ত্রয়োদশ অধ্যায়
স্যার সাইয়েদ আহমদ খান
পূর্বে বর্ণিত হয়েছে স্যার সাইয়েধ আহমদ খান ব্রিটিশ সরকারের অধীনে উচ্চপদের চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপরে ভারতে এক সুশৃংখল ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায়ও তামরা মুসলমানেদর চেয়ে বহু গুণে উন্নত। এ দেশ থেকে সহসা তাদেরকে উৎখাত করা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাদের সাথে এমতাবস্থায় সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া মুসলমানদের আত্মহত্যারই শামিল হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশের সমর্থন দিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের (তাদের ভাষায় বিদ্রোহের) সকল দোষ শুধুমাত্র মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের উপর পাইকারী হারে যে অমানুষিক নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছিল, তাতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ পুস্তিকা ‘আসবাব-ই-বাগাওয়াতে হিন্দু’ ও ‘ভারতীয় মুসলমান’ নামক পুস্তিকার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের রুদ্ররোষ পশমিত করার চেষ্টা করেন। পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের পশ্চাদপদতাকে তিনি তাদের অবনতির কারণ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর বাণী ছিল –‘আগে মূলকে রোগমুক্ত কর। তাহলেই বৃক্ষ বর্ধনশীল হবে’। ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে তিনি গাজীপুরে একটি অনুবাদ সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন। এ সমিতির মাধ্যমে বহু বিদেশী গ্রন্থ অনূদিত হ’য়ে প্রকাশিত হয়।
মুসলিম সমাজের উন্নতকল্পে তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান এই যে, তিনি ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে ১৮৭৫ সালে আলীগড় মোহামেডান ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেন। এ কলেঝে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়। তৎকালে সরকারী ইংরেজী বিদ্যালয়গুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থঅ না থাকায় মুসলমানরা সেখানে তাদের সন্তানকে পাঠাতে সংকোচ বোধ করতো। আধুনিক শিক্ষালাভের পথ থেকে সে প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয় আলীগড় কলেজের মাধ্যমে।
এ কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্যার সাইয়েদ আহমদ মুসলিম সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের যে আন্দোলন গড়ে তোলেন তা ‘আলীগড় আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করে। এ মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনে কবি হালী, মুহসিনুল মুলক, নাজির আহমদ, চেরাগ আলী প্রমুখ মনীষীবৃন্দ যোগদান করে আন্দোলনের অগ্রগতি সাধিত করেন।
মুসলিম স্বার্থের রক্ষাকবচ হিসাবে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্যার সাইয়েদ আহমদ মুসলমানদের জন্যে পৃথক সরকারী মনোনয়নপ্রথার দাবী জানান। তিনি বলেন এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে মুসলমানদের স্বার্থে পদদলিত হবে। ১৮৮৩ সালের ১২ই জানুয়ারী গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের নিকটে মুসলমানদেরন জন্যে পৃথক নমিনেশন প্রথার সমর্থনে তিনি বলেনঃ “সাধারণ যুক্ত নির্বাচন প্রথার দ্বারা শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা হয়। যে দেশে শুধুমাত্র একজাতি ও এক ধর্মের লোক বাস করে সেখানে এ প্রথা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ভারতে বিভিন্ন জাতির বাস, কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ, কেউ সংখ্যালঘু এবং তাদের মধ্যে জাতিভেদ ও ধর্মভেদ বিদ্যমান। এমতাবস্থায় যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তন করলে কুফল দেখা দিতে বাধ্য। এ প্রথা প্রবর্তন করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাহিগুলির দ্বারা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ পদদলিত হবে। তাতে জাতি বিদ্বেষ ও ধর্ম বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করবে। এর জন্যে সরকারকেই দায়ী হতে হবে”।
তার এ যুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব মুসলিম সমাজের জন্যে এক চিন্তার দ্বার উন্মুক্ত করে এবং তার এ প্রস্তাব ফলবতী হয় –ছাব্বিশ বছর পর। ১৯০৬ সালের ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ভারতের বিশিষ্ট ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টের কাছে পৃথক নির্বাচন প্রথার দাবীতে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কারে এ দাবী স্বীকৃতি লাভ করে। এতে করে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজ ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠে। কারণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিঘোষিত নীতি ছিল একজাতীয়তাবাদ। এই নিয়ে বহু বৎসর ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বাকবিতন্ডা ও তিক্ততা চলে। অবমেষে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনান্তে উভয় প্রতিষ্ঠানের যথারীতি ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধিগণ তাঁদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এটাই ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে অভিহিত। চুক্তিটি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচনে মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনাধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। এভাবে হিন্দু কংগ্রেস ভারতে একজাতীয়তার পরিবর্তে দ্বিজাতিত্ব স্বীকার করে নেয়, যা ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি।
স্যার সাইয়েদ আহমদের প্রতিটি নীতি ও কথায় একমত হওয়া না যেতে পারে তবে নিতি তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির দ্বারা ভারতীয় মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যোগাদান করতে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, কংগ্রেস শুধুমাত্র ভারতের হিন্দু স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করবে এবং মুসলমানদের স্বার্থ হবে উপেক্ষিত। এ সত্যটি প্রথমে মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহরা মতো মুসলিম মনীষীগণ উপলব্ধি না করলেও স্যার সাইয়েদের সাবধানবাণীর সত্যতা তাঁদের কাছে পরবর্তীকালে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়িছিল। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতীয়তার প্রেরণা জাগ্রত হয় এবং মুসলিম মানস এ পথেই অগ্রসর হয়। তাই বলতে হয়, ভারতীয় মুসলমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার বীজমন্ত্র বহু আগেই দান করেছিলেন স্যার সাইয়েদ আহমদ।

বংগভংগ
বংগভংগ ও তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের জেনে রাখা দরকার বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে বাংলা তথা সারা ভারতের রাজনৈতিক অংগনে হিন্দু ও মুসলমানদের পজিশন কি ছিল। ১৮৫৭ সালের পর গোটা মুসলিম সমাজদেহ যে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, সে ক্ষত তখনো শুকোয়নি এবং তার থেকে তখনো রক্ত ঝরছিল। ভারতের হিন্দু সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারাকে পুরাপুরি গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে সুযোগ সুবিধা ষোল আনা আদায় করছিল। ইংরেজী ভাষায় জ্ঞান অর্জন করে সরকারী চাকুরীর মাধ্যমে অফিস আদালতে তারা জেঁকে বসেছিল। ব্রিটিশ সরকারের সাথে কোম্পানী শাসন থেকেই তাদের গভীর মিতালি ছিল। বিপ্লবী মুসলিম জাতিকে ভালোভাবে শায়েস্তা করার জন্যে সে মিতালি গভীরতর করার প্রয়োজন উয়য়েরই ছিল। বাংলায় ফারায়েজী ও তিতুমীরের আন্দোলন, সাইয়েধ আহমদ শহীদের আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে ভারতের প্রথম আযাদী আন্দোলন, প্রভৃতির জন্যে ব্রিটিশ মুসলমানদেরকেই দায়ী করেন। অতঃপর তাঁরা মুসলমানদের একেবারে মূলোৎপাটন করার অথবা চিরতরে পংগু করে রাখার পরিকল্পনা করে তাদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকেন। ব্রিটিশ বিরোধী বলে অভিহিত পাটনার দ্বিতীয় মামলা ১৮৭১ সালেল শেষে অথবা ১৮৭২ সালে শেষ হয়।
গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা মিঃ জে, এইচ, র‌্যালির একখানি অসংগতিপূর্ণ রিপোর্টের উপর র্নিভর করেই সরকার সাত ব্যক্তিকে গ্রেফতার ও অভিযুক্ত করেন। …পাঁচজন আসামী যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ডে দন্ডিত হন এবং তাদের যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়।
-(মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহঃ আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃঃ ১৫৩)
ভারতের মুসলিম জারিত এমন সংকট সন্ধিক্ষণে সাইয়েদ আহমদ খান এগিয়ে আসেন।তিনি উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশের সাথে সংঘর্ষে মুসলমানদের কোন মংগল না হয়ে অমংগল হবে। হিন্দুজাতি শিক্ষা দীক্ষা, চাকুরী বাকুরী, ব্যবসা বাণিজ্য প্রভৃতিতে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। মুসলমানদেরকে শিক্ষা দীক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজী ভাষা ও আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষা লাভ করেই জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে। তাঁর মতে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে সমাজের প্রতিষ্ঠা লাভ করাই মুসলমান জাতির আশু কর্তব্য। অতএব সাইয়েদ আহমহ মুসলমানদের ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার উপরে বিশেষ জোর দেন এবং তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৭৭ সালে ইংলিশ পাবলিক স্কুল মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্ট্যাল কলেজ (M.A.O.College)। সাইয়েদ আহমদ ১৮৮৬ সালে মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করে এব উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্যে সর্বপ্রথম তাদের চিন্তাধারা প্রকাশের সুযোগ করে দেন।

আর্য সমাজ
অপরদিকে ১৮৫৭ সালে বোম্বাই শহরে দয়ানন্দ আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এর প্রধান কার্যালয় লাহোরে স্থানান্তরিত হয়।দয়ানন্দ ভারতে গো-সংরক্ষণ প্রচারণা শুরু করেন এবং এতদুদ্দেশ্যে একটি সমিতি গঠন করেন।
দেশে গরু জবাই বন্ধের জন্যে আর্য সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের নিকটে বিরাট আবেদন পত্র প্রেরণ করা হয়। তিনি প্রাচীন বৈদিক বিশ্বাসের প্রতি হিন্দু সমাজকে আহবান জানান এবং ইসলাম ও খৃষ্টধর্মের মতো বৈদেশিক ধর্মের মূলোচ্ছেদের জন্যে জোর প্রচারণা চালান। “ভারত ভারতীয়দের জন্যে” –তাঁর এই সংগ্রামের আহবান বিরাট রাজনৈতিক পরিণাম ডেকে আনে।
-(A Hamid Muslin Separatism in India, p.27; Farquhar Modern Religious Movement in India, p.205)
মুসলমানদের বেলায় ত কথাই নেই, হিন্দুদের সাথে ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক কারণে গভীর মিতালি বিদ্যমান থাকলেও, শাসক ও শাসিতের মনোভাব পুরাপুরিই ছিল। Sir Bampfyde Fuller তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্বলিত গ্রন্থে বলেনঃ “কিছু সংখ্যক ইংরেজ ভারতে এসে ভদ্রতাসুলভ আচরণের প্রাতমিক রীতিপদ্ধতিও ভুলে গিয়েছিল। ইংরেজদের মহলে, রেঁস্তোরা ও ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। সিপাহী বিদ্রোহে নিহত ইংরেজদের স্মরণার্থে কানপুরে একটি উদ্যান তৈরী করা হয়েছিল, সেখানে কোন ভারতীয় প্রবেশ করতে পারত না। যেসব স্থানে ইংরেজরা ঘুরাফেরা করতো সেখানে ভারতীয়দের যাতায়ত বিপজ্জনক ছিল। ভারতীয়দরে প্রতি তাদের ঘৃণা বিদ্বেষ এতোটা চরমে পৌঁছেছিল যে, প্রায়ই তাদের উপর বর্বরতা চালানো হতো এবং হত্যাও করা হতো। অপরাধীর কোন শাস্তিই হতো না, অথবা হলে অত্যন্ত সামান্য জরিমানা পর্যন্তই তা সীমিত থাকতো। তাদের কাছে ভারতীয়দের জীবনের কোন মূল্যই ছিল না। বিনা বিচারে আসামীদের গুলী করে উড়িয়ে দেয়ার অথবা প্রাণদন্ড দেয়ার দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে অফিসারদের বাড়াবাড়িও উপেক্ষা করা হতো। স্যার ব্যামফিল্ড তাঁর ডাইরীতে এ ঘটনাও লিপিবদ্ধ করেন যে, যখন তিনি কানপুরের রাস্তা দিয়ে চলছিলেন তখন জেলার কর্তা রাস্তা ছেড়ে দেয়ার জন্যে পথচারীদেরকে বেত্রাঘাত করছিলেন।
-(Sir Fuller Bampfylde: Some Personal Experiences, p-56, Muorag, London-1930; A Hamid : Muslim Separatism in India, p.28)

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
এ ধরনের ছোটো বড়ো বহু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, যার ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটা চাপা অসন্তোষ গুঞ্জরিত হচ্ছিল। এ সময়ে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। মজার ব্যাপার এই যে, কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘অ্যালেন হিউম’ নামে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সিভিলিয়ান। তাঁর যোগ্যতা যেমন ছিল, তেমনি প্রভূত অর্থ সম্পদের মালিকও ছিলেন তিনি। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠান গঠনে তাঁর যেমন ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল, তেমনি এর পেচনে ছিল তৎকালীন ভাতের বড়োলাট ডাফরীনের (Dufferin) আশীর্বাদ। মিঃ হিউম বেঙল সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণের পর ভারতেই রয়ে যান এবং ভারতের সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক উৎকর্ষ লাভের উদ্দেশ্যে একটি নিখিল ভারত সংগঠনের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি একটি খোলাচিঠির মাধ্যমে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের কাছে আবেদন জানান একতা ও সংগঠনের জন্যে। তিনি এ কথার উপর জোর দিয়ে বলেন যে, সরকার জনগণ থেকে দূরে থাকেন এবং সে কারণে তাঁরা এ দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন। পুনর্গঠনের কাজ এ দেশবাসীকেই করতে হবে, বিদেশীদের দ্বারা তা সম্ভব নয়। কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে মাদ্রাজের গভর্নর প্রতিনিধিদেরকে বৈকালিক চায়ের মজলিসে আতিথ্য দ্বারা আপ্যায়িত করেন। অতএব প্রাথমিক পর্যায়ে কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কংগ্রেসের দুজন অবিসংবাদিত নেতা বাল গংগাধর তিলক ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নীতি ও আদর্শ থেকে কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য জানতে পারা যায়।

