পড়ে। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতার ইচ্ছানুসারে সেটাকে মুসলমানদেরকে রীতিমাফিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে হবে। মুসলিম দেশগুলিতে মেধাবী দরিদ্র ছাত্রদের জন্যে কলেজ প্রতিষ্ঠা করাকে ধর্মীয় কাজ হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু এই উইলের অর্থ কোন অ-মুসলিম কলেজের কাজে ব্যয় করা উইলকারীর ইচ্ছার ব্যতিক্রম বলে বিবেচিত হবে এবং সেটা ট্রাস্টীদের ক্ষমতার গুরুতর অপব্যবহার হিসাবেই গণ্য হবে।
“সুতরাং এই তহবিলের টাকা একটি ইংরাজী কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয় করায় মুসলমানরা কিরূপ ক্রোধের সাথে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কার্যতঃ হয়েছেও তাই। কেবলমাত্র ইসলাম-ধর্মীয় কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সম্পত্তির টাকা দিয়ে সরকার এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে যেখানে ইসলামের নীতিবিরোধী বিষয়সমূহ শিক্ষা দেয়া হয় এবং যে প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলমানদেরকে কার্যতঃ বাদ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ একজন ইংরেজ ভদ্রলোক যিদি ফার্সী বা আরবী ভাষার একটি বর্ণও জানেন না। মুসলমানরা ঘৃণা করে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয়ার জন্যে এ অধ্যক্ষ কেবলমাত্র মুসলমানদের কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত তহবিল থেকে বছরে ১৫০০ স্টার্লিং পাউন্ড বেতন পেয়ে থাকেন। অবশ্য এটা ঐ অধ্যক্ষের কোন অপরাধ নয়। এজন্যে অপরাধী হচ্ছেন সরকার যারা তাকে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন। গত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত সরকার ঐ বিরাট শিক্ষা তহবিলের অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে তছরুপ করে আসছেন। সরকার নিজের গুরুতর বিশ্বাস ভংগের অপরাধ ঢাকা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস হিসাবে ইংরাজী কলেজটির সাথে একটি ছোট মুসলমান স্কুলকে (হুগলী মাদ্রাসা) সংশ্লিষ্ট করেন। কলেজ বিল্ডিং নির্মানের জন্যে উক্ত তহবিলের টাকা তছরুপ করা ছাড়াও কলেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তহবল থেকে বার্ষিক ৫০০০ স্টার্লিং পাউন্ড ব্যয় করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, তহবিলের ৫২৬০ স্টার্লিং পাউন্ড আয়ের মধ্যে মাত্র ২৫০ স্টার্লিং পাউন্ড উক্ত ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলের জন্যে ব্যয় হচ্ছে এবং ট্রাষ্টের মৌল বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ হিসাবে এ ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলটিই শুধু টিকে আছে।
“এ তছরুপের অভিযোগ নিয়ে বাদানুবাদ করা খুব কষ্টকর ব্যাপার কারণ এ অভিযোগ খন্ডন করা সম্ভবপর নয়। মুসলমানরা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে যে, মুসলমানদের এ বিরাট ধর্মীয় সম্পত্তির মালিকানা দখলের অসদুদ্দেশ্যে বিধর্মী ইংরেজ সরকার সম্পত্তির মুসলিম ট্রাষ্টীদের অব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছেন এবং তারপর দাতার পবিত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বরখেলাপ করে সরকার মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন যার ফলে সরকারের কৃত অপরাধ অধিকতর গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, কয়েকবছর আগে আলোচ্য ইংরাজী কলেজের মোট তিনশ’ ছাত্রের মধ্যে এক শতাংশ মুসলমান ছিল না। তারপর এই অবমাননাকর বৈষম্য হ্রাস পেলেও অবিচারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অসন্তোষ এখনও পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছেন এমন এক সিভিলিয়ান লিখেছেন-
তুলেছে যেখানে ইসলামের নীতিবিরোধী বিষয়সমূহ শিক্ষা দেয়া হয় এবং যে প্রতিষ্ঠান থেকে মুসলমানদেরকে কার্যতঃ বাদ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ একজন ইংরেজ ভদ্রলোক যিনি ফার্সী বা আরবী ভাষায় একটি বর্ণও জানেন না। মুসলমানরা ঘৃণা করে এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয়ার জন্যে এ অধ্যক্ষ কেবলমাত্র মুসলমানদের কাজে ব্যয়ের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত তহবিল থেকে বছরে ১৫০০ স্টার্লিং পাউন্ড বেতন পেয়ে থাকেন। অবশ্য এটা ঐ অধ্যক্ষের কোন অপরাধ নয়। এজন্যে অপরাধী হচ্ছেন সরকার যারা তাকে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছেন। গত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত সরকার ঐ বিরাট শিক্ষা তহবিলের অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে তছরুপ করে আসছেন। সরকার কলেজটির সাথে একটি ছোট মুসলমান স্কুলকে (হুগলী মাদ্রাসা) সংশ্লিষ্ট করেন। কলেজ বিল্ডিং নির্মাণের জন্যে উক্ত তহবিলের টাকা তছরুপ করা ছাড়াও কলেজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তহবিল থেকে বার্ষিক ৫০০০ স্টার্লিং পাউন্ড ব্যয় করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে এই যে, তহবিলের ৫২৬০ স্টার্লিং পাউন্ড আয়ের মধ্যে মাত্র ২৫০ স্টার্লিং পাউন্ড উক্ত ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলের জন্যে ব্যয় হচ্ছে এবং ট্রাষ্টের মৌল বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ হিসাবে এ ক্ষুদ্র মুসলিম স্কুলটিই শুধু টিকে আছে।
“এ তছরুপের অভিযোগ নিয়ে বাদানুবাদ করা খুব কষ্টকর ব্যাপার কারণ এ অভিযোগ খন্ডন করা সম্ভবপর নয়। মুসলমানরা অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে যে, মুসলমানরেদ এ বিরাট ধর্মীয় সম্পত্তির মালিকানা দখলের অসদুদ্দেশ্যে বিধর্মী ইংরেজ সরকার সম্পত্তির মালিকানা দখলের অসদুদ্দেশ্যে বিধর্মী ইংরেজ সরকার সম্পত্তির মুসলিম অব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করেছেন এবং তারপর দাতার পবিত্র ধর্মীয় উদ্দেশ্যের বরখেলাপ করে সরকার মুসলমানরেদ স্বার্ত বিরোধী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন যার ফলে সরকারের কৃত অপরাধ অধিকতর গুরুতর হয়ে দেখা দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, কয়েক বছর আগে আলোচ্য ইংরাজী কলেজের মোট তিনশ’ ছাত্রের মধ্যে এক শতাংশও মুসলমান ছিল না। তারপর এই অবমাননাকর বৈষম্য হ্রাস পেলেও অবিচারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের অসন্তোষ এখনও অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছেন এমন এক সিভিলিয়ান লিখেছেন-
“এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার নিজের কাজের দ্বারা যে ঘৃণা ও অবমাননা কুড়িয়েছেন তাকে অতিরঞ্জিত করে দেখা অসুবিধাজনক বলে আমি প্রমাণ করে দেখাতে পারি যে, ভারতে আমার আটাশ বছর বসবাসকালে আমি বিষয়টির সত্যাসত্য যাচাই করে দেখেছি (এ দেশে প্রথম আগমনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমি হুগলী সফর করি) এবং আমি বলতে পারি যে, তখন এদেশীয় বা ইউরোপীয় কারো কাছ থেকেই অন্য কিছু আমি শুনিনি। যথার্থ হোক বা না হোক মুসলমানরা মনে করে যে, এ ব্যাপারে সরকার তাদের প্রতি অন্যায় ও সংকীর্ণমনা আচরণ করেছেন, এবং তাদের কাছে এটা একটা স্থায়ী তিক্ত অভিজ্ঞতায় পর্যবসিত হয়েছে”।
(W W Hunter The Indian Mussalmans, বাংলা অনুবাদ এম আনিসুজ্জামান, পৃঃ ১৬৩-১৬৫)।
এ ছিল দু’জন ইংরেজ সায়েবের স্পষ্টোক্তি যাঁরা ব্রিটিম সরকারের অতীব দায়িত্বশীল কর্মচারী হিসাবে এদেশে এসেছিলেন। মুসলমানদের প্রতি চরম অবিচার দেখে তাঁদের অন্তরাত্মা হয়তো ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। তারই অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিল তাঁদের লেখায়। কিন্তু এতেও কি অবিবেচক ও অত্যাচারী সরকারের টনক নড়েছিল? তাঁরা এ দেশের এক শ্রেণীকে মনে করতেন তাঁদের দুশমন এবং আর এক শ্রেনীকে জানের দোস্ত। দুশমনের ন্যায্যা হক আত্মসাৎ করে তাই দিয়ে মনতুষ্টি সাধন করেছেন দোস্তের। ব্রিটিশ শাসনের শেষ তক এ অবিচার অব্যাহত রয়েছে। গ্রন্থকার ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত উক্ত কলেজ সংলগ্ন ছোট্ট মুসলিম স্কুলে বাল্যজীবন কাটিয়েছে। হান্টার সায়েবের বর্ণিত অবস্থার তখনো কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। ধর্মীয় দানের এর চেয়ে বড়ো আত্মসাৎ ও অপব্যবহার আর কোথাও হয়েছে বলে মানব ইতিহাসে খুঁজে যে পাওয়া যাবে না তা নিঃসংকোচে বলা যেতে পারে। মুসলমানদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, ব্রিটিশ এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর উত্তরাধিকার সূত্রে উক্ত দানের সম্পত্তি ও তহবিল লাভ করেছেন তাদেরই সেকালের দোসর। অতএব অভস্থার পরিবর্তন অচিন্তনীয়।
ইংরেজ-শাসকগোষ্ঠী, খৃষ্টান মিশনারী ও বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী-এ ত্রিচক্রের গভীর ষড়যন্ত্রের ফলেই মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার ফলে শিক্ষা দীক্ষা ও জীবিকার্জনের পথ তাদের রুদ্ধ হয়ে যায়। ১৮৩৭ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে সরকারী কাজকর্মে অফিস আদালতে ইংরাজী ভাষা চালু করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, ইংরেজরা কূটবুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে চুপে চুপে ইংরাজীকরণ নীতি চালু করে; জনসমষ্টিকে সচেতন না করে, নিজের সংকল্প কার্যকর করা। তাদের প্রিয়পাত্র শ্রেণীটির কিনউত এ গোপন ষড়যন্ত্র জানা ছিল। তাই পয়লা এপ্রিল থেকে হঠাৎ ইংরাজী ভাষা হওয়ার সাথে সাথে তারা সকল সরকারী অফিসগুলিতে জেঁকে বসে গেল। এদিকে ইংরেজ মিশনারীদের কূট চালে আরবী ফার্সী শব্দাশ্রিত মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ ভাষা-অবদান উর্দুকেও স্থানচ্যুত করে সংস্কৃত শব্দবহুল হিন্দুস্থানী ভাষাও সৃষ্ট হয় এবং সরকার অনুমোদিত একমাত্র দেশীভাষা হিসাবে চাকুরী প্রাপ্তির সনদ হিসাবে স্বীকৃত হয়।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ …পৃঃ ৯৮-৯৯)। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্যে সকল চাকুরীর দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া।
এভাবে ইংরাজী শিক্ষার বোধন হয়েছিল প্রধানতঃ রাজনৈতিক গরজে এবং নগরবাসী একটিমাত্র শ্রেণীর মংগল বিধানে। বাস্তবপক্ষে ইংরাজী শিক্ষাই হলো এদেশীয়দের সরকারী অফিস আদালতে চাকুরী লাভের একমাত্র পাসপোর্ট। আর এজন্যে এ ভাষাটার শিক্ষা হয় দ্রুত, নিশ্চিত ও সর্বব্যাপক। কিনউত এ শিক্ষানীতির সবচেয়ে মারাত্মক দিক হলো, মাত্র মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজেই তা সীমিত করা হয়ছিল, জনসাধারণ মর্মান্তিকভাবে উপেক্ষিত হলো। আবার ইংরাজী শিক্ষার সমস্ত সুযোগ সুবিধা মধ্যবিত্ত শ্রেনীর হিন্দুরাই আত্মসাৎ করলো, অভিজাত হিন্দুরা এবং সমগ্র মুসলিম দূরেই পড়ে রইলো। দেশকে ইংরেজীয়ানা করণের এই অনুপ্রবেশ-যুদ্ধে মেকলে পন্থীরাই জয়ী হয়েছিলেন। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ পৃঃ ৯৯-১০০; John Marshal An Advanced History of India, pp.818-19)।
উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষাঙ্গন ও চাকুরী ক্ষেত্রে মুসলমানদের কি অবস্থা ছিল সে সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধির জন্যে নিম্নে কিছু খতিয়ান সংযোজিত হলো।
১৮৫২ সালের ৩০শে এপ্রিল সরকারী স্কুল কলেজে হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রসংখ্যাঃ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু মুসলমান অন্যান্য মোট
হিন্দু কলেজ ৪৭১ ০ ০ ৪৭১
পাঠমালা ২১৬ ০ ০ ২১৬
ব্রাঞ্চ স্কুল ২৫৫ ০ ০ ২৫৫
সংস্কৃত কলেজ ২৯৯ ০ ০ ২৯৯
মাদ্রাসা ০ ৪৩৩ ০ ৪৩৩
হুগলী কলেজ ৩৮৯ ৬ ২ ৩৯৭
হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুল ১৬০ ২ ২ ১৬৪
হুগলী মাদ্রাসা ১৮ ১৪৫ ০ ১৬৩
হুগলী মক্তব ৯ ৪৭ ০ ৫৬
সীতাপুর মাদ্রাসা ০ ৪০ ০ ৪০
ঢাকা কলেজ ৩২৩ ২৯ ৩১ ৩৮৩
কৃষ্ণনগর কলেজ ২০৫ ৭ ১ ২১৩
চট্টগ্রাম কলেজ ৯৭ ৮ ২০ ১২৫
কুমিল্লা কলেজ ৮১ ৬ ৪ ৯১
সিলেট কলেজ ৮০ ১১ ১ ৯২
বাউলিয়অ কলেজ ৮৩ ০ ২ ৮৫
মেদিনীপুর কলেজ ১১৭ ৭ ১ ১২৫
যশোর কলেজ ৯৬ ৭ ০ ১০৩
বর্ধমান কলেজ ৭১ ৩ ০ ৭৪
বাঁকুড়া কলেজ ৭৪ ০ ০ ৭৪
বারাসত কলেজ ১৭৪ ০ ০ ১৭৪
হাওডা কলেজ ১২৩ ৬ ০ ১২৯
উত্তরপাড়া কলেজ ১৭৫ ০ ০ ১৭৫
বারাকপুর কলেজ ৮৮ ২ ০ ৯০
রসপাগলা কলেজ ১০ ৩৭ ০ ৪৭
মোট ৩৮৪১ ৭৯৬ ৬৪ ৪৬৭৪
(A.R. Mallick British Policy & the Muslims in Bengal, p.280)
উপরোক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৮৫৬ সালের এপ্রিল মাসের ছাত্রসংখ্যা। ইতিমধ্যে হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সী কলেজে পরিণত হয়েছে এবং কোলকাতা মাদ্রাসায় ইংরাজী শিক্ষার জন্যে অ্যাংলো পার্সীয়ান বিভাগ (A.P.) খোলা হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু মুসলমান অন্যান্য মোট
প্রেসিডেন্সী কলেজ ১২৭ ০ ৫ ১৩২
হিন্দু কলেজ ৪৬২ ০ ০ ৪৬২
কলুটোলা স্কুল ৫৬৭ ০ ৪ ৫৭১
মাদ্রাসা (আরবী) ০ ৫৯ ০ ৫৯
মাদ্রাসা (এপি) ০ ১১১ ০ ১১১
কলিংগ স্কুল ১২৪ ১৫ ৪ ১৪৩
সংস্কৃত কলেজ ৩৩৯ ০ ০ ৩৩৯
পাঠশালা ৩৪৫ ০ ০ ৩৪৫
মেডিক্যাল কলেজ ১৪৮ ৯৬ ৩৪ ২৭৮
হুগলী মাদ্রাসা ৪ ১৭৫ ০ ১৭৯
হুগলী ব্রাঞ্চ স্কুল ১৬৯ ৮ ০ ১৭৭
ঢাকা কলেজ ৩৯০ ২৪ ৪১ ৪৫৫
কৃষ্ণনগর কলেজ ২৪০ ৭ ০ ২৪৭
বহরমপুর কলেজ ২২৭ ১০ ৫ ২৪২
হাওড়া স্কুল ২২৯ ৩ ৪ ২৩৬
উত্তরপাড়া স্কুল ২০৩ ০ ০ ২০৩
বীরভূম স্কুল ১০৪ ১০ ০ ১১৪
মেদিনীপুর স্কুল ১৪৫ ১০ ০ ১৫৫
বাঁকুড়া স্কুল ১৪৬ ১ ০ ১৪৭
বাউলিয়া স্কুল ১২৯ ৫ ০ ১৩৪
রসপাগলা স্কুল ৪০ ৬৩ ০ ১০৩
বারাসত স্কুল ১৯২ ৩ ০ ১৯৫
বারাকপুর স্কুল ১১৬ ২ ০ ১১৮
যশোর স্কুল ১৩৪ ৫ ২ ১৪১
পাটনা স্কুল ১৪৪ ৪ ০ ১৪৮
ফরিদপুর স্কুল ১০২ ৪ ০ ১০৬
বরিশাল স্কুল ২০৯ ২২ ৩ ২৩৪
কুমিল্লা স্কুল ৯৩ ১৬ ৭ ১১৬
নোয়াখালী স্কুল ৬৬ ১ ৪ ৭১
চট্টগ্রাম স্কুল ১৬৬ ৪২ ১৪ ২২২
বগুড়া স্কুল ৮৫ ৬ ০ ৯১
দিনাজপুর স্কুল ১১৪ ৮ ৪ ১২৬
ময়মনসিংহ স্কুল ১৬৭ ৯ ৮ ১৮৪
সিলেট স্কুল ১৫৭ ৫ ২ ১৬৪
মোট ৬৩৩৮ ৭৩১ ১৪৭ ২২১৬
(A.R. Mallick British Policy & the Muslims in Bengal, p.281)
বাংলায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চাকুরীক্ষেত্রে এপ্রিল ১৮৭১ সালে মুসলমানদের স্তান কোথায় ছিল তার একটি খতিয়ান সংযোজন করেন হান্টার সায়েব তাঁর গ্রন্থে। তা নিম্নরূপঃ

ইউরোপীয়ান হিন্দু মুসলমান মোট
চুক্তিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস
(মহারানী কর্তৃক ইংলন্ড থেকে
নিয়োগপ্রাপ্ত ২৬০ ০ ০ ২৬০
রেগুলেশন বহির্ভুত জেলাসমূহেত
বিচার বিভাগীয় অফিসার ৪৭ ০ ০ ৪৭
এক্সট্রা অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার ২৬ ৭ ০ ৩৩
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ৫৩ ১১৩ ৩০ ১৯৬
ইনকাম ট্যাক্স অ্যাসেসর ১১ ৪৩ ৬ ৬০
রেজিষ্ট্রেশন বিভাগ ৩৩ ২৫ ২ ৬০
স্মল কটেজ কোর্টের জজ ও
সাব-অর্ডিনেটজজ ১৪ ২৫ ৮ ৪৭
মুন্সেফ ০ ১৭৮ ৩৭ ২১৬
পুলিশ বিভাগ, সকল গ্রেডের
গেজেটেড অফিসার ১০৬ ৩ ০ ১০৯
গণপূর্ত বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ারিং
এস্টাবলিশমেন্ট ১৫৪ ১৯ ০ ১৭৩
গণপূর্ত বিভাগ, সাব-অর্ডিনেন্ট
এস্টাবলিশমেন্ট ৭২ ১২৫ ৪ ২০১
গণপূর্ত বিভাগ, একাউন্ট
এস্টাবলিশমেন্ট ২২ ৫৪ ০ ৭৬
মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট,
মেডিক্যাল কলেজে, জেলখানায়,
দাতব্য চিকিৎসালয়ে, স্বাস্থ্য
সংরক্ষণ ও রোগ প্রতিষেধক বিভাগে
নিযুক্ত কর্মচারী এবং জেলা
মেডিক্যাল অফিসার ইত্যাদি ৮৯ ৬৫ ৪ ১৫৮
জনশিক্ষা বিভাগ ৩৮ ১৪ ১ ৫৩
শুল্ক, নৌ চলাচল জরিপ, আফিম
নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগ ৪১২ ১০ ০ ৪২২
মোট ১৩৩৪ ৬৮১ ৯২ ২১১১
W W Hunter The Indian Mussalmans, Bangladesh Edition 1975, p. 152)।
উপরোক্ত খতিয়ানটি সংযোজিত করার পর হান্টার সায়েব নিম্নোক্ত মন্তব্য করেনঃ
একশ’ বছর পূর্বে সকল সরকারী পদ মুসলমানদের চিল একচেটিয়া। কদাচিৎ শাসকগণ কিছু অনুগ্রহ বিতরণ করলে হিন্দুরাও গ্রহণ করে কৃতার্থ হতো; এবং টুকটাক দু’একটা অথবা কেরানীগিরিতে দু’চারটা ইউরোপীয়ানকে দেখা যেতো। কিন্তু উপরের হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, পরবর্তীকালে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের হার দাঁড়িয়েছে সাত ভাগের একভাগেরও কম। আর হিন্দুদের সংখ্যা ইউরোপীয়ানদের তুলনায় অর্ধেকেরও বেশী। আর মুসলমানদের সংখ্যা ইউরোপীয়ানদের এক চতুর্থাংশেরও কম। একশ’ বছর পূর্বে সরকারী চাকুরীতে যাদের একচেটিয়া অধিকার ছিল, এখন তাদের আনুপাতিক হার মোট সংখ্যার তেইশভাগের এক ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। এও আবার গেজেটেড চাকুরীর বেলায় যেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্টনের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। প্রেসিডেন্সী শহরের অপেক্ষাকৃত সাধারণ চাকুরীতে মুসলমানদের নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয় গেছে। ক’দিন আগে দেখা গেল যে, কোন বিভাগে এমন একজন কর্মচারীও নেই যে মুসলমানের ভাষা জানে এবং কোলকাতার বুকে কদাচিৎ এমন একটা সরকারী অফিস চোখে পড়ে যেখানে চাপরাশী ও পিয়নের উপরের পদে একটিও মুসলমান চাকুরীতে বহাল আছে।
এ সবের কারণ কি এই যে, মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরা অধিকতর যোগ্য এবং সুবিচার পাবার অধিকার শুধু তারাই রাখে? অথবা ব্যাপার কি এই যে, সরকারী কর্মক্ষেত্রে তারা আসতে চায় না এবং তাদের চাকুরীর জায়গাগুলি হিন্দুদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে? হিন্দুরা অবশ্যি উৎকৃষ্ট মেধার অধিকারী, তাই বলে সরকারী চাকুরীগুলি একচেটিয়া অধিকার ভোগ করার জন্যে যে ধরনের সার্বজনীন ও অসাধারণ মেধা দরকার, তা বর্তমানে তাদের মধ্যে নেই এবং তাদের অতীত ইতিহাসও একথার পরিপন্থী। আসল সত্য কথা এই যে, এদেশের শাসন ক্ষমতা যখন আমাদের হাতে আসে তখন পর্যন্ত মুসলমানরাই ছিল উচ্চতর জাতি। উচ্চতর মুধু মনোবল ও বাহুবলের দিক দিয়েই নয়, বরঞ্চ রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনার দক্ষতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তব জ্ঞানের দিক দিয়েও তারা ছিল উন্নততর জাতি। এতদসত্বেও সরকারী বেসরকারী কর্মক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে গেছে। (W W Hunter: The Indian Mussalmans, pp. 152-53)।
উপরোক্ত খতিয়ানে জনশিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের যে অবস্থা দেখানো হয়েছে, তার থেকেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের জীবিকার্জনের পথ বন্ধ করার জন্যে কিভাবে শিক্ষার অংগন থেকে তাদেরকে দূরে রাখা হয়েছিল। মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্যে সরকারের প্রতি বার বার দাবী জানানো হয়েছে। কিন্তু সবই অরণ্যেরোদন হয়েছে। মুসলমানরা ছিল দারিদ্র-নিষ্পেষিত। উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলমানদের দানের টাকাও সদ্ব্যবহার করা হয়নি। বরঞ্চ তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সৈয়দ আমীর হোসেন নামক পাটনার একজন মুসলমান ১৮৩৭ সালে ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রের স্থলে বাংলা বিধানসভার সভ্য নিযুক্ত হন। মুসলমানদের মধ্যে তিনি মুসলমানদের শিক্ষা সম্বন্ধে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে তাদের শিক্ষা বিস্তৃতির জন্যে বিমেষ জোর দেন। তিনি বলেন-
মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে না। সরকার এ বিষয়ে উদাসীন। ইংরেজী শিক্ষা না করায় ভারতের অন্যান্য জাতির সঙ্গে মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে না। অথচ মুসলমানরা ইংরেজী শিক্ষায় আগ্রহী…. অনেক আরবী-ফার্সী শিক্ষিত ব্য্কিতকে দুঃখ করতে শোনা যায় তাঁরা ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ পাননি। এজন্যে তাঁদের কোন জীবনোপায় নেই। মহসিন ফান্ডের টাকায় হুগলী, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে যে ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তার দ্বারা কোন উপকার হয় না। অতএব হুগলী মাদ্রাসা তুলে দেয়া হোক। রাজশাহী ও চট্টগ্রামের মাদ্রাসার ব্যয় সংকোচ করা হোক। এভাবে মহসিন ফান্ডে যে ৯৩ হাজার টাকা উদ্ধৃত্ত হবে, তার দ্বারা কোলকাতা মাদ্রাসার গৃহে স্বতন্ত্র ডিগ্রী কলেজ খোলা হোক। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে ইংরাজী উচ্চশিক্ষা বৃদ্ধি পাবে। অথচ সরকারের পৃথক খরচ হবে না।
কিন্তু এমন সদযুক্তি সরকারের গ্রাহ্য হয়নি। তদানীন্তন গভর্নর আমীর হোসেনের প্রস্তাবে কর্ণপাত করেননি। এই অজুহাত দেখিয়ে- “এখনও মুসলমানদের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমেনি, ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়েনি। সারা বাংলাদেশে গড়ে ৩২ জন মুসলমান ছেলে বছরে এন্ট্রান্স পাশ করে। তাদের মধ্যে বড়জোর ২০ জন কলেজে পড়ে। এতো কম সংখ্যক ছাত্র দিয়ে প্রেসিডেন্সীর মতো কলেজ খোলা যুক্তিযুক্ত হবেনা। কোলকাতার কলেজগুলিতে মুসলমান ছাত্রদের এক তৃতীয়াংম বেতন দিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করলেই যথেষ্ট হবে”।
একদিকে বিদেশী রাজশক্তির বিরূপ মনোভাব হেতু নিপীড়ন, ঔদাসিন্য ও অবহেলা, অন্যদিকে সেই শক্তিরই অনুগ্রহপুষ্ট প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের হৃদয়হীন বঞ্চনা ও স্বার্থরক্ষার তাগিদে মুসলমানদেরকে শিক্ষা তথা জীবনোপায়ের সবক্ষেত্র হতে সুপরিকল্পিত বিতাড়ন –এই ছিল মুসলমানদের পশ্চাদপদতার কারণ।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ পৃঃ ৩৩২-৩৪)।
ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে শুদুমাত্র মুসলমান ছেলেরা ইংরেজী শিক্ষার জন্যে লালায়িত ছিল না। পর্দার অন্তরালে মুসলমান বালিকারাও এর জন্যে আগ্রহান্বিত ছিল। কিন্তু তাদের জন্যে কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ১৮৪৯ সালে কোলকাতার বেথুন স্কুল (পরে বেথুন কলেজে রূপান্তরিত) স্থাপিত হলেও সেখানে মুসলমান বালিকার প্রবেশাধিকার ছিল না। আবদুল মওদূদ তাঁর গ্রন্থে ১৩০৯ সালের ২৩শে মাঘে প্রকাশিত ‘মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্রের’ বরাত দিয়ে বলেন-
‘মিহির ও সুধাকর’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধ ‘মুসলমান স্ত্রী সমাজে ইংরেজী শিক্ষা’ –এরূপ লিখেছিলেনঃ
আমরা কখনও স্বপ্নে ভাবি নাই ১৯০১ সালের আদমশুমারী আমাদের নিকট ৪০০ (চারশত) মুসলমান স্ত্রীলোকের ইংরেজী শিক্ষার কথা প্রচার করিবে। একথা প্রচারিত হওয়ার পর আমাদের কর্তব্য কি? যদি অন্তপুরে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন সম্ভব, তবে স্কুল স্থাপন করিয়া বালিকাগণকে শিক্ষা দিতে আপত্তি কি? কলিকাতার বেথুল স্কুলে মুসলমান বালিকার প্রবেশাধিকার নাই। বেথুন স্কুল ছাড়া অন্যান্য স্কুলে মুসলমান বালিকার প্রবেশাধিকার নাই। বেথুন স্কুল ছাড়া অন্যান্য স্কুলে পড়িতে পারে। বিশেষ করে আমাদের বালিকা মাদ্রাসাগুলিতে ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা করিলে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করা হয়। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজে বিকাশ… পৃঃ ৩৩৫)।
কিন্তু মুসলমানদের সকল আবেদন নিবেদন, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী সবকিছুই অরণ্যে রোদনে পরিণত হয়েছে। তার ফলে হতভাগ্য মুসলিম সমাজ প্রায় শতাব্দীকাল যাবত শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। বিংশতি শতাব্দীর প্রথম পাদে মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্যে ১৯২৫ সালে কোলকাতা মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ভারত বিভাগের কিছুকাল পূর্বে কোলকাতায় মুসলমানদের জন্যে লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ স্থাপিত হয়।

বাংলার মুসলমান ও বোধনকৃত নতুন বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষার এবং বিশেষ করে বাংলা গদ্যের জন্ম ও ক্রমবিকাশের উপরে বাংলা ভাষার পন্ডিতগণ দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং এর উপরে বিরাট বিরাট গ্রন্থও রচিত হয়েছে। সে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস থেকে বাংলা ভাষার আলোচনা বাদ দিলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। সেজন্যে সংক্ষেপে হলেও এ বিষয়ে মূলকথা কিছু বলে রাখা দরকার। বাংলাভাষার ইতিহাস আলোচনা করতে দেকা যায় ১৭৭৮ সালের পূর্বে এর রূপ ও আকৃতি ছিল একরূপ এবং পরে এ ভাষা ধারণ করে আর এর রূপ।
এদেশে ইংরেজদের আগমনের পূর্বে বাংলাভাষার যে রূপ ছিল তার মধ্যে ছিল অজস্র আরবী-ফার্সী শব্দের মিশ্রণ। এ ছিল তৎকালীন সর্ববংগীয় মাতৃভাষা। এ সাহিত্যের বিকাশ ছিল প্রধানতঃ পদ্যে। গদ্য সাহিত্যের ততোটা প্রচলন ছিল না। থাকলেও তার উন্নতিকল্পে কোন প্রচেষ্টা চালানো হয়নি। এই যে আরবী-ফার্সী শ্বদবহুল বাংলা ভাষা এ শুধু এ দেশের মুসলমানের ভাষা ছিল না। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে কলেরই ছিল এ ভাষা। চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, সরকার সমীপে আবেদন নিবেদন হিন্দু-মুসলমান উভয়েই এ ভাষা ব্যবহার করতো। প্রাচীন রেকর্ড থেকে গহীত জনৈক হিন্দু কর্তৃক একখানি পত্রের উদ্ধৃতি দৃষ্টান্তস্বরূপ পেশ করা হচ্ছে-
শ্রীরাম। গরীব নেওয়াজ সেলামত। আমার জমিদারী পরগণে কাকজোল তাহার দুইগ্রাম শিকিস্তি হইয়াছে সেই দুই গ্রাম পয়স্তি হইয়াছে –চাকালেএকবেলপুরের শ্রী হরে কৃষ্ট রায় চৌদুরী আজ জবরদস্তি দখল করিয়া ভোগ করিতেছে। আমি মালগুজারীর সরবরাহতে মারা পড়িতেছি –উমেদওয়ার যে সরকার হইতে আমিও এক চোপদার সরেজমিনেতে পঁহুচিয়া তোরফেনকে তলব দিয়া আদালত করিয়া হক দেলইয়া দেন। ইতি ১১৮৫ তারিখ ১১ শ্রাবণ। ফিদবী জগতাধিব রায়। (চিঠিখানির ইংরেজী তারিখ হবে ১৭৭৮ সালের ২৬ শে জুলাই)।
এ চিঠিখানির উল্লেখ করে সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর সজনীকান্ত এরূপ মন্তব্য করেনঃ
এক হিসেবে ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে যে ভাষার প্রমাণিক আত্মপ্রকাশ দেখিতেছে তাহা দেশে মুসলমান প্রভাবের ফল। পরবর্তীকালে হেনরী-পিটার ফ্রম্টার ও উইলিয়াম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান ধরিয়া আরবী পারসীর অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমত ওকালতি করিয়াছেন। (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ৬২)।
সজনীকান্ত আরও বলেনঃ কিন্তু ইংরেজের আগমন না ঘটিলে আজিও আমাদিগকে ‘গরীব নেওয়াজ সেলামত’ বলিয়া শুরু করিয়া ‘ফিদবী’ বলিয়া শেষ করিতে হইতো। তাহা মংগলের হইত কি অমংগলের হইত, আজ সে বিচার করিয়া লাভ নাই। ….১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে এই আরবী পারসী নিসূদন যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানীর সময় সদর-মফস্বল আদালতসমূহে আরবী পারসীর পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজীর প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মও এই বৎসরে। এই যজ্ঞের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। আরবী পারসীকে অশুদ্ধ ধরিয়া শুদ্ধ পদ প্রচারের জন্য সেকালে কয়েকটি অভিধান রচিত ও প্রকাশিত হইয়াছিল। সাহেবরা সুবিধা পাইলেই আরবী ও পারসীর বিরোধিতা করিয়া বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে দশ পনের বৎসরের মধ্যেই বাংলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণই পরিবর্তিত হইয়াছিল। (বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস-পৃঃ ৩২)।
উপরে বর্ণিত উইলিয়াম কেরী সায়েবদের আরবী-ফার্সীর বিরুদ্ধে ওকালীতর কারণ ছিল। আবদুল মওদূদ যথার্থ বলেছেন –প্রাচ্য খন্ডে ইউরোপের বিজয়াভিযান হয়েছিল সুপরিকল্পিত তিনটি উপায়েঃ পণ্যবাহী বণিকরূপে, তার পিছনে অস্ত্র নিয়ে পণ্য নিরাপত্তার অজুহাতে এবং তাদের পিছনে মিশনারী নিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির তালিম দেয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে। (আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ…পৃঃ ৩৬৩)।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির তালিম দেয়ার জন্যে তৃতীয় পর্যায়ে এসেছিল খৃষ্টান মিশনারীগণ। কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলিতে খৃষ্টধর্ম প্রচারের জন্যে ইংলন্ডে কতকগুলি ধর্মীয় সংস্থা গঠিত হয়েছিল; তাদের মধ্যে উইলবারফোর্সের নেতৃত্বে ক্লাপহাম উপদলটি (Clapham Seer) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চার্লস গ্রান্ট ছিলেন এ উপদলটির সদস্য এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন ডিরেকটর। তিনি ভারত ভ্রমণের পর এ দেশের অধিবাসীদের ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থার এক নৈরাশ্যজনক চিত্র তুলে ধরে বলেন, “তারা যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে –তাদের মধ্যে খৃষ্টধর্মের আলোক প্রজ্জ্বলিত করা। হিন্দুরা অজ্ঞ বলে তারা ভুল করছে। তাদের ভ্রান্তি তাদের কাছে তুলে ধরা হয়নি। তারা যে উচ্ছৃংখলতা ও পাপাচারে লিপ্ত আছে, তা দূর করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে তাদের মধ্যে আমাদের আলোক ও জ্ঞান বিতরণ করা”।
(Grant’s Observations, published in the printed parliamentary paper relating to the affairs of India Several Vol. 8 (734), Appendix 1. Published 1832, pp. 3-60; M. Fazlur Rahman: The Bengalu Muslims & English Education, pp. 30-32)।
খৃষ্টান মিশনারীগণ তাদের ধর্ম প্রচারের জন্যে প্রধানতঃ এ দেশের হিন্দুকে বেছে নিয়েছিল। এ কাজের জন্যে তাদের অনিবার্যরূপে প্রয়োজন হয়েছিল বাংলাভাষা শিখবার ও শিখাবার। হুগলী শ্রীরামপুরে এ উদ্দেশ্যে তারা একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত করে। পূর্বে বলা হয়েছে –এযাবত বাংলায় যে বাংলা ভাষা রূপ লাভ করেছিল –তা ছিল মিশ্র বাংলা অর্থাৎ আরবী-ফার্সী শব্দ মিশ্রিত বাংলা। যদিও এ বাংলা হিন্দু মুসলমান উভয়ের কথ্যভাষা ছিল, তথাপি হিন্দু ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ এ ভাষাকে ঘৃণা করতেন। মুসলমান জাতি তাদের কাছে ‘স্লেচ্ছ’, ‘যবন’ ও ঘৃণিত জীব। তাদের আরবী-ফার্সী ভাষাও তাদের কাছে ছিল ঘৃণিত। সম্ভবতঃ গোঁড়া হিন্দু পন্ডিতগণ আরবী-ফার্সী শব্দের মধ্যে ‘গামাংসের’ গন্ধ অনুভব করতেন। এ ভাষাকে তাঁরা প্রাকৃত বা লৌকিক আখ্যা দিয়ে অভিশাপ করলেন। ইতিপূর্বে মুসলমান সুলতানদের আমলে এ ভাষায় অনেক হিন্দুধর্ম-গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল। একালের পন্ডিতগণ ফতোয়া দিলেনঃ
অষ্টাদশ পুরাণাদি রামস্য চরিতানিশ্চ,
ভাষায়াং অর্থাৎ লৌকিক ভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ রামচরিত ইত্যাদি যে মানব শুনবে, তার ব্যবস্থা রৌরব নরকে।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ…. পৃঃ ৩৪৪)।
এ কথা খৃষ্টান মিশনারীগণও ভালোভাবে উপলব্ধি করেন যে, যে ভাষার প্রতি হিন্দু পন্ডিতগণ ঘৃণা পোষণ করেন, সে ভাষার শুদ্ধিকরণ ব্যতীত তার দ্বারা খৃষ্টধর্মে আকৃষ্ট করা কষ্টকর হবে। তাই তাঁরা এক ঢিলে দুই পাখী মারার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। ভাষাকে আরবী-ফার্সীর ছোঁয়াচ থেকে রক্ষা করে হিন্দুর গ্রহণযোগ্য করা এবং মুসলমানদের বাংলা মাতৃষাভার নিসূদন যজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞ সম্পান করা যার উল্লেখ সজনীকান্ত করেছেন। এ মহান (?) উদ্দেশ্যে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড (Halhed) ১৭৭৮ সালে A Grammar of the Bengali Literature নামে বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন এবং শ্রীরামপুর প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত গ্রন্থ হিসাবে এইটিই ছিল প্রথম যাতে প্রথম বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাকরণের মাধ্যমে এতদিনের প্রচলিত বাংলা ভাসার পরিবর্তে এক নতুন বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। যে ভাষা ছিল একেবারে আরবী-ফার্সী শব্দ বিবর্জিত এবং সংস্কৃত শব্দবহুল। ব্যাকরণটির ভূমিকায় হ্যালহেড বলেন, “এ যুগে তাঁরাই মার্জিত ভাষায় কথা বলেন, যাঁরা ভারতীয় ক্রিয়াপদের সংগে অজস্র আরবী ফার্সী বিশেষ্যের মিশ্রণ ঘটান”। অতএব একথা নিঃসন্দেহ যে, আঠারো শতকের মার্জিত বাংলা কথ্যভাষা এবং গদ্য ভাষার কাঠামোতে ছিল অজস্র আরবী-ফার্সী শব্দের মিশ্রণ –যার দৃষ্টান্ত উপরে বর্ণিত জনৈক হিন্দু জগতাধিব রায়ের পত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি।
উল্লেখযোগ্য যে, কোম্পানীর ইংরেজ সিভিলিয়ানরেদকে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেয়ার জন্যে ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। উইলিয়াক কেরী হন এ বিভাগের অধ্যক্ষ। তাঁর অধীনে আটজন পন্ডিত নিযুক্ত হন। তাদেঁর মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় তর্কালংকার ও রামরাম বসুর নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। তাঁদের সহায়তায় কেরী বাংলা গদ্য পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করতে থাকেন। প্রথমে রচিত হয় ‘কথোপকথন’ ও পরে ‘ইতিহাস মালা’। বলা বাহুল্য গ্রন্থ দুটির ভাষা ছিল সংস্কৃত স্টাইলের এবং বিষয়বস্তুও ছিল মুসলমানবর্জিত। প্রতাপ আদিত্য, রূপ সনাতন ও বীরবল ছিলেন ভারতীয় ইতিহাসের উপজীব্য চরিত্র। অতএব ভাষা ও বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পন্ডিতদের সাধনার ও হিন্দুত্বের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠায় –ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল ক্ষেত্র প্রশস্ত। একদিকে মিশনারীদের চিল একটা অসভ্য জাতিকে অন্ধকার হতে আলোকে নিয়ে যাওয়ার দম্ভ। আর অন্যকিকে চিল পন্তিতদের সংস্কৃতের তনয়ারূপে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে হিন্দুদের মাহাত্ম্য প্রকাশের অসীম উদ্যম ও আগ্রহ। এ দুটি উদ্দেশ্যের দারা সম্যকভাবেই প্রতিফলিত দেখা যায় –এই কেরীর সৈনাপত্যে পন্ডিতদের রচিত ওই সময়ের গ্রন্থগুলির ভাষা ও বিষয়বস্তুর মূল্যায়নকালে।
(বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস, সজনীকান্ত দাস-পৃঃ ১১২; আদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর পৃঃ ৩৬৪)।
অতএব এসব তথ্যের ভিত্তিতে একথা আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, ইংরেজ ও হিন্দুর যোগসাজসে মুসলমানরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকেই বিতাড়িত হয়নি। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে তাদের যে মাতৃভাষাটি গড়ে উঠেছিল তাকেও নস্যাৎ করা হলো। সমাজের উচ্চস্থান থেকে নীচে নিক্ষেপ করা হলো। মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অন্যকে দেয়া হলো এবং শেষ সম্বল মুখের ভাষাটিও ধ্বংস করা হলো ‘নিসূদন যজ্ঞের’ মাধ্যমে।
শ্রদ্ধেয় আবদুল মওদূদ বলেন –“এই মিশ্ররীতির বাংলাভাষায় সাহিত্য গড়ে উঠার মুখেই বণিকের তুলাদন্ড হলো রাজদন্ডে রূপান্তরিত এবং বণিকের তল্পীবাহক মিশনারীরাও দিলেন সাহিত্যের ভাষার মোড় পরিবর্তণ করে।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তকরা বাংলা ভাষার কাঠামোকেও নতুন ছাঁচে তৈরী করে দিলেন –বাবু সম্প্রদায়ের জন্যে। তার দরুন বাবু কালচারের আবাহন হলো যে ভাষায়, তা কেবল সংস্কৃত ঘেঁষা নয়, একেবারে সংস্কৃতসম। আর এটিও হয়েছে ভাষা ও কৃষ্টির নব প্রবর্তনের সম্বাবনায় এবং মিশনারীকুল তৎপর হয়েছিলেন মুসলমানদের মুখে ভাষা কেড়ে নিয়ে তাকে সাহিত্য ও কালচারের দিক দিয়েও নিঃস্ব করে দিতে”।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ পৃঃ ৩৫৮)।
ইংরেজ তথা মিশনারী –পূর্ব বাংলা ভাষাকে ভিত্তি করে মুসলমানদের যে এক নতুন বাংলাভাষা গড়ে উঠে, যার মধ্যে শক্তি ও প্রেরণা সঞ্চার করছিল আরবী ও ফার্সী তাকে বলা যেতে পারে মুসলমানী বাংলা। স্বভাবতঃই তা মোটেই গ্রহণযোগ্য চিল না হিন্দুদের কাছে। ১৮৩৭ সালের পর হিন্দুবাংলা (আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জিত সংস্কৃত শব্দবহুল বাংলা) প্রাদেশিক মাতৃভাষা হিসাবে সরকার কর্তৃক স্কীকৃতি লারেবর পর মুসলমানী বাংলার অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়। অফিস-আদালত থেকে এতদিনের প্রচলিত ফার্সী ভাষা তার আপন মর্যাদা হারিয়ে ফেলে এবং নতুন বোধনকৃত বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতে থাকে। নতুন বাংলা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর এ ভাষা হ্নিদু সংস্কৃতি ও জাতীয় আশা-আকাংকার বাহন হিসাবে মর্যাদা লাভ করে।
এ নতুন বাংলা ভাষাকে স্কুল কলেজে মাতৃভাষা হিসাবে বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি যে কোলকাতা মাদ্রাসায় অনেক ছাত্র মুসলমানী বাংলাও জানতোনা, সেখানেও এই নতুন বাংলা পাঠ্য করা হয়। প্রফেসার উইলসন প্রমুখ ইউরোপীয় শিক্ষাবিদগণ সংস্কৃত ভাষার সপক্ষে এমন জোর ওকালতি শুরু করেন যে, সায়েবদের সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করাটা একটা চরম বাতিকে পরিণত হয়। উইলসন একটি সহজ সংস্কৃত ব্যাকরণ রচনা করে সায়েবদের সংস্কৃত শিক্ষার পথ সুগম করে দেন। ১৮২৮ সালে তিনি বাংলাভাষায় ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান অনুবাদ সমিতির প্রেসিডেন্ট হন এবং General Committee of Public Instruction বা জনশিক্ষা সাধারণ কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন বাংলাভাষায় বহু পুস্তক রচনা করেন। এসব বইপুস্তক পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয়। মুসলমানী বাংলা এবং নতুন বাংলার মধ্যে শুধু ভাষার দিক দিয়েই নয়-বিষয়বস্তু, সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের দিক দিয়ে এমনই আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল যে, মুসলমানদের জন্যে নতুন ভাষা গ্রহণ অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়ে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি গ্রন্থের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
করুণা নিধন বিলাস, পদাংক দূত, বিশ্ব মংগল, গীতা গোবিন্দ –শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত,
চন্ডী, আনন্দ মংগল দূর্গা সম্পর্কিত,
মহিমা স্তব, গংগা ভক্তি –শিব গংগা সম্পর্কিত
চৈতন্য চরিতামৃত, রস মঞ্জরী, আদিরস, পদাবলী, রতিকাল, রতি বিলাস-প্রেমোদ্দীপক
স্কুলে পাঠ্যপুস্তক হিসাবে গৃহীতঃ
শিশু বোধক –বাংলার সর্বক্র ও গ্রাম্য স্কুলগুলিতে ব্যাপকভাবে পড়ানো হয়। এর মধ্যে ছিল বহু সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ যা প্রধানতঃ হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে লিখিত। এর প্রথম পাঠগুলি –সরস্বতি, গংগা প্রভৃতি সমীপে প্রার্থনা দিয়ে শুরু করা হয়েছে।
তারপর আসে আনন্দ মংগলের কথা। এটাও আগাগোড়া হিন্দুধর্ম ও তাদের দেব-দেবীদের স্তবস্তুতিতে পরিপূর্ণ। এ ধরনের আরও বহু পাঠ্যপুস্তকের নাম পাওয়া যায়। M. Fazlur Rahman: The Bengalu Muslims & English Education, pp. 106-108)।
উল্লেখযোগ্য যে, সংস্কৃতসম হিন্দুবাংলার পূর্বে যে বাংলা ভাষা কয়েক শতাব্দী যাবত লালিত ও পরিপুষ্ট হচ্ছিল তা প্রধানতঃ ভিল পদ্যসাহিত্য বা পুঁথিসাহিত্য। এ সাহিত্যকে আধুনিককালে পুঁথিসাহিত্য হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এ সাহিত্যের যারা চর্চা করেছেন, তাঁদের দুজন ‘মালে মুহাম্মদ’ ও ‘মুহাম্মদ দানিশ’ এ সাহিত্যের রীতিকে বলেছেন ‘চলতি বাংলা’ এবং ‘রেজাউল্লাহ’ (১৮৬১) বলেছেন ‘ইসলামী বাংলা’। ১৮৫৫ সালে পাদরী লং তাঁর গ্রন্থতালিকায় এ ভাষাকে বলেছেন ‘মুসলমানী বাংলা’ আর এ ভাষায় রচিত সাহিত্যের নামকরণ করেছেন ‘মুসলমানী বাংলা সাহিত্য’।
(আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ ….সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৩৫৫)।
এ সাহিত্যের প্রতি হান্টার সায়েবের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তিনি বলেনঃ
আজ পর্যন্ত বদ্বীপ অঞ্চলের কৃষক সমাজ মুসলমান। নিম্নবংগে ইসলাম এতই বদ্ধমূল যে, এটি এক নিজস্ব ধর্মীয় সাহিত্য ও লৌকিক উপভাষার উদ্ভব ঘটিয়েছে। হিরাতের ফার্সী ভাষা থেকে উত্তর ভারতের উর্দু যতোখানি পৃথক, ‘মুসলমানী বাংলা’ নামে পরিচিত উপভাষাটি উর্দু হতে ততোখানি পৃথক”। (W W Hunter: The Indian Mussalmans, p. 146)।
এ সাহিত্যের যে নামই দেয়া হোক, তা ছিল না প্রাণহীন। কয়েক শতাব্দী যাবত তা লক্ষ লক্ষ নর-নারীর প্রাণে সাহিত্য তরংগ তুলেছে। তাদের চিন্তা-ভাবনা ও আশা-আকাংখাকে প্রভাবিত করেছে। শ্রী শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যয় বলেন-
মুসলমান সাহিত্যের গল্পভান্ডারও নিতান্ত দরিদ্র ছিল না। ‘আরব্য উপন্যাস’, ‘হাতেম তাঈ’, ‘লায়লা মজনু’, ‘চাহর দরবেশ’, ‘গোলে বাকাওলী’ প্রভৃতি আখ্যায়িকাগুলি নিশ্চয়ই বাঙালী পাঠকের সম্মুখে এক অচিন্তপূর্ব রহস্য ও সৌন্দর্যের জগত উন্মুক্ত করিয়াছিল। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ যখন ইংরেজী সাহিত্যের আদর্শে আমাদের উপন্যাস সাহিত্য ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিতেছিল তখন এই শ্রেণীর মুসলমানী গল্পের অনুবাদ আমাদের সাহিত্যিক প্রচেষ্টার একটা প্রধান অংগ হইয়াছিল। উহারা পাঠরেক হৃদয় স্পর্শ ও রুচি আকর্ষণ করিতে না পারিলে আমাদের সাহিত্যিক উদ্যমের একটা মুখ্য অংশ কখনই উহাদের অনুবাদে নিয়োজিত হইতে পারিত না। অন্ততঃ এই সমস্ত গল্পের মধ্যে একটা চমকপ্রদ (Sensational), বর্ণবহুল (Romance), একটা নিয়ম-সংযমহীন সৌন্দর্য বিলাসের অপরিমিত প্রাচুর্য আছে, তাহাই আমাদের একশ্রেণীর ধর্মশাস্ত্রাস্বাদক্লিষ্ট, অবসাদগ্রস্ত রুচিকে অনিবার্য বেগে আকর্ষণ করিয়াছিল। (বংগসাহিত্যের উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যয়-৪র্থ সং, পৃঃ ১৮-১৯)।

আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সাম্প্রদায়িকতা
আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি এবং সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের মধ্যে রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ও রাজা রামমোহনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রথমোক্ত দু’জন উইলিয়াম কেরী কর্তৃক নিযুক্ত পন্ডিকগণের অন্তর্ভুক্ত। রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য’ গ্রন্থ ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার পাঁচখাতি গ্রন্থ রচনা করেন, তার মধ্যে রাজাবলী (১৮০৮) বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারপর আসে রামমোহনের নাম। তাঁর গদ্যসাহিত্য ছিল বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত। কিন্তু এঁদের সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা বা মুসলিম বিদ্বেষ ছিল না। অবশ্যি মৃত্যুঞ্জয়ের ‘রাজাবলী’ ছিল চন্দ্র বংশের ক্ষেত্রজ সন্তান বিচিত্রাবলী থেকে বাংলাদেশের কোম্পানী শাসন প্রতিষ্ঠার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস লেখার প্রথম প্রয়াস এবং মুসলমানী আমলটা অত্যন্ত অযত্নের সংগে বিদ্বেষদুষ্ট ভংগীতে লেখা।
পরবর্তকালে বাংলা সাহিত্যের অংগনে দু’জন দিকপালের আবির্ভাব হয়। বাংলা পদ্যসাহিত্যে মাইকেল মধূসূদনের এবং গত্য সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের। বাংলা সাহিত্যে তাঁদের শ্রেষ্ঠ অবদান অনস্বীকার্য।
আবদুল মওদূদ বলেন-
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভার বিকাশক্ষেত্রে যখন মধ্যাহ্ন গগন বিরাজমান, তখন বাংলার রাজনৈতিক গগনেও মোড় ফিরে গেছে। তখন ইংরেজের অনুগ্রহের ষোলআনা অংশটার এক পক্ষ প্রবল দাবী জানাচ্ছে আত্মসচেতন হয়ে। শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সমাজে বেকার সমস্য দেখা দিচ্ছে। এবং তার দরুন তাদের মনে নৈরাশ্যভাব যুগমানসের সন্তান। তিনি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ-মনের প্রতিভূ হিসেবে এবং হিন্দু জাতীয়তা মন্ত্রের উদ্যোক্ত ঋষি হিসেবে বাংলার সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হলেন। এবং এভাবে তীব্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষচিহ্ন তিনি ছড়িয়ে দিলেন লেখনী মুখে, জগতের ইতিসাহে তার দ্বিতীয় নজীরনেই। প্রগাঢ় পান্ডিত্য, ক্ষুরধার বুদ্ধি ও গভীর বিশ্লেষণ শক্তির অধিকারী হয়েও সংকীর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল ও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আদর্শের-উদ্দেশ্যের ক্রীড়নক হয়ে তিনি মানবড়ার যে অকল্যাণ ও অসম্মান করে গেছেন, তারও পৃথিবীর ইতিহাসে তুলনা নেই। অস্ত্রের মুখে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, কালের প্রলেপে সে ক্ষতও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
কিন্তু লেখনীর মুখে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তার নিঃশেষ নেই, নিরাময় নেই –যুগ থেকে যুগান্তরে সে ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে।
-(আবদুল মওদুদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৩৬৯-৭০)।
সাহিত্যের মাধ্যমে বঙ্কিম মুসলিম সমাজ ও জাতির বিরুদ্ধে যে বিষবহ্নি প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন, দৃষ্টান্তসহ তার কিছু আলোচনা আমরা পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে করেছি। বাংলা তথা ভারত উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের চরম অবনতির জন্যে তাঁর সাহিত্যই প্রধানতঃ দায়ী।
বঙ্কিম তাঁর ‘রাজসিংহ’ ও ‘আনন্দমঠে’ মুসলমান বিদ্বেষের যে বিষবহ্নি উদগীরণ করেছেন সে বিষজ্বালায় এ বিরাট উপমহাদেশের দু’টি বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটুকু সম্প্রীতির ফল্গুধারা ছিল, তা নিঃশেষে শুল্ক ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। … এ উপমহাদেশে মুসলমানের অস্তিত্বও বঙ্কিমচন্দ্র অস্বীকার করে তাদের বিতাড়িত করে সদাশয় ব্রিটিশজাতির আবাহনে ও প্রতিষ্ঠায় তিনি বার বার মুখর হয়ে উঠেছেন। (ঐ…পৃঃ ৩৭০)।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পূর্বে মুসলমানদের যে সাহিত্য সাধনা ছিল, তার মতবাদের প্রভাব ও ছদ্মবেশী রূপকাভিপ্রায়, ও ইহার ঘটনাবলীও প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিবিম্ব নহে। জীবনোদ্ভুত এক উচ্চতর আদর্শ কল্পনার সুকুমার ভাবরঞ্জিত ও অসাধারণত্বের স্পর্শদীপ্ত।
-(বংগ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, শ্রী শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যয়, ৪র্থ সং, পৃঃ ১৮-১৯)।
একথা উল্লেখ্য যে, সাহিত্যের অংগনে সাম্প্রদায়িকতার বীজ প্রথম বপন করেন ভূদেব মুখোপাধ্যয় তাঁর ‘অঙ্গুরী বিনিময়ে’ (১৮৫৭)। সম্ভবত তাঁর থেকে প্রেরণা লাভ করে বঙ্কিম সে বীজকে সাম্প্রদায়িকতার বিরাট বিষবৃক্ষে পরিণত করেন। বঙ্কিমের মৃত্যুর পরে বাংলা সাহিত্য সাম্প্রদায়িকতার পংকিলতা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি। তাঁর পদাংক অনুসরণ করে পরবর্তীকালেও লেখনী চালনা করেছেন পন্ডিত-অপন্ডিত, সাহিত্যিক-অসাহিত্যিক বর্ণহিন্দু সম্পদায়।
বাংলা সাহিত্যকে যে দু’জন মনীষী-কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় –সুষমামন্ডিত ও কিরীটশোভিত করেছেন, তাদের লেখনীও সে পংকিলতার স্পর্শমুক্ত হতে পারেনি। শরৎচন্দ্রের সাম্প্রদায়িকতা বিষদুষ্ট লেখনীর উদ্ধৃতি আমরা উপরে দিয়েছি।
কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথকেও যখন এ আবর্তে অবগাহন করতে দেখি তখন ক্ষোভে ও লজ্জায় স্বতঃই বেদনার্তকন্ঠে মুসলমান বলে উঠে জুলিয়াস সীজারের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ না করে রবীন্দ্রনাথের ‘দুরাশা’ গল্পটি ও ‘শিবাজী উৎসব’ কবিতা পাঠ করে দেখতে পাঠক সমাজকে অনুরোধক করি।
(আবদুল মওদূদঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৩১৭)।

অষ্টম অধ্যায়
আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও মুসলমান
বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য সাধনা যখন সাফল্যের শীর্ষে, তখন তারই সমসাময়িক একজন মুসলমান বাংলাসাহিত্য গগনে উদিত হন। তিনি হলেন মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর সাতিত্য ছিল আলবৎ আধুনিক বাংলা সাহিত্য এবং রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বহু ঊর্ধ্বে। বঙ্কিমচন্দ্র যখন সাহিত্যের অংগনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছিলেন, তখন মশাররফ হোসনে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে শিল্পীসুলভ মনোভাব নিয়ে মুসলমানদের প্রতি উপদেশমূলক সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় তিনি সাহিত্য সাধনা করেন এবং উপন্যাস, জীবনী, ঐতিহাসিক কাহিনী, নাটক, রম্যরচনা, কবিতা ও গান তাঁর সাহিত্য সাধনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর শ্রেষ্ঠতম রচনা ‘বিষাদসিন্ধু’। বিষাদসিন্ধুর চরিত্রগুলি ইতিহাস থেকে গৃহীত হলেও এটাকে কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলা যায় না। তথাপি মুসলমান সমাজে এটা ছিল সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ।
বর্তশান বাংলা সাহিত্যের গগনে আর একটি জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব ঘটে এবং তা হলো বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের অংগনে আরও অনেক মুসলিম কবি-সাহিত্যিকের আগমন সমসাময়িককালে হয়েছে। যথা- কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখ। নিজেদের স্বতন্ত্র ধারায় সাহিত্য সৃষ্টি করে তাঁরা মুসলমান জাতিকে আত্মসচেতনাঁ ও স্বাতন্ত্রবোধে উদ্ধুদ্ধ করেন। নজরুলের আগেও বাংলা সাহিত্যের আসরে বহু মুসলিম কবি সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু তাঁদের ও নজরুলের সাহিত্য ধারায় ছিল সুস্পষ্ট পার্থক্য। অন্যান্যগণ সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেছেন মনে হয় ভীরু পদক্ষেপে, মনের দুর্বলতা সহকারে। বাংলা সাহিত্যকে হিন্দুর, সংস্কৃত-তনয়া মনে করে গা বাঁচিয়ে যেন তাতে ছোঁয়া না লাগে মুসলমানের আরবী-উর্দু-ফার্সীর শব্দাবলীর, এমনকি উপমায়, অলংকারে ও রচনারীতিতে মুসলমানী নিদর্শন-আলামতকে সতর্কতার সাথে বাঁচিয়ে চলেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের হঠাৎ আবির্ভাব যেমন সৃষ্টি করলো বিস্ময়, তেমনি সূচনা করলো এক বৈপ্লবিক যুগের। যে মুসলমানের বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে বোধনকৃত করে বেদ-পুরাণ ও হিন্দু-জাতিত্বমুখী করা হয়েছিল, নজরুল তার গতিমুখ ফিরিয়ে করলেম মুসলমানের কেবলামুখী। মানুষের তাজা খুনে লালে-লাল করা যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে তীব্র গতিতে ও বীরবিক্রমে, তেমনি যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে তীব্র গতিতে ও বীরবিক্রমে প্রবেশ করলেন –সাহিত্যের ময়দানে। তাঁর মনে কোনদিন স্থান পায়নি দ্বিধাসংকোচ, ভীরুতা ও কাপুরুষতা। তাই তিনি তাঁর বিজয় নিশান উড়াতে পেরেছিলেন সাহিত্যের ময়দানে। তিনি তৎকালীন মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের দ্বিধাসংকোচ ঘুঁচিয়ে দিয়ে সাহিত্য ক্ষেত্রে মুসলমানসুলভ আযাদী এনে দিয়েছিলেন। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে আরবী-ফার্সীর ঝংকার পুনরায় শুনা যেতে থাকে। তাঁর আরবী-ফার্সী শব্দাবলীর ব্যবহার পদ্ধতি এত সুনিপুণ, সুশৃংখল ও প্রাণবন্ত যে, ভাষা পেয়েছে তার স্বচ্ছন্দ গতি, ছন্দ হয়েছে সাবলিল এবং সুরের ঝংকার হয়েছে সুমধুর ও হৃদয়গ্রাহী। তিনি আধুনিক বাংলা ভাষায় আরবী-ফার্সী শব্দ আমদানী করে ভাষাকে শুধু সৌন্দর্যমন্ডিতই করেননি, বাংলা ভাষায় মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও নিজস্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলা ভাষায় মুসলিম সাহিত্যসেবীদের জন্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে দেন তিনি। কবি নজরুল ছিলেন কাব্য সাহিত্য জগতের এক অতি বিস্ময়। তাঁর এ প্রতিভা ছিল একান্ত খোদাপ্রদত্ত। তাঁর আবির্ভাব হয় ধূমকেতুর মতো এমন এক সময়ে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তাঁর সম্মানজনক আসন করে নিয়েছেন। বিপ্লবী কবি নজরুল-প্রতিভার স্বীকৃতি তাঁকে দিতে হয়েছে এ আশিষের ভাষায়-

আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নি-সেতু
দুর্দিনের ঐ দুর্গ শিরে-
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের তালে হোকনা লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন
নজরুলের কাব্য প্রতিভা যেমন তাঁকে সুউচ্চ আসনে সমাসীন করেছে সাহিত্য জগতের, তেমনি তাঁর বিপ্লবী কবিতা সুপ্ত মুসলিম মানসকে করেছে জাগ্রত, তাদের নতুন চলার পথে দিয়েছে অদম্য প্রেরণা ও প্রাণশক্তি। এতোদিন মুসলমানরা যে সাহিত্যক্ষেত্রে ছিল আংক্তেয় তাদের সে গ্লানি গেল কেটে। তাদের জড়তা গেল ভেঙে। জীবনের সকল কর্মক্ষেত্রে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো নতুন উৎসাহ উদ্যমে। নজরুল সুপ্ত মুসলিমকে এই বলে ডাক দিলেন-
দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠিছে দ্বীন ইসলামী লাল মশাল,
ওরে বেখবর তুইও ওঠ জেগে, তুইও তোর প্রাণপ্রদীপ জ্বাল।
তাঁর এ আহবান ব্যর্থ যায়নি। শুধু সাহিত্যক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও মুসলমানের নতুন কাফেলা শুরু করলো যাত্রা অবিরাম গতিতে।

উনবিংশ শতকে মুসলমান
মুসলমান চরম অগ্নি পরীক্ষার মুখে
ইংরাজী ১৮০০ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল এবং তার পরেও কয়েক দশক ছিল মুসলশানদের জন্যে অগ্নিযুগ। বাংলার মুসলমান এ সময়ে জাতি হিসাবে এক অগ্নি গহ্বরের প্রান্তে অবস্থান করছিল। তাদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর তাদের অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছিল চরম বিপর্যয়। বিদেশী শাসক ও তাদের এতদ্দেশীয় অনুগ্রহপুষ্ট সহযোগীদের নির্যাতন নিষ্পেষণেও মুসলমান জাতি তাদের শাসন শোষণকে মেনে নিতে পারেনি। শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও খন্ডযুদ্ধের মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বহুবার এবং বহুস্থানে এই শতকের মধ্যে। ফকীর বিদ্রোহ, ফারায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের আন্দোলন, সাইয়েদ আহমদের জেহাদ আন্দোলন, ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলক ছিল ব্রিটিম ও হিন্দু কর্তৃক মুসলমানদের প্রতি অমানুষিক ও পৈশাচিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিস্ফোরণ। এর এক একটির পৃথক আলোচনাই এ অধ্যায়ের মূল বিষয়বস্তু।

ফকীর আন্দোলন
ফকীর আন্দোলনের যতোটুকু ইতিহাস জানতে পারা যায়, তার থেকে প্রমাণিত হয় যে, পলাশী যুদ্ধের পর এবং বিশেষ করে ১৭৬৪ সালে মীর কাসেমের পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া ‘দেওয়ানী’ লাভ ক’রে যখন তাদের অত্যাচারমূলক শাসন দন্ড চালাতে শুরু করে তার পর থেকে ‘ফকীর বিদ্রোহ’ শুরু হয় এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮৩৩ অথবা ১৮৩৪ সালে। ফকীর বিদ্রোহের পশ্চাতে কোন মহান উদ্দেশ্য ছিল কিনা, এবং বিদ্রোহ পরিচালনার জন্যে কোন সুসংগঠিত ও সুশৃংখল বাহিনী ছিল কিনা, তা বলা মুশকিল। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে যে ফকীর বিদ্রোহ হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোন যোগসূত্র ছিল কিনা, তাও বলা কঠিন। তবে যে কারণে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন তা হলো একাধারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও তাদের অনুগ্রহপুষ্ট নতুন হিন্দু জমিদার, মহাজনদের অমানুষিক অত্যাচার উৎপীড়ন।
তাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৃষ্ট ও আশ্রয়পুষ্ট শোষনকারী, জমিদারদের উচ্ছেদ করা ও তাদের অর্থাগার লুট করা। উত্তরবংগে এদের অভিযানের ফলে বহু জমিদার ইতিপূর্বেই (১৭৭৩) ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। (ময়মনসিংহে ফকীর অভিযান, খালেকদাদ চৌধুরী, ডঃ হাসান জামান সম্পাদিত ‘শতাব্দী পরিক্রমা’, পৃঃ ২৬)।
ফকীর আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মজনু শাহ, মাজু শাহ, টিপু পাগল ও গজনফর তুর্কশাহ। খালেকদাদ চৌধুরী তাঁর ময়মনসিংহে ফকীর অভিযান প্রবন্ধে মজনু শাহকে মাজু শাহের বড়ো ভাই উল্লেখ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে এতটুতু জানা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে তিনি একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন। ১৭৬৪ সালে মীর কাসেম আলীর পরাজয়ে….এ দেশে ইংরেজ অধিকার বদ্ধমূল হয়। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে ঐ একই সাথে মজনুর (মজনু শাহ) অনুচরদের হাতে ব্রিটিশ শক্তিকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। (‘বিপ্লব আন্দোলনে দক্ষিণবংগের অবদান’-আজিজুর রহমান, হাসান জামান সম্পাদিক ‘শতাব্দী পরিক্রমা’, পৃঃ ১৮০)।
১৭৮৪ সালে মাজুশাহ ময়মনসিংহ, আলাপসিং, জাফরশাহী এবং শেরপুর পরগণার জমিদারদের সমস্ত ধনদৌলত লুন্ঠন করে। সেখানে সংবাদ রটে যে, মাজু শাহের ভাই মজনু শাহ দুইশ’ দুর্ধর্ষ ফকীরসহ জাফরশাহী পরগণায় আসছেন। তাঁর এই অভিযানের ভয়ে জমিদার এবং প্রজারা অন্যত্র পালিয়ে যায়। কিন্তু ঢাকার চীফ মিঃ ডে-র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বেগমবাড়ীর সৈন্যবাহিনীই সেই অভিযান প্রতিরোধ করে। ফলে ফকীরেরা ফিরে যায়। মিঃ ডে-র রিপোর্টে আরও উল্লেখ আছে যে, জমিদারদের ধন সম্পদ লুন্ঠনের ব্যাপারটি সত্য নয়। খাজনা ফাঁকি দেয়ার জন্যে সুচতুর ও অসাধু জমিদারেরা এরূপ মিথ্যা সংবাদ রেভেনিউ কমিটির কাছে পাঠিয়েছিল। (শতাব্দী পরিক্রমা, পৃঃ ২৭)।
পুনরায় ফকীর অভিযান শুরু হয় দু’বছর পর ১৭৮৬ সালে । ময়মনসিংহকে ফকীরদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে লেফটন্যান্ট ফিল্ডকে ঢাকা পাঠানো হয়। ময়মনসিংহের কলেক্টর রাউটনের সাহায্যের জন্যে আসাম গোয়ালপাড়া থেকে ক্যাপ্টেন ক্রেটনকে পাঠানো হয়। সুসজ্জিত ইংরেজ সৈন্যদের সাথে ফকীরদের যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়, তাতে ফকীর বাহিনী পরাজিত হয়ে ছত্রভংগ হয়ে যায়। তারপর আর বহুদিন যাবত তাদের কোন তৎপরতার কথা জানা যায় না।
ফকীরদের অভিযান বন্ধ হওয়ার পর জমিদারগণ তাদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণের নাম করে প্রজাদের নিকট থেকে বর্ধিত আকারে রাজস্ব আদায় করতে থাকে এবং নতুন কর ধার্য করতে থাকে। তাতে প্রজাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে।
প্রজাদের নির্যাতনের অবসানকল্পে ১৮২৬ সালে টিপু পাগল নামক জনৈক প্রভাবশালী ফকীর কৃষক প্রজাদের নিয়ে এক শক্তিশালী বাহিনী গঠন করেন। জমিদারেরা সকল ন্যায়নীতি ও ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন নং-৮ অগ্রাহ্য করে প্রজাদের উপর নানাবিধ ‘আবওয়াব’ ধার্য করতে থাকে। এসব আবওয়াব ও নতুন নতুন উৎপীড়নমূলক কর জবরদস্তি করে আদায় করা হতো। তাছাড়া জমিদারেরা আবার প্রতিপত্তিশালী লোকদের কাছে তাদের জমিদারী অস্থায়ীভাবে উচ্চমূল্যে ইজারা দিত। ইজারাদারেরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উৎপীড়নের মাধ্যমে প্রজাদের কাথ থেকে উচ্চহারে খাজনা আদায় করতো। এসব উৎপীড়ন বন্ধের জন্যে টিপু প্রজাদেরকে সংগঠিত করেন।
এসব অভিযানকারী ফকীরদেরকে ইতিহাসে অনেকে লুন্ঠনকারী দস্যু বলে অভিহিত করেছেন। আসলে ব্যাপার তা নয়। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন জনগণের শ্রদ্ধেয় অলী-দরবেশ শ্রেণীর লোক।
সবুব পরগণার লেটীরকান্দা গ্রামের প্রভাবশালী ফকীরের মস্তান ছিলেন টিপু পাগল। তিনি একজন কামেল দরবেশ ছিলেন বলে সকলে বিশ্বাস করতো। বহু অলৌকিক কাহিনী তাঁর সম্বন্ধে আজো প্রচলিত আছে এবং তাঁর মাজারে ওরস উপলক্ষে আজো বহু লোকের সমাগম হয় (খালেকদাদ চৌধুরী, শতাব্দী পরিক্রমা, পৃঃ ২৮-২৯)।
মানুষকে ধর্মকর্ম শিক্ষাদান করা এসব ফকীরের কাজ ছিল। কিন্তু জনসাধারণেল চরম দুর্দশা দেখে তাঁদের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছিল। তার ফলে জনসাধারণের চরম দুর্দশা দেখে তাঁদের অন্তরাত্মা কেঁদে উঠেছিল। তার ফলে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তারা মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়েছেন।
এসব ফকীরের দল অসভ্য বর্বর ছিল –তাও নয়। তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত ও রুচিবোধ সম্পন্ন। এমনকি টিপুর মাতার মধ্যেও ছিল অসাধারণ সাংগঠনিক যোগ্যতা। টিপু ও তাঁর বাহিনীকে প্রেরণা যোগতেন টিপু জননী। ১৮২৫ সালে টিপুর নেতৃত্বে ফকীর দল জমিদারদের খাজনা বন্ধের আন্দোলন করে। জমিদারদের বরকন্দাজ বাহিনী ও ফকীরদের মধ্যে এক সংঘর্ষে করকন্দাজ বাহিনী নির্মূল হয়ে যায়। জমিদারদের মধ্যে এক সংঘর্ষে বরকন্দাজ বাহিনী নির্মূল হয়ে যায়। জমিদারগণ কোম্পানীর শরণাপন্ন হয়। কোম্পানী টিপু ও তাঁর সহকারী গজনফর তুর্কশাহকে বন্দী করার জন্যে একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী পাঠায়। একটি সেনাদল পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায় কিন্তু অপর একটি দল টিপুকে বন্দী করে। তুর্কশাহ তার দল নিয়ে কোম্পানীর সেই সেনাদলকে আক্রমণ করে টিপুকে মুক্ত করেন।
এ ঘটনার পর ম্যাজিস্ট্রেট ডেমপিয়ার একটি শক্তিশালী ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী নিয়ে শেরপুর আগমন করে। টিপু বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধে টিপু তাঁর জননীসহ বন্দী হন।
পরবর্তীকালে ১৮৩৩ সালে টিপুর দু’জন শক্তিশালী সহকর্মীর নেতৃত্বে ফকীরদল পুনরায় সংঘবদ্ধ হয় এবং শেরপুর থানা আক্রমণ করে তা জ্বালিয়ে দেয়। তারপর ক্যাপ্টেন সীল ও লেফটন্যান্ট ইয়ংহাজবেন্ডের অধীনে একটি সেনাবাহিনী প্রেরিত হয় ফকীর বাহিনী দমন করার জন্যে। এক প্রচন্ড সংঘর্ষ হয় এবং এই সংঘর্ষে ফকীর বাহিনী পরাজিত ও ছত্রভংগ হয়ে যায়।
উপরে ফকীর বিদ্রোহের কিছু বিবরণ দেয়া হলো। তবে ফকীরদের সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা ইংরেজ লেখক ও ইতিহাসকারদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে। ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁদেরকে বেদুইন বলেছেন, আর হান্টার বলেছেন ‘ডাকাত’। তাঁদের আক্রমণ অভিযানে কয়েক দশক পর্যন্ত নব প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশরাজ এখানে টলটলায়মান হয়ে পড়েছিল, সম্ভবতঃ সেই আক্রোশেই তাদের ইতিহাস বিকৃত করে রচনা করা হয়েছে। উপরে মজনু শাহ ও মাজু শাহকে দুই ভাই বলা হয়েছে। এর সত্যাসত্য যাচাই করার কোন ঐতিহাসিক তথ্য বা উপাদান আমাদের কাছে নেই। তবে কেউ কেউ বলেছেন মজনু শাহ ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের মেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। কানপুরের চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থিত মাকানপুরে অবস্থিত শাহ মাদারের দরগায় মজনু শাহ বাস করতেন। সেখান থেকেই হাজার হাজার সশস্ত্র অনুচরসহ তিনি বাংলা বিহারের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ ও অত্যাচারী জমিদারদে বিরুদ্ধে অভিযান চালান। তাঁর কার্যক্ষেত্র বিহারের পুর্ণিয়া অঞ্চল এবং বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা ময়মনসিংহ ছিল বলে বলা হয়েছে।
১৭৭২ সালের প্রথমদিকে মজনু শাহ বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র অনুচরসহ উত্তর বংগে আবির্ভূত হন। তাঁর এ আবির্ভাবের কথা জানতে পারা যায় রাজশাহীর সুপারভাইজার কর্তৃক ১৭৭২ সালের ২২শে জানুয়ারী তারিখে কোম্পানীর কাছে লিখিত এক পত্রে। তাতে বলা হয়, তিনশ’ ফকীরের একটি দল আদায় করা খাজনার এক হাজার টারা নিয়ে গেছে এবং আশংকা করা যাচ্ছে যে, তারা হয়তো পরগণা কাচারীই দখল করে বসবে। তলোয়ার, বর্শা, গাদাবন্দুক এবং হাউইবাজির হাতিয়ারে তারা সজ্জিত। কেউ কেউ বলে তাদের কাছে নাকি ঘূর্ণায়মান কামানও আছে। (স্বাধীনতা সংগ্রাসের ইতিহাস, আবু জাফর, পৃঃ ৩৩)
১৭৭৬ সালে মজনু শাহ বগুড়া মহাস্থান আগমন করে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। সে সময় বগুড়া জেলার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মিঃ গ্লাডউইন। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে সৈন্য সাহায্য চেয়ে পাঠান। ১৭৮৬ সালের আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ফকীর সর্দারকে (মজনু শাহ) ইংরেজদের বিরুদ্ধে পর পর দু’টো সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ফকীরদের পক্ষে যেমন কিছু লোক হতাহত হয়, ইংরেজদেরও অনুরূপভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়।… ঐতিহাসিক তথ্য থেকে অনুমিত হয় যে, এরপর গঙ্গা পাড়ি দিয়ে মজনু শাহ দেশে চলে যান। আর কোন দিন তাকেঁ বাংলাদেশে দেখা যায়নি। আনুমানিক ১৭৮৭ সালে কানপুর জেলার মাখনপুর এলাকায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে সরকারী সূত্রে জানা যায়। তাঁর মৃতদেহ সেখান থেকে তাঁর জন্মভূমি মেওয়াঁতে নিয়ে গিয়ে দাফন করা হয় (স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, আবু জাফর, পৃঃ ৪০-৪১)।
মজনু শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র পরাগ আলী, পালিত পুত্র চেরাগ আলী, অন্তরঙ্গ ভক্ত মুসা শাহ, সোবহান শাহ, শমশের শাহ প্রমুখ শিষ্যগণ অষ্টাদশ শতকের শেষতক ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন।

নবম অধ্যায়
ফারায়েজী আন্দোলন
ইংরেজরা পলাশী ক্ষেত্রে যুদ্ধের অভিনয় করে কূট কলাকৌশলে সিরাজদ্দৌলাকে পরাতি করে এবং ১৭৬৪ সালে মীর কাসেমকে পরাজিত করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শাসনদন্ড লাভ করেই ক্ষান্ত হলো না। বরঞ্চ মুসলমান জাতি নির্মূল করার নতুন ফন্দি ফিকির খুঁজতে লাগলো। তাদের অদম্য অর্থলিপ্সা প্রজাপীড়নে তাদেরকে উন্মুক্ত করলো। মুসলমানদেরআয়মা, লাখেরাজ বাজেয়াপ্ত হলো। মুসলমানদের হাত থেকে খাজনা আদায়ের তারা প্রজাদের উপরে শুরু করলো নির্মম শোষণ-পীড়ন। বিলাতী বস্ত্রের বাজার সৃষ্টির জণ্যে তাঁতীদের নির্মূল করার ১৭৭০-১৮২৫) কাজ শুরু হলো। ১৭৬৬ সালে প্রতিমণ লবণের উপর দু’টাকা হারে কর ধার্য করে লবণ ব্যবসা ইউরোপীয়দের একচেটিয়া অধিকারে নেয়া হলো। এভাবে মুসলমানরা সকল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র তেকে বিতাড়িত হয়ে দারিদ্র্যে নিষ্পেষিত হতে লাগলো।
শুধু তাই নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনেও মুসলমানরা বাধাগ্রস্ত হতে লাগলো। অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের এলাকায় গো-কুরবানী এবং আজান দেয়া নিষিদ্ধ হলো। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান প্রজাদের দাড়ির উপরে ট্যাক্স ধার্য করলো।তাদের পূর্জাপার্বণে মুসলমানদেরকে চাঁদা দিতে, পূজার যোগন ও বেগার দিতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদেরকে ধূতি পরতে ও দাড়ি কামিয়ে গোঁফ রাখতে বাধ্য করা হলো। মুসলমানদের ধর্ম, তাহজিব-তমদ্দুনকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির মধ্যে একাকার করে ফেলার এক সর্বনাশা পরিকল্পনা শুরু হলো। ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়ে উঠলো দিশেহারা। বাংলার মুসলমানদের এ চরম দুর্দিনের সময় ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে ফরিদপুর ঝেলার বন্দর পরগণায় জন্মগ্রহণ করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। আঠার বছর বয়সে সেখানেই অবস্থান করে ধর্ম, সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে শিক্ষা আঠার বছর সেখানেই অবস্থান করে ধর্ম, সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনীতিতে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ইসলাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা এবং ইসলামী জীবনদর্শন সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভবতঃ তিনি এ সময়েই করেন। ইসলাম নিছক কতিপয় ক্রিয়া অনুষ্ঠানের সমষ্টিই নয়, বরঞ্চ এ হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামের পরিপূর্ণ অনুশাসন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পালন করে চলাও কিছুতেই সম্ভব নয় রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতিরেকে। এ তত্ত্বজ্ঞানও তিনি লাভ করেন। অতঃপর ১৮২০ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তণ করেন।
মক্কায় অবস্থানকালে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদীর ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটে এবং এ আন্দোলনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন।
দিল্লীতে শাহ আবদুল আযীয দেহলভীর নেতৃত্বে ভারতভূমিতেও আবদুল ওহাব নজদীর অনুকরণে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় –ঐতিহাসিকগণ যার বিকৃত নাম দিয়েছেন ‘ওহাবী আন্দোলন’। তিনি ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেন এবং ‘দারুল হরব’কে ‘দারুল ইসলাম’ তথা একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সক্রিয় আন্দোনে আত্মনিয়োগ করেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী, শাহ আবদুল আযীযের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই।
হাজী শরীয়তুল্লাহও এ দেশকে ‘দরুল হরব’ ঘোষণা করেন এবং যতোদিন এ দেশ ‘দারুল ইসলাম’ না হয়েছে ততোদিন এখানে ‘জুমা’ ও ঈদের নামাজ সংগত নয় বলে ঘোষণা করেন। হিন্দুর পূজাপার্বণে কোন প্রকার আর্থিক অথবা দৈহিক সাহায্য-সহযোগিতা ইসলাম-বিরুদ্ধ (শিরক ও হারাম) বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, মুসলমানদেরকে ধূতি ছেড়ে তহবন্দ-পায়জামা পরিধান করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে এবং সকল প্রকার কুসংস্কার থেকে তওবা করতে হবে। মোটকথা যাবতীয় পাপকাজ পরিত্যাগ করে নতুনভাবে ইসলামী জীবন যাপন করতে হবে।
শোষিত-বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত মুসলমান জনসাধারণ হাজী শরীয়তুল্লাহর আহবাদে নতুন প্রাণসঞ্চারণ অনুভব করলো এবং দলে দলে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। অল্প সময়ের মধ্যে দশ হাজার মুসলমান তাঁর দলভুক্ত হলো। এটা হলো হিন্দু জমিদারদের পক্ষে এক মহাআতংকের ব্যাপার। এখন মুসলমান নিষ্পেষণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং যেসব নিম্নশ্রেণীর দরিদ্র মুসলমানদেরকে তারা তাদের দাসানুদাসে পরিণত করে ইসলাম ধর্ম থেকেও দূরে নিক্ষেপ করেছে, তারাও তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। অতএব, তাদের উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হয়ে উঠারই কথা। “The Zaminders were alarmed at the spread of the new creed which bound the Mussalman peasantry toghetrer as one mai” –(Dr. James Wise; Journal of Asiatic Society of Bengal Vol. LXII, 1894 No,1)।
হাজী শরীয়তুল্লাকে দমন করার জন্যে ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর হলো হিন্দু জমিদারগণ। তাঁদের দলে যোগদান করলো কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী আধা-মুসলমান যারা ছিল হিন্দু জমিদারদের দাসানুদাস। অদূরদর্শী মোল্লা-মৌলভী ও পীর, যারা মুসলমানদের মধ্যে শিরক বিদয়াত প্রভৃতি কুসংস্কারের নামে দু’পয়সা কামাই করছিল, তারাও ফারায়েজী আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো।
একদিকে ব্রিটিশ এবং অপরদিকে অত্যাচারী হিন্দু জমিদার মহাজনদের উপর্যুপরি অত্যাচার-নিষ্পেষণে মুসলমানরা অনন্যোপায় হয়ে মাথানত করে সবকিছু সহ্য করে যাচ্ছিল। শরীয়হতুল্লাহর আহবানে নিপীড়িত মুসলমানগণ দলে দলে তাঁর কাছে এসে জমায়েত হতে লাগলো এবং ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করলো। সম্ভবতঃ ‘ফরয’ শব্দ থেকে ফরায়েজী ভুলতে বসেচিল এবং বহু অনৈসলাশী আচার-অনুষ্ঠানকে মুসলমান সমাজে প্রচলিত করেছিল। যাবতীয় ইসলাম বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নবী মুহাম্মদের (সা) প্রতিষ্ঠিত ইসলামের বিরোধী রীতিনীতি পরিত্যাগ করে নভী মুহাম্মদের (সা) প্রতিষ্ঠিত ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই ছিল আরবের মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহাব নজদী, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তীতুমীর প্রমুখ মনীষীদের আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
হাজী শরীয়াতুল্লাহর আন্দোলনে হিন্দুস্বার্থে চরম আঘাত লেগেছিল বলে তারা ইংরেজ শাসকদের সহায়তায় তাঁকে দমন করতে সকল শক্তি প্রয়োগ করলো। তৎকালীন হিন্দু সমাজের মনোভাব হাজী শরীয়তুল্লাহর প্রতি কতখানি বিদ্বেষাত্মক ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৩৭ সালের ২২শে এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত একখানি পত্রে। পক্রটি নিম্নে উদ্ধৃত হলোঃ
ইদানিং জেলা ফরিদপুরের অন্তঃপতি শিবচর থানার সরহদ্দে বাহাদুরপুর গ্রামে সরিতুল্লা নামক একজন বাদশাহী লওনেচ্ছুক হইয়া নূন্যাধিক বার হাজার জোলা ও মুসলমান দলবদ্ধ করিয়া নতুন এক শরা জারি করিয়া নিজ মতাবলম্বী লোকদিগের মুখে দাড়ি, কাছা খোলা, কটিদেশে ধর্মের রজ্জুভৈল করিয়া তৎচতুর্দিগস্থ হিন্দুদিগের বাটি চড়াও হইয়া দেবদেবী পূজার প্রতি অশেষ প্রকার আঘাত জন্মাইতেছে –এই জিলা ঢাকার অন্তঃপাতি মতলবগঞ্জ থানার রাজনগর নিবাসী দেওয়ান মৃত্যুঞ্জয় রায়ের স্থাপিত দ্বাদশ শিবলিঙ্গ ভাঙ্গিয়া নদীতে বিসর্জন দিয়াছে এবং ঐ থানার সরহদ্দে পোড়াগাছা গ্রামে একজন ভদ্রলোকের বাটিতে রাত্রিযোগে চড়াও হইয়া সর্বস্ব হরণ করিয়া তাহার গৃহে অগ্নি দিয়া অবশিষ্ট যে ছিল ভস্মরাশি করিলে এজন যবন মৃত হইয়া ঢাকায় দওরায় অর্পিত হইয়াছে।
আর শ্রুত হওয়া গেল, সরিতুল্লার দলভুক্ত দুষ্ট যবনেরা ঐ ফরিদপুরের অত্নঃপাতি পাটকান্দা গ্রামের বাবু তরিনী চরণ মজুমদারের প্রতি নানা প্রকার দৌরাত্ম্য অর্থাৎ তাহার বাটিতে দেব-দেবী পূজায় আঘাত জন্মাইয়া গোহত্যা ইত্যাদি কুকর্ম উপস্থিত করিলে মজুমদার বাবু যবনদিগের সহিত সম্মুখ যুদ্ধ অনুমতি বোধ করিয়া –ঐ সকল দৌরাত্ম্য ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজুরে জ্ঞাপন করিলে ঐ সাহেব বিচারপূর্বক কয়েকজন যবনকে কারাগারে বন্ধ করিয়াছেন এবং এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিতেছেন। হে সম্পাদক মহাশয়, দুষ্ট যবনেরা মফঃস্বলে এ সকল অত্যাচার ও দৌরাত্ম্যে ক্ষান্ত না হইয়া বরং বিচারগৃহে আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। শ্রুত হওয়া গেল, ফরিদপুরের ম্যাজিষ্টেট সাহেবের হুজরে জে সকল আমলা ও মোক্তার –কারেরা নিযুক্ত আছে, তাহারা সকলেই সরিতুল্লা যবনের মতাবলম্বী –তাহাদের রীতি এই যেদি কাহার নামে মিথ্যা অভিযোগ করিতে হয়, তবে কেহ ফরিয়াদী কেহ বা সাক্ষী হইয়া মোকদ্দমা উপস্থিত করে সুতরাং ১২০০০ লোক দলবদ্ধ। ইহাতে ফরিয়াদীর সাক্ষীর ত্রুটি কি আছে… আমি বোধ করি, সরিতুল্লা যবন যে প্রকার দলবদ্ধ হইয়া উত্তর উত্তর হইতেছে অল্প দিনের মধ্যে হিন্দুধর্ম লোপ পাইয়া অকালে প্রলয় হইবেক। করিতুল্লার চোটপাটের শত অংশের এক অংশ তিতুমীর করিয়ছিল না। ইতি সন ১২৪৩ সাল, তারিখ ২৪শে চৈত্র”। (“সংবাদপত্রে সেকালের কথা”-ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয় সম্পাদিত –শতাব্দী পরিক্রমা, পৃঃ ১৯৪-৯৫)।
পত্রখানির প্রতিটি ছত্রে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সমাজের মানসিকতা পরিস্ফুট হয়েছে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে বাংলাদেশ থেকে বহু মুজাহিদ, যাকাত, ফেৎরা, লিল্লাহ থেকে সংগৃঞীত বহু অর্থ এবং নানা প্রকার সাহায্য পশ্চিম ভারতের সিত্তানা কেন্দ্রে পাঠাতেন।
ঢাকা জেলার নয়াবাড়ী নাম স্থানে প্রথমে শরীয়তুল্লাহর নুতন কর্মক্ষেত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের চরম বিরোধিতার ফলে তাঁকে আপন গ্রামে ফিরে গিয়ে তাঁর প্রচারকার্য শুরু করতে হয়। তাঁর আন্দোলন ঢাকা, বরিশাল, নদিয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে। নিরক্ষর, চাষী, তাঁতী ও অন্যান্য সাধারণ মুসলমানদের নামাজ-রোজার প্রচলন, ধুতির পরিবর্তে তহবন্দ-টুপির ব্যবহার, মসজিদগুলির সংস্কার প্রভৃতি কাজ পূর্ণ উদ্যমে চলতে থাকে। হাজী শরীয়তুল্লাহ নিজে মাথায় প্রকান্ড পাগড়ী ও গায়ে জামার উপরে হুদরিয়া পরতেন –যে পোশাক সাধারণতঃ কোন মুসলমান ব্যবহার করতো না। ১৮৪০ সালে তিনি পরলোক গমন করার পর তাঁর যোগ্য পুত্র দুদু মিয়া তাঁর আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ মুহসীন ওরফে দুদু মিয়া ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৩১ সালে তিনি হজ্ব পালনের জন্যে মক্কা গমন করে পাঁচ বৎসর অবস্থান করেন এবং প্রত্যাবর্তনের পর পিতার কাজে সাহায্য করেন।
পিতার ন্যায় দুদু মিয়াও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। জমিদারদের সংগে তাঁকে বার বার সংঘর্ষে আসতে হয়। ১৮৪২ সালে তিনি ফরিদপুরের জমিদার বাড়ী আক্রমণ করেন এবং মদন নারায়ণ ঘোষকে বন্দী ও পরে হত্যা করেন। পুলিশ তাঁকেসহ ১১৭জন ফারায়েজীকে গ্রেফতার করে। বিচারে ২২ জনের কারাদন্ড হয়। কিন্তু দুদু মিয়াকে প্রমাণের অভাবে খালাস দেয়া হয়। ১৮৪৬ সালে এনড্রিও এন্ডারসন এর গোমস্তা কালি প্রসাদ মনিবের আদেশে সাত আটশ’ লোক নিয়ে দুদু মিয়ার বাড়ী চড়াও করে এবং প্রায় দেড় লক্ষ মূল্যের অলংকারাদিসহ বহু ধনসম্পদ লুন্ঠন করে নিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়েও কোন ফল হয় না।
জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী হয়ে কোন সুবিচার না পেয়ে দুদু মিয়া এবার নিজ হাতে শত্রুদের উচিত শাস্তি দিতে মনস্থ করেন। ১৮৪৬ সালর নভেম্বর মাসে, তাঁর গৃহ লুণ্ঠিত হওয়ার একমাস পরে, তিনি শত্রুদের অত্যাচার-উৎপীড়নের ইন্ধন সংযোগকারী নীলকর ডানলপের কারখানা অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে দেন এবং গোমস্তা কালী প্রসাদকে হত্যা করেন। দুই বৎসর পর্যন্ত মামলা চলার পর দুদু মিয়া তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান।
জনসাধারণের মধ্যে দুদু মিয়ার অসাধারণ প্রভাব প্রতিপত্তি লক্ষ্য করে সরকার বিব্রত হয়ে পড়েন। ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলন চলাকালে দুদু মিয়া উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারেন এই অজুহাতে তাঁকে কারাগারে আটক করে রাখা হয়। প্রথমে আলীপুরে এবং পরে তাঁকে ফরিদপুর জেলে রাখা হয়। ১৮৫৯ সাল মুক্তিলাভ করে তিনি ঢাকায় আসেন এবং এখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
দুদু মিয়া পিতার আন্দোলনকে অধিকতর শক্তিশালী করেছিলেন বটে। কিন্তু নীতির দিক দিয়ে তিনি পিতার আদর্শের কিছুটা পরিবর্তন করেছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ যে ছয়টি বিষয়ের উপর তাঁর আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন তা হচ্ছে
>> মুসলমান শাসিত দেশ ব্যতীত অন্য কোথাও জুমা ও ঈদের নামায বৈধ নয়;
>> মহররমের পর্ব ও অনুষ্ঠান পালন ইসলাম বিরুদ্ধ এবং পাপকার্য;
>> ‘পীর’ ও ‘মুরীদ’ পরিভাষাদ্দয়ের স্থলে ‘উস্তাদ’ ও ‘শাগরেদ’ পরিভাষাদ্বয়ের ব্যবহার। কারণ ‘মুরীদ’ তার যথাসর্বস্ব ‘পীরের’ কাছে সমর্পণ করে যা ঠিক নয়। পক্ষান্তারে ‘শাগরেদকে’ তা করতে হয় না।
>> এ আন্দোলনে যারাই যোগদান করবে তাদের মধ্যে উচ্চ-নীচ, ‘আশরাফ’-‘আতরাফ’ –কোন ভেদাভেদ থাকবে না। বরঞ্চ সকলের মধ্যে সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে –‘পীরি-মুরীদির’ মধ্যে যার অবাব দেখা যায়।
>> পীরপূজা ও কবরপূজা ইসলাম বিগর্হিত বলে এসবের বলে তীব্র প্রতিবাদ জানান।
>> তৎকালে পীরের হাতে হাত রেখে ‘বয়আত’ করার যে প্রথা প্রচলিত ছিল, তার পরিবর্তে ‘ফারায়েজী’ আন্দোলনে যোগদানকারী শুধুমাত্র সকল পাপ কাজ থেকে খাঁটি দিলে ‘তওবা’ করে পরিপূর্ণ ইসলামী জীবন যাপন করার শপথ গ্রহণ করবে।
>> ধাত্রীকর্তৃক নব প্রসূত সন্তানের নাড়িকর্তনকেও ইসলাম বিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, এ কাজ পিতার, বেগানা ধাত্রীর নয়।
জেমস টেইলর বলেন যে, কোরআনকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ফারায়েজী আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং কোরআন যেসব অনুষ্ঠানাদি সমর্থন করে না তা সবই বর্জনীয়। মহররমের অনুষ্ঠান পালনই শুধু নিষিদ্ধ নয়, এ অনুষ্ঠানের ক্রিয়াকলাপ দেখাও নিষিদ্ধ। (Dr. A. R. Mallick: British Policy & the Muslims in Bengal. P. 69)।
হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর আন্দোলনকে জোরদার করার জন্যে দুদু মিয়া সমগ্র পূর্ববাংলা কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক এলাকায় একজন করে খলিফা নিযুক্ত করেন যাদের কাজ ছিল আন্দোলনের দিকে মানুষকে আহবান করা, কর্মী সংগ্রহ করা ও সংগঠন পরিচালনার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করা। এবাবে যে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরী হলো তার মাথায়, দুদু মিয়া, ‘পীর’ রূপে বিরাজমান হলেন যে পীরপ্রথাকে তাঁর পিতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। (Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXIII, pt. 2, No.1,1894, p.50; Encyclopedia of Islam, Vol.2, p-59)।
হাজী শরীয়তুল্লাহর জিবদ্দশায় যে আন্দোলন পরিচালিত ছিল, তা ছিল মুখ্যতঃ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। অত্যাচারী জমিদারদের প্ররোচনায় দু’একটি সংঘর্ষ ব্যতীত কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে, তাঁর আন্দোলনের সংঘর্ষ হয়নি। কিন্তু দুদু মিয়ার সময়ে আন্দোলন অনেকটা রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। সকল জমিদার ও নীলকরগণ তাঁর আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়। তাই দুদু মিয়ার সারা জীবন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কেটে গেছে। একদিকে গরীব প্রজাদের উপর জমিদার-নীলকরদের নানাপ্রকার উৎপীড়ন এবং তাদের দুঃখ মোচনে দুদু মিয়ার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা তাদেরকে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ করে। দুদু মিয়ার সাংগঠনিক যোগ্যতাও ছিল অসাধারণ। বাংলার জমিদারগণ চিল প্রায়ই হিন্দু এবং নীলকরগণ ছিল ইংরেজ খৃষ্টান ও তাদের গোমস্তা কর্মচারী ছিল সবই হিন্দু। এ কারণেও কৃষক প্রজাগণ জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ হয়েছিল। দুদু মিয়াকে সারা জীবন জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই কেটে গেছে। নিত্য নতুন মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমায় তাঁকে জড়িত করা হয়। এসবের জন্যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য বরণ করতে হয়।
দুদু মিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র যথাক্রমে গিয়াসউদ্দীন হায়দার ও নয়া মিয়া ফারায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। নয়া মিয়ার মৃত্যুর পর দুদু মিয়ার তৃতীয় পুত্র আলাদীন আহমদ আন্দোলন পরিচালন করেন। তিনি ১৯০৫ সালের বংগভংগ সমর্থনে নওয়াব সলিমুল্লাহর সাথে সহযোগিতা করেন। আলাদীনের পর তাঁর পুত্র বাদশাহ মিয়া আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯২২ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন এবং এ সময়ে সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। তারপর ফারায়েজী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন নিয়ে এ আন্দোলনের শুরু হেয়ছিল তা ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে ক্রমশঃ অন্য ধারায় প্রবাহিত হয়। যে পীর-মুরীদি হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রত্যখ্যান করে আন্দোলনকে খাঁটি ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন, অবশেষে এ আন্দোলন সেই পীর-মুরীদিতেই রূপান্তরিত হয়ে গেল। ফলে এ আন্দোলনের মাবলম্বীদের কার্যকলাপ ও কর্মপদ্দীত থেকে পূর্বের সে জেহাদী প্রেরণা ও সংগ্রামী মনোভাব বিদায় গ্রহণ করলো।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি