চতুর্থ অধ্যায়
পাকিস্তান আন্দোলন
এ উপমহাদেশের বুকে ‘পাকিস্তান’ নামে মুসলমানকের একটি স্বাধীন সার্বভৌম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সকল যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। কারণ এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উপরেই ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের অস্তিত্ব একান্তভাবে নির্ভরশীল। পাকিস্তান আন্দোলনের দাবী একদিকে যেমন বৃটিশ সরকার মেনে নিতে পারেননি, অপরদিকে হিন্দুকংগ্রেসকেও শুধু মেনে নিতেই অস্বীকার করেনি, বরঞ্চ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিরোধিতা করেছে। তথাপি উপমহাদেশের দশকোটি মুসলমানে ক্রমাগত সাত বছর যাবত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলিম নরনারীর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন দেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে। এ পাকিস্তান আন্দোলনের পশ্চাতে যে আদর্শিক ও ইসলামী চেতনা সক্রিয় ও বলবৎ চিল তা মুসলিম জাতির এক চিরস্মরণীয় বস্তু এবং এর বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ভবিষ্যৎ মুসলিম প্রজন্মের জানা ও স্মরণ রাখা একান্ত আবশ্যক।
লর্ড কার্জন কর্তৃক শুধুমাত্র প্রশাসনিক কারণে ১৯০৫ সালের বংগদভংগ এবং হিন্দুদের বংগভংগ রদ আন্দোলন এবং ১৯১১ সালে তা রহিতকরণ, উপমহাদেশের যত্রতত্র এবং যখন তখন মুসলমাদের গায়ে পড়ে হিন্দুদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি এবং সুমলমানদের জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধন এবং সাতটি প্রদেশে আড়াই বছর কংগ্রেসের কুশাসন সম্পর্কে এ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ আলোচনায় এ সত্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, এ উপমহাদেশে হিন্দুজাতি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে মুসলিম জাতিকে হয় তাদের দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে অথবা নির্মূল করতে চায়। এ লক্ষ্য হাসিলে জন্যেই কংগ্রেসের দাবী চিল এই যে এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারকে তার তাহেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এই সাথে কংগ্রেসের আর একটি অদ্ভুত ও অবাস্তর দাবী চিল এই যে, এ উপমহাদেশে বসবাসকারী সকলে মিলে একজাতি –ভারতীয় জাতি। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এ উপমহাদেশ কোন এক জাতির নয় বরঞ্চ বহু জাতির আবাসভূমি। তাদের মধ্যে প্রধান ও উল্লেখযোগ্য হিন্দু ও মুসলিম জাতি। হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ এবং হিন্দুরামরাজ্য স্থাপনই চিল কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য। কংগ্রেস ও তার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আচরণে এ বিশ্বাস মুসলমানদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয় এবং এ কারণেই মুসলমানগণ পাকিস্তান আন্দোলন করতে বাধ্য হন।
এখন দেখা যাক কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তা ও রামরাজ্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে হিন্দু ঐতিহাসিকগণ কি বলেন।
ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেনঃ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে হ্নিদু জাতীয়থা জ্ঞানের উন্মেষ হয়, তার প্রকৃত রূপ ছিল হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘রামরাজ্য’ স্থাপন। তখন বাংলাদোশ হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠায়, পুনায় সার্বজনীন সভা ও মাদ্রাজে মহাজন সভা প্রতিষ্ঠায় মূলত প্রাচীন হিন্দুত্বের পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টাই লক্ষিত হয়েছিল। দয়ানন্দের ১৮৮২ সালে ‘দোরক্ষিণী সমিতি’ প্রতিষ্ঠা ও ১৮৯৬ সালে বালগংগাধর তিলকের ‘শিবাজী উৎসব’ অনুষ্ঠান একই অনুপ্রেরণা প্রসূত। বংকিমচন্দ্রের সাহিত্য সাধনাও একই উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। তাঁর ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থ ও ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্র সমস্বরে প্রচারিত করেছে –হিন্দুধর্ম, জাতি ও জাতীয়দা জ্ঞান একই অবিভাজ্য বিষয় –এ তিনের একই চিন্তাধারার অভিব্যক্তি। এ জন্যে মুসলিম শিরে তাঁর অভিশাপ, গালাগালি ও বিদ্বেষ বিস বর্ষণে কিছুমাত্র কৃপণতা ছিলনা। ....সেকালে বীরদের জীবনী আমদানী করতে হয়েছে। রাজা প্রতাপের দেশপ্রেম ও শিবাজীর বীরত্বব্যঞ্জক কর্মসমূহ তখন আমাদের ঘরে ঘরে কীর্তিত হতো। অন্য কোনও সাহিত্য এমন বীর রসাত্মক কবিতার সাক্ষাৎ মিলবেনা, যেমন কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ শিবাজীর উপর এবং শিখগুরু বান্দা ও গুরুগোবিন্দের উপর। বস্তুতঃ জাতি বৈরিতার যে তীব্র আন্দোলন সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও সংবাদপত্রের মারফৎ উত্থিত হয়েছিল ও তীব্ররূপ ধারণ করেছিল, পৃথিবীর কোন দেশের সাহিত্যেই তার তুলনা নেই। (Dr. R.C. Majumdar History of Freedom Movement.pp.202-205; আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ২৬৭)
কংগ্রেসের জাতীয়তার অর্থ হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন এবং হিন্দু রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা তা ঐতিহাসিক ডঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদারের কথায়ই সস্পষ্ট হয়ে গেল।এজাতীয়তার মধ্যে মুসলমানদের স্থান কিভাবে হতে পারে? তার পরেও কংগ্রেসের ভারতীয় জাতীয়তার দাবী চরম প্রতারণা ব্যতীত আর কিছু হতে পারে কি? এ দাবীর উপরেও আলোকপাত করেছেন ডঃ মজুমদার। তিনি বলেনঃ ১৮৩৩ সালে কি ভারতীয়তার জাতীয়দার অস্তিত্ব ছিল? এ প্রশ্নের জাবাব হবে না..... তখন বাঙালী নেতার, মায় রামমোহন রায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন অন্যান্য ভারতীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বৃটিশের জয়লাভের জন্য।....১৮৩৩ সালে বাংলাদেশে দুটি জাতির মানুষ ছিল- হিন্দু ও মুসলমান। যদিও তারা একই দেশের বাসিন্দা ছিল তবুও এক ভাষা ব্যতীত অন্য সকল বিষয়ে ছিল বিভিন্ন। ধর্মে, শিক্ষায়,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তারা ছয়শ” বছর ধরে বাস করেছে যেন দুটি ভিন্ন পৃথিবীতে। রামমোহন রায়, দ্বারিকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রমুখ কোলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ মুসলমানদের মনে করতেন হিন্দুদের যতো দুর্গতি ও অলক্ষণের মূল উৎস হিসাবে যা হিন্দুরা নয়শো বছর ধরে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছে। আর তাঁরা বৃটিশ শাসনকে মনে করতেন বিধতার আশীর্বাদ, যার প্রসাদে হিন্দুরা কখ্যাত মুসলিম শাসন থেকে পরিত্রাণ পেয়েছে। সমস্ত বাংলাসাহিত্যে ও পত্র- পত্রিকায় মুসলমানদের উল্লাখ করা হতো ‘যবন’ হিসাবে-তখন বৃটিশকে বিতাড়িত করে হিন্দু বা ভারতীয় শাসন স্থাপনের কোন ইচ্ছাই ছিলনা। এমনকি রাজা রামমোহন রায়েরও এমন ইচ্ছা জন্মেনি। এমনকি প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ঠাকুরের মতো বিশিষ্ট নাগরিক প্রকাশ্যে বলতেন যে, যদি ঈশ্বর তাঁকে ‘স্বরাজ’ ও বৃটিশ শাসনের’ মধ্যে একটি বেছে নিতে বলেন, তাহলে তিনি শেষেরটাই বিনা দ্বিধায় বেছে নেবেন। (Dr.R.C. Majumdar: History of freedom Movement.p 193)
ডঃ মজুমদার হিন্দু ও মসলমানদের দুটি পৃথক জাতি বলেই প্রমাণ করেছেন। উপরে উল্লেখিত হিন্দু মনীষীগণ মুসলমানদেরকে হিন্দুজাতির শক্রই মনে করতেন। এ পৃথক ও বিপরীতমুখী দুটি জাতিকে নিয়ে এক ভারতীয় জাতি গঠন কিভাবে সম্ভব? কখন এর উৎপত্তি হয়েছিল এবং এ এক জাতীয়তার উদ্যেক্তা কে ছিলেন?
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মরহুম কোন যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীতই জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নিজেকে হিন্দু কংগ্রেসের সাথে সম্পৃক্ত রাখেন। তিনিও স্বয়ং হিন্দু ও মুসলমানকে দুটি পৃথক জাতিই মনে করতেন। এককালে তাঁর সম্পাদানায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত “দৈনিক আল হেলাল” পত্রিকায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেনঃ
‘হিন্দু আওর মুসলমানোকো আপস মে মিলা কর কওমিয়ত কি তা’মীর কীয়া চীয হ্যায়? কিয়া ইনমে সে এক তেল আওর দুসরা পানি নিহি?”
“হিন্দু ও মসলমানকে পরস্পর মিলিত করে এক জাতি গঠন কত হাস্যকার! এদের মধ্যে কি একটা তেল এবং দ্বিতীয়টা পানি নয়?
ডঃ মজুমদারও হিন্দু ও মুসলমানের সম্পূর্ণ পৃথক বৈশিষ্ট্যই তুলে ধরেছেন। তাহলে এক ভারতীয় জাতীয়তার ধারণা কাল্পনিক ও প্রতারণামূলকই বলতে হবে। ১৮৫৭ সালে মুসলমান সিপাহীদের প্রচেষ্টায় যে সর্বপ্রথম উপমহদেশের আযাদী আন্দোলন শুরু হয় হিন্দুজাতি তারও বিরুধিতা করে। রাজা রামমোহনতো এ স্বাধীনাতা যুদ্ধে বৃটিশের জয়লাভের জন্য ‘ঈশ্বরের’ কাছে প্রাথানা করেছেন। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ বলেনঃ সিপাহী বিদ্রোহের (সিপাহিদের আযাদী আন্দোলন) সময় আমাদের জাতীয় প্রেস বিদ্রোহীদের কোনও সহানুভূতি দেখায়নি.......... তখন সমস্ত প্রেস বৃটিশ শাসনের সুফলের গুণগন করেছে এবং বিদ্রোহীদেরকে সমাজের ইতর শ্রেণীর লোক বলে গালাগালি দিয়েছে। প্রায় সমল সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা ও ভূমিকা পালন করেছে। কারণ তখনকার হিন্দু মধ্যেবিত্ত শ্রেণী বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনও প্রকার বিদ্রোহ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলনা ( Benoy Ghosh History of Bengal 1757-1905.C.U. Contribution, pp. 227-28)
উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে একত্রে মিলিত করে একভারতীয় জাতীয়তার ধারণা যে কত উদ্ভট তা মিঃ নিরোদ চন্দ্র চৌধরীর বক্তব্যে প্রমাণিত হয়ে। তিনি বলেনঃ বংগবিভাগ হিন্দু ও মুসলমাদের মধ্যে চিরন্তন বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে দিল এবং আমাদের মনে তাদের প্রতি ঘৃণার উদ্রক করে বন্ধুত্বের বাঁধন চিরতরে ছিন্ন করে দিল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটলো রাস্তাঘাটে, হাটে-রাজারে, শিক্ষাংগনে এবং স্থান করে নিল মানুষের হৃদয়ে।
তিনি আরও বলেন যে, তিনি যে স্কুলে পড়াশুনা করতেন সেখানে মুসলমান সহপাঠীদের সাথে একত্রে বসতে তাঁরা ঘৃণাবোধ করতেন যে, তাদের মুখ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ বেরোতো। অতএব হিন্দুদের দাবী অনুযায়ী হিন্দু ও মুসলমান ছাত্রদের বসার স্থান পৃথক করে দেয়া হয়েছিল।
মিঃ চৌধুরী বলেন, পাঠাভ্যাস করার আগেই আমাদেরকে বলা হতো যে, একদা ও দেশে মুসলিমি শাসনকালে তারা আমাদের উপর অত্যাচার উৎপীড়ন করে এবং ভারতে তাদের ধর্ম প্রচার করে এক হাতে কুরআন এবং অন্য হাতে তরবারী নিয়ে। উপরন্ত মুসলিম শাসকরা আমাদের নারী অপহরণ করেছে, আমাদের মন্দির ধ্বংস করেছে এবং আমাদের পবিত্র ধর্মীয় স্থানের অবমাননা করেছে। ( N. C. Chaudhury : The Autobiography of an Unknown Indian: Abdul Hamid : Muslim Separatism in India)
এই যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে অবিরল বিদ্বোষাত্মক অপপ্রচার, হিন্দু কবি সাহত্যিক কর্তৃক মুসলমানদেরকে ‘যবন’ ও ‘স্লেচ্ছ’ নামে আখ্যায়িত করণ,তারপর তাদেরকে নিয়ে এক জাতি গঠনের অর্থ ছিল এই যে হিন্দুর ধর্মপ্রথা অনুযায়ী মুসলমানদেরকে একটি অতি নিম্নশ্রেণী হিসাবে হিন্দুর দাসানুদাস করে রাখা। অথবা শক্তি বলে তাদেরকে একেবারে নির্মূল করা। ‘মুসলমানগণ এ ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন এবং তাঁরা কিছুতেই একজাতীয়তার ধারণা মেনে নিতে পারেননি।
যে কংগ্রেস উপমহাদেশেরে একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বলে দাবী করে, এক ভারতীয় জাতীয়তার দাবীদার তার জন্মইতিহাসটা একবার আলোচনা করে দেখা যাক যে সত্যিই সে মুসলমানদের শুভাকাংখী ও প্রতিনিধিত্বকারী কিনা।

কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
কংগ্রেসের জন্মের দু’বছর আগে, ১৮৮৩ সালে, জন ব্রাইট ‘ইন্ডিয়া কমিটি’ গঠন করেন এবং পঞ্চাশজন বৃটিশ এমপিকে তার সদস্য করেন। ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত প্রভাবশালী বৃটিশি সিভিলিয়ান এলেন অক্টাভিয়ান হিউম ( A.O Hume) ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করেন। তিনি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও ভারতের রয়ে যান। তিনি ভারতের সামাজিক পুনরুথানের জন্যে একটি সর্বভারতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠার ধারণা পোষাণ করতেন যা রাজনৈতিক অগ্রগতির সহায়ক হতে পারে। তদনুযায়ী তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের নিকটে একখানি খোলা চিঠি প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি একটি সমিতি ও সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, জনগণের সাথে সরকারের সংযোগ সংস্পর্শ না থাকার কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন। পুনর্গঠনের কাজ স্বয়ং দেশবাসীকেই করতে হবে যা বিদেশীদের দ্বারা আশা করা যায় না যতোই তাঁরা এ দেশকে ভালোবাসুক না কেন।
যাই হোক, এলেন হিউমের উপরোক্ত চিন্তাভাবনা ও চেষ্টাচরিত্রের ফলে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন হয়। এর পেছনে বড়োলাট লর্ড ডাফরিনের যথেষ্ট আশীর্বাদ থাকলেও তিনি সরাসরি এর সাথে জড়িত হতে চাননি।তবে তিনি আশা পোষণ করতেন যে সংগঠনটি সুদৃঢ় ও সুসংহত হয়ে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। হিউম প্রস্তাব করেন যে একজন প্রাদেশিক গভর্ণরকে সভাপতিত্ব করার অনুমতি দেয়া হোক। লর্ড ডাফরিন তাতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনের পর মাদ্রাজের গভর্ণন প্রতিনিধিবৃন্দকে এক সান্দ্ধ্যভোজে অপ্যয়িত করেন। অতএব সরকার এবং কংগ্রেস গঠিত হয় সেজন্যে একদল ইরেজ এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, স্যার উইলিয়ম ওয়ে ডারবার্ন (WEDDERBURN) জর্জ ইউল (YULE) এবং চার্লস ব্র্যাড্ল (BRADLAUGH) চার্লস ব্র্যাডল (BRADLAUGH) ১৮৮৮ সালে কংগ্রেসের বেতনভুক কর্মচারী নিযুক্ত হন। উইলিয়ম ডিগবী ছিলেন লন্ডনের বিশেষ প্রচারকর্মী। ইন্ডিয়া পত্রিকা করে কংগ্রেসের কর্মসূচী এবং ভারতীয় বিষয়াদি বিশেষভাবে ইংরেজ জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। উইলিয়ম হান্টার ছিলেন কংগ্রেসের বড়ো সমর্থক এবং তাঁর জীবনীকার বলেন, বৃটিশ জনমত প্রভাবিত করার পক্ষে হান্টারের কৃতিত্বই একমাত্র কার্যকর। অধ্যাপক সীলি অক্সফোর্ডের ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন। তিনি বলেন ইংল্যান্ড অথবা ফ্রান্সের সংগে ভারতের তুলনা হয় না। ইউরোপের বহু জাতির মতো ভারতে বহু জাতির বাস। স্যার হেনরী জেমসের মতে, ভারতে সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্যে হিন্দুর ধর্মীয় আচরণই দায়ী। স্যার থিওডোর মরিসন বলেন, মসলমানরা ইউরোপীয় সংজ্ঞায় জাতি না হলেও অন্য ভারতীয় থেকে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র ভাবছে ও জাতি হিসাবে গড়ে উঠছে। (abdul hamid: muslim separatism in India, p. 29: justice syed shameem hussain kadir :-creation of Pakistan, p. 12; আবদুল মওদূদ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ; সংস্কতির রূপান্তরঃ পৃঃ ২৭৯-৮০)
একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কংগ্রেসের চরিত্র বৈশিষ্ট্য কি হতে পারবে, তা কংগ্রেসের দু’জন প্রখ্যাত ও অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতার নীতিপদ্ধতি ও রাজনৈতিক দর্শন ও মূলনীতি থেকে ভালোভাবেই অনুমান করা যেতো। তাঁরা ছিলেন বালগংগাধর তিলক ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
তিলক গ্রাজুয়েশনের পর সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন বিগত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথমদিকে। কিন্তু বংগভংগ রদ আন্দোলনের তিনি ছিলেন পুরোভাগে। তিনি দক্ষ রাজনীতিবিদ ও প্রত্যক্ষ সংগ্রামে (direct action) বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি সামরিক মনা মারাঠা জাতির ধর্মীয় ও রাজনীতি ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করেন এবং কংগ্রেসকে সে প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি গো হত্যা নিবারণ সমিতি (anti-cow-slaughter society) গঠন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং মসজিদের সামনে গীতিবাদ্য নিষিদ্ধ করণের প্রতিবাদে আন্দোলন করেন যার ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িক হাংগামা শুরু হয়। অতএব তিলকের নেতৃত্বে সকল ক্ষেত্রে হিন্দু পুনরুজ্জীবনের যে তৎপরতা শুরু হয়েছিল তা ছিল অবশ্যই মুসলিম বিরোধী এবং তাঁর ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদের’ মধ্যে কোনই পার্থক্য ছিলনা। (abdul hamid muslim separatism in India, p, 30)
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী উনবিংশতি শতাব্দীর ষাটের দশকে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে। (ics) যোগদান করেন। কিন্তু কয়েক বছর পরে চাকুরী থেকে অপসারিত হওয়ার পর রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি কংগ্রেসের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর সকল যোগ্যতা ও দক্ষতা মুসলিম স্বার্থ বিরোধী তৎপরতায় ব্যয়িত করেন।
বংগভংগ আন্দোলনে তিনিই সর্বপ্রথম শিংগা ফুকিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বাংলা বিভাগের ঘোষণা শুনে মনে হলো যেন আকাশ থেকে আমাদের উপর বজ্রপাত হলো। আমাদেরকে অপমানিত, অপদন্ত ও প্রতারিত করা হয়েছে। অতঃপর তাঁর উদ্যোগে ১৬ই অক্টোবর (১৯০৫) কোলকাতায় জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। সকল হিন্দু কালো ব্যাজ ধারণ করেন এবং মাথায় ভস্ম মাখেন। অনশন পালন করেন এবং গংগায় স্নান করেন। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
ছ’বছর যাবত হিন্দুদের তীব্র সন্ত্রাসী আন্দোলনের ফলে বংগভংগ ১৯১১ সালে রহিত করা হয়। বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের সান্ত্বনার জন্য সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে কতিপয় কংগ্রেস নেতা তাঁদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, বাংলায় আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপিত হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে। অতএব সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নেতৃত্ব এবটি প্রতিনিধি দল বড়োলাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে সাক্ষাৎ করে। মুখপাত্র সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী বলেন, প্রদেশে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সে দুটি অঞ্চলের অধীবাসীদের মধ্যে বিদ্যামান মতবিরোধ বহুগুণে বেড়ে যাব্ (a hamid: muslim separatism in India, pp. 30, 93)
এসব দৃষ্টান্ত থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষ্য হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন ও রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা।
উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে স্যার সাইয়েদ আহমদ খান ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কংগ্রেসকে ভালো চোখে দেখতে পারেননি। কংগ্রেসের জন্মইতিহাস, তার কেন্দ্রীয় কাঠামো, পরিচালকবৃন্দ, তার নীতিপলিসি ও উদ্দেশ্য লক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সাইয়েদ আহমদ উপলব্ধি করেছিলেন যে,
কংগ্রেস প্রতি পদে পদে মুসলিম স্বার্থে আঘাত হানবে। তাই তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান কংগ্রেসে যোগদান করা থেকে বিরত থাকতে। তিনি বলেন, ভাইসরয়, সেক্রেটারী অব স্টেট এবং এমন কি গোটা হাউস অব কমনস যদি প্রকাশ্যে কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন করে, তথাপি তিনি দৃঢ়তার সাথে এর বিরুদ্ধে অকস্থান করবেন। তিনি আরও বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলো যদি কার্যকর করা হয়, তাহলে বৃটিশ সরকারের পক্ষে শান্তি রক্ষা করা অথবা সহিংসতা ও নিশ্চিত গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।(justice Syed Sharneem Hussain Kadir Creation of Pakistan. P. 12; I H. Qurrshi Struggle for Pakistan. P.29: The Times- 12 Nov. 1888)
সাইয়েদ আহমদের আশংকা ও ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। সমসাময়িক মুসলিম পত্র পত্রিকাও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাদের অভিমত ব্যক্ত করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মুহমেডাম অবজার্ভার,দি ভিক্টোরিয়া পেপার, দি মুসলিম হেরান্ড, রফিক-এ-হিন্দু, প্রভৃতি। নিম্নর মুসলিম সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোও সমম্বরে কংগ্রেসের প্রতি আবেদন জানায়ঃ
সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মুহমেডাম এসেসিয়েশন, দি মুহামেডাম লিটারারী সোসাইটি অব বেঙল, দি আঞ্জমনে ইসলাম অব মাদ্রাজ, দিন্দিগাল আঞ্জুমন,মুহমেডান সেন্ট্রাল এসোসিয়েশন অব দি পাঞ্জা।_ (justice Syed Shameem kadir: Creation of Pakistan. P. 13,14)
কংগ্রেস মিথ্যা ও কপটতাপূর্ণ প্রচারণার দ্বারা মুসলমান ও বহির্বিশ্বকে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। কংগ্রেস সমর্থক কতিপয় ইংরেজও একই ধরনের প্রচারণা চালান। যুক্তরাজ্যে কংগ্রেসের প্রচারকর্মী ডিগবী বলেন, কংগ্রেস সকল জাতি ও শ্রেণীর মুখপাত্র, এমনকি মুসলমানেরও। কংগ্রেসের জন্মদাতা এলেন হিউম কংগ্রেসের সমালোচনা বরদাশত করতে পারতেন না। ইংল্যান্ড গঠিত উন্ডিয়া কমিটিও কংগ্রেসের সাথে সুর মিলিয়ে কথা বলতো। কিন্তু্ এতো সবের পরেও উপমাহাদেশের মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবেই তার পরিচিতি লাভ করে এবং এটাই ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি।

পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি
ধর্মীয় বিশ্বাস, আদর্শ, নিজস্ব সভ্যতা সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য স্বতন্ত্র জীবনবোধ ও জীবন বিধান এবং পরকালে স্রষ্টা রাসুল আলামীনের কাছে জবাবদিহির ও ভিত্তিতে মুসলমান একটি জাতি যা জাতীয়তার অন্যান্য সকল সংজ্ঞা অস্বীকা করে। উপমাহদেশে এ জাতীয়তার তথা ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি স্থাপিত হয় হিজরী ৯৩ সালের রজব মাসে-তথা ৭১২ খৃষ্টাব্দে যখন ইমাদ-আদ্দীন মুহাম্মদ বিন কাসিম নামক সতেরো বছর বয়স্ক এক যুবক অধিনায়ক দেবল (বর্তমান করাচী) পোতাশ্রয়ে অবতরণ করেন এবং রাজা দাহিরের বন্দীশালা থেকে মুসলমান নারী শিশুকে মুক্ত করেন। রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সেখানে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন।
কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাত বলেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা তখনই হয়, যখন প্রথম মুসলমান সিন্ধু ভূখন্ডে প্রথম পদক্ষেপ করেন। (Justice Shameem Hussain Kadir : Creation of Pakistan.1) দেবল অর্থাৎ করাচীর পর নিরন (বর্তমান হায়দরাবাদ) এবং তারপর সিহওয়ানে ইসলামের বিজয় পতাকা উদড্ডীন হয়। অতঃপর ১০ই রমজানুল মুবারক ( হিঃ ৯৩ ) রাওর দুর্গ অধিকৃত হয় এবং যুদ্ধে দেবল রাজা পরাজিত ও নিহত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্রাকহ্মণাবাদ ( বর্তমান সংঘর) এবং আলওয়ার (বর্তমান রূহরীর পূর্বে অবস্থিত শহর) মুসলমানদের করতলগত হয় যার ফলে মূলতান আত্নসমর্পণ করে। ৯৬ হিজরীতে উত্তর ভারতও স্বেচ্ছায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় খলিফা তাঁকে দামেশকে ডেকে পাঠান।
দক্ষ মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর অধিকৃত ভূখন্ডে দৃষ্টান্তমূলক ইসলামী শাসান ব্যবস্থা কায়েম করেন যা হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রজাদের এতোটা মন জয় করতে সক্ষম হয় যে বিরাট সংখ্যক অমুসলিম প্রজা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর ইসলামী শিক্ষার প্রভব এতো বিরাট ছিল যে তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর নিদের্শ অনুযায়ী তাঁদের জীবন ঢেলে সাজান সিন্ধু ভাষার জন্যে আরবী বর্ণমালাও গৃহীত হয়

উপমহাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তার উখান ও পতন
মুহাম্মদ বিন কাসিম এ উপমাহাদেশে শুধু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, তিনি ইসলামী সভ্যতা- সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠারও অগ্রদূত ছিলেন। ইসলামী শাসন ও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতিই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে অগ্রতিহন প্রেরণা সৃষ্টি করে। যে সভ্যতা সংস্কৃতির বীজ বপন করা হয়, তা অংকুরিত হয়ে কালপ্রবাহে বিকশিত ও বর্ধিত হয় এবং পরবর্তীকালে বহু মুসলিম শাসকের বিজয়ীর বেশে এ উপমহদেশে আগমনের ফলে উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামী পতাকা উড্ডীন হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্দ্ধু বিজয়ের পর থেকে এগারো শতাধিক শতাব্দীর মধ্যভাগে নিজেদের মধ্যে চরম অন্তর্দ্বন্দ্বও নৈতিক অধঃপতন এবং বৈদেশিক শক্তির আক্রমণের ফলে উপমাহদেশের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।

ইসলামের সহজাত ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য
ইসালমের অর্থ আল্লাতায়ালার নিরংকুশ দাসত্ব আনুগত্যের জন্যে স্বতঃ সফূর্তভাবে আত্মসর্মণ করা এবং এর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট এই যে, ইসলামের অনুসারীগন কোন খোদাহীন ব্যবস্থা অথবা অমুসলিমদের প্রাধান্য মেনে নিতে পারেনা। ইসলাম মানব জাতির জন্যে একটা পূর্ণাগ জীবন বিধান পেশ করে এবং মৌল নীতি জীবনের সকল আধ্যত্মিক ও বৈষায়িক দিকের উপর সমভাবে প্রযোজ্য। ইসলামের রাষ্ট্র ও ধর্ম পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়, বরঞ্চ জীবনের বৈষয়িক ও পার্থিব দিকওলো জীবনের আধ্যাত্মিক দিকগুলোর সাথে একীভূত। একজন মুসলমান রাষ্ট্রপ্রাধান হিসাবে অথবা সাধারণ নাগরিক হিসাবে তার সকল কাজর্কম সম্পন্ন করে এ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে যে, তার সকল ক্রিয়কর্ম আল্লাহতায়ালা দেখছেন এবং তাঁর কাছে অবশেষে তার সমুদয় কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। ইসলামের উপরোক্ত মৌল নীতি, আদর্শ ও নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কয়েক শতাব্দী যাবত বলবৎ থাকে। দেশের আইন ( Law of the land) ইসলামী হলেও ব্যক্তি ও পারিবারিক আইনের প্রশ্নে অন্য প্রত্যেক সম্প্রদায় তার নিজস্ব ধর্মীয় বিধান মেনে চালার অধিকারী ছিল।
উপমাহদেশের মুসলিম শাসকবৃন্দের মধ্যে আকবর ব্যতীত সকলেই ইসলামী সভ্যতা- সংস্কৃতির ধারকবাহক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি ব্যক্তিজীবনে ৪১৪ বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ইসলামী অনুশাসন পুরোপুরি মেনে চলতে ব্যর্থ হলেও সর্বত্র দেশের ছিল ইসলামী। ইসলামের প্রচারও প্রসারের কাজ শাসকবৃন্দ প্রত্যক্ষভাবে করেননি। এ কাজ নিষ্ঠা সহকারে করেছেন বহিরাগত বহু আলেম- পীর দরবেশ। তবে মুসলিম শাসগণ ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা ও খানকা স্থাপন করেছেন। এ সবের ব্যয়ভার বহনের জন্যে বহু লাখেরাজ জমি দান করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহে উপমাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী দাওয়াত সম্প্রসারণে কার্যকর ভুমিকা পালন করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে উপমহাদেশের অমসলিমগণ ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলামের সূশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়। কালক্রমে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়ে-যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রে রূপন্তরিত হয়।
উপমহদেশে বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রমশঃ ইসলামী শাসন রহিত করে ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও নীতির সাথে সাংঘর্ষিক ইন্ডিয়ান সিভিল এন্ড ক্রিমিনাল কোডস অব প্রসিডিওর এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোড প্রবর্তন ও বলবৎ করা হয়। মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বস্বহারা করে রাখা হলো।
বৃটিশ ও হিন্দুজাতির যোগসাজস ও ষড়যন্ত্রে মুসলমানদেরকে সর্বস্বহারা করা হয়, ক্ষুধা দারিদ্রের নিষ্পষণে নিষ্পেষিত করা হয়। কিন্তু এতদসত্তেও তাদের মনমস্তিস্ক থেকে ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও ইসলামী চিন্তাচেতনা নির্মূল করা যায়নি। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিগত শতাব্দীতে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, বিদ্র্রোহ ঘোষণা করা হয়েছে। সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভীর তাহরিকে মুজাহেদীন ও সশস্ত্র জিহাদ, বাংলাদেশে ফারায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের ইসলামী আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যেমে দুর্বার ইসলামী চেতনারই বহিঃ প্রকাশ ঘটেছে। উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও কয়েক শতাব্দী যাবত তার লালন পালান এবং তা অক্ষুণ্ন রাখার সংগ্রামই পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে।

মুসলমান একটি জাতি
উপরের আলোচনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে মুসলমান একটি জাতির নাম। ঈমান- আকীদাহ ( ধর্মীয় বিশ্বাস) ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, ধর্মের ভিত্তিতে ভালোমন্দ ন্যায়- অন্যায় ও হালাল-হারাম নির্ণয়, জীবনের প্রতিটি প্রকাশ্য ও গোপন কাজের জন্যে পরকালে আল্লাহতালায়ার নিকট জবাবদিহির অনুভূতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি,রুচি ও মননশীলতা, চিন্তাচেতনা-এ সকল দিক দিয়ে মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি। এ স্বাতন্ত্রবোধ ধর্মবিশ্বাস, থেকেই নিঃসৃত। যারা ভৌহীদ,রেসালাত ও আখেরাতে সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসী, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে খোদাকর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যারা পুরোপুরি পালন করে, তারা গোটা মানবজাতির মধ্যে একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং এ জাতিকে আল্লাহতায়ালা ‘উম্মতে মুসলেমা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উপরের গুণালীবিশিষ্ট মানবসমষ্টি মুসলিম জাতি এবং বিপরীত গুণাবলীবিশিষ্ট মানব সমষ্টি অমুসলিম জাতি- তাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু- খৃষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ প্রভৃতি। এর কোন একটির সাথে মিলেও মুসলমান এক জাতি হতে পারেনা। উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান দু’টি পৃথক পৃথক জাতি-তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, ন্যায়-অন্যায় ও হালাল হারামের মাপকাঠি সম্পূর্ণ পৃথক ও বিপরীতমুখী হওয়ায় উহয়ে দু’টি পৃথক জাতি। এ দ্বিজাতিতত্ত্বর ভিত্তেতেই পাকিস্তানের সৃষ্টি।
মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি এ তত্ত্ব আধুনিক যুগের কোন আবিস্কার নয়। দুনিয়ার প্রথম মানষ একজন মুসলমান, আল্লাহর নবী ও খলিফা ছিলেন। আল্লাহ তাকে অগাধ জ্ঞান ভান্ডার দান করেন। তাঁর থেকে ইসলাম ও ইসলামী জাতীয়তার সূচনা। উপমহদেশে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এ তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক ও স্বধীন আবাসভূমি দাবী করা হয়েছিল। এ জাতীয়াতা ইসলামের শাশ্বথ ‘থিওরি’ বা মতবাদ। হিন্দু কংগ্রেস উপমহাদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানের উপর সংখ্যগুরু হিন্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে এক জাতীয়তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন এক প্রখ্যাত আলেম, দেওবন্দের শায়খুল হাদীস মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী। তিনি কংগ্রেসের সুরে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করেন একই ভৌগোলিক সীমারেখার ভিতরে বসবাসকারী মুসলমান নির্বিশেষে মিলে এক জাতি। উপমহদেশে মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে
৪১৬ বাংলার মুসলমাদের ইতিহাস
দ্বিজাতিতত্ত্বের (Two Nation Theory) ভিত্তিতেই পাকিস্তানের দাবী করে। মাওলানা মাদানীর উপরোক্ত ঘোষণায় শুধু মুসলিম লীগ নয়, আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলমান বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তখনো পাকিস্তান দাবী উথাহিত না হলেও মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি এ সত্যটি সকলের জানা ছিল এবং বারবার এ কথা বিভিন্ন সময়ে ঘোষণা করা হয়।
মাওলানা মাদানীর উক্ত ঘোষণা পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দাশর্নিক কবি আল্লামা ইকবালকে অবহিত করা হয়। তিনি ছিলেন রোগশয্যায় শায়িত। তিনি ধীরে ধীরে কম্পিত কলেবরে শয্যার উপর উঠে বসেন এবং স্বভাব কবি রোগযন্ত্রণার মধ্যেও কয়েকছত্র কবিতার সুরে মাদানী সাহেবের উক্তির তীব্র সমালোচনা করেন-
আজম হনুয নাদানিস্ত রমূ যে দ্বীন ওয়ার না,
যে দেওবন্দ্ হুসাইন আহমদ ই’চেবুল আজবীস্ত।
সরুদে বর সরে মেম্বর কে মিল্লা আয ওতনস্ত,
চে বেখবর আয মকামে মুহাম্মদে আরবীস্ত।
বমস্তাফা বরে সা খেশরা কে দ্বীন হমাউস্ত,
আগার বাউ নারসীদী তামেমে বু লাহাবীস্ত।
(আল্লামা ইকবালঃ আরমগানে হেজায্ পৃঃ ২৭৮)
অর্থঃ আজমবাসী দ্বীনের মর্ম বুঝেনি মোটে
তাই দেওবন্দের হুসাইন আহমদ কন আজব কথা।
মেম্বর থেকে ঘোষণা করেন, ‘ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়’
মুহাম্মদ আল আরাবীর মর্যাদা থেকে বেখবর তিনি। পৌছাতে না পারে যদি, সবই হবে বুলাহাবী।
ডঃ ইকবালের কয়েক ছত্র কবিতা যদিও মাওলানা মাদানী সাহেবের মতবাদ খন্ডন করলো, তথাপি তা এক জাতীয়তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট ছিলনা। এ সময়ে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী উপমহদেশের রাজনৈতিক, ধার্মীয় ও সাংস্কৃতিক চুলচেরা পর্যালোচান করে তাঁর সম্পাদিত মাসিক তর্জুমানুল কুরআনে ধারাবাহিকভাবে ‘মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসী কাশমাকা’ শীর্ষখ যে দীঘ্য প্রবন্ধ লেখেন তার মধ্যে ইসলামী জাতীয়তার উপর তথ্যবহুল আলোকপাত করেন। এ বিষয়ের উপরে শাতাধিক পৃষ্ঠার একটি পৃথক গ্রন্হ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্হে তিনি ইসলামী জাতীয়তার ভিত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ
“যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে আল্লাহ ও তাঁর রসুল তা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনীতিক অবৈজ্ঞতার দরুন মানবতাকে বিভিন্ন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত করেছিল, ইসলাম তার সবশ্রেণীর সমমর্যাদাসম্পন্ন এ সমানাধিকার প্রধান করেছে।
“ইসলামী জাতীয়তায় মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়ি্ক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয় যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধমানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্র জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে,তারা সম্পুর্ণ ভ্ন্নি জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। তার অনুসারিগণ নিজেদের পারস্পরিক মতবিরোধ ও বৈষম্য সত্ত্বেও একই দল ও একই মধ্যে গণ্য।
“এ দু’টি জাতির মধ্যে বংশ ও গোত্রের দিক দিয়ে কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য বিশ্বাস ও কর্মের। কাজই একই পিতা-তারর দু’টি সন্তানও ইসলাম ও কুফরের উল্লিখিত ব্যবধানের দরুন স্বতন্ত্র দুই জাতির মধ্যে গণ্য হতে পারে এবং দুই নিঃসম্পর্ক ও অপরিচিত ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষাত হওয়ার কারণে এক জাতির অন্তভূক্ত হতে পারে।
“জন্মভূমির পার্থক্যও এ উভয় জাতির মধ্যে ব্যবধানের কারণ হতে পারে না। এখানে পার্থক্য করা হয় হক এ বাতিলের ভিত্তিতে। আর হক ও বাতিলেরে ‘স্বদেশ’ বা জন্মভূমি বলতে কিছু নেই। একই শহর, একই মহল্লা ও একই ঘরের দুই ব্যাক্তির জাতীয়তা ইসলাম এ কুফরের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন হতে পারে। একজন নিগ্রো ইসলামের সূত্রে একজন মরক্কোবাসীর ভাই হতে পারে।
“বর্ণের পার্থক্যও এখানে জাতীয় পার্থক্যের কারণ নয়। বাহ্যিক চেহারার রং ইসলামে নগণ্য। এখানে একমাত্র আল্লাহর রঙেরই গুরুত্ব রয়েছে। তা- ই হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম রং।
“ভাষার বৈষম্যও ইসলাম ও কুফরের পার্থক্যের কারণ নয়। ইসলামে মুখেরে ভাষার কোনই মূল্য নেই। মূল্য হচ্ছে মনের-হৃদয়ের ভাষাহীন কথার।
“ইসলাম জাতীয়তার এ বৃত্তর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কালেমা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ। বন্ধুতা আর শক্রতা এ কালেমার ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এর স্বীকৃতি মানুষকে একীভূ করে, অস্বীকৃতি মানুষের মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটায়। এ কালেমা যাকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে রক্ত, মাটি,ভাষা, বর্ণ অন্ন, শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি কোন সূত্র এবং কোন আত্মীয়তাই যুক্ত করতে পারে না। অনুরূভাবে এ কালেমা যাদেরকে যুক্ত করে তাদেরকে কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন করতে পারে না
মাওলানা আরও বলেন”
“উল্লেখ্য যে অমুসলিম জাতি সমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে মানষ হওয়ার দিক দিয়ে মসলিম-অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থখ্য হেতু আমাদেরকে তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে। কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে। এমনকি তারা যাদ ইসলামের দুশমন না হায়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Comrnon Cause) সহযেগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে ‘একজাতি’বানিয়ে দিতে পারেনা”
মাওলানা মওদূদীর ইসলামী জাতীয়তা সম্পর্কিত উক্ত গ্রন্হখানি তৎকালীন চিন্তাশীল মুসলিম সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মাওলানা মাদানীর ব্ক্তৃতা ও পুস্তিকা যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা কর্মীগণ একে শাণিত হাতিয়ার হিসাব ব্যবহার করেন। বস্তুতঃ এ গ্রন্হখানিই দ্বিজাতিতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রচনা করে এবং এটাই পাকিস্তান সৃষ্টর মূল কারণ হয়ে পড়ে। গ্রন্হখানি কংগ্রেসের মারাত্মক রামরাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা এবং মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানীর আঞ্চলিক জাতিয়তার যুক্তিতর্ক নস্যাৎ করে তাকে অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, অনৈসলামী এবং অন্তঃসার শূন্য প্রমাণ করে।
উপরে বর্ণিত বুনিয়াদী কারণেই মানব সৃষ্টর সূচনা থেকেই মুসলমান ও অমুসলমান দু’টি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার উদ্ভব হয়েছে- এযাবত তা বলবৎ আছে এবং চিরদিন থাকবে।ঐ একই কারণে উপমহাদেশে মুসলমান ও অন্যান্য জাতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এখানে শত শত বছর ধরে হিন্দু ও মুলমান একত্রে বাস করে আসছে- একই শহরে, গ্রামে ও মহল্লায়- একই আঙিনার এপারে-ওপারে। একই ভাষায় উভয়ে কথা বলে, একই মাটিতে জন্ম, একই আলো- বাতাসে লালিত- পালিত ও বর্ধিত। কিন্তু উভয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি, একই জাতিতে পরিনতি হয়নি। উপমহাদেশের অনেক পন্ডিত ব্যক্তিও এ সত্য স্বীকার করেন। স্বয়ং কবি রবিন্দ্রনাথের কথাই ধরা যাক। তিনি বলেনঃ
“আর মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু- মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধও।
আমরা বহু শত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক ক্ষেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি। আমরা এক ভাষার কথা কই, আমরা একই সুখ দুঃখের মানুষ। তবু প্রতিবেশীর সংগে যে সম্বন্ধ মনুষোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া
এমন একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি যে একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই।
আমরা জানি বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসেনা-ঘরে মুসলমান আসিয়া জাজিমের এক অংশ কতুলিয়া দেয়া হয়, হুকার জল ফেলিয়া দেয়া হয়”। (রবীন্দ্র রচনাবলী, ১২শ খন্ড, পৃঃ ৯০৯; আবদুল মওদূদঃ মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশঃ সংস্কৃতির রুপান্তর; পৃঃ ৪২০)
বাবু নীরদ চৌধুরী বলেনঃ
“সত্য বলতে মিঃ জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের বহু পূর্বেই দুই জাতিতত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। আর এ শুধু তত্ত্বকথা না, এটা ঐতিহাসিক বাস্তব ঘটনা। সকলেই বর্তমান শতকের প্রথমে এটির অস্তিত্বের কথা জানতো। এমনকি আমরা ছেলেবেলায় স্বদেশী আন্দোলনের পূর্ব থেকেই জানতাম”। (autobiography of an unknown Indian, pp. 229-31)
এ সত্যটি ইউরোপীয়দেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক এ কথাটি পরিষ্কারভাবে বলেনঃ
“হিন্দু ও মুসলমান এক গ্রামে, এক শহরে, এক জেলায় বাস করলেও বরাবর দু’টি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রে ইউরোপের দু’টি জাতির চেয় আরও বিচ্ছিন্ন থেকেছে। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, ফরাসী ও জার্মান জাতি ইউরোপবাসীদের চক্ষে দু’টি কট্টর দুশমনের জাতি। তবুও একজন ফরাসী যুবক জার্মানীতে ব্যবসায় বা শিক্ষাব্যপদেশে গিয়ে যে কোন জার্মান পরিবারে সহজে বাস করতে পারে, একসাথে থানা খেতে পারে, একই উপাসনা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু কোন মুসলিম কোন হিন্দু পরিবারে এমন প্রবেশাধিকার পায়না”। (s.t. morison: political India.p. 103)
স্বয়ং হিন্দুধর্মের অথবা ব্রাক্ষণদের স্বকপোলকল্পিত ধর্মীয় বিধি-বিধানের রম সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, পরধর্মের প্রতি সহনশীলতার চরম অভাব মুসলমানদের প্রতি অমানবোচিত আচরণের জন্যে দায়ি। হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য তার বর্ণপ্রথা (caste system)। এ প্রথা অনুযায়ী হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে বর্ণিত কিছুসংখ্যক মানুষকে নিন্মশ্রেণী বলে অভিহিত করা হয়। হিন্দুধর্ম তাদেরকে কোন মানবিক অধিকার দেয় না। তারা ঘৃণ্য, অপবিত্র, অস্পৃশ্য, তাদেরকে হিন্দুধর্মের অর্ন্তভুক্ত বলে ঘোষাণা করে তাদেরকে এ ধরণা দেয়া হয়েছে যে, উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের সেবা কারার জন্যেই তাদেরকে সৃষ্টি এবং এটাই তাদের ধর্ম এটাই তাদের মহাপুণ্য কাজ। উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর সাথে নিম্নশ্রেণীর হিন্দু একই বিদ্যালয়ে বিদ্যাভ্যাস করতে পারেনা। হিন্দু হয়েও নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ধর্মগ্রন্হ পড়তে পারেনা, মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না। হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে কথিত একটি সাথে হিন্দু সমাজের আচরণ হলে মুসলমানদের সাথে অধিকতর বর্বরোচিত হওয়াই স্বাভাবিক। তাই মুসলমানদের সাথে ব্স্তুই হিন্দুর কাছে অপবিত্র ও অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। তবে মুসলমানদের সাথে আচরণে অধিকতর কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছে মুসলিম শাসনের অবসান ও বৃটিশ শাসন প্রতিষ্ঠর পর, উপমহাদেশে মুসলমানের অস্তিত্বই ছিল তাদের অসহনীয়।
মুসলমানদের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে হিন্দুরা মসুলমানের সাথে বিরোধের ছলছুতো তালাশ করতো। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রাচীনকালে হিন্দুদের গরুর গোশত ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিলনা। গরুর গোশত এক অতি উপাদেয় খাদ্য এবং মুসলমানসহ দুনিয়ার সকল মানুষ তা ভক্ষণ করে থাকে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে পশু কুরবানী মুসলমানদের প্রতি ইসলামের নির্দেশ। যেসব পশু কুরবনী করা জায়েয তাদের মধ্যে গরু অন্যতম। উপমহদেশে মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষ বাধাবার ছুতো হিসাবে গরুকে হিন্দুর উপাস্য দেবতার আসনে স্থান দেয়া হায়। অতঃপর গোহত্যা-নিবারণ সমিতি’ ‘গোরক্ষিনী সমিতি’ প্রভৃতি স্থাপন করে মুসলমানদের সাথে সাম্প্রদায়ি সংঘর্ষর সূত্রপাত করা হয়। একই বস্তু একজাতির আহার্য এবং অন্য জাতির উপস্য দেবতা। গরুকে দেবতা বলে স্বীকার করার পর দুনিয়ার প্রতিটি গরু ভক্ষণকারীকে নির্মূণ করা হবে হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মীয় কর্তব্য। অতএব গরু ভক্ষনকারী ও গরুর পূজারী দুই জাতি গঠন গোপূজারী জাতিই বা কি করে মেনে নিতে পারে? এ দুই জাতিকে মিলিত করে এক জাতি গঠনের প্রচেষ্টা শুধূ হাস্যকরই নয়, দুরভিসন্ধিমূল ।
হিন্দু ও মুসলমান যে দুটি পৃথক-কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নহও তা অকাট্য যুক্তিসহ প্রমাণ করেন। ১৯৪০ সালের ২২শে মার্চ লাহোরের মিন্টু পার্কে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে তিনি তাঁর সভাপতির ভাষেণে বলেনঃ
“এ কথা বঝা বড়ো কঠিন যে আমাদের হিন্দু ভাইয়েরা ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ কেন বুঝতে পারেন না। আসলে এদুটো কোন ধর্ম নয় বরঞ্চ প্রকৃত পক্ষে দুটো পৃথক ও সুস্পষ্ট সামাজিক বিধিবিধান( Social order) এবং হিন্দু ও মুসলমানকে মিলি করে এক জ্ঞাতীয়তা গঠন একটি কল্পনাবিলাস মাত্র। এক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভুল ধারণাটি সীমালংঘন করে আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে পড়েছে। যথাসময়ে আমাদের দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তন করতে ব্যর্ধ হলে, ভারতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হবে। হিন্দু ও মুসলমানের পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি ও সাহিত্যাবলী আছে। তারা দুটি স্বতন্ত্র সভ্যতা সংস্কৃতিরও অধিকারী যা দুটি বিপরীত ধারণা বিশ্বাসের ভিত্তিতে গঠিত। তাদের জীবনের ইতিহাসের ভ্ন্নি উৎস থেকে প্রেরণা লাভ করে। তাদের রয়েছে পৃথক মহাকব্য, মহগ্রন্হ, পৃথক জাতীয় বীর এবং পৃথক প্রাসংগিক উপাদান ও ঘ্টনাপঞ্জী।
অধিকাংশক্ষেত্রে একজনের জাতীয় বীর অন্য জনের শক্র। এ ধরনের বিপরীতমুখী দুটি জাতিকে যাদের একটি সংখ্যাগুরু এবং অপরটি সংখ্যালঘূ- একই রাষ্ট্র যুক্ত করে দিলে অশান্তি বাড়তে থাকবে এবং এমন রাষ্ট্রে সরকার পরিচলানার জন্যে যে কাঠামোই তৈরী হবে তা শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে।
জাতিরি যে কোন সংজ্ঞা অনুযায়ী মুনলমান একটি জাতি এবং অবশ্যই তাদের থাকতে হবে একটি আবাসভূমি, একটি ভূখন্ড বা অঞ্চল এবং একটি রাষ্ট্র। আমাদের জাতি প্রতিভা অনুযায়ী নিজস্ব আদের্শর ভিত্তিতে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজি ও রাজনৈতিক জীবনে উন্নতি সাধন করু – এটাই আমাদের কামনা।“
সর্বশেষে কায়েদে আজম বলেনঃ
“ইসলামের অনুগত বান্দাহ হিসাবে এগিয়ে আসুন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে জনগণকে সংগঠিত করুন। আমি নিশ্চি আপনারা এমন এক শক্তিতে পরিনত হবেন। যাকে দুনিয়ার কোন শক্তি পরাভূত করতে পারবেনা।“
পরদিন অর্থাৎ ২৩শ মার্চ উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগারিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গহীত হয়। এ প্রস্তাব পেশ করেন বাংলর প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা মৌলভী এ,কে ফজলুল হক। মূল প্রস্তাবের ভাষা নিম্নরূপঃ
Resolved that it the considered view of this Session of the All India Muslim League that no Constitutional Plan would be workable in this country or acceptable to the Musilms unless it is designed on the following basic principles, viz, that geographically contiguous units are demarcated into rerritorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the North- western and Eastern zones of India should be grouped to constitute ‘independent States’ in which the Constiuent units shall be autonomous and sovereign.
That adequate, effective and mandatory safeguards should be specially provided in the Constitution for minorities in these units and in the regions for minorities in these, cultural, economic, political, of their religious, cultural, economic, political, administrative and oher rights and interests in consultation with them, and in other parts of India where the Mussalmans are in a minority, adequate, effective and mandatory safeguards shall be specially provided in the constitution for them and other minorities for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.
Justice Syed Shameem Husain Kadir Creation of Pakistan, p. 192.
লাহোরে প্রস্তাবের সাথে এ ঘোষণাও সুস্পষ্টরূপে করা হয় যে, এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে পরামর্শক্রমে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত করা হবে। অনুরূপভাবে ভারতের যেসব অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যালঘু, সেসব অঞ্চলে তাদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এ প্রশাসনিক অধিকার এ স্বর্থ সংরক্ষিত করতে হবে।

হিন্দুদের বিরোধিতা
লাহোরে প্রস্তাবের ভালো দিকটার কোন প্রকার বিচার বিবেচনা না করেই হিন্দুদের পক্ষ থেকে তার চরম বিরোধিতা করে অশালীন ব্ক্তব্য বিবৃতি প্রকাশিত হতে থাকে। মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার এবং তাদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির সকল তৎপরতা শুরু হয়।ওয়ার্ধাও একই সুরে কথা বলতে থাকে। মিঃ গান্ধী আশা করেন যে, নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন হিন্দু প্রভাবিত পত্র পত্রিকার পক্ষ থেকে লাহোরে প্রস্তাবের উপর অবিচল থাকেন। তিনি বলেন, আমি এখনো আশা করি, বিবেকবান হিন্দুগণ আমাদের প্রস্তাব গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখবেন। কারণ এর মধ্যে স্বল্প সময়ে স্বাধীনতা লাভের সম্ভবনা নিহিত আছে। এ স্বাধীনতা আমরা শান্তিপূর্ণভাবে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ধরে রাখতে পারবো ছাব্বশি মে, ১৯৪০ বোম্বে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কায়েদে আজম কংগ্রেসের মিথ্যা প্রচারণার উল্লেখ করে বলেনঃ
এ অত্যন্ত বিস্ময়কর যে মিঃ গন্ধী ও মিঃ রাজা গোপালাচারিয়ার মতো লোক লাহোর প্রস্তাবকে ‘ভারতের অংগচ্ছদ’ (Vivisection of India) এবং ‘শিশুকে দুখন্ড কর্তিত করার’ নামে আখ্যায়িত করছেন। ভারত অবশ্য প্রকৃতি কর্তৃকই বিভ্ক্ত। ভারতের ভৌগোলিক মানচিত্রে মুসলিম ভারত এবং হিন্দুভারত স্থান লাভ করে আছে। তাহলে এ হৈ চৈ কেন তা আমি যা দ্বিধাবিভক্ত ও দ্বিখন্ডিত করা হচ্ছে? কোথায় সে কেন্দ্রীয় সরকার যার হুকুম শাসন লংঘন করা হচ্ছে? ভারত বৃটিশের শাসনাধীন থাকার ফলে অখন্ড ভারত ও একটি একক কেন্দ্রীয় সরকারের ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারতীয় জাতি এবং কেন্দ্রীয় সরকার বলে কিছু ছিলনা। এ কংগ্রেস হাই কমান্ডের খোশখেয়াল মাত্র।.... আমাদের আদর্শ ও সংগ্রাম কারো স্বার্থে আঘাত দেয়ার জন্যে নয়, বরঞ্চ নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যে।
( Justice Syed Shameem Husain Kadir Creation of Pakistan, pp. 193-94)
উল্লেখ্য লাহোর প্রস্তাবে ‘পাকিস্তান’ শব্দের উল্লেখ না থাকলেও হিন্দু ভারতই একে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে অভিহিত করে। আর এটাই ছিল যথার্থ। বহু দিন পূর্বে চৌধুরী রহমত আলীর দেয়া নামটাই সার্থক হলো।

পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা
পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা অথবা পরিকল্পনা কোন অভিনব রাজনৈতিক দশর্ন নয়। এ শব্দটির প্রকৃত মর্ম হলো ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তাই কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাত বলেন, পাকিস্তানের সূচনা তখন থেকে হয় যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম বিজয়ীর বেশে সিন্দ্ধুতে পদার্পণ করেন।অতঃপর এ উপমহাদেশে কয়েকশ’ বছর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে পুনরায় বৃটিশ ভারতে মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠর চিন্তভাবনা ও প্রচেষ্টা শুরু হয়। উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ- পূর্ব অঞ্চলগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রাজনৈতিক চিন্তাশীলদের দৃষ্টি এড়্য়নি। তাই বিশ্ব ইসলামী ঐক্যের অগ্রদূত সাইয়েদ জামালুদ্দীন আফগানিস্তান এবং উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম রিপাবলিক গঠনের সম্ভবনা সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করেন, এটাকে অনেকে প্যানইসলামিজম নামে অভিহিত করেন।
চৌধরী রহমত আলী ১৯১৫ সালে ‘বজমে শিবলী’ অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে দাবী করেন যে, উত্তর ভারত মুসলিম অধ্যুষিত বলে তাকে মুসলিম দেশ হিসাবেই গণ্য করা হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, “এটাকে আমরা মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করব। এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা এবং আমাদের উত্তরাঞ্চল ভারতীয় হওয়া পরিহার করব।এটা পূর্বশর্ত। অতএব যতো শীঘ্র আমরা ভারতীয়তা (indianism) পরিহার করব, ততোই আমাদের ও ইসলামের জন্য মংগলকর হবে। (I. H Qureshi The Struggle Pakistan, pp. 115-116)
অতঃপর ১৯১৭ সালে ডাঃ আবদুল জাব্বার খাইরী এবং অধ্যাপক আবদুস সাত্তার খাইরী (তাঁরা খাইরী ভ্রাতৃদ্বয় নামে পরিচিত) স্টকহলমে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভারত বিভাগের পরিকল্পনার প্রস্তাব উথাপন করেন। (Syed Sharifuddin pirzada: Evolution of Pakistan, (Lahore,1963 pp. 68-90)
বাদাউনের ‘যুলকারনাই’ পত্রিকায় ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে জনৈক আবদুল কাদির বিলগ্রামীর পক্ষ থেকে মিঃ গান্ধীর নামে খোল চিঠি প্রকাশিত হয়। ও চিঠিগুলোতে তিনি উপমহাদেশ বিভাগের যুক্তি পেশ করেন। এ বিভাগের জন্যে তিনি মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলোর একটি তালিকাও পেশ করেন। যা প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের উভয় অংশের ভৌগোলিক সীমার সাথে প্রায় সামঞ্জস্যশীল। যেহেতু ও চিঠিগুলোতে উল্লেখ্য বিষয় অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে জন্যে তা দু’বার পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। (Muhammd Abdul Qadir Bilgrami Hindu Muslim Ittehad par Khula Khat Mahatma Gandhi Ken am Aligarh, 1925)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে টাইমস অব ইন্ডয়ার সম্পাদক লোভাট ফ্রেজার ডেইলী এক্সপ্রেস অব লন্ডনে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন যাতে কন্সটান্টিনোপল থেকে ভারতের সাহরানপুর-এর দিকে একটি তীর অংকিত করা হয়। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর দিকে এক মুসলিম করিডোর দেখানো হয়েছে। (I.H Qureshi The Muslim Community of the indo-pakistan Subcontinent, pp. 295-96)
হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকার প্রায় উল্লেখ করতেন যে, হিন্দু ও মুসলমান দু’টি পৃথক জাতি। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার অন্য এক নেতা লালা লাজপাত রায় ১৯২৪ সালে ভারত বিভাগের প্রস্তাব দেন।(LH. Qureshi: The Struggle for Pakistan, p. 116: Richard Symonds The Naking of Pakistan, 1950,p.59)
ডেরা ইসমাইল খান জেলার সরদার মুহম্মদ গুল খান ১৯২৩ সালে ফ্রন্টিয়ার ইনকোয়ারীক কমিটির কাছে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ ভারত বিভাগের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। পেশাওর থেকে আগ্রা পর্যন্ত অঞ্চল মুসলমানেদের জন্যে নির্ধারণ করার দাবী জানান। (I.H> Qureshi The Struggle for Pakistan, p.116-17)
আগা খান ১৯২৮ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত সকল দলীয় কনভেনশনে প্রত্যেক প্রদেশের স্বাধীনতার দাবী উথাপন করেন। (উক্ত গ্রন্হ)
ডঃ মাহম্মদ ইকবাল ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ বার্ষিক সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনার পর বৃটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই অথবা বাইরে মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উথাপন করেন।
ডঃ ইকবাল তাঁর প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রর কোন নাম দেননি। এ কাজটি করেছেন চৌধুরী রহমদ আলী। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারী মাসে, চৌধুরী রহমত আলী এবং তাঁর ক্যাম্ব্রিজের তিনজন সহকর্মী নাউ অর নেভার (Now or Never) শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন।
চৌধূরী রহমত আলী তাঁর প্রচারপত্র ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে, লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানকারী মুসলিম ডেলিগেটদের কাছে এবং ইংলন্ডের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকটে প্রেরণ করেন। একখানি প্রত্রসহ প্রচারপত্র পাঠানো হয় তাতে বলা হয় আমি এতদসহ পাকিস্তানের তিন কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে একটি আবেদন আপনাদের সামনে পেশ করছি, যারা ভারতের উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি প্রদেশে বাস করে যথা পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সামান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর সিন্দ্ধু ও বেলুচিস্তান { উল্লখ্য চৌধুরী রহমত আলী উপরোক্ত পাচটিঁ প্রদেশ নিয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের দাবী করেন যার নাম তিনি পাকিস্তান’দেন}
মুসলমানদের এক জীবন মরণ সন্দ্ধিক্ষণে এ আবেদন করা হয়। বলা হয়, ভারত একটি জাতির দেশ নয়, বরঞ্চ বহু জাতির দেশ।.......... আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আমাদের সামাজিক রীতি-নীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের উত্তরাধিকার ও বিবাহ সম্পর্কিত আইন ভারতে বসবাসকারী অন্যান্য জাতির থেকে মূলতঃ পৃথক। আমরা জতীয় রীতি-নীতি ও প্রথাপদ্ধতি এবং বর্ষ, মাস ও দিন পাঞ্জকা পৃথক। এমনকি আমাদের আহারাদি ও পোশাক পরিচ্ছদও সম্পুর্ণ আলাদা। যদি আমরা, পাকিস্তানের মুসলমানকে আমাদের জাতীয়তার সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যসহ প্রতারিত করে প্রস্তাবিত ভারতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে আমাদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হবে। এ প্রস্তাব আমাদের জাতির মৃত্যুঘন্টারই অনুরূপ।–( G. Allana Muslim Political Thought Through theAges 1562-1947,pp. 295-300)
এ কথা নিঃ সন্দেহে বলা যায় যে, ‘পাকিস্তান’ নামটি চৌধুরী রহমত আলীরই উদ্ভবন- যা লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের রাজনৈতিক অংগনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং প্রায় সাত বছর পর তা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়।
সাইয়েদ শরীফুদ্দীন পীরজাদা তার (Evolution of Pakistan ) গ্রন্হে বলেনঃ এসব প্রস্তাব ও পরামর্শ যা স্যার আবদুল্লাহ হারুন, মাওলানা মওদূদী, চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রমুখ ব্যক্তিগণ উপস্থাপন করেন তা সবই এক অর্থে পাকিস্তান সৃষ্টরই পথ নিদের্শক ছিল।
সর্বশেষে ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ কর্তৃক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লাহোর প্রস্তাব তথা পাকিস্তান প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

ষষ্ঠ অধ্যায়
পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা
পাকিস্তান তাথা ভারত বিভাগের প্রস্তাব হিন্দুরা তাদের স্বার্থের পরিন্হী মনে করে মেনে নিতে পারেনা এবং তাই তারা তীব্র বিরোধিতা শুরু করে।পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ৬ই মে পুনাতে, বলেন,হিন্দু মহসভা এবং মুসলিম লীগের কোন ইতিবাচক কর্মসূচী নেই। তিনি পাকিস্তান প্রস্তাবকে নির্বুদ্ধতা বলে আখ্যয়িত করে বলেন, এ চব্বশি ঘন্টার অধিককাল টিকে থাকবেনা। হিন্দু মহাসভা ১৯ মে পাকিস্তান প্রস্তাবকে হিন্দু বিরোধী এবং জাতীয়তা বিরোধী বলে উল্লেখ করে।
কংগ্রেস ও হিন্দুজাতির চরম বিরোধিতা ও প্রতিবন্দ্ধকাত সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্দোলন চলতে থাকে এবং হিন্দুদের বিরোধিতা ও অপপ্রচার মুসলমানদের ঐক্য সুদৃঢ় করতে থাকে।
পাকিস্তান আন্দোলকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণার জন্যে মুসলিম ভারতের ইতিহাসে সর্বত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়, তা এই যে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামিলুদ্দীন আহমদকে আহবায়ক করে একটি লেখক কমিটি গঠন করা হয়। প্রখ্যাত প্রবন্দ্ধকারগণ বিভিন্ন প্রচারপত্র রচনা করেন এবং সেগুলো পাকিস্তান সাহিত্য অনুক্রম (Pakistan Literature series) নামে লাহোরের শেখ মুহাম্মদ আশরাফ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। জামিলুদ্দীন আহমদ বলেন, স্বাধীন পাকিস্তান এবং স্বাধীন হিন্দুস্তান বন্দ্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে অবস্থান করতে থাকবে। ভারতীয় ঐক্য এক অলীক কল্পনা বিলাস এবং ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্হী। (I.H Qurshi The Struggle for Pakistan, o. 136)
পয়লা জুলাই, ১৯৪০ কায়েদে আযম শিমলা অবস্থানকালে ভাইসরয়ের নিকটে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং প্রস্তাবগুলোকে “পরীক্ষামূক” বলে চিহ্নিত করেন। প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপঃ
ভারত বিভাগ এবং উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের যে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কোন বিবৃতি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা যাবে না
ভারতের মুসলমানদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিশ্চিয়তা দান করতে হবে যে, মুসলিম ভারতের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন অন্তর্বর্তীকালীন অথাবা চুড়ান্ত সাংবিধানিক স্কীম গঠন করা হবে না। ইউরোপে যেভাবে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে এবং ভারত বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে তাতে আমরা পুনোপুরি উপলদ্ধি করছি যে, যুদ্ধ প্রচেষ্টা তীব্রতর করা উচিত। যাতে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শান্তি শৃংখলা নিশ্চত করা সম্ভব যদি বৃটিশ সরকার কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারসমূহে দেশ পরিচানার ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্বকে সমান অংশীদার হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হন।
সাময়িকভাবে এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় নিন্মক্ত পদক্ষেপ করতে হবে যাতে সরকারের অধিকার এখতিয়ারে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সরকারের সাথে সহযোগিতার ফরমুলা মেনে চলা যায়ঃ
ক. বর্তমান সাংবিধানিক আইনের আওতায় ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিন্স সম্প্রসারিত করতে হবে। আলোচনার পরই অতিরিক্ত সংখ্যা নির্ধারিত হবে। কিন্তু মুসলিম প্রতিনিধিত্ব অবশ্যই হিন্দুর সমসংখ্যক হতে হবে যদি কংগ্রেস যোগদান করেন। অন্যথায়, অতিরিক্ত সদস্যদের অধিকাংশ মুসলমান হতে হবে। কারণ প্রধান গুরুদায়িত্ব মুসলমানদেরকেই বহন করতে হবে।
খ. যে সকল প্রদেশে আইনের ৯৩ ধারা বলবৎ, সেখানে নন- অফিসিয়াল উপদেষ্টা নিয়োগ করতে হবে। আলোচনার পর সংখ্যা নির্ধারিত হবে। তবে উপদেষ্টাগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মুসলিম প্রতিনিধিগণের হবে। কিন্তু যেসব প্রদেশে কোয়ালিশন সরকার আছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর দায়াত্বি হবে আলোচানার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
গ. প্রেসিডেন্টসহ পনেরো জনের একটি সমর কাউন্সলি (War Council) হবে। ভাইসরয় সভাপতিত্ব করবেন। এখনেও মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর সমান হবে যদি কংগ্রেস যোকদান করে।
সর্বশেষ কথা এই যে, সমর কাউন্সিলে, ভাইসরয়ের কার্যকরী কাউন্সিলে (Executive Ccouncil) এবং গভর্ণরের নন-অফিসিয়াল উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা মুসলিম প্রতিনিধি হবেন, তাঁদেরকে বেছে নেবে মুসলিম লীগ।
পয়লা জুলাই সুভাসচন্দ্র বোস গ্রেফতার হন এবং তেসরা জুলাই মিঃ গান্ধী বৃটেনের প্রতিটি নাগরিকের কাছে অহিংস নীতি অবলম্বন করে অস্ত্র পরিহারের আবেদন জানান। সাথে সাথেই দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার পুনর্দাবী করা হয়। সেইসাথে কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার গঠনের দাবীও জানানো হয়।
মিঃ জিন্নাহ ভাইসরয়ের নিকট তাঁর যে পরীক্ষামূল (Tentative) প্রস্তাব পেশ করেন, সে সম্পর্কে ভাইসরয় ৬ই জুলাই তারিখে লিখিত তাঁর পত্রে তাঁর দৃষ্টভংগী মিঃ জিন্নাহকে জানিয়ে দেন।তিনি তাঁর কাউন্সিল সম্প্রসারণে সম্মত হন কিন্তু তার মধ্যে মুসলিম অংশীদারিত্ব অসম্মতি জানান। কাউন্সিলের মুসলিম সদস্যগণকে মুসলিম লীগ নমিনেশন দেবে এ দাবী মানতেও তিনি রাজী নন। কারণ, তিনি বলেন, এটা ভারত সচিবের অধিকার এবং কাউন্সিল সদস্যগণ রাজনৈতিক দলের মনোনীত হবেন না। প্রাদেশিক গভর্ণরদের নন- অফিসিয়াল উপদ্ষ্টে নিয়োগও তিনি মেনে নিতে পারেন না। ওয়ার কাউন্সিল (War Council) গঠনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।এর বিস্তারিত খুটিনাটি বিষয়গুলো নির্ধারিত করা হবে।
মিঃ জিন্নাহর পরীক্ষামূলক প্রস্তাবের শর্তাবলী প্রত্যাখ্যান করা হলো। কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিক মিঃ জিন্নাহ দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি তাঁর আলাপ আলোচানা অব্যাহত রাখেন।

ব্রিটিশ সরকারের আগস্ট প্রস্তাব
ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে মতানৈক্য এবং কংগ্রেসলীগ ও বড়োলাটের মধ্যে মতবিরোধের কারণে হতাশ হয়ে পড়েননি।১৯৪০ সালের ৮ই আগস্ট ব্রিটিশ সরকার যে ঘোষাণা দেন তা আগস্ট প্রস্তাব নামে অভিহতি করা হয়।এ ঘোষণায় কিছু নতুন ধারণা দেয়া হয়। প্রথমতঃ ইন্দোব্রিটিশ ইতিহাসে এই প্রথমবার ভারতীয়দের নিয়ে একটি গণপরিষদ গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।এ যাবত ব্রিটিশ পার্লান্টের ইচ্ছাই ছিল চুড়ান্ত এবং ভারত সরকার আইন ১৯৩৫ এ প্রাধান্য অনুমোদন করতো। এখন ভারতীয় গণপরিষদের ধারণা শুধু সমর্থনই করা হলোনা, বরঞ্চ তা গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হলো।দ্বিতীয়তঃ গণপরিষদ সম্পর্কে কংগ্রেসের ধারণা প্রত্যাখ্যান করা হয়। একথাও সুস্পষ্ট করে বলা হয় যে, গণরিষদ এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেনা যার দ্বারা সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়। তৃতীয়তঃ ডমিনিয়ন স্টেটাসকেই ভারতের লক্ষ্য মনে করা হয়। এসব ব্যবস্থা গৃহীত হবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। আগষ্ট প্রস্তাবের কিছু মন্দ দিকও ছিল যা লীগ ও কংগ্রেসের প্রস্তাবে তুলে ধারা হয়।
মিঃ জিন্নাহ ১২ই ও ১৪ই আগষ্ট উপরোক্ত প্রস্তাব নিয়ে মতবিনিময় করেন। তবে পয়লা ও দুসরা সেপ্টেম্বরে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র মুসলিম লীগের অনুমোদন ব্যতীত প্রণীত হবে না এ দাবী মেনে নেয়ার মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। সেইসাথে এয়ার্কিং কমিটি এ কথা ঘোষণা করা যথার্থ মনে করে যে, কমিটি লাহোর প্রস্তাব ও তার শর্তাবলীর মূলনীতির উপর অবিচল আছে এবং তা এই যে, ভারতের মুসলমান একটি জাতি এবং তাদের ভবিষ্যৎ ভাগ্য নির্ধারণের অধিকারী তারাই। মধ্যেবর্তী ব্যবস্থার জন্যে সরকারের প্রস্তাব অসন্তোষজনক। মুসলিম লীগ এয়ার্কিং কমিটির ১৬ই জুনের দাবীগুলি মেনে নেয়া হয়নি। নিম্নলিখিত কারণে সরকারের আগস্ট প্রস্তাব মেনে যায় না বলে মুসলিম লীগরে পক্ষ থেকে ঘোষাণা করা হয়ঃ
১. বড়োলাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যার যে প্রস্তাব করা হয়, সে সম্পর্কে লীগ সভাপতি অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সাথে কোন আলাপ আলোচানা করা হয়নি।
২. কাউন্সিল কিভাবে গঠিত হবে তার ধরন সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটিকে অবহিত করা হয়নি।
৩. অন্য কোন দলের সাথে কাজ করতে লীগকে ডাকা হবে ও সম্পর্কে ওয়ার্কিং কমিটি অবহিত নয়।
৪. কাউন্সিলের নতুন সদস্যদের কোন কোন পদ (Portfolio) দেয়া হবে, সে সম্পর্কে লীগের কোন ধারনা নেই।
৫. যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদ (War Advisory Council) সম্পর্কে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা অম্পষ্ট ও দুর্বোধ্য।
মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তার সভাপতিকে এ ক্ষমতা দান করে যে, তিনি প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্র, যুদ্ধ উপদেষ্টা পরিষদের গঠন পদ্ধতি ও দায়িত্ব কর্তব্য এবং বড়োলাটের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কলেবর বৃদ্ধি সম্পর্কে বড়োলাটের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করবেন।
মিঃ জিন্নাহ ২০শে সেপ্টম্বর বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পরদিন বড়োলাটে লীগের উথাপিত প্রশ্নগুলির জবাব দেন। ২৮শে সেপ্টম্বর নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন বড়োলাটের জাবাব সম্পর্কে আলোচানা হয়। বড়োলাটের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয় বলে কমিটি অভিমত ব্যক্ত করে। সরকারের আগস্ট প্রস্তাব সম্পর্কে কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তীব্র। কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ১০ই আগস্ট বড়োলাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানান। কংগ্রেস প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। বলা হয়, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নন এবং প্রস্তাবটি সরাসরি দ্বন্দ্ব সংগ্রামে উন্ধন যোগাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের বিষয়টি ভারতের উন্নতির পথে এক অলংঘ্য প্রতিবন্ধক।কংগ্রেসকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করতে হবে বলে ভীত প্রদর্শন করা হয়।
সরকারের আগস্ট প্রস্তাব রাজিনৈতিক দল কর্তৃ গৃহীত হয়নি।কিন্তু এতে মুসলমানদের কিছু লাভ হয়েছে। ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়,তা মধ্যবর্তী হোক অথবা চুড়ান্ত মুসলমানদের সন্তোষজনক অনুমোদন লাভ করা হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দান করেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে এবং লাহোর প্রস্তাবের পর পাঁচ মাসের মধ্যে সরকারের এ ধরনের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা মুসলিম লীগের কম কৃতিত্ব নয়।মুসলমানদের প্রতি কংগ্রেসের আচড়ণের ফলেই এ কৃতিত্ব লাভ হয়। কংগ্রেসের হাতে মুসলমানদের ভাগ্য ছেড়ে দেয়া সরকার সমীচীন মনে করেননি।

কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন ও মুসলমান
মিঃ গান্ধী বড়োলাটে লর্ড লিনলিথগোর সাথে ২৭শে ও ৩০শে সেপ্টম্বর সাক্ষাৎ করেন ও তাঁর এ দৃষ্টভংগী মেনে নিতে পারেননি।তিনি বলেন, একজন বিবেকবান বিরুদ্ধবাদী যুদ্ধ করতে না পারেন, তিনি জনগণের কাছে তাঁর দৃষ্টিভংগী পেশ করতে পারেন। কিন্তু তাঁকে এ অনুমতি দেয়া যেতে পারেনা যে, তিনি অন্যকে যুদ্ধে বাধা দান করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করবেন। ১১ই অক্টোবর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সত্যাগ্রহ শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
গান্ধীজির নির্দেশে সর্বপ্রথম বিনোবা ভাবে গ্রেফতারীর জন্যে নিজেকে পেশ করেন। রাজা গোপালাচারিয়া এবং আবুল কালাম আজাদও কারাবরণ করেন। কংগ্রেসপন্থীদের ব্যাপক কারাবরণ সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। বিশেষ করে মুসলিম প্রদেশগুলিতে এ সত্যাগ্রহ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সারা ভারতের মধ্যে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সবচেয়ে ক্ষীণ সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম দিকে ডাঃ খান এ আন্দোলনে যোগদান করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ১৪ই ডিসেম্বর তাঁর গ্রেফতারী জনমনে শান্ত পরিবেশের উপর সামান্য তরংগ সৃষ্টি করে মাত্র।
একচল্লিশের এপ্রিলে মিঃ গান্ধী সকল কংগ্রেসীর জন্যে সত্যাগ্রহ উন্মুক্ত করে দেন। তার পলে প্রায় ২০,০০০ লোক স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। কংগ্রেসের জন্যে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। আন্দোলন ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে আসে।
কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলন মুসলমানগণ মেনে নিতে পারেননি। কারণ কংগ্রেসের দুরভিসদ্ধি তাঁরা বুঝতে পারেন। ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে মিঃ জিন্নাহ দিল্লীতে প্রদত্ত তাঁর এক ভাষণে কংগ্রেসের দাবীর প্রতি উপহাস করে বলেন যে, কংগ্রেস আন্দোলন করছে স্বাধীনতার জন্যে।তাঁর কাছে এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ কথা পরিস্কার যে, কংগ্রেস সরকারকে ভীতি প্রদর্শন করে এক স্বীকৃতি আদায় করতে চায় যে কংগ্রেস ভারতবাসীর একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন। কংগ্রেসের মনোভাব হলোঃ ‘মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দাবী প্রত্যাখ্যান করে আমাদের দাবী মেনে নাও।কংগ্রেস ক্ষমতা লাভ করতে চায় এবং চায় অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি বলপ্রয়োগের ক্ষমতা হস্তন্তরের জন্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বল প্রয়োগ করতে চায়।
একচল্লিশের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে এবং এপ্রিলে অনুষ্ঠিত মাদ্রাজ মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে মিঃ জিন্নাহর ভাষণের সমর্থনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, সরকার যদি তাঁদের বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভংগ করে কংগ্রেসের দাবী মেনে নেয় তাহলে উদ্ভুত পরিস্থিতি মুকাবিলা করার জন্যে মুসলিম লীগ যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত থাকবে
(The Struggle for Pakistan, Ishtiaq Hussain Qureshi, pp. 163-64)

লিবারাল পার্টি প্রস্তাব-১৯৪১
দুটি প্রধান দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নীতি পলিসি আলোচনার পর দেখা যাক ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশন কি মনোভাব পোষণ করছে। আইন সভায় তাঁদের একটি ক্ষুদ্র দল আছে। তবে তাঁদের মধ্যে স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্র, স্যার চিমনলাল শিতলবন্দ এবং স্যার শ্রী নিবাস শাস্ত্রর মতো অভজ্ঞ ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকও আছেন। তাঁদের দুষ্টিভংগী ও মনোভাব জানারও প্রয়োজন আছে। চল্লিশের ডিসেম্বরে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত তাঁদের বার্ষিক অধিবেশনে লিবারালগণ তাঁদের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতির মূলনীতি মূলনীতি ঘোষণা করেন এবং তা সমাধানের ভিত্তি হিসাবে গৃহীত হবে বলে তাঁরা মনে করেন। এ বিষয়ে তাঁরা যে প্রস্তাব করেন তা নিম্নরূপঃ
১. যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সহায়তা দান।
২.যুদ্ধ শেষ হওয়ার দু’বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা করা উচিত য
যে ভারত একটি ডমিনিয়ন হবে।
৩. কেন্দ্রীয় সরকাকে পুনগঠিত করতে হবে যাতে ভাইসরয় একটি পরিপূর্ণ জাতীয় সরকারের শাসনতান্ত্রিক প্রধান হতে পারেন।
৪. ভারত বিভাগ প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং সাম্প্র্রদায়িক নির্বাচন প্রথা ক্রমশঃ রহিত করতে হবে।
৫. কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন দুঃখজনক। একচল্লিশের মার্চে লিবারালগণ বোম্বাইয়ে এক নির্দলীয় সম্মলনে মিলিত হন। সম্মেলনকে নির্দলীয় বলা হলেও তা ছিল হিন্দুমহাসভা প্রভাবিত এতে তিন চারজন মুসলমান অংশগ্রহণ করলেও তাঁরা মুসলিম স্বার্থে কোন কথা বলতে পারেননি। হিন্দু মহাসভার তিনজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি- সাভারকার ডাঃ মুঞ্জে ও ডাঃ শ্যমাপ্রসাদ মুখার্জি সম্মেলনে যোগদান করেন। তেজ বাহাদুর সাপ্র সভাপতিত্ব করেন এবং স্যার নৃপেন্দ্র নাথ সরকার কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন যা গৃহীত হয়। প্রস্তাবগুলি সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। এতে তথাকথিত লিবারালগণ উম্মা প্রকাশ করেন এবং ২৯শে জুন পুনায় ন্যাশনাল লিবারাল ফেডারেশনের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সংকট নিরসনের জন্যে তাঁদের উথপিত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্যে সরকারের তীব্র সমলোচনার করা হয়। মুসলিম লীগের সম্মতি ব্যতিরেকে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ ভারত সচিবের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ভারত বিভাগ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয় এবং প্রস্তাবিত বিভাগ প্রতিরোধের জন্যে সকল ভারতবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়।
সাপ্রু প্রস্তাব বা সুপারিশের উপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে কায়েদে আযম মাহাম্মদ আলী জিন্নহ বলেন, কেন্দ্র একটি জাতীয় সরকার গঠনের যে দাবী কংগ্রেসের পক্ষ থেকে করা হয়েছে সাপ্রূ প্রস্তাব রহিত করার শামিল। ভারত সচিব এল এম অ্যামেরী ২২শে এপ্রিল ১৯৪১, হাউস অব কমন্স এ নম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, ভারতে যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বিরাজ করছে তা এ জন্যে নয় যে, বৃটিশ ভারতের স্বাধীনতা দিতে রাজী নয়, বরঞ্চ এ জন্যে যে ভারত তার দাবীতে একমত হতে পারেনি। অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন ধরনের যে এক্সিকিউটিভের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা হিন্দু মুসলিম অনৈক্য প্রশামিত না করে অধিকতর বর্ধিত করবে, আমি সাপ্রুর মতো লোকের কাছে এ আবেদন রাখব যে, তাঁরা যেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
গান্ধীর প্রতিক্রিয়া
ভারত সচিবের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন মিঃ গান্ধী। তিনি বলেন, অনৈক্যের জন্যে ভারতের স্বাধীনতা বিলাম্বিত হচ্ছে এ কথা বলে অ্যামেরী ভারতীয় জ্ঞানবুদ্ধির( Indian intelligence) অবমাননা করেছেন। ভারতের শ্রেণী বিভেদের জন্যে ব্রিটিশ রাজনীতিকগণই দায়ী। যতোদিন ব্রিটিশ অস্ত্রের মাধ্যমে ভারতকে পদানত রাখবে ততোদিন এ বিভেদ মতানৈক্য চলতে থাকবে। আমি স্বীকার করি যে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে এক দুর্লংঘ্য ব্যবধান রয়েছে। ব্রিটিশ রাজনীতিকগণ কে স্বীকার করেন না যে এ একটি ঘরোয়া বিবাদ (Domestic quarrel)? তারা ভারত ছেড়ে চলে যাকনা, তারপর আমি ওয়াদা করছি, কংগ্রেস, লীগ এবং অন্যান্য দল তাদের নিজেদের স্বার্থেই একত্রে মিলিত হয়ে ভারত সরকার গঠনের সমাধান বের করবে। ....বাইরের কোন হস্তক্ষেপ আহবান না করতে যদি আমরা একমত হই –তাহলে সম্ভবতঃ এ সংকট এক পক্ষকাল বিদ্যমান থাকবে। অন্য কথায় ব্রিটিশ ক্ষমতা ছেড়ে চলে গেলে, হিন্দুই যথেষ্ট শক্তিশারী হবে –সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্যে। গান্ধীজির এ কথা কারো বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়। ১৯৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত তিনি তাঁর এ কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। মুসলিম জাতির অস্তিত্ব সহ্য করতে না পারা এবং উপরোক্ত অশোভন উক্তি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠানকে ত্বরান্বিত করে।

প্রতিরক্ষা পরিষদ (Defence Council) গঠন
একচল্লিশের ২০শে জুলাই বোম্বাই-এর গভর্ণর স্যার রজার লিউমলী মিঃ জিন্নাহর নিকটে এ মর্মে ভাসরয়ের এক বাণী পৌঁছিয়ে দেন যে, ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদনক্রমে ভাইসরয় তাঁর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল (Executive Council) অতিরিক্ত পাঁচটি কোর্ট ফাইলসহ বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত করেছেন। নতুন পদ গ্রহণে যাঁরা সম্মত হয়েছেন তাঁরা হলেন স্যার হোসী মোদী, স্যার আকবর হায়দরী, আর রাও, এম এস এনী এবং স্যার ফিরোজ খান নূন। একই সাথে ত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিরক্ষা পরিষদ (Defence Council) গঠনের কথাও বলা হয়। দেশীয় রাজ্য থেকেও দশজন সদস্য গ্রহণ করা হবে। এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব অপরিহার্য বিধায় বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রীগণকেও তিনি সদস্যপদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েয়েছ।
পরের দিন মিঃ জিন্নাহ স্যার রজার লিউমলীর প্রত্রের জবাবে ভাইসরয়ের পদক্ষেপের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, মুসলিম লীগের সভাপতি ও ওয়ার্কিং কমিটিকে ডিঙিয়ে এসব ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো নীতিবহির্ভূত হয়েছে। আগষ্টের ২৪,২৫ ও ২৬ তারিখে বোম্বাইয়ে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ তারিখের গৃহীত প্রস্তাবে পাঞ্জাব, বাংলা ও আসামের প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে স্যার সেকান্দার হায়াত খান, ফজলুল হক ও স্যার সা’দুল্লাহকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
আটজন মুসলমান প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন সিকান্দার হায়াত, ফজলুল হক, সা’দুল্লাহ, বেগম শাহনেওয়াজ এবং ছাতারীর নবাব, লীগের নির্দেশক্রমে পাঞ্জাব, বাংলা ও আসামের প্রধানমন্ত্রীগণ ১১ই সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ছাতারীর নবাব হায়ধরাবাদ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভাপতি হওয়ার কারণে পূর্বেই পদত্যাগ করেন। বেগম শাহনওয়াজ এবং স্যার সুলতান আহমদ পদত্যাগ না করার জন্যে পাঁচ বছরের জন্যে লীগ থেকে বহিস্কৃত হন। লীগ ২৬ ও ২৭ তারিখের দিল্রীর বৈঠকে সেন্ট্রাল এসেম্বলীর গোটা অধিবেশন থেকে বাইরে আসার সিদ্ধান্ত করে। তদনুযায়ী ২৮ তারিখে মুসলিম লীগ দল হাউস থেকে ওয়াকআউট করে। তাঁরা অভিযোগ করেন যে, ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রে এবং প্রদেশে লীগকে তার সত্যিকার দায়িত্ব ও অধিকারের অংশীদারিত্ব প্রদানে অস্বীকার করেন। (The Struggle for Pakistan I.H. Qureshi, pp. 169-191)
অক্টোবরের মাঝামঝি ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সম্প্রসারণ সম্পন্ন করা হয়। একই দিনে অসহযোগ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট বহু কংগ্রেসীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। কংগ্রেসের একটি অংশ প্রস্তাব করে যে, প্রদেশে আবার ক্ষমতাগ্রহণ করা হোক। কিন্তু মিঃ গান্ধী এতে সম্মত হননি।
এদিকে লীগের অবস্থা সংকটমুক্ত ছিলনা। কারণ যেসব দল তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মনে করে তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। যদিও বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক প্রতিরক্ষা পরিষদ থেকে এস্তেফা দান করেন, তিনি তা করেছিলেন অনিচ্ছাকৃতভাবে। লীগ বিরোধীমহল তাঁকে পরোক্ষভাবে তাদের সমর্থনের নিশ্চয়তা দান করে। মুসলিম লীগের একটি দল ফজলুল হক সাহেবের লীগ থেকে বহিস্কার দাবী করে। অন্যটি নমনীয় হওয়ার পক্ষে ছিল। কায়েদে আযম স্বয়ং কিছু অবকাশ দানের পক্ষে ছিলেন যাতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন। ফজলুল হক দুঃখ প্রকাশ করে যে পত্র দেন তা লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে আলোচনার পর বিষয়টির পরিসমাপ্তি ঘটে।
কিন্তু বছরের শেষে মিঃ ফজলুল হক এবং তাঁর জনৈক সহকর্মী ঢাকার নবাব, বাংলার আইন পরিষদের লীগ দল থেকে বেরিয়ে কংগ্রেস এবং অন্যান্য হিন্দু দলের সংগে মিলিত হয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। পরিষদের ইউরোপিয়ান দলও তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে। নতুন কোয়ালিশন সরকার এ কথাই প্রমাণ করে যে, একদিকে কংগ্রেস এবং অপরদিকে ব্রিটিশ সরকার বংলায় মুসলিম লীগের প্রভাব বিনষ্ট করতে চান। লীগের পক্ষ থেকে ফজলুল হক সাহেবের কৈফিয়ৎ তলব করা হলে তিনি গড়িমসি করতে থাকেন। ফলে ১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর ফজলুল হক সাহেবকে লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। (Creation of Pakistan Justice Sayed Shameem Husain Kadir, pp.226-27)


পিডিএফ লোড হতে একটু সময় লাগতে পারে। নতুন উইন্ডোতে খুলতে এখানে ক্লিক করুন।




দুঃখিত, এই বইটির কোন অডিও যুক্ত করা হয়নি