বাল গংগাধর তিলক
বাল গংগাধর তিলক বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর বিগত শতকের আটের দশকে সাংবাদিকতা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে তাঁকে রাজনীতির পুরোভাগে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সুদক্ষ রাজনীতিবিদ। পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে বিরোধিতার পরিবর্তে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামের (Direct Action) নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যুদ্ধপ্রিয় মারাঠা জাতির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করে তা কংগ্রেসের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করেন।
-(C.Y. Chintamoni India Politics Since the Mutiny, p. 81, Andhara University, Waltar-1937; A Hamid Muslim Separatism in India, p.29)
বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। ক’বছর পর চাকুরী থেকে অপসারিত হওয়ার পর সাংবাদিকতায় যোগদান করেন। তিনি বহু আদে থেকেই উপলব্ধি করেছিলৈন যে, হিন্দুজাতীয়তা তার ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ পরিহার না করলে কিছুতেই শক্তি অর্জন করতে পারবে না। অতএব কয়েক বছর আগে থেকেই তিনি গো-বধ প্রতিরোধ সমিতির (Ati-cow-killinh society) কর্মতৎপরতা প্রসারিত করেন এবং গণপতি উৎসব পালনের উদ্দেশ্যে বিশেষ এক সংগীত রচনা, তার প্রকাশনা ও বিতরণের ব্যবস্থাদি করেন। ঐতিহাসিক ‘হিন্দু মুসলিম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ’ এবং তার ‘হিসাব নিকাশের দিনের আগমনী’ সম্পর্কিত বিষয়াদিতে পরিপূর্ণ ছিল এসব সংগীত। তিনি উগ্র হিন্দু শ্রেণী-চেতনা জাগ্রত করেন। তিলকের গো-বধ প্রতিরোধ সমিতি মূলতঃ দাক্ষিনাত্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও, তার কর্মতৎপরতা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রচারক বাহিনী দেশের শহরে শহরে, গ্রামেগঞ্জে ‘গো মাতার আর্তনাদ’ The cry of the cow শীর্ষক প্রচারপত্র বিতরণ করতে থাকে। জনসভায় হিন্দুগণ গোহত্যার প্রতিবাদ করে প্রস্তাবাদি গ্রহণ করতে থাকেন এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে তা জনগণেল মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে থাকে। স্বভাবতঃই তার ফলে স্থানে স্থানে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষও হতে থাকে।
-(A Hamid Muslim Separatism in India, pp.45,48)
সারাদেশে যে সময়ে এ ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, সে সময়ে ১৮৯৯ সালে, লর্ড কার্জন ভারতের বড়োলাট হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, সে সময়ে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী চিল কোলকাতায়। প্রথম কয়েক বৎসর কার্জন বাঙালী হিন্দুদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন প্রশাসন ক্ষেত্রে দক্ষতার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করেন এবং অযোগ্যতা, দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা, প্রভৃতি উচ্ছেদ করে প্রশাসনের মানোন্নয়নে মনোযোগ দেন, তখন স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর প্রশংসা, মাহাত্মকীর্তন ও স্তুতির পরিবর্তে নিন্দা ও সমালোচনা শুরু করে। কার্জন প্রশাসন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেন। তার সবগুলি, মনঃপূত না হলেও, বিনাবাক্যে গৃহীত হয়। কিন্তু তাঁর বংগভংগ প্রতিক্রিয়াশীলদের অতিমাত্রায় ক্ষিপ্ত করে তোলে।
বংগভংগ ছিল কার্জন প্রশাসনের সবচেয়ে সুফলপ্রদ ব্যবস্থা। কিন্তু তথাপি এ এক অশুভ পরিণাম ডেকে আনে, ভারতের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির পরিবর্তণ সাধন করে, হিন্দু ও মুসলিম জাতির মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। যে মুসলিম জাতি কিছুকাল যাবত রাজনৈতিক অংগন থেকে দূরে সরে ছিল, তাদের মধ্যে পুনরায় রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়। অতএব বংগভংগ ভারতীয় রাজনীতিতে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে সন্দেহ নেই।
এখন আমাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগিসহ আলোচনা করা দরকার যে, বংগভংগের প্রকৃত কারণই বা কি চিল, এবং তা অর্ধযুগ পরে বাতিলই বা হলো কেন।
বংগভংগ করা হয়েছিল সুষ্ঠু ও সুফলপ্রসূ প্রশাসনিক কারণে। বাংলা তখন ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রধান প্রদেশ ছিল। বিহার ও উড়িষ্যা এই প্রদেশেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং আয়তন ছিল ১৭৯,০০০ বর্গমাইল এবং লোকসংখ্যা ৭৯,০০০,০০০। এত বড়ো একটি প্রদেশ একজন ছোটলাট বা গভর্নরের শাসনাধীন ছিল। এত বড়ো প্রদেশের সুষ্ঠু শাসন পরিচালনা আইন শৃংখলা মজবুত রাখা এবং সকল অঞ্চলের উন্নয়নের প্রতি দৃষ্টি রাখা ছিল একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। বাংলার পূর্বাঞ্চল যেহেতু নদীবহুল এবং যাতায়াতের সযোগ সুবিধা না থাকায় ছোটলাটের পক্ষে এ অঞ্চল দেখাশুনা করা সম্ভব ছিল না। ছোটলাটের পাঁচ বৎসরের কার্যকালের মধ্যে একবারও এ অঞ্চল পরিদর্শন করার সুযোগ হতো না বলে, এ দিকটা ছিল অত্যন্ত অবহেলিত ও অনুন্নত। (A.R. Mallick Parition ofBengal, p.-2; এম এ রহিমঃ বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস পৃঃ ২০১)।
বিগত শতকের ছয়ের দশকে উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে নিযুক্ত তদন্ত কমিটি মন্তব্য করেন যে, বিশাল বাংলা প্রদেশের প্রশাসনিক অব্যবস্থাই এই দুর্ভিক্ষের কারণ। বাংলার গভর্নর উইলিয়ম গ্রে ১৮৬৭ সালে এবং স্যার জন ক্যাম্পবেল ১৮৭২ সালে অভিযোগ করেন যে, এত বড়ো প্রদেশের শাসন কার্য পরিচালনা করা একজনের পক্ষে বড়োই কঠিন। তার ফলে শ্রহট্ট, কাছার ও গোয়ালপাড়া একজন চীফ কমিশনারের শাসনাধীন করা হয়। তবুও বাংলা প্রদেশের আয়তন বিশালই রয়ে যায় এবং শাসন পরিচালনায় অসুবিধার সৃষ্টি হয়। পুনরায় ১৮৯২ সালে এবং ১৮৯৬ সালে সরকারী মহল থেকেই প্রস্তাব করা হয় যে, আসাম ও পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম বিভাগ ও ঢাকা ময়মনসিংহ জেলাদ্বয় নিয়েএকটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হোক। এ শতকের শেষে লর্ড কার্জন যখন বড়োলাটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তাঁর নিকটে উক্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়।
উক্ত প্রস্তাব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার পূর্বে আর একটি গুরুতর বিষয় লর্ড কার্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মধ্য প্রদেশের চীঠ কমিশনার স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার (Andrew Fraser) প্রস্তাব দেন যে, যেহেতু মধ্য প্রদেশের অধীন সম্বলপুরের আদালতে উড়িয়া ভাষা ব্যবহৃত হয়,অথচ সমগ্র প্রদেশে এ ভাষার প্রচলন নেই, সেজন্যে উড়িয়া ভাষার পরিবর্তে হিন্দি ভাষা ব্যবকার করা হোক, অথবা সম্বলপুরকে উড়িষ্যার সাথে যুক্ত করে দেয়া হোক। উল্লেখ্য যে উড়িষ্যা ছিল বাংলার সাথে যুক্ত। এ প্রস্তাবও করা হয় যে, অন্যথায় গোটা উড়িষ্যাকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে যুক্ত প্রদেশের সাথে সামিল করা হোক।
একদিকে বাংলার গভর্নরদের পক্ষ থেকে বাংলার আয়তন হ্রাস করার প্রস্তাব এবং অপরদিকে স্যার অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের প্রস্তাব লর্ড কার্জনকে বিব্রত করে। তিনি স্বয়ং বেরারকে ব্রিটিশ ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯০২ সালের মে মাসে সেক্রেটারিয়েট ফাইলে এভাবে তাঁর মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেন যে, বেরারের বিষয়টির সাথে বাংলার সমস্যা বিবেচনা করা যেতে পারে।
আলোচনার পর চট্টগ্রাম বন্দরকে আসামের সাথে সংযুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করা হয়। তার জন্যে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, এর দ্বারা বাংলা সরকারের প্রশাসনিক গুরুভার লাঘব করা হবে, পূর্ব বাংলার জেলাগুলিতে শাসন পরিচালনায় পরিলক্ষিত ত্রুটি বিচ্যুতিসমূহ দূরীভূত হবে এবং আসামের জন্যে যে সমুদ্রপথ একান্ত আবশ্যক, চট্টগ্রামের সংযুক্তিতে সে আমশ্যক পূরণ হবে। ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন এ প্রস্তাব অনুমোদন করে ভারত সচিবকে অবহিত করেন। অতঃপর তিনি এ বিষয়ে জনগণের মতামত ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন। পূর্ব বাংলাকে আসামের অন্তর্ভুক্তকরণ জনগণ কিছুতেই মেনে নিবে না –এ কথা স্পষ্ট উপলব্ধি করেন।
অতঃপর লর্ড কার্জন ইংলন্ড গমন করেন এবং ১৯০৫ সালের প্রথম দিকে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে বৃহত্তর আসাম গঠনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। কার্জনের প্রত্যাবর্তনের পর করিকল্পনাটি ভারত সচিব ব্রডরিক সমীপে পেশ করা হয়। ব্রডরিক পরিকল্পিত নতুন প্রদেশের নাম দেন ইস্টার্ন বেঙ্গল এন্ড আসাম (পূর্ব বংগ ও আসাম)।
-(A Hamid: Muslim Separatism in India, pp.51-52)
বংগভংগ নানা ঘাত প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের জন্যে অত্যন্ত মংগল হলেও এর পিছনে তাদের কোন প্রচেষ্টাই ছিল না। বংগভংগের পর তাদের যে প্রভূত মংগল সাধিত হতে যাচ্ছিল, তা ছিল তাদের কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত। শাসন কার্য সহজ, দ্রুততর, সুষ্ঠু ও সুন্দর করার জন্যে এবং এর সুফল যাতে অবহেলিত ও অনুন্নত বাংলার পূর্বাঞ্চলও ভোগ করতে পারে তার জন্যে এ বংগভংগের পরিকল্পনা ছিল শাসকদের। মুসলমাদের নয় এর কারণগুলি ছিল অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত এবং তা নিম্নরূপঃ-
প্রথমতঃ এ অঞ্চলটি ছিল সর্বদিক দিয়ে অনুন্নত। হিন্দু জমিদারগণ এ অঞ্চলের কৃষক প্রজাদের শোষণ করে সে শোষণলব্ধ অর্থ কোলকাতায় বসে বিলাসিতায় উড়িয় দিতেন। প্রজাদের শিক্ষাদীক্ষঅ, সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার প্রতি ছিল তাঁদের চরম অবহেলা ঔদাসিন্য। কোলকাতা শহর ও পশ্চিম বাংলা উত্তরোত্তর উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করছিল। প্রশাসন ব্যবস্থাও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তার জন্যে পূর্বাঞ্চলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছিল। এ অঞ্চল নদীবহুল ছিল বলে নৌকা যাত্রীদের ধনসম্পদ জলদস্যুগণ নির্বিবাদে লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতো যার প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা করা যেতো না। পুলিশ বাহিনী ছিল অপর্যাপ্ত ও দুর্বল যার ফলে সমাজের সর্বস্তরে অরাজকতা ও বিশৃংখলা বিরাজ করতো।প্রদেশের শাসকগণ এ অঞ্চলের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পরিহার করে বসেছিলেন এবং তাদের সকল সময় ও শ্রম কোলকাতার জন্যে ব্যয়িত হতো। পূর্বাঞ্চলের নামে ভীত শংকিত হয়ে পড়তেন এবং পূর্বাঞ্চলে বদলী হওয়অকে নির্বাসন দন্ড মনে করতেন।
উপরে বর্ণিত সমস্যগুলির সমাধানের জন্যে বংগভংগ করা হয়েছিল। নতুন প্রদেশ আসাম, উত্তর ও পূর্ববংগ নিয়ে গঠিত হলো এবং এর আয়তন দাঁড়ালো ১০৬,৫০০ বর্গমাইল যার দুই তৃতীয়াশ ছিল মুসলমান। অর্থাৎ প্রদেশটি একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হয়ে পড়লো। ১৯০৫ সালের ২০শে জুলাই নতুন প্রদেশ গঠন ঘোষিত হলো এবং ১৬ই অক্টেবর থেকে এর কাজ শুরু হলো। নতুন প্রদেশের প্রথম গভর্নর স্যার ব্যবাফিল্ড ফুলার (Sir Bampfylde Fuller) প্রথম দিন ঢাকায় উপনীত হয়ে বিব্রত হয়ে পড়েন। মুসলমাগণ নতুন গভর্নরকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন এবং হিন্দুগণ কের বিক্ষোভ প্রদর্শন। নুতন গভর্নরকে চিরাচরিত প্রথানুযায়ী অভিনন্দন অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ক্রুদ্ধ জনতা তিনজন ইংরেজ মহিলাকে পথ চলাকালে আক্রমণ করে।
(Fuller Some Personal Experiences –p.126; A Hamid Muslim Separatism in India, p.53)
হিন্দুবাংলা বংগভংগের ফলে উগ্রমূর্তি ধারণ করে। এটাকে হিন্দুমহল প্রথমতঃ ‘জাতীয় ঐক্যের’ প্রতি আঘাত বলে অভিহিত করে। অতঃপর নানাভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে তাকে, যথা তাদের ‘রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার শাস্তি’, ‘মুসলমানদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব’, এবং অবশেষে এটাকে ‘মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা’ নামে অভিহিত করে। রাতারাতি বংগভংগের বিরুদ্ধে হিন্দুগণ আন্দোলন শুরু করে দিলেন। ‘জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলো’, ‘পবিত্র বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা হলো’, ‘ব্রিটিশ সরকার এবং দেশদ্রোহী মুসলমানদের মধ্যে এক অশুভ আঁতাত’ প্রভৃতি উত্তেজনাকর উক্তির দ্বারা বাংলার আকাশ বাতাস বিষাক্ত করা শুরু করলো বাংলার হিন্দু সমাজ।
হিন্দু আইনজীবীগণ এর আইনগত বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, বাংলা ভাষার সাহিত্যিকগণ প্রচার শুরু করলেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি চরম আঘাত হানা হলো। সমগ্র হিন্দুবাংলা এ ধরনের প্রলাপোক্তি শুরু করলো।
এ ধরনের অসংগত ও অবাস্তব প্রচারণার কারণ কি ছিল? মুসলমানদের উপরে হঠাৎ এ আক্রমণ ও অশোভন উক্তি শুরু হলো কেন? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে বংগভংগে কায়েমী স্বার্থ বিপন্ন ও বেসামাল হয়ে পড়েছিল। যে সংখ্যাধিক্যের কারণে বাংগালী হিন্দুগণ উভয় বাংলার চাকুরী বাকুরী ও জীবন জীবিকার উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিল, তা বংগভংগের ফলে বিনষ্ট হয়ে গেল। নতুন বাংলায় মুসলমানরা হলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলার পূর্বাঞ্চলের মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর বশ্যতা ও পরাভব থেকে মুক্তি লাভ করলেন এবং তাঁদের মনে এ আশার সঞ্চার হলো যে, এখন স্থানীয় সমস্যাদির উপর তাঁদের কথা বলার অধিকার থাকবে। সমসাময়িক লেখম সরদার আলী খান বলেন, “যত সব হৈ হল্লা এবং হঠাৎ রাতারাতি যে দেশপ্রেমের আন্দোলন শুরু হলো মাতৃভূমি অথবা ভারতের কল্যাণের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। যে প্রদেশে হিন্দুগণ সুস্পষ্ট সংখ্যালঘু সেখানে তাদের শ্রেণীপ্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখা ব্যতীত অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্য এ আন্দোলনের নেই। (Sardar Ali Khan India of Today, p-62. Bombay, Times Press, 1908)
বংগভংগ বিরোধী আন্দোলন অন্যতন তেনা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেন-
বংগভংগের ঘোষনা আকষ্কিক বজ্রপাতের ন্যায়। যে ১৬ই অক্টোবর নতুন বাংলার (পূর্ব বাংলা ও আসাম) সূচনা হয়, সেদিন কোলকাতায় হিন্দুগণ জাতীয় শোকদিবস পালন করেন। ঐ দিন তারা কালো ব্যাজ পরিধান করেন, মাথার ভষ্ম মাখেন, পানাহার পরিত্যাগ করে নানারূপ বিক্ষোভ ধ্বনি সহকারে মিছিল করে গঙ্গাস্নান করেন। অপরাহ্নে এক জনসভায় মিলিত হয়ে তাঁরা বংগভংগ রদের শপথ গ্রহণ করেন।
মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর ‘আমাদের মুক্তি সংগ্রাম’ গ্রন্থে বলেনঃ “যে সময়ের কথা বলা হইতেছে তখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা একই লেফটন্যান্ট গভর্নরের শাসনধীন ছিল। শাসন কার্যের সুবিধার জন্য পূর্ব বাংলাকে আসামের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়া একটি নূতন প্রদেশ গঠনের বিষয় ব্রিটিশ সরকার অনেকদিন হইতে চিন্তা করিতেছিলেন। বড়লাট লর্ড কার্জন অবশেষে ভারত সচিবের সহিত পরামর্শ করিয়অ বংগ বিভাগের অনুকূলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলার শিক্ষিত হিন্দু সমাজ ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। দূর মফঃস্বলেও বংগভংগের বিরোধিতা করিয়া সভাসমিতিতে প্রস্তাব গৃহীত হইতে থাকে”। (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃঃ ১৭৭)।
বংগভংগ বিরোধী আন্দোলন কিভাবে বিস্তৃতি লাভ ও শক্তি সঞ্চার করে তার উল্লেখ করে ওয়ালিউল্লাহ বলেন-
“আন্দোলন শহর হইতে গ্রামে এবং গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে বিস্তৃতি লাভ করিতে থাকে। নেতৃস্থানীয় বিপ্লববাদীরা একটু দূরে থাকিয়া ভাবপ্রবণ ছাত্র সমাজ হইতে সদস্য সংগ্রহ পূর্বক তাহাদের দলের পুষ্টি সাধন করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে শ্রি অরবিন্দ ঘোষ বরোদ রাজ্যের চাকুরীতে ইস্তাফা দিয়া বাংলায় ফিরিয়া আসনে। বিপ্লবীরা তাঁহার নিকট নতুন প্রেরণা লাভ কের। শ্রী বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার স্বভাবসুলভ ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতার সাহায্যে দেশের সর্বত্র বিপ্লবের বীজ ছড়াইতে থাকেন” –(আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃঃ ১৭৯)।
কতিপয় মুসলমা হিন্দুদের প্রচার ও তথাকথিত দেশপ্রেম আন্দোলনে বিভ্রান্ত হয়ে বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে, বালগংগাধর তিলক প্রমুখ হিন্দু নেতৃবৃন্দ শিবাজীকে আন্দোলনের প্রতীক হিসাবে উপস্থিত করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুজাতির সুপ্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগ্রত করতে লাগলেন, তখন তাঁরা বংগভংগের সুদূরপ্রসারী মংগল ও তার বিরোধিতারমূল রহস্য উপলব্ধি করে আন্দোলন পরিত্যাগ করেন। এ প্রসংগে আবদুল মওদূদ তাঁর “মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর” গ্রন্থে বলেন –“কিন্তু এই বংগভংগ বিভাগকে কেন্দ্র করে শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় যে তুমুল আন্দোলন করে, তার প্রতিধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলি ও বেতনভুক্ত সাংবাদিকরা। নিজস্ব সংবাদদাতার পত্র ও ডিসপ্যাচসমূহে যেসব পরস্পর বিরোধী সংবাদ পরিবেশিত হতে লাগলো ‘দি টাইমস’ ও ‘মানচেষ্টার গার্জেনে’ তাতে ব্রিটিশ জনমত বিভ্রান্ত হ’য়ে পড়লো সঠিন পরিস্থিতি অনুধাবন করতে অসমর্থ হয়ে। টাইমস পত্রিকায় বংগভংগকে সমর্থন করে ও কার্জনের কার্যাবলীকে পূর্ণ অনুমোদন জানিয়ে সুন্দর সুন্দর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়; মানচেষ্টার গার্জেনে বিভাগকে নিন্দা করে গরম গরম প্রবন্ধ বের হ’তে থাকে, নিজস্ব সংবাদদাতার লোমহর্য়ক বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে আন্দোলন সম্পর্কে ও বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে। কটন, নেভিন্সন ও হার্ডি বিক্ষোভকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রচার করতে থানে। নেভিন্সন ছিলেন মানচেষ্টার গার্জেনের কলকাতাস্থ রিপোর্টার ও কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ লোক। তিনি বিলেতে এক কৌতুকপ্রদ সংবাদ পরিবেশন করেনঃ ‘জাতীয় অন্যায়ের বার্ষিকী পালনটা ভারতের ‘ভস্মবধূবারে’ পরিণত হয়েছে। এদিন সগস্র সহস্র ভারতীয় কপালে ভস্মের তিলক ধারণ করে। প্রভাতে তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে নীরবে গংগাস্নান করে ও উপবাস করে। গ্রাহে, শহরে, বাজারে সব দোকানপাট বন্ধ করে, স্ত্রীলোকেরা রান্না করে না ও অরংকার প্রসাধন ত্যাগ করে। পুরুষগণ পরস্পর হাতে হলদে সুতার রাখীবন্দ করে লজ্জার এ দিনটিকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে এবং সারাদিনটি প্রায়শ্চিত্তে, শোক পালনে ও উপবাসে কাটায়। (The new Spirit of India, pp-167-70)
জনৈক ব্যারিস্টার আবদুর রসূল ও কতিপয় মুসলমান ব্যক্তিগত স্বার্থে এ আন্দোলনে যোগদান করেন। সেটাকে ফলাও করে বলা হয়, বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রগায়ই শরীক ছিল। এ সম্পর্কে আবদুল মওদূদের প্রকাশিত তথ্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেনঃ
“মিঃ রসূল ১২৫ টাকা, নোয়াখালীর লিয়াকত হোসেন ৬০টাকা ও মাদারীপুরের জনৈক দিলওয়ার আহমদ ৪০ টাকা মাসিক ভাতায় কংগ্রেস কর্তৃক মুসলমানদের নিকট আন্দোলন প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন, সমসাময়িক পুলিম রিপোর্টে দেখা যায়। রিপোর্টে দেখা যায়। রিপোর্টে স্পষ্টভাবে লেখা ছিলঃM r. Rasul is a Muslim Leader of the Hindus (মিঃ রসূল হিন্দুদের মুসলমান নেতা।)
-(আবদুল মওদূদ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর পৃঃ ২৮২)
মজার ব্যাপার এই যে, ১৯০৭ সালের শেষের দিকে মিঃ হার্ডি এ দেশে আসেন আন্দোলন দেখার জন্যে। তিনি বাংলায় পৌঁছলে ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকা প্রচার করে, “লোকে তাঁকে দেখে আনদ্দে উন্মত্ত হয়েছে। এবং ঈশ্বর তাঁকে হিন্দুর বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে প্রেরণ করেছেন”।
এভাবে হিন্দুদের নিকেট ‘ঈশ্বর প্রদত্ত দেবতা’ হার্ডি তাদের অসীম শ্রদ্ধা ও গরম গরম সম্বর্ধনা লাভ করে দেশে ফিরে গিয়ে বলেন –হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় বংগভংগ বিভাগের তীব্র বিরোধী। সিরাজগঞ্জে তিনি মুসলমানদের মুখে ‘বন্দোমাতরম’ গাণ শুনেছেন, বরিশালে হিন্দু মুসলমান উভয়ে তাঁকে এ গান শুনিয়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু ইংলিশম্যান পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে দু’একজন মুসলমানের নাম করতে বললে তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত গোপনীয়। তার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে আবদুর রষূলের নামটাও হয়তো তার জানা ছিল না। টাইমস পত্রিকা তাঁকে তীব্র ভৎসতা করে ও অন্যান্য সংবাদপত্রে তাঁকে ‘মূর্খ’, ‘হাস্যম্পদ’, ‘বিদূষক ও পাগল’ উপাধিতে ভূষিত করে।
-(আবদুল মওদূদঃ ঐ পৃঃ ২৮২-৮৩)
বিভাগ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের যে সমর্থন ছিল না তার জ্বলন্ত প্রমাণ ঢাকার খাজা সলিমুল্লাহ ও মুসলিম বাংলার তৎকালীন উদীয়মান নেতা এবং পরবর্তীকালের শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বক্তৃতা বিবৃতি। বংগভংগ রদ ঠেকাবার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে খাজা সলিমুল্লাহ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং ১৯১২ সালের মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি যে উক্তি করেন তাতে বাংলার মুসলমানদের অসন্তোষ বিক্ষোভই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেন যে, বংগভংগ রদের ফলে বিষাদের সঞ্চার হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, বগভংগের ফলে অনুন্নত পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মনে চরম আঘাত লেগেছে এবং তাদের ঘরে ঘরে বিষাদের সঞ্চার হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, বংগভংগের ফলে অনুন্নত পূর্ব বাংলা ও আসামের অবহেলিত অধিবাষীগণ যে সুযোগ পেয়েছিল এবং বিশেষ করে মুসলমানদের উন্নতির যে সুযোগ পেয়েছিল, এবং বিশেষ করে মুসলমানদের উন্নতির যে সুযোগ তা সহ্য করতে না পেরে বিভাগ বিরোদীরা বংগভংগ বানচাল করার জন্যে রাজদ্রোহিতা মূলক ষড়যন্ত্রের আশ্রায় গ্রহণ করে। এতে করে, তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার এ আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছেন। নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন “এতদিন সমগ্র প্রাচ্যে মনে রকা হতো যে যাই ঘটুক না কেন ব্রিটিশ সরকার কখনো প্রতিশ্রুতি ভংগ করেন না। যদি কোন কারণে এ বিশ্বাস খর্ব হয়, তাহলে ভারতে ও প্রাচ্যে ব্রিটিশের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে”।
-(ডঃ এম এ রহিমঃ বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃঃ ২০৯-১০, A Hamid Muslim Separatism in India, pp.94-95)
নবাব সলিমুল্লাহ উক্ত অধিবেশনে আরও বলেনঃ
“বাংলা বিভাগে আমরা তেমন বেশী কিছু লাভ করিনি। কিন্তু তবুও তা আমাদের দেশবাসী অন্য সম্প্রদায়ের সহ্য হলো না বলে তারা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে আকাশ-পাতাল আলোড়ন সৃষ্টি করলো। খুন খারাবি ও ডাকাতির মাধ্যমে তারা প্রতিশোধ নেয়া শুরু করলো। তারা বিলেতী দ্রব্যাদি বর্জন করলো। এ সবকিছুই সরকারের কাছে অর্থহীন ছিল। মুসলমানরা এসব অপরাধ যজ্ঞে শরীক না হয়ে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। …মুসলিম কৃষক সম্প্রদায় এ বিভাগে লাভবান হয়েছিল। তাদের হিন্দু জমিদারগণ তাদেরকে বিরোধিতার সংগ্রামে টেনে আনবার চেষ্টা করে। এতে তারা কর্ণপাত করেনি।…
এতে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ বাধে। …সরকার দমননীতি অবলম্বন করেন। তাতেও লাভ হয়নি। একদিকে ছিল ধনশালী বিক্ষুব্ধ সম্প্রদায়। অপরদিকে ছিল দরিদ্রমুসলমান –যারা সরকারের পক্ষ অবলম্বন করে। এভাবে চলে বছরের পর বছর। হঠাৎ সরকার বংগভংগ রদ করে দেন প্রশাসনিক কারণে। ….এর আগে আমাদের সাথে কোন পরামর্শও করা হয়নি। আমরা সব কিছু নীরবে সহ্য করেছি”। অতঃপর সরকার দিল্লী দরবারে তাঁকে যে জি সি আই ই উপাধিতে ভূষিত করেন, তার জন্যে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে এ উপাধিকে ঘুষ ও তাঁর গলায় অপমানের বন্ধন বলে গণ্য করেন। (A Hamid Muslim Separatism in India, p.92; আহমদঃ রুহে রওশন মুস্তাকবেল, পৃঃ ৫৮-৫৯)
পরবর্তীকালে মওলানা মুহাম্মদ আলী বলেনঃ
পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে তাদের শাসকদের যুদ্ধে নামানো হ’য়েছিল…
…এবং যখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আর সুবিধাজনক রইলো না, তখন তারা সন্ধি করে বসলো সুবিধাজনক গতিতে।
ইতিহাসের এর চেয়ে ঘৃণ্যতর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, আনুগত্যের পুরস্কারস্বরূপ সদ্যলব্ধ অধিকারসমূহ কেড়ে নেওয়া হলো এবং সন্তোষ প্রকাশকে চরম অপরাধ গণ্য করে শাস্তি দেয়া হলো।
(Iqbal Select Writings and Speeches, p.262)
বংগভংগের ফলে পূর্ববাংলার হতভাগ্র মুসলমানদের সুযোগ সুবিধার আশার আলোক দেখা দিয়েছিল। বংগভংগ রদ করে তা নস্যাৎ করার যে তীব্র আন্দোলন শুরু করেছিল হিন্দুবাংলা, তাতে দূরদর্শী মুসলিম রাজনীতিবিদগণ আতংকিত হয়ে পড়লেন। হিন্দুদের চক্রান্ত উন্মোচন করে বাংলা তথা ভারতের মুসলিম স্বার্থ সমুন্নত করার জন্যে ভারতের সকল মুসলমান চিন্তাশীল ও রাজনীতিবিগণ চেষ্টা করতে লাগলেন। ১৯০৬ সালে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা শহরে নিখিলভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন নাম দিয়ে এক সম্মেলন আহবান করেন। মুসলমানদের সংকট মুহুর্তে এমন সম্মেলনের প্রয়োজনীয়তা সকলে উপলব্ধি করলেন এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আট হাজার প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুহসিনুল মুলক, ভিখারুল মুলক, আগা খান, হাকিম আজমল খান ও মওলানা মুহাম্মদ আলী। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে একটি পৃথক দল গঠিত হয়। কারণ বিভাগ বিরোধী আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাজে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে এ দলটির লক্ষ্য শুধু হিন্দুস্বার্থ সংরক্ষণ ও মুসলিম স্বার্থ দলন। বিভাগকে বানচাল করার জন্যে নানান অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। কোলকাতায় বর্ণহিন্দুদের ঘনো ঘনো বৈঠকে আলোচানর পর ঘোষণা করা হয়, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বাঙালী জাতিকে নির্মূল করার জন্যে বংগমাতাকে দ্বিখন্ডিত করেছে, বাঙালী কৃষককুলকে আসামের চা বাগানে কুলিমজুর হিসাবে নিয়োগ করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। অতএব হে বাঙালী জাতি। ‘বংগভংগ রদকে’ বাঙালীর ‘মুক্তি সনদ’ হিসেবে গ্রহণ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়। যারা ‘মুক্তি সনদে’ বিশ্বাসী নয় তারা বাঙালী নয়, বিশ্বাসঘাতক ও ইংরেজের দালাল। মুসলিম লীগ অধিবেশনে নবাব সলিমুল্লাহর উপর অর্পিত হলো বাংলার মুসলমানদেরকে হিন্দুদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘মুক্তিসনদ’ আন্দোলন থেকে দূরে রাখার দায়িত্ব। ফলে বর্ণহিন্দুদের সমস্ত আক্রোশ গিয়ে পড়লো খাজা সলিমুল্লাহর উপর। শুরু হলো ফ্যাসিবাহী ও সন্দ্রাসবাদী কার্যকলাপ। খাজা সাহেব বরিশাল ভ্রমণ করলে তাঁকে কালো পতাকা দেখানো হয়, তাঁকে ইংরেজের দালাল, ‘বাংলার দুশমন’ বলে গালি দেয়া হয়। কুশিল্লাহর জনসভায় তাঁকে আক্রমণ করা হয়। তাঁকে নিয়ে হোসামিয়া মাদ্রাসার ছাত্রশিক্ষক ও মুসলিম জনগণ শোভাযাত্রা করা কালে যোগীরাম পাল নামক জনৈক হিন্দু কর্তৃক একটি দোতলার বারান্দা থেকে একটি ঝাড়ু দেখিয়ে দেখিয়ে অপমান রকা হয়। রাজগঞ্জের রাস্তা অতিক্রমকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলী ছোড়া হয়। তিনি প্রাণে রক্ষা পেলেও সাঈদ নামে জনৈক যুবক প্রাণ হারায়। বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বাহ্যতঃ ইংরেজদের বিরুদ্ধে হলেও এর দ্বারা ‘এক ঢিলে দুই পাখী’ মারার লক্ষ্যই আন্দোলনকারীদের ছিল। অর্থাৎ মুসলমানদেরকে ইংরেজ দালাল হিসাবে চিত্রিত করে তাদের নির্মূল করা এবং ইংরেজদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া।
১৯০৮ সালে ৩০শে মে কোলকাতার যুগান্তর পত্রিকা হিন্দুদের প্রতি এক উদাত্ত আহবান জানিয়ে বংগমাতার খন্ডনকারীদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। বলা হয় “মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে, একমাত্র কোন বস্তু তার পিপাসা নিবারণ করতে পারে। মানুষের রক্ত এবং ছিন্ন মস্তক ব্যতিত অন্য কিছুই তাকে শাস্ত করতে পারে না। অতএব জননীর সন্তানদের উচিত মায়ের পূজা করা এবং তার ইপ্সিত বস্তু দিয়ে সন্তুষ্টি বিধান করা। এসব হাসিল করতে যতি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে হয়, তবুও পশ্চাদপদ হওয়া উচিত হবে না। যেদিন গ্রামে গ্রামে এমনিভাবে মায়ের পূজা করা হবে, সেদিনই ভারতবাসী স্বর্গীয় শক্তি ও আশীর্বাদে অভিষিক্ত হবে”।
-(ইবনে রায়হানঃ বংগভংগের ইতিহাস-পৃঃ ৬-৭)।
বংগমাতাকে খুশী করার জণ্যে যে উদাত্ত আহবান জানানো হলো, তার পর শুরু হলো হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও রক্তের হোলিখেলা।
মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর ‘আমাদের মুক্তি সংগ্রাম’ গ্রন্থে বলেন “কলিকাতা এবং ঢাকাকে কেন্দ্র করিয়াই প্রধানতঃ বিপ্লব আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিল। কলিকাতার বিপ্লববাদীরা ‘যুগান্তর’ এবং ঢাকার বিপ্লববাদীর ‘অনুশীলন’ নাম দিয়া তাহাদের গঠন করেন। সাধারণতঃ এই দুইটি সমিতির সদস্যগণই বোমা তৈরী ও অগ্নেয়াস্ত্র আমাদনীর ব্যবস্থা করিতেন। ইহার পর অন্যান্য নামেও মফঃস্বলের কোন কোন স্থানে গুপ্ত সমিতি গঠিত হইয়াছিল”।
-(মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহঃ আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃঃ ১৮০)
স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বংগভংগের তীব্র নিন্দা করে বলেন, বাংলাদেশ বিভক্ত কের হিন্দুদেরকে অপমান ও অপদস্ত করা হয়েছে। বংগভংগের প্রতিবাদে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯০৬ সালের ৭ই আগষ্ট স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে। বিলাতী দ্রব্য বর্জন করা হয় এবং আগুন লাগানো হয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ শিক্ষাংগন পরিত্যগ করে। বালগংদাধর তিলক বংগভংগের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তা জাগ্রত ও সুসংহত করার জন্যে মারাঠা নায়ক শিবাজীকে ভারতের সকল হিন্দুদের জাতীয় বীরের আসনে প্রতিষ্ঠার আয়োজন করেন। দেশের সর্বত্র শিবাজীর জন্মবার্ষিকী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিপালিত হয়। সভায় সভায় কংগ্রেসের নেতাগণ মুসলমান সম্রাটের বিরুদ্ধে শিবাজীর সংগ্রামের প্রশংসা করতে থাকেন। শিবাজীকে হিন্দুদের জাতীয় বীর ও তাঁর সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন। এ সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা গড়ে উঠে। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদেরকে হত্যা করে বংগভংগ রদ করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য। -(এম এ রহিমঃ বাংলামর মুসলমানদের ইতিহাস, পৃঃ ২০৫-৬; সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিঃ নেশন ইন মেকিং, ১৮; এ হামিদঃ মুসলিম সেপারেটিজম ইন ইন্ডিয়া, ৫৭, ৬৯-৭০)।
বংগভংগের পর হিন্দুবাংলা মুসলমানদের প্রতি এতখানি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে যে সংবাদপত্রে এবং জনসভায় মুসলমানদের প্রতি নানারূপ অসম্মানকর ও বিদ্রুপাত্ম বিশ্লেষণ প্রয়োগ করা হতে থাকে। মুসলমানদের অতীত বর্বরতার বিবরণসহ কল্পিত ইতিহাস লিখিত হয়। সাইয়েদ আহমদ খানকে দেশদ্রোহী এবং মুসলমানকেরদে ইংরেজের দালালরূপে চিহ্নিত করা হয়। ….প্রতিদিন সংবাদপত্রে এ ধরনের সংবাদ পরিবেশ করা হয় যে, সরকার হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালাতে মুসলমাদেরকে উত্তেজি করছেন এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উপেক্ষা প্রদর্শন করছেন। আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার জন্যে হিন্দুদেরকে আহবান জানানো হয়। একটি সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত বলে যে মুসলিম গুন্ডাদেরকে এবং তাদের সাহায্যকারী সরকারী কর্মচারীদেরকে জীবন্ত দগ্ধিভূত করলেও হিন্দু সমাজের প্রতিশোধ গ্রহণ যথেষ্ট হবে না। -(Khan, India of today, p.87; A Hamid Muslim Separatism in India, p.61)
মিঃ এন সি চৌধুরী বলেন, বংগভংগ হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক চিরদিনের জন্যে বিনষ্ট করে দেয় এবং বন্ধুত্বের পরিবর্তে আমারেদ মনে তাদের জন্যে ঘৃণার উদ্রেক করে। রাস্তাঘাটে, স্কুলে, বাজারে সর্বত্র এ ঘৃণার ভাব পরিস্ফুট হয়। স্কুলে হিন্দু ছেলেরা মুসলমানদের নিকটে বসতে ঘৃণা প্রকাশ করে এই বলে যে তাদের মুখ থেকে পিঁয়াজের গন্ধ বেরুচ্ছে। মিঃ চৌধুরী বলেন যে, তিনি স্কুলে গিয়ে এ আচরণ স্বচক্ষে দেখেছেন। ফলে ক্লাশে হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক পৃথক আসনের ব্যব্স্থা করা হয়। তিনি আরও বলেন, “আমরা লেখাপড়া শিখবার আগেই আমাদেরকে বলা হতো যে এককালে মুসলমানরা এ দেশ শাসন করতে গিয়ে আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। এক হাতে কোরআন এবং অন্য হাতে তরবারী নিয়ে এ দেশে তারা ইসলাম জারী করেছে।মুসলমান শাসকগণ আমাদের নারী হরণ করেছে, মন্দির ধ্বংস করেছে, আমাদের ধর্মীয় স্থানসমূহ অপবিত্র করেছে। অতএব বংগভংগই মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করেনি। এ ছিল বহু পূর্ব থেকেই। বংগভংগ তা বর্ধিত করেছে মাত্র।
-(N.C. Chowdhury: The Auto-biography of an Unknown Indian pp.227, 230; Zuberi TAZKIRA WADAR, p.169-70; A Hamid: Muslim Separatism in India, pp.61-62)
বংগভংগ রদ করার জন্যে উভয় বাংলার হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়েছে বলে বিকৃত, কাল্পনিক ও উদ্ভট ইতিহাস পরিবেশন করে পরবর্তী বংশধরগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। এ কথাও বলা হয় যে, এক খাজা সলিমুল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন বাংগালী মুসলমা বংগভংগ মেনে নেয়নি। এ প্রকৃত সত্যের অপলাপ ব্যতীত কিছু নয়। উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বংগভংগের ফলে অবহেলিত মুসলমান সমাজের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বলে হিন্দুবাংলা নিছক হিংসা পরবশ হয়ে বিভাগ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তাদের বক্তৃতা বিবৃতি, তাদের আচরণ, মারাঠা নেতা শিবাজীকে দৃশ্যপটে টেনে এনে হিন্দু জাতীয়তা জাগ্রত করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি হিন্দু মুসলিম ঐক্য ও মিলনকে নস্যাৎ করে দিয়েছে, চারদিকে দাংগা হাংগামা শুরু হয়েছে, মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু হয়েছে। এতসবের পর হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে বংগভংগ রদ করেছে এ কথা বলা মস্কিষ্ক বিকৃতিরই পরিচায়ক অথবা দুরভিসন্ধিমূলক সন্দেহ নেই।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বংগভংগের ফলে বাংলায় যে সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছিল বাংলার হিন্দুগণ, যার প্রতি মুসলমানদের কোন সমর্থণ ছিল না, বরঞ্চ মুসলমানদের জীবন ও ধনসম্পদ বিপন্ন হয়েছিল, সে সন্ত্রাসবাদ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে এবং সে সংকটসদ্ধিক্ষণে মুসলমানদের কর্তব্য নির্ধারনের জন্যে ১৯০৬ সালে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন আহুত হয়। এ সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত করার পিছনে বাংলার মুসলমাদের তৎকালীন উদীয়মান নেতা আবুল কাসেম ফজলুল হকের অবদান চিল সবচেয়ে বেশী। উক্ত সম্মেলনের জন্যে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয় তার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন এ, কে, ফজলুল হক ও ভিখারুল মুলক। সম্মেলনকে জয়যুক্ত করার জণ্যে ৩৩ বৎসর বয়স্ক যুবক এ, কে, ফজলুল হক প্রভূত উৎসাহ উদ্যমসহ সারা ভারত সফর করেন যার ফলে সম্মেলনে ৮০০০ প্রতিনিধি যোগদান করেন। এ সম্মেলনেই বাংলা তথা সারা ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে এবং জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বলতে গেলে বংগভংগের ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে হিন্দু বিদ্বেষ, ক্রোধ ও প্রতিহিংসার বহ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল, তাই মুসলিম লীগের জন্ম দিয়েছিল। ফজলুলহক তার পর কোন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। কারণ ১৯০৬ সালেই তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত সরকারী চাকুরী করেন। ১৯১১ সালে চাকুরী ইস্তফা দেয়ার পর খাজ সলিমুল্লাহর পরামর্শক্রমেই তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৩ সালে বংগীয় ব্যভস্থাপক সভায় সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকা বিভাগ নির্বাচনী এলাকা থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রায় বাহাদুর কুমার মহেন্দ্র মিত্রকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জয়যুক্ত হন। অতঃপর ব্যবস্থাপক সভার প্রথম বাজেট অধিবেশনে তাঁর প্রথম বক্তৃতায় বিভাগ রদের তীব্র সমালোচনা করেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে এ কে ফজলুল হককে বাদ দিয়ে বাংলার মুসলমান বলে আর কিছু চিন্তা করা যায় না। অতএব তিনি যখন বংগভংগের সপক্ষে ছিলেন এবং বংগভংগ রদের বিরুদ্ধে বংগীয় ব্যবস্থাপক সভায় প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন তখন এ কথা অবিশ্বাস্য, হাস্যকর ও চিন্তার অতীত যে হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে বংগভংগ রদ আন্দোলন পরিচালনা করে। বংগীয় ব্যবস্থাপক সভায় এ কে ফজলুল হক সাহেবের বক্তৃতায় এ কথা অধিকতর সুস্পষ্ট হয় যে বংগভংগ রদ ছিল মুসলমানদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং এর দ্বারা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করা হয়। ১৯১৩ সালে ৪ঠা এপ্রিল, বংগীয় ব্যবস্থাপক সভার ১৯১৩-১৪ সালের বাজেট অধিবেশনে বাংলার মুসলমানদের জনপ্রিয় নেতা জনাব এ কে ফজলুল হক তাঁর প্রথম বক্তৃতায় বলেন,
“I would like only remind the offocials that they are in honour bound to render adequate compensation to the Muslim Community for all the grievous wrong inflicted on them by the unceremonious annulment of the partition Our share we claim as our indivisible right, and the excess we claim by way of compensation for wrong done to us by the annulment of the pertition. This is the view of the general Muslim public, and if the officials will not meet the demands in full, there is certain to be discontent in the community.”
-(Budge Speech of Mr. A.K. Fazlul Huq. Bengal Legislative Council, dated 4th April, 1913 Bangladesh Historical Studies-Journal of the Bangladesh Itihash Samiti, vol 1, 1976, p.148)
_আমি সরকারী কর্মচারীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, লৌকিকতাহীনভাবে বংগভংগ রদ করে তাঁরা মুসলিম সমাজের প্রতি যে মর্মান্তক অত্যাচার করেছেন, তার যথোপযুক্ত ক্ষতিপুরণ দিতে তাঁর নীতিগতভাবে বাধ্য। ..অখন্ডনীয় অধিকার হিসাবে আমরা আমাদের অংশ দাবী করছি এবং ক্ষতিপূরণ হিসাবে অতিরিক্ত দাবী আমরা এ জন্যে করছি যে বিভাগ রদ করে আমাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। এ দাবী হচ্ছে মুসলিম জনসাধারণের এবং এ দাবী পূরণ করা না হলে মুসলিম সমাজের বিক্ষুব্ধ হওয়া সুনিশ্চিত”।
বাঙালী মুসলমানদের নেতা জনাব ফজলুল হকের উপরোক্ত বাজেট বক্তৃতায় বাংলার মুসলমান জনগণের অন্তরের কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে। বংগভংগ রদ করে মুসলমানদের প্রতি যে চরম অন্যায় করা হয়েছিল এবং এতদ্বারা মুসলমাগণ যে মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, সে বিক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল হক সাহেবের উপরোক্ত বক্তৃতায়। এর পর কি করে বলা যেতে পারে যে বংগভংগ ছিল মুসলমানদের কাছে অবাঞ্ছিত? এবং বংগভংগ রদের জন্যে তারা এমন শ্রেণীর সাথে হাত মিলিয়েছিল যাদের মুসমিল বিদ্বেষ এবং মুসলিম দলন নীতি ও কর্মসূচী বাংলা তথা সারা ভারতে দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল?
বংগবিভাগের পর হিন্দুদের একচেটিয়া স্বার্থ ও সুযোগ সুবিধা বিঘ্নিত হয়েছিল বলে গোটা হিন্দু বাংলা, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, এবং বলতে গেলে সারা ভারতের হিন্দুজাতি এ বিভাগ বানচাল করার জন্যে যেভাবে স্বর্গমর্ত আলোড়ন শুরু করেছিল এবং একসাথে মুসলিম ও ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ শুরু করেছিল, তাতে ইংরেজগণ অতিমাত্রায় বিচলিত ও বিব্রত হয়ে পড়েন কাতরণ ভারত ও বাংলার প্রকৃত অবস্থা তাদের জানার উপায় ছিল না। লন্ডনের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বাংলা ও ভারতের ঘটনা প্রবাহের বিপরীতমুখী সংবাদ পরিবেশন করা হতো। উপরন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস একজন ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বহু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কংগ্রেসের সদস্য হওয়ায় স্বভাবতঃই তাঁদের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল কংগ্রেস তথা হিন্দুজাতির সপক্ষে।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যে নির্বাচর অনুষ্ঠিত হয়, তাতে হাউস অব কমন্সে বেশ কিছু সংখ্যক এমন লোক নির্বাচিত হন যাঁরা ছিলেন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। তাঁরা বংগভংগ বিরোধী আন্দোলনের সাথে গভীর যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন এবং পার্লামেন্টে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপন করে সরকারকে বিব্রত করে তোলেন। স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন (William Wedderburn) নামক তাদেঁর একজন ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টারী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ দলের আর একজন সদস্য, স্যার হেনরী কটন, ভারতীয়দের আশা-আকাংখার প্রতিনিধিত্ব করে গর্ববোধ করেন। এ সমস্ত সদস্যগণ বার বার একথাই বলতে থাকেন যে ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ হচ্ছে উভয় বাংলাকে এক করে দেয়া। পার্লামেন্টের জনৈক সদস্য লন্ডন থেকে তাঁর জনৈক ভারতীয় বন্ধুর নিকটে লিখিত একপত্রে এতখানি পর্যন্ত বলেন যে, “মর্লী নতি স্বীকার করবে, আন্দোলন করতে থাক”। পত্রকানি বাংলার সংবাদপত্রে স্থান লাভ করে এবং তার ফরে আন্দোলন ক্রমশঃ জোরদার হতে থাকে। -(S.M. Mitra, Indian Problems, p 72, Murray, London, 1908; A Hamid: Muslim Seoaratism in India, p.66)
শ্রমিক দলের দুজন নেতা, রামজে ম্যাকডোনাল্ড এবং কিয়ার হার্ডি (Keir Hardie) শাস্তি মিশনের নামে ভারত সফরে আসেন। ভারতীয় কংগ্রেস তাদের সফরের কর্মসূচী তৈরী করে সর্বত্র তাদেরকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করে। ম্যাকডোনাল্ড ছয় সপ্তাহ ভ্রমণের পর মন্তব্য করেন যে, বংগ বিভাগ মারাত্মক ভুল হয়েছে। তিনি জনৈক হিন্দুকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে ব্রিটিশ সরকার তাদের কথা মেনে না নিলে শ্রমিক দলের সদস্যগণ মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করবে না। হার্ডি দু’মাস কাল ভারতে অবস্থান করেন। তাঁর সফরসূচি ও বক্তৃতা বিবৃতি কোলকাতার হিন্দু সংবাদপত্র সমূহ ফলাও করে প্রকাশ করতো। তিনি বলেন পূর্ব বাংলার অবস্থা রাশিয়া থেকেও মর্মন্তুদ। এখানে হিন্দুদের উপর চরম নির্যাতন চলছে। তিনি প্রায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ করেন যে তারা হিন্দু বিধবাদের শ্লীলতাহানি করছে। এতে করে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। তিনি প্রতিটি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যে ঈশ্বর হার্ডিকে পাঠিয়েছেন”। হার্ডি ইংলন্ডে ফিরে গিয়ে প্রস্তাব করেন যে, ভারতীয় অভাব অভিযোগের প্রতি সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে ভারতীয় কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।
-(A Hamid Muslim Separatism in India, 67. The Times Edition, London, Oct. 1907, January-April, 1908, December 1910)
লর্ড ম্যাকডোনাল্ড, যিনি চরম মুসলিম বিদ্বেষী বলে পরিচিত ছিলেন, বংগ বিভাগকে পলাশী ক্ষেত্রে ক্লাইভের বিজয়ের পর প্রশাসন ক্ষেত্রে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের মারাত্মক ভুল বলে অভিহিত করেন। (Times Weelky Edition London January 1908, p-4)
১৯১০ সালের শেষের দিকে বড়োলাট কার্জনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে এলেন লর্ড মিন্টো। পরের বছর যুবরাজ জর্জেল (পরবর্তীকালে রাজা পঞ্চম জর্জ) ভারত সফরের কথা। বংগভংগের জন্যে বিক্ষুব্ধ হিন্দুগণ যতি তাঁর সফরকালে কোনরূপ অবাঞ্ছিত আচরণ প্রদর্শন করে তাহলে যুবরাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হবে এবং ভারত সরকারের দুর্নাম হবে এ আশংকায় লর্ড মিন্টো অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। অতএব তিনি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি এবং গোখলের সাথে চিন্তিত হয়ে পড়েন। অতএব তিনি সুরেন্দ্রতনাথ ব্যানার্জি এবং গোখলের সাথে সাক্ষাত করে একথাই বুঝাবার চেষ্টা করেন যে বংগভংগের জন্যে তিনি মোটেই দায়ী নন। তিনি আলাপ আলোচনায় তাঁদেরকে অনেকটা শান্ত করেন। ফলে মিন্টো বিভাগকে পুরাপুরি কার্যকর করার ব্যাপারে ততোটা মনোযোগ দিতে পারেননি। কিন্তু এ সময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার জন্যে পূর্ব বাংলার গভর্নর ফুলার মোটে দায়ী না হলেও তাঁকেই কেন্দ্র করে বিভাগ বিরোধী আন্দোলন পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ঘটনাটি হলো এই যে, হত্যাকান্ডের অপরাধে নিম্ন আদালত জনৈক উদয় পান্ডের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে। ইংলন্ডে হাউস অব কমন্সে প্রশ্নটি উত্থাপিত হলে বারত সচিব এমন জবাব দান করেন যাতে ফুলারের প্রতি দোষারূপ করা হয়। ফুলারকে সমর্থন করারও কেউ থাকে না। এ বিভাগবিরোধী আন্দোলনে ইন্ধন যোগায়। একটি স্কুলের উত্তেজিত একদল ছাত্র জনৈক ইংরেজ ব্যাংক কর্মচারীকে আক্রমণ করে এবং বিলেতী বস্ত্র বোঝাই একটি গো-গাড়ীর উপর হামলা চালায়। সরকারী নিয়ম নীতি অনুযায়ী স্কুলটিকে অনুমোদিত স্কুলের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্যে ফুলার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটকে অনুরোধ জানান। ভারত সরকার এটাকে অবিবেচনাপ্রসূত মনে করে ফুলারকে তাঁর অনুরোধ প্রত্যাহার করতে বলেন। এতে করে প্রাদেশিক গভর্নরের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে বলে ফুলার ভারত সরকারের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান। অন্যথায় তিনি চাকুরী থেকে ইস্তাফা দেয়ারও হুমকি দেন। বড়োলাট তাঁর কথায় অটল থাকলেন এবং ফুলারকে ইস্তাফা দিতে হলো। বড়োলাট সংগে সংগেই তাঁর ইস্তাফা মঞ্জুল করলেন। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে ফুলারের অপসারণে অবস্থার কোনই উন্নতি হলো না। আন্দোলন শতগুণে বর্ধিত হলো। ফুলারের অপসারণ বারুদের স্তূপে অগ্নি সংযোগের ন্যায় কাজ করলো। বিভাগ বিরোধী আন্দোলনকারীগণ যেন নতুন উৎসাহ, উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করলো। বলতে গেলে আন্দোলনকারীদের সাদা চামড়ার মুরব্বীগণ লন্ডন থেকেই যুদ্ধের নাকাড়া বাজাচ্ছিলেন। ভারতীয় হিন্দু কংগ্রেসের বন্ধুমহল ত আছেই, ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্যও আছেন এবং তাদের সংগে প্রত্যক্ষে না হলেও পরোক্ষ যোগ দিলেন ভারত সচিব মোর্লি। বংগভংগ রদের জন্যে ভারতের হিন্দুদেরকে তাঁরা নাচাতে শুরু করলেন।
উল্লেখ্য যে ১৮৮৫ সালে জনৈক ইংরেজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯০৫ সালের পূর্বে ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। ‘স্বরাজের’ কথাও তাদের মনের কোণে স্থান পায়নি কোন দিন। দয়ানন্দ সরস্বতীর ‘আর্য সমাজ’ রাজা রামমোহন রায়ের ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠাগুলি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ইংরেজ প্রভুদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি কখনো। বরঞ্চ বাংলার হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে বলা হতো, “আমরা পরমেশ্বরের সমীপে সর্বদা প্রার্থনা করি, পুরুষানুক্রমে যেন ইংরেজাধিকারে থাকিতে পারি। ভারত ভূমি কত পূণ্য করিয়াছিল এই কারণে ইংরেজ স্বামী পাইয়াছে”। -সংবাদ ভাস্কর ২০শে জুন, ১৮৫৭, কলিকাতা- Society for Pakistan Studies প্রকাশিত ‘সিপাহী বিপ্লব ও বাঙালী হিন্দু সমাজ’ এর সৌজন্যে।
১৯০৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত সমাজ ইংরেজদের প্রতি এরূপ মনোভাবই পোষণ করে আসতো। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বাংলা তথা ভারতের মুসলমানগণ ইংরেজ ও হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল। কিন্তু বংগভংগের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য উন্নয়নের কিছু লক্ষণ দেখতে পাওয়া গেল বলে হিন্দু সমাজ ঈর্ষায় ফেটে পড়লো। বংগভংগ রদ করার তীব্র আন্দোলনে মেতে উঠলো হিন্দুবাংলা। Glipses of old Dhaka গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ “This Sinister movement was sponsored and conducted by babus Surendra Nath Banarjee (afterwards knighted) and Bepin Chandra Pal, leader and demagogue of Hindu youths. The started boycotting and burning British made goods on account of which the mills of Lancashire were affected. The terrorists and their secret organizations began to harass the English people by the use of bomb and revolver. This education gangster committing dcoities in order to create a sense of insecurity in the country (Glimpses of old Dhaka, p/XXVII).
“এ অশুভ আনেআলনের উদ্যোক্ত ও পরিচালক ছিলেন হিন্দু যুব সম্পদায়ের নেতা বাবু সুরেন্দ্র ব্যানার্জি (পরবর্তীকালে নাইট খেতাবপ্রাপ্ত) এবং বাবু বিপিনচন্দ্র পাল। তাঁরা বিলাতী দ্রব্যাদি বর্জন ও জ্বালিয়ে দেয়ার কাজও শুরু করেন যার ফলে ল্যাঙ্কাশায়ারের কলকারখানাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। সন্ত্রাসবাদীরা এবং তাদের গোপন সংস্থাগুলি বোমা ও রিভললভারের আক্রমণে ইংরেজদেরকে ব্যতিব্যস্ত করা শুরু করলো। তাদের শিক্ষিত গুন্ডাবাহিনী দেশের মধ্যে নিরাপত্তার ব্যাঘ্যাত ঘটাবার জন্যে দস্যুবৃত্তিও শুরু করে দিল”।
অন্যতম সন্ত্রাসবাদী বারীন্দ্র কুমার ঘোষ লন্ডন থেকে কোলকাতায় এলেন ১৯০৪ সালে যখন বাংলা বিভাগের পরিকল্পনা পাকাপোক্ত হয়েছিল। পরের বৎসর এলেন তাঁর ভাই অরবিন্দ। ‘বংগমাতার’ অংগচ্ছেদ বলে বংগভংগের ধর্মীয় রূপ দেয়া হলো। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে মেতে উঠলো সমগ্র হিন্দুবাংলা।
সারা ভারতের হিন্দুদের মুসলিম বিদ্বেষ শতগুণে বর্ধিত হলো আরও দুটি কারণে। এতদিন পর্যন্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কে কথা বলার কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। বাংলা বিভাগ বিরোধী আন্দোলন ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে মুসলমাদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিল। এ বৎসরেই ১লা অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে নেতৃস্থানীয় ৩৬ জন মুসলমানের একটি প্রতিনিধিদল বড়োলাটের সাথে সাক্ষাত করে মুসলমানের জন্যে পৃথক নির্বাচনের দাবী জানান। বড়োলাট সম্মত হন এবং তারপরও বহু চাপ সৃষ্টির ফলে এবং সৈয়দ আমীর আলীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯০৯ সালে পৃতক নির্বাচন পদ্ধবি বৃটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হয়। মুসলমানদের পৃথক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম লীগ’ এবং মুসলমানদেরজ জন্যে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা –এ দুটি বস্তু সারা হিন্দু ভারতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে সন্ত্রাসবাদ ও ‘স্বরাজ’ আন্দোলন একসাথেই সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।তাদের প্রথম লক্ষ হলো বংগভংগ বানচাল করা। দ্বিখন্ডিত ‘বাংলা মা’কে পুনর্জীবিত ও সন্তুষ্ট করার জন্যে মানুষের মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হলো। বোমা বিস্ফোরনে সরকারী অফিস আদালত ধ্বংস করা, সভা সমিতি বানচালক রা, খুন জখম, লুটতরাজ প্রভৃতি চলতে থাকলো পূর্ণ উদ্যমে। মেনিদীপুরের ক্ষুদিরাম ও বগুড়ার প্রফুল্ল চাকী এসব ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ডে আত্মনিয়োগ করলো। বিভাগ বিরোধী আন্দোলন কেউ সমর্থন কা করলে তার আর রক্ষা ছিল না। গুন্ডামী ও হত্যাকান্ডের সমালোচনা করলেও তার মুন্ডপাত করা হতো। এসব কারণে জনৈক হিন্দু সরকারী উকিলকে ১৯০৯ সালে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯১০ সালে ডি এস পি শামসুল আলমকেও হত্যা করা হয়। বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নরকে চার চার বার আক্রমণ করা হয়। ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এলেনের উপর হাতবোমা নিক্ষেপ করা হয়।
বংগভংগ সমর্থনকারী মুসলমানদের বিরুদ্ধে এসব সন্ত্রাসবাদীরা ছিল খড়গহস্ত। আবার নিরীহ ও সরলপ্রকৃতির কিছু মুসলমানদেরকে বিভাগ বিরোধী আন্দোলনে ভিড়াবার জন্যে হিন্দুগণ অন্যপথ অবলম্ব করলো। ‘বংগভংগের ইতিকথায়’ ইবনে রায়হান বলেনঃ
হিন্দু মেয়েরা মুসলমানদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে হিন্দু মুসলিম দুটি প্রাণ তথা দুই বাংলার মিলনের প্রতীক রাখী বন্ধনী পরিয়ে দিত মুসলমানদের হাতে, তাদের হৃদয় মন জয় করার জন্যে চারদিকে হতে ভেসে আসতো সুললিত কন্ঠের সুমধুর সুর-
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল।
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক
হে ভগবান।
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক
হে ভগবান।
-(বংগভংগের ইতিকথা, ইবনে রায়হান, পৃঃ ১০-১১)
নারী কণ্ঠের এ মনমাতানো উদাত্ত আহবানে কিছু মুসলমান বিভ্রান্ত হলো। তাদের মধ্যে ছিলো ব্রাহ্মণবাড়ীয়া নিবাসী সাকেব ব্যারিষ্টার আবদুল রসূল। তাঁর কথা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এসব আত্মপ্রবঞ্চিত মুসলমানদের ভুল ভেঙে গেল যখন তারা দেখলো সন্ত্রাসবাদীদের সাহিত্য ও প্রচার পুস্তিকাসমূহ –যা ভরপুর ছিল হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের উদাত্ত আহবানে। এর পুরোভাবে ছিল হিন্দু ব্রাহ্মণগণ এবং হত্যাকান্ড উৎসর্গীকৃত করা হতো। এ কাজ করা হতো গঙ্গাজ্যল স্পর্শ করে বিশিষ্ট মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে। নৃশংস হত্যকান্ডের জন্যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের অনুমোদন লাভ করা হলো এভাবে যে ‘ভগবৎগীতায়’ আছে, হিন্দুত্ব রক্ষার্তে নরহত্যা দূষণীয় নয়; বরঞ্চ পুন্য কাজ। ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের শপথ ্রহণ করা হতো কালীমন্দির প্রাংগণে। এভাবে এ বিভাগ বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চারিত হতো হিন্দু ধর্মের ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে। এসব লক্ষ্য করারপর কোন মুসলমানের পক্ষেই এ আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। (A Hamid Muslim Separatism in India. P.60)
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র নরহত্যা শুধু যে বৈধ তা নয়, বরঞ্চ তা অপরিহার্য। আমরা বিঙ্কমের কপালকুন্ডলায় দেখতে পাই কিভাবে হিন্দুতান্ত্রিক কাপালিক নরমাংস দ্বারা ভৈরবীপূজা করে তার ধর্ম পালন করতো। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে দু একটি বাক্য এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
“গৃহপার্শ্ব দিয়া কাপালিক নব কুমারকে সেই সৈকতে লইয়া চলিলেন, এমন সময় তীরে তুল্যবেগে পূর্বদৃষ্টা রমনী তাঁহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল; গমনকালে তাঁহার কর্নে বলিয়া গেল, এখনো পালাও। নরমাংস নহিলে তান্ত্রিকের পূজা হয় না, তুমি ক জান না?
-নব কুমারের বলপ্রয়োজে দেখিয়া কাপালিক কহিল, ‘মূর্খ! কি জন্য বল প্রকাশ কর? তোমার জন্ম আজি সার্থক হইল। ভৈরবীর পূজায় তোমার এই মাংসপিন্ত অর্পিত হইবেক, ইহার অধিক তোমার তুল্য লোকের আর কি সৌভাগ্য হইতে পারে”?
-(বঙ্কিমের কপাল কুন্ডলাঃ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ‘কাপালিক সঙ্গে’ –হতে গৃহীত)
অতএব যে সন্ত্রাসবাদ ও হত্যাকান্ডকে ধর্মীয় রূপ দেয়া হয়েছিল, হিন্দুধর্মীয় রূপ –তার সাথে মুসলমানদের সংশ্রব –সম্বন্ধ থাকতে পারেনা। আর থাকতে পারে না বলেই এ সন্ত্রাসবাদ ও হত্যাকান্ডের শিকার মুসলমানরাও হয়েছিল।
সন্ত্রাসবাদ, নাগরিকদের বিশেষ করে ইংরেজদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা যতোটা ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রহ তরে তুলেছিল, সম্ভবত তার চেয়ে অধিক বিব্রত করেছিল –বিলাতী বস্ত্রাদি বর্জন নীতি। মানচেষ্টারের কলকারখানাগুলি বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। মানচেষ্টার চ্যাম্বার অব কমার্সের কাছে হিন্দু বণিক সমিতির পক্ষ থেকে অনবরত চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে বলা হচ্ছিল, ‘যদি এ দেশে তোমাদের বস্ত্রাদি চালাতে চাও, তবে বংগভংগ রদ করো’।
ভারতীয় কংগ্রেসেও ঘোষণা করে যে –বংগভংগ রদের একমাত্র পথ হচ্ছে বিলাতী দ্রব্যাদি বর্জন। তবে কংগ্রেস একথাও বলে যে এ বর্জন নীতি শুধু বাংলাদেশে সীমিত থাকবে।
একথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে বিভাগবিরোধী আন্দোলনের ধারা ক্রমশঃ অন্য একটি খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। তা হলো এই যে, মুসলমান জাতিকেই একেবারে ভারত ভূমি থেকে নির্মূল করে দেয়া। সম্রাট পঞ্চম জর্জ যখন ১৯১১ সালে ভারতে আগমন করেন তখন বহু হিন্দু প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থে তাঁকে প্রদত্ত আবেদনপত্রে বলা হয় যে, বিভিন্ন সংস্কারাদির দ্বারা মুসলমাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ প্রদান করা হচ্ছে। হিন্দু-পত্রিকাগুলি বলে যে মুসলমানরা দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক, সরকারের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ভানমাত্র, ব্রিটেনের প্রতি তাদের দরদমাত্র নেই, তাদের যোগসাজশ রয়েছে মিশরীয় রাদ্রোহীদের সাথে –(A Hamid Muslim Separatism in India, p. 83). The Times, London এর সংবাদদাতা স্যার ভ্যালেন্টাইন বলেন যে, তিলক এবং তার ভাবাদর্শে পুনায় প্রতিষ্ঠিত স্কুল, পাঞ্জাব ও বাংলার জাতীয়তাবাদী হিন্দুগণকে প্রায় একথা বলতে শুনা যেতো যে, স্পেন থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে যেমন মুসলমাদেরকে নির্মূল করা হয়েছে, তেমনি ভারত থেকেও তাঁদেরকে নির্মূল করা হবে। বড়োলাট কার্জনের ব্যক্তিগত স্টাফদের সাথে জড়িত স্যার ওয়ালটার লরেন্স ইদোরের মহারাজা স্যার প্রতাপ সিংহ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেনঃ
“একবার শিলার লর্ড কার্জন কর্তৃক আমাকে এবং আমর স্ত্রীকে প্রদত্ত একটি বিদায়কালীন নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন স্যার প্রতাপ সিংহ। ভোজের পর রাত দুটো পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার বিভিন্ন আলাপ আলোচনা হয়। তিনি তাঁর জীবনের বহু আশা-আকাংখা আমার কাছে ব্যক্ত করেন। তার মদ্যে একটি হচ্ছে ভারত থেকে মুসলমানেরদ নির্মূল করা। আমি তাঁর কথার প্রতিবাদ করে আমাদের উভয়েরই কতিপয় মুসলমান বন্ধুর নাম করলাম। তিনি বল্লেন, ‘হ্যাঁ, তাদেরকে আমি পছন্দ করি, কিন্তু অধিকতর পছন্দ করি তাদের মৃত্যু”।
স্যার লরেন্স বলেন, ‘স্যার প্রতাপের এ ধরনের আলাপ সম্পর্কে আমি প্রায়ই চিন্তা করি। বহু বৎসর ধরে ভারতীয়দের সাথে কারো পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু এমন এক সময় আসবে হঠাৎ তারা তাদের হৃদয়ের দ্বার উন্মোচ করবে এবং ভিতরের গোপন রহস্যটি উদঘাটন করে ফেলবে। স্যার প্রতাপ সিংহ একজন ভালোহিন্দু রাজপুত। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। বহু লোকের সাথে মিশেছেন। ভালো ইংরেজী জানেন। বহু জাতির লোকের সাথে তাঁর পরিচয়। বলতে গেলে তিনি একজন বিশ্বজনীন (Cosmopolotan) সভ্যতার ধারক বাহক। কিন্তু তাঁর অন্তরের গভীরমত প্রদেশে দুরপনেয় মুসলিম বিদ্বেষ বাসা বেঁধে আছে”।
(Sir Waliter Lawence: The India We Served, p. 209, Cassel Londin, 1928; A. Hamid Muslim Separatism in India, pp.83-84)
স্যার লরেন্স একটি অতি মোক্ষম সত্য উদঘাটন করেছেন। ভারত ভূমি থেকে মুসলমানদের নির্মূল করা স্যার প্রতাপ সিংহের মতো কেবলমাত্র দু’একজন হিন্দু ভদ্রলোকের অন্তরের কথাই নয়, বরঞ্চ এ হচ্ছে গোটা হিন্দুজাতিরই অন্তরের কথা। পরবর্তী সময়ে ভারতে পাকিস্তান আন্দোলন চলাকালে, শ্যামাপ্রসান মুখার্জি প্রমুখ হিন্দু মহাসভার নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্য বক্তৃতা বিবৃতিতে বার বার উপরোক্ত মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

চতুর্দশ অধ্যায়
বংগভংগ রদ ও তার প্রতিক্রিয়া
বাংলায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে এ আন্দোলন ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯১০ সালের শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসছিল। আন্দোলনের সিপাহীরা একরকম রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এ বৎসরেই জনৈক বাংগালী হিন্দু ব্যবস্থাপক সভায় বিষয়টি নতুন করে উত্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে তিনি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে সম্মত হন। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ছিলেন আন্দোলনের উদ্যোক্তা। তিনিও সবশেষে তাঁর ‘বাঙালী’ পত্রিকার মাধ্যমে বলেন, “আমরা অবশ্য স্বীকার করি যে এ বিভাগ টিকে থাকার জন্যে হয়েছে এবং আমরা একে বানচাল করতে চাইনা”।
-(Fraser, India Under Cuzon and After, p.391. A. Hamid: Muslim Separatism in India, p.86)
কিন্তু সুদূর লন্ডনের বুকে কোন পোটন হস্ত বংগবিভাগের বিরুদ্ধে মারণাস্ত্র তৈরী করে চলেছিল তা জানা যায়নি।
রাজা পঞ্চম জর্জ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণের কথা আপন মুখে ঘোষণা করার অভিপ্রায়ে ১৯১১ সালে ভারতে আগমন করেন। শুধুমাত্র রাজ্যভিষেক ঘোষণার উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে সুদূরবর্তী উপনিবেশে আগমন কর –এ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে এক অভূতপূব ও নজীরবিহীন ঘটনা। সন্ত্রাসবাদীদের অশুভ ষড়যন্ত্রের আশংকা তখনো মন থেকে মুছে ফেলা যায়নি। ভারতে তখন দুর্ভিক্ষ বিরাজমান। ইতালী-তুর্কী যুদ্ধের কারণে মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ। এসব কারণে পঞ্চম জর্জের মন্ত্রীমন্ডলী ভারত সফর অবিবেচনা প্রসূত মনে করে তাঁকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেন। রাজা সকল উপদেশ উপেক্ষা করে ভ্রমণের প্রস্তুতি করতে থাকেন। নবেম্বর মাসে ভারতের উদ্দেম্যে যাত্রা করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তিনি বোম্বাই অবতরণ করেন। ভারতবাসীকে কি কি পুরস্কার বা রোয়োদাদ প্রদানে আপ্যায়িত করেন। সবশেষে মে মুহুর্ত এসে গেলো। এক অতি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রাজা পঞ্চম জর্জ এক একটি করে তাঁর অপার করুণা প্রিয় প্রজাবৃন্দের উপর বর্ষণ করতে লাগলেন। সকল রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমাত ঘোষনা করা হলো, শিক্ষার উন্নয়ণে একটা মোটা রকমের অংক বরাদ্দ করা হলো; ভারতীয় সৈনিকদের জন্যে ‘ভিক্টোরিয়া ক্রস’ সম্মান লাভের অযোগ্যতা দূরীভূথ হলো, অল্প বেতনভূক্ত সরকারী কর্মচারীদেরকে অতিরিক্ত অর্ধ মাসের বেতন দেয়া হলো; ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে দিল্লী স্থানান্তরিত করা হলো। সর্বশেষে বলা হলো ‘বংগভংগ’ রদ করা হলো। হিন্দুগণ আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়লো। বংগভংগ বাতিরের ঘোষণা দ্বারা তাৎক্ষণিক সুবিধা এই হলো যে, ভারত সাম্রাজ্যের অপরাধ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির মধ্য দিয়ে রাজদম্পতির নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল।
কিছুদিন পর যখন রাজা কোলকাতায় এলেন, তখন হিন্দুবাংলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজা ব্রিটিম সাম্রাজ্যের প্রতি তাদের অদম্য আনুগত্য প্রদশ্রন করে বিরাট বিরাট শোভাযাত্রা করে। হ্নিদু সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয় যে, হিন্দু মন্দিরে শ্বেত মহারাজা ও মহারাণীর মুরতি স্থাপনের প্রস্তাব করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং লর্ড হার্ডিঞ্জের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়।
অপরদিকে বিভাগ বাতিল করে মুসলমাদের প্রতি করা হয় চরম বিশ্বাসঘাতকতা। কার্জন বিভাগ সম্পাদন করে এবং হার্ডিঞ্জ তা বাতিল করে। কিন্তু উভয়ের কার্যপ্রনালীর মধ্যে বিরাট পার্থক্য এই যে কার্জন প্রকাশ্যে বংগভংগের প্রস্তাব দেন তার সপক্ষে ন্যায়সঙ্গত যুক্তি পেশ করেন। এ নিয়ে বহুদিন আলাপ আলোচনা হয়, বহু কাগজ কালি ব্যয় হয়। প্রস্তাবটি যথারীতি চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত এবং যথাসময়ে তা কার্যকর করা হয়। পক্ষান্তরে হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনা অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে অগ্রসর হয় এবং জনসাধারণের কাছে তা প্রকাশ লাভ করে অতি আকস্মিকভাবে এবং এক অতি বিস্ময়ের রূপ নিয়ে। ব্রিটিশ সরকারের এ সিদ্ধান্তের দ্বারা একের সর্বনাশ করে অপরের পৌষ মাস এনে দিলেও এর দ্বারা তাদেরপ্রগলভতা, ডিগবাজী ও একটি অনুন্নত অঞ্চলের সম্প্রদায়ের ন্যায়সংগত অধিকার ফিরে দিয়ে আবার তা কেড়ে নেয়ার অন্যায় অবিচারমূলক মনোবৃত্তি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অক্ষয় হয়ে থাকবে।
ব্রিটিশ সরকারের এ হাস্যকর অভিনয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে যতটুকু আভাস পাওয়া যায় তা হলো এই যে, বিভাগ রদের খেলাটা তৎকালীন ভারত সচিব ‘ক্রু’র (Crew) মস্তিষ্কে স্থান লাভ করেছিল। যারা বিভাগকে মারাত্মক ভুল বলে অভিহিত করে বিক্ষুব্ধ হয়েছিল, তাদেরকে শান্ত করাই ছিল ক্রুর অভিপ্রায়। হার্ডিঞ্জ বলেন, “পরে আমাকে এ কথা জানানো হলো যে, উভয় বাংলায় যদি শান্তি প্রতিষ্ঠি করতে হয়, তাহলে সমস্ত বাংগালী যেটাকে অন্যায় অবিচার মনে করেছে তা দূর করার জন্যে কিছু করা একেবারে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অবশ্য এ সময়ে বিদেশেও এমন আশা করা হচ্ছিল যে এ ‘অবিচার’ দূর করার জন্যে কিছু করা হবে। আমি অনুভব করলাম যে যদি কিছু করা না হয়, তাহলে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতে আমাদেরকে অধিকতর বিপদের সম্মুখীন হতে হবে”।
-(Hardige of Penhurst My India Years, p.36, Murray London, 1948; A. Hamid Muslim Soparatism in India, p.88)
উপরে বর্ণিত স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির উক্তিতে বুঝতে পারা যায় যে, বিভাগ বিরোধী আন্দোলনকারীগণ এক রকম হতাশ হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিলেন এবং বিভাগকে মেনে নিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনে যেসব সাদা চামড়ার বন্ধুগণ ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন, তাঁরা হাল ছেড়ে দেননি। তাঁরা তাদের কাজ করেই যাচ্ছিলেন যার দ্বারা ভারত সচিব ক্রু অবশ্যই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আবদুল হামিদ বলেন যে, বিভাগ রদ করার সপক্ষে যত প্রকার যুক্তি প্রদর্শন করা হয় তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, “উভয় বাংলার হিন্দুগণ প্রায় সব ভূসম্পদের মালিক ছিলেন। ব্যবসা বাণিজ্য ও চাকুরী বাকুরীতেও ছিল তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব। ফলে তাঁরা জনগনের উপরও অত্যধিক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিলেন। তাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি তাদেরকে যে প্রভাব প্রতিপত্তি দান করেছিল, বংগ বিভাগের ফলে তাঁরা সে প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বেন। কায়েমী স্বার্থ ও শ্রেণীপ্রাধান্য অক্ষুণ্ণ রাখার সপক্ষে এ যুক্তি বটে।
বিভাগ রদ করার পেছনে যেকোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না, বরঞ্চ বলতে গেলে ছিল এক চরম দুরভিসন্ধি, তা উপরের কথায় সুস্পষ্ট বুঝতে বাকী ছিল না যে সরকার তাদেরকে প্রতারিত করেছে। তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে। এ সম্পর্কে মুশতাক হোসেন তাঁর এক নিবন্ধে বলেন,
“মুসলমানরা এ পদক্ষেপকে (উভয় বাংলার একত্রীকরণ) অবজ্ঞার চোখেই দেখবে। ব্রিটিশ মন্ত্রীমন্ডলী কার্জনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে অস্বীকার করেন। অতঃপর উভয় বাংলার একত্রীকরণ এটাই প্রমাণ করে যে কর্তৃপক্ষ পংগু হয়ে পড়েছেন। ভবিষ্যতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর কেউ আস্থা পোষণ করতে পারবে না। ….আমরা এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাল্টাবার কোন আন্দোলন করব না। কিন্তু আমাদের দাবী এই যে বিভাগের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলমানগণ যেসব সুযোগ সুবিধা লাভ করেছিল, তা যেকোন ভাবে তাদের জন্যে সুনিশ্চিত করতে হবে। …ত্রিপলী ও পারস্যের ব্যাপারে ব্রিটিশ নীতি মুসলমাদেরকে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। …এই কঠোর পদক্ষেপ আমাদের জাতির মনে তিক্ততার সৃষ্টি করেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে যে কংগ্রেস থেকে সরে থেকে বিশেষ লাভ হয়নি। কেউ বা হয়তো মুসলিম লীগ ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান করবে। এতদিন ধরে ঠিক এই টাই কংগ্রেস প্রত্যাশা করছিল। কিন্তু আমরা এরূপ চিন্তাধারার সাথে একমত নই। আমরা আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বিসর্জন দিয়ে একটি শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারি না। এ হচ্ছে আত্মহত্যার পথ। একটি স্রোতস্বিনী সমুদ্রে মিলিত হওয়ার পর তার সত্তা হারিয়ে ফেলে। সরকারের প্রতি আনুগত্য থাকার কারণে আমরা কংগ্রেসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নই। আনুগত্যই আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়, বরঞ্চ উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র। আনুগত্য সর্বদাই শর্তসাপেক্ষ। আনুগত্য অসম্ভব রকমের চাপ সহ্য করতে পারে না।
….এ দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, মুসলমাগণ সরকারের প্রতি আর আস্থা স্থাপন করতে পারে না। আমাদের নির্ভর করতে হবে খোদার উপরে এবং আমাদের চেষ্টাচরিত্রের উপরে। ….এদিক দিয়ে যদি আমরা সুসংবদ্ধ হতে পারি তাহলে সরকার আমাদের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করতে বাধ্য হবেন। যা কিছু ঘটেছে তার থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
…….আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা সরকার অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। রাজার পক্ষ থেকে ঘোষণাটি যেন একটি গোলান্দাজ বাহিনীর ন্যায় মুসলমানদের শবদেহকে নির্মমভাবে নিষ্পেষিত করে গেল”।
-(Zuberi Tazkira Waqar, pp.228-40; A Hamid Muslim Separatism in India, p.91)

১৯১২ সালে মার্চ মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনের সভাপতির ভাষণে বংগভংগ সংগ্রামের আহত সৈনিক খাজা সলিমুল্লাহ বলেনঃ
বংগভংগের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর প্রসংগটি পুনরায় উত্থাপনের কোন ন্যায়সংগত কারণ কোন দায়িত্বশীল বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি আবিস্কার করতে পারেনি। এ বিভাগ ১৯০৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে ১৯১১ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। মুসলমানদের আশা আকাংখার সম্ভাবনা দেখে আমাদের শত্রুগণ ব্যথিত হয়ে পড়লেন। প্রকৃত পক্ষে বিভাগের ফলে আমরা তেমন বিশেষ কিছুই লাভ করিনি। যতটুকুই লাভ করেছিলাম আমাদের প্রতিবেশী অন্য সম্প্রদায় স্বর্গমর্ত্য আলোড়ন সৃষ্টি করে তাও আমাদের নিকট থেকে কেড়ে নিল। হত্যা ও দস্যুবৃত্তি করে তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করলো, তারা বিলাতী দ্রব্যাদি বর্জন করলো। সরকার এতে কিছুই মনে করলেন না। এসব হত্যাকান্ডে মুসলমানগণ অংশগ্রহণ কা করে সরকারের প্রতি অনুগতই রইলো। …বিভাগের ফলে মুসলমান কৃষককুল লাভবান হলো। হ্নিদু জমিদারগণ তাদেরকে আন্দোলনে টেনে নামাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু তারা কর্ণপাত করলো না। এত করে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ শুরু হলো। সরকা দমননীতি অবলম্বন করলেন। তাতে ফলোদয় হলো না। একদিকে ছিল সম্পদশালী বিক্ষুব্ধ সম্পদ্রায এবং অপরদিকে দরিদ্র মুসলমান এবং এরা ছিল সরকারের সাথে। এভাবে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হলো। আকষ্মিকভাবে সরকার বিভাগ রদ করে দিলেন। এ বিষয়ে আমাদের সাথে কোন আলাপ আলোচনাও করা হলো না। (Ahmed, Ruh-i-Raushan Mustaqbil, pp 58-59; A. Hamid:Muslim Separatism in India, p.92)

১৯২৩ সালে কোকোনাদায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মাওলানা মুহাম্মদ আলী তাঁর সভাপতির বাষণে বংগভংগ রদের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেনঃ “আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ তাদের সদ্যলব্ধ অধিকারসমূহ থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হরো এবং (সরকারের প্রতি) সন্তোষ প্রকাশকে চরম অপরাধ বলে শাস্তি দেয়া হলো। এ এমন এক ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত যা ইতিহাস থেকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে”।
-(Iqbal Select Writings & Speeches, p.162)
ব্রিটিশ সরকার যে মুসলমানদের সাথে বিশ্বাঘাতকতা করেছিলেন, ডিগবাজী খেয়েছিলেন, মুসলমানদের প্রতি যে চরম অন্যায় করা হয়েছিল এবং এক শ্রেণীর সন্ত্রাস ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্যে তাঁদের চির গর্বিত মস্তক অবনত হয়েছিল, এ অনুভূতি তাঁদের অনেকেরই মধ্যে এসেছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত দীর্ঘ দিনের সুটিন্তিত সিদ্ধান্তকে সাত বৎসর পর রাজা পঞ্চম জর্জের মুখের ঘোষণা দ্বারা পরিবর্তিত করে দুনিয়ার সামনে তাঁদের মর্যাদা যে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল এ অনুভূতিও তাঁদের ছিল। তাই অনেকে বংগভংগের কার্যকারণের ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজা পঞ্চম জর্জের মন রক্ষার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে পূর্ব বাংলঅল মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দেবার জন্য এবং বংগভংগ রদের দরুন তাদের যে বিপুল ক্ষতি হয়েধিছল তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত সরকার করেন যাতে করে এ অঞ্চলের অনুন্নত লোকদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হতে পারে। দুই বাংলার একত্রীকরণে বাংলার হিন্দুগণ আনন্দে গদগদ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মুসলমানদো কোন প্রকার উন্নতি ও সুখ সমৃদ্ধি তারা বরদাশত করতে কিছুতেই রাজী ছিল না। তাই সরকার কর্তৃক ঢকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত তাদের মাথায় যেত আবার বজ্রাগাত হলো। কতিপয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অগ্নিশর্মা হয়ে এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন। যেহেতু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হিন্দু শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রভাবের মূল উৎসকেন্দ্র, সেজন্য আর একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হলে প্রথকটির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে বলে তাঁরাপ্রচার করতে লাগলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল অবিলম্বে বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে সাক্ষাৎ করে। তাঁরা বলেন যে, প্রদেশে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ফলে জাতীয় জীবনের শান্তি সম্প্রীতি বিনষ্ট হবে। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকাধীন অধিবাসীদের মধ্যে বিরাজমান অনৈক্য উত্তরোত্তর বর্ধিত হবে। তাঁরা বড়োলাটকে এ বিষয়েও সাবধান করে দেন যে, নতুন বিশ্ববিধ্যালয়ের সূচনা হবে অত্যন্ত নগণ্য ও হাস্যখর। কারণ, তাঁদের মতে, যথেষ্ট প্রজ্ঞাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর অবাব হবে এবং মূলতঃ মুসলমান কৃষিজীবীদের জন্যে প্রস্তাবিত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের কোন মূল্য হবে বলেও তাঁদের সন্দেহ আছে।
-(Govt. of India, Speeches by Lord Hardinge of Penhurst. Vol.1, pp.203-20, Calcutta,1916)
এ সম্পর্কে বাংলার মুসলিম জননেতা মরহুম এ কে ফজলুল হক বংগীয় ব্যবস্থাপক সভায় ১৯১৩-১৪ সালের বাজেট অধিবেশনে যে বক্তৃতা করেন তা বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে তার কিঞ্চিত উদ্ধৃত করলাম। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেনঃ
“ভারত সরকারের ২৫শে আগষ্টের প্রতিবেদনে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় যে, বংগভংগ রদের দরুন যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তার দ্বারাম মুসলিম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না, তারপর আঠার মাস অতিবাহিত হয়ে গেল এবং এখন দেখার সময় এসেছে তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি কতখানি পালন করেন।দিল্লী দরবারের ঘোষণার অল্পদিন পর মহামান্য বড়োলাট যখন ঢাকায় পদার্পন করেন, তখন প্রত্যেকেই আশা করেছিল যে, মুসলমানদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তিনি কোন একটা ঘোষনা করবেন। অবশ্য আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা শুনতে পেয়েছি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে আমরা যা আশা করেছিলাম, সেদিক দিয়ে এ অতি তুচ্ছ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বকে ছোট করতে চাই না। কারণ, পূর্ব বাংলার শিক্ষার উন্নয়নে যে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল, তা এর দ্বারা বিদূরিত হবে। একটি মুসলিম কেন্দ্রে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অমেষ সুযোগ সুবিধার কথাও অস্বীকার করিনা। কিন্তু এই যে বলা হচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু মুসলমানদের উপকারার্থে করা হচ্ছে অথবা এটা হচ্ছে মুসলমানদের খুশী করার একটা বিশিষ্ট পদক্ষেপ –আমি এসবের প্রতিবাদ করছি। বড়োলাট সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যায় হিন্দু মুসলমান উভয়েরই জন্যে এবং তাই হওয়া উচিত’। এ সংকুচিত করা হয়েছে এই ভয়ে যে হিন্দুদের মদ্যে আমর বংগভংগের প্রতিক্রিয়া জাগ্রত হতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পরিকল্পিত একটি মুসলিম জলেক এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজ –এটাকে মুসলমাদের প্রতি অনুগ্রহ করার অভিপ্রায় বলেও ধরা যেতে পারে না। কারণ অর্ধশতাব্দীর অধিককাল যাবত ষোল আনা শিক্ষক-কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জামাদি সহ সরকার কোলকাতায় একটি একচেটিয়া হিন্দু-কলেজ চালিয়ে আসছেন এবং ঢাকায় একটি মুসলিম কলেজ হলে তা হবে মুসলমানদের দীর্ঘ দিনের অবহেলিত দাবীর দীর্ঘসূত্রী স্বীকৃতি। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ সম্পর্কে কথা এই যে, যে অঞ্চলে মুসলমানগণ দীর্ঘকাল যাবত আরবী ও ফার্সী শিক্ষার বাসনা পোষণ করে আসচে, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের শুধু স্বাভাবিক ফল মাত্র এই ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। এটা সকলের জানান না থাকতে পারে যে, পূর্ব বাংলার জেলাগুলি থেকে অদিক সংখ্যক ছাত্র বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলিতে পড়াশুনা করে এবং এই শ্রেণীর অধিবাসীদের প্রয়োজন পূরণ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের কোন ব্যবস্থা ব্যতীত একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিছুতেই ন্যায়সংগত হতোনা। আমি আশা করি সরকারী কর্মকর্থাগণ এ কথা উপলব্ধি করবেন যে, যদিও মুসলমানগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই রায় দিয়েছে, কিন্তু এটাকে, এমনকি একটি মুসলিম কলেজ এবং ফ্যাকাল্টি অব ইসলামিক স্টাডিজকেও তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহ বলে তারা মনে করে না।
-(Bangladesh Historical Studies Speech ni the budget for 1913-14, pp.149-50)
উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বংগভংগ, ঢাকায় বিশ্ববিধ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তথা মুসলমানদের কোন সুযোগ সুবিদার ব্যাপারে হিন্দু ভারত ও ইংরেজদের মানসিকতা ও আচরণ কি ছিল।
বংগভংগ ও বংগভংগ রদের ফলে মুসলমানরা কি লাভ করলো আর কি হারালো তাই আমাদের যাচাই পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।
সুষ্ঠু ও সুসমঞ্জস্য প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রয়োজনে ভারতের ব্রিটিশ আমলাগণ বহু দিন যাবত কতিপয় প্রাদেশিক এলাকার পুনর্বন্টন ও পুনর্বিন্যাসের চিন্তাভাবনা করছিলেন এবং এ বিষয়ে সেক্রেটারিয়েটে ফাইলের পর ফাইল তৈরী হয়েছিল। লর্ড কার্জন এসবকে ভিত্তি করে সর্ববৃহৎ প্রদেশ বাংলাকে বিভক্ত করে ‘পূর্ববাংলা ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। বাংলার মুসলমানদের এ বিষয়ে কোন ধ্যান-ধারণাই ছিল না। অবশ্য বিভাগের ফলে মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলার মুসলমানদের সর্ববিধ মংগল ও উন্নতির আশা পরিকল্পিত হলো। বাংলার হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের ভবিষ্যৎ সুযোগ সুবিধায় নিছক ঈর্ষান্বি হয়ে বিভাগের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। সে আন্দোলন পরে সন্ত্রাসবাদ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের রূপ গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের প্রহি হিন্দু মানসিকতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ভারতভূমিতে মুসলমানগণ তাদের অস্তিত্ব, তাহজি তামাদ্দুন, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে বিপন্ন মনে করে। আত্মরক্ষার জন্যে ‘মুসলিম লীগ’ নামে ভারতীয় মুসলমানের জন্যে একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কায়েম হয়। ভারতের হিন্দু মুসলিম মিলে একজাতীয়তার ছদ্মনামে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে তাদের হিন্দুজাতীয়তার মধ্যে একাকার করার ষড়যন্ত্রও মুসলমানরা উপলব্ধি করে। আগা খানের নেতৃত্বে ৩৬ জন বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ একটি প্রতিনিধি দল বড়োলাটকে তাঁদের আশা আকাংখা ব্যাখ্যা করে পৃথম নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন করেন। মুসলমানগণ একটি পৃথম জাতি হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে, যার ফলশ্রুতি স্বরূপ –ভারত বিভক্তি হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভ হয়।

পঞ্চদশ অধ্যায়
উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ
উনিশ শ’ ছয় থেকে ছত্রিশ –এ তিরিশ বছরের ইতিহাস মুসলমানদের আযাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবুও বলতে হবে এ তিনটি দশকে তারা চিল আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে জর্জরিত এবং কখনো দেখতে পাই তাদের রাজনৈতিক মানস নৈরাশ্যে ঝিমিয়ে পড়েছে।
এ দশকত্রয়ের দুটি প্রান্তসীমা ছিল দুটি বৈমিষ্ট্য উজ্জ্বল ও প্রাণন্ত। ১৯০৬ সালে মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার উন্মেষে আশার উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত এবং ছত্রিশে ভারত শাসন আইন (India Act of 1935) অনুযায়ী স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণে তৎপর। মাঝের সময়কালটুকু কেটেছে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে দ্বন্দ্ব কলহে, আত্ম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও প্রতিযোগিতায়, ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুসলমানদের আত্মপ্রত্যয় বিশ্লেষণে এবং তার সাথে সাথে চলেছে আযাদী আন্দোলনও।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বংগ বিভাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন শাসনতান্ত্রিক সুবিধার জন্যে। কিন্তু বংগ বিভাগ যখন হলো এবং মুসলিম অধ্যুসিত পূর্বাঞ্চলের অবহেলিত মানুষের শিক্ষাদীক্ষঅ ও বৈষয়িক উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত হলো, তখন এ বিভাগের তীব্র বিরোধিতা শুরু করলো গোটা হিন্দু সমাজ। তাদের এ অন্ধ বিরোধিতায় এ সত্যটিই উদঘাটিত হলো যে হিন্দু মুসলমান দুটি স্বতন্ত্র জাতি, তাদের আশাআকাঙ্খা, ধর্মকর্ম, জীবনের দৃষ্টিভংগী, সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনিতর গতিধারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক। এ চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে ১৯০৬ সালে একটি শক্তিশালী মুসলিম প্রতিনিধিদলের পক্ষ তেকে পৃথক নির্বাচনের দাবী সরকার সমীপে পেশ করা হয়। জাতীয় স্বাতন্ত্রের জন্যে রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য বিধায় ১৯০৬ সালে ‘মুসলিম লীগ’ নামে ঢাকার বুকে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান –নতুন রাজনৈতিক ও জাতীয় চেতনার অবশ্যম্ভাবী ফল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গালভরা বুলি ছিল এক –জাতীয়তাবাদরে। কিন্তু বংগভংগ রদের জন্যে সমগ্র হিন্দুজাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তাদের এক-জাতীয়তাবাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। হিন্দু মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট হয়ে পড়ে, পারস্পরিক তিক্ততা উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে। পলাশীর বিয়োগান্তক নাটকের পর থেকে উনবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ পাদ পর্যন্ত ইংরেজ কর্তৃক যে মুসলিম দলন চলেছিল, তাতে হিন্দুরা ছিল ইংরেজদের একান্ত বশংবদ ও প্রিয়পাত্র। পক্ষান্তরে মুসলমানরা ছিল তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ও শত্রু। কিন্তু বংগভংগ, পৃথক নির্বাচন প্রভৃতির দ্বারা তাদের মনে যখন এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, মুসলমাদের প্রতি ব্রিটিশের মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা হয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তখন হিন্দুদের আক্রোশ তাদের ব্রিটিশ প্রভুতের উপরেও পড়ে। তারপর শুরু হয় ব্রিটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদ।
রাজ পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরী ১৯১১ সালে ভারত ভ্রমণে আসেন। তাঁদের আগমণ উপলক্ষে দিল্লীতে বিরাট আড়ম্বরপূর্ণ এক দরবার অনুষ্ঠিত হয়। দরবার শেষে রাজা সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঘোষণা করলেন, ভারতের রাজধানী কোলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হবে দিল্লীতে।পরের ঘোষণাটি অধিকতর বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত। তিনি ঘোসনা করেন যে, বংগভংগ রদ করা হলো। এছিল মুসলমানদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা এবং মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধিতা তীব্রতর হয়ে উঠে।
পক্ষান্তরে বংগভংগ রদে হিন্দুরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। এর ফলে একদিকে যেমন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে আদর্শিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য ও দূরত্ব বাড়তে থাকে, তেমনি বাড়তে থাকে মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধিতা। মুসলিম লীগের তিন দফাউদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথম দফাতেই ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টির উল্লেখ। কিন্তু রাজা পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় ঘোষণাটি তাদের চিন্তাধারাকে প্রবাহিত করলো ভিন্ন খাতে। ১৯১২ সালে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে মুসলমাদের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংগঠনের উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করার প্রস্তাব গৃহীত হলো। এ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। এ পরিবর্তিত প্রস্তাব লীগের সম্মুখে পূর্ণ আযাদী অর্জনে স্থির লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করলো। ফলে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দৃষ্টিও এদিকে আকৃষ্ট হলো।
উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ লীগের উক্ত অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন। তবে লীগের সংগঠন সম্পর্কে তাঁর মধ্যে তখনো কোন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখতে পাওয়া যায়নি। লীগের প্রতি তাঁর অনীহা প্রদর্শনের কারণ এই ছিল যে, তখন পর্যন্ত তাঁর মনে এ ধারণা ছিল যে লীগের নীতি ছিল সম্প্রদায় কেন্দ্রিক। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন অত্যুৎসাহী সদস্য এবং বিশ্বাসী ছিলেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যে। তিনি রাজনীতিতে দীক্ষা গ্রহণ করেন গোপাল কৃষ্ণ গোখেলের কাছে। গোখেল মন্তব্য করেছিলেন, “হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত হওয়ার যোগ্যতা জিন্নাহর আছে”।
আনুষ্ঠানিকভাবে লীগের সদস্য হওয়াকে তিনি কংগ্রেসের সদস্য থাকার বিরোধী মনে করেননি বলে লীগের সদস্য হন। তাঁর একান্ত বাসনা ছিল লীগ ও কংগ্রেসের সদস্য থেকে তিনি হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন। আপ্রাণ চেষ্টাও করেন তিনি। কিন্তু তাঁর অক্লান্ত মিলন প্রচেষ্টায় তিনি লক্ষ্য করেন যে, হিন্দু মুসলমানের মিলন ত দূরের কথা সাম্পদায়িক সংঘর্ষের মাধ্যমে তাদের স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। তাদের উভয়ের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৃথক এবং তাদের কর্মধারাও পৃথক পৃথক খাতে প্রবহমান।
উনিশ শ’ চৌদ্দতে প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধ শুরু হলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই এ সময়ে ব্রিটিশকে সাহায্য করে। এ সময়ে হিন্দু মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা খুব জোরদার হয়। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস-লীদের এক যুক্ত কমিটিতে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির দুটি ফল হয়েছিল। এক –এ চুক্তি পরবর্তীকালের খেলাফত আন্দোলন কালীন কংগ্রেস লীগ ঐক্যের পূর্বসূত্র চিহ্নিত করে। দুই –এ চুক্তির ভিতর দিয়ে একজাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কংগ্রেস ভারতীয় আইন পরিষদের অস্তিত্ব ও গুরুত্ব স্বীকার করে নেয়। কংগ্রেস মুসলমানদেরকে দিতে রাজী হয়। বাংলাদেশে তারা পারে শতকরা ৪০টি, পাঞ্জাবে ৫০টি, বিহারে ২৫টি, যুক্ত প্রদেশে ৩০টি, এর সাথে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা মেনে নিয়ে কংগ্রেস মুসলিম স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করে নেয়।
কিন্তু লক্ষ্ণৌ চুক্তির বিরুদ্ধে হিন্দুদের পক্ষ থেকে প্রবল বিরোধিতা শুরু হয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হাংগামাও শুরু হয়।
এ জিনিসটি কয়েকবার লক্ষ্য করা হয়েছে যে, যখনই কোন কিছুর ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে মিলনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে তখনই সংখ্যাগুরু দল সাম্প্রদায়িক হাংগামার সূত্রপাত করে মিলন প্রচেষ্টাকে বানচাল করেছে।
এ কালের তিনটি ঘটনা ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। খেলাফত আন্দোলন, মোপলা বিদ্রোহ ও হিজতর আন্দোলন। তার পটভূমিকা বর্ণতা করাও প্রয়োজন বোধ করি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ব্রিটিশের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে। তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তারা আশা করেছিল ব্রিটিশ সরকার তাদের নিম্নতম দাবীসমূহ মেনে নিবে। ১৯১৭ সালে হাউস অব কমন্সে তদানীন্তন সেক্রেটারী অব স্টেট যে ঘোষণা পাঠ করে শুনান, তাতে ভারত উপমহাদেশে একটি দায়িত্বশীল সরকারের ক্রমপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু ১৯১৯ সালে যে মন্টেগু চেমন ফোর্ড সংস্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়, তা ছিল লক্ষ্ণৌ চুক্তির বিশ্লেষিত দাবীসমূহের পটভূমিতে খুবই অপ্রতুল। এ সালের আর একটি বিধিবদ্ধ আইন, যা বড়োলাট আইন বলে পরিচিত, ভারতীয়গণকে বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ করে। এ আইনে জুরীর পরামর্শ ব্যতিরেকেই রাষ্ট্রবিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেল অধিকর সরকারকে দেয়া হয়েছিল। ভারতে যে কোন আন্দোলন দমন করার জন্যেই যে এ আইন পাশ করা হয়েছিল, তা আর কারো বুঝতে বাকী রইলো না। যুদ্ধকালীন অকুণ্ঠ সমর্থনের এই পুরস্কার দেয়া হলো ভারতবাসীকে। এ আইন পাশ হলো ১৮ই মার্চ, গান্ধী তার প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতাল আহবান করলেন ৩০শে মার্চ। হরতাল করতে গিয়ে প্রচন্ড সংঘর্ষ হলো পাঞ্জাবে। তার ফলে নৃশংস হত্যকান্ড অনুষ্ঠিত হলো জালিয়ানওয়ালাবাগে। জেনারেল ডায়ার নির্মমভাবে ১৬৫০ রাউন্ড গুলী চালিয়ে ৩৭৯ জনকে নিহত ও ১১৩৭ জনকে আহত করে এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের এক অতি কলংকময় অধ্যায় সংযোজন করে।

খেলাফত আন্দোলন
এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত খেলাফত আন্দোলন। তবে এ সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলে রাখা দরকার। ভারতীয় মুসলমারা এ দেশের শাসনক্ষমতা হারিয়ে মনোবেদনা ও আত্মাভিমানে দিন কাটাচ্ছিল। তারা তাদের এ মনোবেদনায় কিছুটা সান্ত্বনা লাভের চেষ্টা করেছিল তুরস্কের সুলতানকে অবলম্বন করে। তুরস্ক শুধু মুসলিম রাষ্ট্রমাত্র ছিলনা, বরঞ্চ তুরস্কের সুলতানকে মুসিলম জাহানের খলিফা ও মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক মনে করা হতো। অবশ্য যতোদিন ভারতে মুগল সম্রাজ্য শক্তিশালী ছিল, ততোদিন তুরস্কের সুলতানকে এ মর্যাদা দেয়া হয়নি। যাহোক, পরবর্তীকালে মুসলমানদের মধ্যে প্যানইসলামী চেতনা তুরস্ককে মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটিশের বিপক্ষ দলে যোগদান করে। ভারতীয় মুসলশান আশা করেছিল, ব্রিটিশকে তাদের অকুন্ঠ সমর্থনের কারণে তুরস্ককে কোন প্রকার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। লয়েড জর্জ সে ধরনের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিমের উদ্দেশ্য। তার জন্যেই লরেন্সকে পাঠানো হয় আরবদের মধ্যে আরব জাতীয়তার বিষাক্ত মন্ত্রপ্রচারক হিসাবে। মক্কার শেরিফ শরীফ হুসাইন হাশেমী লরেন্সের প্রচারণায় প্রভাবিত হেয় ‘আরবদদের জাতীয় স্বাধীনতার’ নামে বিশ্বমুসলিম ঐক্য উপেক্ষা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করে এবং এভাবে তুরস্কের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করে। বাভাভিত্তিক সংকীর্ণ আঞ্চলিক জাতীয়তার বিষবাষ্পে তুরস্কের সুলতানাত তথা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যপ্রতীক বিনষ্ট করাই ছিল ব্রিটিশের লক্ষ্য এবং তা ফলপ্রসূ হলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সম্মিলিত শক্তির জয় হলো এবং তারা যুদ্ধে জয়ী হবার সাথে সাথেই একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে বিরাট তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বাঁদরের পিঠা বন্টনের ন্যায় ভাগ বন্টন করে ফেলে। ১৯১৯ সালের মে মাসে উসমানী রাজধানীতে নমসর্বস্ব সুলতান রয়ে গেলো। আলজিরিয়া থেকে বাহরাইন পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল খন্ডবিখন্ড করে ফ্রান্স, গ্রীস ও বৃটেনের মধ্যে বিতরণ করা হলো।
এভাবে উসমানীয় রাষ্ট্রকে খন্ডবিখন্ড করার কারণে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। মুসলিম নেতৃবৃন্দ ভারতের ভাইসরয়ের কাছে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর এবং সাইয়েদ সুলাইমান নদভী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দল লন্ডন গমন করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নিকটে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। প্রত্যুত্তরে বলা হলো যে, শুধু তুরস্কের ভূখন্ড ব্যতীত অন্যান্য অঞ্চল তুরস্ককে দেয়া যাবে না। তার জন্যে তুরস্ককে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে ভারতে শুরু হয় প্রচন্ড খেলাফত আন্দোলন।
ভারতে শক্তিশালী খেলাফত কমিটি গঠিত হলো। মুসলমানদের দেড় শতাব্দী ব্যাপী পুঞ্জিভূত ব্যথা-বেদনা খেলাফত সংকটকে সম্মুখে রেখে প্রচন্ড বিক্ষোভের অগ্নিশিখা লেলিহান করে। মুসলিম মানসের জাগরণ প্রচেষ্টার পথিকৃৎ ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর। তিনি ছিলেন ‘মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদিশারী। তিনি Comrade নামক একটি ইংরাজী পত্রিকার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সঞ্চারে সচেষ্ট ছিলেন। খেলাফত আন্দোলনে সাড়া দেয়াকে তিনি প্রতিটি মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য বলে উল্লেখ করেন।
কংগ্রেস ও কংগ্রেস সমর্থক জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ খেলাফত আন্দোলনের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করলো। ১৯১৯ সালের ১০ই আগষ্ট সারা দেশে খেলাফত দিবস পালনের আবহান জানানো হলো। সারাদেশে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সভাসমিতির মাধ্যমে অভূতপূর্ব ও অপ্রতিহত পাণচাঞ্চল্য শুরু হলো। এক মাসের মধ্যে বিশ হাজার মুসলমান কারাদন্ডের জন্যে নিজেদেরকে পেশ করলো। হাটে হাটে মাঠে, শহরে বন্দরে গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে শুধু খেলাফত আন্দোলনের কথা এবং তার জন্যে যে কোন ত্যাগ ও কুরবানী করার প্রস্তুতি।
নভেম্বর মাসে দিল্লীতে খেলাফত কমিটির অধিবেশন শুরু হয়। মিঃ গান্ধী এতে যোগদান করেন। তিনি তার বক্তৃতায় ব্রিটিশ সরকারের সাথে ‘অসহযোগিতার’ নীতি অবলম্বনে পরামর্শ দেন।
১৯২০ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত খেলাফত কমিটির সম্মেলনে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ (Non-Cooperation Movement) করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তীব্রতর হতে থাকে।
আমি বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত পল্লীর বিদ্যালয়ে ১৯২২ সালে সর্বপ্রথম হাতেখড়ি গ্রহণ করি। যতোটা মনে পড়ে, সেই শৈশবকালে দেখেছি ছাত্র শিক্ষক, চাষীমজুর ও ইতরভদ্রের মধ্যে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংকল্পে আপামর জনসাধারণ সুদৃঢ় ও অবিচল। যে কোন ত্যাগ স্বীকার এবং হাসিমুখে জীবন দান করতে সদাপ্রস্তুত।
কিন্তু এতকিছুর পরেও এ প্রানবন্ত খেলাফত আন্দোলন অপমৃত্যুর সম্মুখীন হয়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের সাথে ইংরেজদের হাত হতে বহু অঞ্চল পুনর্দখল করেন। তুর্কীজাতিকে করেন ঐক্যবদ্ধ এবং তুরস্ককে পুনরায় গৌরবের মর্যাদায় ভূষিত করেন। কিন্তু ক্ষমতা লাভ করার সাথে সাথেই ১৯২২ সালের নভেম্বর সুলতান মুহাম্মদ হাশেমকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে তুরস্কের সর্বশেষ ও কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ খলিফা সুলতান আবদুল মজিদকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে খেলাফতের উচ্ছেদ সাধন করেন। ভারতে খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মুসলমাদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। ডক্টর মঈনুল হক বলেন, “ভারত উপমহাদেশে খেলাফত আন্দোলনের সাষে সংশ্লিষ্ট মুসলমানদের প্রাণে চরম আঘাত করে কামাল আতাতুর্কের পদক্ষেপ। সকলের চেয়ে বেশী প্রাণে আঘাত পান মওলানা মুহাম্মদ আলী। কারণ তিনিই ছিলেন এ আন্দোলনের উৎস ও প্রাণকেন্দ্র। যে শরীফ হুসাইন ছিল ব্রিটিশের তাবেদার এবং যে তার কার্যকলাপের দ্বারা মুসালিম বিশ্বের নিকটে অপ্রিয় হ’যে পড়েছিল, সে এখন কেলাফতের দাবীদার বলে ঘোষণা করলো। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ তাকে কোন প্রকার সাহায্য করলোনা। ওদিকে ওহাবী নেতা ইবনে সউদের অভিযান ব্যাহত করার শক্তিও তার হলোনা। বছর শেষ হবার সাথে সাথেই ইবনে সউদ মক্কা ও তায়েফের উপর অভিযান চালিয়ে তা হস্তগত করেন এবং এভাবে হেজাজের অধিকাংশ অঞ্চলের উপরে তিনি অধিকার বিস্তার করেন”।
-(Dr. Moyenal Huq, History of Freedom Movement Vol. 3. Part. 1; আবুল আফাক –একটি জীবন, একটি চিন্তাধারা, একটি আন্দোলন –(উর্দুগ্রন্থ) পৃঃ ৬৯)

হিজরত আন্দোলন
খেলাফত আন্দোলনের সময়ে ভারতে হিজরত আন্দোলন শুরু হয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদ রাঁচী জেল থেকে মুক্তিলাভের পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন। আলেমগণ ফতোয়া দেন যে ভারত দারুল হরব এবং এখান থেকে হিজরত করে কোন দারুল ইসলামে যেতে হবে। আফগানিস্তানের বাহশাহ আমীর আমানুল্লাহ খান এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, “ভারতীয় মুসলমানগণ হিজরত করে অবশ্যই আমাদের দেশে আসতে পারেন”। মওলানা আজাদের প্রস্তাবে একেবারে চক্ষু বন্ধ করে মুসলমাগণ হিজরতের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। দিল্লীতে হিজরত কমিটি প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যথারীতি অফিস খোলা হলো। এ আন্দোলনের ফলে, যার প্রেরণাদানকারী ছিলেন স্বয়ং মওলানা আবদুল কালাম আজাদ, হাজার হাজার মুসলমান তাদের যথাসর্বস্ব বিক্রি করে আফগানিস্তানের পথে রওয়ানা হলো। ১৯২০ সালের কেবলমাত্র আগষ্ট মাসেই আঠারো হাজার লো হিজরত করে চলে যায়। পাঁচ লক্ষ থেকে বিশ লক্ষ মুসলমান এ আন্দোলনের ফলে বাস্তুহারা হয়েছে এবং তাদের ভাগ্যে জুটেছে বর্ণনাতীত দুর্গতি।
কিন্তু এ আন্দোলনের মূল ছিল নিছক একটি ঝোঁকপ্রবণতা। কোন একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছাড়াই এবং হিজরতের ফলাফল বিচার বিশ্লেষণ না করেই এ আন্দোলনে ঝাঁপ দেয়া হয়েছিল।
আলী সুফিয়ান আফাকী বলেন, “মওলানা মওদূদী এবং তাঁর ভাই হিজরত করতে মনস্থ করেন। হিজরত কমিটির সেক্রেটারী মিঃ তাজাম্মল হোসেন ছিলেন তাঁদের আত্মীয়। তিনি ভ্রাতৃদ্বয়কে হিজরতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু আলোচনায় জানা গেল যে হিজরত কমিটির এ ব্যাপারে কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। দলে দলে লোক আফগানিস্তানে চলে গেলেও আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয়নি। মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ও মওলানা আহমদ সাঈদ এ ব্যাপারে ছিলেন অগ্রগামী। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেখা করে একটি পরিকল্পনাহীন ছিলেন অগ্রগামী। মওদূদী সাহেব এ দুজনের সাথে দেকা করে একটি পরিকল্পনাহীন আন্দোলনের ত্রুটি বিচ্যুতির প্রতি অংগুলি সংকেত করেন। তাঁরা ত্রুটি স্বীকার করার পর মওদুদী সাহেবকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে অনুরোধ করেন। মওদুদী সাহেব বলেন যে সর্বপ্রথম আফগান সরকারের নিকটে শুনতে হবে যে তাঁরা হিন্দুস্তান থেকে হিজরতকারীদের পুনর্বাসনের জন্যে রাজী আছেন কিনা এবং পুনর্বাসের পন্থাই বা কি হবে। আফগান রাষ্ট্রদূতের সংগে আলাপ করা হলো। তিনি বলেন যে ‘তাঁর সরকার বর্তমানে খুবই বিব্রত বোধ করছেন। যাঁরা আফগানিস্তানে চলে গেছে তাদেরকে ফেরৎ পাঠাতে অবশ্য সরকার দ্বিধাবোধ করছেন। কিন্তু তথাপি তাদের বোঝা বহন করা সরকারের সাধ্যেল অতীত’। এভাবে হিজরত প্রশ্নটির এখানেই সমাপ্তি ঘটে”।
-(আবুল আফাকঃ ‘একটি জীবন, একটি চিন্তাধারা একটি আন্দোলন’, পৃঃ ৭৭-৭৮)।
এভাবে ভারতে খেরাফত আন্দোলন ও হিজরত আন্দোলনের প্রবল গতিবেগ হঠাৎ স্তব্ধ হ’য়ে গেল এবং দুটি আন্দোলনই ব্যর্থ হলো। এ ব্যর্থতার জন্যে ভারতীয় মুসলমানরা দায়ী ছিলনা মোটেই। তুরস্কের জন্যেই তাদের এ ব্যর্থতা। কামালপাশা শুধু খেলাফতেরই অবসান করেননি। দু’বছর খলিয়াকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। ভারতে খেলাফত আন্দোলনকে উপলক্ষ করে যে লেরিহান শিখা জ্বলে উঠ ভারত সরকারকে সন্ত্রন্ত করে তুলেছিল তা অনেকটা ধুম্রজালের ভিতর দিয়েই নিভে গেল মুসলমানদের আশা ও উদ্দীপনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।
এ আন্দোলনের ভিতর দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ঐক্যপ্রচেষ্টা চলছিল, আন্দোলনের ব্যর্থতার সাথে তাও ব্যর্থ হ’য়ে গেল। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে আবার শুরু হলো রক্তাক্ত সংঘর্ষ। খেলাফত আন্দোলনে গান্ধীর সহযোগিতার মধ্যে আন্তরিকতা থাক বা না থাক, এ আন্দোলনকে মন দিয়ে সমর্থন কংগ্রেসের অনেক হিন্দু সদস্যই করতে পারেননি। তাঁদের অনেকের মনেই এ প্রশ্ন ছিল যে মুসলমানদের খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাদের কি লাভ! তাই খেলাফত আন্দোলত তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রবণতা কিছু দিনের জন্যে দাবিয়ে রাখলেও খেলাফথ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মসজিদের সামনে জোরজবরদস্তি বাজনা বাজানোর উপলক্ষ করে দাংগা-হাংগামার সূত্রপাত করলো তারা এবং এ দাংগা রক্তাক্ত সংঘর্ষের রূপ ধারণ করে চারদিকে বিস্তার লাভ করতে লাগলো। সম্প্রদায়গত পার্থক্যটা তাদের মধ্যে স্পষ্টতর হতে লাগলো। বিগত দেড় শতাব্দীর অবহেলিত ও পশ্চাদপদ মুসলমান জীবনক্ষেত্রে কোন সুযোগ সুবিধা চাইতে গেলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশারী সম্প্রদায়ের সাথে বিরোধ হ’য়ে পড়তো অপরিহার্য। বাংলার হিন্দু জমিদারগণ এবং পাঞ্জাবের ব্যবসায়ীগণ এ সময়ে তাদের মুসলমান প্রজা ও খাতকদের উপর চরম নির্যাতন শুরু করেছিল। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন মানুষের মনে যে বিক্ষোভ প্রকাশের প্রেরণা জাগিয়েছিল, আন্দোলন দুটি স্তব্ধ হ’য়ে যাওয়ার পর সে বিক্ষোভ প্রেরণা সাম্প্রাদায়িক সংঘর্ষের ভিতরদি য়ে প্রকাশ লাভ করলো।

মোপলা বিদ্রোহ
খেলাফত আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত তৎকালীন মোপলা বিদ্রোহ। এই মোপলা বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ শাসকদের হিংস্ররূপ যেমন একদিকে পরিস্ফুট হয়েছে, তেমনি মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদেরও হিংসাত্মক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
গ্রন্থের প্রারম্ভে মোপলাদের কিছু পরিচয় দেয়া হয়েছে। তারা চিল দাক্ষিনাত্যের মালাবার অঞ্চলের মুসলমান অধিবাসী, তারা নিজেদেরকে আরব বণিকদের বংশদ্ভূত বলে দাবী করে। তারা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ধর্মভীরু। তারা ইংরেজদের দ্বারা শোষিত নিষ্পেষিত হওয়ার কারণে ১৮৭৩, ১৮৮৫, ১৮৯৪ এবং ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ফলে ব্রিটিমদের হাতে বার বার নির্যাতিত হয়। চাষ ও মৎস্য ব্যবসা ছিল তাদের প্রধান উপজীবিকা। শিক্ষাদীক্ষায় তারা ছিল অনগ্রসর এবং হিন্দু জমিদার, মহাজন ও তহসিলদার তাদের উপর চরম অত্যাচার উৎপীড়ন করতো। ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আবেদন নিবেদন করেও তারা কোন ফল পায়নি। অতএব তাদের নির্যাতনের কাহিনী দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশ ও হিন্দু জমিদার মহাজনের নিষ্পেষণে তারা যুগ যুগ ধরে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল। তারপর বিংশতি শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে ভারতে শুরু হলো খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলনের ঢেউ মালাবারেও গিয়ে পৌঁছলো। আগেই বলা হেয়ছে মোপলাগণ ছিল স্বাধীনচেতা, সাহসী ও ধর্মভীরু। ইসলামী খেলাফতের পুনরুদ্ধার ও সেইসংগে ভারতে স্বাধীনতা অর্জনের ফলে তাদের দীর্ঘদিনের নির্যাতন নিষ্পেষণের অবসান হবে মনে করে তারাও প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনা সহকারে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে। তারপরই তাদের সংঘর্ষ শুরু হয় শাসকদের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী হিন্দু জনসাধারণ তাদের দমন করার কাজে সর্বতোভাবে সাহায্য করে শাসকশ্রেণীকে। ফলে মোপলাদেরকে একসংগে শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।
মোপলা দমন করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার যে বর্বরতা ও নৃশংসতা প্রদর্শন করেছিল, সে লোমহর্ষক ও মর্মন্তুদ কাহিনী বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চলাকালে সরকার সমগ্র মালাবারে জনসভায় অনুষ্ঠান, বাইর থেকে সংবাদ ও সংবাদপত্রের প্রবেশ এবং মালাবার থেকে বাইরে বিনা সেন্সারে সংবাদাদি, টেলিগ্রাম ও পত্রাদি প্রেরণ নিষিদ্ধ ঘোসণা করে। মালাবারকে এক লৌহ যবনিকার অন্তরালে রাখা হয়। তবুও যদি কোন প্রকারে তাদের নির্যাতনের কাহিনী বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং বহির্জগতের মানুষ বিশেষ করে মুসলমান তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে, তার জন্যে মোপলাদের বিরুদ্ধেই স্বার্থান্ধ মহল তীব্র প্রচারণা শুরু করে। সেসব প্রচারণা ছিল অমূলক, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত। ১৯২২ সালে সাহারানপুর ও অমৃতশহর থেকে হিন্দুদের দ্বারা দু’খানি প্রচার পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
অমৃতশহর থেকে প্রকাশিত ‘দাস্তানে জুলুম’ শীর্ষক পুস্তিকায় মোপলাদের পক্ষ থেকে হিন্দুদের উপর অকথ্য অত্যাচার-কাহিনী বর্ণনা করে হিন্দু সম্প্রদায়কে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু নারী হরণ, বলপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিতকরণ প্রভৃতি অভিযোগ করা হয় মোপলাদের বিরুদ্ধে। বিবরণে বলা হয়েছে যে –উৎপীড়নের শিকার যদি হিন্দু পুরুষ হয় তাহলে তাকে প্রথমতঃ গোসল করিয়ে মুসলমানী ধরনে চুল কেটে দেয়া হয় অতঃপর মসজিদে নিয়ে কালেমা পাঠ করতে বাধ্য করা হয়, খৎনা করানো হয় এবং মুসলমানী পোষাক পরিধান করানো হয়। মহিলা হলে শুধু তাকে এক ধরনের রঙিন মোপলা পোষাক পরিধান করানো হয় এবং এক ধরনের কানবালা পরিয়ে দেয়া হয়।
সাহারানপুর থেকে প্রকাশিত ‘মালাবার কি খুনী দাস্তান’ পুস্তিকায় বলা হয়েছে যে, মোপলাগণ প্রতিবেশী হিন্দুদেরকে খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের আহবান জানায়। যোগদান করলে ভালে, নচেৎ অস্বীকারকারীকে মোপলাদের ঘরে আবদ্ধ করে তাদের বলপ্রয়োগ গোমাংস ভক্ষণ করানো হয়। অতঃপর তার আত্মীয় স্বজনকে তার সম্মুখে হত্যা করা হয়। এতেও রাজী না হলে তাকে হত্যা করে তার খন্ডবিখন্ড মৃতদেহ কোন কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয় এবং তার বাড়ীঘর ভস্মীভুত করা হয়।
একদিকে যেমন হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা চলছিল, হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মনমানস তৈরীরকাজ চলছিল, অপরদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত করে শুধু খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন থেকেই তাদের নিবৃ্তত করা হচ্ছিল না, বরং সারাদেশে পাইকারী হারে মুসলিম নিধনযজ্ঞের আহবান জানানো হচ্ছিল। স্বাদীনতা অর্জন অপেক্ষা মুসলিম নিধন একশ্রেণীর লোকের কাছে অধিক প্রিয় ছিল। তাই তারা কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করে সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া বিষাক্ত করে তোলে, যার ফলে নুতন আকারে ভারতব্যাপী দাংগাহাংগামার সূত্রপাত হতে থাকে।
এসব মারাত্মক প্রচারণা খেলাফত আন্দোলনকারী মুসলমানদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। কেন্দ্রীয় খেলাফত কমিটি মোপলাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটি কমিটি নিয়োগ কতের পাঠান এবং তারা যে রিপোর্ট পেশ করেন তাতে মোপলা বিদ্রোহের জন্যে স্থানীয় সরকারী কর্মচারীদেরকে প্রধানতঃ ও প্রথমতঃ দায়ী করেন। তারা বলেন যে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্ত ছিল এবং বিদ্রোহের কোন চিহ্নই পরিলক্ষিত হয়নি। ভারতের অন্যাণ্য অঞ্চলের মুসলমানদের ন্যায় মোপলা মুসলামানগণও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করে এবং স্থানীয় সরকার তা কঠোর হস্তে দমন করার জন্যে উঠেপড়ে লাগে। পুলিশের বর্বরতা তাদেরকে বিদ্রোহ করতে বাধ্য করে। সংঘর্ষের সূচনা এভাবে হয় যে, স্থানীয় খেলাফত কমিটির সেক্রেটারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে একটি গাছের সাথে বেঁধে রাখে। অতঃপর তার স্ত্রীকে তাঁর সম্মুখে এনে বিবস্ত্র করা হয় এবং তিনি অসহায়ের ন্যায় সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। পুলিশ কনস্টেবল চপেটাঘাত করে। অতঃপর অন্য একজন খেলাফত কর্মীকে অস্ত্র নির্মাণের কল্পিত অভিযোগ অভিযুক্ত করা হয়। অবশেষে পুলিশ মোপলাদের বাড়ীঘরের উপর চড়াও হয়, তাদের যাবতীয় জিনিসপত্র লুণ্ঠন করে এবং কোথাও বাড়ীর লোকজনের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এতেও নিরস্ত্র না হয়ে তারা মোপলাদের উপর বেপরোয়া গুলীবর্ষণ করে। মোপলাগণ স্বভাবতঃই চিল স্বাধীনচেতা, সাহসী ও বীর যোদ্ধা। তাদের উপর যখন এরূপ নির্মম অত্যাচার চালানো হয়, তখন তারা মরণপণ করে পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের জন্যে বদ্ধপরিকর হয়। অতঃপর যে সংগ্রাম শুরু হয়, সে সংগ্রামে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মিলিত শক্তি পরাজয় বরণ করে এবং কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত হয়। তারা বহু অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে পলায়ন করে। অতঃপর পরিস্থিতি সম্পূর্ণরূপে মোপলাদের আয়ত্তাধীন হয়। এযাবত হিন্দুদের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল ভালো। উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে মোপলাগণ হিন্দুদের জীবন ও ধনসম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ১৯২১ সালের আগষ্ট মাসে মোপলাগণ দস্তুরমত স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বিদ্রোহ শুরু হওৱয়া এক সপ্তাহের মধ্যেই মোপলাগণ ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে এরনা এবং ওয়ালুভানাদ নামক দুটি বৃহৎ তালুক ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে একটি স্বাধীন খেলাফূত রাজ্য স্থাপন করে।
দু’সপ্তাহ পরে ব্রিটিশ সরকার মালাবারে শত শত সৈন্য, ছোটবড়ো ট্যাংক, কামান, বোমা, কয়েকখানি গানবোট এবং রণপোত প্রেরণ করে এমন এক অব্সথার সৃষ্টি করে যেন কোন বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে এক মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। প্রথম সংগ্রামের সময় পুলিশের ন্যায় কয়েকজন অত্যাচারী জমিদার মহাজন জনতার রুদ্রোরোষে পড়ে প্রাণ হারায়। ব্রিটিশ সরকার একে সম্পদায়িক রূপ দিয়ে হিন্দুদেরকে মোপলাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তখন হিন্দু জনসাধারণ ও জমিদার মহাজন সৈন্য ও পুলিশের সহায়তায় এগিয়ে আসে। হিন্দুদের অধিকাংশই মোপলাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ এবং হিন্দু উভয়ের বিরুদ্ধেই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু হতভাগ্য মোপলাগণ বিরাট সুসংহত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কতক্ষণই বা লড়তে পারে? ভারত থেকে আর্যসমাজের শত শত স্বেচ্ছাসেবক সাহায্য বিতরণের নাম কের মালাবারে গিয়ে পুলিশ ও সৈন্যদেরকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে।
মোপলাগণ অসীম সাহসিকতার সাথে একমাস কাল ব্রিটিশ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম চালায়, সরকার মোপলা এলাকাসমূহের উপর আকাশ থেকে বোমা রণতরী ও কামান থেকে নির্বিচারে গোলাবর্ষন করে প্রায় দশ হাজার নরনারীর প্রাণনাশ করে, তাদের বাড়ীঘর, দোকান পাট ও ক্ষেতখামার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তারপর হিন্দু জনসাধারণের সহায়তায় শুরু হয় পাইকারী হারে ধরপাকড়, পৈশাচিক অত্যাচার ও নির্যাতন । সরকারের পৈমাচিকাত ও বর্বরতার দৃষ্টান্ত একটি ঘটনার দ্বারা প্রমাণ পাওয়ো যায়। প্রায় একশ’জন বিশিষ্ট মোপলা নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার করে একটি মালগাড়ীতে বোবঝাই করা হয় এবং দরজা বন্ধ করে তাদেরকে কালিকট প্রেরণ করাহয়। গন্তব্যস্থানে দরজা খোলা হলে দেখা গেল ষাটজন মৃত্যুবরণ করেছে এবং অবশিষ্টজন মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে। তাদের মৃতদেহের প্রতিও কোন সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি, মানুষের প্রতি মানুষের এ ধরনের পৈমাচিক ও নৃশংস ব্যবহার সত্যযুগে ত দূরের কথা আদিম যুগের ইতিহাসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ব্রিটিশ সরকারের পুলিম ও সৈন্যদের অত্যাচার নির্যাতনের পর যারা বেঁচে রইলো তাদের বিচার শুরু হলো। প্রায় বিশ হাজার মোপলা নরনারীকে গ্রেফতার করা হয়। জেল হাজ্জতেও এদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। তাদের বিচারের জন্যে সরকার স্পেশাল কোর্ট গঠন করে। বাইরে থেকে কোন আইনজীভীকে মালাবারে প্রবেম করতে দেয়া হয়নি বলে হতভাগ্য মোপলাগণ আত্মপক্ষ সমর্থনেও সুযোগ পায়নি। বিচার চলাকালে বিচারাধীন আসামীদের ঘরে ঘরে অন্নবস্ত্রের হাহাকার শুরু হয়। অন্নাভাবে বুহ নরনারী ও শিশু মৃত্যুবরণ করে। এ সময়ে উৎপীড়িতের মর্মন্তুদ হাহাকার ও ক্রন্দন রোলে মালাবারের আকাশ বাতাস ধ্বনিত ও মতিত হয়। প্রায় এক হাজার লোকের প্রাণদন্ড হয়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড, দীর্ঘমেয়াদী সশ্রম কারাদন্ড প্রাপ্ত ও দ্বীপান্তরিত মোপলাদর সংখ্যা দু’হাজারে উপর। অতি অল্প সংখ্যক মোপলাকে খালাস দেয়া হয়। পাঁচ থেকে দশ বছর সশ্রম কারাদন্ড লাভ করেছিল প্রায় আট হাজার মোপলা। অবশিষ্টদের মধ্যে কারও কারাদন্ড ছয় মাসের কম ছিলনা। উপদ্রুত এলকাসমূহের সমজিদগুলির প্রায় সকল ইমামইর রাজদ্রোহিতায় অভিযুক্ত হন। এভাবে মসজিদগুলিকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়। দন্ডপ্রাপ্ত মোপলাগণ দ্বীপান্তরে কয়েক বৎসর বর্ণনাতীত দুঃখকস্ট ভোগ করার পর সরকার তাদের পরিবারবর্গকে আন্দামান গিয়ে তাদের সংগে বসবাসের অনুমতি দেয়। এভাবে মালাবার থেকে মোপলাদের একেবারে প্রায় উচ্ছেদ করে ব্রিটিশ সরকার আত্মপ্রসান লাভ করে।
ভারতের খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাসে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক মোপলাদের উপর অত্যচার নির্যাতনের কাহিনী সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ ও হৃহয়স্পর্শী। গান্ধী ও কংগ্রেস এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব ভূমিকা পালন করে।
খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রবল প্লাবনে সে সময়ে মুসলিম জীবন্মৃত অবস্থায় ছিল এবং তাদের ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ ব্রিটিম সরকারের কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি। বহু কষ্টে একমাত্র খেলাফত কমিটি অসহায় মোপলাদের কিছু সাহায্যদান করতে পেরেছিল। নতুবা আরও বহু মোপলা নরনারী ও শিশু অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। মোপলাদের প্রতি কংগ্রেসের আচরণে কংগ্রেসের বহু মুসলিশ সদস্য বেদনাবোধ করেকংগ্রেসের সমর্থন ছিল বলেই কংগ্রেস নীরবতা অবলম্বন করে।
ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দু মুসলিমকে পাশাপাশি রেখে বিগত কয়েক শতাব্দীর ভারতের ইতিহাস আলোচনা করে একথাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এ উপমহাদেশে ব্রিটিশ ও হিন্দুসম্প্রদায় মুসলমানদের পরম শত্রুরূপে তাদের ভূমিকা পালন করতে কোন দিক দিয়ে ত্রুটি করেনি। এ উপমহাদেশ থেকে মুসলিশ জাতির উচ্ছেদ সাধনই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। পরবর্তী ইতিহাস আলোচনায় এ সত্য অধিকতর সুস্পষ্ট হবে।
(Muslim Separatism in India. Abdul Hamid এবং আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, মুহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ দ্রষ্টব্য)।
চরম নৃশংসতার সাথে মোপলাদের বিদ্রোহ দমন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং মোপলাদের প্রতি কংগ্রেস ও গান্ধীর সম্পূর্ণ উদাসীনতা হিন্দুমুসলিম সম্পর্কে পুনরায় ফাটল সৃষ্টি করে। ১৯২৪ সালে মিঃ গান্ধী কর্তৃক প্রেরিত ডাঃ মাহমুদ মালাবারের হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গান্ধীকে যে রিপোর্ট দেন তাতে বলা হয় যে মোপলাদের অভিযোগ আছে। হিন্দুদেরকে বলপ্রয়োগে মুসলমান করার অভিযোগ সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। তদুত্তরে গান্ধী বলেন, “প্রকৃত সত্য কারোই জানা নেই”।
-(Tha Indian Quarterly Register, 1942, Vol.1.No.2.p.645; Muslim Separatism in India, A Hamid.p.160)
গান্ধীর উপরোক্ত উক্তিতে এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মুসলমানদের কোন কথাই তাঁর বিশ্বাস্য নয় এবং হিন্দু যা কিছুই বলুক তা তিনি বেদবাক্যরূপে গ্রহণ করতে রাজী।
এসব দুঃখজনক ঘটনার পর যা ঘটলো, তা অধিকতর দুঃখজনক। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুলতানে মহররমকে কেন্দ্র করে হিন্দুরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালায়। পরের বছর অবস্থার চরম অবনতি ঘটে সাহরানপুরে যেখান থেকে –আগের বছর ‘মালাবার কি খুনী দাস্তান’ শীর্ষক পুস্তিকা বিতরণের মাধ্যমে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়া হচ্ছিল। সাহরানপুরের এ সাম্পদায়িক সংঘর্সে ৩০০ জন নিহত হয় এবং তার অধিকাংশ ছিল মুসলমান। ১৯২৪ সালে বিভিন্ন স্থানে ১৮টি দাংগাহাংগামা সংঘটিত হয়। এ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দ্রুত গতিতে বিহার ও বাংলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ব্যাপক আকার ধারণ করে।

ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের উপর সুপরিকল্পিত হামলা
ভারতীয় মুসলিম লীগ ক্রমশঃই তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছিল। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে তারা জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে আগেই পিছিয়ে পড়েছিল। সারাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাংগাহাংগামার সময় পুলিশ সাহায্যপুষ্ট হিন্দুদের সাথে তারা পেরে উঠছিল না। অতএব হাংগামায় মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য সাহায্য করাও তাদের সাধ্যের অতীত ছিল। এদিকে অহিংসাবাদী ও সাম্প্রদায়িক মিলনে আস্থাবান বহু কংগ্রেসী সদস্য দাংগা-হাংগামায় উস্কানী দিতে থাকায় কংগ্রেসও মুসলমানদের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে পড়ে। মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক মিলনের আশায় অতিরিক্ত উদারতা প্রদর্শন করতে গিয়ে ইসলামের চিরাচরিত নীতি ভংগ করে। আর্যসমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে তারা দিল্লী জামে মসজিদের পবিত্র মিম্বর থেকে বক্তৃতা করার অনুমতি প্রদান করে। মসজিদের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করে তাঁকে তথা হিন্দুসমাজকে মুসলশানরা যে অভূতপূর্ব উদারতা প্রদর্শন করলো তার প্রতিদান স্বামী শ্রদ্ধানন্দ এমনভাবে দিলেন যে তা বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে অটুট রইলো।
উল্রেখ্য যে এই আর্যসমাজী নেতা কংগ্রেসেরও একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে কারাবরণ করেন। লাহোর জেলে থাকাকালীন পাঞ্জাবের জনৈক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর সাথে তাঁর গোপন শলাপরামর্শ হয় এবং মিয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মুক্তিলাভ করেন। জেল থেকে মুক্তি লাভ করেই তিনি মুসলমানেরকে হ্নিদুধর্মে দীক্ষিত করে তাদেরকে এক নুতন অস্পৃশ্য নিম্নজাতিতে পরিণত করাই ছির তাঁর উদ্দেশ্য। এভাবে মুসলমান জাতিকে একটা ¬অপবিত্র জাতির পর্যায়ে ঠেলে দিবার প্রচেষ্টায় তিনি মেতে উঠলেন। গুরগাও, আলোয়ার, ভরতপুর প্রভৃতি স্থানে বুহ সংখ্যক অশিক্ষিত মুসলমানকে নানা প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন করে ধর্মান্তরিত করা হতে থাকে। ধর্মান্তরের পূর্বে মুসলমাদেরকে গোবরের পানি খেতে এবং গোবর পানিথে আপাদমস্তক ধুয়ে অবগাহন করতে বাধ্য করা হতো। বলপ্রয়োগে এভাবে নিরীহ ও নিরক্ষর মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার কাজ পূর্ণউদ্যমে চলতে লাগলো।
মুসলমান এবং তাদের ধর্শের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের কোনকালেই কোন শ্রদ্ধার মনোভাব ছিলনা। নতুবা ইচ্ছা করলে এ ধর্মীয় উৎপীড়ন তারা অনায়াসেই বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে রইলো। আর্যসমাজীদের এ অশুভ তৎপরতা, (সম্ভবতঃ কতিপয় শক্তিশালী ইংরেহ রাজকর্মচারীর ইংগিতে) মুসলমানদেরকে এতখানি বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত করে তুলেছিল যে, জনৈক আবদুল রশীদ প্রকাশ্য দিবালোকে শ্রদ্ধানন্দনকে হত্যা করে এ অশুভ তৎপরতার সমাপ্তি ঘটায়। বিচারে এই অজ্ঞাতকুলশীল আবদুর রশীদের প্রাণদন্ড হলে সে হাসিমুখে ফাঁসিমঞ্চে আরোহণ করলো।
এ ঘটনার পর স্বয়ং গান্ধীজি প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি কটুক্তি করা শুরু করেন। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় বলতে থাকেন, “ইসলাম অন্য ধর্মাবলস্বীকে হত্যা করার মন্ত্রে দীক্ষা দেয় এবং এটাকে মুসলমানরা মনে করে পরকালের মুক্তির উপায়”।
গান্ধীর উপরো্কত উক্তিতে মুসলিম ভারত মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। মওলানা মুহাম্মদ আলী দিল্লীর জামে মসজিদে একদা বক্তৃতা প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলেণ “গান্ধীজির এ উক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেয়া দরকার। কারণ তাঁর এ উক্তিতে ইসলামের পবিত্র ও মহান জেহাদের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে”।
অতঃপর মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী “আল জিহাদু ফিল ইসলাম” নামক একখানি অতীব যুক্তিপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। এ গ্রন্থে তিনি ইসলামের মূলনীতি, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ, ইসলামী যুদ্ধ ও সন্ধি, আন্তর্জাতিক নীতি ও সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়ে বিশদ পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেন এবং ইসলাম ও ইসলামী জেহাদ সম্পর্কে গান্ধীজি তাঁর উক্তির দ্বারা যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করেন তা খন্ডন করা হয়।
এ গ্রন্থটি সম্পর্কে কিছু কথা পাঠকবর্গের গোচরীভূত করা অপ্রাসাংগিক হবেনা করে মনে করি।
এ বিরাট গ্রন্থখানির প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে ইসলামী জিহাদের মর্যাদা, আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ, সংস্কারমূলক যুদ্ধ, ইসলাম প্রচার ও তরবারী এবং যুদ্ধ ও সন্ধি সম্পর্কে ইসলামী আইন কানুনের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্মের যুদ্ধ নীতি।
সপ্তম অধ্যায়ে বর্তমান সভ্যতার অধীনে পরিচালিত যুদ্ধ ও সন্ধিকে আলোচনার বিষয়বস্তু করা হয়েছে। এ কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, বিষয়টির ওপর এমন তথ্যবহুল, যুক্তিপূর্ণ ও প্রামাণ্য গ্রন্থ আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন ভাষায় কারো দ্বারা লিখিত হয়নি।
এ সম্মান আল্লাহ তায়ালা দান করেন, একমাত্র মওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে।
আল্লাহ ইকবাল গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৯২।

সংগঠন আন্দোলন
‘সংগঠন আন্দোলনের’ নেতা লালা হরদয়াল প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, মুসলমানদেরকে হয় হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হতে হবে, নতুবা তাদেরকে পাততাড়ি গুটিয়ে ভারত ত্যাগ করতে হবে।
১৯২৫ সালে জনৈক হিন্দুনেতা সত্যদেব ঘোষণা করেন, “আমরা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শক্তিশারী, তখন মুসলমানদের নিকটে নিম্ন শর্তাবলী পেম করবঃ
“কোরআনকে ঐশীগ্রন্থ হিসাবে মানা চলবে না, মুহাম্মদকে নবী বলেও স্বীকার করা হবে না। মুসলমানী উৎসবাদি পরিত্যাগ করে হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠান পালন করতে হবে। মুসলমানী নাম পরিহার করে রামদীদ, কৃষ্ণখান প্রভৃতি নাম রাখতে হবে। আরবী ভাষার পরিবর্তে হিন্দি ভাষায় উপাসনা করতে হবে”।
-(A History of Freedom Movement, Bengali Muslim Public Opinion Reflected in the Bengali Press -1901-30 Mustafa Nurul Islam.)
আর্যসমাজীয় শুদ্ধি আন্দোলনের সমসাময়িককালে ডঃ মুঞ্জে ও ভাই পরমানন্দ ‘সংগঠন’ আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দুদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন। ফলে বিভিন্নস্থানে রক্তক্ষয়ী সাম্পদায়িক সংঘর্ষের উৎপত্তি হয়। অবস্থা চরম অবনতির দিকে ধাবিত হলে ডাঃ সাইফুদ্দীন কিচলু আন্দোলনসহ ময়দানে নেমে পড়েন। তাঁদের অক্লান্ত ‘প্রচেষ্টায়, ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ আন্দোলনের মারাত্মক গতিবেগ খানিকটা প্রশমিত হয়।
কিন্তু হিন্দুদের অন্তর থেকে সাম্প্রদায়িক অগ্নিশিখা নির্বাপিত হয়নি কিছুতেই। লাহোরের রাজপাল নামক জনৈক আর্যসমাজী মুসলিম-বিদ্বেষাগ্নি পুনরায় প্রজ্জ্বলিত করে। ‘রঙিলা রসূল’ নামে একখানি পুস্তক সে প্রকাশ করে যার মধ্যে বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তাফার চরিত্রে জঘন্য ও কৃৎসিত কলংক আরোপ করা হয়। এর দ্বারা মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির উপর চরম আঘাত করা হয়। এবার ইলমুদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান রাজপালকে হত্যা করে সহাস্যে ফাঁসীর মঞ্চে গমন করেন।

মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বাতন্ত্র দাবী
সাম্প্রদায়িক দাংগা-হাংগামার গতিবেগ প্রশমিত না হয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ১৯২৭ সালে কানপুরের মওলানা হসরত মোহানী ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্বাতন্ত্রের দাবী সম্বলিত একটি প্রস্তাব সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে পেশ করেন। একে বলা যেতে পারে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম পথের দিশারী।

সর্বদলীয় সম্মেলন
এদিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে মওলানা মুহাম্মদ আলী, মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান, মিসেস সরোজিনী নাইডো, রাজা গোপালাচারিয়া, ডাঃ আনসারী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু দাংগা প্রতিরোধের কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে ১৯২৮ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য কংগ্রেস অধিবেশনের প্রাক্কালে এক সর্বদলীয় সম্মেলন আহুত হয়। ভারতের নেতৃস্থানীয় হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্মেলনে যোগদান করেন। কংগ্রেসের বিদায়ী সভাপতি ডাঃ মুখতার আহমদ আনসারী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু উগ্রপন্থী হিন্দুদের হঠকারিতায় সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির আইন পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে তাদের প্রাপ্য আসন সংখ্যার কিছু সংখ্যক আসন অমুসলমানদেরকে ছেড়ে দিতে আগ্রহী হয় এবং এর বিনিময়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় তাদের ন্যায্যা প্রাপ্য আসন অপেক্ষা শতকরা তিনটি আসন সংখ্যার কিছু সংখ্যক আসন অমুসলমানদেরকে ছেড়ে দিতে আগ্রহী হয় এবং এর বিনিময়ে কেন্দ্রীয় আইন সভায় তাদের ন্যায্যা প্রাপ্য আসন অপেক্ষা শতকরা তিনটি আসন অতিরিক্ত দাবী করে। এ ছিল অধিক সংখ্যক আসন ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রে সামান্য কিছু লাভ করার দাবী। কিন্তু সম্মেলনের হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। মুসলমানদের পক্ষ থেকে বৃহত্তর উদারতার বিনিময়ে সামান্য উদারতা প্রদর্শনের¬ জন্যে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পুনঃ পুনঃ আবেদন ব্যর্থ হয়। ফলে সর্বদলীয় সম্মেলন কোন সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই চরম ব্যর্থতার সাথে শেষ হয়।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঐতিহাসিক চৌদ্দ দফা
মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমে কংগ্রেসের একজন অতি উৎসাহী ও একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন এবং তিনি ছিলেন হিন্দু মুসলিম মিলনের দূত। কিন্তু তাঁর দীর্ঘদিনের মিলন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি কংগ্রেসের হিন্দু সদস্যদের আচরণ এবং মুসলমানদের প্রতি তাদের বৈরী নীতিতে অত্যন্ত ব্যথিত হন। অতঃপর ১৯২১ সালের ডিসেম্বর কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে কংগ্রেসের সাথে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কিন্তু ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনের পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশ্যে কংগ্রেসের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন। এ সম্মেলনে হিন্দু ও শিখদের বিদ্বেষাত্মক মনোভাব লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তার পর পরই দিল্লঈতে অনুষ্ঠিত মুসলিম কনফারেন্সে তিনি তাঁর চৌদ্দ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। এ চৌদ্দ দফার বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বোম্বাই থেকে সিন্ধুকে পৃথক করে সিন্ধুপ্রদেশ গঠন, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে শাসন সংস্কার প্রবর্তণ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলির আইন পরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বন্টন এবং দেশের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতিনিধি নির্বাচনে মুসলমানদের জন্যে পৃথক নির্বাচন প্রবর্তন। তখন থেমে মিঃ জিন্নাহ (পরবর্তীকালে কায়েদে আজম) কংগ্রেস বিরোধিতায় হ’য়ে পড়েন সোচ্চার। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ রামজে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে (Communal Award) ‘চৌদ্দ দফার’ অধিকাংশ দফা স্বীকৃতি লাভ করে। এ চৌদ্দ দফার বাইরে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ উড়িষ্যা এবং আসাম দুটি পৃথক প্রদেশের মর্যাদা লাভ করে।

সাইমন কমিশন
¬¬ভারত শাসন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে অথবা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৮ সালে ভারতে একটি রয়েল কমিশন প্রেরণ করেন। এ কমিশনের সভাপতি ছিলেন স্যার জন সাইমন। কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য নেয়া হয়নি বলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি এ কমিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত করে। কমিশনের সদস্যগণ বোম্বাইয়ে অবতরণ করলে তাঁদেরকে কৃষ্ণ পতাকা দেখানো হয়। যাহোক, সাইমন কমিশন লন্ডনে একটি গোলটেবিল বৈঠকের সুপারিশ পেশ করে।

গোলটেবিল বৈঠক
সাইমন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৩০ সালে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক আহুত হয়। কংগ্রেস এ বৈঠকে যোগদান করা থেকে বিরত থাকে। আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন মওলানা মুহাম্মদ আলী, মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিঃ এ, কে, ফজলুল হক, স্যার মুহাম্মদ ইসমাইল, আগা খান, স্যার আবদুল কাইয়ুম, স্যার আবদুল হালিম গজনবী, স্যার হায়দারী, স্যার মুহাম্মদ শফি, স্যার শাহ নওয়াজ ভুট্টু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। মুসলিম সদস্যগণ লন্ডনে পৌঁছে মহামান্য আগা খানকে তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেন।
প্রায় দু’মাসকাল বৈঠক স্থায়ী হয়। মওলানা মুহাম্মদ আলী ভগ্নস্বস্থ্য নিয়ে বৈঠকে যোগদান করেন এবং অসুস্থ অবস্থায় আসনে উপবেশন করেই তাঁর নব্বই মিনিটব্যাপী দীর্ঘতম ভাষণ দান করেন। এই অগ্নিপুরুষের জ্বালাময়ী ভাষণ যেমন একদিক দিয়ে ছিল একটি উচ্চাংগের সাহিত্য, তেমনি অপর দিক দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠমত অবদান। তিনি সম্রাট পঞ্চম জর্জের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে যে ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন, তা শুধুমাত্র তাঁর কাছে ছিল জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম বস্তু। তিনি তাঁর বক্তৃতায় এক পর্যায়ে অতি আবেগময় কন্ঠে বলেন, “আমি ভারতের স্বাধীনতার সারাংশ নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে চাই। যতি তোমরা স্বাধীনতা না দাও, তাহলে দেশে ফিরে যাওয়ার চেয়ে একটি স্বাধীন দেশে মৃত্যুবরণকে আমি শ্রেয়ঃ মনে করি”।
তাঁর এ আন্তরিকতাপূর্ণ উক্তি চিল একটি ভবিষ্যদ্বানী যা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হতে মোটেই বিলম্ব হলো না। তাঁকে আর তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসতে হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা হয়নি, হয়েছে তাঁর জীবনের অবসান লন্ডনেরবুকেই ক’দিন পরে।
মওলানা মুহাম্মদ আলী বারবার কারাবরণ করে এবং দীর্ঘদিন কারাগারে অতিবাহিত করে একেবারে ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু ভারতের কোটি কোটি নরনারীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে। ‌১৯৩০ সালে ৪ঠা জানুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং এ নিদারুণ সংবাদ তড়িৎগতিতে সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সুধী সমাজ মর্মাহত হয়ে ভারতের এ সিংহপুরুষের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারবার্তা প্রেরণ করতে থাকেন।
মওলানা মুহাম্মদ আলী বারবার কারাবরণ করে এবং দীর্ঘদিন কারাগারে অতিবাহিত করে একেবারে ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু ভারতের কোটি কোটি নরনারীকে শোকসাগরে নিমজ্জিত করে। ১৯৩০ সালে ৪ঠা জানুয়ারী তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং এ নিদারুণ সংবাদ তড়িৎগতিতে সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সুধী সমাজ মর্মাহত হয়ে ভারতের এ সিংহপুরুষেল প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে তারবার্তা প্রেরণ করতে থাকেন।
মওলানা মুহাম্মদ আলীর অস্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মৃতদেহকে পরাধীন ভারত ভূমিতে না এনে বায়তুল মাকদেসে অবস্থিত খলিফা ওমরের মসজিদ প্রংগনে সমাধিস্থ করা হয়।
দেশপ্রেমিক, কবি ও সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বাগ্মী মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহরের মৃত্যুতে ভারতবর্ষের রাজনীতিক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা আর পূরণ হয়নি। তবে লন্ডন যাত্রাকালে তাঁকে যখন স্ট্রেচারের সাহায্যে বোম্বাই বন্দরে জাহাজে তোলা হয়, তখন অনেকেই অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন –“ভারতে আপনার স্থলাভিষিক্ত কে হবে”। তখন তিনি বলেছিলেন “তোমাদের মধ্যে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ রইলো”। তাঁর এ অন্তিম ইচ্ছাও পূরণ হয়েছিল। পরবর্তীকালে মুসলমানদের আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন হয়েছিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।

দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক
প্রথম গোলটেবিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বর্জন করেছিল। উপরন্তু মিঃ গান্ধী লবণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করে তোলেন। সরকারও আন্দোলনকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায় সরকারের সাথে একটা আপোষ নিষ্পত্তিতে উপনীন হবার জন্যে স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু, ভূপালের নবাব হামীদুল্লাহ খান, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী এবং শ্রী জয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মিঃ গান্ধীর সাথে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনায় একটি আপোষেল ক্ষেত্র তৈরী হয়। বড়োলাটের সাথে গান্ধীজির সরাসরি আলাপ আলোচনার পর কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে সম্মত হয়।
‌১৯৩১ সালের আগষ্ট মাসে অনুষ্ঠিতব্য গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মিঃ গান্ধী লন্ডন যাত্রা করেন। লন্ডনে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে সরকার মুসলমানদের ন্যায় তফশিলী সম্প্রদায়কেও একটা স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে গণনা করতে বদ্ধকর। গান্ধী তা মেনে নিতে রাজী ছিলেন না এবং তিনি তার প্রতিবাদে ভারতে প্রত্যাবর্তণ করেন। গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদে সাথে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।
গান্ধীর গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগের পর দু’মাসকাল যাবত বৈঠক চলে এবং বৈঠকে অনেকগুলি সাব কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটির রিপোর্ট বিবেচনার জন্যে পরবর্তী বৎসরের আগষ্ট মাসে গোলটেবিল বৈঠকের তৃতীয় অধিবেশন আহুত হয়।

তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক
বিভিন্ন আইন সভায় মুসলমানদের আসন সংখ্যা ও নির্বাচন প্রথা নিয়ে হিন্দু সদস্যগণ তাদের চিরাচরিত বৈরী ভূমিকাই পালন করেন। ১৯২৮ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে হিন্দুগণ যে আপোষহীন মনোভাব ব্যক্ত করে সম্মেলন ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন, গোলটেবিল বৈঠককে অনুরূপভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার চেষ্টা তাঁরা করেছিলেন। কিন্তু আগা খানের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে মিঃ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এমন যোগ্যতা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাঁদের ন্যায্যা দাবীদাওয়াগুলি পেশ করেছিলেন যে তার অধিকাংশই ব্রিটিশ সরকার মেনে নিতে রাজী হন। আগা খান ও মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যতীতও স্যার মুহাম্মদ শফি, স্যার আবদুল হালিম গজনভী, স্যার আকবর হায়দারী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যুক্তিতর্কে হার মেনে নিয়ে পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, ডাঃ মুঞ্জে, শ্রীজয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য হিন্দু সদস্যগণের সাথে পরামর্শক্রমে উপরোক্ত প্রশ্নটির (আইনসভায় মুসলমানদের আসন বন্টন ও নির্বাচন প্রথা) মীমাংসার ভার অর্পন করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ডের উপর।
ম্যকডোনাল্ড অতীতে হিন্দুপ্রীতির পরিচয় দিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন বলে তার উপর হিন্দুদের গভীর আস্থা ছিল। কিন্তু তিনি যে সাম্প্রদায়িক রায়েদাদ (Communal Award) ঘোষণা করেন তাতে বিভিন্ন আইনসভায় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্যে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পৃথক নির্বাচন প্রথাকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। শুধু আসন সংখ্যায় কিছু রদবদল করে উভয়ের গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়।
ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণায় হিন্দুগণ বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েন। কারণ তারা কখনো এরূপ আশা করেননি। বিশেষ করে তফশিলী সম্পদ্রায়ভুক্ত হিন্দুদের জন্যেও পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাবে তাঁরা খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। মিঃ গান্ধী তখন জারবেদা জেলে কারাজীবন যাপন করছিলেন। তিনি পৃথক নির্বাচনের প্রতিবাদে আমরণ অনশন ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করেন।

পুনাচুক্তি
একদিকে হিন্দু নেতৃবৃন্দ পুনায় গমন করতঃ গান্ধীকে অনশন থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্যে বারবার আবেদন জানাতে থাকেন এবং অপরদিকে বর্ণ হিন্দুগণ তফশিলীদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন বাঁটোয়ারা সংশ্লিষ্ট অংশের রদবদল করতে। কবি রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা ডঃ আম্বেদকর বর্ণহিন্দুদের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং স্থিরীকৃত হয় যে বিভিন্ন আইন সভায় তফশিলীদের জন্যে আসন সংরক্ষিত থাকবে বটে, তবে মিশ্র নির্বাচন প্রথার সাহায্যে তাদেরকে নির্বাচিত হতে হবে। এ চুক্তিটি ইতিহাসে পুনা চুক্তি নামে খ্যাতি লাভ করে।
উল্লেখ্য যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তথা ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র ভারতবাসীকে একজাতীয়তার যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট করে এমন এক জাতীয়তার উদ্ভব করা যার কর্তৃত্ব নেতৃত্ব থাকবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতে। ফলে মুসলিম জাতিকে কৃত্রিম জাতীয়তার সাথে একাকার করে তাদের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করে দেয়া হবে। কিন্তু মুসলমানদের জন্যে সরকার কর্তৃক পৃথক নির্বাচনের স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যও স্বীকার করে নেয়া হয়। এতে বর্ণহিন্দুদের বহুদিনের স্বপ্নসাধ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং তাদের সমস্ত আক্রোশটা গিয়ে পড়ে তাদের এককালীন পরম বন্ধু, হিতৈষী ও অভিভাবক ব্রিটিশ সরকারের উপর। তার জন্যে সৃষ্টি হয় সন্ত্রাসবাদের। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, রাজনৈতিক হত্যা প্রভৃতি নিত্যনতুন ঘটনা ঘটতে থাকে। এ সময়ের কয়েক বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হিন্দু সন্ত্রাসবাদী সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, গোয়েন্দা বিভাগের অন্যতম অফিসার খান বাহাদুর আহসান উল্লাহর হত্যা, ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ ও কয়েকজন নর-নারীর হত্যা, মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা, ডিনামাইট ষড়যন্ত্র প্রভৃতি। লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক চলাকালীন তু’তিন বছরের মধ্যেই এ সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়।

ভারত শাসন আইন
পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। প্রদেশে কিছুটা দায়িত্বশীল সরকার এবং কেন্দ্রে ফেড়ারেল সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল –এ আইনের বিষয়বস্তু বা উদ্দেশ্য। মন্টফোর্ড শাসন সংস্কারে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা দিয়েছিলেন, ভারত শাসন আইনে তার চেয়ে অধিক ক্ষমতা বড়োলাট ও প্রাদেশিক গভর্ণরদের হাতে রয়ে যায়। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে এ নতুন ভারস শাসন আইন চালু হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ এই সংকুচিত বা নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায় (Controlled Power) মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবুও নানান টালবাহানার পর নতুন আইনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে কিভাবে ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব গঠন করে এবং তাদের আড়াই বছরের শাসনে কিভাবে মুসলমানদের উপর অন্যায় অবিচার ও নিষ্পেষণ চালায়, যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত হয়, পরবর্তীতে তার বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ঘোষিত হলে মিঃ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সকলকে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানান। ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কিছু সংখ্যক সদস্য মুসলিম লীগে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। তখন পর্যন্তও মুসলিম লীগের আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ লাভ করেনি। নির্বাচনের পর মিঃ জিন্নাহ কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেন। কিন্তু কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। জিন্নাহর মতো একজন তেজস্বী ও খ্যাতনামা আইনবিদের পক্ষে কংগ্রেসের উপরোক্ত ঔদ্ধত্যের কাছে নতি স্বীকার করা সম্ভব হয়নি। বহু মানঅভিমানের পর বড়োলাট লিনলিথগোর আশ্বাসবাণীর পর কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করতে রাজী হলে, মিঃ জিন্নাহ লীগ সদস্যগণকে তার বিরোধিতা করার নির্দেশ দেন।
লীগ-কংগ্রেসে দ্বন্দ্বকলহের মধ্য দিয়েই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের বিমাতাসুলভ আচরণ, মুসলমানদের তাহজীব তামাদ্দুনের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে হিন্দু রামরাজ্য স্থাপনের প্রচেষ্টা এবং মুসলমানদের প্রতি হিন্দু কংগ্রেসের অন্যায় অবিচার মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র আবাসভূমি লাভের সংগ্রামে বাধ্য করে। সে সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে ‌১৯৪৭ সলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের ভিতর দিয়ে।


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি